আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের সাথে সাংঘর্ষিক বিধান দিলে সেই বিধানদাতা কাফির হিসেবে গণ্য হয়। সুতরাং এরূপ কোনো ব্যক্তিকে উলিল আমর হিসেবে মেনে নেয়া বা তার আনুগত্য করা যাবে না। এছাড়া যে ব্যক্তি নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত যৌক্তিকতার ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং খামখেয়ালী, স্বেচ্ছাচারী, স্বৈরাচারী বা প্রবৃত্তির অনুসারী তারও আনুগত্য করা যাবে না। সুতরাং উলিল আমর হিসেবে মু’মিনদের আনুগত্য লাভের জন্য এগুলো অপরিহার্য শর্ত। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:
৭:৩ :: তোমরা তা-ই অনুসরণ করো যা তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে নাযিল করা হয়েছে এবং তা বাদ দিয়ে (তথা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের সাথে সম্পর্কহীন) বিভিন্ন আওলিয়ার (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) অনুসরণ করো না।
১৮:২৮ :: আর তোমার নিজেকে ধৈর্যশীল রাখো তাদের সাথে যারা তাদের প্রভুকে সকালে ও সন্ধ্যায় ডাকে তাঁর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায়। আর পার্থিব জীবনের শোভা ও চাকচিক্য কামনায় তাদের থেকে তোমার চোখ দুটো যেন তাদেরকে এড়িয়ে না যায়। আর তার আনুগত্য করো না যাকে আমরা আমাদের স্মরণ/স্মারক (কুরআন) থেকে উদাসীন করে দিয়েছি এবং সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে (খামখেয়ালি, স্বেচ্ছাচারী) এবং তার কার্যকলাপ সীমালঙ্ঘনমূলক।
২৬:১৫১-১৫২ :: আর তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী ও অপচয়কারীদের নির্দেশের আনুগত্য করো না, যারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং সংশোধনের কাজ করে না।
৪:২৯ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মতিভিত্তিক লেনদেন সম্পন্ন করা ছাড়া, অসঙ্গতভাবে তোমাদের পরস্পরের মালসম্পদ ভক্ষণ করো না। আর তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু।
উপরোল্লেখিত ৪:২৯ আয়াতে প্রদত্ত নির্দেশ অনুসারে সন্তোষজনক ক্ষতিপূরণের লেনদেন ছাড়া কারো সম্পদ অধিগ্রহণ করা যাবে না। এভাবে কুরআনে মু’মিনদেরকে যেসব নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে সেগুলো উলিল আমরকেও পালন করতে হবে। তিনি এমন কোনো নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন না, যা কুরআনে থাকা সুনির্দিষ্ট কোনো ধারা লঙ্ঘিত হয়। উদাহরণস্বরূপ কুরআনে ধর্মীয় স্বাধীনতার নির্দেশ রয়েছে, সুতরাং কোনো উলিল আমর কোনোরূপ অজুহাতে ঐ নির্দেশের বিপরীতে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার রাখেন না।
সুতরাং উলিল আমর আনুগত্য লাভের শর্ত হলো: তিনি কুরআনের সীমারেখা বা কোনো ধারা লঙ্ঘন করতে পারবেন না এবং স্বেচ্ছাচারী নির্দেশ প্রদান করতে পারবেন না, বরং তাঁর নির্দেশ ন্যায়সঙ্গত ও বাস্তবসম্মত উপযোগিতার প্রেক্ষিতে হবে।
কুরআনে মু’মিনদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে ‘শুনলাম ও মানলাম’ এর যে কথাকে তুলে ধরা হয়েছে তার প্রয়োগ কোন ক্ষেত্রে বা কীভাবে তা নির্ণয় করা জরুরি। কারণ এ বিষয়টিকে অনেকে অন্ধ আনুগত্য দাবি করার জন্য ব্যবহার করে থাকে। তাই নিম্নে এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা লাভের জন্য প্রাসঙ্গিক কিছু আয়াত উল্লেখ করা হলো:
২৪:৫১ :: নিশ্চয় মু’মিনদের কথা তো এই হয় যে, যখন তাদের মধ্যে ফায়সালা করার জন্য তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে আহবান করা হয় তখন তারা বলে, ‘আমরা শুনলাম ও মানলাম’। আর তারাই সফল।
২৫:৭৩ :: এবং যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিলে তার উপর অন্ধ এবং বধিরের মত (প্রতিক্রিয়ায়) পড়ে যায় না।
৯:৩১ :: তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ধর্মীয় পণ্ডিতদেরকে ও সন্ন্যাসীদেরকে তাদের বিধাতা বানিয়ে নিয়েছে এবং মারাইয়াম পুত্র মাসীহকেও। অথচ তাদেরকে এক ইলাহের ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করতে আদেশ দেয়া হয়নি। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তারা যে শিরক (অংশীদার স্থাপন) করে তা থেকে তিনি পবিত্র।
৩:৬৪ :: বলো, হে আহলে কিতাব আসো সেই কথার দিকে যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করবো না এবং তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করবো না এবং আমাদের একে অন্যকে বিধানদাতা (রব) হিসেবে গ্রহণ করবো না। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে বলো, তোমরা সাক্ষী থাকো যে, আমরা (আল্লাহর উদ্দেশ্যে) আত্মসমর্পিত।
উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মু’মিন ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে ডাকা হলে তাতে ‘শুনলাম ও মানলাম’ বলে। আর তা হয় যখন সত্যিই তাকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকেই ডাকা হয় তথা বিষয়টিতে আল্লাহর বিধানকে ও রসূলের কর্মনীতিকে যথারূপে তুলে ধরা হয়। বিষয়টির প্রায়োগিকতা এরূপ যে, মু’মিন ব্যক্তি আল্লাহর বিধান নামে কেউ তার নিকট কিছু বললেই আসলে আল্লাহ সে কথাটিই বলেছেন কিনা তা যাচাই ছাড়া বা আল্লাহর আয়াতের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবনের পূর্বেই দাবিকৃত বা অনুমানকৃত অর্থে তার প্রয়োগের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে বলা হয়নি, বরং প্রকৃতপক্ষে কথাটি আল্লাহর বাণীর সঠিক তাৎপর্য নাকি তাঁর বাণীর তাৎপর্য ভুলভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে তা যাচাই করে আসলে তিনি কী বলেছেন তা বুঝার পরই তাতে বিশ্বাস করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
অন্যদিকে যখন কেউ আল্লাহর বিধানের বাহিরে নিজে থেকে কোনো মূল বিধান জারি করে তখন তার ঐ বিধানকে মেনে নেয়ার অর্থ হলো তাকে রব বা বিধাতা বানানো। সুতরাং মু’মিনের ‘শুনলাম ও মানলাম’ এর বৈশিষ্ট্য আল্লাহর কিতাবের সীমারেখা সংরক্ষণ করে, এটি মু’মিনদের নির্বাহী নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের প্রতি অন্ধ আনুগত্যকে প্রকাশ করে না।
মানা বা আনুগত্যের ক্ষেত্রে কাদের নির্দেশ মানা বা আনুগত্য করা যাবে না তা ইতোপূর্বে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর শুনার ক্ষেত্রে নির্দেশনাটি কীরূপ বিষয় শুনার প্রসঙ্গে বা কোনো বিষয় শুনার পর সেক্ষেত্রে কীরূপ কর্মনীতি অবলম্বনের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে তা নিম্নের আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যেতে পারে:
৩:১৯৩ :: ‘হে আমাদের রব, নিশ্চয় আমরা শুনেছি একজন আহবানকারীকে, যে ঈমানের দিকে আহবান করে যে, ‘তোমরা তোমাদের রবের প্রতি ঈমান আন’। তাই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করুন এবং বিদূরিত করুন আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি, আর আমাদেরকে মৃত্যু দিন নেককারদের সাথে’।
৪:১৪০ :: আর তিনি কিতাবের মধ্যে তোমাদের জন্য নাযিল করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে যে আল্লাহর আয়াতের প্রতি কুফর করা হচ্ছে এবং তার প্রতি উপহাস করা হচ্ছে, তাহলে তাদের সাথে বসবে না যতক্ষণ না তারা তা ভিন্ন অন্য বিষয়ের আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়, অন্যথায় তোমরা নিশ্চয় তখন তাদের মতো হয়ে যাবে। নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদেরকে ও মুনাফিকদেরকে একত্রিতভাবে জাহান্নামে একত্র করবেন।
৩১:৭ :: আর তার কাছে যখন আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন সে অহংকারে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে শুনতে পায়নি, তার দু’কানে যেন বধিরতা; সুতরাং তাকে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও।
৩৬:২৫ :: ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের রবের (প্রতিপালক, বিধাতা) প্রতি ঈমান এনেছি, অতএব তোমরা আমার কথা শোন’।
৪৫:৮ :: যে আল্লাহর আয়াত শোনে যা তার সামনে পাঠ করা হয়, অতঃপর অহমিকার সাথে (কুফুরীর উপর) থাকে যেন সে তা শোনেইনি; কাজেই তাকে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও।
৭২:১৩ :: আর যখন আমরা হিদায়াত (পথনির্দেশ) শুনেছি, তখন আমরা উহার প্রতি ঈমান এনেছি। যে তার রবের (প্রতিপালক, বিধাতা) প্রতি ঈমান আনে, সে (সৎকর্মের প্রতিফলের ক্ষেত্রে) ক্ষতির ভয় করবে না, দ্বিধান্বিত/বিব্রতও হবে না।
৭:২০৪ :: আর যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শুনো এবং চুপ থাকো, যেন তোমাদের প্রতি রহমত (অনুগ্রহ) করা হয়।
৩৯:১৮ :: যারা মনোযোগ দিয়ে কথা শুনে, তারপর তার সর্বোত্তমটিকে অনুসরণ করে, তারাই এমন লোক যাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত দিয়েছেন। আর তারাই চিন্তাশক্তির প্রয়োগকারী।
১. আনুগত্য ও বাইয়াত এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষা : ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিক গুণাবলির পার্থক্যের কারণে আনুগত্যে ব্যতিক্রম হতে পারবে না, শুধুমাত্র আল্লাহর নাফরমানি ছাড়া কোনো কারণে আনুগত্য ত্যাগ করা যাবে না- যতক্ষণ পর্যন্ত পরামর্শভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোনো ব্যক্তি নেতৃত্বের অবস্থানে থাকে। উলিল আমরের প্রতি আনুগত্যের বিষয়ে বাইয়াতের প্রয়োজন রয়েছে যেন আনুগত্য প্রকাশকারীদের মধ্যে সংঘবদ্ধতা সহজ হতে পারে। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াত লক্ষণীয়:
৪:৫৯ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রসূলের ও তোমাদের মধ্য থেকে হওয়া উলিল আমরের (আমীরের/ সমষ্টিগত পরিচালনার দায়িত্বশীল নেতার), তারপর যদি কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে তানাযা/ মতবিরোধ হয়, তাহলে তার সমাধানের জন্য ফিরিয়ে দাও আল্লাহর দিকে এবং তাঁর রসূলের দিকে, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রেখে থাকো। এটাই উত্তম (কর্মপদ্ধতি) এবং পরিণামে সর্বোত্তম।
৬০:১২ :: হে নবী, যখন তোমার কাছে মু’মিন নারীরা এসে বাইয়াত (শপথ) করে এ মর্মে যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক (অংশীদার সাব্যস্ত) করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তাদের সন্তানকে হত্যা করবে না, এবং মিথ্যা দাবি (বুহতান) নিয়ে আসবে না যা তারা রচনা/সংঘটিত করে তাদের হাতসমূহ ও পাসমূহের মধ্যবর্তীতে (অর্থাৎ স্বামীর সন্তান হিসেবে অন্যের সন্তানকে নিয়ে আসবে না), ন্যায়সঙ্গত ক্ষেত্রে তোমাকে অমান্য করবে না, তখন তাদের বাইয়াত গ্রহণ করো এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
২. তথ্য সরবরাহ ও পরামর্শ প্রদান এবং নিজস্ব মত ও মর্জির চেয়ে ‘ইস্তিম্বাতকারী পরিষদকে’ অগ্রাধিকার দেয়া এবং নির্বাহী গোপনীয়তা রক্ষা করা। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:
৪:৮৩ :: আর যখন তাদের কাছে আসে নিরাপত্তার অথবা আশংকার কোনো বিষয়, তখনি তারা তা প্রচার করতে থাকে। অথচ যদি তারা তা পৌঁছে দিতো রসূলের দিকে এবং তাদের মধ্য থেকে হওয়া উলিল আমরের দিকে, তাহলে তা জানতে পারতো তাদের মধ্য থেকে থাকা ঐ ব্যক্তিরা যারা তথ্য যাচাই করে সঠিক সুপারিশ প্রণয়ন করতে পারে, আর যদি তোমাদের উপর আল্লাহর (ব্যাপক) অনুগ্রহ ও দয়া না থাকতো তাহলে তোমরা শয়তানের অনুসরণ করতে, অল্প কয়েকজন ছাড়া।
৩:১১৮ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা তোমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু বা নির্বাহী গোপনীয়তার অংশীদার করো না তোমাদের নিজেদেরকে (তথা মু’মিনদেরকে) ছাড়া অন্যদেরকে। তারা তোমাদের বিপন্ন করার কোনো সুযোগই ছাড়ে না। তারা তা-ই কামনা করে যা দ্বারা তোমরা দুঃখ-কষ্টে পড়ো। নিশ্চয় তাদের মুখের কথায় তাদের বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে। আর তারা তাদের মনে যা গোপন রেখেছে তা আরো বড় ধরনের (বিদ্বেষপূর্ণ)। নিশ্চয় আমরা আমাদের আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করি যেন তোমরা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করতে পারো।
৩. নিরাপত্তা : মু’মিনরা সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে। সুতরাং উলিল আমর যেমন অনুগতদের জন্য নিরাপত্তা প্রাচীর তৈরি করবেন, তেমনি অনুগতরাও উলিল আমরের জন্য নিরাপত্তা প্রাচীর তৈরি করবেন। এছাড়া মু’মিনদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলা হয়েছে যে, তারা নিজেদের প্রাণের চেয়ে রসূলের প্রাণকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। উলিল আমরের কুরআনের আলোকে মু’মিনদেরকে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে রসূলের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। তাই উলিল আমরের জীবন রক্ষায়ও এরূপ গুরুত্ব দেয়া উচিত। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:
৬১:৪ :: নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা তাঁর পথে (তাঁর বিধান বাস্তবায়নের ও জুলুম প্রতিরোধের জন্য) সারিবদ্ধভাবে (ঐক্যবদ্ধ ও শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে) যুদ্ধ করে, যেন তারা সীসাঢালা প্রাচীর।
৯:১২০ :: আহলে মদীনার/ শহরবাসীদের জন্য সঙ্গত নয় এবং তাদের চারপাশের আ’রববাসীদের জন্যও সঙ্গত নয় যে, তারা রসূলের সহযাত্রী হওয়া থেকে পিছনে সরে থাকবে। আর এটাও সঙ্গত নয় যে, তারা গুরুত্ব দেবে তাদের নিজেদের জানপ্রাণকে তার (রসূলের) প্রাণের চেয়ে বেশি। তা এজন্য যে, আল্লাহর পথে তাদের এমন তৃষ্ণা হয় না এবং এমন শারীরিক শ্রমও হয় না এবং এমন ক্ষুধাও হয় না, আর তারা এমন পদক্ষেপও নেয় না যা কাফিরদেরকে ক্রোধান্বিত করে আর তারা কোনো শত্রু থেকে কোনো প্রতিশোধও নেয় না, এছাড়া যে, তাদের জন্য তা সৎকর্ম হিসেবে লেখা হয়। নিশ্চয় আল্লাহ উত্তম কর্মসম্পাদনকারীদের প্রতিফল নষ্ট করেন না।
৪. জবাবদিহিতা ও সমালোচনার যৌক্তিক পদ্ধতি অবলম্বন : উলিল আমরের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখা প্রয়োজন। কিন্তু জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, প্রতিটি সিদ্ধান্তের সকল যৌক্তিকতা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করার পীড়াপীড়ি থাকা উচিত নয়, কারণ তা নির্বাহী গোপনীয়তার লঙ্ঘন এবং নির্বাহী কর্মকাণ্ডে জটিলতা তৈরি করে। যার প্রতি সুধারণা পোষণ করা হয়েছে তার প্রতি ঐ সুধারণা বজায় রাখতে হবে, তবে স্বচ্ছতার খাতিরে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সাধারণ জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থা থাকবে।
অনুরূপভাবে মু’মিনরা পরস্পরকে অন্যায় আচরণ থেকে নিষেধ করতে হবে এবং তাদের পরস্পরের ভুল-ত্রুটি সংশোধনে সহযোগিতা করতে হবে। নিজেদের কার্যাবলির সংশোধনের জন্য তা পর্যালোচনা বা সমালোচনা করার বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে এবং সমষ্টিগত মজলিশে দ্বিস্তরবিশিষ্ট হতে পারে। সমালোচনার নামে যেন গীবতের চর্চা না হয় সে বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন থাকতে হবে। গীবত হলো কাউকে হেয় করে আত্মতুষ্টির জন্য কারো অনুপস্থিতিতে তার নিন্দা করা। এছাড়া অযথা অভিযোগ ও সমালোচনাও বর্জনীয়। সুতরাং সমালোচনার উদ্দেশ্য যেমন হতে হবে সংশোধন বা অন্যায়ের প্রতিবাদ, তেমনি সেজন্য অধিকতর যৌক্তিক কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোনো মু’মিন নারী-পুরুষকে এমন কোনো অভিযোগে কষ্ট দেয়া বা বিড়ম্বনার শিকার করা না হয়, বাস্তবে সে যেরূপ দোষে দোষী নয়। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতটি লক্ষ্যণীয়:
৩৩:৫৮ :: আর যারা মু’মিন পুরুষদেরকে ও মু’মিন নারীদেরকে কষ্ট দেয় বা বিড়ম্বনায় ফেলে এমন অভিযোগে বস্তুত তারা যা উপার্জন (যেরূপ দোষনীয় কর্ম সম্পাদন) করে নি, তারা মিথ্যা অপবাদ আরোপ ও স্পষ্ট পাপের দায়ভার বহন করে।
মানুষ মাত্রেই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। প্রত্যেক মানুষের স্বাধীনভাবে কোনো ধর্ম গ্রহণ, পরিবর্তন, ধর্মান্তরিত হওয়া বা ধর্ম নিরপেক্ষ থাকার অধিকার রয়েছে। আবার রাষ্ট্র নামক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে জাতি, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সমন্বিত অংশগ্রহণের বিষয় রয়েছে। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব কাঠামোতে কর্তৃত্বের অধিকার কীভাবে তৈরি হবে, ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কীরূপ চুক্তির অবকাশ রয়েছে এবং যদি রাসূল বা কোনো ইসলাম ধর্মীয় ধর্মনেতার নেতৃত্বাধীন মুসলিম উম্মাহ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কর্তৃত্ব লাভ করেন সে অবস্থায় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি কীরূপ আচরণ করা হবে বা তাদেরকে কীরূপ অধিকার দেয়া হবে সে বিষয়ে আল কুরআনে অনেক চমৎকার ও শান্তিপূর্ণ দিক নির্দেশনা বিদ্যমান রয়েছে। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:
৪:৬০ :: আর আমরা কোনো রসূল প্রেরণ করি নি, এজন্য ছাড়া যে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তার আনুগত্য করা হবে। আর যদি তারা যখন তাদের নিজেদের উপর জুলুম করেছে তখন তোমার কাছে আসতো, তারপর তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতো এবং রসূলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতো, তাহলে তারা আল্লাহকে তাওবাহ কবুলকারী দয়ালূ হিসেবে পেতো।
৩:২০ :: আর যদি তারা তোমার সাথে বিতর্ক করে তাহলে বলো, “আমি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছি এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও।” আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিলো তাদেরকে এবং উম্মীদেরকে/ অকিতাবীদেরকে বলো, “তোমরা কি (আল্লাহর কাছে) আত্মসমর্পণ করছো/ ইসলাম গ্রহণ করছো?” তারপর যদি তারা (আল্লাহর কাছে) আত্মসমর্পণ করে/ ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তারা হিদায়াত পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয় তোমার দায়িত্ব শুধু বালাগ/ পৌঁছে দেয়া। আর আল্লাহ (তাঁর) বান্দাহদের প্রতি দৃষ্টিবান।
১০৯:৬ :: (কাফিরদেরকে বলো:) “তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা) এবং আমার জন্য আমার দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা)।”
৪২:১৩ :: তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য দ্বীনের পর্যায়ভুক্ত সেই মূল বিধানই প্রদান করেছেন, যা তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং যা আমরা তোমার প্রতি ওয়াহী (অনুপ্রেরণা দান) করেছি এবং যার প্রতি আমি ইবরাহীমকে নির্দেশ প্রদান করেছিলাম এবং মূসাকে ও ঈসাকে, এ মর্মে যে, “তোমরা দ্বীনকে ক্বায়েম/প্রতিষ্ঠা/বাস্তবায়ন করো এবং সেই ক্ষেত্রে (দ্বীন ক্বায়েমের পথে) পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না”। তোমরা মুশরিকদেরকে (আল্লাহর একত্ববাদী দ্বীনের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকার) যে দিকে আহবান করছো তা তাদের নিকট বড়ই দুঃসহ হয়ে গেছে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাঁর দিকে নিয়ে আসার জন্য বাছাই করেন এবং তিনি তাকেই পথনির্দেশ করেন যে (পথনির্দেশের সন্ধানে) অভিমুখী হয়।
৯:৩৩ :: তিনিই সেই সত্তা যিনি তাঁর রসূলকে প্রেরণ করেছেন হিদায়াত ও সঠিক দ্বীন সহকারে যেন সে উহাকে (সঠিক দ্বীনকে) প্রত্যেক দ্বীনের উপর বিজয়ী করতে পারে, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।
৩:১১০ :: তোমরাই (মু’মিনগণ) শ্রেষ্ঠ উম্মাহ (জাতিসত্তা), তোমাদেরকে বের করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য, তোমরা ন্যায়ের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে। আর যদি আহলে কিতাব ঈমান আনতো তা-ই হতো তাদের জন্য উত্তম। তাদের মধ্যে কিছু আছে মু’মিন কিন্তু তাদের অধিকাংশ ফাসিক্ব (দুষ্কর্ম পরায়ণ)।
২২:৩৯-৪১ :: তাদেরকে প্রতিরোধমূলক যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো যাদেরকে জুলুম-নিপীড়ন করা হয়েছে। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম। যাদেরকে তাদের নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বলে, ‘রব্বুনাল্লাহ’ (আল্লাহ আমাদের প্রভু)। আর যদি আল্লাহ (তাঁর বিধানের বা প্রাকৃতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে) মানুষকে প্রতিহত না করতেন তাদের একদল দ্বারা অন্য দলকে,তাহলে অবশ্যই বিধ্বস্ত করা হতো আশ্রম/মঠ (সওয়ামি’), আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বাণিজ্যকেন্দ্র (বিয়া’), উপাসনালয় (সালাওয়াত) এবং মাসাজিদ যেগুলোতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন যে তাঁকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমতাবান, শক্তিমান। যারা এমন যে, যদি আমরা তাদেরকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব-ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করি, তাহলে তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত প্রদান করবে এবং ন্যায়ের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। আর যাবতীয় সিদ্ধান্ত ও কার্যাবলির চূড়ান্ত পরিণতি আল্লাহরই আয়ত্তে।
২৪:৫৫ :: আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনে এবং আমলে সালেহ (সৎকর্ম ও যোগ্যতা অর্জন বা দক্ষতা উন্নয়নমূলক কাজ) করে, অবশ্যই তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে খিলাফাত (ক্ষমতায় অধিষ্ঠান) প্রদান করবেন যেমন তিনি তাদের পূর্ববর্তীদেরকে খিলাফাত (ক্ষমতায় অধিষ্ঠান) প্রদান করেছিলেন, এবং তিনি তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থাকে) প্রতিষ্ঠিত করে দিবেন, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন, এবং তিনি তাদের ভয়ের পর তাদের অবস্থাকে নিরাপত্তায় বদলে দিবেন, ফলে তারা শুধু আমারই ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করবে, আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না, আর এরপরও যে কুফর (সঠিক দ্বীনকে প্রত্যাখ্যান) করবে, তারাই ফাসিক্ব (দুষ্কর্ম পরায়ণ)।
৮:২৬ :: স্মরণ করো যখন তোমরা ছিলে স্বল্পসংখ্যক, পৃথিবীতে তোমাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল, আর তোমরা আশংকা করতে যে, লোকেরা তোমাদেরকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবে। তারপর আল্লাহ তোমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন এবং স্বীয় সাহায্য দিয়ে তোমাদেরকে শক্তিশালী করেছেন এবং তোমাদেরকে উত্তম জীবিকা দিয়েছেন, যেন তোমরা কৃতজ্ঞ হও।
১৭:৮০ :: বলো, হে আমার প্রভু, যেখানে গমন সত্যের দাবি সেখানে আমাকে গমন করান এবং যেখান থেকে নির্গমন সত্যের দাবি সেখান হতে আমাকে নির্গমন করান এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাকে (কার্য নির্বাহের) সহায়ক কর্তৃত্বমূলক শক্তির ব্যবস্থা করে দিন।
৫:৪৮-৫০ :: আর আমি তোমার উপর সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি, তার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবসমূহের সমর্থক (Confirmer) ও পর্যবেক্ষক-নিয়ন্ত্রক (Watcher) রূপে। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরীআত (মৌলিক বিধি) ও মিনহাজ (উন্মুক্ত পন্থা) এবং আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে (জবরদস্তিমূলকভাবে) তোমাদেরকে এক উম্মত বানাতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। সুতরাং তোমরা উত্তম-কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহরই দিকে তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন, যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে। আর তুমি তাদের মধ্যে তার মাধ্যমে বিচার-ফয়সালা করো, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর তাদের থেকে সতর্ক করো। যেন আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তার কিছু থেকে তারা তোমাকে বিচ্যুত না করে। অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে জেনে রাখ যে, আল্লাহ তো তাদেরকে তাদের কিছু পাপের কারণেই আযাব দিতে চান। আর মানুষের অনেকেই ফাসিক। তারা কি তবে জাহিলিয়্যাতের বিধান চায়? আর নিশ্চিত বিশ্বাসী কওমের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক উত্তম?
৫:২ :: হে মু’মিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নির্ধারিত নিদর্শনসমূহকে এবং কোনো হারাম মাসকে (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাসকে) এবং হাদিয়াকে (উপহারকে) এবং কালায়িদকে (বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধিদেরকে) অবমাননা / অবমূল্যায়ন করো না। আর আল বাইতুল হারামের (সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানের) অভিযাত্রীদেরকেও অবমাননা করো না, যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে। আর যখন তোমরা হুরুম (হারাম মাসসমূহ) এর বাহিরে থাকো তখন (স্থলভাগের) শিকার করতে পার। আর কোনো সম্প্রদায়ের এরূপ শত্রুতা যে, তারা তোমাদেরকে আল মাসজিদুল হারামে গমনে বাধা দিয়েছিল, তা যেন তোমাদেরকে অপরাধপ্রবণ না করে যে, তোমরা বাড়াবাড়ি করে ফেল। আর তোমরা সদাচার ও আল্লাহ সচেতনতার বিষয়ে একে অন্যকে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালংঘনের কাজে একে অন্যকে সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহ সচেতন হও। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।
৫:৮ :: হে যারা ঈমান করেছো, আল্লাহর জন্য ন্যায় সাক্ষ্যদাতা হিসেবে দণ্ডায়মান হও। আর যেন তোমাদেরকে কোনো জনগোষ্ঠী কর্তৃক কৃত শত্রুতা অপরাধপ্রবণ না করে যে, তোমরা ন্যায় বিচার করবে না। ন্যায় বিচার করো, সেটাই তাক্বওয়ার (স্রষ্টা সচেতনতার) নিকটতর। আর আল্লাহর সম্পর্কে সচেতন হও। নিশ্চয় তোমরা যা করো সেই বিষয়ে আল্লাহ অবহিত।
৫:৪২-৪৩ :: তারা (ষড়যন্ত্রকারী আহলে কিতাবরা) মিথ্যা শ্রবণে এবং অবৈধ ভক্ষণে অভ্যস্ত। তারপর যদি তারা তোমার কাছে (তাদের নিজেদের মধ্যকার বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারের জন্য) আসে, তাহলে তুমি তাদের মধ্যে বিচার-মীমাংসা করে দাও অথবা তাদের বিচার-মীমাংসা করার ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত থাকো (তাদের নিজেদের মধ্যকার বিচার-মীমাংসা তারা নিজেরাই করুক)। আর যদি তুমি তাদের বিচার-মীমাংসা করার ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত থাকো, তবে তারা তোমার তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর যদি তুমি বিচার-মীমাংসা করো, তাহলে তুমি তাদের মধ্যে ন্যায়ের ভিত্তিতে বিচার-মীমাংসা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকদেরকে ভালবাসেন। আর কিভাবে তারা তোমাকে বিচারক বানায় অথচ তাদের কাছে তাওরাত রয়েছে, তাতে আল্লাহর হুকুম-বিধান রয়েছে, তারপর তারা তা সত্ত্বেও বিমুখ হয়েছে। আসলে তো তারা মু’মিন নয়।
৪:৭৫ :: আর তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছো না অথচ নিপীড়িত হচ্ছে দুর্বল নারী-পুরুষ ও শিশুরা, যারা বলছে, “আমাদের প্রভু, আমাদেরকে এ জনপদ থেকে নিস্তার দিন যার শাসকরা যালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে অভিভাবক নির্ধারণ করুন এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে সাহায্যকারী নির্ধারণ করুন।
২৭:৩০-৩১ :: নিশ্চয় উহা (রাজকীয় পত্রটি) সুলাইমানের পক্ষ থেকে এবং নিশ্চয় উহা ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’/পরম দয়াময় দয়ালু আল্লাহর নামে’ (লিখে শুরু করা হয়েছে)। উহার বক্তব্য এই যে, “তোমরা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করো না এবং আত্মসমর্পণকারী হয়ে আমার কাছে উপস্থিত হও”।
২৭:৩৬ :: তারপর যখন (সাবার রানীর দূতেরা) সুলাইমানের কাছে আসলো। সে (সুলাইমান) বললো, “তোমরা কি আমাকে মালসম্পদ দিয়ে সাহায্য করতে এসেছো? অথচ আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছে তা তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তার চেয়ে উত্তম। বরং তোমরাই তোমাদরে উপঢৌকন নিয়ে গিয়ে আনন্দ করো। তোমরা তাদের কাছে ফিরে যাও। তারপর আমরা তাদের কাছে আসবো এমন সেনাবাহিনী নিয়ে যার মোকাবেলা করার সাধ্য তাদের নেই। আর আমরা তাদেরকে তা থেকে অপমানিত অবস্থায় বের করে দেবো। আর তারা ক্ষুদ্রশক্তি হয়ে থাকবে।
৮:৬০-৬৩ :: আর তোমরা তাদের (কাফিরদের) মোকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি এবং রণকৌশলের প্রশিক্ষিত ঘোড়া প্রস্তুত রাখো। তোমরা এর মাধ্যমে ভীত-সন্ত্রস্ত রাখবে আল্লাহর ও তোমাদের শত্রুদেরকে এবং তারা ছাড়াও অন্য অনেককে যাদের শত্রুতা সম্পর্কে তোমরা জানো না কিন্তু আল্লাহ জানেন। আর তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছুই ব্যয় করবে তিনি তোমাদেরকে তা পূর্ণ করে দিবেন। আর তোমাদের প্রতি যুলুম করা হবে না। আর যদি তারা শান্তিচুক্তির দিকে ঝুঁকে তাহলে তোমরাও সেদিক ঝুঁকো, আর আল্লাহর উপরই ভরসা করো। নিশ্চয় তিনি, তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। আর যদি তারা তোমাকে ধোঁকা দিতে চায়, তাহলে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি তাঁর সাহায্য দ্বারা ও মু’মিনদের দ্বারা তোমাকে শক্তি যুগিয়েছেন। আর তিনি তাদের (মু’মিনদের) অন্তরগুলোকে প্রীতির বন্ধনে যুক্ত করে দিয়েছেন। যদি তুমি পৃথিবীতে যা আছে তার সবই ব্যয় করতে তবুও তাদের অন্তরসমূহকে প্রীতির বন্ধনে যুক্ত করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে প্রীতির বন্ধনকে যুক্ত করেছেন। নিশ্চয় তিনি মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।
২:২৪৬-২৪৭ :: তুমি মূসার পরবর্তীতে বানী ইসরাইলের প্রধানদের প্রতি লক্ষ্য করো নি? যখন তারা তাদের জন্য প্রেরিত নবীকে বলেছিল, আমাদের জন্য একজন রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করুন, আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবো। সে (নবী) বললো, “তোমাদের ক্ষেত্রে এমন সম্ভাবনা আছে কি যে, তোমাদের উপর যুদ্ধ বিধিবদ্ধ করে দেয়া হলো অথচ তোমরা যুদ্ধ করবে না?” তারা বললো, “আমাদের কী হলো যে, আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবো না অথচ আমাদেরকে ও আমাদের সন্তানদেরকে আমাদের বাড়িঘর থেকে বাহির করে দেয়া হয়েছে?” তারপর যখন তাদের উপর যুদ্ধ বিধিবদ্ধ করে দেয়া হলো, তাদের মধ্যকার অল্পসংখ্যক ছাড়া বাকিরা মুখ ফিরিয়ে নিলো। আর আল্লাহ জালিমদের সম্পর্কে পরিজ্ঞাত। আর তাদেরকে তাদের নবী বললো, “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য তালুতকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করেছেন।” তারা বললো, “কীভাবে তার জন্য আমাদের উপর রাজত্ব করার অধিকার থাকতে পারে? অথচ আমরা (বানী ইসরাইল) রাজত্বের বিষয়ে তার চেয়ে অধিক অধিকারী। আর তাকে তো মালসম্পদ থেকেও স্বচ্ছলতা দেয়া হয় নি।” সে (নবী) বললো, “নিশ্চয় আল্লাহ তাকে তোমাদের উপর মনোনীত করেছেন এবং তাকে জ্ঞানগত ও দৈহিক কাঠামোতে সমৃদ্ধ করেছেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাঁর রাজত্ব দান করেন। আর আল্লাহ সর্বব্যাপী সর্বজ্ঞ।”
৪:৮৮-৯১ :: তোমাদের কী হয়েছে যে, মুনাফিক্বদের ব্যাপারে তোমরা দুই দল হয়ে যাচ্ছো? অথচ তাদের উপার্জনের (পাপ প্রবণতার) জন্য আল্লাহ তাদেরকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তোমরা কি ইচ্ছা করো যে, তোমরা তাদেরকে হিদায়াত করবে যাদেরকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের জন্য কোনো পথ পাবে না। তারা আকাঙ্ক্ষা করে যদি তোমরা কুফর করতে যেমন তারা কুফর করেছে তাহলে তোমরা বরাবর হয়ে যেতে! সুতরাং তাদের কাউকে বন্ধু ও অভিভাবক (অলি-আওলিয়া) হিসেবে গ্রহণ করো না, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে (তথা তাগুতের সাথে আপোষ না করে বরং যেখানে নিরাপদে আল্লাহর বিধান অনুসরণ করা যাবে সেখানে চলে আসে)। অন্যদিকে যদি তারা (শত্রুতা সহকারে তোমাদের দিক থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তোমরা তাদেরকে ধরো এবং হত্যা করো, যেখানেই তোমরা তাদেরকে পাও। আর তোমরা তাদের মধ্য থেকে কাউকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে ও সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করো না। কিন্তু তাদেরকে নয় যারা এমন কোনো ক্বওমের সাথে সংযুক্ত হয় তোমাদের ও যাদের মধ্যে (অনাক্রমণ) চুক্তি রয়েছে অথবা যারা (যেসব মুনাফিক্বরা) তোমাদের কাছে এমনভাবে আসে যে, তাদের অন্তর সংকুচিত/বাধাগ্রস্থ হয় তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অথবা তাদের ক্বওমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাদেরকে তোমাদের উপর ক্ষমতাবান করতেন। তাহলে তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো। সুতরাং যদি তারা তোমাদের থেকে সরে দাঁড়ায়, তাহলে তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো না। আর তারা তোমাদের কাছে শান্তিচুক্তি প্রস্তাব করলে, তাহলে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে (ব্যবস্থা গ্রহণের) কোনো পথ রাখেন নি। আর শীঘ্রই তোমরা অন্য কিছু (মুনাফিক্বদেরকে) পাবে, তারা ইচ্ছা করে তোমাদের থেকে নিরাপত্তা পেতে এবং তাদের ক্বওমের থেকে নিরাপত্তা পেতে। যখনই তারা কোনো ফিতনার (ন্যায়কাজে বিঘ্ন সৃষ্টির) দিকে সুযোগ পায়, তারা সেটার মধ্যে (ফিতনার মধ্যে) ঘুরে যায়/ জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং যদি তারা তোমাদের থেকে সরে না যায় এবং তোমাদের কাছে শান্তিচুক্তি প্রস্তাব না করে এবং তাদের হাতসমূহ সংবরণ না করে, তাহলে তোমরা তাদেরকে ধরো এবং হত্যা করো, যেখানেই তোমরা তাদের নাগাল পাও। আর তারাই সেসব লোক, আমরা তোমাদেরকে যাদের উপর চড়াও হওয়ার স্পষ্ট সনদ দিয়েছি।
৮:৫৬-৫৯ :: তাদের মধ্য থেকে যাদের সাথে তুমি চুক্তি করেছো, তারপর প্রত্যেক বার তারা তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে এবং তারা আল্লাহকে ভয় করে না। সুতরাং যদি তুমি যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের নাগাল পাও, তাহলে তাদেরকে যারা তাদের পেছনে আছে তাদের থেকে ছত্রভঙ্গ করে দাও, যেন তারা স্মরণ রাখতে পারে। আর যদি তোমরা কোনো ক্বওমের পক্ষ থেকে খিয়ানাতের/বিশ্বাসঘাতকতার ভয় করো, তাহলে (তাদের সাথে কৃত চুক্তিকে প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে) তাদের দিকে সমানভাবে প্রতিনিক্ষেপ করো। নিশ্চয় আল্লাহ খিয়ানাতকারীদেরকে ভালবাসেন না। আর যারা কুফর করেছে তারা যেন হিসাব করে না নেয় যে, তারা প্রতাপশালী হয়ে গেছে। নিশ্চয় তারা (মু’মিনদেরকে) অক্ষম করতে পারবে না।
৪:৯৭-৯৮ :: নিশ্চয় যারা (আল্লাহর আদেশের বিপরীত কাজের মাধ্যমে) স্বীয় আত্মার উপর জুলুমকারী অবস্থায় থাকে, প্রাণ হরণকালে ফেরেশতারা তাদেরকে বলে, “তোমরা কী অবস্থায় ছিলে?” তারা বলে, “আমরা জমিনে দুর্বল অবস্থায় ছিলাম।” তারা (ফেরেশতারা) বলে, “আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না, যেখানে তোমরা হিজরাত করতে পারতে?” সুতরাং তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। আর তা কতই না মন্দ আবাস! সেই প্রকৃত দুর্বল পুরুষ ও নারী এবং শিশুকিশোর ছাড়া, যারা কোনো উপায় অবলম্বনে সক্ষম হয় না এবং কোনো (যাওয়ার) পথের সন্ধানও পায় না।
৮:৭২ :: নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং হিজরাত করেছে ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছে তাদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে, এবং যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে ও তাদেরকে সাহায্য করেছে; তারাই একে অপরের আওলিয়া (বন্ধু ও অভিভাবক)। আর যারা ঈমান এনেছে কিন্তু (হিজরাতের সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কোনো কারণে) হিজরাত করে নি, তোমাদের উপর তাদের অভিভাবকত্বের কোনো দায়িত্ব নেই, যতক্ষণ না তারা হিজরাত করে। তবে যদি তারা দ্বীনী (ধর্মীয়) বিষয়ে তোমাদের কাছে সাহায্য চায়, তাহলে তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদেরকে সাহায্য করা; এমন ক্বওমের বিরুদ্ধে ছাড়া তোমাদের ও যাদের মধ্যে (অনাক্রমণ) চুক্তি রয়েছে। আর তোমরা যা করো আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।
৯:৩-৮ :: আর সাধারণ ঘোষণা বিঘোষিত হবে আল্লাহর ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে মানবজাতির সামনে ইয়াওমাল হাজ্জিল আকবারে (অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ হজ্জের দিনে) এই মর্মে যে, “নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর রসূল মুশরিকদের থেকে সম্পর্কমুক্ত। সুতরাং যদি তোমরা (মুশরিকরা) তাওবা করো তাহলে তা তোমাদের জন্যই কল্যাণকর। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে রাখো, তাহলে জেনে রাখো যে, নিশ্চয় তোমরা আল্লাহকে অক্ষমকারী নও।” আর যারা কুফর (অর্থাৎ সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান) করেছে তাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তির (অর্থাৎ জাহান্নামের) সংবাদ দাও। কিন্তু মুশরিকদের মধ্য থেকে যাদের সাথে তোমরা চুক্তি করেছো তারপর তারা তা কিছুমাত্র ভঙ্গ করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেনি। সুতরাং তোমরা তাদের সাথে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ করো। নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে [আল্লাহ সচেতনদেরকে] ভালবাসেন। তারপর যখন হারাম মাসসমূহ (বিধিবদ্ধ যুদ্ধবিরতির ও সংরক্ষিত মাসসমূহ) অতিবাহিত হয়ে যাবে তখন তোমরা মুশরিকদেরকে (হারাম এলাকার) যেখানেই পাও (সম্মুখ যুদ্ধে / এনকাউন্টারে) হত্যা করো এবং তাদেরকে (সরাসরি) ধরে ফেলো এবং তাদেরকে অবরোধ ও (অগ্রাভিযান ও পারস্পরিক যোগাযোগে) বাধাগ্রস্ত করো এবং তাদের জন্য (তাদেরকে আচমকা ধরা ও গেরিলা যুদ্ধের জন্য) প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওঁৎ পেতে বসো। তবে যদি তারা তাওবা করে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত প্রদান করে তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াশীল। আর যদি মুশরিকদের মধ্য থেকে কেউ তোমার কাছে আশ্রয় চায় তাহলে তাকে আশ্রয় দাও, যতক্ষণ না সে আল্লাহর বাণী (আল কুরআন) শুনে, তারপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দাও। এটা এজন্য যে, তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা সঠিক জ্ঞান রাখে না। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে কিভাবে মুশরিকদের জন্য কোনো চুক্তি বহাল থাকবে? তাদের সাথে ছাড়া, যাদের সাথে তোমরা আল মাসজিদুল হারামের প্রাঙ্গনে চুক্তি করার পর (তারা তা ভঙ্গ করে নি), সুতরাং যতক্ষণ তারা তোমাদের জন্য (চুক্তির উপর) প্রতিষ্ঠিত থাকে, তোমরাও তাদের জন্য (চুক্তির উপর) প্রতিষ্ঠিত থাক। নিশ্চয় আল্লাহ তো আল্লাহ সচেতনদেরকেই ভালবাসেন। কিরূপে (মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক রাখা যাবে)? অথচ যদি তারা তোমাদের উপর বিজয়ী (তথা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে) থাকে, তারা তোমাদের বিষয়ে সাধারণ আত্মীয়তারও মর্যাদা রাখে না এবং যিম্মাদারি বা সুরক্ষা চুক্তিরও মর্যাদা রাখে না। তারা মুখের কথায় তোমাদেরকে সন্তুষ্ট করে অথচ তাদের অন্তর তা অস্বীকার করে আর তাদের অধিকাংশই নীতিহীন।
২:২৫১ :: তারপর তারা (বানী ইসরাইল) আল্লাহর অনুমতিতে তাদেরকে (জালুতের সেনাদলকে) পরাভূত করলো এবং দাউদ জালুতকে হত্যা করলো। এবং আল্লাহ তাকে (দাউদকে) রাজত্ব এবং বিচারিক বিজ্ঞতা দান করলেন এবং তিনি তাকে যা ইচ্ছা করলেন শিখালেন। আর যদি আল্লাহ মানবজাতির কাউকে দ্বারা অপর কাউকে প্রতিহত না করতেন, তাহলে পৃথিবী ফাসাদপূর্ণ/নৈরাজ্যপূর্ণ হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ জগদ্বাসীর উপর অনুগ্রহশীল।
৩৮:২৬ :: হে দাউদ আমি তোমাকে পৃথিবীতে খলিফা (ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ত) করেছি। সুতরাং তুমি মানুষের মধ্যে সত্য সহকারে বিচার-ফায়সালা করো এবং খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি, কারণ তারা হিসাবের (জবাবদিহির) দিবসকে ভুলে রয়েছে।
১২:৫৪-৫৬ :: আর রাজা (রাষ্ট্রপতি) বললো, “তাকে (ইউসুফকে) আমার কাছে নিয়ে আসো। আমি তাকে আমার জন্য বিশেষ (উপদেষ্টা) করে নেবো।” তারপর যখন সে (রাজা/রাষ্ট্রপতি) তার সাথে (ইউসুফের সাথে) বাক্যালাপ করলো, তখন বললো, “নিশ্চয় আপনি আজ আমাদের কাছে বিশ্বস্ত (সম্মানিত) অবস্থানে পরিগণ্য”। সে (ইউসুফ) বললো, “আমাকে ভূখণ্ডের (রাষ্ট্রের) ধনভাণ্ডারের উপর দায়িত্বশীল মনোনীত করুন। নিশ্চয় আমি সংরক্ষণকারী, জ্ঞানী।” আর এভাবেই আমরা ইউসুফের জন্য পৃথিবীতে সুপ্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেছি, সে তা থেকে যেখানে ইচ্ছা সংস্থাপন করতে পারতো। আমরা যাকে ইচ্ছা আমাদের রহমত প্রদান করি। আর আমরা উত্তম কর্মপরায়ণদের প্রতিফল বিনষ্ট করি না।
১২:৭৬ :: তারপর সে (ইউসুফ) তার (ইউসুফের) সহোদর ভাইয়ের মালপত্র তল্লাশির আগে তাদের (ইউসুফের বৈমাত্রেয় ভাইদের) মালপত্র তল্লাশি করতে লাগলো। তারপর (অন্যদের মালপত্র তল্লাশির শেষে) তার সহোদর ভাইয়ের মালপত্রের মধ্য থেকে তা (রাজার পানপাত্র) বের করলো। এভাবে আমরা ইউসুফের জন্য কৌশল করেছিলাম। আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত, রাজার বিধান (দ্বীনিল মালিক) অনুসারে সে তার সহোদর ভাইকে আটকে রাখতে পারতো না। আমরা যাকে ইচ্ছা করি তাকে মর্যাদায় উন্নীত করি। আর প্রত্যেক জ্ঞানবান ব্যক্তির উপরে রয়েছেন একজন মহাজ্ঞানী।
৪:৬০-৬৩ :: তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা দাবী করে যে, নিশ্চয় তারা ঈমান এনেছে তার উপর যা নাযিল করা হয়েছে তোমার প্রতি এবং যা নাযিল করা হয়েছে তোমার পূর্বে। তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায় অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে অস্বীকার করতে। আর শয়তান চায় তাদেরকে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত করতে। আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা আসো যা আল্লাহ নাযিল করেছেন তার দিকে (কুরআনের দিকে) এবং রাসূলের দিকে’, তখন মুনাফিকদেরকে দেখবে তোমার কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে ফিরে যাচ্ছে। সুতরাং তখন কেমন হবে, যখন তাদের উপর কোন মুসীবত আসবে, সেই কারণে যা তাদের হাত পূর্বেই প্রেরণ করেছে (অর্থাৎ তাদের কৃতকর্মের কারণে)? তারপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করা অবস্থায় তোমার কাছে আসবে যে, আমরা উত্তম আচরণ ও সমঝোতার মাধ্যমে সামর্থ্যবৃদ্ধি ভিন্ন অন্য কিছু চাইনি। তাদের মনে যা আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তুমি তাদের বিষয়ে নির্লিপ্ত হও এবং তাদেরকে সদুপদেশ দাও এবং তাদেরকে তাদের (কর্মকাণ্ডের) পর্যালোচনাস্বরূপ মর্মস্পর্শী কথা বলো।
আলোচনা : উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যে, মহান আল্লাহ মানবজাতির কাছে তাঁর হিদায়াত ও বিধি-বিধান প্রেরণের জন্য মানুষের মধ্য থেকেই তাঁর বাছাইকৃত বান্দাদেরকে নবী-রসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন। তিনি রসূল প্রেরণ করেছেন যেন তাঁর অনুমতিক্রমে তথা তাঁর বিধিবিধান অনুযায়ী মানুষ রসূলের আনুগত্য করে। তবে এক্ষেত্রে তিনি যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তা হলো এই যে, তিনি রসূলদেরকে শুধুমাত্র বালাগ বা তাঁর রিসালাতের বাণী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন, তারপর কেউ ঈমান আনা না আনার বিষয়ে মানুষকে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। সুতরাং যারা ঈমান আনবে না তারা রসূলের আনুগত্য করতে বাধ্য নয়। কিন্তু যারা ঈমান আনবে তারা রসূলের আনুগত্য করতে হবে। সুতরাং রসূল নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বা অন্যদের আনুগত্য পাওয়ার জন্য কোনো বলপ্রয়োগের পদ্ধতি অবলম্বন করেননি। এভাবে ধর্মীয় বিষয়ে যারা ঈমান আনবে এবং যারা কুফর করবে তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে এটাই স্বাভাবিক। আর তাই কুরআনের মাধ্যমে রসূলকে এ ঘোষণা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছৈ যে, “তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা) এবং আমার জন্য আমার দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা)”।
অন্যদিকে সমাজ ও রাষ্ট্রে যেহেতু মু’মিন অমু’মিন নির্বিশেষে সবাই থাকবে, এমতাবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব কাঠামো কীরূপ হবে এ বিষয়ে আল কুরআনের নির্দেশনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য বিষয়। আল কুরআনের নির্দেশনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ রসূলের কাছে সঠিক দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা) দিয়েছেন যেন তিনি তা অন্য সকল দ্বীনের (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থার) উপর প্রতিষ্ঠিত ও বিজয়ী করেন। আর মুসলিম উম্মাহর উদ্ভবও এজন্যই ঘটানো হয়েছে যেন তারা মানবজাতির কল্যাণে তাদের নেতৃত্ব দিতে পারে, তারা কর্তৃত্ব-ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হলে ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করবে এবং তারা তা করবে আল্লাহর প্রতি ঈমানের ভিত্তিতে তথা আল্লাহর বিধি-বিধান অনুযায়ী। আবার মুসলিম উম্মাহর খিলাফাত বা কর্তৃত্বে অধিষ্ঠানের জন্য তাদেরকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা হলো ঈমান এবং সৎকর্ম ও যোগ্যতা অর্জন বা দক্ষতা উন্নয়নমূলক কাজ।
কোনো মুসলিম ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সাথে অমুসলিম ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের দ্বন্দ্ব হলে যদি তাতে অমুসলিম ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, সে অবস্থায় শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অন্যায়কারী মুসলিম ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে সমর্থন করা যাবে না। মু’মিনরা সবসময় ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে। প্রকৃত মুসলিমদের শাসনকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তারা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব অনুযায়ী ন্যায়বিচার করবে এবং কোনো ক্ষেত্রে আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব দ্বারা বিচার করা সম্ভব না হলে বিচার থেকে নিবৃত্ত থাকবে বা সংশ্লিষ্ট পক্ষকে তাদের নিজেদের কোনো কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হতে সুযোগ দিবে। মুসলিম উম্মাহ তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করবে। সুতরাং ন্যায়ের ভিত্তিতেই মুসলিমদের শাসনকর্তৃত্ব বজায় থাকতে পারে, নিছক ধর্মীয় পরিচয়গত কারণে নয়।
দ্বীন কায়েম করা, দ্বীনকে বিজয়ী করা, মুসলিম উম্মাহর খেলাফত ইত্যাদি বিষয়ে বিকৃত ব্যাখ্যার কারণে ইসলাম সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে এগুলোর যে তাৎপর্য প্রতীয়মান হয় তা সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও শান্তি-শৃঙ্খলাপূর্ণ বিষয়। যেমন- দ্বীন কায়েম বলতে বুঝায় নিজেদের মধ্যে এবং সাধ্যমতো ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে দ্বীন-ইসলামের বিধি-বিধানের প্রতিষ্ঠা। ধর্মীয় অঙ্গনে যেমন নিজেদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের বিষয়াবলি পরিপালনের বিষয়, অন্যদের উপর তা চাপানো যাবে না। তেমনি ইসলামের সামাজিক বিধি-বিধানও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, কারণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে তো দ্বীনের প্রতিষ্ঠা হয় না, বরং দ্বীনের নির্দেশনাকে লঙ্ঘন করা হয়। অনুরূপভাবে দ্বীনকে বিজয়ী করা বলতে বুঝায় সত্যভাষণ এবং নিজেদের কর্মে দ্বীনের নির্দেশনাকে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে দ্বীনকে বিজয়ী করা। দ্বীন ইসলামের সামাজিক বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে যে সংগ্রামের নির্দেশনা রয়েছে সেক্ষেত্রে যুদ্ধ হতে পারে প্রতিআক্রমণমূলক যুদ্ধ ও কোনো জনগোষ্ঠীকে জুলুম থেকে বাঁচানোর যুদ্ধ অথবা ইসলামী আদর্শভিত্তিক মডেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর প্রয়োজনীয় সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে পর্যাপ্ত সামরিক সক্ষমতা সাপেক্ষে অন্যদেরকে সতর্কীকরণ করে পরিচালিত অভিযান।
নিরাপদে ইসলামী আদর্শের অনুশীলনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্তৃত্ব অর্জন ও তার স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির বিকল্প নেই। এই প্রেক্ষিতে সূরা আনফালের ৬০-৬৩ আয়াতে কাফিরদেরকে মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি এবং রণকৌশলের প্রশিক্ষিত ঘোড়া প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এবং সেই সাথে মু’মিনদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের সম্পর্ককে মজবুত করার মাধ্যমে অশুভ শক্তির মোকাবেলায় মু’মিনদের ঐক্যের শক্তিকে কাজে লাগানোর গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
স্বতন্ত্রভাবে ‘রাজনৈতিক সংগঠন’ প্রতিষ্ঠা করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করা জরুরি নয়। বরং প্রয়োজন হলো ‘ইসলামের দিকে আহবান, বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং বিশ্বাসীদের নিজেদের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা সহকারে সমাজকল্যাণ কর্ম’। এরি ধারাবাহিকতায় মুসলিম উম্মাহ যখন যতটুকু নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জন করবে, তখন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থাই ততটুকু ইসলামী আইনকে পরিগ্রহণ করে নিবে। অর্থাৎ বিষয়টি একটি বিবর্তন প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে। শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের মোকাবেলায় গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের প্রয়োজন হলে এর ব্যতিক্রম হতে পারে।
দ্বীনের বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম উম্মাহ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে থাকা কোনো ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা আবশ্যক নয়, বরং স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে নিজ বলয়ে ইসলামের বিধি-বিধান চর্চা করাই যথেষ্ট। এজন্য এই উম্মাহ রাষ্ট্রের কাছে যে ন্যায্য দাবি জানাবে তা হলো ‘নিজ বলয়ে নিজেদের ধর্মীয় বিধি-ব্যবস্থা প্রয়োগের স্বায়ত্তশাসন’। মুসলিম উম্মাহর কল্যাণমুখী কার্যক্রমই ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্র ও আন্তঃরাষ্ট্রিক পরিসরে তার স্বাভাবিক ক্ষমতায়ন ঘটাবে, তখন সে সেই বৃহত্তর পরিসরে প্রগতিশীলভাবে আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের ভিত্তিতে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
কুরআন উম্মাহ এবং কওমের ধারণা দেয়, যেখানে উম্মাহ হলো আদর্শিক জাতিসত্তা এবং ক্বওম হলো সমাজ-সংস্থা ও রাষ্ট্রীয় জাতিসত্তা। যেমন সকল বাংলাদেশি একটি কওম, যেখানে উম্মাহর দিক থেকে যেমন মুসলিম উম্মাহ রয়েছে, তেমনি অমুসলিম উম্মাহও রয়েছে। উম্মাহর নেতৃত্ব দেয় ‘উলিল আমর’ (আদেশের অধিকারী নেতা) এবং কওমের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রদানকারী হলো ‘মালিক’ (রাষ্ট্রপতি)।
উপরিউক্ত রাজনৈতিক পদ্ধতিকে ‘আপোষকামিতা’, ‘কিছু আদর্শিক ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া’, ‘পরস্পর পরস্পরের আংশিক অনুসরণ’ ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করে আপত্তিকর সাব্যস্ত করার অবকাশ নেই। কারণ কুরআন কোনো পুরোহিততান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিধান দেয়নি, বরং রাষ্ট্র হলো মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব হওয়ার প্রেক্ষিতে তার স্বাভাবিক সংস্থা যাতে কোনো কোনো নবী-রসূলও সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব চর্চার মাধ্যমে ভূমিকা রেখেছেন, কিন্তু তা কোনো ঐশী অধিকারের ভিত্তিতে নয়, বরং তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটেছিল স্বাভাবিক রাজনৈতিক উত্থান-পতন প্রক্রিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে।
নবী-রসূলগণ বস্তুত তাদেরকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন যাঁরা তাঁদের প্রতি ঈমান এনেছেন, অন্যদের জন্য বালাগ বা তথ্য পৌঁছে দেয়া ছাড়া তাঁদের কোনো কাজ ছিলো না। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের দিক থেকে যে বলপ্রয়োগমূলক বৈধ ক্ষমতা সেটা ধর্মীয় অধিকারের ভিত্তিতে নয়, বরং সর্বজনীন রাজনৈতিক অধিকারের ভিত্তিতে।
বস্তুত আল্লাহর বিধান অনুসারে ফায়সালা করা না করার বিষয়টি ফায়সালাকারী কোন স্তরে রয়েছে তার সাপেক্ষেই নির্ধারিত হতে পারে। যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার করে না তাদেরকে জালিম বলা হয়েছে ধর্মাদর্শের দিক থেকে, এ ক্ষেত্রে মানবজাতির উপর সামাজিক জুলুমের বিষয়টি গৌন, তা কোনোক্ষেত্রে ঘটতে পারে, আবার কোনো ক্ষেত্রে নাও ঘটতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রযন্ত্র (আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ) মাত্রই তাগুত, এমনটি নয়। বরং তাগুত বলা হয়েছে ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণকারী (ফিতনাবাজ) নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব বা শাসকদেরকে, যারা মু’মিনদের উপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে কাফিরদের নেতৃত্ব দেয় বা পরিচালনা করে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের ন্যায্য দাবি মেনে না নিয়ে তাদের নিজেদের খেয়ালখুশিভিত্তিক আইনে বিচারকার্য চালায়।
মুসলিমরা যখন খেলাফত পাবে বা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, তখন তাদেরকে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, প্রত্যেক ধর্মের স্বতন্ত্র ধর্মীয় আচার ও বিচারব্যবস্থার সুযোগ দিতে হবে (শর্ত হলো, তার মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ মৌলিক মানবিক অধিকার ক্ষুন্ন করার মতো কিছু থাকতে পারবে না, যেমন-সতীদাহ), আর ধর্মনিরপেক্ষ থেকে সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য ইসলামের আইনগুলো (অর্থনৈতিক ও বিচারবিভাগীয়) কুরআনের আলোকে পরিচালিত করতে হবে, কারণ এক্ষেত্রে প্রত্যেক রাষ্ট্রেই রাষ্ট্র পরিচালনাকারী পক্ষ তাদের মতাদর্শকেই বাস্তবায়ন করবে, এটাই স্বাভাবিক হয়।
বস্তুত ইসলামে থাকা সামাজিক ব্যবস্থা এরূপ যে, তা ধর্মনিরপেক্ষ পর্যায়ে থেকেও গ্রহণযোগ্য। মুসলিম উম্মাহর মূল নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সরাসরি রসূলের জন্য সংরক্ষিত ছিল, কারণ তিনি আল্লাহর মনোনীত রসূল এবং তাই মু’মিনরা ঈমানের দাবি অনুসারে তাঁর আনুগত্য করতে হবে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তিনি অমুসলিম রাষ্ট্র কর্তৃত্বের সাথে সন্ধিও করেন এবং চুক্তিকে ধর্মীয় সম্পর্কের চেয়েও বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন আল্লাহর বিধান অনুসারে। সুতরাং রসূল ধর্মীয় নেতা হওয়ার দাবির ভিত্তিতে জোর করে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত হন না, বরং স্বাভাবিক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাক্রমে রাষ্ট্র-কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। এটা স্বতন্ত্র বিষয় যে, ধর্মীয় বিশ্বাসমতে, এরূপ পরিস্থিতি গঠনে আল্লাহ সাহায্য করেন এবং তাঁর বিশ্বসাম্রাজ্য পরিচালনা বিধি অনুসারে তিনিই রাষ্ট্রক্ষমতার উত্থান-পতন ঘটিয়ে থাকেন।
রসূল নিছক ধর্মের দাবিতে ক্ষমতা দখল করেননি, বরং তিনি অমুসলিম সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে রাজনৈতিক চুক্তি করেছেন। আবার যখন তিনি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন করেছেন তখনও তিনি তাতে অমুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য তাদের নিজেদের মধ্যকার বিষয়ে তাদের ধর্মীয় নিয়মে বিচার-আচার করার অধিকার দিয়েছিলেন। সূরা মায়িদাহর ৪২-৪৩ আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে, রাসূলের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের অধীনে আহলে কিতাবের নিজেদের বিষয় নিজেরা সমাধান করার বিকল্প ব্যবস্থার অবকাশ তথা অমুসলিমদের স্বায়ত্তশাসন ও তাদের আয়ত্তে তাদের স্বতন্ত্র বিচার-ব্যবস্থার অধিকার ছিল। এছাড়া মুসলিমদের শাসনাধীন সংসদে বা মাসজিদে অমুসলিমদের প্রতিনিধিত্বশীল পরিষদকে প্রবেশাধিকার প্রদানও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও ন্যায়বিচারের অন্তর্ভুক্ত (দ্র: ৬০:৮, ৫:১০৬)।
এক বনে দুই বাঘের রাজত্ব চলে না। রাষ্ট্রে যে উম্মাহ মূল ক্ষমতায় থাকে সেটাই বৃহৎশক্তি ও পরাশক্তি এবং যে উম্মাহ শুধুমাত্র স্বায়ত্তশাসন লাভ করে সেটাই ক্ষুদ্রশক্তি হিসেবে আখ্যায়িত হয়। এমতাবস্থায় মুসলিম উম্মাহ অবশ্যই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় উত্তরণের জন্য ইতিবাচক প্রক্রিয়ায় প্রচেষ্টাশীল থাকবে। কিন্তু এজন্য কোনোক্রমেই কোনো অপকৌশল ও বিশৃঙ্খলার আশ্রয় নিবে না।
খেলাফত অর্জন ও এর স্থিতিশীলতার জন্য প্রতিষ্ঠিত শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হলে তা হতে হবে- (ক) অনাক্রমণ চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণের পর, চুক্তি নবায়ন না করে, নিজেদের মধ্যকার আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাধা আসলে বা রাষ্ট্রের নাগরিকদের উপর রাষ্ট্রীয় জুলুম চললে তার প্রেক্ষিতে। অবশ্য যদি কাফিররা নিজেরা চুক্তি লংঘন করে তবে চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণের পূর্বেই চুক্তি সমাপ্ত হয়ে যায় বিধায় তখনও এ চ্যালেঞ্জ জানানো যেতে পারে। (খ) ইসলামী আদর্শভিত্তিক মডেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে অন্যদেরকে সতর্কীকরণ করে প্রয়োজনসাপেক্ষে ক্বিতাল বা যুদ্ধাভিযান হতে পারে। অর্থাৎ একবার একটি রাষ্ট্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে অন্য যেসব কাছাকাছি রাষ্ট্রকে এ রাষ্ট্রের অধীনস্ত করার মতো রাজনৈতিক শক্তিমত্তা তৈরি হয় তা প্রয়োগ করে চ্যালেঞ্জ জানানো যেতে পারে। যেমন নবী সুলাইমান সাবার রাণীকে রাজকীয় পত্র পাঠিয়েছেন। এক্ষেত্রে ঐ রাষ্ট্রের সাহায্যার্থে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলির এগিয়ে এসে সম্ভাব্য যে সংষর্ষ হতে পারে তা মোকাবিলার সম্ভাবনা বিবেচনায় রাখতে হবে। এক কথায়, খিলাফাত প্রতিষ্ঠার জন্য বা এর স্থিতিশীলতার জন্য যে পদক্ষেপই গ্রহণ করা হোক না কেন, তা ন্যায়সঙ্গত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে এবং তা যেন এমন প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিসহ হয় যে, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই কল্যাণ ব্যবস্থার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হতে পারে।
সূরা বাক্বারাহর ২৪৬-২৪৭ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নবীর উপস্থিতিতে নবীর অনুমোদিত/অধীনস্ত মালিক তথা রাষ্ট্রপতি/সেনাপতি হতে পারে। সুতরাং মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি ধারা হলো ধর্মীয় মূল নেতা ও রাজনৈতিক মূল নেতা যেমন একই জন হতে পারে, তেমনি মুসলিম উম্মাহর আওতায় ধর্মীয় মূল নেতার অধীনে রাষ্ট্রপতি/রাজনৈতিক মূল নেতা থাকার বিষয়টিও গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ উম্মাহর নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দুটি স্বতন্ত্র বিষয়, মুসলিম উম্মাহর মূল নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব দিতে পারে বা তাঁর অধস্তন কেউ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। আবার এখান থেকে আরো বুঝা যায় যে, কোনো অত্যাচারী পরাশক্তির বিরুদ্ধে ক্বিতাল বা যুদ্ধ পরিচালনার স্বাভাবিক পদ্ধতি হলো প্রথমে কোনো ভূখণ্ডে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জনের পর রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তক্রমে যুদ্ধ পরিচালনা করা।
মুসলিম উম্মাহর প্রতি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, যারা চুক্তিবদ্ধ হতে চায় তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে এবং যদি তারা চুক্তিভঙ্গ করার সম্ভাবনা না থাকে সেক্ষেত্রে চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করতে হবে। অবশ্য এ চুক্তি হলো রাজনৈতিক সহাবস্থান বিষয়ক, ধর্মীয়ভাবে পারস্পরিক কিছু বিষয় আত্মীকরণ নয়; যেমন, কোনো হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল হিসেবে চালু করতে সম্মতি নয়। যেসব মু’মিন অপরিহার্য হিজরত করেনি, তারা কুফর করেছে এবং যতক্ষণ হিজরত করবে না ততক্ষণ তারা মু’মিন পদবাচ্য হবে না, ততক্ষণ তাদেরকে আওলিয়া (বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। তারা শত্রুতা সহকারে মু’মিনদের প্রতি বিমুখ হলে তথা মু’মিনদের বিরুদ্ধে কাফিরদের পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধে লিপ্ত হলে তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রের যেখানেই নাগাল পাওয়া যায় সেখানে হত্যা করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু যেসব মুনাফিক্ব মু’মিনদের বিরুদ্ধে কোনো আক্রমণ চালায় না, যারা তাদের ক্বওমের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করে না আবার মু’মিনদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করে না এবং তাদের ক্বওমের থেকেও নিরাপত্তা পেতে চায় ও মু’মিনদের থেকেও নিরাপত্তা পেতে চায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না। এছাড়া যারা এমন ক্বওমের সাথে সংযুক্ত হয় যাদের সাথে মু’মিনদের রাজনৈতিক সহাবস্থানমূলক বা অনাক্রমণ চুক্তি রয়েছে তাহলেও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা যাবে না।
অন্যদিকে যেসব মু’মিন কোনো বাস্তবসঙ্গ কারণে হিজরত করেনি বা করতে পারে নি, তারা হিজরত করার পূর্ব পর্যন্ত তাদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব হিজরতকারীদের উপর নেই। তবে তারা দ্বীনের বিষয়ে সাহায্য চাইলে তাদেরকে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু যে সম্প্রদায়ের সাথে চুক্তি আছে তার বিপরীতে গিয়ে সাহায্য করা যাবে না। সুতরাং রাজনৈতিক সহাবস্থান বা অনাক্রমণ চুক্তিতে চুক্তিবদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে অবস্থানকারী মু’মিন-মুসলিমদের স্বার্থ বা তাদেরকে সাহায্য করার চেয়ে চুক্তিবদ্ধ সম্প্রদায়কে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকাকে অগ্রাধিকার বা বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
যেসব সম্প্রদায় চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর বার বার চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যারা চুক্তি করার পর তাতে খিয়ানাত বা বিশ্বাসঘাতকতা করার লক্ষণ প্রকাশ পায় তাদের চুক্তিকে তাদের দিকে প্রতিনিক্ষেপ করতে হবে। যারা চুক্তি লংঘন করে না তাদের সাথে অবশ্যই চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করতে হবে এবং প্রয়োজনমতো চুক্তির নবায়ন করতে হবে। কিন্তু যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হবে। তবে এসব মুশরিকরা যদি আশ্রয় চায় তাহলে তাদের আল্লাহর আয়াত শুনাতে হবে এবং তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিতে হবে। মুশরিকরা এমন যে, যখন তারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে থাকে, তখন তারা মু’মিনদের প্রতি আত্মীয়তার মর্যাদাও রাখে না এবং সরকার ও নাগরিকের মধ্যে যে স্বাভাবিক সুরক্ষা চুক্তি রয়েছে তারও মর্যাদা রাখে না। অন্যদিকে মুসলিম উম্মাহ কর্তৃত্বে থাকলে তারা মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষ সবার প্রতি আত্মীয়তার মর্যাদাও রক্ষা করে এবং নাগরিক সাধারণের সাথে সরকারের যে স্বত:সিদ্ধ যিম্মাদারি চুক্তি, সেটারও মর্যাদা রক্ষা করে।
কুরআনে যে মুশরিকদের হত্যা করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা তারা মুশরিক হওয়ার কারণে নয়, বরং তারা রাজনৈতিক চুক্তি ভঙ্গ করে মু’মিনদের উপর হামলা চালানোর কারণে, সামাজিক বিশৃঙ্খলা বা রাষ্ট্রে নৈরাজ্য সৃষ্টির কারণে। যে সকল মুশরিক কোনো চুক্তি লঙ্ঘন করেনি, তাদেরকে আক্রমণ করা যাবে না, বরং তাদের সাথে চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করতে হবে।
উপরোল্লেখিত রাজনৈতিক নীতিমালা অনুসারে সাধারণত কর্তৃত্ব কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধানের ভিত্তিতে রাষ্ট্রসমূহকে দুটি প্রধান শ্রেণিতে শ্রেণিবিভাগ করা হয়। যে রাষ্ট্রে মুসলিমদের খিলাফাহ (কর্তৃত্ব-ক্ষমতায় অধিষ্ঠান) প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে ‘দারুল ইসলাম’ বলা হয়। কারণ তাতে ইসলামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিধি-বিধান চালু করা হয়। অন্যদিকে যে রাষ্ট্রে কাফিরদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাকে ‘দারুল কুফর’ বলা হয়। কারণ তাতে দ্বীন-ইসলামকে রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধানের মূল উৎস হিসেবে স্বীকার করা হয় না। তবে ‘দারুল কুফর’ দুই ভাগে বিভক্ত: (ক) ‘দারুল আহদ’ ও (খ) ‘দারুল হারব’। যে রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের সাথে মুসলিম উম্মাহর অনাক্রমণ চুক্তি বা শান্তিচুক্তি হয়, তাকে ‘দারুল আহদ’ (চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্র) বলা হয়। আর যে রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ মুসলিম উম্মাহর সাথে সংঘাতে লিপ্ত থাকে, তাকে ‘দারুল হারব’ (সংঘাতপূর্ণ রাষ্ট্র) বলা হয়। এরূপ রাষ্ট্রে মুসলিমরা ততক্ষণ নিজেদের পরিসরে দ্বীনের বাস্তবায়নের চেষ্টা চালু রাখবে যতক্ষণ সেখানে পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন নিয়মতান্ত্রিক উপায় অবলম্বনের সম্ভাবনা থাকে এবং যতক্ষণ অন্যত্র এর চেয়ে ভালো সম্ভাবনার কারণে হিজরতের প্রয়োজনীয়তা দেখা না দেয়। তারপর দ্বীনের উপর অটল থাকার কারণে যাদেরকে তাদের বাড়িঘর থেকে বহিষ্কার করা হয়, তাদের পাশাপাশি সঠিকভাবে দ্বীন পালনকে অগ্রাধিকার দেয়ার খাতিরে যারা প্রকৃত দুর্বলতাজনিত কারণে হিজরত করতে অপারগ তারা ছাড়া বাকিরা হিজরত করতে হবে।
সুতরাং সকল ‘দারুল কুফর’ই ‘দারুল হারব’ নয়। বরং যে ‘দারুল কুফরে’ মুসলিম উম্মাহর এবং যেকোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকে, কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপর ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিবেচনায় কোনোরূপ নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয় না, বরং তাদের স্বীয় পরিমণ্ডলে নিজ নিজ ধর্মীয় বিধি-বিধান চর্চার স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়, সেরূপ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহ ‘দারুল আহদ’ হিসেবে প্রতীয়মান হয়, সেগুলো ‘দারুল হারব’ নয়। এ ধরনের রাষ্ট্রসমূহকে ‘দারুল ইসলামে’ পরিণত করার জন্য কোনোরূপ বলপ্রয়োগমূলক পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য নয়।
কোনো রাষ্ট্রকে ‘দারুল ইসলামে’ উত্তরণের ক্ষেত্রে গণবিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান, গণতান্ত্রিক নির্বাচন বা ক্রমবিবর্তন প্রক্রিয়ার বিষয়টি ‘বাস্তব পরিস্থিতির দাবি’ ও ‘ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক নীতি’ অনুসারে নির্ধারিত হতে হবে। আমরা যেমন রসূলুল্লাহ দাউদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে পাই, তেমনি রসূলুল্লাহ ইউসুফকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতির অধীনে বিশেষ উপদেষ্টা ও অর্থ বিভাগের কর্তৃত্বমূলক পদে’ দেখতে পাই। তিনি (রসূলুলল্লাহ ইউসুফ) ‘ইসলামের রাষ্ট্রীয় আইন-বিধান’ প্রতিষ্ঠার জন্য রাতারাতি ‘রাজার প্রবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষ আইন-বিধানকে (দ্বীনিল মালিক)’ পরিবর্তন করেন নি; বরং এক্ষেত্রে তিনি একটি ক্রমবিবর্তন প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
যেহেতু দ্বীন গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো জবরদস্তি নেই, তাই কাফিররা তাদের নিজেদের দ্বীন মতো চলার স্বাধীনতা আছে এবং মু’মিনরাও নিজেদের দ্বীন মানার স্বাধীনতা আছে। যারা নিজেদের অপশক্তি প্রয়োগ করে মু’মিনদেরকে নিজেদের জীবনে তাদের দ্বীন পালন থেকে বাধার সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে অন্যরূপ বিধানে চলতে বাধ্য করে তারাই তাগুত। কোথাও কাফিরদের বাস্তব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তার বাস্তবতা অস্বীকারের কিছু নেই, কিন্তু মু’মিনরা তাদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারভার রসূল ও তাঁর অনুপস্থিতিতে উলিল আমরের উপর অর্পণ করতে হবে। নিজেদের মধ্যকার বিষয়ে রসূলকে বা উলিল আমরকে বাদ দিয়ে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া যাবে না। “নিতান্ত বাধ্য হয়ে তাগুতের অধীনে বা তাগুতের বিধানের আওতায় থেকে কর্মসম্পাদন করা” এবং “নিজেদের মূল বিধান (সংবিধান) ও মূল নেতৃত্ব (সরকার) হিসাবে কুরআনের বিধান ও রসূলকে বা উলিল আমরকে গ্রহণ না করে (৪:৬১) তাগুতের আনুগত্য করা ও তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া (৪:৬০) এবং উহাকে উত্তম আচরণ ও সমঝোতার মাধ্যমে সামর্থ্য বৃদ্ধির প্রয়াস বলে অজুহাত পেশ করা (৪:৬২)” দুটি ভিন্ন বিষয়।
নিজেদের মধ্যকার বিষয়ে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া যাবে না। কিন্তু তাদের নাগরিকের অপরাধের ক্ষেত্রে বিচার চাওয়াকে ৪:৬০ আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক বলে সাব্যস্ত করা যায় না। ৪:৫৯ – ৬৫ অনুযায়ী, কুরআন ও রসূলকে বাদ দিয়ে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া এবং নিজেদের পার্থিব স্বার্থবাদিতাকে আড়াল করার জন্য উহাকে ইহসান (উত্তম আচরণ) ও তাওফীক্বের (সমঝোতার মাধ্যমে সামর্থ্যবৃদ্ধির) প্রয়াস বলে অজুহাত পেশ করা মোনাফেকি। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর খেলাফত প্রাপ্তির পূর্বে তাগুতের কাছে তাদের নাগরিকের বিচার চাওয়া একটি ভিন্ন বিষয়, যে ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
এছাড়া যখন কাফিরদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন আল্লাহর বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বিধানের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি নীতিগত অস্বীকৃতি জ্ঞাপন সত্ত্বেও, সাধারণ শৃঙ্খলাগত বিষয়াদিতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রণীত নিয়মাবলির অনুসরণ এবং নাগরিক সুবিধাদির বিপরীতে সরকারকে যথানিয়মে ‘কর’ প্রদান করার নাগরিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মু’মিনদেরকে ইতিবাচক আচরণ করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব কাঠামোতে যখন মু’মিনরা কর্তৃত্ব লাভ করে তখন তাদের দ্বারা কোনোক্রমে ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের অবকাশ নেই, বরং মু’মিনরা ধর্মীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্যই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এভাবে কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয়ে শান্তি-শৃঙ্খলার সাথে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ অনুশীলন করতে বাধ্য।
আল কুরআনের শেষ সূরাটিতে মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্ককে ‘রব্বুন নাস’ (মানুষের প্রতিপালক, প্রভু, বিধানদাতা), ‘মালিকিন নাস’ (মানুষের অধিপতি) ও ‘ইলাহিন নাস’ (মানুষের উপাস্য, মানুষের উপর সার্বভৌমত্বের অধিকারী) হিসেবে প্রকাশ করেছেন। রব বা বিধাতা হিসেবে তিনি মানব জাতিকে তাঁর বিধান প্রদান করেছেন এবং মানুষ যেন তাঁকে ছাড়া নিজেদের মধ্য থেকে একে অন্যকে রব বা বিধানদাতা না বানায় সেই নির্দেশ দিয়েছেন। মালিক হিসেবে তিনি যাকে ইচ্ছা মানব জাতির সমাজ জীবনে রাজত্ব করার সুযোগ দান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছা রাজত্ব কেড়ে নেন। মালিক হিসেবে তিনি তাঁর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী রাজত্ব পরিচালনা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য নবী-রসূল প্রেরণ করেছেন এবং নবী প্রথার সমাপ্তিতে মু’মিনদের মধ্যকার ‘উলিল আমর’ নির্বাচন করে তার আনুগত্য করার জন্য মু’মিনদেরকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। ইলাহ হিসেবে তিনি মু’মিনদের সালাত, নুসুক (ধর্মীয় নির্দেশনাভিত্তিক অনুষ্ঠানাদি) ও মানব জাতির ঐক্যবদ্ধ জীবন যাত্রার কেন্দ্রীয় স্থান বা ক্বিবলা হিসেবে হিসেবে কা’বা/আল বাইতুল হারাম/ আল মাসজিদুল হারামকে নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
কুরআন থেকে জানা যায় যে, ফিরআউন নিজেকে রব, মালিক ও ইলাহ হিসেবে দাবি করেছিল (৭৯:২৩-২৪, ৪৩:৫১, ২৮:৩৮)। বস্তুত যারাই আল্লাহর কিতাবের বাহিরে নিজেরা বিধান রচনা করে এবং নিজেদের খেয়ালখুশিভিত্তিক রাজত্ব ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে তারাই নিজেদেরকে রব, মালিক ও ইলাহ এর স্থানে বসায়, যদিও তারা প্রকৃত রব, মালিক ও ইলাহ নয় এবং যদিও তাদের অনেকে নিজেকে প্রকাশ্যে রব, মালিক ও ইলাহ বলে দাবি করে না। যারা আল্লাহর বিধানের বাহিরে নিজেদের বিধানে মানুষকে চলতে বাধ্য করে, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করে এবং তাদেরকে আল্লাহর বিধান গ্রহণে বাধা দেয় তারাই তাগুত কাফির (প্রতিপালকের বিদ্রোহী ও অবৈধ প্রভুত্বের দাবিদার) এবং সকল সাধারণ কাফিররা এই তাগুত কাফিরদের আনুগত্য ও দাসত্বকারী। নবী-রসূলদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে তাগুতের প্রতি কুফর করে, তাকে ও তার দাসত্ব করাকে পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের দাওয়াত দেয়ার জন্য।
সুতরাং আল্লাহকে রব, মালিক ও ইলাহ হিসেবে মেনে নেয়ার প্রায়োগিক পদ্ধতি হলো আল্লাহর দেয়া কিতাবকে বিধান হিসেবে গ্রহণ করা, আল্লাহর বিধান অনুসারে রসূল ও উলিল আমরের আনুগত্য করা এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে আল মাসজিদুল হারামকে মূল ক্বিবলা বা কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করা। উলিল আমর হলেন রসূলের প্রতিনিধিত্বকারী নির্বাহী নেতৃত্ব এবং যাবতীয় মাসজিদ হলো মুসলিমদের স্থানীয় ক্বিবলা বা ধর্মকেন্দ্র দ্বীনের কেন্দ্র। কুরআন, ‘রসূল ও উলিল আমর’ এবং মাসজিদ হলো মুসলিম উম্মাহর সংবিধান, সরকার ও রাজধানী বা ধর্মগ্রন্থ, ধর্মগুরু ও ধর্মালয়। মাসজিদ মুসলিমদের উপর কুরআনভিত্তিক সাংবিধানিক ও নির্বাহী বিধান ঘোষণার রাজসিংহাসন, কুরআনের বিধান অনুসারে সমষ্টিগত বিষয়াদির তদারকি ও বিচার অনুষ্ঠানের রাজদরবার এবং কুরআনের ভিত্তিতে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত বা ধন-সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের রাজকোষ হিসেবে কাজ করে, যাকে বলা যেতে পারে মুসলিম উম্মাহর সদর দপ্তর। আর উলিল আমর হলেন এই কার্যক্রমে নেতৃত্ব প্রদানকারী কুরআনের বিধান অনুসারে পরিচালিত কর্তৃপক্ষ। এই প্রেক্ষিতে আল্লাহর সার্বভৌমত্বভিত্তিক বিধান অনুসারে উলিল আমর নির্ধারণ ও তার আনুগত্য মু’মিন-মুসলিম হিসেবে জীবন যাপনের জন্য কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা অনুধাবন করা যেতে পারে।
আল কুরআন হলো আসমানী জীবন বিধান সম্বলিত কিতাব। কিন্তু এই কিতাবে লিখিত বিধান অনুসারে কারো প্রতি ব্যভিচারের অভিযোগ শ্রবণ, সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ ও যাচাই এবং ব্যভিচারীকে বেত্রাঘাত করা যেমন কিতাবের কাজ নয়, অনুরূপভাবে তাতে লেখা অন্যান্য বিধানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আর এজন্যই এ কাজগুলো নির্বাহ করার জন্য কিতাবে থাকা নির্দেশ অনুসারেই রসূল ও উলিল আমরকে দায়িত্ব পালন করতে হয়।
উলিল আমর সম্পর্কিত বিধান বাস্তবায়নের জন্য এক উলিল আমর মৃত্যুবরণ করলে বা অপসারিত হলে বা অক্ষম হলে অন্য উলিল আমরের নিকট দায়িত্ব অর্পিত হবে এবং এভাবে যখন যিনি উলিল আমর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন তাঁর আনুগত্য করতে হবে, যতক্ষণ তিনি উলিল আমর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন এবং কুরআনের সীমারেখা সংরক্ষণ করবেন।
যারা কিতাব, ‘রসূল ও উলিল আমর’ এবং মাসজিদকে তাদের সংবিধান, সরকার ও রাজধানী হিসেবে গ্রহণ করবে না, তাদেরকেও সে বিষয়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে তারা কাফির ও মুশরিক হিসেবে সাব্যস্ত হবে এবং তাদের দ্বীন আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এবং সঠিক নয়, কিন্তু ধর্মীয় স্বাধীনতার অবকাশের আওতাভুক্ত হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, উলিল আমরের কোনো নির্বাহী নির্দেশ কোনোক্রমে কুরআনে থাকা কোনো ধারাকে লঙ্ঘন করতে পারবে না। যেমন কুরআনে যে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে (২:২৫৬, ১০৯:৬ সহ আরো অনেক আয়াত), কোনো উলিল আমর কোনোরূপ অজুহাতে তা লঙ্ঘন করে কোনো আইন জারি করতে পারবে না। শুধুমাত্র যেসব বিষয়ে ন্যায়সঙ্গতভাবে সমকালীন পরিস্থিতি অনুসারে কোনো আইন-কানুন নির্ধারণ করার উপযোগিতা তৈরি হয় সেক্ষেত্রে উলিল আমর নির্বাহী বিধান প্রণয়ন করতে পারবেন। কেননা অন্যথায় তিনি আনুগত্য লাভকারী সত্তার ঊর্ধ্বে উঠে দাসত্ব লাভকারীতে পরিণত হবেন, আর এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, নবীরাও মানুষকে নিজেদের দাসত্বকারী বানাতে পারেন না (৩:৭৯)। আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের সীমারেখা লঙ্ঘন করে বিধান দেয়া বা তা মেনে নেয়ার অর্থ হলো একে অন্যকে রব বা বিধানদাতা হিসেবে গ্রহণ করা (৩:৬৪, ৯:৩১)।
কোনো বিষয় নিজ জ্ঞানে আয়ত্ত করা ছাড়া তার পক্ষে বা বিপক্ষে চূড়ান্ত অবস্থান নিয়ে লেগে যাওয়া যাবে না (১৭:৩৬)। অর্থাৎ জ্ঞানায়ত্ত হওয়া ছাড়া অনুসরণ, অন্ধ অনুসরণ, অন্ধ আনুগত্য এবং অন্ধভাবে বিরুদ্ধতা কিছুই করা যাবে না। সুতরাং নিশ্চিত হওয়া ছাড়া কোনো বিধান প্রয়োগ করা যাবে না, আবার অনুমানের উপর ভিত্তি করে বিদ্রোহও করা যাবে না। এভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও কর্তৃত্বের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করা হয়েছে।
মুসলিম উম্মাহর সমষ্টিগত কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য তাদের মধ্যকার উলিল আমর নির্ধারণ ও তার আনুগত্য করতে হবে। এভাবে মুসলিম উম্মাহ আল্লাহর একত্ববাদী বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের সমষ্টিগত কার্যাবলির জন্য স্বতন্ত্র জাতিসত্তা বজায় রাখবে। যে প্রতিষ্ঠান মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার প্রতিষ্ঠান, যেমন: রাষ্ট্র, তাতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে যে-ই নেতৃত্বে থাকে তার যে সকল আদেশ আল্লাহর বিধানের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক নয় তার শৃঙ্খলাজনিত আনুগত্যের বিষয়ে নিষেধ করা হয়নি। অন্যদিকে ইতায়াত বা স্বত:স্ফূর্ত আনুগত্যের ক্ষেত্রে কোনো কাফিরকে মুসলিম উম্মাহর উলিল আমর করা বা তাদের উপর আদেশ দেয়ার ক্ষমতা ও অধিকার প্রত্যর্পণ করার কোনো অবকাশ নেই। মুসলিমদের আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে সংগঠিত জামিয়া বা সংঘবদ্ধতা অবলম্বন করতে হবে এবং মানবজাতির কল্যাণে সাধ্যমতো নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে।
মু’মিনরা তাদের নিজেদের সংঘ-সংগঠন ছাড়া অন্যান্য সম্প্রদায়কে অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না এবং তাদের কোনো সম্প্রদায়ের আনুগত্য করতে পারে না। তবে যে সংঘ-সংগঠন মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সাধারণ সমাজ-সংঘ তার ঐক্য বিনষ্ট করা যাবে না এবং তাতে যার যার ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় রেখে যৌথ স্বার্থের কার্যক্রমে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে লক্ষণীয় যে, বনী ইসরাইল যখন গোবৎস পুজা করেছে তখনো তাদের জাতীয় নেতৃত্বের দায়িত্বে নিয়োজিত রসূলুল্লাহ হারূণ তাদের উপর শিরক প্রতিরোধে অধিক মাত্রায় পীড়াপীড়ি না করে রসূলুল্লাহ মূসার আগমন পর্যন্ত তাদের বিষয়টি স্থগিত রেখেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর উপস্থাপিত ওজর ছিলো, তিনি চাননি বনী ইসরাইলের একাংশকে পৃথক করে দিতে, বনী ইসরাইলের জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করতে (২০:৯৪)।
কুরআনী মানদণ্ডে পরামর্শভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠাকরণের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ, জামিয়া, শূরা ও উলিল আমর বিষয়ে নির্দেশনা অনুসারে বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উম্মাহ বা জামিয়ার বিষয়টি একটি মৌলিক বিষয় এবং এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটি কারো একচেটিয়া দাবির বিষয় নয়, বরং ‘আসলামতু লিরব্বিল আলামীন’ বলে ঘোষণাকারী ব্যক্তিরা আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়নার্থে শূরাভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামোতে একীভূত হতে হবে।
'মুসলিম উম্মাহর’ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এবং সমন্বিত অবস্থায় তার যথাযোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন করার ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। যারা কুরআনকেন্দ্রিক কাজ করছে তাদের সবাইকে নিয়ে একটা একীভূত কাঠামো অপরিহার্য, কাউকে বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। আর সালাত-সিয়াম প্রভৃতি আমলগত বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধির ক্ষেত্রে, প্রাথমিকভাবে সেগুলো নিয়ে পরস্পর বাড়াবাড়ি না করে, যারা কুরআনকে দ্বীনের একমাত্র দলীল বলে মেনে নিয়েছি তাই আল কুরআনের মানদণ্ডে কোন উপলব্ধি সঠিক হয় তা নির্ণয়ের ব্যাপারটাকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাপক আলোচনার জন্য টেবিল টাস্ক হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। অথবা যদি এ বিষয়গুলোতে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তকে উলিল আমর নির্ধারণ করে একীভূত কাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি বলে পরামর্শ আসে, সেক্ষেত্রে সেভাবেই উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। আর এজন্য একটি ‘সমন্বয় উদ্যোগ গ্রহণকারী সংঘ’ কাজ করতে পারে।
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিশ্বজনীন সংঘবদ্ধতা ও পিরামিড সিস্টেমে বৈশ্বিক কেন্দ্রীয় প্রধান উলিল আমরের আওতায় প্রয়োজনমতো উলিল আমর নির্ধারণ ও সমষ্টিগত কার্যক্রম পরিচালনা একটি লক্ষ্যমাত্রা। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার বাস্তব উপায় হলো প্রথমে যাদের মধ্যে একক কাঠামোতে বাস্তব যোগাযোগ স্থাপন ও সমষ্টিগত কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব তাদের মধ্যে এ ব্যবস্থা কার্যকর করা এবং এভাবে ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্রীয় উলিল আমর ও সংঘবদ্ধতা, যাদের মধ্যে আদর্শগত ঐক্য বজায় থাকবে, কিন্তু বাস্তবসঙ্গত কারণে নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামোর একীভুতকরণ প্রক্রিয়াধীন থাকবে। এরূপ নীতি অবলম্বন করা যারা হিজরত করতে পারে নি তাদের বাস্তব অভিভাবকত্ব থেকে রসূল ও মু’মিনদেরকে অব্যাহতি দেয়ার নির্দেশনার (৮:৭২) সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
পরিশেষে বলা যায় যে, আল্লাহর বিধান অনুসারে সমষ্টিগত বিষয়াদির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার জন্য এবং মুসলিম উম্মাহর সংঘবদ্ধতা ও মানবজাতির কল্যাণে সর্বোত্তমভাবে ভূমিকা পালনের জন্য মু’মিনদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা উলিল আমর নির্ধারণ ও তার যথাবিধি আনুগত্য অত্যন্ত আবশ্যকীয় একটি বিষয়। মু’মিনদের পারস্পরিক পরামর্শক্রমে তাদের মধ্য থেকে সততা ও যোগ্যতার দিক থেকে অগ্রগণ্য তথা নেতৃত্বের আমানাত বহনের যোগ্য ব্যক্তিকে নেতৃত্বের আমানাত অর্পণের মাধ্যমে উলিল আমর হিসেবে নির্ধারণ করতে হবে এবং কুরআনের সীমারেখা সংরক্ষণ করে ও পরামর্শভিত্তিক নীতিমালা অনুসারে যতদিন তিনি উলিল আমর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ততদিন তাঁর আনুগত্য করতে হবে। উলিল আমরের সাথে মতবিরোধ হলে তাও কুরআন নির্দেশিত পদ্ধতিতে সমাধান করতে হবে। এ বিষয়গুলো এত গুরুত্বপূর্ণ যে, এগুলোকে আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমানের দাবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে (ইন কুনতুম তু’মিনূনা বিল্লাহি ওয়াল ইয়াওমিল আখির- ৪:৫৯)
আমর أَمْر : আমর শব্দের অর্থ ‘আদেশ, নির্দেশ, সিদ্ধান্ত, সিদ্ধান্তপূর্ণ বিষয়, কার্যক্রম’। কুরআনে জানানো হয়েছে যে, যাবতীয় আমর বা নির্দেশ আল্লাহর আয়ত্তে তথা আল্লাহই আদেশ প্রদানের প্রকৃত অধিকারী এবং তাঁর অনুমোদন ছাড়া কেউ কোনোরূপ আদেশ প্রদানের অধিকার রাখে না। অত:পর আল্লাহ ন্যায়সঙ্গত আদেশ প্রদান ও অন্যায় থেকে নিষেধ করার’ আদেশ দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহর বিধানের সীমারেখা রক্ষা করার শর্তে একে অন্যকে আদেশ দেয়ার অধিকার লাভ করে। আল্লাহর আদেশসমূহ তাঁর নাযিলকৃত কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এটাকে মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সাংবিধানিক আদেশ বলা যেতে পারে। আল্লাহ প্রদত্ত সাংবিধানিক আদেশ বাস্তবায়নের স্বার্থে এবং তার কোনো সীমারেখা লঙ্ঘন না করে রসূল এবং উলিল আমর (আদেশ দেয়ার অধিকারী) ব্যক্তিবর্গ যে ধরনের আদেশ দিয়ে থাকেন সেটাকে ‘নির্বাহী আদেশ’ বলা যেতে পারে। নির্বাহী আদেশ সমকালীন বাস্তবসম্মত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রয়োজন অনুসারে হয়ে থাকে এবং পরিস্থিতির পরিবর্তনে পরিবর্তনীয় ধরনের হয়ে থাকে।
আমরিন জামিয়িন أَمْرٍ جَامِعٍۢ : আমরিন জামিয়িন শব্দের অর্থ হলো ‘সমষ্টিগত বিষয়, সমষ্টিগত দায়-দায়িত্ব, সমষ্টিগত কার্যক্রম’। অর্থাৎ যে কাজ অনেকে মিলে সমষ্টিগতভাবে করা হয় বা করতে হয় এবং যে বিষয়টি কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয় নয় বরং অন্যদের সাথে সম্পর্কিত বিষয় তাকে ‘আমরিন জামিয়িন’ বা সমষ্টিগত বিষয় ও কাজ বলে। উলিল আমর নির্ধারণ, মু’মিনদেরকে পরিচালনা বা তাদের নেতৃত্ব প্রদান, পারস্পরিক পরামর্শ, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সামষ্টিক অর্থনীতি, দণ্ডবিধি কার্যকর করা ইত্যাদি বিষয়গুলো ‘আমরিন জামিয়িন’ বা ‘সমষ্টিগত বিষয়’ এর অন্তর্ভুক্ত।
আল বাইতুল হারাম الْبَيْتَ الْحَرَامَ : আল বাইতুল হারাম শব্দের অর্থ হলো ‘সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠান’। কুরআনে কা’বাকে আল বাইতুল হারাম বলা হয়েছে। আল বাইতুল হারাম হলো মানবজাতির স্রষ্টার নির্দেশিত বিধান মোতাবেক সমষ্টিগত জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত প্রতিষ্ঠান। বস্তুত এটিই হলো মানবজাতির বিশ্বকেন্দ্র। এটি তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ও চিহ্নিত।
আল মাসজিদুল হারাম الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ : আল মাসজিদুল হারাম শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘সংরক্ষিত মাসজিদ’। কা’বাকে কেন্দ্র করে কা’বার প্রাঙ্গনে যে মাসজিদটি রয়েছে তাকে আল মাসজিদুল হারাম বলা হয়। সাধারণত মনে করা হয় মাসজিদ মানে কোনো ভবন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাসজিদ হলো যেখান থেকে কার্যাদি পরিচালনার সাথে জড়িত যাবতীয় ব্যবস্থাপনা করা হয়। সুতরাং মাসজিদ হলো প্রতিষ্ঠান। কুরআনে মুনাফিকদের কর্তৃক নির্মিত ষড়যন্ত্রের মাসজিদের (মাসজিদে দিরার) এর প্রসঙ্গও আলোচিত হয়েছে, যাকে মু’মিনদের বিরুদ্ধে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিলো। সুতরাং মাসজিদ এর ধারণা বুঝতে হলে এই ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের ধারণা থাকতে হবে। মাসজিদ একই সাথে চুক্তি করার স্থান, স্বাক্ষগ্রহন, বিচার ও বিচারের রায় প্রাদনের স্থান হিসেবে কুরআনে পরিচিতি পেয়েছে যা এ নিদের্শ করে যে এটি মুসলিমদের প্রশাসনিক কেন্দ্রের কার্যনির্বাহি স্থান। আল মাসজিদুল হারামকে মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্র বা ক্বিবলাহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। হজ্জের কার্যাদির ব্যবস্থাপনাও আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনার অংশ। আল মাসজিদুল হারাম হলো মানবজাতির মধ্যে শান্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণকর্মের সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে নির্ধারিত কুরআন নির্দেশিত সাংবিধানিক কেন্দ্র। এটিকে সাংবিধানিক কেন্দ্র হিসেবে মর্যাদার সাথে গ্রহণ করে বাস্তব সুবিধার ভিত্তিতে যে কোথাও থেকে নির্বাহী কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে বা বলা যায়, নির্বাহী পরিচালনা কেন্দ্র (সেকেন্ডারি কেন্দ্র) হিসেবে যে কোথাও থেকে কার্যক্রম পরিচালনার অবকাশ রয়েছে। তবে হজ্জ ব্যবস্থাপনা এবং মূল ক্বিবলার জন্য আল মাসজিদুল হারামকে গ্রহণ করতে হবে।
আহলে কিতাব أَهْلُ الْكِتَاب : ‘আহলে কিতাব’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘কিতাব সম্পর্কীয় পরিবার, কিতাবের বলয়ে থাকা ব্যক্তিবর্গ, কিতাবের অনুসারী’। কুরআন নাযিলের সমকালে যারা ‘অকিতাবী’ ছিল তাদেরকে ‘উম্মীয়্যূন’ শব্দ দ্বারা চিহ্নিত করা হতো এবং যারা ‘পূর্ববর্তী কিতাবের অনুসারী’ ছিল তাদেরকে ‘আহলে কিতাব’ বলে চিহ্নিত করা হতো। আহলে কিতাবের দাবি ছিল যে, উম্মীদের প্রতি তাদের তেমন কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। কুরআনে আহলে কিতাবকে ‘আহলে কিতাব’ হিসেবে এবং উম্মীদেরকে ‘উম্মী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে উম্মীদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আহলে কিতাব ও উম্মীদের মধ্য থেকে যারাই কুরআনের প্রতি ঈমান এনেছে তাদেরকে ‘মু’মিন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং কুরআনের পরিভাষা অনুসারে ‘আহলে কিতাব’ শব্দের প্রায়োগিক অর্থ হলো ‘কুরআনের পূর্ববর্তী কিতাবের অনুসারী’। কুরআনে আহলে কিতাবকে ঈমানের আহবান জানানো হয়েছে। আবার মু’মিনদের জন্য আহলে কিতাবের খাদ্য গ্রহণ এবং তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনকে বৈধ করা হয়েছে।
ইখতিলাফ اخْتِلَاف : ইখতিলাফ শব্দের অর্থ “মতভেদ, মতানৈক্য, স্ববিরোধ, বৈপরীত্য”। ইখতিলাফ সম্পর্কে কুরআনের কিছু বক্তব্য হলো: কুরআনে ইখতিলাফ (স্ববিরোধ, বৈপরীত্য) নেই। মানবজাতি শুরুতে একত্ববাদী একক উম্মাহ ছিলো, পরবর্তীতে তারা মতভেদ করে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে, তখন আল্লাহ ইখতিলাফের নিরসনের জন্য নবীদের কাছে কিতাব পাঠিয়েছেন, তবে যারা সত্যিকার ঈমান আনে তারাই কিতাবের মাধ্যমে ইখতিলাফ থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত পথনির্দেশ লাভ করে। আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের মাধ্যমে যাবতীয় ইখতিলাফের নিরসন সম্ভব, কিন্তু কিতাবের মাধ্যমে সত্য জ্ঞান পাওয়ার পরও পারস্পরিক জিদবশত ইখতিলাফ বজায় থাকে। প্রকৃত মু’মিনরা ইখতিলাফ থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত সত্যের সন্ধান করবে, কিন্তু ইখতিলাফ নিরসনের জন্য কারো উপর কিছু চাপিয়ে দিবে না। চূড়ান্ত পর্যায়ে ক্বিয়ামাত দিবসে আল্লাহ যাবতীয় ইখতিলাফের নিরসন ঘটাবেন।
ইতায়াত إِطَاعَةٌ : ইতায়াত শব্দের অর্থ ‘স্বত:স্ফূর্ত আনুগত্য’। কোনো কর্তৃপক্ষকে নিজেদের কর্তৃপক্ষ হিসেবে আন্তরিকভাবে মেনে নেয়ার প্রেক্ষিতে তার আদেশের আনুগত্য করাকে ইতায়াত বলা হয়। আল কুরআনে মু’মিনদেরকে ‘আল্লাহর, তাঁর রসূলের ও উলিল আমরের’ আনুগত্য করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং মু’মিনদের জন্য অন্য সকল আনুগত্য এই কেন্দ্রীয় আনুগত্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। তবে উলিল আমর যদি কোনোক্রমে আল্লাহর বিধানের কোনো সীমা লঙ্ঘন করেন সেক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্য করা যাবে না, বরং তাঁকে সংশোধনী দিতে হবে, যদি তিনি সংশোধিত না হন, তাহলে তাঁকে আর উলিল আমর হিসেবে মেনে নেয়া যাবে না। উলিল আমরের সাথে মতবিরোধ হলে তা আল্লাহর ও তাঁর রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেয়ার অর্থ হলো আল্লাহর বিধানের দিকে ফিরিয়ে দেয়া এবং রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার অর্থ হলো যেন রসূল আল্লাহর বিধান অনুসারে তার সমাধান কার্যকর করেন সেজন্য তাঁর দিকে ফিরিয়ে দেয়া। বর্তমানে রসূলের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্বশীল হিসেবে মু’মিনদের নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষ এই বিষয়ে মীমাংসার দায়িত্ব পালন করবে।
ইমাম إِمَام : ইমাম শব্দের মূল অর্থ হলো ‘যাকে সামনে রাখা হয়’। ইমাম শব্দটি ব্যক্তি, বস্তু ও স্থান প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে মুত্তাকীদের নেতাকেও ইমাম বলা হয়েছে এবং কাফিরদের নেতাকেও ইমাম বলা হয়েছে। নবী-রসূলগণ আল্লাহর মনোনীত ইমাম। এছাড়া যারাই মু’মিনদের বা কাফিরদের ইমাম হয়, তাদেরকে আল্লাহ মু’মিনদের বা কাফিরদের ইমাম বানিয়েছেন হিসেবে সাব্যস্ত হবে। সুতরাং ভালো কাজের ক্ষেত্রে এবং মন্দ কাজের ক্ষেত্রে যাদেরকে সামনে রেখে বা যাদের আদর্শ (ideology) ও নির্দেশ (instruction) অনুসরণ করে জীবন যাপন ও কার্যক্রম করা হয় তারাই হলো ‘ইমাম’। মু’মিনরা চেষ্টা করবে ঈমান ও সৎকর্মের ক্ষেত্রে ইমাম বা অনুসরণযোগ্য হওয়ার জন্য। উলিল আমর ও ইমামের একটি পার্থক্য হতে পারে: উলিল আমর হয় পরিচালনাগত কর্তৃত্বের অধিকারী। কিন্তু ইমাম পরিচালনাগত কর্তৃত্বের অধিকারী হতেও পারেন, নাও হতে পারেন, কিন্তু জনমনে তাঁর কাজের প্রভাব থাকে এবং তাঁকে অনুসরণ করা হয়। ইমাম শব্দের অন্যান্য ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে : আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাবকেও ইমাম বলা হয়, যেহেতু তা সামনে রেখে জীবন যাপন করতে হয়। প্রধান পথকেও ইমাম বলা হয়, যেহেতু সেই পথকে সামনে রেখে শাখা পথগুলোকে চিহ্নিত করা হয়।
ঈমান إِيمَان : ঈমান শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘বিশ্বাস, আস্থা, বিশ্বস্ততা বজায় রাখা’। কুরআনে শব্দটি আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর নবী-রসূলগণ, তাঁর কিতাবসমূহ এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের ক্ষেত্রে তাঁর নাযিলকৃত তথ্য অনুসারে বিশ্বাস রাখার পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ঈমান মানুষের অতীন্দ্রীয় বিষয়সমূহের সাথে সম্পর্কিত বিধায় এটি একটি ধর্মীয় বিষয়। তাই কুরআনে ঈমান আনা না আনার ক্ষেত্রে মানুষকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। সেই সাথে জানানো হয়েছে যে, যারা ঈমানের পরিবর্তে কুফর করবে (অর্থাৎ সত্যকে প্রত্যাখ্যান করবে) তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে যে ব্যক্তি ঈমান আনেনি অথবা ঈমান আনার পর আবার তা ত্যাগ করে কুফর করেছে তাকে শাস্তি দেয়ার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি, বরং তার বিষয়টি আল্লাহর সোপর্দ এবং তিনিই আখিরাতের বিচার দিবসে তার বিচার করবেন।
উম্মাহ أُمَّة : উম্মাহ শব্দের সাধারণ অর্থ ‘জাতি’। তবে উম্মাহ শব্দটি একাধিক বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে। যেমন, ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি হওয়া, ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টি, একাধিক গ্রুপে বিভক্ত জনসমষ্টির প্রত্যেক গ্রুপের ঐক্যবদ্ধ অবস্থা, সামাজিক দূরত্ব সত্ত্বেও বৈশিষ্ট্যগত ঐক্যের প্রেক্ষিতে একই প্রজাতি বা আদর্শবদ্ধ (মনস্ত্বাত্বিক সম্পর্কে জড়িত) সত্তাগত দল, একটি আদর্শিক জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত জাতির আদর্শের ধারক একক ব্যক্তিত্ব যা জাতির প্রতিটি সদস্যের ঐক্যবদ্ধতার প্রতীক। এছাড়া উম্মাহ বলতে কালগত ভিন্নতার উম্মাহ এবং একই কালের ভিন্ন ভিন্ন উম্মাহকেও বুঝায়। কুরআন অনুযায়ী আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন বর্ণ, গোত্র, পেশা, ভাষা ও দেশীয় সীমানায় বিভক্ত করেছেন যেন তারা পরস্পর পরিচিত হতে পারে। কিন্তু এগুলো জাতীয়তার ভিত্তি বা উপাদান হতে পারে না। বরং বিশ্বব্যাপী মানবজাতির একটি জাতি হিসেবে পরিগণ্য এবং আল্লাহই তাদের সবার প্রতিপালক, প্রভু ও বিধানদাতা। কিন্তু মতাদর্শের দিক থেকে এবং যারা আল্লাহকে তাদের প্রভূ হিসেবে বিশ্বাস ও স্বীকার করে তারা এবং অন্যদিকে যারা আল্লাহকে তাদের প্রভু হিসেবে বিশ্বাস ও স্বীকার করে না বা তাঁর সাথে শিরক করে তারা দুটি ভিন্ন জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত। এর প্রথমটি ‘মুসলিম উম্মাহ’ এবং দ্বিতীয়টি ‘অমুসলিম উম্মাহ’। মুসলিম উম্মাহ তাদের সময়, স্থান ও কালগত ব্যবধান সত্ত্বেও একই উম্মাহ হিসেবে সাব্যস্ত হবে। ‘মুসলিম’ (আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণকারী) পরিচয়কে খণ্ডিত করে যারা ইয়াহুদ ও নাসারা (খ্রিস্টান) নামে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে তাদেরকে জানানো হয়েছে যে, তারা যেন এরূপ খণ্ডিত পরিচয়ের পরিবর্তে তাদের পিতৃপুরুষ ইবরাহীমের অনুসরণে ‘মুসলিম’ পরিচয়কেই অবলম্বন করে। অন্যকথায়, তাদের প্রকৃত আদর্শগত পরিচয় যে ‘মুসলিম’, সে বিষয়টি তারা বিস্মৃত হয়েছে বা সে বিষয়ে তাদের উদাসীনতা রয়েছে। তাদের মধ্যেও অনেকে মু’মিন রয়েছে, তবে তাদের কোনো ফিরক্বা বা সম্প্রদায়ের আনুগত্য করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
উলিল আমর أُو۟لِى ٱلْأَمْرِ : উলিল আমর শব্দের অর্থ ‘আদেশ দেয়ার অধিকারী, নির্বাহী পরিচালক, নেতৃত্ব প্রদানকারী’। আল্লাহ মানবজাতির হিদায়াতের জন্য যুগে যুগে তাঁর মনোনীত নবী-রসূলদের কাছে কিতাব নাযিল করেছেন এবং যারা তাঁদের আহবানে সাড়া দিয়ে ঈমান আনবে তাদের মধ্যে কিতাবের বিধি-বিধান বাস্তবায়নের নির্বাহী দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। এভাবে নবী প্রেরণের প্রথার সমাপ্তিতে তথা আল কুরআন নাযিলের পর কিয়ামাত পর্যন্ত এই আল কুরআন অনুযায়ী মু’মিনদেরকে পরিচালনার ব্যবস্থা হিসেবে রসূলের অবর্তমানে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে ‘উলিল আমর’দের আনুগত্য করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং উলিল আমর হলেন মু’মিনদেরকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালনার জন্য তাদের সমকালীন ‘অবিসম্বাদিত নেতা’। মু’মিনদের পরামর্শক্রমেই তাদেরই মধ্য থেকে নেতৃত্ব প্রদানের আমানাত বহনের জন্য উপযুক্ত তথা সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে উলিল আমর হিসেবে নির্ধারণ করতে হবে এবং যতক্ষণ তিনি কুরআন অনুসারে পরিচালিত থাকেন ও পরিচালিত করেন ততক্ষণ তাঁর আনুগত্য করতে হবে। উলিল আমরের মেয়াদকাল বা পুন:নির্বাচন পরামর্শভিত্তিক নীতি অনুসারে নির্ধারিত হবে। উলিল আমরের সাথে মতবিরোধ হলে তাও কুরআনের নির্দেশনা অনুসারে সমাধান করতে হবে।
কাফির كَافِر : কাফির শব্দের অর্থ “যে ঢেকে রাখে, অস্বীকারকারী, প্রত্যাখ্যানকারী, অকৃতজ্ঞ”। কুরআন অনুযায়ী যারা ঈমানের বিষয়গুলোতে ঈমান আনতে অস্বীকার করে বা আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে প্রত্যাখ্যান করে সে কাফির। কাফিররা দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে মানুষকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে যে, “সে ইচ্ছা করলে মু’মিন হতে বা কাফির হতে পারবে, এজন্য কেউ তাকে বাধ্য করতে পারবে না”। যে কাফিররা মু’মিনদেরকে তাদের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অত্যাচার-নির্যাতন করে এবং মু’মিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের মোকাবেলায় বাড়াবাড়ি না করে ন্যায়সঙ্গত পর্যায়ে কঠোরনীতি অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেই সাথে যারা মু’মিনদের উপর হামলা-নির্যাতন চালায় না, তাদের প্রতি সদাচার করার নির্দেশনা রয়েছে।
কা’বা كَعْبَة : কা’বা শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘টাখনু’। যেমন আমরা ওজু করার সময় দুই পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধৌত করতে হয়, এক্ষেত্রে দুই পায়ের টাখনু বুঝাতে ‘কা’বা’ শব্দের দ্বিবচন ‘কা’বায়নি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। শারীরিকভাবে টাখনু মানুষের ভরকেন্দ্র বা ভারসাম্যের অঙ্গ, আর দ্বীনের ক্ষেত্রে কা’বার ভূমিকা তেমনি মানবসমাজের কল্যাণ ও নিরাপত্তার মাধ্যমে শান্তির ভারসাম্য কেন্দ্র। মানবজাতির জন্য যে কা’বা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তা হলো ‘আল বায়তুল হারাম’। অর্থাৎ এক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠানকে কা’বা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মানবজাতিকে একত্ববাদী উপাসনার কেন্দ্রে আবর্তিত রাখার জন্য এবং মানবজাতির প্রতি একত্ববাদের হিদায়াত এবং সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা হিসেবে।
কিতাব كِتَاب : কিতাব শব্দের অর্থ ‘লিখিত জিনিস, বই-পত্র, বিধানগ্রন্থ, বিধিবদ্ধ বিধান, লিখিত বা অলিখিত বিধান, কার্যবিবরণী, প্রাকৃতিক বিধি ইত্যাদি’। কিতাবের প্রতি ঈমান বলেতে বুঝায় আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের প্রতি ঈমান। মহান আল্লাহ যুগে যুগে মানুষের হিদায়াতের জন্য তাদের মধ্য থেকে যাদেরকে নবী-রসূল হিসেবে বাছাই করেছেন তাদের কাছে কিতাব নাযিল করেছেন। এ কিতাবসমূহের মধ্যে সর্বশেষ কিতাব হলো ‘আল কুরআন’। আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের বাহিরে দ্বীন ইসলামের বিষয়ে কোনো দলীল বিধানগত মর্যাদা পেতে পারে না। আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের বিধানই মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মূল বিধান বা সংবিধান হিসেবে সাব্যস্ত। যারা আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাব অনুযায়ী বিচার-ফায়সালা করবে না তারা কাফির বা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে এবং তাদের আনুগত্য করা যাবে না।
ক্বিবলাহ قِبْلَة : ক্বিবলাহ শব্দের অর্থ হলো ‘যে স্থানকে কেন্দ্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়, যে স্থানকে ধর্মমন্দির হিসেবে কবুল বা গ্রহণ করা হয়, যে স্থানের দিকে মুখ ফিরানো হয়, কেন্দ্রীয় উপাসনাগৃহ’। একেক ধর্মের অনুসারীরা একেক ক্বিবলাহর (অর্থাৎ নিজস্ব ধর্মীয় আদর্শ) দিকে মুখ ফিরায় এবং একে অন্যের ক্বিবলাহর অনুসরণ করে না। মুসলিমদের কর্তব্য হলো আল্লাহর আয়াতের মাধ্যমে সর্বশেষ চূড়ান্ত কিবলা হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়া ‘আল মাসজিদুল হারামের’ (আল্লাহর বিধান শুনা ও মানার সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠান) দিকে মুখ ফিরানো এবং স্পষ্ট জ্ঞান প্রাপ্তির পরও অন্যদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করা যাবে না। তবে বিভিন্ন কিবলার যে বিভিন্নতা সেটা নিরসনের মূল পন্থা কখনো কোনো একটি ক্বিবলাহর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন ও অন্য কিবলাগুলোকে নাকচ করা নয়। বরং কল্যাণকর পন্থা পদ্ধতি অবলম্বনকেই মুল নীতি হিসেবে স্থির করে কল্যাণকর্মে প্রতিযোগিতা করাই একই চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছার রাজপথ। ক্বিবলাহ শব্দের মাধ্যমে ‘কেন্দ্র বা রাজধানী’ বুঝায়।
খলীফা خَلِيفَة : খলীফা শব্দের অর্থ ‘প্রতিনিধি, স্থলাভিষিক্ত’। কেউ যখন কারো অনুপস্থিতিতে তার প্রতিনিধিত্ব করে তখন তাকে খলীফা বলা হয়। আবার যখন কেউ পূর্ববর্তী কাউকে হটিয়ে বা তার অপসারণের পর ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ত হয়, তাকেও খলীফা বলা হয়। মানুষকে পৃথিবীতে খলীফা বানানো হয়েছে অর্থাৎ পৃথিবীর বস্তুজগত ও প্রাণীজগতের উপর তাকে বিশেষ ধরনের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। যখন পৃথিবীতে মানুষের সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রে কর্তৃত্বশীল শাসকবর্গ জুলুম করে তখন এক পর্যায়ে তাদেরকে অপসারিত করে মুসলিম উম্মাহকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা হয়। এর মাধ্যমে মুসলিমরা এবং তাদের নেতৃত্ব দানকারী রসূল বা উলিল আমর খলীফা হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে। অন্য কথায়, মুসলিম উম্মাহর খেলাফত রাষ্ট্রে উলিল আমর একই সাথে মুসলিম উম্মাহর উলিল আমর হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রাষ্ট্রের (মুলক) রাষ্ট্রপতি (মালিক) এবং খলীফা হিসেবেও আখ্যায়িত হতে পারেন।
জামিয়া جَمِيعٌ : জামিয়া অর্থ “সকল, সকলে একত্রে, ঐক্য, সংঘ”। বিশেষ করে যখন অনেকে একত্র হয় কোনো একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচীর উপর ভিত্তি করে তখন এর মধ্যে সংঘবদ্ধতার বিষয় বুঝানো হয়। কুরআনে জামিয়া শব্দটির বিপরীতে আনা হয়েছে তাফাররক্বূ বা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া (৩:১০৩) এবং ‘ক্বূলূবুহুম শাত্তা’ বা ‘তাদের অন্তরসমূহ বিভক্ত বা পরস্পরের প্রতি মিল-মহব্বতমুক্ত’(৫৯:১৪) আনা হয়েছে। সুতরাং কিছু লোক কোনো কর্মসূচীর ক্ষেত্রে একসাথে কাজ করার ক্ষেত্রে জামিয়া বলতে বুঝায় তাদের দিলের মিল থাকা এবং ঐক্যবদ্ধতা বা সাংগঠনিকতা থাকা তথা সংঘবদ্ধতা। উচ্ছৃংখল ও বেকুব জনতার ভিড়কে কখনো জামিয়া বলা হয় না। মুসলিম উম্মাহর জামিয়া হতে হবে 'বিহাবলিল্লাহ' বা 'আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে' অর্থাৎ আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে। সুতরাং যেকোনো ঐক্য বা সংঘকে 'মু'মিনদের জামিয়া' হিসেবে সাব্যস্ত করা যায় না এবং বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের সংঘবদ্ধতা থাকলেও মু'মিনদেরকে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের জন্য স্বতন্ত্র জাতিসত্তা বজায় রেখে নিজেদের জামিয়া বা সংঘবদ্ধতা বজায় রাখতে হবে।
তাগুত طَاغُوت : তাগুত শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রমকারী’। পরিভাষায় তাগুত বলতে বুঝায়: যে ব্যক্তি বা পরিষদ আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহর দাসত্ব করার পরিবর্তে নিজের দাসত্ব করতে বাধ্য করে, আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে নিজের বিধান পালনে বাধ্য করে, কাফিরদের উপর নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব বা শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনার পাশাপাশি তাদেরকে মু’মিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় নির্দেশনা দেয়। তাগুত মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করে তথা ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার একটি শর্ত হলো: তাগুতের প্রতি কুফর করা তথা তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করা, তাগুতের ইবাদাত-দাসত্ব বর্জন করা। কাফিররা তাগুতের পথে যুদ্ধ করে এবং মু’মিনরা আল্লাহর পথে তথা ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য জান ও মাল দ্বারা সংগ্রাম করে। তাগুতী অপশাসনের অপসারণের জন্য মু’মিনদের কর্মসূচী হলো: ঈমান ও আমলে সালেহ বা সৎকর্ম ও প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জনমূলক কাজের মাধ্যমে আত্মগঠন করা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যে ধর্মনিরপেক্ষ শাসক ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করে না, তাকে তাগুত আখ্যা দেয়া যায় না।
তানাযা' تَنَازَعَ : তানাযা’ শব্দের অর্থ হলো ‘নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ করা’। মু’মিনদের মধ্যে কোনো বিধানের তাৎপর্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বা কোনো নির্বাহী বিধানের যথোপযোগিতা ও তা বাস্তবায়ন করা না করা নিয়ে তানাযা’ বা মতবিরোধের উৎপত্তি হতে পারে। মু’মিনরা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বিচার-ফায়সালা করার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তা তাদের মু’মিন থাকার শর্ত। কিন্তু কোনো বিধানের তাৎপর্য নির্ণয়ে মু’মিনদের মধ্যে মতবিরোধ হলে অথবা কোনো নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণকে কেন্দ্র করে তাদের নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ হলে অথবা উলিল আমরের সাথে মু’মিনদের কারো বা কতিপয়ের মতবিরোধ হলে সেই অবস্থায় তার সমাধানের জন্য আল্লাহর দিকে ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেয়ার অর্থ হলো ‘আল্লাহর বিধানের দিকে ফিরিয়ে দেয়া তথা আল্লাহর বিধানের সমন্বিত ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ অধ্যয়নের মাধ্যমে তার সমাধান তালাশ করা’ এবং রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার অর্থ হলো, ‘রসূল যেন আল্লাহর বিধান অনুসারে সেই মতবিরোধের সমাধানমূলক সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন সেজন্য তাঁর দিকে ফিরিয়ে দেয়া’। যেখানে রসূল উপস্থিত নেই সেখানে মু’মিনদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ফায়সালার ক্ষেত্রে কুরআনের নির্দেশনা অনুসারে মু’মিনদের নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষ রসূলের প্রতিনিধিত্বশীল ভূমিকা পালন করবে। ৪৯:৯ আয়াত থেকে এরূপ মূলনীতি নির্ণিত হয়। নির্বাহী বিষয়াদিতে পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধরন এমন হওয়া উচিত, যাতে তানাযা’ বা মতবিরোধের উৎপত্তি না ঘটে। ৩:১৫২ ও ৮:৪৬ আয়াতে তানাযা’ বা মতবিরোধের ফলে সাহস ও জীবনীশক্তি কমে যাওয়া, ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া এবং মু’মিনদের প্রতি শত্রুতাকারীদের মোকাবেলায় ব্যর্থ হওয়ার পরিণতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সুতরাং একদিকে যেমন তানাযা’ বা মতবিরোধকে দ্বীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই বরং তা ঘটলে তার সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনি অন্যদিকে যেন তানাযা’ বা মতবিরোধের উৎপত্তি না ঘটে বা অযথা মতবিরোধ তৈরি করা না হয় সেদিকে নিজেদেরকেই সচেতন থাকতে হবে।
তাফরীক্ব, তাফাররুক্ব تَفْرِيق, تَفَرُّق : তাফরীক্ব শব্দের অর্থ হলো ‘বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি’ এবং ‘তাফাররুক্ব’ শব্দের অর্থ হলো ‘পরস্পর বিচ্ছিন্নতা, বিচ্ছিন্নতাবাদিতা, দলাদলি’। কুরআনে মু’মিনদেরকে আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়া, বিচ্ছিন্নবাদিতা বা দলাদলি করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত একই দ্বীনকে সামগ্রিকভাবে অনুসরণের জন্য মু’মিনরা একই জাতিসত্তা হিসেবে থাকতে হবে এবং নিজেদের দ্বীনকে বিভিন্নভাগে বিভক্ত করে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হতে পারবে না। যারা এই ঐক্যের মূলনীতিকে লঙ্ঘন করে যার কাছে দ্বীনের যা আছে তা নিয়ে আলাদা হয়ে থাকে, তারা তাদের নিজ নিজ উপলব্ধি ও অনুশীলন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, অথচ দ্বীনের সামগ্রিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং নিজেরাও পরস্পর বিচ্ছিন্ন দলাদলিতে লিপ্ত হওয়াকে মুশরিকদের কাজ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে (৩০:৩০-৩২)। একমাত্র মুসলিম (আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী) পরিচয় ধারণ করে ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরতে হবে বা আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তবে যুগে যুগে সঠিক জ্ঞান পাওয়ার পরও পরস্পর বাড়াবাড়ি বশত বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা হয়, যা আল্লাহর বিধানে নিষিদ্ধ। অবশ্য যদি দ্বীনের আলোকে বিভিন্ন কর্মসূচী সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন দল বা টীম গঠন করা হয়, যারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, তাহলে তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদিতা বলা যায় না। বরং বিচ্ছিন্নতাবাদিতা বলতে বুঝায়: যা ঐক্যকে বিনষ্ট করে এবং পরস্পরের পরিপন্থী হিসেবে ভূমিকা পালন করে এরূপ দলাদলি করা।
দ্বীন دِين : দ্বীন শব্দের অর্থ “জীবনব্যবস্থা, ধর্ম, প্রতিফল”। কুরআনের মাধ্যমে যে জীবনব্যবস্থা প্রদান করা হয়েছে তা গ্রহণ করার অর্থ হলো “আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করা”। তাই এই জীবনব্যবস্থাকে “দ্বীন ইসলাম” বলা হয়। কুরআনের দৃষ্টিতে এটিই আল্লাহর নিকট একমাত্র সত্য দ্বীন বা “দ্বীনুল হক্ব”। কিন্তু কাউকে দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করার জন্য অথবা গ্রহণ করলে তা থেকে কখনো বের না হওয়ার জন্য বলপ্রয়োগ করা যাবে না। যে ব্যক্তি যে দ্বীন গ্রহণ করবে সে তা চর্চা করার অধিকার রাখে, যতক্ষণ না সে সেই দ্বীনের চর্চার নামে কোনো সামাজিক অপরাধ করে। যেমন: কেউ যদি এমন ধর্মমত চর্চা করে যাতে ধর্মত্যাগকারীকে হত্যা করার কানুন রয়েছে, তবে তাকে তা চর্চা করতে দেয়া যাবে না। কারণ এই হত্যা ধর্মের নামে সামাজিক অপরাধ। বস্তুত ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা সামাজিক অপরাধ থেকে মুক্ত থাকার শর্তযুক্ত। অন্য কথায়, আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীনে ধর্মীয় ও সামাজিক বিধান এমনভাবে প্রদান করা হয়েছে যাতে সামাজিক বিষয়ের বিধান ধর্মনিরপেক্ষ পর্যায়ে থেকেও গ্রহণযোগ্য এবং সামাজিক অপরাধ না করার শর্তে ধর্মকর্মের স্বাধীনতা বজায় থাকবে।
নবী نَبِيّ : নবী শব্দের অর্থ হলো ‘সংবাদবাহক, উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত’। যাকে ‘নবুওয়াত’ বা ‘নবী হওয়ার প্রেক্ষিতে প্রাপ্ত দায়িত্ব নির্বাহ’ এর জন্য বাছাই করা হয় তাঁকে নবী বলে। আল্লাহ যুগে যুগে মানুষের মধ্য থেকে অনেককে নবী হিসেবে মনোনীত করেছেন বা দায়িত্ব প্রদান করেছেন, যাদের নিকট তিনি তাঁর কিতাব বা ওয়াহী নাযিল করেছেন। নবীদের মধ্যে সর্বশেষ হলেন মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সালামুন আলাইহি)। তাই তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ (শেষ নবী) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
নিফাক্ব نِفَاق : নিফাক্ব শব্দের অর্থ ‘দ্বিমুখীতা, কপটতা’। যারা বাহ্যত ঈমান আনে কিন্তু অন্তরে কুফর লুকায়িত রাখে তাদেরকে মুনাফিক্ব বলা হয়। মুনাফিক্ব হলো ‘গোপন কাফির’। যেহেতু তারা মু’মিনদের সাথে মিলেমিশে থাকে তাই তারা মু’মিনদের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর হয়ে থাকে। মু’মিনরা নিশ্চিত প্রমাণের অভাবে তাদেরকে মুনাফিক্ব হিসেবে সাব্যস্ত না করে মু’মিন হিসেবে সাব্যস্ত করতে পারে। তবে যদি কোনো বাস্তব কাজের মাধ্যমে কারো নিফাক্ব প্রমাণিত হয় তাহলে তখন তাকে মুনাফিক্ব হিসেবে সাব্যস্ত করতে হবে। যদিও অন্তরের অবস্থা আল্লাহই সম্পূর্ণ যথাযথভাবে জানেন, তবুও মু’মিনদেরকে বাস্তব কর্মভিত্তিক প্রমাণের উপর ভিত্তি করেই প্রয়োজন সাপেক্ষে তাদের শত্রু-মিত্র বা মুনাফিক্ব ও মু’মিন লোকদেরকে চিহ্নিত করতে হয়। একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে না পড়লে কাউকে মুনাফিক্ব হিসেবে সাব্যস্ত করার জন্য মু’মিনরা ব্যতিব্যস্ত হবে না। কারণ চূড়ান্ত বিচারে মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই কে মু’মিন আর কে মুনাফিক্ব তা চিহ্নিত করে পুরস্কার বা শাস্তি প্রদান করবেন। যারা মুনাফিক্ব তারা জাহান্নামের সবচেয়ে নিচু স্তরে থাকবে তথা সবচেয়ে চরম শাস্তি পাবে।
মালিক, মুলক مَالِكَ الْمُلْكِ : মালিক অর্থ ‘রাজা, রাজ্যাধিপতি, রাষ্ট্রপতি, বাদশাহ, শাসক’ আর মুলক অর্থ ‘রাজত্ব, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব’। ৩:২৬ আয়াতে বলা হয়েছে, “বলো, হে আল্লাহ, মালিকুল মুলক/ রাজত্বের রাজা, আপনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব (বা রাজত্ব অধিষ্ঠানের সুযোগ) দান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছা রাজত্ব কেড়ে নেন এবং যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন এবং যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন। আপনারই হাতে কল্যাণ। নিশ্চয় আপনি সর্ববিষয়ে প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণকারী ও নিয়ন্ত্রণকারী।” সুতরাং আল্লাহর তৈরিকৃত প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে তিনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দেন এবং যখন তিনি কাউকে কোনো ধরনের রাজত্ব দেন তখন সে সেখানে রাজ্যাধিপতি, রাজা বা রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়। মানব সমাজে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে যে রাষ্ট্র বা রাজ্য পরিচালনার বিষয় রয়েছে তাতে যে ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারী হয় তাকেও ‘মালিক’ (রাজা, রাষ্ট্রপতি) হিসেবে অভিহিত করা হয়। যেমন: ২:২৫১ আয়াতে নবী দাউদকে ‘মুলক’ (রাজত্ব, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব) প্রদানের বিষয়টি জানানো হয়েছে, অর্থাৎ তিনি একজন ‘মালিক’ (রাজা, রাষ্ট্রপতি) হয়েছিলেন। ২:২৪৭ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, আল্লাহ তালুতকে বানী ইসরাইলের জন্য ‘মালিক’ (রাজা, রাষ্ট্রপতি) হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। ১২:৭৬ আয়াতে রসূলুল্লাহ ইউসুফ মিশরে যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতির অর্থবিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তাকে বুঝাতে ‘মালিক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আবার ১৮:৭৯ আয়াতে জনৈক স্বৈরাচারী শাসককে বুঝাতে ‘মালিক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ২:২৫৮ আয়াতে ‘মুলক’ (রাজত্ব) পাওয়ার অহংকারবশত যে নবী ইবরাহীমের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলো তার প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং ‘মালিক’ শব্দটি শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত হয় না, কিন্তু তিনিই ‘মালিকুল হক্ব’ (প্রকৃত মালিক ২০:১১৪) এবং ‘আসমানসমূহ ও জমিনের সমগ্র রাজত্বের রাজা’ (৩:১৮৯, ৫:১৭, ৫:১৮, ৫:৪০ সহ আরো অনেক আয়াত)। আল্লাহ কুরআনে রব (প্রতিপালক ও বিধাতা) হিসেবে তাঁর ইবাদাতের (দাসত্ব ও উপাসনা) জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন (৩:৫১, ৪৩:৬৪) এবং তাঁর প্রতি ইসলামের (আত্মসমর্পণ) নির্দেশনা দিয়েছেন (২:১২৮)। অনুরূপভাবে তিনি ইলাহ (উপাস্য ও সার্বভৌম সত্তা) হিসেবে তাঁর ইবাদাতের (দাসত্ব, উপাসনা) নির্দেশনা দিয়েছেন (২:১৩৩) এবং তাঁর প্রতি ইসলামের (আত্মসমর্পণ) নির্দেশনা দিয়েছেন (২:১৩৩, ২২:৩৪, ২৯:৪৬)। কিন্তু তিনি মালিক হিসেবে তাঁর ইবাদাত ও তাঁর প্রতি ইসলামের জন্য দাবি জানান নি বা নির্দেশনা দেন নি। মালিক শব্দটি মানুষের ক্ষেত্রে আল্লাহর নিয়ন্ত্রিত রাজত্বে অধিষ্ঠানের অর্থে ব্যবহৃত হয়। কোনো মানুষ অন্য মানুষের কাছে দাসত্ব ও আত্মসমর্পণ দাবি করতে পারে না, বরং নিয়মতান্ত্রিক আনুগত্য দাবি করতে পারে মাত্র। মালিক শব্দটি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত, তাই কোনো রসূল বা উলিল আমর যখন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব লাভ করেন তখন তিনি ‘মালিক’ হিসেবে সাব্যস্ত হন, অন্যথায় রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে যিনিই অধিষ্ঠিত থাকেন, তিনিই মালিক হিসেবে সাব্যস্ত হন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রচেষ্টারত থাকতে পারে, কিন্তু যদি কোনো ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষাকারী অমুসলিমও রাষ্ট্রপতি হয়ে থাকে, তাহলে তার সাথে বিরুদ্ধবাদিতায় লিপ্ত না হয়ে বরং তার কোনো বিভাগের নেতৃত্বমূলক পদে অধিষ্ঠিত হয়ে তাকে রাজ্য পরিচালনায় সহযোগিতা করা যেতে পারে, যা রসূলুল্লাহ ইউসুফের জীবন-কাহিনী থেকে আমরা শিক্ষা পাই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আল্লাহর মালিকানাধীন কোনো জিনিসের উপর যখন আমাদেরকে নিয়ন্ত্রিত মালিকানা দেয়া হয় (যেমন: ৩৬:৭১ আয়াতে উল্লেখিত গবাদি পশুর মালিকানা) তখন তা হয় ‘আমানাত হিসেবে অর্পিত বিষয়’ (৩৩:৭২, ২৩:৮, ৭০:৩২) তথা তা মূল মালিকের অনুমোদনের বাহিরে ভোগ-ব্যবহার করা সঙ্গত নয়। মুলক বা রাজত্বে আল্লাহর কোনো শরীক নেই (১৭:১১১, ২৫:২) এবং তিনিই চূড়ান্ত ফায়সালাকারী (২২:৫৬)।
মাসজিদ مَسْجِد : মাসজিদ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘সাজদাহর স্থান’। আল কুরআনে সাজদাহ বলতে কী বুঝায় এবং মাসজিদের কর্মকাণ্ড কী হতে পারে তা নির্ণয়ের জন্য মাসজিদ শব্দ ধারণকারী আয়াতসমূহকেও অধ্যয়ন করা জরুরি। অনুরূপভাবে মাসজিদ বলতে কী বুঝায় তা নির্ণয়ের জন্যও সাজদাহ শব্দ ধারণকারী আয়াতসমূহকেও অধ্যয়ন করা জরুরি। আল কুরআনে মাসজিদের ব্যাপকভিত্তিক ভূমিকার উল্লেখ রয়েছে। যাবতীয় মাসজিদের মূল কেন্দ্র হিসেবে আল মাসজিদুল হারামের অবস্থান। আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনার বিষয়সমূহের মধ্যে রয়েছে সাময়িক আশ্রয়ের জন্য বা ধ্যানমগ্নতার উদ্দেশ্যে স্বল্পকালীন অবস্থান (ই'তিকাফ), নৈরাজ্য বা ফাসাদ প্রতিরোধ এবং নিরাপত্তা প্রচেষ্টার কর্মসূচী, ফিতনা বা ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি হুমকি মোকাবিলা, ন্যায়বিচারের ব্যবস্থাকরণ, শান্তিচুক্তি, কুরবানির ব্যবস্থা, জমাকৃত হাদিয়ার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কল্যাণ কর্মসূচী বাস্তবায়ন ও সমৃদ্ধির সম্প্রসারণ এবং আল্লাহর বিধান শুনার ও মানার প্রক্রিয়া চালু রাখার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা পালন ইত্যাদি। সুতরাং মাসজিদকে বর্তমানে যেভাবে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সালাতের জন্য নির্ধারিত ঘর মনে করা হয়, সেটা মাসজিদের আসল স্বরূপ ও প্রকৃতি নয়। মাসজিদের প্রকৃত স্বরূপ হলো এটা মানবজাতির জন্য ঐক্য, শৃঙ্খলা, একত্ববাদী উপাসনা ও সমষ্টিগতভাবে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান। সংক্ষেপে বলা যায়, সাজদাহ শব্দের প্রাথমিক অর্থ ‘মান্য করা, মেনে নেওয়া’। এবং মাসজিদ হলো সেই সাংবিধানিক কেন্দ্র বা প্রতিষ্ঠান যেখানে স্রষ্টার বিধান সংরক্ষণ করা হয় বা সংবিধানের কার্য নির্বাহ করা হয়।
মুশরিক مُشْرِك : মুশরিক শব্দের অর্থ “অংশীদার সাব্যস্তকারী, অংশীবাদী”। কুরআনের আলোকে যারা আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারে কাউকে কোনোরূপ অংশীদার সাব্যস্ত করে এবং আল্লাহর বিধানের মতো অন্য কারো বিধানকেও শর্তহীন ও নিরংকুশ বিধান সাব্যস্ত করে তারাই মুশরিক। কুরআনের আলোকে শিরক করা সবচেয়ে বড় অপরাধ তথা মুশরিক ব্যক্তি হলো সবচেয়ে বড় অপরাধী। যারা শিরকযুক্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। তবে দুনিয়াতে যদি কেউ শিরক থেকে তাওবাহ করে মু’মিন হয়ে যায়, তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। কেউ মুশরিক হওয়া বা মুশরিক হয়ে থাকা ধর্মীয় স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত বিধায় এ কারণে তাকে কোনো শাস্তি দেয়ার অধিকার অন্য কাউকে দেয়া হয়নি।
রসূল رَسُول : রসূল শব্দের অর্থ হলো ‘বার্তাবাহক’। যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া ‘রিসালাত’ বা ‘বার্তা’ অনুসারে দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাঁকে রসূল বলা হয়। রসূল শব্দটি সাধারণ অর্থেও প্রয়োগ করা হয়েছে। যেমন: কোনো রাষ্ট্রপতি যদি কোনো রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেন তবে ঐ রাষ্ট্রদূত হলেন ঐ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একজন রসূল। এজন্য রসূলুল্লাহ ইউসুফের নিকট কারাগারে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য যে দূত এসেছিলো তাকে ‘রসূল’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে পরিভাষায় ‘রসূল’ শব্দটি মূলত ‘রসূলুল্লাহ’ (আল্লাহর রসূল) অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেহেতু কুরআনের পরে আর কোনো কিতাব নেই, আর কুরআনেও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পরে আর কোনো রসূলকে মনোনীত করা হবে মর্মে কোনো পূর্বঘোষণা নেই, তাই মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে ‘খাতামুর রুসুল’ শব্দের সরাসরি উল্লেখ না করা সত্ত্বেও তাঁর পরে আর কাউকে ‘রসূলুল্লাহ’ হিসেবে ঈমান আনার অবকাশ নেই। প্রত্যক্ষভাবে ‘খাতামুর রুসুল’ শব্দটি ব্যবহৃত না হলেও বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহই শেষ রসূল। ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ শব্দের মাধ্যমে ‘খাতামুর রুসুল’ শব্দটি স্বত:সিদ্ধভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় বিধায়, ‘খাতামুর রুসুল’ শব্দটি স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখের প্রয়োজনীয়তা ছিল না।
শরীয়াত شَرِيعَة : শরীয়াত শব্দের অর্থ হলো “মৌলিক বিধান, স্থায়ী নীতিমালা”। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে আল কুরআনের মাধ্যমে দ্বীনের মধ্য থেকে একটি শরীয়াত বা মৌলিক বিধি-বিধান প্রদান করা হয়েছে। এই মৌলিক বিধি-বিধানের সীমা সংরক্ষণ করে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশস্ত পথের অবকাশও তাঁকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি নিজে থেকে কোনো শাশ্বত বিধান বা শরীয়াত প্রণয়ন করতে পারেন না। অন্য কথায়, রসূল নিজে শরীয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি শরীয়াত প্রণেতা ছিলেন না। তাই আল কুরআনের বাইরে কোনো আইন-বিধান শরীয়াত হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে না। যদিও দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বর্তমানে শরীয়াত বলতে যা বুঝায় তার অনেক কিছুই কুরআনের সাথে সঙ্গতিহীন।
শূরা شُورَىٰ : শূরা শব্দের অর্থ ‘পরামর্শ করা’। মু’মিনদের কার্যক্রম শূরা বা পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পাদিত হতে হবে (৪২:৩৮), আর রসূলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে মু’মিনদের সাথে শূরা বা পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে, তারপর সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর তার বাস্তবায়নের জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করতে (৩:১৫৯)। রসূল আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালনা ও বিচার-ফায়সালা করার জন্য আল্লাহর মনোনীত ও তাঁর প্রদত্ত কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। আবার তাঁকে মু’মিনদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আবার জানানো হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি মু’মিনদেরকে মেনে নিলে তথা তাদের পরামর্শকেই সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করলে মু’মিনরাই জটিলতায় পড়ে যাবে (৪৯:৭)। সুতরাং রসূলের কাজকে এবং একই নিয়মে উলিল আমরের কাজকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়: সাংবিধানিক বিধি-ব্যবস্থা বাস্তবায়ন এবং নির্বাহী ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা। এর প্রথমটির জন্য কুরআন থেকে সাংবিধানিক বিধান গ্রহণ করা হবে এবং দ্বিতীয়টির জন্য পরামর্শের মাধ্যমে নির্বাহী বিধান প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। অন্য কথায় নির্বাহী বিধান সমকালীন পরিস্থিতিগত প্রয়োজন এবং স্থান-কাল-পাত্রনির্ভর এবং পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি ও হাতিয়ারের সাথে সম্পর্কিত। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্বাহী বিধান পরিবর্তিত হয়ে থাকে। নির্বাহী বিধান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পরামর্শের প্রয়োজন হয়। এর ফলে পরামর্শে অংশগ্রহণকারীদের মেধা, যোগ্যতা ও অর্জিত জ্ঞানের সমন্বয় ঘটে, তুলনামূলক উত্তম সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয় এবং সবাই অধিক মানসিক দৃঢ়তার সাথে তা বাস্তবায়নে সক্রিয় হতে পারে, নেতৃত্ব-আনুগত্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। উলিল আমর নির্ধারণ, উলিল আমরের মেয়াদকাল নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ও পরামর্শের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।
সুলতান سُلْطَـٰن : সুলতান শব্দের অর্থ “যুক্তিপ্রমাণ, সনদ, প্রত্যক্ষ প্রমাণ, উপযুক্ত কারণ, দায়মুক্তি সনদ, অধিকার, অভিযোগের প্রমাণ, প্রতিবিধান, প্রতিকার বা প্রতিশোধের অধিকার, শক্তি, ক্ষমতা ও কর্তত্ব”। এছাড়া এ শব্দটি শাসককে বুঝানোর জন্যও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কুরআনে শব্দটি শাসককে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়নি। এ থেকে বুঝা যায় যে, শাসককে বুঝাতে ‘সুলতান’ শব্দের ব্যবহার একটি পরবর্তীকালীন চর্চা, আদি অর্থে শব্দটি শাসককে নয়, বরং শাসকের হাতে থাকা শাসনক্ষমতা বা তার শাসনক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার সহায়ক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক শক্তিকে বুঝায়।