আল কুরআনের আলোকে উত্তরাধিকারের বিধান বইটি এ বিষয়ে ‘ফারায়েজ’ নামে প্রচলিত বইসমূহের চেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী একটি উপস্থাপনা। প্রচলিত ফারায়েজ বা মুসলিম উত্তরাধিকার বণ্টন বিধিকে আল কুরআনের আলোকে পর্যালোচনা করলে এতে কুরআনে বর্ণিত বণ্টন বিধির সাথে অনেক মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। প্রচলিত ফারায়েজের উপর ভিত্তি করে এ বিষয়ে গাণিতিক অসঙ্গতিসহ সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে মানবিক দিকটিকে উপেক্ষা করার অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ধর্মীয় আবেগের ভিত্তিতে এরূপ প্রশ্ন উত্থাপনকে ধর্ম বিরুদ্ধতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং দায়সারা পর্যায়ের জবাব দেয়ার চেষ্টা করা হয়, যাতে প্রকৃতপক্ষে উত্থাপিত অভিযোগের যথার্থ সমাধান পাওয়া যায় না। এই প্রেক্ষিতে বইটিতে বস্তুত কুরআনে উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধির বিস্তারিত দিক কী এবং কেন তা যৌক্তিক, তা তুলে ধরা হয়েছে।
মৃত্যুর পূর্বেই সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গতভাবে ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা হলো, এতে নির্ধারিত উত্তরাধিকার প্রাপকদের মধ্যে নির্ধারিত হারে বণ্টন করতে হবে মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত ও ঋণ পরিশোধের পরে। অথচ প্রচলিত ভুল ব্যাখ্যার কারণে ওয়াসিয়্যাতের বিধানকে বাধ্যতামূলক হিসেবে কার্যকর করা হয় না এবং যাদের জন্য উত্তরাধিকারের নির্ধারিত অংশ আছে তাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা হয় না। তাই বইটিতে ওয়াসিয়্যাতের যৌক্তিকতা ও আবশ্যকতা সম্পর্কেও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
বইটিতে উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধির প্রাসঙ্গিক শব্দ ও ধারণাগুলোর বিস্তারিত পর্যালোচনামূলক উপস্থাপনার মাধ্যমে কে কোন অবস্থায় বা কোন শর্তে কতটুকু পাবে তার বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে যে ফতোয়া বা মাসয়ালার কারণে উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে ইয়াতীম নাতিদেরকে বঞ্চিত করা হয়, কুরআনের আলোকে তার পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, ইয়াতীম নাতিদেরকে বঞ্চিত করার নীতি কুরআনসম্মত নয়। গবেষণামূলক তথ্যের মাধ্যমে দাদা-দাদী বা নানা-নানী এবং ইয়াতীম নাতির অংশ নির্ণয়ের উপায় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
উত্তরাধিকারের বিধানের কুরআনভিত্তিক উপস্থাপন হিসেবে বইটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। আয়াতভিত্তিক যাচাইয়ের মাধ্যমে এতে কোনো ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি চিহ্নিত হলে পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধন করা হবে, ইনশাআল্লাহ।
ওয়াসিয়্যাতের বিধান ও উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি কুরআনে উল্লেখিত দুটি বাধ্যতামূলক বিধান। এ বিধানের ভিত্তিমূল হিসেবে যে মূলনীতি জানানো হয়েছে তা হলো: আল্লাহর কিতাবে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়গণ একে অপরের প্রতি অগ্রাধিকারী (৮:৭৫, ৩৩:৬)। একে অন্যের উত্তরাধিকার হরণ করা অত্যন্ত অসঙ্গত কর্ম তথা গর্হিত অপরাধ (৮৯:১৭-২০)। বলপ্রয়োগপূর্বক নারীদের সম্পদের ওয়ারিস হওয়া বা ভোগদখল করা কোনোক্রমেই বৈধ নয় (৪:১৯)।
কুরআনে ওয়াসিয়্যাতের বিধান সম্পর্কিত আয়াতসমূহ হচ্ছে ২:১৮০-১৮২, ৫:১০৬-১০৮, ২:২৪০ এবং উত্তরাধিকারের (তুরাস) নির্ধারিত বণ্টন বিধি সম্পর্কিত আয়াতসমূহ হচ্ছে: ৪:৩৩, ৪:৭-১৪, ৪:১৭৬।
৪:১১-১২ আয়াতে চারবার বলা হয়েছে যে, উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি কার্যকর হবে ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের পরে। আর উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির প্রসঙ্গে ৪:১৩-১৪ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তা লংঘন করলে জাহান্নামে যেতে হবে এবং চিরকাল থাকতে হবে।
উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে ৪:১১ আয়াতে বলা হয়েছে ‘তোমরা জান না তোমাদের পিতাগণ ও পুত্রগণের মধ্যে কে তোমাদের (সমাজের) জন্য উপকার করার দিক থেকে অধিক নিকটবর্তী হবে? এটি (উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি) আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ফরজ। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।’ ৪:১২ আয়াতে বলা হয়েছে ‘এটি (উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি) আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ওয়াসিয়্যাত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সহনশীল’। ৪:১৭৬ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য (উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি) স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন, পাছে তোমরা বিভ্রান্ত হবে। আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী’।
বর্তমানে উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি মুসলিম সমাজে সুন্নী আইন ও শিয়া আইন ইত্যাদি নামে বিভিন্নভাবে প্রচলিত রয়েছে। উত্তরাধিকারের বিভিন্ন বণ্টন বিধির ক্ষেত্রে কিছু আপত্তি এবং তার কিছু জবাবও প্রচলিত রয়েছে। যেমন কুরআনে উত্তরাধিকারের বিষয়ে সুস্পষ্ট, সম্পূর্ণ, সুসমঞ্জস ও যৌক্তিক বণ্টন বিধি রয়েছে কিনা? এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উত্থাপিত প্রশ্ন হলো, কুরআনে প্রদত্ত বন্টনবিধির অংশগুলোর যোগফল কখনো কখনো সমস্তের চেয়ে কম বা বেশি হয়ে যায় কেন? এটা কি কোনোরূপ গাণিতিক ত্রুটি? প্রচলিত আউল ও রদ্দনীতি কি একটি আসমানী বিধানের কৃত্রিম সংশোধনমূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছে? প্রচলিত আছে যে, উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির মাধ্যমে ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হয়ে গেছে। আরেকটি প্রচলিত কথা হচ্ছে, উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বন্টন বিধিতে ইয়াতীম নাতি তার দাদার সম্পদে নিজ চাচার উপস্থিতিতে ওয়ারিস হওয়ার সুযোগ নেই। বলা হয় যে, এ অবস্থায় তাকে ওয়ারিস গণ্য করলে তা হবে কুরআনের বিধানের লংঘন। পক্ষান্তরে মৃত ব্যক্তির পিতার অবর্তমানে মৃত ব্যক্তির দাদা (অর্থাৎ নাতির সম্পদে দাদা) উত্তরাধিকার পাবে, এক্ষেত্রে তার চাচা জীবিত থাকা কোনো সমস্যা নয়। মনে করা হয় যে, এটাই কুরআনের বিধান অনুসারে স্বাভাবিক ব্যবস্থা।
বইটি রচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ সকল আপত্তি অভিযোগের প্রকৃত সমাধান নির্ণয়সহ প্রচলিত উত্তরাধিকার বন্টনবিধিতে কুরআনে প্রদত্ত বন্টনবিধির সাথে কোনো সাংঘর্ষিকতা আছে কিনা এবং সেই কারণে কুরআনের মাধ্যমে যার জন্য যা দেয়া হয়েছে, সে কোনোভাবে তা থেকে বঞ্চিত হয় কিনা তা যাচাই করা। এভাবে কুরআনে বর্ণিত উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বন্টনবিধি অনুযায়ী কার প্রাপ্য কতটুকু তা বুঝে নেয়ার মাধ্যমে প্রত্যেকের যথার্থ অধিকার পরিপূরণের ব্যবস্থা করা এবং সমাজ কল্যাণের সর্বোত্তম ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত করা। সেই সাথে কুরআনে প্রদত্ত উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বন্টনবিধি লংঘন করলে জাহান্নামে যেতে হবে বিধায় তা থেকে সতর্ক থাকা ও সতর্ক করা।
মৃত ব্যক্তির সম্পদ বন্টনের ব্যবস্থা হিসাবে ওয়াসিয়্যাতের বিধানই প্রাথমিক গুরুত্বসম্পন্ন (সূরা বাকারা ২:১৮০-১৮২)। ওয়াসিয়্যাতের মাধ্যমেই প্রত্যেক ব্যক্তির বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে তার জন্য যথাযথ অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। যেমন: এর মাধ্যমে কোনো সন্তান কম বয়সী বা অপ্রতিষ্ঠিত থাকলে তাকে অধিক সম্পদ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু যদি কেউ ওয়াসিয়্যাত না করে থাকে বা যদি তার ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের পর কোনো সম্পদ থাকে তাহলে ঐ অবশিষ্ট সম্পদের ক্ষেত্রেই উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি প্রযোজ্য (সূরা নিসা ৪: ১১-১২)। উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিতে দুটি পুত্র তাদের বয়স, সম্পদ ইত্যাদির পার্থক্য সত্ত্বেও পরস্পরের সমান অংশ পাবে। কিন্তু পুত্র, কন্যা, স্বামী/স্ত্রী, পিতা, মাতা, ভাই, বোন এক শ্রেণি অন্য শ্রেণি থেকে ভিন্ন ভিন্ন নির্ধারিত অনুপাতে পাবে, সকল শ্রেণি সমানুপাতে পাবে না। উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিতে আল্লাহ যার জন্য যে আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করেছেন সেটাই তার প্রাপ্য অধিকার। যেমন বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীকে দেনমোহর দিতে হয় না, বরং আল্লাহর আইন অনুযায়ী বিয়ের শর্ত হিসেবে স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে দেনমোহর দেয়া আবশ্যিক দায়িত্ব তথা স্ত্রীলোকের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ অধিকার; উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির বিষয়টিও অনুরূপ। ওয়াসিয়্যাত ও উত্তরাধিকারের বিধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক ভারসাম্যের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। একজন ব্যক্তি তার জীবিতকালে তার উপার্জিত বা প্রাপ্ত সম্পদের আমানতদার মালিক এবং তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যে, সে তার মৃত্যুর পূর্বে তার সম্পদের বিষয়ে ওয়াসিয়্যাত করে যাবে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার পরিত্যক্ত সম্পদ মহাবিশে^র যাবতীয় সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত (তথা উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি) অনুযায়ী (মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ, মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও উত্তরাধিকারের বিধান পালনার্থে) বন্টিত হবে।
উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা লাভের ক্ষেত্রে সূরা নিসা ৪:১১ আয়াতের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, তোমরা জানো না, তোমাদের সমাজকল্যাণের জন্য তোমাদের পিতা-মাতা ও তোমাদের পুত্র-কন্যার মধ্যে কে উপকার সাধনে অধিক নিকটবর্তী হবে? অর্থাৎ যখন ওয়াসিয়্যাতের পর কোনো সম্পদ অবশিষ্ট থাকবে তখন ঐ সম্পদে কারো প্রত্যক্ষ অধিকার না থাকায় সমাজ কল্যাণের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য তার বন্টননীতি কি হবে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হতো না, তাই আল্লাহ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির মাধ্যমে তা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন।
উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে একটা শর্তসাপেক্ষ দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন: উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুসারে, এক পুত্র পাবে দুই কন্যার সমানুপাতিক। এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে এ নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল বিধান হচ্ছে, যদি পিতা-মাতা সন্তানের উপর নির্ভরশীল হয় সে অবস্থায় তাঁদের সেবা ও সহযোগিতা করতে সক্ষম হলে একটি পুত্রকে দুইটি কন্যার সমানুপাতে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে অধিকার ও দায়িত্বের এই অনুপাতের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো, দুটি পুত্র তাদের বয়স ও সামর্থ্যের পার্থক্য সত্ত্বেও পরস্পর সমানুপাতে উত্তরাধিকার লাভ করে, যেখানে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অবশ্যই ঐ পার্থক্য একটি বাস্তব অনুঘটকে (ঋধপঃড়ৎ) পরিণত হবে। উত্তরাধিকারের প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে মোটাদাগে প্রাপকের শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে (পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী, স্ত্রী, ভাই, বোন), কিন্তু একই শ্রেণির সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন অবস্থার তারতম্য (যেমন, বয়স ও সামর্থ্য) অনুসারে পার্থক্য করা হয়নি। কারণ এক্ষেত্রে এরূপ তারতম্যের কোনো সুনির্দিষ্টতা নেই বরং তা পরিস্থিতি সাপেক্ষ বিষয় বিধায় তা স্থায়ী বিধানে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে অনুপযোগী। এরূপ বাস্তবসম্মত তারতম্য বিবেচনায় সম্পদের বণ্টন নিশ্চিত করার ব্যবস্থাপনা হিসেবে উত্তরাধিকারের বিধানে প্রথমে ওয়াসিয়্যাতের বিধান পরিপূরণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
বিবেক বুদ্ধি অনুযায়ী বুঝা যায় যে, কোনো ব্যক্তির স্বাভাবিক মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে সে তার নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ওয়াসিয়্যাত করে যাওয়া উচিত। কারণ সে বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে তার সম্পদ থেকে কাকে কতটুকু দিতে হবে তা নির্ধারণ করতে পারবে। কিন্তু নিকটতম আত্মীয়দের মধ্যে কে কে গণ্য হবে তা সর্বসম্মতিক্রমে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। আর যদি কারো ওয়াসিয়্যাত না থাকে অথবা ওয়াসিয়্যাতের পরবর্তীতেও কোনো সম্পদ অবশিষ্ট থাকে তাহলে এক্ষেত্রে দুইটি ব্যবস্থার একটি অবলম্বন করা প্রয়োজন হতো। হয়তো এক্ষেত্রে তার সকল উত্তরাধিকারীকে তা সমানভাবে দিতে হতো। নয়তো তাদের শ্রেণিবিন্যাস করে প্রত্যেক শ্রেণির সকল সদস্যকে সমান হারে কিন্তু এক শ্রেণির তুলনায় অন্য শ্রেণিকে অসমান হারে দিতে হতো। কিন্তু উত্তরাধিকারী কাদেরকে নির্ধারণ করা হবে তা সর্বসম্মতিক্রমে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এছাড়া উত্তরাধিকারীদেরকে সমান হারে দিলে তা কি বেশি যৌক্তিক হবে না তাদের শ্রেণিবিভাগ করলে তা বেশি যৌক্তিক হবে তাও সর্বসম্মতিক্রমে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। আর যদি শ্রেণিবিভাগ করা হয় তবে কোন শ্রেণিকে কতটুকু দিতে হবে তাও সর্বসম্মতিক্রমে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। যদি কোনোভাবে আত্মীয়দের শ্রেণিবিভাগ ও শ্রেণিগত নৈকট্যের তারতম্য নির্ধারণ ছাড়া এবং প্রাধিকারের ভিত্তিতে কোনো বাধ্যতামূলক বিধান নির্ধারণ ছাড়া উত্তরাধিকারের বণ্টনের বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে উলিল আমরের (Central Authority) উপর ছেড়ে দেয়া হতো যে, মৃত ব্যক্তির বিভিন্ন আত্মীয়দের বাস্তব অবস্থা সাপেক্ষে উলিল আমর (Central Authority) তা বণ্টন করবেন, তবে তাও বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করতো। সুতরাং বিবেক বুদ্ধি অনুযায়ী, উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি আল্লাহ কর্তৃক সরাসরি নির্ধারিত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধির শেষ আয়াতটিতে (৪:১৭৬) বলা হয়েছে, আল্লাহ তোমাদের জন্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন, পাছে তোমরা বিভ্রান্ত হবে। সুতরাং উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ৪:১৩ আয়াতে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিকে ‘হুদুদুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং কুরআনে উল্লেখিত ‘হুদুদুল্লাহ’ এর আওতায় থাকা কোনো ওয়ারিসকে বাদ দেয়া যাবে না এবং তাদের মধ্যকার কেউ থাকা অবস্থায় অন্য কাউকে ওয়ারিস হিসেবে যোগ করা যাবে না এবং তাদের কাউকে তার প্রাপ্য অংশের চেয়ে কম বা বেশি দেওয়া যাবে না।
৪:১৩ আয়াতে কুরআনে প্রদত্ত উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিকে ‘হুদুদুল্লাহ’ হিসেবে উল্লেখ করার পর আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্যের বিষয় বলা হয়েছে। হুদুদুল্লাহর বাস্তবায়ন হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য। আর হুদুদুল্লাহর আওতায় থাকা কোনো ওয়ারিস যদি না থাকে সে অবস্থায় মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের ব্যবস্থাপনা বা বণ্টন কিভাবে হবে সেক্ষেত্রে রসূলের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হচ্ছে রসূলের আনুগত্য। অন্য কথায় এরূপ সম্পদের ব্যবস্থাপনা বা বণ্টন রসূলের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে হবে। এক্ষেত্রে তিনি কুরআনে বর্ণিত বণ্টন বিধির ছায়া অবলম্বনে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে তা বণ্টন করতে পারেন অথবা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে অন্য কোনো ব্যবস্থাপনা করতে পারেন। যখন যেখানে রসূল উপস্থিত থাকবেন না তখন সেখানে নির্বাহী দায়-দায়িত্ব পালনকারী কর্তৃপক্ষ হচ্ছেন ‘উলিল আমর’ অর্থাৎ মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বের অধিকারী দায়িত্বশীল (Central Authority) । সুতরাং বর্তমানে রসূলের আনুগত্যের নির্দেশ সম্বলিত ধারাটির রূপান্তরিত প্রয়োগক্ষেত্র হচ্ছে ‘উলিল আমরের আনুগত্য’।
যার ক্ষেত্রে কুরআন নির্ধারিত কোনো ওয়ারিস নেই তার পরিত্যক্ত সম্পদ কুরআন নির্ধারিত ওয়ারিসদের মধ্যে নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বন্টনের সুযোগ নেই তথা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় সেটার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মুসলিম উম্মাহর উলিল আমরের তথা সামষ্টিক বিষয়াদির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের (Central Authority) উপর ন্যস্ত হবে। অর্থাৎ এমতাবস্থায় তা মুসলিম উম্মাহর বাইতুল মালের অংশ হবে অথবা উলিল আমর কুরআনে থাকা ওয়ারিসদের মধ্যে নির্ধারিত বণ্টন বিধির ধরন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার আলোকে মৃত ব্যক্তির দূরবর্তী আত্মীয়গণের মধ্যে আত্মীয়তার নৈকট্যের মাত্রা অনুসারে ও কুরআনে বর্ণিত বন্টনবিধির ছায়া অবলম্বনে বন্টন করে দিতে পারবেন। অথবা মৃত ব্যক্তির দূরবর্তী আত্মীয়দের বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় পরামর্শক্রমে বণ্টন করতে এবং প্রয়োজনে বৃহত্তর সমাজ কল্যাণার্থে একটি অংশ পরিগ্রহণ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে যে বন্টনবিধি অনুসরণ করা হবে তা হচ্ছে নির্বাহী বন্টনবিধি। এভাবে যাদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হবে তারা নির্বাহী বন্টনবিধির ভিত্তিতে ওয়ারিস হবে কিন্তু তারা মাওয়ালিয়া (নির্দিষ্ট ওয়ারিস) হিসাবে গণ্য হবে না। কারণ কুরআনের মাধ্যমে যারা মাওয়ালিয়া হিসাবে সাব্যস্ত হয়েছে তারা এর বাইরে রয়েছেন।
উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি অনুসারে প্রত্যেক উত্তরাধিকারী 'যাকার' (পুরুষ) বা 'উনছা' (নারী) হিসেবেই পরিগণিত হবে, এতে কাউকে 'না নারী না পুরুষ' হিসেবে চিহ্নিত করার অবকাশ নেই। সুতরাং হিজড়াদের মধ্য থেকে কাউকে নারী হিসেবে এবং কাউকে পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার বণ্টিত হবে। এক্ষেত্রে যার মধ্যে প্রকাশিত লক্ষণের বেশি মাত্রা নারীদের মতো তাকে নারী হিসেবে এবং যার মধ্যে প্রকাশিত লক্ষণের বেশি মাত্রা পুরুষদের মতো তাকে পুরুষ হিসেবে সাব্যস্ত করা যেতে পারে। অথবা যে নিজেকে নারী হিসেবে বিবেচনা করে তাকে নারী হিসেবে এবং যে নিজেকে পুরুষ হিসেবে বিবেচনা করে তাকে পুরুষ হিসেবে সাব্যস্ত করা যেতে পারে। বিশেষ করে তাদের লৈঙ্গিক লক্ষণ বিবেচনার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। বস্তুত যে বিষয়ে কোনো এক ধরনের বিধান নির্দিষ্ট করে দিলে তা ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় সমান কল্যাণকর হতো না, সেরূপ বিষয়ে কুরআনে কোনো এক ধরনের বিধান নির্দিষ্ট না করে বরং সেক্ষেত্রে বাস্তবভিত্তিক বিভিন্ন পরিবর্তনশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবকাশ রাখা হয়েছে। আর তাই এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার বিষয়টি কুরআনে নির্দেশিত পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ নীতির উপর ভিত্তি করে সম্পাদিত হবে।
৪:৭ থেকে ৪:১৪ পর্যন্ত আয়াতগুলো একই বক্তব্যের কাঠামোবদ্ধ নয় বা একটি অন্যটির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত বাক্য বিন্যাসে গঠিত একক বক্তব্য নয়। কিন্তু এ বক্তব্যগুলোর মধ্যে একটি পারস্পরিক যোগসূত্র রয়েছে যা তাদের পূর্বাপর বক্তব্য প্রসঙ্গের সম্পর্ক থেকে সুস্পষ্ট হয়। বক্তব্যগুলোর স্বাতন্ত্র্য আবিষ্কার করা প্রয়োজন যেন একটিকে অন্যটির অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করা না হয়, আবার বক্তব্যগুলোর যোগসূত্র অনুধাবন করা প্রয়োজন যেন বক্তব্যগুলোর ধারাক্রমিক অবস্থানের কারণ অনুধাবন করা যায় এবং আন্তঃপ্রাসঙ্গিক তথ্যের সমন্বয় সাধন করা যায় তথা একটি বিষয়ের নিয়ামক/ প্রভাবক একাধিক স্বতন্ত্র ও সুসমঞ্জস বক্তব্যের সব নির্দেশনা যথানিয়মে বাস্তবায়ন করা যায়।
৪:৭ আয়াতের মাধ্যমে ৪:৬ পর্যন্ত আয়াতের বক্তব্য থেকে স্বতন্ত্র একটি বক্তব্য শুরু হয়েছে। ৪:৭ আয়াত থেকে শুরু হওয়া বক্তব্য ৪:৯ আয়াতে সমাপ্ত হয়েছে। ৪:১০ আয়াত একটি স্বতন্ত্র বক্তব্য। তারপর ৪:১১ থেকে ৪:১৪ আয়াত একটি স্বতন্ত্র বক্তব্য। তারপর ৪:১৫ আয়াত থেকে আরেকটি বক্তব্য শুরু হয়েছে যা ৪:১৪ পর্যন্তকার আয়াতের সাথে ‘ওয়া’ দিয়ে জুড়ে দেয়া হয়েছে এবং এর মাধ্যমে কিছু বিধান লংঘনের ক্ষেত্রে পার্থিব সুনির্দিষ্ট দন্ডবিধি উল্লেখ করা হয়েছে। উত্তরাধিকারের বিধান লংঘন করলে মুসলিম উম্মাহর ক্ষমতা থাকলে ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা সংশোধন করে দেবে এবং বিধান লংঘনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্বাহী পর্যায়ে কোনো দন্ডবিধি আরোপ করবে, যা আল্লাহ সাংবিধানিকভাবে (তথা কুরআনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে) নির্দিষ্ট করে দেননি। আবার যদি কখনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দন্ড দেয়ার প্রয়োজন বোধ না করা হয় তাহলে দন্ড ছাড়াই শুধু সংশোধন করে দেয়া হবে। উলিল আমর শব্দের অর্থই হলো এ ধরনের কিছু নির্বাহী বিষয় আছে। তবে যা নিতান্ত ধর্মীয় বিষয়, সামাজিক বিষয় নয়, তাই একে রাষ্ট্রীয় আইনরূপে প্রবর্তন (নির্বাহী সংবিধানরূপে প্রবর্তন) করা হয় না, তার জন্য কোনো ধরনের নির্বাহী দন্ডবিধি প্রণীত হবে না, যেমন সালাত সম্পাদন না করার জন্য। উত্তরাধিকারের বিধান লংঘন করলে তার জন্য সাংবিধানিকভাবে (কুরআনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে) কোনো দন্ডবিধি নির্দিষ্ট করা হয়নি। তবে এর সাথে সম্পদের ব্যবস্থাপনা জড়িত বিধায় তা নিতান্ত ধর্মীয় বিষয় নয়। তাই প্রয়োজনসাপেক্ষে এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় আইন প্রবর্তন করা যেতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ এ সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় আইন প্রবর্তিত করা হবে না ততক্ষণ এটি ধর্মীয় বিষয় হিসেবেই বিবেচিত, তাই দন্ডবিধির প্রশ্ন নেই। অন্যদিকে সালাত নিতান্ত ধর্মীয় বিষয়, তা পারস্পরিক লেনদেনের বিষয় নয়, তাই সালাত সম্পাদন না করার জন্য কখনো রাষ্ট্রীয় আইন করা যেতে পারে না। যাকাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অনুদান ঘটলেও তা সালাতের মতই শুধু ধর্মীয় কাঠামো-সংশ্লিষ্ট, সর্বজনীন বিষয় নয়, তাই যারা সালাত ও যাকাত করবে তারাই ধর্মীয় ভাই (৯:৫, ৯:১১, ৯৮:৫)। তাই যাকাত প্রদান না করার ক্ষেত্রেও কোনো রাষ্ট্রীয় দন্ডবিধি প্রবর্তন করা যেতে পারে না। সালাত ও যাকাত অস্বীকারকারী বা অস্বীকারের পর্যায়ভুক্ত পরিত্যাগকারীকে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের পরিধি বহির্ভূত বিবেচনা করা যেতে পারে, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় আইনের বাস্তবায়ন ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং এক্ষেত্রে আইনের সংস্কারের জন্য নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা চালু রাখতে হবে এবং সঠিক ব্যবস্থার প্রবর্তনের পূর্বে অন্তর্র্বতীকালে নিজের অংশে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটলে হ্রাসের ক্ষেত্রে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অংশের ক্ষেত্রে যার অংশ থেকে যতটুকু নিজের অংশে এসে যায়, তাকে স্বেচ্ছায় দানের মাধ্যমে তা প্রত্যর্পণ করতে হবে।
এ বইটির মৌলিক আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আল কুরআনে ওয়াসিয়াতের বিধান, উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি এবং ফারায়েজ বা প্রচলিত মুসলিম উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি ও তার সাথে কুরআনে বর্ণিত বণ্টন বিধির তুলনামূলক আলোচনা। বইটিতে আয়াতসমূহের সমন্বিত তথ্য ও ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং তুলনামূলক যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধারা উপধারার ক্ষেত্রে প্রকৃত উপলব্ধিতে পৌঁছার চেষ্টা করা হয়েছে। কুরআনে বর্ণিত উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধির যৌক্তিকতা, সামঞ্জস্য ও কল্যাণ সম্পর্কেও যথাসম্ভব আলোচনা করা হয়েছে।
সূরা বাকারা ২:১৮০-১৮২
كُتِبَ عَلَيْكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ إِن تَرَكَ خَيْرًا الْوَصِيَّةُ لِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ بِالْمَعْرُوفِ حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِينَ
২:১৮০ :: তোমাদের উপর বিধিবদ্ধ করা হলো যে, তোমাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু সন্নিকটে এসে গেলে যদি সে সম্পদ রেখে যায় তবে সে তার পিতা-মাতার জন্য এবং অন্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ন্যায়সঙ্গত ওয়াসিয়্যাত করতে হবে। এটা আল্লাহ সচেতনদের উপর দায়িত্ব।
فَمَن بَدَّلَهُ بَعْدَ مَا سَمِعَهُ فَإِنَّمَا إِثْمُهُ عَلَى الَّذِينَ يُبَدِّلُونَهُ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
২:১৮১ :: তারপর যে ব্যক্তি তা শুনার পর সেটাকে (তথা ওয়াসিয়্যাতকে) বদলে দেয়, তবে সেটার (তথা বদল করার) অপরাধ বদলকারীদের উপর বর্তাবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
فَمَنْ خَافَ مِن مُّوصٍ جَنَفًا أَوْ إِثْمًا فَأَصْلَحَ بَيْنَهُمْ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
২:১৮২ :: তবে যে ব্যক্তি ওয়াসিয়্যাতকারী কর্তৃক পক্ষপাতিত্ব হয়েছে বা/এবং (বঞ্চিত করার) অপরাধ হয়েছে বলে আশংকা করে, তারপর সে তাদের মধ্যে বিষয়টি সংশোধন করে দেয় তাহলে এতে তার অপরাধ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াশীল।
সূরা মায়িদাহ ৫:১০৬-১০৮
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا شَهَادَةُ بَيْنِكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ حِينَ الْوَصِيَّةِ اثْنَانِ ذَوَا عَدْلٍ مِّنكُمْ أَوْ آخَرَانِ مِنْ غَيْرِكُمْ إِنْ أَنتُمْ ضَرَبْتُمْ فِي الْأَرْضِ فَأَصَابَتْكُم مُّصِيبَةُ الْمَوْتِ تَحْبِسُونَهُمَا مِن بَعْدِ الصَّلَاةِ فَيُقْسِمَانِ بِاللَّهِ إِنِ ارْتَبْتُمْ لَا نَشْتَرِي بِهِ ثَمَنًا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَىٰ وَلَا نَكْتُمُ شَهَادَةَ اللَّهِ إِنَّا إِذًا لَّمِنَ الْآثِمِينَ
৫:১০৬ :: হে মু’মিনগণ, যখন তোমাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু সন্নিকটে এসে যায় তখন তোমরা ওয়াসিয়্যাত করার সময় তোমাদের মধ্য থেকে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখো। অথবা যদি তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং এ অবস্থায় তোমাদের কাছে মৃত্যুর মুসিবত এসে পড়ে তাহলে (তোমাদের নিজেদের মধ্যকার লোক না পেলে) তোমাদের বাইরের (তথা অন্য অঞ্চলের) দুইজনকে সাক্ষী রাখো। তাদের দুইজনকে সালাতের পরে অপেক্ষমান রাখবে। যদি তোমরা সন্দেহ করো তবে তারা উভয়ে আল্লাহর নামে কসম করবে: আমরা কোনো মূল্যেই তা (তথা সাক্ষ্য) বিক্রয় করবো না, যদিও আত্মীয় হয় আর আমরা আল্লাহর নির্দেশিত সাক্ষ্যকে গোপন করবো না। নিশ্চয় তাহলে আমরা অপরাধীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।
فَإِنْ عُثِرَ عَلَىٰ أَنَّهُمَا اسْتَحَقَّا إِثْمًا فَآخَرَانِ يَقُومَانِ مَقَامَهُمَا مِنَ الَّذِينَ اسْتَحَقَّ عَلَيْهِمُ الْأَوْلَيَانِ فَيُقْسِمَانِ بِاللَّهِ لَشَهَادَتُنَا أَحَقُّ مِن شَهَادَتِهِمَا وَمَا اعْتَدَيْنَا إِنَّا إِذًا لَّمِنَ الظَّالِمِينَ
৫:১০৭ :: তারপর যদি লক্ষণ পাওয়া যায় যে, তারা দুজন অপরাধমূলক দাবি করেছে (তথা সাক্ষ্যে হেরফের করেছে), তাহলে তাদের দুজনের দাবিগত অবস্থানের বিপরীতে অন্য দুজন দাঁড়াবে, যারা হবে তাদের (সাক্ষ্যের) বিপক্ষে অধিকার দাবিকারীদের মধ্য থেকে এবং ঘনিষ্ঠতর/অগ্রাধিকারী । তারপর তারা আল্লাহর নামে কসম করবে: আমাদের সাক্ষ্য তাদের দুইজনের সাক্ষ্যের চেয়ে অধিক যথাযথ। আর আমরা সীমালংঘন করিনি। নিশ্চয় তাহলে আমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।
ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَن يَأْتُوا بِالشَّهَادَةِ عَلَىٰ وَجْهِهَا أَوْ يَخَافُوا أَن تُرَدَّ أَيْمَانٌ بَعْدَ أَيْمَانِهِمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاسْمَعُوا وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
৫:১০৮ :: এ পদ্ধতিই (এ সম্ভাবনার) নিকটতম যে, তারা সঠিক রূপেই সাক্ষ্য দিবে অথবা তারা ভয় করবে যে, তাদের শপথের পরে তাদের শপথকে রদ করা হবে। আর তোমরা আল্লাহ সচেতন হও এবং (যথানিয়মে) শুনো। আর নিশ্চয় আল্লাহ নীতি বিচ্যুত সম্প্রদায়কে পথনির্দেশ করেন না।
সূরা বাকারা ২:২৪০
وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا وَصِيَّةً لِّأَزْوَاجِهِم مَّتَاعًا إِلَى الْحَوْلِ غَيْرَ إِخْرَاجٍ فَإِنْ خَرَجْنَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِي مَا فَعَلْنَ فِي أَنفُسِهِنَّ مِن مَّعْرُوفٍ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
২:২৪০ :: তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদের স্ত্রীদেরকে রেখে মৃত্যুবরণ করে তাদের স্ত্রীদের বিষয়ে (মৃত স্বামীর পরিবার পরিজন বা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি) ওয়াসিয়্যাত হচ্ছে, এক বছর পর্যন্ত তাদের স্ত্রীদেরকে ভরণ পোষণ দিতে হবে এবং ঘর থেকে বের করে দেয়া যাবে না। তবে যদি তারা নিজেরাই বেরিয়ে যায় তাহলে সেক্ষেত্রে তারা ন্যায়সঙ্গতভাবে নিজেদের ক্ষেত্রে যা করে সে বিষয়ে তোমাদের দোষ নেই। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।
ওয়াসিয়্যাত শব্দের শব্দমূল হচ্ছে ‘ওয়াও সদ ইয়া’। ওয়াসিয়্যাত শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বিশেষ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশ, স্বীয় মৃত্যু পরবর্তীতে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে অগ্রিম নির্দেশনা’। ওয়াসিয়্যাত শব্দটি বিভিন্ন শব্দরূপে কুরআনে যেসব স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো। আয়াত রেফারেন্সের প্রথম সংখ্যাটি সূরা নম্বর, দ্বিতীয় অংশটি আয়াত নম্বর এবং তৃতীয় অংশটি আয়াতের মধ্যে শব্দের ক্রমিক সংখ্যা নিদের্শক।
(১) ওয়াসিয়্যাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৮ স্থানে: ২:১৮০:১০, ২:২৪০:৬, ৪:১১:৫১, ৪:১২:২১, ৪:১২:৪৫, ৪:১২:৭৬, ৪:১২:৮৩, ৫:১০৬:১১।
(২) ওয়াসসা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ২, অর্থ: পরিস্থিতি নির্বিশেষে মৌলিক নির্দেশ দেয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ১১ স্থানে: ২:১৩২:১, ৪:১৩১:৯, ৬:১৪৪:২১, ৬:১৫১:৩৯, ৬:১৫২:৩২, ৬:১৫৩:১৪, ২৯:৮:১, ৩১:১৪:১, ৪২:১৩:৬, ৪২:১৩:১৩, ৪৬:১৫:১।
(৩) তাওসিয়াহ (ক্রিয়াবিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ২, অর্থ: পরিস্থিতি নির্বিশেষে মৌলিক নির্দেশ) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩৬:৫০:৩।
(৪) আওসা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪, অর্থ: বিশেষ বিষয়ে বা বিশেষ পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কিত আগাম নির্দেশ দেয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ৬ স্থানে: ৪:১১:১, ৪:১১:৫২, ৪:১২:২২, ৪:১২:৪৬, ৪:১২:৭৭, ১৯:৩১:৬।
(৫) মূসিন (কর্তৃবিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ৪, অর্থ: বিশেষ পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কিত আগাম নির্দেশকারী, স্বীয় মৃত্যু পরবর্তীতে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে অগ্রিম নির্দেশনাকারী, ওয়াসিয়্যাতকারী) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ২:১৮২:৪।
(৬) তাওয়াসাও (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৬, অর্থ: পরস্পরকে উপদেশ দেয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ৫ স্থানে: ৫১:৫৩:১, ৯০:১৭:৬, ৯০:১৭:৮, ১০৩:৩:৬, ১০৩:৩:৮।
কুরআনে ওয়াসিয়্যাতের বিধান সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে এ বিষয়ে যা বুঝা যায় তার বিভিন্ন দিক নিম্নে আলোচনা করা হলো।
সূরা বাকারা ২:১৮০-১৮২ আয়াতে ওয়াসিয়্যাতকে বাধ্যতামূলক হিসেবে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে এবং সূরা মায়িদাহ ৫:১০৬-১০৮ আয়াতে ওয়াসিয়্যাতের সাক্ষ্য সম্পর্কিত বিধান বর্ণিত হয়েছে। ওয়াসিয়্যাতকে বাধ্যতামূলক করার কারণ অনুধাবন করা প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের জন্য অত্যন্ত সহজ একটি বিষয়। যাঁর সম্পদ তিনি যদি ন্যায়সঙ্গতভাবে তথা বাস্তব অবস্থার ন্যায়সঙ্গত বিবেচনার ভিত্তিতে তাঁর পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ওয়াসিয়্যাত করে যান তবে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস পাবে, সম্পদের সুষম বণ্টন হবে এবং প্রত্যেকে যথাযথভাবে প্রয়োজনীয় সম্পদের উপযোগিতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পাবে। এক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত বিবেচনা ওয়াসিয়্যাতকারীর বিবেকের উপর নির্ভরশীল এবং বাস্তব অবস্থার পরিপেক্ষিতে নিজ বিবেকের অনুসরণই তার করণীয়। ওয়াসিয়্যাতের ব্যবস্থা না থাকার অপকারিতা তথা ওয়াসিয়্যাতের উপকারিতা একটি অত্যন্ত স্বত:সিদ্ধ স্পষ্ট বিষয়।
সূরা বাকারায় ওয়াসিয়্যাতকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং সূরা নিসায় উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একটি দাবি করা হয় যে, প্রথমে ওয়াসিয়্যাতের বিধানকে ফরজ করা হয়েছিলো এবং পরে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিকে ফরজ করা হয়েছে এবং এভাবে পরেরটি প্রথমটিকে রহিত করে দিয়েছে। অর্থাৎ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি নাজিলের পর ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হয়ে গেছে। অথচ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির আয়াত ৪:১১ ও ৪:১২তে একবার, দুইবার নয়; বরং পরপর চারবার বলা হয়েছে যে, উত্তরাধিকারের বণ্টন হবে ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ এবং ঋণ পরিশোধের পরে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ওয়াসিয়াতের বিধান এবং উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি পরস্পর সাংঘর্ষিক নয় এবং একটি অন্যটিকে রহিত করে না এবং ওয়াসিয়্যাতের পরে থাকা অবশিষ্ট সম্পদেই উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি ফরজ হিসেবে কার্যকর হবে। সুতরাং ওয়াসিয়্যাতের বিধানকে রহিত বলা একটি বিভ্রান্তি ছাড়া কিছু নয়। বরং আল কুরআন স্ববিরোধমুক্ত, এর কোনো আয়াত কখনো মানছুখ (রহিত) হয়নি।
যদি কারো আকস্মিক মৃত্যু হয় এবং এজন্য ওয়াসিয়্যাত করা সম্ভব না হয় অথবা যদি কেউ ওয়াসিয়্যাত করা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করে, সেক্ষেত্রে ওয়াসিয়্যাত না থাকার কারণে সম্পূর্ণ সম্পদ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টিত হবে।
ওয়াসিয়্যাত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং শর্ত দেয়া হয়েছে ওয়াসিয়্যাত করতে হবে ন্যায়সঙ্গতভাবে (বিল মা’রূফ)। আর ওয়াসিয়্যাতকারী যেভাবে ওয়াসিয়্যাত করেছে তাতে কোনো পরিবর্তন করা অপরাধ এবং যারা তা করবে তারা এ অপরাধে অপরাধী হবে। ওয়াসিয়্যাত করার ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি বজায় রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে এ স্বীকৃতি নিহিত রয়েছে যে, মানুষ ইচ্ছা করলে তার পক্ষে ন্যায়নীতি বজায় রেখে ওয়াসিয়্যাত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ওয়াসিয়্যাতকারীকে তার পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়দের মধ্যে প্রত্যেকের বাস্তব অবস্থা বিবেচনা সাপেক্ষে কার জন্য কতটুকু ওয়াসিয়্যাত করা ন্যায়সঙ্গত হবে তা নির্ধারণের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। সুতরাং ওয়াসিয়্যাতকারীকে সাবধান থাকতে হবে, যেন সে ন্যায়নীতির লঙ্ঘন না করে। পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়দের বাস্তব অবস্থার তারতম্য বিবেচনায় যাকে যেভাবে দেয়া কল্যাণকর ও সঙ্গত হয় সেদিকে লক্ষ্য না রেখে কারো প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে তাকে বেশি দিলে বা কারো প্রতি মনোমালিন্যের কারণে তাকে বঞ্চিত করলে তা ন্যায়সঙ্গত ওয়াসিয়্যাত হবে না।
যদি কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ আশংকা করে যে, ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে ওয়াসিয়্যাতকারীর পক্ষ থেকে কোনো পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে বা কাউকে তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার অপরাধ হয়েছে, তাহলে সে প্রথম পর্যায়ে ওয়াসিয়্যাতকারীর এবং ওয়াসিয়্যাতকৃতদের মধ্যে এবং (ইতোমধ্যে ওয়াসিয়্যাতকারীর মৃত্যু হলে) দ্বিতীয় পর্যায়ে ওয়াসিয়্যাতকৃত বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বিষয়টি উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে একটা সমঝোতায় পৌঁছালে এতে ঐ মীমাংসাকারীর উপর কোনো পাপ বা অপরাধ বর্তাবে না।
ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে কার জন্য কী ওয়াসিয়্যাত করবে বা কাকে কতটুকু দিতে হবে তা নির্দিষ্ট নয় বরং তা ওয়াসিয়্যাতকারীর স্বীয় ন্যায়সঙ্গত বিবেচনার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে কাকে কতটুকু দিলে তার প্রতি পক্ষপাতিত্ব হয় বা কাকে কতটুকু দিলে তার ন্যায্য পাওনা থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয় সেটা গাণিতিকভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়ার মতো কোনো বিষয় নয় বরং এটা একটা পরিস্থিতি সাপেক্ষ বিষয় এবং মানুষ তার বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে।
ওয়াসিয়্যাতকারীর নিকটতম আত্মীয়দের পক্ষ থেকে ওয়াসিয়্যাকারীর ওয়াসিয়্যাতে পক্ষপাতিত্বের বা কাউকে ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে ওয়াসিয়্যাত শ্রবণকারী বা যে কোনো শুভাকাক্সক্ষী ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বিষয়টির সংশোধনের জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে পারেন। কুরআনে এই অনুমতি এবং নির্দেশনা স্পষ্ট।
ওয়াসিয়্যাতকারীর ওয়াসিয়্যাতে ন্যায়নীতির লঙ্ঘন হয়েছে বলে আশংকা করলে আশংকাকারী ব্যক্তি তা সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে দেয়াতে দোষ নেই। এটি থেকে স্পষ্ট যে, কেউ দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বা নিজের কাছে বাস্তব পরিস্থিতিগত পরিবর্তন বা কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে ওয়াসিয়্যাতের সংশোধন প্রয়োজন বলে অনুভূত হলে ওয়াসিয়্যাতকারীর জীবদ্দশায় তার দ্বারাই নিজ ওয়াসিয়্যাতের সংশোধন করা যেতে পারে।
২:১৮০-১৮২ আয়াতে যাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তারা হলো ‘পিতা-মাতা এবং অন্য নিকটতম আত্মীয়স্বজন’। এ বিষয়ে ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে ‘লিল ওয়ালিদায়নি ওয়াল আক্বরাবীনা’। ওয়ালিদায়ন শব্দের অর্থ হচ্ছে পিতা-মাতা। আর আক্বরাবূন শব্দটি এসেছে ‘ক্বারীব’ শব্দ থেকে। ক্বারীব শব্দের অর্থ ‘নিকটবর্তী’। আক্বরাবূন শব্দের অর্থ ‘সবচেয়ে নিকটবর্তী’। ‘আক্বরাবূন’ শব্দটি কুরআনের ৭ স্থানে ‘সবচেয়ে নিকটবর্তী আত্মীয়’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে: ২:১৮০:১২, ২:২১৫:১০, ৪:৭:৬, ৪:৭:১২, ৪:৩৩:৭, ৪:১৩৫:১৪, ২৬:২১৪:৩।
সূরা নিসা ৪:১১-১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে যাদের জন্য উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি দেয়া হয়েছে ৪:৭ আয়াতে তাদেরকেই পরস্পরের আক্বরাবূন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ‘সবচেয়ে নিকটবর্তী আত্মীয়’ অর্থে ‘আক্বরাবীন’ হচ্ছে পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রী, ভাই, বোন।
পুত্র-কন্যা এর মতো পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রীও পুত্র-কন্যা তুল্য হিসেবে এবং পিতা-মাতার মতো দাদা-দাদী, নানা-নানীও পিতা-মাতা তুল্য হিসেবে আক্বরাবূন এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন ১২:৬ আয়াতে নবী ইয়াকুবের উক্তিতে নবী ইবরাহীম ও ইসহাককে নবী ইউসুফের দুইজন পিতৃপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে ‘আবাওয়ায়কা’ তথা ‘তোমার দুই পিতৃপুরুষ’। অন্য কথায় নবী ইউসুফের দাদা (ইসহাক) ও দাদার পিতাকে (ইবরাহীম) তাঁর দুইজন পিতৃপুরুষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ৪:২২-২৩ আয়াতে বিবাহ সম্পর্কিত বিধি-নিষেধ উল্লেখ করার ক্ষেত্রে ‘আবাউ’ শব্দের মধ্যে পিতা, দাদা, নানা প্রমুখ এবং ‘উম্মাহাত’ শব্দের মধ্যে মাতা, দাদী, নানী প্রমুখ এবং ‘বানাত’ শব্দের মধ্যে কন্যা, পৌত্রী, দৌহিত্রী প্রমুখ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সুতরাং ‘আক্বরাবূন’ হচ্ছেন পিতা, মাতা, দাদা, দাদী, নানা, নানী, পুত্র, কন্যা, পৌত্র, পৌত্রী, দৌহিত্র, দৌহিত্রী, স্বামী/স্ত্রী, ভাই, বোন। পিতা-মাতা আক্বরাবূন হলেও তাঁদের কথা প্রথমে স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করায় ‘লিল ওয়ালিদায়নি ওয়াল আক্বরবাীন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পিতা-মাতা ও অন্যান্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য’।
পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়রা ছাড়া অন্যান্য সাধারণ আত্মীয়দের জন্য বা অন্য কারো জন্য ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি, সুতরাং তা ঐচ্ছিক। নিকটতম আত্মীয়দের পাশাপাশি অন্যদের জন্যও ওয়াসিয়্যাত করার ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে নিকটতম আত্মীয়দের সকলে স্বচ্ছল হলে এবং সে অবস্থায় সম্পদ অন্য কারো জন্য ওয়াসিয়্যাত করতে হলে অবশ্যই নিকটতম আত্মীয়দের অনাপত্তি/সম্মতি গ্রহণ করতে হবে। তাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করার কারণে তাদেরকে অগ্রাহ্য না করাই বাঞ্ছনীয়। বরং তারা যদি অনাপত্তি ও সম্মতি জানায় সে ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ সম্পদ অন্য কারো জন্য ওয়াসিয়্যাত করা সঙ্গত হবে, অন্যথায় নয়।
এক নজরে যাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা বাধ্যতামূলক | |
পিতা | মাতা |
দাদা/ দাদার পিতা | নানা/ নানার পিতা |
দাদী/ দাদীর মাতা | নানী/ নানীর মাতা |
পুত্র/ পুত্রগণ | কন্যা/ কন্যাগণ |
পুত্রের পুত্র (পৌত্র/ পোতা) | কন্যার পুত্র (দৌহিত্র/ নাতি) |
পুত্রের কন্যা (পৌত্রী/ পুতিন) | কন্যার কন্যা (দৌহিত্রী/ নাতিন) |
স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামী | স্বামীর ক্ষেত্রে স্ত্রী |
ভাই | বোন |
প্রচলিত ধারণা হচ্ছে ৪:১১-১২ আয়াতের দ্বারা ২:১৮০-১৮২ আয়াত মানছুখ (রহিত) হয়ে গেছে। অর্থাৎ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির মাধ্যমে ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হয়ে গেছে। এ বিষয়ে একটি যুক্তি হচ্ছে, যেহেতু ৪:১১ আয়াত ‘ইউসীকুমুল্লাহু’ (আল্লাহ তোমাদেরকে ওয়াসিয়াত করছেন) বাক্যাংশ দ্বারা শুরু হয়েছে এবং ৪:১২ আয়াতেও বলা হয়েছে ‘ওয়াসিয়াতাম মিনাল্লাহ’ (এটা আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত), তাই এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ যাদের জন্য উত্তরাধিকারের অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন বা যাদেরকে ওয়ারিস করেছেন তাদের জন্য কোনো ওয়াসিয়্যাত করা যাবে না। অর্থাৎ দাবি করা হয় যে, বর্তমানে ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাত বৈধ নয়।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, ওয়াসিয়্যাতের বিধান হাদীস দ্বারা রহিত হয়েছে। হাদীস থেকে জানা যায় যে, ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা যাবে না তবে ওয়ারিস ছাড়া অন্যদের জন্য নিজ সম্পদের এক তৃতীয়াংশ বা এক চতুর্থাংশ ওয়াসিয়্যাত করা যাবে।
ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হওয়ার প্রচলিত দাবির উত্তর হচ্ছে, ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতে আল্লাহ চারবার বলেছেন, উত্তরাধিকার বন্টিত হবে ওয়াসিয়্যাতের দাবি পুরণ ও ঋণ পরিশোধের পর। তাই এ আয়াতগুলোতে ওয়াসিয়্যাতকে বা ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাতকে অবৈধ করা হয়নি। বরং ২:১৮০-১৮২ আয়াত অনুসারে পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য তথা ওয়ারিসদের জন্যই ওয়াসিয়্যাত করাকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং এ অবস্থায় ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাত রহিত হয়ে গেছে তবে ওয়ারিস ছাড়া অন্যদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা যাবে এরূপ দাবি করা আয়াতের বিধানকে অগ্রাহ্য করার শামিল।
আর হাদীস দ্বারা ওয়াসিয়্যাতের বিধান ওয়ারিসদের জন্য রহিত হওয়ার দাবিও একটি অসঙ্গত দাবি। কারণ রসূলের কাজ ছিলো কুরআনের অনুসরণ করা , কুরআনের কোনো বিধানকে রহিত করা নয়। আর আল্লাহ কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে একটি বিধান দিবেন অথচ কুরআন বহির্ভুত ওহীয়ে গায়রে মাতলুর (অপঠিত ওহী) মাধ্যমে তা রহিত করবেন যে রহিতকারী তথ্যটি হাদীস থেকে পাওয়া যাবে, এটি কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য দাবি নয়। কারণ নিশ্চিত তথ্যকে কোনো অনিশ্চিত তথ্যের দ্বারা রহিত করা একটি অযৌক্তিক পদ্ধতি। আর নিশ্চয় আল্লাহ অযৌক্তিক পদ্ধতিতে কাজ করার ত্রুটি থেকে পবিত্র।
যদি এ কথা সঠিকও হয় যে, রসূলুল্লাহ (সালামুন আলাইহি) কোনো ব্যক্তিকে তার বিশেষ পরিস্থিতিসাপেক্ষে এক তৃতীয়াংশের বেশি বা এক চতুর্থাংশের বেশি ওয়াসিয়্যাত করতে নিষেধ করেছিলেন, তবে তা ঐ ব্যক্তির সাথেই সংশ্লিষ্ট এবং সে নিষেধাজ্ঞার কারণ তার ওয়ারিস যেন ঐ ওয়াসিয়্যাতের কারণে বঞ্চিত না হয়। অন্যদিকে ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সম্পত্তিও ওয়াসিয়্যাত করা যাবে। কিন্তু ওয়ারিসদেরকে বঞ্চিত করে বা তাদের সম্মতি ছাড়া অন্যদের জন্য সম্পূর্ণ সম্পত্তি ওয়াসিয়্যাত করা বৈধ নয়। কারণ আল্লাহ ওয়ারিসদের মধ্যে বণ্টনের জন্য ওয়াসিয়্যাত করাকে স্বাভাবিক মৃত্যুর সন্নিকটে থাকা ব্যক্তির উপর বাধ্যতামূলক করেছেন।
যদি ওয়ারিসদের জন্য কৃত ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের পর কোনো সম্পদ অবশিষ্ট না থাকে তাহলে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী উত্তরাধিকার বন্টিত হবে না। এক তৃতীয়াংশের বেশি বা এক চতুর্থাংশের বেশি ওয়াসিয়্যাত করতে নিষেধ করার হাদীসটি থেকে এ শিক্ষা নেয়া যায় যে, ওয়ারিস ছাড়া অন্যদের জন্য কোনো নফল ওয়াসিয়্যাত করলে তা যেন এক তৃতীয়াংশের বেশি বা এক চতুর্থাংশের বেশি না হয়। এছাড়া সম্পত্তি যদি অত্যন্ত কম হয়, তবে শুধুমাত্র ওয়ারিসদের জন্যই ওয়াসিয়্যাত করা একটি স্বাভাবিক বিষয়।
ওয়াসিয়্যাতের পরে যা থাকবে তা উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টিত হবে। এটি অত্যন্ত যৌক্তিক একটি ব্যবস্থাপনা। ওয়ারিসদের জন্য সমস্ত সম্পদ ওয়াসিয়্যাত করার চেয়ে অংশবিশেষ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টনের জন্য রেখে দেওয়া উত্তম। কারণ এটা স্বত:সিদ্ধ বাস্তবতা যে, সমস্ত সম্পদ ওয়াসিয়্যাত করে গেলে ওয়াসিয়্যাতকারীর নিজস্ব জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার আশংকাকে উপেক্ষা করা যায় না।
মৃত্যু নিকটবর্তী ব্যক্তির উপর ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কারণ যখন স্বাভাবিকভাবে বুঝা যায় যে, কোনো ব্যক্তি মৃত্যু নিকটবর্তী অবস্থায় রয়েছে, তখন সে ঐ সময়ের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ওয়াসিয়্যাত করতে পারবে। অন্যদিকে তুলনামূলক মধ্যবয়স্কদের উপর বা সম্পূর্ণ সুস্থ সবল অবস্থায় ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করা হলে পরবর্তী বাস্তব পরিস্থিতিগত বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের ফলে কৃত ওয়াসিয়্যাত ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে বলে সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো। সুতরাং মধ্যবয়স্কদের উপর বা সম্পূর্ণ সুস্থ সবল অবস্থায় ওয়াসিয়্যাত বাধ্যতামূলক করা হয়নি, বরং তারা ওয়াসিয়্যাত করা ঐচ্ছিক বিষয়।
২:২৮২ আয়াত অনুযায়ী দাঈন বা ঋণের ক্ষেত্রে লিখিত প্রমাণ ও দুইজন সাক্ষী রাখাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু ৫:১০৬ আয়াত অনুযায়ী ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে শুধু দুইজন সাক্ষী রাখাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২:১০৮০-১৮১ আয়াত থেকেও বুঝা যায় যে, মৌখিক ওয়াসিয়্যাতকে যথেষ্ট সাব্যস্ত করা হয়েছে, লিখিত প্রমাণকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। এর কারণ হতে পারে মৃত্যু আসন্ন ব্যক্তির কৃত ওয়াসিয়্যাত লিখিতভাবে করাকে বাধ্যতামূলক করা হলে তা সাধারণত বাস্তবসম্মত হতো না, যেমন: অনেক ব্যক্তি নিজে শিক্ষিত নাও হতে পারে অথবা অসুস্থ অবস্থায় থাকা এবং আশেপাশে লিখে দেওয়ার মতো ব্যক্তির উপস্থিত না থাকার সম্ভাবনা ইত্যাদি। তবে ২:২৮২ আয়াতের শিক্ষানুসারে বলা যায় যে, যদিও বাস্তবসম্মত কারণে বাধ্যতামূলক করা হয়নি, তবুও সুযোগ থাকলে লিখিতভাবে ওয়াসিয়্যাত করাই স্বাভাবিক এবং কার্যকারিতার জন্য উত্তম। আর কুরআনের সার্বিক শিক্ষানুসারে যেখানে অধিক উপযুক্ত, অধিক মঙ্গলজনক এবং অধিক ন্যায়সঙ্গক উপায় অবলম্বন করা সম্ভব, সেখানে তা কার্যকর করাই উত্তমকর্ম সম্পাদনকারী স্রষ্টা-সচেতন বিশ্বাসীদের করণীয়।
৫:১০৬ আয়াতে ওয়াসিয়্যাত করার বিষয়ে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং ওয়াসিয়্যাতের বিধানের একটি অন্যতম ধারা হচ্ছে ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখতে হবে।
৫:১০৬ আয়াতে ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে সাক্ষী রাখার নির্দেশের দ্বিতীয় ধারা হচ্ছে যদি নিজ এলাকা থেকে দূরদেশে বা প্রবাসে ভ্রমণ করা কালে মৃত্যুর মুসিবত এসে পড়ে তথা অপ্রত্যাশিত হঠাৎ মৃত্যু এসে পড়ে এবং এ অবস্থায় নিজ অঞ্চলের লোক পাওয়া না যায় তাহলে অন্য অঞ্চলের বা প্রবাসী দুইজনকে সাক্ষী রাখতে হবে।
৫:১০৬ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে যে দুইজন ব্যক্তি সাক্ষী তাদেরকে সালাতের পরে অপেক্ষমান রাখতে হবে অর্থাৎ সালাতের পরে সাক্ষ্য গ্রহণ ও ওয়াসিয়্যাতের ভিত্তিতে বণ্টন করতে হবে। সুতরাং ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ বা ওয়াসিয়্যাতের ভিত্তিতে বণ্টনের সময় হচ্ছে সালাতের পরে। এ থেকে এটাও বুঝা যায় যে, সালাতের স্থান (মসজিদ) শুধু আনুষ্ঠানিক সালাতের জন্যই নির্ধারিত নয়, বরং উলিল আমরের (Central Authority) কার্যালয় হিসাবে সেখানে সালাতের পরে উত্তরাধিকারের বণ্টনের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহারিক গুরুত্ব রয়েছে। অর্থাৎ মসজিদ একই সাথে বহুবিধ মাত্রার কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুও বটে।
৫:১০৬ আয়াতের শেষ নির্দেশনা হলো, যদি সাক্ষীদের বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হয় তাহলে তারা আল্লাহর নামে কসম করে বলবে যে, আমরা কোনো মূল্যেই সাক্ষ্য গোপন করবো না, যদিও এর মাধ্যমে উপকারভোগী আমাদের আত্মীয় হয় এবং আল্লাহর নির্দেশিত সাক্ষ্যকে গোপন করবো না। নিশ্চয় এগুলো করলে আমরা অপরাধীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো। এই সাক্ষ্যের ভাষা এই সচেতনতার শিক্ষা প্রদান করে যে, আত্মীয়তার বন্ধন যেন ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষপাতমূলক অন্যায় সাক্ষ্য ও আচরণকে প্রভাবিত না করে। মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়াই কেবল নয়, জানার পরে সত্য সাক্ষ্য গোপন করাও অবৈধ।
৫:১০৭-১০৮ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যদি সাক্ষীদ্বয় সাক্ষ্য হেরফের করার অপরাধে জড়িত হয়েছে বলে লক্ষণ পাওয়া যায় তাহলে এমন দুইজন ব্যক্তি মূল দুইজন সাক্ষীর দাবিগত অবস্থানের বিপরীতে সাক্ষ্য দিতে দাঁড়াবে যারা তাদের সাক্ষ্যের বিপক্ষে (পরিত্যক্ত সম্পদের বা সাক্ষ্যদানের) অধিকার দাবিকারীদের অন্তর্ভুক্ত এবং যারা মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অধিক ঘনিষ্ঠ/অগ্রাধিকারী বা মূল সাক্ষীদ্বয়ের সাক্ষ্যে গরমিল চিহ্নিত করতে পারার প্রেক্ষিতে সাক্ষ্যদানের অধিক যোগ্য। আপত্তিকারীদের অন্তর্ভুক্ত এই দুইজন সাক্ষীকে আল্লাহর নামে কসম করে বলতে হবে, আমাদের সাক্ষ্য তাদের দুইজনের সাক্ষ্যের চেয়ে অধিক যথাযথ। আর আমরা সীমালংঘন করিনি। নিশ্চয় তা করলে আমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।
এভাবে আপত্তিকারীদের অন্তর্ভুক্ত দুইজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিলে মূল দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যকে অগ্রাহ্য করা হবে। অর্থাৎ এরূপ পাল্টাপাল্টি দুই ধরনের সাক্ষ্যের প্রেক্ষিতে ঐ ওয়াসিয়্যাত রহিত হয়ে যাবে। মূল দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্য রহিত হওয়ার কারণে তাদের সাক্ষ্যের উপর ভিত্তিশীল ওয়াসিয়্যাতকে হুবহু বাস্তবায়ন করা যাবে না। বরং এ অবস্থায় ঐ দাবিকৃত ওয়াসিয়্যাতের মাধ্যমে যাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়েছে তাদের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থরক্ষার উপযোগী করে তার মীমাংসা করা যেতে পারে। কেননা মূল দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের প্রতি আপত্তির প্রেক্ষিতে পরবর্তী দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যকে অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এছাড়া ২:১৮২ আয়াতে ওয়াসিয়্যাতকারীর ওয়াসিয়্যাতের মাধ্যমে কোনো পক্ষপাতিত্ব বা বঞ্চিত করার পাপ হয়েছে বলে আশংকা করলে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে দেয়ার মধ্যে কোনো দোষ নেই বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যদি কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা সম্ভব না হয় তাহলে মৃত ব্যক্তির সমস্ত পরিত্যক্ত সম্পত্তি উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টন করতে হবে।
২:২৪০ আয়াতে আল্লাহতায়ালা বিধবাদের জন্য একটি ওয়াসিয়্যাত করেছেন তথা বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন। তা হলো: বিধবা নারীদেরকে তাদের গৃহ থেকে তথা মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব থেকে তারা যে গৃহে বসবাস করছিলো তা থেকে এক বছর পর্যন্ত বের করে দেয়া যাবে না। সেটি তাদের নিজেদের গৃহ হোক বা তাদেরকে বসবাস করতে দেয়া স্টাফ কোয়ার্টার হোক উভয় ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের পুনর্বাসনের সুব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত সময় সুযোগ লাভ করবে। এ একবছর সময়কালে তাদেরকে ভরণ পোষণও দিতে হবে। এ ওয়াসিয়্যাতকে কে কার্যকর করতে হবে তা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কুরআনের সাধারণ শিক্ষা অনুসারে বুঝা যায় যে, এটি প্রাথমিকভাবে মৃত ব্যক্তির পরিবার পরিজনের দায়িত্ব এবং প্রয়োজনসাপেক্ষে বৃহৎ পরিসরে সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর এ দায়িত্ব অর্পিত হবে। ২:১৩৪ আয়াত অনুযায়ী বিধবা নারীদের সাধারণ ইদ্দাত (প্রতীক্ষার সময়কাল) ৪ মাস ১০ দিন, তবে ৬৫:৪ আয়াত অনুযায়ী গর্ভবতী হলে সেক্ষেত্রে ইদ্দাত হলো সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত। ইদ্দাতকাল পূর্ণ হলে ১ বছর সময়ের আগেও বিধবা নারী স্বেচ্ছায় বের হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা বেরিয়ে গেলে এবং নিজেদের জন্য ন্যায়সঙ্গতভাবে কিছু করার সিদ্ধান্ত নিলে (যেমন বিবাহ ও নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা) তাতে অন্যরা দোষী হবে না। অন্য কথায় ইদ্দাত শেষে কিন্তু এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কোনো বিধবা নারী সম্পূর্ণ নিজ ইচ্ছায় বের হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে এক বছর পূর্ণ হতে বাকি থাকা সময়সীমাতে তাদেরকে পূর্ব গৃহে থাকতে দেয়া ও ভরণপোষণ দেয়ার বাধ্যবাধকতা প্রযোজ্য হবে না।
২:২৪০ আয়াতটির প্রচলিত অনুবাদ ও ব্যাখ্যা হচ্ছে, এখানে যারা মৃত্যুবরণ করে তাদেরকে নিজেদের স্ত্রীদের বিষয়ে এক বছরের ভরণ পোষনের জন্য পরিবারের সদস্যদের কাছে ওয়াসিয়্যাত করে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ অনুবাদ বা ব্যাখ্যাটি সঠিক নয়। কারণ যে আয়াতে মৃত্যু আসন্ন ব্যক্তির উপর ওয়াসিয়্যাত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে (২:১৮০) সেটির বাক্য বিন্যাস হলো, কুতিবা আলাইকুম ইযা হাদারা আহাদুকুমুল মাওতু...’’(যখন তোমাদের কেউ মৃত্যুর সন্নিকটে হাজির হয় তখন তার উপর বিধিবদ্ধ করা হলো যে, .....)। কারো উপর কিছু বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে আরবি ভাষায় ও কুরআনে এরূপ বাক্য বিন্যাসই অবলম্বন করা হয়। পক্ষান্তরে ২:২৪০ আয়াতে বলা হয়েছে, ওয়াল্লাযীনা ইউতাওয়াফফাওনা মিনকুম ওয়া ইয়াযারূনা আজজওয়াজান.....(আর যারা তাদের স্ত্রীদেরকে ছেড়ে মৃত্যুবরণ করে তথা যারা মৃত্যুবরণ করে এবং তাদের স্ত্রীরা জীবিত থাকে,.......) । আয়াতটিতে যারা স্ত্রী রেখে মারা যাবে তাদের সাথে সম্পর্কিত করে কিছু বলা হয়েছে কিন্তু তাদের উপর কোনো দায়িত্ব বলা হয়নি। আয়াতটির পরবর্তী অংশে উল্লেখিত হয়েছে ওয়াসিয়াতাল লিআজওয়াজিহিম (তাদের স্ত্রীদের জন্য ওয়াসিয়্যাত)। অর্থাৎ আয়াতটিতে তাদের স্ত্রীদের বিষয়ে কিছু বলা হয়েছে এবং যা বলা হয়েছে তা হলো ‘ওয়াসিয়্যাত’। অন্য কথায়, তাদের স্ত্রীদের জন্য ‘ওয়াসিয়্যাত’ হিসেবে কিছু বলা হয়েছে। কথাটির সহজ তাৎপর্য হলো তাদের স্ত্রীদের জন্য ওয়াসিয়্যাত উপস্থাপন/প্রদান করা হয়েছে। বাক্যটিতে ‘ওয়াসিয়্যাত’ শব্দটি কর্ম (Object) হিসেবে রয়েছে। বাক্যটিতে ‘ওয়াসিয়্যাত’ শব্দটির মাধ্যমে তাদের স্ত্রীদের জন্য কী রয়েছে বা কী দেয়া হয়েছে?- এ প্রশ্নটিরই উত্তর (কর্ম/Object) উল্লেখ করা হয়েছে। ‘ওয়াসিয়্যাত’ শব্দের একটি অর্থ হলো ‘বিশেষ নির্দেশ’। বাক্যটিতে ওয়াসিয়্যাতের ‘কর্তা’ (Subject) কে, তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু ওয়াসিয়্যাত হচ্ছে/ ওয়াসিয়্যাত করা হলো ..... বক্তব্যভঙ্গি থেকে স্বত:সিদ্ধভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এটি আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত বা বিশেষ নির্দেশ।
আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত’ শব্দটি কারো কারো জানা নাও থাকতে পারে। তাই উল্লেখ্য যে, ৪:১১ আয়াতে উত্তরাধিকার বণ্টন সম্পর্কিত বক্তব্য শুরু করা হয়েছে ‘ইউসীকুমুল্লাহু’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ তোমাদেরকে ওয়াসিয়্যাত করছেন’ বক্তব্যের মাধ্যমে এবং ৪:১২ আয়াতে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত সম্পূর্ণ বণ্টন বিধিকেই চিহ্নিত করা হয়েছে ওয়াসিয়্যাতাম মিনাল্লাহ বা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ওয়াসিয়্যাত হিসেবে। এ আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ বিষয়টি স্পষ্ট করা যে, ২:২৪০ আয়াতে প্রদত্ত বিধান বিধবা নারীদেরকে মৃত ব্যক্তির অন্যান্য ওয়ারিসরা বা সমাজ ও রাষ্ট্র এক বছর ভরণ পোষণ দিতে হবে, অবশ্য যদি এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে তারা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেদেরকে নতুন বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ করে তবে এই ভরণ পোষণ এক বছর পূর্ণ হওয়ার প্রয়োজন হবে না বরং তারা নতুন বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া পর্যন্ত হলেই চলবে- এটি হচ্ছে আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত।
সুতরাং মৃত ব্যক্তিকে তার স্ত্রীর জন্য ওয়াসিয়্যাত করার আদেশ দেয়া হয়েছে, তাই মৃত ব্যক্তি এরূপ ওয়াসিয়্যাত করে গেলে তা বাস্তবায়ন করা হবে, অন্যথায় বাস্তবায়ন করা হবে না; এ ধারণাটি সঠিক নয়। বরং প্রত্যেক বিধবার ক্ষেত্রে এ ওয়াসিয়্যাত বা বিশেষ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রচলিত একটি দাবি হচ্ছে ২:২৪০ আয়াতটি ২:২৩৪ আয়াত এবং ৪:১২ আয়াতের মাধ্যমে মানছুখ বা রহিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ বিধবাদেরকে এক বছর ভরণপোষণ দেয়া এবং ঘর থেকে বের করে না দেয়ার বিধান রহিত হয়ে গেছে। নিম্নে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হলো।
২:২৩৪ আয়াত দ্বারা ২:২৪০ আয়াতটি রহিত হয়েছে কিনা তা বুঝার জন্য নিচে ২:২৩৪ আয়াতের অনুবাদ উল্লেখ করা হলো।
২:২৩৪ :: তোমাদের মধ্য হতে যারা স্ত্রীদেরকে রেখে মারা যাবে সে অবস্থায় স্ত্রীরা নিজেদেরকে চার মাস দশ দিন অপেক্ষায় রাখবে। তারপর যখন তাদের (ইদ্দাতের) নির্ধারিত শেষ সীমায় পৌঁছে, তখন তারা নিজেদের সম্বন্ধে ন্যায়সঙ্গতভাবে যা করবে তাতে তোমাদের কোনো দোষ নেই। আর তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ সে বিষয়ে পরিজ্ঞাত।
আয়াতটিতে (২:২৩৪) বিধান দেয়া হয়েছে যে, বিধবাদের ইদ্দাতকাল চারমাস দশদিন। এরপর তারা অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। এ আয়াতটির মাধ্যমে ২:২৪০ আয়াতে বর্ণিত বিধবাকে এক বছরের ভরণপোষণের জন্য যে বিধানটি দেয়া হয়েছে তা রহিত হয়ে গেছে বলে দাবি করা সঠিক নয়। কারণ দুটি বিষয় পরস্পর স্বতন্ত্র। এছাড়া ইদ্দাতকাল শেষ হলে যদি এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে বিধবা নারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাহলে ভরণ পোষণ এক বছর পূর্ণ করা লাগবে না বরং নতুন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া পর্যন্ত হলেই চলবে, তাও ২:২৪০ আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে। এমতাবস্থায় দুটি আয়াত পরস্পর সম্পূরক, আয়াতদ্বয়ে কোনো বৈপরীত্য নেই, সুতরাং এর একটি দ্বারা অন্যটি রহিত হওয়ার মতবাদটি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।
৪:১২ আয়াতে বর্ণিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধিতে বিধবা নারীকে উত্তরাধিকারের অংশীদার করাতে ২:২৪০ আয়াতটি রহিত হয়ে গেছে বলে কৃত দাবিটিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ দেনমোহর দেয়ার পাশাপাশি যেমন স্বামীর উপর ভরণপোষনের দায়িত্ব থাকে, এর একটি অন্যটিকে রহিত করে না; তেমনি বিধবা নারী তার স্বামীর উত্তরাধিকার পাওয়া সত্তে¦ও স্বতন্ত্রভাবে এক বছরের ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার রাখে, এর একটি অন্যটিকে রহিত করে না। উভয়টি আল্লাহর বিধান, এর কোনোটিই রহিত নয় এবং তাই উভয় বিধানই কার্যকর বা বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যক।
পরিশেষে বলা যায় যে, ওয়াসিয়্যাতের বিধান এবং উত্তরাধিকারের বিধান উভয়টি ফরজ বা বাধ্যতামূলক হিসেবে বাস্তবায়ন করতে হবে। উত্তরাধিকারের বিধানের পরে ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হয়ে যাওয়ার মতবাদ একটি ভ্রান্ত মতবাদ। বরং ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের পরে উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হযেছে। বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, পুত্র-কন্যা, পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রী, স্বামী/স্ত্রী এবং ভাই-বোনদের জন্য ন্যায়সঙ্গতভাবে এবং দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রেখে ওয়াসিয়্যাত করতে হবে। যদি ওয়াসিয়্যাতকারী ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছে বা কাউকে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছে বলে আশংকা হয়, সেক্ষেত্রে অন্যরা কোনো মীমাংসার জন্য ভূমিকা রাখলে তথা উদ্বুদ্ধ করলে তা দোষনীয় নয়। সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ওয়াসিয়্যাতকে কার্যকর করতে হবে, সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণ না পেলে দাবিকৃত ওয়াসিয়্যাত কার্যকর হবে না, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে দেয়ার মাধ্যমে ওয়াসিয়্যাতের সংশোধিত রূপ কার্যকর করা যাবে এবং সমঝোতা সম্ভব না হলে মৃতের সমস্ত পরিত্যক্ত সম্পদ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টন করতে হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন, সম্পদের সুষম বণ্টন, সামাজিক বিবাদ বিসম্বাদ হ্রাস করা এবং ব্যাপক সমাজ কল্যাণের জন্য কুরআনে প্রদত্ত ওয়াসিয়্যাতের বিধান পরিপালন করা অত্যাবশ্যক।
وَالَّذِينَ آمَنُوا مِن بَعْدُ وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا مَعَكُمْ فَأُولَـٰئِكَ مِنكُمْ وَأُولُو الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَىٰ بِبَعْضٍ فِي كِتَابِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
৮:৭৫ :: আর যারা পরবর্তী পর্যায়ে ঈমান এনেছে এবং হিজরত করেছে এবং তোমাদের সাথে জিহাদ করেছে, তারা তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর বিধান অনুসারে রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়গণ একে অপরের প্রতি অগ্রাধিকারী। নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞানী।
النَّبِيُّ أَوْلَىٰ بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ وَأُولُو الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَىٰ بِبَعْضٍ فِي كِتَابِ اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُهَاجِرِينَ إِلَّا أَن تَفْعَلُوا إِلَىٰ أَوْلِيَائِكُم مَّعْرُوفًا كَانَ ذَٰلِكَ فِي الْكِتَابِ مَسْطُورًا
৩৩:৬ :: আর নবী মু’মিনদের প্রতি তাদের নিজেদের চেয়ে ঘনিষ্ঠতর এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মাতাস্বরূপ। আল্লাহর বিধান অনুসারে মু’মিনগণ ও মুহাজিরদের চেয়ে রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়গণ একে অপরের প্রতি অগ্রাধিকারী। তবে এটা ভিন্ন বিষয় যে, তোমরা তোমাদের বন্ধু-বান্ধবের প্রতি ভাল কিছু (তথা অনুদান ও ওয়াসিয়্যাত) করবে। এটি বিধানে লিপিবদ্ধ।
كَلَّا بَل لَّا تُكْرِمُونَ الْيَتِيمَ
৮৯:১৭ :: কখনো না। বরং তোমরা ইয়াতীমদেরকে সম্মানজনক আচরণ কর না।
وَلَا تَحَاضُّونَ عَلَىٰ طَعَامِ الْمِسْكِينِ
৮৯:১৮ :: আর তোমরা অভাবগ্রস্তদের অন্ন সংস্থান করার বিষয়ে উৎসাহিত কর না। 1
وَتَأْكُلُونَ التُّرَاثَ أَكْلًا لَّمًّا
৮৯:১৯ :: আর তোমরা (অন্যের) উত্তরাধিকারকে নির্বিচারে গ্রাস করে থাক।
وَتُحِبُّونَ الْمَالَ حُبًّا جَمًّا
৮৯:২০ :: আর তোমরা সম্পদকে মাত্রাতিরিক্ত ভালবাস।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَحِلُّ لَكُمْ أَن تَرِثُوا النِّسَاءَ كَرْهًا وَلَا تَعْضُلُوهُنَّ لِتَذْهَبُوا بِبَعْضِ مَا آتَيْتُمُوهُنَّ إِلَّا أَن يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍ وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِن كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا
৪:১৯ :: হে মু’মিনগণ, তোমাদের জন্য বলপ্রয়োগপূর্বক নারীদের ওয়ারিস হওয়া বৈধ নয়। আর তোমরা তাদেরকে (দেনমোহরবাবদ) যা দিয়েছো তার কোনো অংশ কেড়ে নেয়ার জন্য তাদেরকে (সামাজিক কর্মকা-ে) বাধা দিও না। কিন্তু তারা স্পষ্ট অশ্লীলতায় জড়িত হলে । আর তোমরা তাদের সাথে জীবন যাপন করো ন্যায়সঙ্গতভাবে। যদি তোমরা কোনো কারণে তাদেরকে অপছন্দ কর, তাহলে হতে পারে যে, তোমরা অপছন্দ করছো এমন এক সত্তাকে (তথা নিজের স্ত্রীকে) অথচ আল্লাহ রেখেছেন তার মধ্যে অনেক কল্যাণ।
وَلِكُلٍّ جَعَلْنَا مَوَالِيَ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَالَّذِينَ عَقَدَتْ أَيْمَانُكُمْ فَآتُوهُمْ نَصِيبَهُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدًا
৪:৩৩ :: পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ যা ছেড়ে যায় তার প্রত্যেকটির জন্য আমি নির্দিষ্ট উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করে দিয়েছি। আর যাদেরকে তোমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছো , তাদেরকে তাদের প্রাপ্য অংশ দিয়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে স্বাক্ষী।
لِّلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَّفْرُوضًا
৪:৭ :: পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ যা রেখে যায় তা থেকে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়গণ যা রেখে যায় তা থেকে নারীদেরও অংশ আছে। তা থেকে কম হোক বা বেশি হোক, নির্ধারিত হারে প্রাপ্য অংশ।
وَإِذَا حَضَرَ الْقِسْمَةَ أُولُو الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينُ فَارْزُقُوهُم مِّنْهُ وَقُولُوا لَهُمْ قَوْلًا مَّعْرُوفًا
৪:৮ :: আর যদি (উত্তরাধিকার) বন্টনের সময় আত্মীয় স্বজন , ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্তরা উপস্থিত হয়, তবে তাদেরকে তা থেকে কিছু দিবে এবং তাদের সাথে সদ্ভাবে কথা বলবে।
وَلْيَخْشَ الَّذِينَ لَوْ تَرَكُوا مِنْ خَلْفِهِمْ ذُرِّيَّةً ضِعَافًا خَافُوا عَلَيْهِمْ فَلْيَتَّقُوا اللَّهَ وَلْيَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا
৪:৯ :: আর তারা যেন ভয় করে যে, যদি তারা তাদের পেছনে দুর্বল-অসহায় সন্তানাদি রেখে যেতো তবে তারা তাদের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হতো, সুতরাং তারা যেন আল্লাহ সচেতন হয় এবং সঙ্গত কথা বলে।
إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَىٰ ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا
৪:১০ :: নিশ্চয় যারা যুলুম সহকারে ইয়াতীমের মালসম্পদ ভক্ষণ করে, বস্তুত তারা তাদের পেটে আগুন খাচ্ছে, আর শীঘ্রই তারা জ্বলন্ত আগুনে জ্বলবে।
يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنثَيَيْنِ فَإِن كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِن كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِن كَانَ لَهُ وَلَدٌ فَإِن لَّمْ يَكُن لَّهُ وَلَدٌ وَوَرِثَهُ أَبَوَاهُ فَلِأُمِّهِ الثُّلُثُ فَإِن كَانَ لَهُ إِخْوَةٌ فَلِأُمِّهِ السُّدُسُ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِي بِهَا أَوْ دَيْنٍ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ لَا تَدْرُونَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعًا فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا
৪:১১ :: আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের মধ্যকার (উত্তরাধিকার বণ্টন) বিষয়ে ওয়াসিয়্যাত করছেন: এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের অনুরূপ। তারপর (পরবর্তী ধারা হলো), যদি তারা (তথা সন্তানরা) হয় নারীরাই, অন্যুন দুই (তথা দুইয়ের বেশি বা অন্তত দুইজন), তাহলে তাদের জন্য যা সে (তথা মৃত ব্যক্তি) ছেড়ে গিয়েছে তার তিন ভাগের দুই ভাগ (২/৩)। আর যদি সে (তথা সন্তান) হয় একজনই (নারী), তাহলে তার জন্য দুই ভাগের এক ভাগ (১/২)।
আর তার (তথা মৃত ব্যক্তির) পিতা-মাতা দুইজনের মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্য (/তাদের দুইজনের মধ্য থেকে যেই থাকুক তার জন্য) যা সে ছেড়ে গিয়েছে তা থেকে ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬), যদি তার কোনো সন্তান থাকে। তবে যদি তার কোনো সন্তান না থাকে আর তার পিতা-মাতা তার উত্তরাধিকারী হয়, তাহলে তার মাতার জন্য তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩)। তবে যদি তার ভাই-বোন থাকে, তাহলে তার মাতার জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬)। (এভাবে উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) তার কৃত ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ বা/এবং ঋণ পরিশোধের পরে।
তোমরা জানো না তোমাদের পিতাগণ ও পুত্রগণের মধ্যে কে তোমাদের জন্য উপকার সাধনে অধিক নিকটবর্তী হবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আবশ্যিক বিধান। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।
وَلَكُمْ نِصْفُ مَا تَرَكَ أَزْوَاجُكُمْ إِن لَّمْ يَكُن لَّهُنَّ وَلَدٌ فَإِن كَانَ لَهُنَّ وَلَدٌ فَلَكُمُ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْنَ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِينَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ وَلَهُنَّ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْتُمْ إِن لَّمْ يَكُن لَّكُمْ وَلَدٌ فَإِن كَانَ لَكُمْ وَلَدٌ فَلَهُنَّ الثُّمُنُ مِمَّا تَرَكْتُم مِّن بَعْدِ وَصِيَّةٍ تُوصُونَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ وَإِن كَانَ رَجُلٌ يُورَثُ كَلَالَةً أَوِ امْرَأَةٌ وَلَهُ أَخٌ أَوْ أُخْتٌ فَلِكُلِّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا السُّدُسُ فَإِن كَانُوا أَكْثَرَ مِن ذَٰلِكَ فَهُمْ شُرَكَاءُ فِي الثُّلُثِ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصَىٰ بِهَا أَوْ دَيْنٍ غَيْرَ مُضَارٍّ وَصِيَّةً مِّنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَلِيمٌ
৪:১২ :: আর তোমাদের জন্য যা তোমাদের স্ত্রীগণ রেখে গিয়েছে তার দুই ভাগের এক ভাগ (১/২), যদি তাদের কোনো সন্তান না থাকে। তবে যদি তাদের কোনো সন্তান থাকে, তাহলে তোমাদের জন্য যা তারা ছেড়ে গিয়েছে তা থেকে চার ভাগের এক ভাগ (১/৪)। (এভাবে উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) তাদের কৃত ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ বা/এবং ঋণ পরিশোধের পরে।
আর তাদের জন্য (তথা তোমাদের স্ত্রীদের জন্য) যা তোমরা ছেড়ে গিয়েছো তা থেকে চার ভাগের এক ভাগ (১/৪), যদি তোমাদের কোনো সন্তান না থাকে। তবে যদি তোমাদের কোনো সন্তান থাকে, তাহলে তাদের জন্য যা তোমরা ছেড়ে গিয়েছো তা থেকে আট ভাগের এক ভাগ (১/৮)। (এভাবে উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) তোমাদের কৃত ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ বা/এবং ঋণ পরিশোধের পরে।
আর যদি কোনো পুরুষ বা নারী এরূপ হয় যে, তাকে পূর্বসূরী করা হয় (তথা তার উত্তরসূরী থাকে), (এবং) সে (তথা ঐ মৃত ব্যক্তি- পুরুষ বা নারী) কালালাহ হয় এবং তার একজন ভাই বা/এবং একজন বোন থাকে, তাহলে তাদের দুইজনের মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্য (/তাদের দুইজনের মধ্যে যেই থাকুক তার জন্য) ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬)। তবে যদি তারা (তথা ভাই/বোন) এর চেয়ে বেশি হয় (তথা একাধিক হয়), তাহলে তারা তিনভাগের এক ভাগে (১/৩) অংশীদার হবে। (এভাবে উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) কৃত ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ বা/এবং ঋণ পরিশোধের পরে।
অক্ষতিকর উপায়ে । এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ওয়াসিয়্যাত (তথা বিশেষ নির্দেশ)। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সহনশীল।
تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
৪:১৩ :: এগুলো আল্লাহপ্রদত্ত সীমাসমূহ। আর যে আল্লাহর এবং তাঁর রসূলের আনুগত্য করে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার নিচ অংশে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। তারা তাতে স্থায়ী হবে। এটাই মহাসফলতা।
وَمَن يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُّهِينٌ
৪:১৪ :: আর যে আল্লাহকে ও তাঁর রসূলকে অমান্য করে এবং তাঁর প্রদত্ত সীমাসমূহ লংঘন করে, তিনি তাকে আগুনে (তথা জাহান্নামে) প্রবেশ করাবেন। সে তাতে স্থায়ী হবে। আর তার জন্য অপমানকর শাস্তি রয়েছে।
يَسْتَفْتُونَكَ قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِي الْكَلَالَةِ إِنِ امْرُؤٌ هَلَكَ لَيْسَ لَهُ وَلَدٌ وَلَهُ أُخْتٌ فَلَهَا نِصْفُ مَا تَرَكَ وَهُوَ يَرِثُهَا إِن لَّمْ يَكُن لَّهَا وَلَدٌ فَإِن كَانَتَا اثْنَتَيْنِ فَلَهُمَا الثُّلُثَانِ مِمَّا تَرَكَ وَإِن كَانُوا إِخْوَةً رِّجَالًا وَنِسَاءً فَلِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنثَيَيْنِ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ أَن تَضِلُّوا وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
৪:১৭৬ :: তারা তোমার কাছে কালালাহর মধ্যকার (উত্তরাধিকার বণ্টন) বিষয়ে সমাধান জানতে চায়। বলো, আল্লাহ তোমাদেরকে (এ বিষয়ে) সমাধান দিচ্ছেন: যদি কোনো পুরুষ মৃত্যুবরণ করে, যার কোনো সন্তান নেই এবং তার একজন বোন থাকে, তাহলে তার জন্য যা সে ছেড়ে গিয়েছে তার দুই ভাগের একভাগ (১/২)। আর (অন্যদিকে বিপরীত অবস্থায়) সে (তথা ভাইটি) তাকে (তথা বোনটিকে) পূর্বসূরী করবে (তথা তার উত্তরসূরী হবে), যদি তার (তথা বোনটির) কোনো সন্তান না থাকে। তবে যদি তারা (বোনেরা) হয় দুইজন, তাহলে তাদের দুইজনের জন্য যা সে (তথা ভাইটি) ছেড়ে গিয়েছে তা থেকে তিন ভাগের দুই ভাগ (২/৩)। আর যদি তারা হয় ভাই-বোন, পুরুষরা ও নারীরা (তথা ভাইয়েরাও থাকে এবং বোনেরাও থাকে), তাহলে এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের অনুরূপ।
আল্লাহ তোমাদের জন্য স্পষ্টভাবে বিশদ বর্ণনা করছেন, পাছে তোমরা বিভ্রান্ত হবে। আর আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞানী।
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
৪:১ :: হে মানুষ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের বিষয়ে সচেতন থাকো যিনি তোমাদেরকে একক ব্যক্তিসত্তা থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে (অর্থাৎ তার সমজাতীয় উপাদান থেকে) তার জোড়া/সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের দুজন থেকে অনেক পুরুষ ও অনেক নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। তোমরা আল্লাহর বিষয়ে সচেতন থাকো, যাঁর (ব্যবস্থার) মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে (অধিকার) চেয়ে থাকো। আর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়তার বিষয়েও (সচেতন থাকো)। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক।
وَآتُوا الْيَتَامَىٰ أَمْوَالَهُمْ وَلَا تَتَبَدَّلُوا الْخَبِيثَ بِالطَّيِّبِ وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَهُمْ إِلَىٰ أَمْوَالِكُمْ إِنَّهُ كَانَ حُوبًا كَبِيرًا
৪:২ :: আর ইয়াতীম ছেলেমেয়েদেরকে তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দাও । আর মন্দ বস্তুকে ভালো বস্তু দ্বারা বদল করে নিও না । আর তোমাদের সম্পদের সাথে মিলিয়ে তাদের সম্পদ ভক্ষণ করো না। নিশ্চয় তা মহাপাপ।
وَلَا تُؤْتُوا السُّفَهَاءَ أَمْوَالَكُمُ الَّتِي جَعَلَ اللَّهُ لَكُمْ قِيَامًا وَارْزُقُوهُمْ فِيهَا وَاكْسُوهُمْ وَقُولُوا لَهُمْ قَوْلًا مَّعْرُوفًا
৪:৫ :: আর তোমরা নির্বোধদের হাতে তোমাদের সম্পদ প্রত্যর্পণ করো না, যেটাতে আল্লাহ তোমাদের জন্য প্রতিষ্ঠা (জীবনে প্রতিষ্ঠিত থাকার উপকরণ) বানিয়েছেন। আর তোমরা তাদেরকে তার মধ্যে (সম্পদের সুষম ব্যবস্থাপনার মধ্যে) জীবিকা সরবরাহ করো এবং পোশাকাদি প্রদান করো। এবং তোমরা তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত কথা বলো।
وَابْتَلُوا الْيَتَامَىٰ حَتَّىٰ إِذَا بَلَغُوا النِّكَاحَ فَإِنْ آنَسْتُم مِّنْهُمْ رُشْدًا فَادْفَعُوا إِلَيْهِمْ أَمْوَالَهُمْ وَلَا تَأْكُلُوهَا إِسْرَافًا وَبِدَارًا أَن يَكْبَرُوا وَمَن كَانَ غَنِيًّا فَلْيَسْتَعْفِفْ وَمَن كَانَ فَقِيرًا فَلْيَأْكُلْ بِالْمَعْرُوفِ فَإِذَا دَفَعْتُمْ إِلَيْهِمْ أَمْوَالَهُمْ فَأَشْهِدُوا عَلَيْهِمْ وَكَفَىٰ بِاللَّهِ حَسِيبًا
৪:৬ :: আর ইয়াতীম ছেলেমেয়েদেরকে পরীক্ষা করো যখন তারা বিয়ে করার বয়সে পৌঁছে যায়। তারপর যদি তোমরা তাদের মধ্যে সঠিক বোধবুদ্ধি (সম্পদের সঙ্গত ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা) অনুভব করো তাহলে তাদের ধন-সম্পদ তাদেরকে দিয়ে দাও। আর তোমরা তাদের সম্পদ খেয়ো না অপচয় করে এবং তারা বড় হওয়ার আগে তাড়াহুড়া করে। আর যে ধনী সে যেন সংযত থাকে, আর যে দরিদ্র সে যেন ন্যায়সঙ্গতভাবে খায়। অতঃপর যখন তোমরা তাদের ধন-সম্পদ তাদের নিকট সোপর্দ করবে তখন তাদের উপর তোমরা সাক্ষী রাখবে। আর হিসাব গ্রহণকারী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।
وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّىٰ يَبْلُغَ أَشُدَّهُ وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا
১৭:৩৪ :: উত্তম উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি ছাড়া ইয়াতীমের সম্পদের কাছে যেও না, (তার সম্পদের ব্যবস্থাপনা করবে) যতক্ষণ না সে যৌবনে (স্থিতিশীল শক্তিসামর্থ্যরে বয়সে) পৌঁছে। আর তোমরা প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো। নিশ্চয় প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।
فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْيَتَامَىٰ قُلْ إِصْلَاحٌ لَّهُمْ خَيْرٌ وَإِن تُخَالِطُوهُمْ فَإِخْوَانُكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ الْمُفْسِدَ مِنَ الْمُصْلِحِ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَأَعْنَتَكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
২:২২০ :: দুনিয়া ও আখিরাতে। এবং তারা তোমাকে ইয়াতীমের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, তাদের জন্য (অভিভাবকত্ব ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার) সংস্কারমূলক কাজ করাই উত্তম ও কল্যাণকর। যদি তোমরা (অভিভাবকত্ব গ্রহণকারীগণ) তাদের সাথে একত্রে থাকো, তবে তারা তোমাদের ভাই। এবং আল্লাহ জানেন কে সংস্কারকারী হওয়ার পরিবর্তে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে (কঠিন বিধান দিয়ে) জটিলতায় ফেলতে পারতেন। নিশ্চয় আল্লাহ মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।
وَآتِ ذَا الْقُرْبَىٰ حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا
১৭:২৬ :: এবং আত্মীয়-স্বজনকে তাদের হক্ব (অধিকার, প্রাপ্য) প্রদান করো এবং মিসকীন ও ছিন্নমূল/উদ্বাস্তু/বাস্তুহারাদেরকেও। এবং তোমরা অপব্যয় করো না।
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا
১৭:২৭ :: নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। এবং শয়তান তার প্রভুর প্রতি অকৃতজ্ঞ।
وَإِمَّا تُعْرِضَنَّ عَنْهُمُ ابْتِغَاءَ رَحْمَةٍ مِّن رَّبِّكَ تَرْجُوهَا فَقُل لَّهُمْ قَوْلًا مَّيْسُورًا
১৭:২৮ :: আর যদি তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে ও প্রত্যাশায় থাকা অবস্থায় তাদের থেকে বিমুখ হও (তাদেরকে দান করা সম্ভব না হয়), তাহলে তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বলো।
তুরাস শব্দটির শব্দমূল হচ্ছে ‘ওয়াও র ছা’। তুরাস শব্দটির অর্থ হলো ‘উত্তরাধিকার’। শব্দটি বিভিন্ন শব্দরূপে যেসব স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো।
(১) তুরাস (অর্থ: উত্তরাধিকার) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৮৯:১৯:২।
(২) মীরাস (অর্থ: স্বত্ব, উত্তরাধিকার) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৩:১৮০:২৪, ৫৭:১০:৯।
(৩) ওয়ারিস (কর্তৃবিশেষ্য, অর্থ: স্বত্বাধিকারী, উত্তরাধিকারী, বহুবচন: ওয়ারিসূন, ওয়ারাসাহ) ব্যবহৃত হয়েছে ৭ স্থানে: ২:২৩৩:৩১, ১৫:২৩:৬, ২১:৮৯:১১, ২৩:১০:৩, ২৬:৮৫:৩, ২৮:৫:১২, ২৮:৫৮:১৭।
(৪) ওয়ারিসা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১, অর্থ: ওয়ারিস হওয়া, উত্তরসূরী হওয়া, পূর্বসূরী করা, স্বত্বাধিকারী হওয়া, উত্তরাধিকারী হওয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ১৩ স্থানে: ৪:১১:৩৯, ৪:১২:৫৩, ৪:১৯:৮, ৪:১৭৬:২০, ৭:১০০:৪, ৭:১৬৯:৫, ১৯:৬:১, ১৯:৬:২, ১৯:৪০:৩, ১৯:৮০:১, ২১:১০৫:১০, ২৩:১১:২, ২৭:১৬:১।
(৫) আওরাসা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪, অর্থ: কাউকে ওয়ারিস বানানো) ব্যবহৃত হয়েছে ১২ স্থানে: ৭:৪৩:৩৩, ৭:১২৮:১০, ৭:১৩৭:১, ১৯:৬৩:৪, ২৬:৫৯:২, ৩৩:২৭:১, ৩৫:৩২:২, ৩৯:৭৪:৭, ৪০:৫৩:৫, ৪২:১৪:২৩, ৪৩:৭২:৪, ৪৪:২৮।
আল কুরআনের আলোকে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো।
৮:৭৫ ও ৩৩:৬ আয়াতে উত্তরাধিকার বিধানের ভিত্তিমূলক মূলনীতি বিবৃত হয়েছে। তা হলো: আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়গণ একে অপরের প্রতি অগ্রাধিকারী।
৩৩:৬ আয়াতে প্রথমে বলা হয়েছে, নবী মু’মিনদের প্রতি তাদের নিজেদের চেয়ে ঘনিষ্ঠতর।
আয়াত দুটিতে ‘অগ্রাধিকারী, ঘনিষ্ঠতর’ অর্থে ব্যবহৃত আরবি শব্দ হচ্ছে ‘আওলা’। আওলা শব্দটি হচ্ছে ‘ওয়ালি’ শব্দের Comparative । এ শব্দটির শব্দমূল হচ্ছে ‘ওয়াও লাম ইয়া’। এ শব্দমূলের অর্থ হচ্ছে ‘বন্ধুত্ব, অভিভাবকত্ব, ঘনিষ্ঠতা, অগ্রাধিকার’। আওলা শব্দটি একবচনে ৬ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে: ৩:৬৮:২, ৪:১৩৫:২১, ৮:৭৫:১৩, ১৯:৭০:৬, ৩৩:৬:২ এবং ৩৩:৬:১১। আওলা শব্দটির দ্বিবচন আওলাইয়ান ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে ৫:১০৭:১৪। ‘ওয়াও লাম ইয়া’ থেকে গঠিত আওলা শব্দটির প্রয়োগ অনুসারে এর অর্থ হচ্ছে ‘অগ্রাধিকারী, ঘনিষ্ঠতর’।
এই অগ্রাধিকার বা অধিক ঘনিষ্ঠতা উত্তরাধিকারের বণ্টনের ক্ষেত্রেও হতে পারে আবার অন্য ক্ষেত্রেও হতে পারে। সুতরাং ৮:৭৫ ও ৩৩:৬ আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী সাধারণভাবে মু’মিন ও মুহাজিরদের চেয়ে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়গণ একে অন্যের প্রতি অগ্রাধিকারী তথ্যটির দুটি তাৎপর্য হচ্ছে:
১. আত্মীয় মু’মিনগণ অন্য মু’মিনদের চেয়ে অগ্রাধিকারী, কারণ তাতে আত্মীয়তার মাত্রা যোগ হয়েছে।
২. আত্মীয়গণ প্রাত্যহিক অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব ও উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী মু’মিনদের চেয়ে অগ্রাধিকারী। তবে এ অগ্রাধিকার আদর্শিক ক্ষেত্রে নয়, বরং আদর্শগত দিক থেকে মু’মিনরাই পরস্পরের বন্ধু ও অভিভাবক। এ বিষয়টি প্রমাণিত হয় ৪:৭, ৪:৩৩, ৪:১১-১২, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি এবং ৯:২৩, ৯:৭১ আয়াতে বর্ণিত বন্ধুত্ব ও অভিভাবকত্বের নীতি অনুসারে।
সুতরাং উত্তরাধিকার বিধানের ভিত্তিমূলক প্রথম মূলনীতি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দেরকে পরস্পরের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
৮৯:১৭-২০ আয়াতে মানুষের মধ্যে উত্তরাধিকারের বিধান অনুযায়ী সঠিকভাবে সম্পদ বণ্টন না করে অন্যের উত্তরাধিকারকে নির্বিচারে গ্রাস করার অভ্যাস ও মানসিকতা তুলে ধরা হয়েছে। এরূপ ব্যক্তিরা ইয়াতীম ছেলে-মেয়েদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করে না, মিসকীনের অন্ন সংস্থান বা কল্যাণ করার জন্য উৎসাহিত করে না। এর পেছনে যে মনস্তত্ব কাজ করে তা হলো সম্পদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণ, যার ফলে সম্পদের প্রতি অনৈতিক লোভ তৈরি হয়। এ লোভের কারণেই মানুষ উত্তরাধিকারের সঠিক বণ্টন করে না এবং অন্য উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সম্পদ আত্মসাৎ করে।
৪:১৯ আয়াতে বলপ্রয়োগপূর্বক নারীদের সম্পদের উত্তরাধিকারী বা ভোগদখলকারী হওয়াকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এটা একটা অত্যন্ত স্বত:সিদ্ধ যৌক্তিক বিষয় যে, নারীদেরকে তাদের সম্পদের অধিকার বা উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না এবং তাদের সম্পদকে তাদের স্বত:স্ফূর্ত অনুদান ও সম্মতি ছাড়া বলপ্রয়োগপূর্বক ব্যবহার করা যাবে না। তা সত্ত্বেও এখনো সমাজে এরূপ অনিয়ম অবিচার ব্যাপকভাবে বর্তমান রয়েছে। অনেক সময় এরূপ প্রচারণা চালানো হয় যে, ভালো মেয়েরা পিতা-মাতার সম্পত্তি থেকে নেয় না, তাদের ভাইকে ছেড়ে দেয়। এভাবে এক ধরনের মানসিক ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে নারীদেরকে তাদের প্রাপ্য উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। কোনো নারীর স্বামী যদি তার উত্তরাধিকারের বিষয়ে কথা বলে তখন স্বয়ং সেই নারীও তাকে অপমানসূচক কথা বলে যে, কেন তুমি শ^শুরবাড়ির বিষয়ে লোভ করছো? অথচ এটা একটা ন্যায়সঙ্গত অধিকারের প্রশ্ন। অথচ এটা নিশ্চিত নয় যে, যদি ঐ নারীকে তার প্রাপ্য সম্পদের মালিকানা প্রদান করা হতো তারপরেও সে তার ঐ সম্পদ তার ভাইকে দান করে দিতো। বরং অনেক সময় সে সামাজিক অপতৎপরতাকে নীরবে হজম করে বিধায় বাহ্যত এরূপ কথা বলে। আর এভাবে উত্তরাধিকার আত্মসাৎকারী হওয়া সত্ত্বেও অনেকের সামাজিক সম্মান, প্রতিপত্তি বজায় থাকে; যা প্রমাণ করে যে, সাধারণভাবে পুরো সমাজই ন্যায়বিচারের বিষয়ে উদাসীন। এটি সমাজের নৈতিক অধ:পতনের অন্যতম লক্ষণ।
উত্তরাধিকার যেন সঠিক নিয়মে বণ্টিত হতে পারে এবং কেউ যেন কাউকে তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করতে না পারে, ইয়াতীম ছেলে মেয়েরা যেন সম্মানের সাথে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, নারী যেন নিজ সম্পদে নিজের যথাযথ অধিকার পায় এবং উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় তথা যেন নারীর উত্তরাধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায় এসবের বাস্তবসম্মত উপায় হিসেবে আল্লাহ স্বয়ং উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি প্রদান করেছেন।
একটি প্রচলিত ধারণাপ্রসূত কথা হচ্ছে: উত্তরাধিকার ও সুদ সম্পর্কিত আয়াতগুলো নবীর জীবনের শেষ দিকে নাজিল হয়েছে এবং তার ব্যাখ্যা দেয়ার আগেই নবীজী দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন - তাই এ দুটি বিষয়ে প্রকৃত ব্যাখ্যা জানা সম্ভব হয়নি এবং মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে।
অথচ উত্তরাধিকার বন্টন সম্পর্কে কুরআনের শেষ বক্তব্য হচ্ছে, আল্লাহ তোমাদের জন্য স্পষ্টভাবে বিশদ বর্ণনা করছেন, পাছে তোমরা বিভ্রান্ত হবে। আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞানী (৪:১৭৬)। সুতরাং অবশ্যই উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহ (৪:১১, ৪:১২, ৪:১৭৬) থেকে স্পষ্টভাবে নির্ণয় করা সম্ভব। তবে, উলুল আলবাব/ চিন্তাশীলগণ ব্যতীত অন্যরা পুন:পুন: স্মরণীয় তথ্য গ্রহণ (সঠিক বুঝ লাভ) করে না। তাই আমরা আল্লাহর উপর ভরসা রেখে বিষয়টি নিয়ে চিন্তার প্রয়াস পাচ্ছি। কারণ আল্লাহ বলেছেন, যারা আমার (সাথে সম্পর্কিত) বিষয়ে প্রচেষ্টা করে আমি তাদেরকে আমার পথসমূহে পথপ্রদর্শন করি।
কুরআনে উত্তরাধিকারের বন্টনবিধি যেভাবে দেয়া হয়েছে তা ভাষারীতির উৎকর্ষসম্পন্ন বিবৃতিমূলক পদ্ধতিতে উল্লেখিত হয়েছে। আর এতে অংশগুলোও উল্লেখ করা হয়েছে আনুপাতিক অংশ হিসাবে যা প্রদত্ত বন্টন বিধির বিশ্লেষণ থেকে বুঝা যায়। এরূপ উপস্থাপনা পদ্ধতির মাধ্যমে সামান্য পরিসরে সকল অবস্থার সাথে সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান নির্দেশ করা হয়েছে। কুরআনিক বণ্টন পদ্ধতির মাধ্যমে আল্লাহ যার বিপরীতে যাকে যেভাবে কম বা বেশি অনুপাতে দিয়েছেন তা বজায় রেখে নির্দিষ্ট উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সহজেই সমস্ত সম্পদের বণ্টন করা যায়। ভাষারীতি ও অনুপাতভিত্তিক বন্টন পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন থাকলে সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহ থেকে পরিপূর্ণ বন্টনবিধি বুঝে নেয়া মোটেই কঠিন নয়।
৪:১১-১২ আয়াতের বক্তব্য কাঠামোতে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বন্টন বিধি দুটি মৌলিক ভাগে বিভক্ত:
প্রথম আয়াতে (৪:১১) মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ বর্ণিত হয়েছে তথা এটি মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতার সাথে সম্পর্কিত। আয়াতটির শেষদিকে বলা হয়েছে, ‘তোমরা জান না, পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যার মধ্যে কে উপকার সাধনে অধিক নিকটবর্তী হবে’। আয়াতটিতে উল্লেখিত দুটি পক্ষের একটি পক্ষ হচ্ছে পুত্র-কন্যা যার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি সাপেক্ষে পিতা-মাতার জন্য ভিন্ন ভিন্ন আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে কিন্তু পিতা-মাতার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি সাপেক্ষে পুত্র-কন্যার জন্য ভিন্ন আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়নি।
আর দ্বিতীয় আয়াতে (৪:১২) মৃত ব্যক্তির স্ত্রী/ স্বামীর অংশ এবং মৃত ব্যক্তি কালালাহ হলে সে অবস্থায় তার ভাইবোনের অংশ বর্ণিত হয়েছে। আয়াতটিতে স্বামী/ স্ত্রীর জন্য পুত্র-কন্যার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি সাপেক্ষে ভিন্ন ভিন্ন আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু স্বামী/ স্ত্রীর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি সাপেক্ষে পুত্র-কন্যার জন্য ভিন্ন ভিন্ন আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করা হয়নি। আর পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ ৪:১১ আয়াতেই নির্ধারণ করা হয়েছে, ৪:১২ আয়াতে পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ নতুন করে বা ভিন্নভাবে নির্ধারণ করা হয়নি।
এ সম্পর্কিত শেষ আয়াতটি (৪:১৭৬) সূরাটির পরিশিষ্ট। প্রকৃতপক্ষে আয়াতটির বক্তব্য বিষয় হলো প্রথম আয়াতের (৪:১১) একটি অন্তর্নিহিত বন্টন বিধিকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা। আয়াতটিতে মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাইবোনের প্রাপ্য উত্তরাধিকার বর্ণনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতার অংশ বর্ণনায় পুত্র-কন্যার জন্য যে অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, পুত্র-কন্যার অনুপস্থিতিতে ভাইবোনের জন্য সেরূপ প্রাপ্য অংশই নির্ধারণ করা হয়েছে।
৪:১১ আয়াতে ব্যবহৃত সর্বনাম ও ক্রিয়া থেকে বুঝা যায়, যে মৃত ব্যক্তির সম্পদ বন্টনের কথা বলা হচ্ছে সে পুরুষ। কিন্তু যদি সে নারী হয় তাহলেও তার সম্পদ এই একই বন্টনবিধি আনুযায়ী বন্টন করতে হবে। কারণ, ৪:১২ আয়াত অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তি পুরুষ না স্ত্রীলোক তা শুধমাত্রু তার স্বামী বা স্ত্রীর প্রাপ্য অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ স্বামীর সম্পদে স্ত্রীর বা স্ত্রীর সম্পদে স্বামীর অংশ কতটুকু তা ১২ নং আয়াতে বলে দেয়া হয়েছে। অন্য আত্মীয়দের ক্ষেত্রে মৃত পুরুষ লোকের সম্পদে যেরূপ বন্টন, মৃত মহিলার সম্পদেও সেরূপ বন্টন। কারণ সাধারণ নিয়মানুসারে যৌথ নির্দেশ পুরুষবাচক শব্দে দেয়া হয় আর ব্যতিক্রম উল্লেখ করে দেয়া হয়। এছাড়া এ বিষয়ে উদাহরণ হিসেবে ১২ নং আয়াতে মৃত পুরুষ কালালাহ ও মৃত মহিলা কালালাহর সম্পদ বন্টনের অভিন্ন নিয়ম প্রদান করা হয়েছে।
৪:১৭৬ আয়াতে দুটি বিষয় অনুক্ত (Non expressed) কিন্তু বোধগম্য (Understood) অবস্থায় রয়েছে। বিষয় দুটি হলো:
(ক) মৃত ভাইয়ের এক বা একাধিক ভাই কিভাবে উত্তরাধিকার পাবে?
(খ) মৃত বোনের এক বা একাধিক বোন বা একাধিক ভাই বা ভাই-বোন কিভাবে উত্তরাধিকার পাবে?
৪:১৭৬ আয়াতে অবলম্বনকৃত ভাষারীতির মাধ্যমে বক্তব্য বিন্যাস সংক্ষেপীকরণ করা হয়েছে। কারণ ‘ক’ এর সাথে সম্পর্কিত কোনো অবস্থায় প্রদত্ত ব্যবস্থা যদি ‘খ’ এর সাথে সম্পর্কিত অনুরূপ অবস্থায় প্রযোজ্য ব্যবস্থা হয়, তবে তা বক্তব্যের প্রাসঙ্গিক অবস্থান ও বর্ণনাভঙ্গি থেকে সহজ বোধগম্য হলে সেক্ষেত্রে তা বক্তব্যের উৎকর্ষের প্রয়োজনে অনুল্লেখিত রাখা হয়।
উল্লেখিত ভাষাতাত্ত্বিক কারণে ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টনের ক্ষেত্রে, মৃত ব্যক্তি ভাই হলে তার ভাই/ বোন/ ভাই-বোন যেভাবে পাবে, মৃত ব্যক্তি বোন হলেও তার ভাই/ বোন/ ভাই-বোন সেভাবে পাবে।
উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি বর্ণনায় যেক্ষেত্রে যে ‘বচন’ (এক বচন, দ্বিবচন, বহুবচন) ব্যবহার করা হয়েছে বক্তব্য প্রসঙ্গ অনুসারে যেক্ষেত্রে তা যে ধরনের প্রভাব রাখে নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো:
১. ৪:১২ আয়াতে স্বামী-স্ত্রীর আনুপাতিক অংশ বর্ণনায় বহুবচন ‘লাকুম’ (তোমাদের জন্য) এবং ‘লাহুন্না’ (তাদের জন্য তথা স্ত্রীদের জন্য) শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ এতে স্বামীদের ক্ষেত্রেও বহুবচন এবং স্ত্রীদের ক্ষেত্রেও বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ একজন স্বামীর একজন স্ত্রী হলেও বহু স্বামীর স্ত্রীসংখ্যা মিলে বহুবচন হয়। অনুরূপভাবে যদিও একজন স্ত্রীর স্বামী একজনই থাকে তবুও বহু স্ত্রীর স্বামীদেরকে তথা পুরুষদেরকে প্রধান সম্বোধিত ব্যক্তিবর্গ হিসেবে সাব্যস্ত করে ‘তোমাদের জন্য’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
তাই এতে বহুবচন ব্যবহৃত হলেও স্বামীর জন্য বর্ণিত অংশের প্রাপক হয় একজন স্বামী। অন্যদিকে স্ত্রীর জন্য বর্ণিত অংশের প্রাপক যেমন একজন স্ত্রী হতে পারে, তেমনি যদি একাধিক স্ত্রী থাকে সেক্ষেত্রে তারা যৌথভাবে ঐ অংশের প্রাপক হবে এবং তা তাদের মধ্যে সমান হারে ভাগ হবে।
২. ৪:১৭৬ আয়াতে বক্তব্যের ধারাবাহিকতা অনুসারে একজন ভাই তার বোনের উত্তরাধিকারী হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু যদি একজন ভাইয়ের পরিবর্তে একাধিক ভাই থাকে, তাহলে তারাও উত্তরাধিকারী হবে। অর্থাৎ আয়াতটিতে ভাইকে উত্তরাধিকারী হিসেবে উল্লেখ করার ক্ষেত্রে একবচন ব্যবহৃত হলেও বহু ভাইয়ের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে।
৩. ৪:১১ আয়াতে পিতা-মাতার অংশ বর্ণনায় পিতা-মাতাকে দ্বিবচনে এবং মাতাকে একবচনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই এতে বর্ণিত অংশটিতে প্রত্যক্ষভাবে পিতা-মাতাই অন্তর্ভুক্ত। দাদা-দাদী ও নানা-নানী পিতা-মাতা শ্রেণির হলেও তারা মৃতের সাথে পিতা-মাতার সম্পর্কসূত্রে পিতা-মাতা শ্রেণিভুক্ত হয়েছে। মৃত ব্যক্তির সাথে দাদা-দাদীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে পিতা-মাতা মাধ্যম (Media) শ্রেণি হওয়ায় পিতা-মাতা জীবিত থাকলে তারা মৃত ব্যক্তির আক্বরাব (নিকটতম) হয় না। কিন্তু পিতা-মাতা জীবিত না থাকলে, দাদা-দাদী ও নানা-নানী তাদের জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে। অর্থাৎ পিতার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে দাদা-দাদী এবং মাতার জন্য নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশের স্থলাভিষিক্ত প্রাপক হবে নানা-নানী; যদিও আয়াতটিতে পিতা-মাতার বিষয়টি দ্বিবচনে উল্লেখ করা হয়েছে।
৪. যেক্ষেত্রে তুলনামূলক অবস্থা বুঝাতে বা কোনো শর্ত হিসেবে বচন উল্লেখ করা হয়েছে সেক্ষেত্রে ব্যবহৃত বচন সরাসরি প্রযোজ্য হওয়া শর্তের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। যেমন, এক পুত্র পাবে দুই কন্যার সমান সূত্রটি অনুসারে একটি পুত্র ও তিনটি কন্যা একসাথে থাকলে একটি পুত্রকে দুই কন্যা হিসেবে বিবেচনা করে সম্পদকে মোট পাঁচ ভাগ করতে হবে। তা থেকে প্রত্যেক কন্যা এক ভাগ পাবে এবং পুত্রটি দুই ভাগ পাবে।
৪:১১ আয়াতে বর্ণিত ধারা হলো পুত্র না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র কন্যা থাকলে তার আনুপাতিক অংশ হলো ১/২। ধারাটি তাতে উল্লেখিত শর্তানুসারে কার্যকর হবে অর্থাৎ যখন পুত্র থাকে না এবং একাধিক কন্যা থাকে না শুধু তখন একটিমাত্র কন্যার আনুপাতিক অংশ হবে ১/২। নিম্নোক্ত দুটি ধারার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য:
(ক) ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত ধারা একটিমাত্র ভাই বা একটিমাত্র বোন থাকলে তার আনুপাতিক অংশ ১/৬।
(খ) ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ধারা ভাই না থাকা অবস্থায় একটিমাত্র বোন থাকলে তার আনুপাতিক অংশ ১/২।
পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতার নির্ধারিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে, তোমরা জান না তোমাদের পিতা-মাতা ও পুত্র-কন্যার মধ্যে কে উপকার সাধনে নিকটতম হবে? এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আবশ্যিক বিধান। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।
এ কথার তাৎপর্য হলো আমরা যেভাবে জানি বাস্তবে কখনো তার উল্টোটা ঘটতে পারে। যেমন আমরা হয়তো ভাবলাম পুত্র-কন্যা উপকার সাধনে নিকটতম হবে কিন্তু বাস্তবে পিতা-মাতাই উপকার সাধনে নিকটতম হবে। আবার কখনো আমরা ভাবলাম পিতা-মাতা উপকার সাধনে নিকটতম হবে কিন্তু বাস্তবে পুত্র-কন্যাই উপকার সাধনে নিকটতম হবে। এটা একটা সাধারণ বিবৃতি। এর মাধ্যমে পিতা-মাতা বা পুত্র-কন্যার মধ্য থেকে একটি পক্ষই উপকার সাধনে সব সময় নিকটতম হবে তা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। বরং এর মাধ্যমে বুঝা যায় যে, উপকার সাধনে কখনো পিতা-মাতা নিকটতম হতে পারে, আবার কখনো পুত্র-কন্যা নিকটতম হতে পারে। কখন কে নিকটতম হবে তা আমরা জানি না কিন্তু আল্লাহ জানেন।
সুতরাং উত্তরাধিকারের প্রাপ্য অংশ নির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে উপকার সাধনে কখন কে নিকটতম হবে সেটাই ভিত্তিমূলক বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং সামগ্রিক সমাজ কল্যাণের ভারসাম্যপূর্ণ উপায় হিসেবে আল্লাহ তাঁর জ্ঞান ও বিজ্ঞতার মাধ্যমে যার জন্য যা আবশ্যিক নির্ধারিত অংশ করেছেন তাকে সেটা দেয়াই আমাদের কর্তব্য।
আগে দাইন (ঋণ) পরিশোধ করতে হবে, পরে ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ করতে হবে। কারণ দাইন বা ঋণ অন্যের অধিকারের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু আয়াতে আগে ওয়াসিয়্যাত এবং পরে দাইন (ঋণ) এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। এর যে যৌিিক্তকতা বুঝা যায় তাহলো, ওয়াসিয়্যাত থাকার সম্ভাবনা ঋণ থাকার সম্ভাবনার চেয়ে বেশি। ওয়াসিয়্যাত করাকে ফরজ করা হয়েছে, কিন্তু ঋণ একটি অনুমোদিত বিষয় মাত্র। এছাড়া মানুষের ওয়াসিয়্যাত তার মৃত্যুর পর কার্যকর করা হয়, কিন্তু ঋণ ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় পরিশোধ করার চেষ্টা করতে হয়, যদি না পারে সেক্ষেত্রেই তার মৃত্যুর পর তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে তা পরিশোধ করতে হয়। ঋণের প্রসঙ্গ পরে বলার মাধ্যমে ঋণ রেখে যাওয়ার বিষয়ে পরোক্ষভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বা জীবদ্দশায় ঋণ পরিশোধের চেষ্টাকে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একইসাথে একজন বিবেকবান ব্যক্তি যখন সজ্ঞানে ওয়াসিয়্যাতের আবশ্যকতা পূরণ করবে, তখন তিনি প্রথমে নিজেই ঋণ পরিশোধকেও ওয়াসিয়্যাত বা উইলে ব্যবস্থা নিবে, এটাই অধিক সম্ভব ও বাস্তবসম্মত। অনুরূপভাবে ওয়াসিয়্যাতের প্রসঙ্গ আগে বলার মাধ্যমে ওয়াসিয়্যাত করে যাওয়ার বাধ্যবাধকতাকে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তবে পরিশোধের দিক থেকে দাইন বা দেনা পরিশোধ যে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য তা সহজ বোধগম্য বিষয়।
৪:১২ আয়াতের একটি নির্দেশনা হচ্ছে গায়রা মুদাররিন অর্থাৎ (উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) অক্ষতিকর উপায়ে।
গায়রা শব্দটির অর্থ ‘ব্যতীত’। মুদাররিন শব্দটির অর্থ ‘ক্ষতিকর’। গায়রা শব্দটি কর্মকারক। তাই এর পূর্বে কোন ক্রিয়ার প্রয়োজন। কিন্তু এর পূর্ববর্তী ক্রিয়া উহ্য রয়েছে। এক্ষেত্রে এটিকে ‘ফারীদাতাম মিনাল্লাহ’ এবং ‘ওয়াসিয়াতাম মিনাল্লাহ’ এর মতো বিবেচনা করলে এর অর্থ হয় (অবলম্বন করো) অক্ষতিকর উপায়কে। অন্যদিকে গায়রা মুদাররিন বাক্যটিকে মিম বা’দি ওয়াসিয়্যাতিন .... এর মতো বিবেচনা করলে এর অর্থ হয় (উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) অক্ষতিকর উপায়ে। উভয় অবস্থায় এর তাৎপর্য একই থাকে, আর তা হলো শুধু ভাগ ঠিক হলে চলবে না, ভাগগুলোর মানও যেন প্রত্যেকের মধ্যে ন্যায্যভাবে বন্টিত হয় তা খেয়াল রাখতে হবে।
গায়রা মুদাররিন এর দ্বিতীয় তাৎপর্য হতে পারে, অধিক নফল ওয়াসিয়্যাতের মাধ্যমে এবং ওয়ারিসদের পাশাপাশি অন্য কাউকে কিছু দেয়ার জন্য মিথ্যাভাবে কারো কাছে ঋণী থাকার কথা বলে ওয়ারিসদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। এ বিষয়ে হাদীসে নির্দেশনা রয়েছে। নফল ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে হাদীসের নির্দেশনা হচ্ছে, তা যেন এক তৃতীয়াংশের বেশি না হয়, বরং এক তৃতীয়াংশও অনেক, তাই তা যেন এক চতুর্থাংশের বেশি না হয় সেভাবে ওয়াসিয়্যাত করা।
গায়রা মুদাররিন এর তৃতীয় তাৎপর্য হতে পারে, নফল ওয়াসিয়্যাত (ওয়ারিস ব্যতীত অন্যদের জন্য কৃত ওয়াসিয়্যাত) ও ঋণের পরিমাণ অধিক হলে অক্ষতিকর উপায়স্বরূপ সেক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করা। যেমন:
১. নফল ওয়াসিয়াতের ক্ষেত্রে, যদি এক তৃতীয়াংশের বেশি নফল ওয়াসিয়্যাত থাকে তবে ঐ পরিমাণকে যাদের জন্য যা ওয়াসিয়্যাত করা হয়েছে তাদের পরস্পরের মধ্যে আনুপাতিক হারে হ্রাসসকরনের মাধ্যমে হাদীসের নির্দেশনার সাথে সঙ্গতি রেখে এক তৃতীয়াংশের মধ্যে বা এক চতুর্থাংশের মধ্যে সীমিত করে পরিপূরণ করা যেতে পারে। অথবা এক্ষেত্রে উলিল আমর যদি আরো কম পরিমাণের মধ্যে সীমিত করাকে যৌক্তিক মনে করেন তবে তাও করা যেতে পারে। এমনকি হাদীসেও ‘এক তৃতীয়াংশ বা এক চতুর্থাংশ’ শব্দের মাধ্যমে পরিস্থিতি অনুসারে বিভিন্নভাবে সীমিত করার বিকল্প সম্পর্কেই ধারণা দেয়া হয়েছে।
২. অধিক পরিমাণ ঋণের ক্ষেত্রে, যদি ঋণদাতা পাওনাদার কোনো অংশ মাফ না করে তবে তা কিস্তিতে পরিশোধের ব্যবস্থা করা বা উলিল আমরের (Central Authority) পক্ষ থেকে পরিশোধের ব্যবস্থা করার পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।
গায়রা মুদাররিন এর চতুর্থ তাৎপর্য হতে পারে, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে যাচাই বাছাই সাপেক্ষে প্রমাণিত ঋণ প্রাপককে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কারণ প্রমাণিত ঋণ প্রাপককে ঋণ পরিশোধ না করলে ঐ ঋণ প্রাপককে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় এবং তার অধিকার অনাদায়ী থেকে যায় বিধায় তা করা যাবে না। সুতরাং প্রমাণিত ঋণ প্রাপককে অবশ্যই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
৪:৭ আয়াত অনুযায়ী, পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়গণ যা রেখে যায় তাতে পুরুষ ও নারীর প্রাপ্য অংশ নির্ধারিত।
৪:৩৩ আয়াত অনুযায়ী, পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়গণ যা রেখে যায় তার প্রত্যেকটি সম্পদের জন্য উত্তরাধিকারী নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
সুতরাং ৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াতের সমন্বিত তথ্য অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার পরিত্যক্ত সম্পদের প্রত্যেকটির জন্য মহান আল্লাহ অব্যবহিত উত্তরাধিকারী (মাওয়ালিয়া) নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন এবং তাদের প্রত্যেকের প্রাপ্য অংশও নির্ধারিত করে দিয়েছেন।
৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াতের সমন্বিত তথ্য থেকে উত্তরাধিকার বণ্টন পদ্ধতির মূলনীতি পাওয়া যায়। আয়াতের বক্তব্য বিষয় থেকে নির্ণিত নিম্নলিখিত শর্তসমূহ থেকে বণ্টন পদ্ধতির মূলনীতি উৎসারিত হয়:
(১) উত্তরাধিকারের বিধানে মৃত ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয়দেরকে যেভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে উত্তরাধিকার লাভের প্রশ্নে তারা সেভাবে নিকটতম হিসেবে সাব্যস্ত হবে। যেমন প্রদত্ত শর্ত অনুসারে ভাই-বোন কখনো পায় এবং কখনো পায় না। অর্থাৎ আত্মীয়তার দিক থেকে ভাই-বোন ‘আক্বরাবূন’ বা ‘নিকটতম আত্মীয়’ হলেও উত্তরাধিকারের প্রশ্নে তারা শর্ত সাপেক্ষে উত্তরাধিকার লাভ করতে পারে।
(২) উত্তরাধিকারের বিধানে যাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাদের প্রত্যেকের প্রাপ্য অংশ নির্ধারিত। সুতরাং তাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ নির্ধারিত প্রাপ্য অংশই পাবে, এর চেয়ে কম বা বেশি পাবে না।
(৩) উত্তরাধিকারের বিধানে যাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তারা মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের প্রত্যেকটি অংশের প্রাপক। অন্য কথায়, তাদের কেউ জীবিত থাকা অবস্থায় তাদের বাহিরের কেউ উত্তরাধিকারী হতে পারবে না এবং আল্লাহ যাদেরকে নির্দিষ্ট করেছেন তাদের কেউ বাদ যাবে না।
(৪) উত্তরাধিকারের বিধানে যাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তারা পরিত্যক্ত সম্পদের প্রত্যেকটি অংশের প্রাপক। অন্য কথায় সমস্ত পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টিত হবে এবং তা থেকে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
(৫) মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের প্রত্যেকটির জন্য মাওয়ালিয়া নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক স্বতন্ত্র মানসম্পন্ন জিনিস স্বতন্ত্রভাবে বণ্টিত হবে এবং প্রত্যেক স্বতন্ত্র মানসম্পন্ন জিনিসের উপর মাওয়ালিয়ার অন্তর্ভুক্ত সকলের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত কারণে যে একককে (Unit) ভাঙ্গা যায় না সেরূপ এককটিকে না ভেঙ্গে এককের স্বত্ব আনুপাতিক হারে বণ্টিত হবে তথা এককটির উপযোগ (Unit/ উপকারিতা) উত্তরাধিকারীরা আনুপাতিক হারে ভোগ করবে। যেমন: ধরা যাক, এক কক্ষবিশিষ্ট একটি কক্ষে উত্তরাধিকারী দুই ভাই পরিবারসহ থাকা সম্ভব নয় এবং দুই ভাই পূর্ব থেকেই আলাদা দুটি বাসায় নিজ নিজ পরিবারসহ আছে। এমতাবস্থায় তারা দুই ভাই যৌথভাবে এ কক্ষটিকে ভাড়া দিয়ে ভাড়া হিসেবে প্রাপ্ত টাকা সমান দুই ভাগ করে গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া তারা চাইলে সেটাকে নিজেদের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় বা সমন্বয়ও করে নিতে পারে।
এই শর্তসমূহ পরিপূরণ করে উত্তরাধিকার বণ্টন করার একমাত্র গাণিতিক পদ্ধতি হচ্ছে আনুপাতিক ভাগ বণ্টন পদ্ধতি। কারণ যাদেরকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাদের প্রত্যেকের উপস্থিতি অথবা কারো কারো অনুপস্থিতির কারণে তাদের নির্ধারিত অংশগুলোকে সাধারণ ভগ্নাংশ পদ্ধতিতে বণ্টন করার অর্থ হচ্ছে কখনো যোগফল সম্পূর্ণ অংশের সমান, কখনো সম্পূর্ণ অংশের চেয়ে কম এবং কখনো সম্পূর্ণ অংশের চেয়ে বেশি হবে। অন্যদিকে আনুপাতিক ভাগ বণ্টন পদ্ধতিতে নরমালাইজেশন (normalization) করা হয় এবং তাই শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহের যোগফল ১ এর চেয়ে কম বা বেশি যা-ই হোক, বাস্তবে সম্পূর্ণ সম্পদই বণ্টিত হয়, অবশিষ্টও থাকে না, ঘাটতিও পড়ে না।
৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াতের তথ্য অনুসারে জানা যায় যে, পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রী এবং ভাই, বোনের জন্য যে নির্ধারিত অংশগুলো উল্লেখ করা হয়েছে সেটা তাদের পারস্পরিক তুলনামূলক অংশ বা শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ। আনুপাতিক ভাগ বণ্টন পদ্ধতিতে বণ্টন করার পর উপস্থিত ওয়ারিসদের শ্রেণিসংখ্যা সাপেক্ষে নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রকৃত প্রাপ্য অংশ এবং ঐ শ্রেণির জন্য উল্লেখিত শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ সমানও হতে পারে, অসমানও হতে পারে কিন্তু উভয় অবস্থায় অন্যদের সাথে শ্রেণিগত অনুপাত সমান থাকে।
যখন একজনমাত্র ওয়ারিস থাকে, তখন তার জন্য উল্লেখিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ যাই হোক আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে তার প্রাপ্য অংশের পরিমাণ হয় সম্পূর্ণ। কারণ আনুপাতিক ভগ্নাংশের অর্থই হচ্ছে এক ওয়ারিসের সাথে অন্য ওয়ারিসের অনুপাত বা তুলনামূলক অংশ। অন্য ওয়ারিস না থাকা অবস্থায় তার আনুপাতিক ভগ্নাংশ সম্পূর্ণ অংশে রূপান্তরিত হয় এবং এক্ষেত্রে আনুপাতিক ভাগ বণ্টন পদ্ধতির একই সূত্র প্রযোজ্য।
শ্রেণিগত আনুপাতিক সংখ্যাসমূহ
আয়াতসমূহে বিভিন্ন শ্রেণির জন্য যেসব আনুপাতিক ভগ্নাংশ উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হলো: ১/২ , ১/৩ , ২/৩ , ১/৪ , ১/৬ , ১/৮ ।
আনুপাতিক ভগ্নাংশগুলোর হর ২, ৩, ৪, ৬ ও ৮ এর ল.সা.গু হলো: ২৪।
সুতরাং আমরা সকল আনুপাতিক ভগ্নাংশকে সমহরে (হর হিসেবে ২৪ কে নিয়ে) প্রকাশ করলে অনুপাত বা তুলনা স্পষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে সহজ হবে। সেক্ষেত্রে উল্লেখিত আনুপাতিক ভগ্নাংশগুলোর সমহরে প্রকাশিত ভগ্নাংশ নিম্নরূপ হয়:
১/২ = ১২/২৪ , ১/৩ = ৮/২৪ , ২/৩ = ১৬/২৪ , ১/৪ = ৬/২৪ , ১/৬ = ৪/২৪ , ১/৮ = ৩/২৪ ।
ভগ্নাংশগুলোকে সমহরে প্রকাশ করায় সমহরবিশিষ্ট প্রতিটি ভগ্নাংশের লবই হবে নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রাপ্য আনুপাতিক সংখ্যা।
সুতরাং ১/২ = ১২, ১/৩ = ৮, ২/৩ = ১৬, ১/৪ = ৬, ১/৬ = ৪, ১/৮ = ৩।
(পূর্ণসংখ্যাগুলো হলো প্রতিটি ভগ্নাংশকে সমহর ২৪ দ্বারা গুণ করে প্রাপ্ত পূর্ণ সংখ্যা।)
পরিস্থিতি: কোনো মৃত ব্যক্তির তিন কন্যা, পিতা-মাতা ও দুই স্ত্রীর মধ্যে ১০০০ টাকা ভাগ করে দিতে হবে।
সমাধান: সূরা নিসা ৪:১১-১২ আয়াত অনুযায়ী,
তিন কন্যার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ২/৩ বা তিনকন্যার শ্রেণিগত আনুপাতিক সংখ্যা = ১৬
পিতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১/৬ বা পিতার শ্রেণিগত আনুপাতিক সংখ্যা = ৪
মাতার আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১/৬ বা মাতার শ্রেণিগত আনুপাতিক সংখ্যা = ৪
স্ত্রীদের আনুপাতিক ভগ্নাংশ = ১/৮ বা স্ত্রীদের শ্রেণিগত আনুপাতিক সংখ্যা = ৩
আনুপাতিক ভগ্নাংশসমূহের সমষ্টি = ৯/৮ বা আনুপাতিক সংখ্যাসমূহের সমষ্টি = ২৭
সুতরাং উক্ত পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রাপ্য সম্পদ নির্ণয়ের সূত্র প্রয়োগ নিম্নে দেখানো হলো:
তিন কন্যা পরস্পর সমান হারে পাবে। সুতরাং প্রত্যেক কন্যা পাবে ৫৯২.৫৯/৩ = ১৯৭.৫৩
স্ত্রীরা পরস্পর সমান হারে পাবে। সুতরাং প্রত্যেক স্ত্রী পাবে ১১১.১১/২ = ৫৫.৫৫
অতএব,
প্রত্যেক কন্যা পাবে ১৯৭.৫৩ টাকা, পিতা পাবে ১৪৮.১১ টাকা, মাতা পাবে ১৪৮.১১ টাকা, প্রত্যেক স্ত্রী পাবে ৫৫.৫৫ টাকা।
দ্বিতীয় পদ্ধতি:
উল্লেখিত আনুপাতিক ভগ্নাংশ থেকে নির্ণিত শ্রেণিগত আনুপাতিক প্রয়োগ করে দেখানো সূত্রানুসারে,
তিন কন্যা পরস্পর সমান হারে পাবে। সুতরাং প্রত্যেক কন্যা পাবে ৫৯২.৫৯/৩ = ১৯৭.৫৩
স্ত্রীরা পরস্পর সমান হারে পাবে। সুতরাং প্রত্যেক স্ত্রী পাবে ১১১.১১/২ = ৫৫.৫৫
অতএব,
প্রত্যেক কন্যা পাবে ১৯৭.৫৩ টাকা, পিতা পাবে ১৪৮.১১ টাকা, মাতা পাবে ১৪৮.১১ টাকা, প্রত্যেক স্ত্রী পাবে ৫৫.৫৫ টাকা।
কুরআনে যে ওয়ারিস বা যে শ্রেণির ওয়ারিসের জন্য (‘লাহু/ ...’ শব্দের পর) যে প্রাপ্য অংশসমূহ (২/৩ , ১/২ , ১/৬ , ১/৩ , ১/৪ , ১/৮ ) উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ। আয়াতসমূহের বক্তব্য বিশ্লেষণ এবং তাতে প্রদত্ত বণ্টন বিধির বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। আয়াতসমূহের বর্ণিত ভগ্নাংশগুলোকে শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ হিসেবে সাব্যস্ত করে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি অবলম্বনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো।
পুত্র-কন্যা থাকা বা না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা ও স্বামী/স্ত্রীর প্রাপ্য অংশ যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ:
পুত্র-কন্যা থাকলে পিতা-মাতা পাবে ১/৬ ।
পুত্র-কন্যা না থাকলে মাতা পাবে ১/৩ ।
পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই বোন থাকলে মাতা পাবে ১/৬ ।
পুত্র-কন্যা থাকলে স্বামী পাবে ১/৪ ।
পুত্র-কন্যা না থাকলে স্বামী পাবে ১/২ ।
পুত্র-কন্যা থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৪ ।
পুত্র-কন্যা না থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৮ ।
কোনো ওয়ারিসের প্রাপ্য অংশের উপর পুত্র-কন্যা বা অন্য কোন ওয়ারিসের উপস্থিতি অনুপস্থিতির প্রভাব সম্পর্কিত কতিপয় বিশেষ তথ্য:
১. পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন থাকলেও স্বামী বা স্ত্রীর জন্য হ্রাসকৃত বা বর্ধিত অংশ উল্লেখিত হয়নি।
২. স্বামী বা স্ত্রী থাকা বা না থাকা সাপেক্ষে কারো জন্য হ্রাসকৃত বা বর্ধিত অংশ উল্লেখিত হয়নি।
৩. স্বামী বা স্ত্রীর জন্য পুত্র-কন্যার সাথে বা পুত্র-কন্যা ছাড়া পিতা-মাতা থাকা বা না থাকা, পুত্র-কন্যার সাথে বা পুত্র-কন্যা ছাড়া ভাই-বোন থাকা বা না থাকা ইত্যাদি বিবেচনা করে কোন হ্রাসকৃত বা বর্ধিত অংশ উল্লেখিত হয়নি।
৪. যখন পুত্র-কন্যা থাকে না এবং ভাই বোন ওয়ারিস হয় তখন পুত্র-কন্যা থাকলে তাদের মধ্যে (তথা পুত্র-কন্যার মধ্যে) যেমন এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের সমান বলা হয়েছে তেমনি ভাই বোনের মধ্যেও এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের সমান বলা হয়েছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে পুত্র-কন্যার মধ্যে প্রযোজ্য সূত্র ভাই বোনের মধ্যে প্রযোজ্য হবে।
৫. ৪:১২ আয়াতে ভাইবোনের জন্য প্রদত্ত অংশে তারা সমান অংশীদার হবে, সেখানে এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের সমান তা প্রযোজ্য হবে না। কারণ, ৪:১২ আয়াতে ভাই-বোন পায় সন্তান থাকা অবস্থায় ও পিতা/মাতা না থাকার কারণে এবং সন্তান থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা যেমন পরস্পর কম বেশি পায় না, তেমনি সন্তান থাকা অবস্থায় ভাই-বোন পরস্পর কম বেশি পায় না।
উপরিউক্ত তথ্য থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কুরআনে বিভিন্ন ওয়ারিসের মধ্য থেকে কারো কারো থাকা বা না থাকা সাপেক্ষে অন্য কারো কারো জন্য হ্রাসকৃত বা বর্ধিত ভগ্নাংশ উল্লেখিত হয়েছে, আবার কারো কারো থাকা বা না থাকা সাপেক্ষে অন্য কারো কারো জন্য হ্রাসকৃত বা বর্ধিত ভগ্নাংশ উল্লেখিত হয়নি। যাদের থাকা বা না থাকা সাপেক্ষে অন্য কারো কারো জন্য হ্রাসকৃত বা বর্ধিত ভগ্নাংশ উল্লেখিত হয়নি, বাস্তবে তাদের কারো কারো না থাকার কারণে উল্লেখিত ভগ্নাংশগুলোর যোগফল ১ এর চেয়ে কম হওয়া একান্তই স্বাভাবিক বিষয়। আর বাস্তবে দেখা যায় যে, তাদের সবার বর্তমান থাকার কারণে উল্লেখিত ভগ্নাংশগুলোর যোগফল বিপরীতক্রমে ১ এর চেয়ে বেশিও হয়ে থাকে।
যোগফল ১ এর চেয়ে বেশি হওয়া অনেকের কাছে আপত্তিকর মনে হয়। অথচ যোগফল ১ এর চেয়ে বেশি হওয়া আপত্তিকর হলে, ১ এর চেয়ে কম হওয়াও আপত্তিকর হওয়ার কথা। বস্তুত আনুপাতিক ভগ্নাংশগুলোর যোগফল ১ এর চেয়ে কম বা ১ এর চেয়ে বেশি হওয়া উভয় অবস্থার কোনোটি আপত্তিকর নয়। কারণ আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে আনুপাতিক ভগ্নাংশগুলোর যোগফল যাই হোক না কেন, সব অবস্থায় সম্পূর্ণ সম্পদ জীবিত থাকা নির্দিষ্ট ওয়ারিসদের মধ্যে পূর্ণভাবে বণ্টিত হয়ে যায়, কিছুই ঘাটতি পড়ে না এবং কিছুই অবশিষ্ট থাকে না এবং কেউ তার প্রাপ্য অংশ থেকে কমও পায় না, বেশিও পায় না।
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে বণ্টন করার পর প্রত্যেকের আনুপাতিক ভগ্নাংশ একই থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন প্রকৃত প্রাপ্য অংশ হয়। এর কারণ, আনুপাতিক ভগ্নাংশ এবং ওয়ারিসদের বিভিন্ন শ্রেণির উপস্থিতি সাপেক্ষে সম্পূর্ণ সম্পদ থেকে প্রাপ্য অংশ হুবহু একই ভগ্নাংশ হয় না। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে কাউকে তার জন্য নির্দিষ্ট অংশের চেয়ে কম বা বেশি দেয়া হয়। বরং সম্পূর্ণ সম্পদ থেকে প্রকৃত প্রাপ্য অংশ যাই হোক না কেন সেটাই সম্পূর্ণ সম্পদ থেকে প্রাপ্য আনুপাতিক ভগ্নাংশ হিসেবে যথাস্থানে থাকে।
যেমন, একটিমাত্র কন্যার প্রাপ্য আনুপাতিক ভগ্নাংশ হলো ১/২ এবং যখন সে সন্তান হিসেবে একমাত্র সন্তান শুধু এতটুকু নয়, বরং তার সাথে অন্য কোনো শ্রেণির কোনো ওয়ারিস থাকে না, তখন আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে তার প্রাপ্য অংশ হলো ১ তথা সম্পূর্ণ। কারণ তার সাথে অন্য কোনো ওয়ারিস উপস্থিত না থাকলে তাকে নিম্নোক্ত গাণিতিক উপায়ে প্রকাশ করতে হয়।
একটিমাত্র কন্যা + শূন্য ওয়ারিস (অর্থাৎ অন্য কোনো ওয়ারিস জীবিত নেই)
= ১/২ + ০
= ১/২
এখন এরূপ পরিস্থিতিতে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি অনুযায়ী,
কন্যাটির প্রাপ্য অংশ = ১/২ ১/২ = ১ (সম্পূর্ণ)
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতির যৌক্তিকতা বোঝার জন্য উল্লেখ্য যে, যোগফল ১ এর চেয়ে কম বা বেশি হওয়া গাণিতিকভাবে একই ধরনের সমস্যা। কারণ একই পদ্ধতি তথা আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমেই উভয় গাণিতিক বণ্টন সমস্যার সমাধান করা হয়।
কেউ কেউ মনে করেন যে, যোগফল ১ এর চেয়ে কম হওয়া বড় সমস্যা নয়, তা কাউকে না কাউকে দেয়া যাবে। কিন্তু যোগফল ১ এর চেয়ে বেশি হওয়া বড় সমস্যা, কারণ সে অবস্থায় প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অংশ দেয়া যায় না। নিম্নে এ প্রসঙ্গে পূর্বের উদাহরণটি আবার দেয়া হলো:
তিন কন্যা + পিতা + মাতা + স্ত্রী।
২/৩ + ১/৬ + ১/৬ + ১/৮
= ১৬/২৪ + ৪/২৪ + ৪/২৪ + ৩/২৪
= ২৭/২৪
দেখা যাচ্ছে, উদাহরণটিতে যোগফল ১ এর চেয়ে বেশি হয়। এ থেকে স্পষ্ট যে, আয়াতগুলোতে বর্ণিত অংশকে শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ হিসেবেই নির্ধারণ করা হয়েছে তথা আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে বণ্টন করতে হবে। আর এটা স্বত:সিদ্ধ যে, ভগ্নাংশগুলোর যোগফল ১ এর বেশি হলে যদি আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে যখন ভগ্নাংশগুলোর যোগফল ১ এর চেয়ে কম হবে তখনো আনুপাতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে তথা আনুপাতিক হারে নির্দিষ্ট ওয়ারিসদেরকেই তা দিতে হবে, সম্পদের একটি অংশকে অবশিষ্ট অংশ হিসেবে দাবি করে তা অন্য কাউকে দেয়া যাবে না। কারণ অনুপাত পদ্ধতি অবলম্বন করলে উভয় ক্ষেত্রে করতে হবে।
কেউ কেউ প্রস্তাব করেন যে, প্রথমে স্ত্রীর জন্য উল্লেখিত ভগ্নাংশ দেয়া হবে, তারপর বাকি অংশ তিন কন্যা ও পিতা-মাতার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। কিন্তু এ প্রস্তাবনা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এভাবে বণ্টন করলে আয়াতের নির্দেশনা লংঘিত হবে, এর মাধ্যমে যেমন আয়াতে বর্ণিত অংশ বণ্টিত হবে না, তেমনি প্রত্যেকের আনুপাতিক ভগ্নাংশও ঠিক থাকবে না।
প্রথমে স্বামী/স্ত্রীর জন্য উল্লেখিত ভগ্নাংশ দেয়ার পরে পুত্র-কন্যা বা পিতা-মাতার মধ্যে তাদের জন্য উল্লেখিত ভগ্নাংশ অনুযায়ী বণ্টন করার প্রস্তাব প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, ৪:১২ আয়াত অনুযায়ী কালালাহর সম্পদ বন্টন প্রসঙ্গে প্রদত্ত ভাই বোনের জন্য উল্লেখিত ভগ্নাংশও কি স্বামী/স্ত্রীর জন্য উল্লেখিত ভগ্নাংশ বণ্টনের পরে দেয়া হবে, নাকি তাদের সাথে সমস্ত সম্পদে এ বণ্টন কার্যকর হবে? আয়াতের বর্ণনারীতিতে তাদের প্রাপ্য অংশকে স্বামী/স্ত্রীর অংশ দেয়ার পর অবশিষ্ট সম্পদে কার্যকর সাব্যস্ত করার অবকাশ নেই। সুতরাং প্রথমে স্বামী/স্ত্রীর অংশ দিয়ে দেয়ার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রাপ্য ভগ্নাংশগুলোর যোগফল ১ এর চেয়ে বেশি না হয়ে বরং যে অবস্থায় যোগফল ১ এর চেয়ে কম হয়, আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে বণ্টন না করলে সে অবস্থায় একটা অংশ অবণ্টিত থেকে যাওয়ার অবকাশ তৈরি হয়। যেমন নিম্নের উদাহরণটি লক্ষ করা যেতে পারে।
তিন কন্যা + স্ত্রী।
= ২/৩ + ১/৮
= ১৬/২৪ + ৩/২৪
= ১৯/২৪ ।
আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে বণ্টন না করলে এ অবস্থায় অবণ্টিত থাকার মতো অংশ হলো ৫/২৪ ।
উত্তরাধিকারীদের জন্য উল্লেখিত ভগ্নাংশগুলোকে তাদের শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ সাব্যস্ত করার বিষয়ে ৪:১১ আয়াতের বর্ণনারীতিতে তুলনামূলক অবস্থা বা প্রাপ্য অংশ লক্ষণীয়। ৪:১১ আয়াতের শুরুতে পুত্র-কন্যার মধ্যে উত্তরাধিকার বণ্টন বিষয়ে ‘এক পুরুষের অংশ দুই নারীর অংশের সমান’ বলার মাধ্যমে পুত্র-কন্যার মধ্যে পারস্পরিক অনুপাত দেয়া হয়েছে (পুত্র:কন্যা = ২:১)। আবার ৪:১১ আয়াতের শেষাংশে মৃতের পিতা ও পুত্রের মধ্যকার প্রাপ্য নির্ধারণে তুলনামূলক অবস্থান সম্পর্কিত একটি প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। এ থেকেও বুঝা যায় যে, পুত্র কন্যা, পিতা মাতা, স্বামী বা স্ত্রী এবং ভাই, বোনের জন্য উল্লেখিত অংশগুলো হচ্ছে তাদের শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ।
উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আয়াতসমূহে উল্লেখিত ভগ্নাংশসমূহের তুলনামূলক পার্থক্য থেকেও আনুপাতিক বন্টন পদ্ধতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন সন্তান না থাকলে স্বামী পাবে ১/২ , স্ত্রী পাবে ১/৪ এবং সন্তান থাকলে স্বামী ও স্ত্রীর অংশ অর্ধেক হ্রাস পেয়ে স্বামী পাবে ১/৪ , স্ত্রী পাবে ১/৮ । উভয় অবস্থায় স্বামীর অংশ স্ত্রীর অংশের দ্বিগুণ। একটিমাত্র কন্যা সন্তান থাকলে সে পাবে ১/২ , পিতা-মাতা পাবে ১/৩ , স্ত্রী পাবে ১/৮ । অর্থাৎ স্ত্রীর তুলনায় কন্যা ৪ গুণ বেশি পাবে। অন্যদিকে তিনটি কন্যা সন্তান হলে তারা পাবে ২/৩ , পিতা-মাতা পাবে ১/৩ , স্ত্রী পাবে ১/৮ । অর্থাৎ কন্যা শ্রেণি পিতা-মাতা শ্রেণির দ্বিগুণ পাবে কিন্তু কন্যা শ্রেণির প্রাপ্য ২/৩ হওয়া সত্ত্বেও তৃতীয় শ্রেণিতে থাকা স্ত্রী তখনো ১/৮ পাবে তথা পিতা-মাতার অংশ এবং স্ত্রীর অংশের পারস্পরিক তুলনামূলক অবস্থান পূর্বের মতো একই থাকে। যারা এ উচ্চতর গাণিতিক হিসাব বুঝতে সক্ষম নয় বা ইচ্ছুক নয় বা বুঝলেও তা প্রকাশে অনিচ্ছুক, তারাই কুরআনের উত্তরাধিকার বিধানে গাণিতিক ভুল রয়েছে বলে মনে করে বা দাবি করে।
এ প্রসঙ্গে পরিশেষে বলা যায় যে, কুরআনে বর্ণিত উত্তরাধিকারের অংশগুলো হলো শ্রেণিগত আনুপাতিক ভগ্নাংশ এবং তা আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতিতে বণ্টন করতে হবে। এ বিষয়টি বণ্টন পদ্ধতির শর্তসমূহ এবং আনুপাতিক বণ্টনের হিসাব সম্পর্কে গাণিতিক ধারণা থাকলে সহজেই অনুধাবন করা যেতে পারে।
এ গ্রন্থের সংকলক ছাড়াও অন্য যারা উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি অবলম্বনের নীতিগত অবস্থানে পৌঁছেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন QURAN A Reformist Translation গ্রন্থের প্রণেতা এদিপ ইউকসেল এবং ‘কুরআনে বর্ণিত ফারায়েজ ব্যবস্থা’ গ্রন্থের প্রণেতা প্রফেসর ডক্টর মো: কামরুল আহসান।
১.
এদিপ ইউকসেল রচিত কুরআনের অনুবাদ গ্রন্থ থেকে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতির আলোচনা সম্বলিত সূরা নিসার ১১ ও ১২ আয়াতের Endnotes থেকে নিম্নে উদ্ধৃতি দেয়া হলো:
Endnotes: Surah An Nisa
[[004:011 In this and following verses and from 2:180 we learn that priority is given to the will in the distribution of inheritance. According to these verses, first the debt is paid and the distribution according to the will is fulfilled. This Quranic rule allows the testator and the testatrix to adjust their will depending on specific conditions and needs of the inheritors or other personal issues. For instance, one may leave more inheritance to a daughter whom might be more in need than the others might. The testator or the testatrix might leave more to someone who is sick or handicapped. The Quran, by giving precedence to the will over the default distribution provides flexibility and thus accommodates special circumstances. Unfortunately, unable to comprehend the wisdom behind this divine arrangement, the followers of hadith and sunna have abrogated these verses via hadith fabrications and sectarian rules and thereby have deprived the so-called Muslims from God's mercy.
004:012. After paying the debt and distributing the shares according to the will, the inheritance will be distributed if the diseased had a mother, father, or wife, and the rest will be distributed to men and women according to the instructed ratio. It is important to remember that the ratio of shares instructed by the Quran to each other is as important as their ratio to the whole. In brief, the fractions are compared both to the whole and to each other. A deceased person might leave behind hundreds of combinations of relatives, father or no father, mother or no mother, son or no son, one son or more sons, daughter or no daughter, one daughter or more daughters, brother or no brother, one brother or more brothers, sister or no sister, one sister or more sisters, and numerous combinations among them. If the Quran suggested the fractions as merely their ratio compared to the whole inheritance, since for each combination of inheritors the ratios too would need to be changed, we would need hundreds of verses detailing the ratio for each combination. However, when we comprehend that the ratio in suggested distributions also reflect the amount of inheritance in proportion to each other, the verses about inheritance can easily be understood and implemented.
For instance, let us assume that after deducting the debt and other shares, a man left a 50 thousand dollar inheritance to his wife and father without specially allocating the shares. Their shares should be 1/4th and 1/6th, respectively. Thus, the formula would be (1/4)+(1/6)=50,000.
If we find the common denominator, then we see the ratio of inheritance as much clearer. When we take the common denominator, the numerator start to make sense in comparison to the share of each inheritor and to the inheritance: (3/12)+(2/12)=50,000. That means, the wife receives $30,000 and the father receives $20,000 of the inheritance.
In sum, to learn the default shares of inheritors the fractions indicating the shares are added up and equated to the inheritance. Let's assume that we are asked to distribute 19 gold pieces among two people; one will receive 1/5th and the other 1/3rd
(k1 + k2 + ... + kn) * x = t
pn = kn * x
k1 = 1/5
k2 = 1/3
(1/3 + 1/5) * x = 19 x = 19 * 15/ 8
p1 = (1/5) * 19 * 15/ 8 p1= 7 + 1/8
p2 = (1/3) * 19 * 15/ 8 p2= 11 + 7/8
The Old Testament does deprive daughters of inheritance from their parents and favors the first born against other children. Under the patriarchs, the property of a diseased father was divided among the sons of his legal wives and their concubines would not get a share (Genesis 21:10; 24:36; 25:5). The Mosaic law made specific regulations regarding the distribution of real property, giving the eldest son a larger portion than the rest. Deuteronomy 21:17; Numbers 27:8; 36:6; 27:9-11.]]
Reference: Edip Yuksel, Layth Saleh al-Shaiban & Martha Schulte-Nafeh. QURAN A Reformist Translation, US: brainbowpress, 2010, Page No. 102-103
২.
প্রফেসর ডক্টর মো: কামরুল আহসান (সাবেক ডীন, বুয়েট) রচিত ‘কুরআনে বর্ণিত ফারায়েজ ব্যবস্থা’ বই থেকে আনুপাতিক বণ্টন পদ্ধতি সম্পর্কে উপস্থাপনার বিশেষ কিছু অংশ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওয়ারিশদের অংশের যোগফল ১ (এক) এর কম অথবা বেশি। তাই উপরিউক্ত আলোচনা ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে অনুপাতভিত্তিক বণ্টনের হিসাব পদ্ধতি হবে ফারায়েজের জন্য যথাযথ। (পৃষ্ঠা:৮৩)
কোন একজন অংশীদারের সম্পূর্ণ ত্যাজ্য সম্পত্তিতে অথবা কোন একটা বিশেষ সম্পত্তিতে অংশ বের করার জন্য প্রথমে সব ওয়ারিশদের অনুপাতের যোগফল বের করতে হবে। অতঃপর যোগফল দিয়ে যে সম্পত্তির অংশের পরিমাণ বের করা দরকার তাকে ভাগ করতে হবে। ভাগফলকে যে ওয়ারিশের জন্য সম্পত্তির অংশের পরিমাণ বের করতে হবে তার অনুপাত দিয়ে গুণ করতে হবে। তবেই সেই ওয়ারিশের অংশের পরিমাণ জানা যাবে। (পৃষ্ঠা:৮৫)
বণ্টনযোগ্য সম্পত্তিকে অনুপাতসমূহের যোগফল দিয়ে সরাসরি ভাগ করে অংশীদারের অনুপাত দ্বারা গুণ করলেই অংশীদারের পাওনা বের হবে। অনুপাতের যোগফল ১ (এক) এর কম বা বেশি দেখার প্রয়োজন নেই। (পৃষ্ঠা:৮২)
কুরআনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ওয়ারিশদের যে অংশ দেয়া আছে তা একজনের সাথে অন্যান্য ওয়ারিশদের তুলনার জন্য বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। তবে কেবলমাত্র একজন ওয়ারিশ হলে বণ্টনের জন্য তার তুলনামূলক অংশের প্রয়োজন নেই। কেননা, কেবলমাত্র একজন ওয়ারিশ হলে সে ১০০% বণ্টনযোগ্য ত্যাজ্য সম্পত্তির মালিক। তবে উদাহরণগুলোতে বর্ণিত অংশ উল্লেখ করার পর Normalize করে একমাত্র ওয়ারিশের অংশ দেখানো হয়েছে Confusion এড়ানোর জন্য। তবে ফলাফল একই। (পৃষ্ঠা:১১০)
অর্থাৎ কুরআনে উল্লেখিত যে আট জন ওয়ারিশ হিসেবে তালিকাভুক্ত (মাতা, পিতা, ছেলে, মেয়ে, স্বামী, স্ত্রী, ভাই ও বোন) তাদের মধ্যে যদি শুধুমাত্র একজন জীবিত থাকে তাহলে সে বণ্টনযোগ্য সমস্ত সম্পদের মালিক হবে। (পৃষ্ঠা:১১৪)
উদ্ধৃতি: মো: কামরুল আহসান, কুরআনে বর্ণিত ফারায়েজ ব্যবস্থা, প্রকাশনা: মাসুদা আহসান, জানুয়ারি ২০২০