সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ‘পার্সেন্টেজভিত্তিক হিসাব ও রিবা’ প্রসঙ্গটি আলোচনার দাবি রাখে। মূলধনের সাথে সেটার উপর বাড়তি নেয়া হলে তা পার্সেন্টেজভিত্তিক হিসাবের মাধ্যমে হোক বা মোটের উপর একটি পরিমাণ হোক, উভয় অবস্থায় তা সুদ। যেমন, একজন সুদদাতাকে ১০,০০০ টাকায় ৩% সুদে ১০ বছরে সুদাসলে ১৩,০০০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। আবার অন্য একজন সুদদাতাকে কোনো পার্সেন্টেজের উল্লেখ ছাড়াই ১০,০০০ টাকায় ১০ বছরে সুদাসলে মোট ১৩,০০০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। তাহলে আসলে দুজন ব্যক্তিকে একই পার্সেন্টেজ পরিশোধ করা হলো, যদিও প্রথমজন পার্সেন্টেজ আকারে হিসাব করেছে এবং দ্বিতীয়জন একটি সরাসরি এমাউন্ট হিসাব করেছে।
প্রকৃতপক্ষে রিবা হওয়া না হওয়ার বিষয়টি পার্সেন্টেজভিত্তিক হিসাব করা না করার বিষয় নয়। পার্সেন্টেজভিত্তিক হিসাব একটি হিসাব পদ্ধতি মাত্র। কোনো লেনদেনের হিসাব পার্সেন্টেজভিত্তিক হওয়ার মানেই তা রিবা হওয়া নয়। অনুরূপভাবে কোনো লেনদেনের হিসাব পার্সেন্টেজভিত্তিক না হওয়ার মানেই তা রিবামুক্ত হওয়া নয়। বস্তুত রিবার বিষয়টি লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্ব থাকা না থাকার শর্তের সাথে জড়িত। যদি লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্ব ছাড়া শুধু লাভ গ্রহণ করা হয় সেটাই হচ্ছে রিবা।
রিবা বা সুদকে পুঁজি বা অর্থের ভাড়া হিসেবে দাবি করে বলা হয় যে, “ভাড়া দেয়া এক প্রকার বিনিয়োগ, যা নিশ্চিত লাভের ব্যবসা। সুতরাং ভাড়া ও ব্যবসা এবং রিবা বস্তুত একই রকম বিষয়।”
এ প্রসঙ্গে আরো প্রশ্ন করা হয় যে, “আমার বাড়ি ভাড়া নিয়ে সে উপকৃত হচ্ছে তাই আমাকে ভাড়া দিচ্ছে আবার পরে বাড়ি ফিরিয়ে দিচ্ছে। তেমনি অর্থ ধার নিয়ে আমাকে কেন উপকৃত হওয়ার বিনিময় দেবে না, শুধু ধার নেয়া অর্থ বা তার সমমূল্য ফেরত দেবে; এর যৌক্তিকতা কী?”
রিবা ও ভাড়ার পার্থক্য বুঝার জন্য প্রধান লক্ষণীয় বিষয় হলো : যেসব দ্রব্য ব্যবহার করলে তা নি:শেষ হয়ে যায় সে ধরনের দ্রব্যের লেনদেনের ক্ষেত্রে ফেরত দেয়ার সময় গৃহীত দ্রব্যের সমরূপ অন্য একটি দ্রব্য ফেরত দিতে হয়। তাই এ ধরনের দ্রব্য ভাড়া দেয়া যায় না, বরং ঋণ দেয়া যায়। অন্যদিকে যেসব দ্রব্য ব্যবহার করার পরও মূল দ্রব্যটি থেকে যায় তা ভাড়া দেয়া যায়।
ঋণের ক্ষেত্রে ঋণকৃত অর্থ বা দ্রব্যের পূর্ণ দায়বদ্ধতা ঋণগ্রহীতার কাছে হস্তান্তর হয়ে যায়। তারপর যদি কোনো কারণে ঐ ঋণকৃত অর্থ বা দ্রব্য নষ্ট হয় বা হারিয়ে যায়, তাহলেও সে ঋণদাতাকে তার সমপরিমাণ অর্থ বা দ্রব্য ফেরত দিতে বাধ্য। অন্যদিকে ভাড়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই সম্পদ ঋণগ্রহীতার কাছে আমানাতস্বরূপ, তাই সে তার খেয়ানত করতে পারবে না। কিন্তু যদি এমন কোনো কারণে সম্পদ নষ্ট হয় যেক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার পক্ষ থেকে অবহেলা দায়ী নয় বরং তা নিতান্তই দুর্ঘটনাজনিত, তাহলে সেজন্য তাকে খেসারত দিতে হবে না।
ঋণ ও ভাড়ার পার্থক্য অনুসারে বলা যায় যে, পুঁজির বিনিময়ে পুঁজির সাথে গৃহীত সুদকে ভূমি ও অনুরূপ উৎপাদন উপকরণ বা অন্য কোনো দ্রব্যের ভাড়ার সাথে সমতুল্য সাব্যস্ত করা ন্যায়সঙ্গত নয়। কারণ যে মূলধন বা পুঁজি ভোগ করার জন্য বা ব্যবসায়ের জন্য দেয়া হয় এবং তা ভোগ করা হয়ে যায় বা ব্যবসায়ে খাটানো হয়ে যায়, পরে পুন: উৎপাদন করে দিতে হয় সেটা ভাড়াকৃত ভূমি ও অনুরূপ উৎপাদন উপকরণ বা অন্যান্য দ্রব্যের মতো স্থিতিশীল জিনিস নয়। সুতরাং পুঁজি বা মূলধন শুধুমাত্র মূল্যমান অবক্ষয়ের প্রতিপূরণ পেতে পারে তথা মূল্যের তারতম্য ঘটলে সে প্রেক্ষিতে সমমূল্যে ফেরতযোগ্য হতে পারে (নিতান্ত পরিমাণের সমতা নয়, বরং মূল্যমানের দিক থেকে সমতা) কিন্তু সমমূল্যের বেশি তথা রিবা পেতে পারে না।
প্রচলিত অর্থনীতিতে উৎপাদন উপকরণের মধ্য থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন ভূমি, খনিজ সম্পদ, বনভূমি ও বনজ সম্পদ, জলমহাল, মৎসক্ষেত্র, নদী-নালা, খাল-বিল ইত্যাদিকে সংক্ষেপে ‘ভূমি’ বলা হয়। ভাড়া হলো ভূমি ব্যবহারের মূল্য। প্রাকৃতিক সম্পদ বা অনুৎপাদিত ভূমির মতোই মানুষের তৈরি করা মেশিন, দালান-কোঠা, পরিবহন প্রভৃতি, উৎপাদন প্রক্রিয়াতে ব্যবহারের সময় বা উৎপাদনের কাজে লাগানোর পরে যার আকার বদলে যায় না বা নি:শেষ হয়ে যায় না, সেটা বারবার ব্যবহারযোগ্য বিধায় তাও ভাড়ায় খাটানো যায়। প্রচলিত অর্থনীতিতে এগুলোকে ‘স্থির মূলধন’ বলে। তবে ভূমির মতো ভাড়ায় খাটানো যায় বিধায় এগুলোকে ‘উৎপাদিত ভূমি’ বলা যেতে পারে। অন্যদিকে প্রচলিত অর্থনীতিতে যেগুলোকে ‘চলতি মূলধন’ বলা হয়, কাঁচামাল, জ্বালানি, বীজ ও সারের মতো মূলধন যা একবারে ব্যবহারের দ্বারাই নি:শেষ হয়ে যায়, এটাই প্রকৃতপক্ষে মূলধন বা পুঁজি হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার যোগ্য, যা মূল্যমান অবক্ষয়ের প্রতিপূরণ পেতে পারে, কিন্তু ভাড়া পেতে পারে না।
ভাড়ার সাথে রিবার পার্থক্যের প্রেক্ষিতে উপকৃত হওয়ার বিনিময় হিসেবে ভাড়া গ্রহণযোগ্য তথা বৈধ কিন্তু উপকৃত হওয়ার বিনিময় হিসেবে রিবা গ্রহণযোগ্য নয় তথা অবৈধ। বরং যদি ধার দেয়া হয় তাহলে তা দিতে হবে মানবিক সহযোগিতা হিসেবে। অন্যদিকে যদি পুঁজি দ্বারা উপকৃত হওয়ার বিনিময় প্রত্যাশা করতে হয় তাহলে তা করতে হবে ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে, অর্থাৎ যে বিনিয়োগ নিয়ে লাভবান হয় তার লাভের অংশ নেয়ার মাধ্যমে, এ শর্তে যে, যদি ক্ষতি হয় তবে ক্ষতির অংশও বহন করা হবে।
ঋণের বিপরীতে মূলধন বা আসলের সমমূল্যের চেয়ে বেশি তথা রিবা গ্রহণ করলে ঐ ঋণকে ঋণ বলা যায় না, আবার ব্যবসায়ে বিনিয়োগও বলা যায় না। কারণ মূলধনও ঠিক থাকবে আবার সে মূলধনের উপর ভিত্তি করে (ব্যবসায়ে লাভ হোক অথবা লোকসান হোক উভয় অবস্থায়) রিবা গ্রহণ করা হবে অথচ তা ব্যবসায়ের লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে হিসাব করা হবে না, কোনো ব্যবসায়ীকে এভাবে টাকা ধার দেয়াকে ব্যবসায়ের বিনিয়োগ বলা যেতে পারে না। ভিক্ষাকে যেমন উপার্জন বলা যেতে পারে না, সুদকে তেমনি ব্যবসায়ের মুনাফা বলা যেতে পারে না। অর্থাৎ সুদে টাকা ধার দেয়াকে (রিবাকে) ‘ব্যবসা’ বলা যেতে পারে না। এমনকি যদি বলা হয়, ব্যবসায়ে লাভ হলে লভ্যাংশ দিতে হবে আর লোকসান হলে মূলধন ফেরত দিতে হবে, তবে তাও রিবা হিসেবেই সাব্যস্ত হবে। কারণ এ ধরনের লভ্যাংশ গ্রহণ করার চুক্তিও ন্যায়সঙ্গত নয়।
কেউ কেউ প্রশ্ন করেন যে, “সুদ (রিবা) যেমন প্রতি মাসে নির্ধারিত হারে পরিশোধ করতে হয়, বাড়ি ভাড়াও তেমনি প্রতি মাসে নির্ধারিত হারে পরিশোধ করতে হয়। তাহলে রিবাকে ভাড়ার সমতুল্য বলা যাবে না কেন?” এ প্রশ্নের জবাবে বলা যেতে পারে যে, রিবার হারও পরিবর্তনশীল হতে পারে। আসলে রিবা নির্ধারিত/অপরিবর্তনীয় হারে বাড়তি পরিশোধের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং লাভ-ক্ষতি যা-ই হোক উভয় অবস্থায় অথবা লাভ-ক্ষতির সাথে কোনো সম্পর্ক ছাড়া মূলধনের সাথে কোনো বিনিময়হীন বাড়তি অংশ পরিশোধ করাই রিবা। তাই রিবার হার নির্ধারিত/অপরিবর্তনীয় হোক অথবা অনির্ধারিত/(সময়ের বিভিন্ন এককে বা পর্যায়ে) পরিবর্তনশীল হোক উভয় অবস্থায় তা অগ্রহণযোগ্য।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শ্রমিক যে পারিশ্রমিক পায় প্রকৃত প্রস্তাবে তা হচ্ছে ‘শ্রমের ভাড়া’। কারণ শ্রমশক্তি মানুষের দেহ ও মনের সাথে সম্পৃক্ত এমন একটি অবিচ্ছেদ্য ক্ষমতা, যার কোনো দৃশ্যমান আকার বা বাহ্যিকতা নেই এবং যার মালিকানা হস্তান্তর করা যায় না। একই শ্রমিক একবার শ্রম দেয়া ও তার পারিশ্রমিক পাওয়ার পর, আবারো বা অন্যত্রও শ্রম দিতে ও পারিশ্রমিক পেতে পারে, অর্থাৎ তার শ্রমশক্তি তারই থেকে যায়। তাই শ্রমিক তার শ্রমকে (শ্রমশক্তির উপযোগকে) ভাড়ায় খাটাতে পারে, যা তার পারিশ্রমিক হিসেবে সাব্যস্ত হয়। এছাড়া শ্রম বিনিয়োগ করে পুঁজি বিনিয়োগকারীর সাথে উদ্যোক্তা বা সংগঠক হিসেবে লাভ-ক্ষতির অংশীদার হওয়া যায়, যাতে চুক্তি অনুসারে শ্রম বিনিয়োগকারী ও পুঁজি বিনিয়োগকারীর মধ্যে মুনাফার বণ্টন হবে।
ভূমির ভাড়া ও শ্রমিকের মজুরি ন্যায়সঙ্গত নীতিমালার ভিত্তিতে এবং পারস্পরিক সমঝোতাক্রমে নির্ধারিত হতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সাপেক্ষে উলিল আমর (মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা সরকার) সমকালীন পরিস্থিতি বিশ্লেষণপূর্বক বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যেমন, ভূমির ভাড়া হিসেবে কী পরিমাণ অগ্রিম পরিশোধের দাবি করা যাবে, কোনো শ্রমিকের শ্রমঘন্টা ও ন্যুনতম মজুরি কত হতে হবে, সর্বোচ্চ স্তরের কর্মকর্তার মজুরি ও সর্বনিম্ন স্তরের কর্মচারীর মজুরির পার্থক্যের অনুপাত কত হতে হবে, কী ধরনের জিনিস কোন ‘মান’ বজায় রেখে উৎপাদন করতে হবে ইত্যাদি নীতিমালা প্রণয়ন করার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
ন্যায়সঙ্গত সার্ভিস চার্জ একটি স্বাভাবিক, যৌক্তিক বা গ্রহণযোগ্য উপার্জন। এটি একটি স্বত:সিদ্ধ বিষয় যে, কেউ কারো জন্য কোনো শ্রম দিলে সে সেজন্য একটি পারিশ্রমিক লাভ করবে, অনুরূপভাবে কেউ কোনো সার্ভিস বা সেবা প্রদান করলে সেও সেজন্য একটি সার্ভিস চার্জ বা পারিতোষিক লাভ করবে। পুরস্কার, পারিশ্রমিক, পারিতোষিক এবং সার্ভিস চার্জ প্রভৃতিকে আরবিতে আজর (বহুবচনে উজূর) বলা হয়। বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত ‘মজুরি’ শব্দটি ‘আজর’ শব্দ থেকে গঠিত হয়েছে। ইয়াতীমের সম্পদের ব্যবস্থাপনাগত সার্ভিসের জন্য সার্ভিস চার্জ গ্রহণের অনুমতি সম্পর্কিত আয়াত (৪:৬) থেকে সার্ভিস চার্জের বিষয়ে সুষ্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। নিম্নে আয়াতটি উল্লেখ করা হলো:
৪:৬ :: আর ইয়াতীম ছেলেমেয়েদেরকে পরীক্ষা করো যখন তারা বিয়ে করার বয়সে পৌঁছে যায়। তারপর যদি তোমরা তাদের মধ্যে সঠিক বোধবুদ্ধি (সম্পদের সঙ্গত ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা) অনুভব করো তাহলে তাদের ধন-সম্পদ তাদেরকে দিয়ে দাও। আর তোমরা তাদের সম্পদ খেয়ো না অপচয় করে এবং তারা বড় হওয়ার আগে তাড়াহুড়া করে। আর যে ধনী সে যেন সংযত থাকে, আর যে দরিদ্র সে যেন ন্যায়সঙ্গতভাবে খায়। অতঃপর যখন তোমরা তাদের ধন-সম্পদ তাদের নিকট সোপর্দ করবে তখন তাদের উপর তোমরা সাক্ষী রাখবে। আর হিসাব গ্রহণকারী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।
এ আয়াত অনুসারে, যদি ইয়াতীমের অভিভাবকত্ব গ্রহণকারী বা ব্যবস্থাপক দরিদ্র হয়, তাহলে সে ইয়াতীমের সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য ইয়াতীমের সম্পদ থেকে ন্যায়সঙ্গত সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করতে পারবে। কোনো ব্যক্তির কাছে ঐ ইয়াতীমের সম্পদের অনুরূপ সম্পদ থাকলে এবং কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে তার নিজের পক্ষে ঐ সম্পদের ব্যবস্থাপনা সম্ভব না হলে সে ব্যক্তি সম্পদের ধরন ও পরিমাণ এবং ব্যবস্থাপনার ধরনকে বিবেচনায় নিয়ে যেই পরিমাণের সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে কাউকে তা ব্যবস্থাপনার জন্য দিতে সম্মত হতে পারে, যাতে কোনো পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়- এরূপ পরিমাণই হলো ন্যায়সঙ্গত সার্ভিস চার্জ, যেখানে কোনো পক্ষ অপরপক্ষের উপর কৃত্রিম চাপ সৃষ্টি করে না এবং যার মাধ্যমে কোনো পক্ষের স্বার্থহানি ঘটে না। এভাবে যেকোনো সার্ভিসের ক্ষেত্রেই উভয়পক্ষের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত বিনিময় সংঘটিত হতে হবে।
সুতরাং যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমানাত, মানি ট্রান্সফার, পে অর্ডার, বিল পেমেন্ট ইত্যাদি সেবা প্রদান করা হয়, তবে তাতে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ও জনবল কাঠামোর ব্যয় নির্বাহ বাবদ সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করা দোষনীয় নয়।
ইয়াতীমের সম্পদের ব্যবস্থাপনার সার্ভিস চার্জ গ্রহণের ক্ষেত্রে যেমন ন্যায়সঙ্গত সার্ভিস চার্জ গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে আমানাত সার্ভিসের ক্ষেত্রেও অনুরূপভাবে সার্ভিস চার্জ ন্যায়সঙ্গত হতে হবে। এক্ষেত্রে ন্যায্যতার কিছু দিক হলো- আমানাত প্রদানকারীর আমানাত যদি এমন দ্রব্য হয় যা কাজে লাগানোর পরও নি:শেষ হয়ে যায় না, তাহলে তা নিজ কাজে লাগালে সেজন্য ভাড়া দিতে হবে। তবে যে দ্রব্য কাজে লাগালে নি:শেষ হয়ে যায় এরূপ সম্পদের ক্ষেত্রে কোনো ভাড়া প্রযুক্ত হবে না। আমানাত প্রদানকারীকে চুক্তি অনুসারে যথাসময়ে আমানাত প্রত্যর্পণ করতে হবে। আমানাত প্রদানকারী থেকে কতটুকু সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করা যাবে তা উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতি এবং যুক্তিসঙ্গত বাজারমূল্যের উপর নির্ভর করবে।
তবে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ আদান-প্রদান করার ক্ষেত্রে দুই ব্যক্তির মধ্যে পারস্পরিক ঋণের আদান-প্রদানের মতো একই বিধান প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করবে। অন্য কথায় কোনো ব্যক্তি নিজের টাকা ঋণ দিচ্ছে নাকি সে আমানাতকারীদের মাধ্যমে অথবা কাউকে ব্যবসায়িক বিনিয়োগ হিসেবে ঋণ প্রদান করে উপার্জিত অর্থ থেকে ঋণ দিচ্ছে তা লক্ষণীয় বিষয় নয়।
ঋণদাতা ঋণ গ্রহীতার থেকে ঋণস্বরূপ প্রদত্ত দ্রব্য ও তার ভাড়া অথবা তার অনুরূপ দ্রব্য বা তার সমমূল্য ফেরত পাবে, কিন্তু কোনো ক্রমে সুদ গ্রহণ করতে পারবে না। আর যদি সাধারণ ঋণ না দিয়ে ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগ করে, তাহলে তাকে চুক্তি অনুসারে ব্যবসায়ের লাভ বা ক্ষতির অংশীদার হতে হবে, একচেটিয়াভাবে লভ্যাংশ পেতে পারবে না, তা পরিমাণে যত কমই হোক না কেন।
যার কাছে আমানাত রাখা হয়েছে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যে বা যারা আমানাত রেখেছে তার বা তাদের সম্মতিক্রমে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগে পুঁজি বিনিয়োগ করলে চুক্তি অনুসারে লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্বে তারা সকলেই অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। অন্যথায় যাদের থেকে আমানাত গ্রহণ করা হয়েছে তাদেরকে তাদের আমানাতই ফেরত দিতে হবে, তা কাজে লাগিয়ে লাভ বা লোকসান যা-ই হোক তারা তাতে অংশীদার হবে না।
যদি কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসায়িক কাজে বিনিয়োগ করে এবং এক্ষেত্রে ব্যবসায়ের তত্ত্বাবধানের জন্য তার পক্ষ থেকে জনবল নিয়োগ করতে হয়, তাহলে সে ঐ জনবলের জন্য চুক্তি অনুসারে সুনির্দিষ্ট পারিশ্রমিক পেতে পারবে। কিন্তু কোনোক্রমে সরাসরি ঐ ব্যবসায়ের তত্ত্বাবধানের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তির কোন কাজের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কত নেয়া হচ্ছে তা স্পষ্ট করা ছাড়া বা মূলধনের উপর ভিত্তি করে মূলধনের সাথে কোনো বর্ধিত অংশ দাবি করতে পারবে না। অন্যথায় মূলধনের উপর ভিত্তি করে মূলধনের সাথে বাড়িয়ে নেয়া ঐ অংশ রিবা হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
কুরআনে যখন সফর অবস্থায় লেখক পাওয়া যায় না, তখন ঋণ গ্রহণের জন্য হস্তান্তরযোগ্য (বা অস্থাবর) দ্রব্য বন্ধক রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সফর অবস্থা এবং লেখক ও সাক্ষী না পাওয়ার অবস্থা ছাড়া সাধারণ অবস্থায় বন্ধকের জন্য কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি, আবার নিষেধও করা হয়নি।
বন্ধককে ‘আমানাত’ বা ‘বিশ্বস্ততা সহকারে সংরক্ষণের বিষয়’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যে ব্যক্তির কাছে বন্ধক বা আমানাত রাখা হয়েছে সে যেন যথাসময়ে ও যথানিয়মে তা ফেরত দেয়। এটি একটি স্বত:সিদ্ধ বিষয় যে, বন্ধকী জিনিস বা আমানাত ব্যবহার করলে পারস্পরিক সমঝোতাক্রমে তা ব্যবহারের মূল্য ও প্রতিপূরণ দিতে হবে, যেটিকে কোনো দ্রব্যের ভাড়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। পক্ষান্তরে যদি বন্ধক বা আমানাত ব্যবহার বাবদ কোনো মূল্য পরিশোধ করা না হয়, তাহলে তা রিবা হিসেবে সাব্যস্ত হবে। বন্ধকী গরুকে লালন-পালন করার বিনিময় হিসেবে বন্ধকী গরুর দুধপান করা বন্ধকগ্রহীতার জন্য বৈধ বলে প্রতীয়মান হয়। পক্ষান্তরে যেক্ষেত্রে আমানাতকারীর পক্ষ থেকে এরূপ কোনো বিশেষ শ্রম বা সেবার বিষয় নেই, সেক্ষেত্রে বন্ধকী জিনিস বা আমানাত থেকে কোনো অংশ গ্রহণ করা অন্যায় এবং বিনিময়হীন বাড়তি সুবিধা গ্রহণ (রিবা) হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
যে মুদ্রা একই সাথে মুদ্রা এবং তা একটি মূল্যবান ধাতু হওয়ায় তার একটি নিজস্ব মূল্যমান আছে সেটাই সবল মুদ্রা। যেমন স্বর্ণমুদ্রা, রৌপ্যমুদ্রা ইত্যাদি। অবশ্য কাগুজে মুদ্রা যদি স্বর্ণ, রূপা বা এরূপ কিছুর রিজার্ভের রশিদ হয় সেক্ষেত্রে তার মাধ্যমে লেনদেন করা যেতে পারে, যদি চাহিবা মাত্র উহার বাহককে রিজার্ভকৃত মূল দ্রব্য দিতে বাধ্য থাকার সুব্যবস্থা থাকে। এক্ষেত্রে কোনোরূপ পদ্ধতিগত অনিশ্চয়তা ঐ রশিদকে দুর্বল মুদ্রায় পরিণত করে দেয়। আবার যখন কাগুজে মুদ্রাকে স্বর্ণ, রূপা বা এরূপ কিছুর রিজার্ভের রশিদ নয় বরং সরকারসমূহের স্বীকৃতির প্রেক্ষিতে মুদ্রা হিসেবে চালু করা হয় তখন তা হচ্ছে প্রাকৃতিক মূল্যমানবিহীন নিছক/কৃত্রিম মুদ্রা। তাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা হতে হবে ধাতবমুদ্রা (স্বর্ণমুদ্রা, রৌপ্যমুদ্রা) এবং সেই সাথে মূল্যবান ধাতুর রিজার্ভের রশিদরূপ কাগুজে মুদ্রাও গ্রহণযোগ্য। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রচলিত মুদ্রা যেমন ডলার বা টাকা হচ্ছে কৃত্রিম মুদ্রা।
বর্তমানে ইলেকট্রনিক মুদ্রার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যার মাধ্যমে মুদ্রার একককে সুবিধাজনকভাবে বিভক্ত করা যায়। যেমন ইলেকট্রনিক লেনদেন হিসেবে প্রতি সেকেন্ডে ০.৫ পয়সা মোবাইল কল চার্জ ধার্য করা যায়, অথচ বাস্তবে ১ পয়সাকে আরো ক্ষুদ্র আকারে হাতে হাতে লেনদেন করা যায় না বা এরূপ মুদ্রা চালু করা হয়নি। অনুরূপভাবে ইলেকট্রনিক মুদ্রাকে সুবিধামতো লেনদেন করা যায়। কিন্তু এই অজুহাতে ধাতবমুদ্রার ধারণাকে সেকেলে সাব্যস্ত করে নিছক/কৃত্রিম মুদ্রার (যেমন- কাগুজে মুদ্রা ও ইলেকট্রনিক মুদ্রা) ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ নেই। কেননা হিসাব অনুসারে ১ একক স্বর্ণমুদ্রাকে আরো ক্ষুদ্রভাগে ভাগ করে লেনদেন করা যাবে এবং যখন তা হাতে হাতে পরিশোধের প্রশ্ন আসবে তখন কোনো পক্ষের হাতে মুদ্রাটি থাকবে এবং অপর পক্ষ সেটার যতটুকু মূল্যমানের মালিক ততটুকু ছাড়া বাকিটুকু মূল্যমান দিয়ে সে অন্যের সাথে লেনদেন করতে পারবে তথা হিসাব সমন্বয় করতে পারবে।
প্রকৃতপক্ষে ভারসাম্যপূর্ণ মুদ্রা তো সেটাই হতে পারে প্রকৃতিতে যার যোগান খুব বেশিও নয় আবার খুব কমও নয় কিন্তু তার তার বাস্তব চাহিদাগত মূল্যমান বিদ্যমান রয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুদ্রা হিসেবে স্বর্ণমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রা সনাতন মুদ্রা হিসেবে সমাদৃত এবং কাগুজে মুদ্রার বিপরীতে অত্যাধিক গ্রহণোপযোগী মুদ্রা বলে সাব্যস্ত হয়।
প্রাথমিক বিবেচনায় ১ ডলার = ১ টাকা হওয়াই প্রকৃত ন্যায়সঙ্গত হতো যেহেতু উভয়টিই কাগুজে মুদ্রার একক। কিন্তু যেহেতু নিছক কাগুজে মুদ্রার (যা ধাতবমুদ্রা নয়) মূল্যমান হচ্ছে এর সরকারি স্বীকৃতি মাত্র, প্রকৃত (নিজস্ব/বস্তুগত/পণ্যগত) মূল্যমান নয়, তাই এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো ভিত্তিমূলক পণ্যের যেমন স্বর্ণের মূল্যের উঠানামার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত মুদ্রার যেমন ডলারের মূল্যমানের সাপেক্ষে দুটি দেশের মুদ্রার এককের মূল্যমানের তারতম্য আপাত অনাপত্তিকর বলে সাব্যস্ত হয়।
প্রকৃতপক্ষে দুটি দেশের দুটি ভিন্ন মুদ্রার (যেমন ডলার ও টাকার) মানের তারতম্যের স্থিতিশীলতা, এমনকি প্রচলিত আন্তর্জাতিক মুদ্রার মূল্যমান থাকা বা না থাকা শুধুমাত্র বিশ্বস্ততার উপর নির্ভরশীল, এক পক্ষ (সবল পক্ষ) বিশ্বস্ততা লংঘন করলে অন্য পক্ষ (দুর্বল পক্ষ) ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য, যার প্রতিকার করতে সে পক্ষ সক্ষম নয়। আর এভাবে বিশ্বস্ততা লংঘন করে কোনো পক্ষ অতিরিক্ত সুবিধা গ্রহণ করলে এরূপ অতিরিক্ত সুবিধা হচ্ছে রিবা।
১৬:৯২ আয়াতে প্রতিশ্রুতি তথা বিশ্বস্ততা লংঘন করে স্বার্থসিদ্ধিতে অধিকতর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ার বিষয়ে তথা সুদ (অন্যায্যভাবে বাড়তি সুবিধা গ্রহণ) এর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। আয়াতটিতে অন্যায্যভাবে বাড়তি সুবিধা গ্রহণের বিষয় বুঝানো জন্য রিবা (সুদ) শব্দ থেকে গঠিত ‘আরবা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। নিম্নে আয়াতটি উল্লেখ করা হলো।
১৬:৯২ :: আর তোমরা সেই নারীর মতো হয়ো না যে পাক খুলে দিয়েছে তার সুতাকে মজবুত করে পাক দেয়ার পরে। (এভাবে যে) তোমরা গ্রহণ করছো তোমাদের প্রতিশ্রুতিকে পরস্পরের মধ্যে প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে, যেন এক পক্ষ অন্য পক্ষের তুলনায় (অন্যায্যভাবে) স্বার্থসিদ্ধিতে অধিকতর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে। নিশ্চয় আল্লাহ সেটার মাধ্যমে (অর্থাৎ প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে) তোমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেন। আর নিশ্চয় তিনিই তোমাদের জন্য কিয়ামাত দিবসে তোমাদের মতভেদের বিষয়ে (কে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত তা) স্পষ্ট করে দিবেন (তাই সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে দাবি করে অন্যায় উপায় অবলম্বন করা গ্রহণযোগ্য নয়)।
প্রচলিত কাগুজে মুদ্রা ব্যবস্থার কারণে ‘ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং’য়ের নামে ব্যাংকের কাছে থাকা মুদ্রার রিজার্ভের চেয়ে বেশি পরিমাণ টাকা ঋণ দেয়াকে আইন-অনুমোদিত পদ্ধতি বানিয়ে নেয়া হয়েছে। এর ফলে অধিক হারে কৃত্রিম মুদ্রা ছাপানোর মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে এবং ব্যাংক-ঋণের দুইপক্ষের (ঋণদাতা ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতা পুঁজিপতির) বোঝা সর্বসাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতার উপর চেপে বসে এবং ঐ দুই পুঁজিপতি পক্ষ অন্যায়ভাবে (কৃত্রিম মুদ্রার বিনিময়ে) অধিক দ্রব্য সামগ্রী হস্তগত করার সুযোগ পায়।
যেহেতু প্রচলিত কাগুজে মুদ্রা ব্যবস্থা রিবার উদ্ভব ঘটায় এবং নিছক মুদ্রার (অর্থাৎ যে মুদ্রার স্বীকৃতিগত মূল্য ছাড়া নিজস্ব মূল্য নেই এরূপ মুদ্রা) মাধ্যমে পণ্য হস্তগত করতে সুযোগ দেয় অথচ বিপরীতক্রমে আবার মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে সেটাকে সমমূল্যে পুনঃবিনিময়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং যে কোনো বিপর্যয় কাগুজে মুদ্রার মূল্যমানকে উদ্বেগজনক হারে হ্রাস করে তাই এই মুদ্রাব্যবস্থার পরিবর্তন আবশ্যক।
অবশ্য একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবের পূর্বে বর্তমান মুদ্রাব্যবস্থার ও আন্তর্জাতিক মুদ্রার পরিবর্তন সম্ভব নয় বিধায় নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ঐরূপ বিপ্লবের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে বিপ্লব পূর্বকালে বর্তমান মুদ্রাব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা মেনে নিয়ে লেনদেন চালানো হচ্ছে নিরূপায় অবস্থায় দুর্বল ও নিছক (কৃত্রিম) মুদ্রার বিনিময়ে লেনদেন করা।
যতক্ষণ না বর্তমান মুদ্রাব্যবস্থা পরিবর্তন করা যাচ্ছে, ততক্ষণ এর মুদ্রাবাজার অনুসারে মুদ্রার লেনদেন করতে হবে। মুদ্রাবাজার অনুযায়ী বিদ্যমান থাকা সাপেক্ষে দুটি দেশের কাগুজে মুদ্রাকে ভিন্ন ভিন্ন এককের ক্ষেত্রে মানগত সমতা বজায় রেখে পরিমাণগত হ্রাস-বৃদ্ধিসহ বিনিময় করলে (যেমন ১ ডলারের বিনিময়ে ৮৬ টাকা গ্রহণ করলে) তা রিবা নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য বা লেনদেনের প্রেক্ষিতে ১ ডলার = ৮৬ টাকা বা কখনো তার চেয়ে বেশি বা কম যা-ই স্থির হয় সেই সমকালীন প্রেক্ষিতে সাধারণ জনগণের জন্য সেভাবে মুদ্রার বিনিময়ের মধ্যে রিবা না থাকলেও, বাস্তবে মুদ্রামানের তারতম্য ঘটানোর মাধ্যমে যারা অন্য দেশের নাগরিকদের তুলনায় বাড়তি সুবিধা লাভ করে তাদের এই বাড়তি সুবিধা গ্রহণকে (যে উদ্দেশ্যে তারা পরিকল্পিত উপায়ে মুদ্রামানের তারতম্য ঘটিয়ে থাকে) বিশ্ব অর্থনীতিতে সবচেয়ে মারাত্মক পর্যায়ের রিবা হিসেবে সাব্যস্ত করা যেতে পারে।
প্রচলিত মুদ্রাব্যবস্থায় সময়ে সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দেশের মুদ্রামানের পরিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভূত রিবার প্রতিক্রিয়ায় দুর্বল ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রশক্তিগুলো মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত হয়। এছাড়া সীমিত পরিসরে ডলারের বিনিময়ে আন্তর্জাতিক সাধারণ বাজারমূল্যে স্বর্ণ ক্রয় করা সম্ভব হলেও পর্যাপ্ত পরিমাণে ডলার ও স্বর্ণের বিনিময় সম্ভব নয়। এমনকি স্বর্ণমুদ্রা ফিরিয়ে আনাকে পরিকল্পিতভাবে দুঃসাধ্য করে তোলা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে স্বর্ণ সংরক্ষণের পরিমাণকেও আইনগতভাবে সীমিত করে রাখা হয়েছে। বর্তমানে ডলার ছাপানোর পরিমাণের ক্ষেত্রে সমমূল্য পরিমাণের স্বর্ণের রিজার্ভ ও বিনিময় পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় না। এভাবে ডলারের বিনিময়ে স্বর্ণ সংগ্রহ এবং ডলারের বিনিময়ে স্বর্ণের প্রত্যাবর্তন এই দুই ক্ষেত্রে দুই ভিন্ন রকম নীতি অবলম্বন করা স্পষ্টতই যে কোনো বিপর্যয়ের মুখে কাগুজে মুদ্রাকে অস্বীকৃত মুদ্রায় পরিণত করে যাদের নিকট মূল্যবান ধাতু জমা হচ্ছে তাদেরকেই একমাত্র ভবিষ্যৎ সুবিধাভোগী শ্রেণি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মারাত্মক হুমকি রয়েছে। অন্য কথায় প্রচলিত মুদ্রাব্যবস্থা ভবিষ্যৎ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
প্রচলিত কাগুজে মুদ্রা ব্যবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রে ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রা প্রচলিত রেখে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রয়োজনে একটি রাষ্ট্রের মুদ্রাকে (ডলার) আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করায় সেই রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উত্থান-পতন অন্যান্য রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে উত্থান-পতন ঘটায়। আর উত্থান-পতনকে অনেক সময় কৃত্রিমভাবে প্রভাবিত করা হয়। প্রচলিত কাগুজে মুদ্রাব্যবস্থাকে সুদসহ ফেরতের শর্তে ঋণ দেয়ার উপর নীতির ভিত্তিতে কার্যকর করা হয়। অর্থাৎ মুদ্রার প্রথম সরবরাহই ঘটে রিবার শর্ত সহকারে। এ শর্ত পূরণ করতে গিয়ে রিবার আবর্তন ঘটে। কারণ রিবার শর্তে ঋণ প্রদান করে এবং গ্রাহকদের থেকে গৃহীত রিবা এবং তাদের প্রদত্ত রিবার পার্থক্যের মাধ্যমে প্রথম ছাপানো মুদ্রার শর্তে থাকা রিবা পরিশোধ করা হয়। আর এভাবে রিবাকে অপরিহার্য পদ্ধতি বানিয়ে নিয়ে অন্যায়ভাবে রিবা গ্রহীতার সম্পদের অংশ কর্তন করা হয়।
তারপর বৈশ্বিক অর্থনীতির বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সুবিধামতো সুদের হার হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর ফলে অর্থনৈতিক সংকটে থাকা দেশগুলোকে তা থেকে উত্তরণের জন্য রিবা প্রদানের শর্তে ঋণ দেয়া হয়, যা মুদ্রাস্ফীতি ঘটায় এবং সাময়িকভাবে সংকট নিরসন হচ্ছে মনে হলেও ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পায়, উৎপাদনের তুলনায় ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং বণ্টনজনিত বৈষম্য বৃদ্ধি পায় তথা রিবার আবর্তন ঘটতে থাকে। এভাবে সম্পদশালী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র আরো সম্পদশালী হয়, পক্ষান্তরে যারা দরিদ্র তারা বাহ্যিকভাবে কিছু সাময়িক উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করলেও তাদের শ্রমলব্ধ ও ঝুঁকি বহন করে উৎপাদিত সম্পদ থেকে একটি অংশ রিবা বাবদ হাতছাড়া করতে হয়, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ব্যর্থ হয় এবং তারা দারিদ্রের দুষ্টচক্রে আবর্তিত হতে থাকে।
তাই বিশ্বজনীন সুষম অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রচলিত অর্থব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। নতুন অর্থব্যবস্থায় মুদ্রা হিসেবে সনাতন ধাতব মুদ্রা (স্বর্ণমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রা) চালু করতে হবে এবং কাগুজে মুদ্রাকে স্বর্ণের রিজার্ভের রশিদ হিসেবে পুন:প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, কত টাকার নোট কতটুকু স্বর্ণের বিপরীতে মূল্য ধারণ করে তার সেই তথ্য সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট থাকতে হবে এবং আন্তর্জাতিক একক মুদ্রাব্যবস্থা চালু করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মুদ্রা (যেমন- টাকা) হলো বিনিময়ের মাধ্যম। তা সরাসরি ভোগ্যপণ্য নয়, বরং সেটাকে বিভিন্ন পণ্যের বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। টাকা দিয়ে কোনো পণ্য কিনে তা অধিক টাকার বিনিময়ে বিক্রি করার মাধ্যমে, উৎপাদন কাজে লাগিয়ে লাভ-লোকসানের ঝুঁকি শেয়ারের শর্তে লাভজনক অবস্থায় বা কোনো দ্রব্য কিনে/তৈরি করে তা ভাড়া দেয়ার মাধ্যমে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু এরূপ কোনো প্রক্রিয়া ছাড়া নিছক টাকার লেনদেনের মধ্যে অর্থাৎ ঋণ হিসেবে ও ব্যবসায়ের ঝুঁকি শেয়ার ছাড়া পুঁজি হিসেবে টাকার লেনদেনে যদি হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে তাহলে তাতে রিবার উদ্ভব ঘটে। কারণ এরূপ হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে অসম বিনিময় সম্পাদিত হয়। কিন্তু যদি ঐ হ্রাস-বৃদ্ধি সময়ের ব্যবধানে মুদ্রামানের হ্রাস-বৃদ্ধির বিবেচনায়/সমানুপাতিক হ্রাস-বৃদ্ধি হয়, তবে সেটা রিবা নয়।
মজুদদারিতা বলতে বুঝায় কোনো ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রয়যোগ্য পণ্য রয়েছে এবং বাজারে তার চাহিদা রয়েছে কিন্তু তা সত্ত্বেও সে ঐ পণ্যের যোগান না দিয়ে আটকে রাখা, যেন বাজারে সংকট তৈরি হয় এবং পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং তখন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মূল্যে বিক্রয় করে অধিক লাভ পেতে পারে। মজুদদারিতা এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে মূল্যবৃদ্ধি করলে বর্ধিত মূল্য রিবা হিসেবে সাব্যস্ত হবে। তবে এ রিবা গ্রহণকারী তারাই যারা এ বৃদ্ধি প্রক্রিয়ার উদ্যোক্তা, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মূল্যে লেনদেনকারী ক্রেতা-বিক্রেতা নয়।
সূরা মাউনে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগানে বাধা সৃষ্টি তথা মজুদদারিতা বা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে মূল্য বৃদ্ধিকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে ন্যায়সঙ্গত ব্যয় নির্বাহ করার পর যেমন উৎপাদন, ব্যবসা ও সেবাখাতে বিনিয়োগের জন্য সঞ্চয় করা সঙ্গত, তেমনি মধ্যম পন্থায় ব্যয়ের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত অর্থসম্পদকে পরবর্তী ভোগের জন্য সঞ্চয়েও নিষেধাজ্ঞা নেই। এমনকি বিশেষ প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তাগত কারণে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিজের বৈধ সম্পদকে গুপ্তধন আকারে রাখারও সুযোগ রয়েছে। আমরা সূরা ইউসুফ এবং সূরা কাহাফে এর দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।
পূর্বে যখন ধাতব মুদ্রা ছিল তখন তা অলসভাবে জমা রাখার মাধ্যমে তথা স্বর্ণ জমা করে রাখার মাধ্যমে রিবা গ্রহণের সুযোগ সন্ধান করা হতো। আল কুরআনে স্বর্ণ (by extension money) ও অন্যান্য সম্পদ জমা করে রাখা এবং তা সঠিকভাবে ব্যয় না করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমান কালে ব্যবসা উদ্যোগে কাজে না লাগিয়ে ব্যাংকে টাকা জমা রেখে রিবা গ্রহণ করা হয়, এরপর ব্যাংকও সেই টাকা ঋণ দিয়ে রিবা গ্রহণ করে এবং সেই সাথে সম্পদশালীদের কাছে অধিক সম্পদ পুঞ্জীভুতকরণের সুযোগ সৃষ্টির ফলে বাজারের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হয়, যাতে সাধারণ ভোক্তারা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও পরোক্ষভাবে রিবার উদ্ভব ঘটে।
যেখানে এক পক্ষের একক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দুর্বল পক্ষের উপর কোনো বাড়তি বা অন্যায্য বিনিময় চাপিয়ে দেয়া হয় তাতে রিবার উদ্ভব ঘটে। অর্থাৎ যখন কোনো লেনদেন বা বিনিময়ের দুই পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সন্তুষ্টিপূর্ণ সমঝোতার পরিবর্তে কোনো পক্ষের অসহায়ত্বের কারণে এক পক্ষ অধিক বিনিময়মূল্য নির্ধারণ করে এবং অপরপক্ষ বাধ্য হয়ে তা মেনে নেয় তখন রিবার উদ্ভব ঘটে। এই প্রেক্ষিতে পণ্যমূল্য, মজুরি, ভাড়া ইত্যাদি ক্ষেত্রেও রিবার উদ্ভব ঘটা সম্ভব। এসব ক্ষেত্রে কোনো কোনো পরিস্থিতিতে চাহিদা-যোগানের সাধারণ পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক পরিভাষার ‘ভারসাম্য মূল্যে’ বিনিময় হলেও নৈতিক সীমালঙ্ঘন জনিত কারণে চাহিদা ও যোগানের অতিরিক্ত হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে ঐ ‘ভারসাম্য মূল্য’ স্থিরীকৃত হয়। এভাবে ‘চাহিদা ও যোগানের অনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত ভারসাম্যমূল্যে’ বা ‘ন্যায্য মূল্যে’ বিনিময় হয় না, বরং রিবার উদ্ভব ঘটে। তখন রিবা চিহ্নিতকরণ ও রিবা প্রতিরোধের জন্য সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেক্ষেত্রে এ বিষয়ে নির্বাহী ব্যবস্থাপনা হিসেবে দুই বা ততোধিক ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির পর্যবেক্ষণভিত্তিক পরামর্শক্রমে এসবের ন্যায্য পরিমাণের নির্বাহী নীতিমালা নির্ধারণ করে দিতে হবে। কারণ যেক্ষেত্রে কোনো কিছুকে বিধিসঙ্গত বস্তু বা বিষয় হিসেবে চিহ্নিতকরণের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি হিসেবে আল কুরআনে দুজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সিদ্ধান্ত প্রদানের অধিকার দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে (৫:৯৫)।
ন্যায্য মূল্যে চাহিদা-যোগানের নিয়ন্ত্রণের জন্য যেমন যুক্তিসঙ্গত করারোপের পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে, তেমনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন স্বীকৃত বাজারমূল্য নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। আর এক্ষেত্রে দুই বা ততোধিক ন্যায়নিষ্ঠ দায়িত্বশীল নিযুক্ত করতে হবে যারা ক্রেতা-বিক্রেতা, উৎপাদক-ভোক্তা, সেবা বা শ্রম গ্রহণকারী ও প্রদানকারী প্রভৃতির বাস্তবসম্মত সংখ্যা বা পরিমাণ তথা স্বাভাবিক চাহিদা ও যোগানের প্রত্যাশিত অবস্থা, দ্রব্য-সেবা-শ্রমের ধরন এবং সমকালীন বাস্তব পরিস্থিতির প্রয়োজনীয় দিকসমূহ পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে পরামর্শক্রমে যৌথ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বাজারমূল্য, দ্রব্যের মানক্রম, শ্রমঘণ্টা ইত্যাদি নির্ধারণ করে দিবেন। অবশ্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হয়। আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করা যেতে পারে। এভাবে সরকারি সিদ্ধান্তক্রমে সর্বোচ্চ ও মূল্য নির্ধারিত হওয়ার পর তার চেয়ে বেশি পণ্যমূল্য বা ভাড়া গ্রহণ করলে বা তার চেয়ে কম মজুরি প্রদান করলে এর মাধ্যমে যে বাড়তি সুবিধা গ্রহণ করা হয় তা রিবা হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
রিবামুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য একদিকে প্রয়োজন ক্রেতা-বিক্রেতা ও সরকার এ তিন পক্ষের মধ্যকার প্রত্যেক পক্ষের অন্যায় হস্তক্ষেপমুক্ত উন্মুক্ত বাজার এবং অন্যদিকে প্রয়োজন মুক্তবাজার যেন অসঙ্গত বা জনস্বার্থ বিরোধী ধরনের একচেটিয়া কারবারে রূপান্তরিত হওয়ার প্রবণতা থেকে মুক্ত থাকতে পারে সেরূপ নৈতিক ও আইনগত নিয়ন্ত্রণ।
জালিয়াতি, চুরি ও ডাকাতির সাথে রিবার পার্থক্য হচ্ছে জালিয়াতির ক্ষেত্রে এক পক্ষ হিসাবের গরমিল করে চুরি করে যা অন্য পক্ষ বুঝতে পারে না, চুরির ক্ষেত্রে কেউ গোপনে অন্য কারো অর্থসম্পদ নিয়ে যায় এবং ডাকাতির ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করে অন্যের অর্থ সম্পদ কেড়ে নেয়া হয়; কিন্তু রিবার ক্ষেত্রে রিবা দাতা ও রিবা গ্রহীতার মধ্যে চুক্তি হতে পারে এবং বাহ্যত পারস্পরিক সম্মতি ও সমঝোতা থাকতে পারে। যেহেতু ব্যবসার ক্ষেত্রেও পারস্পরিক সম্মতি ও সমঝোতা থাকতে পারে এবং রিবার ক্ষেত্রেও পারস্পরিক সম্মতি ও সমঝোতা থাকতে পারে, তাই রিবার পক্ষে দাবি করা হয় যে, রিবা হচ্ছে ব্যবসায়ের মতো, তা জালিয়াতি, চুরি ও ডাকাতির মতো নয়।
অথচ প্রকৃত তথ্য হচ্ছে আল্লাহ যেমন পারস্পরিক সম্মতি ও সমঝোতাকে ব্যবসায়ের শর্ত করেছেন তেমনি তিনি রিবাকে হারাম করেছেন। সুতরাং যদি পারস্পরিক সম্মতি ও সমঝোতাক্রমে রিবার অনুপ্রবেশ ঘটে তবে তা ‘ব্যবসা’ হিসেবে সাব্যস্ত হবে না। শুধুমাত্র পারস্পরিক সম্মতি ও সমঝোতা একটি বিনিময়ের মধ্যে একটি বিনিময়হীন বৃদ্ধিকে বৈধতা দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। সংক্ষেপে বলা যায়, পারস্পরিক সম্মতিতে বিয়ে বৈধ কিন্তু ব্যভিচার বৈধ নয়, অনুরূপভাবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা বৈধ কিন্তু রিবা বৈধ নয়।
“কেন ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাড়তি কিছু (সুদ তথা রিবা) দিতে হয়?” এ প্রশ্নের উত্তরে তথা রিবার যৌক্তিকতা হিসেবে সবচেয়ে বেশি যে যুক্তিটি আলোচিত হয় তা হলো “অর্থের সময়মূল্য তত্ত্ব”। এ বিষয়ে আমরা ইতোপূর্বে পর্যালোচনা করে দেখেছি যে, তথাকথিত “অর্থের সময়মূল্য তত্ত্ব” এবং তার প্রেক্ষিতে রিবা গ্রহণের যুক্তি গ্রহণযোগ্য বা ন্যায়সঙ্গত নয়। নিম্নে রিবার পক্ষে আরো কিছু যুক্তি ও তার পর্যালোচনামূলক জবাব উপস্থাপন করা হলো:
১. ঋণদাতা যে সম্পদ থেকে নিজে উপকৃত হতে পারতো বা নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারতো, তার পরিবর্তে সে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে অন্যকে লাভবান হবার সুযোগ দিচ্ছে। সুতরাং সুদ হলো ক্ষতিপূরণ এবং লাভের অংশ।
জবাব : ঋণ একটি অর্থনৈতিক সহযোগিতা, যার মাধ্যমে ঋণগ্রহীতা উপস্থিত মুহূর্তে তার প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে এবং সেই সাথে সে ঋণ পরিশোধে দায়বদ্ধ থাকে। কিন্তু এই সহযোগিতার কোনো অর্থনৈতিক বিনিময় গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ঋণ দেয়ার মাধ্যমে অর্থের ঝুঁকি দায়বদ্ধতার মাধ্যমে ঋণগ্রহীতার কাছে হস্তান্তর হয়। ঋণগ্রহীতা এ অর্থ হারিয়ে ফেললেও যেমন তাকে তা ফেরত দিতে হয়, তেমনি সে তা কাজে লাগিয়ে কোনো লাভ করলেও সেই লাভের অংশ এককভাবে ঋণগ্রহীতারই প্রাপ্য। যদিও সে ঐ অর্থকে কাজে লাগিয়েই ঐ লাভ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ঐ অর্থটি এককভাবে লাভ সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়, বরং তার সাথে ঋণগ্রহীতার সময়, শ্রম, যোগ্যতা, মেধা, অভিজ্ঞতা মিলেই লাভ সৃষ্টি হয়। আবার লাভের পরিমাণ কিরূপ হবে তা পূর্ব থেকে জানা থাকে না। এক্ষেত্রে মূলধন ব্যবহারকালীন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সমকালীন বিপদ-আপদ থেকে নিরাপত্তার বিভিন্ন তারতম্যও প্রভাব ফেলে থাকে। তাই অর্থ ও শ্রম বিনিয়োগের পর তা যেমন লাভজনক হতে পারে, তেমনি তাতে লোকসানও হতে পারে।
সুতরাং যদি ঋণদাতা ঐ লাভের অংশ পেতে চায়, তাহলে তাকে লোকসানের ঝুঁকিও বহন করতে হবে। এটাই ন্যায়সঙ্গত বিধান। ঋণগ্রহীতা লাভ-লোকসানের ঝুঁকি বহন করা অবস্থায় বাস্তবে যত বেশিই লাভ করুক না কেন আর সুদের হার যত কমই হোক না কেন, লেনদেনের প্রকৃতি অনুসারে, সুদ কোনোক্রমেই ন্যায়সঙ্গত বিবেচিত হতে পারে না। কারণ এক পক্ষের লাভ অনিশ্চিত ও অনির্ধারিত থাকবে এবং তার লোকসানেরও আশংকাও থাকবে অথচ অন্য পক্ষের লোকসানের কোনো আশংকাই থাকবে না, বরং তার লাভ নিশ্চিত ও নির্ধারিত থাকবে, এটা কোনোক্রমেই ন্যায়সঙ্গত নয়।
এছাড়া, এটা কিভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে যে, ঋণগ্রহীতা কোনো ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঐ অর্থ ব্যবহার করলো, অথচ তাকে ফেরত দেয়ার সময় ঐ অর্থ ছাড়াও একটি বাড়তি অংশ ফেরত দিতে হবে এবং ফেরত দিতে গিয়ে বাস্তবসঙ্গত কারণে যতো দেরি হবে, সেই বাড়তি অংশ তত বাড়তে থাকবে? অনুরূপভাবে, ‘লাভবান হবার সুযোগ’ কোনো নিশ্চিত ও নির্ধারিত এবং ক্রমবর্ধমান ‘লাভ’ সৃষ্টি করে না বিধায়, ব্যবসায়িক কাজের ক্ষেত্রেও প্রদত্ত ঋনের বিনিময়ে কোনো সুদ গ্রহণ করা ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না।
২. ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের শুরু থেকে সরবরাহের মাধ্যমে মূল্য লাভ পর্যন্ত সম্পূর্ণ সময় ব্যবসায়ীর জন্য মূল্যবান। তাকে ঋণের পাশাপাশি এ মূল্যবান সময়কে অবকাশ হিসেবে না দিলে এবং মাঝপথে ঋণ ফেরত নিলে সে ব্যবসা কার্যক্রম চালাতে পারবে না। সুতরাং সে এই ‘অবকাশের মূল্য’ বাবদ ‘সুদ’ পরিশোধ করতে হয়। বেশি অবকাশের জন্য বেশি সুদ এবং কম অবকাশের জন্য কম সুদ পরিশোধ করতে হয়।
জবাব : ঋণ এবং অবকাশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিষয়। ঋণের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতা ঋণকে কাজে লাগানো এবং তা ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে যে অবকাশ পায় তার বিপরীতে ঋণকে যথাসময়ে সমমূল্যে ফেরত দেয়ার দায়বদ্ধতা বহন করে। কিন্তু এ অবকাশের বিপরীতে ঋণের মূলধনের পাশাপাশি কোনো সমমূল্যের অতিরিক্ত বা বাড়তি কোনো বিনিময় আরোপ ন্যায়সঙ্গত নয়। কারণ এ অবকাশ নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট এবং ক্রমবর্ধমান লাভের সৃষ্টি করে না। বরং এ অবকাশকে কাজে লাগিয়ে লাভের উদ্দেশ্যে ঝুঁকি বহন করতে হয় তথা ব্যবসায়ে যেমন লাভ হতে পারে, তেমনি লোকসানও হতে পারে। তাই ব্যবসায়ে লাভ-ক্ষতির অংশীদার হওয়ার পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘অবকাশ’ এর বিপরীতে ‘সুদ’ দাবি করা ন্যায়সঙ্গত নয়।
৩. মুনাফা সৃষ্টি অর্থের নিজস্ব গুণ। কারণ ঋণকৃত অর্থের সাহায্যে বেশি মান ও পরিমাণে দ্রব্য উৎপন্ন হতে পারে, ফলে বেশি লাভ করা সম্ভব হয়। তাই ঋণের বিপরীতে মূলধনের পাশাপাশি একটি বাড়তি অংশ (সুদ বা রিবা) প্রদান করতে হয়।
জবাব : এ যুক্তিটি সাধারণ প্রয়োজনে নেয়া ঋণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আর ব্যবসায়িক প্রয়োজনে নেয়া ঋণের ক্ষেত্রেও যুক্তিটি অকাট্য নয়। অবশ্যই অধিক লাভের উদ্দেশ্যেই অধিক অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অর্থের ব্যবহারকে লাভজনক করার জন্য অর্থের পাশাপাশি সময়, শ্রম, মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হয়। সেই সাথে লাভ বা লোকসান ও তার পরিমাণ সমকালীন বিভিন্ন পরিস্থিতিগত শর্তের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় ঋণদাতা এসব শর্ত পূর্ণ করার দায়িত্ব গ্রহণ ছাড়া শুধুমাত্র ঋণের বিপরীতে কোনো বাড়তি অংশ পাওয়া তথা একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করাকে কোনোক্রমে ন্যায়সঙ্গত বলা যেতে পারে না।
এছাড়া অধিক অর্থের ব্যবহার বিভিন্ন কারণে কখনো কখনো লাভের পরিবর্তে লোকসানের কারণ হয়ে পড়ে। অর্থাৎ অধিক অর্থের বিনিয়োগের ফলে অধিক উৎপাদনজনিত কারণে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে। সুতরাং “মুনাফা সৃষ্টি করা অর্থের নিজস্ব গুণ, তাই ঋণগ্রহীতা অর্থের ঐ গুণের খাতিরে ঋণ পরিশোধ পর্যন্তকার সময়সীমার বিপরীতে সুদ প্রদান করতে হয়”- দাবিটি যুক্তিসঙ্গতও নয়, ন্যায়সঙ্গতও নয়।
৪. একজন মূলধনদাতা কোনো কারণে সমগ্র ব্যবসায়িক কার্যক্রম নিরীক্ষণ করে তাকে লাভের স্থলে লোকসান দেখিয়ে ঠকানো হচ্ছে কিনা তা যাচাই করা সম্ভব নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে লাভ যত বেশিই হোক না কেন, নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য মূলধনের বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট লভ্যাংশ বা সুদ নির্ধারণের মাধ্যমে সে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারে বা একটি ন্যুনতম লাভ পেতে পারে। আর তাকে একটি নির্দিষ্ট লাভ বা সুদ দেয়ার বিনিময়ে তার অর্থ কাজে খাটিয়ে ঋণগ্রহীতা লাভবান হতে পারে।
জবাব : যার ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করা হলো সে লাভের পরিবর্তে লোকসান দেখাতে পারে বা লাভের পরিমাণ কম দেখাতে পারে এবং বিনিয়োগকারী তা নিজে বা কোনো প্রতিনিধির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা বা বুঝা সম্ভব হবে না বিধায় লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্বের পরিবর্তে প্রদত্ত মূলধন এবং তার বিপরীতে নির্দিষ্ট সুদ ফেরত পাওয়ার দাবিকে ন্যায়সঙ্গত সাব্যস্ত করা যেতে পারে না। যদি ব্যবসায়ে লাভ-ক্ষতির বাস্তবমুখী পর্যালোচনা সম্ভব না হয় বা যার ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করা হচ্ছে তার প্রতি আস্থা না থাকে, তাহলে সেখানে বিনিয়োগ না করাই করণীয়। কিন্তু অনাস্থা প্রকাশ করে নিজের একটি নিশ্চিত লাভ, যা বাস্তবে লাভ নয়, বরং অন্যায্যভাবে বাড়তি পাওনা নির্ধারণ করে নেয়া কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারো উপর অনাস্থার উপর ভিত্তি করে তার প্রতি অন্যায় করা সমর্থনযোগ্য নয়, বরং এরূপ সমর্থনের অর্থ দাঁড়াবে গোটা সমাজ জীবনকে পারস্পরিক বাড়াবাড়ির নরকে পরিণত করা।
রিবা একটি অর্থনীতির প্রতীক যাকে তার বৈশিষ্ট্যের আলোকে ‘স্বার্থপরতার অর্থনীতি’ বলা যেতে পারে। অন্যদিকে আল কুরআনের অর্থনৈতিক নীতিমালায় ন্যায়সঙ্গত স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি পরার্থরতার এবং অন্যের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়ার নির্দেশনা প্রদান করে। সামগ্রিক বিবেচনায় কুরআনভিত্তিক অর্থনীতিকে বলা যেতে পারে ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’। যেখানে রিবার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে সম্পদ শুধু সম্পদশালীদের মধ্যে কুক্ষিগত হয়ে যাওয়া, সেখানে আল কুরআনের একটি মৌলিক নির্দেশনাই হলো, সম্পদ যেন শুধুমাত্র সম্পদশালীদের হাতে কুক্ষিগত হয়ে যেতে না পারে। এ থেকে রিবার সাথে আল কুরআনের সামগ্রিক অর্থনীতির মৌলিক পার্থক্য সম্পর্ক ধারণা পাওয়া যায়।
নিম্নে রিবার বিপরীতে এবং রিবা প্রতিরোধের জন্য আল কুরআনে বর্ণিত কতিপয় মৌলিক অর্থনৈতিক নীতিমালার উপর আলোকপাত করা হলো:
যাবতীয় সম্পদের মূল মালিক আল্লাহ। (২:২৫৫, ২:২৮৪, ৩:১০৯, ৩:১৮০, ৪:১৩২, ১০:৫৫, ১০:৬৬, ৫৩:৩১, ৩:১৮৯, ৪২:৪৯, ৫:১৮, ২:১০৭, ৫:৪০, ৫:১২০, ৬৭:১ প্রভৃতি)
মানুষকে আমানতমূলক (২:২৮৩, ৩৩:৭২, ৮:২৭, ২৩:৮) মালিকানা দেয়া হয়েছে - (৩৬:৭১-৭৩) যেন তারা তাদেরকে যা দান করা হয়েছে/ জীবিকা দেয়া হয়েছে/ যার উপর ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে তা থেকে নিজের প্রয়োজনের পাশাপাশি পরার্থেও ব্যয় করতে হবে (২:২৫৪, ২৪:৩৩, ৫৭:৭ প্রভৃতি)।
মানুষের মধ্যে যোগ্যতা-সামর্থ্য, সুযোগ-সুবিধা ও সম্পদের বণ্টনে প্রাকৃতিকভাবে অসমতা রয়েছে। এর কারণ হলো, যেন পরস্পরে সেবার বিনিময় করতে পারে এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক দায়িত্বশীলতা পালনের প্রশ্নে পরীক্ষা হতে পারে। তাই জীবিকার সন্ধানে ব্যাপৃত থাকা আবশ্যকীয় কর্তব্য। (৪৩:৩২, ৬:১৬৫, ৬২:১০)
পার্থিব জীবনের সম্পদ গৌন বিষয়, আখিরাতের সম্পদই স্থায়ী। তাই আখিরাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জ্ঞানীরা পার্থিব সম্পদের দিকে মোহিত থাকে না, তারা অল্পতে সন্তুষ্ট থাকে। ভোগবাদী প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সৎকাজের ও ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করতে হবে এবং ভালো কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে। বস্তুবাদী ও পুঁজিবাদীদের জন্য আখিরাতে কোনো উত্তম অংশ নেই এবং তাদের আনুগত্য করা যাবে না। (৪০:৩৯, ৪২:৩৬, ১৮:৪৫-৪৬, ২৬:১২৮-১২৯, ২০:১৩১, ১৩:২৬, ২৮:৬০-৬১, ৩১:৩৩, ৫৭:২০, ৬২:১১, ২:২১২, ১০২:১-৮, ২:১৪৮, ৩:১১৪, ৩:২০০, ৫:২, ৫৩:২৯, ১১:১৫-১৬, ১৮:২৮, ২৮:৭৯-৮০)
দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ কামনা করতে হবে। সম্পদের দ্বারা আখিরাতের আবাস সন্ধান করতে হবে এবং দুনিয়ার অংশও ভুলে থাকার প্রয়োজন নেই। (২:২০১, ২৮:৭৭, ৫:৮৭-৮৮, ৭:৩২)
সম্পদ যথাখাতে যথানিয়মে ব্যয় না করে বিনিয়োগহীন সঞ্চয় করা ও গুণতে থাকা এবং গোপন করে রাখা যাবে না। বস্তুত শয়তান দারিদ্র্যের ভয় দেখায়, কিন্তু আল্লাহর বিধান অনুসারে চললেই ন্যায়সঙ্গতভাবে সুষম সমৃদ্ধি অর্জিত হবে। (৯:৩৪, ১০৪:১-৪, ৪:৩৭, ২:২৬৮)
সম্পদ যেন শুধু সম্পদশালীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়, এটাই হলো সম্পদ বণ্টনের মূল উদ্দেশ্য। সম্পদ বণ্টনের দুই স্তর: প্রাথমিকভাবে যার যা বিনিময় বাবদ প্রাপ্য তাকে তা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত যারা বঞ্চিত তাদের দুর্দশা লাঘবের জন্য নৈতিক প্রেরণা অনুসারে পরার্থে দিতে হবে, এর মাধ্যমে সম্পদ বণ্টনের উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে। রসূল ও উলিল আমর (মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা সরকার) কর্তৃক যে সম্পদ বণ্টিত হবে সেক্ষেত্রেও এই মূলনীতি বজায় রাখতে হবে। (৫৯:৭, ১৬:৯০, ৫১:১৯, ৭০:২৪-২৫)
ব্যবসা বৈধ। ব্যবসা অব্যাহত রাখার জন্য উৎপাদিত সম্পদের পুরোটি ভোগ, ব্যয় বা দান না করে একটি অংশ ব্যবসায়ে পুন:বিনিয়োগ করতে হয়। এজন্য আয় ও ব্যয় থেকে একটি সঞ্চয়ের প্রয়োজন হয় যা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে হয়। এ সঞ্চয় বৈধ এবং তা অর্থনীতিতে আবর্তন করে, অলস জমা রাখা হয় না। এছাড়া ভবিষ্যত ভোগের জন্য একটি যৌক্তিক পরিমাণ সঞ্চয় করা যেতে পারে। নিরাপত্তাজনিত কারণে গুপ্তধণ আকারেও রাখা যেতে পারে। (২:২৭৫, ১২:৪৭-৪৮, ১৮:৮২)
অপচয় ও কৃপণতা করা যাবে না। ব্যয় ও দানের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। নিজের চেয়ে অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দেয়ার নির্দেশনা থেকে শিক্ষা রয়েছে যে, নিজের চাহিদার ক্ষেত্রে অন্যদের মৌলিক চাহিদার দিকটি বিবেচনায় রাখতে হবে। অনুরূপভাবে যোগান বা সরবরাহের ক্ষেত্রেও নৈতিক বিধিবিধানের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রকৃত চাহিদা পূরণের দিকে লক্ষ্য রেখে সরবরাহ নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। (৩:১৮০, ১৭:২৬-২৯, ২৫:৬৭, ৫৯:৯)
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে যৌথ অংশদারিত্বমূলক ব্যবসায়ের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় বিধায় এরূপ ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সেই সাথে যাদের দ্বারা অর্থ ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব তাদেরকে দাইন বা ঋণ দেয়ার মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় ভূমিকা পালন করা উচিত। অন্যদিকে যাদের পক্ষে ঋণ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে, যারা অর্থনৈতিক উপার্জনে অংশগ্রহণে অক্ষম এবং যারা অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়েছে বা সেক্ষেত্রে সংকটে পড়ে গিয়েছে তাদেরকে সদাক্বাহ প্রদান করা কর্তব্য।
অর্থাৎ যারা অসহায় তাদেরকে সদাক্বাহ প্রদান করতে হবে। যারা ঋণগ্রস্ত তারা যদি বাস্তবসঙ্গত কারণে ঋণ ফেরত দিতে বিলম্ব হয় তাহলে তাদেরকে অবকাশ দিতে হবে। পারলে তাদেরকে মূলধনের কিছু অংশ বা সম্পূর্ণ মূলধন মাফ করে দিতে হবে, তাহলে তা সদাক্বাহ হিসেবে সাব্যস্ত হবে। আর ঋণদাতা যদি ঋণ মাফ না করে তাহলে প্রয়োজনে তাদেরকে সদাক্বাহ ফান্ড থেকে সহায়তা করা যাবে। (৯:৬০, ২:২৮০-২৮২)
যাকাত প্রদান করা বলতে বুঝায় নিজের মধ্যে অর্থনৈতিক মোহ বা কৃপণতা অনুভব করলে তা থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য বা নিজের নৈতিক মানোন্নয়নের জন্য এবং যাকে সহায়তা করা হচ্ছে তাকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের অংশীদার করার উপযোগী পরিমাণে অনুদান প্রদান করা। কুরআনে নিজের ও নিজ পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয়ের পাশাপাশি সদাক্বাহ ও যাকাত বাবদ ইনফাক্ব বা অর্থ ব্যয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। (২:২৫৪, ২৪:৩৩, ৫৭:৭ প্রভৃতি)
রিবা সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয়। (২:২৭৫-২৭৯)
সামগ্রিকভাবে এ সকল নির্দেশকে একটি ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
আল কুরআনের বর্ণিত অর্থনৈতিক নির্দেশনা বা মূলনীতিসমূহের বিপরীতে রিবা একটি ‘স্বার্থপরতার অর্থনীতি’ প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে, যার উপর ভিত্তি করে ‘আধুনিক পুঁজিবাদ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পক্ষান্তরে আল কুরআন পরার্থপরতার নির্দেশ দেয় কিন্তু তাতে কারো ন্যায়সঙ্গত স্বার্থকে উপেক্ষা করে না এবং বাস্তবসম্মত ভারসাম্যকে নষ্ট করে না।
এখন সর্বশেষ কিছু প্রশ্ন হতে পারে, রিবার নিষিদ্ধতা বা রিবামুক্ত অর্থব্যবস্থার যৌক্তিকতা কতটুকু? ব্যবসায়ে বা সেবার ক্ষেত্রে অনির্ধারিত লাভের সুযোগ থাকা বা অনির্ধারিত সার্ভিস চার্জের সুযোগ থাকা অথচ পুঁজির বিনিময়ে পুঁজির সাথে অল্প পরিমাণেও রিবার সুযোগ না থাকার বাস্তব উপযোগিতা কি? রিবামুক্ত অর্থব্যবস্থা বাস্তবে বাস্তবায়নযোগ্য কিনা বা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা রয়েছে কিনা? এরূপ অর্থব্যবস্থা পৃথিবীতে চলমান/প্রচলিত/প্রতিষ্ঠিত রিবাভিত্তিক অর্থব্যবস্থাকে মোকাবিলা করতে সক্ষম কিনা? ইত্যাদি।
এর জবাবে প্রথমেই বলতে হয় আল কুরআনে রিবাকে অর্থনৈতিক জুলুম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এই প্রেক্ষিতেই রিবাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রিবার নিষিদ্ধতার ক্ষেত্রে রিবার পরিমাণ কম না বেশি সেটা মূল বিবেচ্য নয় বরং রিবা নিষিদ্ধতার কারণ হচ্ছে রিবার প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্য বা অন্যায্যতা।
কখনো কখনো এরূপ প্রশ্ন আসে যে, যারা অত্যন্ত চড়া সুদের কারবার করে তা ছাড়া সামান্য পরিমাণ রিবা যেমন মাত্র ১% রিবা গ্রহণ করলে তা ঋণগ্রহীতার উপর তেমন চাপ সৃষ্টি করে না, তাই এরূপ সামান্য পরিমাণ রিবা তেমন আপত্তিজনক কিনা? এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, মাত্র ১ টাকা চুরি করলে তা যার টাকা চুরি করা হলো তার অর্থনৈতিক জীবনে তেমন কোনো চাপ সৃষ্টি করুক বা না করুক, উভয় অবস্থায় চুরি অনৈতিক এবং জুলুম হিসেবে সাব্যস্ত হবে। অনুরূপভাবে মাত্র ১% রিবা গ্রহণ করলেও তা অনৈতিক ও জুলুম হিসেবে সাব্যস্ত হবে। বিষয় এরূপ নয় যে, ঋণগ্রহীতা দরিদ্র হলেই তার থেকে রিবা গ্রহন করা অবৈধ এবং ঋণগ্রহীতা ধনী হলে তার থেকে রিবা গ্রহণ করা বৈধ। বরং ঋণগ্রহীতা দরিদ্র হোক বা ধনী হোক এবং সে ঋণকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ে লাভ করুক বা না করুক, উভয় অবস্থায় (লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্ব নীতির পরিবর্তে) প্রদত্ত ঋণ ও তার সাথে বাড়তি অর্থ (রিবা) গ্রহণ করা অবৈধ। চুরির ক্ষেত্রে যেমন বলা যেতে পারে না যে, ধনীর সম্পদ থেকে দুচারটাকা চুরি করা অপরাধ নয়, রিবার ক্ষেত্রেও তেমনি বলা যেতে পারে না যে, ধনী ব্যক্তির কাছ থেকে রিবা গ্রহণ করা অপরাধ নয়। যারা কোটি কোটি টাকার রিবার কারবার করে তাদের কারণে সমগ্র বিশ্ব অর্থব্যবস্থা বিধ্বস্তপ্রায় হলেও, যারা সামান্য পরিমাণ রিবা গ্রহণ করে তারাও একই প্রকৃতির অপরাধে অপরাধী। বিষয়টি এরূপ যে, দুজন চোরের একজন ১০০ কোটি টাকা চুরি করার সুযোগ পেয়ে তা চুরি করে আর অন্যজন মাত্র ১০০ টাকা চুরি করার সুযোগ পেয়ে তা চুরি করে। দুজনের অপরাধের বাহ্যিক ক্ষয়ক্ষতি কম বেশি হলেও অপরাধ প্রবণতার দিক থেকে দুজনই সমানভাবে দায়ী। বস্তুত যেটা প্রকৃতিগতভাবে বড় অপরাধ, তার সামান্য পরিমাণও বড় অপরাধ। তারপর তার দ্বারা সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণগত কম-বেশি হওয়ার বিষয়টি অপরাধীকে অধিকতর শাস্তির উপযুক্ত করতে পারে।
কুরআন অনুযায়ী বলা যায়, রিবা গ্রহণ করা ঋণগ্রহীতার প্রতি জুলুম এবং রিবা ত্যাগ করে আসল ফেরত পাওয়া ঋণদাতার অধিকার এবং তাকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা তার প্রতি জুলুম। তবে ঋণগ্রহীতা যদি অস্বচ্ছল হয়ে পড়ে সেইক্ষেত্রে তাকে আসল ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছলতা পর্যন্ত অবকাশ দিতে হবে এবং যদি আসল বা তার কোনো অংশ মাফ করে দেয়া হয়, তবে তা ঐ অস্বচ্ছল ব্যক্তির প্রতি সদাক্বাহ হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
একজন অস্বচ্ছল ব্যক্তি যেমন ঋণ গ্রহণ করতে পারে, একজন স্বচ্ছল ব্যক্তিও তেমনি তার ব্যবসা কার্যক্রমকে আরো বেগবান করার জন্য ঋণ গ্রহণ করতে পারে। রিবার অন্যায্যতার বিষয়টি তা অস্বচ্ছল ব্যক্তি থেকে নেয়া হলো, নাকি স্বচ্ছল ব্যক্তি থেকে নেয়া হলো তার উপর নির্ভর করে না। বরং রিবার অন্যায্যতার বিষয়টি নির্ভর করে লেনদেনের মধ্যে এর উদ্ভবের উপর। অর্থাৎ “রিবার উদ্ভব ঘটে কিসের উপর ভিত্তি করে বা এর কাউন্টার ভ্যালু কি?”- এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই বা রিবার কোনো কাউন্টার ভ্যালু নেই। ঋণ প্রদানকারীর অন্যায় আবদার ছাড়া রিবার কোনো বাস্তবসম্মত, যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত ভিত্তি নেই। অর্থাৎ রিবার মাধ্যমে মূলত ঋণগ্রহণকারীর সম্পদের একটি অংশ অন্যায্যভাবে ঋণদাতার কাছে চলে যায়। আর এ কারণেই এটি জুলুম এবং এ কারণেই এটি হারাম বা অবৈধ।
আল্লাহর বিবেচনায় রিবা ও রিবার মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি পায় না, বরং যাকাতের মাধ্যমেই সম্পদ বৃদ্ধি পায় এবং আল্লাহ রিবাকে ক্ষয়িষ্ণু বা সংকুচিত করেন, অন্যদিকে যাকাত ও সদাক্বাহকে বিকশিত বা প্রগতিশীল করেন (৩০:৩৯, ২:২৭৮)।
এটা স্বত:সিদ্ধ যে, কেউ যদি চুরি করে তবে তাতে তার হাতে কোনো সম্পদ যোগ হলেও প্রকৃতপক্ষে সে সম্পদ তার নয়, তাতে তার জন্য বৈধতা নেই। তেমনি রিবার মাধ্যমে বাহ্যত সম্পদ বাড়লেও তাতে মূলত অন্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার সম্পদ হরণ করা হয়, তাতে রিবা গ্রহণকারীর জন্য বৈধতা নেই। কেউ যদি কোথাও ১০০ টাকা রেখে দেয় ১০ বছর পরও তা ১০০ টাকাই থাকবে, বাড়বে না। কিন্তু যদি ১০০ টাকা মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করে ব্যবসায়ের মাধ্যমে লাভ হয়, তা হয় টাকাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি শ্রম ও সময় দেয়ার কারণে। সুতরাং যদি বিনিয়োগকৃত টাকার লাভ নিতে হয়, তবে অবশ্যই তা কাজে লাগিয়ে করা ব্যবসায়ের লোকসানের ঝুঁকিও নিতে হবে। কারণ লোকসান তো মূলত ‘ঋণাত্মক লাভ’ ছাড়া কিছু নয়।
এছাড়া রিবা বাস্তবেই নৈতিক-প্রাকৃতিক নিয়মে এক পর্যায়ে সংকুচিত হতে থাকে এবং যাকাত ও সদাক্বাহ বিকশিত হতে থাকে। কারণ রিবা অর্থনীতিতে বিভিন্ন কুফলের এবং যাকাত ও সদাক্বাহ বিভিন্ন সুফলের সৃষ্টি করে। যেমন, রিবা প্রকৃত প্রয়োজনীয় ও উপকারী জিনিসের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, ব্যবসায়ে লোকসান হলেও সুদ দিতে হয় বিধায় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে, মন্দার সময় সুদী ঋণের ঘাটতি ঘটে এবং অধিকতর মন্দার সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে যাকাত ও সদাক্বাহর মাধ্যমে সবাই অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করতে পারে, সবার স্বচ্ছলতা ফিরে আসে এবং সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
রিবা পরিশোধ বাবদ ঋণগ্রহীতা নিজের সম্পদ থেকে যা সুদে পুঁজি খাটানো পুঁজিপতিকে প্রদান করে তা আর ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং এর মাধ্যমে ঋণগ্রহীতার নিজের সম্পদ থেকে একটি অংশ পুঁজিপতির কাছে চলে যায় এবং তার স্বীয় বৈধ সম্পদের ঘাটতি হয়। অন্যদিকে কোনো যাকাত প্রদানকারী যা যাকাত হিসেবে প্রদান করে তার মাধ্যমে বাহ্যত তার সম্পদ থেকে একটি বিয়োগ ঘটলেও আল্লাহ তাকে তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে ফেরত দিয়ে থাকেন। সুতরাং সে এর মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়। অবশ্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ফেরত দেয়ার দিকটি পার্থিব জীবনে সরাসরি বা বাহ্যজ্ঞানে বুঝা যায় না, বরং তা বিশ্বাসের বিষয়। অনুরূপভাবে আখিরাতেও এর সুফল পাওয়ার বিষয়টিও বিশ্বাসের বিষয়। তবে যারা বাহ্যজ্ঞানের বিপরীতে অন্তর্নিহিত জ্ঞান অর্জনে সমর্থ হয়, তারা অর্থনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিষয়টি বুঝতে পারে। আর তা হলো যাকাত ও সদাক্বাহর মাধ্যমে সম্পদের আবর্তন ঘটে, তা শুধুমাত্র পুঁজিপতির হাতে পুঞ্জিভুত হয় না। ফলে সবার স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পায় এবং ক্রয়-বিক্রয় ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং ফলস্বরূপ সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। যাকাত ও সদাক্বাহ প্রদানকারীরাও পরোক্ষভাবে সম্পদের স্বাভাবিক আবর্তনের সুফল পেয়ে থাকে। এভাবে যাকাত ও সদাক্বাহ পাথির্ব অর্থনৈতিক জীবনেও সমৃদ্ধি হয়ে প্রত্যাবর্তিত হয়।
রিবা ভক্ষণকারী শয়তানের সংস্পর্শে উন্মাদ বা উদ্ভ্রান্ত হয়ে থাকে, সে বাহ্যত অনেক সম্পদের মালিক হলেও তার ‘আরো চাই, আরো চাই’ চিন্তা-ভাবনা তাকে দিশেহারা করে রাখে, সে মানুষের ঠেকায় পড়া অবস্থাকে আরো রিবা অর্জনের উপায় হিসেবে গ্রহণের জন্য ব্যতিব্যস্ত থাকে। তার সম্পদ সে আরো রিবার জন্য ঋণ দেয়, অযথা আমোদ-প্রমোদে অপচয় করে, এটি তার অর্থের প্রকৃত উপযোগিতা বিনষ্ট করে। কথায় আছে, “টাকায় বালিশ কেনা যায়, ঘুম কেনা যায় না”। অনুরূপভাবে “রোগে শরীর ফুলে যাওয়ার মানেই স্বাস্থ্যের উন্নতি নয়”। কিছু লোক অন্যদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে মোটাতাজা হয়ে তাদেরকে কঙ্কালসার বানিয়ে দিলে তাতে সমাজ-সমষ্টির বিবেচনায় সমৃদ্ধি বলে বিবেচিত হতে পারে না। গড় আয়ের বৃদ্ধি মানে সবার আয়ের বৃদ্ধি নয়।- এসব বিষয় বিবেচনায় রাখলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, রিবা ভক্ষণের মাধ্যমে বাহ্যত সম্পদ বৃদ্ধি পেলেও সামগ্রিক বিবেচনায় এবং সামাজিক বিবেচনায় তাতে সম্পদের মূল্যমান হ্রাস পায়। অন্যদিকে সদাক্বাহ সম্পদের সুষম আবর্তন ঘটায়, সদাক্বাহ প্রদানকারীরা কৃপণতা ও অপব্যয় থেকে মুক্ত থাকে, তারা ন্যায়সঙ্গত বিনিময় পদ্ধতি অবলম্বন করে, তাই তাদের সম্পদে তাদের নিজেদের এবং সমাজের সার্বিক উন্নয়ন সাধিত হয়।
রিবা এবং যাকাত ও সদাক্বাহর সাথে একটি পার্থক্য হলো, রিবা পুঁজিহীন ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে বা দরিদ্রের কাছ থেকে পুঁজিপতির দিকে যায় এবং এভাবে যার অধিক আছে সে যার কম আছে তার থেকে কিছু নিয়ে খায়, যা আগুন খাওয়ার সমতুল্য, আগুনের বৈশিষ্ট্য হলো তা নিচের থেকে উপরের দিকে উঠে। অন্যদিকে যাকাত ও সদাক্বাহ বাবদ একজন পুঁজিপতি একজন পুঁজিহীনকে সম্প্রদান করে যা থেকে সে কিছু ফেরত নেয় না এবং যার কোনো প্রতিদান ঐ পুঁজিহীনের কাছ থেকে সে দাবি করে না, এটা পানিসেচের সাথে তুলনীয়, পানির বৈশিষ্ট্য হলো তা উপর থেকে নিচের দিকে নামে।
রিবার অর্থনৈতিক প্রয়োজন প্রসঙ্গে বলা হয় যে, (১) আয় থেকে যে অংশ নিজের উপস্থিত প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্যয় না করে বা অযথা জমা না রেখে অন্যকে ব্যবসায়ের জন্য ঋণ দেয়া হলো তার থেকে বাড়তি অংশ (রিবা) পাওয়ার (লোভের) সুযোগ না থাকলে, পুঁজি সরবরাহে ঘাটতি পড়বে, ফলে অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে পড়বে। (২) ঋণদাতাকে রিবা দেয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকলে ব্যবসায়ী তার পুঁজিকে অধিক লাভজনক খাতে বিনিয়োগের জন্য তাক্বাদা অনুভব করবে না।
রিবার হার উঠানামার বিষয়টি পর্যালোচনা করলে কেন রিবা ছাড়া ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয় তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। কোনো ব্যক্তির কাছে প্রয়োজন পূরণের পর যে উদ্বৃত্ত থাকে, তার একটি সামান্য পরিমাণ সে নিজের কাছে সঞ্চিত রেখে দেয় নিজের ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে অথবা আকস্মিক প্রয়োজন বা অপ্রত্যাশিত অবস্থা মোকাবিলার জন্য বা হঠাৎ কোনো সুবিধাজনক খাতে ব্যয়ের জন্য। এছাড়া অন্য বৃহৎ অংশটি সে রিবার শর্তে ঋণ প্রদান করতে চায়। এক্ষেত্রে সে যদি মনে করে যে, বর্তমানের চেয়ে কিছুদিন পর রিবার হার বাড়বে তাহলে সেই সুযোগের আশায়ও নিজের কাছে সঞ্চিত রাখতে চায়। বস্তুত সে বর্তমানের রিবার হার এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য রিবার হার বিবেচনায় তার কাছে কিরূপ সঞ্চিত রাখবে তার পরিমাণ নির্ধারণ করে। সে যদি দেখে যে, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সরকার বেশি বেকায়দায় পড়েছে তাহলে সে রিবার হার বাড়িয়ে দেয়, অন্যথায় রিবার হার কমিয়ে দেয়। সে যতক্ষণ তার পক্ষে সম্ভব হয়, রিবার হার বাড়ানোর তথা ব্যবসায়ীদেরকে রিবার শর্তে ঋণ গ্রহণে বাধ্য করার পরিবেশ তৈরি করতে চায়। যখন তার চাহিদা পূরণ করে ব্যবসায়ে কোনোরূপ লাভেরই সম্ভাবনা থাকে না, তখন ঋণের চাহিদা কমে যায়। ফলে সে আবার রিবার হার কমিয়ে দেয়। সুতরাং রিবার অনুমোদন থাকার কারণে সে ব্যবসায়ের ঝুঁকি শেয়ার করা ছাড়াই এবং প্রদত্ত ঋণের সমমূল্য ফেরত পাওয়ার সঙ্গত নীতি পরিহার করে রিবার শর্তে ঋণ প্রদান করতে চায় এবং রিবার হার বাড়িয়ে কমিয়ে যেভাবে রিবার শর্তে ঋণ প্রদানের ধারা অব্যাহত রাখা যায় সেভাবে সে তার পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে।
কিন্তু রিবাকে কোনোক্রমে অর্থনীতির চাকা সচল থাকার উপায় হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। বরং রিবার কারণে বার বার অর্থনীতির চাকাকে উল্টোভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মেরামত করা হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু ঐ মেরামত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করে না, কখনো কখনো জুলুমের পরিমাণকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসে মাত্র।
রিবার ফলে অর্থনীতিতে লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে কারবারে অংশগ্রহণের পরিবর্তে অর্থ ঋণ দিয়ে কোনো ঝুঁকি ছাড়াই সেই ঋণ ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি ফেরত পাওয়ার সুবিধা তৈরি হয় বিধায়, যাদের পক্ষে সম্ভব তারা পণ্য ক্রয়ের পরিবর্তে রিবার বিনিময়ে ঋণ দেয়ার জন্য অর্থ সঞ্চয় করে। ঐ অর্থ রিবার বিনিময়ে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে আরো পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করা হয়। ঐ অতিরিক্ত পণ্যের ক্রেতা কম থাকায় তা বিক্রি করে রিবাসহ ঋণ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় অর্থনৈতিক চাপে পড়ে এমন খাতে বিনিয়োগ করা হয়, যা অনৈতিক ও অনুপকারী হলেও তার চাহিদা বেশি অথবা তার জন্য চাহিদা তৈরি করা হয়। যা সমাজের জন্য সামগ্রিক ক্ষতির কারণ হয় এবং তার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতেও পড়ে। তারপর রিবা পরিশোধের জন্য পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করা হয়, যার ফলে সাধারণ ভোক্তাদেরকে তাদের কঠিন শ্রমলব্ধ অর্থের বড় অংশ ব্যয় করতে হয়, রিবার বিষয়টি না থাকলে তাদের উপর যে চাপ পড়তো না। এরপর যেসব বড় প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান নিজ দেশের বাজারে বিক্রয়ের মাধ্যমে রিবা পরিশোধ করেও লাভ করার মতো অবস্থা তৈরি করতে পারে না, তারা বিভিন্ন কৌশলে অন্যদেরকেও রিবাভিত্তিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমে সংযুক্ত তাদের উপর এই ঝুঁকি স্থানান্তরের চেষ্টা করে। এভাবে একটি অন্যায্য ব্যবস্থা ক্রমে আরো প্রসারতা লাভ করে এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করে।
রিবার হার কম হোক অথবা বেশি হোক, উভয় অবস্থায় তা অন্যায্য এবং অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। পুঁজির জন্য রিবার অন্যায্য শর্তের কারণে উৎপাদনের অন্যান্য উপাদানের ন্যায্য পাওনা আদায় করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে এর কারণে শ্রমিক তার পরিশ্রমের যথাযথ পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হয়, তাকে শুধুমাত্র ন্যুনতম অর্থনৈতিক জীবন নির্বাহের জন্য প্রায় সম্পূর্ণ সময় কাজ করতে হয়, যা তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে এবং শারীরিক শক্তি ও মানসিক যোগ্যতাকে বিনষ্ট করে।
রিবা নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমেই অন্য সবার মতো পুঁজি বিনিয়োগকারীদেরও ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত হয়। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি পুঁজি গঠনেরও সুব্যবস্থা হয় এবং অর্থনীতি উত্থান-পতনের চক্র থেকে রক্ষা পায়। কারণ রিবা অনুমোদিত থাকলে এবং রিবার হার কম হলে মানুষের সঞ্চয় স্পৃহা হ্রাস পায়, ফলে পুঁজির সরবরাহও হ্রাস পায় এবং পুঁজি গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন ব্যক্তিগত ও সরকারি পর্যায়ে ঋণ করে অতি ভোগের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, ফলে অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়ে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে বা অর্থের মূল্য কমে যায়। এর ফলে বৃহৎ পুঁজিপতিদের অস্বাভাবিক লাভ হয় এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুতরাং রিবার হার হ্রাস করে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে ফলপ্রসূ হয় না। বরং এর ফলে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা দেশের বাহিরে উচ্চ সুদে পুঁজি বিনিয়োগ করতে সচেষ্ট হতে পারে। এ সময় ফটকা বাজারী কারবারও বেড়ে যায়। বিনিয়োগযোগ্য পুঁজি হ্রাস পেলে রিবার হার আবার বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে রিবার হার বৃদ্ধি পেলেও ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা ব্যবসা ও কলকারখানা বাড়াতে চাইবে না। ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে। এছাড়া রিবা পরিশোধ করতে গিয়ে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। কাঁচামাল ও উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। মানুষ উচ্চসুদে ঋণ গ্রহণে আগ্রহী হবে না, কৃপণতা করবে এবং দ্রব্য ও সেবার চাহিদা হ্রাস পাবে। এভাবে রিবার হার কম হোক বা বেশি হোক, উভয় অবস্থায় তা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর এবং অস্থিতিশীলতার চক্র তৈরি করে।
সুতরাং ন্যায়সঙ্গত ও উন্নয়ন অর্থনীতির জন্য পুঁজির চাহিদা ও সরবরাহ লাভ-লোকসানভিত্তিক হওয়াই একমাত্র সঠিক পন্থা। অর্থাৎ যে ব্যবসায়ে লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকবে এবং লোকসানের ঝুঁকি কম থাকবে তাতে পুঁজির সরবরাহ বেশি হবে। রিবার পরিবর্তে মুনাফার ন্যায্য বণ্টনভিত্তিক ব্যবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প উদ্যোগ বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সুষম উন্নয়নের গতি সৃষ্টি হবে। তারপর যেসব সমাজ কল্যাণমূলক খাতে বিনিয়োগ অর্থনৈতিক লাভের বিবেচনায় কম লাভজনক সেক্ষেত্রে যাকাত বা উন্নয়ন অর্থনীতির অনুদান থেকে উলিল আমর (মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা সরকার) এর ব্যবস্থাপনার আওতায় বিনিয়োগ করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে রিবার শর্তে যে ঋণ গ্রহণ করা হয়, তা দেশের পুঁজিপতিদের থেকে গ্রহণ করা হোক বা বিদেশ থেকে গ্রহণ করা হোক, উভয় অবস্থায় রিবা পরিশোধের জন্য হয় অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহ করতে হয় না হয় বাড়তি কর আরোপ করতে হয় অথবা সুদাসল পরিশোধের জন্য আবার সুদের শর্তে ঋণ করতে হয়। এরূপ কৃত্রিমভাবে মুদ্রাস্ফীতি ঘটানোর মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে অন্যায়ভাবে সর্বসাধারণের শ্রমলব্ধ উপার্জন থেকে পুঁজিপতিদের কাছে সম্পদ পৌঁছে দেয়া হয়। আর রিবা পরিশোধের জন্য যে বাড়তি কর আরোপ করা হয় তাতেও একইভাবে সর্বসাধারণের উপার্জন থেকে একটি অংশকে রিবা নামক অন্যায্য দাবি পরিশোধের জন্য কেটে নেয়া হয়। আর ঋণ পরিশোধের জন্য আবার ঋণ করা ঋণের বোঝা বাড়াতে থাকে, যা থেকে সহজে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব হয় না, বরং ঋণদাতাদেরকে বিভিন্ন অবৈধ স্বার্থ প্রদানের মাধ্যমে রিবা নামক অন্যায্য দেনা পরিশোধের সময় দীর্ঘায়িত করার সুযোগ নিতে হয়, যে সময়ের সাথে সাথে রিবা নামক অন্যায্য দেনার পরিমাণও শুধু বাড়তে থাকে। এভাবে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে স্থায়ী শোষক ও শোষিতের সম্পর্ক তৈরি হয়।
রিবার মাধ্যমে পুঁজিপতিদের পুঁজি বৃদ্ধির জন্য পুঁজির একটি অংশকে ঋণ দিয়ে ঐ ঋণকে একটি অসঙ্গত বাড়তি অংশ (রিবা) সহ ফেরত নেয়া হয় তথা গরীবের সামান্য টাকা থেকে অন্যায়ভাবে ধনীর কাছে আরো ধনের ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ রিবার মাধ্যমে ধনীরা গরীবের কাছ থেকে হাত পেতে ভিক্ষা না নিয়ে রাষ্ট্রীয় আইনী অনুমোদনের ব্যবস্থা করে গরীবের টাকা কেড়ে নেয়, আর গরীব তার থেকে ঋণ নেয়ার সময়ই তাকে এ ডাকাতি করার জন্য অগ্রিম সম্মতি দিয়ে রেখেছিল বিধায় আইনগতভাবে এর কোনো প্রতিকার করতে পারে না, বরং সুদ পরিশোধ না করলে ঐ গরীবই আইনের চোখে অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে যেসব ধনী অন্য গরীবদের থেকে রিবার শর্তে টাকা ধার নেয়, তারা ঐ গরীবদের টাকা একত্র করে তুলনামূলক বেশি রিবার শর্তে বৃহৎ ব্যবসায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়, ঐ ব্যবসায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অসংখ্য তুলনামূলক গরীব পুঁজিপতির সম্মিলিত টাকার বড় অংক ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করে, যে ঋণের বিপরীতে প্রদেয় রিবাকে সে তার দ্রব্যমূল্যের সাথে যোগ করে সাধারণ ভোক্তাদের থেকে তা আদায় করে নেয়। এরপর সে যে রিবা পরিশোধ করে তা থেকে ক্ষুদ্র পুঁজিপতিরা (যারা এই রিবা দেয়া নেয়ার মধ্যবর্তী কারবারীকে রিবার শর্তে টাকা দিয়েছিল) চুক্তি অনুসারে তাদের সামান্য রিবা পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাদের পক্ষে ঐ কারবারীর কাছ থেকে বৃহৎ পুঁজিপতির মতো বৃহৎ পরিমাণে ঋণ নেয়া সম্ভব নয়, তারা ক্ষুদ্র পুঁজিপতি বিধায় তাদেরকে ক্ষুদ্র ঋণেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। অথচ তাদেরই জমানো টাকাকে একত্র করে সেই টাকার বৃহৎ অংশ বৃহৎ পুঁজিপতি অনায়াসেই ঋণ আকারে নিয়ে গিয়ে তার ব্যবসাকে ক্রমে ক্রমে একচেটিয়া ব্যবসায়ে পরিণত করতে থাকে। এভাবে রিবা একচেটিয়া কারবারের প্রসার ঘটায় এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উদ্যোগকে গ্রাস করে ফেলে। এর ফলে তার জন্য অর্থনৈতিক শোষণের সুযোগ প্রশস্ত হয়। ব্যবসায়ের স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হয় এবং জাতির বৃহত্তর অংশ গুটিকয়েক পুঁজিপতির দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে যায়।
রিবার হার বৃদ্ধির আশায় অনেক সময় পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজির একটি বৃহত্তর অংশ ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করা বা অর্থনৈতিক আবর্তন থেকে সরিয়ে রাখে, যার ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা অনুপাতে সরবরাহ সম্ভব হয় না। পুঁজিপতিরা ব্যবসায়ের স্বাভাবিক প্রয়োজনের পরিবর্তে শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিস্বার্থ অনুযায়ী পুঁজির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ঋণে পুঁজি খাটানো হয় না, ফলে মানসম্পন্ন উৎপাদন হ্রাস পায়। আবার দীর্ঘমেয়াদী ঋণের ক্ষেত্রে যেরূপ আন্দায-অনুমানের ভিত্তিতে রিবা ধার্য করা হয় তা পরিশোধ করতে গিয়ে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেওলিয়া হয়ে পড়তে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রকৃত চাহিদার সাথে মিল রেখে সরবরাহের পরিবর্তে নিছক অর্থনৈতিক লাভের খাতিরে কম প্রয়োজনীয় বা বিলাসপূর্ণ দ্রব্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে সেটার চাহিদা তৈরির চেষ্টা করতে পারে, যা অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
রিবা সমাজ ও জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছু নয়। কারণ যে সমাজ কোনো ব্যক্তির লালন-পালনে ও যোগ্যতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে, একজন রিবা খোর ব্যক্তি সেই সমাজকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে রিবার শর্ত জুড়ে দেয় তথা তাকে একটি বাড়তি অংশসহ ঋণ পরিশোধ করতে হবে বলে আবদার জানায়। যদি জাতীয় দুর্যোগের সময় নি:স্বার্থ দান করা তো দূরে থাকুক, রিবার শর্ত ছাড়া ঋণ প্রদান করা না হয়, তাহলে তা বিশ্বাসঘাতকতার চরম রূপ ছাড়া অন্যরূপ কিছু বলা যেতে পারে না।
রিবার ফলে যখন অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, তখন ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কম থাকায় তারা পণ্য ক্রয় করতে পারে না অথচ উৎপাদিত ব্যাপক পরিমাণ পণ্য শুধুমাত্র বাজার দর নষ্ট হওয়ার আশংকায় নষ্ট করে ফেলা হয়, তবুও কম মূল্যে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানো হয় না। যদি রিবা না থাকতো সে অবস্থায় ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়তো এবং উৎপাদন ব্যয় কম হতো বিধায় এভাবে ভোক্তাদেরকে বঞ্চিত করে উৎপাদিত পণ্য নষ্ট করার অমানবিক আচরণ থাকতো না বা হ্রাস পেতো।
রিবা সমাজকল্যাণ কার্যক্রমকে ব্যাহত করে, রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে, রিবার শর্তে ঋণদাতা পুঁজিপতিদের অন্যায্য স্বার্থ হাসিলে কাজ করতে বাধ্য করে তথা রিবা একই সাথে নৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টি করে।
রিবার চূড়ান্ত ক্ষতিকর পরিণতি হচ্ছে রিবা আল্লাহর বিধানে নিষিদ্ধ এবং একটি অর্থনৈতিক জুলুম বিধায় রিবা গ্রহণকারীকে চিরকাল জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। আবার যারা স্বেচ্ছায় রিবার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে, যেমন- রিবার শর্ত মেনে নিয়ে ঋণ করা এবং রিবার সাক্ষী ও হিসাব সংরক্ষক হওয়া বা ব্যবস্থাপনা কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকা, তারাও রিবা সম্পর্কিত অপরাধের একটি অংশ বহন করবে।
রিবার ফলে বিশ্ব অর্থনীতির বিপর্যয়ের মাধ্যমে মানবজাতির যে সমূহ ক্ষতির দিক রয়েছে সেই প্রেক্ষিতে রিবা গ্রহণকারীর বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা বিঘোষিত হয়েছে। এর একটি বিশেষ তাৎপর্য হলো ইসলামী আদর্শ অনুসারে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় রিবাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তবে আল কুরআনের আলোকে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের যে যুক্তিসঙ্গত ক্রমধারা প্রতীয়মান হয় তাতে রিবা মোকাবেলায় মু’মিনরা নিজেদের পক্ষ থেকে সদাক্বাতের প্রতিযোগিতা করাই প্রথম কর্মসূচী হিসেবে প্রতীয়মান হয়। তারপর যখন মু’মিনরা খিলাফাত বা কর্তৃত্ব অর্জন করবে তখন তারা রিবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে, এর পূর্বে রিবা গ্রহণকারীদের বিপরীতে কোনো বাড়াবাড়িমূলক আচরণের অবকাশ নেই।
রিবা গ্রহণকারীর বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণার আরেকটি তাৎপর্য হচ্ছে- আল্লাহ ও তাঁর রসূল যে অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চান রিবা হচ্ছে সেই অর্থব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই এ দুই ব্যবস্থার মধ্যে দ্বান্দ্বিকতার প্রেক্ষিতে অবশ্যই রিবা গ্রহণকারী পরাস্ত হবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলই বিজয়ী হবেন তথা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রস্তাবিত অর্থব্যবস্থার অনুসরণকারীরাই সুষম অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সফলতা এবং যথাযথ কল্যাণ লাভ করবে। আর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রস্তাবিত সেই অর্থব্যবস্থা হচ্ছে যাকাত, সদাক্বাহ এবং রিবামুক্ত ঋণ ও ব্যবসা। সুতরাং রিবামুক্ত অর্থব্যবস্থার বাস্তবায়নই বিশ্ব অর্থনীতির দুরবস্থা মোকাবেলার প্রকৃত কার্যকর উপায়। রিবা যদি হয় আগুন তুল্য, তবে কুরআন নির্দেশিত যাকাত, সদাক্বাহ, ইনফাক্ব, দাইন ও বাই’ ইত্যাদি হচ্ছে পানি তুল্য, যে পানির মাধ্যমে ঐ আগুনকে নিভানো সম্ভব হবে। শুধু “আগুনে সব পুড়ে গেলো” বলে চিৎকার করলে আগুন নিভে যাবে না, যতক্ষণ না তা নিভানোর জন্য পানি ঢালা হবে।
যেহেতু রিবা গ্রহণ করা স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম নয় এবং ন্যায়সঙ্গত নয়, তাই অবশ্যই রিবামুক্ত অর্থব্যবস্থা বাস্তবায়ন করাকে অসম্ভব মনে করার কোনো অবকাশ নেই। রিবা অর্থনীতির জন্য কোনো অপরিহার্য বা প্রয়োজনীয় জিনিস নয়, বরং রিবা প্রচলিত থাকার কারণে এটাকে বাহ্যত সহজ ব্যাপার মনে হয় এবং রিবামুক্ত অর্থব্যবস্থা বাস্তবায়নকে কঠিন মনে হয়। বস্তুত মানুষের প্রবৃত্তির কাছে অধ:পতন সহজ মনে হয় কিন্তু প্রবৃত্তির কাছে যে নৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও ন্যায়পরায়ণতাকে কঠিন মনে হয়, বিবেকের উদ্বোধন সেটাকেই আত্মার সহজ পথ হিসেবে দেখতে পায়। আল্লাহ মানুষকে কোনো অসাধ্য বিধান দেননি এবং এমন বিধানও দেননি, যা তাদেরকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিয়ে যায়, দুর্ভোগে নিপতিত করে। বস্তুত আল্লাহই প্রকৃতির স্রষ্টা এবং তাঁর বিধান প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল, ন্যায়সঙ্গত, বাস্তবায়নযোগ্য ও কল্যাণকর। সুতরাং রিবামুক্ত অর্থব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন যারা আল্লাহর বিধানের প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস রাখে, তারা রিবামুক্ত অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু করা। অন্যদিকে যদি মানব সমাজের সবাই সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা রিবা থেকে বের হবে না, তারা এই অবৈধ ব্যবস্থাকেই আঁকড়ে ধরবে, তাহলে রিবামুক্ত অর্থব্যবস্থা বাস্তবায়িত হবে না এবং এর ফলস্বরূপ তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করবে, তারা নিজেরাই দুনিয়া ও আখিরাতে খেসারত দিতে হবে। সুতরাং যারা ঈমানের দাবিদার যদি তারা তাদের ঈমানের দাবিতে সত্যবাদী হয়, তাহলে তারা রিবামুক্ত অর্থব্যবস্থার বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে হবে। তারা তাদের সাধ্যমতো রিবামুক্ত দাইন/ঋণ লেনদেন করলে এবং লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্বভিত্তিক বাইয়ুন/ব্যবসা করলে এবং সেই সাথে সদাক্বাহ ও যাকাতের বিধান অনুসরণ করলে যারা রিবা ছাড়া ঋণ দিতে চায় না, তাদের কাছ থেকে ঋণ নিতে আসবে এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না এবং তখন তারাও বাধ্য হয়ে ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে জড়িত হওয়ার বিকল্প পাবে না। এভাবে সদাক্বাহর ক্রমবিকাশের সাথে সাথে রিবা ক্রমবিলুপ্ত হতে থাকবে। কারণ এ দুটি এমন বিপরীতমুখী অর্থব্যবস্থা যে, এর একটির উপস্থিতি যত বেশি হবে অপরটির উপস্থিতি তত কম হবে এবং দুটি একসাথে দ্বান্দ্বিক অবস্থানে উপস্থিত হলে রিবা পরাজিত হতে বাধ্য।
রিবা তথা প্রদত্ত ঋণের চেয়ে বাড়তি ফেরত নেয়া এবং সমজাতীয় পণ্যের অসম বিনিময় এবং লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্ব ছাড়া শুধু পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা গ্রহণ ইত্যাদি আল্লাহর বিধানে নিষিদ্ধ একটি অর্থনৈতিক শোষণমূলক ব্যবস্থা। রিবার অন্যায্যতা অত্যন্ত স্বত:সিদ্ধ একটি বিষয়। অথচ সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যানকারীরা শয়তানের সংস্পর্শে দিশেহারা হয়ে রিবা এবং ব্যবসায়ের বৈধ মুনাফাকে সমান বলে বিবেচনা করে থাকে। তাদের দৃষ্টিতে রিবা ছাড়া বর্তমান অর্থব্যবস্থা অচল হয়ে পড়বে অথচ আল কুরআনে রিবা গ্রহণকারীর বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে (অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগত) আদর্শিক যুদ্ধের ঘোষণা বিঘোষিত হয়েছে। সুতরাং রিবা ছাড়া অর্থব্যবস্থা অচল হবে না বরং রিবার কারণেই অর্থব্যবস্থা বাহ্যত সচল মনে হলেও কার্যত বিশ্ব অর্থনীতি ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েছে।
রিবার কারণে কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে পাহাড় পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেও মানবজাতির বৃহত্তর অংশ দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত। কিছু উদ্যোক্তা রিবা ব্যবস্থার অবৈধ সুযোগে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হলেও তার প্রতিক্রিয়ায় বিপরীতপক্ষে অসংখ্য ছোট ছোট উদ্যোক্তা চরম মার খাচ্ছে। কিছু বড় প্রতিষ্ঠান একচেটিয়া কারবারের সুযোগ পাচ্ছে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় অসংখ্য ছোট প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রিবা ব্যবস্থার অবৈধ সুবিধার মাধ্যমে গুটিকতকের হাতে সম্পদের পুঞ্জিভূতকরণ প্রকৃতপক্ষে মানবতার প্রতি একটা উপহাসের নামান্তর। সুতরাং রিবা ব্যবস্থা একই সাথে একটি অন্যায্য ব্যবস্থা এবং চূড়ান্ত বিচারে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী মরণাস্ত্রস্বরূপ। তাই রিবার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে এবং শোষণমুক্ত অর্থনীতির মাধ্যমে বিশ্ব মানবতাকে সুষম সমৃদ্ধি উপহার দিতে হলে আল কুরআন নির্দেশিত রিবামুক্ত অর্থনীতি চর্চা অত্যাবশ্যক।
আজর اَجْرُ : আজর শব্দের অর্থ হলো, ‘পারিশ্রমিক, পারিতোষিক, প্রতিফল’। আজরের বিষয়ে প্রধান নির্দেশনা হলো, আল কুরআনের বালাগ (প্রচার) করার বিনিময়ে কোনো আজর বা পারিশ্রমিক-পারিতোষিক গ্রহণ (দাবি) করা যাবে না। তবে পারস্পরিক উপকারমূলক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে কেউ কাউকে কোনো পারিতোষিক দেয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। আর যদি কাউকে কোনো সুনির্দিষ্ট দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয় তাহলে তাকে চুক্তি অনুসারে পারিশ্রমিক দেয়া কর্তব্য। বিয়েতে স্ত্রীকে যে মোহরানা দিতে হয় সেটাকে আজর তথা পারিতোষিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে সেটা আবশ্যকীয় বা ফরজ পারিতোষিক। কারণ এক্ষেত্রে একচেটিয়াভাবে স্ত্রীকে পারিতোষিক দেয়ার বিষয়টি আল্লাহর বিধানের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে। যারা স্বপ্রণোদিতভাবে দ্বীনের কাজে আটকে যায় অথবা যাকে কোনো নির্দিষ্ট কাজের জন্য পরামর্শক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নিযুক্ত করা হয় এবং সেজন্য তার উপার্জন সীমিত হয়ে যায় বা তার দ্বারা তা সম্ভব না হয় এরূপ ব্যক্তিকে সদাক্বাত দেয়ার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। যদি কাউকে কোনো সুনির্দিষ্ট কাজে পরামর্শের ভিত্তিতে নিযুক্ত করা হয় সেক্ষেত্রে পরামর্শ অনুসারে তাকে কোনো নির্ধারিত হারে সদাক্বাত প্রদান করা যেতে পারে। এটাকে আজর বা পারিশ্রমিক বলা যেতে পারে না, কারণ এক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজে কোনো নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের প্রার্থী নয় বা বিনিময় ছাড়াও সে সাধ্যমতো কাজটি করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকে। এ বিষয়ে সদাক্বাত আদায়ের দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকেও সদাক্বাত বণ্টনের একটি খাত হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়ার বিষয়টি লক্ষণীয়। সেবা প্রদানের বিনিময়ে যে সার্ভিস চার্জ নেয়া হয়, সেটাও আজর বা পারিতোষিকের অন্তর্ভুক্ত।
ইজারা إِيْجَارَة : ইজারা শব্দের অর্থ হলো ভাড়া (Lease, Rent)। ইজারা শব্দটি গঠিত হয়েছে ‘আজর’ (পারিশ্রমিক, পারিতোষিক) শব্দ থেকে। কুরআনে ‘আজর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তবে ‘ইজারা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় নি। কোনো ব্যক্তিকে তার শ্রম বা সেবার বিনিময় দেয়াকে ‘আজর’ বলা হয়। অন্যদিকে কোনো বস্তু ক্রয় না করায় তার মালিকানা অর্জিত হয় নি, কিন্তু তা থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে এরূপ অবস্থায় বস্তুটির মালিককে ঐ জিনিস থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগবাবদ যা প্রদান করা হয় তাকে ‘ইজারা’ (ভাড়া) বলে। যে বস্তু ব্যবহার করলে তার উপযোগ নি:শেষ হয়ে যায় এমন বস্তুর ইজারা হয় না, বরং এরূপ বস্তুর বিনিময়ে ক্রয়মূল্য প্রদান করতে হয় অথবা অনুরূপ বস্তু ফেরত দিতে হয়। ইজারার ক্ষেত্রে ইজারা প্রদানকারী ও গ্রহণকারীর মধ্যে পারস্পরিক সন্তুষ্টি সহকারে যে সমঝোতা হয় সেটাই ন্যায়সঙ্গত। অন্যদিকে এক্ষেত্রে এক পক্ষের একচেটিয়া প্রভাবের ফলে কম-বেশি ইজারা নির্ধারিত হলে তাতে রিবার উদ্ভব ঘটা সম্ভব। রিবা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনসাপেক্ষে সরকার কর্তৃক সর্বোচ্চ ইজারা নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে।
তিজারাত تِجَارَة : তিজারাত শব্দের অর্থ হলো ‘সাধারণ ব্যবসায়, লেনদেন, কেনাবেচা’। তিজারাত নগদও হতে পারে এবং বাকিতেও হতে পারে। কুরআনে নগদ তিজারাতের হিসাব-নিকাশ লিখে রাখাকে বাধ্যতামূলক করা হয় নি। তবে এ থেকে বুঝা যায় যে, বাকিতে কোনো কেনা-বেচা হলে তা লিখে রাখতে হবে।
দাইন دَيْن : দাইন শব্দের অর্থ হলো ‘দেনা, ঋণ, ধারে ক্রয়-বিক্রয়’। দাইন বলতে সেই ঋণকে বুঝায় যা ফেরত দেয়া না দেয়ার বিষয়ে মামলা দায়ের হতে পারে এবং তাতে বিচারের প্রয়োজন হবে। তাই দাইন ছোট হোক বা বড় হোক সেজন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে। যেমন- দুজন পুরুষকে সাক্ষী রাখতে হবে, যদি দুজন পুরুষ পাওয়া না যায় তাহলে একজন পুরুষ ও দুজন নারীকে সাক্ষী রাখতে হবে, দাইন ফেরত দেয়ার সময়সীমা নির্দিষ্ট হতে হবে, দাইনের বিবরণ ও শর্তাবলী লিখিত হতে হবে।
রিবা رِبَا : রিবা শব্দের অর্থ হলো ‘সুদ, প্রদেয় ঋণের চেয়ে অধিক ফেরত নেয়া, অসম বিনিময়ের বর্ধিত অংশ, অন্যায্য শর্তের মাধ্যমে একচেটিয়া মুনাফা ইত্যাদি’। আল কুরআনে রিবাকে হারাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং যে ব্যক্তি রিবা গ্রহণ করবে তাকে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামী হতে হবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া রিবার বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা বিঘোষিত হয়েছে। রিবাকে হারাম করার কারণ হিসেবে একে অর্থনৈতিক ‘জুলুম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে রিবাকে অর্থনীতির একটি সাধারণ অঙ্গ হিসেবে ধরা হলেও বাস্তবে রিবার মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতি জুলুমের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে এবং অন্যায্যভাবে একচেটিয়া কারবারের দৌরাত্ম্য সৃষ্টি হচ্ছে ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রিবার ভয়াবহ পরিণতি থেকে বাঁচার জন্য কুরআনের নির্দেশনা অনুসারে রিবামুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
বাই’ بَيْعُ : বাইয়ুন শব্দের অর্থ হলো চুক্তিভিত্তিক কার্যক্রমসম্পন্ন ব্যবসা। অর্থাৎ যে ধরনের ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসা কার্যক্রমে প্রামাণ্য লেনদেন সংঘটিত হওয়ার শর্ত রয়েছে সেটাকেই বাইয়ুন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বাইয়ুন যেমন একক মালিকানাধীন ব্যবসা হতে পারে, তেমনি হতে পারে তাবাইয়া’/ বাইয়ে মুশারাকা/ অংশগ্রহণমূলক/ অংশীদারিত্বমূলক/ অংশীদারসম্পন্ন/ যৌথ মালিকানাধীন ব্যবসা। এ অংশগ্রহণ পুঁজি বা শ্রম যেভাবেই অংশগ্রহণ হোক না কেন। আর কুরআনে তাবাইয়া’/ বাইয়ে মুশারাকার ক্ষেত্রে সাক্ষী রাখাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বাকিয়া মিনার রিবা بَقِيَ مِنَ الرِّبَا : বাকিয়া মিনার রিবা শব্দের অর্থ হলো ‘সুদের বকেয়া’। সূরা বাক্বারাহর ২:২৭৮ আয়াতে মু’মিনদেরকে ‘বাকিয়া মিনার রিবা’ (সুদের বকেয়া) ছেড়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ২:২৭৫ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, রিবা নিষিদ্ধ করার আয়াত নাজিলের পূর্বে যে রিবা গ্রহণ করা হয়েছে তা রিবা গ্রহণকারীর ইচ্ছাধীন বিষয় এবং তার ব্যাপার আল্লাহর কাছে সোপর্দ। অন্য কথায় এর পূর্বের সুদ সুদদাতার কাছে প্রত্যর্পন করার জন্য কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয় নি। সেই প্রেক্ষিতে আয়াতটি নাযিলের পর যেমন নতুন করে রিবা গ্রহণ করা যাবে না, তেমনি পূর্বের হিসাবকৃত রিবার যতটুকু বকেয়া রয়ে গেছে, তখনো সংগ্রহ করা হয় নি, তা ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রুউছু আমওয়াল رُءُوسُ أَمْوَال : রুউছু আমওয়াল অর্থ ‘মালসমূহের মাথা বা প্রধান অংশ, আসল বা মূলধন’। সূরা বাক্বারাহর ২:২৭৮-২৭৯ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, যদি তোমরা ‘বাকিয়া মিনার রিবা’ (সুদের বকেয়া) ছেড়ে দাও তাহলে ‘রুউছু আমওয়াল’ (আসল) তোমাদেরই প্রাপ্য। অন্য কথায় রিবাযুক্ত আমওয়াল (সুদাসল) থেকে রিবা (সুদ) ছেড়ে দিলে ‘রুউছু আমওয়াল’ (আসল) ফেরত পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ তথ্য থেকে রিবার সংজ্ঞা নির্ণয় করা সহজ হয়। তা হলো, আসলকে যদি অন্যায্যভাবে বৃদ্ধিসহ ফেরত চাওয়া হয় তাহলে ঐ অন্যায্য বৃদ্ধিকে রিবা বলে।
রিহান رِهَان : রিহান (রেহান) শব্দের অর্থ হলো ‘বন্ধক’। কুরআনে যখন সফর অবস্থায় লেখক পাওয়া যায় না, তখন ঋণ গ্রহণের জন্য হস্তান্তরযোগ্য দ্রব্য বন্ধক রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং বন্ধককে ‘আমানাত’ বা ‘বিশ্বস্ততা সহকারে সংরক্ষণের বিষয়’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যে ব্যক্তির কাছে বন্ধক বা আমানাত রাখা হয়েছে সে যেন যথাসময়ে ও যথানিয়মে তা ফেরত দেয়। যেহেতু বন্ধক হলো আমানাত তাই বন্ধকী দ্রব্য নিজে ব্যবহার করলে তার বিনিময় দিতে হবে। তবে বিনিময় ঐ দ্রব্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, যা ব্যবহারের পর নি:শেষ হয়ে যায়, পরে অনুরূপ দ্রব্য ফেরত দিতে হয়।
যাকাত زَكَوٰة : যাকাত শব্দটির অর্থ হলো ‘পরিশুদ্ধতা, উন্নয়ন’। প্রথম অর্থটির ভিত্তিতে দ্বিতীয় অর্থটির বিস্তৃত রূপ হলো ‘নৈতিকতাভিত্তিক উন্নয়ন’। একটি আরবি প্রবাদ আছে “আল ইলমু ইয়াযকু আলাল ইনফাক্ব” যার অর্থ হলো, “বিতরণ করলে জ্ঞান বৃদ্ধি পায়”। আবার “যাকায যারউ” বাক্যটির অর্থ হলো অর্থ “চারাটি বৃদ্ধি পেলো”। ১৮:১৯ আয়াতে আছে “ফালইয়ানজুর আইয়ুহা আযকা ত্বয়ামান”, যার অর্থ হলো, “সে যেন লক্ষ করে কোন খাদ্যটি সবচেয়ে সুস্বাদু পুষ্টিকর ও বিশুদ্ধ?”। উর্বর জমিকে ‘আরদুন যাকিয়্যাহ’ বলা হয়। এসব প্রেক্ষিতে যাকাত বলতে ‘পরিশুদ্ধতা এবং অন্যকে সমৃদ্ধ করার উপযোগী গুণে সমৃদ্ধতা’কে বুঝায়। যাকাত বা পরিশুদ্ধতা অর্জনে সক্রিয়তা মু’মিনদের অন্যতম গুণ এবং যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে সেই সফল হবে। আত্মশুদ্ধি বা যাকাত অর্জনের জন্য মু’মিনরা দুঃস্থ ও অভাবগ্রস্তদেরকে দান করে। আল কুরআনে ‘যাকাত প্রদান করাকে’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ‘যাকাত প্রদান করা’র বিস্তৃত রূপ হলো সমাজের নৈতিক ও সামগ্রিক সুষম উন্নয়নের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতা-সামর্থ্য অনুসারে উদারভাবে অংশগ্রহণ করা। এর অন্যতম একটি দিক হলো যারা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে আছে তাদের প্রতি আর্থিক দায়িত্ব পালন এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক অনুদান প্রদান করা। অর্থনৈতিক যাকাত হিসেবে যারা অনুদান করে আল্লাহর অনুগ্রহে তারাই প্রকৃত ও স্থায়ী সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। তবে আল কুরআনে যাকাত বলতে শুধু অর্থনৈতিক প্রদেয় প্রদানকে বুঝায় না, বরং যাকাতের ব্যাপক তাৎপর্য হলো চিন্তা-চেতনা ও সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে পরিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা।
সদাক্বাত صَدَقَة : সদাক্বাত শব্দটির অর্থ হলো ‘স্বীকৃত প্রাপ্য পরিশোধমূলক অনুদান প্রদান করা’। অর্থাৎ সাধারণভাবে দান শব্দটি যেরূপ কাউকে দয়া করে কিছু দেয়ার অর্থে প্রচলিত, যাতে যে ব্যক্তি দিচ্ছে সে নিজেকে বড় বলে এবং যে ব্যক্তি নিচ্ছে সে নিজেকে ছোট বলে অনুভব করার মতো মনোভাবের উদ্ভব ঘটতে পারে, কুরআনে বর্ণিত সদাক্বাত সেরূপ নয়। বরং এতে সদাক্বাত হলো আল কুরআন উপস্থাপিত জীবনব্যবস্থাকে গ্রহণ করার দাবিতে সত্যবাদী হওয়ার প্রমাণস্বরূপ আল্লাহ যাদেরকে সম্পদের প্রাপক হিসেবে বিশেষ ঘোষণা দিয়েছেন তাদেরকে তাদের অধিকার পরিপূরণের জন্য অনুদান প্রদান করা। এ অনুদান ক্ষেত্রবিশেষে উভয়পক্ষের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমেও নির্ধারিত হতে পারে। যেমন আল্লাহর বিধান অনুসারে স্ত্রীকে মোহরানা দেয়া স্বামীর উপর একটি আবশ্যকীয় দায়িত্ব। এই মোহরানাকে সদুক্বাত বলেও চিহ্নিত করা হয়েছে। আর মোহরানার পরিমাণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে (বা তাদের পরিবারের দায়িত্বশীলদের মধ্যে) পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে থাকে। আল্লাহর ঘোষণা অনুসারে মু’মিনদের কাছে পরিজ্ঞাত যে, তাদের সম্পদে বঞ্চিত ও প্রার্থীদের হক্ব রয়েছে। এমতাবস্থায় এ হক্ব পরিপূরণের জন্য তারা সদাক্বাত করে থাকে। সদাক্বাত প্রকাশ্যে করাও উত্তম আর গোপনে দরিদ্রদের কাছে পৌঁছে দেয়া আরো উত্তম। সদাক্বাত করতে না পারলে সুন্দরভাবে কথা বলতে হবে। সদাক্বাত করে তার বিনিময় চাওয়া যাবে না বা বিনিময়স্বরূপ কোনো পরিশ্রম করিয়ে কষ্ট দেয়া যাবে না আবার খোঁটাও দেয়া যাবে না। ব্যক্তিগতভাবে এরূপ সদাক্বাতের পাশাপাশি সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনায় সদাক্বাত আদায় এবং তা নির্দিষ্ট খাতসমূহে বণ্টন করাকে ফরজ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সদাক্বাতের পরিমাণ যেমন সদাক্বাতকারীদের ইচ্ছার ভিত্তিতে হতে পারে, তেমনি যদি পরামর্শভিত্তিক কোনো ন্যুনতম পরিমাণকে নির্বাহীভাবে নির্ধারণ করা হয় তবে সেটা দেয়াটা কর্তব্য বলে সাব্যস্ত হবে।
১। Riba from Quran and its Message by Joseph A Islam
২। আল কোরআনের আলোকে অর্থনীতি, ডক্টর মোহাম্মদ জিয়াউল হক, প্রিয়বই প্রকাশনী।
৩। ইসলামে অর্থব্যবস্থা, ড. মোঃ ইব্রাহীম খলিল, মেরিট ফেয়ার প্রকাশন।
৪। মহানবীর (সা.) অর্থনৈতিক শিক্ষা, মুহাম্মদ আকরাম খান, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার।
৫। কুরআন ও সুন্নাহয় সুদ নিষিদ্ধকরণ, ইমরান নযর হোসেন, মাহমুদ ব্রাদার্স।
৬। মুয়ামালাত : প্রচলিত রিবা ব্যবস্থার বিকল্প, ওমর ইব্রাহিম ভাদিল্লো, সম্পাদনা: ইমদাদ হুসেইন খান, মেটাকেভ পাবলিকেশন্স।
৭। সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, আধুনিক প্রকাশনী।
৮। বিশ্ববাজার ধসের মূল কারণ সুদ, মুফতি মুহাম্মদ শফী, মাকতাবাতুল আখতার।
৯। সুদ নিষিদ্ধ : পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়, বিচারপতি মুহাম্মদ তকি ওসমানী, নতুন সফর প্রকাশনী।
১০। সুদ একটি ভয়াবহ অভিশাপ : পরিত্রাণের উপায়, অধ্যাপক শাহ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার।
১১। সুদ সমাজ অর্থনীতি, অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ ব্যুরো।
১২। পরার্থপরতার অর্থনীতি, আকবর আলি খান, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।