মুরতাদ হত্যা প্রসঙ্গে একটি দাবি হলো, যদিও আল কুরআনে মুরতাদকে হত্যার জন্য কোনো আদেশ নেই, তবুও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ তাঁর হাদীসের মাধ্যমে এ আদেশ দিয়েছেন। কুরআনে আল্লাহর, তাঁর রসূলের এবং উলিল আমরের আনুগত্য করার নির্দেশ রয়েছে (৪:৫৯)। এমতাবস্থায়, কুরআনে একটি শাস্তি না থাকলেও যদি হাদীস থেকে ঐ শাস্তির কথা জানা যায়, তাহলে সেই শাস্তি কার্যকর করতে হবে। এ কারণে হাদীসের নির্দেশ অনুসারে মুরতাদকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে হবে। এ অধ্যায়ে আমরা এ দাবির গ্রহণযোগ্যতা পর্যালোচনা করবো।
“আল্লাহর আনুগত্য” এবং “রসূল ও উলিল আমরের আনুগত্য” প্রসঙ্গে বুঝার জন্য তথা আল কুরআন এবং হাদীসের বিধানের তুলনামূলক অবস্থান জানার জন্য প্রথমে সংবিধান, সাংবিধানিক আইন-বিধান এবং নির্বাহী আইন-বিধান সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। কারণ মানুষের চিরায়ত জীবনপদ্ধতির মাধ্যমে তাদের মধ্যে যে মৌলিক সাধারণ বোধ অর্জিত হয় তার উপর ভিত্তি করেই আল্লাহ তাঁর কিতাবের বক্তব্য প্রকাশ করেন, আর সেজন্য মানুষের পক্ষে তা বুঝা সহজ হয়। একইভাবে আল্লাহর কিতাবের বক্তব্য বুঝার জন্য বাস্তবভিত্তিক উদাহরণের মাধ্যমে অনুধাবনের প্রয়াস বাঞ্ছনীয়, কারণ অন্যথায় তার বাস্তব স্বরূপ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জিত হয় না।
সংক্ষেপে কোনো রাষ্ট্রের মৌলিক জীবন ব্যবস্থাকে সংবিধান বলা হয়। অর্থাৎ সংবিধান হলো ঐ আইন-বিধানের সমষ্টি যা রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে অন্যান্য সকল আইন-বিধানের মূল নিয়ামক হিসেবে স্থির করে। সংবিধান লিখিত বা অলিখিত হতে পারে এবং তা দুষ্পরিবর্তনীয় বা সুপরিবর্তনীয় হতে পারে। একটি সংবিধান কিভাবে পরিবর্তিত হবে তা সংবিধানে ঠিক করা থাকে। সাংবিধানিক পদ্ধতি অনুসারে সংবিধান পরিবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত সংবিধানের সকল ধারা বলবৎ থাকে, তবে জরুরি অবস্থায় সংবিধানের কিছু ধারার বাস্তবায়ন স্থগিত রাখা হয়। সাধারণ অবস্থায় সংবিধানের কোনো ধারাকে লঙ্ঘন করে কোনো নির্বাহী আইন-বিধান প্রণীত ও বাস্তবায়িত হতে পারে না। সংবিধানে থাকা আইন-বিধান হলো সাংবিধানিক আইন-বিধান এবং সংবিধান বাস্তবায়নের কর্তৃত্ব চর্চাকারী নির্বাহী কর্তৃপক্ষ বা সরকারের বিভিন্ন বিভাগের প্রণীত আইন ও আদেশাবলী হলো নির্বাহী আইন-বিধান। সাংবিধানিক আইন-বিধান হলো সংবিধান পরিবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত স্থায়ী গুরত্বসম্পন্ন এবং রাষ্ট্রীয় সংগঠন ও পরিচালনার মূলনীতিসমূহ এবং তা নির্বাহী আইন-বিধানের মাধ্যমে অপরিবর্তনীয়। অন্যদিকে নির্বাহী আইন-বিধান হলো সেই সব আইন-বিধান যা সংবিধান অনুযায়ী প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে ও সংবিধানের ধারাসমূহ সংরক্ষণ করে বা কোনো ধারাকে লঙ্ঘন না করে প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়, যা নির্বাহী ক্ষমতাবলে ও তুলনামূলক সাধারণ নিয়মে প্রণীত ও পরিবর্তিত হয়।
সাংবিধানিক আইন-বিধান ও নির্বাহী আইন-বিধানের উপরোল্লেখিত তুলনাকে সামনে রেখে আল কুরআনে “আল্লাহর আদেশের আনুগত্য” এবং “রসূল ও উলিল আমরের আদেশের আনুগত্য” সম্পর্কিত আয়াতসমূহ অধ্যয়ন করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আল কুরআন হলো আল্লাহ প্রদত্ত সংবিধান সম্বলিত গ্রন্থ, যাতে তাঁর প্রণীত সাংবিধানিক আইন-বিধান রয়েছে এবং আল কুরআন অনুসরণ করে রসূল ও উলিল আমর প্রয়োজনীয় নির্বাহী আইন-বিধান প্রণয়ন করতে পারেন। রসূল ও উলিল আমর (মুসলিম উম্মাহর নির্বাহী কর্তৃপক্ষ) আল কুরআনের মাধ্যমে প্রাপ্ত দায়িত্ব পালনার্থে বা আল কুরআনের বিধি-বিধান বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় নির্বাহী আইন-বিধান প্রণয়ন করতে পারেন, তবে তা আল কুরআনের মাধ্যমে প্রদত্ত সীমা সংরক্ষণ করবে এবং আল কুরআনে থাকা কোনো ধারাকে লঙ্ঘন করবে না। অন্য কথায় যে বিষয়ে আল কুরআনে কোনো কিছু নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে সেই বিষয়ে রসূল ও উলিল আমর অন্যরূপ বিধান দিতে পারেন না। তাঁরা শুধুমাত্র যেসব বিষয়ে আল কুরআনে কোনো বিধান নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি, সেইসব বিষয়ে সমকালীন পরিস্থিতি অনুসারে প্রয়োজনীয় আইন-বিধান প্রণয়ন করতে পারেন।
যেসব বিধান স্থায়ী গুরুত্বসম্পন্ন বা অপরিবর্তনীয় ধরনের সেইসব বিধান সাংবিধানিক বিধান হওয়ার উপযুক্ত এবং এ ধরনের যাবতীয় বিধান আল কুরআনে সন্নিবেশিত রয়েছে। একমাত্র যেসব বিধান পরিস্থিতি সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল পর্যায়ের সেই ধরনের ক্ষেত্রে নির্বাহী আইন-বিধানের অবকাশ রয়েছে এবং নির্বাহী আইন-বিধান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবর্তনশীল। যে ধরনের ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে সেজন্য স্থায়ীভাবে ভিন্ন ভিন্ন আইন-বিধান প্রণয়ন করা যেতে পারে, সেগুলোও সাংবিধানিক বিধানের আওতাভুক্ত। অন্যদিকে যে ধরনের পরিস্থিতিগত ভিন্নতা এরূপ স্থায়ী গুরুত্বের উপযোগী নয়, বরং প্রত্যেক পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে উপস্থিত মুহুর্তে পর্যালোচনা করে পরবর্তী ক্রান্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য কোনো আইন-বিধান প্রণয়ন করা যথোপযুক্ত হবে, সেরূপ ক্ষেত্রে নির্বাহী আইন-বিধানের অবকাশ রয়েছে।
যেক্ষেত্রে সাংবিধানিক ধারার মাধ্যমে কোনো ছাড় বা অবকাশ বা স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে সেই ক্ষেত্রে নির্বাহী আইন-বিধানের মাধ্যমে তা হরণ করা যাবে না এবং সাংবিধানিক ধারার মাধ্যমে যা এক ব্যক্তি কর্তৃক অন্য ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদানের অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়, নির্বাহী আইন-বিধানে তা শাস্তিযোগ্য হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে না। শুধুমাত্র যা শাস্তিযোগ্য অথচ সেজন্য সাংবিধানিক ধারায় কোনো নির্দিষ্ট শাস্তি নেই, সেরূপ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সাপেক্ষে কোনো শাস্তি প্রদান করা যেতে পারে। এক কথায়, না সরকারের স্বাধীনতা নাগরিকের সংবিধান প্রদত্ত স্বাধীনতাকে বাতিল করবে আর না নাগরিকের স্বাধীনতা সরকারের সংবিধান প্রদত্ত স্বাধীনতাকে বাতিল করবে। উভয়ের স্বাধীনতার সীমা রয়েছে, যার বাইরে তার স্বাধীনতার দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।
উপরোল্লেখিত শর্তসমূহ সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য জানার জন্য নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:
২:১৮৫ :: রমাদানের মাস, যাতে আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, মানবজাতির জন্য পথনির্দেশ এবং পথনির্দেশ সম্পর্কিত স্পষ্ট প্রমাণ এবং (সত্য-মিথ্যার) পার্থক্যকারী হিসেবে। সুতরাং তোমাদের মধ্য থেকে যে মাসটিকে প্রত্যক্ষ করবে / মাসটির সাক্ষ্য দেবে সে তাতে সিয়াম পালন করবে। আর যে অসুস্থ থাকবে বা সফরে থাকবে, সেক্ষেত্রে গণনা (সমন্বয় করতে হবে) অন্য দিনসমূহ থেকে। আল্লাহ তোমাদের প্রতি সহজ করতে চান এবং তিনি তোমাদের প্রতি কঠিন করতে চান না। আর যেন তোমরা গণনা পূর্ণ করতে পারো এবং যেন তোমরা আল্লাহর বড়ত্ব-মহিমা ঘোষণা করতে পার তাঁর দেখানো পথনির্দেশের উপর (নির্ভরতার ভিত্তিতে) এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারো।
৪:৮২ :: তবে কি তারা আল কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না? যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হতো তাহলে তারা এতে অনেক স্ববিরোধ বৈপরীত্য পেতো।
৬৯:৪৪-৪৮ :: আর যদি সে আমাদের নামে কিছু বানিয়ে বলতো, তাহলে আমরা তার ডান হাত ধরে ফেলতাম, তারপর তার মহাধমনী কেটে দিতাম, সুতরাং তোমাদের মধ্য থেকে কেউই তা থেকে নিবারণকারী হতে পারতো না। আর নিশ্চয় তা (আল কুরআন) স্রষ্টা-সচতেনদের জন্য স্মরণিকা (স্মরণীয় তথ্য, উপদেশ ও বিধি-বিধান সংবলিত গ্রন্থ)।
৫:১০১ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা এমন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করো না যা এমন যে, যদি তা (সেই বিষয়ে নির্দিষ্ট বিধান) প্রকাশ করা হয় তাহলে তা তোমাদের জন্য বিড়ম্বনাকর হবে। আর যদি কুরআন নাযিলকালে তোমরা সেজন্য জিজ্ঞাসা করো, তাহলে তা তোমাদের জন্য প্রকাশ করা হবে। আল্লাহ সেগুলোতে ছাড় দিয়েছেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল সহনশীল।
১৬:৮৯ :: আর সেদিন আমরা প্রত্যেক উম্মাতের মধ্যে তাদের উপর তাদের মধ্য থেকে সাক্ষী উত্থিত করবো, আর তোমাকে এদের উপর সাক্ষী হিসেবে আনবো। আর আমরা তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি যা (এর বিষয়বস্তু হিসেবে প্রয়োজনীয়) সবকিছুর (সকল তথ্য ও বিধি-বিধানের) স্পষ্ট ও বিশদ বিবরণ এবং মুসলিমদের জন্য পথনির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরূপ।
১৮:২৬ :: বলো, “আল্লাহ ভালো জানেন তারা (আসহাবে কাহাফ) কতকাল অবস্থান করেছিলো। তাঁরই আয়ত্তে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়াবলী। তিনিই উত্তম দ্রষ্টা ও উত্তম শ্রোতা। তাদের জন্য তিনি ছাড়া কোনো অভিভাবক (ওয়ালী) নেই আর তিনি তাঁর হুকুমের ক্ষেত্রে কাউকে অংশীদার করেন না।
১৮:২৭ :: আর তুমি তিলাওয়াত করো সেই কিতাব থেকে যা তোমার প্রভু তোমার প্রতি ওহী করেছেন। তাঁর বাণীর কোনো পরিবর্তনকারী নেই। আর তাঁকে ছাড়া তুমি কোনো আশ্রয় পাবে না।
১৮:২৮ :: আর তোমার নিজেকে ধৈর্যশীল রাখো তাদের সাথে যারা তাদের প্রভুকে সকালে ও সন্ধ্যায় ডাকে তাঁর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায়। আর পার্থিব জীবনের শোভা ও চাকচিক্য কামনায় তুমি তাদের থেকে তোমার চোখ দুটো যেন তাদেরকে এড়িয়ে না যায়। আর তার আনুগত্য করো না যাকে আমরা আমাদের স্মরণ/স্মারক (কুরআন) থেকে উদাসীন করে দিয়েছি এবং সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং তার কার্যকলাপ সীমালঙ্ঘনমূলক।
৬:১১৪-১১৫ :: তবে কি আমি আল্লাহ ছাড়া কাউকে হুকুমদাতা মানবো? আর তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদের প্রতি স্বব্যাখ্যাত কিতাব (আল কুরআন) নাযিল করেছেন। আর যাদেরকে (ইতোপূর্বে) কিতাব দেয়া হয়েছিলো তারা জানে যে, নিশ্চয় তা তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। সুতরাং তুমি সন্দেহকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। আর তোমার প্রভুর বাণী সত্য (তথ্য ও বিধি-বিধান) এবং ন্যায়বিচারের দিক থেকে সম্পূর্ণ হয়েছে। তাঁর বাণীর কোনো পরিবর্তনকারী নেই। আর তিনি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।
৭:৫৪ :: নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন ছয় দিবসে, তারপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন আরশে। তিনি রাত দিয়ে দিনকে ঢেকে দেন এবং তা (রাত) সেটাকে (দিনকে) দ্রুত অনুসরণ করে। সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রসমূহ তাঁরই নির্দেশক্রমে নিয়োজিত রয়েছে। প্রশ্নাতীতভাবে, সৃষ্টিও তাঁর, আদেশও তাঁর। বড়ই সমৃদ্ধিময় আল্লাহ রব্বুল আলামীন।
৩:১২৮ :: তোমার জন্য কোনো (স্বাধীন) সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবকাশ নেই। হয়তো আল্লাহ তাদের তাওবাহ কবুল করবেন অথবা তিনি তাদেরকে শাস্তি দিবেন, কারণ তারা যালিম।
৪৫:১৮ :: তারপর আমরা তোমাকে কার্যনির্বাহে একটি শারীয়াতের (সাংবিধানিক আইন-বিধানের) উপর নির্ধারিত করেছি, সুতরাং তুমি তা অনুসরণ করো এবং যারা জ্ঞান রাখে না তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না।
৬৫:৫ :: উহা (তালাকের বিধান) আল্লাহর আদেশ, তিনি তা তোমাদের প্রতি নাযিল করেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি সচেতন হয় তিনি তার থেকে তার মন্দসমূহকে মোচন করে দেন আর তার প্রতিফলকে মানসম্মত করবেন।
৪২:২১ :: নাকি তাদের এমন শরিকগণ রয়েছে যারা তাদের জন্য এমন দ্বীনের শরীয়াত প্রদান করে আল্লাহ যার অনুমতি দেন নি। আর যদি ফায়সালা সম্পর্কিত (পূর্ব ঘোষণার) বাণী না থাকলে, তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েই যেতো। আর যালিমদের জন্য কষ্টদায়ক শাস্তি রয়েছে।
৯:৩১ :: তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ধর্মীয় পণ্ডিতদেরকে ও সন্ন্যাসীদেরকে তাদের বিধাতা বানিয়ে নিয়েছে এবং মারাইয়াম পুত্র মাসীহকেও। অথচ তাদেরকে এক ইলাহের ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করতে আদেশ দেয়া হয়নি। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তারা যে শিরক (অংশীদার স্থাপন) করে তা থেকে তিনি পবিত্র।
৩:৬৪ :: বলো, হে আহলে কিতাব আসো সেই কথার দিকে যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করবো না এবং তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করবো না এবং আমাদের একে অন্যকে বিধানদাতা (রব) হিসেবে গ্রহণ করবো না। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে বলো, তোমরা সাক্ষী থাকো যে, আমরা (আল্লাহর উদ্দেশ্যে) আত্মসমর্পিত।
৩:৭৯-৮০ :: কোনো মানুষের পক্ষে সঙ্গত নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমাত ও নবুওয়াত দান করার পর সে মানুষকে বলবে, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদাতকারী হওয়ার পরিবর্তে আমার ইবাদাতকারী (দাসত্ব ও উপাসনাকারী) হয়ে যাও। কিন্তু (তার কথা তো হবে), “তোমরা রব্বানী (রবের বিধান দ্বারা কর্মসম্পাদনকারী) হয়ে যাও, কিতাব শিক্ষাদানের এবং সেটার অধ্যয়নের মাধ্যমে।” আর সে ফেরেশতাগণকে ও নবীগণকে বিধাতা হিসেবে মেনে নিতে তোমাদেরকে নির্দেশ দিবে না। এটা কি সম্ভব যে, তোমরা তো হবে মুসলিম (আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী) অথচ তারপরও সে-ই তোমাদেরকে কুফর করার নির্দেশ দিবে?
৪:৬৪ :: আর আমি যে কোনো রাসূল প্রেরণ করেছি তা কেবল এ জন্য, যেন আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদের আনুগত্য করা হয়। আর যদি তারা- যখন নিজদের প্রতি যুলম করেছিল তখন তোমার কাছে আসতো অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইত এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইতো তাহলে অবশ্যই তারা আল্লাহকে তাওবা কবূলকারী, দয়ালু পেতো।
৬০:১২ :: হে নবী, যখন তোমার কাছে মু’মিন নারীরা এসে বাইয়াত (শপথ) করে এ মর্মে যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক (অংশীদার সাব্যস্ত) করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তাদের সন্তানকে হত্যা করবে না, এবং মিথ্যা দাবি (বুহতান) নিয়ে আসবে না যা তারা রচনা/সংঘটিত করে তাদের হাতসমূহ ও পাসমূহের মধ্যবর্তীতে (অর্থাৎ স্বামীর সন্তান হিসেবে অন্যের সন্তানকে নিয়ে আসবে না), ন্যায়সঙ্গত ক্ষেত্রে তোমাকে অমান্য করবে না, তখন তাদের বাইয়াত গ্রহণ করো এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
২৮:৮৫ :: নিশ্চয় তিনিই যিনি তোমার উপর ক্বুরআনকে ফরজ (আবশ্যকীয়) করেছেন, তোমাকে প্রত্যাবর্তনস্থলে ফিরিয়ে দিবেন। বলো, “আমার প্রভুই ভালো জানেন, কে হিদায়াত নিয়ে এসেছে আর কে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।”
৫:৪৮ :: আর আমি তোমার উপর সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি, তার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবসমূহের সমর্থক (Confirmer) ও পর্যবেক্ষক-নিয়ন্ত্রক (Watcher) রূপে। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরীআত (মৌলিক বিধি) ও মিনহাজ (উন্মুক্ত পন্থা) এবং আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে (জবরদস্তিমূলকভাবে) তোমাদেরকে এক উম্মত বানাতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। সুতরাং তোমরা উত্তম-কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহরই দিকে তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন, যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে।
৫:৮৭ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা পবিত্র জিনিসগুলোকে তোমাদের জন্য হারাম করো না, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য হালাল করেছেন। আর তোমরা সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না।
৬৬:১ :: হে নবী, কেন তুমি তা হারাম করো যা আল্লাহ তোমার জন্য হালাল করেছেন? তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি অন্বেষণে? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।
১৭:৭৩-৭৫ :: আর তারা উপক্রম হয়েছিলো তোমাকে ফেতনায় ফেলতে তা থেকে যা আমি তোমার প্রতি ওহি করেছি, যেন তুমি আমাদের নামে তা ছাড়া কিছু রচনা করো। আর সেরূপ হলে তখন তারা তোমাকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতো। আর যদি আমি তোমাকে অবিচলিত না রাখতাম তাহলে তুমি তাদের দিকে অল্প কিছুটা প্রায় ঝুঁকে যাচ্ছিলে। সেক্ষেত্রে আমি তোমাকে জীবদ্দশায় দ্বিগুণ এবং মৃত্যু পরবর্তকালে দ্বিগুণ শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাতাম। তারপর তুমি আমাদের বিরুদ্ধে কোনো সাহায্যকারী পেতে না।
১০:১৫ :: আর যখন তাদেরকে আমাদের সুস্পষ্ট বিশদ বিবরণের আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে শুনানো হয়, তখন যারা আমাদের কাছে (জবাবদিহিতার জন্য) সাক্ষাতের আশা রাখে না, তারা বলে, “এটা (এই কুরআন) ছাড়া অন্য কুরআন আনো অথবা তাতে (কুরআনে) বদলে দাও। বলো, আমার পক্ষে সম্ভব নয় যে, আমি নিজ থেকে তা বদলাতে পারি। আমার কাছে যা ওহী করা হয় আমি তা ছাড়া কিছু অনুসরণ করি না। নিশ্চয় আমি ভয় করি, যদি আমি আমার প্রভুর অবাধ্য হই, মহাদিবসের শাস্তির (ভয়)।
৬:১৯ :: বলো, “সাক্ষ্যদানে সর্বশ্রেষ্ঠ কে? বলো, আল্লাহ সাক্ষী আমার ও তোমাদের মধ্যে। আর আমার কাছে এই কুরআন ওহী করা হয়েছে যেন আমি তা দ্বারা সতর্ক করি তোমাদেরকে এবং তাদেরকেও যাদের কাছে তা পৌঁছে যায়। তোমরা কি সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহ (সার্বভৌম সত্তা ও উপাস্য) আছে? বলো, আমি সেই সাক্ষ্য দিই না। বলো, তিনিই একক ইলাহ। আর নিশ্চয় তোমরা যে শিরক করো আমি তা থেকে মুক্ত।”
৩:১৫৯ :: আল্লাহর অনুগ্রহে তুমি তাদের প্রতি কোমলচিত্ত হয়েছো। যদি তুমি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে তাহলে তারা তোমার চারপাশ থেকে সরে যেতো। সুতরাং তুমি তাদের প্রতি উদারতাপূর্ণ আচরণ করো এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং নির্বাহী কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের সাথে পরামর্শ করো। তারপর যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো তখন (তার বাস্তবায়নে) আল্লাহর উপর ভরসা করো। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর উপর ভরসাকারীদেরকে ভালবাসেন।
৪২:৩৮ :: (উত্তম প্রতিফল তাদের জন্য) যারা তাদের প্রতিপালকের আহবানে সাড়া দেয় এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নির্বাহী কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তাদেরকে যা জীবিকা দিয়েছি তা থেকে (যথানিয়মে ও যথোচিত খাতে) ব্যয় করে।
উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে:
মানবজাতির হিদায়াতের জন্য এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী হিসেবে আল কুরআন নাযিল করা হয়েছে। কুরআন স্ববিরোধমুক্ত এবং কুরআনের বিপরীত কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে হতে পারে না। সুতরাং যে বিষয় আল কুরআনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তা সত্য এবং যা আল কুরআনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ তা মিথ্যা। অন্যদিকে আল কুরআনের বিষয়বস্তুর বাইরের সাধারণ বাস্তবতার বিষয়গুলো হলো মানুষের অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সাথে সম্পর্কিত, তা চিরন্তন মৌলিক পথনির্দেশের ধারা-উপধারা হিসেবে সন্নিবেশিত নয়, বরং সেক্ষেত্রে বাস্তবতার বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। সর্বোপরি আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবে না থাকা কোনো বিষয় ধর্মীয় বিধান ও তার দলীল হতে পারে না।
রাসুল মানুষের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে উপদেশবাণী অনুসরণের জন্য উপস্থাপন করেছেন তা হলো আল কুরআন। তিনি আল্লাহর নামে কিছু বানিয়ে বলেননি এবং আল্লাহর রসূল হওয়ার কারণে তা তাঁর পক্ষে সম্ভবও ছিলো না। বরং তিনি যদি এমনটি করতেন তাহলে আল্লাহ কঠিনভাবে তাঁর অপমৃত্যু ঘটাতেন।
যে বিষয়গুলোতে আল কুরআনে ছাড় দেয়া হয়েছে তাতে ছাড় দেয়াই আমাদের জন্য কল্যাণকর ছিলো। তাই কুরআন নাযিলকালে এমন প্রশ্ন করতে নিষেধ করা হয়েছে যা নির্দিষ্ট করে দিলে তা আমাদের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হতো।
আল্লাহ তাঁর হুকুমে কাউকে শরিক করেন না। তিনি তাঁর বিধি-বিধান কুরআনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। তাই তিনি রসূলকে তাঁর নাযিলকৃত কিতাব কুরআনে যা ওহী করা হয়েছে তা তিলাওয়াত বা পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর বাণীর কোনো পরিবর্তনকারী নেই। সুতরাং রসূলও আল্লাহর বাণীর পরিবর্তন করে অন্যরূপ কিছু বলার অধিকার রাখেন না। রসূলকে আরো নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত স্মারকগ্রন্থ কুরআন থেকে উদাসীন তাদের আনুগত্য করা যাবে না।
রাসূলকে বলার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তিনি যেন অন্যদেরকে প্রশ্ন করেন যে, তিনি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে হুকুমদাতা মানতে পারেন? আল্লাহ তাঁর হুকুমসমৃদ্ধ কিতাবকে স্বব্যাখ্যাত কিতাব আকারে নাযিল করেছেন, যা পরিপূর্ণ। মানবজাতির প্রতি আল্লাহর নাযিলকৃত বাণী সত্য তথ্য ও বিধি-বিধান এবং ন্যায়বিচারের দিক থেকে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। সৃষ্টিও আল্লাহর এবং আদেশও আল্লাহর। রসূল নিজেও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন বা আদেশ দেয়ার অধিকার রাখেন না। বরং আল্লাহ তাঁকে একটি শরীয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি নিজে শরীয়ত প্রণেতা নন। যারা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের বাইরে কারো থেকে শরীয়তের বিধান গ্রহণ করে তারা আল্লাহর সাথে শিরক করে, যার কোনো অনুমোদন ও বৈধতা নেই। আল্লাহ তাঁর আদেশসমূহ কিতাবের মাধ্যমে নাযিল করেছেন।
আল্লাহর নবী রসূলগণ কাউকে নিজেদের দাসত্বের দিকে আহবান করেন না, বরং তাঁরা মানুষকে তাদের রবের (প্রতিপালক, প্রভু, বিধাতা) বিধান অনুসারে তাঁর দাসত্ব করার জন্যই আহবান করেন। নি:শর্ত নিরংকুশ আনুগত্যই দাসত্ব। যারা আহবার ও রুহবান তথা ধর্মীয় পণ্ডিত ও সন্ন্যাসীদের নি:শর্ত আনুগত্য করে তারা তাদেরকেই রব বা বিধাতা বানিয়েছে। ধর্মগুরুদের কথাকে কিতাব দ্বারা যাচাই ছাড়া বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়ার মানে তাদেরকে ‘রব’ বা বিধানদাতা বানানো তথা শিরক। অনুরূপভাবে কেউ যদি কোনো নবীর নামে প্রচারিত কোনো কথা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়া সত্ত্বেও নবী বলেছেন মনে করেও অনুসরণ করে তাহলে সে নবীকে রব বা বিধাতা বানালো। যদিও বাস্তবে কোনো নবী এরূপ কোনো কথা বলেননি।
আল্লাহ নবী-রসূল পাঠিয়েছেন তাঁর অনুমতিক্রমে তথা তাঁরই বিধান অনুসারে নবী-রসূলদের আনুগত্য করার জন্য। বাস্তবে নবী-রসূলগণ আল্লাহর অনুমতির বাহিরে বা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো আদেশ-নিষেধ করেন না। যেহেতু রসূলের আনুগত্য আল্লাহর অনুমতিক্রমে, সুতরাং তিনি আল্লাহর বিধানে যেক্ষেত্রে অবকাশ রাখা হয়নি সেরূপ কোনো বিধান দিতে পারেন না এবং দেননি।
রাসূলের কাছে করা শপথবাক্যের একটি হলো, “ন্যায়সঙ্গত ক্ষেত্রে তাঁকে অমান্য করা হবে না বা তাঁর আনুগত্য বজায় রাখা হবে”। এর মানে এ নয় যে, রসূল অন্যায় নির্দেশ দেয়ার সম্ভাবনা ছিল, বরং এটা আনুগত্যের মূলনীতি স্পষ্ট থাকার জন্য যে, রসূলও অন্যায় আদেশ দেয়ার অধিকার রাখেন না; যদি দিতেন তবে তা তাঁর রাসূল পদের সাথে সঙ্গতিশীল হতো না এবং মু’মিনরাও তা মান্য করতে হতো না। সুতরাং রসূল অন্যায় নির্দেশ দেননি, যদি রসূলের নামে কোনো অন্যায় নির্দেশ প্রচার করা হয়, সেটা তাঁর নামে মিথ্যা প্রচার, সে নির্দেশ মানতে হবে না, এমনকি যদি রসূলও এরূপ নির্দেশ দিতেন তবুও তা মানতে হতো না। ন্যায়-অন্যায়ের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো- ন্যায়-অন্যায়বোধের ভিত্তিতে রসূলের আনুগত্য, রসূলের আনুগত্যের নামে ন্যায়ের লংঘন নয়। সুতরাং যে নির্দেশের মাধ্যমে ন্যায় লংঘিত হয়, রসূল সেরূপ বিধান দেননি। যদি দেখা যায় কোনো বিধানে ন্যায় লংঘিত হয়, তা মানা যাবে না, এমনকি রসূল দিলেও তা মানা যেতো না, তবে প্রকৃত কথা হলো, রসূল সেরূপ বিধান দেননি, তাই রসূল সেরূপ কোনো বিধান দিয়েছেন বললে বস্তুত তা রসূলের নামে অন্যদের বানানো। অনুরূপভাবে রসূলের পরবর্তীতে কোনো উলিল আমর যদি ন্যায়ের পরিপন্থী নির্দেশ দেন, তবে তিনি উলিল আমর হিসেবে আনুগত্য পাওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলবেন।
রসূলের উপর কুরআনকে ফরজ করা হয়েছে এবং তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আল কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে আদেশ প্রদান ও বিচার-ফায়সালা করতে। সুতরাং কুরআনের কোনো সীমা লঙ্ঘন করে রাসূল কোনো বিধান দিতে পারেন না এবং দেননি। যদি রাসূলের নামে এমন কোনো বিধান প্রচার করা হয় যা আল কুরআনের পরিপন্থী, তাহলে তা রাসূলের নামে বানানো কথা বলে সাব্যস্ত হবে।
আল্লাহ ছাড়া কেউ হালাল-হারাম করার অধিকার রাখে না। এমনকি রসূলও আল্লাহর হালাল করা বিষয়কে হারাম করতে পারেন না।
রাসূলকে তৎকালীন মুনাফিক্বরা কিছু ক্ষেত্রে কুরআনের বিধি-বিধানকে বদলে দেয়ার জন্য বা অন্যরূপ একটি কুরআন আনার জন্য তথা তাদের মনমতো বিধান প্রণয়নের জন্য বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে রসূলকে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজে থেকে কোনো মৌলিক বিধান রচনা করা থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। যদি রসূল এরূপ কিছু করতেন তাহলে তাঁকে দুনিয়া ও আখিরাতে দ্বিগুণ শাস্তি পেতে হতো বলে জানানো হয়েছে। যেহেতু কুরআন আল্লাহ সংরক্ষণ করেছেন তাই কুরআনকে বিকৃত করা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি ঠিকই, কিন্তু রসূলের পরবর্তীতে তাঁর নামে কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক অনেক কথা চালিয়ে দেয়া হয়েছে, যা তিনি বলতে পারেন না এবং বলেননি।
রসূল শুধুমাত্র কুরআন দ্বারা তাঁর সমকালীনদেরকে সতর্ক করেছেন এবং এখনো যাদের কাছে কুরআন পৌঁছে যাবে তিনি তাদেরকে এর দ্বারা সতর্ক করছেন বলে সাব্যস্ত হবে। সুতরাং আমাদের জন্য রসূলের পক্ষ থেকে কুরআন ছাড়া কোনো শাশ্বত বা চিরন্তন স্মরণীয় তথ্য ও আদেশ-নিষেধ নেই। যেসব বিষয়ে কুরআনে কোনো বিষয় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি সেসব বিষয়ে রসূল পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আদেশপ্রাপ্ত ছিলেন এবং মু’মিনদেরও অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য সেটাই হতে হবে। যেহেতু এ ধরনের বিষয়গুলো সমকালীন পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল, তাই পরিস্থিতির পরিবর্তনে এ ধরনের বিষয়ে সিদ্ধান্তও পরিবর্তন হতে পারে। অন্যকথায় একটি পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও বিধান পরবর্তী পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও বিধান দ্বারা পরিবর্তিত হতে পারে। এ ধরনের বিষয়গুলোকেই নির্বাহী সিদ্ধান্ত ও বিধান বলা হয়। নির্বাহী বিধানকে সরাসরি স্থায়ী বিধানের মর্যাদা দেয়া যেতে পারে না এবং তা কুরআনে থাকা চিরন্তন বিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হতে পারবে না। কারণ সেক্ষেত্রে তা কুরআনের মতো মূল বিধানে পরিণত হয়ে যাবে এবং এর মাধ্যমে শিরক বা অংশীদারিত্ব হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, আল কুরআন অনুযায়ী একমাত্র আল কুরআনে থাকা বিধি-বিধানই চিরন্তন সাংবিধানিক বিধান হিসেবে কার্যকর করতে হবে এবং কুরআনের সাথে সঙ্গতি রেখে পরিস্থিতি সাপেক্ষে ও পরামর্শক্রমে বিভিন্ন নির্বাহী বিধান প্রণীত ও বাস্তবায়িত হতে পারে। কিন্তু কোনো নির্বাহী বিধানের মাধ্যমে কুরআনের কোনো ধারাকে লঙ্ঘন করা যেতে পারে না। কুরআনের বাহিরে রসূল সমকালীন পরিস্থিতিতে নির্বাহী সিদ্ধান্তক্রমে যেসব আদেশ-নিষেধ করেছেন তাতে এমন কোনো বিধান থাকা সম্ভব নয়, যা কুরআনের কোনো ধারাকে লঙ্ঘন করে বা কুরআনের কোনো ধারার সাথে সাংঘর্ষিক হয়। আর নির্বাহী বিধান যেহেতু পরিস্থিতিসাপেক্ষে পরিবর্তনশীল প্রকৃতির হয়ে থাকে, তাই রসূল যদি বর্তমানে জীবিত থাকতেন তাহলে বর্তমান পরিস্থিতি অনুসারে নির্বাহী বিধান প্রণয়ন করতেন, বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া সরাসরি পূর্বের নির্বাহী বিধানকে কার্যকর করতেন না। তাই বর্তমানে মু’মিনরা রসূলের অনুসরণের প্রকৃত উপায় হলো: কুরআনের বিধি-বিধানকেই সাংবিধানিক বিধান হিসেবে কার্যকর করা এবং নির্বাহী কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতি অনুসারে পরামর্শের ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন ও অপসারণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা।
চূড়ান্ত কথা হলো: যেহেতু কুরআন অনুযায়ী মুরতাদ হত্যার বৈধতা নেই, তাই রসূলের নামে বানানো হাদীসের নির্দেশ অনুসরণের নামে মুরতাদ হত্যার কোনো অবকাশ নেই।
কেউ ইসলাম ত্যাগ করলে বা মুরতাদ হলে এর শাস্তিস্বরূপ তাকে হত্যা করতে হবে বলে দাবি করার জন্য কিছু হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। নিম্নে এরূপ দুটি হাদীস পর্যালোচনাসহ উল্লেখ করা হলো:
১. ইকরিমাহ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, ‘আলী (রাঃ)-এর কাছে একদল যিন্দীককে (নাস্তিক ও ধর্মত্যাগীকে) আনা হল। তিনি তাদেরকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলেন। এ ঘটনা ইব্নু আব্বাস (রাঃ)-এর কাছে পৌঁছলে তিনি বললেন, আমি কিন্তু তাদেরকে পুড়িয়ে ফেলতাম না। কেননা, রসূলুল্লাহ্ (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিষেধাজ্ঞা আছে যে, তোমরা আল্লাহ্র শাস্তি দ্বারা শাস্তি দিও না। বরং আমি তাদেরকে হত্যা করতাম। কারণ, রসূলুল্লাহ্ (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশ আছে, যে কেউ তার দ্বীন বদলে ফেলে তাকে তোমরা হত্যা কর।
(আধুনিক প্রকাশনী- ৬৪৪২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৪৫৪), সূত্র: http://ihadis.com/books/bukhari/hadis/6922
পর্যালোচনা: মান বাদ্দালা দ্বীনাহু ফাক্বতুলূহু (যে তার দ্বীনকে ত্যাগ করে তাকে হত্যা করো) - বুখারী ৬৯২২।
এখানে ‘আদ দ্বীন’ বলা হয় নি বা ‘আল ইসলাম’ বলা হয়নি। বলা হয়েছে, ‘দ্বীনাহু’ বা ‘তার দ্বীন’। আর ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়া লিয়া দ্বীন’ আয়াত অনুসারে যে ব্যক্তি যে দ্বীন অবলম্বন করে সেটাই হলো ‘দ্বীনাহু’ বা তার দ্বীন। সুতরাং এ হাদীস অনুসারে কেউ অন্য ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম হলে সেও হত্যাযোগ্য আসামী হয়ে পড়ে।
আর যদি এতে শুধুমাত্র কোনো মুসলিম ইসলাম ত্যাগ করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বুঝানো হয়, তবুও প্রশ্ন হলো, স্বধর্ম ত্যাগের কারণে যদি আমরা কোনো মুসলিমকে হত্যা করার অধিকার রাখি, তবে একইভাবে এর মাধ্যমে আমরা অন্যদের এ অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য যে, তারাও তাদের ধর্ম ত্যাগ করে কেউ মুসলিম হলে তাকে হত্যা করতে পারবে। এছাড়া আমরা তাদের অধিকার স্বীকার করি বা না করি উভয় অবস্থায়, আমরা যদি কাউকে ইসলাম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণের জন্য হত্যা করতে পারি, তবে অন্য ধর্মাবলম্বীরা কেন তাদের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে হত্যা করতে পারবে না? কিংবা তারা কেন এ সুযোগ দিবে? আমাদের মতো একই নীতিতে কি তারাও ইসলাম গ্রহণকারীকে হত্যা করতে পারে না? সে অবস্থায় ইসলামের দাওয়াত ও তা গ্রহণের ক্ষেত্রে কি আমরা নিজেরাই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলো না? কুরআন থেকে স্পষ্ট যে, ধর্ম ত্যাগের কারণে কাউকে হত্যা করা বৈধ নয়। সেই সাথে যুক্তিবুদ্ধির দিক থেকেও এটা চরম নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয়। এরূপ করা কোনোক্রমে ধর্ম নয়, বরং ধর্মের নামে চরম পর্যায়ের অধর্ম ও অমানবিকতা।
কুরআনে রসূলের সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, কুরআনকে রসূলের উপর ফরজ করা হয়েছে (২৮:৮৫) এবং নিশ্চয় তিনি তাঁর উপর নাযিলকৃত কিতাব কুরআনের ভিত্তিতে সরল পথের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন (৩৬:১-৫)। সুতরাং রসূল কোনোক্রমেই কুরআন লংঘনকারী ছিলেন না। আর তাই কুরআনের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে রসূল মুরতাদ হত্যার আদেশ দিতে পারেন না এবং দেননি। স্বধর্ম ত্যাগের কারণে হত্যার আদেশ সম্বলিত হাদীসটি যে রসূলের নামে বানানো মিথ্যা কথা, হাদীসটির বক্তব্য থেকেই তা বুঝা যায়। কারণ এরূপ হাদীস স্বধর্ম ত্যাগকে বাধাগ্রস্ত করে এবং একই সাথে স্বয়ং ইসলামের প্রচারকেও বাধাগ্রস্ত করে।
যেহেতু হাদীসটি কুরআনের বিধিবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক তাই তা স্বয়ং বাতিল। কারণ কুরআন সত্য এবং কুরআনের সাংঘর্ষিক কথা মাত্রই বাতিল। এমতাবস্থায় এটি রসূলের নামে প্রচারিত সত্য হাদীস হতে পারে না। যেহেতু কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক কথা স্বয়ং বাতিল, যা যে-ই বলুক না কেন, সেহেতু এ হাদীসকে রসূলের হাদীস বলে মেনে নেয়ার এবং এর উপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো অবকাশ নেই। যারা হাদীসের প্রকৃত তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন তারা জানেন যে, বুখারীতে কোনো হাদীস থাকার অর্থই হাদীসটি সত্য হওয়া নয়, বরং এর দ্বারা বুঝায় বুখারী হাদীসটি সংগ্রহ করেছেন এবং হতে পারে তিনি এটাকে সত্য মনে করেছেন। কিন্তু তিনি সত্য মনে করলেও বাস্তবে তা মিথ্যা হওয়া সম্ভব।
২. ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ জনৈক অন্ধ লোকের একটি ‘উম্মু ওয়ালাদ’ ক্রীতদাসী ছিলো। সে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে গালি দিতো এবং তার সম্পর্কে মন্দ কথা বলতো। অন্ধ লোকটি তাকে নিষেধ করা সত্ত্বেও সে বিরত হতো না। সে তাকে ভর্ত্সনা করতো; কিন্তু তাতেও সে বিরত হতো না। একরাতে সে যখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে গালি দিতে শুরু করলো এবং তার সম্পর্কে মন্দ কথা বলতে লাগলো, সে একটি ধারালো ছোরা নিয়ে তার পেটে ঢুকিয়ে তাতে চাপ দিয়ে তাকে হত্যা করলো। তার দু’পায়ের মাঝখানে একটি শিশু পতিত হয়ে রক্তে রঞ্জিত হলো। ভোরবেলা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘটনাটি অবহিত হয়ে লোকজনকে সমবেত করে বললেনঃ আমি আল্লাহর কসম করে বলছিঃ যে ব্যক্তি একাজ করেছে, সে যদি না দাঁড়ায়, তবে তার উপর আমার অধিকার আছে। একথা শুনে অন্ধ লোকটি মানুষের ভিড় ঠেলে কাঁপতে কাঁপতে সামনে অগ্রসর হয়ে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সামনে এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আমি সেই নিহত দাসীর মনিব। সে আপনাকে গালাগালি করতো এবং আপনার সম্পর্কে অপমানজনক কথা বলতো। আমি নিষেধ করতাম কিন্তু সে বিরত হতো না। আমি তাকে ধমক দিতাম; কিন্তু সে তাতেও বিরত হতো না। তার গর্ভজাত মুক্তার মত আমার দুটি ছেলে আছে, আর সে আমার খুব প্রিয়পাত্রী ছিলো। গতরাতে সে আপনাকে গালাগালি শুরু করে এবং আপনার সম্পর্কে অপমানজনক কথা বললে আমি তখন একটি ধারালো ছুরি নিয়ে তার পেটে স্থাপন করে তাতে চাপ দিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলি। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ তোমরা সাক্ষী থাকো, তার রক্ত বৃথা গেলো।
সূত্র : http://www.ihadis.com/books/abi-dawud/hadis/4361
পর্যালোচনা: এ হাদীসকে রসূলের প্রতি অপমানজনক কথাবার্তার বলার অপরাধে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং রসূল ঐ হত্যাকে বৈধ হত্যা হিসেবে সমর্থন করেছেন বলে দলীল দেয়া হয়। রসূলের নামে মন্দ কথা বলা এবং মুরতাদ হওয়াকে সমান অপরাধ এবং উভয়টির জন্য একইরূপ মৃত্যুদণ্ড বলে দাবি করা হয়। “ধর্মীয় বিষয়ে মিথ্যারোপ, কটুক্তি ও অপপ্রচারের মোকাবেলায় রসূল ও মু’মিনদের করণীয়” অধ্যায়ে রসূলের নামে মন্দ কথা বলার জবাবে মু’মিমরা ধৈর্য ধারণ, তাদেরকে উপেক্ষা করা এবং আল্লাহর পবিত্রতা জ্ঞাপনের কুরআনিক নির্দেশনা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে এবং কুরআনে হত্যা বা মৃত্যুদন্ড সম্পর্কিত বিধানের ভিত্তিতে এটা স্পষ্ট যে, রসূলের নামে মন্দ কথা বলার জন্য কাউকে হত্যা করা বৈধ নয়।
উপরোল্লেখিত হাদীসটির বক্তব্য যে, সত্য হতে পারে না, যে কোনো সুস্থমস্থিষ্কের ব্যক্তির কাছে তা ধরা পড়ার কথা। হাদীসটিতে বলা হয়েছে যে, বাঁদীটিকে কথিত অন্ধ সাহাবিটি অত্যন্ত ভালবাসতো এবং তার গর্ভে তার দুটি সন্তান জন্ম নিয়েছিলো। বাঁদীটি রসূলকে গালাগাল করতো, কিন্তু কিজন্য সে রসূলকে গালাগাল করতো, এর কোনো প্রেক্ষাপট বর্ণিত হয়নি। তার সাথে তার বাঁদীর দ্বন্দ্বে সে নিজের অন্যায় অবিচারকে নবীর শিক্ষা হিসেবে প্রচার করলে এবং সেজন্য বাঁদীটি তাকে ও তার নবীকে গালাগাল করলে এতে সে-ই দায়ী হয়, বাঁদীটি নয়। বাঁদীটি তাকে গালাগাল করার কারণে রেগে গিয়ে সে বাঁদীটিকে হত্যা করে নিজেকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্য বাঁদীটি স্বয়ং নবীকেই গালাগাল করেছিলো মর্মে মিথ্যা অভিযোগ করতে পারে। এছাড়া যদি সত্যিই বাঁদীটি নবীকেই গালাগাল করে থাকে, তাহলে সে ঐ বাঁদীকে নবীর সামনে উপস্থিত করতে পারতো, যাতে নবীর বিরুদ্ধে তার ক্ষোভের কারণ কী সে তা জানাতে পারতো এবং নবী নিজের পক্ষ থেকে তাকে বাস্তব যুক্তিসম্মতভাবে জবাব দিতে পারতেন, যা তার ভুল ধারণাকে নিরসন করতো। নবীকে গাল দিলে তাকে হত্যা করতে হবে বলে যে দাবিটি করা হয়, যদিও তা মিথ্যা, তবুও সেটাকে কিছুক্ষণের জন্য সত্য মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকে যায় যে, বাঁদীটি যে রসূলকে গালাগাল করেছে, এ বিষয়ে কোনো সাক্ষীকে উপস্থাপন করা হয়নি তথা হত্যাকারীর অভিযোগ প্রমাণিত নয়। এমতাবস্থায় হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির নামে এ অভিযোগ করেই তার হত্যাকে বৈধ প্রমাণ করতে পারে না এবং দায়মুক্ত হতে পারে না। এরপর সে নিষ্ঠুরভাবে বাঁদীটিকে হত্যা করার সময় তার গর্ভের শিশু তার দুপায়ের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এলো এবং রক্তরঞ্জিত হয়ে গেলো। একজন গর্ভবতী নারীকে এভাবে হত্যা করার মাধ্যমে ঐ গর্ভস্থ সন্তানের প্রতিও চরম অবিচার করা হয়েছে। এটাকে কোনোভাবেই বৈধ বলা যেতে পারে না। রসূল কোনোক্রমেই এরূপ পাশবিকতাকে সমর্থন করে ঐ হত্যাকারীকে দায়মুক্ত ঘোষণা করতে পারেন না।
এ হাদীসে রসূল ও তাঁর সাহাবীদেরকে যেরূপ কঠোর ও অমানবিক হিসেবে দেখানো হয়েছে তার সম্ভবপরতা বুঝার জন্য কুরআনে বর্ণিত ‘মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ও তাঁর সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং মু’মিনদের মধ্যে কোমল’ হওয়ার গুণকে তুলে ধরা হয় (৪৮:২৯)। তাই এ প্রসঙ্গে দুটি বিষয় বিবেচ্য: (১) “কাফিরদের বিরুদ্ধে কঠোর ও মু’মিনদের মধ্যে কোমল” বলতে কোন ধরনের কাফিরদের প্রতি এবং কীরূপ কঠোর হওয়া বুঝায়? (২) রসূল কি সত্যি মুরতাদকে কঠোর ও অমানবিক শাস্তির মাধ্যমে হত্যা করাকে সমর্থন করেছেন?
কুরআনে কাফিরদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া বলতে সেই কাফিরদের বিরুদ্ধে কঠোরতার কথা বুঝানো হয়েছে যারা মু’মিনদের উপর অন্যায়ভাবে আক্রমণ করে। কাফিরদের বিরুদ্ধে কঠোরতাস্বরূপ যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধক্ষেত্রে যখন যুদ্ধ চলমান থাকে তখন তাদেরকে যুদ্ধের অংশ হিসেবে হত্যা করা যেতে পারে কিন্তু যারা অস্ত্র নামিয়ে ফেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতা নয়। সেই সাথে যারা কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত কিন্তু আক্রমণকারী নয় তাদের সাথেও মহানুভব আচরণের নির্দেশই দেয়া হয়েছে। যুদ্ধ ও কঠোরতা সম্পর্কিত নির্দেশগুলো সেই কাফিরদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তারা কুফরিবশত মু’মিনদের প্রতি সহিংস আচরণ করে। (এ প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য: ২:১৯০, ৪:৮৯-৯০, ৮:৬০-৬১, ৪৭:৪, ৬০:৮)।
সাধারণ নীতি হিসেবে ‘কাফিরদের বিরুদ্ধে কঠোর ও মু’মিনদের প্রতি কোমল’ বলতে কোন ধরনের মু’মিন ও কাফিরদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং কারা এ সাধারণ নীতির ব্যতিক্রমের আওতাধীন তা একই বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমেই নির্ণয়যোগ্য। যেহেতু কুরআন অনুযায়ী শুধুমাত্র মুরতাদ হওয়ার কারণে কাউকে শাস্তি দেয়ার অবকাশ নেই, তাই ‘কাফিরদের বিরুদ্ধে কঠোর’ এর নীতি হিসেবে ‘মুরতাদ হত্যা’ করার বৈধতা তৈরি হয় না। বরং ‘কাফিরদের বিরুদ্ধে কঠোর’ হওয়ার অর্থ যদি ‘কাফিরদেরকে হত্যা করা’ বুঝানো হতো, তাহলে শুধু মুরতাদ নয়, সকল কাফিরই হত্যাযোগ্য সাব্যস্ত হতো। কিন্তু বাস্তবে কুরআনে কাফিরদেরকে হত্যা করার অবকাশ দেয়া হয় নি, বরং তাদেরকে স্পষ্টভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা জানিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, “তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন এবং আমার জন্য আমার দ্বীন” (সূরা কাফিরূন)।
এমতাবস্থায় যে হাদীসগুলোকে ‘রসূল কিছু মুরতাদকে কঠোর ও অমানবিকভাবে হত্যা করাকে সমর্থন করেছেন’ মর্মে উপস্থাপন করা হয়, সে হাদীসগুলো যে রসূলের চরিত্র হরণের জন্য মিথ্যা অপপ্রচার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হাদীসগুলো কুরআনের শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক এবং হাদীস বর্ণনার দিক থেকেও সেগুলোর বর্ণনাকারীদেরকে সত্যবাদিতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এমতাবস্থায় হাদীসগ্রন্থে উদ্ধৃত থাকার উপর ভিত্তি করে এগুলোকে ঐতিহাসিক সত্য বলে সাব্যস্ত করার কোনো অবকাশ নেই।
বস্তুত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ যে রিসালাত এর দাবিতে নিজেকে রসূল হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন সেই কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশনা অনুসারে মুরতাদ হত্যা অবৈধ হওয়ায় তিনি কখনো মুরতাদ হত্যা করতে পারেন না এবং করেন নি। যেহেতু কুরআনের আলোকে মুরতাদ হত্যার অবৈধতা প্রমাণিত হয়, তাই সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে তৈরি হাদীসগ্রন্থের হাদীসে ‘মুরতাদ হত্যার নির্দেশ রয়েছে এবং রসূল নিজেও মুরতাদ হত্যাকে সমর্থন করেছেন’ মর্মে যে কথা বানানো হয়েছে সেটাকে কোনোভাবে সত্য বলে গ্রহণ করা যেতে পারে না। কুরআন অনুযায়ী স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, যদি রসূল নিজেও ‘আল্লাহর সাথে শিরক’ তথা কোনো ক্ষেত্রে কুরআনের থেকে ভিন্নরূপ বিধি-বিধান প্রণয়ন বা অনুসরণ করতেন তাহলে তাঁর নিজেরও সকল আমল বরবাদ হয়ে যেতো। তাই চূড়ান্ত কথা হলো, না রসূল এরূপ নির্দেশ দিতে পারেন আর না তিনি নিজে মুরতাদকে হত্যা করতে বা মুরতাদ হত্যাকে সমর্থন করতে পারেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, মুরতাদ হত্যার পক্ষে উপস্থাপিত হাদীসসমূহ রসূলের নামে বানানো কথা। প্রকৃতপক্ষে রসূল মুরতাদ হত্যার নির্দেশ দেননি এবং নিজেও কাউকে মুরতাদ হওয়ার কারণে হত্যা করেন নি এবং এরূপ অবৈধ হত্যাকে সমর্থনও করেন নি। বস্তুত মুরতাদ হত্যা সম্পর্কিত ঘটনাগুলো সম্পূর্ণত বানানো গল্প। এমতাবস্থায় যারা হাদীসের দোহাই দিয়ে মুরতাদ হত্যা করবে তারা নিজেরাই অন্যায় হত্যার কারণে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার আসামী হবে।
আল কুরআন আল্লাহ রব্বুল আলামীন কর্তৃক নাযিলকৃত সর্বশেষ কিতাব, যা পৃথিবীতে উপস্থিত থাকা একমাত্র পরিপূর্ণ নির্ভুল ও চিরসংরক্ষিত গ্রন্থ। এ গ্রন্থে মহান আল্লাহ মানুষকে সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত জীবন পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে তাদের দুনিয়ার জীবনকে সুখী, সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল করা এবং আখিরাতেও জাহান্নাম থেকে মুক্ত থেকে চিরসুখের জান্নাত লাভের জন্য যা তাদের সাধারণ অভিজ্ঞতামূলক পদ্ধতিতে জানা সম্ভব নয় এমন সকল প্রয়োজনীয় মৌলিক তথ্য ও বিধি-বিধান স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কুরআনে উপস্থাপিত দ্বীন বা ধর্ম ও জীবনব্যবস্থাকে গ্রহণ করার জন্য কাউকে বাধ্য করার অবকাশ নেই বলে কুরআনেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা কুরআনের সত্য বুঝার পরও তার প্রতি ঈমান রাখবে না, বরং ঐ সত্যকে প্রত্যাখ্যান করবে তারা দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে তাদেরকে কুরআনের সত্য গ্রহণ করার জন্য বলপ্রয়োগ করা যাবে না। রসূল এবং মু’মিনদেরকে শুধুমাত্র কুরআনের স্পষ্ট প্রচারের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং কাউকে বলপ্রয়োগ করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। কেউ কুরআনকে প্রত্যাখ্যান করলে অথবা একবার গ্রহণ করে পরবর্তীতে প্রত্যাখ্যান করলে এজন্য তাকে শাস্তি দেয়ার অধিকার আল্লাহ কাউকে দেননি। বরং তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছেন যে, কেউ ইচ্ছা করলে কোনো ধর্ম গ্রহণ করতে পারে অথবা নাও গ্রহণ করতে পারে। এমনকি কেউ বারবার ঈমান আনা এবং কুফর করারও সুযোগ রাখা হয়েছে।
অথচ আল কুরআনের বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করে কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু কথিত হাদীসকে মুরতাদ হত্যার পক্ষে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। যারা এরূপ করে তারা নিজেরাই যে আল কুরআনকে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে মুরতাদে পরিণত হয়ে যায় এ বিষয়ে তাদের কোনো চেতনাই নেই। কাদেরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে কুরআনে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ঐ দণ্ডবিধির বাইরে কাউকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলে তা অবৈধ হত্যা হিসেবে সাব্যস্ত হবে এবং এভাবে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করার মতো জঘন্য অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত হবে বলেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যেহেতু কুরআনের দণ্ডবিধিতে মুরতাদকে কোনোরূপ শাস্তি প্রদানের অবকাশ নেই, তাই মুরতাদ হত্যা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ হত্যা। মুরতাদ হত্যার নীতি কুরআনে বর্ণিত ধর্মীয় স্বাধীনতাকে হরণ করে এবং একই সাথে এটি স্বয়ং ইসলামের প্রচারের ক্ষেত্রেও আত্মঘাতি মরণাস্ত্রস্বরূপ।
‘ইসলামে মুরতাদ হত্যার বিধান রয়েছে’ মর্মে যে বিভ্রান্তিকর ধারণা প্রচলিত রয়েছে তা বিশ্বের শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ হুমকি। কুরআন ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা, মানবজাতির কল্যাণের জন্য কল্যাণকর্মে প্রতিযোগিতা এবং সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অপরাধ, অবিচার ও শোষণ প্রতিরোধের নির্দেশ প্রদান করে। কুরআনে মানবজাতির কল্যাণ সাধন এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের জন্য মুসলিম উম্মাহর নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে তাদেরকে ঈমান এবং আমলে সালেহ তথা সৎকর্ম এবং যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনমূক কর্মের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। মুসলিমরা বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থাকতে হবে, শান্তি-শৃঙ্খলাকে বিনষ্ট করা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। কুরআনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো রাষ্ট্রের অমুসলিম কর্তৃত্বের সাথে মুসলিম উম্মাহর কর্তৃপক্ষ যেন ‘শান্তিচুক্তি’ করে সেজন্য নির্দেশনা রয়েছে। চুক্তি ভঙ্গকারী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং যথাযথ দণ্ডবিধি অনুসারে তাদেরকে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
‘মুরতাদকে হত্যা করা আল কুরআনের আলোকে সম্পূর্ণ অবৈধ’- বিষয়টি বিশ্বব্যাপী জঙ্গীবাদ ও ধর্মীয় উগ্রতা প্রতিরোধ এবং বিশ্বশান্তির জন্য এবং একই সাথে ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও বিধি-বিধানের যথাযথ প্রচারের জন্য ব্যাপকভাবে আলোচিত ও পর্যালোচিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ইখতিলাফ اخْتِلَاف : ইখতিলাফ শব্দের অর্থ “মতভেদ, মতানৈক্য, স্ববিরোধ, বৈপরীত্য”। ইখতিলাফ সম্পর্কে কুরআনের কিছু বক্তব্য হলো: কুরআনে ইখতিলাফ (স্ববিরোধ, বৈপরীত্য) নেই। মানবজাতি শুরুতে একত্ববাদী একক উম্মাহ ছিলো, পরবর্তীতে তারা মতভেদ করে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে, তখন আল্লাহ ইখতিলাফের নিরসনের জন্য নবীদের কাছে কিতাব পাঠিয়েছেন, তবে যারা সত্যিকার ঈমান আনে তারাই কিতাবের মাধ্যমে ইখতিলাফ থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত পথনির্দেশ লাভ করে। আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের মাধ্যমে যাবতীয় ইখতিলাফের নিরসন সম্ভব, কিন্তু কিতাবের মাধ্যমে সত্য জ্ঞান পাওয়ার পরও পারস্পরিক জিদবশত ইখতিলাফ বজায় থাকে। প্রকৃত মু’মিনরা ইখতিলাফ থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত সত্যের সন্ধান করবে, কিন্তু ইখতিলাফ নিরসনের জন্য কারো উপর কিছু চাপিয়ে দিবে না। চূড়ান্ত পর্যায়ে ক্বিয়ামাত দিবসে আল্লাহ যাবতীয় ইখতিলাফের নিরসন ঘটাবেন।
ইলহাদ إِلْحَاد : ইলহাদ শব্দের অর্থ “তথ্যগত বিকৃতি ঘটানো, নাম বিকৃত করা, অসত্য দাবি করা”। কুরআনে আল্লাহর নাম এবং তাঁর আয়াতের ক্ষেত্রে এবং আল মাসজিদুল হারামে ইলহাদ করার প্রসঙ্গ এসেছে। এছাড়া “মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে অনারব এক লোক যা শিখায় সেটাই তিনি কুরআন হিসেবে আবৃত্তি করেন” এরূপ অসত্য দাবি প্রসঙ্গেও ইলহাদ শব্দটি এসেছে। প্রচলিত অর্থে ইলহাদ শব্দটি “ধর্মীয় বিষয়ে নিন্দা এবং ধর্মানুভূতিতে আঘাত”ও বুঝিয়ে থাকে। ইলহাদ বা ব্লাসফেমির জন্য মৃত্যুদণ্ডের দাবি করা হয়। কিন্তু কুরআনে ইলহাদ বা ধর্মীয় তথ্যের বিকৃতি এবং ধর্মীয় বিষয়ে নিন্দা বা ধর্মানুভূতিতে আঘাত ইত্যাদির জন্য কোনো শাস্তির নির্দেশনা দেয়া হয়নি। এমতাবস্থায় এজন্য মৃত্যুদণ্ডের দাবি কুরআনসম্মত নয়, বরং এ কারণে মৃত্যুদণ্ড দিলে তা অবৈধ হত্যা হিসেবে সাব্যস্ত হবে। ইলহাদের মোকাবেলায় ধৈর্য সহকারে সঠিক তথ্য তুলে ধরা এবং ইলহাদকারীকে উপেক্ষা করা উচিত। আর সামাজিক ক্ষেত্রে তথ্য বিকৃতিজনিত কারণে কোনো সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি ঘটলে ঐ ক্ষয়ক্ষতি অনুসারে কোনো শাস্তি হতে পারে, সেটি স্বতন্ত্র বিষয়।
ঈমান إِيمَان : ঈমান শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘বিশ্বাস, আস্থা, বিশ্বস্ততা বজায় রাখা’। কুরআনে শব্দটি আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর নবী-রসূলগণ, তাঁর কিতাবসমূহ এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের ক্ষেত্রে তাঁর নাযিলকৃত তথ্য অনুসারে বিশ্বাস রাখার পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ঈমান মানুষের অতীন্দ্রীয় বিষয়সমূহের সাথে সম্পর্কিত বিধায় এটি একটি ধর্মীয় বিষয়। তাই কুরআনে ঈমান আনা না আনার ক্ষেত্রে মানুষকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। সেই সাথে জানানো হয়েছে যে, যারা ঈমানের পরিবর্তে কুফর করবে (অর্থাৎ সত্যকে প্রত্যাখ্যান করবে) তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কুরআনে যে ব্যক্তি ঈমান আনেনি অথবা ঈমান আনার পর আবার তা ত্যাগ করে কুফর করেছে তাকে শাস্তি দেয়ার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি।
কাফির كَافِر : কাফির শব্দের অর্থ “যে ঢেকে রাখে, অস্বীকারকারী, প্রত্যাখ্যানকারী, অকৃতজ্ঞ”। কুরআন অনুযায়ী যারা ঈমানের বিষয়গুলোতে ঈমান আনতে অস্বীকার করে বা আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে প্রত্যাখ্যান করে সে কাফির। কাফিররা দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে মানুষকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে যে, “সে ইচ্ছা করলে মু’মিন হতে বা কাফির হতে পারবে, এজন্য কেউ তাকে বাধ্য করতে পারবে না”। যে কাফিররা মু’মিনদেরকে তাদের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অত্যাচার-নির্যাতন করে এবং মু’মিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের মোকাবেলায় বাড়াবাড়ি না করে ন্যায়সঙ্গত পর্যায়ে কঠোরনীতি অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেই সাথে যারা মু’মিনদের উপর হামলা-নির্যাতন চালায় না, তাদের প্রতি সদাচার করার নির্দেশনা রয়েছে।
ক্বিসাস قِصَاص : ক্বিসাস শব্দের অর্থ “সমান বদলা, অনুরূপ শাস্তি”। কুরআনে হত্যার বদলে ক্বিসাস তথা মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেয়া হয়েছে এবং জানানো হয়েছে যে, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যাকারী ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার মধ্যেই মানবজাতির জন্য ‘জীবন বা আয়ু’ নিহিত রয়েছে। অর্থাৎ একজন অন্যায় হত্যাকারী অন্যের জীবনের অধিকার কেড়ে নেয়ার মাধ্যমে তার নিজের জীবনের অধিকার হারায়, আর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার মাধ্যমে একদিকে যেমন সে আর কাউকে একইভাবে তথা অন্যায়ভাবে হত্যা করার সুযোগ পায় না, তেমনি তার এ পরিণতির কারণে অন্যরাও অন্যায় হত্যা থেকে বিরত থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়। অন্যথায় এরূপ হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। অবশ্য যদি নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীরা হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেয়, তাহলে সে ক্ষমা পেতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে তাকে ন্যায়সঙ্গতভাবে নির্ধারিত “দিয়্যাত বা রক্তপণ” আদায় করতে হবে।
তাহরীফ تَحْرِيف : তাহরীফ শব্দের অর্থ “হরফের হেরফের করা, বক্তব্যের বিকৃতি ঘটানো”। কুরআনে আল্লাহর কিতাবের আয়াতে থাকা বক্তব্যের তাৎপর্যকে বিকৃত করাকে বুঝাতে “তাহরীফ” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। তাহরীফ দুই প্রকার হতে পারে, শব্দগত তাহরীফ বা কোনো শব্দকে বিকৃত করা এবং অর্থগত তাহরীফ বা কোনো শব্দের অর্থকে বিকৃত করা। পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের ক্ষেত্রে অনেকে শব্দগত তাহরীফ করেছিলো এবং আল্লাহ নাযিল করেননি এমন কিছু রচনা করে তা আল্লাহর নামে চালিয়ে দেয়া তথা আল্লাহর কিতাবের মধ্যে সংযোজন ঘটানো হয়েছিলো। আল কুরআনকে আল্লাহ সংরক্ষিত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন বিধায় আল কুরআনের ক্ষেত্রে শব্দগত তাহরীফ ঘটানো সম্ভব নয়, তবে কুরআনের কিছু কিছু শব্দকে কুরআন যে অর্থে ব্যবহার করেছে (যা ঐ শব্দসমূহ ব্যবহারের সম্পূর্ণ তালিকা এবং পূর্বাপর ও অন্য আয়াতের বক্তব্য থেকে জানা যায়), ঐ অর্থ থেকে বিচ্যুত করা এবং কুরআনের বাইরেও অন্য গ্রন্থ রচনা করে সেগুলোকেও এক প্রকার ওহীর সংকলন বলে দাবি করার মাধ্যমে অর্থগত তাহরীফ ঘটানো সম্ভব। অবশ্য যথাযথ অধ্যয়নের (হাক্বক্বা তিলাওয়াহ) মাধ্যমে এরূপ অর্থগত তাহরীফ চিহ্নিত করে প্রকৃত তাৎপর্য নির্ণয় করা সম্ভব।
দ্বীন دِين : দ্বীন শব্দের অর্থ “জীবনব্যবস্থা, ধর্ম, প্রতিফল”। কুরআনের মাধ্যমে যে জীবনব্যবস্থা প্রদান করা হয়েছে তা গ্রহণ করার অর্থ হলো “আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করা”। তাই এই জীবনব্যবস্থাকে “দ্বীন ইসলাম” বলা হয়। কুরআনের দৃষ্টিতে এটিই আল্লাহর নিকট একমাত্র সত্য দ্বীন বা “দ্বীনুল হক্ব”। কিন্তু কাউকে দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করার জন্য অথবা গ্রহণ করলে তা থেকে কখনো বের না হওয়ার জন্য বলপ্রয়োগ করা যাবে না। যে ব্যক্তি যে দ্বীন গ্রহণ করবে সে তা চর্চা করার অধিকার রাখে, যতক্ষণ না সে সেই দ্বীনের চর্চার নামে কোনো সামাজিক অপরাধ করে। যেমন: কেউ যদি এমন ধর্মমত চর্চা করে যাতে ধর্মত্যাগকারীকে হত্যা করার কানুন রয়েছে, তবে তাকে তা চর্চা করতে দেয়া যাবে না। কারণ এই হত্যা ধর্মের নামে সামাজিক অপরাধ। বস্তুত ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা সামাজিক অপরাধ থেকে মুক্ত থাকার শর্তযুক্ত। অন্য কথায়, আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীনে ধর্মীয় ও সামাজিক বিধান এমনভাবে প্রদান করা হয়েছে যাতে সামাজিক বিষয়ের বিধান ধর্মনিরপেক্ষ পর্যায়ে থেকেও গ্রহণযোগ্য এবং সামাজিক অপরাধ না করার শর্তে ধর্মকর্মের স্বাধীনতা বজায় থাকবে।
ফাসাদ فَسَاد : ফাসাদ শব্দের অর্থ হলো “বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, অরাজকতা ইত্যাদি”। আল কুরআনে ফাসাদকে অত্যন্ত মন্দ কর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ফাসাদ প্রতিরোধের জন্য নির্দেশনা ও বিধি-বিধান প্রদান করা হয়েছে। ফাসাদের বিভিন্ন স্তর রয়েছে এবং তাই ফাসাদ মোকাবেলার ক্ষেত্রেও ফাসাদের মাত্রাগত তারতম্য অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ফাসাদ যখন মৃত্যুদন্ডযোগ্য বলে সাব্যস্ত হবে, তখন ফাসাদের জন্য মৃত্যুদন্ড প্রদান করা যাবে। যেসব অপরাধের জন্য সুনির্দিষ্ট দণ্ড প্রদান করা হয়েছে যা মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে লঘুতর, সেরূপ অপরাধকে মৃত্যুদন্ডযোগ্য ফাসাদ বলে চিহ্নিত করা যাবে না। অন্যকথায় মৃত্যুদণ্ডযোগ্য ফাসাদ হিসেবে সাব্যস্ত করতে হলে তা সেই অপরাধগুলোর চেয়ে গুরুতর হতে হবে। যেমন: চুরির জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে না বা চুরিকে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য ফাসাদ বলার সুযোগ নেই। অন্যদিকে এটেম্পট টু মার্ডারের মাধ্যমে ডাকাতি করলে সেজন্য মৃত্যুদন্ড দেয়া যাবে।
বালাগ بَلَاغ : বালাগ শব্দের অর্থ “পৌঁছে দেওয়া, প্রচার”। আল কুরআনে আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাবের তথ্য বালাগ বা প্রচারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাদের কাছে আল্লাহর কিতাবের আয়াত পৌঁছেনি, তাদেরকে কোনো আয়াতের অনুসরণ করা না করার জন্য দায়ী করা হবে না। বরং তারা শুধুমাত্র বিবেকের অনুসরণ করা না করার জন্য দায়ী হবে। অন্যদিকে যাদের কাছে আল্লাহর আয়াত পৌঁছে যাবে, তাদের কর্তব্য হলো আল্লাহর আয়াতকে গ্রহণ করা, অন্যথায় তারা আল্লাহর কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হবে। তবে আল্লাহর আয়াতকে গ্রহণ করার জন্য কাউকে বাধ্য করা যাবে না। বরং রসূল ও তাঁর অনুসারীদের কর্তব্য হলো শুধুমাত্র “বালাগ” বা “পৌঁছে দেয়া, প্রচার করা”।
মুনাফিক্ব مُنَافِق : মুনাফিক্ব শব্দের অর্থ “শঠ, ভণ্ড, যে মুখে ঈমান আনে কিন্তু মনে কুফর করে, যে নিছক ব্যক্তিস্বার্থে দল বদল করে ফেলে”। একজন মুনাফিক্ব মানে হলো একজন গোপন কাফির বা গোপন মুশরিক। অর্থাৎ সে বাহ্যত মু’মিন সেজে থাকে বা নিজেকে মু’মিন বলে দাবি করে কিন্তু বস্তুত সে কাফির বা মুশরিক। যেহেতু প্রকাশ্য কাফির বা প্রকাশ্য মুশরিকের চেয়ে মুনাফিক অধিক ক্ষতিকর, তাই মুনাফিক্বরা জাহান্নামের সবচেয়ে নিম্নস্তরে বা নিকৃষ্ট শাস্তির অবস্থানে থাকবে। কুরআনে মুনাফিক্বদের বিষয়ে সাবধান থাকতে বলা হয়েছে, তবে যে মুনাফিক্বরা মু’মিনদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে তাদের ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেনি বা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেনি তাদেরকে ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে।
মুরতাদ مُرْتَدّ : মুরতাদ শব্দের অর্থ “যে ফিরে গিয়েছে”। শব্দটি যে দ্বীন ইসলাম ত্যাগ করেছে তাকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। “দ্বীন থেকে ফিরে যাওয়া” প্রসঙ্গ কুরআনে এসেছে, তবে যে ফিরে গিয়েছে তাকে চিহ্নিত করার জন্য “মুরতাদ” শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। অন্য কথায়, যে ফিরে গিয়েছে তাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার কোনো প্রয়োজন নেই। কুরআনে দ্বীন ইসলাম থেকে ফিরে যাওয়া এবং আবার ফিরে আসা এবং এমনকি বারবার ঈমান আনা ও কুফর করার সুযোগ রাখা হয়েছে। যদিও যে দ্বীন ইসলাম থেকে ফিরে যায় সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানানো হয়েছে, তবুও এজন্য তাকে অন্য কেউ কোনোরূপ শাস্তি প্রদানের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, কুরআনের বিধানকে লঙ্ঘন করে কিছু কথিত হাদীসের কথা বলে “মুরতাদকে হত্যা করতে হবে” মর্মে প্রচারণার কারণে একদিকে বিশ্বে জঙ্গীবাদ ও ধর্মীয় উগ্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে এর মাধ্যমে ইসলামের বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। কুরআনের আয়াতসমূহ থেকে মুরতাদ হত্যা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ বলে প্রমাণিত হয়।
মুশরিক مُشْرِك : মুশরিক শব্দের অর্থ “অংশীদার সাব্যস্তকারী, অংশীবাদী”। কুরআনের আলোকে যারা আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারে কাউকে কোনোরূপ অংশীদার সাব্যস্ত করে এবং আল্লাহর বিধানের মতো অন্য কারো বিধানকেও শর্তহীন ও নিরংকুশ বিধান সাব্যস্ত করে তারাই মুশরিক। কুরআনের আলোকে শিরক করা সবচেয়ে বড় অপরাধ তথা মুশরিক ব্যক্তি হলো সবচেয়ে বড় অপরাধী। যারা শিরকযুক্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। তবে দুনিয়াতে যদি কেউ শিরক থেকে তাওবাহ করে মু’মিন হয়ে যায়, তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। কেউ মুশরিক হওয়া বা মুশরিক হয়ে থাকা ধর্মীয় স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত বিধায় এ কারণে তাকে কোনো শাস্তি দেয়ার অধিকার অন্য কাউকে দেয়া হয়নি।
শরীয়াত شَرِيعَة : শরীয়াত শব্দের অর্থ হলো “মৌলিক বিধান, স্থায়ী নীতিমালা”। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে আল কুরআনের মাধ্যমে দ্বীনের মধ্য থেকে একটি শরীয়াত বা মৌলিক বিধি-বিধান প্রদান করা হয়েছে। এই মৌলিক বিধি-বিধানের সীমা সংরক্ষণ করে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশস্ত পথের অবকাশও তাঁকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি নিজে থেকে কোনো শাশ্বত বিধান বা শরীয়াত প্রণয়ন করতে পারেন না। অন্য কথায়, রসূল নিজে শরীয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি শরীয়াত প্রণেতা ছিলেন না। তাই আল কুরআনের বাইরে কোনো আইন-বিধান শরীয়াত হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে না। যদিও দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বর্তমানে শরীয়াত বলতে যা বুঝায় তার অনেক কিছুই কুরআনের সাথে সঙ্গতিহীন।
Apostasy in Islam: A Historical & Scriptural Analysis by Taha Jabir Alalwani, International Institute of Islamic Thought
ইসলাম ত্যাগকারী মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কেন?
https://www.islamicqa.org/3601
মুরতাদের শাস্তি, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী
মুরতাদ হত্যার পক্ষে বিপক্ষে, হাসান মাহমুদ
প্রচলিত ও প্রকৃত ইসলাম : একটি পর্যালোচনা, আবু সাঈদ খান
No Capital Punishment for Apostasy in Islam, Azhar Goraya, ReviewofReligions.org
Qur'an, Hadith and Scholars: Apostasy
Islam: Muslims Divided Over Penalty For Apostasy by Joyce Davis
Four-in-ten countries and territories worldwide had blasphemy laws in 2019 by Virginia Villa