দি  ইন্সটিটিউট ফর কুরআনিক রিসার্চ এন্ড এ্যাপ্লিকেশন (ইক্বরা)

লক্ষ্য

ইক্বরার লক্ষ্য হলো বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য স্রষ্টার ঐশী বাণীর সমন্বিত অধ্যয়ন ও সার্বজনীন প্রয়োগের জন্য জ্ঞানদীপ্ত অনুশীলন।

উদ্দেশ্য

ইক্বরার উদ্দেশ্য হলো কুরআনের বাণীর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ অনুধাবনের জন্য টেকসই ভিত্তি প্রস্তুত করা এবং জীবন ও সমাজের প্রায়োগিকতার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানভিত্তিক ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামো নির্মাণ।

প্রকাশিত বইসমূহ

সালাতের উদ্দেশ্য এবং বাস্তবায়ন

১.

একটি উদাহরন নিয়ে শুরু করা যাক। ধরে নিন হাবিব সাহেব ঢাকায় অবস্থিত একটি অফিসের ম্যানেজার। তার অফিসের বস ও চেয়ারম্যান রাজীব সাহেব। জনাব হাবিবকে তার বস চট্রগ্রামের শাখা অফিসে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা সম্বলিত চিঠি নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দিয়ে বিদেশে চলে গেলেন দীর্ঘ ছয় মাসের জন্য। ঐ চিঠিতে ম্যানেজার হাবিব সাহেবের দায়িত্ব ও করণীয় কাজগুলো সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা আছে।

হাবিব সাহেব সম্প্রতি একটি গাড়ী কিনেছেন। তিনি ঠিক করলেন চট্রগ্রাম সে নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে যাবেন। গত এক মাস ধরে ইতিমধ্যে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণও নিতে শুরু করেছেন। প্রতিদিন অফিস শেষে জোশের সাথেই সে ড্রাইভিং ক্লাস করেন। ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় আস্তে আস্তে চালাতে অভ্যস্ত হচ্ছেন। ছুটির দিনগুলোতে একটু বেশি সময় ধরে ড্রাইভিং প্র্যাক্টিস করেন। নিজের টাকায় কেনা অনেক দিনের শখের গাড়িটি যখন তিনি চালান তখন তার খুব ভালো লাগে। এক ধরনের প্রশান্তি তার চোখে মুখে ঝিলিক দেয়।

দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, হাবিব সাহেব গাড়ি চালানো শিখছেন তো শিখছেন। এদিকে তার বস চেয়ারম্যান সাহেব ছয় মাসের সফরে বিদেশে। অদভুত শোনালেও হাবিব সাহেব গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষন নিতে নিতে চট্রগ্রাম যে যাওয়ার কথা সেটা পুরোই ভুলে গেলেন।

উপরের গল্পটার সাথে মুসলিমদের নামাযের অনুষ্ঠানের এক ধরনের মিল আছে। সালাত একটি মাধ্যম যার অনুশীলনের পেছনে একটি মহৎ উদ্দেশ্য ছিলো। কিন্তু হাবিব সাহেব যেমন গাড়ি চালানো শেখার অনুষ্ঠানে নিজেকে এমনভাবে সীমিত ও সীমাবদ্ধ করেছেন যে তিনি গাড়ি চালিয়ে যে চট্রগ্রাম যেতে হবে এবং একটি গুরুত্বপূণ কাগজ আনার এবং সেটার নির্দেশনা বুঝে কাজ করার বিষয়টা বেমালুম তার সচেতনতার বাইরে চলে গেছে।

মুসলিমদের সালাত চর্চার অবস্থাটাও অনেকটা একই। সালাত চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ছিলো না। ইংরেজী একটা কথা আছে: "It is a means to an end, not an end in itself." সালাত একটা প্রক্রিয়া, অনুষ্ঠান, অনুশীলন। সালাতই কিন্তু লক্ষ্য নয়, বরং লক্ষ্যে পৌছানোর একটি প্রক্রিয়া বা অনুশীলন।

২.

সকল বিধান মানুষের কল্যানের জন্য, স্রষ্টার এতে কোন লাভ ক্ষতি নেই

স্রষ্টা সৃষ্টির অমুখাপেক্ষী। সৃষ্টির সবাই মিলে স্রষ্টাকে অস্বীকার করলে এবং স্রষ্টার দাসত্বের বিদ্রোহী হলে মহাপরাক্রমশালী এবং মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও প্রতিপালনকারীর কিছুই হ্রাস বৃদ্ধি হয় না। এরপরেও তিনি জমীনে তার প্রতিনিধি হিসেবে যাদের মনোনয়ন করলেন, তাদের বিশেষ দায়িত্বের অংশ হিসেবে তাদের কল্যানের জন্যই তিনি কিছু বিধান দিলেন। এই বিধান পালন মানুষের নিজের মঙ্গলের জন্য। যে স্রষ্টার নির্দেশিত পথ অনুসরণ করবে সে তার পুরস্কার পাবে এবং মঙ্গল লাভ করবে এবং যে সেই বিধানের প্রতি উদাসীন ও বিদ্রোহী হবে, ক্ষতি ও আফসোস একমাত্র সেই উদাসীন ও বিদ্রোহীর নিজের হবে।

স্রষ্টা যুগে যুগে যে বিধান নাজিল করেছেন সেই বিধানের অনুসরনই "সালাত" শব্দের মূল অর্থ। শব্দমূল এবং অর্থের দিক থেকে স্রষ্টার বিধানের নিবীড় অনুসরনের নাম হলো সালাত। এটিই কুরানিক আরবীতে সালাত শব্দের প্রাথমিক অর্থ এবং ভাবগত / আদর্শগত ব্যাপক অর্থ।

এই ব্যাপক ও ভাবগত অর্থের পাশাপাশি যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী বা প্রায়োগিক অনুষ্ঠান অর্থ সেটিও বিদ্যমান এবং সেটি হলো প্রকৃতি ও সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, প্রকৃতির যে নিপুন ছন্দ আছে তার অংশ হয়ে নিয়মিত স্রষ্টার বিধানের অনুশীলনের জন্য নির্দিষ্ট পাঠ, যেটিকে আমরা আনুষ্ঠানিক সালাত বা আমাদের এই অঞ্চলে ফার্সি শব্দ নামাযের মাধ্যম আমরা পরিচিত।

৩.
যেহেতু আমাদের প্রচলিত ধর্ম পালনে আনুষ্ঠানিক নামাযের দিকে আমাদের সকল মনোযোগ এবং আলোচনা সেই অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক সেহেতু এই আলোচনায় আমরা একটু মনোযোগ দিতে চাই সালাতের মূল অর্থ, ব্যাপক ও ভাবগত / আদর্শগত অর্থের দিকে।

মূলত যে প্রশ্নটি নিয়ে আমরা চিন্তা করতে চাই সেটি হলো, ব্যক্তি পর্যায়ে আকিমুস সালাত বা সালাত প্রতিষ্ঠা বা প্রয়োগ কিভাবে সালাতের যে উদ্দেশ্য সেটির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবায়ন হতে পারে?

বলে রাখা প্রয়োজন আমাদের আলোচনাটি যেন বায়বীয় না হয়, যেন সেটি প্রকৃত পরিবর্তন ও টেকসই পরিবর্তনমুখী হয় সেটিই আমাদের মূল বিবেচনা।

৪.

সালাতের উদ্দেশ্য

সালাতের উদ্দেশ্য যদি কুরআন থেকে আমরা খুঁজতে চাই, তবে সরাসরি কালাম হিসেবে নবী মুসাকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন যে আমার স্মরণের জন্য সালাত প্রতিষ্ঠা বা বাস্তবায়ন করো (সুরা ত্বহা ২০: ১৪ আয়াত)।

এটিই সালাতের উদ্দেশ্য বিষয়ে সবচেয়ে সরাসরি বক্তব্য। অর্থাৎ স্রষ্টার স্মরণ হলো সালাতের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য। এখন যদি এর ভাবগত জায়গা থেকে আমরা বাস্তব ও বস্তুগত জায়গায় আসতে চাই, তা হলে স্মরণ হয়ে যায় স্রষ্টার বিধান সম্পর্কে সচেতনা হওয়া, বিধানগুলো পাঠ ও আত্নস্থ করা যেন জীবন যাপনে সেই বিধান, আদর্শ ও স্থায়ী নির্দেশনাগুলো আমরা প্রয়োগ করতে পারি। প্রয়োগ করার মতো সচেতনতা অজর্ন করা।

আমরা কুরআন পাঠ থেকে জানতে পারি যে এক স্রষ্টার দাসত্ব করা এবং সালাত প্রতিষ্ঠা তথা স্রষ্টার নির্দেশের নিবীড় অনুসরনই সব যুগে স্রষ্টার সার্বজনীন আদেশ ছিলো। তাই নবী ইব্রাহীম, দাউদ, সুলায়মান, মুসা, ঈসা সবার ক্ষেত্রেই আমরা জানি সালাত প্রতিষ্ঠা বা বাস্তবায়নের নির্দেশ ছিলো। এক্ষেত্রে সালাতের ব্যাপক অর্থই প্রযোজ্য কারন ঐতিহাসিকভাবে আমরা জানি যে বর্তমানে মুসলিমরা যেভাবে সালাত করে, বণী ইসরাইলের সালাত হুবহু একই নয়। অন্য জাতিদের স্রষ্টার উপাসনা পদ্ধতি ভিন্ন। কিন্তু প্রত্যেকের ক্ষেত্রে যেটা কমন সেটা হলো প্রত্যেকেই তাদের বিধান গ্রন্থ থেকে স্রষ্টার বিধানের অনুসরনে সচেষ্ট।

আমরা যদি রাসুল স. এর সময়ে নিজেদেরকে কল্পনায় নিয়ে যাই আমরা দেখতে চেষ্টা করতে পারি যে রাসুলের কাছে আল্লাহর ওহী নাজিল হচ্ছে। অল্প কয়েকটি আয়াত, কিছূ দিনের গ্যাপ, কখনো কয়েক সপ্তাহ, কখনো মাসের বিরতী তারপর আবার নতুন ওহী আসা। এ প্রক্রিয়া চলছে এবং রাসুল অন্যদের সে বার্তা পৌছে দিচ্ছেন।

যে জাতির কাছে এই ওহী আসছে আল্লাহর বিধান হিসেবে তারা আগে কোন কিতাবের অধিকারী ছিলো না। এমনটি রাসুল নিজেও অন্য কোন কিতাব পাঠে অভ্যস্ত ছিলেন না - এমনটাই কুরআনের বাণী থেকে বুঝে নেওয়া সম্ভব।

এমতাবস্থায় তিনি মানুষকে কিভাবে আল্লাহর বিধান পড়ে শুনাতেন? এই বিধান শুনানোর, শিখানোর প্রধান ও সম্ভবত একমাত্র ব্যবস্থা সেটি ছিলো আনুষ্ঠানিক সালাত। অর্থাৎ সালাত হিসেবে আমরা যা দেখি, শুনি ও করি সেটি ছিলো একটি জাতিকে ঐশী সংবিধান পাঠ করে শুনানো এবং সেই সংবিধান অনুসারে জীবন পরিচালনা করার একটি প্রশিক্ষন অধিবেশন।

রাসুল ঘরে ঘরে গিয়ে কুরআন শুনিয়ে আসেননি। অথবা তিনি উটের পিঠে চড়ে চড়ে বিভিন্ন বেদুইন পল্লীতে গিয়ে নতুন আয়াত শুনাননি। ইয়াথরিবের মদিনায় তার দপ্তর তিনি সুনির্দিষ্ট সময়ে অধিবেশনের মতো করে দাড়িয়ে কুরআন পাঠ করতেন এবং বাকিরা সেটাতে যুক্ত হতো, শুনতো এবং চলে যেতো।

উপরের এই বিষয়টা কল্পনা করা খুব কঠিন নয়। একটা জাতিকে কোন বিষয়ে সুষমভাবে প্রশিক্ষিত করা খুব সহজ না। সেই বাস্তবতায় পুরো জাতির প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠি, নারী ও পুরুষ উভয়কেই তিনি যে দীর্ঘ ২৩ বছরে কুরআনের বিধানের আলোকে শিক্ষিত করলেন সেটির বাস্তব প্রক্রিয়া আসলে কি ছিলো?

এর উত্তরই হলো সালাতের অধিবেশন। দূর দুরান্ত থেকে এবং কাছের মানুষদের কুরআন জানা, পাঠ, শিক্ষা এবং অনুশীলনের অধিবেশনই সালাত।

কর্ম দিবসের বিভিন্নর সময়ে যেমন সালাত হতো, তেমনি রাসুল এবং তার ইনার সার্কেল বা কাছের মানুষদের কুরআন পাঠ অধিবেশন হতো রাতেরও কিছু অংশে।

এই ছিলো সালাতের উৎপত্তিগত ঐতিহাসিক পটভূমি। আল্লাহই ভালো জানেন।

এখন যেমন আমরা কুরআন শেখার জন্য স্কুল, মাদ্রাসা, কোচিং, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিগত শিক্ষক রাখার আয়োজন করি, এর সবকিছূর অর্গানিক ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ছিলো রাসুলের নেতৃত্বে কুরআন পাঠ এবং যখন এরকম অধিবেশন চলতো তখন সেটা নীরবে ও মনোযোগের সাথে শুনারও নির্দেশনা আমরা পাই কুরআনে।

৫.

এখন আমাদের সময়ে আসা যাক।

আমরা আরব নই। আরবী আমাদের মাতৃভাষা নয়। তারপরও ঐতিহ্যের পরম্পরায় এবং কুরআনের আদী ভাষার প্রতি সন্মান ও আনুগত্য দেখিয়ে আমরা সালাতে কুরআন আরবীতেই তেলোয়াত বা পাঠ করি।

কিন্তু সালাতের যে মূল উদ্দেশ্য ছিলো স্রষ্টার বিধানের পাঠ, বুঝে হৃদয়াঙ্গম করা, ইন্টারনালাইজ বা অন্তরে গ্রহন করা যেন জীবনের কাজের সেই নীতি নৈতিকতাকে প্রয়োগ করা যায় সেটা অনুপস্থিত।

যেহেতু আমরা সালাতের মূল বিষয় এবং এর উদ্দেশ্য থেকে বিচু্্যত সেহেতু আমাদের সালাত এখন ঘুরে ফিরে কয়েকটা ছোট সুরা পাঠ করা। পুরো কুরআন অবহেলিত।

আমাদের সমাজের দিকে যে সংকট আমরা দেখতে পাই তা হলো নৈতিকতা ও সুশিক্ষার সংকট। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা যদি প্রকৃত সালাত চর্চা করতে পারতাম তাহলে নি:সন্দেহে নৈতিক আদর্শে প্রত্যেক ব্যক্তি বলীয়ান হতো এবং ব্যক্তি থেকেই পরিবার ও সমাজ ও রাষ্ট্রে তার প্রভাব ছড়িয়ে যেত।

কুরআন যা শিক্ষা দেয় তার একটি বড় অংশই নৈতিকতা যেমন: সত্যের সাথে জীবন যাপন করা, মিথ্যা পরিহার, সঠিক কথা বলা, ন্যায় ও ন্যায্যতা বজায় রাখা, অঙ্গীকার সন্মান করা, অন্যকে হেয় না করা, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ পোষণ না করা, ক্ষমার চর্চা, পরার্থপরতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ, ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করা, আত্নীয় ও গরীবদের জন্য নিজের অর্জিত সম্পদ ব্যয় করার মতো মহত্ব, নি:স্বার্থতার চর্চা - এসবই নৈতিকতার নির্দেশনা যা মানবিক মানুষ গড়ার নির্দেশনা।

আপনি যদি এই লেখাটির বা আলোচনার পাঠক ও শ্রোতা হন তাহলে আপনার কাছে, আমার কাছে প্রশ্ন যে সালাতের উদ্দেশ্য ও উৎপত্তির বিষয়টি বুঝে থাকলে একজন বাঙ্গালী মুসলিম যার মাতৃভাষা আরবী নয়, যে আরবীতে সেভাবে অভ্যস্ত নয় - তার সালাতের উদ্দেশ্য সফল করতে করণীয় কি হতে পারে?

৬.

করণীয়

যেকোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটি বেশি গুরুত্বপুর্ণ।

আমি পুরা জীবনে লক্ষাধিক রাকাত সালাত করলাম, কিন্তু পুরো জীবনে কুরআনে আল্লাহ কি কি নির্দেশ দিয়েছেন তা সম্পর্কে গাফিল থাকলাম - তাহলে সালাতের উদ্দেশ্য, শিক্ষা সব কিছু ব্যর্থ করে নিলাম নিজের জীবনে।

এই আলোচনার প্রস্তাবনা হলো, আনুষ্ঠানিক সালাত সম্পন্ন করার পরে, নিজ মাতৃভাষায় কুরআনের সুরাগুলো সালাতের বৈধকে বা সালাতের পরে বা আগে পড়া উচিত। নিয়মিত, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কুরআন পাঠ করার অভ্যাস এবং পাঠ মানে বুঝে পাঠ।

আমাদের এটা বোঝার মতো সাধারন জ্ঞান আশা রাখি আমাদের আছে যে যে পড়ায় আমি বুঝলামই না যে কি পড়লাম, সেটা পড়া বলে না। জাতি হিসেবে আমরা না বুঝে পড়ার যে কালচারে অভ্যস্ত কুরআন সেভাবে না বুঝে মুখস্ত করার জন্য নাজিল হয় নাই। এটা শয়তানের ধোঁকা ছাড়া আর কিছূ না, মুখে মুখে মুসলমান দাবী করা জনগোষ্ঠিকে কুরআনের বক্তব্য, পাঠ, প্রয়োগ থেকে দূরে রাখার শয়তানী কুটকৌশল মাত্র।

যেহেতু আমরা যারা প্রাপ্তবয়স্ত তাদের সিংহভাগই শেখানো হয়েছে কিছু ছোট সুরা মুখস্ত করা এবং সেগুলো ব্যবহার করে সালাত করা - এর ফলে কুরআন পাঠের, জানার যে মূল উদ্দেশ্য ছিলো সেটা আমাদের অপূরনীয়ই থেকে যায়।

সালাতের লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের করণীয় কাজগুলোকে সংক্ষেপে এভাবে বলা যেতে পারে:

ক. কুরআনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে স্বার্থক করতে হলে আনুষ্ঠানিক সালাতের পরে নিজ উদ্যোগে বোধগম্যভাষায় যেকোন স্ট্যান্ডার্ড অনুবাদ থেকে কুরআন পাঠ করা উচিত।

মোটিভেশন থাকবে কুরআনে প্রতিপালক যে বিধান, অনুপ্রেরণা দিয়েছে সেগুলো জানা, বোঝা যেন তা জীবনে প্রয়োগ করা যায়।

কুরআনকে স্রষ্টার প্রতিশ্রুতি অনুসারে সহজ করা হয়েছে। কেবলমাত্র স্রষ্টা বিদ্রোহী ব্যক্তির পক্ষেই এর উল্টোটা দাবী করা সম্ভব যে কুরআন অনেক কঠিন, তুমি পড়লে বুঝবা না। এ ধরনের কথার অর্থই হলো কুরআন থেকে মানুষকে দূরে রাখার ছল। কোন কোন আয়াতের মমার্থ একবার না বুঝলেও বারবার পাঠে স্রষ্টার তরফ থেকেই সেই বোধ আমাদের মধ্যে তৈরী হবে।

খ. ২৩ বছরের ব্যাপ্তি নিয়ে যে কুরআন নাজিল হয়েছে তা বারবার পঠিত হবে, পার পার পাঠের মাধ্যমে তার জীবনব্যাপি নিরবিচ্ছিন্ন অনুশীলন হবে - এটাই কুরআনের স্পিরিট। কুরআন পাঠে, বোধগম্যতায় তাড়াহুড়া যিনি কুরআন নাজিল করেছেন স্বয়ং তাঁরই নিষেধ।

গ. প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বারবার কুরআন পাঠ হবে, সালাতের দাবি সেটই। গুটি কয়েক ছোট সুরার অল্প কিছু আয়াতে কুরআনকে সীমাবদ্ধ করার যে অভ্যাস আমরা করেছি সেটি কুরআন নাজিলের যে উদ্দেশ্য তার বিরুদ্ধে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।

ঘ. আনুষ্ঠানিক সালাত কুরআন পাঠ চর্চার অনুশীলন হলেও এটি একই সাথে বান্দার ও স্রষ্টার সংযোগও বটে। সালাত শব্দের প্রাথমিক অর্থ স্রষ্টার বিধানের নিবীড় অনুশীলন হলেও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ হলো: সংযোগ, যোগাযোগ। তাই সালাতের অন্যতম আরেকটি প্রায়োগিক উদ্দেশ্য হলো বান্দার সাথে স্রষ্টার সংযোগ। এই সংযোগের শুরুতে যে সুরা ফাতিহা পাঠ করা হয় তা হলো বান্দা ও স্রষ্টার সংযোগের চুক্তি বা অঙ্গীকারনামা।

সুতরাং সেই পরিপ্রেক্ষিতে সুরা ফাতিহার পরে সেই আয়াতগুলোই পাঠ করা উচিত যেগুলো স্রষ্টার প্রশংসামূলক এবং স্রষ্টার কাছে আবেদন, নিবেদন ও ক্ষমা প্রার্থনামুলক।

ঙ. আপনি যদি কখনোই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নিজের মাতৃভাষায় কুরআন পাঠ না করে থাকেন তা হলে প্রতিদিন নিয়ম করে অল্প করে হলেও নিয়মিত ও ধারাবাহিক কুরআন পাঠ করুন নিজের ভাষায়। আরবী না বুঝলে আপাতত আরবীতে না পড়ে নিজের ভাষাতেই পড়ুন।

আরবী সেভাবে শিখুন যেন সালাতে যে সুরা পাঠ করছেন বা কুরআনের যেকোন আয়াত সরাসরি আরবীতে পড়লে যেন নিজেই অর্থ বুঝতে পারেন।

যতদিন সেভাবে আরবী শেখা না হচ্ছে ততদিন একটি স্ট্যান্ডার্ড অনুবাদ থেকে কুরআন পড়ুন। কুরআনের ব্যাখ্যা বোঝার জন্য আর কোন কিছুর সহায়তা নেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। হাদীস, তাফসির, ওয়াজ এগুলো সবগুলো কুরআন পাঠের সময়ে বন্ধ রাখূন। যিনি কুরআন নাজিল করেছেন তাঁর কাছে প্রার্থণা করুন কুরআনের মর্মাথ ও শিক্ষা যেন আপনার অন্তরে প্রদান করে। হে প্রভু আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন- এই দোওয়া কুরআনেই স্র্রষ্টা শিখিয়েছেন। সেই দোয়াকে আশ্রয় করে প্রার্থনা করুন।

আশা করা যায় সালাতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমরা সচেতন হয় নতুন চেতনায় আমাদের জীবনে সালাতকে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হবো।

যে পথ খোঁজে, যে সত্য অনুসন্ধান করে নিশ্চই আল্লাহ তাকে পথের খোঁজ দেন এবং পথে চলতে সাহায্য করেন। তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী।


কুরআনের আলোকে সালাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আপনারা এই বইটি পড়তে পারেন যা অনলাইনে বা পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন:

ট্যাগ / কী-ওয়ার্ড:

অন্যান্য প্রবন্ধ

October 6, 2025
On a New Understanding of Iman, Belief and Faith according to Quran

On the Reinterpretation of Iman in Islam This video explores a provocative reinterpretation of one of Islam’s fundamental concepts: iman. The author Dr. Hal al-Sed Hassan argues that the traditional understanding of iman as “faith” or “belief” has been deliberately misconstrued over centuries, and that this misunderstanding has led to significant social and theological consequences within the Islamic […]

June 7, 2025
শেষ জামানা সম্পর্কে কুরআন কি বলে?

শেষ জামানা বা আখিরুজ্জামান সম্পর্কে কুরআনে কি বলে? বিস্তারিত জানাচ্ছেন একজন কুরআনের স্কলার

May 30, 2025
প্রচলিত কুরবানি: কুরআন থেকে পর্যালোচনা

প্রচলিত কুরবানিকে যদি আমরা কুরআন থেকে পর্যালোচনা করি, তাহলে কি পাই?

May 16, 2025
Explaining the Qur'an through the Qur'an

Introductory presentation for a series applying the intratextual approach to the exegesis of Surat al-An'am, here on CASQI's channel.

May 3, 2025
কুরআনকে কি সংবিধান বলা যেতে পারে?

সাধারন ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যে একটি কমন ধারনা হলো: ইসলামের সংবিধান হলো কুরআন এবং আধুনিক সময়ে যেসব সেকুলার সংবিধান করা হয় তা হলো "তাগুত"। বিষয়টি কি সত্যিই এরকম সাদা কালো? কুরআন কি সংবিধানি? একজন ইসলামে বিশ্বাসীর পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে এই প্রশ্নের মিমাংসায় পৌছতে হলে আমাদের প্রথমে কয়েকটি কনসেপ্ট ক্লিয়ার করে এগুতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে […]

May 2, 2025
কোরআন বোঝা কি কঠিন?

মুসলিমদের জীবন বিধানের সকল মূলনীতি কোরআনে আল্লাহ বলে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তোমার ওপর যে কিতাব (কোরআন) নাজিল করা হয়েছে ‎তাতে রয়েছে সকল বিষয়ের বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৮৯) দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ দেশের মুসলিমদের কোরআন দেখে শুদ্ধ করে পড়ার প্রতি গুরুত্ব থাকলেও ইসলামি জীবন বিধানের মৌলিক উৎস […]

April 15, 2025
সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার : কুরআনে সামাজিক মূল্যবোধ

১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ যে মূলনীতিসমূহ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে এবং ২০২৪ সালে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য যে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ কর্তৃক পেশ করা হয়েছে তাতে অন্যতম তিনটি মূলনীতি হলো, ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’। বস্তুত এই মূলনীতিসমূহ […]

April 11, 2025
নাসর হামিদ আবু যায়েদ - একজন আধুনিক কুরআন স্কলারের কর্ম-পরিচিতি

নাসর হামিদ আবু যায়েদ - একজন আধুনিক কুরআন স্কলারের কর্ম-পরিচিতি ... তার কাজ ও জীবন সম্পর্কে