উলিল আমর

বইটির পিডিএফ কপি ডাউনলোড

আল কুরআনের আলোকে উলিল আমর

মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সমষ্টিগত দায়িত্ব পালনে নেতৃত্ব ও মান্যতার নির্দেশনা

বইটি সম্পর্কে

"আল কুরআনের আলোকে উলিল আমর : মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সমষ্টিগত দায়িত্ব পালনে নেতৃত্ব ও মান্যতার নির্দেশনা" বইটিতে মুসলিমদেরকে আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব আল কুরআনের বিধি-বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করা, তাদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-ফায়সালা করা, তাদের মধ্যে সম্পদের ন্যায়সঙ্গত ও ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন করা ইত্যাদির প্রয়োজনে অবিসম্বাদিত নেতৃত্ব নির্বাচন ও তার আনুগত্য, আনুগত্য লাভের শর্ত, মুসলিমদের মধ্যে দলাদলি পরিহার করে ঐক্যবদ্ধতা ও সংঘবদ্ধতা এবং বিশ্বজনীন একক জাতিসত্তা হিসেবে ভূমিকা পালনের জন্য যেসব নির্দেশনা রয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কুরআন অনুযায়ী মহান আল্লাহ মানুষকে একই আদি পিতামাতা থেকে সৃষ্টি করে অসংখ্য নারী-পুরুষ আকারে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদেরকে বিভিন্ন সভ্যতা, সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছেন, যেন তারা পরস্পর পরিচিত হতে পারে। বর্ণ, গোত্র, পেশা, ভাষা ও দেশীয় সীমানাসমূহ মানুষের পরস্পরের পরিচিতি ও কর্মনির্বাহের সুবিধার জন্য। কিন্তু এগুলো জাতীয়তার প্রকৃত ভিত্তি বা উপাদান হতে পারে না। যারা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের তথ্য অনুসারে ঈমান এনে তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণ করে তারা মতাদর্শগত পরিচয়ে শুধুমাত্র 'মুসলিম' হিসেবে দ্বীনকে অখণ্ডভাবে ধারণ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা দ্বীনের ক্ষেত্রে পরস্পর বিচ্ছিন্নতা থেকে নিষেধ করেছেন। সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরতে হবে এবং সমষ্টিগত দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য নেতৃত্ব ও মান্যতার নির্দেশনাসমূহের অনুসরণ অপরিহার্য।

বর্তমানে বিশ্বে মুসলিম জাতি বিভিন্ন রাষ্ট্রে, মাজহাবে, ফিরক্বায়, তরিকায়, রাজনৈতিক দলাদলিতে বিভক্ত। তাদের কোনো অবিসম্বাদিত নেতা নেই, যাকে তারা মুসলিম জাতির নেতা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে বা মান্যতার প্রমাণ দিতে পারে। আর এর পরিণতিস্বরূপ বর্তমান বিশ্বে মুসলমান জাতি নৈতিকতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম অধ:পতিত অবস্থায় রয়েছে। যে মুসলিম জাতির উত্থানের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ঈমানদারির সাথে মানবজাতির কল্যাণ সাধন, ন্যায় কাজের নির্দেশ ও অন্যায় কাজে নিষেধ করা, আজ তারাই বহুবিধ অন্যায়ে জড়িত এবং তার কোনো প্রতিকার নেই। অনৈক্যের ফলে তারা জাতিগতভাবেও লাঞ্চিত, নিপীড়িত এবং নির্জীব। কিন্তু যেকোনো প্রকারে ঐক্যের চিন্তা বা নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাও কোনো বাস্তব সমাধান নয়। বরং ঐক্যের মূলনীতি তথা আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে ঐক্যের শর্ত এবং নেতৃত্বের মূলনীতি তথা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী নেতৃত্ব প্রদান ছাড়া এ অবস্থার প্রকৃত পরিবর্তন অসম্ভব। জাতীয় ঐক্যবদ্ধতা এবং উলিল আমর নির্বাচন ও তার সঠিক নীতিভিত্তিক আনুগত্যকে ঈমানের দাবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা একই সাথে তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসের প্রায়োগিক স্বরূপ। এ বইটিতে এ বিষয়গুলো আয়াতভিত্তিক উপস্থাপনার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এতে মুসলিম উম্মাহর সমষ্টিগত কার্যক্রমের ক্ষেত্রে কুরআনে থাকা শান্তিপূর্ণ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত পন্থা-পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে। আশা করা যায় বইটি কুরআনিক নির্দেশনা অনুসারে মুসলিম উম্মাহর জামিয়া বা ঐক্য এবং জাতীয় অবিসম্বাদিত নেতৃত্ব সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারবে।

অধিকতর অধ্যয়নের ভিত্তিতে বইটিতে কোনো ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি চিহ্নিত হলে বা কেউ দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক আয়াতসমূহের দ্বারা যাচাই করে পরবর্তী সংস্করণ সম্পন্ন করা হবে ইনশাআল্লাহ।

এক নজরে মূল প্রতিপাদ্য

১. আল্লাহ রব্বুল আলামীন যুগে যুগে একমাত্র আল্লাহকে রব ও ইলাহ মেনে নিয়ে তাঁর ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করা ‌ও তাগুতকে (তাঁর প্রতি বিদ্রোহী হয়ে যে নিজেই অন্যদের প্রভু সেজে বসে) বর্জন করার আহবান এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য নবী-রসূল ও কিতাব প্রেরণ করেছেন। কিতাবের মাধ্যমে তিনি মানবজাতির কাছে তাঁর পক্ষ থেকে হিদায়াত (পথনির্দেশ), যিকির (স্মরণীয় উপদেশ) ও হুকুম (আইন-বিধান) নাযিল করেছেন। আর যারা ঈমান আনবে তারা যেন ঐ বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হতে পারে সেজন্য তিনি নবী-রসূলকেই কিতাবের বিধান সমাজে কার্যকরী করার নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রদান করেছেন। এই প্রেক্ষিতে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে প্রেরণ করে তিনি তাঁকে কিতাবের নির্বাহী দায়িত্ব প্রদান করার পাশাপাশি যখন যেখানে রসূল উপস্থিত থাকবেন না তখন সেখানে রসূলের পক্ষে প্রতিনিধিত্বমূলক নেতৃত্ব প্রদানকারী উলিল আমরের আনুগত্যের নির্দেশ প্রদান করেছেন।

২. মু'মিনদের মধ্য থেকে উলিল আমর নির্বাচিত করা এবং তাঁর আনুগত্যের বিধানের মাধ্যমে ক্বিয়ামাত পর্যন্ত আল্লাহর নাযিলকৃত সর্বশেষ কিতাব আল কুরআনের বিধি-বিধান সমাজে কার্যকরী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেহেতু রসূল একজন মানুষ হিসেবে জরাজীর্ণ ব্যাধি-মৃত্যুর স্বাভাবিক নিয়মের অধীন, তাই রসূলের অবর্তমানে উলিল আমরের ব্যবস্থা একটি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা হিসেবে প্রতীয়মান হয়। রসূল যতদিন জীবিত ছিলেন তিনিই কুরআনের বিধি-বিধান বাস্তবায়নে মূল নেতৃত্ব প্রদান ও কর্তৃত্ব চর্চা করেছেন। আর কিতাব বা বিধানের পাশাপাশি রসূল ও উলিল আমর তথা নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তা হলো যেহেতু কিতাবে বিধান লিখিত কিন্তু সেই বিধান অনুযায়ী বিচার কার্যকর করা, সাক্ষ্য প্রমাণ তালাশ ও যাচাই করা, সম্পদের বণ্টন করে যার যার প্রাপ্য তার কাছে পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি কিতাবের কাজ নয়, বরং সেজন্য কিতাব অনুযায়ী কর্তৃত্ব চর্চা করার মতো ব্যক্তিসত্তা প্রয়োজন।

৩. উলিল আমরের দায়িত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ আমানাত। অন্য সব আমানাতের মতো এ আমানাতও তার যথাযথ প্রাপককে প্রদান করা তথা উপযুক্ত ব্যক্তির উপর অর্পণ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এ আমানাত অর্পণ এবং উলিল আমর হিসেবে দায়িত্ব পালন একটি সমষ্টিগত কাজ (আমরিন জামিয়িন)। মু'মিনদের মধ্যকার কর্মকাণ্ড তথা সমষ্টিগত কার্যক্রম পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন হতে হবে। সুতরাং কাউকে উলিল আমর হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ বা উলিল আমর নির্বাচিত করার বিষয়টিও পরামর্শক্রমেই নির্ধারণ করতে হবে। একজন উলিল আমরের মেয়াদকালের পর বা ওফাতের পর বা বাস্তবসম্মত বৈধ কারণে অপসারনের পর বা স্বাভাবিক পদত্যাগের পর অন্য একজন উলিল আমর নির্বাচনের বিষয়টিও পুনরায় পরামর্শের মাধ্যমে হতে হবে। কোনোক্রমে এমন পদ্ধতি অবলম্বন করা যাবে না যার ফলে উপযুক্ত ব্যক্তির হাতে আমানাত অর্পণের দায়িত্ব পালনে মৌলিক ত্রুটি ঘটে এবং পরামর্শমূলক পদ্ধতির মাধ্যমে স্বয়ং পরামর্শের স্বাভাবিক রীতিকে উপেক্ষা করা হয়। তবে এ নীতিমালা রক্ষা করে কিরূপ পদ্ধতিতে উলিল আমর নির্বাচিত করা হবে তা সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয় নি, বরং তা পরামর্শের মাধ্যমে বাস্তব পরিস্থিতির দাবি অনুসারে ও কুরআনের কোনো সীমারেখা লঙ্ঘন না করে নির্ধারণ করতে হবে।

৪. কুরআনে সমষ্টিগত বিষয় ও কার্যক্রমের ক্ষেত্রে পরামর্শের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। অনেকে পরামর্শ এবং ভোটাভুটিকে এক করে দেখলেও বাস্তবে এ দুয়ের মধ্যে তফাত রয়েছে। কারণ ভোটাভুটিতে কোনো একটি মতের পক্ষে বিপক্ষে কত জন মত প্রকাশ করেছে তার হিসাব করে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে পরামর্শের নির্দেশনার অর্থ হলো সবার মতামতকে পর্যালোচনার মাধ্যমে অধিকতর যৌক্তক মতকে গ্রহণ করার ব্যবস্থা। সবার পরামর্শ বিবেচনায় নিয়ে উলিল আমর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এবং তাতে কুরআনের কোনো নির্দেশনার কোনোরূপ লঙ্ঘন না হলে ঐ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে এবং সে বিষয়ে ভিন্নমত থাকলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেই ভিন্নমতের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান থাকবে, তবে প্রাথমিকভাবে ঐ সিদ্ধান্ত অনুসারে কার্য সম্পাদিত হবে ও তার পুন:মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে।

৫. আল্লাহর বিধান জানা ও মানার দিক থেকে যারা এগিয়ে তারাই মুত্তাকীদের ইমাম বা স্রষ্টা-সচেতনদের মধ্যে অগ্রণী ও অনুসরণীয়। মুত্তাকীদের ইমামদের থেকেই উলিল আমর নির্বাচিত হবেন। এক্ষেত্রে মু'মিনদের নির্বাচনে অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য তারা দায়ী হবে না। কারণ আল্লাহর জানানো একটি মূলনীতি হলো তিনি আমাদেরকে আমাদের সাধ্য অনুসারে দায়ী করবেন।

৬. মু'মিনরা ঈমান ও আমলে সালেহ (বিশ্বাস এবং সৎকর্ম ও যোগ্যতা-দক্ষতা অর্জন) এর ক্ষেত্রে যথাযথ মানে এলে আল্লাহ তাদেরকে পৃথিবীতে খিলাফাহ প্রদান করবেন বা ক্ষমতায়ন ঘটাবেন। সে অবস্থায় তাদের উপর অন্যদের কর্তৃত্ব চেপে থাকায় তারা আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনিরাপদ থাকবে না (২৪:৫৫)। এরূপ অবস্থায় মু'মিনদের উলিল আমর একই সাথে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি (মালিক) হিসেবেও দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবেন এবং তিনি খলীফা হিসেবেও অভিহিত হবেন। খিলাফাহর জন্য কোনো অপকৌশল ও অনিয়িমতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের অবকাশ নেই।

৭. বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহ আদর্শগতভাবে একই জাতিসত্তা এবং তাই তাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে বা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরতে হবে, আল্লাহর রজ্জু তথা তাঁর বিধানের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ হতে হবে। এটা হতে প্রথমত একই ধরনের বিশ্বাস ও কর্মনীতির দিক থেকে এবং সেই সাথে যাদের মধ্যে বাস্তব যোগাযোগ সম্ভব তাদের মধ্যে এটা সাংগঠনিক কাঠামোবদ্ধভাবেও হতে হবে। মু'মিনদের জামিয়া বা সংঘবদ্ধতা যারা আল্লাহর বিধানকে গ্রহণ করেনি তাদের থেকে পৃথক রাখতে হবে। সমগ্র বিশ্বে যদি অন্তত তিনজন মু'মিনও থাকে এবং তাদের মধ্যে বাস্তব নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো বজায় রাখার মতো অবস্থা থাকে তাহলে তাদেরকে এরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। যতটুকু এলাকায় এটা সম্প্রসারিত হবে তার সম্পূর্ণটি একটি এককে পরিণত হবে এবং এভাবে সম্ভব হলে এক পর্যায়ে এক বিশ্ব এক রাষ্ট্র এবং বর্তমানের সকল রাষ্ট্র তারই উপরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যেন বর্ণ, গোত্র, পেশা, ভাষা ও দেশীয় সীমানাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ফলে মানবজাতির মধ্যে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসন করা যায়।

৮. মানবজাতির ইতিহাসের প্রথমে তারা সবাই তাওহীদের উপর একক জাতিসত্তা (উম্মাতিন ওয়াহিদাতিন) হিসেবে ছিল। পরবর্তীতের তাদের মধ্যে শিরক ও কুফরের মাধ্যমে ইখতিলাফ বা মতভেদ তৈরি হয় এবং এভাবে তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এই ইখতিলাফের নিরসনের জন্য আল্লাহ কিতাব নাযিলের মাধ্যমে তাওহীদের পক্ষে যুক্তিপ্রমাণ এবং তাঁর বিধি-বিধান জানিয়ে দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও এবং সঠিক জ্ঞান পাওয়ার পরও মানুষ আবার পরস্পরের উপর বাড়াবাড়ি ও জিদবশত ইখতিলাফ করেছে এবং দ্বীনের ক্ষেত্রে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যারা দ্বীনের যেরূপ রূপ ও অংশ গ্রহণ করেছে তারা তা নিয়ে স্বতন্ত্র মিশনারী দলে পরিণত হয়েছে এবং তা নিয়েই তারা সন্তুষ্ট। অন্যদিকে সঠিকভাবে দ্বীনের উপর ঐক্যবদ্ধ থাকার মূলনীতি হলো দ্বীনকে তার প্রকৃত স্বরূপে ও সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করা। মু'মিনদের কর্তব্য হলো দ্বীনের উপর নিজেকে অটল অবিচল রেখে অন্যদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া (বালাগ বা প্রচার)। কিন্তু কোনো মতভেদকে জোর করে মিটিয়ে দেয়ার অবকাশ নেই, বরং আল্লাহ নিজেই কিয়ামাত দিবসে এর অনিবার্য ফায়সালা করবেন। মু'মিনরা দ্বীনের ক্ষেত্রে পরস্পর বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ পালনের জন্য সদা সচেষ্ট থাকতে হবে।

৯. উলিল আমর কুরআন অনুযায়ী পরিচালনা করতে ও বিচার-মীমাংসা করতে হবে। কুরআনের কোনো সীমা লঙ্ঘন করলে এবং সংশোধনী দেয়া সত্ত্বেও সংশোধিত না হলে তিনি উলিল আমর হিসেবে থাকবেন না। যতক্ষণ তিনি কুরআনের সীমারেখা সংরক্ষণ করে উলিল আমর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ততক্ষণ তাঁর আনুগত্য করতে হবে। এটা আল্লাহর নির্দেশ এবং ঈমান বজায় রাখার শর্ত। যদি উলিল আমরের সাথে তানাযা' বা মতবিরোধ তৈরি হয় তাহলে তা আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী রসূল ঐ দ্বন্দ্ব নিরসন করবেন। রসূলের অবর্তমানে প্রধান উলিল আমর মু'মিনদের সাথে অন্যান্য উলিল আমরের দ্বন্দ্বের মীমাংসা করবেন। আর যদি প্রধান উলিল আমরের সাথে দ্বন্দ্ব হয় এবং সেই প্রেক্ষিতে মু'মিনরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, তাহলে একটি নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষে থাকা মু'মিনদের পরিষদ তা নিরসনে ভূমিকা পালন করবেন।

১০. আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির সাথে তাঁর সম্পর্ককে তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করে 'রব্বুন নাস' (মানবজাতির প্রতিপালক, প্রভু ও বিধানদাতা), 'মালিকুন নাস' (মানবজাতির মালিক, শাসক, অধিপতি) ও 'ইলাহুন নাস' (মানবজাতির উপাস্য ও তাদের উপর সার্বভৌম সত্তা) হিসেবে প্রকাশ করেছেন। তিনি রব হিসেবে কিতাব বা বিধান নাযিল করেছেন, মালিক হিসেবে ঐ বিধান অনুযায়ী মানুষকে পরিচালনা ও তাদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-ফায়সালা করার জন্য নবী-রসূল মনোনীত করেছেন এবং শেষ নবীর পর মু'মিনদের পরামর্শক্রমে তাদের নেতৃত্বের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিকে উলিল আমর হিসেবে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা দিয়েছেন এবং ইলাহ হিসেবে মানবজাতির মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার জন্য একক বিশ্বকেন্দ্র বা মূল ক্বিবলা হিসেবে কা'বাতুল বাইতুল হারাম বা আল মাসজিদুল হারামকে নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং আল্লাহর একত্ববাদভিত্তিক সংবিধান, সরকারব্যবস্থা ও রাজধানীকে গ্রহণ করার সাথে উলিল আমরের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং যারা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব, রসূল ও উলিল আমর এবং আল মাসজিদুল হারাম ও মাসাজিদসমূহকে তাদের সংবিধান, সরকারব্যবস্থা ও সদর দপ্তর হিসেবে গ্রহণ করে সংঘবদ্ধ হবে তারাই বিশ্বজনীন মুসলিম উম্মাহ হিসেবে সাব্যস্ত হবে। তবে যারা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী নয়, তাদেরকে পৃথিবীতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি না করে তাদের ধর্মকর্ম পালনের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে।

ভূমিকা

Coming Soon

কিতাব নাযিল ও নবী-রসূল প্রেরণের ধারা

শুধু আল্লাহর ইবাদাতের আহবান, তাগুতকে বর্জন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য নবী-রসূল ও কিতাব প্রেরণ

আল কুরআন অনুসারে মানব জাতির ইতিহাসের প্রারম্ভে তাদের আদি পিতা-মাতাকে যখন পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয় তখনি আল্লাহ তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি মানুষের পথনির্দেশ পাঠাবেন, তখন যারা তা অনুসরণ করবে তারা কল্যাণপ্রাপ্ত হবে এবং যারা তা প্রত্যাখ্যান করবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই প্রেক্ষিতে তিনি যুগে যুগে মানুষের মধ্য থেকে নবী-রসূল মনোনীত করে তাদের কাছে তাঁর পক্ষ থেকে পথনির্দেশস্বরূপ কিতাব পাঠিয়েছেন। নবী-রসূলদের পাঠানো হয়েছিল মানুষের জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে। নবী-রসূলদের কাছে কিতাব নাযিলের মাধ্যমে মানুষের জন্য আল্লাহর প্রতি অভিযোগ করার আর কোনো অবকাশ থাকে নি। নবীদের মূল দাওয়াত ছিল : আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, শুধু তাঁরই ইবাদাত করতে হবে এবং তাগুতকে (যারা খোদাদ্রোহী হয়ে নিজেরাই অন্যদের প্রভু সেজে বসেছে তাদেরকে) বর্জন করতে হবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করা যাবে না। তাঁদের দায়িত্ব ছিল এ কিতাব অনুসারে মানুষের মধ্যকার মতভেদ নিরসন করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আর মানুষের দায়িত্ব হলো সকল নবী-রসূলের প্রতি এবং তাঁদের কাছে নাযিলকৃত কিতাবের প্রতি ঈমান আনা এবং নবী-রসূলের আনুগত্য করা। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয় :

২:৩৮-৩৯ :: আমি বললাম, “তোমরা সকলে এখান থেকে (পৃথিবীতে) নেমে পড়ো। তারপর যখন তোমাদের কাছে আমার পক্ষ থেকে পথনির্দেশ পৌঁছবে তখন যারা আমার পথনির্দেশ অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। আর যারা কুফর (সত্যকে প্রত্যাখ্যান) করবে এবং আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে তারাই জাহান্নামবাসী হবে এবং তারা তাতে স্থায়ী হবে।

৭:৩৫-৩৬ :: হে আদম সন্তান, যদি তোমাদের কাছে আমার পক্ষ থেকে কোনো রসূল আসে, যারা তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ বিবৃত করে, তখন যারা স্রষ্টা-সচেতন হবে এবং আত্মসংশোধন ও সৎকর্ম করবে তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। আর যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে এবং সেটার প্রতি ঔদ্ধত্য দেখাবে, তারাই জাহান্নামবাসী হবে এবং তারা তাতে স্থায়ী হবে।

২:১৩৬ :: তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা নাযিল করা হয়েছে আমাদের উপর ও যা নাযিল করা হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানদের উপর আর যা প্রদান করা হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা প্রদান করা হয়েছে তাদের রবের পক্ষ হতে (অন্যান্য) নবীগণকে। আমরা তাঁদের কারো মধ্যে পার্থক্য করি না। আর আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী’।

৩:৮৪ :: তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা নাযিল করা হয়েছে আমাদের উপর ও যা নাযিল করা হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানদের উপর আর যা প্রদান করা হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা প্রদান করা হয়েছে তাদের রবের পক্ষ হতে (অন্যান্য) নবীগণকে। আমরা তাঁদের কারো মধ্যে পার্থক্য করি না। আর আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী’।

৪:১৬৫ :: আর রাসূলগণকে (পাঠিয়েছি) সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী হিসেবে, যাতে রাসূলগণ আসার পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোনো অভিযোগ না থাকে। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

২:২১৩ :: মানুষ ছিল এক উম্মত। অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে নবীদেরকে প্রেরণ করলেন এবং সত্যসহ তাদের সাথে কিতাব নাযিল করলেন, যাতে মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত। আর তারাই তাতে মতবিরোধ করেছিল, যাদেরকে তা দেয়া হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষবশত। অতঃপর আল্লাহ নিজ অনুমতিতে মুমিনদেরকে হিদায়াত দিলেন যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছিল। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন।

৫৭:২৫ :: নিশ্চয় আমি আমার রাসূলদেরকে স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ পাঠিয়েছি এবং তাদের সাথে কিতাব ও (ন্যায়ের) মানদন্ড নাযিল করেছি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আমি আরো নাযিল করেছি লোহা, তাতে প্রচন্ড শক্তি ও মানুষের জন্য বহু কল্যাণ রয়েছে। আর যাতে আল্লাহ জেনে নিতে পারেন, কে না দেখেও তাঁকে ও তাঁর রাসূলদেরকে সাহায্য করে। অবশ্যই আল্লাহ মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী।
১০:১৩ :: আর অবশ্যই আমি তোমাদের পূর্বে বহু প্রজন্মকে ধ্বংস করেছি, যখন তারা যুলম করেছে। আর তাদের নিকট তাদের রাসূলগণ প্রমাণাদিসহ আগমন করেছিল, কিন্তু তারা ঈমান আনার ছিল না। এভাবে আমি অপরাধী কওমকে শাস্তি প্রদান করি।

৩৫:২৪ :: নিশ্চয় আমি তোমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। আর কোনো উম্মাত ছিল না এছাড়া যে, তার মধ্যে সতর্ককারী গত হয়েছে (অর্থাৎ প্রত্যেক উম্মাতের কাছেই সতর্ককারী এসেছিল)।

২৬:২০৮ :: আমি কোনো জনপদকে ধ্বংস করিনি এছাড়া যে, তার জন্য সতর্ককারী ছিল।

২৮:৫৯ :: আর তোমার প্রতিপালক কোনো জনপদকে / সভ্যতাকে ধ্বংসকারী নন, যতক্ষণ না তার কেন্দ্রে কোনো রসূল প্রেরণ করেন যে তাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করে। আর আমি কোনো জনপদকে ধ্বংসকারী নই এছাড়া যে, তার অধিবাসীরা জালিম।

১০:৪৭ :: আর প্রত্যেক উম্মাতের জন্যই রাসূল রয়েছে। তারপর যখন তাদের রসূল এসে যায় তখন তাদের মধ্যে ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে ফায়সালা হয়ে যায় এবং তাদের প্রতি কোনো জুলুম করা হয় না।

৭:১০৩-১০৫ :: তাদের পরে আমি মূসাকে প্রেরণ করেছি ফিরআউন ও তার সভাসদের কাছে আমার আয়াতসমূহসহ। কিন্তু তারা তার প্রতি জুলুম করলো। সুতরাং লক্ষ্য করো ফাসাদকারীদের পরিণতি কিরূপ হয়েছে? আর মূসা বললো, হে ফিরআউন, নিশ্চয় আমি বিশ্বপ্রভুর পক্ষ থেকে একজন রসূল। আমার উপর দায়িত্ব এই যে, আমি যেন আল্লাহর ব্যাপারে সত্য ছাড়া কিছু না বলি। নিশ্চয় আমি তোমাদের নিকট তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণসহ এসেছি। সুতরাং বানী ইসরাইলকে আমার সাথে যেতে দাও।

৪৪:১৭-১৮ :: এদের পূর্বে আমি ফিরআউনের সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছিলাম। তাদের কাছে এসেছিল এক সম্মানিত রসূল। (সে বলেছিলো,) “আল্লাহর বান্দাহদেরকে আমার কাছে অর্পণ করো। নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত রসূল।”
৪৩:৬৩ :: আর যখন ঈসা স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ এসেছিলো, সে বলেছিলো, অবশ্যই আমি তোমাদের কাছে প্রজ্ঞাসহ এসেছি এবং যে তোমরা যেসব বিষয়ে মতভেদ করছো তার কিছু বিষয়ে তোমাদের কাছে স্পষ্ট তথ্য প্রকাশ করতে পারি। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো।

২১:২৫ :: আর আমরা তোমার পূর্বেও কোনো রসূলকে প্রেরণ করি নি এছাড়া যে, আমরা তার প্রতি ওয়াহী করেছি এ মর্মে যে, ‘আমি ছাড়া কোনো ইলাহ (উপাস্য ও সার্বভৌম সত্তা) নেই, সুতরাং আমার ইবাদাত (উপাসনা ও দাসত্ব) করো’।
৩৯:৬৫-৬৬ :: আর নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি এবং যারা তোমার পূর্বে (নবী-রসূল) ছিলো তাদের প্রতি ওয়াহী করেছি যে, “নিশ্চয় যদি তুমি শিরক (আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত) করো, তাহলে তোমার কার্য বিনষ্ট হবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। বরং শুধুমাত্র আল্লাহরই ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করো এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হও।”

১৬:৩৬ :: আর নিশ্চয় আমি প্রত্যেকের উম্মাতের মধ্যে রসূল প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে, আল্লাহর ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করো এবং তাগুতকে (যারা খোদাদ্রোহী হয়ে নিজেই অন্যদের প্রভু সেজে বসে তাদেরকে) প্রত্যাখ্যান করো। তারপর তাদের মধ্যে কতককে আল্লাহ পথনির্দেশ করেছেন এবং তাদের মধ্যে কতকের উপর পথভ্রষ্টতা অবধারিত হয়েছে। সুতরাং পৃথবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো সত্যকে মিথ্যা সাব্যস্তকারীদের কিরূপ পরিণতি হয়েছিলো?

৩৯:১৭ :: আর যারা তাগুতের দাসত্ব পরিত্যাগ করেছে এবং আল্লাহর দিকে অভিমুখী হয়েছে তাদের জন্যই সুসংবাদ। সুতরাং আমার এরূপ বান্দাদেরকে সুসংবাদ দাও।

৭৯:১৭-১৯ :: ফিরআউনের কাছে যাও। নিশ্চয় সে তাগুত (পালনকর্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী) হয়েছে। তারপর তাকে বলো, “তোমার কি আগ্রহ আছে যে, তুমি পরিশুদ্ধতা অবলম্বন করবে? আর আমি তোমাকে তোমার প্রভুর দিকে পথনির্দেশ করবো, ফলে তুমি তাঁকে ভয় করবে (তাঁর সন্তুষ্টির কাজ করবে এবং অসন্তুষ্টির কাজ থেকে বিরত থাকবে)?

৭৯:২৩-২৪ :: তারপর সে (ফিরআউন) লোকদেরকে সমবেত করলো এবং ঘোষণা করলো। তারপর বললো, “আমিই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভু”।

৪৩:৫১ :: আর ফিরআউন তার ক্বওমের মধ্যে ঘোষণা দিল। সে বললো, “হে আমার ক্বওম, মিসরের রাজত্ব কি আমার নয়? আর আমার পাদদেশে বহমান এসব নদ-নদী? তোমরা কি দেখছো না?”

২৮:৩৮ :: ফিরআউন বললো, “হে পারিষদবর্গ, আমি ছাড়া তোমাদের অন্য ইলাহ (উপাস্য) আছে বলে আমি জানি না। হে হামান, তুমি আমার জন্য ইট পোড়াও এবং একটি সুউচ্চ প্রাসাদ তৈরি করো, যাতে আমি সেটাতে উঠে মূসার ইলাহকে দেখতে পারি। আর আমি তো মনে করি সে অবশ্যই মিথ্যাবাদী”।

১১:৯৬-৯৮ :: আর নিশ্চয় আমরা মূসাকে পাঠিয়েছি আমাদের আয়াতসমূহ এবং স্পষ্ট প্রমাণসহ। ফিরআউন ও তার পারিষদের কাছে। তবুও তারা ফিরআউনের কার্যনীতির অনুসরণ করেছে, অথচ ফিরআউনের কার্যনীতি সত্যসঙ্গত ছিলো না। ক্বিয়ামাত দিবসে সে তার ক্বওমের অগ্রভাগে থাকবে এবং তাদেরকে (জাহান্নামের) আগুনে উপনীত করে দেবে। আর তা অতি নিকৃষ্ট উপনীত হওয়ার স্থান যাতে তারা উপনীত হবে।

কিতাবের মাধ্যমে প্রদত্ত বিধান বাস্তবায়নে নবী-রসূলদের কর্তৃত্ব ও তাঁদের আনুগত্য

আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবসমূহ হলো মানবজাতির জন্য তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে স্মারক বা স্মরণিকা এবং তাঁর আদেশ ও আইন তথা সংবিধান সম্বলিত গ্রন্থ। আর সংবিধান কার্যকর হওয়ার জন্য নির্বাহী সত্তার প্রয়োজন যে সংবিধানের বিধিবিধান বাস্তবায়ন করে পরিচালনা করবে, বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার করবে, নেয়ামতের বণ্টন করবে, হক্ব পরিপুরণ বা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে।

এই প্রেক্ষিতে আসমানী সংবিধান বাস্তবায়নের নির্বাহী ক্ষমতা সেই নবী-রসূলদের হাতেই অর্পণ করা হয়েছিল যাদের কাছে আল্লাহ তাঁর কিতাব ও ওয়াহী নাযিল করেছিলেন। তাই নবী-রসূলগণ আল্লাহর কিতাব অনুসারে জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদের আনুগত্য করার জন্য দাবি জানিয়ে বলেছিলেন, “ফাত্তাক্বুল্লাহা ওয়া আতিউনি” অর্থাৎ “আল্লাহ সচেতন হও এবং আমার আনুগত্য করো”।

ঈমান আনার অর্থই হলো “আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ শুনা ও মানার অঙ্গীকার”। তাই মু’মিন তথা বিশ্বাসী মানুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য ছিল নবী-রসূলের আনুগত্য করা এবং তা থেকে বিমুখ না হওয়া। অন্যদিকে যারা বিমুখ হবে তাদের প্রতি নবী-রসূলদের দায়িত্ব ছিল শুধুমাত্র ‘বালাগুম মুবীন’ বা ‘সুস্পষ্ট, জ্বলজলে প্রচার’। যারা আনুগত্য করার অঙ্গীকার সত্ত্বেও বাস্তবে আনুগত্য থেকে বিমুখ হয়, তারা মু’মিন দাবিদার হলেও বাস্তবে মু’মিন নয়। তাদের আমলের দায়-দায়িত্ব তাদের উপরই বর্তাবে এবং নবী-রসূলদের উপরও নিজ নিজ আমলের দায়-দায়িত্বই বর্তাবে। আল্লাহর নাজিলকৃত বিধানের সামগ্রিক আনুগত্য করতে হবে, খণ্ডিত আনুগত্য গ্রহণযোগ্য নয়। অনুরূপভাবে মুখে আনুগত্যের দাবি করে সম্পর্ক বজায় রাখাই প্রকৃত আনুগত্য নয়, যদি বাস্তব কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা হয়। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

৬:১২৪ :: আর যখন তাদের কাছে কোনো আয়াত আসে, তখন তারা বলে, “আমরা কখনো তা বিশ্বাস করবো না, যতক্ষণ না আমাদেরকে তা দেয়া হয় যা আল্লাহর রসূলগণকে দেয়া হয়েছে”। আল্লাহই ভালো জানেন তিনি কোন পাত্রে তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব অর্পণ করবেন। যারা অপরাধ করেছে তাদের উপর শীঘ্রই আল্লাহর পক্ষ থেকে শক্তি ও সম্ভ্রমের ক্ষুদ্রতা এবং কঠিন শাস্তি আপতিত হবে, তারা যে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করতো সেই কারণে।

৬:১১৪-১১৫ :: আমি কি আল্লাহ ছাড়া কাউকে ফায়সালাকারী হিসেবে তালাশ করবো? অথচ তিনিই তোমাদের প্রতি সুবিস্তৃত স্বব্যাখ্যাত কিতাব নাযিল করেছেন। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তারা জানে যে তা তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে সত্যসহ নাযিল হয়েছে, সুতরাং তুমি সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। আর তোমার প্রভুর বাণী সত্য ও ন্যায়ের দিক থেকে পরিপূর্ণ হয়েছে। তাঁর বাণীর কোনো পরিবর্তনকারী নেই। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।

৪:৬৪-৬৫ :: আর আমি কোনো রসূল প্রেরণ করিনি এছাড়া যে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তার আনুগত্য করতে হবে। আর যদি যারা তাদের নিজেদের উপর যুলুম করেছে তারা তোমার নিকট আসতো, তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতো এবং রসূলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতো, তাহলে তারা আল্লাহকে পেতো তাওবাহ কবুলকারী ও দয়ালু। সুতরাং না (তাদের আচরণ মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়)। তোমার প্রভুর শপথ, তারা মু’মিন হিসেবে সাব্যস্ত হবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের মধ্যকার বিবাদ-বিসম্বাদের বিষয়ে তোমাকে বিচার-ফায়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ করবে, তারপর তুমি যে ফায়সালা করো সেই বিষয়ে তাদের মনের মধ্যে কোনো দ্বিধা-সংকোচ রাখবে না এবং ক্রমাগত আত্মসমর্পিত থাকবে।

৪:১০৫ :: নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি, যেন (কিতাবের মাধ্যমে) আল্লাহ তোমাকে যা (যেরূপ বিচারনীতি) দেখিয়েছেন তদনুযায়ী তুমি মানুষের মধ্যে বিচার-ফায়সালা করো। আর খিয়ানতকারীদের পক্ষে তর্ক করো না।

৫:৪৮-৫০ :: আর আমি তোমার উপর সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি, তার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবসমূহের সমর্থক (Confirmer) ও পর্যবেক্ষক-নিয়ন্ত্রক (Watcher) রূপে। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরীআত (মৌলিক বিধি) ও মিনহাজ (উন্মুক্ত পন্থা) এবং আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে (জবরদস্তিমূলকভাবে) তোমাদেরকে এক উম্মত বানাতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। সুতরাং তোমরা উত্তম-কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহরই দিকে তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন, যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে। আর তুমি তাদের মধ্যে বিচার-ফায়সালা করো আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী এবং তাদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করো না এবং তাদের বিষয়ে সাবধান থাকো যেন তোমার প্রতি আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার কোনো বিষয়ে তারা তোমাকে ফেতনায় ফেলতে না পারে। তারপর যদি তারা বিমুখ হয় তাহলে জেনে রাখো যে, নিশ্চয় আল্লাহ তাদের কতিপয় পাপের জন্য তাদেরকে শাস্তি দিতে ইচ্ছা করেন। আর নিশ্চয় অধিকাংশ মানুষ ফাসেক্ব (দুষ্কর্ম পরায়ণ)। তবে কি তারা অজ্ঞানতা ও অন্ধকার যুগের (জাহিলিয়্যাতের) বিধান তালাশ করে? আর নিশ্চিত বিশ্বাসী ক্বওমের জন্য বিধান দানে আল্লাহর চেয়ে উত্তম কে হতে পারে?

৫৭:২৫ :: নিশ্চয় আমি আমার রাসূলদেরকে স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ পাঠিয়েছি এবং তাদের সাথে কিতাব ও (ন্যায়ের) মানদন্ড নাযিল করেছি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আমি আরো নাযিল করেছি লোহা, তাতে প্রচন্ড শক্তি ও মানুষের জন্য বহু কল্যাণ রয়েছে। আর যাতে আল্লাহ জেনে নিতে পারেন, কে না দেখেও তাঁকে ও তাঁর রাসূলদেরকে সাহায্য করে। অবশ্যই আল্লাহ মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী।

৩৮:২৬ :: হে দাউদ, নিশ্চয় আমি তোমাকে পৃথিবীতে/ ভূখণ্ডে খলীফা বানিয়েছি। সুতরাং তুমি মানুষের মধ্যে সত্য (বিধান) অনুযায়ী বিচার-ফায়সালা করো এবং খেয়ালখুশির অনুসরণ করো না, কারণ তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে পথভ্রষ্ট করে দেবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে পথভ্রষ্ট হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি, তারা হিসাবের দিনকে ভুলে যাওয়ার কারণে।

২৬:১০৫-১১০ :: নূহের ক্বওম রসূলগণকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলো। যখন তাদের ভাই নূহ তাদেরকে বলেছিল, “তোমরা কি স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করবে না? নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত রসূল। সুতরাং আল্লাহর প্রতি সচেতন হও এবং আমার আনুগত্য করো। আমি তোমাদের নিকট এই (বালাগের/ প্রচারের) জন্য কোনো পারিশ্রমিক ও পারিতোষিক চাই না, আমার প্রতিদান তো জগতসমূহের প্রতিপালক-প্রভুর নিকট আছে। সুতরাং তোমরা আল্লাহর প্রতি সচেতন হও এবং আমার আনুগত্য করো”।

২৬:১২৩-১৩১ :: আদ সম্প্রদায় রসূলগণকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলো। যখন তাদের ভাই হুদ তাদেরকে বলেছিল, “তোমরা কি স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করবে না? নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত রসূল। সুতরাং আল্লাহর প্রতি সচেতন হও এবং আমার আনুগত্য করো। আমি তোমাদের নিকট এই (বালাগের/ প্রচারের) জন্য কোনো পারিশ্রমিক ও পারিতোষিক চাই না, আমার প্রতিদান তো জগতসমূহের প্রতিপালক-প্রভুর নিকট আছে। তোমরা কি প্রতিটি উঁচু স্থানে নিরর্থক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করছো? আর তোমরা এমন প্রাসাদ নির্মাণ করছো যেন তোমরা স্থায়ী হবে। আর যখন তোমরা আঘাত হানো তখন আঘাত হেনে থাকো কঠোরভাবে। সুতরাং (এসবের পরিবর্তে) তোমরা আল্লাহর প্রতি সচেতন হও এবং আমার আনুগত্য করো”।

২৬:১৪১-১৫০ :: সামুদ সম্প্রদায় রসূলগণকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলো। যখন তাদের ভাই সালেহ তাদেরকে বলেছিলো, “তোমরা কি স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করবে না? নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত রসূল। সুতরাং তোমরা আল্লাহর প্রতি সচেতন হও এবং আমার আনুগত্য করো। আমি তোমাদের নিকট এই (বালাগের/ প্রচারের) জন্য কোনো পারিশ্রমিক ও পারিতোষিক চাই না, আমার প্রতিদান তো জগতসমূহের প্রতিপালক-প্রভুর নিকট আছে। তোমাদেরকে কি নিরাপদ অবস্থায় ছেড়ে রাখা হবে, যা এখানে আছে তাতে- উদ্যানে, ঝর্ণাধারাসমূহে, শস্যক্ষেত্রে এবং সুকোমল গুচ্ছবিশিষ্ট খেজুর বাগানে? আর তোমরা নৈপুণ্যের সাথে পাহাড় কেটে গৃহ নির্মাণ করছো! সুতরাং তোমরা আল্লাহর প্রতি সচেতন হও এবং আমার আনুগত্য করো”।

২৬:১৬০-১৬৩ :: লূতের ক্বওম রসূলগণকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলো। যখন তাদের ভাই লূত তাদেরকে বলেছিলো, “তোমরা কি স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করবে না? নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত রসূল। সুতরাং আল্লাহর প্রতি সচেতন হও এবং আমার আনুগত্য করো”।

২৬:১৭৬-১৭৯ :: আয়কাবাসীরাও রসূলগণকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলো। যখন শুয়াইব তাদেরকে বলেছিলো, “তোমরা স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করবে না? নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত রসূল। সুতরাং তোমরা আল্লাহর প্রতি সচেতন হও এবং আমার আনুগত্য করো”।

৭১:১-৩ :: নিশ্চয় আমি নূহকে তার ক্বওমের কাছে রসূল হিসেবে পাঠিয়েছিলাম এ মর্মে যে, “তোমার ক্বওমকে সতর্ক করো তাদের কাছে কষ্টদায়ক শাস্তি আসার আগেই”। সে বলেছিলো, “হে আমার ক্বওম, নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্ককারী, এ মর্মে যে, তোমরা আল্লাহরই ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করো এবং তাঁর প্রতি সচেতন হও এবং আমার আনুগত্য করো”।

২০:৯০ :: আর ইতোপূর্বে হারূণ তাদেরকে (বানী ইসরাইলকে) বলেছিলো, “হে আমার ক্বওম, নিশ্চয় এর মাধ্যমে (গোবাছুর তৈরির মাধ্যমে) তোমাদেরকে ফিতনায় ফেলা হয়েছে। আর নিশ্চয় তোমাদের প্রভু দয়াময়। সুতরাং তোমরা আমার অনুসরণ করো এবং আমার নির্দেশের আনুগত্য করো”।

৪৩:৬৩ :: আর যখন ঈসা স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ এসেছিলো তখন সে বলেছিলো, “নিশ্চয় আমি তোমাদের নিকট হিকমাহ (বিজ্ঞতাপূর্ণ বিষয়) নিয়ে এসেছি এবং যেন তোমাদের কাছে তার কিছু বিষয় স্পষ্ট করতে পারি যে বিষয়ে তোমরা মতভেদ করছো। সুতরাং আল্লাহর প্রতি সচেতন হও এবং আমার আনুগত্য করো”।

৪:৮০ :: যে রসূলের আনুগত্য করে সে আল্লাহরই আনুগত্য করে। আর যে মুখ ফিরিয়ে নিবে তবে আমি তোমাকে তাদের উপর হাফীয (রক্ষক, তত্ত্বাবধায়ক) করে পাঠাইনি।

২:২৮৫ :: রসূল তার প্রতি ঈমান এনেছে যা তার কাছে তার প্রভুর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে, এবং মু’মিনরাও তাতে ঈমান এনেছে। তারা প্রত্যেকে ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর রসূলগণের প্রতি। (তারা বলে,) “আমরা তাঁর রসূলদের মধ্য থেকে কারো প্রতি পার্থক্য করি না”। আর তারা বলে, “আমরা শুনলাম এবং আনুগত্য করলাম। আমাদেরকে ক্ষমা করুন, আমাদের প্রভু, আর আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তন”।

৫:৭ :: আর স্মরণ করো তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ এবং তোমাদের ঐ অঙ্গীকার যাতে তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছো, যখন তোমরা বলেছো, “আমরা শুনলাম এবং আনুগত্য করলাম”। আর আল্লাহর প্রতি সচেতন হও। নিশ্চয় আল্লাহ অন্তরসমূহে অন্তর্নিহিত বিষয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানী।

৩৩:৩৬ :: আর কোনো মু’মিনের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোনো বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিলে সেই বিষয়ে ভিন্নরূপ (মত পোষণ ও কার্য সম্পাদন) করার ইখতিয়ার (স্বাধীনতা) নেই। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হয় সে স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হয়।

৬৪:১৬ :: তোমরা সাধ্যমতো আল্লাহর প্রতি সচেতন থাকো এবং শুনো এবং আনুগত্য করো এবং তোমাদের জন্য উত্তম (মান ও পরিমাণে পরার্থে) ব্যয় করো। আর যাকে মনের সংকীর্ণতা থেকে বাঁচানো হয়েছে তবে নিশ্চয় তারাই সফলতা লাভকারী।

৩:৩২ :: বলো, আল্লাহর ও রসূলের আনুগত্য করো। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে (তারা কাফির হিসেবে সাব্যস্ত হবে এবং) আল্লাহ কাফিরদেরকে ভালবাসেন না।

৮:২০ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা আল্লাহর ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো এবং তোমরা (নির্দেশ) শুনা সত্ত্বেও তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না।

২৪:৪৭-৫১ :: আর তারা বলে, “আমরা আল্লাহর প্রতি ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনলাম এবং আনুগত্য করলাম”। তারপর তা সত্ত্বেও তাদের একদল বিমুখ হয়ে যায়, বস্তুত তারা মু’মিন নয় (যদিও তারা নিজেদেরকে ঈমানদার দাবি করে)। আর যখন তাদেরকে আল্লাহর ও তাঁর রসূলের দিকে আহবান করা হয় তাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেয়ার জন্য তখন তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর যদি কখনো সত্য তাদের পক্ষে হয় তখন তারা তার কাছে বিনীতভাবে উপস্থিত হয়। তাদের অন্তরে কি রোগ আছে, না তারা সন্দেহ সংশয় পোষণ করে, না তারা ভয় করে যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাদের প্রতি অন্যায় করবেন? বরং তারা যালিম। নিশ্চয় মু’মিনদের বক্তব্য তো এই হয় যখন তাদেরকে আহবান করা হয় আল্লাহর ও তাঁর রসূলের দিকে তাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেয়ার জন্য তখন তারা বলে, “আমরা শুনলাম এবং আনুগত্য করলাম”। আর তারাই কল্যাণপ্রাপ্ত/ সফলতা লাভকারী।

২৪:৫৪ :: বলো, আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রসূলের আনুগত্য করো। তারপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে তার উপর তার কাজের দায়ভার এবং তোমাদের উপর তোমাদের কাজের দায়ভার। আর যদি তোমরা তার আনুগত্য করো তাহলে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর রসূলের দায়িত্ব শুধু স্পষ্ট প্রচার।

৫:৯২ :: আর তোমরা আল্লাহর ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো এবং সাবধানতা অবলম্বন করো। তারপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে জেনে রাখো যে, আমার রসূলদের উপর শুধুমাত্র স্পষ্ট প্রচার করারই দায়িত্ব রয়েছে।

৬৪:১২ :: আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রসূলের আনুগত্য করো। তারপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে আমার রসূলদের দায়িত্ব শুধুমাত্র স্পষ্ট প্রচার।

৪৭:২৫-২৬ :: নিশ্চয় যারা নিজেদের কাছে সৎপথ স্পষ্ট হবার পর তাদের পেছনের দিকে ফিরে যায়, শয়তান তাদের প্ররোচিত করেছে এবং তাদের কাছে মিথ্যে আশাবাদকে প্রলম্বিত করেছে। এটা এজন্য যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা যারা অপছন্দ করে তাদেরকে তারা বলে, আমরা কিছু বিষয়ে তোমাদের আনুগত্য করব; আর আল্লাহ তাদের গোপন ষড়যন্ত্র অবগত আছেন।

৪৮:১৬ :: পেছনে থাকা আ’রববাসীদেরকে বলো, শীঘ্রই তোমাদেরকে এক কঠোর যোদ্ধা জাতির বিরুদ্ধে আহবান করা হবে। তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে অথবা তারা আত্মসমর্পণ করবে। তখন যদি তোমরা আনুগত্য করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে উত্তম প্রতিফল দিবেন। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, যেমন পূর্বে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে, তাহলে তিনি তোমাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তি দিবেন।

মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর রিসালাতের বিশ্বজনীনতা এবং নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি

পূর্বে আল্লাহ প্রত্যেক উম্মাতের মধ্যে এবং প্রত্যেক জনপদের / সভ্যতার কেন্দ্রে রসূল প্রেরণ করেছেন। কিন্তু নবুওয়াতের সর্বশেষ পর্যায়ে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে শেষ নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে এবং তাঁকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। আর কুরআনও নাযিল করা হয়েছে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য স্মরণীয় উপদেশ সম্বলিত গ্রন্থ হিসেবে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে এ পর্যায়েও প্রত্যেক জনপদে / সভ্যতায় রসূল পাঠাতে পারতেন। কিন্তু তিনি এ পর্যায়ে বিশ্বজনীনতা ও বৈশ্বিক কেন্দ্রিকতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই জনপদসমূহের কেন্দ্রে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে রিসালাত অর্পণের জন্য বাছাই করে নিয়েছেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি প্রাথমিকভাবে এমন এক ক্বওমকে সতর্ক করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন যাদের কাছে তাঁর পূর্বে কোনো সতর্ককারী আসে নি এবং তাদের নিকটবর্তী বাপদাদাদেরকে সতর্ক করা হয় নি। তবে সেই সাথে তিনি সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্যও সতর্ককারী হিসেবে এসেছেন। এবং তিনি কুরআন দ্বারা সতর্ক করেছেন তাঁর সমসাময়িক যাদেরকে তিনি সতর্ক করতে পেরেছেন এবং এছাড়াও তাঁর সমকালে ও পরবর্তীকালে যাদের কাছেই কুরআন পৌঁছে যাবে তাদের সবাইকে তিনি কুরআন দ্বারাই সতর্ক করছেন বলে গণ্য হবে। এ প্রেক্ষিতে তাঁর পরবর্তীতে আর কারো নিকট ওয়াহি নাযিলের কোনো প্রত্যয়ন নেই বিধায় কেউ যদি মিথ্যা ওয়াহির দাবি করে তবে সে সবচেয়ে বড় জালিম বলে গণ্য হবে। এছাড়া তিনি একজন রসূল মাত্র, যার পূর্বেও অনেক রসূল গত হয়েছেন। তাই তিনি মৃত্যুবরণ করলে বা নিহত হলে উল্টোদিকে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং তাঁর কাছে নাযিল হওয়া কুরআন যাদের কাছেই পৌঁছে যাবে তারা সবাই কুরআনকে অনুসরণ করতে হবে। যারা তাদের নিকট স্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণ এসে যাওয়ার পরও মতভেদ করে দলে দলে বিভক্ত হয়ে গেছে তাদের মতো হওয়া যাবে না। আল্লাহর নির্দেশনাকে যথাযথভাবে অনুসরণের সদিচ্ছা না থাকলে আল্লাহ বিভিন্নভাবে শাস্তি প্রদান করতে পারেন, যেমন: উপর থেকে, নিচ থেকে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে এক দলের সাথে অন্য দলের সংঘর্ষের মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

২৮:৫৯ :: আর তোমার প্রভু কোনো জনপদকে ধ্বংসকারী নন, যতক্ষণ না উহার কেন্দ্রে রসূল প্রেরণ করেন, যে তাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করে। আর আমি কোনো জনপদকে ধ্বংসকারী নই, উহার অধিবাসীরা যালিম হওয়া ছাড়া।

৬:৯২ :: আর এই কিতাব (কুরআন), যা আমি নাযিল করেছি, বড় বরকতময়, যা (যেসব কিতাব) তার সামনে আছে তার (তথা পূর্বের কিতাবের) সত্যতা প্রতিপাদনকারী, এবং যেন তুমি সতর্ক করতে পারো উম্মুল ক্বুরা (জনপদ জননী/ জনপদের কেন্দ্র) এবং তার চারপাশের সবাইকে। আর যারা আখিরাতের প্রতি ঈমান আনে তারা উহার (কুরআন) প্রতি ঈমান আনে। আর তারা তাদের সালাতসমূহকে সংরক্ষণকারী।

৪২:৭ :: আর এভাবে আমি তোমার নিকট আরবী ভাষায় কুরআনকে ওয়াহি করেছি যেন তুমি সতর্ক করতে পারো উম্মুল ক্বুরা (জনপদ জননী/ জনপদের কেন্দ্র) ও তার চারপাশের সবাইকে। আর সতর্ক করতে পারো একত্রিত হওয়ার দিন সম্পর্কে যাতে কোনো সন্দেহ নেই। একদল প্রবেশ করবে জান্নাতে এবং একদল প্রবেশ করবে জাহান্নামে।

২১:১০৫-১০৭ :: আর নিশ্চয় আমি যাবূরে স্মরণীয় উপদেশের পর লিখে দিয়েছিলাম যে, আমার সৎকর্মশীল বান্দারাই পৃথিবীর উত্তরাধিকারী হবে। নিশ্চয় এর (কুরআনের) মধ্যে ইবাদাতকারী ক্বওমের জন্য পরিপূর্ণ বার্তা রয়েছে। আর আমি তোমাকে ‘রহমাতুল্লিল আলামীন’/বিশ্ববাসীর জন্য দয়াস্বরূপ প্রেরণ করেছি (অর্থাৎ রসূল হিসেবে মনোনীত করেছি)।

৯:৬১ :: আর তাদের মধ্যে রয়েছে যারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে, “সে কান পাতলা (সবার কথা শুনে)”। বলো, “কান পাতলা হওয়া (সবার কথা শুনা) তোমাদের জন্য কল্যাণকর”। সে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং মু’মিনদের প্রতি আস্থা রাখে এবং সে তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনে তাদের জন্য রহমতস্বরূপ। আর যারা আল্লাহর রসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

২৫:১ :: বড় বরকতময় সেই সত্তা যিনি তাঁর বান্দার উপর ফুরক্বান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী কুরআন) নাযিল করেছেন, যেন সে বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী (লিল আলামীনা নাযীর) হতে পারে।

২৫:৫১-৫২ :: যদি আমরা ইচ্ছা করতাম তাহলে আমরা প্রত্যেক জনপদে সতর্ককারী পাঠাতে পারতাম। সুতরাং কাফিরদের আনুগত্য করো না এবং তাদের বিরুদ্ধে উহা (নাযিলকৃত কিতাব) দ্বারা মহাসংগ্রাম (জিহাদান কাবীরা) চালিয়ে যাও।

৬:৯০ :: তারাই (উল্লেখিত নবী-রসূলগণ) এমন লোক, যাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের প্রাপ্ত হিদায়াতকে অনুসরণ করো। বলো, আমি তোমাদের কাছে এর জন্য (হিদায়াতের তথ্য পৌঁছে দেয়ার জন্য) কোনো পারিশ্রমিক-পারিতোষিক চাই না। উহা (কুরআন) তো বিশ্ববাসীর জন্য স্মরণীয় উপদেশ/স্মারক (যিকরা লিল আলামীন)।

৮১:২৭-২৮ :: উহা (কুরআন) বিশ্ববাসীর জন্য স্মরণীয় উপদেশ/স্মারক (যিকরুল্লিল আলামীন)। তোমাদের মধ্য থেকে যে সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকতে চায় তার জন্য।

২৮:৪৬ :: আর তুমি তূরের পাশে উপস্থিত ছিলে না, যখন আমি (মূসাকে) ডেকেছিলাম। কিন্তু এটা তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে রহমাত/দয়া (কুরআন), যেন তুমি এমন এক ক্বওমকে সতর্ক করতে পারো, যাদের কাছে তোমার আগে কোনো সতর্ককারী আসে নি, যেন তারা স্মরণীয় উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।

৩২:৩ :: নাকি তারা বলে, সে (রসূল) উহা (কুরআন) রচনা করেছে? বরং তা সত্য, তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে। যেন তুমি এমন এক ক্বওমকে সতর্ক করতে পারো, যাদের কাছে তোমার আগে কোনো সতর্ককারী আসে নি, যেন তারা হিদায়াত পেতে পারে।

৩৬:৫-৬ :: (কুরআন) পরাক্রমশালী দয়ালু সত্তার (আল্লাহর) পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। যেন তুমি এমন এক ক্বওমকে সতর্ক করতে পারো, যাদের (নিকটবর্তী) বাপদাদাদেরকে সতর্ক করা হয়নি, তাই তারা অসচেতন হয়ে রয়েছে।

৪:৭৯ :: তোমার কাছে যে কল্যাণ পৌঁছে তা আল্লাহর (অনুগ্রহ) থেকে, আর যে অকল্যাণ তোমার কাছে পৌঁছে তা তোমার নিজের (দুর্বলতা) থেকে। আর আমি তোমাকে মানবজাতির জন্য রাসূলরূপে প্রেরণ করেছি এবং সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ যথেষ্ট।

৪:১৭০ :: হে মানুষ, অবশ্যই তোমাদের নিকট রাসূল এসেছে, তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে সত্য নিয়ে। সুতরাং তোমরা ঈমান আনো, তা তোমাদের জন্য উত্তম হবে। আর যদি কুফর কর, তবে নিশ্চয় আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা রয়েছে, তা আল্লাহর আয়ত্তে এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

৭:১৫৭-১৫৮ :: যারা অনুসরণ করে রাসূলের, যে উম্মী নবী (রসূলান নাবীয়্যাল উম্মীয়্যা) যার গুণাবলী তারা নিজদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তু হারাম করে। আর তাদের থেকে বোঝা ও শৃংখল- যা তাদের উপরে ছিল- অপসারণ করে। সুতরাং যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং তার সাথে যে আলো (কুরআন) নাযিল করা হয়েছে তা অনুসরণ করে তারাই সফলকাম। বলো, ‘হে মানুষ, আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল, যার রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ (সার্বভৌম ও অলৌকিক ক্ষমতায় প্রয়োজন পূর্ণকারী ও উপাস্য) নেই। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু দেন। সুতরাং তোমরা ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি ও তাঁর প্রেরিত উম্মী নবীর প্রতি, যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীসমূহের প্রতি ঈমান রাখে। আর তোমরা তার অনুসরণ করো, আশা করা যায়, তোমরা হিদায়াত লাভ করবে।

৩৪:২৮ :: আর তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জ্ঞান রাখে না।

৩৩:৪০ :: মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যকার কোনো পুরুষের পিতা নয়। বরং সে আল্লাহর রসূল এবং শেষ নবী। আর আল্লাহ সকল বিষয়েই জ্ঞানী।

৬:৯৩ :: তার চেয়ে বড় জালিম কে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে অথবা বলে, “আমার উপর ওয়াহী এসেছে” অথচ সত্য কথা হচ্ছে তার উপর কোনো ওয়াহী আসে নি; এবং যে বলে, “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন শীঘ্রই আমিও অনুরূপ জিনিস নাযিল (রচনা) করবো।”? (তুমি তাদের পরিণতি অনুভব করতে) যদি তুমি দেখতে পারতে (ঐ অবস্থা-) যখন এমন জালিমেরা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরায় এবং ফেরেশতারা হাত বাড়িয়ে বলে, “তোমাদের প্রাণগুলো বের করে দাও। আজ তোমাদেরকে অপমানজনক শাস্তি দেয়া হবে। তোমরা সত্যতা/ সঠিক তথ্য ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে যা (যে মিথ্যা) বলেছো তার কারণে এবং তাঁর আয়াতের মোকাবেলায় ঔদ্ধত্য করার কারণে।”

৬:১৯ :: বলো, সাক্ষ্যদানে সর্বশ্রেষ্ঠ কে? বলো, আল্লাহ আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী। আর আমার নিকট এ কুরআন ওহী করা হয়েছে যেন আমি এর দ্বারা সতর্ক করি তোমাদেরকে এবং তাদেরকেও যাদের কাছে তা পৌঁছে যায়। তোমরা কি সাক্ষ্য দিচ্ছেো যে, আল্লাহ ছাড়াও আরো ইলাহ (সার্বভৌমত্বের অধিকারী, অলৌকিক ক্ষমতায় প্রয়োজন পূরণকারী ও উপাস্য) আছে? বলো, আমি সেই সাক্ষ্য দিই না। বলো, নিশ্চয় তিনি একমাত্র ইলাহ। আর তোমরা যে শিরক (অংশীদার স্থাপন) করো আমি তা থেকে মুক্ত।

৩:১৪৪ :: আর মুহাম্মাদ একজন রসূল ছাড়া কিছু নয়। তার পূর্বে অনেক রসূল গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মৃত্যুবরণ করে অথবা নিহত হয়, তাহলে কি তোমরা দুই পায়ের গোাড়ালির উপর ভর করে বিপরীত দিকে ফিরে যাবে? আর যে তার দুই পায়ের গোড়ালির উপর ভর করে বিপরীত দিকে ফিরে যাবে, সে আল্লাহর কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবেন।

৩:১০৫ :: আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা বিভিন্ন ফিরক্বায় বিভক্ত হয়ে গেছে এবং তাদের নিকট স্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণ আসা সত্ত্বেও মতভেদ করেছে। আর তাদের জন্যই রয়েছে মহাশাস্তি।

৬:৬৫ :: বলো, তিনি সক্ষম তোমাদেরকে শাস্তি দিতে তোমাদের উপর থেকে অথবা তোমাদের পাদদেশ থেকে অথবা তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করতে এবং এক দলকে অন্য দলের সংঘর্ষের আস্বাদ গ্রহণ করাতে। দেখ আমি কিভাবে আয়াতসমূহ বিভিন্নভাবে বিবৃত করি, যেন তারা উপলব্ধি করতে পারে।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের ভিত্তিতে পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমানে আল্লাহর মনোনীত নবী-রসূল আগমনের অবকাশ নেই, কারণ মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পরবর্তী কোনো রসূলের ওপর ওহী হওয়ার বিষয়ে কুরআনে কোনো প্রত্যয়ন করা হয়নি এবং কুরআনের পরবর্তী কোনো কিতাবে ঈমান আনতেও বলা হয়নি। তবে ‘রসূল’ শব্দের সাধারণ প্রয়োগ অনুসারে বলা যেতে পারে যে, যে ব্যক্তিই কোনো জনগোষ্ঠীর সামনে কুরআনের বার্তা প্রথমবার পৌঁছে দিবেন তিনিই ঐ জনগোষ্ঠীর জন্য সাধারণ অর্থে একজন রসূল হিসেবে পরিগণ্য হবেন, যা ঐ জনগোষ্ঠীর কাছে আল্লাহর আয়াত পৌঁছানোর সাথে সম্পর্কিত মাত্র এবং প্রত্যেক মু’মিনই কুরআনের বালাগের (প্রচারের) ক্ষেত্রে এরূপ রসূল হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত রয়েছে। কিন্তু আল্লাহর মনোনীত রসূলের সাথেই ঈমান ও আনুগত্যের সম্পর্ক। সাধারণ অর্থে যারা রসূল তাদের প্রতি ঈমান ও আনুগত্যের সম্পর্ক নেই, শুধুমাত্র তাদের পৌঁছে দেয়া কুরআনের আয়াতের প্রতিই ঈমানের প্রশ্ন জড়িত। আর কুরআন নাযিলের পর যার কাছেই কুরআন পৌঁছে যাবে তাকে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহই কুরআন দ্বারা সতর্ক করছেন হিসেবে সাব্যস্ত হবে। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর ওফাতের পর মু’মিনরা উল্টোদিকে ফিরে যাবে না, বরং তাঁর রিসালাত তথা কুরআনকে অনুসরণ করে যথানিয়মে নিজেদের দায়-দায়িত্ব পালন করতে হবে।

মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর ওফাতের পর তাঁর পক্ষে কুরআনের বিধিবিধান কার্যকর করা তথা কুরআনের বিধিবিধান অনুযায়ী মু’মিনদেরকে বাস্তব নেতৃত্ব দেয়া, তাদেরকে পরিচালিত করা, তাদের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের বণ্টন করা, তাদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-ফায়সালা করা সম্ভব নয় বিধায়, এক্ষেত্রে নতুন বিধানগত ধারা প্রদান করা হয়েছে। আর তা হলো, বর্তমানে আসমানী ঘোষণায় সরকার (নবী-রসূল) নির্ধারণের পরিবর্তে আসমানী বিধান অনুসারে জমিনী শূরার (পরামর্শের) মাধ্যমে সরকার (উলিল আমর) নির্ধারণের ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। মুসলিমদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা ও রাখার জন্য নবী-রসূলের আগমনকে অপরিহার্য মনে করা বা কোনো নবী-রসূল আগমন করলেই মুসলিমদের সকল অনৈক্য আপসে দূর হয়ে যাবে বলে মনে করা সঠিক নয়। বরং মু’মিনরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ পালনের জন্য মু’মিনদেরকেই সক্রিয় প্রচেষ্টা চালু রাখতে হবে।

উলিল আমর (মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব) নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব

উলিল আমর শব্দের অর্থ হলো “আদেশ দেয়ার অধিকারী, নির্বাহী পরিচালক, নেতৃত্ব প্রদানকারী”। আল কুরআনের পরিভাষায় উলিল আমর বলতে মুসলিম উম্মাহর সমষ্টিগত কার্যক্রমের জন্য আল কুরআনের নীতিমালার আওতায় যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হয় এবং তার আনুগত্য বজায় রাখতে হয় তাকে ‘উলিল আমর’ বলা হয়।

যে কোনো সমষ্টিগত বা ঐক্যবদ্ধ কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য নেতৃত্ব ও শৃঙ্খলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক সকল ক্ষেত্রেই ঐক্যবদ্ধতা ও শৃঙ্খলার জন্য নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব গঠন, নেতৃত্বের পক্ষ থেকে স্থিরিকৃত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশের আনুগত্য এবং প্রয়োজনে নেতৃত্বের পরিবর্তন ইত্যাদি স্বাভাবিক প্রয়োজনেই মানব সমাজের স্বত:সিদ্ধ রীতিনীতি হিসেবে চালু রয়েছে।

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয়েছে যে, কুরআনের দাবি অনুসারে মানব জাতির আদিপিতা ও আদিমাতাকে যখন পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয় তখনি তাঁদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো যে, আল্লাহ মানুষের নিকট তাঁর পথনির্দেশ প্রেরণ করবেন, যারা তা মেনে চলবে তাদেরকে দুঃখজনক ও হতাশাপূর্ণ পরিণতি ভোগ করতে হবে না। অন্যদিকে যারা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আসা সত্য তথ্য ও বিধি-বিধানকে প্রত্যাখ্যান করবে তারা কষ্টদায়ক শাস্তি লাভ করবে।

উক্ত ঘোষণার বাস্তবায়নস্বরূপ যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্য থেকে তাঁর নির্বাচিত পুরুষদের নিকট, যাদেরকে নবী ও রসূল বলা হয়, তাঁর পথনির্দেশ পাঠিয়েছেন। এই ভিত্তিতে মানবজাতির কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর পথনির্দেশকে তাদের জন্য মূল বিধান হিসেবে গ্রহণ করবে এবং তাঁর নির্বাচিত নবী-রসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ করবে। নবী-রসূলগণ আল্লাহ প্রদত্ত পথনির্দেশ অনুযায়ী মানুষকে পরিচালনা করতেন, তাদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-ফায়সালা করতেন এবং তাদের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের সুষ্ঠু বণ্টন করতেন। তাদেরকে পরিচালনা করতে গিয়ে আল্লাহ প্রদত্ত পথনির্দেশের সীমালঙ্ঘন না করে তাঁরা প্রয়োজনীয় নির্দেশও প্রদান করতেন এবং এরূপ নির্দেশকে তাঁদের ‘নির্বাহী নির্দেশ’ বলা যেতে পারে। নির্বাহী নির্দেশের বিষয় স্থান-কাল-পাত্রনির্ভর তথা উপস্থিত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সমকালীন প্রযুক্তি, হাতিয়ার ও কর্মকৌশল ব্যবহার করে পরিস্থিতির পরিবর্তন সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল প্রকৃতির হয়ে থাকে।

যারা নবী-রসূলদেরকে তাদের জন্য আসমানী ব্যবস্থায় নির্ধারিত কর্তৃত্ব হিসেবে গ্রহণ করতো না এবং তাঁদের আনুগত্য স্বীকার করতো না তাদের প্রতি তাঁদের দায়িত্ব ছিল শুধুমাত্র স্পষ্টভাবে বালাগ বা তথ্য পৌঁছে দেয়া। অন্যদিকে যারা মু’মিন হয়ে তাঁদের আনুগত্য স্বীকার করতো তাদেরকেই তাঁরা বাস্তব নেতৃত্ব প্রদান করেছেন।

এই প্রেক্ষিতে সর্বশেষ আসমানী কিতাব আল কুরআন এবং সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে প্রেরণের পর মু’মিনদেরকে তাদের স্বতন্ত্র একক জাতিসত্তা বজায় রেখে তাদের সমষ্টিগত বিষয়াদিতে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য রসূলের পাশাপাশি উলিল আমর বা নেতৃত্ব নির্ধারণ করে তাঁদের আনুগত্য করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ যখন যেখানে রসূল উপস্থিত থাকবেন না তখন সেখানে রসূলের নেতৃত্বের অধীনে ও রসূলের পক্ষ থেকে কুরআনের সমষ্টিগত বিধান বাস্তবায়নের জন্য নির্বাহী নেতৃত্ব প্রদান করবেন উলিল আমর। রসূলের সমকালে এই উলিল আমরগণ রসূল কর্তৃক নির্ধারিত বা অনুমোদনপ্রাপ্ত ছিলেন। আর রসূল তাঁদেরকে নির্ধারণ করতেন বাস্তবসম্মতভাবে কখনো নিজ বিবেচনায়, কখনো মু’মিনদের সাথে পরামর্শ করে। এছাড়া কোথাও মু’মিনরা পরামর্শক্রমে কাউকে উলিল আমর হিসেবে নির্ধারণ করার প্রস্তাব পেশ করলে তিনি তাকে অনুমোদন প্রদান করাও এর একটি পদ্ধতি হতে পারে। কিন্তু রসূলের ওফাতের পর উলিল আমর নির্ধারণের একমাত্র পন্থা হিসেবে মু’মিনদের পারস্পরিক পরামর্শক্রমে উলিল আমর নির্ধারণ এবং কেন্দ্রীয় উলিল আমর কর্তৃক স্বীয় বিবেচনা অনুসারে বা মু’মিনদের সাথে পরামর্শ করে অন্যান্য বিভাগীয় ও স্থানীয় উলিল আমর নির্ধারণ করার পদ্ধতি অবশিষ্ট রয়েছে।

বস্তুত কুরআনে থাকা সমষ্টিগত বিধানসমূহ বাস্তবায়ন ও কার্যকর করার জন্যই উলিল আমর নির্ধারণ ও তাঁর আনুগত্য করা অপরিহার্য। ৩:১০০-১১০, ৪:৫৮-৬৫, ৪:৮৩, ৫:৪৯-৫১ ও ২৪:৬২ আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন উলিল আমর নির্ধারণ ও তাঁদের আনুগত্যের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনে বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে। নিম্নে আয়াতসমূহের অনুবাদ উল্লেখ করা হলো:

৩:১০০ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যদি তোমরা যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের কোনো ফেরক্বার আনুগত্য করো তাহলে তারা তোমাদেরকে তোমাদের ঈমানের পরে আবার কাফির বানিয়ে দিবে।

৩:১০১ :: আর কীরূপে তোমরা কুফর করতে পারো অথচ তোমাদের কাছে আল্লাহর আয়াতসমূহ আবৃত্তি করা হচ্ছে এবং তোমাদের মধ্যে তাঁর রসূল রয়েছেন? আর যে ব্যক্তি (তার প্রভু হিসেবে) আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে, তিনি তাকে সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথে পথনির্দেশ করেন।

৩:১০২ :: হে যারা ঈমান করেছো, তোমরা আল্লাহর প্রতি সচেতন থাকো যেভাবে তাঁর প্রতি সচেতন থাকা কর্তব্য এবং তোমরা মুসলিম (তাঁর প্রতি আত্মসমর্পিত) অবস্থায় থাকা ছাড়া মৃত্যুবরণ করো না।

৩:১০৩ :: আর তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধরো (বা, আল্লাহর রজ্জুর মাধ্যমে গঠিত সংঘকে আঁকড়ে ধরো) এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না এবং তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামাতকে স্মরণ করো, যখন তোমরা পরস্পরের শত্রু ছিলে তারপর তিনি তোমাদের অন্তরসমূহকে সম্প্রীতিপূর্ণ করেছেন, ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পরের ভাই হয়ে গেলে, আর তোমরা ছিলে অগ্নিকুণ্ডের কিনারায়, তারপর তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বিশদ বর্ণনা করেন, যেন তোমরা সঠিক পথনির্দেশ পেতে পারো।

৩:১০৪ :: আর তোমাদের মধ্যে (মুসলিম উম্মাহর মধ্যে) একটি উম্মাহ (কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিত্ব ও পরিচালনাকারী উম্মাহ) হোক, যারা কল্যাণের বিষয় ও কল্যাণকর্মের দিকে আহবান করবে এবং ন্যায়ের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখবে (বা নিষেধ করবে)। আর (যারা এসব কাজ করে তারাই) সফলতা লাভকারী।

৩:১০৫ :: আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা বিভিন্ন ফিরক্বায় বিভক্ত হয়ে গেছে এবং তাদের কাছে স্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণাদি এসে যাওয়ার পরেও ইখতিলাফ/মতভেদ করেছে। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।

৩:১০৬ :: সেদিন কিছু চেহারা হবে শুভ্র (আশাবাদী) এবং কিছু চেহারা হবে মলিন (নিরাশাবাদী)। তারপর যাদের চেহারা মলিন হবে, (তাদেরকে বলা হবে,) “তোমরা কি তোমাদের ঈমানের পর কুফর করেছো? সুতরাং তোমরা যে কুফর (সত্য প্রত্যাখ্যান) করতে সেজন্য শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করো।”

৩:১০৭ :: আর যাদের চেহারা শুভ্র হবে, তারাই আল্লাহর রহমতের মধ্যে থাকবে। তারা তাতে স্থায়ী হবে।

৩:১০৮ :: এগুলো আল্লাহর আয়াতসমূহ, আমরা তোমার কাছে সেগুলো যথাযথভাবে আবৃত্তি করছি। আর আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি যুলুম করার ইচ্ছা করেন না।

৩:১০৯ :: আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই এবং যাবতীয় বিষয় তাঁরই দিকে ফিরে যাবে।

৩:১১০ :: তোমরাই উত্তম ও কল্যাণধর্মী উম্মাহ (জাতিসত্তা), তোমাদেরকে মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদেরকে উদ্ভব ঘটানো হয়েছে, তোমরা ন্যায়ের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখবে (বা, নিষেধ করবে) এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে। আর যদি আহলে কিতাব (সর্বশেষ নবী ও সর্বশেষ কিতাবের প্রতি) ঈমান আনতো, তাহলে তা-ই তাদের জন্য উত্তম ও কল্যাণকর হতো। তাদের মধ্যে কতক মু’মিন এবং অধিকাংশই ফাসিক্ব (দুষ্কর্ম পরায়ণ)।

৪:৫৮ :: নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা অর্পণ করো আমানত উহার উপযুক্ত প্রাপককে। আর যখন তোমরা মানুষের মধ্যে বিচার-ফায়সালা করবে তখন তোমরা বিচার-ফায়সালা করবে আদল-ইনসাফের সাথে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে অতি উত্তম উপদেশ দেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।

৪:৫৯ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রসূলের ও তোমাদের মধ্য থেকে হওয়া উলিল আমরের (আমীরের/ সমষ্টিগত পরিচালনার দায়িত্বশীল নেতার), তারপর যদি কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে তানাযা/ মতবিরোধ হয়, তাহলে তার সমাধানের জন্য ফিরিয়ে দাও আল্লাহর দিকে এবং তাঁর রসূলের দিকে, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রেখে থাকো। এটাই উত্তম (কর্মপদ্ধতি) এবং পরিণামে সর্বোত্তম।

৪:৬০ :: তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা দাবী করে যে, নিশ্চয় তারা ঈমান এনেছে তার উপর যা নাযিল করা হয়েছে তোমার প্রতি এবং যা নাযিল করা হয়েছে তোমার পূর্বে। তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায় অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে অস্বীকার করতে। আর শয়তান চায় তাদেরকে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত করতে।

৪:৬১ :: আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা আসো যা আল্লাহ নাযিল করেছেন তার দিকে (কুরআনের দিকে) এবং রাসূলের দিকে’, তখন মুনাফিকদেরকে দেখবে তোমার কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে ফিরে যাচ্ছে।

৪:৬২ :: সুতরাং তখন কেমন হবে, যখন তাদের উপর কোন মুসীবত আসবে, সেই কারণে যা তাদের হাত পূর্বেই প্রেরণ করেছে (অর্থাৎ তাদের কৃতকর্মের কারণে)? তারপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করা অবস্থায় তোমার কাছে আসবে যে, আমরা উত্তম আচরণ ও সমঝোতার মাধ্যমে সামর্থ্যবৃদ্ধি ভিন্ন অন্য কিছু চাইনি।

৪:৬৩ :: তাদের মনে যা আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তুমি তাদের বিষয়ে নির্লিপ্ত হও এবং তাদেরকে সদুপদেশ দাও এবং তাদেরকে তাদের (কর্মকাণ্ডের) পর্যালোচনাস্বরূপ মর্মস্পর্শী কথা বলো।

৪:৬৪ :: আর আমি কোনো রসূল প্রেরণ করিনি এছাড়া যে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তার আনুগত্য করতে হবে। আর যদি যারা তাদের নিজেদের উপর যুলুম করেছে তারা তোমার নিকট আসতো, তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতো এবং রসূলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতো, তাহলে তারা আল্লাহকে পেতো তাওবাহ কবুলকারী ও দয়ালু।

৪:৬৫ :: সুতরাং না (তাদের আচরণ মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়)। তোমার প্রভুর শপথ, তারা মু’মিন হিসেবে সাব্যস্ত হবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের মধ্যকার বিবাদ-বিসম্বাদের বিষয়ে তোমাকে বিচার-ফায়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ করবে, তারপর তুমি যে ফায়সালা করো সেই বিষয়ে তাদের মনের মধ্যে কোনো দ্বিধা-সংকোচ রাখবে না এবং ক্রমাগত আত্মসমর্পিত থাকবে।

৪:৮৩ :: আর যখন তাদের কাছে আসে নিরাপত্তার অথবা আশংকার কোনো বিষয়, তখনি তারা তা প্রচার করতে থাকে। অথচ যদি তারা তা পৌঁছে দিতো রসূলের দিকে এবং তাদের মধ্য থেকে হওয়া উলিল আমরের দিকে, তাহলে তা জানতে পারতো তাদের মধ্য থেকে থাকা ঐ ব্যক্তিরা যারা তথ্য যাচাই করে সঠিক সুপারিশ প্রণয়ন করতে পারে, আর যদি তোমাদের উপর আল্লাহর (ব্যাপক) অনুগ্রহ ও দয়া না থাকতো তাহলে তোমরা শয়তানের অনুসরণ করতে, অল্প কয়েকজন ছাড়া।

৫:৪৯ :: আর তাদের মধ্যে বিচার-ফায়সালা করো আল্লাহর নাযিলকৃত (কিতাবের) বিধানের মাধ্যমে আর তাদের প্রবৃত্তির (বা প্রবৃত্তিপ্রসূত বিধানের) অনুসরণ করো না। আর তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকো যেন তারা তোমাকে ফিতনায়/ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলতে না পারে, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন তার কোনো কিছু প্রয়োগের বিষয়ে। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ ইচ্ছা করেন যে, তাদেরকে তাদের কিছু পাপের কারণে শাস্তি প্রদান করবেন। আর নিশ্চয় অধিকাংশ মানুষ ফাসিক্ব (দুষ্কর্ম পরায়ণ)

৫:৫০ :: তাহলে কি তারা জাহিলিয়্যাতের (মুর্খতার) বিধান তালাশ করে? আর প্রত্যয়শীল ক্বওমের কাছে বিধান দেয়ার যোগ্যতায় আল্লাহর চেয়ে উত্তম কে আছে?

৫:৫১ :: হে যারা ঈমান করেছো, তোমরা ইয়াহুদকে ও নাসারাকে (মতাদর্শগত আপোষস্বরূপ) বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যে তাদেরকে এরূপ বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম ক্বওমকে হিদায়াত করেন না।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে উলিল আমরের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যেতে পারে। নিম্নে আয়াতসমূহের ধারাবাহিকতায় আমরা বিষয়টি আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছি:

৩:১০০ থেকে ৩:১১০ আয়াতের ধারাবাহিক বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, পূর্ববর্তী যেসব কিতাবধারীরা শেষ নবী ও শেষ কিতাবের প্রতি ঈমান না এনে স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসেবে থেকে যায়, তাদের কোনো ফিরক্বার বা সম্প্রদায়ের আনুগত্য করলে তারা মু’মিনদেরকে কাফির বানিয়ে ছাড়বে। সুতরাং মু’মিনরা একটি স্বতন্ত্র একক জাতিসত্তা হিসেবে থাকতে হবে, তারা অন্য কোনো জাতি-গোষ্ঠীর আনুগত্যের মধ্যে বিলীন হতে পারবে না। মু’মিনরা আল কুরআনকে অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহকে আঁকড়ে ধরতে হবে এবং আল্লাহর রসূল তাদেরকে কুরআন অনুসারে জীবন যাপনে বাস্তব নেতৃত্ব দিয়েছেন। এভাবেই তারা সিরাতুল মুসতাক্বীম বা সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। মু’মিনরা যথাসাধ্য ও যথোচিতভাবে আল্লাহর প্রতি সচেতন থাকতে হবে এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে যে, যেন তারা মৃত্যু পর্যন্ত মুসলিম হয়ে থাকতে পারে এবং মুসলিম অবস্থায় থাকা ছাড়া তাদের মৃত্যু না হয়। অত:পর মু’মিনদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, যেন তারা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে। কুরআনের সামগ্রিক শিক্ষা অনুসারে এর বাস্তব স্বরূপ হলো- আল্লাহ প্রদত্ত সংবিধান সংবলিত গ্রন্থকে, তাঁর নির্ধারণ করে দেয়া মু’মিনদের নির্বাহী পরিচালনাকারী সরকারব্যবস্থা হিসেবে রসূল ও উলিল আমরকে এবং তাঁর নির্ধারণ করে দেয়া মু’মিনদের যাবতীয় উপাসনামূলক ও কুরআনে থাকা সমষ্টিগত বিধি-বিধান কার্যকর করার কেন্দ্র বা রাজধানী হিসেবে আল মাসজিদুল হারাম ও উপকেন্দ্র বা উপরাজধানীস্বরূপ অন্যান্য মাসজিদকে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে জামিয়া বা ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, যেন তারা বিভিন্ন পরস্পর বিচ্ছিন্ন দলে দলে বিভক্ত হয়ে না যায়। এটাই মু’মিনদের বিশ্বব্যাপী এক বিশ্বে এক জাতিসত্তা হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকার একমাত্র সূত্র।

“ওয়া’তাসিমূ বিহাবলিল্লাহি জামীয়া” (তোমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো) নির্দেশটিতে ‘জামিয়া’ শব্দটি একটি বিশেষ শর্ত সৃষ্টি করছে। আর তা হলো যদি দুইয়ের বেশি লোক হয় তাহলে তারা নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামোতে সংঘবদ্ধ হয়ে সাধ্যমতো কুরআনের সংবিধান অনুসরণ করতে হবে, এটা বাধ্যতামূলক। কারণ ‘জামিয়া’ বা ‘জমা’ বলতে অন্তত তিনজন ব্যক্তিকে বুঝানো হয়। আর যদি দুইয়ের বেশি না হয় তথা মাত্র দুজন হয়, তবে তারা দুজন নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো গঠন করা বা সমষ্টিগত কার্যক্রম (আমরিন জামিয়িন) চালু করা বাধ্যতামূলক নয়। অবশ্য যদি মাত্র একজন ব্যক্তিও মুসলিম হয়, তাহলে সেও ‘মুসলিম উম্মাহ’ বা ‘মুসলিম জাতিসত্তা’ এর প্রতিনিধিত্বকারী এবং সে ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর বিধান অনুসরণ করতে হবে। আর অন্তত তিনজন মুসলিম থাকলে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের মধ্যে সাধ্যমতো ‘আমরিন জামিয়িন’ বা সামষ্টিক কার্যক্রম চালু করতে হবে।

মুসলিম উম্মাহ এমন এক উম্মাহ যারা পুরো মানবজাতির সামনে একতাবদ্ধ হওয়ার একমাত্র কার্যকর সূত্রের অনুসরণের ভিত্তিতে মানবজাতির সামনে সত্যের সাক্ষ্যদাতা এবং তাদেরকে কল্যাণের দিকে আহবানকারী এবং তাদের নেতৃত্ব প্রদানকারী, যারা ঈমানের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে ন্যায়ের বাস্তবায়ন করবে এবং তাদেরকে অন্যায় থেকে বিরত রাখবে বা অন্যায়ের প্রতিরোধ করবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আল কুরআন অনুযায়ী ‘খায়ের’ বা ‘কল্যাণকর বিষয়’ আল কুরআনের একটি গুণবাচক নাম। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতটি লক্ষণীয়:

১৬:৩০ :: আর যারা তাকওয়ার অবলম্বন করেছে, তাদের বলা হল, ‘তোমাদের রব কী নাযিল করেছেন’? তারা বলল, ‘কল্যাণ’। যারা উত্তম কাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে এ দুনিয়ায় মঙ্গল এবং নিশ্চয় আখিরাতের আবাস উত্তম এবং মুত্তাকীদের আবাস কতইনা নেয়ামতপূর্ণ!

সুতরাং মুসলিমরা কল্যাণকর বিধিব্যবস্থা ও তার উৎস আল কুরআনের অনুসারী এবং মানুষকে আল কুরআনের দিকে আহবানকারী এবং আল কুরআন অনুসারে কল্যাণকর্ম সম্পাদনকারী এবং অন্যদেরকেও কল্যাণকর্মে অংশগ্রহণের জন্য আহবানকারী। বস্তুত এটাই প্রকৃত মুসলিম উম্মাহর পরিচয়। (যদিও বর্তমানে যারা মুসলিম দাবিদার তাদের অধিকাংশই এরূপ নয় তথা প্রকৃত মুসলিম নয় বিধায় এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে)।

অন্যদিকে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে একটি উম্মাহ থাকতে হবে যারা এ কাজগুলো নিয়মিত আঞ্জাম দিবে। অন্য কথায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহ সমগ্র মানবজাতির মধ্যে যে কাজগুলো করার জন্য সাধারণভাবে দায়িত্বশীল, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সেই কাজগুলো নিয়মিত ও কর্তৃত্বসম্পন্নভাবে করার জন্য একটি উম্মাহ থাকতে হবে। বস্তুত মানবজাতির জন্য মুসলিম উম্মাহ যেরূপ নেতৃত্ব প্রদানকারী উম্মাহ, তেমনি তারা হবে মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার নেতৃত্ব প্রদানকারী উম্মাহ। এই উম্মাহকে বলা হয়েছে ‘খায়রা উম্মাহ’ (উত্তম, শ্রেষ্ঠ, কর্তৃত্বসম্পন্ন, কল্যাণকর্ম বাস্তবায়নকারী উম্মাহ)। মুসলিম উম্মাহর এ শ্রেষ্ঠত্ব ঈমান ও নৈতিক গুণের উপর ভিত্তিশীল।

এ বিষয়টিকে একটি উদাহরণের মাধ্যমে বুঝা যেতে পারে। সাধারণভাবে বাংলাদেশের সকল নাগরিকই বাংলাদেশী। কিন্তু ‘প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীগণ, সচিবগণ, কমিশনারগণ, বিচারপতিগণ, সামরিক কর্মকর্তাগণ, মেয়রগণ, পুলিশ কর্মকর্তাগণ, ইউনিয়নের চেয়ারম্যানগণ’ তথা বাংলাদেশের সংবিধানের নির্বাহী ক্ষমতা যারা প্রয়োগ করেন তারাই ‘খায়রা বাংলাদেশী’। অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকার হলো বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যকার কর্তৃত্বসম্পন্ন বাংলাদেশী, যারা সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে সাধারণ নাগরিকদেরকে পরিচালিত করে থাকে। বাংলাদেশ সরকারকে বলা যেতে পারে ‘খায়রা বাংলাদেশী’।

অনুরূপভাবে সাধারণভাবে মুসলিম উম্মাহ হলো গোটা মানবজাতির জন্য ‘খায়রা উম্মাহ’। আবার মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও একটি ‘খায়রা উম্মাহ’ থাকতে হবে, যারা এ কাজে বিশেষ কর্তৃত্বের সাথে ‘প্রতিনিধিত্বশীল’ ও ‘পরিচালনামূলক’ ভূমিকা পালন করবেন। মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার এই ‘উম্মাহ’ই হলো মু’মিনদের মধ্যকার ‘উলিল আমর’ যাদের আনুগত্য করার জন্য মু’মিনদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যারা ‘কল্যাণকর বিধিব্যবস্থা বাস্তবায়নে আহবানকারী, ন্যায়ের বাস্তবায়নকারী ও অন্যায়ের প্রতিরোধকারী’ তারাই সফল এবং ‘সমগ্র মুসলিম উম্মাহ’ সাধারণভাবে এ দায়িত্বে নিয়োজিত। সুতরাং মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার যারা বিশেষভাবে এ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তারা হলো ‘মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার প্রতিনিধিত্বশীল ও কর্তৃত্বসম্পন্ন উলিল আমর’, যাদের আল কুরআনের নির্দেশনা অনুসারে আল কুরআনের বিধানসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করা হয়।

এ নির্দেশনার সঠিক তাৎপর্য না বুঝতে পারায় বা গোপন করে ভিন্নার্থে প্রয়োগ করে বিভিন্ন দল গঠনের কারণে সারা বিশ্বে মুসলিম উম্মাহর অখন্ড জাতিসত্তা বিনষ্ট হয়ে তারা বিশৃংখল জাতিতে পরিণত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে কুরআনের বিধান কার্যকরী নেই বিধায় পৃথিবীতে আদল (ন্যায়বিচার) ও ইহসান (সদাচার) প্রতিষ্ঠিত নেই। আর এ কারণেই সমগ্র বিশ্বে আজ মুসলিমরাসহ প্রায় সমগ্র মানবজাতি শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত। যারা মু’মিনদের মধ্যে প্রতিনিধিত্বশীল ও কর্তৃত্বসম্পন্ন উম্মাহ পরিগঠনের নির্দেশনাকে ভুল ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী দলে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন দল গঠন করে নিজেদেরকে সেই নির্দেশনার অনুসরণে গঠিত দল বলে দাবি করে তারা প্রকৃতপক্ষে ঐক্যবদ্ধতার নির্দেশকে লঙ্ঘনকারী। যে আয়াতটি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম জাতিসত্তার ঐক্যের বাস্তব ফর্মুলা দিয়েছে যে, তাদের একক কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হতে হবে, সে আয়াতকেই তারা পরস্পর প্রতিদ্বন্দী দল গঠনের নির্দেশনা হিসেবে উপস্থিত করে, যা একটি চরম আফসোসের বিষয়।

যারা আল্লাহর নির্দেশনাকে লঙ্ঘন করে পরস্পর বিচ্ছিন্ন দল দলে বিভক্ত তারা বিভিন্নভাবে যে অধ:পতিত অবস্থায় রয়েছে এটা তাদের নিজেদেরই কর্মফল। বস্তুত আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি যুলুম করেন না। আর আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর এবং সব বিষয় তাঁর দিকেই ফিরে যাবে। সুতরাং যারা আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিফল আশা করে তাদেরকে আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে মুসলিম উম্মাহতে পরিণত হতে হবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমানের ভিত্তিতে মানবজাতির কল্যাণার্থে কাজ করতে হবে, ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে হবে।

কল্যাণ কর্ম এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মানবজাতির স্বাভাবিক নির্বাহী রীতি। কুরআন অনুযায়ী যথাযথভাবে না হলেও তা সমাজে প্রচলিত আছে বা থাকবে। কুরআন মানব সমাজে ইনপুট দিচ্ছে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও সংবিধানের ভিত্তিতে, একটি ধর্মীয় স্বাধীনতার অবকাশসম্পন্ন, দ্বীনে হক্ব (সঠিক জীবনব্যবস্থা) অবলম্বনকারীদের কর্তৃক অনুশীলিত, স্বতন্ত্র সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে তথা ৩:১১০ আয়াত অনুসারে আল্লাহর প্রতি ঈমানের ভিত্তিতে কল্যাণ কর্মের বাস্তবায়নে দাওয়াত বা আহবান এবং আদল-ইহসানের তথা ন্যায়-আচার, ন্যায়-বিচার এবং পরোপকার ও পরার্থে ত্যাগ-স্বীকারের সমন্বিত কর্মসূচী। এতে মুসলিমদের আমর বিল মা’রূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার তথা ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ দ্বিস্তর বিশিষ্ট, ক. খেলাফত পূর্ব, খ. খেলাফত উত্তর। এতে দুটি মূল কর্মসূচী- ক. দ্বীনের ক্ষেত্রে দাওয়াত, খ. আদল-ইহসান প্রতিষ্ঠা এবং ফাসাদ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সাধ্যমতো প্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ। মুসলিম উম্মাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠা হলে সেক্ষেত্রে ‘উলিল আমরকে’ দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে হয়, যথা : (ক) রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ভূমিকা এবং (খ) উম্মাহর উলিল আমর হিসেবে উম্মাহর ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা।

৪:৫৮ থেকে ৪:৬৫ আয়াতের ধারাবাহিক বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বসহ যেকোনো আমানাত তার কাছেই অর্পণ করতে হবে যে উহার আহল তথা হক্বদার বা উপযুক্ত প্রাপক ও যোগ্য। উপযুক্ত প্রাপককে আমানত অর্পণের নির্দেশনার দুটি মাত্রা রয়েছে। এর সাধারণ মাত্রা হলো, যে আমানত রেখেছে তাকে তা ফেরত দেয়া। আর এর বিশেষ মাত্রা হলো, যে যোগ্যতা রাখে যে, তার কাছে অর্পণযোগ্য আমানত (যেমন, নেতৃত্বের/ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের আমানত) অর্পণ করা হবে, তাকেই সেরূপ আমানত অর্পণ করা।

উপযুক্ত প্রাপককে আমানত অর্পণের পাশাপাশি যেভাবে আদল-ইনসাফ সহকারে বিচার-ফায়সালার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং পরবর্তী আয়াতে আনুগত্যের ক্ষেত্রে ‘তোমাদের মধ্য থেকে হওয়া উলিল আমরের আনুগত্য’ প্রসঙ্গ এসেছে, তাতে এখানে বিশেষ করে নেতৃত্বের আমানত প্রণিধানযোগ্য নির্দেশনা হিসেবে সাব্যস্ত। অর্থাৎ আল কুরআনে থাকা সামষ্টিক বিষয়াদি (আমরিন জামিয়িন) সম্পর্কিত বিধি-বিধান বাস্তবায়নের নির্বাহী দায়িত্ব তথা মুসলিম উম্মাহর সদস্যদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারভার, নেয়ামতের বণ্টনভার ও মুসলিম উম্মাহকে পরিচালনার দায়-দায়িত্ব পালনের আমানত উহার যোগ্য ব্যক্তির নিকট অর্পণ করতে হবে। এভাবে সে হবে মু’মিনদের মধ্যকার উলিল আমর। এবং এ প্রেক্ষিতে তার আনুগত্য করতে হবে এবং সে যখন এ প্রাপ্ত আমানতের ভিত্তিতে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে, তখন তাকে অবশ্যই আদল-ইনসাফের ভিত্তিতে বিচার-ফায়সালা করতে হবে।

উলিল আমর সম্পর্কিত ৪:৫৯ আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি যে, আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে মু’মিনদের যাবতীয় আনুগত্য নিয়ন্ত্রিত হবে তিনটি মূল আনুগত্য দ্বারা, তা হলো, আল্লাহর আনুগত্য এবং রসূলের আনুগত্য ও উলিল আমরের আনুগত্য। আর এ সম্পর্কিত ৪:৮৩ আয়াত থেকে থেকে আমরা জানতে পারি যে, সাধারণ মু’মিনরা যেভাবে কোন ইতিবাচক বা নেতিবাচক বিষয়ের তথ্য জানার সাথে সাথে তা যেখানে সেখানে প্রচার করা শুরু করে তা উচিত নয়, বরং তা রসূলের ও উলিল আমরের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, তারপর রসূল ও উলিল আমর একটি দায়িত্বশীল পরিষদের দ্বারা সে বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। সুতরাং এ আয়াতগুলো থেকে মু’মিনদের জন্য সাংগঠনিক কাঠামো বা নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো তথা নিজেদের মধ্য থেকে উলিল আমর নির্বাচনের গুরুত্ব অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়।

পূর্বে উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয়েছে যে, আল্লাহ যুগে যুগে কিতাব পাঠানোর পাশাপাশি কিতাবের ধারক ও বাহক নবী-রসূলকে তা প্রচার ও প্রতিষ্ঠার নির্বাহী দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এ কারণে প্রত্যেক রসূল এসে বলেছিলেন যে, ‘আমি তোমাদের বিশ্বস্ত রসূল। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো’। অর্থাৎ মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পূর্বে আনুগত্য লাভের সত্তা ছিলেন আল্লাহ ও তাঁর রসূল। কিন্তু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর সময় এসে আনুগত্যের সত্তা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে আল্লাহকে, তাঁর রসূলকে ও উলিল আমরকে।

তারই ধারাবাহিকতায় আল্লাহর মনোনীত নবী-রসূল প্রেরণের প্রথা পরিসমাপ্তির প্রেক্ষিতে তথা সর্বশেষ নবী ও রসূলুল্লাহ মুহাম্মাদের উপর সর্বশেষ কিতাব আল কুরআন নাযিলের পর তাতে রসূলের আনুগত্যের সাথে উলিল আমরের আনুগত্যের ধারা সন্নিবেশিত বা প্রবর্তন করা হয়েছে। অন্যথায় আল কুরআনের নির্বাহী দায়িত্ব মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর মৃত্যুর পর অন্য কারো নিকট অর্পণ করা যেতো না এবং আল কুরআন কালাকালভেদী সংবিধানে পরিণত হতে পারতো না। কিন্তু এ ধারা প্রবর্তনের মাধ্যমে যখন যেখানে রসূল উপস্থিত থাকবেন না তখন সেখানে এবং মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর ওফাতের পর সকল স্থানে ও সময়ে উলিল আমরই আল কুরআনে থাকা সংবিধানের নির্বাহী দায়িত্ব পালন করবেন।

সংবিধান একটি বস্তুসত্তা বিধায় কোন ব্যক্তিসত্তা বা নির্বাহী দায়িত্বশীল ছাড়া তা মানব সমাজে কার্যকর হতে পারে না। এজন্য পূর্বে আল্লাহ তাঁর কিতাব নাজিলের পাশাপাশি নবী-রসূলদেরকে উহার নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন। কিন্তু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পর ঐ নির্বাহী ক্ষমতা উলিল আমরের উপর হস্তান্তর করেছেন, যাঁরা আল কুরআনের আলোকে মুসলিম উম্মাহর মধ্য থেকে মুসলিম উম্মাহর সদস্যদের তথা মুসলিমদের পরামর্শের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন এবং আল কুরআন অনুসারে মুসলিম উম্মাহকে পরিচালনা করবেন, তাদের মধ্যে কুরআনের বন্টনবিধি অনুসারে নেয়ামতের বন্টন করবেন, তাদের অধিকার সংরক্ষণ করবেন, এবং কুরআনের দন্ডবিধি অনুসারে তাদের আভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-মীমাংসা করবেন।

মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পর প্রত্যেক মুসলিমই দায়ীয়ান ইলাল্লাহ (আল্লাহর দিকে আহবানকারী) হিসাবে আল কুরআনের দাওয়াত সম্প্রসারণ করবেন এবং আল কুরআন অনুসারে দায়িত্বপ্রাপ্ত উলিল আমর মুসলিম উম্মাহর (উম্মাতাম মুসলিমাতান) মধ্যে আল কুরআন নামক আসমানী সংবিধান কার্যকর করার নির্বাহী দায়িত্ব পালন করবেন এবং কিয়ামাত পর্যন্ত যত মানুষের কাছে কুরআন পৌঁছবে তাদের সবাইকে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ আল কুরআনের মাধ্যমে সতর্ক করেছেন বলে গণ্য হবে।

আল্লাহ কুরআনে থাকা সংবিধানের প্রণয়নকারী এবং রসূল ও উলিল আমর উহার বাস্তবায়নকারী। সংবিধানের বিধান বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রসূল ও উলিল আমর দুই ধরনের আদেশ দিতে পারেন, যথা: (১) সাংবিধানিক আদেশ তথা সংবিধানে থাকা আদেশ বাস্তবায়নের জন্য ঐ আদেশ ও রায় প্রদান করতে পারেন এবং (২) নির্বাহী আদেশ তথা সাংবিধানিক আদেশ বাস্তবায়নের জন্য যাকে যে বাস্তবসম্মত আদেশ দেয়া প্রয়োজন তাকে সেই আদেশ দিতে পারেন, যা উপস্থিত স্থান-কাল-পাত্র এবং সমকালীন প্রযুক্তি, হাতিয়ার ও কর্মকৌশলনির্ভর এবং উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলার সাথে সম্পর্কিত। আল্লাহর আনুগত্য মানে হলো কুরআনের অনুসরণ করা। রসূল ও উলিল আমর কুরআন থেকে যে সাংবিধানিক আদেশ প্রদান করার উহার আনুগত্য করার মানেও হলো কুরআনের অনুসরণ করা। অন্যদিকে তাঁদের নির্বাহী আদেশের আনুগত্য করার মানে হলো সমকালীন বাস্তব প্রয়োজনে উদ্ভুত পরিস্থিতিনির্ভর যেসব আদেশ প্রদান করা হয়, যা পরিস্থিতির পরিবর্তন সাপেক্ষে কার্যকর আদেশ হিসেবে বহাল থাকে না, বরং নতুন পরিস্থিতিতে নতুন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ আবশ্যক হয়ে পড়ে এরূপ আদেশের আনুগত্য করা। এ বিষয়টি পরবর্তীতে ‘সাংবিধানিক বিধান ও নির্বাহী বিধান’ এর তাৎপর্য প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিতভাবে আলোচিত হবে ইনশাআল্লাহ।

যেহেতু আল্লাহর আনুগত্য মানে হলো ‘সংবিধান প্রণয়নকারীর আনুগত্য’ এবং ‘রসূল ও উলিল আমরের আনুগত্য’ মানে হলো ‘সংবিধান বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের আনুগত্য’ তাই ‘আল্লাহর আনুগত্য’ এবং ‘রসূল ও উলিল আমরের আনুগত্য’কে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং উভয় সেটের জন্য স্বতন্ত্রভাবে ‘আতিউ’ (আনুগত্য করো) শব্দ যোগ করা হয়েছে। অর্থাৎ (ক) আতিউল্লাহা এবং ওয়া আতিউর রসূলা ওয়া উলিল আমরি মিনকুম’। এ বাক্যে আল্লাহ শব্দের আগে ‘আতিউ’ রয়েছে এবং ‘আর রসূলা ওয়া উলিল আমরি মিনকুম’ এর আগে ‘আতিউ’ রয়েছে।

কেউ কেউ দাবি করেন যে, আল্লাহ ও রসূল শব্দের আগে ‘আতিউ’ শব্দ থাকা এবং ‘উলিল আমর’ শব্দের আগে ‘আতিউ’ শব্দ না থাকার কারণ হিসেবে বলেন যে, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য শর্তহীন, কিন্তু উলিল আমরের আনুগত্য শর্তযুক্ত হওয়ার কারণে এরূপ করা হয়েছে। অথচ দাবিটি সঠিক নয়। কারণ আরবি ভাষারীতি অনুসারে ‘আর রসূল’ শব্দের পূর্বে থাকা ‘আতিউ’ শব্দটিই ‘ওয়া’ (এবং) শব্দ দ্বারা যুক্ত ‘উলিল আমরি মিনকুম’ শব্দের পূর্বে প্রযোজ্য। অন্যথায় প্রশ্ন থেকে যায় যে, ‘উলিল আমরের’ ক্ষেত্রে নির্দেশ কী? প্রকৃতপক্ষে ‘উলিল আমরের’ ক্ষেত্রেও নির্দেশ হলো যে, ‘উলিল আমরের’ আনুগত্য করতে হবে, যা ‘আতিউ’ শব্দ দ্বারা নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং তা ‘আর রসূল’ শব্দের আগে বসে ‘ওয়া’ (এবং) শব্দ দ্বারা ‘উলিল আমরকে’ও যুক্ত করেছে। অর্থাৎ রসূলের এবং উলিল আমরের আনুগত্য করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেক্ষেত্রে ‘আতিউল্লাহা’ শব্দের ‘আতিউ’ দ্বারাও তো ‘রসূল ও উলিল আমরের আনুগত্যের নির্দেশ’ বুঝানো যেতো। কিন্তু কেন ‘আর রসূলা ওয়া উলিল আমরি মিনকুম’ এর পূর্বে আরেকবার ‘আতিউ’ শব্দটি যোগ করা হয়েছে? এর যুক্তিসঙ্গত জবাব হচ্ছে, এর মাধ্যমে ‘আল্লাহর আনুগত্য’ এর একটি সেট (যা দ্বারা সংবিধান প্রণয়নকারীর আনুগত্য বুঝানো হয়েছে) এবং ‘রসূল ও উলিল আমরের আনুগত্য’ এর একটি সেট (যা দ্বারা সংবিধান বাস্তবায়নকারীদের আনুগত্য বুঝানো হয়েছে) তৈরি করা হয়েছে।

‘উলিল আমর’ শব্দটি বহুবচন। এর একবচন হচ্ছে ‘যিল আমর’। সুতরাং রসূলের উপস্থিতিতে তিনিই প্রধান ‘যিল আমর’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু যেহেতু তিনি রসূল এবং রসূল হওয়ার কারণে তিনি একই সাথে আমাদের জন্য কুরআন প্রাপ্তির মাধ্যম এবং আল্লাহ কর্তৃক নিযুক্ত নেতা ছিলেন, তাই তাঁর প্রসঙ্গে ‘রসূল’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। রসূল কুরআন অনুযায়ী আদেশ নিষেধ করেছেন এবং উলিল আমরও কুরআন অনুযায়ী আদেশ নিষেধ করবেন। সুতরাং রসূলের এবং উলিল আমরের আনুগত্য একই ধারাভুক্ত তথা নির্বাহী আনুগত্যের ধারাভুক্ত। এজন্য ‘আতিউল্লাহ’ একটি সেট, এবং ‘ওয়া আতিউর রসূলা ওয়া উলিল আমরি মিনকুম’ একটি সেট। এজন্য ‘উলিল আমরি’ শব্দের আগে আলাদাভাবে ‘আতিউ’ শব্দ যোগ করা হয় নি, যেহেতু ‘রসূলা’ শব্দের আগে যোগ করা ‘আতিউ’ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাতে প্রযোজ্য হবে। যেসব আয়াতে আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্যের উপর জোর দেয়া হয়েছে এবং দুইবার ‘আতিউ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়নি, তাতে ‘সাংবিধানিক বিষয়ের আনুগত্য ও নির্বাহী বিষয়ের আনুগত্য’কে স্বতন্ত্র গুরুত্ব দেয়া হয়নি।

আল্লাহর আনুগত্য হয় তাঁর প্রদত্ত সাংবিধানিক আদেশ (সংবিধান-কুরআন) পালনের মাধ্যমে। আর রসূল ও উলিল আমরের আনুগত্য হয় ঐ সাংবিধানিক আদেশ বাস্তবায়নকল্পে তাঁদের প্রদত্ত নির্বাহী আদেশ পালনের মাধ্যমে। অর্থাৎ দু ধরনের আনুগত্য- সাংবিধানিক আদেশের আনুগত্য ও নির্বাহী আদেশের আনুগত্য। সংবিধান তথা চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয় বিধান শুধুমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত এবং তা সম্পূর্ণরূপে আল কুরআনে সন্নিবেশিত।

একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি সহজে বুঝা যেতে পারে। সূত্র ও ফলাফল হয় অপরবর্তনীয়। কিন্তু ঐ সূত্র প্রয়োগ করে ফলাফল লাভের জন্য প্রযুক্তি ও হাতিয়ার পরিবর্তনশীল। তদ্রূপ আল্লাহর সাংবিধানিক বাক্যাবলি সত্য বিধান ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থার নিশ্চয়তায় আল কুরআনে সুসম্পূর্ণ অবস্থায় বিদ্যমান। আর এর নির্বাহী বাস্তবায়ন ও তদ্প্রয়োজনে কৃত নির্বাহী আদেশ পরিস্থিতিসাপেক্ষ ও পরিবর্তনশীল এবং সবসময় সাংবিধানিক আদেশের সীমারেখা সংরক্ষনের শর্তযুক্ত।

রসূলের সাংবিধানিক আদেশের একটি উদাহরণ হলো, আল্লাহ রসূলকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তিনি যেন মু’মিন পুরুষ ও নারীদেরকে লজ্জাস্থান হিফাযাতের ও চোখ সংযত করার নির্দেশ দেন। এখন তিনি কুরআনের নির্দেশ অনুসারে যখন এ নির্দেশ দেন, সেটা হয় রসূলের সাংবিধানিক আদেশ তথা সাংবিধানিক আদেশকে রসূল কর্তৃক বাস্তবে আদেশের স্তরে কার্যকর করা। অন্যদিকে নির্বাহী আদেশের উদাহরণ হলো, কোনো যুদ্ধে যদি কোনো কর্মকৌশল হিসেবে রসূল কাউকে কোথাও পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন, সেটা হলো একটি নির্বাহী আদেশ। উভয় আদেশ পালনই ফরজ। কিন্তু নির্বাহী আদেশ একবার পালন হয়ে গেলে তার পরিসমাপ্তি ঘটে, পুনরায় পরিস্থিতি তৈরি হলে যদি পুনরায় আদেশ দেয়া হয় তাহলে পুনরায় তা কার্যকর করতে হবে। অন্যদিকে সাংবিধানিক আদেশের পরিস্থিতি যতবার সৃষ্টি হয়, একবারের সাংবিধানিক আদেশই ততবার কার্যকর করতে হয়। অন্য কথায় সাংবিধানিক আদেশ সরাসরি চিরন্তন প্রকৃতির, অন্যদিকে নির্বাহী আদেশ পরিস্থিতি সাপেক্ষে নবায়নযোগ্য অথবা পরিবর্তনশীল প্রকৃতির। একবারের নির্বাহী আদেশ যতক্ষণ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না, ততক্ষণ কার্যকর থাকবে, কিন্তু পূর্ববর্তী নির্বাহী আদেশ পরবর্তী নির্বাহী প্রধানের স্বয়ংক্রিয় অনুমোদন সাপেক্ষে বা নবায়নজনিত কারণে কার্যকর হয়, যেখানে পরিস্থিতি সাপেক্ষে যে কোনো সময় তিনি পরামর্শক্রমে ভিন্ন সিদ্ধান্ত চালু করার ক্ষমতা রাখেন। বিষয়টির উদাহরণ হলো, রসূল যদি বর্তমানে জীবিত থাকতেন তবে বর্তমানে নিছক তীর চালনার প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতেন না, বরং আধুনিক সমরাস্ত্রের প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে তিনি নিজেই নিজের পূর্বতন নির্বাহী ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করতেন। সাংবিধানিক ও নির্বাহী বিধানের তাৎপর্য সম্পর্কিত আয়াতসমূহ পরবর্তী ‘সাংবিধানিক ও নির্বাহী বিধান’ অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ‘রসূল ও উলিল আমর’ উভয়ে ‘আল কুরআনের সমষ্টিগত বিধিব্যবস্থা বাস্তবায়নের নির্বাহী কর্তৃপক্ষ’ হলেও রসুল ও উলিল আমরের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো পার্থক্য রয়েছে। যেমন:

১. রসূলের উপরই কুরআন নাযিল করা হয়েছে এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনা অত্যাবশ্যক। কিন্তু উলিল আমর নিজেরা বাছাই করতে হয়, তা ঈমানের বিষয় নয়।

২. আপেক্ষিকভাবে বলা যেতে পারে যে, রসূলের আনুগত্য নি:শর্ত কিন্তু উলিল আমরের আনুগত্য নি:শর্ত নয়। অর্থাৎ যদিও রসূলের আনুগত্যও আল্লাহর অনুমতিক্রমে এবং মা’রুফ বা ন্যায়সঙ্গত ক্ষেত্রে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বস্তুত তিনি আল্লাহর বিধানের বাহিরে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো আদেশ দিতে পারেন না এবং যদি ভুলক্রমে এরূপ করে বসেন সেক্ষেত্রে তাঁকে কুরআনের আয়াতের মাধ্যমেই সংশোধনী দেয়া হয়েছে বিধায় এবং তিনি রিসালাতের ক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম করলে আল্লাহ তাঁকে সরাসরি শাস্তি দেয়ার হুমকি ছিল (অন্য কথায়, বাস্তবে তিনি কোনো ব্যতিক্রম করার কথা নয় বিধায়) রসূলের সাথে মতবিরোধ (তানাযা) করার সুযোগ নেই। কিন্তু উলিল আমরের সাথে মতবিরোধ (তানাযা) করার সুযোগ আছে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এর মানে এ নয় যে, রসূলের কোনো নির্বাহী আদেশ চিরন্তন বিধান হয়ে যেতে পারে। বরং নির্বাহী আদেশের প্রকৃতিই এরূপ হয়ে থাকে যে, তা পরিস্থিতিসাপেক্ষ ও পরিবর্তনীয়। চিরন্তন বিধান শুধুমাত্র একমাত্র সার্বভৌম সত্তা আল্লাহর অধিকার। আর তাই কুরআনের বাহিরে আমাদের জন্য কোনো শাশ্বত বিধান নেই।

৩. রসূলের নির্বাচন ও অপসারনের বিষয়টি আল্লাহর ব্যাপার, অর্থাৎ আল্লাহ যেমন সরাসরি রসূল মনোনীত করেন, তেমনি যদি কোনো রসূলকে অপসারিত করার প্রয়োজন হতো তাহলে তাও তিনিই সরাসরি করতেন এবং এমনভাবে তা করতেন যার ফলে তা স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যেতো। এটি একটি নীতিগত বিষয় কিন্তু বাস্তবে রসূল আল্লাহর বিধানের যথাযথ অনুসারী ছিলেন বিধায় রসূলের অপসারণের কোনো বিষয় ঘটেনি। অন্যদিকে উলিল আমরের নির্বাচন এবং প্রয়োজনে তথা কুরআনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে সেক্ষেত্রে অপসারন করাও কোরআনের আলোকে একটি করণীয় হিসাবে মু’মিনদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত বিষয়।

৪. রসূলের জন্য রসূল হিসেবে আল্লাহ যেসব বিশেষ বিধি-বিধান দিয়েছেন, যা যেকোনো নির্বাহী কর্তৃত্বের সাথে সম্পর্কিত নয়, সেগুলো শুধু রসূলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু উলিল আমরের ক্ষেত্রে শুধু রসূলের সাথে সম্পর্কিত সেইসব বিধিবিধানই প্রযোজ্য, যা রসূল যদি রসূল না হয়ে সাধারণ নির্বাহী কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত থাকতেন সেক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতো। অর্থাৎ যেকোনো নির্বাহী কর্তৃত্বের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, রসূলের প্রসঙ্গে এরূপ যেসব বিধি-বিধান রয়েছে সেগুলোই উলিল আমরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

উলিল আমরের প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব এবং কার্যক্রম, অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধির জন্য প্রসঙ্গক্রমে আল কুরআন অধ্যয়নের একটি পদ্ধতি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন। তা হলো: প্রথমে কুরআন অধ্যয়নকে এভাবে বিবেচনা করতে হবে যে, আমরা রসূলের সমকালকে অধ্যয়ন করছি। কারণ কুরআন রসূলের সমকালীন বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ক্রমে ক্রমে নাযিল হয়েছিল। তারপর এর অধ্যয়নকে এভাবে বিবেচনা করতে হবে যে, আমরা রসূলের পরবর্তীতে রয়েছি, এখন (ক) এর কিছু বিধান আমাদের উপর হুবহু প্রযোজ্য, (খ) কিছু বিধানের প্রয়োগক্ষেত্র এখন নেই, এবং (গ) কিছু বিধানের মূল দিকটি রূপান্তরিত প্রয়োগক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, যেমন, রসূলের সাথে সম্পর্কিত কিছু ধারা উলিল আমরের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে। যেহেতু ‘রসূল ও উলিল আমর’ হলেন ‘আল কুরআনের সমষ্টিগত বিধি-বিধান কার্যকর করার নির্বাহী কর্তৃপক্ষ’, তাই এরূপ কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের প্রেক্ষিতে রসূলের যেসব অধিকার ও দায়িত্ব বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো বর্তমানে উলিল আমরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

বিষয়টি অধিকতর স্পষ্ট করার জন্য পুনরায় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রসূলের কাছে কুরআন নাযিলের মাধ্যমে আল্লাহ মু’মিনদেরকে যেসব বিধান দিয়েছেন তা বাস্তবায়নের জন্য রসূল কুরআন থেকে যেসব আদেশ দিয়েছেন তার আনুগত্য মানে ‘রসূলের সাংবিধানিক দায়িত্ব অনুসারে প্রদত্ত সাংবিধানিক আদেশের আনুগত্য’। যেমন: কুরআনে রসূলকে বলা হয়েছে যে, তিনি যেন মু’মিন নারী-পুরুষদেরকে তাদের লজ্জাস্থান হেফাযত করতে ও দৃষ্টি সংযত রাখতে বলেন। সুতরাং রসূল অবশ্যই তা বলেছেন। এছাড়া রসূল মুসলিম উম্মাহকে পরিচালনার জন্য সাংবিধানিক সীমারেখা সংরক্ষণ করে অনেক নির্বাহী আদেশও দিয়েছেন, যা পরবর্তীকালের লোকদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ নির্বাহী আদেশ সমকালেই প্রযোজ্য হয়। রসূলের আনুগত্য করলে আল্লাহর আনুগত্য করা হয়। কারণ আল্লাহই রসূলের আনুগত্য করার আদেশ দিয়েছেন। অনুরূপভাবে আল্লাহ উলিল আমরের আনুগত্যেরও নির্দেশ দিয়েছেন। তাই উলিল আমর যখন কুরআন থেকে কোনো সাংবিধানিক আদেশ দেন, সেটার আনুগত্য যেমন আল্লাহর আনুগত্য, তেমনি তিনি যখন কুরআনের সীমারেখা সংরক্ষণ করে কোনো নির্বাহী আদেশ দেন, সেটার আনুগত্যও আল্লাহর আনুগত্য। নির্বাহী আদেশ যেহেতু সমকালীন পরিস্থিতিনির্ভর ও পরিবর্তনীয় প্রকৃতির হয়ে থাকে, তাই রসূলের ওফাাতের পর রসূলের আনুগত্য হিসেবে তৎকালীন সময়ে প্রদত্ত কোনো নির্বাহী আদেশের সন্ধান ও আনুগত্য করার অবকাশ নেই, কারণ তাহলে তা আর নির্বাহী আদেশের পর্যায়ে থাকে না, বরং শাশ্বত বিধানে পরিণত হয়ে যায়।

এমতাবস্থায় বর্তমানে নির্বাহী নির্দেশের আনুগত্য শুধুমাত্র উলিল আমরের আনুগত্যের ক্ষেত্রে সম্ভব, রসূলের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। তবে কুরআন অনুসরণ করলে রসূলের ‘সাংবিধানিক আদেশ’ এর আনুগত্য হয়ে যায়। এটা এ বিষয়ের অনুরূপ যে, যে কারো কাছে কুরআন পৌঁছলে তাকে রসূলই কুরআন দ্বারা সতর্ক করছেন বলে সাব্যস্ত হয়।

৪:৬৫ আয়াতে রসূলকে নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারভার অর্পণ করা বা তাঁকে নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের ফায়সালাকারী মানার পূর্বে কেউ মু’মিন হতে পারে না বলে সুষ্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। অবশ্য এ ঘোষণার মাধ্যমে দ্বারা মোটেই এ কথা বুঝায় না যে, এতে রসূলকে সংবিধান প্রণেতা হিসেবে গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। বরং কুরআন হলো সংবিধান সংবলিত গ্রন্থ, আর এর সংবিধান বাস্তবায়নের জন্য রসূলের জীবদ্দশায় তিনি স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক নিযুক্ত সরকার প্রধান। একটি (সংবিধান- কুরআন) হলো বস্তুসত্তা, অন্যটি (সংবিধান বাস্তবায়নের সরকার প্রধান- রসূল) হলো ব্যক্তিসত্তা। উদাহরণস্বরূপ কুরআনে রয়েছে জিনাকারীকে ১০০ বেত দিতে হবে, এখন কেউ কারো বিরুদ্ধে জেনার অভিযোগ নিয়ে কুরআনের কাছে আসবে না এবং কুরআন তা তদন্ত করে কোনো রায় দেবে না যে, হ্যাঁ সে জেনাকারী, বা না সে জেনাকারী নয়; এবং শেষে তার উপর রায় কার্যকর করবে না। বরং এ কাজটি যিনি করবেন তিনিই হলেন এ সংবিধানের বাস্তবায়নকারী নির্বাহী কর্তৃত্ব, তথা রসূলের জীবদ্দশায় রসূলই এ দায়িত্ব পালন করবেন। এখন যদি চারজন সাক্ষী পাওয়া যায়, তাহলে রসূল তাকে জিনাকারী সাব্যস্ত করে রায় ঘোষণা ও রায় কার্যকর করবেন। এতে তিনি তাকে ১০০ বেতের চেয়ে ১ বেত কম বা ১ বেত বেশি দেয়ার সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন না। কারণ এক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ ধারা রয়েছে। যেক্ষেত্রটিকে সংবিধানে ধারাভুক্ত করা হয়নি এমন কোনো ক্ষেত্রে বিষয়টি উপস্থিত পরিস্থিতি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নির্বাহী কর্তৃত্ব সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এ অবকাশ রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে রসূল নিজে কোনো সিদ্ধান্ত দিবেন, এবং সেক্ষেত্রেও তা সেভাবেই মানতে হবে যেভাবে তাঁর দ্বারা কার্যকর সাংবিধানিক ধারার ক্ষেত্রে মানতে হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, নির্বাহী ক্ষেত্র এর কথাটির অর্থই হলো তা পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিসাপেক্ষ। তাই এরূপ দুটি মামলা রসূলের কাছে দুটি ভিন্ন সময়ে আসলে সামগ্রিক বিশ্লেষণ ভিত্তিতে তাঁর নির্বাহী রায় দুই রকম হতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি পূর্বের মামলার রায় সরাসরি পরের মামলায় দিয়ে দিবেন না, বরং পরের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ভিত্তিতে পরের রায় তৈরি হবে। এটাই হলো নির্বাহী ফায়সালার ধরন।

৪:৬৫ আয়াতে রসূলকে ফায়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়টি যে নির্বাহী কর্তৃত্বের বিষয় তা বুঝার জন্য এর পরিপ্রেক্ষিত সম্বলিত পূর্ববর্তী আয়াতসমূহ ৪:৬০-৬৪ সমন্বিতভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। ৪:৬০ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাগুতকে বর্জন করার জন্য। ৪:৬১ আয়াতে বলা হয়েছে যখন আল্লাহ যা নাজিল করেছেন (সংবিধান সম্বলিত কিতাব কুরআন) এবং রসূলের (আসমানী সংবিধানের বাস্তবায়নকারী আল্লাহর নিযুক্ত নির্বাহী কর্তৃত্ব- সরকার প্রধান) এর দিকে ডাকা হয়, তখন মুনাফিকরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। ৪:৬২ আয়াতে বলা হয়েছে, তবে তারা তাদের কৃতকর্মের কারণে কোনো মুসিবতের মুখে পড়লে তখন আল্লাহর নামে শপথ করে রসূলের কাছে এসে বলে যে, আমরা তাগুতের কাছে গিয়েছিলাম আসলে মু’মিনদের প্রতি ইহসানের মনোভাব এবং তাদের তাওফীক্ব যেন বৃদ্ধি পেতে পারে এর বন্দোবস্ত করার উদ্দেশ্যে। ৪:৬৩ আয়াতে তাদের অন্তরের বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ যে জানেন তা উল্লেখ করে তাদেরকে উপেক্ষা করা, সদুপদেশ দেয়া এবং মর্মস্পর্শী কথার মাধ্যমে বুঝানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ৪:৬৪ আয়াতে রসূলকে যে মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ও নিযুক্ত সরকার প্রধান হিসেবেই প্রেরণ করা হয়, যেন মানবজাতি আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর আনুগত্য করে তা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্য রসূল জোর করে এ আনুগত্য আদায় করেন না, বরং যারা মু’মিন হয় মানবজাতির মধ্য থেকে তারাই রসূলের আনুগত্য করে, আর যারা তা করবে না তারা মু’মিনই হবে না। এ বিষয়টি ৪:৬৫ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, যেহেতু আমি তোমাকে রসূল করে পাঠিয়েছি, সুতরাং তোমার প্রভুর শপথ, তারা তোমাকে নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের ফায়সালাকারী না মানা পর্যন্ত মু’মিনই হবে না। এছাড়া তারা তোমার ফায়সালার প্রতি কোনোরুপ কুণ্ঠাবোধও করতে পারবে না। আর তারা ‘ইউসাল্লিমূ তাসলীমা’ তথা ‘সকল ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ বজায় রাখতে হবে’।

“ইউসাল্লিমূ তাসলীমা” বলতে বুঝায়, যতবারই এ ধরনের বিষয়সহ যে কোনো বিষয়ে আল্লাহর আদেশ পরিপালনের মাধ্যমে তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণের প্রশ্ন আসে, ততবারই যেন ধারাক্রমিকভাবে আত্মসমর্পণ করা হয়। ইসলাম হলো আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ, যা একটি সুস্থির নীতি হিসেবে সিদ্ধান্তের বিষয়। (দ্র : ২:১৩১)। আর তাসলীম হলো ধারাক্রমিক ইসলাম/ আত্মসমর্পণ, অর্থাৎ যতবারই কোনো কাজের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের প্রশ্নটি সামনে আসে ততবারই আত্মসমর্পণ। এ বিষয়ে দেখুন ৩৩:২২ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, “ওয়া আম্মা রআল মু’মিনূনাল আহযাবা ক্বলূ হাযা মা ওয়াদানাল্লাহু ওয়া রসূলুহু, ওয়া সদাক্বাল্লাহু ওয়া রসূলুহু, ওয়া মা যাদাহুম ইল্লা ঈমানাওঁ ওয়া তাসলীমা”। অর্থ : “আর যখন মু’মিনগণ (তাদের বিরুদ্ধে) বিভিন্ন হিযব/ সেনাদলকে দেখলো, তারা (মু’মিনগণ) বললো, এটা তো তাই যা আল্লাহ এবং তাঁর রসূল আমাদের সাথে ওয়াদা করেছেন। আর আল্লাহ এবং তাঁর রসূল সত্য বলেছেন। আর এটি তাদের মধ্যে ঈমান ও তাসলীম ছাড়া অন্যরূপ কিছু বাড়ায়নি”। সুতরাং ‘ইউসাল্লিমূ তাসলীমা’ বলতে রসূলের কাছে আত্মসমর্পণ করার কথা বুঝায় না, বরং রসূলের আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকে বুঝায়।

৫:৪৯-৫১ আয়াত থেকেও দুটি বিষয় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, (ক) রসূল (অনুরূপভাবে উলিলি আমরগণ) আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের বিধান অনুযায়ীই বিচার-ফায়সালা করতে হবে এবং (খ) মু’মিনরা আহলে মতাদর্শগত আপোষস্বরূপ বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে না, তাদের মধ্যে যারা তাদেরকে এরূপ বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করবে তারা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হিসেবে সাব্যস্ত হবে। সুতরাং এ থেকে স্পষ্ট যে, মুসলিম উম্মাহ মানবজাতির কল্যাণে কাজ করার দায়িত্ব এবং সাধারণ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদিতে বিভিন্ন কাজ করার সাধারণ অবস্থার পাশাপাশি তাদেরকে তাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা বজায় রাখতে হবে। আর তাই মুসলিম উম্মাহর উলিল আমর বস্তুত তাদেরই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হিসেবে নির্বাচিত হবে, যেকোনো সাধারণ নেতৃত্বকে ‘উলিল আমরি মিনকুম’ (তোমাদের মধ্যকার উলিল আমর) হিসেবে সাব্যস্ত করা হবে না। ৪:৮৩ আয়াতের নির্দেশনা হলো, যেকোনো মুসলিম কোনো নিরাপত্তামূলক ও ভীতিজনক খবর শুনামাত্রই সর্বত্র ছড়িয়ে দিবে না, বরং তারা প্রথমত তা রসূল ও উলিল আমরের কাছেই পৌঁছে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন তাঁরা সেটা একটি তদন্ত ও বিশ্লেষণকারী পরিষদের মাধ্যমে যাচাই করে প্রকৃত করণীয় সম্পর্কিত প্রস্তাবনা তৈরি করতে পারেন। এভাবে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, উলিল আমর বলতে যেকোনো জ্ঞানী-গুণিকে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের যেকোনো কর্তৃপক্ষকে নয়, বরং মুসলিম উম্মাহকে তাদের সমষ্টিগত বিষয়াদিতে পরিচালনার জন্য গঠিত কর্তৃপক্ষকে বুঝানো হয়েছে।

‘উলিল আমর সম্পর্কিত নির্দেশনা’ তথা ইসলামী জীবনব্যবস্থা অনুসরণ ও বাস্তবায়নের বিষয়ে জরুরি জ্ঞাতব্য যে, প্রচলিত বা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনেক বিষয় ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যশীল হলেও যতক্ষণ প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব আল কুরআনের বিধিবিধানকেই একমাত্র সংবিধান হিসাবে মেনে নেবে না এবং সর্বক্ষেত্রে ইসলামের অনুসরণ ও দীন কায়েমের (ইসলামী বিধান বাস্তবায়নের) প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবে না ততক্ষণ তারা মুসলিম উম্মাহর উলিল আমর হিসাবে সাব্যস্ত হবে না।

>>  পরবর্তী পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য ক্লিক করুন