আল কুরআনের আলোকে মুরতাদ - ইক্বরা

আল কুরআনের আলোকে মুরতাদ হত্যার অবৈধতা

শিরকের অপরাধ ও ধর্মীয় স্বাধীনতা

আল কুরআনের আলোকে যাবতীয় অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো শিরক করা অর্থাৎ কথা বা কাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করা। কিয়ামাতের দিন অন্য কোনো অপরাধ ক্ষমা করা হোক বা না হোক, শিরকের অপরাধ ক্ষমা করা হবে না মর্মে সুস্পষ্ট ও চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে (যদি না বিশ্বজাহানের প্রতিপালক ও মহাবিচারন কোরো জন্য ব্যতিক্রম না করেন, যা করার পূর্ণ কতৃত্ব ও অধিকার তাঁর নিকট সংরক্ষিত)। শিরকের মতো সর্বোচ্চ সত্যের লঙ্ঘনের মতো অপরোধের পরেও কোন মানুষের পক্ষ্যে অন্য মানুষকে জোর করে শিরক থেকে বিরত রাখার সুযোগ নেই, বরং যারা শিরক করে তাদেরকে যদি তারা স্বেচ্ছায় শিরক পরিত্যাগ না করে তবে তাদেরকে তাদের বিবেকের ব্যাপারে স্বাধীন থাকার অবকাশ দেয়া হয়েছে। অন্য কথায় পৃথিবীতে শিরকের জন্য কোনো মানবীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রযোজ্য দণ্ডবিধি নেই। সুতরাং আল কুরআন অনুসারে শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও এটি ধর্মীয় বিষয় হওয়ায় এক্ষেত্রে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

১৮:১৪-১৬ :: আমি তাদের (আসহাবে কাহাফের) হৃদয় মজবুত করে দিলাম যখন তারা উঠে দাঁড়ালো এবং বললো, আসমান জমিনের প্রতিপালকই আমাদের প্রতিপালক। আমরা কখনো তিনি ব্যতীত কোন ইলাহকে আহবান করবো না (শিরক করবো না)। নিশ্চয়ই আমরা বলবো তখন অত্যন্ত অপরাধমূলক কথা (অর্থাৎ যদি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে আহবান করি তবে সে আহবান এমন হবে যাতে আমরা অপরাধী হয়ে যাব)। এরাতো আমাদেরই কওম। এরা আল্লাহর পরিবর্তে অনেক ইলাহ গ্রহণ করেছে। এরা তাদের ইলাহ হবার উপর কোনো যুক্তিপ্রমাণ উপস্থিত করে না কেন? তাহলে তার চেয়ে বড় জালিম কে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে? যখন তোমরা তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদাত করে তাদের থেকে আলাদা হয়েছো তখন গুহাটিতে আশ্রয় গ্রহণ করো। তোমাদের প্রতিপালক নিজ অনুগ্রহকে তোমাদের প্রতি প্রসারিত করে দেবেন এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কাজকে সহজ করে দেবেন।

আলোচনা: আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করার অর্থ হলো: (ক) আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী / ক্ষমতা ও অধিকারের বিষয়ে কথা বা কাজের মাধ্যমে মিথ্যাকে সম্পৃক্ত করা তথা কুফর ও শিরক করা। (খ) আল্লাহ বলেননি এমন কোনো তথ্য বা আদেশ-নিষেধ আল্লাহ দিয়েছেন বলে চালিয়ে দেয়া। বিপরীতক্রমে আল্লাহর দেয়া কোনো তথ্য বা আদেশ-নিষেধকে তা আল্লাহর দেয়া তথ্য বা আদেশ-নিষেধ নয় তথা মনগড়া বলে সাব্যস্ত করা। তবে ১৮:১৪-১৬ আয়াতের সমগ্র বক্তব্যটি তথা সবচেয়ে বড় জুলুম সম্পর্কিত প্রশ্নের পূর্বাপর কথা থেকে স্পষ্ট হয় যে, এখানে বিশেষভাবে শিরককে সবচেয়ে বড় জুলুম হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

৪:৪৮ :: নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করাকে ক্ষমা করবেন না এবং তা (শিরক) ছাড়া অন্যবিধ অপরাধ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। আর যে আল্লাহর সাথে শিরক করে সে মহাপাপ রচনা করে (অত্যন্ত বড় অপরাধ করে)।

৪:১১৬ :: নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করাকে ক্ষমা করবেন না এবং তা (শিরক) ছাড়া অন্যবিধ অপরাধ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। আর যে আল্লাহর সাথে শিরক করে সে সুদূর পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হয়।

৬:৮৮ :: উহা আল্লাহর হিদায়াত, যা দ্বারা তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন। আর যদি তারা শিরক করতো তাহলে তাদের সব কৃতকর্ম ব্যর্থ হয়ে যেতো।

২২:৩১ :: আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে এবং তাঁর সাথে শিরককারী না হয়ে। যে তাঁর সাথে শিরক করে সে যেন আকাশ থেকে পড়লো, তারপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো অথবা বাতাস তাকে বহুদূরে উড়িয়ে দিলো।

৪১:৬ :: বলো, নিশ্চয় আমি তোমাদেরই মতো মানুষ। আমার কাছে ওহী করা হয় যে, তোমাদের ইলাহ একক ইলাহ। সুতরাং তাঁর দিকে সুপ্রতিষ্ঠিত হও এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আর দুর্ভোগ মুশরিকদের জন্য।

৯৮:৬ :: নিশ্চয় আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা কুফর করেছে তারা এবং মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে যাবে, তারা তাতে স্থায়ী হবে, তারাই নিকৃষ্ট সৃষ্টি।

১৯:৮৮-৯২ :: তারা বলে, ‘পরম দয়াময় (আল্লাহ) সন্তান গ্রহণ করেছেন’। তোমরা তো ভীষণ গর্হিত বিষয় (outrageous claim) নিয়ে এসেছো। আকাশমণ্ডলী ফেটে পড়ার, পৃথিবী বিদীর্ণ হওয়ার এবং পাহাড়সমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পতিত হওয়ার উপক্রম হয়। এজন্য যে, তারা পরম দয়াময়ের (আল্লাহর) সন্তান আছে বলে দাবি করে। অথচ পরম দয়াময়ের জন্য সন্তান গ্রহণ করা শোভনীয় নয়।

১৭:১১১ :: বলো, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেন নি এবং রাজত্বে তাঁর কোনো শরিক নেই এবং তিনি দুর্বলতার ঊর্ধ্বে বিধায় কোনো অভিভাবক নেই। সদা তাঁরই মহিমা ঘোষণা করো।

৩৭:১৭৮-১৮০ :: আর তাদেরকে কিছুকাল উপেক্ষা করে চলো। আর তুমিও দেখো, শীঘ্রই তারাও দেখবে (এর পরিণাম)। তারা যা আরোপ করে তা থেকে তোমার প্রভু পবিত্র, যিনি মহাসম্মানের মালিক।

৬:১০৬ :: তুমি তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে যা ওহী করা হয় তা-ই অনুসরণ করো। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ (উপাস্য ও সর্বময় প্রয়োজন পূর্ণকারী সার্বভৌম সত্তা) নেই। এবং মুশরিকদের থেকে বিমুখ থাকো।

১৫:৯৪ :: তারপর তোমাকে যা আদেশ দেয়া হয়েছে তুমি তা প্রকাশ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করো এবং মুশরিকদের থেকে বিমুখ থাকো। ৬:১০৭ :: আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে তারা শিরক করতে পারতো না। আমি আমরা তোমাকে তাদের উপর রক্ষক বানাইনি। আর তুমি তাদের উপর কর্মবিধায়কও নও।

২০:৯২-৯৪ :: সে (নবী মূসা) বললো, ‘হে হারুন, কিসে তোমাকে নিবৃত্ত করলো যখন তুমি তাদেরকে (বাছুর পূজা করে) বিভ্রান্ত হয়ে যেতে দেখলে, (এ বিষয়ে) যে, তুমি আমার অনুসরণ করলে না, তুমি কি আমার আদেশ অমান্য করেছো?’ সে (নবী হারুন) বললো, হে আমার মায়ের ছেলে, আমার দাঁড়ি টেনে ধরো না এবং আমার চুলও টেনে ধরো না, নিশ্চয় আমি আশংকা করেছিলাম যে, তুমি বলবে, ‘তুমি বানী ইসরাইলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছো (বানী ইসরাইলের ঐক্য বিনষ্ট করেছো) এবং আমার কথা পরিপালনে যত্নবান হও নি’।

৪:১৫৩ :: আহলে কিতাব তোমার কাছে দাবি জানায় যেন তুমি তাদের উপর আকাশ থেকে কিতাব নাযিল করো। তবে নিশ্চয় তারা মূসার কাছে এর চেয়ে বড় দাবি জানিয়েছিলো। তারা বলেছিলো, আমাদেরকে আল্লাহকে প্রকাশ্যে দেখাও। সুতরাং তাদের জুলুমের কারণে তাদেরকে বজ্রপাত আঘাত হেনেছিলো। তারপর তাদের নিকট (একত্ববাদের) স্পষ্ট প্রমাণ আসার পরেও তারা বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করেছিলো। তারপরও আমরা তাদেরকে তা থেকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। আর আমরা মূসাকে সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রদান করেছিলাম।

৯:১১ :: তারপর যদি তারা (মুশরিকরা) তাওবা করে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত প্রদান করে, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীন সম্পর্কিত ভাই। আর আমরা আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করি সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা জ্ঞানার্জন করে।

২৫:৬৮-৭০ :: এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহকে ডাকে না, এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে না, যাকে হত্যা করা আল্লাহ হারাম (অবৈধ) করেছেন, এবং ব্যভিচার (বিবাহ-বহির্ভুত যৌনসম্পর্ক স্থাপন) করে না। আর যে এগুলো করবে সে তার পাপের পরিণামের সাক্ষাৎ পাবে। কিয়ামাতের দিন তাদের শাস্তিকে বর্ধিত করা হবে এবং তারা তাতে হীন অবস্থায় স্থায়ী হবে। কিন্তু সে ছাড়া যে (এগুলো থেকে) তাওবাহ করবে এবং ঈমান আনবে এবং সৎকর্ম করবে। তাহলে তারাই ঐসব লোক যাদের মন্দকর্মসমূহকে সৎকর্মসমূহের মাধ্যমে বদলে দেয়া হবে। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।

৩৯:১৪-১৫ :: বলো, আমি আমার দ্বীনকে (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থাকে) আল্লাহর জন্যই একনিষ্ঠ করে দিয়ে আমি তাঁর ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করি। তারপর তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে যার ইচ্ছা ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করতে থাকো। বলো, নিশ্চয় তারাই ক্ষতিগ্রস্ত যারা কিয়ামাতের দিন তাদের নিজেদেরকে ও তাদের পরিবার-পরিজনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তা-ই কি সুস্পষ্ট ক্ষতি নয়?

২২:১৭ :: নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং যারা ইয়াহুদ হয়েছে এবং সাবেয়ীন, নাসারা, মাজুস এবং যারা শিরক করেছে; নিশ্চয় আল্লাহ তাদের মধ্যে কিয়ামাতের দিবসে ফায়সালা করে দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সকল বিষয়ে সাক্ষী।

১০৯:১-৬ :: বলো, হে কাফিরগণ (ইসলাম প্রত্যাখ্যানকারীগণ)! আমি তাদের উপাসনা ও দাসত্ব করি না, তোমরা যাদের উপাসনা ও দাসত্ব করো। আর তোমরা তাঁর উপাসনা ও দাসত্ব কর না, আমি যাঁর উপাসনা ও দাসত্ব করি। আর আমি তাদের উপাসনা ও দাসত্বকারী নই, তোমরা যাদের উপাসনা ও দাসত্ব করেছো। আর তোমরাও তাঁর উপাসনা ও দাসত্বকারী নও, আমি যাঁর উপাসনা ও দাসত্ব করি। তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা) আর আমার জন্য আমার দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা)।

আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শিরক করলে কিয়ামাতের দিন ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে, সেদিন শিরকের অপরাধ ক্ষমা করা হবে না। তবে কোনো শিরককারী যদি পৃথিবীতে তাওবাহ করে ঈমান আনে তাহলে তাকে ক্ষমা করা হবে এবং সে মু’মিন হিসেবে অন্য মু’মিনদের দ্বীন সম্পর্কিত ভাই হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

বানী ইসরাইল যখন বাছুর পূজা করেছিলো তখন রসূলুল্লাহ হারুন তাদের প্রতি বাড়াবাড়ি না করে রসূলুল্লাহ মূসা ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। রসূলুল্লাহ মূসা রাগবশত তাঁর দাঁড়ি ও চুল টেনে ধরে প্রশ্ন করেছিলেন যে, কিসে তাঁকে বানী ইসরাইলের মধ্যে বাছুর পূজা চালু হওয়াকে প্রতিরোধ করা থেকে নিবৃত্ত করেছিলো? জবাবে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি যেন তাঁর দাঁড়ি ও চুল ছেড়ে দেন, কারণ তিনি এ বিষয়ে নিবৃত্ত থাকার কারণ হলো, এর মাধ্যমে বানী ইসরাইলের মধ্যে গোত্রীয় ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছিল। তাই তিনি নবী মূসার উপস্থিতি পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। যেহেতু তিনি নবী মূসার নেতৃত্বের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। এভাবে দেখা যায় যে, শিরক প্রতিরোধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রেও গোত্রীয় ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। বানী ইসরাইল বাছুর পূজার মাধ্যমে শিরক করা সত্ত্বেও তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিল।

‘আল্লাহর সন্তান আছে’ বলা মহাবিশ্বের মহাবাস্তবতার সাথে সাংঘর্ষিক বিষয় বিধায় আকাশমণ্ডলী ভেঙ্গে পড়ার, পৃথিবী বিদীর্ণ হওয়ার এবং পাহাড়সমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর প্রতিক্রিয়ায় এরূপ উক্তিকারীদের উপর কোনো মানুষ কোনো দণ্ড প্রয়োগ করতে পারবে না। বরং মু’মিনদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন বলে যে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ থেকে পবিত্র। এরূপ উক্তির মাধ্যমে তাদের যে অপরাধ হয়, তার পরিণামস্বরূপ আল্লাহ নিজেই তাদেরকে শাস্তি দিবেন। শিরক করলে সকল আমল ব্যর্থ হয়ে যাবে, মুশরিকরা সবচেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টি হিসেবে সাব্যস্ত হবে এবং তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের স্থায়ী শাস্তি। কিন্তু মু’মিনরা তাদেরকে কোনো দণ্ড প্রয়োগ করতে পারবে না। বরং শিরকের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুশরিকদের থেকে বিমুখ থাকতে হবে। শিরকের বিষয়ে তথা ধর্মীয় ক্ষেত্রে রসূলকে তাদের রক্ষক ও কর্মবিধায়ক বানানো হয়নি। ধর্মীয় বিষয়ে কাউকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শিরক থেকে নিবৃত্ত করার অবকাশ নেই। বরং তাদেরকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে যে, তারা আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদাত (উপাসনা) করার ইচ্ছা করতে পারে। তবে এজন্য তাদেরকে কিয়ামাতের দিবসে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। মুশরিকরা তাদের শিরকের উপর থাকতে পারবে, যদিও তা ধর্মীয় বিবেচনায় সবচেয়ে বড় অপরাধ, কিন্তু এর বিচার-ফায়সালা কিয়ামাতের দিন আল্লাহ নিজেই করবেন। সর্বোপরি, রসূলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তিনি যেন কাফিরদেরকে বলে দেন যে, “তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন-ধর্ম এবং আমার জন্য আমার দ্বীন-ধর্ম”। অর্থাৎ তোমরা শিরকযুক্ত দ্বীন পালন করবে এ অধিকার যেমন তোমাদের আছে, তেমনি আমরা শিরকমুক্ত দ্বীন পালন করবো এ অধিকারও আমাদের আছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, আল কুরআনের ঘোষণা অনুসারে ধর্মীয় বিবেচনায় শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ। তবে তা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে কোনো মানুষ অন্য মানুষকে কোনো দণ্ড প্রদান করতে পারবে না। বরং আল কুরআনে মুশরিক ও তাওহীদে বিশ্বাসী মু’মিনদের নিজ নিজ ধর্মমতের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সমাজে সহাবস্থানের তথা সামাজিক অপরাধ থেকে বিরত থাকার শর্তে প্রত্যেকের নিজ নিজ ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা সংরক্ষণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

ধর্মীয় বিষয়ে মিথ্যারোপ, কটুক্তি ও অপপ্রচারের মোকাবেলায় রসূল ও মু’মিনদের করণীয়

আল্লাহ, তাঁর কিতাব ও তাঁর রসূল সম্পর্কে যা সত্য নয় তা বলার মাধ্যমে মিথ্যারোপ হয়। আল্লাহর সন্তান আছে বলা, রসূলকে যাদুকর ও পাগল ইত্যাদি বলা এবং রসূল নিজেই কুরআন রচনা করে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিচ্ছেন বা তিনি লোকদেরকে তাদের ইলাহদের ইবাদাত থেকে বাধা দিতে (বা তাদের ইবাদাত নষ্ট করতে) চাচ্ছেন ইত্যাদি বলার মাধ্যমে স্রষ্টার প্রতি এবং তাঁর প্রেরিত কিতাব ও রসূলের প্রতি কটুক্তি ও অপপ্রচার করা হয়। কিন্তু এসবের মোকাবেলায় রসূল ও মু’মিনদেরকে আল্লাহর পবিত্রতা জ্ঞাপন করা, সবর করা, সরল ও যুক্তিপূর্ণভাবে তাদের কথার জবাব দেয়া, সত্য তুলে ধরা এবং তাদের থেকে বিমুখ থাকার শিক্ষা ও নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। কাফির-মুশরিকরা দীন-ইসলাম ও এর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উপহাস-বিদ্রূপ করার প্রতিক্রিয়ায় তাদের মন্দের জবাব ভালো আচরণ দিয়ে এবং সৌজন্য ও ভদ্রতার সাথে তাদের উপেক্ষা করার মাধ্যমে দিতে বলা হয়েছে। কোনোভাবে এসব কারণে তাদের উপর বলপ্রয়োগ করার বা তাদের উপর কোনো দণ্ডবিধি প্রয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

৩৯:৩২ :: সুতরাং তার চেয়ে বড় জালিম কে, যে আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা বলে এবং সত্যকে মিথ্যা বলে যখন তার কাছে আসে? জাহান্নামই কি কাফিরদের আবাস নয়?

৬:২১ :: আর তার চেয়ে বড় জালিম কে, যে আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা রচনা করে অথবা তাঁর আয়াতসমূহের প্রতি মিথ্যা সাব্যস্ত করে? নিশ্চয় জালিমরা সফল হবে না।

১১:১৮ :: আর তার চেয়ে বড় জালিম কে, যে আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা রচনা করে, তাদেরকে তাদের প্রভুর সামনে উপস্থিত করা হবে এবং সাক্ষীরা বলবে, এরাই ঐ সমস্ত ব্যক্তিরা যারা তাদের প্রভুর সম্পর্কে মিথ্যা বলেছিল। জালিমদের উপর আল্লাহর অভিশাপ নয় কি?

৩:৭৫-৭৮ :: আর আহলে কিতাবের মধ্যে কেউ কেউ আছে যার কাছে যদি তুমি স্বর্ণের স্তুপও আমানাত রাখো, সে তা তোমাকে যথানিয়মে ফেরত দিবে। আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যার কাছে যদি তুমি একটি স্বর্ণমুদ্রাও আমানাত রাখো, সে তা তোমাকে যথানিয়মে ফেরত দেবে না, তার পেছনে স্থায়ীভাবে দণ্ডায়মান হওয়া (তাগাদা দেয়াতে লেগে থাকা) ছাড়া। এর কারণ তারা (এ দ্বিতীয় শ্রেণির আহলে কিতাব) বলে, ‘উম্মীদের (অকিতাবীদের) ক্ষেত্রে আমাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই’। এবং তারা আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা বলে, অথচ তারা (তাদের এসব মিথ্যা সম্পর্কে) জানে। বরং যে তার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে এবং স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ স্রষ্টা-সচেতনদেরকে ভালবাসেন। নিশ্চয় যারা আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতিকে এবং তাদের পারস্পরিক শপথকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করে, তাদের জন্য আখিরাতে কোনো সুফলপ্রাপ্তির অংশ নেই এবং কিয়ামাত দিবসে আল্লাহ তাদের সাথে কথাও বলবেন না এবং তাদের দিকে তাকাবেনও না এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। তাদের মধ্যে একটি দল রয়েছে, যারা কিতাবের প্রতি জিহবা কুঞ্চিত করে, যেন তোমরা সেটাকে (তাদের সংযোজনকৃত শব্দকে) কিতাবের অংশ মনে করো, অথচ তা কিতাবের অংশ নয়, এবং তারা বলে ‘উহা আল্লাহর পক্ষ থেকে’, অথচ তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়, এবং তারা আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা বলে, অথচ তারা (তাদের এ মিথ্যা সম্পর্কে) জানে।

৩:১৮৪-১৮৫ :: তারপর যদি তারা তোমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে, তবে (জেনে রাখো যে,) নিশ্চয় তোমার পূর্বের রসূলদেরকেও মিথ্যা সাব্যস্ত করা হয়েছিলো, তারা এসেছিলো স্পষ্ট যৌক্তিক প্রমাণ এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষামূলক পুস্তিকাসমূহ (যবুরসমূহ) এবং আলোকপ্রদ গ্রন্থসমূহ নিয়ে। প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে। আর নিশ্চয় তোমাদের প্রতিফল কিয়ামাত দিবসে পূর্ণ করে দেয়া হবে। তারপর যাকে (জাহান্নামের) আগুন থেকে রক্ষা করা হলো এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হলো, নিশ্চয় সে-ই সফলতা লাভ করলো। আর পার্থিব জীবন ছলনার সামগ্রী ছাড়া কিছু নয়।

১০:৪১ :: আর যদি তারা তোমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে, তবে বলো, আমার জন্য আমার কর্ম এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কর্ম। আমি যা কর্ম করি সেই বিষয়ে তোমরা দায়মুক্ত এবং তোমরা যা কর্ম করো সেই বিষয়ে আমি দায়মুক্ত।

১৫:৯৪-৯৬ :: সুতরাং তোমাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা ব্যাপকভাবে প্রকাশ্যে প্রচার করো এবং মুশরিকদের থেকে বিমুখ থাকো। নিশ্চয় তোমাকে উপহাসকারীদের বিরুদ্ধে আমরাই যথেষ্ট। যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহ (উপাস্য ও সার্বভৌম সত্তা) সাব্যস্ত করে। সুতরাং শীঘ্রই তারা (এর পরিণাম) জানতে পারবে।

১৮:১০৬ :: এটাই তাদের প্রতিফল - জাহান্নাম, কারণ তারা কুফর করেছিলো এবং আমার আয়াত ও আমার রসূলকে উপহাসের বিষয়রূপে গ্রহণ করেছে।

৬:১০ :: এবং নিশ্চয় তোমার পূর্ববর্তী রসূলগণকেও উপহাস করা হয়েছিল, তারপর যা নিয়ে তারা উপহাস করেছিলো তা-ই তাদেরকে পরিবেষ্টিত করেছিল।

৩৭:১২-১৫ :: বরং তুমি আশ্চর্যবোধ করছো এবং তারা উপহাস করছে। এবং যখন তুমি স্মরণীয় উপদেশ দিচ্ছো তারা সেই স্মরণীয় উপদেশ গ্রহণ করছে না। এবং যখন তারা কোনো আয়াত দেখে তারা উপহাস করে। এবং তারা বলে, এটা স্পষ্ট যাদু ছাড়া কিছু নয়।

৫:৫৭-৫৮ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা তাদেরকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করো না তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের দ্বীনকে উপহাস ও খেলার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং কাফিরদেরকেও না। আর তোমরা আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন করো যদি তোমরা মু’মিন হও। যখন তোমরা সালাতের জন্য আহবান জানাও তখন তারা সেটাকে উপহাস ও খেলার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে। তা এ কারণে যে, তারা এমন জনগোষ্ঠী, যারা বিবেক প্রয়োগ করে না।

৬৮:৫১ :: এবং নিশ্চয় যারা কুফর করেছে তারা যেন তোমাকে আছড়ে ফেলে দেবে তাদের দৃষ্টি দিয়ে, যখন তারা স্মরণীয় উপদেশ (কুরআন) শুনে, এবং তারা বলে, নিশ্চয় সে (রসূল) একটা পাগল।

২৩:৬৯-৭০ :: নাকি তারা তাদের রসূলকে চিনতে পারে নি, ফলে তারা তাকে অস্বীকার করছে? নাকি তারা বলে, তার মধ্যে পাগলামি রয়েছে? বরং তাদের কাছে ‘সত্য’ এসেছে। এবং তাদের অধিকাংশ লোক সত্যকে অপছন্দকারী।

১৫:৬-৭ :: এবং তারা বললো, হে যার উপর স্মরণীয় উপদেশ (কুরআন) নাযিল হয়েছে, নিশ্চয় তুমি একটা পাগল। কেন তুমি আমাদের কাছে ফেরেশতাদেরকে নিয়ে আসো না, যদি তুমি সত্যবাদী হও?

৪৪:১৩-১৪ :: কীভাবে তারা উপদেশ গ্রহণ করবে? অথচ তাদের নিকট এসেছে স্পষ্ট রসূল। তারপর তারা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো এবং বললো, ‘সে (রসূল) একটা শিক্ষিত পাগল’।

৮১:২২ :: এবং তোমাদের সাথী (রসূল) পাগল নয়।

৫২:২৯ :: সুতরাং তুমি স্মরণীয় উপদেশ দিতে থাকো। তোমার প্রভুর অনুগ্রহে তুমি গণকও নও এবং পাগলও নও।

৬৮:২ :: তোমার প্রভুর অনুগ্রহে তুমি পাগল নও।

২১:৫ :: বরং তারা বলে, এটা (কুরআন) এলোমেলো স্বপ্ন/ অলীক কল্পনা, বরং সে (রসূল) নিজেই এটা রচনা করেছে, বরং সে (রসূল) এজন কবি। অন্যথায় সে এমন কোনো নিদর্শন নিয়ে আসুক, যা পূর্ববর্তীদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে।

৫২:৩০ :: নাকি তারা বলে, সে (রসূল) একজন কবি, আমরা তার প্রতি ভাগ্যের অনিশ্চয়তার (দুর্ভাগ্য আপতিত হওয়ার) অপেক্ষা করছি।

৩৬:৬৯ :: আর আমরা তাকে (রসূলকে) কবিতা শিখাইনি এবং তা তার জন্য শোভনীয়ও নয়। (যা তার কাছে নাজিল করা হয়েছে) তা স্মরণীয় উপদেশ ও স্পষ্ট কুরআন ছাড়া কিছু নয়।

১০:২ :: এটা কি মানুষের কাছে আশ্চর্যের বিষয় যে, আমরা তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির নিকট ওহী করেছি যে, মানুষকে সতর্ক করো এবং যারা ঈমান আনে তাদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য তাদের প্রভুর কাছে সত্যিকার পদমর্যাদা রয়েছে। কাফিররা বললো, নিশ্চয় এই ব্যক্তি (রসূল) স্পষ্ট যাদুকর।

৩৮:৪-৫ :: এবং তারা আশ্চর্যান্বিত হলো যে, তাদের কাছে তাদের মধ্য থেকে একজন সতর্ককারী এসেছে। আর কাফিররা বললো, এ ব্যক্তি (রসূল) যাদুকর, অত্যন্ত মিথ্যাবাদী।

১০:৩৮ :: নাকি তারা বলে যে, সে (রসূল) তা রচনা করেছে? সুতরাং তোমরা তার কোনো সূরার মতো একটি সূরা নিয়ে আসো এবং আল্লাহকে ছাড়া যাদেরকেই তোমরা ডাকতে সক্ষম হও ডেকে নাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।

১১:৩৫ :: নাকি তারা বলে, সে (রসূল) তা (কুরআন) রচনা করেছে? বলো, যদি আমিই তা রচনা করি, তবে আমার (নিজে রচনা করে আল্লাহর নামে প্রচার করার) অপরাধের ভার আমি বহন করবো, আর আমিও তা থেকে দায়মুক্ত যা কিছু অপরাধ তোমরা করো।

২৫:৪-৬ :: আর যারা কুফর করেছে তারা বলে, এটা (কুরআন) মিথ্যা উদ্ভাবন ছাড়া কিছু নয়, যা সে (রসূল) রচনা করেছে এবং সেই কাজে তাকে অন্য একটি সম্প্রদায় সাহায্য করেছে। নিশ্চয় তারা (কাফিররা, এ অভিযোগের মাধ্যমে) জুলুম ও মিথ্যা নিয়ে এসেছে। এবং তারা বলে, এটা (কুরআন) পূর্ববর্তীদের উপকথা, সে নিজেই তা লিখেছে তারপর তা তার কাছে সকালে ও বিকালে পাঠ করে শুনানো হয়। বলো, তা তিনি নাযিল করেছেন যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর গোপন রহস্য জানেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল দয়ালু।

৪২:২৪ :: নাকি তারা বলে, সে (রসূল) আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা রচনা করেছে? যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতে তাহলে তোমার অন্তরকে মোহর মেরে দিতে পারতেন। এবং আল্লাহ মিথ্যাকে মিটিয়ে দেন এবং তাঁর বাণী দ্বারা সত্যকে সত্য প্রমাণিত করেন। নিশ্চয় তিনি অন্তরের অন্তর্নিহিত বিষয়ে পরিজ্ঞাত।

৪৬:৮ :: নাকি তারা বলে, সে (রসূল) তা (কুরআন) রচনা করেছে? বলো, যদি আমিই তা রচনা করি (তবে নিজে রচনা করে আল্লাহর নামে চালানোর কারণে) আমাকে তোমারা কেউই আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচাতে সক্ষম হবে না। তিনিই ভালো জানেন, যে আলোচনায় তোমরা লিপ্ত রয়েছো। আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে তিনিই যথেষ্ট। এবং তিনি ক্ষমাশীল দয়ালু।

৩২:৩ :: নাকি তারা বলে, সে (রসূল) তা (কুরআন) রচনা করেছে? বরং তা (কুরআন) তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে সত্য, যেন তুমি সতর্ক করতে পারো এমন এক সম্প্রদায়কে যাদের কাছে তোমার পূর্বে কোনো সতর্ককারী আসে নি, যেন তারা হিদায়াত পেতে পারে।

১০:৩৭ :: এবং আল্লাহ ব্যতীত কারো পক্ষে এই কুরআন রচনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু তা (কুরআন) হলো তার সামনে থাকা পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যতা প্রতিপাদনকারী এবং কিতাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা। তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তা বিশ্বপ্রভুর পক্ষ থেকে।

২:২৩ :: আর আমি আমার বান্দাহর প্রতি যা নাযিল করেছি যদি তোমরা তাতে সন্দেহ করো, তাহলে এর কোনো সূরার অনুরূপ সূরা রচনা করে আনো। আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীদেরকেও ডেকে নাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।

৮১:২৫-২৬ :: এবং তা (আল কুরআন) বিতাড়িত শয়তানের বাণী নয়। সুতরাং তোমরা কোথায় যাচ্ছো?

১৭:৮১ :: এবং বলো, সত্য সমাগত ও মিথ্যা অপসৃত। নিশ্চয় মিথ্যা অপসৃয়মান।

৬:১০৪ :: নিশ্চয় তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে অন্তর্দৃষ্টি এসে গেছে। সুতরাং যে (তা কাজে লাগিয়ে) দেখবে সে তার নিজের কল্যাণ করবে এবং যে অন্ধত্ব অবলম্বন করবে (চোখ বন্ধ রাখবে) তাতে সে নিজেরই অকল্যাণ করবে। আর আমি তোমাদের উপর রক্ষক নই।

৩৪:৪৩ :: আর যখন তাদের সামনে আমাদের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হয় তখন তারা বলে, এ (রসূল) এমন এক ব্যক্তি ছাড়া কেউ নয়, যে তোমাদেরকে সেই উপাস্যদের উপাসনা থেকে বাধা দিতে চায়, তোমাদের বাপদাদা যাদের উপাসনা করেছিলো। এবং তারা বলে, এটা (কুরআন) মনগড়া মিথ্যা ছাড়া কিছু নয়। এবং যারা কুফর করেছে তারা যখন তাদের কাছে সত্য আসে তখন সেই সত্য প্রসঙ্গে আরো বলে, এটা (কুরআন) এক স্পষ্ট যাদু ছাড়া কিছু নয়।

২৫:৪২ :: (কাফিররা বলে), ‘সে (রসূল) তো আমাদেরকে আমাদের দেবতাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিত, যদি আমরা তাদের প্রতি অবিচল না থাকতাম’। আর যখন তারা আযাব দেখবে, তখন অবশ্যই জানতে পারবে কে অধিক পথভ্রষ্ট-বিভ্রান্ত।

৮:৩২ :: আর যখন তারা (মুশরিকরা) বললো, হে আল্লাহ, যদি এ কুরআন আপনার পক্ষ থেকে সত্য হয়, তাহলে আমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর-বৃষ্টি বর্ষণ করুন অথবা আমাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তি প্রদান করুন।

৬:১০৬-১০৮ :: তুমি সেটাই অনুসরণ করো যা তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে তোমার কাছে ওহী (অনুপ্রেরণা প্রদান) করা হয়। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ (উপাস্য ও সার্বভৌম সত্ত্বা) নেই। এবং মুশরিকদের থেকে বিমুখ থাকো। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তবে তারা শিরক করতে পারতো না। এবং আমি তোমাকে তাদের উপর রক্ষক বানাই নি। এবং তুমি তাদের উপর কর্মবিধায়কও নও। এবং তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না, তাহলে তারা শত্রুতা ও অজ্ঞতাসহকারে আল্লাহকে গালি দিবে। এভাবেই প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের কর্মকে চাকচিক্যময় করা হয়েছে। তারপর তাদের প্রভুর কাছেই তাদের প্রত্যাবর্তন্থল। তারপর তিনি তাদেরকে তথ্য জানিয়ে দিবেন, যা কিছু তারা করতো।

৪:১৪০ :: আর তিনি কিতাবের মধ্যে তোমাদের জন্য নাযিল করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে যে আল্লাহর আয়াতের প্রতি কুফর করা হচ্ছে এবং তার প্রতি উপহাস করা হচ্ছে, তাহলে তাদের সাথে বসবে না যতক্ষণ না তারা তা ভিন্ন অন্য বিষয়ের আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়, অন্যথায় তোমরা নিশ্চয় তখন তাদের মতো হয়ে যাবে। নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদেরকে ও মুনাফিকদেরকে একত্রিতভাবে জাহান্নামে একত্র করবেন।

৬:৬৮-৬৯ :: যখন তুমি তাদেরকে দেখবে যারা আমাদের আয়াতসমূহের বিষয়ে নিছক সমালোচনা করে, তখন তুমি তাদেরকে উপেক্ষা করে চলো, যতক্ষণ না তারা তা ভিন্ন অন্য বিষয়ের আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়, আর যদি শয়তান তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তাহলে স্মরণ হওয়ার পর জালিম কওমের সাথে বসো না। আর যারা স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করে তাদের উপর তাদের (আল্লাহর আয়াতের সমালোচনাকারীদের) কোনোরূপ হিসাব দেয়ার দায়িত্ব বর্তাবে না, কিন্তু তাদেরকে উপদেশ দেয়ার দায়িত্ব রয়েছে যেন তারা স্রষ্টা-সচেতন হতে পারে।

:১৬১ :: নবীর পক্ষে সম্ভব নয় যে, কোনো বস্তু অন্যায়ভাবে গোপন করে আত্মসাৎ করবে। আর যে ব্যক্তি কোনো বস্তু অন্যায়ভাবে গোপন করে আত্মসাৎ করবে সে যা অন্যায়ভাবে গোপন করে আত্মসাৎ করবে তা নিয়ে উপস্থিত হবে। তারপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে যা কিছু (পাপ-পূণ্য) সে উপার্জন করেছে তা পূর্ণ করে দেয়া হবে। আর তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।

৯:৫৮-৫৯ :: আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যারা তোমাকে সদাক্বাতের বণ্টনের বিষয়ে অভিযুক্ত করে। যদি তাদেরকে তা থেকে কিছু দেয়া হয়, তাহলে তারা খুশি হয়। আর যদি তাদেরকে তা থেকে কিছু দেয়া না হয়, তাহলে তখন তারা বিক্ষুব্ধ হয়। অথচ যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাদেরকে যা-ই দেন তাতেই খুশি হতো এবং তারা বলতো, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট, তাহলে শীঘ্রই আল্লাহ তাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ থেকে প্রদান করতেন এবং রসূলও (তা থেকে দিতে পারতেন)। নিশ্চয় আমরা আল্লাহর দিকেই আগ্রহান্বিত।

৯:৬১ :: আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যে নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে, সে (নবী) কান পাতলা (সবার কথাই শুনে)। বলো, তোমাদের কল্যাণের জন্যই সবার কথা শুনা হয়, সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং মু’মিনদের প্রতি আস্থা রাখে এবং তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনে তাদের জন্য রহমতস্বরূপ, আর যারা আল্লাহর রসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।

৯:৬৪-৬৬ :: মুনাফিক্বরা ভয় পাচ্ছে যে, তাদের সম্পর্কে কোনো সূরা নাযিল হয়ে যাবে যা তাদের মনে কী রয়েছে তা তাদেরকে জানিয়ে দেবে। বলো, তোমরা উপহাস করতে থাক, নিশ্চয় আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেবেন, যে বিষয়ে তোমরা ভয় পাচ্ছো। আর যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো, তারা বলবে, নিশ্চয় আমরা এমনি এমনি আলোচনা করছিলাম এবং খেল-তামাসা করছিলাম। বলো, আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রসূলকে নিয়েই কি তোমরা উপহাস করছিলে? ওজর-অজুহাত পেশ করো না। নিশ্চয় তোমরা ঈমানের পরে কুফর করেছো। যদি তোমাদের মধ্যকার একটি দলকে আমরা ক্ষমা করে দিই, তবুও একটি দলকে শাস্তি দেবো, কারণ তারা ভীষণ অপরাধী।

১৫:৯৭-৯৮ :: আর নিশ্চয় আমরা জানি যে, তারা যা বলে তাতে তোমার অন্তর সংকুচিত হয়। সুতরাং তুমি তোমার প্রভুর পবিত্রতা-মহিমা ব্যক্ত করো এবং সাজদাহকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও।

১৬:১২৭ :: এবং তুমি সবর করো। এবং তোমার সবর আল্লাহর সাহায্যক্রমেই। তাদের কার্যক্রমের উপর তুমি দুঃখিত হয়ো না। এবং তারা যেসব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করছে সে বিষয়ে তুমি সংকীর্ণমনা হয়ো না।

২০:১৩০ :: তারা যা বলে সে বিষয়ে তুমি সবর করো। এবং তোমার প্রভুর প্রশংসাসহ পবিত্রতা জ্ঞাপন করো সূর্য উদয়ের পূর্বে এবং তা অস্ত যাওয়ার পূর্বে। এবং রাতের বিভিন্ন প্রহরেও পবিত্রতা জ্ঞাপন করো এবং দিনের অন্য ভাগসমূহেও, যেন তুমি সন্তুষ্ট হতে পারো।

৩৮:১৭ :: তারা যা বলে সে বিষয়ে তুমি সবর করো। এবং আমার বান্দা শক্তি-সামর্থ্যের অধিকারী দাউদের কথা স্মরণ করো। নিশ্চয় সে ছিল স্রষ্টা- অভিমুখী।

৫০:৩৯ :: তারা যা বলে সে বিষয়ে তুমি সবর করো। আর তোমার প্রভুর প্রশংসাসহ পবিত্রতা জ্ঞাপন করো, সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে।

৭৩:১০ :: এবং তারা যা বলে সেই বিষয়ে তুমি সবর করো। এবং সুন্দরভাবে (সৌজন্য ও ভদ্রতার সাথে) তাদেরকে পরিহার করো।

৫০:৪৫ :: তারা যা বলে আমরা তা জানি। আর তুমি তাদের উপর জবরদস্তিকারী নও। সুতরাং তাদেরকে আল কুরআনের মাধ্যমে স্মরণীয় উপদেশ দিতে থাকো, যারা আমার শাস্তির প্রতিশ্রুতিকে ভয় করে।

৯:১২-১৩ :: আর যদি তারা (মুশরিকরা) চুক্তি করার পর তাদের শপথ (চুক্তির ধারা বা শর্ত) ভঙ্গ করে এবং তোমাদের দ্বীন-ধর্মের প্রতি কটুক্তি করে, তাহলে কাফিরদের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। নিশ্চয় তাদের জন্য কোনো শপথ (চুক্তির মেয়াদ পূরণের শর্ত পালন) থাকতে পারে না, যাতে তারা (শান্তি বিনষ্ট করা থেকে) নির্লিপ্ত হয়। তোমরা কি সেই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না যারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং রসূলকে বের করে দেয়ার সংকল্প করেছিল এবং তারাই প্রথমে আক্রমণ করেছিল? তোমরা কি তাদেরকে ভয় করো? অথচ আল্লাহ অধিক হক্বদার যে, তোমরা তাঁকেই ভয় করবে, যদি তোমরা মু’মিন হও।

২৩:৯৬ :: মন্দকে প্রতিহত করো ভালো আচরণের মাধ্যমে। তারা যা বর্ণনা (বা কটুক্তি) করে আমরা তা জানি।
৪১:৩৪ :: আর ভালো ও মন্দ সমান নয়। (মন্দকে) প্রতিহত করো ভালো আচরণের মাধ্যমে। ফলে তখন তোমার ও যার মধ্যে শত্রুতা রয়েছে সে যেন হয়ে যায় অন্তরঙ্গ বন্ধু।

৪২:৪০ :: মন্দের প্রতিবিধান অনুরূপ মন্দ। তবে যে ব্যক্তি ক্ষমা করে দেয় ও মীমাংসা করে, তবে তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে। নিশ্চয় তিনি জালিমদেরকে ভালবাসেন না।

আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সবচেয়ে বড় জুলুম হচ্ছে আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা বলা এবং তাঁর আয়াতসমূহের প্রতি মিথ্যা সাব্যস্ত করা। আহলে কিতাবের একটি অংশ জ্ঞাতসারে আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা বলে এবং জিহবা কুঞ্চিত করে কিতাবের মধ্যে নিজেদের মনগড়া শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটায় এবং বলে যে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে অথচ তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়। কাফির মুশরিকরা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলো। এ প্রেক্ষিতে জানানো হয়েছে যে, পূর্ববর্তী রসূলদেরকেও অনুরূপভাবে মিথ্যা সাব্যস্ত করা হয়েছিলো। মিথ্যা সাব্যস্তকারীদেরকে কিয়ামাত দিবসে তাদের প্রতিফল পূর্ণ করে দেয়া হবে। এ তথ্যের মাধ্যমে মূলত রসূল ও মু’মিনদের মধ্যে ধৈর্যধারণের মনোভাব তৈরি করা হয়েছে। সেই সাথে রসূলকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, যেন তিনি তাদেরকে বলে দেন যে, আমার জন্য আমার কর্ম এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কর্ম। আমার কর্মের বিষয়ে তোমরা দায়মুক্ত এবং তোমাদের কর্মের বিষয়ে আমি দায়মুক্ত।

রসূলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তাঁকে যা জানানো হয়েছে তথা তাঁর কাছে যে কিতাব নাযিল করা হয়েছে তিনি যেন তা ব্যাপকভাবে প্রকাশ্যে প্রচার করে দেন এবং মুশরিকদের থেকে বিমুখ থাকেন। তারা যেমন তাঁকে উপহাস করেছে অনুরূপভাবে পূর্ববর্তী রসূলদেরকেও উপহাস করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে তাদেরকে তা-ই পরিবেষ্টিত করেছিলো যা নিয়ে তারা উপহাস করেছিলো (অর্থাৎ মন্দ কাজের মন্দ পরিণতি)। আর আল্লাহর আয়াত ও রসূলকে উপহাস করার ফলে তাদেরকে জাহান্নামে যেতে হবে।

আহলে কিতাবের মধ্য থেকে যারা দ্বীনকে উপহাস ও খেলার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে তাদেরকে এবং কাফিরদেরকে পৃষ্ঠপোষক (Patron) ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। তারা বিবেক প্রয়োগ না করায় সালাতের আহবানকে উপহাস ও খেলার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছে। তবে এ কারণে তাদেরকে মেরে ফেলতে বা শাস্তি দিতে বলা হয় নি।

কাফিররা কুরআন শুনলে একে যাদু বলে থাকে এবং এমন প্রতিক্রিয়া দেখায় যে, যেন তারা রসূলকে তাদের দৃষ্টি দিয়ে আছড়ে ফেলে দেবে। তারা সত্যকে অপছন্দকারী তাই তারা রসূলকে সত্যবাদী হিসেবে চিনতে পারার পরও অস্বীকার করে এবং বলে যে, তোমার মধ্যে পাগলামী রয়েছে। তারা রসূলকে পাগল এবং শিক্ষিত পাগল বলে উপহাস করে এবং গণক হিসেবেও সাব্যস্ত করে। এর জবাবে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহর অনুগ্রহে রসূল পাগল নন, তাঁর মধ্যে কোনো পাগলামি নেই এবং তিনি গণকও নন। এছাড়া তারা কুরআনকে এলোমেলো স্বপ্ন বা অলীক কল্পনা এবং কবিতা হিসেবে সাব্যস্ত করে। জবাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, কুরআন কবিতা নয় এবং রসূলকে কবিতা শেখানো হয় নি এবং কবিতা চর্চা রসূলের পক্ষে শোভনীয়ও নয়, বরং কুরআন হলো স্পষ্ট স্মরণীয় উপদেশ। কাফির মুশরিকরা বলতো যে, তারা অপেক্ষা করছে যে, কখন রসূলের প্রতি ভাগ্যের অনিশ্চয়তা বা দুর্ভাগ্য আপতিত হবে।

কাফির মুশরিকরা রসূলকে স্পষ্ট যাদুকর এবং অত্যন্ত মিথ্যাবাদী হিসেবে সাব্যস্ত করেছিলো এবং দাবি করেছিলো যে, রসূল নিজেই কুরআন রচনা করে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিয়েছেন বা আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা করেছেন। তাদের দাবি হলো, এটা রসূল নিজেই রচনা করেছেন এবং অন্য একটি সম্প্রদায় তাকে এ কাজে সাহায্য করেছে এবং তিনি তা লিখে নিয়েছেন এবং সকালে বিকালে তাঁকে তা পাঠ করে শুনানো হয়। তাদের দাবির জবাবে জানানো হয়েছে যে, তাদের এ কথা সঠিক নয়, বরং কুরআন আল্লাহ ছাড়া কারো পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয়। যদি তারা তাদের এ দাবিতে সত্যবাদী হয়, তাহলে তারা যেন এর কোনো সূরার অনুরূপ সূরা রচনা করে আনে এবং এ কাজে আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের সকল সাক্ষীকে সাহায্যের জন্য ডেকে নেয়। কিন্তু তারা তা কখনো করতে সক্ষম হবে না। রসূলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যেন তিনি তাদেরকে বলে দেন যে, যদি আমি নিজেই তা রচনা করে আল্লাহর নামে প্রচার করি, তাহলে এর অপরাধের দায়ভার আমি বহন করবো এবং তোমরা যা অপরাধ করো আমি তা থেকে দায়মুক্ত। আল্লাহ ইচ্ছা করলে রসূলের অন্তরকে মোহর মেরে দিতে পারতেন। আল্লাহ মিথ্যাকে মিটিয়ে দেন এবং তাঁর বাণী দ্বারা সত্যকে সত্য প্রমাণিত করেন। যদি এটা রসূল নিজেই রচনা করে আল্লাহর নামে চালিয়ে দেন তাহলে কেউই তাকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। তোমরা যে আলোচনায় লিপ্ত রয়েছো তিনি তা জানেন। আর তিনিই সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট।

কাফিররা কুরআনকে শয়তানের বাণী বলে দাবি করতো, জবাবে জানানো হয়েছে যে, কুরআন শয়তানের বাণী নয়। সুতরাং তোমরা এর বিপরীতে কোন দিকে যাচ্ছো? তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, কুরআন শয়তানের বাণী নয়, এরপরও যদি তারা তা মেনে না নেয়, বরং কুরআনকে শয়তানের বাণী বলে, তবে তাদেরকে জোর করে এ কথা মানাতে বলা হয়নি। কুরআন মানবজাতির প্রভুর পক্ষ থেকে সত্য। আর সত্য সমাগত হলে মিথ্যা অপসৃত হয় তথা যারা সত্যকে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক সত্যের সাক্ষাতে তারা মিথ্যা থেকে মুক্ত হয়। কুরআন মানবজাতির প্রভুর পক্ষ থেকে অন্তর্দৃষ্টি, যে তা কাজে লাগিয়ে দেখবে সে নিজের কল্যাণ করবে এবং যে অন্ধত্ব অবলম্বন করবে বা চোখ বন্ধ রাখবে সে নিজেরই অকল্যাণ করবে। বস্তুত কুরআনে থাকা জবাবে কোনো জটিলতা ও কুটতর্ক নেই। এতে কাফির মুশরিকদের বক্তব্যের জবাবের পাশাপাশি আল্লাহর পথে দাওয়াত বা ইসলামের মূল শিক্ষা সরলভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

মুশরিকরা বিবেক প্রয়োগ না করে শুধুমাত্র তথাকথিত ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট লালন করতো বিধায় তারা শিরক পরিত্যাগ করে আল্লাহর একত্ববাদের আহবান, কুরআন ও রসূলকে গ্রহণ করতে পারে নি। তাদের সেন্টিমেন্টের প্রভাবে তারা একদিকে আল্লাহর কাছে দোয়া করে বসেছে যে, যদি কুরআনই সত্য হয়, তাহলে আল্লাহ যেন তাদেরকে পাথরবৃষ্টি দিয়ে কষ্টদায়ক শাস্তির মাধ্যমে ধ্বংস করে দেন। প্রকৃতপক্ষে এর মাধ্যমে তারা তাদের আহত সেন্টিমেন্টের এক ধরনের বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছে মাত্র। তাদেরকে তাদের শিরক পরিত্যাগের জন্য যুক্তিপূর্ণ আহবানের বাহিরে কোনো বলপ্রয়োগ না করা সত্ত্বেও তারা অভিযোগ করেছে যে, রসূল তাদেরকে তাদের ইলাহদের ইবাদাত থেকে বাধা দিতে চান। তারা কোনোক্রমেই আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াতের প্রতি সহনশীল হতে পারেনি, বরং তারা রসূল ও মু’মিনদের প্রতি উপহাস ও আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলো। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা তাওহীদের দাওয়াতের মাধ্যমে তাদের শিরকী সেন্টিমেন্টে আঘাতের প্রতিক্রিয়া। বস্তুত সত্যনিষ্ঠ জীবন পদ্ধতি অবলম্বনের জন্য তথাকথিত সেন্টিমেন্টের লালন নয়, বরং সত্যাগ্রহ এবং সত্যভিত্তিক আত্মসংশোধিত জীবন যাপনই সঠিক কর্মনীতি। মুশরিকদের মুর্খতাজনিত ও সহিংস প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশনা হলো, রসূল যেন শুধুমাত্র কুরআনের অনুসরণ করতে থাকেন এবং মুশরিকদেরকে উপেক্ষা করেন। যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে তারা শিরক করতে পারতো না। রসূলকে তাদের উপর রক্ষক ও কর্মবিধায়ক করে পাঠানো হয় নি। মুশরিকরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে আহবান করে তাদেরকে গালি দেয়া যাবে না। কারণ তাহলে তারা শত্রুতা ও অজ্ঞতাবশত আল্লাহকেই গালি দিবে। প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের কর্মকাণ্ডকে চাকচিক্যময় করা হয়েছে। তারপর আল্লাহর কাছেই প্রত্যাবর্তন হবে।

আল্লাহর আয়াতের প্রতি উপহাস ও সমালোচনাকারীরা জাহান্নামে যাবে, পৃথিবীতে তাদেরকে উপহাস ও সমালোচনাকালে এড়িয়ে চলতে হবে কিন্তু অন্য সময় সাধারণ সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতে নিষেধাজ্ঞা নেই। আল্লাহর আয়াতের সমালোচনা ও দ্বীন-ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করার জবাব বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে প্রদান করতে হবে, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নয়। তাদের বিভ্রান্তিকর যুক্তিকে উত্তম যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে আর যখন তারা নিছক সমালোচনার জন্য সমালোচনায় প্রবৃত্ত হয় তখন তাদেরকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে হবে। কুরআনে জাহিল বা মুর্খদেরকে সালাম জানিয়ে এড়িয়ে যেতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এটাই নিজেরাও জাহেলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে এবং সময়ের অপচয় থেকে বেঁচে থাকার উত্তম উপায়।

মুনাফিক্বরা রসূলকে অবমাননাকর বক্তব্যের মাধ্যমে অভিযুক্ত করেছিলো যে, তিনি সদাক্বাত বণ্টনের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব করেন এবং তাদের মনে হয় তিনি কোনো বস্তু অন্যায়ভাবে গোপন করে আত্মসাৎ করেছেন। তাদের এ কথার জবাবে জানানো হয়েছে যে, এটা নবীর পক্ষে সম্ভব নয়। যে কিছু আত্মসাৎ করে কিয়ামাত দিবসে সে আত্মসাৎকৃত বস্তুসহ উপস্থিত হবে এবং তাদেরকে তাদের প্রতিফল পূর্ণ করে দেয়া হবে। আর সদাক্বাত বণ্টনের বিষয়ে মুনাফিক্বদের নীতি তো এই যে, যখন তাদেরকে সদাক্বাত থেকে কিছু দেয়া হয় তখন তারা খুশি হয় আর যখন তাদেরকে কিছু দেয়া হয় না তখন তারা বিক্ষুব্ধ হয়। অথচ তাদের উচিত ছিলো আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাদেরকে যা দেন তাতেই সন্তুষ্ট হওয়া। সদাক্বাত বণ্টনের বিষয়ে তাদের অভিযোগ ন্যায়সঙ্গত নয়, বরং তাদের নিজেদের স্বার্থপরতা থেকে উদ্ভুত।

মুনাফিক্বরা রসূলকে নানাভাবে মনোকষ্ট দিতো। যেমন তারা রসূলকে কান পাতলা বা সবার কথা শ্রবণকারী বলে অবজ্ঞা করতো। এর জবাবে জানানো হয়েছে যে, রসূল সবার কথা শুনা তাদের জন্যই কল্যাণকর। বস্তুত রসূল আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখেন এবং মু’মিনদের প্রতি আস্থা রাখেন। মুনাফিক্বরা আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রসূলকে নিয়ে উপহাস করেছিলো এবং ঈমানের পর কুফর করেছিলো। তাদের একটি দলকে ক্ষমা করা হলেও অন্য দলকে আল্লাহ শাস্তি দিবেন কারণ তারা ভীষণ অপরাধী। আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন, কিন্তু তারা ঈমানের পর কুফর করার কারণে মু’মিনরা তাদেরকে হত্যা করতে বলা হয় নি।

কাফির মুশরিক মুনাফিক্বরা রসূলকে যা বলে তাতে রসূলের অন্তর ভারাক্রান্ত ও সংকুচিত হয়। এ বিষয়ে তাঁকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যেন তিনি আল্লাহর পবিত্রতা-মহিমা ব্যক্ত করেন, তারা যা বলে তাতে সবর করেন, তাদের কার্যক্রমের উপর দুঃখিত না হন এবং তাদেরকে সুন্দরভাবে বা সৌজন্য ও ভদ্রতার সাথে উপেক্ষা করেন। তিনি তাদের উপর জবরদস্তিকারী নন। তাই তিনি যেন তাদেরকে কুরআনের মাধ্যমে স্মরণীয় উপদেশ দিতে থাকেন যারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতিকে ভয় করে। আর কাফির মুশরিক মুনাফিকরা যা বলে আল্লাহ তা জানেন।

যদি মুশরিকরা চুক্তি করার পর তাদের শপথ তথা চুক্তির ধারা বা শর্ত ভঙ্গ করে এবং দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে কটুক্তি করে তাহলে কাফিরদের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে, যেন তারা শান্তি বিনষ্ট করা থেকে নির্লিপ্ত হয়।
সর্বোপরি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, ভালো ও মন্দ সমান নয়। মন্দের জবাব দিতে হবে ভালো দিয়ে, সমান প্রতিশোধ হতে পারে কিন্তু কোনোক্রমে বাড়াবাড়ি নয়। মন্দকে ভালো আচরণের মাধ্যমে প্রতিহত করতে হবে, যেন শত্রুতাকারী অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায় যে, আল কুরআনে আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও রসূলদের প্রতি বা দ্বীন-ইসলামের বিষয়ে মিথ্যারোপ, কটুক্তি ও অপপ্রচারের মোকাবেলায় রসূল ও মু’মিনদের করণীয় হিসেবে যে পথনির্দেশ দেয়া হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত সার হলো, আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা জ্ঞাপন, সবর, মন্দের জবাব ভালো দিয়ে দেয়া, মিথ্যার বিপরীতে সত্য তথ্য ও তার স্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণ উপস্থাপন এবং জাহালত প্রদর্শনকারীদেরকে সৌজন্যের সাথে উপেক্ষা করা। যারা শান্তিচুক্তি লংঘন করে ও দ্বীন-ইসলামের বিরুদ্ধে কটুক্তি করে তাদেরকে শান্তি বিনষ্ট করা থেকে বিরত রাখার জন্য যুদ্ধ করার নির্দেশনা রয়েছে।

এ সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত নির্দেশনার ভিত্তিতে প্রতীয়মান হয় যে, তারা রাজনৈতিক চুক্তি লংঘন করাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মূল কারণ এবং দ্বীন-ইসলামের বিরুদ্ধে কটুক্তি হলো তাদের চুক্তি লংঘনের সাথে উপস্থিত থাকা একটি বৈশিষ্ট্য যা তাদের কর্তৃক সত্য বিরোধিতার লক্ষণ। কিন্তু এ দুটি বিষয়ের মধ্যে শুধুমাত্র চুক্তি লংঘনই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কারণ হিসেবে যথেষ্ট হবে (দ্র: ৯:১-১৩, ৮:৫৬-৫৮)।

অন্যদিকে কোনো আয়াতে শুধুমাত্র দ্বীন-ইসলামের বিরুদ্ধে কটুক্তির কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমোদন দেয়া হয়নি। বরং যে আয়াতটিতে দ্বীন-ইসলামের বিরুদ্ধে কটুক্তি ও যুদ্ধের প্রসঙ্গ একসাথে এসেছে (৯:১২) তার পরবর্তী আয়াতটিতেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ঐ কটুুক্তিকারীরাই প্রথমে মু’মিনদের উপর আক্রমণ করেছিলো। এছাড়া চুক্তিভঙ্গকারী ও কটুক্তিকারী কাফিরদের প্রধানদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যা থেকে বুঝা যায় যে, যুদ্ধ হবে মূলত ঐ প্রধানদেরকে ধরাশায়ী করা এবং প্রয়োজনে হত্যা করার জন্য, কিন্তু চুক্তিভঙ্গকারী ও কটুক্তিকারী সর্বসাধারণকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার জন্য নয়।
বস্তুত যুদ্ধের নির্দেশনা বা অনুমোদন শুধুমাত্র দ্বীন-ইসলামের বিরুদ্ধে কটুক্তির সাথে সম্পর্কিত নয়। বরং দ্বীন-ইসলামের বিরুদ্ধে কটুক্তির জবাবে সাধারণ নির্দেশনা হলো কটুক্তিকারীদেরকে উপেক্ষা করা, ধৈর্য ধারণ করা এবং আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা-মহিমা জ্ঞাপন করা। এমতাবস্থায় এ কথা সুস্পষ্ট যে, আল কুরআনে দ্বীন-ইসলামের বিরুদ্ধে কটুক্তিকারীদেরকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি প্রদান করার অনুমোদন বা বৈধতা দেয়া হয়নি।

ধর্মবিষয়ে সন্দেহ, সমালোচনামুখী দৃষ্টিভঙ্গি, জিজ্ঞাসা ও জবাব

ধর্মের বিষয়ে জিজ্ঞাসা ও সমালোচনা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে সন্দেহজনিত কারণে জিজ্ঞাসা, সত্য প্রত্যাখ্যানের মনোভাবজনিত দাবি, অপ্রাসঙ্গিক-অপ্রয়োজনীয় বা অযথা প্রশ্ন, বাস্তব পর্যালোচনামূলক বা সমালোচনামুখী দৃষ্টিভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা ইত্যাদি। সব ধরনের প্রশ্নের মূল্যমান সমান নয় এবং তাই এসবের জবাবের ধরনের মধ্যেও পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। আল কুরআনে সাধারণভাবে সত্যের প্রতি সন্দেহ পোষণ থেকে বিরত থাকার জন্য এবং যৌক্তিক সমালোচনামুখী দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যালোচনার মাধ্যমে সত্য শিক্ষা গ্রহণের জন্য জিজ্ঞাসা ও চিন্তা-গবেষণাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কুরআনের মাধ্যমে রসূলকে করা বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতগুলো লক্ষণীয়:

২:২৩ :: আর যদি তোমরা সেই বিষয়ে সন্দেহ করো যা আমি আমার বান্দাহর প্রতি নাযিল করেছি (অর্থাৎ যদি কুরআনের বিষয়ে সন্দেহ করো), তাহলে এর কোনো সূরার মতো সূরা রচনা করে আনো এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমাদের সাক্ষীদেরকে আহবান করো, যদি তোমরা তোমাদের সন্দেহে সত্যবাদী হয়ে থাকো।

১০:৯৪ :: সুতরাং আমি তোমার নিকট যা নাযিল করেছি, তা নিয়ে তুমি যদি সন্দেহে থাক, তাহলে যারা তোমার পূর্ব থেকেই কিতাব পাঠ করছে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর। অবশ্যই তোমার নিকট তোমার রবের পক্ষ থেকে সত্য এসেছে। সুতরাং তুমি সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।

৬:১১৪ :: আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বিধানদাতা ও বিচারক হিসেবে তালাশ করব? অথচ তিনিই তোমাদের নিকট বিস্তারিত কিতাব নাযিল করেছেন। আর যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছিলাম তারা জানে যে, তা তোমার রবের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে নাযিলকৃত। সুতরাং তুমি কখনো সন্দেহকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।

৩২:২৩ :: আর আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম। সুতরাং তুমি তা (কুরআন) প্রাপ্তির বিষয়ে সন্দেহ করো না। আর আমি সেটাকে বানী ইসরাইলের জন্য পথনির্দেশ করেছিলাম।

৬৭:৩-৪ :: যিনি স্তরে স্তরে সাত আকাশ সৃষ্টি করেছেন। তুমি পরম দয়াময়ের সৃষ্টিতে কোনো খুঁত দেখবে না। তুমি আবার দৃষ্টি ফিরাও কোনো ত্রুটি দেখো কি? তারপর দ্বিতীয়বার দৃষ্টি ফিরাও, সেই দৃষ্টি অবনমিত ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে।

৪:৮২ :: তবে কি তারা কুরআন নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে না? যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হতো তাহলে তারা তাতে অনেক স্ববিরোধ ও অসঙ্গতি খুঁজে পেতো।

২:১৮৬ :: আর যখন আমার বান্দাহগণ আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তবে নিশ্চয় আমি অত্যন্ত নিকটবর্তী। আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনায় সাড়া দিই যখন সে আমার কাছে প্রার্থনা করে। সুতরাং তারা অবশ্যই আমার ডাকে সাড়া দেয়া উচিত এবং আমার প্রতি ঈমান রাখা উচিত, যেন তারা সঠিক পথপ্রাপ্ত হতে পারে।

১৭:৮৫ :: আর তারা তোমাকে রুহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, রুহ আমার প্রভুর আদেশঘটিত একটি বিষয়। আর তোমাদেরকে জ্ঞানের অল্প পরিমাণই প্রদান করা হয়েছে।

৭:১৮৭ :: তারা তোমাকে সায়াত (ক্বিয়ামাত) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তা কখন ঘটবে? বলো, নিশ্চয় সেটার জ্ঞান আমার প্রভুর কাছেই আছে। শুধু তিনিই যথাসময়ে তা সংঘটিত করবেন। তা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে একটি ভারী বিষয় হবে। তা আকস্মিকভাবেই সংঘটিত হবে। তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, যেন তুমি তা সম্যক অবহিত! বলো, নিশ্চয় সেটার জ্ঞান আল্লাহর নিকটই আছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ (যথোপযোগী) জ্ঞানার্জন করে না।

৩৩:৬৩ :: লোকেরা তোমাকে সায়াত (ক্বিয়ামাত) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, সেটার জ্ঞান আল্লাহর কাছেই আছে। আর তোমার কি জানা আছে যে, সম্ভবত সায়াত (ক্বিয়ামাত) নিকটেই?

৭৯:৪২-৪৪ :: তারা তোমাকে সায়াত (ক্বিয়ামাত) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তা কখন ঘটবে? সেটার আলোচনায় তোমার কী সম্পর্ক? সেটার চূড়ান্ত জ্ঞান তো তোমার প্রভুর কাছেই।

২০:১০৫ :: আর তারা তোমাকে পাহাড়সমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। সুতরাং বলো, আমার প্রভু সেগুলোকে (ক্বিয়ামাতের দিন) সমূলে উৎপাটিত করে বিক্ষিপ্ত করে দিবেন।

২:১৮৯ :: তারা তোমাকে আহিল্লাহ (মাসের শুরুতে ও শেষের চন্দ্র তিথিসমূহ বা সরু চাঁদসমূহের উদ্দেশ্য) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, তা মানবজাতির (সাধারণ প্রয়োজন) ও হজ্জের জন্য সময় নির্ধারণের উপায়। আর তোমরা গৃহসমূহে সেগুলোর পেছন দিয়ে প্রবেশ করার মধ্যে কোনো পূণ্য নেই। কিন্তু পূণ্য তো সেই করে যে স্রষ্টা সচেতনতা অবলম্বন করে। আর তোমরা গৃহসমূহে সেগুলোর ফটকদ্বার দিয়ে প্রবেশ করো। এবং আল্লাহর প্রতি সচেতন থাকো, যেন তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পরো।

২:২১৭ :: তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে হারাম মাস (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাস) সম্পর্কে, সেটাতে যুদ্ধ করা প্রসঙ্গে। বলো, “সেটাতে (তথা কোনো হারাম মাসে) যুদ্ধ করা অনেক বড় গুনাহ। আর আল্লাহর পথ থেকে বাধা দেয়া ও তাঁর প্রতি কুফর (অবিশ্বাস ও অকৃতজ্ঞতা) করা এবং আল মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দেয়া এবং সেটার যথোপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে তা থেকে বহিষ্কার করা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় গুনাহ। আর ফিতনা (ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ এবং ভিন্ন ধর্ম অবলম্বনের কারণে নির্যাতন) হত্যার চেয়েও গুরুতর গুনাহ। আর তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে থামবে না, যতক্ষণ না তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে, যদি তাদের সাধ্যে কুলায়। আর তোমাদের মধ্য থেকে যে তার দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) থেকে ফিরে যাবে তারপর কাফির (সত্য প্রত্যাখ্যানকারী) অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করবে, তারাই এমন লোক যাদের আমলসমূহ দুনিয়াতে ও আখিরাতে বরবাদ হয়ে যাবে। আর তারাই (দোযখের) আগুনে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। তারা তাতে স্থায়ী হবে।

৪:১৫৩ :: আহলে কিতাব তোমার কাছে দাবি করছে যেন তুমি তাদের উপর আকাশ থেকে কিতাব নাযিল করো। তবে নিশ্চয় তারা মূসার কাছে সেটার চেয়ে বড় দাবি করেছিলো। তারা বলেছিলো, আমাদেরকে প্রকাশে আল্লাহকে দেখাও। সুতরাং তাদের যুলুমের কারণে তাদেরকে বজ্রপাত পাকড়াও করেছিলো। তারপর তাদের নিকট স্পষ্ট যৌক্তিক প্রমাণ (বাইয়িনাত) এসে যাবার পরও তারা বাছুরকে (উপাস্য হিসেবে) গ্রহণ করেছিলো। তারপর তা থেকে আমরা তাদেরকে ক্ষমা করেছিলাম। আর আমরা মূসাকে সুস্পষ্ট সনদ প্রদান করেছিলাম।

২:২০৮ :: নাকি তোমরা তোমাদের রসূলকে সেইরূপ প্রশ্ন করতে চাও পূর্বকালে মূসাকে যেরূপ প্রশ্ন করা হয়েছিলো? আর যে ব্যক্তিকে ঈমানের পরিবর্তে কুফরকে বদল করে নেয়, তবে নিশ্চয় সে সরল পথ থেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।

১০১-১০২ :: হে যারা ঈমান করেছো, তোমরা এমন বিষয়াদির প্রশ্ন করো না যা (যেরূপ বিধিবিধান নির্দিষ্টভাবে) প্রকাশ করলে তা তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলবে। আর যদি তোমরা কুরআন নাযিলকালে সেগুলোর বিষয়ে প্রশ্ন করো তাহলে তা তোমাদের জন্য (নির্দিষ্টভাবে) প্রকাশ করা হবে। আল্লাহ তোমাদেরকে সেগুলোর বিষয়ে উদারতা প্রদর্শন করেছেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল সহনশীল। নিশ্চয় সেগুলো নিয়ে তোমাদের পূর্বের একটি সম্প্রদায় প্রশ্ন করেছিলো। তারপর তারা তা পরিপালনের ক্ষেত্রে কাফির (প্রত্যাখ্যানকারী) হয়ে গেছে।

৯৩:১০ :: আর সওয়ালকারীকে (সাহায্যপ্রার্থী ও প্রশ্নকারীকে) ধমক দিও না।

১০:৯৪ :: আর যদি আমি তোমার প্রতি যা নাযিল করেছি সেই বিষয়ে তোমার সন্দেহ থাকে, তাহলে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো যারা তোমার পূর্ব থেকে কিতাব পাঠ করছে। নিশ্চয় নিশ্চয়ই তোমার কাছে তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে সত্য এসেছে। সুতরাং তুমি সন্দেহকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।

১৬:৪৩ :: আর আমি তোমার পূর্বেও পুরুষ মানুষ ছাড়া কাউকে নবী-রসূল করে প্রেরণ করি নি, যাদের কাছে আমি ওহী করেছিলাম। সুতরাং তোমরা আহলে যিকরকে (যারা স্মরণীয় উপদেশের ব্যাপক চর্চা করে তাদেরকে) জিজ্ঞাসা করো, যদি তোমরা না জানো।

২১:৭ :: আর আমি তোমার পূর্বেও পুরুষ মানুষ ছাড়া কাউকে নবী-রসূল করে প্রেরণ করি নি, যাদের কাছে আমি ওহী করেছিলাম। সুতরাং তোমরা আহলে যিকরকে (যারা স্মরণীয় উপদেশের ব্যাপক চর্চা করে তাদেরকে) জিজ্ঞাসা করো, যদি তোমরা না জানো।

২৫:৫৯ :: যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে এবং যা এতদুভয়ের মধ্যে আছে সেগুলোকে সাত দিনে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন। পরম দয়াময়। তাকে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো যে অবহিত।

১২:৭ :: নিশ্চয় ইউসুফ ও তার ভাইদের কাহিনীতে জিজ্ঞাসাকারীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।

১৬:৬৭ :: আর খেজুর গাছের ফল ও আঙ্গুর থেকে তোমরা মাদক ও উত্তম জীবিকা গ্রহণ করে থাকো। নিশ্চয় এর মধ্যে সেই জনগোষ্ঠীর জন্য নিদর্শন রয়েছে যারা বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগ করে।

৩৯:৬ :: তিনি তোমাদেরকে একটি জীবনসত্তা (নাফসিন ওয়াহিদাহ) থেকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তার থেকে তার জোড়া বানিয়েছেন। এবং তিনি তোমাদের জন্য আট জোড়া প্রকারের গবাদি পশু অবতারিত করেছেন। তিনি তোমাদেরকে তোমাদের মায়েদের পেটে সৃষ্টি করেছেন, এক এক পর্যায়ে এক এক আকৃতি দিয়ে, তিন তিনটি অন্ধকার আবরণের মধ্যে। এ-ই হলেন আল্লাহ। তোমাদের প্রভু। মহাবিশ্বের রাজত্ব তাঁরই। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ (সার্বভৌম উপাস্য) নেই। সুতরাং তোমাদেরকে কোন দিকে ফিরানো হচ্ছে?

৬:৯৫ :: নিশ্চয় আল্লাহ শস্যদানা ও বীজ বিদীর্ণকারী। তিনিই জীবন্তকে প্রাণহীন থেকে বের করেন এবং তিনিই প্রাণহীনকে জীবন্ত হতে নির্গতকারী। এ-ই হলেন আল্লাহ। সুতরাং তোমাদেরকে কোন দিকে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে?

৪০:৬১-৬২ :: আল্লাহ সেই সত্তা যিনি তোমাদের জন্য রাতকে বানিয়েছেন যেন তোমরা তাতে বিশ্রাম করতে পারো এবং দিনকে দেখার উপযোগী করেছেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের উপর মহাঅনুগ্রহশীল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ শোকর (কৃতজ্ঞতা) করে না। এ-ই হলেন আল্লাহ, তোমাদের প্রভু, সবার ও সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ (সার্বভৌম উপাস্য) নেই। সুতরাং তোমাদেরকে কোন দিকে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে?

৮১:২৫-২৬ :: আর তা (কুরআন) অভিশপ্ত শয়তানের (উপস্থাপিত) বক্তব্য নয়। সুতরাং তোমরা কোনদিকে চলে যাচ্ছো

আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্ম বিষয়ে সন্দেহ এবং সন্দেহজনিত বা সন্দেহবোধক জিজ্ঞাসার জবাবে সন্দেহ নিরসনের পদ্ধতি, জিজ্ঞাসার যথোপযোগী জবাব দান এবং জিজ্ঞাসার ক্ষেত্রে কোন ধরনের জিজ্ঞাসা নীতিগতভাবে সঠিক এবং কোন ধরনের জিজ্ঞাসা নীতিগতভাবে সঠিক নয় তা চিহ্নিতকরণই করণীয়। জিজ্ঞাসাকারীকে ধমক দেয়া যাবে না। তবে কুরআনে জিজ্ঞাসার বিষয়ে যে দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেভাবে উপদেশ দিতে হবে।

যে ধরনের জিজ্ঞাসা বা দাবি কুফরের মনোবৃত্তি তাড়িত, (যেমন: আল্লাহকে দেখিয়ে দিতে পারবে কিনা বা কিতাব নাযিল হতে দেখানো যাবে কিনা?) তা থেকে বিরত থাকা উচিত। বস্তুত এরূপ জিজ্ঞাসা বা দাবির জবাবে উল্লেখ্য যে, ঈমানের বিষয় চাক্ষুস প্রমাণের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং নিদর্শন নির্ভর যৌক্তিক প্রমাণের সাথে সম্পর্কিত। আর নিদর্শন নির্ভর প্রমাণ গ্রহণ করা না করার বিষয়টি বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগের সাথে সম্পর্কিত এবং এ বিষয়ে কাউকে জোর করে কিছু বিশ্বাস করতে বাধ্য করা যায় না। ধর্মীয় সত্যে বিশ্বাসের জন্য সত্যসন্ধানী ও সত্যনিষ্ঠ না হলে ব্যক্তি নিজে দায়ী থাকবে এবং প্রাকৃতিক নিয়মে এবং শেষ বিচারে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কিন্তু পার্থিব ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রশ্নে সে স্বাধীন।

যে ধরনের জিজ্ঞাসার জবাবদানের সাথে রসূল বা ধর্মপ্রচারকের সম্পর্ক নেই বা তাঁকে তা জানানোও হয়নি এবং মানুষের করণীয় সম্পাদনের ক্ষেত্রে তা জানা আবশ্যক নয় (যেমন: কিয়ামাত কবে হবে?) এরূপ প্রশ্নের জবাবে তার জ্ঞান আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত রয়েছে বলে জানিয়ে দিতে হবে।

কুরআনের সত্যে সন্দেহ হলে তা নিরসনের যৌক্তিক উপায় হিসেবে এর কোনো সূরার অনুরূপ সূরা রচনার চ্যালেঞ্জ এবং ইতিবাচক পদ্ধতি হিসেবে যারা পূর্ব থেকে কিতাব পাঠ করে এবং কিতাবে থাকা স্মরণীয় উপদেশের চর্চা করে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিতাবে যে বিষয়গুলোর বিস্তারিত বা প্রায়োগিক কোনো নির্দিষ্ট রূপ উল্লেখ করাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে সেসব বিষয়ে মানুষ বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থান-কাল-পাত্র অনুসারে বিভিন্নরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীন ও বিবেকসঙ্গত কাজের জন্য দায়বদ্ধ। কুরআন নাযিলকালে এ ধরনের বিষয়াদিতে প্রশ্ন করতে নিষেধ করা হয়েছে।

আল কুরআনে সমালোচনামুখী দৃষ্টিভঙ্গিকে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে সমালোচনামুখী দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যালোচনার মাধ্যমে সত্য বিশ্বাসে উপনীত হওয়ার পন্থা শিক্ষা দেয়া হয়েছে। আবার সেই সাথে নিছক সমালোচনার উদ্দেশ্যে সমালোচনা কিংবা নেতিবাচক মনোভাব থেকে যে সমালোচনা করা হয় সেটার ক্ষেত্রে আল্লাহর শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু যারা আল্লাহর আয়াতের বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব থেকে নিছক সমালোচনার উদ্দেশ্যে সমালোচনা করে বা কুরআন ত্রুটিমুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাতে অযথা ত্রুটি নির্দেশ করে তাদেরকে কোনো পার্থিব দণ্ডবিধিতে শাস্তি দিতে বলা হয়নি, বরং তাদেরকে সমালোচনাকালে এড়িয়ে যেতে বলা হয়েছে (৪:১৪০, ৬:৬৮-৬৯)।

আল্লাহর বিষয়ে সন্দেহ নিরসনের জন্য আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা নিয়ে চিন্তাভাবনা জাগিয়ে তোলা হয়েছে। যারা আল কুরআনকে শয়তানের বাণী বলে অভিহিত করে তাদের জবাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আল কুরআন শয়তানের বাণী নয়। তাদেরকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, সুতরাং আল্লাহর ও তাঁর কিতাবের প্রতি উদাসীন হয়ে তোমরা কোনদিকে চলে যাচ্ছো বা কেউ তোমাদেরকে কোন দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে? তোমরা কিভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছো? এভাবে মানুষের চিন্তাভাবনা ও বিবেকবুদ্ধিকে নাড়া দেয়া হচ্ছে, যেন তারা সত্যের আহবানে সাড়া দিতে পারে।

ধর্মীয় বিষয়ে সন্দেহ, সমালোচনামুখী দৃষ্টিভঙ্গি, জিজ্ঞাসা ও জবাবের বিষয়ে আল কুরআনের শিক্ষা অনুসারে যারা দ্বীন-ইসলাম এবং আল্লাহ, তাঁর রসূল ও কিতাব সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে বা প্রশ্ন তোলে বা সমালোচনা করে তাদেরকে বিবেকবুদ্ধি জাগিয়ে তোলার মতো প্রশ্ন করতে হবে এবং সৌজন্যের সাথে এড়িয়ে যেতে হবে। কিন্তু এরূপ সন্দেহ প্রকাশ বা প্রশ্ন তোলা বা সমালোচনার জন্য তাদেরকে হামলা করা বা কোনোরূপ শাস্তি দেয়ার অবকাশ নেই। ধর্মত্যাগী বা মুরতাদও এর মধ্যে শামিল রয়েছে। সুতরাং মুরতাদকে হত্যা করা বা মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেয়ার বিষয়টি কুরআনের শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, বরং তা অবৈধ।

ধর্মীয় অপরাধ বনাম সামাজিক অপরাধ

ধর্মীয় অপরাধ বলতে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণগত অপরাধকে বুঝায়। অন্যদিকে সামাজিক অপরাধ বলতে সামাজিক নৈতিকতার দৃষ্টিভঙ্গি ও রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী এবং সামাজিক তথা আন্ত:ব্যক্তিক, আন্ত:গোষ্ঠিক ও সমষ্টিগত সম্পর্ক বিষয়ক আচরণগত অপরাধকে বুঝায়। আল কুরআনে থাকা বিধি-বিধান থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এতে ধর্মীয় অপরাধের জন্য বা কোনো নিতান্ত ধর্মীয় দায়িত্ব পালন না করার কারণে, যেমন- সালাত, সিয়াম ইত্যাদি সম্পাদন না করার জন্য কোনো পার্থিব দণ্ডবিধি দেয়া হয় নি, যা কোনো কর্তৃত্বসম্পন্ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কারো উপর প্রয়োগ করা যেতে পারে। অন্যদিকে কুরআনে সামাজিক অপরাধের জন্য, যেমন-ব্যভিচার, চুরি, ডাকাতি, হত্যা ইত্যাদির জন্য পার্থিব দণ্ডবিধি দেয়া হয়েছে যা কোনো কর্তৃত্বসম্পন্ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংশ্লিষ্ট অপরাধীর উপর প্রয়োগ করা যেতে পারে।

অপরাধের শ্রেণিবিভাগ : ধর্মীয় অপরাধ, সামাজিক অপরাধ ও ধর্মের নামে সামাজিক অপরাধ

আল্লাহ মানুষকে তাদের অপরাধের জন্য শাস্তি দেন বা দন্ডবিধি প্রদান করেন। ৩৬:৬ আয়াত থেকে জানা যায় যে, কোনো জনপদে আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্ককারী নবী-রসূল প্রেরিত না হলে তার অধিবাসীরা সঠিক ধর্ম বিশ্বাস ও আচরণ থেকে অসচেতন থাকা সম্ভব। আর ৬:১৩১ আয়াত থেকে জানা যায় যে, কোনটি সঠিক এবং কোনটি ভুল তা না জানিয়ে বা কোনো নির্দিষ্ট কাজ অপরাধ হওয়ার বিষয়টি যে ব্যক্তি কোনোভাবে জানতে পারেনি, তাকে সেজন্য শাস্তি দেয়া আল্লাহর রীতি নয়। আয়াত দুটি নিম্নরূপ:

৩৬:৬ :: (কুরআন নাযিল করা হয়েছে) যাতে তুমি সতর্ক করতে পার এমন এক জাতিকে যাদের বাপদাদাদেরকে সতর্ক করা হয়নি, যার ফলে তারা অসচেতন।

৬:১৩১ :: এটা এজন্য যে আল্লাহ কোন জনপদকে ধ্বংস করেন না অন্যায়ভাবে এবং (সত্যপথ কোনটি আর ভুলপথ কোনটি সে সম্পর্কে) যখন তারা থাকে অসচেতন।

অপরাধ অপরাধ কিনা তা জানানোর জন্য আল্লাহ দুটি ব্যবস্থা রেখেছেন। একটি হচ্ছে আক্বল ও ইলহাম তথা বিবেক-বুদ্ধি, অন্যটি হচ্ছে আল্লাহর নাযিলকৃত ওহী। আক্বল ও ইলহামের মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তি সামাজিক অপরাধ সম্পর্কে অবগত রয়েছে। আর আল্লাহর নাযিলকৃত ওহীর মাধ্যমে ধর্মীয় অপরাধ, যেমন শিরক যে ধর্মীয় অপরাধ এ বিষয়টি অবগত হয়। ওহীর মাধ্যমে যেসব সামাজিক অপরাধের ক্ষেত্রে স্থায়ী ও সুনির্দিষ্ট দন্ডবিধি নির্ধারিত করে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তা নির্ধারিত হয়, কিন্তু সামাজিক অপরাধটি যে অপরাধ তা নির্ধারণের জন্য ওহী অত্যাবশ্যক নয়, যদিও ওহী থেকেও সামাজিক অপরাধের দণ্ডবিধির বিষয়ে বক্তব্য ও বিধি-বিধান জানা যায়। অন্যদিকে আক্বল ও ইলহামের মাধ্যমে ধর্মীয় অপরাধ যে অপরাধ সে বিষয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কিন্তু এক্ষেত্রে বিবেকবুদ্ধিকে চূড়ান্ত জ্ঞানের জন্য যথেষ্ট সাব্যস্ত করা হয়নি, বরং ওহীর মাধ্যমে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আর এরূপ ওহীনির্ভর বিষয় তথা নিছক ধর্মীয় বিষয়ে মানুষকে তা গ্রহণ করা-না করার স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে। তবে ওহীর নির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করাকে ধর্মীয় অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং এরূপ অপরাধের শাস্তি আল্লাহ নিজে প্রদান করবেন, এক্ষেত্রে কোনো মানুষ অপর মানুষকে শাস্তি দিতে পারবে না, বরং প্রত্যেকের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে হবে।

সুতরাং অপরাধ দুই প্রকার: (১) ধর্মীয় অপরাধ, যেমন- শিরক এবং (২) সামাজিক অপরাধ, যেমন- ব্যাভিচার। আবার রয়েছে ধর্মের নামে সামাজিক অপরাধ, যেমন- সতীদাহ, যা একসময় ভারতবর্ষে চালু ছিল। ধর্মের নামে হলেও সামাজিক অপরাধকে উচ্ছেদ করতে হবে, কারণ ধর্মীয় স্বাধীনতার অর্থ এ নয় যে, ধর্মের নামে সামাজিক অপরাধকে ধর্মীয় কর্ম বানিয়ে ফেলা হবে আর উহাকেও চালু থাকার সুযোগ দিতে হবে। সুতরাং ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পূর্ণ নি:শর্ত নয়, বরং তা সামাজিক অপরাধ থেকে বিরত থাকার শর্তযুক্ত। অন্যায় হত্যার শাস্তিস্বরূপ ক্বিসাস বা মৃত্যুদণ্ডের দণ্ডবিধিসহ বিভিন্ন সামাজিক অপরাধের জন্য কুরআনে যেসব দণ্ডবিধি দেয়া হয়েছে তা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

ধর্মীয় অপরাধের, যেমন- সালাত আদায় না করার জন্য কোন পার্থিব দন্ডবিধি নেই। ধর্মীয় অপরাধ, যেমন- শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও উহার জন্য কোন পার্থিব দন্ডবিধি নেই বরং উহার জন্য রয়েছে ধর্মীয় স্বাধীনতা, উহার শাস্তি শুধুমাত্র আল্লাহর হাতে, তা পৃথিবীতেও আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যক্ষ শাস্তি হতে পারে, যেমন নূহের কওমকে ধ্বংস করা হয়েছে, আর পরকালে তো আল্লাহ সরাসরি শাস্তি দিবেনই। ধর্মীয় অপরাধের জন্য মানুষ কর্তৃক নির্বাহীভাবে কার্যকর করার কোন দন্ডবিধি নেই। এর কারণ হলো ধর্মীয় অপরাধজ্ঞান ওহীনির্ভর, আর ওহীকে গ্রহণ করা না করা যৌক্তিক বিশ্বাসনির্ভর, আর এটাই হচ্ছে পৃথিবীর মূল পরীক্ষা যে, মানুষ ধর্মীয় স্বাধীনতা সত্ত্বেও সঠিক ধর্মচর্চায় আত্মনিয়োগ করে কিনা।

পক্ষান্তরে সামাজিক অপরাধের জন্য দন্ডবিধি রয়েছে, যেমন- ব্যাভিচারের শাস্তি। প্রত্যেক সামাজিক অপরাধ একই সাথে ধর্মীয় অপরাধ, কিন্তু প্রত্যেক ধর্মীয় অপরাধ মাত্রই সামাজিক অপরাধ নয়। তাই যে ধর্মীয় অপরাধের জন্য সামাজিক শাস্তি নেই তা হচ্ছে নিতান্ত ধর্মীয় অপরাধ। অন্যদিকে যে অপরাধের জন্য সামাজিক দণ্ডবিধি দেয়া হয়েছে তা একই সাথে ধর্মীয় ও সামাজিক অপরাধ। এছাড়া ধর্মীয় অপরাধ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে যদি অপরাধী থেকে এটেম্পট টু মার্ডার বা কোনো সামাজিক অপরাধ প্রকাশ পায় তবে উহার জন্য দন্ডবিধি রয়েছে। এ বিষয়ে ২:৫৪ ও ৭:১৫০ আয়াত লক্ষণীয়।

২:৫৪ :: আর (সেই সময়ের কথা উল্লেখ্য) যখন মূসা তার জনগোষ্ঠীকে বলেছিলো, হে আমার ক্বওম, নিশ্চয় তোমরা বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করে তোমাদের নিজেদের উপর জুলুম করেছো। সুতরাং তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তার দিকে তাওবাহ করো (ফিরে এসেো)। সেই সাথে তোমরা তোমাদের নিজেদের (মধ্যকার বাড়াবাড়িকারীদেরকে) হত্যা করো (মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করো)। এটাই তোমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে তোমাদের জন্য উত্তম। তখন তিনি তোমাদের তাওবাহ কবুল করেছেন। নিশ্চয় তিনি তাওবাহ কবুলকারী দয়ালু।

৭:১৫০ :: আর যখন মূসা তার জনগোষ্ঠীর নিকট রাগান্বিত ও বিক্ষুব্ধ অবস্থায় ফিরে গেলো, তখন বললো, “আমার পরে তোমরা আমার কী মন্দ প্রতিনিধিত্ব করেছো! তোমাদের প্রভুর (পক্ষ থেকে উপাসনা পদ্ধতির) আদেশ আসার আগেই তোমরা (মনগড়াভাবে উপাসনা করতে) তাড়াহুড়া করলে?” আর সে ফলকগুলো ফেলে দিলো আর তার ভাইয়ের মাথা ধরে নিজের দিকে টেনে আনতে লাগলো। সে (হারুন) বললো, “হে আমার মায়ের ছেলে (সহোদর ভাই), এ জাতি আমাকে দুর্বল মনে করেছে এবং আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে। সুতরাং তাই তুমি আমার ব্যাপারে শত্রুদেরকে আনন্দিত করো না এবং আমাকে জালিম ক্বওমের অন্তর্ভুক্ত সাব্যস্ত করো না।”

৭:১৫০ ও ২:৫৪ আয়াতের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাছুর পুজা থেকে নিষেধ করায় কিছু লোক নবী হারুণকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলো, তাদেরকেই মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং যদি ধর্মীয় কারণে কাউকে হত্যা করা হয় বা হত্যার চেষ্টা করা হয় তাহলে ঐ অপরাধীর উপরও পার্থিব দণ্ডবিধি কার্যকর হবে।

দ্বীনে জবরদস্তি না থাকা এবং সামাজিক অপরাধের দণ্ডবিধি

সামাজিক অপরাধের দণ্ডবিধি দ্বীন গ্রহণের জন্য জবরদস্তি নয়, বরং তা হলো সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টিমূলক অপরাধ দমনের লক্ষ্যে দ্বীন নির্দেশিত শাস্তি। একজন ব্যক্তি দ্বীন ইসলামকে গ্রহণ না করলেও তাকে এ সামাজিক বিধানগুলো মানতে হবে, কারণ তা সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য।

ক্বিতালের বিধান দ্বীনের বিষয়ে জবরদস্তির উদ্দেশ্যে নয়

ক্বিতাল বা যুদ্ধের নির্দেশনা দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির উদ্দেশ্যে নয়, বরং বাড়াবাড়ির মোকাবেলায় (ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে) এবং অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের মোকাবেলায় এবং সামাজিক চুক্তি ভঙ্গ করে রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে ফাসাদ সৃষ্টির মোকাবেলায় এবং মজলুমদেরকে উদ্ধার করার জন্য। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

২:১৯০ :: তোমরা আল্লাহর পথে সেই লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, কিন্তু সীমা লংঘন করো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই সীমা লংঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না।

২:১৯১ :: (যুদ্ধ পরিস্থিতিতে) তোমরা তাদেরকে হত্যা কর (যুদ্ধক্ষেত্রের) যেখানেই তোমরা তাদের নাগাল পাও। আর তোমরা তাদেরকে বের করে দাও যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে। ফিতনা (অর্থাৎ ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ এবং ভিন্ন ধর্ম অবলম্বনের কারণে নির্যাতন) হত্যার চেয়ে গুরুতর। তোমরা আল মাসজিদুল হারামের কাছে তাদের সাথে যুদ্ধ করো না যতক্ষণ না তারা তাতে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে। কিন্তু যদি তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাহলে তাদেরকে হত্যা কর। (অর্থাৎ তাদেরকে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিহত করো এবং আন্তর্জাতিক আদালত প্রতিষ্ঠা করে বিচারিক প্রক্রিয়ায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করো)। এরূপই (যুদ্ধের নৈতিক বিধি প্রত্যাখ্যানকারী) কাফিরদের প্রতিফল।

২:১৯২ :: তারপর যদি তারা বিরত হয় তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াশীল।

২:১৯৩ :: আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যতক্ষণ না ফিতনার (ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের এবং ভিন্ন ধর্ম অবলম্বনের কারণে নির্যাতনের) অবসান ঘটে এবং দীন বা জীবনব্যবস্থা হয় আল্লাহর জন্য (আল্লাহর মনোনীত জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, যাতে অন্যদেরকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে)। তারপর যদি তারা (ষড়যন্ত্র, আক্রমণ ও ক্ষয়ক্ষতি সাধন থেকে) বিরত হয়, তাহলে অত্যাচারীদের উপর ছাড়া কোনো কঠোরতা নয়।

২:১৯৪ :: হারাম মাসের ক্ষেত্রে ঐ হারাম মাস (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাস) এবং সমস্ত হুরুমাত (অর্থাৎ মর্যাদাপূর্ণ নিষিদ্ধ বিষয়) কিসাসের অন্তর্ভুক্ত (অর্থাৎ এক পক্ষ কর্তৃক অবমাননার কারণে বিপরীত পক্ষ কর্তৃক অনুরূপ অবমাননার প্রতি অনাপত্তির অবকাশ তৈরি হয়।)। সুতরাং যে তোমাদের উপর আক্রমণ করবে তোমরাও তার উপর প্রতিআক্রমণ করবে যেরূপ সে তোমাদের উপর আক্রমণ করেছে। তোমরা আল্লাহ সচেতন হও আর জেনে রাখো যে, নিশ্চয় আল্লাহ সচেতনদের সাথেই আল্লাহ আছেন।

২:১৯০-১৯৪ আয়াতের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আল কুরআনে ক্বিতালের বা যুদ্ধের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা ধর্মীয় বাড়াবাড়ির উদ্দেশ্যে নয়, বরং ধর্মীয় বাড়াবাড়িকে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে, ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এবং যুলুম প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষামূলক।

পরিশেষে বলা যায় যে, আল কুরআনে নিতান্ত ধর্মীয় বিষয় এবং সামাজিক বিষয়কে ভিন্ন ভিন্নভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণজনিত অপরাধকে প্রকৃত বিচারে অধিক বড় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা সত্ত্বেও এজন্য কোনো পার্থিব দণ্ডবিধি আরোপ করা হয় নি, বরং তা ধর্মীয় স্বাধীনতার ধারাভুক্ত করে দিয়ে এর শাস্তির বিষয়টি সরাসরি আল্লাহর বিচারাধীন করা হয়েছে। অন্যদিকে সামাজিক অপরাধের বিষয়ে পার্থিব দন্ডবিধি প্রদান করা হয়েছে, যদি মু’মিনরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত থাকে, তাহলে তারা তা সমাজে সর্বজনীনভাবে প্রয়োগ করবে। এমতাবস্থায় কেউ মুরতাদ হলে বা ধর্মত্যাগ করলে তাকে এজন্য কোনো মানবীয় কর্তৃত্বসম্পন্ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কোনোরূপ শাস্তি প্রদান করা কুরআনের সামগ্রিক শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব কাঠামো, রাজনৈতিক চুক্তি ও ধর্মীয় স্বাধীনতা

মানুষ মাত্রেই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। প্রত্যেক মানুষের স্বাধীনভাবে কোনো ধর্ম গ্রহণ, পরিবর্তন, ধর্মান্তরিত হওয়া বা ধর্ম নিরপেক্ষ থাকার অধিকার রয়েছে। আবার রাষ্ট্র নামক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে জাতি, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সমন্বিত অংশগ্রহণের বিষয় রয়েছে। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব কাঠামোতে কর্তৃত্বের অধিকার কীভাবে তৈরি হবে, ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কীরূপ চুক্তির অবকাশ রয়েছে এবং যদি রাসূল বা কোনো ইসলাম ধর্মীয় ধর্মনেতার নেতৃত্বাধীন মুসলিম উম্মাহ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কর্তৃত্ব লাভ করেন সে অবস্থায় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি কীরূপ আচরণ করা হবে বা তাদেরকে কীরূপ অধিকার দেয়া হবে সে বিষয়ে আল কুরআনে অনেক চমৎকার ও শান্তিপূর্ণ দিক নির্দেশনা বিদ্যমান রয়েছে। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

৪:৬০ :: আর আমরা কোনো রসূল প্রেরণ করি নি, এজন্য ছাড়া যে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তার আনুগত্য করা হবে। আর যদি তারা যখন তাদের নিজেদের উপর জুলুম করেছে তখন তোমার কাছে আসতো, তারপর তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতো এবং রসূলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতো, তাহলে তারা আল্লাহকে তাওবাহ কবুলকারী দয়ালূ হিসেবে পেতো।

৩:২০ :: আর যদি তারা তোমার সাথে বিতর্ক করে তাহলে বলো, “আমি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছি এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও।” আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিলো তাদেরকে এবং উম্মীদেরকে/ অকিতাবীদেরকে বলো, “তোমরা কি (আল্লাহর কাছে) আত্মসমর্পণ করছো/ ইসলাম গ্রহণ করছো?” তারপর যদি তারা (আল্লাহর কাছে) আত্মসমর্পণ করে/ ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তারা হিদায়াত পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয় তোমার দায়িত্ব শুধু বালাগ/ পৌঁছে দেয়া। আর আল্লাহ (তাঁর) বান্দাহদের প্রতি দৃষ্টিবান।

১০৯:৬ :: (কাফিরদেরকে বলো:) “তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা) এবং আমার জন্য আমার দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা)।”

৪২:১৩ :: তিনি তোমাদের জন্য সেই দ্বীনই বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন, যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি যা আমরা তোমার প্রতি ওহী (অনুপ্রেরণা দান) করেছি এবং যার প্রতি আমি ইবরাহীমকে নির্দেশ প্রদান করেছিলাম এবং মূসাকে ও ঈসাকে, এ মর্মে যে, “তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং সেটার ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা (দলে দলে বিভক্তি) করো না”। তোমরা মুশরিকদেরকে (আল্লাহর একত্ববাদী দ্বীনের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকার) যে দিকে আহবান করছো তা তাদের নিকট বড়ই দুঃসহ হয়ে গেছে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাঁর দিকে মনোনীত করেন এবং তিনি তাকেই তাঁর দিকে হিদায়াত দেন যে তাঁর অভিমুখী হয়।

৯:৩৩ :: তিনিই সেই সত্তা যিনি তাঁর রসূলকে প্রেরণ করেছেন হিদায়াত ও সঠিক দ্বীন সহকারে যেন সে উহাকে (সঠিক দ্বীনকে) প্রত্যেক দ্বীনের উপর বিজয়ী করতে পারে, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।

৩:১১০ :: তোমরাই (মু’মিনগণ) শ্রেষ্ঠ উম্মাহ (জাতিসত্তা), তোমাদেরকে বের করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য, তোমরা ন্যায়ের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে। আর যদি আহলে কিতাব ঈমান আনতো তা-ই হতো তাদের জন্য উত্তম। তাদের মধ্যে কিছু আছে মু’মিন কিন্তু তাদের অধিকাংশ ফাসিক্ব (দুষ্কর্ম পরায়ণ)।

২২:৩৯-৪১ :: তাদেরকে প্রতিরোধমূলক যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো যাদেরকে জুলুম-নিপীড়ন করা হয়েছে। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম। যাদেরকে তাদের নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বলে, ‘রব্বুনাল্লাহ’ (আল্লাহ আমাদের প্রভু)। আর যদি আল্লাহ (তাঁর বিধানের বা প্রাকৃতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে) মানুষকে প্রতিহত না করতেন তাদের একদল দ্বারা অন্য দলকে,তাহলে অবশ্যই বিধ্বস্ত করা হতো আশ্রম/মঠ (সওয়ামি’), আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বাণিজ্যকেন্দ্র (বিয়া’), উপাসনালয় (সালাওয়াত) এবং মাসাজিদ যেগুলোতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন যে তাঁকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমতাবান, শক্তিমান। যারা এমন যে, যদি আমরা তাদেরকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব-ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করি, তাহলে তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত প্রদান করবে এবং ন্যায়ের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। আর যাবতীয় সিদ্ধান্ত ও কার্যাবলির চূড়ান্ত পরিণতি আল্লাহরই আয়ত্তে।

২৪:৫৫ :: আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনে এবং আমলে সালেহ (সৎকর্ম ও যোগ্যতা অর্জন বা দক্ষতা উন্নয়নমূলক কাজ) করে, অবশ্যই তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে খিলাফাত (ক্ষমতায় অধিষ্ঠান) প্রদান করবেন যেমন তিনি তাদের পূর্ববর্তীদেরকে খিলাফাত (ক্ষমতায় অধিষ্ঠান) প্রদান করেছিলেন, এবং তিনি তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থাকে) প্রতিষ্ঠিত করে দিবেন, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন, এবং তিনি তাদের ভয়ের পর তাদের অবস্থাকে নিরাপত্তায় বদলে দিবেন, ফলে তারা শুধু আমারই ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করবে, আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না, আর এরপরও যে কুফর (সঠিক দ্বীনকে প্রত্যাখ্যান) করবে, তারাই ফাসিক্ব (দুষ্কর্ম পরায়ণ)।

৮:২৬ :: স্মরণ করো যখন তোমরা ছিলে স্বল্পসংখ্যক, পৃথিবীতে তোমাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল, আর তোমরা আশংকা করতে যে, লোকেরা তোমাদেরকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবে। তারপর আল্লাহ তোমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন এবং স্বীয় সাহায্য দিয়ে তোমাদেরকে শক্তিশালী করেছেন এবং তোমাদেরকে উত্তম জীবিকা দিয়েছেন, যেন তোমরা কৃতজ্ঞ হও।

১৭:৮০ :: বলো, হে আমার প্রভু, যেখানে গমন সত্যের দাবি সেখানে আমাকে গমন করান এবং যেখান থেকে নির্গমন সত্যের দাবি সেখান হতে আমাকে নির্গমন করান এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাকে (কার্য নির্বাহের) সহায়ক কর্তৃত্বমূলক শক্তির ব্যবস্থা করে দিন।

৫:৪৮-৫০ :: আর আমি তোমার উপর সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি, তার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবসমূহের সমর্থক (Confirmer) ও পর্যবেক্ষক-নিয়ন্ত্রক (Watcher) রূপে। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরীআত (মৌলিক বিধি) ও মিনহাজ (উন্মুক্ত পন্থা) এবং আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে (জবরদস্তিমূলকভাবে) তোমাদেরকে এক উম্মত বানাতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। সুতরাং তোমরা উত্তম-কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহরই দিকে তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন, যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে। আর তুমি তাদের মধ্যে তার মাধ্যমে বিচার-ফয়সালা করো, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর তাদের থেকে সতর্ক করো। যেন আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তার কিছু থেকে তারা তোমাকে বিচ্যুত না করে। অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে জেনে রাখ যে, আল্লাহ তো তাদেরকে তাদের কিছু পাপের কারণেই আযাব দিতে চান। আর মানুষের অনেকেই ফাসিক। তারা কি তবে জাহিলিয়্যাতের বিধান চায়? আর নিশ্চিত বিশ্বাসী কওমের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক উত্তম?

৫:২ :: হে মু’মিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নির্ধারিত নিদর্শনসমূহকে এবং কোনো হারাম মাসকে (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাসকে) এবং হাদিয়াকে (উপহারকে) এবং কালায়িদকে (বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধিদেরকে) অবমাননা / অবমূল্যায়ন করো না। আর আল বাইতুল হারামের (সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানের) অভিযাত্রীদেরকেও অবমাননা করো না, যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে। আর যখন তোমরা হুরুম (হারাম মাসসমূহ) এর বাহিরে থাকো তখন (স্থলভাগের) শিকার করতে পার। আর কোনো সম্প্রদায়ের এরূপ শত্রুতা যে, তারা তোমাদেরকে আল মাসজিদুল হারামে গমনে বাধা দিয়েছিল, তা যেন তোমাদেরকে অপরাধপ্রবণ না করে যে, তোমরা বাড়াবাড়ি করে ফেল। আর তোমরা সদাচার ও আল্লাহ সচেতনতার বিষয়ে একে অন্যকে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালংঘনের কাজে একে অন্যকে সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহ সচেতন হও। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।

৫:৮ :: হে যারা ঈমান করেছো, আল্লাহর জন্য ন্যায় সাক্ষ্যদাতা হিসেবে দণ্ডায়মান হও। আর যেন তোমাদেরকে কোনো জনগোষ্ঠী কর্তৃক কৃত শত্রুতা অপরাধপ্রবণ না করে যে, তোমরা ন্যায় বিচার করবে না। ন্যায় বিচার করো, সেটাই তাক্বওয়ার (স্রষ্টা সচেতনতার) নিকটতর। আর আল্লাহর সম্পর্কে সচেতন হও। নিশ্চয় তোমরা যা করো সেই বিষয়ে আল্লাহ অবহিত।

৫:৪২-৪৩ :: তারা (ষড়যন্ত্রকারী আহলে কিতাবরা) মিথ্যা শ্রবণে এবং অবৈধ ভক্ষণে অভ্যস্ত। তারপর যদি তারা তোমার কাছে (তাদের নিজেদের মধ্যকার বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারের জন্য) আসে, তাহলে তুমি তাদের মধ্যে বিচার-মীমাংসা করে দাও অথবা তাদের বিচার-মীমাংসা করার ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত থাকো (তাদের নিজেদের মধ্যকার বিচার-মীমাংসা তারা নিজেরাই করুক)। আর যদি তুমি তাদের বিচার-মীমাংসা করার ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত থাকো, তবে তারা তোমার তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর যদি তুমি বিচার-মীমাংসা করো, তাহলে তুমি তাদের মধ্যে ন্যায়ের ভিত্তিতে বিচার-মীমাংসা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকদেরকে ভালবাসেন। আর কিভাবে তারা তোমাকে বিচারক বানায় অথচ তাদের কাছে তাওরাত রয়েছে, তাতে আল্লাহর হুকুম-বিধান রয়েছে, তারপর তারা তা সত্ত্বেও বিমুখ হয়েছে। আসলে তো তারা মু’মিন নয়।

৪:৭৫ :: আর তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছো না অথচ নিপীড়িত হচ্ছে দুর্বল নারী-পুরুষ ও শিশুরা, যারা বলছে, “আমাদের প্রভু, আমাদেরকে এ জনপদ থেকে নিস্তার দিন যার শাসকরা যালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে অভিভাবক নির্ধারণ করুন এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে সাহায্যকারী নির্ধারণ করুন।

২৭:৩০-৩১ :: নিশ্চয় উহা (রাজকীয় পত্রটি) সুলাইমানের পক্ষ থেকে এবং নিশ্চয় উহা ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’/পরম দয়াময় দয়ালু আল্লাহর নামে’ (লিখে শুরু করা হয়েছে)। উহার বক্তব্য এই যে, “তোমরা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করো না এবং আত্মসমর্পণকারী হয়ে আমার কাছে উপস্থিত হও”।

২৭:৩৬ :: তারপর যখন (সাবার রানীর দূতেরা) সুলাইমানের কাছে আসলো। সে (সুলাইমান) বললো, “তোমরা কি আমাকে মালসম্পদ দিয়ে সাহায্য করতে এসেছো? অথচ আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছে তা তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তার চেয়ে উত্তম। বরং তোমরাই তোমাদরে উপঢৌকন নিয়ে গিয়ে আনন্দ করো। তোমরা তাদের কাছে ফিরে যাও। তারপর আমরা তাদের কাছে আসবো এমন সেনাবাহিনী নিয়ে যার মোকাবেলা করার সাধ্য তাদের নেই। আর আমরা তাদেরকে তা থেকে অপমানিত অবস্থায় বের করে দেবো। আর তারা ক্ষুদ্রশক্তি হয়ে থাকবে।

৮:৬০-৬৩ :: আর তোমরা তাদের (কাফিরদের) মোকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি এবং রণকৌশলের প্রশিক্ষিত ঘোড়া প্রস্তুত রাখো। তোমরা এর মাধ্যমে ভীত-সন্ত্রস্ত রাখবে আল্লাহর ও তোমাদের শত্রুদেরকে এবং তারা ছাড়াও অন্য অনেককে যাদের শত্রুতা সম্পর্কে তোমরা জানো না কিন্তু আল্লাহ জানেন। আর তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছুই ব্যয় করবে তিনি তোমাদেরকে তা পূর্ণ করে দিবেন। আর তোমাদের প্রতি যুলুম করা হবে না। আর যদি তারা শান্তিচুক্তির দিকে ঝুঁকে তাহলে তোমরাও সেদিক ঝুঁকো, আর আল্লাহর উপরই ভরসা করো। নিশ্চয় তিনি, তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। আর যদি তারা তোমাকে ধোঁকা দিতে চায়, তাহলে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি তাঁর সাহায্য দ্বারা ও মু’মিনদের দ্বারা তোমাকে শক্তি যুগিয়েছেন। আর তিনি তাদের (মু’মিনদের) অন্তরগুলোকে প্রীতির বন্ধনে যুক্ত করে দিয়েছেন। যদি তুমি পৃথিবীতে যা আছে তার সবই ব্যয় করতে তবুও তাদের অন্তরসমূহকে প্রীতির বন্ধনে যুক্ত করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে প্রীতির বন্ধনকে যুক্ত করেছেন। নিশ্চয় তিনি মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।

২:২৪৬-২৪৭ :: তুমি মূসার পরবর্তীতে বানী ইসরাইলের প্রধানদের প্রতি লক্ষ্য করো নি? যখন তারা তাদের জন্য প্রেরিত নবীকে বলেছিল, আমাদের জন্য একজন রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করুন, আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবো। সে (নবী) বললো, “তোমাদের ক্ষেত্রে এমন সম্ভাবনা আছে কি যে, তোমাদের উপর যুদ্ধ বিধিবদ্ধ করে দেয়া হলো অথচ তোমরা যুদ্ধ করবে না?” তারা বললো, “আমাদের কী হলো যে, আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবো না অথচ আমাদেরকে ও আমাদের সন্তানদেরকে আমাদের বাড়িঘর থেকে বাহির করে দেয়া হয়েছে?” তারপর যখন তাদের উপর যুদ্ধ বিধিবদ্ধ করে দেয়া হলো, তাদের মধ্যকার অল্পসংখ্যক ছাড়া বাকিরা মুখ ফিরিয়ে নিলো। আর আল্লাহ জালিমদের সম্পর্কে পরিজ্ঞাত। আর তাদেরকে তাদের নবী বললো, “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য তালুতকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করেছেন।” তারা বললো, “কীভাবে তার জন্য আমাদের উপর রাজত্ব করার অধিকার থাকতে পারে? অথচ আমরা (বানী ইসরাইল) রাজত্বের বিষয়ে তার চেয়ে অধিক অধিকারী। আর তাকে তো মালসম্পদ থেকেও স্বচ্ছলতা দেয়া হয় নি।” সে (নবী) বললো, “নিশ্চয় আল্লাহ তাকে তোমাদের উপর মনোনীত করেছেন এবং তাকে জ্ঞানগত ও দৈহিক কাঠামোতে সমৃদ্ধ করেছেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাঁর রাজত্ব দান করেন। আর আল্লাহ সর্বব্যাপী সর্বজ্ঞ।”

৪:৮৮-৯১ :: তোমাদের কী হয়েছে যে, মুনাফিক্বদের ব্যাপারে তোমরা দুই দল হয়ে যাচ্ছো? অথচ তাদের উপার্জনের (পাপ প্রবণতার) জন্য আল্লাহ তাদেরকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তোমরা কি ইচ্ছা করো যে, তোমরা তাদেরকে হিদায়াত করবে যাদেরকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের জন্য কোনো পথ পাবে না। তারা আকাঙ্ক্ষা করে যদি তোমরা কুফর করতে যেমন তারা কুফর করেছে তাহলে তোমরা বরাবর হয়ে যেতে! সুতরাং তাদের কাউকে বন্ধু ও অভিভাবক (অলি-আওলিয়া) হিসেবে গ্রহণ করো না, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে (তথা তাগুতের সাথে আপোষ না করে বরং যেখানে নিরাপদে আল্লাহর বিধান অনুসরণ করা যাবে সেখানে চলে আসে)। অন্যদিকে যদি তারা (শত্রুতা সহকারে তোমাদের দিক থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তোমরা তাদেরকে ধরো এবং হত্যা করো, যেখানেই তোমরা তাদেরকে পাও। আর তোমরা তাদের মধ্য থেকে কাউকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে ও সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করো না। কিন্তু তাদেরকে নয় যারা এমন কোনো ক্বওমের সাথে সংযুক্ত হয় তোমাদের ও যাদের মধ্যে (অনাক্রমণ) চুক্তি রয়েছে অথবা যারা (যেসব মুনাফিক্বরা) তোমাদের কাছে এমনভাবে আসে যে, তাদের অন্তর সংকুচিত/বাধাগ্রস্থ হয় তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অথবা তাদের ক্বওমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাদেরকে তোমাদের উপর ক্ষমতাবান করতেন। তাহলে তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো। সুতরাং যদি তারা তোমাদের থেকে সরে দাঁড়ায়, তাহলে তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো না। আর তারা তোমাদের কাছে শান্তিচুক্তি প্রস্তাব করলে, তাহলে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে (ব্যবস্থা গ্রহণের) কোনো পথ রাখেন নি। আর শীঘ্রই তোমরা অন্য কিছু (মুনাফিক্বদেরকে) পাবে, তারা ইচ্ছা করে তোমাদের থেকে নিরাপত্তা পেতে এবং তাদের ক্বওমের থেকে নিরাপত্তা পেতে। যখনই তারা কোনো ফিতনার (ন্যায়কাজে বিঘ্ন সৃষ্টির) দিকে সুযোগ পায়, তারা সেটার মধ্যে (ফিতনার মধ্যে) ঘুরে যায়/ জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং যদি তারা তোমাদের থেকে সরে না যায় এবং তোমাদের কাছে শান্তিচুক্তি প্রস্তাব না করে এবং তাদের হাতসমূহ সংবরণ না করে, তাহলে তোমরা তাদেরকে ধরো এবং হত্যা করো, যেখানেই তোমরা তাদের নাগাল পাও। আর তারাই সেসব লোক, আমরা তোমাদেরকে যাদের উপর চড়াও হওয়ার স্পষ্ট সনদ দিয়েছি।

৮:৫৬-৫৯ :: তাদের মধ্য থেকে যাদের সাথে তুমি চুক্তি করেছো, তারপর প্রতেক বার তারা তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে এবং তারা আল্লাহকে ভয় করে না। সুতরাং যদি তুমি যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের নাগাল পাও, তাহলে তাদেরকে যারা তাদের পেছনে আছে তাদের থেকে ছত্রভঙ্গ করে দাও, যেন তারা স্মরণ রাখতে পারে। আর যদি তোমরা কোনো ক্বওমের পক্ষ থেকে খিয়ানাতের/বিশ্বাসঘাতকতার ভয় করো, তাহলে (তাদের সাথে কৃত চুক্তিকে প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে) তাদের দিকে সমানভাবে প্রতিনিক্ষেপ করো। নিশ্চয় আল্লাহ খিয়ানাতকারীদেরকে ভালবাসেন না। আর যারা কুফর করেছে তারা যেন হিসাব করে না নেয় যে, তারা প্রতাপশালী হয়ে গেছে। নিশ্চয় তারা (মু’মিনদেরকে) অক্ষম করতে পারবে না।

৪:৯৭-৯৮ :: নিশ্চয় যারা (আল্লাহর আদেশের বিপরীত কাজের মাধ্যমে) স্বীয় আত্মার উপর জুলুমকারী অবস্থায় থাকে, প্রাণ হরণকালে ফেরেশতারা তাদেরকে বলে, “তোমরা কী অবস্থায় ছিলে?” তারা বলে, “আমরা জমিনে দুর্বল অবস্থায় ছিলাম।” তারা (ফেরেশতারা) বলে, “আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না, যেখানে তোমরা হিজরাত করতে পারতে?” সুতরাং তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। আর তা কতই না মন্দ আবাস! সেই প্রকৃত দুর্বল পুরুষ ও নারী এবং শিশুকিশোর ছাড়া, যারা কোনো উপায় অবলম্বনে সক্ষম হয় না এবং কোনো (যাওয়ার) পথের সন্ধানও পায় না।

৮:৭২ :: নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং হিজরাত করেছে ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছে তাদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে, এবং যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে ও তাদেরকে সাহায্য করেছে; তারাই একে অপরের আওলিয়া (বন্ধু ও অভিভাবক)। আর যারা ঈমান এনেছে কিন্তু (হিজরাতের সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কোনো কারণে) হিজরাত করে নি, তোমাদের উপর তাদের অভিভাবকত্বের কোনো দায়িত্ব নেই, যতক্ষণ না তারা হিজরাত করে। তবে যদি তারা দ্বীনী (ধর্মীয়) বিষয়ে তোমাদের কাছে সাহায্য চায়, তাহলে তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদেরকে সাহায্য করা; এমন ক্বওমের বিরুদ্ধে ছাড়া তোমাদের ও যাদের মধ্যে (অনাক্রমণ) চুক্তি রয়েছে। আর তোমরা যা করো আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।

৯:৩-৮ :: আর সাধারণ ঘোষণা বিঘোষিত হবে আল্লাহর ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে মানবজাতির সামনে ইয়াওমাল হাজ্জিল আকবারে (অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ হজ্জের দিনে) এই মর্মে যে, “নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর রসূল মুশরিকদের থেকে সম্পর্কমুক্ত। সুতরাং যদি তোমরা (মুশরিকরা) তাওবা করো তাহলে তা তোমাদের জন্যই কল্যাণকর। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে রাখো, তাহলে জেনে রাখো যে, নিশ্চয় তোমরা আল্লাহকে অক্ষমকারী নও।” আর যারা কুফর (অর্থাৎ সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান) করেছে তাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তির (অর্থাৎ জাহান্নামের) সংবাদ দাও। কিন্তু মুশরিকদের মধ্য থেকে যাদের সাথে তোমরা চুক্তি করেছো তারপর তারা তা কিছুমাত্র ভঙ্গ করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেনি। সুতরাং তোমরা তাদের সাথে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ করো। নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে [আল্লাহ সচেতনদেরকে] ভালবাসেন। তারপর যখন হারাম মাসসমূহ (বিধিবদ্ধ যুদ্ধবিরতির ও সংরক্ষিত মাসসমূহ) অতিবাহিত হয়ে যাবে তখন তোমরা মুশরিকদেরকে (হারাম এলাকার) যেখানেই পাও (সম্মুখ যুদ্ধে / এনকাউন্টারে) হত্যা করো এবং তাদেরকে (সরাসরি) ধরে ফেলো এবং তাদেরকে অবরোধ ও (অগ্রাভিযান ও পারস্পরিক যোগাযোগে) বাধাগ্রস্ত করো এবং তাদের জন্য (তাদেরকে আচমকা ধরা ও গেরিলা যুদ্ধের জন্য) প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওঁৎ পেতে বসো। তবে যদি তারা তাওবা করে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত প্রদান করে তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াশীল। আর যদি মুশরিকদের মধ্য থেকে কেউ তোমার কাছে আশ্রয় চায় তাহলে তাকে আশ্রয় দাও, যতক্ষণ না সে আল্লাহর বাণী (আল কুরআন) শুনে, তারপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দাও। এটা এজন্য যে, তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা সঠিক জ্ঞান রাখে না। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে কিভাবে মুশরিকদের জন্য কোনো চুক্তি বহাল থাকবে? তাদের সাথে ছাড়া, যাদের সাথে তোমরা আল মাসজিদুল হারামের প্রাঙ্গনে চুক্তি করার পর (তারা তা ভঙ্গ করে নি), সুতরাং যতক্ষণ তারা তোমাদের জন্য (চুক্তির উপর) প্রতিষ্ঠিত থাকে, তোমরাও তাদের জন্য (চুক্তির উপর) প্রতিষ্ঠিত থাক। নিশ্চয় আল্লাহ তো আল্লাহ সচেতনদেরকেই ভালবাসেন। কিরূপে (মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক রাখা যাবে)? অথচ যদি তারা তোমাদের উপর বিজয়ী (তথা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে) থাকে, তারা তোমাদের বিষয়ে সাধারণ আত্মীয়তারও মর্যাদা রাখে না এবং যিম্মাদারি বা সুরক্ষা চুক্তিরও মর্যাদা রাখে না। তারা মুখের কথায় তোমাদেরকে সন্তুষ্ট করে অথচ তাদের অন্তর তা অস্বীকার করে আর তাদের অধিকাংশই নীতিহীন।

২:২৫১ :: তারপর তারা (বানী ইসরাইল) আল্লাহর অনুমতিতে তাদেরকে (জালুতের সেনাদলকে) পরাভূত করলো এবং দাউদ জালুতকে হত্যা করলো। এবং আল্লাহ তাকে (দাউদকে) রাজত্ব এবং বিচারিক বিজ্ঞতা দান করলেন এবং তিনি তাকে যা ইচ্ছা করলেন শিখালেন। আর যদি আল্লাহ মানবজাতির কাউকে দ্বারা অপর কাউকে প্রতিহত না করতেন, তাহলে পৃথিবী ফাসাদপূর্ণ/নৈরাজ্যপূর্ণ হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ জগদ্বাসীর উপর অনুগ্রহশীল।

৩৮:২৬ :: হে দাউদ আমি তোমাকে পৃথিবীতে খলিফা (ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ত) করেছি। সুতরাং তুমি মানুষের মধ্যে সত্য সহকারে বিচার-ফায়সালা করো এবং খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি, কারণ তারা হিসাবের (জবাবদিহির) দিবসকে ভুলে রয়েছে।

১২:৫৪-৫৬ :: আর রাজা (রাষ্ট্রপতি) বললো, “তাকে (ইউসুফকে) আমার কাছে নিয়ে আসো। আমি তাকে আমার জন্য বিশেষ (উপদেষ্টা) করে নেবো।” তারপর যখন সে (রাজা/রাষ্ট্রপতি) তার সাথে (ইউসুফের সাথে) বাক্যালাপ করলো, তখন বললো, “নিশ্চয় আপনি আজ আমাদের কাছে বিশ্বস্ত (সম্মানিত) অবস্থানে পরিগণ্য”। সে (ইউসুফ) বললো, “আমাকে ভূখণ্ডের (রাষ্ট্রের) ধনভাণ্ডারের উপর দায়িত্বশীল মনোনীত করুন। নিশ্চয় আমি সংরক্ষণকারী, জ্ঞানী।” আর এভাবেই আমরা ইউসুফের জন্য পৃথিবীতে সুপ্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেছি, সে তা থেকে যেখানে ইচ্ছা সংস্থাপন করতে পারতো। আমরা যাকে ইচ্ছা আমাদের রহমত প্রদান করি। আর আমরা উত্তম কর্মপরায়ণদের প্রতিফল বিনষ্ট করি না।

১২:৭৬ :: তারপর সে (ইউসুফ) তার (ইউসুফের) সহোদর ভাইয়ের মালপত্র তল্লাশির আগে তাদের (ইউসুফের বৈমাত্রেয় ভাইদের) মালপত্র তল্লাশি করতে লাগলো। তারপর (অন্যদের মালপত্র তল্লাশির শেষে) তার সহোদর ভাইয়ের মালপত্রের মধ্য থেকে তা (রাজার পানপাত্র) বের করলো। এভাবে আমরা ইউসুফের জন্য কৌশল করেছিলাম। আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত, রাজার বিধান (দ্বীনিল মালিক) অনুসারে সে তার সহোদর ভাইকে আটকে রাখতে পারতো না। আমরা যাকে ইচ্ছা করি তাকে মর্যাদায় উন্নীত করি। আর প্রত্যেক জ্ঞানবান ব্যক্তির উপরে রয়েছেন একজন মহাজ্ঞানী।

৪:৬০-৬৩ :: তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা দাবী করে যে, নিশ্চয় তারা ঈমান এনেছে তার উপর যা নাযিল করা হয়েছে তোমার প্রতি এবং যা নাযিল করা হয়েছে তোমার পূর্বে। তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায় অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে অস্বীকার করতে। আর শয়তান চায় তাদেরকে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত করতে। আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা আসো যা আল্লাহ নাযিল করেছেন তার দিকে (কুরআনের দিকে) এবং রাসূলের দিকে’, তখন মুনাফিকদেরকে দেখবে তোমার কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে ফিরে যাচ্ছে। সুতরাং তখন কেমন হবে, যখন তাদের উপর কোন মুসীবত আসবে, সেই কারণে যা তাদের হাত পূর্বেই প্রেরণ করেছে (অর্থাৎ তাদের কৃতকর্মের কারণে)? তারপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করা অবস্থায় তোমার কাছে আসবে যে, আমরা উত্তম আচরণ ও সমঝোতার মাধ্যমে সামর্থ্যবৃদ্ধি ভিন্ন অন্য কিছু চাইনি। তাদের মনে যা আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তুমি তাদের বিষয়ে নির্লিপ্ত হও এবং তাদেরকে সদুপদেশ দাও এবং তাদেরকে তাদের (কর্মকাণ্ডের) পর্যালোচনাস্বরূপ মর্মস্পর্শী কথা বলো।

আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যে, মহান আল্লাহ মানবজাতির কাছে তাঁর হিদায়াত ও বিধি-বিধান প্রেরণের জন্য মানুষের মধ্য থেকেই তাঁর বাছাইকৃত বান্দাদেরকে নবী-রসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন। তিনি রসূল প্রেরণ করেছেন যেন তাঁর অনুমতিক্রমে তথা তাঁর বিধিবিধান অনুযায়ী মানুষ রসূলের আনুগত্য করে। তবে এক্ষেত্রে তিনি যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তা হলো এই যে, তিনি রসূলদেরকে শুধুমাত্র বালাগ বা তাঁর রিসালাতের বাণী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন, তারপর কেউ ঈমান আনা না আনার বিষয়ে মানুষকে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে।

সুতরাং যারা ঈমান আনবে না তারা রসূলের আনুগত্য করতে বাধ্য নয়। কিন্তু যারা ঈমান আনবে তারা রসূলের আনুগত্য করতে হবে। সুতরাং রসূল নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বা অন্যদের আনুগত্য পাওয়ার জন্য কোনো বলপ্রয়োগের পদ্ধতি অবলম্বন করেননি। এভাবে ধর্মীয় বিষয়ে যারা ঈমান আনবে এবং যারা কুফর করবে তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে এটাই স্বাভাবিক। আর তাই কুরআনের মাধ্যমে রসূলকে এ ঘোষণা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছৈ যে, “তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা) এবং আমার জন্য আমার দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা)”।

অন্যদিকে সমাজ ও রাষ্ট্রে যেহেতু মু’মিন অমু’মিন নির্বিশেষে সবাই থাকবে, এমতাবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব কাঠামো কীরূপ হবে এ বিষয়ে আল কুরআনের নির্দেশনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য বিষয়। আল কুরআনের নির্দেশনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ রসূলের কাছে সঠিক দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা) দিয়েছেন যেন তিনি তা অন্য সকল দ্বীনের (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থার) উপর প্রতিষ্ঠিত ও বিজয়ী করেন। আর মুসলিম উম্মাহর উদ্ভবও এজন্যই ঘটানো হয়েছে যেন তারা মানবজাতির কল্যাণে তাদের নেতৃত্ব দিতে পারে, তারা কর্তৃত্ব-ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হলে ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করবে এবং তারা তা করবে আল্লাহর প্রতি ঈমানের ভিত্তিতে তথা আল্লাহর বিধি-বিধান অনুযায়ী। আবার মুসলিম উম্মাহর খিলাফাত বা কর্তৃত্বে অধিষ্ঠানের জন্য তাদেরকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা হলো ঈমান এবং সৎকর্ম ও যোগ্যতা অর্জন বা দক্ষতা উন্নয়নমূলক কাজ।

কোনো মুসলিম ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সাথে অমুসলিম ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের দ্বন্দ্ব হলে যদি তাতে অমুসলিম ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, সে অবস্থায় শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অন্যায়কারী মুসলিম ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে সমর্থন করা যাবে না। মু’মিনরা সবসময় ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে। প্রকৃত মুসলিমদের শাসনকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তারা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব অনুযায়ী ন্যায়বিচার করবে এবং কোনো ক্ষেত্রে আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব দ্বারা বিচার করা সম্ভব না হলে বিচার থেকে নিবৃত্ত থাকবে বা সংশ্লিষ্ট পক্ষকে তাদের নিজেদের কোনো কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হতে সুযোগ দিবে। মুসলিম উম্মাহ তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করবে। সুতরাং ন্যায়ের ভিত্তিতেই মুসলিমদের শাসনকর্তৃত্ব বজায় থাকতে পারে, নিছক ধর্মীয় পরিচয়গত কারণে নয়।

দ্বীন কায়েম করা, দ্বীনকে বিজয়ী করা, মুসলিম উম্মাহর খেলাফত ইত্যাদি বিষয়ে বিকৃত ব্যাখ্যার কারণে ইসলাম সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে এগুলোর যে তাৎপর্য প্রতীয়মান হয় তা সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও শান্তি-শৃঙ্খলাপূর্ণ বিষয়। যেমন- দ্বীন কায়েম বলতে বুঝায় নিজেদের মধ্যে এবং সাধ্যমতো এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে দ্বীন-ইসলামের বিধি-বিধানের প্রতিষ্ঠা। ধর্মীয় অঙ্গনে যেমন নিজেদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের বিষয়াবলি পরিপালনের বিষয়, অন্যদের উপর তা চাপানো যাবে না। তেমনি ইসলামের সামাজিক বিধি-বিধানও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, কারণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে তো দ্বীনের প্রতিষ্ঠা হয় না, বরং দ্বীনের নির্দেশনাকে লঙ্ঘন করা হয়। অনুরূপভাবে দ্বীনকে বিজয়ী করা বলতে বুঝায় সত্যভাষণ এবং নিজেদের কর্মে দ্বীনের নির্দেশনাকে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে দ্বীনকে বিজয়ী করা। দ্বীন ইসলামের সামাজিক বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে যে সংগ্রামের নির্দেশনা রয়েছে সেক্ষেত্রে যুদ্ধ হতে পারে প্রতিআক্রমণমূলক যুদ্ধ ও কোনো জনগোষ্ঠীকে জুলুম থেকে বাঁচানোর যুদ্ধ অথবা ইসলামী আদর্শভিত্তিক মডেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর প্রয়োজনীয় সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে পর্যাপ্ত সামরিক সক্ষমতা সাপেক্ষে অন্যদেরকে সতর্কীকরণ করে পরিচালিত অভিযান।

নিরাপদে ইসলামী আদর্শের অনুশীলনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্তৃত্ব অর্জন ও তার স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির বিকল্প নেই। এই প্রেক্ষিতে সূরা আনফালের ৬০-৬৩ আয়াতে কাফিরদেরকে মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি এবং রণকৌশলের প্রশিক্ষিত ঘোড়া প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এবং সেই সাথে মু’মিনদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের সম্পর্ককে মজবুত করার মাধ্যমে অশুভ শক্তির মোকাবেলায় মু’মিনদের ঐক্যের শক্তিকে কাজে লাগানোর গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।

স্বতন্ত্রভাবে ‘রাজনৈতিক সংগঠন’ প্রতিষ্ঠা করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করা জরুরি নয়। বরং প্রয়োজন হলো ‘ইসলামের দিকে আহবান, বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং বিশ্বাসীদের নিজেদের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা সহকারে সমাজকল্যাণ কর্ম’। এরি ধারাবাহিকতায় মুসলিম উম্মাহ যখন যতটুকু নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জন করবে, তখন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থাই ততটুকু ইসলামী আইনকে পরিগ্রহণ করে নিবে। অর্থাৎ বিষয়টি একটি বিবর্তন প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে। শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের মোকাবেলায় গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের প্রয়োজন হলে এর ব্যতিক্রম হতে পারে।

দ্বীনের বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম উম্মাহ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে থাকা কোনো ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা আবশ্যক নয়, বরং স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে নিজ বলয়ে ইসলামের বিধি-বিধান চর্চা করাই যথেষ্ট। এজন্য এই উম্মাহ রাষ্ট্রের কাছে যে ন্যায্য দাবি জানাবে তা হলো ‘নিজ বলয়ে নিজেদের ধর্মীয় বিধি-ব্যবস্থা প্রয়োগের স্বায়ত্তশাসন’। মুসলিম উম্মাহর কল্যাণমুখী কার্যক্রমই ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্র ও আন্তঃরাষ্ট্রিক পরিসরে তার স্বাভাবিক ক্ষমতায়ন ঘটাবে, তখন সে সেই বৃহত্তর পরিসরে প্রগতিশীলভাবে আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের ভিত্তিতে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

কুরআন উম্মাহ এবং কওমের ধারণা দেয়, যেখানে উম্মাহ হলো আদর্শিক জাতিসত্তা এবং ক্বওম হলো সমাজ-সংস্থা ও রাষ্ট্রীয় জাতিসত্তা। যেমন সকল বাংলাদেশি একটি কওম, যেখানে উম্মাহর দিক থেকে যেমন মুসলিম উম্মাহ রয়েছে, তেমনি অমুসলিম উম্মাহও রয়েছে। উম্মাহর নেতৃত্ব দেয় ‘উলিল আমর’ (আদেশের অধিকারী নেতা) এবং কওমে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রদানকারী হলো ‘মালিক’ (রাষ্ট্রপতি)।

উপরিউক্ত রাজনৈতিক পদ্ধতিকে ‘আপোষকামিতা’, ‘কিছু আদর্শিক ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া’, ‘পরস্পর পরস্পরের আংশিক অনুসরণ’ ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করে আপত্তিকর সাব্যস্ত করার অবকাশ নেই। কারণ কুরআন কোনো পুরোহিততান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিধান দেয়নি, বরং রাষ্ট্র হলো মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব হওয়ার প্রেক্ষিতে তার স্বাভাবিক সংস্থা যাতে কোনো কোনো নবী-রসূলও সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব চর্চার মাধ্যমে ভূমিকা রেখেছেন, কিন্তু তা কোনো ঐশী অধিকারের ভিত্তিতে নয়, বরং তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটেছিল স্বাভাবিক রাজনৈতিক উত্থান-পতন প্রক্রিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে।

নবী-রসূলগণ বস্তুত তাদেরকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন যাঁরা তাঁদের প্রতি ঈমান এনেছেন, অন্যদের জন্য বালাগ বা তথ্য পৌঁছে দেয়া ছাড়া তাঁদের কোনো কাজ ছিলো না। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের দিক থেকে যে বলপ্রয়োগমূলক বৈধ ক্ষমতা সেটা ধর্মীয় অধিকারের ভিত্তিতে নয়, বরং সর্বজনীন রাজনৈতিক অধিকারের ভিত্তিতে।

বস্তুত আল্লাহর বিধান অনুসারে ফায়সালা করা না করার বিষয়টি ফায়সালাকারী কোন স্তরে রয়েছে তার সাপেক্ষেই নির্ধারিত হতে পারে। যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার করে না তাদেরকে জালিম বলা হয়েছে ধর্মাদর্শের দিক থেকে, এ ক্ষেত্রে মানবজাতির উপর সামাজিক জুলুমের বিষয়টি গৌন, তা কোনোক্ষেত্রে ঘটতে পারে, আবার কোনো ক্ষেত্রে নাও ঘটতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রযন্ত্র (আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ) মাত্রই তাগুত, এমনটি নয়। বরং তাগুত বলা হয়েছে ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণকারী (ফিতনাবাজ) নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব বা শাসকদেরকে, যারা মু’মিনদের উপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে কাফিরদের নেতৃত্ব দেয় বা পরিচালনা করে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের ন্যায্য দাবি মেনে না নিয়ে তাদের নিজেদের খেয়ালখুশিভিত্তিক আইনে বিচারকার্য চালায়।

মুসলিমরা যখন খেলাফত পাবে বা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, তখন তাদেরকে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, প্রত্যেক ধর্মের স্বতন্ত্র ধর্মীয় আচার ও বিচারব্যবস্থার সুযোগ দিতে হবে (শর্ত হলো, তার মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ মৌলিক মানবিক অধিকার ক্ষুন্ন করার মতো কিছু থাকতে পারবে না, যেমন-সতীদাহ), আর ধর্মনিরপেক্ষ থেকে সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য ইসলামের আইনগুলো (অর্থনৈতিক ও বিচারবিভাগীয়) কুরআনের আলোকে পরিচালিত করতে হবে, কারণ এক্ষেত্রে প্রত্যেক রাষ্ট্রেই রাষ্ট্র পরিচালনাকারী পক্ষ তাদের মতাদর্শকেই বাস্তবায়ন করবে, এটাই স্বাভাবিক হয়।

বস্তুত ইসলামে থাকা সামাজিক ব্যবস্থা এরূপ যে, তা ধর্মনিরপেক্ষ পর্যায়ে থেকেও গ্রহণযোগ্য। মুসলিম উম্মাহর মূল নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সরাসরি রসূলের জন্য সংরক্ষিত ছিল, কারণ তিনি আল্লাহর মনোনীত রসূল এবং তাই মু’মিনরা ঈমানের দাবি অনুসারে তাঁর আনুগত্য করতে হবে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তিনি অমুসলিম রাষ্ট্র কর্তৃত্বের সাথে সন্ধিও করেন এবং চুক্তিকে ধর্মীয় সম্পর্কের চেয়েও বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন আল্লাহর বিধান অনুসারে। সুতরাং রসূল ধর্মীয় নেতা হওয়ার দাবির ভিত্তিতে জোর করে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত হন না, বরং স্বাভাবিক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাক্রমে রাষ্ট্র-কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। এটা স্বতন্ত্র বিষয় যে, ধর্মীয় বিশ্বাসমতে, এরূপ পরিস্থিতি গঠনে আল্লাহ সাহায্য করেন এবং তাঁর বিশ্বসাম্রাজ্য পরিচালনা বিধি অনুসারে তিনিই রাষ্ট্রক্ষমতার উত্থান-পতন ঘটিয়ে থাকেন।

রসূল নিছক ধর্মের দাবিতে ক্ষমতা দখল করেননি, বরং তিনি অমুসলিম সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে রাজনৈতিক চুক্তি করেছেন। আবার যখন তিনি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন করেছেন তখনও তিনি তাতে অমুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য তাদের নিজেদের মধ্যকার বিষয়ে তাদের ধর্মীয় নিয়মে বিচার-আচার করার অধিকার দিয়েছিলেন। সূরা মায়িদাহর ৪২-৪৩ আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে, রাসূলের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের অধীনে আহলে কিতাবের নিজেদের বিষয় নিজেরা সমাধান করার বিকল্প ব্যবস্থার অবকাশ তথা অমুসলিমদের স্বায়ত্তশাসন ও তাদের আয়ত্তে তাদের স্বতন্ত্র বিচার-ব্যবস্থার অধিকার ছিল।

এক বনে দুই বাঘের রাজত্ব চলে না। রাষ্ট্রে যে উম্মাহ মূল ক্ষমতায় থাকে সেটাই বৃহৎশক্তি ও পরাশক্তি এবং যে উম্মাহ শুধুমাত্র স্বায়ত্তশাসন লাভ করে সেটাই ক্ষুদ্রশক্তি হিসেবে আখ্যায়িত হয়। এমতাবস্থায় মুসলিম উম্মাহ অবশ্যই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় উত্তরণের জন্য ইতিবাচক প্রক্রিয়ায় প্রচেষ্টাশীল থাকবে। কিন্তু এজন্য কোনোক্রমেই কোনো অপকৌশল ও বিশৃঙ্খলার আশ্রয় নিবে না।

খেলাফত অর্জন ও এর স্থিতিশীলতার জন্য প্রতিষ্ঠিত শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হলে তা হতে হবে- (ক) অনাক্রমণ চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণের পর, চুক্তি নবায়ন না করে, নিজেদের মধ্যকার আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাধা আসলে বা রাষ্ট্রের নাগরিকদের উপর রাষ্ট্রীয় জুলুম চললে তার প্রেক্ষিতে। অবশ্য যদি কাফিররা নিজেরা চুক্তি লংঘন করে তবে চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণের পূর্বেই চুক্তি সমাপ্ত হয়ে যায় বিধায় তখনও এ চ্যালেঞ্জ জানানো যেতে পারে। (খ) ইসলামী আদর্শভিত্তিক মডেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে অন্যদেরকে সতর্কীকরণ করে প্রয়োজনসাপেক্ষে ক্বিতাল বা যুদ্ধাভিযান হতে পারে। অর্থাৎ একবার একটি রাষ্ট্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে অন্য যেসব কাছাকাছি রাষ্ট্রকে এ রাষ্ট্রের অধীনস্ত করার মতো রাজনৈতিক শক্তিমত্তা তৈরি হয় তা প্রয়োগ করে চ্যালেঞ্জ জানানো যেতে পারে। যেমন নবী সুলাইমান সাবার রাণীকে রাজকীয় পত্র পাঠিয়েছেন। এক্ষেত্রে ঐ রাষ্ট্রের সাহায্যার্থে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলির এগিয়ে এসে সম্ভাব্য যে সংষর্ষ হতে পারে তা মোকাবিলার সম্ভাবনা বিবেচনায় রাখতে হবে। এক কথায়, খিলাফাত প্রতিষ্ঠার জন্য বা এর স্থিতিশীলতার জন্য যে পদক্ষেপই গ্রহণ করা হোক না কেন, তা ন্যায়সঙ্গত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে এবং তা যেন এমন প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিসহ হয় যে, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই কল্যাণ ব্যবস্থার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হতে পারে।

সূরা বাক্বারাহর ২৪৬-২৪৭ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নবীর উপস্থিতিতে নবীর অনুমোদিত/অধীনস্ত মালিক তথা রাষ্ট্রপতি/সেনাপতি হতে পারে। সুতরাং মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি ধারা হলো ধর্মীয় মূল নেতা ও রাজনৈতিক মূল নেতা যেমন একই জন হতে পারে, তেমনি মুসলিম উম্মাহর আওতায় ধর্মীয় মূল নেতার অধীনে রাষ্ট্রপতি/রাজনৈতিক মূল নেতা থাকার বিষয়টিও গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ উম্মাহর নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দুটি স্বতন্ত্র বিষয়, মুসলিম উম্মাহর মূল নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব দিতে পারে বা তাঁর অধস্তন কেউ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। আবার এখান থেকে আরো বুঝা যায় যে, কোনো অত্যাচারী পরাশক্তির বিরুদ্ধে ক্বিতাল বা যুদ্ধ পরিচালনার স্বাভাবিক পদ্ধতি হলো প্রথমে কোনো ভূখণ্ডে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জনের পর রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তক্রমে যুদ্ধ পরিচালনা করা।

মুসলিম উম্মাহর প্রতি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, যারা চুক্তিবদ্ধ হতে চায় তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে এবং যদি তারা চুক্তিভঙ্গ করার সম্ভাবনা না থাকে সেক্ষেত্রে চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করতে হবে। অবশ্য এ চুক্তি হলো রাজনৈতিক সহাবস্থান বিষয়ক, ধর্মীয়ভাবে পারস্পরিক কিছু বিষয় আত্মীকরণ নয়; যেমন, কোনো হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল হিসেবে চালু করতে সম্মতি নয়। যেসব মু’মিন অপরিহার্য হিজরত করেনি, তারা কুফর করেছে এবং যতক্ষণ হিজরত করবে না ততক্ষণ তারা মু’মিন পদবাচ্য হবে না, ততক্ষণ তাদেরকে আওলিয়া (বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। তারা শত্রুতা সহকারে মু’মিনদের প্রতি বিমুখ হলে তথা মু’মিনদের বিরুদ্ধে কাফিরদের পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধে লিপ্ত হলে তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রের যেখানেই নাগাল পাওয়া যায় সেখানে হত্যা করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু যেসব মুনাফিক্ব মু’মিনদের বিরুদ্ধে কোনো আক্রমণ চালায় না, যারা তাদের ক্বওমের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করে না আবার মু’মিনদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করে না এবং তাদের ক্বওমের থেকেও নিরাপত্তা পেতে চায় ও মু’মিনদের থেকেও নিরাপত্তা পেতে চায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না। এছাড়া যারা এমন ক্বওমের সাথে সংযুক্ত হয় যাদের সাথে মু’মিনদের রাজনৈতিক সহাবস্থানমূলক বা অনাক্রমণ চুক্তি রয়েছে তাহলেও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা যাবে না।

অন্যদিকে যেসব মু’মিন কোনো বাস্তবসঙ্গ কারণে হিজরত করেনি বা করতে পারে নি, তারা হিজরত করার পূর্ব পর্যন্ত তাদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব হিজরতকারীদের উপর নেই। তবে তারা দ্বীনের বিষয়ে সাহায্য চাইলে তাদেরকে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু যে সম্প্রদায়ের সাথে চুক্তি আছে তার বিপরীতে গিয়ে সাহায্য করা যাবে না। সুতরাং রাজনৈতিক সহাবস্থান বা অনাক্রমণ চুক্তিতে চুক্তিবদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে অবস্থানকারী মু’মিন-মুসলিমদের স্বার্থ বা তাদেরকে সাহায্য করার চেয়ে চুক্তিবদ্ধ সম্প্রদায়কে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকাকে অগ্রাধিকার বা বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

যেসব সম্প্রদায় চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর বার বার চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যারা চুক্তি করার পর তাতে খিয়ানাত বা বিশ্বাসঘাতকতা করার লক্ষণ প্রকাশ পায় তাদের চুক্তিকে তাদের দিকে প্রতিনিক্ষেপ করতে হবে। যারা চুক্তি লংঘন করে না তাদের সাথে অবশ্যই চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করতে হবে এবং প্রয়োজনমতো চুক্তির নবায়ন করতে হবে। কিন্তু যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হবে। তবে এসব মুশরিকরা যদি আশ্রয় চায় তাহলে তাদের আল্লাহর আয়াত শুনাতে হবে এবং তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিতে হবে। মুশরিকরা এমন যে, যখন তারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে থাকে, তখন তারা মু’মিনদের প্রতি আত্মীয়তার মর্যাদাও রাখে না এবং সরকার ও নাগরিকের মধ্যে যে স্বাভাবিক সুরক্ষা চুক্তি রয়েছে তারও মর্যাদা রাখে না। অন্যদিকে মুসলিম উম্মাহ কর্তৃত্বে থাকলে তারা মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষ সবার প্রতি আত্মীয়তার মর্যাদাও রক্ষা করে এবং নাগরিক সাধারণের সাথে সরকারের যে স্বত:সিদ্ধ যিম্মাদারি চুক্তি, সেটারও মর্যাদা রক্ষা করে।

কুরআনে যে মুশরিকদের হত্যা করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা তারা মুশরিক হওয়ার কারণে নয়, বরং তারা রাজনৈতিক চুক্তি ভঙ্গ করে মু’মিনদের উপর হামলা চালানোর কারণে, সামাজিক বিশৃঙ্খলা বা রাষ্ট্রে নৈরাজ্য সৃষ্টির কারণে। যে সকল মুশরিক কোনো চুক্তি লঙ্ঘন করেনি, তাদেরকে আক্রমণ করা যাবে না, বরং তাদের সাথে চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করতে হবে।

উপরোল্লেখিত রাজনৈতিক নীতিমালা অনুসারে সাধারণত কর্তৃত্ব কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধানের ভিত্তিতে রাষ্ট্রসমূহকে দুটি প্রধান শ্রেণিতে শ্রেণিবিভাগ করা হয়। যে রাষ্ট্রে মুসলিমদের খিলাফাহ (কর্তৃত্ব-ক্ষমতায় অধিষ্ঠান) প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে ‘দারুল ইসলাম’ বলা হয়। কারণ তাতে ইসলামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিধি-বিধান চালু করা হয়। অন্যদিকে যে রাষ্ট্রে কাফিরদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাকে ‘দারুল কুফর’ বলা হয়। কারণ তাতে দ্বীন-ইসলামকে রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধানের মূল উৎস হিসেবে স্বীকার করা হয় না। তবে ‘দারুল কুফর’ দুই ভাগে বিভক্ত: (ক) ‘দারুল আহদ’ ও (খ) ‘দারুল হারব’। যে রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের সাথে মুসলিম উম্মাহর অনাক্রমণ চুক্তি বা শান্তিচুক্তি হয়, তাকে ‘দারুল আহদ’ (চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্র) বলা হয়। আর যে রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ মুসলিম উম্মাহর সাথে সংঘাতে লিপ্ত থাকে, তাকে ‘দারুল হারব’ (সংঘাতপূর্ণ রাষ্ট্র) বলা হয়। এরূপ রাষ্ট্রে মুসলিমরা ততক্ষণ নিজেদের পরিসরে দ্বীনের বাস্তবায়নের চেষ্টা চালু রাখবে যতক্ষণ সেখানে পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন নিয়মতান্ত্রিক উপায় অবলম্বনের সম্ভাবনা থাকে এবং যতক্ষণ অন্যত্র এর চেয়ে ভালো সম্ভাবনার কারণে হিজরতের প্রয়োজনীয়তা দেখা না দেয়। তারপর দ্বীনের উপর অটল থাকার কারণে যাদেরকে তাদের বাড়িঘর থেকে বহিষ্কার করা হয়, তাদের পাশাপাশি সঠিকভাবে দ্বীন পালনকে অগ্রাধিকার দেয়ার খাতিরে যারা প্রকৃত দুর্বলতাজনিত কারণে হিজরত করতে অপারগ তারা ছাড়া বাকিরা হিজরত করতে হবে।

সুতরাং সকল ‘দারুল কুফর’ই ‘দারুল হারব’ নয়। বরং যে ‘দারুল কুফরে’ মুসলিম উম্মাহর এবং যেকোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকে, কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপর ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিবেচনায় কোনোরূপ নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয় না, বরং তাদের স্বীয় পরিমণ্ডলে নিজ নিজ ধর্মীয় বিধি-বিধান চর্চার স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়, সেরূপ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহ ‘দারুল আহদ’ হিসেবে প্রতীয়মান হয়, সেগুলো ‘দারুল হারব’ নয়। এ ধরনের রাষ্ট্রসমূহকে ‘দারুল ইসলামে’ পরিণত করার জন্য কোনোরূপ বলপ্রয়োগমূলক পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য নয়।
কোনো রাষ্ট্রকে ‘দারুল ইসলামে’ উত্তরণের ক্ষেত্রে গণবিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান, গণতান্ত্রিক নির্বাচন বা ক্রমবিবর্তন প্রক্রিয়ার বিষয়টি ‘বাস্তব পরিস্থিতির দাবি’ ও ‘ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক নীতি’ অনুসারে নির্ধারিত হতে হবে। আমরা যেমন রসূলুল্লাহ দাউদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে পাই, তেমনি রসূলুল্লাহ ইউসুফকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতির অধীনে বিশেষ উপদেষ্টা ও অর্থ বিভাগের কর্তৃত্বমূলক পদে’ দেখতে পাই। তিনি (রসূলুলল্লাহ ইউসুফ) ‘ইসলামের রাষ্ট্রীয় আইন-বিধান’ প্রতিষ্ঠার জন্য রাতারাতি ‘রাজার প্রবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষ আইন-বিধানকে (দ্বীনিল মালিক)’ পরিবর্তন করেন নি; বরং এক্ষেত্রে তিনি একটি ক্রমবিবর্তন প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
যেহেতু দ্বীন গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো জবরদস্তি নেই, তাই কাফিররা তাদের নিজেদের দ্বীন মতো চলার স্বাধীনতা আছে এবং মু’মিনরাও নিজেদের দ্বীন মানার স্বাধীনতা আছে। যারা নিজেদের অপশক্তি প্রয়োগ করে মু’মিনদেরকে নিজেদের জীবনে তাদের দ্বীন পালন থেকে বাধার সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে অন্যরূপ বিধানে চলতে বাধ্য করে তারাই তাগুত। কোথাও কাফিরদের বাস্তব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তার বাস্তবতা অস্বীকারের কিছু নেই, কিন্তু মু’মিনরা তাদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারভার রসূল ও তাঁর অনুপস্থিতিতে উলিল আমরের উপর অর্পণ করতে হবে। নিজেদের মধ্যকার বিষয়ে রসূলকে বা উলিল আমরকে বাদ দিয়ে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া যাবে না। “নিতান্ত বাধ্য হয়ে তাগুতের অধীনে বা তাগুতের বিধানের আওতায় থেকে কর্মসম্পাদন করা” এবং “নিজেদের মূল বিধান (সংবিধান) ও মূল নেতৃত্ব (সরকার) হিসাবে কুরআনের বিধান ও রসূলকে বা উলিল আমরকে গ্রহণ না করে (৪:৬১) তাগুতের আনুগত্য করা ও তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া (৪:৬০) এবং উহাকে উত্তম আচরণ ও সমঝোতার মাধ্যমে সামর্থ্য বৃদ্ধির প্রয়াস বলে অজুহাত পেশ করা (৪:৬২)” দুটি ভিন্ন বিষয়।
নিজেদের মধ্যকার বিষয়ে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া যাবে না। কিন্তু তাদের নাগরিকের অপরাধের ক্ষেত্রে বিচার চাওয়াকে ৪:৬০ আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক বলে সাব্যস্ত করা যায় না। ৪:৫৯ – ৬৫ অনুযায়ী, কুরআন ও রসূলকে বাদ দিয়ে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া এবং নিজেদের পার্থিব স্বার্থবাদিতাকে আড়াল করার জন্য উহাকে ইহসান (উত্তম আচরণ) ও তাওফীক্বের (সমঝোতার মাধ্যমে সামর্থ্যবৃদ্ধির) প্রয়াস বলে অজুহাত পেশ করা মোনাফেকি। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর খেলাফত প্রাপ্তির পূর্বে তাগুতের কাছে তাদের নাগরিকের বিচার চাওয়া একটি ভিন্ন বিষয়, যে ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

এছাড়া যখন কাফিরদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন আল্লাহর বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বিধানের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি নীতিগত অস্বীকৃতি জ্ঞাপন সত্ত্বেও, সাধারণ শৃঙ্খলাগত বিষয়াদিতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রণীত নিয়মাবলির অনুসরণ এবং নাগরিক সুবিধাদির বিপরীতে সরকারকে যথানিয়মে ‘কর’ প্রদান করার নাগরিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মু’মিনদেরকে ইতিবাচক আচরণ করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব কাঠামোতে যখন মু’মিনরা কর্তৃত্ব লাভ করে তখন তাদের দ্বারা কোনোক্রমে ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের অবকাশ নেই, বরং মু’মিনরা ধর্মীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্যই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এভাবে কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয়ে শান্তি-শৃঙ্খলার সাথে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ অনুশীলন করতে বাধ্য। এমতাবস্থায় ‘মুরতাদ হত্যার অবৈধতা’ আল কুরআনের সামগ্রিক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নীতিমালার সাথে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বিপরীতক্রমে ‘মুরতাদকে হত্যা বা কোনোরূপ দণ্ড প্রদান করা’ কোনোক্রমেই কুরআনসম্মত নয়।

মুরতাদ, ইলহাদ ও তাহরীফ প্রসঙ্গ

আল কুরআনের আলোকে মুরতাদ বা স্বধর্মত্যাগীকে হত্যা বৈধ না অবৈধ?- প্রশ্নটির সাথে আরো দুটি সম্পূরক প্রশ্ন হলো, যে ইলহাদ বা ধর্মীয় বিষয়কে অবমাননা করে এবং যে তাহরীফ বা ধর্মীয় তথ্যের বিকৃতি ঘটায় তাদেরকে হত্যা করা বৈধ না অবৈধ? তাই এ অধ্যায়ে আমরা মুরতাদ, ইলহাদ ও তাহরীফ প্রসঙ্গে থাকা আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে এ বিষয়ে আল কুরআনের আলোকে প্রকৃত তথ্য অনুধাবনের চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।

মুরতাদ প্রসঙ্গ

মুরতাদ শব্দটির মূল অক্ষরসমূহ হলো ‘র দাল দাল’। এ মূল অক্ষরসমূহ থেকে গঠিত যেসব শব্দ কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে তার নির্ঘণ্ট নিম্নরূপ:

১. রদ্দ (ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ১, অর্থ: ফিরিয়ে নেয়া, ফিরিয়ে দেয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ২:২২৮:২৪, ২১:৪০:৭।

২. মারাদ্দ (ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ১, অর্থ: রদ (রহিত) করা, প্রত্যাবর্তন করা) ব্যবহৃত হয়েছে ৬ স্থানে: ১৩:১১:২৮, ১৯:৭৬:১৩, ৩০:৪৩:১১, ৪০:৪৩:১৫, ৪২:৪৪:১৮, ৪২:৪৭:৯।

৩. র-দ্দু (কর্তা, ক্রিয়ারূপ ১, অর্থ: যে ফিরিয়ে দেয়, যে রদ করে) ব্যবহৃত হয়েছে ৪ স্থানে: ১০:১০৭:১৪, ১৬:৭১:১১, ২৮:৭:১৮, ২৮:৮৫:৬।

৪. মারদূদ (কর্ম, ক্রিয়ারূপ ১, অর্থ: যাকে রদ করা হয়েছে, যাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ১১:৭৬:১৪, ৭৯:১০:৩।

৫. রদ্দা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১) ব্যবহৃত হয়েছে ৩৬ স্থানে: ২:৮৫:৪১, ২:১০৯:৭, ২:২১৭:৩৩, ৩:১০০:১১, ৩:১৪৯:৮, ৪:৪৭:১৬, ৪:৫৯:১৫, ৪:৮৩:১১, ৪:৮৬:৮, ৪:৯১:১০, ৫:১০৮:১১, ৬:২৭:৯, ৬:২৮:১০, ৬:৬২:২, ৬:৭১:১১, ৬:১৪৭:৯, ৭:৫৩:২৫, ৯:৯৪:২২, ৯:১০১:১৯, ৯:১০৫:৮, ১০:৩০:৭, ১২:৬৫:৬, ১২:৬৫:১৪, ১২:১১০:১৫, ১৪:৯:২১, ১৬:৭০:৭, ১৭:৬:২, ১৮:৩৬:৬, ১৮:৮৭:৮, ২২:৫:৪৬, ২৮:১৩:১, ৩৩:২৫:১, ৩৮:৩৩:১, ৪১:৪৭:২, ৬২:৮:১০, ৯৫:৫:২।

৬. তারাদ্দাদা/ইয়াতারাদ্দাদু (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৫, অর্থ: তারা ঘুরপাক খাচ্ছে, তারা দোদুল্যমান থাকছে, ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য: তারাদ্দুদ) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৯:৪৫:১৪।

৭. ইরতাদ্দা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৮, ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য: ইরতিদাদ, অর্থ: বিপরীত দিকে ফিরে যাওয়া, ফিরে পাওয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ৮ স্থানে: ২:২১৭:৩৯, ৫:২১:১০, ৫:৫৪:৫, ১২:৯৬:৮, ১৪:৪৩:৫, ১৮:৬৪:৬, ২৭:৪০:১২, ৪৭:২৫:৩।
নিম্নে ‘রদ্দ’ শব্দের বিভিন্ন শব্দরূপের সাথে সম্পর্কিত আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হলো। চিহ্নিতকরণের সুবিধার জন্য ‘রদ্দ’ শব্দটির অর্থের অংশটুকু আন্ডারলাইন করা হলো।

[ক] ঈমান থেকে কুফরের দিকে বা পিছনের দিকে ফিরে যাওয়া, ফিরিয়ে দেয়া বা ফিরিয়ে নেয়া অর্থে ব্যবহার

২:১০৯ :: আহলে কিতাবের অনেকেই চায় যদি তোমাদের ঈমানের পরে তোমাদেরকে কাফির অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারতো! তাদের কাছে সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরেও তাদের নিজেদের হিংসাবশত (তারা এরূপ চায়)। সুতরাং তোমরা তাদেরকে মার্জনা করো ও উপেক্ষা করো যতক্ষণ না আল্লাহর আদেশ এসে যায়। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।

২:২১৭ :: তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে হারাম মাস (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাস) সম্পর্কে, সেটাতে যুদ্ধ করা প্রসঙ্গে। বলো, “সেটাতে (তথা কোনো হারাম মাসে) যুদ্ধ করা অনেক বড় গুনাহ। আর আল্লাহর পথ থেকে বাধা দেয়া ও তাঁর প্রতি কুফর (অবিশ্বাস ও অকৃতজ্ঞতা) করা এবং আল মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দেয়া এবং সেটার যথোপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে তা থেকে বহিষ্কার করা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় গুনাহ। আর ফিতনা (ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ এবং ভিন্ন জীবনব্যবস্থা অবলম্বনের কারণে নির্যাতন) হত্যার চেয়েও গুরুতর গুনাহ। আর তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে থামবে না, যতক্ষণ না তারা তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) থেকে ফিরিয়ে দেয়, যদি তাদের সাধ্যে কুলায়। আর তোমাদের মধ্য থেকে যে তার দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) থেকে ফিরে যাবে তারপর কাফির (সত্য প্রত্যাখ্যানকারী) অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করবে, তারাই এমন লোক যাদের আমলসমূহ দুনিয়াতে ও আখিরাতে বরবাদ হয়ে যাবে। আর তারাই (দোযখের) আগুনে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। তারা তাতে স্থায়ী হবে।

৩:১০০ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যদি তোমরা আহলে কিতাবের কোনো দলের আনুগত্য করো, তাহলে তারা তোমাদের ঈমানের পর তোমাদেরকে কাফির অবস্থায় ফিরিয়ে নেবে।

৩:১৪৯ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যদি তোমরা তাদের আনুগত্য করো যারা কুফর করেছে তাহলে তারা তোমাদেরকে পশ্চাদপদে ফিরিয়ে দিবে, ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।

৪:৯১ :: শীঘ্রই তোমরা অপর কিছু লোক পাবে যারা তোমাদের থেকেও নিরাপদ থাকতে চায় এবং তাদের জনগোষ্ঠী থেকেও নিরাপদ থাকতে চায়, প্রত্যেকবার যখন তাদেরকে ফিতনার দিকে (ধর্মীয় স্বাধীনতা নস্যাৎ করার দিকে) ফিরিয়ে দেয়া হয় তারা তাতে নিমগ্ন হয়। সুতরাং যদি তারা তোমাদের প্রতি শত্রুতা ছেড়ে না দেয় এবং তোমাদের কাছে শান্তিচুক্তির প্রস্তাব না করে এবং তাদের হস্ত সংবরণ না করে তাহলে তাদেরকে ধরো এবং হত্যা করো, (যুদ্ধক্ষেত্রের) যেখানেই তাদেরকে পাও। আর আমরা তাদের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে স্পষ্ট ছাড়পত্র দিয়েছি।

৬:৭১ :: বলো, আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমরা কি এমন কাউকে ডাকবো যে আমাদের কোনো উপকারও করে না এবং ক্ষতিও করে না। আর আমরা কি পশ্চাদদিকে ফিরে যাবো, আল্লাহ আমাদের হিদায়াত করার পরেও, তার মতো পৃথিবীতে যাকে শয়তান মোহগ্রস্ত করেছে, সে দিশেহারা অথচ তার সঙ্গীরা তাকে হিদায়াতে দিকে ডাকছে, “তুমি আমাদের সঙ্গে এসো”। বলো, “নিশ্চয় আল্লাহর হিদায়াতই হিদায়াত এবং আমাদেরকে বিশ্বপ্রভুর প্রতি আত্মসমর্পণকারী হওয়ার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে”।

৯:৪৫ :: বস্তুত তোমার কাছে তারা (যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে) অব্যাহতির অনুমতি চাচ্ছে যারা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান (বিশ্বাস) করে না এবং তাদের মনসমূহ সংশয়গ্রস্ত হয়েছে। সুতরাং তারা তাদের সংশয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে / দোদুল্যমান থাকছে।

২:২১৭ :: তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে হারাম মাস (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাস) সম্পর্কে, সেটাতে যুদ্ধ করা প্রসঙ্গে। বলো, “সেটাতে (তথা কোনো হারাম মাসে) যুদ্ধ করা অনেক বড় গুনাহ। আর আল্লাহর পথ থেকে বাধা দেয়া ও তাঁর প্রতি কুফর (অবিশ্বাস ও অকৃতজ্ঞতা) করা এবং আল মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দেয়া এবং সেটার যথোপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে তা থেকে বহিষ্কার করা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় গুনাহ। আর ফিতনা (ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ এবং ভিন্ন জীবনব্যবস্থা অবলম্বনের কারণে নির্যাতন) হত্যার চেয়েও গুরুতর গুনাহ। আর তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে থামবে না, যতক্ষণ না তারা তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) থেকে ফিরিয়ে দেয়, যদি তাদের সাধ্যে কুলায়। আর তোমাদের মধ্য থেকে যে তার দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) থেকে ফিরে যাবে তারপর কাফির (সত্য প্রত্যাখ্যানকারী) অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করবে, তারাই এমন লোক যাদের আমলসমূহ দুনিয়াতে ও আখিরাতে বরবাদ হয়ে যাবে। আর তারাই (দোযখের) আগুনে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। তারা তাতে স্থায়ী হবে।

৫:২১ :: হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা পবিত্র ভূখণ্ডটিতে প্রবেশ করো যা আল্লাহ তোমাদের জন্য লিখে দিয়েছেন। এবং তোমরা তোমাদের পেছনের দিকে ফিরে যেও না, তাহলে তোমরা তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে।

৫:৫৪ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের মধ্য থেকে যে তার দ্বীন-ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, তবে শীঘ্রই আল্লাহ এমন জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আসবেন যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারাও তাঁকে ভালবাসবে, তারা হবে মু’মিনদের প্রতি কোমল এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর, তারা আল্লাহর পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করবে এবং (এর উপর) কোনো নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না। উহা আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা করেন তাকে তা দান করেন। আর আল্লাহ সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ।

৪৭:২৫ :: নিশ্চয় যারা তাদের কাছে হিদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পরেও তাদের পেছনের দিকে ফিরে যায়, শয়তান তাদের জন্য তাদের কাজকে শোভন করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দিয়ে থাকে।

[খ] সাধারণ অর্থে (ফিরে যাওয়া, ফিরে পাওয়া, ফিরিয়ে দেয়া, রদ করা ইত্যাদি অর্থে) ব্যবহার

২:২২৮ :: তালাকপ্রাপ্তা নারীরা তিন কুরু (অর্থাৎ তিনটি পূর্ণ সময়ান্ত হায়েজ) পর্যন্ত প্রতীক্ষা করবে। আর যদি তারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে তাহলে আল্লাহ তাদের গর্ভে যা সৃষ্টি করেছেন তা গোপন করা তাদের পক্ষে বৈধ নয়। তাদের স্বামীরা যদি সংশোধনের ইচ্ছা করে তাহলে তারা উক্ত সময়ের মধ্যে তাদেরকে দাম্পত্য সম্পর্কে ফিরিয়ে নেয়ার অধিক হকদার। আর নারীদের অধিকার রয়েছে যেমন তাদের উপর পুরুষদের অধিকার রয়েছে। আর নারীদের উপর পুরুষদের (অধিকার ও পদমর্যাদাগত) উচ্চমান রয়েছে। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান ও মহাবিজ্ঞ।

২১:৪০ :: বরং তা (ক্বিয়ামাতের শাস্তি) তাদের কাছে পৌঁছবে আকস্মিকভাবে এবং তাদেরকে হতবুদ্ধি করে দেবে, তারপর তারা তা ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হবে না এবং তাদেরকে অবকাশ দেয়া হবে না।

১৩:১১ :: তার জন্য (মানুষের জন্য) তার সামনে ও পেছনে ক্রমাগত প্রহরী (ফেরেশতারা) রয়েছে, তারা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী তার সংরক্ষণ করে। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো জনগোষ্ঠীর অবস্থার পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে। আর যখন আল্লাহ কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য মন্দ শাস্তির ইচ্ছা করেন সেটার কোনো রদকরণ হতে পারে না। আর তিনি ছাড়া তাদের জন্য কোনো অভিভাবক নেই।

১৯:৭৬ :: আর যারা হিদায়াত গ্রহণ করে আল্লাহ তাদের হিদায়াত বাড়িয়ে দেন। আর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবসম্পন্ন সৎকর্মসমূহ তোমার প্রভুর নিকট প্রতিদানের দিক থেকেও উত্তম এবং প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গেও উত্তম।

৩০:৪৩ :: সুতরাং তোমার সত্তাকে প্রতিষ্ঠা করো সুপ্রতিষ্ঠিত জীবনব্যবস্থার জন্য সেই দিন আসার আগে আল্লাহর পক্ষ থেকে যার কোনো রদকরণ নেই। সেদিন তারা বিভক্ত হয়ে যাবে।

৪০:৪৩ :: কোনো সন্দেহ নেই যে, তোমরা আমাকে তার দিকে আহবান করছো যার জন্য কোনো আহবান হতে পারে না, না দুনিয়াতে আর না আখিরাতে। আর নিশ্চয় আমাদের প্রত্যাবর্তন আল্লাহর দিকে আর নিশ্চয় অপব্যয়কারী ও সীমালঙ্ঘনকারীরা জাহান্নামের অধিবাসী।

৪২:৪৪ :: আর যাকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য তাঁর পরে কোনো অভিভাবক নেই। আর তুমি যালিমদেরকে দেখবে যখন তারা শাস্তি দেখবে তখন তারা বলবে, “প্রত্যাবর্তনের কোনো পথ আছে কি?”

৪২:৪৭ :: সাড়া দাও তোমাদের প্রভুর জন্য সেই দিন আসার আগে আল্লাহর পক্ষ থেকে যার কোনো রদকরণ নেই। তোমাদের জন্য সেদিন কোনো আশ্রয়স্থলও থাকবে না এবং কোনো প্রতিরোধকারীও থাকবে না।

১০:১০৭ :: আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোনো ক্ষতির স্পর্শ করান তাহলে তিনি ছাড়া কেউ তার প্রতিরোধকারী নেই আর যদি তিনি তোমাকে কোনো কল্যাণ দান করতে চান তাহলে তাঁর অনুগ্রহের রদকারী কেউ নেই। তিনি তাঁর বান্দাহদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তা পৌঁছান। আর তিনি ক্ষমাশীল দয়ালু।

১৬:৭১ :: আল্লাহ জীবিকা উপার্জনে কারো চেয়ে কতককে অন্য কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। তারপর যাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে তারা তাদের জীবিকা থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে দেয় না যাদেরকে তাদের ডানহাত অধিকৃত করেছে (অর্থাৎ যারা তাদের অধীনস্থ) যেন তারা তাতে তাদের সমান হয়ে না যায়। তবে কি তারা আল্লাহর অনুগ্রহকে অস্বীকার করছে?

২৮:৭ :: আর আমি মূসার মায়ের নিকট ওহী করলাম যে, তাকে (মূসাকে) দুধপান করাও। তারপর যখন তার বিষয়ে আশংকা করবে তখন তাকে নদীটিতে ভাসিয়ে দাও এবং ভয় পেয়ো না ও দুঃখবোধ করো না। নিশ্চয় আমি তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে রসূলগণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করবো।

২৮:৮৫ :: নিশ্চয় যিনি তোমার উপর কুরআনকে ফরজ করেছেন তিনি তোমাকে প্রত্যাবর্তনস্থলে ফিরিয়ে দেবেন। বলো, “আমার প্রভু সর্বাধিক জানেন কে হিদায়াতসহ এসেছে এবং কে স্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে রয়েছে”।

১১:৭৬ :: হে ইবরাহীম, তুমি এ থেকে নিবৃত্ত হও। নিশ্চয় তোমার প্রভুর আদেশ এসে গেছে এবং নিশ্চয় তাদের উপর এমন শাস্তি আসছে যা রদ হবার নয়।

৭৯:১০ :: তারা বলে, “(মৃত্যুর পরে আবার) আমাদেরকে কি নিশ্চয় পূর্বাবস্থায় (পুনর্জীবনে) ফিরিয়ে নেয়া হবে?”

২:৮৫ :: তারপর তোমরাই তো তারা যারা নিজেদের লোকদেরকে হত্যা করছে এবং তোমাদের কোনো দলকে পাপ ও সীমালঙ্ঘনের সাথে তাদের বিরুদ্ধে পরস্পরকে সহযোগিতা করে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে আর যদি তারা তোমাদের সামনে বন্দী অবস্থায় আসে, তখন তোমরা তাদেরকে মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করে থাক। অথচ তাদেরকে বের করে দেয়াই তোমাদের জন্য হারাম ছিল। তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু বিষয়ে ঈমান রাখ এবং কিছু বিষয়ে কুফর করো? সুতরাং তোমাদের মধ্য থেকে যে এরূপ করে তার প্রতিফল কী হতে পারে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া? আর ক্বিয়ামাত দিবসে তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হবে কঠিন শাস্তির দিকে। আর তোমরা যা করো আল্লাহ সে বিষয়ে অসচেতন নন।

৪:৪৭ :: হে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল, তোমরা সেই কিতাবের প্রতিও ঈমান আনো যা আমরা নাজিল করেছি তোমাদের কাছে যে কিতাব আছে তার সত্যতা প্রতিপাদন করে চেহারাহসমূহকে বিকৃত করে পেছনের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার আগে অথবা সাবতের বিধান লঙ্ঘনকারীদের যেভাবে লা’ত দেয়া হয়েছে সেরূপভাবে তোমাদেরকে লা’নত করার আগে। আর আল্লাহর আদেশ নিশ্চিতভাবেই কার্যকরী হয়ে থাকে।

৪:৫৯ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রসূলের ও তোমাদের মধ্য থেকে ‘উলিল আমরের’। তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে মতবিরোধ করো তখন তা আল্লাহর দিকে ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দিবে, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখো। উহাই (নীতি হিসেবেও) উত্তম এবং পরিণতির দিক থেকেও শ্রেষ্ঠ।

৪:৮৩ :: আর যখন তাদের কাছে কোনো নিরাপত্তার বা ভয়ের বিষয় আসে, তখন তারা তা প্রচার করতে থাকে। অথচ যদি তারা তা ফিরিয়ে দিতো রসূলের দিকে ও তাদের মধ্য থেকে উলিল আমরের দিকে, তাহলে তা জানতে পারতো যারা তাদের মধ্য থেকে তা ইস্তিম্বাত (তদন্ত ও পর্যালোচনার মাধ্যমে সঠিক সমাধান নির্ণয়) করতে পারতো। আর যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না হতো তাহলে তোমরা শয়তানের অনুসরণ করতে, অল্পসংখ্যক ব্যতীত।

৪:৮৬ :: আর যখন তোমাদেরকে শুভেচ্ছা জানানো হয় তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তমভাবে শুভেচ্ছা জানাবে অথবা সেরূপই ফিরিয়ে দিবে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে হিসাব গ্রহণ করবেন।

৫:১০৮ :: এ পদ্ধতিই (এ সম্ভাবনার) নিকটতম যে, তারা সঠিক রূপেই সাক্ষ্য দেবে অথবা তারা ভয় করবে যে, তাদের (ওয়াসিয়্যাত সম্পর্কে পরবর্তীতে শপথকারীদের) শপথের পরে তাদের (পূর্ববর্তীতে শপথকারীদের) শপথকে রদ করা হবে। আর তোমরা আল্লাহ সচেতন হও এবং (যথানিয়মে) শুনো। আর নিশ্চয় আল্লাহ নীতি বিচ্যুত জনগোষ্ঠীকে পথনির্দেশ করেন না।

৬:২৭ :: আর যদি তুমি দেখতে যখন তাদেরকে (জাহান্নামের) আগুনের সামনে আটকানো হবে, তখন তারা বলবে, হায়! যদি আমাদেরকে (পার্থিব জীবনে) ফিরিয়ে দেয়া হতো তাহলে আমরা আমাদের প্রভুর আয়াতকে মিথ্যা সাব্যস্ত করতাম না এবং আমরা মু’মিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম!

৬:২৮ :: বরং তারা পূর্বে যা গোপন করতো এখন তা তাদের নিকট প্রকাশ করা হয়েছে। যদি তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হতো তাহলে তাদেরকে যা করতে নিষেধ করা হয়েছে তারা সেটারই পুনরাবৃত্তি করতো আর নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।

৬:৬২ :: তারপর তাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে, যিনি তাদের প্রকৃত মাওলা (অভিভাবক)। হুকুম তাঁরই এবং তিনি সর্বাপেক্ষা দ্রুত হিসাবকারী।

৬:১৪৭ :: সুতরাং যদি তারা তোমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে তাহলে বলো, “তোমাদের প্রভু সর্বব্যাপী দয়ার অধিকারী অথচ অপরাধী জনগোষ্ঠী থেকে তাঁর শাস্তিকে ফিরিয়ে দেয়া যায় না”।

৭:৫৩ :: তারা কি এতে বিবৃত পরিণতির অপেক্ষা করছে? যেদিন এতে বিবৃত পরিণতি আসবে, যারা পূর্বে তা ভুলে ছিলো তারা বলবে, “নিশ্চয় আামদের প্রভুর রসূলগণ সত্য নিয়ে এসেছিলেন। সুতরাং আমাদের জন্য শাফায়াতকারীগণ আছে কি, যারা আমাদের জন্য শাফায়াত করবে? অথবা আমাদেরকে কি (পার্থিব জীবনে) ফিরিয়ে দেয়া হবে, যাতে আমরা যা করেছিলাম তার চেয়ে ভিন্নরূপ করতে পারি?” নিশ্চয় তারা নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং তারা যা রচনা করতো তা তাদের থেকে উধাও হয়ে যাবে।

৯:৯৪ :: তারা তোমাদের কাছে ওজর পেশ করবে যখন তোমরা তাদের কাছে ফিরে আসবে। বলো, “তোমরা ওজর পেশ করো না, আমরা কখনো তোমাদেরকে বিশ্বাস করবো না। নিশ্চয় আল্লাহ আমাদেরকে তোমাদের খবর জানিয়ে দিয়েছেন। আর শীঘ্রই আল্লাহ এবং তাঁর রসূল তোমাদের আমল দেখবেন। তারপর তোমাদেরকে অদৃশ্য ও দৃশ্যের সর্বজ্ঞ সত্তার কাছে ফিরিয়ে নেয়া হবে। তখন তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবেন, যা কিছু তোমরা করতে”।

৯:১০১ :: আর আ’রাবের (অনগরীদের) মধ্য থেকে এবং আহলে মদীনার (নগরীয়দের) মধ্য থেকে মুনাফিক রয়েছে। তারা মুনাফিক্বীতে নাছোড়বান্দা। তোমরা তাদেরকে জানো না। আমরা তাদেরকে জানি। শীঘ্রই আমরা তাদেরকে দুবার শাস্তি দেবো। তারপর তাদেরকে মহাশাস্তির দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।

৯:১০৫ :: আর বলো, “তোমরা কাজ করো। শীঘ্রই আল্লাহ ও রসূল ও মু’মিনগণ তোমাদের আমল দেখবেন। আর শীঘ্রই তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে অদৃশ্য ও দৃশ্যের সর্বজ্ঞ সত্তার কাছে। তখন তিনি তোমাদের তোমাদের জানিয়ে দেবেন, যা কিছু তোমরা করতে।

১০:৩০ :: সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি তার পূর্বকৃত কর্মকাণ্ড পরীক্ষা করে নেবে এবং তাদেরকে আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে নেয়া হবে, যিনি তাদের প্রকৃত মাওলা (অভিভাবক)। আর তাদের থেকে উধাও হয়ে যাবে, যা তারা রচনা করতো।

১২:৬৫ :: আর যখন তারা (নবী ইউসুফের ভাইয়েরা) তাদের জিনিসপাতি খুললো, তারা পেলো তাদের পণ্যমূল্য তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা বললো, “হে আমাদের পিতা! আমরা আর কী অনুসন্ধান করতে পারি! এই আমাদের পণ্যমূল্য! আমাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে! আর আমরা আমাদের পরিবারের জন্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে আসবো এবং আমরা আমাদের ভাইয়ের হেফাযত করবো এবং আমরা এক উট বোঝাই পণ্য বাড়িয়ে নেবো। ঐ পরিমাণ পাওয়া সহজ হবে।

১২:১১০ :: শেষপর্যন্ত যখন রসূলগণ হতাশ হলো এবং তারা (লোকেরা) ধারণা করলো যে, নিশ্চয় তাদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়া হয়েছে, তখন তাদের কাছে (রসূলদের কাছে) আমাদের সাহায্য এসেছে, তখন তাদেরকে নাজাত দেয়া হয়েছে যাদেরকে আমরা ইচ্ছা করেছি। আর অপরাধী জনগোষ্ঠী থেকে আমাদের শাস্তিকে ফিরিয়ে নেয়া হয় না।

১৪:৯ :: পূর্বে যারা ছিল তাদের সংবাদ কি তোমাদের কাছে পৌঁছে নি? নূহের সম্প্রদায়, আদ, সামূদ এবং যারা তাদের পরের, যাদেরকে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তাদের কাছে তাদের জন্য প্রেরিত রসূলগণ এসেছিল, তখন তারা তাদের হাত তাদের মুখে ফিরিয়ে দিতো এবং বলতো, “তোমরা যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছো আমরা তার প্রতি কুফর (অবিশ্বাস-অস্বীকার) করি এবং তোমরা আমাদেরকে যেদিকে ডাকছো আমরা সে বিষয়ে বিভ্রান্তিকর সন্দেহের মধ্যে রয়েছি”।

১৬:৭০ :: আর আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তারপর তোমাদেরকে ওফাত (মৃত্যু) দেন। আর তোমাদের মধ্যে রয়েছে যাকে ফিরিয়ে দেয়া হয় শোচনীয় বয়সে, যখন জানার পরেও কিছু জানে না (জানা বিষয়ও অজানাতে পরিণত হয়)। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।

১৭:৬ :: তারপর আমরা তোমাদের জন্য তাদের উপর (বিজয়ের) পালা ফিরিয়ে দিলাম এবং তোমাদেরকে মালসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে সাহায্য করলাম এবং তোমাদেরকে জনশক্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ করলাম।

১৮:৩৬ :: (সম্পদশালী লোকটি আরো বললো), “আর আমি কিয়ামাত প্রতিষ্ঠিত হবে বলে মনে করি না আর যদি আমাকে আমার প্রভুর দিকে ফিরিয়ে দেয়া হয় তাহলেও আমি নিশ্চয় উহার চেয়ে (আমার বর্তমান অবস্থানের চেয়ে) শ্রেষ্ঠ প্রত্যাবর্তনস্থলই পাবো”।

১৮:৮৭ :: সে (জুলকারনাইন) বললো, “যে জুলুম করবে আমি তাকে শাস্তি দেবো, তারপর তাকে ফিরিয়ে নেয়া হবে তার প্রভুর দিকে, তখন তিনি তাকে অপ্রীতিকর শাস্তি দিবেন”।

২২:৫ :: হে মানুষ, পুনরুত্থান সম্বন্ধে যদি তোমরা সন্দেহ পোষণ কর তবে (ভেবে দেখ) আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে। তারপর ফোঁটা আকৃতির বস্তু থেকে। তারপর কোনো স্থান থেকে ঝুলে থাকা সদৃশ বস্তু থেকে। (এ তথ্য জানানো হলো) তোমাদের নিকট (পুনরুত্থানের সম্ভবপরতা) স্পষ্ট করার জন্য। আর আমি আমার ইচ্ছানুসারে (তোমাদেরকে) মাতৃগর্ভে (ভ্রুণ আকারে) স্থির রাখি এক নির্দিষ্ট আজাল/(গর্ভে থাকার) সময়সীমা পর্যন্ত। তারপর আমি তোমাদেরকে বের করি শিশুরূপে। তারপর (আমি তা করি) তোমরা তোমাদের যৌবনে উপনীত হওয়ার জন্য। আর তোমাদের মধ্য থেকে কারো ওফাত ঘটানো হয় এবং কাউকে ফিরিয়ে দেয়া হয় শোচনীয় বয়সে (বার্ধক্যে), যখন (মস্তিষ্কের স্মরণশক্তি বিষয়ক কোষগুলো দুর্বল হয়ে) অনেক কিছু জানার পরও তারা তা ভুলে যায়। আর তুমি ভূমিকে দেখ শুষ্ক, তারপর যখন আমরা তাতে পানি বর্ষণ করি, তখন তা আন্দোলিত ও স্ফীত হয় এবং সকল প্রকার সুদৃশ্য উদ্ভিদ উদগত করে।

২৮:১৩ :: তারপর আমরা তাকে (মূসাকে) তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলাম, যেন তার চোখ জুড়িয়ে যায় এবং যেন সে দুঃখবোধ না করে এবং যেন সে জানতে পারে যে, নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য কিন্তু তাদের (মানুষদের) অধিকাংশই জ্ঞানার্জন করে না।

৩৩:২৫ :: আর আল্লাহ তাদেরকে তাদের আক্রোশসহ ফিরিয়ে দিলেন যারা কুফর করেছে। তারা কোনো কল্যাণ লাভ করে নি। যুদ্ধে মু’মিনদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আর আল্লাহ সর্বশক্তিমান, পরাক্রমশালী।

৩৮:৩৩ :: (সুলাইমান বললো), “সেগুলোকে (ঘোড়াগুলোকে) আমার কাছে ফিরিয়ে আনো”। তারপর সে সেগুলোর গোছায় ও গলদেশে হাত বুলাতে লাগলো।

৪১:৪৭ :: তাঁরই দিকে (আল্লাহরই দিকে) ফিরিয়ে দেয়া হয় ক্বিয়ামাতের জ্ঞান (অর্থাৎ ক্বিয়ামাত কবে হবে তা শুধু আল্লাহর জানা)। তাঁর অজ্ঞাতসারে কোনো ফলই তার আবরণ থেকে বেরিয়ে আসে না এবং কোনো নারী গর্ভধারণ করে না এবং প্রসবও করে না। আর সেদিন তিনি তাদেরকে ডেকে বলবেন, “আমার শরিকরা কোথায়?” তারা বলবে, “আমরা আপনার কাছে ঘোষণা করছি যে, (আপনার শরিক রয়েছে মর্মে) আমাদের মধ্য থেকে কোনো সাক্ষী নেই”।

২:৮ :: বলো, “নিশ্চয় তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়ন করছো তা তোমাদের সাথে সাক্ষাত করবেই। তারপর তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে অদৃশ্য ও দৃশ্যের সর্বজ্ঞ সত্তার কাছে। তখন তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবেন যা কিছু তোমরা করতে।

৯৫:৫ :: তারপর আমরা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি হীনদের হীনতমে।

১২:৯৬ :: তারপর যখন সুসংবাদদাতা এলো, তখন সে তা (ইউসুফের জামাটি) তার (ইয়াকুবের) চেহারার সামনে রাখলো, তখন সে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলো। সে বললো, “আমি কি তোমাদেরকে বলি নি যে, আমি আল্লাহর নিকট থেকে জানি যা তোমরা জানো না?”।

১৪:৪৩ :: তারা মাথা তুলে (ভীতি-বিহবল হয়ে) ছুটতে থাকবে, তাদের পলক নিজেদের দিকে ফিরে আসবে না এবং তাদের অন্তর উড়ে যাবে (উদাস হয়ে পড়বে)।

১৮:৬৪ :: সে (মূসা) বললো, “উহাই সেই স্থান যা আমরা অনুসন্ধান করছি”। সুতরাং তারা তাদের উভয়ের পদচিহ্ন অনুসরণ করে পিছনে ফিরে গেলো।

২৭:৪০ :: যার কাছে কিতাবের জ্ঞান ছিলো সে বললো, “আমি আপনার চোখের পলক আপনার দিকে ফিরে আসার আগেই তা (সাবার রানীর সিংহাসন) আপনার কাছে নিয়ে আসছি”। তারপর যখন সে (সুলাইমান) তার কাছে প্রতিস্থাপিত দেখলো, তখন সে বললো, “এটা আমার প্রভুর অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন যে, আমি কি কৃতজ্ঞ হই না অকৃতজ্ঞ হই। আর যে কৃতজ্ঞ হয় তবে নিশ্চয় সে কৃতজ্ঞ হয় তার নিজেরই কল্যাণের জন্য এবং যে অকৃতজ্ঞ হয় তবে (তার জানা উচিত যে,) নিশ্চয় সে আমার প্রভু অভাবমুক্ত, সুমহৎ মর্যাদাবান।

ইলহাদ প্রসঙ্গ

ইলহাদ বা ব্লাসফেমি: ইলহাদ শব্দের মূল অক্ষরসমূহ হলো ‘লাম হা দাল’। এ মূল অক্ষরসমূহ থেকে গঠিত ‘ইলহাদ’ শব্দটি দুটি শব্দরূপে (ক্রিয়াবিশেষ্য ও ক্রিয়া) কুরআনের যেসব স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে তা নিম্নরূপ:

১. ইলহাদ (ক্রিয়াবিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ৪, অর্থ: বিকৃতি ঘটানো) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ২২:২৫:২০।

২. ইউলহিদূনা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪, অর্থ: বিকৃতি ঘটায়, অসত্য দাবি করে) ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ৭:১৮০:৮, ১৬:১০৩:১০, ৪১:৪০:৩।

এছাড়া, ‘লাম হা দাল’ মূল অক্ষরসমূহ থেকে গঠিত অন্য একটি শব্দ ‘মুলতাহাদ’ (আশ্রয়স্থল) শব্দটি দুটি স্থানে (১৮:২৭:১৫ ও ৭২:২২:১২) ব্যবহৃত হয়েছে, তবে তা ‘ইলহাদ’ এর সাথে সম্পর্কিত নয়।
নিম্নে ইলহাদ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হলো (এবং ইলহাদ শব্দের অর্থের অংশটুকুকে আন্ডারলাইন করা হলো):

২২:২৫ :: নিশ্চয় যারা কুফর (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান) করেছে এবং আল্লাহর পথ থেকে বাধা দেয় এবং আল মাসজিদুল হারাম থেকেও বাধা দেয়, যেটাকে আমি সেটার ক্ষেত্রে আত্মনিয়োজিত স্থানীয়দের জন্য (স্থানীয়ভাবে বসবাসরত কর্মচারী প্রশাসনের জন্য) এবং সেটাতে গমনাগমনকারী অস্থানীয়দের জন্য (প্রবেশাধিকার, নিরাপত্তা বিধান ও বরকত বণ্টন বিষয়ে) সমান করেছি, এবং যে তাতে বিকৃতি ঘটাতে ও জুলুম করতে ইচ্ছা করে আমি তাকে কষ্টদায়ক শাস্তির (অর্থাৎ জাহান্নামের) স্বাদ আস্বাদন করাবো।

৭:১৮০ :: আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সুন্দর নামসমূহ (আসমাউল হুসনা), সুতরাং সেসব নামে তাঁকে ডাকো / তাঁর কাছে দোয়া করো। আর তাদেরকে পরিহার করো যারা তাঁর নামসমূহের বিষয়ে বিকৃতি ঘটায়। শীঘ্রই তাদেরকে তার প্রতিফল দেয়া হবে যা তারা করতো।১৬:১০৩ :: আর নিশ্চয় আমরা জানি যে, তারা বলে, “বস্তুত তাকে জনৈক লোক শিখিয়ে দেয়”। তারা যার দিকে ইঙ্গিত করে অসত্য দাবি করে তার ভাষা তো অনারবীয় অথচ ইহা (কুরআন) সুস্পষ্ট আরবী ভাষা।

৪১:৪০ :: নিশ্চয় যারা আমাদের আয়াতসমূহের বিষয়ে বিকৃতি ঘটায়, তারা আমাদের কাছে গোপন নয়। তবে যাকে (জাহান্নামের) আগুনে নিক্ষেপ করা হবে সে উত্তম নাকি ক্বিয়ামাতের দিন যাকে নিরাপদ রাখা হবে সে? তোমরা যা ইচ্ছা করো, নিশ্চয় তিনি তোমরা যা করো তার সম্যক দ্রষ্টা।

তাহরীফ প্রসঙ্গ

তাহরীফ প্রসঙ্গে ৪ স্থানে ‘ইউহাররিফূনা’ (তারা তাহরীফ করে) শব্দটি এসেছে, যথা: ২:৭৫:১৩, ৪:৪৬:৪, ৫:১৩:৮, ৫:৪১:২৭।

এছাড়া তাহরীফ বা আল্লাহর কিতাবের তথ্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা এবং যা কিতাবের তথ্য নয় সেটাকে কিতাবের তথ্য হিসেবে চালিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস প্রসঙ্গে কুরআনে বক্তব্য রয়েছে। এছাড়া মিথ্যাভাবে ওহীর দাবি করা বা মিথ্যা নবুয়াত দাবিকে এবং আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপকে সবচেয়ে বড় জুলুম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

নিম্নে তাহরীফ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হলো (এবং তাহরীফ শব্দের অর্থের অংশটুকুকে আন্ডারলাইন করা হলো):

২:৭৫ :: তোমরা কি মনে করো যে, তারা তোমাদের আহবানে ঈমান আনবে? অথচ নিশ্চয় তাদের একদল আল্লাহর বাণী শুনে, তারপর তা বুঝার পরেও তা (কিতাবের তথ্য) বিকৃত করে অথচ তারা (কিতাবের সঠিক তথ্য ও তাদের বিকৃতি সম্পর্কে) জানে।

৪:৪৬ :: যারা ইয়াহুদ হয়েছে তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ আল্লাহর কালিমাকে তার স্বস্থান (যথার্থ তাৎপর্য) থেকে বিচ্যুত (বিকৃত) করে। আর তারা তাদের জিহবা কুঞ্চিত করে (শব্দ নিয়ে খেলা করে) ও দীনকে তাচ্ছিল্য করে (খোঁচা মেরে) বলে, ‘আমরা শুনলাম ও অমান্য করলাম এবং শুনো, শ্রুতিহীন হয়ে এবং আমাদের রাখাল হও!” অথচ যদি তারা তারা বলতো ‘আমরা শুনলাম ও মানলাম এবং শুন এবং আমাদের দিকে লক্ষ্য করো”, তাহলে তা তাদের জন্য উত্তম ও কল্যাণকর এবং সুসঙ্গত হতো। কিন্তু আল্লাহ তাদের কুফরের কারণে তাদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন সুতরাং তারা ঈমান আনবে না, অল্পসংখ্যক ছাড়া।

৫:১৩ :: তারপর তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে আমরা তাদেরকে অভিশাপ দিয়েছি এবং তাদের অন্তরসমূহকে শক্ত করে দিয়েছি। তারা কালিমাকে তার স্বস্থান (যথার্থ তাৎপর্য) থেকে বিচ্যুত (বিকৃত) করে। আর তাদেরকে যা দিয়ে (যেসব আয়াতের মাধ্যমে) উপদেশ দেয়া হয়েছিল তারা তার কিছু অংশ ভুলে গিয়েছে। আর তুমি তাদের পক্ষ থেকে খেয়ানত ঘটার প্রমাণ পেতে থাকবে, তাদের অল্পসংখ্যকের ক্ষেত্রে ছাড়া। সুতরাং তাদেরকে মার্জনা করো এবং উপেক্ষা করো। নিশ্চয় আল্লাহ উত্তম আচরণকারীদেরকেই ভালবাসেন।

৫:৪১ :: হে রসূল তোমাকে যেন দুঃখ না দেয় (তাদের কার্যকলাপ ও অপকৌশল) যারা কুফরের দিকে দ্রুত ধাবিত হয়, যারা মুখে বলে আমরা ঈমান এনেছি অথচ তাদের অন্তর ঈমান আনেনি, এবং যারা ইয়াহুদ হয়েছে- যারা মিথ্যা শুনতে অভ্যস্ত (মিথ্যাবাদীদের মিথ্যা কথার প্রতি আকর্ষিত, যাচাই ছাড়াই সেটা গ্রহণ করে নেয়), যারা তোমার নিকট আসে না এমন একদলের (তাদের ধর্মীয় আলেমদের) পক্ষ থেকে ছাড়া যারা (নিজেরা) তোমার কাছে আসে না, যারা কান পেতে থাকে (রসূল কখন কোন কথা বলেন তা শুনে তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার জন্য) এবং যারা কালিমাকে যথাস্থানে (যথার্থ তাৎপর্যসহ) সংস্থাপিত করার পরেও তার বিচ্যুতি (তাৎপর্যগত বিকৃতি) ঘটায়। তারা বলে, “এই ধরনের তথ্য/বিধান দিলে তা গ্রহণ করো এবং এই ধরনের তথ্য/বিধান না দিলে তা বর্জন করো”। বস্তুত আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট রাখতে চান তার জন্য তুমি আল্লাহর নিকট কিছুই করার নেই। আল্লাহ তাদের অন্তরকে পবিত্র করতে চান না এবং তাদের জন্য আছে দুনিয়ায় লাঞ্চনা এবং আখিরাতে তাদের জন্য আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

ধর্ম বিষয়ক বিকৃতি সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য

৩:৭৮ আয়াতে কিতাবের তাহরীফ করার একটি পদ্ধতি হিসেবে যা কিতাবের অংশ নয়, সেটাকে কিতাবের অংশের মতো করে পাঠ করার প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতটি নিম্নরূপ:

৩:৭৮ :: তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা নিজদের জিহবা দ্বারা বিকৃত করে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা সেটা কিতাবের অংশ মনে কর, অথচ সেটি কিতাবের অংশ নয়। তারা বলে, ‘এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে’, অথচ তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়। আর তারা আল্লাহর উপর মিথ্যা বলে, অথচ তারা জানে।

২:৭৯ আয়াত থেকে জানা যায় যে, ধর্মগ্রন্থের ক্ষেত্রে কেউ কেউ ধর্মগ্রন্থের মধ্যে নিজের থেকে কিছু লিখে দিয়ে সেটাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বলে উল্লেখ করতো বা নিজে থেকে কোনো ধর্মগ্রন্থ রচনা করে সেটাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে উল্লেখ করে। আয়াতটি নিম্নরূপ:

২:৭৯ :: সুতরাং তাদের জন্য দুর্ভোগ যারা নিজ হাতে কিতাব লেখে তারপর বলে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে, যেন তার বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য ক্রয় করতে পারে। তাদের হাত যা লিখেছে সেজন্য তাদের দুর্ভোগ এবং তারা যা (যে পাপ) উপার্জন করেছে সেজন্য তাদের দুর্ভোগ।

ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিকৃত তথ্যের অন্যতম দিক হলো মিথ্যা ওহীর দাবি করা এবং আল্লাহর নামে মিথ্যা রচনা করা। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতটি লক্ষণীয়:

৬:৯৩ :: তার চেয়ে বড় জালিম কে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে অথবা বলে, “আমার উপর ওয়াহী এসেছে” অথচ সত্য কথা হচ্ছে তার উপর কোনো ওয়াহী আসে নি; এবং যে বলে, “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন শীঘ্রই আমিও অনুরূপ জিনিস নাযিল (রচনা) করবো।”? (তুমি তাদের পরিণতি অনুভব করতে) যদি তুমি দেখতে পারতে (ঐ অবস্থা-) যখন এমন জালিমেরা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরায় এবং ফেরেশতারা হাত বাড়িয়ে বলে, “তোমাদের প্রাণগুলো বের করে দাও। আজ তোমাদেরকে অপমানজনক শাস্তি দেয়া হবে। তোমরা সত্যতা/ সঠিক তথ্য ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে যা (যে মিথ্যা) বলেছো তার কারণে এবং তাঁর আয়াতের মোকাবেলায় ঔদ্ধত্য করার কারণে।”

ধর্ম বিষয়ে বিকৃতির অন্যতম কারণ হলো প্রকৃত তথ্য গোপন করা, তাই আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের কোনো তথ্য গোপনকারীর জন্য আখিরাতে কঠিন শাস্তি রয়েছে এবং তাদের উপর আল্লাহর ও অভিশাপকারীদের অভিশাপ। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

২:১৫৯-১৬০ :: নিশ্চয় যারা আল্লাহ স্পষ্ট যৌক্তিক প্রমাণ ও পথনির্দেশ থেকে যা নাযিল করেছেন তা মানবজাতির জন্য কিতাবের মধ্যে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা সত্ত্বেও গোপন রাখে, তারাই এমন লোক যাদেরকে আল্লাহ অভিশাপ দেন এবং অভিশাপকারীগণও অভিশাপ দেয়। তারা ছাড়া যারা তাওবাহ করে এবং (নিজেদের কাজকে) সংশোধন করে নেয় এবং (পূর্বে গোপন করা তথ্যকে) স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দেয়, তারাই এমন লোক আমি যাদের তাওবাহ কবুল করি। আর আমি তাওবাহ কবুলকারী দয়ালু।

২:১৭৪-১৭৬ :: নিশ্চয় যারা তা গোপন রাখে আল্লাহ তাঁর কিতাব থেকে যা নাজিল করেছেন এবং বিনিময়ে তুচ্ছমূল্য ক্রয় করে, তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া কিছু ভক্ষণ করে না এবং আল্লাহ ক্বিয়ামাতের দিন তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না এবং তাদের জন্য আছে কষ্টদায়ক শাস্তি। তারাই এমন লোক যারা হিদায়াতের পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা গ্রহণ করেছে এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি। সুতরাং আগুনের উপর তাদের কতই না ধৈর্য! তা এ কারণে যে, নিশ্চয় আল্লাহ সত্য সহকারে/ যথাযথভাবে কিতাব নাজিল করেছেন এবং নিশ্চয় যারা কিতাবের মধ্যকার বিষয়ে ইখতিলাফ করেছে তারা বিবাদে লিপ্ত হয়ে বহুদূর চলে গেছে।

ইখতিলাফ বা মতভেদের মাধ্যমে ধর্ম বিষয়ক বিকৃতি তৈরি হয়। যুগে যুগে মতভেদের জবাবে বা মতভেদ নিরসনের জন্য নবীদের কাছে কিতাব পাঠানো হয়েছে, কিন্তু কিতাবের মাধ্যমে সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরও আবার জিদবশত মতভেদ করা হয়। কিতাবের মাধ্যমে তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত হয়, যারা সঠিকভাবে তাতে ঈমান রাখে। সর্বোপরি জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ ক্বিয়ামাতের দিন যাবতীয় মতভেদের চূড়ান্ত ফায়সালা করে দিবেন। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

২:১১৩ :: আর ইহুদিরা বলে, “খ্রিস্টানরা সঠিক কোনো কিছুর উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।” আর খ্রিস্টানরা বলে, “ইহুদিরা সঠিক কোনো কিছুর উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।” অথচ তারা (ইহুদিরা ও খ্রিস্টানরা) কিতাব অধ্যয়ন করে। এভাবে যারা কোনো জ্ঞান রাখে না তারাও তাদের বক্তব্যের মতোই বলে। তারপর আল্লাহ ক্বিয়ামাতের দিন তাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেবেন যেসব বিষয়ে তারা মতভেদ করে।

২:২১৩ :: মানবজাতি ছিল একই উম্মাহ। তারপর (তারা মতভেদ করলে) আল্লাহ নবীদেরকে প্রেরণ করলেন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে এবং তাদের সাথে সত্য সহকারে/ যথাযথভাবে কিতাব নাজিল করলেন যেন তিনি মানবজাতির মধ্যে সেই বিষয়ে মীমাংসা করে দেন যেসব বিষয়ে তারা মতভেদ করেছিলো। অথচ যাদেরকে তা (কিতাব) দেয়া হয়েছিল তারা এরপরও যখন তাদের কাছে সুস্পষ্ট যৌক্তিক প্রমাণ এসেছিলো তারা মতভেদ করেনি পারস্পরিক জিদবশত (মতভেদ করা) ছাড়া। তারপর তারা সত্য থেকে যেসব বিষয়ে মতভেদ করেছিলো সে বিষয়ে আল্লাহ তাঁর অনুমতিক্রমে তাদেরকে হিদায়াত দেন (সঠিক পথনির্দেশ করেন) যারা (আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাবের প্রতি যথাযথভাবে) ঈমান আনে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথের পথনির্দেশ করেন।
সামগ্রিক আলোচনা: মুরতাদ, ইলহাদ ও তাহরীফ সম্পর্কিত উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যারা প্রকৃত দ্বীন ইসলাম জেনে ও বুঝে গ্রহণ করে তা থেকে বেরিয়ে যায় বা মুরতাদ হয়, তা নিজে থেকে হোক বা অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে হোক, তারা ক্বিয়ামাত দিবসে জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং কঠিন শাস্তি ভোগ করবে। একদল লোক মু’মিনদেরকে বিভ্রান্ত করে ঈমান থেকে কুফরে ফিরে যাওয়ার জন্য অপচেষ্টা চালিয়ে থাকে। তাই এ বিষয়ে মু’মিনদেরকে সবসময় সাবধান থাকতে হবে এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া যাবে না, বরং তাদেরকে উপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তাদেরকে এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বা যেকোনো ভাবে যারা ঈমান থেকে কুফরে ফিরে যায় বা মুরতাদ হয় তাদেরকে কোনো পার্থিব শাস্তি দেয়ার জন্য মু’মিনদেরকে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। মু’মিনরা শুধু তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করবে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা করবে যারা মু’মিনদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হয়।

তারপর বিভিন্ন প্রকার ইলহাদ ও তাহরীফ যেমন, তুচ্ছমূল্যে কিতাবের প্রকৃত তথ্য গোপন করা, কিতাবের উচ্চারণের সময় তাতে শব্দের সংযোজন বা কোনো শব্দ তার যথাযথ অবস্থানে যে অর্থ প্রকাশ করে তা থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে তার তাৎপর্যগত বিকৃতি সাধন, নিজের হাতে কিতাব লিখে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে বলে চালিয়ে দেয়া, মিথ্যা নবুওয়াতের দাবি করা, আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করা, কিতাবের বিষয়াদিতে মতভেদ করা ইত্যাদি বিকৃতি সাধনকারীদের জন্য ক্বিয়ামাত দিবসে কষ্টদায়ক শাস্তি থাকার কথা বলা হয়েছে, পৃথিবীতেও আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্চিত করবেন, মৃত্যুকালে ফেরেশতারা কঠিন শাস্তি সহকারে তাদের প্রাণ হরণ করবে, কিন্তু মু’মিনরা তাদেরকে উপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। তাদেরকে মু’মিনরা কোনোরূপ শাস্তি দেয়ার জন্য আল্লাহ কোনো দণ্ডবিধি প্রদান করেননি।

ধর্ম বিষয়ে বিকৃতিকারীরা যেসব বিকৃতি ঘটিয়েছে এবং মতভেদ করেছে তার বিপরীতে আল্লাহ প্রয়োজনীয় যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, প্রকৃত তথ্য জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর পথের দিকে হিকমাহ, সদুপদেশ ও উত্তম বিতর্কের মাধ্যমে আহবান করার পদ্ধতি অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সর্বপ্রকার বুদ্ধিবৃত্তিক হামলার মোকাবেলার উপায় হিসেবে কুরআন দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদান কাবীরা বা বড় ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার নির্দেশ দেয়া হয়েছে (দ্র: ২৫:৫২)।

বস্তুত ধর্মীয় তথ্যগত বিকৃতির জবাব হলো সঠিক তথ্য তুলে ধরা। আর সামাজিক তথ্যগত বিকৃতির ফলে সামাজিক ক্ষয়ক্ষতির উপর ভিত্তি করে নির্বাহী সিদ্ধান্তে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন শাস্তি হতে পারে, তাই এ বিষয়ে স্থায়ী কোনো বিধান নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি।

পরিশেষে বলা যায় যে, আল কুরআন অনুসারে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কারো উপর সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া বা মুরতাদ হওয়ার অভিযোগ এনে এমনকি সে ইসলামের কোনো বিষয়ে তথ্যগত বিকৃতি ঘটিয়ে নতুন মাজহাব তৈরি করার অজুহাতে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার এমনকি তার উপর কোনো ধরনের দন্ড আরোপের কোনো অবকাশ নেই।

>>  পরবর্তী পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য ক্লিক করুন