এতিম শব্দটির অর্থ হচ্ছে নিঃসঙ্গ। ইসলামী পরিভাষায় যেসব শিশুসন্তানের বাবা ইন্তেকাল করেছেন, তাকে এতিম বলা হয়। কোরআনে এতিম শব্দটি একবচনে এসেছে আটবার। দ্বিবচনে এসেছে একবার। আর বহুবচনে এসেছে ১৪ বার। সে হিসাবে কোরআনে এতিম শব্দটি ২৩ বার ব্যবহৃত হয়েছে।
এতিমদের অধিকার রক্ষায় কুরআনে অনেক জায়গায় সতর্কবাণী উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, এতিমের ধন-সম্পত্তি তার কাছে পৌঁছে দাও। আর এর অর্থ হচ্ছে সে বালেগ হলেই কেবল তার কাছে তার গচ্ছিত মালামাল পৌঁছে দেয়া যেতে পারে।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
‘যখন আমি বনি ইসরাইলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো উপাসনা করবে না, বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, এতিম ও দীন দরিদ্রদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, মানুষকে সৎ কথাবার্তা বলবে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে এবং জাকাত দেবে, তখন সামান্য কয়েকজন ছাড়া তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে, তোমরাই অগ্রাহ্যকারী।’ (সূরা-বাকারা, আয়াত : ৮৩)।
‘সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ করবে; বরং বড় সৎকাজ হলো এই ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর, কিয়ামত দিবসের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং সব নবী-রাসূলের ওপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্মীয়স্বজন, এতিম-মিসকিন, মুসাফির-ভিুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যধারণকারী, তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী আর তারাই পরহেজগার।’ (সূরা-বাকারা, আয়াত-১৭৭)।
‘তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, কী তারা ব্যয় করবে? বলে দাও যে বস্তুই তোমরা ব্যয় করো, তা হবে বাবা-মায়ের জন্য, আত্মীয়-আপনজনদের জন্য, এতিম-অনাথদের জন্য, অসহায়দের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। আর তোমরা যেকোনো সৎ কাজ করবে, নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত ভালোভাবেই আল্লাহর জানা রয়েছে।’ (সূরা-বাকারা, আয়াত : ২১৫)।
‘দুনিয়া ও আখেরাতের বিষয়ে। আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, এতিম-সংক্রান্ত হুকুম। বলে দাও, তাদের কাজকর্মে সঠিকভাবে গুছিয়ে দেয়া উত্তম, আর যদি তাদের ব্যয়ভার নিজের সাথে মিশিয়ে নাও, তাহলে মনে করবে তারা তোমাদের ভাই। বস্তুত অমঙ্গলকামী ও মঙ্গলকামীদের আল্লাহ জানেন। আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে তোমাদের ওপর জটিলতা আরোপ করতে পারতেন। নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী, মহাপ্রাজ্ঞ।’ (সূরা-বাকারা, আয়াত : ২২০)।
‘এতিমদের তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দাও। খারাপ মালামালের সাথে ভালো মালামালের অদলবদল কোরো না। আর তাদের ধন-সম্পদ নিজেদের ধন-সম্পদের সাথে সংমিশ্রণ করে তা গ্রাস কোরো না। নিশ্চয়ই এটা বড়ই মন্দ কাজ।’ (সূরা-নিসা, আয়াত : ২)।
‘আর যদি তোমরা ভয় করো যে, এতিম মেয়েদের হক যথাযথভাবে পূরণ করতে পারবে না, তবে সেসব মেয়ের মধ্য থেকে যাদের ভালোলাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্কা করো যে, তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে একটি অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদের, এতে পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা।’ (সূরা-নিসা, আয়াত : ৩)।
‘আর এতিমদের প্রতি বিশেষভাবে নজর রাখবে, যে পর্যন্ত না তারা বিয়ের বয়সে পৌঁছে। যদি তাদের মধ্যে বুদ্ধি-বিবেচনার উন্মেষ আঁচ করতে পারো, তবে তাদের সম্পদ তাদের হাতে অর্পণ করতে পারো। এতিমের মাল প্রয়োজনাতিরিক্ত খরচ কোরো না বা তারা বড় হয়ে যাবে মনে করে তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলো না। যারা সচ্ছল তারা অবশ্যই এতিমদের মাল খরচ করা থেকে বিরত থাকবে। আর যে অভাবগ্রস্ত সে সঙ্গত পরিমাণ খেতে পারে। যখন তাদের হাতে তাদের সম্পদ প্রত্যর্পণ করো, তখন সাক্ষী রাখবে। অবশ্য আল্লাহই হিসাব নেয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট।’ (সূরা-নিসা, আয়াত : ৬)।
‘সম্পত্তি বণ্টনের সময় যখন আত্মীয়স্বজন, এতিম ও মিসকিন উপস্থিত হয়, তখন তা থেকে তাদের কিছু খাইয়ে দাও এবং তাদের সাথে কিছু সদালাপ করো।’ (সূরা-নিসা, আয়াত : ৮)।
‘যারা এতিমদের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করেছে এবং সত্বরই তারা অগ্নিতে প্রবেশ করবে।’ (সূরা-নিসা, আয়াত : ১০)।
‘আর উপাসনা করো আল্লাহর, শরিক কোরো না তাঁর সাথে অন্য কাউকে। বাবা-মায়ের সাথে সৎ ও সদ্ব্যবহার করো এবং নিকটাত্মীয়, এতিম-মিসকিন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্বিতজনকে।’ (সূরা-নিসা, আয়াত : ৩৬)।
‘তারা আপনার কাছে নারীদের বিবাহের অনুমতি চায়। বলে দিন আল্লাহ তোমাদের তাদের সম্পর্কে অনুমতি দেন এবং কুরআনে তোমাদের যা যা পাঠ করে শোনানো হয়, তা ওই সব পিতৃহীন নারীদের বিধান, যাদেরকে তোমরা নির্ধারিত অধিকার প্রদান কর না অথচ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করার বাসনা রাখ। আর অক্ষম শিশুদের বিধান এই যে, এতিমদের জন্য ইনসাফের ওপর কায়েম থাক। তোমরা যা ভালো কাজ করবে, তা আল্লাহ জানেন।’ (সূরা-নিসা, আয়াত : ১২৭)
‘এতিমদের ধনসম্পদের কাছেও যেয়ো না, কিন্তু উত্তম পন্থায় যে পর্যন্ত সে বয়ঃপ্রাপ্ত না হয়। ওজন ও মাপ পূর্ণ করো ন্যায়সহকারে। আমি কাউকে তার সাধ্যের অতীত কষ্ট দিই না। যখন তোমরা কথা বলো তখন সুবিচার করো, যদি সে আত্মীয়ও হয়। আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ করো। (সূরা-আল আনআম, আয়াত : ১৫২)।
‘আর এ কথাও জেনে রাখো যে, কোনো বস্তুসামগ্রীর মধ্য থেকে যা কিছু তোমরা গনিমত হিসেবে পাবে, তার এক-পঞ্চমাংশ হলো আল্লাহর জন্য, রাসূলের জন্য, তাঁর নিকটাত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং এতিম-অসহায় ও মুসাফিরদের জন্য; যদি তোমাদের বিশ্বাস থাকে আল্লাহর ওপর এবং সে বিষয়ের ওপর যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি ফয়সালের দিনে, যেদিন সম্মুখীন হয়ে যায় উভয় সেনাদল। আর আল্লাহ সব কিছুর ওপরই ক্ষমতাশীল।’ (সূরা-আল আনফাল, আয়াত : ৪১)
‘আর, এতিমের মালের কাছেও যেয়ো না, একমাত্র তার কল্যাণ আকাক্সা ছাড়া; সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যৌবনে পদার্পণ করা পর্যন্ত এবং অঙ্গীকার পূর্ণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সূরা-বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩৪)।
‘প্রাচীরের ব্যাপার সেটি ছিল নগরীর দু’জন পিতৃহীন বালকের। এর নিচে ছিল তাদের গুপ্তধন এবং তাদের বাবা ছিলেন সৎকর্মপরায়ণ। সুতরাং আপনার পালনকর্তা দয়াবশত ইচ্ছা করলেন যে, তারা যৌবনে পদার্পণ করুক এবং নিজেদের গুপ্তধন উদ্ধার করুক। আমি নিজ মতে এটা করিনি। আপনি যে বিষয়ে ধৈর্যধারণ করতে অক্ষম হয়েছিলেন, এই হলো তার ব্যাখ্যা।’ (সূরা-আল-কাহাফ, আয়াত ৮২)।
‘আল্লাহ জনপদবাসীর কাছ থেকে তাঁর রাসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর রাসূলের, তাঁর আত্মীয়স্বজনের, এতিমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্য, যাতে ধনৈশ্বর্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়। রাসূল তোমাদের যা দেন, তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো এবং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সূরা-আল হাশর, আয়াত : ৭)।
‘তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দীকে আহার্য দান করে।’ (সূরা-আদ দাহর, আয়াত : ৮)।
‘এতিম আত্মীয়কে অথবা ধূলিধূসরিত মিসকিনকে।’ (সূরা-আল বালাদ, আয়াত : ১৫)।
‘তিনি কি আপনাকে এতিম রূপে পাননি?’ (সূরা-আদ দুহা, আয়াত : ৬)। ‘সুতরাং আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না।’ (সূরা-আদ দুহা, আয়াত : ৯)
‘আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচার দিবসকে মিথ্যা বলে? সে সেই ব্যক্তি, যে এতিমকে গলাধাক্কা দেয়।’ (সূরা-আল মাউন, আয়াত : ২)।
কুরআনের এ আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায়, এতিমের হক রক্ষা করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
- ইমাম বাতায়নে প্রকাশিত আর্টিকেল
কুরআনে বনী ইসরাইলের প্রসঙ্গ উত্থাপন হয়েছে এতিম প্রসঙ্গে সুরা বাকারায়। দেখা যাক বনী ইসরাইলের কাছে সংরক্ষিত কিতাবে এতিম সম্পর্কে আমরা কি পাই - ইহুদী এনসাইক্লোপেডিয়া থেকে:
The Authorized Version, in all cases but one, renders "yatom," the Hebrew word for "orphan," by "fatherless"; the exception being in Lam. v. 3, where "yetomim" is rendered "orphans," the word being followed by the expression "and fatherless."
Orphans are represented throughout the Bible as helpless beings; and therefore the Pentateuch reiterates continually the command to render justice to orphans. In the contrary case their oppressor is to expect the severest punishment (see Exodus. xxii. 21-23, and elsewhere). God Himself is termed "the father of the fatherless" (Psalms. lxviii. 6 [A. V. 5]). When Job wished to point out the excessive wickedness of his companions he said: "Ye would overwhelm the fatherless" (Book of Job vi. 27). In other instances Job speaks of the wicked who are not afraid to commit injustice even toward orphans (ib. xxiv. 9; xxxi. 17, 21).
(Credit: Jewish Encyclopedia entry on Orphan)
অন্যান্য:
আল-কোরআনে এতিম প্রসঙ্গ
এতিম প্রতিপালন
কুরআনে এতিম শব্দের উল্লেখ - কুরআন করপাস