দি  ইন্সটিটিউট ফর কুরআনিক রিসার্চ এন্ড এ্যাপ্লিকেশন (ইক্বরা)

লক্ষ্য

ইক্বরার লক্ষ্য হলো বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য স্রষ্টার ঐশী বাণীর সমন্বিত অধ্যয়ন ও সার্বজনীন প্রয়োগের জন্য জ্ঞানদীপ্ত অনুশীলন।

উদ্দেশ্য

ইক্বরার উদ্দেশ্য হলো কুরআনের বাণীর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ অনুধাবনের জন্য টেকসই ভিত্তি প্রস্তুত করা এবং জীবন ও সমাজের প্রায়োগিকতার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানভিত্তিক ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামো নির্মাণ।

প্রকাশিত বইসমূহ

প্রচলিত কুরবানি: কুরআন থেকে পর্যালোচনা

কুরআনের সরল বিধান ও ধর্মাচারবাদিদের জটিলতা

কুরআনে সরলভাবে বিভিন্ন বিধান দেয়া হয়েছে, যা পালনের ক্ষেত্রে বিবেকবুদ্ধির প্রয়োগ অনুসারে যেভাবে উত্তম হয় সেভাবে সম্পাদন করাই স্বাভাবিক। কিন্তু ধর্মাচারবাদিরা কোনো বিধান পালনের সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি বিষয়কে সুনির্দিষ্ট করতে চেয়ে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করে। কুরআনের শুরুর দিকে সূরা বাক্বারাহতেই এ বিষয়ে বানী ইসরাইলের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর বিধানগুলোকে সরলভাবে গ্রহণ করতে হবে এবং এর পালনের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে সুনির্দিষ্ট করে জটিলতা তৈরি করা থেকে বিরত থাকা সমীচীন। উল্লেখিত ঐতিহাসিক উদাহরণ হলো= বানী ইসরাইলকে রসূলুল্লাহ মূসা জানিয়েছেন যে, আল্লাহ তাদেরকে একটি গাভী জবেহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশ অনুসারে তারা একটি গাভী জবেহ করলেই নির্দেশটি পালন হয়ে যেতো। কিন্তু তারা বিভিন্ন খুঁটিনাটি প্রশ্ন শুরু করলো যে, গরুটির রঙ, বয়স ইত্যাদি কেমন? তাদের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে তাদেরকে এসব বিষয় নির্দিষ্ট করে দেয়া হলো এবং তা তাদের জন্য জটিলতা তৈরি করলো। সূরা বাক্বারাহর ৬৭-৭১ আয়াতে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নে আয়াতগুলোর অনুবাদ উল্লেখ করা হলো।

সূরা বাক্বারাহ, আয়াত ৬৭-৭১

২:৬৭ :: আর (সেই সময়ের কথা উল্লেখ্য) যখন মূসা বললো তার ক্বাওমের উদ্দেশ্যে, “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন যে- ‘তোমরা যবেহ করো একটি গাভীকে’”। তারা বললো, ‘তুমি কি আমাদেরকে গ্রহণ করেছো ঠাট্টার পাত্ররূপে?’ সে বললো, ‘আমি আশ্রয় চাই আল্লাহর কাছে মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে’।

২:৬৮ :: তারা বললো, “প্রার্থনা করো আমাদের জন্য তোমার রবের কাছে যেন আমাদের জন্য তিনি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন সেটা কেমন হবে?” সে বললো, “নিশ্চয় তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় সেটা (হতে হবে) একটি গাভী, না বুড়ি আর না নবযৌবনা, এ দুয়ের মাঝামাঝি বয়সের।’ সুতরাং তোমরা পালন করো যা তোমাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছে।”

২:৬৯ :: তারা বললো, “প্রার্থনা করো আমাদের জন্য তোমার রবের কাছে যেন আমাদের জন্য তিনি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন সেটার রং কেমন হবে।” সে বললো, “নিশ্চয় তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় সেটা (হতে হবে) একটি গাভী গাঢ় হলুদ তার রং দর্শকদেরকে আনন্দ দেয়।”

২:৭০ :: তারা বললো, “প্রার্থনা করো আমাদের জন্য তোমার রবের কাছে যেন আমাদের জন্য তিনি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন, সেটা কেমন হবে? নিশ্চয় (নির্দিষ্ট ধরনের) গাভীটি আমাদের উপর (অন্যান্য গাভীর সাথে স্বীয়) সাদৃশ্যের অবতারণা করছে। আর নিশ্চয় আমরা, ইনশাআল্লাহ (যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন), হিদায়াতপ্রাপ্ত হবো।”

২:৭১ :: সে বললো, “নিশ্চয় তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় সেটা (হতে হবে) একটি গাভী, না জমি চাষে লাগানো হয়েছে আর না কোনো ক্ষেতে পানি সেচের কাজে লাগানো হয়েছে, সম্পূর্ণ সুস্থ, তাতে কোন খুঁত নেই।” তারা বললো, “এখন তুমি যথাযথ তথ্য নিয়ে এসেছো।” তারপর তারা সেটা যবেহ করলো। অথচ তারা তা করতে আগ্রহী ছিল না।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, আল্লাহর বিধান সরল প্রকৃতির এবং সেখানে ধর্মাচার পালনের বিভিন্ন দিককে সুনির্দিষ্ট করে দেয়ার পরিবর্তে মূল বিধানটিকে বিবেকসঙ্গত সুবিধাজনকভাবে পালনের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়, যাতে বিভিন্ন বিকল্পের অবকাশ রয়েছে। বিধানটি পালনের বিভিন্ন দিককে নির্দিষ্ট করে নিয়ে তাকে জটিল ধর্মাচারে পরিণত করা বানী ইসরাইলের অগ্রহণযোগ্য মানসিকতার অনুসরণ, যা সমুচিত নয়।

কুরবানির পর্যালোচনা

প্রতি বছর ১০ জিলহজ্জ বিশ্বব্যাপী গবাদি পশু জবেহের মাধ্যমে কুরবানি অনুষ্ঠান করা হয়। ধারণা করা হয় যে, এটি নবী ইবরাহীম থেকে চালু হওয়া একটি বিধান, যেখানে আল্লাহ তাঁকে স্বপ্নযোগে তাঁর প্রিয় বস্তু তথা নবী ইসমাইলকে জবেহ করার জন্য আদেশ দিয়েছেন এবং তিনি তা পালন করতে গেলে আল্লাহ তাঁকে তা থেকে থামিয়ে দিয়ে একটি দুম্বা কুরবানির আদেশ দেন এবং তিনি তা করেন। তারপর এ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রতিবছর কুরবানির বিধান জারি করেন।

কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে কুরবানির বিধান বর্ণনা করা হয়। এজন্য যেসব শব্দ সম্বলিত আয়াতসমূহকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয় তা হলো- কুরবান, হাদয়ি, কালায়িদ, নুসুক/মানসাক/মানাসিক এবং নাহর। নিম্নে আমরা এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখবো যে, কুরআনে কুরবানির বিধানের যে প্রেক্ষাপট বলা হয় তা সঠিক কিনা এবং সেই ঘটনার প্রকৃত তাৎপর্য কী? সেই সাথে, যে শব্দগুলোকে কুরবানির প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয় তার প্রকৃত তাৎপর্য কী?

কুরবানি শব্দটির অর্থ

কুরবানি শব্দটির প্রকৃত আরবি রূপ হলো ‘কুরবান’ (Root Qaf Ra Ba)। কুরআনে ‘কুরবান’ শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যথা- 

১. ‘নৈকট্য স্থাপনের উপাদানস্বরূপ পেশকৃত উৎসর্গ’ (৩:১৮৩, ৫:২৭)। 

২. 'নৈকট্য স্থাপনের উপাদানস্বরূপ গৃহীত উপাসনার সত্তা’ (৪৬:২৮) 

এই উৎসর্গ যে পশু থেকেই হতে হবে তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি।

নিচে ‘কুরবান’ শব্দযুক্ত আয়াতসমূহের অনুবাদ উল্লেখ করা হলো-

৩:১৮৩ :: যারা বললো, “নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমাদের প্রতি এই যে, আমরা বিশ্বাস করবো না কোনো রসূলের প্রতি যতক্ষণ না সে আমাদের কাছে আসবে সেই কুরবান (নৈকট্য স্থাপনের উপাদানস্বরূপ পেশকৃত উৎসর্গ) নিয়ে, আগুন যেটিকে খেয়ে ফেলবে।” বলো, “নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছিলো অনেক রসূল আমার আগে সুস্পষ্ট যুক্তিগত প্রমাণ নিয়ে আর তা নিয়ে যা তোমরা বলেছো। তাহলে কেন তোমরা হত্যা করেছো তাদেরকে, যদি তোমরা হও সত্যবাদী?”

See: Burnt Offering in Judaism from Wikipedia

৫:২৭ :: পাঠ করো তাদের কাছে আদমের দুই পুত্রের সংবাদ যথাযথভাবে। যখন তারা দুজন কুরবান (নৈকট্য স্থাপনের উপাদানস্বরূপ পেশকৃত উৎসর্গ) পেশ করলো, তখন কবুল করা হলো তাদের দুজনের একজন থেকে আর কবুল করা হয়নি অন্যজন থেকে। (যার কুরবান কবুল করা হয়নি) সে বললো, “নিশ্চয় আমি তোমাকে হত্যা করবো।“ (যার কুরবান কবুল করা হলো) সে বললো, “নিশ্চয় আল্লাহ কবুল করেন স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বনকারীদের থেকে।”

৪৬:২৮ :: তারপর কেন তাদেরকে তারা সাহায্য করলো না যাদেরকে তারা গ্রহণ করেছিলো আল্লাহকে বাদ দিয়ে কুরবান ('নৈকট্য স্থাপনের উপাদানস্বরূপ গৃহীত) উপাসনার সত্তা রূপে? বরং তারা হারিয়ে গেছে তাদের থেকে। আর সেটাই তাদের মিথ্যা আরোপের পরিণতি আর যা তারা (মিথ্যাভাবে) রচনা করছিল (তার পরিণতি)।

আয়াতগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, উৎসর্গ অর্থে কুরবান প্রসঙ্গে দুটিমাত্র তথ্য রয়েছে। তা হলো-

১. মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পূর্বে কোনো কোনো রসূল এমন উৎসর্গ পেশ করেছিলেন, যা কবুল হওয়ার নিদর্শনস্বরূপ আগুন এসে তা খেয়ে ফেলেছিলো/ জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। 

২. আদমের দুই পুত্র কুরবান করেছিলো এবং তাদের একজনের কুরবান কবুল হয়েছিলো ও অন্যজনেরটি কবুল হয়নি। আদমের দুই পুত্রের কুরবানির ঘটনায় আমাদের জন্য শিক্ষণীয় দিক রয়েছে। তবে তাতে আমাদেরকে কুরবানির কোনো বিধান দেয়া হয় নি।

কুরআনে কোনো আয়াতে আমাদেরকে ‘কুরবান’ করার কথা বলা হয়নি। তবে প্রচলিত কুরবানির যে ব্যবস্থা, সেটা প্রকৃতপক্ষে কুরআনে ‘মানসাক’ শব্দের মাধ্যমে প্রদত্ত বিধানের মাধ্যমে প্রচলিত হয়েছে। ‘নুসুক বা মানসাক’ শব্দকে ‘কুরবান’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। আমরা ‘নুসুক ও মানসাক’ শব্দের বিশ্লেষণপর্বে এর প্রকৃত তাৎপর্য এবং বিধান সম্পর্কে আলোচনা করবো।

কুরবানির কথিত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

প্রচলিত রয়েছে যে, আল্লাহ নবী ইবরাহীমকে স্বপ্নযোগে তাঁর প্রিয় জিনিস তথা পুত্র নবী ইসমাইলকে কুরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই অনুসারে তিনি যখন নবী ইসমাইলকে কুরবানি করতে উদ্যত হয়েছেন তখন আল্লাহ ইসমাইলকে বাঁচিয়ে নেন এবং তার স্থলে একটি স্বর্গীয় দুম্বা কুরবানি হয়ে যায়। তারপর এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মুসলিমদেরকে প্রতি বছর জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে বিশ্বব্যাপী গবাদি পশু কুরবানি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এভাবে কুরবানির প্রথা চালু হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটের প্রমাণ হিসেবে সূরা সাফফাতের ১০০-১১১ আয়াতের দলীল দেয়া হয়ে থাকে। তাই নিম্নে আয়াতগুলোর অনুবাদ উল্লেখ করা হলো-

৩৭:১০০ :: (ইবরাহীম প্রার্থনা করেছিলো) “হে আমার রব, আমাকে দান করুন (একটি সন্তান, যে হবে) সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত।

৩৭:১০১ :: সুতরাং আমরা তাকে সুসংবাদ দিলাম সহনশীল এক পুত্রের।

৩৭:১০২ :: তারপর যখন সে পৌঁছলো তার সাথে দৌড়াদৌড়ির বয়সে, তখন সে বললো, “হে আমার পুত্র, নিশ্চয় আমি দেখেছি আমার স্বপ্নের মধ্যে যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি। তাই লক্ষ্য করো তুমি কী দেখো? (তুমি বিষয়টিকে কিভাবে বিশ্লেষণ করবে?)” সে (তার পুত্র) বললো, “হে আমার আব্বা, আপনি করুন যা করতে আপনি আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন। আপনি আমাকে পাবেন ইনশাআল্লাহ (যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন) সবরকারীদের অন্তর্ভুক্ত।”

৩৭:১০৩ :: তারপর যখন তারা দুজন আত্মসমর্পন করলো। আর সে (ইবরাহীম) তাকে (ইসমাইলকে) শোয়ায়ে দিলো কপালের উপর।

৩৭:১০৪ :: আর আমরা তাকে ডেকে বললাম, “হে ইবরাহীম।

৩৭:১০৫ :: নিশ্চয় তুমি বাস্তব সত্যরূপে সাব্যস্ত করেছো তোমার স্বপ্নকে (ভাবার্থের পরিবর্তে)। নিশ্চয় এভাবে (তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে) আমরা প্রতিফল দিই সজ্জনদেরকে।

৩৭:১০৬ :: নিশ্চয় এটা ছিলো স্পষ্ট পরীক্ষা।

৩৭:১০৭ :: আর আমরা তাকে (ইবরাহীমকে) ছাড় দিয়েছিলাম/ দায়মুক্ত করেছিলাম, (অন্যথায়) এক মহা জবেহ (হতো) বিধায়।

৩৭:১০৮ :: আর আমরা তাকে (তার স্মরণ) রেখে দিয়েছি পরবর্তীদের মধ্যে।

৩৭:১০৯ :: ইবরাহীমের উপর সালাম।

৩৭:১১০ :: এভাবে আমরা প্রতিফল দিই সজ্জনদেরকে।

৩৭:১১১ :: নিশ্চয় সে আমাদের মু’মিন বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের আলোকে কুরবানির প্রেক্ষাপট হিসেবে প্রচলিত আখ্যানের পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে-

১. নবী ইবরাহীম স্বপ্নে দেখেছেন যে, তিনি তাঁর পুত্রকে জবেহ করতে উদ্যত হয়েছেন। কিন্তু প্রচলিত আখ্যানে বলা হয়ে থাকে- আল্লাহ তায়ালা স্বপ্নযোগে হযরত ইবরাহীম (আ) কে আদেশ দিলেন : ‘তোমার প্রিয় বস্তুকে আমার নামে কুরবানি দাও।' সুতরাং প্রচলিত বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়।

২. নবি ইবরাহীম স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, তিনি তাঁর পুত্রকে জবেহ করতে যাচ্ছেন। তিনি তাঁর পুত্রকে (ইসমাইলকে) তা জানিয়ে তার মতামত চাইলেন। তিনি (ইসমাইল) এই স্বপ্নকে আল্লাহর নির্দেশ ভেবে তা পালনের জন্য বললেন এবং এক্ষেত্রে নিজে ধৈর্যশীলতা অবলম্বন করবেন বলেও জানালেন। পরে যখন ইবরাহীম ইসমাইলকে জবেহ করার জন্য শুইয়ে দিলেন তখন আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি তাঁর স্বপ্নকে সত্য সাব্যস্ত করেছেন ও বাস্তব রূপ দিয়ে ফেলেছেন। অর্থাৎ তিনি স্বপ্নকে বাস্তবেই কার্যকরযোগ্য সাব্যস্ত করে তাকে জবেহ করতে যাচ্ছিলেন। তিনি স্বপ্নে যেমন দেখেছিলেন যে, তিনি তাঁর পুত্রকে জবেহ করতে যাচ্ছেন, জবেহ করেছেন- তা নয়। বাস্তবেও তিনি সেই উদ্যোগ নিয়েছেন। এছাড়া তিনি তাঁর স্বপ্নকে ভাবার্থে গ্রহণের পরিবর্তে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন এবং সেটাকে সঠিক সাব্যস্ত করেছিলেন। এক্ষেত্রেও প্রচলিত আখ্যানে ভিন্ন রকম বলা হয় যে, তিনি যেটা স্বপ্নে দেখেছিলেন সেটাই আল্লাহর নির্দেশ ছিল। আরো বলা হয়, তিনি চোখ বেঁধে ইসমাইলকে জবেহ করে ফেলেছেন এবং চোখ খুলে দেখেন যে, ইসমাইল পাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং ইসমাইলের পরিবর্তে একটা স্বর্গীয় দুম্বা জবেহ হয়ে গেছে। এ থেকেও বোঝা যায় যে, প্রচলিত আখ্যান গ্রহণযোগ্য নয়।

৩. ইবরাহীম তাঁর স্বপ্নকে সত্য সাব্যস্ত করেছিলেন এবং ইসমাইলও এটাকে স্বপ্নযোগে আল্লাহর নির্দেশ বলে মনে করেছিলেন। যদি ইবরাহীম তাঁর স্বপ্নকে আল্লাহর নির্দেশ হিসেবে নিশ্চিত হতেন, তাহলে সেক্ষেত্রে ইসমাইলের মতামত চাওয়ার কোনো প্রয়োজন হতো না। আল্লাহ স্বপ্নযোগে কোনো নির্দেশ দেন মর্মে কোনো আয়াত নেই। স্বপ্ন ইঙ্গিতধর্মী ও ভাবার্থমূলক হয়ে থাকে। নবী ইবরাহীমকে তাঁর স্বপ্ন অনুসারে ইসমাইলকে জবেহ করতে দেয়া হয় নি এবং অনুরূপভাবে এখনো কেউ অনুরূপ স্বপ্ন দেখলেও সে তা করতে পারবে না। আল্লাহর বিধান অনুসারে, যে ব্যক্তি অন্যকে হত্যা করেছে অথবা হত্যাকান্ড ঘটানোর মত ফাসাদ বা বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে হত্যা করা পাপ। সুতরাং ধর্মাচার হিসেবে নরবলি একটি পাপ। আর তাই আল্লাহর বিধানে নরবলির কোনো অবকাশ নেই। নবি ইবরাহীম সজ্জন লোক ছিলেন, তিনি স্বপ্নকে সত্য সাব্যস্ত করায় ভুল করতে যাচ্ছিলেন, তাই আল্লাহ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে দোষমুক্ত রাখার মাধ্যমে উত্তম প্রতিফল দিয়েছেন।

আয়াতে বলা হয়েছে, এটা ছিল স্পষ্ট পরীক্ষা। তাই কেউ কেউ মনে করেন যে, আল্লাহ পরীক্ষাস্বরূপ তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর পুত্রকে জবেহ করার জন্য, এ পরীক্ষা যে, তিনি নির্দেশ পালনের প্রতি নিষ্ঠা রাখেন কিনা। যখন তাঁর নিষ্ঠার প্রমাণ পাওয়া গেল, তখন আল্লাহ তাঁর পুত্রকে বাঁচিয়ে দিলেন। এভাবে তাঁর নিষ্ঠারও প্রমাণ হলো, আবার পুত্রও জবেহ হলো না। কিন্তু এ ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, আল্লাহর বিধানে যা অন্যায়, আল্লাহ কখনো তার নির্দেশ দেন না। সুতরাং পরীক্ষাটা ছিল এই যে, স্বপ্নটিই পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে যে, তিনি এর প্রতিক্রিয়ায় কী করেন- এটাকে আল্লাহর নির্দেশ ভেবে আক্ষরিকভাবে বাস্তবায়ন করার ভুল করেন, নাকি ভাবার্থে গ্রহণ করেন এবং আল্লাহর নির্দেশ পালনের মানসিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি তাঁর ধর্মের মূলনীতির অনুসরণ করতে পারেন।

৪. ১০৭ নং আয়াতটিতে বলা হয়েছে ‘ওয়া ফাদায়নাহু বিযিবহিন আযীম’ (আর আমরা তাকে ছাড় দিয়েছিলাম/ দায়মুক্ত করেছিলাম, অন্যথায় এক মহা জবেহ হতো বিধায়।)

পূর্বাপর আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, এখানে ‘ফাদায়নাহু’ বলতে ‘নবী ইবরাহীম’কে দায়মুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। ফিদইয়া শব্দের প্রচলিত অর্থ করা হয় ‘মুক্তিপণ দেয়া’, অথচ তার প্রকৃত অর্থ ‘ছাড় দেয়া’। যখন ছাড় দেয়া হয়, তখন যে কাজটি করার বিধান ছিলো, তা করা হয় না, তার পরিবর্তে অন্য কিছু করার কারণে তা করা থেকে ছাড় পাওয়া যায়। ৩৭:১০৭ আয়াত অনুসারে, নবী ইবরাহীমকে ছাড় দেয়া হয়েছে হয়েছে ‘মহা জবেহ’ সম্পাদন এর স্থলে। অর্থাৎ তাঁকে ‘মহাজবেহ’ সম্পাদন করতে দেয়া হয় নি। এর পরিবর্তে তাঁকে কিছুই করতে হয় নি। কারণ, এটা করণীয় ছিল না যে, এর পরিবর্তে অন্য কিছু করতে হবে। যদি জবেহটি সংঘটিত হতো তাহলে তাতে নবী ইবরাহীম এক সাংঘাতিক জবেহের (নরবলির) দোষে দায়ী হয়ে যেতেন, তাই আল্লাহ তাঁকে নিবৃত্ত করারা মাধ্যমে ঐরূপ দায়ী হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তাঁকে নিবৃত্ত করার মাধ্যমে নৈতিকভাবে দায়ী হওয়া থেকে দায়মুক্ত করা হয়েছে।

‘বিযিবহিন আযীম’ (সাংঘাতিক জবাই) এর প্রচলিত ব্যাখ্যা হলো, ইসমাইলের পরিবর্তে একটি দুম্বা জবাই করা হয়েছে, এটাকে ‘সাংঘাতিক জবাই’ বলা হয়েছে অথবা প্রতি বছর ১০ জিলহজ্জে কুরবানির বিধান দেয়া হয়েছে, এটাকে ‘সাংঘাতিক জবাই’ বলা হয়েছে। কিন্তু এ দুটি তথ্যের একটিও কুরআনে নেই। তাই তা গ্রহণযোগ্য নয়। বস্তুত ইসমাইলকে জবেহ করলে সেই ‘নরবলি’ হতো ‘সাংঘাতিক জবাই’, এটাই স্বত:সিদ্ধ এবং বিবেকসঙ্গত, সেই সাথে আয়াতের ব্যাকরণগত গঠন অনুসারেও স্বাভাবিক।

৫. প্রচলিত আখ্যানে বলা হয় যে, নবি ইবরাহীমের কুরবানির স্মৃতি হিসেবে প্রতি বছর জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে বিশ্বব্যাপী প্রত্যেক আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন মুসলিমের উপর কুরবানিকে ওয়াজিব করা হয়েছে। অথচ কুরআন এরূপ তথ্য দেয় না। বরং কুরআনে ইবরাহীমকে পরবর্তীদের মধ্যে স্মরণীয় রাখার যে বিষয়টি রয়েছে তা এই কুরবানির সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং তাঁর সামগ্রিক ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। যেমন, সূরা সাফফাতে অন্যান্য নবিদের বিষয়েও একইরূপ তথ্য রয়েছে। (দ্র. ৩৭:৭৮-৭৯, ৩৭:১০৮-১০৯, ৩৭:১১৯-১২০, ৩৭:১২৯-১৩০)।

সুতরাং বর্তমানে যে কুরবানি প্রচলিত তাকে ইবরাহীমের ঘটনার স্মরণমূলক সাব্যস্ত করার বিষয়টিও কুরআন দ্বারা সরাসরি প্রমাণিত নয়।

নাহার শব্দের তাৎপর্য

সূরা কাওসারে বর্ণিত ‘নাহার’ শব্দের অর্থ করা হয় ‘কুরবানি’ এবং বলা হয় যে, এর মাধ্যমে প্রতি বছর জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে বিশ্বব্যাপী সামর্থ্যবানদের উপর গবাদি পশু কুরবানি করার বিধান দেয়া হয়েছে। নিম্নে সূরাটির অনুবাদ উল্লেখ করা হলো-

১০৮:১ :: নিশ্চয় আমরা তোমাকে দিয়েছি কাওসার (বহুমাত্রিক সমাধানসূত্র)।

১০৮:২ :: সুতরাং তোমার প্রভুর উদ্দেশ্যে সালাত (সংযোগ স্থাপন) করো এবং  নহর কর (জ্ঞানের গভীরতা ও দূরদর্শিতা অর্জন ও প্রয়োগ, সামষ্টিক কল্যাণার্থে ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে উৎসর্গ এবং আদর্শিক আপোষহীনতা অবলম্বনমূলক কর্মরীতি প্রবর্তন কর)।

১০৮:৩ :: নিশ্চয় তোমার শত্রুরাই শিকড় কাটা।

নহর শব্দটি একটি বহু অর্থবোধক শব্দ। “নাহারতুশ শাইয়া ইলমা” অর্থ “আমি বিষয়টি গভীরভাবে জেনেছি”। তাই “নহর করা” শব্দের একটি অর্থ হলো “জ্ঞানের গভীরতা অর্জন ও প্রয়োগ করা”। এছাড়া শব্দটির আরো কিছু আভিধানিক অর্থ হলো:  বুকের উপরের অংশে / কণ্ঠাস্থিতে আঘাত করা, আত্মাহুতি, পৃষ্ঠ প্রদর্শন না করে প্রতিরোধের জন্য মুখোমুখি দাঁড়ানো, নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করা ইত্যাদি। সালাত ও কুরবানির সাথে সম্পর্কিত করে এর আরো কিছু অর্থ করা হয়, যেমন: আত্মনিবেদিত ভঙ্গিতে কোনো দিকে মুখ করে দাঁড়ানো, বুকের উপরের অংশে হাত রাখা, এক হাতের উপর অন্য হাত রাখা, কান পর্যন্ত হাত তোলা, উট কুরবানি করা ইত্যাদি।

বস্তুত সূরা কাওসারের ২নং আয়াতে সাধারণভাবে ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা বলা হয়েছে। এতে জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে, বিশ্বব্যাপী, সামর্থ্যবানদের জন্য গবাদি পশু কুরবানি করা- এরূপ কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান দেয়া হয় নি।

হাদয়ি/হাদিয়া শব্দের তাৎপর্য

কুরবানির প্রসঙ্গে তৃতীয় যে শব্দটিকে প্রতিশব্দ হিসেবে ধরা হয় তা হলো ‘হাদয়ি’ বা ‘হাদিয়া’। 

হাদিয়া শব্দটিকে আরবিতে ব্যাকরণগতকারণে ‘হাদইয়ু هَدْيُ  হাদইয়া / হাদিয়া هَدْيَ  এবং হাদয়ি’ هَدْيِ   এ তিনটি রূপে লেখা হয়। বস্তুত তিনটিই একই শব্দ। বাংলা ভাষায় আমরা যেমন ‘ফিদইয়া’কে فِدْيَة  ‘ফিদিয়া’ বলি, তেমনি ‘হাদইয়া’কে هَدْيَ  ‘হাদিয়া’ বলি। ‘হাদিয়া’ শব্দটি আমাদের কাছে বহুল পরিচিত এবং আমরা আমাদের কথাবার্তায় প্রায়ই এ শব্দটি ব্যবহার করি। হাদিয়া মানে ‘উপহার, উপঢৌকন’। কুরআনে হাদিয়া শব্দটি ‘হাদইয়ু, হাদইয়া ও হাদয়ি’ শব্দরূপে ব্যবহৃত হয়েছে মোট ৭ স্থানে: ২:১৯৬:১০, ২:১৯৬:১৬, ২:১৯৬:৪৪, ৫:২:১২, ৫:৯৫:২৪, ৫:৯৭:১০, ৪৮:২৫:৮। 

সাধারণত হজ্জের আয়াতসমূহে বর্ণিত হাদিয়া শব্দটির অনুবাদ করা হয় ‘কুরবানির পশু’। তাই এটা বুঝা প্রয়োজন যে, হাদিয়াকে কুরবানির পশু অর্থে অনুবাদ করা হয় কেন এবং কুরবানির পশু ছাড়া কোনো কিছু হাদিয়া হিসেবে দেয়া যেতে পারে কিনা। নিম্নে বিষয়টি আলোচনা করা হলো।

২:১৯৬ আয়াতে হজ্জ ও উমরাহর ক্ষেত্রে মাহিল্লুতে (হাদিয়া জমা দেয়ার যথাস্থানে) হাদিয়া পৌঁছানোর কথা বলা হয়েছে। হজ্জ ও উমরাহ প্রসঙ্গে হাদিয়া মানে কা’বায় পৌঁছানোর উপহার।

৫:৯৫ আয়াত অনুযায়ী, হুরুমুন (হারাম মাসসমূহে থাকা) অবস্থায় স্থলভাগের (বাহীমাতুল আনআম) শিকার করলে তার অনুরূপ গবাদি পশুকে কা’বাতে হাদিয়া হিসাবে পৌঁছাতে হবে, দুজন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি যে প্রাণীকে বধ করা হয়েছে সেটা কোন গবাদি পশুর অনুরূপ তার নির্বাহী ফয়সালা করবেন এবং এক্ষেত্রে তাদের সুচিন্তিত ফয়সালাই কার্যকর হবে তথা এ ফয়সালাকে নির্বাহী আওতায় রাখা হলো। সামর্থ্যের অভাবে না পারলে ঐ সমমূল্য খরচ করে যতজন মিসকিনকে মধ্যমমানের খাদ্য খাওয়ানো যায় ততজন মিসকিনকে খাওয়াতে হবে বা ততসংখ্যক রোযা রাখতে হবে।

২২:৩৩ আয়াতে নুসুকের (কুরবানির) আনআম বা গবাদি পশুর প্রসংগে মাহিল্লু (কুরবানির স্থান) চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং হাদিয়া হিসেবে অন্যতম হচ্ছে নুসুকের (কুরবানির) গবাদি পশু। আয়াতটিতে কুরবানির গবাদি পশুর প্রসঙ্গ বোঝার জন্য ২২:২৮ ও ২২:৩৩-৩৭ আয়াত সমন্বিতভাবে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।

সুতরাং ২:১৯৬, ৫:৯৫ এবং ২২:৩৩ আয়াতের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে হাদিয়া ও নুসুক হিসেবে পশু জবেহ করার সম্পর্ক প্রতিভাত হয়। হাদিয়া হচ্ছে উপহার এবং নুসুক হচ্ছে ধর্মীয় ও সামাজিক সংহতিমূলক রীতি। অর্থাৎ হজ্জের একটি নুসুক হচ্ছে হাদিয়া হিসেবে জমা দেয়া পশুগুলো থেকে কুরবানি করা। 

২:১৯৬ :: আর তোমরা আল্লাহর (সন্তুষ্টি অর্জনের) উদ্দেশ্যেই হজ্জ ও উমরা পূর্ণ করো। তবে যদি তোমরা বাধাপ্রাপ্ত হও, তাহলে হাদিয়া (উপহার) হিসেবে যা সহজ হয় (তাই যথেষ্ট)। আর (এমতাবস্থায়) তোমরা মাথামুণ্ডন করো না যতক্ষণ না হাদিয়া (উপহার) যথাস্থানে পৌঁছে। তোমাদের মধ্য থেকে যে অসুস্থ হয় বা তার মাথায় কষ্টদায়ক কিছু হয় তাহলে ফিদইয়া (বিকল্প মুক্তিপণ) হবে সিয়াম করা (অর্থাৎ রোজা রাখা) বা সদাকক্বাহ দেয়া বা নুসুক করা (অর্থাৎ ধর্মীয় বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে পশু উৎসর্গ ও সংহতিমূলক রীতি পালন করা)। অন্যদিকে যখন তোমরা নিরাপদ থাক তখন যে ব্যক্তি হজ্জ পর্যন্ত উমরা করার সুযোগ নেয়, তাহলে হাদিয়া (উপহার) হিসেবে যা সহজ হয় (তাই যথেষ্ট)। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তা পায় না (অর্থাৎ হাদিয়া পায় না বা হাদিয়া দেয়াতে অংশগ্রহণের সামর্থ্য পায় না) তাহলে (দায়িত্ব হচ্ছে) হজ্জের মধ্যে তিন দিন সিয়াম করা (রোজা রাখা) এবং সাতদিন যখন তোমরা ফিরে যাবে তখন। (তার ক্ষেত্রে) উহাই পরিপূর্ণ দশ। এ অবকাশ তার জন্য যার পরিবার পরিজন আল মাসজিদুল হারামের উপস্থিতি নয় (অর্থাৎ হারাম এলাকার বাসিন্দা নয়)। তোমরা আল্লাহ সচেতন হও। আর জেনে রাখো যে, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।

২২:২৮ :: এ উদ্দেশ্যে যে, যেন তারা তাদের কল্যাণ প্রত্যক্ষ (অর্জন) করতে পারে এবং যেন তারা আল্লাহ তাদেরকে বাহীমাতুল আনআম (অর্থাৎ গবাদি পশু প্রকৃতির বিচরণশীল চতুষ্পদ পশুসমূহ) থেকে যা জীবনোপকরণ হিসেবে দিয়েছেন তার উপর সুপরিজ্ঞাত দিনসমূহে (অর্থাৎ হজ্জের দিনসমূহে) আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে (অর্থাৎ হজ্জ উপলক্ষ্যে আল্লাহর নামে পশু জবেহ করার জন্য)। তারপর তোমরা তা থেকে নিজেরা খাও এবং সংকটাপন্ন অভাবগ্রস্তদেরকে খাওয়াও।

২২:৩৩ :: সেগুলোতে (অর্থাৎ গবাদি পশুগুলোতে) তোমাদের জন্য সুনির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত (অর্থাৎ হজ্জ উপলক্ষ্যে যথাস্থানে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত) বিভিন্ন উপকারলাভের সুযোগ রয়েছে। তারপর তার (জমা দেয়ার) যথাস্থান হচ্ছে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার প্রতীকবহ চিরায়ত মহতী প্রতিষ্ঠানের সন্নিকটে (কা’বার আওতায় নিয়ন্ত্রিত)।

২২:৩৪ :: আর প্রত্যেক উম্মাতের জন্যই আমি মানছাক (অর্থাৎ ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে সংহতিমূলক রীতি) নির্ধারণ করে দিয়েছি; তাই যেন তারা আল্লাহ তাদেরকে বাহীমাতুল আনআম (অর্থাৎ গবাদি পশু প্রকৃতির বিচরণশীল চতুষ্পদ পশুসমূহ) থেকে যা জীবনোপকরণ হিসেবে দিয়েছেন তার উপর আল্লাহর নাম স্মরণ করে (অর্থাৎ আল্লাহর নামে পশু জবেহ করে)। তোমাদের ইলাহ (সর্বময় প্রয়োজন পূরণকারী, সার্বভৌমত্বের অধিকারী ও উপাস্য) একক ইলাহ। সুতরাং তাঁরই উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণ করো। আর (আল্লাহর প্রতি) বিনীতদেরকে সুসংবাদ দাও।

২২:৩৫ :: যারা এমন যে, যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের মন কেঁপে উঠে। আর তাদের উপর যে বিপদাপদ আপতিত হয় সে বিষয়ে ধৈর্যশীল হয় এবং সালাত প্রতিষ্ঠাকারী হয় এবং আমি তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দিয়েছি তা থেকে (নিজ প্রয়োজনের পাশাপাশি পরার্থে) ব্যয় করে।

২২:৩৬ :: আর কুরবানির উপযোগী মাংসল পশুসমূহকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নির্ধারিত নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। সেগুলোর মধ্যে তোমাদের জন্য ব্যাপক কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং তোমরা সেগুলোর উপর আল্লাহর নাম স্মরণ করো (উৎসর্গের জন্য) সারিবদ্ধ করা অবস্থায়। তারপর যখন সেগুলোর পার্শ্বদেশ (মাটিতে) ঠেকে যায় (অর্থাৎ নিষ্প্রাণ হয়ে যায়) তখন তা থেকে তোমরা খাও এবং যারা আবেদন করে না এরূপ অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও এবং যারা আবেদন করে এরূপ অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও। এভাবে আমি সেগুলোকে তোমাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত করেছি যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।

২২:৩৭ :: আল্লাহর কাছে সেগুলোর (উৎসর্গকৃত পশুগুলোর) গোশত ও রক্ত পৌঁছে না (মূল্যায়ন পায় না), বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের আল্লাহ সচেতনতা। এভাবে তিনি সেগুলোকে তোমাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত করেছেন যেন তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে পারো, তাঁর হিদায়াত অনুযায়ী। আর উত্তম আচরণকারীদেরকে সুসংবাদ দাও।

৫:৯৫ :: হে যারা বিশ্বাস করেছো, তোমরা (স্থলভাগের) শিকারকে হত্যা করো না এ অবস্থায় যে, তোমরা হুরুমুন (হারাম মাসসমূহে থাকা) অবস্থায়। আর যে সেটাকে হত্যা করবে তোমাদের মধ্য থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে, তার জরিমানা হচ্ছে সেটার অনুরূপ যা সে হত্যা করেছে, (যা দিতে হবে) গবাদি পশু থেকে। ঐ (ধরনের গবাদি পশু নির্ধারণের) ব্যাপারে নির্বাহী সিদ্ধান্ত দেবে তোমাদের মধ্যকার দুজন ন্যায়বিচারক। সেটাকে হাদিয়া হিসাবে পৌঁছাতে হবে কা’বায়। অথবা তার কাফফারা (ক্ষতিপূরণ) হবে (সমমূল্য দ্বারা যতজনকে মধ্যম মানের খাদ্য খাওয়ানো যেতে পারে ততজন) মিসকীনকে খাওয়ানো অথবা মিসকীন সংখ্যার সমানুপাতে সিয়াম পালন করা। (এটা এজন্য যে,) যেন সে স্বাদ আস্বাদন করে তার কাজের পরিণামের। আল্লাহ উদারনীতি দেখিয়েছেন (এ বিধান নাযিলের) আগে যা হয়ে গিয়েছিলো সে ব্যাপারে। আর যে পুনরাবৃত্তি করবে, আল্লাহ তাকে দন্ড দিবেন। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, মহাদন্ডদাতা।

মাহিল্লুতে হাদিয়া পৌঁছানোর সাথে সম্পর্কিত বিধি-বিধান

২:১৯৬ আয়াতের বক্তব্যকে চারটি ধারায় বিভক্ত করলে উপলব্ধি সহজ হয়। তাই নিম্নে আয়াতটির বক্তব্যকে চারটি ধারায় বিভক্ত করে উপস্থাপন করা হলো।

১. “আর তোমরা আল্লাহর (সন্তুষ্টি অর্জনের) উদ্দেশ্যেই হজ্জ ও উমরাহ পূর্ণ করো। তবে যদি তোমরা বাধাপ্রাপ্ত হও, তাহলে (তোমাদের জন্য কা’বায় পৌঁছানোর) হাদিয়া হিসেবে যা সহজ হয় (তা-ই যথেষ্ট)।”

এ অংশের ভিত্তিতে একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, বাধাপ্রাপ্ত ব্যক্তির কুরবানির পশু কিভাবে তার যথাস্থানে পৌঁছবে? যেহেতু হাদিয়ার মাহিল্লু বা যথাস্থান হিসেবে প্রাচীন গৃহের সন্নিকটে বলে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে সেই প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, এ আয়াতে এ ব্যক্তির প্রসঙ্গটিই উল্লেখ করা হয়েছে যে ব্যক্তি বাধাগ্রস্ত হবে তারপর হজ্জ করতে পারবে তথা বাধার কারণে হজ্জে বিলম্ব ঘটবে কিন্তু হজ্জ মৌসুমের মধ্যে বাধা অপসারিত হবে ও হজ্জ করতে পারবে। কারণ হাদিয়া তার মাহিল্লুতে পৌঁছাতে হবে, আর বাধা অপসারিত হওয়ার পরেই কেবল হজ্জকারী মাহিল্লুতে হাদিয়া নিয়ে যেতে পারে, এটা একটা স্বত:সিদ্ধ বাস্তবতা।

তবে এর মানে এ নয় যে, যাদের ক্ষেত্রে বাধা অপসারিত হবে না বিধায় তারা হজ্জ করতে পারবে না তারা পথিমধ্যে কুরবানিও করতে পারবে না। বরং তারা কুরবানি করতে পারবে, যদিও কুরবানি করা তাদের উপর বাধ্যতামূলক নয়। কারণ হজ্জ মওসুমের মধ্যে যার বাধা অপসারিত হয় না তার ক্ষেত্রে কী তা আয়াতটিতে উল্লেখ করা হয়নি। স্বত:সিদ্ধভাবে বুঝা যায় যে, তার জন্য ঐ বছর হজ্জ ও কুরবানির বাধ্যবাধকতা নেই।

২. “আর (এমতাবস্থায়) তোমরা মাথামুণ্ডন করো না যতক্ষণ না হাদিয়া যথাস্থানে পৌঁছে। তোমাদের মধ্য থেকে যে অসুস্থ হয় বা তার মাথায় কষ্টদায়ক কিছু হয় তাহলে ফিদইয়া (ক্ষতিপূরণ) হবে সিয়াম করা (রোজা রাখা) বা সদাকাহ দেয়া বা নুসুক করা (ধর্মীয় ও সামাজিক সংহতিমূলক রীতি পালন করা)।” 

এটি বাহ্যত একটি স্বতন্ত্র আদেশ হলেও, প্রকৃতপক্ষে পূর্ববর্ণিত দফার সাথে সম্পৃক্ত। যেহেতু ৪৮:২৭ আয়াতে নিরাপদ অবস্থায় নির্ভয়ে মাথা মুন্ডন করে ও চুল ছোট করে আল মাসজিদুল হারামে প্রবেশের কথা বলা হয়েছে। অথচ এখানে (২:১৯৬) মাথামুন্ডন করতে নিষেধ করা হয়েছে, যতক্ষণ না হাদিয়া তার যথাস্থানে পৌঁছে। অবশ্য কারো যদি মাথায় কোনো অসুবিধা থাকে যে কারণে তার মাথামুন্ডন বা চুল ছোট করতে হয়, তাহলে তাকে অনুমতি দেয়া হয়েছে, তবে তাকে ফিদিয়া দিতে হবে। এ থেকে বুঝা যায় যে, নিরাপদ অবস্থা এবং অনিরাপদ অবস্থায় মাথামুন্ডন সম্পর্কে দুই ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্য থেকে মাথামুন্ডন না করার নিষেধাজ্ঞাটি স্পষ্ট এবং মাথামুন্ডন করার বিষয়টি স্বাভাবিক রীতি হিসেবে অনুশীলনযোগ্য কিন্তু তা আবশ্যক নয়।

৩. “অন্যদিকে যখন তোমরা নিরাপদ থাক তখন যে ব্যক্তি হজ্জ পর্যন্ত উমরাহ করার সুযোগ নেয়, তাহলে (তার জন্য কা’বায় পৌঁছানোর) হাদিয়া হিসেবে যা সহজ হয় (তা-ই যথেষ্ট)।” 

আয়াতের এ অংশে উমরাহসহ হজ্জের বিষয়ে বলা হয়েছে যে, সেক্ষেত্রে হজ্জকারী সামর্থ্য অনুসারে যা সহজ তাই হাদিয়া দিবে। এর কারণ হলো এই যে, একদিকে উমরাহ পালনের সময় তাকে একবার হাদিয়া দিতে হয়েছিল। আবার উমরার পরবর্তীতে হজ্জ পর্যন্ত অবস্থানের কারণে তথা সফরকালের দীর্ঘতার ফলে তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে যেতে পারে। ‘যে হজ্জ পর্যন্ত উমরাহ করতে সক্ষম হয় / উমরাহ করার ফায়দা নেয়’ কথাটির অর্থ হচ্ছে হজ্জের মাসের আগে মক্কায় পৌঁছা এবং এর ফলে উমরাহ করতে পারা।

৪. “পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তা পায় না (অর্থাৎ হাদিয়া পায় না বা হাদিয়া দেয়াতে অংশগ্রহণের সামর্থ্য পায় না) তাহলে (দায়িত্ব হচ্ছে) হজ্জের মধ্যে তিন দিন সিয়াম করা (রোজা রাখা) এবং সাতদিন যখন তোমরা ফিরে যাবে তখন। (তার ক্ষেত্রে) উহাই পূর্ণ দশ। এ অবকাশ তার জন্য যার পরিবার পরিজন আল মাসজিদুল হারামের উপস্থিতি নয় (অর্থাৎ হারাম এলাকার বাসিন্দা নয়)। তোমরা আল্লাহ সচেতন হও। আর জেনে রাখো যে, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।”

এটি হচ্ছে এ আয়াতের সর্বশেষ অংশ। এতে হাদিয়া দিতে সক্ষম না হলে আল মসজিদুল হারামের উপস্থিতি তথা হারাম এলাকার অধিবাসী ছাড়া অন্যদের জন্য হজ্জের মধ্যে তিনদিন এবং বাড়ি ফিরে সাতদিন সিয়াম পালন করতে হবে। তারপর একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে যে, “তিলকা আশারাতুন কামিলাতুন” অর্থাৎ (তার ক্ষেত্রে) উহাই পূর্ণ দশ।

এ ধারাটি থেকে দুটি বিষয় অনুধাবন করা যায়। যা নিম্নরূপ:

ক. হজ্জের মধ্যে ৩ দিন সিয়াম পালন করলে এবং বাড়ি গিয়ে ৭ দিন সিয়াম পালন করলে সেভাবেই তাদের ক্ষেত্রে ১০ দিন পূর্ণ হবে। অন্য কথায়, তাদেরকে হজ্জের ১০ দিন ক্রমাগত সিয়াম পালন করা প্রয়োজন নেই, বরং হজ্জের মধ্যে ৩ দিন সিয়াম পালন করে বাকি ৭ দিন বাড়ি গিয়ে সিয়াম পালন করার মাধ্যমেই ১০ দিনের বিধান পূর্ণ হয়ে যাবে। অন্য কথায়, হজ্জের মধ্য থেকে ৭ দিন তাদেরকে ছাড় দেয়া হলো যে, তারা হাদিয়া না দেয়া সত্ত্বেও ঐ ৭ দিন সিয়াম পালন না করে ঐ ৭ দিনের সিয়াম বাড়ি গিয়ে পালন করবে। এ ধারাটি থেকে পরোক্ষভাবে অনুধাবন করা যায় যে, হজ্জের সাধারণ সময়সীমা হচ্ছে ১০ দিন। অবশ্য বাস্তব পরিস্থিতি সাপেক্ষে প্রয়োজন হলে এর চেয়ে বেশি করাও অসঙ্গত নয়। আর হজ্জের মধ্যে ৩ দিন সিয়াম পালন করার বিধান এবং ২:২০৩ আয়াতের অন্তত দুইদিন হজ্জের বিধান অনুসারে বিশেষ ‘যিকর’ করার বিধান থেকে স্পষ্ট যে, হজ্জের ন্যুনতম দিনসংখ্যা ৫ দিনের চেয়ে কম হবে না।

খ. যারা হারাম এলাকার স্থানীয় তারা যদি হাদিয়া দিতে না পারে তাহলে তারা ঐ মাসে হজ্জ করবে না, কারণ যেহেতু তারা স্থানীয় তাই তারা চাইলে সহজেই অন্য মাসে হজ্জ পরিপালন করা সম্ভব। অথবা তারা হজ্জ করলে দশটি সিয়াম ধারাবাহিকভাবে পালন করতে হবে, যেহেতু তারা ঐ এলাকার স্থানীয়, তাই তাদের জন্য তিন দিন ও সাত দিনে সিয়াম পালনের দুটি পর্ব প্রযোজ্য হবে না।

নুসুক, মানসাক ও মানাসিক

কুরবানি বোঝাতে ব্যবহৃত আর যে শব্দটি ব্যবহৃত হয় তা হলো ‘নুসুক, মানসাক বা মানাসিক’।

নুসুক ও মানসাক শব্দ একটি অন্যটির প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ এবং মানাসিক হলো ‘মানসাক’ শব্দের বহুবচন। তবে নুসুক ও মানসাক শব্দের মধ্যে সামান্য ব্যবহারিক পার্থক্য রয়েছে।

নুসুক হলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুশীলনীয় সংহতিমূলক রীতি, যেমন ২:১৯৬-এ বাধাপ্রাপ্ত অবস্থায় ব্যক্তিগত বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ বা ৬:১৬২-এ ব্যক্তিগত জীবনের উৎসর্গ। এটি ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সংযোগ গড়ে তোলে।

মানসাক/মানাসিক হলো সমষ্টিগত পর্যায়ে অনুশীলনীয় সংহতিমূলক রীতি যেমন ২২:৩৪-এ উম্মাহর যৌথভাবে পশু উৎসর্গ রীতি বা ২:২০০-এ হজ্জের সম্মেলনী রীতিনীতির সম্পাদন।

নুসুক শব্দটি যেসব আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো, ২:১৯৬, ৬:১৬২। নুসুক এর প্রতিশব্দ মানসাক (বহুবচনে মানাসিক) শব্দ যেসব স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো: ২:১২৮, ২:২০০, ২২:৩৪, ২২:৬৭। নুসুক শব্দ থেকে গঠিত নাসিক (কর্তা, মানসাক সম্পাদনকারী) শব্দটি যে স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো: ২২:৬৭।

নিম্নে বিভিন্ন আয়াতের প্রয়োগ অনুসারে নুসুক, মানসাক ও মানাসিকের স্বরূপ চিহ্নিত করা হলো-

কোনো অনুষ্ঠানে একত্র হলে আপ্যায়নের সেরা উপায় পশুর গোশতের ব্যবস্থা করা। 

১. সূরা বাক্বারাহ ২:১৯৬ নুসুক প্রসঙ্গে বক্তব্য : বাধাপ্রাপ্ত হলে হাদিয়া যথাস্থানে পৌঁছানোর আগে মাথামুন্ডন করা যাবে না। যদি কোনো কারণে তা করতে হয়, তাহলে ব্যক্তিগতভাবে অন্যদের সাথে সংহতিমূলক কোনো রীতি অনুশীলন করতে হবে। 

২. সূরা আনয়াম ৬:১৬২ নুসুক প্রসঙ্গে বক্তব্য : জীবন-মরণ এবং সালাত (সংযোগ) ও নুসুক (সংহতি) আল্লাহর জন্য। 

৩. সূরা হজ্জ ২২:৩৪-৩৬ মানসাক প্রসঙ্গে বক্তব্য : সকল উম্মাহর মধ্যে মানসাক তথা ধর্মীয় ও সামাজিক সংহতিমূলক রীতি প্রবর্তন করা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে, হজ্জ উপলক্ষ্যে হাজীদের পক্ষ থেকে পশুর উপর আল্লাহর নাম স্মরণ করতে হবে তথা হজ্জ বা অনুরূপ সম্মেলন উপলক্ষে সারিবদ্ধভাবে পশু জবেহ করতে হবে। সুতরাং আয়াতগুলোতে ‘হজ্জ উপলক্ষে আল্লাহর নামে পশু জবেহ করা’কে একটি ‘মানসাক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

৪. সূরা হজ্জ ২২:৬৭ মানসাক প্রসঙ্গে বক্তব্য : সকল উম্মাহর মধ্যে মানসাক তথা ধর্মীয় ও সামাজিক সংহতিমূলক রীতি প্রবর্তন করে দেয়া হয়েছে, তারা তা পালনকারী হয়ে থাকে বা হওয়া উচিত। সকল সম্প্রদায় একই ধরনের মানসাক পালন করতে হবে, এমনটি বাধ্যতামূলক নয়। বরং তাদের মধ্যে বিভিন্নতার অবকাশ রয়েছে এবং এই বৈচিত্র্যের বিপরীতে বিতর্ক করা সমুচিত নয়। নিম্নে আয়াতটি উল্লেখ করা হলো-

২২:৬৭ :: প্রত্যেক উম্মাতের জন্য আমরা নির্ধারিত করেছি মানছাক (ধর্মীয় ও সামাজিক সংহতিমূলক রীতি), তারা সেটার অনুশীলনকারী পক্ষ। সুতরাং তারা যেন তোমার সাথে মতবিরোধ না করে এই ব্যাপারে। আর তুমি দোয়া করো তোমার রবের কাছে। নিশ্চয় তুমি সঠিক নীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হিদায়াতের উপর আছো।

৫. সূরা বাক্বারাহ ২:১২৮ মানাসিক প্রসঙ্গে বক্তব্য : সমষ্টিগতভাবে অনুশীলনীয় ধর্মীয় ও সামাজিক সংহতিমূলক রীতিনীতি দেখিয়ে দেয়ার বা তার দার্শনিক বোধ প্রদানের প্রার্থনা। 

৬. সূরা বাক্বারাহ ২:২০০ মানাসিক প্রসঙ্গে বক্তব্য : হজ্জ সম্মেলনে সমষ্টিগতভাবে অনুশীলনীয় ধর্মীয় ও সামাজিক সংহতিমূলক রীতিনীতিসমূহ সম্পন্ন করা।

কুরবানি সর্ম্পকিত বিবিধ প্রশ্নোত্তর

কুরবানি সম্পর্কিত আয়াতসমূহ উপরে আলোচনা করা হয়েছে। এখন এর সাথে আনুষঙ্গিক কিছু প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করা যেতে পারে, যার ভিত্তি হবে কুরআনের নীতিমালা ও বক্তব্য কাঠামোর উপর চিন্তা-ভাবনা।

১. প্রশ্ন : প্রত্যেক হাজীর পক্ষ থেকেই কি হাদিয়া হিসেবে পশু জমা দিতে হবে?

উত্তর : হাদিয়া যে শুধু পশু হতে হবে এমনটি বাধ্যতামূলক করা হয়নি।  বাস্তবেও এত পশু জবেহ করার কোনো দরকার নেই। এছাড়া বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জিনিসের সংকট থাকতে পারে, যেমন পোশাক বা চিকিৎসা সামগ্রী।  এমতাবস্থায় শুধু পশুকেই হাদিয়া দেয়ার শর্ত বাস্তবসম্মত নয়।

২. প্রশ্ন : যদি পশু ছাড়া অন্য কিছু হাদিয়া দেয়া গ্রহণযোগ্য হয়, তবে হাদিয়া কী হবে তা কে নির্ধারণ করে দেবে? আর কারো কারো ক্ষেত্রে হাদিয়া পেশ করতে সক্ষম না হওয়ার বিষয়টি কিভাবে ঘটতে পারে?

উত্তর : হাদিয়া পেশ করতে সক্ষম না হওয়ার কারণ হতে পারে হাদিয়া না পাওয়া অথবা হাদিয়া পেশ করার সামর্থ্য না পাওয়া। সামর্থ্যবান ব্যক্তিরাই হজ্জে আসার কথা।  কিন্তু যারা সাময়িক কোনো বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় সফর দীর্ঘ হয় এবং যারা অগ্রিম সফরে আসায় উমরা ও হ্জ্জ দুটোই করে তাদের ক্ষেত্রে সামর্থ্য হ্রাস পাওয়া অস্বাভাবিক নয়।  এছাড়া যেকোনোভাবে এমনটি ঘটতে পারে।  যদি হাদিয়া দেয়ার সামর্থ্য না থাকে কিন্তু হজ্জের যাতায়াতের সামর্থ্য থাকে সে ব্যক্তিও হ্জ্জ করার অধিকার পাবে। কারণ যে হাদিয়া দিতে পারে না তার জন্য বিকল্প বিধান দেয়া হয়েছে।

উলিল আমর বাস্তব প্রয়োজনানুসারে কুরবানির পশু ছাড়াও অন্যরূপ হাদিয়া দেয়ার আহবান জানাতে পারেন। সেক্ষেত্রে হাদিয়া দিতে না পারার অর্থ হবে কুরবানির পশু দিতে না পারা অথবা উলিল আমর নির্ধারিত হাদিয়াও দিতে না পারা। উলিল আমর অন্য কোনো হাদিয়া নির্ধারণ করতে পারলেও কুরবানির পশুও হাদিয়া হিসেবে বহাল থাকবে। কারণ কুরবানি হচ্ছে হজ্জের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য।

৩. প্রশ্ন : হাজীদের পক্ষ থেকে হাদিয়া হিসেবে জমা দেয়া প্রতিটি পশু জবেহ করতে হবে না প্রয়োজনসংখ্যক? একাধিক হাজী মিলে একটি পশু হাদিয়া দেয়ার সুযোগ আছে কি?

উত্তর : যথাস্থানে হাদিয়া জমা দেয়ার পর যারা আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কুরবানির ব্যবস্থা হবে। কারণ প্রত্যেক হজ্জকারীর পক্ষ থেকে একটি করে পশু জবেহ করতে হবে এমন কোনো বিধান দেয়া হয়নি।

যারা হাদিয়া হিসেবে পশু জমা দিবে তারা প্রত্যেকেই কি একটি পশু জমা দিতে হবে? এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে প্রত্যেক হজ্জকারীকে পশু হাদিয়া দেয়ার ক্ষেত্রে একাই একটি পশু হাদিয়া দিতে হবে এরূপ বিধান দেয়া হয়নি। তাই অবশ্যই কয়েকজন যৌথভাবে একটি পশু হাদিয়া দিতে পারবে। সাধারণত প্রচলিত রীতি হচ্ছে সর্বোচ্চ সাতজন মিলে একটি পশু হাদিয়া দিতে পারে। কিন্তু আল কুরআনে এরূপ কোনো ঊর্ধ্বসংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। সুতরাং কতজন মিলে একটি পশু হাদিয়া দিতে পারবে তা অনির্দিষ্ট। তবে যেন হাজীদের খাওয়ার ব্যবস্থা হয় ও অন্যদেরকে দেয়া যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই পশু জবেহের ন্যুনতম পরিমাণ নির্ধারিত হবে এবং তদনুযায়ী একেকটি সর্বোচ্চ শরীকসংখ্যা স্বয়ং নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। অবশ্য কেউ একাই এক বা একাধিক পশু হাদিয়া দিলে তাতে আপত্তি নেই।

আর হাদিয়া দিতে সমর্থ না হওয়া তথা হাদিয়া প্রদানে অংশগ্রহণকারী হওয়ার সামর্থ্য না থাকার প্রসঙ্গ থেকে বুঝা যায় যে, অংশগ্রহণকারীরা পরস্পর সমান হারে মূল্য পরিশোধ করতে হবে।

৪. প্রশ্ন : কুরবানি কি ১০ই জিলহজ্জ থেকে ১২ই জিলহজ্জের মধ্যেই করতে হবে? এ সময়সীমায় বিশ্বব্যাপী সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা কুরবানি করতে হবে কি?

উত্তর : কোন কোন তারিখে কুরবানির ব্যবস্থা করা হবে তা বাস্তব পরিস্থিতি সাপেক্ষে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বশীলগণ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।

সাধারণত জিলহজ্জ মাসে হাজীরা ১০-১২ তারিখে কুরবানি করার রীতি রয়েছে। তার সাথে সঙ্গতি রেখে বিশ্বব্যপী এ সময়কালে কুরবানি করার রীতি রয়েছে। তবে কুরআনে এই সময়সীমাকে নির্দিষ্ট করা হয়নি এবং সমগ্র পৃথিবীতে একই সময়কালে (১০-১২ জিলহজ্জ) কুরবানি করার কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি। অন্য কথায় বলা যায়, কুরআনে বিশ্বব্যাপী কুরবানির কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান নেই। এমনকি, কুরবানির জন্য কোনো নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকানার শর্তও দেয়া হয় নি, এবং নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তার উপর কুরবানিকে বাধ্যতামূলক করা হয় নি। 

৫. প্রশ্ন : যেহেতু কুরবানির স্থান কা’বার সন্নিকটে নির্ধারিত, তাহলে হাজীরা সেখানে হজ্জের সময়কালে কুরবানি করা ছাড়া অন্যত্র সেই সময়ে বা অন্য সময়ে কুরবানি করা সঙ্গত হবে কি? কুরবানি কি সারা বিশ্বে সর্বজনীনভাবে সামর্থ্যবানদের উপর একই সময়ে বা বিভিন্ন সময়ে সম্পাদনযোগ্য বাধ্যতামূলক বিধান?

উত্তর : কুরবানি করা (মানসাক) হজ্জের একটি আবশ্যক (ফরজ) কাজ। তবে প্রত্যেকে কুরবানি করা বাধ্যতামূলক নয়, বরং হজ্জের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কুরবানির জন্য জমাকৃত পশু থেকে প্রয়োজন অনুসারে কুরবানির ব্যবস্থা করবেন।

যারা হজ্জ করবেন তাদের পক্ষ থেকে হাদিয়া দেয়া পশুগুলোর মধ্য থেকে যেগুলো কুরবানি করা হবে তার জন্য নির্ধারিত স্থান প্রাচীন গৃহ তথা কা'বার সন্নিকটে। কিন্তু হজ্জকারী ছাড়া অন্যদের পক্ষ থেকে সামর্থ্য থাকলেও কুরবানি করা বাধ্যতামূলক নয়।

তবে যে কেউ যে কোনো দিন যে কোনো স্থানে কুরবানি করাতে কোনো নিষেধ নেই। যারা মনে করেন যে, প্রাচীন গৃহের সন্নিকটে মাহিল্লু (হাদিয়া জমা দেয়ার যথাস্থান) বলা হয়েছে বিধায় কুরবানির একমাত্র অনুমোদিত স্থান হচ্ছে মিনায় তাঁদের ধারণাটি সঠিক নয়। কারণ আয়াতটিতে কা’বায় পৌঁছানোর হাদিয়া এবং হজ্জ উপলক্ষে নুসুকের (কুরবানির) গবাদি পশুর যথাস্থানের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দেয়া হয়েছে মাত্র। এর মাধ্যমে মিনা ছাড়া সকল স্থানে কুরবানিকে নিষিদ্ধ হয়ে যায় না।

যদি হজ্জ ও কুরবানি ব্যবস্থাপনার সুবিধার জন্য কয়েকটি দিনকে কুরবানির জন্য নির্দিষ্ট করা হয় এবং বিশ্বজনীন সংহতি রক্ষা করে তথা যেদিন হাজীরা কুরবানি করে সেদিন অন্যান্য দেশেও কুরবানি করা হয়, তবে তাকে আপত্তিকর বলা যায় না। কিন্তু একই দিনে বিশ্বব্যাপী কুরবানি করাকে বাধ্যতামূলক বলে সাব্যস্ত করা যাবে না।

বস্তুত কুরবানির মূল উদ্দেশ্য হতে হবে ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি করা’। এর বিধানগত মূল দিক হলো, আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা এবং তা থেকে কুরবানিকারী ব্যক্তি নিজেও খেতে পারবে।

৬. প্রশ্ন : কুরবানির গোশতকে কি হুবহু তিন ভাগ করতে হবে, যার একভাগ নিজেদের জন্য, একভাগ আত্মীয়দের জন্য এবং একভাগ দরিদ্রদের জন্য? কুরবানির গোশতের বেশিরভাগ অংশ নিজেরা খেলে কি কোনো সমস্যা আছে?

উত্তর : কুরবানির গোশতকে তিন ভাগ করার বিষয়টি যেভাবে চর্চা করা হয়, হুবহু সেরূপ নয়। কুরআনে কুরবানির গোশত থেকে নিজে খাওয়া এবং আবেদনকারী দরিদ্র ও আবেদন জানায় না এমন দরিদ্রদেরকে খাওয়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে (দ্র. সূরা হজ্জ ২২:৩৬)। এ থেকে তিন ভাগ করার ধারণা এসেছে। বস্তুত হুবহু তিন ভাগ করতে হবে এমন নয়। বরং নিজেদের পাশাপাশি আরো দুই গ্রুপের লোকদেরকে যে খাওয়াতে হবে- সেটাই নির্দেশ। আর ঐ দুই গ্রুপের মধ্যে আত্মীয় ও অনাত্মীয় উভয়েই থাকতে পারে। নিজেদের জন্য রাখার চেয়ে বেশির ভাগ বিতরণ করা কুরবানির প্রেরণার সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ।

৭. প্রশ্ন : কুরবানির পশু কেমন হতে হবে, কতজন শরিক থাকতে পারবে, কুরবানির সময় কি বলতে হবে ইত্যাদি যেসব বিধি-বিধান বলা হয়ে থাকে, সেগুলোর সঠিকত্ব কতটুকু?

উত্তর : কুরবানির বিধিবিধান হিসেবে যেসব শর্তাদি লেখা হয়ে থাকে, এগুলো কুরআন বহির্ভূত বিধি-বিধান। এগুলোকে বিধান হিসেবে বাস্তবায়ন না করে, কুরবানি সম্পর্কিত কিছু পরামর্শ বলা যেতে পারে। এই নিয়মগুলো বাধ্যতামূলক নয়। শুধু কুরবানি উপলক্ষে নয়, বরং যেকোনো সময় পশু জবেহকালে তার উপর আল্লাহর নাম নিতে হবে, অন্যথায় তা হালাল হবে না, যদি আল্লাহর নাম না নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিতভাবে জানা যায়।

৮. প্রশ্ন : আল্লাহ  কুরবানীর গোসত নিজে আহার করতে ও দু:স্থ, অভাবগ্রস্থকে আহার করাতে বলছেন। আল্লাহ কি গোসত রান্না করে খাওয়াতে বলেছেন নাকি বিলাতে বলেছেন? যদি রান্না করে খাওয়াতে বলেন তাহলে গোসত বিলিয়ে দিলে হাজিদের কুরবানি সম্পূর্ণ হবে কিনা?

উত্তর : আল্লাহ কুরবানির গোশত নিজেরা খেতে এবং আবেদনকারী হয় ও হয় না এ উভয় শ্রেণির অভাবীদেরকে খাওয়াতে বলেছেন। তা রান্না করে করা হোক বা রান্না ছাড়া গোশত বিতরণের মাধ্যমে করা হোক। কারণ গোশত বিতরণ করলে ঐ গোশত যে পাবে সে নিজে রান্না করে খেলে তাতেও সে গোশত খাওয়া হয় এবং তার কাছে বিতরণের মাধ্যমে বিতরণকারী তাকে গোশত খাওয়ানো হয়।

এই যে রান্না করে খাওয়াতে হবে কিনা নাকি কাঁচা গোশত বিতরণ করলে চলবে- এ ধরনের বিধান কুরআনের উদ্দেশ্য নয়, বরং কুরআন মানুষকে মৌলিক নির্দেশনা দেয়, তারপর যেভাবে তা পালন করা সময়-সুযোগ ও পরিবেশের চাহিদা সেই অনুযায়ী বিবেকসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেয়া মানুষের কর্তব্য- যা বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে বিভিন্নরূপ হতে পারে। এটাই কুরআনের বিধানের প্রকৃতি। প্রচলিত ধর্মজীবীরাই মানুষের জন্য বিধানকে কঠিন বা জটিল করে তোলে।

৯. ওয়াজ বা খুতবায় কুরবানির ফজিলত সম্পর্কে কিছু হাদিস বয়ান করা হয়, যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন। যেমন- (ক) কুরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা কবুল হয়ে যায়, (খ) কুরবানির পশুর প্রত্যেকটি পশমের জন্য একটি করে সওয়াব পাওয়া যায়, (গ) কুরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কাজ আল্লাহর নিকট আর কিছুই নেই, (ঘ) যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না, সে ঈদগাহের কাছেও না আসে।

উত্তর : নিম্নে বক্তব্যগুলোর পর্যালোচনা করা হলো-

ক) কুরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা কবুল হয়ে যাওয়ার কথাটি গ্রহণযোগ্য নয় এবং রসূল তা বলেন নি। কারণ, কুরআন অনুযায়ী, আল্লাহর নিকট কুরবানির পশুর রক্ত ও গোশত পৌঁছায় না, বরং যদি কুরবানির মাধ্যমে তাকওয়া বা স্রষ্টা-সচেতনতা অর্জিত হয়, তাহলে সেই তাকওয়া পৌঁছে বা মূল্যায়নযোগ্য হয় (দ্র. সূরা হজ্জ ২২:৩৭)। সুতরাং কুরবানি করলেই তা কবুল হতে পারে না, বরং তা দ্বারা যদি তাকওয়া বা স্রষ্টা-সচেতনতা অর্জিত হয়, তাহলেই কেবল কুরবানি কবুল হয় বা ফলপ্রসূ হয়।  

খ) কুরবানির পশুর প্রত্যেকটি পশমের জন্য একটি করে সওয়াব পাওয়ার ধারণাও কুরআনসম্মত নয়। কুরআন অনুযায়ী, কোনো ভালো কাজের সামগ্রিক মূল্যমানের দশগুণ পুরস্কার রয়েছে। একটি ভালো কাজের প্রকৃত মূল্যায়নের জন্য সেই কাজের পেছনে থাকা নিষ্ঠার মান বিবেচ্য হয়ে থাকে। সুতরাং দুজন ব্যক্তির কুরবানি কবুল হওয়া সত্ত্বেও উভয়ের কাজের ধরন অনুসারে মানগত মাত্রা ভিন্ন হতে পারে। কুরবানির পশুর পশম সংখ্যার সমান সওয়াব পাওয়ার ধারণাতে এই বিষয়টি অনুপস্থিত, বরং প্রত্যেক আমলকারী সমানভাবে সওয়াব পাওয়ার, এমনকি নিষ্ঠা বেশি হওয়া সত্ত্বেও যে পশু কুরবানি করা হয়েছে তার পশমসংখ্যা কম হওয়ায় কম সওয়াব পাওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই ‘ন্যায়বিচার’ হিসেবে সাব্যস্ত হয় না। সুতরাং হাদীসটি রসূলের নামে বানানো কথা এবং এর উদ্দেশ্য ইসলমাকে অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্মে পরিণত করা।

গ) কুরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কাজ আল্লাহর নিকট আর কিছুই নেই- কথাটি গ্রহনযোগ্য নয়, (অর্থাৎ রসূল বলেন নি)। কারণ, কুরআনে এরূপ কোনো তথ্য নেই, এমনকি কুরআনে কোনো ‘কুরবানির দিন’ নির্ধারণ করা হয়নি। কুরবানি কোনো বিশ্বজনীন ‘ফরজ’ নয়, বরং এটা হজ্জের সময় ও নির্দিষ্ট স্থানে আবশ্যকভাবে পালনীয়, অন্যত্র সাধারণভাবে নির্ধারিত একটি ব্যবস্থা, যেক্ষেত্রে কোনো সময়কে নির্দিষ্ট করা হয়নি এবং প্রতি বছর পালন করারও কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। এমনকি প্রচলিত হাদীস বা ফিকাহ অনুসারেও এটাকে বিশ্বব্যাপী পালনীয় কোনো ‘ফরজ’ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয় না। এমতাবস্থায়, কুরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করা সবচেয়ে উত্তম কাজ হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে না। আর কুরবানির মাধ্যমে নিজেকে পবিত্র করার কোনো ধারণাও কুরআন বহির্ভূত ধারণা।

ঘ) যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না, সে ঈদগাহের কাছে আসতে নিষেধাজ্ঞাও গ্রহণযোগ্য নয়, (অর্থাৎ রসূল বলেন নি)। কারণ, সামর্থ্যবান ব্যক্তি মাত্রই কুরবানি করতে হবে- এমন কোনো নির্দেশ নেই। এছাড়া ঈদ পালন বা ঈদগাহে সমাবেশও কোনো ধর্মীয় বিধান নয়, একটি প্রচলিত রীতি মাত্র। এমতাবস্থায়, ঈদগাহে সম্মেলনে অংশগ্রহণ থেকে কাউকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার অর্থ হলো- কুরবানিকে বাধ্যবাধকতা হিসেবে আরোপ করা। একটি ঐচ্ছিক কাজে অংশগ্রহণ না করার ফলে কোনো সম্মেলনে বাধাদান মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের পরিপন্থি।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায় যে, কুরআনে কুরবানি সম্পর্কিত বিধানের সারকথা হলো- হজ্জ সম্পাদনের সময় নির্দিষ্ট স্থানে (কা’বার সন্নিকটে বা নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায়) আল্লাহর নাম নিয়ে পশু উৎসর্গ করতে হবে, ঐ পশুগুলোর রক্ত ও গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছবে না, বরং এ নির্দেশ পালনের মাধ্যমে আল্লাহ সচেতনতা তৈরি হলে সেটাই আল্লাহর কাছে পৌঁছবে। তাই ঐ উৎসর্গিত পশুর গোশতের বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, তা থেকে নিজেরা খেতে হবে এবং যারা আবেদন করে না ও যারা আবেদন করে উভয় শ্রেণির মানুষকে তা থেকে খাওয়াতে হবে।

পরিভাষা 

আল বাইতুল হারাম  الْبَيْتَ الْحَرَامَ : আল বাইতুল হারাম শব্দের অর্থ হলো ‘সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠান’। কুরআনে কা’বাকে আল বাইতুল হারাম বলা হয়েছে। আল বাইতুল হারাম হলো মানবজাতির স্রষ্টার নির্দেশিত বিধান মোতাবেক সমষ্টিগত জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত প্রতিষ্ঠান। বস্তুত এটিই হলো মানবজাতির বিশ্বকেন্দ্র। এটি তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ও চিহ্নিত।

আল মাসজিদুল হারাম  الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ : আল মাসজিদুল হারাম শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘সংরক্ষিত মাসজিদ’। কা’বাকে কেন্দ্র করে কা’বার প্রাঙ্গনে যে মাসজিদটি রয়েছে তাকে আল মাসজিদুল হারাম বলা হয়। সাধারণত মনে করা হয় মাসজিদ মানে কোনো ভবন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাসজিদ হলো যেখান থেকে কার্যাদি পরিচালনার সাথে জড়িত যাবতীয় ব্যবস্থাপনা করা হয়। সুতরাং মাসজিদ হলো প্রতিষ্ঠান। কুরআনে মুনাফিকদের কর্তৃক নির্মিত ষড়যন্ত্রের মাসজিদের (মাসজিদে দিরার) এর প্রসঙ্গও আলোচিত হয়েছে, যাকে মু’মিনদের বিরুদ্ধে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিলো। সুতরাং মাসজিদ এর ধারণা বুঝতে হলে এই ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের ধারণা থাকতে হবে। মাসজিদ একই সাথে চুক্তি করার স্থান, স্বাক্ষগ্রহন, বিচার ও বিচারের রায় প্রাদনের স্থান হিসেবে কুরআনে পরিচিতি পেয়েছে যা এ নিদের্শ করে যে এটি মুসলিমদের প্রশাসনিক কেন্দ্রের কার্যনির্বাহি স্থান। আল মাসজিদুল হারামকে মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্র বা ক্বিবলাহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। হজ্জের কার্যাদির ব্যবস্থাপনাও আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনার অংশ। আল মাসজিদুল হারাম হলো মানবজাতির মধ্যে শান্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণকর্মের সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে নির্ধারিত কুরআন নির্দেশিত সাংবিধানিক কেন্দ্র। এটিকে সাংবিধানিক কেন্দ্র হিসেবে মর্যাদার সাথে গ্রহণ করে বাস্তব সুবিধার ভিত্তিতে যে কোথাও থেকে নির্বাহী কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে বা বলা যায়, নির্বাহী পরিচালনা কেন্দ্র (সেকেন্ডারি কেন্দ্র) হিসেবে যে কোথাও থেকে কার্যক্রম পরিচালনার অবকাশ রয়েছে। তবে হজ্জ ব্যবস্থাপনা এবং মূল ক্বিবলার জন্য আল মাসজিদুল হারামকে গ্রহণ করতে হবে।

উমরাহ  عُمْرَة : উমরাহ শব্দটির শব্দমূল অনুসারে এর অর্থ হলো ’বয়স অতিবাহিত করা, বসবাস করা, পরিদর্শন করা, পরিভ্রমণ করা’। উমরাহ বিষয়টিকে হজ্জের অনুরূপভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, পার্থক্য হলো, হজ্জের মাসসমূহ ছাড়া অন্য মাসে হজ্জের অনুষ্ঠানাদি সম্পাদান করাকে উমরাহ বলা হয়। সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ও ব্যবস্থাপনার কারণে হজ্জ ও উমরাহর মধ্যে হজ্জ অগ্রাধিকার পায়। অন্য কথায়, হজ্জ মূল দায়িত্ব এবং উমরাহ আনুষঙ্গিক দায়িত্বস্বরূপ।

কা’বা  كَعْبَة : কা’বা শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘টাখনু’। যেমন আমরা ওজু করার সময় দুই পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধৌত করতে হয়, এক্ষেত্রে দুই পায়ের টাখনু বুঝাতে ‘কা’বা’ শব্দের দ্বিবচন ‘কা’বায়নি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। শারীরিকভাবে টাখনু মানুষের ভরকেন্দ্র বা ভারসাম্যের অঙ্গ, আর দ্বীনের ক্ষেত্রে কা’বার ভূমিকা তেমনি মানবসমাজের কল্যাণ ও নিরাপত্তার মাধ্যমে শান্তির ভারসাম্য কেন্দ্র। মানবজাতির জন্য যে কা’বা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তা হলো ‘আল বায়তুল হারাম’। অর্থাৎ এক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠানকে কা’বা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মানবজাতিকে একত্ববাদী উপাসনার কেন্দ্রে আবর্তিত রাখার জন্য এবং মানবজাতির প্রতি একত্ববাদের হিদায়াত এবং সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা হিসেবে। হজ্জ মানেই হলো আল বায়ত তথা কা’বার হজ্জ অনুষ্ঠান। হজ্জের সময় এ প্রতিষ্ঠানে তাওয়াফ বা আবর্তন করতে হয়।

ক্বালায়িদ  قَلَائِد : ক্বালায়িদ (একবচনে ক্বিলাদাহ) এর প্রধান দুটি অর্থ হলো, (১) কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যোগাযোগ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিস্বরূপ ঘাড়ে বা কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়া বেল্টধারী বা ব্যাজধারী প্রতিনিধি। এই অর্থে আধুনিক পরিভাষায় এর একটি অর্থ হলো ‘রাষ্ট্রদূত’। (২) গলায় মালা পরানো কুরবানির বা মানতের পশু। কুরবানির পশুগুলো হাদিয়ার অন্তর্ভুক্ত। কুরআনে হাদিয়াকে যথাস্থানে (মাহিল্লুতে) জমা দেয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ক্বালায়িদের প্রসঙ্গে তা বলা হয়নি। কুরআনে শব্দটির প্রয়োগ পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, এতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বা প্রতিনিধি ও ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধিদেরকে বুঝাতে ক্বালায়িদ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ক্বালায়িদ সম্পর্কে কুরআনের নির্দেশনা হলো, তাদেরকে অবমাননা করা যাবে না, অন্য কথায় তাদেরকে যথাবিহিত সম্মান ও বিশেষাধিকার (due protocol) দিতে হবে। ক্বালায়িদের নির্দেশনা দেয়ার পেছনে মানবজাতিকে কল্যাণের উপর প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

নুসুক, মানাসিক (কুরবানী)  نُسُك : নুসুক ও এর প্রতিশব্দ মানসাক এর অর্থ হলো ‘ধর্মীয় ও সামাজিক সংহতিমূলক রীতিনীতি’। নুসুক এর বহুবচন হলো ‘মানাসিক’। প্রচলিতভাবে নুসুক, মানসাক বা মানসিক শব্দটিকে ‘কুরবানি’ শব্দে অনুবাদ করা হয়। হজ্জের একটি মানসাক হিসেবে কুরবানি করতে হয়। কুরবানির পশুর গোশত ও রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না কিন্তু কুরবানির উদ্দেশ্য হিসেবে কার্যকর আল্লাহ সচেতনতাই তাঁর নিকট পৌঁছে। কুরবানির সাথে সম্পর্কিত আল্লাহ সচেতনতার কিছু দিক হলো আল্লাহর দেয়া নেয়ামত তাঁর নির্দেশনা অনুসারে কাজে লাগানো, আল্লাহ প্রদত্ত অধিকারের ভিত্তিতে আল্লাহর নাম নিয়ে পশু জবেহ করা এবং তার গোশত থেকে নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি যারা আবেদন করে না এবং যারা আবেদন করে এই উভয় শ্রেণির অভাবীদেরকেও তা থেকে খাওয়ার ব্যবস্থা করা। কুরবানির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক হাজীর খাদ্যসংস্থানের ব্যবস্থা যেমন হয় তেমনি একটি উপলক্ষ্যে আশপাশের অভাবীদেরকেও খাদ্য সহায়তা দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

সদাক্বাহ  صَدَقَة : সদাক্বাহ শব্দটির শব্দমূল ‘সদ দাল ক্বফ’ এর অর্থ হলো ‘সত্য বলা, সত্য করা, সত্য সাব্যস্ত করা, সত্য প্রতিপাদন করা, দান সদাকাহ করা’। তাই উৎপত্তিগত অর্থ অনুসারে সদাকাহর তাৎপর্য হলো ‘সত্য ব্যবস্থাকে মেনে নেয়ার প্রমাণস্বরূপ বিশেষ আর্থিক প্রদেয় যা (যেই প্রদেয়) কিছু বিশেষ ধারার মাধ্যমে প্রযুক্ত হয় এবং কিছু বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত প্রাপককে প্রদান করতে হয়। হজ্জের সময় যারা হাদিয়া জমা দেয়ার যথাস্থানে হাদিয়া পৌঁছানোর পূর্বে অসুস্থতা বা মাথায় কষ্ট থাকার কারণে মাথামুণ্ডন করবে তাদেরকে ফিদইয়াস্বরূপ সিয়াম করা বা সদাক্বাহ দেয়া বা নুসুক (কুরবানি) করার বিধান দেয়া হয়েছে।

হাজ্জ  حَجُّ : হজ্জ শব্দের অর্থ হলো ‘যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সমাধান করা, সম্মেলন করা, সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা, একই বিন্দুতে মিলিত হওয়া, কোনো কিছুর উদ্দেশ্য স্থির করা, তীর্থস্থানে যাওয়ার ইচ্ছা করা’। আল কুরআনে বর্ণিত সময়ে ও নিয়মে কা’বায় উপস্থিত হয়ে সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পরিপালন করাকে হজ্জ বলে। হজ্জে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার জন্য আলোচনা ও যুক্তি উপস্থাপন (হুজ্জাত) করা সঙ্গত কিন্তু দুই অনমনীয় পক্ষে বিভক্ত হয়ে বিতর্ক (জিদাল) করা সঙ্গত নয়। হজ্জ হলো মূলত মানবজাতির কল্যাণে বিশ্বপ্রভুর নির্দেশিত ও তাঁর নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক বিশ্ব সম্মেলন। হজ্জের যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি এই উদ্দেশ্যের দিকে লক্ষ রেখে সম্পাদন করা উচিত, অন্যথায় তা নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হবে।

হাদইয়া / হাদিয়া  هَدْيَ : হাদিয়া অর্থ ‘উপহার, উপঢৌকন’।  হজ্জ সম্পাদনের জন্য হাজীদেরকে কা’বায় হাদিয়া পৌঁছাতে হয়। হাদিয়ার মধ্যে অন্যতম হাদিয়া হলো কুরবানির পশু। কিন্তু কুরবানির পশু ছাড়াও আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত কোনো বিকল্প হাদিয়া বা নিজের সাধ্য ও সুবিধামতো কোনো হাদিয়া দেয়া যেতে পারে। বাস্তব পরিস্থিতি অনুসারে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রস্তাবিত ন্যুনতম মূল্যের হাদিয়াও যদি দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে যারা আল মাসজিদুল হারামের এলাকায় বসবাস করে না এরুপ হাজীদেরকে হজ্জের মধ্যে তিনদিন এবং বাড়ি ফেরার পর সাতদিন সিয়াম পালন করতে হবে।


শওকত জাওহার

রিসার্চ ফেলো, দি ইক্বরা

Other Resources:

Sacrifice in Ancient Israel

Sacrifice and the Old Testament

Korban

পশু কুরবাণী প্রসঙ্গে কুরআনের পাঠ ও চিন্তা

কোরবানি: বাইবেলে ও কোরানে

ট্যাগ / কী-ওয়ার্ড:

অন্যান্য প্রবন্ধ

May 30, 2025
প্রচলিত কুরবানি: কুরআন থেকে পর্যালোচনা

কুরআনের সরল বিধান ও ধর্মাচারবাদিদের জটিলতা কুরআনে সরলভাবে বিভিন্ন বিধান দেয়া হয়েছে, যা পালনের ক্ষেত্রে বিবেকবুদ্ধির প্রয়োগ অনুসারে যেভাবে উত্তম হয় সেভাবে সম্পাদন করাই স্বাভাবিক। কিন্তু ধর্মাচারবাদিরা কোনো বিধান পালনের সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি বিষয়কে সুনির্দিষ্ট করতে চেয়ে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করে। কুরআনের শুরুর দিকে সূরা বাক্বারাহতেই এ বিষয়ে বানী ইসরাইলের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে শিক্ষা দেয়া […]

May 16, 2025
Explaining the Qur'an through the Qur'an

Introductory presentation for a series applying the intratextual approach to the exegesis of Surat al-An'am, here on CASQI's channel.

May 3, 2025
কুরআনকে কি সংবিধান বলা যেতে পারে?

সাধারন ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যে একটি কমন ধারনা হলো: ইসলামের সংবিধান হলো কুরআন এবং আধুনিক সময়ে যেসব সেকুলার সংবিধান করা হয় তা হলো "তাগুত"। বিষয়টি কি সত্যিই এরকম সাদা কালো? কুরআন কি সংবিধানি? একজন ইসলামে বিশ্বাসীর পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে এই প্রশ্নের মিমাংসায় পৌছতে হলে আমাদের প্রথমে কয়েকটি কনসেপ্ট ক্লিয়ার করে এগুতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে […]

May 2, 2025
কোরআন বোঝা কি কঠিন?

মুসলিমদের জীবন বিধানের সকল মূলনীতি কোরআনে আল্লাহ বলে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তোমার ওপর যে কিতাব (কোরআন) নাজিল করা হয়েছে ‎তাতে রয়েছে সকল বিষয়ের বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৮৯) দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ দেশের মুসলিমদের কোরআন দেখে শুদ্ধ করে পড়ার প্রতি গুরুত্ব থাকলেও ইসলামি জীবন বিধানের মৌলিক উৎস […]

April 15, 2025
সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার : কুরআনে সামাজিক মূল্যবোধ

১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ যে মূলনীতিসমূহ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে এবং ২০২৪ সালে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য যে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ কর্তৃক পেশ করা হয়েছে তাতে অন্যতম তিনটি মূলনীতি হলো, ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’। বস্তুত এই মূলনীতিসমূহ […]

April 11, 2025
নাসর হামিদ আবু যায়েদ - একজন আধুনিক কুরআন স্কলারের কর্ম-পরিচিতি

নাসর হামিদ আবু যায়েদ: এক মুক্তচিন্তার কুরআন গবেষকের জীবনচিত্র পূর্ণ নাম: নাসর হামিদ আবু যায়েদ (Nasr Hamid Abu Zayd)জন্ম: ১০ জুলাই ১৯৪৩, তানতা, মিসরমৃত্যু: ৫ জুলাই ২০১০, কায়রো, মিসরপরিচয়: কুরআন গবেষক, সাহিত্য সমালোচক, ধর্মতাত্ত্বিক ও মুক্তচিন্তার ইসলামী চিন্তাবিদ 🎓 শিক্ষা ও পেশাজীবন নাসর হামিদ আবু যায়েদ কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা ও ইসলামি শিক্ষায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ […]

April 1, 2025
Recovering Orignal Qur’anic Vocabulary - How the Qur’an Evolved?

In this interview, the host discuss with Dr. Munther Younes of Cornell University to discuss his research on the transmission and evolution of the Qur'anic text. Dr. Younes is Reis Senior Lecturer of Arabic Language and Linguistics at Cornell University and a renowned expert in the Arabic language. They discuss the Arabic of the Qur'an, […]

March 30, 2025
রহমানের ভাষার নিয়ামত এবং নোম চমস্কির ইউনিভার্সাল ল্যাংগুয়েজ থিওরী

আর রহমান দয়াময় সত্তা আল্লামাল ক্বুরআন তিনি শিক্ষা দিয়েছেন পঠন ক্ষমতা খালাক্বাল ইনসান তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ আল্লামাহুল বায়ান তিনি তাকে শিক্ষা দিয়েছেন স্পষ্টভাবে বিবৃত করার ভাষা। - সুরা আর-রাহমান, আয়াত ১-৪ সুরা আর-রাহমান কুরআনের ৫৫তম সুরা এবং মুসলিমদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় একটি সুরা। এই সুরার সুচনায় আমরা মানুষের পাঠ করার ক্ষমতা এবং কথা বলার […]