সালাত

কুরআনের আলোকে সালাত

বিশ্বপ্রভুর বিধানের নিবিড় অনুসরণমূলক আনুষ্ঠানিক ও বাস্তবমুখী সংযোগ কর্মসূচী

বিবিধ-২

১৩. রাকায়াত সংখ্যা

জিজ্ঞাসা: প্রতি ওয়াক্তের সালাতে রাকায়াত সংখ্যা কত?

জবাব: কুরআনে রাকায়াত সংখ্যা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ নির্দেশ নেই। সুতরাং প্রতি ওয়াক্তের সালাত এক রাকায়াত (ইউনিট) হিসেবে সম্পাদন করলে তা আপত্তিকর নয়। তবে পরোক্ষ নির্দেশনার ভিত্তিতে (৪:১০২) প্রতি ওয়াক্তের সালাত অন্তত দুই রাকায়াত হিসেবে সম্পাদন করার রীতি অবলম্বন করা যেতে পারে।

সালাতে রাকায়াত সংখ্যা নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছার বিষয়ে একমাত্র আয়াত হলো ৪:১০২।

কুরআনকেন্দ্রিক অনেক ভাইয়ের উপলব্ধি হচ্ছে এক রাকায়াতই যথেষ্ট এবং অনেক ভাইয়ের উপলব্ধি হচ্ছে অন্তত দুই রাকায়াত সম্পাদন করতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে রাকায়াত শব্দটি কুরআনে ব্যবহৃত পরিভাষা নয়। রাকায়াত শব্দটি এসেছে রুকূ' শব্দ থেকে। বুঝানো হয়, এক রুকূ'তে এক রাকায়াত। সাধারণ ধারনা হচ্ছে প্রতি রাকায়াতে একটি রুকূ' ও দুইটি সাজদাহ করতে হয়। প্রচলিত আনুষ্ঠানিকতায় রুকূ' বলতে বুঝানো হয় দাঁড়ানো অবস্থা থেকে দুই হাত হাঁটুতে রেখে অবনত হওয়া এবং সাজদাহ বলতে বুঝানো হয় বসা অবস্থা থেকে আভূমি অবনত হওয়া। রাকায়াত শব্দটি দ্বারা সালাতের ইউনিটকে বুঝানো হয়। সূরা নিসার ১০২ নং আয়াত থেকে সালাতের ইউনিটের ধারণা পাওয়া যায়। ৪:১০২ আয়াত থেকে জানা যায় সালাত শুরু হয় ক্বিয়ামের মাধ্যমে ও শেষ হয় সাজদাহর মাধ্যমে। সুতরাং একবার ক্বিয়াম থেকে সাজদাহ সম্পন্ন হওয়াকে যদি এক রাকায়াত বলা হয়, তবে দুইবার ক্বিয়াম থেকে সাজদাহ সম্পন্ন হওয়া হচ্ছে দুই রাকায়াত হওয়া। এই হিসাবে ৪:১০২ আয়াতে একবারের সালাতে ক্বিয়াম থেকে সাজদাহ দুইবার সম্পন্ন হওয়ার তথা সালাতের দুইটি রাকায়াতের পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে, যদিও রাকায়াত শব্দটি উল্লেখ করা হয়নি।

আয়াতটি নিম্নরূপ:

৪:১০২ :: ‘(কাফিরদের কর্তৃক ফিতনায় পড়ার আশংকাগ্রস্ত অবস্থায়) যখন তুমি (রসূল) তাদের মধ্যে থাক এবং তাদের জন্য সালাত কায়িম করো তখন তাদের মধ্য থেকে একদল যেন তোমার সাথে দাঁড়ায় এবং তারা যেন তাদের অস্ত্র সাথে নিয়ে সতর্ক থাকে। তারপর যখন তারা সাজদাহ করে নেবে (অন্তত একটি সাজদাহ দেবে) তখন তারা যেন তোমাদের পেছনে থাকে। এবং আসবে অন্যদল যারা সালাত করেনি তখন তারা যেন তোমার সাথে সালাত করে। তারা যেন সতর্কতা অবলম্বন করে এবং সশস্ত্র থাকে, কাফিররা তো এ সুযোগই চায় যে, যদি তোমরা তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও মালসামানা থেকে অসাবধান হয়ে যাও তবে যেন তারা একসাথে তোমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। অবশ্য বৃষ্টির কারণে যদি তোমরা কষ্টকর মনে করো বা যদি তোমরা অসুস্থ হয়ে পড় তাহলে অস্ত্র সরিয়ে রাখায় তোমাদের জুনাহ (গুনাহ) হবে না। তবে খুব সতর্ক হয়ে থাকবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদের জন্য অপমানজনক শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন’।

[প্রাসঙ্গিক নোট : ১. ফাআক্বামতা লাহুমুস সালাতা = তাদের নেতৃত্বমূলক অবস্থানে থেকে সালাত প্রতিষ্ঠা করে থাকো।

২. তায়েফ/ তায়েফাহ (একবচন) ও তায়েফীন (বহুবচন) অর্থ যাতায়াতকারী, যে কোথাও বারবার যাতায়াত করে বা করতে হয়।]

প্রতি ওয়াক্তে সালাতের বাধ্যতামূলক রাকায়াতসংখ্যা ২ বলে উপলব্ধির যুক্তি উপস্থাপন:

এ আয়াতের পূর্বের আয়াতে সফরে কাফিরদের ফিতনায় জড়িয়ে পড়ার আশংকাগ্রস্ত অবস্থায় সালাতের ক্বসর করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ আয়াতে তারই ধারাবাহিকতায় সালাতে ক্বসর করার পদ্ধতি এবং পূর্ণ সালাতের কাঠামো বলে দেয়া হয়েছে। এ আয়াতে একসাথে থাকা অবস্থায় জামায়াতে সালাতের নির্দেশ রয়েছে। তারপর যারা আশংকাগ্রস্ত তাদের সালাতে ক্বসর করার পদ্ধতি বলা হয়েছে।

এ আয়াত থেকে জানা যায়, ক্বিয়াম দ্বারা সালাত শুরু এবং সাজদাহ দ্বারা সালাত শেষ। আয়াতটি থেকে আরো জানা যায়, একদল অন্তত একটি সাজদাহ করছে এবং তারপর অন্যদল আসছে। এবং স্বাভাবিকভাবে দ্বিতীয় দলও প্রথম দলের মত অন্তত একটি সাজদাহ করবে, কারণ, তা না হলে দুই দলের মধ্য থেকে এক দলের সালাত ক্বসর হবে না। আবার স্বয়ং ইমাম যেহেতু উভয় দলের সাথে থাকছেন তাই তাঁর সালাত পূর্ণাঙ্গ হলে দুই দলের এক দলেরও সালাত পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না যেহেতু তারা কেউ পূর্ণ সময় ইমামের সাথে সালাত সম্পন্ন করছে না বরং অবশ্যই ইমামের সালাত তাদের উভয় দলের যৌথ সময়ের সমান কিন্তু একটি দলেরও হুবহু অনুরূপ নয়। তাই উভয় দলের সালাত ক্বসর হওয়ার কারণে উভয় দলের সাজদাহর পরিমাণ পরস্পর সমান এবং ইমামের সাজদাহ হচ্ছে উভয় দলের যৌথ পরিমাণের সমসংখ্যক।

যেহেতু ইমামের ওজর নেই, তাই ইমাম ক্বসর না করে পূর্ণ সালাত সম্পন্ন করলেন এবং দুই দল ক্বসরের অনুমতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্তত একটি করে সাজদাহ দেয়ার মাধ্যমে সালাত ক্বসর করলেন। সুতরাং এ কথা বলা যেতে পারে যে, সালাতের ক্বসর হলো অন্তত এক ইউনিট এবং সালাতের পূর্ণরূপ হলো অন্তত দুই ইউনিট। এ আয়াতে সালাত ক্বসর করার পদ্ধতি এবং পূর্ণ সালাতের কাঠামো একসাথে বলে দেয়া হয়েছে, যেহেতু কুরআনে সালাতের পূর্ণ কাঠামো প্রদান করা প্রয়োজন ছিল তাই প্রসঙ্গক্রমে এখানে তা উপস্থাপিত হয়েছে।

এখানে ইমামের সালাত ক্বসর হলে মুক্তাদীর সালাত অতিমাত্রার ক্বসর হয় এবং মুক্তাদীর সালাত ক্বসরের যথাযথ রূপ হলে ইমামের সালাত ক্বসর নয়। যেহেতু এ আয়াত ব্যতীত এবং কোথাও ক্বসরের ও পূর্ণ সালাতের রূপ উপস্থাপিত হয়নি, তাই অবশ্যই এ আয়াতে মুক্তাদীর সালাতই ক্বসরের একমাত্র রূপ এবং ইমামের সালাতই পূর্ণ সালাতের একমাত্র রূপ। সুতরাং পূর্ণ সালাত হচ্ছে প্রতি ওয়াক্তে দুই রাকায়াত এবং ক্বসর সালাত হচ্ছে এক রাকায়াত।

প্রতি ওয়াক্তে সালাতের বাধ্যতামূলক রাকায়াতসংখ্যা ১ বলে উপলব্ধির যুক্তি উপস্থাপন:

সালাতে বাধ্যতামূলকভাবে একাধিক রাকায়াতের বা একাধিক সাজদাহর প্রমাণ নেই। সুতরাং এক রাকায়াত সালাতও পূর্ণ সালাত, এবং একাধিক রাকায়াত মানে একাধিক পর্ব বিশিষ্ট সালাত, যে বিষয়ে আদেশও নেই, নিষেধও নেই।

কেউ কেউ মনে করেন যে, ৪:১০১-১০২ আয়াতে অপূর্ণ/ অর্ধেক সালাতের প্রসংগে বলার পর ৪:১০৩ আয়াতে পূর্ণ সালাত প্রতিষ্ঠা করতে বলা হয়েছে। অথচ বিষয়টি তা নয়। কারণ, ৪:১০৩ আয়াতে নিরাপদ থাকলে সালাত প্রতিষ্ঠা করতে আদেশ দেয়া হয়েছে, সালাত পূর্ণ করতে নয়। সুতরাং সালাত ক্বসর (সংক্ষিপ্ত) করা মানে অপূর্ণ/অর্ধেক সালাত করা নয়, বরং অদীর্ঘায়িত সালাত করা।

এর মানে এ নয় যে, ক্বসরকৃত সালাত আবার নতুন করে সম্পাদন করতে বলা হয়েছে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, নিরাপদ অবস্থায় সালাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে তথা যথানিয়মে বা স্বাভাবিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সংক্ষিপ্ত করার অর্থ দীর্ঘায়িত না করা, এর বিপরীতে হচ্ছে অসংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘায়িত করা। কেউ যদি এক রাকায়াত পড়ে এবং তাতে ‘সূরা বাকারা’ পড়ে, এবং অন্য কেউ যদি দুই রাকায়াত পড়ে এবং তাতে ‘সূরা ফালাক ও সূরা নাস’ পড়ে, তবে কার সালাত তুলনামূলক ক্বসর (সংক্ষিপ্ত / অদীর্ঘায়িত) হল? সালাত ক্বসর করা হল একাধিক রাকায়াত না করা অথবা এক রাকায়াতের ক্ষেত্রে উহাকে দীর্ঘায়িত না করে সংক্ষিপ্ত করা যেন কম সময়ে সম্পন্ন করা যায়। এমনকি মাত্র একটি আয়াত পড়েও এক রাকায়াত সালাত সম্পাদন করা যেতে পারে। সালাত ক্বসর/ সংক্ষিপ্ত করার অর্থ হচ্ছে, স্বস্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে যেরূপে সম্পাদন করা হয় তার চেয়ে সংক্ষেপে সম্পাদন করা। সুতরাং সালাত সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘায়িত করার বিপরীতে কোন মধ্যবর্তী নির্ধারিত রূপ / মান (স্ট্যান্ডার্ড) / সীমারেখা নেই। এটি এমন একটি আপেক্ষিক বিষয় যা ব্যক্তি ও সমষ্টির তাৎক্ষণিক বিবেচনার সাথে সম্পর্কিত। সাধারণ অবস্থায় সালাত দীর্ঘায়িত করতে হবে, যে দীর্ঘায়িত এর কোন সুনির্দিষ্ট মাত্রা নেই, এটা ব্যক্তির বিবেচনায় ‘অদীর্ঘায়িত নয়’ বলে বিবেচিত হলেই এর ন্যুনতম মাত্রা বজায় থেকেছে বলে সাব্যস্ত হবে। বিপরীতভাবে ক্বসর সালাত মানে ‘অদীর্ঘায়িত সালাত’ করা, যা কতটুকু অদীর্ঘায়িত হতে পারে তা পরিস্থিতি সাপেক্ষে নির্ধারিত হতে পারে।

৪:১০২ আয়াতে (ভয়ের অবস্থায়) সালাত কায়েমের ক্ষেত্রে রসূলকে মু’মিনদের একাধিক দলের / টীমের (তায়েফার) সালাতে নেতৃত্ব দেয়ার যে আদেশ দেয়া হয়েছে তাতে মু’মিনদের উভয় দলের সালাত ক্বসরকৃত / সংক্ষিপ্ত কিন্তু অপূর্ণ নয়। কুরআনে অপূর্ণ / অর্ধেক ও পূর্ণ সালাতের কথা বলা হয়নি, বরং সংক্ষিপ্ত / অদীর্ঘায়িত এবং অসংক্ষিপ্ত / দীর্ঘায়িত সালাতের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং ৪:১০২ আয়াত অনুসারে (ভয়ের অবস্থায়) রসূল একই ওয়াক্তে একাধিক দলের সাথে একাধিক বার (ক্বসরকৃত / সংক্ষিপ্ত) সালাত প্রতিষ্ঠা করার জন্য বা তিনি নিজে একাধিক পর্ব বিশিষ্ট/ একাধিক রাকায়াত বিশিষ্ট (তথা অন্তত দুই রাকায়াত বিশিষ্ট) সালাত প্রতিষ্ঠা করার জন্য আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন। এখানে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি যে, ভয়ের অবস্থা না থাকলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে একাধিক পর্ব বিশিষ্ট/ একাধিক রাকায়াত বিশিষ্ট সালাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুতরাং একাধিক রাকায়াত বিশিষ্ট সালাত প্রতিষ্ঠা করা বাধ্যতামূলক নয়। অন্য কথায় প্রতি ওয়াক্তে সালাতের বাধ্যতামূলক রাকায়াতসংখ্যা ১।

উপলব্ধিদ্বয়ের তুলনামূলক পর্যালোচনা এবং তথ্যগত সিদ্ধান্ত:

উপর্যুক্ত দুইটি উপলব্ধির মধ্যে প্রথমটি প্রাথমিক উপলব্ধি যার উৎকর্ষিত রূপ হচ্ছে দ্বিতীয়টি। তবে প্রথম উপলব্ধিরও একটি আবেদন রয়েছে, অর্থাৎ দুই রাকায়াত বাধ্যতামূলক না হলেও দুই রাকায়াত করে চর্চা করার রীতি সাধারণভাবে অবলম্বনযোগ্য বলে সাব্যস্ত হয়। কারণ যদিও এক রাকায়াত সম্পাদন করাতে নিষেধাজ্ঞা নেই, তবুও আয়াতের সমগ্র বক্তব্য কাঠামো থেকে পরোক্ষভাবে অন্তত দুই রাকায়াত সম্পাদন করার রীতিই অধিক যুক্তিবহ বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ, রসূলের সাথে দুটি তায়েফা (টীম) অন্তত এক রাকায়াত করে সম্পাদন করেছেন এবং তিনি উভয় তায়েফার সাথে ছিলেন বিধায় তিনি অন্তত দুই রাকায়াত সম্পাদন করেছেন। ক্বসর যেমন সময় এবং ক্বিরায়াতের দীর্ঘতার দিক থেকে সংক্ষিপ্তকরণ হতে পারে, তেমনি ইউনিটসংখ্যার দিক থেকেও হতে পারে। সে হিসেবে স্বাভাবিক ইউনিটসংখ্যা (রাকায়াতসংখ্যা) অন্তত দুই এবং তদানুসারে ক্বসরকৃত ইউনিটসংখ্যা (রাকায়াতসংখ্যা) এক, এভাবে অনুশীলন করার অবকাশ রয়েছে। এছাড়া রিপিটিশন, রিভিশন, রিসার্চ ইত্যাদি বাস্তব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিধায় ৪:১০২ আয়াত অনুযায়ী সালাত সম্পাদনের আদেশ পালনের নির্বাহী কর্মকান্ডস্বরূপ প্রতি ওয়াক্তে দুই রাকায়াত বিশিষ্ট সালাত অনুশীলন করা যেতে পারে, যা পরিস্থিতি অনুযায়ী কম বেশি করা যায়। বিশেষ করে, ইয়াওমুল জুময়াতে তথা জুময়ার সালাত হিসেবে যে সালাত চর্চা করা হয় তাতে ‘দুই রাকায়াত’ সালাতই ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। প্রচলিত ৫ ওয়াক্ত সালাতের মধ্যে ‘সালাতিল ফজর’ দুই রাকায়াত পড়া হয়। এবং অন্যান্য ওয়াক্তে দুইয়ের অধিক রাকায়াত পড়া হলেও মূলত প্রথম দুই রাকায়াতকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় বা পরবর্তী রাকায়াতগুলোর তুলনায় বিশেষ ধরনে পড়া হয়। ১৫:৮৭ আয়াতকেও এ বিষয়ে পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে কেউ যদি যে কোনো ওয়াক্তে একেক বার একেকভাবে যেমন দুই রাকায়াত, তিন রাকায়াত, চার রাকায়াত, পাঁচ রাকায়াত পড়ে তাতে কোন আপত্তির দিক নেই। অনুরূপভাবে কেউ যদি প্রতি রাকায়াতে দুই বা তিন বা চার সাজদাহ করে তাতেও কোন আপত্তির দিক নেই। যদি শৃঙ্খলার কথা বলা হয়, তবে একাকী পড়ার ক্ষেত্রে এটি কোনো সমস্যা নয়, এবং যৌথভাবে পড়ার ক্ষেত্রেও ইমামের অনুসরণ করাই শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে দেয়, সুতরাং সেক্ষেত্রেও তা সমস্যা নয়। অন্তত দুই রাকায়াত করে সালাত করা একদিকে যেমন শৃঙ্খলার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আয়াতের নির্দেশনার ভিত্তিতে সুসঙ্গত, অন্যদিকে তেমনি ধারাবাহিক চর্চার সাপেক্ষেও ভারসাম্যপূর্ণ বলে সাব্যস্ত হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, ব্যক্তিগতভাবে সালাত করার সময় কেউ সাধারণ অবস্থায় যত বেশি রাকায়াতই সম্পাদন করুক না কেন, তা আপত্তিকর নয়। ধরি একজন ব্যক্তি ছয় রাকায়াত সম্পাদন করে থাকে এবং ক্বসরে পাঁচ বা চার বা তিন বা দুই বা এক রাকায়াত সম্পাদন করলো, পরিস্থিতির ধরন অনুসারে, আমরা কুরআন অনুসারে এতে আপত্তিজনক কিছু পাই না। তবে সাধারণভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় (বিশেষ করে জামায়াতে সালাতের সালাতের ক্ষেত্রে) অন্তত দুই রাকায়াত সম্পাদন করার রীতি এবং সে হিসেবে ক্বসরে এক রাকায়াত সম্পাদন করার রীতি অনুশীলন করা যেতে পারে।

{একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, ৪:১০২ আয়াতে (ভয়ের অবস্থায়) একই ওয়াক্তে একাধিক দলের (তায়েফার) সাথে রসূল একাধিকবার সালাত সম্পাদনের নির্দেশনা পাওয়া যায়। সুতরাং ইমাম একই ওয়াক্তে একাধিক দলের (তায়েফার) ইমামতি করতে পারেন। এছাড়া যে কেউ একই ওয়াক্তে একাধিকবার সালাত সম্পাদন করতে পারে, এতে কোনো নিষেধ নেই।}

১৪. রুকূ'-সাজদাহর সংখ্যা

জিজ্ঞসা: সালাতের প্রতি রাকায়াতে রুকূ’-সাজদাহর সংখ্যা কয়টি?

জবাব: ৪:১০২ আয়াত অনুযায়ী বুঝা যায় যে, সালাত শেষ হবে সাজদাহর মাধ্যমে। তাতে সাজদাহর কোন সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। তাই অন্তত একটি সাজদাহ করাই যথেষ্ট সাব্যস্ত হয়। কিন্তু প্রচলিত নিয়মানুসারে প্রতি রাকায়াতে দুই সাজদাহ করলে এবং ক্বসর সালাতে এক সাজদাহ করলে তাও একটি গ্রহণযোগ্য রীতি হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রচলিত নিয়মে ৫ ওয়াক্ত সালাতে রাকায়াত সংখ্যা দেখা যায় ২-৪-৪-৩-৪। আমরা আগেই দেখেছি যে, কুরআন অনুযায়ী ৫ ওয়াক্ত সালাত বাধ্যতামূলক নয়, বরং ৩ ওয়াক্ত সালাত বাধ্যতামূলক। আবার ৪:১০২ আয়াত অনুসারে প্রতি ওয়াক্তে যদিও অন্তত ১ রাকায়াত সালাত সম্পাদন করাই বাধ্যতামূলক বা যথেষ্ট, তবু অন্তত দুই রাকায়াত করে সম্পাদন করাই অধিক সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য রীতি হিসেবে সাব্যস্ত হয়। এখন প্রতি রাকায়াতে কয়টি সাজদাহ করা বাধ্যতামূলক? যেহেতু কোনো আয়াতে এ বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে কোনো সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি, তাই অন্তত ১টি সাজদাহ করা বাধ্যতামূলক বা যথেষ্ট। ৪:১০২ আয়াতে কয়টি সাজদাহ তা বলা হয়নি, কিন্তু অন্য আয়াতের মাধ্যমে একাধিক সাজদাহর রীতি পরিপালন করলে তা সাংঘর্ষিক হবে না। প্রচলিত রীতিতে প্রতি রাকায়াতে ২টি সাজদাহ করা হয় এবং ৫০:৪০ আয়াতের পরোক্ষ তথ্য অনুসারে এ রীতিটি গ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত হয়। নিচে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

৫০:৩৯-৪০ আয়াতে বলা হয়েছে,  ফাসবির আলা মা ইয়াক্বূলূনা ওয়া সাব্বিহ বিহামদি রব্বিকা ক্বাবলা তুলুয়িশ শামসি ওয়া ক্বাবলাল গুরুবি। ওয়া মিনাল্লাইলি ফাসাব্বিহহু ওয়া আদবারাস সুজূদি

এখানে, আদাবারাস সুজূদি বা ‘সাজদাহসমূহের অব্যবহিত পরসমূহেও’ আল্লাহর তাসবীহ করতে বলা হয়েছে। এখানে ‘আদবার’ শব্দটি বহুবচন হওয়ায় প্রতিটি ওয়াক্তের সালাত সমাপ্ত হওয়ার অব্যবহিত পরে তাসবীহ করতে হবে। আদবারাছ ছুজূদ শব্দে আদবারা শব্দের কারণে অন্তত তিন ওয়াক্তে বাধ্যতামূলক সাজদাহর প্রসঙ্গ নির্ধারিত হয় এবং যেহেতু সাজদাহ সালাতের সাথেও সম্পর্কিত তাই এটি পরোক্ষভাবে অন্তত তিন ওয়াক্তে বাধ্যতামূলক সালাতের জন্যও প্রযোজ্য হয়ে যায়।

ছুজূদ শব্দটি মাসদার এবং একবচন। আদবারাছ ছুজূদ শব্দটিতে আদবার শব্দের কারণে ছুজূদ শব্দটি বহুবচনের স্থলাভিষিক্ত বা বহুবচনের অর্থবোধক ধরা যেতে পারে। এটি হচ্ছে একবচন যদি বহুবচনকে অনুসরণ করে তবে একবচনটি বহুবচনের স্থলাভিষিক্ত বা বহুবচনের অর্থবোধক হয়। এরূপ আরো শব্দ রয়েছে যা কুরআনে ক্ষেত্রবিশেষে বহুবচনের অর্থবোধক অবস্থায় প্রয়োগ হয়েছে, যেমন রফীক্ব, যহীর ইত্যাদি।

প্রতি ওয়াক্তে দুই রাকায়াতে একটি করে সাজদাহ হলে তিন ওয়াক্তে সামগ্রিকভাবে বহুবচন হয়। কিন্তু হাফিযু আলাস সালাওয়াতি (তোমরা সালাতসমূহকে হেফাযত করো) বাক্যের মাধ্যমে যেমন সপ্তাহ জুড়ে সকল সালাত বা সমগ্র জীবনের সকল সালাতকে বুঝানো যেতে পারে, তেমনি অন্যান্য আয়াত সাপেক্ষে বুঝা যায় যে, ‌এটি প্রাত্যহিক ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ দৈনন্দিন তিনটি ওয়াক্তের সালাত বহুবচনের শর্ত পূরণ করে। অনুরূপভাবে আদবারাছ ছুজূদ শব্দের প্রয়োগ হিসেবে যেমন দৈনন্দিন সকল ওয়াক্তের সাজদাহসমূহকে বুঝানো যেতে পারে, তেমনি এর দ্বারা পরোক্ষভাবে প্রতি ওয়াক্তে বহু সাজদাহ করার অবকাশ তৈরি হয়। এক ওয়াক্তে সাজদাহসমূহ (বহুবচন) হতে হলে প্রতি রাকায়াতে সাজদাহসংখ্যা হতে হয় অন্তত ২টি। এভাবে দুই রাকায়াতে সাজদাহ সংখ্যা হয় ৪টি। আরবিতে বচন তিন প্রকার, একবচন, দ্বিবচন ও বহুবচন। দুইয়ের বেশি হলেই তা বহুবচন হয়। সুতরাং প্রতি রাকায়াতে ২ সাজদাহ হলে প্রতি ওয়াক্তে হয় ৪ সাজদাহ, যা বহুবচনের শর্ত পূর্ণ করে। অন্যদিকে প্রতি রাকায়াতে ১ সাজদাহ হলে এবং প্রতি ওয়াক্তে সাধারণভাবে ২ রাকায়াত হলে প্রতি ওয়াক্তে মোট হয় ২ সাজদাহ, যা বহুবচনের শর্ত পূরণ করে না। সুতরাং এ আয়াতের পরোক্ষ তথ্য অনুসারে, সালাতে প্রতি রাকায়াতে অন্তত দুটি সাজদাহ করার রীতি অবলম্বন করা যেতে পারে। এবং এটি পরম্পরাগত অনুশীলনের মধ্যেও রয়েছে, যা কুরআনের এই আয়াতের পরোক্ষ তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাই প্রতি রাকায়াতে দুটি সাজদাহ করার রীতি অনুশীলন করা যেতে পারে।

যেহেতু ছুজূদ শব্দটিকে মাসদার হিসেবে গ্রহণ করলে প্রতি ওয়াক্তে মাত্র এক সাজদাহ করাও অসঙ্গতিশীল বলা যায় না এবং যেহেতু কুরআনে প্রতি রাকায়াতে সাজদাহ সংখ্যা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ নির্দেশ নেই, সেহেতু প্রতি রাকায়াতে অন্তত একটি সাজদাহ করলেও তা আপত্তিকর নয়। অন্য কথায়, প্রতি রাকায়াতে এক সাজদাহর বেশি বাধ্যতামূলক নয়।

কিন্তু রুকূ'র ক্ষেত্রে এরূপ কোন নির্দেশনা না থাকায় একটি রুকূ'ই যথেষ্ট বলে বিবেচনা করা হয় এবং প্রচলিত রীতিতে প্রতি রাকায়াতে একটি রুকূ'ই করা হয় এবং সেই প্রেক্ষিতে সালাতের একটি ইউনিটকে এক রাকায়াত বলা হয়।

৪:১০২ আয়াতে ক্বিয়ামের মাধ্যমে সালাত শুরু এবং সাজদাহর মাধ্যমে শেষ হওয়ার কথা বুঝা যায়। একই রাকায়াতে একবার ক্বিয়াম এবং একবার সাজদাহ  করতে হবে এভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। তাই রুকূ' থেকে দাঁড়ালে এবং তারপর সাজদাহ করলে তা আপত্তিকর নয়। এছাড়া দাঁড়ানো অবস্থা থেকে রুকূ' করার পর রুকূ'র সমাপ্তিতে আবার পূর্বাবস্থায় যাওয়া তথা দাঁড়ানো খুবই স্বাভাবিক। তবে কারো জন্য যদি রুকূ' অবস্থা থেকেই সাজদাহ করা সহজ হয় সে সেভাবে করতে পারে। এক কথায় রুকূ' থেকে দাঁড়িয়ে তারপর সাজদাহ করবে নাকি রুকূ' থেকে সাজদাহ করবে এ বিষয়ে রুকূ'কারী নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

সালাতের প্রতি রাকায়াতে রুকূ' কয়টি এবং ক্বসর সালাতে রুকূ' করা হবে কিনা?

প্রচলিত রীতিতে দেখা যায়, সালাতের প্রতি রাকায়াতে একটি রুকূ' করা হয়, দুইটি সাজদাহ করা হয়। সুরা নিসার ১০২ নং আয়াতে আমরা রুকূ'র কোনো উল্লেখ পাই না। যেহেতু ক্বসর সালাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে সালাতকে সংক্ষিপ্ত করা তাই সাধারণভাবে সালাতে যে রুকূ' করা হয় ক্বসর সালাতে তা করা বা না করা কতটুকু সংক্ষিপ্ত করা হবে তার উপর নির্ভর করে। অবশ্য অন্য কোন আয়াতেও সালাতের মধ্যে রুকূ' করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি বিধায় সালাতে রুকূ' করাকে বাধ্যতামূলক বলা যাবে না।

১৫. আত্তাহিয়্যাতু

জিজ্ঞাসা: সালাতের ‘আত্তাহিয়্যাতু’ পড়া যাবে কিনা?

জবাব: প্রচলিত সালাতে আত্তাহিয়্যাতু’ নামে যা পড়া হয় তার পূর্ণরূপ নিম্নে অর্থসহ উল্লেখ করা হলো:

আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস সালাওয়াতি ওয়াত তাইয়িবাত, আস সালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু, আস সালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস সলিহীন, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু

অর্থ: “আল্লাহর জন্য তাহিয়্যাত (হায়াতের জন্য শুভ কামনা/অভিবাদন), সালাওয়াত (সালাতসমূহ/অনুগ্রহ প্রার্থনা), তাইয়িবাত (পবিত্রতা)। হে নবী, আপনার উপর সালাম (শান্তি) এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত (দয়া) ও বরকত (সমৃদ্ধি) হোক। আমাদের উপর এবং আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাদের উপর সালাম (শান্তি) হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া ইলাহ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রসূল”।

তাহিয়্যাত অর্থ ‘কারো হায়াতের জন্য শুভ কামনা’। কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাহিয়্যাতুহুম ফীহা ছালামুন (তাতে/ জান্নাতে তাদের শুভ কামনা/অভিবাদন হবে ‘শান্তি’) (১০:১০, ১৪:২৩)। সুতরাং তাহিয়্যাত যে সালাম, তা সুস্পষ্ট।

সূরা নিসার ৪:৮৬ আয়াতে তাহিয়্যাতের বিষয়ে বলা হয়েছে-

‘যখন কেউ তোমাদেরকে তাহিয়্যাত (বা সালাম) করে তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম বা অন্তত অনুরূপভাবে তাকে তাহিয়্যাত (বা সালাম) করো। আল্লাহ অবশ্যই প্রতিটি বিষয়ে হিসাব নেবেন’। (৪:৮৬)

কুরআনের কোথাও আল্লাহর জন্য তাহিয়্যাতের কথা বলা হয়নি, এবং বাস্তবে আল্লাহর জন্য তাহিয়্যাত হতে পারে না। আল্লাহর জন্য হতে পারে হামদ  তাসবীহ এবং রসূলের (ও মানুষের) জন্য হতে পারে সালাম (তথা তাহিয়্যাত)। কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে-

‘রসূলদের জন্য সালাম এবং আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্য হামদ’। (৩৭:১৮১-১৮২)

আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাম, কিন্তু আল্লাহকে সালাম নয়। যেমন, বলা হয়েছে, তাহিয়্যাতাম মিন ইনদিল্লাহ (২৪:৬১)। অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে তাহিয়্যাত। কিন্তু আল্লাহর জন্য তাহিয়্যাত নয়।

কেউ কেউ আল্লাহর জন্য তাহিয়্যাত বলার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে গিয়ে বলেন যে, আল কুরআনে আল্লাহকে কর্জে হাসানাহ বা উত্তম ঋণ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অথচ আল্লাহকে ঋণ দেয়া যায় না। তেমনি আল্লাহর জন্য তাহিয়্যাত বলতে দোষ কোথায়?

কুরআনের আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্ট যে, কর্জে হাসানাহর ক্ষেত্রে আসলে আল্লাহ ঋণ গ্রহণ করেন একটি রূপক অর্থে এবং তা হলো রসূলের মাধ্যমেই তা সংগৃহীত ও বণ্টিত হয়, মানুষের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত অর্থনৈতিক বণ্টন ব্যবস্থার বাস্তবায়নের জন্য।

বাগধারার সুনির্দিষ্ট বাগবিধি রয়েছে, একটি রূপক কথার উদাহরণ সামনে এনে যে ক্ষেত্রে সেরূপ রূপক প্রয়োগ নেই সেক্ষেত্রেও চালিয়ে দেয়া যায় না। সাধারণ ভাষারীতিতেও এরূপ প্রায়োগিক বিচ্যুতি গ্রহণযোগ্য হয় না। যেমন, ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ এর অনুসরণে ‘নগরে মানে না আপনি মেয়র’ বলা যায় না।

কুরআনের কোথাও রূপক কোনো অর্থেও আল্লাহর জন্য তাহিয়্যাত বলা হয়নি। সুতরাং তাহিয়্যাতের প্রসঙ্গে কুরআন থেকে যে সূত্র পাওয়া যায় সেটাই এক্ষেত্রে চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করা হবে, এবং তা হলো: তাহিয়্যাত হচ্ছে সালাম, যা মানুষের জন্য প্রযোজ্য, আল্লাহর জন্য নয়, আল্লাহর জন্য হচ্ছে হামদ বা নিরংকুশ প্রশংসা।

কুরআনে তাহিয়্যাত শব্দটি ছয়বার ব্যবহৃত হয়েছে এবং প্রতিবার একই অর্থে। ৪:৮৬:৩, ১০:১০:৫, ১৪:২৩:১৫, ২৪:৬১:৬৪, ২৫:৭৫:৮, ৩৩:৪৪:১।

আল কুরআনে তাহিয়্যাত শব্দ কি অর্থে এবং কি ধরনে ব্যবহৃত হয়েছে তা লক্ষ্য করুন। আলহামদু লিল্লাহ এর মতো করে আততাহিয়্যাতু লিল্লাহ বলা সঙ্গত হবে না। কারণ, ছালাম ও হামদের মধ্যে স্পষ্টভাবে পার্থক্য রেখা টেনে বলা হয়েছে, ওয়া ছালামুন আলাল মুরছালীন, ওয়াল হামদু লিল্লাহি রব্বিল আলামীন (রসূলদের জন্য সালাম এবং আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্য হামদ)। সুতরাং আছ ছালামু লিল্লাহি ওয়াল হামদু বলা সঙ্গত হবে না, অনুরূপভাবে আত তাহিয়্যাতু লিল্লাহি বলা সঙ্গত হবে না।

দ্বিতীয় আপত্তি: আত্তাহিয়্যাতু এর মধ্যে দ্বিতীয় একটি আপত্তির দিক হলো, এতে রসূলকে সম্বোধন করে বলা হয়, ইয়া আইয়ুহান্নাবিয়্যু (হে নবী)। অথচ আমরা এখন তা বলতে পারি না, কারণ রসূল আমাদের মধ্যে উপস্থিত নেই, জীবিত নেই। মৃত ব্যক্তিকে সম্বোধন করে কোনো কথা বলা যেতে পারে না। মৃত ব্যক্তি আমাদের কোনো কথা বা সালাম শুনতেও পারেন না এবং তার জবাবও দিতে পারেন  না।

একটি ভাববার বিষয় হলো, স্বয়ং নবী মুহাম্মাদ (সা.) কি সালাতে বলেছেন যে, “হে নবী, সালাম তোমাকে এবং সালাম আমাদেরকে এবং সালাম আল্লাহর নেক বান্দাদেরকে”।

সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, সালাতে প্রচলিত আত্তাহিয়্যাতু পড়া সঙ্গত হবে না।

১৬. দরুদ

জিজ্ঞাসা: সালাতের শেষ বৈঠকে নবীর উপর সালাত বা দরুদ করা হয়, এটিকে ‘দরুদে ইবরাহীম’ বলে। সালাতে বা সালাতের বাইরে এ দরুদটি পড়া যাবে কিনা?

জবাব: সালাতে দরুদ নামে যা পড়া হয় তা হলো: আল্লাহুম্মা সল্লি আলা মুহাম্মাদিওঁ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ, কামা সল্লায়তা আলা ইবরাহীমা ওয়া আলা আলি ইবরাহীম, ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ; আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিওঁ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ, কামা বারাকতা আলা ইবরাহীমা ওয়া আলা আলি ইবরাহীম, ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ

এ দরুদটির অর্থ হলো: “হে আল্লাহ, আপনি মুহাম্মাদের উপর ও তাঁর বংশীয়দের উপর সালাত করুন, যেভাবে আপনি ইবরাহীমের উপর ও তাঁর বংশীয়দের উপর সালাত করেছেন। নিশ্চয় আপনি প্রশংসিত ও মর্যাদাবান। হে আল্লাহ, আপনি মুহাম্মাদের উপর ও তাঁর বংশীয়দের উপর বরকত দান করুন, যেভাবে আপনি ইবরাহীমের উপর ও তাঁর বংশীয়দের উপর বরকত দান করেছেন। নিশ্চয় আপনি প্রশংসিত ও মর্যাদাবান”।

এ দরুদটির পর্যালোচনায় প্রথমেই উল্লেখ্য যে, সূরা বাকারার ২৮৫ আয়াতসহ অনেক আয়াতে নবী ও রসূলদের মধ্যে পার্থক্য করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং ৪:১৫০-১৫১ আয়াতে রসূলদের মধ্যে পার্থক্য করাকে প্রকৃত বাস্তবতা বা সত্য প্রত্যাখ্যান হিসাবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এই পার্থক্যের প্রধান দিক হলো ঈমানের ক্ষেত্রে পার্থক্য। অর্থাৎ কারো উপর ঈমান করা এবং কারো উপর ঈমান না করা। এরপর সামিগ্রকভাবে অতীত রসূলদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ বা সামগ্রিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে তারতম্য করাও তাঁদের মধ্যে পার্থক্যের একটি বাস্তব দিক। আমরা এরূপ কোনোভাবে তাঁদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না। একটি আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ রসূলদের একজনের উপর অন্যজনকে বিশিষ্টতা দিয়েছেন (২:২৫৩)। এটি আল্লাহর নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু আমাদের প্রতি নির্দেশ হলো আমরা নবীদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবো না। বিশেষ করে যেহেতু কুরআনে বলে দেয়া নাই যে, আল্লাহ অমুক নবীর চেয়ে অমুক নবীকে বেশি মর্যাদা দিয়েছেন। তাই যে নবীকে যে বিশিষ্টতা দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সে নবীর সে বিশিষ্টতাসহ আমরা তাঁকে স্মরণ করবো। কিন্তু আমরা সামগ্রিকভাবে কাকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে এরূপ কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি না।

অথচ নামাজে যে দুরুদ পড়ার প্রচলন করা হয়েছে তাতে বলা হয় যে, “হে আল্লাহ, আপনি ইবরাহীমকে যেভাবে অনুগ্রহ করেছেন, মুহাম্মাদকে সেভাবে অনুগ্রহ করুন”। তার মানে নবী ইবরাহীমের ব্যাপারে এবং দোএবং দরকার নাই, যত দোআ দরকার সব নবী মুহাম্মাদের জন্য! প্রায় ১৫০০ বছর পার হওয়া সত্ত্বেও এখনো সন্দেহের বিষয় যে, আরো কতবার দোআ করলে আল্লাহ কবুল করবেন। দুজন আমাদের প্রার্থনার মধ্যে দুজন মৃত নবীর মধ্যে এ পার্থক্য করা কোনোক্রমেই কুরআনের শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

সালাতে বা যে কোনো সময় রসূলের উপর দরুদ করার বিষয়ে যে আয়াতটিকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয় তা হলো সূরা আহযাব ৩৩:৫৬। নিম্নে আয়াতটির অনুবাদ উল্লেখ করা হলো:

৩৩:৫৬ :: নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি সালাত করেন (অনুগ্রহ করেন বা আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন)। হে ঐসব লোক,যারা বিশ্বাস করেছো, তোমরা তার প্রতি সালাত কর (সমর্থন-সহযোগিতা ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করো)। এবং তোমরা তাসলীম (ধারাবাহিকভাবে আত্মসমর্পণ) করো।

এ আয়াতে উল্লেখিত ‘সালাত’ শব্দের অনুবাদ করা হয় ‘দরুদ’। ‘সালাত’ শব্দের শব্দার্থ হিসেবে ‘দরুদ’ শব্দ লিখে অনুবাদ করলে আয়াতটির অনুবাদ হয় নিম্নরূপ:

৩৩:৫৬ :: নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরুদ করেন। হে ঐসব লোক,যারা বিশ্বাস করেছো, তোমরা তার প্রতি দরুদ করো। এবং তোমরা তাসলীম (ধারাবাহিকভাবে আত্মসমর্পণ) করো।

এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো: আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা যে দরুদ পড়েন তা কোনটি? এবং আল্লাহ দরুদ পড়ার দরকারটাই বা কি? দরুদ যদি ‘অনুগ্রহ প্রার্থনা’ হয়, আল্লাহ কার কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন? কোনোভাবেই কি আমরা যে দরুদ পড়ি আল্লাহ ও ফেরেশতারা সে দরুদ পড়ার কোনো মানে হয়? অবশ্যই নয়। সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, ‘সালাত’ অর্থ কোনো নির্দিষ্ট ‘দরুদ পড়া’ নয়। বরং কারো প্রতি সালাত মানে হলো, তার প্রতি অনুগ্রহ করা বা অনুগ্রহের জন্য প্রার্থনা করা। যিনি সালাত করেন তাঁর সাপেক্ষে এর অর্থ নির্ধারিত হবে। যেমন, “আল্লাহ সালাত করেন” মানে হলো, আল্লাহ অনুগ্রহ করেন। এবং “ফেরেশতারা সালাত করেন” মানে হলো, ফেরেশতারা অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। মু’মিনরা সালাত করার মানেও হলো, অনুগ্রহ প্রার্থনা করা।

কোনো ব্যক্তির প্রতি সালাত করার মূল অর্থ হলো, তার প্রতি অনুকূলতামূলক কিছু করা। এর মধ্যে যেমন অনুগ্রহ প্রার্থনা রয়েছে, তেমনি আরো রয়েছে তাকে সমর্থন-সহযোগিতা করা, তার সাথে সংযোগ-যোগাযোগ রক্ষা করা ইত্যাদি। যে বাক্যে ‘সালাত করা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তার Context অনুসারে এর বিস্তৃত তাৎপর্য অনুধাবন করা যেতে পারে। যেমন, যে আয়াতে রসূলের প্রতি সালাত করতে বলা হয়েছে তার পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে রসূলের ঘরে প্রয়োজনে বা কম প্রয়োজনে ঘন ঘন যাতায়াত, খাওয়ার জন্য বসে থাকা, খাওয়া শেষেও বসে থাকা সাহাবীদের ইত্যাদি যেসব আচরণ রসূলের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা প্রতিরোধ করার জন্য কিছু বিধান দেয়া হয়েছে। তারপর তাঁর প্রতি সালাত করতে বলা হয়েছে।

প্রচলিত দরুদ (আল্লাহুম্মা সল্লি আলা মুহাম্মাদ....) এর পর্যালোচনায় আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো: ৩৩:৫৬ আয়াতে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ তাঁর নবীর প্রতি সালাত করেন এবং আদেশ দিলেন যে, তোমরা তার প্রতি সালাত করো। সেখানে আল্লাহর আদেশ পালন না করে যারা উল্টো আল্লাহর কথা আল্লাহকে ফিরিয়ে দেয় যে, ‘আল্লাহুম্মা সল্লি আলা মুহাম্মাদ’ (হে আল্লাহ আপনি নিজেই মুহাম্মাদের প্রতি সালাত করুন), তাদের এ কাজটিকে কিভাবে মূল্যায়ন করা যায়? আল্লাহ তো বলেই দিলেন যে, আল্লাহ নবীর প্রতি সালাত করেন। তারপরও আমরা যদি আবদার করি যে, “হে আল্লাহ আপনিই নবীর প্রতি সালাত করুন”, তাহলে তা কেমন হলো? তারপর আল্লাহ আমাদেরকে আদেশ দিলেন, “তোমরা তার প্রতি সালাত করো”, এবং আমরা আল্লাহকে বলে দিলাম, “হে আল্লাহ, আপনিই তার প্রতি সালাত করুন”, বিষয়টি কেমন হলো?

৩৩:৫৬ আয়াতে বর্ণিত ‘নবীর প্রতি সালাত’ প্রসংগ বুঝতে হলে ৩৩:৪৩ আয়াতটিও অধ্যয়ন করতে হবে। আয়াতটিতে বলা হয়েছে,

৩৩:৪৩ :: তিনি (আল্লাহ) ও তাঁর ফেরেশতাগণ তোমাদের (মু’মিনদের) প্রতি সালাত করেন (অনুগ্রহ করেন বা আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন), তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনার জন্য,এবং তিনি (আল্লাহ) মু’মিনদের প্রতি দয়াশীল।

সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা শুধু নবীর প্রতিই সালাত করেন না, বরং মু’মিনদের প্রতিও সালাত করেন। আবার আল্লাহ মু’মিনেদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তারা নবীর প্রতি সালাত করে। আবার রসূলকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে মু’মিনদের উপর সালাত করার জন্য। এ নির্দেশ দিয়ে ৯:১০৩ আয়াতে আল্লাহ বলেন, খুয মিন আমওয়ালিহিম সদাক্বাতান তুতহহিরুহুম ওয়া তুযাক্কীহিম বিহা, ওয়া সল্লি আলাইহিম, ইন্না সলাতাকা সাকুনাল্লাহুম, ওয়াল্লাহু সামীউন, আলীমুন। অর্থ “তাদের সম্পদ থেকে সদাকাহ আদায় করো তা দ্বারা (ঐ সদাকাহ দ্বারা) তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করার জন্য। এবং তাদের প্রতি (মু’মিনদের প্রতি) সালাত করো। নিশ্চয় তোমার সালাত তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক। এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ”।

সুতরাং কোনো ব্যক্তিসত্তার ক্ষেত্রে আমরা দুই ধরনের ব্যক্তিসত্তার প্রতি সালাত পাই, যথা (১) রসূলের প্রতি সালাত এবং (২) মু’মিনদের প্রতি সালাত। এর মধ্যে রসূলের প্রতি সালাত করেন আল্লাহ, ফেরেশতাগণ এবং মু’মিনগণ। মু’মিনদের প্রতি সালাত করেন আল্লাহ, ফেরেশতাগণ, রসূল এবং অন্য মু’মিনগণ।

জীবিত রসূলের প্রতি সালাত করা তথা যা তাঁর জন্য কষ্টদায়ক না হয়ে স্বস্তিদায়ক হবে এমন আচরণ করা সম্ভব। কিন্তু তাঁর ওফাতের তাঁর শান্তি আমাদের দোএবং ওপর নির্ভর করতে পারে না, এবং এজন্য আমাদের দোআর কোনো প্রয়োজনই হতে পারে না। কারণ তাঁর শান্তি যদি আমাদের দোআর উপর নির্ভরশীল হয় তার মানে হয় আমরা বেশিজনে বা বেশিবার দোআ করলে তিনি বেশি শান্তি পাবেন এবং কমজনে বা কমবার দোআ করলে তিনি কম শান্তি পাবেন। এটা যে কত অযৌক্তিক তা এবং বলার অপেক্ষা রাখে না।

৫৩ নং আয়াতে যেমন নবীর ওফাতের পর তাঁর স্ত্রীদেরকে বিয়ে না করার নির্দেশ একটি যথার্থ নির্দেশ কিন্তু নবীর স্ত্রীদের ওফাতের মাধ্যমে এ নির্দেশের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিসত্তার অনুপস্থিতি দেখা দেয়ায় নির্দেশ লংঘন করা না করার ক্ষেত্র নেই, তেমনি এ আয়াতে রসূলের প্রতি সালাত করার নির্দেশ রসূলের ওফাতের পূর্ববর্তী পর্যায়ের সমকালীন মু’মিনদের সাথে সম্পর্কিত। বর্তমানে তাঁর নামে দুরুদ পড়ার কোনো মানে নেই।

তাসলীম প্রসঙ্গ:

দরুদের প্রসঙ্গে দ্বিতীয় দলীল হলো ৩৩:৫৬ আয়াতের শেষাংশে উল্লেখিত হয়েছে, ওয়া সাল্লিমূ তাসলীমা (এবং তোমরা তাসলীম করো)।

তাসলীম শব্দটি এসেছে সাল্লামা শব্দ থেকে। এখানে সর্বপ্রধান প্রশ্ন হলো, ৩৩:৫৬ আয়াতে ব্যবহৃত ওয়া সাল্লিমূ তাসলীমা এর সম্পর্ক কি রাসূলের সাথে না আল্লাহর সাথে? বিষয়টির সমাধানের জন্য আমাদেরকে তাসলীম শব্দ ধারণকারী অন্য দুটি আয়াত (৪:৬৫, ৩৩:২২) দেখতে হবে। নিম্নে আয়াতগুলো উল্লেখ করা হলো।

৪:৬৫ আয়াতে বলা হয়েছে, ফালা ওয়া রব্বিকা, লা ইউমিনূনা হাত্তা ইউহাক্কিমূকা ফীমা সাজারা বায়নাহুম ছুম্মা লা ইয়াজিদূ ফী আনফুসিহিম হারাজাম মিম্মা ক্বাদাইতা, ওয়া ইউসাল্লিমূ তাসলীমা। অর্থ: “তোমার রবের শপথ, তারা ততক্ষণ মু’মিন হবে না যতক্ষণ না তারা তাদের পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারভার তোমার উপর অর্পণ না করে তারপর তুমি যে ক্বাদা / রায় ঘোষণা করো তাতে তাদের নিজেদের মধ্যে কোন সংকীর্ণতা / দ্বিধাদ্ব্ন্দ্ব অনুভব না করে, এবং তাসলীম / ধারাক্রমিক আত্মসমর্পণ না করে”।

এ আয়াতের মাধ্যমে আল কুরআন অনুযায়ী (দ্র:৫:৪৮) বিচার-ফায়সালা করে দেয়ার জন্য নির্বাহী দায়িত্ব ও অধিকার আল্লাহ কর্তৃক মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে প্রদান করা হয়েছে এবং তিনি অবশ্যই তাঁর সমগ্র জীবনে যথানিয়মে এ দায়িত্ব পালন করেছেন। সাথে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যতবারই এ ধরনের বিষয়সহ যে কোনো বিষয়ে আল্লাহর আদেশ পরিপালনের মাধ্যমে তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণের প্রশ্ন আসে, ততবারই যেন ধারাক্রমিকভাবে আত্মসমর্পণ করা হয়। ইসলাম হলো আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ, যা একটি সুস্থির নীতি হিসেবে সিদ্ধান্তের বিষয়। (দ্র: ২:১৩১)। এবং তাসলীম হলো ধারাক্রমিক ইসলাম / আত্মসমর্পণ, অর্থাৎ যতবারই কোনো কাজের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের প্রশ্নটি সামনে আসে ততবারই আত্মসমর্পণ।

‘তাসলীম’ শব্দ ধারণকারী দ্বিতীয় আয়াতটিতে তথা ৩৩:২২ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, “ওয়া আম্মা রআল মুমিনূনাল আহযাবা ক্বলূ হাযা মা ওয়াদানাল্লাহু ওয়া রসূলুহু, ওয়া সদাক্বাল্লাহু ওয়া রসূলুহু, ওয়া মা যাদাহুম ইল্লা ঈমানাওঁ ওয়া তাসলীমা অর্থ: “এবং যখন মু’মিনগণ (তাদের বিরুদ্ধে) বিভিন্ন হিযব/ সেনাদলকে দেখলো, তারা (মু’মিনগণ) বললো, এটা তো তাই যা আল্লাহ এবং তাঁর রসূল আমাদের সাথে ওয়াদা করেছেন। এবং আল্লাহ এবং তাঁর রসূল সত্য বলেছেন। এবং এটি তাদের মধ্যে ঈমান ও তাসলীম ছাড়া অন্যরূপ কিছু বাড়ায়নি”।

লক্ষণীয় যে, ৩৩:৫৬ আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর উপর সালাত করেন বলা হয়েছে, তাসলীম করেন বলা হয়নি। আল্লাহ মু’মিনদেরকে আদেশ দিয়েছেন নবীর উপর সালাত করতে, তিনি নবীর উপর তাসলীম করতে বলেননি। আবারো লক্ষণীয় যে, আল্লাহ মু’মিনদেরকে তাসলীম করতে বলেছেন কিন্তু নবীর প্রতি তাসলীম করতে বলেননি। কারণ ইসলাম ও তাসলীমের সম্পর্ক আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সাথে, নবীর সাথে নয়। (দ্র: ২:১৩১)

ছাল্লামা (ক্রিয়ারূপ ২) ক্রিয়াটি কুরআনে ৬ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। যথা: ২:২৩৩, ৪:৬৫, ৮:৪৩, ২৪:২৭, ২৪:৬১, ৩৩:৫৬।

২:২৩৩ আয়াতে শব্দটি ‘পরিশোধ, অর্পণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

৪:৬৫ এবং ৩৩:৫৬ আয়াতে ‘তাছলীমা’ ক্রিয়াবিশেষ্য সহযোগে ‘ধারাবাহিক/উত্তরোত্তর আত্মসমর্পণ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

৮:৪৩ আয়াতে ‘সুষ্ঠু, সুসংহত বা সুসংগঠিত রাখা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

২৪:২৭ ও ২৪:৬১ আয়াতে ‘ছালাম বা শান্তি সম্ভাষণ, অভিবাদন’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘ছাল্লামা’ ক্রিয়ার পরে ‘আলা’ অব্যয় ব্যবহৃত হয়েছে।

সুতরাং ‘ছাল্লামা’ ক্রিয়াটি ‘ছালাম দেয়া’ অর্থে ব্যবহৃত হলে তার পরে ‘আলা’ অব্যয় ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে যদি ‘ছাল্লামা’ ক্রিয়ার পর ‘তাছলীম’ ক্রিয়াবিশেষ্য থাকে, সেক্ষেত্রে ‘ছাল্লামা’ ক্রিয়া দ্বারা ‘ছালাম দেয়া’ বুঝায় না, বরং ‘ধারাবাহিক/উত্তরোত্তর আত্মসমর্পণ’ বুঝায়।

সুতরাং মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর নামের পর ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ বলা এবং অন্য রসূলদের ক্ষেত্রে তা না বলার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। বস্তুত ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ এর পরিবর্তে যেকোনো নবী-রসূলের ক্ষেত্রে ‘সালামুন আলাইহি’ বলা অধিক যুক্তিসঙ্গত।

এক্ষেত্রে ২৭:৫৯ এবং ৩৭:১৮১-১৮২ আয়াতের নির্দেশ ও নির্দেশনা প্রণিধানযোগ্য।

২৭:৫৯ :: বলো, “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য ও আয়ত্তে এবং সালাম/শান্তি তাঁর মনোনীত বান্দাদের প্রতি”। শ্রেষ্ঠ কি আল্লাহ, নাকি তারা যাদেরকে তারা শরীক করে?

৩৭:১৮১-১৮২ :: আর মুরছালীনদের (নবী-রসূলদের) উপর সালাম/শান্তি। এবং সমস্ত প্রশংসা রব্বুল আলামীন (জগতসমূহের প্রতিপালক ও বিধাতা) আল্লাহরই জন্য ও আয়ত্তে।

১৭. দুআ মাসুরা

জিজ্ঞাসা: সালাতে শেষ বৈঠকে দুআ মাসূরা নামে যা পড়া হয় তা গ্রহণযোগ্য কিনা? শেষ বৈঠকে দুআ মাসুরা পড়ার পর দুই কাঁদের দিকে সালাম ফিরিয়ে সালাত সমাপ্ত করা হয়। এ রীতি কি সঠিক?

জবাব: প্রচলিত নামাজের শেষ বৈঠকে দুআ মাসুরা নামে দুটি দুআ পড়া হয়। এর একটিতে কবর আযাব এবং দাজ্জালের ফেতনা থেকে পানাহ চাওয়া হয়। এ দুটি বিষয় কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক মতবাদ। তাই এ দুআ মাসুরা পড়ার কোনো অবকাশ নেই।

অন্য দুআ মাসুরাটি হলো: “আল্লাহুম্মা ইন্নী যলামতু নাফসী যুলমান কাছীরাওঁ ওয়া লা ইয়াগফিরুয যুনূবা ইল্লা আনতাফাগফিরলী মাগফিরাতাম মিন ইনদিকাইন্নাকা আনতাল গাফূরুর রহীম এ দুআ মাসুরার অর্থ হলো: “হে আল্লাহ, নিশ্চয় আমি আমার নিজের উপর অনেক যুলুম করেছি এবং আপনি ছাড়া গুনাহ মাফ করার এবং কেউ নেই, তাই আমাকে আপনার পক্ষ থেকে ক্ষমা করে দিন, নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, দয়াশীল”। যেহেতু এ দুআ মাসূরা আল কুরআনে থাকা দুআগুলোর সাথে সামঞ্জস্যশীল। তাই তা আপত্তিকর নয়।

কিন্তু সূরা নিসার ১০২ নং আয়াত অনুযায়ী সাজদাহর মাধ্যমে সালাত সমাপ্ত হয়ে যায় এবং শেষ সাজদাহর পরে বৈঠক করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই এবং বৈঠক করলেও তা হবে সালাতের বাহিরে। তাই সালাত শেষে কৃত বৈঠকে দুআ মাসূরা পড়া এবং সমষ্টিগতভাবে সালাত করলে তাতে দুআ মাসূরার পর দুই দিকের অন্য মুসল্লিদেরকে সালাম দেয়া দোষনীয় নয়। কিন্তু যখন একাকী সালাত করা হয় তখনও দুই দিকে সালাম দেয়ার রীতি কি অর্থ বহন করে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এবং সাজদাহর পরবর্তীতে দুআ করা দোষনীয় না হলেও, এক্ষেত্রে প্রধান বিষয় হলো আল্লাহর তাসবীহ করা, কারণ এজন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই সালাত শেষে দুআ করার চেয়ে সালাতের মধ্যেই দুআ করা অধিক সঙ্গত।

১৮. ‘আল্লাহু আকবার’ বলা যাবে কিনা?

জিজ্ঞাসা: আজানে, সালাতে, পশু জবেহ করার সময় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘আল্লাহু আকবার’ বলার প্রচলন রয়েছে। কুরআনে সরাসরি আল্লাহু আকবার শব্দটি উল্লেখ না থাকায় অনেকে দাবি করেন যে, আল্লাহু আকবার বলা যাবে না। কারণ এতে ‘আল্লাহ সব ইলাহের মধ্যে বড়’ হওয়ার অর্থ বুঝায়, যা শিরক। বরং ‘আল্লাহু কাবীর বলতে হবে। প্রশ্ন হলো, এ দাবি সঠিক কিনা?

জবাব: আকবার শব্দটি হচ্ছে কাবীর শব্দের কম্পারেটিভ/সুপারলেটিভ ডিগ্রি (দ্র: আরবিতে কম্পারেটিভ ও সুপারলেটিভ ডিগ্রি হিসেবে একই প্যাটার্ন ব্যবহৃত হয়)। আল্লাহু কাবীর শব্দের অর্থ হলো ‘আল্লাহ বড়’। আল্লাহু আকবার শব্দের অর্থ হলো ‘আল্লাহ সবচেয়ে বড়’।

যারা আল্লাহু আকবার বলার ক্ষেত্রে আপত্তি জানান তাদের আপত্তির ক্ষেত্রে যুক্তিগুলো নিম্নরূপ:

(১) আকবার বললে তা কার তুলনায় ‘মিন’ শব্দ দিয়ে তা বলতে হবে। কিন্তু শুধু আকবার বললে তা সঠিক হবে না।

(২) একই জাতীয় জিনিসের মধ্যে তুলনা হয়। তাই আল্লাহু আকবার বললে বড় আল্লাহ, ছোট আল্লাহর বিষয় এসে শিরক হয়।

(৩) আল কুরআনে আল্লাহু আকবার শব্দটি নেই। তাই আল্লাহু আকবার বলা যাবে না।

আপত্তিগুলোর পর্যালোচনা:

(১) মিন শব্দ সহযোগে কার সাথে তুলনা তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে আকবার শব্দের ব্যবহার:

ক. মাক্বতুল্লাহি আকবারু মিন মাক্বতিকুম। (৪০:১০)

খ. লাখালক্বুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি আকবারু মিন খালক্বিন নাছ। (৪০:৫৭)

মিন শব্দ ছাড়াই আকবার শব্দের ব্যবহার:

ক. ক্বলা হাযা রব্বী, হাযা আকবার (৬:৭৮)

খ. ওয়া লা যিকরুল্লাহি আকবার (২৯:৪৫)

সুতরাং মিন’ শব্দ প্রয়োগ করা হোক বা না হোক, ‘আকবার শব্দ ব্যবহৃত হতে পারে, তা প্রমাণিত। কখনো কখনো তুলনার অন্য পক্ষে কে বা কী আছে তা পূর্বাপর বক্তব্য থেকে বুঝা যেতে পারে।

(২) সাধারণত একই জাতীয় জিনিসের মধ্যে তুলনা হয়, কিন্তু সে একই জাতীয় বলতে সবদিক থেকে হুবহু একই জিনিস হতে হবে তা নয়। যেমন:

ক. ৬:৭৬-৭৮ আয়াত অনুসারে নবী ইবরাহীম তুলনা করেছিলেন কাওকাব, কামার ও শামস এ তিনটি জিনিসের মধ্যে। তিনি তিনটি শামসের মধ্যে তুলনা করেননি।

খ. ৬:১৯ আয়াতে বলা হয়েছে, "ক্বুল আইয়ু শাইয়িন আকবারু শাহাদাতান? ক্বুলিল্লাহু"। এখানে, স্বাক্ষ্যদানের ক্ষেত্রে আল্লাহকে অন্যদের তুলনায় আকবার /শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে বা আল্লাহর স্বাক্ষ্যকে অন্যদের স্বাক্ষ্যের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। এক আল্লাহর স্বাক্ষ্যের তুলনায় অন্য আল্লাহর স্বাক্ষ্য নয়, বরং গাইরুল্লাহ বা আল্লাহ ছাড়া যারা আছে তাদের সবার স্বাক্ষ্যের তুলনায় আল্লাহর স্বাক্ষ্য। অর্থাৎ ব্যক্তিসত্তার তুলনায় ব্যক্তিসত্তা কিন্তু উভয় ব্যক্তিসত্তা আল্লাহ নয়, বরং আল্লাহ এবং গায়রুল্লাহ। (গায়রুল্লাহ' শব্দের জন্য দ্র: ৪:৮২)। যেমন, ৪:৮৭ আয়াতে বলা হয়েছে, "ওয়া মান আসদাক্বু মিনাল্লাহি হাদীসান? ৪:১২২ আয়াতে বলা হয়েছে, "ওয়া মান আসদাক্বু মিনাল্লাহি ক্বীলান? এসব আয়াতে এক আল্লাহর সাথে অন্য আল্লাহর হাদীসের তুলনা করা হয়নি। বরং আল্লাহর হাদীসের সাথে গায়রুল্লাহর হাদীসের তুলনা করা হয়েছে।

গ. ২৯:৪৫ আয়াতে বলা হয়েছে, "ওয়া লাযিকরুল্লাহি আকবার"। এখানে একই জাতীয় বিষয় হতে পারে আল্লাহর যিকিরের সাথে অন্য কারো যিকির। যেমন, ২:২০০ আয়াতে বলা হয়েছে, "ফাযকুরুল্লাহা কাযিকরিকুম আবাউকুম আও আশাদ্দা যিকরান"। অর্থাৎ পিতৃপুরুষের যিকিরের সাথে আল্লাহর যিকিরকে তুলনা করা হয়েছে। এক আল্লাহর যিকিরের সাথে অন্য আল্লাহর যিকির নয়। কারণ আল্লাহতো একজনই।

সুতরাং আল্লাহু আকবার বললে আল্লাহর সাথে আল্লাহর তুলনা বুঝাবে না, বরং গায়রুল্লাহর সাথে আল্লাহর তুলনা বুঝাবে। এছাড়া বিষয়টি এখান থেকেও বুঝা যায় যে, ৪:৩৪, ১৩:৯, ১৭:৪৩, ২২:৬২, ৩১:৩০, ৩৪:২৩, ৪০:১২ আয়াতে আল্লাহকে কাবীর (বড়) বলা হয়েছে। যদি আল্লাহু আকবার বা ‘আল্লাহ সবচেয়ে বড়’ বলা না যায়, তবে আল্লাহু কাবীর বা ‘আল্লাহ বড়’ কিভাবে বলা যেতে পারে?

(৩) “কোনো কথা আল কুরআনে শব্দে শব্দে না থাকলে তা বলা যাবে না”- এটি কারো কারো ব্যক্তিগত চিন্তাধারা মাত্র। আল কুরআনে নিম্নের আয়াতগুলোতে আল্লাহর তাকবীর বা বড়ত্ব প্রকাশের আদেশ দেয়া হয়েছে:

ওয়া কাব্বিরহু তাকবীরান (১৭:১১১),

ওয়া রব্বাকা ফাকাব্বির (৭৪:৩),

লিতুকাব্বিরুল্লাহ (২:১৮৫, ২২:৩৭)।

এখন, আল্লাহর তাকবীর / বড়ত্ব বর্ণনা করার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে কেউ যদি নিজের ভাষায় বলে, আল্লাহু আকবার তাহলে তা দোষনীয় হবে কেন? কেউ কেউ বলছে, আল্লাহকে আকবার বলা যাবে না। নিম্নে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হলো:

ক. ২৯:৪৫ আয়াতে বলা হয়েছে, "ওয়া লাযিকরুল্লাহি আকবার"। যদি আল্লাহর যিকিরকে গায়রুল্লাহর যিকিরের তুলনায় আকবার বলা যায়, তাহলে আল্লাহকে গায়রুল্লাহর তুলনায় আকবার বলা যাবে না কেন? আল্লাহ সকল ব্যক্তিসত্তার তুলনায় আকবার। কারণ আল্লাহ হলেন স্রষ্টা ও উপাস্য এবং অন্য সবাই হলো সৃষ্ট ও উপাসক।

খ. ৬:১৯ আয়াতে বলা হয়েছে, "ক্বুল আইয়ু শাইয়িন আকবারু শাহাদাতান? ক্বুলিল্লাহু"। অর্থাৎ "স্বাক্ষ্যদানে কোন সত্তা আকবার? বলো, আল্লাহ"। সুতরাং ৬:১৯ আয়াতে আল্লাহকে আকবার বলা হয়েছে। যদিও ‘আল্লাহু আকবার এভাবে শব্দে শব্দে বলা হয়নি। সুতরাং যারা বলেন আল কুরআনে আল্লাহকে আকবার বলা হয়নি, তাদের কথা সঠিক নয়। তবে আল্লাহু আকবার’ এভাবে একসাথে / শব্দে শব্দে বলা হয়নি।

সুতরাং আল্লাহর তাকবীর করার আদেশ পরিপালনের জন্য আল্লাহু আকবার বলা যাবে। তবে আল কুরআনে যেভাবে আল্লাহর তাকবীর রয়েছে সেভাবে শব্দে শব্দে বলার জন্য নিম্নের তাকবীরগুলোও বলা আমাদের কর্তব্য:

১. ওয়া লাহুল কিবরিয়াউ ফিস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়া হুয়াল আযীযুল হাকীম (৪৫:৩৭)

২. হুয়াল্লাহুল্লাযী লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল মালিকুল ক্বুদ্দুসুস সালামুল মুমিনুল মুহায়মিনুল আযীযুল জাব্বারুল মুতাকাব্বিরু, সুবহানাল্লাহি আম্মা ইউশরিকূন (৫৯:২৩)

৩. আলিমুল গাইবি ওয়াশ শাহাদাতিল কাবীরুল মুতায়াল (১৩:৯)

৪. সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আম্মা ইয়াক্বূলূনা উলুওওয়ান কাবীরান (১৭:৪৩)

৫. ওয়া আন্নাল্লাহা হুয়াল আলিয়্যুল কাবীর (২২:৬২)

৬. ওয়া আন্নাল্লাহা হুয়াল আলিয়্যুল কাবীর (৩১:৩০)

৭. ওয়া হুয়াল আলিয়্যুল কাবীর (৩৪:২৩)

৮. ইন্নাল্লাহা কানা আলীয়্যান কাবীরান (৪:৩৪)

৯. ফালহুকমু লিল্লাহিল আলিয়্যিল কাবীর (৪০:১২)

১৯. খাররা শব্দের দ্বারা কি শারীরিকভাবে ঝুঁকে পড়া বুঝায় নাকি মানসিকভাবে ঝুঁকে পড়া বুঝায়?

জিজ্ঞাসা: কুরআনে রুকূতে ও সাজদাহতে ঝুঁকে পড়ার অর্থে খাররা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, খাররা শব্দের দ্বারা কি শারীরিকভাবে ঝুঁকে পড়া বুঝায় নাকি মানসিকভাবে ঝুঁকে পড়া বুঝায়?

জবাব: খাররা ক্রিয়াটি কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে ১২ স্থানে। সেগুলো হলো- ৭:১৪৩:৩০, ১২:১০০:৫, ১৬:২৬:১১, ১৭:১০৭:১৬, ১৭:১০৯:‌১, ১৯:৫৮:২৭, ১৯:৯০:৭, ২২:৩১:১০, ২৫:৭৩:৭, ৩২:১৫:৮, ৩৪:১৪:১৫, ৩৮:২৪:৩০।

‘খাররা’ শব্দটির যথাযথ অর্থ উপলব্ধির জন্য নিম্নে আয়াতগুলোর অনুবাদ দেয়া হলো (যে শব্দটি খাররা শব্দের অনুবাদ সে শব্দের পরে <খাররা> লেখা হলো):

৭:১৪৩ :: এবং যখন আমার নির্ধারিত সময়ে মূসা এসে গেল এবং তার রব তার সাথে কথা বললেন। সে বলল, ‘হে আমার রব, আপনি আমাকে দেখা দিন, আমি আপনাকে দেখব।’ তিনি বললেন, তুমি আমাকে কখনো দেখবে না। বরং তুমি পাহাড়ের দিকে তাকাও, অতঃপর তা যদি নিজ স্থানে স্থির থাকে তবে তুমি অচিরেই আমাকে দেখবে। অতঃপর যখন তার রব পাহাড়ের উপর নূর প্রকাশ করলেন তখন তা তাকে চূর্ণ করে দিল এবং মূসা বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল <খাররা>। অতঃপর যখন তার হুঁশ আসল তখন সে বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান, আমি আপনার নিকট তাওবা করলাম এবং আমি মুমিনদের মধ্যে প্রথম।’

১২:১০০ :: এবং সে তার পিতামাতাকে রাজকীয় আসনের উপরে উঠিয়ে নিয়েছিলো। এবং তারা (ইউসুফের পিতা, মাতা ও ১১ ভাই) তার জন্য (ইউসুফের জন্য) সাজদাহতে ঝুঁকে পড়লো <খাররূ>। এবং সে বলেছিলো, ‘হে আমার আব্বা, ইহাই আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা, যা আমি আগে দেখেছিলাম। নিশ্চয় আমার প্রভু উহাকে সত্য ঘটনায় পরিণত করেছেন। এবং নিশ্চয় তিনি অনুগ্রহ করেছেন আমার প্রতি, যখন তিনি আমাকে বের করেছেন কারাগার থেকে এবং আপনাদেরকে এনেছেন মরুভূমি থেকে, উহার পরে যে, শয়তান বিরোধ লাগিয়েছিলো আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে। নিশ্চয় আমার প্রভু যা ইচ্ছা করেন তা সম্পাদনের উপায় সম্পর্কে সূক্ষদর্শী। নিশ্চয় তিনি মহাজ্ঞানী ও মহাবিজ্ঞ’।

১৬:২৬ :: তাদের পূর্বে যারা ছিল, তারা ষড়যন্ত্র করেছিল, অতঃপর আল্লাহ তাদের দালানের ভীতে আঘাত করেছিলেন, ফলে তাদের উপর তাদের উপর থেকে ছাদ ধ্বসে পড়েছিল <খাররা>। এবং তাদের উপর আযাব এসছিল এমনভাবে যে, তারা তা উপলব্ধি করতে পারেনি।

১৭:১০৭ :: বলো, ‘তোমরা উহার প্রতি বিশ্বাস করো অথবা বিশ্বাস না করো, নিশ্চয় যাদেরকে (আসমানী কিতাবের) জ্ঞান দেয়া হয়েছে তোমাদের আগে; যখন উহা (আল কুরআন) তাদের কাছে পাঠ করা হয়, তখন তারা চিবুকসমূহের উপর সাজদাহয় ঝুঁকে পড়ে <ইয়াখিররূনা>।

১৭:১০৯ :: এবং তারা চিবুকসমূহের উপর কান্নাতে ঝুঁকে পড়ে <ইয়াখিররূনা> এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে।

১৯:৫৮ :: তারাই ঐসব লোক যাদের উপর আল্লাহ নিয়ামতদান করেছেন, যারা ছিলো নবী, যারা আদমের বংশধর, এবং তাদের মধ্যকার ব্যক্তি যাদেরকে আমি আরোহন করিয়েছিলাম নূহের সাথে (নূহের নৌকায়), এবং ইবরাহীমের ও ইসরাইলের বংশধর, এবং যাদেরকে আমি হিদায়াত করেছিলাম, এবং আমি মনোনীত করেছিলাম। যখন তিলাওয়াত করা হতো তাদের কাছে দয়াময়ের আয়াতসমূহ, তখন তারা সাজদাহতে এবং কান্নাতে ঝুঁকে পড়তো <খাররূ>।

১৯:৯০ :: যাতে আকাশ বিদীর্ণ হওয়ার, পৃথিবী খন্ড খন্ড হওয়ার এবং পাহাড়সমূহ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে পড়ে যাওয়ার <তাখিররু> উপক্রম হয়েছে।

২২:৩১ :: আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হয়ে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করে। এবং যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে যেন আকাশ থেকে পড়ে গেলো <খাররা>। তারপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো অথবা বাতাস তাকে কোনো সুদূর স্থানে উড়িয়ে দিলো।

২৫:৭৩ :: এবং যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিলে তার উপর অন্ধ এবং বধিরের মত (প্রতিক্রিয়ায়) পড়ে যায় না <লাম ইয়াখিররূ>।

৩২:১৫ ::  নিশ্চয় আমার আয়াতসমূহের প্রতি তারাই বিশ্বাস করে যারা এমন যে, যখন তাদেরকে উহা দ্বারা উপদেশ দেয়া হয় তখন সাজদাহয় ঝুঁকে পড়ে <খাররূ> এবং তাদের প্রভুর প্রশংসাজ্ঞাপনসহ পবিত্রতা বর্ণনা করে এবং তারা অহংকার করে না।

৩৪:১৪ :: তারপর যখন আমরা তার উপর মৃত্যুর ফায়সালা করেছিলাম, তখন দাব্বাতুল আরদ/ জমিনের পোকা ছাড়া কেউ তাদেরকে (জিনদেরকে) তার মৃত্যুর ব্যাপারে (সর্বপ্রথম) কেউ সংবাদ দেয়নি, যে (পোকা) তার লাঠিকে খাচ্ছিলো। তারপর যখন সে পড়ে গেলো <খাররা> তখন জ্বিনরা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, যদি তারা গায়েব জানতো, তাহলে তাদেরকে অপমানকর শাস্তির মধ্যে অবস্থান করতে হতো না।

৩৮:২৪ :: দাউদ বলেছিলো, ‘তোমার দুম্বাটিকে তার দুম্বাগুলোর সাথে যুক্ত করার দাবি করে সে তোমার প্রতি যুলুম করেছে। নিশ্চয় যারা একসাথে বসবাস করে তারা অনেক সময় একে অন্যের প্রতি বাড়াবাড়ি করে। যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে তারা ছাড়া। এবং এমন লোক সংখ্যায় খুবই কম’। এবং (তারপর) দাউদ অনুমান করেছিলো যে, (এ ঘটনার মাধ্যমে) আমি তাকে পরীক্ষা করেছি। তখন সে তার রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলো এবং রুকূ'তে ঝুঁকে পড়লো <খাররা> এবং (আল্লাহর দিকে) ফিরে এলো।

উপরিউক্ত আয়াতসমূহ খাররা শব্দের ব্যবহার থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, খাররা বলতে শারীরিকভাবে ঝুঁকে পড়া বা পড়ে যাওয়াকেও বুঝায় আবার মানসিকভাবে ঝুঁকে পড়া বা পড়ে যাওয়াকেও বুঝায়। শব্দটি কোনো স্থানে এর একটি অর্থে, কোনো স্থানে আরেকটি অর্থে এবং কোনো স্থানে উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

২০. সালাতের ক্বসর

জিজ্ঞাসা: সালাতের ক্বসর কখন ও কিভাবে?

জবাব: সাধারণভাবে ধারণা করা হয় সফরে ক্বসর করা বাধ্যতামূলক কোন ওজর থাকুক বা না থাকুক। আবার কতটুকু পথের সফরে ক্বসর করতে হবে, কতদিনের সফরে ক্বসর করতে হবে ইত্যাদি নানান কথা প্রচলিত আছে অথচ এর সবই কুরআনবিরোধী ধারণা। কারণ, কুরআনে ক্বসরের জন্য সফরের পথের দৈর্ঘ্য বা সময়সীমার কোন শর্ত আরোপ করা হয়নি। এক এক ব্যক্তির মুক্বাম (যেখানে সে মুসাফির নয়, তার সাধারণ প্রতিষ্ঠিত অবস্থান) এর পরিসর ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং যেখানে একজন ব্যক্তি সফর করে (মুসাফিরের অবস্থায় থাকে) সেখানে সে ক্বসর করতে পারে। অবশ্য শুধুমাত্র কাফিরদের পক্ষ থেকে ফিতনা তথা কোনরূপ ক্ষতির আশংকাগ্রস্ত অবস্থায় সফরে ক্বসর করার অনুমতি দেয়া হয়েছে, আদেশ নয়। অর্থাৎ যে সফরে কাফিরদের পক্ষ থেকে কোনরূপ আশংকা নেই তাতে ক্বসরের অনুমতি নেই। এবং যে সফরে কাফিরদের পক্ষ থেকে ক্ষতির আশংকা আছে তাতে ক্বসরের অনুমতি আছে, আদেশ নয়। এরূপ সফরে ক্বসর করলে গুনাহ হবে না, তা জানানো হয়েছে, ক্বসরকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। ক্বসর সম্পর্কে কুরআনে যে আয়াতে অনুমতি দেয়া হয়েছে তা নিম্নরূপ:

‘যখন তোমরা পৃথিবীতে সফর করো তখন তোমাদের জুনাহ (গুনাহ) নেই, যদি তোমরা সালাতে ক্বসর করো, যদি তোমরা ভয় করো যে, তোমাদেরকে ফিতনায় ফেলবে যারা কুফরি করেছে তারা, নিশ্চয় কাফিরগণ তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট শত্রু’। (সূরা নিসা/০৪: ১০১)

সালাতের ক্বসর কিভাবে তা ৪:১০২ আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে। ‘প্রতি ওয়াক্তে কয় রাকায়াত সালাত করতে হবে’ শিরোনামে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সালাতের ক্বসর প্রসঙ্গে অনেকে ২:২৩৮-২৩৯ আয়াতের উদ্ধৃতিও দিয়ে থাকেন। যদিও ২:২৩৯ আয়াতে সালাতের কথা প্রত্যক্ষভাবে বলা হয় নি তবুও ৪:১০১-১০৩ আয়াতের বক্তব্যধারার সাথে তার মিল আছে এবং ২:২৩৮ আয়াতের ধারাবাহিকতার প্রেক্ষিতেও তাতে সালাতের প্রসঙ্গ জড়িত। সুতরাং ২:২৩৯ আয়াতটি প্রত্যক্ষভাবে সালাতের সাথে জড়িত না হলেও পরোক্ষভাবে সালাতের সাথে জড়িত। প্রত্যক্ষ বক্তব্য অনুসারে এটাই যথেষ্ট যে, যেখানে ভয় আছে সেখান থেকে নিরাপদ স্থানে দ্রুত চলে যাওয়া (হিজরত) এর নির্দেশ রয়েছে হোক তা পদচারী অবস্থায় (স্বল্প দূরত্বে) বা আরোহী অবস্থায় (অধিক দূরত্বে)। এবং নিরাপদ স্থানে পৌঁছার পর বা নিরাপদে থাকা অবস্থায় আল্লাহ যেভাবে শিখিয়েছেন সেভাবে আল্লাহর যিকর করার নির্দেশ রয়েছে। পরোক্ষভাবে এটি সালাতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যে, যদি ৪:১০১-১০২ আয়াতে বর্ণিত পরিস্থিতি না হয় তথা একদল লোক একসাথে রয়েছে এবং তারা কাফিরদের কর্তৃক ফিতনার আশংকায় রয়েছে এমন না হয়, বরং আরো নাজুক পরিস্থিতি হয়, যেখানে দলবদ্ধভাবে সালাত করা সম্ভব নয়, বরং দ্রুত চলে যাওয়া প্রয়োজন। তাহলে যখন সালাতের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে এরূপ অবস্থা হয়, তখন সালাত হেফাজতের তাৎক্ষণিক উপায় হিসেবে পদচারী বা আরোহী অবস্থায় সালাত করা যাবে।

২১. সালাত কি সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সভা?

জিজ্ঞাসা: সূরা নিসার ৪৩ ও বনী ইসরাইলের ১১০ আয়াত কি সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সভার নির্দেশনা?

জবাব: সূরা নিসার ৪৩ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন ‘সালাতকারী সালাতে যা বলবে তার স্পষ্ট জ্ঞান রাখার পূর্ব পর্যন্ত সালাতের কাছেও না যায়’। এবং সূরা বনী ইসরাইলের ১১০ আয়াতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, যেন সালাতে মধ্যম স্বর অবলম্বন করা না হয়।

কারো কারো উপলব্ধি হচ্ছে, এ দুটি আয়াতের মাধ্যমে বুঝা যায় যে, সালাত হচ্ছে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সভা। তাই সালাতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকে নিজ নিজ বক্তব্য উপস্থাপনে মধ্যম স্বর অবলম্বনের জন্য এবং স্পষ্ট জ্ঞানের ভিত্তিতে বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

উপর্যুক্ত উপলব্ধিটি সালাতের ক্ষেত্রে হুবহু সঠিক উপলব্ধি কিনা সে বিষয়ে ভিন্নমতের অবকাশ থাকলেও আয়াতদ্বয় থেকে নির্বাহী সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সভার ক্ষেত্রে কিরূপ নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে তার নির্দেশনা রয়েছে বা সালাতের একটি শিক্ষা যে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সভায় জ্ঞানের ভিত্তিতে বক্তব্য উপস্থাপন এবং মধ্যম স্বরে বক্তব্য উপস্থাপন তা অনস্বীকার্য।

২২. সালাত কি যুদ্ধকৌশলের নির্দেশনা?

জিজ্ঞাসা: সূরা নিসার ৪:১০২ আয়াত অনুযায়ী সালাত বলতে কি আনুষ্ঠানিক সালাতকে বুঝায় নাকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেয়া যুদ্ধকৌশলের নির্দেশনা বুঝায়? এবং এতে সাজদাহ বলতে কি নির্দেশনা সমাপ্তির পর তা মেনে নেয়ার অভিব্যক্তিকেই বুঝায়? সেক্ষেত্রে কি ইমাম মাঝখানে থাকবেন এবং যাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হবে তারা বৃত্তাকারে দাঁড়াবে?

জবাব: এ নিয়মটিও সালাতের একটি ধরন হতে পারে। তবে এটা তখন চর্চা করা যেতে পারে যখন কোন নির্দেশনামূলক বিষয় জরুরি হয়ে থাকে এবং পরিস্থিতি সাপেক্ষে এ পদ্ধতির উপযোগিতা তৈরি হয়। অন্যথায়, সাধারণভাবে সাজদাহর সবচেয়ে ফর্মাল যে স্বরূপ সেটিই বেশি অনুশীলনযোগ্য। কারণ বলা হয়েছে, তিনি তোমাকে দেখেন ক্বিয়াম ও সাজদাহয় উঠানামা করার বিষয়টি যখন তুমি তাদের সাথে থাকো (২৬:২১৭-২১৯)। অন্য কথায়, সাজদাহ শুধু যাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হবে তারা নয়, বরং যিনি নির্দেশনা দিবেন তিনিও করবেন।

সালাতে ইমামকে মধ্যস্থলে রেখে বৃত্তাকারে দাঁড়ালে অনেকে ইমামের সামনে থাকা হয় এবং অনেকে ইমামের পিছনে থাকা হয়। কিন্তু যদি সবাই ইমামের সামনে থাকে এবং ইমাম তাদের দিকে ফিরে দাঁড়ায় সেক্ষেত্রে বৃত্তাকারে দাঁড়ানোর বিষয়টি হয় না। অন্যদিকে যদি সবাই ইমামের পিছনে থাকে তাহলে প্রচলিত পদ্ধতির সালাত হয় এবং ইমাম ও অনুসারীরা সবাই একই দিকে মুখ ফিরানো অবস্থায় থাকতে পারে। সাধারণত এটিই সালাতের সবচেয়ে স্বাভাবিক আনুষ্ঠানিক স্বরূপ। কারণ ২:১৪২-১৫০ আয়াতে রসূলকে এবং মু’মিনদেরকে একই ‘আল মাসজিদুল হারামের’ দিকে মুখ ফিরাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিলে প্রচলিত সালাতের মতো ইমাম ও মুক্তাদীরা একই দিকে ফিরে সালাত করা বা মুক্তাদিরা ইমামের পিছনে দাঁড়ানোর বিষয়টিই হয়ে থাকে। কিন্তু ‘আল মাসজিদুল হারামের’ দিকে মুখ ফিরানোকে এরূপ হুবহু আক্ষরিকভাবে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়া বাধ্যতামূলক নয়। বরং অবশ্যই এ বিষয়ে বাস্তবসঙ্গত কারণে ব্যতিক্রমের অবকাশ রয়েছে। বিশেষ করে ৪:১০২ আয়াতে থাকা “ফাইযা ছাজাদূ ফালইয়াকূনূ মিওঁ ওয়ারায়িকুম” (তারপর যখন তারা সাজদাহ করবে তখন তারা তোমাদের পিছনে থাকবে) বাক্যের প্রেক্ষিতে মুক্তাদিরা ইমামের সামনে দাঁড়ানো তথা ইমাম মুক্তাদিদের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ানো এবং মুক্তাদিরা ইমামের পিছনে দাঁড়ানো তথা ইমাম ও মুক্তাদিরা একই দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ানো উভয়টিই গ্রহণযোগ্য হওয়ার অবকাশ আছে। কারণ অর্থের প্রশস্ততার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে “তোমাদের পিছনে থাকবে” বলতে ‘দ্বিতীয় পর্যায়ে সালাতকারী দলের পিছনে দাঁড়াবে’ বুঝায়। এবং আক্ষরিকভাবে দেখলে এর দ্বারা প্রথমে সালাতকারী দল ইমামের মুখোমুখি অবস্থান করেছিলো (initially staying face-to-face in front of Imam) বলে প্রতীয়মান হয়।

সালাতে ইমামসহ বৃত্তাকারে তথা গোলটেবিল বৈঠকের মতো করে দাঁড়ালে, ইমাম প্রথম সারিতে অন্যদের সাথে দাঁড়াতে পারে, এক্ষেত্রে ইমামকে মাঝখানে রেখে সবাই বৃত্তাকারে দাঁড়ানো হয় না। কা’বার মধ্যে সালাত করলে এভাবে করা যেতে পারে। এছাড়া অন্যত্রও যদি এভাবে সালাত করা হয় সেটা সবার কাছে উত্তম বিকল্প বলে প্রতীয়মান হোক বা না হোক, সেটাকে সরাসরি আপত্তিকর বলার অবকাশ নেই। প্রয়োজনসাপেক্ষে এভাবে সালাত করা যেতে পারে, তবে সাধারণভাবে ২:১৪২-১৫০ আয়াতের নির্দেশনাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য ইমাম সবার সামনে এবং সবাই ইমামের পিছনে এবং ইমামসহ সবাই একই দিকে মুখ করে সালাত করার প্রচলিত রীতিটি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণযোগ্য।

বস্তুত ৪:১০২ আয়াতে আরবি ভাষারীতি অনুসারে বক্তব্যভঙ্গির পরিবর্তনস্বরূপ সর্বনামের বিভিন্ন পরিবর্তন (কা, কুম, হুম / তোমার, তোমাদের, তাদের) পরিলক্ষিত হয়। এ পরিবর্তন ভাষারীতির অলংকার বিশ্লেষণের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু বক্তব্যের সারসংক্ষেপ কথা হলো: (১) রসূল ইমাম হিসেবে এবং মু’মিনরা মুক্তাদি হিসেবে সালাত করবে, (২) মু’মিনরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে প্রথমে একদল রসূলের সাথে সালাত করবে, (৩) প্রথম দলের সালাত শেষে দ্বিতীয় দল রসূলের সাথে সালাত করবে এবং তখন প্রথম দলটি এই দ্বিতীয় দলের পিছনে অবস্থান করবে। এক্ষেত্রে রসূল উভয় দলের সাথে মোট দুইবার সালাত করা হয় অথবা উভয় দল সংক্ষিপ্ত সালাত করা হয় এবং রসূল সংক্ষিপ্ত সালাতের পরিবর্তে দীর্ঘ সালাত করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, রসূল দুইবার সংক্ষিপ্ত সালাত করা হয়।

২৩. যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি যুদ্ধ চলাকালীন সালাত

জিজ্ঞাসা: সূরা নিসার ১০১-১০২ আয়াত কি যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের সালাত নাকি যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের নয় বরং সাধারণ যুদ্ধাবস্থা বা যুদ্ধ ভাবাপন্ন ভীতিকর অবস্থার সালাত?

উত্তর: ৪:১০১-১০২ আয়াতের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, এটি যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের সালাত নয় বরং সাধারণ যুদ্ধাবস্থা বা যুদ্ধ ভাবাপন্ন ভীতিকর অবস্থার সালাত। এতে কাফিরদের পক্ষ থেকে আক্রমণ হয়নি কিন্তু হতে পারে এরূপ আশংকার কথা বলা হয়েছে, অন্যকথায় সরাসরি যুদ্ধ চলমান নয় বরং যে কোনো সময় যুদ্ধ হতে পারে এরূপ আশংকাপূর্ণ সময়ে সালাতকে সংক্ষিপ্ত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে এবং তখন যথাসময়ে সালাত সম্পাদনের সুযোগ না ঘটলে সেজন্য কোনো হুঁশিয়ারি প্রদানমূলক কোনো আয়াত নেই। বরং কুরআনে থাকা সর্বজনীন মূলনীতি ‘কাউকে তার সাধ্যের বাহিরে দায়ী করা হবে না” এর আওতায় যদি সরাসরি যুদ্ধের প্রেক্ষিতে সালাত সম্পাদন করা সাধ্যাতীত হয় তা সত্ত্বেও সালাত সম্পাদন করা বাধ্যতামূলক বলে সাব্যস্ত হবে না। এমনকি ২:২৩৯ আয়াতে বর্ণিত আশংকাপূর্ণ অবস্থায় পদচারী হওয়া বা আরোহী হওয়ার নির্দেশনা দ্বারাও প্রত্যক্ষভাবে যে কোনো অবস্থায় যেকোনোভাবে সালাত সম্পাদন বাধ্যতামূলক সাব্যস্ত হয় না, বরং এর অন্যতম তাৎপর্য হলো যেখানে স্বাভাবিক নিয়মে আল্লাহর বিধান পালন করা যাবে সেখানে যেভাবেই হোক হিজরত করা। আবার পদচারী বা আরোহী হিজরত করার সময় ঐ অবস্থায় সাধ্যমতো সালাত করা এ নির্দেশনার দ্বিতীয় তাৎপর্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও সেখানেও সরাসরি যুদ্ধ মুহুর্তের কথা বলা হয়নি, বরং আশংকা তথা এক ধরনের আনুমানিক সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে ২২:৪০-৪১ আয়াত অনুযায়ী যাদেরকে তাদের বাড়ি-ঘর থেকে উৎখাত করা হয়েছে বা যাদের বাড়ি-ঘর নেই, বাস্তুহারা, উদ্বাস্তু, শরণার্থী এ ধরনের লোকেরা আবাসন সুবিধা পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদের জন্য সালাত প্রতিষ্ঠা করা বাধ্যতামূলক নয়।

২৪. সালাত ও সকাল-সন্ধ্যায় পারিবারিক ধর্মীয় সভা

জিজ্ঞাসা: সূরা নূরের ৫৮ আয়াত অনুসারে কি সালাতিল ফজর ও সালাতিল ইশা পারিবারিক পর্যায়ের ধর্মীয় সভা?

জবাব: সূরা নূরের ৫৮ আয়াতে সালাতিল ফজরের আগে এবং সালাতিল ইশার পরে কারো ব্যক্তিগত কক্ষে যাতায়াতের ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর এবং ‘মা মালাকাত আইমান’কে অনুমতি গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে কারো কারো উপলব্ধি হচ্ছে সালাতিল ফজর এবং সালাতিল ইশা পারিবারিক পর্যায়ের ধর্মীয় সভা এবং এটি একা একা সম্পাদনের কোনো বিষয় নয়, বরং পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে নিয়মিত এ ধর্মীয় সভা অনুষ্ঠিত হতে হবে।

উপর্যুক্ত উপলব্ধি হুবহু সঠিক কিনা সে বিষয়ে ভিন্নমতের অবকাশ থাকলেও এটা অনস্বীকার্য যে, সালাতিল ফজর এবং সালাতিল ইশা পারিবারিক পর্যায়ে ‘জামায়াতের সাথে’ সম্পাদন করার প্রতি এক ধরনের (পরোক্ষ) নির্দেশনা রয়েছে, যা বাধ্যতামূলক বিষয় না হলেও উৎসাহমূলক বিষয় বলা যেতে পারে। অন্য কথায়, সুযোগ থাকলে পারিবারিক পর্যায়ে ‘জামায়াতের সাথে’ সালাতিল ফজর ও সালাতিল ইশা সম্পাদন করা একটি উত্তম রীতি হিসেবে অনুশীলন করা যেতে পারে।

এছাড়া পারিবারিক পর্যায়ের বিধিনিষেধের সাথে সালাতিল ফজর ও সালাতিল ইশাকে সম্পর্কিত করার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে পারিবারিক পর্যায়ে ফজর ও ইশার সময় ধর্মীয় সভার আয়োজন করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে বলা যেতে পারে, যদিও তা সালাতিল ফজর ও সালাতিল ইশার অনুরূপ/ বাধ্যতামূলক নয় বা নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে এমন নয়।

২৫. প্রতি দিনের প্রতি ওয়াক্ত সালাত জামায়াতের সাথে পড়া বাধ্যতামূলক কিনা

জিজ্ঞাসা: প্রতি দিনের প্রতি ওয়াক্ত সালাত জামায়াতের সাথে পড়া বাধ্যতামূলক কিনা? রসূল কর্তৃক মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় না করে ঘরে সালাত আদায়কারীদের ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছা (যদি না তাতে নারী ও শিশু থাকে), এ বিষয়টি জামায়াতে সালাতের গুরুত্ব প্রকাশ করে?

জবাব: সাধারণত প্রতি দিনের প্রতি ওয়াক্ত সালাত বাধ্যতামূলক বলে দাবি করা হয় এবং এজন্য ২:৪৩ এবং ৪:১০২ আয়াতকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ২:৪৩ আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো এবং যাকাত প্রদান করো এবং রুকূ'কারীদের সাথে রুকূ' করো”। এবং ৪:১০২ আয়াতে সফরে কাফিরদের ফেতনার আশংকা অবস্থায় মু’মিনদের সাথে রসূল থাকলে তিনি তাদের ইমাম হিসেবে সালাত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মু’মিনরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে কিভাবে জামায়াতের সাথে সালাত সম্পাদন করবে সেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ থেকে দাবি করা হয় যে, যুদ্ধাবস্থার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও যেখানে একা একা সালাত করার তুলনায় জামায়াতের সাথে সালাত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, প্রতি দিনের প্রতি ওয়াক্ত সালাত জামায়াতের সাথে প্রতিষ্ঠা করা বাধ্যতামূলক।

এ প্রসঙ্গে প্রথমে ৪:১০২ আয়াতের ভিত্তিতে সঠিক তথ্য হলো, আয়াতটিতে প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্ত সালাত জামায়াতের সাথে সম্পাদন করা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। জামায়াত এবং জুমুয়া সমার্থক। যখন জুমুয়ার দিনে তথা জামায়াতে সালাত আদায় করার দিনে সালাতের জন্য আহবান করা হবে তাতে সাড়া দিয়ে জামায়াতে সালাত আদায় করতে হবে। অর্থাৎ সাধারণত সপ্তাহে একটি দিনকে (এক ওয়াক্ত সালাত) জামায়াতবদ্ধভাবে সালাত আদায় করার জন্য নির্দিষ্ট করা এবং তাতে জামায়াতে সালাত করার ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। যারা উপার্জনের সাথে যুক্ত (পুরুষ বা নারী) এমন সকল মু'মিনের জন্য তাতে সাড়া দেয়া জরুরি। (দ্র. ৬২:৯)। তবে সেজন্য প্রথমে চাই মু'মিনদের মধ্যে সেরূপ ব্যবস্থাপনার জন্য 'উলিল আমর' (যিনি সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনার পরিচালনার দায়িত্বশীল) নির্ধারণ করা। (দ্র. ৪:৫৯)। অন্যদিকে ৪:১০২ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যখন যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করবে তারা কোনোক্রমে একই সাথে অবস্থান করে তখন তারা জামায়াতে সালাত সম্পাদন করে নেবে।

তারপর ২:৪৩ আয়াতের বক্তব্য অনুসারে প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্ত সালাত জামায়াতের সাথে সম্পাদন করা বাধ্যতামূলক কিনা তা পর্যালোচনা করা যেতে পারে। আয়াতটিতে বলা হয়েছে, “তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো এবং যাকাত প্রদান করো এবং রুকূ'কারীদের সাথে রুকূ' করো”। এখানে প্রথম লক্ষণীয় বিষয় হলো, আয়াতটিতে সালাত প্রতিষ্ঠা’ এবং রুকূ' করা’ দুটি স্বতন্ত্র কাজ হিসেবে উল্লেখিত। সুতরাং ‘রুকূ'কারীদের সাথে রুকূ' করো’ বলতে জামায়াতের সাথে সালাত সম্পাদন করো’ হতে পারে না।

তারপর বলা হয় যে, এখানে রুকূ' দ্বারা সালাতকে বুঝিয়েছে, কারণ রুকূ' হলো সালাতের একটি রুকন বা বেনা। কিন্তু কুরআনের কোনো আয়াতে রুকূ'কে সালাতের রুকন বা বেনা বলে উল্লেখ নেই। সুতরাং এ দাবিটি গ্রহণযোগ্য নয়।

রুকূ' সম্পর্কে বুঝার জন্য রুকূ' সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন প্রয়োজন। আয়াতসমূহ হলো: ২:৪৩, ২:১২৫, ৩:৪৩, ৫:৫৫, ৯:১১২, ২২:২৬, ২২:৭৭, ৩৮:২৪, ৪৮:২৯, ৭৭:৪৮।

রুকূ' অর্থ স্বীয় পূর্বমত বা রীতি বা সাধারণ অবস্থা বাদ দিয়ে প্রাপ্ত তথ্য-নির্দেশ মেনে নেয়া, স্বীয় দুর্বলতার স্বীকৃতি দিয়ে সঠিক ব্যবস্থা বা পথনির্দেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার মনোবৃত্তি, কুর্নিশ করা, কোনো কিছু বিনীতভাবে সম্পাদন করা।

রুকূ'কারীদের সাথে রুকূ' করার অর্থ হলো: রুকূ'কারীদের সাথে একীভুত হয়ে যাওয়া, তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন না থাকা, তাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়া। রুকূ' সালাত ও যাকাত থেকে একটি স্বতন্ত্র বিষয় এবং রুকূ' করা অবস্থায় সালাত প্রতিষ্ঠা ও রুকূ' করা অবস্থায় যাকাত প্রদান করতে হয় (৫:৫৫)।

অবশ্য রুকূ'কে একটি আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়ে সালাতে রুকূ' করার যে রীতি প্রচলিত রয়েছে সেটা সরাসরি নির্দেশকৃত নয়, আবার তা আপত্তিকরও নয় তথা তা বাধ্যতামূলক না হলেও গ্রহণযোগ্য। কারণ ক্বিয়াম ও সাজদাহর মধ্যবর্তীতে রুকূ'র উল্লেখ থাকায় এবং ক্বিয়ামরুকূ' ও সাজদাহর অর্থানুসারে এগুলোর এক ধরনের আনুষ্ঠানিক ধারাবাহিক ক্রমিকতা নির্ণয় সাদৃশ্যপূর্ণ বিধায় তা গ্রহণযোগ্য।

তবে ‘রুকূ'কারীদের সাথে রুকূ' কর’ -এর অর্থ কোনোক্রমে ‘প্রতি ওয়াক্তের সালাত জামায়াতের সাথে আদায় কর’ নয়। যদি এর অর্থ জামায়াতের সাথে সালাত আদায় করা হতো তবে প্রতি ওয়াক্তের সালাত জামায়াতের সাথে আদায় করা ফরজ সাব্যস্ত হতো। অথচ যারা আয়াতটির অর্থ ‘জামায়াতে সালাত আদায় করা’ বলেন, তারাও প্রতি ওয়াক্ত সালাত জামায়াতে পড়াকে ফরজ মনে করেন না, তাদের ভাষায় তারা একে ওয়াজিব নামক সুন্নাত / নফল মনে করেন।

যেহেতু জুমুয়া এবং জামায়াত সমার্থক, তাই সূরা জুমুয়া অনুসারে প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্ত সালাত জামায়াতে করা বাধ্যতামূলক নয়। এবং তা থেকে এটাও প্রমাণিত হয়ে যায় যে, ‘রুকূ'কারীদের সাথে রুকূ' করা’ মানে ‘জামায়াতে সালাত করা’ নয়।

রসূল কর্তৃক এভাবে মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় না করে ঘরে সালাত আদায়কারীদের ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছার কথা বলে যারা হাদীস বানিয়েছে তাদের পক্ষে এরূপ মিথ্যাচার খুবই স্বভাবগত একটা ব্যাপার, রসূলের অবমাননা করে তাঁর উপর মিথ্যা আরোপই হাদীসশাস্ত্রের উৎপত্তিগত মূল স্বরূপ।

যেখানে সালাতিল ফজরের আগে ও সালাতিল ইশার পরে কারো ব্যক্তিগত কক্ষে ঢুকার আগে অনুমতি নেয়ার বিধান (২৪:৫৮) দৈনন্দিন সালাতের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে মাসজিদের চেয়ে ঘরের গুরুত্বকে অধিক তুলে ধরে, যেখানে নবী যাকারিয়া তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষে সালাত আদায়ের উদাহরণ উল্লেখের মাধ্যমে কুরআন সালাতের জন্য মিহরাব বা ব্যক্তিগত কক্ষের (Private Chamber) গুরুত্ব তুলে ধরে (৩:৩৯), সেখানে রসূল কি করে এমন কথা বলতে পারেন? অবশ্যই রসূল তা বলেননি। বরং এ ধরনের হাদীস রসূলের চরিত্র হনন ছাড়া এবং কিছু নয়।

২৪:৫৮ আয়াতে 'সালাতিল ফজরের আগে এবং সালাতিল ইশার পরে এবং যুহরের সময় যখন এক্সট্রা পোশাক খুলে বিশ্রাম নেয়া হয় তখন অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যাবে না' নির্দেশনার মাধ্যমে এখানে ব্যক্তিগত কক্ষের বিষয়ই বুঝানো হয়েছে, সালাতিল ফজর সম্পাদনের পরে এবং সালাতিল ইশার আগে তাওয়াফ বা সাধারণভাবে তাতে আসা যাওয়া করাকে স্বাভাবিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং এতে বক্তব্যের ধারা অনুসারে স্ব স্ব বাড়িতে সালাতের দিকটাই গুরুত্ব পাচ্ছে। কোনো আয়াত নেই, যেখানে প্রতি ওয়াক্ত সালাতের জন্য মাসজিদে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাই স্বাভাবিক অবস্থা হিসেবে সাধারণত সালাতের ক্ষেত্রে মাসজিদের চেয়ে বাড়িই অগ্রাধিকার পায়।

তবে জমায়েতে সালাত করার দিনে নিদা বা আহবানে সাড়া দিয়ে মাসজিদে যেতে হবে। প্রতি দিন প্রতি ওয়াক্তের জন্য আহবান করার কোনো নির্দেশ দেয়া হয়নি।

প্রসঙ্গক্রমে স্পষ্ট করা প্রয়োজন যে, সাধারণত মিহরাব শব্দের অর্থ করা হয় মসজিদে ইমাম দাঁড়াবার স্থান বা ইমামের সামনের জায়গা। কিন্তু এটি মিহরাব শব্দের অর্থ হিসেবে পরবর্তী সংযোজন, অর্থ বিকৃতি এবং কুরআনিক প্রয়োগের পরিপন্থী। মিহরাব শব্দটি কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে ৪ স্থানে: ৩:৩৭:১৪, ৩:৩৯:৭, ১৯:১১:৫, ৩৮:২১:৭ এবং এর বহুবচন 'মাহারিব' (মিহরাবসমূহ) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩৪:১৩:৬।

মিহরাব শব্দের প্রচলিত অর্থ যে সঠিক নয়, নিম্নে আয়াতসমূহের ভিত্তিতে তার পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হলো।

৩:৩৭ >>> মারইয়াম কি মাসজিদে ইমামের ইমামতির জায়গায় থাকতো? তিনি কি সালাতের ইমাম ছিলেন? নাকি তিনি তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষে থাকতেন, যেখানে গিয়ে নবী যাকারিয়্যা তাঁর কাছে রিযক তথা ফলমূল দেখতে পেয়েছিলেন?

৩:৩৯ >>> এটি আমাদের আলোচ্য আয়াত, তাই অন্য আয়াতগুলো থেকে অর্থ নির্ণয়ের পর এতে তা বসিয়ে দিতে হবে।

১৯:১১ >>> এতে কি নবী যাকারিয়্যা (সালামুন আলাইহি) তাঁর ক্বওমের কাছে মসজিদে মুসল্লিদের সামনে থাকা ইমামের জায়গা থেকে বের হয়ে এসেছিলেন? সেক্ষেত্রে তো সেখানে দাঁড়িয়েই তিনি লোকদেরকে যা বলার বলে দিতে পারতেন।

৩৮:২১ >>> বিবদমান দুটি লোক কি প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে প্রেসিডেন্ট দাউদ (সালামুন আলাইহি)-এর মসজিদের ইমামের জন্য সামনে থাকা জায়গায় ঢুকেছিল? নাকি তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষে ঢুকেছিল?

৩৪:১৩ >>> জিনেরা কি বিভিন্ন মসজিদে ইমামের জন্য সামনে দাঁড়ানোর জায়গাটুকু বানাতো? নাকি তারা প্রেসিডেন্ট সুলাইমান (সালামুন আলাইহি)-এর রাষ্ট্রীয় গুরত্বপূর্ণ বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য 'ব্যক্তিগত কক্ষ'  (Private Chamber) তৈরি করতো?

সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, মিহরাব অর্থ ব্যক্তিগত কক্ষ এবং নবী যাকারিয়া মিহরাবে সালাত করার প্রসঙ্গ থেকে ব্যক্তিগত কক্ষে তথা ব্যক্তিগতভাবে সালাত করার উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত প্রকাশ পায়। কেউ বলতে পারে যে, এটা নফল সালাত ছিলো। কিন্তু কুরআনে যেহেতু এটা নফল সালাত ছিলো বলে একে বিশেষায়িত করা হয়নি, তাই ফরজ সালাত ও নফল সালাত উভয়টির ক্ষেত্রে এটি দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রযোজ্য।

২৬. তাহাজ্জুদ

জিজ্ঞাসা: ক্বিয়ামুল লাইল ও তাহাজ্জুদ বলতে একই বিষয় বুঝায় কিনা? তাহাজ্জুদ কি সালাতের মাধ্যমেই সম্পাদন করতে হয় বা এটি কি সালাতের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যেতে পারে? আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাত অতিবাহিত করার সাজদাহ ও ক্বিয়ামের স্বরূপ কী? গভীর রাতে আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত, তাসবীহ, ক্ষমা প্রার্থনা, সাজদাহ, ক্বিয়াম ইত্যাদি কি সবার জন্য বাধ্যতামূলক? তাহাজ্জুদ কি প্রথম দিকে ফরজ ছিল এবং পরে নফল করে দেয়া হয়েছে? এছাড়া ৭৩:১-৪ আয়াতে যে সময়সীমার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, ৭৩:২০ আয়াতের মাধ্যমে কি তা রহিত হয়েছে?

জবাব: ৭৩:১-৮ ও ৭৩:২০ আয়াতে রসূলকে ক্বিয়ামুল লাইল বা রাতের বেলায় আল্লাহর উদ্দেশ্যে দণ্ডায়মান হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ সময় তিনি যা করবেন তার মধ্যে অন্যতম একটি দিক হলো ক্বওল বা ‘বক্তব্য বিষয়ের’ অনুশীলন। ক্বিয়ামুল লাইলের জন্য যখন রাতের বেলায় ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠা হয় এবং জেগে থেকে রাত অতিবাহিত করা হয় তখন তাকে তাহাজ্জুদ বলে। ক্বিয়ামুল লাইল বলতে শুধু ক্বিয়াম নয়, বরং ক্বিয়াম অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াতেরও প্রসঙ্গ রয়েছে। এবং তাহাজ্জুদ প্রসঙ্গেও বলা হয়েছে যে, ওয়া মিনাল লাইলি ফাতাহাজ্জাদ বিহী, নাফিলাতাল লাকা (রাতের বেলায় জেগে উঠে অতিবাহিত করো তা সহ/ কুরআন সহ, এটা তোমার জন্য নফল) (১৭:৭৯)। এর তাৎপর্য হলো: রাতের বেলায় তথা ফজরেরও আগে ঘুম থেকে জেগে সময় অতিবাহিত করো বুরআন তিলাওয়াত ও গবেষণার জন্য, এটি তোমার জন্য সর্বাধিক মনস্তাত্ত্বিক পরিগঠনের জন্য একটি অতিরিক্ত সুযোগ ও মূল (বাধ্যতামূলক) দায়িত্বের তুলনায় একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব। তাহাজ্জুদ করতে হবে কুরআনসহ, তা সালাতের মাধ্যমেও হতে পারে, সালাতের বাহিরেও হতে পারে। সুতরাং তাহাজ্জুদের মূল বিষয় কুরআন, সালাত নয়, যদিও সালাতের মাধ্যমে কুরআন পাঠও তাহাজ্জুদ হিসেবে সাব্যস্ত হবে, তবুও সালাত ছাড়াও শুধু কুরআন তিলাওয়াত বা গবেষণার মাধ্যমেও তাহাজ্জুদ হতে পারে।

১৭:৭৯ আয়াতে ‘তাহাজ্জুদ’ কোন সালাতের নাম নয়, বরং এর অর্থ ‘রাতে ঘুম থেকে জেগে, জেগে থাকা’। বলা হয়েছে, ওয়া মিনাল লাইলি ফাতাহাজ্জাদ বিহী। এখানে বিহী (উহা সহ) দ্বারা বুঝানো হয়েছে ‘কুরআন সহ’। কারণ, পূর্বের আয়াতে ব্যবহৃত ‘সালাত’ শব্দটি হচ্ছে শব্দগত স্ত্রীলিঙ্গ, ‘কুরআন’ শব্দটি হচ্ছে শব্দগত পুংলিঙ্গ। এবং এ আয়াতে ব্যবহৃত বিহী শব্দটি হচ্ছে শব্দগত পুংলিঙ্গ। সুতরাং তাহাজ্জুদ কুরআনের সাথে সম্পর্কিত, তা সালাতের মাধ্যমে হোক বা অন্য ভাবে হোক।

গভীর রাতে আল্লাহর তাসবীহ, কুরআন তিলাওয়াত, সাজদাহ ও রুকূ'র মাধ্যমে রাত্রি অতিবাহিত করার সাথে সম্পর্কিত কিছু আয়াত হলো: ৭৩:১-৮, ৭৩:২০, ২৫:৬৪, ৩:১৭, ৫১:১৭-১৮: ৩২:১৬।

গভীর রাতে আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত, তাসবীহ, ক্ষমা প্রার্থনা, সাজদাহ, ক্বিয়াম ইত্যাদি সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়নি, তবে এটা মু’মিনদের বৈশিষ্ট্য, তাই অনিয়মিতভাবে হলেও মু’মিনরা তাদের ঈমানের চেতনাগত মান অনুসারে এটি করে বা করবে।

তাহাজ্জুদ প্রথম দিকে ফরজ ছিল এবং পরে নফল করা হয়েছে এরূপ কোনো প্রমাণ কুরআনে নেই। সূরা বানী ইসরাইলের ৭৯ নং আয়াতে রসূলকে তাহাজ্জুদের (রাত্রের শেষ প্রহরে জাগরণের) নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং সেটাকে নফল বলা হয়েছে।

৭৩:১-৪ আয়াতে রসূলকে রাতের অর্ধেক বা তার চেয়ে কিছু বেশি বা কিছু কম সময় কুরআন নিয়ে দাঁড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

৭৩:২০ নং আয়াতে তাঁর সাথে একদল লোকও একই কাজে নিয়োজিত ছিল বলে উল্লেখ করে তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, তারা যতটুকু সহজ হয় ততটুকু কুরআন পাঠ করতে।

এর সূরাটির প্রথম দিকে রসূলকে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা রহিত করা হয়নি। বরং রসূলের জন্য সেই নির্দেশটি অন্যদের অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পালনের নতুন নির্দেশনার সংযোজন ঘটেছে, যা পূর্বের নির্দেশের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, বরং তার বিশেষ ব্যাখ্যামূলক বলে সাব্যস্ত হতে পারে।

২৭. নফল সালাত ও সাহায্য প্রার্থনার সালাত

জিজ্ঞাসা: সাহায্য প্রার্থনার উপায় হিসেবে ফরজ/ বাধ্যতামূলক সালাতের বাহিরেও নফল/ অতিরিক্ত বিশেষ সালাত করা যাবে কিনা?

জবাব: আল্লাহ আল কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেন যে, সালাত ও সবরের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে। তাই আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনার উদ্দেশ্যে বাধ্যতামূলক সালাতের বাহিরেও কেউ সালাত করতে পারে।

তবে সূরা মুজজামমিলের আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, দিনের বেলায় উপার্জনমূলক ও অন্যান্য বাধ্যতামূলক দায়-দায়িত্বের ব্যস্ততা অবলম্বনকেই অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। আয়াতটিতে বলা হয়েছে, ‘দিনের বেলায় তো তোমার অনেক ব্যস্ততা আছে’। (সূরা মুজজামমিল ৭৩: ০৭)।

সুতরাং সাধারণভাবে অনুশীলনযোগ্য নফল সালাত হচ্ছে শুধুমাত্র তাহাজ্জুদ যা রাতের শেষার্ধ বা তার চেয়ে কম বা বেশি সময় ধরে পড়া যেতে পারে। এটি রসূলের জন্য একটি নফল তথা রসূলের জন্য এমন একটি নির্দেশ যা সবার জন্য কমন বাধ্যতামূলক নির্দেশের তুলনায় অতিরিক্ত। এবং মু’মিনদের জন্য এর নির্দেশ নেই, কিন্তু তাদের জন্যও এটি অনুপ্রেরণামূলক এবং বিশেষ করে মু’মিনদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে এটি অবলম্বন করতে হবে এবং একদল মু’মিন এক্ষেত্রে রসূলের সাথে তা সম্পাদন করেছে মর্মে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু যেহেতু বাধ্যতামূলক নয় তাই নিয়মিত না হলেও তাতে আপত্তি নেই।

আল কুরআনে তাহাজ্জুদ ব্যতীত এবং কোন নফল সালাত নেই। ইশরাকের সালাত, চাসতের সালাত, আওয়াবীন সালাত, কুসুফের সালাত, খুসুফের সালাত, তাহিয়্যাতুল ওজুর সালাত, দুখুলুল মাসজিদের সালাত, সালাতুত তাসবীহ, তারাবীর সালাত, ঈদের সালাত ইত্যাদি নামে যেসব সালাতের নিয়ম প্রবর্তন করা হয়েছে তা কোনক্রমেই কোন বিধান হিসেবে প্রযোজ্য হতে পারে না।

কিতাব ও কুতিবা শব্দটি বাধ্যতামূলক ধরনকে প্রকাশ করে কিন্তু বাধ্যতামূলক এককের বাহিরে ঐচ্ছিক কর্মসূচীকে নিষিদ্ধ করে না। যেমন রমাদানের আইয়ামাম মাদূদাতে সিয়াম কুতিবা (২:১৮৩-১৮৪), কিন্তু এর বাহিরেও সিয়াম পালন নিষিদ্ধ নয়। হজ্জে আইয়ামাম মাদূদাতে যিকরুল্লাহর (আল্লাহর যিকির) আদেশ একটি বিশেষ আদেশ (২:২০৩), কিন্তু যিকরুল্লাহ (আল্লাহর যিকির) আইয়ামাম মাদূদাতে সীমাবদ্ধ বিষয় নয়।

কুরআনাল ফাজরি একটি বাধ্যতামূলক বিষয়, কিন্তু অন্য সময়েও কুরআন পাঠ করা যাবে। তেমনি সালাতিল ফজর, সালাতিল ইশা ও আস সালাতিল উসতা হচ্ছে বাধ্যতামূলক / কিতাবাম মাওক্বূতান, কিন্তু এর বাহিরেও সালাত করা নিষিদ্ধ নয়।

২৮. সালাত শিক্ষার ক্ষেত্রে হাদীসগ্রন্থ এবং ভাষা-বিজ্ঞান ও পরম্পরাগত অনুশীলনের উপযোগিতা

জিজ্ঞাসা: যেহেতু কুরআনে রুকূ'-সাজদাহর পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়নি এবং ২:২৩৯ ও ৪:১০৩ আয়াতে নিরাপত্তার সময় স্বাভাবিক পদ্ধতিতে সালাত প্রতিষ্ঠা করতে এবং যেভাবে আল্লাহ শিখিয়েছেন সেভাবে তাঁর যিকর করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাই সালাত শিক্ষার জন্য কি আমরা হাদীসগ্রন্থসমূহের উপর নির্ভরশীল হবো না? অথবা আমরা কি রুকূ'-সাজদাহর পদ্ধতি পরম্পরাগত অনুশীলন থেকে গ্রহণ করবো? সেক্ষেত্রেও আমরা কি কুরআনের বাহির থেকে নিয়ম-পদ্ধতি গ্রহণ করা হলো না?

জবাব: আল্লাহ মানুষকে আল কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং বায়ান/ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন (৫৫:১০৪), তিনি মানবজাতির প্রতিনিধি আদমকে নামকরণ শিক্ষা দিয়েছেন (২:৩১), মানুষকে লেখা শিখিয়েছেন (২:২৮২, ৯৬:৩-৫), নবী দাউদকে বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছেন (২১:৮০), মানুষকে শিকার করার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন (৫:৪), আদমের এক পুত্র অন্য পুত্রকে হত্যা করে ফেললে তাকে কিভাবে কবর দিতে হবে একটি কাকের মাধ্যমে তার প্রাকৃতিক পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন ৫:৩১) প্রভৃতি তথ্যের মাধ্যমে মানুষের যাবতীয় প্রকৃত শিক্ষা-প্রশিক্ষণের মূল কর্তা হিসেবে আল্লাহকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সুতরাং সবাই আল্লাহর কাছ থেকে সালাতের পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষালাভ করেছে তথা নিজ নিজ সালাত ও তাসবীহের পদ্ধতিজ্ঞান অর্জন করেছে (২৪:৪১)।

আল্লাহ কুরআনের মাধ্যমে হুকুম বা বিধান দিয়েছেন, মানুষকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং কুরআনকে মানবজাতির জন্য বায়ান বা স্বব্যাখ্যাত ও সুস্পষ্ট ভাব প্রকাশক বিবৃতি হিসেবে নাযিল করেছেন। তিনি মানুষকে যে বায়ান বা ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন যা তারা পরম্পরাগতভাবে অনুশীলন করে আসছে তার বিশুদ্ধ চর্চার ভিত্তিতে মানুষ কুরআনের বক্তব্যের বাস্তব স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে সক্ষম। প্রাসঙ্গিক আয়াতসমূহ: ৫৫:১-৪, ৩:১৩৮, ১৩:৩৬-৩৭।

কুরআন মানুষের ভাষায় নাযিল হয়েছে এবং তাই মানুষ তার ভাষায় যে জিনিসকে ওয়াজহুন বা ‘মুখমণ্ডল’ বলে, কুরআনেও ওয়াজহুন বা ‘মুখমণ্ডল’ বলে সেটাকেই বুঝানো হয়েছে। তাই কুরআনে মুখমণ্ডলের কোনো সীমা-পরিসীমা নির্ধারণ করে দেয়ার প্রয়োজন নেই। মানুষ যে বিষয়কে ক্বিয়াম বা ‘দাঁড়ানো’ বলে কুরআনেও ক্বিয়াম বা ‘দাঁড়ানো’ বলতে সেটাকেই বুঝানো হয়েছে। কুরআনে যখন দাঁড়াতে বলা হয়, তখন এটা স্বত:সিদ্ধ যে, তা দ্বারা স্বাভাবিকভাবে দাঁড়ানোই বুঝায়। যেহেতু মানুষ জানে যে, স্বাভাবিকভাবে দাঁড়ানোর স্বরূপ কী এবং অস্বাভাবিকভাবে দাঁড়ানোর স্বরূপ কী, তাই এ বিষয়ে কুরআনে অতিরিক্ত নির্দিষ্টতার মাধ্যমে কোনো জটিলতা আরোপ করা হয়নি। দুই পায়ের মধ্যে কতটুকু ফাঁকা রাখতে হবে এটি কোনো প্রশ্নই হওয়ার যোগ্য নয়। কুরআনে যে বিষয়গুলোর চুলচেরা স্বরূপকে চিহ্নিত করা হয়নি, তার মাধ্যমে মানুষকে সহজতা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে অতিরিক্ত প্রশ্ন মূলত জটিলতার অন্বেষণ মাত্র। এছাড়া যে বিষয়ে আল্লাহ কোনো বিধানকে নির্দিষ্ট করে দেননি, সে বিষয়ে অন্য কারো বিধান দেয়ার অধিকার নেই। (প্রাসঙ্গিক আয়াত ৪২:২১)

মানুষ যেমন নামকরণের ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষা অনুসারে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার উপযোগী নামকরণ করে থাকে, তেমনি কখনো জ্ঞানগত সীমাবদ্ধতার কারণে ভুল নামকরণ করতে পারে। এ ধরনের বিষয় পরবর্তীতে জ্ঞানপ্রাপ্তির বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ধরা পড়ে এবং তখন মানুষ সঠিক বা অধিকতর মানসম্মত নামকরণের মাধ্যমে পূর্বতন নামকরণকে পরিবর্তন বা পরিমার্জন করে। সুতরাং কোনো বিষয়ে মানবীয় ভাষায় বা পরম্পরাগত উপলব্ধি ও অনুশীলনে যদি কুরআনের কোনো তথ্যের ভিত্তিতে বা বাস্তবতার অধিকতর যৌক্তিক অভিজ্ঞানের মাধ্যমে ত্রুটি চিহ্নিত হয় তা অবশ্যই সংশোধনযোগ্য। এছাড়া সাধারণভাবে কুরআনে বর্ণিত তথ্যের অনুধাবন ও অনুশীলনের জন্য ভাষা ও পরম্পরাগত উপলব্ধিকেই ধারণ করতে হয়, কারণ এটা আল্লাহ প্রদত্ত প্রক্রিয়া যার মধ্যে তিনি মানুষকে দিনাতিপাত করাচ্ছেন।

প্রচলিত হাদীসগ্রন্থসমূহে যদি মানুষের সাধারণ বোধি বা পরম্পরাগত অনুশীলনের বিষয়টিকে লেখা হয়ে থাকে তবে সেটার সাথে ক্বিয়াম, রুকূ' বা সাজদাহর সাদৃশ্য মানে তা হাদীসগ্রন্থ থেকে গ্রহণ করা নয়, বরং যে কেউ যেমন বাস্তবতার বিষয়টি নিজ ভাষায় বিবরণসহ লিখতে পারে যে, কপাল থেকে (কপালসহ) থুতনি পর্যন্ত এবং এক কান থেকে অন্য কান পর্যন্ত বিস্তৃত অংশকে মুখমণ্ডল বা চেহারা বলে, বিষয়টি তদ্রূপ।

কুরআনের বিধি-বিধানের ব্যাখ্যার জন্য আমাদেরকে কোনো হাদীসগ্রন্থের উপর নির্ভরশীল করা হয়নি, বরং মানবজাতিকে আল্লাহ যে ভাষাজ্ঞান (বায়ান) শিক্ষা দিয়েছেন তার মাধ্যমে তথা স্বাভাবিক পরম্পরাগত অনুধাবনের মাধ্যমে কুরআনের তথ্যসমূহের বাস্তব স্বরূপ সম্পর্কে মানুষ পরিজ্ঞাত হতে পারে। হাদীসগ্রন্থের মাধ্যমে কুরআনে নেই এমন অতিরিক্ত বিধি-বিধান আরোপ করার কোনো অবকাশ নেই, কারণ আল্লাহ কুরআনকেই তাঁর হুকুম হিসেবে নাযিল করেছেন এবং হুকুম দানে তিনি কাউকে শরীক হিসেবে গ্রহণ করেন না। প্রাসঙ্গিক আয়াতসমূহ:  ১৮:২৬, ১৩:৩৬-৩৭।

সুতরাং আল্লাহ সালাত বা তাঁর যিকির শিক্ষা দেয়ার তাৎপর্য হলো: তিনি কুরআনের মাধ্যমে সালাতের বিধি-বিধান শিক্ষা দিয়েছেন। সেইসাথে তাদেরকে ভাষাজ্ঞান শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে ও তাদের সাধারণ বা পরম্পরাগত অনুধাবন-অনুশীলনে শব্দের বাস্তব সংযোগ (যেমন, সূর্য বললে মানুষ সূর্যকে চিহ্নিত করতে পারা) শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে তিনি ঐ বিধি-বিধান বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশিত তথ্যের বাস্তব স্বরূপ সম্পর্কিত জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন।

২৯. মেরু অঞ্চলে সালাতের ও সিয়ামের সময়সীমা

জিজ্ঞাসা: মেরু অঞ্চলে আনুষ্ঠানিক সালাত ও সিয়াম সম্পাদনের সময়সীমা কিভাবে নির্ধারিত হবে? যেহেতু তাতে ২৪ ঘন্টার স্বাভাবিক দিন-রাত্রির পরিবর্তে একাদিক্রমে দিন এবং একাদিক্রমে রাত বর্তমান থাকে?

জবাব: ৪:১০৩ আয়াত অনুসারে ‘নিশ্চয় সালাত মু’মিনদের উপর ওয়াক্ত সাপেক্ষে নির্ধারিত বিধান’। তাই সালাতের ওয়াক্তসমূহ নির্ণয়ের মাধ্যমে নির্ধারিত ওয়াক্তে ঐ ওয়াক্তের সালাত সম্পাদন করতে হবে। অমেরু অঞ্চলে সূর্যোদয়, মধ্যাহ্নে সূর্য পশ্চিমাকাশের দিকে ঢলে পড়া ও সূর্যাস্ত এবং গোধুলি প্রভৃতির ভিত্তিতে সালাতের ওয়াক্তসমূহ সহজেই নির্ণয় করা সম্ভব হয়। কিন্তু মেরু অঞ্চলে যেখানে একাদিক্রমে কয়েকদিন দিন (daytime) এবং কয়েকদিন রাত (nighttime) তাতে কিভাবে সালাত ও সিয়াম সম্পাদন করতে হবে তা নির্ণয় করার জন্য সূর্যোদয়, মধ্যাহ্নে সূর্য পশ্চিমাকাশের দিকে ঢলে পড়া ও সূর্যাস্ত ইত্যাদি প্রসঙ্গে কুরআনে ব্যবহৃত শব্দসমূহের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ অর্থের তুলনায় এর সর্বত্র প্রয়োগযোগ্য অর্থকে বিবেচনা করতে হবে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হলো:

সূর্যোদয়কে ‘তুলুয়ে শামস’, সূর্য মধ্যাহ্নে পশ্চিমাকাশের দিকে ঢলে পড়াকে ‘দুলুকে শামস’ এবং সূর্যাস্তকে ‘গুরুবে শামস’ বলা হয়। কিন্তু তুলুয়ে শামস এর প্রকৃত মানে এ নয় যে, এ সময়ই সূর্যকে প্রথম দেখা যায়। বস্তুত ‘তুলু’ শব্দটি কোনো বিষয়ের উদ্ভাস বা সূচনা ঘটাকে নির্দেশ করে। এজন্য ফজর শুরু হওয়ার সময়কে বলা হয় ‘মাতলায়িল ফাজর’ (৯৭:৪)। এর মানে এ নয় যে, এ সময় ফজরকে দেখা যায়। বরং এর মানে এটা ফজর শুরু হওয়ার সময়। ‘তুলুয়ে শামস’ সম্পর্কে বুঝার জন্য সূর্যের আলো ও চাঁদের আলোর তুলনা এবং ছায়ার সাথে সূর্যের সম্পর্ক জানা প্রয়োজন।

১০:৫ আয়াতে সূর্যকে ‘দিয়া’ এবং চাঁদকে ‘নূর’ হিসেবে বানানোর কথা বলা হয়েছে। ‘দিয়া’ হলো প্রখর আলো এবং ‘নূর’ হলো স্নিগ্ধ আলো। সাধারণত ‘দিয়া’ দিনের বৈশিষ্ট্য এবং ‘নূর’ রাতের বৈশিষ্ট্য। তাই ২৮:৭১ আয়াতে ‘লাইলের’ বিপরীতে ‘দিয়া’ এর প্রসঙ্গ বলা হয়েছে এবং ২৮:৭২ আয়াতে ‘নাহার’ এর বিপরীতে ‘লাইল’ এর প্রসঙ্গ বলা হয়েছে ‘স্বস্তি সহকারে অবস্থান বা বিশ্রাম নেয়ার’ সময়কাল হিসেবে। এই হিসেবে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় হচ্ছে দিন এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময় হচ্ছে রাত। তবে রাতের মধ্যকার twilight (গোধুলি) এর সময়সীমা হলো দিন ও রাতের সংমিশ্রিত অংশ। এর মধ্য থেকে সূর্যোদয় পূর্ববর্তী (ফজর) সময়সীমাকে দিনের অংশ হিসেবে এবং সূর্যাস্ত পরবর্তী সময়সীমাকে রাতের অংশ হিসেবে ধরতে হবে। কারণ সূর্যাস্ত পরবর্তী গোধুলি হচ্ছে এমন সময় যখন রাতের মধ্যে দিনের কিছু অংশ থাকে কিন্তু রাত থেকে দিনকে ক্রমে সরিয়ে নেয়া হয় এবং সময়টি রাত হিসেবে সাব্যস্ত হয়। অনুরূপভাবে সূর্যোদয় পূর্ববর্তী গোধুলির সময়টি দিন হিসেবে সাব্যস্ত হয়। অমেরু অঞ্চলে যেভাবে সূর্যোদয়কে বুঝানো হয়, মেরু অঞ্চলে সেভাবে চিহ্নিত করার পরিবর্তে বরং সূর্যকে ‘দিয়া’ হিসেবে বানানোর ঘোষণার প্রেক্ষিতে সেখানে ‘তুলুয়ে শামস’ বলতে সেই সময়টিকে চিহ্নিত করার অবকাশ রয়েছে যখন থেকে সূর্য ‘দিয়া’ বা ‘প্রখর আলো’ ছড়ানো শুরু করে। অন্যদিকে যখন সূর্যালোক স্থির হয়ে যায়, ঐ আলোর সময়টি ‘নাহার’ বা দিন না হয়ে ‘লাইল’ বা রাত হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

২৫:৪৫ আয়াতে ছায়ার সাথে সূর্যের সম্পর্ক বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। নিম্নে আয়াতটি উল্লেখ করা হলো।
২৫:৪৫ :: তুমি কি লক্ষ্য করো না তোমার প্রভুর প্রতি, কিভাবে তিনি ছায়াকে দীর্ঘ করেন? যদি তিনি ইচ্ছা করতেন, উহাকে (ছায়াকে) স্থির করতেন। তারপর আমরা সূর্যকে উহার বিষয়ে দলীল বা দিক-নির্দেশক (indication/indicator/guide) করেছি।

দিনের (নাহার) এর প্রথমভাগে ‘তুলুয়ে শামস’ বা সূর্যোদয় হয়, সূর্য ‘দিয়া’ বা ‘প্রখর আলো’ ছড়ানো শুরু করে এবং সূর্যালোকের কারণে বস্তুর ছায়া পশ্চিম দিকে দীর্ঘ হয় এবং দিনের মধ্যাহ্নের পর তথা ‘দুলুকে শামস’ বা সূর্য অস্তাচলের দিকে প্রথম ঢলে পড়ার সময় থেকে সূর্যালোকের কারণে বস্তুর ছায়া পূর্বদিকে দীর্ঘ হয়। ‘গুরুবে শামস’ বা ‘সূর্যাস্তের’ মাধ্যমে ‘দিয়া’ বা প্রখর আলো সমাপ্ত হয়ে সূর্যালোক স্থির হয়ে যায়। অমেরু অঞ্চলে ‘দিয়া’ বা প্রখর আলো শুরু হওয়ার সময়কে ‘তুলুয়ে শামস’ এর সমপর্যায় এবং ‘দিয়া’ বা প্রখর আলো সমাপ্ত হওয়ার সময়কে ‘গুরুবে শামস’ এর সমপর্যায় হিসেবে সাব্যস্ত করা যেতে পারে। এই প্রেক্ষিতে ‘দিবাভাগের’ (Daytime) মধ্যবিন্দু সময়কে ‘দুলুকে শামস’ হিসেবে সাব্যস্ত করা যেতে পারে।

অন্যকথায় বলা যায়, কুরআনে বর্ণিত ‘নাহার’ ও লাইল’ দ্বারা অমেরু অঞ্চলে যে ‘দিন’ ও ‘রাত’ বুঝায়, মেরু অঞ্চলের ক্ষেত্রে তা হুবহু একই অর্থ বহন করবে না। আল্লাহ চাইলে কিয়ামাত পর্যন্ত দিনকে বা রাতকে দীর্ঘ করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি অমেরু অঞ্চলে ২৪ ঘণ্টায় দিন-রাতের আবর্তন ঘটান। আর ‘সূর্যোদয়’ ও ‘সূর্যাস্ত’ এবং সূর্যকে দেখা না দেখার উপর ভিত্তি করে ‘দিন’ ও ‘রাত’ হিসেব করলে ‘মেরু অঞ্চলে’ কয়েকদিন ধরে দিন এবং কয়েক দিন ধরে রাত থাকে। এমনকি মেরু অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে ছয় মাস দিন এবং ছয় মাস রাত থাকতে পারে। কিন্তু ২৮:৭১-৭২ আয়াত অনুযায়ী, ‘নাহার’ (দিন) ‘দিয়া’ বা প্রখর আলো ধারণ করে এবং ‘লাইল’ (রাত) ‘দিয়া’ বা প্রখর আলো ধারণ করে না। এই প্রেক্ষিতে যে অমেরু অঞ্চলে প্রচলিত অর্থে কয়েকদিন রাত বা দিন থাকে, তাতেও প্রকৃতপক্ষে ২৪ ঘণ্টার ‘নাহার’ ও ‘লাইল’ আবর্তিত হয়।

প্রশ্ন হতে পারে যে, যেখানে কয়েকদিন ধরে দিন তাতে রাতের অন্ধকার পাওয়া যায় না, সুতরাং কিভাবে তাতে রাতের আবর্তন হয় বলে ধরা যেতে পারে। এ বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য জ্ঞাতব্য যে, অমেরু অঞ্চলে সূর্য দেখা না দেখা এবং সূর্যালোক ও অন্ধকার দিন ও রাত নির্ণয়ের জন্য নিদর্শনস্বরূপ। কিন্তু মেরু অঞ্চলে ‘নাহার’ ও ‘লাইল’ চিহ্নিত করার জন্য তা আবশ্যক নয়। কারণ ১৭:১২ আয়াত অনুযায়ী, ‘নাহার’ (দিন) ও ‘লাইল’ (রাত) দুটি নিদর্শন হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্য কথায়, পৃথিবীর অর্ধাংশে দিন এবং অর্ধাংশে রাত সৃষ্টি করা হয়েছে। তারপর পৃথিবীর ঘূর্ণনের মাধ্যমে ঋতুর পরিবর্তন ঘটে এবং রাতের নিদর্শনকে (অন্ধকার) ম্রিয়মান করা হয়েছে এবং দিনের নিদর্শনকে দেখার উপযোগী করা হয়েছে। সুতরাং সূর্য দেখা যাওয়াকে নয়, বরং দেখার উপযোগী আলোকে দিনের নিদর্শন বানানো হয়েছে। বস্তুত কুরআনে দিনের বেলাকে সব কিছু স্পষ্ট আলোতে দেখার ও ব্যস্ততার সময় হিসেবে এবং রাতকে পূর্ণ বিশ্রাম বা ঘুমের সময় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং কুরআনে ‘নাহার’ ও ‘লাইল’ শব্দ দিয়ে শুধুমাত্র জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় (Astronomical) দিন-রাতকে বুঝানো হয় নি, বরং স্বাভাবিক নাগরিক জীবন যাপনের ২৪ ঘণ্টার দিন-রাতকেও বুঝানো হয়েছে।

এমতাবস্থায়, মেরু অঞ্চলে যেখানে একাদিক্রমে কয়েকদিন দিন ও কয়েকদিন রাত থাকে, তাতেও তারা যেভাবে অমেরু অঞ্চলের লোকদের মতো দিবাভাগের প্রখর আলোতে কর্মব্যস্ত থাকে এবং রাতের বেলায় বা বিশ্রাম ও ঘুম উপযোগী স্নিগ্ধ আলোতে ঘুমায়, সেভাবেই নাগরিক জীবন যাপনের দিন-রাত হিসেব করা যেতে পারে।

অমেরু অঞ্চলে সালাত ও সিয়াম সম্পাদনের জন্য মেরু অঞ্চলের দিন-রাতের বিভিন্ন সময়ের সমপর্যায়ের সময়সীমা নির্ণয় করাকে মেঘলা বাদলা দিনে সূর্য না দেখা সত্ত্বেও দিনের বেলা ও রাতের বেলাকে যথানিয়মে হিসাব করার সমতুল্য বলা যেতে পারে। বস্তুত কুরআনে দিন-রাতের লক্ষণ হিসেবে সূর্য দেখা না দেখার চেয়ে এর ‘দিয়া’ বা ‘প্রখর আলোর প্রভাব’কে মুখ্য গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এভাবে সালাত ও সিয়ামের বিধান সর্বজনীন ও স্বাভাবিকভাবে অনুসরণযোগ্য হয়েছে।

শেষ কথা

আল কুরআনের আলোকে সালাতের রূপরেখা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের উপলব্ধি চালু রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে থাকা আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত সমাধান নির্ণয় করার জন্য চেষ্টা করেছি। এতে আমরা আমাদের সাধ্যমতো উত্তম উপলব্ধিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করেছি। এর ফলে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, আল কুরআনে সালাতকে ব্যাপক ও আনুষ্ঠানিক উভয় অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে এবং সালাত বলতে শুধু নামাজ নামে পরিচিত কাঠামোকেই বুঝানো হয়নি, বরং অমুসলিমদের উপাসনা অনুষ্ঠানকেও সালাত হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ সালাতের বাহ্যিক কাঠামোতে অগ্রহণযোগ্য বিকৃতি এবং সালাতের উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে এবং আনুষ্ঠানিক সালাত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বাস্তব সালাত সম্পাদন করার পরিবর্তে আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়াকে কোনো পুণ্যের কাজ হিসেবে নয়, বরং দুর্ভোগের কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আমরা যেন আমাদের সালাতকে কোনোভাবে নষ্ট না করি এবং কামনা-বাসনার অনুসরণের পরিবর্তে আল্লাহর বিধানের অনুবর্তী থাকি সেই বিষয়েই কুরআনে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহ কুরআনে সালাতের কাঠামোর বিষয়ে অতিরিক্ত রূপরেখা ও নিয়ম-পদ্ধতি আরোপ করার পরিবর্তে মৌলিক কাঠামোগত নির্দেশনা দিয়ে বিষয়টি ব্যাপকভাবে আমাদের বাস্তব পরিস্থিতি সাপেক্ষে বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিক উপলব্ধি ও সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে নিবেদনের রীতিনীতি পরিগঠনের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ আনুষ্ঠানিকতার কঠোরতা বা চুলচেরা নির্দিষ্টতা নয়, বরং উদ্দেশ্য অনুসারে মৌলিক আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির অনুশীলনই কুরআনের আলোকে মুখ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসাবে বেশি প্রশ্ন আসে যে, আমরা হাদীসে রসূল নামে দাবিকৃত বুখারী, মুসলিম ইত্যাদিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবো? এ প্রশ্ন এমন এক দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে যা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি বিষয়। তাই আমরা এ বইয়ে এ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম। এছাড়া আরো কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, (১) যারা বর্তমান কাঠামো প্রতিষ্ঠা করলেন তারা কেন তা করলেন এবং কিভাবে তা করতে পারলেন? (২) এত যুগ ধরে এত আলেম মিলে কি ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি ও পারছেন না? (৩) যারা প্রচলিত কাঠামোকে সঠিক মনে করে আমল করে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের কী হবে? আমরা পাল্টা প্রশ্ন করতে পারি যে, আমাদের করণীয় নির্ধারণে এসব প্রশ্নের সত্যি কি কোনো ভূমিকা আছে? এবং মহান আল্লাহকে ন্যায়বিচারক বলে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও এসব প্রশ্ন কি আদৌ উত্থাপিত হওয়ার যোগ্য? আমাদেরকে ভাবতে হবে যে, সত্য আসার পর টালবাহানা করা অত্যন্ত বড় অপরাধ। আমরা ভাবতে হবে যে, আমরা কি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য জবাব দিতে পারবো? আমরা ভুল চিন্তা ও অন্ধ অনুসরণজনিত শিরক থেকে বাঁচতে চাই এবং আল্লাহর আদেশ যথাযথভাবে জেনে ও মেনে যথাযথ কল্যাণ লাভ করতে চাই।

বইয়ে থাকা আয়াতসমূহ শাশ্বত সত্যের ধারক। কিন্তু সংকলক কর্তৃক তথ্য সমন্বয়মূলক আলোচনার অংশে যে কোনো মানবীয় উপলব্ধি প্রয়াসের মতো অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি ও উপলব্ধিগত দুর্বলতা থেকে যাওয়া স্বাভাবিক। তাই যদি এ বিষয়ে পরবর্তীতে কোনো ত্রুটি চিহ্নিত হয় বা কেউ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তাহলে আয়াতসমূহের দ্বারা পুনরায় যাচাই সাপেক্ষে তা সংশোধন করা হবে ইনশাআল্লাহ।

ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ, তাওয়াক্কালতু আলাইহি ওয়া ইলাইহি উনিব (সূরা হূদ ১১:৮৮)

>>  পরবর্তী পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য ক্লিক করুন