শওকত জাওহার, রিসার্চ ফেলো, দি ইক্বরা
আল কুরআনে কোনো আয়াতে কাউকে ত্যাজ্য পুত্র করার অনুমোদন দেয়া হয়নি।
প্রশ্ন হতে পারে যে, যদি কাউকে ত্যাজ্য পুত্র করার বিষয়ে কুরআন নীরব থাকে, সেক্ষেত্রে এটাকে ‘অনুমোদন’ বলে ধরা যেতে পারে কিনা? এর জবাবে জ্ঞাতব্য যে, ৮:৭৫, ৩৩:৬, ৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াত অনুযায়ী সন্তানরা তাদের পিতা-মাতার সম্পদের উত্তরাধিকারী হবে। সুতরাং এ আয়াতসমূহের ভিত্তিতে স্পষ্ট হয় যে, কাউকে ত্যাজ্য-পুত্র বলে ঘোষণা দিয়ে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা আল কুরআন পরিপন্থী ও অবৈধ।
নিম্নে আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হলো:
৮:৭৫ :: আর যারা পরবর্তী পর্যায়ে ঈমান এনেছে এবং হিজরত করেছে এবং তোমাদের সাথে জিহাদ করেছে, তারা তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর বিধান অনুসারে রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়গণ একে অপরের প্রতি অগ্রাধিকারী। নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞানী।
৩৩:৬ :: আর নবী মু’মিনদের প্রতি তাদের নিজেদের চেয়ে ঘনিষ্ঠতর এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মাতাস্বরূপ। আল্লাহর বিধান অনুসারে মু’মিনগণ ও মুহাজিরদের চেয়ে রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়গণ একে অপরের প্রতি অগ্রাধিকারী। তবে এটা ভিন্ন বিষয় যে, তোমরা তোমাদের বন্ধু-বান্ধবের প্রতি ভাল কিছু (তথা অনুদান ও ওয়াসিয়্যাত) করবে। এটি বিধানে লিপিবদ্ধ।
৪:৭ :: পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ যা রেখে যায় তা থেকে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ যা রেখে যায় তা থেকে নারীদেরও অংশ আছে। তা থেকে কম হোক বা বেশি হোক, নির্ধারিত হারে প্রাপ্য অংশ।
৪:৩৩ :: পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ যা ছেড়ে যায় তার প্রত্যেকটির জন্য আমি নির্দিষ্ট উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করে দিয়েছি। আর যাদেরকে তোমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছো, তাদেরকে তাদের প্রাপ্য অংশ দিয়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে স্বাক্ষী।
তা সত্ত্বেও যদি কোনো পিতা তার সন্তানকে ত্যাজ্য পুত্র করে এবং উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার ওয়াসিয়্যাত করে যায় তাহলে ঐ পুত্র এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বসম্পন্নদের নিকট অন্যায্যতার অভিযোগ এবং ওয়াসিয়্যাত অনুযায়ী বণ্টনের ক্ষেত্রে সংশোধনীর জন্য আবেদন করতে পারবে। অর্থাৎ তার আইনী সহায়তা নেওয়া / arbitration (শালিস) এর সুযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে যদি ওয়াসিয়্যাতের সাক্ষীরা ত্যাজ্য পুত্রের বিষয়টি উত্থাপন করে সে অবস্থায় ঐ পুত্রের যথার্থ হক্ব বিবেচনায় তার ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্য অগ্রাধিকার পাবে। কুরআনে বিল মারুফ শব্দটি এখানে লক্ষ্যনীয় যার অর্থ ন্যায় সঙ্গত বা ন্যায়মূলকভাবে। সুতরাং ত্যায্য করা হলেও সেটি যদি অন্যায্য হয় তবে সেটির প্রতিকার চাওয়ার অধিকার ভুক্তভোগীর রয়েছে।
এ বিষয়ে ২:১৮০-১৮২ এবং ৫:১০৬-১০৮ আয়াত দ্রষ্টব্য।
২:১৮০ :: তোমাদের উপর বিধিবদ্ধ করা হলো যে, তোমাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু সন্নিকটে এসে গেলে যদি সে সম্পদ রেখে যায় তবে সে তার পিতা-মাতার জন্য এবং অন্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ন্যায়সঙ্গত ওয়াসিয়্যাত করতে হবে। এটা আল্লাহ সচেতনদের উপর দায়িত্ব।
২:১৮১ :: তারপর যে ব্যক্তি তা শুনার পর সেটাকে (তথা ওয়াসিয়্যাতকে) বদলে দেয়, তবে সেটার (তথা বদল করার) অপরাধ বদলকারীদের উপর বর্তাবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
২:১৮২ :: তবে যে ব্যক্তি ওয়াসিয়্যাতকারী কর্তৃক পক্ষপাতিত্ব হয়েছে বা/এবং (বঞ্চিত করার) অপরাধ হয়েছে বলে আশংকা করে, তারপর সে তাদের মধ্যে(১) বিষয়টি সংশোধন করে দেয় তাহলে এতে তার অপরাধ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াশীল।
(১) অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ে ওয়াসিয়্যাতকারী ও ওয়াসিয়্যাতকৃতদের মধ্যে। যদি ওয়াসিয়্যাতকারীর মৃত্যু ঘটে তবে ওয়াসিয়্যাতকৃত বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে।
৫:১০৬ :: হে মু’মিনগণ, যখন তোমাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু সন্নিকটে এসে যায় তখন তোমরা ওয়াসিয়্যাত করার সময় তোমাদের মধ্য থেকে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখো। অথবা যদি তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং এ অবস্থায় তোমাদের কাছে মৃত্যুর মুসিবত এসে পড়ে তাহলে (তোমাদের নিজেদের মধ্যকার লোক না পেলে) তোমাদের বাইরের (তথা অন্য অঞ্চলের) দুইজনকে সাক্ষী রাখো। তাদের দুইজনকে সালাতের পরে অপেক্ষমান রাখবে। যদি তোমরা সন্দেহ করো তবে তারা উভয়ে আল্লাহর নামে কসম করবে: “আমরা কোনো মূল্যেই তা (তথা সাক্ষ্য) বিক্রয় করবো না, যদিও আত্মীয় হয় আর আমরা আল্লাহর নির্দেশিত সাক্ষ্যকে গোপন করবো না। নিশ্চয় তাহলে আমরা অপরাধীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।”
৫:১০৭ :: তারপর যদি লক্ষণ পাওয়া যায় যে, তারা দুজন অপরাধমূলক দাবি করেছে (তথা সাক্ষ্যে হেরফের করেছে), তাহলে তাদের দুজনের দাবিগত অবস্থানের বিপরীতে অন্য দুজন দাঁড়াবে, যারা হবে তাদের (সাক্ষ্যের) বিপক্ষে অধিকার(২) দাবিকারীদের মধ্য থেকে এবং ঘনিষ্ঠতর/অগ্রাধিকারী(৩)। তারপর তারা আল্লাহর নামে কসম করবে: “আমাদের সাক্ষ্য তাদের দুইজনের সাক্ষ্যের চেয়ে অধিক যথাযথ। আর আমরা সীমালংঘন করিনি। নিশ্চয় তাহলে আমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।”
(২) তথা পরিত্যক্ত সম্পদের অধিকার বা সাক্ষ্যের অধিকার।
(৩) তথা মৃত ব্যক্তির আত্মীয়তায় ও উত্তরাধিকারের প্রশ্নে অগ্রাধিকারী [বা সাক্ষ্যদানের অধিক উপযুক্ত]।
৫:১০৮ :: এ পদ্ধতিই (এ সম্ভাবনার) নিকটতম যে, তারা সঠিক রূপেই সাক্ষ্য দিবে অথবা তারা ভয় করবে যে, তাদের শপথের পরে(৪) তাদের শপথকে(৫) রদ করা হবে। আর তোমরা আল্লাহ সচেতন হও এবং (যথানিয়মে) শুনো। আর নিশ্চয় আল্লাহ নীতি বিচ্যুত সম্প্রদায়কে পথনির্দেশ করেন না।
(৪) তথা পরবর্তী দুইজন সাক্ষীর শপথের পরে।
(৫) তথা পূর্ববর্তী মূল দুইজন সাক্ষীর শপথকে।
রাষ্ট্রিয় আইনের দৃষ্টিতে
মুসলিম পারিবারিক আইন ও হিন্দু আইন অনুযায়ী, বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কটা কোনো চুক্তি নয়। এই সম্পর্ক বিবাহ, তালাক বা দাসমুক্তির মতো না। এটি চাইলেই যে কোনো সময় ভেঙে ফেলা যায় না। মনে রাখতে হবে– রক্তের সম্পর্ক কখনও মুখের কথায় পরিবর্তন করা সম্ভব নয়; এটি স্থায়ী বিষয়।
তবে বাবা-মা চাইলে তার সম্পদ থেকে সন্তানকে বঞ্চিত করতে পারে। তবে সন্তানদের ত্যাজ্য করে নয়।
কেউ সন্তানকে ত্যাজ্য করলে তা ধর্মীয় বা রাষ্ট্রীয় কোনো নিয়মেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এ ধরনের নীতিমালা ইসলাম ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। - অ্যাডভোকেট আবুল হাসান, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
... তাই এই ধরনের ত্যাজ্য যদি কেউ করে, তাহলে সেই ত্যাজ্যের বিষয় ধর্মীয় বা রাষ্ট্রীয় কোনো নিয়মেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এই ধরনের নীতিমালা না ইসলামে আছে, না রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোথাও লিপিবদ্ধ আছে।
কিন্তু ত্যাজ্যপুত্র বা কন্যা বলতে কোনো আইনি বিধান না থাকলেও মা-বাবা ইচ্ছে করলে তাঁর সব সম্পত্তি সাফ কবলা রেজিস্ট্রি বা দান করে অপর সন্তানকে বঞ্চিত করতে পারেন। তবে সাফ কবলা বা দান লিখিত ও রেজিস্ট্রিকৃত না হলে ত্যাজ্যপুত্র বা ত্যাজ্য কন্যা বললেই বা ঘোষণা করলেই সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হবে না। সম্পর্ক ছিন্নও হবে না।
মুসলিম আইন অনুযায়ী, কাউকে ত্যাজ্যপুত্র করা বা মৃত্যুর সময় অসিয়তের মাধ্যমে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হারাম এবং অবৈধ। শরিয়তের দৃষ্টিতে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই যাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করা হয় কিংবা যাকে তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার অসিয়ত করা হয়, সে কোনোভাবেই তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। - অ্যাডভোকেট আবুল হাসান, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
অন্যান্য সুত্র:
আইন জিজ্ঞাসা- সন্তানকে কি ত্যাজ্য করা যায়?
সন্তানকে ত্যাজ্য করা কি আইনসঙ্গত