বিধিবদ্ধ সিয়াম পালনের মূল সময়গত অবস্থান হলো ‘শাহরু রমাদান’ বা রমাদানের মাস। তাই বিধিবদ্ধ সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে রমাদানের মাস নির্ণয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রমাদানের মাস নির্ণয়ের বিষয়ে আমরা তিন দফায় অগ্রসর হবো: (ক) চান্দ্র মাস নির্ণয়ের পদ্ধতি (খ) হারাম মাসসমূহের অবস্থান নির্ণয় এবং (গ) রমাদানের মাস চিহ্নিতকরণের উপায়।
সিয়াম বিধিবদ্ধ করা হয়েছে “শাহরু রমাদানে’ বা ‘রমাদানের মাসে’। শাহর শব্দটি দ্বরা মূলত চান্দ্রমাসকে বুঝানো হয়। তাই শাহরু রমাদান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রথমত চান্দ্র মাস নির্ণয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডার হিসাব করার ক্ষেত্রে তিন ধরনের হিসাব পদ্ধতি রয়েছে। চান্দ্রবর্ষ ক্যালেন্ডার (Lunar Calendar), সৌরবর্ষ ক্যালেন্ডার (Solar Calendar) এবং চান্দ্র-সৌরবর্ষ ক্যালেন্ডার (Lunisolar Calendar)। এর মধ্যে চান্দ্রবর্ষ ক্যালেন্ডার এবং সৌরবর্ষ ক্যালেন্ডার হচ্ছে দুটি মূল ক্যালেন্ডার। অন্যদিকে লুনি-সোলার বা চান্দ্র-সৌরবর্ষ ক্যালেন্ডার হচ্ছে চান্দ্রবর্ষ ক্যালেন্ডার এবং সৌরবর্ষ ক্যালেন্ডারের এক ধরনের সমন্বয়ের মাধ্যমে তৈরিকৃত ক্যালেন্ডার যেখানে ঋতু ও মাসের অবস্থান প্রতিবছর একইথাকে।
চান্দ্র মাসের গণনা শুরু ও শেষ হবে এভাবে যে, পর্যেবক্ষণ ও হিসাব মোতাবেক যে তারিখে কোনো মাসের প্রথম হিলাল দেখা যাওয়া নিশ্চিত, কোনো কারণে দেখতে অসুবিধা হলেও, ঐ তারিখকে মাসের প্রথম তারিখ ধরতে হবে। এজন্য হিলাল (মাসের প্রথম সরু চাঁদ ও শেষ সরু চাঁদ) চোখে দেখা ও হিসাব করা প্রয়োজন। হিলালের আকৃতি হলো কাল উরজূনিল ক্বাদীম বা `খেজুর গাছের একটি পুরনো ডালের মতো’ (৩৬:৩৯)। একটি মাসে দুটি পক্ষ থাকে, শুক্ল পক্ষ ও কৃষ্ণ পক্ষ। শুক্ল পক্ষের শেষ দিন চাঁদ পূর্ণরূপ ধারণ করে তথা পূর্ণিমা হয় (৮৪:১৮)। বিপরীতক্রমে কৃষ্ণপক্ষের শেষদিন অমাবস্যা থাকে। অমাবস্যার আগে মাসের শেষ হিলাল সম্পর্কেই বলা হয়েছে যে, চাঁদ তার মনজিল অতিক্রম করে `খেজুর গাছের একটি পুরনো ডালের ন্যায়’ দৃশ্যমান রূপে ফিরে যায়। ৩৬:৩৯ আয়াতে বলা হয়েছে, ওয়াল ক্বামারা ক্বাদ্দারনাহু মানাযিলা, হাত্তা আদা কাল উরজূনিল ক্বাদীম। এখানে প্রথম চন্দ্রকলা বুঝার জন্য “আদা” শব্দটি লক্ষ্যণীয়। আদা মানে “পুনরায় ফিরে যাওয়া”। অর্থাৎ এ অবস্থা প্রথমেও ছিল, পরে আবার হলো। এ থেকে বুঝা যায় মাসের শুরু হিলাল বা নতুন চাঁদ থেকে। আদা শব্দের ব্যবহার বুঝার জন্য ১৭:৮ আয়াত দেখা যেতে পারে, যেখানে বলা হয়েছে, ওয়া ইন উত্তুম, উদনা। অর্থাৎ “যদি তোমরা (ফাসাদের) পুনরাবৃত্তি করো, তবে আমিও (শাস্তির) পুনরাবৃত্তি করবো”।
সুতরাং চান্দ্রমাস হলো সরু চাঁদ থেকে পূর্ণিমা এবং তারপর সরু চাঁদে ফিরে যাবার চন্দ্রচক্র (Lunar month = The crescent to full and back to crescent moon cycle)।
চাঁদের বিভিন্ন অবস্থা
যে তারিখে প্রথম হিলাল দেখা যাবে সেটাই হচ্ছে নতুন মাসের প্রথম তারিখ। যতদিন নিশ্চিত হিসাব পদ্ধতি অবলম্বন সম্ভব ছিল না ততদিন কোনো মাসের শেষ সরুতম চাঁদটি চোখে দেখা গেলে ও তার পরদিন কোন হিলাল দেখা না গেলে, অর্থাৎ আমাবশ্যার পর পরবর্তী মাসের প্রথম হিলালের তারিখ সম্পর্কে অগ্রিম ধারণা পাওয়া যেত। আর সাধারণত কোনো মাসের প্রথম হিলাল চোখে দেখা যাওয়ার পর মাসটি শুরু হওয়ার এবং পরের মাসের প্রথম হিলাল দেখা যাওয়ার পর চলতি মাস শেষ হওয়ার সাক্ষ্য দেয়া যেতো। কিন্তু এখন বিজ্ঞানভিত্তিক হিসাবের মাধ্যমে এ সাক্ষ্য দেয়া যায়, চোখে দেখা জরুরি নয়। সুতরাং আধুনিক হিসাব অনুসারে চান্দ্রমাসের পরিসর হচ্ছে new moon to new moon তথা যে তারিখে new moon phase উদিত হবে সেটাই হচ্ছে মাসের প্রথম তারিখ।
সিয়ামের জন্য রমাদান মাসের সাক্ষ্য দেয়ার ভিত্তিতে দায়িত্ব অর্পিত হয় (২:১৮৫)। হজ্জের ক্ষেত্রেও আহিল্লাহকে (হিলালসমূহকে / চোখে দেখা যাওয়ার মতো সরু চাঁদসমূহকে) মাওয়াক্বীত (মীক্বাতসমূহ / সময় নির্ণায়ক উপাদান) হিসাবে অবলম্বন করতে হয়। বিজ্ঞানভিত্তিক হিসাবের ক্ষেত্রেও আহিল্লাহকেই মাওয়াক্বীত হিসেবে অবলম্বন করতে হয় (২:১৮৯, ৩৬:৩৯)।
আহিল্লাহ শব্দটি হচ্ছে হিলাল শব্দের বহুবচন। হিলাল শব্দটির শব্দমূল হচ্ছে ‘হা লাম লাম’। আল কুরআনে এ শব্দমূল থেকে গঠিত দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। একটি হলো আহিল্লাহ (২:১৮৯:৩), অন্যটি হলো উহিল্লা (২:১৭৩:৯, ৫:৩:৮, ৬:১৪৫:২৬, ১৬:১১৫:৯)। উহিল্লা শব্দের অর্থ: ‘উৎসর্গের ঘোষণা দেয়া’। সুতরাং আহিল্লাহ শব্দটির সাথেও উৎসর্গের ঘোষণার সাথে সম্পর্ক রয়েছে। আহিল্লাহ সম্পর্কে বলা হয়েছে এটিকে মানবজাতির জন্য (মাস চিহ্নিতকরণের সাধারণ সুবিধার জন্য) এবং হজ্জের জন্য সময় নির্ধারণের উপায় বানানো হয়েছে। অর্থাৎ হজ্জের মাসসমূহকে চিহ্নিত করার হিলালসমূহকে হজ্জের ঘোষণার সাথে সম্পর্কিত করা হয়। এছাড়া হারাম মাসসমূহকে চিহ্নিত করার হিলাল সম্পর্কেও ঘোষণার বিষয় রয়েছে, যাতে সবাই হারাম মাসসমূহ সম্পর্কে পরিজ্ঞাত থাকতে পারে। যেহেতু হারাম মাসসমূহ এবং হজ্জের মাসসমূহ আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গের প্রতীকবহ, তাই এর সাথে উৎসর্গেরও সম্পর্ক রয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, উৎসর্গের ঘোষণার সাথে সম্পর্কিত মাসের হিসাব শুরু ও শেষ করার সরু চাঁদের প্রেক্ষিতে সরু চাঁদকে (Crescent moon) হিলাল শব্দ দ্বারা নামকরণ করা হয়েছে।
চন্দ্রের মনজিলের মাধ্যমে তথা হিলাল থেকে হিলাল এর এক চক্রের মাধ্যমে কোনো চান্দ্রমাস শেষ হয়ে অন্য চান্দ্রমাস শুরু হওয়ার বিষয়টির লক্ষণ সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় তথা মাশহূর হয় বিধায় চান্দ্রমাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘শাহর’। যেহেতু চান্দ্র মাস ২৯ বা ৩০ দিনে হয় এবং এ দুটি সংখ্যার মধ্যে ৩০ একটি রাউন্ড ফিগার এবং গড় হিসাব করলে ২৯ দিনের বেশি হওয়ায় প্রায় ৩০ দিন বলতে হয়, তাই যখন সাধারণভাবে মাস বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে তখন ৩০ দিন বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ মাসের মূল হিসাবটি কিন্তু কোন ভিত্তি ছাড়া ৩০ দিনে একমাস এ হিসাব নয়, বরং চান্দ্রমাসের হিসাবের ভিত্তির উপরই এ হিসাব প্রতিষ্ঠিত। শাহর শব্দটি দ্বারা সাধারণভাবে ৩০ দিনের এক মাস বুঝায় এবং চান্দ্রবর্ষের এক মাস বা চান্দ্রমাস বুঝায়। আল কুরআনে ২৯ বা ৩০ দিনের চান্দ্রমাস (প্রাকৃতিক পঞ্জিকা মাস) এবং যে কোনো একটি দিন থেকে শুরু করে ৩০ দিনে ১ মাস হিসাবে হিসাবকৃত মাস উভয় ক্ষেত্রে ‘শাহর’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
২:১৮৪ আয়াতে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি সিয়াম পালনে অতিকষ্টে সক্ষম সে সিয়াম পালন না করলে একজন করে মিসকীনকে খাওয়াতে হবে। ৫৮:৪ আয়াতে যিহারের(৪) কাফফারা হিসেবে বলা হয়েছে, “ফামাল লাম ইয়াজিদ ফাসিয়ামু শাহরায়নি মুতাতাবিয়ায়নি মিন ক্বাবলি আইঁ ইয়াতামাচ্ছা। ফামাল লাম ইয়াছতাত্বি’ ফাইতয়ামু ছিত্তীনা মিসকীনান,” অর্থাৎ “যে (দাসমুক্তির) সামর্থ্য পায় না সে সিয়াম পালন করবে ধারবাহিকভাবে দুই মাস, (স্বামী-স্ত্রী) একে অপরকে স্পর্শ করার আগে। আর যে তাতেও অসমর্থ সে ষাটজন মিসকীনকে খাওয়াবে”। এখানে দেখা যাচ্ছে দুই মাসের সিয়ামের পরিবর্তে ষাটজন মিসকীনকে খাওয়ানোর কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ২ মাস = ৬০ দিন বা ১ মাস = ৩০ দিন হিসেবে প্রতি সওমের বদলে একজন মিসকীন খাওয়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ সিয়াম ও মিসকীনের এ সংখ্যাসাম্যের প্রসংগটি উল্লেখ করে ইহরাম অবস্থায় স্থলভাগের শিকার বধ করার কাফফারা হিসেবে বলা হয়েছে, “...আও কাফফারাতুন তয়ামু মাসাকীনা আও আদলু যালিকা সিয়ামান” (৫:৯৫)। অর্থাৎ জরিমানা (জাযা) হিসেবে বধকৃত পশুর অনুরূপ গবাদি পশু কা’বায় পৌঁছাতে না পারলে কাফফারা হিসেবে সেটার সমমূল্যে যতজন মিসকীনকে মধ্যমমানে খাওয়ানো যেতে পারে ততজনকে খাওয়াতে হবে অথবা ততসংখ্যক সিয়াম পালন করতে হবে। সুতরাং ৫৮:৪ আয়াতে বর্ণিত দুই মাসের সিয়ামের বদলে ষাট জন মিসকীনকে খাওয়ানো বলতে প্রতি সওমের পরিবর্তে একজন মিসকীন খাওয়ানো বুঝায় এবং ১ মাস = ৩০ দিন বুঝায়।
(৪) যিহার বলতে বুঝায় স্ত্রী কে মা হিসাবে প্রকাশ করা বা মায়ের মত বলা। এটি কুরআন নাযিলের সমসাময়িক কালে তালাক দানের একটি কুপ্রথা ছিল।
এক্ষেত্রে প্রসঙ্গক্রমে ৫:৮৯ আয়াতে বর্ণিত তথ্য সিয়ামসংখ্যা ও মিসকীন সংখ্যার মধ্যে সমতার প্রশ্নে সরল সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগকে রহিত করে কিনা সেটাও বিবেচ্য। ৫:৮৯ আয়াতে দৃঢ় বন্ধনযুক্ত শপথ ভঙ্গ করার কাফফারা হিসেবে তিনটি বিকল্প দেয়া হয়েছে (১) দশজন মিসকীনকে মধ্যম মানের খাদ্য খাওয়ানো বা তাদেরকে পরিধেয় বস্ত্র দেয়া (২) অথবা একজন দাস মুক্ত করা (৩) তা না পারলে তিন দিন সিয়াম পালন করা। শেষে আবার এ কথার উপর জোর দেয়া হয়েছে যে, এটা শপথ দৃঢ় শপথ ভঙ্গের কাফফারা। এ আয়াতে দেখা যায় যে, দশজন মিসকীনকে খাদ্য খাওয়ানোর পরিবর্তে তিন দিন সিয়াম পালন করা। এটি একটি সিয়ামের পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাওয়ানো বা ধারাবাহিক দুইমাস সিয়ামের পরিবর্তে ষাটজন মিসকীনকে খাদ্য খাওয়ানো বা মিসকীন সংখ্যা ও সিয়াম সংখ্যার সমতার সাথে সঙ্গতিশীল নয়। তাই ষাটজন মিসকীনের বিপরীতে দুই মাস বলতে ষাট দিন বুঝার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য কিনা সে প্রশ্নটি আসে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, ৫:৮৯ আয়াতে প্রথমে তিন দিন সিয়ামের কথা বলে তা না পারলে দশজন মিসকীনকে খাওয়ানোর কথা বলা হয়নি। বরং প্রথমেই দশজন মিসকীনকে খাওয়ানোর প্রসঙ্গ এসেছে, তারপর দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে এসেছে কোনো দাসকে মুক্ত করে দেয়া এবং তা সম্ভব না হলে তিন দিনি সিয়াম পালন করার কথা বলা হয়েছে এবং এটিকে আদল বা ‘মিসকীন সংখ্যার সম সংখ্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি, যা ৫:৯৫ আয়াতে চিহ্নিত করা হয়েছে। আবার এক্ষেত্রে আগে সিয়াম পালনের সময়সীমা চিহ্নিত করে পরে তা না পারলে মিসকীন খাওয়ানোর কথাও বলা হয়নি, যা ২:১৮৪ আয়াত ও ৫৮:৪ আয়াতে বলা হয়েছে। সুতরাং এতে দৃঢ় শপথ ভঙ্গের কাফফারার বিধানস্বরূপ যে বিকল্প দেয়া হয়েছে তাতে সংখ্যাগত সমতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি, বরং সাধারণভাবে কিছু বিকল্প দেয়া হয়েছে যার যে কোনোটি অবলম্বন করা যেতে পারে। অন্যদিকে ২:১৮৪, ৫:৯৫ ও ৫৮:৪ আয়াতে সংখ্যাগত সমতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অন্যকথায়, যখন সংখ্যাগত সমতাকে গুরুত্ব দেয়া হয় বা যখন কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমায় সিয়ামের বিধানকে প্রাথমিক গুরুত্ব দিয়ে তা না পারলে মিসকীনকে খাওয়ানোর বিকল্প দেয়া হয়, তখন তাতে উল্লেখিত মিসকীন সংখ্যা দ্বারা ঐ সময়সীমাতে থাকা দিনসংখ্যা নির্ণয় করা যায়।
৯:৩৬ আয়াত অনুযায়ী একটি সৌরবর্ষে ১২টি পূর্ণ চন্দ্র চক্র বা ১২টি চান্দ্রমাস রয়েছে। আর সাধারণভাবে চান্দ্রমাস হয়ে থাকে ২৯ বা ৩০ দিনে। ৫৮:৪ আয়াত অনুযায়ী দুটি শাহর বা ‘মাসের’ (যা চান্দ্রমাস নয়, বরং যে কোনো একটি দিন থেকে শুরু করে একটি মাস পূর্ণ করার অর্থ বুঝায়) সিয়ামের পরিবর্তে ৬০ জন মিসকীনকে খাওয়ানো যেতে পারে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে শাহর মানে ‘যে কোনো একটি দিন থেকে শুরু করে ধারাবাহিক ত্রিশ দিনের সমষ্টি’। অর্থাৎ আল কুরআনে যখন ক্যালেন্ডার মাস না বুঝিয়ে সাধারণভাবে মাস বুঝানোর জন্য শাহর শব্দ ব্যবহৃত হয়, তখন শাহর বা মাস বলতে ৩০ দিনকে বুঝায়। যেসব আয়াতে শাহর বা তার বহুবচন আশহার ব্যবহৃত হয়েছে সাধারণভাবে মাস (৩০ দিনের যোগফল) বুঝাতে সেগুলো হলো : ২:২২৬, ২:২৩৪, ৪:৯২, ৩৪:১২, ৪৬:১৫, ৫৮:৪, ৬৫:৪, ৯৭:৩।
পক্ষান্তরে আল কুরআনে চান্দ্রবর্ষের ন্যাচারাল ক্যালেন্ডার মাস (চন্দ্রের তিথি হিসেবে ২৯ বা ৩০ দিন এবং “যে কোনো দিন থেকে মাস শুরু নয়, বরং হিলাল থেকে মাস শুরু”- এই পদ্ধতি হিসেবে) বুঝাতেও শাহর শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ সম্পর্কিত শাহর বা তার বহুবচন আশহার এবং শুহুর (বছরের/ গণনাচক্রের সকল মাসকে একসাথে বুঝানোর জন্য) শব্দ ধারণকারী আয়াতগুলো হলো : ২:১৮৫, ২:১৯৪, ২:১৯৭, ২:২১৭, ৫:২, ৫:৯৭, ৯:২, ৯:৫, ৯:৩৬।
দিন রাতের হিসাব নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে সূর্য তথা সূর্যের উদয়-অস্ত বা পৃথিবীর আহ্নিক গতি (দ্র : ৯১:১-৪)। মাসের দিনসংখ্যা নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে চন্দ্র তথা মনজিলসমূহ/ তিথিসমূহ। চান্দ্রমাসের শুরু শেষ নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে হিলাল থেকে হিলাল এর চক্র (২:১৮৯, ৩৬:৩৯)। চান্দ্রবর্ষে ৬ মাস ৩০ দিন ও ৬ মাস ২৯ দিন হয়। যে কোনো মাস ৩০ দিনে বা ২৯ দিনে হতে পারে। বিভিন্ন বছর একই ক্যালেণ্ডার মাস বিভিন্ন দিনসংখ্যায় হতে পারে। যেমন কোনো বছর রমাদান মাস ২৯ দিনে এবং কোন বছর ৩০ দিনে হতে পারে। আবার ধারাবাহিকভাবে একাধিক বছর রমাদান মাস ২৯ দিনে (বা ৩০ দিনে) হতে পারে। এক্ষেত্রে হিলালের উদয়ই হচ্ছে দিনসংখ্যা নির্ণয়ের উপায়।
একটি সৌরবর্ষের পরিসর নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে পৃথিবীর বার্ষিক গতি (দ্র : ১০:৫, ১৭:১২)। পৃথিবীর বার্ষিক গতি অনুসারে ৩৬৫ দিনে ১টি সৌরবর্ষ হয়। ১৭:১২ আয়াত অনুযায়ী একটি দিন থেকে ঐ দিনের পুনরাবৃত্তি পর্যন্ত (যেমন Spring Equinox থেকে পরবর্তী Spring Equinox পর্যন্ত) একটি সৌরবর্ষ। আবার একটি সৌরবর্ষে ১২ টি চান্দ্রমাস অতিবাহিত হয় বিধায় প্রাকৃতিকভাবে ১২ মাসে ১ বছরের হিসাব প্রতিষ্ঠিত। এই প্রাকৃতিক প্রেক্ষিতে আল কুরআন অনুসারে ১২টি চান্দ্রমাস (শাহর) নিয়ে একটি গণনাচক্র/ ইদ্দাত তথা একটি চান্দ্রবর্ষ। ১ টি বর্ষে ১২ টি চান্দ্রমাস হিসেবে মাসের গণনার বিধান সৃষ্টির প্রথম থেকে বিধিবদ্ধ (৯:৩৬)।
চান্দ্রমাসের হিসাবে যেমন কোনো মাস ৩০ দিন এবং কোনো মাস ২৯ দিন অনুরূপভাবে চান্দ্রমাস হিসাবের দিনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে সৌরমাস হিসাবের ক্ষেত্রেও প্রথমত ৩০ দিনে ১ মাস ধরা হয় এবং সেক্ষেত্রে সৌরবর্ষের জন্য আরো ৫ দিনের প্রয়োজন হয় বিধায় কিছু মাসকে ৩১ দিনে হিসাব করা হয়। কারণ পৃথিবীর বার্ষিক গতি অনুসারে ৩৬৫ দিনে ১টি সৌরবর্ষ হয়। এভাবে কোনো সৌরমাস ৩০ ও কোনো সৌরমাস ৩১ দিনে হিসাব করার ভিত্তিতে বছরের নির্দিষ্ট তারিখে দিন রাত সমান হওয়ার হিসাবও নির্ধারণ করা সহজ হয়। Year is related to earth since the earth revolves around the sun in a year.
১ বছরের মাসসংখ্যা নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে পৃথিবীর বার্ষিক গতি অনুসারে ১ টি সৌরবর্ষে অতিবাহিত পূর্ণ চান্দ্রমাসের সংখ্যা। অর্থাৎ সৌরবর্ষের হিসাবের ক্ষেত্রেও ৩০ দিনে ১ মাস এবং ১২ মাসে ১ বছর নির্ধারণের বিষয়টি মূলত চান্দ্রমাস ও চান্দ্রবর্ষের হিসাব পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে গৃহীত হয়েছে।
চান্দ্রবর্ষ (চন্দ্রমাসসমূহের গণনাচক্রে/ ১২ মাসের যোগফলে) ৩৫৪ দিন, পক্ষান্তরে সৌরবর্ষ (পৃথিবীর বার্ষিক গতি) ৩৬৫ দিন। অর্থাৎ একটি সৌরবর্ষের তুলনায় একটি চান্দ্রবর্ষে ১১ দিন কম থাকে। এই প্রেক্ষিতে ১৮:২৫-২৬ আয়াত অনুযায়ী চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষের হিসাব পদ্ধতির বাস্তবতা বিবৃত হয়েছে যে, তিনশ সৌরবর্ষ হচ্ছে তিনশ নয় চান্দ্রবর্ষের প্রায় সমানুপাতিক। সৌরবর্ষকে আরবিতে ‘সানাতুন’ এবং চান্দ্রবর্ষকে ও চান্দ্রসৌরবর্ষকে (যাতে চন্দ্রচক্রকে মাস হিসেব করা হয়) আরবিতে ‘আমুন’ বলা হয়। আল কুরআন অনুযায়ী, সৌরবর্ষ ও চান্দ্রবর্ষ বা চান্দ্রসৌরবর্ষ উভয়ের হিসাব প্রাকৃতিক নিয়মবদ্ধ এবং আল কুরআন অনুসারে, এটা আল্লাহর নির্ধারিত প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা। সুতরাং উভয় হিসাব অবশ্যই গ্রহণযোগ্য (দ্র: ৫৫:৫)।
মাসের হিসাব নির্ণয়ের ভিত্তি হিসেবে নতুন চাঁদ থেকে নতুন চাঁদের সময়সীমাকে (duration of moon cycle) গ্রহণ করা হয়েছে বিধায় ইংরেজিতে মাসকে month বলা হয় (Month & Moon are cognate)। একটি বর্ষে চারটি ঋতু থাকে। ঋতুগুলো হলো বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত। প্রতিটি ঋতু তিনটি চান্দ্রমাসের প্রায় সমান দৈর্ঘ্যের হয়ে থাকে। এভাবে চারটি ঋতুর মোট সময়কাল তথা একটি বর্ষের মাসসংখ্যা হলো ১২। সুতরাং চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষ উভয়টিতে ১২ মাসে এক বছর হিসেব করতে হয়, এটাই প্রাকৃতিক পদ্ধতি।
৬:৯৬, ১০:৫, ১৭:১২, ১২:৪৭-৪৯, ২০:৫৯, ১০৬:১-৪ আয়াত থেকে চান্দ্রবর্ষ ক্যালেন্ডার ও সৌরবর্ষ ক্যালেন্ডার উভয়টির ব্যবহারিক উপযোগিতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
সৌরবর্ষ পৃথিবীর বার্ষিক গতির সাপেক্ষে হিসাবকৃত বিধায় প্রতি বছর একই সৌরমাস একই ঋতুতে পড়ে। অন্যদিকে একটি চান্দ্রবর্ষ একটি সৌরবর্ষের চেয়ে ১১ দিন কম বিধায় একই চান্দ্রমাসের (যেমন রবিউল আউয়াল মাসের) আবর্তন বিভিন্ন বছর সৌরবর্ষের বিভিন্ন ঋতুতে হতে থাকে। অর্থাৎ চান্দ্রবর্ষে একই মাস একই ঋতুতে আসে না, বরং এর আবর্তন ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে হতে থাকে। মানুষের নির্বাহী সিদ্ধান্তনির্ভর কর্মকান্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে সৌরবর্ষের হিসাবের কিছু সুবিধা দেখা যায়, যাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ঋতু অনুসারে পূর্বসিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়। তাই চান্দ্রমাসকে একই ঋতুতে পাওয়ার জন্য চান্দ্র-সৌরবর্ষ ক্যালেন্ডার (Lunisolar Year Calendar) এর উদ্ভব ঘটে। চান্দ্রসৌরবর্ষে (Lunisolar Year Calendar) প্রতি তৃতীয় বর্ষে একটি চান্দ্রমাস যোগ করা হয়, এই মাসকে intercalary month / leap month বলা হয় (লুনিসোলার হিব্রু ক্যালেন্ডারে intercalary মাস লক্ষণীয়)। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে একই চান্দ্রমাসকে (একই ক্রমিকের চান্দ্রমাসকে বা একই নামের চান্দ্রমাসকে) নির্দিষ্ট ঋতুতে স্থির রাখা বা হিসাব করা।
৯:৩৬ আয়াতে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম থেকে ১২টি চান্দ্রমাসের গণনাচক্র (Counting Cycle) এবং এর মধ্য থেকে ৪টি মাস হারাম মাস হওয়া এবং মুশরিকদের কর্তৃক ‘নাসী’ তথা ‘হারাম মাসের অবস্থানের রদবদল বা হারাম মাসকে যথাসময়ে পালন করাকে স্থগিত করে পরে অন্য মাসকে হারাম ঘোষণা করে বার্ষিক হারাম মাসের সংখ্যাগত সমন্বয়’ কুফরের বা সত্য বিধান প্রত্যাখ্যানের একটি বৃদ্ধি হওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে অনেকে ভেবে থাকেন যে, ১২টি চান্দ্রমাসে একটি চান্দ্রবর্ষ হিসেব করতে হবে এবং এটাই ইসলামী বর্ষ গণনা পদ্ধতি এবং চান্দ্রসৌরবর্ষ (Lunisolar Year Calendar) তথা চান্দ্রবর্ষে একটি intercalary month / leap month মাস যোগ করা বা ১৩ মাস হিসেব করা মানে নাসী এবং এটি কুফর। অথচ প্রকৃতপক্ষে এটি ‘নাসী’ নয়, এবং কোনো চান্দ্রবর্ষে intercalary month / leap month যোগ করে ১৩তম মাস হিসেব করা কুফর নয়। কারণ ১২টি চান্দ্রমাসের যোগফলে একটি চান্দ্রবর্ষ হিসেব করলেও হারাম মাসসমূহ যে ঋতুতে পালন করতে হবে, intercalary month / leap month যোগ করে কোনো বর্ষে ১৩তম মাস হিসেব করলেও সেই ঋতুতেই হারাম মাসসমূহ পালন করতে হবে। যে চান্দ্রবর্ষে ১৩তম মাস যোগ করা হয় বস্তুত সেই সৌরবর্ষেও চন্দ্রচক্র (Moon Cycle) ১২টিই থাকে। তাই কুরআনের বিবৃতির লংঘন হয় না বা লংঘন সম্ভব নয়, কারণ এটাই প্রাকৃতিক ব্যবস্থা যে, একটি সৌরবর্ষে চন্দ্রচক্র ১২টিই থাকবে। কিন্তু একটি ক্যালেন্ডার হিসেব করতে গিয়ে এই ১২টি চন্দ্রচক্রের পর যে কয়দিন একটি চন্দ্রচক্রের সমান নয় কিন্তু বাড়তি দিন সেই কয়দিনের যোগফলকে একসাথে একটি চন্দ্রমাসের হিসেবে আনা তথা ১৩তম মাস হিসেব করার মাধ্যমে একই ঋতুতে হারাম মাসসমূহ পালন (বা বর্ষ শুরু করা) মূলত বর্ষ গণনাকে সহজীকরনের জন্য করা হয়। অন্যদিকে চান্দ্রবর্ষ হিসেব করলে একই ঋতু একেক বর্ষে একেক চান্দ্রমাসে হিসেব করতে হয়। উভয় অবস্থায় হারাম মাসসমূহ একই ঋতুতে হিসেব করতে হবে বিধায় এবং হারাম মাসকে একই ঋতুতে পালন না করাটাই ‘নাসী’ বিধায় চান্দ্র-সৌরবর্ষের মাধ্যমে নাসী ঘটে না, বরং নাসী থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে সহজ হিসাব পদ্ধতির জন্য চান্দ্রসৌরবর্ষ একটি গ্রহণযোগ্য হিসেবে পদ্ধতি। হারাম মাসসমূহ ও এর ঋতু সম্পর্কে ‘হারাম মাসসমূহের অবস্থান নির্ণয়’ পরিচ্ছেদে আলোচনা করা হবে।
হারাম মাসসমূহের সংখ্যা এবং নাম বা সময়গত অবস্থান বুঝার জন্য কিছু প্রাথমিক তথ্য
৯:৩৬-৩৭ আয়াত অনুযায়ী, সৃষ্টির শুরু থেকে একটি বর্ষে (উল্লেখ্য কুরআন অনুসারে বর্ষ হিসেব করার ভিত্তি হলো সূর্য বা দিনের প্রকৃতি যেমন Spring Equinox থেকে Spring Equinox) ১২ টি চান্দ্রমাসের হিসাব আল্লাহর বিধানে সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক নিয়ম। ১২ টি চান্দ্রমাসের মধ্যে চারটি মাস হচ্ছে হারাম মাস।
৯:১-৫ আয়াত অনুযায়ী, চারটি হারাম মাস একটির সাথে অন্যটি সন্নিহিত বা পরস্পর সংলগ্ন। ৯:৩৬ আয়াতেও হারাম মাসসমূহ সম্পর্কে বলা হয়েছে মিনহা আরবায়াতুন হুরুমুন (সেগুলো থেকে / ১২ মাস থেকে ধারাবাহিক ৪টি মাস হারাম)। এতে আরবায়াহ শব্দটির গঠনগত প্যাটার্ন এর কারণে এতে চারটি মাস ধারাবাহিক হিসেবে সাব্যস্ত হয়। সাধারণভাবে ‘চার’ বুঝাতে আরবায়া শব্দ ব্যবহৃত হয় (২৪:৬, ২৪:৮)। অন্যদিকে ধারাবাহিক বা গ্রুপবদ্ধ চার বুঝাতে আরবায়াহ শব্দ ব্যবহৃত হয়ে (২:২২৬, ২:২৩৪, ২:২৬০, ৪:১৫, ২৪:৪, ২৪:১৩, ৯:২, ৯:৩৬)।
৯:৮১ আয়াত অনুসারে হারাম মাসসমূহ শেষ হওয়ার পর যখন মু’মিনরা যুদ্ধাভিযানে বের হচ্ছিল তখন ছিল প্রচন্ড গরমের সময়। সুতরাং হারাম মাসসমূহ সবচেয়ে গরম মাসের পূর্বেই অতিক্রান্ত হয়েছিলো।
৯:২৮ আয়াত অনুযায়ী, ইয়াওমুল হাজ্জিল আকবারে যে মুশরিকরা শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়নি বা যে মুশরিকরা ইতোমধ্যে চুক্তি লংঘন করেছে তাদের যে হারাম চারমাসের অবকাশ দেয়া হলো এবং অন্য যারা আল মাসজিদুল হারামের প্রাঙ্গনে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে ও পরবর্তীতে তা লংঘন করেনি তাদেরকে চুক্তিকাল পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির অবকাশ দেয়া হলো, এ সময়কালের সমাপ্তিকে আমিহিম হাযা তথা ‘আরববাসীদের গণনাপদ্ধতির সে বছরের চান্দ্রবর্ষ / চান্দ্রসৌরবর্ষ’’ শেষ হওয়া, যার পরে তার আর আল মাসজিদুল হারামের কাছে আসার অবকাশ নেই - হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
২:১৯৬ অনুযায়ী হজ্জের মাসসমূহ নির্ধারিত এবং কেউ হজ্জের মাসের আগে তামাত্তায়া বিল উমরাতি ইলাল হাজ্জি তথা হজ্জ পর্যন্ত উমরাহ সম্পন্ন করতে পারবে, অর্থাৎ কেউ হজ্জের মাসের আগে পৌঁছে গেলে সে উমরাহ করতে পারে। এ আয়াত থেকে এটি স্পষ্ট যে উমরা হচ্ছে হজ্জের মাস ছাড়া অন্য মাসে। উমরার মাধ্যমে বায়তুল হারামের আবাদ বা এর কার্যকারিতা সতেজ থাকে।
২:১৯৭ অনুযায়ী হজ্জের মাসসমূহ নির্ধারিত। হজ্জের মাসসমূহ যা ৩ মাসের কম এবং ৪ মাসের বেশি হতে পারে না, কারণ হারাম মাসের সংজ্ঞা অনুসারে হজ্জের মাসসংখ্যা হারাম মাসসংখ্যাকে অতিক্রম করতে পারে না, বিষয়টি সামনের আলোচনায় আরো স্পষ্ট হবে।
২৮:২৭ আয়াতে উল্লেখিত ঘটনায় নবী মূসার সাথে তাঁর শ্বশুর যে চুক্তি করেছিলেন তার মেয়াদ ছিল আট বা দশ হিজাজ। হিজাজ শব্দটি হচ্ছে হিজজাহ শব্দের বহুবচন। হিজজাহ হচ্ছে হিজ্জ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। অন্যদিকে হিজ্জ হচ্ছে হজ্জ শব্দের প্রতিশব্দ। আর হিজ্জাহ দ্বারা একটি সম্পূর্ণ হজ্জ মওসুমকে বুঝায়। হিজজাহ অর্থ হজ্জ মওসুম এবং হিজাজ অর্থ হজ্জ মওসুমসমূহ। ২৮:২৭ আয়াতে হজ্জ মওসুমকে বর্ষ গণনার একক হিসেবে ধরা হয়েছে বিধায় সাধারণ ‘আট বর্ষ’ শব্দ দ্বারা আট হিজাজ শব্দের অনুবাদ করা হয়। নবী মূসা সেখানে হজ্জ মওসুমে বা তার অব্যবহিত পরে গিয়েছিলেন, যার ফলে তাঁর কাছে ৮ বা ১০ বছরের চুক্তির প্রস্তাবনা পেশা করার ক্ষেত্রে পরবর্তী বছরগুলোকে সহজেই হজ্জ মওসুমের সাথে সম্পৃক্ত করে উল্লেখ করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এছাড়া সে সময় হজ্জের সাথে সম্পর্কিত করে বর্ষ গণনার ক্ষেত্রে হজ্জ মওসুমে ব্যবসায় কাফেলার বাণিজ্য সফর একটি প্রধান কারণ বলে প্রতীয়মান হয়।
৯:৩৬-৩৭ আয়াত অনুযায়ী, নাসী তথা প্রত্যেক ১২টি চান্দ্রমাসের মধ্যে ৪টি হারাম মাস পালনের ক্ষেত্রে হারাম মাসের হিসাব স্থগিতকরণ বা মূলতবীকরণের মাধ্যমে হারাম মাসের স্থানচ্যুতি বা রদবদলের মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থার লঙ্ঘন তথা কুফর বৃদ্ধি পায়। আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনায় থাকা মুশরিকরা কোনো কোনো বর্ষে হারাম মাসকে স্থগিত করে পরবর্তীতে অন্য একটি হালাল মাসকে হারাম মাস ঘোষণা দিয়ে হারাম মাসের স্থানচ্যুতি ঘটাতো কিন্তু হারাম চার মাসের মাসসংখ্যা ঠিক রাখতো। এভাবে তারা নাসী তথা হারাম মাসের স্থানচ্যুতি বা রদবদল ঘটাতো। আল্লাহ এই নাসীর অনুশীলনকে নিষিদ্ধ করেছেন। নাসী করার কারণ ছিলো নিজেদের সুবিধামতো যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়ে হারাম মাসে যুদ্ধ বিরতি না করতে চাওয়া এবং অন্য কোনো মাসকে যুদ্ধ বিরতির মাস হিসেবে রদবদল করে নিয়ে হারাম মাসের সংখ্যা ঠিক রাখার মাধ্যমে হারাম মাসের বিধান লংঘন করেও অভিযোগ থেকে নিজেদেরকে দায়মুক্তকরণ।
প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ থেকে হারাম মাসসমূহ ও হজ্জের মাসসমূহ সম্পর্কে মানুষ পরিজ্ঞাত হতে পারতো এবং এভাবে চিহ্নিত সময়সীমাকে আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িতদের ঘোষিত সময়সীমা জেনে নিয়ে তার সাথে সমন্বিত করা কঠিন বিষয় ছিল না। কিন্তু যদি হঠাৎ করে পূর্বঘোষিত কোনো হারাম মাসকে হালাল ঘোষণা দিয়ে প্রাকৃতিক প্রপঞ্চের সাথে সম্পর্কহীন কোনো মাসকে তার বদল হিসেবে নতুন ঘোষণা জারি করা হয় তথা নাসী করা হয় তাহলে তা সর্বজনীনভাবে পরিজ্ঞাত বিষয় হওয়া কোনো সহজ ও স্বাভাবিক বিষয় হতো না। এছাড়া এর মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত হারাম মাসগুলোকে হারাম (সংরক্ষিত) হিসেবে পালনের উদ্দেশ্যও ব্যাহত হতো। তাই নাসীকে একটি বাড়তি কুফর বা ন্যায়সঙ্গত প্রাকৃতিক বিধান প্রত্যাখ্যান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আরবিতে চান্দ্রবর্ষের মাসসমূহের বর্তমান প্রচলিত নাম হচ্ছে: (১) মহররম (২) সফর (৩) রবিউল আউয়াল (৪) রবিউস সানি (৫) জমাদিউল আউয়াল (৬) জমাদিউস সানি (৭) রজব (৮) শাবান (৯) রমাদান (১০) শাওয়াল (১১) জিলক্বদ (১২) জিলহজ্জ্ব। ইতিহাসসূত্রে জানা যায় পূর্বে নবম মাসের নাম ছিল নাতিক। কুরআন নাযিলের পরে কোন এক সময় থেকে এটিকে রমাদান নামে পরিবর্তন করা হয়।
আরবিতে ১২ টি চান্দ্রমাসের প্রচলিত নামসমূহের মধ্যে প্রথম মাসের নাম মহররম। মহররম শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘যাকে হারাম করা হয়েছে’। একটি মাসের নাম হিসেবে এর অর্থ হচ্ছে ‘যে মাসকে হারাম করা হয়েছে’। ১৪:৩৭ আয়াতে বর্ণিত নবী ইবরাহীমের প্রার্থনায় তিনি ‘আল্লাহর বাইতকে’ (প্রতিষ্ঠানকে) বাইতিকা মুহাররম বলে উল্লেখ করেছেন। আর ৫:২ এবং ৫:৯৭ আয়াতে এটিকে আল বাইতুল হারাম বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে মাসের নাম হিসেবে ‘মুহাররম’ শব্দের ব্যাস বাক্য হচ্ছে আশ শাহরুল হারাম। অথচ আল কুরআন অনুসারে হারাম মাস শুধু একটি নয়, বরং চারটি হারাম মাস (আরবায়াতু হুরুমুন ৯:৩৬) যাকে একসাথে বলা হয় ‘আশহুরুল হুরুমুন’ (৯:৫)। আর হারাম মাসসমূহের প্রতিটিই হচ্ছে ‘আশ শাহরুল হারাম’ (২:১৯৪, ২:২১৭, ৫:২, ৫:৯৭)। সুতরাং একটিমাত্র মাসের নাম ‘মুহাররাম’ রাখা গ্রহণযোগ্য কিনা তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ আছে।
আরবিতে ১২ টি চান্দ্রমাসের প্রচলিত নামসমূহের মধ্যে শেষ মাসের নাম জিলহজ্ব। জিলহজ্জ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘হজ্জওয়ালা মাস’ বা ‘হজ্জের মাস’। আল কুরআনে হজ্জের মাসসমূহের কথা বলা হয়েছে, হজ্জের জন্য শুধুমাত্র একটিমাত্র মাসের কথা বলা হয় নি। (আল হাজ্জু আশহুরুম মা’লূমাত ২:১৯৭)। আশহুর হচ্ছে ‘শাহর’ বা ‘মাস’ শব্দের বহুবচন। সুতরাং একটিমাত্র মাসের নাম ‘জিলহজ্জ’ রাখা গ্রহণযোগ্য কিনা তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ আছে।
মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর সা. পরবর্তীতেও নাসী (হারাম মাসের রদবদল) হওয়ার প্রমাণ
বর্তমানে প্রচলিত ১২টি চান্দ্রমাসের যে চারটি মাসকে হারাম মাস হিসেবে দাবি করা হয় তাহলো, ১ম মাস (মুহাররম), ৭ম মাস (রজব), ১১শ মাস (জিলক্বদ) ও ১২শ মাস (জিলহজ্জ্ব)। অথচ সূরা তাওবা ৯:১-৫ আয়াত এবং ৯:৩৬ আয়াত অনুসারে হারাম চারটি মাস পরস্পর সংলগ্ন / সন্নিহিত। এ থেকে স্পষ্ট যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পরবর্তীতেও নাসী (হারাম মাসের রদবদল) হয়েছে। সুতরাং আমাদেরকে অবশ্যই আল কুরআনের আলোকে এবং প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ (Natural phenomenon) পর্যবেক্ষণ করে হারাম মাসসমূহকে চিহ্নিত করতে হবে। হারাম মাসসমূহসহ কুরআনে নির্দেশিত যেকোনো বিধানের বাস্তবরূপ থেকে কোনোভাবে বিচ্যুতি ঘটলে সেই বিচ্যুতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদেরকে কুরআন, ভাষারীতিগত বিশ্লেষণ এবং বাস্তবতার জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে এবং এভাবে প্রকৃত স্বরূপকে উন্মোচন করা সম্ভব। কারণ আল্লাহ যিকর হিসেবে কুরআন নাযিল করেছেন এবং তার হেফাযত করছেন। যিকর হেফাযতের বাস্তব দিক হচ্ছে আল কুরআনের শব্দের পাশাপাশি তার অর্থও হেফাযতে থাকা। কিন্তু অনুবাদগুলোতে কিছু অর্থ যে ঠিকভাবে আসেনি, গবেষণায় তা ধরা পড়ে। এর তাৎপর্য হচ্ছে, সঠিক অর্থ প্রতিশব্দের মধ্যে রয়েছে, উপাদান হারিয়ে যায়নি, এজন্যই কুরআনভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে সঠিক অর্থ নির্ণয় সম্ভব।
হারাম মাসসমূহের তাৎপর্য এবং এতে সিয়াম ও হজ্জের সম্পর্ক
হারাম মাসসমূহ বলতে সেই মাসসমূহকে বুঝায় যে মাসসমূহকে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা অনুসারে মানবজাতির জন্য কোনো বিষয়কে হারাম বা অসিদ্ধ / নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত করে মাসগুলোকে তা থেকে বিরত থাকার জন্য সংরক্ষিত বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। হারাম মাসসমূহে কী থেকে বিরত থাকতে হবে সেই নির্দেশনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সেগুলোতে বন্য পশু শিকার বা নিধন করা হারাম এবং যুদ্ধ করা হারাম (ব্যতিক্রম হচ্ছে কোনো পক্ষ যুদ্ধ বিরতির এ আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে হামলা করে বসলে আক্রান্ত পক্ষ কর্তৃক প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ)। এটি বিশ্বজনীন যুদ্ধবিরতির (global ceasefire) সময়।
রমাদান মাসের নাম আল কুরআনে উল্লেখিত একটিমাত্র মাসের নাম হলেও এ মাসে যা করতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো সিয়াম। এছাড়া এ মাসে কুরআন নাজিল হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি এ মাসে হজ্জ করার বিধান থাকতো তবে একই আয়াতে (২:১৮৭) বা কোনো না কোনো আয়াতে তা উল্লেখ করা হতো। এছাড়া যেহেতু হজ্জের জন্য একাধিক মাস আছে সেহেতু রমাদান মাসে হজ্জ করতে হবে এমনটি জরুরিও হয় না। অন্যদিকে রমাদান মাসে হজ্জ করতে হলে হজ্জকারীকে হজ্জের সফর উপলক্ষে রমাদানের সিয়াম স্থগিত করতে হয়। একটি বিধান পরিপালনের জন্য অন্য একটি বিধানকে যথাসময়ে পালন করা অসম্ভব হওয়ার মতো করে দুটি বিধান দেয়া যৌক্তিক বলা যায় না এবং আল্লাহ তা দেননি। এছাড়া রমাদানে হজ্জ করলে হারাম এলাকার বাহির থেকে আসা হাজীদেরকে ক্ষেত্রবিশেষে সিয়াম পালন করার প্রয়োজন হবে (২:১৯৬), যেহেতু সফর উপলক্ষে রমাদানের সিয়াম পালন স্থগিত হয় (২:১৮৫) সেহেতু রমাদানে হজ্জের জন্য সফরকারীকে আবার রমাদানেই হজ্জের তিন দিন সিয়াম পালন করার বিধান দেয়া পরস্পর বিপরীত হয়। অন্য কথায়, রমাদানের সিয়ামের ক্ষেত্রে যদি কেউ সফরে থাকে তাদেরকে ছাড় দেয়া হয়েছে, যাতে তাদের অতিরিক্ত কষ্ট না হয়। অথচ ২:১৯৬ আয়াত অনুযায়ী সফরকারী হওয়া সত্ত্বেও হজ্জের মধ্যে একটি বিশেষ ক্ষেত্রে (হজ্জের অনুষ্ঠানাদির পালনের পাশাপাশি) সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে। তাই এ থেকে বুঝা যায় যে, হারাম চারমাসের প্রথম মাস তথা রমাদান মাসে সিয়াম হবে, হজ্জ নয়। এটিও প্রমাণ করে রমাদানে সিয়াম হওয়ার কথা নয়। এছাড়া তাদের জন্য হজ্জ থেকে বাড়িতে ফেরার পর যে সাতটি সিয়াম যদি রমাদানেই হজ্জ হয় তবে সেক্ষেত্রে তারা কি বাড়ি ফিরে রমাদানের বাকি সিয়াম পালন করবে নাকি ঐ সাতটি সিয়াম পালন করবে সে দ্বান্দ্বিকতা তৈরি হয়। এটিও প্রমাণ করে যে, রমাদানে হজ্জ নয়। তবে যেহেতু হজ্জের মাসগুলো ছাড়া অন্য যে কোনো মাসে উমরাহ করা যেতে পারে, তাই কেউ উমরাহ পালন করতে চাইলে তা করতে পারে। কারণ রমাদানে উমরা করতে পারবে না, আল্লাহ এরূপ নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। এমনকি কেউ রমাদানের আগেই উমরা করে একই সফরে রমাদান পরবর্তীতে হজ্জের মাসে হজ্জও করতে পারে। এছাড়া যে আয়াতে রমাদান মাসের পরিচয় দেয়া হয়েছে (২:১৮৫) তাতে রমাদান মাসে সিয়াম পালন করতে বলা হয়েছে, হজ্জ পালন করতে বলা হয় নি। তাই হারাম চারমাসের একটি সিয়ামের জন্য এবং অন্য তিনটি হজ্জের জন্য এটি নির্ধারিত হয়ে যায়।
২:১৯৬ আয়াত অনুযায়ী হারাম এলাকার বাহির থেকে আগত যেসব হাজীর উপর হজ্জের সময়কার সিয়ামের বিধান প্রযোজ্য হবে তারা বাড়ি ফিরে সাতটি সিয়াম পালনের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয় যে, রমাদান মাস হজ্জের মাসসমূহের মাঝে বা শেষে হতে পারে না। কারণ সেক্ষেত্রে বাড়ি ফিরার পরে রমাদান মাস পড়লে তাতে রমাদানের বিধিবদ্ধ সিয়াম পালনের বিষয় রয়েছে। এমতাবস্থায় দুটি নির্দেশ পরস্পর সাংঘর্ষিক হতো। সুতরাং এ থেকে স্পষ্ট যে, হারাম চারমাসের মধ্যকার শেষ তিনটি মাস হচ্ছে হজ্জের মাস এবং তার আগের মাসটি হচ্ছে রমাদানের মাস বা সিয়ামের মাস।
৯:৩ আয়াতে ‘ইয়াওমাল হাজ্জিল আকবারে’ বা ‘শ্রেষ্ঠ হজ্জের দিনে’ যে ঘোষণা দিতে নির্দেশ দেয়া হলো তা থেকে চারমাসের অবকাশ ধরা হলে হারাম চারমাসের প্রতিটিই হজ্জের মাস হয়। কিন্তু লক্ষণীয় যে, হারাম চারমাসে বিচরণ করার অবকাশের কথা বলা হয়েছিলো ৯:২ আয়াতে, তা ৯:৩ আয়াতে নেই। অন্যকথায় সূরাটি যখন নাজিল হয় তখনই হারাম চারমাসের অবকাশের কথা বলা হয়েছে কিন্তু তখনি হজ্জের মাস শুরু হয়ে যেতে হবে এমনটি জরুরি নয়। বরং তার পরবর্তী মাসে তথা একমাস অতিক্রম হওয়ার পরে শুরু হওয়া ‘ইয়াওমাল হাজ্জিল আকবারে’ বা ‘শ্রেষ্ঠ হজ্জের দিনে’ যখন মানবজাতির সমাবেশ ঘটবে তখন মানবজাতির উদ্দেশ্যে আল্লাহ ও রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্কমুক্ততার এবং হারাম মাসসমূহ পর্যন্ত মুশরিকরা অবকাশ পাওয়ার ঘোষণা বিঘোষিত করার নির্দেশ রয়েছে। এমতাবস্থায় সূরাটি নাজিলের প্রথম থেকে তারা চারমাসের অবকাশ পেয়েছে এবং হজ্জের সময় মানবজাতির উদ্দেশ্য করে এ বিষয়ক ঘোষণা বিঘোষিত হয়েছে। এক্ষেত্রে হজ্জের সময় থেকে শুরু করে চারমাসের অবকাশ জরুরি নয়। অন্য কথায়, হজ্জের মধ্যকার ঘোষণার দিন থেকে নয়, বরং চারমাসের অবকাশ আরো আগেই শুরু হয়েছে তথা আয়াতগুলো নাজিলের সাথে সাথে শুরু হয়েছে, এবং হজ্জের মধ্যকার ঘোষণার দিন হারাম মাসসমূহ বর্তমান থাকা পর্যন্ত অবকাশের ঘোষণা জানানো হয়েছে।
উপরিউক্ত অনুসিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দেয়ার কারণ হলো, রমাদানের মাস নির্ণয়ের প্রাকৃতিক উপায় (যা পরে আলোচিত হবে), হারাম চার মাস, হজ্জের পরিজ্ঞাত মাসসমূহ হারাম মাসসমূহের অন্তর্ভুক্ত হওয়া- এ তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে প্রতীয়মান হয় যে, রমাদানের মাস থেকে হারাম মাসসমূহ শুরু হয়, আবার রমাদানের মাসে সিয়াম করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে হজ্জের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়নি।
হারাম মাসসমূহের হারাম বিষয় অনুযায়ী হারাম মাসের অবস্থান
৫:৯৭ আয়াতে বলা হয়েছে যে, হারাম মাসসমূহ নির্ধারণ করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে। হারাম মাসসমূহ হারাম হওয়ার কারণ এতে এমন কিছু বিষয় হারাম যা অন্যমাসে সাধারণভাবে সেভাবে হারাম নয়। হারাম মাসের যথাযথ বাংলা অর্থ হচ্ছে সংরক্ষিত মাস। অর্থাৎ যে মাসকে কোনো বিশেষ বিষয়ের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
হারাম মাসসমূহ মূলত বন্য পশু-পাখির সংরক্ষণের জন্য সংরক্ষিত মাস। অর্থাৎ এ মাসগুলোতে বন্য পশু পাখি শিকার করা যাবে না। অর্থাৎ এ মাসগুলো হচ্ছে বন্য পশু পাখির সংরক্ষণের জন্য (animal conservation and nature preservation) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস, এ সময়কালে বন্য পশু পাখি শিকার করলে তাদের বংশধারা ব্যাহত হবে এবং পশু-পাখির প্রতি অনধিকার চর্চা করা হবে। বন্য পশু পাখির সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাস হওয়ার (তথা বন্য পশু পাখিকে শিকার করা থেকে বিরত থাকার) স্বাভাবিক তাৎপর্য বা প্রাকৃতিক কার্যকারণ হচ্ছে এ সময়কালটি পশু-পাখির সাধারণ প্রজননকাল হওয়ার প্রেক্ষিতে নাজুক ঋতুকাল (Delicate season for mating and breeding of wild animals)। এরূপ জৈবিক ঋতু হলো বসন্ত। এ থেকে বুঝা যায় যে, বসন্তের প্রথম মাসই হবে হারাম মাসসমূহের প্রথম মাস।
আমরা যখন হারাম মাসসমূহে অবস্থান করি সে অবস্থা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে 'আনতুম হুরুমুন' (৫:১, ৫:৯৫) এবং যতক্ষণ আমরা এ 'হুরুমুন' অবস্থায় থাকি তা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘মা দুমতুম হুরুমান’ (৫:৯৭)।
হুরুমুন অবস্থায় তথা হারাম মাসসমূহে (বসন্তের প্রথম মাস থেকে ক্রমাগত চারটি মাস) জলভাগের শিকার হালাল কিন্তু স্থলভাগের শিকার হালাল নয়। যদি কেউ ‘হু্রুমুন’ অবস্থায় স্থলভাগের শিকার করে তবে তার ক্ষেত্রে যে বিধান বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নরূপ:
৫:৯৫ :: হে মু’মিনগণ, তোমরা হুরুমুন অবস্থায় (স্থলভাগের) শিকারকে হত্যা করো না। তোমাদের মধ্যে যে ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে হত্যা করে তার জরিমানা হচ্ছে যে পশুকে সে হত্যা করেছে গবাদি পশুর মধ্য থেকে তার মতো একটি পশু। সেটা (অর্থাৎ ঐ ধরনের গবাদি পশু) নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দিবে তোমাদের মধ্যকার দুজন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি। সেটাকে হাদিয়া হিসেবে কা’বায় পৌছাতে হবে। অথবা তার কাফফারা (ক্ষতিপূরণ) হবে (সমমূল্য দ্বারা যতজনকে মধ্যম মানের খাদ্য খাওয়ানো যেতে পারে ততজন) মিসকীনকে খাওয়ানো অথবা সমসংখ্যক সিয়াম পালন করা। (এটা এজন্য যে,) যেন সে তার কাজের পরিণামের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। (এ বিধান নাজিলের) আগে যা হয়ে গিয়েছিলো সে বিষয়ে আল্লাহ উদারতা দেখিয়েছেন। আর যে পুনরাবৃত্তি করবে আল্লাহ তাকে দণ্ড দিবেন। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান ও মহাদণ্ডদাতা।
হারাম মাসগুলোর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ হারাম বিষয় হলো: হারাম মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ করা যাবে না। অর্থাৎ এ মাসগুলোকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতি হিসেবে বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির মাস হিসেবে নির্ধারিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বছরের যে কোনো চারমাসকে হারাম মাস হিসেবে নির্ধারণ করা যেতো। সুতরাং হারাম মাসসমূহের যে হারাম বিষয়টি প্রকৃতিগতভাবে সুনির্দিষ্ট ঋতুর সাথে সম্পর্কিত তা হলো বন্য পশু-পাখির সংরক্ষণের দিক। আর তাই বন্য পশু-পাখির সংরক্ষণের জন্য নির্ধারিত চার মাসই হারাম মাস এবং সেই মাসগুলোকে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বিরতির জন্যও সংরক্ষিত মাসসমূহে পরিণত করা হয়েছে।
৯:৮১ আয়াত অনুসারে হারাম মাসসমূহের পরে যুদ্ধাভিযানের সময় ছিল প্রচণ্ড গরমের সময়। সুতরাং হারাম মাসসমূহ ছিল উষ্ণতম মাসের আগে। অন্য কথায় হারাম মাসসমূহ শুরু হয়েছিল বসন্ত ঋতুতে। বসন্তের প্রথম মাস থেকে শুরু করে ধারাবাহিক চারমাস হারাম মাস। যার প্রথম তিনটি মাস হলো বসন্ত এবং চতুর্থতম মাসটি হলো গ্রীষ্মের প্রথম মাস।
রমাদানের মাসে সিয়াম পালন করলে সিয়াম পালনকারীর উপর দিনের বেলায় পানাহার ও স্ত্রীমিলন হারাম। এছাড়া রমাদানে মাসজিদে এ’তেকাফ করলে এ’তেকাফকারীর উপর এ’তেকাফকালের দিনগুলোতে রাতের বেলায়ও স্ত্রীমিলন হারাম থাকে। এভাবে প্রতিবর্ষে বিধিবদ্ধ সিয়াম পালনের মাধ্যমে একটি মাসে সিয়াম পালনকারীদের জন্য কিছু বিষয় হারাম হিসেবে প্রযোজ্য হয় বিধায় হারাম মাসসমূহের মধ্যকার রমাদানের মাসকে কুরআন নাযিলের ও বিধিবদ্ধ সিয়াম পালনের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে।
অনুরূপভাবে হারাম চারটি মাসের মধ্য থেকে দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ মাসকে (শাওয়াল, জিলক্বদ ও জিলহজ্জ) হজ্জের মাসসমূহ হিসেবে বাছাই করা হয়েছে। এভাবে হজ্জের সময়ে হজ্জকারীদের উপরও যেসব বিষয় হারাম হয় (দাম্পত্য ঘনিষ্ঠতা, ঝগড়া ও বিধান লংঘনমূলক কিছু বা ফাসেকি, দ্র: ২:১৯৭) সেগুলোর প্রেক্ষিতে হজ্জের মাসসমূহকে হারাম মাসসমূহের অন্তর্গত করে দেয়া হয়েছে।
রমাদানের মাস চিহ্নিতকরণের প্রয়োজনে ইতোমধ্যে চান্দ্রমাস নির্ণয়ের পদ্ধতি এবং হারাম মাসসমূহের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ পর্যায়ে আমরা রমাদানের মাস সম্পর্কে থাকা আয়াত অনুসারে রমাদানের মাস চিহ্নিতকরণের উপায় অন্বেষণ করবো।
রমাদানের মাস সম্পর্কে ২:১৮৫ আয়াতে যে তথ্যটি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো: “রমাদানের মাস (শাহরু রমাদান), যাতে আমি আল কুরআন নাজিল করেছি, মানবজাতির জন্য হিদায়াত হিসেবে এবং হিদায়াতের স্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে এবং সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী হিসেবে। সুতরাং তোমাদের মধ্য থেকে যে এ মাসকে প্রত্যক্ষ করবে (তথা এ মাস শুরু হওয়ার অভিলক্ষণ বা অভিজ্ঞান পাবে) সে যেন তাতে (মাসব্যাপী) সিয়াম পালন করে”।
সর্বপ্রথম নির্ণেয় বিষয় হচ্ছে শাহরু রমাদান শব্দের অর্থ কি? সাধারণত এর অর্থ করা হয় ‘রমাদান মাস’। কিন্তু এ অর্থ কি সঠিক? এর অর্থ কি ‘রমাদান মাস’ নাকি ‘রমাদানের মাস’?
প্রচলিত ধারণামতে, হিজরী ক্যালেন্ডারের নবম মাসের নাম হচ্ছে ‘রমাদান’। অথচ যদি রমাদান শব্দটি একটি মাসের নামবাচক বিশেষ্য হতো তাহলে শুধু রমাদান বলা হতো, শাহরু রমাদান বলা হতো না। শাহরু রমাদান অর্থ রমাদান মাস নয়, বরং এর অর্থ রমাদানের মাস। কারণ আরবী ব্যাকরণ পরিভাষায় শাহরু শব্দটি হচ্ছে মুদাফ (সম্বন্ধ পদ) এবং রমাদান শব্দটি হচ্ছে মুদাফ ইলাইহি (যার সাথে সম্বন্ধিত)। সুতরাং শাহরু রমাদানের সঠিক অনুবাদ হচ্ছে রমাদানের বৈশিষ্ট্যের মাস।
শাহরু রমাদান শব্দের অর্থ রমাদানের মাস হওয়ায় প্রমাণিত হয় যে, শাহরু রমাদান কোনো মাসের নামবাচক বিশেষ্য নয়, বরং শাহরু রমাদান হচ্ছে একটি মাসের বিশেষণমূলক নাম (গুণবাচক বিশেষ্য)। যে মাসটি রমাদানের মাস হবে সেই মাসটিকেই শাহরু রমাদান বলতে হবে, তা কোনো ক্যালেন্ডারে মাসের গণনাক্রমের একই ক্রমিকের মাস হোক বা একেক বর্ষে একেক ক্রমিকের মাস হোক, তা বিবেচ্য নয়। বরং মাসটি চিহ্নিত হবে তার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অনুসারে।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি বুঝা যেতে পারে। আমরা জানি যে, ঘড়ির মাধ্যমে প্রতিদিনের সময়কে চিহ্নিত করার জন্য ১২ টি ঘণ্টার হিসাব চালু আছে। এতে মধ্যাহ্নের পূর্বের সময়কে a.m এবং মধ্যাহ্নের পরের সময়কে p.m দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সকালে সূর্যোদয় এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত ঘটে। কুরআনের নির্দেশ অনুসারে সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের আগে আল্লাহর তাসবীহ বা পবিত্রতা জ্ঞাপন করতে হবে। এখন ঘড়ির হিসাবে ১ থেকে ১২ টা এবং তারপর আবার ১ থেকে ১২ টা হিসেব করা হয়। প্রতিটি ঘণ্টার আলাদা নাম না দিয়ে আমরা সেটাকে সংখ্যায় হিসেব করে থাকি। সে হিসেবে কোনো মাসে 05:00 a.m / 06:00 a.m / 07:00 a.m যে ঘণ্টাতেই সূর্যোদয় হোক সেটাকে সূর্যোদয়ের সময় বলতে হবে এবং অনুরূপভাবে 05:00 p.m / 06:00 p.m / 07:00 p.m যে ঘণ্টাতেই সূর্যাস্ত হোক তাকে সূর্যাস্তের সময় বলতে হবে। এমন নয় যে, প্রতিদিন 06:00 a.m কে সূর্যোদয়ের সময় বলা হবে বা 06:00 p.m কে সূর্যাস্তের সময় বলা হবে। বরং বাস্তবে যে দিন যে ঘন্টায় সূর্যোদয় হবে সেদিন সে ঘণ্টাটিই সূর্যোদয়ের সময় এবং যে ঘণ্টায় সূর্যাস্ত যাবে সেদিন সে ঘণ্টাটিই সূর্যাস্তের সময়। অনুরূপভাবে, কোনো বর্ষে চান্দ্রমাসের ধারাবাহিক হিসাব ক্রমের ৩নং মাস, কোনো বর্ষে ৪নং মাস এবং ৫নং মাস রমাদানের মাস হতে পারে। প্রতি বর্ষে একই ক্রমিকের মাসকেই যে রমাদানের মাস মনে করতে হবে তা নয়। আবার যদি চান্দ্রসৌরবর্ষ (Lunisolar Year) ক্যালেন্ডার হিসেব করা হয় সেক্ষেত্রে রমাদানের মাসকে প্রতিবর্ষে একই ক্রমিকের মাস হিসেবে পাওয়া যেতে পারে।
শাহরু রমাদান বা রমাদানের মাস বলতে কোন মাসটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে তা বুঝার উপায় হলো রমাদান শব্দের অর্থ অনুধাবন এবং হারাম মাসসমূহের সাথে সম্পর্কিত হারাম বিষয়ের সাপেক্ষে হারাম মাসসমূহকে চিহ্নিতকরণ।
যদিও রমাদান শব্দের অর্থ হিসেবে ‘হিজরী ক্যালেন্ডারের নবম মাসের নাম, যাতে সিয়াম পালন করা হয়’ লেখা হয়, তবুও এর প্রকৃত অর্থ নির্ণয়ের জন্য রমাদান শব্দটির শব্দমূল ‘র মীম দদ’ থেকে গঠিত শব্দসমূহের অর্থ জানা প্রয়োজন।
নিম্নে Arabic-English-Dictionary, J.G. Hava, Beyrut Catholic Press, 1899 গ্রন্থে রমাদান শব্দের শব্দমূল থেকে গঠিত বিভিন্ন শব্দের যেসব অর্থ দেয়া হয়েছে তা দেখানো হলো:
Translation and Meaning of رمض in Almaany English Arabic Dictionary
رَمِضَ ( فعل ): - اِشتَدَّ حَرُّه
- Become intensely hot - become burning; become scorching; be blazing; be glowing
Source: https://www.almaany.com/en/dict/ar-en/%D8%B1%D9%85%D8%B6/
এ শব্দমূল থেকে যেসব শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে সেগুলোর অর্থগত বিভিন্নতার উদাহরণ জানার জন্য Lanes Lexicon দেখা যেতে পারে। Lanes Lexicon এর অনলাইন পেজ:
http://lexicon.quranic-research.net/data/10_r/199_rmD.html
বিভিন্ন অভিধানের তথ্য সমন্বয়ের ভিত্তিতে রমাদান শব্দের শব্দমূল ‘র মীম দদ’ থেকে যেসব শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে নিম্নে সেগুলোর একটি বিস্তৃত তালিকা ও সরল অর্থ উল্লেখ করা হলো:
১. রমাদা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১, উপরূপ ১) = সে উত্তপ্ত ভূমিতে মেষচারণ করলো, সে উত্তপ্ত পাথরে গরম ছাই দিয়ে পাক করলো, সে উত্তপ্ত পাথরে বর্শা বা ছুরিকে ধারালো করলো।
২. রমুদা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১, উপরূপ ২) = এটা (ব্লেড বা ছুরি) ধারালো হলো।
৩. রমিদা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১, উপরূপ ৩) = সে আলোর তীব্রতা বা তাপ দ্বারা প্রভাবিত হলো, সে মাটি বা পাথরের স্পর্শে পায়ে তাপ অনুভব করলো, সে তৃষ্ণার কারণে তীব্র জ্বালা অনুভব করলো, সে মরুভূমি থেকে চাষের জমিতে ফিরে এলো, সে বিষয়টির কারণে দু:খিত ও অস্থির হলো, তা আলোর উজ্জলতায় জ্বলজ্বলে হলো।
৪. রম্মাদা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ২) = সে তাকে উত্তাপে বা উত্তপ্ত ভূমিতে দগ্ধ করলো, সে তাকে কষ্ট দিলো, সে তার জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করে প্রস্থান করলো, সে একটি নিদিষ্ট সময়কালের কাজ শুরু করার (যেমন রমাদানের সিয়াম পালনের) মনস্থির করলো।
৫. আরমাদা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪) = তা উত্তপ্ত হলো ও দগ্ধ করলো, সে বিচলিত করে দিলো, সে ব্যথিত করলো।
৬. তারাম্মাদু (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৫) = সে উত্তপ্ততার ফলে পাগুলো স্থানচ্যুত হয়ে থেমে যাওয়া পর্যন্ত ধাওয়া করলো।
৭. ইরতামাদা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৮) = সে তাপদগ্ধ হলো, সে শোকতপ্ত হলো।
৮. রমাদ (ক্রিয়াবিশেষ্য) = বালির উপর রোদ পড়ার প্রভাব, উদ্দীপনা বা উত্তপ্ততা, কোনো বিষয়ের কারণে উদ্বেগ, দু:খ বা শোকের উদ্ভব ঘটা।
৯. রমিদ (ক্রিয়াবিশেষ্য) = উত্তপ্ত ভূমি বা উত্তপ্ত পাথর, করমর্দনের মাধ্যমে উষ্ণ তালু।
১০. রমাদাহ (ক্রিয়াবিশেষ্য) = উত্তাপ অনুভব।
১১. রমদাউ (ক্রিয়াবিশেষ্য) = অতিমাত্রায় উত্তপ্ত ভূমি বা পাথর।
১২. রমাদিইয়ু (ক্রিয়াবিশেষ্য) = গরমের শুরুতে বা শেষে বৃষ্টি, রমাদান মাসের বৃষ্টি, কোনো কিছুকে রোদে শুকানো।
১৩. রমীদ (কর্মবিশেষ্য, মারমূদ এর সমার্থক শব্দ) = পাথরে ধার দেয়া ধারালো বর্শা বা ছুরি।
১৪. রমাদান = প্রচলিত অর্থ হলো হিজরী ক্যালেন্ডারের নবম মাসের নাম, নবম মাসের পূর্ব নাম ছিল নাতিক, এটি সবচেয়ে গরম মাসে পড়েছিল বিধায় এটিকে রমাদান নামকরণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
উপরিউক্ত তালিকা অনুসারে রমাদান শব্দের অর্থ নির্ণয়ের জন্য এর শব্দমূলের যেসব অর্থকে বিবেচনায় নেয়া হয় তার মধ্যে রয়েছে গরমের আগে বা পরে বৃষ্টি, পাথরে বর্শাকে ধার দেয়ার প্রবৃত্তি, আলোর তীব্রতা, উষ্ণতা, তাপ বৃদ্ধি, অসহ্য / দুর্বিসহ তাপ, উত্তপ্ত ভূমি, জ্বালিয়ে দেয়া, পিপাসা ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে রমাদান শব্দের অর্থ হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত হয়েছে, ‘জ্বালিয়ে দেয়ার মতো অসহ্য বা প্রচণ্ড তাপ’। আবার রমাদানের অর্থ হিসেবে দ্বিতীয় বহুল প্রচলিত অর্থ হলো ‘গ্রীষ্মের শেষদিকে উত্তপ্ত ভূমিতে বৃষ্টি’। এ দুটি অর্থের উপর ভিত্তি করে ‘শাহরু রমাদানের’ নাম ‘শাহরু রমাদান’ রাখার কারণ হিসেবে বলা হয় যে, যে বছর কুরআন নাজিল হয় সে বছর ‘শাহরু রমাদান’ মাসটি জুন, জুলাই, আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে পড়েছিল।
যদি ‘রমাদান’ শব্দের অর্থ ‘দুর্বিসহ গরম’ হয় এবং সেই প্রেক্ষিতে রমাদানের মাস সবচেয়ে বড় দিন (summer solstice) ২০, ২১ বা ২২ জুন এর সাথে সম্পর্কিত মাসটি হয় তাহলে এর পূর্ববর্তী তিনটি মাস বা পরবর্তী তিনটি মাসসহ মোট চারটি মাস হবে হারাম মাস এবং হারাম মাসগুলো হবে বন্য পশুর জন্য নাজুক সময় এবং হারাম মাসসমূহের মধ্যে রমাদানের মাস ছাড়া বাকি মাসগুলো হজ্জের মাস। পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা স্পষ্ট হয়েছি যে, বন্য প্রাণীদের প্রজননের জন্য নাজুক সময় হলো ‘বসন্ত ঋতু’। সুতরাং জুন মাস রমাদানের মাস হলে অন্য তিনটি হারাম মাস হবে রমাদানের মাসের পূর্ববর্তী তিনটি মাস (মার্চ, এপ্রিল, মে)। অন্যদিকে পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা এটাও স্পষ্ট হয়েছি যে, হারাম মাসসমূহের মধ্যে শেষ মাস নয়, বরং প্রথম মাসই রমাদানের মাস, সিয়ামের মাস। এ হিসেবে ‘রমাদানের মাস’ হলো বসন্তের প্রথম মাস। অন্যদিকে যদি রমাদানের মাস গ্রীষ্মের প্রথম মাস (জুন মাস) হয় এবং বাকি হারাম মাসগুলো হয় তার পূর্ববর্তী তিনটি মাস (বসন্তের মাসসমূহ), সেক্ষেত্রে মাসসমূহকে হিসেব করতে হয় উল্টোদিক থেকে। অর্থাৎ প্রথমে জুন মাসে রমাদানের মাস হিসেব করে তারপর তার আগের তিনটি মাসকে হারাম মাস হিসেবে পালন করা। এভাবে উল্টোদিক থেকে হিসেব করা স্বাভাবিক নয়। বরং প্রথমে কোনো মাসের প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ (Natural phenomenon) প্রত্যক্ষ করে তারপর সেই মাস থেকে সামনের দিকে হিসেব করা স্বাভাবিক পদ্ধতি। সে হিসেবে ‘রমাদানের মাস’ হারাম মাসসমূহের প্রথম মাসটি বা বসন্তের প্রথম মাসটি, এটিই স্বাভাবিক পদ্ধতি। যেহেতু কুরআনে একমাত্র ‘রমাদানের মাস’টি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে “শাহিদা’ বা প্রত্যক্ষ করে তার সাপেক্ষে অন্য মাসগুলোকে হিসেব করার পদ্ধতি দেয়া হয়েছে।
বসন্তের প্রথম মাসকে ‘রমাদানের মাস’ হিসেবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ‘রমাদান’ শব্দের অর্থ সঙ্গতিশীল নাকি অসঙ্গতিশীল, এটাই প্রধান নির্ণেয় বিষয়। প্রকৃতপক্ষে রমাদান শব্দের শব্দমূল ‘র মীম দদ’ এর মূল অর্থ হলো ‘তীব্রতা’ (Intensity), যা প্রকৃতিতে রঙ, আলো, উষ্ণতা ও প্রাণপ্রাচুর্যের সাথে সম্পর্কিত। একটি মাসের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে এই তীব্রতা ঋতুগত বৈশিষ্ট্যের নির্দেশক।
ঋতুগত বৈচিত্র্যের সাপেক্ষে ‘রমাদানের মাস’ চিহ্নিতকরণের জন্য সূরা ক্বুরাইশে উল্লেখিত ঋতু সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। সূরা কুরাইশের বক্তব্য বিষয় হলো: শীত ও গ্রীষ্মে কুরাইশদের বাণিজ্য সফরের সুবিধার পেছনে আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনায় তাদের সম্পৃক্ততা কাজ করেছিল বিধায় তাদের উচিত এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই প্রতিষ্ঠানের প্রভুর অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করা। আরবি ভাষায় বসন্ত ও গ্রীষ্ম ঋতুকে একসাথে সয়ফ এবং শরৎ ও শীত ঋতুকে একসাথে শীতায়ি বলা হয়। অন্য কথায় এ চারটি ঋতুকে আরবিতে প্রধান দুই ঋতু হিসেবে ধরা হয়। তাই শীতায়ি ও সয়ফে বাণিজ্য সফর বলতে সমগ্র বর্ষে প্রধান দুটি ঋতু বৈচিত্র্যের সাথে সঙ্গতি রেখে দুটি প্রধান বাণিজ্যিক সফরের আয়োজনকে বুঝায়। শীতায়ি এর আওতাধীন ছয় মাস হলো ‘সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি’ যখন Fall Equinox থেকে শুরু করে দিন ধীরে ধীরে ছোটো হতে থাকে এবং প্রকৃতিতে রঙ ও উষ্ণতার ক্ষেত্রে মলিনতা সৃষ্টি হয়। এ সময়কালে ‘বারদুন’ (২১:৬৯) বা ‘শীতলতা’ এর পরিবেশ থাকে। অন্যদিকে সয়ফ এর আওতাধীন ছয় মাস হলো ‘মার্চ থেকে আগস্ট’ যখন Spring Equinox থেকে শুরু করে দিন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং প্রকৃতিতে রঙ ও উষ্ণতার ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতা সৃষ্টি হয়। এ সময়কালে ‘রমাদুন’ বা ‘উষ্ণতা’ এর পরিবেশ থাকে।
যেহেতু ‘রমাদুন’ (উষ্ণতা) এমন একটি প্রাকৃতিক অবস্থা যা সমগ্র সয়ফে তথা বসন্ত-গ্রীষ্মে বিদ্যমান থাকে বা ‘রমাদুন’ হলো ‘সয়ফের’ প্রাকৃতিক অবস্থা, তাই ‘শাহরু রমাদান’ হবে বসন্ত-গ্রীষ্মের ছয় মাসের মধ্যকার একটি মাস। ‘শাহরু রমাদান’ নামটিতে ব্যবহৃত ‘রমাদান’ শব্দের প্যাটার্ন হচ্ছে ‘ফায়ালান’। এই প্যাটার্নটি কোনো কিছুর স্বস্তিদায়ক বা স্বাভাবিক ও সহনীয় পর্যায়ের নির্দেশক। এই প্যাটার্নে আল কুরআনে তিনটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। রমাদান ছাড়া অন্য দুটি শব্দ হলো- (১) হায়াওয়ান (২৯:৬৪:১২), অর্থ: স্বস্তিকর জীবন বা প্রাণবন্ততা। (২) শানাআন (৫:২:২৯, ৫:৮:১১), অর্থ: স্বাভাবিক শত্রুতা। সুতরাং রমাদান শব্দের অর্থ সহনীয় পর্যায়ে প্রকৃতির তীব্রতা (The intensity of nature at a moderate level)। এটি এমন একটি ঋতুর নির্দেশক যা শারীরবৃত্তীয় ও মনস্তাত্ত্বিক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, জৈব প্রকৃতিতে তীব্রতা আনয়ন করে। এ থেকে বুঝা যায় যে, ‘শাহরু রমাদান’ বলতে সবচেয়ে উত্তপ্ত মাস নয়, বরং জৈবপ্রকৃতিতে তীব্রতার মাস তথা বসন্ত বিষুবীয় মাসকে (Vernal / Spring equinoctial month) বুঝায়।
‘শাহরু রমাদান’ বলতে বসন্তের প্রথম মাসকে চিহ্নিত করার কারণ হলো ‘সয়ফ’ বা বসন্ত-গ্রীষ্মের মাসগুলোর মধ্যে সবগুলো মাসেই ‘রমাদুন’ এর বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় বিধায় এর মধ্য থেকে কোনো একটি মাসকে ‘শাহরু রমাদান’ হিসেবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো:
(১) তা হবে ঐ প্রাকৃতিক অবস্থার সূচনা পর্যায়, যেহেতু তা না হলে বাকি মাসগুলোর মধ্য থেকে কোনো মাসকে নির্দিষ্ট করা অর্থবহ হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তাল পাকার মাস হিসেবে ভাদ্র মাসকে চিহ্নিত করা হয়, যদিও তার পরবর্তী দু’মাসেও তাল পাকার অবস্থাটি বিদ্যমান থাকে।
(২) ‘রমাদুন’ শব্দটির অর্থ ‘উষ্ণতা’ এর পাশাপাশি ‘শাহরু রমাদান’ এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্যাটার্ন ‘ফায়লান’ এর প্রেক্ষিতে এর মধ্যে সহনীয় পর্যায় থাকতে হবে, আর তাই এটিকে ‘দুর্বিসহ বা প্রচণ্ড উষ্ণতা’ অর্থে গ্রহণ করা সঠিক নয়।
(৩) হারাম মাসসমূহের শেষে যখন প্রচণ্ড গরম ছিলো ৯:৮১ আয়াতে ঐ অবস্থার জন্য ‘হাররান’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যদি ‘প্রচণ্ড গরম’ বুঝাতে ‘রমাদান’ শব্দ ব্যবহৃত হতো তবে তাতে ‘রমাদান’ শব্দটিই ব্যবহৃত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ ছিলো।
সুতরাং এ বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে বুঝা যায় যে, বসন্তের প্রথম মাসই রমাদানের মাস হিসেবে প্রত্যক্ষ (শাহিদা) করার বিষয় এবং তারপর রমাদানের মাসে সিয়াম পালন করতে হবে এবং তার পরবর্তী তিন মাসে হজ্জ সম্পাদিত হবে এবং সমষ্টিগতভাবে এই চারমাসকে হারাম মাস হিসেবে পালন করতে হবে। হারাম মাসসমূহে বন্য পশু শিকার বা বধ করা যাবে না এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতি হিসেবে যুদ্ধবিরতি পালন করতে হবে।
রমাদানের মাসকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আল কুরআন নাজিলের প্রসঙ্গটি সম্পৃক্ত। এ মাসে আল কুরআন নাজিলের সূচনা হয়েছে। আর যে রাতে আল কুরআন নাজিল হয়েছে তা হচ্ছে ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘নির্ধারণের রাত, পরিমাপের রাত’ (৯৭:১)। কোনো রাতকে ‘পরিমাপের রাত’ বলার তাৎপর্য হচ্ছে তাতে রাতটির পরিমাপের ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য স্থাপন বা সমীকরন করা। আধুনিক পরিভাষায় এরূপ রাতকে বলা হয় equinox or night of equation or equinoctial night.
প্রতি বছর দুটি equinox হয়। একটিকে বলা হয় March equinox (19, 20 or 21 March) এবং অন্যটিকে বলা হয় September equinox (21, 22 or 23 September)। ঋতুর দিক থেকে এর একটিকে Spring or Vernal equinox এবং অন্যটিকে Autumn or Fall equinox বলা হয়।
হারাম মাসসমূহের মুল হারাম বিষয় হলো বন্য প্রাণী শিকার না করা। অর্থাৎ এ সময়কাল হচ্ছে বন্য প্রাণীদের প্রজননের জন্য নাজুক ঋতু (Delicate season for mating and breeding of wild animals)। বন্য প্রাণী সংরক্ষণের প্রসঙ্গ এবং রমাদান শব্দের অর্থ অনুসারে প্রতীয়মান হয় যে, Autumn or Fall equinox এর তুলনায় Spring or Vernal equinox এর মধ্যেই লাইলাতুল কদর সাব্যস্ত হওয়ার শর্ত পাওয়া যায়। অর্থাৎ লাইলাতুল কদর হচ্ছে Spring or Vernal equinox.
কুরআন নাজিলের লাইলাতুল কদর ছিল এমন একটি রাত যাতে ফজর উদয় পর্যন্ত শান্তিময় প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় ছিল (৯৭:৫)। শান্তিময় প্রাকৃতিক পরিবেশের শর্তানুসারে বুঝা যায় যে, এটি ছিল গাছিক্ব বা অন্ধকার রাতের সম্পূর্ণ বিপরীত, যেহেতু অন্ধকার রাত ভয়াবহ বিধায় তা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে (সূরা ফালাক্ব, ১১৩:৩)। সুতরাং লাইলাতুল কদর ছিল The spring equinox of brightest full supermoon glowing with the intensity of light. - এ সম্ভাবনাই সবচেয়ে দাবি রাখে। আল্লাহই মহাজ্ঞানী এবং তিনি ভালো জানেন।
যেহেতু যৌক্তিক অভিলক্ষণ অনুসারে মাসটির সাক্ষ্য দেয়ার বিষয় রয়েছে, তাই এক্ষেত্রে কুরআনের বিভিন্ন তথ্য এবং বাস্তব ঋতু ও অন্যান্য অবস্থার সমন্বয়ের ভিত্তিতেই মাসটির অভিলক্ষণ চিহ্নিত হবে। আমাদের গবেষণালব্ধ তথ্য অনুসারে এক্ষেত্রে মাসটিকে চিহ্নিত করার জন্য যেসব লক্ষণকে বিবেচনা করা প্রয়োজন তাহলো: যেন মাসটিকে বসন্তের প্রথম মাস হিসেবে সাব্যস্ত করা যায় তথা যেন মাসটির গণনা Spring equinox থেকে বা তার পূর্বাপর নিকটবর্তী সময় থেকে শুরু হতে পারে।
অবশ্য পূর্বে ওজরবশত মাসটিকে তার হুবহু অবস্থানে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কখনো কখনো অনিচ্ছাকৃতভাবে সামান্য ব্যতিক্রম হলে আমরা সেটাকে দোষনীয় হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি না। যেহেতু সূরা মুজজামমিল ৭৩:২০ আয়াতে বলা হয়েছে, “আল্লাহ রাত ও দিনের পরিমাপ নির্ধারণ করেন। তিনি জানেন যে, তোমরা তা হুবহু হিসাব করতে পার না। সুতরাং তিনি তোমাদের উপর (ওজরের ক্ষেত্রে) ক্ষমাপরবশ।”
তবে বর্তমানে বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আগে থেকেই পূর্ণিমার অবস্থান এবং Spring equinox এর তারিখ সম্পর্কে যথাযথ তথ্য জেনে নেয়া অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে। তাই বর্তমানে এ বিষয়ে অগ্রিম শতবর্ষ ক্যালেন্ডারও সংগ্রহে রাখা যেতে পারে, যেন যুগোপযোগী পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে যথাসময়ে হারাম মাসসমূহের বিধান পরিপালনের ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয়।
Full Supermoon of Spring / vernal equinox কেমন হয়ে থাকে, তা সম্পর্কে ধারণা অর্জনের জন্য নিম্নে একটি আর্টিকেল সংযুক্ত করা হলো।
Super Warm Moon: Catch its glimpse tonight
March 20, 2019 by Sameer
Hyderabad: On the horizon of Hyderabad City, residents will be able to watch the unique phenomenon of full Moon tonight but it will not be so near the Earth as it was in February last.
In astronomical terms, it is called “Super Moon” or “Full Moon”. Generally, the first Moon of the month of March is called “Warm Moon”. The Super Moon will therefore be a Warm Moon.
According to Dr. B.G. Siddarth, Director of Birla Planetarium, the Warm Moon will continue to glow with full light on the first day of the Spring.
He further told that at 9:43 p.m. tonight, “Super Warm Moon” will glow with its fullest intensity of light. It will lit the entire Sky.
It is reported that it is the proclamation of the commencement of Spring Season in the north hemisphere of the globe. It marks the beginning of Autumn Season in which trees start shedding leaves. From today onwards, temperature will start increasing. The underground creepers and earthworms will now start coming out from the ground.(5)
(5) Link: https://archive.siasat.com/news/super-warm-moon-catch-its-glimpse-tonight-1478977/
শাহরু রমাদান যেমন বসন্তের একটি মাস তেমনি শাহরু রমাদানকে অনেকে কুরআনের বসন্ত বা কুরআনময় বসন্ত নামেও চিহ্নিত করে থাকেন।(৬)
(৬) এ বিষয়ে ধারণা পেতে এ দুটি লিংকের আর্টিকেল দেখা যেতে পারে: https://saudigazette.com.sa/article/88822 http://en.imam-khomeini.ir/en/c104_12456/Ask_Question/Religious_Argumentation/Why_the_holy_month_of_Ramadan_is_called_as_spring_of_Quran_
উত্তর গোলার্ধ ও দক্ষিণ গোলার্ধের হারাম মাসসমূহ এবং রমাদান ও হজ্জ
উত্তর গোলার্ধের হারাম মাসসমূহ হচ্ছে উত্তর গোলার্ধের বসন্তের প্রথম মাস (রমাদান) থেকে চতুর্থ মাস পর্যন্ত। তেমনি দক্ষিণ গোলার্ধের হারাম মাসসমূহ হচ্ছে দক্ষিণ গোলার্ধের বসন্তের প্রথম মাস (রমাদান) থেকে চতুর্থ মাস পর্যন্ত। রমাদানের মাসে আল কুরআন নাজিল হয়েছে এবং তাই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, এ মাসের সাথে সম্পর্কিত সিয়ামের বিধান পালনের জন্য প্রত্যেককে নিজ নিজ অঞ্চলের সাপেক্ষে এ মাসের অভিলক্ষণ প্রত্যক্ষ করলে বা অভিজ্ঞান পেলে মাসটিকে সিয়ামের মাধ্যমে অতিবাহিত করতে হবে। যেহেতু উত্তর গোলার্ধে মার্চ মাসে এ মাসের অভিলক্ষণ পাওয়া যাবে, অন্যদিকে দক্ষিণ গোলার্ধে সেপ্টেম্বর মাসে এ মাসের অভিলক্ষণ পাওয়া যাবে, তাই উত্তর গোলার্ধের রমাদানের মাস মানে হলো মার্চ মাস এবং দক্ষিণ গোলার্ধের রমাদানের মাস মানে হলো সেপ্টেম্বর মাস।
রমাদানের মাস থেকে শুরু করে চারমাস হারাম মাস। সুতরাং উত্তর গোলার্ধে মার্চের মাঝামাঝি থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত হারাম মাস। আর দক্ষিণ গোলার্ধে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত হারাম মাস। হারাম মাসসমূহে বন্য প্রাণী শিকার করা যাবে না এবং মাসগুলো বিধিবদ্ধ যুদ্ধবিরতির মাস হিসেবে সংরক্ষিত।
হজ্জের মাসসমূহ হচ্ছে কা’বা (আল বাইতুল হারাম) এর অবস্থান সাপেক্ষে তথা উত্তর গোলার্ধের রমাদান পরবর্তী তিনটি মাস। দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে যারা হজ্জ করবে তারাও উত্তর গোলার্ধের রমাদান পরবর্তী তিন মাসে কা’বায় হজ্জ করতে যাবে, যেহেতু হজ্জ মানেই হলো আল বাইতের হজ্জ তাই হজ্জের মাসসমূহ আল বাইতের অবস্থানগত ঋতুচক্র সাপেক্ষেই নির্ধারিত হবে।
সুতরাং উত্তর গোলার্ধের ক্ষেত্রে হারাম মাসসমূহ এবং সিয়ামের মাস ও হজ্জের মাসসমূহ একই সময়কালের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে দক্ষিণ গোলার্ধে হারাম মাসসমূহের মধ্যে সিয়ামের মাস অন্তর্ভুক্ত হলেও হজ্জ করার ক্ষেত্রে তাদেরকে উত্তর গোলার্ধের সাপেক্ষে নির্ধারিত হজ্জের মাসসমূহে হজ্জ করতে হবে।
সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, হারাম মাসসমূহ হলো বন্য পশু সংরক্ষণের সাথে সম্পর্কিত মাসসমূহ এবং এসব মাসে যুদ্ধবিগ্রহও বন্ধ থাকবে। হারাম মাসসমূহের প্রথম মাস হলো বসন্তের প্রথম মাস বা রমাদানের মাস, যাতে সিয়াম হবে। আর বিশ্বকেন্দ্ররূপ পবিত্র প্রতিষ্ঠান (আল বাইতুল হারাম বা কা’বা) এর ভৌগোলিক অবস্থানগত ঋতুচক্র সাপেক্ষে হারাম চারমাসের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ মাসে তথা পরিজ্ঞাত তিনটি মাসে হজ্জ সম্পাদিত হবে। এভাবে, কা’বার ভৌগোলিক অবস্থানগত ক্ষেত্রে সিয়ামের মাস এবং হজ্জের মাসসমূহকে হারাম মাসসমূহের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত করা হয়েছে। অন্যদিকে হজ্জের মাসসমূহ সারা বিশ্বে একই হলেও, রমাদানের মাস এবং হারাম মাসসমূহ স্ব-স্ব অঞ্চল সাপেক্ষে নির্ধারিত হবে।
‘শাহরু রমাদানে সিয়াম সংখ্যা কত?’ এ প্রশ্নের উত্তরে একটি ধারনা তত্ত্ব হলো ‘শাহরু রমাদানে পুরো মাস নয়, বরং মাত্র ১০ দিন সিয়াম পালন করা বাধ্যতামূলক’। ইতোপূর্বে আমরা শাহরু রমাদানে পুরো মাস তথা ২৯ বা ৩০ দিন যে বর্ষে রমাদানের মাস যতদিনে হয় ততদিন সিয়াম পালন করার উপলব্ধির দলীল বিশ্লেষণ করেছি। এ পর্যায়ে এ প্রসঙ্গে থাকা ১০ সিয়াম তত্ত্বের স্বরূপ ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে করছি।
১০ সিয়াম তত্ত্বের পেছনে কার্যকর থাকা যুক্তিসমূহ
‘শাহরু রমাদানে পুরো মাস নয়, মাত্র ১০ দিন সিয়াম পালন করা বাধ্যতামূলক’ এই তত্ত্বের পেছনে যে যুক্তিসমূহ কার্যকর ছিলো তা নিম্নরূপ:
১. ২:১৮৪ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ যার অনুবাদ সাধারণত করা হয় ‘নির্দিষ্ট কয়েকদিন’। নির্দিষ্ট কয়েকদিন কি করে একমাস হতে পারে? বরং তা তো একমাসের চেয়ে কম বা সর্বোচ্চ তার তিন ভাগের এক ভাগ হতে পারে।
২. সাধারণত ‘মা’দূদাত’ শব্দ আরবি ভাষারীতিতে দুহাতের আঙ্গুলসংখ্যায় গণনাযোগ্য এমন সামান্য গণনার জন্য ব্যবহারের রীতি রয়েছে। শব্দটির গঠন এবং অর্থগত ভাব (গণনাযোগ্যতা এবং স্বাক্ষর নিরক্ষর সবার জন্য সহজ শর্তে) থেকে এরূপ রীতির প্রচলন। আর আল কুরআনেও দেখা যায়, ১২:২০ আয়াতে নবী ইউসুফকে তার বাল্যবয়সে যে কাফেলা বিক্রি করে দিয়েছে তারা তাঁকে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করেছে, তারা তাঁর বেশি দাম পাওয়ার আশা করে নি, তারা তাঁকে ‘দারাহিমা মা’দূদাত’ বা ‘নির্দিষ্ট কয়েক দিরহামে’ বিক্রি করে দিয়েছে। এ কুরআনিক প্রয়োগ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ‘মা’দূদাত’ মানে ‘নির্দিষ্ট কয়েকটি’, সামান্য বা অল্প কয়েক।
৩. ২:২০৩ আয়াতেও ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং তাতে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র তিনদিনের জন্য যা সমগ্র আয়াতটি পড়লে স্পষ্ট বুঝা যায়। যেহেতু ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ বহুবচন, তাই এর নিম্নসীমা ৩ হবে এটাই স্বাভাবিক।
৪. ২:৮০ আয়াত এবং ৩:২৪ আয়াতে ইহুদিদের উক্তি উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা বলে ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ (নির্দিষ্ট কয়েকদিন) ছাড়া আমরা জাহান্নামের আগুনে থাকবো না। তারা নিশ্চয় একমাস বুঝাতে ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ নিজেরা জাহান্নামে থাকবে এ কথা বুঝায়নি, বরং অল্প কয়েকদিন জাহান্নামে থাকবে এটাই বুঝিয়েছে, যা আয়াতে উল্লেখিত বক্তব্যের ধরন থেকে বুঝা যায়।
৫. ২:১৮৫ আয়াতে বলা হয়েছে যে, “আল্লাহ তোমাদের জন্য কঠিনতা চান না, তিনি তোমাদের জন্য সহজতা চান এবং যেন তোমরা সংখ্যা পূরণ করতে পারো (ওয়ালিতুকমিলুল ইদ্দাতা)”। এখানে সংখ্যাকে পূর্ণ করতে (তুকমিলু) করতে বলা হয়েছে। পূর্ণ সংখ্যা হচ্ছে দশ (১০)। কারণ ১০ এ এসে গণনা বা সংখ্যা পূর্ণ হয়ে আবার এক দশ এক = এগারো, এভাবে সংখ্যার হিসাব চলতে থাকে এবং তা অনন্ত ধারায় চলতে পারে। কিন্তু প্রতি দশে একটি পূর্ণতা বা Round figure। এ বিষয়টি নিশ্চিত হয় ২:১৯৬ আয়াতে হজ্জের সময় একটি বিশেষ প্রসংগে তিনদিন ও সাতদিন মোট দশদিনের সিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, “তিলকা আশারাতুন কামিলাতুন” (উহা দশ, পূর্ণতাপ্রাপ্ত)। এখানে ২:২৮৫ আয়াতে বর্ণিত ‘তুকমিলু’ শব্দের সাথে সামঞ্জস্যশীল ‘কামিলাতুন’ শব্দ ব্যবহার হয়েছে। যার দ্বারা বুঝা যায় যে, ২:২৮৫ আয়াতে ইদ্দাত/ সংখ্যাকে/ গণনাকে পূর্ণ করার যে নির্দেশনা রয়েছে তা পূর্ণ হবে ১০ এ এসে। অন্য কথায় বলা যায়, ‘আইয়ামাম মা’দূদাতের’ সর্বনিম্ন সীমা যেমন ৩ দিন, তেমনি এর সর্বোচ্চ সীমা ১০ দিন।
৬. আরেকটি বিষয় আয়াতটিতে (২:১৮৫) আছে যে, আল্লাহ সহজতা চান, কঠিনতা নয়। এক মাসের তুলনায় ১০ দিনের মধ্যে সহজতা রয়েছে, কারণ এটি একদিকে সিয়ামের একটা পূর্ণ কোর্স যেমন সম্পন্ন করতে কার্যকর অন্যদিকে তেমনি সিয়ামকে উপলক্ষ করে বর্তমানে যেভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা, কর্মে নিয়োগ স্থগিতকরণ এবং আচ্ছামতো ইফতার সেহেরি খাওয়ার ধুম পড়ার মাধ্যমে সিয়ামের উদ্দেশ্য পরিপন্থী কঠিনতার পরিবেশ তৈরি করে তা থেকে মুক্ত রাখবে।
৭. প্রশ্ন হতে পারে যে, ২:১৮৫ আয়াতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি মাসটির (মানে রমাদান মাসের) সাক্ষ্য দিবে, সে তাতে (মানে রমাদান মাসে) সিয়াম পালন করবে। তাহলে কিভাবে পুরো রমাদান মাসের পরিবর্তে ১০ দিন সিয়াম পালন করবে? এর উত্তরে দুটি কথা বলা যায়। (ক) রমাদান মাসে কুরআন নাযিল এবং লাইলাতুল কদরে কুরআন নাযিল। সুতরাং রমাদান মাসের একটি রাতে নাযিল হওয়া সত্ত্বেও বলা হয়েছে যে, কুরআন রমাদান মাসে নাযিল হয়েছে। এর মানে এ নয় যে, পুরো মাসজুড়ে কুরআন নাযিল হয়েছে। (খ) যদি বলা হয় ফেব্রুয়ারি মাসে এস এস সি পরীক্ষা, এর মানে এ মাসের দশদিনে হোক বা পনেরো দিনে হোক বা পুরো মাস হোক, সব অবস্থায় কথাটি শুদ্ধ থাকে। কেউ কেউ বলেন যে, ‘ফালইয়াসুমহু’ এর ‘হু’ দ্বারা পুরো মাস সিয়াম হবে, কারণ না হলে হতো ‘ফীহি’ বা উহার মধ্যে। কিন্তু এ কথাও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ কুরআন প্রসংগে বলা হয়েছে, “লা রয়বা ফীহি’ (উহার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই)। এর মানে কুরআনের কোনো কোনো অংশে সন্দেহ নেই তা নয়, বরং কুরআনের কোনো অংশেই সন্দেহ নেই। সুতরাং ‘হু’ আর ‘ফীহি’ এর যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। এ দুটির ব্যবহার বাক্য অনুসারে অর্থ হবে, স্থায়ী কোন স্থির অর্থ হবে না যে, হু মানেই পুরো, ফীহি মানেই কোনো অংশ। বরং ‘হু’ মানে পুরো বা অংশবিশেষে এবং ‘ফীহি’ মানেও পুরো বা অংশবিশেষে হতে পারে।
৮. যদি প্রশ্ন করা হয় যে, সিয়ামের সংখ্যা কত হবে তা কেন হজ্জ সম্পর্কিত ২:১৯৬ আয়াত থেকে নিতে হবে? এর উত্তর হচ্ছে, কোনো এক প্রসংগে যা বলা হয়, তাতে এমন তথ্য থাকা সম্ভব যা অন্য ক্ষেত্রেও কাজে লাগে। আর কুরআনে একই আয়াতে একই বিষয়ের সকল তথ্য উল্লেখ করে দেয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়নি। যেমন ২:১৮৩ আয়াতে সিয়ামের প্রসংগ শুরু হলেও সিয়াম পালন কিভাবে করা হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে ২:১৮৭ আয়াতে।
৯. প্রচলিত আছে যে, ২:১৮৪ আয়াত দ্বারা আশুরার তিনটি রোযাকে ফরজ করা হয়েছিল এবং ২:১৮৫ আয়াত দ্বারা তা রহিত হয়েছে। আরো প্রচলিত আছে যে, ২:১৮৫ আয়াত অনুযায়ী রমাদান মাসে কি পুরো মাস সিয়াম করতে হবে নাকি ২:১৮৪ অনুযায়ী রমাদান মাসে কয়েকদিন সিয়াম পালন করলেই তা রমাদান মাসে সিয়াম হিসেবে যথেষ্ট হয়ে যাবে তা একমাত্র হাদীসের মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব যে, রমাদানের চাঁদ দেখে সিয়াম শুরু এবং ঈদের / শাওয়ালের চাঁদ দেখে সিয়াম শেষ। সুতরাং হাদীস অনুযায়ী এখন ২:১৮৪ আয়াত রহিত। কিন্তু হাদীসের মাধ্যমে কুরআনের আয়াতকে এভাবে রহিত করার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এছাড়া কুরআনের একটি আয়াতের সাথে অন্য একটি আয়াতে স্ববিরোধ নেই (৪:৮২), সুতরাং একটি দ্বারা অন্যটি রহিত হয়েছে মর্মে প্রচারণাটি মিথ্যা।
১০. ৮৯:২ আয়াতে দশ রাতের শপথ করা হয়েছে। প্রচলিত ধারণামতে এটি হলো জিলহজ্জের ১০ টি রাত। আবার এটাও দেখা যায় যে, রমাদান মাসে ১০ রাত এতেকাফ করার একটি রীতি রয়েছে। আর আল কুরআনেও ২:১৮৭ আয়াতে সিয়ামের রাতের প্রসংগে উল্লেখ আছে ‘লাইলাতাস সিয়াম’। তাই যদি সিয়াম ১০ হয়, তবে লাইলাতাস সিয়ামও ১০ হয় এবং ৮৯:২ আয়াতের দশ রাত দ্বারা এ দশ রাতকে বুঝানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
সারসংক্ষেপ : রমাদান মাসে সিয়াম পালন করতে হবে নির্দিষ্ট কয়েকদিন তথা ১০ দিন, যা মাসের সাক্ষ্য দেয়ার মাধ্যমে তথা শুরু থেকে শুরু হবে এবং যে রোগগ্রস্ত হওয়ায় বা সফরে থাকায় গ্যাপ যাবে সে রমাদান মাসের বাকি দিনগুলোর মধ্যকার দিনগুলোতে সে সংখ্যা পূরণ করে নিবে।
দশ সিয়ামের উপলব্ধির কার্যকারণ ও উপস্থাপনার যৌক্তিকতা
উপর্যুক্ত যু্ক্তিধারা অধ্যয়ন করলে ১০ সিয়ামের উপলব্ধি কিভাবে ও কেন তৈরি হয়েছে তা বুঝা মোটেই কঠিন নয়। যারা কুরআনের বিধি বিধানের প্রচলিত ব্যাখ্যা পর্যালোচনা সাপেক্ষে তা গ্রহণ করা অথবা নতুন উপলব্ধিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের মধ্যেও আপাত সিদ্ধান্তগত ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। তার মধ্যে ‘শাহরু রমাদানে সিয়াম সংখ্যা কত?’ এ প্রশ্নের ক্ষেত্রেও এরূপ ভিন্নতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যেসব উপলব্ধি উপস্থাপিত হয়েছে তার মধ্যে নতুন করে জনপ্রিয় হওয়া একটি তত্ত্ব হলো ‘১০ সিয়াম তত্ত্ব। আমাদের বর্তমান গবেষণায় পূর্ণ মাস সিয়ামকে যৌক্তিক হিসেবে প্রতীয়মান হলেও ‘১০ সিয়াম তত্ত্ব’ উপস্থাপনকে নেতিবাচক সমালোচনার করা সমীচীন মনে করি না। কারণ যদি আমাদের বর্তমান উপলব্ধি সঠিক হয় এবং ‘১০ সিয়াম তত্ত্ব’ ভুল হয়, সেক্ষেত্রেও ‘পূর্ণ মাস সিয়ামের’ গ্রহণযোগ্য যুক্তির অভাবে এবং ‘১০ সিয়াম তত্ত্বকে’ কুরআনের আয়াতসমূহের যৌক্তিক তথ্য বিন্যাসের ফলাফল হিসেবে প্রতীয়মান হওয়ার প্রেক্ষিতে তা উপস্থাপিত হওয়া দোষনীয় নয়। কোনো বিষয়ে সাময়িকভাবে কোনো ভুল উপলব্ধি বা অনুসিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে এবং উপস্থিত গবেষণা অনুসোরে তা শেয়ার করা যেতে পারে। তারপর যদি পরবর্তী গবেষণামূলক যাচাইয়ের মাধ্যমে তার ত্রুটি চিহ্নিত হয়, তাহলে তা পরিহার করে অধিক যুক্তিভিত্তিক তথ্যই গ্রহণ করতে হবে। এ নীতিগত পদ্ধতি অনুধাবনের জন্য নিম্নে কয়েকটি বিশেষ পয়েন্টে দৃষ্টি আকর্ষন করা হলো:
(১) নবী ইবরাহীম যখন সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য একটা চিন্তাপ্রক্রিয়ায় ক্রমান্বয়ে কাওকাব (গ্রহ), ক্বামার (চন্দ্র) ও শামসকে (সূর্য) নিজের রব (প্রভু) বলেছিলেন (৬:৭৬-৭৮), পরবর্তীতে কি আল্লাহ এজন্য তাঁকে দায়ী করেছিলেন? নাকি প্রথমেই (৬:৭৫) আল্লাহ এটাকে তিনি নিজে নবী ইবরাহীমকে একটা যৌক্তিক পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ায় ‘মালাকূতাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ’ বা ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর পরিচালনব্যবস্থাকে ‘নুরিয়া’ বা পর্যবেক্ষণ করানোর মতো বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন?
(২) ‘১০ সিয়াম তত্ত্ব’ উপস্থাপনের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীরা কি আল কুরআনের প্রতিটি বিধানের সঠিক তাৎপর্য এখনি বলতে পারবেন? কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছার পূর্বে আপাত সিদ্ধান্ত অনুসারে অন্তর্বর্তীকালে চলা কি সাধ্যসীমায় আসার পূর্বেকার অবস্থা নয়? ৭:৪২ আয়াতে আল্লাহ কি ঈমান ও আমলে দায়-দায়িত্বের প্রকৃতি প্রসংগে বলেননি যে, তিনি কাউকে সাধ্যাতীত বিষয়ে দায়ী করবেন না?
(৩) ২:১৪৩ আয়াত অনুযায়ী, আল্লাহর নিকট কি কাজের বাহ্যিক আকার-আকৃতির তুলনায় কর্মনীতিটিই প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়? যে বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য তিনি নিজেই সাময়িকভাবে ক্বিবলার পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন এবং পরবর্তী পরিবর্তনের মাধ্যমে মূল ক্বিবলায় ফিরিয়ে দিয়ে তা চূড়ান্ত করে দিয়েছেন। তারপর নীতিগত অবস্থানের পরিবর্তন না হলে বাহ্যিক কর্মের পার্থক্যের কারণে যে আল্লাহর কাছে ঈমান ব্যর্থ হবে না আয়াতের শেষদিকে তাও তিনি উল্লেখ করেছেন।
(৪) যারা কিতাবের তথ্য গোপন করে, তাদের প্রসংগে বলা হয়েছে যে, “আল্লাহ কিতাবে যে তথ্য নাযিল করেছেন যারা তা গোপন করে এবং বিনিময়ে তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে, তারা নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া কিছু খাচ্ছে না, আর কিয়ামাত দিবসে আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না এবং তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি” (২:১৭৪)। তাদের প্রসংগে আরো বলা হয়েছে, “নিশ্চয় আমি যেসব স্পষ্ট নিদর্শন ও হিদায়াত অবতীর্ণ করেছি মানুষের জন্য কিতাবে উহা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার পরও যাহারা উহা গোপন রাখে আল্লাহ তাহাদেরকে লা’নত দেন এবং অভিশাপকারীরাও তাদেরকে লা’নত দেয়। কিন্তু যাহারা তাওবা করে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে আর সত্যকে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে, ইহারাই তাহারা যাহাদের তাওবা আমি কবুল করি। আমি অতিশয় তাওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু” (২:১৫৯-১৬০)। এমতাবস্থায়, যারা আয়াতের তথ্য বুঝার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে উপলব্ধিগত দুর্বলতা থাকলে, পরে উপলব্ধিতে সুষ্পষ্টতা অনুভব করলে তা সামনে নিয়ে আসে, কিভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে তার তোয়াক্কা না করে, তাদের বিষয়টি কি যারা আয়াতের তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করে অথচ পরে তাওবা করে আবার প্রকাশ করে দেয়, তাদের চেয়েও নিম্নমানের বলে বিবেচিত হতে পারে?
(৫) কুরআন তো আল্লাহ ক্রমে ক্রমে নাজিল করেছেন, যেখানে অনেক আয়াত আছে বিভিন্ন প্রশ্ন তৈরির প্রেক্ষিতে তার উত্তর হিসেবে নাজিল হয়েছে এবং এটাও বলা হয়েছে যে, কুরআন নাজিলকালীন সময়কালে (ইতিহাসসূত্রে, ২৩ বছর সময়কালের মধ্যে) যদি কোনো বাহুল্য প্রশ্ন করা হয়, তার প্রেক্ষিতে আল্লাহ কিছু নির্ধারণ করে দিলে তা তোমাদের জন্যই কষ্টকর হবে, তাই এরূপ বাহুল্য প্রশ্ন থেকে বিরত থাক। তাহলে এ কুরআন নাজিল সমাপ্ত হওয়ার আগে যারা যতটুকু নাজিল হয়েছিল তাতে থাকা তথ্যগুলোতে ঈমান করেছে এবং তাতে থাকা আমল পরিপালন করেছে তারা কি তাদের নিজেদের সময়গত অবস্থান অনুযায়ী যথাস্থানে ছিলো না? আল্লাহ কি কাজের সংখ্যা নিয়ে হিসাব করবেন নাকি আনুপাতিক পদ্ধতিতে? ৬:১৬৫ আয়াত থেকে এ বিষয়টি অত্যন্ত সুষ্পষ্ট যে, প্রত্যেক ব্যক্তির সুযোগ-সুবিধা, যোগ্যতা-সামর্থ্য সম্পূর্ণ বিবেচনায় রেখে তার পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে।
১০ সিয়াম তত্ত্বের পর্যালোচনা
এ পর্যায়ে ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’, ‘ওয়ালিতুকমিলুল ইদ্দাত’, ‘তিলকা আশারাতুন কামিলাতুন’, এবং ‘ওয়া লায়ালিন আশরিন’ এ বিষয়গুলোর উপর আলোকপাতের মাধ্যমে ‘দশ সিয়াম তত্ত্বের' পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হলো।
আইয়ামাম মা’দূদাত (২:১৮৪)
আইয়ামাম মা’দূদাত এর অর্থ বুঝার জন্য মা’দূদাত শব্দটি যে শব্দমূল থেকে গঠিত হয়েছে (আইন দাল দাল) তা থেকে গঠিত শব্দসমূহ, তার অর্থ এবং কুরআনের কোন কোন আয়াতে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা উল্লেখ করা হলো:
১. আদ্দান = গণনা। ১৯:৮৪ ও ১৯:৯৪।
২. আদাদ = সংখ্যায়ন। ১০:৫, ১৭:১২, ১৮:১১, ২৩:১১২, ৭২:২৪, ৭২:২৮।
৩. ইদ্দাত = গণনাচক্র। ২:১৮৪, ২:১৮৫, ৯:৩৬, ৯:৩৭, ১৮:২২, ৩৩:৪৯, ৬৫:১, ৬৫:৪, ৭৪:৩১।
৪. আদ্দীন = গণনাকারীগণ। ২৩:১১৩।
৫. মা’দূদ = গণনাকৃত / স্থিরিকৃত। ১১:১০৪।
৬. মা’দূদাত (একবচন ও বহুবচন) = গণনাকৃত/ স্থিরিকৃত। ২:৮০, ২:১৮৪, ২:২০৩, ৩:২৪, ১১:৮, ১২:২০।
৭. আদ্দা (ক্রিয়া) = গণনা করা। ১৪:৩৪, ১৬:১৮, ১৯:৮৪, ১৯:৯৪, ২২:৪৭, ৩২:৫, ৩৮:৬২।
৮. আদ্দাদা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ২) = বারবার গণনা করা। ১০৪:২।
৯. তা’তাদ্দূনা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৮) = গণনা করতে হবে। ৩৩:৪৯।
মা’দূদাত শব্দটির অনুবাদ যেভাবে ‘কয়েক/ অল্প কিছু’ লেখা হয়, প্রকৃতপক্ষে শব্দটির শব্দমূল থেকে উৎপত্তিগত অর্থ হিসেবে তা যথার্থ নয়। তবে ব্যবহারিক / প্রায়োগিক ভাব থেকে বা পূর্বাপর বক্তব্যের সাপেক্ষে এরূপ অর্থ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু এরূপ দ্বিতীয় পর্যায়ের (Secondary) অর্থ অনুসারে তাকে কোনো নির্দিষ্ট সীমায় সীমিত করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ভিত্তির প্রয়োজন হবে। ৩০ দিনকে সাধারণত কয়েক দিন বলা হয় না, এ যুক্তিতে ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ বলতে ৩০ দিন হতে পারে না, কথাটি চূড়ান্তভাবে বলা যেতে পারে না। কারণ ১ মাসকে ৩০ দিনে রূপান্তরিত করে উল্লেখ করলে সেক্ষেত্রে ১২ মাস (১ চান্দ্রবর্ষ) বলতে ৩৫৪ দিনকে বুঝাবে। সেক্ষেত্রে তুলনামূলক অবস্থানে তথা ৩৫৪ দিনের তুলনায় ৩০ দিনকে ‘কয়েকদিন বা অল্প কিছু দিন’ বুঝানো যেতে পারে। এছাড়া যদি শব্দটির মূল অর্থ ‘গণনাকৃত দিনসমূহ’ অর্থকে প্রাধান্য দেয়া হয় সেক্ষেত্রে রমাদানের সিয়ামের ক্ষেত্রে ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ দ্বারা বুঝাবে ‘একটি মাস দ্বারা সীমাবদ্ধ গণনাকৃত দিনসমূহে’।
ওয়ালিতুকমিলুল ইদ্দাত (২:১৮৫)
আমরা উপর্যুক্ত তালিকায় দেখেছি ‘ইদ্দাত’ মানে গণনাচক্র। বিষয়টি নিম্নে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
৯:৩৬ আয়াতে বলা হয়েছে যে, “নিশ্চয় মাসসমূহের ইদ্দাত/ গণনাচক্র আল্লাহর নিকট বারো মাস, আল্লাহর কিতাবে, আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে, .....”। আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে মাস সংখ্যা ১২ নয়, বা এটাও বলা হয়নি যে, এক বছরে মাসের সংখ্যা/ গণনা ১২। বরং বলা হয়েছে ‘মাসসমূহের ইদ্দাত’ ১২ মাস। অর্থাৎ মাসসমূহের গণনাচক্র ১২ মাস। মানে ১, ২, ৩ এভাবে ১২ পর্যন্ত গণনা করলে একটি গণনাচক্র পুরো হয়ে যাবে, তারপর আবার ১ থেকে নতুন গণনাচক্র শুরু হবে। এভাবে মাসসমূহের ১ গণনাচক্রকে ১ বছর হয়, সেটা ভিন্ন কথা।
বিষয়টিকে এভাবে বুঝা যেতে পারে যে, ঘন্টাসমূহের গণনাচক্র ২৪ ঘন্টা। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় ১ দিন। সপ্তাহে দিনসমূহের গণনাচক্র ৭ দিন, অর্থাৎ ৭ দিনে ১ সপ্তাহ। মাসে দিনসমূহের গণনাচক্র ৩০ দিন, অর্থাৎ ৩০ দিনে ১ মাস। ইত্যাদি।
বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়, যখন আমরা খেয়াল করি যে, ৬৫:৪ আয়াতে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীদের সাথে সম্পর্কিত তাদের বিয়ের ক্ষেত্রে অপেক্ষার সময়কালকে বলা হয়েছে, ‘ইদ্দাতুহুন্না’ বা ‘তাদের ইদ্দাত’। একটি বিশেষ অবস্থার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, “ফাইদ্দাতুহুন্না ছালাছাতু আশহুর” অর্থাৎ “তাদের ইদ্দাত/ গণনাচক্র তিন মাস”। অর্থাৎ এক্ষেত্রে গণনাচক্র হবে তিন মাস তথা মাসগুলোকে ১ মাস, ২ মাস, ৩ মাস এভাবে ৩ মাস গণনা পূর্ণ করলে তাদের ইদ্দাত/ গণনাচক্র পূর্ণ হবে।
শাহর বলতে চান্দ্রমাসকে বুঝানো হয়, তাই শাহরের বা মাসের গণনাচক্র ১২ বলতে বুঝায় চান্দ্রবর্ষ ১২টি শাহর বা চান্দ্রমাসে পূর্ণ হয় এবং তারপর আবার নতুন গণনাচক্র বা নতুন চান্দ্রবর্ষ শুরু হয়। এটি একটি প্রাকৃতিক ঘটনাচক্র। কারণ মূলত একটি বর্ষের হিসাব নির্ভর করে পৃথিবীর বার্ষিক গতির উপর। তাই প্রাকৃতিক মূল বর্ষ হলো সৌরবর্ষ যা ৩৬৫ দিনে হয়ে থাকে। অন্যদিকে মাস হয় চন্দ্রচক্রের মাধ্যমে, যা ২৯ বা ৩০ দিনে হয়ে থাকে। একটি বর্ষে চাঁদের ১২ টি পূর্ণ চক্র তথা ১২ টি চান্দ্রমাস হয়ে থাকে। তাই একটি বর্ষের পূর্ণ মাস সংখ্যা ১২ হয়ে থাকে। চান্দ্রসৌরবর্ষ পদ্ধতির হিসাব নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একাধিক সৌরবর্ষকে চান্দ্রবর্ষসমূহের সাথে ঋতুগতভাবে সমন্বয় করার জন্য কোনো কোনো চান্দ্রসৌরবর্ষে একটি অধিমাস হিসেব করে ১৩ টি মাস হিসাব করা হয়, সেটি একটি ভিন্ন বিষয়। তাতে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১২ টি পূর্ণ চান্দ্রমাসের হিসাবের কোনো পরিবর্তন হয় না, বরং একাধিক সৌরবর্ষকে একাধিক চান্দ্রবর্ষের সাথে হিসেব সমন্বয় করা হয় মাত্র। বিষয়টি এ বইয়ের পরিশিষ্টে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
সুতরাং ইদ্দাত/ গণনাচক্র সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রেক্ষিতে হয়ে থাকে, যেক্ষেত্রে যেটি নির্ধারিত হয়, সেক্ষেত্রে তত পর্যন্ত গণনা করতে হবে, এটাই হলো ইদ্দাত/ গণনাচক্রের মূল বিষয়। এমতাবস্থায়, “ওয়ালিতুকমিলুল ইদ্দাতা” বা “যেন তোমরা ইদ্দাত/ গণনাচক্র পূর্ণ করো” বলতে কতদিন গণনা করতে হবে, তা নির্ধারিত হবে অন্য বক্তব্যের মাধ্যমে। তা যদি ১০ দিন নির্ধারণ করে দেয়া হয় তবে ১০ দিন, ১২ দিন নির্ধারণ করে দেয়া হয় তবে ১২ দিন এবং ৩০ দিন নির্ধারণ করে দেয়া হয় তবে ৩০ দিন পূর্ণ করতে হবে, এক্ষেত্রে যেটি নির্ধারণ করা হবে সেটি পূর্ণ করাই হবে ইদ্দাত / গণনাচক্র পূর্ণ করা।
যাদের আইয়ামাম মা’দূদাতে/ শাহরু রমাদানে রোগ বা সফরের কারণে কোন সিয়াম গ্যাপ যায় তারা যেন ‘মিন আইয়ামিন উখারা’তে বা ‘অন্য দিনসমূহে’ গ্যাপ যাওয়া সিয়ামের সমসংখ্যক সিয়াম পালন করে সে বিধান দেয়ার উদ্দেশ্য প্রসংগে ‘ওয়া লিতুকমিলুল ইদ্দাত’ বা ‘যেন তোমরা ইদ্দাত/ গণনাচক্র পূর্ণ কর’ কথাটি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত।
তিলকা আশারাতুন কামিলাতুন (২:১৯৬)
তিলকা আশারাতুন কামিলাতুন = উহা দশ, পূর্ণতাপ্রাপ্ত। ২:১৯৬ আয়াতে এ বাক্যের পূর্বের বক্তব্য অনুসারে, এখানে ১০ বলতে ৭ দিন + ৩ দিন = ১০ দিনকে বুঝিয়েছে। সুতরাং এখানে ১০ দিনকে পূর্ণতাপ্রাপ্ত বলা হয়েছে। কি হিসেবে পূর্ণতাপ্রাপ্ত? নির্ধারিত বিধানের মোট সময়কাল হিসেবে। এখন এ আয়াত থেকে “সংখ্যার পূর্ণতা ১০ এ এসে হয়” বলে তথ্য গ্রহণ করার অবকাশ নেই, তা বলা যায় না। বরং হিসাব পদ্ধতিতে সাধারণত সংখ্যার পূর্ণতা ১০ এ এসে হয়, এটাও স্বত:সিদ্ধ বাস্তবতা। কিন্তু বক্তব্যটি তার নিজস্ব বক্তব্য প্রসংগের বাহিরে অন্যত্র কাজে লাগানো যাবে কিনা তা নির্ভর করবে, অন্যত্র (যেমন রমাদানের সিয়াম সংখ্যা কত?) কাজে লাগানোর জন্য যদি কোন অবকাশ/ সুযোগ থাকে, তবে কাজে লাগানো যাবে। কিন্তু যদি সুনির্দিষ্ট তথ্যের মাধ্যমে কোন ক্ষেত্রে এ বক্তব্যকে কাজে লাগানোর অবকাশ রাখার পরিবর্তে বরং অবকাশ রহিত হয়ে যায়, তাহলে সেখানে এ তথ্যকে কাজে লাগিয়ে কোন তথ্যগত সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। যেমন, ইতোপূর্বের আলোচনায় প্রতীয়মান যে, ২:১৮৪ ও ২:১৮৫ আয়াত দ্বারা শাহরু রমাদানে পূর্ণ মাস সিয়াম পালন সাব্যস্ত হয়, তাই ‘তিলকা আশারাতুন কামিলাতুন’ বাক্যটি থেকে পাওয়া তথ্য ২:১৯৬ আয়াতের প্রসংগে সীমিত থাকবে, ২:১৮৫ আয়াতের ‘ওয়া লিতুকমিলুল ইদ্দাতা’ এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। ইতোপূর্বের আলোচনায় এটিও প্রতীয়মান হয় যে, ‘ওয়া লিতুকমিলুল ইদ্দাতা’ দ্বারা যে কোনো গণনাচক্র, যা নির্ধারণ করে দেয়া হয়, তা পূর্ণ করা বুঝায়, তা দ্বারা যেমন ১০ পূর্ণ করা বুঝানো যেতে পারে, তেমনি ৩০ পূর্ণ করাও বুঝানো যেতে পারে। এমতাবস্থায়, ২:১৮৪ ও ২:১৮৫ আয়াত অনুযায়ী, শাহরু রমাদানে সিয়াম সংখ্যা পূর্ণ মাস হওয়ায়, সেখানে ‘ওয়া লিতুকমিলুল ইদ্দাত’ বলতে ২৯ বা ৩০ দিন তথা মাসের দিনসংখ্যা পূর্ণ করা বুঝাবে। আর ২:১৯৬ আয়াতের ‘তিলকা আশারাতুন কামিলাতুন’ শুধুমাত্র ২:১৯৬ আয়াতের বক্তব্য প্রসংগেই প্রযোজ্য হবে, শাহরু রমাদানের সিয়াম সংখ্যার বিষয়ে নয়।
ওয়া লায়ালিন আশরিন (৮৯:২)
ওয়া লায়ালিন আশরিন আয়াতটির অর্থ হলো ‘শপথ দশ রাতের’।
সিয়াম যদি ১০ দিন হয়, তাহলে লাইলাতাস সিয়াম বা সিয়ামের রাত (২:১৮৭) হয় ১০ রাত। সেক্ষেত্রে ‘ওয়া লায়ালিন আশরিন’ বলতে ‘লায়লাতাস সিয়াম’ বা ‘সিয়ামের রাত’ কে বুঝাতে পারে, এ সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ইতোপূর্বের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শাহরু রমাদানে পূর্ণ মাস সিয়াম পালন করতে হবে। তাহলে লাইলাতাস সিয়ামও হয় পূর্ণ মাসের রাতসমূহ তথা ২৯ বা ৩০ রাত। এ অবস্থায় ‘ওয়া লায়ালিন আশরিন’ বলতে ‘লায়লাতাস সিয়াম’ বুঝাবে না।
.সাধারণত হাদীসের মাধ্যমে বলা হয় যে, “১০ রাত বলতে বুঝিয়েছে ‘মহররম মাসের প্রথম ১০ রাত, অথবা রমাদান মাসের শেষ ১০ রাত যখন এ’তেকাফ করা হয়, অথবা জিলহজ্জ মাসের প্রথম ১০ রাত”। অথচ এ তিনটি মতের একটির ক্ষেত্রে কুরআন থেকে দলীল নেই।
.তাহলে ‘ওয়া লায়ালিন আশরিন’ বা ‘দশ রাতের শপথ’ বলতে কি বুঝায়? প্রশ্নটির উত্তর নির্ণয়ের আগে আমরা যদি দেখি যে, এ ‘দশরাতের শপথের’ আগে পরে অন্য কি কি বিষয়ের শপথ রয়েছে এবং শপথের পরবর্তীতে কি বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, তাহলে ‘দশরাতের’ তাৎপর্য উপলব্ধি বা তা চিহ্নিত করার বিষয়টি সহজ হতে পারে।
.“শপথ ফজরের, শপথ দশ রাতের, শপথ জোড়ের ও বিজোড়ের, শপথ রাতের যখন তা যেতে থাকে। উহার মধ্যে কি বিবেকবান ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট কসম আছে?” (৮৯:১-৫)
এ বক্তব্য দেয়ার পর, আদ, সামুদ ও ফেরাউনের সমৃদ্ধ অবস্থা অথচ বিদ্রোহাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে তাদেরকে শাস্তি প্রদানের প্রসংগ আলোচিত হয়েছে। (দ্র : ৮৯:৬-১৪)
তারপর মানুষকে রিযিকের প্রাচুর্য ও অপ্রাচুর্য দেয়ার মাধ্যমে পরীক্ষা করা অথচ তাকে সে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করা এবং অন্যায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার বিষয় আলোচিত হয়েছে। (দ্র : ৮৯:১৫-২০)
তারপর তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে চূড়ান্ত বিচারের দিনে পাপীদেরকে শাস্তি দেয়া এবং পূণ্যবানদেরকে পুরস্কার দেয়ার বিষয় আলোচিত হয়েছে। (দ্র: ৮৯:২১-৩০)
এখন উপর্যুক্ত বক্তব্য কাঠামোর উপর দৃষ্টিপাত করলে বুঝা যায় যে, প্রথমে যে বিষয়গুলোর শপথ করা হয়েছে, তাতে উদ্দেশ্যমুখী অবস্থান্তর প্রক্রিয়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শপথের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার বিভিন্ন অবস্থার কারণ, তাদের কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন অবস্থার উপর ভিত্তি করে তাদের ফলাফলের বিভিন্ন অবস্থা এবং বর্তমান কর্মজীবনের পর চূড়ান্ত বিচারের অনিবার্যতা তুলে ধরা হয়েছে।
এ অবস্থান্তর প্রক্রিয়ার বিষয়টির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ‘দশ রাত’ বলতে ‘মাসের প্রতি দশ রাতকে’ বুঝানো হয়েছে মর্মেও একটি উপলব্ধি রয়েছে। সেই উপলব্ধির প্রেক্ষাপট ও সারকথা হলো: ৩৬:৩৯ এবং ৮৪:১৮-১৯ আয়াতে চাঁদের একটি ধারাক্রমিক পর্যায় অতিক্রমের মাধ্যমে হ্রাসবৃদ্ধির অবস্থান্তর প্রক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়টিকে ৮৯:১-৫ আয়াতে বর্ণিত শপথের বিষয়বস্তুর সাথে সমন্বিতভাবে বিবেচনা করলে একটি চিন্তাসূত্র পাওয়া যায়। সাধারণভাবে রাউন্ড ফিগারসম্পন্ন একটি পূর্ণ মাসের রাত সংখ্যা হলো ৩০ রাত, যাকে ৩ ভাগ করলে প্রতি ভাগে ১০ রাত পড়ে। প্রথম ১০ রাতে চাঁদের ক্রমবৃদ্ধি, মাঝের ১০ রাতে বৃদ্ধি ও হ্রাসের মধ্যবর্তী অবস্থা এবং শেষ ১০ রাতে চাঁদের ক্রমহ্রাসের ঘটনা ঘটে থাকে। তাই সাধারণভাবে ১০ রাত দ্বারা মাসের ১০ রাত ভিত্তিক বিভাগ ও প্রতি বিভাগের ১০ রাতকে বিবেচনা করা যেতে পারে।
তবে আমরা যদি কুরআনে ৮৯:২ আয়াত ছাড়া আর কোনো স্থানে সরাসরি ‘১০ রাত’ প্রসঙ্গ উল্লেখ থাকার বিষয় অনুসন্ধান করি, তাহরে দেখা যায় যে, এছাড়া একমাত্র ৭:১৪২ আয়াতে ‘১০ রাত’ এর উল্লেখ রয়েছে। যেহেতু ৮৯:২ আয়াত ছাড়া একমাত্র ৭:১৪২ আয়াতে ‘১০ রাত’ এর উল্লেখ রয়েছে, তাই অবশ্যই ঐ ১০ রাতই এক্ষেত্রে মূল বিবেচনাযোগ্য বিষয় বা ‘লক্ষণীয় ১০ রাত’ বলতে প্রধানত ঐ ১০ রাতকেই বুঝানো হয়েছে।
৭:১৪২ আয়াতে উল্লেখিত ১০ রাত একটি মানব জাতির প্রকৃত ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ ১০ রাত, যাতে একটি বিশেষ অবস্থান্তর সংঘটিত হয়েছিলো। আয়াতটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ মূসাকে ৩০ রাতের একটি প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করিয়ে তারি সাথে সাথে আরো ১০ রাতের বিশেষ সংযোজনের মাধ্যমে মোট প্রশিক্ষণকালকে (মীক্বাতকে) ৪০ রাতে পূর্ণ করা হয়েছিল। এতে যে অবস্থান্তর ঘটেছিল, তা হলো প্রথমে তাঁর যে মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি তার উপর ভিত্তি করে একটি সাধারণ কোর্স সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথেই পুনরায় ১০ রাতের বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্সের মাধ্যমে মোট প্রশিক্ষণ কোর্সের মীক্বাত/ নির্ধারিত সময়সীমার পরিপূর্ণতা বিধান। এটিও একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতির বা মাইন্ড ডেভেলপমেন্টের ধারাক্রম, যা কোন উদ্দেশ্যকে একটা যৌক্তিক ধারাবাহিকতা ও পদ্ধতিতে সুসম্পন্ন করার প্রক্রিয়া নির্দেশ করে। এই ১০ রাত এদিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ যে, এতে নবী মূসার সাথে আল্লাহর বাক্যালাপের পাশাপাশি তাঁকে তাঁর সম্প্রদায়ের জন্য ফলকসমূহের মধ্যে লিখিত উপদেশগ্রন্থ প্রদান করা হয়েছিলো (৭:১৪২-১৪৫)। সুতরাং সকল বিবেচনায় এ ‘১০ রাত’ প্রসঙ্গেই সূরা ফজরে শপথ করা হয়েছে এবং অবশ্যই বিবেকবানদের জন্য এতে সূরাটির সমগ্র বক্তব্য কাঠামোতে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যথেষ্ট শপথ রয়েছে।
আর লাইলাতাস সিয়ামে মাসজিদে এ’তেকাফের বিষয়ে কথা হলো, ২:১৮৭ আয়াতে সিয়াম ও লাইলাতাস সিয়াম প্রসংগের সাথে মাসজিদে এ’তেকাফের বিষয় উল্লেখ করায় রমাদানে এ’তেকাফের বিশেষ গুরুত্ব প্রতীয়মান হয়, যদিও এ’তেকাফের জন্য রমাদানকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। যদি ১০ দিনের একটি এ’তেকাফ কোর্স করা হয়, তা অবশ্যই ভালো, যদি কেউ পূর্ণ মাস এ’তেকাফ করে, তাও করতে পারে, এমনকি যদি কেউ পূর্ণ মাসের সাথে ১০ দিন বাড়িয়ে ৪০ দিন এ’তেকাফ করে নবী মূসার জন্য আল্লাহর নির্ধারিত প্রশিক্ষণ কোর্সের থেকে অনুপ্রেরণার প্রেক্ষিতে, তাতেও কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এসব ঊর্ধ্বক্রমের বিপরীতে যদি কেউ মাত্র ১ দিন এ’তেকাফ করে তাতেও আপত্তি নেই। সুতরাং ‘ওয়া লায়ালিন আশরিন’ দ্বারা এ’তেকাফের দশ রাত সরাসরি এভাবে সুনির্দিষ্ট করা যায় না। কারণ এ’তেকাফ যদি মাত্র ১ দিনও করা হয়, তারও অবকাশ আছে। এ’তেকাফের কোন দিনসংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়নি এবং এ’তেকাফ যে করতে হবে, তাও বাধ্যতামূলক করা হয়নি।
‘সিয়াম ১০ দিন বনাম পূর্ণ মাস’ প্রসঙ্গে দুটি প্রশ্ন
এ প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন হলো: ২:১৮৫ আয়াতে ‘যে অসুস্থ থাকবে বা সফরে থাকবে তার ইদ্দাত/ গণনা অন্য মাসে’ না বলে ‘অন্য দিনসমূহে’ বলা হলো কেন? এর থেকে কি বুঝা যায় না যে, সিয়াম রমাদান মাসেই করতে হবে?
সাধারণ বিবেচনায় বুঝা যায় যে, ‘অন্য মাসে’ বললেও এ প্রশ্ন তৈরি হতে পারতো যে, অন্য ‘একই মাসে’ নাকি ‘একাধিক মাসে’? বস্তুত ‘অন্য দিনসমূহে’ বলতে বুঝায় তা অন্য একাধিক মাসের দিনসমূহে সম্প্রসারিত হতে পারে। আবার, ‘মিন আইয়ামিন উখারা’ শব্দগুচ্ছ ‘শাহরু রমাদানের’ বিপরীতে বলায় ‘শাহরু রমাদানের দিনসমূহ’ এর বিপরীতে ‘অন্য দিনসমূহ’ বলতে স্বাভাবিকভাবে তা অন্য মাসসমূহের অন্তর্ভুক্ত দিনসমূহকেই চিহ্নিত করে, তাই এখানে অন্য মাস কথাটির উল্লেখের প্রয়োজনীয়তা থাকে না।
আরেকটি প্রশ্ন হলো: মিন আইয়ামিন উখারা’ (‘অন্য দিনসমূহ থেকে’ বা ‘অন্য দিনসমূহের মধ্য থেকে’) কথাটির মাধ্যমে কি এটা বুঝা যায় না যে, অন্য দিনসমূহ হবে ‘রমাদান মাসের মধ্যকার বা মধ্য থেকে প্রথম ১০ দিন ছাড়া অন্য দিনসমূহ’?
উত্তর : রমাদানের মাসে ১০ দিন সিয়াম বললে এ প্রশ্নও দেখা দেয় যে, তা কোন ১০ দিন, প্রথম ১০ দিন, অথবা মধ্যবর্তী ১০ দিন নাকি শেষ ১০ দিন? নাকি রমাদানের মাসের মধ্য থেকে যেকোনো ১০ দিন? প্রকৃতপক্ষে ‘মিন আইয়ামিন উখারা’ বা ‘অন্য দিনসমূহ থেকে’ কথাটি বলা হয়েছে ‘শাহরু রমাদানের’ বিপরীতে। তাই ‘মিন আইয়ামিন উখারা’ বা ‘অন্য দিনসমূহ থেকে’ কথাটি দ্বারা রমাদানের মাসের মধ্যকার বা মধ্য থেকে প্রথম ১০ দিন ছাড়া অন্য দিনসমসূহ বুঝাবে না, বরং ‘রমাদানের মাসের পরিবর্তে অন্য দিনসমূহ থেকে/ রমাদানের মাস ছাড়া অন্য দিনসমূহ থেকে’ এভাবে বুঝাবে।
বিধিবদ্ধ সিয়ামের দিনসংখ্যা প্রসঙ্গে শেষকথা
উপরিউক্ত পর্যালোচনা তথা আয়াতভিত্তিক গবেষণার ভিত্তিতে আমাদের নিকট শাহরু রমাদানে পূর্ণ মাস সিয়াম বিধিবদ্ধ করা হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আমাদের গবেষণার তথ্য আমরা আয়াতভিত্তিক যুক্তি বিন্যাসসহ শেয়ার করলাম যা অন্যদের জন্য কোনো উপলব্ধিকে চাপিয়ে দেয়া নয়। বরং আমরা বিশ্বাস করি প্রত্যেকের উচিত হলো আয়াতভিত্তিক যাচাইয়ের মাধ্যমেই কোনো উপলব্ধিকে গ্রহণ করা বা পুনর্বিবেচনা করা বা তা থেকে ভিন্ন উপলব্ধিতে উপনীত হওয়ার মতো যথেষ্ট দলীল ও যৌক্তিক কারণ থাকলে ভিন্ন উপলব্ধিতে উপনীত হওয়া ও তা শেয়ার করা। এই প্রেক্ষিতে যদি আমাদের গবেষণায় আয়াতভিত্তিক তথ্য নির্ভর পর্যালোচনার মাধ্যমে কোনো দুর্বলতা চিহ্নিত হয় তাহলে আমরা পরবর্তীতে আমাদের উপলব্ধিকে সংশোধনের ক্ষেত্রে ইনশাআল্লাহ সবসময় প্রস্তুত।
আমরা অধিকতর উত্তম উপলব্ধির জন্য চিন্তা-গবেষণার তথ্য-অনুসিদ্ধান্ত শেয়ার করাকে প্রয়োজন মনে করি, কিন্তু একজনের উপলব্ধিকে অন্যজনের উপর চাপিয়ে দেয়াকে সঠিক মনে করি না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা একমাত্র কুরআনকে দ্বীনের দলীল হিসেবে বিশ্বাস করবো ততক্ষণ কোনো আয়াতের উপলব্ধির ক্ষেত্রে ভিন্নতার কারণে আমাদের নীতিগত ঐক্য ব্যাহত হতে পারে না। এ নীতিগত ঐক্যের উপর ভিত্তি করে যেসব বিষয়ে অভিন্ন উপলব্ধি রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে সমষ্টিগত উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজ জীবনেও কুরআনের বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আর যেসব ক্ষেত্রে উপলব্ধির ভিন্নতা রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে পারস্পরিক আলোচনা (বিভিন্ন উপলব্ধি ও তার যৌক্তিক ভিত্তি শেয়ার করা) অব্যাহত রাখতে হবে।
আইয়ামাম মা’দূদাত اَيَّامًا مَعْدُودَةً : আইয়ামাম মা’দূদাত শব্দটির শাব্দিক অর্থ হলো ‘গণনাযোগ্য দিনসূহ’। এখানে ‘গণনাযোগ্য’ বলতে সর্বকালে সর্বস্থানে সর্বসাধারণের দ্বারা সহজে গণনাযোগ্যকে বুঝায়। তাই প্রায়োগিকভাবে শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ‘সহজে গণনাযোগ্য কয়েক দিন’। আইয়ামাম মা’দূদাতের সর্বনিম্ন সীমা হলো ‘তিন দিন’। কারণ ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ শব্দটি বহুবচন। আরবিতে বচন তিন প্রকার: একবচন, দ্বিবচন ও বহুবচন। বহুবচনের সর্বনিম্ন সংখ্যা তিন। তাই ‘আইয়ামাম মা’দূদাতের’ সর্বনিম্ন সংখ্যা ‘তিন দিন’। কিন্তু ‘আইয়ামাম মা’দূদাতের’ সর্বোচ্চ সংখ্যা কত দিন, তা সুনির্দিষ্ট নয়। আইয়ামাম মা’দূদাতের সর্বোচ্চ সংখ্যা কত দিন, তা অনির্দিষ্ট হলেও বিধিবদ্ধ সিয়ামের ক্ষেত্রে ‘আইয়ামাম মা’দূদাত’ এবং ‘রমাদানের মাস’ শব্দদ্বয়ের উপর ভিত্তি করে পূর্ণ মাস (৩০ দিন) সিয়াম করতে হবে বলে বুঝা যায়।
ইতমাম اِتْمَام : ইতমাম শব্দটির অর্থ হলো ‘পরিপূর্ণ করা’। দৈনন্দিন আনুষ্ঠানিক সিয়াম পরিপূর্ণ করার সময়সীমা প্রসঙ্গে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, ‘ছুম্মা আতিম্মুস সিয়ামা ইলাল লাইল’ (২:১৮৭)। ‘আতিম্মূ’ ক্রিয়াটির ক্রিয়াবিশেষ্য হলো ‘ইতমাম’। তাই নির্দেশটির অর্থ হলো ‘তারপর তোমরা রাত পর্যন্ত সিয়ামকে ইতমাম (পরিপূর্ণ) করো’। বর্তমানে সিয়াম ‘ইতমাম’ করার বিষয়টি ‘ইফতার’ করা হিসেবে প্রচলিত রয়েছে। ‘ইফতার’ শব্দের অর্থ হলো ‘বিদীর্ণ করা, ভেঙ্গে ফেলা’। আমরা মনে করি কুরআনের বর্ণনার সাথে সঙ্গতি রেখে ইতমাম শব্দটি চালু করাই উত্তম হবে। ‘রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করার’ নির্দেশ পালনার্থে সিয়াম শেষে কোন সময় থেকে পানাহার করা যাবে তা নিয়ে দুটি ভিন্ন উপলব্ধির সৃষ্টি হয়েছে। কারো উপলব্ধি হলো রাত শুরু হয় সন্ধ্যার পরে, তাই সন্ধ্যাকালীন Twilight শেষ হলে ‘ইতমাম’ করতে হবে। এক্ষেত্রে সূর্যাস্তের ১২ মিনিট বা ২৪ মিনিটি বা ৪৮ মিনিট বা ৭২ মিনিট পরে ইতমাম করার পক্ষে বিভিন্নরূপ উপলব্ধি রয়েছে। অন্যদিকে সাধারণ উপলব্ধি হলো সূর্যাস্তের অব্যবহিত পরপরই / সাথে সাথে রাত শুরু হয়, তাই তখনি ইতমাম করা যেতে পারে। আমাদের গবেষণার ফলাফল এ সাধারণ উপলব্ধির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তবে বিষয়টির ক্ষেত্রে উপলব্ধির শেয়ার করা ছাড়া একের উপলব্ধি অন্যকে মানতে বাধ্য করার মতো চাপাচাপিকে আমরা অসঙ্গত মনে করি।
ইদ্দাত عِدَّةٌ :ইদ্দাত শব্দটির অথ হলো ‘সংখ্যা, গণনা, গণনাচক্র, তালাকপ্রাপ্তা ও বিধবা নারীদের অপেক্ষার সময়কাল’। বিধিবদ্ধ সিযামের ক্ষেত্রে যারা ঐ সময় অসুস্থ থাকবে বা সফরে থাকবে তারা অসুস্থকালীন বা সফরকালীন সিয়াম না করে ঐ সমান সংখ্যক সিয়াম পরবর্তী অন্য দিনসমূহ থেকে সমন্বয় করতে হবে। অর্থাৎ যথাসময়ে যতটি সিয়াম করতে পারেনি, পরবর্তীতে ততটি সিয়াম করে নিতে হবে। এভাবে বিধিবদ্ধ সিয়ামের পূর্ণ সংখ্যা (৩০) পূর্ণ করতে হবে। এপ্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘ফাইদ্দাতুম মিন আইয়ামিন উখারা’ (তাহলে ইদ্দাত / গণনা সমন্বয় করতে হবে অন্য দিনসমূহ থেকে) এবং ‘ওয়ালিতুকমিলুল ইদ্দাত’ (যেন তোমরা ইদ্দাত / গণনা পূর্ণ করো)। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে একদিকে যেমন বিধিবদ্ধ সিয়ামের জন্য একটি মূল সময়গত অবস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে ‘রমাদানের মাস’, অন্যদিকে যারা অসুস্থতা বা সফরের কারণে তখন সিয়াম করতে পারবে না তাদের জন্য অন্য মাসে সমসংখ্যক সিয়ামের মাধ্যমে তা পূর্ণ করার অবকাশ দেয়া হয়েছে। এরূপ সুযোগ রাখার কারণ হলো, আল্লাহ আমাদের জন্য কঠিনতা চান না, তিনি আমাদের জন্য সহজতা চান। আল্লাহর বিধানে সিয়ামের জন্য নির্ধারিত মূল সময়গত অবস্থান এমন নয় যে, কোনোভাবেই তার মধ্যকার কোনো সিয়াম বাদ যেতে পারে না এবং তার বাহিরে কোনো সিয়াম হতে পারে না। বরং তিনি স্বয়ং তাতে বিশেষ কারণে সিয়াম না করে তার বাহিরে সিয়াম করারও সুযোগ দিয়েছেন। এতে আল্লাহর বিধানের প্রকৃত স্বরূপ অনুধাবন করা সহজ যে, তাঁর বিধানে আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এ’তেকাফ عَاكِفُ :এ’তেকাফ শব্দটির অর্থ হলো ‘ধ্যান, চিন্তামগ্নতা, আত্মনিয়োজিত থাকা, কোনো বিশেষ কারণে বা দায়িত্বের প্রেক্ষিতে কোথাও বিশেষভাবে অবস্থান করা, স্থানীয় হওয়া, কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে সাময়িক আশ্রয় গ্রহণের জন্য অবস্থান করা’। কুরআনে এ’তেকাফের বিধানে এ’তেকাফ বলতে মাসজিদে এ’তেকাফকে বুঝানো হয়েছে। এ’তেকাফ সম্পর্কিত বিধান হলো “মাসজিদে এ’তেকাফ করার সময়কালে স্ত্রীমিলন থেকে বিরত থাকতে হবে”। ব্যাপকার্থে পুরো পৃথিবীকে সিজদার স্থান বলা গেলেও পরিভাষায় সিজদার জন্য মোটামুটি স্থায়ীভাবে নির্ধারিত করে নেয়া প্রতিষ্ঠানকে বুঝায়। আবার সিজদা শব্দটিও আনুষ্ঠানিক সিজদার পাশাপাশি ব্যাপকার্থে আল্লাহর বিধান শুনা ও মানার বাস্তব তৎপরতাকে নির্দেশ করে। রসূলুল্লাহ মূসাকে যেমন পবিত্র তুওয়া উপত্যকায় জুতা নিয়ে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছিলো এ’তেকাফ সম্পর্কিত বিধানটি অনুরূপ একটি শিষ্টাচারমূলক বিধান। এ’তেকাফের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে বিধিবদ্ধ সিয়াম সম্পর্কিত আয়াতসমূহে। তাই রমাদানের মাসে এ’তেকাফ করার রীতি বিশেষ গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়। অবশ্য এ’তেকাফের জন্য কোনো মাস বা দিনসংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়নি এবং এমনকি এ’তেকাফকে বাধ্যতামূলকও করা হয়নি। তবে এ’তেকাফের বিধান থেকে বুঝা যায় যে, এ’তেকাফ একটি উৎসাহমূলক বিধান।
কাফফারা كَفَّارَةٌ : কাফফারা শব্দের অর্থ হলো ‘দোষমোচন’। কোনো অন্যায় বা ভুল কাজ করার মাধ্যমে যে দোষ হয় তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ বিধান দেয়া হয়েছে, ঐ বিধান পালন করাকে কাফফারা বলা হয়। কয়েকটি কাফফারা স্বরূপ প্রদত্ত বিধানে সিয়াম করার বিধান দেয়া হয়েছে। যেমন: কেউ কোনো মু’মিনকে ভুলক্রমে হত্যা করলে, কেউ শপথ ভঙ্গ করলে, কেউ হারাম মাসসমূহে কোনো বন্যপ্রাণীকে হত্যা করলে এবং কেউ যিহার (স্ত্রীকে মা হিসেবে প্রকাশ করার কুপ্রথা চর্চা) করলে তাকে তার দোষ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রদত্ত ব্যবস্থার মধ্যে সিয়ামের বিধানও রয়েছে।
তাক্বওয়া تَقْوَىٰ : তাক্বওয়া শব্দটির অর্থ হলো ‘সচেতন থাকা, সাবধানতা অবলম্বন করা, কোনো কিছু থেকে বেঁচে থাকা, সংযত থাকা, কাউকে বা কোনো কিছুকে ভয় করা ইত্যাদি’। পরিভাষায় তাক্বওয়া বলতে বুঝায় ‘আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন করা’। যখন শব্দটি শাব্দিক অর্থে তথা সাধারণভাবে ভয় করা বা সাবধানতা অবলম্বন করা অর্থে ব্যবহৃত হয় তখন কার থেকে বা কী থেকে সচেতন থাকতে হবে তা উল্লেখ থাকে। আর যখন সে বিষয়টি উল্লেখ ছাড়া তাক্বওয়া অবলম্বনের কথা বলা হয় তখন তা দ্বারা আল্লাহ সচেতন থাকাকে বুঝায় এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ সচেতন থাকে তাকে ‘মুত্তাক্বী’ বলা হয়। বিধিবদ্ধ আনুষ্ঠানিক সিয়ামের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, “যাতে তোমরা আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন করতে পারো।”
তাক্বত طَاقَة : তাক্বত শব্দটির অর্থ ‘অতিকষ্টে সম্পাদনের সক্ষমতা, অসাবলীলভাবে সম্পাদনের সক্ষমতা’। কোনো বিষয়ে পূর্ণ শক্তি-সামর্থ্য থাকাতে ‘ক্বুদরত’ বলা হয়। আর কোনো বিষয়ে একেবারে অক্ষম না হয়ে অতিকষ্টে সক্ষম হওয়ার মতো সক্ষমতাকে ‘তাক্বত’ বলা হয়। সিয়ামের প্রসঙ্গে যাদের সিয়ামের ‘তাক্বত’ রয়েছে তথা যারা অতিকষ্টে সিয়াম করতে সক্ষম (যাদের জন্য সিয়াম তুলনামূলক বেশি কষ্টসাধ্য) তারা সিয়াম করার পরিবর্তে প্রতিটি সিয়ামের বিপরীতে একজন মিসক্বীনকে খাদ্য খাওয়ানোর বিকল্প ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। এই বিভাগের মধ্যে পড়তে পারে, বৃদ্ধ, চিররুগী, গর্ভবতী নারী, দুগ্ধপোষ্য শিশুর মা, কঠোর কায়িক শ্রমের মাধ্যমে উপার্জনকারী ব্যক্তি এবং কোনো ঋতুবতী নারী যদি ঋতুকালীন সময়ে অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। আল্লাহর বিধানে যে অতিরিক্ত কঠোরতা নেই, বরং কল্যাণকর উদ্দেশ্যে কিছু বিধি-বিধান আরোপ করলেও তাতে মানুষের বিভিন্ন অবস্থার কথা বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় ছাড়ও দেয়া হয়েছে, এ ধারাটি তার একটি প্রমাণ।
ফিদইয়া فِدْيَةٌ : ফিদইয়া শব্দটির অর্থ হলো ‘মুক্তিপণ, দায়মুক্তি, দায়মুক্তি স্বরূপ বিকল্প ব্যবস্থা’। বিধিবদ্ধ সিয়াম করার ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি অতিকষ্টে সক্ষম বা কোনো বিশেষ জটিলতায় আবদ্ধ থাকার কারণে সাধারণ ব্যক্তিদের তুলনায় অসাবলীলভাবে সক্ষম তিনি সিয়াম করার পরিবর্তে ফিদইয়া দিতে পারবেন। ফিদইয়া হলো একটি সিয়ামের পরিবর্তে একজন মিসক্বীনকে খাদ্য খাওয়ানো। একই মিসক্বীনকে পূর্ণ মাস খাদ্য খাওয়ানো বা একই দিনে ৩০ জন মিসক্বীনকে খাদ্য খাওয়ানো যেভাবেই তাঁর জন্য সুবিধা হয় তিনি সেভাবে ফিদইয়া দিতে পারবেন। কারণ এক্ষেত্রে কোনো পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। যারা অতিকষ্টে সক্ষম তাদের উদাহরণ হিসেবে আমরা বৃদ্ধ, চিররুগী, গর্ভবতী নারী, দুগ্ধপোষ্য শিশুর মা, কঠোর কায়িক শ্রমের মাধ্যমে উপার্জনকারী ব্যক্তি প্রমুখকে বিবেচনা করতে পারি। যাদের উপার্জন সীমিত তাদের পক্ষেও একজন মিসক্বীনকে খাদ্য খাওয়ানো খুব কঠিন নয়। কারণ বাস্তবে দুজনের খাবারকে তিন জনে ভাগ করে খাওয়া খুব কঠিন নয়। তা সত্ত্বেও যারা নিজেরাই মিসক্বীন তাদের ক্ষেত্রে ফিদইয়ার বিষয়টি প্রযোজ্য হবে না, কারণ সকল বিধানের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ নিয়ম হলো ‘কারো উপর সাধ্যাতীত দায়িত্ব নেই’।
ফুরক্বান فُرْقَان : ফুরক্বান শব্দের অর্থ হলো ‘সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, সঠিক ও ভুলের পার্থক্যকারী মানদন্ড’। আল কুরআনে ‘কুরআনকে’ এবং ‘কুরআনের সাথে সঙ্গতিশীল, কুরআনের জ্ঞানে উৎকর্ষিত বিবেককে’ ফুরক্বান বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য তাৎক্ষণিক / উপস্থিত মানদণ্ড হিসেবে বিবেক প্রয়োগ করা এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য সেটাকে কুরআন দ্বারা যাচাই করা প্রয়োজন। বিবেকসঙ্গত তথ্যের ক্ষেত্রে নিশ্চয়তাবোধ লাভের উপায় হিসেবে এবং সহজাত বিবেককে বিশেষ নির্দেশনার মাধ্যমে উৎকর্ষিত করার জন্য ‘ফুরক্বান’ হিসেবে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। ‘শাহরু রমাদান’ বা ‘রমাদানের মাসে’ মানবজাতির জন্য হিদায়াত, হিদায়াতের স্পষ্ট প্রমাণ এবং সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী হিসেবে কুরআন নাযিল হয়েছে বিধায় এ মাসকে বিধিবদ্ধ সিয়ামের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। ফুরক্বান শব্দের মাধ্যমে কোনো তথ্য বা বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে শাশ্বত বিধান কিনা তা কুরআন দ্বারা যাচাই করার মূলনীতি দেয়া হয়েছে। যে বিষয়ে কুরআনে কোনো বিধান নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি সেক্ষেত্রে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফুরক্বান হিসেবে বিবেককে কাজে লাগাতে হবে। এক কথায়, আমাদের জন্য দুটি ফুরক্বান রয়েছে, একটি হলো কুরআন যা থেকে আমরা সকল মূল বিধান জানতে পারি (২:১৮৫) এবং অন্যটি হলো বিবেক যা প্রয়োগ করে আমরা বিভিন্ন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি (৮:২৯)।
মাসজিদ مَسْجِد : মাসজিদ শব্দের অর্থ ‘সিজদার স্থান, আল্লাহর বিধান শুনা ও মানার অনুশীলনের প্রতিষ্ঠান’। সিজদা শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘ভক্তি প্রদর্শন, প্রণিপাত বা মাটিতে মাথা ঠেকানো’। কিন্তু ব্যাপকার্থে আল্লাহর বিধান শুনা ও মানার তৎপরতাকে সিজদা বলা হয়। আল কুরআনে মাসজিদের ব্যাপকভিত্তিক ভূমিকার উল্লেখ রয়েছে। যাবতীয় মাসজিদের মূল কেন্দ্র হিসেবে আল মাসজিদুল হারামের অবস্থান। আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনার বিষয়সমূহের মধ্যে রয়েছে সাময়িক আশ্রয়ের জন্য বা ধ্যানমগ্নতার উদ্দেশ্যে স্বল্পকালীন অবস্থান (এ’তেকাফ), নৈরাজ্য বা ফাসাদ প্রতিরোধ এবং নিরাপত্তা প্রচেষ্টার কর্মসূচী, ফিতনা বা ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি হুমকি মোকাবিলা, ন্যায়বিচারের ব্যবস্থাকরণ, শান্তিচুক্তি, কুরবানির ব্যবস্থা, জমাকৃত হাদয়ির ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কল্যাণ কর্মসূচী বাস্তবায়ন ও সমৃদ্ধির সম্প্রসারণ এবং আল্লাহর বিধান শুনার ও মানার প্রক্রিয়া চালু রাখার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা পালন ইত্যাদি। সুতরাং মাসজিদকে বর্তমানে যেভাবে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সালাতের জন্য নির্ধারিত ঘর মনে করা হয়, সেটা মাসজিদের আসল স্বরূপ ও প্রকৃতি নয়। মাসজিদের প্রকৃত স্বরূপ হলো এটা মানবজাতির জন্য ঐক্য, শৃঙ্খলা, একত্ববাদী উপাসনা ও সমষ্টিগতভাবে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান।
লাইলাতুল ক্বদর لَيْلَةُ الْقَدْرِ : লাইলাতুল ক্বদর শব্দের অর্থ হলো ‘নির্ধারণের রাত, (প্রায় সমান) পরিমাপের রাত’। একটি সৌরবর্ষ হিসেব করার মূলনীতি হলো যখন দিন রাতের পরিমাপ প্রায় সমান তখন থেকে পরবর্তী ঐ একই দিন (যা একই ঋতুতে পড়ে) পর্যন্ত দিনসংখ্যা নিয় একটি সৌরবর্ষ। অন্য কথায়, Spring Equinox থেকে Spring Equinox পর্যন্ত একটি সৌরবর্ষ। একটি সৌরবর্ষে দুটি Equinox রয়েছে। একটি Spring Equinox এবং অন্যটি Fall Equinox. এর মধ্য থেকে Spring Equinox প্রাণচাঞ্চল্যের প্রতীক বিধায় তা থেকেই সাধারণত বর্ষ গণনা সূচনা করা হয়। অবশ্য কোথাও কোথাও বিপরীতটিও প্রচলিত ছিলো। তবে কুরআনের তথ্য সমন্বয় থেকে হারাম মাসসমূহের সাথে বন্য পশু শিকার নিষিদ্ধতা, সিয়াম ও হজ্জের যে সম্পর্ক বুঝা যায় এবং ‘রমাদান’ শব্দের অর্থ সাপেক্ষে কুরআন নাযিলের সময়কার ‘লাইলাতুল ক্বদর’ Spring Equinox ছিলো বলে বুঝা যায়। কারণ এ রাতটিতে ফজর পর্যন্ত প্রাকৃতিক শান্তিময় পরিবেশ বজায় ছিলো। যা ‘গাছিক্ব’ (অমাবস্যার রাত) এর সম্পূর্ন বিপরীতে পূর্ণিমার রাত হিসেবেই সাব্যস্ত হয়। অন্য কথায় সে বছর Spring Equinox একই সাথে পূর্ণিমার রাতও ছিলো। এই প্রেক্ষিতে Spring Equinox ও তার পূর্ব বা পরের পূর্ণিমার রাতের মধ্য থেকে কখনো ‘লাইলাতুল ক্বদর’ সংঘটিত হয় বলে প্রতীয়মান হয়। যদিও প্রতি বছর ঠিক কোন রাতটি ‘লাইলাতুল ক্বদর’ তা সরাসরি উল্লেখ নেই বিধায় এবং ঐ রাতে আমাদেরকে কোনো করণীয় দেয়া হয়নি বিধায় প্রতি বছরের ‘লাইলাতুল ক্বদর’ স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করার বিষয়ে আমরা কোনো নির্দিষ্ট উপলব্ধিতে উপনীত হতে পারিনি। তবে কুরআন নাযিলের সময়কালীন ‘লাইলাতুল ক্বদর’ এর যে বৈশিষ্ট্যগুলো সংশ্লিষ্ট তথ্যগুলো থেকে বুঝা যায় তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তা ছিলো ঐ বছরের Spring Equinox এবং একই সাথে Full Supermoon Night. এসব তথ্যের সমন্বয়ে বুঝা যায় যে, রমাদানের মাস হলো Spring Equinox কে পরিবৃতকারী চান্দ্রমাস।
শাহরু রমাদান شَهْرُ رَمَضَانَ : শাহরু রমাদান শব্দের অর্থ হলো ‘রমাদানের মাস’। সাধারণত ‘রমাদান মাস’ হিসেবে অনুবাদ করা হলেও বস্তুত সঠিক অনুবাদ হবে ‘রমাদানের মাস’। নামটি থেকে বুঝা যায় যে, রমাদান এমন কোনো বৈশিষ্ট্য যে বৈশিষ্ট্য মাসটিকে শাহরু রমাদান বলা হয়েছে। অন্য কথায়, শাহরু রমাদান কোনো মাসের নামবাচক বিশেষ্য (Proper Noun) নয়, বরং এটি হলো একটি গুণবাচক বিশেষ্য বা বিশেষণ (Adjective)। রমাদান শব্দটি সঠিক অর্থ হলো ‘উষ্ণতা ও বর্ণিল উজ্জলতার সহনীয় তীব্রতা, জৈব প্রকৃতির স্বাভাবিক তীব্রতা’। একটি মাস হিসেবে এটি ঋতু বৈচিত্র্যে প্রাণচাঞ্চল্যের স্বাভাবিক তীব্রতার সূচনাকালীন মাসকে নির্দেশ করে। রমাদানের মাসে কুরআন নাযিলের সূচনা হয়েছে এবং রমাদানের মাসের অন্তর্ভুক্ত ‘লাইলাতুল ক্বদর’ এ কুরআন নাযিলের সূচনা হয়েছে তথ্য দুটির সমন্বয়ে বুঝা যায় যে, বসন্তকালের প্রথম চান্দ্রমাস যা Spring Equinox কে অন্তর্ভুক্ত করে, সেটাই হলো রমাদানের মাস। রমাদানের মাসে কুরআন নাযিলের সূচনা হয় মাসটিকে বিধিবদ্ধ সিয়ামের মূল সময়গত অবস্থান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। রমাদানের মাস হারাম মাসসমূহের অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ যে মাসগুলোতে বন্য পশু শিকার করা যাবে না এবং আন্তর্জতিক যুদ্ধ বিরতি পালন করতে হবে, সেই চারমাসের অন্তর্ভুক্ত প্রথম মাস।
সফর سَفَر : সফর শব্দটির অর্থ হলো ‘ভ্রমণ, পর্যটন’। যিনি সফর করেন তাঁকে মুসাফির বলা হয়। মুসাফির শব্দটি মুক্বীম শব্দের বিপরীত। মুক্বীম মানে যিনি তিাঁর মুক্বামে / প্রতিষ্ঠিত অঞ্চলে রয়েছেন। একজন ব্যক্তি যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং তাই সেখানে তিনি নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত অবস্থায় অনুভব করেন সেটাই তাঁর মুক্বাম। কোনো ব্যক্তি নিজ বাড়ি থেকে কত দিনের জন্য কত মাইল দূরত্ব অতিক্রম করলে তাকে সফর বলা হবে এসব নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ করা হয়। কিন্তু কুরআনে এ বিষয়ে কোনো কিছু নির্দিষ্ট করা হয়নি। কারণ বস্তুত বিষয়টি নির্দিষ্ট হওয়ার উপযুক্ত নয়। মূলত কোনো ব্যক্তি যখন যতটুকু দূরত্বে সফরের অবস্থায় থাকেন বা নিজের মূক্বীম অবস্থার বাহিরে থাকেন, তা যত দিনের জন্যই হোক না কেন, তিনিই মুসাফির তথা সফররত অবস্থায় আসেন হিসেবে সাব্যস্ত হবে। তারপর যদি সফরকৃত অঞ্চলে তাঁর এক ধরনের আত্মপ্রতিষ্ঠামূলক অবস্থান তৈরি হয়, তাহলে তিনি মুসাফির থেকে মুক্বীমে পরিণত হয়েছেন বলে সাব্যস্ত হবে। কোনো ব্যক্তি সফরে থাকলে তিনি তখন সিয়াম না করে সফর অবস্থা থেকে মুক্বীম অবস্থায় পরিণত হওয়া বা ফিরে আসার পর ঐ দিনসমূহের সিয়াম করতে পারবেন বলে বিধান দেয়া হয়েছে।
সিয়াম صِيَامُ : সিয়াম শব্দটির অর্থ ‘আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ’। যখন এক বা একাধিক দিন সিয়াম পালনের নির্দেশ দেয়া হয় তা দ্বারা আনুষ্ঠানিক সিয়াম বুঝায়। আনুষ্ঠানিক সিয়াম হলো আত্মসংযম বা আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ বা আনুষ্ঠানিক অনুশীলন। আনুষ্ঠানিক সিয়াম হলো দিনের বেলায় পানাহার এবং স্ত্রীমিলন থেকে বিরত থাকা। আনুষ্ঠানিক সিয়াম দুই প্রকার। একটি হলো কোনো ক্ষেত্রে ফিদইয়া (দায়মুক্তি) স্বরূপ বা কোনো দোষত্রুটির প্রেক্ষিতে কাফফারা (দোষমোচন) স্বরূপ যে সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে। অন্যটি হলো প্রতি বছর ‘রমাদানের মাসে’ বিধিবদ্ধ সিয়াম পালন করা। সিয়াম বিধিবদ্ধ করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, “যাতে তোমরা আল্লাহ সচেতন জীবন যাপন করতে পারো”। সুতরাং আনুষ্ঠানিক সিয়াম থেকে আল্লাহ সচেতনতার শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলে আনুষ্ঠানিক সিয়ামের উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না তথা সিয়ামের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। আর আনুষ্ঠানিক সিয়াম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বাস্তবে আল্লাহ সচেতন জীবন যাপন করলে এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ থেকে নিজেকে বিরত রাখলে সেটাই বাস্তব বা ব্যাপক অর্থে প্রযোজ্য সিয়াম।
হারাম মাস الشَّهْرُ الْحَرَامُ : হারাম মাস শব্দের অর্থ হলো ‘সংরক্ষিত মাস, যে মাস কোনো বিশেষ কাজের জন্য সংরক্ষিত বা যে মাসে কোনো কিছু থেকে বিরত থাকার জন্য বিশেষ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে’। কুরআন অনুযায়ী সৃষ্টির শুরু থেকে সনাতন বিধান হিসেবে ১২ মাসের মধ্যে ক্রমাগত / ধারাবাহিক ৪ মাস হারাম মাস। এ মাসগুলোতে বন্য প্রাণী শিকার করা যাবে না এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বিরতি পালন করতে হবে। এ থেকে বুঝা যায় যে, মাসগুলো ঋতুপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য অনুসারে নির্ধারিত হয়েছে। যে মাসসমূহ বন্য প্রাণীদের সংরক্ষণের জন্য নিবেদিত তথা যে মাসসমূহ বন্য প্রাণীদের প্রজনন বা প্রসবকালের দিক থেকে সেগুলোর জন্য নাজুক সময় হিসেবে সাব্যস্ত সেই মাসগুলোই হলো হারাম মাস। হারাম মাসসমূহে সিয়াম এবং হজ্জের বিধানকেও সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। কারণ হজ্জের তিনটি মাসে হজ্জকারীদের জন্য কিছু বিশেষ নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। আর তার পূর্বে সিয়ামের মাসে সিয়াম পালনকারীদের উপর কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। সিয়ামের মাস হলো ‘রমাদানের মাস’। ‘রমাদানের মাস’ কথাটির অর্থ, হজ্জের মাসসমূহ হারাম মাসসমূহের অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং হারাম মাসসমূহের মূল হারাম বিষয় যা ঋতুপ্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত (বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ) ইত্যাদি বিষয় থেকে স্পষ্ট হয় যে, হারাম মাসসমূহ হলো রমাদানের মাস থেকে শুরু করে ধারাবাহিক চারমাস এবং মাসগুলো হলো বসন্ত ঋতুর প্রথম মাস থেকে ধারাবাহিক চারমাস। পশু-পাখির সংরক্ষণ এবং যুদ্ধের বিভিষিকামুক্ত বা শান্তিপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থার সুফল পেতে হলে হারাম মাসের বিধান পরিপালন করা খুবই জরুরি।