কুরআনে প্রদত্ত ওয়াসিয়্যাত ও উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিধি-বিধানের যথাযথ জ্ঞান ও তার সঠিক প্রয়োগের অভাবে সমাজে সম্পদ বণ্টনের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। অথচ কুরআনের বিধি-বিধান সঠিকভাবে জানলে ও পরিপালনের জন্য যথাযথ উদ্যোগ চালু থাকলে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব যেমন হ্রাস পেতো তেমনি সম্পদের কল্যাণমূলক সুষম বণ্টনও নিশ্চিত হতো। এর মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পেতো। কুরআনে একদিকে যেমন মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নির্ধারিত আনুপাতিক অংশসহ নির্দিষ্ট ওয়ারিস চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে তেমনি উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রথমে মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পূরণ ও ঋণ পরিশোধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া উত্তরাধিকার বণ্টনকালে উত্তরাধিকারী নয় এমন যেসব আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ছেলেমেয়ে এবং অভাবগ্রস্তরা উপস্থিত হন তাদেরকেও তা থেকে কিছু অনুদান দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে সমাজ কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়েছে। উত্তরাধিকারীদের বাস্তব অবস্থা ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য মৃত্য নিকটবর্তী ব্যক্তির উপর ওয়াসিয়্যাতকে বাধ্যতামূলক করা হলেও বর্তমান সমাজে এ বিষয়ে অজ্ঞতা, অনীহা এবং বিভ্রান্তি বজায় থাকার কারণে এ বিধানটি অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। এর ফলে সমস্ত উত্তরাধিকার সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখকৃত অংশ বণ্টন পদ্ধতিতে বণ্টিত হচ্ছে। অথচ আল্লাহর বিধানে ওয়াসিয়্যাত ও উত্তরাধিকারের বণ্টন-বিধির যে পূর্বাপর প্রক্রিয়াগত সম্পর্ক সেটাই সর্বোচ্চ সমাজ কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য সর্বাধিক কার্যকর পন্থা বিধায় কুরআনে ওয়াসিয়্যাত ও উত্তরাধিকার উভয়টির বিধান দেয়া হয়েছে। উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি কার্যকর করার ক্ষেত্রেও প্রচলিত ধারা উপধারার অনেক কিছু কুরআনে প্রদত্ত বণ্টন নীতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে সমাজে যেভাবে প্রচলিত ফারায়েজ চালু আছে তাও যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। বরং বিভিন্ন ওয়ারিসকে বঞ্চিত করার মন্দ রেওয়াজ এখনো ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে যার ফলে দীর্ঘসূত্রিতায় আটকে পড়া মামলা-মোকদ্দমার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এসব কিছুর পেছনে কুরআনে উত্তরাধিকারের বিধানকে কিরূপ মুখ্য গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং এর লংঘনের যে অশুভ পরিণতি উল্লেখ করা হয়েছে তা সম্পর্কে সচেতনতার অভাবই প্রধান কারণ। তাই উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সামাজিক সংকট নিরসনে সরকারের আইন বিভাগে যারা রয়েছেন তারা কুরআনের ভিত্তিতে প্রচলিত ফারায়েজকে সংশোধন করে আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। সেই সাথে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে যেসব রাজনৈতিক অরাজনৈতিক জনপ্রতিনিধি রয়েছেন, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় সমাজসেবামূলক যেসব অধিদপ্তর এবং সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাঁরা এক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা পালনার্থে কুরআনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ স্কলারদের নিয়ে কুরআন কাউন্সেলিং সেল গঠন করতে পারেন। এক্ষেত্রে তারা যেমন নিজেদের মধ্যকার সংশ্লিষ্ট কুরআন গবেষকদেরকে কাজে লাগাতে পারেন, তেমনি যারা কুরআনের যথাযথ জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত এমন স্কলারদের সহযোগিতাও গ্রহণ করতে পারেন। যদি এভাবে কুরআন কাউন্সেলিং করা যায় তবে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সামাজিক সংকট নিরসনে নি:সন্দেহে তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
পরিশেষে বলতে হয়, হাজার বছর ধরে আল কুরআনে প্রদত্ত পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ওয়াসিয়্যাত করার বাধ্যতামূলক বিধানকে সমাজে মানছুখ (রহিত) বা নফল (ঐচ্ছিক) কাজ হিসেবে সাব্যস্ত করা হচ্ছে। সেই সাথে ফারায়েজ বা মুসলিম উত্তরাধিকার বিধানের নামে লিখিত গ্রন্থসমূহে প্রথমে কুরআনের আয়াত উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে কুরআনে বর্ণিত বণ্টন বিধিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে যার যা প্রাপ্য তাকে তা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে কাউকে প্রাপ্যের চেয়ে বেশি দেয়া হয়েছে। এর ফলে আল্লাহ প্রদত্ত কল্যাণকর বিধানের কল্যাণ থেকে মানব সভ্যতা বঞ্চিত হয়েছে এবং ন্যায়বিচার লংঘিত হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত বিধান পরিপালনের মাধ্যমে মানব সভ্যতাকে সত্যিকার কল্যাণমুখী ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য ওয়াসিয়্যাত ও উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিসহ যাবতীয় আইন-কানুনকে আল কুরআনের ভিত্তিতে যাচাই করে নিয়ে সঠিকভাবে পুন:বিন্যস্ত করার কোনো বিকল্প নেই।
একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, যদি এই ব্যাখ্যা সঠিক হয়, তাহলে প্রকৃত ব্যাখ্যা পুন:উপস্থাপিত হওয়ার পূর্বে মধ্যবর্তীকালে যারা প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুসরণ করে অতীত হয়ে গেছেন তাদের কী হবে বা তাদের কর্মের মূল্যায়ন কিভাবে হবে বা আখিরাতে তারা কিরূপ দায়ী হবেন? এর জবাব হচ্ছে, প্রত্যেকে তার সাধ্যসীমায় উত্তম কর্মের জন্য দায়িত্বশীল। তাই জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় থাকার শর্তসহ কে তার সাধ্য অনুযায়ী (যেমন যতটুকু জ্ঞান আয়ত্ত করেছে সে অনুযায়ী) উত্তম কর্ম সম্পাদন করেছে সেটার সাপেক্ষেই তার আমলের মূল্যায়ন হবে। এ কারণে মধ্যবর্তীকালীন যারা জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় থেকে যতটুকু যা জেনেছে তা অনুসারে উত্তম কর্ম সম্পাদন করেছে তারা দায়মুক্ত হয়ে যাবে। যারা সঠিক কর্মনীতির উপরে থেকে (সত্য জানার ও মানার স্বাভাবিক রীতি বজায় রেখে) প্রচলিত ব্যাখ্যাকে কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা মনে করার কারণে অনুসরণ করেছেন তারা আখিরাতে দায়মুক্ত হতে পারেন। অতীত জনগোষ্ঠী সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে, তারা ছিল এক উম্মাত যারা অতীত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে তা তাদের জন্য। আর তোমরা যা করছ তা তোমাদের জন্য। তারা যা করত সে বিষয়ে তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে না। (সূরা বাকারা ২:১৪১)।
সুতরাং আমাদেরকে আমাদের সাধ্যমতো সঠিক তথ্যজ্ঞান অর্জন ও তদনুযায়ী উপলব্ধ বিধান পরিপালন করতে হবে। আমাদেরকে সাবধান থাকতে হবে যেন অন্ধ অনুসরণের মাধ্যমে শিরকের গুনাহে গুনাহগার না হই এবং যেন সঠিক কার্যনির্বাহের মাধ্যমে যথাযথ কল্যাণ লাভ করতে পারি।
যেহেতু প্রকৃত ব্যাখ্যার অনুসরণ ব্যতীত সার্বিকভাবে প্রকৃত কল্যাণ লাভ করা সম্ভব নয়, তাই প্রকৃত ব্যাখ্যা জানার পর তা মানবজাতির সামনে উপস্থাপন না করা সবচেয়ে বড় জুলুম। সুতরাং আমাদের কাজ হবে যারা বর্তমান আছে তাদের সামনে গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত তথ্য উপস্থাপন করা এবং তা অনুসরণ করা।
যে কোনো মানবীয় উপলব্ধি প্রয়াসের মতো এ বইয়েও ভুল-ত্রুটি থেকে যাওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক। তাই এ বইয়ে কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে যে তথ্যগত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়েছে, কুরআনের আলোকেই তার পর্যালোচনা বা যাচাই করে কোনো ত্রুটি চিহ্নিত হলে যথাযথভাবে তথা আয়াতের ভিত্তিতে অকাট্য যুক্তি উপস্থাপনসহ তুলে ধরা হলে অবশ্যই তদনুযায়ী পরবর্তী সংস্করণ করা হবে ইনশাআল্লাহ।
ওয়া মা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ। আলাইহি তাওয়াক্কালতু ওয়া ইলাইহি উনিব। (সূরা হূদ ১১:৮৮)
আল কুরআনের আলোকে উত্তরাধিকারের বিধান গবেষণামূলক অধ্যয়ন ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে যেসব প্রাসঙ্গিক মৌলিক শব্দ, বাক্য ও শর্ত তথা আলোচ্য বিষয় বা ধারণা সহায়ক হতে পারে সেগুলোর তথ্যগত বিশ্লেষণকে পরিশিষ্ট হিসেবে উপস্থাপন করা হলো।
ওয়ারিস শব্দটি একটি বহুল প্রচলিত শব্দ। ওয়ারিস শব্দটির অর্থ হচ্ছে উত্তরাধিকারী। যেমন ২:২৩৩ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যখন তালাকদাতা স্বামীর সন্তানকে তথা নিজ সন্তানকে দুধ পান করায় তখন ঐ সময়কালে তাকে ভরণপোষণ ও পোশাকাদি দেয়া স্বামীর কর্তব্য এবং (ইতোমধ্যে স্বামীর মৃত্যু হলে) তা একইভাবে তার ওয়ারিসদেরও দায়িত্ব।
৪:৩৩ আয়াতে পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ যে সম্পদ রেখে যায় তাতে আল্লাহ যাদেরকে ওয়ারিস হিসেবে নির্ধারিত করে দিয়েছেন তাদেরকে ‘মাওয়ালিয়া’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণত ‘মাওয়ালিয়া’ শব্দটিকে ‘ওয়ারিস’ শব্দের সমার্থক হিসেবে অনুবাদ করা হয়।
২৮:৫ আয়াতে বলা হয়েছে, আমি ইচ্ছা করলাম যাদেরকে পৃথিবীতে দুর্বল করে রাখা হয়েছে তাদেরকেই অগ্রনায়ক করতে এবং তাদেরকে উত্তরাধিকারী [ওয়ারিস] করতে। অর্থাৎ ফেরাউন ও তার দলবলের ধ্বংসের পর বানী ইসরাইলকে তাদের স্থান ও সম্পদের ওয়ারিস করা হয়েছে।
সুতরাং ‘ওয়ারিস’ শব্দটি ‘মাওয়ালিয়া’ শব্দটির তুলনায় সাধারণ পর্যায়ের। ‘মাওয়ালিয়া’ হচ্ছে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী ‘অব্যবহিত/ নির্দিষ্ট ওয়ারিস’। আর ‘মাওয়ালিয়া’ এর অন্তর্ভুক্ত কেউ না থাকলে যারা ঐ সম্পদের উত্তরাধিকার লাভ করবে তারাও সম্পদের ‘ওয়ারিস’ হয়েছে বলা যায়।
‘মাওয়ালিয়া’ শব্দটি হচ্ছে ‘মাওলা’ শব্দের বহুবচন। ‘মাওলা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘রক্ষাকর্তা, উত্তরাধিকারী’। ‘মাওয়ালিয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ৪:৩৩:৩, ১৯:৫:৩ এবং ৩৩:৫:১৪।
৪:৩৩ আয়াতে মৃত ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয় [আক্বরাবূন] হিসেবে সাব্যস্ত করে যাদের মধ্যে সম্পূর্ণ উত্তরাধিকার বণ্টনের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে সেই অব্যবহিত/ নির্দিষ্ট ওয়ারিসদেরকে ‘মাওয়ালিয়া’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯:৫ আয়াতে নবী যাকারিয়ার প্রার্থনায় প্রকাশিত উদ্বেগ তুলে ধরা হয়েছে, যাতে তিনি তাঁর ‘মাওয়ালিয়ার’ প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন। তিনি তাঁর প্রার্থনায় বলেছিলেন: আমি আমার উত্তরাধিকারীদের [মাওয়ালিয়া] (কর্মকা-ের বিষয়ে) আশংকা রাখি, আর আমার স্ত্রী বন্ধ্যা, সুতরাং আপনার পক্ষ থেকে আমাকে একজন উত্তরাধিকারী [সন্তান] দান করুন।
৩৩:৫ আয়াতে যে পালিত পুত্রদের পিতৃপরিচয় জানা যায় না তাদেরকে দ্বীনের ভিত্তিতে ভাই এবং ‘মাওয়ালিয়া’ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
৪:৭, ৪:৩৩ ও ৩৩:৫ আয়াতের সমন্বিত তথ্য থেকে বুঝা যায়, ‘মাওয়ালিয়া’ এর একটি অর্থ হচ্ছে নির্দিষ্ট ওয়ারিস, যাদের মধ্যে উত্তরাধিকার বণ্টিত হবে এবং তাদের প্রাপ্য অংশও নির্ধারিত। আর ‘মাওয়ালিয়া’ এর অন্য একটি অর্থ হচ্ছে যাদেরকে দ্বীনের খাতিরে অব্যবহিত উত্তরাধিকারীদের আওতাভুক্ত করা হয়েছে কিন্তু তারা ‘আক্বরাবূন’ না হওয়ায় তাদের জন্য কোনো নির্ধারিত অংশ নেই এবং তারা নির্দিষ্ট উত্তরাধিকারী নয়। এ প্রসঙ্গে ৩৩:৫ আয়াতটি একটি নৈতিক ব্যবস্থাপনার নির্দেশক, যা থেকে বুঝা যায় যে, পালিত পুত্রদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করতে হবে। যেসব উত্তরাধিকারীর জন্য নির্ধারিত বণ্টন বিধি দেয়া হয়েছে পালিত পুত্র তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে নির্দিষ্ট উত্তরাধিকারীদের মধ্য থেকে যাদের সাধ্য রয়েছে তাদের উচিত উত্তরাধিকার থেকে তাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ‘ওয়ারিস’ অর্থ হচ্ছে উত্তরাধিকারী, আর ‘মাওয়ালিয়া’ অর্থ হচ্ছে ‘অব্যবহিত (রসসবফরধঃব) ওয়ারিস/ নির্দিষ্ট ওয়ারিস’। উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিতে আল্লাহ যাদেরকে ‘ওয়ারিস’ হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তারাই হচ্ছেন মূল ‘মাওয়ালিয়া’। তাদের মধ্য থেকে কেউ জীবিত থাকা অবস্থায় অন্য কেউ ওয়ারিস হওয়ার অবকাশ নেই। কিন্তু মাওয়ালিয়া এর অন্তর্ভুক্ত কেউই না থাকলে শুধু সেই অবস্থায় নির্বাহী ব্যবস্থাপনায় অন্য ওয়ারিস হতে পারে। অন্য ওয়ারিস নির্ধারণের ও তাদের মধ্যে বণ্টনের ক্ষেত্রে মাওয়ালিয়ার মধ্যে নির্ধারিত বণ্টন বিধি থেকে শিক্ষা নেয়া যেতে পারে।
আল কুরআনে কোনো ব্যক্তি নিজে বিবাহ করার মাধ্যমে যাদের সাথে সম্পর্কিত হয়, যার সাথে তার স্বীয় ঔরসগত সম্পর্ক নেই, সেই বৈবাহিক সম্পর্ক বুঝাতে ‘ছিহর’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আর বংশীয় সম্পর্ক বুঝাতে ‘নাসাব’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে বৈবাহিক সম্পর্কের বিপরীতে (তথা বিপরীত সম্পর্ক হিসাবে) ‘নাসাব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
নাসাব শব্দের শব্দমূল হচ্ছে ‘নূন ছীন বা’। শব্দমূলের অর্থ ‘বংশগত আত্মীয়তা’।
নাসাব/ নসব (বংশগত আত্মীয়তার সম্পর্ক) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ২৫:৫৪:৮, ৩৭:১৫৮।
আনসাব (নাসাব এর বহুবচন) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ২৩:১০১:৬।
ছিহর শব্দের শব্দমূল হচ্ছে ‘সদ হ র’। শব্দমূলের অর্থ ‘গলানো, ক্ষারণ, বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তা’।
ছিহর (বিবাহগত আত্মীয়তার সম্পর্ক) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ২৫:৫৪:৯।
সাধারণভাবে রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় বুঝাতে ‘উলুল আরহাম’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে। আবার কখনো কখনো ‘উলুল আরহাম’ বুঝাতে শুধু ‘আরহাম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
আরহাম শব্দের শব্দমূল হচ্ছে ‘র হা মীম’। শব্দমূলের অর্থ হচ্ছে ‘দয়া, গর্ভ, জরায়ু, গর্ভসূত্রের আত্মীয়তা, রক্তসম্পর্কের আত্মীয়তা’।
উলুল আরহাম (গর্ভসূত্রের আত্মীয়/ রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়) শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৮:৭৫:১০-১১, ৩৩:৬:৮-৯।
উলুল আরহাম বুঝাতে আরহাম শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ৪:১:২৩, ৪৭:২২:১০, ৬০:৩:৩।
রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় এবং বৈবাহিক সম্পর্কের আত্মীয় উভয় প্রকার আত্মীয়দেরকে একসাথে ‘ক্বুরবা’ (একবচনে ‘যুল ক্বুরবা’ এবং বহুবচনে ‘উলুল ক্বুরবা’) এবং ‘যা মাক্বরাবাহ’ বলা হয়।
ক্বুরবা শব্দটির শব্দমূল হচ্ছে ‘ক্বফ র বা’। শব্দমূলের অর্থ হচ্ছে ‘নৈকট্য, উৎসর্গ, নৈকট্যের মাধ্যম, নিকটবর্তী আত্মীয়তা’।
যুল ক্বুরবা (একবচন) ও উলুল ক্বুরবা (বহুবচন) এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘নিকটবর্তী আত্মীয়তার অধিকারী’।
ক্বুরবা (আত্মীয়-স্বজন) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১৬ স্থানে: ২:৮৩:১৩, ২:১৭৭:২৪, ৪:৮:৫, ৪:৩৬:১০, ৪:৩৬:১৫, ৫:১০৬:৪৩, ৬:১৫২:২৭, ৮:৪১:১১, ৯:১১৩:১২, ১৬:৯০:৮, ১৭:২৬:৩, ২৪:২২:১০, ৩০:৩৮:৩, ৩৫:১৮:১৮, ৪২:২৩:১৮, ৫৯:৭:১২।
‘যা মাক্বরাবাহ’ (ক্বুরবা এর প্রতিশব্দ) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে। ৯০:১৫:৩।
‘ক্বফ র বা’ শব্দমূল থেকে গঠিত একটি শব্দ ‘ক্বারীব’ এর কম্পারেটিভ ও সুপারলেটিভ শব্দরূপ হচ্ছে ‘আক্বরাব’। ‘ক্বারীব’ অর্থ ‘নিকটবর্তী, নিকটবর্তী আত্মীয়’। আর ‘আক্বরাব’ অর্থ ‘অধিক/সর্বাধিক নিকটবর্তী, সর্বাধিক নিকটবর্তী আত্মীয়’।
অধিক/ সর্বাধিক নিকটবর্তী অর্থে ‘আক্বরাব’ বা ‘আক্বরাবূন’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ১৩ স্থানে: ২:২৩৭:২৫, ৩:১৬৭:২১, ৪:১১:৬১, ৫:৮:১৮, ৫:৮২:১১, ১৬:৭৭:১৩, ১৭:৫৭:৯, ১৮:২৪:১৪, ১৮:৮১:৮, ২২:১৩:৪, ২৬:১৪৩:৩, ৫০:১৬:১০, ৫৬:৮৫:২।
সর্বাধিক নিকটবর্তী আত্মীয় অর্থে ‘আক্বরাবূন’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ৬ স্থানে: ২:১৮০:১২, ২:২১৫:১০, ৪:৭:৬, ৪:৭:১২, ৪:৩৩:৭, ৪:১৩৫:১৪।
যেসব আয়াতে ‘আক্বরাবূন’ শব্দটি সবচেয়ে নিকটবর্তী আত্মীয়’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোতে ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ হলো ‘আল ওয়ালিদানি ওয়াল আক্বরাবূন’ অর্থাৎ ‘পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ’।
৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াত অনুযায়ী, পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়গণ [আক্বরাবূন] যা রেখে যায় তাতে যেমন পুরুষদেরকে ‘মাওয়ালিয়া’ [প্রধান ওয়ারিস] বানিয়ে অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তেমনি নারীদেরকেও মাওয়ালিয়া [প্রধান ওয়ারিস] বানিয়ে অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ কথার স্বত:সিদ্ধ হচ্ছে মৃত ব্যক্তি হলেন মাওয়ালিয়ার (প্রধান ওয়ারিসদের) আক্বরাবূন এবং মাওয়ালিয়া (প্রধান ওয়ারিসগণ) হলেন মৃত ব্যক্তির আক্বরাবূন। মৃত ব্যক্তি যেমন মাওয়ালিয়ার পিতা বা মাতা হতে পারে, তেমনি পিতা এবং মাতাকেও মৃত ব্যক্তির মাওয়ালিয়া বানানো হয়েছে। সুতরাং পিতা-মাতা অবশ্যই আক্বরাবূনের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং ‘আল ওয়ালিদানি ওয়াল আক্বরাবূন’ অর্থ ‘পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ’। অর্থাৎ পিতা-মাতা অবশ্যই ‘আক্বরাবূনের’ অন্তর্ভুক্ত কিন্তু তাদেরকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার জন্য প্রথমে তাদের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে ‘ওয়া’ [এবং] শব্দের পরে অর্থের মধ্যে ‘অন্য’ শব্দটির প্রায়োগিকতা স্বত:সিদ্ধভাবে এসে যায় এবং এভাবে মধ্যবর্তীতে ‘অন্য’ শব্দ উহ্য করে দিয়ে বক্তব্য প্রদান করা আরবি ভাষারীতির একটি রীতি।
৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াত অনুযায়ী যাদেরকে মৃত ব্যক্তির মাওয়ালিয়া [প্রধান ওয়ারিস] বানিয়ে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি দেয়া হয়েছে তারা হলেন তার আক্বরাবূন [সবচেয়ে নিকটবর্তী আত্মীয়]। ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী যাদের জন্য উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি দেয়া হয়েছে তারা হলো: পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রী, ভাই, বোন। সুতরাং এরাই আক্বরাবূন। এর মধ্য থেকে স্বামী/স্ত্রী ছাড়া বাকি সবাই রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়।
৪:৮ আয়াতে (আক্বরাবূনের মধ্যে) উত্তরাধিকার বণ্টনের সময় (ইয়াতীম ছেলে-মেয়ে ও মিসকীনদের পাশাপাশি) যেসব আত্মীয় স্বজন উপস্থিত হয় তাদেরকে ‘উলুল ক্বুরবা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং (বণ্টনের অব্যবহিত পরে) তাদেরকে জীবিকাস্বরূপ কিছু দিতে এবং তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত কথা বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং ‘আক্বরাবূন’ ছাড়া অন্য আত্মীয়গণ হচ্ছেন ‘উলুল ক্বুরবা’।
৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী, আক্বরাবূনের মধ্য থেকে ভাই, বোন শুধুমাত্র তখন পায় যখন মৃত ব্যক্তির সাথে তাদের কালালাহ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। (কালালাহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য কালালাহ সম্পর্কিত অধ্যায়টি দ্রষ্টব্য)। সুতরাং যে অবস্থায় ভাই, বোন উত্তরাধিকারের কোনো নির্ধারিত অংশ পায় না, ঐ অবস্থায় ভাই-বোন ‘উলুল ক্বুরবার’ অন্তর্ভুক্ত হিসেবে সাব্যস্ত হবে। অনুরূপভাবে পিতা-মাতা জীবিত থাকলে দাদা, দাদী, নানা, নানী ‘উলুল ক্বুরবা’ হিসেবে সাব্যস্ত হবে এবং কোনো পুত্র-কন্যা জীবিত থাকলে ঐ পুত্র-কন্যার সম্পর্ক সূত্রে থাকা পৌত্র, পৌত্রী, দৌহিত্র, দৌহিত্রী ‘উলুল ক্বুরবা’ হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
বিবাহগত সম্পর্কের দিক থেকে একমাত্র স্বামী/স্ত্রী আক্বরাবূনের অন্তর্ভুক্ত। বিবাহসূত্রের অন্য সকল আত্মীয়-স্বজন ‘উলুল ক্বুরবার’ অন্তর্ভুক্ত।
আক্বরাব শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘নিকটতম আত্মীয়’। প্রায়োগিকভাবে ‘আক্বরাব’ শব্দটির দুটি অর্থ রয়েছে। (১) সাধারণভাবে আত্মীয় হিসেবে অন্য আত্মীয়দের তুলনায় নিকটতম [আক্বরাব] হওয়া। (২) উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নিকটতম আত্মীয় [আক্বরাব] হিসেবে অধিভুক্ত হওয়া।
সাধারণভাবে সকল নাতিই সমান স্তরের প্রপুত্র। তবে উত্তরাধিকার প্রাপ্তির প্রশ্নে ইয়াতীম নাতি ‘আক্বরাব’ হয়, কিন্তু অন্য নাতিরা ‘আক্বরাব’ হয় না। কারণ প্রথমত সকল নাতিই পুত্রতুল্য হলেও পুত্রদের তুলনায় প্রপুত্ররা দ্বিতীয় স্তরের পুত্র হওয়ায় উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে স্তরগত দূরত্বের বিবেচনায় পুত্র ‘আক্বরাব’ হয় কিন্তু নাতি ‘আক্বরাব’ হয় না। তবে ইয়াতীম নাতির পিতা না থাকার কারণে দাদার উত্তরাধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সে তার নিজ পিতার প্রাপ্য আনুপাতিক অংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হয়, যে ক্ষেত্রে অন্য নাতিরা তাদের নিজ পিতা জীবিত থাকায় দাদার উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তিনি (তাদের নিজ পিতা) প্রতিবন্ধক হয়ে থাকেন অর্থাৎ তারা উত্তরাধিকার পায় না। এমতাবস্থায় উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ইয়াতীম নাতি তার দাদার ‘আক্বরাবে’ পরিণত হয় কিন্তু অন্য নাতিরা ‘আক্বরাব’ হয় না। এক্ষেত্রে পার্থক্য তৈরি হওয়ার কারণ প্রত্যেক নাতির নিজ নিজ পিতা জীবিত থাকা বা না থাকা। সংক্ষেপে বলা যায়, যেহেতু নাতির পিতার মাধ্যমেই দাদার সাথে নাতির বংশধারার সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে থাকে তাই উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নাতি দাদার ‘আক্বরাব’ সাব্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে নাতির পিতা প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে।
যারা ইয়াতীম নাতি উত্তরাধিকারী হতে পারে না বলে মতপ্রকাশ করেন তাঁরা সাধারণত উত্তরাধিকারের পরিবর্তে ২:১৮০ আয়াতে বর্ণিত ‘আক্বরাবূনা’ শব্দের আওতায় ইয়াতীম নাতি নাতিনর জন্য ওয়াসিয়্যাত করার সুপারিশ উপস্থাপন করেন। আয়াতটিতে বলা হয়েছে:
কুতিবা আলাইকুম ইযা হাদারা আহাদাকুমুল মাওতু ইন তারাকা খায়রানিল ওয়াসিয়্যাতু লিল ওয়ালিদায়নি ওয়াল আক্বরাবীনা বিল মা’রূফি হাক্বক্বান আলাল মুত্তাক্বীনা
২:১৮০ :: তোমাদের উপর বিধিবদ্ধ করা হলো যে, তোমাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু সন্নিকটে এসে গেলে যদি সে সম্পদ রেখে যায় তবে সে তার পিতা-মাতার জন্য এবং অন্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ন্যায়সঙ্গত ওয়াসিয়্যাত করতে হবে। এটা আল্লাহ সচেতনদের উপর দায়িত্ব।
আয়াতটিতে প্রদত্ত বিধান বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে জানা প্রয়োজন যে, ৪:৭-৮ এবং ৪:৩৩ আয়াত অনুসারে, পিতা-মাতা ছাড়া অন্য আক্বরাবূনের মধ্যে রয়েছে অন্য সকল ওয়ারিস এবং দ্বিতীয় স্তরের (স্থলাভিষিক্ত) আক্বরাবূনও এর অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূন হলো দাদা-দাদী, নানা-নানী, পৌত্র-পৌত্রী ও দৌহিত্র-দৌহিত্রী। কিন্তু চাচা মামা প্রথম বা দ্বিতীয় কোনো স্তরের আক্বরাবূন নন, তাঁরা হলেন উলুল ক্বুরবা। আর বৈবাহিক সম্পর্কের আওতায় আক্বরাবূন হিসাবে শুধুমাত্র স্বামী বা স্ত্রী অন্তর্ভুক্ত। তাই শশুর, শাশুড়ি প্রমুখ হলেন উলুল ক্বুরবা।
২:১৮০ আয়াত অনুসারে যেমন ইয়াতীম নাতি আক্বরাবূন হওয়ায় তাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা কর্তব্য, তেমনি দাদা আক্বরাবূন হওয়ায় তাঁর জন্য ওয়াসিয়্যাত করা কর্তব্য। সুতরাং ইয়াতীম নাতির জন্য ওয়াসিয়্যাত করা যেতে পারে বিধায় যদি ইয়াতীম নাতি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে দাদার জন্য ওয়াসিয়্যাত করা যেতে পারে বিধায় দাদাও উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা। কিন্তু ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করলেও পিতা না থাকা অবস্থায় পিতার প্রাপ্য অংশের স্থলাভিষিক্ত ওয়ারিস হিসেবে দাদাকে উত্তরাধিকার দেয়া হয় অর্থাৎ দাদাকে বঞ্চিত করা হয় না। অনুরূপভাবে ইয়াতীম নাতিকেও বঞ্চিত করা যেতে পারে না।
এছাড়া, আয়াতটিতে আক্বরাবূনের জন্য ওয়াসিয়্যাত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে উত্তরাধিকারের বিধানের ক্ষেত্রেও তা আক্বরাবূনের মধ্যে বণ্টনের বিধিব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনো কোনো ওয়ারিস কোনো কোনো অবস্থায় প্রাপক হয় এবং কোনো অবস্থায় প্রাপক হয় না, যেমন ভাই-বোন। অনুরূপভাবে দাদা-দাদী এবং নাতি-নাতিনও কোনো কোনো অবস্থায় প্রাপক হয় এবং কোনো অবস্থায় প্রাপক হয় না। যেমন পিতা থাকলে দাদা-দাদী প্রাপক হবে না। অনুরূপভাবে নাতি-নাতিনের পিতা থাকলে নাতি-নাতিন প্রাপক হবে না। নাতি নাতিন যেমন আক্বরাবূন হিসেবে ওয়াসিয়্যাতের প্রাপক, তেমনি তারা আক্বরাবূন হিসেবে প্রযোজ্য অবস্থায় (অর্থাৎ পিতৃহীন বা ইয়াতীম অবস্থায়) উত্তরাধিকারের প্রাপক।
সুতরাং প্রথম স্তরের সর্বাবস্থায় প্রাপক আক্বরাবূন হলেন পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, স্বামী/স্ত্রী। প্রথম স্তরের শর্তযুক্ত অবস্থায় প্রাপক আক্বরাবূন হলেন ভাই-বোন। আর দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূন হলেন দাদা নানা, দাদী নানী, পৌত্র, দৌহিত্র, পৌত্রী, দৌহিত্রী। প্রথম স্তরের আক্বরাবের মধ্য থেকে যার মাধ্যমে দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূনের সাথে মৃত ব্যক্তির সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তার বর্তমানে দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূন উত্তরাধিকার বণ্টনের বিবেচনা থেকে বাদ যায়। যেমন পিতা দাদা দাদীকে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে, মাতা নানা নানীকে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে, পুত্র তার নিজ পুত্র-কন্যাকে (মৃতের ঐ পুত্রের মাধ্যমে সম্পর্কিত মৃতের পৌত্র-পৌত্রীকে) বিবেচনা থেকে বাদ রাখে, কন্যা তার নিজ পুত্র-কন্যাকে (মৃতের ঐ কন্যার মাধ্যমে সম্পর্কিত মৃতের দৌহিত্র- দৌহিত্রীকে) বিবেচনা থেকে বাদ রাখে।
আওলাদ শব্দের আওতায় শুধু পুত্র নয় বরং প্রপুত্রও শামিল। এর একটি প্রমাণ হলো, আয়াতের (৪:১১) পরবর্তী অংশে আক্বরাবূনের তুলনামূলক অবস্থানের বিষয়ে যে প্রশ্ন করা হয়েছে তাতে আওলাদ শব্দের পরিবর্তে আবনা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আর আবনা শব্দে পুত্রের মত প্রপুত্রও শামিল। সুতরাং আওলাদ শব্দ (যার বিকল্প শব্দ হিসাবে আবনা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে) দ্বারা প্রপুত্রকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্য কথায়, ওয়ালাদ (আওলাদ শব্দের একবচন) অর্থ পুত্র, প্রপুত্র প্রমুখ।
আরবি ভাষারীতি অনুসারে পিতা ও পুত্র বুঝাতে যেখানে জন্মগত সম্পর্কের দিককে গুরুত্ব দেয়া হয় সেখানে ওয়ালিদ ও ওয়ালাদ ব্যবহৃত হয় এবং যেখানে জন্মগত সম্পর্কের মধ্যে অন্তর্নিহিত আবেগিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়া হয় সেখানে আবু ও ইবনু শব্দ ব্যবহৃত হয়।
কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের উদাহরণ থেকে স্পষ্ট যে, আবু ও ইবনু এর বহুবচনের (আবাউ ও আবনা) আওতায় দাদা ও নাতি অন্তর্ভুক্ত। আবার কুরআনে ৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াত অনুযায়ী স্পষ্ট যে, ওয়ারিস ও মৃত ব্যক্তি পরস্পর আক্বরাবূন। তবে পুত্র থাকা অবস্থায় প্রপুত্র ওয়ালাদ হওয়া সত্ত্বেও ওয়ারিস হবে না, বরং সে হবে এমন ওয়ালাদ যে ওয়ারিস হিসাবে বিবেচ্য ওয়ালাদ নয়। কারণ ওয়ারিস হিসাবে বিবেচ্য হওয়ার জন্য আক্বরাবূন (নিকটতম) হওয়া শর্ত। আর সাধারণভাবে আক্বরাবূন হলেও পুত্র থাকা অবস্থায় তার সূত্রে প্রপুত্র স্তরগত দূরত্বের কারণে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আক্বরাবূন হিসেবে বিবেচনা থেকে বাদ যায়।
আক্বরাবূন শব্দের কারণে এ কথা স্বত:সিদ্ধ যে, একই শব্দের আওতায় থাকা ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যদি ঊর্ধ্বতন বা অধ:স্তনের একাধিক স্তর থাকে, তবে সেক্ষেত্রে প্রথম স্তর দ্বিতীয় স্তরের তুলনায় আক্বরাবূন তথা প্রথম স্তরের ব্যক্তি জীবিত থাকা অবস্থায় সে-ই উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আক্বরাবূন হিসেবে সাব্যস্ত হয়। অন্যভাবে বলা যায়, প্রথম স্তরের উপস্থিতিতে দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূনকে স্তরগত বিবেচনায় উত্তরাধিকার প্রাপ্তির বিবেচনা থেকে বাদ রাখা হয়। কিন্তু প্রথম স্তরের অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূন উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিবেচনায় আসে। এক্ষেত্রে তারা বিবেচনায় আসে প্রথম স্তরের যে আক্বরাবূনের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির সাথে তাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তার আনুপাতিক অংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হিসেবে। তাদেরকে আক্বরাবূন সাব্যস্ত করার কারণ হলো যারা কখনোই আক্বরাবূন হয় না তাদের তুলনায় তারা কখনো কখনো আক্বরাবূন হিসেবে সাব্যস্ত হয়, কারণ তারা মৃত ব্যক্তির ঊর্ধ্বতন বা অধ:স্তন সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করে।
লম্বরূপ সরলরৈখিক ঊর্ধ্বক্রমের মধ্যবর্তী ব্যক্তি ঊর্ধ্বক্রমের উপরের ব্যক্তিকে ও নিম্নক্রমের মধ্যবর্তী ব্যক্তি নিম্নক্রমের নিচের ব্যক্তিকে বঞ্চিত করে। যেমন পিতা দাদাকে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে এবং পুত্র নাতিকে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে। কিন্তু এক পুত্র অন্য পুত্রের পুত্রকে বঞ্চিত করতে পারে না। অর্থাৎ কোনো ইয়াতীম নাতি এজন্য বঞ্চিত হবে না যে, তার চাচা আছে। পিতা দাদাকে ও দাদীকে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে,কারণ দাদী মাতৃতুল্য হলেও তার সাথে সম্পর্ক পিতার মাধ্যমে বা এক্ষেত্রে পিতা সম্পর্কের মধ্যবর্তী ব্যক্তি। মাতা নানাকে ও নানীকে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে, কারণ নানা পিতৃতুল্য হলেও তার সাথে মৃতের সম্পর্ক মাতার মাধ্যমে বা এক্ষেত্রে মাতা সম্পর্কের মধ্যবর্তী ব্যক্তি। পুত্র পৌত্র-পৌত্রী উভয়কে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে, কারণ পৌত্রী কন্যাতুল্য হলেও তার সাথে সম্পর্ক পুত্রের মাধ্যমে। কন্যা দৌহিত্র-দৌহিত্রী উভয়কে বিবেচনা থেকে বাদ রাখে, কারণ দৌহিত্র পুত্রতুল্য হলেও তার সাথে সম্পর্ক কন্যার মাধ্যমে।
উত্তরাধিকার বণ্টন প্রসঙ্গে প্রদত্ত অংশসমূহ যে আনুপাতিক পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত তা স্পষ্ট হওয়ার জন্য ৪:৩৩ আয়াতটিতে ব্যবহৃত ‘লিকুল্লিন’ শব্দটির তাৎপর্য জানা জরুরি। এ প্রসঙ্গে ‘লিকুল্লি’ ও ‘লিকুল্লিন’ শব্দ দুটির প্রায়োগিক পার্থক্য নির্ণয় করতে হবে।
নিম্নে ‘লিকুল্লি’ ও ‘লিকুল্লিন’ শব্দ দুটির কোনটি কোন কোন আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে তার তালিকা দেয়া হলো-
লিকুল্লি শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৩০ স্থানে: ৪:১১:২৪, ৪:১২:৬১, ৬:৬৭:১, ৬:১০৮:১৫, ৬:১১২:৩, ৬:১৫৪:১০, ৭:৩৪:১, ৭:১৪৫:১০, ১০:৪৭:১, ১০:৪৯:১২, ১০:৫৪:৩, ১৩:৭:১৩, ১৩:৩৮:২০, ১৪:৫:১৯, ১৫:৪৪:৪, ১৬:৮৯:১৯, ২২:৩৪:১, ২২:৬৭:১, ২৪:১১:১৫, ২৫:৩১:৩, ৩১:৩১:১৭, ৩৪:৯:২৭, ৩৪:১৯:১৭, ৪২:৩৩:১৩, ৪৫:৭:২, ৫০:৮:৩, ৫০:৩২:৪, ৬৫:৩:১৯, ৮০:৩৭:১, ১০৪:১।
লিকুল্লিন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ৬ স্থানে: ২:১৪৮:১, ৪:৩৩:১, ৫:৪৮:২৫, ৬:১৩২:১, ৭:৩৮:৩৬, ৪৬:১৯:১।
‘লিকুল্লি’ এবং ‘লিকুল্লিন’ শব্দ দুটির মধ্যে অর্থগত পার্থক্য রয়েছে। শুধু ‘লিকুল্লি’ শব্দটি পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে না। পূর্ণ অর্থ প্রকাশের জন্য ‘লিকুল্লি’ শব্দের পরে কোনো বিশেষ্য বসে এবং ঐ বিশেষ্যের মাধ্যমেই নির্দিষ্ট হয় ‘লিকুল্লি’ শব্দটি দ্বারা কোন ব্যক্তি, বস্তু বা বিষয়কে নির্দেশ করা হয়েছে। ‘লিকুল্লি’ অর্থ ‘প্রত্যেক ... জন্য’। এখানে শূন্যস্থানে ‘লিকুল্লি’ এর পর ব্যবহৃত বিশেষ্য এর অর্থ বসবে। যেমন, ‘লিকুল্লি উম্মাতিন’ (৭:৩৪, ১০:৪৭, ২২:৩৪) অর্থ হচ্ছে ‘প্রত্যেক উম্মাতের জন্য’।
অন্যদিকে ‘লিকুল্লিন’ একটি পূর্ণ অর্থ প্রকাশক শব্দ। ‘লিকুল্লিন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘প্রত্যেকের জন্য, প্রত্যেকটির জন্য’। কোনো বাক্যে ‘লিকুল্লিন’ শব্দ দ্বারা প্রত্যেকটি ব্যক্তির জন্য, বস্তুর জন্য না প্রসঙ্গগত বিষয়ের জন্য বুঝাচ্ছে তা বক্তব্য বিষয়ের মাধ্যমে অথবা পরবর্তী ব্যাখ্যামূলক শব্দ বা বাক্যাংশের মাধ্যমে বুঝা যায়। যেমন ‘লিকুল্লিন’ শব্দটি ২:১৪৮, ৬:১৩২ ও ৪৬:১৯ আয়াতে ব্যক্তির জন্য বুঝাতে এবং ৪:৩৩ আয়াতে বস্তুর জন্য বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।
৪:৩৩ আয়াতে ‘লিকুল্লিন’ শব্দটির সাথে সম্পর্কিত বাক্য হলো: ওয়া লিকুল্লিন জায়ালনা মাওয়ালিয়া মিম্মা তারাকাল ওয়ালিদানি ওয়াল আক্বরাবূনা। অর্থাৎ পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ যা রেখে যায় আমি তার প্রত্যেকটির জন্য উত্তরাধিকারী নির্দিষ্ট করে দিয়েছি। এখানে ‘লিকুল্লিন’ বলতে বুঝানো হয়েছে ‘মিম্মা তারাকাল ওয়ালিদানি ওয়াল আক্বরাবূনা’ এর ‘লিকুল্লিন’। অর্থাৎ ‘পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়রা’ যা রেখে যায় তা থেকে প্রত্যেকটি অংশের জন্য। ‘পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়রা যা রেখে যায় তার প্রত্যেকটি অংশের জন্য ....... নির্দিষ্ট করা হয়েছে।’ কী বা কাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে? এর উত্তর হচ্ছে ‘মাওয়ালিয়া’ তথা ‘অব্যবহিত উত্তরাধিকারী’ নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
কিছু ক্ষেত্রে শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ও প্রকৃত প্রাপ্য অংশ অভিন্ন হয়ে থাকে, আর কিছু ক্ষেত্রে শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ ও প্রকৃত প্রাপ্য অংশ ভিন্ন হয়ে থাকে; এটি একটি স্বাভাবিক বিষয়। একই ব্যক্তির একই আনুপাতিক ভগ্নাংশ অন্য ওয়ারসিদের মধ্য থেকে কে কে উপস্থিত আছে তার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন প্রকৃত অংশে রূপায়িত হয়, এটি আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্বাভাবিক প্রকৃতি। আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণের তাৎপর্য হলো, উত্তরাধিকারের প্রাপকদের বিভিন্ন শ্রেণির উপস্থিতি সাপেক্ষে তাদের প্রাপ্য অংশ নির্ধারণে তাদের মধ্যকার পারস্পরিক তুলনামূলক তারতম্য (অনুপাত) স্থির করা।
আয়াতসমূহে বর্ণিত ও অন্তর্নিহিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ণয়ের উপায়
আয়াতসমূহে বর্ণিত ও অন্তর্নিহিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ণয়ের জন্য নিম্নোক্ত দুটি উপায় রয়েছে:
(১) প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
(২) তুলনামূলক পদ্ধতিতে প্রাপ্তব্য (প্রত্যক্ষভাবে অনুল্লেখিত) আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
৪:১১ আয়াতে সন্তান না থাকা অবস্থায় ও ভাই-বোন থাকা অবস্থায়, এ দু অবস্থায় মাতার অংশ প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখিত কিন্তু পিতার অংশ তুলনামূলক পদ্ধতিতে প্রাপ্তব্য।
সন্তান না থাকা অবস্থায় মা পাবে ১/৩ ভাগ। সুতরাং পিতা পাবে ১ - ১/৩ = ২/৩ ভাগ। এক্ষেত্রে, মায়ের ১/৩ ভাগের বিপরীতে পিতার ২/৩ ভাগ ধরার কারণ হচ্ছে, আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে পিতা-মাতা ওয়ারিস। সুতরাং মাতার অংশ ও পিতার অংশের সমষ্টি ১ হিসাবে ধরা হবে। আবার যদি তাদের সাথে অন্য ওয়ারিসও থাকে তবে ১/৩ + ২/৩ + অন্য আনুপাতিক অংশ কার্যকর হবে সমস্ত সম্পদে, যদিও ১/৩ + ২/৩ + অন্য আনুপাতিক অংশ = ১ এর বেশি হয়। অর্থাৎ এখানে অন্য ওয়ারিস থাকলেও এই ১/৩ + ২/৩ = ১ হবে পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ অন্য ওয়ারিসের আনুপাতিক ভগ্নাংশের তুলনায়। যেমন, তিন কন্যা ও পিতা-মাতা থাকলে, তিন কন্যা পাবে ২/৩ , পিতা ও মাতা পাবে (১/৬ + ১/৬ =) ১/৩ । সাথে স্বামী/ স্ত্রী থাকলেও তাদের আনুপাতিক অংশ এটিই থাকবে। কারণ, সর্বাবস্থায় পারস্পরিক আনুপাতিক ভগ্নাংশগুলোর যোগফল ১ হওয়া শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো শর্ত নয়। শুধুমাত্র সন্তান না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা যখন ওয়ারিস তখন তাদের উভয়ের আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণের সুনির্দিষ্টি ক্ষেত্রে যোগফল ১ হওয়ার বিষয়টি প্রযোজ্য। কারণ এতে বক্তব্যভঙ্গি (ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু ...) থেকে তাদের উভয়ের মধ্যকার অনুপাতের যোগফল ১ হওয়ার বিষয়টি স্থিরিকৃত হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভাই-বোন থাকা অবস্থায় মাতা পাবে ১/৬ , যা সন্তানের উপস্থিতিতে মাতার অংশের অনুরূপ। সুতরাং এ অবস্থায় পিতাও পাবে ১/৬ । অর্থাৎ এক্ষেত্রে ভাই-বোনের উপস্থিতির প্রভাব সন্তানের উপস্থিতির প্রভাবের সমান।
আনুপাতিক অংশের পরিবর্তে অবশিষ্টাংশের ধারণা গ্রহণ করলে যেসব ক্ষেত্রে অবশিষ্টাংশ অনুসারে বণ্টিত হবে তার তালিকা নিম্নরূপ:
(ক) এক বা একাধিক পুত্র পাবে অবশিষ্টাংশ।
(খ) পুত্র-কন্যা মিলিতভাবে থাকলে তারা পাবে অবশিষ্টাংশ।
(গ) পুত্র-কন্যা না থাকলে সে অবস্থায় পিতা-মাতা উভয়ে ওয়ারিস হলে পিতা পাবে অবশিষ্টাংশ।
(ঘ) পুত্র-কন্যা না থাকলে কিন্তু ভাই-বোন থাকলে সে অবস্থায় পিতা-মাতা উভয়ে ওয়ারিস হলে পিতা পাবে অবশিষ্টাংশ।
(ঙ) পুত্র-কন্যা না থাকলে পিতা-মাতা উভয়ে ওয়ারিস না হয়ে পিতা বা মাতা ওয়ারিস হলে তখন পিতা বা মাতা পাবে অবশিষ্টাংশ।
(চ) পুত্র-কন্যা না থাকলে কিন্তু ভাই-বোন থাকলে সে অবস্থায় পিতা-মাতা উভয়ে ওয়ারিস না হয়ে পিতা বা মাতা ওয়ারিস হলে তখন পিতা বা মাতা পাবে অবশিষ্টাংশ। (এরূপ হলে, ভাই-বোনকে পুত্র-কন্যার সমান গুরুত্ব দেয়া হয় না, কারণ পুত্র-কন্যা থাকা অবস্থায় শুধু পিতা বা শুধু মাতা যেই থাকুক সে পায় ১/৬ )।
(ছ) পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় এক বা একাধিক ভাই পাবে অবশিষ্টাংশ।
(জ) পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন মিলিতভাবে থাকলে তারা পাবে অবশিষ্টাংশ।
(ঝ) একটি উপলব্ধি অনুযায়ী, শুধু দুই কন্যা থাকলে তারা পাবে অবশিষ্টাংশ।
(ঞ) একটি উপলব্ধি অনুযায়ী, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় শুধু দুইয়ের বেশি বোন থাকলে তারা পাবে অবশিষ্টাংশ।
কিন্তু আনুপাতিক অংশ বণ্টন পদ্ধতি অনুসারে উপরিউক্ত অবশিষ্টাংশের ধারণা ও ধারাগুলো সঠিক নয়।
প্রকৃতপক্ষে আউল বা রদ্দ নীতি এবং আনুপাতিক বন্টন পদ্ধতি একই বিষয়। কিন্তু আউল বা রদ্দ নীতির প্রচলিত প্রয়োগ রীতি এবং আনুপাতিক অংশ বন্টন পদ্ধতি একই বিষয় নয়। অর্থাৎ বর্তমানে আউল বা রদ্দ নীতি সবসময় প্রয়োগ করা হয় না বরং অনেক সময় আসাবার মধ্যে অবশিষ্ট অংশ বন্টন করা হয় বা যাবিল আরহামের মধ্যে বন্টন করা হয়, শুধুমাত্র কিছু বিশেষ অবস্থায় আউল বা রদ্দ নীতি প্রয়োগ করা হয় যা একটি সমস্যায় পড়া অবস্থায় বাধ্য হয়ে করা সমাধান হিসাবে প্রবর্তিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এছাড়া আউল ও রদ্দ নীতির মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতি দেখা যায়। আউলের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী অন্তর্ভুক্ত অথচ রদ্দের ক্ষেত্রে তারা অন্তর্ভুক্ত নয়। এরূপ স্ববিরোধ আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। যেমন প্রচলিত ফারায়েজ অনুসারে পিতা ভাই-বোনকে বঞ্চিত করে, অথচ মা বঞ্চিত করে না। দাদা ওয়ারিস হয় অথচ ইয়াতীম নাতি ওয়ারিস হয় না। ইত্যাদি।
আনুপাতিক বন্টন পদ্ধতি হচ্ছে সর্বাবস্থায় আউল বা রদ্দ নীতি বাস্তবায়নের নামান্তর। তখন এটাই হয় মূল সূত্র। এ ক্ষেত্রে তথাকথিত যাবিল ফুরুজ, আসাবা ও যাবিল আরহামের প্রশ্ন নেই। বরং প্রত্যেকেই যাবিল ফুরুজ, যারা কুরআনের আলোকে ওয়ারিস। এতে প্রচলিত ফারায়েজের এ নীতি স্বীকৃত নয় যে, পুরুষের মাধ্যমে সম্পর্কিতরা আসাবা, নারীর মাধ্যমে সম্পর্কিতরা যাবিল আরহাম। বরং এখানে পুরুষ ও নারীর মাধ্যমে সম্পর্কিত সমস্তরের রক্তসম্পর্কের আত্মীয়রা (উলুল আরহাম) একই রূপ শর্তানুসারে ওয়ারিস হয়। যেমন দাদা, নানা, দাদী, নানী প্রমুখ।
পিতার অংশ পাবে দাদা-দাদী, যেখানে দাদা-দাদীর পারস্পরিক অনুপাত হবে পিতা-মাতার পারস্পরিক অনুপাতের অনুরূপ, কিন্তু মাতা তার নিজের অংশ পাবে। অনুরূপ মাতার অংশ পাবে নানা-নানী, যেখানে নানা নানীর পারস্পরিক অনুপাত হবে পিতা-মাতার পারস্পরিক অনুপাতের অনুরূপ, কিন্তু পিতা তার নিজের অংশ পাবে। ইয়াতীম পৌত্র, পৌত্রী, দৌহিত্র, দৌহিত্রীর মধ্যে সম্পদ অনুরূপ পদ্ধতিতে সম্পদ বণ্টিত হবে।
প্রচলিত ফারায়েজেও স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যে, পিতা দাদীকে বঞ্চিত করে। কিন্তু দাদা দাদীর মাতাকে বঞ্চিত করে না। কারণ দাদা নিকটবর্তী হলেও দাদীর মাতার সাথে মৃতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দাদা মাঝখানের কেউ নন।
একই যুক্তি অনুসারে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, পিতা মাতার মাতাকে বা নানীকে বঞ্চিত করে না। কারণ, নানীর সাথে মৃতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পিতা মাঝখানের কেউ নয় (লম্বরূপ সরলরৈখিক ঊর্ধ্বক্রমের বিবেচনায়)।
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি হলো আউল ও রদ্দ নীতিকে বিভিন্ন শর্তে বিভিন্নভাবে প্রয়োগ না করে একইরূপে প্রয়োগের জন্য গৃহীত বণ্টন পদ্ধতি। নিম্নে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি এবং বিভিন্নভাবে প্রয়োগের শর্তকে পরিহার করে আউল ও রদ্দ নীতিতে বণ্টনের পদ্ধতি পরপর উপস্থাপনের মাধ্যমে উভয়টি যে একই পদ্ধতির দুই ধরনের গাণিতিক উপস্থাপনা তা দেখানো হলো।
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতির সূত্র
নির্দিষ্ট শ্রেণির নির্ণেয় প্রাপ্য সম্পদ = (শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ/ আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহের সমষ্টি) * মোট সম্পদ (একক)
যেমন: কোনো ব্যক্তির তিন কন্যা, পিতা-মাতা ও স্ত্রীর মধ্যে ১০০০ টাকা ভাগ করে দিতে হবে।
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি অনুসারে,
তিন কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ২/৩ ,
পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১/৬ ,
মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১/৬ ,
স্ত্রীর আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১/৮ ।
আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহের সমষ্টি = ৯/৮ ।
সুতরাং,
Image 232
তিন কন্যা পরস্পর সমান হারে পাবে। সুতরাং প্রত্যেক কন্যা পাবে ৫৯২.৫৯/৩ = ১৯৭.৫৩
স্ত্রীরা পরস্পর সমান হারে পাবে। সুতরাং প্রত্যেক স্ত্রী পাবে ১১১.১১/২ = ৫৫.৫৫
অতএব,
প্রত্যেক কন্যা পাবে ১৯৭.৫৩ টাকা, পিতা পাবে ১৪৮.১১ টাকা, মাতা পাবে ১৪৮.১১ টাকা, প্রত্যেক স্ত্রী পাবে ৫৫.৫৫ টাকা।
প্রচলিত শর্তসমূহ বিবেচনা ছাড়া সাধারণভাবে আউল বা রদ্দ নীতিতে বণ্টনের সূত্র
উল্লেখিত অংশসমূহের যোগফল থেকে হরকে হ্রাস/বৃদ্ধি করে লবের সমান করতে হবে এবং তদনুসারে প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অংশ দিতে হবে।
যেমন, উপরের উদাহরণের বণ্টনটি আউল/রদ্দ পদ্ধতি প্রয়োগ করে নিম্নরূপ হয়:
তিন কন্যা + পিতা + মাতা + স্ত্রী = ২/৩ + ১/৬ + ১/৬ + ১/৮
= ১৬/২৪ + ৪/২৪ + ৪/২৪ + ৩/২৪
= ২৭/২৪
= ২৭/২৭
সুতরাং
তিন কন্যা পাবে (১৬/২৭ ) ১০০০ = ১৬০০০/২৭ = ৫৯২.৫৯
পিতা পাবে (৪/২৭ ) ১০০০ = ৪০০০/২৭ = ১৪৮.১৪
মাতা পাবে (৪/২৭ ) ১০০০ = ৪০০০/২৭ = ১৪৮.১৪
স্ত্রী পাবে (৩/২৭ ) ১০০০ = ৩০০০/২৭ = ১১১.১১
উল্লেখ্য: যেহেতু প্রদত্ত উদাহরণে উল্লেখিত অংশসমূহের যোগফল ১ এর বেশি তাই প্রচলিত ফারায়েজেও উপরের পদ্ধতিতে আউল প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু যদি যোগফল ১ এর কম হতো তাহলে প্রচলিত ফারায়েজ অনুসারে রদ্দ নীতি হলো স্ত্রীকে রদ্দের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। যেমন,
ধরি উপরের উদাহরণটির ক্ষেত্রে পিতা জীবিত নেই। এরূপ ক্ষেত্রে প্রচলিত ফারায়েজের নিয়মে বণ্টন কিরূপ হবে তা নিম্নে দেয়া হলো।
তিন কন্যা, মাতা ও স্ত্রীর মধ্যে ১০০০ টাকা ভাগ করে দিতে হবে।
প্রচলিত ফারায়েজের নিয়মে,
তিন কন্যা পাবে = ২/৩
মাতা পাবে = ১/৬
স্ত্রী পাবে = ১/৮
অংশসমূহের যোগফল = ২/৩ + ১/৬ + ১/৮
= ১৬/২৪ + ৪/২৪ + ৩/২৪
= ২৩/২৪
অবশিষ্ট অংশ = ১/২৪
সুতরাং স্ত্রী পাবে = ৩/২৪ * ১০০০
= ১২৫ টাকা।
কিন্তু তিন কন্যা ও মাতার মধ্যে রদ্দ হবে।
তাই তাদের মধ্যে নিম্নোক্তভাবে বণ্টন হবে।
প্রথম পর্যায়ে, তিন কন্যা পাবে = ১৬/২৪ * ১০০০ = ৬৬৬.৬৬
মাতা পাবে = ৪/২৪ * ১০০০ = ১৬৬.৬৬
মোট বণ্টিত হলো ১২৫ + ৬৬৬.৬৬ + ১৬৬.৬৬ = ৯৫৮.৩২
অবশিষ্ট রয়েছে ১০০০ - ৯৫৮.৩২ = ৪১.৬৮
অর্থাৎ পুনরায় ৪১.৬৮ টাকা তিন কন্যা ও মাতার মধ্যে বণ্টন করতে হবে।
তিন কন্যার অংশ + মাতার অংশ
= ২/৩ + ১/৬
= ৪/৬ + ১/৬
= ৫/৬
রদ্দের নিয়মানুসারে হরকে ৫ ধরতে হবে।
সুতরাং তিন কন্যা পাবে = ৪/৫ * ৪১.৬৮ = ৩৩.৩৪
মাতা পাবে = ১/৫ * ৪১.৬৮ = ৮.৩৪
অর্থাৎ, তিন কন্যা মোট পাবে = ৬৬৬.৬৬ + ৩৩.৩৪ = ৭০০ টাকা।
মাতা মোট পাবে = ১৬৬.৬৬ + ৮.৩৪ = ১৭৫
প্রচলিত ফারায়েজের রদ্দ নীতিতে বণ্টনের মাধ্যমে, তিন কন্যা পাবে ৭০০ টাকা, মাতা পাবে ১৭৫ টাকা, স্ত্রী পাবে ১২৫ টাকা।
অনুপাত পদ্ধতিতে বন্টন হচ্ছে আউল বা রদ্দ নীতির সার্বিক প্রয়োগ তথা প্রত্যেকটি উল্লেখিত অংশকে আনুপাতিক অংশ সাব্যস্ত করার মাধ্যমে সকল অবস্থায় উপস্থিত ওয়ারিসদের মধ্যে সমস্ত সম্পদের বন্টন। যদি কিছু ক্ষেত্রে আউল বা রদ্দ নীতি প্রয়োগ করার মাধ্যমে বন্টন করা হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে কিছু অবশিষ্ট রাখা হয় তাহলে তা স্ববিরোধী বিষয় হয়ে যায়। কারণ আউল বা রদ্দ নীতি প্রয়োগের অর্থ হলো কুরআনে বর্ণিত/ প্রদত্ত ওয়ারিসদের অংশকে আনুপাতিক অংশ সাব্যস্ত করে সেটার মাধ্যমে ওয়ারিসদের মধ্যে যে অনুপাত তৈরি হয় তা প্রয়োগ করা। তাহলে কিছু ক্ষেত্রে অবশিষ্ট রেখে দেয়ার অর্থ হলো প্রদত্ত অংশকে তাদের আনুপাতিক অংশ হিসাবে স্বীকৃতি না দিয়ে কার্যকর করা। যদি প্রদত্ত অংশকে আনুপাতিক অংশ হিসাবে স্বীকৃতি না দেয়া হয় তবে কখনোই আউল বা রদ্দ নীতি প্রয়োগ করা যাবে না। আর যদি আউল বা রদ্দ নীতি প্রয়োগ করতে হয় তবে প্রদত্ত অংশকে সব ক্ষেত্রে আনুপাতিক অংশ হিসাবে কার্যকর করতে হবে তথা সব ক্ষেত্রে ওয়ারিসদের মধ্যে সমস্ত সম্পদ বন্টিত হবে, কখনো কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।
উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির সাথে সম্পর্কিত ৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াতে পিতা-মাতাকে বুঝানোর জন্য ‘ওয়ালিদান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, আবার ৪:১১ আয়াতে পিতা-মাতাকে বুঝানোর জন্য ‘আবাওয়ান’ (আবাওয়ায়) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সন্তানের প্রসঙ্গে ৪:১১ আয়াতে ‘আওলাদ’ এবং ‘ওয়ালাদ’ শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে, আবার ‘আবনাউ’ শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ওয়ালিদান’ শব্দটি হচ্ছে ‘ওয়ালিদ’ শব্দের দ্বিবচন। ‘আবাওয়ান’ শব্দ হচ্ছে ‘আবুন’ শব্দের দ্বিবচন। ‘আওলাদ’ শব্দটি হচ্ছে ‘ওয়ালাদ’ শব্দের বহুবচন। আর ‘আবনাউ’ হচ্ছে ‘ইবনুন’ শব্দের বহুবচন। ‘ওয়ালিদ’ শব্দের অর্থও পিতা, ‘আবুন’ শব্দের অর্থও পিতা। ‘ওয়ালাদ’ শব্দের অর্থ পুত্র/সন্তান। ‘ইবনুন’ শব্দের অর্থ পুত্র।
‘ওয়ালিদ’ শব্দটি বংশসূত্রের পূর্বপুরুষ এবং ‘ওয়ালাদ’ শব্দটি বংশসূত্রের উত্তর পুরুষকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। সম্বোধনের ক্ষেত্রে পিতাকে ‘ওয়ালিদ’ না বলে ‘আবুন’ বলা হয়। ‘আবুন’ শব্দে আবেগিক নৈকট্য প্রকাশ পায়। তাই যেখানে ‘আবুন’ (বা তার দ্বিবচন ‘আবাওয়ায়’ ও বহুবচন ‘আবাউ’) ব্যবহৃত হয়েছে সেই বক্তব্যের মাধ্যমে আবেগিক নৈকট্যের দিককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে যেখানে ‘ওয়ালিদ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সেই বক্তব্যের মধ্যে বংশসম্পর্কের দিককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
পুত্রের ক্ষেত্রেও সম্বোধনের সময় ‘ওয়ালাদ’ শব্দের পরিবর্তে ‘ইবনু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। ‘ইবনু’ শব্দে আবেগিক নৈকট্য প্রকাশ পায় তাই যেখানে ‘ইবনু’ বা তার বহুবচন ‘আবনাউ’ ব্যবহৃত হয়েছে সেই বক্তব্যের মাধ্যমে আবেগিক নৈকট্যের দিককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে যেখানে ‘ওয়ালাদ’ বা তার বহুবচন ‘আওলাদ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সেখানে বংশসম্পর্কের দিককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
সাধারণভাবে পালিত পুত্রকেও ‘ওয়ালাদ’ বলা হয় (২৮:৯)। কিন্তু আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পালিত পুত্রকে পুত্র ডাকলেও সে পুত্র হয়ে যায় না, তাই তার পিতার নামে ডাকার ক্ষেত্রে পালক পিতার নামে ডাকা যাবে না, বরং তাদের নিজ পিতার নামেই ডাকতে হবে। (৩৩:৪-৫)।
‘আবাউ’ শব্দটি দ্বারা পিতার পাশাপাশি দাদা ও দাদার পিতা প্রমুখ ঊর্ধ্বতন পিতৃপুরুষকেও বুঝানো হয়। অনুরূপভাবে ‘আবানাউ’ শব্দটি দ্বারা পুত্রের পাশাপাশি নাতি, নাতির পুত্র প্রমুখকেও বুঝায়। ‘আবনাউ’ শব্দের মতো ‘আওলাদ’ শব্দটিও অধ:স্তন বংশধারার জন্য ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ পুত্রের অধ:স্তন স্তরের ক্ষেত্রে ‘ওয়ালাদ’ বলতে নাতিকে বুঝাবে।
দাদার ক্ষেত্রে ‘আবু’ শব্দের প্রয়োগের একটি উদাহরণ হচ্ছে ১২:৬ আয়াতে ‘আবু’ শব্দের দ্বিবচন ‘আবাওয়ায়’ (দুজন পিতৃপুরুষ) ব্যবহার করে দাদাকে ও দাদার পিতাকে বুঝানো হয়েছে। ‘আবাওয়ায়’ শব্দটি এখানে দুজন ‘আবু’ তথা দুজন পিতৃপুরুষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আয়াতটিতে নবী ইউসুফের পিতা (নবী ইয়াকুব) নবী ইউসুফকে প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন যে, তোমার দুই পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের উপর তোমার প্রভু যেভাবে নেয়ামত পূর্ণ করেছিলেন, সেভাবে তোমার উপর ও ইয়াকুবের অন্যান্য পরিজনের প্রতি নেয়ামত পূর্ণ করবেন। ১২:৬৮ আয়াত থেকে জানা যায় যে, নবী ইউসুফের পিতা ছিলেন নবী ইয়াকুব। সুতরাং আয়াতটিতে ব্যবহৃত ‘আলাইকা ও আলা আলি ইয়া’কূবা’ অর্থ হচ্ছে ‘তোমার প্রতি ও ইয়াকুবের অন্যান্য পরিজনের প্রতি’। ‘আলে’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘পরিবার, পরিজন, কর্মচারী, সমমনা ব্যক্তিবর্গ প্রমুখ’। সুতরাং আয়াতটিতে নবী ইউসুফের দাদা ইসহাক এবং দাদার পিতা ইবরাহীমকে তাঁর দুজন ‘আবু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এমনকি ভাবাবেগমূলক অর্থে চাচাকেও ‘আবু’ শব্দের আওতাভুক্ত করা হয়। যেমন, ২:১৩৩ আয়াতে নবী ইয়াকুবের পিতা ইসহাক, চাচা ইসমাইল এবং দাদা ইবরাহীমকে একসাথে বুঝানোর জন্য ‘আবু’ শব্দের বহুবচন ‘আবায়ি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। দাদা পিতৃতুল্য হওয়ার যুক্তি অনুসারে চাচা ভ্রাতৃতুল্য হয়। কিন্তু চাচা পিতার ভাই এবং চাচার পুত্র চাচাতো ভাই বিধায় চাচা পিতৃতুল্য হিসেবেই সাব্যস্ত হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে চাচা ভ্রাতৃতুল্য হওয়ার যুক্তিটিকে অগ্রাহ্য করে মানবীয় মনস্তত্ত্বভিত্তিক যে যুক্তিটি প্রতিষ্ঠিত হবে তা হলো: পিতৃতুল্য হওয়ার দুটি মাত্রা রয়েছে, পিতার পিতৃপুরুষ হওয়া এবং পিতার ভ্রাতৃপুরুষ হওয়া। এ দুটি মাত্রার মধ্যে আবার পিতার পিতৃপুরুষ হওয়া পিতৃপুরুষ হিসেবে আইনগত ধারায় অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু পিতার ভ্রাতৃপুরুষ হওয়া পিতৃপুরুষ হিসেবে আইনগত ধারায় অন্তর্ভুক্ত হয় না। অর্থাৎ আইনগত কোনো ধারাতে ‘আবু’ শব্দের আওতায় দাদাকে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও চাচাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এর প্রমাণ হলো বিবাহ ও পর্দা সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে বুঝা যায় যে, দাদার প্রসঙ্গে পিতা থেকে আলাদা শব্দে আইনের ধারা উল্লেখ করা হয় না, কিন্তু চাচার প্রসঙ্গে পিতা থেকে আলাদা শব্দে আইনের ধারা উল্লেখ করা হয়।
সুতরাং উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিতে চাচা, মামা, ফুফু, খালা প্রমুখ পিতৃতুল্য-মাতৃতুল্য হিসেবেও সাব্যস্ত হবে না, ভ্রাতৃতুল্য-ভগ্নীতুল্য হিসেবেও সাব্যস্ত হবে না। শুধুমাত্র যখন নির্দিষ্ট কোনো ওয়ারিস জীবিত থাকবে না তখন চাচা, মামা, ফুফু, খালাকে উত্তরাধিকার দেয়া যেতে পারে এবং সেক্ষেত্রে তাঁরা পিতৃতুল্য-মাতৃতুল্য হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারেন এবং চাচাতো ভাই-বোন, মামাতো ভাই-বোন, ফুফাতো ভাই-বোন ও খালাতো ভাই-বোনকে ভাই-বোনতুল্য সাব্যস্ত করা যেতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে এভাবে বণ্টনকে বলা যেতে পারে, কুরআনে নির্ধারিত কোনো ওয়ারিস উপস্থিত না থাকা অবস্থায় উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধির ছায়া অবলম্বনে উত্তরাধিকার বণ্টনের নির্বাহী বিধির একটি সুপারিশমাত্র। এক্ষেত্রে সম্পদ কিভাবে বণ্টিত হবে সে বিষয়ে উলিল আমর (ঈবহঃৎধষ অঁঃযড়ৎরঃু) যথোপযুক্ত পরামর্শকদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
ভাই-বোনকে বুঝাতে আরবিতে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয় তা নিম্নরূপ:
‘আখু’ শব্দের অর্থ ভাই। ‘আখু’ শব্দের দ্বিবচন হচ্ছে ‘আখাওয়ান’ এবং বহুবচন হচ্ছে ‘ইখওয়ান’ এবং ‘ইখওয়াত’। ‘উখতু’ শব্দের অর্থ বোন। ‘উখতু’ শব্দের দ্বিবচন হচ্ছে ‘উখতান’ এবং বহুবচন হচ্ছে ‘আখাওয়াত’।
৪৯:১০ আয়াতে বলা হয়েছে, ইন্নামাল মু’মিনূনা ইখওয়াতুন, ফাআসলিূ বায়না আখাওয়ায়কুম। অর্থাৎ নিশ্চয় মু’মিনগণ ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই (বিবদমান) ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। এ আয়াতে ঈমানের ভিত্তিতে যে ভ্রাতৃত্ব তথা আদর্শিক ভ্রাতৃত্বের জন্য ‘আখাওয়ায়’ ও ‘ইখওয়াত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু যেখানে এরূপ প্রসঙ্গ থাকে না সেরূপ আইনগত ধারাতে ‘আখাওয়ায় ও ইখওয়াত’ বলতে পূর্ণ আপন/বৈমাত্রেয়/বৈপিত্রেয় ভাইদেরকে বুঝাবে। যেমন, ৪:২২ আয়াতে ‘উখতায়’ বলতে পূর্ণ আপন/বৈমাত্রেয়/বৈপিত্রেয় দুই বোনকে বুঝানো হয়েছে। আয়াতটির সংশ্লিষ্ট অংশ হলো: ওয়া আন তাজমাউ বায়নাল উখতায়নি (৪:২৩)। অর্থাৎ তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে .................. দুই বোনকে একত্র করা (দুই বোনকে একত্রে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করা)। এটি আইনগত ধারা যাতে দুই বোনকে একসাথে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করাকে হারাম করা হয়েছে। অথচ ভাবমূলক বা আদর্শিক কারণে যারা পরস্পরের বোন (যারা পূর্ণ আপন/বৈপিত্রেয়/বৈমাত্রেয় বোন নয়) তারা এ আয়াতের আওতাভুক্ত নয়। কারণ যদি তারা এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে তো বহুবিবাহ মাত্রেই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অথচ কুরআনে বহুবিবাহকে হারাম করা হয়নি। এমন কি এ আয়াতের আওতায় চাচাতো, ফুফাতো, মামাতো ও খালাতো বোনকে একসাথে বিবাহ করাও নিষিদ্ধ নয়। এখানে ভাষারীতির দিক থেকে দুই বোনকে একত্র করার অর্থ হচ্ছে দুই বা ততোধিক বোনকে একত্র করা। কারণ দুইয়ের বেশি বোনকে একত্র করলে তাতেও দুই বোনকে একত্র করা হয়। তাই দুই বা দুইয়ের বেশি বোনকে একত্র করা না বলে বলা হয়েছে দুই বোনকে একত্র করা। এভাবে সংক্ষেপে পূর্ণ কথা উপস্থাপিত হয়ে যায়। এভাবে কুরআনে শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে বক্তব্যের স্পষ্টতা, সরলতা ও পরিপূর্ণতার পাশাপাশি ভাষারীতির সকল সূত্রকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো হয়েছে এবং যেখানে যেভাবে শব্দের গাঁথুনি ও বাক্যের বিন্যাস প্রয়োজন, সেখানে সেভাবেই করা হয়েছে।
সূরা ইউসুফ ১২:৫৯ আয়াতে সুনির্দিষ্টভাবে বৈমাত্রেয় ভাই বুঝাতে বিআখিল লাকুম মিন আবীকুম’ (তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাই/ তোমাদের পিতৃ শরিক ভাই) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। শুধুমাত্র ‘আখু’ শব্দ দ্বারা সাধারণভাবে ভাই বুঝায়, সে পূর্ণ আপন ভাই হোক বা বৈমাত্রেয়/পিতৃ শরিক ভাই হোক বা বৈপিত্রেয়/মাতৃ শরিক ভাই হোক।
‘ওয়ালাদ’ শব্দটি পুংলিঙ্গ, একবচন হলেও এটি পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। ‘ওয়ালাদ’ এর স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে ‘ওয়ালাদা’। কিন্তু আসলে ‘কন্যা সন্তান’ বুঝানোর জন্যও ‘ওয়ালাদ’ শব্দই ব্যবহার করা হয়। যেমন বাংলায় ‘সন্তান’ বললে ছেলে ও মেয়ে যে কোনো সন্তানকে বুঝায়। সুতরাং ‘ওয়ালাদ’ শব্দের অর্থ পুত্র বা কন্যা। এ বিষয়ে উদাহরণস্বরূপ ২:২৩৩ আয়াত লক্ষণীয়।
‘ওয়ালাদ’ শব্দের মত আরেকটি শব্দ ‘জওজ’, যা পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। ‘জওজ’ শব্দটি পুংলিঙ্গ, একবচন এবং এর অর্থ হলো ‘স্বামী’। ‘জওজ’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হলো ‘জওজা’। অথচ স্ত্রীকে বুঝানোর জন্যও ‘জওজ’ ব্যবহার করা হয়। ‘জওজ’ শব্দের ব্যবহার ইংরেজি ঝঢ়ড়ঁংব এর মতো, যা স্বামীর বিপরীতে স্ত্রী এবং স্ত্রীর বিপরীতে স্বামীকে বুঝায়।
‘ওয়ালাদ’ দ্বারা বুঝায় এক বা একাধিক পুত্র বা কন্যা বা পুত্র-কন্যা। ‘ওয়ালাদ’ এর বহুবচন হলো ‘আওলাদ’। ‘আওলাদ’ এর অর্থ ‘পুত্রগণ’। অথচ এটি দ্বারা ‘পুত্র-কন্যা’ এমনকি ‘কন্যাগণ’ও বুঝায়। ৪:১১ আয়াত অনুাযায়ী, ‘আওলাদ’ হিসেবে কখনো কখনো শুধু কন্যাগণ থাকতে পারে।
অনুরূপভাবে ‘জওজ’ এর বহুবচন ‘আজওয়াজ’। নারীর জন্য একই সাথে বহুবিবাহ বৈধ না হওয়ায় কোনো নারীর জন্য বহুবচনে ‘আজওয়াজ’ (স্বামীগণ) শব্দের প্রয়োগ ঘটে না। কিন্তু পুরুষের জন্য শর্তসাপেক্ষে বহুবিবাহ বৈধ বিধায় কোনো পুরুষের জন্য বহুবচনে ‘আজওয়াজ’ (স্ত্রীগণ) শব্দের প্রয়োগ ঘটতে পারে। ৪:১২ আয়াতে স্ত্রীগণকে বুঝাতে বুঝাতে বহুবচনে ‘আজওয়াজ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
৪:১১ আয়াত অনুযায়ী, ‘আওলাদ’ শব্দের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে কখনো শুধুমাত্র একটি কন্যা থাকতে পারে, যার সাথে কোনো পুত্র নেই। অনুরূপভাবে ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত ‘আজওয়াজ’ শব্দের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে কখনো একটিমাত্র স্ত্রী এবং কখনো একাধিক স্ত্রী থাকতে পারে।
অন্যদিকে ‘ওয়ালাদ’ ও ‘আখু’ শব্দের মধ্যে ব্যাকরণগত ব্যবহারিক ধরনের ক্ষেত্রে ‘ওয়ালাদ’ ও ‘জওজ’ শব্দের মধ্যকার মিল পাওয়া যায় না। ‘আখু’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ভাই। ‘আখু’ শব্দটি শুধুমাত্র পুরুষের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং তা দ্বারা একবচনই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। তবে ‘আখু’ শব্দের বহুবচন ‘ইখওয়াত’ দ্বারা ‘ভাইগণ’ বুঝানোর পাশাপাশি ‘ভাই-বোন’ও বুঝায়, এবং বাস্তবে কখনো একটিমাত্র ভাই বা একটিমাত্র বোনও ‘ইখওয়াত’ শব্দের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।
‘ইখওয়াত’ শব্দটি বহুবচন। বহুবচন হওয়ার একটি প্রমাণ হলো, ৪:১৭৬ আয়াতে বলা হয়েছে- ‘ওয়া ইন কানূ ইখওয়াতার রিজালাওঁ ওয়া নিসাআন ফালিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’। অর্থাৎ ‘যদি থাকে ভাই বোন, পুরুষেরা (ভাইয়েরা) ও নারীরা (বোনেরা) তাহলে, এক পুরুষ (ভাই) পাবে দুই নারীর (বোনের) সমান’। এখানে ‘ইখওয়াতান’ এর জন্য ব্যবহৃত ক্রিয়া বহুবচন, ‘ইখওয়াতান’ এর ব্যাখ্যামূলক বদল হিসাবে ব্যবহৃত ‘রিজালান’ এবং তার সাথে সংযুক্ত ‘নিসাআন’ উভয়টি বহুবচন। তাই ব্যাকরণগতভাবে ‘ইখওয়াতার রিজালাওঁ ওয়া নিসাআন’ কথাটির ব্যাখ্যা দাঁড়ায়, ‘ইখওয়াতান’ অর্থ ‘ভাইগণ’, ‘বোনগণ’, ‘ভাই-বোন’ এবং প্রত্যেক অবস্থায় এটি বহুবচন তথা দুইয়ের বেশি।
বচনের ব্যবহারবিধি অনুসারে, ভগ্ন বহুবচন পুরুষবাচক হলেও তা নারী পুরুষের সম্মিলিত অবস্থার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে, এবং এমনকি শুধু নারীদের বহুবচনের জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতেও এর প্রমাণ রয়েছে। যেমন, ৪:১১ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’। তারপর এই ‘আওলাদের’ দুটি অবস্থা এভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, (ক) লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি। অর্থাৎ যখন নারী-পুরুষ সম্মিলিত অবস্থায় থাকে। (খ) ফাইন কুন্না নিছাআন। অর্থাৎ যখন ‘আওলাদ’ হিসাবে ‘নিসাআন’ বা নারীরা থাকে। সুতরাং এখানে শুধু নারীদের বহুবচনও ‘আওলাদ’ হিসাবে সাব্যস্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে আরেকটি উদাহরণ হলো ৪:১২ আয়াতে ‘জওজ’ এর ভগ্ন বহুবচন ‘আজওয়াজ’ পুংলিঙ্গের শব্দ হলেও তা দ্বারা স্ত্রীদেরকে বুঝানো হয়েছে তথা তা শুধু নারীদের বহুবচনের অর্থ প্রকাশ করেছে। প্রসঙ্গত পুনরুল্লেখ্য যে, ‘আজওয়াজ’ এর একবচন ‘জওজ’ শব্দটি পুংলিঙ্গ হলেও তা দ্বারা স্বামীকে যেমন বুঝায়, তেমনি স্ত্রীকে বুঝানোর জন্যও ‘জওজ’ ব্যবহৃত হয়, যদিও এজন্য স্ত্রীলিঙ্গের শব্দ হচ্ছে ‘জওজাহ’।
আরেকটি বিশেষ বিষয় হচ্ছে সুনির্দিষ্টভাবে দুই বুঝানোর জন্য দ্বিবচন ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সাধারণভাবে বহুসংখ্যকের ধারণাকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য বহুবচন ব্যবহৃত হয়, যাতে কখনো কখনো অন্তত দুই সংখ্যার অন্তর্ভুক্তিরও অবকাশ থাকে। যেমন, ৪:১২ আয়াতে বলা হয়েছে, ফা-ইন কানূ আকছারা মিন যালিকা ফাহুম শুরাকাউ। এতে ব্যবহৃত কানূ, ফাহুম, শুরাকাউ শব্দ তিনটি হচ্ছে বহুবচন। অথচ পূর্বে ‘আখুন আও উখতুন’ এর কথা তথা ‘এক ভাই’ বা ‘এক বোন’ এর কথা বলা হয়েছিল। সুতরাং আকছারা মিন যালিকা বলতে বুঝানো হয়েছে ‘একের বেশি ভাই’ বা ‘একের বেশি বোন’ বা ‘ভাই বোন’ যার ন্যুনতম সংখ্যা হয় দুই।
উপর্যুক্ত ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রতীয়মান হয় যে, ৪:১২ আয়াতে ব্যবহৃত ‘আখু’ শব্দটি একবচন এবং এর দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে এক ভাইকে বুঝাবে এবং ‘উখতু’ শব্দটি একবচন এবং এর দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে এক বোনকে বুঝাবে। যদিও কখনো কখনো সাধারণত একবচন দ্বারা এক বা একাধিক এর অর্থ গ্রহণ করার অবকাশ থাকে। কিন্তু এখানে পরের অংশে ফা-ইন কানূ আকছারা মিন যালিকা বাক্যাংশের মাধ্যমে ‘আখু’ ও ‘উখতু’ কে এক ভাই ও এক বোনের জন্য সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে, ৪:১৭৬ আয়াতে ব্যবহৃত ‘উখতু’ শব্দটিও এক বোনের জন্য সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কারণ ঐ আয়াতে পরের অংশে বলা হয়েছে, ফা-ইন কানাতাছনাতাইনি বা যদি তারা (বোনেরা) হয় দুজন। তাই ফা-ইন কানাতাছনাতাইনি বাক্যাংশের পূর্বে ব্যবহৃত ‘উখতু’ শব্দটি একবচন হওয়ার পাশাপাশি এটি দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে এক বোনকেই বুঝায়, এখানে একাধিক বোন অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অবকাশ নেই।
একবচন দ্বারা একজনকে বুঝায়, যদিও একবচনের মাধ্যমে প্রদত্ত বক্তব্য একাধিক ব্যক্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে, যদি ভিন্ন কোনো নির্দেশনা না থাকে। অর্থাৎ এক বা একাধিক ব্যক্তিকে বুঝাতে সাধারণভাবে একবচন ব্যবহৃত হয়। অন্য কথায়, সাধারণ বিবৃতি প্রকাশের জন্য একবচন ব্যবহৃত হয়। কিন্তু যদি একাধিক ব্যক্তির জন্য ভিন্ন নির্দেশনা থাকে, সেক্ষেত্রে একবচন সুনির্দিষ্টভাবে একজনকে অন্তর্ভুক্ত করে, একাধিক ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয় না।
‘ওয়ালাদ’ শব্দটি ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে একবচনের গঠনগত রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি অনুধাবনযোগ্য বিষয় হলো, যেহেতু ‘ওয়ালাদ’ শব্দের দ্বারা বহুজনকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় বা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তা সত্ত্বেও ৪:১১ আয়াতে প্রথমবার ‘আওলাদ’ বা বহুবচন ব্যবহৃত হওয়ার কারণ কী? প্রশ্নটি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, যখন পুরুষ ও নারী উভয়কে অন্তর্ভুক্ত করে বহুবচনের অবকাশ সৃষ্টি করা হয়, বাস্তবে এর আওতায় কখনো কখনো মাত্র একজন থাকতে পারে তা ভিন্ন কথা, তখন বহুবচন ব্যবহৃত হয়। যেমন, ৪:১১ আয়াতে প্রথমবার ‘আওলাদ’ শব্দ ব্যবহৃত হওয়ার পরবর্তীতে কয়েকবার সাধারণভাবে এক বা একাধিক পুত্র বা কন্যা বুঝাতে ‘ওয়ালাদ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু প্রথমবার ‘আওলাদ’ শব্দ ব্যবহারের কারণ তার পরপরই বলা হয়েছে, লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি (এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের মতো)। অর্থাৎ এতে নারী-পুরুষ উভয়কে অন্তর্ভুক্ত করে বক্তব্য শুরু করা হয়েছে। বচনের ব্যবহার সম্পর্কিত এরূপ আরেকটি উদাহরণ হলো, ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোন প্রসঙ্গে ‘ইখওয়াত’ (বহুবচন) ব্যবহৃত হওয়ার পরপর ‘রিজালাওঁ ওয়া নিসাআন’ (পুরুষগণ ও নারীগণ) শব্দের মাধ্যমে ‘ইখওয়াত’ এর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে যে, তাতে পুরুষ ও নারী তথা ভাই ও বোন উভয়ে অন্তর্ভুক্ত।
৪:১১ এর ফাইন কুন্না নিসাআন ফাওক্বাছনাতাইনি .........., ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান........... দ্বারা বুঝা যায় যে, ‘আওলাদের’ (বহুবচনের) আওতায় বাস্তবে কখনো মাত্র একজনও উপস্থিত থাকতে পারে।
উপরিউক্ত ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুসারে নিম্নের দুটি সিদ্ধান্ত প্রতিপাদিত হয়-
(ক) ৪:৩৩ এর ‘মাওয়ালিয়া’ (বহুবচন) এর আওতায় কখনো মাত্র একজনও উপস্থিত থাকতে পারে।
(খ) ৪:১১ আয়াতে ব্যবহৃত ‘ইখওয়াত’ (বহুবচন) এর আওতায় কখনো মাত্র একজন ভাই বা একজন বোন উপস্থিত থাকতে পারে।
৪:১১ আয়াতে বলা হয়েছে, লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি। ‘যাকার’ শব্দটির শব্দমূল হলো ‘যাল কাফ র’। ‘উনছায়ায়নি’ শব্দটি হলো ‘উনছা’ শব্দের দ্বিবচন। ‘উনছা’ শব্দের শব্দমূল হলো ‘আলিফ নূন ছা’। ‘যাকার’ ও ‘উনছা’ শব্দ পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গকে নির্দেশ করে, তা মানুষের ক্ষেত্রে হোক বা পশুর ক্ষেত্রে হোক। এ বিষয়ে সূরা আনআম ৬:১৪৩ আয়াতে ‘যাকার’ ও ‘উনছা’ শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়।
‘যাকার’ অর্থ পুরুষ (male), যা যে কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অন্যদিকে ‘পুরুষ মানুষ’ (man) বুঝাতে ‘রজুল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। বস্তুত ‘যুল আক্বল’ বা বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন পুরুষ বুঝাতে ‘রজুল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। তাই পুরুষ জিনকে বুঝাতেও ‘রজুল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে (দ্র. ৭২:৬)।
যখন আওলাদকে দুটি লিঙ্গগত বিভাজনে বিভক্ত করা হলো তখন কন্যা প্রসঙ্গে ‘উনছা’ তথা Female শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু যখন ‘আওলাদ’ শব্দের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে শুধু কন্যাদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে তখন তাদের জন্য ‘ইনাছা’ (‘উনছা’ এর বহুবচন) শব্দ ব্যবহার না করে ‘নিসা’ (নারী,Women) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ যখন লিঙ্গগত পরিচয়ের মাধ্যমে শ্রেণি চিহ্নিত করা হয়েছে তখন ‘উনছা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আর যখন লিঙ্গগত শ্রেণি চিহ্নিত করার প্রয়োজন হয়নি, তখন ‘নিসা’ (স্ত্রীলিঙ্গের শব্দ কিন্তু যাতে লিঙ্গগত পরিচিতির প্রতি আলোকপাত করার প্রসঙ্গ নেই) ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে কুরআনে প্রতিটি শব্দকে প্রয়োগস্থানভিত্তিক সর্বোত্তম প্রয়োগরীতি অনুযায়ী প্রয়োগ করা হয়েছে।
‘মারউ/ইমরুউ’ শব্দের শব্দমূল হলো ‘মীম র আলিফ’ এবং অর্থ হলো ‘পুরুষ মানুষ’। এ শব্দটির একটি প্রতিশব্দ হলো ‘রজুল’। ‘রজুল’ শব্দটির শব্দমূল হলো ‘র জীম লাম’। ‘মারউ/ ইমরুউ’ এবং ‘রজুল’ শব্দের বহুবচন হলো ‘রিজাল’।
‘রজুল’ এবং ‘মারউ/ইমরুউ’ শব্দদ্বয়ের মধ্যে ‘রজুল; শব্দটি সাধারণ এবং এতে কিছুটা শক্তিসামর্থ্যে কঠোরতার দিক রয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে ‘মারউ/ইমরুউ’ শব্দের অর্থের মধ্যে সহমর্মিতার দিকটিকে প্রধান করে দেখা হয়। তাই প্রসঙ্গ অনুসারে যদি ‘রিজাল’ শব্দটি কোথায় ‘রজুল’ এর বহুবচন হিসেবে এবং কোথায় ‘মারউ/ইমরুউ’ এর বহুবচন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে তা নির্ণয় করা যায় তবে শব্দটির অর্থগত ধরনে সেরূপ প্রভাবের বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে।
‘রিজাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হলো ‘নিসা’। ‘নিসা’ শব্দটির শব্দমূল হলো ‘নূন ছীন ওয়াও’। ‘নিসা’ শব্দটি ‘ইমরাআত’ শব্দের বহুবচন। অন্যভাবে বলা যায়, মারউন/ইমরুউ এবং রজুল উভয় শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হলো ইমরাআত। ইমরাআত শব্দটি একবচন (৪:১২, ২৭:২৩) এবং এর দ্বিবচন হলো ‘ইমরাআতান’ (২:২৮২, ২৮:২৩)।
‘মারউ/ইমরুউ’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ ‘ইমরাআত’ এবং এক্ষেত্রে পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গের মূল অক্ষরসমূহ (Root Letters) একই। কিন্তু ‘রজুল’ শব্দটির একই মূল অক্ষরসমূহ থেকে গঠিত স্ত্রীলিঙ্গ ‘রজুলাহ’ হলেও ‘রজুল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবেও ‘ইমরাআত’ শব্দ ব্যবহৃত হয়।
‘মারউ/ইমরুউ’ এবং এর বহুবচন ‘রিজাল’ ভিন্ন ভিন্ন শব্দমূল থেকে গঠিত। অনুরূপভাবে ‘ইমরাআত’ এবং এর বহুবচন ‘নিসা’ ভিন্ন ভিন্ন শব্দমূল থেকে গঠিত।
‘ইমরাআত’ বা ‘নিসা’ শব্দটি যখন কারো সাথে সম্পর্কিত করে প্রকাশ করা হয় তখন তা দ্বারা স্ত্রী বুঝায় যদি পূর্বাপর বক্তব্য প্রসঙ্গ থেকে তা দ্বারা স্ত্রী বুঝানোর বিষয়টি স্পষ্ট হয়; অন্যথায় তা দ্বারা সমাজস্থ নারীগণকে সাধারণভাবে বুঝায়, দাম্পত্য সম্পর্কীয় স্ত্রী বুঝায় না। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে ‘ইমরাআত’ বা ‘নিসা’ শব্দের আওতায় বোন বা কন্যাও অন্তর্ভুক্ত হয়। সুনির্দিষ্টভাবে দাম্পত্য সম্পর্কীয় স্ত্রী বুঝাতে ‘জওজ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু যদি বক্তব্য বিষয় ব্যাপক বা সাধারণ পর্যায়ের হয় সেক্ষেত্রে ‘জওজ’ শব্দটি দ্বারা সাধারণভাবে পুরুষের বিপরীতে নারীকে বুঝায় যারা দাম্পত্য সম্পর্কে আবদ্ধ বা দাম্পত্য সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার উপযোগী। এক কথায়, ‘জওজ/ আজওয়াজ’ শব্দটির আওতায় কোনো অবস্থায় বোন বা কন্যা অন্তর্ভুক্ত হবে না। আরবী ভাষারীতির এ তথ্য সামনে থাকলে কোথায় ‘ইমরাআত’, ‘নিসা’, ‘জওজ/ আজওয়াজ’ ইত্যাদি শব্দ কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং কোন স্থানে এ শব্দগুলোর মধ্য থেকে কোনটি কেন ব্যবহার করা হয়েছে তা বুঝা সহজ হয়।
মিরাসের বন্টন বিধির আয়াত ৪:১৭৬ আয়াতে ‘ইনিমরুউন মাতা’ (যদি কোনো পুরুষ মৃত্যুবরণ করে) শব্দের পরিবর্তে ‘ইনিমরুউন হালাকা’ (যদি কোনো পুরুষ হালাক হয়) ব্যবহার করার কারণে অর্থের কোনো তারতম্য ঘটে কিনা সে বিষয়ে কারো দ্বিধাদ্বন্দ্বতৈরি হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, মওত এবং হালাক সমার্থক শব্দ। তবে হালাক শব্দটি মওত শব্দের চেয়ে বেশিমাত্রায় মৃত্যু ধারণাটির গভীরতার অনুভূতি সৃষ্টি করে।
‘অংশ’ বুঝাতে ৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতে ‘হাযযু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং ৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াতে ‘নাসীব’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। তাই অনেকের মধ্যে এ দুটি শব্দের পার্থক্য সম্পর্কে কৌতুহল থাকতে পারে। সাধারণভাবে অংশ, (ব্যক্তিগত বা) সমষ্টিগত অংশ ইত্যাদি বুঝাতে ‘হাযযু’ শব্দ ব্যবহৃত হয় এবং ‘প্রাপ্য অংশ’ বুঝাতে ‘নাসীব’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। উভয় শব্দই অনুগ্রহস্বরূপ প্রদত্ত কোনো অংশকে (Grace) বুঝাতেও ব্যবহৃত হয়।
৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতে দুই নারীর সমষ্টিগত অংশ বুঝাতে ‘হাযযু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যা অংশ হিসাবে সাধারণ প্রকৃতির গুরুত্ববহ। আর ৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াতে ‘প্রাপ্য অংশ’ অর্থে ‘নাসীব’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এই প্রাপ্যতা তৈরি হয়েছে তাদের জন্য কোনো অংশ নির্ধারণ করে দেয়ার কারণে। সুতরাং যেভাবেই প্রাপ্যতা তৈরি হোক না কেন, প্রাপ্য অংশ বুঝাতে ‘নাসীব’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কর্মের গুণে হোক বা গ্রেস (Grace) হিসাবে নির্ধারণ করে দেয়ার কারণে হোক, প্রকৃত প্রাপ্য অংশ হোক বা কল্পিত/ মনগড়া প্রাপ্য অংশ হোক, প্রাপ্য অংশ বুঝাতে নাসীব শব্দ ব্যবহৃত হয়।
‘ওয়া ইন’ ও ‘ফা ইন’ শব্দ দুটি নিয়েও কেউ কেউ জটিলতা অনুভব করতে পারেন। ‘ওয়া ইন’ অর্থ ‘এবং যদি’, ‘ফা ইন’ অর্থ ‘তারপর যদি’। এটি ধারাবাহিক বিবৃতির একটি বাক-রীতি। নিয়ম অনুসারে যেখানে যে শব্দটি ব্যবহারযোগ্য সেখানে সে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু এ শব্দদ্বয়ের পার্থক্যের কারণে শব্দদ্বয়ের প্রত্যেকটির পরে উল্লেখিত ভগ্নাংশসমূহের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য সূচিত হয় না।
‘ওয়া ইন’ ব্যবহৃত হয়েছে আলোচ্য প্রসঙ্গের বড় বড় বিভাজনকে সংযোজনের ক্ষেত্রে বা ‘ফা-ইন’ ব্যবহারের পর সেটার সাথে নিকটবর্তী প্রসঙ্গের সংযোজনের ক্ষেত্রে। আর ‘ফা-ইন’ ব্যবহৃত হয়েছে সাধারণভাবে কোনো প্রসঙ্গ উল্লেখ করার পর (তা ‘ওয়া ইন’ দ্বারা সংযোজিত প্রসঙ্গ হোক বা সাধারণভাবে বর্ণিত প্রসঙ্গ হোক), সেটার সাথে কোনো শর্তযুক্ত প্রসঙ্গ প্রথমবারের মতো সংযোজনের ক্ষেত্রে বা একই প্রসঙ্গের মধ্যে কোনো নতুন শর্ত সংযোজনের ক্ষেত্রে।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত প্রতিটি অংশ সুনির্দিষ্ট ও সমমর্যাদার, সেটাকে ‘ওয়া ইন’ এর দ্বারা শর্তযুক্তভাবে বিবৃত করা হোক বা ‘ফা-ইন’ এর দ্বারা শর্তযুক্তভাবে বিবৃত করা হোক, সকল অবস্থায় তা আরবী ভাষারীতির সংশ্লিষ্ট যাবতীয় শর্ত পূরণ করে ব্যবহৃত হয়েছে এবং একই ধরনের অর্থকে ধারণ করেছে।
উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি প্রসঙ্গে উল্লেখিত ভগ্নাংগুলোর একবচন, দ্বিবচন ও বহুবচন নিয়েও জটিলতা অনুভব হতে পারে। আবার ‘মা তারাকা’ ও ‘মিম্মা তারাকা’ শব্দদ্বয়ের প্রয়োগ সম্পকের্ও জটিলতা অনুভব হতে পারে। তাই এ প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন।
কুরআনে উল্লেখিত ভগ্নাংগুলোর একটি সারসংক্ষেপ তালিকা দেয়া হলো:
ক) দুইয়ের বেশি কন্যার জন্য = ছুলুছা (দ্বিবচন) মা তারাকা
খ) এক কন্যার জন্য = আন নিসফু।
গ) পিতা মাতা উভয়ের প্রত্যেকের জন্য (ওয়ালাদ থাকলে) = আছ ছুদুছু মিম্মা তারাকা
ঘ) মাতার জন্য (ওয়ালাদ না থাকলে) (পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে) = আছ ছুলুছু (একবচন)।
ঙ) মাতার জন্য (ইখওয়াত থাকলে) = আছ ছুদুছু
চ) স্বামীর জন্য (ওয়ালাদ না থাকলে) = নিসফু মা তারাকা আজওয়াজুকুম
ছ) স্বামীর জন্য (ওয়ালাদ থাকলে) = আর রুবুউ মিম্মা তারাকনা
জ) স্ত্রীর জন্য (ওয়ালাদ না থাকলে) = আর রুবুউ মিম্মা তারাকতুম
ঝ) স্ত্রীর জন্য (ওয়ালাদ থাকলে) = আছ ছুমুনু মিম্মা তারাকতুম
৪:১২ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ এর সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে
ঞ) এক ভাই বা এক বোন = আছ ছুদুছু
ট) একাধিক ভাই বা বোন (শরিক হবে) = ফিছ্ ছুলুছি (একবচন)
৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ ভাইবোনের ক্ষেত্রে
ঠ) ওয়ালাদ না থাকা পুরুষের একটিমাত্র বোন = নিসফু মা তারাকা
ড) ওয়ালাদ না থাকা নারীর ভাইটি = ইয়ারিছুহা
ঢ) ওয়ালাদ না থাকা পুরুষের দুটি বোন = আছ ছুলুছানি (দ্বিবচন) মিম্মা তারাকা
যদি আমরা উপর্যুক্ত তালিকা থেকে নিম্নের শব্দগুলো বিশেষভাবে লক্ষ্য করি তাহলে আমাদের কাছে ‘মা তারাকা’ এবং ‘মিম্মা তারাকা’ শব্দের ব্যবহারের নিয়মটি স্পষ্ট হবে।
১. আন নিসফু ২. নিসফু মা তারাকা ৩. ছুলুছা মা তারাকা ৪. আছ ছুলুছানি মিম্মা তারাকা
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, যেখানে উল্লেখিত কোনো ভগ্নাংশের পূর্বে ‘আলিফ লাম’ বা ‘আল’ যুক্ত করা হয়েছে সেখানে পরে হয়তো ‘মা তারাকা’ বা ‘মিম্মা তারাকা’ কোনোটিই ব্যবহৃত হয়নি, নয়তো ‘মিম্মা তারাকা’ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু যেখানে উল্লেখিত কোনো অংশের পূর্বে ‘আলিফ লাম’ বা ‘আল’ যুক্ত করা হয়নি সেখানে পরে ‘মা তারাকা’ ব্যবহৃত হয়েছে।
সুতরাং ‘মা তারাকা’ ও ‘মিম্মা তারাকা’ শব্দদ্বয় আরবী ভাষার বিশেষ রীতি অনুসারে ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু কোথায় এ দুটি শব্দগুচ্ছের কোনটি ব্যবহৃত হয়েছে বা কোনোটি ব্যবহৃত হয়নি তার ভিত্তিতে উল্লেখিত আনুপাতিক ভগ্নাংশগুলোর বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য হবে না।
কোনো ভগ্নাংশকে ‘আল’ দ্বারা যুক্ত করলে তা নির্দিষ্ট হয়। নির্দিষ্ট হওয়ার পরে তা অন্য শব্দের সাথে সংযুক্ত হয় না। যেমন ‘আন নিসফু’। আর যদি কোনো ভগ্নাংশ অন্য শব্দের সাথে সম্পর্কিত হয় তাহলে ঐ ভগ্নাংশটির প্রথমে ‘আল’ যুক্ত করা ছাড়াই তা নির্দিষ্ট হয়। যেমন ‘নিসফু মা তারাকা’ অর্থ ‘যা সে তরক করে তার অর্ধেক (নিসফু)।’ এখানে ‘নিসফু’ ভগ্নাংশটি পরের ‘মা’ শব্দটির সাথে সম্পর্কিত হয়ে নির্দিষ্ট হয়েছে। সুতরাং ‘আন নিসফু’ এবং ‘নিসফু মা তারাকা’ শব্দদ্বয়ের অর্থ একই।
উল্লেখিত ভগ্নাংশের শুরুতে ‘আল’ যোগ করা বা না করার ক্ষেত্রে রীতি হলো, যখন কোনো প্রসঙ্গে প্রথমবার ভগ্নাংশ উল্লেখ করা হয় তখন ‘মা তারাকা’ যোগ করা এবং যখন ঐ প্রসঙ্গের ধারাবাহিকতার সাথে সম্পর্কিত আরেকটি ভগ্নাংশ উল্লেখ করা হয় তখন ‘মা তারাকা’ বাদ দিয়ে ভগ্নাংশটির শুরুতে ‘আল’ যুক্ত করা।
যেখানে কোনো বিষয়ে স্পষ্টতার খাতিরে ভগ্নাংশটি সমগ্র বণ্টনীয় সম্পদের উপর কার্যকর হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করার প্রয়োজন হয়, তখন ‘মা তারাকা’ বা সমজাতীয় শব্দ সংযোজন করা হয়। তারপর যখন এ ধরনের শব্দ সংযোজন ব্যতীত ঐ প্রসঙ্গ স্বত:সিদ্ধভাবে স্পষ্ট থাকে, তখন তা সংযোজন করা হয় না।
যখন ‘মা তারাকা’ যোগ করলে অংশটির পূর্বে ‘আল’ যুক্ত করা যায় না অথচ ‘আল’ যুক্ত না করলে উচ্চারণের দিক থেকে ছন্দ পতন হয়, তখন অংশটির পূর্বে ‘আল’ যুক্ত করে পরে ‘মা তারাকা’ এর পরিবর্তে ‘মিম্মা তারাকা’ বলা হয়। যেমন, ‘আছ ছুদুছু মিম্মা তারাকা’ অর্থ ‘যা সে তরক করে তা থেকে ১/৬ (ছুদুছু)’। এখানে ‘মিম্মা’ শব্দের কারণে বক্তব্যের অর্থ একই থাকে কিন্তু ‘ছুদুছু’ শব্দটি ‘মা’ শব্দের সাথে সম্পর্কিত না হয়ে আলাদা থাকে, সে কারণে ‘ছুদুছু’ এর পূর্বে ‘আল’ যুক্ত করে তাকে নির্দিষ্ট করতে হয়। কিন্তু ‘আছ ছুদুছু মা তারাকা’ ব্যবহৃত হলে তা শুদ্ধ হতো না। কারণ এক্ষেত্রে ‘ছুদুছু’ শব্দটি ‘আল’ দ্বারা নির্দিষ্ট হয়, তারপর আবার ‘মা তারাকা’ দ্বারাও নির্দিষ্ট হতো, যা ব্যাকরণগত দৃষ্টিকোণ থেকে অশুদ্ধ হতো। অথবা ‘আছ ছুদুছু মা তারাকা’ ব্যবহৃত হলে সেক্ষেত্রে বাক্যাংশটির অর্থ হতো ‘এক ষষ্ঠাংশ, যা তরক করা হয়েছে’। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে ‘মা তারাকা’ শব্দটি হতো ‘আছ ছুদুছু’ এর বিশেষণ। অন্য কথায়, সেক্ষেত্রে কথাটির তাৎপর্য হতো, মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের পরিমাণই হলো এক ষষ্ঠাংশ, বাকি পাঁচ ষষ্ঠাংশ সে তরক করেনি। এ ধরনের তথ্যটি অর্থবহ হতো না। এজন্য ‘আছ ছুদুছু মা তরাকা’ বাক্যাংশ ব্যবহার করলে তা শুদ্ধ হতো না। তাই সকল শর্ত রক্ষা করে এ ধরনের ক্ষেত্রে ‘আছ ছুদুছু মিম্মা তারাকা’ ব্যবহৃত হয়েছে।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত প্রতিটি আনুপাতিক ভগ্নাংশ সুনির্দিষ্ট ও সমমর্যাদার। কোনো আনুপাতিক ভগ্নাংশের পূর্বে ‘আল’ যুক্ত করা হোক বা না হোক, এবং সেটার পরে ‘মা তারাকা’ বা ‘মিম্মা তারাকা’ শব্দগুচ্ছ দুটির মধ্য থেকে যেটিই যুক্ত করা হোক বা কোনোটিই যুক্ত করা না হোক, সকল অবস্থায় তা আরবী ভাষারীতির সংশ্লিষ্ট যাবতীয় শর্ত পূরণ করে ব্যবহৃত হয়েছে এবং একই ধরনের অর্থকে ধারণ করেছে।
ফা-ইন কুন্না নিছাআন ফাওক্বাছনাতাইনি ফালাহুন্না ছুলুছাা মা তারাকা (৪:১১)
ফা-ইন কানাতাছনাতাইনি ফালাহুমাছ ছুলুছানি মিম্মা তারাকা (৪:১৭৬)
‘ছুলুছাা মা তারাকা’ বাক্যাংশে ‘ছুলুছানি’ না হয়ে ‘ছুলুছাা’ হওয়ার কারণ হচ্ছে তা ‘মা তারাকা’ এর সাথে সম্পর্কিত হয়ে নির্দিষ্ট হয়েছে এবং এরূপ অবস্থায় ‘নি’ বাদ পড়ে। কিন্তু ‘আছ ছুলুছানি মিম্মা তারাকা’ বাক্যাংশে ‘আছ ছুলুছানি’ শব্দ ‘আল’ শব্দাংশের মাধ্যমে নির্দিষ্ট হয়েছে এবং এখানে ‘মিন’ অব্যয়ের মাধ্যমে তা ‘মা তারাকা’ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে বা তা কোনো শব্দের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে নির্দিষ্ট হয়নি। তাই এখানে ‘ছুলুছানি’ শব্দের ‘নি’ বাদ পড়েনি। সুতরাং ‘ছুলুছাা মা তারাকা’ অর্থ ‘যা তরক করে সেটার দুই তৃতীয়াংশ’ যা নির্দিষ্ট এবং ‘আছ ছুলুছানি মিম্মা তারাকা’ অথ ‘যা তরক করে তা থেকে দুই তৃতীয়াংশ’ যা নির্দিষ্ট। উভয়টি নির্দিষ্ট, কিন্তু দুটি দুই নিয়মে নির্দিষ্ট হয়েছে এবং ভিন্ন ভিন্ন নিয়মের কারণে একটি ‘ছুলুছাা’ এবং অন্যটিতে ‘ছুলুছানি’ হয়েছে। কিন্তু ‘ছুলুছাা’ এবং ‘ছুলুছানি’ উভয়ের অর্থ একই আর তা হলো ‘দুই তৃতীয়াংশ’।
দুইয়ের অধিক কন্যার অংশ ‘ছুলুছাা’ তথা ‘দুই তৃতীয়াংশ’। যদি এখানে শেষে খালি আলিফ থাকা সত্ত্বেও তার পূর্ব দুই যবর থাকতো তথা ‘ছুলুছান’ হতো তাহলে এটি একবচন হিসেবে সাব্যস্ত হতো এবং এর অর্থ হতো ‘এক তৃতীয়াংশ’। কিন্তু শেষে ‘আলিফ’ এবং তার পূর্বের ‘ছা’ এর উপর এক যবর থাকার কারণে এর অর্থ হচ্ছে ‘দুই তৃতীয়াংশ’। ছুলুছাা এর মত শেষে শুধু আলিফ দ্বারা সমাপ্ত হওয়া দ্বিবচনের উদাহরণ রাসূলাা (২০:৪৭) যার অর্থ দুজন রাসূল। যেখানে ‘রসূলানি’ শব্দের পরিবর্তে ‘রসূলাা’ হয়েছে তা পরবর্তী শব্দের (রব্বিকা) সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে। ‘রসূলাা রব্বিকা’ অর্থ ‘তোমার রবের দুজন রসূল’। ‘ছুলুছু’ এর দ্বিবচন তিনভাবে হতে পারে: ছুলুছাা, ছুলুছান, ছুলুছায়। আর কখনো কখনো এটি হতে পারে ছুলুছায়নি।
৪:১১ আয়াতে ব্যবহৃত ‘ছুলুছাা’ শব্দটি যে ‘ছুলুছ’ (১/৩) এর দ্বিবচন (১/৩ + ১/৩) এবং ‘ছুলুছাা’ এর অর্থ যে ২/৩ এ বিষয়টি সাধারণ যৌক্তিকতা বিবেচনার মাধ্যমেও সহজ বোধগম্য। একটিমাত্র কন্যার জন ১/২ নির্ধারণ করা অথচ শুধু দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার জন্য ১/৩ নির্ধারণ করা কোনো যুক্তিসিদ্ধ বণ্টন হয় না। সুতরাং দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার জন্য উল্লেখিত ‘ছুলুছাা’ অর্থ ১/৩ নয়, বরং এটি হলো দ্বিবচন তথা এর অর্থ হলো ২/৩ ।
এ বিষয়টি এত বিশদভাবে আলোচনা করার কারণ হলো কেউ কেউ এখানে একবচন ও দ্বিবচন এর পার্থক্য নির্ণয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব অনুভব করতে পারেন। বিশেষ করে ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতে ‘ছুলুছাা’ ও ‘ছুলুছানি’ দুটি ভিন্ন প্যাটার্নে থাকার কারণে এ দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে। উভয়টি দ্বিবচন এবং এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। অর্থাৎ উভয়টির অর্থ একই আর তা হলো ‘দুই তৃতীয়াংশ’ (২/৩ )।
উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো, ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ অর্থাৎ একজন পুরুষ পাবে দুজন নারীর অংশের মতো।
মিছলু এর দুটি অর্থ হলো: (ক) সমান বা প্রায় সমান (খ) অনুরূপভাবে (যা ধরনগত মিল বুঝায়, পরিমাণগত সমতা নয়)। বক্তব্যের ধরন থেকে মিছলুন শব্দটি সমান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে নাকি অনুরূপভাবে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা নির্ধারিত হবে।
‘একজন পুরুষ পাবে দুজন নারীর অংশের মতো’ বাক্যটির ধরন অনুসারে দুজন নারীর অংশের যোগফল এবং একজন পুরুষের অংশ সমানুপাতিক তথা সমান। একজনের সাথে একজনের তুলনা না হয়ে একজনের সাথে দুজনের তুলনা হওয়ায় এখানে ‘সমান’ অর্থ বুঝাতে ‘মিছলু’ শব্দটি বাছাই করা হয়েছে। এছাড়া এখানে ‘মিছলু’ শব্দ বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রথমেই একটি সহজতা সৃষ্টি করা হয়েছে, তা হলো বন্টনের ক্ষেত্রে দশমিক পর্যায়ে যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বন্টন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় সেক্ষেত্রে প্রায় সমান হয় এরূপ বন্টনই যথেষ্ট।
পুত্র-কন্যার এবং ভাই-বোনের অংশ নির্ণয়ের সূত্র বিশ্লেষণ : (লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি)
পুত্র-কন্যার এবং ভাইবোনের অংশ নির্ণয়ের সূত্র লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ বর্ণনার উপর ভিত্তি করে কৃত নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা করলে এ বিষয়ে চমৎকার কিছু তথ্য আবিষ্কৃত হবে। প্রশ্নগুলো হলো:
- ৪:১১ আয়াতে কেন ‘ফাইন কুন্না নিছাআন ফাওক্বাছনাতাইনি’ বলা হলো?
- কেন এখানে ‘নিছাআন’ বলতে হলো?
- কেন এখানে ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’ বলতে হলো?
- তারপর কেন ‘ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান’ বলা হলো?
- কেন এখানে ‘ইমরাআতুন’ বলা হলো না?
- কেন এখানে ‘ওয়াহিদাতান’ বলতে হলো?
- যদি শুধু দুজন নারী হয় তাদের বিষয়ে কেন সরাসরি কিছু বলা হলো না?
- কেন এক বা একাধিক পুরুষ কত পাবে তা বলা হলো না?
- কেন পুরুষ ও নারী একসাথে থাকলে তারা মোট কতটুকু পাবে তা বলা হলো না?
উপর্যুক্ত প্রশ্নগুলোর প্রেক্ষিতে বর্ণনারীতির উপর গভীর মনোনিবেশ করলে কিছু বিশেষ তথ্য জানা যায়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:
৪:১১ আয়াতে প্রথমে বলা হলো ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’। এ বক্তব্যের প্রাথমিক বিস্তৃতি/ পরিসর হলো ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ পর্যন্ত। এখানে ‘আয যাকার’ = একজন পুরুষ। কারণ তাকে তুলনা করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট সংখ্যাসম্পন্ন নারীদের সাথে তথা ‘উনছায়ায়নি’ বা ‘দুজন নারীর’ সাথে। তাই এখানে ‘আয যাকার’ ≠ এক বা একাধিক পুরুষ। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যবহৃত একবচন ‘ওয়ালাদ’ অর্থ ‘এক বা একাধিক পুত্র/ এক বা একাধিক কন্যা/ পুত্র-কন্যা’। পক্ষান্তরে ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম এর অব্যবহিত পরে এবং মূল ধারা হিসেবে লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি উল্লেখ করায় প্রথমে ‘ওয়ালাদ’ শব্দের পরিবর্তে ‘আওলাদ’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে।
এরপর বলা হলো ‘ফাইন কুন্না নিছাআন ফাওক্বাছনাতাইনি ফালাহুন্না ছুলুছা মা তারাকা’। বাক্যটিতে ‘মা তারাকা’ শব্দের মাধ্যমে এ অংশটিকে ‘আওলাদিকুম’ এর ‘কুম’ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মৃত ব্যক্তিকে Third Person Singular Number হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, ফলে এটি আওলাদ সম্পর্কিত মূল ধারার থেকে একটু ভিন্নমাত্রা লাভ করেছে। অর্থাৎ এটি মূল ধারার সাথে উপধারার মতো। এটি যে আওলাদ সম্পর্কিত ধারার অন্তর্ভুক্ত, ‘ফাইন কুন্না নিছাআন’ শব্দের মাধ্যমে তা স্পষ্ট হয়। এখানে ‘কুন্না’ দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তা হলো, এখানে ‘কুন্না’ শব্দ দ্বারা পূর্বে থাকা ‘আওলাদ’কে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এখানে ‘ফাইন কুন্না’ শব্দের তাৎপর্য হলো, যদি আওলাদ হিসেবে যারা থাকে তারা হয়। তারা কী হয়? ‘খবরে কানা’ (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্যটি) হলো, ‘নিসাআন’ তথা ‘নারীগণ’। এরপর দ্বিতীয় ‘খবরে কানা’ হলো ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’। এখানে ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’ তথা ‘দুই থেকে ঊর্ধ্বসংখ্যক/ দুই থেকে তদুর্ধ্ব’ শব্দ ব্যবহারের কারণ হলো, ‘নিসাআন’ বহুবচন, তাই বহুবচনের সাথে মিল রেখে বহুবচনকে মূল গুরুত্ব দিয়ে ফাওক্বাছনাতাইনি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
‘ফাওক্বাছনাতাইনি’ শব্দটি ব্যবহার করার মাধ্যমে নারী সংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন তারা ২/৩ শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশকে পরস্পর সমান হারে ভাগ করে নেবে তথ্যটি নিশ্চিত হয়ে যায়। তাই এ শব্দটি ব্যবহার করার প্রয়োজন ছিল। আবার এর মাধ্যমে পূর্ববর্তী অংশে থাকা মূল ধারাটির ব্যাখ্যা হয়ে যায়, যাতে বলা হয়েছে, ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’, কিন্তু তারা কতটুকু অংশ পাবে তা সরাসরি বলা হয়নি।
যেহেতু দুইয়ের বেশি নারী পাবে ২/৩ , তাই নারী-পুরুষ একসাথে পাবে ২/৩ । কারণ এক পুরুষকে দুই নারীর মতো বিবেচনা করা হবে। যদি শুধু এক বা একাধিক পুরুষ থাকে তাহলে তারা কতটুকু পাবে? উত্তর হলো ২/৩ । যেহেতু তারা দুই বা দুইয়ের বেশি নারীর মতো।
সুতরাং ‘ফাইন কুন্না নিছাআন’ তথা ‘যদি আওলাদ হয় নারীগণ’ তারা যা পাবে (২/৩ ), আওলাদের জন্য তা-ই বরাদ্দ, তাদের আওতায় পুরুষ বা নারী এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে যতসংখ্যকই থাকুক না কেন, যদি না কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যার জন্য আলাদাভাবে কোনো অংশ উল্লেখ করা হয়।
পুত্র-কন্যার জন্য আনুপাতিক অংশের শেষ ধারা হিসেবে বলা হয়েছে ‘ফাইন কানাত ওয়াহিদাতান ...’। এ বাক্যে ‘কানাত’ এবং ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দের মাধ্যমে দুটি বিষয় স্পষ্ট, তা হলো ‘আওলাদের আওতায় আছে একজনমাত্র নারী এবং তার সাথে কোনো পুরুষ নেই’। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির সন্তান হিসেবে শুধু একটি কন্যা আছে এবং মৃত ব্যক্তির কোনো পুত্রও নেই।
এখানে ‘ইমরাআত’ শব্দ ব্যবহার না করার কারণ পূর্বে ‘নিসাআন’ ব্যবহার করার কারণে ‘ইমরআত’ ব্যবহার করা ছাড়াই এ উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেছে। এরূপ অন্য একটি উদাহরণ হলো ৪:১৭৬ আয়াতে পূর্বে ‘উখতু’ ব্যবহার করার কারণে পরে ‘উখতায়ায়নি’ ব্যবহার করা ছাড়াই এ উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেছে।
ফাইন কানাত ওয়াহিদাতান বাক্যে ‘ওয়াহিদাতান’ ব্যবহার করার কারণ ‘খবরে কানা’ (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্য) হিসেবে নারীটির সংখ্যাকে গুরুত্ব দেয়া। ‘ফাইন কুন্না নিসাআন ফাওক্বাছনাতাইনি’ বাক্যাংশে দুটি ‘খবরে কানা’, উভয়টির প্রয়োজন ছিল, একটি আওলাদের সাথে সম্পর্কিত কারণে, অন্যটি সংখ্যাগত বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার জন্য। যদিও ‘কানাত’ দ্বারা একবচন স্ত্রীলিঙ্গ, ‘কানাতা’ দ্বারা দ্বিবচন স্ত্রীলিঙ্গ, ‘কুন্না’ দ্বারা বহুবচন স্ত্রীলিঙ্গ বুঝায় তবু ‘খবরে কানা’ হিসেবে কোনো শব্দ ব্যবহার করা আরবি ভাষারীতির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, এ বৈশিষ্ট্যগত কারণে এবং পূর্বাপর বক্তব্যের কিছু বিশেষ দিকের উপর গুরুত্ব আরোপের প্রয়োজনে আয়াতগুলোতে ‘নিসাআন’, ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’, ‘ওয়াহিদাতান’ এবং ‘ইছনাতাইনি’ শব্দগুলোকে ‘খবরে কানা’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
যদি ‘ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান ফালাহান্নিসফু’ ধারাটি সংযোজিত না হতো তাহলে শুধু একটিমাত্র কন্যা থাকা অবস্থায় সেও ২/৩ অংশই পেতো এবং সেক্ষেত্রে পূর্বে বর্ণিত সকল ধারা ভিন্নভাবে উল্লেখ করতে হতো।
‘এক পুত্র পাবে দুই নারীর অংশের মতো’ কথাটি গাণিতিকভাবে ‘এক পুত্র পাবে এক নারীর দ্বিগুণ’ কথাটির সমতুল্য হলেও ভাষাগত প্রকাশের দিক থেকে এখানে যে ভিন্নতা আছে তার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমত এখানে নারীদের অংশকে পুরুষের অংশের সাথে তুলনা করে নির্ধারণ করা হয়নি বরং পুরুষের অংশকে নারীদের অংশের সাথে তুলনা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। ৪:১৭৬ আয়াতেও নারীর অংশকে ভিত্তি বানানো হয়েছে। ‘এক পুরুষের অংশ দুই নারীর অংশের মতো’ বলায় পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা ১/২ পাওয়া এবং কন্যা ছাড়া একটিমাত্র পুত্র ২/৩ পাওয়া কোনো সাংঘর্ষিক ধারা নয়।
৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ‘এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের মতো সূত্রটি পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোনের মধ্যে প্রযোজ্য এমন একটি সাধারণ সূত্র যা পুত্র-কন্যা মিলিতভাবে থাকুক বা বিচ্ছিন্নভাবে (তথা শুধু পুত্র বা শুধু কন্যাগণ) থাকুক, উভয় অবস্থায় প্রযোজ্য। ভাই-বোনদের ক্ষেত্রেও একই কথা। পার্থক্য হচ্ছে, একটিমাত্র কন্যা থাকলে (যখন পুত্র নেই) বা একটিমাত্র বোন থাকলে (যখন ভাই নেই) সে পাবে ১/২ , যা উল্লেখিত সূত্রের এক ধরনের ব্যতিক্রমসদৃশ হলেও পুরোপুরি ব্যতিক্রম নয়, কারণ সূত্রটিকে ‘এক পুরুষের জন্য এক নারীর দ্বিগুণ’ বা ‘এক নারীর জন্য এক পুরুষর অর্ধেক’ এভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ‘সে (ভাই) তার (বোনটির) উত্তরাধিকার পাবে’ তথ্যটিতে ভাই কতটুকু অংশ পাবে তা সরাসরি উল্লেখ করা না হলেও পরবর্তী বাক্যের মাধ্যমে তা নির্ণিত হয়ে যায় যে, ভাই পাবে ঐ পরিমাণ যা ভাইটির পরিবর্তে দুই বোন থাকলে পায় তথা ভাই পাবে ২/৩ অংশ (শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ হিসেবে)। আয়াতটিতে বক্তব্য প্রসঙ্গ একটি ভাইয়ের সম্পদ বণ্টন থেকে শুরু করা হয়েছে বিধায় ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’ বলা হয়েছে। কিন্তু যদি বোনটির ভাইসংখ্যা এক ভাইয়ের তুলনায় একাধিক ভাই হয়, তবে সেক্ষেত্রেও তারা বোনটির উত্তরাধিকার পাবে তথা সেক্ষেত্রে ‘ওয়া হুম ইয়ারিছূহা’ (তারা/ ভাইয়েরা তার/বোনটির উত্তরসূরী হবে) তথ্যটি প্রযোজ্য হবে, যদিও তা আলাদাভাবে বলার প্রয়োজন নেই বিধায় আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এক্ষেত্রে এক ভাই থাকলে সে যে অংশ পায়, ভাইয়েরা যৌথভাবে সে অংশ পাবে। দুই ভাইয়ের অংশ মানে চার বোনের অংশ। অন্য কথায় দুই বোন যা পায় দুইয়ের বেশি বোনও তাই পায়। যদি এক ভাই এবং এক বোন থাকে তবে তারা একসাথে তা-ই পাবে শুধু দুই বোন থাকলে সে যা পায় এবং এক্ষেত্রে ঐ অংশটি ভাই-বোনের মধ্যে এভাবে বণ্টিত হবে যে, এক ভাই পাবে দুই বোনের অংশের মতো। অন্যভাবে বলা যায়, এক ভাই ও এক বোন একসাথে ২/৩ অংশ পাবে এবং তাতে আবার এক ভাই পাবে দুই বোনের অংশের মতো।
৪:১১ আয়াতে এক বা একাধিক পুত্রের এবং পুত্র-কন্যা একসাথে থাকলে তাদের আনুপাতিক অংশ কত হবে তা নির্ণয়ের সূত্র লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে ৪:১৭৬ আয়াতে এক বা একাধিক ভাইয়ের এবং ভাই-বোন একসাথে থাকলে তাদের আনুপাতিক অংশ কত হবে তা নির্ণয়ের সূত্র লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি শেষে উল্লেখ করা হয়েছে।
লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি বাক্যটিকে একটি সাধারণ সূত্র সাব্যস্ত করার যুক্তি
৪:১১ আয়াতে উল্লেখিত ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ (এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের মতো) বাক্যটিকে কেউ কেউ একটি সাধারণ সূত্র হিসেবে সাব্যস্ত করেন। নিম্নোক্ত যুক্তির ভিত্তিতে এটিকে একটি সাধারণ সূত্র হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়:
‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বাক্যের পরপরই প্রথমে বলা হয়েছে ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’। তারপর ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতে এটি আর পুনরুল্লেখিত হয়নি। ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতার অংশ বলার পর ৪:১২ আয়াতে স্বামী-স্ত্রী ও ভাই-বোনের অংশ বলা হয়েছে। ৪:১২ আয়াত ‘ওয়া’ (এবং) দিয়ে শুরু হয়েছে যা প্রমাণ করে যে, এটি ৪:১১ আয়াতের সাথে সম্পর্কিত। ৪:১৩ আয়াতে বলা হয়েছে ‘তিলকা হুদুদুল্লাহ’ (এটি আল্লাহর সীমা)। এখানে ‘তিলকা’ শব্দ দ্বারা ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতকে একসাথে সংযুক্ত করে একটি একক বক্তব্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং ৪:১১ আয়াতে প্রথমে বলে নেয়া ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ হচ্ছে একটি সাধারণ নিয়ম, যা ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত সকল অনুল্লেখিত ওয়ারিসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু ৪:১৭৬ আয়াত ‘ওয়া’ দ্বারা সংযুক্ত না হওয়ায় তা ৪:১৭৫ আয়াতের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং তা একটি একক বক্তব্য, যা সূরা নিসার শেষে পরিশিষ্ট আকারে রয়েছে। ৪:১৭৬ আয়াত ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তাতে শেষদিকে আবার ‘লিয যাকারি হাযযিল উনছায়ায়নি’ বলে দেয়া হয়েছে, যাতে কোনো অস্পষ্টতা না থাকে। আর তাই এর পরপরই বলা হয়েছে ‘ইউবায়্যিনু লাকুম আন তাদিল্লূ’ (আল্লাহ তোমাদের কাছে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন পাছে তোমরা বিভ্রান্ত হবে)। এ কারণে ৪:১২ আয়াত অনুসারে যখন একাধিক ভাই-বোন ১/৩ অংশে শরিক হবে তখন তাদের মধ্যেও পুরুষ : নারী = ২ : ১ সূত্রটি প্রয়োগ করতে হবে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সর্বত্র নারীর অংশ স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে, কিন্তু সর্বত্র পুরুষের অংশ উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং যে যে ক্ষেত্রে পুরুষের অংশ উল্লেখ করা হয়নি সে সে ক্ষেত্রে পুরুষটি কোনো নারীর সাথে অংশীদার হলে তার দ্বিগুণ পাবে এবং কোনো পুরুষের সাথে অংশীদার হলে উভয় পুরুষ পরস্পরের সমান পাবে।
পর্যালোচনা
৪:১১ আয়াতে বর্ণিত ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ বা ‘এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের মতো’ বাক্যটি কি যেকোনো নারী পুরুষের জন্য প্রযোজ্য? অর্থাৎ এটি কি পুত্র ও কন্যা, পুত্র ও মাতা, পুত্র ও স্ত্রী, পুত্র ও বোন, পিতা ও কন্যা, পিতা ও মাতা, পিতা ও স্ত্রী, পিতা ও বোন, স্বামী ও কন্যা, স্বামী ও মাতা, স্বামী ও বোন, ভাই ও কন্যা, ভাই ও মাতা, ভাই ও স্ত্রী, ভাই ও বোন এই সকল অবস্থায় প্রযোজ্য? যদি ‘একটি পুরুষ পাবে দুজন নারীর সমান’ কথাটি একটি সাধারণ নিয়ম হয়, তবে এর অর্থ হচ্ছে দুজন পুরুষ পরস্পরের সমান পাবে এবং দুজন নারী পরস্পরের সমান পাবে’। যেমন, পুত্র ও পিতা, পুত্র ও স্বামী, পুত্র ও ভাই, পিতা ও স্বামী, পিতা ও ভাই, স্বামী ও ভাই, কন্যা ও মাতা, কন্যা ও স্ত্রী, কন্যা ও বোন, মাতা ও স্ত্রী, মাতা ও বোন পরস্পরের সমান পাওয়ার কথা।
‘এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের মতো’ এটি একটি সাধারণ নিয়ম কিনা তথা এটি যেকোনো নারী পুরুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা, এই প্রশ্নের সমাধান হলে এর সাথে সম্পর্কিত নিচের প্রশ্নগুলোর সমাধান পাওয়া যাবে। যথা :
(ক) যখন পুত্র সন্তান না থাকা অবস্থায় একটি কন্যা সন্তান থাকে, তখন ঐ কন্যা পায় ১/২ , পিতা পায় ১/৬ , মাতা পায় ১/৬ । এখানে প্রথমত পিতা কন্যার চেয়ে তথা ১ জন নারীর চেয়ে কম পাচ্ছে এবং মাতার সমান তথা ১ জন নারীর সমান পাচ্ছে। আবার এ অবস্থায় কন্যা ও মাতা উভয়ে নারী হওয়া সত্ত্বেও একজন অন্যজনের তুলনায় বেশি পাচ্ছে। এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? মাতা পিতার সাথে যখন দুইয়ের বেশি কন্যা অংশীদার হয় তখন কন্যারা একত্রে পায় ২/৩ যাতে প্রত্যেক কন্যার অংশ কত হবে তা কন্যাদের সংখ্যার উপর নির্ভর করে (যেমন কন্যা সংখ্যা ৩ না ৪ না ৫ ইত্যাদি)। এ অবস্থায়ও প্রত্যেক নারীর (মা ও মেয়ের) পারস্পরিক অংশ সমান হয় না এবং পুরুষের অংশ দুজন নারীর অংশের সমান হয় না। এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
(খ) যখন পিতার সাথে ১ টি পুত্র ও ২ টি কন্যা অংশীদার হয় তখন ঐ পুত্র-কন্যার সম্মিলিত অংশ কতটুকু? তারা কি পিতার অংশের পর অবশিষ্ট সম্পদে তথা ৫/৬ ভাগ সম্পদে পুরুষ : নারী = ২ : ১ এভাবে পাবে? নাকি পিতা পাবে ১/৬, পুত্র পাবে ১/৬ এবং ২ কন্যার প্রত্যেকে পাবে ১/১২? যদি তা হয়, তাহলে যখন পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা পিতার সাথে অংশীদার হয় সে কিভাবে ১/১২ না পেয়ে ১/২ পেতে পারে? এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
অন্যদিকে যখন মাতার সাথে ১ টি পুত্র ও ২ টি কন্যা অংশীদার হয় তখন ঐ পুত্র-কন্যার সম্মিলিত অংশ কতটুকু? তারা কি মাতার অংশের পর অবশিষ্ট সম্পদে তথা ৫/৬ ভাগ সম্পদে পুরুষ : নারী = ২ : ১ এভাবে পাবে? নাকি মাতা পাবে ১/৬ , পুত্র পাবে ১/৩ এবং ২ কন্যার প্রত্যেকে পাবে ১/৬ ? যদি তা হয়, তাহলে যখন পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা মাতার সাথে অংশীদার হয় সে কিভাবে ১/৬ না পেয়ে ১/২ পেতে পারে? এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
(গ) কন্যা না থাকা অবস্থায় এক বা একাধিক পুত্র থাকলে তাদের অংশ কিভাবে নির্ধারিত হবে? তারা কি তাদের সাথে কোনো পুরুষ অংশীদার থাকলে তার সমতুল্য অংশ পাবে? যেমন যদি দুই পুত্র ও পিতা থাকে তাহলে পিতা পাবে ১/৬ এবং দুই পুত্রের প্রত্যেকে পাবে ১/৬ ? অনুরূপভাবে যদি দুই পুত্র ও মাতা থাকে তাহলে কি পুরুষ নারীর দ্বিগুণ পাওয়ার সূত্রমতে, মাতা পাবে ১/৬ এবং দুই পুত্রের প্রত্যেকে পাবে ১/৩ ?
(ঘ) ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী যখন ভাই না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র বোন থাকে, তখন ঐ বোন পায় ১/২ । তার সাথে মৃতের স্বামী থাকলে সে পায় ১/৪ । এখানে দেখা যায় ১ টি নারী ১ টি পুরুষের দ্বিগুণ পাচ্ছে। এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? আর বোনটির সাথে যদি মৃতের স্ত্রী থাকে তবে বোন পায় ১/২ , স্ত্রী পায় ১/৮ । এ অবস্থায় বোন ও স্ত্রী উভয়ে নারী হওয়া সত্ত্বেও একজন অন্যজনের তুলনায় বেশি পাচ্ছে। এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম? আবার যদি এ অবস্থায় দুই বোন থাকে তারা পায় ২/৩ তথা প্রত্যেক বোন পায় ১/৩ , আর তাদের সাথে মৃতের স্বামী থাকলে সে পায় ১/৪ , অন্যদিকে তাদের সাথে মৃতের স্ত্রী থাকলে সে পায় ১/৮ । এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
(ঙ) ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী ভাই তার বোনের ওয়ারিস হবে। কিন্তু কতটুকু অংশের ওয়ারিস হবে? ভাই কি তার সাথে থাকা পুরুষ অংশীদারের সমান ওয়ারিস হবে? যেমন ভাই ও স্বামী ওয়ারিস হলে, স্বামী পাবে ১/৪ এবং ভাই পাবে ১/৪ ? অথবা নারী অংশীদারের দ্বিগুণ পাবে যেমন ভাই ও স্ত্রী ওয়ারিস হলে, স্ত্রী পাবে ১/৮ , ভাই পাবে ১/৪ ?
(চ) ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী যদি ১ ভাই ও ২ বোন এবং স্বামী থাকে, তাহলে ভাই-বোন কতটুকু করে পাবে? তারা কি স্বামীর অংশের পর অবশিষ্ট সম্পদে তথা ৩/৪ ভাগ সম্পদে পুরুষ : নারী = ২ : ১ এভাবে পাবে? নাকি স্বামী পাবে ১/৪ , ভাই পাবে ১/৪ এবং ২ বোনের প্রত্যেকে পাবে ১/৮ ? যদি তা হয়, তাহলে ভাই না থাকা অবস্থায়, ১ টি মাত্র বোন মৃতের স্বামীর সাথে অংশীদার হয় সে কিভাবে ১/৮ না পেয়ে ১/২ পায়? এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
অন্যদিকে, ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী যদি ১ ভাই ও ২ বোন এবং স্ত্রী থাকে, তাহলে ভাই বোন কতটুকু করে পাবে? তারা কি স্ত্রীর অংশের পর অবশিষ্ট সম্পদে তথা ৭/৮ ভাগ সম্পদে পুরুষ : নারী = ২ : ১ এভাবে পাবে? নাকি স্ত্রী পাবে ১/৮ , ভাই পাবে ১/৪ এবং ২ বোনের প্রত্যেকে পাবে ১/৮ ? যদি তা হয়, তাহলে ভাই না থাকা অবস্থায়, ১ টি মাত্র বোন মৃতের স্বামীর সাথে অংশীদার হয় সে কিভাবে ১/৮ না পেয়ে ১/২ পায়? এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
(ছ) মৃতের ওয়ারিস যদি হয় পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা ও স্বামী। তাহলে কন্যা পায় ১/২ এবং স্বামী পায় ১/৪ । এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
মৃতের ওয়ারিস যদি হয় পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা ও স্ত্রী। তাহলে কন্যা পায় ১/২ এবং স্ত্রী পায় ১/৮ । এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
(জ) মৃতের ওয়ারিস পুত্র না থাকা অবস্থায় দুইয়ের বেশি বোন এবং স্বামী হলে তখন কন্যারা একত্রে পায় ২/৩ যাতে প্রত্যেক কন্যার অংশ কত হবে তা কন্যাদের সংখ্যার উপর নির্ভর করে (যেমন কন্যা ৩ না ৪ না ৫ ইত্যাদি)। আর স্বামী পায় ১/৪ । এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
মৃতের ওয়ারিস পুত্র না থাকা অবস্থায় দুইয়ের বেশি বোন এবং স্ত্রী হলে তখন কন্যারা একত্রে পায় ২/৩ যাতে প্রত্যেক কন্যার অংশ কত হবে তা কন্যাদের সংখ্যার উপর নির্ভর করে (যেমন কন্যা ৩ না ৪ না ৫ ইত্যাদি)। আর স্ত্রী পায় ১/৮ । এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
(ঝ) যখন স্বামীর সাথে ১ টি পুত্র ও ২ টি কন্যা অংশীদার হয় তখন ঐ পুত্র-কন্যার সম্মিলিত অংশ কতটুকু? তারা কি স্বামীর অংশের পর অবশিষ্ট সম্পদে তথা ৩/৪ ভাগ সম্পদে পুরুষ : নারী = ২ : ১ এভাবে পাবে? নাকি স্বামী পাবে ১/৪ , পুত্র পাবে ১/৪ এবং ২ কন্যার প্রত্যেকে পাবে ১/৮ ? যদি তা হয়, তাহলে যখন পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা স্বামীর সাথে অংশীদার হয় সে কিভাবে ১/৮ না পেয়ে ১/২ পেতে পারে? এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
অন্যদিকে যখন স্ত্রীর সাথে ১ টি পুত্র ও ২ টি কন্যা অংশীদার হয় তখন ঐ পুত্র-কন্যার সম্মিলিত অংশ কতটুকু? তারা কি স্ত্রীর অংশের পর অবশিষ্ট সম্পদে তথা ৭/৮ ভাগ সম্পদে পুরুষ : নারী = ২ : ১ এভাবে পাবে? নাকি স্ত্রী পাবে ১/৮ , পুত্র পাবে ১/৪ এবং ২ কন্যার প্রত্যেকে পাবে ১/৮ ? যদি তা হয়, তাহলে যখন পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা স্ত্রীর সাথে অংশীদার হয় সে কিভাবে ১/৮ না পেয়ে ১/২ পেতে পারে? এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
(ঞ) কন্যা না থাকা অবস্থায় এক বা একাধিক পুত্র থাকলে তাদের অংশ কিভাবে নির্ধারিত হবে? তারা কি তাদের সাথে কোনো পুরুষ অংশীদার থাকলে তার সমতুল্য অংশ পাবে? যেমন যদি দুই পুত্র ও স্বামী থাকে তাহলে স্বামী পাবে ১/৪ এবং দুই পুত্রের প্রত্যেকে পাবে ১/৪ ? অনুরূপভাবে যদি দুই পুত্র ও স্ত্রী থাকে তাহলে কি পুরুষ নারীর দ্বিগুণ পাওয়ার সূত্রমতে, স্ত্রী পাবে ১/৮ এবং দুই পুত্রের প্রত্যেকে পাবে ১/৪ ?
(ট) ওয়ারিস হচ্ছে পিতা, মাতা ও স্বামী। তাহলে স্বামী পাবে ১/৪ , মাতা পাবে ১/৩ । এখন পিতা কি স্বামীর সমান তথা ১/৪ পাবে? পিতার অংশ অনুল্লেখিত থাকায় যদি স্বামীর অংশের সাথে মাতার অংশের তুলনা করা হয়, তাহলেও দেখা যায় পুরুষ নারীর তুলনায় কম পাচ্ছে। এটা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
ওয়ারিস হচ্ছে পিতা, মাতা ও স্ত্রী। তাহলে স্ত্রী পাবে ১/৮ , মাতা পাবে ১/৩ । এখন পিতা কি মাতার দ্বিগুণ পাবে না স্ত্রীর দ্বিগুণ পাবে? এখানে দেখা যায় দুই নারীর একজনের তুলনায় অন্যজন কম বেশি পাচ্ছে। এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
(ঠ) ওয়ারিস হচ্ছে কয়েকজন ভাই থাকা অবস্থায় পিতা, মাতা ও স্বামী। তাহলে স্বামী পাবে ১/৪ , মাতা পাবে ১/৬ । এখন পিতা কি স্বামীর সমান তথা ১/৪ পাবে? নাকি মাতার দ্বিগুণ তথা ১/৩ পাবে?
ওয়ারিস হচ্ছে কয়েকজন ভাই থাকা অবস্থায় পিতা, মাতা ও স্ত্রী। তাহলে স্ত্রী পাবে ১/৮ , মাতা পাবে ১/৬ । এখন পিতা কি মাতার দ্বিগুণ পাবে না স্ত্রীর দ্বিগুণ পাবে? এখানে দেখা যায় দুই নারীর একজনের তুলনায় অন্যজন কম বেশি পাচ্ছে। এরূপ অবস্থা কি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম?
উপরিউক্ত সমস্যাগুলোর পর্যালোচনার মাধ্যমে বলা যায়, এটি একটি সাধারণ নিয়ম হলে এই একটি নিয়মের মাধ্যমেই বিধান সমাপ্ত হয়ে যেতে পারত এবং এক্ষেত্রে শুধু ওয়ারিস কে কে হবে তাদের তালিকা (পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী/ স্ত্রী, ভাই, বোন) উল্লেখ করলে এবং কার উপস্থিতিতে কে বঞ্চিত হবে তা জানিয়ে দিলেই যথেষ্ট হতো।
এমতাবস্থায় সূত্রটিকে ওয়ারিসদের মধ্যে একটি সর্বজনীনভাবে গৃহীত সূত্র সাব্যস্ত করার পক্ষে বলা যেতে পারে, এটি একটি সাধারণ নিয়ম, কিন্তু এর অনেক ব্যতিক্রম রয়েছে। তাই বিভিন্ন ওয়ারিসের প্রাপ্য সম্পর্কে যা বলা হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে এটি খাটবে না, শুধু যার অংশ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি (এক বা একাধিক পুত্র, পুত্র-কন্যা, সন্তান ও ভাই-বোন না থাকা অবস্থায় পিতা, সন্তান না থাকা কিন্তু ভাই-বোন থাকা অবস্থায় পিতা, ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত একাধিক ভাই বা একাধিক বোন বা ভাই-বোন, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত এক বা একাধিক ভাই, এবং ভাই-বোন) শুধু তাদের ক্ষেত্রে সাধারণ সূত্রটি প্রযোজ্য হবে আর যাদের অংশ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোতে সাধারণ সূত্রের সাথে যে ব্যাতিক্রম পাওয়া যায় তা ব্যাতিক্রম হিসাবেই সাব্যস্ত হবে।
এ দাবির পর্যালোচনায় বলা যায়, যাদের অংশ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি তাদের ক্ষেত্রে এই সাধারণ সূত্র প্রযোজ্য ধরলেও প্রশ্ন দেখা দেয়। যেমন, ওয়ারিস হচ্ছে কয়েকজন ভাই থাকা অবস্থায় পিতা, মাতা ও স্ত্রী। তাহলে স্ত্রী পাবে ১/৮ , মাতা পাবে ১/৬ । এখন পিতা কি মাতার দ্বিগুণ পাবে না স্ত্রীর দ্বিগুণ পাবে?
সূত্রটিকে ওয়ারিসদের মধ্যে একটি সর্বজনীনভাবে গৃহীত সূত্র সাব্যস্ত করার পক্ষে পরিশেষে বলা যেতে পারে, এটি শ্রেণি-ভিত্তিক প্রযোজ্য সূত্র, যেমন: পুত্র-কন্যা এক শ্রেণি, পিতা-মাতা এক শ্রেণি, স্বামী/স্ত্রী এক শ্রেণি এবং ভাই-বোন এক শ্রেণি। পিতা ও মাতা এক গ্রুপ, স্ত্রী ভিন্ন গ্রুপ, তাই পিতা মাতার দ্বিগুণ পাবে, স্ত্রীর দ্বিগুণ নয়।
এ দাবির পর্যালোচনায় বলা যায়, তাহলেও সমস্যা থেকে যায়। যেমন: যদি পুত্র, মা ও স্ত্রী থাকে তাহলে পুত্র কার দ্বিগুণ পাবে? মায়ের না স্ত্রীর? এক্ষেত্রে তো মা ও স্ত্রী কেউই পুত্রের গ্রুপে পড়ে না। তবে কি পুত্র অবশিষ্টাংশ পাবে? অথচ অবশিষ্টাংশের ধারণা গ্রহণযোগ্য হলে পিতার ক্ষেত্রেও তা গ্রহণ করা যেতে পারে। এ অবস্থায়, এক পুরুষ পাবে দুই নারীর অংশের সমান, ধারাটি সাধারণ ধারায় পরিণত হয় না।
তথ্যগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রকৃত সমাধান নির্ণয়
৪:১১ আয়াতের বক্তব্য শুরু হয়েছে ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বাক্যের মাধ্যমে। তার পরপরই বলা হয়েছে ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’। এরপর বলা হয়েছে, ‘ফা-ইন কুন্না নিছাআন ফাওক্বাছনাতাইনি ফালাহুন্না ছুলুছাা মা তারাকা, ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান ফালাহান নিসফু’। এর মধ্য দিয়ে আওলাদের প্রাপ্য অংশ বর্ণনা শেষ হয়ে গেছে। এর পরপরই বলা হয়েছে ‘ওয়া লিআবাওয়ায়হি .............’ তথা আওলাদের অংশের পর পিতা-মাতার অংশ বলা হয়েছে। সুতরাং ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বাক্যে ‘আওলাদ’ প্রসঙ্গে আল্লাহ যে ওয়াসিয়াতের কথা বলেছেন তা ‘ওয়া লিআবাওয়ায়হি’ বাক্যাংশের পূর্বেই শেষ হয়েছে। অন্য কথায় ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বাক্যের পরিসীমা হচ্ছে ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি, ফা-ইন কুন্না নিছাআন ফাওক্বাছনাতাইনি ফালাহুন্না ছুলুছা মা তারাকা, ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান ফালাহান নিসফু’। অন্য কথায়, ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ বাক্যটি কোনো সাধারণ নিয়ম নয়, বরং এটি ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বাক্যের সাথে সুনির্দিষ্টভাবে জড়িত তথা আওলাদের মধ্যকার এক পুরুষের জন্য আওলাদের মধ্যকার দুই নারীর অংশের মতো। এটি যে আওলাদের প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট তার প্রমাণ হচ্ছে ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বলার পর আওলাদের অংশ বর্ণনার মধ্যেই এটি বলা হয়েছে। এছাড়া ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বলার পর এ বাক্যটি উল্লেখ করে তারপর নারীদের তথা আওলাদের অন্তর্ভুক্ত নারীদের অংশ বর্ণনা শুরু করা হয়েছে ‘ফা-ইন কুন্না নিছাআন’ শব্দগুচ্ছের মাধ্যমে, যা প্রমাণ করে যে, ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ বাক্যাংশটি এর পূর্ববর্তী ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ এবং এর পরবর্তী ‘ফা-ইন কুন্না নিছাআন’ বাক্যাংশ দুটির মধ্যবর্তী এমন বক্তব্য যা এ দুটি বক্তব্যের সাথে সুনির্দিষ্টভাবে জড়িত। যদি এটি এমন একটি সাধারণ নিয়ম হতো যা পুত্র-কন্যার পাশাপাশি পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তাহলে এ বাক্যাংশটি ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ এর পরপর এবং সেটার পরিসরের ভিতরে বলা হতো না, বরং সেক্ষেত্রে এ আয়াতটি ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ এর মাধ্যমে শুরু না করে অন্যভাবে শুরু করা হতো, যাতে ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বাক্যাংশের আগেই ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ বলে নেয়া হতো।
৪:১১ ও ৪:১২ আয়াত একটির সাথে অন্যটি সংযুক্ত। কারণ ৪:১১ আয়াতে উত্তরাধিকারের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে এবং পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতার অংশ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ৪:১২ আয়াতে উত্তরাধিকারের বিধান বর্ণনার ধারাবাহিকতায় স্বামী-স্ত্রী ও ভাই-বোনের অংশ বলা হয়েছে। এভাবে ৪:১১ ও ৪:১২ উভয়টি মিলে যে একক (Unit), সেটাকে ৪:১৩ আয়াতে ‘তিলকা হুদুদুল্লাহ’ (এটা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা) বলা হয়েছে। ৪:১২ আয়াত যেমন ‘ওয়া’ দিয়ে শুরু হয়েছে তথা ‘ওয়া’ দিয়ে স্বামীর অংশ বর্ণনা করা শুরু করা হয়েছে তেমনি এর পূর্বে ৪:১১ আয়াতে পিতা-মাতার অংশও ‘ওয়ালিআবাওয়ায়হি’ তথা ‘ওয়া’ দিয়ে শুরু করা হয়েছে এবং এর পর তথা স্বামীর অংশের পর ৪:১২ আয়াতে স্ত্রীর অংশও ‘ওয়া’ দিয়ে শুরু করা হয়েছে, এমনকি ভাই বোনের অংশ যেহেতু তারা কালালাহর ভাই-বোন হওয়ার প্রেক্ষিতে পায় তাই কালালাহর প্রসঙ্গও ‘ওয়া’ দিয়ে শুরু করা হয়েছে। সুতরাং পুত্র-কন্যার অংশ প্রথমে বলা হয়েছে এবং তারপর পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন সবার অংশ ‘ওয়া’ দিয়ে শুরু করে সবার অংশকে একই বক্তব্যে যুক্ত করা হয়েছে। সুতরাং ৪:১২ আয়াত ‘ওয়া’ দিয়ে শুরু হওয়ার হওয়ার উপর ভিত্তি করে ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ বাক্যাংশটিকে একটি সাধারণ নিয়ম হিসাবে সাব্যস্ত করা যথাযথ যুক্তিযুক্ত হবে না। বরং ৪:১২ আয়াতটি ‘ওয়া’ দিয়ে শুরু হওয়া সত্ত্বেও ৪:১১ আয়াতে উল্লেখিত ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ বাক্যাংশটি শুধুমাত্র আওলাদের প্রসঙ্গে প্রযোজ্য।
৪:১৭৬ আয়াতে পুনরায় ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ বলা হয়েছে। এর কারণ হলো, ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোন পাচ্ছে পুত্র-কন্যার অবর্তমানে এবং তাদের জন্য পুত্র-কন্যার সমানুপাতিক অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই ভাই-বোনের মধ্যকার এক পুরুষ পাবে ভাই-বোনের মধ্যকার এক নারীর অংশের মতো।
অন্যদিকে ৪:১২ আয়াতে ভাই-বোনের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ফা-ইন কানূ আকছারা মিন যালিকা ফাহুম শুরাকা-উ ফিছ ছুলুছি তথা ‘যদি ভাই-বোন একাধিক হয় তাহলে তারা ১/৩ অংশে শরিক হবে’। এখানে ১ ভাই : ১ বোন = ১ : ১। কারণ এক্ষেত্রে বোনের জন্য কোনো আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করে ভাইয়ের আনুপাতিক অংশ অনুল্লেখিত রাখা হয়নি বরং ভাই-বোন উভয়ের অংশ অনুল্লেখিত রাখা হয়েছে। তাই তারা উভয়ে পরস্পরের সমানুপাতে পাবে। অন্যভাবে বলা যায়, ৪:১২ আয়াতে ভাই-বোন একসাথে থাকা অবস্থায় তাদের অংশকে ২:১ আকারে উল্লেখ করা হয়নি বিধায় তারা পরস্পর সমানুপাতে পাবে। ৪:১২ আয়াত অনুযায়ী শুধু ভাই বা শুধু বোন থাকলে সে ১/৬ পাবে তথা এক্ষেত্রে ভাই বা বোন ভিন্ন অনুপাতে পাবে না। অনুরূপ উদাহরণ দেখা যায়, ৪:১১ অনুযায়ী পুত্র-কন্যা থাকা অবস্থায় পিতা ও মাতা পরস্পর সমানুপাতে পায় তথা উভয়ের প্রত্যেকে ১/৬ পায় কিন্তু পুত্র-কন্যা না থাকলে তাদের পারস্পরিক অনুপাতে হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে।
এ পর্যায়ে বিবেচ্য প্রশ্ন হলো, যদি লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি ধারাটি শুধু পুত্র-কন্যার ক্ষেত্রে এবং ভাই-বোনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ধারা হয়, তাহলে পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোন শব্দের পরিবর্তে পুরুষ ও নারী শব্দ ব্যবহার করার কারণ কী হতে পারে? এর যে কারণ বুঝা যায় তা নিম্নরূপ:
১. যেন উভয় স্থানে একই সূত্র প্রয়োগ করা যায়।
২. পুরুষ ও নারী শব্দ প্রয়োগ করলেও কাদের প্রসঙ্গে শব্দটি উল্লেখ করা হচ্ছে সে প্রসঙ্গ কাঠামো পূর্বেই আওলাদ এবং ইখওয়াত শব্দের মাধ্যমে সেট করা হয়েছে।
লক্ষণীয় যে, ধারাটির ক্ষেত্রে ‘যাকার’ ও ‘উনছা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, ‘রজুল’ ও ‘ইমরাআত’ শব্দ নয়। ‘যাকার’ ও ‘উনছা’ শব্দ সাধারণভাবে পুরুষ লোক ও নারী লোক বুঝায় না, বরং প্রসঙ্গ কাঠামোর মধ্য থেকে একেকটি লিঙ্গগত (Gender based) গ্রুপকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
আরো লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম শব্দের দুটি ব্যাপ্তি আছে। প্রাথমিক ব্যাপ্তি হচ্ছে, ‘লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ এবং এর চূড়ান্ত ব্যাপ্তি হচ্ছে ‘............ ফালাহান নিসফু’ পর্যন্ত। এরপর ‘ওয়া লিআবাওয়ায়হি’ থেকে আরো বিভিন্নজনের উত্তরাধিকার বন্টন বিধি সংযোজন করা হয়েছে কিন্তু তা ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ এর ব্যাপ্তিকে ছাড়িয়ে গেছে।
৪:১১ আয়াতে বর্ণিত ‘লিয যাকারি হাযযিল উনছায়ায়নি’ বাক্যটিকে ৪:১৭৬ আয়াতে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এই পুনরাবৃত্তি দুটি তথ্যগত সিদ্ধান্ত গঠনে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। একটি হলো, এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ভাই-বোনের অংশ হলো ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত পুত্র-কন্যার অংশের সমতুল্য এবং এর একটি অপরটিকে ব্যাখ্যা করে। অন্যটি হলো, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’ বাক্যে বর্ণিত ভাই তার বোনের উত্তরাধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রে ভাইয়ের শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ কত হবে তা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এ বাক্যটিই সমাধানসূত্র হিসেবে কাজ করে।
উপরিউক্ত তথ্যগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি (এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের অনুরূপ) বাক্যটি হলো শুধুমাত্র পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোনের মধ্যে প্রযোজ্য সূত্র।
৪:১১ আয়াতে দুই কন্যার ও ৪:১৭৬ আয়াতে দুইয়ের বেশি বোনের প্রাপ্য অংশ অনুল্লেখিত। অথচ ৪:১১ আয়াতে বলা হয়েছে এক পুত্র পাবে দুই কন্যার সমান অংশ। একটি মতে, ‘দুই কন্যার অংশও অনুল্লেখিত’। দুই কন্যার অংশ জানা না থাকলে এক পুত্রের অংশও অজানা থেকে যায়। এক্ষেত্রে একটি অভিমত হলো, যাদের অংশ অনুল্লেখিত তারা পাবে অবশিষ্টাংশ। কিন্তু এটি কি যৌক্তিক হতে পারে যে, যখন পিতা বা মাতা দুজনের একজন জীবিত নেই, তখন এক পুত্র বা দুই কন্যা অবশিষ্টভোগী হিসেবে পাবে ছয় ভাগের পাঁচ ভাগ ( ৫/৬ ) এবং সেক্ষেত্রে কন্যার সংখ্যা দুইয়ের বেশি হলে তাদের জন্য তিনভাগের দুই ভাগই (২/৩ ) নির্ধারিত থাকবে?
এছাড়া, ৪:১৭৬ আয়াত অনুসারে বন্টনের ক্ষেত্রে বোনের সংখ্যা দুইয়ের বেশি হলে তারা কতটুকু পাবে তাও সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। সেই সাথে ৪:১১ আয়াতে পুত্রের ও ৪:১৭৬ আয়াতে ভাইয়ের প্রাপ্য অংশও সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।
সুতরাং ৪:১১ আয়াতে থাকা ‘এক পুরুষ পাবে দুই নারীর সমান’ সূত্রটি পুত্র-কন্যার ক্ষেত্রে একটি সাধারণ সূত্র যা পুত্র-কন্যা মিলিতভাবে থাকলেও প্রযোজ্য এবং পুত্র-কন্যার মধ্য থেকে যেকোনো একটির উপস্থিতিতেও প্রযোজ্য।
৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোন মিলিতভাবে থাকা অবস্থার প্রেক্ষিতে ‘এক পুরুষ পাবে দুই নারীর সমান’ বলা হয়েছে। কিন্তু তারা মিলিতভাবে কতটুকু সম্পদের ওয়ারিস হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। সাধারণত ধরা হয়, অন্যদের অংশ বন্টনের পর অবশিষ্ট অংশ পুত্র-কন্যা বা ভাই-বোন পাবে। অথচ আনুপাতিক অংশ হিসাবে বন্টনের ক্ষেত্রে অবশিষ্ট অংশরূপে কিছু থাকে না। যেহেতু পুত্র-কন্যা হচ্ছে একাধিক কন্যার সমতুল্য এবং ভাই-বোন হচ্ছে একাধিক বোনের সমতুল্য তাই এটা একটা স্বত:সিদ্ধ ব্যাপার যে, একাধিক কন্যা বা একাধিক বোন যে অনুপাতের উত্তরাধিকারী অর্থাৎ তিন ভাগের দুই ভাগ সেটাই পুত্র-কন্যার মধ্যে বা ভাই-বোনের মধ্যে এমনভাবে ভাগ হবে যে, এক পুরুষ পাবে দুই নারীর অংশের সমান। কিন্তু একটিমাত্র কন্যা বা বোন থাকলে তার আনুপাতিক অংশ ১/২ , কারণ তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ বা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
পুত্র-কন্যার অংশ বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-
দুইয়ের বেশি কন্যা .... ২ কন্যা .... ১ কন্যা।
বিপরীতক্রমে,
ভাই-বোনের অংশ বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-
১ বোন .... ২ বোন .... দুইয়ের বেশি বোন।
একইভাবে, পুত্র : কন্যা = ২:১ বলা হয়েছে সর্বপ্রথম দিকে।
আর, বিপরীতক্রমে, ভাই : বোন = ২:১ বলা হয়েছে সর্বশেষে।
তাই, এক পুত্র কতটুকু পাবে তা যে সূত্র থেকে পাওয়া যায়, শুধু এক ভাই কতটুকু পাবে তা সেই একই সূত্র থেকে পাওয়া যায়। সূত্রটি হলো, লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি (এক পুরুষ পাবে দুই নারীর অংশের অনুরূপ)।
অন্য কথায়, শুধু এক পুত্র পাবে ২/৩ । পুত্র কন্যা না থাকা অবস্থঅয় শুধু এক ভাই পাবে ২/৩ ।
ফাইন কুন্না নিছাআন = যদি তারা হয় নারী = যদি পুত্র না থাকা অবস্থায় শুধু নারী থাকে। (৪:১১)
ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান = যদি সে হয় একজনমাত্র নারী = যদি পুত্র না থাকা অবস্থায় শুধু একজন নারী থাকে (৪:১১)
‘নিসাআন’ এবং ‘ওয়াহিদাতান’ উভয়টি ‘খবরে কানা’ হওয়ায় পুত্র না থাকা অবস্থার কথা সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’ এর ধারাক্রমে এবং এটি বুঝাচ্ছে যে, আওলাদ হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছে শুধু একজন (স্ত্রীলিঙ্গ ওয়াহিদাতান, কারণ সে নারী)। প্রথমে ‘নিসাআন’ শব্দ দ্বারা পুত্র না থাকার শর্তটি সাব্যস্ত হয়েছে, আর পরে ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দ দ্বারা পুত্র না থাকার বিষয়টি সাব্যস্ত হয়েছে। সেই সাথে ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দ দ্বারা আওলাদ এর প্রতিনিধিত্বকারী মাত্র একজন হওয়ার বিষয়টি বুঝানো হয়েছে। উপর্যুক্ত আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দটি কেন ব্যবহৃত হয়েছে বা শব্দটি ব্যবহারগত গুরুত্ব কী ছিল, তা স্পষ্ট হওয়া। ‘খবরে কানা’ (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্য) ‘নিসাআন’ হওয়ায় ক্রিয়া হিসেবে ‘কুন্না’ ব্যবহৃত হয়েছে, ‘খবরে কানা’ (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্য) ‘ওয়াহিদাতান’ হওয়ায় ক্রিয়া হিসেবে ‘কানাত’ ব্যবহৃত হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে ‘কুন্না’ ও ‘কানাত’ হিসেবে যারা বা যে আছে তারা বা সে ‘আওলাদ’ এর প্রতিনিধিত্ব করছে।
‘ফাইন কুন্না নিছাআন ফাওক্বাছনাতাইনি’ এবং ‘ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান’ বাক্যাংশদ্বয়ে ‘যখন পুত্র সন্তান নেই’ কথাটি আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু বাক্যাংশদ্বয়ের অর্থই হচ্ছে ‘যখন পুত্র সন্তান নেই’। কারণ পুত্রদের সাথে থাকা কন্যাদের জন্য এ অংশগুলো বন্টিত হয়নি। বরং পুত্রদের সাথে থাকা কন্যারা কিভাবে পাবে তার নির্দেশনা রয়েছে লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি বাক্যে আর তা হলো ‘দুই কন্যা মিলে এক পুত্রের সমান পাবে’। এখানে যে পুত্র না থাকা অবস্থাকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে তার প্রমাণ হলো ‘ফাইন কুন্না নিছাআন’ বাক্যের অর্থই হলো ‘যদি তারা হয় নারীগণ’। অর্থাৎ এখানে আওলাদ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ‘যদি তারা হয় নারীগণ’। অন্যকথায় যদি অবস্থা এমন হয় যে, ‘যদি আওলাদ বলতে শুধু নারীগণ হয়, নারী-পুরুষ একসাথে নয় বা শুধু পুরুষ নয়’। এ ধরনের বর্ণনাভঙ্গি থেকে স্পষ্ট হয় যে, নারী-পুরুষ একসাথে যেমন আওলাদ হতে পারে, তেমনি শুধু পুরুষগণও আওলাদ হতে পারে, এমনকি শুধু নারীগণও আওলাদ হতে পারে, তাই বাক্যটিতে যদি এ তিন অবস্থার তৃতীয়টি হয় সেই শর্তের উল্লেখ করা হয়েছে।
‘ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান’ বাক্যের অর্থ হলো ‘আর যদি সে হয় একজন’। এখানে বুঝানো হয়েছে ‘আওলাদের মধ্য থেকে যে আছে সে যদি একজন নারী হয়। আওলাদ হচ্ছে বহুবচন, তাই এখানে সম্পূর্ণ বক্তব্য হচ্ছে ‘যদি আওলাদের স্থলে বা আওলাদ সম্পর্কিত নির্দেশনার প্রতিনিধিত্বকারী একজনমাত্র ওয়ালাদ হয়, আর সে হয় নারী, একজন’। এখানে, ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দের মাধ্যমে কন্যাটি একজনমাত্র হওয়ার বা কন্যাটির সংখ্যাগত অবস্থা প্রকাশ করা হয়েছে। আর এ অবস্থায় তার সাথে কোনো পুত্র না থাকার শর্তটি দুটি উপায়ে বুঝানো হয়েছে। (ক) এ বাক্যাংশ পূর্বের বাক্যাংশের সাথে সম্পর্কিত, পূর্বের বাক্যাংশে পুত্র না থাকা অবস্থায় কন্যাদের কথা বলা হয়েছে এবং এখানে অনুরূপ অবস্থায় একটিমাত্র কন্যার কথা বুঝানো হয়েছে। (খ) ‘ওয়া ইন কানাত’ বাক্যাংশের অর্থ হলো ‘আর যদি সে হয়’, এতে ব্যবহৃত ক্রিয়া হচ্ছে ‘কানাত’ যা হলো স্ত্রীলিঙ্গ, একবচন। তাই এখানে স্বত:সিদ্ধভাবে পুত্র না থাকা অবস্থার কথা বলা হয়েছে বলে সাব্যস্ত হয়। তারপর পরবর্তী ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দটিও পূর্বের ক্রিয়ার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ তথা এটিও স্ত্রীলিঙ্গ, একবচন এবং সেই সাথে ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দের অর্থ হলো ‘একজন’।
‘ওয়া ইন কানাত’ এরপর পূর্ববর্তী বাক্যাংশের ‘নিসা’ বা ‘উনছায়ায়নি’ শব্দের পরিবর্তে ‘ইমরাআত’ বা ‘উনছা’ শব্দ ব্যবহার না করে ‘ইসমে কানা’ (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্য) হিসেবে ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ ‘কানাত’ ক্রিয়া ব্যবহারের কারণে এ পর্যায়ে ‘উনছা’ বা ‘ইমরাআত’ শব্দের ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা থাকেনি। যদিও পূর্বের বাক্যাংশে ‘নিছাআন’ শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ছিল বিধায় তাতে ‘নিসাআন’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। তাতে ‘নিসাআন’ শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ছিল ‘আওলাদ’ শব্দের আওতায় শুধুমাত্র নারীগণ থাকার দিকটি উল্লেখ করার জন্য বা ‘আওলাদ’ এর একটি অবস্থা তুলে ধরার জন্য এবং প্রথমবার ক্রিয়ার সাথে তা কাদের বিপরীতে ব্যবহৃত হয়েছে তা স্পষ্ট উল্লেখ করার জন্য।
‘ওয়া ইন কানাত ওয়াহিদাতান’ বাক্যাংশে ‘ওয়াহিদাতান’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে পূর্বের বাক্যাংশের ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’ এর বিপরীতে সংখ্যার উল্লেখ করার জন্য। অর্থাৎ পূর্বের বাক্যাংশে নারীগণের সংখ্যা সম্পর্কিত যে তথ্যটি উল্লেখিত হয়েছে তার সাথে সমন্বয় রেখে পরবর্তী আয়াতে নারীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে, যা একইসাথে সংখ্যা বিষয়ক ধারা প্রকাশ করে এবং বক্তব্য উপস্থাপনের রীতিগত উৎকর্ষকে ধারণ করে।
ফাইন কুন্না নিসাআন ফাওক্বাছনাতাইনি (৪:১১) শব্দগুচ্ছের মাধ্যমে দেয়া অংশটি হচ্ছে ‘আওলাদের’ জন্য নির্ধারিত অংশ, কারণ এটি পূর্ববর্তী ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম এর ব্যাখ্যামূলক বদল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি পরবর্তীতে যদি একটিমাত্র কন্যার জন্য আলাদা অংশ উল্লেখ করা না হতো তবে তার জন্যও একই অংশ প্রযোজ্য হতো। সুতরাং আওলাদের আওতায় এক বা একাধিক পুত্র/ একাধিক কন্যা/ পুত্র-কন্যা থাকলে তারা পাবে ২/৩ । শুধুমাত্র একটি কন্যা থাকলে (কোনো পুত্র না থাকলে) সে পাবে ১/২ ।
‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বাক্যাংশের মাধ্যমে একদিকে যেমন মাতার আনুপাতিক অংশ উল্লেখিত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি পিতার আনুপাতিক অংশ নির্ধারিত হয়েছে যদিও তা সরাসরি উল্লেখ না করে উহ্য রেখে দেয়া হয়েছে। যেহেতু ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বাক্যাংশের মাধ্যমে মাতার আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করার দ্বারা পিতার আনুপাতিক অংশ সহজেই নির্ধারিত হয়ে যায় তাই তা উহ্য রেখে দেয়া হয়েছে। এভাবে ভাষারীতির উৎকর্ষসম্পন্ন প্রয়োগ ঘটেছে এবং উত্তরাধিকার বিধানে নারীর অংশকে অধিক আলোকপাত করা হয়েছে।
‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বাক্যোংশের দুটি সুস্পষ্ট প্রভাব হচ্ছে:
(১) পিতা-মাতার সাথে তথা পিতা-মাতা শ্রেণির সাথে অন্য বিবেচনাযোগ্য ওয়ারিস (তথা ভাই-বোন) না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে মাতা কতটুকু পাবে (এবং পিতা কতটুকু পাবে) তা নির্ধারণ করা। এখানে মাতার অংশ বলা হয়েছে যা পিতা থাকা বা না থাকা উভয় অবস্থায় প্রযোজ্য। এমন কি যখন পুত্র-কন্যা থাকলে পিতা কতটুকু পাবে ও মাতা কতটুকু পাবে তা বলা হয়েছে তাও এভাবে কার্যকর হবে যে, সে অবস্থায় পিতা থাকুক বা না থাকুক মাতা পাবে ১/৬ , আর মাতা থাকুক বা না থাকুক পিতা পাবে ১/৬ ।
(২) পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে মাতার অংশ কত হবে তা উল্লেখিত হয়েছে অথচ পিতার অংশ অনুল্লেখিত রয়েছে। এখন ‘ওয়া ওয়ারিছাহু আবাওয়াহু’ = আর তার ওয়ারিস হয় তার পিতা-মাতা (৪:১১) = তার পিতা-মাতা একমাত্র ওয়ারিস হলে মাতা পাবে ১/৩ । তখন স্বাভাবিকভাবেই পিতা পাবে অবশিষ্ট অংশ তথা ২/৩ । আর যদি অন্য ওয়ারিস থাকে তাহলে তাদের প্রাথমিক পারস্পরিক অনুপাত অন্যদের সাপেক্ষেও একই শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ হিসাবে কার্যকর হবে। কারণ, পিতা-মাতা ও তিন কন্যার ক্ষেত্রে আনুপাতিক অংশসমূহের যোগফল ১/৬ + ১/৬ + ২/৩ = ১। কিন্তু যদি সাথে অন্য ওয়ারিস থাকে তবুও তাদের এ শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ পরিবর্তিত হবে না, বরং তা একই শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ হিসাবে কার্যকর হবে। যেমন, যদি স্বামী থাকে তবে স্বামীর ১/৪ এর বিপরীতে তিন কন্যার আনুপাতিক অংশ ২/৩ , এবং পিতার আনুপাতিক অংশ ১/৬ ও মাতার আনুপাতিক অংশ ১/৬ বহাল থাকে। এর কারণ হলো আনুপাতিক অংশের যোগফল ১ এর চেয়ে বেশি হওয়া কোনো সমস্যা নয়। আনুপাতিক অংশ আনুপাতিক হারে হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারে এটাই আনুপাতিক অংশের বৈশিষ্ট্য। তবে শর্ত হলো আনুপাতিক হারে হ্রাস-বৃদ্ধি হতে হবে যোগফল ১ হওয়ার জন্য এবং যারা প্রাপক তাদের মধ্যে সম্পূর্ণটি বন্টনের জন্য, কিন্তু কোনোক্রমে তাদেরকে একই অনুপাতে দিয়ে সম্পত্তির কোনো অংশ আলাদা করে নেয়া যাবে না।
ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু বাক্যাংশটি পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে তথা জীবিত থাকলে তারা এভাবে পাবে, ওয়ারিস না হলে তথা জীবিত না থাকলে তারা পাবে না, এরূপ অযৌক্তিক কথা বলার জন্য ব্যবহৃত হয়নি। কারণ যদি তারা জীবিত না থাকে তাহলে তারা কিছু পাবে না এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার এবং এটা অন্য যেকোনো ওয়ারিসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সুতরাং বক্তব্যটি এরূপ হলে তা শুধু পিতা-মাতা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা অর্থবহ হতো না। এ বক্তব্যের প্রকৃত তাৎপর্য কী তা আয়াতের পরবর্তী অংশ থেকে স্পষ্ট হয়। পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে, যদি ইখওয়াতুন থাকে তাহলে মা পাবে ১/৬ । অন্যকথায়, পরবর্তী অংশে পিতা-মাতার সাথে ভাই-বোন থাকলে মাতার অংশ কত হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং, ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ তথ্যটির প্রকৃত তাৎপর্য হলো যদি পুত্র কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনও না থাকে। কারণ, পুত্র কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশ বদলে যায়। কিন্তু স্বামী/ স্ত্রী থাকুক বা না থাকুক পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশ বদলে যায় না। সুতরাং এখানে পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকা না থাকাকে বিবেচনা করা হয়েছে কিন্তু স্বামী/ স্ত্রী থাকা বা না থাকাকে বিবেচনা করা হয়নি। সুতরাং, ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ এর মর্মার্থ হলো, ‘এবং (যদি) তার ওয়ারিস হয় তার পিতা-মাতা এ অবস্থায় যে, বিবেচনাযোগ্য অন্য কোনো ওয়ারিস তথা ভাই-বোন নেই’। পরবর্তী অংশ থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, বিবেচনাযোগ্য অন্য ওয়ারিস হচ্ছে ভাই-বোন, স্বামী/ স্ত্রী নয়। সুতরাং মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনও না থাকলে মাতা পাবে ১/৩ , পিতা পাবে ২/৩ । যেহেতু স্বামী/ স্ত্রীকে বিবেচনা করা হয় না তাই তারা জীবিত থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় মাতা ও পিতার আনুপাতিক অংশ একইরূপ থাকবে। কিন্তু যদি ভাই-বোন থাকে তাহলে ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ এর অবস্থা বদলে যায় বা বহাল থাকে না। কারণ সেক্ষেত্রে পিতা-মাতার সাথে বিবেচনাযোগ্য অন্য ওয়ারিস থাকে।
সুতরাং ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বাক্যাংশটি প্রমাণ করে যে, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার সাথে ভাই-বোন থাকলে তারাও ওয়ারিস হবে, যেহেতু সে অবস্থায় পিতা-মাতা এমন ওয়ারিস নয়, যাদের সাথে বিবেচনাযোগ্য অন্য ওয়ারিস নেই। পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা, স্বামী/ স্ত্রী সব অবস্থায় ওয়ারিস, কিন্তু ভাই-বোন সব অবস্থায় ওয়ারিস নয়। পুত্র-কন্যা থাকা বা না থাকা উভয় অবস্থায় স্বামী/ স্ত্রী এমন ওয়ারিস নয়, যার থাকা বা না থাকা সাপেক্ষে পিতা-মাতা বা পুত্র-কন্যার জন্য ভিন্ন ভিন্ন অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ভাই-বোন এমন ওয়ারিস যে, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় তারা না থাকলে পিতা-মাতা প্রসঙ্গে বলা যায়, ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’, কিন্তু তারা (ভাই বোন) থাকলে, তখন তারাও পিতা-মাতার সাথে ওয়ারিস হয়, যারা ওয়ারিস হওয়ার কারণে পিতা-মাতার অংশ পরিবর্তিত হয় এবং সেক্ষেত্রে পিতা-মাতা প্রসঙ্গে ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ তথ্যটিতে প্রদত্ত আনুপাতিক অংশ বহাল রাখা হয়নি বরং অন্যরূপ আনুপাতিক অংশ প্রদান করা হয়েছে।
অনুরূপভাবে ৪:১৭৬ আয়াতে উল্লেখিত ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিসুহা’ বাক্যটির তাৎপর্য হলো ‘কোনো ভাই তার বোনের ওয়ারিস হবে এবং এক্ষেত্রে অন্য কোনো ওয়ারিস (পিতা-মাতা এবং স্বামী/ স্ত্রী) থাকুক বা না থাকুক, তারা বিবেচনায় আসবে না, বরং সে তার জন্য একই নির্ধারিত আনুপাতিক অংশ পাবে’। আর বন্টনবিধির বিশ্লেষণ থেকে বুঝা যায়, তার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক অংশ হচ্ছে ২/৩ । ৪:১৭৬ আয়াতে পুত্র-কন্যার অবর্তমানে ভাই-বোন ওয়ারিস হওয়ার কথা বলা হয়েছে, আর ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যার অংশও এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, পিতা-মাতা বা স্বামী/ স্ত্রী থাকা বা না থাকার কারণে তাদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অংশ উল্লেখ করা হয়নি।
যদি দুটি শ্রেণির মধ্যে বন্টন হয়, যার একটি শ্রেণির আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়েছে, অন্য শ্রেণির আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়নি, তখন এর নিম্নোক্ত দুটি তাৎপর্য হয়:
(ক) যার আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়েছে সেটাই তার আনুপাতিক অংশ, অপর শ্রেণির অনুপস্থিতিতে যে আনুপাতিক অংশ দ্বারা প্রাপ্ত প্রকৃত অংশ হবে সম্পূর্ণ সম্পত্তি।
(খ) যার আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়নি সে যদি প্রথম পক্ষের সাথে উপস্থিত থাকে তাহলে তার অনুল্লেখিত আনুপাতিক অংশ হবে সম্পূর্ণ অংশ থেকে প্রথম শ্রেণির আনুপাতিক অংশের বিয়োগফল। আর প্রথম শ্রেণির অনুপস্থিতিতে এ বিয়োগফলরূপ আনুপাতিক অংশের দ্বারা প্রাপ্ত প্রকৃত অংশ হবে সম্পূর্ণ সম্পত্তি। যেহেতু প্রথম শ্রেণির আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়েছে তার সাথে (তথা দ্বিতীয় শ্রেণির সাথে) সহঅবস্থানের সাপেক্ষে এবং তার (তথা দ্বিতীয় শ্রেণির) আনুপাতিক অংশ অনুল্লেখিত, তাই প্রথম শ্রেণির জন্য উল্লেখিত আনুপাতিক অংশ ও তার জন্য অনুল্লেখিত আনুপাতিক অংশের যোগফল হবে ১, তা ১ এর বেশি বা কম হবে না। কারণ বহু জ্ঞাত আনুপাতিক অংশের যোগফল ১ এর বেশি বা কম হতে পারে, যার ফলে শ্রেণিগুলোর বাস্তব উপস্থিতির বিভিন্ন সংমিশ্রণে প্রত্যেক শ্রেণির প্রকৃত অংশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন হয় কিন্তু উপস্থিত এক শ্রেণির সাথে অন্য শ্রেণির অনুপাত সব ক্ষেত্রে স্থির থাকে। কিন্তু কোনো অনুল্লেখিত আনুপাতিক অংশ ও উল্লেখিত আনুপাতিক অংশের যোগফল ১ এর চেয়ে কম বা বেশি হয় না, বরং ১ হয়। কারণ একমাত্র সেই ক্ষেত্রেই কোনো শ্রেণির আনুপাতিক অংশ অনুল্লেখিত রাখা যৌক্তিক হয় যখন তার সাথে যে শ্রেণির উপস্থিত থাকার সাপেক্ষে তার আনুপাতিক অংশ অনুল্লেখিত রাখা হয়েছে সেই শ্রেণির উল্লেখিত অংশ ও তার জন্য নির্ধারিত অথচ অনুল্লেখিত আনুপাতিক অংশের যোগফল ১ হয়, ১ এর চেয়ে কম বা বেশি হয় না। এটি একটি সাধারণ যুক্তিসিদ্ধ বিষয়।
সুতরাং পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় মায়ের অংশ ১/৩ হওয়ার অর্থ হচ্ছে এ অবস্থায় পিতার অংশ হচ্ছে ২/৩ ।
অন্যদিকে যদি যে শ্রেণির আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়েছে কোনো শর্ত সাপেক্ষে তার আনুপাতিক অংশকে কমানো বা বাড়ানো হয়, তাহলে যে শ্রেণির আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়নি এ অবস্থায় তার আনুপাতিক অংশ তার প্রথম পর্যায়ের আনুপাতিক অংশের তুলনায় একই শর্তে বাড়বে কিনা বা কমবে কিনা এবং যদি বাড়ে বা কমে তবে বেড়ে বা কমে তার নতুন আনুপাতিক অংশ কত হবে তা নির্ভর করবে ঐ শর্ত দ্বিতীয় শ্রেণির উপর প্রযোজ্য হয় কিনা এবং শর্তের ধরন কী তার উপর।
যেহেতু পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে মাতার আনুপাতিক অংশ ১/৬ হয়, যা হচ্ছে পুত্র-কন্যা থাকা অবস্থায় মাতার আনুপাতিক অংশ, তাই এ থেকে বুঝা যায় যে, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনকে পুত্র-কন্যার সমান গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাই এ অবস্থায় পিতার আনুপাতিক অংশও ১/৬ হবে, যেহেতু পুত্র-কন্যা থাকা অবস্থায় পিতার আনুপাতিক অংশও মাতার মতোই ১/৬ হয়।
৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ একসাথে বিবেচনা করলে এ কথা স্পষ্ট যে, সন্তান না থাকা অবস্থায় মাতার আনুপাতিক অংশ সন্তান থাকা অবস্থায় মাতার আনুপাতিক অংশের দ্বিগুণ হয় এবং পিতার আনুপাতিক অংশ মাতার আনুপাতিক অংশের দ্বিগুণ হয়। এটা বিভিন্ন অবস্থায় ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন, সন্তান থাকা অবস্থায় ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ পরস্পরের সমান হলেও সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই পায় বোনের দ্বিগুণ।
পরিশেষে বলা যায়, ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু (যদি তাকে পূর্বসূরী করে তার পিতা-মাতা) দ্বারা বুঝানো হয়েছে, (সন্তান না থাকা অবস্থায়) তার পিতা-মাতার সাথে (আনুপাতিক অংশের হ্রাসবৃদ্ধির জন্য বিবেচনায় নেয়ার মতো ওয়ারিস ছাড়া) অন্য কোনো ওয়ারিস থাকুক বা না থাকুক, তার পিতা-মাতা তার ওয়ারিস হিসেবে থাকলে, তারা এভাবে পাবে। তবে তার ভাই-বোন থাকলে সে ভাই-বোনকে পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশের হ্রাসবৃদ্ধির জন্য বিবেচনায় নেয়া হবে। ভাই-বোন ছাড়া অন্য কারো উপস্থিতির জন্য সন্তান না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না।
৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা (তার ভাই তার ওয়ারিস হবে) তথ্যটি দ্বারা কী বুঝায়? মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা অবস্থায় তার ভাই কি তার সম্পূর্ণ সম্পত্তির ওয়ারিস হবে? নাকি সে কোনো নির্দিষ্ট আনুপাতিক অংশের প্রাপক হবে?
৪:১১ আয়াতে যেমন ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ (এবং তার ওয়ারিস হলে তার পিতা-মাতা) বলার পর মাতার আনুপাতিক অংশ কত হবে সে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তেমনি, ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’ বা ‘সে (ভাইটি) তার (বোনটির) ওয়ারিস হবে’ বলার পর তার আনুপাতিক অংশ কত হবে সে নির্দেশনা পাওয়া যায় পরবর্তী বাক্যাংশ ‘ফালিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’ থেকে।
‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’ বলতে বুঝায় তার আনুপাতিক অংশে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানোর জন্য কোনো ওয়ারিসকে বিবেচনা করা হবে না। এটা দ্বারা সে সমস্ত সম্পদের বা অবশিষ্ট সমস্ত সম্পদের ওয়ারিস হবে বুঝায় না। কারণ ৪:১১ আয়াতে পিতা-মাতার বিষয়ে ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বলার পর মাতার আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তারপর ‘ইখওয়াত’ থাকা অবস্থায় মাতার আনুপাতিক অংশকে হ্রাস করা হয়েছে। কিন্তু ‘স্বামী/ স্ত্রীর’ উপস্থিতি অনুপস্থিতিকে মাতার আনুপাতিক অংশকে হ্রাসবৃদ্ধির জন্য বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এ থেকে বুঝা যায়, ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ দ্বারা বুঝিয়েছে ‘যদি পিতা-মাতার সাথে এমন কেউ না থাকে যার উপস্থিতিকে তাদের আনুপাতিক অংশকে হ্রাস বৃদ্ধির জন্য বিবেচনায় নেয়া হয়’। অনুরূপভাবে ৪:১৭৬ আয়াতে ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিসুহা’ দ্বারা বুঝাবে ‘সে ভাইটি তার বোনটির ওয়ারিস হবে এমনভাবে যে, তার আনুপাতিক অংশকে হ্রাস-বৃদ্ধি করার জন্য কাউকে বিবেচনায় নেয়া হবে না’। কিন্তু তার আনুপাতিক অংশ কত তা উল্লেখ করা হয়নি, তা পরবর্তী নির্দেশনা থেকে পরোক্ষভাবে পাওয়া যায়।
সুতরাং ওয়া হুয়া ইয়ারিসুহা [আার সে (ভাই) তাকে (বোনকে) পূর্বসূরী করবে] বাক্যটির তাৎপর্য হলো, ভাইটির সাথে অন্য কোনো ওয়ারিস থাকুক বা না থাকুক ভাইটি তার নির্দিষ্ট আনুপাতিক অংশই পাবে, তার নির্দিষ্ট আনুপাতিক অংশের (তথা দুই বোনের সমান অংশ প্রাপ্তির) হ্রাস-বৃদ্ধির জন্য অন্য কাউকে বিবেচনায় নেয়া হবে না। কিন্তু ভাইয়ের আনুপাতিক অংশ কত তা এখান থেকে স্পষ্ট নয়। তা পাওয়া যায়, পরবর্তী বক্তব্য থেকে যাতে বলা হয়েছে ‘ফালিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি’।
৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতের মধ্যে তিনটি প্রত্যক্ষ সামঞ্জস্য :
(১) পুত্র-কন্যা একসাথে থাকলে এবং ভাই-বোন একসাথে থাকলে উভয় ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি (এক পুরুষ পাবে দুই নারীর অংশের মতো)।
(২) একজনমাত্র কন্যা থাকলে সে পাবে ১/২ । একইভাবে বলা হয়েছে, একজনমাত্র বোন থাকলে সে পাবে ১/২ ।
(৩) ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত তথ্যানুযায়ী, পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোনের অবস্থার ক্ষেত্রে আরেকটি সাধারণ অবস্থা হচ্ছে এই যে, যখন পুত্র-কন্যা থাকে তখন পিতা ও মাতা প্রত্যেকে পাবে ১/৬ । (এক্ষেত্রে, ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী, ভাই-বোনের কোনো অংশ নেই তথা পিতা ও মাতার সাথে পুত্র কন্যা থাকা অবস্থায় ভাই-বোন কিছু পাচ্ছে না। আর এক্ষেত্রে ৪:১১ আয়াতেও ভাই-বোনের কোনো অংশ উল্লেখিত হয়নি)। তারপর, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায়, ভাই-বোন না থাকলে মাতা পাবে ১/৩ । আর পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে মাতা পাবে ১/৬ ।
লক্ষণীয় যে, পুত্র-কন্যা থাকা অবস্থায় মাতা পাবে ১/৬ (ভাই-বোন থাকুক বা না থাকুক); আর পুত্র কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে সেক্ষেত্রেও মাতা পাবে ১/৬ । আর ৪:১৭৬ অনুযায়ী পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনের অংশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং পিতা ও মাতার সাথে পুত্র কন্যা থাকলে ভাই-বোনের কোনো অংশ নেই কিন্তু পুত্র-কন্যা না থাকলে ভাই-বোনের অংশ আছে। আর পিতা ও মাতার সাথে পুত্র-কন্যা থাকলে মাতা যতটুকু লাভ করে, পুত্র-কন্যা না থেকে ভাই-বোন থাকলেও মাতা সেরূপ অংশ লাভ করে। আর এটাই হচ্ছে ৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতে থাকা তৃতীয় প্রত্যক্ষ সামঞ্জস্য।
দুইয়ের বেশি বোন, পুত্র ও ভাইয়ের অংশ নির্ণয়ের উপায়:
উপর্যুক্ত তিনটি সাধারণ অবস্থা বা সামঞ্জস্য বিবেচনায় রেখে আরো কিছু সামঞ্জস্য সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ হয়, যার মাধ্যমে দুইয়ের বেশি বোন, পুত্র ও ভাইয়ের অংশ নির্ণয় করা যায়।
(১) ৪:১১ আয়াতে পুত্র ও কন্যার জন্য প্রদত্ত অংশ পুত্র-কন্যা না অবস্থায় ভাই-বোনের জন্য প্রযোজ্য যা ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং ৪:১১ আয়াতে এ বিষয়টি অন্তর্নিহিত রয়েছে কিন্তু ফতোয়া জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে ৪:১৭৬ আয়াতে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং আয়াতটিকে ৪:১১, ৪:১২ আয়াত থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বা সূরা নিসার শেষ আয়াত হিসাবে সংস্থাপিত করা হয়েছে। এটি কুরআনের অন্য সকল সূরার শেষ আয়াতের ধরনের থেকে ব্যতিক্রম। অন্য সব সূরার শেষ আয়াত পূর্ববর্তী কাছাকাছি আয়াতসমূহের সাধারণ শেষকথা। সেভাবে অব্যবহিত পূর্ব বক্তব্যের ধারাবাহিকতা ৪:১৭৫ আয়াতে শেষ হয়েছে, তারপর ৪:১৭৬ আয়াতটি পরিশিষ্ট হিসেবে সংযোজিত হয়েছে। এভাবে ৪:১৭৬ আয়াতের সংস্থাপনের মাধ্যমে মূল অধ্যায় শেষ হওয়ার পর যে পরিশিষ্ট বা সংযোজনী লেখা হয় তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। (অবশ্য এতদসত্ত্বেও সূরার প্রথম আয়াতকে জন্ম সম্পর্কিত এবং শেষ আয়াতকে মৃত্যু সম্পর্কিত করার মাধ্যমে একটি যোগসূত্র তৈরি করা হয়েছে)।
(২) ৪:১১ আয়াতে দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার জন্য উল্লেখিত আনুপাতিক অংশ ২/৩ । ৪:১৭৬ আয়াতে দুই কন্যার জন্য উল্লেখিত আনুপাতিক অংশ ২/৩ । তাতে দুইয়ের বেশি কন্যার অংশ সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু একটিমাত্র কন্যার অংশ যেমন ১/২ , একটিমাত্র বোনের অংশও তেমনি ১/২ । এ থেকে বুঝা যায় যে, কন্যাদের ক্ষেত্রে যেমন দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার আনুপাতিক অংশের মধ্যে পার্থক্য নেই, বোনদের ক্ষেত্রেও তেমনি দুই বোনের আনুপাতিক অংশই দুইয়ের বেশি বোনের আনুপাতিক অংশ হিসেবেও প্রযোজ্য হবে। কিন্তু দুইয়ের বেশি বোনের অংশ সরাসরি উল্লেখ না করার একটি ভাষারীতিগত কারণ বিবেচনা করা যাক।
কন্যাদের অংশ এভাবে বলা হয়েছে, দুইয়ের বেশি বা দুই কন্যার অংশ ২/৩ এবং একটিমাত্র কন্যার অংশ ১/২ ।
বোনদের অংশ এভাবে বলা হয়েছে, একটিমাত্র বোনের অংশ ১/২ এবং দুই বোনের অংশ ২/৩ ।
অর্থাৎ কন্যাদের অংশ বর্ণনার ক্ষেত্রে কন্যাদের সংখ্যার ঊর্ধ্ব থেকে নিম্নক্রম তথা দুইয়ের বেশি কন্যা, দুই কন্যা, এক কন্যা এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। অন্যদিকে বোনদের অংশ বর্ণনার ক্ষেত্রে বোনদের সংখ্যার নিম্ন থেকে ঊর্ধ্বক্রম তথা এক বোন, দুই বোন এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। সুতরাং এমতাবস্থায় দুইয়ের বেশি বোনের অংশ উল্লেখ করলে তা উল্লেখের স্থান ছিল দুইয়ের বেশি বোনের অংশ বর্ণনার শেষে। কিন্তু যেহেতু পূর্বাপর বক্তব্য অনুসারে এবং ৪:১১ আয়াতের ওজনে (তুলনামূলক বিবেচনার ভিত্তিতে) দুইয়ের বেশি বোনের অংশ হিসেবে দুই বোনের অংশটিই প্রযোজ্য হবে বলে বুঝা যায় (Understood) তাই তা অনুক্ত (Non-expressed) রেখে দেয়া হয়েছে। এরূপ অবস্থায় বক্তব্যের অংশবিশেষ উহ্য রেখে দেয়ার রীতি আরবি ভাষায় প্রচলিত রয়েছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে কুরআনেও এ রীতিটি অবলম্বন করা হয়েছে।
উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বুঝা যায় যে, ৪:১১ আয়াত অনুযায়ী, পুত্র না থাকা অবস্থায় শুধু দুই কন্যার আনুপাতিক অংশ ২/৩ এবং দুইয়ের বেশি কন্যার আনুপাতিক অংশও ২/৩ । অনুরূপভাবে ভাই না থাকা অবস্থায় শুধু দুই বোনের আনুপাতিক অংশ ২/৩ এবং দুইয়ের বেশি বোনের আনুপাতিক অংশও ২/৩ ।
দুইয়ের বেশি বোনের আনুপাতিক অংশ সরাসরি উল্লেখ না করা সত্ত্বেও দুই বোনের জন্য উল্লেখিত আনুপাতিক অংশই তার জন্য প্রযোজ্য হওয়ার বিষয়টি বা দুইয়ের বেশি বোনের আনুপাতিক অংশ সরাসরি উল্লেখ না করার কারণ বুঝার ক্ষেত্রে পুত্র কন্যা ও ভাই বোনের মধ্যে বণ্টনের জন্য প্রযোজ্য সূত্রটি লক্ষণীয়। ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যা প্রসঙ্গে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের প্রসঙ্গে উল্লেখিত লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি এর মাধ্যমে দুইয়ের বেশি বোনের অংশ এবং এছাড়াও এক বা একাধিক পুত্রের অংশ ও এক বা একাধিক ভাইয়ের অংশ হিসেবে ২/৩ সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি শিরোনামে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
(৩) শুধুমাত্র এক বা একাধিক পুত্র থাকলে তারা সেভাবে পাবে পুত্র কন্যা না থাকা অবস্থায় শুধুমাত্র এক বা একাধিক ভাই থাকলে তারা যেভাবে পায়। ৪:১৭৬ আয়াতে ভাইয়ের অংশের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’। শুধুমাত্র একাধিক ভাই থাকলে তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আরবি ভাষারীতি অনুযায়ী এরূপ অনুরূপতার বিষয়টি উল্লেখের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই; কারণ তা বক্তব্যের সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্য নষ্ট করে। শুধু এক ভাই থাকলে সে যতটুকু অংশের ওয়ারিস হয়, একাধিক ভাই থাকলে তারা সম্মিলিতভাবে পরস্পর সমান হারে ততটুকু অংশের ওয়ারিস হয়।
(৪) যখন পুত্র-কন্যা আছে তখন পিতা ও মাতা প্রত্যেকে পাবে ১/৬ (এ অবস্থায় ভাই-বোন থাকলেও তাদের জন্য তথা ভাই-বোনের জন্য কোনো অংশ নেই)। যখন পুত্র-কন্যা নেই এবং ভাই-বোনও নেই তখন মাতা পাবে ১/৩ । আবার যখন পুত্র-কন্যা নেই কিন্তু ভাই-বোন আছে তখন মাতা পাবে ১/৬ । অর্থাৎ পুত্র-কন্যা থাকলে মাতা যেরূপ ১/৬ পেত, তেমনি পুত্র-কন্যার পরিবর্তে ভাই-বোন থাকলেও মাতা পাবে ১/৬ । সুতরাং পুত্র-কন্যা থাকলে পুত্র-কন্যা যে অংশ পেত, পুত্র-কন্যা না থাকলে ভাই-বোন সেই অংশ পাবে। এখন পুত্র-কন্যাও নেই, ভাই-বোনও নেই এ অবস্থায় মাতার অংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১/৩ । তাহলে পুত্র-কন্যা থাকলে যেভাবে মাতার মত পিতাও ১/৬ পায়, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে সেভাবেই মাতার মত পিতাও ১/৬ পাবে। এ তথ্যটি স্বত:সিদ্ধ যৌক্তিক তথ্য হিসাবে আসে বিধায় পিতার অংশ আলাদাভাবে বলার প্রয়োজনীয়তা থাকে না, তাই পিতার অংশ আলাদাভাবে বলা হয়নি।
পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার অংশ যে ধারাবাহিকতায় বলা হয়েছে সে ধারাবাহিকতায় যে দুই স্থানে শুধু মাতার অংশ উল্লেখ করা হয়েছে সে দুই স্থানের কোন স্থানে পিতার অংশ কত হবে তা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কয়েকটি পয়েন্ট লক্ষণীয়। যেমন, প্রথমত লক্ষণীয় যে, পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার অংশ বর্ণনা শুরু হয়েছে ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ (আর তার ওয়ারিস হয় তার পিতা-মাতা) বাক্যাংশের মাধ্যমে। এরপর এ অবস্থায় মাতা কতটুকু পাবে এবং ভাই-বোন থাকলে মাতা কতটুকু পাবে তা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এ দুই স্থানে মাতার সাথে সাথে পিতাও ওয়ারিস, কিন্তু পিতার অংশ সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। তা সত্ত্বেও আয়াতের বক্তব্যধারার বিশ্লেষণাত্মক অধ্যয়নের মাধ্যমে তা নির্ণয় করা যায়। নিম্নে বিষয়টি আলোচনা করা হলো।
প্রথম স্থান, যেখানে বলা হয়েছে, মাতা পাবে ১/৩ , তাতে পিতার আনুপাতিক অংশ কত তা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো: ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বাক্যটির ক্ষেত্রে দুটি অবস্থান হতে পারে, (ক) পিতা-মাতা একমাত্র ওয়ারিস। (খ) অন্য এক বা একাধিক ওয়ারিসের পাশাপাশি পিতা-মাতাও ওয়ারিস।
যদি পুত্র-কন্যা থাকে তাহলে পিতা পায় ১/৬ , মাতা পায় ১/৬ । তাদের সাথে পুত্র-কন্যা ছাড়া অন্য ওয়ারিস (স্বামী/স্ত্রী) থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় তাদের আনুপাতিক অংশ একইরূপ। তেমনি পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোন না থাকা অবস্থায় (যেহেতু পরে পুত্র-কন্যা নেই কিন্তু ভাই-বোন আছে এরূপ অবস্থায় মাতার অংশ উল্লেখ করা হয়েছে) অন্য ওয়ারিস (স্বামী/ স্ত্রী) থাকলেও মাতার অংশ হবে ১/৩ । সুতরাং ‘পিতা-মাতা ওয়ারিস হয়’ কথাটির অর্থ হচ্ছে (ক) যদি পিতা-মাতা একমাত্র ওয়ারিস হয় তাহলে তাদের অংশ এরূপ এবং (খ) অন্য ওয়ারিস থাকলে তাদের এই আনুপাতিক অংশ সেই ওয়ারিসদের আনুপাতিক অংশের সাথে কার্যকর হবে।
এরূপ অবস্থায় মাতা ১/৩ পাওয়ার অর্থই হচ্ছে অবশিষ্ট অংশ পিতার তথা পিতার অংশ হচ্ছে ২/৩ । কারণ এখানে অন্য ওয়ারিস থাকলেও এই ১/৩ + ২/৩ = ১ হবে পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশ, অন্য ওয়ারিসের আনুপাতিক অংশের তুলনায়। যেমন, তিন কন্যা ও পিতা-মাতা থাকলে, তিন কন্যা পাবে ২/৩ , পিতা ও মাতা পাবে (১/৬ + ১/৬ =) ১/৩ । সাথে স্বামী/ স্ত্রী থাকলেও তাদের আনুপাতিক অংশ এটিই থাকবে।
এরপর পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে মাতার অংশ হয় ১/৬ যা পুত্র কন্যা থাকা অবস্থার অনুরূপ। সুতরাং পুত্র-কন্যার প্রভাব ও ভাই-বোনের প্রভাব সমান। তাই এরূপ অবস্থায় পিতার অংশও ১/৬ । কারণ, পুত্র-কন্যা থাকা অবস্থায় পিতার অংশ ১/৬ ।
(৫) এক পুরুষের জন্য এক নারীর দ্বিগুণ বলা হয়নি। তাই যদি এক পুত্র ও এক কন্যা থাকে, তবে পুত্র যদিও কন্যার দ্বিগুণ পায় তবু তা কন্যার দ্বিগুণ হিসাবে পায় না, বরং এক পুত্রকে দুই কন্যা বিবেচনা করার ভিত্তিতে পায়। অর্থাৎ ধরা হবে তিন কন্যা আছে। তাই সম্পদ তিন ভাগ করা হবে। তারপর কন্যাটি তার এক ভাগ এবং পুত্রটি দুই কন্যার মতো (১ ভাগ + ১ ভাগ) = ২ ভাগ পাবে। এভাবে যখন পুত্র না থাকা অবস্থায় দুই কন্যা (বা দুইয়ের বেশি কন্যা) থাকে তখন তারা সম্মিলিতভাবে যে ২/৩ আনুপাতিক অংশ পায়, কন্যা না থাকা অবস্থায় এক পুত্র (বা একাধিক পুত্র) সেই ২/৩ আনুপাতিক অংশ পায়। এভাবে শুধু (দুই বা) দুইয়ের বেশি কন্যা থাকলে তারা যেমন শুধু এক কন্যা থাকলে সে যা পায় তার দ্বিগুণ পাওয়া হয় না, তেমনি শুধু এক পুত্র থাকলে সে শুধু এক কন্যা থাকলে সে যা পায় তার দ্বিগুণ পাওয়া হয় না। সুতরাং এক পুরুষ (পুত্র) পাবে দুই নারীর (কন্যার) (সম্মিলিত) অংশের মতো, কথাটি নারী পুরুষ সম্মিলিতভাবে থাকুক বা স্বতন্ত্রভাবে থাকুক উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ এটি সাধারণ সূত্র। (যদি কথাটি হতো এক পুত্রের জন্য এক কন্যার দ্বিগুণ তবে প্রদত্ত বন্টন বিধির ধারাসমূহের সাপেক্ষে কথাটি সাধারণ সূত্র হিসাবে উল্লেখ করা যেতো না।)
শুধু পিতা থাকলে তার অংশ এবং শুধু মাতা থাকলে তার অংশ:
পুত্র কন্যা থাকলে মাতা পাবে ১/৬ (পিতা থাকুক বা না থাকুক), পিতা পাবে ১/৬ (মাতা থাকুক বা না থাকুক)। অনুরূপভাবে, পুত্র কন্যা না থাকা অবস্থায়, মাতা পাবে ১/৩ (যদি ভাই-বোন না থাকে), (পিতা থাকুক বা না থাকুক)। আর এ অবস্থায় পিতা পাবে ২/৩ (যদি ভাই-বোন না থাকে), (মাতা থাকুক বা না থাকুক)। কারণ, কোনো ওয়ারিসের জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক অংশ অন্য ওয়ারিসের অনুপস্থিতিতে হ্রাস পায় না, যদি না তা শর্ত হিসাবে উল্লেখ থাকে এবং যদি না হ্রাসকৃত আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়। অন্যথায় এক ওয়ারিসের অনুপস্থিতিতে অন্য ওয়ারিসের আনুপাতিক অংশে হ্রাসবৃদ্ধি হয় না, শুধু প্রকৃত প্রাপ্ত অংশ হ্রাসবৃদ্ধি হয়। যেমন যদি শুধুমাত্র একজন ওয়ারিস থাকে তাহলে তার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক অংশ যাহাই হোক না কেন বাস্তবে অন্য কোনো ওয়ারিস না থাকায় তার প্রকৃত প্রাপ্ত অংশ হয় ১ তথা সম্পূর্ণ সম্পত্তি।
৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যার অংশ বলার পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের ও ঋণ পরিশোধের কথা উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু পিতা-মাতার অংশ বলার পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের এবং ঋণ পরিশোধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ৪:১২ আয়াতে স্বামীর অংশ বলার পর, স্ত্রীর অংশ বলার পর এবং ভাই-বোনের অংশ বলার পর এই তিনবার মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের অংশ বলার পর ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা উল্লেখ করা হয়নি। এখানে ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যার অংশের পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা না বলার সাথে ৪:১৭৬ আয়াতে ভাইবোনের অংশ বলার পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা না বলার একটি মিল রয়েছে।
আনুপাতিক অংশ নির্ধারণ পদ্ধতি ও বর্ণনারীতির ভিত্তিতে চিন্তা গবেষণার মাধ্যমে ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যার অংশ বলার পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা উল্লেখ না করার তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়। সাধারণত কারো আনুপাতিক অংশ সৃষ্টি হয় অন্য কারো আনুপাতিক অংশের তুলনায়। তাই পুত্র-কন্যার আনুপাতিক অংশ বলার পর যখন পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশও বলা হলো, তখন মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা বলা হয়েছে। এরপর বলা হয়েছে, ‘তোমরা জানো না তোমাদের পিতা-মাতা ও তোমাদের পুত্র-কন্যার মধ্যে কে উপকারের দিক থেকে তোমাদের অধিক নিকটবর্তী’। এভাবে পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতার অংশ সম্পর্কিত ধারা শেষ হওয়ার পর ৪:১২ আয়াতে স্বামীর অংশ উল্লেখ করা হয়েছে, এরপর স্ত্রীর অংশ উল্লেখ করা হয়েছে, এরপর ভাই-বোনের অংশ উল্লেখ করা হয়েছে এবং প্রত্যেকের অংশের পরপর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।
৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের অংশ বলার পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা উল্লেখ না করার তাৎপর্য হতে পারে: যেহেতু ভাই-বোন পাচ্ছে পুত্র-কন্যা না থাকায় এবং পুত্র-কন্যার অনুরূপভাবে, তাই পুত্র-কন্যার অংশের পর যেমন মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা বলা হয়নি সেটার সাথে মিল রাখার জন্য এখানেও মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা বলা হয়নি।
পুত্র-কন্যার আনুপাতিক অংশের পর এবং পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনের আনুপাতিক অংশের পর ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ ও ঋণ পরিশোধের ধারাটি উল্লেখ না করার মানে এ নয় যে, পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোনের অংশ বন্টনের সাথে মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের সম্পর্ক নেই। বরং সমগ্র বক্তব্য কাঠামো নিয়ে চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, যদি পিতা-মাতার অংশ উল্লেখ করার মাধ্যমে বক্তব্য শুরু হতো এবং পুত্র-কন্যার অংশ পরে বলা হতো তাহলে পিতা-মাতার অংশের পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা না বলে পুত্র-কন্যার অংশের পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা বলা হতো। ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের অংশের পর মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও ঋণ পরিশোধের কথা উল্লেখ না করার মাধ্যমে ৪:১১ আয়াতে পুত্র-কন্যার অংশ বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখা হয়েছে।
আউল সমস্যা সমাধানকল্পে কৃত একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যা পাবে ২/৩ এবং একটিমাত্র কন্যা থাকলে সে পাবে ১/২ ; এটি শুধু তখন যখন পিতা-মাতা ও স্বামী/ স্ত্রী নেই, সাথে কোনো পুত্র থাকুক বা না থাকুক। এক পুত্র পাবে দুই কন্যার সমান তথ্যটি শুধুমাত্র যখন পুত্র-কন্যা মিলিতভাবে আছে তখন প্রযোজ্য।
যদি পিতা-মাতা ও স্বামী/স্ত্রী থাকে, তাহলে প্রথমে পিতা-মাতা ও স্বামী/ স্ত্রী তাদের অংশ পাবে, তারপর বাকি সম্পূর্ণ অংশ দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যা পাবে বা একটিমাত্র কন্যা পাবে, যেমন এক বা একাধিক পুত্র বা পুত্র-কন্যা পায়।
আর যেখানে পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার ওয়ারিস হওয়ার কথা বলা হয়েছে তার অর্থ হলো পিতা-মাতা একমাত্র ওয়ারিস হওয়া। এ অবস্থায় মাতা ১/৩ এবং পিতা পাবে ২/৩ । কিন্তু যদি পিতা-মাতার সাথে অন্য কেউ থাকে তাহলে তার অংশ দেয়ার পর অবশিষ্ট থেকে মাতা পাবে ১/৩ এবং পিতা পাবে ২/৩ । অনুরূপভাবে ৪:১৭৬ আয়াতে ভাইকে বোনের ওয়ারিস করা হয়েছে তার অর্থ হলো সম্পূর্ণ বা অবশিষ্ট সম্পূর্ণ অংশের ওয়ারিস হওয়া।
পর্যালোচনা
এ ব্যাখ্যা অনুসারে একজন ব্যক্তির যদি একটিমাত্র পুত্র থাকে সে বা একটি পুত্র ও একটি কন্যা থাকে তারা পাবে সম্পূর্ণ, যেমন ৬/৬ , যদি পুত্র না থাকা অবস্থায় একটি মাত্র কন্যা থাকে সে পাবে অর্ধেক, যেমন ৩/৬ , যদি পুত্র না থাকা অবস্থায় ১০ টি কন্যা থাকে তবু তারা পাবে দুই তৃতীয়াংশ, যেমন ৪/৬ । প্রশ্ন হলো, কেন একটি মাত্র কন্যা শুধু কন্যাদের সংখ্যা যদি ১০ জনও হয় তাদের চেয়ে বিশেষ গুরুত্ব পায়? কেন ১ পুত্রের সাথে থাকা একটি কন্যা এক তৃতীয়াংশ পায় অথচ পুত্র না থাকা অবস্থায় দশ কন্যা মিলে ২/৩ পায়? কেন পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র বা একাধিক কন্যা ১/২ বা ২/৩ পায় তথা কেন তারা সম্পূর্ণ সম্পত্তি পায় না? অবশিষ্ট সম্পত্তি কেন অবন্টিত অবস্থায় থেকে যাবে? আর যদি বন্টন করা হয় তবে তা কে পাবে? একটি ব্যাখ্যা হতে পারে যে, তা জাতীয় সম্পত্তির আওতাভুক্ত হবে। কিন্তু এছাড়া অন্য যত ব্যাখ্যা দেয়া হোক তাতে আপত্তি থেকে যায় যে, কিভাবে অন্যান্য ওয়ারিস নির্ধারণ করা হবে যাদেরকে কুরআনে ওয়ারিস করা হয়নি?
এ ব্যাখ্যা অনুসারে, যদি একটিমাত্র কন্যা থাকে সাথে আর কেউ না থাকে তবে কন্যাটি পাবে অর্ধেক যেমন ৩/৬ । কিন্তু যদি পিতা ও কন্যা থাকে, তবে পিতা পাবে ১/৬ এবং কন্যাটি পাবে ৫/৬ । প্রশ্ন হচ্ছে, পিতা থাকা অবস্থায় সে বেশি পাচ্ছে অথচ তার সাথে কেউ না থাকলে সে কম পাচ্ছে এর কারণ কী?
এ ব্যাখ্যাতে যে তথ্যটি তুলে ধরা হয়েছে যে, ‘একটিমাত্র কন্যা ১/২ পাবে এবং দুইয়ের বেশি কন্যা ২/৩ পাবে যখন তার বা তাদের সাথে অন্য কোনো ওয়ারিস নেই’, এ তথ্যটির কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। কারণ একইভাবে বলা যায়, পুত্র থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার যে অংশ বলা হয়েছে স্বামী/ স্ত্রী থাকলে তা কার্যকর হবে না, পুত্র থাকা অবস্থায় স্বামী/ স্ত্রীর যে অংশ বলা হয়েছে পিতা-মাতা থাকলে তা কার্যকর হবে না ইত্যাদি। সুতরাং এরূপ ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। বরং যার থাকা বা না থাকাকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে সে ছাড়া অন্য কেউ থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় বর্ণিত অংশ কার্যকর হবে, এটাই যৌক্তিক ব্যাখ্যা হয়।
সুতরাং যে আউল সমস্যা সমাধানের জন্য শুধু কন্যার বা শুধু কন্যাদের অংশ তারা একমাত্র ওয়ারিস হওয়ার সময় কার্যকর বলা হচ্ছে সে আউল সমস্যা আসলে কোনো সমস্যাই নয়। কারণ প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেকের জন্য বর্ণিত অংশ হচ্ছে তার শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ। এ ব্যাখ্যাটি আউল সমস্যাকে সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত না করে বরং আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিকেই উত্তরাধিকার বণ্টনের পদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত করে।
পুত্র-কন্যার অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাখ্যা হলো: এক পুত্র পাবে দুই কন্যার সমান, কিন্তু যদি কন্যা সংখ্যা দুইয়ের বেশি হয় তাহলে কন্যারা পাবে ২/৩ এবং এক বা একাধিক পুত্র পাবে ১/৩ । অন্যদিকে যদি কন্যা সংখ্যা মাত্র একজন হয় তাহলে কন্যাটি পাবে ১/২ এবং এক বা একাধিক পুত্র পাবে ১/২ ।
এ ব্যাখ্যাটির পর্যালোচনায় বলা যেতে পারে, ব্যাখ্যাটি আক্ষরিকতাবাদের প্রভাবে প্রভাবিত যুক্তির ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু আরবি ভাষারীতি এবং যৌক্তিকতা যাচাই করলে ব্যাখ্যাটি গ্রহণযোগ্য হয় না। কারণ ৪:১১ আয়াতে ব্যবহৃত শব্দাবলির বিন্যাস থেকে স্পষ্ট যে, দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার অংশ ২/৩ এবং একটিমাত্র কন্যার অংশ ১/২ কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সাথে কোনো পুত্র না থাকার শর্ত প্রযোজ্য। আর যৌক্তিকতা চিন্তা করলেও বুঝা যায় যে, একটিমাত্র কন্যার বিপরীতে যত পুত্রই থাকুক না কেন কন্যাটি পাবে ১/২ এবং পুত্ররা সম্মিলিতভাবে ১/২ , আবার একটিমাত্র পুত্রের বিপরীতেও যদি দশজন কন্যা থাকে তবুও ঐ দশ কন্যা সম্মিলিতভাবে পাবে ২/৩ এবং পুত্রটি একাই পাবে ১/৩ এটি যুক্তিসিদ্ধ নয়।
পুত্র-কন্যার অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাখ্যা হলো: প্রতি এক পুত্র পাবে প্রতি দুই কন্যার সমান। যদি প্রতি এক পুত্রের বিপরীতে মাত্র একজন করে কন্যা থাকে তাহলে প্রতি এক কন্যা পাবে প্রতি এক পুত্রের অর্ধেক। কিন্তু যদি প্রতি এক পুত্রের বিপরীতে দুইয়ের বেশি কন্যা থাকে তাহলে তারা পাবে ২/৩ এবং পুত্র বা পুত্ররা পাবে ১/৩ ।
এ ব্যাখ্যাটির পর্যালোচনায় বলা যেতে পারে, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ভাইবোনের ক্ষেত্রেও কি অনুরূপ কথা প্রযোজ্য? এর উত্তর হলো, না। বরং আয়াতটি থেকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, একজনমাত্র বোন থাকলে এবং ভাই না থাকলে বোন পাবে ১/২ । দুইজন বোন থাকলে এবং ভাই না থাকলে তারা পাবে ২/৩ । শুধু ভাই (বা ভাইয়েরা) থাকলে সে (বা তারা) ওয়ারিস হবে। ভাই-বোন মিলিতভাবে থাকলে এক ভাই পাবে দুই বোনের সমান। সুতরাং ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত পুত্র/কন্যার অংশ সম্পর্কে আরবি ভাষারীতি এবং আয়াতসমূহের সমন্বিত তথ্যভিত্তিক অনুবাদের বিপরীতে উপরিউক্ত প্রস্তাবনাটি গ্রহণযোগ্য নয়।
‘অথবা’ ও ‘এবং’ এ দুটি শব্দের পাশাপাশি আরেকটি প্রয়োজনীয় শব্দগুচ্ছ হচ্ছে ‘অথবা/ এবং’। অর্থাৎ ‘অথবা’ ‘এবং’ শব্দ দুটি দ্বারা যে বিপরীত দুটি অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়, তার সাথে আরেকটি অভিব্যক্তির জন্য ‘অথবা/ এবং’ শব্দগুচ্ছের প্রয়োজন হয়।
‘অথবা/ এবং’ ও ‘এবং/ অথবা’ একই অর্থ প্রকাশক। যদি আরবিতে ‘অথবা’ বুঝাতে একটি শব্দ এবং ‘এবং’ বুঝাতে অন্য একটি শব্দ ব্যবহৃত হয়, কিন্তু ‘অথবা/ এবং’ বুঝাতে ঐ দুটি শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ ব্যবহৃত না হয়, তাহলে ঐ দুটি শব্দের কোনো একটি একই সাথে ‘অথবা/ এবং’ অভিব্যক্তির জন্যও ব্যবহৃত হওয়ার কথা।
‘অথবা’ এর আরবী ‘আও’। ‘এবং’ এর আরবী ‘ওয়া’। প্রশ্ন হচ্ছে ‘অথবা/ এবং’ এর আরবি হিসেবে ‘আও’ ব্যবহৃত হবে নাকি ‘ওয়া’ ব্যবহৃত হবে? যদি এজন্য ‘আও’ ব্যবহৃত হয়, তাহলে এর অর্থ হবে ‘অথবা/ এবং’। কারণ ‘আও’ এর প্রাথমিক অর্থ হচ্ছে ‘অথবা’। আর যদি এজন্য ‘ওয়া’ ব্যবহৃত হয়, তাহলে এর অর্থ হবে ‘এবং/ অথবা’। কারণ ‘ওয়া’ এর প্রাথমিক অর্থ হচ্ছে ‘এবং’। তাই শব্দার্থ লেখার ক্ষেত্রে ‘/’ চিহ্নের আগে প্রাথমিক অর্থ এবং পরে দ্বিতীয় ধরনের অর্থ লেখা হবে।
যদি ‘আও’ এর অর্থ ‘অথবা/ এবং’ হয়, তাহলে ‘ওয়া’ এর অর্থ ‘এবং/ অথবা’ হতে পারে না। কারণ সেক্ষেত্রে ‘আও’ এবং ‘ওয়া’ এর অর্থের মধ্যে কোনো তফাৎ থাকে না। সুতরাং ‘অথবা/ এবং’ বা ‘এবং/ অথবা’ যা-ই বলা হোক, এ অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য হয় ‘আও’ ব্যবহৃত হবে, না হয় ‘ওয়া’ ব্যবহৃত হবে, এ দুটির উভয়টি ব্যবহৃত হতে পারে না।
উপর্যুক্ত যুক্তিটি গাণিতিক ধরনের যুক্তি। তাই এ যুক্তির ভিত্তিতে শব্দ দুটির প্রায়োগিকতা পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি। উত্তরাধিকার বন্টন বিধিতে দুই স্থানে এ অর্থ নির্ণয়ের প্রভাব রয়েছে। একটি হচ্ছে, ওয়াসিয়্যাত ও দাইন (ঋণ) বিষয়ে ‘আও’ শব্দের ব্যবহার। অন্যটি হচ্ছে, ওয়া লাহু আখুন আও উখতুন ............ ফাইন কানূ আকছারা মিন যালিকা ........ বাক্যে ‘আও’ শব্দের ব্যবহার ও পরবর্তী বাক্যাংশের অর্থ নির্ণয়ে এর প্রভাব।
আল কুরআনে ‘আও’ এর প্রায়োগিকতা তথা প্রায়োগিক অর্থ হিসেবে ‘অথবা/এবং’ সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। কারণ ২৩:৫-৭ আয়াতে ‘আজওয়াজিহিম’ এবং ‘মা মালাকাত আইমানুহুম’ এর মধ্যে ‘আও’ ব্যবহৃত হয়েছে। আর বক্তব্যের স্বত:সিদ্ধ অভিব্যক্তি থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, এখানে ‘আও’ এর অর্থ ‘অথবা/ এবং’। শুধু ‘আও’ শব্দ দ্বারা শুধু ‘অথবা’ নয়, বরং ‘অথবা/ এবং’ বুঝায়। এ বিষয়ে আরেকটি উদাহরণ হলো ৭৬:২৪ আয়াত :: ফাসবির লিহুকমি রব্বিকা ওয়া লা তুতি’ মিনহুম আছিমান আও ইছমান। এ আয়াতে ব্যবহৃত ‘আও’ শব্দটিরও অর্থ হলো ‘অথবা/এবং’।
‘আও’ দ্বারা যুক্ত দুটি অপশনের একটি অথবা উভয়টি একসাথে প্রযোজ্য হতে পারে। আবার ‘ওয়া’ দ্বারা যুক্ত দুটি বিষয়ের মধ্য থেকেও কখনও একটি বিষয় এবং কখনও উভয় বিষয় উপস্থিত থাকতে পারে। সুতরাং ‘আও’ এবং ‘ওয়া’ এর পার্থক্য হলো: যখন একাধিক বিষয়ের কোনো একটি বা সবকটির প্রযোজ্যতা নির্দেশ করা হয় তখন ‘আও’ ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে যখন একাধিক বিষয়ের সংযোজনকে গুরুত্ব দেয়া হয় তখন ‘ওয়া’ ব্যবহার করা হয়, বাস্তবে কখনো কখনো তার মধ্যকার কোনো কোনো বিষয়ের উপস্থিতি নাও থাকতে পারে।
শুধুমাত্র অভিধান থেকে ‘আও’ শব্দের এ ধরনের ব্যবহারিক অর্থ নাও বুঝা যেতে পারে। কুরআনে ব্যবহৃত আরবি শব্দগুলো আল কুরআনে কি অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে তার জন্য দুটি মূল ভিত্তিগত উপাদান হচ্ছে: ক. শব্দটির শব্দমূল খ. কুরআনে শব্দটির প্রায়োগিকতা।
‘ওয়া’ শব্দ দ্বারা সবসময় দুটি ভিন্ন বিষয়কে যোগ করা হয় না, বরং অনেক সময় একই বিষয়ের দুটি ভিন্ন ব্যাখ্যাকে বা বিশেষণকেও যোগ করা হয়। তবে ‘ওয়া’ শব্দটির অর্থ ‘এবং’। অন্যদিকে ‘আও’ শব্দের অর্থ দুটি (১) ‘অথবা’ (২) ‘অথবা/এবং’।
ফাইন কানূ = তারপর যদি তারা হয়। আকছারা মিন যালিকা = সেটার চেয়ে বেশি।
‘ফা-ইন কানূ আকছারা মিন যালিকা’ বলতে বুঝায় যদি তারা সেটার চেয়ে বেশি হয় তথা একাধিক হয়। অর্থাৎ একাধিক ভাই হোক বা একাধিক বোন হোক বা ভাই-বোন হোক।
‘ফা-ইন কানূ আকছারা মিন যালিকা’ (৪:১২) এর অনুবাদ অনেকে এভাবে করেন যে, ‘যদি তারা সেটার চেয়ে বেশি হয় তথা দুইয়ের বেশি হয়’। কিন্তু এর পূর্বের অংশে এক ভাই বা এক বোন এর কথা বলা হয়েছে। এখন, সেটার চেয়ে বেশি হওয়ার অর্থ হলো একের চেয়ে বেশি হওয়া তথা একাধিক হওয়া। যেমন,একাধিক ভাই বা একাধিক বোন বা ভাই-বোন। সুতরাং সঠিক অর্থ হবে, যদি তারা সেটার চেয়ে বেশি হয় তথা একের বেশি (বা একাধিক) হয়’।
একাধিক এর ন্যুনতম পরিমাণ হলো দুই। যারা একের বেশি হওয়ার পরিবর্তে দুইয়ের বেশি হওয়ার অনুবাদ করেছেন তাঁরা এক ভাই বা এক বোন এর বিষয়কে মোট দুজন হিসাবে নিয়েছেন, যা যৌক্তিক নয়। এছাড়া, তাঁরা ‘ফালিকুল্লি ওয়াহিদিম মিনহুমা’ এর দ্বারা মনে করেছেন এক ভাই ও এক বোন একসাথে উপস্থিত। অথচ ‘আখুন আও উখতুন’ শব্দগুচ্ছের ‘আও’ শব্দ দ্বারা স্পষ্ট যে, এক ভাই থাকা অবস্থায় কোনো বোন নেই আর এক বোন থাকা অবস্থায় কোনো ভাই নেই, এরূপ অবস্থাও আয়াতে বিবৃত হয়েছে। সুতরাং ‘ফালিকুল্লি ওয়াহিদিম মিনহুমা’ বাক্যাংশের একটি অর্থ হবে, ‘তাদের দুজনের যেই থাকুক সেই একজনের জন্য’। আর ‘ফা-ইন কানূ আকছারা মিন যালিকা’ দ্বারা যেমন ভাই একাধিক হতে পারে, তেমনি বোন একাধিক হতে পারে আবার ভাই-বোন উভয়েও থাকতে পারে, তাতে কোনো আপত্তি নেই। কারণ এখানে ভাই ও বোনদের মধ্য থেকে ভাইদের সাথে বোনেরা থাকতে পারবে না বা বোনদের সাথে ভাইয়েরা থাকতে পারবে না এরূপ কোনো শর্ত প্রযোজ্য নয়। বরং ‘আও’ শব্দের একটি অর্থ ‘অথবা/এবং’ হওয়ায় এক ভাই ও এক বোন মিলে মোট দুজন থাকলেও তাদের প্রত্যেকে সমানভাবে তথা এক ষষ্ঠাংশ ১/৬ করে পাবে, যার স্বাভাবিক যোগফল দাঁড়াচ্ছে তারা উভয়ে মিলে মোট এক তৃতীয়াংশ ১/৩ পাবে।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় যদি একাধিক ভাই বা একাধিক বোন অথবা একাধিক ভাই ও একাধিক বোন থাকে তাহলে তাদের সম্মিলিত অংশ কত হবে? এবং তাতে তারা পরস্পর সমানুপাতে পাবে কিনা? পরবর্তী অংশে যদি তারা এর বেশি হয় তথা একাধিক হয় বিচ্ছিন্নভাবে ভাইয়ের সংখ্যা বা বোনের সংখ্যা বা সম্মিলিতভাবে ভাই ও বোনের সংখ্যা, তবে তারা একত্রে এক তৃতীয়াংশ পাবে, অর্থাৎ এক ভাই ও এক বোন মোট এ দুজনে মিলে যেমন এক তৃতীয়াংশ পায়, এক্ষেত্রেও তাদের জন্য তেমনি মোট এক তৃতীয়াংশই বরাদ্দ থাকবে, তাদের সংমিশ্রণ যেভাবেই হোক না কেন। আর যেহেতু এক ভাই বা এক বোন অথবা মিলিতভাবে এক ভাই ও এক বোন থাকা অবস্থায় এক ভাই ও এক বোন পরস্পর সমানুপাতে পায়, সুতরাং স্বত:সিদ্ধভাবে এক্ষেত্রেও তারা শরিক হবে কথাটির অর্থ হচ্ছে তারা পরস্পর সমানুপাতে/ সমান হারে শরিক হবে। এখানে তাদেরকে অসমান হারে (যেমন ভাই পাবে বোনের দ্বিগুণ এরূপভাবে) দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ফাহুম = তাহলে তারা (হবে)। শুরাকাউ (শরীক এর বহুবচন) = শরিকগণ/ অংশীদারগণ।
৪:১২ আয়াতে বর্ণিত, ‘যদি তারা সেটার অধিক হয় তবে তারা ১/৩ অংশে শরিক হবে’ বলতে বুঝানো হয়েছে একাধিক ভাই বা একাধিক বোন বা ভাই-বোন থাকলে তারা ১/৩ অংশে শরিক হবে। আর এখানে তারা প্রত্যেকে সমানভাবে শরিক হবে। কারণ, বক্তব্যের প্রথম অংশে এক ভাইয়ের জন্য ১/৬ অথবা এক বোনের জন্যও ১/৬ দেয়া হয়েছে তথা ভাই বা বোন যেই হোক উভয়ে একই পরিমাণ পাচ্ছে। সুতরাং এখানে ভাই-বোন মিলিতভাবে থাকলেও তারা পরস্পর সমানভাবে পাবে, এক ভাই দুই বোনের সমান পাবে না।
‘ইসমে কানা/ইয়াকুন’ (‘কানা’ ক্রিয়ার বিশেষ্য) হিসেবে যদি কোনো বিশেষ্য উল্লেখ থাকে তাহলে সেটাই হলো ‘ইসমে কানা’। অন্যথায় ‘হুয়া/হিয়া’ কে ‘ইসমে কানা’ হিসেবে ধরা হয়। আর ‘কানা’ ক্রিয়ার কর্তা (্ইসমে কানা) সম্পর্কে যে তথ্যটি উল্লেখ করা হয় সেটাই হলো ‘খবরে কানা’ (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্য)।
৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে উল্লেখিত ‘ইসমে কানা/ইয়াকুন’ এবং ‘খবরে কানা/ইয়াকুন’
৪:৫ আয়াতে ইয়াতীমরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদের সম্পদের ব্যবস্থাপনাকারী অভিভাবকদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, ওয়ারযুক্বূহুম ফীহা। আর ৪:৮ আয়াতে ওয়ারিস আত্মীয়দের মধ্যে সম্পদ বণ্টনের সময়কালে উপস্থিত ওয়ারিস নয় এমন আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম এবং অভাবগ্রস্তদেরকে বণ্টিত সম্পদ থেকে খরচ করে কিছু দেয়ার জন্য বলা হয়েছে, ফারযুক্বুহুম মিনহু। এই প্রেক্ষিতে ওয়ারযুক্বুহুম ফীহা এবং ফারযুক্বুহুম মিনহু বাক্য দুটির মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন।
ওয়ারযুক্বুহুম ফীহা (সেটার মধ্যে তাদেরকে উপজীবিকা দাও) বাক্যটির অর্থ হলো ইয়াতীমদেরকে তাদের সম্পদের মধ্যে উপজীবিকা দিয়ে যেতে হবে, অর্থাৎ এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সম্পদে তাদের মালিকানা বজায় থাকবে কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মালিকানার প্রয়োগ/ ব্যবস্থাপনা তাদের হাতে থাকবে না, তাই তাদেরকে তাদের সম্পদ থেকে উপজীবিকা দিয়ে যেতে হবে, ব্যবস্থাপনা করবে অন্য কেউ। এতে ইয়াতীমদের সম্পদের ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে তোমাদের সম্পদ শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে, তোমরা (ব্যবস্থাপনা পরিষদ) ও তারা (স্বত্বাধিকারী) মিলে যে ‘বৃহত্তর তোমরা’, এই তোমাদের সম্পদকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে নষ্ট হতে দেয়া যাবে না। যেহেতু সম্পদ সুষ্ঠুভাবে আবর্তিত হলে তা সবার সম্পদে পরিণত হতে থাকে, তাই বিশেষ তাৎপর্যমন্ডিতভাবে একে তোমাদের সম্পদ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ফারযুক্বূহুম মিনহু (তাদেরকে তা থেকে উপজীবিকা দাও) বাক্যটির অর্থ হলো, বণ্টিত সম্পদ থেকে যাদের দ্বারা সাধ্যানুসারে সম্ভব তারা ওয়ারিস নয় এমন আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তদেরকে এককালীন কিছু উপজীবিকার সরবরাহ করতে হবে, অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। একটি কল্যাণ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য এ নির্দেশনা পরিপালনের ক্ষেত্রে লক্ষ রাখা উচিত যে, এটি যেন নামমাত্র আদেশ পালন না হয়, বরং মানবতাবোধ, কল্যাণ মনোভাব এবং আল্লাহর আদেশ পালনে নিষ্ঠার ভিত্তিতে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তদেরকে সাধ্যমতো অনুদান দেয়া উচিত।