১.
স্টারপিক ফ্যাক্টরির মালিক সোহান সাহেব। ফ্যাক্টরির বয়স প্রায় ২৫ বছরের বেশি, মালিকের বয়স ৬৭ বছর। তার ফ্যাক্টরির পুরনো এবং বিশ্বস্ত ম্যানেজার হলো ফারুক সাহেব। মালিক সোহান সাহেব এবার ঠিক করেছেন টানা ২ মাসের জন্য তিনি ফ্যাক্টরির নিয়মিত কাজ থেকে বিরতি নিয়ে আমেরিকায় তার মেয়ে, মেয়ে জামাই ও নাতিদের সাথে সময় কাটাবেন।
দীর্ঘ ২ মাস তার ফ্যাক্টরির অপারেশন থেকে অনুপস্থিত থাকা নিয়ে সোহান সাহেবের জন্য কিছু দু:শ্চিন্তার হলেও তিনি এই সময়ে তার সিনিয়র ম্যানেজারদের কার কি কাজ, দায়িত্ব, কর্তব্য, কোন সমস্যা হলে কিভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে এ সব কিছু খুব পরিস্কার করে একটি চিঠিতে লিখে সবাইকে সেটা পৌছে দিয়েছেন। সাথে এটাও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন: আমার অনুপস্থিতিতে এই ১০ পাতার চিঠিটাই তোমাদের প্রত্যেকের জন্য গাইডলাইন। আশা করি তোমরা এই চিঠি নিয়মিত পড়বেন, এখানে থেকে নিজেদের করণীয় বুঝে নিবে। তাহলেই এই ২৫ বছরের ফ্যাক্টরিতে রেগুলার কাজের ব্যাঘাত হবে না, কর্মচারীরা শান্তিতে কাজ করতে পারবে এবং তোমরা নিজেরাও ভালো থাকবে।
ঐ চিঠি প্রাপ্তদের মধ্যে পুরনো এবং বিশ্বস্ত ম্যানেজার ফারুক সাহেব একজন। সোহান সাহেবের বিদেশে চলে যাওয়ার পর একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো ফ্যাক্টরিতে।
ফ্যাক্টরি মালিকের বিদেশ চলে যাওয়ার পরের দিন। ম্যানেজার ফারুক সাহেব প্রতিদিন তার মালিকের রেখে যাওয়া চিঠিখানা খুলে আবেগে একবার প্রথমেই চুমা খেয়ে নেয়, তার অফিস কামরার সবচেয়ে উচু যে তাঁক তার উপরে রাখে, নীচে বা ডেস্কে অন্য কাগজের সাথে রাখে না, পাছে বসের অপমান হয়! সুন্দর করে রাখার জন্য সে আবার আলাদা একটা বক্সও অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে যেন চিঠিটায় কোন ধুলা বালির স্পর্শ না হয়। হাজার হোক বসের চিঠি!
দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে ফারুক সাহেব বসের রুমে চলে যান। সেখানে সে চিঠিটাকে সযত্নে বাক্স থেকে বরে করে বসের চেয়ারের দিকে মুখ করে খোলেন, যারা প্রফেশনাল কবিতা আবৃত্তি করেন তাদের মতো শুদ্ধ ও প্রমিত উচ্চারনে; প্রতিটা শব্দের, বণ্যের, দাড়ি ও কমায় তার ব্যাপক মনোযোগ। বসের চেয়ারকে লক্ষ্য করে চিঠিটা অফিস সময়ের ভিতরে তিনবার অন্তত পাঠ তিনি করবেনই। মাঝেমধ্যে আবেগে চিঠিটার অক্ষরগুলায় হাত বুলান। বসের হাতের লেখা কত সুন্দর সেটা নিয়ে মনে মনে তারিফ করেন। এটা তার রুটিনে পরিণত হয়েছে। বসের এবং বসের পরিবারের জন্য একটা ছোট প্রশংসামূলক ছোট্ট কবিতাও ঐ চিঠি শেষ করে প্রতিদিন পাঠ করেন।
যেহেতু বিশ্বস্ত ও পুরনো কর্মচারী ফারুক সাহেব করেন, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে এ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার, সাব-ম্যানেজার ও অফিসারও তার পেছনে লাইন ধরে। তারাও মোটামুটি একটা শিডিউল করে ফেলেছেন এই নতুন প্রোগ্রামে যেখানে তারা বসের রুমে, বসের চেয়ারের দিক ফিরে তাদের জন্য লেখা বসের চিঠি, বসের চেয়ারকেই শুনায়।
রুটিন মেকানিক্যাল কাজের একটা হিপনোটিক এফেক্ট আছে। আপনি যখন কোন কাজ যান্ত্রিকভাবে দিনের পর দিন করতে থাকেন, তখন একসময়ে সবাই ভুলে যায় সে কেন করছে ঐ কাজটি। ঐ হিপনোটিক এফেক্টে এক সময়ে স্টারপিক ফ্যাক্টরির সব ম্যানেজার, সব অফিসার বেমালুম ভুলে গেছেন যে তাদের ঐ চিঠি বসের চেয়ারের জন্য নয়, তাদের জন্য। ঐ চিঠি তাদের জন্য নির্দেশনা। ঐ চিঠি কেবল সুর করে পাঠ করায় কোন উপকার নাই, বরং বাস্তব সমস্যার সমাধান কিভাবে করবে, কিভাবে তাদের ফ্যাক্টরীর কাজ সম্পাদন করবে তার মধ্যে ঐ চিঠির উদ্দেশ্য নিহিত।
ঐ ফ্যাক্টরিতে এই ২ মাসে অনেক ধরনের ক্রাইসিস তেরী হয়েছে। মালিক যা যা আংশকা করেছিলো তাতো হয়েছেই, অনেক ধরনের আরো অতিরিক্ত ক্রাইসিসও যু্ক্ত হয়েছে। এক্সপোর্ট সময়মতো হচ্ছে না, এলসি সময় মতো প্রসেস হচ্ছে না, ব্যাংকে টাকা আটকে আছে, কর্মচারীরা বেতন দেরী হওয়ার জন্য স্ট্রাইকে যাওয়ার পায়তারা করছে ইত্যাদি। সব মিলিয়ে ফ্যাক্টরী পথে বসে যাওয়ার অবস্থা।
এ দিকে আমাদের বিশ্বস্ত মানেজার কিন্তু সকাল, দুপুর ও বিকাল রুটিন করে ঐ চিঠি পাঠ অব্যাহত রেখেছে। তারা এই প্রোগ্রামের নাম দিয়েছে চিঠি খতম প্রোগ্রাম। যে যত বেশি পাঠ খতম করতে পারছে তার জন্য আলাদা একটা পয়েন্ট সিস্টেম এইচআর ডিপার্টমেন্ট ঠিক করে নিয়েছে। তাদের দিলে বড় আশা যে মালিক নিশ্চই ফিরে আসার পর তাদের এই খতমের পুরস্কার দিবেন!
২.
স্রষ্টা সেমিটিক জাতির মধ্যে বিধান নাজিল করেছে। একটি হলো তাওরাত, নবী মুসা আ. এর মাধ্যমে এবং অন্যটি কোরআন, নবী মুহাম্মদ স. এর মাধ্যমে। যে কোরআন আমরা পেয়েছি সেটি নিজেকে কি বলে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে? কোরআন নিজেকে বলছে পদনির্দেশক, সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী / মানদন্ড, উপদেশ, প্রজ্ঞা, স্মরণকারী ইত্যাদি।
এই কোরআন যদি আপনারা কেউ নিজ ভাষায় পড়ে থাকেন তাহলে জানবেন যে এখানে লিগ্যাল অর্থে আইন কানুন খুবই কম, হাতে গোনা। এখানে বেশিরভাগ আয়াতই অনুপ্রেরণামুলক, উপদেশ মূলক, যুক্তির কথাবার্তায় ভরা, প্রকৃতির নির্দশন চোখ কান খুলে দেখে নেওয়ার আয়াতে পরিপূর্ণ। এই কুরআন মানুষের জন্য, মানুষের ভাষায়, মানুষের সমাজের সমস্যা সামাধানের প্রিন্সিপ্যাল / নীতিমাল ইত্যাদি নিয়ে নাজিল হওয়া একটি কিতাব।
ঐ যে ফ্যাক্টরির কথা বলা হলো, ঠিক সেরকম আমরা আল্লাহর বাণী আল্লাহকেই সুর করে শুনাতে ব্যস্ত। সেই নির্দেশনা, পথনির্দেশ কি তা নিয়ে আমরা বেমালুম বেহুশ। বরং আমাদের ভিতরে কিছু মানুষ শয়তানের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে কুরআন না বুঝলেও ঠিকাছে। অক্ষরে অক্ষরে নেকী।
খেয়াল করেন, শুধুমাত্র এই ডকট্রিন চালু করার ফলে (যে কুরআন বুঝে পড়ার দরকার নাই, সো কলড সহীহ ও শুদ্ধ উচ্চারনে, কোন কম্প্রিহেনশন ছাড়াই শব্দ উচ্চারন করলেই সওয়াব) নন-এরাবিক মুসলিমদের কাছে এই কুরআনের বাণী চিরতরে না বুঝার বন্দোবস্ত করা।
আরো খেয়াল করেন, এই যে রমজান মাসের যে এত পবিত্রতা, ফজিলত তার মূল কারন হলো এই মাসে কুরআন নাজিল হয়ছে। আর এই কুরআন যে আমজনতা অন্তত এই মাসে পড়বে, জানবে তার রব তার জন্য কি নির্দেশনা দিয়েছে - সেটাকেও চিরতর অসম্ভব করার জন্য যে আয়োজন তার নাম হলো তারাবীহ। তারাবীহতে কি হয়? একজন হুজুর হাই স্পিডে এমনকিছু পাঠ করে যা সে নিজে বুঝে না, তার পেছনের মানুষগুলাও বুঝে না।
অথচ এর পরিবর্তে মানুষ যদি ঘরে বসে, অথবা মসজিদে বসে, অথবা বাড়ির ছাদে বসে, অথবা মাঠে বসে কুরআন তার মাতৃভাষায় এই নিয়তে পাঠ করতো যে আমি জানবো আমার স্রষ্টা আমার জন্য যে চিঠিটি লিখেছে তার বিষয়বস্তু কি? তাহলে প্রায় সব শিক্ষিত মানুষই প্রতি রমজানে অন্তত ১বার কাভার টু কাভার কুরআন পড়তো।
আপনি যে এই পোস্টটি পড়ছেন, আপনাদের কারো বয়স ৪৫, কারো ২৮, কারা ৫৪ বছর। এদের মধ্যে আমরা কতজন যে কুরআন নিজের মাতৃভাষায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি সেই সংখ্যাটি খুব কম হওয়াই দু:খজনক বাস্তবতা। অর্থাৎ দেখেন ধর্মব্যবসায়ীদের চক্করে যে বেশি লাভবান হয়েছে তার নাম শয়তান। তাদের মাধ্যমে শিক্ষিত জনগোষ্ঠির একটা বড় অংশ অক্ষর জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও কুরআন কাভার টু কাভার কোন দিন নিজ মাতৃভাষায় পড়েন নি।
আর যারা আরবী বুঝে না, কিন্তু নিয়মিত সহীহ ও শুদ্ধ উচ্চারনে আরবীতে কুরআন পড়েই যাচ্ছেন, পড়েই যাচ্ছেন, পড়েই যাচ্ছেন - তাদের অবস্থা ম্যানেজার ফারুক সাহেবের মতোই, যিনি ভুলে গেছেন যে এই কুরআন কেন পাঠানো হয়েছে? তিনি চিঠি তেলোয়াতে ব্যস্ত, কিন্তু চিঠির কনটেন্ট ও কনটেক্সট নিয়ে বেখবর!
৩.
এখন কল্পনা করেন, ২ মাস পর সোহান সাহেব ফিরে এসে যদি দেখে তার চিঠিটা কেউ পড়েনি, কেউ বুঝে দেখিনি, কেউ নির্দেশনা মানে নি- বরং এটা এটাকে একটা অর্থহীন অনুষ্ঠানে পরিণত করেছে যেখানে চিঠি সুর করে পাঠ করে, তিলোয়াত করে; কিন্তু পড়ার অর্থে পড়ে নি - ওনার অবস্থা কি হবে।
এর সাথে ফ্যাক্টর যোগ করেন যে তার অভিজ্ঞ ম্যানেজার ফারুক, যিনি এই ফ্যাক্টরিতে আছেন প্রায় ১৫ বছর ধরে। মালিকের বিরক্তি কতটা তুঙ্গে উঠবে ভেবে দেখেন!
আমাদের মসজিদ মাদ্রাসায় যারা রাতদিন কুরআন খতম করছেন এবং দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করছেন - তাদের অবস্থাটা কি একটু ভেবে দেখেন। বিচার দিবসে ঐসব তথাকথিত আলেমদের অবস্থা কল্পনা করেন যারা তুচ্ছ মুল্যে সহীহ ও শুদ্ধ উচ্চারনের ব্যবসায় আপনাকে, আমাকে, জেনারেশন আফটার জেনারশনকে কুরআনের বাণী থেকে দূরে রাখলো?
বস ফিরত আসার পর ঐ ফ্যাক্টরীর ম্যানেজার প্রথম দিনেই স্যাকড। তার যত ফেইক ভক্তি, ফেইক ইমোশন - সেগুলোর দুইপয়সারও দাম নাই মালিকের কাছে। একইভাবে আমাদের সো কলড কুরআন খতম, যে মারা গেছে সেই মুর্দার লাশের পাশে ভাড়া করে আনা মাদ্রাসার হুজুরদের দিয়ে সুরা ইয়াসিন, সুরা রহমান খতম অথবা এই রমজানে মহল্লায় মহল্লায় তারাবীতে কুরআন খতম - এই কর্মকান্ডের মৌলিক কোন দাম / উপযোগিতা, ভ্যালু স্রষ্টার কাছে আছে কি? If you don't know where you are going, no matter what road you take, you will end up in wrong destination. কেউ একজন বলছিলো, `আপনার গন্তব্য, উদ্দেশ্য যদি না জানা থাকে - যে পথেই আপনি যাত্রা করে আর যতদূর আপনি যান না কেন; আপনি ভুল স্থানে হাজির হতে বাধ্য'। কোরআন কেন পাঠানো হলো, সেটাই যদি আমরা না বুঝি - কোরআন নিয়ে যত শত টিভি প্রোগ্রাম হোক, কোরআনের পাখিদের আপনি যতই পাগড়ি পড়ান অথবা আর্ন্তজাতিক তেলোয়াতের অনুষ্ঠানই হোক অথবা হুজুরদের এন্টারটেইনিং কোরআনের জলছা হোক, অথবা আমরা লক্ষ কোটি কুরআনের হাফিজ পয়দাকারী হই না কেন- আমরা কোথাও গিয়ে হাজির হতে পারবো না। তাই কি হচ্ছে না বিগত হাজার বছর ধরে?!
মহান স্রষ্টা বিধান দিলেন হেদায়তের জন্য, পথ নির্দেশ করার জন্য, বিধান দিলো মানুষের চলমান সমাজের জন্য কিছু নীতিমালা হিসেবে - যার বড় অংশই সার্বজনীন ভ্যালু ক্যারি করে, যা অসম্প্রদায়িক, ব্যক্তিগত নীতিনৈতিকতার চর্চার দর্শন - আর আমরা সেটাকে বানালাম তোতা পাখির মতো না বুঝে স্বর উৎপাদনের প্রতিযোগিতায়, ওয়াজের মাঠের এন্টারটেইনমেন্ট স্ক্রিপ্টে এবং মৃত মানুষকে পড়ে শুনানোর সুরেলা তেলাওয়াতে!
আফালা ইয়াতাদাব্বারুনাল কুরআনা?
আম আলা কুলুবিন আকফালুহা!
তারা কি কোরআন নিয়ে গভীর চিন্তা করে না?
নাকি তাদের অন্তরে তালা লেগে গেছে!
- সুরা মুহাম্মদ (৪৭), আয়াত ২৪