উত্তরাধিকারের বিধান

আল কুরআনের আলোকে উত্তরাধিকারের বিধান - কালালাহ ও পরিশিষ্ট

সম্পদের কল্যাণমূলক সুষম বন্টন বিধি

পরিশিষ্ট ২: কালালাহ: প্রচলিত ধারণা ও প্রকৃত সংজ্ঞা

প্রথম ভাগ: কালালাহ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা ও তার পর্যালোচনা

উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির ক্ষেত্রে কালালাহ এর সংজ্ঞা সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়। অভিধানে ও আরবি সাহিত্যে ‘কালালাহ’ শব্দ যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তাতে এর অর্থ নিয়ে মতভেদ তৈরি হয়েছে এবং কোনো অর্থকে সুনির্দিষ্ট করা কঠিন হয়েছে। কারণ মৃত ব্যক্তিকে যেমন কালালাহ বলা হয় তেমনি আবার মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকেও কালালাহ বলা হয়। এছাড়া কালালাহ হওয়ার শর্ত হিসেবে তিন ধরনের শর্তের ধারণা রয়েছে। যেমন: (১) মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা, অথবা (২) মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা না থাকা অথবা (৩) মৃত ব্যক্তির সন্তান ও পিতা-মাতা না থাকা। লক্ষণীয় যে, কে এবং কোন শর্তে কালালাহ এ দুটি পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে গাণিতিকভাবেই কালালাহ এর ছয়টি সংজ্ঞা তৈরি হয়। এর মধ্য থেকে একেকজন একেক সংজ্ঞাকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন কিন্তু অন্য সংজ্ঞাগুলোকে ভুল বলতে পারেন না। 

কে এবং কোন শর্তে কালালাহ এর ভিত্তিতে কালালাহ এর সংজ্ঞাসমূহ

কে কালালাহ (মৃত ব্যক্তি নাকি মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন?) এবং কোন শর্তে কালালাহ (মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকলে? নাকি মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা না থাকলে নাকি মৃত ব্যক্তির সন্তান ও পিতা-মাতা না থাকলে?) এ দুটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে কালালাহ এর নিম্নোক্ত ছয়টি সংজ্ঞা তৈরি হয়: 

১. যে মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই সে কালালাহ। 

২. যে মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা নেই সে কালালাহ। 

৩. যে মৃত ব্যক্তির সন্তান ও পিতা-মাতা নেই সে কালালাহ। 

৪. যে মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই তার ভাই-বোন (বা ভাই-বোন ও চাচা, মামা, ফুফু খালা) কালালাহ। 

৫. যে মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা নেই তার ভাই-বোন (বা ভাই-বোন ও চাচা, মামা, ফুফু খালা) কালালাহ। 

৬. যে মৃত ব্যক্তির সন্তান ও পিতা-মাতা নেই তার ভাই-বোন (বা ভাই-বোন ও চাচা, মামা, ফুফু খালা) কালালাহ। 

এ ছয়টি সংজ্ঞার মধ্য থেকে কোনো একটি সংজ্ঞাকে ১০০% নিশ্চয়তা দিয়ে একমাত্র সঠিক না বলে বরং কেউ একটি সংজ্ঞাকে অগ্রাধিকারযোগ্য মনে করেন এবং কেউ অন্য একটি সংজ্ঞাকে অগ্রাধিকারযোগ্য মনে করেন। এর ফলে কালালাহ এর বিধান এক ধরনের অনিশ্চিত অবস্থায় পতিত হয়। 

সাধারণ বিবেকবুদ্ধি (Common sense) অনুযায়ী বলা যায় যে, এর মধ্য থেকে কোনো একটি সংজ্ঞাই সঠিক হতে পারে অথবা একাধিক সংজ্ঞা সঠিক হলে সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় থাকবে বা কোন সংজ্ঞাটি কোন অবস্থায় প্রযোজ্য হবে তার নির্দিষ্টতা থাকবে। উত্তরাধিকারের বন্টনবিধি সম্বলিত শেষ আয়াতটিতে (যা কালালাহ সম্পর্কিত আয়াত) উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ এমনভাবে বিধান বর্ণনা করেছেন যে, মানুষ বিভ্রান্ত হবে না। সুতরাং কালালাহর সংজ্ঞা এমন অনিশ্চিত হওয়া অসম্ভব। উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আয়াতসমূহকে গভীর চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে (হক আদায় করে) তিলাওয়াত করলে নিশ্চয় সঠিক সংজ্ঞা নির্ণয় করা সম্ভব। 

এক্ষেত্রে প্রথম বিবেচ্য হচ্ছে প্রচলিত সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে সঠিক সংজ্ঞা পাওয়া যাবে কিনা? তথা মৃত ব্যক্তির সন্তান/ পিতা-মাতা/ সন্তান ও পিতা-মাতা না থাকার শর্ত সম্পর্কিত ধারণাটি সঠিক কিনা তা নির্ণয় করা। তারপর দ্বিতীয় বিবেচ্য হচ্ছে শর্ত সম্পর্কিত উপরোল্লিখিত ধারণা সঠিক হলে তার মধ্যকার কোন শর্তটি বা কোন অবস্থার ক্ষেত্রে কোন শর্তটি প্রযোজ্য হবে তা নির্ণয় করা। এক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় হলো, আয়াতসমূহ থেকে কিভাবে কালালাহ এর সংজ্ঞা নির্ণয় করা যায়?  

কালালাহ সম্পর্কিত দুটি আয়াত (৪:১২ ও ৪:১৭৬) ভাই-বোনের অংশ বর্ণনা করে। ৪:১৭৬ আয়াতে মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। এখান থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট যে, (ক) কালালাহ এর সংজ্ঞার ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন একটি অনিবার্য প্রসংগ, কালালাহ মৃত ব্যক্তি নিজে হোক বা তার ভাই-বোন হোক তা নির্ণয় করতে হবে কিন্তু এ দুটির যেটিই হোক, ভাই-বোন একটি অনিবার্য প্রসংগ। (খ) কালালাহ এর সংজ্ঞার ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার শর্তটি কালালাহর সংজ্ঞা নির্ণয়ে একটি শর্ত অন্তত ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত কালালাহর সংজ্ঞা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এ শর্তটিই প্রযোজ্য। সুতরাং ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ এর ক্ষেত্রে ভিন্ন কোনো শর্ত রয়েছে কিনা এবং সেই প্রেক্ষিতে কোন আয়াতে কাকে (মৃত ব্যক্তি বা তার ভাই-বোন) কালালাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেটাই নির্ণেয় বিষয়। কারণ ৪:১২ আয়াতে ভাই-বোনের জন্য যে আনুপাতিক অংশ নির্ধারিত করা হয়েছে ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের জন্য তা থেকে ভিন্নরূপ আনুপাতিক অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। 

৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ৪:১২ আয়াতে কালালাহ এর সন্তান বা পিতা-মাতা বা সন্তান ও পিতা-মাতা না থাকার কথা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। পক্ষান্তরে ৪:১৭৬ আয়াতে মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার শর্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু মৃত ব্যক্তি কালালাহ নাকি তার ভাই-বোন কালালাহ তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের জন্য প্রদত্ত অংশ ভিন্নরূপ হওয়ার কারণেই কালালাহ এর সংজ্ঞা নির্ণয় এবং কোন সংজ্ঞার ভিত্তিতে ভাই-বোন কোন আয়াতে বর্ণিত আনুপাতিক অংশ লাভের অধিকারী হবে তা উত্তরাধিকারের বিধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ সমস্যার সমাধানের জন্য বিভিন্ন বিকল্প সমাধান প্রস্তাব করা হয়। এসব সমাধান প্রস্তাবনার পর্যালোচনার মাধ্যমে কোনটি প্রকৃত সমাধান হিসেবে গ্রহণযোগ্য তা নির্ণয় করা প্রয়োজন।

কালালাহ সমস্যার প্রথম সমাধান প্রস্তাবনা ও তার পর্যালোচনা

প্রস্তাবনা: একটি সমাধান চিন্তা করা হয়েছে এভাবে যে, ৪:১৭৬ আয়াত ৪:১২ আয়াতের কালালাহ সম্পর্কিত অংশকে মানছুখ (রহিত) করেছে। 

পর্যালোচনা: এ সমাধান স্পষ্টত কুরআন পরিপন্থী সমাধান, তাই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ কুরআন স্ববিরোধমুক্ত এবং তাই এর কোনো আয়াত বা আয়াতাংশ মানছুখ (রহিত) হয়নি। 

কালালাহ সমস্যার দ্বিতীয় সমাধান প্রস্তাবনা ও তার পর্যালোচনা

প্রস্তাবনা: ৪:১২ আয়াতে ভাই-বোন বলতে বৈপিত্রেয়/ মাতৃশরিক ভাই-বোনের অংশ বর্ণনা করা হয়েছে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে বৈমাত্রেয়/ পিতৃশরিক ও পূর্ণ আপন/ পিতৃমাতৃ উভশরিক ভাই-বোনের অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। 

পর্যালোচনা: এ সমাধানটিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আয়াতদুটিতে ব্যবহৃত ‘আখুন, উখতুন, ইখওয়াতুন’ এর অর্থ এক আয়াতে এক ধরনের ভাই-বোন, অন্য আয়াতে অন্য ধরনের ভাই-বোন ধরে নেয়া একটি চাপিয়ে দেয়া বিষয় যার কোনো অবকাশ নেই। এছাড়া ৪:১৭৬ আয়াতে নি:সন্তান ব্যক্তির ভাই-বোনের সম্পদে তার ভাই-বোনকে উত্তরাধিকার প্রদান করে তাদেরকে কালালাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, ঐ মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক। তাই এ দাবিটি গ্রহণযোগ্য নয়। 

কালালাহ সমস্যার তৃতীয় সমাধান প্রস্তাবনা ও তার পর্যালোচনা

প্রস্তাবনা: ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ এবং ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ হওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত ভিন্ন। এক্ষেত্রে আবার তিনটি ভিন্ন অভিমত তৈরি হয়েছে। যথা: 

অভিমত ১: কালালাহ বলতে ৪:১২ আয়াতে বুঝিয়েছে সেই মৃত ব্যক্তি যার সন্তান নেই এবং ৪:১৭৬ আয়াতে বুঝিয়েছে সেই মৃত ব্যক্তি যার সন্তান ও পিতা-মাতা নেই। 

অভিমত ২: কালালাহ বলতে ৪:১২ আয়াতে বুঝিয়েছে সেই মৃত ব্যক্তি যার পিতা-মাতা নেই এবং ৪:১৭৬ আয়াতে বুঝিয়েছে সেই মৃত ব্যক্তি যার সন্তান ও পিতা-মাতা নেই। 

অভিমত ৩: কালালাহ বলতে ৪:১২ আয়াতে বুঝিয়েছে সেই মৃত ব্যক্তি যার সন্তান ও পিতা-মাতা নেই এবং ৪:১৭৬ আয়াতে বুঝিয়েছে সেই মৃত ব্যক্তি যার সন্তান নেই। 

পর্যালোচনা:

অভিমত ১ ও ২ এর পর্যালোচনা 

৪:১৭৬ আয়াতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে যার সন্তান নেই এবং ........। আয়াতে যে বর্ণনারীতিতে কালালাহ সম্পর্কিত সম্পত্তির বন্টনবিধির বন্টন বিধি উল্লেখ করা হয়েছে তাতে এ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ এর সংজ্ঞা হিসেবে মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার কারণে তার ভাই-বোনের সাথে তার কালালাহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট, মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় এ কথা প্রযোজ্য। এছাড়া যদি এ আয়াতে বলা হতো যে, যে কালালাহ এর সন্তান/পিতা-মাতা নেই, .... অথবা যদি এ আয়াতে বলা হতো যে, যদি কোনো ব্যক্তি নি:সন্তান হয় এবং তার পিতা-মাতাও না থাকে, ..........; শুধু এ দুটি বর্ণনার কোনো একটি উল্লেখ থাকলে অভিমত ১ বা ২ গ্রহণযোগ্য হতে পারতো। কিন্তু আয়াতটিতে এ দুটি বর্ণনার কোনো একটিও উল্লেখ করা হয়নি। বরং বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নি:সন্তান অবস্থায় মারা যায় এবং ..........। তাই অভিমত ১ ও ২ গ্রহণযোগ্য নয়। 

অভিমত ১ এর পক্ষে বিশেষ যুক্তি ও তার পর্যালোচনা

যুক্তি: যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা না থাকে কিন্তু পিতা-মাতা থাকে এবং ভাই-বোনও থাকে এরূপ অবস্থার ক্ষেত্রে ৪:১১ আয়াতে মাতার আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়েছে এবং ভাইবোনের আনুপাতিক অংশ উল্লেখ করা হয়নি। আবার ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াত দুটির বক্তব্য ‘ওয়া’ (এবং) দ্বারা যুক্ত। এই প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত ভাই-বোনের আনুপাতিক অংশ হলো ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত অবস্থায় তথা মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা নেই কিন্তু পিতা-মাতা এবং ভাই-বোন আছে এরূপ অবস্থায় ভাই-বোনের প্রাপ্য আনুপাতিক অংশ। অন্য কথায় ৪:১১ আয়াত ও ৪:১২ আয়াত ‘ওয়া’ দ্বারা সংযুক্ত থাকার কারণে ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত ‘কালালাহ’ এর অর্থ হলো ‘যার পুত্র-কন্যা নেই কিন্তু পিতা-মাতা আছে’ এবং ৪:১৭৬ আয়াতের ‘কালালাহ’ এর অর্থ হলো ‘যার পুত্র-কন্যাও নেই এবং পিতা-মাতাও নেই’। ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনের উত্তরাধিকারের বিষয়ে মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার শর্ত দেয়া হয়েছে বিধায় ৪:১২ আয়াতেও কালালাহ বলতে তাকেই বুঝাবে যার সন্তান নেই। আবার ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত কালালাহর পিতা-মাতা থাকার প্রেক্ষিতে বুঝা যায় যে, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত কালালাহর পিতা-মাতা নেই, যদিও তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।

পর্যালোচনা: উপরিউক্ত যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ৪:১৭৬ আয়াতে উল্লেখিত মৃত ব্যক্তির পুত্র/কন্যা না থাকা এবং ভাই/বোন থাকার বিষয়টি স্পষ্ট। কিন্তু পিতা-মাতা জীবিত না থাকার শর্ত দেয়া হয়নি, বরং আয়াতটির বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক, সন্তান না থাকলে ভাই-বোন উত্তরাধিকারী হবে।

আবার যে মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা নেই তার পিতা-মাতা থাকলেও যেহেতু তার ভাই-বোনের প্রাপ্য আনুপাতিক অংশ ৪:১৭৬ আয়াত অনুুযায়ী নির্ধারিত হবে, তাই ৪:১২ আয়াতের কালালাহর সংজ্ঞা এটি হতে পারে না যে, যে মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা নেই কিন্তু পিতা-মাতা আছে এবং ভাই-বোন আছে সে কালালাহ এবং তার ভাই-বোন ৪:১২ আয়াত অনুযায়ী পাবে। বরং পুত্র-কন্যা না থাকা ব্যক্তির ভাই-বোন যেহেতু ৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী উত্তরাধিকার পাবে, তাই ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত কালালাহর ক্ষেত্রে তার সন্তান না থাকার ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়। একই কারণে ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াত ‘ওয়া’ (এবং) দ্বারা যুক্ত হওয়ার ভিত্তিতে ৪:১২ আয়াতের ক্ষেত্রে পিতা-মাতা আছে বলে ধারণা প্রকাশ করলে তাও গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে ‘ওয়া’ (এবং) সম্পর্কিত যুক্তিটির ভিত্তি দুর্বল। কারণ পুত্র-কন্যার অংশ বর্ণনার পর পিতা-মাতার অংশ, স্বামী/ স্ত্রীর অংশ, ভাই-বোনের অংশ সবই ‘ওয়া’ (এবং) দ্বারা সংযুক্ত হয়েছে। তাই বাক্যগুলো ‘ওয়া’ দ্বারা যুক্ত হওয়া মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা জীবিত থাকার ধারণাকে নিশ্চিত করে না। 

অভিমত ৩ এর পর্যালোচনা  

৪:১৭৬ আয়াত অনুযায়ী, যার সন্তান নেই এবং তার ভাই-বোন আছে সে ও তার ভাই-বোনের মধ্যে কালালাহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার পিতা-মাতা থাকা না থাকাকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। তাই সন্তান না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা থাকলে বা না থাকলে উভয় অবস্থায় কালালাহ সম্পর্কের প্রেক্ষিতে ভাই-বোন এ আয়াত অনুসারে তাদের অংশ পাবে। এছাড়া অভিমত ৩ অনুযায়ী সন্তান ও পিতা-মাতা না থাকলে ভাই-বোন যা পায় (৪:১২), সন্তান নেই কিন্তু পিতা-মাতা আছে এ অবস্থায় ভাই-বোন তার চেয়ে বেশি পায় (৪:১৭৬), এটি স্পষ্টত যুক্তিবিরোধী কথাও বটে। তাই যেকোনো বিচারে অভিমত ৩ গ্রহণযোগ্য নয়। 

কালালাহ সমস্যার চতুর্থ সমাধান প্রস্তাবনা ও তার পর্যালোচনা

প্রস্তাবনা: কালালাহ বলতে বুঝায় পিতা-মাতা ও সন্তান ছাড়া রক্তসম্পর্কীয় অন্য আত্মীয়, যেমন ভাই, বোন, চাচা, ফুফু, মামা, খালা। যদি একজন ব্যক্তির উত্তরাধিকার বন্টনের পর কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহলে পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা, স্বামী/ স্ত্রীর মধ্য থেকে যারা উপস্থিত আছে তাদের সাথে উত্তরাধিকার থেকে পাওয়ার জন্য কালালাহ এর মধ্য থেকে কাউকে মৃত ব্যক্তি নির্বাচিত করে যেতে পারবে। সেক্ষেত্রে যাকে নির্বাচিত করা হবে তার যদি ভাই/বোন থাকে তাহলে তারা অবশিষ্ট অংশ থেকে কতটুকু পাবে তা ৪:১২ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, উল্লেখিত অংশের পর অবশিষ্ট সমগ্র অংশ নির্বাচিত কালালাহ পাবে। যেমন যদি কালালাহর একজন ভাই থাকে তবে সে পাবে অবশিষ্ট অংশের ১/৬  এবং নির্বাচিত কালালাহ পাবে অবশিষ্ট অংশের ৫/৬ । এভাবে সমগ্র অবশিষ্ট অংশ কালালাহ ও তার ভাইয়ের মধ্যে বন্টিত হয়ে যাবে। তবে যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকে (পিতা মাতা ও স্বামী/স্ত্রী থাকুক বা না থাকুক) এ অবস্থায় তার ভাই-বোনের মধ্যে কিভাবে বন্টন হবে তা-ই জানানো হয়েছে ৪:১৭৬ আয়াতে। 

চতুর্থ প্রস্তাবনার যুক্তি

৪:১২ আয়াতের কালালাহ সম্পর্কিত বক্তব্য হলো: ওয়া ইন কানা রজুলুইঁ ইউরাসু কালালাতান আভিমরাতুওঁ ওয়া লাহু আখুন আও উখতুন ফালিকুল্লি ওয়াহিদিম মিনহুমাছ ছুদুছু ফা-ইন কানূ আকছারা মিন যালিকা ফাহুম শুরাকাউ ফিছ ছুলুছি মিম বা’দি ওয়াসিয়্যাতিইঁ ইউসা বিহা আও দাইনিন। (৪:১২) 

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা যেতে পারে যে, এখানে যে রজুল বা পুরুষকে কালালাহ বলা হয়েছে এবং যার প্রসঙ্গে ‘ইউরাসু’ কর্মবাচ্য ব্যবহৃত হয়েছে সে মৃত ব্যক্তি নয়, বরং মৃত ব্যক্তি কর্তৃক উত্তরাধিকারের অংশ দেয়ার জন্য মনোনীত ব্যক্তি। এই মনোনীত ব্যক্তি হতে হবে এমন কেউ যে নির্দিষ্ট ওয়ারিস নয়। যেমন- চাচা, মামা, ভাই, ফুফু, খালা, বোন। অন্য কথায়, মৃত ব্যক্তিকে নয়, বরং মৃত ব্যক্তির কর্তৃক উত্তরাধিকারের অংশ দেয়ার জন্য মনোনীত ব্যক্তিকে কালালাহ বলা হয়। কিন্তু ৪:১৭৬ আয়াতে কালালাহ বলতে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ৪:১৭৬ আয়াতে কালালাহ হিসাবে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন সুনির্দিষ্ট। অন্যদিকে ৪:১২ আয়াতে কালালাহ বলতে যেমন ভাই-বোন হতে পারে, তেমনি চাচা, ফুফু, মামা, খালাও হতে পারে। আর ৪:১২ আয়াতে উল্লেখিত ‘ওয়া লাহু আখুন আও উখতুন’ (আর তার এক ভাই বা এক বোন থাকে) বলতে  মৃত কর্তৃক মনোনীত কালালাহর ভাই-বোনের কথা বলা হয়েছে, মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন নয়। অবশ্য যদি সে তার কোনো ভাইকে কালালাহ হিসাবে মনোনীত করে সেক্ষেত্রে কালালাহর ভাই-বোন এবং মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন অভিন্ন হয় তা ভিন্ন বিষয়। সংক্ষেপে বলা যায়, ৪:১২ আয়াতে উল্লেখিত ভাই-বোন বলতে বুঝায় কালালাহর ভাই-বোন এবং ৪:১৭৬ আয়াতে উল্লেখিত ভাই-বোন বলতে বুঝায় মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন, যারা মৃত ব্যক্তির কালালাহ হিসেবে সাব্যস্ত।

চতুর্থ প্রস্তাবনা অনুসারে ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত অবস্থায় কালালাহ ও তার ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ 

এ প্রস্তাবনা অনুসারে ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত অবস্থায় কালালাহ ও তার ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আবার দুটি উপমত তৈরি হয়েছে। 

উপমত ১: এক্ষেত্রে একটি মত হলো, ৪:১২ আয়াত অনুসারে, মৃত ব্যক্তি কর্তৃক মনোনীত কালালাহর যদি কোনো ভাই বা বোন থাকে তবে কালালাহ + ঐ ভাই বা বোন = দুই জন, এবং এ দুইজনের প্রত্যেকের অংশ ১/৬ । আর যদি কালালাহ এবং তার ভাই-বোন মিলে দুইয়ের বেশি হয় তাহলে তারা সকলে মিলে পাবে ১/৩ । 

উপমত ২: অন্য একটি মত হলো, ৪:১২ আয়াত অনুসারে, কালালাহ যতটুকু অংশের ওয়ারিস হবে তার ১/৬  পাবে তার ভাই বা বোন আর সে পাবে ৫/৬ , আর সে (নির্বাচিত কালালাহ) ছাড়া তার ভাই-বোন যদি দুই বা দুইয়ের বেশি হয় তবে তারা পাবে ১/৩  অংশ আর সে পাবে ২/৩ । 

চতুর্থ প্রস্তাবনার পর্যালোচনা

এক: এ অভিমত অনুসারে, ৪:১২ আয়াতে কালালাহ বলতে মৃত ব্যক্তিকে না বুঝিয়ে তার মনোনীত ব্যক্তিকে বুঝায় এবং ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোনকে কালালাহ সাব্যস্ত করা হয়। অথচ ৪:১৭৬ আয়াতে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে মৃত ব্যক্তি কর্তৃক মনোনীত করা বা না করার জন্য অপেক্ষমান রাখা হয়নি, বরং আল্লাহ নিজেই কালালাহ হিসাবে সাব্যস্ত করে তাদের জন্য বন্টনবিধি উল্লেখ করেছেন। ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে কালালাহ প্রসঙ্গে ভাই-বোন ব্যতীত অন্য কাউকে ওয়ারিস করার উল্লেখ নেই এবং ভাই-বোনকে মৃত ব্যক্তি মনোনীত করলেই শুধু পাবে, অন্যথায় পাবে না এরূপ তথ্যও নেই, একাধিক ভাই থাকলে তাদের কাউকে মনোনীত করা ও কাউকে মনোনীত না করার অবকাশ দেয়া হয়েছে মর্মেও কোনো প্রমাণ নেই। 

৪:১৭৬ আয়াতে যেভাবে ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে তার সাথে তুলনা করলে ৪:১২ আয়াতের ব্যাখ্যা হিসাবে এ কথা গ্রহণযোগ্য নয় যে, মৃত ব্যক্তি কাউকে কালালাহ হিসাবে মনোনীত করবে অথচ সেই কালালাহর ভাই-বোনকে মৃত ব্যক্তি নিজে কালালাহ হিসাবে মনোনীত করবে না তবু তারা কালালাহর ভাই-বোন হওয়ার কারণে কালালাহসহ দুই ভাই ১/৩   পাবে, অথবা কালালাহর এক ভাই পাবে ১/৬  আর কালালাহ পাবে ৫/৬ ।  এক কথায়, যদি ৪:১২ আয়াতের ব্যাখ্যায় কালালাহ বলতে মৃত ব্যক্তি কর্তৃক মনোনীত এমন ব্যক্তি যে সচরাচর ওয়ারিস নয় এরূপ বুঝায় তবে ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে সাংঘর্ষিকতা দেখা দেয়। 

দুই: যদি ৪:১২ এবং ৪:১৭৬ উভয় আয়াতে কালালাহ বলতে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে বুঝায় এবং ৪:১২ আয়াতে যে মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা আছে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে যে মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা নেই এরূপ দুই অবস্থার কথা বুঝায় তাহলেও প্রশ্ন আসে যে, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ভাই-বোন হচ্ছে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন। অথচ এ প্রস্তাবনা অনুসারে ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত ভাই-বোন হচ্ছে সেই রজুলের ভাই-বোন যে রজুল হচ্ছে কালালাহ, অর্থাৎ কালালাহর ভাই-বোন; এ দুই ধরনের বর্ণনার কারণে উভয় আয়াতে কালালাহ বলতে ভাই-বোনকে বুঝাতে পারে না। 

তিন: একটি অবস্থা হতে পারে যে, ৪:১৭৬ আয়াতে মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থার কথা বলা হয়েছে এবং ৪:১২ আয়াতে কালালাহ ওয়ারিস হয় পুত্র-কন্যার সাথে। এক্ষত্রে বিবেচ্য প্রশ্ন হলো, কেন এখানে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ হিসেবে বা মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে কালালাহর ভাই-বোন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে? অর্থাৎ কেন মৃত ব্যক্তির সাথে তার ভাই-বোনের সম্পর্ককে কালালাহ সম্পর্ক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে? অন্যভাবে বলা যায়, কালালাহ সম্পর্ক কিভাবে তৈরি/ প্রতিষ্ঠিত হয়? এটা কি যৌক্তিক দাবি সাব্যস্ত হতে পারে যে, পুত্র-কন্যা না থাকলে ভাই-বোন সরাসরি কালালাহ, আর পুত্র-কন্যা থাকলে ভাই-বোনদের মধ্য থেকে যাকে মৃত ব্যক্তি মনোনীত করে শুধু সে-ই কালালাহ? 

চার: ৪:১৭৬ আয়াতে কালালাহ বলতে ভাই-বোন এবং ৪:১২ আয়াতে কালালাহ বলতে ভাই-বোন ছাড়া অন্য কালালাহ যথা চাচা, ফুফু, মামা, খালা ইত্যাদি বুঝায় বলে কৃত দাবির ক্ষেত্রেও প্রশ্ন আসে যে, যেখানে ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোন সরাসরি কালালাহ সাব্যস্ত হয়, সেখানে ৪:১২ আয়াতে কেন সব চাচা সরাসরি কালালাহ সাব্যস্ত না হয়ে কোনো চাচা কালালাহ সাব্যস্ত হয় এবং অন্য চাচা ঐ কালালাহর ভাই হিসাবে সাব্যস্ত হয়? এছাড়া এক্ষেত্রে আরো প্রশ্ন হতে পারে যে, কেন মৃত ব্যক্তি তার কোনো চাচাকে কালালাহ সাব্যস্ত করে যাবে এবং তখন তার অন্য চাচারা ও ফুফুরাও ওয়ারিস হবে অথচ মামারা ও খালারা ওয়ারিস হবে না? আবার বিপরীতক্রমে কেন মৃত ব্যক্তি তার কোনো মামাকে কালালাহ সাব্যস্ত করে যাবে এবং তখন তার অন্য মামারা ও খালারা ওয়ারিস হবে অথচ চাচারা ওয়ারিস হবে না? এছাড়া, কেন যাকে কালালাহ করা হয়েছে তার ভাই (তথা মৃতের এক চাচা) পাবে ১/৬  এবং কালালাহ (মৃতের কালালাহ রূপ চাচা) পাবে ৫/৬  ? এরূপ বিধান কি সামঞ্জস্যপূর্ণ? 

পাঁচ: ৪:৮ অনুযায় যে আত্মীয়-স্বজন ওয়ারিস নয়, তারা হচ্ছে ‘উলুল ক্বুরবা’। সুতরাং চাচা, ফুফু, মামা, খালা হচ্ছেন উলুল ক্বুরবা। আর ভাই-বোনকে যেহেতু ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে ওয়ারিস করা হয়েছে তাই তারা ‘উলিল ক্বুরবা’ নয়, বরং তারা ‘আক্বরাবূন’। তবে মৃত ব্যক্তির সাথে তার ভাই-বোনের কালালাহ সম্পর্ক তৈরি হলে শুধু সেক্ষেত্রে ভাই-বোন ওয়ারিস হয়, অন্যথায় তারা ওয়ারিস হয় না। যখন ভাই-বোন ওয়ারিস হয় না ঐ অবস্থায় ভাই-বোনও ‘উলিল ক্বুরবা’ হিসেবে সাব্যস্ত হয। উত্তরাধিকার বণ্টনকালে (বণ্টনের অব্যবহিত পরে) উলিল ক্বুরবাকেও তা থেকে উপজীবিকা হিসেবে কিছু দেয়ার নির্দেশ রয়েছে। 

এমতাবস্থায় যদি উলিল ক্বুরবার মধ্য থেকে কাউকে কালালাহ হিসাবে এক ধরনের ওয়ারিস করা হয় তাহলে সে অন্যান্য ‘উলিল ক্বুরবার’ চেয়ে আলাদা গুরুত্ব পেয়ে যায়। অথচ এরূপ প্রয়োজন থাকলে তার জন্য ওয়াসিয়্যাত করে যাওয়ার সুযোগ তো আছেই। তা সত্ত্বেও তাকে আলাদাভাবে ওয়ারিস করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে দাবি করলে তা যাচাই ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়। 

ছয় : চতুর্থ প্রস্তাবনাটি যে সঠিক নয় নিচে তা ‘ইউরাসু’ শব্দের বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝা যেতে পারে। উত্তরাধিকারের বন্টন বিধি বর্ণিত হয়েছে তিনটি আয়াতে ৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াত। এই তিনটি আয়াতে একই প্রসঙ্গে তথা উত্তরাধিকার বন্টন প্রসঙ্গে ‘ওয়ারিসা’ ক্রিয়ার বর্তমান কর্তৃবাচ্য, বর্তমান কর্মবাচ্য এবং অতীত কর্তৃবাচ্য ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং এ শব্দগুলোর অর্থ একইভাবে নির্ণিত হবে।

ওয়ারিসা (৪:১১) = অতীত কর্তৃবাচ্য। 

ইউরাসু (৪:১২) = বর্তমান কর্মবাচ্য। 

ইয়ারিসু (৪:১৭৬) = বর্তমান কর্তৃবাচ্য। 

৪:১১ আয়াতে ‘ওয়ারিসা’ এর কর্তা (Subject)  হচ্ছে ‘জীবিত পিতা-মাতা’ এবং কর্ম (Object)  হচ্ছে ‘মৃত ব্যক্তি’। অর্থাৎ ‘মৃত ব্যক্তিকে ওয়ারিসা বা পূর্বসূরী করার’ কথা বলা হয়েছে। । 

৪:১৭৬ আয়াতে ‘ইয়ারিসু’ এর কর্তা (Subject)  হচ্ছে ‘হুয়া’ তথা ‘সে’ আর এখানে ‘হুয়া’ বলতে মৃত ব্যক্তি হিসাবে যার প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল সেই ‘ইমরুউ’ (পুরুষটি তথা ভাইটি) যদি জীবিত থাকতো আর অন্যদিকে তার একটি বোন মৃত হতো তাহলে সেই জীবিত ‘ইমরুউ’কে (পুরুষ তথা মৃত বোনের ভাইটি) বুঝানো হয়েছে। অন্য কথায়, ৪:১৭৬ আয়াতের কর্তা (ঝঁনলবপঃ) হচ্ছে জীবিত ভাই এবং কর্ম (Object)  হচ্ছে মৃত বোন (হা)। 

৪:১২ আয়াতে ‘ইউরাসু’ শব্দটি ‘রজুল’ তথা ‘কালালাহর’ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ ঐ বাক্যটিতে ইউরাসু শব্দটি হচ্ছে প্রথম ইসমে কানা (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্য)। আর মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ইউরাসু (যাকে পূর্বসূরী করা হয়েছে) শব্দটি ব্যবহার করার অর্থ ‘তার জীবিত কোনো ওয়ারিস/পূর্বসূরীকারী/ উত্তরাধিকারী আছে’। আর বাক্যটির দ্বিতীয় ইসমে কানা (‘কানা ক্রিয়ার তথ্য) হলো ব্যক্তিটি কালালাহ। অর্থাৎ বাক্যটিতে ‘ইউরাসু’ এবং ‘কালালাহ’ শব্দ দুটি একই ব্যক্তির বিশেষণকে প্রকাশ করে এবং ব্যক্তিটি হলো মৃত ব্যক্তি। এর কারণ ‘ইউরাসু’ হচ্ছে কর্মবাচ্য। আর কর্তৃবাচ্যের ‘ওয়ারিসা’ ও ‘ইয়ারিসা’ এর কর্তা যদি জীবিত ব্যক্তি হয়, তাহলে তখন মৃত ব্যক্তি হয় কর্মবাচ্য ‘ইউরাসু’ তথা ‘যাকে পূর্বসূরী করা হয়েছে’। ৪:১২ আয়াতের কালালাহ হওয়া সম্পর্কিত শর্তটির বিশ্লেষণাত্মক অর্থ হলো যদি কোনো মৃত ব্যক্তি কালালাহ হয়, ........। আর ‘ইউরাসু’ কর্মবাচ্য হওয়ার কারণে তার সাথে সম্পর্ক রেখে তার ওয়াসিয়্যাতের প্রসঙ্গেও কর্মবাচ্য ‘ইউসা’ ব্যবহার করা হয়েছে, যদিও ৪:১১ আয়াতে কর্তৃবাচ্য ‘ইউসী’ ব্যবহৃত হয়েছিল এবং ৪:১২ আয়াতে অন্য দুবার কর্তৃবাচ্য ‘ইউসীনা’ এবং ‘তূসূনা’ ব্যবহৃত হয়েছে। 

সর্বোপরি যদি মৃত ব্যক্তি যাকে কালালাহ সাব্যস্ত করে যায় কথাটি এ দিক থেকেও অগ্রহণযোগ্য যে, মৃত ব্যক্তি কিভাবে কাউকে উত্তরাধিকারের অংশীদার করতে পারে, যেহেতু মৃত ব্যক্তি কাউকে কিছু দেয়ার কথা বলে গেলে তা হচ্ছে ওয়াসিয়্যাত। আর ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের পরেই উত্তরাধিকার বন্টন হবে, তার আগে নয়। 

সুতরাং মৃত ব্যক্তি যাকে কালালাহ সাব্যস্ত করে যায় সেই হলো কালালাহ তথ্যটি গ্রহণযোগ্য নয়। ৪:১২ আয়াতে বলা হয়েছে যদি ব্যক্তিটি কালালাহ হয় এবং তার একটি ভাই থাকে, ..........। এই প্রেক্ষিতে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন মাত্রই কালালাহ, এরূপ সরল সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও কোনো অবকাশ নেই। বরং ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে কালালাহ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। 

সাত: চতুর্থ প্রস্তাবনার একটি সম্পূরক ব্যাখ্যা ও তার পর্যালোচনা:

সম্পূরক ব্যাখ্যা: পুত্র-কন্যা পাবে অবশিষ্টাংশ। যদি শুধু পুত্র বা শুধু কন্যা থাকে তারাও পাবে অবশিষ্টাংশ। শুধু এক কন্যা থাকলে সে পাবে অবশিষ্টাংশ থেকে অর্ধেক। দুই বা দুইয়ের বেশি কন্যা থাকলে তারা পাবে অবশিষ্টাংশ থেকে দুই তৃতীয়াংশ। অনুরূপভাবে পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় ভাই-বোন কালালাহ হিসেবে পাবে ৪:১৭৬ আয়াত অনুসারে পুত্র-কন্যার অনুরূপভাবে। আর ৪:১২ আয়াতে কালালাহ মৃত ব্যক্তি নয় বরং মৃত ব্যক্তি কর্তৃক ওয়ারিস হিসাবে নমিনী করে যাওয়া বাড়তি ওয়ারিস। ‘ইউরাসু’ অর্থ যাকে (মৃত ব্যক্তি কর্তৃক) ওয়ারিস করা হয়েছে। এরূপ যে পুরুষ বা নারীকে নমিনী করা হয়েছে তার তথা কালালাহর যদি ভাই-বোন থাকে তারা কিভাবে পাবে তা-ই বলা হয়েছে ৪:১২ আয়াতে। এটা তারা পাবে অবশিষ্টাংশ থেকে। এখানে ১/৬  বলতে বুঝাবে অবশিষ্টাংশের ১/৬  তথা কালালাহর জন্য থাকা অংশের ১/৬ । 

পর্যালোচনা: এ ব্যাখ্যার পর্যালোচনায় পূর্ববর্তী পর্যালোচনাটি প্রযোজ্য এবং সেই সাথে এই প্রশ্নটি যুক্ত হবে যে, ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ভাই-বোন যে অবশিষ্টাংশ থেকে পাবে তা কিভাবে আয়াতের বক্তব্য থেকে প্রমাণ করা যাবে? আর ৪:১২ আয়াতের কালালাহ ও তার ভাই-বোনেরা যে অবশিষ্টাংশ থেকে পাবে তা কিভাবে আয়াতের বক্তব্য থেকে প্রমাণ করা যাবে? প্রকৃতপক্ষে, কন্যাগণ ও ভাই-বোনকে অবশিষ্টাংশ থেকে দিতে হবে দাবিটি আয়াত দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভব নয়, তাই এ দাবিটি গ্রহণযোগ্য নয়।

কালালাহ সমস্যার পঞ্চম সমাধান প্রস্তাবনা (একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাখ্যা) ও তার পর্যালোচনা

প্রস্তাবনা: কালালাহ এর দুটি অবস্থান। ৪:১২ এর কালালাহ হচ্ছে যার পিতা নেই এবং স্বামী/ স্ত্রী নেই (যখন তার সন্তান আছে)। ৪:১৭৬ এর কালালাহ হচ্ছে যার পিতা নেই এবং স্বামী/ স্ত্রী নেই (যখন তার সন্তান নেই)। 

৪:১৭৬ অনুযায়ী, কালালাহ এর এক বোন পাবে ১/২  যখন কোনো ভাই নেই, দুই বোন পাবে ২/৩ , যখন কোনো ভাই নেই। কিন্তু ভাই-বোন একসাথে থাকলে ভাইয়ের সংখ্যা যতই হোক আর বোনের সংখ্যা যতই হোক, এক ভাই পাবে দুই বোনের সমান। 

৪:১১ আয়াতে ব্যবহৃত ইখওয়াত বলতে বুঝাবে অন্তুত দুই ব্যক্তি, যার একজন পুরুষ (তথা একাধিক ভাই বা ভাই-বোন)। কারণ, ৪:১১ তে আছে, সন্তান না থাকা অবস্থায় ইখওয়াত থাকলে মাতা পাবে ১/৬ । অথচ ৪:১৭৬ অনুযায়ী যেহেতু সন্তান না থাকা অবস্থায় এক ভাই সম্পূর্ণ সম্পত্তি পায় তাহলে মাতার অংশ শূন্য। তাই, একাধিক ভাই বা ভাই-বোন থাকলে মাতা পাবেন ১/৬  এবং তারা পাবে ১/৬  এর পরবর্তী বাকি অংশ। কিন্তু একটি মাত্র ভাই থাকলে মাতা কিছু পাবে না। 

পর্যালোচনা : এ ব্যাখ্যাটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ৪:১৭৬ আয়াতে, যখন কালালাহ এর সন্তান নেই একথা বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে যখন কোনো পুরুষ মৃত্যুবরণ করে যার সন্তান নেই। আর কালালাহ এর সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বামী/স্ত্রী জীবিত থাকা বা না থাকাকে বিবেচনা করার অবকাশ নেই। কারণ উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির আয়াতসমূহে কারো জন্য উল্লেখিত আনুপাতিক অংশকে হ্রাস বা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে স্বামী/স্ত্রী জীবিত থাকা বা না থাকাকে শর্ত করা হয়নি। 

৪:১১ আয়াতে ইখওয়াত বা ভাই-বোনের অংশ সম্পর্কেও এ ব্যাখ্যাতে কৃত দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত ‘ইখওয়াত’ এর আওতায় এক বা একাধিক ভাই/বোন থাকতে পারে। এক ভাই পাবে সম্পূর্ণ, অথচ একাধিক ভাই পাবে ৫/৬  কথাটি যুক্তিসিদ্ধও নয়। 

কালালাহ সমস্যার ষষ্ঠ সমাধান প্রস্তাবনা ও তার পর্যালোচনা

প্রস্তাবনা : কালালাহ সম্পর্কিত বিধানের ক্ষেত্রে ৪:১২ আয়াতে বুঝিয়েছে, যে মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা নেই কিন্তু সন্তান আছে, তার ভাই-বোন কতটুকু পাবে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে বুঝিয়েছে, যে মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই, পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক, তার ভাই-বোন কতটুকু পাবে। 

পর্যালোচনা : প্রাথমিকভাবে বলা যেতে পারে যে, পূর্বে উল্লেখিত অভিমত, উপলব্ধি বা বিকল্প প্রস্তাবনাগুলো গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় একমাত্র বাকি থাকা উপলব্ধি/ অভিমত/ বিকল্প প্রস্তাবনা ৬ গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আবার ‘উপলব্ধি ৬ সঠিক’ কথাটি নিশ্চিতভাবে বলা যাবে আয়াতসমূহে থাকা তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে ষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ার পর।

দ্বিতীয় ভাগ: কালালাহ এর প্রকৃত সংজ্ঞা নির্ণয়

কুরআনে কালালাহ শব্দটি দুই বার ব্যবহৃত হয়েছে, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে। কুরআন সংজ্ঞা দেয়ার ভঙ্গিতে বক্তব্য উপস্থাপন করে না, বরং সাধারণ বিবৃতির ধরনে বক্তব্য উপস্থাপন করে। এই বিবৃতি থেকে সংজ্ঞা নির্ণয় করা সম্ভব হয়। কালালাহ কাকে বলে? এর একটি সাধারণ পরম্পরাগত ভাষাগত উপলব্ধি আরবি ভাষায় প্রসিদ্ধ ছিল। তাই কুরআনে যদি কালালাহ সম্পর্কে কোনো বিধান দেয়া হয় তাহলে তাকে আলাদাভাবে বলে দেয়া দরকার নেই কাকে কালালাহ বলে। আবার যদি এমন হয় যে, কালালাহ এর মৌলিক দুটি অবস্থা রয়েছে ক এবং খ। তাহলে উভয় অবস্থার মধ্য থেকে যখন যে অবস্থার প্রেক্ষিতে একজন ব্যক্তি কালালাহ হোক, যদি বিধান একই হয়ে থাকে তাহলে আলাদাভাবে দুটি অবস্থা উল্লেখ না করলেও যথেষ্ট হয়। কিন্তু যদি এমন হয় যে, যে ব্যক্তি ক নং অবস্থার প্রেক্ষিতে কালালাহ তার সাথে সম্পর্কিত ধারা এবং যে ব্যক্তি খ নং অবস্থার প্রেক্ষিতে কালালাহ তার সাথে সম্পর্কিত ধারা আলাদা তাহলে ধারা দুটি আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। কুরআনের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যখন তা নাযিল হয়েছে তখন প্রচলিত ভাষারীতির কারণে এবং সরাসরি নাযিলকালীন পরিস্থিতিতে উপস্থিত থাকায় এবং পূর্ব থেকে মনোভাবগত প্রস্তুতি অর্জনের সুযোগ ঘটায় উপস্থিত মু’মিনগণ তাৎক্ষণিকভাবে তার সঠিক অর্থ সহজেই বুঝতে পেরেছেন এবং এজন্য অত্যধিক সুস্পষ্ট ক্ষেত্রে তাদের আলাদা কোনো জিজ্ঞাসা ও জবাবের প্রয়োজন হয়নি। এরই পাশাপাশি কুরআনে বর্ণনারীতি এমন যে, বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখিত বিষয়গুলো একত্র করলে পরবর্তীতে সময়ের ব্যবধানে সংজ্ঞা ও সামগ্রিক ধারা বিশ্লেষণের জন্য যা প্রয়োজন তার পূর্ণ জবাব পাওয়া যাবে, এজন্য দ্বিতীয় কোনো উৎসের প্রতি মুখাপেক্ষী হতে হবে না, শুধুমাত্র জীবন্ত ভাষা ও চিরন্তন বাস্তবতাজ্ঞান ব্যবহার করে কুরআনের পাতা উল্টালেই যথেষ্ট। কালালাহ এর বিষয়টিও এরূপ। 

কুরআনের কোনো বক্তব্য বুঝতে গিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয় কুরআনের অন্য বক্তব্যের মাধ্যমে তার সমাধান পাওয়া যায়। কালালাহ বিষয়ে দুটি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াত। আয়াতদ্বয়ের সমন্বিত বিশ্লেষণ থেকে কালালাহ সমস্যার সমাধান নির্ণয় সম্ভব। অবশ্য যখন তা প্রথম নাযিল হয় তখন কালালাহর প্রকৃত সংজ্ঞাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকায় তাদের জন্য হয়তো ব্যাপক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা নির্ণয় করার প্রয়োজন হয়নি। অবশ্য ৪:১২ আয়াতে কালালাহ সম্পর্কিত যে দিকটি উল্লেখ রয়েছে, তার প্রেক্ষিতে অন্য একটি দিকের বিষয়ে প্রশ্ন তৈরি হওয়ায় ৪:১৭৬ আয়াত নাজিল হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে কালালাহ বিষয়ে বিষয়ে কিছু অস্পষ্টতা তৈরি হওয়ায় আমাদেরকে ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতের সমন্বিত তথ্য বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে কালালাহর সংজ্ঞা নির্ণয় করতে হবে। একবার সমাধান নির্ণয়ের পর যদি বিষয়টি সঠিকভাবে চর্চা করা হয় তাতে বণ্টন বিধির উপলব্ধি ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে উদ্ভুত জটিলতা থাকবে না। অন্যথায় আবার জটিলতা তৈরি হতে পারে এবং তাহলে পরবর্তীতে কাউকে আবার গবেষণার মাধ্যমে নতুন করে সমাধানে উপনীত হতে হবে। 

কোনো ক্ষেত্রে উপলব্ধির জটিলতা তৈরি হলে ঐ বিষয় সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে সমাধান নির্ণয়ের একটি উদাহরণ হলো, ৪:৩ আয়াতে বর্ণিত ‘নিসা’ বলতে যে ইয়াতীম ছেলে-মেয়ের মাতা তথা ইয়াতীম ছেলে-মেয়ে থাকা বিধবাকে বুঝানো হয়েছে ৪:৬ ও ৪:১২৭ আয়াতের মাধ্যমে তা স্পষ্টভাবে নির্ণিত হয়। এক্ষেত্রেও অসম্ভব নয় যে, যখন ৪:৩ নাযিল হয়েছিলো তখন তৎকালীন মু’মিনরা হয়তো তাৎক্ষণিকভাবেই আয়াতটিতে ‘নিসা’ বলতে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে তা বুঝে গিয়েছিলো। কারণ তারা জানতো যে, ইয়াতীম বয়সী মেয়েকে বিবাহের কথা বুঝানো স্বাভাবিক নয়, বরং তাদের মাকে তথা ইয়াতীম সন্তান থাকা বিধবাকে বিবাহের কথা বুঝানোই স্বাভাবিক। তবু আমরা দেখেছি সময়ের ব্যবধানে ইয়াতীম মেয়েকে বিবাহের অর্থ প্রচলিত হয়ে গেছে। তাই এখন আমাদেরকে আবার গবেষণার মাধ্যমে সঠিক অর্থ নির্ণয় করতে হচ্ছে।

৪:১৭৬ আয়াতে বলা হয়েছে তারা তোমার কাছে ফতোয়া জানতে চায়, বলো, আল্লাহ ফতোয়া জানাচ্ছেন, আল কালালাহ এর বিষয়ে। ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে (যার সম্পদ বণ্টন করতে হবে) কালালাহ হিসেবে উপস্থাপন করে তার ভাই-বোনের কে কতটুকু পাবে সে বিধান দেয়া হয়েছে। কালালাহ কাকে বলে তা সমকালীন লোকেরা জানতো। কিন্তু কুরআন আমাদেরকে এজন্য অতীতের আলাদা কোনো উৎসের মুখাপেক্ষী করেনি। উপস্থিত মুহুর্তে তারা যেভাবে বুঝেছিল, আমরা কুরআনের মধ্যে গবেষণা করলেই তা বুঝতে পারবো। এমনকি যদি তারা বুঝেছিল হিসেবে আমাদের কাছে এমন কোনো আলাদা তথ্যসূত্র পৌঁছে যা কুরআনের মধ্যে গবেষণা করে উন্মোচিত তথ্যের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে আমাদের কাছে পৌঁছা ঐ দ্বিতীয় তথ্যসূত্র বাতিল বলে গণ্য হবে, কারণ কুরআন সুরক্ষিত এবং ঐ দ্বিতীয় তথ্যসূত্রের সেরূপ কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর তাই কুরআন আমাদেরকে কুরআনের মধ্যে গবেষণা করে কুরআনের বক্তব্য উপলব্ধি করা যেতে পারে এমন বর্ণনারীতির মাধ্যমেই তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। 

৪:১৭৬ আয়াতে কালালাহর বিষয়ে ফতোয়া জানানো হয়েছে। কিন্তু এই এই অবস্থায় কোনো ব্যক্তিকে কালালাহ বলা হয়, এভাবে আল্লাহ সংজ্ঞা উপস্থাপন না করে, যেভাবে বিধানটি বর্ণনা করেছেন তাতেই সংজ্ঞাটি স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ বলেননি যে, যে ব্যক্তি নি:সন্তান অবস্থায় মারা যায় তার ভাই বা বোন থাকলে সেই মৃত ব্যক্তিকে বা তার ভাই বোনকে কালালাহ বলে। কিন্তু আল্লাহ বলেছেন, যদি কোনো পুরুষ নি:সন্তান অবস্থায় মারা যায় এবং তার ভাই বা বোন থাকে, তাহলে ভাই বা বোনটি এরূপ এরূপ সম্পত্তি পাবে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এটি কালালাহর বিষয়ে ফতোয়া। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, এ বর্ণনারীতির মাধ্যমে কালালাহর সংজ্ঞাটি উপস্থাপিত হয়ে গেছে। আর এক্ষেত্রে তা হচ্ছে যে ব্যক্তি নি:সন্তান অবস্থায় মারা যায় এবং তার ভাই বা বোন থাকে সে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন তার কালালাহ হিসেবে সাব্যস্ত হয়। যখন ভাই-বোনের সাথে সম্পর্কের দিক থেকে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। 

৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনের জন্য প্রদত্ত অংশ ভিন্ন ভিন্ন। এমতাবস্থায়, উভয় অবস্থায় মৃত ব্যক্তির সাথে তার ভাই-বোনের কালালাহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন শর্তের ভিত্তিতে এ কথা স্বত:সিদ্ধভাবে প্রমাণিত। কিন্তু সেই ভিন্ন ভিন্ন শর্ত কী কী? ৪:১৭৬ আয়াতে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত শর্তটি হচ্ছে মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই (পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক, তাকে শর্ত করা হয়নি)। সুতরাং যখন এ শর্তে কালালাহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, তথা যখন মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার কারণে তার ভাই-বোন কালালাহ হিসেবে তার ছেড়ে যাওয়া সম্পদ পায় তা-ই ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে তার ভাই-বোনের কালালাহ বলার ক্ষেত্রে অন্য কোনো শর্ত রয়েছে যা মৃত ব্যক্তিকে তার ভাই-বোনের কালালাহ সম্পর্কে সম্পর্কিত করে এবং তার ভাই-বোন তার ছেড়ে যাওয়া সম্পদের অংশ পায়। সেই শর্তটি যা মৃত ব্যক্তিকে তার ভাই-বোনের সাথে কালালাহ সম্পর্কে সম্পর্কিত করে এবং তার ভাই-বোনকে একটি নির্দিষ্ট অংশের প্রাপক বানায়, শর্তটি আবিষ্কারই কালালাহ এর সম্পূর্ণ সংজ্ঞা নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ বলা হয়েছে এবং তার সম্পদ থেকে তার ভাই-বোনের অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। আবার ৪:১৭৬ আয়াতেও কালালাহর সম্পদ বন্টন প্রসঙ্গে দেওয়া ফতোয়ায় তার সম্পদ থেকে তার ভাই-বোনের অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। কালালাহ প্রসঙ্গ ছাড়া সাধারণভাবে ভাই-বোনের অংশ কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। বরং ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়ার শর্তে ভাই-বোনের অংশ বলা হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে এ শর্ত উপস্থিত না থাকলে ভাই-বোন থাকলেও ভাই-বোন উত্তরাধিকার পাবে না। অন্য কারো অংশ উল্লেখের ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ শব্দ দ্বারা বিশেষিত করা হয়নি। অন্য কথায় বলা যায়, মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়া না হওয়ার বিষয়টি ভাই-বোনের উত্তরাধিকার পাওয়া না পাওয়ার সাথে সম্পর্কিত বিষয়, অন্য কারো উত্তরাধিকার পাওয়া না পাওয়ার সাথে সম্পর্কিত বিষয় নয়। আর তাই ভাই-বোন না থাকা অবস্থায় মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়ার ঘটনাটি ঘটা সম্ভব নয়। অন্য কথায় মৃত ব্যক্তি কালালাহ হিসাবে সাব্যস্ত হতে হলে তার ভাই-বোন থাকতে হবে। অন্য কথায়, কালালাহ হচ্ছে মৃত ব্যক্তির সাথে তার ভাই-বোনের এক ধরনের সম্পর্ক যে সম্পর্কের অবস্থায় ভাই-বোন উত্তরাধিকার পায় এবং ঐরূপ বিশেষ অবস্থায় সৃষ্ট সম্পর্ক ছাড়া সাধারণভাবে ভাই-বোন হিসাবে যে সম্পর্ক তা ভাই-বোন উত্তরাধিকার পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। 

৪:১৭৬ আয়াতে উল্লেখিত যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে এ অবস্থায় যে তার পুত্র/কন্যা নেই কিন্তু ভাই/বোন আছে তার ভাই/বোন কতটুকু পাবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। এখান থেকে বলা যায় যে, পুত্র/কন্যা না থাকা এবং ভাই/বোন থাকা হচ্ছে কালালাহ সম্পর্ক তৈরি হওয়ার একটি অবস্থা। কিন্তু এটাই কি কালালাহ সম্পর্ক তৈরি হওয়ার একমাত্র অবস্থা? না। কারণ এটা কালালাহ সম্পর্ক তৈরি হওয়ার একমাত্র অবস্থা হলে ৪:১২ আয়াত ও ৪:১৭৬ আয়াতের বক্তব্য স্ববিরোধী হয়ে যায় তথা উভয় আয়াতে উল্লেখিত ভাই-বোনের অংশ সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। সুতরাং এখান থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, কালালাহ হওয়ার জন্য একাধিক অবস্থা হতে পারে, যার একটি অবস্থা ৪:১৭৬ আয়াতে স্পষ্ট যে, মৃত ব্যক্তির পুত্র/কন্যা নেই কিন্তু ভাই-বোন আছে এবং এ অবস্থায় মৃত ব্যক্তি ও তার ভাই-বোনের মধ্যে কালালাহ সম্পর্ক তৈরি/প্রতিষ্ঠিত হয়। 

৪:১৭৬ আয়াতে একটা নির্দিষ্ট অবস্থার ক্ষেত্রে কালালাহ সম্পর্কের ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশের বিষয়ে ফতোয়া জানতে চাওয়ার জবাবে প্রদত্ত ফতোয়ায় ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। যদি এ ফতোয়া জানতে চাওয়া না হতো তবে কি উত্তরাধিকারের বন্টনবিধি অসম্পূর্ণ থাকতো? তা অসম্ভব। বরং ফতোয়া জানতে না চাইলে সাধারণ বর্ণনাভঙ্গিতে এই ধারা সংযোজিত হতে পারতো কিন্তু ফতোয়া জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে পরিপ্রেক্ষিত উল্লেখসহ তা সংযোজিত হয়েছে। এরূপ বিবৃতি থেকে লোকেরা কোনো বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করে আরো স্পষ্ট হওয়ার জন্য কিভাবে ব্যাকুলতা অনুভব করতো তা বুঝা যায়। বরং গভীর চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে এটা বুঝা যায় যে, ৪:১৭৬ আয়াতে যে ফতোয়া দেয়া হয়েছে ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতে প্রদত্ত বন্টন বিধিতে তা অন্তর্নিহিত ছিল, শুধুমাত্র ফতোয়া জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে ৪:১৭৬ আয়াতে সেটাকে আরো সুস্পষ্ট করা হয়েছে এবং শেষে বলা হয়েছে ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য বয়ান করলেন পাছে তোমরা বিভ্রান্ত হবে’। সুতরাং ৪:১৭৬ আয়াতের মাধ্যমে উত্তরাধিকারের বন্টনবিধির যাবতীয় দিক এমনভাবে প্রতিভাত হওয়ার সুযোগ ঘটেছে যে, আর বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। 

৪:১৭৬ আয়াতের বক্তব্য একটি সম্পূরক তথ্য মাত্র, যা ৪:১১ আয়াতে অন্তর্নিহিত ছিল, বিষয়টি এভাবেও বুঝা যায় যে, ৪:১১-১২ আয়াতে উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিধি-বিধান বর্ণনার পর ৪:১৩ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিলকা হুদুদুল্লাহ’ তথা ‘উত্তরাধিকারের বিষয়ে এটাই আল্লাহর নির্ধারিত সীমা’। সুতরাং ৪:১৭৬ আয়াতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের নতুন কোনো বিধান দেয়া হয়নি, বরং একটি অন্তর্নিহিত বিধানকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র। 

৪:১১-১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতের শব্দাবলি ও বক্তব্য কাঠামো থেকে যুক্তিসঙ্গতভাবে বিভিন্ন সূত্র পাওয়া যায় যার মাধ্যমে ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ সম্পর্কের দ্বিবিধ শর্ত বা অবস্থা এবং শর্তের ভিন্নতার প্রেক্ষিতে ভিন্নভাবে ভাই-বোনের প্রাপ্য নির্ধারণের বিষয়টি নির্ণয করা সম্ভব। 

ভাই-বোন সর্বাবস্থায় ওয়ারিস নয়, তারা শর্তসাপেক্ষ ওয়ারিস। শর্তটি হচ্ছে মৃত ব্যক্তি বা তার ঐ ভাই-বোন কালালাহ হওয়া। ৪:১৭৬ আয়াতে যার পুত্র/কন্যা নেই এবং তার ভাই/বোন আছে তার ভাই-বোন উত্তরাধিকার পায় তথা এ অবস্থায় তার ও তার ভাই-বোনের মধ্যে কালালাহ সম্পর্ক তৈরি/প্রতিষ্ঠিত হয়, আবার ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ বলা হয়েছে। সুতরাং কালালাহ হচ্ছে ব্যক্তিসত্তা। ৪:১৭৬ আয়াতে প্রথমেই বলা হয়েছে যে, লোকেরা ফতোয়া জানতে চায় এবং আল্লাহ ফতোয়া জানাচ্ছেন কালালাহর বিষয়ে। সুতরাং এখানে কালালাহ শব্দটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শর্ত তৈরি করে। অন্য কথায় ভাই-বোনের মধ্যে কালালাহ সম্পর্ক তৈরি/প্রতিষ্ঠিত হওয়া একটি শর্ত হিসেবে কার্যকর থাকে। ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত স্বামী/ স্ত্রীকে উত্তরাধিকার প্রদানের প্রসঙ্গে ভাই-বোনের উপস্থিতি অনুপস্থিতির কোনো শর্ত নেই। 

সুতরাং কালালাহর সংজ্ঞা, প্রকার ও কালালাহ সম্পর্কিত বন্টনবিধির শর্তাদি বুঝার জন্য দুটি বিশেষ বিবেচ্য বিষয় হলো:

(ক) ভাই-বোনের উপস্থিতি অনুপস্থিতির বিবেচনা শুধুমাত্র পিতা/মাতা ও পুত্র/কন্যার সাথে সম্পর্কিত যা ৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট। যেমন ৪:১১ আয়াতে বলা হয়েছে, যদি (পুত্র/কন্যা না থাকা অবস্থায়) ভাই-বোন থাকে, তবে মাতার অংশ কত হবে। আর ৪:১৭৬ আয়াতে ভাই-বোন উপস্থিত থাকলে উত্তরাধিকার পাবে, যদি মৃতের পুত্র/কন্যা না থাকে। 

(খ) কালালাহ শব্দের সাথে ভাই-বোনের প্রসঙ্গ ওতপ্রোতভাবে জড়িত যা ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট। অর্থাৎ কালালাহ হচ্ছে ভাই-বোনের বিশেষ এক ধরনের (তথা একটি বিশেষ অবস্থায়) পারস্পরিক সম্পর্ক। আর কালালাহ শব্দের সাথে মৃত ব্যক্তির পুত্র/কন্যা না থাকার অবস্থাটি ৪:১৭৬ আয়াতের প্রসঙ্গ, ৪:১২ আয়াতের প্রসঙ্গ নয়। 

এ দুটি বিষয় স্মরণ রেখে আরো কিছু পয়েন্টে মনোনিবেশ করা যাক। ৪:১১ আয়াতে পিতা-মাতা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে ওয়া ওয়ারিসাহু আবাওয়াহু (আর তাকে পূর্বসূরী করে তার পিতা-মাতা)। ৪:১৭৬ আয়াতে কোনো মৃত বোনের ভাই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ওয়া হুয়া ইয়ারিছুহা [আর সে (ভাই) তাকে (বোনকে) পূর্বসূরী করে।] এ দুটি তথ্য হচ্ছে হচ্ছে দুটি রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়ের উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিষয়, যার একটিতে পিতা-মাতা তথা রক্তসম্পর্কের ঊর্ধ্বধারা ওয়ারিস, অন্যটিতে ভাই-বোন তথা রক্তসম্পর্কের পার্শ্বধারা ওয়ারিস। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায়, রক্ত সম্পর্কের নিম্নধারা তথা পুত্র-কন্যা হচ্ছে সর্বপ্রথম বিবেচ্য ওয়ারিস। 

সুতরাং ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত ইন কানা রজুলুন ইউরাসু কালালাতান (যদি কোনো পুরুষ, যাকে পূর্বসূরী করা হয়, সে হয় কালালাহ), বাক্যটিতে ‘ইউরাসু’ বা ‘যাকে পূর্বসূরী করা হয়’ বলতে বুঝানো হয়েছে, ‘যাকে স্বাভাবিক অবস্থায়, সবচেয়ে প্রাথমিক বিবেচনায়, তার সন্তান কর্তৃক পূর্বসূরী করা হয়/ যে তার সন্তানকে উত্তরসূরী হিসেবে রেখে যায়’। অর্থাৎ ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত কালালাহ এর স্বাভাবিক অবস্থা হচ্ছে, মৃত ব্যক্তির সন্তান আছে, সাথে পিতা বা মাতা থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে, কিন্তু সন্তান ও পিতা-মাতা উভয়ে থাকতে পারে না। কারণ, সন্তান এবং পিতা-মাতা উভয়ে থাকলে মৃত ব্যক্তি কালালাহ হতে পারে না, বরং সে অবস্থায় সে একজন সাধারণ ব্যক্তি হয়। কারণ মৃত ব্যক্তির ভাই-বোন উত্তরাধিকার পেতে পারে মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়ার শর্তে। এটি এ থেকেও বুঝা যায় যে, উত্তরাধিকার বিধান বর্ণনা শুরুই করা হয়েছে ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বক্তব্যের মাধ্যমে, এবং সেখানে আওলাদের অংশ বর্ণনার পর ‘ওয়া’ তথা ‘এবং’ শব্দ দ্বারা পিতা-মাতার অংশ, তারপর স্বামী/ স্ত্রীর অংশ এবং তারপর ভাই-বোনের অংশ বলা হয়েছে। (পিতা মাতার অংশ ও স্বামী/ স্ত্রীর অংশ বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রসঙ্গত ওয়ালাদ থাকা না থাকার দ্বিবিধ অবস্থা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।) এই বর্ণনাভঙ্গির মধ্যে যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার কারণে সে তার ভাই-বোনের সাথে উত্তরাধিকারগত সম্পর্কে কালালাহ হয়, সেক্ষেত্রে ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ ভিন্ন হওয়ার ইঙ্গিত অন্তর্নিহিত ছিল। 

আবার ৪:১১ আয়াতে মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা থাকা অবস্থায় সন্তান না থাকলে কিন্তু ভাই-বোন থাকলে ভাই-বোনের কোনো অংশ উল্লেখিত হয়নি ঠিকই, কিন্তু সে অবস্থায় মাতার অংশ (এবং সঙ্গতভাবে পিতার অংশও) সেটাই করা হয়েছে, সন্তান থাকলে মাতার অংশ (এবং সঙ্গতভাবে পিতার অংশও) যেটা হয়। এ ক্ষেত্রে সন্তান না থাকা অবস্থায় মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে সন্তানের অনুরূপ অনুঘটকে (Factor)  পরিণত করা হয়েছে। ভাই-বোনকে এরুপ অনুঘটক বানানোর মধ্যে ‘যদি সন্তান না থাকা অবস্থায় ভাই-বোনকে ওয়ারিসে পরিণত করা হয়, তবে ভাই-বোনের অংশ হবে সন্তানের অংশের অনুরূপ’ এই ইঙ্গিত অন্তর্নিহিত ছিল। ৪:১৭৬ আয়াতে এ অন্তর্নিহিত বিষয়কে উত্থাপিত ফতোয়া জিজ্ঞাসার জবাবে প্রদত্ত ফতোয়ার মাধ্যমে সুস্পষ্ট করা হয়েছে। 

৪:১২ আয়াতে ‘ইউরাছু কালালাহ’ এর স্বাভাবিক তাৎপর্য হচ্ছে, ‘কালালাহর সন্তান কালালাহকে পূর্বসূরী করে’। কারণ পুত্র-কন্যা না থাকা অবস্থায় পিতা-মাতা যাকে ওয়ারিস করে সেই কালালাহর প্রসঙ্গ ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, যদি এখানে সেই কালালাহর প্রসঙ্গ হতো তবে ভাই-বোনের এ অংশটি সেখানেই বলা যেতো এবং বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় অধিক খাপ খেতো এবং এরূপ মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ হিসেবে উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তাও থাকতো না। বরং ৪:১১ আয়াতের শেষাংশে এরূপ কালালাহর বিধান পরোক্ষভাবে অন্তর্নিহিত আছে, যদিও তাতে কালালাহ শব্দ উল্লেখ করা হয়নি। 

লক্ষণীয় যে, ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ বলার ক্ষেত্রেই শুধু কালালাহ শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে, পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা বা স্বামী/স্ত্রীর প্রাপ্য অংশ বলার ক্ষেত্রে কালালাহ শব্দ উল্লেখ করা হয়নি। আরো লক্ষণীয় হলো, পুত্র-কন্যা থাকলে পুত্র-কন্যার জন্য যেরূপ অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, ৪:১৭৬ আয়াতে পুত্র-কন্যা না থাকলে ভাই-বোনের জন্য সেরূপ অংশই নির্ধারণ করা হয়েছে। 

আসলে ৪:১৭৬ আয়াত অধ্যয়নের মাধ্যমে বুঝা যায় যে, ৪:১২ আয়াত নাজিলের সময়কালে লোকেরা যে ব্যক্তির পিতা-মাতা নেই কিন্তু সন্তান আছে তাকেই কালালাহ হিসেবে জানতো। কিন্তু ৪:১৭৬ আয়াতে যে ব্যক্তির সন্তান নেই (তার পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক) তার ভাই-বোন কিভাবে পাবে তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। তারপর কুরআনে তাদের এ ফতোয়া জানতে চাওয়াকে একটি শিরোনামের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে যে, তারা ফতোয়া জানতে চায়, বলো, আল্লাহ ফতোয়া জানাচ্ছেন, ‘আল কালালাহর’ বিষয়ে। তারা যে ‘আল কালালাহ’ শব্দযোগে বিধান জানতে চেয়েছে তা আবশ্যক নয়। কারণ কুরআনের নিজস্ব বর্ণনারীতি হচ্ছে যে বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় সে জানতে চাওয়া বিষয়টিকে একটি শিরোনামের আওতায় প্রথমে উল্লেখ করা হয়, যেমন ২:১৮৯ (আনিল আহিল্লাতি), ৪:১২৭ (ফিন্নিছায়ি), অনুরূপভাবে ৪:১৭৬ (ফিল কালালাতি)। এভাবে, যে ব্যক্তির সন্তান নেই, পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক, তার ভাই-বোন থাকলে ভাই-বোনের সাথে তার সম্পর্কও কালালাহ সম্পর্ক এ বিষয়টি তুলে ধরা হলো। অন্য কথায়, লোকেরা সাধারণভাবে কালালাহ এর যে সংজ্ঞা জানতো সে প্রেক্ষিতে ৪:১২ আয়াতে বিধান দেয়া হয়েছে। আর অন্য একটি অবস্থার কালালাহ (যে অবস্থায় থাকা ভাই-বোনকে লোকেরা সাধারণত কালালাহ হিসেবে চিহ্নিত নাও করতে পারে বিধায় এবং তাদের ধারণায় নি:সন্তান ব্যক্তির ভাই-বোন কিভাবে উত্তরাধিকার পাবে তা অনুল্লেখিত রয়ে গেছে বিধায় তারা এ বিষয়টিতে ফতোয়া জানতে চেয়েছে। ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী যে ব্যক্তি তার সন্তান কর্তৃক পূর্বসূরী হয় না (পিতা-মাতা কর্তৃক পূর্বসূরী হোক বা না হোক), তাই ভাই-বোন তার কালালাহ হিসেবে সাব্যস্ত হয়। কিন্তু ৪:১২ আয়াতের কালালাহ হচ্ছে যে ব্যক্তি তার সন্তান কর্তৃক পূর্বসূরী হয় (কিন্তু তার পিতা-মাতা নেই) তথা এরূপ ব্যক্তি কালালাহ বলে সাব্যস্ত হবে এবং তার পিতা-মাতা নেই বিধায় ভাই-বোন তার সম্পদের উত্তরাধিকার পাবে। 

কিভাবে নাজিলকালীন লোকেরা ৪:১২ আয়াতে ‘ইউরাসু’ বলতে সন্তান কর্তৃক পূর্বসূরী করা হয় বুঝেছিল, যদিও সন্তান কর্তৃক কথাটি উল্লেখ নেই এবং কেন সন্তান কর্তৃক কথাটি উল্লেখ নেই? এর জবাব হচ্ছে, কুরআনে যখন কোনো বিষয়ে সাধারণভাবে বলা হয় তখন তার স্বাভাবিক মূল অবস্থান বলা হয়, আনুষংগিক অবস্থান নয়। তাই ইউরাসু বললে স্বত:সিদ্ধভাবে বুঝা যাবে যে, এখানে মূলগতভাবে সন্তান কর্তৃক পূর্বসূরী করার কথা বুঝানো হয়েছে, কোনো সংযোজিত ওয়ারিস থাকুক বা না থাকুক। আর এখানে সন্তান কর্তৃক কথাটি যোগ করা হয়নি, কারণ ভাষারীতির স্বাভাবিকতা অনুযায়ী যে বিষয়টি স্বত:সিদ্ধভাবে বুঝা যাবে তা উল্লেখ করে দেয়া ভাষারীতির উৎকর্ষের পরিপন্থী। যেহেতু কুরআনে ভাষারীতির উৎকর্ষ রক্ষা করা হয়েছে তাই কুরআনে এ স্থানে কার কর্তৃক পূর্বসূরী করা হয় তা উহ্য রাখা হয়েছে। আর পিতা-মাতা না থাকার বিষয়টি এখানে স্বত:সিদ্ধভাবে প্রযোজ্য হবে, কারণ ৪:১১ আয়াতে বর্ণিত বণ্টনের নিয়ম অনুসারে প্রতীয়মান হয় যে, সন্তান ও পিতা-মাতা একসাথে উপস্থিত থাকলে ‘কালালাহ’ প্রসঙ্গটি থাকে না এবং ভাই-বোন ওয়ারিস হয় না।

৪:১১, ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে বুঝা যায় যে, যদি দুটি ভাই একে অপরের উত্তরাধিকার পাওয়ার যোগ্য হয় তবে তারা একে অপরের কালালাহ। দুটি ভাই একে অপরেরর কালালাহ হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে তাদের পিতা-মাতা না থাকা। যেহেতু পিতা-মাতার মাধ্যমে ভাই-বোন পরস্পরের রক্তসম্পর্কের আত্মীয় তাই পিতা-মাতার অনুপস্থিতিই তাদেরকে পরস্পরের কালালাহতে পরিণত করতে পারে। মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়ার অর্থই হচ্ছে তার জীবিত ভাইও কালালাহ হওয়া। 

মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়ার অর্থ হচ্ছে যদি সে মৃত না হয়ে জীবিত হতো আর তার জীবিত ভাইটি জীবিত না হয়ে মৃত হতো তবে বিপরীতক্রমে সে তার ভাইটির উত্তরাধিকার থেকে পেতো। এরূপ ধারার যথার্থতা যাচাই করার জন্য ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিসুহা’ তথ্যটি লক্ষনীয়। ৪:১৭৬ আয়াতের প্রথমাংশের প্রেক্ষিতে ‘ওয়া হুয়া ইয়ারিসুহা’ কথাটির অর্থ হচ্ছে, ‘বিপরীতক্রমের যদি বোনটি মৃত্যুবরণ করে আর ভাইটি জীবিত থাকে তবে ভাইটি বোনটির ওয়ারিস হবে’। ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে কালালাহ বলা হয়েছে। এ কথার একটিই অর্থ হয়, আর তা হচ্ছে বিপরীতক্রমে তার জীবিত ভাইও কালালাহ তথা মৃতব্যক্তির পিতা-মাতা জীবিত নেই। কিন্তু সন্তান জীবিত আছে কিনা সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। 

৪:১২ আয়াতে প্রথম শর্ত হিসেবে/ প্রথম ‘খবরে কানা’ (‘কানা’ ক্রিয়ার তথ্য) হিসেবে/ মৃত ব্যক্তির প্রথম সিফাত (বিশেষণ) হিসেবে ‘ইউরাসু’ শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে সে কারো না কারো কর্তৃক পূর্বসূরী হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এখানে প্রত্যক্ষভাবে সন্তান জীবিত থাকার কথা বলা না হলেও পরোক্ষভাবে তা বলা হয়েছে। কারণ প্রথমত, এখানে ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা পিতা-মাতা হতে পারে না, যেহেতু পিতা-মাতা ও সন্তান উভয়ের উপস্থিতিতে কালালাহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না এবং ভাই-বোন উত্তরাধিকার পেতে পারে না, আবার, পিতা-মাতা না থাকার কারণেই ভাই-বোন পরস্পরের কালালাহ হতে পারে বিধায় পিতা-মাতার অনুপস্থিতিহেতু তারা (তথা পিতা-মাতা) স্বাভাবিকভাবেই ‘ইউরাসু’ ক্রিয়ার কর্তা হওয়া অসম্ভব/ অবাস্তব। দ্বিতীয়ত, এখানে ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা ভাই-বোন হতে পারে না, যেহেতু ভাই-বোন সর্বাবস্থায় ওয়ারিস হয় না এবং ভাই-বোন থাকার কথাটি ‘ওয়া লাহু আখুন আও উখতুন’ শব্দে আলাদাভাবে বলা হয়েছে। তাহলে এখানে ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা হিসেবে প্রাথমিকভাবে দুটি বিকল্পের কথা ভাবা যেতে পারে যথা : স্বামী/স্ত্রী অথবা সন্তান। তৃতীয়ত, এখানে ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা স্বামী/স্ত্রী হতে পারে না, যদিও সন্তানের পাশাপাশি তারাও ওয়ারিস হিসেবে থাকতে পারে। কিন্তু তারা ওয়ারিস হিসেবে থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় ইউরাসু ক্রিয়া কার্যকর থাকার একমাত্র উপায় হচ্ছে ইউরাসু ক্রিয়ার মূলগত কর্তা হিসেবে সন্তানকে সাব্যস্ত করা। যদি সন্তান না থাকে কিন্তু স্বামী/স্ত্রী থাকে তবে ইউরাসু ক্রিয়াটি মৃত ব্যক্তির সিফাত হিসেবে যথাযথ হয় না। কারণ, মৃত ব্যক্তির কালালাহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পিতা-মাতা ও সন্তানের একসাথে উপস্থিতি প্রতিবন্ধক, স্বামী/স্ত্রীর উপস্থিতি নয়। তাই কালালাহ এর সিফাত হিসেবে ব্যবহৃত ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা হিসেবে স্বামী/স্ত্রী বিবেচ্য নয়। আসলে পিতা-মাতা হচ্ছে রক্তসম্পর্কের ঊর্ধ্বধারা, সন্তান হচ্ছে রক্তসম্পর্কের নিম্নধারা এবং ভাই-বোন হচ্ছে রক্তসম্পর্কের পার্শ্বধারা। রক্তসম্পর্কের এ তিনটি গ্রুপকে ওয়ারিস করা হয়েছে। এর মধ্যে পিতা-মাতা ও সন্তান সবসময় ওয়ারিস, ভাই-বোন শুধু কালালাহ সম্পর্ক তৈরি হওয়ার শর্তে ওয়ারিস। স্বামী/স্ত্রী রক্তসম্পর্কীয় নয়। তাই স্বামী/স্ত্রী বিবেচনা বহির্ভূত। কালালাহ শব্দের অর্থের ক্ষেত্রেও স্বামী/স্ত্রীর কোনো যোগসূত্র নেই এবং তাই স্বাভাবিকভাবেই ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা হিসেবেও স্বামী/স্ত্রীর কোনো গুরুত্ব নেই। এভাবে পরোক্ষভাবে ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা হিসেবে সন্তান থাকার বিষয়টি নির্দিষ্ট হয়ে যায়। 

৪:১২ আয়াতে কালালাহ এবং ইউরাসু শব্দ দুটি ব্যবহারের মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে যে, মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা তো নেই ঠিকই কিন্তু সে সন্তান কর্তৃক ইউরাসু তথা তার সন্তান আছে। আর এটাই সর্বাধিক স্বাভাবিক অবস্থার প্রসংগ কাঠামোকে অবলম্বন করে উপস্থাপিত বক্তব্যরীতি। এ বিষয়ে ৪:১১ আয়াতের সূচনা অংশ লক্ষনীয়। ৪:১১ আয়াতে ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বাক্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, মূলগত ওয়ারিস হলো সন্তান, তারপর সংযোজিত ওয়ারিস হলো পিতা-মাতা, স্বামী/স্ত্রী এবং ভাই-বোন। সুতরাং ইউরাসু ক্রিয়ার কর্তা হচ্ছে সন্তান এবং কালালাহ দ্বারা যাদের অনুপস্থিতি বুঝায় তারা হচ্ছেন পিতা-মাতা। আর এটাই সর্বাধিক স্বাভাবিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল। রজুল এর সিফাত হিসেবে ব্যবহৃত ইউরাসু হচ্ছে প্রথম ‘খবরে কানা’ এবং এটি কর্মবাচ্য, যার অর্থ হচ্ছে ‘যাকে পূর্বসূরী করা হয়’ তথা ‘যার উত্তরসূরী থাকে’। আসলে পিতা-মাতা হচ্ছে পূর্বপুরুষ, সন্তান হচ্ছে উত্তরপুরুষ, তাই ইউরাসু এর কর্তা হিসেবে সন্তান হচ্ছে সর্বাধিক স্বাভাবিক অবস্থা। রজুল এর সিফাত (ইউরাসু) ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে মৃতব্যক্তিটি কালালাহ হওয়ার পাশাপাশি তার স্বাভাবিক মূলগত ওয়ারিসের উপস্থিতির তথ্য জানিয়ে দেয়া, (সাথে সংযোজিত ওয়ারিস থাকুক বা না থাকুক)। এভাবে এখানে যে প্রকৃতপক্ষে পিতা-মাতা ও সন্তান এ দু শ্রেণির উভয় শ্রেণি অনুপস্থিত নয়, তা নিশ্চিত করা হয়েছে। অন্যথায় বুঝা যেতো যে, মৃত ব্যক্তিটির পিতা-মাতা নেই, সন্তান থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। 

প্রশ্ন হতে পারে যে, কেন ৪:১২ আয়াতে কালালাহ এর সন্তান থাকার বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হলো না? এর জবাব হচ্ছে, আরবি ভাষারীতির শৈল্পিক উৎকর্ষসম্পন্ন বর্ণনারীতিতে বিধানটি বর্ণিত হয়েছে, যে বর্ণনারীতিতে তথ্যটি পরোক্ষ হলেও অস্পষ্ট নয়। কিন্তু তবুও এ সম্পর্কে প্রশ্ন তৈরি হওয়ায় ৪:১৭৬ আয়াতে ‘যার সন্তান নেই (তার পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক)’ তার ভাই-বোন তার কালালাহ (সে নিজে কালালাহ হোক বা না হোক) এবং এক্ষেত্রে তার ভাই-বোনের প্রাপ্য অংশ ৪:১২ এর তুলনায় ভিন্নরূপ তথ্যটি সুনির্দিষ্ট করে দেয়ায়, এ বিষয়ে আর কোনো ধরনের অস্পষ্টতা অবশিষ্ট থাকেনি। এছাড়া, যার সন্তান নেই তার ভাই-বোন কতটুকু পাবে তা ৪:১১ আয়াতে অন্তর্নিহিত ছিল, কিন্তু এ বিষয়ে অনেকের মধ্যে অস্পষ্টতা থাকায় তারা ফতোয়া জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে ৪:১৭৬ আয়াতে এটি স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। 

৪:১৭৬ আয়াতে মৃতব্যক্তির সন্তান না থাকায় তার ভাই-বোন ‘কালালাহ’, মৃতব্যক্তির পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক। যদি মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতাও না থাকে, তাহলে মৃত ব্যক্তি ও তার ভাই-বোন পরস্পরের কালালাহ এবং সেক্ষেত্রেও এ আয়াত (৪:১৭৬) অনুযায়ী বন্টন হবে, কারণ মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই। মৃত ব্যক্তির সন্তান নেই কিন্তু পিতা-মাতা আছে এ অবস্থায় তার ভাই-বোন তো তার কালালাহ, কিন্তু সে নিজে ভাই-বোনের কালালাহ নয় (ঐ ভাই-বোনের ছাড়া যে ভাই-বোনের সন্তান নেই)। 

এক কথায় একজন ব্যক্তির সন্তান না থাকলে সে কালালাহ তা ঠিক নয়। বরং যার সন্তান নেই তার ভাই-বোন তার কালালাহ। আর যার পিতা-মাতা নেই তার ভাই-বোন ও সে পরস্পরের কালালাহ, এ অবস্থায় মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে বন্টন হবে ৪:১২ অনুযায়ী। আর যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকে তাহলে তার পিতা-মাতা থাকুক বা না থাকুক, তার ভাই-বোন তার কালালাহ, আর বন্টন হবে ৪:১৭৬ অনুযায়ী। ৪:১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে ব্যবহৃত কালালাহ শব্দের মধ্য থেকে ৪:১২ আয়াতে মৃত ব্যক্তিকে বুঝাতে ‘কালালাহ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে ‘মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনকে’ বুঝাতে গিয়ে ‘কালালাহ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, ৪:১১ আয়াতে ‘ইউসীকুমুল্লাহু ফী আওলাদিকুম’ বলতে ‘আওলাদের মধ্যে সম্পদ বণ্টন প্রসঙ্গে ওয়াসিয়্যাতকে’ বুঝানো হয়েছে, অনুরূপভাবে ৪:১৭৬ আয়াতে ‘আল্লাহু ইউতীকুম ফিল কালালাহ’ বলতে ‘কালালাহর মধ্যে সম্পদ বণ্টন প্রসেঙ্গে ফতোয়াকে’ বুঝানো হয়েছে। 

কালালাহ সম্পর্কিত ৪:১২ আয়াতে ওয়াসিয়্যাত প্রসঙ্গে ব্যবহৃত ক্রিয়াটির বাচ্য সম্পর্কেও ধারণা রাখা প্রয়োজন। ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতের প্রথমার্ধে তিনবার কর্তৃবাচ্য ‘ইউসী, ইউসীনা, তূসূনা’ ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও ৪:১২ আয়াতে কালালাহ সম্পর্কিত বিধানের শেষাংশে ‘ইউসা’ শব্দটি কর্মবাচ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। আয়াতগুলো ভালোভাবে লক্ষ্য করলে এর কারণ বুঝা সহজ হয়। ৪:১২ আয়াতের কালালাহ সম্পর্কিত অংশে কালালাহ এর সিফাত হিসেবে ‘ইউরাসু’ তথা কর্মবাচ্য ব্যবহৃত হওয়ায় তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কর্মবাচ্যে ‘ইউসা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এটা আল কুরআনের শব্দ চয়নে সর্বাধিক যথোপযুক্ত পদ্ধতির প্রয়োগের একটি উদাহরণ। ‘ইউসা’ শব্দ ব্যবহারের কারণে এখানে বিধানের ধারাটি উত্তরাধিকার বন্টন সম্পর্কিত অন্য ধারাসমূহের চেয়ে ভিন্ন ধরনের বলে সাব্যস্ত হয় না। আর ‘ইউরাসু’ শব্দটি কর্মবাচ্য হলেও এটি মৃতব্যক্তির সিফাত, জীবিত ওয়ারিসের সিফাত নয়, তাই ‘ইউরাসু’ শব্দের কারণে ‘কালালাহ’ বলতে ‘জীবিত ওয়ারিসকে’ বুঝানো হয়েছে এমন নয়, বরং এ আয়াতে ‘ইউরাসু’ এবং ‘কালালাহ’ শব্দ দুটি হচ্ছে একই মৃত ব্যক্তির দুটি অবস্থা। অবশ্য পিতা-মাতা না থাকার কারণে মৃত ব্যক্তি কালালাহ হওয়ার অর্থ হচ্ছে তার জীবিত ভাই-বোনও কালালাহ হওয়া। 

কালালাহ সম্পর্কিত ৪:১২ আয়াতে ‘কালালাতান’ এবং ৪:১৭৬ আয়াতে ‘আল কালালাতি’ ব্যবহৃত হওয়ার বিষয়টিও তাৎপর্যপূর্ণ। ‘কালালাহ’ শব্দটি অনির্দিষ্টভাবে ব্যবহৃত শব্দ এবং ‘আল কালালাহ’ শব্দটি নির্দিষ্টভাবে ব্যবহৃত শব্দ। যেহেতু ফতোয়া জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে ফতোয়া জানানো হচ্ছে, তাই ‘কালালাহ’ শব্দটি নির্দিষ্ট হয়েছে। এরূপ আরো উদাহরণ হচ্ছে, ২:১৮৯ আয়াতে ‘আল আহেল্লা’ সম্পর্কিত তথ্য এবং ৪:১২৭ আয়াতে ‘আন নিসা’ সম্পর্কিত তথ্য।

উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে ‘কালালাহ সম্পর্কিত সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে’ নিম্নোক্ত চারটি প্রশ্নের উত্তর সুস্পষ্ট হয়। 

(১) ৪:১৭৬ আয়াতে ‘কালালাহর সম্পর্কিত সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে’ মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকার শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। তা থেকে ৪:১২ আয়াতে বক্তব্য কাঠামোতে মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকার সম্ভাবনা বুঝা যায়। কিন্তু ৪:১৭৬ আয়াতকে বাদ দিয়ে (ফতোয়া জানতে চাওয়ার এবং ৪:১৭৬ আয়াত নাজিলের আগে) কিভাবে ৪:১২ থেকে এ কথা বুঝা যেতে পারে যে, এখানে সন্তানের উপস্থিতি ধর্তব্য? মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকা যদি ‘কালালাহ সম্পর্কিত সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে’ একটি শর্ত হয়, তবে একই সাথে সন্তান থাকা অবস্থায়ও ‘কালালাহ সম্পর্কিত সম্পদ বণ্টন’ বিষয়টি কিভাবে সামঞ্জস্যশীল হতে পারে?

(২) ৪:১২ আয়াতে কেন রজুল এর সিফাত হিসেবে কর্মবাচ্য ‘ইউরাসু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে? ইউরাসু এর কর্তা কে? 

(৩) ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতের প্রথমার্ধে তিনবার কর্তৃবাচ্য ‘ইউসী, ইউসীনা, তূসূনা’ ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও ৪:১২ আয়াতে কালালাহ সম্পর্কিত বিধানের শেষাংশে ‘ইউসা’ শব্দটি কর্মবাচ্যে ব্যবহারের কারণ কী? 

(৪) ৪:১২ আয়াতে ‘কালালাতান’ এবং ৪:১৭৬ আয়াতে ‘আল কালালাহ’ শব্দ ব্যবহার করার তাৎপর্য কী?

কুরআনের আয়াতে এ বিষয়গুলো বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতিতে বিবৃত করা হয়নি বরং প্রয়োগকৃত শব্দ ও বক্তব্য কাঠামো বিশ্লেষণের মাধ্যমে সব সূত্র পাওয়া যাবে এরূপ বর্ণনাভঙ্গিতে সংক্ষেপকরন করে বিবৃত করা হয়েছে। কুরআন অনুশীলনের ক্ষেত্রে যখন ছেদ পড়েছে তখন বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য অনুধাবন এবং সেটার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভুল কথা ও রীতির প্রচলন ঘটেছে। তখন পূর্ববর্তী হাদীসগুলোও লেজেগোবরে অবস্থায় কিছু সঠিক তথ্য ও কিছু অসঠিক ধারণামূলক কথার সংমিশ্রণে সামনে এসেছে। আবার ঐ হাদীসগুলোর বক্তব্যের আকস্মিক সমন্বয়ের জন্য কিছু হাদীস বানিয়েও নেয়া হয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে প্রাপ্ত হাদীসসমূহে এর নমুনা দেখতে পাই। কথায় বলে, যা কিছু রটে কিছু না কিছু বটে। হাদীসের ক্ষেত্রেও এরূপ দশাই ঘটেছে। তাতে অনেক ভুল কথা থাকলেও সেই সাথে কিছু সঠিক তথ্য মিশে আছে। তাই বিদ্যমান হাদীস শাস্ত্রে কুরআনের কোনো তথ্যের উপলব্ধির ক্ষেত্রে যেসব অবিন্যস্ত উপাত্ত রয়েছে তা থেকে কতটুকু কুরআনের বক্তব্য কাঠামো অনুসারে গ্রহণযোগ্য তা চিহ্ণিত করার ক্ষেত্রেও কুরআনের বক্তব্য কাঠামো নিয়ে চিন্তা গবেষণা করাই যথার্থ উপায়। হাদীসের নামে পৌঁছা তথ্যকে সরাসরি রসূলের কথা মনে করার কোনো অবকাশ নেই। বরং হাদীসকে প্রশ্নবিদ্ধ ইতিহাস ও অভিধানশাস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে কুরআনের কোনো তথ্যের বিষয়ে সঠিক সমাধানে পৌঁছার জন্য কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নকেই মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

পরিভাষা

এ বইটিতে উল্লেখিত উত্তরাধিকারের বিধান অনুধাবনের সাথে সম্পর্কিত কুরআনিক পরিভাষাসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাঠকের সুবিধার্থে এখানে (বাংলা বর্ণানুক্রমে) তুলে ধরা হলো:

আক্বরাবূন أَقْرَبُونَ

‘আক্বরাবূন’ শব্দটি ‘আক্বরাব’ শব্দের বহুবচন। ‘আক্বরাব’ শব্দটি ‘ক্বারীব’ শব্দের কম্পারেটিভ ও সুপারলেটিভ ডিগ্রী। ‘ক্বারীব’ শব্দের অর্থ হলো ‘নিকটবর্তী’। সুতরাং ‘আক্বরাব’ শব্দের অর্থ হলো ‘নিকটতম’। শব্দটি ‘নিকটতম আত্মীয়’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধিতে শব্দটি ‘নিকটতম আত্মীয়’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআন অনুসারে যাদের মধ্যকার কেউ জীবিত থাকলে তাদের মধ্যে মৃত ব্যক্তির সমস্ত উত্তরাধিকার বণ্টিত হবে তাদেরকে ‘আক্বরাবূন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন ‘রক্তসম্পর্কের আত্মীয়’। তাঁরা হলেন: পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বোন। আর বৈবাহিক সম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে শুধুমাত্র স্বামীর ক্ষেত্রে স্ত্রী এবং স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দাদা, দাদী ও নানা, নানী পিতা-মাতার সূত্রে ঊর্ধ্বতন বিধায় তাঁরা দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূন। অনুরূপভাবে পোতা, পুতিন, নাতি, নাতিন পুত্র-কন্যার সূত্রে অধ:স্তন বিধায় তারা দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূন।

আরহাম  أَرْحَامُ

‘আরহাম’ শব্দটি ‘রেহেম’ শব্দের বহুবচন। ‘রেহেম’ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে, যথা: গর্ভ, গর্ভসম্পর্কিত/রক্তসম্পর্কিত আত্মীয়তা। কুরআনে রক্তসম্পর্কের আত্মীয়দেরকে ‘আরহাম’ ও ‘উলুল আরহাম’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যাদেরকে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাদের মধ্যে স্বামী/স্ত্রী ছাড়া বাকি সবাই রক্তসম্পর্কের আত্মীয়। কুরআনের বিধান অনুসারে রক্তসম্পর্কের আত্মীয়রা পরস্পরের উত্তরাধিকার লাভের জন্য অগ্রাধিকারী এবং তাই রক্তসম্পর্কের আত্মীয়তার দিক থেকে সবচেয়ে নিকটতমদেরকেই উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। 

ওয়ারিস  وَارِثُ

‘ওয়ারিস’ শব্দের অর্থ ‘উত্তরাধিকারী’। তবে ‘উত্তরাধিকারী’ অর্থে ‘ওয়ারিস’ শব্দটি সাধারণ পর্যায়ের। কুরআনে যাদেরকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে তারা যেমন ‘ওয়ারিস’, তেমনি কুরআনে নির্দিষ্টকৃত উত্তরাধিকারীদের কেউ জীবিত না থাকলে আল্লাহর বিধানকে লংঘন না করে যারা ঐ উত্তরাধিকার লাভ করে তারাও ‘ওয়ারিস’ হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

ওয়াসিয়্যাত  وَصِيَّةُ

‘ওয়াসিয়্যাত’ শব্দের অর্থ হলো: বিশেষ নির্দেশ, নাজুক পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে অগ্রিম নির্দেশনা, স্বীয় মৃত্যু পরবর্তীকালে সম্পদের বণ্টনের বিষয়ে নির্দেশনা। ইংরেজি পরিভাষায় একে উইল (Will)  বলা হয়। 

৪:১১ আয়াতে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কে কতটুকু পাবে তার উল্লেখ শুরু করা হয়েছে ‘ইউসীকুমুল্লাহু’ (আল্লাহ তোমাদেরকে ওয়াসিয়্যাত করছেন) বাক্যের মাধ্যমে। ৪:১২ আয়াতে উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধিকে ‘ওয়াসিয়্যাতাম মিনাল্লাহ’ (আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ওয়াসিয়্যাত/বিশেষ নির্দেশ) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২:২৪০ আয়াতে আল্লাহর একটি ওয়াসিয়্যাত উল্লেখ করা হয়েছে বিধবা নারীদেরকে এক বছর তাদের গৃহ থেকে বের করে না দিয়ে ভরণপোষণের ব্যবস্থা করার জন্য। এ ওয়াসিয়্যাত কে কার্যকর করবে তা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এ থেকে স্বত:সিদ্ধভাবে বুঝা যায় যে, এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক দায়িত্ব হলো মৃত ব্যক্তির পরিবার পরিজনের এবং প্রয়োজনে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এ ওয়াসিয়্যাত প্রযোজ্য হবে।

২:১৮০ আয়াতে যদি কোনো ব্যক্তি বার্ধক্য অবস্থায় বা এমন অবস্থায় উপনীত হলে যাতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সে মৃত্যুর সন্নিকটে রয়েছে বলে ধারণা হয় তার উপর তার পিতা-মাতা ও অন্যান্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ওয়াসিয়্যাত (Will)  করে যাওয়াকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধিতে যে উত্তরাধিকারীদের জন্য যে আনুপাতিক অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে সেটা কার্যকর করতে হবে মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ এবং ঋণ পরিশোধের পরে।

কালালাহ  كَلَالَة

‘কালালাহ’ শব্দটি দ্বারা বুঝায় ‘কোনো ব্যক্তি তার মৃত ভাই বা বোনের উত্তরাধিকারী হওয়ার পর্যায়ে উপনীত আত্মীয়তা’। দুই অবস্থায় একজন পুরুষ বা নারী কালালাহ হিসেবে তার মৃত ভাই বা বোনের উত্তরাধিকার লাভ করে। যদি মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান না থাকে সে অবস্থায় ভাই-বোন ৪:১৭৬ আয়াতে বর্ণিত আনুপাতিক অংশের অধিকারী হবে। আর যদি মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা না থাকে কিন্তু সন্তান থাকে সে অবস্থায় ভাই-বোন ৪:১২ আয়াতে বর্ণিত আনুপাতিক অংশের অধিকারী হবে। 

ছিহর  صِهْر

‘ছিহর’ শব্দের অর্থ হলো ‘বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তা’। বংশগত আত্মীয়তার বিপরীতে বৈবাহিক সম্পর্কের আত্মীয়তা বুঝাতে ‘ছিহর’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। বৈবাহিক সম্পর্কে আত্মীয়দের মধ্যে রয়েছে স্বামী/স্ত্রী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, শ্যালক, শ্যালিকা দেবর, ননদ প্রভৃতি। বৈবাহিক সূত্রের আত্মীয়দের মধ্যে শুধুমাত্র স্বামী/স্ত্রী আক্বরাবূন (সবচেয়ে নিকটতম আত্মীয়) হিসেবে উত্তরাধিকারী। অন্যরা উলিল ক্বুরবা (উত্তরাধিকারী নন এমন আত্মীয়) হিসেবে সাব্যস্ত।

তুরাস تُرَاث

‘তুরাস’ শব্দটির অর্থ হলো ‘উত্তরাধিকার’। কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করাকে ‘তুরাস’ বলা হয়। ৮৯:১৯ আয়াতে নির্বিচারে অন্যের উত্তরাধিকারকে গ্রাস করার বিষয়ে তিরস্কার করা হয়েছে।

দাইন   دَيْن

‘দাইন’ শব্দটির অর্থ হলো ‘ঋণ, দেনা’। ২:২৮২ আয়াতে ঋণ লেনদেন সম্পর্কিত বিধি-বিধান দেয়া হয়েছে। ঋণ লেনদেন লিখিত এবং পরিশোধের সময়সীমা নির্দিষ্টকৃত হতে হবে। তবে যদি বাস্তবসম্মত অসুবিধার কারণে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে ঋণ প্রাপককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ঋণ ফেরত দেয়ার মতো স্বচ্ছলতা পর্যন্ত অবকাশ দেয়ার জন্য। যদি কোনো ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তবে তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে প্রথমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে এবং মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত থাকলে তার দাবি পূরণ করতে হবে। তারপর বাকি সম্পদ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নির্ধারিত হারে বণ্টন করতে হবে।

মাওয়ালিয়া  مَوَالِيَ

‘মাওয়ালিয়া’ শব্দটি হচ্ছে ‘মাওলা’ শব্দের বহুবচন। ‘মাওলা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘রক্ষাকর্তা, উত্তরাধিকারী’। তবে ‘মাওয়ালিয়া’ শব্দটি ‘নির্দিষ্ট উত্তরাধিকারী’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্য কথায়, পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়গণের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে যাদেরকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে তাদেরকে মৃত ব্যক্তির ‘মাওয়ালিয়া’ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

মীরাস  مِيرَاثُ

‘মীরাস’ শব্দটির অর্থ ‘স্বত্ব, উত্তরাধিকার’। কুরআনে ‘মীরাস’ শব্দটি দুইবার ব্যবহৃত হয়েছে (৩:১৮০:২৪, ৫৭:১০:৯) এবং উভয়স্থানে শব্দটি ‘আল্লাহর মালিকানা’ বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে মানুষের পরস্পরের উত্তরাধিকার বুঝানোর জন্য কুরআনে ‘তুরাস’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে (৮৯:১৯:২)। তাই আমরা মানুষের পরস্পরের উত্তরাধিকার বুঝাতে ‘তুরাস’ শব্দ ব্যবহার করাই সঙ্গত হবে।

নাসাব نَسَب

‘নাসাব’ (বহুবচনে ‘আনসাব’) শব্দের অর্থ হলো ‘বংশগত আত্মীয়তা’। শব্দটি আত্মীয়তার দুটি মূল শ্রেণিকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ‘বৈবাহিক আত্মীয়তা’র বিপরীতে ব্যবহৃত হয়। ‘উলুল আরহাম’ শব্দটি রক্তসম্পর্কের সকল আত্মীয়কে অন্তর্ভুক্ত করে তা পিতৃকুলের সাথে সম্পর্কিত (চাচা, ফুফু) হোক বা মাতৃকুলের সাথে সম্পর্কিত (মামা, খালা) হোক এবং রক্তসম্পর্কের পূর্বপুরুষ (পিতা), উত্তরপুরুষ (সন্তান) ও পার্শ্বপুরুষ (ভাই) সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে। অন্যদিকে ‘নাসাব’ শব্দটি দ্বারা বুঝায় কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কোন পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে সেই সম্পর্ক নির্ধারণ করা।

নাসীব/নসীব نَصِيبٌ

‘নাসীব’ শব্দের অর্থ ‘প্রাপ্য অংশ’। এই প্রাপ্যতা কারো কর্মের গুণে হোক বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গ্রেস (Grace) হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়া হোক উভয় অবস্থায় ‘নাসীব’ শব্দ ব্যবহৃত হতে পারে। ৪:৭ আয়াতে উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য অংশকে ‘নাসীবাম মাফরূদা’ (নির্ধারিত প্রাপ্য অংশ) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

যিল ক্বুুরবা/ উলুল ক্বুরবা  ذِي الْقُرْبَىٰ/ أُولُو الْقُرْبَىٰ

‘যিল ক্বুরবা’ শব্দটির অর্থ হলো ‘আত্মীয়তার/নৈকট্যের অধিকারী’। ‘যিল ক্বুরবা’ শব্দের বহুবচন হলো ‘উলুল ক্বুরবা’। ‘আক্বরাবূন’ (সবচেয়ে নিকটতম আত্মীয়গণ) তথা যাদের জন্য উত্তরাধিকার নির্ধারিত তারা ছাড়া অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনকে ‘উলিল ক্বুরবা’ বলা হয়। ৪:৮ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে (আক্বরাবূনের মধ্যে) উত্তরাধিকার বণ্টনকালে যেসব ‘উলুল ক্বুরবা’ (উত্তরাধিকারী নন এমন আত্মীয়-স্বজন) উপস্থিত হবেন তাঁদের সাথে ন্যায়সঙ্গত ও ভদ্রোজনোচিত কথা বলতে হবে এবং তাঁদেরকেও উপজীবিকাস্বরূপ পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে কিছু দিতে হবে। আক্বরাবূনের মধ্য থেকে কেউ জীবিত না থাকলে উলিল আমর (Central Authority) উপযুক্ত ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শক্রমে মৃত ব্যক্তির ‘উলুল ক্বুরবার’ মধ্যে তা বণ্টন করতে পারেন অথবা অংশবিশেষ বা প্রয়োজনে সম্পূর্ণ সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করতে পারেন। এরূপ ক্ষেত্রে উলিল আমরের কল্যাণকর সিদ্ধান্তের আনুগত্য করতে হবে।

হাযযু  حَظّ

‘হাযযু’ শব্দের অর্থ হলো ‘অংশ, ব্যক্তিগত অংশ, সমষ্টিগত অংশ’। উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধি বর্ণনায় ৪:১১ ও ৪:১৭৬ আয়াতে পুত্র-কন্যার প্রাপ্য অংশ এবং পুত্র-কন্যা জীবিত না থাকলে সে অবস্থায় ভাইবোনের প্রাপ্য অংশ প্রসঙ্গে একটি মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে লিয যাকারি মিছলু হাযযিল উনছায়ায়নি (একজন পুরুষের জন্য দুইজন নারীর সমষ্টিগত অংশের অনুরূপ)। আয়াতটিতে ‘হাযযু’ শব্দটি ‘সমষ্টিগত অংশ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ দুই কন্যা একসাথে যা পাবে এক পুত্র একাই তা পাবে। অনুরূপভাবে দুই বোন একসাথে যা পাবে এক ভাই একাই তা পাবে। এর কারণ হলো পুত্র ও ভাই পুরুষ হওয়ার কারণে তাদের উপর অর্পিত অর্থনৈতিক দায়িত্ব বেশি এবং কন্যা ও বোন নারী হওয়ার কারণে তাদের উপর অর্পিত অর্থনৈতিক দায়িত্ব কম।