সিয়াম

আল কুরআনের আলোকে সিয়াম

স্রষ্টা সচেতন জীবন যাপনে আত্মসংযমের প্রশিক্ষণ

বইটি সম্পর্কে

‘আল কুরআনের আলোকে সিয়াম’ বইটিতে সিয়াম সম্পর্কে কুরআনের তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিয়ামের সংজ্ঞা, উদ্দেশ্য, পদ্ধতি বা করণীয়, সময়কাল, প্রকারভেদ এবং সংশ্লিষ্ট ধারা-উপধারা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। যেহেতু সিয়াম বিষয়ে আয়াত সংখ্যা খুব বেশি নয়, কুরআনে সিয়াম শব্দটি এর বিভিন্ন শব্দরূপে মাত্র ১৪ বার ব্যবহৃত হয়েছে, তাই সিয়াম সম্পর্কে কুরআনের তথ্যগুলো সমাজে মোটামুটি প্রচলিত রয়েছে। তা সত্ত্বেও সিয়ামের তাৎপর্য বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে ব্যাপক উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয় এবং তা প্রমাণ করে যে, সমাজে সিয়াম সম্পর্কিত আলোচনায় এ বিষয়ে যথানিয়মে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। সিয়াম যে শুধু আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ নয় এবং কোনো সীমিত দিনসংখ্যার সাথে সম্পর্ক ছাড়া সিয়ামের উল্লেখ করলে তা যে সিয়ামের মূল অর্থ (আত্মসিংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ) অনুসারে ‘আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় তথা যাবতীয় অন্যায় থেকে নিজেকে বিরত রাখা’ বুঝায়, এ বিষয়টি তেমন আলোচিত হয় না।এ ছাড়াও সিয়ামের মাস ‘শাহরু রমাদান’ (রমাদানের মাস) সম্পর্কে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা ছাড়া চান্দ্রবর্ষের নবম মাসই রমাদানের মাস হিসেবে সমাজে প্রচলিত করে দেয়া হয়েছে। কুরআন নাযিলের মাসটিকে সঠিক নিয়মে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে তার অর্থগত তাৎপর্য এবং হারাম মাসসমূহের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে বিবেচনায় নেয়া হয় না। এ বইয়ে বিষয়টি বিস্তারিত পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে, ‘রমাদানের মাস’ হলো হারাম মাসসমূহের (বন্য পশু সংরক্ষণের এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বিরতির জন্য সংরক্ষিত মাসসমূহের) অন্তর্ভুক্ত প্রথম মাস এবং তাই সার্বিক বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, তা Spring Equinox কে অন্তর্ভুক্তকারী বসন্ত ঋতুর প্রথম মাস। ‘শাহরু রমাদানে সিয়াম সংখ্যা কত?’ এ বিষয়েও আয়াতের তথ্য সমন্বয়ের ভিত্তিতে সমাধানে পৌঁছার চেষ্টা করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে ব্যাপক এ বইয়ে গৃহীত অনুসিদ্ধান্তের ভিত্তিমূলক তথ্য বিশ্লেষণ বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর ইফতারের সময়সীমা নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে যে, তা কি সন্ধ্যায় নাকি সন্ধ্যা পরবর্তী রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? কুরআন অনুসারে সিয়াম পূর্ণ করার সময়সীমা হলো ‘ইতমাম’, যদিও বর্তমানে তা ‘ইফতার’ শব্দে প্রচলিত। এ মতপার্থক্যের সমাধানের ক্ষেত্রেও এতে বিস্তারিত গবেষণামূলক পদ্ধতিতে তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি অনুসিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে পাঠককে উপস্থাপিত বিশ্লেষণকে যাচাই করে নিজ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মনস্থির করতে হবে, যদি আয়াতের ভিত্তিতে অধিকতর যাচাইয়ের মাধ্যমে কোথাও বিশ্লেষণগত ত্রুটি চিহ্নিত হয়, পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধিত করা হবে ইনশাআল্লাহ।যেহেতু সিয়াম কুরআনে প্রদত্ত একটি বিধিবদ্ধ বিধান এবং কুরআনে এর বিস্তারিত পদ্ধতি ও বিভিন্ন অবস্থায় বিকল্প করণীয়সমূহ বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, তাই কুরআন থেকেই সিয়াম সম্পর্কিত বিস্তারিত ধারণা লাভ ও উপস্থাপন করার উদ্দেশ্যেই বইটিতে প্রয়াস নেয়া হয়েছে। কারণ কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী এতে আল্লাহ তাঁর সীমাসমূহ স্পষ্টভাবে বিশদ বর্ণনা করেছেন এবং মু’মিনরা তা স্পষ্টভাবে অনুধাবনের জন্য তাদেরকে তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতে হবে এবং কুরআন দ্বারা একে অন্যকে উপদেশ বা স্মরণীয় তথ্য স্মরণ করিয়ে দিতে হবে এবং পরামর্শের মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে কর্ম সম্পাদন করতে হবে। সুতরাং কুরআনের আলোকে সিয়ামের সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন ও উদ্দেশ্য অর্জনে তথ্যগত সহযোগিতার উদ্দেশ্যে বইটি রচিত হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগ্রহে আগ্রহী পাঠকবৃন্দ তাতে প্রাসঙ্গিক তথ্যসমূহ একসাথে পেয়ে উপকৃত হতে পারেন।

ভূমিকা

এক নজরে মূল প্রতিপাদ্য

১. সিয়াম শব্দটির মূল অর্থ হলো ‘আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ’। সুতরাং সিয়াম বলতে নিছক উপবাস বুঝায় না, বরং যখন আত্মসংযমের প্রশিক্ষণ হিসেবে উপবাস করা হয় তখন সেটা আনুষ্ঠানিক সিয়াম হয়। আর বাস্তবে আত্মসংযমের মাধ্যমে কোনো অন্যায় বিষয় ও কাজ থেকে বিরত থাকাই হলো বাস্তব বা ব্যাপকার্থে সিয়াম।

২. যখন কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য সিয়াম করতে নির্দেশ দেয়া হয় তাতে আনুষ্ঠানিক সিয়ামকে বুঝানো হয়। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য সিয়ামের নির্দেশনার বাহিরে একটি গুণ বা বিশেষণ হিসেবে সিয়ামের কথা বলা হলে তা দ্বারা সার্বক্ষণিক সিয়াম বা সংযমকে বুঝানো হয় বা যে কোনো অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকাকে বুঝানো হয়।

৩. সিয়ামের উদ্দেশ্য হলো আত্মসংযমের মাধ্যমে তাক্বওয়া বা আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বনের শিক্ষা গ্রহণ করা। সিয়ামের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে জ্ঞাত থেকে সিয়াম সাধনা হিসেবে উপবাস করলে তা কল্যাণকর হবে, কিন্তু সিয়ামের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে অজ্ঞতা থাকলে নিছক রমাদানের মাসে উপবাস থাকার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই।

৪. সিয়ামের বিধান শুধুমাত্র কুরআনেই দেয়া হয়নি, বরং পূর্ববর্তী ঐশী কিতাবসমূহেও এর বিধান ছিলো। অর্থাৎ পূর্ববর্তী জাতিদেরকেও সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছিলো। কুরআনে পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে মারইয়ামের সিয়াম সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি মৌনতা অবলম্বনের সিয়াম করেছেন। আর ইন্দ্রয়ের সংযম পালনকারী হিসাবে নবী ইয়াহিয়ার উল্লেখ রয়েছে সিয়ামের সাধারণ রূপ হলো পানাহার না করা। কিন্তু এ সাধারণ রূপের বাইরেও আনুষ্ঠানিক সংযম সাধনা (সিয়াম) হতে পারে, যেমন মৌনতা অবলম্বন করা।

৫. পূর্ববর্তীদের সিয়াম পালনের মধ্যে আমরা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করি। সময় সীমার দিক থেকে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে ১ দিন থেকে শুরু করে ৪০ দিন পর্যন্ত সিয়াম পালন সম্পর্কে জানা যায়। এছাড়া বিভিন্ন মাসে বা প্রত্যেক মাসে এক দিন বা কয়েক দিন করে সিয়াম পালনের বিষয়ও রয়েছে।

৬. কুরআন নাযিলের সূচনার মাস হিসেবে সিয়ামের জন্য রমাদানের মাসকে নির্বাচন করা হয়েছে। কুরআনের প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি মানবজাতির জন্য পথনির্দেশ, পথনির্দেশের স্পষ্ট প্রমাণবহ বিবরণ এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী মানদণ্ড। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহ সচেতন জীবন যাপনে যোগ্য করে তোলা কুরআনরূপ নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং আল্লাহর বড়ত্ব-মহিমা ঘোষণারও একটি উপায়। আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াত অনুযায়ী আত্মনিয়ন্ত্রণই প্রকৃত সিয়াম।

৭. আল্লাহ আমাদের জন্য সহজতা চান, তিনি আমাদের জন্য কঠিনতা চান না। তাই তিনি আমাদেরকে সিয়ামের বিধানে বেশ কিছু সহজতার অবকাশ দিয়েছেন। যেমন: (ক) যে ব্যক্তি রমাদানের মাসে অসুস্থ থাকবে বা সফরে থাকবে সে ঐ দিনগুলোর সিয়াম সমান সংখ্যায় পরবর্তী অন্য দিনসমূহে করতে পারবে। (খ) যে ব্যক্তি সিয়াম করার ক্ষেত্রে অতিকষ্টে সক্ষম বা তাতে কোনো বিশেষ অসুবিধায় পরিবৃত (encircled) থাকে, সে সিয়াম না করে প্রতিটি সিয়ামের পরিবর্তে ফিদইয়া (দায়মুক্তি স্বরূপ ব্যবস্থা) হিসেবে কোনো মিসক্বীনের খাদ্য দান করতে পারে।

৮. আল্লাহ আমাদের অত্যন্ত নিকটেই রয়েছেন এবং আমাদের প্রতিটি আহবানে সাড়া দেন। আমরা যদি তাঁর নৈকট্য (সন্তুষ্টি) অর্জন করতে হয় তাহলে আমাদেরকেও তাঁর আহবানে সাড়া দিতে হবে। তিনি আমাদেরকে সন্ন্যাসব্রত অবলম্বনের উদ্দেশ্যে সিয়ামের বিধান দেননি, বরং এটা একটা সীমিত সময়ের প্রশিক্ষণমূলক ব্যবস্থা মাত্র। তাই সিয়ামের দিনের বেলা স্ত্রী সংসর্গ নিষিদ্ধ হলেও রাতের বেলায় তা নিষিদ্ধ নয়, বরং আল্লাহ স্বামী-স্ত্রীকে একে অন্যের পোশাক স্বরূপ সৃষ্টি করেছেন। তাই তারা পরস্পরের থেকে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখবে, এটাই আল্লাহ প্রদত্ত প্রকৃতিগত নির্দেশনা।

৯. আনুষ্ঠানিক সিয়াম হলো দিনের বেলায় পানাহার থেকে বিরত থাকা, আর অনানুষ্ঠানিক বাস্তব সিয়াম হলো জীবনব্যাপী যাবতীয় অবৈধ ভক্ষণ থেকে বিরত থাকা। তাই বিধিবদ্ধ সিয়াম সম্পর্কিত আয়াতসমুহের উপসংহারমূলক আয়াতটিতে (২:১৮৮) অন্যায় পন্থায় অন্যের সম্পদ খাওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদি প্রথমটি পালন করা হয় অর্থাৎ রমাদানের মাসে দিনের বেলায় কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকা হয়, কিন্তু দ্বিতীয়টি পালন করা না হয় অর্থাৎ অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে খাওয়া থেকে বিরত থাকা না হয়, তাহলে প্রথমটির উদ্দেশ্য অর্জিত হবে না বা সেক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক সিয়াম ব্যর্থ হবে।

১০. মাসজিদে এ’তেকাফ করার অর্থ হলো আল্লাহর বিধান অনুধাবন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে নেয়া সময়কালে গভীর ধ্যান বা চিন্তামগ্নতা, আত্মনিয়োজিত থাকা এবং মাসজিদে অবস্থান করা, তা কোনো সাময়িক আশ্রয়ের জন্যও হতে পারে। মাসজিদে এ’তেকাফ করার সময় স্ত্রীমিলন থেকে বিরত থাকতে হবে। মাসজিদে এ’তেকাফকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি এবং এজন্য কোনো মাস ও দিনসংখ্যাও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। তবে সিয়াম সম্পর্কিত আয়াতসমূহের মধ্যে এ’তেকাফের বিধান দেয়ার কারণে রমাদানের মাসেই এ’তেকাফের অনুশীলন বেশি হয়ে থাকে। তবে রমাদানের মাসে এবং রমাদানের মাস ছাড়াও অন্য মাসে এ’তেকাফ হতে পারে। সাধারণত ১০ দিন এ’তেকাফের রীতি থাকলেও তা পূর্ণ মাস অথবা তার চেয়ে বেশিও করা যেতে পারে, আবার যে কোনো সংখ্যক দিন এমনকি মাত্র ১ দিনও করা যেতে পারে।

১১. রমাদানের সিয়াম ছাড়াও আরো দুই ধরনের সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে, তা হলো: ফিদইয়া (দায়মুক্তি স্বরূপ) সিয়াম এবং কাফফারা (দোষমোচন স্বরূপ) সিয়াম। ফিদইয়া স্বরূপ সিয়াম হলো হজ্জের সময় হাদিয়া (উপহার) জমা দেয়ার আগে মাথামুণ্ডন করলে সিয়াম করতে হবে। আর কাফফারা স্বরূপ সিয়াম হলো, কেউ কোনো মু’মিনকে ভুলক্রমে হত্যা করলে, কেউ শপথ ভঙ্গ করলে, কেউ হারাম মাসসমূহে কোনো বন্যপ্রাণীকে হত্যা করলে এবং কেউ যিহার (স্ত্রীকে মা হিসেবে প্রকাশ করার কুপ্রথা চর্চা) করলে তাকে তার দোষ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রদত্ত ব্যবস্থার মধ্যে সিয়ামের বিধানও রয়েছে।

১২. বিধিবদ্ধ সিয়ামের মাস এবং কুরআন নাযিলের মাস হলো রমাদানের মাস। কিন্তু রমাদানের মাস নির্ণয়ের উপায় কী? এ বিষয়ে এ বইয়ে বিস্তারিত গবেষণামূলক তথ্যের মাধ্যমে যে অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়েছে তা হলো: রমাদানের মাস হারাম মাসসমূহের (বন্য পশু সংরক্ষণের এবং বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতি সংরক্ষিত মাসসমূহের) অন্তর্ভুক্ত প্রথম মাস, যা ‘শাহরু রমাদান’ শব্দটির অর্থ বিশ্লেষণ থেকেও বুঝা যায়, আর তাই এটি হলো বসন্ত ঋতুর প্রথম মাস। কুরআনময় বসন্তে তাক্বওয়ারূপ ফসলের পরিচর্যার জন্য সিয়ামরূপ সাধনাকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে।

সিয়াম সম্পর্কিত আয়াতসমূহ

يَا  أَيُّهَا  الَّذِينَ  آمَنُوا  كُتِبَ  عَلَيْكُمُ  الصِّيَامُ  كَمَا  كُتِبَ  عَلَى  الَّذِينَ  مِن  قَبْلِكُمْ  لَعَلَّكُمْ  تَتَّقُونَ

২:১৮৩ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের উপর সিয়াম (আত্মসংযম) বিধিবদ্ধ করা হলো যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর বিধিবদ্ধ করা হয়েছিলো, যেন তোমরা তাক্বওয়া (আল্লাহ সচেতনতা) অবলম্বন করতে পারো।

أَيَّامًا  مَّعْدُودَاتٍ  فَمَن  كَانَ  مِنكُم  مَّرِيضًا  أَوْ  عَلَىٰ  سَفَرٍ  فَعِدَّةٌ  مِّنْ  أَيَّامٍ  أُخَرَ  وَعَلَى  الَّذِينَ  يُطِيقُونَهُ  فِدْيَةٌ  طَعَامُ  مِسْكِينٍ  فَمَن  تَطَوَّعَ  خَيْرًا  فَهُوَ  خَيْرٌ  لَّهُ  وَأَن  تَصُومُوا  خَيْرٌ  لَّكُمْ  إِن  كُنتُمْ  تَعْلَمُونَ

২:১৮৪ :: (সহজে) গণনাযোগ্য কয়েক দিন। তবে তোমাদের মধ্য থেকে যে অসুস্থ থাকবে বা সফরে থাকবে, সেক্ষেত্রে গণনা (সমন্বয় করতে হবে) অন্য দিনসমূহ থেকে। আর যারা তাতে (সিয়াম পালনে) অতিকষ্টে সক্ষম / বিশেষ অসুবিধায় পরিবৃত (encircled) অবস্থায় অসাবলীলভাবে সক্ষম তাদের উপর দায়িত্ব হলো ফিদইয়া স্বরূপ অভাবগ্রস্তকে খাওয়ানো। আর যে ব্যক্তি স্বত:স্ফূর্তভাবে উত্তম কাজ / কল্যাণকর্ম করে সেটা তার জন্যই উত্তম / কল্যাণকর। আর তোমরা সিয়াম পালন করা তোমাদের জন্য উত্তম / কল্যাণকর; যদি তোমরা (এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে) জানতে পারো!

شَهْرُ  رَمَضَانَ  الَّذِي  أُنزِلَ  فِيهِ  الْقُرْآنُ  هُدًى  لِّلنَّاسِ  وَبَيِّنَاتٍ  مِّنَ  الْهُدَىٰ  وَالْفُرْقَانِ  فَمَن  شَهِدَ  مِنكُمُ  الشَّهْرَ  فَلْيَصُمْهُ  وَمَن  كَانَ  مَرِيضًا  أَوْ  عَلَىٰ  سَفَرٍ  فَعِدَّةٌ  مِّنْ  أَيَّامٍ  أُخَرَ  يُرِيدُ  اللَّهُ  بِكُمُ  الْيُسْرَ  وَلَا  يُرِيدُ  بِكُمُ  الْعُسْرَ  وَلِتُكْمِلُوا  الْعِدَّةَ  وَلِتُكَبِّرُوا  اللَّهَ  عَلَىٰ  مَا  هَدَاكُمْ  وَلَعَلَّكُمْ  تَشْكُرُونَ

২:১৮৫ :: রমাদানের মাস, যাতে আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, মানবজাতির জন্য পথনির্দেশ এবং পথনির্দেশ সম্পর্কিত স্পষ্ট প্রমাণ এবং (সত্য-মিথ্যার) পার্থক্যকারী হিসেবে। সুতরাং তোমাদের মধ্য থেকে যে মাসটিকে প্রত্যক্ষ করবে / মাসটির সাক্ষ্য দেবে সে তাতে সিয়াম পালন করবে। আর যে অসুস্থ থাকবে বা সফরে থাকবে, সেক্ষেত্রে গণনা (সমন্বয় করতে হবে) অন্য দিনসমূহ থেকে। আল্লাহ তোমাদের প্রতি সহজ করতে চান এবং তিনি তোমাদের প্রতি কঠিন করতে চান না। আর যেন তোমরা গণনা পূর্ণ করতে পারো এবং যেন তোমরা আল্লাহর বড়ত্ব-মহিমা ঘোষণা করতে পার তাঁর দেখানো পথনির্দেশের উপর (নির্ভরতার ভিত্তিতে) এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারো।

وَإِذَا  سَأَلَكَ  عِبَادِي  عَنِّي  فَإِنِّي  قَرِيبٌ  أُجِيبُ  دَعْوَةَ  الدَّاعِ  إِذَا  دَعَانِ  فَلْيَسْتَجِيبُوا  لِي  وَلْيُؤْمِنُوا  بِي  لَعَلَّهُمْ  يَرْشُدُونَ

২:১৮৬ :: আর যখন আমার বান্দা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন (জ্ঞাতব্য যে), নিশ্চয় আমি নিকটেই। আমি আহবানকারীর আহবানে সাড়া দিই যখন সে আমাকে আহবান করে। সুতরাং তারা তারা আমার প্রতি সাড়া দিক এবং আমার প্রতি বিশ্বাস-আস্থা স্থাপন করুক, যেন তারা সঠিক পথপ্রাপ্ত হয়।

أُحِلَّ  لَكُمْ  لَيْلَةَ  الصِّيَامِ  الرَّفَثُ  إِلَىٰ  نِسَائِكُمْ  هُنَّ  لِبَاسٌ  لَّكُمْ  وَأَنتُمْ  لِبَاسٌ  لَّهُنَّ  عَلِمَ  اللَّهُ  أَنَّكُمْ  كُنتُمْ  تَخْتَانُونَ  أَنفُسَكُمْ  فَتَابَ  عَلَيْكُمْ  وَعَفَا  عَنكُمْ  فَالْآنَ  بَاشِرُوهُنَّ  وَابْتَغُوا  مَا  كَتَبَ  اللَّهُ  لَكُمْ  وَكُلُوا  وَاشْرَبُوا  حَتَّىٰ  يَتَبَيَّنَ  لَكُمُ  الْخَيْطُ  الْأَبْيَضُ  مِنَ  الْخَيْطِ  الْأَسْوَدِ  مِنَ  الْفَجْرِ  ثُمَّ  أَتِمُّوا  الصِّيَامَ  إِلَى  اللَّيْلِ  وَلَا  تُبَاشِرُوهُنَّ  وَأَنتُمْ  عَاكِفُونَ  فِي  الْمَسَاجِدِ  تِلْكَ  حُدُودُ  اللَّهِ  فَلَا  تَقْرَبُوهَا  كَذَٰلِكَ  يُبَيِّنُ  اللَّهُ  آيَاتِهِ  لِلنَّاسِ  لَعَلَّهُمْ  يَتَّقُونَ

২:১৮৭ :: তোমাদের জন্য সিয়ামের রাতে তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি আবেগ উদ্দীপক ঘনিষ্ঠতা বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক। আল্লাহ জানেন যে, তোমরা তোমাদের নিজেদের প্রতি খিয়ানত করছো। তারপর তিনি তোমাদের তাওবা কবুল করেছেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। সুতরাং এ পর্যায়ে তোমরা তাদের সাথে বিশেষ খোশালাপ ও দাম্পত্য সুখময় মিলনে মিলিত হও আর আল্লাহ তোমাদের জন্য যা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন তা অন্বেষণ করো। আর তোমরা খাও ও পান করো যতক্ষণ না তোমাদের জন্য (দিগন্তের) কালো রেখা থেকে ফজরের মধ্যকার (দিগন্তের) সাদা রেখা স্পষ্ট হয়। তারপর তোমরা তোমরা রাত (রাতের সূচনা) পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো। আর তোমরা যখন মাসজিদে আকিফূন (এ’তেকাফরত / আত্মনিয়োজিত, ধ্যান ও গভীর চিন্তামগ্ন এবং অবস্থানকারী) থাকো, তখন (এ’তেকাফের দিনগুলোতে দিনে-রাতে কখনো) তাদের সাথে বিশেষ খোশালাপ ও দাম্পত্য সুখময় মিলনে মিলিত হয়ো না। এগুলো আল্লাহর স্থিরিকৃত সীমাসমূহ। সুতরাং তোমরা তা লংঘনের কাছেও যেও না। এভাবে আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ মানবজাতির জন্য সুষ্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন যেন তারা আল্লাহ সচেতন হতে পারে।

وَلَا  تَأْكُلُوا  أَمْوَالَكُم  بَيْنَكُم  بِالْبَاطِلِ  وَتُدْلُوا  بِهَا  إِلَى  الْحُكَّامِ  لِتَأْكُلُوا  فَرِيقًا  مِّنْ  أَمْوَالِ  النَّاسِ  بِالْإِثْمِ  وَأَنتُمْ  تَعْلَمُونَ

২:১৮৮ :: আর তোমরা তোমাদের একে অন্যের সম্পদ অন্যায্য উপায়ে খেয়ো না এবং পাপাচারের মাধ্যমে মানুষের সম্পদের কিছু অংশ খাওয়ার জন্য সিদ্ধান্তকারী কর্তৃপক্ষ ও বিচারকদের কাছে তা (মালসম্পদ) পেশ করো না[1], অথচ তোমরা (সেটাকে পাপাচার হিসেবেই) জানো।

وَأَتِمُّوا  الْحَجَّ  وَالْعُمْرَةَ  لِلَّهِ  فَإِنْ  أُحْصِرْتُمْ  فَمَا  اسْتَيْسَرَ  مِنَ  الْهَدْيِ  وَلَا  تَحْلِقُوا  رُءُوسَكُمْ  حَتَّىٰ  يَبْلُغَ  الْهَدْيُ  مَحِلَّهُ  فَمَن  كَانَ  مِنكُم  مَّرِيضًا  أَوْ  بِهِ  أَذًى  مِّن  رَّأْسِهِ  فَفِدْيَةٌ  مِّن  صِيَامٍ  أَوْ  صَدَقَةٍ  أَوْ  نُسُكٍ  فَإِذَا  أَمِنتُمْ  فَمَن  تَمَتَّعَ  بِالْعُمْرَةِ  إِلَى  الْحَجِّ  فَمَا  اسْتَيْسَرَ  مِنَ  الْهَدْيِ  فَمَن  لَّمْ  يَجِدْ  فَصِيَامُ  ثَلَاثَةِ  أَيَّامٍ  فِي  الْحَجِّ  وَسَبْعَةٍ  إِذَا  رَجَعْتُمْ  تِلْكَ  عَشَرَةٌ  كَامِلَةٌ  ذَٰلِكَ  لِمَن  لَّمْ  يَكُنْ  أَهْلُهُ  حَاضِرِي  الْمَسْجِدِ  الْحَرَامِ  وَاتَّقُوا  اللَّهَ  وَاعْلَمُوا  أَنَّ  اللَّهَ  شَدِيدُ  الْعِقَابِ

২:১৯৬ :: আর তোমরা আল্লাহর (সন্তুষ্টি অর্জনের) উদ্দেশ্যেই হজ্জ ও উমরা পূর্ণ করো। তবে যদি তোমরা বাধাপ্রাপ্ত হও, তাহলে হাদিয়া (উপহার) হিসেবে যা সহজ হয় (তাই যথেষ্ট)। আর তোমরা মাথামুণ্ডন করো না যতক্ষণ না হাদিয়া (উপহার) যথাস্থানে পৌঁছে। তোমাদের মধ্য থেকে যে অসুস্থ হয় বা তার মাথায় কষ্টদায়ক কিছু হয় তাহলে ফিদইয়া (দায়মুক্তি স্বরূপ বিকল্প ব্যবস্থা) হবে সিয়াম করা (অর্থাৎ রোজা রাখা) বা সদাকাহ দেয়া বা নুসুক করা (অর্থাৎ ধর্মীয় বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে পশু উৎসর্গ ও সংহতিমূলক রীতি পালন করা)। অন্যদিকে যখন তোমরা নিরাপদ থাক তখন যে ব্যক্তি হজ্জ পর্যন্ত উমরা করার সুযোগ নেয়, তাহলে হাদিয়া (উপহার) হিসেবে যা সহজ হয় (তাই যথেষ্ট)। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তা পায় না (অর্থাৎ হাদিয়া পায় না বা হাদিয়া দেয়াতে অংশগ্রহণের সামর্থ্য পায় না) তাহলে (দায়িত্ব হচ্ছে) হজ্জের মধ্যে তিন দিন সিয়াম করা এবং সাতদিন যখন তোমরা ফিরে যাবে তখন। (তার ক্ষেত্রে) উহাই পরিপূর্ণ দশ। এ অবকাশ তার জন্য যার পরিবার পরিজন আল মাসজিদুল হারামের উপস্থিতি নয় (অর্থাৎ হারাম এলাকার বাসিন্দা নয়)। তোমরা আল্লাহ সচেতন হও। আর জেনে রাখো যে, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।

وَمَا  كَانَ  لِمُؤْمِنٍ  أَن  يَقْتُلَ  مُؤْمِنًا  إِلَّا  خَطَأً  وَمَن  قَتَلَ  مُؤْمِنًا  خَطَأً  فَتَحْرِيرُ  رَقَبَةٍ  مُّؤْمِنَةٍ  وَدِيَةٌ  مُّسَلَّمَةٌ  إِلَىٰ  أَهْلِهِ  إِلَّا  أَن  يَصَّدَّقُوا  فَإِن  كَانَ  مِن  قَوْمٍ  عَدُوٍّ  لَّكُمْ  وَهُوَ  مُؤْمِنٌ  فَتَحْرِيرُ  رَقَبَةٍ  مُّؤْمِنَةٍ  وَإِن  كَانَ  مِن  قَوْمٍ  بَيْنَكُمْ  وَبَيْنَهُم  مِّيثَاقٌ  فَدِيَةٌ  مُّسَلَّمَةٌ  إِلَىٰ  أَهْلِهِ  وَتَحْرِيرُ  رَقَبَةٍ  مُّؤْمِنَةٍ  فَمَن  لَّمْ  يَجِدْ  فَصِيَامُ  شَهْرَيْنِ  مُتَتَابِعَيْنِ  تَوْبَةً  مِّنَ  اللَّهِ  وَكَانَ  اللَّهُ  عَلِيمًا  حَكِيمًا

৪:৯২ :: কোনো মু’মিনকে ভুলক্রমে (অনিচ্ছাকৃতভাবে) ছাড়া হত্যা করা অন্য মু’মিনের জন্য সঙ্গত নয়। আর যে ব্যক্তি কোনো মু’মিনকে ভুলবশত (অনিচ্ছাকৃতভাবে) হত্যা করে, তাহলে তাকে কোনো মু’মিন দাসকে মুক্ত করতে হবে এবং তার (নিহত ব্যক্তির) পরিবার পরিজনের কাছে দিয়াত (রক্তপণ) সমর্পণ করতে হবে যদি না তারা তা সদাক্বাত করে দেয়। অন্যদিকে যদি নিহত ব্যক্তি হয় তোমাদের শত্রু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত অথচ মু’মিন, তাহলে কোনো মু’মিন দাসকে মুক্ত করতে হবে। আর যদি নিহত ব্যক্তি হয় যে সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে, তাহলে তার পরিবার পরিজনের কাছে দিয়াত (রক্তপণ) সমর্পণ করতে হবে এবং কোনো মু’মিন দাসকে মুক্ত করতে হবে। তবে যদি তা (মু’মিন দাস বা তাকে মুক্ত করার সামর্থ্য) পাওয়া না যায়, তাহলে ধারাবাহিকভাবে দুইমাস সিয়াম করতে হবে। এটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওবাহর পদ্ধতি। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।

لَا  يُؤَاخِذُكُمُ  اللَّهُ  بِاللَّغْوِ  فِي  أَيْمَانِكُمْ  وَلَـٰكِن  يُؤَاخِذُكُم  بِمَا  عَقَّدتُّمُ  الْأَيْمَانَ  فَكَفَّارَتُهُ  إِطْعَامُ  عَشَرَةِ  مَسَاكِينَ  مِنْ  أَوْسَطِ  مَا  تُطْعِمُونَ  أَهْلِيكُمْ  أَوْ  كِسْوَتُهُمْ  أَوْ  تَحْرِيرُ  رَقَبَةٍ  فَمَن  لَّمْ  يَجِدْ  فَصِيَامُ  ثَلَاثَةِ  أَيَّامٍ  ذَٰلِكَ  كَفَّارَةُ  أَيْمَانِكُمْ  إِذَا  حَلَفْتُمْ  وَاحْفَظُوا  أَيْمَانَكُمْ  كَذَٰلِكَ  يُبَيِّنُ  اللَّهُ  لَكُمْ  آيَاتِهِ  لَعَلَّكُمْ  تَشْكُرُونَ

৫:৮৯ :: আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের ‘কথার কথা’ ধরনের শপথের জন্য ধরবেন না। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে তোমাদের দৃঢ় বন্ধনযুক্ত শপথের জন্য ধরবেন। এ ধরনের শপথভঙ্গের জন্য কাফফারা (দোষমোচন) হলো দশজন মিসকীনকে তোমরা তোমাদের পরিবারকে যেরূপ মধ্যমমানের খাদ্য খাওয়াও অনুরূপ খাদ্য খাওয়ানো বা তাদেরকে (অনুরূপভাবে) পরিধেয় বস্ত্র দেয়া অথবা কোনো দাস মুক্ত করা, তবে যে তার সামর্থ্য পাবে না তাহলে তিনদিন সিয়াম পালন করা। সেটাই তোমাদের শপথভঙ্গের জন্য কাফফারা (দোষমোচন) যখন তোমরা হলফ করে/নিশ্চয়তার সাথে তা করো। আর তোমরা তোমাদের শপথসমূহকে হেফাজত করো। এভাবে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো।

يَا  أَيُّهَا  الَّذِينَ  آمَنُوا  لَا  تَقْتُلُوا  الصَّيْدَ  وَأَنتُمْ  حُرُمٌ  وَمَن  قَتَلَهُ  مِنكُم  مُّتَعَمِّدًا  فَجَزَاءٌ  مِّثْلُ  مَا  قَتَلَ  مِنَ  النَّعَمِ  يَحْكُمُ  بِهِ  ذَوَا  عَدْلٍ  مِّنكُمْ  هَدْيًا  بَالِغَ  الْكَعْبَةِ  أَوْ  كَفَّارَةٌ  طَعَامُ  مَسَاكِينَ  أَوْ  عَدْلُ  ذَٰلِكَ  صِيَامًا  لِّيَذُوقَ  وَبَالَ  أَمْرِهِ  عَفَا  اللَّهُ  عَمَّا  سَلَفَ  وَمَنْ  عَادَ  فَيَنتَقِمُ  اللَّهُ  مِنْهُ  وَاللَّهُ  عَزِيزٌ  ذُو  انتِقَامٍ

৫:৯৫ :: হে মু’মিনগণ, তোমরা হারাম মাসসমূহে থাকা অবস্থায় (স্থলভাগের) শিকারকে হত্যা করো না। তোমাদের মধ্যে যে ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে হত্যা করে তার জরিমানা হচ্ছে যে পশুকে সে হত্যা করেছে গবাদি পশুর মধ্য থেকে তার মতো একটি পশু। সেটা (অর্থাৎ ঐ ধরনের গবাদি পশু) নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দিবে তোমাদের মধ্যকার দুজন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি। সেটাকে হাদিয়া (উপহার) হিসেবে কা’বায় পৌছাতে হবে। অথবা তার কাফফারা (দোষমোচন) হবে (সমমূল্য দ্বারা যতজনকে মধ্যম মানের খাদ্য খাওয়ানো যেতে পারে ততজন) মিসকীনকে খাওয়ানো অথবা সমসংখ্যক সিয়াম পালন করা। (এটা এজন্য যে,) যেন সে তার কাজের পরিণামের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। (এ বিধান নাজিলের) আগে যা হয়ে গিয়েছিলো সে বিষয়ে আল্লাহ উদারতা দেখিয়েছেন। আর যে পুনরাবৃত্তি করবে আল্লাহ তাকে দণ্ড দিবেন। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান ও মহাদণ্ডদাতা।

قَدْ  سَمِعَ  اللَّهُ  قَوْلَ  الَّتِي  تُجَادِلُكَ  فِي  زَوْجِهَا  وَتَشْتَكِي  إِلَى  اللَّهِ  وَاللَّهُ  يَسْمَعُ  تَحَاوُرَكُمَا  إِنَّ  اللَّهَ  سَمِيعٌ  بَصِيرٌ

৫৮:১ :: নিশ্চয় আল্লাহ শুনেছেন সে নারীর কথা যে তোমার সাথে তার স্বামীর ব্যাপারে বিতর্ক করেছে আর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছে। আর আল্লাহ তোমাদের দুজনের কথোপকথন শুনছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।

الَّذِينَ  يُظَاهِرُونَ  مِنكُم  مِّن  نِّسَائِهِم  مَّا  هُنَّ  أُمَّهَاتِهِمْ  إِنْ  أُمَّهَاتُهُمْ  إِلَّا  اللَّائِي  وَلَدْنَهُمْ  وَإِنَّهُمْ  لَيَقُولُونَ  مُنكَرًا  مِّنَ  الْقَوْلِ  وَزُورًا  وَإِنَّ  اللَّهَ  لَعَفُوٌّ  غَفُورٌ

৫৮:২ :: তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদের স্ত্রীকে যিহার করে (অর্থাৎ মায়ের মতো হিসাবে প্রকাশ করে) তাদের স্ত্রীরা তাদের মা হয়ে যায় না। যারা তাদেরকে জন্ম দিয়েছে তারা ছাড়া কেউ তাদের মা নয়। আর নিশ্চয় তারা তো অত্যন্ত মন্দ ও অসত্য কথাই বলছে। আর নিশ্চয় আল্লাহ উদার ক্ষমাশীল।

وَالَّذِينَ  يُظَاهِرُونَ  مِن  نِّسَائِهِمْ  ثُمَّ  يَعُودُونَ  لِمَا  قَالُوا  فَتَحْرِيرُ  رَقَبَةٍ  مِّن  قَبْلِ  أَن  يَتَمَاسَّا  ذَٰلِكُمْ  تُوعَظُونَ  بِهِ  وَاللَّهُ  بِمَا  تَعْمَلُونَ  خَبِيرٌ

৫৮:৩ :: আর যারা তাদের স্ত্রীকে যিহার করে (অর্থাৎ মায়ের মতো হিসাবে প্রকাশ করে), তারপর তারা যা বলেছিলো তা থেকে ফিরে যায় (অর্থাৎ স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতে চায়), তারা স্ত্রীমিলনের আগে একজন দাসকে মুক্ত করতে হবে। তোমাদেরকে এ উপদেশ দেয়া হচ্ছে। আর তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা সম্যক অবগত।

فَمَن  لَّمْ  يَجِدْ  فَصِيَامُ  شَهْرَيْنِ  مُتَتَابِعَيْنِ  مِن  قَبْلِ  أَن  يَتَمَاسَّا  فَمَن  لَّمْ  يَسْتَطِعْ  فَإِطْعَامُ  سِتِّينَ  مِسْكِينًا  ذَٰلِكَ  لِتُؤْمِنُوا  بِاللَّهِ  وَرَسُولِهِ  وَتِلْكَ  حُدُودُ  اللَّهِ  وَلِلْكَافِرِينَ  عَذَابٌ  أَلِيمٌ

৫৮:৪ :: কিন্তু যে সেই সামর্থ্য পায় না তবে সে স্ত্রীমিলনের আগে ধারাবাহিকভাবে দুই মাস সিয়াম পালন করবে। কিন্তু যে তা পারবে না তবে সে ষাটজন মিসকীনকে আহার করাবে। এটাই বিধান, যেন তোমরা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস করো। আর এগুলো আল্লাহর সীমা। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।

فَكُلِي  وَاشْرَبِي  وَقَرِّي  عَيْنًا  فَإِمَّا  تَرَيِنَّ  مِنَ  الْبَشَرِ  أَحَدًا  فَقُولِي  إِنِّي  نَذَرْتُ  لِلرَّحْمَـٰنِ  صَوْمًا  فَلَنْ  أُكَلِّمَ  الْيَوْمَ  إِنسِيًّا

১৯:২৬ :: তারপর তুমি (মারইয়াম) খাও ও পান করো এবং চোখ জুড়াও। তারপর যখন তুমি কোনো লোককে দেখবে, তখন বলো, “নিশ্চয় আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে সওম পালনের (মৌনতা অবলম্বনের) মানত করেছি। তাই আজ  আমি কোনো মানুষের সাথে বাক্যালাপ করবো না”।

إِنَّ  الْمُسْلِمِينَ  وَالْمُسْلِمَاتِ  وَالْمُؤْمِنِينَ  وَالْمُؤْمِنَاتِ  وَالْقَانِتِينَ  وَالْقَانِتَاتِ  وَالصَّادِقِينَ  وَالصَّادِقَاتِ  وَالصَّابِرِينَ  وَالصَّابِرَاتِ  وَالْخَاشِعِينَ  وَالْخَاشِعَاتِ  وَالْمُتَصَدِّقِينَ  وَالْمُتَصَدِّقَاتِ  وَالصَّائِمِينَ  وَالصَّائِمَاتِ  وَالْحَافِظِينَ  فُرُوجَهُمْ  وَالْحَافِظَاتِ  وَالذَّاكِرِينَ  اللَّهَ  كَثِيرًا  وَالذَّاكِرَاتِ  أَعَدَّ  اللَّهُ  لَهُم  مَّغْفِرَةً  وَأَجْرًا  عَظِيمًا

৩৩:৩৫ :: নিশ্চয় মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী) পুরুষ ও নারী, মু’মিন (বিশ্বাসী) পুরুষ ও নারী, বিনয়ী পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, (জবাবদিহিতার অনুভূতিতে) বিনীত পুরুষ ও নারী, সদাক্বাতকারী পুরুষ ও নারী, সিয়ামকারী (রোযাদার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুশীলনকারী) পুরুষ ও নারী, লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী পুরুষ ও নারী, এবং বেশি বেশি করে আল্লাহকে স্মরণকারী পুরুষ ও নারী; তাদের জন্যই আল্লাহ ক্ষমা ও মহাপুরস্কার রেখেছেন।

[1] অর্থাৎ অন্যের সম্পদকে আত্মসাৎ করার জন্য সে বিষয়ে কোনো মিথ্যা মামলা দায়ের করো না এবং অন্যায় সুবিধা ভোগ করার জন্য ঘুষ (অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত উপহার) পেশ করো না।

সিয়াম এর অর্থ ও নির্ঘণ্ট

সিয়াম ও সওম এর শব্দমূল হলো ‘সদ ওয়াও মীম’। সিয়াম ও সওম উভয়টি একই ক্রিয়া (স-মা) এর দুটি মাসদার বা ক্রিয়াবিশেষ্য (Verbal Noun) এবং একটি অন্যটির সমার্থক শব্দ। সওম শব্দটি ফা’ল প্যাটার্নে এবং সিয়াম শব্দটি ফিয়াল প্যাটার্নে গঠিত হয়েছে।

সওম ও সিয়াম শব্দের অর্থ হলো বিরত থাকা, সংযত থাকা, আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, উপবাস করা, যৌবনপ্রাপ্ত ঘোড়াকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে গিয়ে খাদ্য-পানীয় কমিয়ে দেয়া, পানাহার ও যৌনমিলন থেকে বিরত থাকা, কথা বলা থেকে বিরত থাকা বা মৌনতা অবলম্বন করা (যেন দৌড়-ঝাঁপ করতে পারার মতো হালকা-পাতলা গড়নের হতে পারে এবং যুদ্ধক্ষেত্রের বিভীষিকা ও ক্ষুৎ-পিপাসার কষ্ট স্বীকারে সমর্থ হয়ে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে পারে) ।

বস্তুত আল্লাহর বিধানে যা কিছু নিষিদ্ধ তা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখাই সিয়াম। আর যখন একটি আনুষ্ঠানিক কাজ হিসেবে সিয়াম পালন করা হয় বা এর নির্দেশ দেয়া হয় তখন এর দ্বারা ‘ফজর থেকে রাত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রীমিলন থেকে বিরত থাকা’র প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচীকে (training program) বুঝায়।

সিয়াম সম্পর্কে ভালোভাবে অনুধাবনের জন্য সিয়াম সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন প্রয়োজন। তাই নিম্নে সিয়াম এবং এর বিভিন্ন শব্দরূপ কুরআনে কোন কোন আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে তার নির্ঘণ্ট (Concordance) উল্লেখ করা হলো:

সওম ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ১৯:২৬:১৪।

সিয়াম ব্যবহৃত হয়েছে ৯ স্থানে: ২:১৮৩:৬, ২:১৮৭:৪, ২:১৮৭:৪৫, ২:১৯৬:২৯, ২:১৯৬:৪৮, ৪:৯২:৫১, ৫:৮৯:২৯, ৫:৯৫:৩৪, ৫৮:৪:৪।

সায়িমীন (কর্তা, পুংলিঙ্গ, ক্রিয়ারূপ ১, সিয়ামকারী) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩৩:৩৫:১৬।

সয়িমাত (কর্তা, স্ত্রীলিঙ্গ, ক্রিয়ারূপ ১, সিয়ামকারী) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩৩:৩৫:১৭)।

ইয়াসুম এবং ‘আন তাসূমূ’ (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১, সিয়াম করা) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ২:১৮৪:২৭, ২:১৮৫:১৭।

সুতরাং সিয়াম ও এর বিভিন্ন শব্দরূপ ধারণকারী আয়াতসমূহের সমন্বিত তালিকা নিম্নরূপ:

২:১৮৩, ২:১৮৪, ২:১৮৫, ২:১৮৭, ২:১৯৬, ৪:৯২, ৫:৮৯, ৫:৯৫, ৫৮:৪, ১৯:২৬, ৩৩:৩৫।

সিয়াম ও সওমের সম্পর্ক

সিয়াম ও সওম উভয় শব্দের মূল অর্থ 'বিরত থাকা, সংযত থাকা, আত্মনিয়ন্ত্রণ করা'। তবে কুরআনের প্রয়োগ থেকে বুঝা যায় যে, যখন সিয়াম শব্দ ব্যবহার করা হয় তখন অন্য এক ধরনের বিষয় (দিনের বেলায় দাম্পত্য মিলন এবং পানাহার) থেকে বিরত থাকার আনুষ্ঠানিকতা এবং যখন সওম শব্দ ব্যবহার করা হয় তখন এক ধরনের বিষয় (সাধারণ কথাবার্তা) থেকে বিরত থাকার আনুষ্ঠানিকতাকে বুঝানো হয়। এটাই শব্দ দুটির প্রায়োগিক পার্থক্য। অর্থাৎ শব্দ দুটির মূল অর্থ একই হলেও প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক বিস্তৃত অর্থের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

সওমসিয়ামের প্রায়োগিক অর্থ নিম্নরূপ:

(ক) সওম শব্দের প্রায়োগিক অর্থ হলো: সাধারণ কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা, মৌনব্রত পালন করা।

(খ) সিয়াম শব্দের প্রায়োগিক অর্থ হলো: দিনের বেলায় দাম্পত্য মিলন ও পানাহার থেকে বিরত থাকা।

অনেকে সিয়ামকে সওমের বহুবচন সাব্যস্ত করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সিয়ামসওম উভয়টি একবচন। কুরআনে সিয়াম শব্দের প্রয়োগ থেকে সিয়াম শব্দটি একবচন মাসদার (ক্রিয়াবিশেষ্য) হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। যেমন, সিয়াম শব্দটি যে সওম শব্দের বহুবচন নয় নিম্নের আয়াতসমূহে সিয়াম শব্দের পর্যালোচনার মাধ্যমে তা বুঝা যায়:

(১) ২:১৮৭ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘লাইলাতুস সিয়াম’। যদি ‘সিয়াম’ শব্দটি ‘সওম’ এর বহুবচন হয়, তাহলে এর অর্থ হয় ‘সওমসমূহের রাতে’। ‘লাইলাহ শব্দটি একবচন। তবে কি বহু সওমের রাত মাত্র একটি?

(২) ২:১৮৭ আয়াতে বলা হয়েছে, “সুম্মা আতিম্মুস সিয়ামা ইলাল লাইল” (তারপর একটি রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো)। ‘লাইল শব্দটি একবচন। যদি ‘সিয়াম শব্দটি ‘সওম’ এর বহুবচন হয়, তবে কি বহু সওম একটি মাত্র রাত পর্যন্ত পূর্ণ করতে হবে।

(৩) ২:১৯৬ আয়াতে বলা হয়েছে, “ফিদইয়াতুম মিন সিয়ামিন আও সদাক্বাতিন আও নুসুকিন” (ফিদইয়া হলো সিয়াম বা সদাক্বাহ বা নুসুক)। এখানে ‘সদাক্বাহ’ এবং ‘নুসুক’ যেমন একবচনে এবং মাসদার/ক্রিয়াবিশেষ্য হিসেবে উল্লেখ করা হলো, তার সাথে থাকা সিয়াম শব্দটিও অনুরূপভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

সুতরাং প্রকৃতপক্ষে সিয়াম শব্দটি বহুবচন নয়। সিয়াম হলো একটি কাজের নাম, যা বহু দিনে বা মাসে সম্পাদন করা যেতে পারে। যেমন, ২:১৯৬ “ফাসিয়ামু ছালাছাতি আইয়্যাম” এখানে সিয়াম কাজটি কত দিনে করা হবে সে দিনসংখ্যাকে বহুবচনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “তিন দিন”। অর্থাৎ সিয়াম কাজটি তিনটি দিনে হবে। ৪:৯২ ও ৫৮:৪ “ফাসিয়ামু শাহরাইনি মুতাবিআইনি(ধারাবাহিক দুইমাস সিয়াম পালন)। অর্থাৎ উল্লেখিত ক্ষেত্রে সিয়াম কাজটি করতে হবে ধারাবাহিক দুটি মাসে।

উল্লেখ্য যে, সিয়াম শব্দের অনুরূপ প্যাটার্নে একটি মাসদার/ক্রিয়াবিশেষ্য (Verbal Noun) হলো ‘ইয়াব’ (প্রত্যাবর্তন), দেখুন- ৮৮:২৫:৩।

সুতরাং সিয়াম বলতে সাধারণ রীতিতে দিনের বেলায় পানাহার ও যৌনমিলন থেকে বিরত থাকার আনুষ্ঠানিক দিককে বুঝায় (২:১৮৭) এবং যখন এই সাধারণ রীতির চেয়ে ভিন্নভাবে সিয়াম পালন করা হয় যেমন পানাহার করা হতে পারে কিন্তু মৌনতা অবলম্বনের সিয়াম করা হবে, তখন ঐরূপ সিয়ামকে সওম বলে (১৯:২৬)।

সিয়ামের প্রকার

সিয়ামকে দুই প্রকারে প্রকারভেদ করা যেতে পারে, অনানুষ্ঠানিক সিয়াম এবং আনুষ্ঠানিক সিয়াম। অনানুষ্ঠানিক সিয়ামের জন্য দিন-রাত বা মাসের প্রয়োজন নেই, বরং এটা সার্বক্ষণিক বিষয় এবং এজন্য পানাহার থেকে বিরত থাকার প্রয়োজন নেই, বরং অন্যায় প্রবণতা থেকে বিরত থাকাই যথেষ্ট। এরূপ অনানুষ্ঠানিক সিয়াম পালনকারীও 'সায়িমূন' (৩৩:৩৫) এর অন্তর্ভুক্ত সাব্যস্ত হবে।

কিন্তু যখন কোনো বিশেষ কারণে বা সময়ে এক বা একাধিক দিন সিয়াম পালনের নির্দেশনা দেয়া হয় তখন তা দ্বারা আনুষ্ঠানিক সিয়াম বুঝানো হয়। আনুষ্ঠানিক সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে দিনের বেলায় পানাহার ও দাম্পত্য মিলন থেকে বিরত থাকতে হবে। এক্ষেত্রে পানাহার থেকে বিরত না থেকে যদি সাধারণভাবে অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা হয় তাতে সিয়াম পালন হবে না। আবার আনুষ্ঠানিক সিয়াম থেকে তাক্বওয়ার শিক্ষা গ্রহণ না করলে বা তাক্বওয়া অর্জন না করলে, আনুষ্ঠানিক সিয়ামের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয় বিধায় এরূপ আনুষ্ঠানিক সিয়ামও মূল্যহীন হয়ে যাবে (২:১৮৩)। অনেকটা আক্ষরিকভাবে সব নিয়ম মেনে সিয়াম পালন করা হলো কিন্তু সিয়াম শেষে মাত্রাতিরিক্ত পানাহার করা হলো, এটিও সিয়ামের যে স্পিরিট তার পরিপন্থি।

অনানুষ্ঠানিক সিয়ামের ধারণা সিয়াম শব্দের অর্থগত ব্যাপকতার উপর ভিত্তিশীল এবং আনুষ্ঠানিক সিয়ামের ধারণা সিয়াম সম্পর্কিত বিশেষ নির্দেশনাসমূহের উপর ভিত্তিশীল। স্রষ্টার প্রতি সচেতন থেকে নিষিদ্ধ বস্তু এবং ক্ষেত্র বিশেষে অনুমোদিত বিষয়ের থেকে নিজেকে বিরত থাকাও অনানুষ্ঠানিক সিয়ামের অংশ। কুরআনে বিরত থাকা অর্থে ইজতানাবু শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যার মধ্যে স্রষ্টা যে কাজ নিষেধ করেছেন তা যেমন আছে, তেমনি আছে মদ, জুয়ার মতো শয়তান উদ্বুদ্ধ বিষয় (৫:৯০), মিথ্যা স্বাক্ষ্য (২২:৩০), অন্যের প্রতি সন্দেহ করা বা অন্যের প্রতি অন্যায়ভাবে গুপ্তচরগিরি করা (৪৯:১২), তাগুত বর্জন (১৬:৩৬, ৩৯:১৭), দুর্ব্যবহার ও ঝগড়া-বিবাদ (২:১৯৭) ইত্যাদি। সামগ্রিকভাবে এ সকল বিরত থাকার বিষয়ে বিরত থাকাও স্রষ্টা সচেতন ব্যক্তির সংযম পালন। জিতেন্দ্রিয় বা আত্নসংযমী ব্যক্তি হিসেবে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত যে নবীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে (৩:৩৯) তিনি হলেন ইয়াহিয়া যার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দটি হলো: হাসূর (বিশেষ্য, অর্থ:আত্মসংবরণকারী, ব্রতচারী, সন্ন্যাসী, জিতেন্দ্রিয়, স্ত্রী-সংস্রব-আসক্তি থেকে আত্মনিবারিত, (আল্লাহর পথে) নিজেকে আবদ্ধ রাখা ব্যক্তি)।

সামগ্রিকভাবে সিয়াম পালন বা সংযমের বিষয়ে তিন ধরনের সরাসরি সংযম বা সংযমি বৈশিষ্ট্যের সাথে আমরা কুরআনে পরিচিতি লাভ করি: খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকা, মৌণতা বা কথা বলা থেকে বিরত থাকা এবং ইন্দ্রিয় সংযম। প্রথমটি মূলত দৈহিক, দ্বিতীয়টি মানসিক এবং তৃতীয়টি ইন্দ্রিয়ের প্রাবল্য বিষয়ক।

সিয়ামের উদ্দেশ্য

আনুষ্ঠানিক সিয়াম পালনকে বিধিবদ্ধ করার উদ্দেশ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে “যেন তোমরা তাক্বওয়া তথা আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন করতে পারো”। অর্থাৎ আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বনের জন্য যোগ্য বা উপযুক্ত করার উদ্দেশ্যে সিয়ামকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বনের অর্থ হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং তিনি সন্তুষ্ট হন এমন কাজ করা এবং তিনি অসন্তুষ্ট হন এমন কাজ না করা। আমরা সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক কাজ করার এবং মিথ্যা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজজীবনে প্রকৃত ও স্থায়ী কল্যাণ অর্জনের জন্য সচেষ্ট থাকলে তাতেই আল্লাহ সন্তুষ্ট হন এবং এর বিপরীত কাজে তিনি অসন্তুষ্ট হন। তাই তিনি আমাদেরকে যেসব প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান দিয়েছেন তাও আমাদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে এবং বাস্তবসম্মত ও ন্যায়নীতি বাস্তবায়নের জন্যই প্রদান করেছেন। তাই আল্লাহর বিধান পরিপালনের মাধ্যমে আমরা যথাযথ কল্যাণ প্রাপ্ত হতে পারি এবং কল্যাণের সম্প্রসারণের মাধ্যমে তাঁর কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করতে পারি। এভাবে আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াতের জন্য / ভিত্তিতে আল্লাহর বড়ত্ব-মহিমা প্রকাশ এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করাকেও সিয়ামের উদ্দেশ্য হিসেবে জানানো হয়েছে।

সিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহর বড়ত্ব-মহিমা প্রকাশের অনুশীলন ঘটে, কারণ এ সময় সিয়াম পালনকারী সিয়াম পালনের কারণে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ও তাঁর বিধিবদ্ধ নিয়মানুসারে সাধারণভাবে বৈধ চাহিদাসমূহ থেকেও বিরত থাকে। এরূপ অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জিত যোগ্যতার ফলস্বরূপ যখন সে সকল সময় আল্লাহর বিধান অনুসারে চলতে গিয়ে যাবতীয় অবৈধ চাহিদা পূরণ থেকে বিরত থাকে তখন সে কার্যত আল্লাহর বড়ত্ব-মহিমা প্রকাশের বাস্তব গুণে স্থায়ীত্ব লাভ করে।

অনুরূপভাবে সিয়াম পালন হলো আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বনের উদ্দেশ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুশীলন করে কুরআনরূপ নিয়ামতের জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। যখন এই অনুশীলনের ফলস্বরূপ অর্জিত যোগ্যতার ফলস্বরূপ জীবনের সকল ক্ষেত্রে কুরআনের ভিত্তিতে নিজের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রিত রাখা হবে তখন সেটাই প্রকৃত কৃতজ্ঞতায় পরিণত হবে।

সিয়াম পালনকালে সাময়িকভাবে মানুষের মধ্যে ক্লান্তিবোধ আসতে পারে, তার কর্মশক্তি হ্রাস পেতে পারে। কিন্তু সিয়ামের যে উদ্দেশ্য আত্মিক শক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বনের যোগ্য করে তোলা, সেজন্য এ সাময়িক শারীরিক অবসাদকে মেনে নিতে হয়। কারণ মানুষের দেহকে তো খাদ্য দিয়ে পরিপুষ্ট করতে হয়, কিন্তু তার আধ্যাত্মিক পরিপুষ্টি ছাড়া শুধু দৈহিক পরিপুষ্টি তাকে প্রকৃত মানুষের স্তরে আনতে নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হয়। আধ্যাত্মিক পরিপুষ্টির জন্য প্রয়োজন দৈহিক প্রবৃত্তির মোকাবেলায় নৈতিক বাধ্য বাধকতাকে অগ্রাধিকার দেয়ার যোগ্যতা। এজন্য যে আত্মনিয়ন্ত্রণ শক্তির প্রয়োজন সিয়ামের মাধ্যমে তারই প্রশিক্ষণ হয়। আত্মনিয়ন্ত্রিত মানুষই আত্মবলে বলীয়ান হতে পারে এবং মানব সভ্যতার প্রকৃত উৎকর্ষ সাধন করতে পারে। সিয়াম পালনকালে যতটুকু অলসতা, অবসাদ বা নিদ্রালুতার প্রকাশ পায় সেটাকে ঐ ওষুধের সাথে তুলনা করা যেতে পারে যার মনোদৈহিক শক্তির জন্য খুবই কার্যকর কিন্তু সাময়িকভাবে তার প্রতিক্রিয়ায় শারীরিক অলসতা, অবসাদ বা নিদ্রালুতা দেখা দেয়। এছাড়া সিয়াম শব্দের উৎপত্তিগত দিক থেকে কোনো ঘোড়ার যৌবনপ্রাপ্তির পর সেটাকে যুদ্ধ ময়দানের বিভিষিকা ও ক্ষুধা-তৃষ্ণা মোকাবেলার যোগ্য করার জন্য প্রশিক্ষণ হিসেবে সাময়িকভাবে আহার ও পানীয় কমিয়ে দেয়াকে সিয়াম বলা হয়। যদিও এতে প্রশিক্ষণকালীন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে যদিও ঘোড়াটি সাময়িকভাবে দুর্বল ও ক্ষীণ হয়ে পড়ে, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি ফলস্বরূপ সে ঘোড়া প্রকৃত সুঠাম ও যুদ্ধক্ষেত্রের দুর্নিবার ঘোড়া হয়ে উঠে। তবে যে ঘোড়াকে পানাহার কমিয়ে দেয়া হলো কিন্তু যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ঘোড়ায় তৈরি করা গেলো না, সে ঘোড়াকে পানাহার কমিয়ে দেয়ার কোনো সার্থকতা নেই। অনুরূপভাবে কেউ যদি সিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহসচেতনতা অবলম্বনের যোগ্য না হয়, তাহলে তার সিয়াম সঠিক প্রশিক্ষণে পরিণত হলো না, তার পানাহার না করার মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই।

সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন করার প্রশিক্ষণ প্রদান করা। এটি দুই স্তরবিশিষ্ট একটি প্রক্রিয়া। প্রথমত একজন সিয়াম পালনকারী সিয়াম পালন কালে দিনের বেলায় পানাহার করবে না। কারণ কী? কারণ হলো সিয়াম পালনকালে দিনের বেলায় পানাহার করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। এভাবে সে আল্লাহ সচেতনতার পরিচয় দিলো। কিন্তু দ্বিতীয়ত প্রশ্ন হলো, কেন আল্লাহ সিয়াম পালন করতে বা সিয়াম পালনকালে দিনের বেলায় পানাহার করতে নিষেধ করলেন? যেহেতু আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন করাই সিয়াম পালনের উদ্দেশ্য, সুতরাং অবশ্যই এর মাধ্যমে এরূপ শিক্ষা দেয়াই উদ্দেশ্য যে, আল্লাহর নিষিদ্ধ কোনো কাজ করা যাবে না, নিজের প্রবৃত্তিতে সেটার চাহিদা অনুভব হলেও। এখন যদি সিয়াম থেকে এ শিক্ষা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে সিয়াম পালন সঠিক উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত। এমতাবস্থায় সিয়াম পালন করা আর না করা উভয়টির নৈতিক মূল্য সমান। বরং সিয়াম থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করলে আনুষ্ঠানিক সিয়াম একটি অর্থহীন উপবাস অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হয়। তাই সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রয়োজন, তাহলেই এটি সঠিক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে পরিণত হতে পারবে।

সিয়াম পালনকারীরা সিয়ামের উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারলে তথা আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন করলে তাদের নিজেদের জীবন যেমন কল্যাণময় হয়ে উঠবে তেমনি তাদের অবদানের প্রেক্ষিতে একটি কল্যাণ সমাজের গোড়াপত্তন হবে। এজন্য বলা হয়েছে যে, “যদি তোমরা সিয়ামের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে পারো, তাহলে তোমাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে যে, সিয়াম পালন করা তোমাদের জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর একটি ব্যবস্থা”।

আল্লাহ দিনের বেলায় পানাহার না করে সিয়াম করতে বলেছেন বলেই আমরা যখন দিনের বেলায় পানাহার না করে সিয়াম করি, তখন এর মাধ্যমে তাক্বওয়া বা আল্লাহ সচেতনতার একটি আনুষ্ঠানিক চর্চা হয়। এই আনুষ্ঠানিক সিয়াম থেকে প্রাপ্ত তাক্বওয়ার শিক্ষা অর্জনের জন্যই সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে। এখন যারা আনুষ্ঠানিক সিয়াম করে কিন্তু তার মাধ্যমে যে সীমিত পরিসরে তাক্বওয়ার চর্চা হয় তা থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে তাক্বওয়া অবলম্বন করে না, তারা সিয়ামের আনুষ্ঠানিকতায় আটকে আছে, এর থেকে যে তাক্বওয়ার শিক্ষা তা গ্রহণ করেনি। এমতাবস্থায় তাদের এ সিয়াম সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ তথা এ আনুষ্ঠানিক তাদের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না।

সিয়ামের বিধিবদ্ধতা

সিয়াম একটি বিধিবদ্ধ তথা বাধ্যতামূলক বিধান। সিয়াম প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, “কুতিবা আলাইকুমুস সিয়াম তথা “তোমাদের উপর সিয়ামকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে”। “কুতিবা” শব্দটির শাব্দিক অর্থ হলো “লিখে দেয়া হয়েছে”। কিন্তু এটি একটি আরবি বাগধারা যার অর্থ হলো “বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে”। তাই “কুতিবা আলাইকুম” বলে উল্লেখকৃত বিষয়টি বাধ্যতামূলক বিধান হয়ে থাকে। নিম্নে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হওয়ার জন্য “কুতিবা” শব্দের প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

‘কুতিবা (লিখে দেয়া হয়েছে) এবং এর অনুরূপ অর্থে ‘কাতাবা (তিনি লিখে দিয়েছেন) শব্দ কী অর্থ প্রকাশ করে নিম্নে তার কিছু উদাহরণ দেয়া হলো:

ক্বিসাস (হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড) লিখে দেয়া হয়েছে। (২:১৭৮)

ওয়াসিয়্যাতের বিধান লিখে দেয়া হয়েছে। (২:১৮০)

সিয়ামের বিধান লিখে দেয়া হয়েছে। (২:১৮৩)

আল্লাহ যা লিখে দিয়েছেন তা অনুসন্ধান করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (২:১৮৭)

ক্বিতাল বা ন্যায়যুদ্ধের বিধান লিখে দেয়া হয়েছে। (২:২১৬)

ক্বিতাল বা ন্যায়যুদ্ধের বিধান লিখে দেয়ার পর তাদের অধিকাংশই সে বিধান পালন থেকে বিমুখ থেকেছে। (২:২৪৬)

নিহত হওয়ার প্রাকৃতিক নিয়ম লিখে দেয়া হয়েছে, সে নিয়মানুসারে যে কোথাও নিহত হওয়ার উপযোগী আঘাতপ্রাপ্ত হবে তাতে সে নিহত হবেই। (৩:১৫৪)

যদি আল্লাহ আত্মহত্যার প্রতিবিধান লিখে দিতেন অল্পসংখ্যক ছাড়া তা পালন করতো না। (৪:৬৬)

ক্বিতাল বা ন্যায়যুদ্ধের বিধান লিখে দেয়ার পর তারা মানুষকে ভয় করতে লাগলো এবং বললো, প্রভু তুমি কেন আমাদের উপর এ বিধান লিখে দিয়েছো? (৪:৭৭)

ইয়াতীম ছেলে-মেয়েদের মায়েদের জন্য যা লিখে দেয়া হয়েছে তা না দেয়ার সমালোচনা। (৪:১২৭)

চোখের বদলে চোখ এরূপ দণ্ডবিধি লিখে দেয়া হয়েছে। (৫:৪৫)

আল্লাহ নিজের উপর রহমত করাকে লিখে নিয়েছেন। (৬:১২)

আল্লাহ নিজের উপর রহমত করাকে লিখে নিয়েছেন। (৬:৫৪)

আল্লাহর লিখে দেয়া প্রাকৃতিক নিয়মে যে মুসিবত আসার কথা সেটাই আসে। (৯:৫১)

শয়তানের প্রকৃতিগত কাজের বিষয় লিখে দেয়া হয়েছে। (২২:৪)

আল্লাহ অন্তরে ঈমান থাকার প্রকৃতিগত নিয়ম লিখে দিয়েছেন।  (৫৮:২২)

‘কুতিবাসম্পর্কিত উপরিউক্ত আয়াতগুলোর সমন্বিত অধ্যয়ন অনুসারে কোনোক্রমেই বলা যেতে পারে না যে, ‘কুতিবা মানে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের মতো বিষয়, মানলে ভালো, না মানলে ঐ ভালোটা হবে না, তবে এটা রাষ্ট্রীয় আইনের মতো নয়।

বরং ‘কুতিবামানে হলো:

(১) প্রকৃতিগত বিষয় লিখে দেয়া, যেমন, লিখে দেয়া হলো যে, আমরা চোখ দিয়ে দেখবো, এখন চাইলেও আমরা অন্য কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে দেখতে পারবো না।

(২) কোনো উদ্দেশ্যের জন্য কোনো সর্বাধিক উপযোগী নিয়ম লিখে দেয়া, যে উদ্দেশ্যে নিয়মটি লিখে দেয়া হয়েছে ঐ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ঐ নিয়মটি পালন অপরিহার্য।

(৩) কোনো সাংবিধানিক বিধান লিখে দেয়া বা বিধিবদ্ধ করা তথা চূড়ান্ত করে দেয়া। যার অর্থ হলো, যদি সংবিধানকে স্বীকৃতি দেয়া হয় তবে নিজের উপর ঐ বিধান অপরিহার্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

সুতরাং ‘ফরজএবং ‘কুতিবা একই ধরনের অর্থবোধক। কিন্তু এ দুটি শব্দের মাধ্যমে একই বিষয়কে দুটি ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশ করা হয় মাত্র। তা নিম্নরূপ:

ক. যখন ‘ফরজশব্দ ব্যবহার করা হয় তার অর্থ হলো কোনো ক্ষেত্রে কখন, কী, কীভাবে, কতটুকু করতে হবে তা আবশ্যকীয় / নির্ধারণ করা।

খ. যখন ‘কুতিবাশব্দ ব্যবহার করা হয় তার অর্থ হলো কোনো ক্ষেত্রে নিজেকে যথোপযোগী পয়েন্টের উপর রাখার জন্য যথোপযোগী কোনো নিয়মকে বিধিবদ্ধ করা।

যেহেতু ‘মুত্তাক্বী হওয়ার জন্য সিয়ামকে ‘কুতিবা করা হয়েছে, লিখে দেয়া হয়েছে বা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে, তাই মুত্তাক্বী হওয়ার উপায় হিসেবে লিখে দেয়া সিয়াম পালন করা মু’মিনদের জন্য বাধ্যতামূলক, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

পূর্ববর্তীদের সিয়াম

কুরআনে পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে মারইয়াম ও নবী যাকারিয়ার সওম সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। মারিয়ামকে বাক্যালাপ না করা তথা মৌনতা অবলম্বনের সওম পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো, যা এক প্রকারের আনুষ্ঠানিক সিয়াম। এ থেকে বুঝা যায় যে, পূর্ববর্তীদের সিয়াম আক্ষরিকভাবে আমাদেরকে যে পদ্ধতিতে সিয়াম পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে হুবহু সে ধরনের হতে হবে তা নয়। বরং সিয়ামের মূল দিক (কোনো নির্দিষ্ট সময় বিশেষ ধরনের সংযম পালন করা) এবং উদ্দেশ্য (আত্মনিয়ন্ত্রণশক্তি অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহ সচেতন জীবনপদ্ধতি অবলম্বন করা) এ দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের সিয়ামের মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে। এছাড়া মারইয়ামকে সওম মানত করার নির্দেশ দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করার মধ্যে আমরাও আল্লাহর উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে সওম তথা মৌনতা অবলম্বনের সিয়াম পালনের প্রতি পরোক্ষভাবে উৎসাহ রয়েছে। নবী যাকারিয়ার প্রার্থনার উত্তরে যখন তাকে সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয় তখন তাঁকে তিনদিন মৌণব্রত পালনের নির্দেশ দেওয়া হয় (১৯:১০)।

পূর্ববর্তীদের উপরও তাক্বওয়া বা আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বনের উদ্দেশ্যে সিয়াম পালনকে (আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুশীলনমূলক প্রোগ্রাম) বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে তথ্যটির মাধ্যমে জানা যায় যে, সিয়াম কোনো নতুন বিধান নয়, বরং একই উদ্দেশ্যে এরূপ বিধান পূর্ববর্তীদেরকেও দেয়া হয়েছিলো। এছাড়া এ থেকে এটাও জানা যায় যে, যুগে যুগে সিয়ামের যে বিধান দেয়া হয়েছিলো সেটা একই মূল উদ্দেশ্যে আর তা হলো এর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বনের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে।

বনি ইসরাইলদের পালিত রীতির মধ্যে দুই ধরনের সিয়াম রয়েছে। খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকা এবং কথা বলা থেকে বিরত থাকা। হিব্রু ভাষায় সওম (צ֔וֹם, বিশেষ্য) ও সুম (צוּם, ক্রিয়া) এই দুটো শব্দই সিয়ামের জন্য পাওয়া যায়। কথা বলা থেকে বিরত থাকার যে সংযম তাকে হিব্রুতে বলা হয় তা’আনিত দিব্বুর। বনী ইসরাইলের নবী যাকারিয়ার তিনদিন মৌনব্রত পালনও সওম ছিলো বলে জানা যায়। এছাড়াও তাওরাত, যবুর ও ইঞ্জিলে আমরা সিয়াম পালনের অনেক উদাহরন পাই।

নবী মুসা স্রষ্টার সান্নিথে তৌরাত নাযিলের সময়ে ৪০ দিন ও ৪০ রাত টানা সিয়াম পালন করেন (ডিউটেরোনমি ৯:৯)। এরকম তিনি তিনবার পবিত্র সিনাই পর্বতে আরোহন করেন এবং তিন বারই ৪০ দিন রাতের সিয়াম পালন করেন তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যখন তার কাছে তৌরাত নাযিল হয়।

নবী দাউদ, নবী ইলিয়াস সিয়াম পালন করেছেন বলে উল্লেখ আছে পুরাতন নিয়ম বা ওল্ড টেস্টামেন্টে।

বাইবেলে নবী ঈসার দীর্ঘ ৪০দিন ৪০ রাতের সিয়ামের উল্লেখ পাওয়া যায় (মথি ৪:২, ‍লুক ৪:২)। যবুরে স্রষ্টার সন্মুখে বিনয়ী হওয়ার জন্য সিয়াম করার নির্দেশ রয়েছে। নবী ঈসার বর্ণনায় তিনি তার সাহাবীদের নির্দেশ দেন যখন তোমরা সিয়াম করবে তখন লোক দেখানোর জন্য করবে না, এমনকি লোকে যে না বুঝতে পারে তেমন সিয়াম করার জন্য তার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে যেন রিয়া বা লোক দেখানোর মনোভাব থেকে একজন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয় (মথি ৬:১৭-১৮)।

তৌরাতে সিয়াম পালনের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে জানা যায় বান্দাকে স্রষ্টার সামনে বিনত হওয়া, নিজের কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমার অংশ হিসেবে, নফসের চাহিদাকে দমনের জন্য, শোক পালনের জন্য এবং সামগ্রিকভাবে স্রষ্টার সামনে নিজের ক্ষুদ্রত্ব প্রকাশের উপায় হিসেবে সিয়াম পালন করার নির্দেশ রয়েছে।

সিয়াম কতদিন ও কোন মাসের দিনসমূহ

২:১৮৩ আায়াতে সিয়াম বিধিবদ্ধ করার বিষয়টি জানানো হয়েছে এবং ২:১৮৪ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, সিয়াম ‘আইয়ামাম মা’দূদাতে’ (সহজে) গণনাযোগ্য কয়েকদিন’। কিন্তু এই ‘সহজে গণনাযোগ্য কয়েকদিন’ বলতে কয়দিন বা কোন দিনসমূহ তা জানানো হয়েছে পরবর্তী আয়াতটিতে তথা ২:১৮৫ আয়াতে। তা হলো, ‘শাহরু রমাদান’ বা ‘রমাদানের মাস’। এ থেকে বুঝা যায় যে, রমাদানের মাসের দিনসমূহই হচ্ছে বিধিবদ্ধ সিয়ামের জন্য নির্ধারিত ‘(সহজে) গণনাযোগ্য কয়েকদিন’। যেহেতু শাহর বলতে চান্দ্রমাস (নতুন সরুচাঁদ থেকে নতুন সরুচাঁদের পূর্ণ চন্দ্রচক্র) বুঝায় এবং চান্দ্রমাস কখনো ২৯ দিনেও হয় আবার কখনো ৩০ দিনেও হয়, যা পরবর্তী মাসের নতুন চাঁদের উপর ভিত্তিশীল, তাই সিয়ামও কোনো বর্ষে ২৯ দিন এবং কোনো বর্ষে ৩০ দিন হতে পারে।

শুধুমাত্র আল কুরআনের আয়াত থেকে ‘শাহরু রমাদানে সিয়াম সংখ্যা কত?’ এ প্রশ্নটির উত্তর অনুধাবনের ক্ষেত্রে উপলব্ধিগত ভিন্নতার প্রেক্ষিতে কেউ কেউ মনে করেন যে, মাত্র ৩ দিনেই ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ হতে পারে, তাই অন্তত ৩ দিন সিয়াম পালনই বাধ্যতামূলক, এর বেশি সিয়াম পালন করা ঐচ্ছিক, কেউ আবার মনে করেন যে, ‘(সহজে) গণনাযোগ্য কয়েকদিন’ হিসেবে কয়দিন সিয়াম পালন করা হবে তা একজন সিয়ামকারী নিজেই স্থির করতে পারেন, তিনি ৩ দিন থেকে ১০ দিন পর্যন্ত যে কোনো দিনসংখ্যায় সিয়াম পালন করতে পারেন, আবার কেউ মনে করেন যে, যেহেতু ১০ দিন সম্পর্কে ‘তিলকা আশারাতুন কামিলাতুন’ (উহাই পূর্ণ ১০) তথ্যটি বিদ্যমান রয়েছে, তাই ১০ দিন সিয়াম পূর্ণ করতে হবে। আর এ সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত মত হলো ‘রমাদানের মাসে’ পূর্ণ মাস তথা ২৯ বা ৩০ দিন সিয়াম পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে অনেকে মনে করেন যে, চাঁদ দেখে সিয়াম শুরু এবং চাঁদ দেখে সিয়াম শেষ করা এবং চাঁদ দেখা না গেলে ৩০ দিন সিয়াম পূর্ণ করার হাদীসের ভিত্তিতে ২৯ বা ৩০ দিন সিয়ামের পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পক্ষান্তরে যারা শুধু কুরআনের ভিত্তিতে পূর্ণ রমাদানের মাস তথা ২৯ বা ৩০ দিন সিয়াম পালন বাধ্যতামূলক বলে বিশ্বাস করেন তাঁদের দাবি হলো, কুরআনের আয়াত থেকেই এ বিষয়টি স্পষ্ট, এটি হাদীসের উপর নির্ভরশীল নয়। এ ক্ষেত্রে আমরা (এ বইয়ের সংকলক ও প্রকাশক) সর্বশেষ উপলব্ধিটিতেই উপনীত হয়েছি (অর্থাৎ শাহরু রমাদানে পূর্ণ মাস সিয়াম)। নিম্নে আমাদের উপলব্ধি বিস্তারিতভাবে শেয়ার করা হলো:

 

‘শাহরু রমদানে সিয়াম সংখ্যা কত?’ প্রশ্নের প্রেক্ষাপট

সূরা বাকারা ২:১৮৫ আয়াতে শাহরু রমাদানে সিয়াম পালনের নির্দেশ রয়েছে, তাই শাহরু রমাদানে (রমাদানের মাসে) সিয়াম পালন করতে হবে এবং পুরো মাস করতে হবে এটাই সাধারণ উপলব্ধি।

কিন্তু সূরা বাকারা  ২:১৮৪ আয়াতে সিয়াম পালন বিধিবদ্ধ করার অবস্থান নির্ধারিত করা হয়েছে তা হলো ‘আইয়ামাম মা’দূদাত বা (সহজে) গণনাযোগ্য কয়েকদিন’। এ প্রেক্ষিতে প্রশ্ন আসে যে, “প্রকৃতপক্ষে শাহরু রমাদানে কতটি সিয়াম পালন করতে হবে?”

এর জবাবে যারা ২৯ বা ৩০ দিন পুরো মাসে সিয়াম পালনের কথা বলেন, তাঁরা বলেন যে, যেহেতু ২:১৮৫ আয়াতে রমাদানের মাসে সিয়াম পালন করতে বলা হয়েছে তাই পুরো মাসেই সিয়াম পালন করতে হবে।

এ জবাবের জবাবে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় যে, “তাহলে ২:১৮৪ আয়াতে ‘আইয়ামাম মা’দূদাতএর কথা কেন বলা হলো? রমাদানের মাসে কিছুদিন সিয়াম পালন করলে তাও তো রমাদান মাসেই পালন করা হলো, তাহলে পুরো মাস পালন করতে হবে, এটি কিভাবে নির্ধারিত হয়?” তখন বিভিন্ন জবাব দেয়া হয়। যেমন:

(১) ২৯ বা ৩০ দিনকে পুরো বছরের তুলনায় (সহজে) গণনাযোগ্য কয়েক দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

(২) হাদীসে এসেছে, “রমাদান মাসের চাঁদ দেখে সিয়াম শুরু হবে, শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখে সিয়াম শেষ হবে ও ঈদুল ফিতর পালিত হবে, ঈদের দিন সিয়াম করা যাবে না বা করা হারাম”।

(৩) প্রথমে ২:১৮৪ আয়াতে কিছুদিনের সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছিল পরে ২:১৮৫ আয়াত দ্বারা তা মানছুখ বা রহিত করে দেয়া হয়েছে এবং পুরো মাস সিয়াম পালনের বিধান দেয়া হয়েছে।

এ তিনটি জবাবের প্রথম জবাবটি একদিকে অগ্রহণযোগ্য নয়, অন্যদিকে তা মূল প্রশ্নের জবাব হিসেবে যথেষ্ট নয়। অর্থাৎ মূল প্রশ্নের জবাব যদি হয়, পুরো মাস সিয়াম পালন করতে হবে, তাহলে এ কথাটি প্রযোজ্য যে, রমাদানের মাসের দিনগুলোকে কিছুদিন বা কয়েক দিন শব্দে প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যদিকে যদি সঠিক জবাব হয়, রমাদানের মাসের মধ্যে কিছুদিন (পুরো মাস নয়) সিয়াম পালন করতে হবে, তাহলে ‘আইয়ামাম মা’দূদাত দ্বারা ঐ কিছুদিনকে বুঝাবে। যেহেতু প্রথম কথাটি উভয় অবস্থায় প্রযোজ্য হতে পারে, তাই শুধু এ কথা বলার মাধ্যমে প্রশ্নটির যথাযথ উত্তর হয় না।

আর দ্বিতীয় কথাটির অংশবিশেষ অর্থাৎ ‘রমাদানের চাঁদ দেখে সিয়াম শুরু হওয়া এবং শাওয়ালের চাঁদ দেখে সিয়াম শেষ হওয়া’ সঠিক হবে যদি কুরআনের আয়াত থেকে পুরো মাস সিয়াম পালনের আদেশ প্রমাণিত হয়। যেহেতু হাদীস দ্বীনের দলীল নয়, দ্বীনের দলীল শুধুমাত্র আল কুরআন, তাই এ জবাবটি গ্রহণযোগ্য নয়। আর দ্বিতীয় অংশে যে ঈদের দিন সিয়াম পালন হারাম হওয়ার প্রসংগ, তা সম্পূর্ণত কুরআন পরিপন্থী একটি কথা, যা রসূল কখনোই বলতে পারেন না এবং বলেননি।

আর তৃতীয় যে কথাটি “প্রথমে ২:১৮৪ আয়াতে কিছুদিনের সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছিল পরে ২:১৮৫ আয়াত দ্বারা তা মানছুখ বা রহিত করে দেয়া হয়েছে এবং পুরো মাস সিয়াম পালনের বিধান দেয়া হয়েছে”, এটি সম্পূর্ণরূপে কুরআন পরিপন্থী একটি কথা। কারণ কুরআনের কোনো আয়াত কখনোই মানছুখ/রহিত হয়নি। (ইনশাআল্লাহ এ বিষয়ে ‘মানছুখ’ সম্পর্কিত বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে)।

প্রশ্ন হলো, “তাহলে আল কুরআন থেকে কি এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট/ সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়?” এর জবাব হলো, যেহেতু আল্লাহ আল কুরআনে বিধান দিয়েছেন, তাই তিনি যে বিধান দিয়েছেন তাই পালনীয়। আর আল কুরআনের আয়াত সুসম্পূর্ণ, সুস্পষ্ট, স্বব্যাখ্যাত, সহজ ও যথেষ্ট। যদি সাময়িকভাবে তা বুঝতে কারো অসুবিধা হয়, তা জ্ঞানচর্চার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষের ব্যক্তিগত উপলব্ধিগত দুর্বলতার কারণে, নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টায় মানুষের এ দুর্বলতা থেকে উত্তরণ ঘটে এবং সহজ বিষয় সে সহজে বুঝতে পারে। একটি উদাহরণ হচ্ছে, যদি কোনো শিক্ষক কোন ছাত্রকে বলে যে, এ গাণিতিক সমস্যাটি সহজ, তার মানে হলো, নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সামান্য প্রচেষ্টাতেই সমস্যাটির সমাধান সে করতে পারবে। অন্যদিকে কোনো গাণিতিক সমস্যাকে জটিল বলার মানে হলো, অনেক প্রচেষ্টা করা সত্ত্বেও তার সমাধান সহজবোধ্য হয় না, শুধুমাত্র অল্প কিছু ব্যক্তি যারা সর্বাধিক উচ্চস্তরের গণিত গবেষক, তারাই ঐ সমস্যা ও তার সমাধান বুঝবেন। আল কুরআন সহজ মানে এটা উচ্চস্তরের গবেষক ও সাধারণ পাঠক উভয়ের জন্য সহজ, শুধু তাদেরকে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সামান্য প্রচেষ্টা (চিন্তাশীলতার প্রয়োগ) করতে হবে। আল কুরআন সহজ, তবে গল্পের মতো নয়, চিন্তাশীলতার সাথে পড়তে হয় এমন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সহজ বোধগম্য গ্রন্থ।

 

সূরা বাকারা ২:১৮৪ ও ২:১৮৫ আয়াতের প্রাসঙ্গিক বাক্য থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য নির্ণয়

“শাহরু রমাদানে সিয়াম সংখ্যা কত?” প্রশ্নটির উত্তর অনুধাবনের জন্য নিম্নে সূরা বাকারা ২:১৮৪ আয়াত ও সূরা বাকারা ২:১৮৫ আয়াতের প্রাসঙ্গিক বাক্য থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য নির্ণয় করা হলো:

সূরা বাকারা ২:১৮৪ আয়াতে বলা হয়েছে, “(সিয়াম বিধিবদ্ধ করা হলো) আইয়ামাম মা’দূদাতে/ (সহজে) গণনাযোগ্য কয়েকদিন। তবে তোমাদের মধ্য থেকে হবে অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, সেক্ষেত্রে মিন আইয়ামিন উখারা/ অন্য দিনসমূহ থেকে গণনা (সমন্বয় করতে হবে)।

সূরা বাকারা ২:১৮৫ আয়াতে বলা হয়েছে, “রমাদানের মাস, যাতে আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, মানবজাতির জন্য পথনির্দেশ এবং পথনির্দেশ সম্পর্কিত স্পষ্ট প্রমাণ এবং (সত্য-মিথ্যার) পার্থক্যকারী হিসেবে। সুতরা তোমাদের মধ্য থেকে যে মাসটিকে প্রত্যক্ষ করবে/ মাসটির সাক্ষ্য দেবে সে তাতে সিয়াম পালন করবে। আর যে অসুস্থ থাকবে বা সফরে থাকবে, সেক্ষেত্রে মিন আইয়ামিন উখারা/ অন্য দিনসমূহ থেকে গণনা (সমন্বয় করতে হবে)”।

২:১৮৪ আয়াতে অসুস্থতা বা সফরকালীন না রাখা সিয়ামগুলোর জন্য ‘অন্য দিনসমূহ থেকে’ শব্দগুচ্ছ বলার মাধ্যমে তিনটি কথা নির্দিষ্ট হয়ে যায়, যথা:

(১) ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ এর সুনির্দিষ্ট অবস্থান আছে, যাতে সিয়াম পালন করতে হবে। অর্থাৎ এ দিনসমূহ একটি সুনির্দিষ্ট তারিখে শুরু হয়ে একটি সুনির্দিষ্ট তারিখে শেষ হবে, যার মধ্যে অসুস্থতা বা সফরজনিত কারণে গ্যাপ গেলে তারপর সে গণনা অন্য দিনে চলে যাবে অর্থাৎ তা আর ‘আইয়ামাম মা'দূদাত’ এর মূল অবস্থানের মধ্যে থাকবে না, এর বাহিরে চলে যাবে, যে কারণে ‘উখারা(পরবর্তী অন্য)’ শব্দটি প্রযোজ্য।

(২) আইয়ামাম মা’দূদাতের একটি সুনির্দিষ্ট গণনাচক্র রয়েছে, যার থেকে যতটি গ্যাপ যাবে ততটির ইদ্দাত/গণনাচক্র অন্য দিনসমূহ থেকে সুসম্পন্ন করতে হবে।

(৩) ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ এর সাথে তুলনার্থকভাবে ‘মিন আইয়ামিন উখারা’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে।

২:১৮৫ আয়াতে শাহরু রমাদান প্রসংগে বলা হয়েছে, যে ঐ মাসটির সাক্ষ্য দিবে অর্থাৎ শাহরু রমাদানের সাক্ষ্য দিবে, সে তাতে তথা মাসটিতে তথা শাহরু রমাদানে সিয়াম পালন করবে। সেইসাথে ২:১৮৫ আয়াতেও অসুস্থতা বা সফরকালীন না রাখা সিয়ামগুলোর জন্য ‘অন্য দিনসমূহ থেকে’ শব্দগুচ্ছ বলার মাধ্যমে একটি কথা নির্দিষ্ট হয়ে যায়, তা হলো : এ আয়াতে (২:১৮৫) ‘শাহরু রমাদান’ এর সাথে তুলনার্থকভাবে মিন আইয়ামিন উখারা শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ ‘শাহরু রমাদানে যে সিয়াম তার কোনটি গ্যাপ গেলে তার ইদ্দাত/ গণনাচক্র শাহরু রমাদানের পরবর্তী দিনসূহ থেকে হবে যাকে ‘মিন আইয়ামিন উখারা/ অন্য দিনসমূহ থেকে’ শব্দগুচ্ছ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে।

এখানে একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে, একটি মাসের সাথে তুলনার্থকভাবে ‘দিনসমূহ’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা রীতিসিদ্ধ কিনা? এর উত্তর হচ্ছে, ইদ্দাত/গণনাচক্রকে একই এককে হিসাব করে মা’দূদাত/গণনাকৃত করার জন্য এমনটি করা রীতিসিদ্ধ। অর্থাৎ এ অবস্থায় ‘মাস’কে ‘দিনসমূহে’ রূপান্তর করে নেয়া হয়েছে। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে, ৪৬:১৫ আয়াতে বলা হয়েছে, “আমি মানুষকে অসিয়ত করেছি তার পিতামাতার সাথে ইহসান (সুন্দর আচরণ) করার করার জন্য। তার মা তাকে কষ্টের সঙ্গে গর্ভে ধারণ করে এবং কষ্টের সঙ্গে প্রসব করে। তাকে গর্ভধারণ ও দুধপান ছাড়াতে সময় লাগে ত্রিশ মাস”। এখানে আড়াই বছর বা দুই বছর ছয় মাস না বলে ‘ত্রিশ মাস’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ একই এককে (মাসে) রূপান্তর করে হিসাব করা হয়েছে।

আমরা জানি যে, ১ বছর = ১২ মাস। ১ মাস = ৩০ দিন (সাধারণ হিসেবে)। আবার, ১ বছর = ৩৫৪ দিন (চান্দ্রবর্ষে)। অর্থাৎ মাসকে যেমন ‘দিন’ একক দ্বারা প্রকাশ করা যেতে পারে, তেমনি বছরকেও ‘দিন’ একক দ্বারা প্রকাশ করা যেতে পারে। সুতরাং বক্তব্যে যে দিককে গুরুত্বারোপ করার উদ্দেশ্য থাকে বা যা বক্তব্যের উদ্দেশ্যকে অধিক কার্যকরভাবে পূর্ণ করে সেভাবে বক্তব্য বিন্যাস করা হয়।

উপরিউক্ত তথ্য অনুসারে বক্তব্যের বিশেষ ক্ষেত্রে বা প্রেক্ষিতে মাসকে ‘দিনসমূহ’ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা নি:সন্দেহে স্বাভাবিক ভাষারীতির সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। তাই ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ (সহজে গণনাযোগ্য কয়েক দিন) এবং ‘শাহরু রমাদান’ (রমাদানের মাস) সম্পূর্ণভাবে একই সময়কাল বা দিনসংখ্যাকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হওয়ার ক্ষেত্রে ভাষারীতির দিক থেকে কোনো অসঙ্গতি নেই।

‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ এবং ‘শাহরু রমাদান’ বলতে হুবহু একই সময়কালকে বুঝানো হয়েছে কিনা সেই বিষয়টি স্পষ্টভাবে অনুধাবনের সুবিধার্থে নিম্নের টেবিলে বাম পাশে ২:১৮৪ ও ২:১৮৫ আয়াতের ভিত্তিতে সিয়ামের মূল অবস্থানের সময়সীমাকে এবং ডান পাশে তাতে সম্ভব না হলে বিকল্প সময়সীমাকে চিহ্নিত করা হলো:

 

আয়াত নাম্বার

বিধিবদ্ধ সিয়ামের সময়গত মূল অবস্থান

মূল অবস্থানে সম্ভব না হলে সময়গত বিকল্প অবস্থান

২:১৮৪

আইয়ামাম মা’দূদাত

মিন আইয়ামিন উখারা

২:১৮৫

শাহরু রমাদান /আশ শাহরু /হু

মিন আইয়ামিন উখারা

এ প্রসঙ্গে আরেকটি পদ্ধতি ‘ফরম্যাটিং মেথড’ প্রয়োগ করে ‘আইয়ামাম মা’দূদাতএবং ‘শাহরু রমাদান সর্বসম বিষয় কিনা তা নির্ণয়ের সমীকরণ উপলব্ধির জন্য নিম্নে ২:১৮৪ ও ২:১৮৫ আয়াতের ‘একই বিষয়কে বুঝানো শব্দগুলোকে’ বোল্ড ও আন্ডারলাইন দ্বারা চিহ্নিত করা হলো:

আইয়ামাম মা’দূদাতিন ফামান কানা মিনকুম মারীদ্বান আও আলা ছাফারিন, ফাইদ্দাতুম মিন আইয়ামিন উখারা (২:১৮৪)

শাহরু রমাদানাল্লাযী উনযিলা ফীহিল ক্বুরআনু, হুদাল্লিন্নাছি ওয়া বাইয়িনাতিম মিনাল হুদা ওয়াল ফুরক্বানি, ফামান শাহিদা মিনকুমু শাহরা ফালইয়াসুমহু। ওয়া মান কানা মারীদ্বান আও আলা ছাফারিন, ফাইদ্দাতুম মিন আইয়ামিন উখারা। (২:১৮৫)

দেখা যাচ্ছে যে, ২:১৮৪ আয়াতে ‘আইয়ামাম মা’দূদাত এর বিপরীতে ‘মিন আইয়ামিন উখারা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আবার ২:১৮৫ আয়াতে ‘শাহরু রমাদান, আশ শাহরা এবং হু’ এ তিনটি শব্দ দ্বারা একই বিষয়কে বুঝানো হয়েছে এবং তার বিপরীতে ‘মিন আইয়ামিন উখারা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। তাই আমরা ২:১৮৪ আয়াতের ‘আইয়ামাম মা’দূদাত শব্দকে বোল্ড করেছি এবং তার বিপরীতে ‘মিন আইয়ামিন উখারা শব্দগুচ্ছকে আন্ডারলাইন করেছি। আর ২:১৮৫ আয়াতে ‘শাহরু রমাদান, আশ শাহরা এবং হু’ শব্দ তিনটিকে বোল্ড করেছি এবং তার বিপরীতে ‘মিন আইয়ামিন উখারা শব্দগুচ্ছকে আন্ডারলাইন করেছি।

উপরের দুটি পদ্ধতি (Table & Formatting) প্রয়োগ করে দেখা যায় যে, ‘মিন আইয়ামিন উখারা (অন্য দিনসমূহ থেকে) শব্দগুচ্ছ দ্বারা যেমন একদিকে ‘আইয়ামাম মা’দূদাত এর বাহিরের দিনসমূহকে চিহ্নিত করা হয়েছে, একইভাবে সেটাকে ‘শাহরু রমাদানএর বাহিরের দিনসমূহকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ ২:১৮৪ ও ২:১৮৫ আয়াতের বক্তব্য বিশ্লেষণ থেকে যে সুনির্দিষ্ট তথ্য নির্ণয় হয় তা হলো : বিধিবদ্ধ সিয়ামের ক্ষেত্রে, আইয়ামাম মা’দূদাত = শাহরু রমাদান

বিষয়টিকে নিম্নে গাণিতিক পদ্ধতিতেও নির্ণয় করে দেখানো হলো:

একটি গাণিতিক স্বত:সিদ্ধ হলো, যদি A - B = C এবং D - B = C হয়, তাহলে, A = D হয়।

এখন এ গাণিতিক স্বত:সিদ্ধ প্রয়োগ করে আমরা ২:১৮৪ ও ২:১৮৫ আয়াত থেকে ‘শাহরু রমাদানে সিয়াম সংখ্যা কত?” এ প্রশ্নের উত্তর নির্ণয় করতে পারি।

যেহেতু,

আইয়ামাম মা’দূদাত - অসুস্থতা বা সফরজনিত কারণে গ্যাপ যাওয়া দিনসমূহ

= (উহার ইদ্দাত/ গণনাচক্র) মিন আইয়ামিন উখারা

এবং,

শাহরু রমাদান/ আশ শাহরা / হু - অসুস্থতা বা সফরজনিত কারণে গ্যাপ যাওয়া দিনসমূহ

= (উহার ইদ্দাত/ গণনাচক্র) মিন আইয়ামিন উখারা

সুতরাং,

বিধিবদ্ধ সিয়ামের ক্ষেত্রে, আইয়ামাম মা’দূদাত = শাহরু রমাদান

চূড়ান্ত তথ্য হচ্ছে, শাহরু রমাদানে সিয়াম সংখ্যা হচ্ছে শাহরু রমাদানে যতদিন থাকে (কোন বর্ষে ২৯ দিন, কোন বর্ষে ৩০ দিন, যা চাঁদের মনজিল/ তিথিসমূহের তথা হিলাল থেকে হিলাল এর চক্রের উপর নির্ভরশীল) ততদিন। আর এটাকেই ‘আইয়ামাম মা’দূদাত তথা ‘সহজে গণনাযোগ্য কয়েক দিন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

অসুস্থ ও সফরে থাকা ব্যক্তিদের সিয়াম

যারা ‘আইয়ামাম মা’দূদাতে’ (সহজে গণনাযোগ্য দিনসমূহে) বা ‘শাহরু রমাদানে’ (রমাাদানের মাসে) অসুস্থ থাকবে বা সফরে থাকবে তারা অসুস্থতা বা সফরের দিনসমূহে সিয়াম পালন না করে সুস্থা হবার পরে বা সফর শেষে তথা রমাদানের মাসের পরবর্তী বিভিন্ন মাসের বিভিন্ন দিনে (গ্যাপ যাওয়া সিয়ামের সমসংখ্যক দিনে) সিয়াম পালনের মাধ্যমে গণনা সমন্বয় করতে পারবে। অর্থাৎ রমাদানের মাসে একটি সিয়াম পালন করতে না পারলে রমাদানের বাহিরে অন্য যে কোনো মাসের যে কোনো এক দিনে ঐ সিয়ামটি পূরণ করতে পারবে।

এ থেকে বুঝা যায় যে, সিয়াম একটি বার্ষিক কর্মসূচী, যার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট দিনকে তথা রমাদানের মাসের দিনসমূহকে নির্বাচিত করা হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি ঐ দিনসমূহে বা তার কোনো কোনো দিন অসুস্থতা বা সফরের কারণে সিয়াম পালন করতে না পারে তাহলে সে বছরের অন্য যে কোনো দিন সিয়াম পালনের মাধ্যমে সেই সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। এরূপ ব্যক্তিকে রমাদানের বাইরে অন্য দিনসমূহে সিয়াম পালনের ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে বিধায় সে এভাবে সিয়াম সংখ্যা পূর্ণ করার সুযোগ লাভ করে।

এভাবে সিয়ামের দিনসমূহের ক্ষেত্রে দুটি সময়গত অবস্থান পাওয়া যায়: (১) মূল অবস্থান: রমাদানের মাসের দিনসমূহ (২) অসুস্থতা বা সফরজনিত কারণে ঐ দিনসমূহে বা তার কিছু দিনে সিয়াম পালন সম্ভব না হলে সেক্ষেত্রে, বিকল্প অবস্থান: রমাদানের পরবর্তী অন্যান্য মাসসমূহের দিনসমূহ।

এক্ষেত্রে একটি মূল সময়গত অবস্থান নির্ধারণ করার মাধ্যমে সিয়াম সাধণার জন্য সময় শৃঙ্খলা বিধান করা হয়েছে। অন্যদিকে যারা অসুস্থতা বা সফরজনিত কারণে তাতে বা তার কিছুদিন সিয়াম করতে পারবে না তাদের জন্য বছরের অন্য দিনসমূহ থেকে ঐ সংখ্যাকে সমন্বয় করার সুযোগ দেয়ার কারণ হিসেবে যা উল্লেখ করা হয়েছে তাহলো:

(১) আল্লাহ আমাদের জন্য সহজতা চান, তিনি আমাদের জন্য কঠিনতা চান না, এবং

(২) যেন আমরা সিয়ামের পূর্ণ কোর্সের দিনসংখ্যাকে পূর্ণ করতে পারি।

সুতরাং যারা রমাদানের পূর্ণ মাস সিয়াম পালন করবে এবং যারা অসুস্থতা বা সফরের কারণে রমাদানের বাহিরে বা রমাদানের কিছু দিন ও তার বাহিরে কিছু দিন সহ পূর্ণ মাসের সিয়াম পালন করবে উভয়েই সিয়ামের পূর্ণ কোর্স পালন করার কৃতিত্ব পাবে এবং তা তাদের জন্য কঠিনতার পরিবর্তে একটি সহজতা হিসেবেই প্রতীয়মান হয়। কারণ রমাদানের মাসের বাহিরে অন্য মাস রমাদানের মাস না হওয়া সত্ত্বেও তারা তাতে একটি সিয়ামের বদলে একটি সিয়ামই পালন করতে হবে এবং তাদের কৃতিত্ব হ্রাস পাবে না।

‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান, কঠিনতা চান না’ তথ্যের উপর ভিত্তি করে একটি প্রশ্ন আসে যে, স্বয়ং সিয়ামের বিধানকেই তো অনেকের কাছে একটি কঠিন বিধান মনে হয়, কারণ এতে দীর্ঘ প্রায় ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা পানাহার না করে থাকায় শরীরে অবসাদ আসে এবং শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়ে’। এ কথার জবাবে বলা যায় যে, সহজতা চাওয়া এবং কঠিনতা না চাওয়ার তাৎপর্য হলো অযথা বা অনাবশ্যক কঠিনতা আরোপ না করা। কিন্তু প্রত্যেক কাজে কিছু না কিছু কষ্ট হতেই পারে, তাই প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করতে গিয়েও কিছু না কিছু কষ্ট হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে আল্লাহ কঠিনতা চান না বিধায় যারা এ সময় অসুস্থ থাকবে বা সফরে থাকবে তাদের জন্য অন্য দিনসমূহে এ সংখ্যা পূরণের সুযোগ রেখেছেন। তিনি অযথা কঠিন বিধান চাপিয়ে দেননি। যাদের জন্য সিয়াম পালন করা তুলনামূলক অধিক কষ্টদায়ক হবে তাদের জন্য সিয়ামের পরিবর্তে মিসক্বীনকে আহার করানোর ফিদইয়ার ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। তাই সিয়াম মাত্রই একটি কঠিন বিধান বলার অবকাশ নেই।

অসুস্থ ও সফরে থাকা ব্যক্তিদের জন্য দেয়া ব্যবস্থার মাধ্যমে একদিকে যেমন সিয়ামের জন্য রমাদানের মাসকে বাছাই করায় রমাদানের মাসে সিয়াম পালনের গুরুত্ব জানা যায়, অন্যদিকে তেমনি সিয়াম, সিয়ামের উদ্দেশ্য ও সংখ্যার গুরুত্ব এবং এর সাথে সম্পর্কিত আল্লাহর বিভিন্ন অনুগ্রহও অনুধাবন করা যায়।

ফিদইয়া

যারা বিশেষ কোনো অসুবিধায় পরিবৃত (encircled) থাকার কারণে বা সিয়াম পালন সর্বসাধারণের তুলনায় অধিক কষ্টসাধ্য হওয়ার কারণে সিয়াম পালন করবে না তাদেরকে সিয়াম পালন না করে ফিদইয়া (দায়মুক্তি / বিকল্প ব্যবস্থা) হিসেবে অভাবগ্রস্তকে খাদ্য খাওয়াতে হবে বলে বিধান দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রদত্ত ধারাটি হলো: “ওয়া আলাল্লাযীনা ইউত্বীক্বূনাহু ফিদইয়াতুন তয়ামু মিসক্বীন(যারা তাতে অর্থাৎ সিয়াম পালনে অতি কষ্টে সক্ষম বা বিশেষ অসুবিধায় পরিবতৃ অবস্থায় অসাবলীলভাবে সক্ষম তাদের উপর দায়িত্ব হলো ফিদইয়া দেয়া এবং তা হলো ফিদইয়া স্বরূপ অভাবগ্রস্তকে খাদ্য খাওয়ানো)।

এ বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবনের জন্য নিম্নে এ বাক্যটির প্রতিটি শব্দের অর্থ লেখা হলো:

ওয়া = আর।

আলাল্লাযীনা = তাদের উপর দায়িত্ব যারা।

ইউত্বীক্বূনাহু = উহাতে (তথা সিয়াম পালনে) অতিকষ্টে সক্ষম, বিশেষ অসুবিধায় পরিবৃত অবস্থায় অসাবলীলভাবে সক্ষম।

ফিদইয়াতুন = ফিদইয়া দেয়া, ফিদইয়াস্বরূপ।

তয়ামু মিসক্বীন = অভাবগ্রস্তের খাদ্য দান করা।

এখানে, ‘ইউত্বীক্বূনাহুশব্দটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এটি একটি যুক্ত শব্দ, যার প্রথমাংশ ‘ইউত্বীক্বূনা। এর অর্থ হলো, ‘অতিকষ্টে সক্ষম, বিশেষ অসুবিধায় পরিবৃত অবস্থায় অসাবলীলভাবে সক্ষম’। কারণ, সম্পূর্ণ বা সাবলীল সক্ষমতাকে ‘ক্বুদরত বলা হয়, ‘ত্বাক্বত বলা হয় না। তাই আল্লাহর জন্য ‘ক্বুদরত শব্দ ব্যবহৃত হয়, কিন্তু ‘তাক্বত শব্দ ব্যবহৃত হয় না। দ্বিতীয় অংশ, ‘হুঅর্থ “উহাতে”। এটি পূর্বে উল্লেখিত ক্রিয়াবিশেষ্য ‘সিয়াম’কে (২:১৮৩) নির্দেশ করে। অন্যদিকে ‘ফিদইয়া শব্দটি পূর্বে উল্লেখ করা হয়নি, পরে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ‘ফিদইয়া শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ, তাই ‘হু (পুংলিঙ্গ সর্বনাম) দ্বারা ফিদইয়াকে বুঝাতে পারে না। অর্থাৎ এখানে ‘ফিদইয়া দিতে সক্ষম বুঝানো হয়নি, বরং সিয়াম পালনে অতিকষ্টে সক্ষম বা বিশেষ অসুবিধায় পরিবৃত অবস্থায় অসাবলীলভাবে সক্ষম বুঝানো হয়েছে।

যারা মনে করেন যে, ইউত্বীক্বূনাহু শব্দ দ্বারা সিয়াম পালনে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে তাদের ধারণা সঠিক নয়। এর একটি প্রমাণ হলো, যারা রমাদানের মাসে অসুস্থ থাকবে বা সফরে থাকবে তারা অন্য দিনসমূহে সিয়াম পালন করার বিধান দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে যারা সম্পূর্ণ সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও সিয়াম পালন করবে না, তারা সিয়াম পালন না করে ফিদইয়াস্বরূপ মিসক্বীনের খাদ্য দান করতে পারবে, এরূপ বিধান অসুস্থ ও সফরে থাকা ব্যক্তিদের জন্য প্রদত্ত বিধানের সাথে সঙ্গতিশীল হয় না। এ থেকেও বুঝা যায় যে, ‘ইউত্বীক্বূনাহূ’ বলতে সিয়াম পালনে সম্পূর্ণ সক্ষম ব্যক্তিকে বুঝানো হয়নি।

কেউ কেউ বলেন যে, ২:১৮৪ আয়াতে বর্ণিত সিয়াম পালনের পরিবর্তে ফিদইয়াস্বরূপ মিসক্বীনের খাদ্য দান করার বক্তব্যটি ২:১৮৫ আয়াত দ্বারা মানছুখ (রহিত) হয়ে গেছে। অথচ ২:১৮৫ আয়াতে ২:১৮৪ আয়াতে বর্ণিত ফিদইয়ার বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই, তাই ২:১৮৫ আয়াত দ্বারা ২:১৮৪ আয়াতে বর্ণিত ফিদইয়ার অংশটি রহিত হওয়ার দাবি সঠিক নয়।

২:১৮৪ আয়াতে উল্লেখিত অসুস্থ থাকা বা সফরে থাকা ব্যক্তিরা অন্য দিনসমূহে সিয়াম পালন করতে হবে মর্মে বর্ণিত ধারাটি ২:১৮৫ আয়াতে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। কিন্তু ২:১৮৪ আয়াতে বর্ণিত ফিদইয়ার ধারাটি ২:১৮৫ আয়াতে পুনরাবৃত্তি করা হয়নি। কিন্তু এ থেকে ২:১৮৪ আয়াতের ফিদইয়ার অংশটিকে রহিত বলা যেতে পারে না। কারণ ২:১৮৪ আয়াতে বর্ণিত ধারাসমূহ আয়াতটি বক্তব্য কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত। আর ২:১৮৫ আয়াতে ‘অসুস্থ থাকা বা সফরে থাকা ব্যক্তিদেরকে অন্য দিনসমূহে সিয়াম পালন করতে হবে’ মর্মে বর্ণিত ধারাটি পুনরাবৃত্তি করার বিষয়টি আয়াতটির বক্তব্য কাঠামোর সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ছিলো বিধায় পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। তাতে এ ধারাটির যৌক্তিকতা সম্পর্কে পরবর্তী বক্তব্যগুলো রাখা হয়েছে। তাতে ‘ফিদইয়া’ সম্পর্কিত ধারাটির পুনরাবৃত্তির প্রয়োজনীয়তা ছিলো না বিধায় তা পুনরাবৃত্তি করা হয়নি। ২:১৮৪ আয়াতে যে দিকের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে সেই প্রেক্ষিতে সিয়ামের দিনসমূহকে ‘আইয়ামাম মা’দূদাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর যারা অসুস্থতার কারণে বা সফরে থাকার কারণে তাতে সিয়াম পালন করতে পারবে না তারা অন্য দিনসমূহে সিয়াম পালন করতে হবে মর্মে জানানো হয়েছে। অন্যদিকে ২:১৮৫ আয়াতে এই ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ এর সময়গত সুনির্দিষ্ট অবস্থান হিসেবে জানানো হয়েছে যে, তা হলো ‘শাহরু রমাদান’ বা ‘রমাদানের মাস’। এতে কেন রমাদানের মাসকে বিধিবদ্ধ সিয়ামের জন্য বাছাই করা হলো তাও উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর জানানো হয়েছে যে, যারা এ মাসে অসুস্থ থাকবে বা সফরে থাকবে তারা অন্য দিনসমূহে সিয়াম পালন করবে। এভাবে বক্তব্যের প্রয়োজনে এতে এ বিষয়টি পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এছাড়া এর মাধ্যমে ‘আইয়ামাম মা’দূদাত এবং ‘শাহরু রমাদান যে একই সময়কালকে প্রকাশ করে তাও স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু কোনোক্রমেই ২:১৮৫ আয়াতে ২:১৮৪ আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো তথ্য নেই। তাই ২:১৮৫ আয়াতের দ্বারা ২:১৮৪ আয়াতে বর্ণিত ফিদইয়ার বিষয়টি মানছুখ (রহিত) হওয়ার দাবি সঠিক নয়।

কারা সিয়াম পালনের পরিবর্তে ফিদইয়া দিতে পারবে তার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, যারা ভীষণ কায়িক শ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করে, অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি, যারা এমন রোগে আক্রান্ত যা থেকে সহজে মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বা কোনো বিশেষ রোগের চিররুগী, যারা সারা বছরব্যাপী সফরে থাকেন। এছাড়া গর্ভবতী এবং দুগ্ধপোষ্য শিশুর মা যদি বিবেচনা করে দেখেন যে, সিয়াম পালন করা তাঁর জন্য বিশেষ অসুবিধার হবে তাহলে তাঁরাও এর অন্তর্ভুক্ত হবেন। আসলে বিষয়টি মু’মিন ব্যক্তির নিজস্ব বিবেকসঙ্গত বিবেচনার উপর নির্ভরশীল।

প্রশ্ন হতে পারে যে,, যারা ফিদইয়া দিতে সক্ষম নয় তারাও কি ফিদইয়া দিতে হবে? এর উত্তর হলো, এটি স্বতন্ত্রভাবে বলার প্রয়োজনীয়তা নেই, কারণ ফিদইয়া দিতে হবে মিসকীনকে, এখন যে নিজেই মিসকীন সে তো ফিদইয়ার প্রাপক, সে ফিদইয়া দেয়ার দায়িত্বশীল নয়, এটা সাধারণ বিবেকবুদ্ধি (Common sense) দিয়ে এমনিতেই বুঝা যায়। এছাড়া এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, সর্বজনীন মূলনীতি, “আল্লাহ কারো উপর সাধ্যাতীত দায়িত্বভার অর্পণ করেন না” (২:২৩৩, ২:২৮৬, ৬:১৫২, ৭:৪২, ২৩:৬২, ৬৫:৭)। সুতরাং এরূপ ব্যক্তি ফিদইয়া দেয়া ছাড়াই আনুষ্ঠানিক সিয়াম পালন থেকে অব্যাহতি পাবে। আল্লাহর বিধান ও বিচার পদ্ধতিতে বিভিন্ন স্তরের যোগ্যতা-সামর্থ্য ও সুযোগ-সুবিধার ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে তাদের পারস্পরিক অবস্থার তারতম্য বিবেচনায় নেয়া হয় (৬:১৬৫)।

উল্লেখ্য যে, ফিদইয়ার বিধান থাকা এটি প্রমাণ করে না যে, ‘সিয়াম পালন বাধ্যতামূলক নয়’; বরং সক্ষম ব্যক্তিদের উপর তো অবশ্যই সিয়াম পালন বাধ্যতামূলক, কিন্তু যারা অতিকষ্টে সক্ষম তাদের জন্য সিয়াম পালন না করে তার পরিবর্তে ফিদইয়াস্বরূপ মিসক্বীনের খাদ্য দান করার অবকাশ রয়েছে। কারণ সে সিয়াম পালনে সক্ষমতার দিক থেকে সাধারণ অবস্থার চেয়ে ব্যতিক্রমমূলক অবস্থায় রয়েছে। তাই তার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমমূলক বিধান দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম কখনো সাধারণ অবস্থায় থাকা ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য বিষয়কে সাধারণ অবস্থায় থাকা ব্যক্তিদের জন্যও ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত করে না। তাই তাক্বওয়া অবলম্বনের উদ্দেশ্যে আত্মসংযমের প্রশিক্ষণমূলক বিধান হিসেবে প্রদত্ত সিয়াম একটি আবশ্যকীয় দায়িত্ব। তবে একটি প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম প্রশিক্ষণের জন্য যথোপযোগী হওয়া সত্ত্বেও কোনো কোনো প্রশিক্ষণার্থী সঠিক পদ্ধতিতে তাতে অংশগ্রহণ না করার কারণে সঠিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ নাও করতে পারে। তাই আনুষ্ঠানিক সিয়ামকারী অনেক ব্যক্তি বাস্তবে আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন করে না, এটি তাদের ব্যর্থতা। তাই সিয়ামের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য সিয়ামকে তাক্বওয়ার প্রশিক্ষণ কোর্স হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, নিছক উপবাসের একটি অনুষ্ঠান হিসেবে নয়।

ফিদইয়া প্রসঙ্গে একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো: যদি ফিদইয়ার মাধ্যমে সিয়ামের উদ্দেশ্য সরাসরি পূর্ণ হতো তাহলে ফিদইয়াকে ফিদইয়া (মুক্তিপণ, দায়মোচন, জরিমানা) বলা হতো না। বিষয়টি এরূপ নয় যে, যে কেউ সিয়াম পালন না করে মিসক্বীনকে খাদ্য খাওয়ালে তা ফিদইয়া হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে; বরং বিষয়টি হলো: যারা সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে বিশেষ অসুবিধার মধ্যে থাকে তারা সিয়াম পারন না করে ফিদইয়াস্বরূপ মিসক্বীনের খাদ্য দান করতে পারবে।

এটা জরুরি নয় যে, ফিদইয়ার দ্বারা আক্ষরিকভাবে সিয়ামের প্রতিটি দিক রক্ষা পেতে হবে, বরং এক্ষেত্রে মূল মেজাজ (Spirit) রক্ষা পেলে সেটাকে যথেষ্ট সাব্যস্ত করা হয়। আর এজন্য সিয়াম পালন করতে না পারলে সেজন্য ফিদইয়াস্বরূপ মিসক্বীনকে খাদ্য খাওয়ানোর বিধান দেয়া হয়েছে। সিয়ামের মূল অনুপ্রেরণাগত দিক হলো ‘তাক্বওয়া (আল্লাহ সচেতনতা)। সিয়াম করতে না পারলে ফিদইয়ার মাধ্যমেও তাক্বওয়ার চর্চা হয় এবং সেই সাথে একটি প্রত্যক্ষ সমাজকল্যাণকর্ম সম্পাদিত হয়। তাই সিয়াম পালন করতে না পারলে তার ফিদইয়স্বরূপ মিসক্বীনের খাদ্য দান করার বিষয়টি একটি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও কল্যাণকর ব্যবস্থা।

মাসিক রজ:স্রাবকালে নারীদের সিয়াম

সিয়াম প্রসঙ্গে একটি সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন হয়ে থাকে ‘মাসিক রজ:স্রাবকালে নারীরা সিয়াম পালন করতে হবে কিনা বা তারা এ সিয়াম পরবর্তী অন্য দিনে পালন করলে হবে কিনা?’ এ ধরনের প্রশ্নের জবাব আয়াতে থাকা তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমেই নির্ণয় করতে হবে। কারণ যদি আয়াতের তথ্য থেকে কোনো বিধান নির্গত না হয় সেটাকে বিধান হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে না, বরং সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিধান দেয়ার পরিবর্তে তা ব্যক্তির বিবেকসঙ্গত সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে তথা ব্যক্তিকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে এবং সমষ্টিগত বিষয় হলে পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য রেখে দেয়া হয়েছে বলে সাব্যস্ত হবে।

কোনো আয়াতে মাসিক রজ:স্রাবকালে নারীরা সিয়াম করতে পারবে না এরূপ বিধান দেয়া হয়নি। মাসিক রজ:স্রাব কোনো অসুস্থতা নয়, এটি নারীদের একটি মাসিক স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া। তাই কেউ রমাদানের মাসে অসুস্থ থাকলে সে অন্য দিনসমূহে ঐ সংখ্যা পূর্ণ করার যে বিধান দেয়া হয়েছে এক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। অন্য কথায় মাসিক রজ:স্রাবকালেও নারীরা সিয়াম পালন করতে হবে। কিন্তু যদি মাসিক রজ:স্রাব কারো ক্ষেত্রে অসুস্থতায় রূপ নেয়, সে ঐ দিনসমূহে সিয়াম পালন না করে অন্য দিনসমূহে সিয়াম পালন করতে পারবে। আবার যদি মাসিক রজ:স্রাবকালে কোনো নারীর জন্য সিয়াম পালন অতিকষ্টে সক্ষম হওয়ার মতো বিষয়ে পরিণত হয়, সে নারীর ক্ষেত্রে সিয়াম করার পরিবর্তে ফিদইয়াস্বরূপ মিসক্বীনের খাদ্য দান করার অবকাশ রয়েছে। এক কথায়, যেহেতু মাসিক রজ:স্রাব কোনো অসুস্থতা নয়, তাই মাসিক রজ:স্রাবকালেও সিয়াম পালন করতে হবে। কিন্তু যদি কারো ক্ষেত্রে তা অসুস্থতায় পরিণত হয় বা কারো ক্ষেত্রে ঐ অবস্থায় সিয়াম পালন অতিরিক্ত কষ্টদায়ক হয়, তার ক্ষেত্রে অসুস্থতা বা অতিকষ্টে সিয়াম পালনে সক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত বিধান প্রযোজ্য হবে।

‘সিয়াম করা তোমাদের জন্য কল্যাণকর’ তথ্যটির তাৎপর্য

২:১৮৪ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সিয়াম করা তোমাদের জন্য কল্যাণকর; যদি তোমরা জানতে পারো!’। এ তথ্যটির দুই ধরনের তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়। যেমন:

(১) সিয়াম করা আমাদের জন্য কল্যাণকর হবে যদি আমরা এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব জানতে পারি। অন্য কথায় সিয়াম কী ও কেন বা সিয়ামের গুরুত্ব কী তা না জানলে সিয়াম করার কল্যাণ অর্জন করা সম্ভব নয়। এটা নিশ্চিত যে, সিয়াম যে উদ্দেশ্যে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে যদি আমরা সেই উদ্দেশ্যের দিকে লক্ষ রেখে সিয়াম সাধনা না করি বা সিয়ামকে তাক্বওয়া (আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন) এর ক্ষেত্রে একটি প্রশিক্ষণ কোর্স হিসেবে গ্রহণ না করি তাহলে সিয়াম সাধনার নামে মাসব্যাপী আমাদের উপবাস থাকার মধ্যে কোনো প্রকৃত কল্যাণ নেই।

(২) ‘সিয়াম করা তোমাদের জন্য কল্যাণকর’ তথ্যটির পূর্বে আলোচ্য বিষয়টি ছিলো, যাদের ক্ষেত্রে সিয়াম পালন তুলনামূলক অধিক কষ্টসাধ্য, যারা সিয়াম পালনে অতিকষ্টে সক্ষম বা যারা কোনো বিশেষ অসুবিধামূলক অবস্থায় পরিবৃত (encircled) অবস্থায় থাকে, তারা সিয়াম পালনের পরিবর্তে ফিদইয়াস্বরূপ প্রতিটি সিয়ামের বিপরীতে একজন মিসক্বীনকে খাদ্য দান করতে পারে। কিন্তু এ বিষয়টির কোনো সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই যে, কার ক্ষেত্রে সিয়াম পালন অতিকষ্টে সক্ষমতার বিষয়টি প্রযোজ্য হতে পারে। অর্থাৎ এটি ব্যক্তি নিজেই বিবেচনা করার মতো একটি বিষয় (Subjective)। তাই কোনো ব্যক্তি যদি বিবেচনা করে যে, সে সম্ভবত এক্ষেত্রে মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে, সেক্ষেত্রে সে সিয়াম এবং ফিদইয়া এই দুইয়ের মধ্য থেকে সিয়াম পালন করাকে বাছাই করে নেয়া তার জন্য অধিক কল্যাণকর সাব্যস্ত হবে। অন্য কথায় এ বক্তব্যের মাধ্যমে এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে সিয়াম পালনের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে।

রমাদানের মাসে সিয়াম নির্ধারণের কারণ

২:১৮৫ আয়াতে রমাদানের মাসে সিয়াম নির্ধারণের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, “রমাদানের মাস, যাতে আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, মানবজাতির জন্য পথনির্দেশ এবং পথনির্দেশ সম্পর্কিত স্পষ্ট প্রমাণ এবং (সত্য-মিথ্যার) পার্থক্যকারী হিসেবে। সুতরাং তোমাদের মধ্য থেকে যে মাসটিকে প্রত্যক্ষ করবে/ মাসটির সাক্ষ্য দেবে সে তাতে সিয়াম পালন করবে”। আয়াতটির শেষাংশে বলা হয়েছে, “যেন তোমরা আল্লাহর বড়ত্ব-মহিমা ঘোষণা করতে পার তাঁর দেখানো পথনির্দেশের উপর (নির্ভরতার ভিত্তিতে) এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারো”।

উপরিউক্ত বক্তব্য থেকে রমাদানের মাসে সিয়াম নির্ধারণের কারণ সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। রমাদানের মাসে কুরআন নাযিলের সূচনা হয়েছে বিধায় বিধিবদ্ধ সিয়ামের জন্য রমাদানের মাসকে বাছাই করা হয়েছে। কুরআনের বৈশিষ্ট্য হলো কুরআনই মানবজাতির জন্য সঠিক পথনির্দেশ এবং এটি অত্যন্ত যৌক্তিক ও স্পষ্ট প্রমাণবহ পথনির্দেশ এবং সেই সাথে এটি মানুষের জন্য জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে মৌলিক তথ্য ও বিধি-বিধানের বিষয়ে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী মানদণ্ড হিসেবে নাযিল করা হয়েছে।

রমাদান মাসকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বিশেষ মাস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সিয়ামকে এই বড়ত্ব-মহিমা প্রকাশ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায়ে পরিণত করা হয়েছে। কারণ সিয়াম হলো তাক্বওয়ার অনুশীলনের মাস আর যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে তাদেরকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্যই দিশারী হিসেবে আল কুরআন নাযিল হয়েছে। আল কুরআন মূলত সমগ্র মানবজাতির হিদায়াত হিসেবে নাযিল করা হয়েছে। তবে আল কুরআন থেকে হিদায়াত গ্রহণের প্রকৃত কল্যাণ তারাই লাভ করতে পারবে যাদের মধ্যে তাক্বওয়া বা আল্লাহ সচেতনতা বিদ্যমান থাকে। কুরআন নাযিলের রমাদান মাস হলো তাক্বওয়ার ফসল বিকাশের বসন্তকাল। রমাদান মাসে কুরআন নাযিল হওয়ার কারণে এ মাসটিকে সিয়াম পালনের মাস হিসেবে বাছাই করা হয়েছে।

সিয়াম হলো কুরআন হিসেবে যে হিদায়াতের নিয়ামত দেয়া হয়েছে তার কৃতজ্ঞতা। নিয়ামাতের কৃতজ্ঞতা ও অনুগ্রহের স্বীকৃতির শ্রেষ্ঠ পন্থা হলো যে উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য নিয়ামতটি প্রদান করা হয়েছে সেটাকে পূর্ণ করার জন্য নিজেকে সর্বোত্তমভাবে প্রস্তুত করা। কুরআন নাযিলের মাসে সিয়াম পালন করা হলো কুরআন রূপ নিয়ামাতের কৃতজ্ঞতা আদায়ের মাধ্যম। কারণ সিয়ামের মাধ্যমে কুরআন অনুযায়ী পথ চলার যোগ্যতা অর্জনের অনুশীলন হয়।

সিয়াম, আল্লাহর নৈকট্য ও তাঁর আহবানে সাড়া দেয়া

সিয়াম প্রসঙ্গের বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় বলা হয়েছে, “আর যখন আমার বান্দা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন (জ্ঞাতব্য যে), নিশ্চয় আমি নিকটেই। আমি আহবানকারীর আহবানে সাড়া দিই যখন সে আমাকে আহবান করে। সুতরাং তারা তারা আমার প্রতি সাড়া দিক এবং আমার প্রতি বিশ্বাস-আস্থা স্থাপন করুক, যেন তারা সঠিক পথপ্রাপ্ত হয়”।(২:১৮৬)

এ কথার তাৎপর্য হলো, আল্লাহর নৈকট্যের জন্য কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন নেই, বান্দা যখনই তাঁর কাছে প্রার্থনা করে তিনি শুনেন এবং তার প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে থাকেন। এ সাড়া দেয়ার অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রার্থিত বিষয় তাকে দিয়ে দেয়া নয়, বরং আল্লাহর কাছে প্রার্থিত কিছু কিছু বিষয় মানুষ দ্বিবিধ কারণে নাও পেতে পারে, একটি হলো প্রার্থিত বিষয়টি তার জন্য কল্যাণকর নাও হতে পারে, অনেক সময় মানুষ না জানার কারণে যেটিকে কল্যাণকর মনে করে সেটি তার জন্য কল্যাণকর হয় না এবং তাই সে তার জন্য কল্যাণকর ভেবে অকল্যাণ প্রার্থনা করে বসে, দ্বিতীয়টি হলো, আল্লাহ যে নিয়ম-নীতিতে বিশ্বসাম্রাজ্য পরিচালনা করছেন তাতে তাকে প্রার্থিত বিষয় পাওয়ার জন্য যথানিয়মে তার সাধ্যমতো দায়িত্বটুকু পালন করতে হবে এবং জগতের কার্যক্রম ব্যবস্থাপনায় যে মূলনীতিসমূহকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে তার প্রার্থনা ও প্রচেষ্টা তার সাথে সামঞ্জস্যশীল হতে হবে। অন্যদিকে মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিধি-বিধান ও নিয়ম-নীতি পরিপালনের আহবান জানানো হয়েছে তার সবই তার জন্য কল্যাণকর বিধায় এবং আল্লাহর বান্দা হিসেবে তার যে অবস্থান সেই প্রেক্ষিতেও তার কর্তব্য হলো সেসব বিধি-বিধান ও নিয়ম-নীতি জানার ও মানার ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া দেয়া।

যেহেতু আল্লাহর কাছে প্রার্থনার জন্য কাউকে মাধ্যম সাব্যস্ত করার প্রয়োজন নেই, তাই কাউকে আল্লাহর কাছে শাফায়াতকারী বা আল্লাহর নৈকট্যের মাধ্যম হিসেবেও গ্রহণ করা উচিত নয়। যেহেতু আমাদের যাবতীয় সমস্যা সংকট নিরসনে আল্লাহর নিকট আহবান করলে তিনি সাড়া দেন তথা তিনি আমাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধানে নির্দেশিকা প্রদান করেন, তাই আমাদের কর্তব্য হলো তাঁর পাঠানো কিতাব থেকে পথনির্দেশ গ্রহণ করা। কোনো বিষয়ে আমরা সমস্যা বোধ করলে, তা পার্থিব প্রয়োজন সম্পর্কিত হোক বা কোনো বিষয় উপলব্ধিগত জটিলতা হোক বা কোনো বিধানের উপকারিতা-উপযোগিতা সম্পর্কিত হোক, তার সমাধানের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে হবে, কারণ তিনি সর্বাপেক্ষা নিকটতম এবং সকলের সংকট মোচনকারী। আল্লাহর সম্পর্কে প্রশ্ন বলতে আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, পছন্দ-অপছন্দ, বিধি-বিধান, নৈকট্যের উপায় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নকে বুঝায়। উত্তরে বলা হয়েছে তিনি অত্যন্ত নিকটে। আর মানুষ আল্লাহর নৈকট্য থেকে লাভবান হওয়ার উপায় হলো আল্লাহর আহবানে সাড়া দেয়া তথা আল্লাহকে স্মরণ করা, তাঁর গুণাবলী ও বিধি-বিধানকে স্মরণ করা, তাঁর অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা, বিভিন্ন সমস্যা-সংকটে ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তাঁরই নিকট আহবান করা, তাঁর বিধান থেকে সমস্যার সমাধান তালাশ করা।

কোনো বিষয়ে কুরআনে কোনো নির্দিষ্ট বিধান উল্লেখ না করার অর্থ হলো ঐ বিষয়ে বিবেক-বুদ্ধি অনুসারে এবং প্রকৃতি ও বাস্তবতার প্রেক্ষিতে সমাধান নির্ণয় করার অবকাশ রয়েছে। তাই আল্লাহর আহবানে সাড়া দেয়ার অর্থ হলো আল্লাহর কিতাব ও তাঁর তৈরি বিশ্বপ্রকৃতি থেকে যাবতীয় সমস্যার সমাধানের জন্য যথানিয়মে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। আর এর মাধ্যমে আল্লাহর তৈরি নৈতিক ও প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে মানুষ তাদের প্রার্থিত বিষয় থেকে যখন যেভাবে যতটুকু পাওয়ার তা পেতে পারবে। 

সিয়াম, সন্ন্যাসব্রত ও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক

সিয়াম প্রসঙ্গে যেন কোনোভাবে এমনটি মনে না হয় যে, সন্ন্যাসব্রতের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্য লাভ করতে পারে; সেই বিষয়ে ২:১৮৬ আয়াতটির বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরে। আয়াতটি থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহর নৈকট্যের জন্য সন্ন্যাসব্রতের প্রয়োজন নেই, বরং সিয়ামের বিধানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দিনের বেলায় যে দূরত্বের বিধান রয়েছে সেটা আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে একটি সাময়িক ব্যবস্থামাত্র; যার ধারাবাহিকতায় ২:১৮৭ আয়াতের বক্তব্যে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, আল্লাহর বিধানে সিয়াম পালনের সময়কালে রাতের বেলা যেমন পানাহার বৈধ তেমনি স্বামী-স্ত্রীর একান্ত ঘনিষ্ঠতাও বৈধ। আয়াতটিতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে পোশাকের উপমায় প্রকাশ করা হয়েছে যে, স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের পোশাক। পোশাককে স্থায়ীভাবে শরীর থেকে পৃথক রাখা যায় না, তেমনি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও স্থায়ীভাবে কোনো দূরত্ব আরোপ করা যেতে পারে না। বিশেষ অবস্থায় সীমিত পর্যায়ের যে বিধি-নিষেধ তা নিছক আত্ম-প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ও সাময়িকভাবে প্রযোজ্য বিষয় মাত্র।

পোশাক ও শরীর পরস্পরের Complementary বা পরিপূরক, ঠিক তেমনি স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরের পরিপূরক। পোশাক মানুষের শরীরকে ঢেকে রাখে, তার লজ্জাস্থানের গোপনীয়তা সংরক্ষণ করে বা লজ্জা ধরে রাখার জন্য মানুষ পোশাক পরে থাকে। তেমনি স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে লজ্জাস্কর কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকতে সহায়ক উপকরণ হয়ে থাকে।

পোশাক শরীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। তেমনি স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্কের কারণে পারিবারিক জীবনের সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধি তথা সুন্দর সমাজ-সভ্যতার বিকাশ ঘটে।

পোশাক শীত-গ্রীষ্মের আবহাওয়ার বিপরীতে স্বাচ্ছন্দের উপকরণ এবং বর্ম স্বরূপ হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও তাদের জন্য নৈতিক পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে থাকে।

তাই তাক্বওয়ার চর্চার জন্য সাময়িকভাবে স্বামী-স্ত্রীর বিশেষ সম্পর্কের উপর কোনো বিধিনিষেধ আরোপ হলেও তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো দীর্ঘস্থায়ী দূরত্ব না থাকাটাও তাক্বওয়া বা আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বনের অন্যতম উপায়ে পরিণত হয়। এজন্য যেমন একদিকে এরূপ সাময়িক দূরত্বের বিধি-নিষেধ রয়েছে তেমনি অন্যদিকে ঐ সময় পার হলে ঐ দূরত্বকে অতিক্রম করে পরস্পরে ঘনিষ্ঠ হওয়ারও নির্দেশ রয়েছে।

এ'তেকাফ

রমাদানের মাসে বিধিবদ্ধ সিয়াম সম্পর্কিত আয়াতসমূহে এ’তেকাফের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “আর তোমরা যখন মাসজিদে আকিফূন (এ’তেকাফরত / আত্মনিয়োজিত, ধ্যান ও গভীর চিন্তামগ্ন এবং অবস্থানকারী) থাকো, তখন (এ’তেকাফের দিনগুলোতে দিনে-রাতে কখনো) তাদের সাথে বিশেষ খোশালাপ ও দাম্পত্য সুখকর মিলন (সহবাস) করো না”।

এ’তেকাফ বলতে (আল্লাহর স্মরণে) মাসজিদে অবস্থান করা, আত্মনিয়োজিত ও ধ্যানমগ্ন থাকাকে বুঝায়। এ’তেকাফের জন্য শ্রেষ্ঠ সময়কাল হলো রমাদান মাস। যদিও এ’তেকাফকে এবং রমাদান মাসে এ’তেকাফকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি, তবুও এ’তেকাফ প্রসঙ্গে যত আয়াত এসেছে তার মাধ্যমে এ বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রমাদান ছাড়া অন্য মাসেও এ’তেকাফ করা যেতে পারে। এছাড়া যদি মাসজিদের কোনো বিশেষ প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের জন্য এ’তেকাফ তথা গভীর চিন্তামগ্নতার প্রয়োজনে মাসজিদে অবস্থান প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে এ’তেকাফ সঙ্গত।

মাসজিদে এ’তেকাফের সময় স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিশেষ খোশালাপ ও দাম্পত্য সুখকর মিলন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সাধারণভাবে সিয়ামের রাতের বেলায় স্ত্রীদের প্রতি আবেগ উদ্দীপক ঘনিষ্ঠতাকে বৈধ করা হয়েছে তথা দিনের বেলায় তা বৈধ নয়। কিন্তু তার সাথে যখন বলা হলো মাসজিদে এ’তেকাফ করলে স্ত্রীদের সাথে বিশেষ খোশালাপ ও দাম্পত্য সুখকর মিলন করা যাবে না, এ থেকে বুঝা যায় যে, মাসজিদে এ’তেকাফ করলে শুধু রাতে নয়, বরং দিনেও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকতে হবে। এর ফলে গভীর চিন্তামগ্নতা বা ধ্যানের ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্ততা থেকে মুক্ত থাকা যাবে। এছাড়া যদি মাসজিদের বিশেষ কোনো সমাধানযোগ্য বিষয় নিয়ে চিন্তাগবেষণার বিষয় থাকে, সেক্ষেত্রেও এটি সমাধানের জন্য ও তথ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বিশেষ উপায়ে পরিণত হতে পারে। সাময়িক আশ্রয়ণ হিসেবেও মাসজিদে অবস্থান করলে সেটাও এ’তেকাফের অন্তর্ভুক্ত।

মাসজিদে এ’তেকাফ অবস্থায় স্ত্রীমিলন না করা (এমনকি স্বামী-স্ত্রী উভয়ে একসাথে এ’তেকাফ করলেও) পবিত্র তুওয়া উপত্যকায় জুতা খুলে প্রবেশ করার মতো শিষ্টাচারেরও অন্তর্ভুক্ত।

এ’তেকাফ কতদিন করা হবে তা অনির্দিষ্ট। সাধারণভাবে ১০ দিন এ’তেকাফ করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু কেউ যদি একটি দিনও এ’তেকাফ হিসেবে পালন করে তাও এ’তেকাফের অন্তর্ভুক্ত হবে বা সেটাকেও আপত্তিকর বলা যেতে পারে না। এ’তেকাফ সিয়ামের মতোই একটি অনুশীলন। কিন্তু এর মাধ্যমে জীবনব্যাপী সন্নাসব্রত পালনের দীক্ষা গ্রহণের অবকাশ নেই। কারণ স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের পোশাকের সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং নিজেদের সাথে খেয়ানত পরিহার করে বৈধ সময়সীমায় স্ত্রীদের সাথে বিশেষ খোশালাপ এবং দাম্পত্য সুখকর মিলনের জন্য নির্দেশ রয়েছে।

আনুষ্ঠানিক সিয়ামের পদ্ধতি বা করণীয়

২:১৮৭ আয়াতে আনুষ্ঠানিক সিয়াম (আত্মসংযম সাধনা) এর পদ্ধতি কী বা এক্ষেত্রে কী কী করণীয় রয়েছে তা উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতটির তথ্য অনুসারে আনুষ্ঠানিক সিয়ামের পদ্ধতি বা করণীয় বিষয় হলো: (ক) দিনের বেলায় পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে এবং (খ) দিনের বেলায় স্ত্রীমিলন থেকেও বিরত থাকতে হবে।

আনুষ্ঠানিক সিয়ামের জন্য দিনের বেলায় পানাহার থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়ে ২:১৮৭ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “আর তোমরা খাও ও পান করো যতক্ষণ না তোমাদের জন্য (দিগন্তের) কালো রেখা থেকে ফজরের মধ্যকার (দিগন্তের) সাদা রেখা স্পষ্ট হয়। তারপর তোমরা তোমরা রাত (রাতের সূচনা) পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো”। এ তথ্যের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, দিগন্তের কালো রেখা থেকে ফজরের মধ্যকার দিগন্তের সাদা রেখা স্পষ্ট হলে তারপর আর পানাহার করা যাবে না এবং এভাবে সিয়াম করতে হবে এবং এভাবে রাতের সূচনা পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করতে হবে। অর্থাৎ রাতের আগমন করলে তারপর আবার পানাহার করা যাবে। অন্য কথায় সিয়াম পালনের জন্য পানাহার করা যাবে না, বিষয়টি শুধুমাত্র দিনের বেলায় প্রযোজ্য। তাই রাতের সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত পুরো রাতের বেলায় পানাহার করা যাবে।

আর আনুষ্ঠানিক সিয়ামের জন্য দিনের বেলায় স্ত্রীমিলন থেকে বিরত থাকার নির্দেশনাও ২:১৮৭ আয়াত থেকেই পাওয়া যায়। আয়াতটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “তোমাদের জন্য সিয়ামের রাতে তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি আবেগ উদ্দীপক ঘনিষ্ঠতা বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক। আল্লাহ জানেন যে, তোমরা তোমাদের নিজেদের প্রতি খিয়ানত করছো। তারপর তিনি তোমাদের তাওবা কবুল করেছেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। সুতরাং এ পর্যায়ে তোমরা তাদের সাথে বিশেষ খোশালাপ ও দাম্পত্য সুখকর মিলন (সহবাস) করো আর আল্লাহ তোমাদের জন্য যা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন তা অন্বেষণ করো”। এ থেকে বুঝা যায় যে, সিয়াম করা হলে সেক্ষেত্রে দিনের বেলায় স্ত্রীমিলন করা বৈধ নয়। অর্থাৎ সিয়াম করার জন্য দিনের বেলায় স্ত্রীমিলন থেকে বিরত থাকতে হবে।

সিয়াম পরিপূর্ণ করার সময়সীমা (ইতমাম/ইফতার)

সিয়াম পরিপূর্ণ করার সময়সীমা প্রসঙ্গে ২:১৮৭ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, “ছুম্মা আতিম্মুস সিয়ামা ইলাল লাইল(তারপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো)। ‘আতিম্মু (পরিপূর্ণ করো) নির্দেশবাচক ক্রিয়াটির মাসদার/ক্রিয়াবিশেষ্য হলো ‘ইতমাম (পরিপূর্ণ করা)। তাই সিয়াম পরিপূর্ণ করার পর যে সময় থেকে আবার পানাহার করা যেতে পারে ঐ সময়কে বলা যেতে পারে ‘ইতমামের সময়’। কিন্তু প্রচলিত নিয়মে ঐ সময়টিকে ‘ইফতারের সময়’ বলা হয়। ‘ইফতার শব্দটির অর্থ হলো ‘ফাটিয়ে দেয়া’। যাই হোক, ইতমামের সময়টি ইফতারের সময় হিসেবে চালু হয়ে গেছে। এখন আমরা আবার কুরআনে শিক্ষার সাথে সঙ্গতি রেখে ‘ইতমাম শব্দটিকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করতে পারি।

কত সময় পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করতে হবে এ বিষয়টি উপলব্ধির ক্ষেত্রে আরবি অব্যয় ‘ইলা এর বিভিন্ন ব্যবহার সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। ‘ইলা শব্দটি দ্বারা যুক্ত জিনিসটি বর্ণিত বা নির্দেশিত কাজের অন্তর্গত নাকি বহির্গত সেই প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ‘ইলা শব্দের তিন ধরনের ব্যবহার রয়েছে। যথা: (১) যদি ‘ইলা শব্দটি ‘মিন’ শব্দের বিপরীতে ব্যবহৃত হয়, তাহলে তাতে ‘ইলাশব্দের দ্বারা যুক্ত পরবর্তী জিনিসটি বিবৃত কাজের মধ্যে অন্তর্গত হতে পারে। (২) যদি ‘ইলা শব্দটি দ্বারা যুক্ত জিনিসটি বিবৃতিতে থাকা কোনো কাজের সাথে সম্পর্কিত জিনিসটির অংশ হয় তাহলে ‘ইলা শব্দের দ্বারা যুক্ত পরবর্তী জিনিসটি ঐ কাজের অন্তর্গত হতে পারে। (৩) যদি ‘ইলা শব্দের দ্বারা যুক্ত জিনিসটি বিবৃতিতে থাকা কাজের সাথে সম্পর্কিত মূল জিনিসের থেকে স্বতন্ত্র হয়, তাহলে ‘ইলা শব্দের দ্বারা যুক্ত পরবর্তী জিনিসটি ঐ কাজের বহির্গত হতে পারে।

নিম্নে ‘ইলা শব্দের এসব ব্যবহার প্রসঙ্গে আরবি ভাষারীতির নিয়ম সম্পর্কে Lane’s Lexicon অভিধানগ্রন্থ এবং Revive Arabic ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য উল্লেখ করা হলো।

এ বিষয়ে Lane's Lexicon এ রয়েছে:

فَاغْسِلُوا  وُجُوهَكُمْ  وَأَيْدِيَكُمْ  إِلَى  المَرَافِقِ

It is disputed whether [the meaning be Then wash ye your faces, and your arms with the elbows, or, and your arms as far as the elbows; i. e., whether] the elbows be meant to be included among the parts to be washed, or excluded therefrom.

‘ইলা শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে ক্লাসিক্যাল এরাবিক রিসার্চার আসিম ইকবালের Revive Arabic ওয়েবসাইটে রয়েছে:

قَرَأْتُ  ٱلْقُرْآنَ  مِنْ  أَوَّلِهِ  إِلَىٰ  آخِرِهِ

I recited The Qur'an from its beginning to / till its end. In this context, beginning and end are included.

 

خَرَجَ  مِنَ  ٱلْكُوفَةِ  إِلَى  ٱلشَّامِ.

He went forth from Koofah to Shaam. Now there are 2 options, he reached Shaam but did not enter it, or he entered Shaam.

When that which comes after  إِلَىٰ happens to be of the same kind or general nature or genus as that which comes before it, the preposition usually has an inclusive signification.

فَاغْسِلُوا  وُجُوهَكُمْ  وَأَيْدِيَكُمْ  إِلَى  الْمَرَافِقِ

Then wash your faces and your hands to / up to the elbows.

When that which comes after  إِلَىٰ  happens to be of a different kind or class or genus to that which comes before it, the preposition usually has an exclusive signification.

ثُمَّ أَتِمُّوا ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱللَّيْلِ

Then you complete the fast to / till / until the night [1]

উপরিউক্ত ভাষারীতিগত বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে, ‘রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো’ নির্দেশের তাৎপর্য হলো, যখনি রাত শুরু হয় তখনি সিয়াম পূর্ণ হয়। অন্য কথায় রাত শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পানাহার করা যাবে না। কিন্তু রাত শুরু হলে বা রাতের শুরুতেই পানাহার করা যেতে পারে।

এর পরবর্তী প্রশ্ন হলো, রাত কখন শুরু হয়? এ বিষয়ে দুই ধরনের উপলব্ধি রয়েছে। একটি হলো, সূর্যাস্তের সাথে সাথে রাত শুরু হয়। অন্যটি হলো সূর্যাস্ত পরবর্তী শাফাক্ব বা সন্ধ্যারাগ (পশ্চিমাকামের লাল আভা) সমাপ্ত হলে রাত শুরু হয়। উভয়টি কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের দুটি ভিন্ন রূপ অনুধাবনের সাথে সম্পর্কিত। তাই এ বিষয়ে যিনি যেভাবে অনুধাবন করছেন তিনি তা উপস্থাপন করে তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে উত্তম সমাধানের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করা এবং এজন্য আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত। যিনি যেভাবে অনুধাবন করেছেন ভিন্নরূপ উপলব্ধির যৌক্তিকতা স্পষ্ট হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেভাবে অনুসরণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে যে, সেটা যদি সঠিক অনুধাবন না হয়? এর জবাবে বলা যায়, যেহেতু নিজ জ্ঞানে আয়ত্ত করা ছাড়া কোনো কিছুর পক্ষে বা বিপক্ষে চূড়ান্ত অবস্থান নেয়া নিষিদ্ধ (১৭:৩৬), তাই চূড়ান্ত অবস্থান গ্রহণ না করে নিজ উপলব্ধি অনুসারে প্রাথমিক অনুসরণ করাই সঙ্গত। কিন্তু সেই সাথে সেই উপলব্ধি অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। তবে আলোচনার মাধ্যমে সঠিক উপলব্ধিতে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। নিজ বিবেকের যথাযথ ব্যবহার করে এবং পুন:যাচাইয়ের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে উপস্থিত অনুধাবন অনুযায়ী আয়াতের নির্দেশ পালন করলে তা দোষনীয় হতে পারে না, বরং এটাই বাস্তবসম্মত পদ্ধতি।

কখন রাত শুরু হয় এ বিষয়ে আমাদের উপলব্ধি হলো, সূর্যাস্তের সাথে সাথে রাত শুরু হয়। এ বিষয়ে আমাদের গবেষণা আমরা বইয়ের পরিশিষ্ট অংশে বিস্তারিত উল্লেখ করবো। তবে আমরা এ উপলব্ধি শেয়ার করছি অন্যদের উপর তা চাপিয়ে দেয়ার জন্য নয়, বরং এই উপলব্ধিতে উপনীত হওয়ার যৌক্তিক ভিত্তি উপস্থাপনের জন্য এবং তা নিয়ে আরো আলোচনার অবকাশ আছে। এছাড়া যাঁরা শাফাক্বের বা পশ্চিমাকাশের লাল আভার (Twilight) সমাপ্তির পর পানাহার করেন, তাঁদের এ কাজকে দোষনীয় বলা যায় না, বরং তাঁরা তাঁদের দিক থেকে একটি নিরাপদ ব্যবস্থা অবলম্বন করছেন। কারণ যদিও সন্ধ্যার সাথে সাথে পানাহার করা যেতে পারে, তবুও ঐ সময় পানাহার যে করতেই হবে, এরূপ নির্দেশ দেয়া হয়নি। তাই কেউ যদি সন্ধ্যার দুই তিন ঘণ্টা পরেও পানাহার করে, বা রাতের শেষ প্রহরের আগে মোটেই পানাহার না করে তাতে কোনো দোষ নেই। সুতরাং যারা সন্ধ্যা থেকেই পানাহার করা যেতে পারে বলে বুঝেন, তাঁরা যেমন সন্ধ্যা থেকেই পানাহার করতে পারেন, তেমনি যাঁরা আরো দেরিতে পানাহার করাকে সঠিক মনে করেন, তাঁদেরকে দেরিতে পানাহার করতে দেয়াতে কারো কোনো আপত্তি করার অবকাশ নেই। বিপরীতক্রমে তাঁরাও যারা সন্ধ্যার সাথে সাথে পানাহার করেন, তাঁদেরকে নিজেদের উপলব্ধি ও তার ভিত্তিমূলক যৌক্তিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে পারেন, কিন্তু সন্ধ্যার সাথে সাথে পানাহার করার কারণে তিরস্কার করা সঙ্গত নয়। যেহেতু তাঁরাও আয়াতের বক্তব্যকে সেভাবেই উপলব্ধি করছেন। এভাবে আমরা উভয় পক্ষ বাড়াবাড়ি পরিহার করে কুরআন অনুসরণের নীতিগত ঐক্যের উপর ভিত্তি করে ঐক্যবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকতে পারি।

[1]  https://revivearabic.blogspot.com/2016/09/arabic-particles-arabic-preposition-ila.html

সিয়াম ও অন্যায় পন্থায় অন্যের সম্পদ ভক্ষণ না করা

২:১৮৭ আয়াতে বিধিবদ্ধ সিয়ামের আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি হিসেবে দিনের বেলায় পানাহার ও স্ত্রীমিলন করা যাবে না বলে বিধান দেয়া হয়েছে। তারপর ২:১৮৮ আয়াতে বলা হয়েছে, “আর তোমরা তোমাদের একে অন্যের সম্পদ অন্যায্য উপায়ে খেয়ো না এবং পাপাচারের মাধ্যমে মানুষের সম্পদের কিছু অংশ খাওয়ার জন্য সিদ্ধান্তকারী কর্তৃপক্ষ ও বিচারকদের কাছে তা (মালসম্পদ) পেশ করো না[1], অথচ তোমরা (সেটাকে পাপাচার হিসেবেই) জানো।”

আনুষ্ঠানিক সিয়ামের সময় আমরা দিনের বেলায় আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য পানাহার থেকে বিরত থাকি। কিন্তু এভাবে দিনের বেলায় পানাহার থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে আমাদেরকে সিয়ামের বিধান দেয়া হয়নি। আনুষ্ঠানিক সিয়ামের এ বিধান দেয়া হয়েছে একটি আত্মসংযমের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি হিসেবে। এ প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা আল্লাহ সচেতনতার শিক্ষা পাই। এ শিক্ষা অবলম্বনে যখন আমরা আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বিরত থাকি, ব্যাপক অর্থে সেটাই সিয়াম (আত্মসংযম)। তাই আনুষ্ঠানিক সিয়ামের ক্ষেত্রে আমাদেরকে দিনের বেলায় সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকতে হয়। কিন্তু আনুষ্ঠানিক সিয়ামের সময় এবং সার্বক্ষণিকভাবে আমাদেরকে অন্যায় পন্থায় মানুষের সম্পদ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ২:১৮৮ আয়াতটিতে এই বাস্তব ও সার্বক্ষণিক সিয়ামের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

অন্যায় পন্থায় অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করার মধ্যে সব ধরনের অবৈধ অর্থনৈতিক পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত, যেমন, চুরি, ডাকাতি, আত্মসাৎ, প্রতারণা, জালিয়াতি, ঘুষ, সুদ, জুয়া, অবৈধ পণ্যের ব্যবসা ইত্যাদি। সাধারণভাবে অন্যায় পন্থায় অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করার নিষেধাজ্ঞার পর স্বতন্ত্রভাবে একটি বিশেষ অন্যায় পন্থার উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো: অন্যের সম্পদকে অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলা দায়ের করা এবং সিদ্ধান্তকারী কর্তৃপক্ষ ও বিচারকদের কাছে ঘুষ বা অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত উপহার পেশ করা।

মিথ্যা মামলা দায়ের করে মিথ্যাভাবে প্রমাণ উপস্থিত করার মাধ্যমে বিচারককে বিভ্রান্ত করে নিজের পক্ষে রায় আদায় করা সম্ভব হলেও তাতে নিজের বৈধ অধিকার তৈরি হবে না। বরং এটি একটি পাপাচার হিসেবেই সাব্যস্ত হবে এবং আল্লাহর নিকট পাপী হিসেবেই উপস্থিত হতে হবে। অনুরূপভাবে সিদ্ধান্তকারী কর্তৃপক্ষকে ঘুষ বা অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত উপহার প্রদানের মাধ্যমে যদি অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষেণর সুবিধামূলক ব্যবস্থা করে নেয়া হয় সেটাকেও অবৈধ করা হয়েছে। ঘুষ প্রদান করে মামলার রায় নিজের পক্ষে নেয়াও অবৈধ।

সাধারণভাবে অন্যায় পন্থায় অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করার নিষেধাজ্ঞার পরে ঘুষের বিষয়টি স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখের মাধ্যমে এটি বিশেষ নেতিবাচক গুরুত্ব পেয়েছে। অর্থাৎ অন্যান্য নেতিবাচক উপায়ের তুলনায় এটি এমন এক নেতিবাচক উপায় যার মাধ্যমে বাকিগুলোও সহজ হয়ে যায় এবং এ নেতিবাচক উপায়টিকে প্রতিরোধ করলে বাকিগুলোও কঠিন হয়ে যায়। কারণ একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করতে পারবে না, এ বিষয়টি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তকারী কর্তৃপক্ষ বা সরকারি কর্মকর্তা এবং বিচারকগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু যদি তাঁদেরকে ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে কিনে ফেলা যায়, তাহলে অন্যের সম্পদকে অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করার রাস্তা কণ্টকমুক্ত হয়ে যায়।

এছাড়া একবার যদি ঘুষের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদেরকে ও বিচারকদেরকে হাত করা যায় তারপর এমন এক অসৎ চর্চা শুরু হয়ে যায় যে, যে কেউ এ পন্থায় অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে আবার সরকারি কর্মকর্তারাও এমনকি কাউকে তার বৈধ প্রাপ্য দেয়ার ক্ষেত্রেও ঘুষ ছাড়া দিতে নারাজ হয়ে পড়ে। ঘুষের এই ধরনের কুফলের কারণে ঘুষ আদান-প্রদান থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে।

সর্বোপরি ঘুষ প্রদান যে পাপাচার এ বিষয়টি মানুষ সহজাত বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে পূর্ব থেকেই জানে। তাই বলা হয়েছে, এটাকে পাপাচার হিসেবে জানা সত্ত্বেও তোমরা ঘুষের লেন-দেন করো না।

সিয়াম সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, যেখানে বিধিবদ্ধ আনুষ্ঠানিক সিয়াম পালনের জন্য দিনের বেলায় যে কোনো পানাহার থেকে বিরত থাকতে হয়, সেখানে সিয়ামের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ বা আত্মসংযমের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বনস্বরূপ আল্লাহর নিষিদ্ধ তথা অন্যায় পন্থায় মানুষের সম্পদ খাওয়া থেকে বিরত থাকাই হলো সিয়াম সাধনার সার্থকতা।

[1] অর্থাৎ অন্যের সম্পদকে আত্মসাৎ করার জন্য সে বিষয়ে কোনো মিথ্যা মামলা দায়ের করো না এবং অন্যায় সুবিধা ভোগ করার জন্য ঘুষ (অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত উপহার) পেশ করো না।

ফিদইয়া (দায়মুক্তি) ও কাফফারা (দোষমোচন) স্বরূপ সিয়ামের বিধান

রমাদানের মাসে বিধিবদ্ধ আনুষ্ঠানিক সিয়াম ছাড়াও ফিদইয়া (দায়মুক্তি) ও কাফফারা (দোষমোচন) স্বরূপ সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কিত বিধান আলোচনা করা হলো:

১. হজ্জের সময় হাদিয়া (উপহার) জমা দেয়ার আগে মাথামুণ্ডন করলে তার দায়মুক্তি স্বরূপ সিয়াম

হজ্জের সময় প্রথম কাজই হলো যথাস্থানে হাদিয়া (উপহার) জমা দেয়া। এ প্রসঙ্গে নির্দেশনা হলো হজ্জের উপহার জমা দেয়ার আগে মাথামুণ্ডন করা যাবে না। কিন্তু কেউ যদি অসুস্থ হওয়ার কারণে বা তার মাথায় কষ্টদায়ক কিছু থাকার কারণে উপহার জমা দেয়ার আগে মাথামুণ্ডন করতে হয় তাহলে তার দায়মুক্তি স্বরূপ যেসব বিকল্প ধিান দেয়া হয়েছে তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে সিয়াম করা। এ প্রসঙ্গে ২:১৯৬ আয়াতে বিধান দেয়া হয়েছে এবং তা নিম্নরূপ: “আর তোমরা আল্লাহর (সন্তুষ্টি অর্জনের) উদ্দেশ্যেই হজ্জ ও উমরা পূর্ণ করো। তবে যদি তোমরা বাধাপ্রাপ্ত হও, তাহলে হাদিয়া (উপহার) হিসেবে যা সহজ হয় (তাই যথেষ্ট)। আর তোমরা মাথামুণ্ডন করো না যতক্ষণ না হাদিয়া (উপহার) যথাস্থানে পৌঁছে। তোমাদের মধ্য থেকে যে অসুস্থ হয় বা তার মাথায় কষ্টদায়ক কিছু হয় তাহলে ফিদইয়া (দায়মুক্তি স্বরূপ বিকল্প ব্যবস্থা) হবে সিয়াম করা (অর্থাৎ রোজা রাখা) বা সদাকাহ দেয়া বা নুসুক করা (অর্থাৎ ধর্মীয় বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে পশু উৎসর্গ ও সংহতিমূলক রীতি পালন করা)।”

২. কোনো মু’মিনকে ভুলবশত হত্যা করার দণ্ডবিধির অন্তর্ভুক্ত সিয়াম

কোনো মু’মিন যদি ভুলবশত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে অন্য কোনো মু’মিনকে হত্যা করে তাহলে তার দোষমোচনের জন্য যেভাবে তাওবাহ করতে হবে তার পদ্ধতি হিসেবে বিভিন্ন বিধান দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি বিভাগ হলো যদি নিহত মু’মিন এমন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয় যাদের সাথে মু’মিনদের চুক্তি রয়েছে তাহলে তার পরিবার-পরিজনকে দিয়াত (রক্তপণ) দিতে হবে এবং কোনো মু’মিন দাসকে মুক্ত করতে হবে, কিন্তু যদি মু’মিন দাস পাওয়া না যায় বা তাকে মুক্ত করার সামর্থ্য না থাকে, তাহলে ধারাবাহিকভাবে দুই মাস সিয়াম পালন করতে হবে। ৪:৯২ আয়াতে বিধানটি বর্ণিত হয়েছে। আয়াতটি নিম্নরুপ:

৪:৯২ :: কোনো মু’মিনকে ভুলক্রমে (অনিচ্ছাকৃতভাবে) ছাড়া হত্যা করা অন্য মু’মিনের জন্য সঙ্গত নয়। আর যে ব্যক্তি কোনো মু’মিনকে ভুলবশত (অনিচ্ছাকৃতভাবে) হত্যা করে, তাহলে তাকে কোনো মু’মিন দাসকে মুক্ত করতে হবে এবং তার (নিহত ব্যক্তির) পরিবার পরিজনের কাছে দিয়াত (রক্তপণ) সমর্পণ করতে হবে যদি না তারা তা সদাক্বাত করে দেয়। অন্যদিকে যদি নিহত ব্যক্তি হয় তোমাদের শত্রু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত অথচ মু’মিন, তাহলে কোনো মু’মিন দাসকে মুক্ত করতে হবে। আর যদি নিহত ব্যক্তি হয় সেই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে, তাহলে তার পরিবার পরিজনের কাছে দিয়াত (রক্তপণ) সমর্পণ করতে হবে এবং কোনো মু’মিন দাসকে মুক্ত করতে হবে। তবে যদি তা (মু’মিন দাস বা তাকে মুক্ত করার সামর্থ্য) পাওয়া না যায়, তাহলে ধারাবাহিকভাবে দুইমাস সিয়াম করতে হবে। এটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওবাহর পদ্ধতি। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।

৩. শপথ ভঙ্গের কাফফারা হিসেবে সিয়াম

৫:৮৯ আয়াতে শপথ ভঙ্গের কাফফারা (দোষমোচন) হিসেবে সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে। আয়াতটি নিম্নরূপ:

৫:৮৯ :: আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের ‘কথার কথা’ ধরনের শপথের জন্য ধরবেন না। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে তোমাদের দৃঢ় বন্ধনযুক্ত শপথের জন্য ধরবেন। এ ধরনের শপথভঙ্গের জন্য কাফফারা (দোষমোচন) হলো দশজন মিসকীনকে তোমরা তোমাদের পরিবারকে যেরূপ মধ্যমমানের খাদ্য খাওয়াও অনুরূপ খাদ্য খাওয়ানো বা তাদেরকে (অনুরূপভাবে) পরিধেয় বস্ত্র দেয়া অথবা কোনো দাস মুক্ত করা, তবে যে তার সামর্থ্য পাবে না তাহলে তিনদিন সিয়াম পালন করা। সেটাই তোমাদের শপথভঙ্গের জন্য কাফফারা (দোষমোচন) যখন তোমরা হলফ করে/নিশ্চয়তার সাথে তা করো। আর তোমরা তোমাদের শপথসমূহকে হেফাজত করো। এভাবে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো।

৪. হারাম (বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও বন্য প্রাণীর শিকার-বিরতির সংরক্ষিত) মাসে বন্য প্রাণী শিকারের কাফফারা হিসেবে সিয়াম

৯:৩৬-৩৭ আয়াত অনুযায়ী আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে তথা বিশ্বপ্রকৃতির সনাতন পদ্ধতি হিসেবে প্রত্যেক চান্দ্রবর্ষের ১২ টি চান্দ্রমাসের মধ্য থেকে ৪টি মাস বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য ‘হারাম মাস’ হিসেবে বিধিবদ্ধ। অর্থাৎ এ সময়কালে বন্য প্রাণী শিকার করা নিষিদ্ধ বা এ সময়কালে বন্য প্রাণী শিকার থেকে বিরত থাকতে হবে। এ চারটি মাস হলো বন্য প্রাণীর সংরক্ষনের জন্য তাদের বার্ষিক নাজুক সময়কাল তথা বন্য প্রাণীর প্রজনন ও প্রসবকালীন নাজুক সময়কাল। এই হারাম চার মাস হলো ‘শাহরু রমাদান’ (রমাদানের মাস) থেকে শুরু করে ধারাবাহিক চার মাস, অন্যভাবে বলা যায়, মাসগুলো হলো বসন্তের প্রথম মাস থেকে ধারাবাহিক চারমাস। এ বিষয়টি এ বইয়ের পরিশিষ্টে ‘রমাদানের মাস নির্ণয়ের উপায়’ শিরোনামে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। যদি কেউ এ মাসগুলোতে কোনো বন্য প্রাণী শিকার করে তার কাফফারা হিসেবে যে বিধান দেয়া হয়েছে তার মধ্যে একটি বিকল্প হিসেবে সিয়ামের বিধান অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে ৫:৯৫ আয়াতে বিধান বর্ণিত হয়েছে। আয়াতটি নিম্নরূপ:

৫:৯৫ :: হে মু’মিনগণ, তোমরা হারাম মাসসমূহে থাকা অবস্থায় (স্থলভাগের) শিকারকে হত্যা করো না। তোমাদের মধ্যে যে ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে হত্যা করে তার জরিমানা হচ্ছে যে পশুকে সে হত্যা করেছে গবাদি পশুর মধ্য থেকে তার মতো একটি পশু। সেটা (অর্থাৎ ঐ ধরনের গবাদি পশু) নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দিবে তোমাদের মধ্যকার দুজন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি। সেটাকে হাদিয়া (উপহার) হিসেবে কা’বায় পৌছাতে হবে। অথবা তার কাফফারা (দোষমোচন) হবে (সমমূল্য দ্বারা যতজনকে মধ্যম মানের খাদ্য খাওয়ানো যেতে পারে ততজন) মিসকীনকে খাওয়ানো অথবা সমসংখ্যক সিয়াম পালন করা। (এটা এজন্য যে,) যেন সে তার কাজের পরিণামের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। (এ বিধান নাজিলের) আগে যা হয়ে গিয়েছিলো সে বিষয়ে আল্লাহ উদারতা দেখিয়েছেন। আর যে পুনরাবৃত্তি করবে আল্লাহ তাকে দণ্ড দিবেন। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান ও মহাদণ্ডদাতা।

৫. যিহার (স্ত্রীকে মা হিসেবে প্রকাশ করার কুপ্রথা) এর দণ্ডবিধির অন্তর্ভুক্ত সিয়াম

আল কুরআনে যিহার সম্পর্কিত বিধি-বিধান থেকে স্পষ্ট যে, কুরআন নাযিলের সমকালে আ’রবে স্ত্রীকে মা হিসেবে প্রকাশ করার একটি কুপ্রথা চালু ছিলো, যা ছিলো এক প্রকারের তালাক্ব বা বিয়ে বিচ্ছেদ পদ্ধতি। কিন্তু কুরআনে এটিকে তালাক্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি কিন্তু কেউ এরূপ মন্দ কথা বললে সে তার স্ত্রীর নিকট ফিরে যাওয়ার আগে তাকে তার এ দোষের জন্য একটি শাস্তি ভোগ করতে হবে আর তা হলো সে কোনো দাসকে মুক্ত করতে হবে। আর যদি কোনো দাস না পায় বা সেটার সামর্থ্য না রাখে তাহলে তাকে ধারাবাহিকভাবে দুই মাস সিয়াম পালন করতে হবে। এ বিষয় ৫৮:১-৪ আয়াতে বিধান বর্ণিত হয়েছে। আয়াতসমূহ নিম্নরূপ:

৫৮:১-৪ :: নিশ্চয় আল্লাহ শুনেছেন সে নারীর কথা যে তোমার সাথে তার স্বামীর ব্যাপারে বিতর্ক করেছে আর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছে। আর আল্লাহ তোমাদের দুজনের কথোপকথন শুনছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদের স্ত্রীকে যিহার করে (অর্থাৎ মায়ের মতো হিসাবে প্রকাশ করে) তাদের স্ত্রীরা তাদের মা হয়ে যায় না। যারা তাদেরকে জন্ম দিয়েছে তারা ছাড়া কেউ তাদের মা নয়। আর নিশ্চয় তারা তো অত্যন্ত মন্দ ও অসত্য কথাই বলছে। আর নিশ্চয় আল্লাহ উদার ক্ষমাশীল।  আর যারা তাদের স্ত্রীকে যিহার করে (অর্থাৎ মায়ের মতো হিসাবে প্রকাশ করে), তারপর তারা যা বলেছিলো তা থেকে ফিরে যায় (অর্থাৎ স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতে চায়), তারা স্ত্রীমিলনের আগে একজন দাসকে মুক্ত করতে হবে। তোমাদেরকে এ উপদেশ দেয়া হচ্ছে। আর তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা সম্যক অবগত। কিন্তু যে সেই সামর্থ্য পায় না তবে সে স্ত্রীমিলনের আগে ধারাবাহিকভাবে দুই মাস সিয়াম পালন করবে। কিন্তু যে তা পারবে না তবে সে ষাটজন মিসকীনকে আহার করাবে। এটাই বিধান, যেন তোমরা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস করো। আর এগুলো আল্লাহর সীমা। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।

শেষকথা

আল কুরআনের আলোকে সিয়াম সম্পর্কে যেসব তথ্য ও বিধি-বিধান রয়েছে তা থেকে স্পষ্ট যে, আল কুরআনে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সিয়ামকে মুখ্য গুরুত্ব দেয়া হয়নি, বরং আনু্ষ্ঠানিক সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে অনানুষ্ঠানিক বা ব্যাপক অর্থে সিয়াম বা আত্মসংযমের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে। অন্য কথায় আনুষ্ঠানিক সিয়াম হলো একটি প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রাম এবং সে প্রশিক্ষণ অনুসারে যখন বাস্তবে আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বিরত থাকার মাধ্যেমে আত্মনিয়ন্ত্রণ করা হয় সেটাই বাস্তব সিয়াম। যখন কোনো সময়সীমা বা নির্দিষ্ট দিনসংখ্যার সাথে সম্পর্কিত করে সিয়ামের কথা বলা হয় তখন আনুষ্ঠানিক সিয়ামকে বুঝানো হয়। কিন্তু যেখানে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য বা নির্দিষ্ট দিন বা দিনসমূহের জন্য সিয়ামের কথা বলা হয় না, বরং সাধারণভাবে সিয়াম বা সিয়ামকারীর প্রসঙ্গ বলা হয় তখন তা দ্বারা বাস্তব সিয়ামকেই বুঝানো হয়ে থাকে। যদি একজন ব্যক্তি বাস্তবে সিয়ামকারী না হয় তথা বাস্তবে যদি সে আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বিরত না থাকে তাহলে আনুষ্ঠানিক সিয়ামকারী হওয়ার কারণে সে সিয়ামকারী বিশেষণে বিভুষিত হতে পারে না। অন্য কথায়, আনুষ্ঠানিক সিয়াম গ্রহণযোগ্যই হবে না যদি তা থেকে বাস্তব সিয়ামের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করা না হয় এবং বাস্তবেই আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বিরত থাকা না হয়। একজন ব্যক্তি যদি আনুষ্ঠানিক সিয়াম করার পাশাপাশি তা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাস্তব সিয়াম করে থাকে তথা আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বিরত থাকে তাহলেই কেবল সে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যা ৩৩:৩৫ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

আনুষ্ঠানিক সিয়ামের মাধ্যমে আত্মসংযমের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আল্লাহ সচেতন জীবন যাপনের জন্য যোগ্যতা অর্জিত হয়। বিধিবদ্ধ সিয়ামের জন্য কুরআন নাযিল সূচনা হওয়ার মাস হওয়ার প্রেক্ষতে রমাদানের মাসকে বাছাই করা হয়েছে, যে মাসের মাধ্যমে হারাম মাসসমূহ শুরু হয়। এভাবে বিশ্বপ্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল সংরক্ষিত অন্যতম মাসকে কুরআন নাযিলের জন্য এবং একই সাথে সিয়াম সাধনার জন্য বাছাই করা হয়েছে। সিয়ামকারী ব্যক্তি বাস্তব জীবনে হিদায়াতের জন্য এবং সত্য-মিথ্যার মানদণ্ড হিসেবে কুরআনকেই প্রয়োগ করতে হবে এবং কুরআন রূপ নিয়ামতের জন্য সিয়াম সাধনা এবং তার শিক্ষার প্রয়োগের মাধ্যমে আল্লাহর বড়ত্ব-মহিমা ঘোষণা করবে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। রমাদানের সিয়াম ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফিদইয়া বা দায়মুক্তি স্বরূপ বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে এবং কাফফারা বা দোষমোচনের ব্যবস্থা হিসেবেও সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ সচেতন জীবন যাপনে আত্মসংযমের প্রশিক্ষণ এবং বাস্তব আত্মসংযম উভয় ধরনের সিয়াম সাধনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পার্থিব ও পারলৌকিক প্রকৃত কল্যাণের জন্য অত্যাবশ্যক।

পরিশিষ্ট ১: দিন রাত ও এর বিভিন্ন সময়সীমা

নাহার (দিন) ও লাইল (রাত) শব্দের নির্ঘণ্ট (Concordance)

নাহার (দিন): নাহার (দিন) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৫৭ স্থানে: ২:১৬৪:৮, ২:২৭৪:৫, ৩:২৭:৪, ৩:২৭:৬, ৩:৭২:১৩, ৩:১৯০:৮, ৬:১৩:৬, ৬:৬০:৮, ৭:৫৪:১৭, ১০:৬:৫, ১০:২৪:৩২, ১০:৪৫:৯, ১০:৫০:৮, ১০:৬৭:৮, ১১:১১৪:৪, ১৩:৩:১৮, ১৩:১০:১৪, ১৪:৩৩:৯, ১৬:১২:৪, ১৭:১২:৩, ১৭:১২:১০, ২০:১৩০:১৮, ২১:২০:৩, ২১:৩৩:৫, ২১:৪২:৫, ২২:৬১:৭, ২২:৬১:৯, ২৩:৮০:৮, ২৪:৪৪:৪, ২৫:৪৭:১০, ২৫:৬২:৫, ২৭:৮৬:৮, ২৮:৭২:৭, ২৮:৭৩:৬, ৩০:২৩:৫, ৩১:২৯:৮, ৩১:২৯:১০, ৩৪:৩৩:৯, ৩৫:১৩:৪, ৩৫:১৩:৬, ৩৬:৩৭:৬, ৩৬:৪০:১১, ৩৯:৫:৮, ৩৯:৫:১০, ৪০:৬১:৮, ৪১:৩৭:৪, ৪১:৩৮:৯, ৪৫:৫:৩, ৪৬:৩৫:২১, ৫৭:৬:৪, ৫৭:৬:৬, ৭১:৫:৭, ৭৩:৭:৪, ৭৩:২০:১৯, ৭৮:১১:২, ৯১:৩:১, ৯২:২:১।

লাইল (রাত) শব্দের বিভিন্ন শব্দরূপের ব্যবহার সম্পর্কিত পরিসংখ্যান:

লাইল (রাত) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৮১ স্থানে: ২:১৬৪:৭, ২:১৮৭;৪৭, ২:২৭৪:৪, ৩:২৭:২, ৩:২৭:৮, ৩:১১৩:১২, ৩:১৯০:৭, ৬:১৩:৫, ৬:৬০:৪, ৬:৭৬:৪, ৬:৯৬:৪, ৭:৫৪:১৬, ১০:৬:৪, ১০:২৪:৩০, ১০:২৭:২০, ১০:৬৭:৫, ১১:৮১:১৩, ১১:১১৪:৭, ১৩:৩:১৭, ১৩:১০:১২, ১৪:৩৩:৮, ১৫:৬৫:৫, ১৬:১২:৩, ১৭:১:৫, ১৭:১২:২, ১৭:১২:৭, ১৭:৭৮:৭, ১৭:৭৯:২, ১৯:১০:১২, ২০:১৩০:১৫, ২১:২০:২, ২১:৩৩:৪, ২১:৪২:৪, ২২:৬১:৫, ২২:৬১:১১, ২৩:৮০:৭, ২৪:৪৪:৩, ২৫:৪৭:৫, ২৫:৬২:৪, ২৭:৮৬:৫, ২৮:৭১:৭, ২৮:৭২:১৭, ২৮:৭৩:৫, ৩০:২৩:৪, ৩১:২৯:৬, ৩১:২৯:১২, ৩৪:৩৩:৮, ৩৫:১৩:২, ৩৫:১৩:৮, ৩৬:৩৭:৩, ৩৬:৪০:৯, ৩৭:১৩৮:১, ৩৯:৫:৬, ৩৯:৫:১২, ৩৯:৯:৫, ৪০:৬১:৫, ৪১:৩৭:৩, ৪১:৩৮:৮, ৪৪:২৩:৩, ৪৫:৫:২, ৫০:৪০:২, ৫১:১৭:৪, ৫২:৪৯:২, ৫৭:৬:২, ৫৭:৬:৮, ৭১:৫:৬, ৭৩:২:২, ৭৩:৬:৩, ৭৩:২০:৯, ৭৩:২০:১৮, ৭৪:৩৩:১, ৭৬:২৬:২, ৭৬:২৬:৬, ৭৮:১০:২, ৭৯:২৯:২, ৮১:১৭:১, ৮৪:১৭:১, ৮৯:৪:১, ৯১:৪:১, ৯২:১:১, ৯৩:২:১।

লায়াল (লাইল এর বহুবচন) ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ৩৪:১৮:১৫, ৬৯:৭:৪, ৮৯:২:১।

লাইলাত (লাইল এর স্ত্রীলিঙ্গ) ব্যবহৃত হয়েছে ৮ স্থানে: ২:৫১:৫, ২:১৮৭:৩, ৭:১৪২:৪, ৭:১৪২:১১, ৪৪:৩:৪, ৯৭:১:৪, ৯৭:২:৪, ৯৭:৩:১।

বায়াত (লাইল এর প্রতিশব্দ) ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ৭:৪:৭, ৭:৯৭:৭, ১০:৫০:৬।

আনাআল লাইল (‘আনাআ’ শব্দটি ‘ফি’লুন’ এর বহুবচন ‘আফআল’ এর প্যাটার্নে গঠিত, এর মূল অক্ষরসমূহ Root Letters হলো ‘আলিফ নূন ইয়া’) ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ৩:১১৩:১১, ২০:১৩০:১৪, ৩৯:৯:৪।

কাওকাব ও কাওয়াকিব: ‘কাওকাব’ শব্দের অর্থ হলো ‘গ্রহ’। ‘কাওয়াকিব’ হলো ‘কাওকাব’ শব্দের বহুবচন। রাতের সূচনা কখন ঘটে তা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কাওকাব শব্দের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

কাওকাব শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ৬:৭৬:৬, ১২:৪:১০, ২৪:৩৫:১৫ এবং কাওয়াকিব শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৩৭:৬:৬, ৮২:২:২।

 

 

নাহার ও লাইল বিষয়ক ‘কী পয়েন্টস’ সম্পর্কিত আয়াতসমূহের অনুবাদ

أُحِلَّ  لَكُمْ  لَيْلَةَ  الصِّيَامِ  الرَّفَثُ  إِلَىٰ  نِسَائِكُمْ  هُنَّ  لِبَاسٌ  لَّكُمْ  وَأَنتُمْ  لِبَاسٌ  لَّهُنَّ  عَلِمَ  اللَّهُ  أَنَّكُمْ  كُنتُمْ  تَخْتَانُونَ  أَنفُسَكُمْ  فَتَابَ  عَلَيْكُمْ  وَعَفَا  عَنكُمْ  فَالْآنَ  بَاشِرُوهُنَّ  وَابْتَغُوا  مَا  كَتَبَ  اللَّهُ  لَكُمْ  وَكُلُوا  وَاشْرَبُوا  حَتَّىٰ  يَتَبَيَّنَ  لَكُمُ  الْخَيْطُ  الْأَبْيَضُ  مِنَ  الْخَيْطِ  الْأَسْوَدِ  مِنَ  الْفَجْرِ  ثُمَّ  أَتِمُّوا  الصِّيَامَ  إِلَى  اللَّيْلِ  وَلَا  تُبَاشِرُوهُنَّ  وَأَنتُمْ  عَاكِفُونَ  فِي  الْمَسَاجِدِ  تِلْكَ  حُدُودُ  اللَّهِ  فَلَا  تَقْرَبُوهَا  كَذَٰلِكَ  يُبَيِّنُ  اللَّهُ  آيَاتِهِ  لِلنَّاسِ  لَعَلَّهُمْ  يَتَّقُونَ

২:১৮৭ :: তোমাদের জন্য সিয়ামের রাতে তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি আবেগ উদ্দীপক ঘনিষ্ঠতা বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক। আল্লাহ জানেন যে, তোমরা তোমাদের নিজেদের প্রতি খিয়ানত করছো। তারপর তিনি তোমাদের তাওবা কবুল করেছেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। সুতরাং এ পর্যায়ে তোমরা তাদের সাথে সহবাস করো আর আল্লাহ তোমাদের জন্য যা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন তা অন্বেষণ করো। আর তোমরা খাও ও পান করো যতক্ষণ না তোমাদের জন্য দিগন্তের কালো রেখা থেকে ফজরের সাদা রেখা স্পষ্ট হয়। তারপর তোমরা তোমরা রাত (রাতের সূচনা) পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো। আর তোমরা যখন মাসজিদে আকিফূন (এ’তেকাফরত/আত্মনিয়োজিত, ধ্যান ও গভীর চিন্তামগ্ন এবং অবস্থানকারী) থাকো, তখন (এ’তেকাফের দিনগুলোতে দিনে-রাতে কখনো) তাদের সাথে সহবাস করো না। এগুলো আল্লাহর স্থিরিকৃত সীমাসমূহ। সুতরাং তোমরা তা লংঘনের কাছেও যেও না। এভাবে আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ মানবজাতির জন্য সুষ্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন যেন তারা আল্লাহ সচেতন হতে পারে।

تُولِجُ  اللَّيْلَ  فِي  النَّهَارِ  وَتُولِجُ  النَّهَارَ  فِي  اللَّيْلِ  وَتُخْرِجُ  الْحَيَّ  مِنَ  الْمَيِّتِ  وَتُخْرِجُ  الْمَيِّتَ  مِنَ  الْحَيِّ  وَتَرْزُقُ  مَن  تَشَاءُ  بِغَيْرِ  حِسَابٍ

৩:২৭ :: আপনি রাতকে দিনে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতে প্রবেশ করান। এবং মৃত থেকে জীবন্তকে বের করেন এবং জীবন্ত থেকে মৃতকে বের করেন। আর যাকে ইচ্ছা হিসাবের বাইরে (তথা তার ধারণাতীত উৎস থেকে ও ব্যাপক পরিমাণে) রিযক (জীবিকা) প্রদান করেন।

لَيْسُوا  سَوَاءً  مِّنْ  أَهْلِ  الْكِتَابِ  أُمَّةٌ  قَائِمَةٌ  يَتْلُونَ  آيَاتِ  اللَّهِ  آنَاءَ  اللَّيْلِ  وَهُمْ  يَسْجُدُونَ

৩:১১৩ :: তারা সকলে সমান নয়। আহলে কিতাবের মধ্য থেকে আছে একটি (ন্যায়ের উপর) প্রতিষ্ঠিত উম্মাহ (উম্মাতুন ক্বায়িমাতুন)। তারা রাতের বিভিন্ন প্রহরে আল্লাহর আয়াতসমূহ অধ্যয়ন করে। আর তারা (আল্লাহকে) সাজদাহ করে।

فَلَمَّا  جَنَّ  عَلَيْهِ  اللَّيْلُ  رَأَىٰ  كَوْكَبًا  قَالَ  هَـٰذَا  رَبِّي  فَلَمَّا  أَفَلَ  قَالَ  لَا  أُحِبُّ  الْآفِلِينَ

৬:৭৬ :: তারপর যখনি তার উপর রাত আচ্ছন্ন হলো, তখনি সে (ইবরাহীম) একটি ক্বাওকাব/ গ্রহ (সন্ধ্যাতারা) দেখলো। সে বললো, “এটাই আমার প্রভু”। তারপর যখন সেটা অস্ত গেলো তখন সে বললো, “আমি অস্তগামীদেরকে ভালবাসি না”।

فَالِقُ  الْإِصْبَاحِ  وَجَعَلَ  اللَّيْلَ  سَكَنًا  وَالشَّمْسَ  وَالْقَمَرَ  حُسْبَانًا  ذَٰلِكَ  تَقْدِيرُ  الْعَزِيزِ  الْعَلِيمِ

৬:৯৬ :: তিনিই প্রভাতের উন্মেষক। আর তিনি রাতকে বানিয়েছেন বিশ্রামের সময় এবং সূর্য ও চাঁদকে করেছেন হিসাবের উপকরণ। এটা মহাশক্তিমান মহাজ্ঞানীর (আল্লাহর) নির্ধারিত প্রাকৃতিক আইন (তাক্বদীর)।

إِنَّ  رَبَّكُمُ  اللَّهُ  الَّذِي  خَلَقَ  السَّمَاوَاتِ  وَالْأَرْضَ  فِي  سِتَّةِ  أَيَّامٍ  ثُمَّ  اسْتَوَىٰ  عَلَى  الْعَرْشِ  يُغْشِي  اللَّيْلَ  النَّهَارَ  يَطْلُبُهُ  حَثِيثًا  وَالشَّمْسَ  وَالْقَمَرَ  وَالنُّجُومَ  مُسَخَّرَاتٍ  بِأَمْرِهِ  أَلَا  لَهُ  الْخَلْقُ  وَالْأَمْرُ  تَبَارَكَ  اللَّهُ  رَبُّ  الْعَالَمِينَ

৭:৫৪ :: নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন ছয় দিবসে, তারপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন আরশে। তিনি রাত দিয়ে দিনকে ঢেকে দেন এবং তা (রাত) সেটাকে (দিনকে) দ্রুত অনুসরণ করে। সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রসমূহ তাঁরই নির্দেশক্রমে নিয়োজিত রয়েছে। প্রশ্নাতীতভাবে, সৃষ্টিও তাঁর, আদেশও তাঁর। বড়ই সমৃদ্ধিময় আল্লাহ রব্বুল আলামীন।

وَالَّذِينَ  كَسَبُوا  السَّيِّئَاتِ  جَزَاءُ  سَيِّئَةٍ  بِمِثْلِهَا  وَتَرْهَقُهُمْ  ذِلَّةٌ  مَّا  لَهُم  مِّنَ  اللَّهِ  مِنْ  عَاصِمٍ  كَأَنَّمَا  أُغْشِيَتْ  وُجُوهُهُمْ  قِطَعًا  مِّنَ  اللَّيْلِ  مُظْلِمًا  أُولَـٰئِكَ  أَصْحَابُ  النَّارِ  هُمْ  فِيهَا  خَالِدُونَ

১০:২৭ :: আর যারা মন্দ উপার্জন করেছে তারা তাদের মন্দের প্রতিফল পাবে ঐ মন্দের অনুরূপ। আর তাদেরকে অপমান আচ্ছন্ন করবে। তাদের জন্য আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচাতে কোনো ত্রাণকর্তা নেই। যেন তাদের মুখমণ্ডলসমূহ রাতের অন্ধকারের কোনো টুকরা ঢেকে ফেলেছে। তারাই ‘আসহাবুন নার (যারা জাহান্নামের আগুনে শাস্তি পাবে)। তারা তাতে স্থায়ী হবে।

هُوَ  الَّذِي  جَعَلَ  لَكُمُ  اللَّيْلَ  لِتَسْكُنُوا  فِيهِ  وَالنَّهَارَ  مُبْصِرًا  إِنَّ  فِي  ذَٰلِكَ  لَآيَاتٍ  لِّقَوْمٍ  يَسْمَعُونَ

১০:৬৭ :: তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য রাতকে বানিয়েছেন যেন তোমরা স্বস্তি পাও এবং দিনকে বানিয়েছেন দেখার উপযোগী। নিশ্চিয় এতে নিদর্শন রয়েছে সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা (মনোযোগ দিয়ে) শুনে।

আলোচনা : দিন দেখার উপযোগী। এর মানে এ নয় যে, রাতে মোটেই আলো দেখা যাবে না। রাত অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে, এর মানে এ নয় যে, রাতের কোনো অংশে কোনো প্রকার আলো থাকবে না। পূর্ণিমার রাতে আলো থাকা সত্ত্বেও “রাত অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে” তথ্যটি যথাস্থানে ঠিক থাকে।

قَالُوا  يَا  لُوطُ  إِنَّا  رُسُلُ  رَبِّكَ  لَن  يَصِلُوا  إِلَيْكَ  فَأَسْرِ  بِأَهْلِكَ  بِقِطْعٍ  مِّنَ  اللَّيْلِ  وَلَا  يَلْتَفِتْ  مِنكُمْ  أَحَدٌ  إِلَّا  امْرَأَتَكَ  إِنَّهُ  مُصِيبُهَا  مَا  أَصَابَهُمْ  إِنَّ  مَوْعِدَهُمُ  الصُّبْحُ  أَلَيْسَ  الصُّبْحُ  بِقَرِيبٍ

১১:৮১ :: তারা (আগমনকারীগণ) বললো, “হে লূত, নিশ্চয় আমরা তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে প্রেরিত। তারা তোমার কাছে পৌঁছতে পারবে না। সুতরাং তুমি তোমার পরিবার সহকারে রাতের একাংশে ভ্রমণ করো, আর তোমাদের মধ্য থেকে কেউই পিছনে তাকাবে না; (তোমরা যাও) তোমার স্ত্রী ছাড়া। নিশ্চয় তার উপর তা-ই আপতিত হবে যা তাদের উপর আপতিত হবে। নিশ্চয় তাদের ব্যাপারে ওয়াদাকৃত (নির্ধারিত) সময় হচ্ছে প্রভাতবেলা (সোবহ)। প্রভাত (সোবহ) কি নিকটবর্তী নয়?

وَأَقِمِ  الصَّلَاةَ  طَرَفَيِ  النَّهَارِ  وَزُلَفًا  مِّنَ  اللَّيْلِ  إِنَّ  الْحَسَنَاتِ  يُذْهِبْنَ  السَّيِّئَاتِ  ذَٰلِكَ  ذِكْرَىٰ  لِلذَّاكِرِينَ

১১:১১৪ :: সালাত প্রতিষ্ঠা করো দিনের দুই তরাফে (ভাগে) এবং রাত থেকে যুলাফায় (কাছাকাছি পর্যায়ের লগ্নসমূহে)। নিশ্চয় ভালো কাজ মন্দ কাজকে অপসারিত করে। এটা স্মরণকারীদের জন্য স্মরণীয় বিষয়।

وَهُوَ  الَّذِي  مَدَّ  الْأَرْضَ  وَجَعَلَ  فِيهَا  رَوَاسِيَ  وَأَنْهَارًا  وَمِن  كُلِّ  الثَّمَرَاتِ  جَعَلَ  فِيهَا  زَوْجَيْنِ  اثْنَيْنِ  يُغْشِي  اللَّيْلَ  النَّهَارَ  إِنَّ  فِي  ذَٰلِكَ  لَآيَاتٍ  لِّقَوْمٍ  يَتَفَكَّرُونَ

১৩:৩ :: আর তিনিই সেই সত্তা যিনি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী স্থাপন করেছেন; এবং (সৃষ্টি করেছেন) প্রত্যেক প্রকার ফলমূল, তিনি সেটার মধ্যে দুই প্রকারে জোড়া সৃষ্টি করেছেন। তিনি রাত দিয়ে দিনকে ঢেকে দেন। নিশ্চয় সেটার মধ্যে সেই সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনসমূহ রয়েছে, যারা বৈজ্ঞানিক চিন্তা-গবেষণা (তাফাক্কুর) করে।

وَجَعَلْنَا  اللَّيْلَ  وَالنَّهَارَ  آيَتَيْنِ  فَمَحَوْنَا  آيَةَ  اللَّيْلِ  وَجَعَلْنَا  آيَةَ  النَّهَارِ  مُبْصِرَةً  لِّتَبْتَغُوا  فَضْلًا  مِّن  رَّبِّكُمْ  وَلِتَعْلَمُوا  عَدَدَ  السِّنِينَ  وَالْحِسَابَ  وَكُلَّ  شَيْءٍ  فَصَّلْنَاهُ  تَفْصِيلًا

১৭:১২ :: আর আমি রাতকে ও দিনকে দুটি নিদর্শন করেছি। আর আমি রাতের নিদর্শনকে করেছি নিষ্প্রভ এবং দিনের নিদর্শনকে করেছি দেখার উপযোগী, যেন তোমরা তোমাদের প্রভুর অনুগ্রহ (জীবিকা, শিক্ষা প্রভৃতি) অন্বেষণ করতে পারো এবং যেন তোমরা বর্ষসংখ্যা ও হিসাব জানতে পারো। আর আমি সবকিছুই বিস্তারিত বিবৃত করেছি।

أَقِمِ  الصَّلَاةَ  لِدُلُوكِ  الشَّمْسِ  إِلَىٰ  غَسَقِ  اللَّيْلِ  وَقُرْآنَ  الْفَجْرِ  إِنَّ  قُرْآنَ  الْفَجْرِ  كَانَ  مَشْهُودًا

১৭:৭৮ :: সালাত প্রতিষ্ঠা করো ‘দুলুকিশ শামস (মধ্যাহ্নে সূর্য ঢলে পড়া) থেকে ‘গাছাক্বিল লাইল (রাতের তমসাচ্ছন্নতা) পর্যন্ত সময়কালে। আর ফজরের কুরআন পাঠ (খুবই গুরুত্বপূর্ণ)। নিশ্চয় ফজরের কুরআন পাঠ (বিশেষ) প্রত্যক্ষণীয় বিষয়।

وَمِنَ  اللَّيْلِ  فَتَهَجَّدْ  بِهِ  نَافِلَةً  لَّكَ  عَسَىٰ  أَن  يَبْعَثَكَ  رَبُّكَ  مَقَامًا  مَّحْمُودًا

১৭:৭৯ :: আর রাতের কিছু সময় তাসহ (কুরআনসহ) তাহাজ্জুদ করো (জেগে উঠে কাটাও) (সালাত/ কুরআন অধ্যয়ন ও গবেষণা/ নির্বাহী দায়িত্বপালনের জন্য)। এটা তোমার জন্য অতিরিক্ত দায়বদ্ধতা (নাফিলাহ)। আশা করা যায় যে, তোমার প্রভু তোমাকে প্রশংসিত অবস্থানে (মাক্বামে মাহমূদ) সমুত্থিত করবেন।

قَالَ  رَبِّ  اجْعَل  لِّي  آيَةً  قَالَ  آيَتُكَ  أَلَّا  تُكَلِّمَ  النَّاسَ  ثَلَاثَ  لَيَالٍ  سَوِيًّا

১৯:১০ :: সে (যাকারিয়া) বললো, “হে আমার প্রভু, আমাকে কোনো নিদর্শন নির্ধারণ করে দিন”। তিনি (আল্লাহ) বললেনন, “তোমার জন্য নিদর্শন হচ্ছে এই যে, “তুমি (ইঙ্গিতে ছাড়া) মানুষের সাথে ক্রমাগতভাবে / ধারাবাহিকভাবে তিনটি রাত কথা বলবে না”।

فَاصْبِرْ  عَلَىٰ  مَا  يَقُولُونَ  وَسَبِّحْ  بِحَمْدِ  رَبِّكَ  قَبْلَ  طُلُوعِ  الشَّمْسِ  وَقَبْلَ  غُرُوبِهَا  وَمِنْ  آنَاءِ  اللَّيْلِ  فَسَبِّحْ  وَأَطْرَافَ  النَّهَارِ  لَعَلَّكَ  تَرْضَىٰ

২০:১৩০ :: তারা যা বলে সে বিষয়ে ধের্য ধরো এবং তোমার প্রভুর প্রশংসাসহ পবিত্রতা জ্ঞাপন (হামদ ও তাসবীহ) করো সূর্য উদয়ের আগে এবং সেটার (সূর্যের) অস্তের আগে। এবং রাতেমর বিভিন্ন প্রহরে (আনাআল লাইলে) এবং দিনের বিভিন্ন ভাগে (আতরফান্নাহার), যেন তুমি সন্তুষ্ট হতে পারো।

يُسَبِّحُونَ  اللَّيْلَ  وَالنَّهَارَ  لَا  يَفْتُرُونَ

২১:২০ :: তারা (ফেরেশতাগণ) তাঁর তাসবীহ/ পবিত্রতা বর্ণনা করে রাতে ও দিনে। আর তারা তাতে অলসতা করে না।

আলোচনা: এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, সাধারণভাবে সারা দিন বুঝাতে ‘রাতে ও দিনে’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কুরআনে কখনো কখনো ‘সকালে ও বিকালে’ এবং ‘সকালে ও সন্ধ্যায়’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘রাতে ও দিনে’ শব্দের সাথে ‘সকালে ও বিকালে’ এবং ‘সকালে ও সন্ধ্যায়’ শব্দের মিল-অমিল হলো: ‘সকালে ও বিকালে’ বা ‘সকালে ও সন্ধ্যায়’ শব্দের দ্বারাও সারা দিন বুঝাতে পারে। তবে শব্দ দুটি দ্বারা নির্দিষ্টভাবে ‘সকালে ও বিকালে’ এবং ‘সকালে ও সন্ধ্যায়’ও বুঝানো হয়। ‘সকালে ও বিকালে’ শব্দের অর্থ হলো ‘দিনের শুরুতে ও দিনের শেষে’। আর ‘সকালে ও সন্ধ্যায়’ শব্দের অর্থ হলো ‘দিনের শুরুতে ও রাতের শুরুতে’। যেখানে যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে সেভাবে বিশেষ সময়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাই সারাদিন তাসবীহ করার ভাবার্থ গ্রহণের পাশাপাশি ‘সকালে, বিকালে ও সন্ধ্যায়’ বিশেষভাবে তাসবীহ করার নির্দেশটিও যেন পরিপালন করা হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি। সেই সাথে অন্য আয়াতের মাধ্যমে ঐ দুটি/তিনটি সময় ছাড়াও আরো কিছু সময়ে (যেমন, যোহরসহ দিনের অন্যান্য ভাগে এবং রাতের বিভিন্ন প্রহরে) তাসবীহ করারও নির্দেশনা রয়েছে।

ذَٰلِكَ  بِأَنَّ  اللَّهَ  يُولِجُ  اللَّيْلَ  فِي  النَّهَارِ  وَيُولِجُ  النَّهَارَ  فِي  اللَّيْلِ  وَأَنَّ  اللَّهَ  سَمِيعٌ  بَصِيرٌ

২২:৬১ :: এটা এজন্য যে, আল্লাহ রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।

وَهُوَ  الَّذِي  جَعَلَ  لَكُمُ  اللَّيْلَ  لِبَاسًا  وَالنَّوْمَ  سُبَاتًا  وَجَعَلَ  النَّهَارَ  نُشُورًا

২৫:৪৭ :: আর তিনি সেই সত্তা যিনি তোমাদের জন্য রাতকে বানিয়েছেন আবরণস্বরূপ এবং ঘুমকে বিশ্রামস্বরূপ এবং দিনকে বানিয়েছেন পুনরুত্থানস্বরূপ।

أَلَمْ  يَرَوْا  أَنَّا  جَعَلْنَا  اللَّيْلَ  لِيَسْكُنُوا  فِيهِ  وَالنَّهَارَ  مُبْصِرًا  إِنَّ  فِي  ذَٰلِكَ  لَآيَاتٍ  لِّقَوْمٍ  يُؤْمِنُونَ

২৭:৮৬ :: তারা কি দেখে না যে, আমি রাতকে বানিয়েছি যেন তারা তাতে স্বস্তি লাভ করে এবং দিনকে (বানিয়েছি) দেখার উপযোগী? নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে সেই ক্বওমের জন্য যারা ঈমান রাখে।

قُلْ  أَرَأَيْتُمْ  إِن  جَعَلَ  اللَّهُ  عَلَيْكُمُ  اللَّيْلَ  سَرْمَدًا  إِلَىٰ  يَوْمِ  الْقِيَامَةِ  مَنْ  إِلَـٰهٌ  غَيْرُ  اللَّهِ  يَأْتِيكُم  بِضِيَاءٍ  أَفَلَا  تَسْمَعُونَ

২৮:৭১ :: বলো, “তোমরা কি ভেবে দেখেছো, যদি আল্লাহ তোমাদের উপর কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত রাতকে সুদীর্ঘ করে দেন, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ আছে কি, যে তোমাদেরকে আলো এনে দেবে? তোমরা কি শুনো না?”

আলোচনা: এ আয়াতে কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত রাতকে সুদীর্ঘ করার কথা বলা হয়েছে, যার অর্থ অন্যদিকে বিপরীত গোলার্ধে কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত দিনকে সুদীর্ঘ করে দেয়া (যা পরের আয়াতটিতে বলা হয়েছে)। এমতাবস্থায় এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, পৃথিবীর ঘূর্ণন থামিয়ে দিয়ে কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত তাকে স্থির রাখা। এখান থেকে বুঝা যায় যে, রাতকে কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত স্থায়ী করার মানে হলো, রাত দিনের উপর অগ্রগামী (সাবেক্ব) হওয়া বা দিবসকে পিছনে ফেলে স্থায়ীভাবে চলতে থাকা (দ্র. ৩৬:৪০)। একই সাথে এর মানে হলো অন্য গোলার্ধে দিন রাতের উপর অগ্রগামী (সাবেক্ব) হওয়া। কিন্তু ৩৬:৪০ আয়াতটিতে বক্তব্য উপস্থাপনে উপযোগিতার মাত্রা বিবেচনায় সূর্য ও চন্দ্র প্রসঙ্গে এবং রাত ও দিন প্রসঙ্গে একটি দিক উল্লেখ করে তার অনিবার্য বিপরীত দিকটি অনুল্লেখিত রাখা হয়েছে মাত্র।

রাত যদি কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত দীর্ঘ হয় তাহলে ‘আলো’ পাওয়া যাবে না। এর কারণ সূর্যকে আলোর উৎস বানানো হয়েছে। দিনের আলো শেষে রাতের প্রথমাংশে যে আলো তা সূর্যের কারণেই হয়। চন্দ্রও সূর্যের আলোতেই প্রতিবিম্বিত হয়। “রাত যদি কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত দীর্ঘ হয়, তাহলে আলো পাওয়া যাবে না” তথ্যটির অর্থ হলো, যেহেতু দিনের মূল বৈশিষ্ট্য হলো সূর্যালোক থাকা এবং রাতের মূল বৈশিষ্ট্য হলো সূর্যালোক অপসারিত হয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া, তাই রাতকে কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত দীর্ঘ করলে তথা রাতের বেলায় পৃথিবীর ঘূর্ণন থামিয়ে দিলে দিন ফিরে আসবে না বিধায় আলো পাওয়া সম্ভব নয়। এ আয়াতের সূত্র অনুসারে কোনো রাতে কোনোভাবে আলো থাকতে পারে না, সে দাবি করা যায় না।

قُلْ  أَرَأَيْتُمْ  إِن  جَعَلَ  اللَّهُ  عَلَيْكُمُ  النَّهَارَ  سَرْمَدًا  إِلَىٰ  يَوْمِ  الْقِيَامَةِ  مَنْ  إِلَـٰهٌ  غَيْرُ  اللَّهِ  يَأْتِيكُم  بِلَيْلٍ  تَسْكُنُونَ  فِيهِ  أَفَلَا  تُبْصِرُونَ

২৮:৭২ :: বলো, “তোমরা কি ভেবে দেখেছো, যদি আল্লাহ তোমাদের উপর কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত দিনকে সুদীর্ঘ করে দেন, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ আছে কি, যে তোমাদেরকে রাত এনে দেবে? যেন তোমরা তাতে প্রশান্তি পেতে পারো। তোমরা কি দেখো না?”

وَمِن  رَّحْمَتِهِ  جَعَلَ  لَكُمُ  اللَّيْلَ  وَالنَّهَارَ  لِتَسْكُنُوا  فِيهِ  وَلِتَبْتَغُوا  مِن  فَضْلِهِ  وَلَعَلَّكُمْ  تَشْكُرُونَ

২৮:৭৩ :: আর তিনি তাঁর দয়ায় তোমাদের জন্য রাত ও দিনের ব্যবস্থা করেছেন, যাতে তোমরা তাতে (রাতের বেলায়) স্বস্তি লাভ করতে পারো এবং (দিনের বেলায়) তাঁর অনুগ্রহ (জীবিকা, শিক্ষা ইত্যাদি) অন্বেষণ করতে পারো এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারো।

وَمِنْ  آيَاتِهِ  مَنَامُكُم  بِاللَّيْلِ  وَالنَّهَارِ  وَابْتِغَاؤُكُم  مِّن  فَضْلِهِ  إِنَّ  فِي  ذَٰلِكَ  لَآيَاتٍ  لِّقَوْمٍ  يَسْمَعُونَ

৩০:২৩ :: আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে আছে রাতে ও দিনে তোমাদের ঘুম এবং (আরো আছে) তাঁর অনুগ্রহ (জীবিকা, শিক্ষা ইত্যাদি) অন্বেষণ। নিশ্চয় সেটার মধ্যে নিদর্শন আছে সেই কওমের জন্য যারা (মনোযোগ দিয়ে) শুনে।

أَلَمْ  تَرَ  أَنَّ  اللَّهَ  يُولِجُ  اللَّيْلَ  فِي  النَّهَارِ  وَيُولِجُ  النَّهَارَ  فِي  اللَّيْلِ  وَسَخَّرَ  الشَّمْسَ  وَالْقَمَرَ  كُلٌّ  يَجْرِي  إِلَىٰ  أَجَلٍ  مُّسَمًّى  وَأَنَّ  اللَّهَ  بِمَا  تَعْمَلُونَ  خَبِيرٌ

৩১:২৯ :: তুমি কি দেখোনি যে, আল্লাহ রাতকে প্রবেশ করান দিনের মধ্যে আর দিনকে প্রবেশ করান রাতের মধ্যে। আর তিনি নিয়োজিত করেছেন সূর্যকে ও চন্দ্রকে। প্রত্যেকেই চলছে সুনির্দিষ্ট শেষ সময়সীমার দিকে। আর নিশ্চয় তোমরা যা করছো আল্লাহ তা সম্যক অবগত।

يُولِجُ  اللَّيْلَ  فِي  النَّهَارِ  وَيُولِجُ  النَّهَارَ  فِي  اللَّيْلِ  وَسَخَّرَ  الشَّمْسَ  وَالْقَمَرَ  كُلٌّ  يَجْرِي  لِأَجَلٍ  مُّسَمًّى  ذَٰلِكُمُ  اللَّهُ  رَبُّكُمْ  لَهُ  الْمُلْكُ  وَالَّذِينَ  تَدْعُونَ  مِن  دُونِهِ  مَا  يَمْلِكُونَ  مِن  قِطْمِيرٍ

৩৫:১৩ :: তিনি প্রবেশ করান রাতকে দিনের মধ্যে আর তিনি প্রবেশ করান দিনকে রাতের মধ্যে। আর তিনি নিয়োজিত করেছেন সূর্যকে ও চন্দ্রকে। প্রত্যেকেই চলছে সুনির্দিষ্ট শেষ সময়সীমার দিকে। আল্লাহই তোমাদের প্রভু। তাঁরই কর্তৃত্বাধীন সমস্ত রাজত্ব-আধিপত্য। আর তাঁকে ছাড়া যাকে যাকে তোমরা ডাকো,তারা খেজুরের আঁটির পর্দা পরিমাণও ক্ষমতা রাখে না।

وَآيَةٌ  لَّهُمُ  اللَّيْلُ  نَسْلَخُ  مِنْهُ  النَّهَارَ  فَإِذَا  هُم  مُّظْلِمُونَ

৩৬:৩৭ :: আর তাদের জন্য একটি নিদর্শন হলো রাত। আমি তা থেকে (রাত থেকে) দিনকে অপসারিত করি। সুতরাং তখন তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়।

لَا  الشَّمْسُ  يَنبَغِي  لَهَا  أَن  تُدْرِكَ  الْقَمَرَ  وَلَا  اللَّيْلُ  سَابِقُ  النَّهَارِ  وَكُلٌّ  فِي  فَلَكٍ  يَسْبَحُونَ

৩৬:৪০ :: সূর্যের ক্ষমতা নেই চাঁদের নাগাল পাওয়ার। আর রাত পারে না দিনের অগ্রগামী হতে। আর প্রত্যেকেই মহাশূন্যে সাঁতার কাটছে।

আলোচনা: আয়াতটিকে ২৮:৭১-৭২ আয়াতের সাথে সমন্বিতভাবে অধ্যয়ন করলে বুঝা যায় যে, রাত দিনের উপর অগ্রগামী (সাবেক্ব) হওয়ার অর্থ হলো কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত রাত স্থায়ী হওয়া তথা পৃথিবীর ঘূর্ণন থেমে যাওয়া। অনুরূপভাবে এ ঘটনার ক্ষেত্রে বিপরীত গোলার্ধে দিন কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে যাবে তথা দিন রাতের উপর অগ্রগামী (সাবেক্ব) হয়ে যাবে। অর্থাৎ আল্লাহ চাইলে দিনের উপর রাতকে এবং রাতের উপর দিনকে অগ্রগামী করতে তথা পৃথিবীতে দিন ছাড়া রাতকে এবং রাত ছাড়া দিনকে কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত স্থায়ী করে দিতে সক্ষম। কিন্তু তিনি তা করেন না। অন্য কথায় রাত দিনের আবর্তন আল্লাহর তৈরি নিয়মে হচ্ছে এবং তিনি চাইলে এর চেয়ে ভিন্নরূপ (আবর্তনহীনতা) হতে পারতো। সূর্যের ক্ষমতা নেই চাঁদের নাগাল পাওয়ার। এ তথ্যের অনিবার্য বিপরীতক্রমিক তথ্য হচ্ছে চাঁদের ক্ষমতা নেই সূর্যের নাগাল পাওয়ার। রাত পারে না দিনের সাবেক্ব হতে, এ কথারও অনিবার্য বিপরীতক্রমিক তথ্য হচ্ছে দিন পারে না রাতের সাবেক্ব হতে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রে একটি তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে এবং বিপরীতক্রমিক তথ্যটি অনুল্লেখিত রয়েছে। যে তথ্যটি উল্লেখ করার উপযোগিতা অধিক তা-ই উল্লেখিত হয়েছে এবং বিপরীতক্রমকিটি অনুল্লেখিত রাখা হয়েছে।

وَإِنَّكُمْ  لَتَمُرُّونَ  عَلَيْهِم  مُّصْبِحِينَ

৩৭:১৩৭ :: আর তোমরা গমন করে থাক তাদের (কওমে লূতের ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকার) পাশ দিয়ে সকালে (সুবহের সময়)।

وَبِاللَّيْلِ  أَفَلَا  تَعْقِلُونَ

৩৭:১৩৮ :: এবং রাতের বেলায়। তোমরা কি বিবেক-বুদ্ধি (আক্বল) প্রয়োগ করবে না?

خَلَقَ  السَّمَاوَاتِ  وَالْأَرْضَ  بِالْحَقِّ  يُكَوِّرُ  اللَّيْلَ  عَلَى  النَّهَارِ  وَيُكَوِّرُ  النَّهَارَ  عَلَى  اللَّيْلِ  وَسَخَّرَ  الشَّمْسَ  وَالْقَمَرَ  كُلٌّ  يَجْرِي  لِأَجَلٍ  مُّسَمًّى  أَلَا  هُوَ  الْعَزِيزُ  الْغَفَّارُ

৩৯:৫ :: তিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সত্যসহকারে/যথাযথভাবে। তিনি দিনকে রাতের উপর জড়িয়ে দেন। এবং তিনি সূর্যকে ও চন্দ্রকে নিয়োজিত করেছেন। প্রত্যেকেই চলছে নির্দিষ্ট শেষ সময়সীমার (আজালুম মুসাম্মা তথা প্রলয় মুহুর্তের) দিকে। জেনে রাখো, তিনিই মহাশক্তিমান, ক্ষমাশীল।

أَمَّنْ  هُوَ  قَانِتٌ  آنَاءَ  اللَّيْلِ  سَاجِدًا  وَقَائِمًا  يَحْذَرُ  الْآخِرَةَ  وَيَرْجُو  رَحْمَةَ  رَبِّهِ  قُلْ  هَلْ  يَسْتَوِي  الَّذِينَ  يَعْلَمُونَ  وَالَّذِينَ  لَا  يَعْلَمُونَ  إِنَّمَا  يَتَذَكَّرُ  أُولُو  الْأَلْبَابِ

৩৯:৯ :: নাকি সে (তার মতো) যে বিনয়ী (ক্বানিতূন), রাতের বিভিন্ন প্রহরে সাজদাহকারী ও কিয়ামকারী, যে আখিরাতকে ভয় করে এবং যে তার প্রভুর দয়ার আশা করে? বলো, “তারা কি সমান হতে পারে যারা জ্ঞান অর্জন করে এবং যারা জ্ঞান অর্জন করে না? নিশ্চয় উপদেশ স্মরণ রাখে চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ (উলুল আলবাব)”।

اللَّهُ  الَّذِي  جَعَلَ  لَكُمُ  اللَّيْلَ  لِتَسْكُنُوا  فِيهِ  وَالنَّهَارَ  مُبْصِرًا  إِنَّ  اللَّهَ  لَذُو  فَضْلٍ  عَلَى  النَّاسِ  وَلَـٰكِنَّ  أَكْثَرَ  النَّاسِ  لَا  يَشْكُرُونَ

৪০:৬১ :: তিনিই আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য রাতকে বানিয়েছেন যেন তোমরা তাতে স্বস্তি লাভ করো এবং দিনকে (বানিয়েছেন) দেখার উপযোগী। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের উপর মহাঅনুগ্রহশীল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে না।

فَإِنِ  اسْتَكْبَرُوا  فَالَّذِينَ  عِندَ  رَبِّكَ  يُسَبِّحُونَ  لَهُ  بِاللَّيْلِ  وَالنَّهَارِ  وَهُمْ  لَا  يَسْأَمُونَ

৪১:৩৮ :: তারপর যদি তোমরা অহংকার করো, তবে (জেনে রাখো,) যারা তোমার প্রভুর কাছে আছে তারা তাঁর পবিত্রতা জ্ঞাপন (তাসবীহ) করে রাতে ও দিনে, আর তারা ক্লান্ত হয় না।

فَاصْبِرْ  عَلَىٰ  مَا  يَقُولُونَ  وَسَبِّحْ  بِحَمْدِ  رَبِّكَ  قَبْلَ  طُلُوعِ  الشَّمْسِ  وَقَبْلَ  الْغُرُوبِ

৫০:৩৯ :: সুতরাং তারা যা বলে ঐ ব্যাপারে (প্রতিক্রিয়া হিসেবে) তুমি ধৈর্য ধরো (সবর করো)। আর তোমার প্রভুর প্রশংসা (হামদ) সহকারে তাঁর পবিত্রতা জ্ঞাপন (তাসবীহ) করো সূর্য উদয়ের আগে ও সূর্য অস্তের আগে।

وَمِنَ  اللَّيْلِ  فَسَبِّحْهُ  وَأَدْبَارَ  السُّجُودِ

৫০:৪০ :: আর রাতের কিছু অংশে তাঁর পবিত্রতা জ্ঞাপন (তাসবীহ) করো এবং সাজদাহসমূহের পরেও (তাসবীহ করো)।

وَاصْبِرْ  لِحُكْمِ  رَبِّكَ  فَإِنَّكَ  بِأَعْيُنِنَا  وَسَبِّحْ  بِحَمْدِ  رَبِّكَ  حِينَ  تَقُومُ

৫২:৪৮ :: আর তোমার প্রভুর হুকুমের জন্য ধৈর্য ধরো (সবর করো), নিশ্চয় তুমি আমার চোখের সামনে আছো। আর তোমার প্রভুর প্রশংসা (হামদ) সহকারে পবিত্রতা জ্ঞাপন (তাসবীহ) করো, যখন তুমি দাঁড়াও (কিয়াম করো)।

وَمِنَ  اللَّيْلِ  فَسَبِّحْهُ  وَإِدْبَارَ  النُّجُومِ

৫২:৪৯ :: আর রাতের কিছু অংশেও তুমি তাঁর পবিত্রতা জ্ঞাপন (তাসবীহ) করো। আর নক্ষত্রসমূহের অস্তগমনের সময়ও (তাঁর তাসবীহ করো)।

يُولِجُ  اللَّيْلَ  فِي  النَّهَارِ  وَيُولِجُ  النَّهَارَ  فِي  اللَّيْلِ  وَهُوَ  عَلِيمٌ  بِذَاتِ  الصُّدُورِ

৫৭:৬ :: তিনিই রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং তিনিই দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান। আর তিনিই মস্তিষ্কসমূহের (সদরসমূহের) চিন্তা-চেতনা সম্পর্ককে জ্ঞাত।

وَأَمَّا  عَادٌ  فَأُهْلِكُوا  بِرِيحٍ  صَرْصَرٍ  عَاتِيَةٍ

৬৯:৬ :: আর আদকে ধ্বংস (হালাক) করা হয়েছিল প্রচণ্ড ঝঞ্জা বায়ু দিয়ে।

سَخَّرَهَا  عَلَيْهِمْ  سَبْعَ  لَيَالٍ  وَثَمَانِيَةَ  أَيَّامٍ  حُسُومًا  فَتَرَى  الْقَوْمَ  فِيهَا  صَرْعَىٰ  كَأَنَّهُمْ  أَعْجَازُ  نَخْلٍ  خَاوِيَةٍ

৬৯:৭ :: তিনি তা তাদের উপর প্রবাহিত করেন সাত রাত ও আট দিন ক্রমাগতভাবে। (যদি তুমি সেখানে থাকতে তবে) তুমি দেখতে সেই কওমকে সেটার মধ্যে পড়ে থাকা অবস্থায়, যেন তারা পরিত্যক্ত খেজুর গাছের কাণ্ডসমূহ।

قَالَ  رَبِّ  إِنِّي  دَعَوْتُ  قَوْمِي  لَيْلًا  وَنَهَارًا

৭১:৫ :: সে (নূহ) বলেছিলো, “হে আমার প্রভু, নিশ্চয় আমি আহবান করেছি (দাওয়াত দিয়েছি) আমার কওমকে রাতে ও দিনে।

يَا  أَيُّهَا  الْمُزَّمِّلُ

৭৩:১ :: হে যোগ্য সংগঠক (মুযযামমিল)।

قُمِ  اللَّيْلَ  إِلَّا  قَلِيلًا

৭৩:২ :: রাতে দাঁড়াও (কিয়াম করো), কিছু অংশ ছাড়া।

نِّصْفَهُ  أَوِ  انقُصْ  مِنْهُ  قَلِيلًا

৭৩:৩ :: সেটার (রাতের) অর্ধেক অংশ অথবা তা (রাত) থেকে কিছু কম করো।

أَوْ  زِدْ  عَلَيْهِ  وَرَتِّلِ  الْقُرْآنَ  تَرْتِيلًا

৭৩:৪ :: অথবা সেটার উপর (অর্ধরাতের উপর) কিছু বাড়িয়ে নাও। আর আল কুরআনকে (নির্দেশনা অনুসারে) যথাযথ বিন্যাসে বিন্যস্ত করো।

إِنَّا  سَنُلْقِي  عَلَيْكَ  قَوْلًا  ثَقِيلًا

৭৩:৫ :: নিশ্চয় আমি তোমার উপর শীঘ্রই অর্পণ করি ভারী বাণী।

إِنَّ  نَاشِئَةَ  اللَّيْلِ  هِيَ  أَشَدُّ  وَطْئًا  وَأَقْوَمُ  قِيلًا

৭৩:৬ :: নিশ্চয় রাতের বেলায় জেগে উঠা পদক্ষেপ গ্রহণে (ও প্রবৃত্তি দলনে) প্রবলতর এবং কথা বুঝার ক্ষেত্রে অধিক কার্যকর।

إِنَّ  لَكَ  فِي  النَّهَارِ  سَبْحًا  طَوِيلًا

৭৩:৭ :: নিশ্চয় তোমার জন্য আছে দিনের বেলায় দীর্ঘ ব্যস্ততা।

إِنَّ  رَبَّكَ  يَعْلَمُ  أَنَّكَ  تَقُومُ  أَدْنَىٰ  مِن  ثُلُثَيِ  اللَّيْلِ  وَنِصْفَهُ  وَثُلُثَهُ  وَطَائِفَةٌ  مِّنَ  الَّذِينَ  مَعَكَ  وَاللَّهُ  يُقَدِّرُ  اللَّيْلَ  وَالنَّهَارَ  عَلِمَ  أَن  لَّن  تُحْصُوهُ  فَتَابَ  عَلَيْكُمْ  فَاقْرَءُوا  مَا  تَيَسَّرَ  مِنَ  الْقُرْآنِ  عَلِمَ  أَن  سَيَكُونُ  مِنكُم  مَّرْضَىٰ  وَآخَرُونَ  يَضْرِبُونَ  فِي  الْأَرْضِ  يَبْتَغُونَ  مِن  فَضْلِ  اللَّهِ  وَآخَرُونَ  يُقَاتِلُونَ  فِي  سَبِيلِ  اللَّهِ  فَاقْرَءُوا  مَا  تَيَسَّرَ  مِنْهُ  وَأَقِيمُوا  الصَّلَاةَ  وَآتُوا  الزَّكَاةَ  وَأَقْرِضُوا  اللَّهَ  قَرْضًا  حَسَنًا  وَمَا  تُقَدِّمُوا  لِأَنفُسِكُم  مِّنْ  خَيْرٍ  تَجِدُوهُ  عِندَ  اللَّهِ  هُوَ  خَيْرًا  وَأَعْظَمَ  أَجْرًا  وَاسْتَغْفِرُوا  اللَّهَ  إِنَّ  اللَّهَ  غَفُورٌ  رَّحِيمٌ

৭৩:২০ :: নিশ্চয় তোমার রব জানেন যে,তুমি দাঁড়িয়ে থাক রাতের প্রায় তিনভাগের দুইভাগ এবং (কখনো) রাতের অর্ধেক এবং (কখনো) রাতের তিনভাগের একভাগ। আর যারা তোমার সাথে আছে তাদের একটি দলও (অনুরূপ করে)। আর আল্লাহ রাত ও দিনের পরিমাপ নির্ধারণ করেন। তিনি জানেন যে,তোমরা তা হুবহু হিসাব করতে পারো না। সুতরাং তিনি তোমাদের উপর (ওজরের ক্ষেত্রে) ক্ষমাপরবশ। সুতরাং তোমরা কুরআন থেকে পাঠ করো, যতটুকু সহজসাধ্য হয়। তিনি জানেন যে,তোমাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ অসুস্থ হবে। আর অন্য অনেকে আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা, শিক্ষা প্রভৃতি) তালাশ করতে পৃথিবীতে ভ্রমণ করবে। আর অন্য অনেকে আল্লাহর পথে যুদ্ধাভিযানে থাকবে। সুতরাং তোমরা তা (কুরআন) থেকে পাঠ করো, যতটুকু সহজসাধ্য হয়। আর তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো এবং যাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহকে ঋণ দাও, উত্তম ঋণ। আর তোমরা নিজেদের কল্যাণে কল্যাণকর্ম থেকে যা আগে পাঠাবে তোমরা আল্লাহর কাছে তা (তার শুভ প্রতিফল) পাবে। সেটাই উত্তম এবং প্রতিফল হিসেবে মহিমান্বিত। আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াশীল।

كَلَّا  وَالْقَمَرِ

৭৪:৩২ :: কখনো নয়। কসম চাঁদের।

وَاللَّيْلِ  إِذْ  أَدْبَرَ

৭৪:৩৩ :: আর রাতের, যখন তা ফিরে যায়।

وَالصُّبْحِ  إِذَا  أَسْفَرَ

৭৪:৩৪ :: আর প্রভাতের (সোবহের), যখন তা ফর্সা হয়।

وَاذْكُرِ  اسْمَ  رَبِّكَ  بُكْرَةً  وَأَصِيلًا

৭৬:২৫ :: আর তোমার প্রভুর স্মরণ (যিকর) করো সকালে ও বিকালে।

وَمِنَ  اللَّيْلِ  فَاسْجُدْ  لَهُ  وَسَبِّحْهُ  لَيْلًا  طَوِيلًا

৭৫:২৬ :: আর রাতের কিছু অংশে তাঁরই উদ্দেশ্যে সাজদাহ করো এবং তাঁরই পবিত্রতা জ্ঞাপন (তাসবীহ) করো দীর্ঘ রাত।

وَجَعَلْنَا  اللَّيْلَ  لِبَاسًا

৭৮:১০ :: আর আমি রাতকে বানিয়েছি পোশাকস্বরূপ

وَجَعَلْنَا  النَّهَارَ  مَعَاشًا

৭৮:১১ :: আর আমি দিনকে বানিয়েছি জীবিকা অর্জনের সময়।

وَأَغْطَشَ  لَيْلَهَا  وَأَخْرَجَ  ضُحَاهَا

৭৯:২৯ :: আর সেটার রাতকে (অন্ধকারে) আচ্ছন্ন করেছেন এবং সেটার পূর্ণ সূর্য দীপ্তিকালকে (দুহাকে) বের করেছেন।

وَاللَّيْلِ  إِذَا  عَسْعَسَ

৮১:১৭ :: শপথ রাতের, যখন তা বিদায় নেয়।

وَالصُّبْحِ  إِذَا  تَنَفَّسَ

৮১:১৮ :: আর প্রভাতের (সোবহের), যখন তা শ্বাস নেয়।

فَلَا  أُقْسِمُ  بِالشَّفَقِ

৮৪:১৬ :: সুতরাং না। আমি কসম করি দিগন্তের লালাভার (শাফাক্বের)

وَاللَّيْلِ  وَمَا  وَسَقَ

৮৪:১৭ :: এবং রাতের এবং তা (রাত) যা কিছুকে সমন্বিত করে তার।

وَالنَّهَارِ  إِذَا  جَلَّاهَا

৯১:৩ :: শপথ দিনের যখন তা (দিন) সেটাকে (সূর্যকে) প্রকট করে।

وَاللَّيْلِ  إِذَا  يَغْشَاهَا

৯১:৪ :: শপথ রাতের, যখন তা (রাত) সেটাকে (সূর্যকে) আচ্ছন্ন করে।

وَاللَّيْلِ  إِذَا  يَغْشَىٰ

৯২:১ :: শপথ রাতের, যখন তা (অন্ধকারে) আচ্ছন্ন করে।

وَالنَّهَارِ  إِذَا  تَجَلَّىٰ

৯২:২ :: শপথ দিনের যখন তা আলোকিত করে।

وَالضُّحَىٰ

৯৩:১ :: শপথ পূর্ণ সূর্য দীপ্তকালের (দুহার)।

وَاللَّيْلِ  إِذَا  سَجَىٰ

৯৩:২ :: এবং রাতের, যখন তা নিঝুম হয়।

سَلَامٌ  هِيَ  حَتَّىٰ  مَطْلَعِ  الْفَجْرِ

৯৭:৫ :: শান্তি (সালাম), তা (লাইলাতুল কদর) ফজরের উদয় মুহুর্ত পর্যন্ত।

 

 

দিন-রাতের বিভিন্ন সময়সীমা নির্ণয়ের সাথে সম্পর্কিত শব্দাবলির নির্ঘণ্ট (Concordace)

নিম্নে দিন-রাতের বিভিন্ন সময়সীমা নির্ণয়ের সাথে সম্পর্কিত শব্দাবলির (মূল অক্ষরসমূহ থেকে গঠিত) বিভিন্ন শব্দরূপের নির্ঘণ্ট উল্লেখ করা হলো:

১. (ক) দুহা (অর্থ: পূর্ণ সূর্য দীপ্তিকাল/ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৬ স্থানে: ৭:৯৮:৭, ২০:৫৯:৮, ৭৯:২৯:৪, ৭৯:৪৬:৯, ৯১:১:২, ৯৩:১:১।

১. (খ) তাদহা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ২০:১১৯:৬।

২. (ক) ফজর (অর্থ: সকাল)শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৬ স্থানে: ২:১৮৭:৪২, ১৭:৭৮:৯, ১৭:৭৮:১২, ২৪:৫৮:১৮, ৮৯:১:১, ৯৭:৫:৫।

২. (খ) মতলায়ে ফজর (অর্থ: ফজরের উদয় মুহুর্ত)শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৯৭:৫:৪-৫। [উল্লেখ্য: মাতলা শব্দটি সময়বাচক।

৩. (ক) সুবহ (অর্থ: সকাল) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৫ স্থানে: ১১:৮১:২৬, ১১:৮১:২৮, ৭৪:৩৪:১, ৮১:১৮:১, ১০০:৩:২।

৩. (খ) সবাহ (অর্থ: সকাল) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩৭:১৭৭:৫।

৩. (গ) মুসবিহীন (মুসবিহ এর বহুবচন, কর্তাবিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ৪) ব্যবহৃত হয়েছে ৫ স্থানে: ১৫:৬৬:৯, ১৫:৮৩:৩, ৩৭:১৩৭:৪, ৬৮:১৭:১০, ৬৮:২১:২।

৩. (ঘ) ইসবাহ (ক্রিয়াবিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ৪) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৬:৯৬:২।

৩. (ঙ) আসবাহা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪) ব্যবহৃত হয়েছে ২৮ স্থানে: ৩:১০৩:১৭, ৫:৩০:৭, ৫:৩১:২৩, ৫:৫২:২২, ৫:৫৩:১৪, ৫:১০২:৭, ৭:৭৮:৩, ৭:৯১:৩, ১১:৬৭:৫, ১১:৯৪:১৫, ১৮:৪০:১৩, ১৮:৪১:২, ১৮:৪২:৩, ১৮:৪৫:১৪, ২২:৬৩:৯, ২৩:৪০:৪, ২৬:১৫৭:২, ২৮:১০:১, ২৮:১৮:১, ২৮:৮২:১, ২৯:৩৭:৪, ৩০:১৭:৬, ৪১:২৩:৭, ৪৬:২৫:৬, ৪৯:৬:১৩, ৬১:১৪:৩৪, ৬৭:৩০:৪, ৬৮:২০:১।

৩. (চ) হীনা তুসবিহূনা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪) শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩০:১৭:৫-৬।

৪. (ক) বুকরাত (অর্থ: সকাল) ব্যবহৃত হয়েছে ৭ স্থানে: ১৯:১১:১০, ১৯:৬২:১০, ২৫:৫:৮, ৩৩:৪২:২, ৪৮:৯:৭, ৫৪:৩৮:৩, ৭৬:২৫:৪।

৪. (খ) ইবকার (ক্রিয়াবিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ৪, অর্থ: সকাল) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৩:৪১:২০, ৪০:৫৫:১২।

৫. (ক) গাদাত (অর্থ: সকাল) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৬:২৫:৬, ১৮:২৮:৭।

৫. (খ) গুদুব্ব (গাদাত এর বহুবচন, অর্থ: সকালসমূহ) ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ৭:২০৫:১১, ১৩:১৫:১০, ২৪:৩৬:১৩।

৫. (গ) গুদুব্ব (একবচন হিসেবে, অর্থ: সকাল) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৩৪:১২:৩, ৪০:৪৬:৪।

৫. (ঘ) গাদাআ (অর্থ: সকালের নাস্তা অর্থে) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ১৮:৬২:৬।

৫. (ঙ) গাদাওয়া (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১, অর্থ: সকালে যাত্রা করা) ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ৩:১২১:২, ৬৮:২২:২, ৬৮:২৫:১।

উল্লেখ্য: গুদুব্ব হচ্ছে সেই সময় যখন বস্তুর ছায়া প্রথম সাজদাহ করে তথা এটা হচ্ছে সূর্যোদয়ের অব্যবহিত পরের সময়। (১৩:১৫)

৬. হীনা তাছরাহূনা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১, অর্থ: সকাল) শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ১৬:৬:৬-৭।

৭. (ক) শারক্বিয়্য (অর্থ: সূর্যোদয়ের দিক) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ১৯:১৬:১০।

৭. (খ) শারক্বিয়্যাত (শারক্বিয়্য এর দ্বিবচন) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ২৪:৩৫:২৩।

৭. (গ) মাশরিক্ব (অর্থ: সূর্যোদয়ের স্থান) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৬ স্থানে। ২:১১৫:২, ২:১৪২:১৪, ২:১৭৭:৭, ২:২৫৮:৩১, ২৬:২৮:৩, ৭৩:৯:২।

৭. (ঘ) মাশরিক্বাইন (মাশরিক্ব এর দ্বিবচন) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৪৩:৩৮:৯, ৫৫:১৭:২।

৭. (ঙ) মাশারিক্ব (মাশরিক্ব এর বহুবচন) ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ৭:১৩৭:৬,  ৩৭:৫:৭, ৭০:৪০:৭।

৭. (জ) আশরাক্বা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪, অর্থ: উদ্ভাসিত হওয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩৯:৬৯:১।

৭. (ঝ) মুশরিক্বীন (মুশরিক্ব এর বহুবচন, কর্তাবিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ৪) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ১৫:৭৩:৩, ২৬:৬০:২।

৭. (ঞ) ইশরাক্ব (ক্রিয়াবিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ৪, ‘তুলুয়িশ শামস এর প্রতিশব্দ, অর্থ: সূর্য উদয়ের মুহুর্ত) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩৮:১৮:৭।

যাহীরাত/ হীনা তুযহিরূনা (দুপুর)

৮. (ক) যহীরাত (যহীর শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ, অর্থ: দুপুর) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ২৪:৫৮:২৩।

৮. (খ) আযহারা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪) ব্যবহৃত হয়েছে ৭ স্থানে: ৯:৩৩:৮, ৩০:১৮:৮, ৪০:২৬:১৫, ৪৮:২৮:৮, ৬১:৯:৮, ৬৬:৩:১১, ৭২:২৬:৪।

৮. (গ) হীনা তুযহিরূনা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪) শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩০:১৮:৭-৮।

আসীল/ আসাল (বিকাল)

৯. (ক) আসীল (অর্থ: বিকাল) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৪ স্থানে: ২৫:৫:৯, ৩৩:৪২:৩, ৪৮:৯:৮, ৭৬:২৫:৫।

৯. (খ) আসাল (আসীল এর বহুবচন) ব্যবহৃত হয়েছে ৪ স্থানে: ৭:২০৫:১২, ১৩:১৫:১১, ২৪:৩৬:১৪।

উল্লেখ্য: আসাল হচ্ছে সেই সময় যখন বস্তুর ছায়া শেষ সাজদাহ করে তথা এটা হচ্ছে সূর্যাস্তের অব্যবহিত পূর্বের সময়। (১৩:১৫)

১০. আসর (অর্থ: প্রবহমান কাল/ সময়)শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ১০৩:১:১।

১১. দাহর (অর্থ: মহাকাল)শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৪৫:২৪:১২, ৭৬:১:৭।

১২. হীনা তুমছূনা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪, অর্থ: প্রায় সন্ধ্যা) শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩০:১৭:৩-৪।

১৩. রওয়াহ (অর্থ: সন্ধ্যা) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩৪:১২:৫।

১৪. হীনা তুরীহূনা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪, অর্থ: সন্ধ্যা) শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে। ১৬:৬:৪-৫।

১৫. (ক) আশিয়্য (অর্থ: রাতের প্রথম ভাগ) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১০ স্থানে: ৩:৪১:১৯, ৬:৫২:৭, ১৮:২৮:৮, ১৯:১১:১১, ১৯:৬২:১১, ৩০:১৮:৬, ৩৮:১৮:৬, ৩৮:৩১:৪, ৪০:৪৬:৫, ৪০:৫৫:১১।

১৫. (খ) আশিয়্যাত (আশিয়্য শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৭৯:৪৬:৭।

১৫. (গ) ইশা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ১২:১৬:৩, ২৪:৫৮:২৭।

১৭. তুলুয়িশ শামস (ক্রিয়াবিশেষ্য, অর্থ: সূর্য উদয় মুহুর্ত)শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ২০:১৩০:৯, ৫০:৩৯:৯।

১৮. দুলুকিশ শামস (ক্রিয়াবিশেষ্য, অর্থ: দ্বিপ্রহরে প্রথমবার সূর্য ঢলে পড়ার মুহুর্ত)শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ১৭:৭৮:৩।

১৯. (ক) গারবিয়্য (অর্থ: পূর্বদিক) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ২৮:৪৪:৪।

১৯. (খ) গারবিয়্যাত (গারবিয়্য এর স্ত্রীলিঙ্গ, অর্থ: পূর্বদিক) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ২৪:৩৫:২৫।

১৯. (গ) মাগরিব (অর্থ: সূর্যাস্তের স্থান) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৭ স্থানে: ২:১১৫:৩, ২:১৪২:১৫, ২:১৭৭:৮, ২:২৫৮:৩৫, ১৮:৮৬:৪, ২৬:২৮:৪, ৭৩:৯:৩।

১৯. (ঘ) মাগরিবাইন (মাগরিব এর দ্বিবচন) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৫৫:১৭:৪।

১৯. (ঙ) মাগারিব (মাগরিব এর বহুবচন) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৭:১৩৭:৮, ৭০:৪০:৫।

১৯. (চ) গারাবা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১, অর্থ: অস্ত যাওয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ১৮:১৭:১১, ১৮:৮৬:৭।

১৯. (ছ) গুরূব (গুরুবিশ শামস বুঝাতে ব্যবহৃত, ক্রিয়াবিশেষ্য) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ২০:১৩০:১২, ৫০:৩৯:১২।

২০. (ক) গাছাক্বিল লাইল (ক্রিয়াবিশেষ্য, অর্থ: রাতের গাঢ় অন্ধকার) শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ১৭:৭৮:৬।

২০. (খ) গাছিক্ব (কর্তাবিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ১) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ১১৩:৩:৩।

২১. শাফাক্ব (অর্থ: সূর্যোদয় পূর্ববর্তী ও সূর্যাস্ত পরবর্তী দিগন্তের লালাভা) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৮৪:১৬:৩।

২২. (ক) তরাফ (অর্থ: ভাগ) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩:১২৭:২।

২২. (খ) তরাফাইন (তরাফ এর দ্বিবচন) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ১১:১১৪:৩।

২২. (গ) আতরাফ (তরাফ এর বহুবচন) ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ১৩:৪১:৮, ২০:১৩০:১৭, ২১:৪৪:১৬।

২৩. (ক) যুলফাত (অর্থ: নিকটবর্তী) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৬৭:২৭:৩।

২৩. (খ) যুলাফ (যুলফাত এর বহুবচন, অর্থ: নিকটবর্তী অংশসমূহ) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ১১:১১৪:৫।

২৩. (গ) যুলফা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৪ স্থানে: ৩৪:৩৭:৮, ৩৮:২৫:৭, ৩৮:৪০:৪, ৩৯:৩:১৬।

২৩. (ঘ) আযলাফা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪) ব্যবহৃত হয়েছে ৪ স্থানে: ২৬:৬৪:১, ২৬:৯০:১, ৫০:৩১:১, ৮১:১৩:৩।

২৪. (ক) ছাহার (অর্থ: রাতের শেষ লগ্ন) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৫৪:৩৪:৯।

২৪. (খ) আছহার (ছাহার এর বহুবচন) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৩:১৭:৬, ৫১:১৮:১।

 

দিন-রাতের বিভিন্ন সময়সীমা নির্ণয়ের জন্য কিছু বিশেষ দ্রষ্টব্য

১. রাত হচ্ছে ‘মাতলায়িল ফজর বা ফজর উদয় পর্যন্ত সময়কাল (৯৭:৫)

২. দিন সূর্যকে প্রকট করে এবং রাত সূর্যকে আচ্ছন্ন করে (৯১:৩-৪)

৩. রাতকে দিনের মধ্যে এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। (৩:২৭, ২১:২৯, ৩৫:১৩, ৫৭:৬)

৪. রাতকে দিনের উপর জড়িয়ে দেয়া হয় এবং দিনকে রাতের উপর জড়িয়ে দেয়া হয়। (৩৯:৫)

৫. রাত থেকে দিনকে সরানো হয়, তখন সবাই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। (৩৬:৩৭)

৬. রাত দিয়ে দিনকে ঢেকে দেয়া হয়। (৭:৫৪, ১৩:৩)

৭. নবী ইবরাহীম তাঁর উপর রাত আচ্ছন্ন হলে তখনি কাওকাব (সন্ধ্যাতারা/শুকতারা/শুক্রগ্রহ) দেখেছিলেন (৬:৭৬)

৮. শাফাক্ব শুধুমাত্র লাইলের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং তা কোনো না কোনোভাবে লাইল থেকে ভিন্নমাত্রিক তাৎপর্যমণ্ডিত (৮৪:১৬-১৭)। সূর্যোদয়ের পূর্ববর্তী শাফাক্বের সময়গত নাম হচ্ছে ফজর, যা শুরু হয় দিগন্তে সাদা আভা স্পষ্ট হওয়ার মাধ্যমে (২:১৮৭, ৯৭:৫) এবং সূর্যাস্তের পরবর্তী শাফাকের সময়গত নাম হচ্ছে আশিয়্য/আশিয়্যাত তথা ইশার প্রথম দিকের পর্যায়।

৯. ফজর হচ্ছে তরাফায়িন নাহারি বা দিনের দুটি তরাফের মধ্য থেকে একটি তরাফের অন্তর্ভুক্ত। (১১:১১৪, ২৪:৫৮)

১০. ইশার সময়টিকে জুলাফাম মিনাল লাইল হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। (২৪:৫৮, ১১:১১৪)

১১.ইলাল লাইল এবং ইলা গাছাক্বিল লাইল দুটি স্বতন্ত্র বিষয়। (২:১৮৭, ১৭:৭৮)

১২. রাতের বিভিন্ন প্রহরকে ‘আনাআল লাইল বলা হয়। (৩:১১৩, ২০:১৩০, ৩৯:৯)

১৩. রাতের কতটুকু সময় কোন কাজ করা হচ্ছে তার সাপেক্ষে তাকে দুই বা তিন ভাগে ভাগ করে সময়দৈর্ঘ্য উল্লেখের উদাহরণ। (৭৩:১-৬, ৭৩:২০)

১৪. রাতের শেষদিকের অংশকে ছাহারআছহার বলা হয়। (৫৪:৩৪, ৩৭:১৭, ৫১:১৮)

১৫. রাতের গাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্নতাকে বা সবচেয়ে অন্ধকার অংশকে ‘গাছাক্ব’ বলা হয়। (১৭:৭৮)

১৬. দিনের আলো সম্পূর্ণ অপসারিত হলে বা দিনের যে অংশকে রাত দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় বা তা রাত বলে সাব্যস্ত হয়, সে অংশের পরে রাত গভীর অন্ধকারময় হয়ে যায় (৩৬:৩৭)

উপর্যুক্ত পয়েন্টগুলোর সাপেক্ষে নির্ণিত তথ্য হচ্ছে, ফজর হচ্ছে দিনের সেই অংশ যাতে শাফাক্ব থাকে এবং যাতে রাত দিনে প্রবেশ করেছে এবং ঐ সময়টি দিনের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হয় (রাতের অংশ হিসেবে নয়)। অনুরূপভাবে সন্ধ্যা বা সূর্যাস্তের পরবর্তী আশিয়্য/ আশিয়্যাত (ইশার প্রথম দিকের পর্যায়) হচ্ছে রাতের সেই অংশ যাতে শাফাক্ব থাকে এবং যাতে দিন রাতে প্রবেশ করেছে এবং ঐ সময়টি রাতের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হয় (দিনের অংশ হিসেবে নয়)। আশিয়্য/ আশিয়্যাতকে বর্তমানে মাগরিব বলা হয়, অথচ মাগরিব শব্দটি কুরআনে শুধুমাত্র সুর্যাস্তের স্থান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

ইলাল লাইল বলতে বুঝায় সূর্যাস্তের অব্যবহিত পরবর্তী সময় এবং ইলা গাছাক্বিল লাইল বলতে বুঝায় সন্ধ্যাকালীন শাফাক্বের পরবর্তী অন্ধকারাচ্ছন্নতার প্রথম পর্যায়। দিনের প্রথম তরাফ (ভাগ) শুরু হয় ফজর থেকে এবং দিনের শেষ তরাফ (ভাগ) শেষ হয় সূর্যাস্তের মাধ্যমে তথা তরাফটি সূর্যাস্তের পূর্বে অবস্থান করে।

খুব সংক্ষেপে দিন হচ্ছে ফজরের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়। আর রাত হচ্ছে সূর্যাস্তের অব্যবহিত পরবর্তী সময় থেকে ফজর শুরু হওয়া পর্যন্ত। দিন সূর্যকে প্রকট করে কিন্তু সূর্যের আলো যতক্ষণ থাকে তার পুরোটাই দিন তা নয়। রাত সূর্যকে আচ্ছন্ন করে কিন্তু রাতের প্রথম অংশেও সূর্যের আলো মোটেই থাকতে পারবে না তা নয়। সূর্যাস্ত হলে দিন শেষ কিন্তু দিনের আলো কিছুটা রয়ে যায় রাতের প্রথম অংশে। অনুরূপভাবে ফজর শুরু হলে রাত শেষ কিন্তু রাতের অন্ধকারের কিছুটা রেশ রয়ে যায় দিনের প্রথম অংশে, কারণ তখনো সূর্য উদিত হয়নি। দিনের প্রথম অংশ সূর্যোদয়ের আগে এবং শেষ অংশ সূর্যাস্তের আগে থাকার প্রেক্ষিতে এ দুটি সময়কে সূর্যের উদয়-অস্তের সাথে সম্পর্কিত করে উভয় ক্ষেত্রে ক্বাবলা (আগে) শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে, কোন ক্ষেত্রে বা’দা (পরে) শব্দ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়নি (২০:১৩০, ৫০:৩৯-৪০)। বিশেষ করে ৫০:৩৯-৪০ আয়াতে ‘সূর্যাস্তের আগে’ এবং ‘রাতের কিছু অংশে’ তথ্য দুটি থেকে স্পষ্ট যে, যদি সূর্যাস্তের পরে রাতের অংশ শুরু না হতো, তবে দিনের শেষাংশ হিসেবে সূর্যাস্তের আগে বলার পরিবর্তে সূর্যাস্তের পরের অংশের বিষয়টি গুরুত্ব পেতো।

‘ইলাল লাইল মানে ‘ইলাল গুরুবনয়। কারণ ‘গুরুব হচ্ছে সূর্যাস্তের শুরু থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত মাত্র কয়েক মিনিট সময় এবং এটি লাইল (রাত) নয়, বরং সূর্যাস্তের অব্যবহিত পরেই লাইল (রাত) শুরু হয়। আবার ‘ইলাল লাইল এর বদলে ইলাশ শাফাক্ব বলাও সঙ্গত হতো না, কারণ ‘শাফাক্ব সূর্যাস্তের পরে যেমন আছে, সূর্যোদয়ের আগেও তেমনি আছে। তাই ইলাল লাইল মানে পরম্পরাগত উপলব্ধি অনুসারে ‘সূর্যাস্তের অব্যবহিত পরের সময়’। যেমন ‘তুলুয়িশ শামসের বা সূর্যোদয়ের মাধ্যমে ফজরের সময়সীমা শেষ হয়ে ‘দুহা বা পূর্ণ সূর্য দীপ্তিকালের সময়সীমা শুরু হয়, যদিও তা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা না থাকায় স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয়নি।

ইলাল লাইল এবং ইলা গাছাক্বিল লাইল এর পার্থক্যের প্রেক্ষিতে, দিনের মধ্যে রাতের প্রবেশ এবং রাতের মধ্যে দিনের প্রবেশের প্রেক্ষিতে, মাতলায়িল ফজরের (ফজরের উদয়) মাধ্যমে রাতের সমাপ্তি ঘটে এবং “রাত থেকে দিনকে অপসারিত করার পর রাত সম্পূর্ণ অন্ধকারময় হয়ে যায়" তথ্যের প্রেক্ষিতে এটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, রাতের সূচনা ঘটে সূর্যাস্তের অব্যবহিত পরেই এবং সূর্যাস্ত পরবর্তী শাফাক্বের সময়টিতে দিনের আলো থাকলেও তা দিন হিসেবে নয়, বরং রাত হিসেবেই সাব্যস্ত হবে

 

ফালাম্মা আলাইহি জান্নাল লাইলু রআ কাওকাব [তারপর যখনি তার উপর রাত আচ্ছন্ন হলো তখনি সে একটি (উদিত) গ্রহকে দেখেছিলো] (৬:৭৬) এর ভিত্তিতে রাতের সূচনা নির্ণয়ের প্রসঙ্গ

(ক)১২:৪ অনুসারে, সূর্য ও চাঁদ কাওকাবের (গ্রহের) অন্তর্ভুক্ত নয়। আয়াতটিতে সৌরজগতের কেন্দ্রীয় জ্যোতিষ্ক সূর্য এবং পৃথিবীর উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তারক উপগ্রহ চন্দ্র ছাড়াও ১১টি গ্রহ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে।

(খ) নবী ইবরাহীমের উপর যখনি (লাম্মা) রাত আচ্ছাদিত হলো, তখনি তিনি কোনো বিশেষ উদিত গ্রহকে দেখেছিলেন। আকাশে ৫টি গ্রহকে দেখা যায়। বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি। এজন্য সূর্য (রবি) ও চন্দ্র (সোম) ছাড়াও সৌরজগতের এই ৫টি গ্রহকে বিবেচনায় নিয়ে সপ্তাহের সাত দিনের নামকরণ করা হয়েছিলো। এ গ্রহগুলোর মধ্যে শুক্রগ্রহই হচ্ছে সবচেয়ে উজ্জল গ্রহ। যদিও একমাত্র এ গ্রহটি তার সবচেয়ে উজ্জল অবস্থায় দিনের বেলায়ও কিছুটা দৃশ্যমান হয়, তবুও সাধারণত এটি সন্ধ্যার আকাশে সন্ধ্যাতারা হিসেবে এবং ভোরের আকাশে শুকতারা নামে দৃশ্যমান হয় এবং গ্রহটি মধ্যরাতের আকাশে দৃশ্যমান থাকে না।

(গ) যখন নবী ইবরাহীম একটি বিশেষ গ্রহকে দেখলেন তখন দিন নয়, রাত ছিলো। কিন্তু বিষয় শুধু এতটুকু নয়, বরং তিনি যখন গ্রহটিকে দেখেছেন তা হলো ‘ফালাম্মা আলাইহি জান্নাল লাইল (যখনি তার উপর রাত আচ্ছন্ন হলো), এ থেকে বুঝা যায় যে, তিনি গ্রহটিকে রাতের সূচনাকালে দেখেছেন। কারণ ‘লাম্মা শব্দটি একটি অবস্থা থেকে অন্য একটি অবস্থান্তরে যাওয়ার প্রথম দিককে বুঝায়।

(ঘ) সাধারণত সন্ধ্যা এবং রাতকে আলাদা শব্দে প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু রাত বললে সাধারণত সন্ধ্যার পরবর্তী সময় বুঝালেও সন্ধ্যা মূলত রাতের প্রথমাংশ। তাই সন্ধ্যাতারা রাতের আকাশের তারা হিসেবে সাব্যস্ত, দিনের আকাশের তারা হিসেবে নয়। অন্য কথায়, সন্ধ্যাকে বিস্তৃত করে বললে শব্দটি ‘সন্ধ্যাদিন’ নয়, বরং ‘সন্ধ্যারাত’ হয়। সুতরাং সন্ধ্যা রাতের অংশ এবং রাতের সূচনাকালে আকাশে সন্ধ্যাতারা দেখা যায়।

ফজর কি রাতের অংশ বলে সাব্যস্ত হবে না দিনের অংশ বলে সাব্যস্ত হবে?

যদিও ‘দুহা (পূর্ণ সূর্য দীপ্তিকাল) এর সাপেক্ষে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ‘দুহা বা ‘দিবাভাগ’ এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় হলো ‘লাইল বা ‘রাত’। কিন্তু সূর্যোদয় পূর্ববর্তী ‘শাফাক্ব (Twilight) এবং সূর্যাস্ত পরবর্তী ‘শাফাক্ব’ (Twilight) সরাসরি দিন (নাহার) বা রাত (লাইল) নয়, বরং তা হলো দিন-রাতের সংমিশ্রিত অংশ। এই সংমিশ্রিত অংশ থেকে সূর্যোদয় পূর্ববর্তী Twilight তথা ফজরকে দিনের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয় এবং সূর্যাস্ত পরবর্তী Twilight তথা আশিয়্যকে রাতের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। কারণ সূর্যোদয় পূর্ববর্তী Twilight হলো এমন সময় যখন রাত বিদায় নিচ্ছে এবং তাতে দিনের আলো এসে যাওয়ায় তা দিন হিসেবে সাব্যস্ত হয়। তেমনি সূর্যাস্ত পরবর্তী Twilight হলো এমন সময় যখন দিন বিদায় নিচ্ছে এবং তাতে রাতের আগমন ঘটায় তা রাত হিসেবে সাব্যস্ত হয়। এই প্রেক্ষিতে কুরআনে ফজর উদয় পর্যন্ত রাতের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং রাতের সাথে সম্পর্কিত বিধান ফজর উদয় পর্যন্ত কার্যকর হবে, ফজর থেকে দিনের সাথে সম্পর্কিত বিধানের কার্যকারিতা শুরু হবে।

যদি ফজর রাতের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হতো, তাহলে সিয়াম পালনকালেও ফজরে স্ত্রীসঙ্গ বৈধ হতো। কিন্তু বাস্তবতা হলো ফজর থেকে সিয়াম শুরু হয়ে যায়। সুতরাং ফজর দিনের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হবে, রাতের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হবে না (২:১৮৭, ৯৭:৫)।

অনেকে ‘তরাফায়িন নাহারি শব্দের অর্থ করেন ‘দিনের দুটি প্রান্ত/ প্রান্তভাগ’ এবং এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলেন তা হলো ‘দিন-রাতের দুটি সংমিশ্রিত অংশ’। এ প্রসঙ্গে বলা হয় যে, তরাফায়িন নাহারি দ্বারা দিনের কোন দুটি তরাফকে বুঝায় তা স্পষ্ট করার জন্য ‘ওয়া যুলাফাম মিনাল লাইল বা ‘রাতের মধ্য থেকে নিকটবর্তী সময়’ ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে ব্যবহৃত অব্যয় ‘ওয়া হচ্ছে ব্যাখ্যামূলক ‘ওয়া। অর্থাৎ সূর্যাস্তের পূর্বের ফজর হচ্ছে দিনের একটি তরাফ যা একই সাথে ‘যুলাফাম মিনাল লাইল এবং ‘সূর্যাস্তের পরবর্তী সময়টি যখন শাফাক্ব থাকে তা হচ্ছে দিনের অন্য একটি তরাফ যা একই সাথে ‘যুলাফাম মিনাল লাইল

কিন্তু উপরের দাবি বা যুক্তি যথাযথ বলে প্রতীয়মান হয় না। কারণ ‘দিন-রাতের সংমিশ্রিত অংশ’ বুঝালে শব্দটি হতো ‘তরাফায়িন নাহারি ওয়াল লাইলি। এককভাবে ‘তরাফায়িন নাহারি বলায় এ কথা সুস্পষ্ট যে, এই তরাফের সম্পর্ক শুধুমাত্র দিনের সাথে, এর সম্পর্ক কোনোভাবেই রাতের সাথে নয়। এছাড়া ‘যুলাফ শব্দটি হচ্ছে ‘যুলফাত শব্দের বহুবচন। তাই ‘দিন-রাতের সংমিশ্রিত অংশ’ বুঝালে ‘তরাফায়িন নাহারি এর সাথে সঙ্গতি রেখে প্রযোজ্য শব্দ হতো ‘ওয়া যুলফাতাইনি মিনাল লাইল। যেহতেু ‘ফজরের মাধ্যমে রাতের বিদায় ও দিনের সূচনা ঘটে, কিন্তু ফজরকে রাতের শেষ অংশ সাব্যস্ত না করে দিনের সূচনা বলে সাব্যস্ত করা হয়, তাই রাতের শেষদিকের অংশ (ছাহারআছহার) ফজরের মাধ্যমে শেষ হয় এবং তা ফজরের পূর্ববর্তী কাছাকাছি অংশ। সুতরাং যুলাফাম মিনাল লাইল শব্দের অর্থ যদিও ‘রাতের মধ্য থেকে (দিনের) নিকটবর্তী লগ্নসমূহ’। কিন্তু প্রায়োগিকভাবে এর দ্বারা বুঝানো হয় ‘দিন শেষে দিনের নিকটবর্তী রাতের মধ্যকার লগ্নসমূহ’। অর্থাৎ এক্ষেত্রে দিন শুরুর আগের তথা ফজরের আগের লগ্নসমূহ বিবেচ্য নয়। তাই যুলাফাম মিনাল লাইল প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র সূর্যাস্ত পরবর্তী রাতের প্রথম দিকের সময়সীমাকে বুঝায় যার পরিসীমা হচ্ছে ‘ইলাল লাইলে থেকে ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল বা রাতের অন্ধকারাচ্ছন্নতার প্রথম পর্যায় পর্যন্ত।

দিন ও রাতের মধ্য থেকে দিনের আগে রাত এবং রাতের আগে দিন থাকে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট বিষয়। একটি দিক থেকে দিনের আগে রাতের হিসাব অগ্রগণ্য, তা হচ্ছে মহাজাগতিক বাস্তবতা। সৃষ্টির আদি অবস্থা নাস্তিবাচক এবং পরবর্তী অবস্থা হচ্ছে যখন তাতে কোন আস্তিকে আনা হয়েছে সেই প্রেক্ষিতে আস্তিবাচক। এজন্য আলোর আগে অন্ধকার, দিনের আগে রাত, জীবনের আগে প্রাণহীনতা। অন্যদিকে মানবীয় সভ্যতায় মানবীয় সক্রিয়তার সূচনা, ক্রমবিকাশ ও সমাপ্তির প্রেক্ষিতে আগে দিনের হিসাব, পরে রাতের হিসাব। এজন্য প্রতিদিনের সালাতের ক্ষেত্রে দিনের দুই তরাফের সালাতের মধ্যে একটি হচ্ছে ‘আস সালাতিল উসতা। অন্য কথায় দিন-রাতের সকল সালাতের মধ্যে প্রথম সালাত হচ্ছে ‘সালাতিল ফজর এবং শেষ সালাত হচ্ছে ‘সালাতিল ইশা এবং উভয়ের মধ্যে রয়েছে ‘আস সালাতিল উসতা যা এমন সময় যে, তার পূর্বাপর অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে পার্থিব উপার্জনমূলক ব্যস্ততা রয়েছে (২৪:৫৮, ২:২৩৮, ৬২:৯)। সালাতিল ইশাসালাতিল ফজরের মধ্যবর্তীতে কোনো বাধ্যতামূলক সালাত না থাকার প্রেক্ষিতেও এটা স্পষ্ট যে, সালাতিল ফজর হচ্ছে প্রথম সালাত এবং সালাতিল ইশা হচ্ছে শেষ সালাত এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তীতে অবস্থিত সালাতটি হচ্ছে ‘আস সালাতিল উসতা। এছাড়া ৬৯:৬-৭ আয়াতে বর্ণিত ‘সাত রাত ও আট দিন’ সম্পর্কিত বিবরণ থেকেও স্পষ্ট যে, ‘দিন থেকে দিন’ মানে একাধিক ইয়াওম (রাত-দিনের যোগফলে হওয়া দিন) তথা দৈনিক তারিখের হিসাব দিন থেকে শুরু করাই স্বাভাবিক। এমতাবস্থায়, ‘যুলাফাম মিনাল লাইল এর প্রয়োগ ‘দিন শেষে দিনের নিকটবর্তী রাতের মধ্যকার লগ্নসমূহ’ অর্থে হওয়া স্বাভাবিক যুক্তিসম্মত বলে সাব্যস্ত হয়।

সুতরাং ফজর যদিও একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দিন-রাতের সংমিশ্রিত অংশ, তবু্ও তা রাতের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত না হয়ে দিনের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হবে। অনুরূপভাবে, ফজরের বিপরীতে থাকা সূর্যাস্ত পরবর্তী শাফাক্ব থাকাকালীন সন্ধ্যা বা আশিয়্য/আশিয়্যাত দিনের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত না হয়ে রাতের অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হবে। কারণ সেটাকে একদিকে ‘যুলাফাম মিনাল লাইলের অংশ (দিন শেষে দিনের নিকটবর্তী রাতের মধ্যকার লগ্নসমূহ) সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং অন্যদিকে ফজর যেমন এমন সময় যখন রাত দিনে প্রবেশ করেছে এবং তা দিনের অংশ বলে সাব্যস্ত হয়, আশিয়্যও তেমনি এমন সময় যখন দিন রাতে প্রবেশ করেছে এবং তা রাতের অংশ বলে সাব্যস্ত হয়।

দিন-রাতের বিভিন্ন সময়সীমার সারসংক্ষেপ

সুবহকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়, সুবহে কাজেব এবং সুবহে সাদেক। এর প্রথমটি পাখিদের জন্য সুবহ হিসেবে কাজ করে এবং দ্বিতীয়টি মানুষের জন্য প্রকৃত সুবহ হিসেবে সাব্যস্ত হয়। তাই সুবহ এবং ফজর হুবহু অভিন্ন নয়। সুবহের সূচনা ও মাতলায়িল ফজরকেও হুবহু একই বলা যায় না, বরং সুবহে সাদেকের সূচনা এবং মাতলায়িল ফজর হচ্ছে একই মুহূর্ত। সুবহ এবং ফজরের সময়সীমা যেমন এর সূচনার দিক থেকে ভিন্ন, তেমনি সমাপ্তির দিক থেকেও ভিন্ন। কারণ ইশরাক্বও সুবহের আওতাভুক্ত কিন্তু তা ফজরের সমাপ্তির নির্দেশক। কারণ, ফজর শব্দ দ্বারা মূলত ক্বাবলা তুলুয়িশ শামসির (সূর্যোদয়ের পূর্বের) সময়কে চিহ্নিত করা হয়।

ফজর নামক সময়কে গুরুত্ব দেয়ার জন্য ‘মাতলায়িল ফজর শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, বিশেষ করে ‘ফজর’ যে দিনের অংশ তা স্পষ্ট করার ক্ষেত্রে এটি খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখে। ফজর কখন শুরু হয় তা ২:১৮৭ আয়াতের মাধ্যমে সুস্পস্ট হয়েছে। যখন দিগন্তে রাতের কাল রেখা থেকে সাদা রেখা স্পষ্ট হয় তখন ফজর শুরু হয়। আর ‘মাতলায়িল ফজর বা ‘ফজর উদয়ের’ মাধ্যমে রাতের সমাপ্তি ঘটে (৯৭:৫)। সুতরাং ফজর দিনের অন্তর্ভুক্ত, তা রাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। এজন্য ‘সালাতুল ফজর দিনের প্রথম তরাফের সালাত হিসেবে সাব্যস্ত হয় (১১:১১৪)। ফজর হচ্ছে মূলত ‘ক্বাবলা তুলুয়িশ শামস বা ‘সূর্যোদয়ের পূর্ববর্তী সময়কাল’। অনুরূপভাবে আসীল তথা ‘সূর্যাস্তের পূর্ববর্তী সময়কাল’ হচ্ছে সালাত প্রসঙ্গে দিনকে যে দুই তরাফে বিভক্ত করা হয়েছে তার সাপেক্ষে দিনের দ্বিতীয় তরাফের অন্তর্ভুক্ত সময়কাল।

বুকরাত, ইবকার, সুবহ, সবাহ, এবং হীনা তুসবিহূনা যেমন সকালকে বুঝায় তথা একটি অন্যটির প্রতিশব্দ, কিন্তু যেখানে যে ধরনের অর্থসঙ্গতি অনুসারে যে প্রতিশব্দটি অধিক ব্যবহার উপযোগী সাব্যস্ত হয়েছে তা ব্যবহার করা হয়েছে। তেমনি হীনা তুরীহূনা এবং আশিয়্য হচ্ছে একটি অন্যটির প্রতিশব্দ। ইশা একটি ব্যাপকত্বসম্পন্ন সময় যার প্রথমদিকের অংশকে আশিয়্য বলা হয়।

৮৪:১৬-১৯ আয়াতে বলা হয়েছে, “ফালা উক্বছিমু বিশ শাফাক্বি, ওয়াল লাইলি ওয়া মা ওয়াছাক্বা, ওয়াল ক্বামারি ইযাত তাছাক্বা, লাতারকাবুন্না তবাক্বান আন ত্ববাকিন। এ আয়াতগুলোতে কিছু উদ্দেশ্যমুখী অবস্থান্তর প্রক্রিয়ার নিদর্শনের কসম করে মানুষ এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যাওয়ার নিশ্চয়তা প্রকাশ করা হয়েছে।

এখানে, শাফাক্ব শব্দটির অর্থ কী? শাফাক্ব কি রাতের অংশ না দিনের অংশ? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যেহেতু ৮:১৬-১৭ আয়াতে শাফাক্বকে লাইল থেকে আলাদাভাবে বলা হয়েছে তাই এটি শুধুমাত্র রাতের অংশ হতে পারে না।

২:১৮৭ আয়াতে বলা হয়েছে, “ছুম্মা আতিম্মুস সিয়ামা ইলাল লাইল। কিন্তু ৮৪:১৬-১৭ আয়াতে শাফাক্বলাইল আলাদাভাবে বলায় লাইল শব্দটি কোনো না কোনো মাত্রায় শাফাক্ব এর চেয়ে ভিন্নতা রক্ষা করে। তাই লাইলের শুরু এর অপর নাম শাফাক্বের শুরু এভাবে বলা যেতে পারে না। তবে যদি বলা হয়, রাতের শাফাক্বের শুরু ও লাইলের শুরু অভিন্ন, তাহলে ঠিক আছে। অর্থাৎ শাফাক্বকে দুইদিকেই হিসাব করতে হবে, দিনের শাফাক্ব এবং রাতের শাফাক্ব। দিনের শাফাক্ব হচ্ছে ফজর। রাতের শাফাক্ব হচ্ছে আশিয়্য

সুতরাং শাফাক্ব (দিগন্তের রক্তিমাভা) শব্দটি সাধারণত সন্ধ্যার জন্য ব্যবহার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ফজর এবং আশিয়্য উভয়টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একে ইংরেজিতে Twilight বলা হয়। বিজ্ঞানসম্মত তথ্য অনুসারে, এটি হলো সূর্যোদয়ের পূর্ববর্তী ১৮ ডিগ্রী তথা ৭২ মিনিট এবং সূর্যাস্তের পরবর্তী ১৮ ডিগ্রী তথা ৭২ মিনিট পর্যন্ত সময়কাল।

প্রশ্ন হতে পারে যে, শাফাক্ব শব্দটির অর্থ অভিধানে বা অনুবাদগ্রন্থগুলোতে ‘সন্ধ্যাকালীন রক্তিমাভা’’ করা হয়েছে। তাই এটিকে সূর্যোদয়ের পূর্ববর্তী ও সূর্যাস্তের পরবর্তী উভয় সময়সমীমা হিসেবে সাব্যস্ত করা সঠিক হবে কিনা? এর জবাব হচ্ছে অভিধানে বা অনুবাদগ্রন্থগুলোতে একে ‘সন্ধ্যাকালীন রক্তিমাভা’ অর্থ করার কারণ প্রচলিত মৌখিক ভাষারীতি। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং বিজ্ঞানসম্মত সংজ্ঞা তথা বাস্তবতার প্রেক্ষিতে Twilight সূর্যোদয়ের আগে ও সূর্যাস্তের পরে উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং কুরআনে শব্দটি যেভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে তাতে এই বিজ্ঞানসম্মত সংজ্ঞাই সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

সন্ধ্যার শাফাক্বের পরে আসা গাছাক্বিল লাইল থেকে রাত শুরু হতে পারে না। কারণ সেক্ষেত্রে ‘ইলাল লাইল’ এবং ‘ইলা গাছাক্বিল লাইল’ এর পার্থক্য নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। অথচ কুরআনে এ দুটি শব্দ আলাদাভাবে উল্লেখের বাস্তবসম্মত তাৎপর্য রয়েছে। এ দুটি বিষয় আলাদা না হলে, রাতের মধ্যে দিনের প্রবেশ এবং রাত দিনকে ঢেকে দেয়া এবং রাত থেকে দিনকে অপসারিত করা এবং এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাত অন্ধকারময় হওয়ার তথ্য অর্থবহ হয় না। সিয়াম পূর্ণ করতে হবে ইলাল লাইল পর্যন্ত এবং দিনের শেষ তরাফের সালাতও স্বত:সিদ্ধভাবে ইলাল লাইল পর্যন্ত। আর সালাতিল ইশা হচ্ছে ইলা গাছাক্বিল লাইল বা রাতের গাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্নতার প্রথম পর্যায় পর্যন্ত। এছাড়া যদি ইলাল লাইল এবং ইলা গাছাক্বিল লাইল একই বিষয় হয় তাহলে ‘সালাতিল ইশা’ হয় ‘ইলাল লাইল পর্যন্ত তথা রাতের সময় শুরু হলে সালাতিল ইশার সময় শেষ হয়ে যায় বা ইশার সালাত হয়ে পড়ে দিনের সময়ের ভিতরে, তা রাতের মধ্যকার সালাত হয় না, আর তাই তা জুলাফাম মিনাল লাইলের সালাতও হয় না। এমতাবস্থায় আয়াতসমূহের বক্তব্য অসংলগ্ন প্রতিপন্ন হয়, যা অসম্ভব। সুতরাং অবশ্যই ইলাল লাইল এবং ইলা গাছাক্বিল লাইল দুটি স্বতন্ত্র বিষয় এবং ইলাল লাইল থেকে লাইল বা রাত শুরু হয় এবং ইলা গাছাক্বিল লাইল বলতে রাতের গাঢ় অন্ধকারের প্রথম পর্যায়কে বুঝায়।

সন্ধ্যা থেকেই রাত শুরু হওয়া সত্ত্বেও সাধারণত সন্ধ্যার পরবর্তী অংশকে রাত বলার রীতি প্রচলিত। অনুরূপভাবে সন্ধ্যা থেকেই ইশা শুরু হলেও সাধারণত সন্ধ্যার অব্যবহিত পরের অংশকে ইশা বলার রীতি প্রচলিত রয়েছে। রাতের প্রথম অংশকে যেমন সন্ধ্যারাত বলা হয়, অনুরূপভাবে ইশার প্রথম অংশকে স্বতন্ত্র শব্দ ‘আশিয়্য’ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। তাই ইশার সালাত সাধারণত সন্ধ্যার সাথে সাথে করার চেয়ে ইলা গাছাক্বিল লাইলে করা হয়। ইশার সালাতের পরে ব্যক্তিগত কক্ষে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাচ্চাদেরকেও অনুমতি নিতে হবে (২৪:৫৮)। এর মাধ্যমে বুঝা যায় যে, সালাতিল ইশার পর বিশ্রাম নেয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। আবার এরপর অনুমতি নিয়ে যাতায়াতের প্রসঙ্গ থেকে বুঝা যায় যে, সালাতিল ইশার পর সাথে সাথেই পূর্ণ বিশ্রামের সময় হয়ে যায় তাও নয়। আবার আনুষ্ঠানিক সালাতের পর বাস্তব সালাতের তথা আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণমূলক বিভিন্ন বাস্তব কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও একটা সময়গত পরিসর থাকা স্বাভাবিক, সে হিসেবে সালাতিল ইশা সন্ধ্যার সাথে সাথে করে নেয়াও অনুমোদিত, যেহেতু তাও ইশার অন্তর্ভুক্ত সময়।

ইশরাক্ব, গাদাত, গুদুব্ব, রওয়াহ, হীনা তাছরাহূনা হচ্ছে সূর্যোদয় অব্যবহিত পরের সময় এবং আসীলহীনা তুমছূনা হচ্ছে সূর্যাস্তের অব্যবহিত পূর্বের সময়।

তুলুয়িশ শামস (সুর্যোদয়), দুলুকিশ শামস (সূর্য ঢলে পড়া), গুরুবিশ শামস / গুরুব (সুর্যাস্ত) কোন সময়কাল (পিরিয়ড) নয়, বরং এগুলো হলো মুহুর্ত, যা মাসদার বা ক্রিয়াবিশেষ্য এর অর্থ ধারণ করে। ‘গুরুবিহা এবং ‘গুরুব দুটি শব্দের যেখানে ‘গুরুব আছে সেখানেও মূলত ‘গুরুবিহা বুঝানো হয়েছে। সংক্ষেপনের জন্য ‘গুরুব ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর সম্প্রসারিত রূপ বুঝার জন্য অন্যত্র ‘গুরুবিহা ব্যবহৃত হয়েছে। এটা আল কুরআনের একটি প্রয়োগরীতি। ইলা গাছাক্বিল লাইল শব্দগুচ্ছে ‘গাছাক্বিল লাইল’ শব্দের আগে ‘ইলা থাকায় এর দ্বারা গাঢ় অন্ধকারের পূর্ণ পর্যায়কে না বুঝিয়ে এর প্রথম পর্যায়কে বুঝায়।

>>  পরবর্তী পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য ক্লিক করুন