কুরআনে আমরিন জামিয়িন বা সামষ্টিকভাবে সম্পাদিত কাজ বা দলবদ্ধভাবে করা কাজ প্রসঙ্গটি হাজির পাওয়া যায়। এটি খুব স্বাভাবিক কারন মানুষ গোষ্ঠিবদ্ধ সামাজিক প্রাণী। সে পরিবার ও সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে, এভাবেই সে আদিমযুগ থেকে নিজেকে রক্ষা করে এসেছে।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে যা একজন করতে পারে, একের অধিক মানুষ তা আরো সুন্দরভাবে, দ্রুততার সাথে এবং দক্ষতার সাথে করতে পারে। আমরা একটি আধুনিক সময়ের দুইতালা দালানের কথাই চিন্তা করতে পারি যা তৈরী করতে অনেকগুলো মানুষের প্রয়োজন হয়, অনেক কাঁচামালের প্রয়োজন হয় যা একজনের পক্ষে জোগাড় ও উৎপাদন করা প্রায় অসম্ভব।
সমাজের নানান ধরনের সমস্যার সমাধানও ঠিক তেমনি কেবলমাত্র একজনের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। অথচ আল্লাহ মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে যে মহান দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, সেখানে খলিফা হিসেবে, বিশ্বাসী বান্দা হিসেবে সমাজের কাছে সে দায়বদ্ধ। সমাজের অন্যায়, অন্যায্যতা দূর করা থেকে শুরু করে অসহায়ের পাশে দাড়ানো সহ আরো অনেক দায়িত্ব একজন বিশ্বাসীর উপরে বর্তায় যার কিছু কিছু সে একা করতে পারলেও যেগুলো দীর্ঘমেয়াদী ও যার জন্য অনেক প্রচেষ্টার প্রয়োজন তা কেবল একজনের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আবার অন্যদিকে সে সমস্যাগুলোর মধ্যে এমন অনেক কিছু থাকে যা সমাধান না করলে এর কু প্রভাব সমাজের সবার উপরেই পড়ে। যেমন: সমাজে অনৈতিকতা, দুর্নীতি, লুটপাট, কুশাসন, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিকতা।
এমনতাস্থায় কুরআনের আমরিন জামিয়িন বা সামষ্টিক কাজের যে শিক্ষা আমরা পাই তার ভিত্তিতে কুরআনের শিক্ষার্থী হিসেবে অনেকের একটি চিন্তার জায়গা হলো: কিভাবে ঐক্যবদ্ধ বা সংঘবদ্ধ হওয়া যায়? এর প্রক্রিয়াটি কি হবে।
কুরআনের পাঠক, শিক্ষার্থী ও সাধারনভাবে বিশ্বাসীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চিন্তা ও প্রচেষ্টায় যে সব চ্যালেঞ্জ দেখা যায় তার মধ্যে কয়েকটি হলো: থিওলজী বা ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন বিষয়ে মতের অমিল, কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের অনুধাবন সংক্রান্ত দূরত্ব ইত্যাদি। এর বাইরে পারস্পরিক বিদ্ধেষ, নেতৃত্বের আকাংখা, নিজ ফ্যান ফলোয়ারের উপরে স্বীয় প্রভাব অব্যহত রাখা, পার্থিব সুবিধা, গর্ববোধ ইত্যাদি সমস্যা রয়েছে।
কুরআনে আল্লাহ মনে করিয়ে দিয়েছেন যে পূর্বে যারা মতবিরোধ করতো, তারা মতবিরোধ করেছিলো তাদের কাছে কিভাবের জ্ঞান আসার পরে এবং পারস্পরিক বিদ্ধেষ অন্যতম ফ্যাক্টর ছিলো। সুতরাং কুরআনের দাবীদার আমরা মুসলিমরাও যে পূর্ববর্তী আহলে কিতাবদের মতো একই চোরাবালিতে হাবুডুবু খাবো এটা খুব আশ্চর্যের বিষয় নয়।
এখন যারা আমরিন জামিয়িন বা সংঘবদ্ধ কর্মের বিষয়ে অগ্রসর হতে চান তাদের জন্য করণীয় কি হতে পারে?
কারো কারো মতে, কুরানিক আন্ডাস্ট্যান্ডিং বা বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে কিছু কমন জায়গায় একমত হওয়ার প্রচেষ্টা জারি রাখা। এই প্রচেষ্টা একটা পর্যায়ে আসার পর সংঘবদ্ধ হওয়া।
এই পথের মুশকিল হলো: পারস্পরিক বিদ্ধেষ, বোঝার ঘাটতিসহ পূর্বোল্লেখিত অনেকগুলো কারনে এই প্রচেষ্টা আশানরূপ ফল আনছে না। বরং থিওলজীকাল ডিবেটের চোরাবালিতে আটকে তর্ক, কুতর্ক, অন্যের থেকে নিজে বেশি বুঝি মনোভাব প্রর্দশন, ইগো ইত্যাদির কারনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বদলে আরো বেশি দলাদলি ও বিভক্তিই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই উত্তরোত্তর বিভক্তি ও মতভেদ এটাই প্রমাণ করে যে থিওলজীকাল লাইনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা খুব একটা কাজে আসবে না।
হাজার বছরের শিয়া সুন্নী বিভাজন, বিভিন্ন সুন্নী মাযহাবের পার্থক্য এবং কুরানিস্টদের মধ্যে সালাত, যাকাতসহ আরো অনেক বিষয়ে মতের অমিল থেকে এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।
তাহলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে তাগিদ, যে ডাক ও দাবী কুরআনের মাধ্যমে স্রষ্টার সেই আহ্বানের দিকে আমরা কিভাবে অগ্রসর হবো?
একটা উদাহরন দেওয়া যাক। ধরুন একটি গ্রামে প্রায় ২৫ জন ছোট ছেলে মেয়ে আছে যাদের বয়স ৭ থেকে ৯। এখন তাদেরকে একত্র করার প্রয়োজন। যদি কোন বিশেষ কারন ছাড়া তাদের ডাকা হয় গ্রামের একটি নির্দিষ্ট স্থানে, তারা হয়তো কয়েকজন আসবে, তাও ১ দিন আসার পর আর নাও আসতে পারে। কারন ডাকার কোন সুনির্দিষ্ট কারন বলা হয় নি। ঐ একই ছেলে মেয়েদের জন্য পড়ার জন্য পাঠশালায় জড়ো হতে বলা হয় তারা কিন্তু শিক্ষার জন্য নিয়মিত ঐক্যবদ্ধ হয়ে ক্লাস করবে।
একই কথা কুরআন প্রেমি ভাই বোনদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কোন নিদিষ্ট কাজ, আমল সালেহ কেন্দ্রিক কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হয়। কোন বাস্তব, সমাজের প্রয়োজন এরকম কোন সৎকর্মে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং সৎকর্মে প্রতিযোগিতার বাস্তবতায় নিয়োজিত হয়ে।
আমাদের চারপাশে তাকালে আমরা দেখবো যে ধর্ম ও ধর্ম বিষয়ে যাবতীয় আয়োজন অনেকটা কথার দোকানে পরিনত হয়েছে যেখানে কেবলমাত্র কথার বিকিকিণি হয়ে থাকে। এখানে তর্কের পিঠে তর্ক যার সিংহভাগই কুতর্ক এবং যার কোন শেষ নেই। একজন বিশ্বাসী জানে যেকোন সময়ে তার ইহকালের সমাপ্তি ঘটবে, তাকে তার স্রষ্টার সামনে হিসাবে দাড়াতে হবে। এমতাবস্থায় কেবলমাত্র থিওরী, তাত্ত্বিক থিওলজী বা ধর্মতত্বের মতবিরোধে সে যদি লিপ্ত থাকে এবং সময়ক্ষেপণ করে সত্যিকারের আমল সালেহ যা কেবলমাত্র স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য সে করবে - তা না করতে পারে, তাহলে এটি নিতান্তই দূভার্গের হবে।
এই বাস্তবতার পেরিপ্রেক্ষিতে কুরআন প্রেমী ভাই বোনদের কাছে আহ্বান থাকবে নিজেদের জ্ঞানের গরিমা, অহংকার, বোঝাবুঝির দূরত্ব ভুলে, সৎকাজের প্রতিযোগিতায় নিজেদের আত্ননিয়োগ করা। আমাদের ঈমান যেমনই হোক না কেন, যত দূর্বলই হোক না কেন - সৎকর্মের মাধ্যমে অন্তত পক্ষে কিছুটা হলেও আশা রাখা যাবে যে স্রষ্টার সৃষ্টিকুলের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব ছিলো তার সামান্য কিছু পালনে আমরা সচেষ্ট হয়েছিলাম।
অন্যথায় আমাদের যাবতীয় জ্ঞান, পুঁথিগত বিদ্যা ভারবাহী গাধার পিঠে চাপানো কিতাবের মতোই মূল্যহীন মরিচিকায় পরিনত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আল্লাহ আমাদের এই বিপর্যয় থেকে হিফাযত করুন, তিনিই একমাত্র হিফাযতকারী এবং অসার তর্ক-বিতর্কের দোকনদারী থেকে বের হয়ে তাঁর সৎকর্মশীল বান্দাদের মধ্যে অর্ন্তভূক্ত করুন যারা সৎকাজে ঐকবদ্ধ এবং সৎকাজে পরস্পরের প্রতিযোগী।
মিরপুর, ঢাকা। ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩
সাদিক মোহাম্মদ আলম
প্রতিষ্ঠাতা, প্রস্তাবিত দি ইন্সটিটিউট ফর কুরআনিক রিসার্চ এন্ড এ্যাপ্লিকেশন (দি ইক্বরা)
আমরিন জামিয়িন’ বা ‘সমষ্টিগত বিষয় ও কার্যক্রম’ সম্পর্কে কুরআনের আয়াত সমূহ দেখার জন্য আল কুরআনের আলোকে উলিল আমর সংকলনটি পড়ে দেখার পরামর্শ থাকলো।