আল কুরআনের আলোকে মুরতাদ - ইক্বরাবইটির পিডিএফ কপি ডাউনলোড

আল কুরআনের আলোকে মুরতাদ হত্যার অবৈধতা

বইটি সম্পর্কে

মুরতাদ বা ধর্মত্যাগীকে এবং ধর্মীয় বিষয়ে সমলোচনা ও ধর্মানুভূতিতে আঘাতের জন্য মৃত্যুদণ্ডের দাবি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতার বহির্প্রকাশ হলেও এর পেছনে ধর্মের প্রকৃত নির্দেশনা সম্পর্কে বিভ্রান্তিও বহুলাংশে দায়ী। বিশ্বব্যাপী ধর্মের নামে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে শুধু কঠোর উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, বরং এ বিষয়ে যে ধর্মীয় বিভ্রান্তি রয়েছে তার অপনোদনও জরুরি। আর এই বিভ্রান্তি অপনোদনের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবাধিকার বিষয়ে আল কুরআনের শিক্ষার বস্তুনিষ্ঠ প্রচারই সর্বাধিক কার্যকর মহৌষধ।

এ বইয়ে আল কুরআনের আলোকে মুরতাদ হত্যার অবৈধতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। যেহেতু ধর্মীয় বিশ্বাস-অবিশ্বাস, গ্রহণ এবং ধর্মত্যাগের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা স্রষ্টা প্রদত্ত, তাই মুরতাদ বা ধর্মত্যাগের জন্য পার্থিব শাস্তির দাবি এবং মুরতাদ হত্যা উভয়টি সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। এ অবৈধতার বিষয়টি কুরআনে ধর্ম ও সমাজ জীবন সম্পর্কে যে ন্যায়সঙ্গত ও কল্যাণকর রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়েছে তার সামগ্রিক কাঠামোর সাথে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বিষয়। তাই এ বইয়ে বিষয়টির বস্তুনিষ্ঠ অনুধাবনের জন্য এর সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রসঙ্গের আলোচনা করা হয়েছে।

মুরতাদ হত্যার নীতি কুরআনে উল্লেখিত ধর্মীয় স্বাধীনতার নীতিমালাকে লঙ্ঘন করে। যেহেতু কুরআনের দণ্ডবিধিতে মুরতাদকে কোনোরূপ শাস্তি প্রদানের অবকাশ নেই, তাই মুরতাদ হত্যা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ হত্যা।

ইসলামের সুমহান শিক্ষার প্রচার এবং মুসলিম উম্মাহর উদ্ভব ঘটানোর পেছনে থাকা উদ্দেশ্য অর্জন তথা মানবজাতির কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য ‘আল কুরআনের আলোকে মুরতাদ হত্যার অবৈধতার’ বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও পর্যালোচিত হওয়া প্রয়োজন। যারা জঙ্গীবাদ ও ধর্মীয় উগ্রতার বৈশ্বিক হুমকি মোকাবেলা করে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ার প্রত্যাশা করেন তাদের সবার জন্যই এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ববহ। বইটিতে কোনো ক্ষেত্রে কোনোরূপ ত্রুটি চিহ্নিত হলে তা পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করা হবে, ইনশাআল্লাহ।

এক নজরে মূল প্রতিপাদ্য

১. মুসলিমদের মধ্য থেকে কেউ ইসলাম ত্যাগ করলে তাকে ‘মুরতাদ’ বলা হয়। দাবি করা হয় যে, কেউ মুরতাদ হলে তাকে শাস্তিস্বরূপ হত্যা করতে হবে। একইভাবে ধর্মীয় বিষয়ে নিন্দা বা ধর্মানুভূতিতে আঘাতের জন্যও মৃত্যুদণ্ডের দাবি করা হয়। আল কুরআনের আলোকে পর্যালোচনা করলে এরূপ হত্যা সম্পূর্ণ অবৈধ হিসেবে প্রমাণিত হয়।

২. ‘মুরতাদ হত্যার অবৈধতা’ বিষয়টি দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা বিষয়ে আল কুরআনের বিভিন্ন মৌলিক নীতিমালার সাথে সম্পর্কিত। এর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো: (ক) ‘রসূলের দায়িত্ব শুধুমাত্র প্রচার করা, তিনি সত্য ধর্ম গ্রহণের জন্য বলপ্রয়োগ করতে পারবেন না’, (খ) যার ইচ্ছা সেই ঈমান আনতে পারে অথবা কুফর বা প্রত্যাখ্যানও করতে পারে, (গ) যে ইসলাম গ্রহণ করবে সে ইসলাম চর্চা করবে আর যে অন্য ধর্ম অবলম্বন করবে সে তার ধর্ম চর্চা করবে, প্রত্যেকের ধর্মীয় ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা রয়েছে ইত্যাদি।

৩. কুরআনে শিরককে সবচেয়ে বড় অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। শিরক হলো আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারে কাউকে কোনোরূপ অংশীদার সাব্যস্ত করা এবং আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের মতো অন্য বিধানকে ঐশী বিধানের সমতুল্য ও পরমভাবে গ্রহণ করা। কিন্তু কুরআনে কাউকে বলপ্রয়োগ করে শিরক থেকে বিরত রাখার সুযোগ দেয়া হয়নি বা শিরক করার কারণে কাউকে পৃথিবীতে কোন ধরনের দৈহিক অথবা মানসিক শাস্তি দেয়ার অধিকারও দেয়া হয়নি। শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ হলেও এটি এক ব্যক্তি কর্তৃক অন্য ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার বিষয় নয়, বরং এর মাধ্যমে ব্যক্তি নিজে বিশ্বাসগত ও জীবনাচারগত ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আল্লাহর ঘোষণা অনুসারে শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও এ বিষয়ে মনস্তাত্বিক স্বাধীনতা রয়েছে।

৪. ধর্মীয় বিষয় যেমন আল্লাহ, তাঁর কিতাব ও তাঁর রসূল সম্পর্কে মিথ্যারোপ করা, কটুক্তি এবং অপপ্রচারের জবাবে রসূল ও মু’মিনদেরকে ধৈর্য ধারণ এবং আল্লাহর পবিত্রতা জ্ঞাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেই সাথে বলা হয়েছে যে, যারা এরূপ করে তাদের মোকাবেলায় প্রকৃত সত্য উপস্থাপন করা এবং তাদেরকে ক্ষমা ও উপেক্ষা করা উচিত।

৫. ধর্ম অথবা যেকোনো বিষয়ে সেটির সত্যাসত্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি হলে মানুষ পর্যালোচনার মাধ্যমে সত্য গ্রহণের পথে অগ্রসর হয়। কিন্তু সঠিক কর্মনীতি অবলম্বন না করে নিছক নেতিবাচক সন্দেহ পোষণ করা উচিত নয়। কুরআনের দাবি হলো কুরআনের যাবতীয় তথ্য বিশ্বপ্রভুর পক্ষ থেকে আগত সত্য। তাই এর প্রতি সন্দেহ পোষণ করা উচিত নয়। সন্দেহ নিরসনের ক্ষেত্রে যৌক্তিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। আর সমালোচনামুখী দৃষ্টিভঙ্গিতে যাচাই করাই হলো সেই যৌক্তিক পদ্ধতি। যারা অযথা সন্দেহে নিপতিত থাকবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু সন্দেহ প্রকাশ বা সমালোচনার জন্য কাউকে শাস্তি প্রদানের অবকাশ নেই।

৬. শিরক এবং অনুরূপভাবে যা কিছু শুধুমাত্র ধর্মীয় অপরাধ সেজন্য কুরআনে কোনো দণ্ডবিধি দেয়া হয়নি। অন্য কথায় ধর্মীয় স্বাধীনতার সম্পূরক নীতি হিসেবে কুরআনে প্রকৃত সত্য ধর্মের বিপরীত বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধর্মীয় অপরাধ সংঘটিত হলে সেজন্য কোনো মানুষ অপর মানুষকে শাস্তি দেয়ার অবকাশ রাখা হয়নি। অন্যদিকে সামাজিক অপরাধ তথা যেসব অপরাধের মাধ্যমে সামাজিক ক্ষতি (এক ব্যক্তি কর্তৃক অন্য ব্যক্তির ক্ষতি) সাধিত হয়, সেরূপ অপরাধের জন্য দণ্ডবিধি রয়েছে। যেমন: চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, যৌন হয়রানি, নরহত্যা ইত্যাদি।

৭. একটি রাষ্ট্রে একাধিক ধর্মীয় সম্প্রদায় বসবাস করতে পারে। কুরআনে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং শুধুমাত্র সামাজিক অপরাধের ক্ষেত্রে দণ্ডবিধি প্রণয়নের নীতির সাথে সমন্বয় রেখে রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানে রাখা হয়েছে।

৮. মুরতাদ (ধর্মত্যাগী), ইলহাদ (ধর্মীয় বিষয়ে অবমাননা ও ধর্মানুভূতিতে আঘাত) এবং তাহরীফ (ধর্মীয় তথ্যের বিকৃতি) বিষয়ক আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে দেখা যায় যে, এসব বিষয়কে যৌক্তিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে, কিন্তু এসবের জন্য কাউকে অন্য কারো কর্তৃক দণ্ডযোগ্য সাব্যস্ত করা যাবে না।

৯. কুরআনে মৃত্যুদণ্ডের অপরাধকে মৌলিকভাবে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা: (১) কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, (২) জান, মাল, ইজ্জতের উপর হামলার মাধ্যমে ফাসাদ বা বিপর্যয় সৃষ্টি, যেজন্য মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বা অবকাশ রয়েছে। এই দ্বিতীয় বিভাগের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত ও তাঁর রসূলের প্রবর্তিত আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে ফাসাদ সৃষ্টি অন্তর্ভুক্ত। কুরআনে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য হিসেবে সাব্যস্ত অপরাধের বাইরে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিলে তা অবৈধ হত্যা হিসেবে সাব্যস্ত হবে। যেমন: কাউকে চুরির শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদণ্ড দিলে তা অবৈধ হত্যা হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

১০. আল কুরআনে থাকা বিধান ও অধিকারক সার্বজনীন এবং মানুষের মানবাধিকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কুরআন প্রদত্ত কোনো বিধান ও অধিকারকে লঙ্ঘন না করে প্রয়োজনীয় নির্বাহী বিধান প্রণীত ও বাস্তবায়িত হতে পারে। কিন্তু কোনো নির্বাহী বিধানের মাধ্যমে কখনো সাংবিধানিক বিধান রহিত হতে পারে না।

ভূমিকা

আধুনিক সময়ে মুসলিমদের পশ্চাদমুখীতার একটি উদাহরন হলো মুসলিম বিভিন্ন দেশে ব্লাসফেমী আইন, যার মূল উৎস হলো মুরতাদ সম্পর্কে মুসলিমদের কুরআনের শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতা। মুরতাদ ও এ সম্পর্কে যে শরীয়া আইন প্রচলিত তার কোনটাই কুরআনের শিক্ষার সাথে সামন্জস্যপূর্ণ নয়। বরং কুরআনের মূলনীতি বিরুদ্ধ হাদীস এবং আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধে মানুষের তৈরী মনগড়া বিভিন্ন ব্যাখ্যা সম্বলিত ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমে মুরতাদ সম্পর্কে মধ্যযুগীয় বেশ কিছু রাজনৈতিক ফতোয়া ধর্মীয় বিধানে পরিনত হয়েছে।

ধর্মত্যাগ এবং ধর্মনিন্দা অনেকের কাছে ইতিহাসের নিদর্শন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশে, ধর্মত্যাগ এবং ব্লাসফেমির বিরুদ্ধে আইন বইয়ে (সংবিধানে) রয়েছে। এবং অনেকগুলি বিভিন্ন মাত্রায় প্রয়োগ করা হয়েছে।

মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যাগুলোর মধ্যে ধর্মীয় ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার চর্চা একটি গুরুত্ব বিষয় যা নতুন করে ভাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে কারন এ সম্পর্কে মধ্যযুগের আইন ও শাসন ব্যবস্থার প্রভাব এখনো ধর্মীয় বিধানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে যাচ্ছে। ধর্মের নামে বাড়বাড়ি, জোর করে ধর্মীয় অনুশাসন বিশেষ করে যে ধরনের বাধ্যবাধকতা স্রষ্টার নির্দেশ নয় অথচ পরে ধর্মের নামে মানুষের দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সেগুলোর প্রতিক্রিয়া হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহ অনেক কমে আসছে। অনেক মুসলিম প্রধান দেশে এখন প্রকাশে ধর্মত্যাগ ঘটছে। পশ্চিমে অভিবাসনকারী অনেক মুসলিম এবং তাদের সন্তানরা ইসলামের অনেক আরোপিত বিষয়ের অন্যায্যতার প্রতিবাদ হিসেবে পুরো ধর্মকে পরিত্যাগ করছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে আমেরিকায় বেড়ে ওঠা প্রায় এক-চতুর্থাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম ধর্মহীন হয়ে যাচ্ছে যাদের অধিকাংশই প্রবাসী পরিবারের সন্তান। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করা এসব মুসলিমদের অধিকাংশই থেকে যাচ্ছে নাস্তিক হিসেবে। তারা কোনো ধর্মই গ্রহণ করছে না।

যারা ইসলাম ত্যাগ করছে, তাদের মধ্যে পঞ্চান্ন শতাংশ থেকে যাচ্ছে নাস্তিক। তারা কোনো ধর্মই গ্রহণ করছে না। বাইশ শতাংশ গ্রহণ করছে খৃস্টধর্ম। একুশ শতাংশ গ্রহণ করছে বৌদ্ধ, হিন্দু, ইহুদি ধর্মসহ আরও বিভিন্ন ধর্ম। যারা ইসলাম ত্যাগ করছে, তাদের বড় একটি অংশ ধর্মকেই অপছন্দ করে। কেউ কেউ পারিবারিকভাবে ধর্মীয় চর্চা না থাকার কথাও বলেছে। ২০১৭ সালের সমীক্ষায় ইসলাম থেকে ধর্মান্তরিতদের তাদের নিজস্ব ভাষায় ধর্ম ত্যাগ করার কারণ ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছিল। এরমধ্যে বারো শতাংশ বলেছে, তারা ধর্মকে অপছন্দ করে। আট শতাংশ বলেছে, তারা আল্লাহতে বিশ্বাস করে না। পাঁচ শতাংশ বলেছে, তারা ধর্ম পালনে অভ্যস্ত ছিল না। সমীক্ষায় পাঁচজনের একজন ইসলাম ত্যাগের নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করেছে। তাদের মধ্যে নয় শতাংশ বলেছে, তারা মুসলিম হিসেবে বেড়ে উঠেছে ঠিক, কিন্তু কখনোই ইসলামি আচারে যুক্ত হয়নি। সাত শতাংশ বলেছে, তারা ইসলামি শিক্ষার সাথে দ্বিমত পোষণ করে। ষোলো শতাংশ বলেছে, তারা অন্যান্য ধর্ম বা দর্শন লালন করে। চৌদ্দ শতাংশ বলেছে, তারা তাদের ব্যক্তিগত মত এবং স্টাডির উপর ভিত্তি করে ইসলাম ত্যাগ করেছে। (১)


(১) ‘আমেরিকায় এক চতুর্থাংশ ধর্মহীন’ : ঈমান হারাচ্ছে প্রবাসী মুসলমানদের সন্তানরা, মুনশী নাঈম, ফাতেহ২৪ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত

ধর্মত্যাগের বিপরীতে আমরা যদি ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননা আইন ও তার প্রয়োগের দিকে নজর দেই, পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি নতুন বিশ্লেষণে (২) দেখা গেছে যে, সারা বিশ্বে জরিপ করা ১৯৮ টি দেশ এবং অঞ্চলর মধ্যে ৭৯ টি তে, যা শতকরা হিসাবে (৪০%), ২০১৯ সালে ব্লাসফেমি নিষিদ্ধ করার জন্য আইন বা নীতি ছিল, যাতে পবিত্র বলে বিবেচিত ঈশ্বর বা মানুষের বা বস্তুর অবমাননা বলে বিবেচিত হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। বাইশটি দেশে (১১%) ব্যক্তিগত বিশ্বাস ত্যাগ বা ধর্ম ত্যাগ করার বিরুদ্ধে আইন ছিল।


(২) Four-in-ten countries and territories worldwide had blasphemy laws in 2019, https://www.pewresearch.org/fact-tank/2022/01/25/four-in-ten-countries-and-territories-worldwide-had-blasphemy-laws-in-2019-2

এই আইনগুলি মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকাতে সবচেয়ে সাধারণ বিষয় ছিল, যেখানে এই অঞ্চলের ২০টি দেশের মধ্যে ১৮টি দেশ (৯০%) ব্লাসফেমিকে অপরাধমূলক হিসাবে চিহ্নিত করে আইন রয়েছে এবং তাদের মধ্যে ১৩ টি (৬৫%) ধর্মত্যাগকে অপরাধ হিসাবে সাব্যস্ত করে।

বিশ্লেষনে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ব্লাসফেমি আইন বইগুলিতে (সংবিধানে) ছিল পাঁচটি বৈশ্বিক অঞ্চলের সবগুলোতে, যার মধ্যে সাব-সাহারান আফ্রিকার ১৮টি দেশ, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ১৭টি, ইউরোপের ১৪টি এবং আমেরিকার ১২টি দেশ রয়েছে৷ কিছু দেশে - যেমন আফগানিস্তান, ব্রুনাই, ইরান, মৌরিতানিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান এবং সৌদি আরব - ব্লাসফেমি আইন লঙ্ঘন করার দায়ে মৃত্যুদণ্ডের সম্ভাবনা রয়েছে। নিউজিল্যান্ডে, একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্লাসফেমি আইন ২০১৯ সালে বাতিল করা হয়েছিল যখন দেশের মিডিয়া রিপোর্ট করেছে যে এটি ১৯২২ সাল থেকে তা প্রয়োগ করা হয়নি। গ্রীসও ২০১৯ সালে তার ব্লাসফেমি আইন বাতিল করেছে, মানবাধিকার কর্মীরা এর বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানের পর।

পাকিস্তান, ত্রিনিদাদ এবং টোবাগো এবং বার্বাডোজ সহ কিছু দেশে, ব্লাসফেমি আইন তাদের ব্রিটিশ শাসনের সময়কালের। যদিও বার্বাডোজ এবং ত্রিনিদাদ এবং টোবাগোর নাগরিকরা ২০১৯ সালে ব্লাসফেমির অভিযোগের জন্য ফৌজদারি শাস্তির সম্মুখীন হয়নি, পাকিস্তানে ২০১৮ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ব্লাসফেমির অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে।

ধর্মত্যাগ আইন ২০১৯ সালে ব্লাসফেমি আইনের তুলনায় বিশ্বজুড়ে কম মাত্রায় ছিল, মাত্র ২২ টি দেশে বিদ্যমান এবং পাঁচটি অঞ্চলের মধ্যে মাত্র তিনটিতে, রিসার্চ করা দেশগুলোর মধ্যে। ধর্মত্যাগ আইন যেসব দেশে রয়েছে, তার বেশিরভাগ দেশগুলি মধ্যপ্রাচ্য-উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের (১৩টি)। সাতটি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে এবং দুটি সাব-সাহারান আফ্রিকায় ছিল। ২০১৯ সাল পর্যন্ত, ইউরোপ বা আমেরিকাতে কোনো ধর্মত্যাগের আইন ছিল না।
একজনের বিশ্বাস ত্যাগ করার জন্য শাস্তি বিভিন্ন দেশের উপর নির্ভর করে ভিন্ন রকম হয়। আলজেরিয়ায়, যারা ইসলাম থেকে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হয় তারা উত্তরাধিকার পেতে অক্ষম। ২০১৯ সালে, ব্রুনাই একটি আইন প্রয়োগ করেছে যা ইসলাম থেকে ধর্মত্যাগের জন্য মৃত্যুদণ্ডের অনুমতি দেয়।

কুরআনে প্রায় ২০০ এর উপরে আয়াত রয়েছে যেখানে মানুষকে তাদের কাজের জন্য দায়ী করা হয়েছে এবং তাদের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে আবার মুরতাদ প্রসঙ্গে যদি আমরা পৃথিবীতে মৃত্যুদন্ডের মতো শাস্তির কথা বলি তবে তা অবশ্যই কুরআনের নীতির বিপরীত।

রাসুলের সুন্নাহ যদি লক্ষ্য করা হয়, সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হতে পারে রাসুল সা. তার জীবদ্দশায় কি কাউকে দ্বীন বা ধর্ম বা তিনি যে আদর্শ প্রচার করেছেন তা অস্বীকার করার জন্য কাউকে মুরতাদ বা অনুরূপ অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন? তিনি কি কাউকে এই অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন বা অন্যকে এই দন্ড দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেছেন?

আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং আর্ন্তজাতিক মন্ডলে পরিচিত ইসলামী স্কলার এবং ইসলামিক লিগ্যাল থিওরীর একটি এক্সপার্ট, ড. তাহা জাবির আলালওয়ানির রচিত: এ্যাপোস্ট্যাসি ইন ইসলাম (The Apostasy in Islam: A Historical & Scriptural Analysis) বইতে তিনি লেখেন: “এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে রাসুল সা. তার সম্পূর্ণ জীবনে একটিবারের জন্যও কাউকে মুরতাদ বা ধর্মত্যাগের জন্য মৃত্যুদন্ড দেননি।”

এটি দু:খজনক যে মুসলিম বিশ্বে ইজমার নামে মুরতাদ প্রসঙ্গে নতুন বিশ্লেষণের সুযোগকে অতীতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ধর্মত্যাগের ফিকহী নাম হলো আল-রিদ্দাহ। তবে উল্লেখ্য যে ইসলামী আদি ইতিহাস ও পরে ধর্মশাস্ত্র / ফিকহের ফরমেশন সময়ে অনেক আইন-বিশারদের নাম পাওয়া যায় যেমন: উমর ইবন আল খাত্তাব, ইব্রাহিম আল নাখি, সুফিয়ান আল থাওরী এবং অন্যান্যরা মুরতাদের শাস্তি হিসেবে কখনোই মৃতুদন্ডকে সমর্থণ করে নাই।
প্রশ্ন হলো কুরআনে মুরতাদ (Apostasy) ও ইলহাদ (Blasphemy) প্রসঙ্গে মৃত্যুদন্ডের কথা না থাকলেও, কিভাবে শরীয়াতে মৃত্যুদন্ড এতোটা নিশ্চিতভাবে স্থাপিত হলো?

এই প্রশ্নের দুটো দুইটি মাত্রা আছে: প্রথমত রাজনৈতিক এবং দ্বিতীয়ত ধর্মীয়।

খুলাফায়ে রাশেদীনদের সময়ের পরে উমাইয়্যা ও আব্বাসী খলিফাদের শাসনামলে যখন হাদীস শাস্ত্র রচিত হয় (আমরা জানি যে রাসুল নিজের জীবদ্দশায় কুরআন ছাড়া আর কিছূ লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করেছে এবং প্রথম চারজন খলিফাও রাসুলের কথা ও কাজ সংরক্ষণের বিরোধী ছিলেন) তখনই ফিকহ শাস্ত্রের গোঁড়া পত্তন ঘটে। এ সময়কাল হিজরী ২০০ সন থেকে প্রায় ৪৫০ হিজরী। এ সময়গুলোতে মুক্তচিন্তা বা ভিন্ন চিন্তা অনেকটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার চোখে দেখা হতো কেননা যে খলিফা শাসনে ছিলো তার বা তার সভা পন্ডিতের স্কুল অফ থটকেই বিশ্বাসের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হতো। তাই যখনই কোন ব্যক্তি বা স্কলার ভিন্ন কোন মতের স্বাধীনতা চর্চা করতেন বা চাইতেন, সেটাকে রাষ্ট্রের ও খলিফার শাসনের বিরুদ্ধাচারণ হিসাবে ইন্টারপ্রেট বা অর্থ করা হতো। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ট্রিজন (Treason) বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আর এ থেকেই রাজনৈতিক প্রভাবে মুরতাদ ও ইলহাদ প্রশ্নে মৃত্যুদন্ড অনেকটা ফিকহের মোডাস অপারেন্ডি (Modus Operandi)-তে পরিণত হয়।

এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারনে অনেক ইসলামী প্রভাবশালী পন্ডিতকেও মুরতাদ ও ইলহাদ বা জিন্দিক হিসেবে কেবল চিহ্নিতই করা হয় নি, কাউকে কাউকে কারাগার, নির্বাসন ও মৃত্যুদন্ডকেও মাথায় নিতে হয়েছে। ফিকহ শাস্ত্রের বুনিয়াদী সময়ে এরকম উল্লেখযোগ্য ইসলামী স্কলারদের মধ্যে রয়েছে: আহমেদ ইবন নাসর আল খুজাই, ইবনে আল-আব্বার আল আন্দালুসি, লিসান আল-দ্বীন ইবনুল খাতিব, আবু হাইয়ান আল তাওহীদি, মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল করিম ইবন আহমদ, মুহাম্মদ ইবন আলি ইবন আল-হাসান, আল-কিয়াহাররাসি, আবু নাসর মনসুর ইবন আলি, ইব্রাহিম ইবন উমর, ইবন জারকুন, সাঈফ আল-দ্বীন প্রমুখ।

ইতিহাস এবং বর্তমান সময়ে মুরতাদ প্রবণতাকে অপরাধ চিহ্নিত করে পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত দেশে যে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি যেমন: কারাবাস, নির্বাসন এবং নিজ মাতৃভূমিতে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা এমনকি মৃত্যুদন্ড দেওয়ার যে প্রচলন আছে সেটিকে কুরআনের আয়াত, নীতি আদর্শ ও মূলনীতির সাপেক্ষে বিশ্লেষণ করার একটি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

এই বইটি রচনা করা হয়েছে দ্বীন ত্যাগ অথবা দ্বীন থেকে কেউ যদি ফিরে যায় তবে তার ক্ষেত্রে পার্থিব কোন শাস্তি হবে কি না তা সম্পর্কে কুরআনের ‍মূলনীতিকে বিশ্লেষণ করে। এখানে দ্বীনের একমাত্র দলিল কুরআন, এই নীতিকে সত্য (কারো অধিকার নেই হুকুম/ মূল-আইন দেয়ার শুধু আল্লাহর ছাড়া। ১২:৪০) ধরে নিয়ে বিশ্লেষণ হয়েছে। মুরতাদ হত্যার অবৈধতার পাশাপাশি রাসুলের প্রতি অবমাননা প্রসঙ্গ, ধর্মীয় বনাম সামাজিক অপরাধের ধরন ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে।

আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের কাছে ইসলামে মুরতাদ হত্যার অবৈধতা নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও আমাদের জানা মতে এ ধরনের মৌলিক কাজ বাংলা ভাষায় সীমিত। আশা করা যায় বইটি বাংলাভাষীদের কাছে এবং ইসলামী আইন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের জন্য উপকারী হবে।

- সাদিক মোহাম্মদ আলম
প্রতিষ্ঠিাতা, দি ইন্সটিটিউট ফর কুরআনিক রিসার্চ এন্ড এ্যাপ্লিকেশন

প্রাথমিক কথা

‘মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড’ ধারা সম্বলিত ‘ব্লাসফেমি আইন’ এবং ‘মুরতাদ হত্যা কমিটি’ গঠন করে গোপন জঙ্গীবাদী অপতৎপরতা মানব জাতির ধর্মচিন্তা ও মতপ্রকাশ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার মানবাধিকারসহ বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে একটি প্রধান বৈশ্বিক সমস্যা। ইসলামের দোহাই দিয়ে মুরতাদ তথা ইসলাম ধর্ম ত্যাগকারীর শাস্তি হিসেবে এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা ধর্ম অবমাননার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের দাবি করা হলেও প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মূল ধর্মগ্রন্থ ‘আল কুরআনে’ এ দাবির পক্ষে কোনো দলীল নেই। বরং এরূপ শাস্তি সম্পূর্ণত কুরআন বিরুদ্ধ এবং কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশের লংঘন এবং কুরআনের আলোকে তা অন্যায় হত্যা হিসেবেই সাব্যস্ত হয়। আল কুরআনে ধর্মীয় স্বাধীনতার নীতি ঘোষিত হয়েছে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণকে ‘ফিতনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তার অবসান ঘটানোর জন্য তথা ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য সংগ্রামের নির্দেশ রয়েছে। অথচ কুরআনের নির্দেশনার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে ক্বায়েমী স্বার্থবাদী ফতোয়াবাজদের ফতোয়া অনুসারে রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং এমনকি সাধারণ নাগরিক পর্যায়ে মুরতাদ হত্যা সংঘটিত হওয়া বা এর অবকাশ মেনে নেওয়া মানবজাতির জন্য একটি স্থায়ী মারাত্মক হুমকি। এরূপ হুমকির মোকাবেলার জন্য বা মানব সভ্যতাকে ধর্মের নামে অধর্মকারী ধর্মজীবীদের বর্বরতা থেকে বাঁচানোর জন্য আল কুরআনের আলোকে মুরতাদ হত্যার অবৈধতার বিষয়টি সঠিকভাবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।

মুরতাদ হত্যার বৈধতা-অবৈধতা প্রসঙ্গে প্রথমে প্রচলিতভাবে ‘কাদেরকে মুরতাদ সাব্যস্ত করে তাদেরকে হত্যার জন্য দাবি জানানো হয় বা আইন প্রণয়ন করা হয়?’ তা উল্লেখ করা যেতে পারে। একজন মুসলিমের সন্তানকে মুসলিম বিবেচনা করা হয়, যতক্ষণ সে নিজের ইসলাম ত্যাগের ঘোষণা না দেয়। যদি সে নিজের ইসলাম ত্যাগের ঘোষণা দেয় তাহলে তাকে ‘মুরতাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আবার কোনো অমুসলিম ইসলাম গ্রহণের পর তা ত্যাগ করলে তাকেও মুরতাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ইসলাম ত্যাগের পর অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করা হোক বা না হোক উভয় অবস্থায় ইসলাম ত্যাগকারীকে মুরতাদ (مُرْتَدّ) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। উভয় প্রকার মুরতাদের শাস্তি হিসেবে প্রচলিত হাদীস ও মাযহাব ভিত্তিক ধর্মীয় ব্যখ্যায় মৃত্যুদণ্ডের দাবি করা হয়।

এছাড়া যে কেউ ইসলামের কোনো বিষয়ে সমালোচনা, কটুক্তি বা দোষারোপ করলে অথবা কোনোভাবে ধর্ম ও ধর্মপ্রবর্তকের অবমাননা করলে তাকে মুলহিদ (مُلْحِد) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং তার শাস্তি হিসেবেও মৃত্যুদণ্ডের দাবি করা হয়। এছাড়া যে ব্যক্তি জন্মগতভাবে মুসলিম হয়েও বা ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়ার পরও সহীহ আক্বীদার (সঠিক বিশ্বাসের) পরিবর্তে ভ্রান্ত আক্বীদা বা বিশ্বাস ধারন বা / ও প্রচার করে তাকে ধর্মীয় পরিভাষায় যিনদীক্ব (زِنْدِيق) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং তার শাস্তি হিসেবেও মৃত্যুদণ্ডের দাবি করা হয়।

ধর্মত্যাগ (Apostasy) এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা ধর্ম অবমাননা (blasphemy) এবং কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায় জন্মগতভাবে মুসলিম হয়েও বা ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়ার পরও রাষ্ট্রের প্রভাবশালী ধর্মগোষ্ঠীর আক্বিদাকে গ্রহণ না করার (যানদাক্বাহ) শাস্তি তথা তাদের মৃত্যুদণ্ড শুধু রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের মাধ্যমে কার্যকরযোগ্য, নাকি যে কোনো মুসলিম বা কতিপয় মুসলিমও তাদেরকে হত্যা করার অধিকার রাখে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এছাড়া মুরতাদ হত্যার পূর্বে তাদেরকে তাওবার (নিজ কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা ও ক্ষমা চাওয়ার) সুযোগ দিয়ে এবং তারা তাওবা করলে তা গ্রহণ করে শাস্তি রদ করার অবকাশ আছে, নাকি তারা তাওবা করলেও তাদেরকে মৃত্যুদন্ড দেয়া বাধ্যতামূলক, তা নিয়েও মতভেদ রয়েছে। মুরতাদ ও যিনদীক্বের সন্তানদেরকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হবে কিনা এবং ইসলাম গ্রহণ না করলে হত্যা করতে হবে কিনা তা নিয়েও মতভেদ রয়েছে।

মুরতাদ, মুলহিদ ও যিনদীক্বের সংজ্ঞা, প্রকার ও মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি সম্পর্কে উপরে বর্ণিত সংক্ষিপ্ত তথ্যের বিস্তারিত বিবরণ জানার জন্য এ বইয়ের শেষে উল্লেখিত তথ্যসূত্র ও গ্রন্থপঞ্জি দেখা যেতে পারে।

কুরআনে ঘোষিত ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী হওয়ায় বর্তমানে মুসলিম স্কলারদের কেউ কেউ যেমন: ইউসুফ আল কারযাভী, জাভেদ আহমেদ ঘামিদি, জামাল বাদাভী প্রমুখ মুরতাদ হত্যা বা মুরতাদের মুত্যুদন্ডের নীতির প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন। কিন্তু ধর্মীয় ইমাম বা মুফতিদের বৃহত্তর অংশ মুরতাদ হত্যার নীতিকে সঠিক মনে করেন এবং এজন্য তাঁরা হাদীস থেকে দলীল দিয়ে থাকেন যে, ‘রসূলুল্লাহ বলেছেন, যে নিজের ধর্ম ত্যাগ করে তাকে হত্যা করো’ এবং দাবি করা হয় যে, কিছু হাদীস থেকে রসূলের কোনো কোনো সাহাবী মুরতাদকে হত্যা করেছেন বলে জানা যায়। পক্ষান্তরে যাঁরা মুরতাদ হত্যাকে সঠিক মনে করেন না, তাঁরা এ হাদীসগুলোকে কুরআনের সাথে বৈপরীত্যের কারণে অগ্রহণযোগ্য বা বানানো হাদীস বলে বিশ্বাস করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলেও সত্য যে, যারা ঐ হাদীসগুলোকে সহীহ বলে বিশ্বাস করে তারা ঐ হাদীসগুলোর পরবর্তী পর্যায়ে এ প্রসঙ্গে থাকা কুরআনের আয়াতকে প্রযোজ্য মনে করেন না, বরং রসূল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হওয়ার পর থেকে মৃত্যুদন্ডই কার্যকরযোগ্য বলে মনে করেন। আমরা কুরআনের আলোকে পর্যালোচনা করে দেখবো যে, মুরতাদের বিষয়ে কুরআনের নির্দেশনা কী? কুরআনের নির্দেশনার পরিপন্থী হাদীস সহীহ হতে পারে কিনা এবং হাদীসের মাধ্যমে কুরআনের নির্দেশনার কার্যকারিতা রহিত হতে পারে কিনা?

রসূলের দায়িত্ব ও ধর্মীয় স্বাধীনতা

[ক] রসূলের দায়িত্ব শুধুমাত্র বালাগ/প্রচার, ধর্ম অবলম্বনের ক্ষেত্রে প্রত্যেকে স্বাধীন, জবরদস্তির কোনো অবকাশ নেই

আল কুরআনে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কুরআনের আলোকে স্রষ্টার প্রতি আত্নসমর্পণ বা ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও কাউকে ইসলামে প্রবেশ করানোর বা ধরে রাখার জন্য জবরদস্তির কোনো অবকাশ নেই। বরং যে সত্যধর্মাদর্শ অবলম্বনের মাধ্যমে কল্যাণপ্রাপ্ত হতে ইচ্ছুক সে যেন সেই সুযোগ পেতে পারে সেজন্য রসূলকে শুধু প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মাত্র, কোনোক্রমে কাউকে কোনো ধর্ম অবলম্বনের জন্য জবরদস্তি করার কোনো অবকাশ দেয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

৩:১৯-২০ :: নিশ্চয় আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা) হলো ইসলাম। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের নিকট জ্ঞান আসার পরই তারা মতভেদ করেছে, পরস্পর বিদ্বেষবশত। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফর করে, নিশ্চয় আল্লাহ হিসাবকরণে দ্রুত। যদি তারা তোমার সাথে বিতর্ক করে, তবে তুমি বলো, ‘আমি আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করলাম এবং আমার অনুসারীগণও’। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে এবং অকিতাবীদেরকে বলো, ‘তোমরা কি ইসলাম গ্রহণ করেছ’? তখন যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তারা অবশ্যই হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর যদি ফিরে যায়, তাহলে তোমার দায়িত্ব শুধু পৌঁছিয়ে দেয়া। আর আল্লাহ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।

৩:৬৪-৬৫ :: বলো, হে আহলে কিতাব, আসো সেই কথার দিকে যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা ও দাসত্ব করবো না এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবো না এবং আমরা আল্লাহকে ছাড়া একে অন্যকে বিধানদাতা (রব) হিসেবে গ্রহণ করবো না। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে বলো, তোমরা সাক্ষী থাকো যে, আমরা মুসলিম (আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী)। হে আহলে কিতাব, কেন তোমরা ইবরাহীমের বিষয়ে বিতর্ক করো, অথচ তাওরাত ও ইনজীল তো তার (পূর্ববর্তীতে নয়, বরং) পরবর্তীতেই নাযিল হয়েছে। তবুও কি তোমরা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করবে না?

২:২১৩ :: মানুষ ছিল এক উম্মত। অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে নবীদেরকে প্রেরণ করলেন এবং সত্যসহ তাদের সাথে কিতাব নাযিল করলেন, যাতে মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত। আর তারাই তাতে মতবিরোধ করেছিল, যাদেরকে তা দেয়া হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষবশত। অতঃপর আল্লাহ নিজ অনুমতিতে মুমিনদেরকে হিদায়াত দিলেন যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছিল। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন।

১৩:৪০ :: আর আমি তাদেরকে যে (শাস্তির) প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যদি তার কিছু তোমাকে দেখাই অথবা তোমার মৃত্যু ঘটাই, তোমার কর্তব্য তো শুধু তথ্য পৌঁছে দেয়া আর হিসাব গ্রহণ করার দায়িত্ব আমার।

১৬:৮২ :: তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমার দায়িত্ব শুধুমাত্র তথ্য পৌঁছে দেয়া।

৪২:৪৮ :: তারপর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে আমি তোমাকে তাদের উপর রক্ষক করে পাঠাইনি। তোমার উপর তথ্য পৌঁছে দেয়া ছাড়া কোনো দায়িত্ব নেই। আর নিশ্চয় যখন আমরা মানুষকে আমাদের রহমত আস্বাদন করাই তখন সে খুশি হয়। আর যখন তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের উপর কোনো বিপদ ঘটে, তখন সে অকৃতজ্ঞ হয়ে যায়।

৬:১০৭ :: আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে তারা শিরক করতে পারতো না। আমি আমরা তোমাকে তাদের উপর রক্ষক বানাইনি। আর তুমি তাদের উপর কর্মবিধায়কও নও।

৪:৮০ :: যে রসূলের আনুগত্য করে, নিশ্চয় সে আল্লাহরই আনুগত্য করে। আর যে বিমুখ হয়ে যায়, তবে আমরা তোমাকে তাদের উপর রক্ষক করে পাঠাইনি।

৫০:৪৫ :: তারা যা বলে আমরা তা জানি। আর তুমি তাদের উপর জবরদস্তিকারী নও। সুতরাং তুমি কুরআন দ্বারা তাকে উপদেশ দাও, যে শাস্তির প্রতিশ্রুতিকে ভয় করে।

৮৮:২১-২৬ :: সুতরাং তুমি উপদেশ দাও। নিশ্চয় তুমি একজন উপদেশদাতা। তুমি তাদের উপর নিয়ন্ত্রক নও। কিন্তু যে মুখ ফিরিয়ে নেবে ও কুফর করবে, তবে তাকে আল্লাহই মহাশাস্তি দিবেন। নিশ্চয় আমাদের কাছেই তাদের প্রত্যাবর্তন। তারপর নিশ্চয় তাদের হিসাবের দায়িত্ব আমাদেরই।

২১:৪২ :: বলো দয়াময়ের পরিবর্তে কে তোমাদেরকে দিনে ও রাতে রক্ষা করছে? বরং তারা তো তাদের প্রভুর উপদেশ থেকে বিমুখ।

১৮:৬ :: তুমি যেন তাদের পেছনে ঘুরে ঘুরে তোমার জীবনকে বিপন্ন করে ফেলবে, যদি তারা এ হাদীসের (কুরআনের) প্রতি ঈমান না আনে তবে সেই দুঃখে!

২৬:২-৪ :: এগুলো স্পষ্ট কিতাবের আয়াত। তুমি যেন তোমার জীবনকে বিপন্নকারী হবে তারা মু’মিন হচ্ছে না বিধায়! যদি আমরা ইচ্ছা করতাম তবে তাদের উপর আকাশ থেকে এমন নিদর্শন পাঠাতে পারতাম যাতে তাদের ঘাড় নুইয়ে পড়তো।

৬:৩৫ :: আর যদি তাদের বিমুখতা তোমার কাছে ভীষণ (কষ্টদায়ক) হয়, তাহলে তুমি সক্ষম হলে পৃথিবীতে কোনো সুড়ঙ্গ তালাশ করো অথবা আকাশে উঠার কোনো সিঁড়ি সন্ধান করো, তারপর তাদের কাছে কোনো নিদর্শন নিয়ে আসো। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে তাদের সবাইকে হিদায়াতের উপর একত্র করতে পারতেন। সুতরাং তুমি জাহেলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।

১৩:৩১ :: আর যদি কুরআন এরূপ হতো যে, তা দিয়ে পাহাড়কে গতিশীল করা যেতো, অথবা তা দিয়ে পৃথিবীকে টুকরো টুকরো করে ফেলা যেতো, অথবা তা দিয়ে মৃত ব্যক্তিকে কথা বলানো যেতো; বরং সমস্ত সিদ্ধান্তকর বিষয়ই আল্লাহর আয়ত্তে। তবে মু’মিনরা কি এ বিষয়ে নিশ্চিত নয় যে, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে সমস্ত মানুষকে হিদায়াত করতেন? আর যারা কুফর করে তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে তাদের বিপর্যয় ঘটতেই থাকবে অথবা তাদের আবাসের আশেপাশে বিপদ আপতিত হতে থাকবে, যতক্ষণ না আল্লাহর প্রতিশ্রুতি (প্রতিশ্রুত সময়সীমা) এসে যায়। নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিশ্রুতির খেলাফ করেন না।

৫:১০৫ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা তোমাদের নিজেদের জন্য দায়বদ্ধ। যে পথভ্রষ্ট হয় তার কারণে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, যখন তোমরা সঠিক পথনির্দেশ গ্রহণ করো। আল্লাহর দিকেই তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন। তারপর তিনি তোমাদেরকে তথ্যাদি জানিয়ে দিবেন, যা তোমরা করতে।

১০:৯৯ :: আর যদি তোমার প্রভু ইচ্ছা করতেন তাহলে পৃথিবীতে যারা আছে তাদের সকলেই ঈমান আনতো। তবে কি তুমি মানুষকে জবরদস্তি করবে, যতক্ষণ না তারা মু’মিন হয়?

৫:৪৮ :: আর আমরা তোমার কাছে সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি যা সেটার সামনে থাকা কিতাবের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর উপর পর্যবেক্ষক-নিয়ন্ত্রকস্বরূপ। সুতরাং তুমি তাদের মধ্যে বিচার-ফায়সালা করো আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা অনুযায়ী। আর তুমি তাদের প্রবৃত্তিগত দাবির অনুসরণ করো না, যখন তোমার কাছে সত্য এসেছে। তোমাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকের (প্রত্যেক সম্প্রদায়ের) জন্য আমরা শিরআত (মূল নীতিমালা) ও মিনহাজ (মূল নীতিমালার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ পরিস্থিতিসাপেক্ষ কর্মপথ বা নির্বাহী সিদ্ধান্তের পরিসর) বানিয়ে দিয়েছি। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে তোমাদেরকে একক উম্মাহ বানিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু যেন তোমাদেরকে যা দেয়া হয়েছে তাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন (সেজন্য তিনি তা করেননি)। সুতরাং তোমরা উত্তম ও কল্যাণকর্মে পরস্পরের অগ্রণী হতে থাক। আল্লাহর দিকেই তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন। তারপর তিনি তোমাদেরকে তথ্যাদি জানিয়ে দিবেন যেসব বিষয়ে তোমরা মতভেদ করতে।

১৮:২৯ :: আর বলো, সত্য তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে। সুতরাং যার ইচ্ছা সে ঈমান আনুক এবং যার ইচ্ছা সে কুফর করুক। নিশ্চয় আমরা জালিমদের জন্য (জাহান্নামের) আগুন প্রস্তুত রেখেছি, যার প্রাচীরগুলো তাদেরকে ঘিরে রাখবে। তারা পানীয় চাইলে তাদেরকে দেয়া হবে গলিত শিশার ন্যায় পানীয়, যা তাদের মুখমণ্ডলকে দগ্ধ করবে, কত নিকৃষ্ট পানীয়! আর কত নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল!

৭৪:৫৪-৫৫ :: কখনো না। নিশ্চয় তা স্মরণীয় উপদেশ। সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে তা স্মরণ রাখবে।

৮০:১১-১২ :: কখনো না। নিশ্চয় তা স্মরণীয় উপদেশ। সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে তা স্মরণ রাখবে।

৭৩:১৯ :: নিশ্চয় এটা স্মরণীয় উপদেশ। সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে তার প্রভুর দিকে অগ্রসর হওয়ার পথ অবলম্বন করুক।

৭৬:২৯ :: নিশ্চয় এটা স্মরণীয় উপদেশ। সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে তার প্রভুর দিকে অগ্রসর হওয়ার পথ অবলম্বন করুক।

২:২৫৬ :: দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা) গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় বিভ্রান্তি থেকে সঠিক দিগ-দর্শন সুস্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং যে তাগুতকে (ধর্মীয় স্বাধীনতা নস্যাতকারী খোদাদ্রোহীদেরকে) প্রত্যাখ্যান করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, নিশ্চয় সে এমন মজবুত হাতল ধারণ করে যা কখনো ভেঙ্গে যাবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।

১০৯:১-৬ :: বলো, হে কাফিরগণ (ইসলাম প্রত্যাখ্যানকারীগণ)! আমি তাদের উপাসনা ও দাসত্ব করি না, তোমরা যাদের উপাসনা ও দাসত্ব করো। আর তোমরা তাঁর উপাসনা ও দাসত্ব কর না, আমি যাঁর উপাসনা ও দাসত্ব করি। আর আমি তাদের উপাসনা ও দাসত্বকারী নই, তোমরা যাদের উপাসনা ও দাসত্ব করেছো। আর তোমরাও তাঁর উপাসনা ও দাসত্বকারী নও, আমি যাঁর উপাসনা ও দাসত্ব করি। তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা) আর আমার জন্য আমার দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা)।

১০:১০৪ :: বলো, হে মানুষ, যদি তোমরা আমার দ্বীনের (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থার) বিষয়ে সন্দেহে থাকো, তবে (জেনে রাখো), আমি তাদের উপাসনা ও দাসত্ব করি না, তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের উপাসনা ও দাসত্ব কর। কিন্তু আমি আল্লাহর উপাসনা ও দাসত্ব করি, যিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটান। আর আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যেন আমি মু’মিনদের অন্তর্ভুক্ত হই।

৬০:৪ :: ইবরাহীম ও তার সাথে যারা ছিল তাদের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। তারা যখন স্বীয় সম্প্রদায়কে বলছিল, ‘তোমাদের হতে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যা কিছুর উপাসনা ও দাসত্ব কর তা হতে আমরা সম্পর্কমুক্ত। আমরা তোমাদের প্রতি কুফর করছি এবং আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরন্তন (আদর্শগত) শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হলো, যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো। তবে স্বীয় পিতার প্রতি ইবরাহীমের উক্তিটি ব্যতিক্রম: ‘আমি অবশ্যই তোমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবো আর তোমার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আমি কোনো অধিকার রাখি না’। (তারা প্রার্থনা করেছিলো-) হে আমাদের প্রভু, আমরা আপনার ওপরই ভরসা করি, আপনারই অভিমুখী হই আর প্রত্যাবর্তন তো আপনারই কাছে।

২৬:২১৬ :: তারপর যদি তারা তোমাকে অমান্য করে, তাহলে তুমি বলো, নিশ্চয় আমি তা থেকে দায়মুক্ত যা তোমরা করো।

১১:২৮ :: সে (নবী নূহ) বললো, হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা কি ভেবে দেখেছো, যদি আমি আমার প্রভুর পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণের উপর থাকি এবং তিনি আমাকে তাঁর অনুগ্রহ প্রদান করেন, তারপর তোমাদের উপর অন্ধত্ব বজায় থাকে, আমি কি তোমরা অনিচ্ছুক হওয়া সত্ত্বেও তা গ্রহণ করতে তোমাদেরকে জবরদস্তি করতে পারি?

২৮:৫৫ :: আর যখন তারা (মু’মিনরা) অসার বাক্য শুনে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, ‘আমাদের জন্য আমাদের কর্ম এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কর্ম। তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা মুর্খ হতে চাই না।’

১০:৪১ :: আর যদি তারা তোমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে তাহলে বলো, আমার জন্য আমার কর্ম এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কর্ম। তোমরা তা থেকে দায়মুক্ত যা আমি করি এবং আমি তা থেকে দায়মুক্ত যা তোমরা করো।

৩৯:৩৯-৪১ :: বলো, হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা তোমাদের অবস্থানে থেকে কাজ করো। নিশ্চয় আমিও (আমার অবস্থানে) কর্মরত। তারপর শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে- কার উপর লাঞ্চনাদায়ক শাস্তি আসবে এবং কার উপর স্থায়ী শাস্তি আপতিত হবে? নিশ্চয় আমরা মানুষের জন্য সত্যসহ তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি। তারপর যে হিদায়াত গ্রহণ করে সে তার নিজ কল্যাণেই তা করে। আর যে পথভ্রষ্টতা অবলম্বন করে সে তার নিজের অকল্যাণেই পথভ্রষ্টতা অবলম্বন করে। আর তুমি তাদের উপর উকিল বা কর্মবিধায়ক নও।

৪২:১৫ :: তারপর এমতাবস্থায় তুমি তাদেরকে আহবান করো। আর তুমি সুপ্রতিষ্ঠিত থাকো, যেমন তোমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে। আর তাদের প্রবৃত্তিগত দাবির অনুসরণ করো না। আর বলো, আমি ঈমান এনেছি আল্লাহ তাঁর কিতাব থেকে যা নাযিল করেছেন তার প্রতি। এবং আমি আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে। আল্লাহ আমাদেরও প্রভু এবং তোমাদেরও প্রভু। আমাদের জন্য আমাদের কর্ম এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কর্ম।

আমাদের ও তোমাদের মধ্যে (পারস্পরিক অভিযোগের এবং একের কর্ম অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার) কোনো যুক্তি নেই। আল্লাহ আমাদেরকে (ফায়সালার জন্য) একত্র করবেন এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন।

আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন হলো ইসলাম তথা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ, আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব ও বিধান অনুযায়ী জীবন যাপনপদ্ধতি। কিন্তু আল্লাহ মানুষকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছেন যেন সে স্বেচ্ছায় এই আত্নসমর্পণ ও আনুগত্যে প্রবেশ করে। ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে আহবানের জন্য আল্লাহ নবী-রসূলের কাছে ওহী ও কিতাব নাযিলের মাধ্যমে ধর্মীয় মতভেদের ক্ষেত্রে সঠিক সমাধান কী, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তবে জ্ঞান সত্ত্বেও মানুষ পারস্পরিক জিদবশত মতভেদ অব্যাহত রেখেছে। এমতাবস্থায় যারা ঈমান আনবে তারা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের জ্ঞান দ্বারা উপকৃত হয়ে হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে। কিন্তু যারা ঈমান আনবে না তাদের নিকট আল্লাহর নাজিলকৃত ওহী পৌঁছে দেয়া ছাড়া রসূলদের উপর অন্য কোনো দায়িত্ব দেয়া হয়নি, তাদেরকে জবরদস্তি করার অধিকারও দেয়া হয়নি। আহলে কিতাব তথা কুরআনের পূর্ববর্তী কিতাব ধারণকারীদেরকে এবং উম্মীদেরকে তথা অকিতাবীদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করা এবং তাদের কাছে নিজেদের মুসলিম পরিচয় স্পষ্ট করা ছাড়া ইসলাম গ্রহণে তাদেরকে বাধ্য করার অবকাশ নেই।

রসূলকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তাঁর দায়িত্ব শুধু পৌঁছে দেয়া, তাঁকে অন্যদের রক্ষক, নিয়ন্ত্রক, কর্মবিধায়ক ও তাদের উপর জবরদস্তিকারী হিসেবে পাঠানো হয়নি। আরো জানানো হয়েছে যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে মুশরিকরা শিরক করতে পারতো না, তিনি ইচ্ছা করলে সবাইকে একক উম্মাহ বানিয়ে দিতে পারতেন, তিনি ইচ্ছা করলে সবাইকে হিদায়াতের উপর একত্র করতে পারতেন।

সুতরাং কাউকে ঈমান আনার জন্য জবরদস্তি করা যাবে না, এমনকি কেউ ঈমান আনছে না বিধায় পেরেশানিতে নিজের জীবনকে বিপন্ন করারও প্রয়োজনীয়তা নেই। কুরআন স্মরণীয় উপদেশ, যার ইচ্ছা ঈমান আনবে, যার ইচ্ছা তা প্রত্যাখ্যান করবে। যারা কুরআনকে বা আল্লাহ প্রদত্ত স্মরণীয় উপদেশকে গ্রহণ করবে না আল্লাহ নিজেই তাদের থেকে হিসাব নিবেন এবং তাদেরকে শাস্তি দিবেন। কিন্তু কোনো মানুষ এজন্য অপর মানুষকে শাস্তি দেয়ার অধিকার নেই। যারা রসূলের দাওয়াতকে উপেক্ষা করবে, যারা রসূলকে অমান্য করবে, তাদের কাছে তথ্য পৌঁছে দেয়ার পর তাদের প্রতি রসূলের আর কোনো দায়িত্ব নেই।

রসূলকে বলা হয়েছে যে, যদি রসূলের কাছে তাদের ঈমান না আনা কষ্টকর বিষয় হয়, তাহলে তিনি যেন জমিনে সুড়ঙ্গ বা আকাশে উঠার সিঁড়ির সন্ধান করেন এবং তারপর তাদের কাছে কোনো নিদর্শন নিয়ে আসেন। অর্থাৎ বুঝানো হয়েছে যে, যারা ঈমান আনে না তাদেরকে ঈমান আনানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হওয়া আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ চাইলে ঘাড় নুইয়ে দেয়া নিদর্শন নাযিল করতে পারতেন, আল্লাহ চাইলে কুরআনকে এমন বানাতে পারতেন যে, কুরআন দ্বারা পাহাড়কে চলমান করা যেতো, পৃথিবীকে দীর্ণ করা যেতো। কিন্তু আল্লাহ চান যে, মানুষ বিবেক প্রয়োগ করে সত্যকে গ্রহণ করুক। তাই মানুষকে ধর্ম অবলম্বনের ক্ষেত্রে বিবেক প্রয়োগের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, মু’মিনগণ শুধু নিজেদের জন্য দায়বদ্ধ, তারা যদি সঠিক পথনির্দেশ অবলম্বন করে তাহলে যারা পথভ্রষ্টতাকে গ্রহণ করে তাতে মু’মিনদের ক্ষতি নেই।

অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ধর্মের ক্ষেত্রে তথা কোনো ধর্মকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে বা ধর্মান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো জবরদস্তি নেই, বরং প্রত্যেকে নিজ ইচ্ছায় কোনো ধর্ম গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার বা ধর্মান্তরিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। অত:পর যে ব্যক্তি যে ধর্ম গ্রহণ করবে সে ব্যক্তি তার ধর্ম চর্চা করার অধিকার রাখে। যার যার ধর্ম তার তার এবং যার যার ধর্মীয় কর্মের জন্য সে সে দায়ী হবে, একের ধর্মীয় কর্মের জন্য অন্যকে জবাবদিহি করতে হবে না। রসূলের ধর্ম হলো আল্লাহর একত্ববাদী উপাসনা ও দাসত্বের ধর্ম।

শরিকদের সাথে তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসীদের কিয়ামাত পর্যন্তকার আদর্শিক দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকবে কিন্তু তা কোনোক্রমে ধর্মীয় বাড়াবাড়িমূলক ধর্মযুদ্ধ নয়, বরং নিজেদের ধর্মীয় স্বাধীনতার ভিত্তিতে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষার মূলনীতি। এর মাধ্যমে একত্ববাদী ধর্ম ও বহুত্ববাদী ধর্মের বৈপরীত্যকে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বহুত্ববাদী ধর্মের লোকদেরকেও তাদের ধর্মকর্ম চালিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, যারা রসূলের নির্দেশ অমান্যকারী তিনি তাদের কর্ম থেকে দায়মুক্ত। তবে রসূল স্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও যারা তা থেকে অন্ধ হয়ে থাকবে, তাদেরকে সঠিক পথনির্দেশের উপর আনার জন্য রসূল জবরদস্তি করতে পারেন না বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। রসূলের কাজ সত্য ধর্মের দিকে আহবান করা, অত:পর যারা তা গ্রহণ করবে এবং যারা তা গ্রহণ করবে না তাদের উভয়ে নিজ নিজ ধর্ম পালন করে যাবে এবং কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দিবেন এবং যারা সঠিক ধর্ম অবলম্বন করেনি তাদেরকে তিনি শাস্তি দিবেন।

সুষ্পষ্টভাবে এ মূলনীতি জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে যে, আমাদের ও তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক অভিযোগের এবং একের কর্ম অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার কোনো যুক্তি নেই। কারণ আমাদের কর্মের জন্য তোমাদেরকে জবাব দিতে হবে না এবং তোমাদের কর্মের জন্য আমাদেরকে জবাব দিতে হবে না। তাই যার যার অবস্থানে তার তার ধর্মকর্ম করে যাওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে। যারা হিদায়াত গ্রহণ করবে তারা কল্যাণপ্রাপ্ত হবে এবং যারা পথভ্রষ্টতা অবলম্বন করবে তারা অকল্যাণগ্রস্ত হবে। সুতরাং সত্য ধর্মের আহবান নিজেদের দায়িত্ব পালনের জন্য এবং অন্যদের কল্যাণ কামনার কারণে। কিন্তু কারো উপর জোর করে কোনো ধর্ম চাপিয়ে দেয়া যাবে না। বরং যারা সত্য ধর্ম অবলম্বন করতে চায় তারা যেন তার সুযোগ পেতে পারে সেজন্য আল্লাহপ্রদত্ত নির্দেশনা অনুসারে ধর্মপ্রচার করতে হবে।

[খ] ইসলামী দাওয়াতের মূল কর্মপন্থা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণ

ইসলামী দাওয়াতের মূল কর্মপন্থা হলো প্রজ্ঞা ও সদুপদেশপূর্ণ আহবান এবং উত্তম বিতর্ক। আর কুরআনে এ কর্মপন্থার অনেক নমুনা রয়েছে যা থেকে স্পষ্ট হয় যে, ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রে যেমন নিজেদের অবস্থানের সঠিকত্বের বিষয়ে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ এবং সত্য ত্যাগের পরিণামের বিষয়ে সাবধানবাণী রয়েছে, তেমনি তাতে বক্তব্য ও আহবানকে যৌক্তিকতার সাথে তুলে ধরা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণের দিকটিও লক্ষ রাখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

১৬:১২৫ :: তোমার প্রভুর পথের দিকে আহবান করো প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করো। নিশ্চয় তোমার প্রভু অধিক জানেন কে তাঁর পথ থেকে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং তিনিই হিদায়াতপ্রাপ্তদের বিষয়ে অধিক জানেন।

২৫:৬৩ :: আর দয়াময়ের বান্দারাই তো পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে আর যখন জাহেল-মুর্খরা তাদের সাথে সংলাপ করে তখন তারা বলে, ‘সালাম’ (শান্তিই কাম্য)।

১৬:১০৩ :: আর আমরা জানি যে, তারা বলে নিশ্চয় তাকে (মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে) জনৈক লোক শিখিয়ে দেয়। তারা যার প্রতি বিকৃতভাবে তথ্যনির্দেশ করে, সে তো অনারব অথচ এর (কুরআনের) ভাষা সুষ্পষ্ট আরবি।

২:২৩ :: আর আমি আমার বান্দাহর প্রতি যা নাযিল করেছি যদি তোমরা তাতে সন্দেহ করো, তাহলে এর কোনো সূরার অনুরূপ সূরা রচনা করে আনো। আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীদেরকেও ডেকে নাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।

১২:৩৬-৩৭ :: আর তার সাথে (নবী ইউসুফের সাথে) দুজন যুবকও কারাগারে প্রবেশ করলো। তাদের দুজনের একজন বললো, নিশ্চয় আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি মদ নিংড়াচ্ছি। এবং অন্যজন বললো, আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি আমার মাথায় রুটি বহন করছি এবং পাখি তা হতে খাচ্ছে। আমাদেরকে এর ব্যাখ্যা বলে দিন। নিশ্চয় আমরা আপনাকে সদাচারীদের অন্তর্ভুক্ত দেখছি। সে (নবী ইউসুফ) বললো, তোমাদেরকে জীবিকাস্বরূপ যে খাদ্য দেয়া হয় তা তোমাদের কাছে আসার আগেই আমি তোমাদেরকে তোমাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দিবো। এটা তা-ই যা আমাকে আমার প্রভু শিক্ষা দিয়েছেন। নিশ্চয় আমি সেই জনগোষ্ঠীর ধর্মাদর্শ ত্যাগ করেছি যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না এবং তারা আখিরাতের প্রতিও কাফির বা অবিশ্বাসী।

২১:৬২-৬৬ :: তারা বললো, আমাদের উপাস্যদের সাথে কি তুমিই এরূপ করেছো, হে ইবরাহীম? সে (নবী ইবরাহীম) বললো, কেউ তা করেছে! এই যে তাদের বড়টি! তাদেরকেই জিজ্ঞেস করো যদি তারা বিবৃত করতে পারে। সুতরাং তারা নিজেদের দিকে ফিরে গেলো (পরস্পরের মুখোমুখি হলো) এবং বললো, নিশ্চয় তোমরাই যালিম। তারপর তাদের মাথা নত হয়ে গেলো (এবং বললো), ‘নিশ্চয় তুমি জানো এগুলো তো কিছু বিবৃত করতে পারে না। সে (নবী ইবরাহীম) বললো, তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ইবাদাত করো যারা তোমাদের কিছুমাত্র উপকারও করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারে না?

২:২৫৮ :: তুমি কি তার প্রতি দৃষ্টিনিবেশ করোনি যে ইবরাহীমের সাথে বিতর্ক করেছে তার প্রভুর সম্পর্কে, এজন্য যে, আল্লাহ তাকে রাজত্ব দিয়েছিলেন। যখন ইবরাহীম বললো, তিনিই আমার প্রভু যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। তখন সে বললো, আমি জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহীম বললো, তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ সূর্যকে পূর্বদিক থেকে উদিত করেন, সুতরাং তুমি সেটাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত করো। সুতরাং যে কুফর করেছিলো সে হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। আর আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।

২৬:১৬-২৯ :: (আল্লাহ বললেন,) ‘তোমরা উভয়ে (নবী মূসা ও হারূন) ফিরআউনের কাছে যাও এবং বলো, নিশ্চয় আমরা বিশ্বপ্রভুর প্রেরিত রসূল। দাবি জানানো হচ্ছে যে, তুমি বানী ইসরাইলকে আমাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দাও। সে (ফিরআউন) বললো, আমরা কি তোমাকে (তোমার) শৈশবে তোমাকে লালন-পালন করিনি? আর তুমি বয়সের অনেক বছর আমাদের মধ্যে অবস্থান করেছো। আর তুমি তোমার কাজ করেছো যা তুমি করেছো আর তুমি অকৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত। সে (নবী মূসা) বললো, আমি তা করেছি যখন আমি পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। তারপর আমি তোমাদের থেকে ফেরারী (পলাতক) হয়ে গিয়েছি, যখন তোমাদের বিষয়ে আশংকাগ্রস্ত হয়েছি। তারপর আমার প্রভু আমাকে বিচারবোধ দিয়েছেন এবং আমাকে রসূলদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আর ঐ অনুগ্রহ যা তুমি আমার উপর করেছো, তার কারণ তো এই ছিল যে, তুমি বানী ইসরাইলকে দাস বানিয়ে রেখেছো। ফিরআউন বললো, আর বিশ্বপ্রভু কে? সে (নবী মূসা) বললো, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর প্রভু, যদি তুমি বিশ্বাসী হও। সে (ফিরআউন) তার চারপাশে যারা আছে তাদেরকে বললো, তোমরা কি শুনছো না? সে (নবী মূসা) বললো, তোমাদের প্রভু এবং তোমাদের পূর্ববর্তী পিতৃপুরুষদের প্রভু। সে (ফিরআউন) বললো, নিশ্চয় তোমাদের রসূল যাকে তোমাদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে নিশ্চিতই উন্মাদ। সে (নবী মূসা) বললো, পূর্ব-পশ্চিম এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর প্রভু, যদি তোমরা বিবেক প্রয়োগ করো। সে (ফিরআউন) বললো, যদি তুমি আমাকে ছাড়া কোনো ইলাহ (সার্বভৌমত্বের অধিকারী উপাস্য) গ্রহণ করো তাহলে আমি অবশ্যই তোমাকে কারাগারে বন্দি করবো।

৫৪:১৭ :: আর নিশ্চয় আমরা কুরআনকে সহজ করেছি স্মরণীয় উপদেশ গ্রহণের জন্য। সুতরাং কে আছো উপদেশ গ্রহণকারী?

২০:২৫-২৮ :: সে (নবী মূসা) বললো, হে আমার প্রভু, আমার মন-মস্তিষ্ককে প্রসারিত করে দিন। আর আমার কাজকে সহজ করে দিন। আর আমার ভাষার জটিল গ্রন্থি খুলে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে; (তথা আমাকে সহজবোধ্য বাক্যগঠন ও বাক্যবিন্যাসের যোগ্যতা দান করুন)।

৩৯:২৭ :: আর নিশ্চয় আমরা মানুষের জন্য এই কুরআনে সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছি, যাতে তারা স্মরণীয় উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।

৮৮:১৭ :: তারা কি উটের দিকে লক্ষ্য করে না, কিরূপে (কিরূপ প্রয়োজনীয় উপাদানের সমন্বয়ে) সেটাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?

৫৬:৬৮-৭০ :: তোমরা কি পানি সম্পর্কে ভেবে দেখেছ যা তোমরা পান করো? তোমরা কি তা মেঘ থেকে নামিয়ে আনো নাকি আমরা তা বর্ষণ করি? আমরা ইচ্ছা করলে তা লোনা করে দিতে পারতাম, তবুও কি তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবে না?

৩৯:৯ :: নাকি যে রাতের বিভিন্ন প্রহরে সাজদাহরত হয়ে ও দাঁড়িয়ে বিনীত থাকে, আখিরাতকে ভয় করে, আর তার প্রভুর দয়ার আশা রাখে (সে তার মতো যে তা করে না)? বলো, যারা জ্ঞানার্জন করে এবং যারা জ্ঞানার্জন করে না তারা কি সমান? নিশ্চয় চিন্তাশক্তির যথাযথ প্রয়োগকারীরাই স্মরণীয় উপদেশ গ্রহণ করে।

৩৪:২৪-২৬ :: বলো, কে তোমাদেরকে আকাশমণ্ডলী থেকে ও পৃথিবী থেকে জীবিকা দেন? বলো, আল্লাহ। বলো, নিশ্চয় আমরা অথবা তোমরা হিদায়াতের উপর অথবা সুষ্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে। বলো, তোমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে না আমাদের অপরাধ সম্পর্কে এবং আমরাও জবাবদিহি করতে হবে না তোমাদের কর্ম সম্পর্কে। বলো, আমাদের প্রভু আমাদেরকে (ফায়সালার জন্য) একত্র করবেন। তারপর তিনি আমাদের মধ্যে নিষ্পত্তি করে দিবেন। আর তিনি শ্রেষ্ঠ নিষ্পত্তিকারী সর্বজ্ঞ।

৩৪:৫০ :: বলো, যদি আমি পথভ্রষ্ট হই, সেজন্য আমি অকল্যাণে পতিত হবো। আর যদি আমি হিদায়াতপ্রাপ্ত হই, তবে তা এজন্য যে, আমার প্রভু আমার প্রতি ওহী করেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, অতি নিকটবর্তী।

৬:১৯ :: বলো, সাক্ষ্যদানে কে সবচেয়ে বড়? বলো, আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী। আর আমার প্রতি এ কুরআন ওহী করা হয়েছে তা দ্বারা সতর্ক করার জন্য তোমাদেরকে এবং যাদের কাছেই তা পৌঁছে যাবে তাদেরকে। তোমরা কি সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহও আছে? বলো, আমি সাক্ষ্য দিই না। বলো, নিশ্চয় তিনি একক ইলাহ। আর তোমরা যে শিরক করো আমি তা থেকে দায়মুক্ত।

আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামের দিকে আহবান হতে হবে প্রজ্ঞা ও সদুপদেশপূর্ণ আহবানের মাধ্যমে এবং প্রয়োজনে বিতর্ক করতে হলে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করতে হবে। আর উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক বলতে বুঝায়, যে মানতে চায় না বিধায় বক্রযুক্তির আশ্রয় নেয় তাকে মানানোর জন্য ব্যাখ্যায় যাওয়ার পরিবর্তে লা-জবাব করে দেয়ার মতো বা তার যুক্তিকে অসার প্রমাণ করার মতো প্রাসঙ্গিক যুক্তি প্রদান এবং প্রতিপক্ষের যুক্তি প্রদানকারী কর্তৃক মুর্খতা প্রদর্শনের পূর্ব পর্যন্ত বিতর্ক করা, মুর্খতা প্রদর্শন করলে সালাম জানিয়ে বিতর্ক শেষ করা।

অভিযোগের জবাবে সরলভাবে জানিয়ে দিতে হবে যে, অভিযোগটি সঠিক নয় এবং সেইসাথে প্রয়োজনে অভিযোগটি যে ভুল তা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক যুক্তির অবতারণা করতে হবে। যেমন, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ও কুরআনের ক্ষেত্রে একটি অভিযোগ ছিল যে, জনৈক লোক তা রসূলকে শিখিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এ অভিযোগের ক্ষেত্রে তারা যে লোকটির দিকে ইঙ্গিত করে যে, লোকটি রসূলকে শিখিয়ে দেয়, সে লোকটির ভাষা হলো অনারব ভাষা, অথচ কুরআন স্পষ্ট আরবি ভাষারীতির গ্রন্থ। এছাড়া কুরআনের বিষয়ে সন্দেহ থাকলে এর অনুরূপ কিছু আনার বিষয়েও চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে।

নবী ইউসুফ কর্তৃক কারাগারে দুজন সঙ্গীর স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেয়ার সময় তিনি যেভাবে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন তা থেকে দাওয়াতের পদ্ধতি হিসেবে যুক্তিপূর্ণ উপস্থাপন, সঠিক সময়সীমা নির্বাচন, মনোযোগ আকর্ষণ ইত্যাদি শিক্ষা পাওয়া যায়। নবী ইবরাহীম ‘মূর্তিগুলো কে ভেঙ্গেছে?’ প্রশ্নটির জবাবদানের সময় দাওয়াত দেয়ার যে কৌশলী কর্মপন্থা অবলম্বন করেছেন তা থেকেও শ্রোতাদেরকে সত্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার দিকে নিয়ে আসার শিক্ষা পাওয়া যায়।

বিতর্কের ক্ষেত্রে আমরা নবী ইবরাহীম কর্তৃক তৎকালীন রাজার সাথে বিতর্ক এবং নবী মূসা কর্তৃক ফিরআউনের সাথে বিতর্ক থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়ে থাকি। নবী ইবরাহীম যখন দেখলেন যে, রাজা বক্রযুক্তির আশ্রয় নিয়ে নিজেকে জীবনদাতা ও প্রাণহরণকারী হিসেবে দাবি করছে তখন তিনি তাকে বললেন যে, তাহলে আমার প্রভু তো সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন, তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত করো দেখি। এতে রাজা হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। আর ফিরআউনের সাথে নবী মূসার বিতর্কের সময় ফিরআউনের যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, ‘বিশ্বপ্রভু আবার কে?’, এই প্রশ্নটির জবাব যখন ফিরআউন নিচ্ছিলো না বরং অনর্থক অভিযোগ করে যাচ্ছিলো, তখন তার মধ্যবর্তী অযথা কথাগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে নবী মূসা ‘প্রভুর পরিচয়’ সম্পর্কিত উত্তর অব্যাহত রেখেছেন, কারণ এ প্রশ্নটির জবাব এবং তিনি সবার কাছে যে দাওয়াত উপস্থাপন করতে চেয়েছেন উভয়টি একই এবং তিনি এর একটি চমৎকার সুযোগ পেয়েছেন। যেহেতু নবী মূসা সম্পর্কে ফিরআউনের অভিযোগসমূহ যে ফিরআউন নবী মূসার কথার প্রত্যুত্তরে অক্ষম হয়ে তার কর্তৃক মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে অযথা অভিযোগমাত্র, শ্রোতারা তা পরিবেশ ও কথার ধরন থেকে স্বত:সিদ্ধভাবে বুঝতে পারার কথা।

উপদেশ গ্রহণের জন্য কুরআনকে সহজ করা হয়েছে। সুতরাং কুরআনের আলোকে দাওয়াত উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও দাওয়াতের ভাষা ও বক্তব্য সহজ হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে যাদেরকে উদ্দেশ্য করে দাওয়াত উপস্থাপন করা হচ্ছে তারা যেন বুঝতে পারে সেভাবে বাক্য গঠন ও বাক্য বিন্যাস করার চেষ্টা করতে হবে। নবী মূসার প্রার্থনা থেকেও এ শিক্ষা পাওয়া যায়।

কুরআনের বক্তব্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার উদাহরণ দেয়া হয়েছে এবং বিজ্ঞানসম্মত ও বাস্তবভিত্তিক নিদর্শনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিন্তাশীলতা জাগ্রত করার উপযোগী প্রশ্নকরণ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। সুতরাং দাওয়াত উপস্থাপনের প্রজ্ঞাপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে উদাহরণ দেয়া এবং যে প্রশ্নের উত্তর শ্রোতার বিবেক-বুদ্ধি ও সাধারণ বাস্তবতার জ্ঞান থেকে স্বত:সিদ্ধভাবে উদ্ভাসিত হবে এরূপ প্রশ্নকরণের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

রসূলকে দাওয়াত উপস্থাপনের জন্য যে পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে তার একটি শিক্ষা হলো: নিজেদেরকে সঠিক বলে জানা ও দাবি করা সত্ত্বেও সেটা অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। এতে রসূলকে যা বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল (হয় তোমরা সঠিক না হয় আমরা সঠিক), তার তাৎপর্য এ নয় যে, রসূল সন্দেহে ছিলেন যে, তিনি সঠিক নাকি মুশরিকরা সঠিক। বরং এটা হলো, যৌক্তিক সম্ভাবনা তত্ত্ব, দুটি বিপরীতমুখী দাবিতে থাকা ব্যক্তিদের উভয় পক্ষ সঠিক হতে পারে না, সুতরাং কোনো এক পক্ষ সঠিক। এ যৌক্তিক সম্ভাবনা তত্ত্বের উদ্দেশ্য হলো, প্রতিপক্ষকে তাদের অবস্থান সম্পর্কে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করা। একই সাথে এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষের অবস্থান অসঠিক হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে সঠিক অবস্থানে আসার ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ না করে বরং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়ার এবং তাদের ধর্মীয় অবস্থানের উপর থাকার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে।

দাওয়াত উপস্থাপনের ক্ষেত্রে শ্রোতাদেরকে জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে যে, যদি রসূল পথভ্রষ্ট হন, তবে এজন্য তিনিই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, আর যদি তিনি সঠিক পথপ্রাপ্ত হন, তবে তা তাঁর উপর ওহী নাযিল হওয়ার কারণেই। অন্যদের নিকট থেকে সাক্ষ্য চাইতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর সাথে কোনো ইলাহ আছে বলে তারা সাক্ষ্য দেয় কিনা? সেক্ষেত্রে তারা যে সাক্ষ্যই দিক, সেই সাক্ষ্য তারা কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তির উপর ভিত্তি করে দিচ্ছে নাকি অগ্রহণযোগ্য যুক্তিতে দিচ্ছে তা তাদেরকে তাদের বিবেকের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। সেই সাথে রসূলকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তিনি যেন বলে দেন যে, তিনি আল্লাহর সাথে অন্য কোনো ইলাহ থাকার সাক্ষ্য দেন না। এভাবে দাওয়াত বস্তুত বিবেকের কাছে, কিন্তু কেউ সত্য ধর্মমতের বিপক্ষে অবস্থান নিলে উভয়পক্ষ স্রষ্টার কাছে নিজ নিজ কাজের জন্য দায়ী থাকবে বলে জানিয়ে দিতে হবে এবং পৃথিবীতে সকলের ধর্মীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণ করতে হবে।

শেষকথা: পরিশেষে বলা যায় যে, ধর্মমতের ভিন্নতার মোকাবেলায় নিজ নিজ ধর্মমতকে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করা ছাড়া অন্য কিছুর অবকাশ নেই। যেখানে বলা হয়েছে, ‘হয় আমরা না হয় তোমরা সঠিক বা ভ্রান্ত’ এর চেয়ে ভিন্ন কিছুকে অন্যদের উপর জোর করে চাপানোর সুযোগ দিলে ধর্মীয় কারণে হানাহানির এমন এক পথ খুলে যায় যা শেষ হওয়ার নয়। সত্য ধর্মকে অনুসন্ধান, অনুধাবন ও অনুশীলন করতে হয়, এটা নিছক দাবি করার বিষয় নয়। প্রত্যেক পক্ষ নিজ ধর্মমতকে সঠিক আখ্যা দিয়ে বিপরীতপক্ষকে ‘মুরতাদ’ আখ্যা দিয়ে চিরস্থায়ী হত্যাকাণ্ডের মিশন চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে সব লাভ-ক্ষতির ঊর্ধ্বে থাকা স্রষ্টার যেমন কোনো কোনো লাভ নেই, তেমনি তাতে মানবজাতির জন্যও কোনো কল্যাণ নেই। এর মাধ্যমে তো বরং একটা অন্তহীন খুনাখুনির ধারা চালু হয় মাত্র। অথচ যেজন্য এ হত্যাকাণ্ড তার পেছনে কোনো ন্যায়সঙ্গত ভিত্তি নেই, শুধুমাত্র একপক্ষের ধর্মমতের সাথে ভিন্নতাই বিপরীতপক্ষের অপরাধ। আর সঠিক ধর্ম থেকে ফিরে যাওয়ার কারণে কাউকে হত্যা করার জন্য কুরআনে কোনো অনুমোদন নেই, বরং কুরআন অনুযায়ী এরূপ হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণ অবৈধ।

>>  পরবর্তী পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য ক্লিক করুন