সালাত শব্দটি একটি বহু অর্থবোধক শব্দ। উদাহরণস্বরূপ নিম্নে ‘কুরআনীয় অভিধান’ গ্রন্থে সালাত শব্দের যেসব অর্থ দেয়া হয়েছে তা উল্লেখ করা হলো:
সূত্র: মুহাম্মদ আবু হেনা, মুহাম্মদ ইয়াহিয়া, কুরআ’নীয় অভিধান, একাডেমি অব কুরআন স্টাডিজ, ঢাকা, বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ: মার্চ ২০১৬, পৃষ্ঠা: ১২৬
কুরআনে সালাত শব্দটির প্রয়োগ এবং আরবি ভাষারীতি অনুসারে সালাত শব্দটির যেসব অর্থ পাওয়া যায় তার মোটামুটি একটি তালিকা হলো: (১) নিবিড় অনুসরণ (২) সংযোগ (৩) যোগাযোগ (৪) আনুকূল্য/ অনকূলতা (৫) সমর্থন, সহযোগিতা (৬) অনুগ্রহ (৭) দুআ বা আশীর্বাদ প্রার্থনা ইত্যাদি।
‘সালাত’ শব্দটি ‘সল্লা’ ক্রিয়া (ক্রিয়ারূপ ২) এর ‘মাসদার’ (ক্রিয়াবিশেষ্য) ‘তাসলিয়া’ এর সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত।
‘সল্লা’ শব্দের অর্থ ‘সে তাসলিয়া / সালাত করেছে’। অর্থাৎ ‘তাসলিয়া’ শব্দের একটি সমার্থক শব্দ হচ্ছে ‘সালাত’। এটি কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। যেমন, ৯:১০৩ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ওয়া সল্লি আলাইহিম, ইন্না সালাতাকা ছাকানুল্লাহুম’। এখানে ‘সল্লি’ করার পর উহাকে ‘সালাতাকা’ শব্দের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ৪:১০২ আয়াতেও ‘সালাত’ এবং ‘সল্লা’ শব্দের ব্যবহার থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ‘সালাত’ হচ্ছে ‘সল্লা’ ক্রিয়া (ক্রিয়ারূপ ২) এর একটি ‘মাসদার’ (ক্রিয়াবিশেষ্য)। সুতরাং ‘সল্লা’ ক্রিয়ার দুটি মাসদার রয়েছে: ‘তাসলিয়া’ এবং ‘সালাত’। ‘সালাত’ শব্দটি ‘ফায়ালাহ’ প্যাটার্নে গঠিত হয়েছে।
‘সল্লা’ ও ‘আক্বামাস সালাত’ শব্দ দুটির পার্থক্য:
‘সল্লা’ এর বিস্তৃত রূপ হচ্ছে ‘সল্লা সালাত’।
‘সল্লা’ / ‘সল্লা সালাত’ = সে সালাত করলো।
‘আক্বামাস সালাত’ = সে সালাত প্রতিষ্ঠা করলো।
‘সল্লা’ / ‘সল্লা সালাত’ বাক্যে ‘সালাত’ শব্দটি হলো ‘মাসদার’ বা ক্রিয়া বিশেষ্য। কিন্তু ‘আক্বামাস সালাত’ বাক্যে ‘সালাত’ শব্দটি হলো ‘মাফঊল’ বা কর্মবিশেষ্য।
যখন কোনো মাসদারকে মাফউল হিসেবে ব্যবহার করা হয় তখন ঐ মাফউলের অর্থ হয় এমন কোনো সত্তা বা বিষয় যার মধ্যে ঐ ক্রিয়াবিশেষ্যে চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে সালাতের মূল অর্থ এবং আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির সম্পর্ক বিষয়ে ধারণা লাভ করা যেতে পারে। ধরা যাক, একজন ট্রাফিক পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হলো ট্রাফিক কন্ট্রোল করার জন্য এবং বলা হলো এজন্য সে ‘লাল, সবুজ ও কমলা আলোর সংকেত’ ব্যবহার করতে হবে। এখন যদি সে আলোর সংকেত ব্যবহার ছাড়া ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে চেষ্টা করে তাহলে সে পরিপূর্ণ নির্দেশনা পালন করা হলো না। আবার যদি সে শুধু আলোর ব্যবহার করে কিন্তু ট্রাফিক কন্ট্রোলের মূল কাজটি না করে তাহলে তার আলোর ব্যবহার সঠিক উদ্দেশ্য পরিপূরণে ব্যর্থ হতে পারে।
অনুরূপভাবে ‘সালাত’ অর্থ হচ্ছে ‘আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণ, সংযোগ, অনুকূলতা’। এজন্য একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে যেন এই মূল কাজটি করার জন্য মনোদৈহিক অভিব্যক্তির মাধ্যমে নিজেকে সময়ে সময়ে রিচার্জ করে নেয়া হয়। এখন কেউ যদি এ আনুষ্ঠানিক কাজটিকেই একমাত্র সালাত বলে মনে করে সে আলোকসজ্জাকেই ট্রাফিক কন্ট্রোল হিসেবে যথেষ্ট মনে করলো। এবং কেউ যদি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াটি ছাড়াই আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণের অনুশীলন করতে সচেষ্ট হয়, সেও একদিকে পরিপূর্ণ নির্দেশনা অনুসরণ করা হয় না, অন্যদিকে মানবীয় দুর্বলতা হেতু নিবিড় অনুসরণে পূর্ণমাত্রায় সক্ষম হবে না এবং আলোর ব্যবহার যে ট্রাফিক কন্ট্রোলের প্রাথমিক রূপ তা অস্বীকার করা হয়।
এ উদাহরণে আলোর ব্যবহার হচ্ছে আনুষ্ঠানিক সালাতের প্রতীক, মূল ট্রাফিক কন্ট্রোল হলো ব্যাপক অর্থে সালাতের প্রতীক।
আনুষ্ঠানিক সালাতের আনুষ্ঠানিক বা কাঠামোগত দিক উপলব্ধির জন্য আরেকটি উদাহরণ হলো ‘সেনাবাহিনীর প্যারেড’। যখন কেউ সাধারণভাবে দাঁড়ায় বা হাঁটে সেটাকে প্যারেড বলা হয় না এবং এর পূর্বশর্ত হিসেবে নির্দিষ্ট পোশাক পরারও প্রয়োজন হয় না। কিন্তু প্যারেডে উপস্থিত হওয়ার আগে নির্দিষ্ট পোশাক পরে আসার শর্ত থাকে। এবং প্যারেডে একটা শৃঙ্খলার সাথে দাঁড়াতে হয় এবং পদচারণার ক্ষেত্রে ‘লেফট-রাইট’ একটা ছন্দ বজায় রাখতে হয়। যে কোনো সময়ের দাঁড়ানোকে প্যারেডে দাঁড়ানো বলে না, শুধু যখন কেউ প্যারেড করার উদ্দেশ্যে দাঁড়ায় সেটাকে প্যারেডে দাঁড়ানো বলা যেতে পারে। অনুরূপভাবে যখন আনুষ্ঠানিক সালাতের উদ্দেশ্যে দাঁড়ানো হয় তখন সেটাকে বলা হয় ‘সালাতে দাঁড়ানো’ এবং ‘সালাতে দাঁড়ানোর পূর্বশর্ত’ হিসেবে ওজু-গোসল-তায়াম্মুম বা শরীর-পোশাক ও সালাতের স্থানের পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতার শর্ত রয়েছে। প্যারেড যেমন একটি উদ্দেশ্যপূর্ণ ও প্রতীকী শৃঙ্খলা, আনুষ্ঠানিক সালাতও তেমনি একটি উদ্দেশ্যপূর্ণ ও প্রতীকী শৃঙ্খলা। কেউ যদি প্যারেডের শৃঙ্খলা রক্ষা করে কিন্তু বাস্তব রণাঙ্গনে কমান্ড ফলো না করে তার প্যারেড যেমন মূল্যহীন, তেমনি যে আনুষ্ঠানিক সালাত করে কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে স্বর্গীয় বিধান অনুসরণ করে না তার আনুষ্ঠানিক সালাত মূল্যহীন।
আল কুরআনে দেখা যায়, সালাত করা, সালাত কায়েম করা, সালাত কায়েমের জন্য পরিচ্ছন্ন হওয়া, সালাত হেফাযত করা, সালাতের উপর দায়েম (প্রতিষ্ঠিত) থাকা, সালাতের আমর ও নাহি (আদেশ ও নিষেধ), ক্বিয়ামের (দাঁড়ানোর) মাধ্যমে সালাত শুরু ও সাজদাহর (প্রণিপাতের) মাধ্যমে শেষ করা, ইয়াওমুল জুমআতে (জমায়েতের দিনে) সালাতের জন্য নিদা / আহবান করা, সালাতে খাশিয়ূন (বিনীত) হওয়া, সালাতের ব্যাপারে ছাহূন (উদাসীন) না হওয়া, সালাতে যা বলা হয় তা বুঝার মত মানসিক স্তরে না থাকা অবস্থায় সালাতের কাছে না যাওয়া, সালাতে মধ্যম স্বর অবলম্বন করা, ভয়ের অবস্থায় সফরে সালাতে ক্বসর (সংক্ষিপ্ত/ অদীর্ঘায়িত) করা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়সহ রসূলের ব্যাপারে আল্লাহর ও ফেরেশতাদের সালাত, মু’মিনদের ব্যাপারে আল্লাহর ও ফেরেশতাদের সালাত, রসূলের ব্যাপারে মু’মিনদের সালাত, মু’মিনদের ব্যাপারে রসূলের সালাত, মু’মিনের মৃত্যুর পর তার ব্যাপারে অন্য মু’মিনদের সালাত ইত্যাদি প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছে।
এর মধ্যে ৭৫:৩১-৩২ আয়াতে সালাত শব্দের কুরআনিক প্রায়োগিক সংজ্ঞা নির্ণয়ের সূত্র পাওয়া যায়।
৭৫:২৯-৩২ :: এবং এক পায়ের গোছার সাথে আরেক পায়ের গোছা জড়িয়ে যাবে। তোমার প্রভুর দিকেই সেদিন চালিয়ে নেয়া হবে। অথচ সে সত্যতা প্রতিপাদন করেনি এবং সালাত করেনি। কিন্তু সে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে এবং বিমুখ হয়ে ফিরে গেছে।
৭৫:৩১-৩২ আয়াতে ‘সদ্দাক্বা’ ও ‘সল্লা’ শব্দদ্বয়ের বিপরীত শব্দ হিসাবে যথাক্রমে ‘কাযযাবা’ ও ‘তাওয়াল্লা’ শব্দদ্বয় ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ ‘সদ্দাক্বা’ শব্দের বিপরীত শব্দ হচ্ছে ‘কাযযাবা’ এবং ‘সল্লা’ শব্দের বিপরীত শব্দ হচ্ছে ‘তাওয়াল্লা’। ‘সদ্দাকা’ অর্থ ‘সত্যতা প্রতিপাদন করা’, ‘কাযযাবা’ অর্থ ‘মিথ্যা সাব্যস্ত করা’। ‘তাওয়াল্লা’ অর্থ ‘বিপরীতক্রমে বা বিমুখ হয়ে ফিরে যাওয়া’। সুতরাং ‘সল্লা’ হচ্ছে ‘অভিমুখী হয়ে এগিয়ে আসা’। অন্য কথায় বলা যায়, ‘তাওয়াল্লা’ হচ্ছে ‘প্রতিকূলতা’ এবং ‘সল্লা’ হচ্ছে ‘অনুকূলতা বা আনুকূল্য করা’। বিশেষ করে ৪:৮৮-৮৯ আয়াতের মধ্যকার ৪:৮৯ আয়াতে ব্যবহৃত ‘তাওয়াল্লাও’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ‘জিঘাংসামূলক চরম প্রতিকূলে অবস্থান নেয়ার’ অর্থে। সুতরাং ‘সল্লা’ মানেও ‘ইতিবাচক কর্মসূচীসম্পন্ন অনুকূলতা’ হওয়াই স্বত:সিদ্ধভাবে সাব্যস্ত হয়। ‘তাওয়াল্লা’ অর্থ হলো: সঠিক জীবনব্যবস্থা থেকে বিমুখ হয়ে প্রতিকূলতামূলক কর্মসূচীর সর্বাত্মক বাস্তবায়নে সক্রিয় থাকা। এবং ‘সল্লা’ অর্থ হলো: সঠিক জীবনব্যবস্থার প্রতি অনুকূলতা বা ইতিবাচক সংযোগ সংরক্ষণমূলক কার্যক্রম করা।
প্রশ্ন হচ্ছে আয়াত দুটিতে সদ্দাকা, কাযযাবা, সল্লা ও তাওয়াল্লা বলতে কার বা কিসের প্রতি সত্যতা প্রতিপাদন করা বা মিথ্যা সাব্যস্ত করা, আনুকূল্য করা বা প্রতিকূলে যাওয়ার কথা বুঝানো হয়েছে? বর্ণনাভঙ্গি থেকে স্পষ্ট যে, এখানে গ্রহণীয় জীবনব্যবস্থার প্রতি সত্যতা প্রতিপাদন করা বা মিথ্যা সাব্যস্ত করা, আনুকূল্য করা বা প্রতিকূলে যাওয়ার কথা বুঝানো হয়েছে। কেননা কোনো ব্যক্তিসত্তার প্রতি সালাতের ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তিসত্তার কথা উল্লেখ করা হয়ে থাকে এবং তার আগে ‘আলা’ অব্যয়টি যুক্ত করা হয়।
সেই সাথে কুরআনে যেভাবে সালাতের শর্ত, সময়, পদ্ধতি ইত্যাদি উল্লেখ করা হয়েছে তাতে এ কথা স্পষ্ট যে, সালাতের একটি আনুষ্ঠানিক রূপও বিদ্যমান রয়েছে যা নিয়মিতভাবে দ্বীনের নিবিড় অনুসরণের প্রতীকী কর্মসূচীরূপে সম্পাদিতব্য। অর্থাৎ সালাতের দুটি ধরন রয়েছে, যথাঃ আনুষ্ঠানিক সালাত এবং বাস্তব সালাত তথা আনুষ্ঠানিক সালাতের শিক্ষা বাস্তবায়ন। সুতরাং সালাতের সংজ্ঞা হলো, গ্রহণীয় জীবনব্যবস্থার প্রতি আনুষ্ঠানিক ও বাস্তব অনুকূলতামূলক কর্মসূচী সম্পাদন করা।
বস্তুত ‘সালাত’ হলো ‘কারো দিকে বা কোনো ব্যবস্থার দিকে ইতিবাচকভাবে অগ্রসর হওয়া’। এবং ‘তাওয়াল্লা’ হলো ‘কারো থেকে বা কোনো ব্যবস্থার থেকে নেতিবাচকভাবে মুখ ফিরানো বা মুখ ফিরিয়ে নেয়া’। যখন ‘আলা’ শব্দ যোগে সালাত করার কথা বলা হয় তখন এর অর্থ হলো ‘কারো প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করা, কারো অনুকূলে অবস্থান নেয়া, কারো প্রতি সংযোগ রক্ষামূলক কর্ম সম্পাদন করা’।
২০:১৪ আয়াত অনুযায়ী আল্লাহর যিকিরের বা স্মরণের অনুশীলনের জন্য সালাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ৬২:১০ আয়াত অনুযায়ী সালাত কাযা বা যথানিয়মে সম্পাদনের পরে জমিনে ছড়িয়ে পড়তে হবে, আল্লাহর ফযল বা অনুগ্রহ তালাশ (তথা জীবিকা উপার্জন, শিক্ষাচর্চা ইত্যাদি) করতে হবে এবং তাতে বেশি বেশি করে আল্লাহর যিকির বা স্মরণ করতে হবে।
সুতরাং একটি আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি হিসাবে সালাত হচ্ছে অনুকূলতামূলক কর্মসূচী, কারো বা কোনো ব্যবস্থার অনুকূলে সাড়া দেয়ার ও কর্মকান্ড সম্পাদনের (রোল প্লে/ ভূমিকা পালন করার) প্রতীকী উপস্থাপন ধরনের কর্মসূচী এবং বাস্তবেও তার দাবি পূরণ করা। অন্য কথায়, আনুষ্ঠানিক সালাত হচ্ছে, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে ইসলামী জীবনব্যবস্থার প্রতি অনুকূলতামূলক প্রতীকী কর্মসূচী। এটি দুইভাবে হতে পারে (১) একাকী একটি আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির মাধ্যমে নিজেকে সঠিক জীবন ব্যবস্থার ভিত্তিতে পরিচালনার রোল প্লে করা। (২) অনেকে একত্রে একটি আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির মাধ্যমে নিজেদেরকে সঠিক জীবন ব্যবস্থার ভিত্তিতে পরিচালনার রোল প্লে করা।
সালাতের প্রকৃত স্বরূপ ও গুরুত্ব অনুধাবনের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, সালাত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, সালাত মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে নিষেধ করে (২৯:৪৫)। আবার রসূলুল্লাহ শোয়ায়েবের সালাত প্রসঙ্গে জানানো তথ্য অনুসারে, তাঁর সালাত তাঁকে আদেশ দেয় আল্লাহ ছাড়া অন্যদের দাসত্ব না করতে এবং স্বীয় সম্পদের ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারিতা না করতে (১১:৮৭)। যারা সালাতের মধ্যে খাশিয়ূন (বিনীত) থাকে (২৩:২) এ হচ্ছে তাদের সাথে সম্পর্কিত বিষয়। পক্ষান্তরে যারা সঠিকভাবে সালাত সম্পাদন করে না সেরূপ সালাতকারীদের সম্পর্কে ১০৭:৪-৭ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং যারা সঠিকভাবে সালাত সম্পাদন করে তাদের সম্পর্কে ৭০:১৯-৩৫ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সালাত সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সালাত তিন প্রকার। যথা:
১. দ্বীন সম্পর্কিত বাস্তব সালাত তথা বিশ্বপ্রভুর বিধানের নিবিড় অনুসরণ এবং তার সাথে স্বীয় ব্যক্তিত্বের সংযোগ সাধন বা অনুকূলতা বজায় রাখা।
২. দ্বীন সম্পর্কিত আনুষ্ঠানিক সালাত তথা বিশ্বপ্রভুর বিধানের নিবিড় অনুসরণমূলক আনুষ্ঠানিক কর্মসূচী।
৩. কোনো ব্যক্তিসত্তার প্রতি সালাত (আনুকূল্য, সহযোগিতা, অনুগ্রহ, আশীর্বাদ প্রার্থনা): যেসব আয়াতে ‘আলা’ অব্যয় সহযোগে বা অনুরূপ অর্থগত অবস্থানে কোনো ব্যক্তিসত্তার প্রতি সালাতের কথা এসেছে সেক্ষেত্রে সালাত হলো কোনো ব্যক্তিসত্তার প্রতি অনুকূলতামূলক বা সংযোগমূলক বা যোগাযোগমূলক কর্মসূচী। এতে সহযোগিতা, অনুগ্রহ বা আশীর্বাদ প্রার্থনার মাধ্যমে ব্যক্তির প্রতি সালাত করা হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্যাটার্নটি হলো: সালাত + আলা (একটি অব্যয়) + কোনো ব্যক্তিসত্তা। অর্থাৎ এতে কোনো না কোনো ব্যক্তিসত্তার প্রতি সালাত প্রসঙ্গের উল্লেখ থাকে।
ব্যক্তিসত্তার প্রতি সালাত আবার কয়েক ভাগে বিভক্ত। যেমন-
৩.১ রসূলের প্রতি আল্লাহর ও ফেরেশতাদের সালাত। (৩৩:৫৬)
৩.২ রসূলের প্রতি মু’মিনদের সালাত। (৩৩:৫৬)
৩.৩ মু’মিনদের প্রতি আল্লাহ ও ফেরেশতাদের সালাত। (২:১৫৭, ৩৩:৪৩)
৩.৪ মু’মিনদের প্রতি রসূলের সালাত। (৯:৯৯, ৯:১০৩)
৩.৫ মু’মিনদের প্রতি অন্য মু’মিনদের সালাত (মুনাফিকদের মৃত্যুর পর তাদের প্রতি সালাতে নিষেধাজ্ঞার পরোক্ষ শিক্ষা অনুসারে মু’মিনরা মু’মিনদের প্রতি সালাত করবে, এমনকি মৃত মু’মিনের প্রতিও)। (৯:৮৪)
সালাত সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সালাত তিন প্রকার। যথা:
১. দ্বীন সম্পর্কিত বাস্তব সালাত তথা বিশ্বপ্রভুর বিধানের নিবিড় অনুসরণ এবং তার সাথে স্বীয় ব্যক্তিত্বের সংযোগ সাধন বা অনুকূলতা বজায় রাখা।
২. দ্বীন সম্পর্কিত আনুষ্ঠানিক সালাত তথা বিশ্বপ্রভুর বিধানের নিবিড় অনুসরণমূলক আনুষ্ঠানিক কর্মসূচী।
৩. কোনো ব্যক্তিসত্তার প্রতি সালাত (আনুকূল্য, সহযোগিতা, অনুগ্রহ, আশীর্বাদ প্রার্থনা): যেসব আয়াতে ‘আলা’ অব্যয় সহযোগে বা অনুরূপ অর্থগত অবস্থানে কোনো ব্যক্তিসত্তার প্রতি সালাতের কথা এসেছে সেক্ষেত্রে সালাত হলো কোনো ব্যক্তিসত্তার প্রতি অনুকূলতামূলক বা সংযোগমূলক বা যোগাযোগমূলক কর্মসূচী। এতে সহযোগিতা, অনুগ্রহ বা আশীর্বাদ প্রার্থনার মাধ্যমে ব্যক্তির প্রতি সালাত করা হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্যাটার্নটি হলো: সালাত + আলা (একটি অব্যয়) + কোনো ব্যক্তিসত্তা। অর্থাৎ এতে কোনো না কোনো ব্যক্তিসত্তার প্রতি সালাত প্রসঙ্গের উল্লেখ থাকে।
ব্যক্তিসত্তার প্রতি সালাত আবার কয়েক ভাগে বিভক্ত। যেমন-
৩.১ রসূলের প্রতি আল্লাহর ও ফেরেশতাদের সালাত। (৩৩:৫৬)
৩.২ রসূলের প্রতি মু’মিনদের সালাত। (৩৩:৫৬)
৩.৩ মু’মিনদের প্রতি আল্লাহ ও ফেরেশতাদের সালাত। (২:১৫৭, ৩৩:৪৩)
৩.৪ মু’মিনদের প্রতি রসূলের সালাত। (৯:৯৯, ৯:১০৩)
৩.৫ মু’মিনদের প্রতি অন্য মু’মিনদের সালাত (মুনাফিকদের মৃত্যুর পর তাদের প্রতি সালাতে নিষেধাজ্ঞার পরোক্ষ শিক্ষা অনুসারে মু’মিনরা মু’মিনদের প্রতি সালাত করবে, এমনকি মৃত মু’মিনের প্রতিও)। (৯:৮৪)
আল কুরআন অনুসারে সালাতের গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে সালাতের গুরুত্বের বিভিন্ন দিক উল্লেখ করা হলো:
১. সালাত সম্পাদনকারীরা জান্নাত লাভ করবে। (২৩:১-১১, ৭০:১৯-৩৫)
২. সালাত পরিত্যাগকারীরা জাহান্নামে যাবে। (৭৪:৩৮-৪৮, ১০৭:১-৭)
৩. সালাত ও যাকাত দ্বীন ইসলামের মৌলিক কর্মকাঠামো, যারা তা পরিপালন করবে তারাই পরস্পর দ্বীনী ভাই। (৯৮:৫, ৯:১১)
৪. আনুষ্ঠানিক সালাত সম্পাদন আল্লাহর আদেশ, যেজন্য কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে এবং যার নির্দিষ্ট সময়সীমা ও প্রক্রিয়া রয়েছে। (৪:১০১-১০৩, ৫:৬, ৪:৪৩, ১৭:১১০, ১১:১১৪, ৬২:৯-১১)
৫. নিছক আনুষ্ঠানিক সালাত বা সালাতের আনুষ্ঠানিকতা কল্যাণ অর্জনে কোনো কাজে আসবে না। সালাতের প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জন এবং আনুষ্ঠানিক সালাতের শিক্ষানুসারে বাস্তব সালাত প্রতিষ্ঠাই পুণ্য কাজ হিসেবে সাব্যস্ত হবে। (২:১৭৭, ১০৭:১-৭)
৬. যারা সালাতকে নষ্ট করেছে তথা আল্লাহ প্রদত্ত উদ্দেশ্য, শিক্ষা, প্রক্রিয়া ইত্যাদিকে প্রবৃত্তির অনুসরণে বিকৃত করেছে তারা কিতাবের নিকৃষ্ট পর্যায়ের প্রতিনিধি হিসেবে সাব্যস্ত। (৮:৩৫, ১৯:৫৯)
৭. সালাতের ক্ষেত্রে অলসতা করা মুনাফিকদের কাজ। (৪:১৪২, ৯:৫৪)। তাই মুনাফিকসুলভ জীবনধারা পরিহার করে নিজেকে মু’মিন হিসেবে আত্মগঠনের জন্য সালাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করণীয়।
৮. শয়তানের অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে যিকর (আল্লাহর স্মরণ ও স্মরণিকা/কুরআন) থেকে এবং সালাত থেকে ফিরিয়ে রাখা। (৫:৯১)
৯. প্রকৃত মু’মিনদেরকে তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য সালাত থেকে উদাসীন রাখতে পারে না। (২৪:৩৭)
১০. নিজে সালাত করার পাশাপাশি পরিবার-পরিজনকেও এ বিষয়ে আদেশ দিতে হবে। নবী ইবরাহীম তাঁর পরিবার পরিজনকে ‘আল বাইতুল মুহাররাম’ তথা কা’বার কাছে আবাসনের ব্যবস্থা করেছেন যেন তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে। (২০:১৩২, ১৪:৩৭)
১১. সালাত নারী-পুরুষ সকলেই সম্পাদন করতে হবে। (৩৩:৩৩)
১২. নবী ঈসা বলেছেন যে, তিনি যতদিন জীবিত থাকেন ততদিন সালাত প্রতিষ্ঠা ও যাকাত প্রদানের জন্য আদেশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। (১৯:৩১)
সালাত যে কুরআন নাযিলের মাধ্যমে বা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর সমকাল থেকে শুরু হয়েছে তা নয়। বরং কুরআন থেকে জানা যায় যে, পূর্ববর্তী নবীদের সময়ও সালাতের নির্দেশ ও অনুশীলন ছিল। নিম্নে বিভিন্ন নবীর সালাতের প্রসঙ্গ সম্পর্কিত আয়াতসমূহের নাম্বার উল্লেখ করা হলো:
১. নবী ইবরাহীমের সালাত ১৪:৩৭, ১৪:৪০
২. নবী ইবরাহীম, লূত, ইসহাক, ইয়াকুব প্রমুখের সালাত ২১:৭৩
৩. নবী ইসমাইলের সালাত ১৯:৫৫
৪. নবী মূসার সালাত ২০:১৪
৫. নবী যাকারিয়ার সালাত ৩:৩৯
৬. নবী ঈসার সালাত ১৯:৩১
এছাড়াও ২:৮৩ আয়াতে বনী ইসরাইলের সালাত এবং ৩১:১৭ আয়াতে লুকমান এর সালাত প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে। ৯৮:৫ আয়াত অনুযায়ী, অতীতে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের সবাইকে সালাতের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
ঈসা ইবনে মারইয়ামের প্রার্থনা ও সালাত
আমরা কুরআনের মাধ্যমে জানতে পারি যে, রসূলুল্লাহ ঈসা ইবনে মারইয়াম বলেছেন,
“এবং যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন এবং যতদিন আমি জীবিত থাকি তিনি আমাকে সালাত ও যাকাত আদায় করতে আদেশ করেছেন’। ১৯:৩১
বাইবেল ও ইতিহাসসূত্রে জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ ঈসা (সালামুন আলাইহি) রসূলুল্লাহ মুহাম্মাদের (সালামুন আলাইহি) কাছে কুরআন নাযিলের প্রায় ৬০০ বছর আগে তাঁর নবুয়াত পূর্ণ করেন। বাইবেলের বিবরণে আমরা দেখি যে, রসূলুল্লাহ ঈসা নিয়মিত সালাত / প্রার্থনা করতেন।
ঈসা নবীর জন্ম হয়েছিলো বনী ইসরাইল গোত্রে এবং তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন বনী ইসরাইল জাতির কাছে (সুরা আস-সফ, ৬১:৬) আল্লাহর দ্বীন প্রচারে। আল্লাহ তাঁকে কিতাব, হিকমাত, তাওরাত ও ইনজিল শিক্ষা দিয়েছেন।
স্রষ্টায় আত্নসমর্পনকারী মুসলিম হিসেবে আমরা পূর্ববর্তী সকল কিতাবকে আল্লাহর তরফ থেকে বলে মানি এবং রাসুলদের মধ্যে কাউকে বাদ দেই না বা তাদের মধ্যে তারতম্য করি না। এ কারণেই, মূল তাওরাত এবং ইঞ্জিলের কিছু অংশ বিকৃত হোক বা না হোক, আমরা ঈসার সালাত / প্রার্থনা / স্রষ্টার সাথে সংযোগের বিবরণগুলো পাঠ করে তার সালাত সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে প্রশস্ত করতে পারি।
কিভাবে তারা সালাত করবে, এই প্রশ্নের উত্তরে নবী ঈসা আ. যেভাবে সালাত করার নির্দেশনা দেন যা বাইবেলে সংরক্ষিত রয়েছে এবং যেটিকে এখন অব্দি ঈসার মিল্লাতের অনুসারীরা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনা হিসেবে সংরক্ষণ করে আসছে। ঈসার মাতৃভাষা ছিলো আরামাঈক ভাষা যা হিব্রু ভাষা থেকেও প্রাচীন। এই সালাতের আয়াতগুলো ঈসায়ী পরিভাষায় ‘লর্ডস প্রেয়ার’ নামে পরিচিত (৪) ।
(৪) লর্ডস প্রেয়ার, উইকিপিডিয়া https://en.wikipedia.org/wiki/Lord%27s_Prayer
আমরা এই প্রার্থনার প্রতিটি আয়াত মূল আরামাঈক ভাষার উল্লেখপূর্বক এখানে পর্যালোচনা করছি:
১.আবুন দ'বিস সামাই, নেতকাদাস ইসমাখ
“আমাদের আসমানি প্রতিপালক পিতা, পবিত্র তোমার নাম”
২.তেতে মালাকুতাখ
“তোমারই সার্বভৌমত্ব”
৩. নেহওয়ে যেওয়ানাখ আয়কান্না দ'বিওয়াহমায়া আফ বা'আরহা
“তোমারই ইচ্ছা পূর্ণ হোক যেরূপ স্বর্গে, সেরূপ মর্ত্যে”
৪. হাবলান লাখমা দ'সুনকানান ইয়ামানা
“আমাদের প্রয়োজনের লোকমা দান করো এই দিনে”
৫. ওয়াহ বুকলান খাওআন আয়কান্না দাফ খনান শবোকান ইখায়য়াবান
“আমাদের জুলুমকে/ অন্যায়কে ক্ষমা করো, যেরূপ আমরা ক্ষমা করি আমাদের উপরে জুলুককারীদের / অন্যায়কারীদের”
৬. ওয়া লা তাহলানাল নিসুনা ইল্লা পাসসান মিন বিশা
“আমাদের পরীক্ষায় ফেলো না বরং শয়তানের চক্রান্ত থেকে মুক্তি দাও”
৭. মেতোল দিলাখি মালকুথা ওয়া হায়লা ওয়াতিসবুখতাল আহলাম আলমিন
“কেননা তোমারই সার্বভৌমত্ব এবং ক্ষমতা এবং মহিমা। যুগে যুগে এবং চিরদিন”।
উপরের আয়াতগুলো যদি আমরা ফাতিহার সাথে তুলনা করি তাহলে ভাবগত অনেক সাদৃশ্য আমাদের কাছে উজ্জল হবে।
ঈসা স্রষ্টাকে ‘আবুন’ বা ‘আমাদের পিতা’ নামে সম্বোধন করতেন এবং এই সম্বোধন ছিলো প্রতিপালন করার অর্থে।
ফাতিহায় আমরা ‘রাব্বিল আলামীন’ সম্বোধন করে সেই প্রতিপালন অর্থেই রব্ব তথা জগতের প্রতিপালককে স্মরণ করি।
‘বিসমিল্লাহ’ উচ্চারণের মাধ্যমে আমরা স্রষ্টার মহিমান্বিত নামকে স্বরণ করি। একইভাবে ঈসায়ী সালাতে আমরা দেখি তিনি ‘নেতকাদাস ইসমাখ’ - প্রভুর নামের পবিত্রতা ঘোষণা করছেন শুরুতেই।
আরামাঈকে ‘ইসমাখ’, আরবীর ‘ইসম’ এর খুব কাছাকাছি। আরামাঈক, হিব্রু এবং আরবী - সবগুলোই সেমিটিক ভাষা যাদের উৎস খুব কাছাকাছি।
সুরা ফাতিহায় আমরা স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসাবে ক্বিয়ামাত দিবসকে স্বরণ করি। ঈসায়ী সালাতেও আমরা বারবার স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের দিকটি পাই।
ফাতিহায় যেমন ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে স্রষ্টার দেখানো পথে চলার শক্তি চাওয়া হয়, যারা নিয়ামত প্রাপ্ত এবং যারা পথভ্রষ্ট তাদের মধ্যে একটি তুলনামূলক দৃষ্টিপাত দিয়ে নিয়ামতের পথে চালিত হওয়ার শক্তির আকাঙ্ক্ষা করা হয়, ঠিক তেমনি ঈসায়ী সালাতের শেষভাগটায় আমরা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে জীবন চলার ক্ষেত্রে পরীক্ষা থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি পাই।
লক্ষণীয় যে সূরা ফাতিহা যেমন ৭টি আয়াত, তেমনি ঈসায়ী সালাতের মূলভাব ৭টি আয়াতে বিভক্ত।
এই আয়াতগুলো থেকে সম্ভবত আমরা এই উপসংহারে পৌছাতে পারি যে, পৃথিবীর বিভিন্ন যুগে যুগে রাসুলরা যে সালাত করেছেন সেগুলোর ভাষা এক না হলেও (ভাষা এক হওয়া সম্ভব নয়, কেননা স্বজাতির ভাষাতেই তাদেরকে পাঠানো হতো), সেগুলোতে স্রষ্টার প্রতি সমর্পণ, স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি, স্রষ্টার মহিমা ঘোষণা এবং ব্যক্তিগতভাবে জীবনযাপনে স্রষ্টার নিয়ামতের আকাঙ্ক্ষা এবং সম্ভাব্য অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়া - এই বিষয়গুলোই মূল ছিলো।
ঈসা ইবনে মারইয়াম কখন কখন সালাত করতেন এর উত্তরে আমরা ইঞ্জিলে কিছু হিন্টস পাই যেমন:
খুব ভোরে সালাত করতেন (মার্ক ১:৩৫), তার শিষ্যরা দুপুরে এবং অপরাহ্ণে সালাত করতেন (এক্টস ১০:৯, ৩:১), ঈসা সন্ধ্যায় সালাত করতেন (১৪:২৩) এবং রাতেও সালাত করেছেন (১৪:৩৩-৩৯)। উল্লেখ্য যে, বনী ইসরাইল তাওরাত অনুসারে তিনবার সালাত করে, সকাল, দুপুরের পর এবং সন্ধ্যায়। সুতরাং বনী ইসরাইলের মিল্লাতে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঈসাও যে একই সময়গুলোতে সালাত করবেন সেটিই স্বাভাবিক ধরে নেওয়া যায় এবং পূর্ববর্তী কিতাব থেকেও এটির সমর্থন পাওয়া যায়।
সাধারণত অনুবাদে সালাত শব্দটির শব্দার্থ হিসেবে ‘নামাজ’ শব্দটি লেখা হয় এবং ‘নামাজ’ বলতে একটি নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াসম্পন্ন কর্মসূচীকে বুঝানো হয়। কুরআনের কিছু আয়াতে এরূপ আনুষ্ঠানিক সালাতের নির্দেশনা পাওয়া যায়। কিন্তু কুরআনের অনেক আয়াতে সালাত শব্দটি আনুষ্ঠানিক সালাতের অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে ব্যাপক অর্থে বা বাস্তব সালাতের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, সালাত শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক বিষয় নয়। অন্য কথায়, কুরআনের প্রেক্ষিতে সালাতের ব্যাপক ও বিস্তৃত এবং নির্দিষ্ট ও সীমিত দুই ধরনের অর্থই বুঝা যায়। সামগ্রিক ও ব্যাপক অর্থে সালাত প্রতিষ্ঠা করা অর্থ স্রষ্টার বিধান, স্রষ্টার নির্দেশনা, স্রষ্টার যে প্রদর্শিত ও নির্দেশিত জীবন ব্যবস্থা সেটিকে জীবনে প্রয়োগ করা; ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত - উভয় ক্ষেত্রেই। এবং নির্দিষ্ট ও সীমিত অর্থে সালাত একটি বিশেষ উপাসনা পদ্ধতি যেখানে স্রষ্টার বিধান ও নির্দেশনাবলী পাঠের মাধ্যমে স্রষ্টার স্মরণকে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
আল কুরআনে সালাত শব্দটি আনুষ্ঠানিক ও বাস্তব সালাত উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহারের বিষয়টি অনুধাবনের সুবিধার জন্য প্রথমে শব্দের অর্থের ব্যাপকতার মাত্রা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো। কোনো শব্দ দ্বারা যদি কোনো স্থানে ব্যাপক বিষয়কে বুঝানো হয় এবং কোনো স্থানে তার মধ্যকার কোনো এক বা একাধিক ক্ষেত্রে তা সীমিত হওয়ার মতো নিয়ামক প্রসঙ্গ থাকে, তাহলে ঐ নিয়ামক প্রসঙ্গসম্পন্ন স্থানে ছাড়া অন্য স্থানে তা ব্যাপক ও বহুমাত্রিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সাব্যস্ত হয়।
যে ক্রিয়াবিশেষ্য দ্বারা এমন কোনো কাজকে বুঝায় যা সম্পাদনের জন্য কোনো পূর্বশর্ত রয়েছে বা যার কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামো (শুরু-শেষ ও প্রক্রিয়া) রয়েছে, সেটি দ্বারা একটি আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডকে বুঝায়, যে আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ক্রিয়াবিশেষ্যের অর্থের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা বিদ্যমান থাকে। এবং কাজটি যদি কোনো উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণমূলক হয় তবে ঐ আনুষ্ঠানিক কাজের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নমূলক কাজসমূহও ঐ ক্রিয়াবিশেষ্যের সাথে সম্পর্কিত হবে। অর্থাৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নমূলক কাজসমূহ ছাড়া নিছক আনুষ্ঠানিক কাজটির সম্পাদনকারী ব্যক্তি কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করেনি এবং আনুষ্ঠানিক কাজটির দ্বারা কোনো সুফল পাবে না বলে সাব্যস্ত হবে। তারাই কাজটি সঠিকভাবে সম্পাদন করেছে বলে সাব্যস্ত হবে যারা আনুষ্ঠানিক কাজটি করবে এবং সেই সাথে ব্যাপক ও বিস্তৃত কর্মকাণ্ডেও ঐ ক্রিয়াবিশেষ্যের অর্থের ব্যাপকতার সাথে সম্পর্কিত কাজসমূহ (বা আনুষ্ঠানিক কাজের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নমূলক কাজসমূহ) সম্পাদন করবে। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক কাজের ক্ষেত্রে এর উদ্দেশ্যের প্রতি সচেতন ও বস্তুনিষ্ঠ থাকতে হবে।
‘সল্লা’ বা ‘আক্বামাস সালাত’ বলতে কোথায় ‘আনুষ্ঠানিক সালাত’ এবং কোথায় ‘ব্যাপক বা বাস্তব সালাত’ বুঝানো হয়েছে তা চিহ্নিত করার উপায় হচ্ছে যেখানে সালাতের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়ে আহবান করা বা তা কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমায় সম্পন্ন করা বা সেজন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থানে আসার বিষয় উল্লেখ থাকে; সালাতের জন্য কোনো পূর্বশর্ত পালন করা, সালাতের পরে অন্য কাজের অবকাশ বা আদেশ এবং কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম বা প্রক্রিয়ায় তা সম্পাদন করার উল্লেখ থাকে, তখন তা দ্বারা আনুষ্ঠানিক সালাত বুঝানো হয়েছে বলে সাব্যস্ত হয়। অন্যদিকে যখন এসব বিষয় ছাড়া সালাত করার বা সালাত প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয় তখন সালাত শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলে সাব্যস্ত হবে। এই ব্যাপক অর্থের মধ্যেও অনুরূপ কিছু প্রায়োগিক দিক রয়েছে যা হলো: কুরআনের মধ্যে স্রষ্টার যে বিধান রয়েছে সেই বিধানের শিক্ষাচর্চার আয়োজন, বৈঠক, ধর্ম অধিবেশন। সালাতের আনুষ্ঠানিক উপাসনা পদ্ধতির বাধ্যতামূলক পর্যায়ের কাঠামো নির্ধারিত হবে সম্পর্কিত সকল আয়াত থেকে যতটুকু কাঠামো পাওয়া যায় তা চিহ্নিত করার মাধ্যমে। এবং প্রচলিত কাঠামোতে অতিরিক্ত কিছু থাকলে এবং তা আয়াতসমূহে বর্ণিত নির্দেশনার সম্পূরক হলে তা আপত্তিকর নয়, তবে সেটিকে বাধ্যতামূলক বা বিধান মনে করা যাবে না। আনুষ্ঠানিক সালাতের ক্ষেত্রেও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং বাস্তব জীবনে তা বাস্তবায়ন করাই হলো সালাত প্রতিষ্ঠার পরিপূর্ণ রূপ। এবং বাস্তব সালাতের ক্ষেত্রে বাস্তবে আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণই সালাত প্রতিষ্ঠা হিসেবে সাব্যস্ত হবে। উভয় ক্ষেত্রে সমগ্র জীবনে আল্লাহর বিধানকে বাস্তবায়নের উদ্যোগই সালাত, তবে প্রথম অবস্থায় আনুষ্ঠানিক বিষয়টি প্রাথমিক গুরুত্ব পায় এবং দ্বিতীয় অবস্থায় আনুষ্ঠানিক বিষয়টি গৌন গুরুত্ব পায়।
যে সকল আয়াতে সুনির্দিষ্টভাবে আনুষ্ঠানিক সালাতকে বুঝানো হয়েছে তা ছাড়া বাকি আয়াতগুলোতে সালাত শব্দটি আনুষ্ঠানিক সালাত এবং বাস্তব সালাত উভয় প্রসঙ্গে প্রযোজ্য। বিশেষ করে যে আয়াতগুলোতে সালাত শব্দটি দ্বারা বাস্তব সালাতকে বুঝানো হয়েছে তা হলো ৭০:২২-৩৪ এবং ১০৭:৪-৭। ৭০:২২-৩৪ আয়াতে মুসল্লীনের তথা সালাতকারীদের যে পরিচয় (সংজ্ঞা) উল্লেখ করা হয়েছে তাতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এ আয়াতসমূহে সালাত দ্বারা বাস্তব সালাতকে বুঝানো হয়েছে, আনুষ্ঠানিক সালাতকে নয়। অনুরূপভাবে ১০৭:৪-৭ আয়াতে যে ধরনের মুসল্লীনের জন্য দুর্ভোগের কথা বলা হয়েছে তাও বাস্তব সালাতকে নষ্ট করার (নষ্ট সালাত সম্পাদন করার) কারণে।
সুতরাং আল কুরআনে আনুষ্ঠানিক সালাতকেও সালাত বলা হয়েছে এবং বাস্তব সালাতকেও সালাত বলা হয়েছে। কুরআন অনুসারে সালাত বলতে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সালাতকে বুঝায় না।
যে সকল আয়াতে সুনির্দিষ্টভাবে আনুষ্ঠানিক সালাতকে বুঝানো হয়েছে তা হলো: ২:২৩৮-২৩৯, ৩:৩৯, ৪:৪৩, ৪:১০১-১০৩, ৪:১৪২-১৪৩, ৫:৬, ৫:৫৮, ৫:১০৬, ৮:৩৫, ৯:৫৪, ১০:৮৭, ১১:১১৪, ১৭:৭৮, ১৭:১১০, ২৪:৩৭, ২৪:৫৮, ৬২:৯-১১, ৭৩:২০।
উপর্যুক্ত আয়াতসমূহে যেভাবে সালাতের পূর্বশর্ত, প্রক্রিয়া, পূর্বাপর করণীয়, সময়সীমা ইত্যাদি উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট যে, তাতে আনুষ্ঠানিক সালাতকে বুঝানো হয়েছে, আনুষ্ঠানিক সালাত বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ব্যাপক ও বাস্তব সালাতকে বুঝানো হয়নি। অবশ্য আনুষ্ঠানিক সালাত যদি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে তা কোনো কাজে আসবে না (২:১৭৭, ১০৭:৪-৭) বিধায় আনুষ্ঠানিক সালাতের পাশাপাশি তা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাস্তবে সে শিক্ষা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাস্তব সালাত সম্পাদন করা ছাড়া সালাত প্রতিষ্ঠা করা পরিপূর্ণতা লাভ করে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেহেতু কুরআনে আনুষ্ঠানিক সালাতের জন্যও নির্দেশ রয়েছে তাই আনুষ্ঠানিক সালাতকে সম্পূর্ণত উপেক্ষা করা যায় না।
অনেকে ‘সালাত’ এবং ‘আমলে সালেহ’ বা ‘খায়ের’ তথা কল্যাণকর্ম সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন বলে দাবি করেন তথা ‘আমলে সালেহ’ বা ‘খায়ের’ ছাড়া স্বতন্ত্র কোনো আনুষ্ঠানিক সালাত থাকাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন। অথচ ২:২৭৭ ও ২২:৭৭-৭৮ আয়াতে ‘আমলে সালেহ’ ও ‘খায়ের’ এবং ‘সালাত প্রতিষ্ঠা’ পৃথকভাবে উল্লেখিত হয়েছে, যার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট যে, ‘আমলে সালেহ’ ও ‘খায়ের’ এবং ‘সালাত প্রতিষ্ঠা’ এর মধ্যে পরিধিগত মিল থাকলেও এ দুটি সব দিক থেকে হুবহু অভিন্ন বিষয় নয়, বরং এ দুটি বিষয়ের মধ্যে কিছুটা তাৎপর্যগত ভিন্নতাও রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ‘সালাত’ একটি ব্যাপকভিত্তিক বিষয় হলেও এর একটি আনুষ্ঠানিক দিক এবং বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সালাত প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি বিভিন্ন কল্যাণকর্মের উল্লেখের মাধ্যমে সালাতের বিশেষ ধরণ ও পরিসরগত স্বাতন্ত্র্য প্রতীয়মান হয় (২:১৭৭)। তাই সালাত বলতে ‘সঠিক জীবনব্যবস্থাকে নিবিড়ভাবে অনুসরণ’ বুঝানোর পাশাপাশি এর একটি আনুষ্ঠানিক কাঠামোও অনুশীলন করার নির্দেশনাকে কোনোক্রমে উপেক্ষা করা যেতে পারে না।
(ক) যখন সালাতের নির্ধারিত সময়সীমার উল্লেখ করা হয় তখন তা দ্বারা আনুষ্ঠানিক সালাতকেই বুঝানো হয়। কারণ অন্যথায় নির্ধারিত সময়সীমার উল্লেখের কোনো তাৎপর্য থাকে না। (৪:১০৩, ২৪:৫৮, ১৭:৭৮, ১১:১১৪)
(খ) যখন সালাতের জন্য ইয়াওমুল জুমুয়াতে নিদা বা আহবানের বিষয় উল্লেখ করা হয় তখন তা দ্বারা আনুষ্ঠানিক সালাতকে বুঝানো হয়। (৬২:৯, ৫:৫৮)
(গ) যখন সালাতের পূর্বশর্ত হিসেবে ওজু (গোসল) বা তায়াম্মুমের কথা উল্লেখ করা হয় তখন তা দ্বারা আনুষ্ঠানিক সালাতকে বুঝানো হয়। (৪:৪৩, ৫:৬)। ওজু শুধুমাত্র সাধারণ পরিচ্ছন্নতা নয়। কারণ, ওজুকে সালাতের পূর্বশর্ত করা হয়েছে এবং ওজুর জন্য কয়েকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। (৫:৬)
(ঘ) যখন ক্বিয়ামের মাধ্যমে সালাত শুরু এবং সাজদাহর মাধ্যমে সালাত শেষ করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয় তখন তা দ্বারা আনুষ্ঠানিক সালাতকে বুঝানো হয়। (৪:১০২)
(ঙ) যখন সালাতে কিছু বলা এবং তাতে মধ্যম মাত্রার স্বর অবলম্বনের নির্দেশনা প্রদান করা হয় তখন তা দ্বারা আনুষ্ঠানিক সালাতকে বুঝানো হয়। (৪:৪৩, ১৭:১১০)
(চ) যখন সালাতকে ক্বসর বা সংক্ষিপ্ত করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়, তখন তা দ্বারা আনুষ্ঠানিক সালাতকে বুঝানো হয়। (৪:১০১-১০২)
(ছ) ৪:১০২ আয়াতে উল্লেখিত ‘যারা এখনো সালাত করেনি’ তারা এসে সালাতে দাঁড়াবে নির্দেশনাটির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক সালাতকে বুঝানো হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
(জ) জুমুয়ার সালাতের জন্য কেনাবেচা বন্ধ করে আসতে হবে। সালাত শেষ হলে জমিনে (কর্মক্ষেত্রে) ছড়িয়ে পড়তে হবে। সালাত আল্লাহর স্মরণের জন্য এবং সালাতের পর বেশি করে আল্লাহর স্মরণ করতে হবে। আনুষ্ঠানিক সালাত আমাদেরকে গুরুত্বক্রম অনুসারে আগে পরে কাজ করার এবং যখন যে কাজ করা উচিত তখন তা করার শিক্ষা দেয় (৬২:৯)।
(ঝ) নির্ধারিত সময়ে আনুষ্ঠানিক সালাত হচ্ছে একটি শৃংখলা (discipline) যা অন্য সব কাজে শৃংখলা রক্ষা করার যোগ্যতা তৈরি করে। এছাড়া এর মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদাত ‘আনুষ্ঠানিক উপাসনা’ এবং ‘ব্যাপক কর্মকান্ডে একমাত্র আল্লাহর আদেশ ও অনুমোদনকে মূল নিয়ামক হিসাবে গ্রহণ’- এ দুটি স্তরে বিভক্ত হয়। মানুষের জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে মাথানত করার ব্যবস্থা না থাকলে সে সম্পূর্ণ অহংকারমুক্ত হয়ে সত্যিকারার্থে একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করার যোগ্য হয় না। কারণ, মানুষ অন্যান্য সৃষ্টির মত স্বয়ংক্রিয়ভাবে আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণকারী নয়, বরং তার মধ্যে ইচ্ছার স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত এরূপ মানসিকতা রয়েছে যা তাকে সচেতনভাবে বা অসচেতনভাবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা বা দাসত্ব করতে অথবা অন্য মানুষের উপর নিজেই প্রভুত্ব করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আনুষ্ঠানিক সালাত একমাত্র আল্লাহর উপাসনা ও দাসত্ব করার মানসিক প্রস্তুতি তৈরি করে এবং এরূপ মানসিক প্রস্তুতির পরীক্ষাস্বরূপ হয়।
(ঞ) সালাত একটি একক তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, যা কল্যাণমূলক কাজ (২২:৭৭-৭৮, ২:১৭৭), শূরা বা পরামর্শ (৪২:৩৮), দুআ বা প্রার্থনা (৭:৫৫, ১৭:১১০) এবং যিকর বা আল্লাহর স্মরণ (৫:৯১) এর পাশাপাশি স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখযোগ্য। সুতরাং সালাতকে কল্যাণকর কাজ, শূরা, প্রার্থনা এবং যিকরের সাথে পূর্ণরূপে সন্নিবেশিত বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত করে তার আনুষ্ঠানিক দিক থাকার বিষয়টিকে অস্বীকার করা সঙ্গত নয়।
প্রকৃতপক্ষে আনুষ্ঠানিক সালাতের একটি উপযোগিতা রয়েছে তবে সালাত নিছক অনুষ্ঠানসর্বস্ব নয় বরং সচেতন/উদ্দেশ্যমুখী অনুষ্ঠান। বস্তুত আনুষ্ঠানিক সালাতের মাধ্যমে ব্যক্তিকে একটি অনুষ্ঠানের কাঠামো ও অন্তর্নিহিত ভাবধারার মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে নিজ ব্যক্তিত্বকে পরিশীলিত করার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
মানুষের জীবনে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় বিষয়ের গুরুত্ব রয়েছে। আনুষ্ঠানিক বিষয় শৃংখলা, প্রশিক্ষণ, কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রে সম্পূরক মনস্তাত্ত্বিক উদ্দীপনা সৃষ্টি ইত্যাদির জন্য উপযোগী হয়ে থাকে। কিন্তু নিছক আনুষ্ঠানিকতা একটি মূল্যহীন বিষয়। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক বিষয় যদি অনুষ্ঠানসর্বস্বতা হয়ে পড়ে তবে তার কোনো গুরুত্ব নেই। এবং আনুষ্ঠানিক কাজ প্রতিষ্ঠার অর্থ কোনো আনুষ্ঠানিক কাজ যথাযথভাবে করে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সে শিক্ষাকে বাস্তবায়ন করা। আনুষ্ঠানিক সালাত প্রতিষ্ঠা করার অর্থও অনুরূপ। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক সালাত যথাযথভাবে সম্পাদন করে সালাতের শিক্ষা অনুযায়ী জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর স্মরণ অব্যাহত রেখে তদনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করলেই সালাত প্রতিষ্ঠা করা হয়। সালাতের অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে পূর্ণরূপে সালাত প্রতিষ্ঠা করা যায় না, আবার সালাতের অনুষ্ঠান করলে কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান পালনের অনুশীলন না করলে সে মুসল্লিদের (সালাতকারীদের) জন্য দুর্ভোগ (সূরা মাউন)।
আনুষ্ঠানিক সালাতের বাহ্যিক বাধ্যতামূলক কাঠামো হচ্ছে ‘ক্বিয়াম, (কুরআন থেকে বা কুরআন বাস্তবায়নের জন্য) কথা বলা (ক্বওল) ও সাজদাহ’। (৪:৪৩, ৪:১০২)
‘ক্বিয়াম’ শব্দের মূল অর্থ ‘দাঁড়ানো’। এর ইতিবাচক ভাবার্থ হলো উদ্যোগী হওয়া এবং নেতিবাচক ভাবার্থ হচ্ছে থমকে যাওয়া।
অনুরূপভাবে ‘সাজদাহ’ শব্দের মূল অর্থ হলো ‘কারো প্রতি ভক্তির অভিব্যক্তি, যে ভক্তির স্বরূপ যে সত্তার প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করা হবে তার সাথে ভক্তের সম্পর্কের ধরনের উপর নির্ভর করে’। সাজদাহর ভাবার্থ হচ্ছে ‘মনোভাবগত ও আচরণগতভাবে প্রণত হওয়া বা থাকা এবং ভক্তি প্রদর্শন বা নির্দেশ পরিপালনে নতশির হয়ে থাকা’।
বিচ্ছিন্নভাবে ‘ক্বিয়াম’, ‘কথা বলা (ক্বওল)’ ও ‘সাজদাহ’ করলে তা সালাত নয় এবং সেজন্য ওজু (গোসল) বা তায়াম্মুম করারও প্রয়োজন নেই। কিন্তু যখন তা আনুষ্ঠানিক সালাত হিসেবে একক কাঠামোবদ্ধভাবে করা হয় তখন সেজন্য ওজু (গোসল) বা তায়াম্মুম করার শর্ত রয়েছে। (৫:৬, ৪:৪৩)
ক্বিয়াম-সাজদাহর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক সালাত হওয়া এবং সালাত না হওয়া এই দুই অবস্থার পার্থক্য অনুধাবন করা যেতে পারে প্যারেড থেকে। সাধারণভাবে দাঁড়ানো বা হাঁটা প্যারেড নয়, কিন্তু যখন প্যারেড হিসেবে সুসংবদ্ধভাবে দাঁড়ানো ও মার্চ করা হয় তখন তা প্যারেড নামে সাব্যস্ত হয়। অনুরূপভাবে যখন আনুষ্ঠানিক সালাত হিসেবে ক্বিয়াম-সাজদাহ করা হয় তখন তা আনুষ্ঠানিক সালাত নামে সাব্যস্ত হয় এবং তার পূর্বে ওজু করতে হয়।
সালাত কী ও কী নয় তা নিয়ে এখনো ব্যাপক বিতর্ক লক্ষ্য করা যায়। এর অন্যতম একটি দিক হলো- আনুষ্ঠানিক সালাত আছে নাকি নেই?
আমরা যদি সালাতের মৌলিক অর্থ থেকে দেখা শুরু করি, তাহলে এ আরবি শব্দটিকে 'সংযোগ ও যোগাযোগ' অর্থে পাওয়া যায়।
এ সংযোগ বিশ্বাসীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বাসীরা যদি স্রষ্টার সাথে তাঁর বিধান অনুশীলনের মাধ্যমে সংযোগ বা যোগাযোগ রক্ষা না করে তাহলে তারা তার স্মরণ করতে পারবে না এবং তাঁর বিধান পালন থেকে বিমুখ হয়ে পড়বে।
স্রষ্টার বিধান মেনে চলার জন্য প্রয়োজন তাঁর বিধান জানা ও মানার প্রক্রিয়ায় নিজেকে সংযুক্ত রাখা। এই সংযুক্তিই সালাত।
স্রষ্টার বিধান অনুযায়ী কর্ম সম্পাদনের সংযুক্তি হিসেবে মানুষকে তিনটি প্রধান কর্মসূচী পালন করতে হয়। (১) স্রষ্টার উদ্দেশ্যে বিনয়ী হয়ে দাঁড়ানো তথা উদ্যোগী হওয়া, (২) স্রষ্টার বিধানের সীমারেখায় ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য যথা প্রার্থনা, অঙ্গীকার ও অন্যকে উদ্বুদ্ধকরণমূলক কথা, (৩) স্রষ্টার প্রতি সম্মান রেখে ও নিরহংকারের সাথে যে কোনো পরিস্থিতিতে তাঁর বিধানকে মেনে নেয়ার অভিব্যক্তি।
এ তিনটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত নাম হলো : (ক) ক্বিয়াম, (খ) ক্বওল এবং (গ) সাজদাহ।
এ ক্বিয়াম, ক্বওল ও সাজদাহর যোগফলই সালাত।
যখন এই সংযুক্তিকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয় তা হলো আনুষ্ঠানিক সালাত, যার উদ্দেশ্য হলো সেই সংযুক্তিকে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতীকী স্ব-প্রশিক্ষণ।
ক্বিয়াম, ক্বওল ও সাজদাহ যখন আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হয় তখন তা শব্দগুলোর ভাবার্থের চেয়েও প্রাথমিক স্বরূপকে বেশি ধারণ করে।
ক্বিয়াম অর্থ দাঁড়ানো। আমরা কাউকে দেখে যখন বলি সে দাঁড়িয়ে আছে এটাই দাঁড়ানোর অবস্থা।
ক্বওল অর্থ বক্তব্য প্রকাশ করা। আমরা যখন কারো সম্পর্কে বলি যে, সে কিছু বলছে, সেটাই কথা বলার অবস্থা।
সাজদাহ অর্থ মাথাবনত করে সম্মান জানানো। আমরা কারো যে কাজটি দেখে বলি সে সাজদাহ করছে সেটাই সাজদাহ করার অবস্থা।
আনুষ্ঠানিক সালাত করার পর যখন তা বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করা হয় সেটাই সালাত কায়েম বা প্রতিষ্ঠা করা।
কুরআনে নিছক আনুষ্ঠানিক সালাতের মূল্য নেই, তবে সালাত প্রতিষ্ঠার জন্য এই আনুষ্ঠানিক রূপকে উদ্দেশ্যনিষ্ঠ থেকে সম্পাদন করার নির্দেশনা রয়েছে।
কেউ কেউ বলেন, সালাত ও রুকূ'-সাজদাহ এসবের অর্থ হচ্ছে ‘কল্যাণকর কাজ করা’। তাঁরা বলেন যে, সালাত হবে সম্পূর্ণরূপে অনুষ্ঠান থেকে মুক্ত একটি ব্যবহারিক প্রক্রিয়া। তাঁরা কিছু যুক্তি উপস্থাপন করেন। নিম্নে তাঁদের উপস্থাপিত কতিপয় যুক্তি ও তার পর্যালোচনা উল্লেখ করা হলো।
১। ‘পূর্ব পশ্চিম সবই আল্লাহর অধিকারভুক্ত। তোমরা যেদিকেই মুখ ফিরাবে সেদিকেই আল্লাহর চেহারা রয়েছে। তিনি ব্যাপকত্বের অধিকারী ও জ্ঞানী’। (২:১১৫)
“পূর্ব পশ্চিমে মুখ ফিরানোর মধ্যে কোন পুণ্য নেই। পুণ্য আছে- ..... সালাত প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে, .....” (২:১৭৭)
আলোচনা: অনুষ্ঠানে কল্যাণ নেই, সালাত প্রতিষ্ঠায় কল্যাণ আছে, সুতরাং পূর্ব বা পশ্চিমে মুখ ফিরানো সালাতের আবশ্যকীয় শর্ত নয়।
‘প্রত্যেকের জন্য অভিমুখ আছে যেদিকে সে মুখ ফিরায়। সুতরাং তোমরা খায়রাত / কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা কর’। (২:১৪৮)
আলোচনা: প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ বা মতবাদ রয়েছে, গতিপথ ও রূপকল্প রয়েছে; মুসলিমদের অভিমুখ হলো প্রকৃত কল্যাণ অর্জন করা যা কোনো অনুষ্ঠাননির্ভর অভিমুখ নয় বরং কল্যাণকর কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে এ অভিমুখের সুফল লাভ করতে হয়।
‘তুমি (মুহাম্মাদ) যেখান থেকেই বের হও না কেন (তোমার বর্তমান কার্যনির্বাহ যেখান থেকেই কর না কেন) তোমার ওয়াজহুন / চেহারাকে আল মাসজিদুল হারামের দিকে ফিরাও (যেন তা তোমার অধিকারে আসে, কারণ সেটাই কার্যকর বিশ্বকেন্দ্র), এবং তোমরা যেখানেই থাক না কেন আল মাসজিদুল হারামের দিকে তোমাদের চেহারা ফিরাও (আল মাসজিদুল হারামকে তোমাদের সাংবিধানিক পরিচালনা কেন্দ্ররূপে পুনরুদ্ধারের জন্য এবং পুনরুদ্ধারের পর তা থেকে জারীকৃত নির্দেশনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য)” (২:১৫০)
এ আয়াতে সালাতের উল্লেখ নেই সুতরাং এটা সালাতের সাথে সম্পর্কিত নয়। এখানে সবসময় মসজিদে হারামমুখী থাকার নির্দেশই পাওয়া যায়।
পর্যালোচনা: ওয়াজহুন / চেহারা ফিরানোর ব্যাপকত্বের পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক সালাতে দাঁড়ানোর সময় সম্ভব ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আল মাসিজদুল হারামের’ দিকে মুখ ফিরানোই আয়াতের স্বাভাবিক মর্ম। কারণ সালাতের সাথে ক্বিবলার একটি সম্পর্ক রয়েছে (১০:৮৭)। তবে মনে রাখতে হবে, আল মাসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরানোর অনুষ্ঠানে কোনো কল্যাণ নেই যদি তা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা না হয়। সুতরাং আয়াতগুলোর বাস্তবভিত্তিক বা ব্যবহারিক তাৎপর্যের পাশাপাশি তা আনুষ্ঠানিক সালাতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আয়াতগুলোর বক্তব্য একই সাথে আনুষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক দ্বিমাত্রিক তাৎপর্যকে ধারণ করে, এর একটিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্যটিকে অস্বীকার করার কোনো আবশ্যকতা নেই।
২। কুরআন থেকে জানা যায়, সালাত আল্লাহর উদ্দেশ্যে, আল্লাহ ও ফেরেশতাদের কর্তৃক রাসূল ও মু’মিনদের উপর এবং মু’মিনদের কর্তৃক রসুলের উপর ইত্যাদি বিভিন্নরূপে সম্পাদিত হতে পারে এমন বিষয়ের নাম। সুতরাং সালাত হচ্ছে আল্লাহর বিধানের নিবিড়/ঐকান্তিক অনুসরণ এবং নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে ও পরস্পরকে সহযোগিতার মাধ্যমে তার সামাজিক বাস্তবায়ন।
পর্যালোচনা: সালাত মানে কোনো বাস্তব কাজের মাধ্যমে কারো প্রতি অনুরাগের বহি:প্রকাশ। সালাত যার প্রতি করা হবে তার সাথে সালাতকারীর সম্পর্কের ভিত্তিতে এর ধরণ নির্দিষ্ট হবে। সুতরাং আল্লাহর উদ্দেশ্যে বা আল্লাহর বিধানের সাথে সংযোগ অর্থে বান্দার সালাত, বান্দার প্রতি আল্লাহর সালাত এবং বান্দাদের পরস্পরের প্রতি সালাত- এ তিনটির ধরণ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আল্লাহর উদ্দেশ্যে সালাত দ্বারা অবশ্যই কোনো ব্যক্তি নিজে এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গই উপকৃত হয়, আল্লাহ নন। তবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সালাতের জন্য আনুষ্ঠানিক কাঠামো, ঐ অনুষ্ঠান থেকে শিক্ষা নেয়া, ঐ অনুষ্ঠানের সময়সীমা এবং তা সম্পাদনের প্রস্তুতিপর্বে করণীয় ইত্যাদি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, যা আনুষ্ঠানিক সালাতের নির্দেশক। অবশ্যই সালাত হলো বাস্তবে আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণ। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, সালাতের কোনো আনুষ্ঠানিক দিক থাকতে পারে না বা আনুষ্ঠানিক সালাতের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। বরং যেসব আয়াতে আনুষ্ঠানিক সালাতের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেগুলোর ভিত্তিতে বাস্তব সালাতের পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক সালাতও সম্পাদন করা কর্তব্য।
৩। সালাত এমন কিছু যা অন্যায় ও অশ্লীল কাজ দূর করে (২৯:৪৫)। আনুষ্ঠানিক সালাত দ্বারা তা হয় না। সুতরাং কুরআনে সালাত দ্বারা কোনো আনুষ্ঠানিক সালাতকে বুঝানো হয়নি।
পর্যালোচনা: আনুষ্ঠানিক সালাত দ্বারা অন্যায় ও অশ্লীল কাজ দূর হওয়া না হওয়া নির্ভর করে আনুষ্ঠানিক সালাতকে নিছক আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে নাকি তা দ্বারা বাস্তব সালাতের শিক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে তার উপর। আনুষ্ঠানিক সালাত যদি যথাযথ মানে থাকে তাহলেই তা অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে। কিন্তু যদি কোনো সালাতকারী সালাত সম্পাদনের পরেও অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত না থাকে, তার মানে হলো সে সালাতের উদ্দেশ্য ও শিক্ষা সম্পর্কে উদাসীন বা সে তার সালাতকে নষ্ট করে ফেলেছে, নষ্ট সালাত সম্পাদন করেছে। সে যথাযথ সালাত সম্পাদনকারী নয়। সুতরাং প্রকৃত/যথাযথ ও গ্রহণযোগ্য মানের সালাতই অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। এমতাবস্থায় যার সালাত তাকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখেনি সে যথাযথ সালাত করেনি হিসেবে সাব্যস্ত হবে। এটি সালাতের ব্যর্থতা নয়, কারণ তার সালাত গ্রহণযোগ্য ধরনের সালাতই নয়। নিছক আনুষ্ঠানিক সালাত ব্যক্তিকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখতে না পারার ফলে আনুষ্ঠানিক সালাতকে অস্বীকারের অবকাশ নেই। কারণ আনুষ্ঠানিক সালাত এবং নিছক আনুষ্ঠানিক সালাত একই বিষয় নয়। নিছক আনুষ্ঠানিকতার কোনো মূল্য নেই, উদ্দেশ্যমুখী আনুষ্ঠানিকতাই গ্রহণযোগ্য অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে উদ্দেশ্যমূলক কাজ করলে তাই যথেষ্ট হবে কি হবে না? এ প্রশ্নের উত্তর হলো- যে ধরনের মুসল্লী অনুষ্ঠান থেকে উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারে তাদের পরিচয়ই রয়েছে ৭০:১৯-৩৫ আয়াতে, অন্যদিকে যে ধরনের মুসল্লী অনুষ্ঠান থেকে উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারে না তাদের পরিচয়ই রয়েছে ১০৭:৪-৭ আয়াতে। যারা উদ্দেশ্য সামনে না রেখে অনুষ্ঠান করে তারা উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। এজন্য বলা হয়েছে, সালাতে কী বলো তা জানার আগে সালাতের কাছেও যেও না। ইসলামে নিছক অনুষ্ঠানের মূল্য নেই কিন্তু উদ্দেশ্যমুখী অনুষ্ঠানের মূল্য আছে। অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে যদি উদ্দেশ্যমূলক কাজ যথাযথভাবে করা সম্ভব হতো তাহলে অনুষ্ঠানের নির্দেশই থাকতো না। অনুষ্ঠান সচেতন সক্রিয়তার নিয়ামক। আল্লাহ অন্তর্যামী তবু তাঁর কাছে মৌখিক প্রার্থনার নিয়ম এবং যে প্রাণী যবেহ করতে আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি তা খেতে নিষেধাজ্ঞা অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে। সুতরাং সালাত অনুষ্ঠানসর্বস্ব হওয়া অর্থহীন কিন্তু সালাতের অনুষ্ঠান অপরিহার্য।
৪। সালাত তারাই করে যারা সালাতের উপর দায়িমুন (স্থায়ী) থাকে এবং যারা বঞ্চিত ও প্রার্থীদেরকে তাদের হক / অধিকার প্রদানসহ বিভিন্ন সৎকাজে তৎপর। (৭০:১৯-৩৪) সুতরাং সালাত বলতে আনুষ্ঠানিক সালাতকে বুঝায় না।
পর্যালোচনা: ৭০:১৯-৩৫ আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সালাতকেই সালাত বলা হয় না। বরং বাস্তব সালাতকেও (আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণ) সালাত বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে সালাত শব্দের অর্থ অনুসারে এর মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিকতা মূল বিষয় নয়, বরং আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণই মূল বিষয়। কিন্তু বিভিন্ন আয়াতে আনুষ্ঠানিক সালাতেরও নির্দেশনা রয়েছে। তাই বাস্তব সালাতের পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক সালাত সম্পাদন করাও মু’মিনদের করণীয়। সুতরাং এ কথা যেমন ঠিক যে, সালাত বলতে শুধু আনুষ্ঠানিক সালাত বুঝায় না, বরং বাস্তব সালাতকেও সালাত বলা হয়। তেমনি এ কথাও ঠিক যে, আনুষ্ঠানিক সালাতকেও সালাত বলা হয়, যেক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক সালাতের বিধান প্রসঙ্গে নির্দেশনা রয়েছে সেই অনুযায়ী বাস্তব সালাতের পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক সালাতও সম্পাদন করতে হবে।
৫। ১১:৮৭ আয়াতে নবী শুয়াইবকে তার ক্বওম যে প্রশ্ন করেছে “তোমার সালাত কি তোমাকে আদেশ / নির্দেশনা (আমর) দেয় যে, ...........”। আনুষ্ঠানিক সালাতের সাথে এ ধরনের আদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এর মানে হলো, দ্বীনের সাথে নবী শুয়াইবের ব্যবহারিক সংযোগ (সালাত), এটি আনুষ্ঠানিক নামাজ নয়।
পর্যালোচনা: সালাত আদেশ দেয়, (১) বাপদাদারা যাদের দাসত্ব করতো তা পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করতে হবে; (২) নিজ ইচ্ছামতো নিজের মালসম্পদ ব্যয় না করে আল্লাহর নির্দেশমতো ব্যয় করতে হবে। এর মানে হলো, সালাত এমন কিছু যা থেকে আদেশ / নির্দেশনা পাওয়া যায়। এটাই যথাযথ সালাতের বৈশিষ্ট্য। যে ব্যক্তি সালাত করে অথচ সমাজের ধর্মীয় ও আর্থসামাজিক অবস্থার সংস্কারে সক্রিয় হয় না সে যথাযথ সালাতই করে না। যথাযথ সালাতকারীকে বাপদাদা থেকে চলে আসা ধর্মের অন্ধ অনুসারী এবং পার্থিব কায়কারবারের ক্ষেত্রে নিজ ইচ্ছামতো আয়ব্যয়ের মতবাদের প্রবক্তারা একজন তিরস্কারযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন করে। সালাত হলো দ্বীনের সাথে আনুষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক সংযোগ তথা এর আনুষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক উভয় দিকই রয়েছে। আয়াতটি উভয় সালাতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সুতরাং আয়াতটি আনুষ্ঠানিক সালাতকে নাকচ করে না।
৬। ১৯:৫৯ আয়াতে সালাতকে নষ্ট করা এবং কামনা বাসনার অনুসরণ (ইত্তেবায়ে শাহাওয়াত) করার কথা পাশাপাশি বলা হয়েছে। যা দ্বারা বুঝা যায় যে, কামনা বাসনার অনুসরণ করা হচ্ছে সালাতকে নষ্ট করা এবং কামনা বাসনার অনুসরণ না করে দ্বীনের অনুসরণ করাই হচ্ছে সালাত।
পর্যালোচনা: ১৯:৫৯ এর তাৎপর্য হচ্ছে সালাত নষ্ট করার সাধারণ পরিণতি বা সেটার সাথে অনিবার্যভাবে এসে যাওয়া একটা স্বাভাবিক কর্মপদ্ধতি হচ্ছে কামনা বাসনার অনুসরণ করা। সালাত মানে দ্বীনের সাথে আনুষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক সংযোগ। আনুষ্ঠানিক সংযোগ যদি তার যথাযথ প্রক্রিয়ায় সম্পাদন না করে নষ্ট করা হয় অথবা ব্যবহারিক সংযোগকে যদি নষ্ট করা হয় তাহলে একই পরিণতি হবে। সুতরাং সঠিক জীবনব্যবস্থার নিবিড় অনুসরণ না করে কামনা বাসনার অনুসরণ করা হচ্ছে সালাতকে নষ্ট করা কথাটির মাধ্যমে সালাতের ব্যাপকতা বিষয়ক তাৎপর্য প্রতীয়মান হয়, তবে তা দ্বারা আনুষ্ঠানিক সালাত নাকচ হয় না।
৭। ৭:১৭০ আয়াতে কিতাবকে আঁকড়ে ধরা এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করাকে মুসলিহ হওয়া হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং সালাত হচ্ছে কিতাব অনুসারে আমলে সালেহ করা।
পর্যালোচনা : ৭:১৭০ আয়াত অনুসারে কিতাবকে আঁকড়ে ধরা এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করা সৎকর্মশীল-সংশোধনকারী (মুসলিহ) হওয়ার প্রধান দুটি শর্ত। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, সালাত অর্থ আমলে সালেহ। বরং সালাত এর অর্থ নির্ণয়ে সালাত সম্পর্কিত সকল আয়াতকেই বিবেচনা করতে হবে। সালাত হচ্ছে দ্বীনের সাথে আনুষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক সংযোগ।
পরিশেষে বলা যায় যে, শারীরিক অঙ্গভঙ্গির ভাষার (Body Language) মাধ্যমে যেমন মানুষের মানসিক অবস্থার (আনন্দ, দুঃখ, বিস্ময়, হ্যাঁ/না ইত্যাদি) প্রকাশ ঘটে, তেমনি আবেগ প্রকাশ, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, কোনো কর্তৃত্ব ও নির্দেশনাকে গ্রহণ করা, আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার প্রমাণবহ শারীরিক অভিব্যক্তিসম্পন্ন আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে আত্ম-সুশৃঙ্খলার প্রশিক্ষণ হতে পারে। সাধারণত দেখা যায়, মানুষ তার বিবেচনাবোধের প্রেক্ষিতে উত্তম রীতি হিসেবে কোনো অনুষ্ঠানের প্রথমে কুরআন পাঠ করে। কিন্তু যদি কুরআনকে শুধু এরূপ পাঠে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, তাহলে তা হবে অর্থহীন। অন্যদিকে যদি ঐ পাঠের মধ্যে জীবনের যাবতীয় কার্যক্রমে কুরআনের নির্দেশনাকে ভিত্তি বানানোর অঙ্গীকার থাকে, তাহলে তাই হবে ঐ পাঠের / রীতির সার্থকতা। তেমনি একটি আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির মাধ্যমে কুরআন পাঠ ও তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সে অনুসারে জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে কুরআনিক নির্দেশনার নিবিড় অনুসরণই হচ্ছে আনুষ্ঠানিক ও বাস্তব সালাত।