দি  ইন্সটিটিউট ফর কুরআনিক রিসার্চ এন্ড এ্যাপ্লিকেশন (ইক্বরা)

লক্ষ্য

ইক্বরার লক্ষ্য হলো বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য স্রষ্টার ঐশী বাণীর সমন্বিত অধ্যয়ন ও সার্বজনীন প্রয়োগের জন্য জ্ঞানদীপ্ত অনুশীলন।

উদ্দেশ্য

ইক্বরার উদ্দেশ্য হলো কুরআনের বাণীর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ অনুধাবনের জন্য টেকসই ভিত্তি প্রস্তুত করা এবং জীবন ও সমাজের প্রায়োগিকতার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানভিত্তিক ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামো নির্মাণ।

প্রকাশিত বইসমূহ

কুরআনে কিতাব মানে কি দুই মলাটের ভিতরে বই?

অনেক কুরআনের পাঠক ধারনা করেন যে কিতাব মানেই ”বই“। যেহেতু আমরা ছাপাখানা আবিস্কারের পরের যুগের আধুনিক সময়ের মানুষ তাই আমাদের কাছে কিতাব বললেই দুই মলাট বিশিষ্ট ভেতরে ঝকঝকে ছাপা যুক্ত কিছু কাগজের বাইন্ডিং চোখে ভেসে ওঠে। কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাসে আধুনিক বই সহজলভ্য ও সাধারন মানুষের হাতে এসেছে এই ছাপাখানা আবিস্কারের পরে। ১৪০০ সালে আবিস্কার হলেও ১৫০০ সালের দিকে প্রচলন শুরু হয় এবং তা সারা পৃথিবীতে ছড়াতে আরো অনেক সময় লেগে যায়, কারন প্রযুক্তি আগের যুগে এত দ্রুত এক দেশ, মহাদেশ থেকে আরে দেশ ও মহাদেশে ছড়াতে পারতো না।

সুতরাং এর আগে, অর্থাৎ ৫০০, ৬০০, ৮০০, ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৬০০, ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের আগে বইয়ের ধারনা কিন্তু অন্যরকম ছিলো। পুরো দেশে কতগুলো চামড়ায় বাধানো বই আছে যার প্রতিটা অক্ষর হাতে লেখা সেটা হয়তো একহাতে গুনেফেলা যেত। সেই প্রাচীণ বই বা স্তুপকৃত পাতা, ফলক হাতে হাতে ঘুরতো। লেখক থেকে লেখকের ছাত্র, সন্তান ও পরিবারে রক্ষিত থাকতো। প্রাচীণ কিছু সভ্যতায় লাইব্রেরী ছিলো এটা সত্য। কিন্তু পড়তে পারতো খুবই কম মানুষ।

কুরআন যখন নাজিল হয় তখন মক্কা, যেটা তৎকালীণ একটা কেন্দ্রিয় শহর ছিলো, এখানে কিছু পড়তে জানা মানুষ থাকলেও শহরের বাইরে পল্লী, বেদুইনদের মধ্যে পড়তে জানতো বললেই চলে। কারন পড়ার কোন প্রয়োজন তাদের যাযাবর / বেদুইন জীবনে ছিলো না। যারা ব্যবসা করতো দূরের শহর ও মানুষের সাথে তাদের ব্যবসার ব্যবহারিক প্রয়োজনে সীমিতভাবে লিখতে পড়তো জানতে হতো।

রাসুল বা তার সমাজ যে খুব একটা পড়ার অভ্যাসে ছিলো না তার সরাসরি প্রমাণ কুরআনের আয়াতের আছে।

তখনকার সময়ে ইহুদী গোত্রে কিছুটা পড়তে জানা মানুষ ছিলো কারন হলো তাদের তাওরাত, তালমুদ ইত্যাদি গ্রন্থের প্রচলন। আরও আগের সময়ে কেবলমাত্র উপসনালয়ের প্রধান বা তার দুই একজন সহকারীরাই কিতাব পড়ে শুনাতো বাকীদের। সাধারন মানুষ পড়তে পারতো না; তাদের সমাজে পড়তে পারার কোন প্রয়োজন ছিলো না।

এখন যে অর্থে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তেমনটি প্রাচীন সমাজে ছিলো না; যে কারনে মলাট বন্দী বই কখনোই সাধারন মানুষের কাছে সহজলভ্য হওয়ার প্রয়োজন হয় নাই।

কিতাব বলতে কী বুঝায়

কিতাব শব্দটি যে তিনটি অক্ষর থেকে উদ্ভুত সেগুলো হলো: কাফ, তা, বা। কুরআন করপাসে এই মূল থেকে আসা সবগুলো শব্দ ও আয়াত দেখুন।

কিতাব শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘লিখিত জিনিস’। কিন্তু প্রায়োগিকভাবে শব্দটি শুধুমাত্র ‘লিখিত জিনিস’ অর্থে ব্যবহৃত হয় না। বরং কিতাব শব্দটি বহু অর্থবোধক শব্দ। কুরআনে ‘কিতাব’ শব্দটি দ্বারা বিভিন্ন বিষয়কে বুঝানো হয়েছে। যেমন:

১. মানুষের হিদায়াত বা পথনির্দেশের জন্য আল্লাহর নাজিলকৃত তথ্য ও বিধি-বিধান সম্বলিত গ্রন্থ, যা লিখিত আকারেও নাযিল হতে পারে আবার নাযিলের পরও লিখিত হতে পারে। (৪:১৩৬, ৬:৭, ৮০:১১-১৬)

২. লিপিবদ্ধ / সংবিধিবদ্ধ (২:২৩৫)

৩. আল্লাহর নির্ধারিত বিধান (৪:২৪, ৪:১০৩, ৮:৬৮)

৪. প্রাকৃতিক নিয়মের কিতাব / নিবন্ধগ্রন্থ (৩:১৪৫, ৭:৩৭, ৬:৫৯, ১০:৬১, ১১:৬, ২২:৭০, ২৭:৭৫, ৩০:৫২, ৩৪:৩,  ৩৫:১১, ৫৭:২২)

৫. সৃষ্টির প্রথম থেকে চলে আসা কিতাব / নিয়ম / বিধান (৯:৩৬, ১০:৩৮)

৬. উম্মুল কিতাব বা যে কিতাব থেকে প্রতি যুগের জন্য নির্ধারিত কিতাব / নির্দেশনা এসেছে (১৩:৩৮-৩৯, ৪৩:৪)

৭. প্রত্যেকের পরিস্থিতিগত বিবরণ ও আমলনামা / নিবন্ধনামা (২০:৫২, ২৩:৬২, ৪৫:২৮-২৯, ১৭:১৩-১৪, ১৮:৪৯, ৩৯:৬৯, ৬৯:১৯, ৬৯:২৫, ৭৮:২৯, ৮৩:৭, ৮৩:৯, ৮৩:১৮, ৮৩:২০, ৮৪:৭, ৮৪:১০)

৮. চুক্তিপত্র (২৪:৩৩)

৯. চিঠি (২৭:২৮-৩০)

উপরোক্ত আয়াতগুলো বিশেষ করে নির্ধারিত বিধান হিসেবে এবং চুক্তিপত্র / চিঠি হিসেবে যখন কিতাব শব্দের ব্যবহার দেখি তখন এটা স্পষ্ট যে শুধু মাত্র ঐশী গ্রন্থ বা দুই মলাটের বইয়ের মধ্যেই কিতাব শব্দটির প্রায়োগিক অর্থ সীমাবদ্ধ নয়।

কনটেক্সট বা পরিপ্রেক্ষিত নির্ভর অর্থ নির্ধারন করার প্রয়োজনীয়তা

কুরআন অধ্যায়ন করার ক্ষেত্রে যারা সঠিক অর্থ অনুধাবন করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তাদের জন্য কয়েক সঠিক অর্থে পৌছানোর জন্য কিছু ব্যাপার মনে রাখা প্রয়োজন।

প্রথমত: একটি উদাহরন থেকে বোঝা যেতে পারে যে কিভাবে যেকোন ভাষায় একই শব্দ পরিপ্রেক্ষিত অনুসারে ভিন্ন প্রায়োগিক অর্থ ধারন করতে পারে।

বাংলায় "সবুজ" শব্দটি নেওয়া যেতে পারে।

১ম উদাহরন বাক্য: সবুজ, ঐ ঘর থেকে আমার কলমটা এনে দাও।

২য় উদাহরন বাক্য: গাছের আমগুলো এখনো বেশ সবুজ।

৩য় উদাহরন বাক্য: ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।

এখানে একই শব্দ সবুজ যার শব্দমূল একই হলেও, বানান এবং উচ্চারণ একই হওয়ার পরেও; যেকোন বাংলাভাষাভাষী বুঝতে পারে যে ১ম উদাহরনে এটি একটি মানুষের নাম; ২য় উদাহরনের এর অর্থ অপরিপক্ক বা কাঁচা এবং ৩য় বাক্যে কাব্যিকভাবে ব্যবহৃত সবুজ অর্থ নবীন, তরুন, অনভিজ্ঞ।

যেকোন ভাষাতেই ব্যবহারিক ও প্রয়োগিক ক্ষেত্রে একই শব্দের এই ভিন্ন ভিন্ন অর্থ ধারন করা খুব স্বাভাবিক। কুরআনের আরবিও এর থেকে আলাদা নয়।

সুতরাং পরের প্রশ্ন হলো: তা হলে কুরআনে একটি শব্দের অর্থ যে ভিন্ন ভিন্ন হতে পরে এই সম্ভাবনা মাথায় রেখে কখন কোন অর্থটি গ্রহন করা উচিত হবে?

এর জন্য আমরা ৪টি ধাপ চিহ্নিত করতে পারি:

১. কুরআনের যত জায়গায় শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, সবগুলো আয়াতকে স্বস্ব কনটেক্সটে অধ্যয়ন করা

২. রুট ওয়ার্ড ভিত্তিক যতগুলো অর্থ সম্ভব সেগুলোকে সম্ভাব্য অর্থ হিসেবে ধরে নেওয়া

৩. কনটেক্সট ভিত্তিক যে অর্থটি সবচেয়ে প্রযোজ্য হয় সেটি নির্বাচিত করা

৪. তারপরেও যদি একাধিক সম্ভাব্য অর্থ হয়, সেক্ষেত্রে কোন অর্থটি যুক্তি ও বিবেকের সাথে সবচেয়ে সংগতিপূর্ণ যা প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক সেটির প্রাধান্য দেওয়া। কুরআনের কোন আয়াতের অর্থই বিবেক বিরোধী হবে না।


আরো পড়ার জন্য রেফারেন্স:

হিস্টোরি অফ বুক

প্রিন্টং প্রেস

বই কি?

ট্যাগ / কী-ওয়ার্ড:

অন্যান্য প্রবন্ধ

October 6, 2025
On a New Understanding of Iman, Belief and Faith according to Quran

On the Reinterpretation of Iman in Islam This video explores a provocative reinterpretation of one of Islam’s fundamental concepts: iman. The author Dr. Hal al-Sed Hassan argues that the traditional understanding of iman as “faith” or “belief” has been deliberately misconstrued over centuries, and that this misunderstanding has led to significant social and theological consequences within the Islamic […]

June 7, 2025
শেষ জামানা সম্পর্কে কুরআন কি বলে?

শেষ জামানা বা আখিরুজ্জামান সম্পর্কে কুরআনে কি বলে? বিস্তারিত জানাচ্ছেন একজন কুরআনের স্কলার

May 30, 2025
প্রচলিত কুরবানি: কুরআন থেকে পর্যালোচনা

প্রচলিত কুরবানিকে যদি আমরা কুরআন থেকে পর্যালোচনা করি, তাহলে কি পাই?

May 16, 2025
Explaining the Qur'an through the Qur'an

Introductory presentation for a series applying the intratextual approach to the exegesis of Surat al-An'am, here on CASQI's channel.

May 3, 2025
কুরআনকে কি সংবিধান বলা যেতে পারে?

সাধারন ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যে একটি কমন ধারনা হলো: ইসলামের সংবিধান হলো কুরআন এবং আধুনিক সময়ে যেসব সেকুলার সংবিধান করা হয় তা হলো "তাগুত"। বিষয়টি কি সত্যিই এরকম সাদা কালো? কুরআন কি সংবিধানি? একজন ইসলামে বিশ্বাসীর পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে এই প্রশ্নের মিমাংসায় পৌছতে হলে আমাদের প্রথমে কয়েকটি কনসেপ্ট ক্লিয়ার করে এগুতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে […]

May 2, 2025
কোরআন বোঝা কি কঠিন?

মুসলিমদের জীবন বিধানের সকল মূলনীতি কোরআনে আল্লাহ বলে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তোমার ওপর যে কিতাব (কোরআন) নাজিল করা হয়েছে ‎তাতে রয়েছে সকল বিষয়ের বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৮৯) দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ দেশের মুসলিমদের কোরআন দেখে শুদ্ধ করে পড়ার প্রতি গুরুত্ব থাকলেও ইসলামি জীবন বিধানের মৌলিক উৎস […]

April 15, 2025
সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার : কুরআনে সামাজিক মূল্যবোধ

১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ যে মূলনীতিসমূহ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে এবং ২০২৪ সালে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য যে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ কর্তৃক পেশ করা হয়েছে তাতে অন্যতম তিনটি মূলনীতি হলো, ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’। বস্তুত এই মূলনীতিসমূহ […]

April 11, 2025
নাসর হামিদ আবু যায়েদ - একজন আধুনিক কুরআন স্কলারের কর্ম-পরিচিতি

নাসর হামিদ আবু যায়েদ - একজন আধুনিক কুরআন স্কলারের কর্ম-পরিচিতি ... তার কাজ ও জীবন সম্পর্কে