“আল্লাহর আনুগত্য” এবং “রসূল ও উলিল আমরের আনুগত্য” প্রসঙ্গে বুঝার জন্য তথা আল কুরআন এবং হাদীসের বিধানের তুলনামূলক অবস্থান জানার জন্য প্রথমে সংবিধান, সাংবিধানিক আইন-বিধান এবং নির্বাহী আইন-বিধান সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। কারণ মানুষের চিরায়ত জীবনপদ্ধতির মাধ্যমে তাদের মধ্যে যে মৌলিক সাধারণ বোধ অর্জিত হয় তার উপর ভিত্তি করেই আল্লাহ তাঁর কিতাবের বক্তব্য প্রকাশ করেন, আর সেজন্য মানুষের পক্ষে তা বুঝা সহজ হয়। একইভাবে আল্লাহর কিতাবের বক্তব্য বুঝার জন্য বাস্তবভিত্তিক উদাহরণের মাধ্যমে অনুধাবনের প্রয়াস বাঞ্ছনীয়, কারণ অন্যথায় তার বাস্তব স্বরূপ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জিত হয় না।
সংক্ষেপে কোনো রাষ্ট্রের মৌলিক জীবন ব্যবস্থাকে সংবিধান বলা হয়। অর্থাৎ সংবিধান হলো ঐ আইন-বিধানের সমষ্টি যা রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে অন্যান্য সকল আইন-বিধানের মূল নিয়ামক হিসেবে স্থির করে। সংবিধান লিখিত বা অলিখিত হতে পারে এবং তা দুষ্পরিবর্তনীয় বা সুপরিবর্তনীয় হতে পারে। একটি সংবিধান কিভাবে পরিবর্তিত হবে তা সংবিধানে ঠিক করা থাকে। সাংবিধানিক পদ্ধতি অনুসারে সংবিধান পরিবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত সংবিধানের সকল ধারা বলবৎ থাকে, তবে জরুরি অবস্থায় সংবিধানের কিছু ধারার বাস্তবায়ন স্থগিত রাখা হয়। সাধারণ অবস্থায় সংবিধানের কোনো ধারাকে লঙ্ঘন করে কোনো নির্বাহী আইন-বিধান প্রণীত ও বাস্তবায়িত হতে পারে না। সংবিধানে থাকা আইন-বিধান হলো সাংবিধানিক আইন-বিধান এবং সংবিধান বাস্তবায়নের কর্তৃত্ব চর্চাকারী নির্বাহী কর্তৃপক্ষ বা সরকারের বিভিন্ন বিভাগের প্রণীত আইন ও আদেশাবলী হলো নির্বাহী আইন-বিধান। সাংবিধানিক আইন-বিধান হলো সংবিধান পরিবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত স্থায়ী গুরত্বসম্পন্ন এবং রাষ্ট্রীয় সংগঠন ও পরিচালনার মূলনীতিসমূহ এবং তা নির্বাহী আইন-বিধানের মাধ্যমে অপরিবর্তনীয়। অন্যদিকে নির্বাহী আইন-বিধান হলো সেই সব আইন-বিধান যা সংবিধান অনুযায়ী প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে ও সংবিধানের ধারাসমূহ সংরক্ষণ করে বা কোনো ধারাকে লঙ্ঘন না করে প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়, যা নির্বাহী ক্ষমতাবলে ও তুলনামূলক সাধারণ নিয়মে প্রণীত ও পরিবর্তিত হয়।
সাংবিধানিক আইন-বিধান ও নির্বাহী আইন-বিধানের উপরোল্লেখিত তুলনাকে সামনে রেখে আল কুরআনে “আল্লাহর আদেশের আনুগত্য” এবং “রসূল ও উলিল আমরের আদেশের আনুগত্য” সম্পর্কিত আয়াতসমূহ অধ্যয়ন করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আল কুরআন হলো আল্লাহ প্রদত্ত সংবিধান সম্বলিত গ্রন্থ, যাতে তাঁর প্রণীত সাংবিধানিক আইন-বিধান রয়েছে এবং আল কুরআন অনুসরণ করে রসূল ও উলিল আমর প্রয়োজনীয় নির্বাহী আইন-বিধান প্রণয়ন করতে পারেন। রসূল ও উলিল আমর (মুসলিম উম্মাহর নির্বাহী কর্তৃপক্ষ) আল কুরআনের মাধ্যমে প্রাপ্ত দায়িত্ব পালনার্থে বা আল কুরআনের বিধি-বিধান বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় নির্বাহী আইন-বিধান প্রণয়ন করতে পারেন, তবে তা আল কুরআনের মাধ্যমে প্রদত্ত সীমা সংরক্ষণ করবে এবং আল কুরআনে থাকা কোনো ধারাকে লঙ্ঘন করবে না। অন্য কথায় যে বিষয়ে আল কুরআনে কোনো কিছু নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে সেই বিষয়ে রসূল ও উলিল আমর অন্যরূপ বিধান দিতে পারেন না। তাঁরা শুধুমাত্র যেসব বিষয়ে আল কুরআনে কোনো বিধান নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি, সেইসব বিষয়ে সমকালীন পরিস্থিতি অনুসারে প্রয়োজনীয় আইন-বিধান প্রণয়ন করতে পারেন।
যেসব বিধান স্থায়ী গুরুত্বসম্পন্ন বা অপরিবর্তনীয় ধরনের সেইসব বিধান সাংবিধানিক বিধান হওয়ার উপযুক্ত এবং এ ধরনের যাবতীয় বিধান আল কুরআনে সন্নিবেশিত রয়েছে। একমাত্র যেসব বিধান পরিস্থিতি সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল পর্যায়ের সেই ধরনের ক্ষেত্রে নির্বাহী আইন-বিধানের অবকাশ রয়েছে এবং নির্বাহী আইন-বিধান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবর্তনশীল। যে ধরনের ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে সেজন্য স্থায়ীভাবে ভিন্ন ভিন্ন আইন-বিধান প্রণয়ন করা যেতে পারে, সেগুলোও সাংবিধানিক বিধানের আওতাভুক্ত। অন্যদিকে যে ধরনের পরিস্থিতিগত ভিন্নতা এরূপ স্থায়ী গুরুত্বের উপযোগী নয়, বরং প্রত্যেক পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে উপস্থিত মুহুর্তে পর্যালোচনা করে পরবর্তী ক্রান্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য কোনো আইন-বিধান প্রণয়ন করা যথোপযুক্ত হবে, সেরূপ ক্ষেত্রে নির্বাহী আইন-বিধানের অবকাশ রয়েছে।
যেক্ষেত্রে সাংবিধানিক ধারার মাধ্যমে কোনো ছাড় বা অবকাশ বা স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে সেই ক্ষেত্রে নির্বাহী আইন-বিধানের মাধ্যমে তা হরণ করা যাবে না এবং সাংবিধানিক ধারার মাধ্যমে যা এক ব্যক্তি কর্তৃক অন্য ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদানের অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়, নির্বাহী আইন-বিধানে তা শাস্তিযোগ্য হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে না। শুধুমাত্র যা শাস্তিযোগ্য অথচ সেজন্য সাংবিধানিক ধারায় কোনো নির্দিষ্ট শাস্তি নেই, সেরূপ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সাপেক্ষে কোনো শাস্তি প্রদান করা যেতে পারে। এক কথায়, না সরকারের স্বাধীনতা নাগরিকের সংবিধান প্রদত্ত স্বাধীনতাকে বাতিল করবে আর না নাগরিকের স্বাধীনতা সরকারের সংবিধান প্রদত্ত স্বাধীনতাকে বাতিল করবে। উভয়ের স্বাধীনতার সীমা রয়েছে, যার বাইরে তার স্বাধীনতার দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।
উপরোল্লেখিত শর্তসমূহ সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য জানার জন্য নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:
২:১৮৫ :: রমাদানের মাস, যাতে আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, মানবজাতির জন্য পথনির্দেশ এবং পথনির্দেশ সম্পর্কিত স্পষ্ট প্রমাণ এবং (সত্য-মিথ্যার) পার্থক্যকারী হিসেবে। সুতরাং তোমাদের মধ্য থেকে যে মাসটিকে প্রত্যক্ষ করবে / মাসটির সাক্ষ্য দেবে সে তাতে সিয়াম পালন করবে। আর যে অসুস্থ থাকবে বা সফরে থাকবে, সেক্ষেত্রে গণনা (সমন্বয় করতে হবে) অন্য দিনসমূহ থেকে। আল্লাহ তোমাদের প্রতি সহজ করতে চান এবং তিনি তোমাদের প্রতি কঠিন করতে চান না। আর যেন তোমরা গণনা পূর্ণ করতে পারো এবং যেন তোমরা আল্লাহর বড়ত্ব-মহিমা ঘোষণা করতে পার তাঁর দেখানো পথনির্দেশের উপর (নির্ভরতার ভিত্তিতে) এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারো।
৪:৮২ :: তবে কি তারা আল কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না? যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হতো তাহলে তারা এতে অনেক স্ববিরোধ বৈপরীত্য পেতো।
৬৯:৪৪-৪৮ :: আর যদি সে আমাদের নামে কিছু বানিয়ে বলতো, তাহলে আমরা তার ডান হাত ধরে ফেলতাম, তারপর তার মহাধমনী কেটে দিতাম, সুতরাং তোমাদের মধ্য থেকে কেউই তা থেকে নিবারণকারী হতে পারতো না। আর নিশ্চয় তা (আল কুরআন) স্রষ্টা-সচতেনদের জন্য স্মরণিকা (স্মরণীয় তথ্য, উপদেশ ও বিধি-বিধান সংবলিত গ্রন্থ)।
৫:১০১ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা এমন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করো না যা এমন যে, যদি তা (সেই বিষয়ে নির্দিষ্ট বিধান) প্রকাশ করা হয় তাহলে তা তোমাদের জন্য বিড়ম্বনাকর হবে। আর যদি কুরআন নাযিলকালে তোমরা সেজন্য জিজ্ঞাসা করো, তাহলে তা তোমাদের জন্য প্রকাশ করা হবে। আল্লাহ সেগুলোতে ছাড় দিয়েছেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল সহনশীল।
১৬:৮৯ :: আর সেদিন আমরা প্রত্যেক উম্মাতের মধ্যে তাদের উপর তাদের মধ্য থেকে সাক্ষী উত্থিত করবো, আর তোমাকে এদের উপর সাক্ষী হিসেবে আনবো। আর আমরা তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি যা (এর বিষয়বস্তু হিসেবে প্রয়োজনীয়) সবকিছুর (সকল তথ্য ও বিধি-বিধানের) স্পষ্ট ও বিশদ বিবরণ এবং মুসলিমদের জন্য পথনির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরূপ।
১৮:২৬ :: বলো, “আল্লাহ ভালো জানেন তারা (আসহাবে কাহাফ) কতকাল অবস্থান করেছিলো। তাঁরই আয়ত্তে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়াবলী। তিনিই উত্তম দ্রষ্টা ও উত্তম শ্রোতা। তাদের জন্য তিনি ছাড়া কোনো অভিভাবক (ওয়ালী) নেই আর তিনি তাঁর হুকুমের ক্ষেত্রে কাউকে অংশীদার করেন না।
১৮:২৭ :: আর তুমি তিলাওয়াত করো সেই কিতাব থেকে যা তোমার প্রভু তোমার প্রতি ওহী করেছেন। তাঁর বাণীর কোনো পরিবর্তনকারী নেই। আর তাঁকে ছাড়া তুমি কোনো আশ্রয় পাবে না।
১৮:২৮ :: আর তোমার নিজেকে ধৈর্যশীল রাখো তাদের সাথে যারা তাদের প্রভুকে সকালে ও সন্ধ্যায় ডাকে তাঁর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায়। আর পার্থিব জীবনের শোভা ও চাকচিক্য কামনায় তাদের থেকে তোমার চোখ দুটো যেন তাদেরকে এড়িয়ে না যায়। আর তার আনুগত্য করো না যাকে আমরা আমাদের স্মরণ/স্মারক (কুরআন) থেকে উদাসীন করে দিয়েছি এবং সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং তার কার্যকলাপ সীমালঙ্ঘনমূলক।
৬:১১৪-১১৫ :: তবে কি আমি আল্লাহ ছাড়া কাউকে হুকুমদাতা মানবো? আর তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদের প্রতি স্বব্যাখ্যাত কিতাব (আল কুরআন) নাযিল করেছেন। আর যাদেরকে (ইতোপূর্বে) কিতাব দেয়া হয়েছিলো তারা জানে যে, নিশ্চয় তা তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। সুতরাং তুমি সন্দেহকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। আর তোমার প্রভুর বাণী সত্য (তথ্য ও বিধি-বিধান) এবং ন্যায়বিচারের দিক থেকে সম্পূর্ণ হয়েছে। তাঁর বাণীর কোনো পরিবর্তনকারী নেই। আর তিনি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।
৭:৫৪ :: নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন ছয় দিবসে, তারপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন আরশে। তিনি রাত দিয়ে দিনকে ঢেকে দেন এবং তা (রাত) সেটাকে (দিনকে) দ্রুত অনুসরণ করে। সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রসমূহ তাঁরই নির্দেশক্রমে নিয়োজিত রয়েছে। প্রশ্নাতীতভাবে, সৃষ্টিও তাঁর, আদেশও তাঁর। বড়ই সমৃদ্ধিময় আল্লাহ রব্বুল আলামীন।
৩:১২৮ :: তোমার জন্য কোনো (স্বাধীন) সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবকাশ নেই। হয়তো আল্লাহ তাদের তাওবাহ কবুল করবেন অথবা তিনি তাদেরকে শাস্তি দিবেন, কারণ তারা যালিম।
৪৫:১৮ :: তারপর আমরা তোমাকে কার্যনির্বাহে একটি শারীয়াতের (সাংবিধানিক আইন-বিধানের) উপর নির্ধারিত করেছি, সুতরাং তুমি তা অনুসরণ করো এবং যারা জ্ঞান রাখে না তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না।
৬৫:৫ :: উহা (তালাকের বিধান) আল্লাহর আদেশ, তিনি তা তোমাদের প্রতি নাযিল করেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি সচেতন হয় তিনি তার থেকে তার মন্দসমূহকে মোচন করে দেন আর তার প্রতিফলকে মানসম্মত করবেন।
৪২:২১ :: নাকি তাদের এমন শরিকগণ রয়েছে যারা তাদের জন্য এমন দ্বীনের শরীয়াত প্রদান করে আল্লাহ যার অনুমতি দেন নি। আর যদি ফায়সালা সম্পর্কিত (পূর্ব ঘোষণার) বাণী না থাকলে, তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েই যেতো। আর যালিমদের জন্য কষ্টদায়ক শাস্তি রয়েছে।
৯:৩১ :: তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ধর্মীয় পণ্ডিতদেরকে ও সন্ন্যাসীদেরকে তাদের বিধাতা বানিয়ে নিয়েছে এবং মারাইয়াম পুত্র মাসীহকেও। অথচ তাদেরকে এক ইলাহের ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করতে আদেশ দেয়া হয়নি। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তারা যে শিরক (অংশীদার স্থাপন) করে তা থেকে তিনি পবিত্র।
৩:৬৪ :: বলো, হে আহলে কিতাব আসো সেই কথার দিকে যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করবো না এবং তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করবো না এবং আমাদের একে অন্যকে বিধানদাতা (রব) হিসেবে গ্রহণ করবো না। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে বলো, তোমরা সাক্ষী থাকো যে, আমরা (আল্লাহর উদ্দেশ্যে) আত্মসমর্পিত।
৩:৭৯-৮০ :: কোনো মানুষের পক্ষে সঙ্গত নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমাত ও নবুওয়াত দান করার পর সে মানুষকে বলবে, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদাতকারী হওয়ার পরিবর্তে আমার ইবাদাতকারী (দাসত্ব ও উপাসনাকারী) হয়ে যাও। কিন্তু (তার কথা তো হবে), “তোমরা রব্বানী (রবের বিধান দ্বারা কর্মসম্পাদনকারী) হয়ে যাও, কিতাব শিক্ষাদানের এবং সেটার অধ্যয়নের মাধ্যমে।” আর সে ফেরেশতাগণকে ও নবীগণকে বিধাতা হিসেবে মেনে নিতে তোমাদেরকে নির্দেশ দিবে না। এটা কি সম্ভব যে, তোমরা তো হবে মুসলিম (আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী) অথচ তারপরও সে-ই তোমাদেরকে কুফর করার নির্দেশ দিবে?
৪:৬৪ :: আর আমি যে কোনো রাসূল প্রেরণ করেছি তা কেবল এ জন্য, যেন আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদের আনুগত্য করা হয়। আর যদি তারা- যখন নিজদের প্রতি যুলম করেছিল তখন তোমার কাছে আসতো অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইত এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইতো তাহলে অবশ্যই তারা আল্লাহকে তাওবা কবূলকারী, দয়ালু পেতো।
৬০:১২ :: হে নবী, যখন তোমার কাছে মু’মিন নারীরা এসে বাইয়াত (শপথ) করে এ মর্মে যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক (অংশীদার সাব্যস্ত) করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তাদের সন্তানকে হত্যা করবে না, এবং মিথ্যা দাবি (বুহতান) নিয়ে আসবে না যা তারা রচনা/সংঘটিত করে তাদের হাতসমূহ ও পাসমূহের মধ্যবর্তীতে (অর্থাৎ স্বামীর সন্তান হিসেবে অন্যের সন্তানকে নিয়ে আসবে না), ন্যায়সঙ্গত ক্ষেত্রে তোমাকে অমান্য করবে না, তখন তাদের বাইয়াত গ্রহণ করো এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
২৮:৮৫ :: নিশ্চয় তিনিই যিনি তোমার উপর ক্বুরআনকে ফরজ (আবশ্যকীয়) করেছেন, তোমাকে প্রত্যাবর্তনস্থলে ফিরিয়ে দিবেন। বলো, “আমার প্রভুই ভালো জানেন, কে হিদায়াত নিয়ে এসেছে আর কে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।”
৫:৪৮ :: আর আমি তোমার উপর সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি, তার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবসমূহের সমর্থক (Confirmer) ও পর্যবেক্ষক-নিয়ন্ত্রক (Watcher) রূপে। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরীআত (মৌলিক বিধি) ও মিনহাজ (উন্মুক্ত পন্থা) এবং আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে (জবরদস্তিমূলকভাবে) তোমাদেরকে এক উম্মত বানাতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। সুতরাং তোমরা উত্তম-কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহরই দিকে তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন, যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে।
৫:৮৭ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা পবিত্র জিনিসগুলোকে তোমাদের জন্য হারাম করো না, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য হালাল করেছেন। আর তোমরা সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না।
৬৬:১ :: হে নবী, কেন তুমি তা হারাম করো যা আল্লাহ তোমার জন্য হালাল করেছেন? তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি অন্বেষণে? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।
১৭:৭৩-৭৫ :: আর তারা উপক্রম হয়েছিলো তোমাকে ফেতনায় ফেলতে তা থেকে যা আমি তোমার প্রতি ওহি করেছি, যেন তুমি আমাদের নামে তা ছাড়া কিছু রচনা করো। আর সেরূপ হলে তখন তারা তোমাকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতো। আর যদি আমি তোমাকে অবিচলিত না রাখতাম তাহলে তুমি তাদের দিকে অল্প কিছুটা প্রায় ঝুঁকে যাচ্ছিলে। সেক্ষেত্রে আমি তোমাকে জীবদ্দশায় দ্বিগুণ এবং মৃত্যু পরবর্তকালে দ্বিগুণ শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাতাম। তারপর তুমি আমাদের বিরুদ্ধে কোনো সাহায্যকারী পেতে না।
১০:১৫ :: আর যখন তাদেরকে আমাদের সুস্পষ্ট বিশদ বিবরণের আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে শুনানো হয়, তখন যারা আমাদের কাছে (জবাবদিহিতার জন্য) সাক্ষাতের আশা রাখে না, তারা বলে, “এটা (এই কুরআন) ছাড়া অন্য কুরআন আনো অথবা তাতে (কুরআনে) বদলে দাও। বলো, আমার পক্ষে সম্ভব নয় যে, আমি নিজ থেকে তা বদলাতে পারি। আমার কাছে যা ওহী করা হয় আমি তা ছাড়া কিছু অনুসরণ করি না। নিশ্চয় আমি ভয় করি, যদি আমি আমার প্রভুর অবাধ্য হই, মহাদিবসের শাস্তির (ভয়)।
৬:১৯ :: বলো, “সাক্ষ্যদানে সর্বশ্রেষ্ঠ কে? বলো, আল্লাহ সাক্ষী আমার ও তোমাদের মধ্যে। আর আমার কাছে এই কুরআন ওহী করা হয়েছে যেন আমি তা দ্বারা সতর্ক করি তোমাদেরকে এবং তাদেরকেও যাদের কাছে তা পৌঁছে যায়। তোমরা কি সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহ (সার্বভৌম সত্তা ও উপাস্য) আছে? বলো, আমি সেই সাক্ষ্য দিই না। বলো, তিনিই একক ইলাহ। আর নিশ্চয় তোমরা যে শিরক করো আমি তা থেকে মুক্ত।”
৩:১৫৯ :: আল্লাহর অনুগ্রহে তুমি তাদের প্রতি কোমলচিত্ত হয়েছো। যদি তুমি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে তাহলে তারা তোমার চারপাশ থেকে সরে যেতো। সুতরাং তুমি তাদের প্রতি উদারতাপূর্ণ আচরণ করো এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং নির্বাহী কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের সাথে পরামর্শ করো। তারপর যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো তখন (তার বাস্তবায়নে) আল্লাহর উপর ভরসা করো। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর উপর ভরসাকারীদেরকে ভালবাসেন।
৪২:৩৮ :: (উত্তম প্রতিফল তাদের জন্য) যারা তাদের প্রতিপালকের আহবানে সাড়া দেয় এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নির্বাহী কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তাদেরকে যা জীবিকা দিয়েছি তা থেকে (যথানিয়মে ও যথোচিত খাতে) ব্যয় করে।
উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে:
• মানবজাতির হিদায়াতের জন্য এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী হিসেবে আল কুরআন নাযিল করা হয়েছে। কুরআন স্ববিরোধমুক্ত এবং কুরআনের বিপরীত কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে হতে পারে না। সুতরাং যে বিষয় আল কুরআনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তা সত্য এবং যা আল কুরআনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ তা মিথ্যা। অন্যদিকে আল কুরআনের বিষয়বস্তুর বাইরের সাধারণ বাস্তবতার বিষয়গুলো হলো মানুষের অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সাথে সম্পর্কিত, তা চিরন্তন মৌলিক পথনির্দেশের ধারা-উপধারা হিসেবে সন্নিবেশিত নয়, বরং সেক্ষেত্রে বাস্তবতার বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। সর্বোপরি আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবে না থাকা কোনো বিষয় ধর্মীয় বিধান ও তার দলীল হতে পারে না।
• রাসুল মানুষের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে উপদেশবাণী অনুসরণের জন্য উপস্থাপন করেছেন তা হলো আল কুরআন। তিনি আল্লাহর নামে কিছু বানিয়ে বলেননি এবং আল্লাহর রসূল হওয়ার কারণে তা তাঁর পক্ষে সম্ভবও ছিলো না। বরং তিনি যদি এমনটি করতেন তাহলে আল্লাহ কঠিনভাবে তাঁর অপমৃত্যু ঘটাতেন।
• যে বিষয়গুলোতে আল কুরআনে ছাড় দেয়া হয়েছে তাতে ছাড় দেয়াই আমাদের জন্য কল্যাণকর ছিলো। তাই কুরআন নাযিলকালে এমন প্রশ্ন করতে নিষেধ করা হয়েছে যা নির্দিষ্ট করে দিলে তা আমাদের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হতো।
• আল্লাহ তাঁর হুকুমে কাউকে শরিক করেন না। তিনি তাঁর বিধি-বিধান কুরআনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। তাই তিনি রসূলকে তাঁর নাযিলকৃত কিতাব কুরআনে যা ওহী করা হয়েছে তা তিলাওয়াত বা পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর বাণীর কোনো পরিবর্তনকারী নেই। সুতরাং রসূলও আল্লাহর বাণীর পরিবর্তন করে অন্যরূপ কিছু বলার অধিকার রাখেন না। রসূলকে আরো নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত স্মারকগ্রন্থ কুরআন থেকে উদাসীন তাদের আনুগত্য করা যাবে না।
• রাসূলকে বলার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তিনি যেন অন্যদেরকে প্রশ্ন করেন যে, তিনি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে হুকুমদাতা মানতে পারেন? আল্লাহ তাঁর হুকুমসমৃদ্ধ কিতাবকে স্বব্যাখ্যাত কিতাব আকারে নাযিল করেছেন, যা পরিপূর্ণ। মানবজাতির প্রতি আল্লাহর নাযিলকৃত বাণী সত্য তথ্য ও বিধি-বিধান এবং ন্যায়বিচারের দিক থেকে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। সৃষ্টিও আল্লাহর এবং আদেশও আল্লাহর। রসূল নিজেও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন বা আদেশ দেয়ার অধিকার রাখেন না। বরং আল্লাহ তাঁকে একটি শরীয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি নিজে শরীয়ত প্রণেতা নন। যারা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের বাইরে কারো থেকে শরীয়তের বিধান গ্রহণ করে তারা আল্লাহর সাথে শিরক করে, যার কোনো অনুমোদন ও বৈধতা নেই। আল্লাহ তাঁর আদেশসমূহ কিতাবের মাধ্যমে নাযিল করেছেন।
• আল্লাহর নবী রসূলগণ কাউকে নিজেদের দাসত্বের দিকে আহবান করেন না, বরং তাঁরা মানুষকে তাদের রবের (প্রতিপালক, প্রভু, বিধাতা) বিধান অনুসারে তাঁর দাসত্ব করার জন্যই আহবান করেন। নি:শর্ত নিরংকুশ আনুগত্যই দাসত্ব। যারা আহবার ও রুহবান তথা ধর্মীয় পণ্ডিত ও সন্ন্যাসীদের নি:শর্ত আনুগত্য করে তারা তাদেরকেই রব বা বিধাতা বানিয়েছে। ধর্মগুরুদের কথাকে কিতাব দ্বারা যাচাই ছাড়া বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়ার মানে তাদেরকে ‘রব’ বা বিধানদাতা বানানো তথা শিরক। অনুরূপভাবে কেউ যদি কোনো নবীর নামে প্রচারিত কোনো কথা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়া সত্ত্বেও নবী বলেছেন মনে করেও অনুসরণ করে তাহলে সে নবীকে রব বা বিধাতা বানালো। যদিও বাস্তবে কোনো নবী এরূপ কোনো কথা বলেননি।
• আল্লাহ নবী-রসূল পাঠিয়েছেন তাঁর অনুমতিক্রমে তথা তাঁরই বিধান অনুসারে নবী-রসূলদের আনুগত্য করার জন্য। বাস্তবে নবী-রসূলগণ আল্লাহর অনুমতির বাহিরে বা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো আদেশ-নিষেধ করেন না। যেহেতু রসূলের আনুগত্য আল্লাহর অনুমতিক্রমে, সুতরাং তিনি আল্লাহর বিধানে যেক্ষেত্রে অবকাশ রাখা হয়নি সেরূপ কোনো বিধান দিতে পারেন না এবং দেননি।
• রাসূলের কাছে করা শপথবাক্যের একটি হলো, “ন্যায়সঙ্গত ক্ষেত্রে তাঁকে অমান্য করা হবে না বা তাঁর আনুগত্য বজায় রাখা হবে”। এর মানে এ নয় যে, রসূল অন্যায় নির্দেশ দেয়ার সম্ভাবনা ছিল, বরং এটা আনুগত্যের মূলনীতি স্পষ্ট থাকার জন্য যে, রসূলও অন্যায় আদেশ দেয়ার অধিকার রাখেন না; যদি দিতেন তবে তা তাঁর রাসূল পদের সাথে সঙ্গতিশীল হতো না এবং মু’মিনরাও তা মান্য করতে হতো না। সুতরাং রসূল অন্যায় নির্দেশ দেননি, যদি রসূলের নামে কোনো অন্যায় নির্দেশ প্রচার করা হয়, সেটা তাঁর নামে মিথ্যা প্রচার, সে নির্দেশ মানতে হবে না, এমনকি যদি রসূলও এরূপ নির্দেশ দিতেন তবুও তা মানতে হতো না। ন্যায়-অন্যায়ের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো- ন্যায়-অন্যায়বোধের ভিত্তিতে রসূলের আনুগত্য, রসূলের আনুগত্যের নামে ন্যায়ের লংঘন নয়। সুতরাং যে নির্দেশের মাধ্যমে ন্যায় লংঘিত হয়, রসূল সেরূপ বিধান দেননি। যদি দেখা যায় কোনো বিধানে ন্যায় লংঘিত হয়, তা মানা যাবে না, এমনকি রসূল দিলেও তা মানা যেতো না, তবে প্রকৃত কথা হলো, রসূল সেরূপ বিধান দেননি, তাই রসূল সেরূপ কোনো বিধান দিয়েছেন বললে বস্তুত তা রসূলের নামে অন্যদের বানানো। অনুরূপভাবে রসূলের পরবর্তীতে কোনো উলিল আমর যদি ন্যায়ের পরিপন্থী নির্দেশ দেন, তবে তিনি উলিল আমর হিসেবে আনুগত্য পাওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলবেন।
• রসূলের উপর কুরআনকে ফরজ করা হয়েছে এবং তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আল কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে আদেশ প্রদান ও বিচার-ফায়সালা করতে। সুতরাং কুরআনের কোনো সীমা লঙ্ঘন করে রাসূল কোনো বিধান দিতে পারেন না এবং দেননি। যদি রাসূলের নামে এমন কোনো বিধান প্রচার করা হয় যা আল কুরআনের পরিপন্থী, তাহলে তা রাসূলের নামে বানানো কথা বলে সাব্যস্ত হবে।
• আল্লাহ ছাড়া কেউ হালাল-হারাম করার অধিকার রাখে না। এমনকি রসূলও আল্লাহর হালাল করা বিষয়কে হারাম করতে পারেন না।
• রাসূলকে তৎকালীন মুনাফিক্বরা কিছু ক্ষেত্রে কুরআনের বিধি-বিধানকে বদলে দেয়ার জন্য বা অন্যরূপ একটি কুরআন আনার জন্য তথা তাদের মনমতো বিধান প্রণয়নের জন্য বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে রসূলকে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজে থেকে কোনো মৌলিক বিধান রচনা করা থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। যদি রসূল এরূপ কিছু করতেন তাহলে তাঁকে দুনিয়া ও আখিরাতে দ্বিগুণ শাস্তি পেতে হতো বলে জানানো হয়েছে। যেহেতু কুরআন আল্লাহ সংরক্ষণ করেছেন তাই কুরআনকে বিকৃত করা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি ঠিকই, কিন্তু রসূলের পরবর্তীতে তাঁর নামে কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক অনেক কথা চালিয়ে দেয়া হয়েছে, যা তিনি বলতে পারেন না এবং বলেননি।
• রসূল শুধুমাত্র কুরআন দ্বারা তাঁর সমকালীনদেরকে সতর্ক করেছেন এবং এখনো যাদের কাছে কুরআন পৌঁছে যাবে তিনি তাদেরকে এর দ্বারা সতর্ক করছেন বলে সাব্যস্ত হবে। সুতরাং আমাদের জন্য রসূলের পক্ষ থেকে কুরআন ছাড়া কোনো শাশ্বত বা চিরন্তন স্মরণীয় তথ্য ও আদেশ-নিষেধ নেই। যেসব বিষয়ে কুরআনে কোনো বিষয় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি সেসব বিষয়ে রসূল পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আদেশপ্রাপ্ত ছিলেন এবং মু’মিনদেরও অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য সেটাই হতে হবে। যেহেতু এ ধরনের বিষয়গুলো সমকালীন পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল, তাই পরিস্থিতির পরিবর্তনে এ ধরনের বিষয়ে সিদ্ধান্তও পরিবর্তন হতে পারে। অন্যকথায় একটি পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও বিধান পরবর্তী পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও বিধান দ্বারা পরিবর্তিত হতে পারে। এ ধরনের বিষয়গুলোকেই নির্বাহী সিদ্ধান্ত ও বিধান বলা হয়। নির্বাহী বিধানকে সরাসরি স্থায়ী বিধানের মর্যাদা দেয়া যেতে পারে না এবং তা কুরআনে থাকা চিরন্তন বিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হতে পারবে না। কারণ সেক্ষেত্রে তা কুরআনের মতো মূল বিধানে পরিণত হয়ে যাবে এবং এর মাধ্যমে শিরক বা অংশীদারিত্ব হবে।
সাংবিধানিক আদেশ (মূল হুকুম) হলো সেই আদেশ যা স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় প্রকৃতির মূল আদেশ, যা সামনে রেখে তার সীমা লংঘন না করেই যাবতীয় নির্বাহী কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। ‘যাবতীয় হুকুম আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে’ অর্থাৎ আল্লাহ প্রদত্ত সাংবিধানিক আদেশই হবে যাবতীয় নির্বাহী আদেশের নিয়ন্ত্রক। নিজে থেকে কোনো মূল নির্দেশ প্রদান করার মানে হলো নিজের দাসত্বে আবদ্ধ করা, যে প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, নবীর কাজ নয় যে, তিনি লোকদেরকে নিজের দাস হতে বলবেন, তিনি তো তাদেরকে রবের বিধানের অনুবর্তী হওয়ার জন্যই বলবেন। আল্লাহ সংবিধান সম্বলিত কিতাব নাযিল করেছেন। এর বাইরে কেউ যদি কোনো কিতাব লিখে সেটাকেও আল্লাহর পক্ষ থেকে (দলীল হিসেবে সাব্যস্ত ধর্মগ্রন্থ) বলে দাবি করে তাহলে তাদের জন্য জাহান্নামের দুর্ভোগ রয়েছে।
আর নির্বাহী বিষয়ের স্বরূপ ও প্রকৃতি বুঝার জন্য রসূলের কথা ও কাজের বিবরণ সম্বলিত হাদীসের প্রকৃত অবস্থান চিহ্নিত করা যেতে পারে। বস্তুত যদি ১০০% নিশ্চয়তা সম্পন্ন ভিডিও আকারেও আমাদের কাছে হাদীস পৌঁছতো সেক্ষেত্রেও তার অবস্থান হতো নিম্নরূপ:
(১) তাতে কুরআনের অনুরূপ কথা রসূলের নিজ ভাষায়ও বলেছেন তা পাওয়া যেতো এবং কুরআন নির্দেশিত কাজ রসূল করেছেন তা দেখা যেতো।
(২) তাতে কুরআনের সীমারেখা রক্ষা করে রসূল তৎকালে যা করেছেন, বলেছেন, অনুমতি দিয়েছেন এবং নির্বাহী আদেশ-নিষেধ করেছেন তার রেকর্ড পাওয়া যেতো।
(৩) তাতে কুরআনবিরুদ্ধ, বিজ্ঞানবিরুদ্ধ, বিবেক-বুদ্ধি বিরুদ্ধ কিছুই থাকতো না।
(৪) তাতে কুরআনে নেই এমন কোনো ঈমান সম্পর্কিত তথ্য ও স্থায়ীভাবে প্রযোজ্য বাধ্যতামূলক করণীয় আমলের তথ্য তথা কুরআনের অতিরিক্ত কোনো মৌলিক ও স্থায়ী নির্দেশ পাওয়া যেতো না।
বস্তুত রসূল যখন যে নির্বাহী আদেশ দেয়া প্রয়োজন ছিলো তাই দিয়েছেন, পরে আবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বা স্থান-কাল-পাত্রের ভিন্নতায় ভিন্ন আদেশ দিয়েছেন, এটাই স্বাভাবিক আর এটাই হয়ে থাকে নির্বাহী আদেশের প্রকৃতি। সুতরাং যদি রসূল এখন জীবিত থাকতেন তাহলে এখন তিনি পূর্বের নির্বাহী আদেশ জারি রাখতেন না, এখনকার সাপেক্ষে নতুন নতুন নির্বাহী আদেশ দিতেন। নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেই রসূল পরামর্শ গ্রহণের জন্য আদেশপ্রাপ্ত ছিলেন (৩:১৫৯)
স্থায়ী বা চিরন্তনভাবে অপরির্তনীয় মূল আইন (হুকুম) ও সিদ্ধান্ত (আমর) শুধুমাত্র আল্লাহরই অধিকার। এমতাবস্থায় রসূল ও উলিল আমরের আমর বা সিদ্ধান্ত এবং হুকুম বা ফায়সালা হলো নির্বাহী পর্যায়ের তথা যা দুটি মৌলিক শর্তকে রক্ষা করতে হবে (১) তা কুরআনের সীমারেখাকে লংঘন করতে পারবে না (২) তা সমকালীন পরিস্থিতিগত প্রয়োজন সাপেক্ষে হবে কিন্তু তা হবে পরিবর্তনশীল প্রকৃতির।
আল্লাহ জীবন পরিচালনার নীতিগত দুটি জিনিসের নির্দেশনা দিয়েছেন, একটি শিরআতান, অন্যটি মিনহাজান (৫:৪৮)। শিরআতান হলো আল্লাহ কর্তৃক বিধিবদ্ধ করে দেয়া দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা (সাংবিধানিক বিধান) আর মিনহাজান হলো ঐ দ্বীনের সীমারেখা রক্ষা করে যুগোপযোগী নিয়ম-কানুন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উন্মুক্ত ও প্রশস্ত পথ বা নির্বাহী বিধানের অবকাশ। নির্বাহী রীতি-পদ্ধতির প্রায়োগিক বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে : উলিল আমর (কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব) ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যথাসাধ্য শক্তির সঞ্চয় ইত্যাদি।
সাংবিধানিক আদেশ ও বিচার বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে উদারণস্বরূপ মু’মিন পুরুষ ও নারীদেরকে পর্দার নির্দেশ জানিয়ে দেয়া (২৪:৩০-৩১), জিনা বা ব্যভিচারের শাস্তি বিধান (২৪:২) উল্লেখ করা যেতে পারে। আর ন্যায়সঙ্গত কোনো আদেশ লঙ্ঘন না করার বাইয়াত বা শপথের বিষয়টি (৬০:১২) নির্বাহী আদেশ বা নির্বাহী বিধানকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
নির্বাহী বিধিব্যবস্থা দুই প্রকার হতে পারে:
(ক) সাংবিধানিক বিধান বাস্তবায়ন সম্পর্কীয় নির্বাহী বিধান।
(খ) সাংবিধানিক সীমারেখা লংঘন না করে তথা সাংবিধানিক সীমারেখার ভিতরে থেকে নির্বাহী রীতিনীতি বা বিধি-ব্যবস্থা। অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাভাবিক কার্যক্রম ও রীতিনীতি।
কারণ প্রত্যেক ব্যক্তিগত কার্যক্রমও কোন না কোনভাবে একটি নির্বাহী সিদ্ধান্ত, তা সংবিধান বাস্তবায়নের উপায়মূলক হোক বা উহার সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া সাপেক্ষে ব্যক্তিগত স্বভাবজাত কাজ হোক। অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষানীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানুষ যত রীতি নীতি অবলম্বন করে তা তার নির্বাহী রীতি-নীতি। কুরআনে বর্ণিত মূলনীতির বাস্তবায়নের জন্য অবলম্বনকৃত এবং কোন মূলনীতির লংঘন না করে এরূপ প্রচলিত ও ক্রমবিকশিত নতুন বা বিশেষ কাঠামোতে সুগঠিত রীতি নীতি সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করা ও প্রয়োগ করা নির্বাহী কর্মকান্ডের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য একটি প্রয়োজনীয় বিষয়।
রসূল ছিলেন আমাদের জন্য কুরআন প্রাপ্তির মাধ্যম, কুরআনের প্রথম অনুসরণকারী এবং আল্লাহ কর্তৃক নিযুক্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী উম্মাহর জন্য স্বয়ং আল্লাহর নিযুক্ত নেতা। কুরআন নাযিলের জন্য আল্লাহ যে পদ্ধতি বাছাই করেছেন (একজন মানুষ রসূলের কাছে ধারাবাহিকভাবে নাযিল করে পরবর্তীতে তাঁরই মাধ্যমে তা সংকলন করিয়ে নেয়া) অবশ্যই এটি কুরআন নাযিলের জন্য সর্বোত্তম পদ্ধতি বিধায় আল্লাহ তা অবলম্বন করেছেন। (দ্র : ৪:১৫৩, ৬:৭-৯, ৬:৫০, ৬:৯১-৯২, ৬:১০৪-১০৫, ৬:১২৪, ৬:১৫৫-১৫৮, ১১:১২, ২৫:৪-৯, ২৫:২০-২১, ২৫:৩০-৩৩, ২৯:৪৮, ৪৩:৩১-৩২, ৭৫:১৬-১৯)। কুরআন নাযিল ও সংকলন সমাপ্ত হওয়ার পর রসূলের মাধ্যমে মানবজাতির কাছে কুরআন নাযিলের বিষয়টি সুসম্পূর্ণ হয়েছে। আর রসূলের মৃত্যুর পর কুরআন বাস্তবায়নের নির্বাহী ব্যবস্থাপনা (নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো) বজায় রাখার জন্য উলিল আমর ব্যবস্থাকে প্রবর্তিত করা হয়েছে। (দ্র : ৪:৫৯)
সুতরাং বিষয় এই যে, আল্লাহ নিজে যাকে মনোনীত করলেন তাকে তিনি ক্রমে ক্রমে কুরআন দ্বারা গাইড করলেন এবং তাঁর আনুগত্য করাকে মু’মিনদের উপর ফরজ করে দিলেন, তাঁর মাধ্যমে দ্বীনের কার্যক্রমকে গতিশীল করে পরিপূর্ণতা পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন এবং বিজয় ও সাহায্য এসে যাওয়ার পর আল্লাহর প্রশংসা, পবিত্রতা জ্ঞাপন ও তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দিলেন। এটাই ছিলো কুরআন নাযিলের ধারাক্রম ও কুরআন অনুযায়ী প্রথম সমাজ গঠনের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে আল্লাহর গৃহীত কর্মনীতি। এভাবে কুরআন নাজিল সমাপ্ত ও সংকলিত হওয়ার পর আমাদেরকে ঐ কুরআন নিয়ে আমাদের পথ চলতে হবে, এখন আমাদের মধ্যে রসূলের উপস্থিতির আবশ্যকতা নেই, বরং কুরআন অনুযায়ী আমাদেরকে সতর্কতার সাথে পথ চলতে হবে, এটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্রমধারা। প্রাসঙ্গিক আয়াত হিসেবে দ্রষ্টব্য ৬:১৯, ৩:১৪৪।
যতদিন পর্যন্ত নবী-রসূল প্রেরণের ধারাবাহিকতা ছিল ততদিন পর্যন্ত রসূলের আনুগত্যের মাধ্যমে উম্মাহর সামষ্টিক কার্যনির্বাহ হতে পারতো। কিন্তু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর মাধ্যমে নবী-রসূলের আগমনের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছে। এমতাবস্থায় উলিল আমরের আনুগত্যের প্রথা জারি করার মাধ্যমে মানুষ হিসেবে জরাজীর্ণ ব্যাধি মৃত্যুর অধীন রসূলের ইন্তেকালের পরও আল কুরআনের বাস্তবায়নের চিরন্তন ব্যবস্থা করা হয়েছে। কুরআন হচ্ছে আল্লাহর কিতাব যার অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য হয়। কুরআন বাস্তবায়নের নির্বাহী দায়িত্ব হচ্ছে রসূলের উপর, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দ্বারা আর এর বাস্তবায়ন সম্ভব নয় এবং তাই তখন এটি আর তাঁর দায়িত্বও নয়। তখন কুরআনের সীমারেখা সংরক্ষণ করে মুসলিম উম্মাহর নির্বাহী দায়িত্ব পালন করবেন উলিল আমর। সুতরাং রসূলের আনুগত্য অনুসরণ সম্পর্কিত আদেশগুলো রসূলের মৃত্যুর পর সরাসরি প্রয়োগের ক্ষেত্র অনুপস্থিত, কারণ রসূল তখন আর নির্বাহী আদেশ দিতে সক্ষম নন, যার আনুগত্য করা সম্ভব। এমতাবস্থায়, যখন যেখানে রসূল থাকবেন না, সেখানে উলিল আমরের আনুগত্য করতে হবে, এটাই সাধারণভাবে রসূলের আনুগত্য অনুসরণ সম্পর্কিত আদেশ পালনের রূপান্তরিত প্রয়োগক্ষেত্র।
রসূল যদি এখনো জীবিত থাকতেন তবে তিনিই মুসলিম উম্মাহর মূল নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন এবং মু’মিন হতে/থাকতে হলে অবশ্যই তাঁর নির্বাহী আদেশ পরিপালন তথা আনুগত্য করতে হতো এবং তাঁর উপর পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারভার অর্পণ করতে হতো। কিন্তু রসূল এখন জীবিত নন বিধায় তিনি এখন কোন আদেশ করেন না এবং আদেশ করেন না বিধায় তাঁর আদেশ পালন করা না করার প্রসংগটি এখন সরাসরি বাস্তবায়ন-সম্পর্কিত বিষয় নয়। আর যদি বলা হয় তিনি জীবিত থাকতে আদেশ করে গেছেন, তবে তা সাংবিধানিক ও নির্বাহী আদেশের পার্থক্য বুঝতে না পারার কারণেই শুধু কেউ বলতে পারে। যিনি সংবিধান প্রণেতা (আল্লাহ) তিনিই শুধু চিরন্তনভাবে পালনীয় আদেশ দিতে পারেন, অন্য কেউ নয়। তাই রসূল এমন কোন আদেশ দিতে পারেন না এবং দেন নি, যা তাঁর পরবর্তীরাও পালন করতে হবে। আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন তথা এরূপ সকল বিষয় আল কুরআনে সন্নিবেশিত রয়েছে।
অবশ্য রসূল ও ‘উলিল আমর’ হুবহু একই অবস্থানে দাঁড় করানো যাবে না। কারণ রসূলের প্রতি ঈমানের সম্পর্ক, উলিল আমরের প্রতি তা নয়। রসূল রসূল হওয়ার কারণে আল্লাহ কর্তৃক মু’মিনদের নেতৃত্বের দায়িত্বে নিযুক্ত এবং আনুগত্য লাভের হকদার ছিলেন। কিন্তু উলিল আমর মু’মিনদের পরামর্শক্রমে নিযুক্ত ও অপসারিত হবেন। রসূলের নিতান্ত রসূল হিসেবে যে বিশেষ মর্যাদা, অধিকার ও দায়িত্ব, উলিল আমরের ক্ষেত্রে হুবহু সেরূপ নয়।
আল্লাহ রসূলকে কুরআনের মাধ্যমে ক্রমাগত নির্দেশনা দিয়েছেন এবং রসূলকে একটি বিশেষ পদমর্যাদা দিয়েছেন। রসূল যদি দোষ করতেন তাঁর দ্বিগুণ শাস্তি হতো। তিনি শেষ নবী হওয়ার প্রেক্ষিতে তাঁর স্ত্রীদেরকে এখতিয়ার দেয়া হয়েছিলো পার্থিব সম্পদ নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে বা রসূলের সাথে থাকলে রসূলের অবাধ্য হওয়া যাবে না। যদি তাঁরা অপরাধ করেন তবে তাঁদেরকে ডবল শাস্তি দেয়া হবে। এটার ভিত্তিতে যখন তাঁরা একসাথে থেকে গেলেন তাতে ঘোষণা দেয়া হলো যে, তাঁরা মু’মিনদের মা। রসূলের জন্য তিনি তাঁর কার্যক্রমের সুবিধার্থে কোনো বিয়ে করাকে জরুরি মনে করলে সে বিষয়ে বা কোনো নারী যদি রসূলের কাছে নিজেকে হেবা করতে চায় তাকে বিয়ে করাতে যেন প্রতিবন্ধকতা না থাকে সেজন্য বিধি-বিধান দেয়া হয়। এটা অন্যদের জন্য নয়। কারণ রসূলের কার্যক্রমকে নির্বিঘ্ন করা তথা আল্লাহর নিযুক্ত শেষনবীর মাধ্যমে কুরআনের ভিত্তিতে সমাজ গঠনের পরিবেশ অনুকূল করাকে আল্লাহ জরুরি সাব্যস্ত করেন, যা অন্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। রসূলের জন্য কিয়ামুল লাইলকে বাধ্যতামূলক করা হয়, অন্যদের জন্য নয়। রসূলকে পালকপুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করার বাধ্যতামূলক বিধান দেয়া হয়, অন্যদের জন্য নয়। এভাবে রসূলকে যে বিষয়গুলোতে বিশেষাধিকার ও দায়িত্ব দেয়া হয়, যা অন্যদের জন্য প্রযোজ্য নয়, তার কারণ কুরআন নামক সংবিধানকে আল্লাহ কর্তৃক সরাসরি নিযুক্ত সরকারপ্রধানের মাধ্যমে প্রথমবার কার্যত বাস্তবায়ন করার সুব্যবস্থা করা। এরপর পরবর্তীদের জন্য না রসূল পাঠানো হবে, না পুনরায় পরিস্থিতি অনুসারে ক্রমে ক্রমে হিদায়াত দেয়ার কিতাব পাঠানো হবে। বরং পরবর্তীরা একসাথে কিতাব পাবে এবং তাদের কাছে আল্লাহর নিযুক্ত কোনো রসূল থাকবে না। এমতাবস্থায় আমাদের কর্তব্য হলো কিতাব নাযিলের পূর্ণতার পর রসূল যে কিতাবটি রেখে গেছেন সেটিকেই আমাদের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করা এবং কিতাব অনুসারে রসূল যে দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন, পুনরায় আল্লাহর নিযুক্ত রসূল আসবে না বিধায় আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে আমাদের মধ্য থেকে আমাদের পরামর্শক্রমে নির্বাহী প্রধান নির্বাচিত করা যিনি রসূল না হওয়ায় রসূলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এক্সট্রা বিষয়গুলো তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, যেমন তাঁর প্রতি ঈমানের প্রশ্ন থাকবে না, তাঁর স্ত্রীগণ আমাদের মা হবেন না, তাঁর কাছে কোনো নারী নিজেকে হেবা করে দেয়ার অবকাশ থাকবে না, তাঁর জন্য কিয়ামুল লাইল বাধ্যতামূলক হবে না ইত্যাদি। কিন্তু যেগুলো রসূল যদি রসূল না হতেন সেক্ষেত্রেও নির্বাহী প্রধান অবস্থায় থাকলে প্রযোজ্য হতো এরূপ, সেগুলো প্রযোজ্য হবে, যেমন দ্বীন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আনুগত্য-অনুসরণ করা এবং তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।
সুতরাং উলিল আমর যতক্ষণ কুরআনের সীমারেখায় কোনো আদেশ দেয়, ততক্ষণ তাঁর সে নির্বাহী আদেশ মানা সেরূপ ফরজ, যেরূপ রসূলের নির্বাহী আদেশ মানা ফরজ ছিলো। তবে উলিল আমরের সাথে মতবিরোধের অবকাশ আছে এবং সেক্ষেত্রে সমাধানের প্রক্রিয়াও আছে। সেটা ভিন্ন প্রকৃতপক্ষে মতবিরোধের কোনোরূপ যৌক্তিক ভিত্তি ছাড়া নিছক ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের স্থান থেকে উলিল আমরের আনুগত্য পরিত্যাগ করা যাবে না।
পরিশেষে বলা যায় যে, আল কুরআন অনুযায়ী একমাত্র আল কুরআনে থাকা বিধি-বিধানই চিরন্তন সাংবিধানিক বিধান হিসেবে কার্যকর করতে হবে এবং কুরআনের সাথে সঙ্গতি রেখে পরিস্থিতি সাপেক্ষে ও পরামর্শক্রমে বিভিন্ন নির্বাহী বিধান প্রণীত ও বাস্তবায়িত হতে পারে। কিন্তু কোনো নির্বাহী বিধানের মাধ্যমে কুরআনের কোনো ধারাকে লঙ্ঘন করা যেতে পারে না। কুরআনের বাহিরে রসূল সমকালীন পরিস্থিতিতে নির্বাহী সিদ্ধান্তক্রমে যেসব আদেশ-নিষেধ করেছেন তাতে এমন কোনো বিধান থাকা সম্ভব নয়, যা কুরআনের কোনো ধারাকে লঙ্ঘন করে বা কুরআনের কোনো ধারার সাথে সাংঘর্ষিক হয়। আর নির্বাহী বিধান যেহেতু পরিস্থিতিসাপেক্ষে পরিবর্তনশীল প্রকৃতির হয়ে থাকে, তাই রসূল যদি বর্তমানে জীবিত থাকতেন তাহলে বর্তমান পরিস্থিতি অনুসারে নির্বাহী বিধান প্রণয়ন করতেন, বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া সরাসরি পূর্বের নির্বাহী বিধানকে কার্যকর করতেন না। তাই বর্তমানে মু’মিনরা রসূলের অনুসরণের প্রকৃত উপায় হলো: কুরআনের বিধি-বিধানকেই সাংবিধানিক বিধান হিসেবে কার্যকর করা এবং নির্বাহী কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতি অনুসারে পরামর্শের ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন ও অপসারণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা।
যেহেতু উলিল আমর রসূলের দায়িত্বের প্রতিনিধিত্ব করেন তাই রসূলের দায়িত্ব ও কর্মক্ষেত্রর পরিধিই উলিল আমরের জন্যও প্রযোজ্য। আবার যেহেতু উলিল আমর এবং রসূল সমপর্যায়ের নন, তিনি মু’মিনদের সাধ্যমতো বিবেচনা অনুসারে মু’মিনদের কর্তৃক নির্বাচিত এবং তাঁর সাথে মতবিরোধ হতে পারে (তবে তার সমাধান করতে হবে) এবং প্রয়োজনে পরামর্শক্রমে উলিল আমর পুন:নির্বাচিত হতে পারে, তাই উলিল আমর মু’মিনদের কাছে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নন।
নিম্নে উলিল আমরের কর্মক্ষেত্রের পরিধি, দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা সম্পর্কে অনুধাবনের জন্য প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন আয়াত উল্লেখ করা হলো:
৩:১০৪ :: আর তোমাদের মধ্যে (মুসলিম উম্মাহর মধ্যে) একটি উম্মাহ (কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিত্ব ও পরিচালনাকারী উম্মাহ) হোক, যারা কল্যাণের বিষয় ও কল্যাণকর্মের দিকে আহবান করবে এবং ন্যায়ের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখবে (বা নিষেধ করবে)। আর (যারা এসব কাজ করে তারাই) সফলতা লাভকারী।
১৬:৯০ :: নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন আদল (ন্যায় আচার, ন্যায় বিচার ও ক্ষতিপূরণ) এবং ইহসান (উত্তম আচরণ, পরোপকার ও পরার্থে ত্যাগ স্বীকার) এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার জন্য এবং তিনি তোমাদেরকে নিষেধ করেন অশ্লীল ও অন্যায় এবং সীমালঙ্ঘন করা থেকে। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যেন তোমরা সদা স্মরণ রাখতে পারো।
৪:৬৫ :: সুতরাং না (তাদের আচরণ মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়)। তোমার প্রভুর শপথ, তারা মু’মিন হিসেবে সাব্যস্ত হবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের মধ্যকার বিবাদ-বিসম্বাদের বিষয়ে তোমাকে বিচার-ফায়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ করবে, তারপর তুমি যে ফায়সালা করো সেই বিষয়ে তাদের মনের মধ্যে কোনো দ্বিধা-সংকোচ রাখবে না এবং ক্রমাগত আত্মসমর্পিত থাকবে।
৮:১ :: তারা তোমাকে আনফাল (নাগরিক পর্যায়ে বণ্টনের অতিরিক্ত সম্পদ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, আনফাল হচ্ছে আল্লাহর জন্য ও রসূলের জন্য (অর্থাৎ তা আল্লাহ প্রদত্ত সংবিধান বাস্তবায়ন ও রাষ্ট্রীয় কার্যাদির জন্য সংরক্ষিত)। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের মধ্যকার অবস্থা সংশোধন করো এবং আল্লাহর ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মু’মিন হও।
৫৯:৭ :: আল্লাহ তাঁর রসূলের কাছে জনপদবাসীর কাছ থেকে যা ফায়স্বরূপ দিয়েছেন, তা আল্লাহর জন্য এবং রসূলের জন্য এবং আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং ইয়াতিম ছেলেমেয়েদের জন্য এবং মিসকীনদের জন্য এবং ইবনে সাবীলের (ছিন্নমূলের/বাস্তুহারাদের/উদ্বাস্তুদের) জন্য। যেন সম্পদ তোমাদের মধ্য থেকে শুধু ধনীদের মধ্যে আবর্তিত/পুঞ্জিভুত না হয়। আর রসূল (নির্বাহী সিদ্ধান্তে) তোমাদেরকে যা দেয় তোমরা তা গ্রহণ করো এবং সে (নির্বাহী নিষেধাজ্ঞারূপে) তোমাদেরকে যা থেকে নিষেধ করে তোমরা তা থেকে বিরত থাকো।আর তোমরা আল্লাহ সচেতন হও, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।
৯:৬০ :: নিশ্চয় সদাক্বাত ফকীর/অভাবগ্রস্তদের জন্য এবং মিসকীন / নিরূপায়দের জন্য এবং তার দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য এবং যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা প্রয়োজন তাদের জন্য এবং দাসমুক্তির জন্য এবং ঋণভারাক্রান্তদের জন্য এবং আল্লাহর পথে ব্যয়ের জন্য এবং ইবনে ছাবীলের (উদ্বাস্তু / বাস্তুহারা / ছিন্নমূলদের) জন্য। (সমষ্টিগত সদাক্বাত ব্যবস্থাপনায় এরূপ বণ্টন) আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ / অত্যাবশ্যক। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।
৭:২০৪ :: আর যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শুনো এবং চুপ থাকো, যেন তোমাদের প্রতি রহমত (অনুগ্রহ) করা হয়।
৯:১২২ :: মু’মিনদের জন্য সুসঙ্গত নয় যে, তারা সবাই একসাথে বের হয়ে পড়বে। তবে কেন এমন হয় না যে, তাদের প্রত্যেক পৃথক বিভাগ থেকে একটি দল বের হবে যেন তারা দ্বীনের বিষয়ে গভীর উপলব্ধি অর্জন (তাফাক্বক্বুহ) করতে পারে এবং (তা প্রয়োগ করে) তাদের ক্বওমকে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে, যেন তারা (তাদের ক্বওম) সচেতন হতে পারে।
৫৮:১১ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যখন (রসূল বা উলিল আমরের পক্ষ থেকে) তোমাদেরকে বলা হয়, মজলিশে অন্যদের জন্য স্থান প্রশস্ত করে দাও, তখন তোমরা স্থান প্রশস্ত করে দেবে, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে স্থান প্রশস্ত করে দেবেন। আর যখন বলা হয়, উঠে আসো/ উঠে যাও, তখন উঠে আসবে/ উঠে যাবে। তোমাদের মধ্যকার যারা ঈমান রাখে এবং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে বহুস্তর মর্যাদায় উন্নীত করবেন। আর তোমরা যা করো আল্লাহ তার খবর রাখেন।
৯:১০৫ :: আর বলো, “তোমরা (যারা জিহাদের আহবানে সাড়া দিতে গড়িমসি করেছে) কাজ করতে থাকো। শীঘ্রই আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং মু’মিনগণ তোমাদের কাজ দেখবেন (যে, তোমরা মুনাফিক্বদের মতো কাজ করো নাকি মু’মিনদের মতো)। আর শীঘ্রই তোমাদেরকে সেই সত্তার কাছে ফিরিয়ে নেয়া হবে যিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যমান বিষয়ে জ্ঞানী। তখন তিনি তোমাদেরকে তা জানিয়ে দিবেন যা তোমরা করতে।
৪:৭৫ :: আর তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছো না অথচ নিপীড়িত হচ্ছে দুর্বল নারী-পুরুষ ও শিশুরা, যারা বলছে, “আমাদের প্রভু, আমাদেরকে এ জনপদ থেকে নিস্তার দিন যার শাসকরা যালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে অভিভাবক নির্ধারণ করুন এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে সাহায্যকারী নির্ধারণ করুন।
৮:৩৯ :: আর তোমরা তাদের (কাফিরদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, যতক্ষণ না ফিতনার (ধর্মীয় কারণে নির্যাতন) অবসান হয় এবং দ্বীনের (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থার) প্রত্যেক ক্ষেত্রে তা আল্লাহর জন্য (সুনিয়ন্ত্রিত) হয়ে যায় (তথা আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মীয় স্বাধীনতা পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়)। তারপর যদি তারা বিরত হয়, তাহলে তোমরা যা করো আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।
৪:৫৯ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রসূলের ও তোমাদের মধ্য থেকে হওয়া উলিল আমরের (আমীরের/ সমষ্টিগত পরিচালনার দায়িত্বশীল নেতার), তারপর যদি কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে তানাযা/ মতবিরোধ হয়, তাহলে তার সমাধানের জন্য ফিরিয়ে দাও আল্লাহর দিকে এবং তাঁর রসূলের দিকে, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রেখে থাকো। এটাই উত্তম (কর্মপদ্ধতি) এবং পরিণামে সর্বোত্তম।
উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে উলিল আমরের কর্মক্ষেত্রের পরিধি এবং দায়িত্ব এবং জবাবদিহিতা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য অনুধাবন করা যায়। যেমন:
১. কল্যাণের বিষয় বা কুরআন অনুশলীলনের দিকে এবং কল্যাণকর্মের দিকে আহবান এবং নেতৃত্ব প্রদান, ন্যায় কাজের নির্দেশ দান, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা, ন্যায়বিচার ও পরোপকার (আদল ও ইহসান) নিশ্চিত করা, শৃঙ্খলা রক্ষা, অন্যায়-অপরাধের শাস্তি কার্যকর করা, বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ফায়সালা করা, মু’মিনদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক সংক্ষণ ও সহযোগিতার ব্যবস্থা করা, সমাজ সংস্কার, সম্পদের মালিকানা বিষয়ক যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তব উপযোগিতাভিত্তিক নীতি নির্ধারণ, অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণ এবং অধিগ্রহণ ব্যবস্থা, সদাক্বাহ সংগ্রহ ও বণ্টন, সর্বজনীন অধিকারের বাস্তবায়নে, সম্পদের সুষম আবর্তনে, কল্যাণ কার্যক্রমে ও সামষ্টিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন, কুরআন পাঠ করে শুনানো এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচী, জামিয়া বা সাংগঠনিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ, সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিচালনা, টীম ওয়ার্ক স্পিরিট প্রতিষ্ঠা, পরামর্শসভার সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, জুলুম প্রতিরোধ ও মজলুমের অভিভাবক হিসেবে ভূমিকা পালন, ফিতনার অবসান ঘটানো বা ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা, কাকে কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে সেজন্য তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি।
উলিল আমরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। কিন্তু পরামর্শের মানে যেমন এ নয় যে, প্রতিটি ক্ষুদ্র বিষয়েও কোনো পরিষদের সাথে পরামর্শ করতে হবে। তেমনি উলিল আমরের কার্যাবলি জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকবে না। যেহেতু যারা নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে উঠতে চায় ও অন্যদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে চায় তাদের জন্য আখিরাতের উত্তম আবাস নেই (দ্র. ২৮:৮৩), তাই উলিল আমরের কার্যাবলির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। তবে জবাবদিহিতার মানে এ নয় যে, প্রতিটি ক্ষুদ্র বিষয়েও কোনো পরিষদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তবে যেহেতু উলিল আমর হচ্ছেন আমানাতদার, তাই তাঁর আমানাতদারিতার বিষয়টি স্বচ্ছ থাকার প্রয়োজনে পরামর্শের ভিত্তিতে যে বিষয়গুলোকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হয় সে বিষয়গুলোতে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে। যেহেতু উলিল আমরের কাজ পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা সাপেক্ষে তাঁর অপসারণ সম্ভব, তাই তাঁর পরিচালনা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়। এটি একটি স্বত:সিদ্ধ ধারা।
আল্লাহ কারো চেয়ে কাউকে দারাজাত বা উচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন যেন একে অন্যের কাজে লাগে (দ্র. ৪৩:৩২)। বাস্তব কর্মদক্ষতার উপর ভিত্তি করেই কর্মগত পদমর্যাদা নির্ধারিত হয়ে থাকে। উলিল আমর হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকে পরামর্শক্রমে উলিল আমর নির্বাচিত করতে হবে। উলিল আমরের কোনো সিদ্ধান্ত বা পরিচালনাগত কার্য কুরআনের কোনো সীমারেখা লঙ্ঘন করেছে কিনা বা স্পষ্টভাবে ন্যায়ের পরিপন্থী কিনা তা পর্যবেক্ষণযোগ্য এবং এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন আসলে উলিল আমরকে তার সন্তোষজনক উত্তর দিতে হবে বা বাস্তব ত্রুটি সংঘটিত হলে তা সংশোধন করে নিতে হবে।
উলিল আমর (নির্বাহী পরিচালকবৃন্দ), মজলিশে শূরা (পরামর্শ পরিষদ) এবং মা’মূর (আনুগত্যকারীগণ) এর সমন্বয়ে মুসলিম উম্মাহর সাংগঠনিক কাঠামো বা নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো গঠিত। নিম্নে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হলো:
১. উলিল আমর (আমীর) : উলিল আমর বলতে কেন্দ্রীয় উলিল আমর এবং সহযোগী উলিল আমরগণকে বুঝায়। সহযোগী উলিল আমরগণ বলতে বুঝাবে স্থানীয় বা ইউনিটভিত্তিক প্রধান উলিল আমরগণ এবং কর্মবিভাগভিত্তিক উলিল আমরগণ। প্রত্যেক উলিল আমরের কর্মবিভাগকে বাস্তবরূপ দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকবে, যাদের নির্বাচন বা নিয়োগ পদ্ধতি পরামর্শভিত্তিক নীতিমালা অনুসারে পরিচালিত হবে।
২. মজলিশে শূরা (পরামর্শ পরিষদ) : শূরা বা পরামর্শের ভিত্তিতে যথোপযুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বিশেষ মজলিশে শূরা গঠিত হবে। এছাড়া সকল মু’মিনই সাধারণ মজলিশে শূরার সদস্য হিসেবে থাকবে। সকল উলিল আমর মজলিশে শূরার সদস্য কিন্তু মজলিশে শূরার সকল সদস্য উলিল আমর নয়। মজলিশে শূরায় পরামর্শক্রমে নির্বাহী বিধান প্রণীত হবে। যে কোনো মুসলিম মজলিশে শূরায় তার মতামত পৌঁছাতে পারবে।
৩. মা’মূর : উলিল আমরের আনুগত্যকারী সকল মু’মিনই মা’মূর পদবাচ্য। এ মা’মূর শব্দটি হচ্ছে উলিল আমর বা আমীর শব্দের সাধারণ ফলাফল। কারণ যিনি আমীর তিনি আমর/ নির্বাহী আদেশ প্রদান করেন। যাকে আদেশ প্রদান করেন বা যে ব্যক্তি সেই আদেশের আনুগত্য করতে হয় তিনি হচ্ছেন মা’মূর। মা’মূর ছাড়া আমীর এবং আমীর ছাড়া মা’মূর হয় না। সুতরাং এর একটির অস্তিত্ব থাকার অর্থই হচ্ছে আরেকটি থাকা।
উলিল আমর শব্দটি বহুবচন। সুতরাং কেন্দ্রীয় প্রধান উলিল আমর ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেকে উলিল আমর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। উলিল আমরের পদসোপানক্রম বাস্তব পরিস্থিতির দাবি অনুসারে পরামর্শক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে নির্ধারিত হবে।
স্বাভাবিকভাবে উলিল আমরদের পদসোপানক্রমে সবার উপরে অবস্থান করবেন কেন্দ্রীয় প্রধান উলিল আমর। এছাড়া অন্যান্য উলিল আমরগণ ক্রমান্বয়ে বাস্তবসঙ্গত ক্রমসোপান বা গ্রেড নির্ধারিত হবে। যেমন কেন্দ্রীয় প্রধান উলিল আমরের পদ গ্রেড ওয়ান হলে, সহযোগী উলিল আমরগণের পদবী গ্রেড ২ এর অন্তর্ভুক্ত এবং এভাবে ক্রমান্বয়ে গ্রেড ৩, গ্রেড ৪ ইত্যাদি পদসোপানক্রম নির্ধারিত হবে। বিষয়টির উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, একটি রাষ্ট্রের মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পদবীকে গ্রেড ১ ধরলে যেমন অন্যান্য মন্ত্রীগণ গ্রেড ২, প্রতিমন্ত্রীগণ গ্রেড ৩ এবং উপমন্ত্রীগণ গ্রেড ৪ এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকেন, উলিল আমরদের পদসোপানক্রমও অনুরূপভাবে নির্ধারিত হবে।
সহযোগী উলিল আমরগণের একেক জন একেকটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। যেমন: পরামর্শ ও নীতি নির্ধারণ, নির্বাচন, প্রশাসন ও শৃঙ্খলা বিধান, বিচার, হিসাব ও বায়তুল মাল, সংস্থাপন, কর্মসংস্থান, খাদ্য, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য, ভূমি, গৃহায়ন, সড়ক, তথ্য ও যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা, পরিকল্পনা, দারিদ্র্য বিমোচন, উন্নয়ন ইত্যাদি।
উপরোল্লেখিত কর্মগত বিভাগের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক স্তরবিন্যাস হতে পারে। যেমন: একটি দেশে জেলা (ইউনিট গ্রেড ১) ও উপজেলা (ইউনিট গ্রেড ২) পর্যায়ে স্থানীয় উলিল আমর নির্ধারিত হবেন। এছাড়া কোনো কর্মসূচী বাস্তবায়নে এক বা একাধিক বিশেষ টীম বা গ্রুপ নির্ধারণ করলে টীম লিডার বা গ্রুপ লিডারও এক পর্যায়ের উলিল আমর হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারেন।
আল কুরআনে রসূলকে নির্বাহী বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পরামর্শের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং মু’মিনদেরকেও তাদের কার্যক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:
৩:১৫৯ :: আল্লাহর রহমতে তুমি তাদের প্রতি কোমল হয়েছো। যদি তুমি তাদের প্রতি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে, তবে তারা সরে পড়তো তোমার আশপাশ থেকে। সুতরাং তুমি তাদের প্রতি উদার হও এবং তাদেরকে ক্ষমা করো এবং (নির্বাহী) কর্মকাণ্ডে তাদের সাথে শূরা/ পরামর্শ করো। তারপর যখন তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তখন (তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে) আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল/ ভরসা করবে। নিশ্চয় আল্লাহ (তাঁর উপর) তাওয়াক্কুলকারীদের/ ভরসাকারীদেরকে ভালবাসেন।
৪২:৩৮ :: এবং যারা সাড়া দেয় তাদের রবের/প্রভু-প্রতিপালকের আহবানে, এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং নিজেদের মধ্যে শূরা/ পরামর্শের ভিত্তিতে তাদের (নির্বাহী) কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে এবং তাদেরকে আমরা যে জীবিকা দিয়েছি তা থেকে (অন্যের প্রয়োজনার্থে) ব্যয় করে।
উপরোল্লেখিত প্রথম আয়াতের মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে, রসূলুল্লাহ (সালামুন আলাইহি)কে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, নির্বাহী কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে যেন যারা মু’মিন রয়েছে, (যদিও কিছু ক্ষেত্রে তাদের বিচ্যুতি হয়ে যায়), তাদের সাথে শূরা/ পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ মু’মিনদের বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলেছেন যে, তারা তাদের নির্বাহী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে শূরা/ পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে। সুতরাং আমাদের নির্বাহী কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আল কুরআনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা।
আবার শূরা বা পরামর্শকে বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নীতিমালা কী হবে তা সম্পর্কে নিম্নের আয়াত দুটি লক্ষণীয়:
৪৯:৭ :: আর জেনে রাখো যে, তোমাদের (কুরআন নাযিলের সমকালীন মু’মিনদের) মধ্যে আল্লাহর রসূল রয়েছে। যদি সে অধিকাংশ বিষয়ে তোমাদেরকে মেনে নেয় (তোমাদের অভিমত ও পরামর্শকেই সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করে), তাহলে তা তোমাদেরকেই জটিলতায় ফেলবে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের কাছে ঈমানকে পছন্দনীয় করে দিয়েছেন এবং উহাকে তোমাদের মন-মস্তিষ্কে শোভনীয় করে দিয়েছেন। আর তিনি তোমাদের কাছে কুফরী ও ফাসেকীকে অপন্দনীয় করে দিয়েছেন। এ ধরনের লোকেরাই সত্যপথগামী।
৬:১১৬ :: আর যদি তুমি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের আনুগত্য করো তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে পথভ্রষ্ট করে দেবে। তারা শুধুমাত্র অনুমানেরই অনুসরণ করে এবং তারা শুধু জল্পনা-কল্পনাই করে।
উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নির্বাহী বিধান বা নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পরামর্শ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি অন্যের কথা শুনার চেয়ে নিজের কথাকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার রীতি অবলম্বন করে তাকে উলিল আমরের দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে না।
আবার অনেক সময় দেখা যায় যে, সবাইকে আশ্বস্ত করার জন্য বাহ্যত পরামর্শ করা হয় কিন্তু বাস্তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পরামর্শকে মোটেই গুরুত্ব দেয়া হয় না। একজন প্রকৃত মু’মিনের আচরণ এরূপ হতে পারবে না। সেই সাথে এটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, সব সময় অন্যদের যে পরামর্শ এসেছে সেটাকেই সিদ্ধান্তে পরিণত করা বাস্তবসম্মত বা কল্যাণকর হয় না। তাই এরূপ ক্ষেত্রে ভিন্নরূপ কিন্তু বাস্তবসম্মত কল্যাণকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়ে। এরূপ প্রসঙ্গে জানানো হয়েছে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রসূল যদি তাঁর সমকালীন মু’মিনদের পরামর্শকেই সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করতেন তাহলে মু’মিনরাই জটিলতায় পড়ে যেতো।
সুতরাং পরামর্শ করতে উত্তম পরামর্শ জানার জন্য। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন উলিল আমর। তিনি পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে বা পরামর্শের সাথে সঙ্গতিহীন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কল্যাণকর বিবেচনার বিষয়ে আশ্বস্ত করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
বস্তুত সবার মন রক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব নয় আর সবার মন রক্ষা করা পরামর্শের উদ্দেশ্যও নয়। যেহেতু অধিকাংশের মত মাত্রই সিদ্ধান্তের ভিত্তি বানানো কুরআনের নির্দেশনার লঙ্ঘন, তাই পরামর্শের মাধ্যমে অধিকাংশের মত অনুসারেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে মর্মে কোনো নীতি প্রণীত হতে পারে না। অন্য কথায় পরামর্শের মাধ্যমে কুরআন নির্দেশিত ‘পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতি’কেই নাকচ করে দেয়া যাবে না। যেহেতু তা কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশনা অনুসারে বিভ্রান্তিকর হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে। পরামর্শ পদ্ধতির মানে অধিকাংশের মত জানার পদ্ধতি নয়, বরং প্রয়োজনে একাধিকবার বসে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পদ্ধতি।
যেহেতু পরামর্শক্রমে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও তা অনেকের দেয়া পরামর্শের চেয়ে ভিন্নরূপ হতে পারে, তাই এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সমালোচনার শিকার হতে পারে। এরূপ সমালোচনাকারীদের মোকাবেলার উপায় হচ্ছে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে সঠিক নীতিমালার ভিত্তিতে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া। এটা একটা বিড়ম্বনা যে, প্রত্যেকে চায় নিজের মতের অনুকূলে সব সিদ্ধান্ত নেয়া হোক, অন্যথা হলেই অহংবোধ আহত হয় এবং সমালোচনামুখর হয়। অথচ সবার মত একরূপ হয় না, একটি মত গ্রহণ করলে অন্যটি বাদ যায়। সুতরাং ব্যক্তি অনুসারে মতের গ্রহণ নয়, বরং মতের উপযোগিতার ভিত্তিতে মতের গ্রহণ এবং যে মতটি গ্রহণ করা হলো এতে ঐ ব্যক্তিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলে ধরা যাবে না। একটি সঠিক মত একটি জ্ঞান থেকে তৈরি হয়, আর জ্ঞান কারো স্বীয় সম্পদ নয়, কেউ জ্ঞান পায় না আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া। সুতরাং কারো জ্ঞানের বিষয় মানে মূলত তার মাধ্যমে আল্লাহ কর্তৃক সে জ্ঞানের প্রকাশ। আর আল্লাহ অনুগ্রহ করার ক্ষেত্রে কাউকে জিজ্ঞেস করে অনুগ্রহ করতে হয় না।
পরিশেষে বলা যায় যে, উলিল আমর পরামর্শের মাধ্যমে নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর ভরসা করবেন। ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে। আবার বাস্তবসঙ্গত কারণে বা পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তের পরিবর্তন প্রয়োজনীয় হতে পারে। তাই পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সবদিক ভালোমতো বিবেচনা করা উচিত, যেন ঘন ঘন তা পরিবর্তন করা না লাগে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর কোনো ঠুনকো কারণে তা পরিবর্তন না করে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর ভরসা করা উচিত।