দি  ইন্সটিটিউট ফর কুরআনিক রিসার্চ এন্ড এ্যাপ্লিকেশন (ইক্বরা)

লক্ষ্য

ইক্বরার লক্ষ্য হলো বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য স্রষ্টার ঐশী বাণীর সমন্বিত অধ্যয়ন ও সার্বজনীন প্রয়োগের জন্য জ্ঞানদীপ্ত অনুশীলন।

উদ্দেশ্য

ইক্বরার উদ্দেশ্য হলো কুরআনের বাণীর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ অনুধাবনের জন্য টেকসই ভিত্তি প্রস্তুত করা এবং জীবন ও সমাজের প্রায়োগিকতার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানভিত্তিক ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামো নির্মাণ।

প্রকাশিত বইসমূহ

দাম্পত্য সংকট নিরসন প্রসঙ্গে ‘দরাবা’ শব্দের তাৎপর্য

সুরা নিসার ৩৪ আয়াতে কোনো স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি দাম্পত্য চুক্তি লংঘনের আশংকা করলে প্রতিকারস্বরূপ স্বামী কী করতে হবে সেই বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যা অনুসরণ করলে অযথা তালাক সংঘটনের পরিমাণ কমে যাবে, পারিবারিক ব্যবস্থা মজবুত হবে এবং সামাজিক সংহতি বজায় থাকবে। আয়াতটিতে দেয়া নির্দেশনাগুলোর একটি হলো ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ (তাদেরকে দরবুন করো), যা দ্বারা স্ত্রীকে স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরিয়ে নেয়া অথবা তার সাথে সম্পর্কিত বিষয়কে পরিবার ও সমাজের যারা সমাধানে সম্পৃক্ত হওয়ার উপযুক্ত তাদের সামনে নিয়ে আসার নির্দেশনা বুঝায়। কিন্তু পরিপ্রেক্ষিত অনুসারে ‘দরাবা’ শব্দের সঠিক প্রায়োগিক অর্থ নির্ণয়ে ভুল করার কারণে এ আয়াতকে অনেকে কুরআনে স্ত্রী প্রহারের বৈধতা দেয়া হয়েছে মর্মে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন। অথচ কুরআনের সামগ্রিক শিক্ষা অনুসারে এতে পারিবারিক সহিংসতা, স্ত্রীকে প্রহার বা স্ত্রীকে দৈহিক শাস্তি দেয়ার কোনো স্থান নেই। এ বিষয়ে সঠিক উপলব্ধির জন্য ‘দরাবা’ শব্দের অর্থ ও কুরআনের যেসব স্থানে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তার (নির্ঘন্ট/ Concordance) সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে দাম্পত্য সংকট নিরসন প্রসঙ্গে ‘দরাবা’ শব্দের তাৎপর্য নির্ণয় করা প্রয়োজন।

দাম্পত্য সংকট নিরসন প্রসঙ্গে ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ শব্দ ধারণকারী আয়াতটি (এবং একই প্রসঙ্গের ধারাবাহিকতায় তার পরবর্তী আয়াত আয়াত) নিম্নে উল্লেখ করা হলো;

الرِّجَالُ  قَوَّامُونَ  عَلَى  النِّسَاءِ  بِمَا  فَضَّلَ  اللَّهُ  بَعْضَهُمْ  عَلَىٰ  بَعْضٍ  وَبِمَا  أَنفَقُوا  مِنْ  أَمْوَالِهِمْ  فَالصَّالِحَاتُ  قَانِتَاتٌ  حَافِظَاتٌ  لِّلْغَيْبِ  بِمَا  حَفِظَ  اللَّهُ  وَاللَّاتِي  تَخَافُونَ  نُشُوزَهُنَّ  فَعِظُوهُنَّ  وَاهْجُرُوهُنَّ  فِي  الْمَضَاجِعِ  وَاضْرِبُوهُنَّ  فَإِنْ  أَطَعْنَكُمْ  فَلَا  تَبْغُوا  عَلَيْهِنَّ  سَبِيلًا  إِنَّ  اللَّهَ  كَانَ  عَلِيًّا  كَبِيرًا

৪:৩৪ :: পুরুষরা নারীদের উপর সামগ্রিক দায়িত্বশীল। এজন্য যে আল্লাহ তাদের এককে অন্যের উপর বিশিষ্টতা দিয়েছেন এবং এজন্য যে পুরুষরা তাদের সম্পদ থেকে (নারীদের জন্য) ব্যয় করে। সুতরাং সৎকর্মশীলা নারীরা বিনয়ী হয় এবং আল্লাহর হেফাজতের আওতায় অদৃশ্যে থাকা বিষয়ের (স্বীয় সতীত্ব ও সন্তানের পিতৃপরিচয়গত বিষয়ের) সংরক্ষণকারিনী হয়। আর যাদের ব্যাপারে তোমরা আশংকা করো যে, তারা দাম্পত্য চুক্তি লংঘন করছে, তাদেরকে উপদেশ দাও এবং তাদেরকে বিছানায় পরিত্যাগ করো এবং তাদেরকে (বিছানায় একা রেখে দেয়া থেকে) ভিন্ন অবস্থায় বের করে আনো (অর্থাৎ সম্পর্ককে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনো)/ তাদেরকে (সমাধানে সম্পর্কিত হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের) সামনে উপস্থাপন কর। তারপর যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করে, তাহলে তোমরা তাদের বিপক্ষে অন্য কোনো ব্যবস্থা তালাশ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বোচ্চে অধিষ্ঠিত, সর্বশ্রেষ্ঠ।

وَإِنْ  خِفْتُمْ  شِقَاقَ  بَيْنِهِمَا  فَابْعَثُوا  حَكَمًا  مِّنْ  أَهْلِهِ  وَحَكَمًا  مِّنْ  أَهْلِهَا  إِن  يُرِيدَا  إِصْلَاحًا  يُوَفِّقِ  اللَّهُ  بَيْنَهُمَا  إِنَّ  اللَّهَ  كَانَ  عَلِيمًا  خَبِيرًا

৪:৩৫ :: আর যদি তোমরা আশংকা করো যে, তাদের দুজনের মধ্যে (অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে) বিরোধ ঘটেছে, তাহলে তোমরা পুরুষটির পরিবার পরিজন থেকে একজন বিচক্ষণ মীমাংসাকারী আর নারীটির পরিবার পরিজন থেকে একজন বিচক্ষণ মীমাংসাকারী নিযুক্ত করো^। যদি তারা (স্বামী-স্ত্রী) দুজনই সংশোধনের মনোবৃত্তি রাখে তাহলে আল্লাহ তাদের দুজনের মধ্যে মিলমিশ তৈরি হওয়ার তাওফিক দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত।

^ এই মীমাংসাকারী পরিবারের সদস্যভুক্ত যেমন হতে পারে, তেমনি পরিবারের পক্ষ থেকে নিযুক্ত পারিবারিক আইনজীবী হওয়ারও সুযোগ রয়েছে।

সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে ব্যবহৃত যে শব্দটির উপর ভিত্তি করে দাবিটি করা হয় তা হলো, ওয়াদরিবূহুন্না, যার একটি শাব্দিক অনুবাদ হতে পারে, ‘আর তাদেরকে বিচলিত / প্রহার/ আঘাত কর’। কিন্তু এ আয়াতে শব্দটি কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা বুঝতে হবে আয়াতটির বিষয়বস্তু এবং আল কুরআনে এ বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কিত ধারাসমূহ এবং ‘দরাবা’ শব্দের প্রায়োগিক অর্থসমূহের কোনটি কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, এ দুটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে।

এখানে দাম্পত্য চুক্তি লংঘনের আশংকার উপর ভিত্তি করে স্বামীকে স্ত্রীর সংশোধনের জন্য তিনটি ব্যবস্থা অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যথা : (১) তাদেরকে উপদেশ দেয়া, (২) তাদেরকে বিছানায় রেখে নিজে ভিন্ন বিছানা বা শয্যা গ্রহন করা যেমন: অন্য ঘরে বা ফ্লোরে শুয়ে থাকা, (৩) তাদেরকে ‘দরবুন’ করা (যা আমাদের বিশ্লেষণীয় বিষয়)।

প্রথম কথা হচ্ছে, আশংকার উপর ভিত্তি করে কখনো শাস্তি  হতে পারে না। এমনকি আশংকাবশত কাউকে দোষী সাব্যস্ত  করা যায় না। যেমন ৪:৯৪ আয়াত অনুযায়ী, সন্দেহবশত যাচাই ছাড়া কাউকে মু’মিন নয় বলে সাব্যস্ত  করা যাবে না। আবার ৪৯:৬ আয়াত অনুযায়ী, যাচাই ছাড়া কোনো সংবাদের উপর ভিত্তি করে কারো বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া যাবে না। ৪৯:১২, ১০:৩৬, ১০:৬৬, ৫৩:২৩ আয়াত অনুযায়ী, অনুমানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ৪:১৯ আয়াত অনুযায়ী, স্ত্রীর কোনো দিক অপছন্দের হলেও অন্য দিক কল্যাণকর হতে পারে, তাই তার সাথে ন্যায়সঙ্গতভাবে (বিল মা’রুফ) বসবাস ও আচরণ করতে হবে। ৬৪:১৪ আয়াত অনুযায়ী, স্ত্রী শত্রু বা শত্রু-ভাবাপন্ন হলেও (তালাক দেয়ার অপরিহার্য এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি না হলে) তাকে ক্ষমা করে দিতে হবে। সুতরাং যে স্ত্রী শত্রু নয়, তার সামান্য অবাধ্যতাকে মেনে নিতে হবে। মেনে নিতে না পারলে সম্পর্ক ছিন্ন হবে। কিন্তু শারীরিক আঘাত করে সম্পর্ক ধরে রাখার কোন নির্দেশনা আল্লাহ দেন নি। এ ধরনের নির্দেশনা যেমন দাম্পত্য কলহের নিষ্পত্তির জন্য বাস্তব সম্মত নয়, ঠিক তেমনি এটি স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যকার ভালোবাসা ও দয়ার যে সম্পর্ক, যেটিকে আল্লাহ চিহ্নিত করেছেন তাঁর নিদর্শনের অংশ হিসেবে (৩০:২১) সেটিরও পরিপন্থী হয়ে দাড়ায়।

স্ত্রী যদি সরাসরি জি¦নাতে বা ব্যাভিচারে লিপ্ত হয় এবং সেক্ষেত্রে স্বামী একমাত্র স্বাক্ষী হয় তাহলে সে অবস্থায়ও তাকে শাস্তি  দেয়ার সুযোগ নেই, বরং অপবাদ দিলে (অভিযোগ করলে) বিষয়টি আদালতে গড়াবে, আদালতে ছাড়া অভিযোগের প্রচার করা যাবে না (২৪:৬-১০)। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক এক মজবুত চুক্তি (৪:২১)। এখানে স্বামীকে পারিবারিক ব্যবস্থাপনাগত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কিন্তু সে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে স্ত্রীর সাথে পরামর্শের মাধ্যমে (৪২:৩৮, ২:২৩৩)।

দাম্পত্য চুক্তি লংঘনের আশংকা হলে, যেমন স্ত্রী পরকিয়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে বলে আশংকা হলে সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন আশংকার উপর ভিত্তি করে শাস্তি  দেয়া বা আদালতে অভিযোগ দায়ের করা যায় না, এছাড়া এর উপর ভিত্তি করেই বিষয়টি সর্বসমক্ষে নিয়ে আসাও সঠিক নয়। অন্যদিকে আশংকার উপর ভিত্তি করে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াও সঠিক নয়। আবার আশংকাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়াও সহজ বা স্বাভাবিক নয়। আশংকা সমূলক হোক বা অমূলক হোক, সেটার নিরসনের জন্য এবং আশংকা গাঢ় হয়ে থাকলে স্ত্রীর সংশোধনের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আয়াতটিতে সে নির্দেশনাই রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ আয়াতে ওয়াদরিবূহুন্না (তাদেরকে দরবুন করো) এর অর্থ কী? এ বিষয়ে প্রথমেই উল্লেখ্য যে, ওয়াদরিবূহুন্না উপদেশমূলক বাক্যে ব্যবহৃত ক্রিয়াটির মূলরূপ হচ্ছে দরাবা (সে দরবুন করেছে)। দরাবা ক্রিয়া ও এর ক্রিয়াবিশেষ্য দরবুন আল কুরআনে মোট ৫৮ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। তার মধ্যে আলোচ্য আয়াতটি (৪:৩৪) ছাড়া অন্য স্থানগুলোতে শব্দটি যেসব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

১. উপস্থাপন করা অর্থে ২৯ স্থানে: ২:২৬:৬, ১৩:১৭:২৪, ১৩:১৭:৪০, ১৪:২৪:৪, ১৪:২৫:৭, ১৪:৪৫:১২, ১৬:৭৪:২, ১৬:৭৫:১, ১৬:৭৬:১, ১৬:১১২:১, ১৭:৪৮:৩, ১৮:৩২:১, ১৮:৪৫:১, ২২:৭৩:৩, ২৪:৩৫:৪১, ২৫:৯:৩, ২৫:৩৯:২, ২৯:৪৩:৩, ৩০:২৮:১, ৩০:৫৮:২, ৩৬:১৩:১, ৩৬:৭৮:১, ৩৯:২৭:২, ৩৯:২৯:১, ৪৩:১৭:৫, ৪৭:৩:১৫, ৫৯:২১:১৫, ৬৬:১০:১, ৬৬:১১:১।

২. (কাউকে বা কারো সাথে সম্পর্কিত বিষয়কে অন্যদের) সামনে উপস্থাপন করা অর্থে ২ স্থানে: ৪৩:৫৭:২, ৪৩:৫৮:৭।

৩. আঘাত করা অর্থে ৯ স্থানে: ২:৬০:৬, ৭:১৬০:১৩, ৮:১২:১৭, ৮:১২:২০, ৮:৫০:৮, ২৬:৬৩:৫, ৩৭:৯৩:৩, ৪৭:৪:৫, ৪৭:২৭:৫।

৪. সমাধান করা অর্থে ১ স্থানে: ২:৭৩:২।

৫. (ঘরদোর) ঝাড়– দেয়া অর্থে ১ স্থানে: ৩৮:৪৪:৪।

৬. পদচালনা / নৃত্য করা অর্থে ১ স্থানে: ২৪:৩১:৬৪।

৭. চাপিয়ে দেয়া অর্থে ৩ স্থানে: ২:৬১:৩৭, ৩:১১২:১, ৩:১১২:১৮।

৮. ভ্রমণ করা অর্থে ৬ স্থানে: ২:২৭৩:৯, ৩:১৫৬:১১, ৪:৯৪:৫, ৪:১০১:২, ৫:১০৬:২২, ৭৩:২০:৩৭।

৯. কোথাও কিছু রাখা বা কাউকে কোনো অবস্থায় রাখা অর্থে ২ স্থানে: ১৮:১১:১, ২৪:৩১:১৫।

১০. নির্মাণ বা স্থাপন করা অর্থে ২ স্থানে: ২০:৭৭:৮, ৫৭:১৩:১৬।

১১. প্রত্যাহার করে নেয়া অর্থে ১ স্থানে: ৪৩:৫:১।

প্রচলিত ভুল ধারণা হলো উপরে উল্লেখিত অর্থগুলোর মধ্য থেকে ‘আঘাত করা’ অর্থে ৪:৩৪ আয়াতে ওয়াদরিবূহুন্না শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ ‘আঘাত করা’ অর্থে যত আয়াতে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে কোথায় (কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে কোন অঙ্গে) এবং কি দ্বারা আঘাত করা হবে তা উল্লেখ রয়েছে। তাই এ আয়াতে (৪:৩৪) ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ অর্থ ‘তাদেরকে আঘাত / প্রহার করো’ হতে পারে না।

অন্যদিকে ৪৩:৫৭-৫৮ আয়াতে ‘দরাবা’ শব্দের ব্যবহার থেকে স্পষ্ট হয় যে, সাধারণভাবে কোনো ব্যক্তিকে দরাবা করার অর্থ হচ্ছে তাকে তথা তার সাথে সম্পর্কিত বিষয়কে অন্যদের সামনে উপস্থাপন করা। নিম্নে আয়াত দুটি উল্লেখ করা হলো।

৪৩:৫৭ :: যখন ইবনে মারইয়ামকে (অর্থাৎ ঈসাকে বা ঈসার বিষয়কে) (জনতার) সামনে উপস্থাপন করা হলো [দুরিবা-ব্নু মারইয়ামা] দৃষ্টান্তরূপে, তখনি তোমার সম্প্রদায় সেই প্রেক্ষিতে হট্টগোল করতে লাগলো।

৪৩:৫৮ :: আর তারা বললো, “আমাদের ইলাহগণ উত্তম, নাকি সে?” নিছক তর্কের জন্য ছাড়া তারা তোমার সামনে তাকে (অর্থাৎ তার বিষয়কে) উপস্থাপন করেনি [মা দরাবূহু]। বস্তুত তারা ঝগড়াকারী সম্প্রদায়।

সুতরাং ৪৩:৫৭-৫৮ আয়াতে দরাবা শব্দের ব্যবহারের ভিত্তিতে স্পষ্ট হয় যে, ৪:৩৪ আয়াতে ব্যবহৃত ওয়াদরিবূহুন্না শব্দের সঠিক অর্থ হচ্ছে ‘তাদেরকে তথা তাদের সাথে সম্পর্কিত বিষয়কে সামনে উপস্থাপন করো’।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, একটি দাবি হচ্ছে, ‘দরাবা’ শব্দের অর্থ হিসেবে ‘উপস্থাপন করা’ অনুবাদ করা হয় যদি এর কর্ম হিসেবে ‘মাছাল’ বা ‘দৃষ্টান্ত’ শব্দটি আসে। এ দাবির জবাবে বলা যায়, ৪৩:৫৭ আয়াতে ‘মাছাল’ শব্দটি আসলেও তা কর্ম (Object) হিসেবে নয়, বরং হাল বা অবস্থা হিসেবে এসেছে। এছাড়া ৪৩:৫৮ আয়াতে মাছাল শব্দটি ছাড়াই ঈসাকে ‘দরাবা করা’ বুঝাতে দরাবূহু শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, ১৩:১৭ আয়াতে মাছাল শব্দটি ছাড়াই ইয়াদরিবুল্লাহুল হাক্বক্বা ওয়াল বাতিলা বাক্যে ‘উপস্থাপন করা’ অর্থে দরাবা শব্দের প্রয়োগ হয়েছে।

এছাড়া ওয়াদরিবূহুন্না কথাটির আরেকটি অর্থ হতে পারে “তাদেরকে বিছানায় পরিত্যাগ করো এবং তাদেরকে (বিছানায় একা রেখে দেয়া থেকে) ভিন্ন অবস্থায় বের করে আনো (অর্থাৎ সম্পর্ককে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনো)।” কারণ পূর্ববর্তী ওয়াহজুরূহুন্না ফিল মাদাজি’” এর প্রেক্ষিতে ওয়াদরিবূহুন্না এর পর আন মাদাজি’” (বিছানা থেকে) শব্দটি উহ্য (Non expressed) আছে হিসেবে উপলব্ধ (Understood)। অর্থাৎ বিছানায় একা রেখে দেয়ার পরবর্তীতে আবার সে অবস্থা থেকে ভিন্ন অবস্থায় বের করে আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর একটি তাৎপর্য হতে পারে তাকে সম্পর্কের স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনা এবং অন্য একটি তাৎপর্য হতে পারে তাদের বিষয়টি অন্দরমহল বা আধুনিক পরিভাষায় বেডরুমে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং পরিবার পরিজনের অন্য যারা সমাধানে সম্পর্কিত হওয়ার যোগ্য তাদের সামনে উপস্থাপন করা।

৪:৩৪ আয়াতে ব্যবহৃত ওয়াদরিবূহুন্না শব্দের অর্থ “তাদেরকে (অর্থাৎ স্ত্রীদেরকে) মৃদু প্রহার করো” হিসেবে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে একটি দাবি হচ্ছে, দরাবা শব্দের মূল অর্থ হলো ‘সে মুদু প্রহার করেছে’ এবং যদি প্রচণ্ড প্রহারের বিষয় হয় তবে হয়তো দররাবা (ক্রিয়ারূপ ২) ব্যবহৃত হয়, নয়তো দরাবা শব্দটির পর আধিক্যবাচক কোনো শব্দ বা দরবান ক্রিয়াবিশেষ্য ব্যবহৃত হয়। এ দাবির জবাবে বলা যায়, দ্বিতীয় তথ্যটি সঠিক হলেও প্রথম কথাটি সঠিক নয়। বরং শুধু দরাবা (ক্রিয়ারূপ ১) ব্যবহারের অর্থ হলো প্রহারের মাত্রা মৃদু না তীব্র তা অনির্দিষ্ট হওয়া, নিশ্চিতভাবে মৃদুমাত্রা হওয়া নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আল কুরআনে আলোচ্য আয়াতটি (৪:৩৪) ছাড়া অন্য যেসব স্থানে ‘প্রহার করা’ অর্থে দরাবা (ক্রিয়ারূপ ১) ব্যবহৃত হয়েছে তার কোথাও মৃদু আঘাত বুঝানো হয়নি, বরং প্রবল আঘাত করার কথাই বুঝানো হয়েছে। সুতরাং ওয়াদরিবূহুন্না শব্দের মাধ্যমে আসলে ‘মিসওয়াক (বা টুথব্রাশ) এর মতো হালকা কিছু দিয়ে মৃদু আঘাত করার’ অর্থে স্ত্রীদেরকে প্রহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে দাবি করা যুক্তিসঙ্গত নয়।

প্রকৃতপক্ষে পরিবারকে রাষ্ট্রের একটি ক্ষুদ্র নমুনা সাব্যস্ত করা মৌলিকভাবে যথাযথ হলেও তা সব দিক ও বিভাগের একই রূপ সামঞ্জস্য তৈরি করে না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক পরস্পরের জোড়া হিসেবে হওয়ায় পরিবারে তাদের মর্যাদাগত অবস্থান প্রায় সমপর্যায়ের। এতে স্বামী শৃঙ্খলাগত কারণে প্রধান হলেও তা দৈহিক দণ্ড কার্যকর করার মতো বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন নয়, বরং তার কাছে যদি স্ত্রীর অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ থাকে তা আদালতে পেশ করতে হবে, নিজে বিচারক হতে পারবে না। সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, পারিবারিক বলয়ে স্ত্রীকে প্রহার করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে মর্মে দাবি করাটা কুরআনের সামগ্রিক নির্দেশনার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়।

সর্বোপরি ২:১২৯ আয়াতের নির্দেশনা হচ্ছে, স্ত্রীকে যাতনা দিয়ে দাম্পত্য সম্পর্কে আটকে রাখা সমুচিত নয়। আবার ৪:১২৮-১৩০ আয়াতে কোনো স্ত্রী তার স্বামীর পক্ষ থেকে দাম্পত্য চুক্তি লংঘনের আশংকা করলে সে অবস্থায় স্ত্রী তার স্বামীর সাথে একটা সমঝোতায় যাওয়ার এবং দুজনে সমঝোতায় পৌঁছতে না পারলে পারস্পরিক সিদ্ধান্তক্রমে দাম্পত্য সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশনা রয়েছে। অনুরূপভাবে কোনো স্বামী তার স্ত্রীর কর্তৃক দাম্পত্য চুক্তি লংঘনের আশংকা করলে সে অবস্থায়ও শেষ পর্যায়ে আবার সম্পর্কের স্বাভাবিকতার মাধ্যমে সংশোধনের শেষ চেষ্টা করা অথবা অন্যদের সামনে বিষয়টা নিয়ে এসে সম্পর্ক রক্ষা করা বা বিচ্ছিন্ন করার চূড়ান্ত পর্যায়ের সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশনাই অন্যান্য নির্দেশনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়।

৪:৩৪ আয়াতে স্ত্রীর দাম্পত্য চুক্তি লংঘনমূলক কাজের প্রতিকারে স্বামীর করণীয় উল্লেখের ধারাবাহিকতায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধের আশংকা করলে তখন মুসলিম সমাজের ভূমিকা কী হবে সে সম্পর্কে ৪:৩৫ আয়াতে নির্দেশনা রয়েছে। তা হলো- স্বামীর পরিবার পরিজনের মধ্য থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার পরিজনের মধ্য থেকে একজনকে হাকাম তথা বিচক্ষণ মীমাংসাকারী হিসেবে নিযুক্ত করতে হবে। তারা প্রথমে চেষ্টা করবে উভয় পক্ষের মধ্যে সংশোধন করে দেয়ার জন্য। যদি তাদের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, তারপর তালাক প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। যদি তালাকের পূর্বে এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তাহলে তালাকের পরিমাণ যে অনেক কমে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। 

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নে আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত দুটি বিশেষ পরিভাষা ‘দরাবা’ ও ‘নুশুয’ এর একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো:

দরাবা ضَرَبَ : দরাবা ক্রিয়াটির অর্থ হচ্ছে ‘আঘাত করা, বিচলিত করা, ভ্রমণ করা, সামনে উপস্থাপন করা, দৃষ্টান্ত পেশ করা, উদাহরণ উপস্থাপন করা, কাউকে কোনো অবস্থায় রাখা বা কোনো অবস্থা থেকে বের করে আনা, কোথাও কিছু রাখা, প্রত্যাহার করে নেয়া’। দাম্পত্য সমস্যা সমাধানের জন্য দেয়া নির্দেশনার ক্ষেত্রে এর অর্থ হচ্ছে সমাধানে সম্পর্কিত হবার যোগ্য ব্যক্তিদের সামনে উপস্থাপন করা।

নুশুয  نُشُوزَ : নুশুয শব্দের শব্দমূল হচ্ছে নুন শীন যা। শব্দমূলের অর্থ হচ্ছে ‘উঠা’। কিন্তু এই শব্দমূল থেকে গঠিত নুশুয শব্দটি শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। অন্য কথায় এর অর্থ হচ্ছে ‘দাম্পত্য চুক্তি লংঘন’ যা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন অন্যত্র অনৈতিক সম্পর্ক, অস্বাভাবিক আচরন, একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্ত্রীদের মধ্যে স্বামীর বৈষম্য সৃষ্টি। ৪:৩৪ আয়াতে যখন কোনো স্বামী আশংকা করে যে তার স্ত্রী নুশুয করছে সে প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে। ৪:১২৮ আয়াতে যখন কোনো স্ত্রী আশংকা করে যে তার স্বামী নুশুয করছে সে প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে। নুশুয শব্দটি আল কুরআনে এ দুটি আয়াতেই উল্লেখ করা হয়েছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, দাম্পত্য সংকট নিরসন প্রসঙ্গে প্রদত্ত নির্দেশনায় ব্যবহৃত ‘দরাবা’ শব্দের প্রায়োগিক অর্থ এর পরিপ্রেক্ষিত ও আইনী প্রয়োগ অনুসারে নির্ধারিত হবে এবং এক্ষেত্রে এর যথাযথ তাৎপর্য ‘স্ত্রীকে স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্কে ফিরিয়ে নেয়া বা তার অসদাচরণের বিষয়টি সমস্যা সমাধানে সম্পৃক্ত হওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিদের সামনে নিয়ে আসা’। স্ত্রীকে প্রহার বা আঘাত করা পারিবারিক সহিংসতা হিসেবে সাব্যস্ত হবে, যা কোনোক্রমেই কুরআনসম্মত নয়। কুরআনে স্ত্রী প্রহারের কোনো অনুমোদন নেই, এমনকি স্ত্রী অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে তার বিচার ভার মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা রাষ্ট্রীয় বিচার বিভাগের উপর অর্পিত হবে, এক্ষেত্রে স্বামী তার স্ত্রীকে অভিযুক্ত করে নিজেই প্রহার করার কোনো অধিকার রাখে না।


লেখক: শওকত জাওহার

রিসার্চ ফেলো, দি ইনস্টিটিউট ফর কুরআনিক রিসার্চ এন্ড এ্যাপ্লিকেশন (ইক্বরা)

১১ জানুয়ারি ২০২২

ট্যাগ / কী-ওয়ার্ড:

অন্যান্য প্রবন্ধ

April 22, 2024
গঠন রীতি ও শব্দের ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে কুরআনের সুরার ক্রম

কুরআনের ক্রম বের করার অনেক প্রচেষ্টা হয়েছে এবং বিভিন্ন মতামত রয়েছে। স্কলার মার্ক ডুরি কুরআনের শব্দ ও গঠন শৈলি ব্যবহার করে একটি ভিন্ন সুরার ক্রমে উপনিত হয়েছেন যা এই প্রবন্ধের বিষয়বস্ত

April 18, 2024
Quran Mistranslated Series - Ep 1: 36:40 "Each in an orbit, floating" - Major Mistranslation That Leads To A Geocentric Model of The Universe

In this series we will tackle Quranic verses which are repeatedly wrong translated across time in many different translation. The first in this series will focus on 36:40

April 16, 2024
The IQRA joins IQSA (International Quranic Studies Association)

We are happy to announce that The IQRA has joined the International Quranic Studies Association (IQSA). The International Qur’anic Studies Association (IQSA) is the first learned society dedicated to the study of the Qur’an. We hold conferences around the world and publish cutting-edge research and scholarship. The IQSA community and its partners include scholars, students, […]

April 15, 2024
আল কুরআনে তাগুতের পরিচয়

২:২৫৬ :: দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় সত্যপথ স্পষ্ট হয়ে গেছে বিভ্রান্তি থেকে। সুতরাং যে ব্যক্তি তাগুতের প্রতি কুফর করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে সে এমন এক মজবুত হাতল আঁকড়ে ধরবে যা ভেঙ্গে যাবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। ২:২৫৭ :: আল্লাহ মু’মিনদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে […]

April 9, 2024
The Origin of Arabic Language & Its History

"And thus We have revealed to you an Arabic Qur'an" - Surah Ash-shuraa, verse 7 We explore the history and development of the Arabic language, as well as its connection to religion. Here are compilation of a few resources via YouTube. The Origins of Arabic - The Arabic Language How Arabia Got Its Name? What […]

April 8, 2024
Ghulam Ahmad Parwez - A Scholar of Islam

Among Muslim scholars, particularly who translated and interpreted the Quran in modern times, I am very fascinated and interested in the thoughts of late Ghulam Ahmad Parwez (1903-1985), also known as G A Parwez. Here is a summary as a way of introduction to this noteworthy scholar. Ghulam Ahmad Parwez was a prominent Islamic scholar, […]

April 6, 2024
The Qur'an and the Just Society - Ramon Harvey - Book Review

Main Topic or Theme The main theme of "The Qur'an and the Just Society" by Ramon Harvey revolves around exploring the ethical and moral framework provided by the Qur'an for creating a just society. Key Ideas or Arguments Chapter Titles or Main Sections Chapter Summaries Key Takeaways or Conclusions Author's Background and Qualifications Ramon Harvey […]

April 5, 2024
না বুঝে কুরআন পড়ে আমরা শয়তানকে যেভাবে সাহায্য করি

১.স্টারপিক ফ্যাক্টরির মালিক সোহান সাহেব। ফ্যাক্টরির বয়স প্রায় ২৫ বছরের বেশি, মালিকের বয়স ৬৭ বছর। তার ফ্যাক্টরির পুরনো এবং বিশ্বস্ত ম্যানেজার হলো ফারুক সাহেব। মালিক সোহান সাহেব এবার ঠিক করেছেন টানা ২ মাসের জন্য তিনি ফ্যাক্টরির নিয়মিত কাজ থেকে বিরতি নিয়ে আমেরিকায় তার মেয়ে, মেয়ে জামাই ও নাতিদের সাথে সময় কাটাবেন। দীর্ঘ ২ মাস তার […]