উলিল আমর

আল কুরআনের আলোকে উলিল আমর

মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সমষ্টিগত দায়িত্ব পালনে নেতৃত্ব ও মান্যতার নির্দেশনা

ইখতিলাফ ও তানাযা’ বা মতভেদ ও দ্বন্দ্বের সমাধান প্রক্রিয়া

ইখতিলাফ (মতভেদ) ও তাফরীক্ব (পরস্পর বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি) সম্পর্কে ইতোপূর্বে প্রাসঙ্গিক আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নে মতভেদের ধরন ও এর নিরসন সম্পর্কে মৌলিক লক্ষণীয় বিষয়সমূহে আলোকপাত করা হলো:

৪:৮২ ও ২:১৭৬ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, আল কুরআনে ইখতিলাফ না থাকায় যারা এর মধ্যে (কল্পিত) ইখতিলাফ তৈরি করে তারা আসলে জিদের বশবর্তী হয়েই সত্য থেকে বহুদূরে সরে যায়।

২:২১৩, ১৬:৬৪, ২৭:৭৬, ৪২:১০, ৪৩:৬৩ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের মধ্যে যাবতীয় ইখতিলাফের সঠিক সমাধান রয়েছে, যদিও তা মেনে নিতে বাধ্য করা হয় নি।

২:১১৩, ৩:৫৫, ৫:৪৮, ৬:১৬৪, ১০:৯৩, ১৬:৩৯, ১৬:৯২, ১৬:১২৪, ১৯:৩৭, ২২:৬৯, ৩২:২৫, ৪২:১০, ৪৩:৬৫, ৪৫:১৭ আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ক্বিয়ামাত দিবসেই ইখতিলাফের বাস্তব নিরসন হবে, আর তা হলো যারা অযথা মতভেদ করে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তাদের জন্য শাস্তি রয়েছে।.

২:৭৫, ২:১৪৬, ২:১৫৯-১৬০, ২:১৭৬, ২:২১৩, ৩:১৯, ৩:৭৮, ৩:১০৫, ৪:১৫৭, ১০:৯৩, ১১:১১০, ১৫:৯০-৯৩, ২৩:৫১-৫৩, ৩০:৩০-৩২, ৪১:৪৫, ৪২:১৪, ৪৫:১৭, ৯৮:৪-৫ আয়াতসমূহ থেকে ইখতিলাফ ও ফারাক সৃষ্টির কার্যকারণ ও বাস্তবচিত্র সম্পর্কে জানা যায় যে, জ্ঞানপ্রাপ্তি সত্ত্বেও পরস্পরের উপর বাড়াবাড়ির উদ্দেশ্যে, অনুমানের ভিত্তিতে এবং জেনে বুঝেও সত্য গোপন ও বিকৃতিকরণের ফলে মতভেদ ও পরস্পর বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়।

৪০:৪ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, যখন দুজন ব্যক্তি আল্লাহর আয়াত নিয়ে (কোনো তথ্যের পক্ষে/বিপক্ষে চূড়ান্ত অবস্থান গ্রহণ করে) বিতর্ক করে তখন তাদের উভয়ে বা কোনো একজন আয়াতের প্রতি কাফির বা অবিশ্বাসী হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে। যেহেতু একটি আয়াতের দুটি স্ববিরোধী অর্থ হতে পারে না, তাই যে ব্যক্তি আয়াতটির সঠিক অর্থের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অবস্থান নেয়, সে কাফির হিসেবে পরিগণ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মু’মিনরা আয়াত উপলব্ধির জন্য পরস্পর আলোচনা করতে পারে, কিন্তু পরস্পর ভিন্ন দুটি চূড়ান্ত অবস্থান নিয়ে বিতর্ক করতে পারে না।

সত্য পাওয়ার ইচ্ছা পূর্ণ হওয়ার একটি পূর্বশর্ত হচ্ছে সন্দেহের মধ্যে পড়ে না থাকা তথা সন্দেহ সত্ত্বেও কোন বিষয়কে আঁকড়ে না থাকা বরং প্রথমে সন্দেহাতীত তথ্যে উপনীত হয়ে তারপর চূড়ান্ত অবস্থান গ্রহণ করা (৩৪:৫৪)।

প্রাথমিকভাবে উপলব্ধিজনিত দুর্বলতার কারণে আল কুরআনের কোনো আয়াত বুঝার ক্ষেত্রে ভিন্নতা তৈরি হলেও আল কুরআন দ্বারা যাচাই করলে তা বহাল থাকবে না। কারণ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কথা তো আল কুরআনের কথা নয়, বরং তাতে একটি বিষয়ে এক ধরনের/ অভিন্ন কথাই রয়েছে। এমতাবস্থায়, আল্লাহর আয়াত উপলব্ধির প্রক্রিয়া হিসেবে আলোচনার টেবিলে/ ফোরামে ভিন্ন ভিন্ন কথা প্রাথমিকভাবে আসতে পারে, কিন্তু এর কোনোটি যদি চূড়ান্ত তথ্য হিসেবে প্রমাণিত না হয়, তাহলে তার পক্ষে চূড়ান্ত অবস্থান নিয়ে বিতর্ক হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে ২:৮০, ৭:৩৩, ১৭:৩৬ আয়াতসমূহ লক্ষণীয়।

সুতরাং যদি কোনো ক্ষেত্রে ভুলক্রমে এমন কোনো তথ্যকে যথাযথ বলে প্রতীয়মান হয় যাতে আয়াতটির প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে ভুল হয়েছে বলে পরবর্তীতে বুঝা যায় বা ভুলক্রমে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার পর ঐ তথ্যের বিপরীতে অধিক যুক্তিসমৃদ্ধ তথ্য সামনে আসে তাহলে অবশ্যই নিজের পূর্বতন উপলব্ধিকে সংশোধন করে নিতে হবে।

কুরআনের কোনো আয়াতের উপলব্ধির ক্ষেত্রে মতভেদ নিরসনের জন্য কুরআনকেই প্রয়োগ করতে হবে এবং যারা উপলব্ধিগত পার্থক্য করবেন যতক্ষণ তারা কুরআনকেই তাদের দলীল হিসেবে সাব্যস্ত করেন ততক্ষণ উভয় পক্ষ একই আয়াতসমূহকে (১১৪ সূরার ৬২৩৬ আয়াত) নিজেদের উপলব্ধির যাচাইয়ের মাপকাঠি সাব্যস্ত করে বিধায় ঐ মতভেদ মূলগতভাবে সংশোধনযোগ্য।

বস্তুত কুরআন স্ববিরোধমুক্ত হওয়ায় মতভেদের উভয় পক্ষ কুরআনের আয়াতের সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধিকারী হতে পারে না। অন্য কথায় কোনো আয়াতের সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধি ও উপস্থাপন করলে আয়াতে বিশ্বাসীদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হতে পারে না। কুরআন মতভেদ সৃষ্টি বা বৃদ্ধি করার জন্য আসেনি, মতভেদের অবসান করার জন্য এসেছে। সুতরাং কোনো বিষয়ে কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন সঠিক উপলব্ধিতে উপনীত করবে। কুরআন এমন দুর্বল বক্তব্যের সমষ্টি নয়, যার ফলে মতভেদের সমস্যা তৈরি হয় অথচ তার সমাধান অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে মতভেদ বজায় রাখার কারণ হয়ে থাকে হঠকারিতা, আর তা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, তাই আল্লাহ কিয়ামাত দিবসেই সকল মতভেদের চূড়ান্ত অবসান ঘটাবেন।

যা আল্লাহর বিধান নয় এবং আল্লাহ কর্তৃক সত্যায়িত নয় এমন কোনো ভিত্তির উপর সবাই কোনো বিষয়ে একমত হয়ে গেলেও সেটা আল্লাহর বিধানের অনুসরণ হিসেবে সাব্যস্ত হয় না।

যে বিষয়কে আল্লাহ অনির্দিষ্ট রেখেছেন এমন কোনো কিছুকে নির্দিষ্ট করে নেয়ার নাম মতভেদের নিরসন নয়। বরং এ ধরনের বিষয়কে অনির্দিষ্ট রাখাটাই আল্লাহর বিধানের দাবি। কারণ যদি সুনির্দিষ্টকরণ প্রয়োজন হতো তাহলে আল্লাহর বিধানগ্রন্থের মাধ্যমেই তা সুনির্দিষ্টকরণ করা যেতো।

কুরআনে উল্লেখিত বিভিন্ন তথ্যের উপলব্ধির ক্ষেত্রে বিভিন্নতা বজায় থাকার বহুবিধ কারণ থাকতে পারে, যথা:

(ক) উপলব্ধিগত পার্থক্য এবং তা পুনর্বিবেচনার পথ রুদ্ধ করে দেয়া,

(খ) উপলব্ধিগত পার্থক্যকে গোষ্ঠীগত উপলব্ধির রূপদান তথা যারা যে ব্যক্তির উপলব্ধিকে সঠিক বলে ধরে নিয়েছে তা পুনর্বিবেচনার পথ রুদ্ধ করে দেয়া এবং

(গ) ইচ্ছাকৃতভাবে কুরআনের তথ্যকে বিচ্ছিন্নভাবে ভুল উপলব্ধির জন্য ব্যবহার করা।

যেহেতু কুরআন স্ববিরোধমুক্ত তাই এর সঠিক উপলব্ধিই মতবিরোধমুক্ত হবে, এটাই চূড়ান্ত কথা। কিন্তু যখন তাতে মতভেদ হয়, সেক্ষেত্রে প্রত্যেক ভিন্ন উপলব্ধি ধারণকারীরা যদি কুরআন দ্বারা সমাধানের নীতিকে মেনে নেয় তথা কুরআনকেই চূড়ান্ত দলীল হিসেবে গ্রহণ করে, তাহলে এর সমাধানের জন্য তারা অনির্দিষ্টকালের সময়সীমায় প্রচেষ্টারত থাকতে পারে। এমতাবস্থায় তারা একই মূল গ্রন্থকে দলীল মানার কারণে, উপলব্ধিগত ভিন্নতা সত্ত্বেও তারা মূলনীতিগত কারণে ঐক্যবদ্ধ বা একক উম্মাহ হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে এবং যেসব ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত অনুবাদগত ত্রুটি চিহ্নিত করা সম্ভব হয় সে ক্ষেত্রে অনুবাদের সম্পাদনার মাধ্যমে মতভেদের নিরসনের প্রক্রিয়া প্রক্রিয়াশীলতার সাথে চলমান থাকবে। কারণ সত্যাগ্রহীদের কাছে সত্য তথ্য সামনে এলে ভুল তথ্যের ভুল সহজেই ধরা পড়ে যায়।

কোনো বিষয়ে আপাত মতভেদের নিরসনের উপায় হলো, স্বীয় উপলব্ধিকে অন্যদের উপর চাপিয়ে না দেয়া এবং সুন্দর সমাধান বুঝার যৌথ প্রচেষ্টায় আলোচনা চলমান রাখা এবং জরুরি না হলে আপাত সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা এবং আপাত সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি হলে পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং তাতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ না করা।

কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছার পূর্বে অন্তর্বর্তীকালীন অনুসরণীয় মূলনীতিসমূহ :

(১) বিবেকসংগত সিদ্ধান্ত অনুসারে চলা।

(২) এমন পদক্ষেপ না নেয়া যা দ্বারা পরে অনুতপ্ত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে, অর্থাৎ বিবেক-সম্মত বিষয়টি অন্যের উপর কোন নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির মতো হতে পারবে না, যেমন দোষ প্রমাণ না হলে দোষী ব্যক্তি মুক্তি পায়, কারণ একজন দোষী ব্যক্তি মুক্তি পাওয়া, একজন নির্দোষ ব্যক্তি শাস্তি পাওয়ার তুলনায় ভালো।

(৩) যদি কেউ প্রচলিত নিয়ম মানতে বাধ্য করে তাহলে তা ওজর হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

(মূলনীতিগুলো নির্ণিত হয়েছে ২৪:১১-২০, ৪৯:৬, ৩:২৮ ও ১৬:১০৬ এর শিক্ষা অনুযায়ী)।

অন্যদিকে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য মোনাফেকিসুলভ কার্যক্রম পরিচালনা করবে তথা কুরআনের তথ্যের নামে কুরআনের কোনো আয়াতকে বিচ্ছিন্নভাবে ভুল উপলব্ধির জন্য কাজে লাগাবে তারা মূলত নিজেদেরকেই বিভ্রান্ত রাখবে। কারণ তাদের প্রচারণা দ্বারা যদি কোনো সত্য সন্ধানী অনিচ্ছাকৃতভাবে সাময়িকভাবে কোনো বিভ্রান্তিকর অবস্থায় থাকে, তাতে তা তার জন্য দোষনীয় হবে না, যেরূপভাবে নবী ইবরাহীম অন্তর্বর্তীকালে চাঁদ, গ্রহ ও সূর্যকে প্রভু বললেও কুরআনে বারবার ঘোষণা এসেছে যে, ইবরাহীম (সা.) মুশরিক ছিলেন না।

যারা ঐকান্তিকতার সাথে কুরআনকে একমাত্র দলীল হিসেবে গ্রহণ করবেন কুরআনের বিধান অনুসরণ করার কারণে তাদের মধ্যে অবশ্যই দ্বীনী ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠবে এবং তারা সাধ্যমতো আল্লাহর ভয় অনুসারে তাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবন পরিগঠনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে যাবে।

সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে তানাযা’ বা মতবিরোধের কারণ ও ফলাফল

তানাযা’ অর্থ মতবিরোধ। অর্থাৎ যখন কোনো বিষয়ে মতভেদ (ইখতিলাফ) থেকে মতামত বিষয়ক বিরোধ তৈরি হয় বা প্রত্যেক পক্ষ নিজ মতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দ্বন্দ্বমূলক অবস্থান গ্রহণ করে তখন তাকে তানাযা’ বলা হয়। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তানাযা’ বা মতবিরোধ কাঙ্খিত না হলেও বিভিন্ন কারণে তা সংঘটিত হতে পারে।

নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে অভিমত পর্যায়ে জিদাল বা বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। এ বিষয়ে রসূলের সাথে এক নারীর বিতর্ককে কুরআনে সমর্থনের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা যেতে পারে, যা থেকে কুরআন অনুসারে এবং রসূলের যুগে মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াত লক্ষণীয়:

৫৮:১-২ :: নিশ্চয় আল্লাহ শুনেছেন সে নারীর কথা যে তোমার সাথে তার স্বামীর ব্যাপারে বিতর্ক করেছে আর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছে। আর আল্লাহ তোমাদের দুজনের কথোপকথন শুনছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদের স্ত্রীকে যিহার করে (অর্থাৎ মায়ের মতো হিসাবে প্রকাশ করে) তাদের স্ত্রীরা তাদের মা হয়ে যায় না। যারা তাদেরকে জন্ম দিয়েছে তারা ছাড়া কেউ তাদের মা নয়। আর নিশ্চয় তারা তো অত্যন্ত মন্দ ও অসত্য কথাই বলছে। আর নিশ্চয় আল্লাহ উদার ক্ষমাশীল।

সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ এবং একে অন্যের মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করার স্বাধীনতা থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গৃহীত সিদ্ধান্তের মূল্যায়ন বা যৌক্তিকতা যাচাই সাপেক্ষে প্রয়োজনে দ্বিমত পোষণ না করলে সিদ্ধান্তে ভুল থাকলে তা চালু হয়ে যাবে বা চালু থাকবে। আবার দ্বিমত পোষণের ভিত্তিতে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যাওয়া সঠিক হবে না। বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিষয়টির মীমাংসা বা সমাধান করতে হবে। আর ৪:৫৯ আয়াত অনুযায়ী তানাযা’ বা মতবিরোধের সমাধান করতে হবে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে।

যদি উলিল আমরের কোনো সিদ্ধান্ত আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয় না হয়, তাহলে পরিস্থিতি সাপেক্ষ বিষয় বিধায় (অন্যকথায়, সাংবিধানিক কোনো ধারার লঙ্ঘন হয়নি, কিন্তু নির্বাহী সিদ্ধান্ত হিসেবে পরিস্থিতি অনুসারে সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি বলে মনে করলে, সেক্ষেত্রে) তানাযা’ বা মতবিরোধ করা বা বজায় রাখা সঠিক হবে না। বরং এক্ষেত্রে নেতৃত্বের নির্দেশ পালন করতে হবে। কারণ তাঁকে উলিল আমর হিসেবে নির্ধারিত করা হয়েছে তথা নির্দেশ দেয়ার অধিকার দেয়া হয়েছে। তাই নিজের ভিন্নমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। বরং পরিস্থিতি মোকাবেলায় কেন নিজের অভিমত উত্তম তা পুনর্বিবেচনার জন্য বিভিন্ন সময় তুলে ধরা যেতে পারে।

নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তানাযা’ বা মতবিরোধ নিজেদের সাহস ও শক্তি হ্রাস করে এবং এর ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ঘটতে থাকে। তাই মতভেদ যেন তানাযা’ বা মতবিরোধে পরিণত হতে না পারে সেদিকে সচেষ্ট থাকা উচিত। ঘন ঘন তানাযা’ বা মতবিরোধ সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

৮:৪৬ :: আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের মধ্যে তানাযা’ বা মতবিরোধ করো না। অন্যথায় (নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ করলে) তোমরা সাহস ও জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলবে। আর তোমরা সবর করো। নিশ্চয় আল্লাহ সবরকারীদের সাথে থাকেন।

৩:১৫২ :: নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর ওয়াদাকে সত্যে পরিণত করেছেন, যখন তোমরা তাদেরকে (কাফিরদেরকে) সচেতনভাবে মোকাবিলা করছিলে, যতক্ষণ না তোমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছো এবং তোমাদের কাজের বিষয়ে তানাযা’ বা নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ করেছো এবং তোমরা যা পছন্দ করো তা তোমাদেরকে দেখানোর পর অবাধ্যতা করেছো। তোমাদের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা দুনিয়া পেতে ইচ্ছা করে এবং তোমাদের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা আখিরাত পেতে ইচ্ছা করে। তারপর তিনি তোমাদেরকে তাদের (প্রতিরোধ করা) থেকে সরিয়ে দিয়েছেন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। আর নিশ্চয় শেষ পর্যন্ত তিনি তোমাদের প্রতি উদারতা দেখিয়েছেন। আর আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি অনুগ্রহশীল।

কুরআনে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলে কোনো মু’মিন তাতে ভিন্নরূপ করার ইখতিয়ার বা অধিকার রাখে না, অর্থাৎ সেক্ষেত্রে ভিন্নরূপ করলে সে আর মু’মিন হিসেবে সাব্যস্ত হবে না। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতটি লক্ষণীয়:

৩৩:৩৬ :: আর কোনো মু’মিনের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোনো বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিলে সেই বিষয়ে ভিন্নরূপ (মত পোষণ ও কার্য সম্পাদন) করার ইখতিয়ার (স্বাধীনতা) নেই। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হয় সে স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হয়।

অন্যদিকে ৪:৫৯ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, উলিল আমরের সাথে তানাযা’ বা মতবিরোধের সৃষ্টি হতে পারে, যার সমাধানের জন্য তা আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে। এ নির্দেশনা থেকে এটিও প্রমাণিত হয় যে, রসূলের সাথে তানাযা’ বা মতবিরোধের অবকাশ নেই, বরং মু’মিনদের নিজেদের মধ্যে এবং উলিল আমর ও অন্য মু’মিনদের মধ্যে তানাযা’ বা মতবিরোধ হতে পারে, যার সমাধানের জন্য রসূলের দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

বস্তুত নিম্নরূপ কারণের প্রেক্ষিতে উলিল আমরের সাথে তানাযা’ বা মতবিরোধের উৎপত্তি ঘটতে পারে:

১. তাঁর কোনো কাজ বা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কুরআনে থাকা কোনো নির্দেশের তথা কোনো সাংবিধানিক বিধানের লঙ্ঘন সম্পর্কিত আপত্তি তৈরি হলে। বাস্তবে অনেক সময় এরূপ আপত্তি সঠিক নাও হতে পারে এবং কোনোরূপ ব্যক্তিগত জিদ থেকে আপত্তি তৈরি হতে পারে। যখন মতবিরোধের মীমাংসার উদ্যোগ নেয়া হবে তখন মতবিরোধ সঠিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল নাকি তা সঠিক হয়নি তা বুঝা যাবে। উম্মাহর ঐক্য, শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতার জন্য মতবিরোধের মীমাংসা জরুরি। যদি উলিল আমর সত্যিকারার্থে কোনো সীমা লঙ্ঘন করে থাকেন এবং সংশোধিত না হন তাহলে তাঁর আনুগত্য করা যাবে না, বরং তাঁকে ‘উলিল আমর’ পদ থেকে অপসারিত করতে হবে এবং নতুন ‘উলিল আমর’ নির্বাচিত করতে হবে।

২. কুরআনের কোনো সীমা লঙ্ঘন না করে নির্বাহী ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত কোনো সাধারণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সর্বাধিক যথোপযুক্ততার প্রশ্নে মতভেদ থাকলেও উলিল আমরের নির্দেশের আনুগত্য করতে হবে, যতক্ষণ না সংশোধনী প্রক্রিয়ায় (ইসলাহ) উলিল আমর কর্তৃক ঐ মতকে পুনর্বিবেচনা করে নতুন সিদ্ধান্ত দেয়া না হয়। কিন্তু যদি উলিল আমর স্বেচ্ছাচারী আচরণ (প্রবৃত্তি বা খেয়ালখুশির অনুসরণ) শুরু করে, যাতে ন্যায়নীতি (মা’রূফ) লঙ্ঘন হয়, তবে সেটাও কুরআনের নির্দেশনারই লঙ্ঘন এবং তাই সেক্ষেত্রেও উলিল আমরের আনুগত্য করা যাবে না, বরং নতুন ‘উলিল আমর’ নির্বাচন করতে হবে। অবশ্য সেজন্য এরূপ অভিযোগ সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হতে হবে।

উলিল আমরের সাথে তানাযা’ বা মতবিরোধের সমাধান পদ্ধতি

৪:৫৯ আয়াতে আল্লাহর, তাঁর রসূলের ও উলিল আমরের আনুগত্য করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং উলিল আমরের সাথে তানাযা’ বা মতবিরোধের সমাধান পদ্ধতি হিসেবে আল্লাহর ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিম্নে আয়াতটি উল্লেখ করা হলো:

৪:৫৯ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রসূলের ও তোমাদের মধ্য থেকে হওয়া উলিল আমরের (আমীরের/ সমষ্টিগত পরিচালনার দায়িত্বশীল নেতার), তারপর যদি কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে তানাযা/ মতবিরোধ হয়, তাহলে তার সমাধানের জন্য ফিরিয়ে দাও আল্লাহর দিকে এবং তাঁর রসূলের দিকে, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রেখে থাকো। এটাই উত্তম (কর্মপদ্ধতি) এবং পরিণামে সর্বোত্তম।

আল্লাহর আনুগত্য বলতে বুঝায় আল্লাহ প্রদত্ত সংবিধান (আল কুরআন) অনুসরণ করা।

রসূলের আনুগত্য বলতে আল কুরআনের বিধি-বিধান বাস্তবায়নে আল্লাহ কর্তৃক মনোনয়নের প্রেক্ষিতে পদাধিকার বলে প্রধান নির্বাহী হিসেবে রসূলকে মেনে নিয়ে তাঁর আনুগত্য করা, যাতে তাঁর নির্বাহী আদেশের আনুগত্যও অন্তর্ভুক্ত।

আর উলিল আমরের আনুগত্য বুঝায়: (ক) রসূল যাকে যে বিভাগের দায়িত্ব দিয়েছেন সে বিভাগের ক্ষেত্রে তার আনুগত্য করা, এবং (খ) রসূলের মনোনয়নের ভিত্তিতে বা মু’মিনদের পরামর্শক্রমে নির্বাচিত ও রসূলের অনুমোদনের ভিত্তিতে যাকে যেখানে যখন রসূল উপস্থিত থাকবেন না সেখানে রসূলের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রতিনিধি করা হয়েছে তার আনুগত্য করা।

তারপর উলিল আমরের সাথে তানাযা’ বা মতবিরোধ হলে তা সমাধানের জন্য আল্লাহর ও তাঁর রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ‘আল্লাহর দিকে ও তাঁর রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার বাস্তব প্রয়োগ’ নিম্নরূপ:

আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেয়ার অর্থ কুরআনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত বা ফায়সালা করার দিকে ফিরিয়ে দেয়া, যদি কুরআনে নির্দেশ থাকে হলে সে নির্দেশই চূড়ান্ত, অন্যথায় বিষয়টিতে ভিন্নমতের অবকাশ আছে হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়া বলতে রসূলের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের দিকে ফিরিয়ে দেয়া বুঝায় না। বরং এর অর্থ হলো রসূল আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের ভিত্তিতে ফায়সালা করার জন্য ফিরিয়ে দেয়া। অন্য কথায় আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেয়ার প্রায়োগিক রূপ হবে নাযিলকৃত কিতাব অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতি অবলম্বন করা এবং রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার প্রায়োগিক রূপ হবে রসূল সমগ্র বিবাদের বিবরণ জেনে কিতাব অনুসারে প্রাপ্ত ফায়সালা জানিয়ে দেয়ার জন্য তাঁকে ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে নেয়া। ৪:৬৫ আয়াতে রসূলকে ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত কেউ মু’মিন হতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং ৩:২৩, ৪:১০৫, ৫:৪৩, ৫:৪৮, ৫:৪৯ প্রভৃতি আয়াত অনুযায়ী আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাব অনুযায়ী ফায়সালা করাই রসূলের দায়িত্ব।

কুরআনে নবী ও রসূল প্রসঙ্গে থাকা আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ যাঁকে নবী মনোনীত করেছেন তিনি মু’মিনদের মধ্যে থেকে নেতৃত্বমূলকভাবে আল্লাহর বিধান চর্চা করে থাকেন এবং এক্ষেত্রে কখনো তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত বা সিদ্ধান্তে ভুল-ত্রুটি ঘটতে পারে, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে সংশোধন করে দেয়া হয়। অন্যদিকে আল্লাহ যাঁকে রসূল মনোনীত করেছেন তিনি রসূল হিসেবে ভূমিকা পালনকালে রিসালাত তথা নাযিলকৃত বিধানের সরাসরি উপস্থাপন ও প্রয়োগের প্রতিনিধিত্ব করেন। আর তাই এক্ষেত্রে রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশের তাৎপর্য হলো:

রসূল বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন যে, আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী মতবিরোধের কোন পক্ষ সঠিক অবস্থানে রয়েছে।

উপরোল্লেখিত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যদি উলিল আমরের আনুগত্য না করে মতবিরোধ করার বিষয়টি আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাবের কোনো বিধান লঙ্ঘনজনিত কারণে বলে প্রমাণিত না হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে রসূল কোনো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবেন না, বরং স্বাভাবিক শৃঙ্খলা বিধি তথা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত মু’মিনদের উপর উলিল আমরের আনুগত্যের ধারা বহাল থাকবে।

রসূলের ওফাতের পর তথা বর্তমানে রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার শিক্ষা প্রয়োগ নিম্নরূপ হবে:

(ক) অন্যান্য উলিল আমরের সাথে মতবিরোধকে প্রধান উলিল আমরের দিকে ফিরিয়ে দেয়া, যেহেতু রসূল তৎকালে সকল উলিল আমরের উপর প্রধান দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তিনি আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত হওয়ার কারণে পদাধিকারবলে এ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তাঁর পদবী হিসেবে ‘রসূল’ শব্দটিই যথোপযুক্ত ছিল। তাই বর্তমানে যিনি প্রধান উলিল আমর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনিও অন্যান্য উলিল আমরের উপর দায়িত্বশীল হিসেবে রসূলের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবেন।

(খ) প্রধান উলিল আমরের সাথে মতবিরোধ যখন দুই দলের দ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটায় তখন ৪৯:৯ আয়াতের নির্দেশনা অনুসারে মু’মিনদের মধ্যকার নিরপেক্ষ তৃতীয় দলকে ভূমিকা রাখতে হবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাহী পরিষদের মাধ্যমে এর সমাধান করার জন্য। অন্য কথায় তখন অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাহী পরিষদের দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে এবং ঐ অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাহী পরিষদই রসূলের প্রতিনিধিত্ব করবেন।

ফায়সালার কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। কিছু মতভেদের বিষয় অনির্দিষ্টকালের জন্য ধারাবাহিক আলোচনার জন্য সংরক্ষিত থাকতে পারে। কিছু মতভেদের বিষয়ে বাস্তব প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে পরামর্শ পদ্ধতি অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো নীতি ঠিক করে সে ভিত্তিতে আপাত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতে পারে। সর্বোপরি, পারস্পরিক বাড়াবাড়ি পরিহার করে কল্যাণ চিন্তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

উলিল আমরের সাথে মতভেদের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত অবস্থান ও উলিল আমরের অবস্থান এবং বিচ্ছিন্নতা প্রতিরোধ ও বাস্তব বিচ্ছিন্নতার প্রতিক্রিয়া

জামিয়া বা সংঘবদ্ধতা, ইতায়াত বা আনুগত্য, তানাযা’ বা মতবিরোধ এবং ইসলাহ বা মীমাংসা সম্পর্কিত আয়াতসমূহের ভিত্তিতে উলিল আমরের সাথে মতভেদের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত অবস্থান ও উলিল আমরের অবস্থান এবং বিচ্ছিন্নতা প্রতিরোধ ও বাস্তব বিচ্ছিন্নতার প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে নিম্নরূপ কর্মনীতি নির্ণয় করা যায়:

১। ব্যক্তিগত অবস্থান (ক): একজন মু’মিন যদি বুঝতে পারে যে, ইসলামের নামে কাজ করা এবং নিজেদেরকে ‘মুসলিম উম্মাহ, বিহাবলিল্লাহি জামিয়া’ হিসেবে দাবি করা বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে কোনোটি সত্যিকারার্থে কুরআনিক নীতিমালা অনুসরণ করে থাকে, তাহলে সেটাকেই ব্যক্তিগত বিবেচনায় প্রকৃত উম্মাহ ও জামিয়া সাব্যস্ত করে তাতে অংশগ্রহণ করবে। এমতাবস্থায় অন্যান্য সংগঠনের বিপরীতে বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই, আল্লাহর তৈরি নৈতিক-প্রাকৃতিক নিয়মে এবং আল্লাহর ইচ্ছা ও সাহায্যক্রমে প্রকৃত মুসলিম উম্মাহ নিজ অবস্থানে নিজ দায়িত্ব পালনে দায়মুক্ত ও প্রগতিশীল অবস্থায় থাকবে।

ব্যক্তিগত অবস্থান (খ): যদি উলিল আমর কুরআনভিত্তিক নীতিমালা লংঘন করেন এবং সংশোধনী দেয়া সত্ত্বেও সংশোধিত না হন বরং বাড়াবাড়ি করেন এবং এক্ষেত্রে একদল প্রবলভাবে তাঁকে সমর্থন করে, তাহলে ঐ উলিল আমরের আনুগত্য করা যাবে না, অন্যদের দৃষ্টিতে আনুগত্য ত্যাগকারী সাব্যস্ত হলেও সাংগঠনিক পরিশুদ্ধির আশা তিরোহিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সে লক্ষ্যে ধীর প্রক্রিয়ায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ঐরূপ আশা তিরোহিত হলে যারা কুরআনভিত্তিক প্রকৃত নীতিমালা চর্চা করবে তাদেরকে নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। পূর্বতন সংগঠন কাঠামো এটিকে বিচ্ছিন্নতা হিসেবে সাব্যস্ত করলেও বস্তুত এক্ষেত্রে তাদের উপর বাড়াবাড়ি ছাড়াই নিজেদের মধ্যে সঠিক নীতিমালার চর্চা করে যেতে হবে, তাহলে নিজেরা দায়মুক্ত ও আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হতে পারবে। বস্তুত যে বা যারা কুরআনভিত্তিক নীতিমালা বজায় রাখবে সে বা তারাই প্রকৃত মুসলিম উম্মাহ।

২। উলিল আমরের অবস্থান (ক): যে ব্যক্তি উলিল আমরের সাথে অযথা মতভেদ করে এবং তা নিরসনের সঠিক উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও তার মতভেদের উপর অযৌক্তিকভাবে অটল থাকে এবং আনুগত্য পরিহার করে, তাকে প্রয়োজন সাপেক্ষে দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে। তাকে তার মতো থাকতে দেয়া যাবে তবে সে যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে কিন্তু বাড়াবাড়ি করা যাবে না।

উলিল আমরের অবস্থান (খ): যদি একদল লোক অযথা মতভেদকে কেন্দ্র করে পৃথক হয়ে যায় তবে সঠিক নীতিমালার ভিত্তিতে তাদেরকে একত্রিত রাখার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যদি তা সম্ভব না হয়, তবে তারা বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করার প্রেক্ষিতে তাদের উপর বাড়াবাড়ি করা যাবে না, বরং নিজেরা সঠিক নীতিমালার ভিত্তিতে কাজ করে যেতে হবে।

৩। বিচ্ছিন্নতা প্রতিরোধে ভূমিকা: সাধারণত দেখা যাবে যে, প্রত্যেক ফিরক্বা নিজেদেরকে সঠিক এবং অন্যদেরকে অসঠিক নীতিমালা চর্চাকারী বলে দাবি করে থাকে। আবার আল্লাহ যে উম্মাহকে একীভূত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং বিচ্ছিন্নতার জন্য নিষেধ করেছেন সেটাও কোনো ফিরক্বা অস্বীকার করতে পারে না। এমতাবস্থায় প্রত্যেকেই দাবিও করে যে, তারা মতভেদ ও ভুল বুঝাবুঝি দূর করার ক্ষেত্রে আন্তরিক প্রচেষ্টা করছে। কিন্তু দাবি করার চেয়ে বড় বিষয় হলো বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত প্রকৃত মু’মিনরা বাস্তবে এজন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং এমনকি প্রয়োজনে তারা নিজেরা আলাদা টীম ওয়ার্কের মাধ্যমে ক্রমে প্রকৃত নীতিমালাভিত্তিক উম্মাহতে পরিণত হতে চেষ্টা করতে হবে।

৪। উলিল আমর যখন রাষ্ট্রনেতা সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক পর্যায়ে মতভেদ: উলিল আমর যদি রাষ্ট্রনেতা থাকা অবস্থায় কুরআনিক বিধানের লংঘন করা শুরু করেন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করেন তবে সেক্ষেত্রে তাকে সংশোধন করা সম্ভব না হলে অবশ্যই যারা তাকে সমর্থন যোগাচ্ছে তাদের থেকে স্বতন্ত্রভাবে যারা কুরআনের নীতিমালার প্রকৃত চর্চা করছে তারা উম্মাহর কার্যক্রম পরিচালনা করবে। আর ঐ রাষ্ট্রপতি পদে থাকা উলিল আমরের (তথা যে নিজেকে মু’মিনদের উলিল আমর দাবি করে অথচ কুরআনের সীমা লঙ্ঘন করে যাচ্ছে তার) রাজনৈতিক জুলুমের মোকাবেলায় নীতিগত বিদ্রোহ বা প্রতিবাদ এবং নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পরিবর্তনের প্রচেষ্টা করতে হবে।

মুসলিম উম্মাহর জামিয়ার ক্ষেত্রে মুনাফেক্বীর প্রতিবন্ধকতা

মুসলিম উম্মাহর জামিয়া বা সংঘবদ্ধতার ক্ষেত্রে মুনাফিক্বদের মুনাফেক্বীর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়। তাই এ বিষয়ে যথাসম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তবে মু’মিনরা আল্লাহর উপর ভরসা রেখে তাঁর প্রদত্ত নির্দেশনার সঠিক অনুসরণ করলে বিভিন্ন পর্যায়ে মুনাফিক্বরা আলাদা হয়ে পড়বে। যদিও তাদের মধ্যকার মুনাফেক্বী সম্পর্কে গায়েব সম্পর্কিত তথ্য জানার কোনো পদ্ধতি নেই, তবুও তাদের কর্মকাণ্ড থেকেই তাদের মুনাফেক্বী প্রকাশ পেয়ে যাবে। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

৬৩:৪ :: আর যখন তুমি তাদেরকে দেখবে, তখন তাদের দেহাবয়ব তোমাকে মুগ্ধ করবে। আর তারা যখন কথা বলবে তখন তুমি তাদের কথা সাগ্রহে শুনবে। অথচ তারা নিজেরা দেয়ালে ঠেস দেয়া কাঠের মতো (চেতনাহীন, নিশ্চল)। তারা প্রতিটি আওয়াজকে তাদের বিরুদ্ধে মনে করে। তারাই শত্রুতাকারী। সুতরাং তাদের সম্পর্কে সচেতন থাকো। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন! তাদেরকে কোথায় ফিরানো হচ্ছে!

৬৪:১৪ :: হে যারা ঈমান এনেছো, নিশ্চয় তোমাদের স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের প্রতি শত্রুতাকারী। সুতরাং তোমরা তাদের বিষয়ে সচেতন থাকো। আর যদি তোমরা উদারতা প্রদর্শন করো ও উপেক্ষা করো ও ক্ষমা করে দাও, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।

৯:১০৫ :: আর বলো, “তোমরা (যারা জিহাদের আহবানে সাড়া দিতে গড়িমসি করেছে) কাজ করতে থাকো। শীঘ্রই আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং মু’মিনগণ তোমাদের কাজ দেখবেন (যে, তোমরা মুনাফিক্বদের মতো কাজ করো নাকি মু’মিনদের মতো)। আর শীঘ্রই তোমাদেরকে সেই সত্তার কাছে ফিরিয়ে নেয়া হবে যিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যমান বিষয়ে জ্ঞানী। তখন তিনি তোমাদেরকে তা জানিয়ে দিবেন যা তোমরা করতে।

৩:১৭৯ :: আল্লাহ এমন নন যে, তিনি মুমিনদেরকে (এমন অবস্থায়) ছেড়ে দেবেন যার উপর তোমরা আছ (অর্থাৎ মু’মিন ও মুনাফিক্বদের সংমিশ্রিত অবস্থা)। যতক্ষণ না তিনি পৃথক করবেন অপবিত্রকে (মুনাফিক্বদেরকে) পবিত্র (মু’মিনদের) থেকে। আর আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তোমাদেরকে গায়েব সম্পর্কে জানাবেন। তবে সেজন্য আল্লাহ তাঁর রাসূলদের মধ্য থেকে যাকে চান বেছে নেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন। আর যদি তোমরা ঈমান আন এবং স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন কর তবে তোমাদের জন্য রয়েছে মহাপ্রতিদান।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কাফির ও মুনাফিক্বদের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তাই যারা ন্যায়সঙ্গত ক্ষেত্রেও উলিল আমরের আনুগত্য পরিহার করে এমন ব্যক্তিদেরকে অবশ্যই দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে অপসারিত করতে হবে।
তবে যারা ঈমান আনা ও আনুগত্য করার পর তা পরিহার করে ও মুনাফেক্বী করে তাদের উপর কোনো বাড়াবাড়ি করা যাবে না, যতক্ষণ না তারা কোনো ফৌজদারি অপরাধ করে। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

২৬:২১৫-২১৬ :: এবং মু’মিনদের মধ্য থেকে যারা তোমার অনুসরণ করে তাদের প্রতি তোমার বাহুকে অবনত করো। তারপর যদি তারা তোমাকে অমান্য করে, তবে বলো, নিশ্চয় তোমরা যা করো তা থেকে আমি সম্পর্কহীন ও দায়মুক্ত।

৩:৬৯-৭৪ :: আহলে কিতাবীদের একদল চায় যেন তোমাদেরকে বিপথগামী করতে পারে, অথচ তারা নিজেদেরকেই বিপথগামী করে। কিন্তু তারা তা অনুভব করে না। হে আহলে কিতাব, কেন তোমরা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করো অথচ তোমরাও (সাধারণভাবে উহার সত্যতার) সাক্ষ্য দান করো। হে আহলে কিতাব, কেন তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো এবং সত্যকে গোপন করো অথচ তোমরা নিজেরাই তা জানো। আহলে কিতাবের একদল বললো, “যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রতি যা নাজিল হয়েছে (আল কুরআন) তোমরা উহার প্রতি দিনের শুরুর অংশে ঈমান আনো এবং দিনের শেষ অংশে তা প্রত্যাখ্যান করো যাতে তারা (সঠিকভাবে ঈমান আনয়নকারীরা তোমরা এর মধ্যে গলদ পেয়েছো ভেবে তোমাদের দেখাদেখি তা থেকে) ফিরে যায়। যারা তোমাদের ধর্মমতে চলবে, তাদের ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করবে না”। বলো, নিঃসন্দেহে হেদায়েত সেটাই, যে হেদায়েত আল্লাহ করেন। (বিশ্বাস করো না) এ মর্মে যে, তোমাদেরকে যা দেয়া হয়েছে তার অনুরূপ অন্য কাউকে দেয়া হবে অথবা তোমাদের প্রভুর সামনে তারা তোমাদেরকে যুক্তিতে পরাভূত করবে। বলো,, মর্যাদা আল্লাহরই হাতে; তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও সর্বজ্ঞ। তিনি যাকে ইচ্ছা নিজের অনুগ্রহের জন্য বিশেষ করে নেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।

৯:৭৪ :: তারা আল্লাহর নামে কসম করে যে, তারা বলে নি, অথচ তারা কুফরী বাক্য বলেছিল এবং তাদের ইসলাম গ্রহণের পর কুফর করেছিল এবং তারা এমন কিছুর জন্য মনস্থ করেছিল যা তারা কার্যকর করতে পারে নি। আর তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করে নি এজন্য ছাড়া যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ (আল্লাহর অনুগ্রহ) থেকে দিয়ে অভাবমুক্ত করেছিলেন। সুতরাং যদি তারা তাওবাহ করে, তা তাদের জন্য উত্তম। আর যদি তারা বিমুখ হয় তাহলে আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে কষ্টদায়ক শাস্তি দিবেন। আর তাদের জন্য পৃথিবীতে কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই।

৪:৮৮-৯১ :: তোমাদের কী হয়েছে যে, মুনাফিক্বদের ব্যাপারে তোমরা দুই দল হয়ে যাচ্ছো? অথচ তাদের উপার্জনের (পাপ প্রবণতার) জন্য আল্লাহ তাদেরকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তোমরা কি ইচ্ছা করো যে, তোমরা তাদেরকে হিদায়াত করবে যাদেরকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের জন্য কোনো পথ পাবে না। তারা আকাঙ্ক্ষা করে যদি তোমরা কুফর করতে যেমন তারা কুফর করেছে তাহলে তোমরা বরাবর হয়ে যেতে! সুতরাং তাদের কাউকে বন্ধু ও অভিভাবক (অলি-আওলিয়া) হিসেবে গ্রহণ করো না, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে (তথা তাগুতের সাথে আপোষ না করে বরং যেখানে নিরাপদে আল্লাহর বিধান অনুসরণ করা যাবে সেখানে চলে আসে)। অন্যদিকে যদি তারা (শত্রুতা সহকারে তোমাদের দিক থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তোমরা তাদেরকে ধরো এবং হত্যা করো, যেখানেই তোমরা তাদেরকে পাও। আর তোমরা তাদের মধ্য থেকে কাউকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে ও সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করো না। কিন্তু তাদেরকে নয় যারা এমন কোনো ক্বওমের সাথে সংযুক্ত হয় তোমাদের ও যাদের মধ্যে (অনাক্রমণ) চুক্তি রয়েছে অথবা যারা (যেসব মুনাফিক্বরা) তোমাদের কাছে এমনভাবে আসে যে, তাদের অন্তর সংকুচিত/বাধাগ্রস্থ হয় তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অথবা তাদের ক্বওমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাদেরকে তোমাদের উপর ক্ষমতাবান করতেন। তাহলে তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো। সুতরাং যদি তারা তোমাদের থেকে সরে দাঁড়ায়, তাহলে তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো না। আর তারা তোমাদের কাছে শান্তিচুক্তি প্রস্তাব করলে, তাহলে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে (ব্যবস্থা গ্রহণের) কোনো পথ রাখেন নি। আর শীঘ্রই তোমরা অন্য কিছু (মুনাফিক্বদেরকে) পাবে, তারা ইচ্ছা করে তোমাদের থেকে নিরাপত্তা পেতে এবং তাদের ক্বওমের থেকে নিরাপত্তা পেতে। যখনই তারা কোনো ফিতনার (ন্যায়কাজে বিঘ্ন সৃষ্টির) দিকে সুযোগ পায়, তারা সেটার মধ্যে (ফিতনার মধ্যে) ঘুরে যায়/ জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং যদি তারা তোমাদের থেকে সরে না যায় এবং তোমাদের কাছে শান্তিচুক্তি প্রস্তাব না করে এবং তাদের হাতসমূহ সংবরণ না করে, তাহলে তোমরা তাদেরকে ধরো এবং হত্যা করো, যেখানেই তোমরা তাদের নাগাল পাও। আর তারাই সেসব লোক, আমরা তোমাদেরকে যাদের উপর চড়াও হওয়ার স্পষ্ট সনদ দিয়েছি।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যখন মুনাফিক্বরা মুসলিমদেরকে আক্রমণ করে কেবলমাত্র তখনই তাদেরকে পাল্টা আক্রমণ করা যাবে, অন্যথায় নিছক তাদের মুনাফিক্বীর কারণে তাদেরকে আক্রমণ করা যাবে না।

মুসলিম উম্মাহর জামিয়া (ঐক্যবদ্ধতা) বনাম সাম্প্রদায়িকতা

৩:১০৩ আয়াতে জামিয়া বা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরার বা আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে সংগঠিত সংঘবদ্ধতাকে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে নিছক জামিয়া বা সংঘবদ্ধতা মুখ্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে সাব্যস্ত হয়নি বরং ‘বিহাবলিল্লাহ’ (আল্লাহর রজ্জু) সেই মুখ্য বিষয় যা অবলম্বনের জন্য এবং যার উপর ভিত্তি করে সংগঠিত জামিয়া বা সংঘবদ্ধতার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেই সাথে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, এক্ষেত্রে ফিরক্বায় ফিরক্বায় বিভক্ত হওয়া বা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়া বা থাকা যাবে না।

সুতরাং যারা আল কুরআনকে সামগ্রিকভাবে ধারণ করবে তারাই মু’মিনদের প্রকৃত জামিয়া হিসেবে সাব্যস্ত হবে। অন্যদিকে যারা কুরআনকে অংশত ধারণ করবে অথচ সেটাকেই একমাত্র গ্রহণযোগ্য স্বরূপ হিসেবে চিহ্নিত করবে অর্থাৎ কুরআনকে বিভক্ত করবে (পছন্দমতো অংশ গ্রহণ করবে) তারাই বিচ্ছিন্নতাবাদী ফিরক্বা হিসেবে সাব্যস্ত হবে। এখানে কোন কাঠামোতে জনসংখ্যা কত তা বিবেচ্য নয়, বরং কারা দ্বীনের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন নীতি অবলম্বন করেছে সেটাই মূল বিষয়।

এখন যদি এখানে কোনো উপলব্ধিগতক্ষেত্রে ইখতিলাফ ঘটে, তবে কোনটি আল কুরআনের আলোকে সঠিক উপলব্ধি তা নির্ণয়ে সময় নেয়া প্রয়োজন। তবে যদি দুই দল লোক দুই ধরনের বিপরীত মতকে চূড়ান্ত করে ফেলে তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে তবে তার চূড়ান্ত সমাধান হলো ৩:৬১ আয়াতে বর্ণিত ‘মুবাহালা’। এরপর যে জনগোষ্ঠী মিথ্যারোপকারী হিসেবে আল্লাহর কাছে সাব্যস্ত হবে, তার ফায়সালা আল্লাহর কাছে এবং উভয় অংশ নিজেকে ‘প্রকৃত মু’মিনদের জামিয়া’ দাবি করে কার্যক্রম পরিচালনা করার অধিকারী, যারা প্রকৃত সত্যের উপর আল্লাহ তাদের অভিভাবক হিসেবে স্বীয় ভূমিকা পালন করবেন।

উলিল আমর বা জামিয়া এমন নয় যে, তার সাথে তানাযা’ বা মতবিরোধ হতে পারে না। এমন কি মু’মিনদের দুই দল যুদ্ধেও লিপ্ত হয়ে যেতে পারে, যদিও তা অনাকাঙ্ক্ষিত। এসব অবস্থায় সমাধান কী হবে তা ৪:৫৯ ও ৪৯:৯ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, তা আল্লাহর ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে এবং আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী মীমাংসা করার ক্ষেত্রে তৃতীয় নিরপেক্ষ দলকে ভূমিকা পালন করতে হবে।

এক কথায় যে জামিয়া বা সংঘবদ্ধতাকে আঁকড়ে থাকতে হবে তা হলো ‘বিহাবলিল্লাহি জামিয়া’ বা ‘আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে সংগঠিত সংঘবদ্ধতা’। সুতরাং যদি পূর্বপ্রতিষ্ঠিত জামিয়ার মধ্যে বিকৃতি দেখা দেয়, এ অবস্থায় আবার সঠিক ভিত্তির উপর মু’মিনদের জামিয়ার পুনর্গঠন করতে হবে। যেহেতু কোনো তথাকথিত জামিয়াকে অবলম্বনই মূল বিষয় নয়, বরং ‘বিহাবলিল্লাহি জামিয়া’ ই মূল বিষয়, তাই বাহ্যত কোনো সংঘবদ্ধতা বা সাংগঠনিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হওয়াই জান্নাতে যাওয়ার সার্টিফিকেট নয়, বরং প্রত্যেক ব্যক্তি আল্লাহর বিবেচনায় যথাযথ মুসলিম হিসেবে মৃত্যুবরণ করার প্রয়াসই মূল কর্মনীতি হওয়া উচিত।

জামিয়ার কর্তব্য হলো দ্বীনুল হক্বের চর্চা করা, আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধতার প্রক্রিয়া চালু রাখা, কোনো নামসর্বস্ব কাঠামোবদ্ধতার ভিত্তিতে নিজেদেরকে একমাত্র জান্নাতী বলে ঘোষণা দেয়া নয়। আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ হওয়ার মানে হলো ব্যক্তিজীবনে মুসলিম হওয়া ব্যক্তিরা সমষ্টিগত দায়িত্ব পালনের জন্য সংঘবদ্ধ হওয়া।

সুতরাং মুসলিমদেরকে অবশ্যই এ মূলনীতির ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ হতে হবে। কিন্তু নিতান্ত একটি নির্দিষ্ট সাংগঠনিক কাঠামোর বাহিরে থাকার অর্থ অমুসলিম হওয়া নয়। কারণ কোন সাংগঠনিক কাঠামো সত্যিকারার্থে আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহ প্রদত্ত মূলনীতি বা বিধানসমূহ পালন করছে সে বিষয়ে পারস্পরিক ভুল বুঝাবুঝি থাকা অসম্ভব নয়। যারা অমুসলিম তাদেরকে আহবান জানাতে হবে মুসলিম তথা আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পিত হওয়ার জন্য আর এ আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে তারা স্বাভাবিকভাবে আল্লাহর একটি নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য ‘বিহাবলিল্লাহি জামিয়া’ (আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ) হয়ে কাজ করবে।

প্রকৃত মুসলিম (আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পিত) না হয়ে মুসলিম দাবিদার ব্যক্তিদের কোনো একটি সংঘের সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদেরকে জান্নাতী মনে করা ইয়াহুদ ও নাসারা (খ্রিস্টানরা) তাদের সম্প্রদায়ভুক্ত হলেই জান্নাতী হবে অন্যথায় জান্নাতী হবে না মর্মে দাবি করার অনুরূপ বিষয়। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতটি লক্ষণীয়:

২:১১১-১১২ :: আর তারা বলেছে, “তারা ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না যারা ইয়াহুদ বা নাসারা (খ্রিস্টান) হয়েছে।” এটা তাদের আকাঙ্ক্ষা মাত্র। বলো, “তোমরা তোমাদের প্রমাণ নিয়ে আসো, যদি তোমরা (তোমাদের দাবিতে) সত্যবাদী হয়ে থাকো।” বলো, “(প্রকৃত কথা হচ্ছে) যে তার সত্তাকে আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পিত করেছে (প্রকৃত মুসলিম) এবং সেই সাথে সে একজন উত্তম কর্মসম্পাদনকারী, সেক্ষেত্রে তার জন্যই তার প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার রয়েছে এবং তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দু:খিতও হবে না।”

যেহেতু মু’মিন মুসলিমদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এবং সমাজ বিনির্মাণ করতে হবে সেজন্য সংঘবদ্ধ বা সাংগঠনিক কাঠামোবদ্ধ হতে হবে, কিন্তু সংঘবদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে থাকতে পারে গোপন কাফির, যাদেরকে মুসলিমরাও চিহ্নিত করা সম্ভব নাও হতে পারে। গোপন কাফিররা জাহান্নামী, গোপন মু’মিনরা জান্নাতী। অনুরূপভাবে এমন অনেক মু’মিন থাকা সম্ভব যারা কোনো একটি সুনির্দিষ্ট সংঘে সংঘবদ্ধ হয়নি, তার বিশেষ প্রেক্ষিতগত কারণে সে স্বতন্ত্র রয়েছে অথবা অন্য কোনো সাংগঠনিক কাঠামোতে রয়েছে যা এখন পর্যন্ত তার বিবেচনায় অধিক গ্রহণযোগ্য।

জান্নাতের জন্য দুটি শর্ত ১. ঈমান ২. আমলে সালেহ। যে ঈমান এনেছে কিন্তু এর দ্বারা কোনো কল্যাণ অর্জন করেনি সে জান্নাতে যাবে না। মু’মিনদেরকে জামিয়া বা ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। প্রথমত, মানসিক ঐক্য। দ্বিতীয়ত, বাস্তব কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক বা সংঘবদ্ধতার ঐক্য। তবে যারা মু’মিনদের সাথে সংঘবদ্ধ থাকবে তাদের মধ্যে অনেক মুনাফিক্ব থাকা সম্ভব। কবীরা গুনাহগার এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে ফেলার মতো লোক থাকা সম্ভব। আবার মুসলিম উম্মাহর বাহিরেও সৎকর্ম সম্পাদনকারী থাকতে পারে, এমনকি যাদের ঈমান নেই। ঈমান ছাড়া সৎকর্ম আখিরাতে মূল্য পাবে না। ঈমান ও ইসলামের দিকে আহবানের অর্থ মুসলিম উম্মাহ হিসেবে সংঘবদ্ধ লোকদেরকে পরিশুদ্ধ মনে করার দাওয়াত নয়। বরং আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে সমষ্টিগত কার্যক্রমের জন্য সংঘবদ্ধতার প্রয়োজন কিন্তু সংঘবদ্ধতা বজায় রাখা ব্যক্তি মাত্রই প্রকৃত মুসলিম এবং সৎকর্মশীল হওয়া নিশ্চিত নয়।

বিভিন্ন স্থানে বাস্তব যোগাযোগে অসুবিধা হেতু মু’মিনদের ভিন্ন ভিন্ন জামিয়া বা সংঘবদ্ধতা দোষনীয় নয়, তাদের মানসিক ঐক্যই তাদেরকে একই জামিয়ার অন্তর্ভুক্ত একই উম্মাহ হিসেবে চিহ্নিত করবে। তাদের একের বিপদে অন্যরা সমব্যথী হবে। অবশ্য যখন তাদের মধ্যে যোগাযোগের উন্নতি সাধিত হবে, তখন একীভূত বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ কাঠামো গড়ে উঠতে হবে। বাস্তব যোগাযোগের দুর্বলতা পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালে স্বতন্ত্র বিভিন্ন সাংগঠনিক কাঠামো বা জামিয়া দোষনীয় নয়, বরং স্বাভাবিক। তবে এরূপ অবস্থায় প্রত্যেকেই নিজেদেরকে ‘মুসলিমূন’ এর পরিচয়ে একক জাতিসত্তার সদস্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, কাউকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ফিরক্বা হিসেবে সাব্যস্ত করা সঠিক হবে না।

যারা শুধুমাত্র কুরআনকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে না, তারা মুসলিম দাবিদার হলেও প্রকৃতপক্ষে মুসলিম নয়। তাদের প্রতিষ্ঠিত মাসজিদে সালাত করা যাবে না। পক্ষান্তরে যারা শুধুমাত্র কুরআনকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে তাদের সকলের মসজিদই সকলের মসজিদ, তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী ভিন্ন ভিন্ন ফিরক্বা হতে পারে না। যদি তাদের কোনো দল কুরআনকে একমাত্র দলিল হিসেবে গ্রহণের দাবি জানায় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইচ্ছাকৃতভাবে কুরআনের অপব্যাখ্যা করে থাকে অর্থাৎ এটা তাদের ষড়যন্ত্র বলে প্রতীয়মান হয়, তবে তারা হলো মুনাফিক্ব যারা ঈমানের দাবি করে কিন্তু ঈমানদার নয়। মুনাফিক্বদের প্রতিষ্ঠিত মাসজিদেও সালাত করা যাবে না। মু’মিন ও মুনাফিক্বদের মধ্যে পরস্পর পরস্পরকে মুনাফিক্ব হিসেবে অভিযুক্ত করতে পারে, কিন্তু একজন প্রকৃত মু’মিন কুরআনের মানদণ্ডে কোনটি ‘বিহাবলিল্লাহি জামিয়া’ তা চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে এবং বিষয়টি বিশ্বাসনির্ভর। আল্লাহই মু’মিনদের অভিভাবক। তবে ধর্মীয় বিষয়ে কোনো বাড়াবাড়ি বা বলপ্রয়োগের অবকাশ নেই।

মুসলিম হওয়া, যাবতীয় সাম্প্রদায়িকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ পরিহার করে নিজেদের একমাত্র ধর্মাদর্শগত পরিচয় হিসেবে ‘মুসলিম’ নামে চিহ্নিত করা এবং মুসলিম নামে পরিচয় প্রদান বা মুসলিম দাবিদার হওয়াকে অন্যান্য ফিরক্বার অনুসরণে সম্প্রদায়গত চেতনা হিসেবে গ্রহণ করা মূল্যহীন হওয়া সম্পর্কে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:

> মুসলিম হওয়ার প্রাথমিক অবস্থা হচ্ছে ঈমানী মজবুতির ঘাটতি (প্রাথমিক পর্যায়ে) থাকলেও ঈমানের দিকে গতিশীল হওয়ার উদ্দেশ্যে ইতায়াত/আনুগত্য করা (৪৯:১৪-১৮) আর তিনি চূড়ান্ত স্তরের মুসলিম হতে পারেন, যিনি প্রথমেই ইসলাম করার/ মুসলিম হবার পরও আল্লাহর কাছে সবসময় নিজেকে যথাযথ মুসলিম বানিয়ে রাখার প্রার্থনা জানান তথা প্রচেষ্টা চালু রাখেন (২:১৩১, ২:১২৮)।

> মু’মিনদেরকে মৃত্যু পর্যন্ত মুসলিম হয়ে থাকতে হবে এবং মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু বরণ করতে হবে (৩:১০২)

> মু’মিনদেরকে যথাযথভাবে ঈমান করতে হবে (৪:১৩৬)। মু’মিনরা মুসলিম বা মুসলিমরা মু’মিন একই সাথে এরূপ গুণাবলিসম্পন্ন এবং কুরআন বর্ণিত অন্যান্য গুণাবলিসম্পন্ন হতে হবে (৩৩:৩৫)।

> মু’মিনদের জাতীয় পরিচয় হবে ‘মুসলিম’ (২২:৭৭-৭৮, ২:১২৮, ৪১:৩৩)।

> মুসলিম দাবিদার ব্যক্তিও খিয়ানতকারী হতে পারে এবং মুসলিমদের বলয়ের বাহিরের কেউও ন্যায়সঙ্গত দাবির উপর থাকতে পারে। এমতাবস্থায় তার বিপক্ষে (পক্ষপাতিত্বস্বরূপ) এবং খিয়ানতকারীর পক্ষে বিতর্ক করা যাবে না। বরং ন্যায়বিচার করতে হবে। (৪:১০৫-১০৭)

> শুধু নামকাওয়াস্তে মুসলিম দাবিদার হওয়া কাউকে শাস্তি থেকে রক্ষা করবে না, বরং এরূপ মনে করা হবে আহলে কিতাবের মতোই খামখেয়ালি (২:৮০-৮১, ৪:১২৩),

বস্তুত ইহুদী ও নাসারা (খ্রিস্টান) উভয়ে আহলে কিতাব। তারা নিজেরাই নিজেদেরকে এই দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ভুক্ত করেছে। আহলে কিতাব মুসলিম ছিল কিন্তু তারা তাদের মুসলিম বা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পিত হওয়ার পরিচয়কে খণ্ডিত করে নিজেদেরকে ‘ইয়াহুদ’ ও ‘নাসারা’ এ দুটি ফিরক্বায় বিভক্ত করে নিয়েছে।

আহলে কিতাব হলো কুরআনের পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের ধারক-বাহক। কুরআন নাযিলের প্রেক্ষিতে তারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, যথা :

(১) যারা প্রকৃতই আহলে কিতাব, তারা তাওরাত ও ইনজীলের যথার্থ অনুসারী এবং সেই প্রেক্ষিতে তারা আল কুরআনে ঈমান করে নিয়ে মু’মিন হয়ে যায় এবং কুরআন সম্পর্কে যথাযথভাবে অবগত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা তাদের কাছে যা আছে তার প্রেক্ষিতে মু’মিন হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার যোগ্য।

(২) যারা তাওরাত ও ইনজীলের অনুসারী কিন্তু আল কুরআনের বিষয়ে ঈমান আনে নি, তা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকার কারণে হোক অথবা তাদের ফাসেক্বীর (অসততার) কারণে হোক। এদের বিষয়ে বলা হয়েছে যে, তারা যদি ঈমান করতো তা-ই তাদের জন্য ভালো হতো।

আহলে কিতাবের মধ্যে থাকা ঈমানদের প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:
৩:১১৩-১১৫ :: তারা সকলে সমান নয়। আহলে কিতাবের মধ্যেও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত উম্মাহ রয়েছে। তারা রাতের বেলায় আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং সাজদাহ করে। তারা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাস করে। আর ন্যায়ের আদেশ দেয় ও অন্যায় থেকে নিষেধ করে বা বিরত রাখে। আর তারা কল্যাণকর কাজে দ্রুত ধাবিত হয় এবং তারা সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত। তারা উত্তম ও কল্যাণকর কাজ থেকে যা করে তা কখনো অস্বীকার করা হবে না। আর আল্লাহ স্রষ্টা-সচেতনদের সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত।

সুতরাং যদিও মু’মিন-মুসলিমরা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সাংগঠনিক কাঠামোবদ্ধভাবে কার্যক্রম পরিচালন করবে, তবু তারা তাদের সাংগঠনিক কাঠামোর বাহিরের সবাইকেই কাফির হিসেবে ভাবার অবকাশ নেই।
অবশ্য সকল মু’মিনেরই কর্তব্য হলো যে, তারা আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকার প্রক্রিয়া চলমান রাখতে হবে এবং নিজেদেরকে সেরূপভাবেই গড়ে তুলতে হবে।

শূরা বা পরামর্শ : উলিল আমর নির্বাচনের পদ্ধতি

বাস্তবসঙ্গত কারণে মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। আর এই প্রেক্ষিতে মানুষের মধ্যে সংঘবদ্ধতা ও নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো গড়ে উঠে, যাতে তারা সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হতে পারে, তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক বণ্টন সহজ হয়, পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-মীমাংসা হতে পারে এবং প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত হয়।

মু’মিনদের মধ্যেও তাদের সমষ্টিগত কাজের সুবিধার্থে স্বাভাবিকভাবেই সংঘবদ্ধতা তৈরি হয়। আর এক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যাদেরকে কোনো আহবায়ক যাবতীয় কুসংস্কারকে চিহ্নিত ও পরিত্যাগ করে ঈমান ও ইসলামের দিকে আহবান করে থাকেন সাধারণত তাঁর নেতৃত্বেই তারা একত্রিত হয়। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও অভিভাবকত্বসুলভ যোগ্যতাসম্পন্ন হিসেবেই বিবেচিত হন।

ঈমানের দিকে আহবানকারীর আহবানে সাড়া দিয়ে ঈমান আনা বিষয়ে নিম্নের আয়াতটি লক্ষণীয়:

৩:১৯৩ :: ‘হে আমাদের রব, নিশ্চয় আমরা শুনেছি একজন আহবানকারীকে, যে ঈমানের দিকে আহবান করে যে, ‘তোমরা তোমাদের রবের প্রতি ঈমান আন’। তাই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করুন এবং বিদূরিত করুন আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি, আর আমাদেরকে মৃত্যু দিন নেককারদের সাথে’।

প্রাথমিকভাবে ঈমানের দিকে আহবানে তথা ঈমানের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত কর্ম সম্পাদন করার প্রতি আহবায়কের ডাকে সাড়া দিয়ে তাকে কেন্দ্র করে সংঘবদ্ধভাবে কাজ শুরু করা হতে পারে। কিন্তু যখন এরূপ বিভিন্ন আহবায়কের সাথে সম্পৃক্ত মু’মিনদের ভিন্ন ভিন্ন সংঘের মধ্যে পারস্পরিক পরিচিতি গড়ে উঠে এবং বৃহত্তর সংঘের প্রশ্ন তৈরি হয় তখন ঐ বৃহত্তর সংঘের প্রধান নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রশ্নটিও সামনে চলে আসে।

এ পর্যায়ে এসে সাধারণত মনস্তাত্ত্বিক সংকীর্ণতার প্রকাশ ঘটে। প্রত্যেক স্বতন্ত্র সংঘের মু’মিনরা ঐ সংঘের নেতৃত্বকেই বৃহত্তর সংঘের নেতৃত্ব হিসেবে দেখতে চাইতে পারে। এখানে এসে আল্লাহর অনুমোদন তথা আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে যার নেতৃত্বের অধিক উপযুক্তততা বা অগ্রগণ্যতার প্রতি সাক্ষ্যদান পক্ষপাতমুক্ত সুবিবেচনামূলক হিসেবে করণীয় হয়ে দাঁড়ায় প্রত্যেক মু’মিন স্বতন্ত্রভাবে এ বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে।

নিজেদের গোত্রের বাহিরে অন্য গোত্রের কেউ এসে নেতৃত্ব দিবে এটা মেনে নিতে না পারার গোত্রবাদ এবং পূর্ব থেকে যারা একসাথে ঈমানের দাবি অনুসারে কাজ করে আসছে তাদের মধ্যে অন্য কেউ (অর্থাৎ যে পূর্ব থেকে একসাথে ছিল না এমন কেউ) নেতৃত্ব দিবে এটা মেনে নিতে না পারার সংঘবাদ একই দোষে দুষ্ট।

যারা হিজরত করে এসেছে তাদের চেয়ে যারা তাদের আশ্রয়হীন অবস্থায় তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছে তারাই সম্মানিত এবং আশ্রিতরা কম মর্যাদার অধিকারী- এরূপ ধারণা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক এবং জাহিলিয়্যাতের ধারণা।

যারা প্রথম দিকে ঈমান এনেছে এবং হিজরাত ও জিহাদ করেছে তারা এবং যারা পরবর্তীতে ঈমান এনেছে এবং হিজরাত ও জিহাদ করেছে তারা সবাই সম্মিলিতভাবে একই উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য সেই সাথে এটাও লক্ষণীয় যে, যারা বিজয় পূর্বকালে ব্যয় ও সংগ্রাম করেছে তারা যারা বিজয় উত্তর কালে ব্যয় ও সংগ্রাম করেছে তাদের তুলনায় মহিমান্বিত মর্যাদাসম্পন্ন।

নেতৃত্বের জন্য যাকে বিভিন্ন যোগ্যতা-দক্ষতায় যে স্তরের অধিক উপযুক্ত হিসেবে পাওয়া যাবে তাকে সেরূপ স্তরে অধিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। শারীরিক ও মানসিক দক্ষতানির্ভর কর্মকাণ্ডের সাপেক্ষে মূল নেতৃত্বের জন্য যারা উভয় ক্ষেত্রে দক্ষ তাদের মধ্য থেকে বাছাই করা প্রয়োজন। দ্বিতীয় স্তরে যারা শুধু মেধাগত দক্ষতায় এগিয়ে তরা গবেষণা, পরামর্শ ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে সহযোগিতাপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং যারা শুধু শারীরিক শ্রমনির্ভর কাজে বেশি উপযুক্ত তারা সেক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করবে।

শারীরিক ও মানসিক বয়সের আদর্শ সমন্বিত বিকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে ৪০ (চল্লিশ) বছর বয়সকে তেজোদ্দীপ্ত যৌবন ও নিস্তেজ বার্ধক্যের মাঝামাঝি ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা ও কর্মশক্তির বয়স হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই প্রেক্ষিতে চল্লিশোর্ধ বয়সের মধ্য থেকে মূল নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য মনোনিবেশ করা যেতে পারে। তবে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে কখনো কখনো প্রবীণদের চেয়ে নবীনদেরকে অধিক যোগ্যতা-দক্ষতার অধিকারী হিসেবে পাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতার জন্য নবীনদের মধ্য থেকে বাছাইকৃত কাউকে পরিচালনাগত দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে এবং সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রবীণদেরকে উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণ করা বা তাদের পরামর্শ গ্রহণকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।

একাধিক প্রায় সমান যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কাউকে প্রধান নির্বাহী হিসেবে নির্বাচিত করার পাশাপাশি অন্যদেরকে সহপ্রধান নির্বাহী হিসেবে নির্বাচিত করা যেতে পারে, যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাহীর প্রতিনিধি হিসেবে (ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে) ভূমিকা পালন করবেন।

এ বিষয়গুলো সামনে রাখলে নেতৃত্ব বিষয়ক মানসিক সংকীর্ণতা পরিহার করা এবং উপযুক্ত নেতৃত্ব নির্বাচন সহজ হতে পারে। তাই নিম্নে এ বিষয়গুলোর সাথে সম্পৃক্ত কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হলো:

২:২৪৬-২৪৭ :: তুমি মূসার পরবর্তীতে বানী ইসরাইলের প্রধানদের প্রতি লক্ষ্য করো নি? যখন তারা তাদের জন্য প্রেরিত নবীকে বলেছিল, আমাদের জন্য একজন রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করুন, আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবো। সে (নবী) বললো, “তোমাদের ক্ষেত্রে এমন সম্ভাবনা আছে কি যে, তোমাদের উপর যুদ্ধ বিধিবদ্ধ করে দেয়া হলো অথচ তোমরা যুদ্ধ করবে না?” তারা বললো, “আমাদের কী হলো যে, আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবো না অথচ আমাদেরকে ও আমাদের সন্তানদেরকে আমাদের বাড়িঘর থেকে বাহির করে দেয়া হয়েছে?” তারপর যখন তাদের উপর যুদ্ধ বিধিবদ্ধ করে দেয়া হলো, তাদের মধ্যকার অল্পসংখ্যক ছাড়া বাকিরা মুখ ফিরিয়ে নিলো। আর আল্লাহ জালিমদের সম্পর্কে পরিজ্ঞাত। আর তাদেরকে তাদের নবী বললো, “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য তালুতকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করেছেন।” তারা বললো, “কীভাবে তার জন্য আমাদের উপর রাজত্ব করার অধিকার থাকতে পারে? অথচ আমরা (বানী ইসরাইল) রাজত্বের বিষয়ে তার চেয়ে অধিক অধিকারী। আর তাকে তো মালসম্পদ থেকেও স্বচ্ছলতা দেয়া হয় নি।” সে (নবী) বললো, “নিশ্চয় আল্লাহ তাকে তোমাদের উপর মনোনীত করেছেন এবং তাকে জ্ঞানগত ও দৈহিক কাঠামোতে সমৃদ্ধ করেছেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাঁর রাজত্ব দান করেন। আর আল্লাহ সর্বব্যাপী সর্বজ্ঞ।”

৬৩:৮ :: তারা বলে, যদি আমরা মদীনায় ফিরে যাই তাহলে অবশ্যই সেখান থেকে মর্যাদাবানরা মর্যাদাহীনদেরকে বহিষ্কার করবে। অথচ মর্যাদা তো আল্লাহর, তাঁর রাসূলের ও মুমিনদের। কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না।

৮:৭৪-৭৫ :: আর যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর পথে হিজরাত ও জিহাদ করেছে এবং যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, তারাই (মুহাজির ও আনসার) প্রকৃত মু’মিন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা। আর যারা পরবর্তীতে ঈমান এনেছে এবং তোমাদের সাথে হিজরাত ও জিহাদ করেছে তারাও তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহর কিতাব (বিধান) অনুযায়ী রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়রা (সম্পদের উত্তরাধিকারিত্বে) একে অন্যের ঘনিষ্ঠতর। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী।

৫৭:১০ :: তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করছো না? অথচ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর উত্তরাধিকার আল্লাহরই। তোমাদের মধ্যে যারা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে এবং যারা বিজয়ের পরে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে উভয়ে সমান নয়, পূর্বে ব্যয় ও সংগ্রামকারীরা পরে ব্যয় ও সংগ্রামকারীদের চেয়ে মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ। অবশ্য আল্লাহ প্রত্যেকের জন্যই উত্তম প্রতিফলের ওয়াদা করেছেন। আর তোমরা যা করো আল্লাহ তা সম্যক অবগত।

৪৬:১৫ :: আর আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার সাথে উত্তম আচরণ করতে। তার মা তাকে কষ্ট করে গর্ভধারণ করেছে এবং কষ্ট করে প্রসব করেছে। আর তাকে গর্ভধারণ করতে ও স্তন্য ছাড়াতে লেগেছে ত্রিশ মাস। শেষ পর্যন্ত যখন সে যৌবনে পৌঁছেছে এবং (যৌবনের মধ্যকার) চল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছেছে, তখন সে বলেছে, “হে আমার প্রভু! আমাকে সামর্থ্য দিন যেন আমি আপনার সেসব নেয়ামতের শোকর করি যা আপনি আমাকে ও আমার পিতামাতাকে দিয়েছেন। আর আমি যেন সৎকর্ম করি যেন আপনি সন্তুষ্ট হন। আর আমার সন্তান-সন্ততিদেরকেও সৎকর্মশীল করুন। নিশ্চয় আমি আপনার কাছে তাওবাহ করছি। আর নিশ্চয় আমি আত্মসমর্পিতদের অন্তর্ভুক্ত।”

১৯:১২ :: “হে ইয়াহইয়া, গ্রহণ করো এই কিতাব দৃঢ়ভাবে।” আর আমরা তাকে (= ইয়াহইয়াকে) বাল্যবয়সেই সুষ্ঠু বিচারবোধ দিয়েছি।

২১:৭৮-৭৯ ::আর দাউদকে ও সুলাইমানকেও (সাহায্য করেছি)। যখন তারা উভয়ে বিচার করছিলো (= উভয়ে একসাথে বিচার করছিলো তথা একজন অন্যজনের পরামর্শ নিয়ে বিচার করছিলো) এক ক্ষেতের মামলায়। যখন উহাতে রাতের বেলায় ছড়িয়ে পড়েছিলো এক কওমের মেষপাল। আর আমরা ছিলাম তাদের বিচারের ব্যাপারে স্বাক্ষী। তখন আমরা সুলাইমানকে এ বিষয়ের (সমাধানের) যথাযথ বুঝ দান করেছি। আর (তাদের) প্রত্যেককেই আমরা দিয়েছি সুষ্ঠু বিচার-ক্ষমতা ও (আসমানী কিতাবের) জ্ঞান। আর আমরা নিয়োজিত করেছি দাউদের সাথে পাহাড়সমূহকে, সেগুলি (তার সাথে) তাসবীহ করতো (= সেগুলোতে তার তাসবীহের প্রতিধ্বনি তৈরি হতো); আর পাখীদেরকেও (তার সাথে নিয়োজিত করেছি)। আর আমারাই ছিলাম এসবের সম্পাদনকারী।

২৫:৩৫ :: আর আমরা মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম এবং তার সাথে তার ভাই হারূনকে সহযোগী হিসেবে নিযুক্ত করেছিলাম।

৭:১৪২ :: আর আমি মূসাকে ত্রিশ রাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম এবং সেটাকে দশ (রাত) দ্বারা পরিপূর্ণ করেছিলাম, ফলে তোমার প্রভুর নির্ধারিত সময়সীমা হলো ‘চল্লিশ রাত’। এবং মূসা তার ভাই হারূনকে বলেছিলো, “আমার ক্বওমের মধ্যে আমার প্রতিনিধিত্ব করো এবং সংশোধন করো এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পথ অনুসরণ করো না।”

উলিল আমরের নির্বাচন ও অপসারণের পদ্ধতি নির্ধারণে শূরা বা পরামর্শের গুরুত্ব

আল কুরআনের নির্দেশনা অনুসারে মু’মিনদের নির্বাহী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে হবে শূরা/ পরামর্শের ভিত্তিতে। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতটি লক্ষণীয়:

৪২:৩৮ :: (উত্তম প্রতিফল তাদের জন্য) যারা তাদের প্রতিপালকের আহবানে সাড়া দেয় এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নির্বাহী কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তাদেরকে যা জীবিকা দিয়েছি তা থেকে (যথানিয়মে ও যথোচিত খাতে) ব্যয় করে।

সুতরাং মুসলিম উম্মাহর উলিল আমরের নির্বাচন ও অপসারনের পদ্ধতি শূরা/ পরামর্শের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। তবে এ ক্ষেত্রে মূলনীতিগত বিষয় আল কুরআন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, তথা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আল কুরআনের নির্দেশ অনুসারে যে ব্যক্তিরা এ ক্ষেত্রে জ্ঞান, চরিত্র ও বাস্তব যোগ্যতার বিবেচনায় অগ্রগণ্য তাদের মধ্য থেকে সাধ্যমতো বিচার বিবেচনা অনুসারে অধিক যোগ্য ব্যক্তিকে মনোনীত করতে হবে। আর যখন সে আল কুরআনের সীমারেখা লংঘন করে অথচ সতর্কীকরণ সত্ত্বেও সংশোধিত হয় না, তখন তার আনুগত্য করা যাবে না তথা তখন তাকে অপসারণ করা অপরিহার্য দায়িত্ব হয়ে পড়বে।

যখন আল কুরআনে যাদের আনুগত্য করতে নিষেধ করা হয়েছে, কোনো উলিল আমরের অধ:পতন ঘটে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, তখন ঐ উলিল আমর আর উলিল আমর থাকবে না তথা আনুগত্যের বৈধ দাবিদার হবে না। তখন তাকে অপসারিত করে তার স্থানে আবার কোনো উপযুক্ত ব্যক্তিকে উলিল আমর হিসেবে নির্বাচিত করতে হবে। এছাড়া, মু’মিনদের পরামর্শভিত্তিক নির্বাহী নীতিমালার ভিত্তিতে উলিল আমরের স্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটতে পারে।

মুসলিম উম্মাহর শূরা (পরামর্শ) বনাম গণতন্ত্র বা অধিকাংশের সম্মতি

মুসলিম উম্মাহর উলিল আমর নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি হলো শূরা বা পরামর্শ। অনেকে এ পদ্ধতিকে গণতন্ত্র বা অধিকাংশের সম্মতি হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। অথচ কুরআনের স্পষ্ট বক্তব্য হলো: ‘অধিকাংশের অনুসরণ’কে নীতি হিসেবে গ্রহণ করলে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত হতে হবে (৬:১১৬)। বস্তুত পরামর্শ ও অধিকাংশের সম্মতি পদ্ধতির মধ্যে নীতিগত পার্থক্য রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে পরামর্শ পদ্ধতিতে অধিকাংশের মতামত ও কমসংখ্যকের মতামতের ক্ষেত্রে কী কর্মনীতি অবলম্বন করা যেতে পারে তা নিয়ে নিম্নে আলোকপাত করা হলো:

১। যাচাই ছাড়াই অধিকাংশের মত মেনে নেয়া যাবে না। এমনকি কিছু বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানের অভাবে সবাই ভুল ধারণার মধ্যে থাকতে পারে। সবার ধারণার বিপরীতে সঠিক জ্ঞান পেলে সেটাই গ্রহণ করতে হবে। কোনো প্রমাণিত জ্ঞান ছাড়া সবার মধ্যে প্রচলিত পরম্পরাগত ধারণাকে অগ্রাহ্য করা যাবে না, যদিও তার ‘সঠিকত্ব পর্যালোচনামূলক গবেষণা’ করা যাবে।

২। পরামর্শ ও ভোট সম্পুর্ণ দুটি ভিন্ন প্রক্রিয়া। পরামর্শে খোলাখুলি আলোচনা, যুক্তিতর্কে উপস্থাপন ও ঐক্যমতে পৌঁছার প্রচেষ্টা থাকে কিন্তু ভোটে থাকে দুই বিপরীত মতের দ্বন্দ্ব ও নিজ মতকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।

৩। সবার বা অধিকাংশের পরামর্শকে কোনো যুক্তি ছাড়াই বা স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। অল্প সংখ্যকের পরামর্শ অধিক যৌক্তিক হলে বা সবার পরামর্শের বাহিরে নিজের মত অধিক যৌক্তিক হলে অল্প সংখ্যকের পরামর্শ বা নিজের মত অনুযায়ী উলিল আমর সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে সে বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করতে হবে।

৪। অধিকাংশের উচিত স্বল্প সংখ্যকের পরামর্শের যৌক্তিকতা অনুধাবনের চেষ্টা করা এবং স্বল্প সংখ্যকের উচিত অধিকাংশের পরামর্শের যৌক্তিকতা অনুধাবনের চেষ্টা করা। সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়লে উলিল আমর তাঁর বিবেচনায় ‘উত্তম পরামর্শ বা মত’ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। আর উলিল আমর নির্বাচনের ক্ষেত্রে অধিকাংশের প্রস্তাবিত উলিল আমরের মধ্যে মৌলিক ত্রুটি না থাকলে তাঁকেই উলিল আমর হিসেবে মেনে নেয়া উচিত। এছাড়া এক্ষেত্রে একটি নির্বাচনী বোর্ড গঠন করে বিভিন্ন পয়েন্টভিত্তিক মূল্যমান নির্ধারণ করে প্রস্তাবিত উলিল আমরদের মধ্যে যিনি অধিক নম্বর (মার্ক) পাবেন (অধিকজনের সম্মতি নয়) তাঁকে উলিল আমর করা যেতে পারে।

৫। কুরআনের কোনো ধারা লংঘিত হলে আনুগত্য অস্বীকারের অধিকার ও দায়িত্ব প্রত্যেকের রয়েছে।

সংখ্যাগত তারতম্যের বাস্তব মূল্য

প্রসঙ্গত কোনো বিষয়ে অধিক সংখ্যক ব্যক্তি ও কম সংখ্যক ব্যক্তির ধারণা ও তার প্রয়োগ কিভাবে মূল্যায়িত হতে পারে বা সংখ্যাগত তারতম্যের বাস্তব মূল্য কী তা নিম্নরূপে বিবেচনা করা যেতে পারে:

(ক) যে বিষয়টি পরম্পরাগত জ্ঞান ও সর্বজন গৃহীত তা যতক্ষণ না কারো কর্তৃক সুনির্দিষ্ট অকাট্য যুক্তি দ্বারা ভুল সাব্যস্ত হবে না, ততক্ষণ তা সঠিক হিসাবে সাব্যস্ত হবে এবং কেউ উহার ব্যতিক্রম করলে তাকে (সাধারণত অনিচ্ছাকৃত) হঠাৎ বিচ্যুতি হিসাবে ধরা হবে এবং তাকে সংশোধন করে দেয়া হবে। যেমন ভাষা ও উহার উচ্চারণ, বানান ইত্যাদি।

(খ) যে বিষয়টি প্রায় সবার বৈশিষ্ট্য হিসাবে পাওয়া যায় উহাকে সাধারণ বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করে যে অত্যল্প সংখ্যকের মধ্যে তা পাওয়া যাবে না তাদেরকে ব্যতিক্রম সাব্যস্ত করা যেতে পারে।

(গ) দুটি বিকল্প প্রায় সমান গুরুত্বের মনে হলে এবং সুনির্দিষ্ট ও অকাট্য যুক্তি দ্বারা কোনো একটিকে অগ্রগণ্য সাব্যস্ত করা কঠিন হয়ে পড়লে সেক্ষেত্রে অধিক সংখ্যক চিন্তাশীল ব্যক্তি যেটিকে অধিক সঠিক বলে মনে করে সে সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করার চর্চা একটি উত্তম নির্বাহী রীতি সাব্যস্ত হতে পারে।

উলিল আমর নির্বাচনের পরামর্শভিত্তিক পদ্ধতিসমূহ

আল কুরআনে উলিল আমর নির্বাচনের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি, বরং কিছু মৌলিক নির্দেশনা (যথোপযুক্ত ব্যক্তিকে আমানাত অর্পণ, ন্যায় সাক্ষ্য, পরামর্শ ইত্যাদি) প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং আল কুরআনের কোনো সীমারেখা লঙ্ঘন না করে এবং মু’মিনদের মধ্যকার পরামর্শের মাধ্যমে উলিল আমর নির্বাচনের পদ্ধতি নির্ধারণ করা যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবে এক্ষেত্রে একাধিক পদ্ধতির অবকাশ রয়েছে এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি সাপেক্ষে যখন যেটি অধিক উপযোগী হতে পারে তা প্রয়োগ করা যেতে পারে।

কেন্দ্রীয় প্রধান উলিল আমর নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেক সময় একাধিক ব্যক্তি প্রায় সমানুপাতিক যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সুতরাং সাধ্যমতো বিবেচনা সাপেক্ষে তাদের মধ্যে যাকে সর্বাধিক যোগ্যতাসম্পন্ন হিসাবে মনে হয় তাকে কেন্দ্রীয় প্রধান উলিল আমর নির্বাচিত করতে হবে। তারপর কেন্দ্রীয় প্রধান উলিল আমর প্রয়োজনমতো উলিল আমর এবং বিশেষ পরামর্শ পরিষদের (মজলিশে শূরা) সদস্য নির্বাচিত করতে পারেন। এক্ষেত্রে তিনি সাধারণভাবে পরামর্শ পদ্ধতি অবলম্বন করবেন, আবার পদাধিকারবলে প্রয়োজনীয় মনোনয়নের অধিকারও রাখবেন।

কেন্দ্রীয় উলিল আমর নির্বাচনের কয়েকটি বিকল্প পদ্ধতি হতে পারে:

১. যদি একাধিক ব্যক্তি একাধিক নেতৃত্বের নাম প্রস্তাব করেন এবং কেউ নিজের নাম প্রস্তাব করেন তবে প্রস্তাবিত উলিল আমরদের মধ্য থেকে কোনো একজনকে পরামর্শক্রমে শেষ পর্যন্ত বাছাই করে নিতে হবে। প্রয়োজনে প্রস্তাবিত উলিল আমরদের মধ্য থেকে কেউ প্রথম কোনো একজনকে বাছাই করতে সহায়তা করবেন স্বীয় অভিমত ব্যক্ত করার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে তিনি যার নাম প্রস্তাব করবেন তার মধ্যে কোনো মৌলিক ত্রুটি (কবীরা গুনাহ) না থাকলে সকলে তাকে মেনে নেয়ার মাধ্যমে উলিল আমর নির্বাচিত হতে পারে।

২. উলিল আমর নির্বাচনের জন্য পরামর্শের মাধ্যমে যে ‘নির্বাচনী পরিষদ’ গঠিত হবে সেই পরিষদের প্রধান পরিষদের অন্য সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে যাকে ‘উলিল আমর’ হিসেবে নির্বাচিত করবেন, সবাই তাকে উলিল আমর হিসেবে মেনে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে ঐ নির্বাচিত উলিল আমরের পক্ষে কম সংখ্যকের মত ছিল না বেশি সংখ্যকে মত ছিল তা দেখা হবে না, বরং সবার পরামর্শের বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা পরিষদের প্রধানের উপর অর্পণ করার ভিত্তিতে তার নির্বাচনের প্রতি সম্মতি বজায় রাখতে হবে। শর্ত হলো এ নির্বাচিত উলিল আমরের মধ্যে কুরআনে বর্ণিত কোনো মৌলিক ত্রুটি না থাকা।

৩. অধিকাংশ প্রায় সমান যোগ্যতাসম্পন্নরা যাকে বাছাই করবেন তার মধ্যে কোনো মৌলিক ত্রুটি না থাকলে তাকে মেনে নেয়ার মাধ্যমে উলিল আমর নির্বাচিত হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, সংখ্যানীতি (অধিকাংশের সিদ্ধান্ত মানা) স্বয়ং কোনো সঠিক পদ্ধতি নয়। সুতরাং অধিকাংশ ব্যক্তির মত যদি যৌক্তিক না হয় বা তাতে মৌলিক ত্রুটি থাকে, তাহলে সে অবস্থায় অধিকাংশের মত প্রতিষ্ঠার অর্থ হলো ‘সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগুরুর স্বৈরাচার’। অন্যদিকে যখন অধিকাংশের মতের ক্ষেত্রে মৌলিক ত্রুটি চিহ্নিত করা যায় না শুধুমাত্র সে ক্ষেত্রে অধিকাংশের মতকে অধিক গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। কারণ সেক্ষেত্রে অধিকাংশের মতকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার অর্থ হলো অভিমত ব্যক্তকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে সমান গুরুত্ব দেয়া।

সুতরাং সমর্থনজ্ঞাপনকারী যে পরিষদের মধ্যকার অধিকাংশের মতকে মূল্যায়ন করা হবে তারা যেন আস্থাভাজন ও পরস্পর প্রায় সমানুপাতিক যোগ্যতাসম্পন্ন হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। সেই সাথে যখন প্রস্তাবিত উলিল আমররা প্রায় সমানুপাতিক যোগ্যতাসম্পন্ন, তাই তাদের মধ্যে ক্রমিকতা নির্ধারণ কঠিন ও অপ্রয়োজনীয় তখন মোটামুটি উপস্থিত বিবেচনায় যাকে বেশি যোগ্য মনে হয় এবং এ বিষয়ে উপস্থিত নির্বাচকমন্ডলীর (যারা নিজেরা প্রায় সমানুপাতিক যোগ্যতাসম্পন্ন) অধিকাংশ যাকে বাছাই করে তাকে মেনে নেয়া একটি স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে সাব্যস্ত হয়।

নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে দ্বিধাবিভক্ত মতামত থেকে কোন মতটি গ্রহণ করতে হবে সেক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি হলো: (১) যদি একটি মত মাত্র একজনও দেয়, এবং এক্ষেত্রে সে সঠিক যুক্তি ও যোগ্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে তার মতের বিপরীতে বাকি সবাই থাকলেও তার একার যুক্তিই গ্রহণযোগ্য এবং সবার উচিত সেই মতকে গ্রহণ করে নেয়া। (২) যদি ভিন্নমত পোষণকারীরা প্রায় সমানুপাতিক যোগ্যতাসম্পন্ন হয় এবং যে তত্ত্ব বা সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি হয়েছে তার ক্ষেত্রে কোনো পক্ষ অকাট্যভাবে নিজ অবস্থানের সঠিকত্ব প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে আপাতত অধিকাংশের মত গ্রহণ করে নেয়াই শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়ক হয়ে থাকে ।

৪. একটি নির্বাচনী বোর্ড গঠন করে বিভিন্ন পয়েন্টভিত্তিক মূল্যমান নির্ধারণ করে প্রস্তাবিত উলিল আমরদের মধ্যে যিনি অধিক নম্বর (মার্ক) পাবেন (অধিকজনের সম্মতি নয়) তাঁকে উলিল আমর করা যেতে পারে।

অনেকে দাবি করে যে, যারা নেত্বত্ব দিতে চায় বা সেজন্য নিজেদের নাম প্রস্তাব করে তারা নেতৃত্বের জন্য অযোগ্য হিসেবে গণ্য হবে। তাই প্রত্যেকে অবশ্যই নিজেকে বাদ দিয়ে অন্যদের নাম প্রস্তাব করতে হবে। এ বিষয়ে তারা দলীলস্বরূপ ২৮:৮৩ আয়াত পেশ করে থাকে। অথচ আয়াতটিতে নেতৃত্ব সম্পর্কে বলা হয় নি, বরং নেতৃত্বে থেকে হোক বা নেতৃত্বের বাহিরে থেকে হোক নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে উঠাতে বা অন্যদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে চাওয়ার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে কোনো সমাজ-সমষ্টিকে, প্রতিষ্ঠান বা সংঘকে নেতৃত্ব দেয়া বা পরিচালনা করার বিষয়টি একটি ভিন্ন বিষয়। নিম্নে আয়াতটি উল্লেখ করা হলো:

২৮:৮৩ :: ঐ আখিরাতের ঘর তাদের জন্য যারা পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে উঠার (বা অন্যদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করার) ইচ্ছা করে না এবং ফাসাদ বা বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় সৃষ্টির ইচ্ছা করে না। আর স্রষ্টা-সচেতনদের জন্যই শুভ পরিণাম।

বস্তুত মুসলিম উম্মাহর পরিচালনাগত বিষয়ে বাস্তবসম্মতভাবে নিজেকে দায়িত্ব নেয়ার মতো অবস্থানে মনে করলে পরামর্শ পরিষদের কাছে সেই ক্ষেত্রে নিজেকে পেশ করা দোষনীয় নয়। যেমন নবী ইউসুফ নিজেকে ‘রক্ষক (হাফীজ) ও জ্ঞানী (আলীম)’ হিসেবে রাজকোষের দায়িত্ব অর্পণের জন্য পেশ করেছিলেন। নিম্নে আয়াতটি উল্লেখ করা হলো:

১২:৫৪-৫৫ :: আর রাষ্ট্রপতি বলেছে, “তাকে (ইউসুফকে) আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে আমার নিজের জন্য বিশেষ (উপদেষ্টা) করে নেবো।” তারপর যখন সে (রাষ্ট্রপতি) তার (ইউসুফ) সাথে কথা বলেছে, তখন সে (রাষ্ট্রপতি) বলেছে, “নিশ্চয় আজ আপনি আমাদের কাছে মর্যাদাবান ও বিশ্বস্ত।” সে (ইউসুফ) বলেছে, “আমাদে দেশের ধনভাণ্ডারের উপর কর্তৃত্ব অর্পণ করুন। নিশ্চয় আমি সংরক্ষণকারী ও জ্ঞানবান।”

উলিল আমর নির্বাচনে পরামর্শের সময় পরামর্শ হতে হবে সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক সাক্ষ্য দানের মাধ্যমে। সুতরাং মনোনয়নকারী পরিষদের বা তাদের মধ্যকার যাকে তারা সবদিক বিবেচনা করে মনোনয়নের প্রস্তাবনা পেশের ক্ষমতা অর্পণ করবেন তার প্রস্তাবনার পক্ষে প্রয়োজনে পুন:পুন আলোচনাক্রমে এক পর্যায়ে চূড়ান্ত ঘোষণার ভিত্তিতে সবাইকে মেনে নেয়ার আহবানের মাধ্যমে মনোনয়ন হতে পারে। এতে অবশ্যই পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্তভাবে ঘোষণা দিতে হবে। এছাড়া প্রয়োজনে প্রধান উলিল আমরের পাশাপাশি প্রাথমিকভাবে তাঁর সহযোগী উলিল আমরদের একটি পরিষদ নির্বাচিত করা যেতে পারে।

উলিল আমরের মেয়াদকাল বা উলিল আমর পুন:নির্বাচন

কেউ উলিল আমর নির্বাচিত হওয়ার অর্থ এ নয় যে, তাঁর চেয়ে যোগ্য আসলেই কেউ নেই। বরং এর অর্থ হলো সামগ্রিক বিবেচনায় তাঁকে যোগ্য সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়েছে। এখন যদি তাঁর চেয়ে যোগ্য কাউকে পাওয়া যায় তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে তা নয়, বরং সেই যোগ্য ব্যক্তি তাঁকে সহযোগিতা করবেন এবং একটা যুক্তিসঙ্গত সময় ব্যবধানে পুনর্বিবেচনা অধিবেশনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে। এই যুক্তিসঙ্গত সময় নির্ধারিত হবে পরামর্শের মাধ্যমে বা পূর্ব থেকে এরূপ নির্বাহী বিধি থাকতে পারে যে, কত সময় পর পর পুনর্বিবেচনা অধিবেশন বসবে, যদি না মধ্যবর্তীতে অনিবার্য প্রয়োজন হয়। পুনর্বিবেচনা অধিবেশনে কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতীত পূর্ববর্তী উলিল আমরকে অপসারণ করা যাবে না।

পুনর্বিবেচনা অধিবেশন একটি নির্বাহী রীতি, যোগ্য ব্যক্তির হাতে আমানত সমর্পনের পদ্ধতি হিসাবে। কিন্তু যখন তখন পরিবর্তন কোন স্থিতিশীলতা বা শৃংখলার উপযোগী নয়। সুতরাং অবশ্যই আমাদেরকে যোগ্য ব্যক্তির হাতে দায়িত্ব সমর্পনের ক্ষেত্রে শৃংখলা ও স্থিতিশীলতার উপযোগী পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

উলিল আমরের মেয়াদকাল পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্তক্রমে নির্ধারিত হবে। যেমন:

(১) এরূপ করা যেতে পারে যে, পরামর্শক্রমে কোনো মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হলো যার পর পুনরায় উলিল আমর নির্ধারণ করা হবে এবং পূর্ববর্তী উলিল আমরকে আবারও নির্ধারণ করার সুযোগ থাকবে।

(২) এরূপও করা যেতে পারে যে, উলিল আমর একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমায় পৌঁছলে পরবর্তী উলিল আমর নির্ধারণ করা হবে।

(৩) এরূপও হতে পারে যে, উলিল আমর যতদিন জীবিত থাকবেন ততদিন তিনি দায়িত্ব পালন করবেন। অবশ্য তিনি যদি কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পদত্যাগ করেন তা ভিন্ন বিষয়।

শর্ত :

(১) মুসলিমদের অধিকার ও কর্তব্য হলো, যদি উলিল আমর কুরআনের কোনো সীমা লঙ্ঘন করেন তাহলে তাঁর বিরোধিতা করা এবং সংশোধিত না হলে তাঁকে অপসারিত করা। আর অপসারণের স্বাভাবিক পদ্ধতি হলো: তাঁর বিরুদ্ধে আনীত মামলার প্রেক্ষিতে তাঁর নেতৃত্ব স্থগিত হবে এবং তাঁর স্থলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। মামলার রায়ে নির্দোষ সাব্যস্ত হলে তিনি পুনরায় উলিল আমরের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। আর তিনি দোষী প্রমাণিত হলে নতুন করে উলিল আমর নির্ধারণ করতে হবে। সাধারণ পদত্যাগের দাবি উত্থাপনও স্বাভাবিক অপসারণ পদ্ধতি। অন্যদিকে বিদ্রোহ দেখা দিলে তা জরুরি অবস্থা হিসেবে সাব্যস্ত হবে, যে ক্ষেত্রে মু’মিনদের নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষকে সমাধানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

(২) যদি উলিল আমর শারীরিক অসুস্থতা বা মানসিক দুর্বলতার জন্য দায়িত্ব পালন করতে অপারগ হন তাহলে নিয়মতান্ত্রিক প্রস্তাবনার মাধ্যমে নতুন উলিল আমর নির্ধারণ করা হবে।

উলিল আমর নির্বাচনের জন্য লক্ষণীয় গুণাবলী ও যোগ্যতা

উলিল আমর মানে যিনি মু’মিনদের সমষ্টিগত কার্যক্রম সম্পাদনের ক্ষেত্রে আল কুরআনের বিধান অনুযায়ী তাদের নেতৃত্ব প্রদান করবেন। তাই উলিল আমরকে মু’মিনদের মধ্য থেকে বা মু’মিনদের অন্তর্ভুক্ত তথা একজন মু’মিন হতে হবে। এছাড়া তার মধ্যে আল কুরআনে বর্ণিত মু’মিনদের গুণাবলীর উপস্থিতি থাকা প্রয়োজন। এসব গুণাবলির মধ্য থেকে যেগুলো কোনো মু’মিনকে নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্য হিসেবে প্রতীয়মান করতে পারে তা লক্ষ্য করার জন্য কুরআনের আয়াতসমূহ থেকে এরূপ অনেক গুণাবলি চিহ্নিত করা যেতে পারে। একজন ব্যক্তিকে যত বেশি গুণাবলিতে সমৃদ্ধ পাওয়া যাবে সে তত বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে। নিম্নে উলিল আমর নির্বাচনের জন্য লক্ষণীয় কিছু গুণাবলী ও যোগ্যতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।

যাদের আনুগত্য করা যাবে না

যাদের আনুগত্য করা যাবে না এমন ব্যক্তিকে উলিল আমর হিসেবে নির্ধারণ করা যাবে না এবং উলিল আমর নির্ধারিত হওয়ার পর কারো এরূপ অধ:পতন ঘটলে তখন আর তার আনুগত্য করা যাবে না বা তাকে উলিল আমর হিসেবে রাখা যাবে না। নিম্নে “যাদের আনুগত্য করা যাবে না” মর্মে নির্দেশনা সম্বলিত বিভিন্ন আয়াত উল্লেখ করা হলো:

৩:১০০ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যদি তোমরা যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের কোনো ফেরক্বার আনুগত্য করো তাহলে তারা তোমাদেরকে তোমাদের ঈমানের পরে আবার কাফির বানিয়ে দিবে।

৩:১৪৯ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যদি তোমরা তাদের আনুগত্য করো যারা কুফর করেছে তাহলে তারা তোমাদেরকে (ঈমান থেকে) পেছনের দিকে ফিরিয়ে দেবে, যার ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

৬:১১৬ :: আর যদি তুমি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের আনুগত্য করো তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে পথভ্রষ্ট করে দেবে। তারা শুধুমাত্র অনুমানেরই অনুসরণ করে এবং তারা শুধু জল্পনা-কল্পনাই করে।

আলোচনা : ৬:১১৬ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সংখ্যানীতির ভিত্তিতে (অর্থাৎ অধিকাংশ ব্যক্তির অভিমতকেই সিদ্ধান্তের উৎস হিসেবে) আনুগত্য করা যাবে না।

৬:১২১ :: আর তোমরা তা থেকে খেয়ো না যার উপর আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি। নিশ্চয় তা ফিসক্ব/নীতিবিরুদ্ধতা। আর নিশ্চয় শয়তান তার বন্ধুদেরকে ওহী করে/ অনুপ্রেরণা দেয় তোমাদের সাথে বিতর্ক করার জন্য। আর যদি তোমরা তাদের আনুগত্য করো তাহলে নিশ্চয় তোমরা মুশরিক।

আলোচনা : যারা আল্লাহর নির্দেশের বিপরীতে অন্য কারো নির্দেশের আনুগত্য করে তারা মুশরিক।

১৮:২৮ :: আর তোমার নিজেকে ধৈর্যশীল রাখো তাদের সাথে যারা তাদের প্রভুকে সকালে ও সন্ধ্যায় ডাকে তাঁর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায়। আর পার্থিব জীবনের শোভা ও চাকচিক্য কামনায় তাদের থেকে তোমার চোখ দুটো যেন তাদেরকে এড়িয়ে না যায়। আর তার আনুগত্য করো না যাকে আমরা আমাদের স্মরণ/স্মারক (কুরআন) থেকে উদাসীন করে দিয়েছি এবং সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে (খামখেয়ালি, স্বেচ্ছাচারী) এবং তার কার্যকলাপ সীমালঙ্ঘনমূলক।

২৫:৫২ :: কাফিরদের আনুগত্য করো না এবং তাদের বিরুদ্ধে তা (কুরআন) দ্বারা বড় ধরনের জিহাদ (বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম) করো।
২৬:১৫১-১৫২ :: আর তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী ও অপচয়কারীদের নির্দেশের আনুগত্য করো না, যারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং সংশোধনের কাজ করে না।

২৯:৮ :: আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার প্রতি উত্তম আচরণ করতে। আর যদি তারা উভয়ে প্রচেষ্টা চালায় যে, যেন তুমি আমার সাথে শিরক করো, যা তুমি (সঠিক বলে) জানো না, তখন তুমি তাদের আনুগত্য করো না। আমারই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল। তখন আমি তোমাদেরকে তোমাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে (ফায়সালা) জানিয়ে দিবেন।

৩১:১৪-১৫ :: আর আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার প্রতি উত্তম আচরণ করতে। তার মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভে বহন করেছে। আর তাকে দুধ ছাড় ছাড়ানো হয় দুই বছরে। (আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি) যেন আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং তোমার পিতামাতারও (কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো)। আমারই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। আর যদি তারা উভয়ে প্রচেষ্টা চালায় যে, যেন তুমি আমার সাথে শিরক করো, যা তুমি (সঠিক বলে) জানো না, তখন তুমি তাদের আনুগত্য করো না। তবে তাদের উভয়ের সাথে ন্যায়সঙ্গতভাবে আচরণ করবে। আর তার (অনুসৃত) পথই অনুসরণ করো যে আমার অভিমুখী হয়েছে। তারপর আমারই কাছে তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল। তখন আমি তোমাদেরকে তোমাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে (ফায়সালা) জানিয়ে দিবেন।

৩৩:৪৮ :: আর কাফিরদের ও মুনাফিক্বদের আনুগত্য করো না। এবং তাদের নির্যাতনকে উপেক্ষা করো। এবং আল্লাহর উপর ভরসা করো। আর কর্মবিধায়ক হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।

৬৮:৮ :: মিথ্যাবাদীদের আনুগত্য করো না।

৬৮:১০ :: এবং যে ঘন ঘন কসম করে (অথচ মিথ্যা কথার জন্য) লাঞ্চিত হয় এরূপ ব্যক্তির আনুগত্য করো না।

৭৬:২৪ :: তোমার প্রভুর হুকুুমের জন্য সবর করো এবং তাদের মধ্যকার কোনো পাপী ও কাফেরের আনুগত্য করো না।

৩৩:৬৬-৬৭ :: যেদিন তাদের মুখমণ্ডলসমূহকে আগুনের মধ্যে ওলট-পালট করা হবে সেদিন তারা বলবে, “হায় আমাদের আফসোস! যদি আমরা আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলের আনুগত্য করতাম!”। এবং তারা বলবে, “হে আমাদের প্রভু, নিশ্চয় আমরা আমাদের কর্তৃত্বশীল ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের আনুগত্য করেছিলাম, অথচ তারা আমাদেরকে সঠিক পথ থেকে পথভ্রষ্ট করে দিয়েছিলো।”

আলোচনা : যে ধরনের নেতারা ইসলাম থেকে পথভ্রষ্ট করে দেয় তাদের আনুগত্য করা যাবে না।

জালিমদের দিকে ঝোঁকা যাবে না

১১:১১৩ :: যারা জুলুম করেছে তাদের দিকে ঝুঁকে পড়বে না, অন্যথায় তোমাদেরকে (জাহান্নামের) আগুন স্পর্শ করবে। আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক (আওলিয়া) থাকবে না এবং তোমাদেরকে সাহায্যও করা হবে না।

যাদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না

যাদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না, এরূপ ব্যক্তিকে মুসলিম উম্মাহর উলিল আমর বা নেতৃত্ব দানকারী হিসেবে নির্বাচিত করা যেতে পারে না। তাই নিম্নে এরূপ নির্দেশনা সম্বলিত বিভিন্ন আয়াত উল্লেখ করা হলো:

৯:১৬ :: নাকি তোমরা হিসাব করে নিয়েছো যে, তোমাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, অথচ এখনো আল্লাহ প্রকাশ করে দেননি তোমাদের মধ্য থেকে কারা জিহাদ (আল্লাহর পথে সংগ্রাম) করেছে এবং আল্লাহকে, তাঁর রসূলকে ও মু’মিনদেরকে ছাড়া কাউকে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গ্রহণ করে নি? আর তোমরা যা করো আল্লাহ তা সম্যক জ্ঞাত।

৩:১১৮ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা তোমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু বা নির্বাহী গোপনীয়তার অংশীদার করো না তোমাদের নিজেদেরকে (তথা মু’মিনদেরকে) ছাড়া অন্যদেরকে। তারা তোমাদের বিপন্ন করার কোনো সুযোগই ছাড়ে না। তারা তা-ই কামনা করে যা দ্বারা তোমরা দুঃখ-কষ্টে পড়ো। নিশ্চয় তাদের মুখের কথায় তাদের বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে। আর তারা তাদের মনে যা গোপন রেখেছে তা আরো বড় ধরনের (বিদ্বেষপূর্ণ)। নিশ্চয় আমরা আমাদের আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করি যেন তোমরা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করতে পারো।

৪:১৪৪ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা মু’মিনদেরকে ছাড়া কাফিরদেরকে আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমরা কি আল্লাহর কাছে তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুস্পষ্ট প্রমাণ পেশ করতে চাও?

৬০:১ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা আমার ও তোমাদের প্রতি শত্রুতাকারীদেরকে আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব পাতাচ্ছো, অথচ নিশ্চয় তারা উহার প্রতি কুফর করেছে তোমাদের কাছে সত্য থেকে যা (কুরআন) এসেছে। তারা রসূলকে ও তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে এ কারণে যে, তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছো যিনি তোমাদের রব (প্রতিপালক, প্রভু, বিধাতা)। যদি তোমরা আমারই পথে সংগ্রামে ও আমার সন্তুষ্টির তালাশে বের হয়ে থাকো, তবে কেন তোমরা গোপনে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করো? অথচ আমি জানি যা তোমরা গোপন করো ও যা তোমরা প্রকাশ করো। আর তোমাদের মধ্য থেকে যে তা করবে, তবে নিশ্চয় সে সরল পথ থেকে পথভ্রষ্ট হয়েছে।

৩:২৮ :: মু’মিনরা যেন মু’মিনদেরকে ছাড়া কাফিরদেরকে আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ না করে। আর যে ব্যক্তি এরূপ করে (তথা কাফিরদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে) তার সাথে কোনো ক্ষেত্রে আল্লাহর সম্পর্ক নেই, এছাড়া যে, তোমরা তাদের (নির্যাতন) থেকে আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে (বাহ্যত) এরূপ করো। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নিজের বিষয়ে সচেতন করছেন। আর আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন।

৪:১৩৯ :: যারা মু’মিনদেরকে ছাড়া কাফিরদেরকে আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করে, তারা কি তাদের কাছে সম্মান তালাশ করে? তবে (জেনে রেখো) সমস্ত সম্মান আল্লাহরই আয়ত্তে।

৯:২৩ :: হে যারা ঈমান এনেছো তোমাদের পিতা ও ভাইদেরকেও আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমানের চেয়ে কুফরকে ভালবাসে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে আওলিয়া হিসেবে গ্রহণ করবে, তারাই যালিম।
উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মুসলিম উম্মাহর উলিল আমর অবশ্যই মু’মিন-মুসলিম হতে হবে এবং কোনো কাফিরকে উলিল আমর হিসেবে নির্বাচিত করার বা মেনে নেয়ার এবং তার আনুগত্য করার অবকাশ নেই। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতটিও বিশেষভাবে লক্ষণীয়:

৪:১৪১ :: যারা (মুনাফিক্ব) অপেক্ষা করে তোমাদের ব্যাপারে (কী ঘটে তা দেখার জন্য)। সুতরাং যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যক্রমে তোমাদের বিজয় হয়, তখন তারা (মু’মিনদেরকে) বলে, “আমরা কি তোমাদেরই সাথে ছিলাম না?” আর যদি কাফিরদের আংশিক বিজয় হয়, তখন তারা (কাফিরদেরকে) বলে, “আমরা কি তোমাদের উপর প্রবল ছিলাম না? অথচ আমরাই তোমাদেরকে মু’মিনদের হাত থেকে রক্ষা করেছি।”। সুতরাং আল্লাহ ক্বিয়ামাত দিবসে তাদের মধ্যে ফায়সালা করে দিবেন। আর আল্লাহ কাফিরদের জন্য মু’মিনদের উপর (স্থায়ী বিজয় ও আধিপত্য লাভের এবং নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা ও অধিকারের) কোনো পথ/উপায়/অবকাশ রাখেন নি।

৪:৫৯ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, “হে যারা ঈমান এনেছো তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রসূলের ও তোমাদেরই মধ্য থেকে হওয়া উলিল আমরের …।” অর্থাৎ উলিল আমর নির্বাচন করতে হবে মু’মিনদেরই মধ্য থেকে এবং তাই যে ব্যক্তি মু’মিন নয় এরূপ ব্যক্তি মু’মিনদের উলিল আমর নয় এবং এরূপ ব্যক্তির আনুগত্য করা যেতে পারে না। আর এটা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত বিষয়। কোনো সমাজতান্ত্রিক পার্টির নেতা যেমন কোনো পুঁজিবাদীকে করা যেতে পারে না, তেমনি মু’মিনদের উলিল আমর কোনো অমু’মিনকে করা যেতে পারে না।

যারা আল্লাহর যিকর থেকে বিমুখ তথা যারা আল কুরআনের বিধি-বিধানকে মূল সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করবে না তাদের আনুগত্য করা যাবে না। ইসলামই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র দ্বীন, ইসলাম ছাড়া অন্য দ্বীন কবুলযোগ্য নয় এবং ইসলামকে গ্রহণ করতে হবে সামগ্রিকভাবে। সুতরাং যারা ইসলামকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করবে না তাদের আনুগত্য হবে না অর্থাৎ তাদের মু’মিনদের নেতা বানানো যাবে না।তবে যারা অন্যান্য দ্বীনের অনুসরণ করে তাদের পূজনীয়দেরকে গালি দেয়া যাবে না এবং তাদেরকে তাদের দ্বীন অনুসরণে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মানুষের পারস্পরিক লেনদেন বা কায়কারবারের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে থাকে, যা কোনো সাধারণ প্রতিষ্ঠানে যেমন হয়ে থাকে, তেমনি হয়ে থাকে কোনো ভূখন্ডের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রেও সরকার বা শাসক ও নাগরিক হিসেবে। পিতামাতা যেমন শিরকের নির্দেশ দিলে তা পালন করা যাবে না, কিন্তু তাদের অন্যান্য আদেশ পালন করা যাবে, অনুরূপভাবে কর্মরত প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের এবং রাষ্ট্রের নাগরিক বা ‘আহলে জিম্মাহ’ (যারা জিম্মাহদারি বা সুরক্ষা প্রদান চুক্তির আওতায় রয়েছে) হওয়ার প্রেক্ষিতে শাসকের আদেশ-নির্দেশ পালন বা শৃঙ্খলাজনিত আনুগত্য করতে হবে, যতক্ষণ না তা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব কুরআনের পরিপন্থী হবে।

জিন্মাহ প্রসঙ্গে ৯:৮ ও ৯:১০ আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। আয়াত দুটি নিম্নরূপ :

৯:৮ :: কিরূপে (মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক রাখা যাবে)? অথচ যদি তারা তোমাদের উপর বিজয়ী থাকে, তারা তোমাদের বিষয়ে সাধারণ আত্মীয়তারও মর্যাদা রাখে না এবং সুরক্ষা চুক্তিরও মর্যাদা রাখে না। তারা মুখের কথায় তোমাদেরকে সন্তুষ্ট করে অথচ তাদের অন্তর তা অস্বীকার করে আর তাদের অধিকাংশই নীতিহীন।

৯:১০ :: তারা মু’মিনদের বিষয়ে সাধারণ আত্মীয়তারও মর্যাদা রাখে না এবং সুরক্ষা চুক্তিরও মর্যাদা রাখে না। আর তারাই সীমালংঘনকারী।

অন্যদিকে মু’মিনদের ‘উলিল আমর’ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাকেই ‘উলিল আমর’ নির্বাচিত করতে হবে যে নিজেও ঈমানদার। আর মু’মিনদের কর্তব্য হলো উলিল আমরের ইতায়াত বা স্বত:স্ফূর্ত আনুগত্য করা, তার হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকুক অথবা না থাকুক। কারণ মু’মিনদেরকে মতাদর্শগত জাতিসত্তা স্বতন্ত্র অস্তত্ব বজায় রেখে আল্লাহর দাসত্ব ও মানবজাতির কল্যাণের জন্য কাজ করে যেতে হবে।

উলিল আমর নির্বাচনের জন্য লক্ষণীয় বিভিন্ন গুণাবলী

উলিল আমর নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রথম শর্ত হলো উলিল আমর নির্বাচিত করতে হবে মু’মিনদের মধ্য থেকে। কিন্তু সেই সাথে উলিল আমর এমন ব্যক্তিকেই নির্বাচিত করতে হবে যার মধ্যে নেতৃত্বের উপযোগী বিভিন্ন গুণাবলী ও যোগ্যতা পাওয়া যায়। উলিল আমরকে দ্বিবিধ কার্যাবলী সম্পাদন করতে হয়, যথা : অন্তর্গত সমস্যা সমাধান ও পরিচালনা এবং বহির্গত সমস্যা সমাধান। তাই এ উভয় ধরনের সমস্যা সমাধানের বাস্তব যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে উলিল আমরের দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে। এছাড়া যিনি বিভিন্ন কাঙ্ক্ষিত গুণাবলীতে যত বেশি সমৃদ্ধ হবেন তিনি উলিল আমর হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে তত বেশি উপযুক্ত। তাই সর্বাধিক উপযুক্ত নেতৃত্ব নির্বাচনের লক্ষ্যে বিভিন্ন আয়াতে যেসব গুণাবলীর নির্দেশনা পাওয়া যায় সেগুলো সামনে রাখতে হবে। নিম্নে এরূপ বিভিন্ন গুণাবলী চিহ্নিত করা হলো:

স্রষ্টা-সচেতনতায় অগ্রগামিতা

৪৯:১৩ :: হে মানুষ, নিশ্চয় আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে, আর আমরা তোমাদেরকে পরিণত করেছি বিভিন্ন শাখায় (সভ্যতায়) ও প্রশাখায় (সম্প্রদায় ও গোত্রে), যেন তোমরা একে অন্যকে চিনতে পারো। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে মর্যাদাবান যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে স্রষ্টা-সচেতন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ সম্যক অবগত।

আলোচনা : স্রষ্টা সচেতন হওয়ার অর্থ হলো স্রষ্টা প্রদত্ত কিতাবের জ্ঞান অর্জন করা এবং সেই অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করা। যে ব্যক্তি যত বেশি স্রষ্টা সচেতন সে তত বেশি মর্যাদাবান। যোগ্যতা হলো মর্যাদার কারণ এবং মর্যাদা হলো যোগ্যতার ফল। সুতরাং যে ব্যক্তি যত বেশি স্রষ্টা সচেতন সে ব্যক্তি তত বেশি যোগ্য। কারণ একজন স্রষ্টা-সচেতন ব্যক্তি কোনো যে ধরনের দায়িত্ব পালনের জন্য যে ধরনের বাস্তব দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন তা অর্জন করবে এবং দায়িত্ব পালনে অবহেলা করবে না। যে ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের জন্য সে দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না সেক্ষেত্রে সে দায়িত্ব গ্রহণ করবে না বা সে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাইবে। সুতরাং সংশ্লিষ্ট কাজে দক্ষতার পাশাপাশি স্রষ্টা-সচেতনতাই প্রকৃত যোগ্যতা হিসেবে অগ্রগণ্য হবে।

জ্ঞানগত ও দৈহিক সমৃদ্ধি

২:২৪৬-২৪৭ :: তুমি মূসার পরবর্তীতে বানী ইসরাইলের প্রধানদের প্রতি লক্ষ্য করো নি? যখন তারা তাদের জন্য প্রেরিত নবীকে বলেছিল, আমাদের জন্য একজন রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করুন, আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবো। সে (নবী) বললো, “তোমাদের ক্ষেত্রে এমন সম্ভাবনা আছে কি যে, তোমাদের উপর যুদ্ধ বিধিবদ্ধ করে দেয়া হলো অথচ তোমরা যুদ্ধ করবে না?” তারা বললো, “আমাদের কী হলো যে, আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবো না অথচ আমাদেরকে ও আমাদের সন্তানদেরকে আমাদের বাড়িঘর থেকে বাহির করে দেয়া হয়েছে?” তারপর যখন তাদের উপর যুদ্ধ বিধিবদ্ধ করে দেয়া হলো, তাদের মধ্যকার অল্পসংখ্যক ছাড়া বাকিরা মুখ ফিরিয়ে নিলো। আর আল্লাহ জালিমদের সম্পর্কে পরিজ্ঞাত। আর তাদেরকে তাদের নবী বললো, “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য তালুতকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করেছেন।” তারা বললো, “কীভাবে তার জন্য আমাদের উপর রাজত্ব করার অধিকার থাকতে পারে? অথচ আমরা (বানী ইসরাইল) রাজত্বের বিষয়ে তার চেয়ে অধিক অধিকারী। আর তাকে তো মালসম্পদ থেকেও স্বচ্ছলতা দেয়া হয় নি।” সে (নবী) বললো, “নিশ্চয় আল্লাহ তাকে তোমাদের উপর মনোনীত করেছেন এবং তাকে জ্ঞানগত ও দৈহিক কাঠামোতে সমৃদ্ধ করেছেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাঁর রাজত্ব দান করেন। আর আল্লাহ সর্বব্যাপী সর্বজ্ঞ।”

জ্ঞানী, আমানাতদার ও আমানাতের সংরক্ষণকারী, প্রতিশ্রুতি পূরণকারী

৩৫:২৮ :: আর এভাবে মানুষ, বিচরণশীল প্রাণী ও চতুষ্পদ গবাদি পশুর মধ্যে রয়েছে বৈচিত্র্যময় বর্ণ। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যকার জ্ঞানী বান্দাদের মধ্য থেকেই (এমন ব্যক্তি পাওয়া যায় যারা) আল্লাহকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।

১২:৫৪-৫৫ :: আর রাষ্ট্রপতি বলেছে, “তাকে (ইউসুফকে) আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে আমার নিজের জন্য বিশেষ (উপদেষ্টা) করে নেবো।” তারপর যখন সে (রাষ্ট্রপতি) তার (ইউসুফ) সাথে কথা বলেছে, তখন সে (রাষ্ট্রপতি) বলেছে, “নিশ্চয় আজ আপনি আমাদের কাছে মর্যাদাবান ও বিশ্বস্ত।” সে (ইউসুফ) বলেছে, “আমাদে দেশের ধনভাণ্ডারের উপর কর্তৃত্ব অর্পণ করুন। নিশ্চয় আমি সংরক্ষণকারী ও জ্ঞানবান।”

৮:২৭ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে খেয়ানত (বিশ্বস্ততা লংঘন) করো না এবং তোমাদের পরস্পরের আমানাতের ক্ষেত্রেও খেয়ানত (বিশ্বস্ততা লংঘন) করো না।

২৩:৮ :: এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তদারককারী (শাব্দিক অর্থ: রাখাল)।

৭০:৩২ :: এবং যারা তাদের আমানাত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তদারককারী (শাব্দিক অর্থ: রাখাল)।

১৭:৩৪ :: আর তোমরা ইয়াতীমের সম্পদের কাছে যেয়ো না, সুন্দরতম পন্থা ছাড়া, যতক্ষণ না সে যৌবনে / স্থিতিশীল শক্তিসামর্থ্যের বয়সে উপনীত হয়। আর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো, নিশ্চয় প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জবাবদিহি করা হবে।

৩:৭৭ :: নিশ্চয় যারা আল্লাহর ফরমান/প্রতিশ্রুতি এবং তাদের চুক্তি বা শপথকে তুচ্ছ মূল্যের বিনিময়ে বিক্রি করে, পরকালে তাদের জন্য কোনো ইতিবাচক অংশ নেই এবং ক্বিয়ামাত দিবসে আল্লাহ তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।

শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত

২৮:২৬ :: তাদের (দুই নারীর) একজন বললো, “আব্বু, তুমি তাকে (মূসাকে) সেবাকর্মী নিযুক্ত করো, কারণ সেবাকর্মী হিসেবে সেই উত্তম হবে যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত।”

বুদ্ধিমত্তা

৪:৫ :: আর তোমরা নির্বোধদের হাতে তোমাদের সম্পদ তুলে দিও না, যাকে আল্লাহ তোমাদের প্রতিষ্ঠিত থাকার উপকরণ বানিয়েছেন এবং তাদেরকে তা থেকে অন্ন-বস্ত্র প্রদান করো এবং তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত কথা বলো।

৪৯:৬ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যদি তোমাদের কাছে কোনো ফাসেক্ব/দুষ্কার্যকারী কোনো তথ্য নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করো। এমন যেন না হয় যে, তোমরা মুর্খতাবশত কোনো জনগোষ্ঠীর ক্ষতি করে বসো, তারপর তোমরা যা করেছো সেই বিষয়ে তোমাদেরকে অনুতাপকারী হতে হয়।

আলোচনা: কোনো ব্যক্তি ফাসেক্ব হলে যাচাই ছাড়া তার তথ্য অনুসারে কোনো পদক্ষেপ নিলে তাতে কোনো জনগোষ্ঠীর ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই এরূপ করা যাবে না, বরং তার দেয়া তথ্যকে যাচাই করতে হবে। কারণ যাচাই ছাড়া তার দেয়া তথ্যকে সরাসরি পরিত্যাগ করাও সঠিক হবে না। সে ফাসেক্ব হলেও তার দেয়া কোনো কোনো তথ্য সঠিকও হতে পারে। এভাবে ফাসেক্বের দেয়া তথ্যকে যাচাই ছাড়া গ্রহণ বা বর্জন করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।

অন্য মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট নয়

২:১৪৫ :: আর (তোমার পূর্বে) যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তুমি যদি তাদের নিকট সব নিদর্শন নিয়ে আস, তারা তোমার কিবলার অনুসরণ করবে না আর তুমিও তাদের কিবলার অনুসরণকারী নও এবং তারা একে অপরের কিবলার অনুসরণকারী নয়। আর যদি তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ কর তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর, তবে নিশ্চয় তুমি তখন যালিমদের অন্তর্ভুক্ত।

২:১২০ :: আর ইয়াহূদ ও নাসারা (খৃস্টান) কখনো তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাতের (ধর্মাদর্শের প্রকৃতি) অনুসরণ কর। বলো, ‘নিশ্চয় আল্লাহর হিদায়াতই হিদায়াত’ আর যদি তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ কর তোমার কাছে যে জ্ঞান এসেছে তার পর, তাহলে আল্লাহর বিপরীতে তোমার কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী থাকবে না।

সত্যবাদী

৯:১১৯ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা আল্লাহর প্রতি সচেতন থাকো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও।

সত্য সাক্ষ্যে অবিচল থাকা এবং পেঁচালো কথা ও পাশ কাটিয়ে যাওয়া থেকে বিরত থাকা

৫:৮ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে (আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকার জন্য) ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সত্য সাক্ষ্যদাতা হিসেবে দণ্ডায়মান হও। আর কোনো ক্বওমের শত্রুতা যেন তোমাদেরকে অপরাধপ্রবণ না করে যে, তোমরা ন্যায়বিচার করতে পারো না। ন্যায়বিচার করো, উহাই স্রষ্টা-সচেতনতার নিকটতর। নিশ্চয় তোমরা যা করো আল্লাহ তা সম্যক অবগত।

৪:১৩৫ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে (আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকার জন্য) ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সত্য সাক্ষ্যদাতা হিসেবে দণ্ডায়মান হও। যদিও তা যায় তোমাদের নিজেদের বা তোমাদের পিতামাতার ও নিকটতম আত্মীয়দের বিপক্ষে যায়। যদি তাদের কেউ ধনী হয় অথবা দরিদ্র হয় (তা বিবেচনার বিষয় নয়)। আল্লাহ তোমাদের চেয়ে তাদের (ধনী-দরিদ্র) উভয়ের প্রতি অধিক হিতকামী। সুতরাং তোমরা প্রবৃত্তিতাড়িত হয়ো না, যার ফলে তোমরা ন্যায়বিচার করতে পারো না। আর যদি তোমরা পেঁচালো কথা বলো অথবা সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাও, তাহলে নিশ্চয় তোমরা যা করো আল্লাহ তা সম্যক অবগত।

সামাজিক প্রতিপত্তিহীন সাধারণ লোকদের সাথে সুসম্পর্ক

১১:২৭-৩১ :: তারপর তার (নূহ) ক্বওমের মধ্য থেকে যারা কুফর করেছে তাদের প্রধানগণ বলেছে, “আমরা তোমাকে আমাদের মতো একজন মানুষ ছাড়া অন্যরূপ দেখছি না। আর তোমার অনুসরণ করতে দেখছি না তাদেরকে ছাড়া যারা আমাদের নিম্নশ্রেণির লোক, যারা অপরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারী। আর আমরা তোমাদেরকে আমাদের উপর বিশিষ্টতার অধিকারী হিসেবে দেখছি না, বরং আমরা তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করি। সে (নূহ) বললো, “হে আমার ক্বওম, তোমরা কি ভেবে দেখেছো, যদি আমি আমার প্রভুর পক্ষ থেকে আসা স্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত হই আর তিনি আমাকে তাঁর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ দিয়েছেন, আর তোমাদের উপর অন্ধত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা কি তোমাদেরকে তা চাপিয়ে দিতে পারি এ সত্ত্বেও যে, তোমরা উহাকে অপছন্দকারী? হে আমার আমি তোমাদের কাছে উহার (রিসালাত পৌঁছানোর) বিনিময়ে কোনো মালসম্পদ চাই না। আর আমার পারিশ্রমিক তো শুধু আল্লাহর কাছেই আছে। আর যারা ঈমান এনেছে আমি তাদেরকে বিতাড়নকারী নই। নিশ্চয় তারা তাদের প্রভুর সাথে সাক্ষাত করবে। কিন্তু আমি তোমাদেরকে দেখছি এক মুর্খ সম্প্রদায়। হে আমার ক্বওম, কে আমাকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করবে, যদি আমি তাদেরকে তাড়িয়ে দিই? তোমরা কি শিক্ষাগ্রহণ করবে না? আর আমি বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধনভাণ্ডার আছে আর আমি গায়েবও জানি না। আর আমি বলি না যে, নিশ্চয় আমি ফেরেশতা। আর তোমাদের চোখ যাদেরকে নিম্নশ্রেণির হিসেবে দেখে তাদের প্রসঙ্গে আমি বলতে পারি না যে, আল্লাহ তাদেরকে কোনো কল্যাণ ও উত্তম গুণ দিবেন না। তাদের ব্যক্তিত্বে কী রয়েছে তা সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। নিশ্চয় (তারা কল্যাণ ও উত্তম গুণ পেতে পারে না বললে) সেক্ষেত্রে আমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।”

যোগ্যতা অনুযায়ী দায়িত্ব অর্পণ বা সুবিচারপূর্ণ কর্মবণ্টন

১৬:৯০ :: নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন আদল (ন্যায় আচার, ন্যায় বিচার ও ক্ষতিপূরণ) এবং ইহসান (উত্তম আচরণ, পরোপকার ও পরার্থে ত্যাগ স্বীকার) এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার জন্য এবং তিনি তোমাদেরকে নিষেধ করেন অশ্লীল ও অন্যায় এবং সীমালঙ্ঘন করা থেকে। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যেন তোমরা সদা স্মরণ রাখতে পারো।

২৩:৬২ :: আমরা কাউকে তার সামর্থ্যের বাহিরে দায়িত্বভার অর্পণ করি না বা দায়ি করি না। আর আমাদের কাছে সঠিকভাবে (সামর্থ্যের স্তর নির্ণয়) ব্যক্তকারী কিতাব রয়েছে। আর তাদেরকে যুলুম করা হবে না।

ক্রোধ সংবরণ, ক্ষমা, পরামর্শ, স্নেহপরায়ণতা

৩:১৫৯ :: আল্লাহর রহমতে তুমি তাদের প্রতি কোমল হয়েছো। যদি তুমি তাদের প্রতি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে, তবে তারা সরে পড়তো তোমার আশপাশ থেকে। সুতরাং তুমি তাদের প্রতি উদার হও এবং তাদেরকে ক্ষমা করো এবং (নির্বাহী) কর্মকাণ্ডে তাদের সাথে শূরা/ পরামর্শ করো। তারপর যখন তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তখন (তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে) আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল/ ভরসা করবে। নিশ্চয় আল্লাহ (তাঁর উপর) তাওয়াক্কুলকারীদের/ ভরসাকারীদেরকে ভালবাসেন।

আলোচনা : রসূল তাঁর সঙ্গীদের প্রতি অভিযোগপ্রবণ ছিলেন না, বরং ক্ষমাপরায়ণ ছিলেন এবং তাদের স্বাভাবিক ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতি কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে তাদের সাথে কোমল ব্যবহার করতেন । উত্তম নেতৃত্বের জন্য এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গুণ।

২৬:২১৫ :: এবং মু’মিনদের মধ্য থেকে যারা তোমার অনুসরণ করে তাদের প্রতি তোমার বাহুকে অবনত (দয়া পরবশ) করো।

৯:১২৮ :: নিশ্চয় তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রসূল এসেছে, তোমাদের ভোগান্তি তার জন্য ভীষণ মর্মপীড়াদায়ক। সে তোমাদের উপর শুভাকাক্ষী, মু’মিনদের প্রতি স্নেহপরায়ণ দয়ালু।

৩:১৩৪ :: যারা স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল অবস্থায় পরার্থে ব্যয় করে এবং ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ উত্তম আচরণকারীদেরকে ভালবাসেন।

ধৈর্য ও অধ্যবসায়

৩:১৪২ :: নাকি তোমরা হিসাব করে নিয়েছো যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে এমতাবস্থায় যে, আল্লাহ তখনো পরখ করে চিহ্নিত করেন নি তোমাদের মধ্য থেকে কারা সংগ্রাম করেছে এবং ধৈর্যশীল ও অধ্যবসায়ীদেরকেও পরখ করে চিহ্নিত করেন নি।

৪২:৪৩ :: আর যে ধৈর্য ধারণ করে ও ক্ষমা করে, নিশ্চয় তা দৃঢ়চিত্ততার বিষয়।

যোগাযোগের দক্ষতা

২০:২৫-২৮ :: সে (মূসা) বললো, “হে আমার প্রভু, আমার (কাজে সফলতার) জন্য আমার মন-মস্তিষ্ককে উন্মুক্ত (বাস্তব পরিস্থিতি ও তা মোকাবেলার উপায় অনুধাবনের উপযোগী) করে দিন। এবং আমার জন্য আমার কাজ বা দায়-দায়িত্বকে সহজ করে দিন। এবং আমার জিহবার গিরা খুলে দিন/ আমার ভাষার অস্পষ্টতা, জড়তা ও জটিলতা দূর করে দিন।”

২৮:৩৪ :: (মূসা দোয়া করেছিল), “আর আমার ভাই হারুণ ভাষা প্রকাশে অধিক সাবলীল। সুতরাং তাকে আমার সাথে সহযোগী হিসেবে প্রেরণ করুন, সে আমার প্রত্যয়ন করবে। নিশ্চয় আমি আশংকা করি যে, তারা আমাকে মিথ্যারোপ করবে।”

৩৮:২০ :: আর আমরা তার (দাউদ) আধিপত্যকে দৃঢ় করেছিলাম এবং তাকে দিয়েছিলাম বিজ্ঞতা ও ফয়সালাকারী কথা বলার দক্ষতা।

কথা ও কাজে সামঞ্জস্য

২:৪৪ :: তোমরা কি মানুষকে ভালো কাজের নির্দেশ দাও অথচ নিজেদের (কর্মে তা বাস্তবায়নের) ক্ষেত্রে বেলায় ভুলে থাকো? অথচ তোমরা কিতাব আবৃত্তি করো। তবে কি তোমরা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করো না?

৬১:২-৩ :: হে যারা ঈমান এনেছো, কেন তোমরা বলো যা তোমরা করো না? আল্লাহর কাছে বড়ই ক্রোধের বিষয় এই যে, তোমরা বলো যা তোমরা করো না।

অল্পে তুষ্টি, অন্য ভাইকে অগ্রাধিকার ও মনের প্রসারতা

৫৯:৯ :: আর (এ সম্পদ তাদের জন্যও) যারা তাদের আগে থেকেই এ রাষ্ট্রে বসবাস করে আসছে এবং ঈমান এনেছে। তারা তাদেরকে ভালোবাসে যারা তাদের কাছে হিজরাত করে এসেছে। আর তারা তাদেরকে (মুহাজিরদেরকে) যা দেয়া হয় তাতে তাদের অন্তরে কোনো ঈর্ষা রাখে না এবং তারা তো নিজেদের উপরে তাদের (মুহাজিরদের) প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয় যদিও তাদের (নিজেদের) সাথে অভাব লেগে থাকে। আর যাকে তার মনের সংকীর্ণতা (স্বার্থপরতা, লোভ, কৃপণতা, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি) থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই সফল।

৬৪:১৬ :: তোমরা সাধ্যমতো আল্লাহর প্রতি সচেতন থাকো এবং শুনো এবং আনুগত্য করো এবং তোমাদের জন্য উত্তম (মান ও পরিমাণে পরার্থে) ব্যয় করো। আর যাকে মনের সংকীর্ণতা থেকে বাঁচানো হয়েছে তবে নিশ্চয় তারাই সফলতা লাভকারী।
উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে অল্পে তুষ্টি, অন্য ভাইকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং মনের সংকীর্ণতা থেকে বেঁচে থাকার উত্তম গুণ সম্পর্কে জানা যায়। একজন সংকীর্ণমনা ব্যক্তি নিজের জীবন ও কর্মে অন্যের জন্য খুব কম স্থান রাখে। তার কাছে নিজের অসুবিধাকে অসুবিধা মনে হয় কিন্তু অন্যের অসুবিধাকে বাহানাবাজি মনে হয়, নিজের দোষ ক্ষমাযোগ্য মনে হয় কিন্তু অন্যের দোষ ক্ষমার অযোগ্য মনে হয়। সংকীর্ণমনতা একটি নৈতিক দোষ। মুসলিম উম্মাহর উলিল আমর যেন সংকীর্ণমনতার ঊর্ধ্বে থাকে বা মনের প্রসারতার অধিকারী হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।

সময় ব্যবস্থাপনা ও সময়োপযোগী কর্মসম্পাদন

১০:৫ :: তিনিই সেই সত্তা যিনি সূর্যকে বানিয়েছেন প্রখর আলোময় এবং চন্দ্রকে বানিয়েছেন স্নিগ্ধ আলোময় এবং উহার (চন্দ্রের) মনজিলসমূহ (তিথিসমূহ) নির্ধারণ করেছেন, যেন তোমরা বছর গণনা করতে এবং হিসাব করতে পারো। আল্লাহ এগুলো যথাযথ সত্য সহকারে ছাড়া সৃষ্টি করেন নি। তিনি আয়াতসমূহ তফসীল আকারে বিস্তৃতভাবে বিবৃত করেন সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা জ্ঞানার্জন করে।

৭৩:৬-৭ :: নিশ্চয় রাতে উঠে দাঁড়ানো প্রবৃত্তি দলন ও পদক্ষেপ গ্রহণে অত্যন্ত প্রবল (কার্যকর) এবং বক্তব্য অনুধাবনেও সুপ্রতিষ্ঠিত/ যথোপযোগী (সময়)। নিশ্চয় দিনের বেলায় তোমার দীর্ঘ ব্যস্ততা রয়েছে।

২৫:৪৭ :: এবং তিনিই তোমাদের জন্য রাতকে করেছেন আবরণ স্বরূপ, বিশ্রামের জন্য তোমাদের দিয়েছেন নিদ্রা এবং সমুত্থানের জন্য দিয়েছেন দিন।

৪:১০১ :: আর যখন তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো তখন তোমাদের উপর সালাত সংক্ষিপ্ত করাতে দোষ নেই, যদি তোমরা আশংকা করো যে, যারা কুফর করেছে তারা তোমাদেরকে ফেতনায় (বিপদে ও বিড়ম্বনায়) ফেলবে। নিশ্চয় কাফিররা তোমাদের জন্য স্পষ্ট শত্রু।

৪:১০৩ :: তারপর যখন তোমরা সালাত সম্পন্ন করো তখন আল্লাহকে স্মরণ করো দাঁড়িয়ে, বসে ও তোমাদের পার্শ্বদেশসমূহে কাত হয়ে (শুয়ে)। তারপর যখন তোমরা নিরাপদে থাকো তখন যথানিয়মে সালাত প্রতিষ্ঠা করো। নিশ্চয় সালাত মু’মিনদের উপর সময়কৃত বিধান (তথা সালাতের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে)।

৬২:৯-১০ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যখন তোমাদের জুমআর দিনে সালাতের জন্য আহবান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে দ্রুত ধাবিত হও এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিহার (স্থগিত) করো। উহাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জ্ঞান রাখো। তারপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন পৃথিবীতে (কর্মক্ষেত্রে) ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (বা জীবিকা) অন্বেষণ করো এবং বেশি বেশি করে আল্লাহর স্মরণ করো, যেন তোমরা সফলতা লাভ করতে পারো।

৪:১৭-১৮ :: নিশ্চয় তাওবাহ তাদের জন্য যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে ফেলে তারপর অনতিবিলম্বে তাওবাহ করে। তারাই এমন লোক যাদের তাওবাহ আল্লাহ কবুল করেন। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী মহাবিজ্ঞ। আর তাদের জন্য তাওবাহ নয় যারা মন্দ কাজ করে যেতে থাকে, শেষ পর্যন্ত যখন তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন বলে ‘নিশ্চয় আমি এখন তাওবাহ করলাম’। আর (তাওবাহ) তাদের জন্যও নয়, যারা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। তাদের জন্যই আমি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ সময় ব্যবস্থাপনার উপযোগী করে চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি ও এর গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করেছেন, বিশ্রামের জন্য রাত এবং কর্মব্যস্ততার জন্য দিন সৃষ্টি করেছেন। নির্দিষ্ট সময়ে সালাত সম্পাদন করা একটি আবশ্যকীয় বিধান। যে সময় কাফিরদের কর্তৃক ফিতনার আশংকা থাকে তখন সালাত সংক্ষিপ্ত করাতে দোষ নেই। জুমআর দিনে সালাতের জন্য আহবান করলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম তথা সাধারণ উপার্জনমূলক কার্যক্রম স্থগিত রেখে সালাত সম্পাদনের জন্য ধাবিত হতে হবে এবং সালাত শেষে আবার কর্মস্থলে ছড়িয়ে পড়তে হবে। তাওবাহ কবুলের জন্যও রয়েছে নির্দিষ্ট সময়সীমা, যা পার হয়ে গেলে আর তাওবাহ কবুল হবে না।

সুতরাং কুরআনে সময়নিষ্ঠ ও সময়োযোগী কার্য সম্পাদেরন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সময়োপযোগী কর্মসম্পাদনের একটি দিক হচ্ছে গুরুত্বক্রম অনুযায়ী কাজ করা। যেমন একটি প্রবাদ হলো: “যখন ঘরে আগুন লাগে তখন আগুন না নিভিয়ে জানালা মেরামত অর্থহীন।” এছাড়া সময় ব্যবস্থাপনার একটি দিক হলো: যে কাজের পূর্বে যে কাজের নির্দেশনা দেয়া হয় তার ধারাক্রম রক্ষা করা। যেমন সালাতের পূর্বে ওজুর নির্দেশ রয়েছে। এছাড়া কোনো কাজ সঠিক নিয়মে সম্পাদনের জন্য পূর্বে ঐ কাজের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। যেমন বলা হয়েছে, “বলো, যে জানে এবং যে জানে না উভয়ে কী সমান?” (৩৯:৯)। কারণ যে জানে সে কাজটি সঠিকভাবে করতে পারবে, অন্যদিকে যে জানে না সে কাজটি করার ক্ষেত্রে অনুমানের আশ্রয় নিবে। তাই কোনো কাজ সঠিকভাবে সম্পাদনের জন্য আগে তা সম্পর্কে মৌলিক তথ্য জানতে হয়। তারপর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানার গভীরতা ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়।

সময় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত নির্দেশনার গুরুত্বের প্রেক্ষিতে যে উলিল আমর নির্বাচনের ক্ষেত্রে তার মধ্যে সময় ব্যবস্থাপনার যোগ্যতাও একটি লক্ষণীয় গুণ।

কাঙ্ক্ষিত মানের সাহস ও মনোবল

৩৩:৩৯ :: যারা আল্লাহর রিসালাতের বালাগ (প্রচার) করতো এবং তাঁকেই ভয় করতো এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতো না। আর হিসাব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট।

৩:১৭৩ :: যাদেরকে মানুষেরা বলেছিল যে, ‘নিশ্চয় লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছে। সুতরাং তাদেরকে ভয় কর’। কিন্তু তা তাদের ঈমান বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা বলেছিল, ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক’!

৩:১৭৫ :: নিশ্চয় শয়তান তোমাদেরকে তার বন্ধুদের (তাগুত ও কাফিরদের) ভয় দেখায়। সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় করো না আর আমাকেই ভয় করো, যদি তোমরা মু’মিন হও।

৪:৭৭ :: তুমি কি তাদেরকে দেখোনি যাদেরকে বলা হয়েছিল, ‘তোমরা তোমাদের হস্ত সংবরণ কর, সালাত কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান করো?’ অতঃপর যখন তাদেরকে যুদ্ধের বিধান দেয়া হল তখন তাদের একদল মানুষকে ভয় করছিল আল্লাহকে ভয় করার মত অথবা তার চেয়েও বেশী এবং বললো, ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান কেন দিলেন? আমাদেরকে কিছু দিনের অবকাশ কেন দিলেন না?’ বলো, ‘পার্থিব ভোগ সামান্য এবং যে স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করে তার জন্য আখেরাতই উত্তম। আর তোমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও যুলুম করা হবে না।’

২:২১৪ :: তোমরা কি হিসাব করে নিয়েছো যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ এখনো তোমাদের উপর তাদের অনুরূপ পরিস্থিতি আসে নি যারা তোমাদের পূর্বে গত হয়েছে। তাদেরকে অর্থসংকট ও দুঃখ-ক্লেষ স্পর্শ করেছিল এবং তাদেরকে (কাফিরদের কর্তৃক নির্যাতনে) প্রকম্পিত করা হয়েছিল। যতক্ষণ না রসূল এবং তাঁর সাথে যারা ছিল তারা বলে উঠলো “আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?” জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।

৯:১৩ :: তোমরা কেন এমন কওমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না, যারা তাদের চুক্তি ভঙ্গ করেছে এবং রাসূলকে বহিষ্কার করার হিম্মত দেখিয়েছে, আর তারাই প্রথমে তোমাদেরকে প্রথমে আক্রমণ করেছে? তোমরা কি তাদেরকে ভয় করছ? অথচ আল্লাহ অধিক উপযুক্ত যে, তোমরা তাঁকে ভয় করবে, যদি তোমরা মুমিন হও।

৯:১৮ :: একমাত্র তারাই আল্লাহর মসজিদসমূহের ব্যবস্থাপনা করবে (মাসজিদের ব্যবস্থাপনার অধিকার রাখে), যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায়, ওরা হিদায়াতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

৬:৮১ :: ‘তোমরা যাকে (আল্লাহর) শরীক করেছ আমি তাকে কিরূপে ভয় করব? অথচ তোমরা ভয় করছ না যে, তোমরা তাকে আল্লাহর সাথে শরীক করছো, যার পক্ষে তিনি তোমাদের উপর কোন প্রমাণ নাযিল করেননি। অতএব কোন্ দল নিরাপত্তার বেশি হকদার, যদি তোমরা জান’?

১১:৫৩-৫৬ :: তারা বললো, “হে হূদ, তুমি আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ সহকারে আসো নি। আর আমরা তোমার কথায় আমাদের উপাস্যদেরকে পরিত্যাগকারী হতে পারি না। আর আমরা তোমার প্রতি বিশ্বাসী নই। আমরা বলি না এছাড়া যে, আমাদের উপাস্যদের মধ্য থেকে কেউ তোমাকে মন্দ দ্বারা আবিষ্ট করেছে।” সে (হূদ) বললো, “নিশ্চয় আমি আল্লোহকে সাক্ষী রাখছি আর তোমরাও সাক্ষী থাকো। নিশ্চয় আমি তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী তোমরা যাদেরকে শরীক করো, আল্লাহ ছাড়া। সুতরাং তোমরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে কায়দা-কৌশল করো, তারপর আমাকে কোনো অবকাশ দিও না। নিশ্চয় আমি আল্লাহর উপর ভরসা করছি, যিনি আমারও প্রভু, তোমাদেরও প্রভু। কোনো জীব নেই এছাড়া যে, তিনি উহার সামনের কেশগুচ্ছকে ধারণকারী (বা সব জীবই তাঁর করায়ত্ত)। নিশ্চয় আমার প্রভু সঠিক সুপ্রতিষ্ঠিত পথে রয়েছেন।”

১১:৮৮ :: সে (শোয়ায়েব) বললো “হে আমার ক্বওম, তোমরা কি ভেবে দেখেছো, যদি আমি আমার প্রভুর পক্ষ থেকে আসা স্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত হই এবং তিনি আমাকে তাঁর পক্ষ থেকে উত্তম জীবিকা প্রদান করেন। আর আমি উহার ব্যতিক্রম করার ইচ্ছা রাখি না, আমি তোমাদেরকে যা করতে নিষেধ করি (অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে যা করতে নিষেধ করি আমি নিজেই তা করতে পারি না)। আমি যথাসম্ভব সংস্কার-সংশোধন ছাড়া অন্যরূপ ইচ্ছা করি না। আর আল্লাহর সাহায্যক্রমে ছাড়া আমার কোনো গঠনমূলক কাজের সামর্থ্য নেই। আমি তাঁরই উপর ভরসা করি এবং তাঁরই দিকে ফিরে যাই।”

২৯:১০ :: আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ এমনও আছে যে বলে, “আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি।” তারপর যখন সে আল্লাহর (পথে থাকার) ব্যাপারে নির্যাতিত হয়, তখন মানুষের ফিতনাকে (মানুষ কর্তৃক কৃত নির্যাতনকে) আল্লাহর শাস্তির মতো গণ্য করে। অবশ্য যদি তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য আসে, তাহলে তারা অবশ্যই বলবে, “নিশ্চয় আমরা তোমাদেরই সাথে ছিলাম। আল্লাহ কি বিশ্ববাসীর মন-মস্তিষ্কে কী আছে তা জ্ঞাত নন?

৩:২৮ :: মু’মিনরা যেন মু’মিনদেরকে ছাড়া কাফিরদেরকে আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ না করে। আর যে ব্যক্তি এরূপ করে (তথা কাফিরদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে) তার সাথে কোনো ক্ষেত্রে আল্লাহর সম্পর্ক নেই, এছাড়া যে, তোমরা তাদের (নির্যাতন) থেকে আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে (বাহ্যত) এরূপ করো। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নিজের বিষয়ে সচেতন করছেন। আর আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন।

১৬:১০৬ :: যে আল্লাহর প্রতি ঈমানের পরেও কুফর করে, সে ছাড়া যাকে বাধ্য করা হয়েছে অথচ তার অন্তর ঈমানে সুদৃঢ় (তবু প্রচণ্ড নির্যাতনে বাধ্য হয়ে সাময়িকভাবে বাহ্যত কুফরী বাক্য উচ্চারণ বা কুফরী কার্য করেছে); কিন্তু (এদের কথা নয়, বরং) যে তার মন-মস্তিষ্ককে কুফরের জন্য উন্মুক্ত করেছে, তাদের উপর আল্লাহর ক্রোধ এবং তাদের জন্য রয়েছে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মু’মিনরা সাহসী হতে হবে, তারা ভীরু ও হতোদ্যম হবে না। মু’মিনরা শুধুমাত্র আল্লাহকেই ভয় করবে এবং শুধু তাঁরই উপর ভরসা রাখবে। তাদেরকে ঈমানের পথে যে চ্যালেঞ্জ বা বাধা রয়েছে তা সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে। কাফিরদের ভয়ে ঈমান ত্যাগ করে তাদের মতো হওয়া যাবে না, বরং আল্লাহর অনুমতি থাকায় বাহ্যত কখনো কুফর করলেও মনে ঈমান ঠিক রাখতে হবে এবং উদ্ধার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

সুতরাং মু’মিনদের উলিল আমরকেও সাহসী ও দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন হতে হবে। অবশ্য এ সাহসের মানে বাস্তবভিত্তিক প্রজ্ঞা পরিহার করে কর্ম সম্পাদন নয়। তবে কাঙ্ক্ষিত মানের সাহস ও মনোবল ছাড়া এ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।

জীবন-মরণ আল্লাহর জন্য নিবেদিত, প্রয়োজনে হিজরত করতে প্রস্তুত

৬:১৬২ :: বলো, “নিশ্চয় আমার সালাত, আমার নুসুক (ধর্মীয় বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে পশু উৎসর্গ ও সংহতিমূলক রীতি পালন করা / কুরবানি), আমার জীবন ও আমার মরণ সবই আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্য নিবেদিত”।

২৯:২৬ :: অত:পর লূত তার (ইবরাহীম) দাওয়াতে ঈমান আনলো। এবং সে (ইবরাহীম) বললো, “নিশ্চয় আমি আমার প্রভুর (বিধানের উপর থাকার) দিকে হিজরত করছি। নিশ্চয় তিনি মহাপরাক্রমশালী মহাবিজ্ঞ।”

৪:১০০ :: আর যে (তাগুতের সাথে আপোষ না করে) আল্লাহর পথে হিজরত করবে, সে পৃথিবীতে অনেক আশ্রয়ের জায়গা ও স্বচ্ছলতা পাবে। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে মুহাজির হয়ে তার ঘর থেকে বের হয়, তারপর পথিমধ্যে তার মৃত্যু হয়, তবে নিশ্চয় তার প্রতিফল দান আল্লাহর উপর ন্যস্ত রয়েছে। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।

৪:৯৭-৯৮ :: নিশ্চয় যারা (আল্লাহর আদেশের বিপরীত কাজের মাধ্যমে) স্বীয় আত্মার উপর জুলুমকারী অবস্থায় থাকে, প্রাণ হরণকালে ফেরেশতারা তাদেরকে বলে, “তোমরা কী অবস্থায় ছিলে?” তারা বলে, “আমরা জমিনে দুর্বল অবস্থায় ছিলাম।” তারা (ফেরেশতারা) বলে, “আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না, যেখানে তোমরা হিজরাত করতে পারতে?” সুতরাং তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। আর তা কতই না মন্দ আবাস! সেই প্রকৃত দুর্বল পুরুষ ও নারী এবং শিশুকিশোর ছাড়া, যারা কোনো উপায় অবলম্বনে সক্ষম হয় না এবং কোনো (যাওয়ার) পথের সন্ধানও পায় না।

দৃঢ়সংকল্প

৪৭:২১ :: স্বত:স্ফূর্ত আনুগত্য ও ন্যায়সঙ্গত বক্তব্য (তাদের করণীয়)। তারপর যখন (যে বিষয়ে সিদ্ধান্তের প্রশ্ন ছিল সেই) বিষয়টিতে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়, তখন যদি তারা আল্লাহর কাছে (উহাকে) সত্যে পরিণত করতো, তা-ই তাদের জন্য কল্যাণকর হতো।

৩:১৫৯ :: আল্লাহর রহমতে তুমি তাদের প্রতি কোমল হয়েছো। যদি তুমি তাদের প্রতি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে, তবে তারা সরে পড়তো তোমার আশপাশ থেকে। সুতরাং তুমি তাদের প্রতি উদার হও এবং তাদেরকে ক্ষমা করো এবং (নির্বাহী) কর্মকাণ্ডে তাদের সাথে শূরা/ পরামর্শ করো। তারপর যখন তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তখন (তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে) আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল/ ভরসা করবে। নিশ্চয় আল্লাহ (তাঁর উপর) তাওয়াক্কুলকারীদের/ ভরসাকারীদেরকে ভালবাসেন।

২০:১১৫ :: আর নিশ্চয় আমি ইতোপূর্বে আদমকে ফরমান দিয়েছিলাম কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল এবং আমি তাকে দৃঢ়সংকল্প পাইনি।

৩:১৮৬ :: অবশ্যই তোমাদেরকে তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের নিজ জীবন সম্পর্কে পরীক্ষা করা হবে। আর অবশ্যই তোমরা শুনবে তোমাদের পূর্বে যাদের কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে এবং মুশরিকদের পক্ষ থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর তবে নিশ্চয় তা হবে দৃঢ় সংকল্পের কাজ।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের আলোকে বলা যায় যে, আল্লাহর উপর ভরসা রেখে দৃঢ়সংকল্পের সাথে কর্মতৎপর থাকা এবং ধৈর্যধারণ করা ও সংকল্পের দুর্বলতা থেকে মুক্ত থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কাঙ্ক্ষিত গুণ।

মুসলিম উম্মাহর উলিল আমরকে দৃঢ়সংকল্প হতে হবে। একজন দৃঢ়সংকল্প ব্যক্তি অযথা অজুহাত প্রদর্শন করে না বরং সমালোচনার মুখে নিজ দুর্বলতার স্বীকৃতি দেয় ও নিজের মানোন্নয়নের চেষ্টা করে, আবার যেক্ষেত্রে সমালোচনা কোনো ভুল ধারণার উপর নির্ভরশীল সেক্ষেত্রে সঠিক অবস্থা তুলে ধরে। কাঙ্ক্ষিত উত্তম মানে কার্য সম্পাদনের প্রচেষ্টা থাকলেও কার্যোপযোগী নিম্নমান সত্ত্বেও কাজকে সামনে এগিয়ে নেয়া এবং প্রয়োজনে কর্মসূচীকে কমবেশি করা কিন্তু ঐ নিম্নমানের চেয়ে নিচে নামতে প্রস্তুত না থাকা, বরং প্রয়োজনে স্বল্পসংখ্যক সাথী নিয়ে কার্যোপযোগী মানে কাজ চালানোর প্রয়াসও দৃঢ়সংকল্পের অন্তর্ভুক্ত।

উন্নত নৈতিকতা

৪৯:১১ :: হে যারা ঈমান এনেছো, কোনো জনগোষ্ঠী যেন অন্য জনগোষ্ঠীকে উপহাস না করে। হতে পারে যে, (যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে) তারা (যারা উপহাস করছে) তাদের চেয়ে উত্তম। আর নারীরাও যেন অন্য নারীদেরকে উপহাস না করে। হতে পারে যে, (যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে) তারা (যারা উপহাস করছে) তাদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা নিজেদেরকে/ একে অন্যকে অযথা দোষারোপ করো না আর তোমরা একে অন্যকে মন্দ উপাধিতে/মন্দ উপনামে ডেকো না। ইহা অত্যন্ত মন্দ যে, কেউ ঈমান আনার পরও মন্দ নামে খ্যাতি লাভ করে। আর (এরূপ আচরণের পর) যে তাওবাহ করে নি, তারাই যালিম।

৪৯:১২ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা বেশি বেশি অনুমান করা থেকে বিরত থাকো। নিশ্চয় কিছু কিছু অনুমান পাপ কাজ। আর তোমরা একে অন্যের গোপন বিষয় খুঁজো না (গুপ্তচরবৃত্তি/ গোয়েন্দাগিরি করো না)। আর তোমরা একে অপরের গীবত করো না (নিছক আত্মতুষ্টির জন্য কারো অনুপস্থিতিতে তাকে নিন্দনীয় সাব্যস্ত করো না)। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করে? তোমরা তা অত্যন্ত অপছন্দ করো। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাহ কবুলকারী দয়ালু।

৯০:১৭-১৮ :: তারপর সেই সাতে সে তাদেরর অন্তর্ভুক্ত হয় যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সবর করার জন্য এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় দয়া করার জন্য। তারাই ডানপন্থী।

১৩:২০-২২ :: যারা আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করে এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না। আর যারা অক্ষুন্ন রাখে ঐ সম্পর্ক যা অক্ষুন্ন রাখতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। আর তাদেরকে প্রভুকে ভয় করে। আর মন্দ হিসেব দেয়ার বিষয়ে আশংকা রাখে। আর যারা তাদের প্রভুর সন্তুষ্টির অন্বেষণে সবর করে। আর সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমরা তাদেরকে যে জীবনোপকরণ বা জীবিকা দিয়েছি তা থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে (নিজের ও অন্যদের কল্যাণার্থে) ব্যয় করে। এবং ভালো দ্বারা মন্দকে দূর করে। তারাই ঐসব লোক যাদের জন্য আখিরাতের উৎকৃষ্ট আবাস রয়েছে।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহে যেসব নৈতিক গুণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেগুলো এবং তার অনুরূপ বিভিন্ন নৈতিক গুণে যারা সমৃদ্ধ তাদের মধ্য থেকেই উলিল আমর নির্বাচিত করা প্রয়োজন।

নিরহংকার

৩২:১৫ :: আমার আয়াতসমূহ কেবল তারাই বিশ্বাস করে, যারা এর দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দেয়া হলে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের রবের প্রশংসাসহ তাসবীহ করে। আর তারা অহঙ্কার করে না।

৪১:৩৮ :: অতঃপর যদি এরা অহঙ্কার করে, তবে যারা তোমার রবের নিকটে রয়েছে তারা দিন-রাত তাঁরই পবিত্রতা জ্ঞাপন করছে এবং তারা ক্লান্তি বোধ করে না।

১৬:২৮-২৯ :: নিজদের উপর যুলমকারী থাকা অবস্থায় ফেরেশতারা যাদের মৃত্যু ঘটাবে, অতঃপর তারা আত্মসমর্পণ করে বলবে, ‘আমরা কোন পাপ করতাম না।’ হ্যাঁ, নিশ্চয় তোমরা যা করতে সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক জ্ঞাত। সুতরাং তোমরা জাহান্নামের দরজাগুলো দিয়ে প্রবেশ কর, তাতে স্থায়ী হয়ে। অতএব অবশ্যই অহঙ্কারীদের আবাস অতিনিকৃষ্ট।

১৬:২৩ :: নিঃসন্দেহে তারা যা গোপন করে এবং যা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে, নিশ্চয় তা আল্লাহ জানেন। নিশ্চয় তিনি অহঙ্কারীদের পছন্দ করেন না।

৫৩:৩২ :: যারা ছোটো-খাটো ত্রুটি বিচ্যুতি ছাড়া বড় বড় পাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে। নিশ্চয় (তাদের ক্ষেত্রে) তোমার প্রভুর ক্ষমা প্রশস্ত। তিনি তোমাদেরকে জানেন যখন তোমাদেরকে পৃথিবী থেকে উদ্ভব ঘটিয়েছেন এবং যখন তোমরা ছিলে (মাতৃগর্ভে) ভ্রূণরূপে। সুতরাং তোমরা নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ বলে দাবি করো না। কে আল্লাহ সচেতন থাকে সে সম্পর্কে তিনিই সর্বাধিক জ্ঞাত।

৪৯:১৭ :: তারা তোমার উপর অনুগ্রহ প্রকাশ করে এ মর্মে যে, তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে। বলো, “তোমাদের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে তোমরা আমার উপর অনুগ্রহ করো নি। বরং আল্লাহ তোমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন এ মর্মে যে, তিনি তোমাদেরকে ঈমান আনার জন্য হিদায়াত করেছেন, যদি তোমরা (তোমাদের ইসলাম গ্রহণের দাবিতে) সত্যবাদী হও।”

২:২৫৫ :: …… তারা তাঁর জ্ঞানের থেকে কিছুই (কোনো জ্ঞানই) আয়ত্ত করতে পারে না, তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত। ……

১৮:৩৯ :: (জনৈক বাগান মালিক অপর বাগান মালিককে বললো,) “আর কেন যখন তুমি তোমার বাগানে প্রবেশ করেছো, তখন তুমি বললে না, ‘আল্লাহ যা চান তা-ই হয়, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কারো কোনো শক্তি নেই’, যদি তুমি আমাকে তোমার চেয়ে সম্পদে ও সন্তানে স্বল্পতর দেখে থাকো।”

৪:১৩৩ :: যদি তিনি ইচ্ছা করেন তবে তোমাদেরকে অপসারিত করবেন, হে মানুষ, এবং অন্যদেরকে নিয়ে আসবেন। আর আল্লাহ তা করতে সম্পূর্ণ সক্ষম।

৫:১০৫ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের উপর তোমাদের নিজেদের দায় বর্তায় (তোমরা নিজেদের পরিণতি চিন্তা করো)। তোমরা যখন সৎপথে রয়েছ, তখন কেউ পথভ্রষ্ট হলে তাতে তোমাদের কোনো ক্ষতি নেই। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি তোমাদেরকে বলে দেবেন, যা কিছু তোমরা করতে।

৫:৫৪ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের মধ্য থেকে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে (মুরতাদ হবে), অচিরে আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। তারা মু’মিনদের প্রতি কোমল হবে এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করবে এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দাকে (বা কটাক্ষকারীর কটাক্ষকে)পরওয়া করবে না। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যা তিনি যাচ্ছে ইচ্ছা দান করেন। আর আল্লাহ সর্বব্যাপী সর্বজ্ঞ।

৭:৪২ :: যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, অবশ্য আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত পর্যায়ে দায়ভার অর্পণ করি না (অর্থাৎ প্রত্যেকের উপর তার সামর্থ্য অনুসারেই দায়ভার বর্তায়), তারাই জান্নাতবাসী হবে।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কোনোভাবে কোনো ধরনের অহংকারের অবকাশ নেই। কেউ জ্ঞানগত বা দৈহিক শক্তি-সামর্থ্যে অগ্রসর হোক অথবা ঈমান ও ইসলামের পথে কোনো ভূমিকা পালন করুক, এতে তার কোনো অহংকারের কিছু নেই। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ মাত্র। আর প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুসারে দায়বদ্ধ। সুতরাং একদিকে যেমন কারো কর্তৃক এরূপ অহংকার অর্থহীন, তেমনি কোনো মেধাবী এবং দ্বীনের কাজে এক সময় ভালো ভূমিকা পালনকারী কেউ যদি দ্বীন থেকে ফিরে যায়, তাতেও অন্যদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। বস্তুত আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর অনুগ্রহ দান করতে সক্ষম এবং যেহেতু নিজেদের সামর্থ্য অনুসারেই প্রত্যেকে দায়ী হবে, তাই নিজেদের দায়ভার নিয়েই চিন্তা করা উচিত।

সুতরাং মু’মিনদের উলিল আমর হিসেবে নিরহংকার ব্যক্তিদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত করতে হবে।

পারস্পরিক জিদ, হঠকারিতা ও একদেশদর্শিতা থেকে মুক্ত

২:৯০ :: যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে তা কত জঘন্য (তা এই) যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা তারা অস্বীকার করেছে এই জিদ ও হঠকারিতার বশবর্তী হয়ে যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তার উপর তাঁর অনুগ্রহ নাযিল করেছেন। সুতরাং তারা ক্রোধের উপর ক্রোধের অধিকারী হল। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।

৩:১৯ :: নিশ্চয় আল্লাহর নিকট দীন হচ্ছে ইসলাম। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের নিকট জ্ঞান আসার পরই তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করেছে, পরস্পর বিদ্বেষবশত। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফর করে, নিশ্চয় আল্লাহ হিসাবকরণে দ্রুত।

৩০:৩২ :: যারা নিজেদের দীনকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে এবং নিজেরাও বিভিন্ন দল হয়ে গেছে। প্রত্যেক মিশনারি দল নিজেদের কাছে যা আছে তা নিয়ে উৎফুল্ল।

২:১৭৬ :: তা এজন্য যে, নিশ্চয় আল্লাহ সত্য সহকারে কিতাব নাযিল করেছেন। আর নিশ্চয় যারা কিতাবের মধ্যকার বিষয় নিয়ে মতভেদ করেছে তারা বহুদূর বিরোধে লিপ্ত।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রকৃত জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও পারস্পরিক জিদ, বিদ্বেষ ও হঠকারিতার কারণে লোকে মতভেদে লিপ্ত হতে পারে। এছাড়া দ্বীনের বিষয়াবলীকে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে একদেশদর্শিতার ফলে দ্বীনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক ভাগ নিজেদের কাছে যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট রয়েছে, যদিও আল্লাহ সেরূপ না হওয়ার জন্যই নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং জিদ, হঠকারিতা ও একদেশদর্শিতা থেকে মুক্ত থাকা অত্যন্ত জরুরি। আর তাই মু’মিনদের উলিল আমর হিসেবে এমন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা উচিত যে পারস্পরিক জিদ, হঠকারিতা ও একদেশদর্শিতা থেকে মুক্ত থাকে।

দৃষ্টিভঙ্গি ও মেজাজের ভারসাম্য

৭৯:৩৭-৪১ :: সুতরাং যে সীমালংঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়, জাহান্নামই হবে তার আবাস। আর যে নিজ প্রভুর সামনে দাঁড়াবার ভয় রাখে এবং নিজের সত্তাকে প্রবৃত্তি অনুসারে চলা থেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।

৭:৩২ :: বলো, 'আল্লাহ নিজের বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে?’ বলো, ‘পার্থিব জীবনে, বিশেষ করে কেয়ামতের দিনে এ সব তাদের জন্য, যারা ঈমান আনে।’ এভাবে আমি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করি।

২০:১৩১ :: আর তুমি কখনো প্রসারিত করো না তোমার দু’চোখ সে সবের প্রতি, যা আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণীকে দুনিয়ার জীবনের জাঁক-জমকস্বরূপ উপভোগের উপকরণ হিসেবে দিয়েছি। যাতে আমি সে বিষয়ে তাদেরকে পরীক্ষা করে নিতে পারি। আর তোমার রবের প্রদত্ত রিয্ক সর্বোৎকৃষ্ট ও অধিকতর স্থায়ী।

২৮:৭৭ :: আর আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন তাতে তুমি আখিরাতের নিবাস অনুসন্ধান করো। তবে তুমি দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তোমার প্রতি আল্লাহ যেরূপ অনুগ্রহ করেছেন তুমিও সেরূপ অনুগ্রহ করো। আর যমীনে ফাসাদ করতে চেয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ ফাসাদকারীদের ভালবাসেন না’।

২২:১১ :: মানুষের মধ্যে এমনও আছে যারা প্রান্তিকতায় দাঁড়িয়ে দ্বিধার সাথে আল্লাহর ‘ইবাদাত করে। অতঃপর তার কল্যাণ হলে তা নিয়ে সে তৃপ্ত থাকে, আর কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হলে সে তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে দুনিয়াতেও আর আখিরাতেও- এটাই হল স্পষ্ট ক্ষতি।

৯:২৪ :: বল, ‘তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্বামী/স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা যার মন্দা হওয়ার আশঙ্কা তোমরা করছ এবং সে বাসস্থান, যা তোমরা পছন্দ করছ, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত’। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।

৪:৭৭ :: তুমি কি তাদেরকে দেখোনি যাদেরকে বলা হয়েছিল, ‘তোমরা তোমাদের হস্ত সংবরণ কর, সালাত কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান করো?’ অতঃপর যখন তাদেরকে যুদ্ধের বিধান দেয়া হল তখন তাদের একদল মানুষকে ভয় করছিল আল্লাহকে ভয় করার মত অথবা তার চেয়েও বেশী এবং বললো, ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান কেন দিলেন? আমাদেরকে কিছু দিনের অবকাশ কেন দিলেন না?’ বলো, ‘পার্থিব ভোগ সামান্য এবং যে স্রষ্টা সচেতনতা অবলম্বন করে তার জন্য আখেরাতই উত্তম। আর তোমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও যুলুম করা হবে না।’

৯:৩৮ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের কী হল, যখন তোমাদের বলা হয়, আল্লাহর পথে বের হও, তখন তোমরা পৃথিবীর প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়? তবে কি তোমরা আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে সন্তুষ্ট হলে? অথচ দুনিয়ার জীবনের ভোগ-সামগ্রী আখিরাতের তুলনায় একেবারেই নগণ্য।

৪৮:১১ :: যে সকল আ’রববাসী পিছনে থেকে গিয়েছে তারা তোমাকে বলবে, “আমাদের ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন আমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছে। সুতরাং আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।” তারা মুখে যা বলে তা তাদের অন্তরে নেই। তাদেরকে বলো, “আল্লাহ তোমাদের কারো কোনো ক্ষতি বা মঙ্গল সাধনের ইচ্ছা করলে কে তাঁকে নিবৃত্ত করতে পারে? বস্তত তোমরা যা করো সেই বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত।”

৩৩:৬ :: আর নবী মু’মিনদের প্রতি তাদের নিজেদের চেয়ে ঘনিষ্ঠতর এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মাতাস্বরূপ। আল্লাহর বিধান অনুসারে মু’মিনগণ ও মুহাজিরদের চেয়ে রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়গণ একে অপরের প্রতি অগ্রাধিকারী। তবে এটা ভিন্ন বিষয় যে, তোমরা তোমাদের বন্ধু-বান্ধবের প্রতি ভাল কিছু (তথা অনুদান ও ওয়াসিয়্যাত) করবে। এটি বিধানে লিপিবদ্ধ।

৪:৯ :: আর তারা যেন ভয় করে যে, যদি তারা তাদের পেছনে দুর্বল-অসহায় সন্তানাদি রেখে যেতো তবে তারা তাদের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হতো, সুতরাং তারা যেন আল্লাহ সচেতন হয় এবং সঙ্গত কথা বলে।

২:২৬৫-২৬৮ :: আর যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্বেষণে এবং (সত্যের প্রতি) তাদের চিত্তকে সুদৃঢ় করতে (নিজেদের ও অন্যদের কল্যাণার্থে) ব্যয় করে তাদের উপমা হলো উঁচু ভূমির একটি বাগাানের সাথে সম্পর্কিত উপমার মতো, যাতে প্রবল বৃষ্টি হয়, ফলে তা উহাতে দ্বিগুণ পরিমাণে উৎপাদিত খাদ্য সামগ্রী এনে দেয়। কিন্তু যদি তাতে প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত না হয়, তাহলে সামান্য বৃষ্টিই যথেষ্ট। আর তোমরা যা করো আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। তোমাদের কেউ কি চায় যে, তার জন্য খেজুরের ও আঙ্গুরের একটি বাগান থাকবে যার নিচ অংশে স্রোতধারা প্রবাহিত হয়, তার জন্য তাতে (ঐ বাগানে) করয়েছে সব ধরনের ফলফলাদি, আর তাকে বার্ধক্য আক্রান্ত করেছে আর তার সন্তানসন্ততি তখনো দুর্বল রয়েছে, তখন উহাকে (বাগানটিকে) ঘূর্ণিঝড় আক্রান্ত করেছে, যাতে আগুন রয়েছে, ফলে তা পুড়ে গেছে। এভাবে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বিশদ বর্ণনা করেন তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ, যাতে তোমরা চিন্তা-গবেষণা করতে পারো। হে যারা ঈমান করেছো, তোমরা পরার্থে ব্যয় করো উৎকৃষ্ট জিনিস থেকে, যা তোমরা উপার্জন করেছো এবং তা থেকে যা আমরা তোমাদের জন্য ভূমি থেকে বের (উৎপাদন) করেছি। আর তোমরা সংকল্প করো না তা থেকে নিকৃষ্ট (মানের ও পরিমাণের) জিনিস ব্যয় করতে, অথচ তোমরা নিজেরা চোখ বন্ধ না করে তা গ্রহণ করতে না। আর জেনে রাখো যে, নিশ্চয় আল্লাহ অমুখাপেক্ষী প্রশংসিত।

২:২১৫ :: তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে তারা কী ব্যয় করবে? বলো, “তোমরা যে উত্তম সম্পদই ব্যয় করো তা ব্যয় করবে পিতামাতার জন্য এবং নিকটতম আত্মীয়দের জন্য এবং ইয়াতীম ছেলেমেয়ের জন্য এবং মিসকীনদের জন্য এবং ছিন্নমূল /বাস্তুহারা / উদ্বাস্তুদের জন্য। আর তোমরা যে উত্তম কাজই করবে আল্লাহ তা সম্পর্কে সম্যক অবগত”।

২৫:৬৭ :: যারা যখন ব্যয় করে তখন অপচয়ও করে না এবং অপর্যাপ্ত ব্যয়ও (কৃপণতা) করে না এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত থাকে।

১৭:২৯ :: আর তুমি (ব্যয় ও দানের ক্ষেত্রে) তোমার হাতকে ঘাড়ে আবদ্ধ করে রেখো না (কৃপণতা করো না) আবার উহাকে সম্পূর্ণ প্রসারিতও করো না (সবই ব্যয় করে ফেলো না)। কারণ তাহলে তুমি বসে পড়বে নিন্দিত ও অক্ষম অবস্থায়।

২:২১৯ :: তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, “এ দুটিতে রয়েছে মানুষের জন্য বড় ধরনের অপকার এবং কিছুটা উপকার। আর এ দুটির উপকারের তুলনায় অপকারই বড়”। আর তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে তারা কী ব্যয় করবে? বলো, “উদারতাপূর্ণ অনুদান (আফওয়া)”। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন যেন তোমরা চিন্তা-গবেষণা করতে পারো।

মজলুমদের অভিভাবক বা জুলুমের প্রতিবাদকারী

৪:৭৫ :: আর তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছো না অথচ নিপীড়িত হচ্ছে দুর্বল নারী-পুরুষ ও শিশুরা, যারা বলছে, “আমাদের প্রভু, আমাদেরকে এ জনপদ থেকে নিস্তার দিন যার শাসকরা যালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে অভিভাবক নির্ধারণ করুন এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে সাহায্যকারী নির্ধারণ করুন।

খেয়ানতকারীদেরকে সমর্থন না করা

৪:১০৭ :: আর তোমরা (বাদী বা অভিযোগ আরোপকারীর সাথে) বিতর্ক করো না তাদের পক্ষে (তাদের থেকে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য) যারা খিয়ানত করে তাদের নিজেদের প্রতি। নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ভালবাসেন না যে হয় খিয়ানতকারী পাপী।

অকিতাবীদের প্রতিও দায়বদ্ধতা

৩:৭৫ :: আর আহলে কিতাবের মধ্য থেকে কেউ কেউ আছে যে এমন যে, যদি তার কাছে স্বর্ণের স্তুপও আমানাত রাখো সে তা ফেরত দেবে। আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যে, যে এমন যে, যদি তুমি তার কাছে একটিমাত্র স্বর্ণমুদ্রাও আমানাত রাখো, সে তা তোমার কাছে ফেরত দেবে না, এছাড়া যে, তুমি তার উপর চড়াও হয়ে দণ্ডায়মান হবে। তা এজন্য যে, তারা বলে, “উম্মীদের (অকিতাবীদের) প্রতি আমাদের উপর কোনো (দায়-দায়িত্বগত বা অভিযুক্ত হওয়ার মতো) পথ নেই।” অথচ তারা জেনে-বুঝে আল্লাহর নামে মিথ্যা বলছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, উলিল আমর নির্বাচনের জন্য যে নৈতিক গুণগুলোতে এগিয়ে থাকার বিষয় বিবেচনা করতে হবে, বস্তুত প্রত্যেক মু’মিনই এসব নৈতিক গুণাবলী অর্জন করা প্রয়োজন। আর এসব নৈতিক গুণাবলিতে যারা এগিয়ে আছে তাদের মধ্য থেকেই উলিল আমর নির্বাচন করা প্রয়োজন।

>>  পরবর্তী পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য ক্লিক করুন