ন্যায়সঙ্গত মৃত্যুদন্ড এবং অন্যায় হত্যার স্বরূপ ও পার্থক্য তথা কখন মৃত্যুদন্ড বৈধ এবং কোন ধরনের হত্যা অন্যায় হত্যা হিসেবে সাব্যস্ত হবে সে সম্পর্কে আল কুরআনে অত্যন্ত সুস্পষ্ট নির্দেশনা বিদ্যমান রয়েছে। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:
৫:৪৫ :: আর আমি তাদের উপর তাতে (তাওরাতে) লিখে দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং জখমের ক্বিসাস (জখমের বদলে সমান জখম)। তবে যে বদান্যতা প্রদর্শন করে (সদাক্বাহ স্বরূপ ক্ষমা করে দেয়), তা তার নিজের জন্য কাফফারা (গুনাহ মোচন) হিসেবে কার্যকর হবে। আর যারা আল্লাহর নাজিল করা বিধান অনুযাযী বিচার-ফায়সালা করে না তারাই জালিম।
২:১৭৮-১৭৯ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের উপর হত্যার দণ্ডবিধি হিসেবে ক্বিসাস (হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া) বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। হত্যাকারী স্বাধীন ব্যক্তি হলে ঐ স্বাধীন ব্যক্তিই দণ্ড পাবে, হত্যাকারী দাস হলে ঐ দাসই দণ্ড পাবে, হত্যাকারী নারী হলে ঐ নারীই দণ্ড পাবে। তবে যাকে তার ভাইয়ের (নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের) পক্ষ থেকে ক্ষমা করে দেয়া হয়, তখন একটি ন্যায়সঙ্গত অনুসরণ (পর্যবেক্ষণ) এবং তার দিকে (নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের দিকে) সদ্ভাবস্পন্ন ও উত্তম ধরনের (রক্তপণ) আদায় (প্রযোজ্য হবে)। এটা তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে একটি (দণ্ডবিধির) লঘুকরণ এবং দয়া। সুতরাং তারপর যে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ি করবে, তার জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। আর তোমাদের জন্য ক্বিসাসের (অন্যায় হত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ডের) মধ্যে জীবন/আয়ু রয়েছে, হে চিন্তাশক্তির অধিকারীরা, যেন তোমরা স্রষ্টা সচেতন হতে পারো।
৫:৩২-৩৪ :: এই (আদম সন্তানদের মধ্যে একজনকে অন্যজন কর্তৃক অন্যায় হত্যার) প্রেক্ষিতে আমরা বানী ইসরাইলের উপর বিধিবদ্ধ করে দিয়েছি যে, যে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে সেই ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করার কারণে ছাড়া অথবা পৃথিবীতে ফাসাদ করা (তথা বিপর্যয় ঘটানো বা জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা ধ্বংস করে দেয়ার অপতৎপরতা ও সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করা) ছাড়া, সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করলো এবং যে ব্যক্তি তার (অন্যায় হত্যার হুমকিতে থাকা ব্যক্তির) জীবন বাঁচালো সে যেন সমস্ত মানুষের জীবন বাঁচালো। আর অবশ্যই তাদের কাছে আমাদের রসূলগণ স্পষ্ট যৌক্তিক প্রমাণসমূহসহ এসেছে, তারপর তাদের মধ্য থেকে অধিকাংশ এরপরও পৃথিবীতে সীমা লংঘনকারী হয়ে রয়েছে। নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে (আল্লাহ প্রদত্ত ও রসূলের প্রবর্তিত বিধান অনুযায়ী পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বা বিদ্রোহাত্মক) যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং পৃথিবীতে ফাসাদ করতে (তথা বিপর্যয় ঘটাতে বা জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা ধ্বংস করে দেয়ার অপতৎপরতা ও সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে) সচেষ্ট হয়, তাদের প্রতিফল (দন্ডবিধি) এই যে, তাদেরকে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হবে অথবা শুলে চড়িয়ে হত্যা করা হবে অথবা তাদের হাতসমূহ ও পাসমূহ বিপরীত দিকে থেকে (ডান হাত বাম পা বা বাম হাত ডান পা) কেটে দেয়া হবে অথবা তাদেরকে (মুক্তভাবে চলাচলের) ভূখন্ড থেকে নির্বাসিত করা হবে। এটা তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্চনা এবং তাদের জন্য আখিরাতে মহাশাস্তি রয়েছে। তারা ছাড়া যারা তোমাদের করায়ত্ত হওয়ার আগেই তাওবাহ করে। জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।
৪:৮৮-৯১ :: তোমাদের কী হয়েছে যে, মুনাফিক্বদের ব্যাপারে তোমরা দুই দল হয়ে যাচ্ছো? অথচ তাদের উপার্জনের (পাপ প্রবণতার) জন্য আল্লাহ তাদেরকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তোমরা কি ইচ্ছা করো যে, তোমরা তাদেরকে হিদায়াত করবে যাদেরকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের জন্য কোনো পথ পাবে না। তারা আকাঙ্ক্ষা করে যদি তোমরা কুফর করতে যেমন তারা কুফর করেছে তাহলে তোমরা বরাবর হয়ে যেতে! সুতরাং তাদের কাউকে বন্ধু ও অভিভাবক (অলি-আওলিয়া) হিসেবে গ্রহণ করো না, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে (তথা তাগুতের সাথে আপোষ না করে বরং যেখানে নিরাপদে আল্লাহর বিধান অনুসরণ করা যাবে সেখানে চলে আসে)। অন্যদিকে যদি তারা (শত্রুতা সহকারে তোমাদের দিক থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তোমরা তাদেরকে ধরো এবং হত্যা করো, যেখানেই তোমরা তাদেরকে পাও। আর তোমরা তাদের মধ্য থেকে কাউকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে ও সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করো না। কিন্তু তাদেরকে নয় যারা এমন কোনো ক্বওমের সাথে সংযুক্ত হয় তোমাদের ও যাদের মধ্যে (অনাক্রমণ) চুক্তি রয়েছে অথবা যারা (যেসব মুনাফিক্বরা) তোমাদের কাছে এমনভাবে আসে যে, তাদের অন্তর সংকুচিত/বাধাগ্রস্থ হয় তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অথবা তাদের ক্বওমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাদেরকে তোমাদের উপর ক্ষমতাবান করতেন। তাহলে তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো। সুতরাং যদি তারা তোমাদের থেকে সরে দাঁড়ায়, তাহলে তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো না। আর তারা তোমাদের কাছে শান্তিচুক্তি প্রস্তাব করলে, তাহলে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে (ব্যবস্থা গ্রহণের) কোনো পথ রাখেন নি। আর শীঘ্রই তোমরা অন্য কিছু (মুনাফিক্বদেরকে) পাবে, তারা ইচ্ছা করে তোমাদের থেকে নিরাপত্তা পেতে এবং তাদের ক্বওমের থেকে নিরাপত্তা পেতে। যখনই তারা কোনো ফিতনার (ন্যায়কাজে বিঘ্ন সৃষ্টির) দিকে সুযোগ পায়, তারা সেটার মধ্যে (ফিতনার মধ্যে) ঘুরে যায়/ জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং যদি তারা তোমাদের থেকে সরে না যায় এবং তোমাদের কাছে শান্তিচুক্তি প্রস্তাব না করে এবং তাদের হাতসমূহ সংবরণ না করে, তাহলে তোমরা তাদেরকে ধরো এবং হত্যা করো, যেখানেই তোমরা তাদের নাগাল পাও। আর তারাই সেসব লোক, আমরা তোমাদেরকে যাদের উপর চড়াও হওয়ার স্পষ্ট সনদ দিয়েছি।
৫:২৭-৩০ :: আর তাদেরকে যথাযথভাবে আবৃত্তি করে শুনাও আদমের দুই পুত্রের সংবাদ। যখন তারা দুজন ক্বুরবান করেছিলো, তখন তাদের একজনের ক্বুরবান ক্ববুল করা হয়েছিলো এবং অন্যজনেরটি ক্ববুল করা হয়নি। সে বললো, ‘নিশ্চয় আমি তোমাকে হত্যা করবো’। সে বললো, ‘নিশ্চয় আল্লাহ স্রষ্টা সচেতনদের থেকে ক্ববুল করেন’। নিশ্চয় যদি তুমি আমাকে হত্যা করার জন্য আমার দিকে তোমার হাত প্রসারিত করো, আমি কিন্তু তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে আমার হাত প্রসারিত করবো না। নিশ্চয় আমি বিশ্বপ্রভু আল্লাহকে ভয় করি। নিশ্চয় আমি ইচ্ছা করি যে, তুমি আমার দোষ ও তোমার দোষের বোঝা বহন করো, ফলে তুমি (জাহান্নামের) আগুনে প্রবেশকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও। আর এটাই জালিমদের প্রতিফল। তারপর তার মন তাকে তার ভাইকে হত্যা করতে উস্কানি দিলো, ফলে সে তাকে হত্যা করলো। সুতরাং সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো।
৫:৯২ :: আর তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো। এবং তোমরা সাবধান থাকো। তারপর যদি তোমরা বিমুখ হও তবে জেনে রাখো যে, আমাদের রসূলের উপর শুধু স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব রয়েছে।
আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, শুধুমাত্র দুটি কারণে কেউ হত্যাযোগ্য হয় তথা কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ন্যায়সঙ্গত হয়: (১) কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা (২) পৃথিবীতে ফাসাদ/বিপর্যয় ঘটানো তথা জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা ধ্বংস করে দেয়ার অপতৎপরতা, যেমন: কোনো রাষ্ট্র বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অন্যায় যুদ্ধ, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করতে প্রচেষ্টা চালানো, ডাকাতি, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ইত্যাদি।
কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড দেয়াকে ক্বিসাস বলা হয়। অন্যায় হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে, রাষ্ট্রপতি বা বিচারপতি তাকে ক্ষমা করার অধিকার রাখে না। তবে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীরা তাকে ক্ষমা করে দিতে পারে। এ অবস্থায় সে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পাবে, কিন্তু তাকে ন্যায়সঙ্গতভাবে অনুসরণ বা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। আর সেই সাথে সে নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসদেরকে একটি সদ্ভাবসম্পন্ন এবং উত্তম মান ও পরিমাণের রক্তপণ আদায় করতে হবে।
যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে তথা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং ফাসাদ করে তাদের শাস্তি রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বা বিচার বিভাগ কর্তৃক পরিস্থিতিগত বিশ্লেষণে ফাসাদের মাত্রাভেদে বিভিন্নভাবে নির্ধারণ করা যাবে, যথা: হত্যা, শুলে চড়ানো, বিপরীত দিক থেকে হাত-পা কেটে দেয়া অথবা দেশ থেকে উৎখাত বা নির্বাসিত করা। সুতরাং মৃত্যুদন্ডই ফাসাদের একমাত্র শাস্তি নয়, বরং যে মাত্রার ফাসাদের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড দেয়া বাস্তবভিত্তিক ও যুক্তিসঙ্গত সাব্যস্ত হবে, সেই মাত্রার ফাসাদের ফলেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে।
৫:৩২-৩৩ আয়াতের সমন্বিত তথ্য অনুসারে ‘আল্লাহ ও রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার’ অপরাধটি ‘পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টির’ সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। এর মাধ্যমে মুসলিম শাসনাধীন রাষ্ট্রে কোনো বিরুদ্ধবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের মতাদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে হত্যাযোগ্য অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়নি।
কেউ ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেলে সে যদি শত্রুপক্ষের সাথে মিশে কোনো দুর্ঘটনা ঘটানোর আশংকা থাকে, তাহলে নিজেদেরকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, এজন্য তাকে নিছক আশংকাবশত হামলা করা যাবে না। বাস্তবে যারা ক্ষতিসাধন করবে তাদেরকে তাদের অপরাধের ধরন অনুসারে শাস্তি দেয়া হবে। কিন্তু নিছক ধর্মত্যাগের কারণে কাউকে শাস্তি দেয়ার সুযোগ নেই। যে মুনাফিকরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে না তাদের মুনাফেকি প্রকাশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অবকাশ নেই। বস্তুত যে মুনাফিকদেরকে হত্যা করার কথা বলা হয়েছে তা ধর্মীয় কারণে নয়, বরং তারা মু’মিনদের উপর সশস্ত্র হামলা করার কারণে। আবার আদমের দুই পুত্রের ঘটনা থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, কেউ হামলা বা হত্যা করতে উদ্যত হতে পারে ভেবে, বাস্তবে হামলা করা বা হত্যা করতে উদ্যত হওয়ার আগেই তাকে হামলা করা বা হত্যা করতে উদ্যত হওয়া যাবে না।
মু’মিনদেরকে সাবধান থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সাবধান থাকার মানেই যারা মু’মিন থেকে কাফির হয়ে গেছে বা কোনো ধরনের মুনাফিক্বী করেছে তাদেরকে নিছক মুরতাদ বা মুনাফিক্ব হওয়ার কারণে হত্যা করা নয়। শুধুমাত্র সেই মুনাফিক্বরাই হত্যাযোগ্য হতে পারে, যারা মু’মিনদের উপর সশস্ত্র হামলা করে, যারা কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এবং ফাসাদ সৃষ্টি করে, যেমন: ডাকাতি, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ে।
মু’মিনরা সাবধান থাকার উপায় হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কর্মরত কোনো ব্যক্তি যে উম্মাহর স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোপনীয় তথ্যাদি জানে সে মুরতাদ হয়ে শত্রুপক্ষে চলে গেলে, তাকে নজরদারিতে রাখা ও সতর্ক থাকা উচিত। কিন্তু যতক্ষণ সে কোনো আক্রমণে জড়িত হচ্ছে না, ততক্ষণ তাকে কোনো শাস্তি দেয়ার অবকাশ নেই।
পরিশেষে বলা যায় যে, ন্যায়সঙ্গত মৃত্যুদণ্ড ও অন্যায় হত্যা সম্পর্কে আল কুরআনের নির্দেশনা অনুসারে প্রমাণিত হয় যে, কোনো ব্যক্তি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করার পর বা ইসলাম গ্রহণ করার পর ইসলাম ত্যাগ করলে এজন্য তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা ন্যায়সঙ্গত নয়, বরং এরূপ ব্যক্তিকে তথা মুরতাদকে হত্যা করা সম্পূর্ণ অবৈধ।
ইসলামে ধর্মীয় স্বাধীনতার যে মানবাধিকার প্রদান করা হয়েছে তার মধ্যে শুধুমাত্র ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্ম অবলম্বনে স্বাধীনতা নয়, বরং মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ বা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তা ত্যাগ করার স্বাধীনতাও অন্তর্ভুক্ত। ধর্মত্যাগী ও বিভিন্ন ধরনের শত্রুদের ক্ষেত্রে মু’মিনদের আচরণ কীরূপ হবে সে সম্পর্কে কুরআনে যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা থেকে স্পষ্টভাবে ধর্মত্যাগের জন্য কাউকে হত্যা করা অবৈধ হিসেবে সাব্যস্ত হয়। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:
২:১০৮ :: তোমরা কি তোমাদের রসূলকে সেরূপ (কুফর মনোভাবাপন্ন) প্রশ্ন করতে চাও যেরূপ পূর্বে মূসাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল? আর যে ব্যক্তি ঈমান বদলে ফেলে কুফর গ্রহণ করে নিশ্চয় সে সরল পথ থেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।
৩:১০৬ :: সেদিন কিছু মুখ উজ্জ্বল হবে এবং কিছু মুখ মলিন হবে। তারপর যাদের মুখ মলিন হবে, (তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে), “তোমরা কি ঈমানের পরে কুফর করেছিলে? সুতরাং তোমরা যে কুফর করেছিলে সেজন্য শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করো।”
৩:৮৫-৯০ :: আর যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য দ্বীন সন্ধান করে, তার থেকে তা ক্ববুল করা হবে না। আর সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ কীভাবে সেই জনগোষ্ঠীকে হিদায়াত দিবেন যারা তাদের ঈমানের পরে কুফর করেছে এবং যারা স্বাক্ষ্য দিয়েছিলো যে, নিশ্চয় রসূল সত্য এবং তাদের কাছে স্পষ্ট যৌক্তিক প্রমাণও এসেছিল? আর আল্লাহ জালিম জনগোষ্ঠীকে হিদায়াত দেন না। তারা সেসব লোক যাদের প্রতিফল এই যে, তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ এবং ফেরেশতাদের এবং সমস্ত মানুষের। তারা তাতে স্থায়ী হবে। তাদের থেকে শাস্তিকে হালকা করা হবে না এবং তাদেরকে বিরামও দেয়া হবে না। তারা ছাড়া যারা উহার পর তাওবাহ করেছে এবং আত্মসংশোধন করেছে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু। নিশ্চয় যারা ঈমানের পরে কুফর করেছে, তারপর কুফরকে বাড়িয়েছে, তাদের থেকে তাওবাহ ক্ববুল করা হবে না এবং তারাই পথভ্রষ্ট।
৪:১৩৭ :: নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, তারপর কুফর করেছে, তারপর ঈমান এনেছে, তারপর কুফর করেছে, তারপর কুফরকে বাড়িয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবে না এবং তাদেরকে সঠিক পথনির্দেশও করবেন না।
৯:৭৪ :: তারা আল্লাহর নামে কসম করে যে, তারা বলে নি, অথচ তারা কুফরী বাক্য বলেছিল এবং তাদের ইসলাম গ্রহণের পর কুফর করেছিল এবং তারা এমন কিছুর জন্য মনস্থ করেছিল যা তারা কার্যকর করতে পারে নি। আর তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করে নি এজন্য ছাড়া যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ (আল্লাহর অনুগ্রহ) থেকে দিয়ে অভাবমুক্ত করেছিলেন। সুতরাং যদি তারা তাওবাহ করে, তা তাদের জন্য উত্তম। আর যদি তারা বিমুখ হয় তাহলে আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে কষ্টদায়ক শাস্তি দিবেন। আর তাদের জন্য পৃথিবীতে কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই।
৪৭:২৫-২৮ :: নিশ্চয় যারা তাদের কাছে হিদায়াত স্পষ্ট হওয়ার পর তাদের পিছনের দিকে ফিরে যায় (মুরতাদ হয়), শয়তান তাদের জন্য (তাদের কাজকে) শোভনীয় করেছে এবং তাদের জন্য (মিথ্যা আশাবাদকে) প্রলম্বিত করেছে। এটা এজন্য যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা যারা অপছন্দ করে তাদেরকে (কাফিরদেরকে) তারা (মুরতাদ মুনাফিক্বরা) বলে, কিছু কিছু বিষয়ে আমরা তোমাদের আনুগত্য করবো। আর আল্লাহ তাদের গোপন ষড়যন্ত্র অবগত আছেন। তখন কেমন হবে যখন ফেরেশতারা তাদের মুখমণ্ডল ও পিঠে আঘাত করতে করতে মৃত্যু ঘটাবে? এটা এজন্য যে, তারা সেটি অনুসরণ করে যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে এবং তাঁর সন্তুষ্টিকে অপছন্দ করে। এজন্য তিনি তাদের আমলসমূহ নিষ্ফল করে দিয়েছেন।
৩:৬৯-৭৪ :: আহলে কিতাবীদের একদল চায় যেন তোমাদেরকে বিপথগামী করতে পারে, অথচ তারা নিজেদেরকেই বিপথগামী করে। কিন্তু তারা তা অনুভব করে না। হে আহলে কিতাব, কেন তোমরা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করো অথচ তোমরাও (সাধারণভাবে উহার সত্যতার) সাক্ষ্য দান করো। হে আহলে কিতাব, কেন তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো এবং সত্যকে গোপন করো অথচ তোমরা নিজেরাই তা জানো। আহলে কিতাবের একদল বললো, “যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রতি যা নাজিল হয়েছে (আল কুরআন) তোমরা উহার প্রতি দিনের শুরুর অংশে ঈমান আনো এবং দিনের শেষ অংশে তা প্রত্যাখ্যান করো যাতে তারা (সঠিকভাবে ঈমান আনয়নকারীরা তোমরা এর মধ্যে গলদ পেয়েছো ভেবে তোমাদের দেখাদেখি তা থেকে) ফিরে যায়। যারা তোমাদের ধর্মমতে চলবে, তাদের ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করবে না”। বলো, নিঃসন্দেহে হেদায়েত সেটাই, যে হেদায়েত আল্লাহ করেন। (বিশ্বাস করো না) এ মর্মে যে, তোমাদেরকে যা দেয়া হয়েছে তার অনুরূপ অন্য কাউকে দেয়া হবে অথবা তোমাদের প্রভুর সামনে তারা তোমাদেরকে যুক্তিতে পরাভূত করবে। বলো,, মর্যাদা আল্লাহরই হাতে; তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও সর্বজ্ঞ। তিনি যাকে ইচ্ছা নিজের অনুগ্রহের জন্য বিশেষ করে নেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।
৩:১৭৬-১৭৮ :: যারা কুফরের দিকে দ্রুত ধাবমান তুমি তাদের জন্য বিষন্ন হয়ো না। নিশ্চয় তারা আল্লাহর কিছুমাত্রও ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ ইচ্ছা করেন যে, তিনি তাদের জন্য আখিরাতে কোনো কল্যাণের অংশ রাখবেন না। আর তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে। নিশ্চয় যারা ঈমানের বদলে কুফর ক্রয় করেছে, তারা আল্লাহর কিছুমাত্রও ক্ষতি করতে পারবে না। আর তাদের জন্য কষ্টদায়ক শাস্তি রয়েছে। আর যারা কুফর করেছে তারা যেন হিসাব না করে যে, নিশ্চয় আমরা তাদেরকে যে অবকাশ দিচ্ছি তা তাদের জন্য কল্যাণকর। নিশ্চয় আমরা তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকি যেন তারা (একই মনোবৃত্তিতে থাকলে তার মাধ্যমে) গুনাহে বৃদ্ধি পায়। আর তাদের জন্য অপমানকর শাস্তি রয়েছে।
৩:১৪৪ :: আর মুহাম্মাদ একজন রসূল ছাড়া অন্যরূপ নয়। নিশ্চয় তার পূর্বে বহু রসূল গত হয়েছে। তবে যদি সে মৃত্যুবরণ করে অথবা নিহত হয়, তোমরা কি তোমাদের গোড়ালির উপর ভর করে পিছনের দিকে ফিরে যাবে? আর যে তার গোড়ালির উপর ভর করে পিছনের দিকে ফিরে যাবে, সে আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর শীঘ্রই আল্লাহ কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবেন।
৬৩:১-৮ :: যখন তোমার কাছে মুনাফিক্বরা আসে, তারা বলে, “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর আল্লাহর রসূল।” আর আল্লাহ জানেন যে, নিশ্চয় তুমি আল্লাহর রসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিশ্চয় মুনাফিক্বরা মিথ্যাবাদী। তারা তাদের শপথকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এবং আল্লাহর পথে বাধা দেয়। নিশ্চয় তারা যা করে তা অত্যন্ত মন্দ। এটা এজন্য যে, নিশ্চয় তারা ঈমান এনেছে তারপর কুফর করেছে। সুতরাং তাদের ক্বলবসমূহের উপর মোহর মেরে দেয়া হয়েছে। সুতরাং তারা উপলব্ধি করে না। আর যখন তুমি তাদেরকে দেখ, তাদের দেহ কাঠামো তোমাকে অভিভূত করে এবং যখন তারা কথা বলে তুমি তাদের কথা সাগ্রহে শুনে থাকো। অথচ তারা যেন দেয়ালে ঠেস দেয়া কাঠের মতো (নির্বোধ)। তারা প্রত্যেক আওয়াজকে তাদের বিরুদ্ধে মনে করে। তারাই শত্রু। সুতরাং তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকো। আল্লাহ তাদেরকে হত করুন, তাদেরকে কোথায় ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে! আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ফিরে আসো যেন আল্লাহর রসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন, তারা তাদের মাথা ঘুরিয়ে নেয়। এবং তুমি তাদেরকে দেখ যে, তারা অহংকারী হয়ে সাড়া দেয়া থেকে বিরত থাকে। তাদের জন্য সমান যে, তুমি কি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো নাকি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো না, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ফাসিক্ব (দুষ্কর্ম পরায়ণ) জনগোষ্ঠীকে হিদায়াত করেন না। তারাই তো বলে, “রসূলের নিকট যারা রয়েছে তাদের জন্য ব্যয় করো না, যেন শেষ পর্যন্ত তারা সরে যায়”। অথচ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর ধনভান্ডার তো আল্লাহরই, কিন্তু মুনাফিক্বরা তা বুঝে না। তারা বলে, “যদি আমরা শহরে ফিরে যাই, তাহলে নিশ্চয় সম্মানীরা সেখান থেকে হীনদেরকে বের করে দিবে।” অথচ সম্মান তো আল্লাহরই জন্য এবং তাঁর রসূলের জন্য এবং মু’মিনদের জন্য। কিন্তু মুনাফিক্বরা তা জানে না।
৫:৫৪ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের মধ্য থেকে যে তার দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা) থেকে ফিরে যাবে, তবে শীঘ্রই আল্লাহ এমন ক্বওমকে নিয়ে আসবেন যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং যারা তাঁকে ভালবাসবে। যারা মু’মিনদের প্রতি কোমল হবে এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে, তারা আল্লাহর পথে জিহাদ (সংগ্রাম) করবে এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দাকে পরোয়া করবে না। এটাই আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা করেন তাকে তা দান করেন। আর আল্লাহ সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ।
৫:১০৫ :: হে মু’মিনগণ তোমাদের উপর তোমাদের নিজেদেরই দায়ভার বর্তায়। যে পথভ্রষ্ট হবে তাতে সে তোমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে না যখন তোমরা হিদায়াত/পথনির্দেশ গ্রহণ করো। আল্লাহর দিকেই তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তনস্থল। তারপর তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবেন যা কিছু তোমরা করছিলে।
৩:১০০ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যদি তোমরা যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের কোনো দলের আনুগত্য করো তাহলে তারা তোমাদেরকে তোমাদের ঈমানের পরে কাফির অবস্থায় ফিরিয়ে দিবে (তোমাদেরকে মুরতাদ বানিয়ে ফেলবে)।
২৯:৮ :: আর আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার সাথে সুন্দর ও উত্তম আচরণ করতে। আর যদি তারা তোমার উপর প্রচেষ্টা চালায় যেন তুমি আমার সাথে শিরক করো, যার বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই (অর্থাৎ যে শিরককে তুমি সত্য হিসেবে জানো না), সুতরাং সেক্ষেত্রে তুমি তাদের আনুগত্য করো না, আমার দিকেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন, তারপর আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবো, যা কিছু তোমরা করছিলে।
৩১:১৪-১৫ :: আর আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার প্রতি- তাকে তার মা কষ্টের পর কষ্ট স্বীকার করে গর্ভে ধারণ করেছে, আর তার দুধপান ছাড়ানো হয় দুই বছরে, (নির্দেশ দিয়েছি এই মর্মে যে,) আমার প্রতি এবং তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আমার দিকেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। আর যদি তারা তোমার উপর প্রচেষ্টা চালায় আমার সাথে শিরক করার জন্য, যার বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই (অর্থাৎ যে শিরককে তুমি সত্য হিসেবে জানো না), সুতরাং সেক্ষেত্রে তুমি তাদের আনুগত্য করো না। আর তাদের সাথে দুনিয়াতে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করবে। আর তুমি তার (অনুসৃত) পথের অনুসরণ করো যে আমার দিকে অভিমুখী হয়। তারপর আমার দিকেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তারপর আমি জানিয়ে দেবো, যা কিছু তোমরা করছিলে।
৯:২৩ :: যে যারা ঈমান (বিশ্বাস) করেছো, তোমরা তোমাদের পিতাদেরকে এবং ভাইদেরকে বন্ধু ও অভিভাবক (আওলিয়া) হিসেবে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমানের তুলনায় কুফরকে ভালবাসে বা পছন্দ করে। আর তোমাদের মধ্য থেকে যে (আমার উপদেশ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেবে, তারাই জালিম।
৬৪:১৪ :: হে যারা ঈমান (বিশ্বাস) করেছো, নিশ্চয় তোমাদের স্ত্রীদের (/স্বামীদের) এবং সন্তানদের মধ্য থেকে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। সুতরাং তোমরা তাদের থেকে সাবধান থাকো। আর যদি তোমরা তাদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করো এবং তাদের (শত্রুতাকে) এড়িয়ে যাও এবং তাদেরকে ক্ষমা করো, তবে নিশ্চয় আল্লাহ তো ক্ষমাশীল দয়ালু।
৩:২৮ :: মু’মিনগণ যেন মু’মিনগণ ছাড়া কাফিরদেরকে বন্ধু ও অভিভাবক (আওলিয়া) হিসেবে গ্রহণ না করে। আর যে ব্যক্তি তা করবে তার সাথে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু যদি তোমরা তাদের সাথে সাবধানতাস্বরূপ বাহ্যত তা করতে বাধ্য হও (তা ভিন্ন বিষয়)। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নিজের বিষয়ে সাবধান-সচেতন করছেন। আর আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন।
৩:১১৮ :: যে যারা ঈমান (বিশ্বাস) করেছো, তোমরা নিজেদের লোকদের (মু’মিনদের) ছাড়া কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের ক্ষতি করতে কোনো সুযোগই ছাড়বে না। যা তোমাদেরকে বিপন্ন করে তারা তা-ই কামনা করে। নিশ্চয় তাদের বিদ্বেষ তাদের মুখেই প্রকাশ পেয়েছে। আর তারা তাদের অন্তরে যা গোপন রেখেছে তা আরো বড়। নিশ্চয় আমরা তোমাদের জন্য আয়াতসমূহকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছি, যদি তোমরা বিবেক-বুদ্ধি (আক্বল) প্রয়োগ করতে!
৬০:৮ :: আল্লাহ তাদের বিষয়ে নিষেধ করেন না যারা দ্বীনের ব্যাপারে (তোমরা তোমাদের দ্বীন-ধর্ম পালন করার কারণে) তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে না, এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দেয় না, (নিষেধ করেন না) এই মর্মে যে, তোমরা তাদের সাথে মহানুভবতা প্রদর্শন করবে এবং তাদের প্রতি ন্যায় বিচার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায় বিচারকারীদেরকে ভালবাসেন।
৪:৮৪ :: তুমি আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো। তোমাকে শুধু তোমার নিজের জন্য দায়ী করা হবে। আর মু’মিনদেরকেও উদ্বুদ্ধ করো। আশা করা যায় যে, আল্লাহ তাদের শক্তি সংকুচিত করবেন যারা কুফর (সত্য অস্বীকার) করেছে। আর আল্লাহ শক্তিতে প্রবল এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানেও প্রবল।
১৪:৩৫-৩৬ :: এবং উল্লেখ্য যখন ইবরাহীম বলেছিল, আমার প্রভু এ নগরীকে নিরাপদ বানিয়ে দিন এবং আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা করা থেকে দূরে রাখুন। প্রভু, নিশ্চয় সেগুলো অধিকাংশ মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে। তারপর যে আমার অনুসরণ করবে সে-ই আমার দলভুক্ত। আর যে আমাকে অমান্য করবে, তবে নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল দয়ালু।
২৬:২১৫-২১৬ :: এবং মু’মিনদের মধ্য থেকে যারা তোমার অনুসরণ করে তাদের প্রতি তোমার বাহুকে অবনত করো। তারপর যদি তারা তোমাকে অমান্য করে, তবে বলো, নিশ্চয় তোমরা যা করো তা থেকে আমি সম্পর্কহীন ও দায়মুক্ত।
৩৩:৩৬ :: মু’মিন পুরুষ ও নারীদের তাদের কোনো বিষয়ে ইখতিয়ার (বিকল্প পছন্দের অধিকার) থাকে না, যখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোনো নির্দেশ নির্ধারিত করে দেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ও তাঁর রসূলকে অমান্য করে সে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হয়।
৭২:২৩ :: আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রচার করা ও তাঁর রিসালাত বা বার্তা বাহক হওয়াই শুধু দায়িত্ব। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ও তাঁর রসূলকে অমান্য করে, তবে নিশ্চয় তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তারা তাতে চিরস্থায়ী হবে।
৪:১৪ :: আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ও তাঁর রসূলকে অমান্য করবে, আর তাঁর (অর্থাৎ আল্লাহর) নির্ধারিত সীমাসমূহ লংঘন করবে, তিনি তাকে (জাহান্নামের) আগুনে প্রবেশ করাবেন, সে তাতে স্থায়ী হবে, এবং তার জন্য অপমানকর শাস্তি রয়েছে।
উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঈমানের পরে কুফর দ্বারা তাকে বদল করলে তারা বিভ্রান্ত হবে। এর একটি রূপ হলো নবী মূসাকে যেভাবে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যা কুফরি মনোভাবাপন্ন, সেরূপ প্রশ্ন করা। কিন্তু তাদেরকে হত্যা করতে বলা হয়নি। বরং ঈমানের পর কুফর করলে সেজন্য কিয়ামাতের দিন শাস্তি হবে।
আল্লাহর নিকট ইসলামই একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন। মুরতাদদের মধ্যে যারা প্রকৃত তাওবাহ করবে তারা ছাড়া অন্যদের তাওবাহ কবুল হবে না। তবে ইসলাম ছাড়া অন্য দ্বীন আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও তার মানে এ নয় যে, জোর করে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীনে নিয়ে আসতে হবে। মুরতাদদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ কথা। একদল লোক ঈমানের পর কুফর করেছিল। তাদের শাস্তি অভিশাপ, কিন্তু হত্যা নয়। তাদেরকে ইহকালে ও পরকালে আল্লাহই শাস্তি দিবেন। তবে তাদের জন্য তাওবাহের অবকাশ রাখা হয়েছে।
যে ব্যক্তি ঈমান আনার পর কুফর করে মুরতাদ হয়েছে সেও বারবার ঈমান আনা ও কুফর করার সুযোগ রয়েছে। মুরতাদকে হত্যা করা হলে সে কুফরের পর আবার ঈমান আনা তারপর আবার কুফর করার কোনো সুযোগই থাকে না। কুরআনকে মুরতাদকে হত্যার কোনো বৈধতা নেই, বরং মুরতাদকে অবকাশ দেয়া হয়েছে। বস্তুত যারা ইসলাম থেকে ফিরে যাবে তাদেরকে এজন্য কোনো শাস্তি দিতে বলা হয়নি, বরং ফিরে গিয়ে আবার আসা আবার ফিরে যাওয়ার অবকাশ আছে।
যারা ইসলামের পর কুফর করেছে এবং কুফরি বাক্য বলেছে তাদের জন্যও তাওবার সুযোগ রয়েছে। তবে তাওবাহ না করলে তাদেরকে আল্লাহ নিজে দুনিয়া ও আখিরাতে মহাশাস্তি দিবেন। কিন্তু মু’মিনরা তাদেরকে হত্যা করতে বলা হয়নি। মুরতাদের মৃত্যুর সময় ফেরেশতাদের কর্তৃক শাস্তির কথা বলা হয়েছে। মু’মিনদের কর্তৃক হত্যা বা কোনোরূপ শাস্তি প্রদান করতে বলা হয়নি।
আহলে কিতাবের কেউ কেউ মুরতাদ হয়ে অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্রের উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু এর জবাবে তথা মুরতাদ হওয়ার কারণে তাদেরকে হত্যা করার আদেশ দেয়া হয়নি।
স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, কাফিররা আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, তাদেরকে দেয়া অবকাশ তাদের জন্য ভালো হয় তা নয়, তবে অবকাশ দেয়া হয়। এতে তাদের কথার জবাব রয়েছে, যারা তাদেরকে অবকাশ দিলে ক্ষতি হবে বলে। অনুরূপভাবে মুরতাদ বিভাগের কাফিরদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর ওফাতের পরে কেউ ঈমান থেকে উল্টোদিকে ফিরে গেলে তারা আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু তাদেরকে অন্যরা হত্যা করতে বলা হয়নি। মু’মিনদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তোমরা কি রসূলের মৃত্যুর পর উল্টোদিকে ফিরে যাবে? কিন্তু উল্টোদিকে ফিরে গেলে সেজন্য কোনো পার্থিব দণ্ডবিধি দেয়া হয়নি।
মুরতাদের চেয়ে মুনাফিক (যারা মু’মিন পরিচয় দেয়, অথচ মু’মিন নয়; বরং গোপন কাফির ও মুশরিক অথবা সুবিধাবাদী) অধিক জঘন্য এবং মুরতাদদের চেয়ে তাদের পক্ষে মু’মিনদের বেশি ক্ষতি করা সম্ভব হয়। মুনাফিক্বরা (আত্মপরিচয় গোপনকারী কাফির-মুশরিক) সবচেয়ে নিম্নতম জাহান্নামে থাকবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে কেউ মুনাফিক্ব প্রমাণিত হলেই তাকে হত্যা করতে আদেশ দেয়া হয়নি। মুনাফিক্বদের মুনাফিকি প্রকাশ পাওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে হত্যা করতে নয়, বরং তাদের থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সুতরাং তাদেরকে আমানতমূলক দায়-দায়িত্ব দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, কিন্তু তারা নিজেদেরকে মু’মিন দাবি করে সাধারণ পর্যায়ে আসা-যাওয়া করার সুযোগকে রহিত করা হয়নি। মুনাফিক্ব মুরতাদ, যারা ঈমান আনার পর কুফর করেছে, তাদের হৃদয়ে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে, কিন্তু তাদেরকে হত্যা করতে বলা হয়নি।
যারা মুরতাদ হবে তাদের পরিবর্তে আল্লাহ অন্যদেরকে নিয়ে আসবেন বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু মু’মিনরা তাদেরকে হত্যা করতে বলা হয়নি। মু’মিনগণ শুধু নিজেদের জন্য দায়বদ্ধ, কেউ পথভ্রষ্ট হলে তাতে মু’মিনদের ক্ষতি নেই। মু’মিনরা নিজে মুরতাদ হয়ে যাওয়া থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অন্য মু’মিনরা কোনো মুরতাদকে (যে মু’মিন থেকে কাফির হয়ে গেছে তাকে) কোনোরূপ শাস্তি প্রদানের জন্য কোনো দণ্ডবিধি দেয়া হয়নি।
পিতা ও ভাই যদি ঈমানের চেয়ে কুফরকে অগ্রাধিকার দেয় (এর মধ্যে মুরতাদ পিতা ও ভাইও অন্তর্ভুক্ত), তাদেরকে ওয়ালী (বন্ধু ও অভিভাবক) বানানো যাবে না। যেসব পিতামাতা শিরকের আদেশ দেয়, তাদের সাথেও অসদাচরণ করা যাবে না, যদিও তাদের আনুগত্য করা যাবে না। পিতামাতা শিরক করলে বা শিরক করার আদেশ দিলে যেমন তাদেরকে হত্যা করতে বলা হয়নি, তেমনি ধর্মত্যাগ করলেও হত্যা করার অবকাশ নেই। পিতা বা ভাই ঈমানের চেয়ে কুফরকে বেশি ভালবাসলে (যার একটি রূপ হলো ঈমান আনার পর কুফর করা) তাদেরকে বন্ধু ও অভিভাবক বানানো যাবে না, কিন্তু হত্যা করতে হবে তা নয়।
মু’মিনদের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ শত্রু (এদের মধ্যে মুরতাদ স্ত্রী ও সন্তানও অন্তর্ভুক্ত, কারণ কোনো আয়াতে মুরতাদদেরকে মেরে ফেলার কথা বলা হয়নি), তাদের সাথে ক্ষমাসুন্দর আচরণ করতে বলা হয়েছে। যেখানে তাদের শত্রুতা সত্ত্বেও মার্জনার নির্দেশ রয়েছে, সেখানে শুধুমাত্র ধর্ম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে তাকে হত্যা করে ফেলার অবকাশ কোথায়?
যদিও মু’মিনদের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব বিশ্বাসভিত্তিক তথা মু’মিনদের সাথেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও যারা আক্রমণকারী নয় তাদের সাথে সাধারণ সদাচার করতে এবং ন্যায়বিচার করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
রসূলের আনুগত্য না করলেও রসূল হত্যা করে ফেলবেন, তা নয়। তিনি মু’মিনদেরকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করবেন, কিন্তু তিনি শুধু নিজের জন্য দায়ী। সুতরাং কেউ ইসলাম ত্যাগ করলে বা মুনাফিকী করলে কিন্তু মু’মিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করলে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে, কিন্তু তাকে হত্যা করার সুযোগ নেই।
নবী ইবরাহীমের প্রার্থনায় যারা তাঁর অবাধ্য হবে তাদের বিষয়েও ক্ষমার আবেদন প্রকাশ পেয়েছে। এমতাবস্থায় কেউ নবীর নির্দেশ অমান্য করার মাধ্যমে কাফির হয়ে গেলে বা মুরতাদ হয়ে গেলে তাকে কোনোরূপ শাস্তি প্রদান করা কুরআনের শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক বলে প্রমাণিত হয়। মু’মিনদের মধ্য থেকেও যদি কেউ রসূলের অবাধ্য হয়ে যায় তবে তাদেরকে যেন তিনি তাদের কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কহীনতা ও দায়মুক্ত হওয়ার কথা জানিয়ে দেন সেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাদেরকে কোনো শাস্তি প্রদান করার কথা বলা হয়নি।
কোনো মু’মিনের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্যতা করার অবকাশ নেই, করলে সে মু’মিন থাকবে না, পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে, কিন্তু তাকে হত্যা করে ফেলতে বলা হয়নি। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হলে সে জাহান্নামে স্থায়ী হবে, কিন্তু তাকে মেরে ফেলতে বলা হয়নি।
সুতরাং এসকল নির্দেশ ও নির্দেশনা থেকে সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কাউকে ধর্মত্যাগের কারণে হত্যা করা সম্পূর্ণ অবৈধ।
আসমাণী গ্রন্থ সমূহের মধ্যে বাইবেলের আদি নিয়ম বা ওল্ড টেস্টামেন্টের লেভিটিকাসে ব্লাসফেমীর জন্য পাথর মেরে মৃত্যূদন্ডের উল্লেখ পাওয়া যায় যেটি খুব সম্ভবত মুসলিম পন্ডিতদের প্রভাবিত করেছিল।
Then the Lord said to Moses: “Take the blasphemer outside the camp. All those who heard him are to lay their hands on his head, and the entire assembly is to stone him. Say to the Israelites: ‘Anyone who curses their God will be held responsible; anyone who blasphemes the name of the Lord is to be put to death. The entire assembly must stone them. Whether foreigner or native-born, when they blaspheme the Name they are to be put to death.
অত:পর প্রভু মুসাকে বললো: যে প্রভুর নামের নিন্দা করেছে তাকে ক্যাম্পের বাইরে নিয়ে যাও। যারাই তার কথা শুনেছে তারাই তার শাস্তি প্রদান করবে, এবং সমবেত সকলেই তাকে প্রস্তর নিক্ষেপ করবে। বনী ইসরাইলকে বলো: "যেই তার প্রভূকে নিন্দা করবে তাকেই মৃতু্্যদন্ড দেওয়া হবে। সমবেত সকলেই তাদের পাথর নিক্ষেপ করবে। ব্যক্তিটি অ-বনী ঈসরাইলী হোক বা ঈসরাইলী হলো, যখনই সে প্রভুর নামের নিন্দা করবে, তাকে মৃতু্্যদন্ড দেওয়া হবে। - লেভিটিকাস অধ্যায় ২৪, ১৩-১৬
আল কুরআনের অনেক আয়াত থেকে জানা যায় যে, মুশরিকরা বিভিন্ন নবী-রসূল ও মু’মিনদেরকে ধর্মত্যাগের জন্য প্রস্তরাঘাতে হত্যার হুমকি দিয়েছিল বা তাদের রীতির কারণে তাঁরা হুমকি অনুভব করেছিলেন। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষ্যণীয়:
২৬:১১৬ :: তারা (কাফিররা) বললো, “যদি তুমি (আমাদের ধর্মত্যাগ করে একত্ববাদী ধর্মের আহবান থেকে) বিরত না হও, হে নূহ, তাহলে তুমি পাথরের আঘাতে নিহতদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”
১৯:৪৬ :: সে (ইবরাহীমের পিতা) বললো, “তুমি কি আমার উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করছো, হে ইবরাহীম? যদি তুমি তা থেকে বিরত না হও, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাকে পাথরের আঘাতে হত্যা করবো। আর (অন্যথায়) তুমি চিরতরে আমাকে ছেড়ে চলে যাও।”
১১:৯১ :: তারা (কাফিররা) বললো, হে শুয়াইব, তুমি যা বলো তার অনেক কথাই আমরা বুঝি না। এবং আমরা তোমাকে আমাদের মধ্যে দুর্বল দেখছি। আর যদি তোমার পরিবার-পরিজন (কর্তৃক প্রতিশোধের আশংকা) না থাকতো, তাহলে অবশ্যই আমরা তোমাকে পাথরের আঘাতে হত্যা করতাম। আর আমাদের উপর তুমি শক্তিশালী নও।”
৪৪:২০ :: (রসূলুল্লাহ মূসা আরো বললো,) “আর আমি আমার ও তোমাদের প্রভুর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যেন তোমরা আমাকে পাথরের আঘাতে হত্যা করতে না পারো।”
৩৬:১৮ :: তারা (কাফিররা) বললো, “আমরা তোমাদেরকে (আল্লাহর প্রেরিত তিনজন রসূলকে) অলক্ষুণে মনে করি। যদি তোমরা (আমাদের ধর্মত্যাগ করে একত্ববাদী ধর্মের আহবান থেকে) বিরত না হও, তাহলে অবশ্যই আমরা তোমাদেরকে পাথরের আঘাতে হত্যা করবো। আর অবশ্যই তোমাদেরকে আমাদের পক্ষ থেকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি স্পর্শ করবে।”
১৮:২০ :: নিশ্চয় তারা (কাফিররা) যদি তোমাদের (আসহাবে কাহাফের) উপর জয়যুক্ত অবস্থায় থাকে, তাহলে তারা তোমাদেরকে পাথরের আঘাতে হত্যা করবে অথবা তারা তোমাদেরকে তাদের মিল্লাতে (শিরকযুক্ত ধর্মাচারে) ফিরিয়ে নেবে। আর তাহলে সেক্ষেত্রে তোমরা কখনোই কল্যাণ অর্জন করতে পারবে না।
উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্মীয় ভিন্নতা, ধর্মত্যাগ এবং ভিন্নধর্ম গ্রহণ বা ভিন্নধর্মের দিকে আহবানের কারণে হত্যা করা একটি চিরাচরিত অনৈসলামিক রীতি। পক্ষান্তরে আল কুরআনে ধর্মীয় স্বাধীনতা, কোনো ধর্ম অবলম্বন করা না করা এবং অবলম্বনের পর তা পরিবর্তন করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করা বা ধর্মত্যাগ করা ইত্যাদির অবকাশ রয়েছে। কুরআন অনুযায়ী ইসলাম আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য একমাত্র সত্য ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও তা ত্যাগ করার ক্ষেত্রে মানুষ স্বাধীন, যদিও সেজন্য সে পথভ্রষ্ট হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং জাহান্নামের শাস্তি পাবে, কিন্তু সেজন্য তাকে মু’মিনদের কর্তৃক কোনো শাস্তি পেতে হবে না। বরং ধর্মত্যাগের কারণে কাউকে হত্যা করা অবৈধ বিধায় কেউ এরূপ করলে সে-ই মৃত্যদণ্ডযোগ্য অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
মুরতাদ হত্যাকে বৈধ বলে দাবি করার জন্য কিছু আয়াতকে উপস্থাপন করা হয়, যদিও আয়াতসমূহের প্রকৃত তাৎপর্য মুরতাদ হত্যাকে সমর্থন করে না। কোনো আয়াতের প্রকৃত তাৎপর্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আয়াতের বক্তব্যকে পূর্বাপর আয়াতসমূহের বক্তব্য এবং একই বিষয়ের অন্যান্য আয়াতের বক্তব্যের সাথে সমন্বিত অধ্যয়নের পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন। পূর্বাপর প্রসঙ্গ এবং অন্যান্য আয়াতের সাথে সমন্বিত অধ্যয়ন না করে কোনো আয়াতের বক্তব্যকে তার প্রকৃত তাৎপর্যগত অবস্থান থেকে বিচ্যুত করে কোনো দাবি সপক্ষে উপস্থাপন করা গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবে কুরআনে স্ববিরোধ আরোপিত হয়, অথচ কুরআন সম্পূর্ণরূপে স্ববিরোধমুক্ত।
মুরতাদ হত্যাকে বৈধ বলে দাবি করার জন্য যেসব আয়াতকে উপস্থাপন করা হয় তা নিম্নরূপ:
২:২১৭ :: তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে হারাম মাস (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাস) সম্পর্কে, সেটাতে যুদ্ধ করা প্রসঙ্গে। বলো, “সেটাতে (তথা কোনো হারাম মাসে) যুদ্ধ করা অনেক বড় গুনাহ। আর আল্লাহর পথ থেকে বাধা দেয়া ও তাঁর প্রতি কুফর (অবিশ্বাস ও অকৃতজ্ঞতা) করা এবং আল মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দেয়া এবং সেটার যথোপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে তা থেকে বহিষ্কার করা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় গুনাহ। আর ফিতনা (ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ এবং ভিন্ন ধর্ম অবলম্বনের কারণে নির্যাতন) হত্যার চেয়েও গুরুতর গুনাহ। আর তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে থামবে না, যতক্ষণ না তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে, যদি তাদের সাধ্যে কুলায়। আর তোমাদের মধ্য থেকে যে তার দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) থেকে ফিরে যাবে তারপর কাফির (সত্য প্রত্যাখ্যানকারী) অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করবে, তারাই এমন লোক যাদের আমলসমূহ দুনিয়াতে ও আখিরাতে বরবাদ হয়ে যাবে। আর তারাই (দোযখের) আগুনে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। তারা তাতে স্থায়ী হবে।
৩৩:৫৭ :: নিশ্চয় যারা আল্লাহকে এবং তাঁর রসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে লা’নত দেন (অভিশপ্ত করেন)। আর তিনি তাদের জন্য অপমানকর প্রস্তুত করেছেন।
৩৩:৫৯-৬২ :: হে নবী, তোমার স্ত্রীদেরকে এবং তোমার কন্যাদেরকে এবং মু’মিনদের নারীদেরকে বলো, যেন তারা তাদের উপর তাদের জিলবাব/ চাদর জড়িয়ে রাখে। এটাই এ সম্ভাবনার নিকটতর যে, তাদেরকে (উন্নত ব্যক্তিত্বসম্পন্না হিসেবে) চিনতে পারা যাবে, ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া (যৌন হয়রানি করা) হবে না। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু। যদি মুনাফিক্বরা এবং যাদের মনে রোগ রয়েছে তারা এবং যারা শহরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভীষণভাবে কাঁপিয়ে তোলে তারা (মুরজিফুন), তাহলে আমি তোমাকে তাদের বিষয়ে তেজোদ্দীপ্ত করবো, তারপর তারা স্বল্প সময় ব্যতীত তোমার প্রতিবেশি হিসেবে থাকতে পারবে না। (তাও থাকবে) অভিশপ্ত অবস্থায়। তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে, পাকড়াও করা হবে এবং একে একে তাদের সকলকে হত্যা করা হবে (মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে)। ইতোপূর্বে যারা অতীত হয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও এটাই ছিল আল্লাহর সুন্নাত (দণ্ডবিধি)। আর তুমি আল্লাহর সুন্নাতে (মূলনীতি বা বিচারনীতিতে) কোনো পরিবর্তন পাবে না।
৫:৩৩-৩৪ :: নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে (আল্লাহ প্রদত্ত ও রসূলের প্রবর্তিত বিধান অনুযায়ী পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বা বিদ্রোহাত্মক) যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং পৃথিবীতে ফাসাদ করতে (তথা বিপর্যয় ঘটাতে বা জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা ধ্বংস করে দেয়ার অপতৎপরতা ও সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে) সচেষ্ট হয়, তাদের প্রতিফল (দন্ডবিধি) এই যে, তাদেরকে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হবে অথবা শুলে চড়িয়ে হত্যা করা হবে অথবা তাদের হাতসমূহ ও পাসমূহ বিপরীত দিকে থেকে (ডান হাত বাম পা বা বাম হাত ডান পা) কেটে দেয়া হবে অথবা তাদেরকে (মুক্তভাবে চলাচলের) ভূখন্ড থেকে নির্বাসিত করা হবে। এটা তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্চনা এবং তাদের জন্য আখিরাতে মহাশাস্তি রয়েছে। তারা ছাড়া যারা তোমাদের করায়ত্ত হওয়ার আগেই তাওবাহ করে। জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।
২:৫৪ :: আর (সেই সময়ের কথা উল্লেখ্য) যখন মূসা তার জনগোষ্ঠীকে বলেছিলো, হে আমার ক্বওম, নিশ্চয় তোমরা বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করে তোমাদের নিজেদের উপর জুলুম করেছো। সুতরাং তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তার দিকে তাওবাহ করো (ফিরে এসেো)। সেই সাথে তোমরা তোমাদের নিজেদের (মধ্যকার বাড়াবাড়িকারীদেরকে) হত্যা করো (মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করো)। এটাই তোমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে তোমাদের জন্য উত্তম। তখন তিনি তোমাদের তাওবাহ কবুল করেছেন। নিশ্চয় তিনি তাওবাহ কবুলকারী দয়ালু।
নিম্নে ‘সমন্বিত অধ্যয়ন পদ্ধতি’ অনুসারে আয়াতসমূহের প্রকৃত তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১. মুরতাদ হওয়ার ফলে আমল বিনষ্ট হওয়া বনাম মুরতাদ হত্যা
২:২১৭ আয়াত অনুসারে, ফিতনা হত্যার চেয়ে বড় অপরাধ, আল্লাহর প্রতি কুফর করা হত্যার চেয়ে বড় অপরাধ এবং যারা আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন বা জীবনব্যবস্থাকে গ্রহণ করার পর তা থেকে ফিরে যাবে বা মুরতাদ হবে ও কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে তাদের আমলসমূহ দুনিয়া ও আখিরাতে ব্যর্থ হবে অর্থাৎ তাদের জন্য সুফলদায়ক হবে না।
উপরোল্লেখিত বক্তব্যকে মুরতাদ হত্যার বৈধতার পক্ষে পেশ করে বলা হয় যে, যেহেতু তাদের আমল দুনিয়া ও আখিরাতে ব্যর্থ, তাই তাদেরকে হত্যা করা যেতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তো তাদের আমলকে দুনিয়া ও আখিরাতে ব্যর্থ বলেছেন, ফলে তাদের আমল তাদের জন্য উপকারী হবে না। কিন্তু তিনি তো এজন্য তাদেরকে হত্যা করার অধিকার কাউকে দেননি। বরং কারো আমলকে ব্যর্থ হিসেবে উল্লেখ করার কারণে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত আল কুরআনে থাকা ধর্মীয় স্বাধীনতার লংঘন এবং তাদেরকে যেসব অবস্থায় স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত বেঁচে থাকার অধিকার দেয়া হয়েছে বলে প্রমাণিত হয় সেই মৌলিক মানবাধিকার (বেঁচে থাকার অধিকার) লংঘন এবং সর্বোপরি এ সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতসমূহের স্পষ্ট বিরুদ্ধাচরণ। নিম্নে আমল ব্যর্থ হওয়া সম্পর্কিত কতিপয় আয়াতের ভিত্তিতে বিষয়টি আলোচনা করা হলো:
৫:৫ আয়াতে যে-ই ঈমানের প্রতি অস্বীকৃতি জানাবে (কুফর করবে) তারই আমল ব্যর্থ। সুতরাং যার আমল ব্যর্থ তাকেই হত্যা করা যাবে মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অর্থ হবে সকল কাফিরকেই হত্যা করা, যা যার ইচ্ছা ঈমান আনবে এবং যার ইচ্ছা কুফর করবে মর্মে যে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে এবং কাফিরদের সম্পর্কে কুরআনে যেসব বক্তব্যে তারা আক্রমণকারী না হলে তাদের সাথে সদাচার করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেইসব নির্দেশকে লংঘন করে।
৫:৫২-৫৪ আয়াতে মুনাফিক্ব এবং মুরতাদদের সম্পর্কে সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ মু’মিনদেরকে বিজয় দিবেন বা এমন কিছু পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাবেন যা তাদেরকে অনুতপ্ত করবে এবং তাদের আমল ব্যর্থ এবং তারা দ্বীন থেকে ফিরে গেলে আল্লাহ এমন লোকদেরকে দ্বীনের মধ্যে আনবেন যারা আল্লাহকে ভালবাসবে এবং আল্লাহও তাদেরকে ভালবাসবেন।
৬:৮৮ আয়াতে শিরক করার পরিণতিতে সমস্ত আমল ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার ঘোষণা রয়েছে। কিন্তু কুরআনে নির্বিচারে মুশরিকদেরকে হত্যা করতে বলা হয়নি। যে আয়াতে মুশরিকদেরকে হত্যার নির্দেশ রয়েছে তাতে ঐ মুশরিকদেরকেই হত্যা করতে বলা হয়েছে যারা বারবার শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে মু’মিনদেরকে আক্রমণ করেছে, কিন্তু যারা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করেনি তাদের সাথে চুক্তি রক্ষা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে (৯:৫-৭)।
৭:১৪৭ ও ১৮:১০৫ আয়াতে বলা হয়েছে যে, যারা আল্লাহর আয়াত ও আখিরাতের সাক্ষাতকে মিথ্যা বলে বা তার প্রতি কুফর করে, তাদের আমলসমূহ ব্যর্থ। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, এ ধরনের লোকদেরকে ধরে ধরে হত্যা করা হবে।
৯:৬৯ আয়াতে অযথা আলোচনা-সমালোচনাকারীদের আমলসমূহকে দুনিয়া ও আখিরাতে ব্যর্থ বলা হয়েছে। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে হত্যা করতে হবে। বরং কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যারা আল্লাহর আয়াত নিয়ে সমালোচনা করে সমালোচনাকালে তাদের থেকে সরে যেতে এবং পরে যখন তারা অন্য প্রসঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হয় তখন তাদের সাথে বসা যাবে (৪:১৪০)।
৩৯:৬৫ আয়াতে বলা হয়েছে যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ও তাঁর পূর্ববর্তী নবী-রসূলদের কাছেও ওহী করা হয়েছে যে, ‘যদি তুমি শিরক করো তাহলে তোমার আমলসমূহ ব্যর্থ হবে’। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, কেউ শিরক করলে অন্য কেউ তাকে হত্যা করতে হবে।
৪৯:২ আয়াত অনুযায়ী নবীর কণ্ঠস্বরের উপর কণ্ঠস্বর চড়া করলে নিজের অজ্ঞাতসারেই আমলসমূহ ব্যর্থ হয়ে যাবে।
সুতরাং আমল ব্যর্থ হওয়ার অর্থ হলো আল্লাহর বিধান অনুসারে আমল ব্যর্থ হওয়া। এটা কোনো ব্যক্তি বুঝতে পারুক বা না পারুক, উভয় অবস্থায় তার অপরাধের মাত্রা অনুসারে তার আমল ব্যর্থ হতে পারে। কারো আমল ব্যর্থ হওয়ার কারণে অন্য কেউ তাকে হত্যা করতে হবে বা হত্যা করতে পারবে এমন কথা কুরআনের কোনো আয়াতেই বলা হয়নি। বরং যার আমল ব্যর্থ তাকে হত্যা করা যায় বা হত্যা করতে হবে বলে দাবি করা সম্পূর্ণভাবে কুরআন বিরুদ্ধ দাবি এবং এরূপ অবৈধ হত্যাকাণ্ডের ফলে হত্যাকারীর উপর মৃত্যুদণ্ড প্রযোজ্য।
২. রসূলকে কষ্ট দেয়ার ফলে আল্লাহর লা’নত বনাম মুরতাদ হত্যা
৩৩:৫৭ আয়াত অনুযায়ী, যারা আল্লাহকে ও তাঁর রসূলকে কষ্ট দেয় তাদের উপর দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর লা’নত। এর উপর ভিত্তি করে দাবি করা হয় যে, যেহেতু তাদের উপর আল্লাহর লা’নত তাই তাদেরকে হত্যা করতে হবে। কেউ মুরতাদ হওয়াও অনুরূপ বিষয় তাই মুরতাদকে হত্যা করতে হবে। অথচ কারো উপর আল্লাহর লা’নত বা অভিশাপের বিষয়টি আল্লাহ কর্তৃক প্রযোজ্য এবং এর ধরন আল্লাহই নির্ধারণ করবেন। কিন্তু আল্লাহ কাউকে লা’নত বা অভিশাপ দেয়ার কারণে তাকে হত্যা করতে হবে বা হত্যা করা যাবে এরূপ দাবি করা কুরআনসঙ্গত নয়, বরং কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশসমূহের লংঘন। নিম্নে ‘আল্লাহর লা’নত’ এবং ‘রসূলকে কষ্ট দেয়া’ প্রসঙ্গে বিভিন্ন আয়াতের ভিত্তিতে বিষয়টি আলোচনা করা হলো:
২:৮৮ আয়াত অনুযায়ী, যেসব আহলে কিতাব (পূর্ববর্তী কিতাবের ধারক-বাহকরা) মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর কাছে অবতীর্ণ কিতাবের কথা শুনতে প্রস্তুত নয় বলে বলেছিলো যে, তাদের অন্তর গিলাফে আবৃত (অর্থাৎ তারা তাদের মনকে গিলাফ পরিয়ে দিয়েছে, যেন তাতে অন্য কারো কথা প্রবেশ করতে না পারে এবং তাদের লালিত বিশ্বাস বজায় রাখতে পারে); বস্তুত তাদের কুফরের কারণে আল্লাহই তাদের প্রতি লা’নত করেছেন, তাই অল্পসংখ্যক ছাড়া তারা ঈমান আনে না। অন্যকথায় যে অল্পসংখ্যক কুফরী মনোভাব রাখে না, তারা আল্লাহর লা’নত থেকে রক্ষা পায় এবং ঈমান আনে। এ থেকে বুঝা যায় যে, কুফরী মনোভাবের কারণে আল্লাহর লা’নত আসে, আর আল্লাহর লা’নতের কারণে ঈমান আনা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। আবার ২:৮৯ আয়াতেও এরূপ কাফিরদের উপর লা’নতের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যারা ঈমান আনে না তাদের সকলকে হত্যা করতে বলা হয়নি।
২:১৫৯-১৬০ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, যারা আল্লাহর কিতাবের তথ্য মানুষকে স্পষ্টভাবে না জানিয়ে গোপন রাখে তাদের উপর আল্লাহর এবং সমস্ত লা’নতকারীদের লা’নত বা অভিশাপ, তবে তাদের মধ্য থেকে যারা যথাযথ তাওবাহ করে এবং নিজেকে সংশোধন করে এবং গোপন করা বিষয়কে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দেয় আল্লাহ তাদের তাওবাহ কবুল করেন। সুতরাং কারো উপর আল্লাহর লা’নতের কথা বলার কারণে তাকে হত্যা করার সুযোগ নেই।
৪:৪৬ আয়াতে ইহুদিদের মধ্যে যারা আল্লাহর কিতাবের কালিমাকে বিকৃত করে দেয়, তাদের প্রতি আল্লাহর লা’নতের কথা বলা হয়েছে, যার ফলে তাদের অল্পসংখ্যক ছাড়া অন্যরা (অর্থাৎ যাদের উপর লা’নত তারা) ঈমান আনে না। কিন্তু তাদেরকে হত্যা করার কথা বলা হয়নি।
৫:১৩ আয়াতে বনী ইসরাইলের মধ্যকার যারা আল্লাহর কিতাবের কালিমাকে বিকৃত করে দেয়, তাদের প্রতি আল্লাহর লা’নতের কথা বলা হয়েছে এবং তাদের অল্পসংখ্যক ছাড়া অধিকাংশই খেয়ানতকারী বলে জানানো হয়েছে। তারপর তাদেরকে উপেক্ষা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, হত্যা করার কথা বলা হয়নি।
৯:৬৮ আয়াতে মুনাফিক্ব নর-নারী ও কাফিরদেরকে আল্লাহ লা’নত করেছেন এবং তাদের জন্য স্থায়ী শাস্তি (জাহান্নাম) রয়েছে মর্মে ঘোষণা রয়েছে, কিন্তু তাদেরকে হত্যা করতে বলা হয়নি।
২৪:২৩ আয়াতে যারা সতী, সরলমনা ও মু’মিন নারীদের উপর অপবাদ আরোপ করে তাদেকে দুনিয়া ও আখিরাতে লা’নতগ্রস্ত করা হয়েছে মর্মে জানানো হয়েছে। কিন্তু দুুনিয়াতে তাদের এই ফৌজদারি অপরাধের জন্য ৮০ বেত্রাঘাতের দণ্ডবিধি রয়েছে (২৪:৪), মৃত্যুদণ্ড নয়।
৩৩:৬৪ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, আল্লাহ কাফিরদেরকে লা’নত দিয়েছেন। কিন্তু কাফিরদেরকে হত্যা করতে বলা হয়নি।
৪৮:৬ আয়াতে মুনাফিক্ব নারী-পুরুষ ও মুশরিক নারী-পুরুষ যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মন্দ ধারণা পোষণ করে তাদেরকে আল্লাহ লা’নত করে মর্মে জানিয়েছেন। কিন্তু তাদেরকে হত্যা করতে বলেন নি।
৩:৮৬-৯১ আয়াতে যারা ঈমানের পরে কুফর করে তথা মুরতাদ হয় তাদের প্রতি আল্লাহ, ফেরেশতাগণ এবং সমস্ত মানবজাতির পক্ষ থেকে লা’নতের কথা বলা হয়েছে কিন্তু যারা এরপর আবার তাওবাহ করে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে তাদের প্রতি আল্লাহ ক্ষমাশীল বলে জানানো হয়েছে। এতেও মুরতাদকে হত্যা করতে বলা হয়নি, বরং তার জন্য সুযোগ রয়েছে যে, সে মৃত্যু পর্যন্ত কাফির অবস্থায় থাকবে অথবা তাওবাহ করবে।
উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কারো উপর দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর লা’নত বা অভিশাপ থাকার উপর ভিত্তি করে কেউ তাকে হত্যা করার অবকাশ নেই। বরং কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হলে ঐ ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার মতো অপরাধ করতে হবে। অন্যকথায় শুধুমাত্র তাদেরকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে যারা কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে এবং যারা মৃত্যুদণ্ডের উপযোগী ফাসাদ বা বিপর্যয়কর কর্মকাণ্ড করবে, তথা জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে খুন, ডাকাতি ও ধর্ষণ ইত্যাদিতে লিপ্ত হবে (দ্রষ্টব্য- ৫:৩২)।
যেহেতু মুরতাদ হওয়ার কারণে কাউকে হত্যা করার সুযোগ নেই বরং তা কুরআনে প্রদত্ত ধর্মীয় স্বাধীনতার লংঘন এবং তাদেরকে অবকাশ দেয়া বা উপেক্ষা করার নির্দেশনার লংঘন, সর্বোপরি কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিষয়ে থাকা সুনির্দিষ্ট বিধানের লংঘন, তাই মুরতাদকে মৃত্যুদন্ড দেয়া স্বয়ং একটি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ।
“মুরতাদ হওয়ার অর্থ হলো রসূলকে কষ্ট দেয়া এবং এ কারণে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে” বলে যে দাবি করা হয়, এ দাবির জবাবে “রসূল ও মু’মিনদেরকে কষ্ট দেয়ার বিভিন্ন স্বরূপ এবং এর প্রতিক্রিয়ায় মু’মিনদের করণীয়” সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:
৩:১৮৬ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, মু’মিনদেরকে আহলে কিতাব ও মুশরিকদের থেকে অনেক কষ্টকর কথা শুনতে হবে এবং তাতে ধৈর্যধারণ করতে হবে।
৬:৩৪-৩৫ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পূর্ববর্তী রসূলদেরকেও মিথ্যাবাদী বলা হয়েছিলো এবং কষ্ট দেয়া হয়েছিলো, তাতে তাঁরা ধৈর্য ধারণ করেছিলেন। আরো বলা হয়েছে যে, তাদের উপেক্ষা যদি তোমার কাছে কষ্টকর হয় তাহলে ভূগর্ভে সুড়ঙ্গ অথবা আকাশে সোপান অন্বেষণ করে কোনো নিদর্শন নিয়ে আসো। আল্লাহ চাইলে সকলকে সঠিক পথনির্দেশের উপর একত্র করতেন। সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় যে, কেউ কুফর করলে বা মুরতাদ হয়ে গেলে সেটাতে মনোক্ষুন্ন হওয়ার কিছু নেই, পৃথিবীতে সবাইকে সঠিক পথনির্দেশের উপর একত্র করে রাখতে হবে, এমন কোনো দায় নেই, বরং এক্ষেত্রে যার যার নিজ ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নেবে, আল্লাহ প্রদত্ত নির্দেশনা অনুসারে সবার জন্য এরূপ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে।
৯:৬১-৬৬ আয়াতে মুনাফিক্বদের কর্তৃক নবীকে কষ্ট দেয়ার উল্লেখ রয়েছে যে, তারা বলতো নবী কান পাতলা বা সবার কথাই শুনে। আল্লাহ জানিয়েছেন যে, সবার কথাই শুনার বিষয়টি তাদের সবার জন্যই কল্যাণকর। তিনি সবার কথা শুনলেও সবার কথায় সমান আস্থা রাখেন না, বরং তিনি মু’মিন বা বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের কথাতেই আস্থা রাখেন। তারপর মুনাফিক্বদের বিদ্বেষ ও বিদ্রূপের বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তাদেরকে প্রশ্ন করলে তারা বলবে যে, তারা এমনিতেই আলাপ-আলোচনা ও কৌতুক করছিলো। অথচ তাদের এ কৌতুক ছিল আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর আয়াত নিয়ে। সর্বোপরি জানানো হয়েছে যে, আল্লাহ যদি মুনাফিক্বদের একটি দলকে ক্ষমা করেন তবুও অন্য দলকে শাস্তি দিবেন, কারণ তারা অপরাধী। এতে দেখা যায় যে, রসূলকে কষ্ট দানকারী এবং আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর আয়াতকে নিয়ে বিদ্রূপকারী সকল এবং ঈমানের পর কুফরকারী সকল মুনাফিক্বের জন্যই অনিবার্য শাস্তির কথা বলা হয়নি, বরং তাদের মধ্য থেকে যারা শাস্তিযোগ্য অপরাধী তাদের পাশাপাশি এমন লোকও ছিল যাদেরকে ক্ষমা করার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া এতে আল্লাহ মুনাফিক্বদেরকে শাস্তি দিবেন বলে জানিয়েছেন, কিন্তু শুধুমাত্র ঈমান আনার পর কুফর করা, আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর আয়াত নিয়ে বিদ্রূপ করা এবং রসূলের বিষয়ে মন্দ কথা বলার মাধ্যমে তাঁকে কষ্ট দেয়ার কারণে রসূল বা মু’মিনরা তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য কোনো নির্দেশ দেয়া হয়নি।
৩৩:৪৮ আয়াতে কাফির ও মুনাফিকদের দেয়া কষ্টকে উপেক্ষা করতে হবে করতে বলা হয়েছে। সুতরাং যতক্ষণ তাদের দেয়া কষ্ট আল্লাহর ঘোষিত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার মতো জান-মাল-ইজ্জতের উপর নৈরাজ্যকর হামলার চেয়ে নিম্ন পর্যায়ে থাকবে, ততক্ষণ ধৈর্য্যের সাথে তাদের দেয়া কষ্টকে মোকাবেলা করতে হবে এবং সমান মাত্রার প্রতিশোধ গ্রহণ করা যাবে, কিন্তু তাদেরকে হত্যা করা যাবে না।
৩৩:৫৩ আয়াত অনুযায়ী নবীকে কষ্ট দেয়ার একটি রূপ হলো নবীগৃহে খাওয়ার পর হাদীসের জন্য মশগুল হওয়া। কিন্তু যাদের এরূপ আচরণ নবীকে কষ্ট দেয়, তাদেরকে হত্যা করতে বলা হয়নি। অনুরূপভাবে কেউ মুরতাদ হলে নবী মনে কষ্ট পান, তাই তাকে হত্যা করতে হবে- এরূপ দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।
৩৩:৫৮ আয়াতে যারা মু’মিন নারী-পুরুষকে মিথ্যা অপবাদ দেয়ার দেয়ার মাধ্যমে কষ্ট দেয় তারা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু মিথ্যা অপবাদকারীদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে বলা হয়নি। বরং ২৪:৪ আয়াতে মিথ্যা অপবাদদাতাদেরকে ৮০ বেত্রাঘাত করার দণ্ডবিধি দেয়া হয়েছে।
উপরোল্লেখিত আয়াতসূহের নির্দেশনা অনুসারে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কেউ মুরতাদ হলে সে নবীর মনে কষ্ট দেয়া হয় এবং তাই তার উপর আল্লাহর লা’নত বা অভিশাপ বিধায় তাকে হত্যা করে ফেলতে হবে বলে দাবি করার মানে হলো এমন একটি বিষয়কে একটি দণ্ডবিধির জন্য কারণ হিসেবে দাবি করা যে বিষয়ের জন্য সেই দণ্ডবিধি আল্লাহ দেননি, বরং সেই দণ্ডবিধির মাধ্যমে আল্লাহর বিধি-বিধানকেই লংঘন করা হয়। এক কথায়, মুরতাদ হত্যাকে বৈধ প্রমাণ করার জন্য যেসব আয়াতকে উপস্থাপন করা হয় সেই আয়াতসমূহে মুরতাদকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়নি এবং মুরতাদ হত্যাকে বৈধতা দেয়া হয়নি।
৩. গুজব রটনা বা কুৎসা রটনার শাস্তি, যৌন হয়রানির জন্য মৃত্যুদণ্ড বনাম মুরতাদ হত্যা
৩৩:৫৯-৬২ আয়াতে নারীদেরকে কষ্ট দেয়া বা যৌন হয়রানি করার শাস্তি হিসেবে ‘মৃত্যুদণ্ডের’ বিধান দেয়া হয়েছে। সুতরাং ধর্ষণ প্রমাণিত হলে ধর্ষককে মৃত্যুদন্ড দিতে হবে। অনেকে এ আয়াতসমূহের মধ্য থেকে ৩৩:৬০ আয়াতে থাকা একটি শব্দ ‘মুরজিফূন’ এর অর্থ করে থাকেন “গুজব রটনাকারী বা কুৎসা রটনাকারী” এবং তার উপর ভিত্তি করে দাবি করেন যে, যারা নবীর নামে গুজব বা কুৎসা রটনা করে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে এবং একইভাবে মুরতাদদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে তাদের এ দাবি এই সম্পর্কে কুরআনের নির্দেশনা ও বিধিবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। নিম্নে আয়াতগুলোর অনুবাদ উল্লেখপূর্বক এ বিষয়ে পর্যালোচনা করা হলো:
৩৩:৫৯ :: হে নবী, তোমার স্ত্রীদেরকে এবং তোমার কন্যাদেরকে এবং মু’মিনদের নারীদেরকে বলো, যেন তারা তাদের উপর তাদের জিলবাব/ চাদর জড়িয়ে রাখে। এটাই এ সম্ভাবনার নিকটতর যে, তাদেরকে (উন্নত ব্যক্তিত্বসম্পন্না হিসেবে) চিনতে পারা যাবে, ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া (যৌন হয়রানি করা) হবে না। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।
৩৩:৬০ :: যদি (এখন থেকে) মুনাফিক্বরা এবং যাদের মনে রোগ রয়েছে তারা এবং যারা শহরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভীষণভাবে কাঁপিয়ে তোলে তারা (মুরজিফুন)(যৌন হয়রানি করা থেকে) বিরত না থাকে, তাহলে আমি তোমাকে তাদের বিষয়ে তেজোদ্দীপ্ত করবো, তারপর তারা স্বল্প সময় ব্যতীত তোমার প্রতিবেশি হিসেবে থাকতে পারবে না।
৩৩:৬১ :: (তাও থাকবে) অভিশপ্ত অবস্থায়। তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে, পাকড়াও করা হবে এবং একে একে তাদের সকলকে হত্যা করা হবে (মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে)।
৩৩:৬২ :: ইতোপূর্বে যারা অতীত হয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও এটাই ছিল আল্লাহর সুন্নাত (দণ্ডবিধি)। আর তুমি আল্লাহর সুন্নাতে (মূলনীতি বা বিচারনীতিতে) কোনো পরিবর্তন পাবে না।
উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের মধ্য থেকে ৩৩:৫৯ আয়াতের প্রেক্ষিতে ৩৩:৬০ আয়াতে বিরত থাকার অর্থ হলো নারীদেরকে যৌন হয়রানি করা থেকে বিরত থাকা। নারীদেরকে যৌন হয়রানির বিষয়টি তাদেরকে ‘কষ্ট দেয়া’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্বাপর প্রসঙ্গ অনুসারে এখানে এর দ্বারা তাদেরকে যৌন হয়রানি করাকে বুঝায়। এ আয়াতটি নাযিলের মাধ্যমে চরমপত্র ঘোষণা করা হয়েছে যে, এখন থেকে কেউ কোনো নারীকে যৌন হয়রানি করলে তাকে ধরা হবে এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
যারা এখানে ‘মুরজিফ’ শব্দের অর্থ করে থাকেন ‘গুজব রটনাকারী বা কুৎসা রটনাকারী’ এবং তার উপর ভিত্তি করে দাবি করেন যে, আয়াতটিতে তাদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেয়া হয়েছে, তাদের এ অনুবাদ ও দাবি সঠিক নয়। কারণ:
(১) মুরজিফ শব্দটির মূল অক্ষরসমূহ হলো ‘র জীম ফা’। কুরআনে এ মূল অক্ষরসমূহ থেকে গঠিত শব্দটির সকল ব্যবহার থেকে শব্দটির সঠিক অর্থ নির্ণয় করা অত্যন্ত সহজ। কুরআনে এ শব্দমূলের শব্দসমূহের ব্যবহার নিম্নরূপ:
তারজুফু অর্থ ‘প্রকম্পিত হবে’ ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৭৩:১৪:২, ৭৯:৬:২।
রজফাহ অর্থ “ভীষণ প্রকম্পন, ভূমিকম্প” ব্যবহৃত হয়েছে ৪ স্থানে: ৭:৭৮:২, ৭:৯১:২, ৭:১৫৫:৯, ২৯:৩৭:৩।
রজিফাহ অর্থ “ভীষণ প্রকম্পনকারী” ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে : ৭৯:৬:৩।
মুরজিফূন (একবচনে ‘মুরজিফ’) অর্থ “যারা এমন কিছু করে যার ফলে ভীষণ প্রকম্পন সৃষ্টি হয়, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভীষণভাবে কাঁপিয়ে তোলে”।
(২) যদি ‘মুরজিফ’ অর্থ “গুজব রটনাকারী বা কুৎসা রটনাকারী” অর্থ করা হয় এবং দাবি করা হয় যে, গুজব রটনা বা কুৎসা রটনার শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড, তাহলে আয়াতটিতে থাকা অন্য দুই বিভাগের লোকদের জন্যও মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে যারা মুনাফিক্ব তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে এবং যাদের মনে রোগ আছে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। অথচ আয়াতটিতে তার পূর্বের আয়াতের সাথে সঙ্গতি রেখে বলা হয়েছে “যদি তারা বিরত না হয় অর্থাৎ নারীদেরকে কষ্ট দেয়া থেকে, বক্তব্য প্রসঙ্গ অনুসারে এর অর্থ হলো যৌন হয়রানি করা থেকে বিরত না হয়, তাহলে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। অন্য কথায়, এখানে মনে রোগ থাকার জন্য বা মুনাফিক্ব হওয়ার জন্য মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা হয়নি, বরং মনে রোগ থাকা, মুনাফিক্ব হওয়া এবং মুরজিফ বা এমন কর্মকাণ্ড সম্পাদনকারী হওয়া যার ফলে সমাজে ভীষণ প্রকম্পন সৃষ্টি হয় এই তিন বিভাগের লোকেরা যদি ‘যৌন হয়রানি করা’ থেকে বিরত না হয়, তাহলে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
নিছক মনে রোগ থাকার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কোনো মানে হয় না, কারণ ‘মনে রোগ থাকা’ একটি ব্যাপক বিষয়, যা দ্বারা মনের যাবতীয় অনৈতিক ও দোষণীয় দোষত্রুটিকে বুঝায়। অনুরূপভাবে শুধু মুনাফিক হওয়ার কারণেই কাউকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার বিষয়টি মুনাফিক্বদের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক। আর যারা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে ভীষণভাবে কাঁপিয়ে তোলে তাদেরকে শুধু এ কারণে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেয়ার কথা বলা হয়নি, বরং ফাসাদকারীদেরকে তাদের ফাসাদের ধরন অনুসারে মৃত্যুদণ্ড বা দেশান্তর করার বিভিন্নরূপ শাস্তি দেয়ার অবকাশ আছে মর্মে ৫:৩৩ আয়াতে জানানো হয়েছে। সুতরাং ৩৩:৬০-৬১ আয়াতে শুধুমাত্র ‘মুরজিফ’ হওয়ার কারণেই মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা হয়নি। বরং ৩৩:৫৯ আয়াতের বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় এখানে “যারা মুনাফিক্ব এবং যাদের মনে রোগ আছে এবং যারা মুরজিফ বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজকে ভীষণভাবে কাঁপিয়ে তোলে” এই লোকেরা যদি নারীদেরকে যৌন হয়রানি করা থেকে বিরত না থাকে, তাহলে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
(৩) রসূলের নামে কটুক্তি বা কুৎসা রটনার জন্য মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি ঘোষিত হয়নি। কুরআনে রসূল ও মু’মিনদেরকে কটুক্তির মোকাবেলায় ধৈর্য ধারণ এবং আল্লাহর পবিত্রতা জ্ঞাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, কটুক্তিকারীদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কথা বলা হয়নি। অপবাদ অপপ্রচার যেমন রসূলের স্ত্রী বা যে কোন সতী নারীর চরিত্রের বিষয়ে অপবাদের ঘটনায় কুরআনে অপবাদকারীর প্রতি যে দণ্ডবিধি দেয়া হয়েছে তা হলো: অপবাদকারীকে ৮০ বেত্রাঘাত করতে হবে। অপবাদ ও অপবাদের প্রচারের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়নি। (২৪:১১-২০, ২৪:৪)
(৪) গুজব যেমন কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা, যার ফলে ঐ সম্প্রদায়ের উপর ভুলক্রমে কেউ হামলা করে বসতে পারে, এর বিষয়ে করণীয় নির্দেশ করে ৪৯:৬ আয়াতে বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ফাসেক্ব ব্যক্তিও কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তা সত্য নাকি মিথ্যা গুজব তা যাচাই করে নিতে হবে। মিথ্যা সংবাদ বা গুজব পরিবেশনকারীর জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়নি। বরং মিথ্যা অপবাদদাতার মতোই গুজব তৈরিকারীও মিথ্যা দাবি (বুহতান) এর অভিযোগে অভিযুক্ত, তাই তার ক্ষেত্রেও অপবাদদাতার মতো একই শাস্তি প্রযোজ্য।
সুতরাং উপরোল্লেখিত বিশ্লেষণ অনুসারে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ৩৩:৫৯-৬২ আয়াতে নারীদেরকে যৌন হয়রানি করার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেয়া হয়েছে।
নারীদেরকে যৌন হয়রানি করার জন্য প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিকে ‘মুরতাদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া’র দলীল হিসেবে পেশ করা যেতে পারে না। কারণ এ দুটি বিষয় সম্পূর্ণ দুটি ভিন্নরূপ বিষয়, যার একটি চরম পর্যায়ের সামাজিক বা ফৌজদারি অপরাধ, আর অন্যটি ধর্মীয় স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত বিষয়।
৪. আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শাস্তি বনাম মুরতাদ হত্যা
৫:৩৩-৩৪ :: নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে (আল্লাহ প্রদত্ত ও রসূলের প্রবর্তিত বিধান অনুযায়ী পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বা বিদ্রোহাত্মক) যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং পৃথিবীতে ফাসাদ করতে (তথা বিপর্যয় ঘটাতে বা জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা ধ্বংস করে দেয়ার অপতৎপরতা ও সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে) সচেষ্ট হয়, তাদের প্রতিফল (দন্ডবিধি) এই যে, তাদেরকে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হবে অথবা শুলে চড়িয়ে হত্যা করা হবে অথবা তাদের হাতসমূহ ও পাসমূহ বিপরীত দিকে থেকে (ডান হাত বাম পা বা বাম হাত ডান পা) কেটে দেয়া হবে অথবা তাদেরকে (মুক্তভাবে চলাচলের) ভূখন্ড থেকে নির্বাসিত করা হবে। এটা তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্চনা এবং তাদের জন্য আখিরাতে মহাশাস্তি রয়েছে। তারা ছাড়া যারা তোমাদের করায়ত্ত হওয়ার আগেই তাওবাহ করে। জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।
৫:৩৩ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, যারা আল্লাহ প্রদত্ত ও রসূলের প্রবর্তিত বিধান অনুযায়ী পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বা বিদ্রোহাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং পৃথিবীতে ফাসাদ করতে তথা বিপর্যয় ঘটাতে বা জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা ধ্বংস করে দেয়ার অপতৎপরতা ও সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয় তাদের দণ্ডিবিধি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, (১) তাদেরকে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হবে, (২) অথবা তাদেরকে শুলে চড়িয়ে হত্যা করা হবে, (৩) অথবা তাদের হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে, যেমন: ডান হাত ও বাম পা অথবা বাম হাত ও ডান পা; (৪) অথবা তাদেরকে মুক্তভাবে চলাচলের ভূখণ্ড থেকে নির্বাসিত করা হবে।
এই আয়াতের (৫:৩৩) রেফারেন্স দিয়ে দাবি করা হয় যে, একজন ব্যক্তি মুরতাদ হওয়ার মানে হলো আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে চলে যাওয়া বা বিদ্রোহ করা। তাই মুরতাদের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।
অথচ আয়াতটিতে মুরতাদের প্রসঙ্গে কোনো কথা বলা হয়নি বা মুরতাদের শাস্তি প্রসঙ্গও আলোচিত হয়নি। কেউ মুরতাদ হয়ে যেমন আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রবর্তিত বিধান অনুযায়ী পরিচালিত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে, তেমনি যারা কখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি এমন কাফির-মুশরিক বা অমুসলিমরাও এরূপ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক বা আক্রমণাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে।
এছাড়া এ আয়াতে যারা এরূপ যুদ্ধে লিপ্ত হবে তাদের সকলের জন্য একই শাস্তির বিধান দেয়া হয়নি, বরং অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় তাদের উপর চারটি বিভিন্ন ধরনের শাস্তি প্রযোজ্য হতে পারে।
যারা ব্যাপকভাবে হত্যাযজ্ঞ চালায় তাদেরকে ব্যাপকভাবে তথা তাদের সকলকে একযোগে হত্যা করা হবে। যারা কাউকে অন্যায়ভাবে শুলিতে চড়িয়ে হত্যা করে তাদেরকেও শাস্তিস্বরূপ শুলিতে চড়িয়ে হত্যা করা হবে। যারা কাউকে অন্যায়ভাবে হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়, তাদেরও হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে। আর যারা এসব কোনোটির সাথে জড়িত হয়নি কিন্তু বিদ্রোহাত্মক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে তাদেরকে ভূখণ্ডে মুক্তভাবে চলাচল করা থেকে নির্বাসিত করা হবে।
সুতরাং ৫:৩৩ আয়াতের রেফারেন্স দিয়ে মুরতাদ তথা ইসলাম ত্যাগকারীদেরকে মুত্যুদণ্ড দেয়ার দাবি করার দাবি গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ আয়াতটিতে এরূপ কোনো বিধান দেয়া হয়নি, বরং আয়াতটিতে মুরতাদ প্রসঙ্গে কোনো বক্তব্যই প্রদান করা হয়নি।
৫:৩৩ আয়াতে যাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কথা বলা হয়েছে তা পূর্ববর্তী আয়াত ৫:৩২ এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অবস্থায় প্রযোজ্য, এটি শুধুমাত্র কেউ আল্লাহ প্রদত্ত ও রসূলের প্রচারিত দ্বীন থেকে ফিরে যাওয়ার কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বৈধতা প্রদান করে না। এ বিষয়টির সম্যক উপলব্ধির জন্য নিম্নে ৫:৩২ আয়াতটি উল্লেখ করা হলো:
৫:৩২ :: এই (আদম সন্তানদের মধ্যে একজনকে অন্যজন কর্তৃক অন্যায় হত্যার) প্রেক্ষিতে আমরা বানী ইসরাইলের উপর বিধিবদ্ধ করে দিয়েছি যে, যে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে সেই ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করার কারণে ছাড়া অথবা পৃথিবীতে ফাসাদ করা (তথা বিপর্যয় ঘটানো বা জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা ধ্বংস করে দেয়ার অপতৎপরতা ও সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করা) ছাড়া, সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করলো এবং যে ব্যক্তি তার (অন্যায় হত্যার হুমকিতে থাকা ও অপমৃত্যুর আশংকায় থাকা ব্যক্তির) জীবন বাঁচালো সে যেন সমস্ত মানুষের জীবন বাঁচালো। আর অবশ্যই তাদের কাছে আমাদের রসূলগণ স্পষ্ট যৌক্তিক প্রমাণসমূহসহ এসেছে, তারপর তাদের মধ্য থেকে অধিকাংশ এরপরও পৃথিবীতে সীমা লঙ্ঘনকারী হয়ে রয়েছে।
৫:৩২ আয়াত থেকে জানা যায় যে, দুটিমাত্র কারণে কাউকে হত্যা করা বা মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে যথা: (১) সে কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার শাস্তিস্বরূপ, (২) সে পৃথিবীতে ফাসাদ/বিপর্যয় ঘটানো তথা জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা ধ্বংস করে দেয়ার অপতৎপরতা, যেমন: কোনো রাষ্ট্র বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অন্যায় যুদ্ধ, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করতে প্রচেষ্টা চালানো, ডাকাতি, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ইত্যাদি।
৫:৩২-৩৩ আয়াতের সমন্বিত তথ্য অনুসারে ‘আল্লাহ ও রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার’ অপরাধটি ‘পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টির’ সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। এর মাধ্যমে মুসলিম শাসনাধীন রাষ্ট্রে কোনো বিরুদ্ধবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের মতাদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে হত্যাযোগ্য অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়নি।
বর্তমানে কোনো রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব চর্চাকারী শাসকগোষ্ঠী যদি মুসলিম পরিচয়ধারী হয়, কিন্তু ইসলামের সুমহান শিক্ষা তথা আদল-ইনসাফের পরিবর্তে জুলুম শোষণ চালায় আর সরকার পরিবর্তনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বিনষ্ট হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে বৈপ্লবিক সরকার গঠনের জন্য কোনো যুদ্ধ পরিচালিত হয়, সেরূপ ন্যায় বিদ্রোহকে অন্যায় বিদ্রোহের সমান সাব্যস্ত করার সুযোগ নেই। যারা রাষ্ট্রে কোনো শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বা অন্যায় বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং যারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অপব্যবহারের মাধ্যমে কৃত সন্ত্রাসের মোকাবেলায় ন্যায়সঙ্গতভাবে বিদ্রোহ করে এ উভয় শ্রেণি সমান নয়। কুরআন মু’মিনদেরকে সাম্প্রদায়িকতাবাদের ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়।
একটি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব যেমন জন্মগত সূত্রে হতে পারে, তেমনি অনুমোদন সূত্রে হতে পারে। কোনো ব্যক্তি নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় তার নাগরিকত্ব পরিবর্তন করতে পারে। নাগরিকত্ব পরিবর্তন এবং কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দুটি ভিন্ন বিষয়। নিয়মানুবর্তিতা বজায় রেখে এক রাষ্ট্রে অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকের অবস্থান একটি স্বাভাবিক বিষয়। কোনো নাগরিক দ্বিনাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারে, যেখানে একটি তার প্রথম শ্রেণির ও অন্যটি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্ব। এ বিষয়গুলো স্বাভাবিক অবস্থায় গ্রহণযোগ্য এবং পারস্পরিক সম্পর্ক ও উন্নয়নের সহায়ক হতে পারে। এমনকি অনুমোদনসূত্রে নাগরিকত্ব লাভকারীকেও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃত্বে অংশগ্রহণের অধিকার প্রদান একটি রাষ্ট্রকে অনেক এগিয়ে দিতে পারে। যতক্ষন পর্যন্ত কোনো নাগরিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও বিপর্যয় সৃষ্টিতে লিপ্ত হবে না, ততক্ষণ সে রাষ্ট্রের জন্য এবং রাষ্ট্র তার জন্য নিরাপদ। এ রাষ্ট্রীয় নীতিগুলোর একটি সম্পূরক নীতি হলো একটি রাষ্ট্রে একাধিক ধর্মের সহাবস্থান এবং ধর্ম পরিবর্তনের অধিকার ও স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখার নীতি।
কুরআনে কোনো ব্যক্তি ঈমান আনা এবং তারপর কুফর করা এবং তারপর ঈমান আনা এবং তারপর কুফর করা তথা বারবার ঈমান আনা এবং কুফর করার সুযোগ রাখা হয়েছে। অন্য কথায়, কেউ যেমন ইসলামে প্রবেশ করতে পারে, তেমনি সে ইসলাম থেকে বেরিয়েও যেতে পারে, আবার চাইলে আবার প্রবেশ করতে পারে এবং এমনকি আবারও বেরিয়ে যেতে পারে। যদি কারো ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া নিরাপত্তার দিক থেকে হুমকির কারণ হয়, তাহলে মু’মিনদেরকে অধিকতর সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, কিন্তু যতক্ষণ সে কোনো ক্ষতিসাধন করবে না, ততক্ষণ শুধুমাত্র ইসলাম ত্যাগের কারণে তাকে কোনো শাস্তি দেয়ার অবকাশ নেই। এমনকি যারা মুখে ঈমানের কথা বলে কিন্তু বাস্তবে মুনাফিক্বীতে লিপ্ত বা সুবিধাবাদী নীতি অনুসরণ করে, তাদেরকেও হামলা করা থেকে নিবৃত্ত থাকতে বলা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা হামলা করে, বরং তাদেরকে উপেক্ষা করতে ও সদুপদেশ দিতে বলা হয়েছে (৪:৯০, ৪:৬০-৬৩)।
মুরতাদ হত্যার পক্ষে একটি যুক্তি দেয়া হয় যে, যদি মুরতাদকে হত্যা করা না হয়, তাহলে যারা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে, কিন্তু নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করবে, যেমন ‘খতমে নবুওয়াতের’ অপব্যাখ্যা করার মাধ্যমে বর্তমানে কোনো মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদারকে নবী হিসেবে বিশ্বাস করবে অথচ নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করবে তাদেরকে প্রতিরোধ করা যাবে না। ফলস্বরূপ ইসলামের বিকৃতি দেখা দিবে এবং অমুসলিম ও মুসলিম সম্প্রদায় মিশে যাবে, মুসলিম না হয়েও নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করার সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু এ যুক্তি মুরতাদকে হত্যা করার জন্য কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি হতে পারে না। কারণ কুরআনে কাউকে ‘ইখতিলাফ’ বা ‘মতভেদের’ কারণে হত্যাযোগ্য সাব্যস্ত করা হয়নি। বরং কুরআনে হত্যাযোগ্য অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে শুধুমাত্র অন্যায়ভাবে হত্যাকারী এবং পৃথিবীতে মানুষের জান-মাল-ইজ্জতের মারাত্মক বিপর্যয়কারীদেরকে।
সুতরাং যারা কোনো মিথ্যা নবুয়াতের দাবিদারকে নবী হিসেবে বিশ্বাস করেও নিজেকে মুসলিম পরিচয় দিবে, বিপরীতপক্ষ তাদেরকে অমুসলিম বলতে পারে, তারা উভয়পক্ষ উভয়পক্ষকে অমুসলিম বলতে পারে। এমতাবস্থায় নিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে কোন পক্ষের সাথে একত্রিত হয়ে কুরআনের বিধি-বিধান চর্চা করবে তা তাকে কুরআন দ্বারা স্বযাচাই করতে হবে। উভয়পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানের পক্ষে কুরআনের বক্তব্য তুলে ধরতে পারে। যে পক্ষ কুরআনের অপব্যাখ্যা করছে তাদেরকে সরাসরি আল্লাহ শাস্তি দিবেন, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়। ধর্মীয় কারণে কারো উপর হামলা করা যেতে পারে না, বা কাউকে দণ্ড দেয়া যেতে পারে না।
কুরআনে মানব সম্প্রদায়ের কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তার সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো দণ্ড কার্যকর করার মতো যেসব দণ্ডবিধি দেয়া হয়েছে তা শুধুমাত্র সামাজিক অপরাধ তথা চুরি-ডাকাতি, খুন-ধর্ষণ ইত্যাদির জন্য। ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠাকারী ইসলামী আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহও ‘ফাসাদ’ বা নৈরাজ্য সৃষ্টির একটি রূপ, আর তাই এজন্য কঠোর দণ্ডবিধি রয়েছে। কিন্তু ধর্মের কোনো বিশেষ ব্যাখ্যা, তা সঠিক হোক বা ভুল হোক, তার ভিত্তিতে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় গঠিত হলে তাদেরকে কোনোরূপ সামাজিক অপরাধ সংঘটন ছাড়াই নিছক ধর্মীয় ভিন্ন মতাবলম্বনের জন্য কোনো দণ্ড আরোপ করা যেতে পারে না। অনুরূপভাবে কেউ কোনো ধর্ম এবং বিশেষ ধর্মীয় মত বা ব্যাখ্যা ত্যাগ করার জন্য, এমনকি কুরআন অনুযায়ী আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য সত্য ধর্ম ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হওয়ার জন্য কারো উপর দণ্ড আরোপ করা যাবে না। কারণ নিতান্ত ধর্মীয় অপরাধের শাস্তি আল্লাহ নিজেই প্রদান করবেন, পৃথিবীতে তিনি মানুষকে যেকোনো ধর্ম গ্রহণ করা ও ত্যাগ করার ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছেন।
৫. নবী মূসা কর্তৃক কিছু বাছুর পূজারীকে হত্যার নির্দেশ বনাম মুরতাদ হত্যা
২:৫৪ আয়াতের ভিত্তিতে দাবি করা হয় যে, নবী মূসার সময়ে যারা বাছুর পূজা করেছিলো নবী তাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন তথা বাছুর পূজার জন্য মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন। এটাকে মুরতাদ হত্যার বৈধতার দলীল হিসেবে দাবি করা হয়। এ দাবির সঠিক পর্যালোচনার জন্য ২:৫৪ আয়াতের পাশাপাশি এর সাথে সম্পর্কিত ৭:১৫০ আয়াতের সমন্বিত অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। নিম্নে আয়াত দুটি উল্লেখ করা হলো:
২:৫৪ :: আর (সেই সময়ের কথা উল্লেখ্য) যখন মূসা তার জনগোষ্ঠীকে বলেছিলো, হে আমার ক্বওম, নিশ্চয় তোমরা বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করে তোমাদের নিজেদের উপর জুলুম করেছো। সুতরাং তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তার দিকে তাওবাহ করো (ফিরে এসেো)। সেই সাথে তোমরা তোমাদের নিজেদের (মধ্যকার বাড়াবাড়িকারীদেরকে) হত্যা করো (মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করো)। এটাই তোমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে তোমাদের জন্য উত্তম। তখন তিনি তোমাদের তাওবাহ কবুল করেছেন। নিশ্চয় তিনি তাওবাহ কবুলকারী দয়ালু।
৭:১৫০ :: আর যখন মূসা তার জনগোষ্ঠীর নিকট রাগান্বিত ও বিক্ষুব্ধ অবস্থায় ফিরে গেলো, তখন বললো, “আমার পরে তোমরা আমার কী মন্দ প্রতিনিধিত্ব করেছো! তোমাদের প্রভুর (পক্ষ থেকে উপাসনা পদ্ধতির) আদেশ আসার আগেই তোমরা (মনগড়াভাবে উপাসনা করতে) তাড়াহুড়া করলে?” আর সে ফলকগুলো ফেলে দিলো আর তার ভাইয়ের মাথা ধরে নিজের দিকে টেনে আনতে লাগলো। সে (হারুন) বললো, “হে আমার মায়ের ছেলে (সহোদর ভাই), এ জাতি আমাকে দুর্বল মনে করেছে এবং আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে। সুতরাং তাই তুমি আমার ব্যাপারে শত্রুদেরকে আনন্দিত করো না এবং আমাকে জালিম ক্বওমের অন্তর্ভুক্ত সাব্যস্ত করো না।”
উপরোল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ২:৫৪ আয়াতে বর্ণিত মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি সবার উপর নয়, বরং আল্লাহ তাদের মধ্যকার তাওবাকারীদের তাওবা কবুল করেছেন। বস্তুত ২:৫১-৫২ আয়াতেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যারা বাছুর পূজা করেছিলো তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিলো। ২:৯৩ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, যাদের অন্তরে গোবৎসপ্রীতি সিঞ্চিত হয়েছিল তারা তূর পর্বতের অঙ্গীকারের সময় বলেছিল, “শুনলাম ও অমান্য করলাম”। এ থেকে বুঝা যায় যে, গোবৎসপ্রীতির কারণে তাদেরকে হত্যা করে ফেলা হয়নি। ৪:১৫৩ আয়াতেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাদের গোবৎস পূজার পাপ ক্ষমা করা হয়েছিল।
বস্তুত শিরকের কারণে মানুষের আমল বা কর্মকাণ্ড চূড়ান্ত বিচারে ব্যর্থ হয়ে যায়, কিন্তু শিরকের কারণে কাউকে হত্যা করার অবকাশ নেই। ২৫:৬৭-৭০ আয়াত থেকে জানা যায় যে, শিরক করা সত্ত্বেও যারা তাওবাহ করবে তাদের জন্য ক্ষমা রয়েছে। ৯:১১ আয়াত অনুযায়ী, যেসব মুশরিক তাওবাহ করবে তারা মু’মিনদের দ্বীনী বা একই ধর্মাদর্শের ভাই হিসেবে সাব্যস্ত হবে। অন্য কথায়, মুশরিকরা শিরক ত্যাগ করে মু’মিন হওয়ার সম্পূর্ণ সুযোগ রয়েছে। কুরআনের কোনো আয়াতে শিরকের জন্য কোনো মানুষ অপর মানুষের উপর কোনো দণ্ড প্রয়োগ করার সুযোগ রাখা হয়নি।
সুতরাং ২:৫৪ আয়াতে বাছুর পূজারীদের মধ্য থেকে যাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো তাদেরকে বাছুর পূজার কারণে নয়, বরং অন্য বাড়াবাড়ির জন্য হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। আর ৭:১৫০ আয়াত থেকে জানা যায় যে, সেই অন্য অপরাধটি ছিলো একটি সামাজিক অপরাধ ‘এটেম্পট টু মার্ডার’। বাছুর পুজা থেকে নিষেধ করায় কিছু লোক নবী হারুণকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলো, তাদেরকেই মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং যদি ধর্মীয় কারণে কাউকে হত্যা করা হয় বা হত্যার চেষ্টা করা হয় তাহলে ঐ অপরাধীর উপরও পার্থিব দণ্ডবিধি কার্যকর হবে। আর এ থেকে আরো বুঝা যায় যে, এটেম্পট টু মার্ডারও মৃত্যুদন্ডযোগ্য ফাসাদ বা নৈরাজ্য সৃষ্টি হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
৭:১৫২-১৫৩ আয়াত থেকে জানা যায় যে, যারা গোবৎস পুজা করেছিল তাদের উপর তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে ক্রোধ এবং দুনিয়াতে লাঞ্চনা নিপতিত হয়েছে। তবে এ লাঞ্চনা তিনি সরাসরি তথা প্রাকৃতিকভাবে দিবেন। কেননা তিনি নবী মূসাকে তাদের উপর দণ্ডবিধি আরোপের নির্দেশ দেন নি, বরং এরূপ নিকৃষ্ট কর্মসম্পাদনকারীদের মধ্য থেকে তাওবাহকারীদের প্রতি তিনি ক্ষমাশীল বলে জানিয়ে দিয়েছেন।
উপরোল্লেখিত অধ্যয়ন অনুসারে বলা যায় যে, নবী মূসা কর্তৃক কিছু বাছুর পূজারীকে হত্যার নির্দেশ বাছুর পূজার কারণে নয়, বরং বাছুর পূজার ক্ষেত্রে নিষেধ করায় তারা নবী হারূণকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলো (অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে, যদি নবী মূসার জন্য অপেক্ষার কথা বলা না হতো তাহলে তারা তাঁকে হত্যা করে ফেলতো) বিধায় তাদেরকে এ দণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
অবশ্য এই নির্দেশ “তোমাদের নিজেদেরকে হত্যা করো” বাক্যটিকে রূপকভাবে “তোমাদের বাছুর পূজার প্রবৃত্তিকে দমন করো” অর্থে গ্রহণ করলে বিষয়টি কোনো হত্যাকাণ্ডের সাথেই সম্পর্কিত থাকে না এবং সেই অবস্থায়ও তা কুরআনের কোনো বিধানের সার্থে অসঙ্গতিপূর্ণ হয় না।
সুতরাং কোনোভাবে ২:৫৪ আয়াতটি মুরতাদ হত্যার বৈধতা প্রদান করে না। বরং মুরতাদ ও হত্যা সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সামগ্রিক বক্তব্য অনুসারে, আল কুরআনের আলোকে মুরতাদ হত্যা সম্পূর্ণ অবৈধ।