দি  ইন্সটিটিউট ফর কুরআনিক রিসার্চ এন্ড এ্যাপ্লিকেশন (ইক্বরা)

লক্ষ্য

ইক্বরার লক্ষ্য হলো বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য স্রষ্টার ঐশী বাণীর সমন্বিত অধ্যয়ন ও সার্বজনীন প্রয়োগের জন্য জ্ঞানদীপ্ত অনুশীলন।

উদ্দেশ্য

ইক্বরার উদ্দেশ্য হলো কুরআনের বাণীর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ অনুধাবনের জন্য টেকসই ভিত্তি প্রস্তুত করা এবং জীবন ও সমাজের প্রায়োগিকতার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানভিত্তিক ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামো নির্মাণ।

প্রকাশিত বইসমূহ

হারাম মাস : বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিরতি

আল কুরআন অনুসারে প্রতি বছর চারটি হারাম মাস (আরবায়াতু হুরুমুন ৯:৩৬) পরিপালন করতে হবে হবে, যাকে একসাথে বলা হয় ‘আশহুরুল হুরুমুন’ (৯:৫)। আর হারাম মাসসমূহের প্রতিটিই হচ্ছে আশ শাহরুল হারাম (২:১৯৪, ২:২১৭, ৫:২, ৫:৯৭)। হারাম মাস সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে বুঝা যায় যে, বিধানটি মূলত বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বিরতির বিধানের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বাস্তবতা হলো সময়ের ব্যবধানে বর্তমান মুসলিম জাতি হারাম মাসসমূহের সাথে সম্পর্কিত বিধি-বিধানের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছে। তাই হারাম মাসসমূহের বিধি-বিধানের কল্যাণ অর্জনের জন্য আল কুরআনের আলোকে হারাম মাসসমূহের প্রকৃত সময়কাল চিহ্নিতকরণ এবং এতে করণীয় সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন ও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

হারাম মাসসমূহের সংখ্যা এবং সময়গত অবস্থান বুঝার জন্য কিছু প্রাথমিক তথ্য

৯:৩৬-৩৭ আয়াত অনুযায়ী, সৃষ্টির শুরু থেকে একটি বর্ষে (উল্লেখ্য কুরআন অনুসারে বর্ষ হিসেব করার ভিত্তি হলো সূর্য বা দিনের প্রকৃতি যেমন Spring Equinox থেকে Spring Equinox) ১২ টি চান্দ্রমাসের হিসাব আল্লাহর বিধানে সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক নিয়ম। ১২ টি চান্দ্রমাসের মধ্যে চারটি মাস হচ্ছে হারাম মাস তথা যুদ্ধবিরতির এবং বন্য প্রাণীর শিকার থেকে নিবৃত্ত থাকার জন্য সংরিক্ষত মাস।

৯:১-৫ আয়াত অনুযায়ী, চারটি হারাম মাস একটির সাথে অন্যটি সন্নিহিত বা পরস্পর সংলগ্ন। ৯:৩৬ আয়াতেও হারাম মাসসমূহ সম্পর্কে বলা হয়েছে মিনহা আরবায়াতুন হুরুমুন (সেগুলো থেকে/১২ মাস থেকে ধারাবাহিক ৪টি মাস হারাম)। এতে আরবায়াহ শব্দটির গঠনগত প্যাটার্ন এর কারণে এতে চারটি মাস ধারাবাহিক হিসেবে সাব্যস্ত হয়। সাধারণভাবে ‘চার’ বুঝাতে আরবায়া শব্দ ব্যবহৃত হয় (২৪:৬, ২৪:৮)। অন্যদিকে ধারাবাহিক বা গ্রুপবদ্ধ চার বুঝাতে আরবায়াহ শব্দ ব্যবহৃত হয়ে (২:২২৬, ২:২৩৪, ২:২৬০, ৪:১৫, ২৪:৪, ২৪:১৩, ৯:২, ৯:৩৬)।

৯:৮১ আয়াত অনুসারে হারাম মাসসমূহ শেষ হওয়ার পর যখন মু’মিনরা যুদ্ধাভিযানে বের হচ্ছিল তখন ছিল প্রচন্ড গরমের সময়। সুতরাং হারাম মাসসমূহ সবচেয়ে গরম মাসের পূর্বেই অতিক্রান্ত হয়েছিলো।

৯:২৮ আয়াত অনুযায়ী, ইয়াওমুল হাজ্জিল আকবারে যে মুশরিকরা শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়নি বা যে মুশরিকরা ইতোমধ্যে চুক্তি লংঘন করেছে তাদের যে হারাম চারমাসের অবকাশ দেয়া হলো এবং অন্য যারা আল মাসজিদুল হারামের প্রাঙ্গনে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে ও পরবর্তীতে তা লংঘন করেনি তাদেরকে চুক্তিকাল পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির অবকাশ দেয়া হলো, এ সময়কালের সমাপ্তিকে ‘আমিহিম হাযা তথা ‘আরববাসীদের গণনাপদ্ধতির সে বছরের চান্দ্রবর্ষ / চান্দ্রসৌরবর্ষ’’ শেষ হওয়া, যার পরে তার আর আল মাসজিদুল হারামের কাছে আসার অবকাশ নেই -  হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

২:১৯৬ অনুযায়ী হজ্জের মাসসমূহ নির্ধারিত এবং কেউ হজ্জের মাসের আগে তামাত্তায়া বিল উমরাতি ইলাল হাজ্জি তথা হজ্জ পর্যন্ত উমরাহ সম্পন্ন করতে পারবে, অর্থাৎ কেউ হজ্জের মাসের আগে পৌঁছে গেলে সে উমরাহ করতে পারে। এ আয়াত থেকে এটি স্পষ্ট যে উমরাহ হচ্ছে হজ্জের মাস ছাড়া অন্য মাসে। উমরাহর মাধ্যমে আল বায়তুল হারামের আবাদ বা এর কার্যকারিতা সতেজ থাকে।

২:১৯৭ অনুযায়ী হজ্জের মাসসমূহ নির্ধারিত। হজ্জের মাসসমূহ যা ৩ মাসের কম এবং ৪ মাসের বেশি হতে পারে না, কারণ হারাম মাসের সংজ্ঞা অনুসারে হজ্জের মাসসংখ্যা হারাম মাসসংখ্যাকে অতিক্রম করতে পারে না। যেহেতু হজ্জের মাসসমূহে হজ্জের সাথে সম্পর্কিত কিছু হারাম বিষয় প্রযোজ্য হয়, যা সাধারণভাবে অন্য মাসসমূহে প্রযোজ্য নয়, তাই হজ্জের মাসসমূহ হারাম মাসসমূহের আওতাভুক্ত।

২৮:২৭ আয়াতে উল্লেখিত ঘটনায় নবী মূসার সাথে তাঁর শ্বশুর যে চুক্তি করেছিলেন তার মেয়াদ ছিল আট বা দশ হিজাজহিজাজ শব্দটি হচ্ছে হিজজাহ শব্দের বহুবচন। হিজজাহ হচ্ছে হিজ্জ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। অন্যদিকে হিজ্জ হচ্ছে হজ্জ শব্দের প্রতিশব্দ। আর হিজ্জাহ দ্বারা একটি সম্পূর্ণ হজ্জ মওসুমকে বুঝায়। হিজজাহ অর্থ হজ্জ মওসুম এবং হিজাজ অর্থ হজ্জ মওসুমসমূহ। ২৮:২৭ আয়াতে হজ্জ মওসুমকে বর্ষ গণনার একক হিসেবে ধরা হয়েছে বিধায় সাধারণ ‘আট বর্ষ’ শব্দ দ্বারা আট হিজাজ শব্দের অনুবাদ করা হয়। নবী মূসা সেখানে হজ্জ মওসুমে বা তার অব্যবহিত পরে গিয়েছিলেন, যার ফলে তাঁর কাছে ৮ বা ১০ বছরের চুক্তির প্রস্তাবনা পেশ করার ক্ষেত্রে পরবর্তী বছরগুলোকে সহজেই হজ্জ মওসুমের সাথে সম্পৃক্ত করে উল্লেখ করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এছাড়া সে সময় হজ্জের সাথে সম্পর্কিত করে বর্ষ গণনার ক্ষেত্রে হজ্জ মওসুমে ব্যবসায় কাফেলার বাণিজ্য সফর একটি প্রধান কারণ বলে প্রতীয়মান হয়।

৯:৩৬-৩৭ আয়াত অনুযায়ী, নাসী তথা প্রত্যেক ১২টি চান্দ্রমাসের মধ্যে ৪টি হারাম মাস পালনের ক্ষেত্রে হারাম মাসের হিসাব স্থগিতকরণ বা মূলতবীকরণের মাধ্যমে হারাম মাসের স্থানচ্যুতি বা রদবদলের মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থার লঙ্ঘন তথা কুফর বৃদ্ধি পায়। আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনায় থাকা মুশরিকরা কোনো কোনো বর্ষে হারাম মাসকে স্থগিত করে পরবর্তীতে অন্য একটি হালাল মাসকে হারাম মাস ঘোষণা দিয়ে হারাম মাসের স্থানচ্যুতি ঘটাতো কিন্তু হারাম চার মাসের মাসসংখ্যা ঠিক রাখতো। এভাবে তারা নাসী তথা হারাম মাসের স্থানচ্যুতি বা রদবদল ঘটাতো। আল্লাহ এই নাসীর অনুশীলনকে নিষিদ্ধ করেছেন। নাসী করার কারণ ছিলো নিজেদের সুবিধামতো যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়ে হারাম মাসে যুদ্ধ বিরতি না করতে চাওয়া এবং অন্য কোনো মাসকে যুদ্ধ বিরতির মাস হিসেবে রদবদল করে নিয়ে হারাম মাসের সংখ্যা ঠিক রাখার মাধ্যমে হারাম মাসের বিধান লংঘন করেও অভিযোগ থেকে নিজেদেরকে দায়মুক্তকরন।

প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ থেকে হারাম মাসসমূহ ও হজ্জের মাসসমূহ সম্পর্কে মানুষ পরিজ্ঞাত হতে পারতো এবং এভাবে চিহ্নিত সময়সীমাকে আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িতদের ঘোষিত সময়সীমা জেনে নিয়ে তার সাথে সমন্বিত করা কঠিন বিষয় ছিল না। কিন্তু যদি হঠাৎ করে পূর্বঘোষিত কোনো হারাম মাসকে হালাল ঘোষণা দিয়ে প্রাকৃতিক প্রপঞ্চের সাথে সম্পর্কহীন কোনো মাসকে তার বদল হিসেবে নতুন ঘোষণা জারি করা হয় তথা নাসী করা হয় তাহলে তা সর্বজনীনভাবে পরিজ্ঞাত বিষয় হওয়া কোনো সহজ ও স্বাভাবিক বিষয় হতো না। এছাড়া এর মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত হারাম মাসগুলোকে হারাম (সংরক্ষিত) হিসেবে পালনের উদ্দেশ্যও ব্যাহত হতো। তাই নাসীকে একটি বাড়তি কুফর বা ন্যায়সঙ্গত প্রাকৃতিক বিধান প্রত্যাখ্যান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর সা. পরবর্তীতেও নাসী (হারাম মাসের রদবদল) হওয়ার প্রমাণ

বর্তমানে প্রচলিত ১২টি চান্দ্রমাসের যে চারটি মাসকে হারাম মাস হিসেবে দাবি করা হয় তাহলো, ১ম মাস (মুহাররম), ৭ম মাস (রজব), ১১শ মাস (জিলক্বদ) ও ১২শ মাস (জিলহজ্জ্ব)। অথচ সূরা তাওবা ৯:১-৫ আয়াত এবং ৯:৩৬ আয়াত অনুসারে হারাম চারটি মাস পরস্পর সংলগ্ন/সন্নিহিত। এ থেকে স্পষ্ট যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পরবর্তীতেও নাসী (হারাম মাসের রদবদল) হয়েছে। সুতরাং আমাদেরকে অবশ্যই আল কুরআনের আলোকে এবং প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ (Natural phenomenon) পর্যবেক্ষণ করে হারাম মাসসমূহকে চিহ্নিত করতে হবে। হারাম মাসসমূহসহ কুরআনে নির্দেশিত যেকোনো বিধানের বাস্তবরূপ থেকে কোনোভাবে বিচ্যুতি ঘটলে সেই বিচ্যুতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদেরকে কুরআন, ভাষারীতিগত বিশ্লেষণ এবং বাস্তবতার জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে এবং এভাবে প্রকৃত স্বরূপকে উন্মোচন করা সম্ভব। কারণ আল্লাহ যিকর হিসেবে কুরআন নাযিল করেছেন এবং তার হেফাযত করছেন। যিকর হেফাযতের বাস্তব দিক হচ্ছে আল কুরআনের শব্দের পাশাপাশি তার অর্থও হেফাযতে থাকা। কিন্তু অনুবাদগুলোতে কিছু অর্থ যে ঠিকভাবে আসেনি, গবেষণায় তা ধরা পড়ে। এর তাৎপর্য হচ্ছে, সঠিক অর্থ প্রতিশব্দের মধ্যে রয়েছে, উপাদান হারিয়ে যায়নি, এজন্যই কুরআনভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে সঠিক অর্থ নির্ণয় সম্ভব।

হারাম মাসসমূহের তাৎপর্য ও হারাম মাসের হারাম বিষয়

হারাম মাসসমূহ বলতে সেই মাসসমূহকে বুঝায় যে মাসসমূহকে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা অনুসারে মানবজাতির জন্য কোনো বিষয়কে হারাম বা অসিদ্ধ/নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত করে মাসগুলোকে তা থেকে বিরত থাকার জন্য সংরক্ষিত বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। হারাম মাসসমূহে কী থেকে বিরত থাকতে হবে সেই নির্দেশনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সেগুলোতে বন্য পশু শিকার বা নিধন করা হারাম এবং যুদ্ধ করা হারাম (ব্যতিক্রম হচ্ছে কোনো পক্ষ যুদ্ধ বিরতির এ আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে হামলা করে বসলে আক্রান্ত পক্ষ কর্তৃক প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ)। এটি বিশ্বজনীন যুদ্ধবিরতির (global ceasefire) সময়।

৫:৯৭ আয়াতে বলা হয়েছে যে, হারাম মাসসমূহ নির্ধারণ করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে। হারাম মাসসমূহ হারাম হওয়ার কারণ এতে এমন কিছু বিষয় হারাম যা অন্যমাসে সাধারণভাবে সেভাবে হারাম নয়। হারাম মাসের যথাযথ বাংলা অর্থ হচ্ছে সংরক্ষিত মাস। অর্থাৎ যে মাসকে কোনো বিশেষ বিষয়ের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

হারাম মাসসমূহ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে এতে যে হারাম বিষয়সমূহ তথা অন্য মাসসমূহে সাধারণভাবে সিদ্ধ যেসব বিষয় এ মাসসমূহে নিষিদ্ধ হিসেবে প্রতীয়মান হয় নিম্নে সেই বিষয়ে আলোকপাত করা হলো:

(১) বন্য পশু-পাখির সংরক্ষণ

এ মাসগুলোতে বন্য পশু পাখি শিকার করা যাবে না। অর্থাৎ এ মাসগুলো হচ্ছে বন্য পশু পাখির সংরক্ষণের জন্য (animal conservation and nature preservation) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস, এ সময়কালে বন্য পশু পাখি শিকার করলে তাদের বংশধারা ব্যাহত হবে এবং পশু-পাখির প্রতি অনধিকার চর্চা করা হবে। বন্য পশু পাখির সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাস হওয়ার (তথা বন্য পশু পাখিকে শিকার করা থেকে বিরত থাকার) স্বাভাবিক তাৎপর্য বা প্রাকৃতিক কার্যকারণ হচ্ছে এ সময়কালটি পশু-পাখির সাধারণ প্রজননকাল।

হারাম মাসসমূহে বন্য পশু-পাখি শিকার করার জরিমানা

আমরা যখন হারাম মাসসমূহে অবস্থান করি সে অবস্থা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে আনতুম হুরুমুন (৫:১, ৫:৯৫) এবং যতক্ষণ আমরা এ হুরুমুন অবস্থায় থাকি তা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, মা দুমতুম হুরুমান (৫:৯৭)

হুরুমুন অবস্থায় তথা হারাম মাসসমূহে (বসন্তের প্রথম মাস থেকে ক্রমাগত চারটি মাস) জলভাগের শিকার হালাল কিন্তু স্থলভাগের শিকার হালাল নয়। যদি কেউ ‘হু্রুমুন’ অবস্থায় স্থলভাগের শিকার করে তবে তার ক্ষেত্রে যে বিধান বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নরূপ:

৫:৯৫ :: হে মু’মিনগণ, তোমরা হুরুমুন অবস্থায় (স্থলভাগের) শিকারকে হত্যা করো না। তোমাদের মধ্যে যে ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে হত্যা করে তার জরিমানা হচ্ছে যে পশুকে সে হত্যা করেছে গবাদি পশুর মধ্য থেকে তার মতো একটি পশু। সেটা (অর্থাৎ ঐ ধরনের গবাদি পশু) নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দিবে তোমাদের মধ্যকার দুজন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি। সেটাকে হাদিয়া হিসেবে কা’বায় পৌছাতে হবে। অথবা তার কাফফারা (ক্ষতিপূরণ) হবে (সমমূল্য দ্বারা যতজনকে মধ্যম মানের খাদ্য খাওয়ানো যেতে পারে ততজন) মিসকীনকে খাওয়ানো অথবা সমসংখ্যক সিয়াম পালন করা। (এটা এজন্য যে,) যেন সে তার কাজের পরিণামের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। (এ বিধান নাজিলের) আগে যা হয়ে গিয়েছিলো সে বিষয়ে আল্লাহ উদারতা দেখিয়েছেন। আর যে পুনরাবৃত্তি করবে আল্লাহ তাকে দণ্ড দিবেন। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান ও মহাদণ্ডদাতা।

(২) বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতি

এ মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ করা যাবে না। অর্থাৎ এ মাসগুলোকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতি হিসেবে বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির মাস হিসেবে নির্ধারিত করা হয়েছে। হারাম মাসসমূহের এ বিধিবদ্ধ যুদ্ধবিরতির আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতি হচ্ছে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের উপায় এবং শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ার বাস্তবভিত্তিক আন্তর্জাতিক যু্দ্ধনীতি। প্রতি বৎসর ধারাবাহিকভাবে চারটি মাসকে বিধিবদ্ধ যুদ্ধবিরতির মাস হিসেবে কার্যকর করলে মানবজাতি যেমন এ মাসগুলোতে যুদ্ধের বিভিষিকা থেকে মুক্ত থাকবে, তেমনি যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে যারা বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়েছিল তারা নিরাপদ স্থানে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পাবে। এছাড়া এ যুদ্ধ বিরতির মাসগুলোতে বিবদমান পক্ষগুলো পরস্পরের মধ্যে সমঝোতার জন্য সুযোগ পাবে, যার ফলে পরবর্তী যুদ্ধের সম্ভাবনাও হ্রাস পাবে এবং মানবজাতি যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তির পরিবেশ পাবে।

হারাম মাসসমূহে আক্রান্ত পক্ষকে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের অনুমতি দেয়ার যৌক্তিকতা ও যুদ্ধনীতি

যদি কোনো পক্ষ হারাম মাসসমূহে যুদ্ধ বিরতির এ আন্তর্জাতিক যুদ্ধ নীতি অনুসরণ না করে অন্য পক্ষের উপর হামলা চালিয়ে বসে তাহলে আক্রান্ত পক্ষকে অনুমতি দেয়া হয়েছে যে, তারা ঐ হারাম মাসেই এর কিসাসস্বরূপ পাল্টা হামলা করতে পারবে তথা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করতে পারবে। তবে তাদেরকে অবশ্যই বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাকতে হবে, আক্রমণকারীদেরকে তাদের অনুরূপ জবাব দেয়া যাবে, কিন্তু প্রতিহত করতে পারলে আক্রমণকারী পক্ষের যারা আক্রমণের সাথে জড়িত ছিল না তাদের উপর হাত তোলা যাবে না।

হারাম মাস নির্ণয়ের জন্য ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জির হিসাব সম্পর্কিত ধারণা

৯:৩৬ আয়াত অনুযায়ী একটি সৌরবর্ষে ১২টি পূর্ণ চন্দ্র চক্র বা ১২টি চান্দ্রমাস রয়েছে। আর সাধারণভাবে চান্দ্রমাস হয়ে থাকে ২৯ বা ৩০ দিনে। ৫৮:৪ আয়াত অনুযায়ী দুটি শাহর বা ‘মাসের’ (যা চান্দ্রমাস নয়, বরং যে কোনো একটি দিন থেকে শুরু করে একটি মাস পূর্ণ করার অর্থ বুঝায়) সিয়ামের পরিবর্তে ৬০ জন মিসকীনকে খাওয়ানো যেতে পারে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে শাহর মানে ‘যে কোনো একটি দিন থেকে শুরু করে ধারাবাহিক ত্রিশ দিনের সমষ্টি’। অর্থাৎ আল কুরআনে যখন ক্যালেন্ডার মাস না বুঝিয়ে সাধারণভাবে মাস বুঝানোর জন্য শাহর শব্দ ব্যবহৃত হয়, তখন শাহর বা মাস বলতে ৩০ দিনকে বুঝায়। যেসব আয়াতে শাহর বা তার বহুবচন আশহার ব্যবহৃত হয়েছে সাধারণভাবে মাস (৩০ দিনের যোগফল) বুঝাতে সেগুলো হলো : ২:২২৬, ২:২৩৪, ৪:৯২, ৩৪:১২, ৪৬:১৫, ৫৮:৪, ৬৫:৪, ৯৭:৩।

পক্ষান্তরে আল কুরআনে চান্দ্রবর্ষের ন্যাচারাল ক্যালেন্ডার মাস (চন্দ্রের তিথি হিসেবে ২৯ বা ৩০ দিন এবং “যে কোনো দিন থেকে মাস শুরু নয়, বরং হিলাল থেকে মাস শুরু”- এই পদ্ধতি হিসেবে) বুঝাতেও শাহর শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ সম্পর্কিত শাহর বা তার বহুবচন আশহার এবং শুহুর (বছরের/ গণনাচক্রের সকল মাসকে একসাথে বুঝানোর জন্য) শব্দ ধারণকারী আয়াতগুলো হলো : ২:১৮৫, ২:১৯৪, ২:১৯৭, ২:২১৭, ৫:২, ৫:৯৭, ৯:২, ৯:৫, ৯:৩৬।

দিন রাতের হিসাব নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে সূর্য তথা সূর্যের উদয়-অস্ত বা পৃথিবীর আহ্নিক গতি (দ্র : ৯১:১-৪)। মাসের দিনসংখ্যা নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে চন্দ্র তথা মনজিলসমূহ / তিথিসমূহ। চান্দ্রমাসের শুরু শেষ নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে হিলাল থেকে হিলাল এর চক্র (২:১৮৯, ৩৬:৩৯)। চান্দ্রবর্ষে ৬ মাস ৩০ দিন ও ৬ মাস ২৯ দিন হয়। যে কোনো মাস ৩০ দিনে বা ২৯ দিনে হতে পারে। বিভিন্ন বছর একই ক্যালেণ্ডার মাস বিভিন্ন দিনসংখ্যায় হতে পারে। যেমন কোনো বছর রমাদান মাস ২৯ দিনে এবং কোন বছর ৩০ দিনে হতে পারে। আবার ধারাবাহিকভাবে একাধিক বছর রমাদান মাস ২৯ দিনে (বা ৩০ দিনে) হতে পারে। এক্ষেত্রে হিলালের উদয়ই হচ্ছে দিনসংখ্যা নির্ণয়ের উপায়।

একটি সৌরবর্ষের পরিসর নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে পৃথিবীর বার্ষিক গতি (দ্র : ১০:৫, ১৭:১২)। পৃথিবীর বার্ষিক গতি অনুসারে ৩৬৫ দিনে ১টি সৌরবর্ষ হয়। ১৭:১২ আয়াত অনুযায়ী একটি দিন থেকে ঐ দিনের পুনরাবৃত্তি পর্যন্ত (যেমন Spring Equinox থেকে পরবর্তী Spring Equinox পর্যন্ত) একটি সৌরবর্ষ। আবার একটি সৌরবর্ষে ১২ টি চান্দ্রমাস অতিবাহিত হয় বিধায় প্রাকৃতিকভাবে ১২ মাসে ১ বছরের হিসাব প্রতিষ্ঠিত। এই প্রাকৃতিক প্রেক্ষিতে আল কুরআন অনুসারে ১২টি চান্দ্রমাস (শাহর) নিয়ে একটি গণনাচক্র/ ইদ্দাত তথা একটি চান্দ্রবর্ষ। ১ টি বর্ষে ১২ টি চান্দ্রমাস হিসেবে মাসের গণনার বিধান সৃষ্টির প্রথম থেকে বিধিবদ্ধ (৯:৩৬)।

চান্দ্রমাসের হিসাবে যেমন কোনো মাস ৩০ দিন এবং কোনো মাস ২৯ দিন অনুরূপভাবে চান্দ্রমাস হিসাবের দিনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে সৌরমাস হিসাবের ক্ষেত্রেও প্রথমত ৩০ দিনে ১ মাস ধরা হয় এবং সেক্ষেত্রে সৌরবর্ষের জন্য আরো ৫ দিনের প্রয়োজন হয় বিধায় কিছু মাসকে ৩১ দিনে হিসাব করা হয়। কারণ পৃথিবীর বার্ষিক গতি অনুসারে ৩৬৫ দিনে ১টি সৌরবর্ষ হয়। এভাবে কোনো সৌরমাস ৩০ ও কোনো সৌরমাস ৩১ দিনে হিসাব করার ভিত্তিতে বছরের নির্দিষ্ট তারিখে দিন রাত সমান হওয়ার হিসাবও নির্ধারণ করা সহজ হয়। Year is related to earth since the earth revolves around the sun in a year.

১ বছরের মাসসংখ্যা নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে পৃথিবীর বার্ষিক গতি অনুসারে ১ টি সৌরবর্ষে অতিবাহিত পূর্ণ চান্দ্রমাসের সংখ্যা। অর্থাৎ সৌরবর্ষের হিসাবের ক্ষেত্রেও ৩০ দিনে ১ মাস এবং ১২ মাসে ১ বছর নির্ধারণের বিষয়টি মূলত চান্দ্রমাস ও চান্দ্রবর্ষের হিসাব পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে গৃহীত হয়েছে।

চান্দ্রবর্ষ (চন্দ্রমাসসমূহের গণনাচক্রে / ১২ মাসের যোগফলে) ৩৫৪ দিন, পক্ষান্তরে সৌরবর্ষ (পৃথিবীর বার্ষিক গতি) ৩৬৫ দিন। অর্থাৎ একটি সৌরবর্ষের তুলনায় একটি চান্দ্রবর্ষে ১১ দিন কম থাকে। এই প্রেক্ষিতে ১৮:২৫-২৬ আয়াত অনুযায়ী চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষের হিসাব পদ্ধতির বাস্তবতা বিবৃত হয়েছে যে, তিনশ সৌরবর্ষ হচ্ছে তিনশ নয় চান্দ্রবর্ষের প্রায় সমানুপাতিক। সৌরবর্ষকে আরবিতে সানাতুন এবং চান্দ্রবর্ষকে ও চান্দ্রসৌরবর্ষকে (যাতে চন্দ্রচক্রকে মাস হিসেব করা হয়) আরবিতে আমুন বলা হয়। আল কুরআন অনুযায়ী, সৌরবর্ষ ও চান্দ্রবর্ষ বা চান্দ্রসৌরবর্ষ উভয়ের হিসাব প্রাকৃতিক নিয়মবদ্ধ এবং আল কুরআর অনুসারে, এটা আল্লাহর নির্ধারিত প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা। সুতরাং উভয় হিসাব অবশ্যই গ্রহণযোগ্য (দ্র: ৫৫:৫)।

মাসের হিসেব নির্ণয়ের ভিত্তি হিসেবে নতুন চাঁদ থেকে নতুন চাঁদের সময়সীমাকে (duration of moon cycle)  গ্রহণ করা হয়েছে বিধায় ইংরেজিতে মাসকে month বলা হয়। একটি বর্ষে চারটি ঋতু থাকে। ঋতুগুলো হলো বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত। প্রতিটি ঋতু তিনটি চান্দ্রমাসের প্রায় সমান দৈর্ঘ্যের হয়ে থাকে। এভাবে চারটি ঋতুর মোট সময়কাল তথা একটি বর্ষের মাসসংখ্যা হলো ১২। সুতরাং চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষ উভয়টিতে ১২ মাসে এক বছর হিসেব করতে হয়, এটাই প্রাকৃতিক পদ্ধতি।

৬:৯৬, ১০:৫, ১৭:১২, ১২:৪৭-৪৯, ২০:৫৯, ১০৬:১-৪ আয়াত থেকে চান্দ্রবর্ষ ক্যালেন্ডার ও সৌরবর্ষ ক্যালেন্ডার উভয়টির ব্যবহারিক উপযোগিতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

সৌরবর্ষ পৃথিবীর বার্ষিক গতির সাপেক্ষে হিসাবকৃত বিধায় প্রতি বছর একই সৌরমাস একই ঋতুতে পড়ে। অন্যদিকে একটি চান্দ্রবর্ষ একটি সৌরবর্ষের চেয়ে ১১ দিন কম বিধায় একই চান্দ্রমাসের (যেমন রবিউল আউয়াল মাসের) আবর্তন বিভিন্ন বছর সৌরবর্ষের বিভিন্ন ঋতুতে হতে থাকে। অর্থাৎ চান্দ্রবর্ষে একই মাস একই ঋতুতে আসে না, বরং এর আবর্তন ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে হতে থাকে। মানুষের নির্বাহী সিদ্ধান্তনির্ভর কর্মকান্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে সৌরবর্ষের হিসাবের কিছু সুবিধা দেখা যায়, যাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ঋতু অনুসারে পূর্বসিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়। তাই চান্দ্রমাসকে একই ঋতুতে পাওয়ার জন্য চান্দ্র-সৌরবর্ষ ক্যালেন্ডার (Lunisolar Year Calendar) এর উদ্ভব ঘটে। চান্দ্রসৌরবর্ষে (Lunisolar Year Calendar) প্রতি তৃতীয় বর্ষে একটি চান্দ্রমাস যোগ করা হয়, এই মাসকে intercalary month / leap month বলা হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে একই চান্দ্রমাসকে (একই ক্রমিকের চান্দ্রমাসকে বা একই নামের চান্দ্রমাসকে) নির্দিষ্ট ঋতুতে স্থির রাখা বা হিসাব করা।

৯:৩৬ আয়াতে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম থেকে ১২টি চান্দ্রমাসের গণনাচক্র (Counting Cycle) এবং এর মধ্য থেকে ৪টি মাস হারাম মাস হওয়া এবং মুশরিকদের কর্তৃক নাসী তথা ‘হারাম মাসের অবস্থানের রদবদল বা হারাম মাসকে যথাসময়ে পালন করাকে স্থগিত করে পরে অন্য মাসকে হারাম ঘোষণা করে বার্ষিক হারাম মাসের সংখ্যাগত সমন্বয়’ কুফরের বা সত্য বিধান প্রত্যাখ্যানের একটি বৃদ্ধি হওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে অনেকে ভেবে থাকেন যে, ১২টি চান্দ্রমাসে একটি চান্দ্রবর্ষ হিসেব করতে হবে এবং এটাই ইসলামী বর্ষ গণনা পদ্ধতি এবং চান্দ্রসৌরবর্ষ (Lunisolar Year Calendar) তথা চান্দ্রবর্ষে একটি intercalary month / leap month মাস যোগ করা বা ১৩ মাস হিসেব করা মানে নাসী এবং এটি কুফর। অথচ প্রকৃতপক্ষে এটি ‘নাসী’ নয়, এবং কোনো চান্দ্রবর্ষে intercalary month / leap month যোগ করে ১৩তম মাস হিসেব করা কুফর নয়। কারণ ১২টি চান্দ্রমাসের যোগফলে একটি চান্দ্রবর্ষ হিসেব করলেও হারাম মাসসমূহ যে ঋতুতে পালন করতে হবে, intercalary month / leap month যোগ করে কোনো বর্ষে ১৩তম মাস হিসেব করলেও সেই ঋতুতেই হারাম মাসসমূহ পালন করতে হবে। যে চান্দ্রবর্ষে ১৩তম মাস যোগ করা হয় বস্তুত সেই সৌরবর্ষেও চন্দ্রচক্র (Moon Cycle) ১২টিই থাকে। তাই কুরআনের বিবৃতির লংঘন হয় না বা লংঘন সম্ভব নয়, কারণ এটাই প্রাকৃতিক ব্যবস্থা যে, একটি সৌরবর্ষে চন্দ্রচক্র ১২টিই থাকবে। কিন্তু একটি ক্যালেন্ডার হিসেব করতে গিয়ে এই ১২টি চন্দ্রচক্রের পর যে কয়দিন একটি চন্দ্রচক্রের সমান নয় কিন্তু বাড়তি দিন সেই কয়দিনের যোগফলকে একসাথে একটি চন্দ্রমাসের হিসেবে আনা তথা ১৩তম মাস হিসেব করার মাধ্যমে একই ঋতুতে হারাম মাসসমূহ পালন (বা বর্ষ শুরু করা) মূলত বর্ষ গণনাকে সহজীকরনের জন্য করা হয়। অন্যদিকে চান্দ্রবর্ষ হিসেব করলে একই ঋতু একেক বর্ষে একেক চান্দ্রমাসে হিসেব করতে হয়। উভয় অবস্থায় হারাম মাসসমূহ একই ঋতুতে হিসেব করতে হবে বিধায় এবং হারাম মাসকে একই ঋতুতে পালন না করাটাই নাসী বিধায় চান্দ্র-সৌরবর্ষের মাধ্যমে নাসী ঘটে না, বরং নাসী থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে সহজ হিসাব পদ্ধতির জন্য চান্দ্রসৌরবর্ষ একটি গ্রহণযোগ্য হিসেবে পদ্ধতি। হারাম মাসসমূহ ও এর ঋতু সম্পর্কে ‘হারাম মাসসমূহ’ অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে।

হারাম মাসসমূহ চিহ্নিতকরণের উপায়

হারাম মাসসমূহের হারাম বিষয় সাপেক্ষেই হারাম মাসসমূহের সময়কাল নির্ণয় করা সম্ভব। তাই নিম্নে এ বিষয়টির উপর ভিত্তি করে দুটি পয়েন্টে আলোকপাত করা হলো এবং তার মাধ্যমে হারাম মাসসমূহকে চিহ্নিত করা হলো:

(১) হারাম মাসসমূহের অন্যতম Common হারাম বিষয় তথা বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ

হারাম মাসসমূহের কমন দুটি হারাম বিষয় হলো এই মাসগুলোতে বন্য প্রাণী (wild-life) শিকার হারাম এবং এ মাসগুলো হলো বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির মাস। এর মধ্যে প্রথমটি সুনির্দিষ্টভাবে একটি জৈবিক প্রকৃতির ঋতুর সাথে সম্পর্কিত। আর তা হলো এটা এমন এক ঋতু যা বন্য প্রাণীদের প্রজননের জন্য নাজুক হিসেবে সাব্যস্ত। Delicate season for mating and breeding of wild animals। সুতরাং এটা হলো বসন্তকাল। অন্য কথায়, বসন্তের প্রথম মাসই হবে হারাম মাসসমূহের প্রথম মাস।

(২) হারাম মাসসমূহের পরে যুদ্ধাভিযানের সময়কালের আবহাওয়া

৯:৮১ আয়াত অনুসারে হারাম মাসসমূহের পরে যুদ্ধাভিযানের সময় ছিল প্রচণ্ড গরমের সময়। সুতরাং হারাম মাসসমূহ ছিল উষ্ণতম মাসের আগে। অন্য কথায় হারাম মাসসমূহ শুরু হয়েছিল বসন্ত ঋতুতে। বসন্তের প্রথম মাস থেকে শুরু করে ধারাবাহিক চারমাস হারাম মাস।যার প্রথম তিনটি মাস হলো বসন্ত এবং চতুর্থতম মাসটি হলো গ্রীষ্মের প্রথম মাস।

পরিশেষে বলা যায় যে, হারাম মাসসমূহ সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন অনুসারে হারাম মাসসমূহ বসন্ত ঋতুতে অবস্থিত এবং এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো এ মাসসমূহে বন্যপ্রাণী শিকার করা যাবে না, যাতে বন্যপ্রাণীর জীববৈচিত্র্য ও বংশধারার সংরক্ষণের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা বজায় থাকে এবং সেই সাথে এ মাসগুলোতে আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে হবে। এভাবে হারাম মাসসমূহকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের পাশাপাশি মানব জাতির মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও কার্যকর উপায়ে পরিণত করা হয়েছে। হারাম মাসের বিধান লংঘন করে বন্যপ্রাণী শিকার করলে তার জরিমানা প্রদান করতে হবে এবং আক্রমণাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা করলে সেক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে দণ্ডপ্রাপ্ত হতে হবে। বিশ্বের পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানমূলক নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হারাম মাসসমূহের বিধি-বিধান যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যক।


লেখক: শওকত জাওহার

রিসার্চ ফেলো, দি ইনস্টিটিউট ফর কুরআনিক রিসার্চ এন্ড এ্যাপ্লিকেশন (ইক্বরা)

১১ জানুয়ারি ২০২২

ট্যাগ / কী-ওয়ার্ড:

অন্যান্য প্রবন্ধ

April 22, 2024
গঠন রীতি ও শব্দের ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে কুরআনের সুরার ক্রম

কুরআনের ক্রম বের করার অনেক প্রচেষ্টা হয়েছে এবং বিভিন্ন মতামত রয়েছে। স্কলার মার্ক ডুরি কুরআনের শব্দ ও গঠন শৈলি ব্যবহার করে একটি ভিন্ন সুরার ক্রমে উপনিত হয়েছেন যা এই প্রবন্ধের বিষয়বস্ত

April 18, 2024
Quran Mistranslated Series - Ep 1: 36:40 "Each in an orbit, floating" - Major Mistranslation That Leads To A Geocentric Model of The Universe

In this series we will tackle Quranic verses which are repeatedly wrong translated across time in many different translation. The first in this series will focus on 36:40

April 16, 2024
The IQRA joins IQSA (International Quranic Studies Association)

We are happy to announce that The IQRA has joined the International Quranic Studies Association (IQSA). The International Qur’anic Studies Association (IQSA) is the first learned society dedicated to the study of the Qur’an. We hold conferences around the world and publish cutting-edge research and scholarship. The IQSA community and its partners include scholars, students, […]

April 15, 2024
আল কুরআনে তাগুতের পরিচয়

২:২৫৬ :: দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় সত্যপথ স্পষ্ট হয়ে গেছে বিভ্রান্তি থেকে। সুতরাং যে ব্যক্তি তাগুতের প্রতি কুফর করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে সে এমন এক মজবুত হাতল আঁকড়ে ধরবে যা ভেঙ্গে যাবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। ২:২৫৭ :: আল্লাহ মু’মিনদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে […]

April 9, 2024
The Origin of Arabic Language & Its History

"And thus We have revealed to you an Arabic Qur'an" - Surah Ash-shuraa, verse 7 We explore the history and development of the Arabic language, as well as its connection to religion. Here are compilation of a few resources via YouTube. The Origins of Arabic - The Arabic Language How Arabia Got Its Name? What […]

April 8, 2024
Ghulam Ahmad Parwez - A Scholar of Islam

Among Muslim scholars, particularly who translated and interpreted the Quran in modern times, I am very fascinated and interested in the thoughts of late Ghulam Ahmad Parwez (1903-1985), also known as G A Parwez. Here is a summary as a way of introduction to this noteworthy scholar. Ghulam Ahmad Parwez was a prominent Islamic scholar, […]

April 6, 2024
The Qur'an and the Just Society - Ramon Harvey - Book Review

Main Topic or Theme The main theme of "The Qur'an and the Just Society" by Ramon Harvey revolves around exploring the ethical and moral framework provided by the Qur'an for creating a just society. Key Ideas or Arguments Chapter Titles or Main Sections Chapter Summaries Key Takeaways or Conclusions Author's Background and Qualifications Ramon Harvey […]

April 5, 2024
না বুঝে কুরআন পড়ে আমরা শয়তানকে যেভাবে সাহায্য করি

১.স্টারপিক ফ্যাক্টরির মালিক সোহান সাহেব। ফ্যাক্টরির বয়স প্রায় ২৫ বছরের বেশি, মালিকের বয়স ৬৭ বছর। তার ফ্যাক্টরির পুরনো এবং বিশ্বস্ত ম্যানেজার হলো ফারুক সাহেব। মালিক সোহান সাহেব এবার ঠিক করেছেন টানা ২ মাসের জন্য তিনি ফ্যাক্টরির নিয়মিত কাজ থেকে বিরতি নিয়ে আমেরিকায় তার মেয়ে, মেয়ে জামাই ও নাতিদের সাথে সময় কাটাবেন। দীর্ঘ ২ মাস তার […]