১. রাত হচ্ছে ‘মাতলায়িল ফজর’ বা ফজর উদয় পর্যন্ত সময়কাল (৯৭:৫)।
২. দিন সূর্যকে প্রকট করে এবং রাত সূর্যকে আচ্ছন্ন করে (৯১:৩-৪)
৩. রাতকে দিনের মধ্যে এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। (৩:২৭, ২১:২৯, ৩৫:১৩, ৫৭:৬)
৪. রাতকে দিনের উপর জড়িয়ে দেয়া হয় এবং দিনকে রাতের উপর জড়িয়ে দেয়া হয়। (৩৯:৫)
৫. রাত থেকে দিনকে সরানো হয়, তখন সবাই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। (৩৬:৩৭)
৬. রাত দিয়ে দিনকে ঢেকে দেয়া হয়। (৭:৫৪, ১৩:৩)
৭. নবী ইবরাহীম তাঁর উপর রাত আচ্ছন্ন হলে তখনি কাওকাব (সন্ধ্যাতারা / শুকতারা / শুক্রগ্রহ) দেখেছিলেন (৬:৭৬)
৮. শাফাক্ব শুধুমাত্র লাইলের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং তা কোনো না কোনোভাবে লাইল থেকে ভিন্নমাত্রিক তাৎপর্যমণ্ডিত (৮৪:১৬-১৭)। সূর্যোদয়ের পূর্ববর্তী শাফাক্বের সময়গত নাম হচ্ছে ফজর, যা শুরু হয় দিগন্তে সাদা আভা স্পষ্ট হওয়ার মাধ্যমে (২:১৮৭, ৯৭:৫) এবং সূর্যাস্তের পরবর্তী শাফাকের সময়গত নাম হচ্ছে আশিয়্য / আশিয়্যাত তথা ইশার প্রথম দিকের পর্যায়।
৯. ফজর হচ্ছে তরাফায়িন নাহারি বা দিনের দুটি তরাফের মধ্য থেকে একটি তরাফের অন্তর্ভুক্ত। (১১:১১৪, ২৪:৫৮)
১০. ইশার সময়টিকে যুলাফাম মিনাল লাইল হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। (২৪:৫৮, ১১:১১৪)
১১. ইলাল লাইল এবং ইলা গাছাক্বিল লাইল দুটি স্বতন্ত্র বিষয়। (২:১৮৭, ১৭:৭৮)
১২. রাতের বিভিন্ন প্রহরকে ‘আনাআল লাইল’ বলা হয়। (৩:১১৩, ২০:১৩০, ৩৯:৯)
১৩. রাতের কতটুকু সময় কোন কাজ করা হচ্ছে তার সাপেক্ষে তাকে দুই বা তিন ভাগে ভাগ করে সময়দৈর্ঘ্য উল্লেখের উদাহরণ। (৭৩:১-৬, ৭৩:২০)
১৪. রাতের শেষদিকের অংশকে ছাহার ও আছহার বলা হয়। (৫৪:৩৪, ৩৭:১৭, ৫১:১৮)
১৫. রাতের গাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্নতাকে বা সবচেয়ে অন্ধকার অংশকে ‘গাছাক্ব’ বলা হয়। (১৭:৭৮)
১৬. দিনের আলো সম্পূর্ণ অপসারিত হলে বা দিনের যে অংশকে রাত দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় বা তা রাত বলে সাব্যস্ত হয়, সে অংশের পরে রাত গভীর অন্ধকারময় হয়ে যায় (৩৬:৩৭)
উপর্যুক্ত পয়েন্টগুলোর সাপেক্ষে নির্ণিত তথ্য হচ্ছে, ফজর হচ্ছে দিনের সেই অংশ যাতে শাফাক্ব থাকে এবং যাতে রাত দিনে প্রবেশ করেছে এবং ঐ সময়টি দিনের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হয় (রাতের অংশ হিসেবে নয়)। অনুরূপভাবে সন্ধ্যা বা সূর্যাস্তের পরবর্তী আশিয়্য / আশিয়্যাত (ইশার প্রথম দিকের পর্যায়) হচ্ছে রাতের সেই অংশ যাতে শাফাক্ব থাকে এবং যাতে দিন রাতে প্রবেশ করেছে এবং ঐ সময়টি রাতের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হয় (দিনের অংশ হিসেবে নয়)। আশিয়্য/ আশিয়্যাতকে বর্তমানে মাগরিব বলা হয়, অথচ মাগরিব শব্দটি কুরআনে শুধুমাত্র সুর্যাস্তের স্থান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
‘ইলাল লাইল’ বলতে বুঝায় সূর্যাস্তের অব্যবহিত পরবর্তী সময় এবং ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ বলতে বুঝায় সন্ধ্যাকালীন শাফাক্বের পরবর্তী অন্ধকারাচ্ছন্নতার প্রথম পর্যায়। দিনের প্রথম তরাফ (ভাগ) শুরু হয় ফজর থেকে এবং দিনের শেষ তরাফ (ভাগ) শেষ হয় সূর্যাস্তের মাধ্যমে তথা তরাফটি সূর্যাস্তের পূর্বে অবস্থান করে।
খুব সংক্ষেপে দিন হচ্ছে ফজরের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়। এবং রাত হচ্ছে সূর্যাস্তের অব্যবহিত পরবর্তী সময় থেকে ফজর শুরু হওয়া পর্যন্ত। দিন সূর্যকে প্রকট করে কিন্তু সূর্যের আলো যতক্ষণ থাকে তার পুরোটাই দিন, তা নয়। রাত সূর্যকে আচ্ছন্ন করে কিন্তু রাতের প্রথম অংশেও সূর্যের আলো মোটেই থাকতে পারবে না তা নয়। সূর্যাস্ত হলে দিন শেষ কিন্তু দিনের আলো কিছুটা রয়ে যায় রাতের প্রথম অংশে। অনুরূপভাবে ফজর শুরু হলে রাত শেষ কিন্তু রাতের অন্ধকারের কিছুটা রেশ রয়ে যায় দিনের প্রথম অংশে, কারণ তখনো সূর্য উদিত হয়নি। দিনের প্রথম অংশ সূর্যোদয়ের আগে এবং শেষ অংশ সূর্যাস্তের আগে থাকার প্রেক্ষিতে এ দুটি সময়কে সূর্যের উদয়-অস্তের সাথে সম্পর্কিত করে উভয় ক্ষেত্রে ক্বাবলা (আগে) শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে, কোন ক্ষেত্রে বা’দা (পরে) শব্দ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়নি (২০:১৩০, ৫০:৩৯-৪০)। বিশেষ করে ৫০:৩৯-৪০ আয়াতে ‘সূর্যাস্তের আগে’ এবং ‘রাতের কিছু অংশে’ তথ্য দুটি থেকে স্পষ্ট যে, যদি সূর্যাস্তের পরে রাতের অংশ শুরু না হতো, তবে দিনের শেষাংশ হিসেবে সূর্যাস্তের আগে বলার পরিবর্তে সূর্যাস্তের পরের অংশের বিষয়টি গুরুত্ব পেতো।
‘ইলাল লাইল’ মানে ‘ইলাল গুরুব’ নয়। কারণ ‘গুরুব’ হচ্ছে সূর্যাস্তের শুরু থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত মাত্র কয়েক মিনিট সময় এবং এটি লাইল (রাত) নয়, বরং সূর্যাস্তের অব্যবহিত পরেই লাইল (রাত) শুরু হয়। আবার ‘ইলাল লাইল’ এর বদলে ইলাশ শাফাক্ব বলাও সঙ্গত হতো না, কারণ ‘শাফাক্ব’ সূর্যাস্তের পরে যেমন আছে, সূর্যোদয়ের আগেও তেমনি আছে। তাই ইলাল লাইল মানে পরম্পরাগত উপলব্ধি অনুসারে ‘সূর্যাস্তের অব্যবহিত পরের সময়’। যেমন ‘তুলুয়িশ শামসের’ বা সূর্যোদয়ের মাধ্যমে ফজরের সময়সীমা শেষ হয়ে ‘দুহা’ বা পূর্ণ সূর্য দীপ্তিকালের সময়সীমা শুরু হয়, যদিও তা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা না থাকায় স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
ইলাল লাইল এবং ইলা গাছাক্বিল লাইল এর পার্থক্যের প্রেক্ষিতে, দিনের মধ্যে রাতের প্রবেশ এবং রাতের মধ্যে দিনের প্রবেশের প্রেক্ষিতে, মাতলায়িল ফজরের (ফজরের উদয়) মাধ্যমে রাতের সমাপ্তি ঘটে এবং “রাত থেকে দিনকে অপসারিত করার পর রাত সম্পূর্ণ অন্ধকারময় হয়ে যায়" তথ্যের প্রেক্ষিতে এটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, রাতের সূচনা ঘটে সূর্যাস্তের অব্যবহিত পরেই এবং সূর্যাস্ত পরবর্তী শাফাক্বের সময়টিতে দিনের আলো থাকলেও তা দিন হিসেবে নয়, বরং রাত হিসেবেই সাব্যস্ত হবে।
(ক) ১২:৪ অনুসারে, সূর্য ও চাঁদ কাওকাবের (গ্রহের) অন্তর্ভুক্ত নয়। আয়াতটিতে সৌরজগতের কেন্দ্রীয় জ্যোতিষ্ক সূর্য এবং পৃথিবীর উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তারক উপগ্রহ চন্দ্র ছাড়াও ১১টি গ্রহ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে।
(খ) নবী ইবরাহীমের উপর যখনি (লাম্মা) রাত আচ্ছাদিত হলো, তখনি তিনি কোনো বিশেষ উদিত গ্রহকে দেখেছিলেন। আকাশে ৫টি গ্রহকে দেখা যায়। বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি। এজন্য সূর্য (রবি) ও চন্দ্র (সোম) ছাড়াও সৌরজগতের এই ৫টি গ্রহকে বিবেচনায় নিয়ে সপ্তাহের সাত দিনের নামকরণ করা হয়েছিলো। এ গ্রহগুলোর মধ্যে শুক্রগ্রহই হচ্ছে সবচেয়ে উজ্জল গ্রহ। যদিও একমাত্র এ গ্রহটি তার সবচেয়ে উজ্জল অবস্থায় দিনের বেলায়ও কিছুটা দৃশ্যমান হয়, তবুও সাধারণত এটি সন্ধ্যার আকাশে সন্ধ্যাতারা হিসেবে এবং ভোরের আকাশে শুকতারা নামে দৃশ্যমান হয় এবং গ্রহটি মধ্যরাতের আকাশে দৃশ্যমান থাকে না।
(গ) যখন নবী ইবরাহীম একটি বিশেষ গ্রহকে দেখলেন তখন দিন নয়, রাত ছিলো। কিন্তু বিষয় শুধু এতটুকু নয়, বরং তিনি যখন গ্রহটিকে দেখেছেন তা হলো ‘ফালাম্মা আলাইহি জান্নাল লাইল’ (যখনি তার উপর রাত আচ্ছন্ন হলো), এ থেকে বুঝা যায় যে, তিনি গ্রহটিকে রাতের সূচনাকালে দেখেছেন। কারণ ‘লাম্মা’ শব্দটি একটি অবস্থা থেকে অন্য একটি অবস্থান্তরে যাওয়ার প্রথম দিককে বুঝায়।
(ঘ) সাধারণত সন্ধ্যা এবং রাতকে আলাদা শব্দে প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু রাত বললে সাধারণত সন্ধ্যার পরবর্তী সময় বুঝালেও সন্ধ্যা মূলত রাতের প্রথমাংশ। তাই সন্ধ্যাতারা রাতের আকাশের তারা হিসেবে সাব্যস্ত, দিনের আকাশের তারা হিসেবে নয়। অন্য কথায়, সন্ধ্যাকে বিস্তৃত করে বললে শব্দটি ‘সন্ধ্যাদিন’ নয়, বরং ‘সন্ধ্যারাত’ হয়। সুতরাং সন্ধ্যা রাতের অংশ এবং রাতের সূচনাকালে আকাশে সন্ধ্যাতারা দেখা যায়।
যদিও ‘দুহা’ (পূর্ণ সূর্য দীপ্তিকাল) এর সাপেক্ষে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ‘দুহা’ বা ‘দিবাভাগ’ এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় হলো ‘লাইল’ বা ‘রাত’। কিন্তু সূর্যোদয় পূর্ববর্তী ‘শাফাক্ব’ (Twilight) এবং সূর্যাস্ত পরবর্তী ‘শাফাক্ব’ (Twilight) সরাসরি দিন (নাহার) বা রাত (লাইল) নয়, বরং তা হলো দিন-রাতের সংমিশ্রিত অংশ। এই সংমিশ্রিত অংশ থেকে সূর্যোদয় পূর্ববর্তী Twilight তথা ফজরকে দিনের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয় এবং সূর্যাস্ত পরবর্তী Twilight তথা আশিয়্যকে রাতের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। কারণ সূর্যোদয় পূর্ববর্তী Twilight হলো এমন সময় যখন রাত বিদায় নিচ্ছে এবং তাতে দিনের আলো এসে যাওয়ায় তা দিন হিসেবে সাব্যস্ত হয়। তেমনি সূর্যাস্ত পরবর্তী Twilight হলো এমন সময় যখন দিন বিদায় নিচ্ছে এবং তাতে রাতের আগমন ঘটায় তা রাত হিসেবে সাব্যস্ত হয়। এই প্রেক্ষিতে কুরআনে ফজর উদয় পর্যন্ত রাতের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং রাতের সাথে সম্পর্কিত বিধান ফজর উদয় পর্যন্ত কার্যকর হবে, ফজর থেকে দিনের সাথে সম্পর্কিত বিধানের কার্যকারিতা শুরু হবে।
যদি ফজর রাতের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হতো, তাহলে সিয়াম পালনকালেও ফজরে স্ত্রীসঙ্গ বৈধ হতো। কিন্তু বাস্তবতা হলো ফজর থেকে সিয়াম শুরু হয়ে যায়। সুতরাং ফজর দিনের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হবে, রাতের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হবে না (২:১৮৭, ৯৭:৫)।
কেউ কেউ ‘তরাফায়িন নাহারি’ শব্দের অর্থ করেন ‘দিনের দুটি প্রান্ত / প্রান্তভাগ’ এবং এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলেন তা হলো ‘দিন-রাতের দুটি সংমিশ্রিত অংশ’। এ প্রসঙ্গে বলা হয় যে, ‘তরাফায়িন নাহারি’ দ্বারা দিনের কোন দুটি তরাফকে বুঝায় তা স্পষ্ট করার জন্য ‘ওয়া যুলাফাম মিনাল লাইল’ বা ‘রাতের মধ্য থেকে নিকটবর্তী সময়’ ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে ব্যবহৃত অব্যয় ‘ওয়া’ হচ্ছে ব্যাখ্যামূলক ‘ওয়া’। অর্থাৎ সূর্যাস্তের পূর্বের ফজর হচ্ছে দিনের একটি তরাফ যা একই সাথে ‘যুলাফাম মিনাল লাইল’ এবং ‘সূর্যাস্তের পরবর্তী সময়টি যখন শাফাক্ব থাকে তা হচ্ছে দিনের অন্য একটি তরাফ যা একই সাথে ‘যুলাফাম মিনাল লাইল’।
কিন্তু উপরের দাবি বা যুক্তি যথাযথ বলে প্রতীয়মান হয় না। কারণ ‘দিন-রাতের সংমিশ্রিত অংশ’ বুঝালে শব্দটি হতো ‘তরাফায়িন নাহারি ওয়াল লাইলি’। এককভাবে ‘তরাফায়িন নাহারি’ বলায় এ কথা সুস্পষ্ট যে, এই তরাফের সম্পর্ক শুধুমাত্র দিনের সাথে, এর সম্পর্ক কোনোভাবেই রাতের সাথে নয়। এছাড়া ‘যুলাফ’ শব্দটি হচ্ছে ‘যুলফাত’ শব্দের বহুবচন। তাই ‘দিন-রাতের সংমিশ্রিত অংশ’ বুঝালে ‘তরাফায়িন নাহারি’ এর সাথে সঙ্গতি রেখে প্রযোজ্য শব্দ হতো ‘ওয়া যুলফাতাইনি মিনাল লাইল’। যেহতেু ‘ফজরের মাধ্যমে রাতের বিদায় ও দিনের সূচনা ঘটে, কিন্তু ফজরকে রাতের শেষ অংশ সাব্যস্ত না করে দিনের সূচনা বলে সাব্যস্ত করা হয়, তাই রাতের শেষদিকের অংশ (ছাহার ও আছহার) ফজরের মাধ্যমে শেষ হয় এবং তা ফজরের পূর্ববর্তী কাছাকাছি অংশ। সুতরাং ‘যুলাফাম মিনাল লাইল’ শব্দের অর্থ যদিও ‘রাতের মধ্য থেকে (দিনের) নিকটবর্তী লগ্নসমূহ’। কিন্তু প্রায়োগিকভাবে এর দ্বারা বুঝানো হয় ‘দিন শেষে দিনের নিকটবর্তী রাতের মধ্যকার লগ্নসমূহ’। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দিন শুরুর আগের তথা ফজরের আগের লগ্নসমূহ বিবেচ্য নয়। তাই যুলাফাম মিনাল লাইল প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র সূর্যাস্ত পরবর্তী রাতের প্রথম দিকের সময়সীমাকে বুঝায় যার পরিসীমা হচ্ছে ‘ইলাল লাইলে’ থেকে ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ বা রাতের অন্ধকারাচ্ছন্নতার প্রথম পর্যায় পর্যন্ত।
দিন ও রাতের মধ্য থেকে দিনের আগে রাত এবং রাতের আগে দিন থাকে এটি অত্যন্ত স্পষ্ট বিষয়। একটি দিক থেকে দিনের আগে রাতের হিসাব অগ্রগণ্য, তা হচ্ছে মহাজাগতিক বাস্তবতা। সৃষ্টির আদি অবস্থা নাস্তিবাচক এবং পরবর্তী অবস্থা হচ্ছে যখন তাতে কোনো আস্তিকে আনা হয়েছে সেই প্রেক্ষিতে আস্তিবাচক। এজন্য আলোর আগে অন্ধকার, দিনের আগে রাত, জীবনের আগে প্রাণহীনতা। অন্যদিকে মানবীয় সভ্যতায় মানবীয় সক্রিয়তার সূচনা, ক্রমবিকাশ ও সমাপ্তির প্রেক্ষিতে আগে দিনের হিসাব, পরে রাতের হিসাব। এজন্য প্রতিদিনের সালাতের ক্ষেত্রে দিনের দুই তরাফের সালাতের মধ্যে একটি হচ্ছে ‘আস সালাতিল উসতা’। অন্য কথায় দিন-রাতের সকল সালাতের মধ্যে প্রথম সালাত হচ্ছে ‘সালাতিল ফজর’ এবং শেষ সালাত হচ্ছে ‘সালাতিল ইশা’ এবং উভয়ের মধ্যে রয়েছে ‘আস সালাতিল উসতা’ যা এমন সময় যে, তার পূর্বাপর অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে পার্থিব উপার্জনমূলক ব্যস্ততা রয়েছে (২৪:৫৮, ২:২৩৮, ৬২:৯)। ‘সালাতিল ইশা’ ও ‘সালাতিল ফজরের’ মধ্যবর্তীতে কোনো বাধ্যতামূলক সালাত না থাকার প্রেক্ষিতেও এটা স্পষ্ট যে, ‘সালাতিল ফজর’ হচ্ছে প্রথম সালাত এবং ‘সালাতিল ইশা’ হচ্ছে শেষ সালাত এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তীতে অবস্থিত সালাতটি হচ্ছে ‘আস সালাতিল উসতা’। এছাড়া ৬৯:৬-৭ আয়াতে বর্ণিত ‘সাত রাত ও আট দিন’ সম্পর্কিত বিবরণ থেকেও স্পষ্ট যে, ‘দিন থেকে দিন’ মানে একাধিক ইয়াওম (রাত-দিনের যোগফলে হওয়া দিন) তথা দৈনিক তারিখের হিসাব দিন থেকে শুরু করাই স্বাভাবিক। এমতাবস্থায়, ‘যুলাফাম মিনাল লাইল’ এর প্রয়োগ ‘দিন শেষে দিনের নিকটবর্তী রাতের মধ্যকার লগ্নসমূহ’ অর্থে হওয়া স্বাভাবিক যুক্তিসম্মত বলে সাব্যস্ত হয়।
সুতরাং ফজর যদিও একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দিন-রাতের সংমিশ্রিত অংশ, তবু্ও তা রাতের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত না হয়ে দিনের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হবে। অনুরূপভাবে, ফজরের বিপরীতে থাকা সূর্যাস্ত পরবর্তী শাফাক্ব থাকাকালীন সন্ধ্যা বা আশিয়্য / আশিয়্যাত দিনের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত না হয়ে রাতের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হবে। কারণ সেটিকে একদিকে ‘যুলাফাম মিনাল লাইলের’ অংশ (দিন শেষে দিনের নিকটবর্তী রাতের মধ্যকার লগ্নসমূহ) সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং অন্যদিকে ফজর যেমন এমন সময় যখন রাত দিনে প্রবেশ করেছে এবং তা দিনের অংশ বলে সাব্যস্ত হয়, আশিয়্যও তেমনি এমন সময় যখন দিন রাতে প্রবেশ করেছে এবং তা রাতের অংশ বলে সাব্যস্ত হয়।
সুবহকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়, সুবহে কাজেব এবং সুবহে সাদেক। এর প্রথমটি পাখিদের জন্য সুবহ হিসেবে কাজ করে এবং দ্বিতীয়টি মানুষের জন্য প্রকৃত সুবহ হিসেবে সাব্যস্ত হয়। তাই সুবহ এবং ফজর হুবহু অভিন্ন নয়। সুবহের সূচনা ও মাতলায়িল ফজরকেও হুবহু একই বলা যায় না, বরং সুবহে সাদেকের সূচনা এবং মাতলায়িল ফজর হচ্ছে একই মুহূর্ত। সুবহ এবং ফজরের সময়সীমা যেমন এর সূচনার দিক থেকে ভিন্ন, তেমনি সমাপ্তির দিক থেকেও ভিন্ন। কারণ ইশরাক্বও সুবহের আওতাভুক্ত কিন্তু তা ফজরের সমাপ্তির নির্দেশক। কারণ, ফজর শব্দ দ্বারা মূলত ক্বাবলা তুলুয়িশ শামসির (সূর্যোদয়ের পূর্বের) সময়কে চিহ্নিত করা হয়।
ফজর নামক সময়কে গুরুত্ব দেয়ার জন্য ‘মাতলায়িল ফজর’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, বিশেষ করে ফজর যে দিনের অংশ তা স্পষ্ট করার ক্ষেত্রে এটি খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখে। ফজর কখন শুরু হয় তা ২:১৮৭ আয়াতের মাধ্যমে সুস্পষ্ট হয়েছে। যখন দিগন্তে রাতের কালো রেখা থেকে সাদা রেখা স্পষ্ট হয় তখন ফজর শুরু হয়। এবং ‘মাতলায়িল ফজর’ বা ‘ফজর উদয়ের’ মাধ্যমে রাতের সমাপ্তি ঘটে (৯৭:৫)। সুতরাং ফজর দিনের অন্তর্ভুক্ত, তা রাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। এজন্য ‘সালাতুল ফজর’ দিনের প্রথম তরাফের সালাত হিসেবে সাব্যস্ত হয় (১১:১১৪)। ফজর হচ্ছে মূলত ‘ক্বাবলা তুলুয়িশ শামস’ বা ‘সূর্যোদয়ের পূর্ববর্তী সময়কাল’। অনুরূপভাবে আসীল তথা ‘সূর্যাস্তের পূর্ববর্তী সময়কাল’ হচ্ছে সালাত প্রসঙ্গে দিনকে যে দুই তরাফে বিভক্ত করা হয়েছে তার সাপেক্ষে দিনের দ্বিতীয় তরাফের অন্তর্ভুক্ত সময়কাল।
বুকরাত, ইবকার, সুবহ, সবাহ, এবং হীনা তুসবিহূনা যেমন সকালকে বুঝায় তথা একটি অন্যটির প্রতিশব্দ, কিন্তু যেখানে যে ধরনের অর্থসঙ্গতি অনুসারে যে প্রতিশব্দটি অধিক ব্যবহার উপযোগী সাব্যস্ত হয়েছে তা ব্যবহার করা হয়েছে। তেমনি হীনা তুরীহূনা এবং আশিয়্য হচ্ছে একটি অন্যটির প্রতিশব্দ। ইশা একটি ব্যাপকত্বসম্পন্ন সময় যার প্রথমদিকের অংশকে আশিয়্য বলা হয়।
৮৪:১৬-১৯ আয়াতে বলা হয়েছে, “ফালা উক্বছিমু বিশ শাফাক্বি, ওয়াল লাইলি ওয়া মা ওয়াছাক্বা, ওয়াল ক্বামারি ইযাত তাছাক্বা, লাতারকাবুন্না তবাক্বান আন ত্ববাকিন”। এ আয়াতগুলোতে কিছু উদ্দেশ্যমুখী অবস্থান্তর প্রক্রিয়ার নিদর্শনের কসম করে মানুষ এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যাওয়ার নিশ্চয়তা প্রকাশ করা হয়েছে।
এখানে, শাফাক্ব শব্দটির অর্থ কী? শাফাক্ব কি রাতের অংশ না দিনের অংশ? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যেহেতু ৮:১৬-১৭ আয়াতে শাফাক্বকে লাইল থেকে আলাদাভাবে বলা হয়েছে তাই এটি শুধুমাত্র রাতের অংশ হতে পারে না।
২:১৮৭ আয়াতে বলা হয়েছে, “ছুম্মা আতিম্মুস সিয়ামা ইলাল লাইল”। কিন্তু ৮৪:১৬-১৭ আয়াতে শাফাক্ব ও লাইল আলাদাভাবে বলায় লাইল শব্দটি কোনো না কোনো মাত্রায় শাফাক্ব এর চেয়ে ভিন্নতা রক্ষা করে। তাই লাইলের শুরু এর অপর নাম শাফাক্বের শুরু এভাবে বলা যেতে পারে না। তবে যদি বলা হয়, রাতের শাফাক্বের শুরু ও লাইলের শুরু অভিন্ন, তাহলে ঠিক আছে। অর্থাৎ শাফাক্বকে দুইদিকেই হিসাব করতে হবে, দিনের শাফাক্ব এবং রাতের শাফাক্ব। দিনের শাফাক্ব হচ্ছে ফজর। রাতের শাফাক্ব হচ্ছে আশিয়্য।
সুতরাং শাফাক্ব (দিগন্তের রক্তিমাভা) শব্দটি সাধারণত সন্ধ্যার জন্য ব্যবহার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ফজর এবং আশিয়্য উভয়টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একে ইংরেজিতে Twilight বলা হয়। বিজ্ঞানসম্মত তথ্য অনুসারে, এটি হলো সূর্যোদয়ের পূর্ববর্তী ১৮ ডিগ্রী তথা ৭২ মিনিট এবং সূর্যাস্তের পরবর্তী ১৮ ডিগ্রী তথা ৭২ মিনিট পর্যন্ত সময়কাল।
প্রশ্ন হতে পারে যে, শাফাক্ব শব্দটির অর্থ অভিধানে বা অনুবাদগ্রন্থগুলোতে ‘সন্ধ্যাকালীন রক্তিমাভা’ করা হয়েছে। তাই এটিকে সূর্যোদয়ের পূর্ববর্তী ও সূর্যাস্তের পরবর্তী উভয় সময়সমীমা হিসেবে সাব্যস্ত করা সঠিক হবে কিনা? এর জবাব হচ্ছে অভিধানে বা অনুবাদগ্রন্থগুলোতে একে ‘সন্ধ্যাকালীন রক্তিমাভা’ অর্থ করার কারণ প্রচলিত মৌখিক ভাষারীতি। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং বিজ্ঞানসম্মত সংজ্ঞা তথা বাস্তবতার প্রেক্ষিতে Twilight সূর্যোদয়ের আগে ও সূর্যাস্তের পরে উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং কুরআনে শব্দটি যেভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে তাতে এই বিজ্ঞানসম্মত সংজ্ঞাই সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
সন্ধ্যার শাফাক্বের পরে আসা গাছাক্বিল লাইল থেকে রাত শুরু হতে পারে না। কারণ সেক্ষেত্রে ‘ইলাল লাইল’ এবং ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ এর পার্থক্য নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। অথচ কুরআনে এ দুটি শব্দ আলাদাভাবে উল্লেখের বাস্তবসম্মত তাৎপর্য রয়েছে। এ দুটি বিষয় আলাদা না হলে, রাতের মধ্যে দিনের প্রবেশ এবং রাত দিনকে ঢেকে দেয়া এবং রাত থেকে দিনকে অপসারিত করা এবং এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাত অন্ধকারময় হওয়ার তথ্য অর্থবহ হয় না। সিয়াম পূর্ণ করতে হবে ‘ইলাল লাইল’ পর্যন্ত এবং দিনের শেষ তরাফের সালাতও স্বত:সিদ্ধভাবে ‘ইলাল লাইল’ পর্যন্ত। এবং ‘সালাতিল ইশা’ হচ্ছে ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ বা রাতের গাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্নতার প্রথম পর্যায় পর্যন্ত। এছাড়া যদি ‘ইলাল লাইল’ এবং ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ একই বিষয় হয় তাহলে ‘সালাতিল ইশা’ হয় ‘ইলাল লাইল’ পর্যন্ত, অর্থাৎ সেক্ষেত্রে রাতের সময় শুরু হলে ‘সালাতিল ইশার’ সময় শেষ হয়ে যায় বা ‘সালাতিল ইশা’ দিনের সময়ের ভিতরে সম্পাদিতব্য হয়ে যায়, তা রাতের মধ্যকার সালাত হয় না, এবং সেক্ষেত্রে তা ‘যুলাফাম মিনাল লাইলের’ সালাত হিসেবে সাব্যস্ত হয় না। এমতাবস্থায় আয়াতসমূহের বক্তব্য অসংলগ্ন প্রতিপন্ন হয়, যা অসম্ভব। সুতরাং অবশ্যই ‘ইলাল লাইল’ এবং ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ দুটি স্বতন্ত্র বিষয় এবং ‘ইলাল লাইল’ থেকে লাইল বা রাত শুরু হয় এবং ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ বলতে রাতের গাঢ় অন্ধকারের প্রথম পর্যায়কে বুঝায়।
সন্ধ্যা থেকেই রাত শুরু হওয়া সত্ত্বেও সাধারণত সন্ধ্যার পরবর্তী অংশকে রাত বলার রীতি প্রচলিত। অনুরূপভাবে সন্ধ্যা থেকেই ইশা শুরু হলেও সাধারণত সন্ধ্যার অব্যবহিত পরের অংশকে ইশা বলার রীতি প্রচলিত রয়েছে। রাতের প্রথম অংশকে যেমন সন্ধ্যারাত বলা হয়, অনুরূপভাবে ইশার প্রথম অংশকে স্বতন্ত্র শব্দ ‘আশিয়্য’ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। তাই ইশার সালাত সাধারণত সন্ধ্যার সাথে সাথে করার চেয়ে ‘ইলা গাছাক্বিল লাইলে’’ করা হয়। বাংলা ভাষায় সকাল এবং সকাল সকাল বা সাত সকাল শব্দের মধ্যে অথবা দুপুর এবং ভর দুপুর শব্দের মধ্যে যেরূপ অর্থগত পার্থক্য আরবিতে ইশা এবং আশিয়্যা শব্দের মধ্যে অনুরূপ অর্থগত পার্থক্য রয়েছে। ইশা বলতে বুঝায় ‘রাতের প্রথমাংশ যা প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত বিস্তৃত’। অন্যদিকে ‘আশিয়্যা’ শব্দের মাধ্যমে ইশার সময়ের প্রথম পর্যায়কে গুরুত্বারোপ করা হয়। ইশার সালাতের পরে ব্যক্তিগত কক্ষে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাচ্চাদেরকেও অনুমতি নিতে হবে (২৪:৫৮)। এর মাধ্যমে বুঝা যায় যে, ‘সালাতিল ইশার’’ পর বিশ্রাম নেয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। আবার এরপর অনুমতি নিয়ে যাতায়াতের প্রসঙ্গ থেকে বুঝা যায় যে, ‘সালাতিল ইশার’’ পর সাথে সাথেই পূর্ণ বিশ্রামের সময় হয়ে যায় তাও নয়। আবার আনুষ্ঠানিক সালাতের পর বাস্তব সালাতের তথা আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণমূলক বিভিন্ন বাস্তব কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও একটা সময়গত পরিসর থাকা স্বাভাবিক, সে হিসেবে ‘সালাতিল ইশা’’ সন্ধ্যার সাথে সাথে করে নেয়াও অনুমোদিত, যেহেতু তাও ইশার অন্তর্ভুক্ত সময়।
ইশরাক্ব, গাদাত, গুদুব্ব, রওয়াহ, হীনা তাছরাহূনা হচ্ছে সূর্যোদয় অব্যবহিত পরের সময় এবং আসীল ও হীনা তুমছূনা হচ্ছে সূর্যাস্তের অব্যবহিত পূর্বের সময়।
‘তুলুয়িশ শামস’ (সুর্যোদয়), ‘দুলুকিশ শামস’ (সূর্য ঢলে পড়া), ‘গুরুবিশ শামস’ / গুরুব (সুর্যাস্ত) কোনো সময়কাল (পিরিয়ড) নয়, বরং এগুলো হলো মুহুর্ত, যা মাসদার বা ক্রিয়াবিশেষ্য এর অর্থ ধারণ করে। ‘গুরুবিহা’ এবং ‘গুরুব’ দুটি শব্দের যেখানে ‘গুরুব’ আছে সেখানেও মূলত ‘গুরুবিহা’ বুঝানো হয়েছে। সংক্ষেপনের জন্য ‘গুরুব’ ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর সম্প্রসারিত রূপ বুঝার জন্য অন্যত্র ‘গুরুবিহা’ ব্যবহৃত হয়েছে। এটা আল কুরআনের একটি প্রয়োগরীতি। ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ শব্দগুচ্ছে ‘গাছাক্বিল লাইল’ শব্দের আগে ‘ইলা’ থাকায় এর দ্বারা গাঢ় অন্ধকারের পূর্ণ পর্যায়কে না বুঝিয়ে এর প্রথম পর্যায়কে বুঝায়।
অনেকে ‘দুলুকিশ শামস’ এবং ‘গুরুবিশ শামস’ উভয়টির অর্থ করেন ‘সূর্যাস্ত বা সূর্য অস্তাচলে ঢলে পড়া’। অথচ সূর্য পশ্চিমাকাশের দিকে প্রথম ঢলে পড়ে মধ্যাহ্নে। এরপর প্রতি মুহুর্তে তা ঢলতে থাকে এবং এক পর্যায়ে ‘গুরুবিশ শামস’ বা সূর্যাস্ত ঘটে। ‘তুলুয়িশ শামস’ হচ্ছে সূর্যোদয়, ‘গুরুবিশ শামস’ হচ্ছে সূর্যাস্ত এবং ‘দুলুকিশ শামস’ হচ্ছে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মধ্যবর্তীতে তথা মধ্যাহ্নে সূর্য পশ্চিমাকাশের দিকে প্রথম ঢলে পড়া।
কেউ কেউ ‘দুলুক’ শব্দটিকে বহুবচন সাব্যস্ত করে বলেন যে, সূর্য তিনবার পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ে, একবার মধ্যাহ্নে বা যুহরে, একবার আসরে এবং একবার মাগরিবে। অথচ শব্দটিকে বহুবচন সাব্যস্ত করলে এই তিনবারে এটি সীমাবদ্ধ করা যায় না। বরং মধ্যাহ্নে প্রথমবার ঢলে পড়ার পর থেকে প্রতি মুহুর্তে সে ঢলে পড়তে থাকে। শামস বা সূর্যের উদয়-অস্ত ও ঢলে পড়ার সাথে সম্পর্কিত তিনটি শব্দ ‘তুলূ’, ‘গুরুব’ এবং ‘দুলুক’ একই (ফুয়ূল) প্যাটার্নে গঠিত এবং সবগুলোই মাসদার / ক্রিয়াবিশেষ্য, এর কোনোটি বহুবচন নয়। সূর্য পশ্চিমাকামের দিকে ঢলে পড়ার ঘটনা প্রথম যখন ঘটে (মধ্যাহ্ন) সেটাই ‘দুলুকিশ শামস’। আসর বা মাগরিবকে ‘দুলুকিশ শামস’ বলে না। বরং সূর্যাস্ত যাওয়াকে ‘গুরুবিশ শামস’ বলে। সংক্ষেপে, সূর্য উদয় হলো ‘তুলুয়িশ শামস’, সূর্যাস্ত হলো ‘গুরুবিশ শামস’ এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তীতে মধ্যাহ্নে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া হলো ‘দুলুকিশ শামস’।
কেউ কেউ ‘দুলুক’ শব্দের অর্থ করেন ‘সূর্যের স্থানান্তর’। কিন্তু তা গ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত হয় না। কারণ যদি সূর্যের প্রত্যেক স্থানান্তর বুঝায় তবে তা দ্বারা সালাতের কোনো প্রারম্ভিক পয়েন্ট চিহ্নিত হয় না; এবং যদি সূর্যের দৃশ্যমান প্রথম স্থানান্তর বুঝায় তবে সেজন্য ‘তুলুয়িশ শামস’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে; এবং যদি সূর্যের দৃশ্যমান শেষ স্থানান্তর বুঝায় (যা যুক্তিসঙ্গত নয়) তবে সেজন্য ‘গুরুবিশ শামস’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এটি দ্বারা সূর্য মধ্যাহ্নে ঢলে পড়াসহ প্রত্যেক ঢলে পড়াও বুঝাতে পারে না, কারণ সেক্ষেত্রেও সালাতের জন্য কোনো প্রারম্ভিক পয়েন্ট চিহ্নিত হয় না। সুতরাং ‘দুলুকিশ শামস’ অর্থ হলো: ‘সূর্য প্রথমবার (মধ্যাহ্নে) ঢলে পড়া’। আসলে সূর্যোদয়ের জন্য ‘তুলুয়িশ শামস’, সূর্যাস্তের জন্য ‘গুরুবিশ শামস’ এবং সূর্য মধ্যাহ্নে ঢলে পড়ার জন্য ‘গুরুবিশ শামস’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সূর্য / শামস শব্দের সাথে ব্যবহৃত তিনটি মাসদার / ক্রিয়াবিশেষ্য দ্বারা সূর্যের তিনটি বিশেষ মুহুর্তকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রশ্ন হতে পারে যে, ‘দুলুকিশ শামস’ থেকে সালাত করার মানে কি এই যে, ‘দুলুকিশ শামস’-এর পূর্বে সালাত করা যাবে না? আসলে তা নয়, বরং এ আয়াতে দিনের দ্বিতীয় তরাফের ও ইশার সময়কে যৌথভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এবং এর বিপরীতে রয়েছে দিনের অপর তরাফ বা প্রথম তরাফ। কারণ ‘দুলুকিশ শামস’ থেকে শুরু হওয়া তরাফ হচ্ছে দিনের দ্বিতীয় তরাফ। কারণ দিন ‘দুলুকিশ শামস’ থেকে শুরু হয় না বরং তুলুয়িশ শামসের পূর্বে মাতলায়িল ফজরের মাধ্যমে শুরু হয়।
দিনের প্রথম তরাফে যে সালাতটি তা প্রথম তরাফের অন্তর্ভুক্ত প্রথম উপভাগ তথা ফজরের মধ্যে সম্পাদনের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ‘সালাতিল ফজর’ শব্দের মাধ্যমে। কিন্তু যদি তা ফজরের মধ্যে সম্পাদন করা না যায় সেদিন তা প্রথম তরাফের ভিতরে যে কোনো সময় পড়ে নিতে হবে। এমতাবস্থায় তা একইভাবে প্রথম তরাফে সম্পাদিত সালাত হিসেবে সাব্যস্ত হবে। এবং ঐ ব্যক্তি যদি ফজরের সময় ঘুমে থাকে তাহলে তা তার জন্য ওজর হিসেবে সাব্যস্ত হবে এবং যখন সে ঘুম থেকে জাগবে তখন সালাত সম্পাদন করলে তার জন্য সেটাই ‘সালাতুল ফজর’ হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে।
জিজ্ঞাসা: আরবি অভিধানগ্রন্থ অনুসারে ‘তরাফায়িন নাহার’ অর্থ ‘দিনের দুই প্রান্ত / প্রান্তভাগ’ নাকি ‘দিনের দুই ভাগ’? আল কুরআনে কি কোনো শব্দ একেক স্থানে একেক অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে না?
জবাব: আরবি অভিধানগ্রন্থে তরাফ শব্দের অর্থ ‘অংশ/ভাগ’ এবং ‘প্রান্ত, প্রান্তভাগ’ উভয়টি রয়েছে। কেউ কেউ চলিত আরবি অভিধান ও ব্যাকরণকে পরিহার বা উপেক্ষা করার কথা বলে থাকেন। কিন্তু আমরা সেটিকে যথাযথ দাবি বলে মনে করি না। প্রকৃতপক্ষে কুরআন একটি ভাষারূপ দিয়ে বা একটি নির্দিষ্ট ভাষারীতিতে (আরবী ভাষায়) আমাদের কাছে নাজিল করা হয়েছে। সুতরাং কুরআনের তথ্য ও বিধি-বিধান জানা-বুঝার সাথে ঐ ভাষার সম্পর্ক রয়েছে। ভাষা আল্লাহর সৃষ্টি এবং তিনিই মানুষকে ভাষা তথা ভাষার ব্যবহার শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ যদি মানুষের মধ্যে মনোভাব প্রকাশ করার ও তা বিনিময় করার প্রক্রিয়া সৃষ্টি না করতেন তবে মানুষ নিজেরা কোনোভাবেই ভাষাকে আয়ত্ত করতে পারতো না। ভাষার মাধ্যমে বাস্তবতাকে মানুষ মস্তিষ্কে গ্রহণ করে এবং অন্যের কাছে সে সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে। একটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘শামস, ক্বামার, ওয়াজহুন, ক্বিয়াম’ ইত্যাদি শব্দগুলো দ্বারা মানুষ যা বুঝে ও বুঝায় কুরআনে যখন শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে তখন মানুষের সেই বুঝার ও বুঝানোর উপর ভিত্তি করেই তা ব্যবহৃত হয়েছে, সুতরাং এগুলো নিয়ে কুরআনে কোনো তথ্য দিলে সেখানে এগুলোর সংজ্ঞা নিয়ে বিস্তর (জটিল সূত্র পরম্পরা) উপস্থাপনের কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকেনি এবং নেই। আমাদের প্রয়োজন কুরআনকে বাস্তবতার জ্ঞানে অনুধাবন করা। বাস্তবতা আল্লাহরই তৈরি করা প্রাকৃতিক নিয়মের স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ার নাম। সুতরাং বাস্তবতার ভিত্তিতেই সত্য ও ন্যায়সঙ্গত তথ্য ও বিধি-ব্যবস্থা উপস্থাপনের জন্যই কুরআন নাযিল করা হয়েছে।
তাহলে প্রচলিত আরবি অভিধান ও ব্যাকরণ নিয়ে আমাদের বক্তব্যের প্রকৃত অবস্থান কী? তা হলো, প্রচলিত আরবি অভিধানের ও ব্যাকরণের উৎস হিসেবে আছে প্রথমত কুরআন এবং তারপর সামগ্রিক আরবি ভাষার ব্যবহার। যে কোনো ভাষারীতির মতোই আরবি ভাষাও একটা মৌলিক শৃঙ্খলার পাশাপাশি কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বাতন্ত্রিক বৈচিত্র্যকেও অন্তর্ভুক্ত করে। একটি শব্দ কালক্রমে সাদৃশাত্মক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অনেক অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকে, কখনো কখনো এ সাদৃশাত্মক বিবর্তন প্রচলিত ভুল-শুদ্ধ ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই প্রচলিত অভিধান ও ব্যাকরণ অনুসারে কুরআনের প্রচলিত অনুবাদগুলোর সবগুলোই প্রায় সম্পূর্ণ সঠিক বলে প্রমাণ করা যাবে, যদিও অনেক আয়াতের অনুবাদে সেগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকে, তবু পার্থক্যসম্পন্ন দুটি অনুবাদের উভয়টি সঠিক বলে প্রমাণ করা যাবে। কারণ অভিধান ও ব্যাকরণের ব্যবহার দেখিয়ে উভয়টিকে প্রমাণ করা সম্ভব হবে।
এবং এখানেই আমাদের মূল বক্তব্যটি এরূপ যে, একটি শব্দের যেসব অর্থ অভিধানে আছে যথাসম্ভব সেগুলো সংগ্রহ করতে হবে, কারণ কুরআন যে অর্থে ব্যবহার করেছে তা ঐ আভিধানিক অর্থগুলোর মধ্যে আছে, হারিয়ে যায়নি। কিন্তু ঐ অর্থগুলোর মধ্য থেকে ঠিক কোন অর্থটি আয়াতের অনুবাদে গ্রহণযোগ্য বলে সাব্যস্ত হবে তা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে:
(ক) ঐ আয়াতের পূর্বাপর বক্তব্য
(খ) অন্যান্য আয়াতে ঐ শব্দের ব্যবহার এবং সেক্ষেত্রেও সেই আয়াতগুলোর পূর্বাপর বক্তব্য এবং
(গ) ঐ শব্দের যে অর্থটি নিলে তা ঐ বিষয়ের তথ্যকে প্রভাবিত করে এমন অন্য সব তথ্যের সম্পূরক হয়।
এখন আসি, তরাফ-তরাফায়-আতরাফ শব্দের ব্যবহার প্রসঙ্গে। যেহেতু তরাফ শব্দের ‘প্রান্ত’ অর্থটি নিলে ( যদিও এটি আরবি ভাষায় ‘প্রান্ত’ অর্থেও প্রচলিত হয়েছে, কিন্তু এটাই একমাত্র অর্থ নয় এবং কুরআনে এ অর্থেই তা প্রয়োগ হওয়া জরুরি নয়) তাতে আয়াতসমূহের বক্তব্যকে সুসমন্বিত ও বাস্তবসম্মত হিসেবে পাওয়া যায় না, ‘ভাগ / অংশ’ অর্থে নিলে তা পাওয়া যায়, তাই কুরআনে শব্দটি ‘প্রান্ত’ অর্থে নয়, বরং ‘ভাগ/অংশ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলে সাব্যস্ত হয়।
কেন ‘প্রান্ত’ অর্থে নিলে তাতে আয়াতসমূহের বক্তব্য সুসমন্বিত ও বাস্তবতাসম্মত হয় না? কারণ, কুরআনে ‘নাহার’ শব্দের সাথে সম্পর্কিত করে ‘তরাফায়িন নাহার’ এবং ‘আতরফান নাহার’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে। যেহেতু দিন হলো রেখাংশের মতো, তাই তরাফ অর্থ ‘প্রান্ত’ নিলে দিনের দুটি প্রান্ত পাওয়ার কথা এবং সেক্ষেত্রে ‘তরাফায়িন নাহার’ বলা স্বাভাবিক, কিন্তু ‘আতরফান নাহার’ বলা যেতে পারে না। যেহেতু কুরআনে ‘আতরফান নাহার’ বা ‘দিনের প্রান্তসমূহ’ শব্দগুচ্ছও ব্যবহৃত হয়েছে, তাই তরাফ শব্দটি কুরআনে ‘প্রান্ত’ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি বলে সাব্যস্ত হয়। কারণ, যদি ‘প্রান্ত’ শব্দের পরিবর্তে ‘ভাগ / অংশ’ অর্থে ব্যবহার হয়, তবে ‘তরাফায়িন নাহার’ এবং ‘আতরফান নাহার’ উভয় শব্দের ব্যবহার স্ববিরোধী হয় না বরং এরূপ ব্যবহার স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব। যেহেতু কুরআনে ‘তরাফায়িন নাহার’ (দ্বিবচন) এবং ‘আরতফান নাহার’ (বহুবচন) উভয়টি ব্যবহৃত হয়েছে, তাই তরাফ শব্দটি ‘প্রান্ত’ অর্থে নয়, বরং ‘ভাগ / অংশ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
কুরআনে তরাফ শব্দটি একবচনে একবারই ব্যবহৃত হয়েছে এবং তাতে তা ব্যবহৃত হয়েছে ‘ভাগ / অংশ’ অর্থে। এবং এর দ্বিবচন (তরাফায়) ও বহুবচন (আতরাফ) ব্যবহৃত হয়েছে দিনের সাথে সম্পর্কিত করে। দিন কোনো ত্রিভুজ বা চতুর্ভুজ ধরনের জিনিস নয় বরং রেখাংশ ধরনের বিষয় (সময়সীমা), তাই এর দুই প্রান্তের বিষয় যুক্তিগ্রাহ্য কিন্তু বহুপ্রান্ত যুক্তিগ্রাহ্য নয়। অত্যন্ত সংকীর্ণ অর্থে দিনের প্রান্ত হতে পারে এমন মুহুর্ত যাতে মানুষের পক্ষে কোনো কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। যেহেতু দিনের দুই তরাফে সালাত প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ রয়েছে তাই ধরা হয় যে, এখানে প্রান্ত মানে প্রান্তভাগ, যা এতটুকু সময়দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট যে, তাতে সালাত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। এখন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সাপেক্ষে এর দুটি প্রান্তভাগ সহজেই নির্ণিত হতে পারে, কিন্তু ‘আতরফান্নাহার’ বা ‘দিনের প্রান্তভাগসমূহ’ কিভাবে হতে পারে? এবং যদি ধরে নিই যে, দিনের দুইয়ের অধিক প্রান্তভাগ হতে পারে, তবে প্রতিটি প্রান্তভাগের আবার দুটি করে প্রান্তভাগ তৈরি হয়। অর্থাৎ দিনের প্রান্তভাগসমূহ শব্দটি স্বয়ং একটি অসমাধানযোগ্য অর্থ সংকটের সৃষ্টি করে। সুতরাং আসলে তরাফায়িন্নাহার মানে ‘দিনের দুই প্রান্ত’ বা ‘দিনের দুই প্রান্তভাগ’ নয়। বরং তরাফায়িন্নাহার মানে ‘দিনের দুই ভাগ’। দিনের ভাগ একটি আপেক্ষিক বিষয়। সালাতের প্রসঙ্গে দিনকে ‘তরাফায়িন্নাহারি’ তথা দুই তরাফে ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তাসবীহের প্রসঙ্গে দিনকে ‘আতরফান্নাহারি’ তথা দুইয়ের অধিক তরাফে ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, তরাফ শব্দের একটি অর্থ ‘প্রান্ত / প্রান্তভাগ’ হলেও এর অপর অর্থটি (অংশ / ভাগ) শব্দটির কুরআনিক প্রায়োগিক অর্থ।
১১:১১৪ আয়াতে সালাত প্রসঙ্গে দিনকে দুটি তরাফে বিভক্ত করা হয়েছে এবং ১৭:৭৮ আয়াত থেকে দিনের দ্বিতীয় তরাফ সম্পর্কে জানা যায় যে, তা শুরু হয় ‘দুলুকিশ শামসির’ মাধ্যমে। সুতরাং ফজর থেকে ‘দুলুকিশ শামসির’ পূর্ব পর্যন্ত দিনের প্রথম তরাফ।
১১:১১৪ আয়াতে ‘তরাফায়িন নাহার’ বা দিনের দুই তরাফে এবং ‘যুলাফাম মিনাল লাইল’ বা দিন শেষে দিনের নিকটবর্তী রাতের মধ্যকার (মিনাল লাইল = রাতের মধ্য থেকে) লগ্নসমূহে সালাত প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নির্ণেয় বিষয় হলো, ১১:১১৪ আয়াত অনুসারে দিনে রাতে অন্তত কয়টি সালাত বাধ্যতামূলক?
রাতের প্রথম ভাগ হলো ‘যুলাফাম মিনাল লাইল’। রাতের শেষভাগ হলো ‘আছহার’। এবং রাতের মধ্যভাগ হলো ‘গাছাকিল লাইল’ বা ‘রাতের ঘন অন্ধকার ও নিস্তব্ধতা’ (বেশি গরমের বিপরীতে বেশি ঠান্ডা), যা রাতের মৌলিক উদ্দেশ্য বিশ্রাম বা ঘুমের জন্য সর্বাধিক উপযোগী, যখন ঘুম আসে। গাছাক্বিল লাইল হচ্ছে রাতের ঘন অন্ধকারের পর্যায়ভাগ। এটি একটি ব্যাপকতাসম্পন্ন সময়সীমা। তাই ইশার সালাতের শেষ সময় নিয়ে মিনিটভিত্তিক হিসাব করা যাবে না। তবে এতটুকু খেয়াল রাখতে হবে যে, তা হলো ঘুমাতে যাওয়ার প্রস্তুতি পর্বে সমাপ্য একটি পর্যায় কারণ সালাতিল ইশার পরেও কিছুক্ষণ পারস্পরিক কক্ষে যাতায়াতের মতো অবস্থা থাকতে পারে, তবে সেজন্য অনুমতি নিতে হবে। (২৪:৫৮)
নবী সুলাইমানের ঘোড় দৌড় দেখা (৩৮:৩০-৩৩) আশিয়্যে এবং নবী ইউসুফের ভাইদের বাড়ি ফিরে আসা (১২:১৬) ইশার সময়ের মধ্যে ঘটেছে। এবং এটি ‘গাছাক্বিল লাইলের’ প্রথম পর্যায়ের মধ্যকার সময়সীমা। বেশি ঘন অন্ধকার বা গাছিক্বের ক্ষেত্রে অনেক শাররি বা অনিষ্টের প্রবল সম্ভাবনা থাকে। তাই প্রার্থনা শিখানো হয়েছে- ‘ওয়া মিন শাররি গাছিক্বিন ইযা ওয়াক্বাব’ (এবং ঘন অন্ধকারময়তার অনিষ্ট থেকে যখন তা আচ্ছাদিত হয়)।
যুলাফ শব্দটি যুলফাত শব্দের বহুবচন হওয়া সত্ত্বেও এতে একটি সালাত তথা ‘সালাতিল ইশা’ সম্পাদন করাই বাধ্যতামূলক দায়িত্ব পালনের জন্য যথেষ্ট। যেমন ‘ছাহার’ (সেহরি) শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘রাতের শেষ লগ্ন’। ৫৪:৩৪:৯ আয়াতে ‘ছাহার’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু কুরআনের ৩:১৭:৬ ও ৫১:১৮:১ স্থানে ‘ছাহার’ এর বহুবচন ‘আছহার’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ রাতের দুইয়ের অধিক শেষ লগ্ন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাতের একেকটি ছাহারের সময়গত দৈর্ঘ্য কতটুকু এবং তা কিভাবে চিহ্নিত বা নির্ণিত হবে? এটি আমাদের দ্বারা হুবহু নির্ণয়যোগ্য নয়। ৫৪:৩৪:৯ আয়াতে ‘ছাহার’ শব্দ ব্যবহারের কারণ সম্পর্কে চিন্তা করলে এর যে কারণটি বুঝা যায় তা হলো, সেটিই রাতটির শেষ লগ্ন যার পরপরই ‘কওমে লূত’কে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এবং অন্য দুটি আয়াতে বহুবচন ব্যবহারের কারণ হতে পারে, মু’মিনরা রাতের শেষ দিকে যে সময়কালে ক্ষমা প্রার্থনা করে তা কয়েকটি ছাহারের সমষ্টি এবং এক্ষেত্রে তাদেরকে ছাহারের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করে কাজ করতে হয় না।
অন্যদিকে তরাফায়িন নাহারি বা ‘দিনের দুই তরাফের’ প্রতিটিতে অন্তত একটি করে সালাত বা মোট দুটি সালাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ সেক্ষেত্রে আলাদা আলাদা নির্দেশনা রয়েছে এবং সেক্ষেত্রে দুটি তরাফে তথা সমগ্র দিনে মাত্র একটি সালাত প্রতিষ্ঠা করতে হলে ‘তরাফায়িন নাহার’ বা ‘দিনের দুই তরাফ’ বলার প্রয়োজন হতো না।
দিনের শেষদিকের তরাফের ক্ষেত্রে ‘লিদুলুকিশ শামসি’ থেকে সালাতের একটি সময়সীমা উল্লেখ করা হয়েছে এবং বিপরীত দিকের তরাফের সালাতের ক্ষেত্রে ‘সালাতিল ফজর’ এর নির্দেশনা রয়েছে। দিনের দুই তরাফের উভয়টিতে অন্তত একটি করে সালাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিধায় ‘যুলাফাম মিনাল লাইলে’ সম্পাদিতব্য ‘সালাতিল ইশা’ সহকারে দিনে-রাতে বা দৈনন্দিন অন্তত তিনটি সালাত হয় এবং এই প্রেক্ষিতে আস সালাতিল উসতা বা মধ্যবর্তী সালাতের অবস্থান তৈরি হয়।
‘তরাফায়িন নাহারি’ শব্দের ‘তরাফায়’ শব্দটি দ্বিবচন এবং শব্দটির অর্থ হলো ‘ভাগ’, যা সকাল-দুপুর-বিকাল এ ধরনের কোনো সময়সীমার নাম নয়। বরং ‘তরাফায়িন নাহারে’ সালাত প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দেয়ার তাৎপর্য হলো, সালাতের জন্য দিনকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে।
সালাতের সাপেক্ষে দিনের দ্বিতীয় তরাফ বা ভাগকে লিদুলূকিশ শামসি ইলাল লাইল’ শব্দের মাধ্যমে চিহ্নিত করা যেতে পারে। অন্য কথায়, সূর্য মধ্যাহ্নে ঢলে পড়া থেকে দিনের শেষ পর্যন্ত হচ্ছে সালাতের সাপেক্ষে দিনের দ্বিতীয় ভাগ। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে তার বিপরীতের বাকি অংশ (তথা ফজরের শুরু থেকে ‘দুলুকিশ শামস’ পর্যন্ত সময়সীমা) হচ্ছে দিনের প্রথম ভাগ। দিনের দ্বিতীয় ভাগের সালাত হচ্ছে ‘আস সালাতুল উসতা, যা দিনের প্রথম ভাগের সালাতের (সালাতিল ফজরের) এবং দিন শেষে রাতের প্রথমাংশে সম্পাদিতব্য সালাতের (সালাতিল ইশার) মধ্যবর্তীতে রয়েছে।
দিনের প্রথম তরাফের সালাত সম্পাদনের মূল সময় হলো ফজর, তাই একে ‘সালাতিল ফজর’ বলা হয়। কিন্তু কেউ যদি কোনো কারণে ফজরে ঘুম থেকে জাগতে না পারে তবে এরূপ ওজর অবস্থায় তাকে দিনের প্রথম তরাফের ভিতর প্রথম তরাফের সালাত সম্পাদন করতে হবে। সেক্ষেত্রে সেটি ফজর নামক সময়ের ভিতরে হবে না, কিন্তু তার জন্য তা ‘সালাতিল ফজর’ হিসেবেই সাব্যস্ত হবে। কারণ ‘ফজর’ শব্দের অর্থ অনুসারে সময় হিসেবে এটি হলো যখন সুবহের মাধ্যমে রাত ভেঙ্গে দিনের সূচনা ঘটে সেই সূচনাপর্বের সময়সীমা (‘মাতলায়িল ফজর’ থেকে ‘তুলুয়িশ শামস’ বা সূর্যোদয় পর্যন্ত)। এবং যে ব্যক্তি ফজরের সময় ঘুম থেকে জাগতে পারেনি, তার জন্য যখন তার ঘুম ভাঙ্গে তখনি তার ফজর। কিন্তু সময়কাল হিসেবে যেহেতু আরো আগেই ফজর শুরু হয় তাই ফজরের পরে ঘুম ভাঙ্গলে তখন সিয়ামের উদ্দেশ্যে সেহরি খাওয়ার অবকাশ নেই অর্থাৎ ঐ সময় কিছু খেয়ে সিয়াম পালনের অবকাশ নেই। ‘কুরআনাল ফজর’ বা ‘ফজরের কুরআন পাঠের’ বিষয়েও এ কথা প্রযোজ্য যে, যদি কোনো কারণে ফজর সময়কালের মধ্যে কারো ঘুম না ভাঙ্গে তাহলে যখনি ঘুম ভাঙ্গবে তখনি তাকে ‘কুরআনাল ফজর’ করে নিতে হবে।
সুতরাং ১১:১১৪ আয়াত অনুসারে অন্তত তিন ওয়াক্ত সালাত বাধ্যতামূলক সাব্যস্ত হয়। এবং বিভিন্ন আয়াতে দিন রাতের তিনটি সালাতের নাম রয়েছে, যথা ‘সালাতিল ফজর’, ‘আস সালাতিল উসতা’ এবং ‘সালাতিল ইশা’।
সালাতসমূহের মধ্যে একটি হলো ‘আস সালাতিল উসতা’ বা ‘মধ্যবর্তী (ওয়াক্তের) সালাত’। এ নামকরণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, দৈনন্দিন বাধ্যতামূলক সালাতের ওয়াক্ত সংখ্যা একটি বিজোড় সংখ্যা। এ থেকে এটিও বুঝা যায় যে, সালাতের ওয়াক্তসংখ্যা অন্তত তিন ওয়াক্ত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতি ওয়াক্তে অন্তত একবার আনুষ্ঠানিক সালাত সম্পাদনের জন্য কয়টি ওয়াক্ত নির্ধারণ করা হয়েছে, যেমন তিন ওয়াক্ত, পাঁচ ওয়াক্ত বা সাত ওয়াক্ত, তা কিভাবে নির্ণিত হবে সেই বিষয়ে আমরা ইতোপূর্বে বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতিতে দেখেছি যে, বাধ্যতামূলক ওয়াক্ত সংখ্যা হিসেবে তিন ওয়াক্তকে পাওয়া যায়। যদি কেউ এ তিন ওয়াক্তে পাঁচবার সালাত করে যেমনটি বর্তমানে প্রচলিত আছে তা দোষণীয় নয়। বহুল প্রচলিত রীতি হলো তিন ওয়াক্তে তিনবার সালাত করার পরিবর্তে পাঁচবার সালাত করা। এ পাঁচবার সালাত করার প্রেক্ষিতে আবার পাঁচ ওয়াক্ত সালাতকে ফরজ বলে দাবি করা হয়। এ পাঁচ ওয়াক্তের নাম বলা হয়: ফজর, যুহর, আসর, মাগরিব ও ইশা। অর্থাৎ ‘আস সালাতিল উসতা’র ওয়াক্তকে যুহর ও আসর নামে দুটি ওয়াক্তে বিভক্ত করা হয়েছে এবং ‘সালাতিল ইশা’র ওয়াক্তকে মাগরিব ও ইশা নামে দুটি ওয়াক্তে বিভক্ত করা হয়েছে। এর মধ্য থেকে যে সময়সীমাকে আসর বলা হয় তার প্রকৃত নাম হলো আসীল। কুরআনে আসীলে বা সূর্যাস্তের আগে তাসবীহ করার জন্য স্বতন্ত্র নির্দেশ রয়েছে কিন্তু আসীলে সালাত করার জন্য স্বতন্ত্র নির্দেশ নেই। বরং ‘আস সালাতিল উসতা’র সময়সীমা শুরু হয় সূর্য মধ্যাহ্ণে প্রথমবার পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার মুহুর্ত থেকে। এ সময়সীমাতে যুহর ও আসীল উভয়টি অন্তর্ভুক্ত এবং উভয়টি মিলে সালাতের প্রসঙ্গে একটি ওয়াক্ত হিসেবে সাব্যস্ত। ২:২৩৮ আয়াতে সালাতসমূহের হেফাজতকারী হতে এবং ‘আস সালাতিল উসতা’র ক্ষেত্রে বিশেষভাবে হেফাযতকারী হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ১১:১১৪ ও ১৭:৭৮ আয়াত অনুসারে এ সময়টি শুরু হয় ‘দুলুকিশ শামস’ বা দুপুরে সূর্য হেলে পড়া থেকে এবং শেষ হয় ‘যুলাফাম মিনাল লাইল’ এর পূর্বে তথা সূর্যাস্তের পূর্বে। এবং ‘যুলাফাম মিনাল লাইলে’ সালাত সম্পাদনের নির্দেশকৃত সালাতকে ‘সালাতিল ইশা’ হিসেবে চিহ্নিত করায় সূর্যাস্তের অব্যবহিত পর থেকে ইশার সময় শেষ হওয়া পর্যন্ত যে কোনো সময় ‘সালাতিল ইশা’ সম্পাদন করা যেতে পারে। ইশার প্রথমাংশ বা আশিয়্যে (যে সময়সীমা শাফাক্ব বা পশ্চিমাকাশের রক্তিমাভার সাথে সম্পর্কিত) তাসবীহ করার জন্য নির্দেশ রয়েছে, কিন্তু এর মধ্যেই সালাতিল ইশা করা অত্যাবশ্যক নয়, বরং ইশার সময়সীমার মধ্যেই ‘সালাতিল ইশা’ সম্পাদন করা যেতে পারে। যেমন ‘আস সালাতিল উসতা’র সময়সীমা শুরু হয় ‘দুলুকিশ শামস’ বা মধ্যাহ্নের অব্যবহিত পরেই, কিন্তু তখনি তা সম্পাদন করতে হবে তা অত্যাবশ্যক নয়, বরং ‘আস সালাতিল উসতা’র সময়সীমার মধ্যে তা সম্পাদন করার অবকাশ আছে। তবে ‘সালাতিল ইশা’ এমন সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা উচিত, যার পরে পারস্পরিক কক্ষে যাতায়াতের ক্ষেত্রে অপ্রাপ্ত বয়স্কদেরকেও অনুমতি নিতে হবে বলে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তখন অনুমতি অত্যাবশ্যক হলেও যাতায়াতের প্রয়োজনীয়তাও বিদ্যমান থাকে। এতে ‘ইশার’ পরে অনুমতি নেয়ার নির্দেশনার পরিবর্তে ‘সালাতিল ইশার’ পরে অনুমতি নেয়ার নির্দেশনা দেয়া থেকে স্পষ্ট হয় যে, এখানে সময়ের চেয়ে সালাতকেই নির্দেশটির বাস্তবায়ন মুহুর্ত শুরুর চিহ্ণ হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে।
‘আনায়িল লাইলে’ তথা রাতের বিভিন্ন প্রহরে আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত করার উল্লেখ রয়েছে (৩:১১৩) এবং সাজদাহয় ও ক্বিয়ামে থাকার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে (৩৯:৯) এবং তাসবীহ করার নির্দেশ রয়েছে (২০:১৩০)। এর মাধ্যমে রাতের বিভিন্ন প্রহরে যেমন- সূর্যাস্ত থেকে ‘গাছাক্বিল লাইল’ পর্যন্ত এবং রাতের শেষ প্রহর / আছহারে যখন তাহাজ্জুদ করা হয় তখন মু’মিনদের কর্মকাণ্ড হিসেবে ‘কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ এবং সালাতের জন্য পরোক্ষ নির্দেশনা তথা উৎসাহপ্রদানমূলক বিবৃতি দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সূর্যাস্ত থেকে ‘গাছাক্বিল লাইল’ পর্যন্ত একাধিক বার সালাত সম্পাদন করার বিষয়ে পরোক্ষ অনুমোদন পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে ‘লিদুলুকিশ শামসি’ থেকে সালাতের একটি ওয়াক্ত শুরু হওয়া (১৭:৭৮) এবং সূর্যাস্তের আগের সময়টিকে বিভিন্ন আয়াতে ‘ক্বাবলা গুরুবিশ শামস’ হিসেবে চিহ্নিত করার (২০:১৩০, ৫০:৩৯) মাধ্যমে এ সময়সীমাতেও একাধিকবার সালাত সম্পাদন করার বিষয়ে পরোক্ষ অনুমোদন পাওয়া যায়। সালাত সম্পাদনের জন্য বাধ্যতামূলক তিনটি ওয়াক্তে একাধিকবার সালাত সম্পাদনের মাধ্যমে বা কখনো প্রতি ওয়াক্তের প্রথম দিকে এবং কখনো মধ্যদিকে সালাত সম্পাদনের মাধ্যমে এক পর্যায়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের রীতি প্রচলিত হয়েছে বলে বুঝা যায়। তবে যেহেতু কুরআন অনুযায়ী তিন ওয়াক্তে একবার করে সালাত সম্পাদন করলেই সালাত সম্পাদনের বাধ্যবাধকতা পরিপূরণ হয়ে যায়, তাই প্রচলিত পাঁচ ওয়াক্ত তথা প্রকৃত তিন ওয়াক্তে পাঁচবার সালাত সম্পাদনকে বাধ্যতামূলক সাব্যস্ত করা যায় না।
পরিশেষে সালাতের ওয়াক্ত প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত তথ্যগত সিদ্ধান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে:
(১) সালাত প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দেশসহ চিহ্নিত সময়সীমা হচ্ছে দিনের দুটি তরাফ (ভাগ) এবং রাতের মধ্যকার যুলাফ (নিকটবর্তী লগ্নসমূহ)।
(২) দিনের প্রথম তরাফের মধ্যে রয়েছে ‘সালাতিল ফজর’, দ্বিতীয় তরাফের মধ্যে রয়েছে ‘আস সালাতিল উসতা’ এবং ‘রাতের মধ্যকার যুলাফে’ রয়েছে ‘সালাতিল ইশা’। সুতরাং সালাতের জন্য বাধ্যতামূলক ওয়াক্ত সংখ্যা হলো তিন ওয়াক্ত এবং এর প্রতি ওয়াক্তে অন্তত একবার সালাত সম্পাদন করা আবশ্যিক।
(৩) দিনের দ্বিতীয় তরাফ শুরু হয় ‘লিদুলুকিশ শামসি’ (মধ্যাহ্নে সূর্য পশ্চিমাকাশের দিকে প্রথমবার ঝুঁকে পড়ার সময়) থেকে এবং শেষ হয় দিন শেষ হওয়ার মাধ্যমে। অনুরূপভাবে ‘যুলাফাম মিনাল লাইল’ শুরু হয় রাত শুরু হওয়ার মাধ্যমে (সূর্যাস্তের মাধ্যমে) এবং এটি বিদ্যমান থাকে ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ তথা রাতের ঘন অন্ধকারের প্রথম পর্যায় বা মধ্যরাতের কাছাকাছি যে সময়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়া হয় সে সময় পর্যন্ত।
[উল্লেখ্য, প্রচলিত ‘সালাতিল মাগরিব’ বস্তুত একটি ‘সালাতিল ইশা’। কুরআনে তুলুয়িশ শামস (সূর্যোদয়) এবং দুলুকিশ শামস (মধ্যাহ্নে সূর্য পশ্চিমাকাশের দিকে ঢলে পড়া) শব্দদ্বয়ের মতো সূর্যের একটি অবস্থা তথা সূর্যাস্ত বুঝাতে ‘গুরুবিহা’ ও ‘গুরুব’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এবং মাগরিব শব্দটি সূর্যাস্তের স্থান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই ‘সালাতুল মাগরিব’ নামটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ আছে।]
‘উসতা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘মধ্যম, মধ্যমস্থ, ভারসাম্যস্থল, কেন্দ্রীয়’। আরবিতে ‘কুবরা, উসতা, সুগরা’ তথা ‘বড়, মধ্যম, ছোট’ এই তিন মাত্রার ক্ষেত্রে ‘উসতা’ শব্দটির সাধারণ প্রয়োগ ঘটে থাকে । এর আরো দিক হচ্ছে, ‘উচ্চ/ ঊর্ধ্ব, মধ্যম, নিম্ন’, ‘দুই বিপরীত প্রান্তিকতা, মধ্যম/ মধ্যবর্তী’। অবস্থানগতভাবে মধ্যম হওয়া যেমন শব্দটির আক্ষরিক দিক, তেমনি নীতিগতভাবে/ পদ্ধতিগতভাবে মধ্যম হওয়াও শব্দটির বিশেষ প্রায়োগিক দিক। সুতরাং ‘উসতা’ মানে (দুই প্রান্তিকতার পরিবর্তে) ‘মধ্যমপন্থী’, ‘মধ্যম নীতি অবলম্বনকারী’। এছাড়া ‘উসতা’ শব্দটি ‘ভারসাম্যপূর্ণ’, ‘উত্তম গুণাবলি সমন্বিত’ ইত্যাদি অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
তিন মাত্রার মধ্যবর্তী অর্থে ‘উসতা’ শব্দের প্রয়োগকে সালাতের মূল ওয়াক্তসংখ্যা তিন ওয়াক্ত হওয়ার একটি প্রমাণ হিসেবে দাবি করা যেতে পারে। অন্যদিকে পরবর্তীতে ‘উসতা’ শব্দটির একটি প্রয়োগ হিসেবে হাতের পাঁচ আঙ্গুলের মধ্যমটিকেও নামকরণ করা হয়েছে এবং এভাবে ‘উসতা’ শব্দের এ প্রয়োগকে সালাতের ওয়াক্তসংখ্যা পাঁচ ওয়াক্ত হওয়ার একটি প্রমাণ হিসেবেও দাবি করা হয়ে থাকে। তবে উসতা বা মধ্যবর্তী শব্দটি আপেক্ষিক। তাই তিন, পাঁচ এমনকি সাত ওয়াক্তের মধ্যবর্তী সালাতও ‘আস সালাতিল উসতা’ শব্দের দ্বারা চিহ্নিত করা যেতে পারে। যেহেতু সালাতের ওয়াক্তসংখ্যা হবে পূর্ণসংখ্যক, তাই ‘উসতা’ শব্দের মাধ্যমে এটা নির্ধারিত হয়ে যায় যে, সালাতের ওয়াক্তসংখ্যা হবে বিজোড় সংখ্যা এবং তা ন্যুনতম ‘তিন’ হতে হবে।
‘আস সালাতিল উসতা’ শব্দটিতে ‘আস সালাত’ হচ্ছে মূল শব্দ এবং ‘আল উসতা’ হচ্ছে তার বিশেষণ। অন্য কথায়, এর অর্থ হচ্ছে, ‘সেই সালাত যা মধ্যবর্তী’। যারা দৈনিক দুই ওয়াক্ত সালাতের কথা বলেন, তাঁর ‘আস সালাতিল উসতা’কে শুধুমাত্র ‘ইয়াওমুল জুময়ার নিদাকৃত সালাত’ অর্থে গ্রহণ করে থাকেন এবং তাঁদের মধ্য থেকে কেউ কেউ ‘উসতা’ বলতে ‘ভারসাম্যপূর্ণ, উত্তম গুণাবলি সমন্বিত’ অর্থে গ্রহণ করেন।
উসতা শব্দটি (তার বিভিন্ন শব্দরূপে) আল কুরআনে যেসব আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে তা নিম্নরূপ:
উম্মাতান ওয়াসাতান ২:১৪৩:৪ (মধ্যমপন্থী উম্মাহ)
আস সালাতিল উসতা ২:২৩৮:৫ (মধ্যবর্তী সালাত)
আওসাত ৫:৮৯:১৭ (মধ্যম মানের), ৬৮:২৮:২ (মধ্যম মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি)
ওয়াসাতনা ১০০:৫:১ (মধ্যস্থলে ঢুকে পড়া)
দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে দাবি করা হয় যে, ‘আস সালাতিল উসতা’ দ্বারা মধ্যবর্তী ওয়াক্তের সালাত বুঝায় না। নিম্নে দৃষ্টিকোণদ্বয়ের সাপেক্ষে কৃত দাবি উল্লেখ করা হলো:
(১) একটি দাবি হলো যে, ‘আস সালাতিল উসতা’ বলতে কোন মধ্যবর্তী ওয়াক্তের সালাত বুঝায় না, বরং এটা দ্বারা ভারসাম্যপূর্ণ সালাতকে বুঝায়। কারণ, সব সালাতকেই হিফাযত করতে হবে, সেক্ষেত্রে আবার মধ্যবর্তী সালাতকে আলাদাভাবে বলার বিষয়টি যুক্তিসঙ্গত নয়, যেহেতু (ক) ‘সব সালাত’ শব্দের মধ্যে ‘আস সালাতুল উসতা’ স্বত:সিদ্ধভাবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, (খ) এভাবে একটি সালাতকে স্বতন্ত্রভাবে গুরুত্ব দিলে এর মাধ্যমে অন্য সালাতগুলোর গুরুত্ব কমে যায়।
(২) একটি দাবি হলো যে, ২:২৩৮ আয়াত অনুযায়ী, ‘সালাত’ এবং ‘মধ্যবর্তী সালাত’ শব্দের দ্বারা প্রচলিত নামাজ বুঝায় না। বরং উক্ত আয়াতে ‘সালাত’ বলতে ‘স্ত্রীলোকের অধিকার’ বা ‘তালাক সম্পর্কিত দায়-দায়িত্ব’ বুঝায়। কারণ এটি তালাকের বিধানের মাঝখানে দেয়া হয়েছে। যদি এখানে নামাজের কথা বুঝানো হয়, তবে কুরআনের বক্তব্য অসংলগ্ন বলে প্রমাণিত হয়, তালাকের মাঝখানে নামাজের কথা বলা এবং পরে আবার তালাকের কথা বলতে থাকা এটি কোনোভাবে যৌক্তিক হতে পারে না।
পর্যালোচনা:
প্রথম দাবিটির পর্যালোচনায় বলা যায় যে, ‘আস সালাতিল উসতা’ বলতে যদি ‘ভারসাম্যপূর্ণ সালাত’ বুঝায়, তাহলেও প্রশ্ন করা যায়, (ক) সালাতসমূহের মধ্যেই তো ভারসাম্যপূর্ণ সালাত আছে, তাহলে তা আলাদাভাবে বলা হলো কেন? (খ) তবে কি কোনো কোনো সালাত ভারসাম্য ছাড়াই করা যাবে? কোন সালাত ভারসাম্যের সাথে এবং কোন সালাত ভারসাম্য ছাড়া করা যাবে, এরূপ কোনো নীতিমালা রয়েছে কি?
দ্বিতীয় দাবিটির পর্যালোচনায় বলা যায় যে, বস্তুত এতে সালাত শব্দটি বহুমাত্রিক অর্থে প্রযোজ্য হবে। কারণ সালাত দ্বারা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সালাত বুঝায় না, বরং আল্লাহর বিধানের নিবিড় ও নিরবচ্ছিন্ন অনুসরণকে সালাত বলা হয়। সেই অর্থে আয়াতটিতে সাধারণভাবে দ্বীনের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখাগত বিধি-বিধান অনুসরণের সাথে সম্পর্ক সংযোগকে যথানিয়মে সংরক্ষণ করার প্রতি মনোযোগী হতে এবং বিশেষভাবে দ্বীনের মূল বা কেন্দ্রীয় বিধি-বিধানের সাথে সম্পর্ক সংযোগ সংরক্ষণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোন নির্দেশগুলো মূল নির্দেশ বলে সাব্যস্ত হবে তা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে কারো উপর বা কোনো ধরাবাঁধা একগুচ্ছ তালিকার উপর নির্ভরশীল করা হয়নি, বরং সে তার স্রষ্টার বিধানগ্রন্থ অধ্যয়ন করে নিজেই তা নির্ণয় করবে এবং এটাই তার সাথে তার স্রষ্টার সরসারি যোগাযোগের উপায়। তাই তালাকের বিধি-বিধানের প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখিত সালাওয়াত শব্দের মধ্যে তালাক সম্পর্কিত বিধি-বিধানসমূহকেও যথানিয়মে অনুসরণ করার অর্থটি অন্তর্ভুক্ত। এবং ‘আস সালাতিল উসতা’ বলতে স্রষ্টার প্রতি নিবেদিত ও তাঁর বিধি-বিধানের অনুকূলে থাকার মূল মনোভাব ও কর্মনীতিকে বুঝায়। বিভিন্ন ধরনের পেরেশানি (ভয়) অবস্থায় সে পদচারী অবস্থায় বা আরোহী অবস্থায় যেভাবে থাকুক সেভাবেই এ বিধি-বিধানের সাধ্যমতো সংরক্ষণ করবে। আবার এ বিষয়ে নির্দেশনাকে এভাবেও বুঝা যেতে পারে যে, ভয়যুক্ত স্থান থেকে পদচারী হয়ে নিকটবর্তী কোনো স্থানে হিজরত করবে এবং তা সম্ভব না হলে আরোহী হয়ে দূরবর্তী কোনো স্থানে হিজরত করবে। অন্যদিকে যখন নিরাপদ থাকবে তখন যেভাবে আল্লাহ তাকে প্রকৃতিগতভাবে শিক্ষা দিয়েছেন সে অনুযায়ী উত্তম পর্যায়ে সালাত সম্পদান করবে।
সেই সাথে আয়াতটি আনুষ্ঠানিক সালাতের অর্থেও প্রযোজ্য। সেক্ষেত্রেও তালাকের বিধি-বিধানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সালাত সম্পর্কিত নির্দেশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বিধি-বিধানের পারস্পরিক সম্পের্কের একটি উদাহরণ স্থাপিত হয়েছে। তালাকের বিধান এবং সালাতের বিধান মু’মিনদের জন্য একই প্রভুর বিধান। মু’মিনদের সমগ্র জীবন ব্যবস্থা আল্লাহর বিধানসমূহের পরিপালনের মাধ্যমেই গড়ে উঠবে এবং আল্লাহর বিধানগুলো পরস্পর অবিচ্ছিন্ন গুরুত্বে আবদ্ধ। সালাতের বিধানের মতোই তালাকের বিধানকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং তালাকের মতো পারস্পরিক সম্পর্কের জটিলতাপূর্ণ ব্যস্ততাতেও সালাতের বিষয়ে উদাসীন হওয়া যাবে না। তালাকের বিধানের মধ্যস্থলে সালাতের বিধান দেয়ার মাধ্যমে আমরা এ ধরনের একটি তাৎপর্য উপলব্ধি করার সুযোগ রয়েছে। তালাকের মতো জটিল বিষয়ের আবর্তে আমরা সালাত সম্পর্কে যেন উদাসীন হয়ে না পড়ি বরং সালাত হেফাযত/ সংরক্ষণ করা তথা কোনো সালাত অসম্পাদিত না রাখার বিষয়ে যেন সচেতন থাকি সে বিষয়ে গুরুত্বারোপের জন্য তালাকের বিধানের মধ্যে সালাতসমূহ হেফাযতের নির্দেশনা অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অনুরূপভাবে, সালাতসমূহের মধ্য থেকে যে সালাতটির হেফাযতের বিষয়ে বেশি মনোযোগী না থাকলে তা হেফাযত করতে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি সেই সালাতটি (আস সালাতিল উসতা) হেফাযতের জন্য বিশেষ গুরুত্ব আরোপ বা আলাদাভাবে নির্দেশ দেয়াও অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। আনুষ্ঠানিক সালাতের ক্ষেত্রে এর দ্বারা ‘আস সালাতিল উসতা’কে অন্য দুই ওয়াক্তের সালাতের চেয়ে অধিক গুরুত্বসম্পন্ন সাব্যস্ত করা হয়েছে বলে ধারণা করার প্রয়োজনীয়তা নেই। বরং ‘আস সালাতিল উসতা’র ক্ষেত্রে বিশেষ করে হেফাতকারী হতে বলার একটি তাৎপর্য হলো, এ সালাতটির হেফাযতে বেশি মনোযোগী না হলে তার হেফাযতে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
সুতরাং আনুষ্ঠানিক সালাতের প্রসঙ্গে প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘আস সালাতিল উসতা’ দ্বারা ‘মধ্যবর্তী ওয়াক্তে সম্পাদিতব্য সালাত’কে বুঝায়।
‘আস সালাত’ শব্দটি একবচন এবং এর দ্বারা দুটি বিষয় বুঝানো যেতে পারে: (১) একটি নির্দিষ্ট সালাত, (২) সাধারণভাবে সালাত, অর্থাৎ Common Noun অর্থে। যখন সুনির্দিষ্টভাবে বহুবচনের প্রয়োজন হয় (উদ্দেশ্যগত কারণে বা সাধারণভাবে বহুসংখ্যকের বিষয় তুলে ধরার ব্যাকরণগত রীতি অনুসারে) তখন বহুবচন ব্যবহার করা হয়। ‘আস সালাত’ এর বহুবচন আনুষ্ঠানিক সালাতের প্রসঙ্গে শুধুমাত্র একটি আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে, তা হলো ২:২৩৮ আয়াত। তাই আয়াতটি আমাদেরকে দৈনন্দিন সালাতের ওয়াক্তসংখ্যা জানতে সাহায্য করে।
২:২৩৮ আয়াতে ‘আস সালাওয়াত’ এবং ‘আস সালাতিল উসতা’ শব্দ ব্যবহারের প্রেক্ষিতে জ্ঞাতব্য তথ্য হলো:
(১) ‘আস সালাত’ শব্দটি একবচন হলেও এ শব্দটি দ্বারা কুরআনে অনেক স্থানে সাধারণভাবে সালাতকে বুঝানো হয়েছে, কিন্তু এখানে বহুবচনে ‘আস সালাওয়াত’ শব্দটি উল্লেখ করার মাধ্যমে বহুবচনের উপর জোর দেয়া হয়েছে তথা সালাতসমূহকে হেফাযতের বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
(২) ‘আস সালাতিল উসতা’ দ্বারা ‘মধ্যবর্তী সালাতটিকে’ অর্থাৎ মধ্যবর্তী ওয়াক্তে যে বাধ্যতামূলক সালাত সম্পাদন করতে হবে সেটিকে বুঝানো হয়েছে।
পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, দৈনন্দিন তিন ওয়াক্ত সালাত বাধ্যতামূলক: (১) সালাতিল ফজর (২) আস সালাতিল উসতা এবং (৩) সালাতিল ইশা। আয়াতসমূহের নির্দেশনা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে বুঝা যায় যে, প্রতিটি ওয়াক্তের প্রথম পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক সালাত এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ঐ আনুষ্ঠানিক সালাতের শিক্ষা অনুসারে বাস্তব সালাত প্রতিষ্ঠা করাই হলো ‘সালাত প্রতিষ্ঠা’ করার পূর্ণ স্বরূপ। এভাবে সালাতের ওয়াক্তসমূহের সাথে আনুষ্ঠানিক সালাত ও বাস্তব সালাত নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত।
প্রতি ওয়াক্তে অন্তত একবার করে আনুষ্ঠানিক সালাত সম্পাদন করা বাধ্যতামূলক। তবে একই ওয়াক্তে একাধিকবার আনুষ্ঠানিক সালাত করার বিষয়ে আদেশও নেই, নিষেধও নেই। বিষয়টি বুঝার জন্য সালাতের পূর্বশর্ত হিসেবে থাকা ওজুর বিধান লক্ষণীয়। ওজু সম্পর্কিত নির্দেশ হলো ‘ফাগছিলূ’ (তোমরা ধৌত করো)। কিন্তু একবার ওজু করার সময় মুখ-হাত ইত্যাদি কতবার ধৌত করতে হবে? সেজন্য কোনো সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং আদেশের আওতায় গ্রহণযোগ্য ন্যুনতম পরিমাণই বাধ্যতামূলক হিসেবে সাব্যস্ত হবে। তাই যদি কেউ প্রতিবার ওজু করার সময় একবার করে মুখ-হাত ইত্যাদি ধৌত করে তাহলে তাতেই তার আদেশ পরিপালন হয়ে যাবে। কিন্তু কেউ যদি একাধিকবার ধৌত করে তা দোষণীয় নয়। প্রতি ওয়াক্তে কয়বার আনুষ্ঠানিক সালাত সম্পাদন করা যাবে বিষয়টিও অনুরূপ। তবে সাধারণত একবার করে আনুষ্ঠানিক সালাত সম্পাদন করে সালাতের শিক্ষা অনুযায়ী ব্যাপকভিত্তিক বা বাস্তব কর্মে আল্লাহর বিধানের নিরবচ্ছিন্ন অনুসরণের দিকে মনোযোগী হওয়াই অধিক সঙ্গত, যেহেতু এটাই আনুষ্ঠানিক সালাতের উদ্দেশ্য।
তাসবীহের নির্দেশ দ্বারা স্বতসিদ্ধভাবেই সালাতের নির্দেশ বুঝায় না। বরং সালাতের ওয়াক্তসংখ্যা এবং তাসবীহের ওয়াক্তসংখ্যা ভিন্ন। তবে তাসবীহ ও সালাতের কিছু ওয়াক্ত Common এবং কিছু ওয়াক্ত Uncommon।
৫০:৩৯-৪০ আয়াত এবং ২০:১৩০ আয়াত অনুযায়ী, তাসবীহের জন্য ৮টি সময়সীমার নির্দেশ রয়েছে। ২০:১৩০ আয়াতে ‘আনাআল্লাইলি’ এবং ‘আতরফান্নাহারি’ উভয়টি বহুবচন।
‘আনাআ’ শব্দটির একবচন হচ্ছে ‘ইনইউন’। ‘ইনইউন’ শব্দটি কুরআনে ব্যবহৃত হয়নি। এবং ‘আতরাফ’ শব্দের একবচন হচ্ছে ‘তরাফ’। ‘তরাফ’ শব্দটি কুরআনে ‘অংশ / ভাগ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ক্বাবলা তুলুয়িশ শামস’ এবং ‘ক্বাবলা গুরুবিশ শামস’ (ক্বাবলা গুরুবিহা) হচ্ছে দিনের দুটি তরাফ। দিনের এ দুটি তরাফ উল্লেখ করা সত্ত্বেও বলা হয়েছে, ‘আতরফান্নাহারি’ (দিনের তরাফসমূহে)। সুতরাং এখানে ‘আতরফান্নাহারি’ মানে হচ্ছে দিনের ঐ দুটি তরাফ ছাড়াও ‘অন্যান্য তরফে’।
এমতাবস্থায় ঐ দুটি তরাফ এবং অন্যান্য আয়াত সাপেক্ষে আরো তিনটি তরাফ মিলে মোট ৫টি তরাফে তাসবীহের নির্দেশ পাওয়া যায়। যেমন, যুহর বা দ্বিপ্রহরে তাসবীহের নির্দেশনা রয়েছে। তাই তাসবীহের প্রসঙ্গে দ্বিপ্রহর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দুটি তরাফ পাওয়া যায়। এবং সূর্যোদয়ের পূর্ববর্তী তরাফ বাদ দিলে সূর্যোদয় থেকে মধ্যাহ্ন পর্যন্ত দুটি তরাফ পাওয়া যায়, যা মধ্যাহ্ন থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দুটি তরাফের বিপরীতে অবস্থান করছে। এভাবে সূর্যোদয় পূর্ববর্তী একটি তরাফ এবং সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চারটি তরাফ হয়। সুতরাং দিনকে সালাত প্রসঙ্গে ২ তরাফে এবং তাসবীহ প্রসঙ্গে ৫ তরাফে বিভক্ত করা হয়েছে।
এবং ‘আনাআল লাইলে’ তথা রাতের অন্তত ৩টি প্রহরে তাসবীহের নির্দেশ পাওয়া যায়। তাসবীহের জন্য রাতের অন্তত তিনটি প্রহর নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আয়াত থেকে পরোক্ষ নির্দেশনার অনুসরণ করা সম্ভব। তাতে সালাতিল ইশার আগে, পরে ও রাতের শেষ প্রহরে তাসবীহ করার জন্য তিনটি সময়কাল নির্ধারণ করা যায়। এভাবে দিন-রাত মিলিয়ে ৮টি সময়সীমায় তাসবীহের নির্দেশ রয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে দৈনন্দিন রাতের শেষ প্রহরে তাসবীহ ও ক্ষমা প্রার্থনা বাধ্যতামূলক করা হয়নি, বরং এটিকে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং মু’মিনরা তাদের ঈমানের বৈশিষ্ট্যগত কারণে স্বত:স্ফূর্তভাবে তা করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ঈমান বৃদ্ধির উপায় হিসেবে এক্ষেত্রে চেষ্টা চালু রাখা প্রয়োজন।
একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, আল্লাহ সকাল-বিকাল যিকর ও তাসবীহ করার যে নির্দেশ দিয়েছেন তা দ্বারা কি নির্দিষ্টভাবে সকাল ও বিকালে তাসবীহ করার নির্দেশ বুঝায় নাকি রাতে-দিনে তথা সবসময় তাসবীহ করার নির্দেশ বুঝায়? এ বিষয়ে ভাষারীতি অনুসারে বলা যায় যে, পূর্ব-পশ্চিম বলতে যেমন পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ সবদিক বুঝায়, তেমনি সকাল-বিকাল বলতেও সকাল-বিকাল-দুপুর-সন্ধ্যা সবসময় বুঝায়। এ বিষয়ে মধ্যরাতের ঘুমের সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময়কে বুঝানোর জন্য বিভিন্ন ভাষারীতি রয়েছে, যেমন সকাল-বিকাল, সকাল-সন্ধ্যা, সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা-দুপুর ইত্যাদি। বিভিন্ন আয়াতে এভাবে বিভিন্ন শব্দ গুচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে। গভীর বিশ্লেষণে কোন স্থানে কোন কারণে কোন শব্দগুচ্ছকে বাছাই করা হয়েছে তা জানা-বুঝা সম্ভব হতে পারে। অর্থাৎ বিষয়টি স্বতন্ত্র গবেষণার দাবি রাখে। তবে এই বিভিন্ন বিন্যাসে থাকা শব্দগুচ্ছ একই বাগর্থ প্রকাশ করে এবং তাহলো ‘দিন-রাতের বিভিন্ন সময় তথা প্রায় সবসময়’। তা সত্ত্বেও যেহেতু প্রাথমিকভাবে ‘সূর্যোদয়ের আগে ও সূর্যাস্তের আগে’ শব্দগুচ্ছের দ্বারা সময়ের সীমিত পরিসরকে বুঝায় এবং সাধারণভাবে রাতে-দিনে কোনো কাজ করার বিষয়ে ‘রাতে-দিনে’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহারের উদাহরণ রয়েছে (২১:২০, ৪১:৩৮, ৭১:৫), তাই সকাল-বিকাল ইত্যাদি যে সময়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোতে তাসবীহ করা যেন অসম্পাদিত থেকে না যায়, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। এসব সময়সীমার প্রতিটিতে অন্তত একবার ‘সুবহানাল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর তাসবীহ’ মৌখিক উচ্চারণ ও মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতিসহ সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
এক. প্রতিদিন দুই ওয়াক্ত সালাত এবং ‘আস সালাতিল উসতা’ শুধুমাত্র ইয়াওমুল জুমুয়াতে- উপলব্ধিটির পর্যালোচনা
যারা বলেন যে, প্রতিদিন দুই ওয়াক্ত সালাত এবং ‘আস সালাতিল উসতা’ শুধুমাত্র ইয়াওমুল জুমুয়াতে তাঁরা নিম্নের তিনটি পয়েন্ট উপস্থাপন করেন:
১. ১১:১১৪ আয়াতে বলা হয়েছে ‘সালাত প্রতিষ্ঠা করো দিনের দুই তরাফে / প্রান্তভাগে এবং রাতের মধ্য থেকে যুলাফে / নিকটবর্তী অংশে’। আয়াতটিতে দিনের দুটি তরাফে / প্রান্তভাগে সালাত সম্পাদন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু সে তরাফ / প্রান্তভাগ দুটি বলতে কোন দুটি তরাফ / প্রান্তভাগকে বুঝাবে তা চিহ্নিত করার জন্য ‘ওয়া’ (এবং, তথা) শব্দযোগে বলা হয়েছে ‘রাতের মধ্য থেকে যুলাফে / নিকটবর্তী অংশে’। অর্থাৎ এখানে ‘ওয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ‘ব্যাখ্যামূলক অর্থে’। সংক্ষেপে বলা যায়, ‘তরাফায়িন নাহারি’ = ‘যুলাফাম মিনাল লাইলি’। অন্য কথায় এখানে ‘সালাতিল ফজর’ এবং ‘সালাতিল ইশা’ প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ‘সালাতিল ইশাকে’ প্রচলিতভাবে ‘সালাতিল মাগরিব’ বলা হয়। এবং ‘প্রচলিত সালাতিল ইশা’ প্রকৃতপক্ষে ‘ইলা গাছাক্বিল লাইলের’ পরে প্রতিষ্ঠা করা হয় বিধায় তা গ্রহণযোগ্য নয়। দিনের প্রথম তরাফের সালাত হলো ‘সালাতিল ফজর’ এবং দ্বিতীয় তরাফের সালাত হলো ‘সালাতিল ইশা’। সালাতিল ইশার সময়সীমা হলো ‘শাফাকের’ সময়সীমা। কারণ শাফাক্বের পর লাইল তথা গাছাক্বিল লাইল শুরু হয়।
২. ১৭:৭৮ আয়াতে বর্ণিত ‘লিদুলুকিশ শামসি ইলা গাছাক্বিল লাইল’ এ যে সালাতটি প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা হলো ‘সালাতিল ইশা’। ‘দুলুকিশ শামস’ মানে সূর্যাস্তের সময় সূর্য অস্তগমনে ঢলে পড়া। অন্য কথায় দিনের দ্বিতীয় তরাফের ক্ষেত্রে ‘যুলাফাম মিনাল লাইল’ এবং ‘লিদুলুকিশ শামসি ইলা গাছাক্বিল লাইল’ এবং ‘শাফাক্ব’ একই বিষয়।
৩. ইয়াওমুল জুমুয়াতে যে সালাতটির জন্য নিদা (আযান)করতে বলা হয়েছে তা হলো যার আগে-পরে ব্যবসায় ইত্যাদি ব্যস্ততা থাকবে। সুতরাং ঐ সালাতটি হলো সেদিনের নিয়মিত দুটি সালাত ‘সালাতিল ফজর’ এবং ‘সালাতিল ইশা’ এর মধ্যবর্তীতে একটি সালাত। এজন্য এ সালাতের নাম হলো ‘আস সালাতিল উসতা’। অন্য কথায় ‘আস সালাতিল উসতা’ শুধুমাত্র ইয়াওমুল জুমুয়াতে আছে, প্রতিদিন নয়। এজন্যই ‘সালাওয়াত’ (সালাতসমূহ) হিফাজাত করার নির্দেশের পাশাপাশি ‘আস সালাতিল উসতা’ হিফাজাতের জন্য আলাদাভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ‘আস সালাতিল উসতা’ বিশেষ (অনিয়মিত) সালাত হওয়ার কারণে এর আগে ‘আল’ যুক্ত হয়েছে, কিন্তু নিয়মিত দুটি সালাত (সালাতিল ফজর ও সালাতিল ইশা) এর পূর্বে ‘আল’ যুক্ত হয়নি।
৪. এটি আবশ্যক নয় যে, ২:২৩৮ আয়াতে ‘সালাওয়াত’ (সালাতসমূহ) শব্দটি বহুবচন হওয়ার কারণে প্রতিদিন দুই ওয়াক্তের বেশি সালাত প্রতিষ্ঠা করাকে বাধ্যতামূলক মনে করতে হবে। কারণ সমগ্র জীবনের সকল সালাতকে একসাথে বুঝানোর জন্য বহুবচন ব্যবহার করা যেতে পারে।
৫. আল্লাহ প্রকৃতির অনুসরণ করতে বলেছেন (৩০:৩০)। সারিবদ্ধ পাখিরা সালাত করে (২৪:৪১)। পাখিরাও সকাল-সন্ধ্যায় সালাত ও তাসবীহ করে (৩৮:১৮-১৯)। এছাড়া অনেক আয়াতে আল্লাহ সকাল-সন্ধ্যায় তাসবীহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং প্রতিদিন দুই ওয়াক্ত সালাত ও তাসবীহ করা প্রকৃতিসম্মত এবং বিভিন্ন আয়াতের দ্বারা নির্দেশিত।
পর্যালোচনা:
১. এখানে ‘তরাফায়িন নাহারি’ এবং ‘যুলাফাম মিনাল লাইলি’কে সমার্থক বিবেচনা করা যেতে পারে না। কারণ ‘যুলাফাম মিনাল লাইল’ মানে হলো ‘রাতের মধ্যকার যুলাফ’। আবার তরাফায়িন্নাহারি এর ‘তরাফায়’ শব্দটি দ্বিবচন হওয়ায় যদি ‘রাতের মধ্যকার নিকটবর্তী অংশ’ বলতে ঐ দুটি তরাফের নিকটবর্তী দুটি ভিন্ন নিকটবর্তী অংশকে বুঝাতো, তাহলে ‘যুলাফ’ (বহুবচন) ব্যবহৃত না হয়ে তরাফায় এর সাথে সম্পর্ক রেখে ‘যুলফাতাইন’ (দ্বিবচন) ব্যবহৃত হতে পারতো।
এছাড়া এ ব্যাখ্যায় ‘তরাফায়িন নাহার’ এবং ‘যুলাফাম মিনাল লাইল’ একে অন্যের সমার্থক অর্থে গ্রহণ করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ফজর দিনের অংশ হলে ইশাকেও দিনের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত করতে হয়। তেমনি ইশাকে রাতের অংশ সাব্যস্ত করলে ফজরকেও রাতের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত করতে হয়।
রাতদিনের সময়সীমা অধ্যায়ে বিভিন্ন আয়াতের তথ্য পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা জেনেছি যে, ফজর দিনের অংশ এবং ইশা রাতের অংশ। এর ফলে দৈনন্দিন দুই ওয়াক্ত সালাতের উপলব্ধির ক্ষেত্রে ‘তরাফায়িন নাহারি ওয়া যুলাফাম মিনাল লাইলি’ বাক্যাংশটি এবং বিশেষ করে এর ‘ওয়া’ অব্যয়টির যেরূপ ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে হয়, তা যথাযথ বিবেচিত হয় না।
২. ‘দুলুকিশ শামস’ শব্দের অর্থ অভিধানে ‘মধ্যাহ্নে সূর্য ঢলে পড়া’ এবং ‘সূর্যাস্ত’ উভয়টি লেখা আছে। কিন্তু আল কুরআনে সূর্যের অবস্থান্তরের জন্য তিনটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যথা ‘তুলুয়িশ শামস’ (সূর্যোদয়), ‘গুরুবিহা’ বা ‘গুরুব’, এক্ষেত্রে সর্বনামের পরিবর্তে সূর্য (শামস) শব্দটি প্রতিস্থাপন করলে শব্দটি হয় ‘গুরুবিশ শামস’ (সূর্যাস্ত) এবং ‘দুলুকিশ শামস’। যেহেতু সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের জন্য আলাদা দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং সে দুটি হচ্ছে সূর্যের অবস্থান্তরের প্রথম ও শেষ পর্যায়। তাই অন্য যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা এ দুয়ের মধ্যবর্তীতে মধ্যাহ্নে সূর্য ঢলে পড়া অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এটিই স্বত:সিদ্ধ যৌক্তিক তথ্য। এ তিনটি শব্দ ‘তুলূ, দুলূক ও গুরূব’ একই ধরনের প্যাটার্নে তৈরি তিনটি মাসদার / ক্রিয়াবিশেষ্য। সালাতের ওয়াক্ত সম্পর্কিত সব আয়াতের সাথে ‘দুলুকিশ শামস’ অর্থ ‘সূর্য মধ্যাহ্নে ঢলে পড়া’ অর্থটিই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
৩. ‘আস সালাতিল উসতা’ শব্দে সালাত শব্দের আগে ‘আল’ ব্যবহৃত হওয়ার কারণ হলো, এতে ‘উসতা’ শব্দটি সালাত শব্দের বিশেষণ। ‘আস সালাতিল উসতা’ বলতে বুঝায় ‘সেই সালাত যা উসতা / মধ্যবর্তী’। তাই ‘আস সালাতিল উসতাকে’ শুধুমাত্র জুমুয়ার দিনের জামায়াতে সম্পাদনীয় সালাত অর্থে গ্রহণ করার আবশ্যকতা নেই, বরং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য আয়াত অনুসারে এর দ্বারা দৈনন্দিন তিন ওয়াক্ত সালাতের মধ্যবর্তী ওয়াক্তের সালাতও ‘আস সালাতিল উসতা’ হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
৪. সাধারণভাবে সালাতসমূহকে বুঝাতেও ‘সালাওয়াত’ (বহুবচন) শব্দ ব্যবহৃত হতে পারে। তবে এটি দৈনন্দিন তিন ওয়াক্ত সালাতকেও বুঝায়, যেহেতু অন্যান্য আয়াতের আলোকে তিন ওয়াক্ত সালাত সম্পর্কে জানা যায়, তাই ‘সালাওয়াত’ শব্দটি দ্বারা দৈনন্দিনের ক্ষেত্রে ঐ তিন ওয়াক্তের সালাতকে এবং ‘আস সালাতিল উসতা’ দ্বারা এর মধ্যকার মধ্যবর্তী সালাতকে বুঝানোর ডাইমেনশনও প্রতীয়মান হয়।
৫. প্রকৃতির মধ্যে ‘জড় প্রকৃতি, উদ্ভিদ প্রকৃতি, প্রাণী প্রকৃতি, মানব প্রকৃতি’ ইত্যাদির মধ্যে অনেক মিল এবং অমিল রয়েছে। মিলের দিকগুলোতে অন্যদের থেকে শিক্ষা নেয়ার আছে, কিন্তু অমিলের ক্ষেত্রে মানুষকে মানুষের বিশেষ মানবীয় প্রকৃতি অনুসারে কাজ করতে হবে। মানুষের জন্য দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) হচ্ছে মানবীয় প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল বিধি-ব্যবস্থা। কুরআনে সাধারণভাবে সকাল-সন্ধ্যা তাসবীহ করার নির্দেশ রয়েছে। পাখিরাও সকাল সন্ধ্যা তাসবীহ করে। কিন্তু তাসবীহ এবং সালাত হুবহু অভিন্ন নয়, যদিও এর একটির মধ্যে অন্যটির উপাদানও পাওয়া যায়। ‘প্রত্যেকে জেনে নিয়েছে তাদের সালাত ও তাসবীহ সম্পর্কে’। তাসবীহ হলো আল্লাহর পবিত্রতা-মহিমা জ্ঞাপন এবং সালাত হলো আল্লাহর বিধি-বিধানের নিবিড় ও নিরবচ্ছিন্ন অনুসরণ। সালাতের একটি ধরন হচ্ছে আনুষ্ঠানিক সালাত। মানুষের জীবন যাপন পদ্ধতিতে দৈনন্দিন কার্যনির্বাহে তিন ওয়াক্ত সালাতের নির্দেশনাকে প্রকৃতিসম্মত বিবেচনা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। মানুষ প্রধানত তিন বেলা খাবার গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে তার দিনের মৌলিক তিনটি বিভাগ তৈরি হয়। এ তিনটি সময়গত বিভাগে সে তিন ধাপে সালাত সম্পাদন করবে এটা অবশ্যই প্রকৃতিসম্মত বলে বিবেচিত হয়। ৭:৩১ আয়াতে প্রত্যেক মাসজিদের কার্যক্রম উপলক্ষে সুন্দর পোশাক গ্রহণের নির্দেশনার পাশাপাশি পানাহারের বিষয়ে বিধি-নিষেধ বর্ণিত হয়েছে। এবং মাসজিদের কার্যক্রমের একটি বিশেষ দিক হলো সালাত। এভাবে সালাতের সাথে পানাহারের বিষয়টির একটি সম্পর্ক বিবেচনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
পরিশেষে বলা যায় যে, দৈনন্দিন দুই ওয়াক্ত সালাতের উপলব্ধির পেছনে কিছু বাস্তব কার্যকারণ বিদ্যমান রয়েছে। তবে পর্যালোচনা সাপেক্ষে এ উপলব্ধির চেয়ে দৈনন্দিন তিন ওয়াক্ত সালাতের উপলব্ধিই আয়াতসমূহের বক্তব্য বিষয় ও বাস্তবতার সাথে অধিক সামঞ্জস্যশীল বলে বিবেচিত হয়।
দুই. প্রতিদিন তিন ওয়াক্ত সালাত এবং গাছাক্বিল লাইল মানে সূর্যাস্ত উপলব্ধিটির পর্যালোচনা
যাঁরা প্রতিদিন তিন ওয়াক্ত সালাত বলে উপলব্ধি ব্যক্ত করেন তাঁদের অনেকে নিম্নের তিনটি পয়েন্ট উপস্থাপন করে থাকেন:
১. ১১:১১৪ আয়াতে ‘সালাতিল ফজর’ ও ‘সালাতিল ইশা’ এ দুটি সালাতের জন্য নির্দেশ রয়েছে। এক্ষেত্রে আয়াতের ব্যাখ্যা তাঁরা সেটিই গ্রহণ করেন যেটি যারা প্রতিদিন দুই ওয়াক্ত সালাতের কথা বলেন তাঁরাও উপস্থাপন করেন।
২. ২:২৩৮ আয়াতে ‘আস সালাতিল উসতা’ হেফাজতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এবং এটি প্রতিদিন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর সময়সীমা বর্ণিত হয়েছে ১৭:৭৮ আয়াতে ‘লিদুলুকিশ শামসি ইলা গাছাক্বিল লাইল’। এ পুরো সময়টাতে একটি সালাত (আস সালাতিল উসতা) প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ‘দুলুকিশ শামস’ হচ্ছে মধ্যাহ্নে সূর্য পশ্চিমাকাশের দিকে প্রথম ঢলে পড়া। এবং গাছাক্ব (অন্ধকারাচ্ছন্নতা) যদিও সূর্যাস্তের অব্যবহিত পূর্বেই শুরু হয় তবুও ‘গাছাক্বিল লাইল’ বলার কারণে এটি লাইলের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। এবং সূর্যাস্তের মাধ্যমে লাইল (রাত) শুরু হয় বিধায় ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ বলতে ‘সূর্যাস্তের সময় পর্যন্ত’ বলে বুঝানো হয়েছে।
৩. এ উপলব্ধির ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় হলো, দিন বলতে বুঝানো হয় ‘সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়’। এবং রাত বলতে বুঝায় ‘সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়’। ফজর এবং ইশাকে ধরা হয় যে, তা ‘তরাফায়িন নাহার’ বা দিনের এমন দুই প্রান্তভাগ যা না রাত, না দিন, বরং এতে রাত দিনের মধ্যে এবং দিন রাতের মধ্যে প্রবেশ করে তাই এটি হলো ‘দিন ও রাতের সংযোগরেখা’। এ মত অনুসারে, সিয়ামের সময়সীমা হচ্ছে ফজর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
পর্যালোচনা:
১. প্রথম পয়েন্টটির পর্যালোচনা পূর্বেই করা হয়েছে।
২. দ্বিতীয় পয়েন্টের পর্যালোচনায় বলা যায় যে, এক্ষেত্রে ‘ইলাল লাইল’ (২:১৮৭) ও ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ (১৭:৭৮) এক ও অভিন্ন হয়ে যায়। অথচ ‘ইলাল লাইল’ এর অর্থ হলো ‘রাতের সূচনা’ পর্যন্ত সময় এবং ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ এর অর্থ হলো ‘রাতের ঘন অন্ধকারের প্রথম পর্যায় পর্যন্ত’। যেহেতু সূর্যাস্তের পরে প্রথম পর্যায়ে ‘শাফাক্ব’ থাকে (৮৪:১৬-১৭) তাই এ সময়টিকে ‘গাছাক্ব’ বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে না। বরং ‘গাছাক্ব’ তো ‘শাফাক্ব’ এর পরেই হয়।
৩. ‘সূর্যোদয়ের আগে ফজর না দিনের অংশ এবং না রাতের অংশ, অনুরূপভাবে সূর্যাস্তের পরের ইশা না দিনের অংশ না রাতের অংশ, বরং এ দুটি সময় হলো দিন-রাতের সংযোগ রেখা’ তথ্যটি পর্যালোচনা সাপেক্ষ। এ দুটি সময় দিন-রাতের সংযোগ রেখা হওয়া যেমন বাস্তবতার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝা যায়, অনুরূপভাবে কুরআনের বর্ণনা থেকেও জানা যায়। কিন্তু এ সংযোগ রেখাদ্বয়ের মধ্য থেকে ফজরকে দিনের তরাফের মধ্যে ধরতে হবে। কারণ ১১:১১৪ ও ২৪:৫৮ আয়াত অনুযায়ী, দিনের দুই তরাফের প্রথম তরাফ হলো ফজর, ২:১৮৭ অনুযায়ী এটি রাতের কালো রেখা শেষে দিনের সাদা রেখার সময়সীমা, সর্বোপরি ৯৭:৫ আয়াত অনুযায়ী, ফজর উদয় পর্যন্ত রাত থাকে তথা ফজর রাতের অংশ নয়। এসব তথ্য থেকে স্পষ্ট যে, ফজর দিন-রাতের সংযোগ রেখা হলেও সময়গত বিবেচনায় এটি দিনের অংশ হিসেবে বিবেচ্য। এছাড়া ১১:১১৪ আয়াতে ‘দিনে-রাতের সংযোগ অংশ’ বলা হয়নি, বরং দিনের তরাফ বা ভাগের কথা বলা হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, এটি দিনের পর্যায়ভুক্ত, এটি রাতের পর্যায়ভুক্ত নয়।
অন্যদিকে ইশা দিনের দ্বিতীয় তরাফ হতে পারে না। কারণ ১১:১১৪ আয়াতে বর্ণিত ‘যুলাফাম মিনাল লাইল’ শব্দগুচ্ছের ‘মিনাল লাইল’ শব্দের দ্বারা বুঝা যায় যে, এটি ‘রাতের অন্তর্ভুক্ত’। আবার এটি হলো ‘ইলাল লাইল’ (রাতের সূচনা) থেকে ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ (রাতের ঘন অন্ধকারের প্রথম পর্যায়) পর্যন্ত সময়সীমা, যার অর্থ হলো এটি রাতের অংশ। ৩৬:৩৭ আয়াত অনুযায়ী, দিন শেষে রাত থেকে যখন দিনকে অপসারিত করা হয় তখনকার সময়টি রাতের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
এক কথায়, ফজর ও ইশা দিন রাতের সংযোগ রেখায় অবস্থান করলেও এর মধ্য থেকে ‘ফজর’ দিনের অংশ এবং ‘ইশা’ রাতের অংশ।
তিন. প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত এবং ‘লিদূলুকিশ শামসি’ মানে ‘তিনবার সূর্য ঢলে পড়া’ তথা ‘যুহর, আসর, মাগরিব’ উপলব্ধির পর্যালোচনা
যাঁরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত বাধ্যতামূলক বলে উপলব্ধি করেন তাঁরা দুটি পয়েন্ট উপস্থাপন করেন-
১. ১১:১১৪ আয়াতে বর্ণিত ‘তরাফায়িন নাহার’ বা ‘দিনের দুই তরাফের’ সালাত হচ্ছে ‘সালাতিল যুহর’ এবং ‘সালাতিল আসর’। এবং ‘যুলাফাম মিনাল লাইল’ এর সালাত হচ্ছে ‘সালাতিল মাগরিব, সালাতিল ইশা’ এবং সালাতিল ফজর।
২. ১৭:৭৮ আয়াতে বর্ণিত ‘লিদুলুকিশ শামসি’ এর সালাত হলো ‘সূর্য তিনবার ঢলে পড়ার সময়গুলোর সালাত’ তথা ‘সালাতিল যুহর’ সালাতিল আসর এবং সালাতিল মাগরিব। এবং ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ এর সালাত হলো ‘সালাতিল ইশা’। এবং সালাতিল ফজরের বিষয়টি ২৪:৫৮ আয়াতে প্রত্যক্ষভাবে এবং ১৭:৭৮ আয়াতে ‘কুরআনাল ফজর’ শব্দের মাধ্যমে বলা হয়েছে।
পর্যালোচনা:
১. দিনের দুই তরাফের সালাত হলো ‘সালাতিল যুহর ও সালাতিল আসর’- এ বাক্যটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ৯৭:৫ ও ২:১৮৭ আয়াত অনুসারে ফজর দিনের অংশ।
২. ‘লিদুলূকিশ শামস’ অর্থ ‘সূর্য তিনবার ঢলে পড়ার সময়গুলো’ করাও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এর কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। সূর্য মধ্যাহ্নে ঢলে পড়ার পর এটি শুধুমাত্র তিনবার হেলে পড়ে না, বরং অসংখ্যবার ঢলে পড়তে থাকে। এমতাবস্থায় এর মধ্য থেকে তিনবার সূর্য হেলে পড়ে বলে অর্থ গ্রহণের অবকাশ নেই। এছাড়া আয়াতটিতে ব্যবহৃত ‘দুলূক’ শব্দটি একটি মাসদার / ক্রিয়াবেশষ্য। সূর্যের সাথে সম্পর্কিত অন্য দুটি ক্রিয়াবিশেষ্য হলো ‘তুলূ’ (সূর্যোদয়) ও গুরূব (সূর্যাস্ত)। যদি ‘দুলূক’ অর্থ ‘সূর্য তিনবার ঢলে পড়া’ হয়, তাহলে ‘তুলূ’ অর্থ হবে ‘সূর্য তিনবার উদয় হওয়া’ এবং ‘গুরূব’ অর্থ হবে ‘সূর্য তিনবার অস্ত যাওয়া’। কিন্তু সেই অর্থ করা হয় না এবং সেই অর্থ অনুসারে সালাতের ওয়াক্ত সংখা নির্ণয় করা হয় না। সুতরাং ‘দুলূক’ অর্থ ‘সূর্য তিনবার ঢলে পড়া’ অর্থটি গ্রহণযোগ্য নয় এবং তাই এ শব্দের ভিত্তিতে ‘সালাতুল যুহর, সালাতুল আসর ও সালাতুল মাগরিব’ এর কথা বুঝারও কোনো সুযোগ নেই। বরং ‘লিদুলূকিশ শামসি’ অর্থ সূর্য হেলে পড়া এবং এর দ্বারা মধ্যাহ্নে সূর্য প্রথমবার হেলে পড়াকেই বুঝায়।
আরবিতে একটি রীতি হচ্ছে কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা স্থানের জন্য গুণবাচক শব্দ হিসেবে কোনো মাসদারকে (ক্রিয়া বিশেষ্যকে) বাছাই করা। যেমন, ২৮:৫৭ ও ২৯:৬৭ আয়াতে ‘হারাম’ শব্দটি স্থান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অনুরূপভাবে, সালাতের স্থানকেও সালাত বলা হয়। ২২:৪০ আয়াতে ‘সালাওয়াত’ (সালাতের বহুবচন) শব্দটি ‘সালাতের স্থানসমূহ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে সালাত শব্দটি তার সাধারণ অর্থে তথা যোগাযোগ অর্থেও প্রযোজ্য আবার আনুষ্ঠানিক সালাতের অর্থেও প্রযোজ্য। আয়াতটি হলো:
২২:৪০ :: যাদেরকে তাদের নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধু এ কারণে যে,তারা বলে,‘রব্বুনাল্লাহ’ (আল্লাহ আমাদের প্রভু)। এবং যদি আল্লাহ (তাঁর বিধানের বা প্রাকৃতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে) মানুষকে প্রতিহত না করতেন তাদের একদল দ্বারা অন্য দলকে, তাহলে অবশ্যই বিধ্বস্ত করা হতো আশ্রম / মঠ (সওয়ামি’) (৫) , আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বাণিজ্যকেন্দ্র (বিয়া’) (৬) , উপাসনালয় (সালাওয়াত) (৭) এবং মাসাজিদ (৮) যেগুলোতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। এবং নিশ্চয় আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন যে তাঁকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমতাবান, শক্তিমান।
(৫) নৈতিক সংশোধন ও প্রশিক্ষণমূলক স্বল্পকালীন অবস্থানের কেন্দ্রসমূহ, খৃস্টান ধর্মাবলম্বী ও অন্যান্যদের আশ্রম/মঠ
(৬) ক্রয়বিক্রয় চুক্তি, অঙ্গীকার ও শপথ অনুষ্ঠানের কেন্দ্রসমূহ
(৭) যোগাযোগ ও সমর্থন যোগানোর কেন্দ্রসমূহ, ভজন-মন্দির, বিশেষ করে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের উপাসনাগৃহ (সালাতের স্থান)
(৮) মাসজিদসমূহ, সাজদাহ সম্পাদনের কেন্দ্রসমূহ, আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের প্রতিষ্ঠানসমূহ
২২:৪০ আয়াতে ‘সালাওয়াত’ ও ‘মাসাজিদ’ দুটি স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এবং আয়াতটিতে মোট চারটি স্থানের (সওয়ামি, বিয়া’, সালাওয়াত ও মাসাজিদ) উল্লেখ করায় বুঝা যায় যে, সালাওয়াত ও মাসাজিদ দুটি আলাদা স্থান। এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন তৈরি হয় যে, সালাওয়াত ও মাসাজিদের মধ্যে পার্থক্য কী?
এজন্য প্রথমে মাসজিদ কি বুঝতে হবে। এবং মাসজিদ বুঝার জন্য সাজদাহ কি তা বুঝতে হবে।
ক্বিয়াম, ক্বওল ও সাজদাহ এর সমন্বিত কাঠামোই হলো সালাতের আনুষ্ঠানিক কাঠামো। এর মধ্যে ক্বিয়াম হলো সালাতের সূচনা পর্যায় এবং সাজদাহ হলো সালাতের সমাপ্তি পর্যায়। সুতরাং আনুষ্ঠানিক ক্বিয়াম, ক্বওল ও সাজদাহর কাঠামো হলো আনুষ্ঠানিক সালাত এবং বাস্তব কার্যক্রমের জন্য যে বাস্তব কর্মোদ্যোগ (ক্বিয়াম), বাস্তবায়নযোগ্য সিদ্ধান্ত, প্রতিশ্রুতি, আবেদন-নিবেদন, পরামর্শ বা প্রজ্ঞাপনমূলক বক্তব্য বিষয় (ক্বওল) এবং ভক্তি-উপাসনাভিত্তিক কার্যক্রমের প্রণতি বা সমাপনী পর্যায়ে পর্যাবৃত্তি তথা একেকটা পর্যায়ের কার্যক্রমের সমাপ্তিমূলক প্রক্রিয়া বা Action (সাজদাহ); এসবের সমন্বয়ই হলো বাস্তব সালাত।
যখন ইবাদাত, সালাত, রুকূ', সাজদাহ ইত্যাদি পাশাপাশি উল্লেখ করা হয় তখন এর প্রতিটি শব্দের দ্বারা জীবনের ব্যাপকভিত্তিক কর্মকাণ্ডকে আল্লাহর বিধান অনুসারে পরিচালনাকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক আঙ্গিকে তুলে ধরা হয়। অন্যদিকে যখন সালাতের কাঠামোর দিক থেকে ক্বিয়াম-সাজদাহর কথা উল্লেখ করা হয় তখন ক্বিয়াম ও সাজদাহ শব্দগুলো একটি নির্দিষ্ট পরিসরে প্রযোজ্য হয়ে উভয়টির সমন্বয়ে সালাত সম্পাদিত হওয়ার কথা বুঝায়।
মাসজিদের সংজ্ঞা বুঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের জন্য কারো ঘাঁটি হিসেবে যে প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয় সেটাও মাসজিদ, যাকে মাসজিদে দিরার বা মু’মিনদের ও সমাজের ক্ষতি সাধনের মাসজিদ বলা হয়। এ বিষয়ে ৯:১০৭-১১০ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মাসজিদ দুই প্রকার। যথা: (১) যথার্থ মাসজিদ, যা তাক্বওয়ার ভিত্তিতে নির্মিত হয় এবং (২) ষড়যন্ত্রমূলক মাসজিদ।
২২:৪০ আয়াতে আগে ‘সালাওয়াত’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং পরে ‘মাসাজিদ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সালাতের অর্থ ও তাৎপর্য এবং মাসজিদ শব্দের ব্যবহারিক তাৎপর্য অনুসারে ‘সালাওয়াত’ বা ‘যোগাযোগ কেন্দ্রসমূহ’ হলো সাধারণ প্রকৃতির প্রতিষ্ঠান, অন্যদিকে মাসজিদ হলো তুলনামূলক বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান। উদাহরণস্বরূপ আমরা প্রশাসনিক কার্যক্রমের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রাম-গ্রামান্তরের গ্রাম পরিষদকেও সালাওয়াতের অন্তর্ভুক্ত এবং বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জেলা বা উপজেলা পরিষদকে মাসজিদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে তুলনামূলক বিশ্লেষণে অনুধাবন করতে পারি।
সংক্ষেপে বলা যায়, যদিও মাসাজিদও সালাওয়াত হিসেবে কার্যকর, তবু মাসাজিদ হলো তুলনামূলক বিশেষ পর্যায়ের ঘাঁটি বা কেন্দ্র ধরনের প্রতিষ্ঠান। ২২:৪০ আয়াতে প্রথমে সাধারণ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান হিসেবে সালাওয়াত এবং পরবর্তীতে বিশেষ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাসাজিদের উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, দুর্বৃত্তদেরকে দমন না করলে তারা এক পর্যায়ে সাধারণ ও বিশেষ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই বিধ্বস্ত করে দেয়।
অবশ্য এ শব্দগুলোর বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাপেক্ষে ভিন্নরূপ অর্থও রয়েছে। যেমন: ‘সালাওয়াত’ শব্দের অর্থ হলো ‘ভজন মন্দির, বিশেষ করে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের উপাসনাগৃহ’, ‘মাসাজিদ’ শব্দের অর্থ ‘ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের উপাসনাগৃহ’, ‘সওয়ামি’ অর্থ ‘খৃস্টান ধর্মাবলম্বী ও অন্যান্যদের আশ্রম / মঠ’ এবং ‘বিয়া’ শব্দের অর্থ ‘ধর্ম নির্বিশেষে চুক্তি ও শপথ অনুষ্ঠানের কেন্দ্র’। এ থেকে বুঝা যায় যে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় স্বাধীনতার সাথে নিজ নিজ ধর্মীয় উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা ও তাতে উপাসনা করবে এটাই স্বাভাবিক এবং এই স্বাভাবিকতাই কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ। এমনকি যারা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী নয়, তারাও চুক্তি ও শপথের মতো নৈতিক গুণগত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে পারে এবং নিরাপত্তা পাওয়ারও অধিকার রাখে। পক্ষান্তরে নেরাজ্য সৃষ্টিকারীরা এই সকল ধরনের ধর্মীয় ও নৈতিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। তাই মানবজাতির সার্বিক কল্যাণের জন্য এ ধরনের নৈরাজ্যবাদীদেরকে দমন করার কোনো বিকল্প নেই।
‘ইয়াহুদিদের উপাসনাগৃহ’ অর্থে ‘সালাওয়াত’ শব্দের ব্যবহার থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণীয় বিষয় হলো, সালাত কোনো নতুন বিষয় নয়, এবং পূর্ববর্তী কিতাবের অনুসারীরা বিশেষ করে ইয়াহুদিরা সালাতের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো। একই সালাত শব্দ ব্যবহার করে কুরআনে সালাতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সালাত সম্পর্কে একটি সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের অবকাশ তৈরি হয়েছে।