৪:৩২ আয়াতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক গঠনপ্রকৃতি ও যোগ্যতা, আর্থিক সামর্থ্য, সামাজিক মানমর্যাদা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তিকে যে বিভিন্নরূপ বিশিষ্টতা তথা বৈশিষ্ট্য, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ইত্যাদি বৈসাদৃশ্য দেয়া হয়েছে সে ব্যাপারে যেন কোনো ব্যক্তি অস্থির হয়ে অন্য ব্যক্তিকে দেয়া বিষয় পাওয়ার জন্য আকাঙ্ক্ষা না করে। বরং সে যেন আল্লাহ তাকে যা কিছু দিয়েছেন তা কাজে লাগিয়ে বৈধপথে উপার্জন করে এবং আল্লাহরই কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করে। মনে রাখতে হবে, আল্লাহপ্রদত্ত প্রাকৃতিক বা জন্মগত বৈশিষ্ট্যের বিষয় প্রতিযোগিতার কোনো ক্ষেত্র নয়, আর এজন্য হিংসা বিদ্বেষ পোষণ করাও চরম মূর্খতা। এই প্রাকৃতিক তারতম্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সমাজ সংস্কৃতিকে বৈচিত্র্যমন্ডিত ও মানুষকে পরস্পরের সম্পূরক ও পরিপূরক করা। কিন্তু কারো উপর কৃত্রিম পার্থক্য চাপিয়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে তার যোগ্যতাকে বিকশিত হতে না দেয়া বা তার প্রতি অবিচার করা। আবার প্রকৃতিগত পার্থক্যকে বিলুপ্ত করে দেয়ার চেষ্টাও হচ্ছে এক ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করা। এ আয়াতে নারীদেরকে তাদের উপযোগী ক্ষেত্রসমূহে উপার্জনের অধিকার দেয়া হয়েছে।
অনেকে ৪৩:১৮ আয়াতের অপব্যাখ্যা করে বলে যে, নারীরা গৃহে অলংকারাদিতে প্রতিপালিত হতে হবে এবং তারা জ্ঞানবুদ্ধি ও বক্তব্য বিতর্কে দুর্বল বিধায় বাইরের দায়িত্বপূর্ণ কাজের জন্য উপযুক্ত নয়। অথচ তাদের এ ধরনের ধারণার সাথে আয়াতটির বক্তব্যের কোনো সামঞ্জস্য নেই। নারীদের কর্মক্ষেত্র বাছাইয়ের অধিকার সম্পর্কে সঠিক ধারণার জন্য এ বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তাই নিম্নে আয়াতটি এবং তার প্রকৃত তাৎপর্য আলোচনা করা হলো:
أَوَمَن يُنَشَّأُ فِي الْحِلْيَةِ وَهُوَ فِي الْخِصَامِ غَيْرُ مُبِينٍ
৪৩:১৮ :: তবে কি যাকে প্রতিপালিত করা হয় অলংকারের মধ্যে, আর সে বাদানুবাদের ক্ষেত্রে অস্পষ্ট? (এটাই হয় তাদের আক্ষেপ অথচ এরূপ নারীকেই তারা স্রষ্টার কন্যা সাব্যস্ত করে তাঁর অংশীদার বানায়)।
ইসলাম বিদ্বেষীরা ও ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণকারীরা মনে করে এ আয়াতটিতে নারীর প্রতি অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে আয়াতটিতে মুশরিকদের চিন্তা-চেতনা এবং তাদের স্ববিরোধী কার্যকলাপকে তুলে ধরা হয়েছে। একদিকে কোনো কন্যা শিশু জন্ম নিলে তারা গ্লানি নিয়ে ভাবে যে, কন্যা সন্তানটিকে রেখে দেবে নাকি মাটিতে পুঁতে দিবে (১৬:৫৮-৫৯), কারণ তারা মনে করে যে, নারী এমনি যে, তাকে অলংকারে প্রতিপালিত করা হয় এবং সে বাদানুবাদের ক্ষেত্রে অস্পষ্ট। অথচ তারা আবার ফেরেশতাদেরকে নারী সাব্যস্ত করে (৪৩:১৯) ও নারীবাচক নাম দেয় (৫৩:২৭), যেমন, লাত, উজজা ও মানাত (৫৩:১৯-২৩)। তারা নিজেদের জন্য তো পুত্র সন্তানই পছন্দ করে কিন্তু আল্লাহর জন্য কন্যা সন্তান সাব্যস্ত করে (৩৭:১৪৯-১৫৪)। তারা যে দেবির মূর্তি বানিয়ে পূজা করে সে মূর্তিগুলোর অবস্থা এমনি যে, মূর্তিগুলোকে অলংকারে সজ্জিত করে রাখে এবং মূর্তিগুলো কোনো কথাও বলতে পারে না (২০:৮৭-৮৯, ২১:৫১-৬৭)।
সুতরাং আয়াতটিতে মুশরিকরা নারীর প্রতি যে অবমূল্যায়ন করেছে এবং নিজেদের স্ববিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে আবার ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা সাব্যস্ত করে কল্পিত দেবি মূর্তি বানিয়েছে এসব বিষয়ের সমালোচনা করা হয়েছে। যারা আল্লাহর জন্য পুত্র-কন্যা সাব্যস্ত করেছে এবং ঈসাকে আল্লাহর পুত্র সাব্যস্ত করেছে আল কুরআনে তাদের সবার ধারণাকেই খন্ডন করা হয়েছে। সুতরাং আল কুরআনে নারীকে অবমূল্যায়ন করার যাবতীয় জাহেলিয়্যাতের এবং একই সাথে শিরকের অসারতা প্রমাণ করা হয়েছে। কুরআন আল্লাহর কিতাব যিনি নারী-পুরুষ উভয়ের স্রষ্টা। তাই কুরআনে নারী-পুরুষ উভয়ের প্রকৃত অবস্থা ও কল্যাণকর ব্যবস্থা ব্যক্ত করা হয়েছে।
অবশ্য এটা অনস্বীকার্য যে, প্রকৃতিগতভাবে নারী এমন সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যার ফলে তার স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্র হিসেবে গৃহ এবং গৃহের পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেমন নারীকে সন্তান গর্ভধারণ ও শিশুকে দুধপান করানোর প্রাকৃতিক দায়িত্বের কারণে বাইরের কর্মস্থলে কাজ করার মতো আবশ্যকীয় দায়-দায়িত্ব আরোপ করা হয়নি, যদিও সেই বিষয়ে তাকে অধিকার দেয়া হয়েছে।
নারী পুরুষকে যে ধরনের বৈচিত্র্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্টতা দেয়া হয়েছে সেই প্রেক্ষিতে নারীর উপর সামগ্রিক দায়িত্বশীল হিসেবে পুরুষকেই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত কারণে ব্যতিক্রম হতে পারবে না, এমন নির্দেশ দেয়া হয়নি বা বলা যায়, নারী নেতৃত্বকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু যেহেতু নেতৃত্ব একটি জটিলতাপূর্ণ বিষয়, যাতে নারীকে জড়ালে তার উপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে, তাই সাধারণভাবে নারী-পুরুষ সম্মিলিত ক্ষেত্রে মূল নেতৃত্বের দায়িত্ব সাধারণভাবে পুরুষদের উপর অর্পণ করা হয়েছে। তবে নারী বিভাগের উপর নারী নেতৃত্ব একান্তই স্বাভাবিক বিষয়, যেমন মারইয়ামকে বিশ্বের নারীদের উপর মনোনীত করা হয়েছে মর্মে উল্লেখিত হয়েছে। এছাড়া মারইয়ামকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে- “রুকুকারীদের সাথে রুকু করার জন্য”, অন্য কথায় তাঁকে সহযোগী হতে বলা হয়েছে, পুরুষদের উপর যেমন নারী পুরুষের সম্মিলিত সালাতে ইমামতি করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়নি। তবে কোনো ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদানে জটিলতা না থাকলে বা স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব হলে তাতে আপত্তি করা যেতে পারে না।
কুরআনে শালীনতার ব্যাপক নির্দেশনা হিসেবে শালীন পোশাক পরা ছাড়াও একে অন্যের গৃহে প্রবেশের ক্ষেত্রে সালাম (শান্তিকামনা) সহকারে অনুমতি গ্রহণ সাপেক্ষে প্রবেশ ও যাতায়াত করা এবং এমনকি যদি গৃহবাসী কর্তৃক ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয় তাহলে কিছু মনে না করে নির্দ্বিধায় ফিরে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে একদিকে শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং অন্যদিকে কাউকে প্রয়োজনে ফিরে যাওয়ার কথা বলার অধিকার দেয়া হয়েছে। যার ফলে এক্ষেত্রে আর কেউ কাউকে অভিযুক্ত করার অবকাশ থাকে না। অবশ্য যেসব গৃহে এমন প্রয়োজনীয় জিনিস ও সেবা থাকে যাতে প্রবেশের সাধারণ পূর্ব অনুমতি রয়েছে সেসব গৃহে সাধারণভাবে প্রবেশের অবকাশ রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া কাদের গৃহে নির্দ্বিধায় যাতায়াত করা যাবে এবং খাদ্য গ্রহণ করা যাবে তাও বিস্তারিত জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এটাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, প্রয়োজন সাপেক্ষে সবাই একসাথে বা একই সময়ে বসে খেতে পারবে, আবার প্রয়োজন সাপেক্ষে যার যার সময় মতো সে সে খেয়ে নেবে এর কোনোটিতে দোষ নেই। এর মাধ্যমে শিষ্টাচার হিসেবে যেরূপ অযথা জটিলতা তৈরির প্রয়োজন নেই তাও স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
৩৩:৩২ আয়াতে নবীর স্ত্রীদেরকে বিশেষভাবে একটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে: “হে নবীর স্ত্রীগণ, তোমরা সাধারণ নারীদের মত নও। যদি তোমরা স্রষ্টা-সচেতনতা রাখো তাহলে বক্তব্যে নমনীয়তা অবলম্বন করো না যাতে যার মনে রোগ আছে সে (অর্থাৎ দুষ্টমনের ব্যক্তি) আগ্রহী হয়ে পড়ে। আর তোমরা বলো ‘স্বাভাবিক সুসঙ্গত কথা’ (ক্বাওলাম মা’রূফ)।”
এ নির্দেশনাটিতে ‘বক্তব্যে নমনীয়তা অবলম্বন না করার’ নির্দেশের জন্য ব্যবহৃত আরবি পাঠ হলো, “লা তাখদ’না বিল ক্বওলি”। অনেকে ভুলভাবে এর অনুবাদ করে “কণ্ঠস্বরকে কোমল ও আকর্ষণীয় করে কথা বলো না”। অথচ আয়াতটিতে কণ্ঠস্বরের আরবি “সওত” (صَوْت) শব্দ ব্যবহার করা হয়নি, বরং ‘ক্বওল’ বা ‘বক্তব্য’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং এতে কণ্ঠস্বর নয়, বরং বক্তব্যের উপর জোর দেয়া হয়েছে। অন্য কথায়, এতে বক্তব্যের অর্থ কী দাঁড়ায় সেটাই মুখ্য বিষয়, কণ্ঠস্বর গৌন বিষয়।
তারপর এতে “কোমল বা আকর্ষণীয় ভঙ্গি অবলম্বন না করার’ কথা বলা হয়নি, বরং ‘নমনীয়তা অবলম্বন না করার’ কথা বলা হয়েছে। আয়াতটিতে ব্যবহৃত ‘তাখদ’না’ শব্দটির মূল অক্ষরসমূহ হলো ‘খ দদ আইন’। এ মূল অক্ষরসমূহ থেকে গঠিত শব্দটি কুরআনে আরো একস্থানে ব্যবহৃত হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে- “নিশ্চয় আমরা ইচ্ছা করলে তাদের কাছে আকাশ থেকে এক নিদর্শন নাযিল করতাম, ফলে তাদের ঘাড়গুলো নমনীয় (খাদিয়ীন) হয়ে পড়তো।” সুতরাং নির্দেশনাটি ইচ্ছাকৃত কোমলতা বা আকর্ষণীয় ভঙ্গি অবলম্বনের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং নমনীয় হয়ে পড়ার সাথে সম্পর্কিত। অন্যকথায়, এতে প্রয়োজনীয় বক্তব্যের ক্ষেত্রে সাবধানতার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ সাবধানতার ধরন সম্পর্কে ভালভাবে বুঝা যায়, যখন এর কারণটি সামনে রাখা হয়। নিম্নে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হলো।
বক্তব্যে নমনীয় না হওয়ার নির্দেশটির কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, “(এমন নমনীয়তা অবলম্বন করো না) যাতে যার মনে রোগ আছে সে (অর্থাৎ দুষ্টমনের ব্যক্তি) আগ্রহী হয়ে পড়ে।” এখানে সুনির্দিষ্টভাবে পুরুষদের সাথে বক্তব্যের বিষয় বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে “যার মনে রোগ আছে সে যেন আগ্রহী হতে না পারে”। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত ক্রিয়া ও সর্বনাম পুংলিঙ্গের হলেও এটা স্বাভাবিক ভাষারীতি যে, সাধারণ বৈশিষ্ট্য পুংলিঙ্গে উল্লেখ করা হয়, যদিও তা পুরুষ বা নারী উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। অন্যকথায়, “যার মনে রোগ আছে” সে যেমন পুরুষ হতে পারে, তেমনি নারীও হতে পারে। অন্যকথায় এখানে শুধুমাত্র পুরুষদের সাথে কথা বলার বিষয়টি নির্দিষ্ট নয় এবং আগ্রহী হওয়া বলতেও শুধুমাত্র ‘যৌন আকর্ষণ অনুভব করার’ বিষয়টি নির্দিষ্ট নয়।
এ প্রসঙ্গে “যার মনে রোগ আছে” সম্বলিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন জরুরি। “যার মনে রোগ আছে” প্রসঙ্গে এ আয়াতটিসহ মোট ১২টি আয়াত রয়েছে। আয়াতগুলো হলো: ২:১০, ৫:৫২, ৮:৪৯, ৯:১২৫, ২২:৫৩, ২৪:৫০, ৩৩:১২, ৩৩:৩২, ৩৩:৬০, ৪৭:২০, ৪৭:২৯, ৭৪:৩১। আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্ট হয় যে, “মনে রোগ” বলতে শঠতা, হিংসা, অনৈতিক ও অশ্লীলতার মনোভাব ইত্যাদি যাবতীয় মানসিক দোষত্রুটিকে বুঝায়।
সুতরাং ‘যাদের মনে রোগ আছে’ তাদের অন্যতম একটি বিভাগ হলো যারা বিভিন্ন চক্রান্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এবং সেই প্রেক্ষিতে তারা বিভিন্ন কথার দুর্বলতা খুঁজে বেড়ায় এবং কোনোভাবে কোনো বক্তব্যে নমনীয়তা পেলে তার সুযোগ নিয়ে তাদের প্রত্যাশিত উপায়ে তথ্য সংগ্রহে আরো আগ্রহী হয়ে পড়ে। নবীর স্ত্রীরা যেহেতু নবীর স্ত্রী সেই প্রেক্ষিতে এক্ষেত্রে তাঁদেরকে অন্য সব সাধারণ নারীদের থেকেও আরো বিশেষভাবে সাবধান থাকতে হবে। কারণ তাঁদের যেকোনো অসাবধানতা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
এ বিষয়টি একই সূরার প্রথম আয়াতে নবীকে যে সাবধানতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার সম্পূরক। আয়াতটিতে বলা হয়েছে: “হে নবী, আল্লাহর প্রতি সচেতন থেকো এবং কাফির ও মুনাফিকদের আনুগত্য করো না। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।” (৩৩:১)
অবশ্য আয়াতটির ব্যাপক তাৎপর্যের আওতায় যারা নারীদের বক্তব্যে কোনো ধরনের কোমলতা থেকে যৌন কামনায় আগ্রহী বা আকৃষ্ট হওয়ার মতো মনের রোগে আক্রান্ত এরূপ পুরুষদের থেকে সাবধানতার জন্য বক্তব্য প্রকাশে সাবলীল থাকার দিকটিও অন্তর্ভুক্ত হয়, যদিও এটাই আয়াতটির প্রাথমিক বা একমাত্র তাৎপর্য নয়।
ইসলামী ধর্মমতের নামে যেসব ধর্মীয় পণ্ডিতদের ব্যক্তিগত মাছালা ও ফতোয়া প্রচলিত রয়েছে যে, “নারীরা পর পুরুষের সাথে হরহামেশা কথা বলতে পারবে না বা পরপুরুষ যেন তাদের কণ্ঠস্বর শুনতে না পায়, তবে একান্ত প্রয়োজনে পুরুষের সাথে কথা বলতে হলে কর্কশ কণ্ঠে কথা বলতে হবে, নারীরা আওয়াজ করে কুরআন তিলাওয়াত বা সালাত করতে পারবে না এবং পুরুষ শুনতে পায় এমন কোনো নসিহতমূলক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে পারবে না ইত্যাদি”- এসব কথার কোনো ভিত্তি কুরআনে খুঁজে পাওয়া যায় না, বরং এ কথাগুলো কুরআনের সাথে সঙ্গতিহীন। কুরআনে ‘ক্বাওলাম মা’রূফ” তথা স্বাভাবিক সুসঙ্গত কথা বলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এটা কর্কশভাবে কথা বলাকে বুঝায় না, বরং কথাবার্তায় সাবলীলতাকে বুঝায়। এছাড়া কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সালাতে মধ্যম আওয়াজ অবলম্বন করার জন্য। তাই পুরুষ ও নারী প্রত্যেকেই তাদের কুরআন পাঠ, সালাত ও বক্তব্যে মধ্যম আওয়াজ অবলম্বন করবে, এটাই স্বাভাবিক।
৩৩:৩৩ আয়াতে নবীর স্ত্রীদেরকে উদ্দেশ্য করে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, “এবং (হে নবীর স্ত্রীগণ,) তোমরা নিজেদের গৃহে স্বস্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করো এবং পূর্ববর্তী জাহিলিয়্যাতের প্রদর্শনী প্রদর্শন করো না। এবং তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো এবং তোমরা যাকাত প্রদান করো এবং তোমরা আল্লাহর ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো। নিশ্চয় আল্লাহ ইচ্ছা করেন তোমাদের থেকে অপরিচ্ছন্নতা দূরীভূত করতে, হে গৃহবাসী (আহলে বাইত), এবং তোমাদেরকে ব্যাপকভাবে পবিত্র করতে।”
আয়াতটি নবীর স্ত্রীদেরকে প্রদত্ত নির্দেশ হলেও আয়াতের শেষে এর উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, “এ নির্দেশের মাধ্যমে আল্লাহ নবী পরিবার থেকে কলুষতা দূরীভূত করতে ইচ্ছা করেন”। অন্য কথায়, এই নির্দেশ পরিপালন কলুষতা থেকে মুক্ত হওয়ার উপায়। সুতরাং আয়াতে উল্লেখিত নির্দেশ থেকে সব নারীদের জন্যই শিক্ষা রয়েছে। এছাড়া আয়াতটিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, পূববর্তী জাহিলিয়্যাতের প্রদর্শনী প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এটা সব নারীদের জন্যই প্রযোজ্য যে, তারা আঁটসাঁট ও অত্যন্ত পাতলা এবং অর্ধনগ্নতার পোশাক পরা এবং অশালীন অঙ্গভঙ্গি করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আয়াতটির প্রথম অংশে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, “তোমরা নিজেদের গৃহে স্বস্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করো”, এর দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে তা বুঝার জন্য নবীর স্ত্রীদের সাথে সম্পর্কিত সামগ্রিক তথ্যসমূহ লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। সাধারণত এর দ্বারা নবীর স্ত্রীরা অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া গৃহের বাইরে না যাওয়া এবং সবসময় গৃহে অবস্থান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়। অথচ এ বিষয়ে কুরআনের সামগ্রিক নির্দেশনা সামনে রাখলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এ নির্দেশের তাৎপর্য এরূপ নয়, যা সাধারণত দাবি করা হয়ে থাকে।
৬৬:৫ আয়াতে নবীর স্ত্রীদের একটি কাঙ্ক্ষিত গুণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা হবে সামাজিক কর্মকাণ্ডে তৎপর বা সচরাচর চলাফেরায় অভ্যস্ত (ছায়িহাত)। অনেক অনুবাদে এ শব্দটিকে ‘রোযা পালনকারিনী’ অনুবাদ করা হয়েছে, যা একটি ভুল অনুবাদ। বরং ‘রোযা পালনকারিনী’কে বলা হয় ‘সয়িমাত’ যা ৩৩:৩৫ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘ছায়িহাত’ শব্দের অর্থ যে ‘যারা (সমাজকর্মে) সচরাচর চলাফেরা করে” তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে, যখন লক্ষ্য করা হবে যে, এর ক্রিয়া ‘ফাছিহূ’ (৯:২) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে “দেশে ঘুরেফিরে পরিভ্রমণ করা” অর্থে। যখন শব্দটি একটি গুণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় তখন স্বাভাবিকভাবে এ পরিভ্রমণ সমাজকর্মের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকে। আর তাই “ছায়িহাত” অর্থ “সমাজকর্মে তৎপর”।
যেহেতু নবীর স্ত্রীদেরকে বিশেষ পরিস্থিতিতে বাইরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ‘জিলবাব’ (চাদর) পরার নির্দেশ দেয়া হয়েছে (৩৩:৫৯) এবং যেহেতু তাঁদের কাংক্ষিত গুণ হিসেবে ‘সমাজকর্মে তৎপর” (৬৬:৫) হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাই তাঁদেরকে “স্বস্তিপূর্ণভাবে গৃহে অবস্থান করার নির্দেশ” এর তাৎপর্য তাঁরা সবসময় গৃহে থাকা এবং কখনো গৃহ থেকে বের না হওয়া হতে পারে না।
বস্তুত “স্বস্তিপূর্ণভাবে গৃহে অবস্থান করার” একটি তাৎপর্য হলো “এমনভাবে গৃহে অবস্থান করা যাতে তাঁদের নিজেদের কারণে গৃহের এবং ফলাফলস্বরূপ তাঁদের নিজেদের ক্ষেত্রে কোনো অস্বস্তি সৃষ্টি হতে না পারে”।
সুতরাং নারীকে স্বস্তিপূর্ণভাবে গৃহে অবস্থান করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে কিন্তু সে নির্দেশের তাৎপর্য এ নয় যে, অত্যন্ত বেশি প্রয়োজন ছাড়া সে গৃহ থেকে বের হতে পারবে না। তবে নির্দেশটির একটি তাৎপর্য হিসেবে ধরা যেতে পারে যে, গৃহই নারীর অবস্থানের প্রধান স্থান এবং সেটাকেই সে অগ্রাধিকার দিবে, তবে সামাজিক কর্মকাণ্ড বা উপার্জনের প্রয়োজনে সে সচরাচর বাইরে যেতে কোনো বাধা নেই। অন্যদিকে তার উপার্জনের অধিকার সত্ত্বেও তার উপর পরিবারের ভরণ পোষণের দায়িত্ব অর্পিত হয় নি, তাই অধিকারের প্রয়োগ সামাজিক কল্যাণ চিন্তা থেকে হতে পারে বা পরিবারের অধিকতর উন্নয়নের জন্য হতে পারে, কিন্তু তা যেন গৃহের স্বস্তিপূর্ণ বসবাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর সামাজিক কর্মকাণ্ডে তৎপরতার গুণবতী হওয়া আল্লাহর পছন্দনীয় বিধায় সেজন্যও সে বাইরে যাবে, তবে তাও যেন তার গৃহে স্বস্তিপূর্ণভাবে বসবাসের সাথে সম্পূরক হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া নারী বাইরে কাজ করলেও তাতে যেন তার গৃহে অবস্থানের মতো স্বস্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকে এবং তা যেন তার সৃষ্টিপ্রকৃতিগত যোগ্যতা বৈশিষ্ট্যের অনুকূল হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সুতরাং নারী যে পেশাই অবলম্বন করুক ঐ কর্মক্ষেত্রে তার ঘরোয়া পরিবেশ রক্ষায় যত্নবান হওয়া উচিৎ। অর্থাৎ কর্মপরিবেশে নারীর প্রাইভেসির ব্যবস্থা থাকতে হবে, যেমন দুগ্ধপোষ্য নারীর সন্তানকে রাখার ও দুধপান করানোর জন্য সুরক্ষিত কক্ষের ব্যবস্থা। অযথা অস্বস্তিদায়ক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, যা তার গৃহের স্বস্তিপূর্ণ দায়-দায়িত্ব পালনে বিঘ্ন ঘটায় এবং তার প্রধান দায়িত্ব তথা গৃহের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
নারী অবশ্যই উপার্জনমূলক চাকুরি করতে পারবে, তবে তা যেন তার নিরাপত্তায় বিঘ্ন না ঘটায়, তার নারীত্বের প্রতি অবমাননামূলক না হয়, তার প্রকৃত সম্মান ও স্বস্তির সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, যেহেতু তাকে সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় নি, তাই যারা তাকে তার আত্মমর্যাদা অনুভবের জন্য চাকুরি করাকে অপরিহার্য সাব্যস্ত করে এবং মাত্রাতিরিক্ত নারী কোটার মাধ্যমে মূলত পুরুষদের চাকুরির ক্ষেত্রকে সীমিত করে দেয়, তাকে তার জ্ঞানগত যোগ্যতার পরিবর্তে চেহারাগত সৌন্দর্যের ভিত্তিতে কাজ করতে হয় এমন কাজে নিযুক্ত করতে চায়, তাদের হীন মতলবের চাতুর্যে পড়ে সে যেন নিজের প্রকৃত শান্তি, স্বস্তি ও মর্যাদার পরিপন্থী চাকুরিকে অপরিহার্য মনে না করে এবং সেরূপ চাকুরির জন্য ছুটতে না থাকে।
নারীদের জন্য স্বতন্ত্র কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকাই অধিক উত্তম। পুরুষ সহকর্মীর সাথে যেন অপরিহার্যভাবে নিভৃতে একান্তে সাক্ষাতের বাধ্যবাধকতা না থাকে, যেন নারীর পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে, গায়ের মাহরাম পুরুষ যেন নারীর হাতটুকুও স্পর্শ না করে (লক্ষ্যনীয় যে, কুরআনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বুঝাতে বাছাইকৃত একটি শব্দ হচ্ছে ‘স্পর্শ করা’, যার ফলে নারী-পুরুষের মধ্যকার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি যৌন সম্পর্কের/ অনুভূতির সাথে কত নিবিড়ভাবে জড়িত তা সহজেই বুঝা যায়)। নারীর সর্বাধিক স্বস্তিপূর্ণ পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দিক বিবেচনায় তার জন্য অধিক উপযোগী চাকুরির ক্ষেত্র হতে পারে হাসপাতাল, শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মহিলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। অর্থাৎ যেখানে নারীরাই অধিক যোগ্যতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।
নারী কর্তৃক চুক্তি ও কর্মের শুদ্ধতা ও কার্যকারিতার জন্য অভিভাবক বা স্বামীর অনুমতির শর্ত আরোপ করা হয়নি। অভিভাবক বা স্বামী নারীকে চাকুরি করতে বাধ্য করতে পারবে না, যেমন বাধ্য করতে পারবে না চাকুরি না করতে। যদি নারী নিজ সিদ্ধান্তে চাকুরি করে তবে সেক্ষেত্রে অভিভাবকের দায়িত্বের মাত্রা কমতে পারে বা তার চাকুরির কারণে স্বামী পারিবারিকভাবে কোনো ক্ষতির শিকার হলে সে ক্ষতিপূরণের অংশটুকুই শুধু স্ত্রীকে বহনের জন্য বলতে পারে। সর্বোপরি নারীর উপার্জনের অধিকার আল কুরআন দ্বারা স্বীকৃত, কিন্তু উপার্জনের জন্য সে এমন কিছুই বেছে নেয়া উত্তম যাতে তার স্বাধীনতা থাকে, নিজ গৃহে অবস্থান করে উপার্জন করতে পারলে সেটাই সর্বোত্তম। ঘরের ও বাইরের কাজে যদি অতিরিক্ত ধকল নিতে হয়, তবে বাইরের কাজ ছেড়ে দেয়াই উত্তম। আর যদি একটির কারণে অন্যটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেক্ষেত্রে সে দুটিই একসাথে করতে পারে, তাতে কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। যে নারী কোনো চাকুরি করে না বা উপার্জন করে না, কিন্তু নিজের সন্তানের লালন-পালনে সুন্দরভাবে ভূমিকা পালন করে সে নারী কোনোভাবেই চাকুরিজীবি নারীর চেয়ে নিম্নমর্যাদার নয়। প্রকৃত মর্যাদা চাকুরি বা গৃহকর্মের পারস্পরিক তুলনার বিষয় নয়, বরং তাক্বওয়ার (স্রষ্টা-সচেতনতা) মাধ্যমেই মানুষ (নারী-পুরুষ উভয়ে) আল্লাহর দৃষ্টিতে অন্য মানুষের তুলনায় মর্যাদাবান হতে পারে।
নবী ইবরাহীম, তাঁর স্ত্রী ও ফেরেশতাদের ঘটনায় (৫১:২৪-৩০) মেহমানদারিতে নবী ইবরাহীম ও তাঁর স্ত্রীর ভূমিকা পারিবারিক বলয়ে নারী-পুরুষের স্বাভাবিক অবদানের ঐতিহ্যকে প্রকাশ করে। যাতে বলা হয়েছে যে, নবী ইবরাহীম তাঁর স্ত্রীর কাছে গেলেন এবং মেহমানদের কাছে মাংসল গো-বৎস ভাজা নিয়ে আসলেন।
নারীর বাইরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিবেচনা অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু সেজন্য সবসময় সাথে কোন মাহরাম পুরুষ থাকতেই হবে, তা বাধ্যতামূলক করা হয় নি। আমরা কুরআনে মারইয়ামের (১৯:১৬-২৯) এবং মাদইয়ানে দুই নারীর স্বাধীন চলাচলের উদাহরণ দেখতে পাই, যা প্রমাণ করে যে, নারীরা একা বা যৌথভাবে স্বাধীন চলাচলের অধিকার সংরক্ষণ করে। কুরআনে নারীদের চলাফেরা, ভ্রমণ বা কর্মকাণ্ডে কোনো সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়নি, তা ঘোড়ায় চড়া, গাড়ি চালানো বা বিমান ওড়ানো যা-ই হোক না কেন।
নারীকে নিজে উপার্জন করার অধিকার দেয়া হয়েছে অথচ তার উপর পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব দেয়া হয় নি। নারীর স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্র গৃহ হলেও তাকে মৃত্যু পর্যন্ত নিজ সম্পদের দখল রাখা যা পরে উত্তরাধিকার আকারে বণ্টিত হবে এবং প্রয়োজনে ঋণ করা বা চুক্তিবদ্ধ হয়ে যৌথ ব্যবসায় পরিচালনা এবং এমনকি উত্তরাধিকারের নির্ধারিত হারে বণ্টনের জন্য সম্পদ রেখে না গিয়ে ওয়াসিয়্যাত করা ইত্যাদির অধিকার দেয়া হয়েছে। সূরা বাক্বারায় পুরুষদের মধ্যকার ঋণ ও ব্যবসায়িক চুক্তির ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি প্রয়োজনে নারীদের মধ্য থেকেও সাক্ষী রাখার নির্দেশনা রয়েছে, যাতে সাক্ষী হিসেবে নারীকে উপযুক্ত বিবেচনা করার বিষয় রয়েছে, তাকে যেসব নারীকে বিয়ে করা হারাম সেই শ্রেণিভুক্ত হওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়নি।
জনসমক্ষে নারী-পুরুষের পারস্পরিক যোগাযোগ হতে পারবে না অথবা নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে উপাসনামূলক কাজ করতে পারবে না, এরূপ কোনো বিধিনিষেধ কুরআনের নির্দেশনার উপর ভিত্তিশীল নয়। হজ্জের সাধারণ রীতি-নীতিতে নারী-পুরুষের সম্মিলিত অবস্থান একটি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিষয় এবং একটি দৃষ্টান্ত যে, প্রকৃতপক্ষে এ বিষয়ে যেসব কড়াকড়ি আরোপ করা হয় কোনো স্বাভাবিক পরিবেশে সেরূপ কড়াকড়ির বাস্তবসম্মত নয়।
২:২৩৫ আয়াতে কোনো বিধবাকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত কথা বলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং তাদের সাথে গোপনে ওয়াদা দেয়া থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এ থেকে নারী-পুরুষের মধ্যে সরাসরি সুসঙ্গতভাবে কথা বলার নির্দেশনা প্রমাণিত নয়, যাতে কোনো মাধ্যম ব্যবহার করে প্রস্তাব দেয়াকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি।
নবী যাকারিয়া ও মারইয়ামের সাক্ষাতকার (৩:৩৭), মারইয়াম ও তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের সাক্ষাতকার (১৯:২৭-৩০), সাবার রাণী ও নবী সুলাইমানের সাক্ষাতকার (২৭:৪৪) এবং নবী মূসা ও মাদইয়ানের অধিবাসী দুই বোনের সাক্ষাতকার (২৮:২৩-২৬) ঘটনাগুলো এ বিষয়ে কুরআনে বর্ণিত উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, যেগুলো থেকে নারী-পুরুষের পারস্পরিক যোগাযোগ যদি স্বাভাবিক, সাবলীল বা সুসঙ্গত হয় সেক্ষেত্রে কোনো বাধা-নিষেধ না থাকা প্রমাণিত হয়।
মাদইয়ানের অধিবাসী যে দুইবোনের সাথে নবী মূসার সাক্ষাতকার হয়েছিলো তাদের একজন তাদের পিতাকে বলেছিলো, “আব্বু, তুমি তাকে শ্রমিক নিযুক্ত করো, কারণ শ্রমিক হিসেবে সেই উত্তম হবে যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত।” (২৮:২৬)
এ ঘটনায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নারীর বৃদ্ধিবৃত্তিক পরামর্শের যোগ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া সাবার রাণী ও নবী সুলাইমানের ঘটনায় (২৭:২৩-৪৪) দেখা যায় যে, সাবার রাণী পরামর্শের ভিত্তিতে তাঁর রাজ্য পরিচালনাগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন এবং তাঁর নির্বাহী পরিষদের সদস্যদের মধ্যে তাঁর সিদ্ধান্তের বিষয়ে পরিপূর্ণ আস্থা ছিলো। তিনি বিদ্রোহ করার পরিবর্তে বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। হুদহুদের বিবেচনায় তিনি এমন ছিলেন যে, তাঁকে রাজ্য পরিচালনার উপযোগী বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা ও অন্যান্য সকল উপকরণ দেয়া হয়েছিলো।
৬০:১২ আয়াত থেকে জানা যায় যে, মু’মিন নারীরা রসূলের কাছে বাইয়াত করার জন্য উপস্থিত হতো এবং তাঁরা কী বাইয়াত (শপথ) করতে হবে কুরআনের তার কিছু বিশেষ ধারা উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ধর্মীয় সভায় নারীদের উপস্থিতি কুরআনের নির্দেশনার সাথে স্বাভাবিকভাবে সুসঙ্গত।
৫৮:১-২ আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে, নারী কোনো নির্বাহী সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নির্বাহী প্রধানের সাথে তার মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বিতর্ক করারও অধিকার রাখে। একটি নারী রসূলের সাথে তার স্বামী যিহার করার (তাকে নিজের মায়ের সমতুল্য হিসেবে প্রকাশ করার মাধ্যমে তালাক দেয়ার একটি কুপ্রথা) বিষয়ে বিতর্ক করছিলো। সেই বিষয়ে তখন পর্যন্ত কোনো আয়াত নাযিল না হওয়ায় সেই বিষয়ে রসূলের মতামত ছিল একটি নির্বাহী মতামত মাত্র, তা কোনো বিধানগত সিদ্ধান্ত ছিল না। এমতাবস্থায় রসূলের সাথে দ্বিমত করে ঐ নারী রসূলের সাথে বিতর্ক করেছিলো এবং আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিলো। আল্লাহ তার মতের অনুকূলেই আয়াত নাযিল করলেন এবং সুনির্দিষ্টভাবে বিধান দিলেন যে, যিহার বাতিল, যিহারের কারণে তালাক সংঘটিত হবে না, কারণ যিহার একটি অত্যন্ত মন্দ ও অসত্য কথা ছাড়া কিছুই নয়, এর মাধ্যমে স্ত্রী মায়ের মতো হয়ে যায় না, বরং স্ত্রী স্ত্রীই থাকে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, নারী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী প্রধানের (তিনি নবী, উলিল আমর ও রাষ্ট্রপতি বা প্রধান বিচারপতি যে-ই হন) নির্বাহী মতের বিপরীতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করার যোগ্যতা ও অধিকার রাখে।
পরিশেষে বলা যায় যে, নারী-পুরুষের পারস্পরিক যোগাযোগে শালীনতা বজায় রাখা এবং নারীর স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্র হিসেবে গৃহকে অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়টি কোনোভাবে নারী-পুরুষের পারস্পরিক যোগাযোগকে সম্পূর্ণরূপে পরিহারের নির্দেশনা দেয় না এবং তা নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণকে অবরোধ করে না।
৩:১৯৫ আয়াত অনুযায়ী, নারীকেও আল্লাহর পথে হিজরত করতে হবে, সমাজকর্মে বা সমাজ কল্যাণের কাজে তৎপর থাকতে হবে, অন্য নারীদের কাছে এবং যথাযথ নিরাপদ ব্যবস্থায় সম্ভবপর ক্ষেত্রে নারী-পুরুষদের কাছে ন্যায়ের বাস্তবান ও অন্যায়ের প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করতে হবে এবং যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করতে হবে। এজন্য নারীদেরও সামরিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
আল কুরআনে অশ্লীলতা ও ব্যভিচার এবং যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য সুনির্দিষ্ট শাস্তি প্রদানের বিধি বিধান বর্ণিত হয়েছে। ব্যভিচার মানব সভ্যতার জন্য একটি বিধ্বংসী তৎপরতা এবং ধর্ষণ মানব সভ্যতার উপর উলঙ্গ হামলা।
২৪:৪ আয়াত অনুযায়ী, কেউ যদি কোন সতী নারী তথা যে নারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যায় নি এমন নারীর উপর ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করে তাকে ৮০ বেত্রাঘাতের বিধান দেয়া হয়েছে। কোনো পুরুষের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের মিথ্যা অভিযোগের ক্ষেত্রেও একই দণ্ডবিধি প্রযোজ্য।
ব্যভিচারের শাস্তি প্রসঙ্গে ৪:১৫ আয়াতে বর্ণিত ব্যবস্থা হচ্ছে যখন নারীটি মু’মিন সমাজের কিন্তু নারীটি যার প্রেমাসক্ত সে পুরুষটি অমু’মিন সমাজের তখন নারীটিকে তার বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ করে দিতে হবে। এ অবস্থা বহাল থাকবে তার মৃত্যু পর্যন্ত বা আল্লাহ তার জন্য অন্য পথ খুলে দেয়া পর্যন্ত তথা পুরুষটি মারা যাওয়া বা স্থানান্তরে চলে যাওয়া, নারীটির সংশোধন হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হওয়া বা বিশ্বাসযোগ্য হওয়া, নারীটির সংশোধনসাপেক্ষে কোন মুমিন পুরুষের সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। সুতরাং এ বিষয়ে যারা ভুল ধারণা পোষণ করেন যে, নারীর শাস্তি কি পুরুষের চেয়ে বেশি? তাদের ধারণাটি আসলে অমূলক চিন্তার উপর তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আয়াতটিতে পুরুষটি ভিন্ন সমাজের হওয়ায় তার উপর মু’মিন সমাজের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় শুধু মু’মিনা নারীটির শাস্তির বিষয়টিতে আলোকপাত করা হয়েছে। আর পরবর্তী আয়াতে (৪:১৬) মু’মিন সমাজেরই দুইজন অশ্লীলতায় জড়িত হলে তাদের উভয়কে শাস্তি দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
২৪:২ আয়াতে ব্যভিচারের দণ্ডবিধি হিসেবে ব্যাভিচারীনী ও ব্যাভিচারী উভয়কে ১০০টি ‘চামড়ায় আঘাত’ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাদেরকে ১০০টি বেত্রাঘাত করতে হবে যার উদ্দেশ্য হবে তাদের চামড়ায় আঘাত করা, এমনভাবে আঘাত করা যেন আঘাতের প্রভাব যথাসম্ভব চামড়ায় প্রভাব ফেলে, চামড়ার নিচে থাকা গোশত ও হাড় পর্যন্ত এর বেশিদূর প্রভাব বিস্তৃত না হয়। কারো প্রতি স্নেহ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাকে শাস্তি না দেয়া অথবা নামমাত্র শাস্তি দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সুতরাং অবশ্যই বেত্রাঘাত হতে হবে মধ্যম মাত্রায়, যেন তা একদিকে ‘মারাত্মক আঘাত’ না হয়, অন্যদিকে ‘নামমাত্র আঘাত’ও না হয়।
আল কুরআনে নারী-পুরুষের মানবিক মর্যাদার সমতা এবং কল্যাণকর সমাজ গঠনে তাদের সুষম অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে প্রয়োজনীয় বিধি বিধান প্রদান করা হয়েছে। নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের পবিত্রতার জন্য শালীন পোশাক এবং পারস্পরিক যোগাযোগে শিষ্টাচারের মৌলিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। পোশাক মানুষের মৌলিক মানবীয় গুণ লজ্জাশীলতা ও শালীনতার স্বাভাবিক প্রতিশ্রুতি এবং তাই শালীন পোশাক পরা সভ্য মানুষ হওয়ার পরিচায়ক। এছাড়া মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ হিসেবে একে অন্যের গৃহে প্রবেশ ও যাতায়াতের ক্ষেত্রে অনুমতি নেয়ার শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
নারী পুরুষ উভয়কে লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার উপযোগী পোশাক পরিধান করতে হবে। তবে নারীদের উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যাতে বলা হয়েছে যে, তারা তাদের একান্ত ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয় ও নিকটবর্তী পরিজন যাদের তালিকা উল্লেখ করা হয়েছে তারা ছাড়া অন্যদের সামনে তাদের রূপসৌন্দর্য প্রকাশ করতে পারবে না, তবে যা স্বাভাবিকভাবে বা বিধিসঙ্গতভাবে প্রকাশযোগ্য তা ভিন্ন। আর যা স্বাভাবিকভাবে বা বিধিসঙ্গতভাবে প্রকাশযোগ্য তার পরিসর হিসেবে সেই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো চিহ্নিত করা যায়, যা ওজু করার সময় ধৌত ও মাসেহ করতে হয়। এছাড়া নারীদেরকে আরো নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা বক্ষদেশে ‘খিমার’ বা এমন বস্ত্রখণ্ড রাখতে হবে যা দ্বারা উহার আকৃতিকে অস্পষ্ট করে দেয়া যায়। যখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে এরূপ অবস্থায় নারীরা বাইরে যাওয়ার সময় তাদের উপর জিলবাব বা চাদর জড়িয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
স্বাভাবিক অবস্থায় নারী-পুরুষের শালীন সমাবেশ এবং পারস্পরিক যোগাযোগে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। নারীরা স্বাধীনভাবে চলাচল এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। বরং মু’মিন নারী-পুরুষ পরস্পরের বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে নিজেদের জীবনে আল্লাহর নির্দেশনা অনুসরণের পাশাপাশি সমাজে ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রয়োজন হলে নারীরাও যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করতে হবে। সুতরাং ইসলামী ধর্মমতের নামে নারীদের উপর যেসব বাড়তি বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় আল কুরআনের আলোকে তার কোনো ভিত্তি পাওয়া যায় না। ইসলামের নামে নারীদের পোষাক, পর্দা বিষয়ে যে বাড়াবাড়ি করা হয় তার অধিকাংশই কুরআন সম্মত নয়। স্রষ্টা কুরআনে ধর্মে বাড়াবাড়ি করতে স্পষ্টতই নিষেধ করেছেন।
কুরআনে মধ্যপন্থা ও ব্যালেন্সড আচরন ও শিষ্টাচার নির্দেশ করে। সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে নারী-পুরুষ উভয়কে শালীন পোশাক পরিধান করতে হবে এবং পারস্পরিক যোগাযোগে শালীনতা ও শিষ্টাচার বজায় রাখতে হবে, এটাই হিজাব সম্পর্কিত আয়াতসমূহের মৌলিক শিক্ষা।
আওরাত عَوْرَة : আওরাত শব্দের অর্থ হলো, ‘ব্যক্তিগত বিষয়, যা নাজুক অবস্থায় থাকতে পারে’। কুরআনে আওরাত শব্দটি তিনটি আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে। একটি আয়াতে নারীদের নারীত্বের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়কে ‘আওরাত’ বলা হয়েছে। আরেকটি আয়াতে তিনটি সময়কে (সালাতুল ফজরের পূর্বের সময়, সালাতুল ইশার পরের সময় এবং দুপুরে যখন ব্যক্তিগত কক্ষে বিশ্রাম নেয়া হয়) ‘আওরাত’ বলা হয়েছে, যার অর্থ হলো ‘ব্যক্তিগত ও গোপনীয়তার সময়’। আর তৃতীয় আয়াতটিতে মুনাফিক্বরা তাদের ব্যক্তিগত বাড়িঘরকে অনিরাপদ অবস্থায় থাকার দাবি করা প্রসঙ্গে উহাকে ‘আওরাত’ (নাজুক অবস্থায় থাকা ব্যক্তিগত সম্পত্তি) বলে উল্লেখ করার উদ্ধৃতি রয়েছে।
ক্বাওলাম মা'রূফ قَوْلًا مَّعْرُوفًا : ক্বাওলাম মা’রূফ শব্দের অর্থ ‘সুসঙ্গত বক্তব্য, স্বাভাবিক সাবলীল কথা’। নবীর স্ত্রীদেরকে কথাবার্তায় নমনীয়তা অবলম্বনের পরিবর্তে ‘ক্বাওলাম মা’রূফ’ বলার বিশেষ নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং এর উদ্দেশ্য হিসেবে জানানো হয়েছে যে, অন্যথায় ‘যাদের মনে রোগ আছে’ তারা আগ্রহী হয়ে পড়তে পারে। ‘যাদের মনে রোগ আছে’ একটি ব্যাপক শব্দ যা দ্বারা মনের যাবতীয় অশোভন ভাব, আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি বুঝায়। এ নির্দেশটির একটি শিক্ষা হলো ‘নারীরা পুরুষদের সাথে কথাবার্তায় এমন কোমল বক্তব্যভঙ্গি পরিহার করবে যা তাদের মধ্যে বিশেষ আকর্ষণ তৈরি করতে পারে, বরং এমনভাবে কথা বলবে যা স্বাভাবিক ও সাবলীল হয়ে থাকে, যেমন কোনো পুরুষ কোনো পুরুষের সাথে এবং কোনো নারী কোনো নারীর সাথে স্বাভাবিকভাবে যেরূপ বক্তব্যভঙ্গিতে কথা বলে, নারী-পুরুষের পারস্পরিক কথার ক্ষেত্রেও সেরূপ স্বাভাবিকতা ও সাবলীলতা বজায় থাকতে হবে।
ক্বাররু قَرْرُ : ক্বাররু অর্থ ‘স্বস্তিকর হওয়া, শান্তিতে থাকা, স্বস্তির সাথে অবস্থান করা’। নবীর স্ত্রীদেরকে উদ্দেশ্য করে স্বস্তিপূর্ণভাবে গৃহে অবস্থানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং সেজন্য ‘ক্বাররু’ ক্রিয়াবিশেষ্য থেকে গঠিত ‘ক্বারনা’ নির্দেশবাচক ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়েছে (৩৩:৩৩)। অনেকে নবীর স্ত্রীরা এবং তাঁদের অনুসরণে নারীরা একান্ত প্রয়োজন ছাড়া গৃহের বাহিরে যাওয়া উচিত নয় বলে মতপ্রকাশের জন্য এ নির্দেশটিকে দলীল হিসেবে পেশ করে থাকেন। কিন্তু এ সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন অনুসারে এ নির্দেশের তাৎপর্য তা নয়, বরং এর প্রকৃত তাৎপর্য হলো, তাঁরা গৃহে অবস্থানকালীন সময়ে স্বস্তিপূর্ণভাবে অবস্থানের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যকথায় তাঁদের গৃহে অবস্থানকালীন সময় তাঁদের অবস্থান যেন স্বস্তিপূর্ণ হয় সেজন্য তাঁদেরকে মনোযোগী হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশ থেকে এ অনুপ্রেরণা গ্রহণ করা যেতে পারে যে, তাঁদের প্রধান কর্মক্ষেত্র বা দায়িত্বের কেন্দ্রস্থল হলো পরিবার। । তবে নারীদেরও উপার্জনের অধিকার ও সমাজকর্মে তৎপরতার দায়িত্ব রয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে শালীনতার সাথে প্রয়োজনে বাহিরে যাতায়াত এবং পুরুষদের সাথে ব্যবসায়িক বা অন্যবিধ কার্যক্রমে অংশগ্রহণে কোনো বাধা নেই।
খিমার خِمَار : খিমার (বহুবচনে খুমুর) শব্দের অর্থ হলো ‘ওড়না, এমন বাড়তি বস্ত্রখন্ড যা দ্বারা বক্ষদেশকে এমনভাবে আবৃত করা যায় যে, উহার আকৃতি অস্পষ্ট হয়ে যায়, মাথাকে ধুলিঝড় থেকে রক্ষার জন্য বিশেষভাবে আবৃত করার কাপড়’। সুতরাং ‘খিমার’ শব্দটির বহু ধরনের ব্যবহার রয়েছে। কুরআনে নারীদেরকে খিমার দ্বারা বক্ষদেশকে আবৃত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রে বক্ষদেশকে আবৃত করার বাড়তি বস্ত্রখণ্ডই ‘খিমার’ হিসেবে সাব্যস্ত হয়। ‘খিমার’ সম্পর্কে ভুল ধারণাবশত অনেকে এর দ্বারা ‘মাথার চুল’ ঢেকে রাখাকে জরুরি সাব্যস্ত করে। কিন্তু কুরআনে মাথার চুল ঢেকে রাখার বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি। এটা মানুষ প্রথাগত কারণে বা ধুলিঝড় থেকে বাঁচার প্রয়োজনে করে থাকে, যা কোনো বিধানের সাথে সম্পর্কিত বিষয় নয়।
ছাওয়াত سَوْءَة : ছাওয়াত শব্দের অর্থ হলো ‘যা গোপনীয়তার উপযোগী, যা ঢেকে রাখার যোগ্য’। শব্দটি কুরআনে ‘লাশ’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে, যা কবর দেয়ার প্রয়োজন হয়। আবার এ শব্দটি মানুষের সেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বুঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে অশালীনতা এড়াতে বা শালীনতার জন্য যা পোশাক দ্বারা আবৃত করা প্রয়োজন।
ছায়িহাত سَائِحَات : ছায়িহাত অর্থ ‘যে নারীরা সমাজকল্যাণ কর্মে তৎপর, সামাজিক পরিমণ্ডলে সচরাচর পরিভ্রমণ করে’। অনেক অনুবাদে শব্দটিকে একটি দ্বিতীয় অর্থে লেখা হয়েছে ‘রোযা পালনকারিনী’। কিন্তু কুরআনে ‘সিয়াম পালনকারিনী’ অর্থে ‘সায়িমাত’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে (৩৩:৩৫)। অন্যদিকে ছায়িহাত শব্দটি যে ‘সমাজকল্যাণের কার্যক্রমে তৎপর’ অর্থে প্রযোজ্য তার প্রমাণ হলো, একই শব্দটির ‘নির্দেশবাচক ক্রিয়া’ হিসেবে ব্যবহৃত “ছীহু” (৯:২) শব্দের অর্থ হলো “দেশে সচরাচর পরিভ্রমণ করো”। সুতরাং যখন নারীদের গুণ বুঝাতে “ছায়িহাত” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে (৬৬:৫) তখন এর দ্বারা “সামাজিক কল্যাণমূলক কাজের উদ্দেশ্যে সচরাচর পরিভ্রমণ করা”কে বুঝায়। আর এ শব্দটির পুংলিঙ্গ “ছায়িহূন” শব্দটিও একই অর্থে পুরুষদের গুণ বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে (৯:১১২)।
জ্বিনা زِنَىٰ : জ্বিনা শব্দের অর্থ হচ্ছে ব্যভিচার, বিবাহ বহির্ভুত যৌন সম্পর্ক, অনৈতিক সর্ম্পক স্থাপন করা। কুরআনে জ্বিনাকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে দণ্ডবিধি দেয়া হয়েছে।
জিলবাব جِلْبَاب : জিলবাব (বহুবচনে জালাবীব) শব্দের অর্থ হলো ‘চাদর, অতিরিক্ত পরিধেয় প্রশস্ত কাপড়, বিশেষ ধরনের পরিচায়ক বাইরের পোশাক’। কুরআনে নবীর স্ত্রী, কন্যা ও মু’মিন নারীদের জন্য সাধারণ অবস্থায় যেরূপ ড্রেসকোড পরিধান করতে বলা হয়েছে যখন তা তাদেরকে হয়রানি থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট হয় না, বরং অধিক সম্ভাবনা থাকে যে, বাইরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের গায়ে বিশেষ ধরনের চাদর জড়িয়ে নিলে তারা হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে পারে, এরূপ অবস্থায় তাদেরকে সেরূপ চাদর পরিধান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদি উল্টো পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, এরূপ চাদর পরার চেয়ে সাধারণ পর্যায়ের শালীন ড্রেস পরাই হয়রানি থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনায় সাধারণ পর্যায়ের শালীন ড্রেসই যথেষ্ট হতে পারে। কারণ মূল উদ্দেশ্য হলো হয়রানি প্রতিরোধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
জুয়ুব جُيُوب : জুয়ুব (একবচনে জায়ব) শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘বক্ষদেশ, বক্ষদেশের পাশে থাকা জামার পকেট (জেব)’। নারীদের ড্রেসকোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান হিসেবে তাদেরকে তাদের জুয়ুব বা বক্ষদেশের ওপর ‘খিমার’ বা এমন বস্ত্রখণ্ড রাখতে বলা হয়েছে যা বক্ষদেশের আকৃতিকে অস্পষ্ট করে দেয়। বিশেষ গুরুত্বের কারণে লজ্জা নিবারণের উপযোগী পোশাক পরার সাধারণ নির্দেশনার পাশাপাশি আলাদাভাবে এই নির্দেশটি প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে নারীদেরকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা আবশ্যক।
তাক্বওয়া تَقْوَىٰ : তাক্বওয়া শব্দের অর্থ হলো “স্রষ্টা-সচেতনতা, স্রষ্টার বিধান লংঘনজনিত শাস্তির ভয়-ভীতি’। স্রষ্টা পরম দয়ালু ও করুণাময় এবং তিনি তাঁর বিধি-বিধান মানুষের কল্যাণের জন্যই প্রদান করেছেন। তিনি মানুষকে সাধ্যাতীত কাজের দায়িত্বভার অর্পণ করেন না এবং তাই বিশেষ বাধ্যবাধকতার পরিস্থিতিতে কোনো কাজ করা না করার কারণে তিনি কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করেন না। এমতাবস্থায় মানবজাতির প্রকৃত কল্যাণের জন্য স্রষ্টা-সচেতনতা এবং তাঁর বিধান লংঘনের বিষয়ে ভয়-ভীতি মানুষের খুবই গুরুত্বপূর্ণ গুণ।
তাবাররুজ تَبَرُّج : তাবাররুজ শব্দের অর্থ হলো ‘প্রদর্শনী’। শব্দটি নারীরা তাদের নারীত্বের ‘প্রদর্শনী’ না করার জন্য নির্দেশ প্রদান প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। বলা হয়েছে ‘পূর্ববর্তী জাহিলিয়্যাতের যুগের মতো করে নিজেদেরকে প্রদর্শনী করো না’। বয়স্করা তাদের বাড়তি পোশাক (সিয়াব) খুলে রাখতে পারবে, কিন্তু শর্ত হলো তারাও যেন তাদের গোপনীয় রূপসৌন্দর্যকে প্রদর্শনী না করে। যেরূপ পোশাক পরিধান করলে নারীদেহের গঠনগত সৌন্দর্য ফুটে উঠে সেই ধরনের (আঁটসাঁট, অত্যন্ত পাতলা ও অর্ধনগ্নতার মতো) পোশাক পরা এবং এমন চালচলন ও অঙ্গভঙ্গি যা নারীদের গোপনীয় রূপসৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলে তা থেকে বিরত থাকতে হবে। নারীত্বের প্রদর্শনী থেকে বিরত থাকা শালীনতা রক্ষার অন্যতম পরিচায়ক।
ফুরূজ فُرُوج : ফুরুজ (একবচনে ফারজ) অর্থ ‘ফাটল, সতীত্ব, লজ্জাস্থান’। কুরআনে শালীনতা সংরক্ষণের নির্দেশ হিসেবে দৃষ্টিকে সংযত রাখতে এবং ফুরুজ বা লজ্জাস্থান হেফাযত করতে বলা হয়েছে। লজ্জাস্থান হেফাযত রাখার একটি তাৎপর্য হলো শালীন পোশাক পরা যার মাধ্যমে লজ্জা নিবারণ করা হয়। আর এর আরেকটি তাৎপর্য হলো অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকা।
ফাহশা ও ফাহিশাহ فَحْشَاء ، فَاحِشَة : ফাহশা ও ফাহিশাহ প্রতিশব্দ এবং এর অর্থ হলো ‘অশ্লীলতা, অশালীনতা’। কুরআনে জানানো হয়েছে যে, আল্লাহ প্রকাশ্য ও গোপন সর্বপ্রকার অশালীন কথা ও কাজকে হারাম বা নিষিদ্ধ করেছেন। আর অশালীনতা এড়ানো বা শালীনতার একটি উপায় হিসেবে শালীন পোশাক পরিধানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হিজাব সম্পর্কিত সামগ্রিক নির্দেশনা অশালীনতা থেকে বিরত থাকা এবং শালীনতা অবলম্বনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
মুরজিফূন مُرْجِفُون : মুরজিফূন শব্দের অর্থ হলো “যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজকে ভীষণভাবে কাঁপিয়ে তোলে”। অনেকে এ শব্দটিকে ‘কুৎসা রটনা বা গুজব রটনা’ অর্থে অনুবাদ করে থাকে। কিন্তু কুরআনে এ শব্দের শব্দমূলের সাথে সম্পর্কিত সকল ব্যবহার এবং কুৎসা রটনা বা গুজব রটনা সম্পর্কিত তথ্য যাচাইয়ের ভিত্তিতে প্রতীয়মান হয় যে, মুরজিফূন শব্দটি দ্বারা তাদেরকেই বুঝানো হয় যারা সমাজকে ভীষণভাবে প্রকম্পিত করার মতো কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়। যারা মুনাফিক্ব এবং যাদের মনে রোগ আছে এবং যেসব ‘মুরজিফূন’ রয়েছে, তারা যদি বিরত না থাকে, তাহলে তাদেরকে ধরা হবে এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
যীনাত زِينَت : যীনাত শব্দের অর্থ ‘সৌন্দর্য, রূপলাবণ্য, সুন্দর সামগ্রী’। নারীদের ড্রেসকোড হিসেবে পিতা-পুত্র-ভাইসহ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যেসব ব্যক্তিদের সামনেও বিশেষ গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে তাছাড়াও অন্যদের সামনে তাদের এমন গোপনীয় সৌন্দর্য আবৃত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যা স্বাভাবিকভাবে প্রকাশযোগ্য নয়। এ নির্দেশনায় নারীদের রূপসৌন্দর্য বুঝাতে ‘যীনাত’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
রীশ رِيش : রীশ শব্দটির অর্থ হলো ‘যা শরীরের শোভা-সৌন্দর্য বর্ধন ও উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ করে’। মানুষের পোশাক পরিধানের প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে লজ্জা নিবারণের কথা বলা হয়েছে এবং দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হিসেবে ‘রীশ’ বা ‘দৈহিক শোভা বর্ধন এবং আবহাওয়া উপযোগী আরামদায়ক পোশাক পরিধানের’ কথা বলা হয়েছে। সুতরাং এ দুটি মুলনীতি পরিপালন হলে সেটাই কুরআন নির্দেশিত পোশাক হিসেবে গণ্য হবে। সৌন্দর্যবোধে মানুষের মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে এবং সৌন্দর্য একটি বহুমাত্রিক বিষয়। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পর্যায়ের সুন্দর পোশাক পরা যেতে পারে। এটি ব্যক্তির অবস্থা ও পছন্দের উপর নির্ভর করে।
লিবাস لِبَاس : লিবাস শব্দের অর্থ ‘পোশাক’। কুরআনে শালীন পোশাক পরিধানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং জানানো হয়েছে যে, আল্লাহ পোশাকের উপকরণ নাযিল করেছেন যেন তা দ্বারা লজ্জা নিবারণ করা যায় এবং একই সাথে তা বিভিন্ন আবহাওয়ায় আরামদায়ক ও শারীরিক শোভা বর্ধনের উপায় হয়। পোশাক উদ্দেশ্যের উপযোগী হতে হয়, যেমন যুদ্ধের পোশাক এমন হতে হয় যেন তা অস্ত্রের আঘাত প্রতিরোধের সহায়ক হয়। সর্বোত্তম পোশাক হলো ‘তাক্বওয়ার পোশাক’ তথা মনকে স্রষ্টা-সচেতনতা দ্বারা সজ্জিত করা। একইভাবে স্রষ্টা-সচেতনতার ভিত্তিতে বাহ্যিক পোশাক আশাকও শালীন হতে হবে।
সিয়াব ثِيَاب : সিয়াব শব্দটির অর্থ হলো ‘অতিরিক্ত পোশাক’। এ শব্দটির দ্বারা সাধারণভাবে ওড়না, পাগড়ি, চাদর ইত্যাদি বাড়তি পোশাককে বুঝানো হয়। নারীদের ড্রেসকোড প্রসঙ্গে দেয়া নির্দেশনায় বলা হয়েছে যে, বয়স্ক নারীরা তাদের ‘সিয়াব’ খুলে রাখলে তাতে দোষ নেই, তবে শর্ত হলো যেন তারা তাদের গোপনীয় রূপসৌন্দর্যের প্রদর্শনী না করে। তবে তাদের জন্যও ‘সিয়াব’ ব্যবহার করাই উত্তম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সিয়াব সম্পর্কিত নির্দেশনা থেকে বুঝা যায় যে, নারীদের ড্রেস কোডের বিষয়টি শালীনতার উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত এবং এটি বয়স্কদের চেয়ে তরুণীদের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
হিজাব حِجَاب : হিজাব শব্দের অর্থ হলো ‘পর্দা, যার দুই পাশে থাকা ব্যক্তি ও বস্তুর মধ্যে আড়াল তৈরি হয়’। কুরআনে হিজাব শব্দটি বস্তুগত ও অবস্তুগত বা মনস্তাত্ত্বিক পর্দা উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন কুরআন প্রচারকারী এবং প্রত্যাখ্যানকারীর মধ্যে পর্দা তৈরি হয়, যে পর্দার কারণে প্রত্যাখ্যানকারীরা কুরআনকে বক্তব্যকে গ্রহণ করতে পারে না। নবীর স্ত্রীদের থেকে তাঁদের গৃহে তাঁদের কাছে কিছু চাইতে হলে তাঁদের পিতা-ভাই-পুত্র প্রমুখ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য মু’মিন পুরুষরা যেন তাঁদের ব্যক্তিগত কক্ষের পর্দার আড়াল থেকে চেয়ে থাকেন, এরূপ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সাধারণভাবে ‘হিজাব’ বলতে ‘নারীদের মাথার চুল ঢাকার স্কার্ফ’ বুঝানো হয়। তবে কুরআনে এ অর্থে ‘হিজাব’ শব্দ ব্যবহৃত হয়নি এবং এরূপ মাথা ঢাকার হিজাবকে বাধ্যতামূলকও করা হয়নি।