মোকাররম হোসাইন
প্রত্যাদেশ বা ওহী যখন ভাষা প্রাপ্ত হয় তখন তা নবীর ভাষাজ্ঞানের মাধ্যমে সমসাময়িক ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করে। শব্দের অর্থ, সীমা ও প্রয়োগ ঐতিহাসিক ভাবে নির্ধারিত থাকে। ইতিহাসের একটা কালের ভাষা থেকে গৃহীত শব্দ যখন প্রত্যাদেশের ভাষাতীত নিগূড় সারবস্তুকে মূর্ত করে তখন সেইসব শব্দ নাজেল কালের ঐতিহাসিক অর্থ দ্বারা নির্ধারিত হয়ে গেলে কোরআনও একটা ঐতিহাসিক সীমার মধ্যে বন্ধি হয়ে যায়। কোরআনের মর্মগত দ্যোতনা একটা ঐতিহাসিক স্থান-কালে সীমিত হয়ে যায়। কোরআন হারায় তার বিশ্বজনিনতা। ওহীর নিগূড় সারবস্তুকে যথাযত ধারন করতে পারে তেমন সব শব্দের হাজিরানা নাজেল কালে মানবিক ভাষায় থাকা সঙ্গত কারনেই অসম্ভব। ভাষা ক্রমাগত বিবর্তিত হয়। নতুন জ্ঞান ও ধারণার বিকাশে নতুন শব্দ ও পরিভাষার উৎপাদন হয়। ঐতিহাসিক নির্দিষ্টতা অতিক্রম করে শব্দের অর্থময়তা আরো বিবিদ সম্ভাবনা আকারে যদি হাজির করা যায় এবং মানুশের জীবন ও জগত পাঠের ক্রম অগ্রগতির প্রেক্ষিতে শব্দের নতুন নতুন অর্থ যদি নির্মিত হয়, কোরআন হয়ে উঠবে গতিশীল জীবনকে ধারন করতে পারা এক মহাগ্রন্থ।
মাটি থেকে মানুষের সৃষ্টি
কোরআন যখন বলে আল্লাহ মাটি (মিন সালসালিম মিন হাম্মিম মসনুন।) থেকে নবী আদমকে (আ:) সৃষ্টি করেছেন, তখন আমরা আক্ষরিক অর্থে মাটি নিয়ে কাজ করা একজন ভাষ্করের মতো আল্লাহকে কল্পনা করতে পারি না। আমাদের কালে অনু, পরমাণু, জৈব ও অজৈব যৌগের ধারণা হাজির আছে। মাটি মূলত প্রকৃতির নানা জৈব ও অজৈব যৌগের এক মিশ্রণ। মানুষের শরির গঠিত হয় নানা জৈব যৌগের সমন্বয়ে। খাদ্য হিসেবে যেসব অজৈব যৌগ আমাদের শরীরে প্রবেশ পরিপাকতন্ত্র তাদের জৈব যৌগে পরিণত করে। ফলে কোরআনের মাটি হচ্ছে মানব শরিরের গাঠনিক যৌগ সমূহের একটা প্রতিনিধিত্বকারি শব্দ। কিংবা মাটি হতে পারে মানব সত্তার একটা গুনবাচক শব্দ। মাটির মতো মানুষ বললে যেমন ভাব আসে।
এক ফোঁটা বীর্য
একইভাবে কোরআন বলে "এক ফোঁটা বীর্য" (নুতফা) থেকে মানব জীবনের শুরু। অথচ আমরা জানি এক ফোঁটা বীর্যে কয়েক লক্ষ শুক্রাণু থাকে যার মধ্য হতে কেবল একটা শুক্রাণুই ডিম্বানুকে নিষিক্ত করে ভ্রূণ গঠন করে। তাহলে নুতফা বা এক ফোঁটা বীর্যের ধারণা কি ভুল? আক্ষরিক অর্থ নিলে ভুল অবশ্যই। কিন্তু কোরআন নাজেলের কালে শুক্রাণু ও ডিম্বানুর ধারনা ছিলো না। ছিলো না তেমন কোনো শব্দ বা পরিভাষা। ফলত নুতফা তথা "এক ফোঁটা বীর্য" এই অভিব্যক্তিতেই শুক্রাণু শব্দের দ্যোতনা খুঁজতে হবে।
সভ্যতার বিকাশ
নবী আদমের (আ:) সময়কে শিকাড়-কুড়ানি জীবন থেকে মানুষের কৃষি সভ্যতার বিকাশের কাল হিসেবে দেখার একটা ইতিহাসবাদি বয়ান আছে। কৃষি সভ্যতা বিকাশের আগে মানুষ ছিলো অন্যসব পশুর মতোই প্রকৃতির নিয়মের অধীন। ফলে মানুশের জন্য কোনো নৈতিক বিধান জরুরি ছিলো না। যেহেতু কৃষি সভ্যতার সাথে সম্পদ ও তার মালিকানার ধারনা হাজির হয়, মানুশ যাযাবার জীবন ছেড়ে স্থায়ী বসতিতে জীবন যাপন করতে শুরু করে এবং মানুশের নানা সংস্কৃতির বিকাশ হতে থাকে, তাই মানুশের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে নির্দিষ্ট নিয়ম কানুনের। আদম ছিলেন ইব্রাহিমি ঐতিহ্যে সেই প্রথম মানুশ যিনি মানুশের জন্য (ঐশী) বিধান হাজির করেন। ফলে আদম প্রথম নবী। আদম সৃষ্টির আগে আল্লাহ ফেরেশতাদের বলেন, "আমি পৃথিবীতে খলিফা প্রতিষ্ঠা করবো (ইন্নি জায়িলু ফিল আরদি খলিফাতুন)।" এই আয়াতে স্পষ্টতই পৃথিবীতে খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। তখন ফেরেশতারা ফাসাদ ও রক্তপাতের দোহাই দিয়ে তাদের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলো। ফেরেশতাদের আশঙ্কাতে কৃষি সভ্যতা বিকাশের ফলস্রুতিতে ধীরেধীরে নগর, রাজত্ব, সাম্রাজ্য, যুদ্ধ, রক্তপাতের যে নতুন ইতিহাসের গোড়াপত্তন শুরু হতে যাচ্ছে তার ইঙ্গিত আছে।
হাবিল ও কাবিল এই দুই সভ্যতার প্রতিনিধি। হাবিল খোদার উদ্দেশ্যে কোরবানি দিয়েছিলো পশু যা শিকারি জীবনের প্রতিনিধি। অন্যদিকে কাবিল দিয়েছিলো শস্য যা কৃষি সভ্যতার প্রতিনিধি। নবী আদমের বেহেস্ত ছিলো শিকার-কুড়ানি জীবনের প্রতিনিধি যা হাবিলের মধ্যে প্রবাহিত। বেহেস্তে (শিকার-কুড়ানি জীবনে) উৎপাদন ব্যবস্থা থাকে না। তারও আগে আদম যখন বেহেস্ত থেকে বিতাড়িত হলেন, আদম ও শয়তানকে পরস্পরের শত্রু হিসেবে নেমে যেতে বলা হয়েছে পৃথিবীতে যেখানে কিছু কালের জন্য তাদের বসবাস ও জীবিকা থাকবে (সূরা বাকারা, আয়াত ৩৬)। মাতায়ুন বা জীবিকা শব্দে কৃষি সভ্যতার ইশারা আছে। আদম সেই নতুন সভ্যতার প্রতিনিধি (খলিফা) যখন মানব সভ্যতা শিকার-কুরানি থেকে কৃষি সভ্যতার দিকে যাত্রা করলো। কৃষি সভ্যতার সাথে আছে মালিকানার সম্পর্ক। মালিকানা মানেই স্বার্থপরতা। শত্রুতা। ভূমি দখলের লড়াই ও রক্তপাত। "আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত ঘটাবে?" (সূরা বাকারা, আয়াত ৩০)।
এই প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ নিতে পারি মান্নাসালয়া নামক কথিত বেহেস্তি খাবারের। কৃষি সভ্যতার আগের শিকার-কুড়ানি জীবনের ইঙ্গিত পাওয়া যায় মান্নাসালয়া শব্দে। বনি ইসরাইল গোত্রের আদি যে বসতি তা কেনান (ফিলিস্তিন) থেকে হারান (তুরস্ক) বিস্তৃত জনপদ। বনি ইসরাইলের ইতিহাসে একটা পর্ব মিশরে কেটেছে দাস হিসেবে। এই মিশরেই নীল নদের আববাহিকায় কৃষি সভ্যতার বিকাশ হয়েছিলো। প্রায় একই সময়ে সুমেরিয় সভ্যতায় কৃষি সভ্যতার উৎপত্তি হয়েছিলো। প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত, শিকার করে বা কুড়িয়ে পাওয়া খাবার (মান্নাসালয়া) ছেড়ে তারা কৃষিতে লিপ্ত হয়। এই বর্ণনায় কৃষি সভ্যতার তুলনায় শিকার-কুড়ানি সভ্যতার প্রতি খোদার পক্ষপাত স্পষ্ট। কারন কৃষি সভ্যতা সম্পদের যে মালিকানার ধারনা নিয়ে আসে দুনিয়াতে, তা মানুষে মানুষে ভেদাভেদের আদি কারন। কৃষি সভ্যতার সূত্র ধরে উৎপত্তি হয় ধনী-দরিদ্র শ্রেণি। দাস ব্যবস্থার উৎপত্তির সাথে আছে কৃষি সভ্যতার যোগ। যে ভূমি ও সম্পদে খোদা অধিকার দিয়েছিলেন মানুষ সহ সব প্রাণকে, তা ক্ষমতাশালী মানুষদের একচ্ছত্র অধিকারে পরিণত হলো।
ভাষা
ইব্রাহিমি ঐতিহ্য অনুযায়ী অন্যসব সৃষ্টির উপর মানুষের যে মর্যাদা বা শ্রেষ্টত্বের বর্ণনা আছে সেইসব আদমের সময়কালে বিকাশ শুরু হয়। আর সেইটা শুরু হয় ভাষার মধ্য দিয়ে। ভাষার মধ্য দিয়াই মানুষের চিন্তাক্ষমতার স্ফুরণ শুরু যা তার প্রকৃতিগত পশু সত্ত্বা থেকে মানুষ হয়ে উঠার প্রথম ধাপ। ভাষার উদ্ভবকালে মানুষ প্রথমত বস্তুর নাম দিতে শিখেছে। কেবল বস্তুর নাম দিয়েই মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ সম্ভব। ইব্রাহিমি ঐতিহ্যে আদমকে আল্লাহ নামকরন শিখিয়েছেন (বা নামকরণের পদ্ধতি বা নামকরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা দিয়েছেন) এমন বর্ণনা আছে। এবং ইব্রাহিমি ঐতিহ্য অনুসারে আদমের এই নামকরণের ক্ষমতার মধ্য দিয়ে আল্লাহ মানুশকে অন্য সব প্রাণির উপর শ্রেষ্টত্ব দান করেছেন। মানুষের ভাষা বিকাশের ইতিহাস থেকে আমরা জানি ভাষা বিকাশের শুরু বস্তুর নামকরনের মধ্য দিয়া। তারপর ক্রিয়াপদ। এরপর বিশেষণ ও অন্যান্য পদাবলি। আদতে সব ক্যাটাগরির পদই নামবাচক। মানুষের ভাষা বিকাশের এই ইতিহাস মানুষের জিনে গ্রন্থিত থাকে যা শিশুদের ভাষা শেখার বিভিন্ন স্তরে মূর্ত হয়। মানুশের ভাষা তার জটিল বুদ্ধিবৃত্তির অভিপ্রকাশ যে বুদ্ধিবৃত্তির কারনে মানুশ অন্য সব প্রাণি থেকে শ্রেষ্ট হয়ে উঠেছিলো এবং শারিরিকভাবে দূর্বল হয়েও কতৃত্ব করার ক্ষমতা অর্জন করেছিলো। যদিও ইসলামি ঐতিহ্যে অন্যসব প্রাণের উপর শ্রেষ্টত্ব বা কর্তা আকারে বিবেচনার চেয়ে মানুশকে আল্লাহর খলিফা হিসেবে দেখার প্রবণতা আছে। অর্থাৎ মানুশ আল্লহর প্রতিনিধি হিশেবে সব প্রাণ ও প্রকৃতি হেফাজত করবে। এই খলিফা হওয়া তার ভাষা বিকাশ তথা বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতা ছাড়া অসম্ভব।
মানুষের সাংস্কৃতিক ইতিহাস এবং লিখিত ভাষার ইতিহাস শুরু এই কালেই। আদম পূর্ব মানব তাই মানুষের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অনুচ্চারিত। "মানুষের কি এমন এক কালপর্ব ছিলো না যখন মানুষ বিষয়ে উল্লেখ করার মতো কিছুই ছিলো না?" (সূরা ইনসান, আয়াত ১)। আদম এই ভাষা উৎপত্তি কালের প্রতিনিধিত্বকারি প্রথম মানুষ। এই কালেই মানুষের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে বিধিবিধান। স্থায়ি বসতিতে বসবাসরত মানুষের শৃঙ্খলা বিধানের জন্য এবং মানুষের আত্মিকভাবে পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের জন্য ওহী জরুরি হয়ে উঠে। মালিকানা ও সম্পদের ধারনাও আসে এই কালে যা মানুষে মানুষে বিবাদ ও রক্তপাতের সূচনা করে ব্যাপক মাত্রায়। তারপর নগর সভ্যতার পত্তন থেকে সাম্রাজ্য হয়ে উঠে কৃষি কেন্দ্রিক জনপদগুলো। ফলত প্রত্যাদেশ অবশ্যম্ভাবি উঠে এই কালে। আর প্রথম নবী হিসেবে ওহীপ্রাপ্ত হন হযরত আদম (আ)।
মালাইকা
কোরআনে ব্যবহৃত মালাইকা (ফেরেশতা) শব্দটির কোরআন নাজেল কালে ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত অর্থ অশরিরি এক রুহানী সত্তা যা আল্লাহর এবাদত করে, আদেশ পালন করে এবং বিশ্বজগতের নানা ঘটনার নিয়ন্ত্রণকারী। এভাবে ঝড়-বৃষ্টির ফেরেশতা হিসেবে আসে মিকাঈল ফেরেশতার নাম। ধ্বংশের ফেরেশতা ঈসরাফিল। মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাঈল। ফেরেশতা ধারানার সমানুপাতিক ধারনা হাজির ছিলো সুমেরিয়, গ্রীক ও আর্য সভ্যতায়। ফেরেশতাদের মতোই একেক দেবতা ছিলো প্রকৃতির একেকটি শক্তির অধিকারি। ভেদটা ছিলো দেবতারা ছিলো উপাস্য। আর ফেরেশতারা মানুশের মতোই একটা সৃষ্টি।
ইতিহাসবাদি বর্ণনায় বহুত্ববাদী ধর্ম থেকে একত্ববাদী ধর্মের বিকাশের কালে কিভাবে দেবতা ধারণা ফেরেশতা ধারণায় উন্নিত হয় তার একটা কৌতুহলোদ্দিপক বয়ান আছে। এই বয়ানটা একত্ববাদী ধর্মতত্ত্বকে বিপ্লব হিসেবে বিবেচনা করে। যে দেবতাদের দোহাই দিয়ে ফেরাউন, নমরুদ, তাগুত, আবু জাহেলরা ক্ষমতার অধিকারি হয়ে জনগনের উপর জুলুম করতো, সেই ক্ষমতার প্রতিক দেবতার মূর্তি ভাঙার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার বৈধতাকে গুড়িয়ে দেয়া হতো। এই বিপ্লবের ইস্তেহারেই দেবতার পরিবর্তে আসে ফেরেশতা ধারনা। ফলে উপাস্যের মর্যদা রহিত হয়ে যায়। তারপর মানুশ আদমকে সিজদার আদিষ্ট হওয়ার মাধ্যমে ফেরেশতাদের মানুশের অধীনতা স্বীকার করতে হয় যার মধ্য দিয়ে দেবত্ব ধারণার চুড়ান্ত বিলুপ্তি ঘটে।
আমরা এই ইতিহাসবাদি বিপ্লবী বয়ান যদি গ্রহণ নাও করি, আমরা জানি এই বিশ্বজগত ও প্রকৃতির সৃষ্টি, বিকাশ ও ধ্বংশ সুনির্দিষ্ট নিয়মের অধীন। আল্লাহর সৃষ্ট প্রাকৃতিক সূত্রেই চলমান এই বিশ্বজগত। ফেরেশতারা এই প্রাকৃতিক নিয়মেরই প্রতিনিধি বা প্রতিকি নাম। আমরা ঝড়-বৃষ্টি আল্লাহর সৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়। মিকাঈল এই প্রকৃতিক নিয়মেরই রূপক। মানুশ ছাড়াও প্রকৃতির বাকি সব প্রাণ (উদ্ভিদ ও প্রাণি এবং অনুজীবের) মৃত্যু আছে। মৃত্যু একটা প্রাকৃতিক নিয়ম। শারিরিক ক্রিয়া থেমে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর জন্য আজরাইল ফেরেশতার মুখোমুখি হতে হয় কিনা একটা প্রশ্ন থেকে যায়। আজরাঈল আল্লাহ সৃষ্ট মৃত্যুর নিয়মেই প্রতিক। ফেরেশতা কখনো হতে পারে রুহানী অনুপ্রেরণা। জিবরাঈলকে অনুপ্রেরণার ফেরেস্তা বলা হইছে বহু বর্ণনায়। মসজিদে নববীতে কবি হাসান বিন সাবিতকে নবী মুহাম্মদ (স:) নিজের পাশে বসাতেন। একটি বর্ণনায় আছে মুহাম্মদ (স:) দোয়া করছেন হাসান বিন সাবিতের জন্য যেনো জিবরাঈল ফেরাশতা তাকে কবিতা লিখতে সাহায্য করে। তার মানে জিবরাঈল শুধু নবীদের সাথে নয়, মানুষের সাথেও অনুপ্রেরণা আকারে যোগাযোগ করে। ইবনুল আরাবী তার ফুতুহাত আল মাক্বিয়া কিতাবের ভুমিকায় লিখেছেন এই কিতাবের একটা শব্দও তার নিজের নয়। জিবরাঈল ফেরেশতার অনুপ্রেরণায় লিখিত। মানুষের আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণারই প্রতীকি নাম জিব্রাঈল বা আরো নির্দিষ্ট করে বললে সৃষ্টিশীলতার অনুপ্রেরণা।
প্রাকৃতিক নিয়মের প্রতীকি অর্থে যদি ফেরেশতা শব্দের অর্থ করি আমরা তবে ফেরেশতাদের যে আদমকে সিজদা করতে আদেশ করা হয়েছিলো তার এককটা হাকিকত বুঝা যায়। ফেরেশতাদের মানুষকে সিজদার আদেশকে আমরা প্রকৃতিকে মানুষের অধীন করে দেয়া অর্থে পাঠ করতে পারি। আমরা যদি হযরত আদমে কৃষি সভ্যতা বিকাশকালের মানুষ বিবেচনা করি তবে দেখবো কৃষি সভ্যতা বিকাশের কালেই মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রন শুরু করেছে। আদমকে বলা হয়েছে দুনিয়ার খলিফা। অ্যাডামাইটরাই যখন শিকাড়-কুড়ানি জীবন থেকে কৃষি জীবন যাপন শুরু করলো তখন থেকেই প্রকৃতির দেখবালের দায় তাদের উপর অর্পিত হলো। ফেরেশতাদের আদমকে সিজদা এবং আদমের খলিফা হওয়া এবং কৃষি সভ্যতার বিকাশ এই তিন প্রপঞ্চকে এক বিন্দুতে ধরতে পারলে ধর্মীয় বয়ানে মানুশের ইতিহাস কিছুটা খোলাশা হয়।
জ্বিন
জ্বিন নামক এক অশরিরি সুমেরিয় বা ব্যাবিলনীয় কল্পনা ছিলো কোরআন নাজেলের বহু আগেই। ঐতিহাসিকভাবে জ্বিন শব্দের একটা অর্থগত সীমানা আছে। কল্পনা আছে। কোরআনে ব্যবহৃত জ্বিন শব্দের অর্থ নির্ধারণে সুমেরিয় ও ব্যাবলনীয় কল্পনাই একমাত্র নিধান হতে দেখা যায়। কিন্তু জ্বিন শব্দের আছে আরো বহু দ্যোতনা। মৌলিকভাবে জ্বিন শব্দের অর্থ গুপ্ত। মানুষের বোধগম্যতার অতীত সব গুপ্ত প্রপঞ্চকে জ্বিনের সাথে যুক্ত করার প্রবণতা এখনো আছে দুনিয়াতে। জীবানু আবিষ্কারের আগে রোগের কারন হিসেবে জ্বিনের প্রভাব বলে দায়ি করা হতো। আজকাল এই প্রবণতা নেই আর। কিন্তু মানসিক রোগের কারন হিসেবে এখনো জ্বিনকে দায়ি করার প্রচলন আছে অনগ্রসর সমাজে। জীবানু আবিষ্কারের আগের জ্বিনই তো জীবানু নামে আবিষ্কার হলো। তাই আমরা জ্বিনের একটা অর্থ করতে পারি জীবানু। জ্বিনের আরেকটা অর্থ হবে নিউরোলজিকাল মিসফাংসন যার কারনে মানুষ পাগল হতে পারে।
জিন যদি আগুনের তৈরি হয়, তাহলে জিন বস্তু না শক্তি? নাকি উচ্চ তাপে বস্তুর গ্যাসীয় অবস্থা? নাকি জিন বলে কিছুই নাই? অনু-পরমাণুর ধারণা আসার আগে মাটি, পানি, বায়ু ও আগুন এই চারটা উপাদানকে সব ধরণের বস্তুর গাঠনিক উপাদান মনে করা হতো। কিন্তু মাটি, পানি ও বায়ুর মতো আগুন কোনো বস্তু নয়। ফলত আগুন কোনো বস্তুর গাঠনিক উপাদান হইতে পারে না। আগুন স্রেফ বস্তুর তাপীয় অবস্থার নির্ধারক। বস্তু যখন পোড়ে, তাপ উৎপাদন হয় যা বস্তুকে গ্যাসীয় অবস্থায় পরিণত করে যেখানে কার্বন ডাইঅক্সাইড সহ আরো কিছু গ্যাস থাকে। আগুন একই সাথে তাপ উৎপাদন করে যেইটা এনার্জি। জিন বলে যদি কিছু থাকে সেইটা উচ্চ তাপীয় বস্তুর গ্যাসীয় অবস্থা বলা যায়। জিন সম্পর্কে ইব্রাহিমি ধর্ম ঐতিহ্যে যেসব ধারণা পাওয়া যায় তাতে জিন অন্যসব প্রাণির মতোই একটা প্রাণি যাদের শারিরিক ক্রিয়া, যেমন খাদ্যগ্রহণ, যৌনতা, ইত্যাদি আছে। তাদের একটা ব্রেণ থাকবে। খাদ্য গ্রহণ ও পরিপাকের জন্য থাকবে পরিপাকতন্ত্র। থাকবে যৌনাঙ্গ। দেখার জন্য চোখ। কিন্তু উচ্চতর তাপে একটা গ্যাসীয় অবস্থা যদি হয় জিন, তবে তার কোনো শরিরতান্ত্রিক ক্রিয়া সম্পাদন করতে পারার মতো কাঠামো অসম্ভব এবং জিনের কোনো শারিরিক কাঠামোই থাকবে না। আর শারিরিক কাঠামো ছাড়া কোনো প্রাণির অস্তিত্ব থাকা সম্ভব না। আগুন গাঠনিক উপাদান না হয়ে বরং সত্তার একটা গুনবাচক।
মানবিক মনস্তত্ত্বের একটা দিক হলো সে নিজেকে একটা শুভ সত্তা আকারে কল্পনা করে। এই কারনেই আমরা মানবিক শব্দটা ব্যবহার করি কেবল শুভ সত্তার প্রতিনিধি আকারে। আর পাশবিক (পশু থেকে উদ্ভূত) শব্দ ব্যবহার করি মানুশের যাবতীয় মন্দ চরিত্রকে বুঝাতে যেনো মন্দ চরিত্রের উৎস মানুশের নিজ সত্তা থেকে নয়। মানুশের নিজেকে একটা শুভ সত্তা হিসেবে কল্পনার ইতিহাস অনেক প্রাচিন। আদি মানুশের নিজের অশুভ সত্তাকে নিজের বাইরের কোনো সত্তা আকারে দেখা অস্বাভাবিক নয়। আর দুষ্ট প্রকৃতির মানুশকে পিশাচ, শয়তান, ইত্যাদি বিমানবিক সত্তার প্রতিনিধি আকারে দেখার প্রবণতা এই কালেও আছে। শয়তান নামক অপর সত্তার উপর নিজ মন্দ কাজের দায় অর্পন করার যে সুযোগ মানুশ জ্বীন বা শয়তান শব্দের ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত অর্থে খুঁজে পায় তা মানুশ অবচেতনভাবেই গ্রহণ করে। জ্বীনের একটা অর্থ হতে পারে মানুশের নফস যা থেকে আসে অন্যায় ও গর্হিত কাজের অসওয়াসা। শয়তানকে বলা যায় ফ্রয়েডিয়ান আনকনসাস যা অজানা, গুপ্ত অপর হিসেবে মানব মনের গহীনে অস্তিত্বশীল।
কেয়ামত
কেয়ামত শব্দের আছে বিবিদ দ্যোতনা। সৃষ্টির নিয়মেই আছে ধ্বংশের পরিণতি। এই বিশ্বজগত একদিন ধ্বংস হবেই। কেয়ামত শব্দে এই মহা ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র আঁকা হয়। কেয়ামত শব্দের আরেকটা অর্থ বিরাট বিপর্যয়। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে মানবজাতি বহু বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। এই বিপর্যয়গুলোকে একেকটা কেয়ামত হিসেবে দেখা যেতে পারে। কেয়ামতের ভবিষ্যতবানি সংক্রান্ত যেসব আয়াতে ও হাদিসে বিভিন্ন নিদর্শনের বর্ণনা আছে সেসব একেকটা ভিন্ন ভিন্ন বিপর্যয়ের নিদর্শন হতে পারে এমন সম্ভাবনাকে বাতিল করতে পারি না আমরা। এমন হওয়া জরুরি নয় যে সবকটি নিদর্শন কেবল একটা মহা বিপর্যয় বা দুনিয়ার চুড়ান্ত ধ্বংশের আলামত আকারে বর্ণিত।
সূরা কাহাফে বর্ণিত জুলকারনাইন আখ্যান উদাহরন হিসেবে হাজির করা যায়। দেয়াল ভেঙে ইয়াজু-মাজুজের বেরিয়ে আসাকে কেয়ামতের নিদর্শন আকারে বর্ণনা করা হয়েছে। এই বর্ণনায় মানুশের জাহান্নাম দর্শনের কথাও আছে। প্রথমত দুনিয়ার চুড়ান্ত ধ্বংস অর্থে কেয়ামত সংঘটিত হলে কেবল জাহান্নাম দেখা যাবে না। জান্নাতও দেখা যাবে একই সাথে। ঐতিহ্যবাদি বর্ণনায় মানুশের একটা অংশ জান্নাতের দিকে এবং আরেকটা অংশ জাহান্নামের দিকে যাত্রা করবে। কিন্তু সূরা কাহাফে ইয়াজুজ-মাজুজের সাথে কেবল জাহান্নামকে সম্পর্কিত করা হয়েছে। মূলত এখানে জাহান্নামের আছে ভিন্ন অর্থ। ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাবে যে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে মানবজাতি তাকে কেয়ামত বলা যায় এবং তাদের ধ্বংসজ্ঞে দুনিয়া পরিণত হবে জাহান্নামে। ফলে সঙ্গত কারনেই ইয়াজুজ-মাজুজের বর্ণনায় জান্নাতের কথা নেই।
কেয়ামতের আরো আছে আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা। পারিবারিক ও সামাজিক উত্তারাধিকার ও শিক্ষার সূত্রে উপলব্ধিহীন ধর্ম বিশ্বাসে দীক্ষিত হওয়া মানুষ যখন একদিন অনুভব করে তার সত্যের উপলব্ধি নেই। সত্যের স্বরূপ তার অজানা। এই উপলব্ধি তাকে নির্জ্ঞনতার স্তরে নামিয়ে দেয়। এই দিনটা তার জীবনে বিপর্যয় নিয়ে আসে। সে পতিত হয় এক মহা আত্মিক সংকটে। এই সংকট তার জীবনে একটা কেয়ামত। তার সত্যের জার্ণি শুরু হয়। আবার যখন সত্যের দেখা মেলে একদিন, তার রুহ জীবন প্রাপ্ত হয়। আত্মিক পুনরুল্থান ঘটে তার। তার হয় আত্মজ্ঞান। আত্মকে অতিক্রম করে যখন সে খোদামূখী হয়ে উঠে সে প্রবেশ করে বেহেস্তি জীবনে।
ইয়াওমুদ্দিন - বিচার দিবস
বিচার দিবসের (ইয়াওমুদ্দিন) আছে বিবিদ অর্থ ও তাৎপর্য। ইয়াওমুদ্দিন ধারণার ঐতিহ্যবাদি তাফসির বিশ্বজগত ধ্বংস সংক্রান্ত কেয়ামত দিবসের সাথে সম্পর্কিত। কেয়ামতের পর সব মানুশ পুনরুল্থিত হয়ে সমবেত হবে হাশর নামক এক ময়দানে যেখানে আল্লাহ এক বিচার সভার আয়োজন করবেন। এই ঐতিহ্যবাদি তাফসিরের বাইরেও দ্বীন শব্দের আছে ভিন্ন তাৎপর্য। দ্বীন শব্দের মৌলিক অর্থ বিচার বা ন্যায়বিচার। ইসলামের প্রতিশব্দ হিসেবেও দ্বীন শব্দের মশহুর ব্যবহার আছে যার ইঙ্গিত হলো মানুশের জীবনে ইসলাম কায়েম হলে ন্যায়বিচার কায়েম হবে। ইব্রাহিমি ঐতিহ্যে জালিমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার তথা দ্বীন কায়েম ধর্মের মৌলিক প্রবণতা। জালিম রাজা নমরুদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে নবী ইব্রাহিমকে (আ:)। নবী মূসাকে (আ:) ফেরাউনের বিরুদ্ধে। নবী দাউদকে (আ:) তালুতের সাথে। নবী মুহম্মদকে (স:) মক্কার কোরাইশ গোত্রপতিদের সাথে। ইব্রাহিমি ধর্মঐতিহ্যে মাহাদি বা মেসিহার আবির্ভাব ধারনার সাথে কেয়ামত ধারনার তাৎপর্যও বুঝা যেতে পারে ভিন্নভাবে। মাহাদির নেতৃত্বে মানুশের মৃত সত্তার পুনরুল্থান হবে। ন্যায়বিচার কায়েমে যে বিপ্লব তাতে আত্মিকভাবে অনুপ্রাণিত ও পুনরুল্থিত বিশাল সংখ্যক মানুশকে সমবেত হতে হয় রাজপথের ময়দানে। হাশর শব্দের একটি অর্থ হতে পারে এই বিপ্লবী ময়দান। প্রতিটি বিপ্লবের পর বিচারের মুখোমুখি হতে হয় জালিমদের। সব জালিম ক্ষমতাতন্ত্রের একটা শেষ বিচারের দিন থাকে। প্রতি যুগেই মাহাদিরা আসবে। প্রথা ও ঐতিহ্যের পর্দার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া ধর্ম পুনরুজ্জিবিত হবে। মাহাদির আগমন মাত্রই বিদ্যমান ক্ষমতাতন্ত্রের ধ্বংশ তথা কেয়ামত অনিবার্য।
জাহান্নাম যে কেবল শেষবিচারের পর শাস্তির স্থান বুঝায় না বরং দুনিয়ার বিবিদ মানবিক বিপর্যয়ের কালকেও বুঝায় তার একটা উদাহরণ উপরের অনুচ্ছেদেই দেয়া হয়েছে। জাহান্নামের আরো অর্থ হতে পারে মানুশের আধ্যাত্মশুণ্য বিপর্যস্ত অবস্থাকেও যার প্রজ্বলিত আগুন গ্রাস করে তার হৃদয় (সূরা মাউন)। খোদামূখি নয় যে জীবন তাতে থাকে লোভ, হিংসা, ঘৃণা, অহংকার, স্বার্থপরতা সহ উনমানুশের সব স্বভাব যা মানুশের অন্তর্গত প্রশান্তি ধ্বংশ করে দিয়ে জীবনকে জাহান্নাম করে তুলে। অন্যদিকে জান্নাতের একটা অর্থ হতে পারে মানুশের খোদামূখি এমন এক নির্বানপ্রাপ্ত জীবন যা কোনো দুঃখ বা যাতনা দ্বারা তাড়িত হয় না। এ জীবন পরম এক প্রশান্তির নিধান। জান্নাত আদমের খোদামূখী জীবনের প্রতিক। বেহেস্তের দরজা খুলে খোদাকে চেনার মধ্য দিয়ে। খোদার প্রেমে আত্মহারা মানুশ যখন তার কাঙ্খা দিয়ে নির্মিত দুনিয়া অতিক্রম করে এমন এক জগতে এসে হাজির হয় যেখানে তাকে আর স্পর্শ করে না কোনো অপ্রাপ্তির গ্লানি। হৃদয়ে জমে থাকা ঘৃণা, বিদ্ধেষ, হিংসা, অহংকার সহ সব অন্ধকার পর্দা পুড়ে ছাই হয়ে গেলে এক অন্তহীন প্রশান্তির দরিয়া প্রবাহিত হয় তার হৃদয়ের বাগানে। তখন মানুশের পুনরুল্থান ঘটে। হয় তার খোদা দর্শন। দুনিয়ার দিক থেকে মানুশের খোদা দর্শনই বেহেস্তের সর্বোচ্চ মকাম। আখিরাতের দিক থেকে সর্বোচ্চ মকাম হলো রুহের তার রবের কাছে ফীরে যাওয়া।
কোরআনে ব্যবহৃত শব্দের অর্থের ঐতিহাসিক সীমা অতিক্রম করতে পারলে কোরান প্রকৃত অর্থেই স্থান-কালের সীমা অতিক্রম করে তার মর্ম জাহের করতে সক্ষম হয়ে উঠে। কোরআনের আক্ষরিকতাই আদতে শব্দের ঐতিহাসিক সীমা। কোরআনের সত্যান্বেষী পাঠককে তাই শব্দের আরো বহু ঠিকানা খুঁজে নেয়ার সাধনা করতে হয়।
লেখার তারিখ: ২৬ জুলাই ২০২১ / ক্রেডিট: মোকাররম হোসাইনের ফেসবুক দেয়াল