হজ্জের মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্ছিন্ন ও বিস্মৃত মুসলিম জাতির জন্য কুরআন থেকে আমরা যে হজ্জের শিক্ষা, উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থার রূপরেখা পাই তার ভিত্তিতে হজ্জ কি রকম হওয়ার কথা ছিলো বা হতে পারতো - এই প্রশ্নের উত্তর আমরা এই অধ্যায়ে খোঁজার চেষ্টা করবো।
প্রথমত হারাম মাসের নীতি অনুসারে সারা পৃথিবীতে, আর পুরো পৃথিবী যদি না মানে, তাহলে কেবলমাত্র মুসলিম দেশগুলোতে সকলে স্রষ্টার এই বিধানকে সন্মান করে একটি বছরের এক তৃতীয়াংশ বা টানা চার মাস সর্বদেশীয় যুদ্ধবিরতি (universal cease-fire) ও প্রকৃতির বিশ্রাম সময় পালন করবে।
এর তাৎপর্য হলো কোনো মুসলিম দেশ এই হারাম মাসগুলোতে পরস্পরের সাথে কোনো ধরনের যুদ্ধ করতে পারবে না। প্রত্যেককে যুদ্ধ বিরতি পালন করতেই হবে। এটিই হারাম মাসের উদ্দেশ্য। এখন যেটা হয় যে যুদ্ধবাজ ও দাঙ্গাবাজদের ক্রমাগত যুদ্ধের কারণে সাধারণ নাগরিকরা বাস্তুচ্যুত হয়, নিজ দেশে রিফুজি হয়, মারা যায়, যুদ্ধের মধ্যে তারাই বলির পাঠা হয়। এরকম সাম্প্রতিক উদাহরণ আমরা দেখতে পাই: সিরিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান ও ইথিওপিয়া সহ পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশেই। অথচ আল্লাহর নির্দেশনা হলো হজ্জের অধিবেশন হবে সবার জানা এই যুদ্ধ বিররিত ও বিশ্বশান্তির মাসসমূহে।
নিরাপত্তা কেবলমাত্র মানুষের জন্য তাই নয়, পশুপাখিরাও মানুষের মতো কমিউনিটি এবং তাদেরও জীবনের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রয়েছে (প্রাসঙ্গিক আয়াত, সূরা আনআম ৬:৩৮)। টানা চারমাস সেই মাসগুলো যেগুলো পশু পাখি ও সকল প্রাণীদের প্রজনন ও নতুন প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সময়। কুরআনের হুরুমুন এর শিক্ষা হলো এই টানা চারমাসে প্রকৃতিকে বিশ্রাম দিতে হবে, কোনো ধরনের স্থলজ শিকার সর্বত্র নিষিদ্ধ থাকবে। এর ফলে বসন্তের এই সময়ে প্রকৃতি তার প্রাণপ্রাচুর্য আবার ফিরে পাওয়ার সুযোগ পাবে, জীববৈচিত্র্য রক্ষা হবে। এটাই কুরআনের শিক্ষা, কিন্তু কুরআন পরিত্যাগকারীদের কাছে এগুলো এতটাই অপরিচিত মনে হবে যেন এগুলো কোনো এনভারোনমেন্টালিস্টদের কনসপিরেসি থিওরী। যেকেউ ইন্টেলেকচুয়ালী অনেস্ট থেকে কুরআনের আয়াতগুলো আরবী অথবা সঠিক অনুবাদে পড়লে এই একই উপসংহারেই উপস্থিত হতে বাধ্য।
কুরআনের নির্দেশনামতে হজ্জ হলে সেখানে মৌলিক কি কি পার্থক্য হতে পারে, আসুন আমরা সে বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করি।
প্রথমত হজ্জ ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে যারা দেশ ও জাতি নিরপেক্ষ হবে। তারা স্রষ্টায় বিশ্বাসী, স্রষ্টা সচেতন ব্যক্তিদের থেকে নির্বাচিত ব্যক্তির সমন্বয়ে হবে। এখানে কোনো জাতির উপরে অন্য জাতির প্রাধান্য দেওয়া যাবে না, বরং এটি আর্ন্তজাতিক একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি হবে। এদের কুরআনে হজ্জের শিক্ষার বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান ও হজ্জ ব্যবস্থাপনার বাস্তব প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। হজ্জ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণ বৈষম্য থাকতে পারবে না।
ভূ-রাজিনৈতিক বাস্তবতায় মক্কা সৌদিআরবে অবস্থিত হলেও হজ্জ ব্যবস্থাপনা কেবলমাত্র সৌদিরা করবে এটি কুরআনের শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। বরং এই ব্যবস্থাপনা কমিটি সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিযুক্ত হবে এবং এর সদস্যরা আর্ন্তজাতিক সকল দেশ ও সংস্খা থেকে আসবে এবং নির্বাহী সিদ্ধান্তে, পরামর্শ অনুসারে এই ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা পরিবর্তিত হবে। ব্যবস্থাপনা কমিটিতে কোনো দেশ বা জাতির কোনো প্রাধান্য থাকবে না। আল মাসজিদুল হারামের অন্যতম নাম, বায়তুল আত্বীক যার প্রধানত অর্থের মধ্যে আছে যে গৃহ বা প্রতিষ্ঠান স্বাধীন। যখন কোন নির্দিষ্ট দেশ, জাতি, বর্ণ, সম্প্রদায় একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করে তখন সেটি তার স্বাধীন চরিত্রকে হারিয়ে ফেলে। সুতরাং কুরআনে মানবজাতির পবিত্র প্রতিষ্ঠান তথা কা’বাকে যে বায়তুল আত্বীক নামে অভিহিত করা হয়েছে তার সম্মান তখনই রক্ষা হবে যখন এটিকে দেশ, জাতি, বর্ণ ও সাম্প্রদায়িক পক্ষপাত থেকে মুক্ত করে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন করা যাবে।
হজ্জের ইনভাইটেশন কার্ড বা নিমন্ত্রণ পত্র আল্লাহর দেওয়া। মানবজাতির (একত্ববাদী আদর্শের) ইমাম ইব্রাহিমের আ. এর মাধ্যমে এই নিমন্ত্রণ পুরো মানবজাতির জন্য। স্রষ্টায় বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সকলের জন্য।
প্রশ্ন জাগতে পারে, বিশ্বাসী বোঝা গেল, কিন্তু স্রষ্টায় অবিশ্বাসীরা হজ্জে বা কা’বায় এসে কি করবে? কুরআনের পাঠক হিসেবে আমরা জানি যে, মানুষের কল্যাণ প্রত্যক্ষ করার জন্য হজ্জের আয়োজন। তাই এমন সবাইকে হজ্জে নিমন্ত্রণ করা সম্ভব যে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলে তার ও তার জাতির কল্যাণ হবে। অর্থাৎ সাধারণভাবে স্রষ্টায় বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়কে হজ্জের নিমন্ত্রণ জানানোর অবকাশ রয়েছে। আর এভাবে হজ্জ একত্ববাদের দাওয়াতের সবেচেয়ে বড় ক্ষেত্র। যারা স্রষ্টায় বিশ্বাসী নয়, তারাও এতে অংশগ্রহণ করলে একত্ববাদের যৌক্তিক আহবান জানার ও তাতে সাড়া দেয়ার সুযোগ পেতে পারে।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরে নেওয়া যাক যে মুসলিম জাতির ঘুম ভাঙ্গলো। অত:পর পৃথিবীতে এমন একদিন আসলো যখন বায়তিল আত্বীক আর কোনো বিশেষ জাতি সম্প্রদায় ও মতাদর্শের হাতে বন্দী নয়। বরং এটি সবার জন্য মুক্ত ও অবারিত গৃহ (Open House) বা প্রতিষ্ঠান।
হজ্জ ব্যবস্থাপনা কমিটি থেকে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে, আগামী বছর হজ্জে যাদের নিমন্ত্রণ দেওয়া হবে তাদের মধ্যে বিশেষ দুটো পিছিয়ে পড়া কমিউনিটি সদস্যদের নিমন্ত্রণ জানানো হবে। এদের মধ্যে একটি কমিউনিটি হলো: ভারতের দলিতদের কমিউনিটি প্রতিনিধিদের মধ্যে ৫০ জনের একটি দলকে, যাদের সদস্য হতে হবে সেই কমিউনিটির যারা নেতৃস্থানীয় নারী-পুরুষ তারা। আর অন্য কমিউনিটিটি হলো মধ্য আমেরিকার নিকারাগুয়া নামের দেশ থেকে একটি ক্ষুদ্র পাহাড়ী জনগোষ্ঠি, তাদের ২৫ জনের একটি প্রতিনিধি দল।
দলিতরা ভারতের অন্যতম নিগৃহীত, গরীব এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে চরম বৈষম্যের শিকার একটি জনগোষ্ঠি। ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭% হলো দলিত যাদেরক শিডিউল কাস্ট, নিম্নবর্ণ ও কোথাও অচ্ছুতও ধরা হয়। এক পরিসংখ্যান মতে দলিতদের সংখ্যা ভারতে প্রায় ২০ কোটি। সময় সময় এই দলিতদের কেউ কেউ হিন্দু ধর্মের বৈষম্য দেখে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। কেউ বৌদ্ধ ধর্ম, কেউ ইসলাম, কেউ খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে।
হজ্জের কল্যাণ বলতে মানবজাতির জন্য কি কল্যাণ হতে পারে সেটা বোঝার সুবিধার জন্য আসুন আমরা একটা হজ্জের কল্পনা করি যেখানে ভারতের দলিতদের নেতৃবৃন্দদের মধ্যে ৫০জনের একটি দল হজ্জে এসেছে। তারা হজ্জের বিভিন্ন অধিবেশন অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করছেন। তাদের সাথে বিশেষ গাইড রয়েছে যারা তাদের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। একটি অধিবেশনে মানুষের মধ্যে সাম্য, এক স্রষ্টার সৃষ্টিতে মানুষে যে কোনো বর্ণ, গো্ত্র, সম্প্রদায়, ভাষা, চামড়ার রঙ এর ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য হতে পারে না তার শিক্ষা তুলে ধরা হচ্ছিলো। একটি অধিবেশনে ইসলামের শিক্ষা, সকল মানবজাতি যে এক পরিবারভুক্ত, সকলেই আদমের সন্তান এবং সবাইকে তার কর্ম অনুসারে স্রষ্টার সামনে জবাবদিহি করতে হবে যেখানে কোনো জাত অভিমান বা বিশেষ প্রিভিলেজ থাকবে না, সবাইকে এমন এক দিনে স্রষ্টার সামনে জবাবদিহির জন্য আসতে হবে, যেদিন কারো প্রতি অণু পরিমান অন্যায় করা হবে না। এই শিক্ষার পাশাপাশি হজ্জে আসা সাদা চামড়া, কালো চামড়া, গরীব, ধনী, ভারতীয়, চীনা, ইউরোপিয় সব মানুষকে একসাথে সব কিছু করতে দেখে, একই সাথে খাওয়া দাওয়া করতে দেখে এই দলিত গ্রুপটি অভিভূত। বিশেষ করে ইসলামের সাম্যের বাণী শুনে তারা অশ্রুবিগলিত হয়ে পড়ে।
হজ্জের আরাফাতের দিনে একটি অধিবেশনে তাদের অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। আরাফাতের পরের দিন তাদের কথা শোনার জন্য বিশেষ অধিবেশন ডাকা হলো। সেই অধিবেশনে জর্ডানের প্রতিনিধি এবং রাশিয়ার মুসলিম ফেডারেশনের প্রতিনিধিরা দলিতদের ভারতীয় কমিউনিটির জন্য ৪০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা ঘোষণা করলো যার মাধ্যমে তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হবে। হজ্জ ব্যবস্থাপনা কমিটির তরফ থেকে প্র্রত্যেক নেতৃত্বস্থানীয় দলিত নেতাদের আর্থিক সহায়তাসহ তাদের পরিবারের শিক্ষার্থী সদস্যদের জন্য বিশেষ স্কলারশিপের ঘোষণা দেওয়া হলো।
হজ্জের অধিবেশন শেষে এই দলিত প্রতিনিধিদল তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ভারতে যখন ফিরে গেল তখন তারা হজ্জের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিন মাসের মাথায় প্রায় ৩০০০ গ্রামের প্রত্যেক দলিত নিজেদের মুসলিম ঘোষণা করলো এবং ইসলামের আদর্শকে আলিঙ্গন করলো। হজ্জ কমিটি থেকে এই ঘোষণা শোনার পর বিশেষ আর্ন্তাজাতিক প্রতিনিধি দলিতদের এলাকায় পাঠানো হলো যারা ইসলামের শিক্ষা দেওয়ার জন্য দলিতদের মধ্যে কাজ করতে শুরু করলো। এই প্রতিনিধি দলের আরেকটি কাজ ছিলো কিভাবে দলিতদের অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত করা যায় তার সুপারিশমালা তৈরী করা।
অন্যদিকে নিকারাগুয়ার প্রতিনিধি দলও প্রচুর ইতিবাচক শিক্ষা, স্রষ্টার একত্ববাদ ও এক আদম পরিবারের শিক্ষার কথা শুনে ও তার প্রয়োগ দেখে অভিভূত। তারাও তাদের দেশে গিয়ে কুরআনের শিক্ষাকে নিজেদের দেশের মানুষদের সাথে শেয়ার করতে লাগলো। এভাবে হজ্জের যে উদ্দেশ্য ছিলো ‘মানবজাতির জন্য কল্যাণ’, তার প্রতিফলন জাতিতে জাতিতে, পৃথিবীর সব কোনায় ছড়িয়ে পড়া মাত্র কয়েক হজ্জের মৌসুমের মধ্যেই সম্ভব। আর এই সম্ভাবনা তখনই ঘটতে পারে যখন আমরা স্রষ্টার নির্দেশনা অনুসারে হজ্জে মানব জাতিকে নিমন্ত্রণ জানাতে শুরু করবো।
বর্তমানে হজ্জের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে একত্ববাদের ও মানব পরিবারের অবিভাজ্যতার শিক্ষা প্রদানের কোনো প্রক্রিয়াই আর উপস্থিত নেই। এই হজ্জের মিলনমেলাই হতে পারে মানব সমাজে স্রষ্টার বাণী পৌছানোর সবচেয়ে বড় আয়োজন। এই হজ্জেরই হওয়ার কথা ছিলো ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্বার সঙ্ঘবদ্ধ সমাবেশের উপলক্ষ্য। আমরা ইউনাইটেড নেশনস এর নাম শুনেছি, তার কাজের সাথেও পরিচিত। কিন্তু আমরা কি একবারও অনুধাবন করতে পেরেছি যে হজ্জের প্রকৃত স্বরূপ যখন বাস্তবায়ন হবে সেটি আসলে মানুষের সকল জাতিসত্ত্বার ইউনিটিরই প্রতীক হওয়ার কথা ছিলো! বিভিন্ন জাতি বা Nations যখন এক কেন্দ্রে মিলিত হয়, একত্রিত হয়, সঙ্ঘবদ্ধ সমাবেশ করে, সেই অবস্থার নামই হলো United অবস্থা। বস্তুত হজ্জ প্রতিষ্ঠানকে ‘মাসাবাতাল লিন নাস’ (মানবজাতির সমাবর্তনস্থল) ঘোষণা করার মাধ্যমেই ‘ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তা’র দীক্ষা দেয়া হয়েছে।
দ্বীন ইসলামে কোনো সংকীর্ণতা নেই এবং যা কিছু কল্যাণকর ও প্রাকৃতিকভাবে স্বাভাবিক স্রষ্টার সুন্নাহ ও বিধান সেই দিকেই নিদের্শক। মানুষ সমাজের দিকে তাকালে আমরা দেখি মানুষ তার নিজস্ব প্রয়োজনে যা যা করে থাকে তা পরিশেষে স্রষ্টার বিধানেরই দিকনিদের্শনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর কারণ হলো মানুষের বিবেক এবং সর্বোচ্চ কল্যাণের লক্ষ্যে ধাবিত হলে, জানুক আর না জানুক মানুষ আসলে কুরআনের নীতিমালায় এসেই উপস্থিত হবে। হজ্জে বিশ্ববাসীর অংশগ্রহণ, কল্যাণ প্রত্যক্ষ করার উদ্দেশ্যে সমাবর্তন, পরস্পরের সাথে তর্ক বিতর্ক, জাতিসমূহের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি, পরস্পরের বিভিন্ন বিষয়ে পরিচিতমূলক আলাপ আলোচনা, চুক্তি এবং চুক্তির ঘোষণা, শান্তি ও নিরাপত্তা ইত্যাদি যাবতীয় কার্যক্রম, যা হজ্জের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে কুরআনে এসেছে তার সামগ্রিকতার সাথে তুলনা করলে আধুনিক বিশ্বে কাছাকাছি অন্য যে প্রতিষ্ঠান ও সেটির কাযর্ক্রম আমাদের সামনে প্রতীয়মান হয় সেটি হলো জাতিসংঘ।
আসুন দেখা যাক, হজ্জে আল্লাহ যেসব বিষয়কে তুলে ধরেছেন সেগুলো আরেকবার আমরা সারসংক্ষেপ করি এবং একই সাথে খেয়াল করি জাতিসংঘের সাথে হজ্জের কতটা সমান্তরাল মিল রয়েছে। এই তুলনার উদ্দেশ্য এই যে মানবজাতির বৃহৎ কল্যাণেরর জন্য যে হজ্জের আহ্বান - ঠিক হুবুহু না হলেও অনুরূপ কল্যাণ, শান্তি ও নিরাপত্তার কাজটি যে প্রতিষ্ঠান বাস্তবেই করছে (জাতিসংঘের বিভিন্ন সমালোচনা, এর অকার্যকরতা সম্পর্কে সচেতেন থাকার পরেও) তার মাধ্যমে এটিই প্রতিভাত করার চেষ্টা যে প্রকৃত হজ্জ সঠিকভাবে ও কুরআনিক নির্দেশনায় করতে পারলে বৈশ্বিকি কতখানি কল্যাণ আনয়ন সম্ভব ছিলো এবং এখনো রয়েছে।
হজ্জ অর্থ সমাবেশ, সম্মেলন, বিতর্কসভা, এ্যাসেম্বলী, কোন উদ্দেশ্যে এক স্থানে মিলিত হওয়া। হজ্জ মানবজাতির জন্য, কোন বিশেষ গোষ্ঠি, বিশ্বাসী, সম্প্রদায়ের জন্য কখনোই নয়। কিছু আয়াতের ভুল ব্যাখ্যার ফলে হজ্জকে এখন সীমিত করে ফেলা হয়েছে।
ইউনাইটেড নেশনসের বা জাতিসংঘের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর যার মূল লক্ষ্য ছিলো বিশ্বের নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য কাজ করা। ইউনাইটেড নেশনস নামটির মধ্যেই নিহিত যে এই প্রতিষ্ঠান সকল জাতির জন্য।
হজ্জে সকল মানব জাতিকে ডাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ইব্রাহিম আ. কে। আর মানবজাতির মধ্যে হজ্জের ঘোষণা দাও। ২২:২৭
মুসলিমরা উম্মাহ বলতে যা বুঝায়, ইউনাইটেড নেশনস শব্দ দুটির মধ্যে একই ধরনের বোধ ধারণ করে। বিভিন্ন জাতিসত্ত্বা, ভূরাজনৈতিক পরিচয়ের ভিন্নতা থাকার পরেও সকল মুসলিম যেমন এক উম্মাহ, আদর্শে সঙ্ঘবদ্ধ বা ইউনাইটেড - ঠিক তেমনি বিশ্বের সব জাতির সঙ্ঘবদ্ধ পরিচয়ের যে প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন, তার নাম ইউনাউটেড নেশনস বা জাতিসংঘ।
ইউনাইটেড নেশনসের হেডকোয়ার্টারে কোন দেশের সাথে অন্য দেশের প্রতিনিধিদের বৈষম্য করা যায় না। এখানে একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র ফিজির রাষ্ট্রদূত আর বিশাল পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের মধ্যে কোন আলাদা বৈষম্য নেই।
হজ্জের প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন আল মাসজিদুল হারামকে আমি আত্মনিয়োজিত স্থানীয় ও সেটিতে গমনাগমনকারী অস্থানীয়দের জন্য সমান করেছি। ২২:২৫
ইউনাইটেড নেশনস একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চায়তা আছে। এখানে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের ডিপ্লোম্যাটিক ইমিউনিটি দেওয়া হয়। যেমন ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যতই শত্রুতা থাকুক না কেন বা একটি দেশের সাথে আরেক দেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি থাকলেও ইউনাইটেড নেশনসের ভিতরে প্রত্যেককে প্রত্যেকের নিরাপত্তা দিতে হবে।
আর যে তাতে (অর্থাৎ ঐ প্রতিষ্ঠানে) প্রবেশ করবে (সদস্য, সভ্য বা member হবে) সে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত হবে। ৩:৯৭
হে মু’মিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নির্ধারিত নিদর্শনসমূহকে এবং কোনো হারাম মাসকে (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাসকে) এবং হাদিয়াকে (উপহারকে) এবং প্রতিনিধিদের অবমাননা করো না। আর আল বাইতুল হারামের (সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানের) অভিযাত্রীদেরকেও অবমাননা করো না… ৫:২
ইউনাইটেড নেশনসের যে হেডকোয়ার্টার তার স্থাপনের কারণ বিশ্ববাসী শান্তি ও নিরাপত্তা, যেমন এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাউন্সিলের নাম হলো সিকিউরিটি কাউন্সিল বা নিরপত্তা পরিষদ। জাতিসংঘে যা হয় তা হলো এ্যাসেম্বলী বা সমাবর্তন।
নিশ্চয় বাক্কাতে মানবজাতির জন্য আদি প্রতিষ্ঠান (আওয়ালা বাইত) স্থাপন করা হয়েছে যা বিশ্ববাসীর জন্য সমৃদ্ধিময় এবং দিকনির্দেশক। তার ক্ষেত্রে (অর্থাৎ আদিগৃহের ক্ষেত্রে) স্পষ্ট প্রমাণবহ নিদর্শনসমূহ রয়েছে। (যেমন তার সাথে সম্পর্কিত) মাকামে ইবরাহীম (ইবরাহীমের আদর্শগত অবস্থান)। আর যে তাতে (অর্থাৎ ঐ প্রতিষ্ঠানে) প্রবেশ করবে (সদস্য, সভ্য বা member হবে) সে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত হবে। আর আল্লাহর (সন্তুষ্টি অর্জনের) উদ্দেশ্যে মানুষের উপর দায়িত্ব হচ্ছে, এ গৃহের (প্রতিষ্ঠানের) হজ্জ করা (অর্থাৎ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা), যে তাতে পৌঁছার উপায়-উপকরণের সামর্থ্য রাখে। আর যে কুফর করে (সত্যকে অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান করে) তবে নিশ্চয় আল্লাহ বিশ্ববাসীর থেকে অমুখাপেক্ষী। ৩:৯৬-৯৭
আর (উল্লেখ্য) যখন আমি ‘আল বাইত’কে (অনন্য প্রতিষ্ঠানকে) স্থাপন করেছি মানবজাতির জন্য সমাবর্তনস্থলরূপে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থারূপে। ২:১২৫
অর্থাৎ জাতিসংঘের কার্যক্রমের অন্যতম হলো বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা, হজ্জের জন্য নির্ধারতি প্রতিষ্ঠান তথা আল-বাইতের উদ্দেশ্যও একইরূপে সমাবর্তনস্থল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
জাতিসংঘের হেডকোয়ার্টার একটি নিরপেক্ষ ও মুক্ত প্রতিষ্ঠান। এটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে হওয়া সত্ত্বেও, এটি আমেরিকার দখলে নয়, বরং সকলের জন্য মুক্ত বা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ।
আসুন দেখা যাক হজ্জের যে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান তাকে আল্লাহ কি নামে অভিহিত করেছেন? একে বলা হয়েছে বায়তুল আত্বীক যার অর্থ কেবল আদি প্রতিষ্ঠান বা প্রাচীন গৃহ নয় - আত্বীক শব্দের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ হলো মুক্ত স্বাধীন। অর্থাৎ এই গৃহকে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন (কোনো গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়ের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ থেকে) মুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে।
জাতিসংঘের অধিবেশনগুলোতে বিভিন্ন জাতির প্রতিনিধিরা (কুরাআনের পরিভাষায় ক্বালাইদরা) বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করে থাকে, চুক্তির বিষয় নিয়ে বক্তব্য - পাল্টা বক্তব্য তুলে ধরে, তর্ক-বিতর্ক হয়। পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বক্তব্য প্রদান করা হয়।
হজ্জেও কি তা হওয়ার কথা ছিলো? হজ্জ সংক্রান্ত আয়াত সমূহে, সুরা বাকারার ২০৩ থেকে ২০৭ এ কিন্তু আমরা এরকম বক্তব্য প্রদানকারীদের কথা পাই।
২:২০৩ :: আর (হজ্জের শেষ কর্মসূচী হিসেবে আল মাসজিুল হারামের কাছে) তোমরা গণনাযোগ্য দিনসমূহে আল্লাহর যিকির (স্মরণ) করো। তবে যে তাড়াতাড়ি করে (নিজ দেশে ফিরে যায়) দুই দিনে, তার উপর কোনো পাপ বর্তাবে না, আর যে বিলম্ব করে তার উপরও কোনো পাপ বর্তাবে না। এটা তার জন্য যে আল্লাহ সচেতন থাকো। আর তোমরা আল্লাহ সচেতন থাকো। আর জেনে রাখো যে, নিশ্চয় তোমাদেরকে তাঁর দিকেই হাশর / সমবেত করা হবে।
২:২০৪ :: আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে যে পার্থিব জীবন সম্বন্ধে তার বক্তব্যে তোমাকে চমৎকৃত করে আর তার মনে যা আছে তার (নিষ্কলুষতা ও নিষ্ঠার) উপর আল্লাহকে স্বাক্ষী রাখে। অথচ সে (সত্য, ন্যায় ও মানবতার প্রতি) সবচেয়ে ভীষণ বিরুদ্ধবাদী।
২:২০৫ :: আর যখন সে (তার জন্য সুবিধাজনক অবস্থানে) ফিরে যায় তখন সে প্রচেষ্টা চালায় (দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লুটপাট ও বিভিন্ন বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে) পৃথিবীতে নৈরাজ্য-বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে এবং ফসলের ক্ষেত এবং (মানুষের ও জীবজন্তুর) বংশ ধ্বংস করতে। আর আল্লাহ নৈরাজ্য-বিশৃংখলা পছন্দ করেন না।
২:২০৬ :: আর যখন তাকে বলা হয়, “আল্লাহ সচেতন হও”, তখন তার আত্মাভিমান তাকে (আরও) অনাচারে লিপ্ত করে। সুতরাং তার জন্য জাহান্নাম যথেষ্ট। আর তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট অবস্থিতি।
২:২০৭ :: আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণে নিজেকে বিক্রয় (নিবেদিত) করে দেয়। আর আল্লাহ (তাঁর) বান্দাদের প্রতি স্নেহশীল।
আমরা জাতিসংঘে যারা বক্তব্য দেয় তাদের মধ্যে এরকম অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পারবো যারা চমৎকার বক্তব্য হয়তো প্রদান করে কিন্তু আদতে তারা যুদ্ধবাজ, দাঙ্গাবাজ ও পৃথিবীতে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী। এরা নিজেদের পিস মেকার দাবী করলেও আদতে তারাই যুদ্ধের মদদদাতা, সন্ত্রাসবাদ ও ধ্বংসাত্বক অস্ত্রের কারবারী। এদের স্বভাব চরিত্রের কথাই কী সুরা বাকারা ২০৪-২০৫ এ তুলে ধরা হয় নি? ২০৩ থেকে স্পষ্ট এখানে হজ্জের কথাই বলা হচ্ছে।
এটা সহজেই লক্ষ্যনীয় যে ইদানীং সারা বিশ্বজুড়েই গ্লোবাল ওয়ার্মিং, এনডেনজারড স্পিশিজি, এনভারোনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটি নিয়ে প্রচুর সভা সমাবেশ সচেনতা লক্ষ্য করা যায়। এর মূল কারণ হলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলুশনের পর থেকে ব্যপক দূষণ এবং নির্বিচারে প্রকৃতির ধ্বংস করার মাধ্যমে মানুষ পুরো পৃথিবীর অনেক জীব বৈচিত্র্য যেমন ধ্বংস করে ফেলছে তেমনি ডেকে নিয়ে এসেছে চরম ধ্বংস।
জাতিসংঘের দিকে তাকালেও আমরা দেখবো environmental sustainability, ecology, animal rights, endangered species, preserved forest, climate change এই শব্দ ও ধারণাগুলো খুবই গুরুত্ব বহন করে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা, সহযোগিতার উদ্যোগ ইত্যাদি নেওয়া হয়।
হজ্জের সাথে জড়িত যে হারাম মাস তার দুটো দিক কুরআনে আমরা পাই। হারাম মাসের একটি কাজ হলো যুদ্ধ ও দাঙ্গা হাঙ্গামা নিষিদ্ধ থাকবে যে মাসে। অর্থাৎ যুদ্ধ বিরতি। এই টানা চারমাস কোনো যুদ্ধ হবে না। অর্থাৎ সামিগ্রকভাবে বিশ্বশান্তি স্থাপনের জন্য এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি ধারণা বা কনসেপ্ট।
গত ২৩ মার্চ ২০২০ সালে জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেজ একটি গ্লোবাল সিসফায়ার বা বৈশ্বিক যুদ্ধবিরতির ডাক দেন।(১৭) বিশ্বের ১৮০টির বেশি দেশ তার এই আহ্বানে সাড়া দেয়।
(১৭) https://www.un.org/en/globalceasefire
কুরআনের যে হারাম মাসের ধারণা, এটিও কিন্তু একটি বৈশ্বিক যুদ্ধবিরতির জন্য স্রষ্টা নির্দিষ্ট সময়। আফসোস মুসলিমরা কুরআন পরিত্যায্যকারী জাতি হিসেবে হারাম মাসের বিধান কখনোই সেভাবে কায়েম করতে পারেনি। এখনও পারছে না। অথচ হজ্জের বিধানের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত হারাম মাস আর হারাম মাস মানেই বৈশ্বিক যুদ্ধ বিরতির মাস। বৈশ্বিক শান্তির সময়।
নিশ্চয় আল্লাহর কাছে মাসের গণনা (প্রতি গণনাচক্রে / প্রতি বর্ষে) ১২ মাস। আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। সেগুলোর মধ্য থেকে (অর্থাৎ একটি গণনাচক্রের ১২ মাসের মধ্য থেকে) ৪ টি মাস হারাম মাস (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধবিরতির ও সংরক্ষিত মাস)। এটাই সঠিক ব্যবস্থা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। সুতরাং সেগুলোর মধ্যে (যুদ্ধ করে বা সংশ্লিষ্ট নিষিদ্ধতা লংঘন করে) তোমাদের নিজেদের উপর জুলুম করো না। ৯:৩৬
তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে হারাম মাস (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাস) সম্পর্কে, সেটাতে যুদ্ধ করা প্রসঙ্গে। বলো, “সেটাতে (তথা কোনো হারাম মাসে) যুদ্ধ করা অনেক বড় গুনাহ। ২:১১৭
হারাম মাসের দ্বিতীয় যে নির্দেশনা তা হলো এই মাসগুলোতে সকলের জন্য স্থলভাগে শিকার করা অর্থাৎ পশুহত্যা করা নিষিদ্ধ। কেউ যদি ভুল করে করে ফেলে তাহলে তাকে গৃহপালিত পশুর মাধ্যমে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে - এমনটাই কুরআনের বিধান। এই হারাম মাসের সময়টি আসলে বসন্তের শুরু থেকে যেটি প্রাকৃতিকভাবে সেই সময়টি যখন পশুপাশির মিলন, সন্তান উৎপাদন এবং একই সাথে সন্তানের শিশুকালের লালনের সময়। এই তিন চারমাসে পশুপাখি নাযুক অবস্থায় থাকে যার ফলে এ সময়ে স্থলভাবে পশু পাখি নিধন স্রষ্টা নিষিদ্ধ করেছেন।
শুধুমাত্র এই একটি আচরণ সঠিকভাবে পালন করলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পশুপাখির সংখ্যার ভারসাম্য পৃথিবী ব্যাপী ঠিক হয়ে আসতো। হজ্জের শিক্ষার মধ্যেও এটি নিহিত যা আমরা বিস্মরিত হয়েছি।
তবে হারাম মাসসমূহে থাকা অবস্থায় (স্থলভাগের) শিকারকারী হওয়া যাবে না। ৫:১
হে মু’মিনগণ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে (হারাম মাসসমূহে স্থলভাগের) কিছু শিকারের বিষয়ে পরীক্ষা করবেন, তোমাদের হাত ও বর্শা যার নাগাল পায়, যেন আল্লাহ স্পষ্ট করতে পারেন কে তাঁকে অদেখা সত্ত্বেও ভয় করে। সুতরাং এরপরও (অর্থাৎ স্পষ্টভাবে জানানোর পরও) যে সীমালংঘন করবে তার জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। ৫:৯৪
হে মু’মিনগণ, তোমরা হারাম মাসসমূহে থাকা অবস্থায় (স্থলভাগের) শিকারকে হত্যা করো না। তোমাদের মধ্যে যে ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে হত্যা করে তার জরিমানা হচ্ছে যে পশুকে সে হত্যা করেছে গবাদি পশুর মধ্য থেকে তার মতো একটি পশু। সেটা (অর্থাৎ ঐ ধরনের গবাদি পশু) নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দিবে তোমাদের মধ্যকার দুজন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি। সেটাকে হাদিয়া (উপহার) হিসেবে কা’বায় পৌছাতে হবে। অথবা তার কাফফারা (ক্ষতিপূরণ) হবে (সমমূল্য দ্বারা যতজনকে মধ্যম মানের খাদ্য খাওয়ানো যেতে পারে ততজন) মিসকীনকে খাওয়ানো অথবা সমসংখ্যক সিয়াম পালন করা। (এটা এজন্য যে,) যেন সে তার কাজের পরিণামের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। ৫:৯৫
তোমাদের জন্য জলভাগের শিকার করা ও তা খাওয়া হালাল করা হয়েছে, তোমাদের (আবাসে) ভোগের জন্য এবং কাফেলার ভোগের জন্য। আর তোমাদের জন্য স্থলভাগের শিকার হারাম করা হয়েছে, যতক্ষণ তোমরা হারাম মাসসমূহে থাকো। আর আল্লাহকে ভয় করো যার দিকে তোমাদেরকে হাশর / সমবেত করা হবে। ৫:৯৬
ভুল অনুবাদের কারনে হুরুমুনকে করা হয়েছে ‘ইহরাম’ আর ‘ইহরাম’ অর্থ করা হয়েছে ‘সাদা কাপড় পরা অবস্থা’। অথচ আরবী ভাষারীতি অনুসারে হুরুমুন অর্থ সংরক্ষিত মাসসমূহ।
হজ্জের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন সহজ করার জন্য আমরা কতিপয় প্রস্তাবনা রাখতে পারি:
(১) আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ওআইসির বা অনুরূপ সংস্থার হাতে অর্পণ করা।
(২) আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনা পরিষদে বৈষম্যহীনভাবে স্থানীয় ও অস্থানীয় প্রতিনিধির সমন্বয় সাধন করা।
(৩) হজ্জকে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বাণিজ্যে পরিণত না করা, বরং কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় হজ্জ অংশগ্রহণকারীদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা।
(৪) অসাম্প্রদায়িক বা ন্যায়সঙ্গতভাবে বিশ্বজনীন কল্যাণ কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
(৫) আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা।
(৬) জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
(৭) বিশ্বাসীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করন।
(৮) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও বিরোধ নিষ্পত্তি।
(৯) ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধনীতি বাস্তবায়ন।
(১০) আন্তর্জাতিক আদালতকে সর্বোচ্চ ক্ষমতায় কার্যকর করা।
(১১) হজ্জে আন্তর্জাতিক আবিষ্কার-উদ্ভাবনের পরিচিতি তুলে ধরা।
(১২) মানবকল্যাণের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ অবদানের জন্য স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিতরণ। কুরআনে সৎকাজে প্রতিযোগিতা করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয় এবং হজ্জের মতো জাতিসমূহের ঐক্যের সমাবর্তনেই এরূপ স্বীকৃতির ঘোষণা ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হবে, এটিই স্বাভাবিক।
পরিশেষে বলা যায় আল কুরআনে যেভাবে হজ্জের বিধি-বিধান দেয়া হয়েছে তা থেকে সুষ্পষ্ট হয় যে, হজ্জ হচ্ছে বিশ্বপ্রভুর প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত মাসসমূহে মানবজাতির কল্যাণে নির্দেশিত বার্ষিক বিশ্বসম্মেলন। হজ্জ শুধুমাত্র মুসলিম জাতির জন্য ঘোষিত কোনো কর্মসূচী নয়। হজ্জের ঘোষণা দেয়া হয়েছে যেন সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে সামর্থ্যবানরা ও বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিরা এতে অংশগ্রহণ করে। যদি মানবজাতি এ আহবানে সাড়া দিয়ে হজ্জের সময় তাদের ধর্মীয় ও জীবন নির্বাহগত কল্যাণকর উপায় সম্পর্কে পরস্পরের চিন্তা চেতনা শেয়ার করার মাধ্যমে পরস্পরের সাথে পরিচিত হতে পারে, তাহলে তা তাদেরকে প্রীতিময় বন্ধনে আবদ্ধ করবে, যা বিশ্বশান্তি, সহিষ্ণুতা এবং ধর্মীয় সহাবস্থান তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। হজ্জের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে আল মাসজিদুল হারামের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বৈশ্বিক টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের এবং বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণের উপায় অবলম্বন। হজ্জ হচ্ছে বিশ্বপ্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের মূল লক্ষ্যে মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যমুখী এমন এক সম্মেলন যাতে একদিকে রয়েছে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের ব্যবস্থা, সেই সাথে রয়েছে মানব জাতির মধ্যে সুষমভাবে পার্থিব সমৃদ্ধির বণ্টনব্যবস্থা। বর্তমানে হজ্জের কুরআন বর্ণিত আদর্শ রূপরেখা সঠিকভাবে প্রচার না পাওয়ায় হজ্জের প্রকৃত ফলপ্রসূতা থেকে মানবজাতি বঞ্চিত হচ্ছে। মানবজাতিকে হজ্জের প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমে কল্যাণ বিশ্বের বৈশ্বিক নাগরিক সুবিধা দেয়ার জন্য আল কুরআনের আলোকে হজ্জের যথাযথ স্বরূপ পুন:প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক।
চন্দ্রের মনজিলের মাধ্যমে তথা হিলাল থেকে হিলাল এর এক চক্রের মাধ্যমে কোনো চান্দ্রমাস শেষ হয়ে অন্য চান্দ্রমাস শুরু হওয়ার বিষয়টির লক্ষণ সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় তথা মাশহূর হয় বিধায় চান্দ্রমাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘শাহর’। যেহেতু চান্দ্র মাস ২৯ বা ৩০ দিনে হয় এবং এ দুটি সংখ্যার মধ্যে ৩০ একটি রাউন্ড ফিগার এবং গড় হিসাব করলে ২৯ দিনের বেশি হওয়ায় প্রায় ৩০ দিন বলতে হয়, তাই যখন সাধারণভাবে মাস বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে তখন ৩০ দিন বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ মাসের মূল হিসাবটি কিন্তু কোন ভিত্তি ছাড়া ৩০ দিনে একমাস এ হিসাব নয়, বরং চান্দ্রমাসের হিসাবের ভিত্তির উপরই এ হিসাব প্রতিষ্ঠিত। শাহর শব্দটি দ্বারা সাধারণভাবে ৩০ দিনের এক মাস বুঝায় এবং চান্দ্রবর্ষের এক মাস বা চান্দ্রমাস বুঝায়। আল কুরআনে ২৯ বা ৩০ দিনের চান্দ্রমাস (প্রাকৃতিক পঞ্জিকা মাস) এবং যে কোনো একটি দিন থেকে শুরু করে ৩০ দিনে ১ মাস হিসাবে হিসাবকৃত মাস উভয় ক্ষেত্রে ‘শাহর’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
২:১৮৪ আয়াতে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি সিয়াম পালনে অতিকষ্টে সক্ষম সে সিয়াম পালন না করলে একজন করে মিসকীনকে খাওয়াতে হবে। ৫৮:৪ আয়াতে যিহারের কাফফারা হিসেবে বলা হয়েছে, “ফামাল লাম ইয়াজিদ ফাসিয়ামু শাহরায়নি মুতাতাবিয়ায়নি মিন ক্বাবলি আইঁ ইয়াতামাচ্ছা। ফামাল লাম ইয়াছতাত্বি’ ফাইতয়ামু ছিত্তীনা মিসকীনান,” অর্থাৎ “যে (দাসমুক্তির) সামর্থ্য পায় না সে সিয়াম পালন করবে ধারবাহিকভাবে দুই মাস, (স্বামী-স্ত্রী) একে অপরকে স্পর্শ করার আগে। আর যে তাতেও অসমর্থ সে ষাটজন মিসকীনকে খাওয়াবে”। এখানে দেখা যাচ্ছে দুই মাসের সিয়ামের পরিবর্তে ষাটজন মিসকীনকে খাওয়ানোর কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ২ মাস = ৬০ দিন বা ১ মাস = ৩০ দিন হিসেবে প্রতি সওমের বদলে একজন মিসকীন খাওয়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ সিয়াম ও মিসকীনের এ সংখ্যাসাম্যের প্রসংগটি উল্লেখ করে ইহরাম অবস্থায় স্থলভাগের শিকার বধ করার কাফফারা হিসেবে বলা হয়েছে, “...আও কাফফারাতুন তয়ামু মাসাকীনা আও আদলু যালিকা সিয়ামান” (৫:৯৫)। অর্থাৎ জরিমানা (জাযা) হিসেবে বধকৃত পশুর অনুরূপ গবাদি পশু কা’বায় পৌঁছাতে না পারলে কাফফারা হিসেবে সেটার সমমূল্যে যতজন মিসকীনকে মধ্যমমানে খাওয়ানো যেতে পারে ততজনকে খাওয়াতে হবে অথবা ততসংখ্যক সিয়াম পালন করতে হবে। সুতরাং ৫৮:৪ আয়াতে বর্ণিত দুই মাসের সিয়ামের বদলে ষাট জন মিসকীনকে খাওয়ানো বলতে প্রতি সওমের পরিবর্তে একজন মিসকীন খাওয়ানো বুঝায় এবং ১ মাস = ৩০ দিন বুঝায়।
এক্ষেত্রে প্রসঙ্গক্রমে ৫:৮৯ আয়াতে বর্ণিত তথ্য সিয়ামসংখ্যা ও মিসকীন সংখ্যার মধ্যে সমতার প্রশ্নে সরল সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগকে রহিত করে কিনা সেটাও বিবেচ্য। ৫:৮৯ আয়াতে দৃঢ় বন্ধনযুক্ত শপথ ভঙ্গ করার কাফফারা হিসেবে তিনটি বিকল্প দেয়া হয়েছে (১) দশজন মিসকীনকে মধ্যম মানের খাদ্য খাওয়ানো বা তাদেরকে পরিধেয় বস্ত্র দেয়া (২) অথবা একজন দাস মুক্ত করা (৩) তা না পারলে তিন দিন সিয়াম পালন করা। শেষে আবার এ কথার উপর জোর দেয়া হয়েছে যে, এটা শপথ দৃঢ় শপথ ভঙ্গের কাফফারা। এ আয়াতে দেখা যায় যে, দশজন মিসকীনকে খাদ্য খাওয়ানোর পরিবর্তে তিন দিন সিয়াম পালন করা। এটি একটি সিয়ামের পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাওয়ানো বা ধারাবাহিক দুইমাস সিয়ামের পরিবর্তে ষাটজন মিসকীনকে খাদ্য খাওয়ানো বা মিসকীন সংখ্যা ও সিয়াম সংখ্যার সমতার সাথে সঙ্গতিশীল নয়। তাই ষাটজন মিসকীনের বিপরীতে দুই মাস বলতে ষাট দিন বুঝার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য কিনা সে প্রশ্নটি আসে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, ৫:৮৯ আয়াতে প্রথমে তিন দিন সিয়ামের কথা বলে তা না পারলে দশজন মিসকীনকে খাওয়ানোর কথা বলা হয়নি। বরং প্রথমেই দশজন মিসকীনকে খাওয়ানোর প্রসঙ্গ এসেছে, তারপর দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে এসেছে কোনো দাসকে মুক্ত করে দেয়া এবং তা সম্ভব না হলে তিন দিনি সিয়াম পালন করার কথা বলা হয়েছে এবং এটিকে আদল বা ‘মিসকীন সংখ্যার সম সংখ্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি, যা ৫:৯৫ আয়াতে চিহ্নিত করা হয়েছে। আবার এক্ষেত্রে আগে সিয়াম পালনের সময়সীমা চিহ্নিত করে পরে তা না পারলে মিসকীন খাওয়ানোর কথাও বলা হয়নি, যা ২:১৮৪ আয়াত ও ৫৮:৪ আয়াতে বলা হয়েছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে দৃঢ় শপথ ভঙ্গের কাফফারার বিধানস্বরূপ যে বিকল্প দেয়া হয়েছে তাতে সংখ্যাগত সমতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি, বরং সাধারণভাবে কিছু বিকল্প দেয়া হয়েছে যার মধ্য থেকে যে কোনোটি অবলম্বন করা যেতে পারে। অন্যদিকে ২:১৮৪, ৫:৯৫ ও ৫৮:৪ আয়াতে সংখ্যাগত সমতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অন্যকথায় যখন সংখ্যাগত সমতাকে গুরুত্ব দেয়া হয় বা যখন কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমায় সিয়ামের বিধানকে প্রাথমিক গুরুত্ব দিয়ে তা না পারলে মিসকীনকে খাওয়ানোর বিকল্প দেয়া হয়, তখন তাতে উল্লেখিত মিসকীন সংখ্যা দ্বারা ঐ সময়সীমাতে থাকা দিনসংখ্যা নির্ণয় করা যায়।
৯:৩৬ আয়াত অনুযায়ী একটি সৌরবর্ষে ১২টি পূর্ণ চন্দ্র চক্র বা ১২টি চান্দ্রমাস রয়েছে। আর সাধারণভাবে চান্দ্রমাস হয়ে থাকে ২৯ বা ৩০ দিনে। ৫৮:৪ আয়াত অনুযায়ী দুটি শাহর বা ‘মাসের’ (যা চান্দ্রমাস নয়, বরং যে কোনো একটি দিন থেকে শুরু করে একটি মাস পূর্ণ করার অর্থ বুঝায়) সিয়ামের পরিবর্তে ৬০ জন মিসকীনকে খাওয়ানো যেতে পারে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে শাহর মানে ‘যে কোনো একটি দিন থেকে শুরু করে ধারাবাহিক ত্রিশ দিনের সমষ্টি’। অর্থাৎ আল কুরআনে যখন ক্যালেন্ডার মাস না বুঝিয়ে সাধারণভাবে মাস বুঝানোর জন্য শাহর শব্দ ব্যবহৃত হয়, তখন শাহর বা মাস বলতে ৩০ দিনকে বুঝায়। যেসব আয়াতে শাহর বা তার বহুবচন আশহার ব্যবহৃত হয়েছে সাধারণভাবে মাস (৩০ দিনের যোগফল) বুঝাতে সেগুলো হলো : ২:২২৬, ২:২৩৪, ৪:৯২, ৩৪:১২, ৪৬:১৫, ৫৮:৪, ৬৫:৪, ৯৭:৩।
পক্ষান্তরে আল কুরআনে চান্দ্রবর্ষের ন্যাচারাল ক্যালেন্ডার মাস (চন্দ্রের তিথি হিসেবে ২৯ বা ৩০ দিন এবং “যে কোনো দিন থেকে মাস শুরু নয়, বরং হিলাল থেকে মাস শুরু”- এই পদ্ধতি হিসেবে) বুঝাতেও শাহর শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ সম্পর্কিত শাহর বা তার বহুবচন আশহার এবং শুহুর (বছরের/ গণনাচক্রের সকল মাসকে একসাথে বুঝানোর জন্য) শব্দ ধারণকারী আয়াতগুলো হলো : ২:১৮৫, ২:১৯৪, ২:১৯৭, ২:২১৭, ৫:২, ৫:৯৭, ৯:২, ৯:৫, ৯:৩৬।
দিন রাতের হিসাব নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে সূর্য তথা সূর্যের উদয়-অস্ত বা পৃথিবীর আহ্নিক গতি (দ্র : ৯১:১-৪)। মাসের দিনসংখ্যা নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে চন্দ্র তথা মনজিলসমূহ / তিথিসমূহ। চান্দ্রমাসের শুরু শেষ নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে হিলাল থেকে হিলাল এর চক্র (২:১৮৯, ৩৬:৩৯)। চান্দ্রবর্ষে ৬ মাস ৩০ দিন ও ৬ মাস ২৯ দিন হয়। যে কোনো মাস ৩০ দিনে বা ২৯ দিনে হতে পারে। বিভিন্ন বছর একই ক্যালেণ্ডার মাস বিভিন্ন দিনসংখ্যায় হতে পারে। যেমন কোনো বছর রমাদান মাস ২৯ দিনে এবং কোন বছর ৩০ দিনে হতে পারে। আবার ধারাবাহিকভাবে একাধিক বছর রমাদান মাস ২৯ দিনে (বা ৩০ দিনে) হতে পারে। এক্ষেত্রে হিলালের উদয়ই হচ্ছে দিনসংখ্যা নির্ণয়ের উপায়।
একটি সৌরবর্ষের পরিসর নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে পৃথিবীর বার্ষিক গতি (দ্র : ১০:৫, ১৭:১২)। পৃথিবীর বার্ষিক গতি অনুসারে ৩৬৫ দিনে ১টি সৌরবর্ষ হয়। ১৭:১২ আয়াত অনুযায়ী একটি দিন থেকে ঐ দিনের পুনরাবৃত্তি পর্যন্ত (যেমন Spring Equinox থেকে পরবর্তী Spring Equinox পর্যন্ত) একটি সৌরবর্ষ। আবার একটি সৌরবর্ষে ১২ টি চান্দ্রমাস অতিবাহিত হয় বিধায় প্রাকৃতিকভাবে ১২ মাসে ১ বছরের হিসাব প্রতিষ্ঠিত। এই প্রাকৃতিক প্রেক্ষিতে আল কুরআন অনুসারে ১২টি চান্দ্রমাস (শাহর) নিয়ে একটি গণনাচক্র/ ইদ্দাত তথা একটি চান্দ্রবর্ষ। ১ টি বর্ষে ১২ টি চান্দ্রমাস হিসেবে মাসের গণনার বিধান সৃষ্টির প্রথম থেকে বিধিবদ্ধ (৯:৩৬)।
চান্দ্রমাসের হিসাবে যেমন কোনো মাস ৩০ দিন এবং কোনো মাস ২৯ দিন অনুরূপভাবে চান্দ্রমাস হিসাবের দিনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে সৌরমাস হিসাবের ক্ষেত্রেও প্রথমত ৩০ দিনে ১ মাস ধরা হয় এবং সেক্ষেত্রে সৌরবর্ষের জন্য আরো ৫ দিনের প্রয়োজন হয় বিধায় কিছু মাসকে ৩১ দিনে হিসাব করা হয়। কারণ পৃথিবীর বার্ষিক গতি অনুসারে ৩৬৫ দিনে ১টি সৌরবর্ষ হয়। এভাবে কোনো সৌরমাস ৩০ ও কোনো সৌরমাস ৩১ দিনে হিসাব করার ভিত্তিতে বছরের নির্দিষ্ট তারিখে দিন রাত সমান হওয়ার হিসাবও নির্ধারণ করা সহজ হয়। Year is related to earth since the earth revolves around the sun in a year.
১ বছরের মাসসংখ্যা নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে পৃথিবীর বার্ষিক গতি অনুসারে ১ টি সৌরবর্ষে অতিবাহিত পূর্ণ চান্দ্রমাসের সংখ্যা। অর্থাৎ সৌরবর্ষের হিসাবের ক্ষেত্রেও ৩০ দিনে ১ মাস এবং ১২ মাসে ১ বছর নির্ধারণের বিষয়টি মূলত চান্দ্রমাস ও চান্দ্রবর্ষের হিসাব পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে গৃহীত হয়েছে।
চান্দ্রবর্ষ (চন্দ্রমাসসমূহের গণনাচক্রে / ১২ মাসের যোগফলে) ৩৫৪ দিন, পক্ষান্তরে সৌরবর্ষ (পৃথিবীর বার্ষিক গতি) ৩৬৫ দিন। অর্থাৎ একটি সৌরবর্ষের তুলনায় একটি চান্দ্রবর্ষে ১১ দিন কম থাকে। এই প্রেক্ষিতে ১৮:২৫-২৬ আয়াত অনুযায়ী চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষের হিসাব পদ্ধতির বাস্তবতা বিবৃত হয়েছে যে, তিনশ সৌরবর্ষ হচ্ছে তিনশ নয় চান্দ্রবর্ষের প্রায় সমানুপাতিক। সৌরবর্ষকে আরবিতে ‘সানাতুন’ এবং চান্দ্রবর্ষকে ও চান্দ্রসৌরবর্ষকে (যাতে চন্দ্রচক্রকে মাস হিসেব করা হয়) আরবিতে ‘আমুন’ বলা হয়। আল কুরআন অনুযায়ী, সৌরবর্ষ ও চান্দ্রবর্ষ বা চান্দ্রসৌরবর্ষ উভয়ের হিসাব প্রাকৃতিক নিয়মবদ্ধ এবং আল কুরআর অনুসারে, এটা আল্লাহর নির্ধারিত প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা। সুতরাং উভয় হিসাব অবশ্যই গ্রহণযোগ্য (দ্র: ৫৫:৫)।
মাসের হিসেব নির্ণয়ের ভিত্তি হিসেবে নতুন চাঁদ থেকে নতুন চাঁদের সময়সীমাকে (duration of moon cycle) গ্রহণ করা হয়েছে বিধায় ইংরেজিতে মাসকে month বলা হয়। একটি বর্ষে চারটি ঋতু থাকে। ঋতুগুলো হলো বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত। প্রতিটি ঋতু তিনটি চান্দ্রমাসের প্রায় সমান দৈর্ঘ্যের হয়ে থাকে। এভাবে চারটি ঋতুর মোট সময়কাল তথা একটি বর্ষের মাসসংখ্যা হলো ১২। সুতরাং চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষ উভয়টিতে ১২ মাসে এক বছর হিসেব করতে হয়, এটাই প্রাকৃতিক পদ্ধতি।
৬:৯৬, ১০:৫, ১৭:১২, ১২:৪৭-৪৯, ২০:৫৯, ১০৬:১-৪ আয়াত থেকে চান্দ্রবর্ষ ক্যালেন্ডার ও সৌরবর্ষ ক্যালেন্ডার উভয়টির ব্যবহারিক উপযোগিতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
সৌরবর্ষ পৃথিবীর বার্ষিক গতির সাপেক্ষে হিসাবকৃত বিধায় প্রতি বছর একই সৌরমাস একই ঋতুতে পড়ে। অন্যদিকে একটি চান্দ্রবর্ষ একটি সৌরবর্ষের চেয়ে ১১ দিন কম বিধায় একই চান্দ্রমাসের (যেমন রবিউল আউয়াল মাসের) আবর্তন বিভিন্ন বছর সৌরবর্ষের বিভিন্ন ঋতুতে হতে থাকে। অর্থাৎ চান্দ্রবর্ষে একই মাস একই ঋতুতে আসে না, বরং এর আবর্তন ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে হতে থাকে। মানুষের নির্বাহী সিদ্ধান্তনির্ভর কর্মকান্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে সৌরবর্ষের হিসাবের কিছু সুবিধা দেখা যায়, যাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ঋতু অনুসারে পূর্বসিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়। তাই চান্দ্রমাসকে একই ঋতুতে পাওয়ার জন্য চান্দ্র-সৌরবর্ষ ক্যালেন্ডার (Lunisolar Year Calendar) এর উদ্ভব ঘটে। চান্দ্রসৌরবর্ষে (Lunisolar Year Calendar) প্রতি তৃতীয় বর্ষে একটি চান্দ্রমাস যোগ করা হয়, এই মাসকে intercalary month / leap month বলা হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে একই চান্দ্রমাসকে (একই ক্রমিকের চান্দ্রমাসকে বা একই নামের চান্দ্রমাসকে) নির্দিষ্ট ঋতুতে স্থির রাখা বা হিসাব করা।
৯:৩৬ আয়াতে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম থেকে ১২টি চান্দ্রমাসের গণনাচক্র (Counting Cycle) এবং এর মধ্য থেকে ৪টি মাস হারাম মাস হওয়া এবং মুশরিকদের কর্তৃক ‘নাসী’ তথা ‘হারাম মাসের অবস্থানের রদবদল বা হারাম মাসকে যথাসময়ে পালন করাকে স্থগিত করে পরে অন্য মাসকে হারাম ঘোষণা করে বার্ষিক হারাম মাসের সংখ্যাগত সমন্বয়’ কুফরের বা সত্য বিধান প্রত্যাখ্যানের একটি বৃদ্ধি হওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে অনেকে ভেবে থাকেন যে, ১২টি চান্দ্রমাসে একটি চান্দ্রবর্ষ হিসেব করতে হবে এবং এটাই ইসলামী বর্ষ গণনা পদ্ধতি এবং চান্দ্রসৌরবর্ষ (Lunisolar Year Calendar) তথা চান্দ্রবর্ষে একটি intercalary month / leap month মাস যোগ করা বা ১৩ মাস হিসেব করা মানে নাসী এবং এটি কুফর। অথচ প্রকৃতপক্ষে এটি ‘নাসী’ নয়, এবং কোনো চান্দ্রবর্ষে intercalary month / leap month যোগ করে ১৩তম মাস হিসেব করা কুফর নয়। কারণ ১২টি চান্দ্রমাসের যোগফলে একটি চান্দ্রবর্ষ হিসেব করলেও হারাম মাসসমূহ যে ঋতুতে পালন করতে হবে, intercalary month / leap month যোগ করে কোনো বর্ষে ১৩তম মাস হিসেব করলেও সেই ঋতুতেই হারাম মাসসমূহ পালন করতে হবে। যে চান্দ্রবর্ষে ১৩তম মাস যোগ করা হয় বস্তুত সেই সৌরবর্ষেও চন্দ্রচক্র (Moon Cycle) ১২টিই থাকে। তাই কুরআনের বিবৃতির লংঘন হয় না বা লংঘন সম্ভব নয়, কারণ এটাই প্রাকৃতিক ব্যবস্থা যে, একটি সৌরবর্ষে চন্দ্রচক্র ১২টিই থাকবে। কিন্তু একটি ক্যালেন্ডার হিসেব করতে গিয়ে এই ১২টি চন্দ্রচক্রের পর যে কয়দিন একটি চন্দ্রচক্রের সমান নয় কিন্তু বাড়তি দিন সেই কয়দিনের যোগফলকে একসাথে একটি চন্দ্রমাসের হিসেবে আনা তথা ১৩তম মাস হিসেব করার মাধ্যমে একই ঋতুতে হারাম মাসসমূহ পালন (বা বর্ষ শুরু করা) মূলত বর্ষ গণনাকে সহজীকরনের জন্য করা হয়। অন্যদিকে চান্দ্রবর্ষ হিসেব করলে একই ঋতু একেক বর্ষে একেক চান্দ্রমাসে হিসেব করতে হয়। উভয় অবস্থায় হারাম মাসসমূহ একই ঋতুতে হিসেব করতে হবে বিধায় এবং হারাম মাসকে একই ঋতুতে পালন না করাটাই ‘নাসী’ বিধায় চান্দ্র-সৌরবর্ষের মাধ্যমে নাসী ঘটে না, বরং নাসী থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে সহজ হিসাব পদ্ধতির জন্য চান্দ্রসৌরবর্ষ একটি গ্রহণযোগ্য হিসেবে পদ্ধতি। হারাম মাসসমূহ ও এর ঋতু সম্পর্কে ‘হারাম মাসসমূহ’ অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে।
পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, হারাম মাসসমূহ হচ্ছে রমাদানের মাস এবং তার পরবর্তী তিনটি মাস। হারাম মাসের প্রথমটিতে সিয়াম এবং পরের তিনটিতে হজ্জ হবে। হারাম মাসসমূহ চিহ্নিতকরণের উপায় সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো।
হারাম মাসসমূহের হারাম বিষয় সাপেক্ষেই হারাম মাসসমূহের সময়কাল নির্ণয় করা সম্ভব। তাই নিম্নে এ বিষয়টির উপর ভিত্তি করে দুটি পয়েন্টে আলোকপাত করা হলো এবং তার মাধ্যমে হারাম মাসসমূহকে চিহ্নিত করা হলো:
(১) হারাম মাসসমূহের অন্যতম Common হারাম বিষয় তথা বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ
হারাম মাসসমূহের কমন দুটি হারাম বিষয় হলো এই মাসগুলোতে বন্য প্রাণী (wild-life) শিকার হারাম এবং এ মাসগুলো হলো বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির মাস। এর মধ্যে প্রথমটি সুনির্দিষ্টভাবে একটি জৈবিক প্রকৃতির ঋতুর সাথে সম্পর্কিত। আর তা হলো এটা এমন এক ঋতু যা বন্য প্রাণীদের প্রজননের জন্য নাজুক হিসেবে সাব্যস্ত। Delicate season for mating and breeding of wild animals। সুতরাং এটা হলো বসন্তকাল। অন্য কথায়, বসন্তের প্রথম মাসই হবে হারাম মাসসমূহের প্রথম মাস।
(২) হারাম মাসসমূহের পরে যুদ্ধাভিযানের সময়কালের আবহাওয়া
৯:৮১ আয়াত অনুসারে হারাম মাসসমূহের পরে যুদ্ধাভিযানের সময় ছিল প্রচণ্ড গরমের সময়। সুতরাং হারাম মাসসমূহ ছিল উষ্ণতম মাসের আগে। অন্য কথায় হারাম মাসসমূহ শুরু হয়েছিল বসন্ত ঋতুতে। বসন্তের প্রথম মাস থেকে শুরু করে ধারাবাহিক চারমাস হারাম মাস।যার প্রথম তিনটি মাস হলো বসন্ত এবং চতুর্থতম মাসটি হলো গ্রীষ্মের প্রথম মাস।
রমাদানের মাস চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে হারাম মাসসমূহকে চিহ্নিতকরণ সম্ভব। তাই প্রথমে রমাদানের মাসকে চিহ্নিত করার জন্য রমাদান সম্পর্কিত আয়াতটির সংশ্লিষ্ট অংশ নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
২:১৮৫ :: রমাদানের মাস (শাহরু রমাদান), যাতে আমি আল কুরআন নাজিল করেছি, মানবজাতির জন্য হিদায়াত হিসেবে এবং হিদায়াতের স্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে এবং সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী হিসেবে। সুতরাং তোমাদের মধ্য থেকে যে এ মাসকে প্রত্যক্ষ করবে (তথা এ মাস শুরু হওয়ার অভিলক্ষণ বা অভিজ্ঞান পাবে) সে যেন তাতে (মাসব্যাপী) সিয়াম পালন করে।
সর্বপ্রথম নির্ণেয় বিষয় হচ্ছে শাহরু রমাদান শব্দের অর্থ কি? সাধারণত এর অর্থ করা হয় ‘রমাদান মাস’। কিন্তু এ অর্থ কি সঠিক? এর অর্থ কি ‘রমাদান মাস’ নাকি ‘রমাদানের মাস’?
প্রচলিত ধারণামতে, হিজরী ক্যালেন্ডারের নবম মাসের নাম হচ্ছে ‘রমাদান’। অথচ যদি রমাদান শব্দটি একটি মাসের নামবাচক বিশেষ্য হতো তাহলে শুধু রমাদান বলা হতো, শাহরু রমাদান বলা হতো না। শাহরু রমাদান অর্থ রমাদান মাস নয়, বরং এর অর্থ রমাদানের মাস। কারণ আরবী ব্যাকরণ পরিভাষায় শাহরু শব্দটি হচ্ছে মুদাফ (সম্বন্ধ পদ) এবং রমাদান শব্দটি হচ্ছে মুদাফ ইলাইহি (যার সাথে সম্বন্ধিত)। সুতরাং শাহরু রমাদানের সঠিক অনুবাদ হচ্ছে ‘রমাদানের (বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন) মাস’।
‘শাহরু রমাদান’ শব্দের অর্থ ‘রমাদানের মাস’ হওয়ায় প্রমাণিত হয় যে, শাহরু রমাদান কোনো মাসের নামবাচক বিশেষ্য নয়, বরং শাহরু রমাদান হচ্ছে একটি মাসের বিশেষণমূলক নাম (গুণবাচক বিশেষ্য)। যে মাসটি রমাদানের মাস হবে সেই মাসটিকেই শাহরু রমাদান বলতে হবে, তা কোনো ক্যালেন্ডারে মাসের গণনাক্রমের একই ক্রমিকের মাস হোক বা একেক বর্ষে একেক ক্রমিকের মাস হোক, তা বিবেচ্য নয়। বরং মাসটি চিহ্নিত হবে তার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অনুসারে।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি বুঝা যেতে পারে। আমরা জানি যে, ঘড়ির মাধ্যমে প্রতিদিনের সময়কে চিহ্নিত করার জন্য ১২ টি ঘণ্টার হিসাব চালু আছে। এতে মধ্যাহ্নের পূর্বের সময়কে a.m এবং মধ্যাহ্নের পরের সময়কে p.m দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সকালে সূর্যোদয় এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত ঘটে। কুরআনের নির্দেশ অনুসারে সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের আগে আল্লাহর তাসবীহ বা পবিত্রতা জ্ঞাপন করতে হবে। এখন ঘড়ির হিসাবে ১ থেকে ১২ টা এবং তারপর আবার ১ থেকে ১২ টা হিসেব করা হয়। প্রতিটি ঘণ্টার আলাদা নাম না দিয়ে আমরা সেটাকে সংখ্যায় হিসেব করে থাকি। সে হিসেবে কোনো মাসে 05:00 a.m / 06:00 a.m / 07:00 a.m যে ঘণ্টাতেই সূর্যোদয় হোক সেটাকে সূর্যোদয়ের সময় বলতে হবে এবং অনুরূপভাবে 05:00 p.m / 06:00 p.m / 07:00 p.m যে ঘণ্টাতেই সূর্যাস্ত হোক তাকে সূর্যাস্তের সময় বলতে হবে। এমন নয় যে, প্রতিদিন 06:00 a.m কে সূর্যোদয়ের সময় বলা হবে বা 06:00 p.m কে সূর্যাস্তের সময় বলা হবে। বরং বাস্তবে যে দিন যে ঘন্টায় সূর্যোদয় হবে সেদিন সে ঘণ্টাটিই সূর্যোদয়ের সময় এবং যে ঘণ্টায় সূর্যাস্ত যাবে সেদিন সে ঘণ্টাটিই সূর্যাস্তের সময়। অনুরূপভাবে, কোনো বর্ষে চান্দ্রমাসের ধারাবাহিক হিসাব ক্রমের ৩নং মাস, কোনো বর্ষে ৪নং মাস এবং ৫নং মাস রমাদানের মাস হতে পারে। প্রতি বর্ষে একই ক্রমিকের মাসকেই যে রমাদানের মাস মনে করতে হবে তা নয়। আবার যদি চান্দ্রসৌরবর্ষ (Lunisolar Year) ক্যালেন্ডার হিসেব করা হয় সেক্ষেত্রে রমাদানের মাসকে প্রতিবর্ষে একই ক্রমিকের মাস হিসেবে পাওয়া যেতে পারে।
শাহরু রমাদান বা রমাদানের মাস বলতে কোন মাসটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে তা বুঝার উপায় হলো রমাদান শব্দের অর্থ অনুধাবন এবং হারাম মাসসমূহের সাথে সম্পর্কিত হারাম বিষয়ের সাপেক্ষে হারাম মাসসমূহকে চিহ্নিতকরণ।
যদিও রমাদান শব্দের অর্থ হিসেবে ‘হিজরী ক্যালেন্ডারের নবম মাসের নাম, যাতে সিয়াম পালন করা হয়’ লেখা হয়, তবুও এর প্রকৃত অর্থ নির্ণয়ের জন্য রমাদান শব্দটির শব্দমূল ‘র মীম দদ’ থেকে গঠিত শব্দসমূহের অর্থ জানা প্রয়োজন। নিম্নে Arabic-English-Dictionary, J.G. Hava, Beyrut Catholic Press, 1899 গ্রন্থে রমাদান শব্দের শব্দমূল থেকে গঠিত বিভিন্ন শব্দের যেসব অর্থ দেয়া হয়েছে তা দেখানো হলো:
Translation and Meaning of رمض in Almaany English Arabic Dictionary
رَمِضَ ( فعل ): - اِشتَدَّ حَرُّه
- Become intensely hot - become burning; become scorching; be blazing; be glowing
Source: https://www.almaany.com/en/dict/ar-en/%D8%B1%D9%85%D8%B6/
এ শব্দমূল থেকে যেসব শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে সেগুলোর অর্থগত বিভিন্নতার উদাহরণ জানার জন্য Lanes Lexicon দেখা যেতে পারে। Lanes Lexicon এর অনলাইন পেজ:
http://lexicon.quranic-research.net/data/10_r/199_rmD.html
বিভিন্ন অভিধানের তথ্য সমন্বয়ের ভিত্তিতে রমাদান শব্দের শব্দমূল ‘র মীম দদ’ থেকে যেসব শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে নিম্নে সেগুলোর একটি বিস্তৃত তালিকা ও সরল অর্থ উল্লেখ করা হলো:
১. রমাদা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১, উপরূপ ১) = সে উত্তপ্ত ভূমিতে মেষচারণ করলো, সে উত্তপ্ত পাথরে গরম ছাই দিয়ে পাক করলো, সে উত্তপ্ত পাথরে বর্শা বা ছুরিকে ধারালো করলো।
২. রমুদা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১, উপরূপ ২) = এটা (ব্লেড বা ছুরি) ধারালো হলো।
৩. রমিদা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১, উপরূপ ৩) = সে আলোর তীব্রতা বা তাপ দ্বারা প্রভাবিত হলো, সে মাটি বা পাথরের স্পর্শে পায়ে তাপ অনুভব করলো, সে তৃষ্ণার কারণে তীব্র জ্বালা অনুভব করলো, সে মরুভূমি থেকে চাষের জমিতে ফিরে এলো, সে বিষয়টির কারণে দু:খিত ও অস্থির হলো, তা আলোর উজ্জলতায় জ্বলজ্বলে হলো।
৪. রম্মাদা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ২) = সে তাকে উত্তাপে বা উত্তপ্ত ভূমিতে দগ্ধ করলো, সে তাকে কষ্ট দিলো, সে তার জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করে প্রস্থান করলো, সে একটি নিদিষ্ট সময়কালের কাজ শুরু করার (যেমন রমাদানের সিয়াম পালনের) মনস্থির করলো।
৪. আরমাদা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪) = তা উত্তপ্ত হলো ও দগ্ধ করলো, সে বিচলিত করে দিলো, সে ব্যথিত করলো।
৫.তারাম্মাদু (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৫) = সে উত্তপ্ততার ফলে পাগুলো স্থানচ্যুত হয়ে থেমে যাওয়া পর্যন্ত ধাওয়া করলো।
৬. ইরতামাদা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৮) = সে তাপদগ্ধ হলো, সে শোকতপ্ত হলো।
৭. রমাদ (ক্রিয়াবিশেষ্য) = বালির উপর রোদ পড়ার প্রভাব, উদ্দীপনা বা উত্তপ্ততা, কোনো বিষয়ের কারণে উদ্বেগ, দু:খ বা শোকের উদ্ভব ঘটা।
৬. রমিদ (ক্রিয়াবিশেষ্য) = উত্তপ্ত ভূমি বা উত্তপ্ত পাথর, করমর্দনের মাধ্যমে উষ্ণ তালু।
৯. রমাদাহ (ক্রিয়াবিশেষ্য) = উত্তাপ অনুভব।
১০. রমদাউ (ক্রিয়াবিশেষ্য) = অতিমাত্রায় উত্তপ্ত ভূমি বা পাথর।
১১. রমাদিইয়ু (ক্রিয়াবিশেষ্য) = গরমের শুরুতে বা শেষে বৃষ্টি, রমাদান মাসের বৃষ্টি, কোনো কিছুকে রোদে শুকানো।
১২. রমীদ (কর্মবিশেষ্য, মারমূদ এর সমার্থক শব্দ) = পাথরে ধার দেয়া ধারালো বর্শা বা ছুরি।
১৩. রমাদান = প্রচলিত অর্থ হলো হিজরী ক্যালেন্ডারের নবম মাসের নাম, নবম মাসের পূর্ব নাম ছিল নাতিক, এটি সবচেয়ে গরম মাসে পড়েছিল বিধায় এটিকে রমাদান নামকরণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
উপরিউক্ত তালিকা অনুসারে রমাদান শব্দের অর্থ নির্ণয়ের জন্য এর শব্দমূলের যেসব অর্থকে বিবেচনায় নেয়া হয় তার মধ্যে রয়েছে গরমের আগে বা পরে বৃষ্টি, পাথরে বর্শাকে ধার দেয়ার প্রবৃত্তি, আলোর তীব্রতা, উষ্ণতা, তাপ বৃদ্ধি, অসহ্য / দুর্বিসহ তাপ, উত্তপ্ত ভূমি, জ্বালিয়ে দেয়া, পিপাসা ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে রমাদান শব্দের অর্থ হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত হয়েছে, ‘জ্বালিয়ে দেয়ার মতো অসহ্য বা প্রচণ্ড তাপ’। আবার রমাদানের অর্থ হিসেবে দ্বিতীয় বহুল প্রচলিত অর্থ হলো ‘গ্রীষ্মের শেষদিকে উত্তপ্ত ভূমিতে বৃষ্টি’। এ দুটি অর্থের উপর ভিত্তি করে ‘শাহরু রমাদানের’ নাম ‘শাহরু রমাদান’ রাখার কারণ হিসেবে বলা হয় যে, যে বছর কুরআন নাজিল হয় সে বছর ‘শাহরু রমাদান’ মাসটি জুন, জুলাই, আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে পড়েছিল।
যদি ‘রমাদান’ শব্দের অর্থ ‘দুর্বিসহ গরম’ হয় এবং সেই প্রেক্ষিতে রমাদানের মাস সবচেয়ে বড় দিন (summer solstice) ২০, ২১ বা ২২ জুন এর সাথে সম্পর্কিত মাসটি হয়, তাহলে এর পূর্ববর্তী তিনটি মাস বা পরবর্তী তিনটি মাসসহ মোট চারটি মাস হবে হারাম মাস এবং হারাম মাসগুলো হবে বন্য পশুর জন্য নাজুক সময় এবং হারাম মাসসমূহের মধ্যে রমাদানের মাস ছাড়া বাকি মাসগুলো হজ্জের মাস। পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা স্পষ্ট হয়েছি যে, বন্য প্রাণীদের প্রজননের জন্য নাজুক সময় হলো ‘বসন্ত ঋতু’। সুতরাং জুন মাস রমাদানের মাস হলে অন্য তিনটি হারাম মাস হবে রমাদানের মাসের পূর্ববর্তী তিনটি মাস (মার্চ, এপ্রিল, মে)। অন্যদিকে পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা এটাও স্পষ্ট হয়েছি যে, হারাম মাসসমূহের মধ্যে শেষ মাস নয়, বরং প্রথম মাসই রমাদানের মাস, সিয়ামের মাস। এ হিসেবে ‘রমাদানের মাস’ হলো বসন্তের প্রথম মাস। অন্যদিকে যদি রমাদানের মাস গ্রীষ্মের প্রথম মাস (জুন মাস) হয় এবং বাকি হারাম মাসগুলো হয় তার পূর্ববর্তী তিনটি মাস (বসন্তের মাসসমূহ), সেক্ষেত্রে মাসসমূহকে হিসেব করতে হয় উল্টোদিক থেকে। অর্থাৎ প্রথমে জুন মাসে রমাদানের মাস হিসেব করে তারপর তার আগের তিনটি মাসকে হারাম মাস হিসেবে পালন করা। এভাবে উল্টোদিক থেকে হিসেব করা স্বাভাবিক নয়। বরং প্রথমে কোনো মাসের প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ (Natural phenomenon) প্রত্যক্ষ করে তারপর সেই মাস থেকে সামনের দিকে হিসেব করা স্বাভাবিক পদ্ধতি। সে হিসেবে ‘রমাদানের মাস’ হারাম মাসসমূহের প্রথম মাসটি বা বসন্তের প্রথম মাসটি, এটিই স্বাভাবিক পদ্ধতি। যেহেতু কুরআনে একমাত্র ‘রমাদানের মাস’টি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে “শাহিদা’ বা প্রত্যক্ষ করে তার সাপেক্ষে অন্য মাসগুলোকে হিসেব করার পদ্ধতি দেয়া হয়েছে।
বসন্তের প্রথম মাসকে ‘রমাদানের মাস’ হিসেবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ‘রমাদান’ শব্দের অর্থ সঙ্গতিশীল নাকি অসঙ্গতিশীল, এটাই প্রধান নির্ণেয় বিষয়। প্রকৃতপক্ষে রমাদান শব্দের শব্দমূল ‘র মীম দদ’ এর মূল অর্থ হলো ‘তীব্রতা’ (Intensity), যা প্রকৃতিতে রঙ, আলো, উষ্ণতা ও প্রাণপ্রাচুর্যের সাথে সম্পর্কিত। একটি মাসের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে এই তীব্রতা ঋতুগত বৈশিষ্ট্যের নির্দেশক।
ঋতুগত বৈচিত্র্যের সাপেক্ষে ‘রমাদানের মাস’ চিহ্নিতকরণের জন্য সূরা ক্বুরাইশে উল্লেখিত ঋতু সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। সূরা কুরাইশের বক্তব্য বিষয় হলো: শীত ও গ্রীষ্মে কুরাইশদের বাণিজ্য সফরের সুবিধার পেছনে আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনায় তাদের সম্পৃক্ততা কাজ করেছিল বিধায় তাদের উচিত এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই প্রতিষ্ঠানের প্রভুর অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করা। আরবি ভাষায় বসন্ত ও গ্রীষ্ম ঋতুকে একসাথে ‘সয়ফ’ এবং শরৎ ও শীত ঋতুকে একসাথে ‘শীতায়ি’ বলা হয়। অন্য কথায় এ চারটি ঋতুকে আরবিতে প্রধান দুই ঋতু হিসেবে ধরা হয়। তাই শীতায়ি ও সয়ফে বাণিজ্য সফর বলতে সমগ্র বর্ষে প্রধান দুটি ঋতু বৈচিত্র্যের সাথে সঙ্গতি রেখে দুটি প্রধান বাণিজ্যিক সফরের আয়োজনকে বুঝায়। শীতায়ি এর আওতাধীন ছয় মাস হলো ‘সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি’ যখন Fall Equinox থেকে শুরু করে দিন ধীরে ধীরে ছোটো হতে থাকে এবং প্রকৃতিতে রঙ ও উষ্ণতার ক্ষেত্রে মলিনতা সৃষ্টি হয়। এ সময়কালে ‘বারদুন’ (২১:৬৯) বা ‘শীতলতা’ এর পরিবেশ থাকে। অন্যদিকে সয়ফ এর আওতাধীন ছয় মাস হলো ‘মার্চ থেকে আগস্ট’ যখন Spring Equinox থেকে শুরু করে দিন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং প্রকৃতিতে রঙ ও উষ্ণতার ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতা সৃষ্টি হয়। এ সময়কালে ‘রমাদুন’ বা ‘উষ্ণতা’ এর পরিবেশ থাকে।
যেহেতু ‘রমাদুন’ (উষ্ণতা) এমন একটি প্রাকৃতিক অবস্থা যা সমগ্র সয়ফে তথা বসন্ত-গ্রীষ্মে বিদ্যমান থাকে বা ‘রমাদুন’ হলো ‘সয়ফের’ প্রাকৃতিক অবস্থা, তাই ‘শাহরু রমাদান’ হবে বসন্ত-গ্রীষ্মের ছয় মাসের মধ্যকার একটি মাস। ‘শাহরু রমাদান’ নামটিতে ব্যবহৃত ‘রমাদান’ শব্দের প্যাটার্ন হচ্ছে ‘ফায়ালান’। এই প্যাটার্নটি কোনো কিছুর স্বস্তিদায়ক বা স্বাভাবিক ও সহনীয় পর্যায়ের নির্দেশক। এই প্যাটার্নে আল কুরআনে তিনটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। রমাদান ছাড়া অন্য দুটি শব্দ হলো- (১) হায়াওয়ান (২৯:৬৪:১২), অর্থ: স্বস্তিকর জীবন বা প্রাণবন্ততা। (২) শানাআন (৫:২:২৯, ৫:৮:১১), অর্থ: স্বাভাবিক শত্রুতা। সুতরাং রমাদান শব্দের অর্থ সহনীয় পর্যায়ে প্রকৃতির তীব্রতা (The intensity of nature at a moderate level)। এটি এমন একটি ঋতুর নির্দেশক যা শারীরবৃত্তীয় ও মনস্তাত্ত্বিক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, জৈব প্রকৃতিতে তীব্রতা আনয়ন করে। এ থেকে বুঝা যায় যে, ‘শাহরু রমাদান’ বলতে সবচেয়ে উত্তপ্ত মাস নয়, বরং জৈবপ্রকৃতিতে তীব্রতার মাস তথা বসন্ত বিষুবীয় মাসকে (Vernal / Spring equinoctial month) বুঝায়।
‘শাহরু রমাদান’ বলতে বসন্তের প্রথম মাসকে চিহ্নিত করার কারণ হলো ‘সয়ফ’ বা বসন্ত-গ্রীষ্মের মাসগুলোর মধ্যে সবগুলো মাসেই ‘রমাদুন’ এর বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় বিধায় এর মধ্য থেকে কোনো একটি মাসকে ‘শাহরু রমাদান’ হিসেবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো: (১) তা হবে ঐ প্রাকৃতিক অবস্থার সূচনা পর্যায়, যেহেতু তা না হলে বাকি মাসগুলোর মধ্য থেকে কোনো মাসকে নির্দিষ্ট করা অর্থবহ হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তাল পাকার মাস হিসেবে ভাদ্র মাসকে চিহ্নিত করা হয়, যদিও তার পরবর্তী দু’মাসেও তাল পাকার অবস্থাটি বিদ্যমান থাকে। (২) ‘রমাদুন’ শব্দটির অর্থ ‘উষ্ণতা’ এর পাশাপাশি ‘শাহরু রমাদান’ এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্যাটার্ন ‘ফায়লান’ এর প্রেক্ষিতে এর মধ্যে সহনীয় পর্যায় থাকতে হবে, আর তাই এটিকে ‘দুর্বিসহ বা প্রচণ্ড উষ্ণতা’ অর্থে গ্রহণ করা সঠিক নয়। (৩) হারাম মাসসমূহের শেষে যখন প্রচণ্ড গরম ছিলো ৯:৮১ আয়াতে ঐ অবস্থার জন্য ‘হাররান’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যদি ‘প্রচণ্ড গরম’ বুঝাতে ‘রমাদান’ শব্দ ব্যবহৃত হতো তবে তাতে ‘রমাদান’ শব্দটিই ব্যবহৃত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ ছিলো। সুতরাং এ বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে বুঝা যায় যে, বসন্তের প্রথম মাসই রমাদানের মাস হিসেবে প্রত্যক্ষ (শাহিদা) করার বিষয় এবং তারপর রমাদানের মাসে সিয়াম পালন করতে হবে এবং তার পরবর্তী তিন মাসে হজ্জ সম্পাদিত হবে এবং সমষ্টিগতভাবে এই চারমাসকে হারাম মাস হিসেবে পালন করতে হবে। হারাম মাসসমূহে বন্য পশু শিকার বা বধ করা যাবে না এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতি হিসেবে যুদ্ধবিরতি পালন করতে হবে।
রমাদানের মাসকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আল কুরআন নাজিলের প্রসঙ্গটি সম্পৃক্ত। এ মাসে আল কুরআন নাজিলের সূচনা হয়েছে। আর যে রাতে আল কুরআন নাজিল হয়েছে তা হচ্ছে ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘নির্ধারণের রাত, পরিমাপের রাত’ (৯৭:১)। কোনো রাতকে ‘পরিমাপের রাত’ বলার তাৎপর্য হচ্ছে তাতে রাতটির পরিমাপের ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য স্থাপন বা সমীকরন করা। আধুনিক পরিভাষায় এরূপ রাতকে বলা হয় equinox or night of equation or equinoctial night.
প্রতি বছর দুটি equinox হয়। একটিকে বলা হয় March equinox (19, 20 or 21 March) এবং অন্যটিকে বলা হয় September equinox (21, 22 or 23 September)। ঋতুর দিক থেকে এর একটিকে Spring or Vernal equinox এবং অন্যটিকে Autumn or Fall equinox বলা হয়।
হারাম মাসসমূহের মুল হারাম বিষয় হলো বন্য প্রাণী শিকার না করা। অর্থাৎ এ সময়কাল হচ্ছে বন্য প্রাণীদের প্রজননের জন্য নাজুক ঋতু (Delicate season for mating and breeding of wild animals)। বন্য প্রাণী সংরক্ষণের প্রসঙ্গ এবং রমাদান শব্দের অর্থ অনুসারে প্রতীয়মান হয় যে, Autumn or Fall equinox এর তুলনায় Spring or Vernal equinox এর মধ্যেই লাইলাতুল কদর সাব্যস্ত হওয়ার শর্ত পাওয়া যায়। অর্থাৎ লাইলাতুল কদর হচ্ছে Spring or Vernal equinox.
কুরআন নাজিলের লাইলাতুল কদর ছিল এমন একটি রাত যাতে ফজর উদয় পর্যন্ত শান্তিময় প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় ছিল (৯৭:৫)। শান্তিময় প্রাকৃতিক পরিবেশের শর্তানুসারে বুঝা যায় যে, এটি ছিল গাছিক্ব বা অন্ধকার রাতের সম্পূর্ণ বিপরীত, যেহেতু অন্ধকার রাত ভয়াবহ বিধায় তা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে (সূরা ফালাক্ব, ১১৩:৩)। সুতরাং লাইলাতুল কদর ছিল The spring equinox of brightest full supermoon glowing with the intensity of light. - এ সম্ভাবনাই সবচেয়ে দাবি রাখে। আল্লাহই মহাজ্ঞানী এবং তিনি ভালো জানেন।
যেহেতু যৌক্তিক অভিলক্ষণ অনুসারে মাসটির সাক্ষ্য দেয়ার বিষয় রয়েছে, তাই এক্ষেত্রে কুরআনের বিভিন্ন তথ্য এবং বাস্তব ঋতু ও অন্যান্য অবস্থার সমন্বয়ের ভিত্তিতেই মাসটির অভিলক্ষণ চিহ্নিত হবে। আমাদের গবেষণালব্ধ তথ্য অনুসারে এক্ষেত্রে মাসটিকে চিহ্নিত করার জন্য যেসব লক্ষণকে বিবেচনা করা প্রয়োজন তাহলো: যেন মাসটিকে বসন্তের প্রথম মাস হিসেবে সাব্যস্ত করা যায় তথা যেন মাসটির গণনা Spring equinox থেকে বা তার পূর্বাপর নিকটবর্তী সময় থেকে শুরু হতে পারে।
অবশ্য পূর্বে ওজরবশত মাসটিকে তার হুবহু অবস্থানে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কখনো কখনো অনিচ্ছাকৃতভাবে সামান্য ব্যতিক্রম হলে আমরা সেটাকে দোষনীয় হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি না। যেহেতু সূরা মুজজামমিল ৭৩:২০ আয়াতে বলা হয়েছে, “আল্লাহ রাত ও দিনের পরিমাপ নির্ধারণ করেন। তিনি জানেন যে, তোমরা তা হুবহু হিসাব করতে পার না। সুতরাং তিনি তোমাদের উপর (ওজরের ক্ষেত্রে) ক্ষমাপরবশ।”
তবে বর্তমানে বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আগে থেকেই পূর্ণিমার অবস্থান এবং Spring equinox এর তারিখ সম্পর্কে যথাযথ তথ্য জেনে নেয়া অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে। তাই বর্তমানে এ বিষয়ে অগ্রিম শতবর্ষ ক্যালেন্ডারও সংগ্রহে রাখা যেতে পারে, যেন যুগোপযোগী পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে যথাসময়ে হারাম মাসসমূহের বিধান পরিপালনের ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয়।
Full Supermoon of Spring / vernal equinox কেমন হয়ে থাকে, তা সম্পর্কে ধারণা অর্জনের জন্য নিম্নে একটি আর্টিকেল সংযুক্ত করা হলো।
Super Warm Moon: Catch its glimpse tonight
March 20, 2019 by Sameer
Hyderabad: On the horizon of Hyderabad City, residents will be able to watch the unique phenomenon of full Moon tonight but it will not be so near the Earth as it was in February last.
In astronomical terms, it is called “Super Moon” or “Full Moon”. Generally, the first Moon of the month of March is called “Warm Moon”. The Super Moon will therefore be a Warm Moon.
According to Dr. B.G. Siddarth, Director of Birla Planetarium, the Warm Moon will continue to glow with full light on the first day of the Spring.
He further told that at 9:43 p.m. tonight, “Super Warm Moon” will glow with its fullest intensity of light. It will lit the entire Sky.
It is reported that it is the proclamation of the commencement of Spring Season in the north hemisphere of the globe. It marks the beginning of Autumn Season in which trees start shedding leaves. From today onwards, temperature will start increasing. The underground creepers and earthworms will now start coming out from the ground.(১৮)
(১৮) Link: https://archive.siasat.com/news/super-warm-moon-catch-its-glimpse-tonight-1478977/
শাহরু রমাদান যেমন বসন্তের একটি মাস তেমনি শাহরু রমাদানকে অনেকে কুরআনের বসন্ত বা কুরআনময় বসন্ত নামেও চিহ্নিত করে থাকেন।(১৯)
(১৯) এ বিষয়ে ধারণা পেতে এ দুটি লিংকের আর্টিকেল দেখা যেতে পারে: https://saudigazette.com.sa/article/88822 http://en.imam-khomeini.ir/en/c104_12456/Ask_Question/Religious_Argumentation/Why_the_holy_month_of_Ramadan_is_called_as_spring_of_Quran_
উত্তর গোলার্ধ ও দক্ষিণ গোলার্ধের হারাম মাসসমূহ এবং রমাদান ও হজ্জ
উত্তর গোলার্ধের হারাম মাসসমূহ হচ্ছে উত্তর গোলার্ধের বসন্তের প্রথম মাস (রমাদান) থেকে চতুর্থ মাস পর্যন্ত। তেমনি দক্ষিণ গোলার্ধের হারাম মাসসমূহ হচ্ছে দক্ষিণ গোলার্ধের বসন্তের প্রথম মাস (রমাদান) থেকে চতুর্থ মাস পর্যন্ত। রমাদানের মাসে আল কুরআন নাজিল হয়েছে এবং তাই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, এ মাসের সাথে সম্পর্কিত সিয়ামের বিধান পালনের জন্য প্রত্যেককে নিজ নিজ অঞ্চলের সাপেক্ষে এ মাসের অভিলক্ষণ প্রত্যক্ষ করলে বা অভিজ্ঞান পেলে মাসটিকে সিয়ামের মাধ্যমে অতিবাহিত করতে হবে। যেহেতু উত্তর গোলার্ধে মার্চ মাসে এ মাসের অভিলক্ষণ পাওয়া যাবে, অন্যদিকে দক্ষিণ গোলার্ধে সেপ্টেম্বর মাসে এ মাসের অভিলক্ষণ পাওয়া যাবে, তাই উত্তর গোলার্ধের রমাদানের মাস মানে হলো মার্চ মাস এবং দক্ষিণ গোলার্ধের রমাদানের মাস মানে হলো সেপ্টেম্বর মাস।
রমাদান মাস থেকে শুরু করে চারমাস হারাম মাস। সুতরাং উত্তর গোলার্ধে মার্চের মাঝামাঝি থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত হারাম মাস। আর দক্ষিণ গোলার্ধে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত হারাম মাস। হারাম মাসসমূহে বন্য প্রাণী শিকার করা যাবে না এবং মাসগুলো বিধিবদ্ধ যুদ্ধবিরতির মাস হিসেবে সংরক্ষিত।
হজ্জের মাসসমূহ হচ্ছে কা’বা (আল বাইতুল হারাম) এর অবস্থান সাপেক্ষে তথা উত্তর গোলার্ধের রমাদান পরবর্তী তিনটি মাস। দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে যারা হজ্জ করবে তারাও উত্তর গোলার্ধের রমাদান পরবর্তী তিন মাসে কা’বায় হজ্জ করতে যাবে, যেহেতু হজ্জ মানেই হলো আল বাইতের হজ্জ তাই হজ্জের মাসসমূহ আল বাইতের অবস্থানগত ঋতুচক্র সাপেক্ষেই নির্ধারিত হবে।
সুতরাং উত্তর গোলার্ধের ক্ষেত্রে হারাম মাসসমূহ এবং সিয়ামের মাস ও হজ্জের মাসসমূহ একই সময়কালের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে দক্ষিণ গোলার্ধে হারাম মাসসমূহের মধ্যে সিয়ামের মাস অন্তর্ভুক্ত হলেও হজ্জ করার ক্ষেত্রে তাদেরকে উত্তর গোলার্ধের সাপেক্ষে নির্ধারিত হজ্জের মাসসমূহে হজ্জ করতে হবে।
সংক্ষেপে, (১) হারাম মাসসমূহ = বন্য পশু সংরক্ষণের সাথে সম্পর্কিত মাসসমূহ, এতে যুদ্ধবিগ্রহও বন্ধ থাকবে এবং হারাম মাসসমূহের প্রথম মাসে সিয়াম হবে।
(২) হজ্জের মাসসমূহ = পরিজ্ঞাত তিনটি মাস, যা রমাদানের পরবর্তী তিনটি মাস এবং তা নির্ধারিত হবে বিশ্বকেন্দ্ররূপ পবিত্র প্রতিষ্ঠান (আল বাইতুল হারাম বা কা’বা) এর ভৌগোলিক অবস্থানগত ঋতুচক্র সাপেক্ষে।
এভাবে, কা’বার ভৌগোলিক অবস্থানগত ক্ষেত্রে সিয়ামের মাস এবং হজ্জের মাসসমূহকে হারাম মাসসমূহের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত করা হয়েছে। অন্যদিকে হজ্জের মাসসমূহ সারা বিশ্বে একই হলেও, রমাদান মাস এবং হারাম মাসসমূহ স্ব-স্ব অঞ্চল সাপেক্ষে নির্ধারিত হবে।
আল কুরআনে মাসজিদ বলতে কী বুঝানো হয়েছে বা এর তাৎপর্য ও ভূমিকা কী তা অনুধাবনের জন্য প্রথমত আল কুরআনে ‘মাসজিদ’ শব্দ ধারণকারী আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।
মাসজিদ শব্দটি একবচনে ও বহুবচনে কুরআনে যেসব স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে তা নিচে উল্লেখ করা হলো।
মাসজিদ (সাজদাহর প্রতিষ্ঠান) শব্দটি ২২ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। ২:১৪৪:১৩, ২:১৪৯:৭, ২:১৫০:৭, ২:১৯১:১৫, ২:১৯৬:৬৫, ২:২১৭:১৭, ৫:২:৩৪, ৭:২৯:৯, ৭:৩১:৭, ৮:৩৪:৯, ৯:৭:১৩, ৯:১৯:৫, ৯:২৮:৯, ৯:১০৭:৩, ৯:১০৮:৫, ১৭:১:৭, ১৭:১:১০, ১৭:৭:১৫, ১৮:২১:৩২, ২২:২৫:৮, ৪৮:২৫:৬, ৪৮:২৭:৮।
মাসাজিদ (মাসজিদ এর বহুবচন) শব্দটি ৬ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। ২:১১৪:৫, ২:১৮৭:৫৩, ৯:১৭:৬, ৯:১৮:৩, ২২:৪০:২২, ৭২:১৮:২।
মাসজিদ শব্দটি একবচনে ও বহুবচনে যেসব আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে এক সাথে আয়াতগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো।
০২:১১৪, ০২:১৪৪, ০২:১৪৯, ০২:১৫০, ০২:১৮৭, ০২:১৯১, ০২:১৯৬, ০২:২১৭, ০৫:০২, ০৭:২৯, ০৭:৩১, ০৮:৩৪, ০৯:০৭, ০৯:১৭, ০৯:১৮, ০৯:১৯, ০৯:২৮, ০৯:১০৭, ০৯:১০৮, ১৭:০১, ১৭:০৭, ১৮:২১, ২২:২৫, ২২:৪০, ৪৮:২৫, ৪৮:২৬, ৭২:১৮।
এছাড়া মাসজিদ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের জন্য ‘আল বাইত’ সম্পর্কিত আয়াতসমূহও অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। এ বইয়ে হজ্জ সম্পর্কিত আয়াতসমূহে ‘আল বাইত’ প্রসঙ্গের আয়াতসমূহ উল্লেখিত হয়েছে। আর মাসজিদ শব্দ ধারণকারী আয়াতসমূহের অনুবাদ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
২:১১৪ :: আর তার চেয়ে বড় যালিম কে হতে পারে যে আল্লাহর মাসজিদসমূহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে উহাতে তাঁর নামের স্মরণ /আলোচনা করতে আর উহাকে খারাব / বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা করে। তারাই ঐসব লোক যাদের কোন অধিকারই নেই যে, উহাতে প্রবেশ করবে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় ছাড়া। তাদের জন্য আছে দুনিয়াতে লাঞ্চনা আর তাদের জন্য আছে আখিরাতে মহাশাস্তি।
২:১৪৪ :: নিশ্চয় আমি দেখেছি তোমার চেহারাকে আকাশের দিকে বারবার ফিরাতে। সুতরাং আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবো তোমার পছন্দের কিবলাতে। সুতরাং তুমি আল মাসজিদুল হারামের দিকে তোমার মুখ ফিরাও। আর যেখানেই তোমরা থাকো উহার দিকে মুখ ফিরাও। আর নিশ্চয় যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তারা জানেই যে, উহাই (অর্থাৎ আল মসজিদুল হারামকে কিবলা নির্ধারণ) তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে সঠিক। আর তাদের আমলের বিষয়ে আল্লাহ উদাসীন নন।
২:১৪৯ :: আর যেখান থেকেই তুমি বের হও আল মাসজিদুল হারামের দিকে তোমার মুখ ফিরাও। আর নিশ্চয় উহাই (আল মাসজিদুল হারাম ক্বিবলাহ হওয়ার বিষয়টি) তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে সঠিক। আর আল্লাহ তোমাদের আমলের বিষয়ে উদাসীন নন।
২:১৫০ :: আর যেখান থেকেই তুমি (রসূল) বের হও (তোমার বর্তমান কার্যনির্বাহ যেখান থেকেই করো না কেন), আল মাসজিদুল হারামের দিকে তোমার মুখ ফিরাও। আর যেখানেই তোমরা থাকো উহার দিকে মুখ ফিরাও। যেন না থাকে মানুষের নিকট তোমাদের বিরুদ্ধে কোন বিতর্কের অবকাশ। কিন্তু তাদের মধ্যকার যারা যুলুম করেছে (তারা বিতর্ক করবেই)। সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, আমাকেই ভয় করো। যেন আমি সম্পূর্ণ করি আমার নিয়ামত তোমাদের উপর। আর যেন তোমরা হিদায়াত পাও।
২:১৮৭ :: তোমাদের জন্য সিয়ামের রাতে তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি আবেগ উদ্দীপক ঘনিষ্ঠতা বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক। আল্লাহ জানেন যে, তোমরা তোমাদের নিজেদের প্রতি খিয়ানত করছো। তারপর তিনি তোমাদের তাওবা কবুল করেছেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। সুতরাং এ পর্যায়ে তোমরা তাদের সাথে সহবাস করো আর আল্লাহ তোমাদের জন্য যা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন তা অন্বেষণ করো। আর তোমরা খাও ও পান করো যতক্ষণ না তোমাদের জন্য দিগন্তের কালো রেখা থেকে ফজরের সাদা রেখা স্পষ্ট হয়। তারপর তোমরা তোমরা রাত (রাতের সূচনা) পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো। আর তোমরা যখন মাসজিদে আকিফূন (এ’তেকাফরত / আত্মনিয়োজিত, ধ্যান ও গভীর চিন্তামগ্ন এবং অবস্থানকারী) থাকো, তখন (এ’তেকাফের দিনগুলোতে দিনে-রাতে কখনো) তাদের সাথে সহবাস করো না। এগুলো আল্লাহর স্থিরিকৃত সীমাসমূহ। সুতরাং তোমরা তা লংঘনের কাছেও যেও না। এভাবে আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ মানবজাতির জন্য সুষ্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন যেন তারা আল্লাহ সচেতন হতে পারে।
২:১৯১ :: (যুদ্ধ পরিস্থিতিতে) তোমরা তাদেরকে হত্যা করো (যুদ্ধক্ষেত্রের) যেখানেই তোমরা তাদের নাগাল পাও। আর তোমরা তাদেরকে বের করে দাও যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে। ফিতনা (ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ এবং ভিন্ন ধর্ম অবলম্বনের কারণে নির্যাতন) হত্যার চেয়ে গুরুতর। তোমরা আল মাসজিদুল হারামের কাছে তাদের সাথে যুদ্ধ করো না যতক্ষণ না তারা তাতে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে। কিন্তু যদি তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাহলে তাদেরকে হত্যা করো। (অর্থাৎ তাদেরকে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিহত করো এবং আন্তর্জাতিক আদালত প্রতিষ্ঠা করে বিচারিক প্রক্রিয়ায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করো)। এরূপই (যুদ্ধের নৈতিক বিধি প্রত্যাখ্যানকারী) কাফিরদের প্রতিফল।
২:১৯৬ :: আর তোমরা আল্লাহর (সন্তুষ্টি অর্জনের) উদ্দেশ্যেই হজ্জ ও উমরা পূর্ণ করো। তবে যদি তোমরা বাধাপ্রাপ্ত হও, তাহলে হাদিয়া (উপহার) হিসেবে যা সহজ হয় (তাই যথেষ্ট)। আর তোমরা মাথামুণ্ডন করো না যতক্ষণ না হাদিয়া (উপহার) যথাস্থানে পৌঁছে। তোমাদের মধ্য থেকে যে অসুস্থ হয় বা তার মাথায় কষ্টদায়ক কিছু হয় তাহলে ফিদইয়া (বিকল্প মুক্তিপণ) হবে সিয়াম করা (অর্থাৎ রোজা রাখা) বা সদাকক্বাহ দেয়া বা নুসুক করা (অর্থাৎ ধর্মীয় বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে পশু উৎসর্গ ও সংহতিমূলক রীতি পালন করা)। অন্যদিকে যখন তোমরা নিরাপদ থাক তখন যে ব্যক্তি হজ্জ পর্যন্ত উমরা করার সুযোগ নেয়, তাহলে হাদিয়া (উপহার) হিসেবে যা সহজ হয় (তাই যথেষ্ট)। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তা পায় না (অর্থাৎ হাদিয়া পায় না বা হাদিয়া দেয়াতে অংশগ্রহণের সামর্থ্য পায় না) তাহলে (দায়িত্ব হচ্ছে) হজ্জের মধ্যে তিন দিন সিয়াম করা (রোজা রাখা) এবং সাতদিন যখন তোমরা ফিরে যাবে তখন। (তার ক্ষেত্রে) উহাই পরিপূর্ণ দশ। এ অবকাশ তার জন্য যার পরিবার পরিজন আল মাসজিদুল হারামের উপস্থিতি নয় (অর্থাৎ হারাম এলাকার বাসিন্দা নয়)। তোমরা আল্লাহ সচেতন হও। আর জেনে রাখো যে, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।
২:২১৭ :: তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে হারাম মাস (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাস) সম্পর্কে, সেটাতে যুদ্ধ করা প্রসঙ্গে। বলো, “সেটাতে (তথা কোনো হারাম মাসে) যুদ্ধ করা অনেক বড় গুনাহ। আর আল্লাহর পথ থেকে বাধা দেয়া ও তাঁর প্রতি কুফর (অবিশ্বাস ও অকৃতজ্ঞতা) করা এবং আল মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দেয়া এবং সেটার যথোপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে তা থেকে বহিষ্কার করা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় গুনাহ। আর ফিতনা (ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ এবং ভিন্ন ধর্ম অবলম্বনের কারণে নির্যাতন) হত্যার চেয়েও গুরুতর গুনাহ। আর তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে থামবে না, যতক্ষণ না তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে, যদি তাদের সাধ্যে কুলায়। আর তোমাদের মধ্য থেকে যে তার দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) থেকে ফিরে যাবে তারপর কাফির (সত্য প্রত্যাখ্যানকারী) অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করবে, তারাই এমন লোক যাদের আমলসমূহ দুনিয়াতে ও আখিরাতে বরবাদ হয়ে যাবে। আর তারাই (দোযখের) আগুনে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। তারা তাতে স্থায়ী হবে।
৫:২ :: হে মু’মিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নির্ধারিত নিদর্শনসমূহকে এবং কোনো হারাম মাসকে (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাসকে) এবং হাদিয়াকে (উপহারকে) এবং কালায়িদকে (বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধিদেরকে) অবমাননা / অবমূল্যায়ন করো না। আর আল বাইতুল হারামের (সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানের) অভিযাত্রীদেরকেও অবমাননা করো না, যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে। আর যখন তোমরা হুরুম (হারাম মাসসমূহ) এর বাহিরে থাকো তখন (স্থলভাগের) শিকার করতে পার। আর কোনো সম্প্রদায়ের এরূপ শত্রুতা যে, তারা তোমাদেরকে আল মাসজিদুল হারামে গমনে বাধা দিয়েছিল, তা যেন তোমাদেরকে অপরাধপ্রবণ না করে যে, তোমরা বাড়াবাড়ি করে ফেল। আর তোমরা সদাচার ও আল্লাহ সচেতনতার বিষয়ে একে অন্যকে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালংঘনের কাজে একে অন্যকে সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহ সচেতন হও। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।
৭:২৯ :: বলো, ‘আমার প্রভু আদেশ করেছেন ন্যায়বিচার করার জন্য’। আর তোমরা প্রত্যেক মাসজিদে তোমাদের সত্তাকে প্রতিষ্ঠা করো। আর তাঁকে (আল্লাহকে) ডাকো তাঁরই জন্য জীবনব্যবস্থাকে একনিষ্ঠ করে নিয়ে। যেভাবে তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন সেভাবে তোমরা ফিরে আসবে।
৭:৩১ :: হে আদম সন্তান, তোমরা প্রত্যেক মাসজিদে তোমাদের সৌন্দর্য (সুন্দর পোশাক) গ্রহণ করো। আর খাও ও পান করো এবং অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে ভালবাসেন না।
৮:৩৪ :: তবে এখন তাদের কী অধিকার আছে যে, তিনি তাদেরকে আযাব দিবেন না এ অবস্থায় যে, তারা বাধা দিচ্ছে আল মাসজিদুল হারাম থেকে? অথচ তারা উহার তত্ত্বাবধায়ক নয়। কেউই উহার তত্ত্বাবধায়ক নয়, আল্লাহ সচেতনগণ ছাড়া। কিন্তু তাদের অধিকাংশই (আসমানী কিতাবের) কোন জ্ঞান রাখে না।
৯:৭ :: আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে কিভাবে মুশরিকদের জন্য কোনো চুক্তি বহাল থাকবে? তাদের সাথে ছাড়া, যাদের সাথে তোমরা আল মাসজিদুল হারামের প্রাঙ্গনে চুক্তি করার পর (তারা তা ভঙ্গ করে নি), সুতরাং যতক্ষণ তারা তোমাদের জন্য (চুক্তির উপর) প্রতিষ্ঠিত থাকে, তোমরাও তাদের জন্য (চুক্তির উপর) প্রতিষ্ঠিত থাক। নিশ্চয় আল্লাহ তো আল্লাহ সচেতনদেরকেই ভালবাসেন।
৯:১৭ :: মুশরিকদের অধিকার নেই যে, তারা আল্লাহর মাসজিদসমূহের ব্যবস্থাপনা করবে। অথচ তারা নিজেরাই নিজেদের কুফরের (আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য অনুসরণের) স্বাক্ষ্য দেয়। তারাই এমন লোক যাদের আমলসমূহ বরবাদ হয়ে গেছে। আর তারা (জাহান্নামের) আগুনে স্থায়ী হবে।
৯:১৮ :: নিশ্চয় তারাই আল্লাহর মাসজিদসূহের ব্যবস্থাপনা করবে (ব্যবস্থাপনার অধিকার রাখে) যারা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায় যে, তারাই পথনির্দেশ গ্রহণকারীদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
৯:১৯ :: তোমরা কি হাজীদেরকে পানি পান করানো এবং আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনা করাকে ঐ ব্যক্তির কাজের সমান বিবেচনা করেছো যে আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান করে এবং (এর ভিত্তিতে) আল্লাহর পথে (তথা আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-ব্যবস্থা বাস্তবায়নে) সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে। তারা আল্লাহর কাছে সমান নয়। আর আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।
৯:২৮ :: হে মু’মিনগণ, নিশ্চয় মুশরিকগণ (মানসিকভাবে) অপবিত্র। সুতরাং তারা যেন তাদের এই চান্দ্রবর্ষের / চান্দ্রসৌরবর্ষের পরে আর আল মাসজিদুল হারামের কাছে আসতে না পারে। আর যদি তোমরা দরিদ্রতার আশংকা করো, তবে শীঘ্রই আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ দ্বারা স্বচ্ছল করে দিবেন, যদি তিনি ইচ্ছা করেন। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও মহাবিজ্ঞ।
৯: ১০৭ :: আর যারা মাসজিদকে গ্রহণ করেছে ক্ষতি সাধন, কুফর (সত্য প্রত্যাখ্যান) এবং মু’মিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার (তথা ঐক্যের মূলনীতিকে উপেক্ষা করার) উদ্দেশ্যে এবং সেই ব্যক্তির ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে যে আগে থেকেই আল্লাহর এবং তাঁর রসূলের (উপস্থাপিত মতাদর্শের) সাথে সাংঘর্ষিকতায় লিপ্ত হয়েছে। আর তারা কসম করে বলবে, “আমরা উত্তম কিছু করা ছাড়া অন্যরূপ ইচ্ছা করি নি”। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।
৯: ১০৮ :: তুমি কখনোই তাতে (তথা তাদের অধিগৃহীত মাসজিদে) দাঁড়াবে না। নিশ্চয় যে মাসজিদ প্রথম দিন থেকেই স্থাপিত হয়েছে আল্লাহ সচেতনতার উপর (ভিত্তি করে), সেটাই অধিক উপযোগিতা রাখে যে, তুমি সেটাতেই দাঁড়াবে। সেটাতে ঐ লোকেরা (আত্মনিয়োজিত) রয়েছে যারা পছন্দ করে যে, তারা (জীবন যাপনের ক্ষেত্রে) পবিত্রতা অর্জন করবে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকেই ভালবাসেন।
১৭:১ :: পবিত্র সেই সত্তা যিনি ভ্রমণে নিয়েছেন (ইসরা করিয়েছেন) তাঁর বান্দাকে একটি রাতে, ‘আল মসজিদুল হারাম’ থেকে ‘আল মসজিদুল আকসা’র দিকে, যার চারপাশকে বরকতময় করা হয়েছে, যেন আমি তাকে আমার নিদর্শনসমূহের থেকে দেখাই। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।
১৭:৭ :: যদি তোমরা ভাল কাজ করে থাকো, তাহলে তোমরা ভাল কাজ করেছো তোমাদের নিজেদের জন্য। আর যদি তোমরা মন্দকাজ করে থাকো, তাহলে উহাও (করেছো তোমাদের নিজেদেরই বিরুদ্ধে)। তারপর যখন এসেছে দ্বিতীয় ওয়াদার সময় (তখন আমি আমার বান্দাদেরকে প্রেরণ করেছিলাম ১৭:৫), তারা কালিমাময় করার জন্য তোমাদের মুখমন্ডলকে, আর তারা মসজিদে দাখিল হওয়ার জন্য যেমনভাবে উহাতে (মাসজিদে) দাখিল হয়েছে প্রথম বারে (পাঠানো বান্দাগণ); আর তারা ধ্বংস করার জন্য যা-ই তাদের আয়ত্তে আসে।
১৮:২১ :: আর এভাবে আমি (মানুষকে) জানিয়ে দিয়েছিলাম তাদের (আসহাবে কাহাফের) ব্যাপারে। যেন তারা জানতে পারে যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য। আর এও যে, শেষ ঘণ্টা আসবেই, উহাতে কোন সন্দেহ নেই। (উল্লেখ্য) যখন (আসহাবে কাহাফের মৃত্যুর পরবর্তীতে এ ঘটনার প্রকৃত শিক্ষা বিস্মৃত হয়ে) তারা (জনসাধারণ) তাদের করণীয় বিষয়ে পরস্পর বিবাদ করছিলো। তখন তারা (কয়েকজন) বলেছিলো, “তাদের স্মরণার্থে একটি স্মৃতিসৌধ বানাও”। তাদের প্রভুই ভাল জানেন তাদের (মর্যাদা) সম্পর্কে। (কিন্তু) যারা তাদের করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিজয়ী হয়েছে তারা বলেছিলো, “অবশ্যই আমরা গ্রহণ/ নির্মাণ করবো তাদের স্মরণার্থে একটি মাসজিদ”।
২২:২৫ :: নিশ্চয় যারা কুফর (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান) করেছে এবং আল্লাহর পথ থেকে বাধা দেয় এবং আল মাসজিদুল হারাম থেকেও বাধা দেয়, যেটাকে আমি সেটার ক্ষেত্রে আত্মনিয়োজিত স্থানীয়দের জন্য এবং সেটার প্রতি কেন্দ্রিকতার অভিব্যক্তিস্বরূপ গমনাগমনকারী অস্থানীয়দের জন্য (প্রবেশাধিকার, নিরাপত্তা বিধান ও বরকত বণ্টন বিষয়ে) সমান করেছি, এবং যে সেটার মধ্যে অন্যায়-অত্যাচার করতে ইচ্ছা করে আমি তাকে কষ্টদায়ক শাস্তির (অর্থাৎ জাহান্নামের) স্বাদ আস্বাদন করাবো।
২২:৪০ :: যাদেরকে তাদের নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধু এ কারণে যে,তারা বলে, ‘রব্বুনাল্লাহ’ (আল্লাহ আমাদের প্রভু)। আর যদি আল্লাহ (তাঁর বিধানের বা প্রাকৃতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে) মানুষকে প্রতিহত না করতেন তাদের একদল দ্বারা অন্য দলকে,তাহলে অবশ্যই বিধ্বস্ত করা হতো আশ্রম/মঠ (সওয়ামি’)(২০), আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বাণিজ্যকেন্দ্র (বিয়া’)(২১) , উপাসনালয় (সালাওয়াত)(২২) এবং মাসাজিদ(২৩) যেগুলোতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন যে তাঁকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমতাবান, শক্তিমান।
(২০) নৈতিক সংশোধন ও প্রশিক্ষণমূলক স্বল্পকালীন অবস্থানের কেন্দ্রসমূহ, খৃস্টান ধর্মাবলম্বী ও অন্যান্যদের আশ্রম/মঠ
(২১) ক্রয়বিক্রয় চুক্তি, অঙ্গীকার ও শপথ অনুষ্ঠানের কেন্দ্রসমূহ
(২২) যোগাযোগ ও সমর্থন যোগানোর কেন্দ্রসমূহ, ভজন-মন্দির, বিশেষ করে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের উপাসনাগৃহ [সালাতের স্থান]
(২৩) মাসজিদসমূহ, সাজদাহ সম্পাদনের কেন্দ্রসমূহ, আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের প্রতিষ্ঠানসমূহ
৪৮:২৫ :: তারাই এমন লোক যারা কুফর (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান) করেছে এবং তোমাদেরকে আল মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দিয়েছে এবং (কা’বায় পৌঁছানোর) হাদিয়াকে সেটার যথাস্থানে পৌঁছানো থেকে আটকে দেয়া হয়েছে। আর যদি না থাকতো এমন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারী, যাদেরকে তোমরা (মু’মিন হিসেবে) জানতে না, তাই তোমরা তাদেরকে পর্যুদস্ত করতে, তাই তাদের প্রেক্ষিতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কলংকযুক্ত হতে, (তাহলে তিনি বিরত রাখতেন না)। (তিনি বিরত রেখেছিলেন) যেন আল্লাহ তাকে তাঁর রহমতের মধ্যে প্রবেশ করান যাকে তিনি ইচ্ছা করেন। যদি তারা পৃথক থাকতো তাহলে আমি (যুদ্ধ থেকে বিরত না রেখে) তাদের মধ্যকার কাফিরদেরকে (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে) কষ্টদায়ক শাস্তি দিতাম।
৪৮:২৬ :: যখন কাফিরেরা (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যানকারীরা) তাদের অন্তরে উগ্রতা জাগিয়ে তুললো, জাহেলিয়াতের উগ্রতা, তখন আল্লাহ রসূলের ও মু’মিনদের উপর প্রশান্তি নাজিল করলেন এবং তাদের জন্য কালিমাতুত তাক্বওয়াকে (আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বনের নির্দেশ বাণীকে) অপরিহার্যরূপে কার্যকর করে দিলেন। আর তারাই ছিল এর সবচেয়ে বেশি হক্বদার এবং এর যোগ্য অধিকারী। আর আল্লাহ সকল বিষয়ে জ্ঞানী।
৭২:১৮ :: নিশ্চয় মাসজিদসমূহ আল্লাহর জন্য। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে দোয়া করো না।
মাসজিদের ভূমিকা সম্পর্কিত নির্দেশনা
মাসজিদ শব্দটির অর্থ হলো ‘সিজদার স্থান, আল্লাহর বিধিবিধান শুনা ও মানার অনুশীলন করার প্রতিষ্ঠান’। মাসজিদ সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে বুঝা যায় যে, মাসজিদ শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সালাত করার স্থান নয়, বরং এটি আল্লাহর বিধানকে বাস্তবায়ন করার সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান। আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে মাসজিদের ভূমিকা সম্পর্কিত যে নির্দেশনা পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ:
(১) মাসজিদসমূহ আল্লাহর জন্য, তাই এতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দোয়া করা যাবে না। অর্থাৎ মাসজিদকে যাবতীয় শিরকের অনুপ্রবেশ থেকে পবিত্র রাখতে হবে।
(২) যারা মাসজিদের সঠিক প্রকৃতিকে বিনষ্ট করে আল কুরআনে তাদেরকে সবচেয়ে বড় জালিম বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আল্লাহ যেভাবে তাঁর নাম স্মরণ করতে নির্দেশনা দিয়েছেন তথা আল কুরআনে যেভাবে আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে মাসজিদে সেভাবে আল্লাহকে স্মরণ করতে যারা বাধা দেয় তাদের কোনো অধিকারই নেই যে, তারা মাসজিদে প্রবেশ করবে। তবে এরূপ অপপ্রয়াস করলে ধরাশায়ী হবে বলে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকার পরিস্থিতিতেই শুধু তাদেরকে মাসজিদে প্রবেশের সুযোগ দেয়া যাবে।
(৩) বিশ্বব্যাপী বিশ্বাসীদের আদর্শিক বিশ্বকেন্দ্র (ক্বিবলাহ) হিসেবে ‘আল মাসজিদুল হারামকে’ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, যেটিকে বিশ্বব্যাপী মানবজাতির মধ্যে বিশ্বপ্রভুর বিধান বাস্তবায়নের জন্য মূল প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে। তাই বিশ্বাসীরা পৃথিবীর যে দেশেই অবস্থান করুক না কেন তাদেরকে এ কেন্দ্রের দিকে মুখ ফিরাতে হবে তথা এটিকে সাংবিধানিক কেন্দ্রের মর্যাদায় গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিতর্ককারীদের বিতর্ককে উপেক্ষা করে আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াত অনুযায়ী কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। এছাড়াও প্রত্যেক মাসজিদে স্বীয় লক্ষ্যকে সঠিক জীবনব্যবস্থার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাখতে হবে। অর্থাৎ সকল মাসজিদকেই ক্বিবলাহরূপে (উপকেন্দ্ররূপে) গ্রহণ করতে হবে। মাসজিদে গমনের ক্ষেত্রে যথাসাধ্য সুন্দর পোশাক (proper dress etiquette, official decorum and maintain of dress code) পরিধান করা উচিত।
(৪) ‘ইতিকাফে’র স্থান হিসেবেও মাসজিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের জন্য কিছু আত্মনিয়োজিত ব্যক্তিকে স্বল্পকালীন ক্রমাগত অবস্থানের তথা দিন-রাত বিশেষ কর্মসূচী বাস্তবায়নে নিমগ্ন থাকা প্রয়োজন হলে তারা মাসজিদে অবস্থান করবে। এছাড়া আল্লাহর বিধি-বিধান বুঝার বা আল্লাহর স্মরণের জন্য কিছুদিন বিশেষভাবে ধ্যানমগ্নতার সাথে অতিবাহিত করতে চাইলে মাসজিদে অবস্থান করবে। এ বিষয়টিকে ‘ইতিকাফ’ বলে। ইতিকাফ উপলক্ষে মাসজিদে অবস্থানকালে স্ত্রী সহবাস করা যাবে না।
(৫) আল মাসজিদুল হারামকে ইতিকাফকারী (তাতে ধ্যানচর্চাকারী ও কোনো নির্দিষ্ট সময়কালে সার্বক্ষণিক আত্মনিয়োজিত), তাওয়াফকারী (গমনাগমনকারী), ক্বিয়ামকারী (এর নীতি আদর্শ বাস্তবায়নকারী), রুকূকারী (এর আদর্শের প্রতি বিনত) ও সাজদাহকারীদের (এর নীতিমালা মান্যকারী ও সম্মান প্রদর্শনকারীদের) জন্য পবিত্র রাখতে হবে অর্থাৎ নীতি আদর্শ পরিপন্থী কিছু যেন তাতে সংঘটিত হতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তাই মাসজিদ হলো এসব কর্মকাণ্ড সম্পাদনের স্থান। মুসলিম উম্মাহর যাবতীয় কার্যক্রম মাসজিদ কেন্দ্রিক আবর্তিত হবে। যেমন এতে সালাত সম্পাদনের পাশাপাশি সালাত শেষে উত্তরাধিকার বণ্টনের জন্য ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে (সূরা মায়িদাহ ৫:১০৬)। এরূপ প্রতিষ্ঠানে সকাল সন্ধ্যায় আল্লাহর তাসবীহ / পবিত্রতা বর্ণনা, কুরআন শিক্ষা ও সালাতের ব্যবস্থা থাকতে হবে অর্থাৎ শিক্ষা-প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচী থাকতে হবে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য অনুদান তহবিল থেকে বণ্টন এবং পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-মীমাংসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। মাসজিদ বা আল বাইত, হজ্জ ও হাদিয়া সম্পর্কিত নির্দেশনা থেকে বুঝা যায় যে, মাসজিদে পর্যটকদের ও সাময়িক আশ্রয় গ্রহণকারীদের (তথা সর্বপ্রকার এ’তেকাফকারীর) আপ্যায়নের ব্যবস্থাও থাকবে। এতে সমষ্টিগত কার্যক্রমের জন্য নিয়মিত ও বিশেষ পরামর্শসভার ব্যবস্থা থাকবে।
(৬) আল মাসজিদুল হারাম বা সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানটির সাথে সম্পর্কিত বিশেষ নির্দেশ হলো “আল মাসজিদুল হারামের কাছে যুদ্ধ করা যাবে না, তবে যদি প্রতিপক্ষ সেখানে হামলা করে বসে তাহলে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ করা যাবে”। প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের মাধ্যমে তাদেরকে প্রতিহত করার পর আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতি লংঘন করার কারণে আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় তাদেরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে।
(৭) আল মাসজিদুল হারামের প্রাঙ্গনে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বিরতির চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। যারা ঐ চুক্তি লংঘন করবে না তাদের সাথে চুক্তির মেয়াদ পর্যন্ত যথানিয়মে চুক্তির শর্তাদি রক্ষা করতে হবে। মেয়াদান্তে পরিস্থিতি অনুসারে চুক্তি নবায়ন করা যেতে পারে।
(৮) আল মাসজিদুল হারামের অভিযাত্রীদেরকে অবমাননা করা যাবে না এবং তাদেরকে অন্যায়ভাবে বাধা প্রদান করা যাবে না। এমনকি যদি অতীতে তারা বাধা প্রদান করেছিলো এরূপ হয়, তবুও তাদের প্রতি বিদ্বেষবশত ন্যায়ের সীমালংঘন করে তাদেরকে অবমাননা করা যাবে না। কোনো জনগোষ্ঠীকে অন্যায়ভাবে আল মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা প্রদান করলে তারা বাধা প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অধিকার প্রাপ্ত হবে।
(৯) মাসজিদের ব্যবস্থাপনার অধিকার তারাই রাখে যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং শিরক করে না, আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে এবং এর ভিত্তিতে আল্লাহর পথে জান মাল দিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে। তাই এ ধরনের ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পরামর্শক্রমে যোগ্য ব্যক্তিদেরকে মাসজিদের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত করতে হবে। লক্ষণীয় যে, মাসজিদে হারামের ব্যবস্থাপনার বাহ্যিক কার্যক্রম সম্পন্ন করা, হাজীদেরকে পানি পান করানো ইত্যাদি বিষয়ের তুলনায় মাসজিদের ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যগত বিষয়ে তথা প্রকৃত নীতিমালার ভিত্তিতে কল্যাণ কার্যক্রমের বিষয়ে ভূমিকা রাখা এবং আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখা অধিক গুরুত্ব ও মর্যাদার বিষয়।
(১০) আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনাগত দায়িত্ব পালন এবং তাতে নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারের দিক থেকে সেটার স্থানীয় কর্মচারী প্রশাসন এবং অস্থানীয় গমনাগমনকারী প্রতিনিধিদের অধিকার সমান থাকবে।
(১১) ফাসাদ সৃষ্টিকারীদেরকে প্রতিহত না করলে তারা মাসজিদসমূহকে বিধ্বস্ত করে দেয়। তাই মাসজিদের সুরক্ষার প্রয়োজনে ফাসাদকারীদেরকে প্রতিহত করার জন্য তথা শান্তির জন্য যুদ্ধ পরিচালনা করা জরুরি হলে ফিতনার অবসান ঘটার পূর্ব পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। সুতরাং মাসজিদের ব্যবস্থাপনাগত কাজের অন্যতম একটি দিক হলো বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য শান্তি মিশন হিসেবে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ ও অভিযান পরিচালনা করা।
(১২) মাসজিদ থেকে বাধা প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই বেসামরিক লোকজনের ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে যুদ্ধ করার পরিস্থিতি না থাকলে যুদ্ধ না করে অন্যভাবে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা যায় কিনা সেদিকেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে লক্ষ রাখতে হবে।
(১৩) মাসজিদ বলতে কী বুঝায় এবং মাসজিদের ভূমিকা কিরূপ, তা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মাসজিদে দিরার বা ‘মানবজাতির ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে নির্মিত মাসজিদ’ সম্পর্কেও অনুধাবন করা প্রয়োজন। যে মাসজিদটি ‘প্রকৃত ঐক্যসূত্রকে বিনষ্ট করে বিভেদ সৃষ্টির জন্য, মানুষের ক্ষতি সাধনের জন্য এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উপস্থাপিত জীবনাদর্শের বিরুদ্ধতাকারী নেতৃত্বের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের জন্য’ নির্মিত হয়েছে তাকে ‘মাসজিদে দিরার’ বলা হয়। এ থেকে বুঝা যায় যে, নেতিবাচকভাবে এমন মাসজিদও হতে পারে, যা আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধতা করার জন্য স্থাপন করা হয়, সুতরাং ইতিবাচকভাবে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোই ‘আল্লাহর মাসজিদে’ পরিণত হতে পারে যা আল্লাহর বিধি-বিধান চর্চার কেন্দ্র হিসেবে কার্যকর থাকে।
আমনা اَمْنًا : আমনা শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘নিরাপত্তা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা’। আল বাইতকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘আমনা’ তথা নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে। যখন কোনো প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে বলে উল্লেখ কর হয় তখন তা দ্বারা বুঝায় ঐ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল মাসজিদুল হারাম যার ভাবগত অর্থ স্রষ্টার তরফ থেকে সাংবিধানিক ভাবে সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠান - পুরো মানবজাতির জন্য নিরাপত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সুতরাং জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-ভাষা-পেশা-সীমানা নির্বিশেষে পুরো মানবসমাজে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করাই আল মাসজিদুল হারাম প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।
আরাফাত عَرَفٰت : আরাফাত শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বহুমাত্রিক পরিচিতির স্থান’। আরাফাতকে মানবজাতির জন্য কেন্দ্রীয় পরিচিতি অনুষ্ঠানের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। হজ্জের সময় আরাফাতে অবস্থান করতে হয় এবং সর্বসাধারণ হজ্জকারীদের সাথে সংহতি বজায় রেখে আরাফাত থেকে আল মাসজিদুল হারামের দিকে যাত্রা করতে হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা-সীমানা-পেশা-জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ হজ্জে অংশগ্রহণ করবে। তারা যেন পরস্পরে পরিচিত হতে পারে, তাদের জীবনাচার বা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ও সুবিধা-অসুবিধার সাথে পারস্পরিক পরিচিতি ঘটতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন সমাধান প্রস্তাবনার সাথেও তারা পরিচিত হতে পারে, সেজন্যই আরাফাতে সমাবেশের ব্যবস্থা। যেহেতু হজ্জের উদ্দেশ্য কল্যান, সেহেতু আরাফাতে সমাবেশ ও সমাবর্তন থেকে হজ্জের বাস্তবমুখী কল্যাণকর্মের অন্যতম আনুষ্ঠানিক সুবিধা পাওয়া যায়।
আল বাইতুল হারাম الْبَيْتَ الْحَرَامَ : আল বাইতুল হারাম শব্দের অর্থ হলো ‘সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠান’। কুরআনে কা’বাকে আল বাইতুল হারাম বলা হয়েছে। আল বাইতুল হারাম হলো মানবজাতির স্রষ্টার নির্দেশিত বিধান মোতাবেক সমষ্টিগত জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত প্রতিষ্ঠান। বস্তুত এটিই হলো মানবজাতির বিশ্বকেন্দ্র। এটি তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ও চিহ্নিত।
আল মাশআরুল হারাম الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ : আল মাশআরুল হারাম-এর শাব্দিক অর্থ হলো ‘যে স্থানের মাধ্যমে হারাম এলাকার অনুভূতি সৃষ্টি হয়’। আল মাশআরুল হারাম হলো হারাম এলাকার একটি সীমানা। প্রচলিত অর্থে আরাফাত থেকে আল মাসজিদুল হারামে দিকে পথিমধ্যে মুজদালিফা নামক স্থানের একটি পাহাড়কে আল মাশআরুল হারাম বলা হয়। হজ্জের সময় এখানে অবস্থান করে আল্লাহকে স্মরণ করার নির্দেশ রয়েছে।
আল মাসজিদুল হারাম الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ : আল মাসজিদুল হারাম শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘সংরক্ষিত মাসজিদ’। কা’বাকে কেন্দ্র করে কা’বার প্রাঙ্গনে যে মাসজিদটি রয়েছে তাকে আল মাসজিদুল হারাম বলা হয়। সাধারণত মনে করা হয় মাসজিদ মানে কোনো ভবন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাসজিদ হলো যেখান থেকে কার্যাদি পরিচালনার সাথে জড়িত যাবতীয় ব্যবস্থাপনা করা হয়। সুতরাং মাসজিদ হলো প্রতিষ্ঠান। কুরআনে মুনাফিকদের কর্তৃক নির্মিত ষড়যন্ত্রের মাসজিদের (মাসজিদে দিরার) এর প্রসঙ্গও আলোচিত হয়েছে, যাকে মু’মিনদের বিরুদ্ধে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিলো। সুতরাং মাসজিদ এর ধারণা বুঝতে হলে এই ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের ধারণা থাকতে হবে। মাসজিদ একই সাথে চুক্তি করার স্থান, স্বাক্ষগ্রহন, বিচার ও বিচারের রায় প্রাদনের স্থান হিসেবে কুরআনে পরিচিতি পেয়েছে যা এ নিদের্শ করে যে এটি মুসলিমদের প্রশাসনিক কেন্দ্রের কার্যনির্বাহি স্থান। আল মাসজিদুল হারামকে মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্র বা ক্বিবলাহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। হজ্জের কার্যাদির ব্যবস্থাপনাও আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনার অংশ। আল মাসজিদুল হারাম হলো মানবজাতির মধ্যে শান্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণকর্মের সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে নির্ধারিত কুরআন নির্দেশিত সাংবিধানিক কেন্দ্র। এটিকে সাংবিধানিক কেন্দ্র হিসেবে মর্যাদার সাথে গ্রহণ করে বাস্তব সুবিধার ভিত্তিতে যে কোথাও থেকে নির্বাহী কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে বা বলা যায়, নির্বাহী পরিচালনা কেন্দ্র (সেকেন্ডারি কেন্দ্র) হিসেবে যে কোথাও থেকে কার্যক্রম পরিচালনার অবকাশ রয়েছে। তবে হজ্জ ব্যবস্থাপনা এবং মূল ক্বিবলার জন্য আল মাসজিদুল হারামকে গ্রহণ করতে হবে।
আহিল্লাহ (হিলাল) أَهِلَّة : আহিল্লাহ শব্দটি হলো হিলাল শব্দের বহুবচন। হিলাল শব্দটির শব্দমূলগত অর্থ হলো উৎসর্গের সাথে সম্পর্কিত ঘোষণা। হারাম মাসসমূহের সরু চাঁদকে (Crescent moon) হিলাল বলা হয়। অবশ্য সাধারণভাবে যে কোনো মাসের সরু বা নতুন চাঁদকে হিলাল বলা হয়। কিন্তু হিলাল শব্দের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগ হজ্জের মাসসমূহের নতুন চাঁদের প্রসঙ্গে। তাই বলা হয়েছে ‘আহিল্লাহ হলো মানবজাতির জন্য ও হজ্জের জন্য সময়সীমা নির্ণায়ক’। চান্দ্রমাসের শুরু হয় সরু বা নতুন চাঁদের মাধ্যমে। হারাম মাসসমূহের সরু চাঁদকে নির্দেশ করে হারাম মাসের ও হজ্জের ঘোষণা দিতে হয় বিধায় হারাম মাসসমূহের সরু চাঁদসমূহ ‘আহিল্লাহ’ নামে আখ্যায়িত হয়েছে।
ই’তেকাফ عَاكِف : ই’তিকাফ শব্দের অর্থ হলো ‘অবস্থান করা, স্থানীয় বাসিন্দা হওয়া, ধ্যানমগ্ন হওয়া, বিশেষ সময়সীমায় কোনো কিছুর প্রতি বিশেষ ধ্যানমগ্নতার সাথে লেগে থাকা, আত্মনিয়োজিত হওয়া’। ই’তিকাফ থেকে আকিফ শব্দটি গঠিত হয়েছে এবং আকিফ শব্দটির বহুবচন হলো আকিফূন। আকিফ বা আকিফূন মানে ই’তিকাফকারী হওয়া। মহান আল্লাহ তায়ালা নবী ইবরাহীম ও ইসমাইলকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তাঁরা ‘আল বাইতকে’ তথা কা’বা গৃহকে তাওয়াফকারী, ই’তিকাফকারী, ক্বিয়ামকারী, রুকুকারী ও সাজদাহকারীদের জন্য পরিচ্ছন্ন রাখেন। এছাড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন মাসজিদে ই’তিকাফরত থাকা অবস্থায় স্ত্রীমিলন থেকে বিরত থাকা হয়। মাসজিদে ই’তিকাফের বিষয় সিয়াম সম্পর্কিত আয়াতে উল্লেখিত হওয়ায় সাধারণত রমাদানের মাসে মাসজিদে ই’তিকাফ করা হয়। ই’তিকাফ করা একটি ঐচ্ছিক বিশেষ উপাসনা অনুষ্ঠান, তবে যে ই’তিকাফ করবে ই’তিকাফের সাথে সম্পর্কিত বিধি-নিষেধ পালন করা তার জন্য বাধ্যতামূলক।
উমরাহ عُمْرَة : উমরাহ শব্দটির শব্দমূল অনুসারে এর অর্থ হলো ’বয়স অতিবাহিত করা, বসবাস করা, পরিদর্শন করা, পরিভ্রমণ করা’। উমরাহ বিষয়টিকে হজ্জের অনুরূপভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, পার্থক্য হলো, হজ্জের মাসসমূহ ছাড়া অন্য মাসে হজ্জের অনুষ্ঠানাদি সম্পাদান করাকে উমরাহ বলা হয়। হজ্জ করাকে যেভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে উমরাহ করার বিষয়টি সেরূপ নয়।
কা’বা كَعْبَة : কা’বা শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘টাখনু’। যেমন আমরা ওজু করার সময় দুই পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধৌত করতে হয়, এক্ষেত্রে দুই পায়ের টাখনু বুঝাতে ‘কা’বা’ শব্দের দ্বিবচন ‘কা’বায়নি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। শারীরিকভাবে টাখনু মানুষের ভরকেন্দ্র বা ভারসাম্যের অঙ্গ, আর দ্বীনের ক্ষেত্রে কা’বার ভূমিকা তেমনি মানবসমাজের কল্যাণ ও নিরাপত্তার মাধ্যমে শান্তির ভারসাম্য কেন্দ্র। মানবজাতির জন্য যে কা’বা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তা হলো ‘আল বায়তুল হারাম’। অর্থাৎ এক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠানকে কা’বা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মানবজাতিকে একত্ববাদী উপাসনার কেন্দ্রে আবর্তিত রাখার জন্য এবং মানবজাতির প্রতি একত্ববাদের হিদায়াত এবং সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা হিসেবে। হজ্জ মানেই হলো আল বায়ত তথা কা’বার হজ্জ অনুষ্ঠান। হজ্জের সময় এ প্রতিষ্ঠানে তাওয়াফ বা আবর্তন করতে হয়।
ক্বালায়িদ قَلَائِد : ক্বালায়িদ (একবচনে ক্বিলাদাহ) এর প্রধান দুটি অর্থ হলো, (১) কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যোগাযোগ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিস্বরূপ ঘাড়ে বা কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়া বেল্টধারী বা ব্যাজধারী প্রতিনিধি। এই অর্থে আধুনিক পরিভাষায় এর একটি অর্থ হলো ‘রাষ্ট্রদূত’। (২) গলায় মালা পরানো কুরবানির বা মানতের পশু। কুরবানির পশুগুলো হাদিয়ার অন্তর্ভুক্ত। কুরআনে হাদিয়াকে যথাস্থানে (মাহিল্লুতে) জমা দেয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ক্বালায়িদের প্রসঙ্গে তা বলা হয়নি। কুরআনে শব্দটির প্রয়োগ পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, এতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বা প্রতিনিধি ও ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধিদেরকে বুঝাতে ক্বালায়িদ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ক্বালায়িদ সম্পর্কে কুরআনের নির্দেশনা হলো, তাদেরকে অবমাননা করা যাবে না, অন্য কথায় তাদেরকে যথাবিহিত সম্মান ও বিশেষাধিকার (due protocol) দিতে হবে। ক্বালায়িদের নির্দেশনা দেয়ার পেছনে মানবজাতিকে কল্যাণের উপর প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ক্বিবলাহ قِبْلَة : ক্বিবলাহ শব্দের অর্থ হলো ‘যে স্থানকে কেন্দ্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়, যে স্থানকে ধর্মমন্দির হিসেবে কবুল বা গ্রহণ করা হয়, যে স্থানের দিকে মুখ ফিরানো হয়, কেন্দ্রীয় উপাসনাগৃহ’। একেক ধর্মের অনুসারীরা একেক ক্বিবলাহর (অর্থাৎ নিজস্ব ধর্মীয় আদর্শ) দিকে মুখ ফিরায় এবং একে অন্যের ক্বিবলাহর অনুসরণ করে না। মুসলিমদের কর্তব্য হলো আল্লাহর আয়াতের মাধ্যমে সর্বশেষ চূড়ান্ত কিবলা হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়া ‘আল মাসজিদুল হারামের’ (আল্লাহর বিধান শুনা ও মানার সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠান) দিকে মুখ ফিরানো এবং স্পষ্ট জ্ঞান প্রাপ্তির পরও অন্যদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করা যাবে না। তবে বিভিন্ন কিবলার যে বিভিন্নতা সেটা নিরসনের মূল পন্থা কখনো কোনো একটি কিবলার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন ও অন্য কিবলাগুলোকে নাকচ করা নয়। বরং কল্যাণকর পন্থা পদ্ধতি অবলম্বনকেই মুল নীতি হিসেবে স্থির করে কল্যাণকর্মে প্রতিযোগিতা করাই একই চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছার রাজপথ। ক্বিবলাহ শব্দের মাধ্যমে ‘কেন্দ্র বা রাজধানী’ বুঝায়।
কুরআনের বক্তব্য অনুসারে, একই মূল ক্বিবলাহর সাথে সম্পর্কিত যত প্রতিষ্ঠানই স্থাপন করা হোক না কেন, তাতে একই ক্বিবলাহর বৃত্তেই পরিবৃত থাকা হয়। তাই বলা যেতে পারে ক্বিবলাহ দুই প্রকার, (১) মূল ক্বিবলাহ, মূল কেন্দ্র বা মূল রাজধানী এবং (২) উপক্বিবলাহ, উপকেন্দ্র বা উপরাজধানী। নবী মূসা ও হারূনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো যে, তাঁরা যেন মিসরে কয়েকটি গৃহ নির্মাণ করেন এবং সেগুলোকে ক্বিবলাহ বানান। এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, মুসলিম উম্মাহর জন্য আল মাসজিদুল হারাম হলো মূল ক্বিবলাহ এবং অন্য সব মাসজিদ হলো উপক্বিবলাহ। কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন প্রত্যেক মাসজিদের অনুকুলেই স্বীয় চেহারাকে প্রতিষ্ঠিত রাখা হয় এবং সুন্দর পোশাক গ্রহণ করা হয়। সংক্ষেপে বলা যায় যে, যে গৃহ বা প্রতিষ্ঠানকে (বাইত) আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধানের সমষ্টিগত অনুশীলনের জন্য মাসজিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয় সেটাকেই মু’মিনরা তাদের ক্বিবলাহ বা কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। ক্বিবলাহর দিকে চেহারা ফিরানোর আনুষ্ঠানিক রূপ হিসেবে আনুষ্ঠানিক সালাত সম্পাদনের সময় ক্বিবলাহর দিকে চেহারা ফেরানো হয়। কিন্তু এর ব্যাপক তাৎপর্য হলো: আল মাসজিদুল হারামকে সাংবিধানিক কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করা এবং কার্যকর করার জন্য লক্ষ্য স্থির করা। এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক আয়াতসমূহ হলো: ২:১৪২-১৫০, ৭:২৯-৩১, ১০:৮৭।
ক্বিয়াম قِيَامٌ : ক্বিয়াম শব্দের শাব্দিক অর্থ দাঁড়ানো। শব্দটির রূপান্তরিত অর্থ হিসেবে ইতিবাচক তাৎপর্য হলো ‘কোনো কাজের বিষেয় উদ্যোগ গ্রহণ করা’ এবং নেতিবাচক তৎপর্য হলো ‘কোনো বিষয়ে পথ চলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ানো’। যেমন ২:২০ আয়াতে শব্দটি থমকে দাঁড়ানো অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার ৪:১২৭ আয়াতে ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের প্রতি ন্যায়সঙ্গতভাবে দায়-দায়িত্ব পালনের জন্য দাঁড়াতে তথা উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ৪:১৩৫ ও ৫:৮ আয়াতে ন্যায় সাক্ষ্য দেয়ার দায়িত্বশীলতা নিয়ে দাঁড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ২:২৩৮ আয়াতে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দাঁড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সালাতে আনুষ্ঠানিকভাবে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রেও বিনীতভাবে দাঁড়ানো এ নির্দেশ পালনের একটি দিক। আবার একই সাথে এটি ব্যাপকার্থেও প্রযোজ্য। সালাতে আনুষ্ঠানিকভাবে দাঁড়ানোর বিষয়টি ৩:৩৯ ও ৪:১০২ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। আবার ব্যাপকার্থে সালাতে দাঁড়ানোর বিষয়টি আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণের জন্য দাঁড়ানোকে বুঝায়।
তাওয়াফ طَوَاف : তাওয়াফ শব্দটির শব্দমূল হচ্ছে ‘তোয়া ওয়াও ফা’। তাওয়াফ শব্দের অর্থ অনুধাবনের জন্য শব্দটি বিভিন্ন শব্দরূপে যেসব আয়াতে এসেছে তা লক্ষ করা যেতে পারে।
‘তোয়া ওয়াও ফা’ শব্দমূল থেকে যেসব শব্দ গঠিত হয়েছে নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো।
১. তূফান (বন্যা) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে। ৭:১৩৩:৩, ২৯:১৪:১৪।
২. তায়িফাহ (একটি দল বা গ্রুপ) ব্যবহৃত হয়েছে ২০ স্থানে। ৩:৬৯:২, ৩:৭২:২, ৩:১৫৪:১০, ৩:১৫৪:১২, ৪:৮১:৮, ৪:১০২:৮, ৪:১০২:১৯, ৪:১১৩:৭, ৭:৮৭:৩, ৭:৮৭:৯, ৯:৬৬:১০, ৯:৬৬:১৩, ৯:৮৩:৫, ৯:১২২:১২, ২৪:২:২৪, ২৮:৪:১০, ৩৩:১৩:৩, ৬১:১৪:২৩, ৬১:১৪:২৮, ৭৩:২০:১২।
৩. তায়িফাতাইন / তায়িফাতান (তায়িফ শব্দের দ্বিবচন, দুইটি দল বা গ্রুপ) ব্যবহৃত হয়েছে ৪ স্থানে। ৩:১২২:৩, ৬:১৫৬:৭, ৮:৭:৫, ৪৯:৯:২।
৪. তফা, ইয়াতূফু (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১, আবর্তন করা, ঘুরা, চারপাশে ঘুরাঘুরি করা, ঘুরপাক খাওয়া, ছুটাছুটি করা, ঘুরে ঘুরে বা চক্রাকারে পরিবেশন করা, চতুর্দিকে হানা দেয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ৮ স্থানে। ৩৭:৪৫:১, ৪৩:৭১:১, ৫২:২৪:১, ৫৫:৪৪:১, ৫৬:১৭:১, ৬৮:১৯:১, ৭৬:১৫:১, ৭৬:১৯:১।
৫. তায়িফ (ক্রিয়ারূপ ১ এর কর্তৃবিশেষ্য, তাওয়াফকারী, আবর্তনকারী, ঘূর্ণনকারী) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে। ২:১২৫:১৯, ২২:২৬:১৩।
৬. তায়িফ (ক্রিয়ারূপ ১ এর কর্তৃবিশেষ্য, তাওয়াফকারী, মন্দ চিন্তা এবং দুর্বিপাক বা ঘূর্ণি whirl) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে। ৭:২০১:৬, ৬৮:১৯:৩।
৭. তাওওয়াফূন (তাওওয়াফ এর বহুবচন, কর্তৃবিশেষ্য, ‘ফা’’য়াল’ প্যাটার্নে, ক্রিয়ারূপ ১ এর কর্তৃবিশেষ্য থেকে গঠিত, অধিক পরিমাণে তাওয়াফকারী বা ঘুরাফেরাকারী, তাওওয়াফূন শব্দের বিশ্লেষণ হিসেবে “বা’দুকুম আলা বা’দিন তথা একের প্রসঙ্গে অপরে বা পরস্পরের প্রসঙ্গে” শব্দের প্রেক্ষিতে পারস্পরিক প্রয়োজনে সাধারণ ঘুরাফেরা বা যাতায়াত করার অর্থ গৃহীত হয়) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে। ২৪:৫৮:৩৭।
৮. ইয়াততাওওয়াফা (ক্রিয়ারূপ ৫ তাতাওওয়াফা এর বর্তমান-ভবিষ্যতকালের রূপ, এর ক্রিয়াবিশেষ্য হচ্ছে তাতাওউফ, অন্য তাওয়াফকারীদের সাথে ধীরস্থিরভাবে তাওয়াফ করাতে নিজেকে সম্পৃক্ত করা) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে। ২:১৫৮:১৬, ২২:২৯:৬।
সুতরাং তাওয়াফ শব্দের শব্দমূল ব্যবহৃত হয়েছে মোট (২+২০+৪+৮+২+২+১+২) = ৪১ স্থানে।
তাওয়াফ শব্দের অর্থ হলো ‘আবর্তন করা, সমাবর্তন করা, বারবার যাতায়াত বা আসা যাওয়া করা, গমনাগমন করা’। হজ্জের সময় কা’বাকে কেন্দ্র করে বা কা’বা প্রাঙ্গনে তাওয়াফ বা সমাবর্তন করতে হয়, এটি একটি বাধ্যতামূলক অনুষ্ঠান। এর মাধ্যমে একই একত্ববাদী প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মানবজাতির আবর্তনের রোল প্লে অনুষ্ঠান করা হয়। কা’বার তাওয়াফের মাধ্যমে আসলে এক ধরনের মানসিক সংকল্পবদ্ধতা সৃষ্টি করা হয়, সার্বভৌম স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব ঘোষণা ও এক মানবপরিবারের ঐক্যের প্রতীক প্রতিষ্ঠানের প্রতি সন্মান প্রদর্শন নিহিত যাতে আল্লাহর বিধানের বৃত্তে মানবজাতির সাথে মিলেমিশে কার্যক্রম পরিচালনার শপথ নিহিত রয়েছে। যদি তাওয়াফের প্রভাব হজ্জকারীর বাস্তব কর্মকাণ্ডে না পড়ে, বরং সে মানুষ ও পশুপাখির বংশ ধ্বংস করার অপতৎপরতায় জড়িয়ে যায়, তাহলে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের দুর্ভোগ।
নজর (নজরানা/ মানত) نَذْرُ : নজর শব্দের অর্থ হলো ‘মানত করা’। নজর বা মানত বলতে বুঝায় যে কাজটি কারো উপর নির্দিষ্টভাবে আবশ্যিক দায়িত্ব নয়, উত্তম বা কল্যাণকর্ম থেকে এরূপ কোনো কাজকে নিজের উপর নির্দিষ্টভাবে আবশ্যিক করে নিলে; যেমন কোনো নিয়্যাত বা ওয়াদার মাধ্যমে তখন তা তার নজর বা মানত হিসেবে সাব্যস্ত হয়। যাবতীয় নজর হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত। কেউ যখন স্বত:প্রণোদিতভাবে বা অন্যের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে কোনো বিপর্যস্ত সম্প্রদায়কে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সহায়তা দেয়ার জন্য ওয়াদা করে সেটা তার একটি মানত হয়। মানত করলে তা পরিপূরণ করা বাধ্যতামূলক। অন্য কথায়, মানত করা আবশ্যিক দায়িত্ব নয়, কিন্তু মানত করলে তা পালন করা আবশ্যিক। হজ্জের কার্যাবলির মধ্যে অন্যতম একটি করণীয় হলো মানত পূর্ণ করা।
নুসুক, মানাসিক (কুরবানী) نُسُك : নুসুক ও এর প্রতিশব্দ মানসাক এর অর্থ হলো ‘ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে পশু উৎসর্গ ও সংহতিমূলক রীতিনীতি’। নুসুক এর বহুবচন হলো ‘মানাসিক’। প্রচলিতভাবে নুসুক, মানসাক বা মানসিক শব্দটিকে ‘কুরবানি’ শব্দে অনুবাদ করা হয়। হজ্জের একটি প্রধান কর্মসূচী হলো হজ্জ উপলক্ষে কুরবানি করতে হয়। কুরবানির পশুর গোশত ও রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না কিন্তু কুরবানির উদ্দেশ্য হিসেবে কার্যকর আল্লাহ সচেতনতাই তাঁর নিকট পৌঁছে। কুরবানির সাথে সম্পর্কিত আল্লাহ সচেতনতার কিছু দিক হলো আল্লাহর দেয়া নেয়ামত তাঁর নির্দেশনা অনুসারে কাজে লাগানো, আল্লাহ প্রদত্ত অধিকারের ভিত্তিতে আল্লাহর নাম নিয়ে পশু জবেহ করা এবং তার গোশত থেকে নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি যারা আবেদন করে না এবং যারা আবেদন করে এই উভয় শ্রেণির অভাবীদেরকেও তা থেকে খাওয়ার ব্যবস্থা করা। কুরবানির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক হাজীর খাদ্যসংস্থানের ব্যবস্থা যেমন হয় তেমনি একটি উপলক্ষ্যে আশপাশের অভাবীদেরকেও খাদ্য সহায়তা দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
বাক্কা بَكَّةَ : ‘বাক্কা’ শব্দটির অর্থ হলো, ‘জনসমাগম, ঘাড় ভেঙ্গে দেয়া, কিছু ছিঁড়ে ফেলা’। ‘বাক্কা’তে মানবজাতির জন্য ‘আওয়ালা বাইত’ (আদি প্রতিষ্ঠান) হিসেবে কা’বাকে স্থাপন করা হয়েছে। এতে হজ্জ অনুষ্ঠানের প্রেক্ষিতে ব্যাপক জনসমাগম হয় বিধায় বা জনসমাগমের উদ্দেশ্য রয়েছে বিধায় স্থানটির এরূপ নামকরণ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। বাইবেলেও Book of Psalms Chapter 84:6 এ ‘বাক্কা’ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বাইবেলে উল্লেখিত শব্দটি বর্তমানে ‘বাকা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাইবেলে শব্দটির উল্লেখ এবং ‘বাকা’ সম্পর্কিত প্রাচীন মানচিত্র পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে ‘বাক্কা’র অবস্থান সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য ব্যাপক তথ্যানুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
মাওয়াক্বীত مَوَاقِيتُ : মাওয়াক্বীত শব্দের অর্থ হলো ‘সময় নির্ধারণের উপায়-উপকরণ’। হজ্জের মাসসমূহ নির্ধারণের জন্য ‘আহিল্লাহ’ তথা সরু চাঁদকে মাস শুরু হওয়ার উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হয় বিধায় আহিল্লাহকে মাওয়াক্বীত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সরু চাঁদের মাধ্যমে চান্দ্র মাসের হিসাব শুরু করতে হয়। এভাবে সময় নির্ধারণ মানবজাতির বিভিন্ন সাধারণ সুবিধার্থে কাজে লাগে এবং বিশেষভাবে হজ্জের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। হজ্জের আয়োজন মানবজাতির কল্যাণার্থে বিধায় হজ্জকে চান্দ্রমাসের হিসাবকরণের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মাক্কা مَكَّةَ : ‘মাক্কা’ শব্দটির অর্থ হলো ‘পানি সংকট, দুধ বা অস্থিমজ্জা শুষে নেয়া, পাপ হ্রাস করা, অস্থিমজ্জার মতো কোনো কিছুর মধ্যস্থলে হওয়া’’। মাক্কার প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে সূরা ফাতহে, যাতে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ও তাঁর সাথে থাকা মু’মিনগণ আল মাসজিদুল হারামে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাক্কা উপত্যকার অভ্যন্তরে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মাক্কাকে বিভিন্ন আয়াতে ‘বালাদিল আমিন’ (নিরাপদ ভূখণ্ড), ‘ওয়াদিন গায়রি যী যারয়িন’ (অনুর্বর / শস্যক্ষেতহীন উপত্যকা) এবং ‘উন্মুল ক্বুরা’ (জনপদ জননী) প্রভৃতি বিশেষণে চিহ্নিত করা হয়েছে। মাক্কার বিষয়ে প্রাচীন ঐতিহাসিক বিবরণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকায় স্থানটি সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
মাক্বামু ইবরাহীম مَقَامُ إِبْرَاهِيمَ : মাক্বাম শব্দের অর্থ হলো ‘অবস্থান’। তবে বস্তুগত অবস্থানের অর্থে ‘মুক্বাম’ শব্দ ব্যবহৃত হয়, যার অর্থ হলো ঐ স্থান যেখানে একজন ব্যক্তি মুক্বীম বা প্রতিষ্ঠিত পর্যায়ে থাকে, মুসাফির বা সফররত পর্যায়ে নয়। অন্যদিকে ‘মাক্বাম’ শব্দটি অবস্তুগত অর্থে ব্যবহৃত হয়। মাক্বাম দ্বারা বুঝায় আদর্শগত অবস্থান, মর্যাদাগত অবস্থান, জবাবদিহিমূলক অবস্থান, মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান প্রভৃতি। সুতরাং ‘মাক্বামে ইবরাহীম’ বলতে বুঝায় নবী ইবরাহীমের আদর্শগত অবস্থান তথা তিনি যে আদর্শ ধারন করতেন বা যে ধরনের আদর্শিক কর্মসূচী সম্পাদনের জন্য আত্মনিবেদিত ছিলেন। ২:১২৫ এবং ৩:৯৭ আয়াতে মাক্বামে ইবরাহীমের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। প্রচলিত কথা হলো মাক্বামে ইবরাহীম বলতে একটি পাথরখণ্ডকে বুঝায় যাতে নবী ইবরাহীমের পায়ের ছাপ আছে। কিন্তু কুরআনে মাক্বাম শব্দের ব্যবহার এবং মাক্বামে ইবরাহীম সম্পর্কিত বক্তব্য অনুসারে এ প্রচলিত মতটি গ্রহণযোগ্য নয়। মাক্বামে ইবরাহীম বলতে নবী ইবরাহীমের আদর্শিক কর্মউদ্যোগকে বুঝায়। কা’বার সাথে সম্পর্কিত নিদর্শনসমূহের মধ্যে এর আবাদের জন্য নবী ইবরাহীমের আদর্শিক অবস্থান অন্যতম নিদর্শনস্বরূপ। মাক্বামে ইবরাহীমকে তথা নবী ইবরাহীমের আদর্শিক অবস্থানকে মুসল্লা হিসেবে তথা সালাত সম্বলিত নীতি-ব্যবস্থাপনা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্য কথায় যে নবী ইবরাহীমের আদর্শকে ধারণ করবে সেই প্রকৃত সালাতকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
মাসজিদ مَسْجِد : মাসজিদ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো ‘সাজদাহর স্থান’। আল কুরআনে সাজদাহ বলতে কী বুঝায় তা নির্ণয়ের জন্য মাসজিদ শব্দ ধারণকারী আয়াতসমূহকেও অধ্যয়ন করা জরুরি। অনুরূপভাবে মাসজিদ বলতে কী বুঝায় তা নির্ণয়ের জন্যও সাজদাহ শব্দ ধারণকারী আয়াতসমূহকেও অধ্যয়ন করা জরুরি। আল কুরআনে মাসজিদের ব্যাপকভিত্তিক ভূমিকার উল্লেখ রয়েছে। যাবতীয় মাসজিদের মূল কেন্দ্র হিসেবে আল মাসজিদুল হারামের অবস্থান। আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনার বিষয়সমূহের মধ্যে রয়েছে সাময়িক আশ্রয়ের জন্য বা ধ্যানমগ্নতার উদ্দেশ্যে স্বল্পকালীন অবস্থান (এ’তেকাফ), নৈরাজ্য বা ফাসাদ প্রতিরোধ এবং নিরাপত্তা প্রচেষ্টার কর্মসূচী, ফিতনা বা ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি হুমকি মোকাবিলা, ন্যায়বিচারের ব্যবস্থাকরণ, শান্তিচুক্তি, কুরবানির ব্যবস্থা, জমাকৃত হাদয়ির ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কল্যাণ কর্মসূচী বাস্তবায়ন ও সমৃদ্ধির সম্প্রসারণ এবং আল্লাহর বিধান শুনার ও মানার প্রক্রিয়া চালু রাখার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা পালন ইত্যাদি। সুতরাং মাসজিদকে বর্তমানে যেভাবে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সালাতের জন্য নির্ধারিত ঘর মনে করা হয়, সেটা মাসজিদের আসল স্বরূপ ও প্রকৃতি নয়। মাসজিদের প্রকৃত স্বরূপ হলো এটা মানবজাতির জন্য ঐক্য, শৃঙ্খলা, একত্ববাদী উপাসনা ও সমষ্টিগতভাবে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান।
মাসাবাত مَثَابَة : মাসাবাত শব্দের অর্থ হলো ‘সমাবর্তনস্থল, পুরস্কার বিতরণস্থল’। কা’বা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো এটি মানবজাতির সমাবর্তনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যকর থাকবে। প্রতি বছর হজ্জের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সমাবর্তন ঘটে থাকে। এ সমাবর্তনের মাধ্যমে বিশ্বজনীন মানব কল্যাণে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সহজ হয়। বর্তমানে হজ্জের উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতির কারণে হজ্জের মাধ্যমে যে সমাবর্তন ঘটে থাকে সেটা ফলপ্রসূ হয় না। মানবজাতির সমাবর্তন শুধুমাত্র ভিড় তৈরির জন্য হতে পারে না, বরং এর মাধ্যমে মানবজাতি প্রগতিশীলতার সাথে কল্যাণ অর্জন করবে এটাই এ সমাবর্তনের প্রকৃত উদ্দেশ্য।
রুকূ’ رُكُوْع : রুকূ’ শব্দের অর্থ হলো ‘স্বীয় দুর্বলতার প্রেক্ষিতে শক্তিমান সত্তার প্রতি বিনীত থাকা ও সশ্রদ্ধভাবে তাঁর নির্দেশনাকে গ্রহণ করে নেয়া’। রুকূ’ মূলত একটি মানসিক অবস্থার কর্মগত বহির্প্রকাশ বা কর্মের ধরনের মাধ্যমে আত্মগরিমা পরিহারের অভিব্যক্তি। কুরআনের নির্দেশনা হলো, সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে রুকূ’ করার আদেশ দিলেও তারা রুকূ’ করে না। রুকূ’কারীদের সাথে রুকূ’ করতে হবে তথা রুকূ’কারীদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা যাবে না। রুকূ’রত অবস্থায় সালাত ও যাকাত করতে হবে। প্রচলিত ধারণা হলো রুকূ’ মানে সালাতে কিয়াম ও সাজদাহর মাঝখানে সামনের দিকে এমনভাবে ঝোঁকা যে, দুই হাতের তালু দিয়ে দুই পায়ের হাঁটুকে ধরা হয় এবং এ অবস্থায় কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত ভূমির সমান্তরালে রাখা হয়। কুরআনে একবার ক্বিয়াম ও সাজদাহর মধ্যবর্তীতে রুকূর উল্লেখ থাকায় এবং ক্বিয়াম মানে দাঁড়ানো ও সাজদাহ মানে সমুচ্চ সুমহান স্রষ্টার প্রতি পরম ভক্তিভরে নত হওয়ার প্রেক্ষিতে রুকূর এ আনুষ্ঠানিক রূপ গ্রহণযোগ্য এবং পরম্পরাগতভাবে অনুশীলনকৃত। কিন্তু এটাই রুকূ’র একমাত্র রূপ নয়। কুরআনে রুকূ’র জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক রূপকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। সালাতে ক্বিয়াম ও সাজদাহর মাঝে রুকূ’ করা সঙ্গত হলেও এটিকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে সালাতে আনুষ্ঠানিকভাবে রুকূ’ করা যেতে পারে কিন্তু এটাই রুকূ’র একমাত্র অর্থ নয়, বরং রকূ’ একটি ব্যাপকভিত্তিক বিষয়।
শাআয়েরুল্লাহ (আল্লাহর উদ্দেশ্যে নির্ধারিত নিদর্শন) شَعَائِرُ اللَّهِ : শাআয়েরুল্লাহ শব্দের অর্থ হলো ‘আল্লাহর উদ্দেশ্যে নির্ধারিত নিদর্শন’। আল্লাহর বিধি-ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে যেসব নিদর্শনকে কাজে লাগানো হয় সেটাই হলো ‘শাআয়েরুল্লাহ’। যেমন কুরবানির জন্য নির্ধারিত মাংসল পশুসমূহকে শায়ায়েরুল্লাহ বলা হয়। যদি মুসলিম উম্মাহ আল্লাহর আয়াতের সাথে সঙ্গতিশীল কোনো পতাকা বা ব্যানার ব্যবহার করে যা দ্বারা আল্লাহর কোনো বিধানকে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে চেতনা জাগ্রত হয়, তাহলে সেটাও শায়ায়েরুল্লাহ এর অন্তর্ভুক্ত হবে। শায়ায়েরুল্লাহকে তথা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নির্ধারিত কোনো নিদর্শনকে অবমাননা করা একটি সাম্প্রদায়িক অপরাধ এবং কোনো সম্প্রদায় এরূপ করলে তারাও নৈতিকভাবে তাদের স্বকীয় সম্মানিত প্রতীকের সম্মান রক্ষার দাবি করার অবকাশ থেকে বঞ্চিত হয়।
শাহর شَهْرُ : শাহর শব্দের অর্থ হলো ‘চন্দ্রচক্র, চান্দ্রমাস, মাস’। চন্দ্রচক্র হিসেবে সাধারণ হিসাব হলো সরু চাঁদ থেকে একটি চান্দ্রমাসকে হিসাব করা। কিন্তু যখন চান্দ্রমাস না বুঝিয়ে সাধারণভাবে মাস বুঝানো হয়, তখন ‘শাহর’ বলতে যেকোনো দিন থেকৈ শুরু করে ক্রমাগত ৩০ দিনকে বুঝায়। চান্দ্রমাসসমূহের মধ্যে যে চারটি চান্দ্রমাস বন্য পশু-পাখির প্রজনন সম্পর্কিত কারণে তাদের জন্য নাজুক সময়কাল বা বন্য পশু-পাখির সংরক্ষণের স্বার্থে তাদেরকে শিকার করা থেকে বিরত থাকা উচিত সেগুলোকে ‘আশহুরুল হুরুম’ বা সংক্ষেপে ‘হুরুম’ বলা হয়। ‘হুরুম’ সম্পর্কিত বিধান সমগ্র বিশ্বব্যাপী প্রযোজ্য। অর্থাৎ এ মাসগুলোতে কোথাও বন্য প্রাণী নিধন করা যাবে না। আবার এই মাসগুলোতে বন্য প্রাণী নিধন থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি পারস্পরিক যুদ্ধ থেকেও বিরত থাকতে হবে, এটাই আল্লাহর নির্ধারিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতি। কিন্তু যদি কোনো পক্ষ এ যুদ্ধনীতিকে লংঘন করে অন্য পক্ষের উপর হামলা চালিয়ে বসে তাহলে যার উপর হামলা চালানো হয়েছে তার প্রতিরক্ষার জন্য সে প্রতিআক্রমণ করতে পারবে। যুদ্ধ শেষে প্রথম আক্রমণকারী পক্ষকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে বা আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে তাদের বিচার করতে হবে।
সদাক্বাহ صَدَقَة : সদাক্বাহ শব্দটির শব্দমূল ‘সদ দাল ক্বফ’ এর অর্থ হলো ‘সত্য বলা, সত্য করা, সত্য সাব্যস্ত করা, সত্য প্রতিপাদন করা, দান সদাকাহ করা’। তাই উৎপত্তিগত অর্থ অনুসারে সদাকাহর তাৎপর্য হলো ‘সত্য ব্যবস্থাকে মেনে নেয়ার প্রমাণস্বরূপ বিশেষ আর্থিক প্রদেয় যা (যেই প্রদেয়) কিছু বিশেষ ধারার মাধ্যমে প্রযুক্ত হয় এবং কিছু বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত প্রাপককে প্রদান করতে হয়। হজ্জের সময় যারা হাদিয়া জমা দেয়ার যথাস্থানে হাদিয়া পৌঁছানোর পূর্বে অসুস্থতা বা মাথায় কষ্ট থাকার কারণে মাথামুণ্ডন করবে তাদেরকে ফিদইয়াস্বরূপ সিয়াম করা বা সদাক্বাহ দেয়া বা নুসুক (কুরবানি) করার বিধান দেয়া হয়েছে।
সাজদাহ سُجُود : সাজদাহ শব্দের অর্থ হলো: মাথা নত করা, ষষ্ঠাংগ প্রণিপাত করা, উপাসনামূলক সম্মান / ভক্তি প্রদর্শন করা, কোনো কর্তৃত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, কোনো কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি প্রদানমূলক ভূমিকা পালন করা, কোনো কর্তত্বের পক্ষ থেকে আসা তথ্য নির্দেশ গ্রহণ ও ভক্তিভরে মান্য করা। কুরআন অনুসারে আকাশমন্ডলীতে ও পৃথিবীতে যারা আছে এবং সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রমন্ডলী, পাহাড়সমূহ, গাছ-গাছালি, প্রাণীসমূহ আর অনেক মানুষ আল্লাহকে সাজদাহ করে। পক্ষান্তরে অনেক মানুষ আল্লাহকে সাজদাহ না করে শাস্তিযোগ্য অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত। সাধারণত মনে করা হয় যে, সাজদাহ এর একমাত্র অর্থ ষষ্ঠাংগ প্রণিপাত। অথচ কুরআনে সাজদাহর কোনো আনুষ্ঠানিক কাঠামো নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। অর্থাৎ এক্ষেত্রে মানুষকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কারণ কুরআনে মানুষকে অযথা বাধ্যবাধকতার মাধ্যমে জীবনে জটিলতাযুক্ত করতে চাওয়া হয়নি। প্রচলিত পদ্ধতির মধ্যে ষষ্ঠাংগে প্রণিপাত আল্লাহর প্রতি উপাসনা হিসেবে গ্রহণযোগ্য। সুতরাং একটি পরম্পরাগত অনুশীলন হিসেবে এটিকে আনুষ্ঠানিক সাজদাহ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে কুরআনে সাজদাহ বলতে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সাজদাহকে বুঝানো হয়নি। বরং সাজদাহ একটি ব্যাপকভিত্তিক শব্দ। শুধুমাত্র যেখোনে পূর্বাপর বক্তব্য অনুসারে সাজদাহকে আনুষ্ঠানিক সাজদাহ হিসেবে সাব্যস্ত করার অবকাশ আছে, সেখানেই সাজদাহ বলতে আনুষ্ঠানিক সাজদাহ হিসেবে নেয়া যাবে। কুরআন অনুসারে আয়াত তিলাওয়াত করে বা শুনে সাজদাহ করতে হবে, সাজদাহতে তাসবীহ করা এবং সাজদাহর পরেও তাসবীহ করার নির্দেশনা রয়েছে।
সিয়াম صِيَامُ : সিয়াম শব্দের অর্থ হলো ‘বিরত থাকা, সংযম অবলম্বন করা’। আনুস্ঠানিক অর্থে সিয়াম বলতে বুঝায় ফজর থেকে রাত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন আচরণ থেকে বিরত থাকা। যেসব হজ্জকারীর পরিবার-পরিজন আল মাসজিদুল হারামে বাসিন্দা নয়, তারা যদি হাদিয়া জমা দিতে না পারে, সেক্ষেত্রে তাদেরকে হজ্জের সময় তিন দিন এবং হজ্জের পরে বাড়িতে ফিরে এসে সাতদিন সিয়াম পালন করতে হবে।
হাজ্জ حَجُّ : হজ্জ শব্দের অর্থ হলো ‘যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সমাধান করা, সম্মেলন করা, সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা, একই বিন্দুতে মিলিত হওয়া, কোনো কিছুর উদ্দেশ্য স্থির করা, তীর্থস্থানে যাওয়ার ইচ্ছা করা’। আল কুরআনে বর্ণিত সময়ে ও নিয়মে কা’বায় উপস্থিত হয়ে সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পরিপালন করাকে হজ্জ বলে। হজ্জে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার জন্য আলোচনা ও যুক্তি উপস্থাপন (হুজ্জাত) করা সঙ্গত কিন্তু দুই অনমনীয় পক্ষে বিভক্ত হয়ে বিতর্ক (জিদাল) করা সঙ্গত নয়। হজ্জ হলো মূলত মানবজাতির কল্যাণে বিশ্বপ্রভুর নির্দেশিত ও তাঁর নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক বিশ্ব সম্মেলন। হজ্জের যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি এই উদ্দেশ্যের দিকে লক্ষ রেখে সম্পাদন করা উচিত, অন্যথায় তা নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হবে।
হাদইয়া / হাদিয়া هَدْيَ : হাদিয়া অর্থ ‘উপহার, উপঢৌকন’। হজ্জ সম্পাদনের জন্য হাজীদেরকে কা’বায় হাদিয়া পৌঁছাতে হয়। হাদিয়ার মধ্যে অন্যতম হাদিয়া হলো কুরবানির পশু। কিন্তু কুরবানির পশু ছাড়াও আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত কোনো বিকল্প হাদিয়া বা নিজের সাধ্য ও সুবিধামতো কোনো হাদিয়া দেয়া যেতে পারে। বাস্তব পরিস্থিতি অনুসারে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রস্তাবিত ন্যুনতম মূল্যের হাদিয়াও যদি দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে যারা আল মাসজিদুল হারামের এলাকায় বসবাস করে না এরুপ হাজীদেরকে হজ্জের মধ্যে তিনদিন এবং বাড়ি ফেরার পর সাতদিন সিয়াম পালন করতে হবে।
হুদা هُدًى : হুদা শব্দের অর্থ ‘হিদায়াত, পথনির্দেশ’। আল কুরআন মানবজাতির জন্য হিদায়াত। আবার আদি প্রতিষ্ঠান (আওয়ালা বাইত) মানবজাতির জন্য হিদায়াতস্বরূপ স্থাপন করা হয়েছে। সুতরাং আদি প্রতিষ্ঠান (আওয়ালা বাইত)-এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আল কুরআনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তথ্য ও বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী হিদায়াত বা পথনির্দেশকে সহজেই গ্রহণ করতে পারার মতো অবস্থায় পৌঁছে দেয়া। আদি প্রতিষ্ঠান (আওয়ালা বাইত) স্বয়ং তাওহীদের হিদায়াত হিসেবে কাজ করে। কারণ এটির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একত্ববাদী উপাসনা এবং মানবজাতির জাতীয় ঐক্যের কেন্দ্রীয় প্রতীক হিসেবে। আদি প্রতিষ্ঠান (আওয়ালা বাইত)-এর হিদায়াত হওয়ার অর্থ এ নয় যে, প্রতিষ্ঠানটি যখন যে কর্তৃপক্ষ যেভাবে কার্যক্রম পরিচালন করে সেটাই হিদায়াত। বরং আদি প্রতিষ্ঠান (আওয়ালা বাইত)-এর হিদায়াত হওয়ার অর্থ হলো প্রতিষ্ঠানটিকে কুরআনে থাকা হিদায়াতকে বাস্তবে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে হবে এই মর্মে এটিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে হিদায়াত হিসেবে নাজিলকৃত কুরআনের সাথে সঙ্গতিশীল কাজের মাধ্যমে আদি প্রতিষ্ঠান (আওয়ালা বাইত) মানবজাতির জন্য হিদায়াতে বা পথনিদের্শক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।