কুরআনের আলোকে সালাত
বিশ্বপ্রভুর বিধানের নিবিড় অনুসরণমূলক আনুষ্ঠানিক ও বাস্তবমুখী সংযোগ কর্মসূচী
ইয়াওমুল জুমুয়া
আরবিতে সাতদিনের নাম সম্পর্কিত পর্যালোচনা
বর্তমানে সপ্তাহের সাত দিনকে আরবিতে যেভাবে বলা হয় তা নিম্নরূপ:
১. ইয়াওমুল আহাদি = রবিবার
২. ইয়াওমুল ইছনাইনি = সোমবার
৩. ইয়াওমুছ ছালাছায়ি = মঙ্গলবার
৪. ইয়াওমুল আরবাআ’য়ি = বুধবার
৫. ইয়াওমুল খামীসি = বৃহস্পতিবার
৬. ইয়াওমুল জুময়া’ = শুক্রবার
৭. ইয়াওমুস সাবতি = শনিবার।
সপ্তাহের সাত দিনের মধ্য থেকে প্রথম পাঁচটি দিনের নাম গ্রহণ করা হয়েছে সংখ্যাবাচক শব্দের (এক, দুই, ...) সাথে সম্পর্কিত করে। আরবিতে প্রথম সাতটি সংখ্যাকে কর্তৃকারকের রূপ ও কর্মকারকের রূপে যেভাবে লেখা হয় তা নিম্নরূপ:
সংখ্যা কর্তৃকারকের রূপ কর্মকারকের রূপ
১ (এক) ওয়াহিদ / আহাদ আহাদ
২ (দুই) ইছনান ইছনাইনি
৩ (তিন) ছালাছাহ ছালাছায়ি
৪ (চার) আরবাআ’হ আরবাআ’য়ি
৫ (পাঁচ) খামছাহ খামীছি
৬ (ছয়) ছিত্তাহ ছিত্তায়ি
৭ (সাত) ছাবআ’হ ছাবআ’য়ি
সুতরাং সপ্তাহের সাতদিনের প্রতি দিনকে সংখ্যাবাচক শব্দের কর্মকারকের সাথে সম্পর্কিত করে নামকরণ করলে দিনসমূহের নাম হয় নিম্নরূপ:
১. ইয়াওমুল আহাদি = রবিবার
২. ইয়াওমুল ইছনাইনি = সোমবার
৩. ইয়াওমুছ ছালাছায়ি = মঙ্গলবার
৪. ইয়াওমুল আরবাআয়ি = বুধবার
৫. ইয়াওমুল খামীসি = বৃহস্পতিবার
৬. ইয়াওমুছ ছিত্তায়ি = শুক্রবার
৭. ইয়াওমুস সাবআ’য়ি = শনিবার।
আবার সপ্তাহের সাত দিনকে ক্রমবাচক সংখ্যার (প্রথম, দ্বিতীয়, ... ) সাথে সম্পর্কিত করে নামকরণ করলে দিনসমূহের নাম হয় নিম্নরূপ:
১. আল ইয়াওমুল আউয়াল = রবিবার
২. আল ইয়াওমুস ছানি = সোমবার
৩. আল ইয়াওমুস ছালিছ = মঙ্গলবার
৪. আল ইয়াওমুর রবি’ = বুধবার
৫. আল ইয়াওমুল খামিছ = বৃহস্পতিবার
৬. আল ইয়াওমুছ ছাদিছ = শুক্রবার
৭. আল ইয়াওমুছ ছাবি’ = শনিবার
এ আলোচনার উদ্দেশ্য হলো বর্তমানে ষষ্ঠ দিন ও সপ্তম দিনকে যথাক্রমে ‘ইয়াওমুল জুমুয়া’ এবং ‘ইয়াওমুস সাবত’ বললেও যেমন প্রথম পাঁচদিনের নাম দিনের সংখ্যাক্রমের সাথে সম্পর্কিত, তেমনি শেষ দুটি দিনের নামও দিনের সংখ্যাক্রমের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু এ দুটি দিনকে অন্য দুটি বিশেষণে বিশেষিত করে এর নামকরণ করা হয়েছে। অন্য কথায় বলা যায়, সপ্তাহের শেষ দুই দিনের নামের ক্ষেত্রে প্রাথমিক নামের স্থানে দ্বিতীয় পর্যায়ের নাম প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
এখন এ দুটি নামের মধ্যে ষষ্ঠদিনের নাম ‘ইয়াওমুল জুমুয়া’ (জমায়েতের দিন) এবং সপ্তম দিনের নাম ‘ইয়াওমুস সাবত’ (সাপ্তাহিক কর্মবিরতির দিন) নামকরণের পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সপ্তাহের প্রথম ছয়দিন পেশাগত কর্মব্যবস্তার পর সপ্তম দিনে কর্মবিরতি বা অবকাশ যাপন করা স্বাভাবিক বিধায় সপ্তম দিনকে ‘ইয়াওমুস সাবত’ হিসেবে নামকরণ করা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এ প্রসঙ্গে জরুরি প্রশ্ন হলো, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দিবসকে বা তার কর্মচারীদের বিভিন্ন গ্রুপের জন্য বিভিন্ন দিবসকে ‘ইয়াওমুস সাবত’ হিসেবে পালন করার অবকাশ আছে কিনা? অন্য কথায়, বিশ্বব্যাপী একই দিনকে সপ্তম দিন ও কর্মবিরতি দিবস হিসেবে পালন করতে হবে- এরূপ কোনো ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা আছে, নাকি এটা একটা নির্বাহী বিষয় যে, এক্ষেত্রে বাস্তব সুবিধা অসুবিধা অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে।
অনুরূপভাবে ষষ্ঠদিনকে ‘ইয়াওমুল জুমুয়া’ বা ‘জমায়েতের দিন’ হিসেবে নির্দিষ্ট করাকে সর্বজনীনভাবে নির্দিষ্ট বিধান হিসেবে কার্যকর করতে হবে, নাকি এটাও পরিস্থিতি সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল সিদ্ধান্ত নির্ভর বিষয়? অন্য কথায় বর্তমানে যে দিনকে ষষ্ঠদিন হিসেবে বা জমায়েতের দিন হিসেবে পালন করা হয়, এ দিনকেই ষষ্ঠদিন সাব্যস্ত করার বা এ দিনকেই বিশ্বব্যাপী একই দিন বাধ্যতামূলকভাবে জমায়েতের দিন হিসেবে পালন করার কোনো ধর্মীয় প্রমাণ ও নির্দেশ রয়েছে কিনা?, এটি একটি জরুরি পর্যালোচনার উপযোগী বিষয়।
ইয়াওমুল জুমুআ কী বার?
‘ইয়াওমুল জুমুআ’ কোন Proper Noun নয়। ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ অর্থ হচ্ছে ‘জমায়েতের দিন’। সুতরাং ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ দুই ধরনের হতে পারে। (১) সাধারণ ‘ইয়াওমুল জুমুআ’, অর্থাৎ যে কোনো দিন যদি লোকজন কোনো বিশেষ কারণে একত্রিত হয় তা একটি ইয়াওমুল জুমুআ হয়ে যায়। এর কোন নির্দিষ্টতা নেই। অর্থাৎ সপ্তাহে যে কোনো দিন এবং এমনকি একাধিক দিন এবং একেক সপ্তাহে একেক সংখ্যক দিন এ ধরনের ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ হতে পারে। (২) নির্দিষ্টকৃত ‘ইয়াওমুল জুমুআ’, অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ নির্ধারণ করা যেতে পারে, যা হতে পারে সপ্তাহে একদিন বা দশ দিনে একদিন বা মাসে একদিন, যেভাবেই নির্দিষ্ট করা হবে সেভাবে। প্রশ্ন হলো কেন কোনো দিনকে ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ নির্ধারণ করা হবে? সাধারণত পার্থিব প্রয়োজনের দিক থেকে এটা হতে পারে ব্যবসায়ের বিশেষ দিন হিসেবে নির্ধারণ করা, যেদিন পূর্ব নির্ধারিত রীতি অনুসারে ব্যবসায়ের কাজে ব্যাপক জমায়েত ঘটবে। এটাকে ‘হাটবার’ বা ‘সাপ্তাহিক মেলার দিন’ বলা হয়ে থাকে। সূরা জুমুআর ৯-১১ আয়াতে ব্যবসায়ের প্রসঙ্গ থেকে এ বিষয়টি সহজে বুঝা যেতে পারে।
“হে মু’মিনগণ, ‘ইয়াওমিল জুমুআয়’ (জুমুআর দিনে) যখন সালাতের জন্য আহবান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর যিকরের দিকে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় / ব্যবসায় কার্যক্রম ত্যাগ কর। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। তারপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা, শিক্ষা প্রভৃতি) অন্বেষণ করো। এবং আল্লাহর যিকির (স্মরণ) বেশি পরিমাণে করো, যাতে তোমরা সফল হও। এবং যখন তারা ব্যবসায় বা ক্রীড়া-কৌতুক দেখলো তখন সেদিকে ছুটে গেলো এবং তোমাকে দন্ডায়মান রেখে গেলো। বলো, আল্লাহর কাছে যা আছে তা ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যবসায়ের তুলনায় কল্যাণকর। এবং আল্লাহ সর্বোত্তম জীবিকাদাতা।” (৬২:৯-১১)
‘ইয়াওমিল জুময়ায়’ (জুমুআর দিনে) যে সালাতটি জামায়াতবদ্ধভাবে আদায় করা ফরজ তা হলো ঐ দিনের আস সালাতুল উসতা যার সময়সীমা হচ্ছে সূর্য ঢলে পড়া থেকে শুরু হয়ে দিনের শেষসীমা পর্যন্ত। কারণ দিন-রাতের তিনটি সালাত (সালাতিল ফজর, আস সালাতিল উসতা এবং সালাতিল ইশা) এর মধ্য থেকে এ সালাতটিই স্বাভাবিকভাবে এমন সময় যার পূর্বাপর ব্যবসায় বা উপার্জনমূলক ব্যস্ততা প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে থাকে। অন্যদিকে সালাতিল ফজরের আগে ও সালাতিল ইশার পরের সময়কে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সময়সীমা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে (২৪:৫৮)। সুতরাং ‘আস সালাতি মিন ইয়াওমিল জুমুআ’ বা জমায়েতের দিনে জামায়াতের সাথে সম্পাদনের জন্য যে সালাতের জন্য নিদা বা আহবান করা হবে তা সূর্য ঢলে পড়ার সাথে সাথে করা যেতে পারে।
নির্দিষ্টকৃত ইয়াওমুল জুমুআর ক্ষেত্রে সপ্তাহ ভিত্তিক হিসাবই অনুশীলন করা উচিত। কারণ সপ্তাহ ভিত্তিক হিসাব মানব সভ্যতায় একটি পরম্পরাগত রীতি এবং এ রীতির একটি যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে। সাত দিনে সপ্তাহ হিসাব করার ভিত্তি হলো, আল্লাহ আকাশসমূহ, পৃথিবী ও উহাদের মধ্যস্থিত সবকিছু ‘সিত্তাতি আইয়ামে’ বা ছয়দিনে সৃষ্টি করেন। উল্লেখ্য, যে ছয়দিনে আসমান জমিন সৃষ্টি করা হয়েছে তা পৃথিবীর হিসাবের চব্বিশ ঘন্টার দিন নয়, কারণ পৃথিবীর দিন নির্ধারিত হয় পৃথিবী আপন অক্ষে একবার ঘুরতে যে সময় লাগে তার ভিত্তিতে। এ ছয়দিন হচ্ছে মহাজাগতিক সৃষ্টি পর্যায়ের ছয়দিন, যার একেক দিন পৃথিবীর পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান হওয়া অসম্ভব নয়। তারপর (ছয়দিনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করার পর) আল্লাহ তায়ালা আরশে অধিষ্ঠিত হন। (৭:৫৪, ১০:৩, ২৫:৫৯, ৩২:৪)।
আরশ শব্দের অর্থ ক্ষমতার গদি। এবং কুরসী শব্দের অর্থ যে স্থানে কারো ক্ষমতা ব্যাপ্ত রয়েছে। যেমন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার গদি মানে বাংলাদেশের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ও প্রয়োগ করার বা ক্ষমতা চর্চার অধিকার। এবং তার স্বাধীন ক্ষমতা ব্যাপ্ত রয়েছে বাংলাদেশের পুরো ভূমণ্ডলে।
ছয়দিনে আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও এগুলোর মধ্যস্থিত সবকিছু সৃষ্টি করার অর্থ ছয় মহাকালে সবকিছু সৃষ্টি করা। তারপর বর্তমান সময়কালকে বলা যেতে পারে সপ্তম দিন বা সপ্তম মহাকাল, মহান আল্লাহ তাঁর আরশে অধিষ্ঠিত থেকে সবকিছু পরিচালনা করার কাল। এখন এই মোট সাত মহাকালের প্রতীক হচ্ছে সপ্তাহের সাতদিন। সুতরাং সপ্তম মহাকালের প্রতীক হচ্ছে সপ্তম দিন। সম্ভবত এই প্রেক্ষিতে মানবসভ্যতায় সাত দিনে সপ্তাহ গণনার হিসাব চালু হয়েছে এবং চালু রয়েছে।
যদিও প্রাথমিকভাবে বলা যায় যে, শুক্র, শনি, রবি যে কোনো দিনকে সপ্তাহের প্রথম দিন ধরা যেতে পারে, এবং প্রথম, দ্বিতীয় বা শেষ এক কথায় যে কোনো দিনকে জুমুআর দিন সাব্যস্ত করা যেতে পারে। সপ্তাহের দিনক্রম বা জুমুআর দিন পরামর্শের মাধ্যমে বারবার পরিবর্তন করা যেতে পারে। তবুও এ কথা বিবেচনাযোগ্য যে, এভাবে পরিবর্তনশীলভাবে সপ্তাহের হিসাব মানুষের মধ্যে স্থিতিশীলতা তৈরি ও তাদের কার্যক্রমে শৃঙ্খলা রক্ষার সহায়ক হয় না। সাধারণত মানুষ এসব হিসাব এজন্যই করে যেন তাদের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে তারা সুবিধা পেতে পারে। তাই যেক্ষেত্রে পরিবর্তনশীলতার চেয়ে স্থিতিশীলতাই কাম্য, সেক্ষেত্রে মানুষ স্থিতিশীলতাকেই অবলম্বন করে, এটাই মানুষের নির্বাহী রীতিনীতি, যা আল্লাহর তৈরি একটি প্রকৃতিগত বাস্তবতা। সেই প্রেক্ষিতে আমরা বিভিন্ন দেশ ও ভাষায় সপ্তাহের দিনগুলোর নাম যাই হোক না কেন, কিভাবে তারা আন্তঃজাতীয় প্রেক্ষাপটে কোনো দিনকে প্রথম দিন সাব্যস্ত করে সবাই একই দিনকে প্রথম দিন হিসেবে পায়, সেই সমীকরণ অন্বেষণ করতে পারি। সামান্য অনুসন্ধানেই এটি নির্ণয় করা সম্ভব।
সপ্তাহের প্রথম দিন হিসেবে যে দিনকে হিসেব করা হয় এটিকে আরবিতে বলে ‘ইয়াওমুল আহাদ’ বা প্রথম দিন। এ দিনটিকে বাংলায় রবিবার এবং ইংরেজিতে Sunday বলা হয়। এভাবে সপ্তম দিনকে (ইয়াওমুস সাবআ’য়ি) আরবিতে বলা হয় ‘ইয়াওমুস সাবত’ (বিশ্রাম দিবস) এবং এ দিনটিকে বাংলায় ‘শনিবার’ ও ইংরেজিতে Saturday বলা হয়। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, কোন দিনটিকে প্রথম দিন হিসেবে ধরা হয় সেটির স্বয়ং একটি স্থিতিশীল হিসাব বিশ্বব্যাপী পরম্পরাগতভাবে প্রচলিত রয়েছে বা যখন থেকেই চালু হোক না কেন, তা স্থিতিশীল হয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা প্রথম দিন বলতে রবিবারকে এবং সপ্তম দিন বলতে শনিবারকে বুঝবো, এটাই মানবজাতির স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সাথে সংহতিপূর্ণ হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, প্রথম দিন থেকে পঞ্চম দিনকে আরবিতে যেভাবে ‘প্রথম দিন, দ্বিতীয় দিন, তৃতীয় দিন, চতুর্থ দিন ও পঞ্চম দিন’ বলে নামকরণ করা হয়েছে, ষষ্ঠ ও সপ্তম দিনের ক্ষেত্রে তা নয় কেন? ষষ্ঠ দিনকে ষষ্ঠ দিন বলার পরিবর্তে ‘ইয়াওমুল জুমুয়া’ বা ‘জমায়েতের দিন’ বলা হয়। এবং সপ্তম দিনকে সপ্তম দিন বলার পরিবর্তে ‘ইয়াওমুস সাবত’ (বিশ্রাম দিবস) বলা হয়। অর্থাৎ প্রথম পাঁচটি দিনকে তার সংখ্যানুক্রম অনুসারে নামকরণ করা হয়েছে এবং তা প্রচলিত আছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম দিনের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যানুক্রমিক নামটিকে ছাপিয়ে সেগুলোর অন্য দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যমূলক নামকরণ প্রচলিত হয়েছে। ষষ্ঠদিনে ‘জুমুআ’ পালন করা হয় তাই ষষ্ঠদিনকে ‘ষষ্ঠ দিন’ বলার পরিবর্তে ‘ইয়াওমিল জুমুআ’ বা ‘জমায়েতের দিন’ বলা হয়। এবং সপ্তাহের প্রথম ছয়দিনকে উপার্জনমূলক কর্মদিবস ধরে সপ্তাহের শেষদিন বা সপ্তম দিনকে বিশ্রাম দিবস বা সাপ্তাহিক ছুটির দিন সাব্যস্ত করা হয়। আমাদেরকে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে যে, এ দুটি দিনকে এ দুটি বৈশিষ্ট্যের সাথে বিশেষিত করা কতটুকু যৌক্তিক? তাহলে আমরা বুঝতে পারবো যে, আসলে ‘আস সালাতি মিন ইয়াওমিল জুমুআ’ সাধারণভাবে কোন দিনে সম্পাদন করা অধিক যুক্তিসঙ্গত হবে?
যেহেতু কুরআন অনুযায়ী আল্লাহ ছয়দিনে আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও এগুলোর মধ্যস্থিত সবকিছু সৃষ্টি করেন এবং সপ্তমদিনে মহাবিশ্ব পরিচালনার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত থেকে বিশ্বসাম্রাজ্যের নিরবচ্ছিন্ন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছেন। সুতরাং এ সপ্তম দিবসকে আল্লাহর বিশ্বপরিচালনা কেন্দ্রে অধিষ্ঠানের ভিত্তিতে বাস্তব পরিচালনা কার্যক্রমের দিক থেকে ‘অভিষেক দিন’ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও পীর ফকিরগণ তাদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বা গদিনশীল থেকে তাদের পরিচালনামূলক কার্যক্রমের উদ্বোধনের দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রতিবছর ‘অভিষেক দিবস’ হিসাবে ঐ দিনকে পালন করার ঘোষণা দিয়ে থাকে। তেমনি আল্লাহ কর্তৃক আরশে অধিষ্ঠিত থেকে মহাবিশ্ব ব্যবস্থাপনা পরিচালনাগত অভিষেকের প্রতীক সম্বলিত সপ্তম মহাকালের ছায়া অবলম্বনে অনুশীলনকৃত সপ্তম দিনে মানুষ যেন জমায়েত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে, সালাত আদায় করে এবং সালাত শেষ হলে কাজে কর্মে নিয়োজিত হতে ছড়িয়ে পড়ে সেজন্য সপ্তম দিনেই ‘আস সালাতি মিন ইয়াওমিল জুমুআ’ সম্পাদন করা একটি যৌক্তিক বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত করা যেতে পারে।
সেই সাথে আরেকটি বিষয় হলো, পূর্বে বাধ্যতামূলকভাবে ‘ইয়াওমুস সাবত’ নির্ধারণ করা হয়েছিল বিধায় এটা স্পষ্ট যে, তখন সবার জন্য একই সপ্তাহান্তের ছুটির দিন তথা সপ্তাহের ছয় দিন কর্মব্যস্ততার পর সপ্তম দিনকে ‘বিশ্রাম দিবস’ হিসেবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। অর্থাৎ এদিন উপার্জনমূলক ব্যস্ততার পরিবর্তে বিশ্রাম গ্রহণ করতে হবে এবং স্বভাবতই এ বিশ্রামের সময়টিকে আল্লাহর প্রতি মনোযোগী থেকে অতিবাহিত করতে হবে। যেমন, ৯৪:৭-৮ আয়াতে রসূলকে দেয়া নির্দেশনা থেকে বুঝা যায় যে, স্বাভাবিক ব্যস্ততা থেকে অবসর পেলে আল্লাহর প্রতি মনোযোগী হওয়ার সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে হবে।
আল কুরআনে সেই ‘ইয়াওমুস সাবত’কে অব্যাহত না রেখে ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ এর বিধান দেয়া হয়েছে এবং এতে ‘আস সালাতি মিন ইয়াওমিল জুমুআ’ এর জন্য নিদা (আহবান) থেকে সালাত কাযা (সম্পন্ন) হওয়া পর্যন্ত সময়সীমায় ব্যবসা তথা উপার্জনমূলক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং পূর্ববর্তী ‘ইয়াওমুস সাবত’ এর বিধান কুরআনের নির্দেশনার মাধ্যমে ‘ইয়াওমুল জুমুআ’র বিধানে রূপান্তরিত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সপ্তাহের সপ্তম দিনে ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ সম্পাদনকে যৌক্তিক সাব্যস্ত করা যেতে পারে।
তবে যেহেতু বর্তমানে সপ্তাহের ষষ্ঠ দিন ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ হিসেবে চালু রয়েছে, তাই মুসলিম উম্মাহর খেলাফত লাভের পূর্বে নির্বাহী কর্মকান্ডের সুবিধার জন্য প্রচলিত ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ তথা শুক্রবারকে ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ হিসাবে উদযাপন ও শুক্রবারে ‘ইয়াওমুল জুমুআর’ সালাত সম্পাদনের জন্য নিদা বা আহবান করা ও ইয়াওমুল জুমুআর সালাত সম্পাদন করা দোষণীয় নয়।
প্রত্যেক ইয়াওমিল জুমুআতে সালাতের জন্য নিদা করা এবং জামায়াতে সালাত বাধ্যতামূলক কিনা?
‘মিন ইয়াওমিল জুমুআ’ (৬২:৯) শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক ‘ইয়াওমিল জুমুআতে’ সালাত বাধ্যতামূলক নয়, বরং যখন কোনো ‘ইয়াওমিল জুমুআতে’ সালাতের জন্য ডাকা হয় (রসূল বা উলিল আমর বা তাঁদের মনোনীনত প্রতিনিধি কর্তৃক, যেহেতু কাউকে সব কাজ ছেড়ে আসার জন্য ডাকার অধিকার তাদেরই আছে, প্রাসঙ্গিক আয়াত- ৪:৫৯), তখন সালাত প্রতিষ্ঠাসহ আল্লাহর যিকিরের জন্য তাড়াতাড়ি আসতে হবে (৬২:৯-১১)।
সুতরাং কোনো জমায়েতের দিন সাধারণ ‘ইয়াওমিল জুমুআ’ হলে (তথা যেদিন মানুষ কোনো কারণে একত্রিত হয়েছে অথচ তা পূর্ব থেকে সালাতের জন্য ‘ইয়াওমিল জুমুআ’ হিসেবে নির্দিষ্টকৃত ছিল না বা যদি তা সপ্তাহের নির্দিষ্টকৃত ‘ইয়াওমিল জুমুআ’ না হয়, তাহলে) তাতে সালাতের জন্য নিদা বা আহবান তথা জামায়াতে সালাত বাধ্যতামূলক নয়। বরং সপ্তাহের নির্দিষ্টকৃত ইয়াওমিল জুমুআ (এটি ইয়াওমিস সাবআ’য়ি বা সপ্তম দিন, শনিবার / Saturday হওয়াটাই অধিক যৌক্তিক) সালাতের জন্য নিদা বা আহবান করা এবং সেই প্রেক্ষিতে বাধ্যতামূলকভাবে জামায়াতে সালাত করার সাধারণ রীতি প্রচলিত থাকবে।
অন্যদিকে নির্দিষ্টকৃত ‘ইয়াওমিল জুমুআ’ ছাড়া সাধারণভাবে কোনো কারণে লোকের ব্যাপক জমায়েত ঘটলে এরূপ কোনো দিন উলিল আমর বিশেষ প্রয়োজন বোধ করলে ‘আস সালাতি মিন ইয়াওমিল জুমুআ’র জন্য নিদা বা আহবান করতে পারেন। যদি নিদা বা আহবান করা হয়, তাহলে তাতে সাড়া দিয়ে জামায়াতে সালাত করতে হবে।
ইয়াওমুল জুমুআতে সালাত সম্পাদন বলতে কি শুধুই আনুষ্ঠানিক সালাত বুঝায়?
আমরা ইতোপূর্বে জেনেছি যে, সালাত হলো আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণ। আনুষ্ঠানিক সালাত হলো আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়ে একটি Prelude বা প্রাক অভিনয়, যার মাধ্যমে বাস্তব সালাতের মূল চেতনাগত দিকটিকে পরিচর্চা করা হয়। সুতরাং স্বাভাবিক প্রশ্ন হলো, ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ বা জমায়েতের দিনে সম্পাদিতব্য সালাতটি কি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সালাতকেই বুঝাবে?
প্রথমত লক্ষণীয় যে, জমায়েতের দিন সালাতের জন্য আহবান করলে আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারপর সালাত সমাপ্ত হলে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে হবে এবং বেশি পরিমাণে আল্লাহর যিকির করতে হবে বলে নির্দেশ রয়েছে। সালাত শেষে কর্মক্ষেত্রে যেয়ে আল্লাহর যিকির বলতে আনুষ্ঠানিক বা মৌখিক যিকিরকে বুঝায় না, বরং আল্লাহকে স্মরণ রেখে তাঁর বিধান অনুসারে কর্মক্ষেত্রের কার্যক্রম সম্পাদন করাকে বুঝায়। সালাতের মুল উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহর যিকির (স্মরণ)। সালাত হলো আল্লাহর যিকিরের একটি রূপ। সালাতের আহবান করলে যিকিরের দিকে আসা এবং সালাত শেষে আবার কর্মক্ষেত্রে গিয়ে যিকির করার দ্বারা বুঝায় আনুষ্ঠানিক যিকির শেষে বাস্তব বা অনানুষ্ঠানিক যিকির করা, আনুষ্ঠানিক সালাত শেষে বাস্তব সালাত করা।
জমায়েতের দিনে সালাত ও যিকিরের একটি দিক যেমন আনুষ্ঠানিক সালাত সম্পাদন করা, তেমনি মুসল্লিদের যে সংজ্ঞা ৭০:১৯-৩৪ আয়াত এবং ১০৭:১-৭ আয়াতে দেয়া হয়েছে তদনুসারে, নির্বাহী সিদ্ধান্তমূলক সমষ্টিগত কার্যক্রমের মাধ্যমে নেয়ামতের বণ্টন, বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-মীমাংসা ইত্যাদিও সালাত হিসেবে সাব্যস্ত হয়। তাই ব্যক্তিগত আয়-উপার্জনমূলক কার্যক্রম স্থগিত রেখে জমায়েতের সালাতের আহবানে সাড়া দেয়াকে কল্যাণকর বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আবার এতে এরূপ কার্যক্রম সরাসরি ব্যক্তিগত আয়-উপার্জনের তুলনায় উপস্থিত বিবেচনায় লাভজনক মনে নাও হতে পারে, তাই দেখা যায় যে, সাহাবীরা রসূলকে দণ্ডায়মান রেখে নিজেরা ব্যবসায়িক খেল-তামাশার প্রদর্শনী দেখতে চলে গিয়েছে, যে বিষয়ে আল্লাহ সংশোধনী দিয়েছেন। সুতরাং জমায়েতের দিনে আনুষ্ঠানিক সালাতের পাশাপাশি মুসল্লিদের বাস্তব গুণাবলির চর্চামূলক কাজেও তাকে লাগাতে হবে, যেন জমায়েতের সালাত নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত না হয়।
ইয়াওমুল জুমুআ এবং ইয়াওমুস সাবত কি একই দিন?
আহলে কিতাবকে দেয়া একটি শাস্তিমূলক ও সাময়িক বিধান ছিলো নখরধারী সব পশু এবং গরু ও ছাগলের চর্বি হারাম করা যা পিঠ, অন্ত্র ও হাড়ের সাথে লেগে থাকে তা ছাড়া (৬:১৪৬)। অনুরূপভাবে সাবত সম্পর্কিত আয়াতসমূহের বক্তব্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝা যায় যে, তাদেরকে শাস্তিস্বরূপ সাময়িকভাবে সাবতের বা বাধ্যতামূলক বিশ্রাম দিবস (পেশাগত কর্মবিরতি দিবস) পালনের বিধান দেয়া হয়েছিলো। অর্থাৎ তৎকালীন সময়ে তাদের সবার জন্য সপ্তাহান্তের একই ছুটির দিন তথা সপ্তাহের ছয় দিন কর্মব্যস্ততার পর সপ্তম দিনকে বিশ্রাম দিবস হিসেবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।
আল কুরআনে সাবতের বিধানকে বহাল রাখা হয়নি। কুরআনে প্রদত্ত শাশ্বত বিধান হলো ‘ইয়াওমুল জুমুআর’ বিধান। ‘সাবতের’ বিধানে অনেক কঠোরতা ছিলো, যেমন ঐ দিন তারা সারাদিন কোনো মাছ শিকার করা নিষিদ্ধ ছিলো। অন্যদিকে ‘ইয়াওমুল জুমুআতে’ যখন সালাতের জন্য নিদা হবে তখন ব্যবসায় বা পেশাগত কর্মকাণ্ড স্থগিত করে আল্লাহর স্মরণের দিকে দ্রুত ধাবিত হতে এবং সালাত শেষে কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়তে ও আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা, শিক্ষা ইত্যাদি) অনুসন্ধান করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ও বিশেষ পূর্বনির্ধারিত সমষ্টিগত নির্বাহী সালাতের সময়টুকু ছাড়া আগে-পরে উপার্জনমূলক কার্যক্রম নিষিদ্ধ নয়, বরং নির্দেশিত রয়েছে। তাই ‘আস সালাতি মিন ইয়াওমিল জুমুআর’ নিদা থেকে সালাত কাযা পর্যন্ত সময়সীমায় সালাতের প্রস্তুতি ও সালাতের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াদি ছাড়া ব্যবসা বা পেশাগত ব্যস্ততা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে। এর আগে-পরে উপার্জনমূলক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে কোনো বাধা-নিষেধ নেই। তাই ‘ইয়াওমুল জুমুআতে’ যদি প্রাতিষ্ঠানিক ছুটি থাকে তবুও এ সময়কে ব্যক্তিগতভাবে উপার্জনমূলক কাজে লাগানো সময় ব্যবস্থাপনার উত্তম উপায় হিসেবেই বিবেচিত হবে।
সুতরাং সপ্তাহান্তে সাপ্তাহিক ছুটি দিবস এবং সপ্তাহান্তে জুমুআর দিবস সপ্তাহের একই দিনের দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সূচক হলেও বর্তমানে সাপ্তাহিক কর্মবিরতি একটি চুক্তিনির্ভর বিষয়, যা চুক্তির মাধ্যমে কার্যকর বা প্রত্যাহার করা যাবে। অর্থাৎ বর্তমানে ইয়াওমুল জুমুআতে সাবত বা বিশ্রাম / পেশাগত কর্মবিরতি হতে হবে এমন কোন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। বরং নির্বাহী সিদ্ধান্তক্রমে ইয়াওমুল জুমুআ সহ বিভিন্ন দিনে সাবত / পেশাগত কর্মবিরতি / সাপ্তাহিক ছুটি দেয়া যাবে এবং বিভিন্ন সেক্টরে বিভিন্ন দিন এবং এমনকি একই সেক্টরে একেক ব্যক্তিবর্গকে একেক দিন সাপ্তাহিক ছুটি দেয়া যেতে পারে। অন্য কথায় বর্তমানে ইয়াওমুল জুমুআকে সাবত হিসেবে পরিপালন করা বাধ্যতামূলক নয়।
সাবত (সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় / বাধ্যতামূলক বিশ্রাম দিবস) সম্পর্কিত আয়াতসমূহ
৭:১৬৩ :: এবং তাদের কাছে জিজ্ঞেস কর নদীতীরের জনপদটি সম্পর্কে। যখন তারা সাবতের (বিশ্রাম দিবস বা সপ্তম দিন বা শনিবার পালনের) বিষয়ে সীমালংঘন করতে লাগল; যখন (অর্থাৎ এ কারণে যে) তাদের ‘ইয়াওমুস সাবতে’ (বিশ্রাম দিবসে বা সপ্তম দিনে বা শনিবারে) তাদের সামনে মাছগুলো ভেসে আসতো, এবং ‘ইয়াওমুস সাবত’ ছাড়া অন্য দিবসে (এভাবে) ভেসে আসতো না। এভাবেই আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি। কারণ তারা ফাসেকি (অবাধ্যতা) করেছিলো।
৭:১৬৬ :: তারপর যখন তারা ঔদ্ধত্যের সাথে ঐ কাজই করতে লাগলো যা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিলো তখন আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলেছি, “তোমরা অপমানিত বানর হয়ে যাও”।
সম্মিলিত আলোচনা: আয়াতদ্বয় থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, সাবত পালনের জন্য ঐদিন (সংশ্লিষ্ট সময়ে) নদীতীরবর্তী বাসিন্দারা মাছ ধরা থেকে বিরত থাকা উচিৎ ছিল। কারণ সাবত পালনের জন্য নদীতীরবর্তী বাসিন্দারা মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তারা ঐ নিষেধ অমান্য করে মাছ ধরেছে। তারা এ নিষেধ অমান্য করার কারণ হচ্ছে, যখন তারা ‘ইয়াওমুস সাবত’ পালন করতো এবং তাই ‘ইয়াওমুস সাবতে’ মাছ ধরতো না তখন তারা খেয়াল করলো যে, ‘ইয়াওমুস সাবতেই’ মাছগুলো দল বেঁধে ভেসে আসে কিন্তু অন্যদিন এভাবে আসে না। এতে তারা লোভের বশবর্তী হয়ে আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে স্বার্থসিদ্ধির মানসিকতায় ঝুঁকে পড়লো তথা ফাসেকী করলো। এভাবে তারা পরীক্ষায় পড়ে গেল। একদিকে আল্লাহর বিধান অন্যদিকে ‘ইয়াওমুস সাবতে’ এত বেশি মাছ নাগালে পেয়েও হাতছাড়া হতে না দেয়ার খায়েশ, তারা দোটানায় পড়ে গেল। এ পরীক্ষায় তারা অকৃতকার্য হলো। কারণ তারা আল্লাহর বিধান অমান্য করলো এবং ঔদ্ধত্যের সাথেই ঐ নিষিদ্ধ কাজ করতে লাগলো। অর্থাৎ তারা ‘ইয়াওমুস সাবতে’ মাছ ধরতে লাগলো। তখন আল্লাহ তাদেরকে অপমানিত বানর বানিয়ে দিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো, নদীতীরবর্তী বাসিন্দারা ‘ইয়াওমুস সাবতে’ মাছ ধরে একটা নিষেধ লংঘন করলো। ব্যাপারটি কি এই যে, ‘ইয়াওমুস সাবতে’ শুধু মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল কিন্তু অন্য কাজ বৈধ ছিল? আয়াতটিতে উল্লেখ আছে তারা ছিল নদীতীরবর্তী। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে, নদীতীরবর্তী বাসিন্দা হওয়ার কারণে মাছের প্রসঙ্গটি এসেছে। প্রকৃত বিষয় হলো, মাছ ধরা তথা পেশাগত বা উপার্জনমূলক কাজ করা যাবে না। যেমন ৬২:৯ আয়াতে ‘ইয়াওমুল জুমুআতে’ সালাতের জন্য আহবান করলে ব্যবসা বন্ধ রেখে আল্লাহর স্মরণের দিকে যেতে বলা হয়েছে, কিন্তু এর মানে এ নয় যে, এটি শুধু ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কুরআনে নির্দেশিত ‘ইয়াওমুল জুমুআ’র বিধান হচ্ছে তৎকালীন ‘ইয়াওমুস সাবতের’ বিধানের মতোই একটি বিধান। এদিন সময়ের একটি পরিসরে ব্যবসা তথা পেশাগত বা উপার্জনমূলক কার্যক্রম নিষিদ্ধ। সময়ের ঐ পরিসরে জুমুআ / জমায়েত হতে হবে, নিজেদের সামষ্টিক বিষয়ে আল্লাহর বিধানমতো বিচার-ফায়সালা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সালাত সম্পাদনের মাধ্যমে আল্লাহর যিকর করতে হবে। কিন্তু বিশেষ কোনো প্রেক্ষাপটে তাদের উপর প্রযোজ্য ‘ইয়াওমুস সাবতের’ বিধানে অধিক কঠোরতা আরোপ করা হয়েছিলো।
১৬:১২৪ :: প্রকৃতপক্ষে সাবতের বিধান তাদের উপর বাধ্যতামূলক করা হয়েছিলো যারা তা পালনের বিষয়ে ইখতিলাফ / মতভেদ করেছিলো। এবং নিশ্চয় তোমার প্রভু তাদের মধ্যে তারা যে বিষয়ে মতভেদ করেছিলো ক্বিয়ামাত দিবসে তার ফায়সালা করে দিবেন।
আলোচনা: অর্থাৎ যারা সাবত পালন করা বাধ্যতামূলক কিনা এ নিয়ে মতভেদ করেছিলো তাদের মতভেদ সঠিক ছিলো না, কারণ প্রকৃতপক্ষেই তা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিলো। তাই তারা সঠিক ভিত্তির উপর মতভেদ করেনি। কিন্তু তারা যাদের সাথে মতভেদ করেছিলো তাদের মধ্যে কে সঠিক এবং কে অসঠিক সেই ফায়সালা আল্লাহ ক্বিয়ামাত দিবসে এমনভাবে করে দিবেন যে, সেদিন মতভেদকারীরা সঠিক তথ্য মেনে নিতে বাধ্য হবে, সেদিন মতভেদের নিরসন হয়ে যাবে। অন্য কথায়, পৃথিবীতে আল্লাহ কিতাবের মাধ্যমে সঠিক ফায়সালা প্রকাশ করলেও মতভেদ বজায় থাকে, কিন্তু ক্বিয়ামাত দিবসে আল্লাহ সরাসরি এমনভাবে ফায়সালা করে দিবেন যে, সেদিন আর মতভেদ বজায় রাখার কোনো অবকাশ থাকবে না।
৪:৪৭ :: হে ঐসব লোক যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তোমাদের সাথে যা আছে তার সত্যায়নকারীরূপে আমি যা নাযিল করেছি তোমরা সেটির প্রতি ঈমান আনো, ঐ সময়ের আগেই যে, আমি চেহারাকে বিকৃত করে পেছন দিকে ফিরিয়ে দেবো অথবা তাদেরকে অভিশপ্ত করবো যেমন আমি অভিশপ্ত করেছিলাম ‘আসহাবুস সাবতকে’ (বিশ্রাম দিবস বা সপ্তম দিন বা শনিবারের বিধানের প্রতি অবাধ্যদেরকে)। এবং আল্লাহর নির্দেশ কার্যকর হয়েই থাকে।
আলোচনা: আয়াতটির বক্তব্য অনুসারে ‘আসহাবুস সাবত’ (যার শাব্দিক অর্থ হলো ‘সাবতের বিধানের সাথে সম্পৃক্তগণ) অভিশপ্ত হয়েছিল। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, সাবতের বিধান ছিল একটি শাস্তিমূলক বিধান, যা পালন করলে তারা লা’নত থেকে রক্ষা পেতে পারতো, কিন্তু যাদের উপর এ বিধান দেয়া হয়েছিল তারা তা লংঘন করেছিল। এজন্য বলা হয়েছে ‘আসহাবুস সাবত’কে অভিশপ্ত করা হয়েছিলো। যদি তারা তা লংঘন না করতো তাহলে তারা অভিশপ্ত হতো না।
৪:১৫৪ :: এবং আমি তাদের অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে তূরকে তাদের উপর সমুচ্চে তুলে ধরেছিলাম। এবং আমি তাদেরকে বলেছিলাম, “তোমরা সাজদাহরত অবস্থায় ফটকদ্বার দিয়ে প্রবেশ করো”। এবং তাদেরকে বলেছিলাম, “সাবতের (বিশ্রাম দিবসের/ সপ্তম দিনের/ শনিবারের) বিষয়ে সীমালংঘন করো না। এবং আমি তাদের থেকে মজবুত অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম।
৪:১৫৫ :: তারপর (তারা লা’নতগ্রস্থ হয়েছে) তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে এবং আল্লাহর আয়াতের প্রতি তাদের কুফরের কারণে এবং নবীদেরকে অনধিকার চর্চার মাধ্যমে হত্যা করার কারণে এবং তাদের এ কথা বলার কারণে যে, ‘আমাদের অন্তরসমূহ গিলাফে ঢাকা’। বরং আল্লাহ মোহর করে দিয়েছেন তাদের অন্তরের উপর তাদের কুফরের পরিণামে। সুতরাং তারা ঈমান আনবে না, অল্পসংখ্যক ব্যতীত”।
২:৬৫ :: এবং (হে বনী ইসরাইল), তোমরা অবশ্যই তাদেরকে জেনেছো তোমাদের মধ্য থেকে যারা সাবতের (বিশ্রাম দিবসের/ সপ্তম দিনের/ শনিবারের) বিষয়ে সীমালংঘন করেছে। সুতরাং আমি তাদেরকে বলেছিলাম, “তোমরা অপমানিত বানর হয়ে যাও”।
২:৬৬ :: এবং আমরা সেটিকে পরিণত করেছি সমকালীন ও পরবর্তীকালের লোকদের জন্য শিক্ষামূলক বিষয়ে এবং স্রষ্টা-সচেতনদের জন্য উপদেশে।
আলোচনা: সাবতের বিধান লংঘনকারীদের পরিণাম সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের লোকদের জন্য শিক্ষামূলক বিষয় এবং মুত্তাকীদের জন্য উপদেশ। সুতরাং মুত্তাকীদেরকে অবশ্যই ‘আসহাবুস সাবতের’ মতো হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং ‘আস সালাতি মিন ইয়াওমিল জুমুআ’সহ যাবতীয় বিষয়ে আল্লাহর বিধান যথাযথভাবে চর্চা করার দিকে পরিপূর্ণ মনোযোগী ও নিষ্ঠাবান হতে হবে।
ইয়াওমুল জুমুআ কিভাবে ষষ্ঠদিনে (শুক্রবারে) রূপান্তরিত হলো?
মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর দ্বীন প্রচারের পূর্ব থেকেই আরব জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরার জন্য আরবগণের মধ্যে শুক্রবারে জমায়েতের আয়োজন / প্রথা বলবৎ ছিলো, যা তখন ‘আল আরুবা’ নামে প্রচলিত ছিলো বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহর ও খোলাফায়ে রাশেদার মৃত্যুর পর কোনো এক সময় এ প্রথাকে দ্বীন ইসলামের সাথে জুড়ে দেয়া হয় এবং ‘আল আরুবা’কেই কুরআনে থাকা ‘ইয়াওমিল জুমুআ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। অথচ ইতোপূর্বে উল্লেখিত ‘সাবত’ ও ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ সম্পর্কিত আয়াতসমূহকে ‘ছয়দিবসে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তারপর আরশে অধিষ্ঠিত থেকে এসবের পরিচালনা কার্যক্রম’ সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সাথে সমন্বিতভাবে অধ্যয়নের ভিত্তিতে ‘ইয়াওমুল সাবআ’য়ি’ বা সপ্তম দিনকেই (শনিবার, Saturday) পূর্বের ‘ইয়াওমুস সাবত’ (বিশ্রাম দিবস) হিসেবে ও বর্তমানে আমাদের জন্য নির্দেশিত ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ (জমায়েতের দিন) পালনের জন্য নির্ধারণযোগ্য দিন হিসেবে যুক্তিসিদ্ধ বলে প্রতীয়মান হয়। এ অবস্থায় কুরআনী তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যশীল শনিবারের পরিবর্তে শুক্রবারকে ইয়াওমিল জুমুআ / জমায়েতের দিন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার পিছনে আরবীয় জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠা করা এবং মুসলিম উম্মাহকে কুরআনের শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পিত গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করেছে বলে সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
ইয়াওমুল জুমুআ কি সমগ্র বিশ্বে একই দিন হতে হবে এবং তা সপ্তাহের কততম দিন হতে হবে?
আল কুরআনে সপ্তাহের কোনো দিনকে ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে নির্ধারিত করে দেয়া হয়নি বিধায় নির্বাহী পরামর্শক্রমে সপ্তাহের যেকোনো দিনকে ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ হিসেবে নির্ধারণ করার অবকাশ রয়েছে। তবে দিবসসমূহ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কুরআনের প্রাসঙ্গিক আয়াতসমূহের বক্তব্যসমূহ থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণপূর্বক শনিবারকে ‘ইয়াওমুল জুমুআ’ নির্ধারণ করাই এক্ষেত্রে বিবেচনার জন্য অগ্রাধিকার রাখে। অবশ্য বাস্তবসম্মত কারণে তা সম্ভব না হলে অন্য দিনেও ইয়াওমুল জুমুআ নির্ধারিত হতে পারে। আবার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কারণে ভিন্ন ভিন্ন দিনেও ইয়াওমুল জুমুআ নির্ধারণ করাও গ্রহণযোগ্য। কিন্তু বিশেষ কারণ না থাকলে বৈশ্বিক সংহতি বজায় রাখার স্বার্থে একই দিনে ইয়াওমুল জুমুআ নির্ধারণ করাই যুক্তিসম্মত বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রকৃত সালাত ও নষ্ট সালাত
সূরা মারইয়ামে পূর্ববর্তী নবী ও তাঁদের নিষ্ঠাবান অনুসারীদের পরবর্তীতে অপদার্থ উত্তরাধিকারী যারা হয়েছিলো তারা সালাত নষ্ট করেছিলো বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতটির বক্তব্য নিম্নরূপ:
১৯:৫৯ :: তারপর তাদের পরে পরবর্তীরা স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। তারা (পরবর্তীরা) সালাতকে নষ্ট করেছে এবং কামনা বাসনার অনুসরণ করেছে। তারপর শীঘ্রই তারা বিপথগামিতার (অমঙ্গলের) সম্মুখীন হবে।
আয়াতটি থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহর মনোনীত বান্দারা যে প্রকৃত সালাত সম্পাদন করেছিলো পরবর্তী অপদার্থ উত্তরাধিকারীরা তা বাদ দিয়ে সালাতকে নষ্ট করেছে তথা নষ্ট সালাত সম্পাদন করা শুরু করেছিলো। এ আয়াতটিও সালাতের যে ব্যাপক অর্থ তথা স্রষ্টার নির্দেশের নিবীড় অনুসরণ সেটির নির্দেশক, কেননা এখানে সালাতের বৈপরীত্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে নিজেদের কামনা বাসনা তথা খেয়াল খুশি। তাদের নষ্ট সালাতের বাহ্যিক ও প্রকৃতিগত দিক কিরূপ ছিলো তার উদাহরণ পাওয়া যায় সূরা আনফাল ৮:৩৫ আয়াতে। আয়াতটির বক্তব্য নিম্নরূপ:
৮:৩৫ :: এবং তাদের সালাত কিছুই নয় ‘আল বাইতের’ (অনন্য প্রতিষ্ঠানের) কাছে শিস / উলুধ্বনি দেয়া এবং করতালি / অনর্থক ব্যস্ততা ছাড়া। সুতরাং তোমরা যে কুফর (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান) করতে তার কারণে তোমরা শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করো।
শিস / উলুধ্বনি দেয়া মানে অর্থহীন আওয়াজ এবং হাততালি বা অর্থহীন ব্যস্ততা বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সালাত সম্পাদনের মাধ্যমে যে সালাত সম্পাদন করা হয় এটা হলো নষ্ট সালাত। প্রকৃত সালাতেও কিছু উচ্চারণের বিষয় ছিলো বা আছে এবং কিছু অঙ্গভঙ্গি ছিলো বা আছে, যা বিকৃত হয়ে তাদের সালাতের এ রূপটি দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু এ বিকৃতি নিছক উচ্চারণ বা অঙ্গভঙ্গির বাহ্যিক কাঠামোতেই নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যেও ঘটেছে। প্রকৃত সালাতে উচ্চারণের উদ্দেশ্য ছিলো সচেতনতার সাথে আত্মপর্যালোচনা সাপেক্ষে ক্ষমা ও অনুগ্রহ প্রার্থনা এবং প্রতিজ্ঞা ও স্মরণীয় তথ্যের স্মরণ। তাতে ছিলো অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে বাস্তব কাজের তৎপরতার জন্য আত্মগঠনমূলক মহড়া। কিন্তু যখন সেই উদ্দেশ্য, কী করছি, কেন করছি এবং এর থেকে শিক্ষা নিয়ে কোথায় কিভাবে তা বাস্তবায়ন করবো, এটি যখন অনুষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো তখন সালাত একটি আচারসর্বস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানমাত্রে পরিণত হলো, কুরআনের ভাষ্য অনুসারে যাকে নষ্ট সালাত নামে আখ্যায়িত করা যায়।
অন্যদিকে প্রকৃত সালাত হলো যাতে চিন্তা-চেতনায় এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের ইতিবাচক পরিগঠনে আত্মনিয়োগের উদ্দেশ্যে নিজেকে প্রস্তত করতে আনুষ্ঠানিক সালাত করা হয় এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাস্তবে সমাজে মিসকীনের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা উপকরণকে সহজলভ্য করে দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করা হয়, তখন এই সালাতই প্রকৃত সালাত হিসেবে আখ্যায়িত।
সালাতের প্রতি কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকদের প্রতিক্রিয়া
১১:৮৭, ৫:৫৭-৫৮, ৪:১৪২-১৪৩, ৯:৫৪ ও ৫:৯১, ৯৬:৯-১০ আয়াত থেকে সালাতের প্রতি কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অনুধাবন করা যায়। আয়াতগুলোর বক্তব্য নিম্নরূপ:
১১:৮৭ :: তারা বললো, “হে শোয়ায়েব, তোমার সালাত কি তোমাকে নির্দেশনা দেয় যে, আমরা তাদের দাসত্ব ছেড়ে দেবো আমাদের বাপদাদারা যাদের দাসত্ব করতো? অথবা আমরা যেন আমাদের মালসম্পদের ব্যাপারে যা আমাদের ইচ্ছা হয় তা না করি? নিশ্চয় তুমি, নিশ্চয় তুমিই সহিষ্ণু, সুবোধ।
৫:৫৭-৫৮ :: হে যারা বিশ্বাস করেছো, তোমরা তাদেরকে আওলিয়া (বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করো না যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যকার যারা এবং যে কাফিররা তোমাদের দ্বীনকে উপহাস ও খেলতামাশারূপে গ্রহণ করেছে। এবং তোমরা স্রষ্টা-সচেতন হও যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। এবং যখন তোমাদেরকে সালাতের দিকে ডাকা হয় তখন তারা সেটাকে উপহাস ও খেলতামাশারূপে গ্রহণ করে। এটা এ কারণে যে, তারা এমন এক ক্বওম যারা আক্বল (বিবেক-বুদ্ধি, Common sense) প্রয়োগ করে না।
৪:১৪২-১৪৩ :: নিশ্চয় মুনাফিকগণ আল্লাহকে ধোঁকা দিতে চায়, অথচ তিনিই তাদেরকে ধোঁকায় রেখেছেন। এবং যখন তারা সালাতের জন্য দাঁড়ায়, তখন তারা দাঁড়ায় অনাগ্রহ-অলসতার সাথে, মানুষকে দেখানোর জন্য। এবং তারা আল্লাহকে অত্যন্ত অল্পই স্মরণ করে। তারা ঐ অবস্থার মধ্যেই দোদুল্যমান। তারা এদের দিকেও না,ওদের দিকেও না। এবং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন,তুমি তার জন্য কোনো পথ পাবে না।
৯:৫৪ :: এবং তাদের বিষয়ে মানা করা হয়নি তাদের থেকে তাদের নাফাক্বাত (ধর্মীয় অনুদান তহবিলে ব্যয়) গ্রহণ করতে এজন্য ছাড়া যে, তারা অবিশ্বাস করেছে আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলের প্রতি এবং তারা সালাতে আসে না এ অবস্থায় ছাড়া যে তারা অনাগ্রহী-অলস, এবং তারা (ধর্ম নির্দেশিত) ব্যয় করে না এছাড়া যে, তারা (মূলত) অনিচ্ছুক, অপছন্দকারী।
৫:৯১ :: নিশ্চয় শয়তান ইচ্ছা করে যে, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাবে, এবং আল্লাহর যিকর (স্মরণ ও স্মরণিকা) থেকে ও সালাত থেকে তোমাদেরকে বাধা দিবে। তবুও কি তোমরা বিরত হবে না?
৯৬:৯-১০ ::তুমি কি তার ব্যাপারটা ভেবে দেখেছো যে নিষেধ করে; এক বান্দাকে, যখন সে সালাত করে?
আলোচনা: আয়াতসমূহ থেকে বুঝা যায় যে, মু’মিনরা যখন সালাত সম্পাদন করে বা সালাত সম্পাদনের জন্য আহবান করে তখন মুশরিক ও কাফিররা তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। মুশরিকরা সালাত পছন্দ না করার কারণ হলো, সালাত এমন একটি কর্মসূচী যা মানুষকে একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করার এবং উপার্জিত সম্পদ নিজ ইচ্ছামতো ব্যয় করার পরিবর্তে আল্লাহর নির্দেশকৃত পথে ব্যয় করতে নির্দেশনা প্রদান করে। শয়তান তথা শয়তানের অনুচরেরা সালাত ও আল্লাহর যিকর থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য মদপান ও জুয়াখেলার প্রসার ঘটিয়ে থাকে। অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের অপসংস্কৃতি ও ক্রীড়াকলাপের মাধ্যমে তারা সালাত ও আল্লাহর স্মরণ থেকে মানুষকে বিমুখ ও উদাসীন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। এছাড়াও তারা প্রত্যক্ষভাবেও সালাতে বাধার সৃষ্টি করে থাকে। এবং মুনাফিকরা সালাত সম্পাদন করে থাকে, যেহেতু তা ছাড়া তাদের মুনাফেকি প্রকাশ হয়ে পড়বে। কিন্তু মুনাফিকরা সালাত সম্পাদনের জন্য দাঁড়ায় অনাগ্রহ ও অলসতার সাথে এবং তারা সালাত সম্পাদন করে মানুষকে দেখানোর জন্য।
ব্যক্তি সম্পর্কীয় সালাত বিষয়ক তথ্য ও নির্দেশনা
ব্যক্তিসত্তার প্রতি সালাত কয়েক ভাগে বিভক্ত। যেমন:
১. রসূলের প্রতি আল্লাহর ও ফেরেশতাদের সালাত। (৩৩:৫৬)
২. রসূলের প্রতি মু’মিনদের সালাত। (৩৩:৫৬)
৩. মু’মিনদের প্রতি আল্লাহ ও ফেরেশতাদের সালাত। (২:১৫৭, ৩৩:৪৩)
৪. মু’মিনদের প্রতি রসূলের সালাত। (৯:৯৯, ৯:১০৩)
৫. মু’মিনদের প্রতি অন্য মু’মিনদের সালাত (মুনাফিকদের মৃত্যুর পর তাদের প্রতি সালাতে নিষেধাজ্ঞার পরোক্ষ শিক্ষা অনুসারে মু’মিনরা মু’মিনদের প্রতি সালাত করবে, এমনকি মৃত মু’মিনের প্রতিও)। (৯:৮৪)
নিম্নে ব্যক্তিসত্তার প্রতি সালাত বিষয়ক আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হলো:
৩৩:৫৬ :: নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি সালাত করেন (অনুগ্রহ করেন বা আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন)। হে যারা বিশ্বাস করেছো, তোমরা তার প্রতি সালাত কর (সমর্থন-সহযোগিতা ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করো)। এবং তোমরা তাসলীম (ধারাবাহিকভাবে আত্মসমর্পণ) করো।
২:১৫৭ :: তারা (সবরকারীরা) ঐসব লোক যাদের উপর তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে (বর্ষণ) করা হয় সালাওয়াত (অনুগ্রহরাজি) এবং দয়া। এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত।
৩৩:৪৩ :: তিনি (আল্লাহ) ও তাঁর ফেরেশতাগণ তোমাদের প্রতি সালাত করেন (অনুগ্রহ করেন বা আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন), তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনার জন্য, এবং তিনি মু’মিনদের প্রতি দয়াশীল।
৯:৯৯ :: এবং আ’রাবদের (অনগরীয়দের) মধ্যে কিছু লোক রয়েছে যারা আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাস করে এবং (ধর্মীয় নির্দেশনা অনুযায়ী) যা ব্যয় করে সেটাকে আল্লাহর কাছে নৈকট্যের মাধ্যম এবং রসূলের সালাওয়াত (সমর্থনপুষ্ট সংযোগসমূহ / আশীর্বাদপ্রাপ্তি) হিসেবে গ্রহণ করে। প্রশ্নাতীতভাবে সেটা তাদের জন্য (আল্লাহর) নৈকট্যের মাধ্যম। শীঘ্রই আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় দয়ার মধ্যে প্রবেশ করাবেন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াশীল।
৯:১০৩ :: তুমি তাদের মালসম্পদ থেকে সদাক্বাহ গ্রহণ করো। সেটার মাধ্যমে তাদেরকে পবিত্র করো ও পরিশুদ্ধ করো। এবং তুমি তাদের ব্যাপারে সালাত করো (সমর্থন-সহযোগিতা ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করো)। নিশ্চয় তোমার সালাত তাদের জন্য প্রশান্তিদায়ক হবে। এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
৯:৮৪ :: এবং তাদের (মুনাফিকদের) মধ্য থেকে কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার ব্যাপারে কখনো সালাত (সংযোগ-সমর্থন ও আশীর্বাদ প্রার্থনা) করবে না এবং (বিশেষ মর্যাদায় কবরস্ত করতে বা ইতিবাচক ভাবাবেগ প্রকাশার্থে) তার কবরের পাশে দাঁড়াবে না। নিশ্চয় তারা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলের প্রতি অবিশ্বাস করেছে এবং ফাসিক্ব (বিধি-লংঘনকারী, দুষ্কর্মশীল) অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে।
উপরিউক্ত আয়াতসমূহ থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ কারো প্রতি সালাত করার অর্থ হলো অনুগ্রহ করা। ফেরেশতা, নবী ও মু’মিনগণ কারো প্রতি সালাত করার অর্থ হলো: আশীর্বাদ প্রার্থনা করা, সমর্থন-সহযোগিতা করা, তার সাথে সংযোগ-যোগাযোগ রক্ষা করা, তার অনুকূলে বা পক্ষে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
মুসল্লীন বা সালাতকারীদের পরিচয় ও মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ
২৩:১-১১, ৭০:১৯-৩৪ এবং ১০৭:১-৭ আয়াতসমূহে মুসল্লীন বা সালাতকারীদের পরিচয় ও মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। নিম্নে আয়াতসমূহের অনুবাদ উল্লেখ করা হলো।
সূরা মু’মিনূন ২৩:১-১১
২৩:১ :: নিশ্চয় সফল হয়েছে মু’মিনগণ।
২৩:২ :: যারা তাদের সালাতের ক্ষেত্রে খাশিয়ূন (বিনীত)।
২৩:৩ :: এবং যারা অনর্থক কথা-কাজ থেকে বিমুখ।
২৩:৪ :: এবং যারা যাকাতের জন্য সক্রিয়।
২৩:৫ :: এবং যারা তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী (সংরক্ষণকারী)।
২৩:৬ :: তাদের স্বাধীনা স্ত্রী এবং ‘মা মালাকাত আইমান’ স্ত্রী (যাদেরকে তাদের প্রতিশ্রুতি ও নিরাপত্তা প্রদায়ক ডানহাত পূর্ণরূপে অধিকৃত করেছে এরূপ স্ত্রী) প্রসঙ্গে ছাড়া। এক্ষেত্রে তারা নিন্দিত হবে না।
২৩:৭ :: সুতরাং যারা সেটির বাইরে কাউকে তালাশ করবে, তারাই সীমালংঘনকারী হবে।
২৩:৮ :: এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তদারককারী (শাব্দিক অর্থ: রাখাল)।
২৩:৯ :: এবং যারা তাদের সালাতসমূহের প্রতি হেফাযতকারী (যত্নবান)।
২৩:১০ :: তারাই ওয়ারিস হবে।
২৩:১১ :: যারা ফিরদাওসের (জান্নাতের) ওয়ারিস হবে। তারা তাতে স্থায়ী হবে।
সূরা মাআরিজ ৭০:১৯-৩৫
৭০:১৯ :: নিশ্চয় মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে অস্থিরমনা করে।
৭০:২০ :: যখন তাকে কোনো অমঙ্গল স্পর্শ করে তখন সে হয় হাহুতাশকারী।
৭০:২১ :: এবং যখন তাকে কোনো মঙ্গল স্পর্শ করে তখন সে হয় সেটার সরবরাহ রোধকারী (মজুদদার)।
৭০:২২ :: মুসল্লীগণ (সালাতকারীগণ) ছাড়া।
৭০:২৩ :: যারা হয় তাদের সালাতের উপর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত।
৭০:২৪ :: এবং যাদের সম্পদে পরিজ্ঞাত হক্ব (স্ব-স্বীকৃত অধিকার) রয়েছে।
৭০:২৫ :: সাহায্যপ্রার্থী, প্রশ্নকর্তা (উত্তর অনুসন্ধানী / গবেষক) এবং (ন্যুনতম চাহিদার যোগান থেকে) বঞ্চিতদের জন্য।
৭০:২৬ :: এবং যারা বিচার দিবসকে সত্য সাব্যস্ত করে।
৭০:২৭ :: এবং যারা তাদের প্রভুর শাস্তি প্রসঙ্গে উদ্বিগ্ন থাকে।
৭০:২৮ :: নিশ্চয় তাদের প্রভুর শাস্তি থেকে নিজেকে নিরাপদ ভাবা যায় না।
৭০:২৯ :: এবং যারা তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী (সংরক্ষণকারী)।
৭০:৩০ :: তাদের স্বাধীনা স্ত্রী এবং ‘মা মালাকাত আইমান’ স্ত্রী (যাদেরকে তাদের প্রতিশ্রুতি ও নিরাপত্তা প্রদায়ক ডানহাত পূর্ণরূপে অধিকৃত করেছে এরূপ স্ত্রী) প্রসঙ্গে ছাড়া। এক্ষেত্রে তারা নিন্দিত হবে না।
৭০:৩১ :: সুতরাং যারা সেটির বাইরে কাউকে তালাশ করবে, তারাই সীমালংঘনকারী হবে।
৭০:৩২ :: এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তদারককারী (শাব্দিক অর্থ: রাখাল)।
৭০:৩৩ :: এবং যারা তাদের সাক্ষ্যের প্রতি (দায়িত্বশীলতার উপর) প্রতিষ্ঠিত।
৭০:৩৪ :: এবং যারা তাদের সালাতের প্রতি হেফাযতকারী (যত্নবান)।
৭০:৩৫ :: তারা থাকবে জান্নাতে সম্মানিত।
সূরা মাউন ১০৭:১-৭
১০৭:১ :: তুমি কি তার ব্যাপারে ভেবে দেখেছো যে (সঠিক) জীবনব্যবস্থার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে?
১০৭:২ :: এরূপ লোকই ইয়াতীমকে ধাক্কা দেয়।
১০৭:৩ :: এবং অভাবগ্রস্তদের অন্নসংস্থানে উৎসাহিত করে না।
১০৭:৪ :: সুতরাং ঐ মুসল্লিদের (সালাতকারীদের) জন্য ধ্বংস।
১০৭:৫ :: যারা তাদের সালাতের (যথোপযুক্ত অনুশীলনের) ব্যাপারে উদাসীন।
১০৭:৬ :: যারা প্রদর্শনীর জন্য কর্ম সম্পাদন করে।
১০৭:৭ :: এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা উপকরণ সহজলভ্যকরণকে রোধ করে।
উপরিউক্ত আয়াতসমূহ থেকে মুসল্লি বা সালাতকারীদের পরিচয় ও মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১। সালাতে খাশিয়ূন বা বিনীত থাকা: প্রকৃত সালাতকারীগণ তাদের সালাত সম্পাদন করে বিনয়ের সাথে। তারা আখিরাতে আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার অনুভূতির সাথে সালাত সম্পাদন করে থাকে।
২। অনর্থক কথা কাজ থেকে বিমুখ থাকা: প্রকৃত সালাতকারীগণ অনর্থক কথা কাজ থেকে বিমুখ থাকে। অন্য কথায়, যারা অনর্থক কথা কাজ থেকে বিমুখ থাকে না বরং অনর্থক কথা কাজে মগ্ন থাকে তারা প্রকৃত সালাতকারী নয়।
৩। যাকাতের জন্য সক্রিয়: প্রকৃত সালাতকারীগণ যাকাতের জন্য সক্রিয় থাকে। সুতরাং সালাতের সাথে যাকাত অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণের প্রত্যয় প্রকাশ পায় এবং এটি যাকাত তথা আত্মশুদ্ধি ও সমাজের পরিশুদ্ধিতার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালনে বাধ্য করে। সালাত প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি যাকাত প্রদান বা যাকাতে সক্রিয় থাকার নির্দেশের একটি তাৎপর্য হলো: আল্লাহর কোনো বিধান পালন যেন কোনো কাঠামোগত বা বাহ্যিক দিক থেকে বিধানের অনুবর্তিতা হিসেবে সাব্যস্ত না হয় বরং তা আল্লাহ যেরূপ পরিশুদ্ধতার নির্দেশ দিয়েছেন তা সহকারে এবং তাতে উত্তরোত্তর অগ্রগতির জন্য সক্রিয় থেকে সম্পাদিত হতে হবে। যাকাত বা পরিশুদ্ধতা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমিত নয়, আবার অর্থনৈতিক দিকটিও এর অন্তর্ভুক্ত। সালাত ও যাকাতকে দ্বীন ইসলামের দুটি মৌলিক কর্মকাঠামো হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে এবং তাই বিভিন্ন আয়াতে সালাত প্রতিষ্ঠা ও যাকাত প্রদানের বিষয়টি একটি কার্যগত জোড়া নির্দেশ হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে এবং যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করবে ও যাকাত প্রদান করবে তাদেরকে দ্বীনী ভাই হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক দুটি আয়াত হলো ৯৮:৫ ও ৯:১১।
৪। লজ্জাস্থানের হেফাযত: প্রকৃত সালাতকারীগণ তাদের লজ্জাস্থানকে হেফাযতে রাখে। তাদের বিবাহিত স্বাধীনা নারী এবং ‘মা মালাকাত আইমান’ (যাদেরকে তারা পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদানের ভিত্তিতে সার্বক্ষণিক অধীনস্ত হিসেবে গ্রহণ করেছে এরূপ স্ত্রী) এর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, কারণ এক্ষেত্রে তারা তিরস্কৃত হবে না। এর বাহিরে অন্য কারো যৌন নিবেদনে সাড়া দিলে তারা তিরস্কৃত হবে অথবা অন্য কাউকে কামনা করলেও তারা অবাধ্য হিসেবে সাব্যস্ত হবে। সেক্ষেত্রে তারা প্রকৃত সালাতকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে না। (উল্লেখ্য, ‘মা মালাকাত আইমান’ এর যে পরিচিতি এখানে উপস্থাপিত হয়েছে তা কুরআন থেকে নির্গত, কিন্তু এখানে তা বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই, তাই এ বিষয়ে ইনশাআল্লাহ ‘মা মালাকাত আইমান’ সম্পর্কিত স্বতন্ত্র পুস্তিকায় আলোচনা করা হবে।)
৫। আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা: প্রকৃত সালাতকারীগণ আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। তারা কখনো কোনো ধরনের আমানতের খেয়ানত করে না এবং যথাযথভাবে প্রতিশ্রুতি পালন করে।
৬। সালাতের হেফাযত: প্রকৃত সালাতকারীগণ কোনোরকমভাবে বা কোনো কোনো সময় সালাত করেন না, বরং তাঁরা যথাসম্ভব যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে নিয়মিত সালাত সম্পাদন করেন, তাঁরা সালাতের হেফাযত করেন। সালাত হেফাযতের অংশ হিসেবে তাঁরা সফরকালে কাফিরদের কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার ফেতনার আশংকা থাকলে সালাত ক্বসর বা সংক্ষিপ্ত করেন। আবার যেকোনো সময় স্বাভাবিকভাবে সালাত সম্পাদন সম্ভব হবে না বলে আশংকা হলে প্রয়োজনে পদচারী হয়ে বা আরোহী হয়ে তথা চলন্ত অবস্থায় সালাত করেন। অন্যদিকে নিরাপত্তাপূর্ণ অবস্থায় তাঁরা স্বাভাবিক নিয়মে সালাত করেন।
৭। অস্থিরমনা ও অকৃতজ্ঞ না হওয়া: প্রকৃত সালাতকারীগণ অস্থিরমনা হন না। তাঁরা ধৈর্য্য ও স্থিরতার সাথে কর্মকাণ্ড সম্পাদন করেন, প্রত্যেক বিষয়কে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও ভরসা রেখে মোকাবেলা করেন। কোনো অমঙ্গল স্পর্শ করলে তাঁরা হাহুতাশ করেন না এবং কোনো মঙ্গল অর্জন করলে তাঁরা সেটির সরবরাহ রোধকারী না হয়ে বরং মঙ্গলজনক বিষয়কে সবদিকে সাধ্যমতো সরবরাহ করেন, ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেন। তাঁরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার অংশ হিসেবে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করেন। তাঁরা মজুদদারিতা করেন না।
৮। সার্বক্ষণিক সালাত: প্রকৃত সালাতকারীগণ সালাতের উপর দায়েম বা স্থায়ী হয়ে থাকেন। তারা সব সময় বা সার্বক্ষণিক সালাতরত থাকেন, সালাত সম্পাদন করেন। তাঁরা কোনোক্রমে আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণ থেকে যেন বিচ্যুত হয়ে না পড়েন সেদিকে সদা সতর্ক হয়ে থাকেন।
৯। মানবিক সাহায্যের দায়িত্ব পালন: প্রকৃত সালাতকারীগণের সম্পদে সাহায্যপ্রার্থী, প্রশ্নকর্তা বা উত্তর অনুসন্ধানী তথা গবেষক এবং ন্যুনতম চাহিদার যোগান থেকে বঞ্চিতদের জন্য স্ব-স্বীকৃত অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ তাঁরা নিজ দায়িত্ববোধ অনুযায়ী মানবিক সাহায্য সহযোগিতা করার কাজে সক্রিয় থাকেন।
১০। বিচার দিবসের বিষয়ে সচেতনতা: প্রকৃত সালাতকারীগণ বিচার দিবসকে সত্য সাব্যস্ত করেন। তাঁরা স্বীয় প্রভুর তথা মহান আল্লাহ তায়ালার শাস্তি প্রসঙ্গে উদ্বিগ্ন থাকেন যে, নিজেদের কার্যক্রমে যদি মৌলিক কোনো ত্রুটি হয়ে যায়, বড় কোনো অপরাধ হয়ে যায় তাহলে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর শাস্তি থেকে নিজেকে নিরাপদ ভাবা যায় না। কোনো বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগকারী ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর শাস্তির আওতামুক্ত বলে ধারণা করতে পারে না।
১১। সত্য সাক্ষ্যের প্রতি দায়িত্বশীলতা: প্রকৃত সালাতকারীরা সত্য সাক্ষ্য প্রদানে দায়িত্বশীলতা বজায় রাখে। তারা কখনো সত্য সাক্ষ্য গোপন করে না ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না। তারা নিজেদেরকে সত্য সাক্ষ্য প্রদানে দায়িত্বশীল অনুভব করে।
১২। সত্য জীবনব্যবস্থাকে সত্য সাব্যস্ত করা: প্রকৃত সালাতকারীগণ সত্য জীবনব্যবস্থাকে সত্য সাব্যস্ত করে। তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে তারা নিজেদের জন্য সত্য জীবনব্যবস্থা অনুসরণকে জরুরি বলে মেনে নেয়।
১৩। ইয়াতীমের প্রতি সদাচার: প্রকৃত সালাতকারীগণ ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের প্রতি সদাচার করে। যারা সঠিক জীবনব্যবস্থার ধার ধারে না, তারা ইয়াতীমকে ধাক্কা দেয়, ইয়াতীমকে অবজ্ঞা অবমাননা করে। কিন্তু প্রকৃত সালাতকারীগণ ইয়াতীমের প্রতি সম্মানজন আচরণ করে, সদাচার করে।
১৪। অভাবগ্রস্তের অন্নসংস্থানে উদ্বুদ্ধকরণ: প্রকৃত সালাতকারীরা নিজেরা অভাবগ্রস্তের অন্নসংস্থানে অংশগ্রহণ করে, আবার সেই সাথে অন্যদেরকেও এজন্য উৎসাহিত করে।
১৫। সালাতের যথোপযুক্ত অনুশীলন: প্রকৃত সালাতকারীগণ সালাতের যথোপযুক্ত অনুশীলনের বিষয়ে উদাসীন থাকে না, বরং সচেতনভাবে সালাতের যথোপযুক্ত অনুশীলন করে থাকে। সালাত যেন কার্যকর হতে পারে, তা যেন নামকাওয়াস্তে না হয়, তা থেকে যেন প্রকৃত কল্যাণ অর্জিত হয়, সেজন্য প্রকৃত সালাতকারীগণ আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে সালাতের উন্নয়ন উৎকর্ষ সাধন করে।
১৬। প্রদর্শনী থেকে মুক্ত থাকা: প্রকৃত সালাতকারীগণ প্রদর্শনীর জন্য কোনো কাজ করে না, তারা যা করে তা মন থেকে সঠিক উদ্দেশ্যে সত্যবাদিতার সাথে করে থাকে। তাদের যাবতীয় কাজের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তারা লোকদেখানো বা মানুষকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে সালাত বা অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদন করে না। তারা যা করে ঐ কাজটির কার্যগত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিষ্ঠার সাথে সঠিক পদ্ধতিতে সময়ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতার প্রয়োগের মাধ্যমেই তা সম্পাদন করে।
১৭। সহযোগিতা উপকরণকে সহজলভ্যকরণ: প্রকৃত সালাতকারীগণ প্রয়োজনীয় জিনিসকে আটকে দেন না, বরং সহযোগিতা উপকরণকে সহজলভ্য করে দেন। তাঁরা মজুদদারিতা করেন না। তাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষকে সহযোগিতা করার জন্য প্রয়োজনীয় উপায়-উপাদানকে সহজলভ্যকরণে ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা বিভিন্ন ধরনের কঠিন স্বত্ব দাবির মাধ্যমে মানুষের জন্য সহযোগিতা উপকরণ প্রাপ্তিকে দুর্লভ করে দিতে ভূমিকা রাখেন না, বরং তাঁরা এ ধরনের উপায় উপাদানকে সহজলভ্যকরণের জন্য নিজেদের ভূমিকা পালন করেন।
সূরা মু’মিনূন, সূরা মাআরিজ ও সূরা মাউনে প্রকৃত সালাতকারী ও অপ্রকৃত বা অগ্রহণযোগ্য সালাতকারীদের যেসব বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে তার মধ্য থেকে অগ্রহণযোগ্য সালাতকারীরা (যাদের জন্য দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে) যা করে প্রকৃত সালাতকারীরা তার বিপরীতটি করে। এ হিসেবে এ সূরাগুলোর সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহ থেকে প্রকৃত সালাতকারীদের যে পরিচয় ও মৌলিক বৈশিষ্ট্য জানা যায় উপরে তা উল্লেখ করা হয়েছে। এ গুণাবলিগুলোর মধ্যে অনেক গুণাবলি ব্যাপকার্থক, যার বাস্তব প্রয়োগ হিসেবে সমগ্র কুরআনে বর্ণিত সমস্ত গুণাবলিই প্রকৃত সালাতকারীদের গুণাবলির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। অন্য কথায়, প্রকৃত সালাতকারীরা সেই সমস্ত গুণাবলির অধিকারী আল কুরআনে মানুষকে যেসব গুণাবলির অধিকারী হওয়ার জন্য পথনির্দেশ করা হয়েছে।
বিবিধ-১ (কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিশেষ জিজ্ঞাসার জবাব)
১. ক্বায়েম, দায়েম, হেফাযত
জিজ্ঞাসা: সালাত ক্বায়েম করা, সালাতের উপর দায়েম থাকা এবং সালাত হেফাজত করার তাৎপর্য কী?
জবাব: অধিকাংশ আয়াতে সালাত ক্বায়েমের কথা বলা হয়েছে। সালাত ক্বায়েমের জন্য সময়সীমাও উল্লেখিত হয়েছে। আবার নিছক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে কোন পুণ্য (কৃতিত্ব / কল্যাণ) নেই, তাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সুতরাং সালাত প্রতিষ্ঠা মানে হলো, যথানিয়মে সালাতের অনুষ্ঠান করে সেই অনুষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সেই শিক্ষার বাস্তবায়ন করা।
৭০:২৩ আয়াতে সালাতের উপর দায়েম (সার্বক্ষণিকভাবে প্রতিষ্ঠিত) থাকার কথা বলা হয়েছে। এর মানে হলো, সার্বক্ষণিকভাবে সালাতে রত থাকতে হবে, নিয়মিত সালাত করতে হবে বা সালাতের ক্ষেত্রে অনিয়মিত হওয়া যাবে না (প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্ত সালাত করা এবং কখনো বাদ না দেয়া) এবং সালাতের অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা যাবে না, বরং সালাতের অনুষ্ঠান থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় তার উপরও অবিচল থাকতে হবে। দায়েম শব্দের অর্থ স্থায়ী হওয়া, সার্বক্ষণিকভাবে রত থাকা, নিয়মিত হওয়া, লেগে থাকা। দায়েম শব্দের অর্থ বুঝার জন্য দ্রষ্টব্য ৩:৭৫, ১১:১০৬-১০৮।
২:২৩৮, ৬:৯২, ২৩:৯, ৭০:৩৪ আয়াতসমূহে সালাতের উপর হেফাযতকারী / সংরক্ষণকারী / যত্নশীল হতে বলা হয়েছে। এর তাৎপর্য হলো, কোনো ওয়াক্তের সালাত যেন অসম্পাদিত থেকে না যায় সে বিষয়ে যত্নশীল হতে হবে, যথাসময়ে ও যথানিয়মে সালাত প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে যত্নবান হতে হবে। এছাড়া এর আরেকটি তাৎপর্য হচ্ছে, সার্বক্ষণিকভাবে সালাতে রত থাকতে হবে। আনুষ্ঠানিক সালাতের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য হলো: কোনো ওয়াক্তের সালাত ইচ্ছা করে বাদ দেয়া যাবে না। বাস্তব সালাতের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য হলো: জীবনের সকল কাজ এমনভাবে সম্পাদন করতে হবে যেন তার মাধ্যমে সালাত তথা আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণ হয়।
২. আস সালাতুল উসতার স্বতন্ত্র গুরুত্ব
জিজ্ঞাসা: সূরা বাকারার ২:২২৬-২৪২ আয়াতে তালাক প্রসঙ্গে বিভিন্ন নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২:২৩৮ আয়াতে সালাতের হিফাযাতকারী হওয়ার আদেশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয় কি? এবং সালাতসমূহের উপর হিফাযাতকারী হওয়ার সাথে আস সালাতুল উসতার হিফাযাতকারী হওয়ার নির্দেশের অর্থ কি? সালাতসমূহের ভিতর কি আস সালাতুল উসতা অন্তর্ভুক্ত নয়?
জবাব: আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করলে এ প্রশ্নগুলোর জবাব সহজে অনুধাবন করা যেতে পারে। বিবাহ-তালাক সামাজিক জীবনের কোলাহলের বিষয়। এ বিষয়ক নির্দেশ এবং সালাত বিষয়ক নির্দেশ একই দীনের (জীবনব্যবস্থার) অন্তর্ভুক্ত এবং জীবনের ধর্মীয় ও সামাজিক ইত্যাদি বিভাজনের তুলনায় সবকিছুর সমন্বয়েই জীবনের অখন্ড / পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়া যায়।
তাই তালাকের আলোচনার মধ্যে সালাতের নির্দেশের মাধ্যমে তালাকবিধি ও সালাতবিধি যে একই দীনের অন্তর্ভুক্ত এবং উভয়টির উপর সমান গুরুত্ব আরোপ করা উচিত, তালাক ও সালাত কোনোটির সাথে সম্পর্কিত আইনের ক্ষেত্রেই উদাসীন থাকা উচিত নয়- এ বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
বিশেষ করে জীবনের বাস্তব কোলাহলে এমনভাবে মগ্ন হয়ে যাওয়া যে, সালাত অসম্পাদিত থেকে যায়- তা যেন না হয় সেজন্য এখানে সালাতসমূহের উপর হিফাযাতকারী হওয়ার নির্দেশ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
ঠিক একইভাবে সালাতুল ফজর ও সালাতুল ইশার তুলনায় আস সালাতুল উসতার সময় জীবনের বাস্তব কোলাহলের সময়। তাই সাধারণভাবে সালাতসমূহের হিফাযাতকারী হতে বলার সাথে স্বতন্ত্রভাবে আস সালাতুল উসতার হিফাযাতকারী হতে বলাও একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয় বলে প্রতিভাত হয়।
এটি হলো যখন আমরা সালাত বলতে আনুষ্ঠানিক সালাতের দিকটিকে বিবেচনায় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি, সেক্ষেত্রে কিভাবে তালাকের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সালাতের প্রসঙ্গ খাপ খেতে পারে সে প্রশ্নের বিবেচনা। কারণ সালাত শব্দের বহুমাত্রিকতার মধ্যে আনুষ্ঠানিক সালাতের ক্ষেত্রেও এখানে বক্তব্যটি প্রযোজ্য। যে আয়াতে কোনো বিষয়ের একাধিক দিক প্রযোজ্য হয় তাতে যদি কোনো বিশেষ শর্তের কারণে কোনো দিক অন্তর্ভুক্ত নয় বলে সাব্যস্ত হয় সেদিকটি ছাড়া বাকি দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত ধরতে হয়। এ আয়াতে সালাতের আনুষ্ঠানিক দিকটিও প্রযোজ্য, কারণ এখানে আনুষ্ঠানিক দিকটিকে উপেক্ষা করার কোনো যুক্তিসঙ্গত শর্ত পাওয়া যায় না।
সেই সাথে বিবেচ্য বিষয় হলো, সালাত বলতে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সালাতকে বুঝায় না। বরং সালাত বলতে ব্যাপকভিত্তিতে আল্লাহ প্রদত্ত জীবনব্যবস্থার নিবিড় অনুসরণকে বুঝায়। সেই প্রেক্ষিতে ২:২৩৮ আয়াতের বক্তব্য নিম্নরূপ:
২:২৩৮ :: তোমরা সালাতসমূহের (জীবনব্যবস্থার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখাগত নির্দেশের নিবিড় অনুসরণের) প্রতি যত্নশীল হও এবং বিশেষবাবে আস সালাতিল উসতার (জীবনব্যবস্থার মৌলিক / কেন্দ্রীয় নির্দেশের নিবিড় অনুসরণের) প্রতি যত্নশীল হও। এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দণ্ডায়মান হও।
৩. মাক্বামে ইবরাহীম
জিজ্ঞাসা: ‘তোমরা মাক্বামে ইবরাহীমকে মুসল্লা হিসেবে গ্রহণ করো’ (২:১২৫) তথ্যটির তাৎপর্য কী? মাক্বামে ইবরাহীমকে মুসল্লা হিসেবে গ্রহণ করা বলতে ‘কা’বার ইমামের দেখাদেখি নামাজের ওয়াক্তসংখ্যা, রাকায়াত, রুকু ও সাজদাহ সংখ্যা এবং পঠনীয় বিষয় নির্ধারণ করা’ বুঝায় কি?
জবাব: সূরা বাক্বারাহ ২:১২৫ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, ‘তোমরা মাক্বামে ইবরাহীমকে মুসল্লা হিসেবে গ্রহণ করো’। এই নির্দেশের তাৎপর্য হিসেবে কেউ কেউ ধারণা করেছেন যে, কা’বার ইমামের দেখাদেখি নামাজের ওয়াক্তসংখ্যা, রাকায়াত, রুকু ও সাজদাহর সংখ্যা এবং পঠনীয় বিষয় নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু এই ধারণা যথার্থ কিনা তা যাচাই করার জন্য আমাদেরকে আয়াতটির সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রসঙ্গে কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন করতে হবে।
মাক্বামে ইবরাহীমকে মুসল্লা হিসেবে গ্রহণ করার তাৎপর্য উপলব্ধির জন্য প্রথমে নিম্নে কুরআনের প্রয়োগ অনুসারে একটি প্রাসঙ্গিক সূত্র নির্ণয় ও আলোচনা করা হলো:
‘ইত্তাখাজা + মিন + মাফউল + মাফউল’ কথাটির অর্থ হলো ‘প্রথম মাফউলের মধ্য থেকে বা পরিসরে দ্বিতীয় মাফউলকে / মাফউল হিসেবে গ্রহণ করা বা তৈরি করা’। অন্য কথায়, “কোনো কিছুর মধ্য থেকে / পরিসরে কোনো কিছুকে / কোনো কিছু হিসেবে গ্রহণ করা / তৈরি করা”। সূত্রটি উদাহরণের মাধ্যমে বুঝা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ নিম্নের আয়াতগুলো লক্ষণীয়:
৩:১৪০ আয়াতে “ওয়া ইয়াত্তাখিজা মিনকুম শুহাদাআ” এর অর্থ হলো: ‘এবং (যেন) তিনি তোমাদের মধ্য থেকে (কাউকে) শহীদ হিসেবে গ্রহণ করেন বা তৈরি করেন’।
৪:৮৯ আয়াতে “ফালা তাত্তাখিজূ মিনহুম আওলিয়াআ হাত্তা ইউহাজিরূ ফী সাবীলিল্লাহি” এর অর্থ হলো: ‘সুতরাং তোমরা তাদের মধ্য থেকে কাউকেই আওলিয়া হিসেবে গ্রহণ করো না / আওলিয়া বানাবে না’।
৭:৭৪ আয়াতে “তাত্তাখিজূনা মিন শুহূলিহা ক্বুসূরান” এর অর্থ হলো: ‘তোমরা এর (পৃথিবীর) সমতুল ভূমি থেকে / সমতল ভূমির পরিসরে প্রাসাদ / দুর্গ গ্রহণ করছো / নির্মাণ করছো’।
১৬:৬৭ আয়াতে “ওয়া মিন ছামারাতিন নাখীলি ওয়াল আ’নাবি তাত্তাখিজূনা মিনহু ছাকারান ওয়া রিযক্বান” এর অর্থ হলো: ‘এবং খেজুর গাছের ফল ও আঙ্গুর থেকে তোমরা মদ ও উত্তম খাদ্য গ্রহণ করো / তৈরি কর’।
১৬:৬৮ আয়াতে “ওয়া আওহা রব্বুকা ইলান নাহলি আনিত্তাখিযি মিনাল জিবালি বুয়ূতান ওয়া মিনাশ শাজারি ওয়া মিম্মা ইয়া’রিশূনা” এর অর্থ হলো: ‘এবং তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে ওহী করেছেন যে, তোমরা পাহাড় থেকে এবং গাছ থেকে এবং তারা (মানুষ) যে মাচান / উঁচু চাল বানায় তা থেকে (তোমাদের জন্য) বাসা গ্রহণ করো / তৈরি করো’।
সুতরাং উপরিউক্ত উদাহরণগুলোর সাথে সমন্বয় রেখে ২:১২৫ আয়াতে ‘মাক্বামে ইবরাহীম থেকে মুসল্লা গ্রহণ করার’ যে নির্দেশ তা অনুধাবন করা প্রয়োজন।
২:১২৫ আয়াতে বলা হয়েছে “ওয়াত্তাখিযূ মিম মাক্বামি ইবরাহীমা মুসল্লা” (এবং তোমরা মাক্বামে ইবরাহীম থেকে মুসল্লা গ্রহণ করো বা বানাও)।
এখন এ বাক্যটিকে বুঝতে হলে আরো দুটি বিষয় বুঝতে হবে, একটি হলো ‘মাক্বামে ইবরাহীম’ কী? আরেকটি হলো, মুসল্লা কী?
মুসল্লা শব্দটি কর্মবাচক বিশেষ্য (Object)। মুসল্লা শব্দের যেসব অর্থ হতে পারে তা হলো: যে বিষয়কে সালাত করা হয়েছে, সালাতকৃত বিষয়, সালাত সম্বলিত বিষয়, সালাতযোগ্য বিষয়। মুসল্লা শব্দটি কুরআনে শুধুমাত্র ১ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে: ২:১২৫:১১। সুতরাং এখানে বাক্যটির অর্থ হলো: “তোমরা ইবরাহীমের আদর্শিক অবস্থান থেকে সালাত সম্বলিত বিষয় গ্রহণ করো / তোমরা ইবরাহীমের আদর্শিক অবস্থানকে সালাত সম্বলিত বিষয় হিসেবে গ্রহণ করো।”।
আয়াতটিতে ইবরাহীমের আদর্শ থেকে শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা নিয়ে সালাত সম্বলিত বিষয় অবলম্বন তথা স্রষ্টার বিধানের প্রতি নিবেদিত কর্মের জন্য আত্মগঠন, পরিবার গঠন ও সমাজ গঠনমূলক কার্যক্রম সম্পাদন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তথ্যটি ভালভাবে অনুধাবনের জন্য মাক্বাম শব্দের তাৎপর্য লক্ষণীয়।
মাক্বাম এর শব্দমূল হচ্ছে ‘ক্বফ ওয়াও মীম’। শব্দমূলের অর্থ হচ্ছে ‘দাঁড়ানো’। এ শব্দটির বিভিন্নরূপ আল কুরআনে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো:
১. ইক্বামা, ইক্বামাত (ক্রিয়ারূপ ৪ এর ক্রিয়াবিশেষ্য, প্রতিষ্ঠা করা, শিবির স্থাপন করা) ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ১৬:৮০:১৭, ২১:৭৩:৯, ২৪:৩৭:১০।
২. মুক্বীম (ক্রিয়ারূপ ৪ এর কর্তৃবিশেষ্য, প্রতিষ্ঠাকারী) ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ৪:১৬২:১৫, ১৪:৪০:৩, ২২:৩৫:১১।
৩. মুক্বীম (ক্রিয়ারূপ ৪ এর কর্তৃবিশেষ্য, প্রতিষ্ঠিত) ব্যবহৃত হয়েছে ৭ স্থানে: ৫:৩৭:১২, ৯:২১:১০, ৯:৬৮:১৬, ১১:৩৯:১০, ১৫:৭৬:৩, ৩৯:৪০:৮, ৪২:৪৫:২৭।
৪. মুক্বাম, মুক্বামাহ (ক্রিয়ারূপ ৪ থেকে গঠিত, প্রতিষ্ঠিত থাকার অবস্থান, যেখানে একজন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠিত থাকে, সফরের বিপরীত) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৪ স্থানে: ২৫:৬৬:৪, ২৫:৭৬:৫, ৩৩:১৩:৮, ৩৫:৩৫:৪।
৫. মাক্বাম (মুক্বাম এর প্রতিশব্দ, আদর্শগত অবস্থান, মর্যাদাগত অবস্থান, জবাবদিহিমূলক অবস্থান, মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১৪ স্থানে: ২:১২৫:৯, ৩:৯৭:৪, ৫:১০৭:৯, ১০:৭১:১৩, ১৪:১৪:৮, ১৭:৭৯:১১, ১৯:৭৩:১৪, ২৬:৫৮:২, ২৭:৩৯:১২, ৩৭:১৬৪:৫, ৪৪:২৬:২, ৪৪:৫১:৪, ৫৫:৪৬:৩, ৭৯:৪০:৪।
মুক্বাম ও মাক্বাম শব্দের পার্থক্য হচ্ছে ‘মুক্বাম’ যেখানে অবস্থানের স্থানকে বুঝায়, মাক্বাম সেখানে অবস্থানের অবস্তুগত দিককে বুঝায়।
শব্দদুটির অর্থগত পার্থক্য বুঝা যাবে যদি ‘মাক্বামে ইবরাহীম’ ও ‘মুক্বামে ইবরাহীম’ শব্দদ্বয়ের অর্থ কী দাঁড়ায় তা উল্লেখ করা হয়।
মুক্বামে ইবরাহীম = ইবরাহীমের মুক্বাম, যেখানে ইবরাহীম মুক্বীম, তিনি মুসাফির নন।
মাক্বামে ইবরাহীম = ইবরাহীমের অবস্থান, মর্যাদাগত দাঁড়াবার স্থান।
২:১২৫:৯ ছাড়া অন্য যে স্থানে ‘মাক্বামে ইবরাহীম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো ৩:৯৭:৪। আয়াতটিতে বলা হয়েছে, “সেটার ক্ষেত্রে (অর্থাৎ আদিগৃহের ক্ষেত্রে) স্পষ্ট প্রমাণবহ নিদর্শনসমূহ রয়েছে। (যেমন তার সাথে সম্পর্কিত) মাক্বামে ইবরাহীম (ইবরাহীমের আদর্শগত অবস্থান)। ....”
বর্তমানে একটি পাথরখণ্ডকে মাক্বামে ইবরাহীম বলে দাবি করা হয়। অথচ মাক্বামে ইবরাহীম কোনোক্রমেই কোনো পাথরের খন্ড নয়। দাবি করা হয় যে, ২:১২৫ আয়াতে ঐ পাথর খন্ডকে সালাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। অথচ ‘মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে একটি পাথরখন্ডকে সালাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ করার আদেশ দেয়া হয়েছে’- কথাটি বাস্তবসম্মত হয় না।
প্রকৃতপক্ষে ‘আওয়ালা বাইতের’ ক্ষেত্রে ইবরাহীমের মাক্বাম থাকার অর্থ হলো তিনি এ গৃহকে ব্যক্তিগত বসবাসের স্থান হিসেবে গ্রহণ করেননি, বরং এ গৃহের সাথে তাঁর আদর্শিক অবস্থানের সম্পর্ক রয়েছে, এর সাথে তাঁর আদর্শিক মর্যাদাগত অবস্থান জড়িত রয়েছে। এ গৃহের কাছে তিনি তাঁর পরিবার পরিজনকে রেখে গেছেন, যেন তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে। নিছক বসবাসের স্থান হিসেবে নয়, বরং এ গৃহের সাথে তাঁদের আদর্শিক ভিশন মিশনের যে সম্পর্ক সেজন্যই তাঁরা এখানে অবস্থান করেছেন।
উপরোল্লেখিত তথ্যগত বিশ্লেষণ ও সমন্বিত অধ্যয়নের পরিপ্রেক্ষেতে পরিশেষে বলা যায় যে, মাক্বামে ইবরাহীমকে মুসল্লা হিসেবে গ্রহণ করা বলতে ‘কা’বার ইমামের দেখাদেখি নামাজের ওয়াক্তসংখ্যা, রাকায়াত, রুকু ও সাজদাহ সংখ্যা এবং পঠনীয় বিষয় নির্ধারণ করা’ বুঝায় না। বরং এর দ্বারা বুঝায়, নবী ইবরাহীমের আদর্শ থেকে শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা নিয়ে নিজেদের সালাত সম্বলিত বিষয় তথা স্রষ্টার বিধানের সাথে সংযোগ স্থাপনকৃত আদর্শিক অবস্থান গ্রহণ করা, নবী ইবরাহীমের মাক্বামকে মুসল্লা বা নিজেদের জন্য অর্জনীয় মাক্বাম হিসেবে গ্রহণ করা।
আর কা’বাতেও যে সালাতের বিকৃতি হয়েছে ও হতে পারে তার প্রমাণস্বরূপ নিম্নের আয়াত লক্ষণীয়:
৮:৩৫ :: এবং তাদের সালাত কিছুই নয় ‘আল বাইতের’ (অনন্য প্রতিষ্ঠান কা’বাগৃহের) কাছে শিস / উলুধ্বনি দেয়া এবং করতালি / অনর্থক ব্যস্ততা ছাড়া। সুতরাং তোমরা যে কুফর (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান) করতে তার কারণে তোমরা শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করো।
১৯:৫৯ :: তারপর তাদের পরে পরবর্তীরা স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। তারা (পরবর্তীরা) সালাতকে নষ্ট করেছে এবং কামনা বাসনার অনুসরণ করেছে। তারপর শীঘ্রই তারা বিপথগামিতার (অমঙ্গলের) সম্মুখীন হবে।
পূর্ববর্তী রসূলদের পরে পরবর্তী স্থলাভিষিক্তরা যেমন সালাতকে নষ্ট করেছে, তেমনি মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পরের পরবর্তী স্থলাভিষিক্তরাও সালাতকে নষ্ট করা সম্ভব। কোথাও তাদের দ্বারা সালাত নষ্ট না হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী দেয়া হয়নি। সুতরাং প্রকৃত সালাতের রূপরেখা নির্ণয়ের উপায় হলো: আল কুরআনে সালাত প্রসঙ্গে যেরূপ নির্দেশনা রয়েছে তা লংঘন না করা এবং যা কিছু বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তার বাহিরের কোনো বিষয়কে বাধ্যতামূলক সাব্যস্ত না করা।
কুরআনে সালাতের বিধানের ক্ষেত্রে যা কিছু ছেড়ে দেয়া হয়েছে তা বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ নেই, সাধারণ রীতি হিসেবে চর্চা করা যেতে পারে যদি কোনো ধারার লংঘন না হয়। যেক্ষেত্রে কুরআন কিছু সুনির্দিষ্ট করেনি, সেক্ষেত্রে বিভিন্নতার অবকাশ রয়েছে এবং বিধান সাব্যস্ত না করার শর্তে ইমামের অনুসরণ করা যেতে পারে।
৪. ক্বিবলাহ, কা’বা, আল বাইত (বাইতুল্লাহ), আল মাসজিদুল হারাম
জিজ্ঞাসা-১: আল্লাহর ওয়াজহুন (চেহারা / সত্তা) সবদিকে। তাহলে আল মাসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরানো কেন?
জবাব: শৃঙ্খলার জন্য এবং মুসলিমদের ঐক্যমুখীতার জন্য আল মাসজিদুল হারামকে কেন্দ্রীয় আনুষ্ঠানিক অভিমুখ (ক্বিবলাহ) হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পূর্ব বা পশ্চিম কোনো একটিমাত্র দিকে ফেরা হয় না। বরং পূর্ববাসীরা পশ্চিমে এবং পশ্চিমবাসীরা পূর্বে ফেরা হয়।
জিজ্ঞাসা-২: যদি আল মাসজিদুল হারাম কোনদিকে তা বুঝা না যায়, তখন কোনদিকে মুখ ফিরাবে?
জবাব: প্রথমত এ অবস্থায় সালাত বাধ্যতামূলক নয় এবং এরূপ অবস্থা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা কর্তব্য। কারণ যেখানে দ্বীনের বিধিবিধান পরিপালনের স্বাভাবিক পরিবেশ থাকে না সেইরূপ অবস্থান ও অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসাই মু’মিনের করণীয় হয়ে থাকে। এছাড়া বিশেষ পরিস্থিতিতে যেমন পদচারী ও আরোহী অবস্থায় সালাত করার পরোক্ষ নির্দেশনা অনুসারে যেখানে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান থাকে না সেখানে স্বাভাবিক রীতিনীতির যা রক্ষা করা সম্ভব নয় তা বাদ দিয়ে বাকিগুলো করাই গ্রহণযোগ্য রীতি। এ অনুসারে তখন যে কোনো দিকে ফিরে সালাত করলে সালাত প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে। এছাড়া আল মাসজিদুল হারামের দিকে ফেরার কথা বলা হয়েছে তাতে সরাসরি বস্তুগতভাবে আল মাসজিদুল হারামের দিকে ফেরার মতো শব্দ ব্যবহার করা হয়নি, বরং শাতরা বা মনোসংযোগমূলক দিক অর্থে সেদিকে মুখ ফেরানোর কথা বলা হয়েছে, তাই যেখানে বস্তুগতভাবে সম্ভব হবে না, সেখানে বস্তুগতভাবে সেদিকে মুখ ফিরানো অপরিহার্য নয়।
জিজ্ঞাসা-৩: আল মাসজিদুল হারামের ভিতরে কোন দিকে ফিরে সালাত করা হয়?
জবাব: আল মাসজিদুল হারাম হলো কা’বাকে কেন্দ্র করে এর চতুর্দিকের পরিধিতে অবস্থিত মাসজিদ। তাই আল মাসজিদুল হারাম থেকে যেদিকেই থাকা হোক না কেন ‘আল মাসজিদুল হারামের দিকে ফিরে সালাত করার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যেমন আল মাসজিদুল হারামের পূর্ব দিকের লোকেরা পশ্চিম দিকে এবং পশ্চিম দিকের লোকেরা পূর্ব দিকে মুখ ফিরায়, সেটির সাথে সামঞ্জস্য রেখে আল মাসজিদুল হারামের ভিতরেও কা’বার দিকে ফিরে সালাত করা হয়। এবং কা’বার ভিতরে সাধারণত সালাত করা হয় না। তবে যদি কা’বার ভিতরেও সালাত করতে হয় সেক্ষেত্রেও একই সামঞ্জস্য বজায় রেখে কা’বার মধ্যস্থলে কোনো কেন্দ্রীয় চিহ্ন রেখে সালাত করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সরাসরি নির্দেশ নেই, কিন্তু মানবীয় নির্বাহী রীতিটি বিবেক-বুদ্ধিসঙ্গত এবং এ বিষয়টি মানুষের বিবেক-বুদ্ধির উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
জিজ্ঞাসা-৪: আল মাসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরিয়ে সালাত এবং আল মাসজিদুল হারামের চারদিকে তাওয়াফ করা কি একটা ঘরের পুজা নয়?
জবাব: আল মাসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরিয়ে সালাত করা এবং আল মাসজিদুল হারামের চারদিকে তাওয়াফ করা মানে ঐ ঘরের পুজা করা নয়। বরং এটা হচ্ছে একটা ঐক্যবদ্ধতার কেন্দ্রের চারদিকে আবর্তিত হওয়ার নির্দেশনা পরিপালন। আল্লাহর নির্দেশক্রমে এই বস্তুগত ঐক্যবদ্ধতার নিশানীকে (আল মাসজিদুল হারামকে) প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, এটি এক আল্লাহর নিশানী নয়, বরং এক আল্লাহর বান্দাদের ঐক্যের (ঐক্যবদ্ধ জীবন চেতনার, ঐক্যবদ্ধভাবে একই আদর্শিক কেন্দ্রের চতুর্দিকে পরিভ্রমণের) নিশানী। সাংগঠনিক আচরণের ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনকারী বস্তু বা বিষয় এবং তাকে কেন্দ্র করে বিধি মোতাবেক আবর্তন সৃষ্টি জগতে ক্রিয়াশীল একটি প্যাটার্ন। এক্ষেত্রে যা আবর্তন করছে এবং যাকে কেন্দ্র করে আবর্তন করছে উভয়টি মূলত সৃষ্টিগত প্যার্টান অনুসারে ক্রিয়াশীল মাত্র, কোনোটিই স্বাধীন ক্ষমতার ভিত্তিতে কর্ম সম্পাদনকারী নয়। সৌরজগতে যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলোর আবর্তন এবং এমনকি পরমাণুতেও ইলেকট্রনের ঘূর্ণন রয়েছে, কা’বার তাওয়াফ হলো অনুরূপ একটি বিষয়। বস্তুত কা’বাকে কেন্দ্র করে তাওয়াফের (ঘুরার) তাৎপর্য হচ্ছে বৃত্তে যেমন কেন্দ্র ও পরিধি থাকে, তেমনি সমগ্র মানবজাতি একই কেন্দ্রীয় ভাবাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তার পরিধিতে আবর্তন করার শিক্ষামূলক প্রতীকী মহড়া। কা’বা হচ্ছে মানবজাতির জন্য আল্লাহর নির্ধারিত একক বিশ্বকেন্দ্রের প্রতীক এবং তাওয়াফ হচ্ছে সেই বিশ্বকেন্দ্রের পরিধিতে মানবজাতির ঐক্যবদ্ধ আবর্তনের প্রতীক। অন্য কথায়, তাওয়াফ হচ্ছে বিশ্বপ্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে মানবজাতির কেন্দ্রীয় ঐক্যের ভিত্তিতে আবর্তনের শিক্ষামূলক একটি অনুষ্ঠান। এতে রয়েছে আল্লাহর আহবানে সাড়া দিয়ে শ্রেণিবাদ পরিহার করে সমগ্র মানবজাতির সাথে ঐক্য বজায় রাখার অভব্যক্তি।
জিজ্ঞাসা-৫: কা’বাকে / আল বাইতুল হারামকে ‘বাইতুল্লাহ’ (আল্লাহর ঘর) বলা হয় কেন? এখানে কি আল্লাহ থাকেন?
জবাব: ২:১২৫ (বাইতী- আমার বাইত), ২২:২৬ (বাইতিয়া- আমার বাইত) এবং ১৪:৩৭ (বাইতিকাল মুহাররাম- আপনার বাইত) শব্দগুলোর প্রেক্ষিতে কা’বাকে / আল বাইতুল হারামকে ‘বাইতুল্লাহ’ বলা হয়। ‘আল্লাহর ঘর’ মানে ‘আল্লাহর থাকার ঘর’ নয়, বরং এর মানে ‘আল্লাহর নির্ধারিত ঘর, যা তিনি তাঁর উপাসনার কেন্দ্রস্থান হিসেবে নির্ধারণ করেছেন’।
জিজ্ঞাসা-৬: কা’বা, আল বাইতুল হারাম ও আল মাসজিদুল হারাম এবং হারাম এলাকার অর্থ কী এবং এগুলোর মধ্যে সম্পর্ক কী
জবাব: কা’বা অর্থ টাখনু, ভিত্তিমূল। বাইত অর্থ ‘নিরাপত্তা বেষ্টনীকৃত (তাঁবু / দুর্গসদৃশ) বিশ্রামস্থল, পরামর্শকেন্দ্র ও কার্যালয়’। বায়ত শব্দটি ‘বায়াত’ বা ‘রাত’ শব্দের সাথে সম্পর্কিত। মানুষ সারাদিন যেখানেই থাকুক না কেন রাতে ঘুমানোর জন্য গৃহে ফিরে আসে, গৃহ হলো নিরাপত্তার প্রতীকস্বরূপ, যাতে সে নিরাপদে ঘুমাতে পারে এবং বিভিন্ন গোপনীয় আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত করতে পারে এবং এমন স্থান যাতে সম্পদের ক্ষেত্রেও সুরক্ষার ব্যবস্থা করা যায়। এসব প্রেক্ষিতে ‘বায়ত’ শব্দটি গৃহ এবং অনুরূপ নিরাপত্তাপূর্ণ তাঁবু ও প্রতিষ্ঠানাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। এবং মাসজিদ অর্থ সাজদাহর প্রতিষ্ঠান, শুনা ও মানার প্রক্রিয়ার বা কোনো সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের প্রতি সম্মান রেখে তাঁর নির্দেশিত নীতিমালা বাস্তবায়নের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা কার্যকর করার প্রতিষ্ঠান। বস্তুত বাইত ও মাসজিদ গৃহরূপ পেতে পারে, তবে তা অপরিহার্য নয়।
আল কা’বা এবং আল বায়তুল হারাম একই জিনিসকে বলা হয় (৫:৯৫)। আল বায়তুল হারামকে সংক্ষেপে ‘আল বায়ত’ বলা হয়। এর আরো বিশেষণ হলো, ‘আওয়ালা বায়ত’ ও ‘বায়তুল আতিক্ব’।
কা’বাকে কেন্দ্র করে এর পরিধিতে গড়া মাসজিদকে আল মাসজিদুল হারাম বলে। আল বায়ত (কা’বা) যদি হয় রাষ্ট্রব্যবস্থা, তবে আল মাসজিদুল হারাম হলো তার সরকারব্যবস্থা। অন্য কথায়, আল বায়তের পক্ষ থেকে ব্যবস্থাপনাগত দায়িত্ব পরিপালনের জন্য ক্রিয়াশীল দ্বিতীয় কক্ষই হলো আল মাসজিদুল হারাম।
এবং হারাম এলাকা হলো ‘আল মাসজিদুল হারাম’কে কেন্দ্র করে ‘আল মাশআরিল হারাম’ পর্যন্ত যে ব্যাসার্ধ, ‘আল মাসজিদুল হারাম’ এর চতুর্দিকে অনুরূপ (বা প্রায় অনুরূপ) ব্যাসার্ধ নিয়ে বিস্তৃত এলাকা।
জিজ্ঞাসা-৭: ক্বিবলাহ পরিবর্তনের বিষয়ে প্রকৃত তথ্য কী? আল মাসজিদুল হারামের আগে যে ক্বিবলাহটি নির্ধারণ করা হয়েছিলো তা কোন আয়াতের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছিলো এবং তা কোনটি ছিলো?
জবাব: সূরা বাক্বারাহ ২:১৪২-১৪৭ আয়াত, বিশেষ করে ২:১৪৩ আয়াত অনুসারে বুঝা যায় যে, আল মাসজিদুল হারামকে ক্বিবলাহ হিসেবে চূড়ান্ত করার আগে রসূল অন্য একটি ক্বিবলাহর অনুসরণ করতেন। এতে বলা হয়েছে যে, কুরআনের মাধ্যমে ক্বিবলাহ পরিবর্তনের আগে রসূল যে ক্বিবলাহর উপর ছিলেন, সেটাও আল্লাহই নির্ধারণ করেছিলেন। এবং তাতে মক্কায় মুশরিক থেকে মু’মিন হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কে রসূলের অনুসরণ করতে প্রস্তুত সেটার পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিলো। কারণ আল্লাহর নির্দেশ রসূলের মাধ্যমেই এসেছিলো। তারপর মদীনায় ক্বিবলাহ পরিবর্তনের মাধ্যমে একদিকে আগের লোকদের মধ্য থেকে নির্বোধেরা প্রশ্ন করার অবকাশ তৈরি হয় যে, কিসে তাদেরকে তাদের ক্বিবলাহর দিক থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে? যাই হোক, আগের ক্বিবলাহ অনুসরণ করে যেসব মু’মিন গত হয়েছে বা যারা (আয়াতটি নাযিলের) গতকাল পর্যন্ত পূর্ববর্তী নির্দেশের উপর ভিত্তি করে আগের ক্বিবলাহ অনুসরণ করেছিলো এবং নতুন নির্দেশের প্রেক্ষিতে নতুন ক্বিবলাহর অনুসরণ শুরু করছে, তাদের ঈমান বিনষ্ট হবে না। কারণ তারা একই মূলনীতির উপর তথা রসূলের অনুসরণের উপর ছিলো বা আছে। বাহ্যত যে পরিবর্তন (আগে এক ক্বিবলাহর অনুসরণ, এখন অন্য ক্বিবলাহর অনুসরণ), এটা কোনো দেখার বিষয়ই নয়, দেখার বিষয় হলো, উভয় অবস্থায় তারা রসূলেরই অনুসরণ করেছে। যেহেতু আগের ক্বিবলাহ কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়নি, তাই রসূল জানতেন যে, ক্বিবলাহর পরিবর্তন ঘটবে। তাই রসূলের বিবেচনায় যখন সময় ঘনিয়ে এসেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে তখন তিনি ক্বিবলাহ পরিবর্তন সংক্রান্ত ওহীর জন্য ব্যাকুলতা বোধ করে বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন। এবং তিনি আল্লাহর পরিকল্পনার প্রতি সন্তুষ্ট বিধায়, নতুন ক্বিবলাহ তাঁকে সন্তুষ্ট করবে এরূপ মনোভাব তাঁর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিলো। তবে নতুন ক্বিবলাহর জ্ঞান আসার পর ইহুদিদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে যদি আবার পূর্বের ক্বিবলাহর দিকে মুখ ফিরানো হয়, তাহলে তাতে জুলুম হবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
আল মাসজিদুল হারামকে চূড়ান্তভাবে ক্বিবলাহ নির্ধারণ করে দেয়ার আগে মধ্যবর্তী অন্তর্বর্তীকালে কোন মাসজিদকে ক্বিবলাহ হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছিলো, তা কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি। তবে সূরা বানী ইসরাইলে রসূলকে আল মাসজিদুল হারাম থেকে আল মাসজিদুল আক্বসায় (দূরবর্তী মাসজিদে) রাতের বেলায় ভ্রমণ (ইসরা) করানোর উল্লেখ রয়েছে, যেন রসূল কিছু নিদর্শন দেখতে পারেন। তাই কুরআন অনুসারে আল মাসজিদুল হারামের সাথে দ্বিতীয় যে মাসজিদটি বিবেচনায় আসে তা হলো ‘আল মাসজিদুল আক্বসা’। প্রশ্ন হলো, আল মাসজিদুল আক্বসা (যা তৎকালীন দ্বিতীয় মাসজিদ, আল মাসজিদুল হারামের সাপেক্ষে যাকে দূরবর্তী মাসজিদ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো) কোন স্থানে অবস্থিত, সেটা একটি গবেষণার বিষয় হতে পারে। এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক হিসেবে সূরা বানী ইসরাইলের আয়াতসমূহকে সামনে রেখে ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটা মোটামুটি নিশ্চিত পর্যায়ের ধারণা লাভ করা যেতে পারে। তবে আমরা যদি তা হুবহু নির্ণয় করতে না পারি, তাতেও কোনো বাস্তব সমস্যা নেই। কারণ বর্তমানে আমাদেরকে সেই অন্তর্বর্তীকালীন ক্বিবলাহর অনুসরণ করতে হবে না। বরং বর্তমানে আমাদেরকে আল মাসজিদুল হারামকে ক্বিবলাহ হিসেবে অনুসরণ করতে হবে।
৫. ওজু, গোসল, তায়াম্মুম
জিজ্ঞাসা: ওজু, গোসল বা তায়াম্মুমের বিস্তারিত বিধি-বিধান কী কী?
জবাব: ওজু, গোসল, তায়াম্মুম সম্পর্কে যে দুটি আয়াতে বিধি-বিধান দেয়া হয়েছে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
৪:৪৩ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না এ অবস্থায় যে, তোমরা আড়ষ্ট মস্তিষ্ক, যতক্ষণ না তোমরা উহার জ্ঞান রাখো যা তোমরা বলো। এবং জুনূব / অপরিচ্ছন্ন অবস্থায়ও নয়, যদি না হও আবিরে ছাবীল / পথিমধ্যে অতিক্রমরত (অসুবিধাসম্পন্ন), যতক্ষণ না তোমরা গোসল / ধৌত করো। এবং যদি তোমরা অসুস্থ থাকো; অথবা তোমরা সফর অবস্থায় থাকো অথবা আসে তোমাদের মধ্য থেকে কেউ শৌচাগার থেকে অথবা তোমরা স্ত্রীদেরকে স্পর্শ করো; তারপর পানি না পাও, তাহলে তোমরা তায়াম্মুম / অনুসন্ধান করো পবিত্র উচ্চভূমি। তখন তোমরা মাসেহ করো / মুছে নাও তোমাদের মুখমন্ডলসমূহ এবং তোমাদের হাতসমূহ। নিশ্চয় আল্লাহ উদার, ক্ষমাশীল।
৫:৬ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যখন তোমরা দাঁড়াও সালাতের দিকে (সালাতের প্রস্তুতিপর্বে), তখন তোমরা গোসল / ধৌত করো তোমাদের মুখমন্ডলসমূহ, এবং তোমাদের হাতসমূহ কনুইসমূহ পর্যন্ত, এবং তোমরা মাসেহ করো / মুছে নাও তোমাদের সমগ্র মাথাসমূহ এবং তোমাদের পাসমূহ টাখনুসমূহ পর্যন্ত। এবং যদি তোমরা জূনূব (অপরিচ্ছন্ন) অবস্থায় থাকো, তাহলে তোমরা ত্বহারাত / পবিত্রতা হাসিল করো। এবং যদি তোমরা অসুস্থ থাকো; অথবা তোমরা সফর অবস্থায় থাকো অথবা আসে তোমাদের মধ্য থেকে কেউ শৌচাগার থেকে অথবা তোমরা স্ত্রীদেরকে স্পর্শ করো; তারপর পানি না পাও, তাহলে তোমরা তায়াম্মুম / অনুসন্ধান করো পবিত্র উচ্চভূমি, তখন তোমরা মাসেহ করো / মুছে নাও তোমাদের মুখমন্ডল এবং তোমাদের হাতসমূহ উহা থেকে (উহার উপাদানের মাধ্যমে)। আল্লাহ এরাদা / ইচ্ছা করেন না তোমাদের উপর কোনো সংকীর্ণতা রাখতে। কিন্তু তিনি এরাদা / ইচ্ছা করেন তোমাদেরকে পবিত্র করতে, এবং সম্পূর্ণ করতে তাঁর নিয়ামত তোমাদের উপর। যেন তোমরা শোকর / কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।
আলোচনা: এ বিষয়ে প্রথম কথা হচ্ছে, যারা সালাতে নিজে কী বলছে সেটার জ্ঞান রাখবে না তারা সালাতের ধারে কাছেও যেতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। অনেকে বলেন যে, এটি শুধু মদপানকারীদের জন্য কিন্তু প্রকৃত কথা হচ্ছে একজন মদ্যপ ব্যক্তির জন্য যদি এ শর্ত প্রযোজ্য হয় তাহলে একজন স্বাভাবিক মানুষের জন্য তা আরো বেশি প্রযোজ্য। অন্য কথায়, সালাতের বিধান পরিপালনের পূর্বশর্ত হিসাবে সালাতে যা বলা হবে তা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হবে।
সালাতের পূর্বে যে বিশেষ পরিচ্ছন্নতার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাতে ধারাবাহিক চারটি কাজ হলো (১) মুখমণ্ডল ধৌত করা, (২) হাতসমূহ কনুই পর্যন্ত ধৌত করা (৩) মাথা মাসেহ করা (৪) পাসমূহ টাখনু পর্যন্ত মাসেহ করা। এ চারটি কাজকে একত্রে ‘ওজু’ শব্দে নামকরণ করে আরবি ভাষায় একটি শব্দ তৈরি করা হয়েছে। এ আলোচনার পরবর্তী অংশে ‘ওজু’ শব্দ দ্বারা এ চারটি কাজকে বুঝানো হবে।
৪:৪৩ ও ৫:৬ আয়াত অধ্যয়নের ভিত্তিতে আামাদের উপলব্ধিকৃত তথ্যসমূহ
(এক): ৫:৬ আয়াতের প্রথমাংশে ওজুর নির্দেশনা রয়েছে। তারপর বলা হয়েছে যে, কেউ যদি অপরিচ্ছন্ন হয় তাকে পবিত্র হতে হবে। তারপর কয়েকটি বিশেষ অবস্থায় পানি না পেলে তায়াম্মুমের বিধান দেয়া হয়েছে। সুতরাং বক্তব্য বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিত অনুসারে অপরিচ্ছন্নতা থেকে পরিচ্ছন্ন হওয়া ব্যক্তি বা সাধারণভাবে পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি ওজুর জন্য পানি পেলে সালাতের জন্য আয়াতের প্রথমাংশে উল্লেখিত ওজুর শর্ত পূরণ করতে হবে। আর পানি না পেলে আয়াতের শেষাংশে উল্লেখিত তায়াম্মুমের বিধান পালন করতে হবে। ৪:৪৩ আয়াতে অপরিচ্ছন্ন হলে তা থেকে নিজেদেরকে ধৌত করার পূর্বে সালাতের কাছে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। তারপর কয়েকটি বিশেষ অবস্থায় পানি না পেলে তায়াম্মুমের বিধান দেয়া হয়েছে। সুতরাং যদি অপরিচ্ছন্নতা ধৌত করার ক্ষেত্রে সমগ্র শরীর ধৌত করা হয় তাহলে তাতে ওজুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও ধৌত করার আওতায় এসে যায় বিধায় সালাত করা যাবে। আর যদি শরীরের কোনো নির্দিষ্ট স্থানে অপরিচ্ছন্নতা থাকার বিষয়টি নিশ্চিতভাবে জানা থাকে এবং তাই শুধু ঐ স্থানটুকু ধৌত করা হয়, যার ফলে ওজুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধৌত করার আওতায় না আসে, তাহলে সালাতের আগে ওজু করতে হবে (৫:৬ আয়াত অনুসারে)। সুতরাং তায়াম্মুম হচ্ছে ওজুর বিকল্প। যদিও ৪:৪৩ আয়াতে ওজুর বিষয়টি উল্লেখ নেই, কিন্তু তাতে কয়েকটি বিশেষ অবস্থায় পানি না পেলে তায়াম্মুমের বিধান উল্লেখিত হয়েছে। অন্যদিকে যদি পানি পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে ওজু করার বিধানটি প্রযোজ্য হবে ৫:৬ আয়াত অনুসারে।
(দুই): ৫:৬ আয়াতে জুনুব বা অপরিচ্ছন্ন অবস্থা থেকে পরিচ্ছন্ন হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে ‘ফাত্তহহারূ’ (তোমরা নিজেদেরকে পরিচ্ছন্ন করো, তোমরা নিজেদের অপরিচ্ছন্নতা দূর করো)। আর ৪:৪৩ আয়াতে জুনুব বা অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় সালাতের কাছেও যেতে নিষেধ করা হয়েছে ‘হাত্তা তাগতাছিলূ’ (যতক্ষণ না তোমরা নিজেদেরকে ভালভাবে ধৌত করবে)। অনেকে ‘তাগতাছিলূ’ ক্রিয়ার ব্যবহারের কারণে ‘সম্পূর্ণ শরীর ধৌত করা’ বাধ্যতামূলক দাবি করেন। যদিও সম্পূর্ণ শরীর ধৌত করাও ‘তাগতাছিলূ’’ ক্রিয়ার আওতাভুক্ত সর্বোচ্চ রূপ, কিন্তু সেটাই ‘তাগতাছিলূ’’ ক্রিয়ার একমাত্র রূপ নয়। ৪:৪৩ আয়াতে উল্লেখিত ‘তাছতাছিলূ’’ হলো ক্রিয়ারূপ-৮ এবং ৫:৬ আয়াতে উল্লেখিত ‘ফাগছিলূ’’ হলো ক্রিয়ারূপ-১। ক্রিয়ারূপ-১ এর ‘ফাগছিলূ’’ শব্দটি ‘‘ধৌত করা’’ বুঝায় এবং ক্রিয়ারূপ-৮ এর ‘তাগতাছিলূ’’ শব্দটি ‘‘নিজেকে ভালভাবে ধৌত করা’’ বুঝায়। যদি অপরিচ্ছন্নতা সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে যায় এবং তা চিহ্নিত করা কঠিন হয়, তাহলে সমগ্র শরীর ধৌত করাই হলো নিজেকে ভালভাবে ধৌত করে পরিচ্ছন্ন করা। আর যদি অপরিচ্ছন্নতা শরীরের কোনো নির্দিষ্ট স্থানে থাকে, তাহলে ঐ স্থানকে ভালভাবে ধৌত করাই নিজেকে ভালভাবে ধৌত করার জন্য যথেষ্ট। ৫:৬ ও ৪:৪৩ এর সমন্বিত বক্তব্য অনুসারে, ‘তাগতাছিলূ’ = ‘ফাত্তাহিরূ’। অর্থাৎ নিজেকে ভালভাবে ধৌত করার ব্যাখ্যা হলো নিজেকে পরিচ্ছন্ন করা। এখানে সর্বাবস্থায় সম্পূর্ণ শরীর ধৌত করাকে বাধ্যতামূলক সাব্যস্ত করার অবকাশ নেই, কারণ কুরআনে এরূপ শর্ত দেয়া হয়নি।
(তিন): সালাতের জন্য (ওজু / তায়াম্মুমের আগে) জুনুব / অপরিচ্ছন্নতা থেকে পবিত্র হতে হবে। পবিত্র হওয়ার মূল উপায় হলো গোসল / ধৌতকরণ। আবীরে সাবীল অবস্থায় (যেমন, বাসে, ট্রেনে বা বিমানে আছে বা কোনো পথের পথিমধ্যে আছে এ অবস্থায় যদি সালাতের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার দিকে থাকে তাহলে) ধৌতকরণ শর্ত নয়, অন্যভাবে পবিত্র হলেই চলবে।
(চার):অপরিচ্ছন্নতা থেকে সাধারণভাবে পরিচ্ছন্ন হওয়া বা সাধারণভাবে পরিচ্ছন্ন অবস্থায় থাকা ব্যক্তিকে সালাতের আগে বিশেষ পরিচ্ছন্নতার শর্তমূলক ওজু করতে হবে। একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে এ নিয়ম বা রীতির প্রবর্তন করা হয়েছে এবং একবার নিয়মটি প্রবর্তনের পর প্রত্যেক সালাত সম্পাদনকারী তা পালন করতে বাধ্য। বাহ্যত এটিকে একটি অতিরিক্ত ও কষ্টদায়ক বিষয় মনে হলেও এর উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়েছে, “আল্লাহ এরাদা / ইচ্ছা করেন না তোমাদের উপর কোনো সংকীর্ণতা রাখতে। কিন্তু তিনি এরাদা / ইচ্ছা করেন তোমাদেরকে পবিত্র করতে, এবং সম্পূর্ণ করতে তাঁর নিয়ামাত তোমাদের উপর, যেন তোমরা শোকর / কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো” (৫:৬)। অর্থাৎ আমাদেরকে পবিত্র করার জন্য এবং আমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামত সম্পূর্ণ করার জন্য এটি প্রয়োজন ছিল বিধায় এইরূপ বিধান দেয়া হয়েছে।
(পাঁচ): সালাত সম্পাদনের পূর্বে অপরিচ্ছন্ন ব্যক্তিকে সাধারণভাবে পরিচ্ছন্ন হতে হবে। আর যদি কোনো অসুস্থ ব্যক্তি পানি না পায় বা বা পানি ব্যবহার তার জন্য ক্ষতিকর হয় তাহলে সে তায়াম্মুম করবে। এবং সফররত অবস্থায়, পায়খানা-পেশাব করে আসার পর অথবা স্ত্রীকে স্পর্শ করার পর, এ তিন অবস্থায় যে ব্যক্তি পানি পায় না, তাকে তায়াম্মুম করতে হবে। অন্যদিকে যদি পানি ব্যবহার ক্ষতিকর না হয় বা পানি পাওয়া যায়, তাহলে ওজু করার নির্দেশনা রয়েছে।
এই নির্দেশনা থেকে পরোক্ষভাবে এটাও জানা যায় যে, সালাতের উদ্দেশ্যে ওজু করার পর সালাত করার আগে যদি কেউ কোনোভাবে অপরিচ্ছন্ন হয়, তাহলে পরিচ্ছন্ন হওয়ার পর এবং সালাত করার আগে তাকে আবার ওজু করতে হবে।
তবে সমগ্র শরীর ধৌত করলে (পরিপূর্ণরূপে গোসল করলে), যাতে ওজুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পূর্ণরূপে ধোয়া হয়, তারপর পায়খানা-প্রস্রাব না করলে, স্ত্রীকে স্পর্শ না করলে বা কোনোভাবে অপরিচ্ছন্ন না হলে সালাত সম্পাদনের জন্য স্বতন্ত্রভাবে ওজু করা জরুরি নয়। কারণ, অপরিচ্ছন্ন হলে গোসলের পূর্বে সালাতের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করা হয়েছে। যার পরোক্ষ শিক্ষা হলো, পূর্ণরূপ গোসল করলে সালাত সম্পাদনে নিষেধ নেই।
এছাড়া ‘ইযা ক্বুমতুম ইলাস সলাহ’ (যখন তোমরা সালাতের দিকে দাঁড়াও) এর মধ্যে ঘুম থেকে জেগেই সালাত করার দিকে অগ্রসর হতে হলে সেক্ষেত্রেও ওজুর করার নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তাই কেউ যদি ওজু করার পর সালাত করার আগে ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে তাকে ঘুম থেকে জাগার পর সালাত করার আগে আবার ওজু করতে হবে।
(ছয়): যারা পানি পাওয়া না গেলে তায়াম্মুম করতে হবে তারা পবিত্র উচ্চভূমি না পেলে তথা তায়াম্মুম করতে না পারলে তাদের জন্য ঐ অবস্থায় সালাত বাধ্যতামূলক নয়।
(সাত): যেহেতু সালাত করার উদ্দেশ্যে উদ্যোগী হলে বা প্রস্তুতি পর্বে ওজু করার বিধান দেয়া হয়েছে, তাই প্রতি ওয়াক্তের সালাতের জন্য স্বতন্ত্রভাবে এ নির্দেশ কার্যকর করতে হবে। অর্থাৎ সালাতের পূর্বে ওজু করার নির্দেশ প্রতি ওয়াক্তের সালাতের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে পরিপালন করতে হবে।
(আট): ওজুতে ধৌত করা ও মাসেহ করার জন্য চারটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। ধৌত করতে হবে মুখমণ্ডল এবং কনুই পর্যন্ত হাতসমূহ, আর মাসেহ করতে হবে মাথা এবং টাখনু পর্যন্ত পাসমূহ। সাধারণত পায়ে ধুলাবালি বেশি লাগে বিধায় পা ধোয়াটাকে বেশি স্বাভাবিক মনে করা হয়। কিন্তু কুরআনে তা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। বরং যদি পায়ে কোনো বিশেষ অপরিচ্ছন্নতা লাগে, তাহলে ওজু করার আগে তা আলাদাভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
টাখনু পর্যন্ত পা মাসেহ করতে হবে নাকি ধৌত করতে হবে এ বিষয়ে একটি উপলব্ধি হলো, যেহেতু পাসমূহ বুঝাতে ব্যবহৃত ‘আরজুলাকুম’ শব্দটিতে ‘লাম’ এর উপর ‘যবর’ রয়েছে, তাই পা ধৌত করতে হবে। কারণ এর দ্বারা বুঝায় যে, এর উপর ‘মুখমণ্ডল এবং কনুই পর্যন্ত হাতসমূহ’ এর ক্ষেত্রে যে ‘ফাগছিলূ’ (তোমরা ধৌত করো) ক্রিয়াটি কার্যকর হয়েছে সেই একই ক্রিয়া কার্যকর হবে। অন্যদিকে, যদি এর উপর ‘ফামছাহূ’ ক্রিয়াটির কার্যকারিতা সাব্যস্ত হতো তাহলে এতে ‘আরজুলাকুম’ এর পরিবর্তে ‘আরজুলিকুম’ শব্দ ব্যবহৃত হতো, অর্থাৎ ‘লামের উপর যবর না হয়ে, লামের নিচে যের ব্যবহৃত হতো’। এক্ষেত্রে ‘পা ধৌত করার কথা মুখমণ্ডল ও হাত ধৌত করার পরে উল্লেখ না করে, মাথা মাসেহ করার পরে উল্লেখ করা হলো কেন?’ প্রশ্নটির জবাব হলো, কোন অঙ্গের পরে কোনো অঙ্গ ধৌত বা মাসেহ করতে হবে সেটার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য এরূপ করা হতে পারে।
কিন্তু এ যুক্তির ভিত্তিতে পা ধৌত করাকে বাধ্যতামূলক সাব্যস্ত করা যেতে পারে না। কারণ, ‘আরজুলাকুম’ এর পরিবর্তে ‘আরজুলিকুম’ ব্যবহৃত হলে ‘ইলাল কা’বায়নি’ বলা রীতিসিদ্ধ হতো না। যেমন, ‘মাসেহ’ করার প্রসঙ্গ কুরআনে চারবার ব্যবহৃত হয়েছে। যথা: ৪:৪৩:৪১, ৫:৬:১৩, ৫:৬:৪৩, ৩৮:৩৩:৪। মাসেহ শব্দ ব্যবহারের পরে ব্যবহৃত বিশেষ্যের শেষ বর্ণে যত স্থানে ‘যের’ ব্যবহৃত হয়েছে তার প্রতিটিতে মাসেহ করার অঙ্গটির সীমা অনির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। কিন্তু ৫:৬ আয়াতে মাথা মাসেহ এবং পাসমূহ মাসেহ করা প্রসঙ্গে পায়ের কতটুকু মাসেহ করতে হবে তা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং যখন কতটুকু অংশ মাসেহ করতে হবে তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয় তখন বিশেষ্যের শেষ বর্ণে ‘যবর’ হয়, ‘যের’ নয়। প্রমাণস্বরূপ দেখা যেতে পারে যে, ৫:৬ আয়াতে হাত ধৌত করার ক্ষেত্রে কতটুকু পরিমাণ ধৌত করতে হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে ‘ইলাল মারাফিক্বি’ এবং এক্ষেত্রে হাতসমূহ বুঝাতে ‘আইদিয়া’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যার শেষ বর্ণে ‘যবর’ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু ৪:৪৩ ও ৫:৬ আয়াতে ‘তায়াম্মুম’ এর ক্ষেত্রে হাতসমূহকে মাসেহ করার’ নির্দেশনাতে হাতের কতটুকু মাসেহ করতে হবে তা অনুল্লেখিত রয়েছে এবং হাতসমূহ বুঝাতে ‘আয়দীকুম’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, অর্থাৎ ‘আয়দিয়া’ এর পরিবর্তে ‘আয়দী’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং যখন ‘মাসেহ’ এর পরে ব্যবহৃত বিশেষ্যের শেষ বর্ণে ‘যবর’ ব্যবহৃত হয়, তখন যে অঙ্গে মাসেহ করতে হবে সেটার কতটুকু মাসেহ করতে হবে তা উল্লেখ থাকে, কিন্তু যখন ‘যের’ ব্যবহৃত হয় তখন কতটুকু মাসেহ করতে হবে তা অনুল্লেখিত থাকে।
‘পা মাসেহ করতে হবে’ বিষয়টি এ থেকেও বুঝা যায় যে, ওজুতে যে চারটি অঙ্গ ধোয়া বা মাসেহ করতে বলা হয়েছে তার মধ্য থেকে ‘ফাগছিলূ’ শব্দের পরে উল্লেখ থাকা অঙ্গ দুটিকে (মুখমণ্ডল ও হাতসমূহ) তায়াম্মুমের ক্ষেত্রে মাসেহ করতে হবে। কিন্তু ‘ওয়ামছাহূ’ এর পরে উল্লেখ থাকা অঙ্গ দুটিকে (মাথা ও পাসমূহ) তায়াম্মুমের ক্ষেত্রে বাদ রাখা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, ‘ওয়ামছাহূ’ এর পরে উল্লেখ থাকা অঙ্গ দুটি (মাথা ও পাসমূহ) এর উপর ‘ওয়ামছাহূ’ ক্রিয়া কার্যকর হবে তথা মাথা ও পা উভয়টি মাসেহ করতে হবে।
৬. মহিলাদের মাসিক রজ:স্রাব (হায়েজ) এর সময় সালাতের আবশ্যকতা থাকা না থাকা
জিজ্ঞাসা: মহিলাদের মাসিক রজ:স্রাব (হায়েজ) এর সময় সালাতের আবশ্যকতা আছে নাকি নেই?
জবাব: ৫:৬ আয়াতে জুনুব অবস্থায় সালাত সম্পাদন না করে সালাতের পূর্বশর্ত হিসেবে ত্বহারাত বা পবিত্র হতে বলা হয়েছে। ২:২২২ আয়াতে নারীদের মাসিক রজ:স্রাব (হায়েজ) সম্পর্কে প্রথম তথ্য জানানো হয়েছে যে, তা হলো কষ্ট। তারপর ঐ অবস্থায় তাদের সাথে সহবাসে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সবশেষে জানানো হয়েছে যে, যখন তারা ত্বহারাত বা পবিত্রতার পর্যায়ে আসবে তখন তাদের সাথে আবার আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী স্বাভাবিক দাম্পত্য ঘনিষ্ঠতায় ফিরে আসতে হবে। সুতরাং শেষদিকে উল্লেখকৃত তথ্য অনুসারে যতক্ষণ তারা হায়েজ অবস্থায় থাকে ততক্ষণ তারা শারীরিকভাবে অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। এবং বিবেক-বুদ্ধিও তাই বলে। মানবদেহের নাভি থেকে উপরের অংশকে ঊর্ধ্বাঙ্গ এবং নাভি থেকে নিচের অংশকে নিম্নাঙ্গ বলা হয়। ঊর্ধ্বাঙ্গের সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে মাথা এবং নিম্নাঙ্গের সর্বনিম্ন অবস্থানে আছে পায়ের পাতা। ঊর্ধ্বাঙ্গে থাকা চোখ, কান, নাক থেকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যা বের হয় তা একজন ব্যক্তিকে শারীরিকভাবে অপবিত্র করে না। কিন্তু নিম্নাঙ্গে থাকা ছিদ্রপথ দিয়ে যা বের হয় (পায়খানা, প্রস্রাব ও রজ:স্রাব) তা একজন ব্যক্তিকে শারীরিকভাবে অপবিত্র করে। শারীরিকভাবে অপবিত্র থাকা অবস্থায় আল্লাহর যিকির, তাসবীহ, হামদ, আল্লাহর কাছে দুআ এবং কুরআন তিলাওয়াত নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু শারীরিকভাবে অপবিত্র থাকা অবস্থায় আনুষ্ঠানিক সালাত করা যাবে না। সুতরাং নারীরা তাদের মাসিক রজ:স্রাব অবস্থায় সালাত করার অবকাশ নেই। এবং তাদেরকে পরবর্তীতেও এ সালাত করতে হবে না। কারণ এরূপ কোনো নির্দেশনা নেই যে, পূর্বের অনাদায়ী সালাত পরে আদায় করতে হয়। তবে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, রজ:স্রাব অবস্থায় সিয়াম পালন থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়নি।
৭. সালাতের জন্য পবিত্রতার পূর্বশর্ত ও আদব কায়দা
জিজ্ঞাসা: আনুষ্ঠানিক সালাতের পূর্বশর্ত হিসেবে যে আহকাম আরকানের কথা প্রচলিত রয়েছে সে বিষয়ে কোনো আয়াতের দলীল রয়েছে কিনা এবং সালাতের আদব কায়দা সম্পর্কে কুরআনে কী রয়েছে?
জবাব: আনুষ্ঠানিক সালাতের পূর্বশর্ত হিসেবে ৪:৪৩ ও ৫:৬ আয়াতে ওজু-গোসল ও তায়াম্মুমের বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে। আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, এর মাধ্যমে উদ্দেশ্য হলো পবিত্রতার ব্যবস্থা করা। শারীরিক পবিত্রতার পাশাপাশি পোশাকও পবিত্র রাখতে হবে (৭৪:৪)। প্রত্যেক মাসজিদের অনুকূলে পোশাকের সৌন্দর্য তথা সাধ্যমতো সুন্দর তথা পরিচ্ছন্ন পরিপাটি পোশাক গ্রহণ করতে বলা হয়েছে (৭:৩১)। পোশাকের উদ্দেশ্য হলো ছাওয়াত/ লজ্জাস্থান ঢাকা (সতর), শারীরিক শোভাবর্ধন ও আবহাওয়া উপযোগী স্বাচ্ছন্দ্য ও সুরক্ষা (৭:২৬, ১৬:৮১, ২৪:৩০-৩১)। তাছাড়া যেখানে সালাত সম্পাদন করা হবে সেই স্থানও পবিত্র রাখতে হবে (২:১২৫, ২২:২৬)। ২০:১২ আয়াতের শিক্ষা অনুসারে জুতা পায়ে পবিত্র স্থানে যাওয়া যাবে না। সুতরাং জুতা পরে সালাত করা যাবে না, এটি সালাতের অন্যতম আদব। সালাতের আরো আদব হলো, বিনয়ের সাথে দাঁড়ানো (২:২৩৮) এবং সালাতের মধ্যে সবসময় আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার অনুভূতিতে নম্রতা বজায় রাখা (২৩:২, ২:৪৫-৪৬)।
৮. যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে সালাত করতে সক্ষম নয়
জিজ্ঞাসা: যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে সালাত করতে সক্ষম নয় সে কিভাবে সালাত করবে? বিশেষ করে তার উপর সালাত বাধ্যতামূলক কিনা?
জবাব: যারা দাঁড়িয়ে সালাত করতে সক্ষম নয়, তাদের প্রতি সালাত প্রতিষ্ঠা করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। ২:২৩৯ আয়াতে ভীতি-বিহবল নাজুক অবস্থায় পদচারী বা আরোহী হতে (তথা হিজরত করতে বা হিজরতের সময় পদচারী বা আরোহী থাকা অবস্থায় সাধ্যমতো আল্লাহর যিকর করতে) এবং নিরাপদ থাকা অবস্থায় আল্লাহ যেভাবে শিখিয়েছেন সেই স্বাভাবিক নিয়মে আল্লাহর যিকির করতে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তার একটি দিক হলো, সালাত হেফাযতের জন্য প্রয়োজন সাপেক্ষে পদচারী হয়ে বা আরোহী হয়ে সালাত সম্পাদন করতে হবে। কারণ ৬২:৯ আয়াত অনুযায়ী, সালাত হলো যিকরের একটি রূপ। এ নির্দেশনা অনুসারে বলা যায় যে, যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে সালাত করতে সক্ষম নয়, সে বসে বা শুয়ে যেভাবে সক্ষম হবে সেভাবে সালাত করবে, এটা বাধ্যতামূলক না হলেও উত্তম বলে সাব্যস্ত হয়। এছাড়া ৩:১৯১ আয়াতে দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে আল্লাহর যিকরের কথা রয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় সালাত নামক সুনির্দিষ্ট কাঠামোসম্পন্ন যিকর দাঁড়িয়েই করতে হবে। কিন্তু ওজর অবস্থায় এ যিকরটিও বসে বা শুয়ে করার অবকাশ রয়েছে।
৯. রাফে ইয়াদাইন ও হাত বাঁধা
জিজ্ঞাসা: তাকবীর দেয়ার সময় এবং দুআতে রাফে ইয়াদাইন বা দুই হাত তোলা যাবে কিনা?
জবাব: মানুষ যখন কাউকে কাছে আসতে বলে তখন ‘এদিকে আসুন’ বলতে পারে, অথবা হাতের ইশারা দিতে পারে অথবা উভয়টি একসাথে করতে পারে। অনুরূপভাবে যখন যেতে বলে তখন ‘এখন যান’ বলতে পারে, অথবা হাতের ইশারা দিতে পারে অথবা উভয়টি করতে পারে। এই যে ‘সাউন্ড’ এন্ড ‘সিগনাল’ এটা মানুষের মধ্যে আল্লাহ কর্তৃক সেটকৃত একটি স্বাভাবিক চর্চা। এর উভয়টির উপকারী দিক রয়েছে। যেমন, অন্য মানুষ শুনার ক্ষেত্রে সাউন্ড এবং দেখার মাধ্যমে বুঝার ক্ষেত্রে ‘সিগনাল’ কাজে আসে। এবং উভয়টি ব্যবহার মানে ‘মাল্টিমিডিয়া’ ব্যবহার করা। মানুষ নিজে এককভাবেও তার ভাবকে প্রকাশ করার জন্য অনেক সময় মনের অজান্তেও সাউন্ডের পাশাপাশি সিগনাল ব্যবহার করে, যখন শ্রোতাকে বা দর্শককে ইচ্ছাকৃতভাবে ঐ সিগনাল দ্বারা বুঝানো তার উদ্দেশ্য হয় না। কোন কিছুকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে ‘সাউন্ড ও সিগনাল’ উভয়টির ব্যবহার একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনার ক্ষেত্রে সবসময় হাত তোলার কোন ঘটনা ঘটে না। অনুরূপভাবে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে গিয়েও হাত তোলার ঘটনা ঘটে না। কিন্তু সালাতে আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে গিয়ে ‘রাফে ইয়াদাইনের’ প্রচলন দেখা যায়। এটিকে একটি আনুষ্ঠানিক অভিব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করলে অগ্রহণযোগ্য বলা যায় না, যদিও এটিকে বাধ্যতামূলকও বলার কোন সুযোগ নেই।
সালাতে বুকে নাকি নাভিতে হাত বাঁধতে হবে নাকি ছেড়ে দিতে হবে এ নিয়েও বিভিন্ন ধরনের মতবাদ দেখা যায়। অথচ প্রকৃত তথ্য হলো, কুরআনে এ বিষয়টিকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। কারণ এটি নির্দিষ্ট করে দেয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তাই নেই। একই সারিতে দাঁড়িয়ে কেউ যদি হাত বুকে বাঁধে, কেউ যদি নাভিতে বাঁধে এবং কেউ যদি ছেড়ে দেয়, তবে তাতে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক জিদ ও বাড়াবাড়ির মনোভাব না থাকলে বিষয়টিকে মোটেই সমস্যা বা বিশৃঙ্খলা বলা যেতে পারে না। এবং ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে এরূপ ভদ্র অনুশীলন চালুও হয়েছে যাতে কেউ বুকে হাত বাঁধে, কেউ নাভিতে হাত বাঁধে ও কেউ ছেড়ে দেয়, অথচ তাদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো মারামারি নেই। আল্লাহ যা নির্দিষ্ট করে দেননি, সেখানে যার কাছে যেটি ভালো মনে হয় তা অন্যদের উপরে চাপিয়ে দেয়ার মনোবৃত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআনে বলা হয়েছে, “আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীত হয়ে দাঁড়াও”। এখন যে ব্যক্তি হাত বুকে বাঁধলে তার বিনয়ের জন্য অধিক উপযোগী হিসেবে বুঝতে পারে, সে সেভাবে বাঁধবে, যে ব্যক্তি নাভিতে বাঁধলে তার অধিক বিনয় প্রকাশ পায় বলে অনুভব করে সে সেভাবে বাঁধবে, এবং যে ব্যক্তি দুইদিকে হাত ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিকভাবে মাথানত করে দাঁড়ানোকেই বিনয় প্রকাশের জন্য সবচেয়ে উত্তম বিবেচনা করে সে সেভাবে দাঁড়াবে।
১০. আয়াত তিলাওয়াতের পর সাজদাহ
জিজ্ঞাসা: প্রচলিত মতে কুরআনে ১৪টি বা ১৫টি এমন আয়াত আছে যেগুলো তিলাওয়াত করলে বা যেগুলোর তিলাওয়াত শুনলে সাজদাহ করতে হয়। এগুলো সালাতের বাহিরে তিলাওয়াত করলে যেমন সাজদাহ করতে হয়, সালাতের মধ্যে তিলাওয়াত করলেও তেমনি সরাসরি সাজদাহয় চলে যেতে হয়, পরবর্তী আয়াত পড়ার আগেই এবং রুকূ' করা ছাড়াই। এ আয়াতগুলোর কোনোটি তিলাওয়াত করলে একটি সাজদাহ করে আবার দাঁড়িয়ে পরবর্তী আয়াত থেকে পড়ে গিয়ে সাধারণ নিয়মে এক রাকায়াতে একটি রুকূ' ও দুইটি সাজদাহ করা হয়। প্রশ্ন হলো, প্রচিলত এ অভিমত বা রীতিটি কি সঠিক? অর্থাৎ এ ১৪টি বা ১৫টি আয়াতকে তিলাওয়াতের জন্য সুনির্দিষ্ট করা এবং এগুলোর কোনোটি তিলাওয়াতের পর এ নিয়মে সাজদাহ করার বিষয়টি যথাযথ বা গ্রহণযোগ্য কিনা?
জবাব: কুরআন পাঠের পরে সাজদাহ করার বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখিত হয়েছে সূরা ইনশিকাক ৮৪:২১ আয়াতে। আয়াতটির অনুবাদ নিম্নরূপ:
৮৪:২১ :: (তাদের কি হয়েছে যে,) যখন তাদের সামনে কুরআন পাঠ করা হয় তখন তারা সাজদাহ করে না?
এখান থেকে বুঝা যায় যে, কুরআনের যে অংশই তিলাওয়াত করা হোক, তিলাওয়াতের পরবর্তী কাজ হলো সাজদাহ করা। সুতরাং আনুষ্ঠানিক সাজদাহর ক্ষেত্রেও এটি এভাবেই বাস্তবায়ন করা উচিত। তিলাওয়াতের পর সাজদাহর জন্য কুরআনের কয়েকটি আয়াতকে যেমন ১৪টি বা ১৫টি আয়াতকে নির্দিষ্ট করে দেয়া এ আয়াতটি (৮৪:২১) অনুযায়ী কুরআনসিদ্ধ নয় বলে প্রতীয়মান হয়। আয়াত তিলাওয়াতের পর সাজদাহ সম্পর্কিত আরো আয়াত হলো:
৩২:১৫ :: আমার আয়াতসমূহের উপর তারাই ঈমান (বিশ্বাস) রাখে যাদেরকে তা দ্বারা উপদেশ প্রদান করলে তখন তারা সাজদাহয় ঝুঁকে পড়ে এবং তাদের প্রভুর প্রশংসাসহ পবিত্রতা জ্ঞাপন করে এবং তারা কোনো বড়াই করে না।
৩:১১৩ :: সকলে সমান নয়। আহলে কিতাবের মধ্যে একটি দল আছে যারা সত্যের উপর সুপ্রতিষ্টিত। তারা রাতের বেলায় আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত করে এবং সাজদাহ করে।
উপর্যুক্ত আয়াতসমূহ থেকে জানা যায়, আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াতের পরবর্তী কাজ হলো সাজদাহ। সুতরাং আনুষ্ঠানিক সালাতেও আয়াত তিলাওয়াতের পর আনুষ্ঠানিক সাজদাহ করা উচিত। তবে এর মানে এ নয় যে, আয়াত তিলাওয়াত ছাড়া সাজদাহ করা যাবে না। ক্বিয়াম অবস্থায় আয়াত তিলাওয়াতের নির্দেশনা আছে (৭৩:২০)। আবার সাজদাহ যেমন সালাতের অংশ তেমনি এটি শুধু সালাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ বিষয় নয়, বরং এটির একটি স্বতন্ত্র অবস্থানও রয়েছে। তাই আনুষ্ঠানিক সাজদাহর ক্ষেত্রেও তা সালাতের বাহিরেও করা যেতে পারে।
আয়াত তিলাওয়াতের পরে যার তিলাওয়াত শুনবে তাদের মতো যিনি তিলাওয়াত করবেন তাঁকে সাজদাহ করতে হবে। কারণ ১৫:৯৮ আয়াতে সাজদাহকারীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এখন একটি প্রশ্ন হলো, আয়াত তিলাওয়াতের বা শুনার পর আনুষ্ঠানিক সাজদাহ বাধ্যতামূলক কিনা? এবং অন্য একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, আয়াত তিলাওয়াতের বা শুনার পর যে সাজদাহ কর্তব্য তা কি আনুষ্ঠানিক সাজদাহ, নাকি এক্ষেত্রে সাজদাহ এর অর্থ হচ্ছে ‘আয়াতের নির্দেশনা মেনে চলার মনোভাবে প্রণত হওয়া’।
এর জবাবে বলা যেতে পারে যে, অবশ্যই মানসিকভাবে সাজদাহ করাটাই মূল বিষয়। কিন্তু সেই সাথে আনুষ্ঠানিক সাজদাহ বাধ্যতামূলক না হলেও সেটিও অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।
যেমন, ফেরাউনের দরবারে রসূলুল্লাহর মূসার সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়ার পর ঈমান এনে যাদুকরগণ যে সাজদাহ করেছে সেটি আনুষ্ঠানিক সাজদাহ এর সাথেই সঙ্গতিশীল বলে বুঝা যায়।
সালাতের আয়াত তিলাওয়াতের পরে সাজদাহ সম্পাদনের ক্ষেত্রে যেমন তিলাওয়াতের পরে সরাসরি সাজদাহ করা যেতে পারে, তেমনি রুকূ' করে তারপরও সাজদাহ করা যেতে পারে।
১১. সালাতে স্বরের মাত্রা
জিজ্ঞাসা: প্রচলিত সালাতে দেখা যায় যে, কোনো ওয়াক্তে উচ্চস্বরে এবং কোনো ওয়াক্তে নিম্নস্বরে সালাত সম্পাদন করা হয়। সালাতের স্বরের এ বিভিন্নতা গ্রহণযোগ্য কিনা?
জবাব: সালাতে স্বরের মাত্রার বিষয়ে কুরআনে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে যে, সালাত সম্পন্ন করতে হবে মধ্যম স্বরে। এ বিষয়ে কুরআনের নির্দেশটি নিম্নরূপ:
‘তোমার সালাতে স্বর বেশি উঁচুও করো না আবার বেশি নিচুও করো না, বরং এ দুয়ের মধ্যবর্তী মাত্রা অবলম্বন করো (তথা মধ্যম স্বরে সালাত সম্পন্ন কর)’। (সূরা বানী ইসরাইল ১৭:১১০)
অথচ আমরা যদি কোন ওয়াক্তে সালাত জোরে আওয়াজ করে পড়ি, কোন ওয়াক্তে নিচু আওয়াজে পড়ি, অথবা কোন রাকায়াত জোরে আওয়াজ করে পড়ি এবং কোন রাকায়াত নিচু আওয়াজে পড়ি তাহলে তা কি কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ লংঘন নয়? প্রকৃত পক্ষে সালাতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই মধ্যম মাত্রার স্বরে পড়তে হবে।
তবে স্বরের মধ্যম মাত্রা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হবে, আবার ব্যক্তি একাকী সালাত করা এবং অন্যদের নেতৃত্বমূলক অবস্থানে থেকে (জামায়াতে সালাতের ইমাম হিসেবে) সালাত করার ক্ষেত্রে ভিন্ন হবে এটা একান্তই স্বাভাবিক। ব্যক্তির স্বাভাবিক বিবেচনায় যা মধ্যম স্বর বলে বিবেচিত, সে অনুসারে তাকে সালাতের স্বর অবলম্বন করতে হবে, এটাই নির্দেশনার মূল তাৎপর্য।
সালাতে মুক্তাদীর স্বরের মাত্রা
সালাতে মুক্তাদী আস্তে বা জোরে সূরা ফাতিহা পড়বে কিনা এও এক বহুল বিতর্কিত বিষয় হিসাবে সমাজে বর্তমান। এ বিষয়ে কুরআনের স্পষ্ট দিকনির্দেশনা হচ্ছে যখন কারো সামনে কুরআন তিলাওয়াত করা হয় তখন তার কর্তব্য হচ্ছে মনোযোগ সহকারে শুনা ও চুপ থাকা। কি নামাজের ভিতরে কি নামাজের বাহিরে সবসময় আল্লাহর এ নির্দেশ পালন করতে হবে।
সুতরাং ইমাম যখন কুরআন তিলাওয়াত করেন তখন মুক্তাদীর কর্তব্য তা মনোযোগ দিয়ে শুনা ও চুপ থাকা, সরবে বা নীরবে নিজেও তিলাওয়াত করা নয়। সুতরাং কেউ এর ব্যতিক্রম করলে সে কুরআনের পরিপন্থী কাজই করলো। এবং কুরআনের এ নির্দেশের কারণে যারা একসাথে বসে প্রত্যেকে উচ্চ আওয়াজে কুরআন খতম বা কুরআন খানি করছে, তারা স্পষ্টত কুরআনের বিধানকে লংঘন করছে। এ বিষয়ে কুরআনের আয়াতটি হচ্ছে:
‘যখন (তোমাদের সামনে) কুরআন পাঠ করা হয় তখন তোমরা মনোযোগ দিয়ে শুনো এবং চুপ থাক যাতে তোমাদেরকে রহম (অনুগ্রহদান) করা হয়’। (সূরা আ’রাফ ৭:২০৪)
১২. মাতৃভাষায় সালাত
জিজ্ঞাসা: মাতৃভাষায় সালাত করা যাবে কিনা?
জবাব: আল্লাহ কুরআন নাযিল করেছেন আরবী ভাষায়। এখন কেউ আরবী বা অন্য ভাষায় কুরআনের ভাব প্রকাশ করলে তা কুরআনের ভাবানুবাদ হবে তবে তা কুরআন নয়। অর্থাৎ কুরআন ও কুরআনের অনুবাদ এক কথা নয়। কুরআন পড়া ফরজ এবং কুরআন বুঝে পড়াই ফরজ। তাই যারা আরবী ভাষা পড়েই তার অর্থ বুঝতে পারে না তাদের কর্তব্য হচ্ছে কুরআন পড়ার পাশাপাশি মাতৃভাষায় তার অর্থ পড়া বা শুনা।
এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হলো যে, সালাতেও কুরআন পড়ার পর তার অর্থ পড়ার পদ্ধতি অসঙ্গত নয়। বিশেষত সালাতে কী পড়া হচ্ছে তা বুঝার পূর্ব পর্যন্ত সালাতের ধারে কাছেও যেতে কুরআনে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। তাই সালাতে কী পড়া হচ্ছে তা বুঝার পূর্ব পর্যন্ত সালাত পড়া অবৈধ। এ বিষয়ে আয়াত হচ্ছে:
‘হে মু’মিনগণ, তোমরা যখন আড়ষ্ট মস্তিষ্ক থাক তখন সালাতের ধারে কাছেও যেও না, যতক্ষণ না যা বলো তার জ্ঞান রাখো / বুঝতে পারো’। (সূরা নিসা ৪:৪৩)
কেউ কেউ বলেন, এটি শুধু নেশাগ্রস্তদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু নেশাগ্রস্তরা যদি বুঝার শর্ত থাকে তবে যারা নেশাগ্রস্ত নয় তাদের জন্য এ শর্ত আরো মজবুতভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা। বস্তুত ‘ছুকারা’ বলতে কি বুঝায় তার ব্যাখ্যা পরবর্তী ‘তোমরা যা বলো তা বুঝতে পারো না’ এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। যে কারণেই হোক, কোনো ব্যক্তি যখন মস্তিষ্কের এমন অবস্থায় থাকে যে, সে মনোসংযোগ করতে পারে না, তাকে কিছু বলতে দিলে সে মনের উপর জোর খাটিয়ে বলে কিন্তু নিজে কী বলছে নিজেই তা ভালোভাবে বুঝে উঠে না, এ অবস্থাকে ‘ছুকারা’ বলে। তাই শব্দটির অনুবাদ হিসেবে ‘নেশাগ্রস্ত’ এর চেয়ে ‘আড়ষ্ট মস্তিষ্ক’ শব্দটি অধিক উপযোগী।
সালাতে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজের ভাষায় কথা বলা ও নিজের ভাষায় দুআ করা সালাতের অর্থের সাথে সঙ্গতিশীল একটি বিষয়। আবার ইমাম যদি সালাতে আল কুরআনের আলোকে মুসল্লিদেরকে নির্দেশনা দেন সেটাও সালাতের অর্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি বিষয়।
>> পরবর্তী পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য ক্লিক করুন