হাদিসের ক্রমসঞ্চরণ ব্যাপারটা হয়েছে অনেকটা এভাবে:
প্রথম যুগে এই লোকশ্রুতিগুলো শিথিলভাবে পরিবার ও গোত্রগুলোয় মুখ থেকে মুখে সঞ্চরিত হয়ে ফিরত। এবং বয়স্ক নরনারীর কাছ থেকে বালকবালিকাদের ভিতরে সেগুলোর স্বত:স্ফুর্ত হস্তান্তর হত বংশপরম্পরায়। প্রতিটি হস্তান্তরের সাথেসাথে স্বাভাবিকভাবে তাতে কিছু পরিবর্তন-পরিবর্ধন হত।
তবে হিজরি প্রথম শতকের শেষদিকে অনেকে এই মৌখিক বিবরণগুলো স্মৃতিতে সংগ্রহ করা শুরু করেন। এঁদের কেউকেউ আবার কিছুকিছু বর্ণনা আংশিকভাবে লিখে রাখারও চেষ্টা করেন – হাদিস লিপিবদ্ধায়নের বিরুদ্ধে আদি ইসলামের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও।
এখন আপাতদৃষ্টিতে আমাদের অনেকের কাছে এমন মনে হতে পারে যে, এই আদি সংগ্রাহকরা নিশ্চয় তাঁদের মৌখিক বা লিখিত বর্ণনাগুলো প্রামাণিক হিসেবে দাবী করার আগে সেগুলোকে যাচাই করে দেখেছেন এবং দেখেছেন অতি সতর্কতার সাথে। কিন্তু বাস্তবে সমস্যা হচ্ছে, অনেকক্ষেত্রে তাঁদের বর্ণনার উৎস শিথিলভাবে উল্লেখ করলেও প্রায়শ তাঁরা পূর্ণাঙ্গ পরম্পরা-শৃংখল বা ইসনাদ দেননি যা মুহম্মদের জীবদ্দশার প্রত্যক্ষদর্শী বা প্রত্যক্ষ শ্রোতা পর্যন্ত গিয়ে পৌছয়।
একমাত্র অতি ধীরে ধীরে, আদি সংগ্রাহকদেরও অনেক দশক পরে, হাদিস সংগ্রহের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ ইসনাদ বাধ্যতামূলক চর্চায় পরিণত হয়। বলা যায়, বিষয়টার গুরুত্ব অনুধাবনে সময় লেগে যায় অন্তত দুইশ’ থেকে তিনশ’ বছর।
এই একই প্রবণতা দেখা যায় সিরাহ সাহিত্যেও। যেমন অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সক্রিয় ইবনে ইসহাকের কথা ধরা যাক। মুহম্মদের এই লোকশ্রুতি-নির্ভর আদি জীবনীকার প্রায়শ তাঁর উৎসগুলোর নামোল্লেখ করেছেন। কিন্তু জরুরী বিবেচনা না করায় পুরুষানুক্রমিক পূর্ণপরম্পরার ব্যাপারটা কোথাও তেমন একটা খেয়াল করেননি।
তাঁর অর্ধশতাব্দী পরে ওয়াকিদি তাঁকে অনুকরণ করেছেন, তা-ও একই জাতীয় শৈথিল্যের সাথে। তবে বয়সে বিশ বছরের তরুণতর তাঁর সচিব ও অনুকারী ইবনে সা’দ সর্বদা চেষ্টা করেছেন পূর্ণাঙ্গ ইসনাদ সহ হুবহু উদ্ধৃতিদানের।
বলা যায়, ওয়াকিদির সমসাময়িক শাফিঈ-র শিক্ষাতেই প্রথমবারের মতো এই পূর্ণাঙ্গ সনদপ্রদান সত্যিকার গুরুত্ব পায়। পূর্ণাঙ্গ ইসনাদের রীতিটা এরপর যখন অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে চালু হয়ে যায়, তখন পন্ডিত ও শাস্ত্রবিদরা স্বভাবতই তাঁদের পরম্পরাকে পুরো মুহম্মদের জীবৎকাল পর্যন্ত পৌছে দিতে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। তবে ক্ষেত্রবিশেষে খানিক সফল হলেও সম্ভবত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা স্মৃতি ও শ্রুতির অর্জন, বর্জন ও অতিরঞ্জনকে এড়িয়ে যেতে পারেননি।
এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, আস্থাযোগ্যতার বিচারে যেকোন হাদিসের পরম্পরা-শিকলের প্রথমযুগের আংটাগুলোর উপর প্রায়শ আমরা ততটা নির্ভর করতে পারি না, যতটা পারি পরবর্তীকালের আংটাগুলোর উপর।
অথচ এধরনের মৌখিক পরম্পরার ক্ষেত্রে মূল সমস্যাই হচ্ছে, এর একটা সিলসিলা বা আংটাও যদি কোথাও ভ্রান্ত হয়, তবে পুরো শৃংখলটাই ছিন্ন হয়ে অর্থহীন হয়ে পড়ে, এবং আদিতে মুহম্মদের উপর আরোপিত হয়ত একটা সর্বজনগ্রাহ্য তথাকথিত হাদিস জনৈক বক্তার মনগড়া বচনে পরিণত হয়।
দুই তিন শতাব্দী পরের শিথিল স্মৃতি-শ্রুতি-নির্ভর শোনাকথা উড়োকথা যেহেতু হাদিসের উৎস, তাই এই এক বা একাধিক ভ্রান্ত আংটার উপস্থিতির ঝুঁকিটা, এমনকি প্রায়-অনিবার্যতা, যেকোন হাদিসের ক্ষেত্রেই অনবরত প্রযোজ্য।
আর পাঁচ জন মানুষের ন্যায় হাদিস বিবরকরাও অল্পস্মৃতিধর দুর্বল মানুষ – তাঁদের মানবচরিত্রের স্বাভাবিক দুর্বলতা, মানুষ্যস্মৃতিশক্তির অনির্ভরযোগ্যতা এবং সর্বোপরি সময়ের দীর্ঘ ব্যবধান, এই ত্রিমুখী কারণ যৌগিকভাবে গোটা হাদিসশাস্ত্রের আস্থাযোগ্যতাকেই বৃহৎ প্রশ্নবোধক চিহ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
যে চাবি মূলচাবির কয়েক ধাপ-পরবর্তী নকলের নকল, তা দিয়ে তালা খোলা যায়না। একইভাবে, মানব মনস্তত্ত্বের যে সহজাত শৈথিল্যের কারণে বাজারে গুজব ছড়ায় এবং ঘটনার বিবরণ এমুখ থেকে ওমুখে ঘুরতে ঘুরতে বিকৃত ও বর্ধিত হতেহতে কালক্রমে আদিসত্য থেকে অবশেষে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সেই একই কারণ হাদিসেরও পরম্পরা-শৃংখলের প্রধান দুর্বলতা।
এবং হাদিস পাঠকালে তাতে যত্রতত্র অসমঞ্জস, অসংলগ্ন, অসমীচীন, অশালীন, অবিবেকী ও অতিবিতর্কিত বিষয় ও বস্তুর যে অন্যায় প্রাচুর্য অনায়াসে লক্ষ্য করা যায়, যা ক্ষিপ্তবিক্ষিপ্ত বহু পরস্পরবিরোধী মনের বহুধা-বিচিত্র মানস প্রক্রিয়ার স্পষ্ট স্বাক্ষরবহ, তা-ই উপরোক্ত দুর্বলতার প্রমাণ। এবং তা-ই এ নিবন্ধে উত্থাপিত হাদিসের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে গভীর সন্দেহের যুক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করে।
হাদিসকে কোরআনের কোনপ্রকার প্রামাণিক ব্যাখ্যা বা আদি ইসলামী নৈতিকতার আদৌ ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে আধুনিক গবেষকদের অন্যতম আপত্তি এখানে। এছাড়া, অন্যত্র যেমন লক্ষ্য করেছি, বিশেষত শরীয়ত বিষয়ক হাদিসগুলোতেই অনুমান, অর্ধসত্য ও পূর্ণমিথ্যাজনিত পরিবর্তন-পরিবর্ধনের সম্ভাবনা বেশী।
তবে শরীয়তের প্রসঙ্গ বাদ দিলে কম বিতর্কিত কিছু হাদিস আছে, বিশেষত ইতিহাস সংক্রান্ত, যেগুলোর কাঠামো ক্ষেত্রবিশেষে অনেকটা সঠিক বলেই ধরে নেয়া যায়। ইবনে সা’দ সংকলিত ‘মুহম্মদের চিঠিগুলো’ এবং, প্রথম সাতটা বাদে, ‘মুহম্মদের সন্ধিচুক্তিগুলো’ এর সম্ভাব্য উদাহরণ। এধরনের হাদিস থেকে সত্যাংশটুকু কিছুটা হলেও উদ্ধারের চেষ্টা করা যেতে পারে তাকে সমালোচনার কষ্টিপাথরে যথাসাধ্য যাচাই ক’রে।
অন্যদিকে, যেসব হাদিস শরীয়তী মছলামাছায়েল, আইনকানুন ও উচিত-অনুচিত সংক্রান্ত, কিংবা যেসব হাদিসে কোন বিশেষ মত বা মতবাদকে সমর্থনের বা বিশেষ দল বা মজহাবকে মদদ যোগানোর প্রয়াস আছে, কিংবা সন্দেহজনক প্রবণতা আছে বিকৃত হওয়ার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অথবা অন্য কোন কারণে, সেগুলোকে সম্ভাব্য গুজব হিসেবে বিবেচনা করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি যেসব হাদিসের মূলেই অসামঞ্জস্য বা স্ববিরোধ, সেগুলোকে সোজাসুজি বাদ দেয়া কর্তব্য।
এখানে উল্লেখ্য যে, তথাকথিত সহি হাদিসগুলোর ৯৯ শতাংশই একটিমাত্র ইসনাদের দ্বারা বর্ণিত তথা আহাদ হাদিস। অর্থাৎ হাদিস সংগ্রাহকরা মাতান বা মূল ভাষ্যের সঠিক ও যৌক্তিক হওয়ার গুরুত্বকে উপেক্ষা করেছেন শুধু তা-ই না। তাঁরা বর্ণনার সত্যতা প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় কোরআন-নির্দেশিত শর্তাবলী (লিখিত নথি এবং অন্তত দু’জন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী) লঙ্ঘন ক’রে প্রাক-ইসলামী আরবের ভ্রান্ত পদ্ধতি সিলসিলা অনুসরণের চেষ্টা করেছেন অসম্পূর্ণ পরম্পরার মাধ্যমে।
এবং এই ছিন্ন-শৃংখল হাদিসের শৃংখলেই বন্দী হয়ে সীমিত হয়ে আছে বহু শতাব্দীর প্রথাগত মুসলিম মন।
অবশ্য ভ্রান্তিপ্রবণ বা প্রায়শ কুশিক্ষাপ্রবণ বলেই হাদিস যে একেবারেই পাঠ করা যাবে না, তা-ও না। প্রায়শ কথাগুলো হয়ত আদিতে স্বয়ং মুহম্মদের মুখনি:সৃত না। হয়ত বর্ণনাগুলোও সাধারণত সঠিক না। হয়ত কখনো তাঁর মুখের বাণীর শব্দান্তরিত বা বিকৃত রূপ; কখনো তাঁর বিষয়ে প্রায়সত্য, অর্ধসত্য বা অসত্য বিবৃতি; আবার হয়ত কখনো এর পাশাপাশি বহু প্রজন্মের বহু বক্তার স্বস্ব জীবনবোধ ও আপন বিচিত্র অভিজ্ঞতারই বিভিন্ন লিখিত বিবরণ – তার সমস্তই একজন অবিসংবাদিত বিগ্রহ তথা মুহম্মদের একক কল্পমূর্তির উপর আরোপিত হয়ে হাদিস নামক একটা বিশাল শাস্ত্রাকারে দানা বেঁধে উঠেছে।
তবু স্মৃতির সাথে বিস্মৃতি এবং বিস্মৃতির সাথে বিকৃতি মিলেমিশে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে থাকা এসব কথামালার মাঝেও থেকেথেকে অনেক নৈতিক সদুপদেশ, অনেক মানবের অনেক আন্তরিক অনুভূতি এবং অনেক ছিন্ন-বিছিন্ন ঐতিহাসিক উপকরণ নানাভাবে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। সমজদার পাঠক ও গবেষকের কাছে স্বতন্ত্র মূল্য থাকতে পারে এসবেরও।
তাই হাদিস পাঠ করা যাবে না, তা না। তবে হাদিসশাস্ত্রের ভ্রান্তিপ্রবণ, প্রায়শ কুশিক্ষাপ্রবণ অতিদুর্বল ভিত্তি ও সামগ্রিক দুরবস্থার কারণে তাকে কোরআনের কোনপ্রকার নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা বা আদি ইসলামী নৈতিকতার আদৌ ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে না। বরং তাকে পড়তে গেলে পড়তে হবে সংশয়বাদী সমালোচকের খোলা মন নিয়ে।
সিরাজ ইসলাম
অতিথি লেখক, ইক্বরা
লেখকের ওয়েবসাইট