মানব সভ্যতার ধারাবাহিকতার জন্য মানুষের সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে বিবাহ ধর্ম নির্দেশিত একটি মৌলিক বিধান। বিবাহের উদ্দেশ্য ও তার কার্যকারিতার জন্য বিবাহের বয়স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিবাহের সাথে সম্পর্কিত যেসব সমস্যার যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান প্রয়োজন তার মধ্যে বাল্যবিয়ে একটি বিশেষ সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। বাল্যবিয়ে সমস্যার অন্যতম কারণ হলো মানুষের ধর্মীয় অজ্ঞতা। যেমন: কুরআনে বিয়ের বয়সের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তা লংঘন করে বাল্যবিয়ে সম্পাদন করা স্রষ্টার বিধান অনুযায়ী বৈধ নয়। অথচ এ বিষয়ে কুরআনের নির্দেশনা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে অনেকে বাল্যবিয়েকে বৈধ বলে দাবি করে থাকেন। আলোচ্য নিবন্ধে বিয়ের বয়স সম্পর্কে কুরআনের নির্দেশনা ও বাল্যবিয়ের অবৈধতা এবং সেই সাথে যেসব তথ্য বিভ্রাটের কারণে এ বিষয়ে ভুল ধারণা প্রচারিত হয়েছে তার যৌক্তিক পর্যালোচনা উপস্থাপনের প্রয়াস নেয়া হয়েছে।
বিয়ের বয়স ও বাল্যবিয়ের অবৈধতা
কুরআনে ‘বিয়ের বয়স’ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ৪:৬ আয়াতে ইয়াতীম ছেলেমেয়েকে তাদের সম্পদ প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে তারা ‘বালাগুন নিকাহ’ তথা ‘বিয়ের বয়সে পৌঁছার’ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছে যে, যখন আঁচ করা যাবে যে, তারা ‘বিয়ের বয়সে’ পৌঁছেছে তখন তা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতাও যাচাই করতে হবে। যদি তাদের মধ্যে ‘রুশদা’ অর্থাৎ সঠিক বোধবুদ্ধি (এক্ষেত্রে সম্পদের সঙ্গত ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা) অনুভব করা যায়, তাহলে তাদের সম্পদ তাদের কাছে প্রত্যর্পণ করতে হবে। অন্যথায় নির্বোধদের হাতে তাদের সম্পদ প্রত্যর্পণ করা যাবে না, বরং তাদের সম্পদ থেকে তাদের জন্য ভরণপোষনের ব্যবস্থাপনা করতে হবে, কিন্তু সম্পদের ব্যবস্থাপনা অন্য অভিভাবক করবে, যা ৪:৫ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুতরাং ৪:৫-৬ আয়াত অনুযায়ী বিয়ের একটি সুনির্দিষ্ট বয়স আছে, যার সাথে শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সম্পর্ক রয়েছে। শারীরিকভাবে এ বয়সটি হলো যৌবনকাল, যা হলো স্থিতিশীল শক্তিসামর্থ্যের বয়স। এ বিষয়টি বুঝা যায়, ইয়াতীমের যৌবন বা স্থিতিশীল শক্তিসামর্থ্যের বয়স পর্যন্ত তার সম্পদের ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা থেকে। অন্য কথায়, ইয়াতীম বিয়ের বয়সে উপনীত হওয়ার অর্থ হলো ইয়াতীম যৌবনে উপনীত হওয়া। ইয়াতীমের যৌবন পর্যন্ত তার সম্পদের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত দুটি আয়াত নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
৬:১৫২ :: আর তোমরা ইয়াতীমের সম্পদের নিকটবর্তী হয়ো না, সুন্দরতম পন্থা ছাড়া। যতক্ষণ না সে যৌবনে/ স্থিতিশীল শক্তিসামর্থ্যের বয়সে <আশুদ্ধা> উপনীত হয়, আর পরিমাপ ও ওজন পূর্ণ করবে ইনসাফের সাথে। আমি কাউকে তার সাধ্য ছাড়া দায়িত্ব অর্পণ করি না। আর যখন তোমরা কথা বলবে, তখন ন্যায়সঙ্গত কথা বলো, যদিও সে (অভিযোগের যোগ্য ব্যক্তি) আত্মীয় হয় এবং আল্লাহর সাথে কৃত নৈতিক প্রতিশ্রুতি পূর্ণ কর। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।
১৭:৩৪ :: আর তোমরা ইয়াতীমের সম্পদের কাছে যেয়ো না, সুন্দরতম পন্থা ছাড়া, যতক্ষণ না সে যৌবনে/ স্থিতিশীল শক্তিসামর্থ্যের বয়সে <আশুদ্ধা> উপনীত হয়। আর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো, নিশ্চয় প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জবাবদিহি করা হবে।
‘আশুদ্দা’ বা ‘যৌবন’ তথা ‘স্থিতিশীল শক্তিসামর্থ্যের বয়স’ এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা যায় যে, এটি হলো শিশু-কিশোর ও প্রৌঢ়-বৃদ্ধের মধ্যবর্তী শক্তিসাম্যের বয়স (সম্পর্কিত আয়াত- ২২:৫, ৪০:৬৭)। এছাড়া ১৮:৮২ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সাধারণত অপ্রাপ্ত বয়স্ক ইয়াতীম সন্তানরা এ বয়সে উপনীত হবার পর তাদের জন্য তাদের পিতা কর্তৃক সঞ্চিত গুপ্তধন উদ্ধার ও সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত শক্তিসামর্থ্যের অধিকারী হয়।
সুতরাং ‘বালাগান নিকাহ’ বা ‘বিয়ের বয়সে পৌঁছা’ মানে হলো ‘বালাগাল আশুদ্ধা’ বা ‘যৌবনকালে পৌঁছা, স্থিতিশীল শক্তিসামর্থ্যের বয়সে পৌঁছা’। অন্যদিকে এর পূর্বে রয়েছে বালাগাল হুলুমা’ বা ‘বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছা’, যে সম্পর্কে ২৪:৫৯ আয়াতে আলোকপাত করা হয়েছে। অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকাল হলো কৈশোর ও যৌবনের মধ্যবর্তী পর্যায়। সাধারণত ছেলেদের বীর্যস্খলন শুরু হওয়া এবং মেয়েদের মাসিক রজ:স্রাব শুরু হওয়াকে বয়সন্ধিকালে পৌঁছার (সাবালক বা সাবালিকা হওয়ার) লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়। অবশ্য কারো কারো ক্ষেত্রে কোনো কারণে বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতে বীর্যস্খলন বা রজ:স্রাব নাও হতে পারে, সেক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছার বিষয়টি অন্যান্য লক্ষণ দ্বারা চিহ্নিত হয়।
ধাত্রীবিদ্যা (Obstetrics) অনুযায়ী, নয় দশ বছর বয়সে মেয়েরা রজঃমতী হলেও তখন থেকেই তারা যথাযথ প্রজনন-শক্তিসম্পন্না হয় না। একে বয়োসন্ধির অনুর্বরতা (Adolescent sterility) বলা হয়। অন্যদিকে বেশি বয়সে প্রথম গর্ভধারণ (elderly primi) বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে। যেমন, বেশি বয়সের মায়েদের জরায়ুর আয়তন যথাযথভাবে বৃদ্ধি পেতে চায় না। ফলে ভ্রুণের মাথার উপর চাপ পড়ে, যা সন্তানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত: বেশি বয়সের মায়েদের স্তনে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে, ফলে শিশুরা পর্যাপ্ত মাতৃদুগ্ধ পায় না। তৃতীয়ত: সুষ্ঠুভাবে সন্তান পরিপালনের জন্য যে ধরনের ধৈর্যের প্রয়োজন অনেক সময় দেখা যায় যে, বেশি বয়সের মায়েদের মধ্যে তা যথাযথভাবে থাকে না, বরং তারা অল্পতেই বিরক্ত হয়ে পড়ে। এসব কারণে মেয়েদের বিয়ে যেন খুব দেরিতে না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। অধিক বয়সের পরিবর্তে বয়ঃসন্ধিকাল শেষ হওয়ার পর মেয়েদের বিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত হলে জরায়ুর টিউমার ও ক্যান্সার, ব্রেস্ট টিউমার, হরমোনাল সমস্যা, ঋতুজনিত সমস্যা ইত্যাদির সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
কোনো ছেলে বা মেয়ের দৈহিক উচ্চতা বৃদ্ধির সমাপ্তির মাধ্যমেই বয়ঃসন্ধিকালের তথা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার জৈবিক প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে বা পরিপক্কতা অর্জিত হয় এবং এটিই যৌবনকাল বা স্থিতিশীল শক্তিসামর্থ্যের বয়স হিসেবে বিবেচিত হয়। আর কুরআনেও বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তে যৌবনকাল বা বা স্থিতিশীল শক্তিসামর্থ্যের বয়সকেই ‘বিয়ের বয়স’ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। যদিও বয়ঃসন্ধিকাল সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের মতো দৈহিক আগ্রহ-অনুভূতি ও জৈবিক প্রক্রিয়া সম্ভব, তবুও তা উভয়ের পরবর্তী যথাযথ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে বা দীর্ঘমেয়াদি তারুণ্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে।
কোনো ছেলে বা মেয়ের বিয়ের বয়স নির্ধারণে শারীরিক বিকাশের সাধারণ অবস্থার পাশাপাশি তার বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতাকেও বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার বিষয়টি শারীরিক নিদর্শনের চেয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যাচাই করা যেতে পারে। একেকজনের ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার বিকাশ একেক সময়ে ঘটতে পারে। আবার কার ক্ষেত্রে কিরূপ বুদ্ধিমত্তাকে তার সাথে পরিস্থিতি সাপেক্ষে যথেষ্ট সাব্যস্ত করা হবে সেটা অভিভাবকদের সুবিবেচনার সাথে সম্পর্কিত। কারণ তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে যে, যখন তারা (তাদের সুবিবেচনা অনুসারে) সঙ্গত বুদ্ধিমত্তা অনুভব করে তখন তারা বিয়ের বয়সে উপনীত হয়েছে মর্মে সিদ্ধান্তে পৌঁছবে এবং সম্পদ প্রত্যর্পণ করবে। তবে এক্ষেত্রে ‘আশুদ্ধা’ বা ‘জৈবিক প্রক্রিয়াগত শক্তির পরিপক্কতার বয়স’ (যৌবন) এর পূর্বশর্ত কার্যকর থাকবে। অন্যকথায়, শারীরিক বিকাশ হলো প্রথম শর্ত এবং মানসিক বিকাশ হলো দ্বিতীয় শর্ত।
সম্পদের সঙ্গত ব্যবস্থাপনাগত বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার প্রশ্নটি পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে হুবহু সমান পর্যায়ে বিবেচ্য নয়। কারণ পুরুষকে নারীর সামগ্রিক দায়িত্বশীল হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং নিজ সম্পদ থেকে নারীর জন্য ব্যয় করতে হবে। অন্যদিকে নারীর সম্পদের মালিকানা এবং বিনিয়োগ বা আয়-উপার্জনের অধিকার রয়েছে, কিন্তু তার অর্থনৈতিক দায়িত্ব পুরুষের তুলনায় কম। তাই যদিও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাগত যোগ্যতা নারীরও থাকতে হবে, তবুও তা পুরুষের সমপর্যায়ের হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। আবার বিয়ের মাধ্যমে স্বামী তার স্ত্রীর সামগ্রিক দায়িত্বশীল হয় এবং নিজ সম্পদ থেকে স্ত্রীর জন্য ব্যয়ভার বহন করতে হয় বিধায়, বিয়ের বয়সের জন্য সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাগত বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা একটি স্বত:সিদ্ধ শর্ত হিসেবেও প্রযোজ্য বলে প্রতীয়মান হয়।
এমনকি ২৪:৩৩ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, শারীরিক ও মানসিকভাবে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সামর্থ্যের পূর্বে যৌনসংযম অবলম্বন করতে হবে। এ থেকেও বুঝা যায় যে, অপরিণত বয়সে বিয়ে গ্রহণযোগ্য নয়।
৪:২১ আয়াতে বিয়েকে ‘মজবুত চুক্তি’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অপরিণত বয়সে এই মজবুত চুক্তি সম্পাদিত হতে পারে না।
২:২২১ আয়াতে মুশরিক নারী-পুরুষকে বিয়ে করতে নিষেধ করা হয়েছে, অন্যদিকে মু’মিন নারী-পুরুষকে বিয়ে করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অপরিণত বয়সে কেউ বুঝে শুনে মু’মিন বা মুশরিক হয় না। এটিও বিয়ের জন্য একটি উপযুক্ত বয়সের নির্দেশনা প্রদান করে।
৪:১৯ আয়াত অনুযায়ী কোনো নারীর প্রতি বলপ্রয়োগপূর্বক তার উত্তরাধিকারী হওয়া বৈধ নয়, যার একটি রূপ হলো, তার সম্মতি ছাড়া তাকে বিয়ে করা যাবে না। সুতরাং বুঝে শুনে সম্মতি প্রকাশের পূর্বের বয়সে বিয়ে হতে পারে না।
৬৫:৪ আয়াতে তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দাত (তালাক পরবর্তীতে পুন:বিবাহের পূর্বে বাধ্যতামূলক অপেক্ষার সময়কাল) প্রসঙ্গে একটি ধারা উল্লেখ করা হয়েছে যে, “যাদের রজ:স্রাব হয়নি তাদের ইদ্দাত হচ্ছে তিন মাস”। এটিকে অনেকে বাল্যবিবাহের পক্ষে একটি তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। অথচ পূর্বে উল্লেখিত আয়াতসমূহের ভিত্তিতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বিয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট বয়স রয়েছে। সুতরাং ৬৫:৪ আয়াতে ‘নাবালিকা’ বা ‘যাদের রজ:স্রাব হওয়ার মতো বয়স হয়নি’ তাদের কথা বরা হয়নি। বরং যাদের কোনো জটিলতার কারণে রজ:স্রাব হয়নি তাদের কথা বলা হয়েছে।
সুতরাং কোনোক্রমেই বাল্যবিবাহ বৈধ নয়। তবে কোনোভাবে বাল্যবিবাহ সংঘটিত হলে তা বহাল রাখা হবে কিনা সেটা সংশ্লিষ্ট অভিভাবক ও আইনগত কর্তৃপক্ষের মধ্যে বাস্তব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে পরামর্শের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
ইয়াতীম মেয়েকে নয়, ইয়াতীম ছেলে-মেয়ে থাকা বিধবাকে বিবাহের নির্দেশনা
৪:৩ আয়াতে ইয়াতীম সমস্যার সমাধানে বিধবা বিবাহের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ আয়াতটিকে ইয়াতীম মেয়েকে বিবাহ করাকে তথা বাল্যবিবাহকে বৈধ সাব্যস্ত করার তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। অথচ আয়াতটিতে ‘ইয়াতীম মেয়েদেরকে’ বিয়ে করার নির্দেশ দেয়া হয়নি, বরং ইয়াতীম ছেলেমেয়ে থাকা বিধবা নারীকে বিয়ে করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিম্নে বিষয়টি আলোচনা করা হলো:
৪:৩ আয়াতে প্রথমেই বলা হয়েছে যে, “ওয়া ইন খিফতুম আল্লা তুক্বছিতূ ফিল ইয়াতামা ফানকিহূ মা তবা লাকুম মিনান নিছায়ি”। ((আর যদি তোমরা ভয় করো যে, তোমরা ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তাহলে বিয়ে করে নাও (ইয়াতীম ছেলেমেয়ে থাকা) নারীদের মধ্য থেকে যে তোমাদের জন্য পছন্দনীয় হয়))।
নিম্নে এর প্রতিটি শব্দের শব্দার্থ দেয়া হলো:
ওয়া = আর।
ইন = যদি।
খিফতুম = তোমরা ভয় করো।
আন = যে,
লা তুক্বছিতূ = তোমরা সুবিচার করতে পারবে না।
ফিল ইয়াতামা = ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের প্রতি।
ফানক্বিহূ = তাহলে বিয়ে করো।
মা তবা লাকুম = যে তোমাদের জন্য পছন্দনীয় হয়।
মিনান নিছায়ি = নারীদের মধ্য থেকে।
আয়াতটিতে যাদেরকে বিয়ে করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদেরকে ‘আননিসা’ (নারীগণ) শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে, সরাসরি ‘ইয়াতীম নারী’ বা ‘ইয়াতীম ছেলেমেয়ে থাকা বিধবা নারী’ কোনোটিই বলা হয়নি। কিন্তু পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এটি ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের প্রতি সুবিচারের উদ্দেশ্যে একটি ব্যবস্থাপনা। সুতরাং এই নারীদের সাথে ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের একটি সম্পর্ক রয়েছে, তারা স্বয়ং ‘ইয়াতীম নারী’ হোক বা “ইয়াতীম ছেলেমেয়ে থাকা বিধবা নারী’ হোক।
এখানে কি “ইয়াতীম নারী’ বুঝানো হয়েছে, নাকি “ইয়াতীম ছেলেমেয়ে থাকা বিধবা নারী’ বুঝানো হয়েছে নাকি উভয় শ্রেণিকে বুঝানো হয়েছে তা নির্ণয় করা সম্ভব হয় ৪:১২৭ আয়াত থেকে।
৪:১২৭ আয়াতে প্রথমাংশে বলা হয়েছে, “ওয়া ইয়াছতাফতূনাকা ফিন নিসায়ি, ক্বুলিল্লাহু ইউফতীকুম ফীহিন্না ওয়া মা ইউতলা আলাইকুম ফিল কিতাবি ফী ইয়াতামান নিছায়িল্লাতী লা তু’তূনাহুন্না মা কুতিবা লাহুন্না ওয়া তারগাবূনা আন তানকিহূহুন্না” ((তারা তোমার কাছে ফতোয়া জানতে চায় (ইয়াতীম ছেলেমেয়ে আছে এমন) নারীদের বিষয়ে। বলো, আল্লাহ তোমাদেরকে তাদের বিষয়ে ফতোয়া দিচ্ছেন। আর (স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন) যা তোমাদের কাছে এই কিতাবে আবৃত্তি করা হচ্ছে, ঐ বিধবা নারীদের ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের বিষয়ে, যাদেরকে (ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের যে মায়েদেরকে) তোমরা তা দিচ্ছো না যা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে তাদের অধিকার হিসেবে, অথচ তোমরা আগ্রহ করছো তাদেরকে বিবাহ করতে।))
নিম্নে এর প্রতিটি শব্দের শব্দার্থ দেয়া হলো:
ওয়া = আর।
ইয়াছতাফতূনাকা = তারা তোমার কাছে ফতোয়া জানতে চায়।
ফিন নিসায়ি = নারীদের বিষয়ে।
ক্বুল = বলো।
আল্লাহু = আল্লাহ।
ইউফতীকুম = তোমাদেরকে ফতোয়া দিচ্ছেন।
ফীহিন্না = তাদের বিষয়ে।
ওয়া = আর (স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন)।
মা = যা।
ইউতলা = আবৃত্তি করা হয়।
আলাইকুম = তোমাদের কাছে।
ফিল কিতাবি = কিতাবে/বিধানে।
ফী ইয়াতামান নিছায়ি = বিধবা নারীদের ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের বিষয়ে।
আল্লাতী = যে বিধবা নারীরা এরূপ যে,
লা তু’তূহুন্না = তোমরা তাদেরকে (ঐ বিধবা নারীদেরকে) প্রদান করো না।
মা = যা।
কুতিবা = বিধিবদ্ধ করা হয়েছে
লাহুন্না = তাদের জন্য (তাদের অধিকার হিসেবে)।
ওয়া = অথচ।
তারগাবূ = তোমরা আগ্রহ করছো।
আন = যে,
তানকিহূহুন্না = তোমরা তাদেরকে বিবাহ করবে।
এ আয়াতে “ইয়াতামান নিসায়ি” (নারীদের ইয়াতীম ছেলেমেয়ে) শব্দটি হলো “কী ওয়ার্ড” (Key Word) যার মাধ্যমে এ প্রশ্নের সমাধান জানা যায। এতে ‘ইয়াতীম ছেলেমেয়েকে” বলা হয়েছে “নারীদের ইয়াতীম ছেলেমেয়ে”। অর্থাৎ ঐ নারীরা হলো “ইয়াতীম ছেলেমেয়ের মা”। অর্থাৎ ঐ বিধবা নারীরা যাদের সাথে তাদের ইয়াতীম ছেলেমেয়ে আছে।
সুতরাং ৪:৩ আয়াতে যে “আন নিসা” বা “নারীদেরকে” বিবাহ করতে আদেশ দেয়া হয়েছে তারা হলো “বিধবা নারীগণ”। অর্থাৎ “যে বিধবা নারীদের সাথে তাদের ইয়াতীম ছেলেমেয়ে আছে” তাদেরকেই বিয়ে করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, স্বয়ং ইয়াতীম মেয়েদেরকে বিয়ে করার নির্দেশ নয়। অন্যকথায় ইয়াতীম মেয়েদেরকে স্ত্রী বানাতে নয়, বরং ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের নিজের ছেলেমেয়ে বানিয়ে নিতেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সুতরাং ৪:৩ আয়াতকে বাল্যবিয়ের তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করার কোনো অবকাশ নেই। বরং ৪:৩ আয়াতে ইয়াতীম সমস্যার সমাধানের জন্য বিধবা বিবাহের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ কর্তৃক বাল্যবিয়ে করার ভুল ধারণার অপনোদন
“মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ও তাঁর স্ত্রী আয়েশার আয়েশার বিয়ের সময় নবীপত্নী আয়েশার বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর তথা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে করেছেন” মর্মে একটি বড় ধরনের ভুল ধারণা সমাজে প্রচলিত রয়েছে। যেহেতু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ শুধুমাত্র কুরআন অনুসরণ করেছেন, তিনি কুরআনের বিধি-বিধান লঙ্ঘন করেননি, তাই তিনি বাল্যবিয়ে করতে পারেন না এবং করেননি।
মুহাম্মাদুর রসূল্লাহর কর্তৃক তাঁর স্ত্রী আয়েশাকে তার বাল্যবয়সে বিয়ে করা সম্পর্কিত ধারণাটি কিভাবে গড়ে উঠেছে এবং কেন তা একটি ভুল প্রচারণা নিম্নে তার তথ্যভিত্তিক আলোচনা উপস্থাপিত হলো।
এ বিষয়ে যে তথ্যগুলো প্রয়োজন তাহলো:
ক. মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ কত বছর বেঁচে ছিলেন?
খ. তিনি কত বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করেন?
গ. তিনি কত বছর বয়সে হিজরত করেন?
ঘ. তিনি হিজরতের কত বছর আগে হযরত আয়েশাকে বিয়ে করেন? এবং তার কত বছর পর তার সাথে বাসর করেন?
ঙ. হযরত আয়েশা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর নবুয়াতের আগে না পরে জন্মগ্রহণ করেন?
চ. হযরত আয়েশা ইসলাম গ্রহণের দিক থেকে নবুয়াতের প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেছেন না এর চেয়ে অনেক দেরিতে?
ছ. অন্য কারো বয়সের সাথে তুলনা করে হযরত আয়েশার বয়স নির্ণয় করা সম্ভব কিনা?
নিম্নে এ প্রশ্নগুলোর সাথে সম্পর্কযুক্ত তথ্য উল্লেখ করা হলো:
‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ যখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর মৃত্যু হয় তখন তাঁর বয়স হয়েছিল তেষট্টি বছর। ইব্ন শিহাব বলেন, সা’ঈদ ইবনুল মুসায়্যিব এভাবেই আমার কাছে বর্ণনা করেন।(১)
(১) বুখারী:৩৫৩৬, http://ihadis.com/books/bukhari/hadis/3536
ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর উপর যখন (ওয়াহী) নাযিল করা হয় তখন তাঁর বয়স ছিল চল্লিশ বছর। অতঃপর তিনি মক্কায় তের বছর অবস্থান করেন। অতঃপর তাকেঁ হিজরত করার আদেশ দেয়া হয়। তিনি হিজরত করে মদীনায় চলে গেলেন এবং সেখানে দশ বছর অবস্থান করলেন, তারপর তাঁর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত্যু হয়।(২)
(২) বুখারী:৩৮৫১, http://ihadis.com/books/bukhari/hadis/3851
হিশাম (ইবনে উরওয়া) এর পিতা/ আবু হিশাম/ উরওয়া হতে থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর মদীনার দিকে বের হওয়ার তিন বছর আগে খাদীজাহ (রাঃ) - এর মৃত্যু হয়। তারপর দু’বছর অথবা এর কাছাকাছি সময় অতিবাহিত করে তিনি ‘আয়িশা (রাঃ) - কে বিবাহ করেন। যখন তিনি ছিলেন ছয় বছরের বালিকা। তারপর নয় বছর বয়সে বাসর উদ্যাপন করেন।(৩)
(৩) বুখারী:৩৮৯৬, http://ihadis.com/books/bukhari/hadis/3896
সুতরাং নবীর সাথে তাঁর স্ত্রী আয়েশার বিয়ে হয় হিজরতের এক বছর আগে বা নবুয়তী দ্বাদশ বর্ষে এবং তাঁদের বাসর উদযাপিত হয় হিজরী দ্বিতীয় বর্ষে।
যে বিষয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে তাহলো, বিয়ের সময় নবীপত্নী আয়েশার বয়স ছয় বছর ছিল এবং বাসরকালে নয় বছর ছিল তথ্যটি সঠিক কিনা?
এ বিষয়ে প্রথমেই জানা প্রয়োজন যে, আরবি শব্দ ছিত্তা অর্থ ছয় এবং তিসয়া অর্থ নয়। অন্যদিকে ছিত্তা আশারা অর্থ ষোল এবং তিসয়া আশারা অর্থ উনিশ। সুতরাং সিত্তা আশারা (ষোল) শব্দটি থেকে ভুলক্রমে আশারা (দশ) বাদ গেলে তা সিত্তা (ছয়) হয়ে যায় এবং তিসয়া আশারা (উনিশ) শব্দটি থেকে আশারা (দশ) বাদ গেলে তিসয়া (নয়) হয়ে যায়। সুতরাং হাদীসের রাবী (বর্ণনাকারী) কোনোক্রমে ভুলে আশারা শব্দটি উল্লেখে ত্রুটি করার কারণে ষোল এর স্থলে ছয় এবং উনিশ এর স্থলে নয় হয়ে গেছে কিনা তা যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বিশেষ করে এ হাদীসের রাবী (বর্ণনাকারী) হিশাম ইবনে উরওয়া সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তার জীবনের প্রথম ৭১ (একাত্তর) বছর মদিনায় কাটান এবং তারপর মদিনা থেকে ইরাক চলে যান। ইরাক চলে যাওয়ার পর তার স্মৃতিশক্তিতে ত্রুটি দেখা দেয়, ফলে তাঁর বর্ণনায় অনেক কিছু উল্টাপাল্টা হয়ে যেতো। তাই তার থেকে কোনো ইরাকী রাবি যত হাদিসই বর্ণনা করবে, সেগুলো গ্রহণযোগ্য হবে না। হযরত আয়েশার বিয়ে ও বাসর সম্পর্কে তাঁর বর্ণিত হাদীসের কোনো রাবী মদিনাবাসী নয়, বরং সকলেই ইরাকের অধিবাসী। সুতরাং হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ী তাঁর এ হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। (তথ্যসূত্র: তাহযীবুত তাহযীব, লেখক ইবনে হাজার আসকালানী, বইটি রিজালশাস্ত্র বা হাদীস বর্ণনাকারীদের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে লিখিত)
তাবারী বর্ণিত একটি ভাষ্যমতে, হজরত আবু বকরের (রা.) চার সন্তানেরই জন্ম হয়েছিল আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগে তথা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর নবুয়াত লাভের পূর্বে। (তথ্যসূত্র: Tarikhu'l-umam wa'l-mamlu'k, Al-Tabari, Vol 4, Pg 50, Arabic, Dara'l-fikr, Beirut, 1979)
সীরাতে ইবনে হিশামের তথ্য অনুযায়ী, হযরত আয়েশা হলেন ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে ২০তম বা ২১ তম। (তথ্যসূত্র: Al-Sirah al-Nabawiyyah, Ibn Hisham, Vol 1, Pg 227 - 234, Arabic, Maktabah al-Riyadh al-hadithah, Al-Riyadh)
হযরত আয়েশার বোন হযরত আসমা ছিলেন তাঁর চেয়ে দশ বছরের বড় (তথ্যসূত্র: Al- Bidayah wa’l- nihayah, Ibn Kathir, Vol 8, Pg 371, Arabic, Dar al-fikr al-arabi, Al-jizah, 1933).
হযরত আসমা একশত বছর বেঁচেছিলেন এবং ৭৩ বা ৭৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। (তথ্যসূত্র: Taqribu’l-tehzib, Ibn Hajar Al- Asqalani, Pg 654, Arabic, Bab fi’l-nisa’, al- harfu’l-alif, Lucknow)
উপরিউক্ত হিসাব অনুসারে হযরত আয়েশার বিয়ের সময় (হিজরতের এক বছর আগে বা নবুয়াতের দ্বাদর্শ বর্ষে) তাঁর বয়স ছিল ষোল বছর এবং বাসর উদযাপনের সময় (দ্বিতীয় হিজরীতে) তাঁর বয়স ছিল উনিশ বছর এবং রসূলের ওফাতের সময় তাঁর বয়স ছিল আটাশ বছর।
তবে আরো বিভিন্ন বর্ণনাসূত্রের ভিত্তিতে বিয়ের সময় হযরত আয়েশার বয়স নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে, যাতে তাঁর বয়স ছয় থেকে উনিশ বছর এর মধ্যে বিভিন্নরূপ বর্ণিত হয়েছে।(৪)
(৪) হযরত আয়েশার বয়স নির্ণয়ের জন্য প্রাসঙ্গিক সীরাতগ্রন্থ, তারিখ / ইতিহাসগ্রন্থ ও রিজালশাস্ত্রীয় গ্রন্থের রেফারেন্স গ্রহণ করা হয়েছে https://www.islamawareness.net/FAQ/what_was_ayesha.html লিংক থেকে।
প্রকৃতপক্ষে কারো বয়সের যথাযথ হিসাব সংরক্ষণ করা সহজ ছিল না। কারণ হাদীস ও ইতিহাস অনুযায়ী তৎকালীন সময়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হতো না, বরং কোনো বিখ্যাত ঘটনার সাথে মিল করে অন্যান্য সাধারণ ঘটনার বছর হিসাব করা হতো। সুতরাং হযরত আয়েশার বিয়ের বয়স সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য থাকা সত্ত্বেও ছয় বছর বয়স সম্পর্কিত একটিমাত্র কথা ছড়িয়ে দেয়া ধর্মের অপব্যবহারের এবং ধর্মবিরুদ্ধ প্রচারণার উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে প্রতীয়মান হয়।
“মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ হযরত আয়েশাকে বিয়ে করার সময় হযরত আয়েশার বয়স ছয় বছর ছিল ও বাসরের সময় হযরত আয়েশার বয়স নয় বছর ছিল” মর্মে যে হাদীস তাতে হযরত আয়েশা থেকে উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে মাঝে সনদ বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। আবার হাদীসটির প্রতিটি বর্ণনাসূত্রে মধ্যবর্তী একজন রাবী (বর্ণনাকারী) হিশাম ইবনে উরওয়া সম্পর্কে স্মৃতিভ্রমের অভিযোগ রয়েছে এবং উল্টাপাল্টা বলে ফেলার অভিযোগ রয়েছে। তাই তিনি ষোলকে ছয় এবং উনিশকে নয় বলা অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে প্রতীয়মান হয়।
অন্যদিকে হযরত আয়েশার বিয়ের সময় (নবুয়াতের দ্বাদর্শ বর্ষে) তাঁর বয়স ষোল বছর হওয়া এবং বাসরের সময় (দ্বিতীয় হিজরীতে) তাঁর বয়স উনিশ বছর হওয়ার পর্যাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র রয়েছে। যেমন বিভিন্ন হাদীসগ্রন্থ ও ইতিহাসগ্রন্থের তথ্যসূত্রে জানা যায় যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা) তেষট্টি বছর বয়সে ওফাত বরণ করেন, তিনি তাঁর চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করেন এবং তারপর তের বছর মক্কায় অবস্থান করেন, তিপ্পান্ত বছর বয়সে হিজরত করেন, তারপর দশ বছর জীবিত ছিলেন, এর মধ্যে হিজরতের তিন বছর আগে তাঁর প্রথম স্ত্রী হযরত খাদিজা ওফাত বরণ করেন, তার দুই বছর পরে তথা হিজরতের এক বছর আগে তথা নবুওয়াতের দ্বাদর্শ বর্ষে তথা রসূলের বায়ান্ন বছর বয়সে তিনি হযরত আয়েশাকে বিয়ে করেন, তার তিন বছর পরে, তথা হিজরাতের দ্বিতীয় বর্ষে হযরত আয়েশার সাথে তাঁর বাসর হয়, ঐ বছর তথা হিজরী দ্বিতীয় বর্ষে বদর যুদ্ধ হয়, বদর যুদ্ধে হযরত আয়েশা অংশগ্রহণ করেন (দ্র. মুসলিম:৪৫৯৪), ঐ সময় পনের বছরের নিচে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি ছিল না (দ্র. বুখারী:৪০৯৭), হযরত আয়েশাসহ তাঁর সব ভাইবোনের জন্ম নবুওয়াতের আগে হয়েছে, তিনি বয়সে তাঁর বোন আসমার চেয়ে দশ বছরের ছোট, নবুয়াতের সময় হযরত আসমার বয়স ছিল চৌদ্দ বছর, হযরত আয়েশা ছিলেন বিশতম ইসলাম গ্রহণকারী ইত্যাদি। এসব বর্ণনা হযরত আয়েশার বয়স বিয়ের সময় ষোল বছর হওয়াকে এবং বাসরের সময় উনিশ বছর হওয়াকে সমর্থন করে।
সর্বোপরি যেহেতু কুরআন অনুযায়ী বাল্যবিবাহ অবৈধ সেহেতু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ কর্তৃক বাল্যবিবাহ করা অসম্ভব। সেই সাথে তিনি হযরত আয়েশাকে বিয়ে করার সময় হযরত আয়েশার বয়স ছয় বা সাত বছর থাকার বিবরণগুলো ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে ত্রুটিপূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, বিয়ের বয়সের বিষয়ে আল কুরআনের সুষ্পষ্ট নির্দেশনা হলো: বিয়ের বয়স হলো যখন কোনো ছেলে বা মেয়ে তার বয়ঃসন্ধিকালের পর যৌবন বা স্থিতিশীল শক্তিসামর্থ্যের বয়সে উপনীত হয় এবং সেই সাথে তার মধ্যে সম্পদের সঙ্গত ব্যবস্থাপনার মতো মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। এই সুষ্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তা লংঘন করা বৈধ নয়। অন্য কথায়, বাল্যবিয়ের অবৈধতা কুরআন দ্বারা প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে যদি কোনোক্রমে বাল্যবিয়ে সংঘটিত হয় সেক্ষেত্রে ঐ ধরনের বিয়ে বহাল রাখা না রাখার বিষয়ে কুরআনে বর্ণিত সাধারণ নীতি অনুসারে বাস্তব পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে যুক্তিসঙ্গত ও কল্যাণকর পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: শওকত জাওহার
রিসার্চ ফেলো, দি ইনস্টিটিউট ফর কুরআনিক রিসার্চ এন্ড এ্যাপ্লিকেশন (ইক্বরা)
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১