উত্তরাধিকারের বিধান

আল কুরআনের আলোকে উত্তরাধিকারের বিধান - ফারায়েজ নামে প্রচলিত বণ্টন বিধি

সম্পদের কল্যাণমূলক সুষম বণ্টন বিধি

অধ্যায় ১৯ : ‘ফারায়েজ’ বা ‘মুসলিম উত্তরাধিকার বিধান’ নামে প্রচলিত বণ্টন বিধি

‘ফারায়েজ’ বা ‘মুসলিম উত্তরাধিকার বিধান’ নামে প্রচলিত বণ্টন বিধি এবং আল কুরআনে উপস্থাপিত বণ্টন বিধির মধ্যে মিল ও অমিলের তুলনামূলক পর্যালোচনার জন্য এ অধ্যায়ে ফারায়েজ বা মুসলিম উত্তরাধিকারের বিধান নামে প্রচলিত বণ্টন বিধি উপস্থাপন করা হলো।

প্রচলিত মতে ফারায়েজের মূল উৎসসমূহ 

প্রচলিত মতে, ফারায়েজের মূল উৎস ৪টি। যথা :

১. আল কুরআন

২. আল হাদীস

৩. ইজমা

৪. কিয়াস।

এছাড়া এর আরো কিছু আনুষঙ্গিক উৎস আছে, যেমন আরবীয় প্রথা এবং কল্যাণ নীতি ইত্যাদি।

ফারায়েজ বিষয়ক মতভেদ ও ভিন্ন ভিন্ন আইন এবং তার কারণ

‘ফারায়েজ’ বা ‘উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি’ নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে সুন্নী আইন ও শিয়া আইনে মতভেদ রয়েছে। এছাড়া সুন্নীদের মধ্যেও হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী ইত্যাদি মতে বিভিন্নতা রয়েছে। এ বিষয়ে তাফসীর ও ফারায়েজের গ্রন্থগুলোতে বিস্তর মতপার্থক্যের উল্লেখ রয়েছে। এর কারণ হিসেবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, সুদ এবং উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আয়াত নবীজীবনের শেষবর্ষে নাজিল হয় এবং এরপর তিনি কিছুদিন মাত্র জীবিত ছিলেন বিধায় এ দুটি বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়ে যেতে পারেননি এবং এজন্য সুদ ও উত্তরাধিকারের বিষয়ে বিস্তর মতভেদের সুযোগ রয়েছে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এ সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে ‘ইয়াতীম নাতির উত্তরাধিকার লাভ’ এবং ‘কালালাহ’ সমস্যার প্রশ্নে।

সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতানুসারে প্রচলিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি

উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি নিয়ে মুসলিম মনীষীদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য থাকায় বিভিন্ন ধারার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতের সমন্বয়ে প্রচলিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি উপস্থাপনই এক নজরে দেখার ক্ষেত্রে যথোপযোগী হবে। তাই নিম্নে বিভিন্ন ধারার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতানুসারে প্রচলিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি উপস্থাপন করা হলো।

প্রচলিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির ভাষ্য অনুযায়ী, আল কুরআনে উল্লেখিত ফারায়েজের মূল ধারাসমূহ 

(১) পুত্র কন্যা এভাবে পাবে যে, এক পুত্র পাবে দুই কন্যার অংশের সমান তথা এক কন্যার দ্বিগুণ। তাদের সাথে অন্য ওয়ারিস না থাকলে তারা সম্পূর্ণ সম্পত্তি পাবে, অন্যথায় তারা অবশিষ্টভোগী হবে।

(২) পুত্র না থাকা অবস্থায় দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যা থাকলে তারা পাবে ২/৩ ।

(৩) পুত্র না থাকা অবস্থায় এক কন্যা থাকলে সে পাবে ১/২ ।

(৪) কন্যা না থাকা অবস্থায় এক বা একাধিক পুত্র থাকলে সে বা তারা সমস্ত সম্পত্তি পাবে যদি অন্য ওয়ারিস না থাকে কিন্তু অন্য ওয়ারিস থাকলে তারা অবশিষ্টভোগী হবে।

(৫) কোনো পুত্র/কন্যা থাকলে মাতা পাবে ১/৬ ।

(৬) কোনো পুত্র/কন্যা থাকলে পিতা পাবে ১/৬ ।

(৭) কোনো পুত্র/কন্যা না থাকলে মাতা পাবে ১/৩ । 

(৮) কোনো পুত্র/ কন্যা না থাকলে কিন্তু একাধিক ভাই বা ভাই-বোন থাকলে মাতা পাবে ১/৬ ।

(৯) কোনো পুত্র/কন্যা না থাকলে, ভাই-বোন থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় পিতা অবশিষ্টভোগী হবে।

(১০) মৃত স্ত্রীর কোনো পুত্র/ কন্যা না থাকলে স্বামী পাবে ১/২ ।

(১১) মৃত স্ত্রীর কোনো পুত্র/কন্যা থাকলে স্বামী পাবে ১/৪ ।

(১২) মৃত স্বামীর কোনো পুত্র/কন্যা না থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৪ ।

(১৩) মৃত স্বামীর কোনো পুত্র/কন্যা থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৮ ।

(১৪) যদি মৃত ব্যক্তির পিতা এবং পুত্র না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির একটি বৈপিত্রেয় ভাই বা একটি বৈপিত্রেয় বোন থাকলে সে পাবে ১/৬ ।

(১৫) যদি মৃত ব্যক্তির পিতা এবং পুত্র না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির একাধিক বৈপিত্রেয় ভাই বা বোন বা ভাই-বোন থাকলে তারা একত্রে পাবে ১/৩  যেখানে ভাই ও বোন পরস্পরের সমান পাবে।

(১৬) যদি মৃত ব্যক্তির পিতা এবং পুত্র না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির ভাই না থাকা অবস্থায় একটি বৈমাত্রেয় বা পূর্ণ আপন বোন থাকলে সে পাবে ১/২ ।

(১৭) যদি মৃত ব্যক্তির পিতা এবং পুত্র না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির ভাই না থাকা অবস্থায় দুই বা দুইয়ের বেশি বৈমাত্রেয় বা পূর্ণ আপন বোন থাকলে তারা পাবে ২/৩ ।

(১৮) যদি মৃত ব্যক্তির পিতা এবং পুত্র না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির বোন না থাকা অবস্থায় এক বা একাধিক বৈমাত্রেয় বা পূর্ণ আপন ভাই থাকলে সে বা তারা সম্পূর্ণ সম্পত্তি পাবে যদি অন্য ওয়ারিস না থাকে, অন্যথায় তারা অবশিষ্টভোগী হবে।

(১৯) যদি মৃত ব্যক্তির পিতা এবং পুত্র না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির বৈমাত্রেয় বা পূর্ণ আপন ভাই-বোন এভাবে পাবে যে, এক ভাই পাবে দুই বোনের অংশের সমান তথা এক বোনের দ্বিগুণ। তাদের সাথে অন্য ওয়ারিস না থাকলে তারা সম্পূর্ণ সম্পত্তি পাবে, অন্যথায় তারা অবশিষ্টভোগী হবে।

ফারায়েজ বন্টনের জন্য ওয়ারিস নির্ধারণের শর্ত

ফারায়েজ বণ্টনের জন্য ওয়ারিস নির্ধারণের শর্ত হচ্ছে মৃত ব্যক্তিকে ওয়ারিসের বা অন্য কথায় ওয়ারিসকে মৃত ব্যক্তির আক্বরাবূন বা নিকটতম আত্মীয় হতে হবে।

ওয়ারিসদের শ্রেণিবিভাগ

কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস অনুসারে ওয়ারিসদেরকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে।

(১) যাবিল ফুরুজ (২) আসাবা (৩) যাবিল আরহাম।

যাবিল ফুরুজ/যা-উইল ফুরুজ (অত্যাবশ্যকীয় অধিকারী)

কুরআনে যাদেরকে ‘নির্ধারিত অংশ’ প্রদান করা হয়েছে তাদেরকে ‘যাবিল ফুরুজ’ বলা হয়। তাঁদের সংখ্যা ১২ জন। নিম্নে ছক আকারে যাবিল ফুরুজের তালিকা উপস্থাপন করা হলো:

আসাবা (অবশিষ্টভোগী)

‘আসাবা’ শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘মাংসপেশী’। ফারায়েজের পরিভাষায় ‘আসাবা’ শব্দের অর্থ হলো ‘অবশিষ্টভোগী’। যাবিল ফুরুজের নির্দিষ্ট অংশ নেয়ার পর যারা অবশিষ্ট অংশ পায় তাদেরকে ‘আসাবা’ বলা হয়। যদি কোনো ‘যাবিল ফুরুজ’ না থাকে তাহলে আসাবাদের মধ্যে সম্পূর্ণ সম্পদ বণ্টিত হয়।

আসাবার শ্রেণিবিভাগ

আসাবা দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা:

(১) যাবিল ফুরুজের মধ্য থেকে কেউ কেউ কোনো অবস্থায় আসাবা হিসেবে সাব্যস্ত হয়। এদের সংখ্যা ছয়জন। তাদের তালিকা হলো: ১. পিতা, ২. দাদা এবং তাদের ঊর্ধ্বক্রম, ৩. কন্যা, ৪. পুত্রের কন্যা এবং তাদের নিম্নক্রম, ৫. পূর্ণ আপন বোন, ৬. বৈমাত্রেয় বোন।

(২) যারা যাবিল ফুরুজ নয় কিন্তু মৃত ব্যক্তির সাথে কোনো পুরুষ আত্মীয়ের মাধ্যমে তাদের রক্তসম্পর্ক আছে। যেমন, চাচা ও ফুফু।

যেহেতু মৃত ব্যক্তির সাথে তার বৈপিত্রেয় ভাই-বোন একজন মহিলার মাধ্যমে অর্থাৎ মাতার মাধ্যমে সম্পর্কিত, তাই তারা আসাবার তালিকাভুক্ত নয়।

যাবিল ফুরুজ ও আসাবাদের মধ্যে বণ্টনের নীতিমালা

(১) যাবিল ফুরুজ (স্বামী/স্ত্রী ছাড়া) ও যাবিল ফুরুজের মধ্যকার আসাবা জীবিত থাকলে অন্য আসাবারা বঞ্চিত হবে।

(২) পিতা জীবিত থাকলে ভাই-বোন বঞ্চিত হবে। তবে মাতা জীবিত থাকলেও বৈপিত্রেয় ভাই-বোন বঞ্চিত হবে না। কারণ মাতা সমস্ত সম্পত্তি পাবেন না, বরং তিনি আংশিকভাবে যাবিল ফুরুজ হিসাবে এবং আংশিকভাবে রদ্দ নীতির মাধ্যমে পাবেন।

(৩) রক্তের নিকটতম আত্মীয়ের কারণে দূরবর্তী আত্মীয় বঞ্চিত হবেন। তাই পিতা জীবিত থাকলে দাদা বঞ্চিত হবেন, মাতা জীবিত থাকলে দাদী বঞ্চিত হবেন এবং পুত্র জীবিত থাকলে পৌত্র-পৌত্রী বঞ্চিত হবে। তবে কোনো পুত্র না থাকলে শুধু কন্যাদের কারণে পৌত্র-পৌত্রী বঞ্চিত হবে না। মৃত ব্যক্তির কোনো পুত্র থাকা অবস্থায় তার ইয়াতীম নাতি দাদার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। অর্থাৎ ইয়াতীম নাতির চাচা তার বঞ্চিত হওয়ার কারণ হবে।

(৪) যাবিল ফুরুজের মধ্যে বণ্টনের সময় অবশিষ্ট থাকলে বা ঘাটতি পড়লে রদ্দ বা আউল নীতির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

(৫) স্বামী/স্ত্রী আউলের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ তাদের অংশ হ্রাস করা যেতে পারে। কিন্তু স্বামী/স্ত্রী রদ্দের অন্তর্ভুক্ত নয় অর্থাৎ তাদের অংশ বৃদ্ধি করা যেতে পারে না।

প্রথম শ্রেণির আসাবাদের তালিকা

১. পুত্র

২. কন্যা: ১ অবস্থায় আসাবা

(ক) যদি পুত্রের সাথে থাকে

৩. পিতা: ২ অবস্থায় আসাবা

(ক) যদি শুধু অধস্তন নারী (কন্যা, পৌত্রী ইত্যাদি) থাকে

(খ) যদি কোনো অধস্তন না থাকে।

৪. দাদা: ২ অবস্থায় আসাবা

(ক) যদি অধস্তন নারী (কন্যা, পৌত্রী ইত্যাদি) থাকে

(খ) যদি কোনো অধস্তন না থাকে

৫. পৌত্রী: ১ অবস্থায় আসাবা

(ক) যদি মৃতের শুধু কন্যা থাকে

৬. পূর্ণ আপন বোন: ২ অবস্থায় আসাবা

(ক) পূর্ণ আপন বা বৈমাত্রেয় ভাইয়ের সাথে

(খ) যদি শুধু অধস্তন নারী (কন্যা, পৌত্রী) থাকে

৭. বৈমাত্রেয় (পিতৃশরিক) বোন: ২ অবস্থায় আসাবা

(ক) পূর্ণ আপন বা বৈমাত্রেয় ভাইয়ের সাথে

(খ) যদি শুধু অধস্তন নারী (কন্যা, পৌত্রী) থাকে

৮. দাদী: ১ অবস্থায় আসাবা

(ক) যদি পিতা না থাকে কিন্তু মাতা থাকে

যেসব যাবিল ফুরুজের অংশ কখনো কখনো শূন্য:

১. দাদা: পিতা থাকলে দাদা বঞ্চিত হবে

২. বৈপিত্রেয় (মাতৃশরিক) ভাই: ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন থাকলে বৈপিত্রেয় ভাই বঞ্চিত হবে

৩. পৌত্রী: পুত্র থাকলে পৌত্রী বঞ্চিত হবে

৪. পূর্ণ আপন বোন: ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন পুরুষ থাকলে পূর্ণ আপন বোন বঞ্চিত হবে

৫. বৈমাত্রেয় (পিতৃশরিক) বোন: ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন পুরুষ থাকলে বৈমাত্রেয় বোন বঞ্চিত হবে

৬. বৈপিত্রেয় (মাতৃশরিক) বোন: ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন থাকলে বৈপিত্রেয় বোন বঞ্চিত হবে

৭. দাদী: পিতা ও মাতা উভয়ে থাকলে দাদী বঞ্চিত হবে

আসাবার ক্রমিক বিন্যাস

১. পুত্র -- পৌত্র -- প্রপৌত্র -- পিতা -- দাদা -- পরদাদা -- ভাই -- ভাতিজা -- ভাতিজা পুত্র -- চাচা -- চাচাতো ভাই -- চাচাতো ভাইয়ের পুত্র। (ক্রম অনুসারে আসাবা হবে, যেমন, পুত্র থাকলে পৌত্র আসাবা হবে না)

২. কন্যা (পুত্রের সাথে থাকলে) -- পৌত্রী -- পূর্ণ আপন বোন ও বৈমাত্রেয় (পিতৃশরিক) বোন।

যাবিল আরহাম (মেয়েলোকের সূত্রে রক্তসম্পর্কের আত্মীয়)

‘যাবিল আরহাম’ শব্দের অর্থ হলো ‘রক্তসম্পর্কের আত্মীয়’। কুরআন অনুসারে সকল রক্তসম্পর্কের আত্মীয়কে উলুল আরহাম বলা হলেও ফারায়েজর পরিভাষায় শুধুমাত্র মেয়েলোকের সূত্রে রক্তসম্পর্কের আত্মীয়রাই যাবিল আরহাম (উলুল আরহাম) হিসেবে সাব্যস্ত হয়। ‘আরহাম’ শব্দটি হচ্ছে রহিম বা রেহেম শব্দের বহুবচন। রেহেম অর্থ স্ত্রীলোকের গর্ভাশয়, রক্তসম্পর্কের আত্মীয়তা। ফারায়েজের পরিভাষা অনুসারে যারা ‘যাবিল ফুরুজ’ বা ‘আসাবা’ নয় এমন রক্তসম্পর্কের আত্মীয়গণকে ‘যাবিল আরহাম’ বলা হয়।

যাবিল আরহামের মধ্যে বন্টনের নীতিমালা

(১) যখন কোনো নসব যাবিল ফুরুজ (অর্থাৎ স্বামী/স্ত্রী ছাড়া অন্য যাবিল ফুরুজ) অথবা আসাবা জীবিত নেই শুধু সে অবস্থায় যাবিল আরহাম পায়।

(২) কিন্তু যদি স্বামী বা স্ত্রী জীবিত থাকে এবং কোনো আসাবা না থাকে, তাহলে স্বামী বা স্ত্রী নির্ধারিত পূর্ণ অংশ পায় এবং অবশিষ্ট অংশ যাবিল আরহাম পায়।

(৩) নিকটবর্তী যাবিল আরহাম দূরবর্তী যাবিল আরহামকে বঞ্চিত করে।

(৪) একই স্তরের দাবিদারদের মধ্যে যারা মৃত ব্যক্তির সাথে যাবিল ফুরুজের বা আসাবার মাধ্যমে সম্পর্কিত তারা অগ্রাধিকার পাবে।

(৫) পিতৃকুল এবং মাতৃকুলের দাবিদার থাকলে পিতৃকুলের দিকে ২/৩  এবং মাতৃকুলের দিকে ১/৩  দিতে হবে। যেমন পিতার মাতার পিতা পাবেন ২/৩  এবং মাতার মাতার পিতা পাবেন ১/৩ ।

(৬) মাতার পিতার পিতা পাবে ২/৩  এবং মাতার পিতার মাতা পাবে ১/৩  কারণ তাঁরা উভয়ে মাতৃকুলের দাবিদার এবং মৃত ব্যক্তির মধ্যবর্তী ঊর্ধ্বতন হচ্ছেন একই জন তথা মা (একই লিঙ্গের), তাই নানা পুরুষ বিধায় ২/৩  ও নানী নারী বিধায় ১/৩  পাবে।

যাবিল আরহামের শ্রেণিবিভাগ

যাবিল আরহাম চার শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা:

(১) মৃত ব্যক্তির বংশধরগণ (যারা যাবিল ফুরুজ বা আসাবা নয়)

(২) মৃত ব্যক্তির পূর্ব পুরুষগণ (যারা যাবিল ফুরুজ বা আসাবা নয়)

(৩) মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতার বংশধরগণ (যারা যাবিল ফুরুজ বা আসাবা নয়)

(৪) মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতার ঊর্ধ্বক্রমের পূর্ব পুরুষগণ (যারা যাবিল ফুরুজ বা আসাবা নয়)

যাবিল আরহাম চার শ্রেণির বিস্তারিত তালিকা 

প্রথম শ্রেণি: (১) কন্যার সন্তান এবং তাদের বংশধরগণ। (২) পুত্রের কন্যার সন্তান এবং তাদের বংশধরগণ। যতই নিম্নক্রম হোক।

দ্বিতীয় শ্রেণি: (১) নানা নানীগণ যতই ঊর্ধ্বক্রম হোক (২) তাঁদের পূর্ব পুরুষগণ যতই ঊর্ধ্বক্রম হোক।

তৃতীয় শ্রেণি: (১) পূর্ণ আপন ভাইয়ের কন্যা এবং তার বংশধরগণ (২) বৈমাত্রেয় ভাইয়ের কন্যা এবং তার বংশধরগণ (৩) পূর্ণ আপন ভাইয়ের পুত্রের কন্যা যতই নিম্নœক্রম হোক, তারা এবং তাদের বংশধরগণ (৪) বৈমাত্রেয় ভাইয়ের পুত্রের কন্যা, যতই নিম্নক্রম হোক তারা এবং তাদের বংশধরগণ (৫) পূর্ণ আপন, বৈমাত্রেয়, বৈপিত্রেয় বোনদের সন্তান এবং তাদের বংশধরগণ।

চতুর্থ শ্রেণি: (১) পিতার পূর্ণ আপন ভাইয়ের কন্যা এবং তার বংশধরগণ (২) পিতার বৈমাত্রেয় ভাইয়ের কন্যা এবং তার বংশধরগণ (৩) পিতার বৈপিত্রেয় ভাইয়েরা, তাদের সন্তান এবং তাদের বংশধরগণ (৪) পিতার পূর্ণ আপন ভাইয়ের পুত্রগণের কন্যাগণ, যতই নিম্নক্রম হোক, তারা এবং তাদের বংশধরগণ (৫) পিতার বৈমাত্রেয় ভাইয়ের পুত্রের কন্যাগণ যতই নিম্নক্রম হোক, তারা এবং তাদের বংশধরগণ (৬) পিতার পূর্ণ আপন, বৈমাত্রেয়, বৈপিত্রে বোন, তাদের সন্তান এবং তাদের বংশধরগণ (৭) মাতার মাতা, বোনেরা, তাদের সন্তান, তাদের বংশধরগণ এবং পূর্ব পুরুষগণ, যতই ঊর্ধ্বক্রম হোক তাদের বংশধরগণ।

আউল ও রদ্দ নীতি

‘আউল’ মানে ‘বৃদ্ধি’। যখন অংশগুলোর যোগফল একটি ভগ্নাংশ হয় যার লব বড়, হর ছোট, তখন হরকে লবের সমান করে নিতে হয় তথা হরের মধ্যে বৃদ্ধি করতে হয় এটাকে ‘আউল’ বলে। যেমন, মৃত ব্যক্তি রেখে গেছেন স্বামী ও তিন বোন। তাহলে স্বামীর অংশ + তিন বোনের অংশ = ১/২  + ২/৩  = ৭/৬ । এ অবস্থায় স্বামীকে দিতে হবে ৩/৭  এবং তিন বোনকে দিতে হবে ৪/৭ ।

‘রদ্দ’ অর্থ ‘ফেরত দেয়া বা ফিরিয়ে দেয়া’। ‘রদ্দ’ হলো আউলের বিপরীত। যখন অংশগুলোর যোগফল একটি ভগ্নাংশ হয় যার লব ছোট, হর বড়, তখন হরকে হ্রাস করে লবের সমান করতে হয়। এটাকে ‘রদ্দ’ বলে।

যাবিল ফুরুজের মধ্যকার আসাবা না থাকা অবস্থায় বণ্টন বিধি অনুযায়ী যোগফল ১ এর চেয়ে কম বা বেশি হলে যাবিল ফুরুজের মধ্যে আউল বা রদ্দ হয়।

স্বামী/স্ত্রী আউলের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ তাদের অংশ হ্রাস করা যেতে পারে। কিন্তু তারা রদ্দের অন্তর্ভুক্ত নয় অর্থাৎ তাদের অংশ বৃদ্ধি করা যেতে পারে না। অর্থাৎ স্বামী/ স্ত্রী কেউই অন্য কোনো উত্তরাধিকারীর বর্তমানে (সে যাবিল ফুরুজ বা আসাবা বা যাবিল আরহাম যে-ই হোক) ফেরতের অংশ লাভের অধিকারী নয়। তবে যদি অন্য কোনো উত্তরাধিকারী না থাকে, শুধুমাত্র সে ক্ষেত্রে স্বামী/স্ত্রী ফেরতের অংশ লাভের অধিকারী হয়।

কালালাহ সমস্যা এবং হিমারিয়া বা গাধা সমাচার নীতি

কালালাহ কাকে বলে সে সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকায় এ বিষয়ে ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে। কালালাহ কি মৃত ব্যক্তি, নাকি তার ভাই বোন, চাচা মামা, ফুফু খালা প্রমুখ তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মৃত ব্যক্তিকে কোন অবস্থায় কালালাহ হিসেবে সাব্যস্ত করা হবে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ মনে করেন যার পিতা নেই সে কালালাহ। অন্য কেউ মনে করেন যার পুত্র নেই সে কালালাহ। তবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ সংজ্ঞা হচ্ছে যার পিতা ও পুত্র নেই সে কালালাহ।

আবার কালালাহর ভাই-বোনদের মধ্যে পূর্ণ আপন, বৈমাত্রেয় এবং বৈপিত্রেয় ভাই-বোনদের কে কোন আয়াত (৪:১২ অথবা ৪:১৭৬) অনুযায়ী পাবে, তা নিয়েও মতভেদ রয়েছে। অনেক মনীষী মনে করেন যে, ৪:১৭৬ আয়াতের মাধ্যমে ৪:১২ আয়াতের দ্বিতীয়ার্ধ তথা কালালাহ সম্পর্কিত অংশ মানছুখ বা রহিত হয়ে গেছে।

তবে শেষ পর্যন্ত ইজমা কিয়াসের মাধ্যমে কালালাহ বিষয়ে যে মতটি সবচেয়ে বেশি গৃহীত হয়েছে তা হলো: (১) মৃত ব্যক্তির পিতা ও পুত্র না থাকলে তাকে কালালাহ বলে। (২) কালালাহর বৈপিত্রেয় ভাই-বোনেরা ৪:১২ আয়াত অনুসারে প্রাপক হবে। (৩) কালালাহর পূর্ণ আপন ও বৈমাত্রেয় ভাই-বোনেরা ৪:১৭৬ আয়াত অনুসারে প্রাপক হবে।

কালালাহ সমস্যার একটি মামলায় হযরত উমার ফারুকের রায়ের মাধ্যমে হিমারিয়া বা গাধা সমাচার নীতির প্রবর্তন ঘটে।

হিমারিয়া বা গাধা সমাচার নীতি সম্পর্কিত মামলার বিবরণ নিম্নরূপ:

দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমার (রা.) এর শাসনামলে তাঁর কাছে উত্তরাধিকার নিয়ে একটি মোকদ্দমা হয়। মোকদ্দমাটি নিম্নরূপ:

মাতা, স্বামী, ২ জন বৈপিত্রেয় ভাই, ২ জন পূর্ণ আপন ভাই ভাই।

খলিফা রায় দেন যে, কুরআন অনুসারে মাতা, স্বামী ও বৈপিত্রেয় ভাই যাবিল ফুরুজ এবং সহোদর ভাই আসাবা।

সুতরাং,

মাতা পাবে = ১/৬

স্বামী পাবে = ১/২  

২ জন বৈপিত্রেয় ভাই পাবে = ১/৩

তাদের অংশের যোগফল = ১/৬  + ১/২  + ১/৩  = ১/৬  + ৩/৬  + ২/৬  = ৬/৬  = ১

কোনো অংশ অবশিষ্ট নেই।

সুতরাং ২ জন পূর্ণ আপন ভাই পাবে = ০। অর্থাৎ পূর্ণ আপন দুই ভাই কিছুই পাবে না।

তখন সহোদর বা পূর্ণ আপন ভাইয়েরা পুনর্বিবেচনা বা ন্যায়বিচারের প্রার্থনা করে। জবাবে খলিফা জানান যে, কুরআন অনুযায়ী বণ্টন হয়েছে, তাই তাঁর কিছুই করার নেই।

তখন পূর্ণ আপন ভাইয়েরা আরজ করে যে, হে আমিরুল মু’মিনীন, মৃত ব্যক্তির আপন ভাই হওয়ার জন্য যখন আমরা উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছি, তখন না হয় ধরে নিন, আমাদের পিতা কোনো হিমার বা গাধা (অর্থাৎ কোনো মানুষ আমাদের পিতা নয়), তাহলে কি আমরা বৈপিত্রেয় ভাইদের সাথে উত্তরাধিকার পেতে পারি না? আর এটা কেন হবে যে, যাদের পিতা এক তারা তো পাবে, কিন্তু যাদের পিতা ও মাতা উভয়ে এক তারা কিছুই পাবে না?

এ কথায় খলিফা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে ন্যায়বিচার বা কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে বৈপিত্রেয় ভাইদের প্রাপ্য ১/৩  অংশ থেকে অর্ধেক সহোদর ভাইদেরকে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন।

উল্লেখিত অবস্থায় খলিফা উমরের রায় অনুসারে সমাধান করার পদ্ধতি শরীয়তে ‘হিমারিয়া বা গাধা নীতি’ নামে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে।

প্রচলিত মতে উত্তরাধিকারের বিধান (৪:১১-১২) দ্বারা যেসব আয়াত মানছুখ (রহিত) হয়েছে

প্রচলিত মতে, উত্তরাধিকারের বিধান (৪:১১-১২) দ্বারা ২:১৮০-১৮২, ২:২৪০ এবং ৪:৮ আয়াত রহিত হয়েছে। এর মধ্যে ২:১৮০-১৮২ আয়াত হচ্ছে ওয়াসিয়াতের বিধান সম্বলিত এবং ৪:৮ আয়াত হচ্ছে উত্তরাধিকার বণ্টনকালে উলুল কুরবা/ (ওয়ারিস নয় এমন) আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীন উপস্থিত হলে তাদেরকে তা থেকে উপজীবিকা হিসেবে কিছু দেয়ার নির্দেশ।

প্রচলিত মতে, ৪:১১-১২ আয়াত দ্বারা ২:১৮০-১৮২ আয়াতে থাকা ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাতের বিধান মানছুখ বা রহিত হয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র যারা ওয়ারিস নয় তাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা মুস্তাহাব এবং হাদীস মতে তা এক তৃতীয়াংশ বা এক চতুর্থাংশে সীমিত হতে হবে।

প্রচলিত মতে, ২:২৪০ আয়াতে প্রদত্ত বিধবাদের জন্য এক বছরের ভরণপোষণের ওয়াসিয়্যাত ২:২৩৪ আয়াতে বর্ণিত বিধবাদের চারমাস দশদিনের ইদ্দাতের বিধান দ্বারা এবং ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত স্ত্রীর জন্য প্রদত্ত উত্তরাধিকারের অংশের দ্বারা রহিত হয়ে গেছে।

প্রচলিত মতে উত্তরাধিকারের কিছু বিশেষ ধারা

(১) কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিমের ওয়ারিস হবে না এবং কোনো অমুসলিম কোনো মুসলিমের ওয়ারিস হবে না।

(২) হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির ওয়ারিস হবে না। (এ বিধির উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়, কেউ তাড়াতাড়ি উত্তরাধিকার পাওয়ার জন্য যেন কাউকে হত্যা করতে উদ্যত না হয় সেজন্যই এ বিধি প্রণীত হয়েছে।)

(৩) জারজ সন্তান ওয়ারিস হবে না। ইত্যাদি।

অধ্যায় ২০ : প্রচলিত ফারায়েজ: আপত্তি, জবাব ও পর্যালোচনা

এ অধ্যায়ে প্রচলিত ফারায়েজের উপর ভিত্তি করে যেসব আপত্তি রয়েছে তার জবাব এবং কুরআনের আলোকে প্রচলিত ফারায়েজের পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হলো:

মুসলিম উত্তরাধিকার বিধান সম্পর্কিত মৌলিক আপত্তিসমূহ

প্রচলিত ফারায়েজ বা মুসলিম উত্তরাধিকার বিধান ও আয়াতের সরল অনুবাদের পার্থক্য সাপেক্ষে ইসলামী উত্তরাধিকার বন্টন বিধির বিষয়ে উত্থাপিত মৌলিক আপত্তিসমূহ নিম্নরূপ:

(১) কুরআনে প্রদত্ত উত্তরাধিকার বন্টন বিধিতে বর্ণিত অংশগুলোর যোগফল কোনো অবস্থায় সমস্ত হয়, কিন্তু কোনো অবস্থায় সমস্তের চেয়ে বেশি হয় এবং কোনো অবস্থায় সমস্তের চেয়ে কম হয়, যার সমাধানের জন্য আউল ও রদ্দ নীতি চালু করা হয়েছে, যা কুরআনে প্রদত্ত বন্টন বিধির একটি কৃত্রিম সংশোধন। তাহলে মানুষ কি আল্লাহর বিধান মানবে, না তাঁর বিধানে থাকা ত্রুটি সংশোধন করে যে মানবীয় বিধান তা মানবে? (নাউযুবিল্লাহ)।

(২) প্রচলিত মতে, ৪:১১-১২ ও ৪:১৭৬ দ্বারা ২:১৮০-১৮২, ২:২৪০, ৪:৮ রহিত হয়েছে এবং ৪:১৭৬ দ্বারা ৪:১২ এর দ্বিতীয়াংশ (কালালাহ এর সাথে সম্পর্কিত অংশ) রহিত হয়েছে। এটি কি প্রমাণ করে না যে, কুরআনে স্ববিরোধ রয়েছে?

(৩) মুসলিম উত্তরাধিকার বন্টন বিধি অনুসারে, মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা থাকা অবস্থায় তার ইয়াতীম নাতি নাতিনদেরকে বঞ্চিত করা হয়। এটি মানবতাবোধকে আহত করে। কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন যে, একটি পাইপের মাঝখানে কাটা পড়লে উপরের অংশ থেকে নিচের অংশে কিছু পৌঁছবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দাদা যদি ইয়াতীম নাতির উত্তরাধিকারী হতে পারে, ইয়াতীম নাতি কেন দাদার উত্তরাধিকারী হতে পারে না? যদি পাইপের মাঝখানে কাটা পড়ে তাহলে নিচের অংশ থেকে উপরের অংশেও কিছু পৌঁছবে না। কেউ কেউ সুপারিশ করেন যে, যদি সম্পত্তি বন্টনের পর কিছু বাকি থাকে তাহলে ইয়াতীমদেরকে দেয়া যেতে পারে। যেহেতু প্রচলিত মতে ২:১৮০-১৮২ এবং ৪:৮ এখন ওয়াজিব নয় বরং মানসুখ বা রহিত; তাই আয়াত দুটির বিধানকে বাধ্যতামূলক হিসেবে নয় বরং মুস্তাহাব/ঐচ্ছিক হিসেবে ইয়াতীম নাতির জন্য কার্যকর করা যেতে পারে। কেউ কেউ বলেন যে, ইয়াতীম নাতি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও তারা ইয়াতীমদের বিষয়ে কুরআনের সাধারণ নির্দেশনা অনুসারে সদাচার প্রাপ্ত হবে। এসব জবাবী সুপারিশকে ইয়াতীমদের বাস্তব অসহায়ত্বের মোকাবেলায় নামমাত্র সান্ত¡নার চেয়ে বেশি কিছু বলা যায় কি?

(৪) প্রচলিত দাবি হচ্ছে, কুরআনের আইন অনুযায়ী যে অবস্থায় পূর্ণ আপন/ পিতৃমাতৃশরিক ভাই-বোন উত্তরাধিকার পায় না কিন্তু বৈপিত্রেয় তথা মাতৃশরিক ভাই-বোন উত্তরাধিকার পায়, এরূপ একটি মোকদ্দমায় ন্যায়বিচার ও কল্যাণ সাধনের জন্য খলিফা হযরত উমার (রা) হিমারিয়া বা গাধা সমাচার নীতি প্রবর্তন করে পূর্ণ আপন ভাই-বোনকে বৈপিত্রেয় ভাই-বোনের সম-অংশীদার করে দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, যদি কুরআনের আইনে ন্যায়বিচার না হয় না হবে, খলিফা উমর কুরআনের আইনের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু প্রবর্তন করার অধিকার রাখেন কি? আর প্রকৃতই ন্যায়বিচারের পরিপন্থী আইন কুরআনে রয়েছে নাকি আইনটিকে বুঝতে বা বুঝাতে গিয়ে ভুল করা হয়েছে? এ প্রসঙ্গের সাথে সম্পূরক আরেকটি প্রশ্ন হলো, যদি কুরআনের আইনে না থাকা সত্ত্বেও ন্যায়বিচারের স্বার্থে পূর্ণ আপন ভাই-বোনকে উত্তরাধিকার দেয়া যায়, তাহলে একইভাবে কুরআনের আইনে না থাকা সত্ত্বেও ন্যায়বিচারের স্বার্থে ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার দেয়া যাবে না কেন?

(৫) প্রচলিত মতে, আসাবা বা অবশিষ্টভোগী হবে কোনো পুুরুষের মাধ্যমে সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজন এবং তাদের বর্তমানে যাবিল আরহাম তথা কোনো নারীর মাধ্যমে সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজন বঞ্চিত হবে। এ ধরনের বণ্টন কি যথার্থ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত?

মৌলিক আপত্তিসমূহের জবাব

প্রথম আপত্তির জবাব

আউল বা রদ্দ নীতি কুরআনের আয়াতে প্রদত্ত বিধির সংশোধন নয়। বরং কুরআনে প্রদত্ত বন্টন বিধির সঠিক উপলব্ধিই হচ্ছে এই যে, কুরআনে থাকা অংশগুলো প্রত্যেকের শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ, যা সমস্ত সম্পদ নির্দিষ্টকৃত ওয়ারিসদের মধ্যে বন্টনের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে। কারণ আয়াতের তথ্যভিত্তিক দুটি শর্ত হলো: কোনো সম্পদ অবন্টিত থাকবে না এবং নির্দিষ্টকৃত ওয়ারিসদের বাহিরেও বন্টিত হবে না। এ দুটি শর্ত পূরণের একমাত্র গাণিতিক বণ্টন পদ্ধতি হলো আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি।

আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতির একটি গাণিতিক মডেল হচ্ছে হচ্ছে আউল ও রদ্দ নীতি, তবে শর্ত হচ্ছে তা সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে, যাতে কোনো ক্ষেত্রে অবশিষ্টাংশ বলে কিছু না থাকে। বর্তমানে প্রচলিত আউল বা রদ্দ নীতি এ শর্ত মেনে প্রয়োগ করা হয় না। বর্তমানে যে ধরনের মূলনীতি অনুসরণ করে আউল ও রদ্দ নীতি প্রয়োগ করা হয় তার পরিপ্রেক্ষিতে যৌক্তিকভাবে উপরিউক্ত আপত্তিটি তৈরি হয়েছে।

আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি অধ্যায়ে এ পদ্ধতির প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুত কুরআনের বন্টন পদ্ধতির বিষয়ে অভিযোগের পিছনে দুটি কারণ দায়ী। একটি কারণ হলো- কুরআনের বন্টন পদ্ধতি বুঝতে না পারা। অন্য কারণটি হলো- যারা কুরআনের ধারক বাহক তারা এর সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন ও অনুসরণ না করা বরং এমন বিধি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যা কুরআনের বিধি ব্যবস্থা থেকে বিচ্যুত হওয়া সত্ত্বেও সেটাকে কুরআনের বিধি ব্যবস্থা মনে করা।

দ্বিতীয় আপত্তির জবাব

কুরআন স্বয়ং তার মধ্যে স্ববিরোধ না থাকার বিষয়ে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে যে, যদি এটি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো রচিত হতো তবে এতে স্ববিরোধ থাকতো, অর্থাৎ এতে স্ববিরোধ পাওয়া যাবে না (৪:৮২)। যদি আপাত স্ববিরোধ মনে হয় তা ধর্তব্য নয়, কারণ চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আপাত স্ববিরোধের সমাধান হয়ে সুসমঞ্জস তথ্য উদ্ঘাটিত হয়।

যেহেতু কুরআনে স্ববিরোধ নেই তাই কুরআনের কোনো আয়াত অন্য আয়াত দ্বারা রহিত হতে পারে না। কুরআনে কোনো রহিত আয়াত না থাকার বিষয়টি বিভিন্নভাবে প্রমাণ করা যায়, তার মধ্যে কুরআনের স্ববিরোধমুক্ততার যুক্তিটি অন্যতম।

উত্তরাধিকারের আয়াত দ্বারা যেসব আয়াত রহিত হয়েছে বলে প্রচলিত মতে দাবি করা হয় প্রকৃতপক্ষে এসব আয়াতে কোনো স্ববিরোধ নেই এবং তাই কোনো আয়াত রহিত হওয়ার দাবিটি সঠিক নয়।

যেমন  ৪:১১-১২ আয়াতে চারবার বলা হয়েছে যে, উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি কার্যকর করতে হবে ওয়াসিয়্যাতের দাবি পুরণ ও ঋণ পরিশোধের পরে। সুতরাং ৪:১১-১২ আয়াত দ্বারা ২:১৮০-১৮২ আয়াতে বিধিবদ্ধ ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হয়নি বরং বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।

অনুরূপভাবে ৪:৮ আয়াতে উত্তরাধিকার বণ্টনকালে (বণ্টনের অব্যবহিত পরে) সাধারণ আত্মীয়-স্বজন (উলুল ক্বুরবা), ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তদেরকে তা থেকে উপজীবিকা হিসেবে কিছু দেয়ার যে আদেশ রয়েছে তাও উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির সম্পূরক নির্দেশ, সুতরাং অবশ্যই তা পরিপালন করতে হবে।

তৃতীয় আপত্তির জবাব

পিতা না থাকা অবস্থায় দাদাকে নাতির সম্পদের ওয়ারিস করা অথচ ইয়াতীম নাতিকে (তার চাচার উপস্থিতিতে) দাদার সম্পদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা একটি অযৌক্তিক ও স্ববিরোধী ব্যবস্থা।

প্রকৃতপক্ষে পিতা জীবিত না থাকা অবস্থায় যেমন দাদা নাতির সম্পদের উত্তরাধিকার পায়, তেমনি ইয়াতিম নাতিও দাদার সম্পদের উত্তরাধিকার পাবে, এক্ষেত্রে ঐ নাতির কোনো চাচা তাকে বঞ্চিত করতে পারবে না।

‘আক্বরাবূন’ (নিকটতম আত্মীয়) শব্দের ব্যাপকতার মাত্রা এবং স্তরগত মাত্রা বিবেচনায় ওয়াসিয়্যাত এবং উত্তরাধিকার উভয়ক্ষেত্রে দাদা ও নাতি পরস্পরের আক্বরাবূন হিসেবে সাব্যস্ত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইয়াতীম নাতিকে ওয়ারিস সাব্যস্ত করার বিষয়টি তার অসহায়ত্ব বিবেচনায় নয়, বরং সে তার নিজ পিতার অনুপস্থিতিতে পিতার আনুপাতিক অংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হওয়ার বিবেচনায় প্রযোজ্য। অর্থাৎ দাদা যেমন তার নাতির ওয়ারিস হয় যদি নাতির পিতা জীবিত না থাকে, অনুরূপভাবে নাতি তেমনি তার দাদার ওয়ারিস হয় যদি নাতির পিতা জীবিত না থাকে। ইয়াতীম নাতির উত্তরাধিকার অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

আর ইতোপূর্বেই স্পষ্ট করা হয়েছে যে, কুরআনের কোনো আয়াত রহিত হওয়ার দাবি সঠিক নয়। সুতরাং ২:১৮০-১৮২ এবং ৪:৮ আয়াতের বিধান অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে।

চতুর্থ আপত্তির জবাব

প্রকৃতপক্ষে হিমারিয়া বা গাধা সমাচার নীতির প্রবর্তনের যে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে তা সঠিক নয়। কারণ কুরআনের বক্তব্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে কালালাহর সংজ্ঞা এবং ভাই-বোনের প্রাপ্য নির্ণয় করলে দেখা যায় যে, হিমারিয়া বা গাধা সমাচার মোকদ্দমার প্রাথমিক ও চূড়ান্ত রায়ের একটিও সঠিক ছিল না। বরং ঐ মোকদ্দমায় মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকায় তার পূর্ণ আপন ও বৈপিত্রেয় ভাইয়েরা ৪:১৭৬ আয়াত অনুসারে পরস্পর সমান হারে ওয়ারিস হতো। অথচ কথিত মোকদ্দমায় প্রাথমিক রায়ে পূর্ণ আপন ভাই-বোনকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং চূড়ান্ত  রায়ে তাদেরকে ৪:১২ আয়াত অনুসারে বৈপিত্রেয় ভাই-বোনদের সাথে সমান অংশীদার করে বণ্টন করা হয়েছে। কালালাহ বা ভাই-বোন উত্তরাধিকার পাওয়ার পূর্বশর্ত অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

এছাড়া কুরআনের বিধানে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী বিধান থাকা এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে কুরআনের বিধানের পরিবর্তে অন্য বিধান জারি করা প্রয়োজন হয়েছিল বলে দাবি করা বিশ^প্রভুর প্রতি একটি মিথ্যা দোষারোপ, যা অমার্জনীয় অপরাধ। কারণ আল্লাহর বাণী সত্য বিধান ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ (৬:১১৫)।

পঞ্চম আপত্তির জবাব

প্রকৃতপক্ষে এই আসাবা এবং যাবিল ফুরুজ সম্পর্কিত বণ্টন যথার্থ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয় তথা কুরআনের আয়াতে প্রদত্ত নির্দেশনার সঠিক উপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।

কুরআনে ৮:৭৫ ও ৩৩:৬ আয়াতে ‘উলুল আরহাম’ তথা রক্তসম্পর্কের আত্মীয়দেরকে (উত্তরাধিকারের প্রশ্নে) পরস্পরের প্রতি অগ্রাধিকারী (আওলা) বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। অন্য কথায়, পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা ও ভাই-বোনকে ‘উলুল আরহাম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ প্রচলিত বণ্টন বিধিতে ‘যাবিল আরহাম’ বা ‘উলুল আরহাম’ বলতে চিহ্নিত করা হয় কথিত ‘আসাবা’দের কেউ না থাকলে কোনো নারীর মাধ্যমে সম্পর্কিত অন্য আত্মীয়দেরকে। সুতরাং এটি গ্রহণযোগ্য নয়।

৪:৭ আয়াত অনুসারে কুরআনে বর্ণিত প্রত্যেক নারী-পুরুষ ওয়ারিস নির্ধারিত হারে উত্তরাধিকারের প্রাপ্য অংশ (নাসীবাম মাফরূদা) লাভ করবে। সুতরাং কুরআনে বর্ণিত প্রত্যেক ওয়ারিসই ‘যাবিল ফুরুজ’ বা ‘নির্ধারিত অংশের প্রাপক’। আর এই যাবিল ফুরুজদের মধ্যে পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা ও ভাই-বোন হচ্ছে ‘উলুল আরহাম’ (ফারায়েজের পরিভাষায়, যাবিল আরহাম) এবং স্বামী/স্ত্রী হচ্ছেন ছিহর বা বৈবাহিক আত্মীয়তা সূত্রে আক্বরাবূনের (নিকটতম আত্মীয়) বা ওয়ারিসের অন্তর্ভুক্ত। উত্তরাধিকারের বিধানে আসাবা বা অবশিষ্টভোগী বলে কেউ নেই এবং যাবিল আরহাম সম্পর্কিত প্রচলিত নিয়ম গ্রহণযোগ্য নয়।

উত্তরাধিকার বন্টন সমস্যা ও তার দুটি প্রস্তাবিত সমাধান, সমাধানের সমালোচনা ও সমালোচনার জবাব এবং জবাবের পর্যালোচনা

‘সামহয়্যার ইন ব্লগে’ উত্তরাধিকার বণ্টন সমস্যা ও তার দুটি প্রস্তাবিত সমাধান, সমাধানের সমালোচনা ও সমালোচনার জবাব নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা(২১) উপস্থাপিত হয়েছে।

(২১) https://www.somewhereinblog.net/blog/mashudul_haque/28898205

এ আলোচনাটি এ বিষয়ে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক হওয়ায় এখানে তা পর্যালোচনাসহ উপস্থাপন করা হলো।

উত্তরাধিকার বন্টন সমস্যার একটি উদাহরণ

যদি মৃত ব্যক্তির ৩ কন্যা, স্ত্রী এবং পিতা ও মাতা থাকেন তাহলে কিভাবে বন্টন করা হবে?

প্রথম সমাধান

৩ কন্যা = ২/৩  ,

স্ত্রী = ১/৮  ,

পিতা = ১/৬  ,

মাতা = ১/৬  ।

মোট = ২/৩  + ১/৮   + ১/৬  + ১/৬  = ২৭/২৪  ।

তথা

৩ কন্যা = ১৬/২৪  ,

স্ত্রী = ৩/২৪ ,

পিতা = ৪/২৪ ,

মাতা = ৪/২৪ ।

কিন্তু আউল প্রয়োগ করে,

৩ কন্যা = ১৬/২৭ ,

স্ত্রী = ৩/২৭ ,

পিতা = ৪/২৭ ,

মাতা = ৪/২৭ ।

প্রথম সমাধানের সমালোচনা

আউলের পক্ষে বলা হয়, কুরআনের আয়াতের বক্তব্যকে আক্ষরিকভাবে নেয়া যাবে না। আউলের আগের পারস্পরিক ভাগসমূহের অনুপাত আউলের পরেও একই থাকে। তাই শরিকদের মোট ভাগ যদি ১ এর অধিক হয় তাহলে আউল প্রযোজ্য হবে তথা পরস্পরের প্রাপ্য ভাগের সমানুপাতে প্রত্যেক শরিকের প্রাপ্য কমে যাবে।

এক্ষেত্রে নিচের প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়।

(১) আউল কার প্রবর্তিত? আল্লাহর না মানুষের?

আল্লাহ ও মুহাম্মাদ (সা) কেন এ বিষয়ে কিছু বলেননি?

ওমর/ আলীকে কেন নতুন করে এ পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হলো?

অর্থাৎ ওমর/ আলী এর সময়কার ফারায়েজী আইন আর মুহাম্মাদ (সা:) এর সময়কার ফারায়েজী আইন কি একই ছিল?

(২) কুরআনের নির্দেশনাগুলোকে আক্ষরিকভাবে নেয়া যাবে না কেন? ৪:১১ আয়াতে যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যদি দুইয়ের বেশি কন্যা থাকে তারা পাবে ২/৩ । এখন প্রদত্ত সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আউল প্রয়োগ করে কন্যাদের দেয়া হচ্ছে ১৬/২৭ । ২/৩  = ১৮/২৭ । অন্যকথায়, ২/৩ – -  ১৬/২৭  = ২/২৭ । অর্থাৎ কুরআনের আয়াত অনুসারে কন্যারা তাদের ২/৩  না পেয়ে ২/২৭  ভাগ কম পাচ্ছে। এটাকে কি বলা যাবে না যে, কুরআনের ৪:১১ আয়াতের নির্দেশটি অমান্য করা হচ্ছে?

(৩) বলা হচ্ছে, কুরআনে থাকা ভাগসমূহের অনুপাত ঠিকই মেইনটেইন করা হয়েছে। কিন্তু  কুরআনে কি বলা হয়েছে যে, প্রত্যেকের ভাগের পরস্পরের অনুপাতের ভিত্তিতে সম্পত্তি বন্টন করতে হবে? নাকি মোট সম্পত্তি থেকে কে কত ভাগ পাবে তা জানানো হয়েছে?

উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করা যাক।

এখানে আউলের আগে ৩ কন্যা ও স্ত্রীর অনুপাত = ২/৩  : ১/৮   = ১৬ : ৩।

আউলের পরে ৩ কন্যা ও স্ত্রীর অনুপাত = ১৬/২৭  : ৩/২৭  = ১৬ : ৩।

অর্থাৎ উভয় অবস্থায় ৩ কন্যার সাথে স্ত্রীর অনুপাত ঠিক থাকছে।

কিন্তু যদি কেউ নিম্নোক্তভাবে বন্টন করে তাহলেও কিন্তু পরস্পরের অনুপাত একই থাকে।

৩ কন্যা = ১৬/২৯  ,

স্ত্রী = ৮/২৯  ,

পিতা = ৪/২৯  ,

মাতা = ৪/২৯ ।

এভাবে বন্টন করলে ২/২৯  অবশিষ্ট রাখা যায় এবং তা অবশিষ্টাংশভোগীদেরকে বা বাইতুল মালে দেয়া যেতে পারে।

কিন্তু তখন প্রশ্ন উঠবে যে, কুরআন অনুযায়ী কন্যাদেরকে ২/৩  দেয়ার কথা কিন্তু ১৬/২৯   কোনোভাবেই ২/৩  এর সমান নয়?

তাহলে এর মাধ্যমে কি প্রমাণিত হয় না যে, আউল করার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করলেও প্রশ্ন থেকেই যায়?

(৪) এক লোক তার সঞ্চিত ৯০,০০০ টাকা তার তিন বন্ধুকে (ক, খ, গ) দেয়ার জন্য একটা উইল করে বিদেশে চলে গেল। উইলটি করলো এরকম:

ক পাবে = ২০,০০০ টাকা।

খ পাবে = ৩০,০০০ টাকা।

গ পাবে = ৫০,০০০ টাকা।

পরে ভাগ করতে গিয়ে দেখা গেল যে, ১০,০০০ টাকা কম পড়েছে।

এক্ষেত্রে কি বলা যাবে না যে, লোকটি ভুল হিসাব করেছে?

এটা ঠিক যে, এক্ষেত্রে টাকা বন্টনের যৌক্তিক উপায় হচ্ছে মোট টাকা ক : খ : গ অনুপাত = ২ : ৩ : ৫ অনুপাতে ভাগ করে দেয়া। সে অনুযায়ী,

ক পাবে = ১৮,০০০ টাকা।

খ পাবে = ২৭,০০০ টাকা।

গ পাবে = ৪৫,০০০ টাকা।

কিন্তু এ সমাধানে আসার পরেও কি বলা যাবে না যে, উইল অনুযায়ী ক ২০,০০০ টাকা, খ ৩০,০০০ টাকা, গ ৫০,০০০ টাকা পায়নি এবং এর কারণ উইলকারী ভুল করেছেন?

মানুষের এমনকি বিখ্যাত মানুষেরও এমন ভুল হতে পারে এবং এমনকি হয়েছেও। কিন্তু আল্লাহর কিতাবে কি এরকম ভুল থাকতে পারে?

দ্বিতীয় সমাধান

৩ কন্যা = ২/৩  ।

বাকি থাকে = ১/৩  ।

এই ১/৩  অংশ ১/৮   : ১/৬   : ১/৬   অনুপাতে তথা ৩ : ৪ : ৪ অনুপাতে স্ত্রী, পিতা ও মাতার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। ফলে,

স্ত্রী =  ৩/৩৩  ,

পিতা = ৪/৩৩  ,

মাতা = ৪/৩৩  ।

সমাধানের ভিত্তি: ওয়ালাদ শব্দটি একবচন, এর বহুবচন হচ্ছে আওলাদ। যেহেতু তিন কন্যার অংশ ২/৩  । তাই প্রথমে তাদেরকে তাদের এই প্রাপ্য অংশ দিতে হবে। তারপর স্ত্রী, পিতা ও মাতার জন্য যে প্রাপ্য অংশ উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো যখন মৃত ব্যক্তির ওয়ালাদ (একবচন, পুংলিঙ্গ) থাকে। কিন্তু একাধিক ওয়ালাদ থাকলে অথবা কন্যা/কন্যারা থাকলে স্ত্রী, মাতা ও পিতা কত পাবে তা উল্লেখ করা হয়নি। যেহেতু এ উদাহরণে ওয়ালাদ বা একজনমাত্র পুত্র উপস্থিত নয়, তাই তিন কন্যাকে তাদের অংশ দেয়ার পর অবশিষ্ট অংশ স্ত্রী, পিতা ও মাতাকে তাদের জন্য উল্লেখিত প্রাপ্য অংশের অনুপাতে ভাগ করে দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।

দ্বিতীয় সমাধানের সমালোচনা

দ্বিতীয় সমাধানের ক্ষেত্রেও নিচের প্রশ্নগুলো এসে যায়:

(১) কেন অবশিষ্টাংশ পিতা, মাতা ও স্ত্রীর মধ্যে সমান তিনভাগে ভাগ করে দেয়া হবে না? কেন এক পুত্র থাকলে তারা যেভাবে পাবে, একাধিক সন্তান থাকলে অবশিষ্টাংশে তারা সেই একইভাবে পাবে?

(২) কেন অবশিষ্টাংশ তাদের মধ্যে আনুপাতিকভাগে বন্টিত হবে? এভাবে তো সেই প্রথম সমাধানের মত আউল বা রদ্দ করা হলো।

সমালোচনার জবাব [মাসুদুল হকের প্রদত্ত জবাব]: (সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)

(১) শরীয়তের আইনে ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমে বিধান তৈরি হতে পারে।

(২) ওমর রা. এর সময় যখন তিনি খুৎবা দিচ্ছিলেন তখন একজন প্রথম আউল জনিত সমস্যা জানতে চায়।  সে সময় সমাবেশে উপস্থিত আলী রা. দাড়িয়ে এই সমাধান দেন, প্রথমে তার সমাধান পুরো সঠিক ছিল না, পরে সবাই আলোচনা করে আউল আইন ঠিক করা হয়। এই ঘটনাকে মিম্বরিয়া বলে। (মুসলিম আইন, প্রথম খন্ড, এম হাবিবুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক ও সভাপতি, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) তারপর সেসময়ই এ সমাধান পর্যালোচনা করে একে আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যা ইজমার অন্তর্ভুক্ত। 

(৩) আউল নীতি ও রদ্দ নীতি

আউল নীতি: আউল শব্দের আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি হওয়া। শরীয়তের নিয়মানুযায়ী যাবিল ফুরুজ বা অংশীদারদের অংশ প্রদানের পর তাদের অংশাবলীর যোগফল যদি মূল সম্পদ হতে বেড়ে যায় বা ১ এর চেয়ে বেশি হয় তাহলে যে নিয়মে তা সমাধান করা হয় সেটাই আউল। কুরআনে অংশীদারদের যে তালিকা রয়েছে তাদের বিভিন্ন বিন্যাস ও সমাবেশে কখনো কখনো তা ১ এর চেয়ে বেশি হওয়াটা গাণিতিকভাবে ও অনুপাতভিত্তিক বন্টনে যদিও সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু এ বিন্যাস খুব সহজলভ্য নয়, তাই হাদীসে এ পরিস্থিতির উদাহরণ নেই, তবে চার খলিফার আমলে এটি আলোচিত হয় এবং পরবর্তীতে শরীয়তের ৩য় উৎস ইজমার মাধ্যমে ইসলামী আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

রদ্দ নীতি: রদ্দ এর আভিধানিক অর্থ ‘প্রত্যাবর্তন করা’ । এটি আউলের বিপরীত নিয়ম। শরীয়তের নিয়মানুযায়ী যাবিল ফুরুজ বা অংশীদারদের অংশ প্রদানের পর তাদের অংশাবলীর যোগফল যদি ১ এর চেয়ে কম হয় এবং মৃত ব্যক্তির কোনো আসাবা না থাকে তাহলে অবশিষ্ট সম্পত্তি স্বামী/স্ত্রী ব্যতিত অন্যান্য অংশীদারদের কাছে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করা হয়।

আউল নীতি ও রদ্দ নীতি প্রয়োগের তিনটি উদাহরণ

উদাহরণ-১

জলিল সাহেব মৃত্যুকালে পিতা ও এক কন্যা রেখে গেলেন।

প্রথমত, কন্যা পাবে ১/২  

পিতা পাবে ১/৬   

এখানে, ১/২  + ১/৬  = ৪/৬  ,

সুতারাং আসাবা বা অবশিষ্টাংশ = ১ -  ৪/৬    =  ২/৬   

দ্বিতীয়ত, পিতা আসাবা হিসেবে এই অংশও পাবে।

তাহলে পিতার মোট প্রাপ্য হবে = ১/৬  + ২/৬   = ৩/৬   =  ১/২ 

কন্যার অংশ = ১/২  

উদাহরণ-২

কামাল সাহেব মৃত্যুকালে মাতা ও ১ কন্যা রেখে গেলেন।

প্রথমত, কন্যা পাবে  ১/২   

মাতা পাবে  ১/৬  

মোট =  ১/২  + ১/৬   =  ৩/৬  + ১/৬   =  ৪/৬ 

দ্বিতীয়ত, রদ্দনীতি প্রয়োগ করে পাই, ৩/৪   +  ১/৪   =  ৪/৪   = ১

তাহলে, কন্যা ৩/৪   ও মাতা  ১/৪   অংশ পাবে।

উদাহরণ-৩

আনিস সাহেব মৃত্যুকালে স্ত্রী, ২ পূর্ণ আপন বোন ও ২ জন বৈপিত্রেয় (মাতৃশরিক) বোন রেখে গেলেন।

প্রথমত, এখানে স্ত্রী পাবে  ১/৪ 

পূর্ণ আপন দুই বোন পাবে  ২/৩  

বৈপিত্রেয় (মাতৃশরিক) দুই বোন পাবে  ১/৩ 

মোট = ১/৪   + ২/৩   + ১/৩   = ৩/১২   + ৮/১২   + ৪/১২   =  ১৫/১২  

দ্বিতীয়ত, ১ এর বেশি হওয়ায় আউল অবলম্বন করে হরকে ১৫ করে পাই,

৩/১৫   + ৮/১৫   +  ৪/১৫   =  ১৫/১৫   = ১

তাহলে স্ত্রী পাবে ৩/১৫  ,

পূর্ণ আপন দুই বোন পাবে ৮/১৫ 

বৈপিত্রেয় (মাতৃশরিক) দুই বোন পাবে ৪/১৫   অংশ পাবে।

উদাহরণ তিনটিতে দেখা যায় প্রথম ২টি উদাহরনে অংশ বৃদ্ধি পায়, দ্বিতীয়টিতে অংশ কিছুটা হ্রাস পায়। এখন ১ম নিয়মটি সাধারণভাবে আসাবা বা অবশিষ্টাংশভোগী নিয়মে করা হয়েছে, ২য় টি রদ্দ নীতি ও ৩য় টিতে আউল নীতি প্রয়োগ করা হয়েছে।  

দেখা যাচ্ছে কুরআনে বর্ণিত অংশ প্রাপ্ত হবার পর সে অংশ দ্বিতীয় ধাপে বাড়তে বা কমতে পারে, আর সেটা মোটেও কুরআনের পরিপন্থী নয় ।

কুরআনে এ সংক্রান্ত আয়াতগুলোতে দেখা যায় কয়েকজনের অনুপাত উল্লেখ করা হয়নি, যেমন পুত্র,ভাই, চাচা ইত্যাদি। এখন কেউ যদি বলে এদের উল্লেখ নেই, তাহলে এদের ভাগ দেয়া হলে কুরআনের বিরুদ্ধে যাবে, তাহলে তা অবান্তর মন্তব্য হবে। আসলে কুরআনে উল্লেখিত অংশ দেবার পর যা বাকি থাকবে সেখান থেকে তাদের অংশ নির্ধারিত হয়। আবার কখনো নিদির্ষ্ট অংশভোগীরাও তা পেতে পারে (যেমন- উদা ১), রদ্দ নীতিতেও বেশি পেয়ে থাকে। তাই নির্ধারিত অংশের বেশি পাওয়া ইসলামী আইনের পরিপন্থী নয়।

অধিকাংশ প্রশ্নে আমি দেখেছি আউল নীতি নিয়ে যত প্রশ্ন অথচ বেশি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্ন নেই । কিন্তু গণিতের দৃষ্টিতে বলা যায়, বৃদ্ধি ধনাত্মক বা ঋণাত্মক দুইই হতে পারে। ইসলামে উত্তরাধিকার আইনে আউল ও রদ্দ নীতিতে পরস্পরের সম্পদের অনুপাত ঠিক রাখা হয়, তাই এভাবে বণ্টন গাণিতিকভাবে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ও বৈজ্ঞানিক।

যেমন ২ নং উদাহরণে প্রথমত অনুপাত থাকে, কন্যা : মা =  ৩/৬   : ১/৬   =  ৩ : ১

রদ্দ নীতি প্রয়োগের পর এ অনুপাত, কন্যা : মা =  ৩/৪   :  ১/৪   =   ৩ : ১ 

৩নং উদাহরণের আউল নীতিতেও ৩ : ৮ : ৪ অনুপাত ঠিক থাকে।

(৩ খ)  অভিযোগকারীর বক্তব্য হচ্ছে, সেরকম তো যেকেউই দাবি করতে পারে যে, তিন কন্যা ও স্ত্রীর অনুপাত,  ১৬/২৭   :  ৩/২৭   এবং  ১৬/২৯  :  ৩/২৯   এ অনুপাত কিন্তু একই থাকে।

এর জবাব হচ্ছে, আউল ও রদ্দ আইন তো কন্ডিশনাল নিয়ম, আইনে যেমন অধ্যাদেশ থাকে। সবক্ষেত্রে তা হবে কেন?

আর এই সমাধান যে কতটা যৌক্তিক তা ফ্রি মাইন্ড নিয়ে একটু দেখলেই বুঝবেন। ধরুন আমার কোনো সম্পত্তির ১/৩   ভাগ পাওয়ার কথা, ২য় জনের পাওয়ার কথা ২/৩  এবং তৃতীয় জনের পাওয়ার কথা ১/৩ । এখন দেখা যাবে মোট সম্পত্তির চেয়ে তা বেশি হয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে সহজেই আউলের মত নিয়ম দিয়ে তা সমাধান করে দেয়া যায়। সেক্ষেত্রে যে দুজনের ১/৩   করে পাওয়ার কথা তারা সমান অংশই পাচ্ছে, তাই আপত্তির জায়গা থাকছে না, যার ২/৩   পাওয়ার কথা সেও নির্দিষ্ট অনুপাতে বেশি পাওয়ায় তারও আপত্তি থাকছে না।

প্রশ্ন করতে পারেন, এরকম অনুপাত হবে কেন যা কখনো একের চেয়ে বেশি হয়। আসলে ক্লাস এইটের ভাগ বাটোয়ারা টাইপ হিসাব চিন্তা করলে তা মনে হতেই পারে। আসলে প্রাপক যখন নিদির্ষ্ট সংখ্যক থাকে তখন তা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু ইসলামী আইনে প্রাপক নির্দিষ্ট সংখ্যক থাকে না, পারমুটেশন, কম্বিনেশন করে তা অনেক বাড়তে পারে, তখন খুব সাধারণ ভাবেই ১ এর চেয়ে তা বেড়ে যায়।

(৪) সমালোচনাকারী উদাহরণ দিয়েছেন যে-

এক লোক তার সঞ্চিত ৯০,০০০ টাকা তার তিন বন্ধুকে (ক, খ, গ) দেয়ার জন্য একটা উইল করে বিদেশে চলে গেল। উইলটি করলো এরকম:

ক পাবে= ২০,০০০টাকা

খ পাবে=৩০,০০০ টাকা

গ পাবে= ৫০,০০০ টাকা

পরে টাকা ভাগ বাটোয়ারা করতে দেখা গেলো ১০,০০০ টাকা কম পড়েছে।

এক্ষেত্রে কি বলা যাবে না যে, লোকটি ভুল হিসাব করেছেন?

আপনার উদাহরনের সাথে ইসলামী আইনের সর্ম্পক নেই। প্রথমত, আপনি বলেছেন ক পাবে একটা নিদির্ষ্ট অ্যামাউন্ট, এরকম নির্দিষ্ট অ্যামাউন্টের উদাহরণ দেয়া হলে তা শুধু অন্যদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা। কারণ ইসলামী আইনে শুধুই অনুপাত নিয়ে আলোচনা করে।

দ্বিতীয়ত, এখানে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রাপক আছে, ইসলামী আইনে নিদির্ষ্ট সংখ্যক প্রাপকের বিবেচনায় প্রণীত হয়নি। এটা সার্বজনীন।

মাসুদুল হকের প্রদত্ত জবাবের পর্যালোচনা [শওকত জাওহারের উপস্থাপিত পর্যালোচনা]

(১) ইজমা কিয়াসের প্রবক্তাদের একটি স্বীকার্য হচ্ছে, ইজমা কিয়াসের মাধ্যমে যে বিধান তৈরি হতে পারে তা হচ্ছে যে বিষয়ে কুরআন হাদীসে বিধান দেয়া হয়নি সে বিষয়ে কুরআন হাদীসের সীমারেখার ভিতরে ও অন্যান্য নির্দেশনার আলোকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য, যাতে কুরআন হাদীসের নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা যায়। কিন্তু যে বিষয়ে কুরআন হাদীসে বিধান দেয়া হয়েছে তাতে ইজমা কিয়াস অচল। তবে সার্বিক ক্ষেত্রে আউল বা রদ্দ নীতির প্রয়োগ তথা প্রতিটি অংশকে আনুপাতিক অংশ হিসাবে ধরা হলে তা (প্রচলিত আউল বা রদ্দ নীতি নয়) কুরআনের আয়াতের বক্তব্যের সঠিক উপলব্ধি, সেক্ষেত্রে এ প্রশ্ন আসতে পারে না। পরবর্তী পয়েন্টে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

(২) আউল নীতি হচ্ছে ইজমা বা কিয়াস, এটি যথার্থ জবাব নয়। কারণ আয়াতে নির্ধারিত অংশের যোগফল ১ এর বেশি হওয়ায় জটিলতা তৈরি হয়েছে, ইজমা-কিয়াসের মাধ্যমে তা দূর করা হয়েছে, এমনটি হলে অভিযোগ যথাস্থানে থেকে যায় যে, তবে কি আয়াতের বক্তব্য অনুসরণ করা অসম্ভব হওয়ায় সেক্ষেত্রে কিয়াসের আওতায় বাড়তি বিধান যোগ করা হয়েছে? আসলে সঠিক উত্তর হচ্ছে এই যে, আয়াতে দেয়া অংশগুলো হচ্ছে আনুপাতিক অংশ। তাই আউল বা রদ্দ নীতি বাড়তি বিধান নয় বরং সর্বক্ষেত্রেই এই একই নীতি (আনুপাতিক অংশের নীতি) প্রযোজ্য হবে।

(৩) আউল, রদ্দ কন্ডিশনাল নিয়ম, অধ্যাদেশের মত, কথাটি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং যদি এ নিয়ম থাকে তবে সার্বিকভাবেই তা প্রযোজ্য হতে হবে। অধ্যাদেশ হলে, এ অধ্যাদেশ কার? অর্থাৎ এ নীতির প্রবর্তক কে? আসলে, এটা অধ্যাদেশ নয়, বরং আয়াতে বর্ণিত অংশগুলো আনুপাতিক অংশ এটাই প্রকৃত কথা। সুতরাং একজনমাত্র ওয়ারিস হলে তার অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পূর্ণ অংশে পরিণত হবে।

১৬/২৭   এর পরিবর্তে ১৬/২৯   দিয়ে অনুপাত একই রেখে  ২/২৯   অন্য কাউকে দিয়ে দেয়া যায় বলে অভিযোগকারী যে অভিযোগ করেছে তার সঠিক জবাব হলো, পারস্পরিক আনুপাতিক অংশের ক্ষেত্রে মূল কথা হলো সমস্ত সম্পদ তাদের মধ্যে ভাগ করতে হবে যাদের অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে যেমন তাদের পারস্পরিক অনুপাত ঠিক থাকতে হবে তেমনি সমস্ত সম্পদই বন্টিত হতে হবে এবং তাদের মধ্যেই বন্টিত হতে হবে। সুতরাং এ দুটি শর্ত একসাথে মেইনটেইন করতে হবে। তাই ২/২৯ অংশ বের করে নিয়ে অন্য কাউকে দেয়ার সুযোগ নেই। একইভাবে, উপরোক্ত শর্ত সাপেক্ষে একজনমাত্র ওয়ারিস হলে তার আনুপাতিক অংশ যাই হোক না কেন সে একাই সমস্ত সম্পত্তি পাবে।

(৪) এ ক্ষেত্রে সমালোচনার জবাবটি সঠিক হয়েছে। তবে এ কথা যোগ করা যেতে পারে যে, যেহেতু আয়াতে বর্ণিত অংশগুলো আনুপাতিক অংশ, তাই এক্ষেত্রে যোগফল ১ হওয়ার চিন্তাটাই একটা ভুল চিন্তা। কারণ, আনুপাতিক অংশের বন্টনের নিয়ম অনুসারে যোগফল ১ হওয়া এবং ১ এর কম বা বেশি হওয়া উভয়টিই সমান। কুরআনে বর্ণিত অংশগুলো আনুপাতিক অংশ হওয়ায়, একজনমাত্র ওয়ারিস থাকলে সে একাই সমস্ত সম্পত্তি পাবে, তার আনুপাতিক অংশ যাহাই বর্ণিত থাকুক না কেন।

অধ্যায় ২১ : প্রচলিত ফারায়েজ ও ব্যাখ্যা থেকে উদ্ভুত সমস্যা বা প্রশ্নসমূহ

উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির বিষয়ে বিশ্লেষণাত্মক সমস্যাসমূহ

প্রচলিত মুসলিম ফারায়েজ এবং ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতের সরল অনুবাদের পার্থক্য সাপেক্ষে উত্তরাধিকার বন্টন বিধির বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে বিভিন্ন চিন্তক পাঠক যেসব সমস্যা চিহ্নিত করেন তা নিম্নরূপ :

(১) শুধু এক পুত্র বা শুধু একাধিক পুত্র বা পুত্র-কন্যা থাকলে তারা কতটুকু পাবে তা কোনো আয়াতে সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। প্রচলিত ফারায়েজে ধরে নেয়া হয় যে, তারা অবশিষ্ট অংশ পাবে।

(২) ৪:১১ আয়াতে উল্লেখিত ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’ এর প্রচলিত অনুবাদ হলো, ‘দুইয়ের বেশি (কন্যা হলে)’। এই অনুবাদ যথাযথ হলে, শুধু দুই কন্যা থাকলে তারা কতটুকু পাবে কোনো আয়াতে তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।

(৩) শুধু দুইয়ের বেশি কন্যা থাকলে তথা পুত্র না থাকা অবস্থায় দুইয়ের বেশি কন্যা থাকলে তারা পাবে ২/৩  এবং শুধু এক কন্যা থাকলে তথা পুত্র না থাকা অবস্থায় এক কন্যা থাকলে সে পাবে ১/২ । কিন্তু ‘শুধু’ বা ‘পুত্র না থাকা অবস্থায়’ শব্দগুলো আরবিতে নেই, অনুবাদকেরা যোগ করে। সুতরাং বর্ণিত অংশগুলো কি পুত্র থাকা বা না থাকা উভয় অবস্থায় প্রযোজ্য নয়? দুইয়ের বেশি কন্যা পায় ২/৩  , তাহলে এক বা একাধিক পুত্র কি বাকি ১/৩  পায়? তাহলে অন্যদের জন্য কিছু বাকি থাকে কি? যদি দুইয়ের বেশি কন্যার সাথে দুই পুত্র থাকে তারা কি ১/৩   পাবে না ৪/৩   পাবে? যদি এক কন্যার সাথে এক পুত্র থাকে তাহলে কি কন্যা ১/২  এবং পুত্র তার দ্বিগুণ তথা ১ পাবে, মোট ৩/২   বন্টিত হবে?

(৪) এক পুত্র পাবে দুই কন্যার অংশের সমান কথাটির অর্থ কি এই যে, প্রত্যেক পুত্রের বিপরীতে দুইজন করে কন্যা থাকলে এটি কার্যকর হবে, পুত্র-কন্যার অনুপাত এর চেয়ে কম বা বেশি হলে এ কথা কার্যকর হবে না বরং তখন পুত্র ও কন্যা পরস্পর সমান পাবে? যেমন, এক কন্যার সাথে এক পুত্র থাকলে কন্যা পাবে অর্ধেক আর পুত্রটি পাবে অর্ধেক? কেন ‘এক পুত্র এক কন্যার দ্বিগুণ পাবে’ না বলে ‘এক পুত্র পাবে দুই কন্যার সমান’ বলা হলো?

(৫) কেউ কেউ মনে করেন যে, দুইয়ের বেশি কন্যা (বা দুই কন্যা) পাবে ২/৩  এবং একটিমাত্র কন্যা পাবে ১/২ , এটি শুধু তখন প্রযোজ্য যখন তাদের সাথে আর কোনো ওয়ারিস যেমন পিতা-মাতা না থাকে। কিন্তু যদি অন্য ওয়ারিস থাকে তাহলে শুধু এক কন্যা বা শুধু একাধিক কন্যা থাকলেও তারা অবশিষ্টাংশ পাবে। প্রশ্ন হচ্ছে এ কথা কিভাবে জানা গেল? যদি বলা হয় যে, কারণ অন্য কারো থাকার কথা উল্লেখ করা হয়নি তাই এভাবে বুঝা যায়। তাহলে তো বলতে হবে, পিতা-মাতার অংশ নির্ধারণে পুত্র-কন্যা থাকা না থাকাকে বিবেচনা করা হয়েছে কিন্তু স্বামী/ স্ত্রীর থাকা না বিবেচনা করা হয়নি, সুতরাং তা কার্যকর হবে যদি স্বামী/ স্ত্রী না থাকে শুধু সে অবস্থায়। অনুরূপভাবে, স্বামী/ স্ত্রীর অংশ নির্ধারণে পুত্র-কন্যা থাকা না থাকাকে বিবেচনা করা হয়েছে কিন্তু পিতা-মাতা থাকা না থাকাকে বিবেচনা করা হয়নি, সুতরাং তা কার্যকর হবে যদি পিতা-মাতা না থাকে শুধু সে অবস্থায়। তাহলে উল্লেখিত অবস্থার ভিন্নরূপ অবস্থায় কে কিভাবে পাবে তা কিভাবে নির্ধারিত হবে?

(৬) কেউ কেউ মনে করেন যে, শুধু দুইয়ের বেশি কন্যা পাবে ২/৩   বলতে বুঝানো হয়েছে অবশিষ্টাংশের ২/৩ , এবং শুধু এক কন্যা পাবে ১/২  বলতে বুঝানো হয়েছে অবশিষ্টাংশের ১/২ । সুতরাং পিতা-মাতা ও স্বামী/ স্ত্রীর অংশ দেয়ার পর অবশিষ্টাংশের ২/৩  পাবে একাধিক কন্যা বা অবশিষ্টাংশের ১/২  পাবে এক কন্যা। আর পুত্র/পুত্ররা/পুত্র-কন্যা পাবে অবশিষ্টের সমস্ত। কিন্তু ‘অবশিষ্টাংশের’ শব্দটি যোগ করার ভিত্তি কী? যদি বলা হয় যে, আউল মুক্ত বন্টনের উদ্দেশ্যে এরূপ ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়েছে, তবে রদ্দের ক্ষেত্রেও তথা যখন সবাইকে তার অংশ দেয়ার পর কিছু বাকি থেকে যায় সেক্ষেত্রেও আপত্তি থাকে যে, সেটার ক্ষেত্রে কী করা হবে? কারণ কুরআন অনুযায়ী যারা ওয়ারিস তাদের ভিতরেই বন্টন করতে হলে এবং সেজন্য রদ্দ করতে হলে তা আউলের বিপরীত অথচ একইরূপ আপত্তিকর বিষয় সাব্যস্ত হয়। কারণ যোগফল সমস্তের বেশি হওয়া যেমন একটি ত্রুটি, সমস্তের কম হওয়াও অনুরূপ একটি ত্রুটি। এছাড়া পিতা-মাতা ও স্বামী স্ত্রীর জন্য অংশ বর্ণনার ক্ষেত্রে যেভাবে ‘মা তারাকা’ বা ‘মিম্মা তারাকা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে বা ‘আল’ যুক্ত অবস্থায় অংশ বর্ণনা করা হয়েছে পুত্র-কন্যার জন্যও অনুরূপ করা হয়েছে। সুতরাং উভয় ক্ষেত্রে একই ধরনের অবস্থা প্রযোজ্য হবে। কোনোটি সমস্ত সম্পদে কার্যকর হবে এবং কোনোটি অবশিষ্ট সম্পদে কার্যকর হবে এ কথা গ্রহণযোগ্য নয়।

(৭) পুত্র থাকা অবস্থায় পিতা মাতা উভয়ের প্রত্যেকের অংশ ১/৬ । একটি মত অনুযায়ী, যদি পিতা ও মাতার মধ্য থেকে মাতা না থাকে তাহলে মাতার অংশ পিতা পাবে (আসাবা হিসাবে)। প্রশ্ন হলো, যদি পিতা না থাকে তাহলে কি পিতার অংশ মাতা পাবে? নাকি মাতার অংশও পিতা পাবে না এবং পিতার অংশও মাতা পাবে না বরং পিতা/মাতা ছাড়া অন্য যে ওয়ারিস থাকবে সে পাবে, যেমন পুত্র-কন্যা? যদি তিন কন্যা এবং শুধু পিতা বা শুধু মাতা থাকে তাহলে পিতার বা মাতার অংশ কত হবে? এক্ষেত্রে কিছু অংশ অবন্টিত থেকে যায় বিধায় এখানে কি রদ্দের বিষয়টি কার্যকর হবে? নাকি মাতা থাকলে তো রদ্দ হবে কিন্তু পিতা থাকলে রদ্দ না হয়ে অবশিষ্টাংশ পিতা পাবে (আসাবা হিসাবে)? নাকি পিতা আসাবা হয় শুধুমাত্র যেক্ষেত্রে পিতার অংশ উল্লেখ থাকে না সেক্ষেত্রে?

(৮) যদি কারো একটিমাত্র কন্যা থাকে এবং পিতা-মাতা থাকে তাহলে কে কতটুকু পাবে? এক্ষেত্রে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাবনা রয়েছে। এ প্রস্তাবনাগুলোর সাথে আসাবার ধারণা সম্পর্কিত। আসাবা (অবশিষ্টাংশভোগী) হওয়ার ভিত্তি  দুটি। প্রথম ভিত্তি: কুরআনে যাকে ওয়ারিস করা হয়েছে অথচ তার অংশ নির্ধারণ করা হয়নি বা কোনো বিশেষ অবস্থায় যার অংশ নির্ধারণ করা হয়নি সে হচ্ছে আসাবা; যেমন পুত্র-কন্যা। দ্বিতীয় ভিত্তি: হাদীস অনুযায়ী, নিকটতম পুরুষ আত্মীয়ের মাধ্যমে সম্পর্কিত আত্মীয় হলো আসাবা। অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোনো ক্ষেত্রে যাবিল ফুরুজ হলেও অন্য কোনো ক্ষেত্রে তার অংশ অনির্ধারিতসে প্রথম স্তরের আসাবা এবং যে ব্যক্তি যাভিল ফুরুজ ধরনের আসাবার অবর্তমানে আসাবা হয় সে দ্বিতীয় স্তরের আসাবা। কন্যা আসাবা নয়। কিন্তু পুত্রের সাথে থাকলে সে আসাবা হয়ে যায়। তাই পুত্র-কন্যা একসাথে থাকলে পিতা-মাতার পর অবশিষ্টাংশ পুত্র-কন্যা পায়। কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তির একটিমাত্র কন্যা থাকে (যখন পুত্র নেই) তাহলে কন্যা পাবে ১/২ , মাতা পাবে ১/৬  , পিতা পাবে ২/৬  (যাভিল ফুরুজ হিসাবে ১/৬  + আসাবা হিসাবে অবশিষ্ট ১/৬ )। অন্য একটি মতে, এক্ষেত্রে রদ্দের নিয়মে কন্যা, মাতা ও পিতা সবাই আনুপাতিক হারে বেশি পাবে। আবার তৃতীয় একটি মতে, কন্যা কন্যা হওয়ায় (তথা পুত্র না হওয়ায়) সে অর্ধেক পাবে, বাকি অর্ধেক পিতা-মাতা সমানভাবে পাবে, যেহেতু সন্তান থাকলে পিতা-মাতার অংশ পরস্পরের সমান হয়।

(৯) দুইয়ের বেশি কন্যার চেয়ে দুই কন্যা কি বেশি পেতে পারে? যদি শুধু পিতা বা মাতা থাকে এবং দুই কন্যা পায় অবশিষ্ট অংশ। প্রশ্নটির কারণ হলো, যেহেতু প্রচলিত মতে যার অংশ উল্লেখ করা হয়নি সে পায় অবশিষ্ট অংশ, আর প্রচলিত অনুবাদ অনুসারে দুইয়ের বেশি কন্যার অংশ সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু দুই কন্যার অংশ সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। অবশ্য সাধারণ মত হলো, দুই কন্যার জন্যও  দুইয়ের বেশি কন্যার সমান অংশ নির্ধারিত হবে। কিন্তু এই সাধারণ মতের ভিত্তি হচ্ছে ‘ফাওক্বাছনাতাইনি’ শব্দটি দুইয়ের ক্ষেত্রেও কার্যকর হয় বলে কৃত ব্যাখ্যা অথবা হাদীসের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত ধারাটি যোগ করা হয়। যেমন ৪:১৭৬ আয়াতের ক্ষেত্রে দুইয়ের বেশি বোনের অংশ সরাসরি উল্লেখ না করা সত্ত্বেও হাদীস অনুযায়ী ২/৩   অংশ নির্ধারণ করা হয়, যদিও সেখানে ‘ফাওক্বা’ বা অনুরূপ কোনো শব্দ নেই যা থেকে ঐ ব্যাখ্যা করা যায়। কেউ কেউ বলেন, ৪:১১ তে দুই কন্যা কত পাবে তা নির্ধারিত হয় ৪:১৭৬ আয়াতে দুই বোনকে যা দেয়া হয়েছে তা দ্বারা এবং ৪:১৭৬ আয়াতে দুইয়ের বেশি বোন কত পাবে তা নির্ধারিত হবে ৪:১১ আয়াতে দুই কন্যাকে যা দেয়া হয়েছে তা দ্বারা। কিন্তু কেন এমনটি হবে? এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা উচিত। 

(১০) তিন কন্যা ও পিতা-মাতার সাথে স্বামী থাকলে বন্টন কিভাবে হবে? প্রচলিত মতে এক্ষেত্রে অংশগুলোর যোগফল সমস্ত সম্পদের বেশি হয়ে যায় ফলে আউলের প্রয়োজন হয়। 

(১১) কেউ কেউ বলেন যে, ‘ওয়ালাদ’ অর্থ ‘একটি পুত্র’। সুতরাং ‘ওয়ালাদ’ থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার ও স্বামী/ স্ত্রীর যে অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে তা কার্যকর হবে শুধু এক পুত্র থাকা অবস্থায়। কিন্তু একাধিক পুত্র থাকলে অথবা এক বা একাধিক কন্যা থাকলে অথবা পুত্র-কন্যা থাকলে তা কার্যকর হবে না। প্রশ্ন হলো তাহলে সে ক্ষেত্রে পিতা-মাতার অংশ ও স্বামী/ স্ত্রীর অংশ কিভাবে নির্ধারিত হবে?

(১২) ওয়ালাদ না থাকলে এবং পিতা-মাতা একমাত্র ওয়ারিস হলে মাতা পাবে ১/৩ । প্রশ্ন হলো এখানে আরবিতে ওয়ারিস হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাহলে একমাত্র ওয়ারিস হলে অর্থ করা হলো কেন? পিতা-মাতা ওয়ারিস হলেও স্বামী/ স্ত্রী ওয়ারিস হতে পারে, কারণ ওয়ালাদ না থাকা অবস্থায় স্বামী/ স্ত্রীর অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, ওয়ালাদ থাকলে পিতা-মাতা ও স্বামী/ স্ত্রী সবাই ওয়ারিস হবে, কিন্তু ওয়ালাদ না থাকলে শুধু পিতা-মাতা ওয়ারিস হবে তা যৌক্তিকও নয় এবং বলাও হয়নি। বরং ওয়ালাদ না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে (একমাত্র ওয়ারিস হোক বা তার সাথে অন্য ওয়ারিস থাকুক উভয় অবস্থায়) মাতার অংশ কত তা উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, অন্য ওয়ারিস না থাকলে মাতা পাবে ১/৩ , অন্য ওয়ারিস থাকলে তার অংশ দেয়ার পর মাতা পাবে অবশিষ্ট থেকে ১/৩ । কিন্তু অবশিষ্টাংশের ১/৩  বলার ভিত্তি কী? পিতা-মাতার অংশ কার্যকর হবে পুত্র-কন্যার সাথে আর স্বামী/ স্ত্রীর অংশ সমস্ত সম্পদে এ ধারণার উপর ভিত্তি করে এ মত দেয়া হয়। কিন্তু আয়াতের বক্তব্য বা ভাষা থেকে এ কথা প্রমাণ করা যায় না। যেহেতু পুত্র-কন্যার পর পিতা-মাতার অংশ বলার আগে সেটাকে যেমন ‘ওয়া’ (এবং) দ্বারা যুক্ত করা হয়েছে, স্বামী/স্ত্রীর অংশ বলার আগেও তেমনি সেটাকে ‘ওয়া’ (এবং) দ্বারা যুক্ত করা হয়েছে। তাই এতে পাথক্য করার কোনো প্রকৃত ভিত্তি নেই।

(১৩) ওয়ালাদ না থাকলে এবং পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে মাতা পাবে ১/৩ । প্রশ্ন হলো তখন পিতা কতটুকু পাবে?

(১৪) ওয়ালাদ না থাকলে এবং পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে, এবং ইখওয়াত থাকলে মাতা পাবে ১/৬  । প্রশ্ন হলো তখন পিতা কতটুকু পাবে? আর ইখওয়াত কিছু পাবে কিনা? যদি পায় তবে কতটুকু পাবে? প্রচলিত মতে, পিতা পাবে অবশিষ্টাংশ এবং ইখওয়াত কিছু পাবে না। কেউ কেউ মনে করেন, পিতা পাবে মাতার দ্বিগুণ এবং ইখওয়াত পাবে ৪:১২ আয়াতে প্রদত্ত ইখওয়াতের অংশ। আবার কেউ কেউ মনে করেন, ওয়ালাদ না থাকলেও পিতার অংশ ওয়ালাদ থাকার সমান, ইখওয়াত থাকুক বা না থাকুক। এসব মতের মধ্যে কোনটি সঠিক এবং কেন?

(১৫) ওয়ালাদ না থাকলে এবং পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে, এবং ইখওয়াত থাকলে মাতা পাবে ১/৬ । প্রশ্ন হলো, ইখওয়াত বলতে একাধিক ভাই এবং ভাই-বোন বুঝায়, নাকি শুধু একাধিক বোন থাকলেও মাতা ১/৬  পাবে? এছাড়া যদি শুধু এক ভাই বা এক বোন থাকে তাহলে মাতা কতটুকু পাবে?

(১৬) কালালাহ বলতে কাকে বুঝানো হয়েছে? মৃত ব্যক্তিকে না মৃত ব্যক্তির কোনো বিশেষ ধরনের ওয়ারিসকে? যদি মৃত ব্যক্তির কোনো বিশেষ ধরনের ওয়ারিসকে বুঝানো হয়, তাহলে কালালাহর এক ভাই বা এক বোন থাকার ব্যাখ্যা কি এই যে, কালালাহসহ মোট দুজন? আর যখন তারা এর চেয়ে বেশি হয় কথটির অর্থ কি এই যে, যখন কালালাহসহ ভাইসংখ্যা দুইয়ের বেশি হয়? এক্ষেত্রে কেউ কেউ মনে করেন, কালালাহর ভাই বা বোন পাবে কালালাহ যে অংশ থেকে পায় সেটার (অর্থাৎ অবশিষ্টাংশের) অংশবিশেষ আর কালালাহ পাবে (অবশিষ্টাংশ থেকে) সেই অংশবিশেষের পরবর্তী সমস্ত অংশ।

(১৭) ৪:১২ আয়াতে, যখন তারা (ভাই/বোন) এর চেয়ে বেশি হয় বলতে একাধিক বুঝানো হয়েছে নাকি দুইয়ের অধিক বুঝানো হয়েছে?

(১৮) ৪:১২ আয়াতে উল্লেখিত তারা (ভাই-বোন) শরিক হবে ১/৩  অংশে বলতে ভাই-বোনকে সমান অংশীদার বুঝানো হয়েছে নাকি এক্ষেত্রেও ভাই পাবে বোনের দ্বিগুণ? এটি কিভাবে নির্ণয় করা হবে?

(১৯) কেউ কেউ মনে করেন যে, মৃত ব্যক্তির ওয়ারিসদের মধ্যে যখন কেউ কেউ থাকে না অথবা তাদের অংশ পাওয়ার পর কিছু অবশিষ্ট থেকে যায় তখন ঐ অবশিষ্ট অংশের ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি কোনো কালালাহ আত্মীয়কে মনোনীত করে যেতে পারেন। ঐ কালালাহ আত্মীয় তার (কালালাহর) ভাই বা বোনসহ প্রত্যেকে অবশিষ্টাংশের ১/৬  পাবে। প্রশ্ন হলো, ‘অবশিষ্টাংশের’ শব্দটি কিভাবে পাওয়া গেল? আবার কেউ কেউ মনে করেন, মনোনীত ব্যক্তির ভাই/বোন পাবে মনোনয়নসম্পৃক্ত পরিমাণের (অবশিষ্টাংশের) ১/৬  এবং মনোনীত ব্যক্তি পাবে অবশিষ্টাংশ (তথা মনোনয়নসম্পৃক্ত পরিমাণের বা অবশিষ্টাংশের অবশিষ্টাংশ)।

(২০) যদি মৃত ব্যক্তি তার কোনো কালালাহ আত্মীয়কে মনোনীত না করেন তাহলে কি তাঁর কালালাহ আত্মীয় কিছু পাবে না? এ অবস্থায় কি কিছু সম্পত্তি অবন্টিতই থেকে যাবে? কেউ কেউ মনে করেন যে, ২:১৮০-১৮২ আয়াত এবং ৪:৮ আয়াত এরূপ অবস্থার জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো এরূপ অবশিষ্ট থাকা ছাড়া কি ২:১৮০-১৮২ এবং ৪:৭ আয়াতের আদেশ মান্য করা হবে না?

(২১) ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ কি একই না ভিন্ন ভিন্ন? যদি একই হয় তাহলে দুই আয়াতের বন্টন বিধিতে স্ববিরোধ রয়েছে। আর যদি ভিন্ন হয় তবে কোন আয়াতে বর্ণিত কালালাহর অর্থ কী? এবং তা কিভাবে নির্ণিত হবে?

(২২) ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ভাই-বোন কি একই না ভিন্ন ভিন্ন? যদি একই হয় তাহলে দুই আয়াতের বন্টন বিধিতে স্ববিরোধ রয়েছে। আর যদি ভিন্ন হয় তবে কোন আয়াতে বর্ণিত ভাই-বোনের অর্থ কী? এবং তা কিভাবে নির্ণিত হবে?

(২৩) ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই যে বোনের ওয়ারিস হবে তা দ্বারা কি সে বোনের একমাত্র ওয়ারিস হওয়ার কথা বলা হয়েছে তথা সে বোনের সমস্ত সম্পত্তি পাওয়ার কথা বলা হয়েছে? তাহলে কি এরূপ অবস্থায় পিতা-মাতা ও স্বামী/ স্ত্রী কিছুই পাবে না? পিতা-মাতা ওয়ারিস হলেও যেমন তার সাথে অন্য ওয়ারিস যেমন স্বামী/ স্ত্রী থাকতে পারে, তেমনি ভাই ওয়ারিস হবে এবং তার সাথে অন্য ওয়ারিসও থাকতে পারে যেমন পিতা-মাতা ও স্বামী/ স্ত্রী, এটিই যৌক্তিক কথা। অন্য ওয়ারিস থাকুক বা না থাকুক মাতার অংশ  ১/৩ । কিন্তু ভাইয়ের কোনো নির্দিষ্ট অংশ বলা হয়নি। তবে কি অন্য ওয়ারিস না থাকলে সে সমস্ত সম্পত্তি পাবে, অন্যথায় অবশিষ্টাংশ পাবে? একাধিক ভাইয়ের ক্ষেত্রেও কি একই কথা প্রযোজ্য?

(২৪) কেউ কেউ মনে করে যে, ভাই-বোন হলো অবশিষ্টাংশের ওয়ারিস। অর্থাৎ ৪:১৭৬ আয়াতের প্রয়োগ এভাবে হবে যে, এক বোন পাবে অবশিষ্টাংশের অর্ধেক, দুই বোন পাবে অবশিষ্টাংশের ২/৩ , শুধু ভাই থাকলে সে পাবে অবশিষ্টাংশ সম্পূর্ণ। কিন্তু অবশিষ্টাংশ শব্দ যোগ করার ভিত্তি কী?

(২৫) শুধু দুইয়ের বেশি বোন থাকলে তারা কতটুকু পাবে তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। কেউ কেউ মনে করেন, তারা পাবে অবশিষ্টাংশ, যেহেতু তাদের অংশ উল্লেখ করা হয়নি। আবার কারো কারো মতে, তারা পাবে শুধু দুই বোনের সমান অংশ তথা ২/৩ ।

আয়াত নম্বর ভিত্তিক বিশেষ সমস্যাসমূহ

৪:১১ আয়াতের প্রসঙ্গে সমস্যাসমূহ

(ক) প্রচলিত একটি অনুবাদ অনুসারে শুধু দুই কন্যা থাকলে তারা কতটুকু পাবে তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।

(খ) শুধু এক বা একাধিক পুত্র থাকলে তারা কতটুকু পাবে তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।

(গ) পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন না থাকলে মাতা পাবে ১/৩  এবং ভাই-বোন থাকলে মাতা পাবে ১/৬ । কিন্তু এ দুই অবস্থায় পিতা কতটুকু পাবে তা উল্লেখ করা হয়নি।

(ঘ) পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় যদি পিতা-মাতার মধ্য থেকে শুধু পিতা বা শুধু মাতা ওয়ারিস হয় সেক্ষেত্রে পিতা বা মাতা কতটুকু পাবে তা উল্লেখ করা হয়নি।

(ঙ) ইখওয়াত বলতে ভাই-বোনের সংখ্যা (একবচন, দ্বিবচন, বহুবচন) ও লিঙ্গ (পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ) নির্দিষ্ট করা হয়েছে কিনা তাও বিবেচ্য বিষয়।

(চ) ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বলতে পিতা-মাতা ওয়ারিস হলে বুঝানো হয়েছে নাকি শুধুমাত্র পিতা-মাতাই ওয়ারিস হলে বুঝানো হয়েছে? যদি শুধুমাত্র পিতা-মাতাই ওয়ারিস হলে বুঝানো হয়, তাহলে মাতার অংশ ১/৩  এবং ভাই-বোন থাকা অবস্থায় ১/৬  উভয়টির সাথেও কি শুধুমাত্র পিতা-মাতাই ওয়ারিস হলে শর্তটি বহাল থাকবে? অর্থাৎ ভাই-বোন থাকলেও কি পিতা-মাতা একমাত্র ওয়ারিস হবে? অন্যকথায়, পিতা-মাতার সাথে ভাই-বোন ওয়ারিস হতে পারে কিনা?

(ছ) ‘ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু’ বাক্যের আওতায় দেয়া পিতা-মাতার অংশ, বিশেষ করে মাতার অংশসমূহ কি তাদের সাথে ওয়ারিস হিসেবে স্বামী/ স্ত্রী থাকলে সেক্ষেত্রেও একই থাকবে?

৪:১২ আয়াতের প্রসঙ্গে সমস্যাসমূহ

(ক) ভাই-বোনের প্রসঙ্গে ‘ফাইন কানা আকছারা মিন যালিকা’ বলতে একাধিক বুঝানো হয়েছে না দুইয়ের অধিক বুঝানো হয়েছে? একাধিক বোন বা একাধিক ভাই বা ভাই-বোন যেভাবেই থাকুক তারা কি এই ১/৩  সম্মিলিতভাবে পাবে?

(খ) ভাই-বোনের প্রসঙ্গে ‘ফাহুম শুরাকাউ’ বলতে তারা সমানুপাতিকভাবে অংশীদার হবে বুঝানো হয়েছে নাকি এখানেও এক ভাই পাবে দুই বোনের সমান?

৪:১৭৬ আয়াতের প্রসঙ্গে সমস্যাসমূহ

(ক) শুধু রবান দুইয়ের বেশি হলে তারা তথা দুইয়ের বেশি বোন কতটুকু পাবে তা উল্লেখ করা হয়নি।

(খ) ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’ বাক্য দ্বারা কি ভাইকে সম্পূর্ণ সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিস করা হয়েছে? নাকি স্বামী/ স্ত্রী থাকলে তার অংশ দেয়ার পর সে অবশিষ্ট সম্পূর্ণ সম্পত্তির ওয়ারিস করা হয়েছে?

(গ) ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা’ বাক্যের মাধ্যমে একটি ভাই যতটুকু পাওয়ার হকদার হয়, শুধু ভাই একাধিক থাকলে তারাও কি ঠিক ততটুকু পাওয়ার হকদার হবে?

(ঘ) ‘ওয়া ইন কানূ ইখওয়াতান রিজালান ওয়া নিসাআন’ বাক্যের ‘নিসাআন’ যে বহুবচন এবং তা দুইয়ের বেশি নারীকে বুঝায় ৪:১১ আয়াতে ব্যবহৃত ‘ফাইন কুন্না নিছাআন ফাওক্বাছনাতাইনি’ এবং দ্বিবচনের ক্ষেত্রে ৪:১৭৬ আয়াতে ব্যবহৃত ‘ফাইন কানাতাছনাতাইনি’ থেকে তা স্পষ্ট হয়। এছাড়া, ৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতে দুই নারী বুঝানোর জন্য ‘উনছায়ায়নি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এখন রিজালান বহুবচন, নিছাআনও বহুবচন। তাহলে, এখানে কি অন্তত তিন বা দুই ভাই এবং সেই সাথে অন্তত তিন বা দুই বোন থাকার কথা বুঝাচ্ছে? নাকি দুই ভাই চার বোন, তিন ভাই ছয় বোন এভাবে ১:২ অনুপাতে ভাই-বোন থাকা অবস্থার কথা বুঝাচ্ছে? (পরের প্রশ্ন থেকে এ প্রশ্নটি আরো স্পষ্ট হবে)।

(ঙ) পুত্র-কন্যা ও ভাই-বোনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ‘লিয যাকারি হাযযিল উনছায়ায়নি’ বাক্যটি কি শুধুমাত্র পুত্র ও কন্যার অনুপাত ১:২ হলে এবং অনুরূপভাবে ভাই ও বোনের অনুপাত ১:২ হলে প্রযোজ্য? যেমন যখন ১ পুত্র ২ কন্যা, ২ পুত্র ৪ কন্যা, ৩ পুত্র ৬ কন্যা এভাবে থাকবে তখন প্রযোজ্য? নাকি পুত্র কন্যা মিলিতভাবে থাকলেই তা প্রযোজ্য হবে পুত্র সংখ্যা যা-ই হোক এবং কন্যা সংখ্যা যা-ই হোক? যেমন, ১ পুত্র ১ কন্যা, ২ পুত্র ১ কন্যা, ১ পুত্র ৩ কন্যা ইত্যাদি যেভাবেই থাকুক না কেন?

সামগ্রিক বন্টন বিধির প্রসঙ্গে বিশেষ সমস্যাসমূহ

(ক) কেউ যাবিল ফুরুজ, কেউ আসাবা বা অবশিষ্টভোগী এবং কেউ যাবিল আরহাম এ বিভাজন কি সঠিক?

(খ) যাবিল ফুরুজদের মধ্যে বন্টন করতে গিয়ে যদি অংশসমূহের যোগফল ১ এর বেশি বা কম হয় তখন আউল বা রদ্দ করতে হবে; কিন্তু শুধু একজন যাবিল ফুরুজ থাকলে এবং কোনো আসাবাও না থাকলে তা থেকে যাবিল আরহামকে দিতে হবে বা তা থেকে ৪:৮ আয়াতে বর্ণিত ইয়াতীম মিসকীনকে দিতে হবে বা তা বাইতুল মালে দিতে হবে এই বন্টন নীতি কি যথার্থ? কেন এক্ষেত্রে আউল বা রদ্দের নিয়মে তথা আনুপাতিক অংশের স্বাভাবিক নিয়মে সেই একমাত্র যাবিল ফুরুজ সম্পূর্ণ সম্পত্তি পাবে না?

(গ) ৪:১১ আয়াতের ক্ষেত্রে, মৃত পুরুষের পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যা যেভাবে পায়, মৃত নারীর পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যা কি সেভাবে পাবে?

(ঘ) ৪:১৭৬ আয়াতের ক্ষেত্রে, মৃত ভাইয়ের শুধু এক বা একাধিক ভাই থাকলে তারা কিভাবে পাবে? মৃত নারীর একাধিক ভাই, এক বা একাধিক বোন এবং ভাই-বোন কিভাবে পাবে?

কালালাহ ও ভাই-বোনের অংশ প্রসঙ্গে বিশেষ সমস্যাসমূহ

(ক) ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ কি একই অর্থবোধক? নাকি এ দুই স্থানের কালালাহর মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে? আসলে কালালাহ এর প্রকৃত অর্থ কী? এ শব্দটির অর্থ সম্পর্কে বিভিন্ন মত চালু আছে। কোন মতটি সঠিক তা কিভাবে নির্ণয় করা যাবে?

(খ) ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে কালালাহর ভাই-বোনদের প্রাপ্য অংশ ভিন্ন দেখা যায়। এর কারণ কী? প্রচলিত উত্তর হচ্ছে, এ দুই স্থানের মধ্যে ৪:১২ আয়াতে বৈপিত্রেয় ভাই-বোনদেরকে বুঝানো হয়েছে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে পূর্ণ আপন ভাই-বোন এবং বৈমাত্রেয় ভাই-বোনদেরকে বুঝানো হয়েছে। দাবি করা হয় যে, এ কথার ভিত্তি হচ্ছে ইজমা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ইজমার ভিত্তি কী? অর্থাৎ আয়াতে উভয় স্থানে ‘আখুন, উখতুন’ শব্দ ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও এ পৃথকীকরণ কিভাবে করা যেতে পারে? যদি এ পৃথকীকরণ সঠিক না হয় তবে কি ভাই-বোনদের অংশ দুই স্থানে দুই রকম দেয়া হয়েছে? কেউ কেউ এ কথা স্বীকার করেন এবং বলেন যে, ৪:১৭৬ আয়াত ৪:১২ আয়াতের কালালাহ সম্পর্কিত অংশকে মানছুখ (রহিত) করেছে। এ বিষয়ে প্রকৃত সমাধান কী? আর যারা মানছুখ হিসাবে মানেননি বরং ৪:১২ আয়াতে বৈপিত্রেয় ভাই-বোন এবং ৪:১৭৬ আয়াতে পূর্ণ আপন ও বৈমাত্রেয় ভাইবোনের কথা বুঝানো হয়েছে বলে দাবি করেন, তাঁরা হিমারিয়া নীতি/ গাধা সমাচার অনুযায়ী, যে অবস্থায় পূর্ণ আপন ভাইয়ের জন্য কিছু অবশিষ্ট থাকে না তখন তাকে বৈপিত্রেয় ভাই-বোনের সাথে সমান অংশীদার সাব্যস্ত করেন। প্রশ্ন হলো, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী যদি পূর্ণ আপন (পিতা-মাতা উভশরিক) ভাই-বোন বঞ্চিত হয়, তাদেরকে বঞ্চিত করতে হবে, সেক্ষেত্রে হযরত উমরের সিদ্ধান্ত অনুসারে বণ্টন করলে তা কি আল্লাহর বিধানের অনুসরণ হয়, নাকি এর মাধ্যমে তার লঙ্ঘন হয় বা ত্রুটি সংশোধন করা হয়?

(গ) কালালাহ সম্পর্কিত ফতোয়া জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে ৪:১৭৬ আয়াতে কালালাহ সম্পর্কিত বন্টনের একটি বাড়তি ধারা উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে যদি ফতোয়া জানতে চাওয়া না হতো তবে কি ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত বন্টন বিধি ছাড়াই উত্তরাধিকার বন্টিত হতো বা তাহলে কি উত্তরাধিকারের বিধান পূর্ণাঙ্গ হতো? অন্য কথায়, কেন ৪:১১, ৪:১২ আয়াতে উত্তরাধিকারের পূর্ণাঙ্গ বিধান দেয়া হয়নি? কেন ৪:১৭৬ আয়াতটি ৪:১৩ আয়াত না হয়ে ৪:১৭৬ আয়াত হলো বা সূরা নিসার শেষ আয়াত হলো যা উত্তরাধিকারের বন্টন বিধি সম্বলিত ৪:১১, ৪:১২ আয়াত থেকে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত?

উল্লেখ্য: উপরিউক্ত সমস্যাগুলোর ধারণা বিভিন্ন বই ও আর্টিকেল ছাড়াও অনলাইন ফোরাম ও ব্লগ ইত্যাদি থেকে সংকলিত হয়েছে। একত্রীকরন, বিন্যাস ও সরলিকরনের ক্ষেত্রে সংকলক কর্তৃক যথেষ্ট পরিমার্জন করা হয়েছে। সমস্যাগুলোর বিষয়ে আলোকপাত করার উদ্দেশ্য হলো এ বিষয়ে পাঠককে ধারণা দেয়া এবং বিভিন্ন চিন্তা-উপলব্ধির তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে তথ্যগত সিদ্ধান্ত বা অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহযোগিতা করা।

সমস্যার গোড়ার কথা ও সমাধান

প্রচলিত মতে অংশগুলোকে আনুপাতিক অংশ না ধরায় সর্বক্ষেত্রে অবশিষ্ট অংশের ধারণা নেয়া হয়েছে। অথচ শুধুমাত্র পুত্র কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলে পিতার অংশ কত হবে সেক্ষেত্রে অবশিষ্ট অংশের ধারণা স্বত:সিদ্ধভাবে আসে এবং তা একটি ব্যক্তিগত আনুপাতিক অংশ সৃষ্টি করে। এই অবশিষ্টাংশের বিষয়টি পিতার আনুপাতিক অংশের নির্ধারক, তা আনুপাতিক অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, পিতা-মাতার আনুপাতিক অংশ শিরোনামে বিষয়টি বিস্তারিত যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে অবশিষ্ট অংশের ধারণা গ্রহণ করলে তা আয়াতসমূহের বিভিন্ন তথ্যের সাথে অসঙ্গতিশীল বলে প্রতীয়মান হয়।

৪:১২ এবং ৪:১৭৬ আয়াতের বক্তব্যে দুইয়ের বেশি কন্যার অংশ ও দুই কন্যার অংশ সমান, অনুরূপভাবে দুই বোনের অংশ ও দুইয়ের বেশি বোনের অংশ সমান এ বিষয়টি সাধারণত সব বিশ্লেষকই মেনে নেন। কিন্তু এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান এই সূত্রটিকে শুধুমাত্র পুত্র-কন্যা মিলিতভাবে থাকার অবস্থায় প্রযোজ্য ধরে নিয়ে, শুধু পুত্র থাকা অবস্থায় তাদেরকে অবশিষ্ট অংশের অধিকারী সাব্যস্ত করা হয়ে থাকে।

এমতাবস্থায় শুধু এক কন্যা থাকলে সে পায় অর্ধেক অথচ শুধু চার পুত্র থাকলে তাদের প্রত্যেকে পিতা-মাতার সাথে যা পায় তা হয় শুধু এক কন্যা থাকলে সে যা পেত তার তিন ভাগের এক ভাগ। একইভাবে শুধু চার কন্যা থাকলে তাদের প্রত্যেকে পিতা-মাতার সাথে যা পায় তা শুধু চার পুত্র থাকলে প্রত্যেক পুত্র যা পেতো তার সমান হয়। কিন্তু যখন পিতা বা মাতা শুধু একজন থাকে সে অবস্থায় পুত্রের অংশ বেড়ে যায় যেহেতু সে অবশিষ্ট অংশের অধিকারী অথচ সে অবস্থায় দুই বা ততোধিক কন্যার অংশ বাড়ে না যেহেতু তাদের অংশ নির্ধারিত ধরে নেয়া হয়েছে।

এছাড়া পিতা-মাতা ও স্বামী থাকলে শুধু এক কন্যাকে অর্ধেক দেয়ার পর তাদের মধ্যে বন্টনের ক্ষেত্রে অংশগুলোর যোগফল সমগ্র সম্পদের চেয়ে বেশি হয়ে যায়।  এমতাবস্থায় স্বামীকে প্রথমে তার অংশ দিয়ে বাকি অংশকে পিতা-মাতা ও এক কন্যার মধ্যে আনুপাতিক হারে ভাগ করতে হয়। অথচ আয়াতে এরূপ কোনো নির্দেশ বা নির্দেশনা নেই।

সন্তান না থাকা অবস্থায় মাতার উল্লেখিত আনুপাতিক অংশের সাপেক্ষে অবশিষ্ট অংশ হলো পিতার আনুপাতিক অংশ। কিন্তু এ বিষয়টির অন্যরূপ প্রয়োগ তথা পিতাকে সাধারণভাবেই অবশিষ্টভোগী হিসেবে সাব্যস্ত করার ফলে কখনো কখনো পিতা তার আনুপাতিক অংশ থেকে বঞ্চিত হয় এমনকি কোনো উত্তরাধিকার লাভ করা থেকে বঞ্চিত হয়। যেমন, যদি ওয়ারিস হয় পিতা, মাতা, স্বামী ও তিনজন বৈপিত্রেয় ভাই। তাহলে মাতা, স্বামী ও তিনজন বৈপিত্রেয় ভাই যাবিল ফুরুজ হিসেবে নির্দিষ্ট অংশ লাভ করে। পিতা পূর্ণ আপন ও বৈমাত্রেয় ভাইকে বঞ্চিত করতে পারলেও বৈপিত্রেয় ভাইকে বঞ্চিত করতে পারে না। এক্ষেত্রে পিতা আসাবা বা অবশিষ্টভোগী হওয়ার কারণে কিছুই পাবে না। কারণ এক্ষেত্রে কোনো অবশিষ্ট থাকে না। অথচ এটি স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধির সাথেও সাংঘর্ষিক হয়।

সুতরাং সমস্যাটি তৈরির পেছনে চারটি মৌলিক কারণ পাওয়া যায়। প্রথমত ,উল্লেখিত অংশগুলোকে ব্যক্তিগত আনুপাতিক অংশ হিসাবে না বুঝা এবং তাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে যৌক্তিক বিশ্লেষণ ছাড়া অবশিষ্টাংশ ধরে নেয়া। দ্বিতীয়ত, এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান কথাটিকে শুধুমাত্র পুত্র কন্যা মিলিতভাবে থাকা অবস্থার জন্য নির্দিষ্ট করে নেয়া। তৃতীয়ত, আয়াতে উল্লেখ না থাকা ও অবকাশ না রাখা সত্ত্বেও অন্য কিছু উৎস (হাদীস, ইজমা, কিয়াস) এর দ্বারা ‘যাবিল ফুরুজ, আসাবা, যাবিল আরহাম’ ইত্যাদি বিভিন্ন ধারা সংযোজন করা। চতুর্থত, আউল ও রদ্দের নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অভিনব শর্ত তৈরি করা।

যদি ‘অংশ’ বলতে ‘ব্যক্তিগত বা শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ’ ধরা হয়, তাহলে এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান কথাটি শুধু এক পুত্রের আনুপাতিক অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। কারণ অন্যথায় শুধু পুত্রের কোনো ব্যক্তিগত আনুপাতিক অংশ পাওয়া যায় না।

এক পুত্র পাবে দুই কন্যার অংশের সমান সূত্রটির ফলে যখন পুত্র কন্যা মিলিতভাবে থাকবে তখন তারা এক বা একাধিক পুত্র তথা দুই বা ততোধিক কন্যার সমতুল্য গণ্য হবে এবং এক্ষেত্রে তাদের আনুপাতিক অংশ হবে ২/৩  । আর এই ২/৩   অংশ বন্টনের ক্ষেত্রে পুত্র: কন্যা = ২:১ হিসাবে বন্টিত হবে।

উত্তরাধিকার বণ্টন বিধিতে যাদের ‘অংশ’ নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে ‘অংশ’ বলতে ‘শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ’ বুঝানো হয়েছে। এর পক্ষে একটি সরল যুক্তি হলো: অন্যথায় কখনো সমস্ত সম্পদ বন্টিত হয় না এবং কখনো বন্টনীয় অংশগুলোর যোগফল সমস্ত সম্পদের চেয়ে বেশি হয়ে যায়।

বর্তমানে অবন্টিত অংশ বন্টনের জন্য দুটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। হয় এটাকে রদ্দ করা হয় তথা পুন:বন্টন করা হয় যাতে প্রত্যেকের প্রাপ্য অংশের পরিবর্তন ঘটে কিন্তু পারস্পরিক অনুপাত ঠিক থাকে। অথবা কিছু পুরুষ আত্মীয়কে আসাবা সাব্যস্ত করে তাদেরকে তথাকথিত অবশিষ্টাংশ দেয়া হয়, নারীদের সাথে সম্পর্কিত সাধারণ আত্মীয়দেরকে দেয়া হয় না। অন্যদিকে যখন যোগফল সমস্তের চেয়ে বেশি হয়ে যায় তখন আউলের মাধ্যমে প্রত্যেকের প্রাপ্য অংশে পরিবর্তন আনা হয় কিন্তু পারস্পরিক অনুপাত ঠিক থাকে। এভাবে রদ্দ ও আউল করাকে একটি উদ্ভূত সমস্যার সমাধান হিসাবে গ্রহণ করা হয় যাকে ধরে নেয়া হয় মূল সূত্রের ব্যতিক্রম অবস্থা বা ঠেকায় পড়ে এক ধরনের সমাধান। অথচ ‘অংশ’ বলতে যদি ‘শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ’ বুঝানো হয় তাহলে এটিই হয়ে যায় একমাত্র সূত্র যা সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য। সেক্ষেত্রে আউল বা রদ্দকে ব্যতিক্রম বা ঠেকায় পড়ে করা সমাধান হিসেবে সাব্যস্ত করার অবকাশ থাকে না।

উত্তরাধিকার বণ্টন বিধিতে যার জন্য যে প্রাপ্য অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা তার শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ সাব্যস্ত করার অর্থ হলো আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে ভাগ করা। আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে একজনমাত্র ওয়ারিস যেই হোক না কেন সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমস্ত সম্পদের ওয়ারিস হয়ে যায়।

সুতরাং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত অবশিষ্ট অংশের প্রাপ্যতার ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ধরে নেয়া অবশিষ্ট অংশের পরিবর্তে সূত্র মোতাবেক সুনির্দিষ্ট শ্রেণিগত আনুপাতিক অংশ নির্ধারিত হয়ে যায়। যেমন শুধু এক বা একাধিক পুত্রের অংশ, (শুধু দুই কন্যার অংশ) এবং ৪:১৭৬ আয়াতের ক্ষেত্রে, এক বা একাধিক ভাইয়ের অংশ, (শুধু দুইয়ের অধিক বোনের অংশ) ইত্যাদি সবই আয়াতের বক্তব্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়।

এ বইতে আল কুরআনের উত্তরাধিকারের বিধান বা নির্ধারিত বণ্টন বিধি সম্পর্কিত আয়াতসমূহের বক্তব্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে কিভাবে এবং কার জন্য কী সুনির্দিষ্ট হয়, তা বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এ অধ্যায়ে যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হলো এ বইয়ে উপস্থাপিত তথ্যগত বিশ্লেষণ অনুসারে তার প্রতিটির সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধান নির্ণয় করা সম্ভব হবে, ইনশাআল্লাহ।

অধ্যায় ২২ : প্রচলিত ফারায়েজ ও কুরআনিক উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির তুলনামূলক চিত্র

এ বইয়ে উপস্থাপিত কুরআনিক উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির সাথে প্রচলিত ফারায়েজের তুলনামূলক চিত্র তথা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলো।

মিলসমূহ

১. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে পুত্র-কন্যার পারস্পরিক অনুপাত পুত্র:কন্যা = ২:১।

২. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতা না থাকা অবস্থায় ভাইবোনের পারস্পরিক অনুপাত ভাই:বোন = ২:১।

৩. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে অন্য ওয়ারিশের উপস্থিতিতে পুত্র জীবিত না থাকলে দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যার অংশ ২/৩  ।

৪. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে অন্য ওয়ারিশের উপস্থিতিতে পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতা না থাকা অবস্থায় ভাই জীবিত না থাকলে দুই বা দুইয়ের বেশি বোনের অংশ ২/৩ ।

৪. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে অন্য ওয়ারিশের উপস্থিতিতে পুত্র জীবিত না থাকলে একটিমাত্র কন্যার অংশ ১/২  ।

৫. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে অন্য ওয়ারিশের উপস্থিতিতে পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতা না থাকা অবস্থায় ভাই জীবিত না থাকলে একটিমাত্র বোনের অংশ ১/২ ।

৬. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে সন্তান জীবিত থাকলে পিতার অংশ ১/৬ ।

৭. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে সন্তান জীবিত থাকলে মাতার অংশ ১/৬ ।

৮. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে সন্তান ও ভাই-বোন জীবিত না থাকলে মাতার অংশ ১/৩ ।

৯. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে স্ত্রীর সন্তান জীবিত না থাকলে স্বামীর অংশ  ১/২  ।

১০. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে স্ত্রীর সন্তান জীবিত থাকলে স্বামীর অংশ ১/৪  ।

১১. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে স্বামীর সন্তান জীবিত না থাকলে স্ত্রীর বা স্ত্রীদের অংশ ১/৪ ।

১২. কুরআনিক বণ্টন বিধি ও প্রচলিত ফারায়েজ উভয়টিতে স্বামীর সন্তান জীবিত থাকলে স্ত্রীর বা স্ত্রীদের অংশ ১/৮ ।

অমিলসমূহ

১. প্রচলিত ফারায়েজে ওয়ারিশদের জন্য কৃত ওয়াসিয়্যাতকে রহিত করে দেয়া হয়। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী প্রথমে ওয়াসিয়্যাত ও ঋণ পূরণ করতে হবে তারপর বাকি সম্পদই হবে বণ্টনযোগ্য সম্পত্তি।

২. প্রচলিত ফারায়েজে কুরআনে বর্ণিত উত্তরাধিকারীদের কাউকে যাবিল ফুরুজ (আবশ্যিক অংশের প্রাপক), কাউকে আসাবা (অবশিষ্টভোগী) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুসারে এরূপ বিভাজনের সুযোগ নেই।

৩. প্রচলিত ফারায়েজে কুরআনে উল্লেখিত নয় কিন্তু পুরুষ নিকটতম আত্মীয়ের সূত্রে সাধারণ আত্মীয় (উলুল ক্বুরবা) আসাবা হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী এর মাধ্যমে ‘হুদুদুল্লাহ’ বা আল্লাহ প্রদত্ত সীমা লংঘন হয়।

৪. প্রচলিত ফারায়েজে যাবিল ফুরুজ বা আসাবা থাকলে উলুল আরহাম (নারী নিকটতম আত্মীয়ের সূত্রে সাধারণ আত্মীয়, যেমন মামা, খালা) বঞ্চিত হয়। কিন্তু কুরআন অনুযায়ী, সকল রক্তসম্পর্কের আত্মীয়ই ‘উলুল আরহাম’, তারা কোনো পুরুষের মাধ্যমে সম্পর্কিত হোক বা নারীর মাধ্যমে সম্পর্কিত হোক। কুরআনে যাদেরকে ওয়ারিহ করা হয়েছে তারাই প্রথম শ্রেণির উলুল আরহাম তথা আক্বরাবূন। অন্যরা দ্বিতীয় শ্রেণির উলুল আরহাম তথা উলুল ক্বুরবা। আক্বরাবূনের কেউ জীবিত থাকা অবস্থায় উলুল ক্বুরবা ওয়ারিশ হবে না।

৫. প্রচলিত ফারায়েজে পিতা জীবিত না থাকলে দাদা-দাদীকে ওয়ারিস করা হয়, মৃত নাতির চাচা জীবিত কিনা তা বিবেচ্য নয়, যেহেতু দাদার সাথে সম্পর্ক পিতার মাধ্যমে, চাচার সাথেও সম্পর্ক পিতার মাধ্যমে, দাদা ও নাতির মধ্যে সম্পর্কসূত্রের ক্ষেত্রে চাচা মাধ্যম নন। কিন্তু বিপরীতক্রমে দাদার সম্পদে ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, যদি তার চাচা জীবিত থাকে। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী ইয়াতীম নাতিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই। বিশেষ করে সাধারণভাবে আত্মীয়-অনাত্মীয় সকল ইয়াতীমের বিষয়েও আল্লাহ সচেতনতার সাথে আচরণ করার জন্য উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির অন্তর্ভুক্ত ৪:৯-১০ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

৬. প্রচলিত ফারায়েজে ওয়ারিসদের অংশের যোগফল যখন ১ এর চেয়ে কম বা বেশি হয় তখন ক্ষেত্রবিশেষে আউল বা রদ্দের নিয়মে এর সমাধান করা হয়। কিন্তু আউল ও রদ্দের নীতির ক্ষেত্রে এমন কিছু ধারা রয়েছে যাতে সবাইকে আউল বা রদ্দের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। কুরআনিক উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি অনুযায়ী উত্তরাধিকারের বণ্টন পদ্ধতি হতে হবে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি। আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি এবং আউল ও রদ্দ নীতি মূলগতভাবে একই বণ্টন পদ্ধতির দুটি ভিন্ন ধরনের গাণিতিক প্রকাশ। কিন্তু আউল ও রদ্দ নীতিতে কিছু বিশেষ ধারা উপধারা যোগ করার মাধ্যমে তা সর্বক্ষেত্রে একই নিয়মে প্রয়োগ করা হয় না। এর ফলে তা কুরআনিক বণ্টন পদ্ধতির সাথে অসামঞ্জস্যশীল হয়ে পড়ে।

৭. প্রচলিত ফারায়েজে একজনমাত্র যাবিল ফুরুজ ওয়ারিস থাকলে সে তার জন্য বর্ণিত অংশ পাবে এবং বাকি অংশ আসাবা বা যাবিল আরহামের মধ্যে বণ্টিত হবে। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে বন্টন করতে হবে বিধায় একজনমাত্র ওয়ারিস থাকলে তার জন্য উল্লেখিত অংশ যা-ই হোক না কেন তা সমস্ত অংশে রূপান্তরিত হয় অর্থাৎ সে একাই সমস্ত উত্তরাধিকার লাভ করবে।

৮. প্রচলিত ফারায়েজে কালালাহ এর সংজ্ঞা নিয়ে বিভিন্ন মতের উদ্ভব ঘটেছিল তবে শেষ পর্যন্ত ইজমা হয়েছে যে, যে মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যা নেই তাকে কালালাহ বলে। অবশ্য এক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রসিদ্ধ মত হিসেবে এটিও চালু আছে যে, পিতা ও পুত্র না থাকলে সে কালালাহ, মাতা ও কন্যা জীবিত থাকলেও সমস্যা নেই। কুরআনিক বণ্টন বিধির তথ্যগত বিশ্লেষণ থেকে বুঝা যায় যে, কালালাহ হচ্ছে যে ভাই/বোন তার মৃত ভাই-বোনের উত্তরাধিকার লাভের জন্য দুটি শর্তের কোনো একটি উপস্থিত থাকে, শর্ত দুটি হলো- তাদের পিতা-মাতা নেই কিন্তু মৃত ব্যক্তির সন্তান আছে, অথবা মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই, পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক।

৯. প্রচলিত ফারায়েজে কারো কারো মতে সূরা নিসার ১২ নং আয়াতের শেষার্ধ তথা কালালাহ সম্পর্কিত অংশ সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াত অনুযায়ী মানছুখ (রহিত) হয়ে গেছে। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী এরূপ রহিতকরণের ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়।

১০. প্রচলিত ফারায়েজ অনুযায়ী সূরা নিসার ১২ নং আয়াতে ভাই-বোন বলতে বৈপিত্রেয় ভাই-বোনকে বুঝে নিতে হবে এবং সূরা নিসার ১৭৬ নং আয়াতে ভাই-বোন বলতে পূর্ণ আপন ও বৈমাত্রেয় ভাই-বোনকে বুঝে নিতে হবে। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী সূরা নিসার ১২ নং ও ১৭৬ নং আয়াতে ভাই-বোনকে বুঝাতে একইভাবে ‘আখু’ ও ‘উখতু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। তাই এ দুই আয়াতের দুইটিতে দুই ধরনের ভাই-বোনকে বুঝে নেয়ার অবকাশ নেই।

১১. প্রচলিত ফারায়েজ অনুযায়ী সন্তান না থাকলে ভাই-বোন থাকলেও পিতা জীবিত থাকলে ভাই-বোন কিছু পাবে না, বরং মাতার অংশের পর পিতা একাই অবশিষ্টভোগী হবে। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী সন্তান না থাকলে ভাই-বোন সন্তানের সমানুপাতিক অংশের উত্তরাধিকারী হবে।

১২. প্রচলিত ফারায়েজ অনুযায়ী যখন পূর্ণ আপন ভাই-বোন সম্পূর্ণ বঞ্চিত হওয়ার অবস্থা তৈরি হয় তখন তাদেরকে বৈপিত্রেয় ভাইদের সাথে সমান অংশীদার করে দিতে হবে। এটাকে হিমারিয়া নীতি বা গাধা সমাচার নীতি বলা হয়। কুরআনিক বণ্টন বিধি অনুযায়ী আল্লাহর বিধান স্বয়ং সত্য ও ন্যায়ে পরিপূর্ণ বিধায় এর কোন লংঘন করলে তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তাই কোনো অবস্থায় যদি পূর্ণ আপন ভাইবোনের কোনো অংশ না থাকে সে অবস্থায় তারা পাবে না, কিন্তু তাদেরকে অন্য কারো সাথে অংশীদার করা যাবে না। বরং সে অবস্থায় তাদেরকে উলুল ক্বুরবা হিসেবে অনুদান দেয়া যেতে পারে।