আল কুরআনের আলোকে রিবা হারাম (নিষিদ্ধ) এবং রিবাকারীর বিরুদ্ধে আল্লাহর ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা রয়েছে। এ বিষয়টি প্রায় সবার কম-বেশি জানা রয়েছে। কিন্তু রিবা বলতে কী বুঝায়, কোন ক্ষেত্রে রিবা রয়েছে এবং কোন ক্ষেত্রে রিবা নেই, রিবা ছাড়া আধুনিক অর্থনীতি সচল থাকা সম্ভব কিনা ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব পরিলক্ষিত হয়। আল কুরআন থেকে রিবা সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় কিনা এ বিষয়েও বিভিন্ন মত প্রচলিত রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে এই বইয়ে আল কুরআনের রিবা সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে রিবার ধারণা তুলে ধরার প্রয়াস নেয়া হয়েছে।
সাধারণত কুরআনে যেসব বিষয়ে আদেশ বা নিষেধ রয়েছে তার সংজ্ঞা প্রদানের স্টাইলে কোনো সংজ্ঞা প্রদান করা হয় নি। কিন্তু এসব বিষয় মানুষের ভাষায় যে অর্থ প্রকাশ করে তার উপর ভিত্তি করেই কুরআনে সেসব বিষয়ে আদেশ বা নিষেধ রয়েছে। তবে যে বিষয়গুলো বিশেষ পরিভাষায় পরিণত হয়েছে এর কোনো বিষয়ে যখন মতভেদের সৃষ্টি হয় তখন তার প্রকৃত রূপ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কুরআনের বক্তব্য ধারার বিশ্লেষণ থেকে সঠিক সংজ্ঞা চিহ্নিত করার উপায় পাওয়া যায়। রিবার বিষয়টিও অনুরূপ। বইটিতে কুরআনের আলোকে রিবার সংজ্ঞা, বিভিন্ন পদ্ধতি, বিভিন্ন বিষয়ের প্রেক্ষিতে রিবার তুলনামূলক অবস্থা, রিবা নিষিদ্ধতার যৌক্তিকতা, রিবার বিকল্প হিসেবে মু’মিনদের অনুশীলনযোগ্য অর্থনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, কুরআন অনুসারে লেনদেনের এক পক্ষ অন্য পক্ষ থেকে কোনো অন্যায্য ও বাড়তি সুবিধা গ্রহণই রিবা। রিবা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
বইটিতে আধুনিক অর্থব্যবস্থার বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোন ক্ষেত্রে রিবা রয়েছে এবং তার বিকল্প হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সাধনে কী কী করা যেতে পারে তা আলোচনার পরিবর্তে রিবার ধারণাগত দিক তথা রিবা কী বা কোন ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে রিবা বলা যায়, তা স্পষ্ট হওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করা যায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে রিবা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে রিবা সম্পর্কিত যে মৌলিক ধারণার প্রয়োজন সেক্ষেত্রে বইটি কাজে আসতে পারে।
বইটিতে কোনো ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যাওয়া অসম্ভব নয়। তাই যদি কোনো ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়ে বা কোনো পাঠক দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাহলে যাচাই সাপেক্ষে পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধন করা হবে, ইনশাআল্লাহ।
১. রিবা শব্দটির অর্থ হিসেবে আমাদের ভাষায় ‘সুদ’ শব্দটি প্রচলিত রয়েছে। যদিও ‘সুদ’ রিবার প্রধান প্রকার, কিন্তু রিবা বললে শুধু সুদ বুঝায় না, বরং রিবা একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ, যা দ্বারা যাবতীয় অসম বিনিময়কে বুঝায়।
২. রিবা হতে পারে কোনো পক্ষের দুর্বলতার সুযোগে কৃত চুক্তির মাধ্যমে অসম বিনিময়, আবার এটি হতে পারে কোনো পক্ষকে প্রতারিত করে বাড়তি সুবিধা অর্জন। রিবা অন্যায্য বিনিময় ব্যবস্থার যাবতীয় দিককে অন্তর্ভুক্ত করে।
৩. রিবা বলতে সরল সুদ বুঝায় নাকি চক্রবৃদ্ধি সুদ বুঝায় অথবা মৌলিক প্রয়োজনে দেয়া ঋণের সুদ বুঝায় নাকি ব্যবসায়িক কার্যক্রমে দেয়া পুঁজির সুদকেও বুঝায় এসব নিয়ে দীর্ঘকালীন বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, প্রদেয় ঋণের মূল্যমানের সমতার অতিরিক্ত যাবতীয় সুদই রিবার অন্তর্ভুক্ত। রিবাকে নিষিদ্ধ করার কারণ এর দ্বারা এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষের উপর অর্থনৈতিক জুলুম হয়। আর এ জুলুমটি হলো কোনো প্রকৃত বিনিময় ছাড়াই এক পক্ষের সম্পদ অন্য পক্ষের হস্তগত হয়।
৪. ঋণ প্রদান করলে সমপরিমাণ অথবা মূল্যমানের হ্রাস-বৃদ্ধি সাপেক্ষে সমমূল্যের দ্রব্য ফেরত নেয়া যাবে। যদি অসমমূল্যের লেনদেন সংঘটিত হয় তাহলে ঐ বৃদ্ধির অংশটি রিবা হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
৫. ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য ঋণ প্রদান করলে ঋণ আদান-প্রদানের নিয়ম কার্যকর হবে, আর যদি বিনিয়োগ তথা লভ্যাংশ পাওয়ার উদ্দেশ্যে দেয়া হয়, তাহলে ব্যবসায়ের লাভ-ক্ষতির অংশীদার হতে হবে, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বা পরিবর্তনশীল হারে লভ্যাংশ ভোগী হওয়া যাবে না, বা মূলধনের উপর ভিত্তি করে মূলধনের সাথে অতিরিক্ত গ্রহণ করা যাবে না। কারণ তা রিবা।
৬. ভাড়া, কৃষিজমির বর্গা, বন্ধক, মুদ্রার লেনদেন, সার্ভিস চার্জ, জরিমানা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কখন কীভাবে রিবা হবে বা হবে না তা এ বিষয়গুলোর অর্থনৈতিক পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত, এর মাধ্যমে একপক্ষীয়ভাবে বাড়তি সুবিধা গ্রহণের সুযোগ তৈরি হলে তা রিবা, অন্যথায় তা রিবা নয়।
৭. রিবার ভয়াবহ পরিণতিস্বরূপ সম্পদ শুধু সম্পদশালীদের মধ্যে আবর্তিত হয় তথা ধনীরা আরো ধনী হয়, দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হয়। বিশ্বপ্রভুর বিধান অনুসারে রিবা ক্রমে ক্রমে বিশ্ব অর্থনীতিকে সংকুচিত করে ফেলে। রিবা গ্রহণকারী স্থায়ী জাহান্নামের শাস্তি পাবে এবং রিবার প্রতি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা বিঘোষিত হয়েছে। অর্থাৎ মু’মিনরা কর্তৃত্ব অর্জন করতে পারলে রিবাকে নিয়ন্ত্রণে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া আল্লাহর বিধান অনুসারে মু’মিনরা যাকাত, সদাক্বাহ, দাইন বা ঋণ এবং বাই’ বা ব্যবসাভিত্তিক অর্থনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে রিবার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে এবং সুষম ও সমৃদ্ধ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
রিবা হচ্ছে আল কুরআনে নিষিদ্ধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। ‘রিবা’ শব্দের সাধারণ অর্থ করা হয় ‘সুদ’। কিন্তু আল কুরআনে রিবার যে ধারণা এবং তা নিষিদ্ধ করার কার্যকারণ উল্লেখ করা হয়েছে তাতে ‘সুদ’ রিবার প্রধান প্রকার হলেও শুধুমাত্র ‘সুদ’ শব্দে রিবার অনুবাদ করা যথার্থ নয়। কারণ রিবা সুদের চেয়ে আরো ব্যাপক একটি বিষয়। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে, কোনো ভাবে অসম বিনিময় সংঘটিত হলে তাতে যে পক্ষে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অংশ পড়ে সে পক্ষের জন্য ঐ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অংশটাই হচ্ছে রিবা।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে রিবার উদ্ভব ঘটতে পারে। রিবার ধারণা বা মূলনীতি স্পষ্ট হলে ব্যাংক, বীমা, বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা তথা বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি যা ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে এবং যা ভবিষ্যতে তৈরি হতে পারে তাতে ঐ মূলনীতির প্রয়োগ করে দেখা সম্ভব যে, তাতে রিবার উদ্ভব ঘটে কিনা। সাধারণত প্রশ্ন আসে যে, আল কুরআন ব্যাংক সম্পর্কে কি বলে? বীমা সম্পর্কে কি বলে? তা হালাল করা হয়েছে নাকি হারাম করা হয়েছে? ইত্যাদি। বস্তুত এগুলো সাধারণ অর্থনৈতিক কাযক্রমের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি, যা মানবীয় কার্যক্রমের সুসংবদ্ধতার ক্রমবিকাশ মাত্র। যদি এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রিবার চর্চা করা হয়, তাহলে তা অবৈধ হয়, অন্যদিকে যদি রিবামুক্ত বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাহলে তা বৈধ হয়। সুতরাং এসব প্রতিষ্ঠানে রিবার চর্চা হয় কিনা তা বুঝার জন্য একদিকে রিবা সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন এবং অন্যদিকে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ বইয়ে রিবার ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর আধুনিক অর্থব্যবস্থায় রিবাযুক্ত বিভিন্ন পদ্ধতি ও বিকল্প প্রস্তাবনা নিয়ে একটি স্বতন্ত্র বইয়ে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
রিবা কী এবং কোনটি রিবার অন্তর্ভুক্ত হবে বা হবে না তা নিয়ে অনেকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়। আল কুরআনে রিবাকে হারাম করা এবং রিবা ভক্ষণকারীর বিরুদ্ধে আল্লাহর ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা এবং রিবা ভক্ষণকারীর পরকালীন পরিণতি হিসেবে চিরস্থায়ী জাহান্নামের শাস্তির কথা উল্লেখিত হওয়া সত্ত্বেও অজ্ঞতা ও লোভবশত রিবা সম্পর্কে অসচেতনতা ও রিবা থেকে সতর্ক থাকার বিষয়ে অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। কেউ কেউ অভিযোগ করে কুরআনে রিবাকে হারাম করা হয়েছে কিন্তু রিবার সংজ্ঞা দেয়া হয় নি বা কুরআন থেকে রিবা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় না। সব ধরনের সুদই রিবা হবে কিনা সে বিষয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অথচ এসব অভিযোগ ও বিতর্কের পেছনে কুরআনের আয়াতসমূহ নিয়ে নিষ্ঠাপূর্ণ ও যথাযথ অধ্যয়নের অভাবই দায়ী।
আল কুরআন ‘এই এই শর্তে এই বিষয়কে এই নামকরণ করা হয়’ এভাবে সংজ্ঞা প্রদানের স্টাইলে সংজ্ঞা প্রদান করে না। কুরআনে বর্ণিত বিষয়াদির প্রায় সবগুলোই মানুষের ভাষার মধ্যে স্বত:সিদ্ধভাবে যে অর্থে প্রযোজ্য হয়ে থাকে সেই অর্থেই প্রয়োগ করা হয়েছে বিধায় সেই বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞা প্রদানের পদ্ধতি অবলম্বনের কোনো প্রশ্ন আসা প্রাসঙ্গিক নয়। তা সত্ত্বেও কুরআন অধ্যয়নের মাধ্যমে দেখা যায় যে, কুরআনের বক্তব্যকে এভাবে সাজানো হয়েছে যে, কুরআনে বর্ণিত যেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হয় সেক্ষেত্রে সঠিক উপলব্ধি তথা প্রকৃত সংজ্ঞা নির্ণয়ের সূত্র কুরআনের বক্তব্যসমূহের অন্তর্নিহিত বিশ্লেষণ থেকে প্রতীয়মান হবে। আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাব থেকে তারাই হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতার সাথে সম্পর্কিত বিষয়াদিতে মতভেদের ক্ষেত্রে সঠিক সমাধান উপলব্ধি ও গ্রহণ করতে সক্ষম হবে যারা সত্যিই আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে (এ বিষয়ে ২:২১৩ আয়াতে আলোকপাত করা হয়েছে)। তাই আমাদেরকে আল্লাহর প্রতি ঈমান রেখে তাঁর কিতাবের যথাযথ অধ্যয়নের মাধ্যমেই রিবাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রকৃত সত্য সন্ধানে সচেষ্ট হতে হবে।
বর্তমানে রিবা এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে যে, রিবা থেকে মুক্ত থাকাকে বা রিবামুক্ত অবস্থায় জীবন যাপন করাকে অত্যন্ত কঠিন মনে হয়। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় রিবামুক্ত অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য আল্লাহর বিধানে যেসব ব্যবস্থা রয়েছে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও মু’মিনদেরকে যথাযথ মাত্রায় সচেষ্ট দেখা যায় না। তাই মু’মিনদেরকে এ বিষয়ে কুরআন দ্বারা উদ্বুদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। রিবার সর্বগ্রাসী ব্যবস্থার ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অর্থনৈতিক শোষণ মানবজাতিকে সমূলে ধ্বংস করার প্রান্তে নিয়ে এসেছে তা থেকে এখনি সতর্ক হওয়া ও সতর্ক করা এবং তার বিপরীতে আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-ব্যবস্থা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই।
বইটিতে রিবা সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে ও সহজ করে রিবার সংজ্ঞা, প্রকৃতি ও বিভিন্ন প্রকার এবং বিভিন্ন বিষয়ের সাথে রিবার তুলনামূলক অবস্থা বিশ্লেষণের মাধ্যমে রিবা কী এবং কেন তা ক্ষতিকর ও নিষিদ্ধ, সর্বোপরি রিবামুক্ত বিকল্প অর্থব্যবস্থার মৌলিক পদ্ধতি সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করা যায় যে, বইটি কুরআনের আলোকে রিবার ধারণা, রিবা নিষিদ্ধতার যৌক্তিকতা ও এর বিকল্প অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে ‘উপলব্ধি শেয়ারিং’ হিসেবে আগ্রহী পাঠকদের জন্য একটি সহায়ক উপকরণ হতে পারে।
রিবা (সুদ…) এর সংজ্ঞা নির্ণয় এবং এর সাথে সম্পর্কিত সামগ্রিক আলোচ্য বিষয় অনুধাবনের জন্য রিবা (সুদ…) সম্পর্কিত আয়াতসমমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন জরুরি। তাই নিম্নে প্রথমে রিবা (সুদ…) সম্পর্কিত আয়াতসমূহের অনুবাদ উল্লেখ করা হলো।
সূরা বাকারা ২:২৭৫-২৮৩
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا فَمَن جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّهِ فَانتَهَىٰ فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ وَمَنْ عَادَ فَأُولَـٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
২:২৭৫ :: যারা রিবা খায় তারা তো শুধু তার মতো দাঁড়ায় যাকে শয়তান তার সংস্পর্শ দ্বারা উন্মাদ/উদ্ভ্রান্ত বানিয়ে দিয়েছে। এটা এজন্য যে, তারা বলে, “নিশ্চয় ব্যবসা তো রিবার মতোই।“। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং রিবাকে হারাম করেছেন। সুতরাং যার কাছে তার প্রভুর পক্ষ থেকে উপদেশ এসে যায়, তারপর সে বিরত হয়, তাহলে যা অতীত হয়েছে তা তারই বিবেচ্য এবং তার ব্যাপার আল্লাহর দিকে সোপর্দ। আর যে ব্যক্তি পুনরায় (রিবার কারবার) করবে, তবে তারাই (জাহান্নামের) আগুনে (শাস্তিস্বরূপ) অবস্থানকারী হবে। তারা তাতে (জাহান্নামে) স্থায়ী হবে।
يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ
২:২৭৬ :: আল্লাহ রিবাকে ক্ষয়িষ্ণু করেন এবং সদাক্বাতকে বর্ধিত করেন। আর আল্লাহ প্রত্যেক কাফির (সত্যকে অবিশ্বাসী ও প্রত্যাখ্যানকারী) পাপীকে ভালবাসেন না।
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
২:২৭৭ :: নিশ্চয় যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত প্রদান করে তাদের জন্য তাদের প্রভুর কাছে তাদের পুরস্কার-পারিতোষিক রয়েছে। আর তাদের কোনো ভয়ও থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
২:২৭৮ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা আল্লাহর প্রতি সচেতন হও এবং রিবা থেকে যা বাকি রয়েছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মু’মিন হও।
فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَإِن تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ
২:২৭৯ :: তারপর যদি তোমরা তা না করো (রিবা ছেড়ে না দাও), তাহলে আল্লাহর ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা (জেনে) নাও। আর যদি তুমি তোমরা তাওবাহ করো, তাহলে মূলধন (রুউছু আমওয়াল) তোমাদেরই প্রাপ্য। তোমরা জুলুমও করবে না এবং তোমরা জুলুমের শিকারও হবে না।
وَإِن كَانَ ذُو عُسْرَةٍ فَنَظِرَةٌ إِلَىٰ مَيْسَرَةٍ وَأَن تَصَدَّقُوا خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ
২:২৮০ :: আর যদি সে (ঋণী ব্যক্তি) কষ্ট-কাঠিন্যে (বাস্তব অসুবিধায়) থাকে, তাহলে তাকে (ঋণ পরিশোধের উপযোগী) সহজতা/স্বচ্ছলতা আসা পর্যন্ত অবকাশ দাও। আর যদি তোমরা তা সদাক্বাহ করো (তোমাদের পাওনা মূলধন বা তার অংশবিশেষের দাবি ছেড়ে দাও), সেটা তোমাদের জন্য উত্তম ও কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে পারো!
وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ تُوَفَّىٰ كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ
২:২৮১ :: আর তোমরা সেদিনের বিষয়ে সচেতন হও, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে, তারপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে যা (যে পাপ বা পূণ্য) সে উপার্জন করেছে তা (তার প্রতিফল) পূর্ণ করে দেয়া হবে এবং তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا تَدَايَنتُم بِدَيْنٍ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى فَاكْتُبُوهُ وَلْيَكْتُب بَّيْنَكُمْ كَاتِبٌ بِالْعَدْلِ وَلَا يَأْبَ كَاتِبٌ أَن يَكْتُبَ كَمَا عَلَّمَهُ اللَّهُ فَلْيَكْتُبْ وَلْيُمْلِلِ الَّذِي عَلَيْهِ الْحَقُّ وَلْيَتَّقِ اللَّهَ رَبَّهُ وَلَا يَبْخَسْ مِنْهُ شَيْئًا فَإِن كَانَ الَّذِي عَلَيْهِ الْحَقُّ سَفِيهًا أَوْ ضَعِيفًا أَوْ لَا يَسْتَطِيعُ أَن يُمِلَّ هُوَ فَلْيُمْلِلْ وَلِيُّهُ بِالْعَدْلِ وَاسْتَشْهِدُوا شَهِيدَيْنِ مِن رِّجَالِكُمْ فَإِن لَّمْ يَكُونَا رَجُلَيْنِ فَرَجُلٌ وَامْرَأَتَانِ مِمَّن تَرْضَوْنَ مِنَ الشُّهَدَاءِ أَن تَضِلَّ إِحْدَاهُمَا فَتُذَكِّرَ إِحْدَاهُمَا الْأُخْرَىٰ وَلَا يَأْبَ الشُّهَدَاءُ إِذَا مَا دُعُوا وَلَا تَسْأَمُوا أَن تَكْتُبُوهُ صَغِيرًا أَوْ كَبِيرًا إِلَىٰ أَجَلِهِ ذَٰلِكُمْ أَقْسَطُ عِندَ اللَّهِ وَأَقْوَمُ لِلشَّهَادَةِ وَأَدْنَىٰ أَلَّا تَرْتَابُوا إِلَّا أَن تَكُونَ تِجَارَةً حَاضِرَةً تُدِيرُونَهَا بَيْنَكُمْ فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَلَّا تَكْتُبُوهَا وَأَشْهِدُوا إِذَا تَبَايَعْتُمْ وَلَا يُضَارَّ كَاتِبٌ وَلَا شَهِيدٌ وَإِن تَفْعَلُوا فَإِنَّهُ فُسُوقٌ بِكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَيُعَلِّمُكُمُ اللَّهُ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
২:২৮২ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যখন তোমরা পরস্পরের মধ্যে দাইনের (ঋণের ও ধারে ক্রয়-বিক্রয়ের) লেনদেন করো নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত, তখন তা লিখে রাখবে। আর তা লিখতে হবে তোমাদের মধ্যকার কোনো লেখক, ন্যায়সঙ্গতভাবে। আর লেখকের লিখতে অস্বীকার করা উচিত নয়, যেরূপ আল্লাহ তাকে লেখা শিখিয়েছেন। সুতরাং সে যেন লেখে। আর যার উপর হক্ব (পাওনা) প্রযোজ্য হয় সে (ঋণগ্রহীতা) যেন (ঋণ গ্রহণের) শর্তাবলী বলে দেয়, এবং সে যেন তার প্রভু আল্লাহকে ভয় করে এবং সে যেন তা থেকে (শর্ত বর্ণনায় বা শর্তানুসারে প্রদানের ক্ষেত্রে) কিছুই না কমায়। তবে যদি যার উপর হক্ব (পাওনা) প্রযোজ্য হয় (ঋণগ্রহীতা) বোকা হয় অথবা দুর্বল হয়, অথবা শর্তাবলীর বলার ক্ষেত্রে পারঙ্গম না হয়, তাহলে তার (পক্ষ থেকে তার কোনো) পৃষ্ঠপোষক (ওয়ালী) শর্তাবলী বলে দেবে, ন্যায়সঙ্গতভাবে। আর তোমরা তোমাদের পুরুষদের মধ্য থেকে দুইজনকে সাক্ষী রাখো। তবে যদি দুজন পুরুষ না থাকে, তাহলে একজন পুরুষকে এবং দুজন নারীকে, সাক্ষী হিসেবে তোমরা যাদের প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারো, যেন তাদের দুজনের (দুজন নারীর) মধ্য থেকে একজন (কোনো কারণে যথাযথভাবে সাক্ষ্য ব্যক্ত করতে) ভুল করলে, সেক্ষেত্রে তাদের দুজনের (দুজন নারীর) মধ্যকার অন্যজন (অন্য নারীটি) তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারে। আর সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করা উচিত নয়, যখন তাদেরকে আহবান করা হয়। আর ছোট হোক বা বড় হোক তা (ঋণ লেনদেনের দলিল) নির্দিষ্ট সময়সীমাসহ লিখে রাখতে তোমরা বিরক্ত হয়ো না (অবহেলা করো না)। এটা আল্লাহর নিকট সর্বাধিক ন্যায্য এবং সাক্ষ্য প্রমাণে সবচেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি এবং তোমরা (শর্তাবলীর বিষয়ে) সন্দেহগ্রস্ত না হওয়ার সবচেয়ে নিকটবর্তী। তবে যদি তোমাদের মধ্যে উপস্থিত বা নগদ সাধারণ ব্যবসায়/ কেনাবেচা/ লেনদেন (তিজারাতান হাদ্বিরাহ) করে থাকো, সেক্ষেত্রে তোমরা তা না লিখলেও তোমাদের দোষ হবে না। আর যখন তোমরা চুক্তিভিত্তিক কার্যক্রমসম্পন্ন অংশগ্রহণমূলক ব্যবসা (তাবাইয়া’ / বাইয়ে মুশারাকা তথা অংশীদারিত্বমূলক/ যৌথ মালিকানাধীন বা অংশীদারসম্পন্ন ব্যবসা) করো, তখন তোমরা সাক্ষী রাখতে হবে। আর লেখককেও ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না এবং সাক্ষীকেও ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। আর যদি তোমরা তা করো, তাহলে নিশ্চয় তা তোমাদের অবাধ্যতা ও দুষ্কর্ম পরায়ণতা (ফুসূক্ব)। আর আল্লাহর প্রতি সচেতন হও। আর আল্লাহ তোমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছেন। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞানী।
وَإِن كُنتُمْ عَلَىٰ سَفَرٍ وَلَمْ تَجِدُوا كَاتِبًا فَرِهَانٌ مَّقْبُوضَةٌ فَإِنْ أَمِنَ بَعْضُكُم بَعْضًا فَلْيُؤَدِّ الَّذِي اؤْتُمِنَ أَمَانَتَهُ وَلْيَتَّقِ اللَّهَ رَبَّهُ وَلَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ وَمَن يَكْتُمْهَا فَإِنَّهُ آثِمٌ قَلْبُهُ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ
২:২৮৩ :: আর যদি তোমরা সফরের উপর/অবস্থায় থাকো এবং লেখক না পাও, তাহলে হস্তান্তরযোগ্য রেহান/ বন্ধক রাখবে। তারপর যদি তোমাদের একে অন্যের কাছে আমানাত (বন্ধক) রাখো, তাহলে যার কাছে আমানাত রাখা হয়েছে সে যেন (যথাসময়ে) আমানাত প্রত্যর্পণ করে এবং তার প্রভু আল্লাহকে ভয় করে। আর তোমরা সাক্ষ্যকে গোপন করো না। আর যে ব্যক্তি তা (সাক্ষ্য) গোপন করে, তবে নিশ্চয় তার অন্তর পাপী। আর তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিজ্ঞাত।
সূরা আলে ইমরান ৩:১৩০
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا الرِّبَا أَضْعَافًا مُّضَاعَفَةً وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
৩:১৩০ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা রিবা খেও না, (যা হতে থাকে) বহুগুণ, গুণিতককৃত/ক্রমবর্ধমান। আর আল্লাহর প্রতি সচেতন হও, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও।
সূরা নিসা ৪:১৬১
وَأَخْذِهِمُ الرِّبَا وَقَدْ نُهُوا عَنْهُ وَأَكْلِهِمْ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ مِنْهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
৪:১৬১ :: আর যেহেতু তারা (ইয়াহুদ সম্প্রদায়) রিবা গ্রহণ করে, অথচ নিশ্চয় তাদেরকে তা থেকে নিষেধ করা হয়েছিলো এবং (অনুরূপ বিভিন্ন) অন্যায় পন্থায় মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করে, আর আমি তাদের মধ্য থেকে কাফিরদের জন্য কষ্টদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি।
সূরা রূম ৩০:৩৯
وَمَا آتَيْتُم مِّن رِّبًا لِّيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُو عِندَ اللَّهِ وَمَا آتَيْتُم مِّن زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ
৩০:৩৯ :: আর যা তোমরা দাও (বা পরিশোধ করো) রিবা বাবদ, যেন বৃদ্ধি করা যায় মানুষের সম্পদে, বস্তুত এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে (তথা প্রকৃত প্রস্তাবে সম্পদ) বৃদ্ধি করা যায় না। আর যা তোমরা দাও যাকাত বাবদ, তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার ইচ্ছা করে, উহারাই (তোমাদের মধ্যকার যাকাত প্রদানকারীরাই) তারা, যারা গুণিতককারী (বহুগুণে বৃদ্ধিকারী)।
সূরা নাহল ১৬:৯২
وَلَا تَكُونُوا كَالَّتِي نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِن بَعْدِ قُوَّةٍ أَنكَاثًا تَتَّخِذُونَ أَيْمَانَكُمْ دَخَلًا بَيْنَكُمْ أَن تَكُونَ أُمَّةٌ هِيَ أَرْبَىٰ مِنْ أُمَّةٍ إِنَّمَا يَبْلُوكُمُ اللَّهُ بِهِ وَلَيُبَيِّنَنَّ لَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ
১৬:৯২ :: আর তোমরা সেই নারীর মতো হয়ো না যে পাক খুলে দিয়েছে তার সুতাকে মজবুত করে পাক দেয়ার পরে। (এভাবে যে) তোমরা গ্রহণ করছো তোমাদের প্রতিশ্রুতিকে পরস্পরের মধ্যে প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে, যেন এক পক্ষ অন্য পক্ষের তুলনায় (অন্যায্যভাবে) স্বার্থসিদ্ধিতে অধিকতর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে। নিশ্চয় আল্লাহ সেটার মাধ্যমে (অর্থাৎ প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে) তোমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেন। আর নিশ্চয় তিনিই তোমাদের জন্য কিয়ামাত দিবসে তোমাদের মতভেদের বিষয়ে (কে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত তা) স্পষ্ট করে দিবেন (তাই সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে দাবি করে অন্যায় উপায় অবলম্বন করা গ্রহণযোগ্য নয়)।
আল কুরআনে ব্যবহৃত রিবা শব্দের শব্দমূল হচ্ছে ‘র বা ওয়াও’। শব্দটি ক্রিয়ারূপ ১ মূলক্রিয়া ‘রবা’ থেকে গঠিত। ‘রবা’ শব্দের অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া।
আল কুরআনে ব্যবহৃত এ শব্দটির বিভিন্ন রূপ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১. রিবা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৮ স্থানে: ২:২৭৫:৩, ২:২৭৫:২০, ২:২৭৫:২৫, ২:২৭৬:৩, ২:২৭৮:১০, ৩:১৩০:৬, ৪:১৬১:২, ৩০:৩৯:৪।
রিবা শব্দের অর্থ সুদ, প্রদেয় ঋণের চেয়ে অধিক ফেরত নেয়া, অসম বিনিময়ের বর্ধিত অংশ, অন্যায্য শর্তের মাধ্যমে একচেটিয়া মুনাফা ইত্যাদি।
২. রবি/ রবিয়ান (ক্রিয়ারূপ ১ এর কর্তাবিশেষ্য)ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ১৩:১৭:১১।
রবি শব্দের অর্থ বেড়ে উঠা, উপরে উঠে আসা, উপরিস্থিত।
৩. রবিয়াতান (ক্রিয়ারূপ ১ এর কর্তাবিশেষ্য, স্ত্রীলিঙ্গ)ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৬৯:১০:৬।
রবিয়াতান শব্দের অর্থ অতি কড়া, অতি কঠোর (যা সাধারণ কঠোরতাকে ছাপিয়ে যায়)।
৪. আরবা (রবি এর কম্পারেটিভ ডিগ্রি)ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ১৬:৯২:১৮।
আরবা শব্দের অর্থ স্বার্থসিদ্ধিতে অধিকতর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত।
৫. রবাত (রবা এর স্ত্রীলিঙ্গ) (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ১) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ২২:৫:৬৪, ৪১:৩৯:১২।
রবাত শব্দের অর্থ স্ফীত হয়।
৬. ইয়ারবূ (রবা এর বর্তমানকাল, ক্রিয়ারূপ ১) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৩০:৩৯:৫, ৩০:৩৯:১০।
ইয়ারবূ শব্দের অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া।
৭. রব্বা (ক্রিয়ারূপ ২) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ১৭:২৪:১১, ২৬:১৮:৩।
রব্বা শব্দের অর্থ লালন পালন করা।
৮. ইউরবা (ক্রিয়ারূপ ৪, বর্তমান কাল) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ২:২৭৬:৪।
ইউরবা শব্দের অর্থ বৃদ্ধি করেন।
৯. রবওয়াতিন ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ২:২৬৫:১৩, ২৩:৫০:৮।
রবওয়াতিন শব্দের অর্থ উচ্চভূমি।
রিবা শব্দের শব্দমূলের (র বা ওয়াও) অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি, তা পরিমাণগত, মানগত বা তুলনামূলক বৃদ্ধি হতে পারে। কিন্তু ঐ শব্দমূল থেকে গঠিত ‘রিবা’ শব্দের অর্থ যে কোনো ধরনের সাধারণ বৃদ্ধি নয়, বরং রিবা শব্দের অর্থ হচ্ছে মূলধনের স্বয়ংক্রিয় বৃদ্ধি বা বর্ধিত অংশ অর্থাৎ যখন মূলধনের সাথে একটি বর্ধিত অংশের লেনদেন হয় যা মূলধনের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে হিসেবে ধরতে হয় (বস্তুত এরূপ বৃদ্ধি হয় না কিন্তু এক পক্ষ অন্য পক্ষ থেকে পরিশোধ বা বিনিময়ের চেয়ে এরূপ বাড়তি সুবিধা গ্রহণ করে), বিনিময়হীন বৃদ্ধি তথা যে বৃদ্ধির বিপরীতে কোনো বিনিময় নেই।
উপর্যুক্ত তালিকার ৪ নং এ বর্ণিত আয়াতে (১৬:৯২) স্বার্থসিদ্ধিতে অধিকতর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য (অধিক স্বার্থসিদ্ধি বৃদ্ধি করার জন্য) অন্যায্য উপায় অবলম্বন করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করে বাড়তি সুবিধা পাওয়াকে ‘আরবা’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে।
অনুরূপভাবে ন্যায়সঙ্গত না হওয়ার বা জুলুম হওয়ার কারণেই মূলধনের সাথে স্বয়ংক্রিয় বা বিনিময়হীন বৃদ্ধিকে হারাম করা হয়েছে এবং একে ‘রিবা’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। (২:২৭৯)।
রিবা সম্পর্কিত আয়াতসমূহ বিশেষ করে ৩০:৩৯, ২:২৭৫ এবং ২:২৭৮-২৭৯ আয়াত একসাথে অধ্যয়ন করলে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, রিবা ব্যবসায়ের একটি ধরন হিসেবে অনুশীলন করা হয়, যখন ‘ঋণ’ প্রদানকে ‘বিনিয়োগ’ সাব্যস্ত করে ‘বাড়তি’ পরিশোধের শর্তারোপ করা হয়; কিন্তু আল্লাহ এটিকে ব্যবসা হিসেবে স্বীকৃতি দেন নি। রিবা হচ্ছে এমন একটি আদান-প্রদান পদ্ধতি যেখানে ‘রুউছু আমওয়াল’ বা ‘মূলধন’ এবং সেই সাথে একটি বাড়তি অংশ ফেরত নেয়া হয়, আর ঐ বাড়তি অংশটাই ‘রিবা’। ‘রুউছু আমওয়াল’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘মালসমূহের মাথা বা প্রধান অংশ’ এবং প্রায়োগিক অর্থ হচ্ছে ‘সুদাসলের মধ্যে আসল’।
২:২৭৮-২৭৯ আয়াতে বলা হয়েছে যে, হিসাবের খাতায় থাকা রিবাযুক্ত আমওয়াল থেকে রিবা হিসেবে যা বাকি আছে তা ছেড়ে দিলে যা থাকবে সেই রুউছু আমওয়াল তোমাদেরই। অন্যকথায় সুদাসল থেকে সুদ ছেড়ে দিলে আসল তোমাদেরই।
তথ্যটিকে নিম্নরূপে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করা যায়:
রিবাযুক্ত আমওয়াল - রিবা = রুউছু আমওয়াল।
বা, সুদাসল - সুদ = আসল বা মূলধন।
সুতরাং ঋণ হিসেবে প্রদত্ত বা ব্যবসায়ে বিনিয়োগকৃত মূলধনের সাথে স্বয়ংক্রিয় বা বিনিময়হীন বৃদ্ধিকে বা বর্ধিত অংশকে রিবা বা সুদ বলে।
অনুরূপভাবে যে কোনোভাবে যদি কোনো কারবারে বিনিময়হীন প্রাপ্য নির্ধারণ করা হয় তবে তাও রিবা বলে প্রতীয়মান হয়। লেনদেনে জুলুম হলে তথা কোনো পক্ষ অন্য পক্ষের তুলনায় বাড়তি সুবিধা গ্রহণ করলে সেই বাড়তি সুবিধা গ্রহণই রিবা।
এমনকি ১৬:৯২ আয়াত অনুযায়ী, অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যে ‘রিবা’ ভক্ষণ করা হয়, তা ছাড়াও ‘রিবা’ আরো ব্যাপক অর্থ বহন করে। যেমন, প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করে বাড়তি সুবিধা পাওয়াও এক প্রকার রিবা।
রিবা সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে বুঝা যায় যে, রিবা প্রধানত ঋণের সাথে সম্পর্কিত। ঋণের ন্যায়সঙ্গত নীতিমালার ভিত্তিতে ঋনের লেনদেন না করে যখন অন্যায়ভাবে এক পক্ষ অন্য পক্ষ থেকে বাড়তি অংশ গ্রহণ করে তখন তা রিবাতে পরিণত হয়।
আবার যারা রিবা গ্রহণ করে তারা ব্যবসাকে রিবার মতো হিসেবে দাবি করে। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং রিবাকে হারাম করেছেন। সুতরাং যদি কোনো ব্যবসায়ে রিবার বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয় তখন তা আর ব্যবসা থাকে না, বরং তা রিবাতে পরিণত হয়।
তাই রিবার পদ্ধতিসমূহ ঋণ ও ব্যবসায়ের সাথে সম্পর্কিত। ঋণ (দাইন) ও ব্যবসা (বাই’ ও তাবাইয়া’) এর বিধি-বিধান অনুযায়ী বাস্তব লেনদেনের বিভিন্ন অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় যে, রিবার বিভিন্ন পদ্ধতি হতে পারে, যেমন:
[ক] ঋণের সাথে সম্পর্কিত রিবা
১. কোনো সাধারণ চাহিদা/প্রয়োজন পূরণের জন্য বা ব্যবসায়ের জন্য যে কারণেই ঋণ নেয়া হোক উভয় অবস্থায় যা ঋণ নেয়া হয়েছে তা বা তার সমমূল্য ফেরত দিতে হবে। ঋণের ক্ষেত্রে যদি পূর্বশর্তের ভিত্তিতে বা বাধ্যতামূলকভাবে যা ঋণ দেয়া হয়েছে তা বা তার সমমূল্যের চেয়ে বেশি ফেরত নেয়া হয় তবে বাড়তি অংশটাই রিবা।
২. বিনিয়োগের ক্ষেত্রে লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্ব ছাড়া শুধু মূলধনের উপর ভিত্তি করে মূলধনের সাথে কোনো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মুনাফা গ্রহণ করলে ঐ মুনাফা হচ্ছে রিবা। ব্যবসা, কারিগরি, শিল্প বা কৃষিতে খাটাবার জন্য প্রদান করলেও যেহেতু এতে লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্ব গ্রহণ করা হয় না, তাই এটাকে প্রকৃত প্রস্তাবে ঋণদাতার বিনিয়োগ বলা যেতে পারে না, বরং এটা ‘ঋণ’ হিসেবেই সাব্যস্ত হবে।
২:২৭৮-২৮০ আয়াত অনুসারে ঋণের সাথে সম্পর্কিত রিবাকেই রিবার প্রধান রূপ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে, যার ফলে রিবা বাদ দিয়ে মূলধন (প্রদত্ত ঋণ) ফেরত পাওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে এবং মূলধন ফেরত নেয়ার ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার স্বচ্ছলতা পর্যন্ত অবকাশ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ঋণের ক্ষেত্রে লেনদেনের রিবামুক্ত ধরন হবে নিম্নরূপ:
১. যখন ঋণের ক্ষেত্রে ঋণের সমপরিমাণ বা সমমূল্য এর যা ফেরত দেয়া হবে বলে উভয় পক্ষের চুক্তি হয় তা ফেরত দেয়া হয় তখন এতে কোনো পক্ষের রিবা হয় না।
২. যখন লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্বের শর্তে মূলধন বিনিয়োগ করা হয় তখন অংশীদারিত্ব চুক্তি অনুসারে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত লাভ পেলে সেই মুনাফা রিবা নয়। আর যদি লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্বের শর্ত না থাকে, তাহলে ঋণগ্রহীতা ব্যবসায়ে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করলেও তা ঋণদাতার বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে না, তাই সে শুধুমাত্র প্রদত্ত ঋণ ফেরত পাবার অধিকার রাখবে। যদি এ অবস্থায় সে শুধু প্রদত্ত ঋণ ফেরত নেয়, তাহলেই লেনদেনটি রিবা থেকে মুক্ত থাকবে।
নিশ্চয় ঋণ হচ্ছে ঋণগ্রহীতার প্রতি ঋণদাতার একটি সহযোগিতা। কিন্তু আল্লাহর বিধানে এ সহযোগিতার কোনো বাধ্যতামূলক অর্থনৈতিক বিনিময় আরোপ করাকে বৈধ করা হয় নি। তাই ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে কৃতজ্ঞতাবোধ ও প্রশংসা পেতে পারে, এছাড়া আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কারের প্রত্যাশাও করতে পারে। কিন্তু ঋণের জন্য ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে কোনো অর্থনৈতিক বিনিময় গ্রহণ করতে পারে না।
ঋণের জন্য ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে কোনো অর্থনৈতিক বিনিময় গ্রহণ বৈধ না হওয়া অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক ও যুক্তিসঙ্গত। ঋণের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতা ঋণদাতার প্রতি ঋণ পরিশোধে দায়বদ্ধ হন, কিন্তু সেই সাথে তিনিই তার কাছে ঋণ থাকা অবস্থায় ঐ ঋণকৃত সম্পদের অধিগ্রহণকারী মালিকে পরিণত হন। অন্যদিকে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ঋণদাতার জন্য তা বিমূর্ত সম্পদে পরিণত হয়, যা সে কাজে লাগাতে পারে না। অন্যদিকে তখন ঋণগ্রহীতা এ সম্পদকে নিজের ভোগের জন্য বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঝুঁকি বহন করত: ব্যবহার করতে পারেন। এমতাবস্থায় যদি এ সম্পদকে বিনিয়োগ করে কোনো লাভ বা ক্ষতি হয় তাহলে তার প্রাপক বা ঝুঁকি বহনকারী ঋণ গ্রহণকারীই হয়ে থাকেন। অন্যদিকে ঋণদাতা শুধুমাত্র প্রদত্ত ঋণ সমমূল্যে ফেরত পাওয়ার দাবিদার হতে পারেন। কারণ তাঁর বিমূর্ত সম্পদকে (তাঁর প্রদত্ত ঋণকে) তিনি কোনো মূল্য সৃষ্টিতে কাজে লাগানো সম্ভব নয়, তাই এর কোনো ধনাত্মক বা ঋণাত্মক মূল্য তাঁর ভাগে যাবে না। অন্যদিকে যদি ঋণদাতা ঋণ না দিতো, তাহলে তা তার বিমূর্ত সম্পদ না হয়ে বাস্তব সম্পদ হিসেবে থাকতো এবং সেই অবস্থায় সে এটাকে নিজে কোনো কাজে লাগিয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত করতে পারতো অথবা তার বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতি বা বাজারমূল্য হ্রাসজনিত ক্ষতিও বহন করতে হতো। কিন্তু সে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে এটাকে নিজের বিমূর্ত সম্পদে এবং ঋণগ্রহীতার দায়বদ্ধতাসম্পন্ন বাস্তব সম্পদে পরিণত করায় ঋণগ্রহীতার কর্তৃক ভোগ বা ব্যবহারের মাধ্যমে এর যে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটবে তা ঋণগ্রহীতার উপর প্রযোজ্য হবে। কিন্তু ঋণগ্রহীতা ঋণদাতাকে গৃহীত ঋণ বা তার অনুরূপ জিনিস বা তার সমমূল্য ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। বস্তুত এটাই ন্যায়বিচার।
ব্যবসায়িক প্রয়োজনে মূলধন সরবরাহ করে লাভের অংশ পেতে চাইলে অবশ্যই লোকসানের ঝুঁকিও বহন করতে হবে। অন্যথায় ঐ মূলধন প্রদান ঋণ প্রদান হিসেবে সাব্যস্ত হবে এবং তাই মূলধনের সাথে কোনো সুদ আরোপ করা বৈধ হবে না।
রিবা ও বৈধ মুনাফার বাস্তবসম্মত পার্থক্যের ভিত্তিতে রিবাকে হারাম এবং ব্যবসায়ের মুনাফাকে হালাল করা হয়েছে। কিন্তু কাফিরদের দৃষ্টিতে রিবা এবং ব্যবসায়ের বৈধ মুনাফা একই ধরনের জিনিস। আল কুরআনে তাদের কর্তৃক অত্যন্ত বাস্তবসম্মত পার্থক্যকে অস্বীকার করার পেছনে প্রকৃত কারণ ও ফলাফল হিসেবে ‘শয়তানের সংস্পর্শে (অন্যায্য লাভের উদ্দেশ্যে) দিশেহারা হয়ে দাঁড়ানো’কে চিহ্নিত করা হয়েছে।
[খ] ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে উদ্ভুত রিবা
যেহেতু ঋণদাতা ঋণগ্রহীতা থেকে ঋণের চেয়ে বাড়তি কোনো অংশ গ্রহন করলে তা রিবা হিসেবে সাব্যস্ত হয়, তাই এ থেকে রিবার যে মূল বৈশিষ্ট্যটি পাওয়া যায় তা হলো, এর মাধ্যমে ‘অসম বিনিময়’ ঘটে। অর্থাৎ ঋণদাতা যা ঋণ দেয়, তার চেয়ে বেশি ফেরত নেয়। তাই ঋণের ক্ষেত্রে ছাড়াও যদি ব্যবসা বা ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অনুরূপভাবে কোনো ‘অসম বিনিময়’ ঘটে, তখন তা আর স্বচ্ছ ব্যবসা থাকে না, ‘ব্যবসা’ নামে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত থাকে না, বরং তা রিবাতে পরিণত হয়। এটিকে বলা যেতে পারে ‘রূপান্তরিত রিবা’। অর্থাৎ রিবা বলতে প্রধানত ঋণের সাথে সম্পর্কিত রিবাকে বুঝায়। কিন্তু ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ের স্বাভাবিক প্রকৃতি বিনষ্ট হয়ে এক পক্ষের জন্য রিবা বা অন্যায্য বাড়তি অংশের উদ্ভব ঘটলে, ব্যবসাটি রিবাতে রূপান্তরিত হয়। এই প্রেক্ষিতে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে রিবার পদ্ধতি হতে পারে:
১. সমজাতীয় কিন্তু ভিন্ন মানসম্পন্ন দ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয় বা বিনিময়ের ক্ষেত্রে অসম পরিমাণ বা পরিমাপে আদান-প্রদানের মাধ্যমে প্রাপ্ত মুনাফা বা লাভ হচ্ছে রিবা। অর্থাৎ যখন কোনো সমজাতীয় কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন মানসম্পন্ন দ্রব্যের মূল্যমানের সমতা বিধানের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড ব্যবহৃত হয় না তখন রিবার উদ্ভব ঘটে।
২. একটি শর্তকে অন্য একটি শর্তের উপর নির্ভরশীল করে এক পক্ষের নিশ্চিত লাভ এবং অন্য পক্ষের অনিশ্চিত লাভের ক্রয়-বিক্রয় হলে তাতে ব্যবসায়ের প্রকৃতি বজায় থাকে না, বরং তাতে রিবার উদ্ভব ঘটে। অনুরূপভাবে এমন কোনো শর্তযুক্ত ক্রয়-বিক্রয় যে শর্তের কারণে বাহ্যত ক্রয়-বিক্রয় সংঘটিত হলেও বস্তুত তাতে বিনিময়হীন বাড়তি সুবিধা গ্রহণ করা হয়, সেটাও রিবা। অনুরূপভাবে যে অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয়ে পণ্য হস্তগত হওয়ার সম্ভাবনা ও পণ্যের মানগত অনিশ্চয়তা ও অনির্দিষ্টতার কারণে কোনো পক্ষ বাড়তি সুবিধা পাওয়া অবশ্যম্ভাবী, এরূপ অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয়ও রিবার অন্তর্ভুক্ত।
উপরোল্লেখিত ক্ষেত্রগুলোতে বৈধ মুনাফার বা লেনদেনের রিবামুক্ত ধরন নিম্নরূপ হতে পারে:
১. যখন অসমজাতীয় জিনিসের ক্রয়-বিক্রয় একচেটিয়া কারবারের অপব্যবহারের প্রভাবমুক্তভাবে পারস্পরিক সমঝোতাক্রমে সম্পন্ন হয় তখন এর মাধ্যমে প্রাপ্ত মুনাফা রিবা নয়।
২. রিবার উদ্ভব ঘটাতে পারে এরূপ কোনো শর্ত আরোপ না করে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত লাভ গ্রহণ করা, যার ফলে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে লাভের বা পারস্পরিক সুবিধার সমতা বজায় রাখা সম্ভব হয়, এরূপ লাভ রিবা নয়।
ব্যাপক অর্থে বা অপকৌশলের মাধ্যমে বাড়তি সুবিধা গ্রহণমূলক রিবা
রিবার আয়াতসমূহে দেখা যায় যে, সাধারণভাবে ‘রিবা’ বলতে ‘প্রদত্ত ঋণের চেয়ে অতিরিক্ত ফেরত নেয়া বা অসম বিনিময়’-কে বুঝানো হয়েছে এবং সেই প্রেক্ষিতে সেই ‘বাড়তি অংশ’ ছেড়ে দিলে ‘রুউছু আমওয়াল’ তথা মূলধন অথবা সমমূল্যের দ্রব্য বা মুদ্রা ফেরত পাওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। আবার ব্যাপক অর্থে প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করে বা কোনোরূপ অপকৌশলের মাধ্যমে ‘বাড়তি সুবিধা’ গ্রহণকেও ‘রিবা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্যাপক অর্থে বা অপকৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে রিবা ভক্ষণের উদাহরণ হিসেবে নিম্নরূপ অবস্থাগুলোকে বিবেচনা করা যেতে পারে:
১. কৃত্রিম মুদ্রার (অর্থাৎ যে মুদ্রার নিজস্ব মূল্যমান নেই শুধুমাত্র বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে সরকার স্বীকৃত মূল্যমান রাখে যেমন কাগুজে মুদ্রার) লেনদেনভিত্তিক রিজার্ভের চেয়ে অতিরিক্ত ঋণ প্রদান সুবিধা দেয়ার জন্য মুদ্রাস্ফীতি ঘটানোর মাধ্যমে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার বাইরে তৃতীয় পক্ষে থাকা মুদ্রাস্ফীতির প্রাক্কালে দ্রব্যসামগ্রী বিক্রেতাদেরকে পুনরায় সমমূল্যে সমপরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়ের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। এভাবে মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বা কৃত্রিম বিনিময় মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে যারা দ্রব্য ক্রয় করত: দ্রব্যমূল্যের হ্রাসবৃদ্ধির দ্বারা বাড়তি সুবিধা হাতিয়ে নেয় তাদের এ কাজটিও রিবার অন্তর্ভুক্ত।
২. সরকারের আয় (কর ও বৈদেশিক ঋণ) এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে রিবা: নাগরিকদের উপর কর আরোপের ক্ষেত্রে যদি করভার (Burden of Tax) ন্যায্যভাবে বণ্টিত না হয় বা কর প্রদানজনিত পরিব্যয় (Cost of Paying Tax) সুষম না হয়, তাহলে বণ্টনজনিত সুবিচার (Distributive Justice) লংঘিত হয় বা রিবার উদ্ভব ঘটে। অনুরূপভাবে যদি করের মাধ্যমে প্রান্তিক সামাজিক ব্যয় (Marginal Social Cost) ও প্রান্তিক সামাজিক সুফল (Marginal Social Benefit) সমান না হয়, তাহলেও রিবার উদ্ভব ঘটে। অর্থাৎ যদি এক একক অতিরিক্ত কর প্রদানের ফলস্বরূপ সমাজের এক একক অতিরিক্ত সাধারণ সুবিধা অর্জিত না হয় তাহলে তাতে রিবার উদ্ভব ঘটে। অর্থনীতিবিদগণ বিশেষ নিয়মে কর ও সুবিধার সমতা নির্ণয় করে থাকেন। প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত ও অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়ের মাধ্যমে এক্ষেত্রে অসমতার সৃষ্টি হয়।
নিম্নরূপ উপায় বা ব্যবস্থা অবলম্বন করার মাধ্যমে উপরোল্লেখিত ধরনের রিবা থেকে মুক্ত থাকা যেতে পারে:
১. ধাতব মুদ্রা যেমন: স্বর্ণমুদ্রা (দিনার) ও রৌপ্যমুদ্রা (দিরহাম) ব্যবহার করলে বাস্তব সঞ্চয়ের চেয়ে অধিক ঋণদান সম্ভব নয় বিধায় এরূপ মুদ্রার মাধ্যমে সঞ্চয়ের চেয়ে অতিরিক্ত ঋণদান পদ্ধতিতে রিবার উদ্ভব ঘটে না।
২. সরকারি আয়-ব্যয়ে রিবামুক্ত লেনদেনের জন্য করদাতাদের প্রকৃত উপকারে আসে না এমন অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়ের জন্য করারোপ করা যাবে না এবং এরূপ অপব্যয় ও অপচয় করা যাবে না। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানির উপর আরোপিত শুল্কের চেয়ে বিলাস দ্রব্যের উপর করের হার অধিক হতে হবে। বেসরকারি খাতে প্রাপ্ত নয় এমন দ্রব্য উৎপাদন ও সেবা সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যে, যেন কোনো খাতে অন্যায্য ব্যয়ের কারণে অন্যান্য আর্থিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অঞ্চলভিত্তিক সুষম উন্নয়নের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় প্রকল্পের জন্য ছাড়া সরকারি ঋণ বৃদ্ধি করা যাবে না। সর্বোপরি এমন সুষম উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে করে কোনো উৎপাদন উপকরণের প্রতি অন্যায্য অবস্থার সৃষ্টি না হয়।
৩:১৩০ আয়াতে রিবার অবস্থামূলক বিশেষণ তথা প্রকৃতি বিশ্লেষণ হিসেবে বলা হয়েছে ‘আদআফাম মুদাআফাতান’। অর্থাৎ রিবার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তা হতে থাকে আদআফান (বহুগুণ, অর্থাৎ এক পর্যায়ে তা আসলের চেয়েও বহুগুণ হয়ে যায়) এবং মুদাআফাতান (গুণিতককৃত তথা উহা গুণিতক হারে বাড়তে থাকে, ক্রমবর্ধমান)। অন্য কথায়, পরিশোধের সময়সীমার উপর ভিত্তি করে এক পর্যায়ে রিবা আসলের বহুগুণ হয়ে যায় এবং রিবার পরিমাণ গুণিতক বা ক্রমবর্ধমান হতে থাকে। এটা রিবার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এর মাধ্যমে আসলে বাস্তব লাভ ক্ষতি যাই হোক না কেন সময়ের সাথে রিবা শুধু গুণিতক হতে থাকা বা ক্রমবর্ধমান হওয়ার বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন ১ বছরে ১ টাকা সুদ হলে ২ বছরে সুদের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ টাকা এবং ৩ বছরে সুদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ টাকা।
এছাড়া রিবার বৈশিষ্ট্য বা অবস্থা নির্দেশক হিসেবে ‘আদআফাম মুদাআফাতান’ শব্দের মাধ্যমে রিবা পদ্ধতিতে আসলের নিশ্চিত বৃদ্ধি, বিনা পরিশ্রমে ও বিনা ঝুঁকিতে তা ক্রমবর্ধমান হওয়ার বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যেই রিবা ও বাইয়ুনের (ব্যবসার) পার্থক্য নিহিত রয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে রিবাকে হারাম করা হয়েছে এবং বাইয়ুন বা ব্যবসাকে হালাল করা হয়েছে।
রিবার প্রকৃতি সম্পর্কিত বক্তব্যের একটি শিক্ষা হচ্ছে, সময়ের ব্যবধানের জন্য (বাকিতে) যদি অতিরিক্ত মূল্যে কোনো বিক্রয় সম্পন্ন হয় তবে তাও একটি নির্দিষ্ট সময়সীমাকে নির্দিষ্ট করে নিয়ে হতে হবে, এমন চুক্তি হতে পারবে না যে, সময় যত বাড়তে থাকবে তার সাথে মূল্যও বাড়তে থাকবে। অন্য কথায়, একই চুক্তিতে একাধিক সময়সীমার বিকল্প থাকবে না, বরং বিকল্পসমূহের মধ্য থেকে একটিকে নির্দিষ্ট করতে হবে, যেন বর্ধিত মূল্য সময় ব্যবধানে ক্রমবর্ধমান হতে থাকার ঘটনা ঘটতে না পারে, নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে মূল্য পরিশোধ করতে সক্ষম না হলেও আর মূল্য বৃদ্ধি পাবে না। অন্যথায় তা ‘রিবা’ হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
আবার রিবা সময়ের ব্যবধানে “দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাওয়া”-কে ‘আসল’ এর সাপেক্ষে বিবেচনা করলে এর তাৎপর্য হবে তা ‘আসলের দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাওয়া’। আর এটাকে রিবার একটি নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই বাকিতে বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও সময় ব্যবধান বা মূল্য পরিশোধের কিস্তি সংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন, কোনোক্রমেই উৎপাদন ব্যয় বা ক্রয়মূল্যের দ্বিগুনের চেয়ে বেশি মূল্য গ্রহণ করা গ্রহণযোগ্য নয়। এরূপ অতিরিক্ত মূল্য গ্রহণ করলে সেই অতিরিক্ত অংশ জুলুম ও রিবা হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
৩:১৩০ আয়াতে ব্যবহৃত ‘আদআফাম মুদাআফাতান’ শব্দের উপর ভিত্তি করে কেউ কেউ সরল সুদ, চক্রবৃদ্ধি সুদ, সাধারণ প্রয়োজনে দেয়া ঋণে সুদ, ব্যবসায়ে বিনিয়োগকৃত পুঁজির সুদ, Interest এবং Usury ইত্যাদি পার্থক্য করতে চেয়েছেন। কিন্তু আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন, ব্যাকরণগত শব্দ বিন্যাসের মাধ্যমে বাক্যের গঠন এবং পূর্বাপর বক্তব্যের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ঋণবাবদ দেয়া মূলধনের মূল্যমানের সমতাকে অতিক্রম করে এরূপ সর্বপ্রকার সুদই রিবা। চুরির পরিমাণ কম হোক বা বেশি হোক উভয় অবস্থায় তা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি সুদের পরিমাণ কম হোক বা বেশি হোক উভয় অবস্থায় তা নিষিদ্ধ। সুদের নিষিদ্ধতার ভিত্তি সুদের পরিমাণগত আধিক্য নয় বরং মৌলিক নীতিগত ন্যায্যতা ও মানবিকতার নৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। অবশ্য সুদের পরিমাণগত আধিক্য জুলুমের মাত্রাকে বৃদ্ধি করে কিন্তু অল্প পরিমাণ সুদও জুলুম হিসেবেই সাব্যস্ত হবে।
অনেকেই ‘আদআফাম মুদআফাতান’ এর অনুবাদ করেন ‘চক্রবৃদ্ধি হারে’। ক্রমবর্ধমান বা চক্রবৃদ্ধি শব্দটির যে সাধারণ অর্থ তাতে বুঝায়, ১ বছরে ১০০ টাকায় ১০ টাকা সুদ হলে ২ বছরে তা হবে ২০ টাকা এবং এভাবে বার্ষিক চক্রে সুদের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। কিন্তু অর্থনীতির পরিভাষায় এটিকে চক্রবৃদ্ধি সুদ বলে না, বরং সরল সুদ বলে। অর্থনীতিতে চক্রবৃদ্ধি কথাটি একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। তা হলো ১ বছরে ১০০ টাকায় ১০ টাকা সুদ হলে, অনাদায়ে দ্বিতীয় বর্ষে সুদ ও আসল মিলে ১১০ টাকাই আসল হিসেবে গণ্য হবে এবং সেই ১১০ টাকার উপর দ্বিতীয় বর্ষে আবার ১০% সুদ দিতে হবে। অর্থনীতিতে বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হওয়া চক্রবৃদ্ধি সুদ অবশ্যই সুদের সবচেয়ে মারাত্মক ধরন।
কিন্তু চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেতে থাকার বৈশিষ্ট্য থাকা সুদকে হারাম করার তাৎপর্য হিসেবে অর্থনৈতিক পরিভাষার এই বিশেষ অর্থের সুদকেই শুধু হারাম গণ্য করা এবং সরল সুদকে হালাল গণ্য করার অবকাশ নেই। কারণ যেমন এ কথা বলা যায় না যে, “শুধু অধিক মাত্রায় জুলুম করা হারাম কিন্তু কম মাত্রায় জুলুম করা হারাম নয়” তেমনি সরল সুদকেও গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। যেহেতু সরল সুদেও জুলুম বিদ্যমান রয়েছে আর সরল সুদও অর্থনৈতিক পরিভাষার বিশেষ অর্থে চক্রবৃদ্ধি সুদ না হলেও সাধারণ অর্থে তাতেও সময় ব্যবধান বৃদ্ধির সাথে সুদের চক্রবৃদ্ধি হয়। তাই সুদের প্রকৃতি হিসেবে চক্রবৃদ্ধি হওয়ার বিষয়টি সুদের অন্যায্যতা তুলে ধরার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, অর্থনীতির বিশেষ পরিভাষায় ব্যবহৃত সরল সুদ ও চক্রবৃদ্ধি সুদের পার্থক্যকরণের মাধ্যমে সরল সুদকে বৈধ করার জন্য নয়। এছাড়া চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বিষয় হিসেবে সুদ খেতে নিষেধ করা হয়েছে, কিন্তু সরল সুদ খেতে পারবে এরূপ কোনো প্রত্যক্ষ অনুমতি দেয়া হয়নি।
২:২৭৫ আয়াতে ‘আল বাই’” (ব্যবসা) এর বিপরীতে ‘আর রিবা’ (সুদ) হারাম করা হয়েছে। তাতে ‘আর রিবা’ শব্দের মাধ্যমে যাকেই রিবা বলা হয় তাকেই হারাম করা হয়েছে, তাকে একাধিক প্রকারে বিভক্ত করে কোনো এক প্রকারকে হারাম করা হয় নি। ২:২৭৮-২৭৯ আয়াতে ‘রুউছু আমওয়াল’ বা ‘মূলধন’ ছাড়া মূলধনের সাথে বাড়তি সংযোজনকেই ‘রিবা’ হিসেবে চিহ্নিত করে তা-ই ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, ছেড়ে না দিলে তার বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে ‘যুদ্ধের ঘোষণা’ জেনে নিতে বলা হয়েছে। সুতরাং ৩:১৩০ আয়াতে বর্ণিত রিবার বৈশিষ্ট্য ২:২৭৮-২৭৯ আয়াতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অর্থেই গ্রহণযোগ্য। অন্য কথায়, রিবা সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন অনুসারে বলা যায় যে, সর্বপ্রকার সুদই রিবা এবং বিশ্বপ্রভুর বিধানে রিবা তথা অসম বিনিময় ব্যবস্থাকে হারাম করা হয়েছে।
কুরআন নাযিলের প্রাক্কালের প্রচলিত রিবাকে ‘রিবা জাহিলিয়্যাহ’ বলা হয়ে থাকে। ইতিহাসসূত্রে সেই সময়ের প্রচলিত রিবা বা ‘রিবা জাহিলিয়্যাহ’ সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় তা এরূপ: তখন কাউকে ঋণ দেয়ার পর বা কোনো পণ্য বিক্রির পর পরিশোধের নির্দিষ্ট সময়ে তা পরিশোধ করতে না পারলে ঐ মূলধনের সাথে বা পণ্যমূল্যের সাথে কিছু বাড়তি অংশ যোগ করার শর্তে আরো সময় দেয়া হতো, তারপর আবারো সময়মতো পুরোপুরি পরিশোধ করতে না পারলে আরো সময় বৃদ্ধি করা হতো এবং আবারো আরো কিছু বাড়িয়ে পরিশোধ করার শর্ত আরোপ করা হতো। এভাবে সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে ‘বাড়তি’ অংশের পরিমাণও বৃদ্ধি করা হতো।
আধুনিককালে ঋণ প্রদানের সময়ই অগ্রিম চুক্তি করা হয় যে, বার্ষিক এত পার্সেন্ট সুদসহ মূলধন ফেরত দিতে হবে অথবা কোনো পণ্যের মূল্য এত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করলে ০% সুদ, অন্যথায় পণ্যমূল্যের সাথে এত পার্সেন্ট সুদ প্রদান করতে হবে। এভাবে মূলধন বা পণ্যের মূল দামের সাথে সুদ যোগ করাকে ‘অর্থের সময়মূল্য’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।
তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ‘রিবা’ এর যে ধরন কুরআন নাযিলে প্রাক্কালে প্রচলিত ছিল এবং যে ধরন আধুনিক কালে চর্চা করা হয়, উভয়টিতেই ‘রিবার’ বিষয়টি সময় ব্যবধানের কারণে মূলধন বা পণ্যমূল্যের সাথে ‘বাড়তি’ অংশ যোগ করতে থাকার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। বস্তুত উভয় ক্ষেত্রে ‘রিবা’-কে ‘অর্থের সময়মূল্য’ হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং সময় ব্যবধান যত বাড়তে থাকে, রিবার পরিমাণ তত বাড়তে থাকে। শুধু তৎকালীন সময় ‘রিবা’ আরোপ করা হতো, নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হওয়ার পরে, আর আধুনিক কালে অগ্রিম ‘রিবার’ পার্সেন্টেজ চুক্তির মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সুতরাং বস্তুত তৎকালীন ও আধুনিক কালের ‘রিবা’ ব্যবস্থার মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই, শুধু ‘রিবা’ আরোপের বিষয়টি অগ্রিম সংঘটিত হবে নাকি নির্দিষ্ট সময়সীমার পরে সংঘটিত হবে, সেই প্রক্রিয়াগত পার্থক্য রয়েছে। এছাড়া তৎকালে নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে ঋণ পরিশোধ করতে পারলে যেমন রিবা প্রযোজ্য হতো না বা বলা যায় ০% রিবা হতো, তেমনি বর্তমানেও কখনো কখনো একটি প্রাথমিক নির্দিষ্ট সময়কে রিবামুক্ত বা ০% রিবা হিসেবে ঋণ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে একটি প্রাথমিক নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ০% রিবার কথা বলা হলেও ঐ মেয়াদের পরবর্তীতে রিবা প্রযোজ্য হয় বিধায়, এরূপ চুক্তি গ্রহণ করাও নীতিগতভাবে রিবাকে গ্রহণ করা হিসেবে সাব্যস্ত হয়।
‘রিবা জাহিলিয়্যাহ’ তথা নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে রিবা ধার্যকরণ এবং বর্তমান কালের রিবা যা ঋণ গ্রহণের সময়ই ধার্য করা হয়, এ দুয়ের মধ্যে যদি তুলনামূলক অন্যায্যতা পর্যালোচনা করতে হয়, তাহলে বর্তমান কালের রিবা ধার্যকরণ পদ্ধতিকেই অধিক অন্যায্য বলতে হয়। কারণ সেই সময়ের রিবার ক্ষেত্রে তো অন্তত এতটুকু বিষয় ছিল যে, নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করলে ঋণগ্রহীতা রিবা বহন করতে হতো না, কিন্তু আধুনিক কালের রিবার ক্ষেত্রে শুরুতেই ঋণের উপর একটি সুদ আরোপ করা হয় এবং প্রথম দিন থেকেই ঐ সুদ তার নির্ধারিত হার অনুসারে হিসাবের আওতায় আসে এবং মেয়াদান্তে সুদাসল পরিশোধ করতে না পারলে যত দিন বিলম্ব হয় তত দিনের সুদ যোগ হতে থাকে।
আল কুরআনে দাইনের (ঋণের ও ধারে ক্রয়-বিক্রয়ের) ক্ষেত্রে সময়সীমা নির্দিষ্ট করে নেয়ার বিধান দেয়া হয়েছে। এখন কেউ যদি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে দাইন (দেনা) পরিশোধ না করতে পারে তাহলে তা তার বাস্তব অসুবিধার কারণে হলে সেক্ষেত্রে করণীয় কি তা ২:২৮০ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তাকে স্বচ্ছলতা পর্যন্ত অবকাশ দেয়া বিধেয়। এমনকি, প্রদত্ত মূলধন বা তার কোনো অংশ ছেড়ে দেওয়াকে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির প্রতি সদাক্বাহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রশ্ন হতে পারে যে, যদি ঋণগ্রহীতার অবহেলাজনিত কারণে বিলম্ব ঘটে তাহলে জরিমানা ধার্য করা যেতে পারে কিনা? এরূপ ক্ষেত্রে স্বভাবতই বিবাদ-বিসম্বাদের সৃষ্টি হয় এবং সেটার মীমাংসার প্রয়োজন হয়। আর জরিমানাও মীমাংসার একটি দিক। কিন্তু এরূপ জরিমানা নির্ধারিত হতে পারবে বাস্তব সমস্যা ঘটার পরে, কিন্তু পূর্বনির্ধারিতভাবে কোনো একাধিক বিলম্বিত সময়সীমার জন্য একাধিক বিলম্বিত জরিমানা আরোপ করা যাবে না। যদি পূর্বেই বিলম্ব ফী নির্ধারণ করা হয় তবে তা রিবার অন্তর্ভুক্ত হবে। কোনো পণ্য ধারে বিক্রয় বা কোনো সেবার বিনিময়মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য।
এ কথা তো একান্তই স্বত:সিদ্ধ যে, ব্যবসা (বাইয়ুন) করা হয় লাভের জন্যই। কিন্তু ব্যবসায়ে যেমন লাভের সম্ভাবনা রয়েছে তেমনি রয়েছে লোকসানের ঝুঁকি। তাই একজন ব্যবসা উদ্যোক্তা এমনভাবে ব্যবসায়ের উদ্যোগ নেয় যেন লোকসানের ঝুঁকির চেয়ে লাভের সম্ভাবনা অধিক থাকে। তা সত্ত্বেও লোকসানের ঝুঁকি ব্যবসায়ের একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়। অন্যদিকে কোনো ব্যবসায়ে সুদভিত্তিক পুঁজি বিনিয়োগের মূল কথাই হলো ব্যবসায়ে লাভ হোক বা লোকসান হোক উভয় অবস্থায় যে পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়েছে তা সুদসহ ফেরত দিতে হবে। নিতান্ত দুর্ঘটনাক্রমে কখনো এটা হতে পারে যে, একজন ব্যবসায়ী দেওলিয়া বা উধাও হয়ে যাওয়ায় পুঁজিপতি তার সুদ এবং এমনকি আসলও পূর্ণরূপে আদায় করতে পারেনি। কখনো কখনো এ বিষয়টিকে সুদী ব্যবসার ঝুঁকি হিসেবে উল্লেখ করে এবং ব্যবসা ও রিবা উভয়টির ক্ষেত্রেই লাভের উদ্দেশ্য থাকার বিষয়টি সামনে এনে ‘সুদে পুঁজি খাটানোও এক ধরনের ব্যবসা’ বলে দাবি করা হয়। সেই সাথে প্রশ্ন করা হয় যে, “ব্যবসা বা ক্রয়-বিক্রয়ের মুনাফা এবং রিবার পার্থক্য কী ও কেন?”
এ বিষয়টি অনস্বীকার্য যে, সুদাসলের মধ্য থেকে আসল ফেরত না দেয়াও জুলুম। তাই ২:২৭৯ আয়াতে বলা হয়েছে যে, (যেহেতু আয়াত নাজিলের আগে গৃহীত সুদ প্রসঙ্গে কড়াকড়ি আরোপ করা হয় নি সেই প্রেক্ষিতে) বাকি থাকা সুদ ছেড়ে দিলে আসল তোমাদেরই। না তোমরা জুলুম করবে আর না তোমরা জুলুমের শিকার হবে।
তারপর “ব্যবসা বা ক্রয়-বিক্রয়ের মুনাফা ও সুদের পার্থক্য কী ও কেন?” প্রশ্নটির বাস্তবভিত্তিক জবাব নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
প্রথমত: ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে লোকসানের ঝুঁকি যেমন প্রাকৃতিক কার্যকারণের সাথে সম্পর্কিত, তেমনি বাস্তব বাজারে চাহিদা-যোগানের কর্মতৎপরতার সাথেও সম্পর্কিত। উভয় অবস্থায় ব্যবসায় তার প্রকৃত সম্পদের মূল্য হারানোর ঝুঁকি বহন করেন।
অন্যদিকে ব্যবসায়ের লাভ-ক্ষতিতে অংশগ্রহণ না করে ঋণ প্রদান করলে সেই ঋণ খেলাপী হওয়ার ঝুঁকি মোকাবেলায় বিভিন্ন ধরনের নিশ্চয়তা বা জামানাত দ্বারা সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা স্বাভাবিক। এরপরও ঋণ খেলাপী হওয়ার ঘটনা ঘটলে তা একটি দুর্ঘটনা, যার ফলে ঋণদাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এ ক্ষতি একজন ব্যবসায়ীর ক্ষতির অনুরূপ হিসেবে তুলনীয় নয়, কারণ একজন ব্যবসায়ী এরূপ কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলে তিনি শুধু তাঁর বিনিয়োগকৃত মূলধনই হারান না, বরং সেই সাথে তাঁর বিনিয়োগকৃত সময় ও শ্রমের মূল্যও হারান।
একজন সুদ প্রদানের শর্তে ঋণদাতা বা ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ে লাভ-ক্ষতির ঝুঁকি বহন করা ছাড়াই তার মূলধনকে অতিরিক্তসহ ফেরত নেয়ার মানেই হলো সে কোনো ঝুঁকি শেয়ার না করা।
তাই ঋণগ্রহীতা বা সে যার ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগ করেছে সে দেওলিয়া হয়ে যাওয়ার (বা পালিয়ে যাওয়ার) ভিত্তিতে ঋণদাতা আসলও ফেরত নিতে না পারার দুর্ঘটনাকে কোনোক্রমেই ক্রয়-বিক্রয়ের স্বাভাবিক ঝুঁকির সদৃশ সাব্যস্ত করা যেতে পারে না। তাই এ ধরনের লোকসানকে পুষিয়ে নেয়ার জন্য ঋণগ্রহীতার থেকে বা যার ব্যবসায়ে ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির শেয়ারিং ছাড়া পুঁজি বিনিয়োগ করা হলো, তার থেকে সুদ দাবি করাকে কোনোক্রমেই ন্যায়সঙ্গত বলা যেতে পারে না।
কেউ তার মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দিতে বাধ্য হলেও যেমন সে তার ছেলের বিয়েতে কনে পক্ষের কাছ থেকে যৌতুক দাবি করা ন্যায়সঙ্গত বিবেচিত হতে পারে না, অনুরূপভাবে কোনো পুঁজিপতি একটি ব্যবসা থেকে সুদাসল উদ্ধার করতে না পারার কারণে অন্য ব্যবসায়ীদের থেকে আসলের পাশাপাশি সুদ দাবি করাও ন্যায়সঙ্গত বিবেচিত হতে পারে না। এছাড়া কোনো কোনো ব্যবসায়ী দেওলিয়া হয়ে গেলে পুঁজিপতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ভেবে সকল ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পুঁজিকে সুদসহ ফেরত দেওয়ার পদ্ধতি (রিবা) গ্রহণ করাকে কোনোভাবেই ন্যায্য বলা যেতে পারে না।
দ্বিতীয়ত: ক্রয়-বিক্রয়ে লাভ ব্যক্তির পণ্য সরবরাহ সেবা বা শ্রম ও সময়ের মূল্য (অর্থাৎ ঐ সময়টিতে নিজেকে ব্যবসায় কাজে নিয়োজিত রাখার মাধ্যমে সময় বিনিয়োগের মূল্য) হিসেবে সাব্যস্ত হয়। কিন্তু সুদ গ্রহণ করা হয় শুধুমাত্র পুঁজি সরবরাহের জন্য। অথচ শুধু পুঁজি লাভ সৃষ্টি করে না। বরং পুঁজিকে অন্য কিছুতে রূপান্তরিত করতে হয় এবং তার সাথে শ্রম ও সময় যুক্ত হয়, এভাবেই লাভের সৃষ্টি হয়। আবার তাতে লোকসানেরও ঝুঁকি থাকে। সুতরাং শুধু পুঁজি দিয়ে লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্বের পরিবর্তে শুধু লাভ দাবি করা ন্যায়সঙ্গত নয়।
তৃতীয়ত: ক্রয়-বিক্রয়ে যে লাভ হয় তা হয় কোনো পণ্যের সাথে ভিন্নজাতীয় পণ্যের বিনিময়ের মাধ্যমে অথবা কোনো পণ্যের বা সেবার বিনিময়ে মুদ্রা উপার্জনের মাধ্যমে। এতে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সমান মুনাফার বিনিময় হয়, যে মুনাফার সমতা সাধারণত তাদের মধ্যে পারস্পরিক ধোঁকাবাজিমুক্ত ও একচেটিয়া কারবারের অপপ্রভাবমুক্ত চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে স্বত:স্ফূর্তভাবে গড়ে উঠে। অথবা ক্রেতা বা বিক্রেতার একচেটিয়া আধিপত্য ও মূল্যের অস্বাভাবিক হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে আপাত নির্ধারিত মূল্যে বিনিময় সংঘটিত হতে পারে। কিন্তু কোনোক্রমেই লেনেদেনের কোনো অংশ বিনিময়হীন আদান-প্রদান হিসেবে সংঘটিত হতে পারবে না। যদি এরূপ শর্ত লংঘিত হয় তাহলে তাতে ব্যবসায়িক স্বচ্ছতা থাকবে না, বরং তাতে রিবা সৃষ্টি হবে, তাই এরূপ লেনদেনকে ব্যবসা (বাইয়ুন) বলা যাবে না। কারণ যেখানে কোনো না কোনোভাবে (এক পক্ষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কৃত শর্তের মাধ্যমে বা ধোঁকার মাধ্যমে বা একচেটিয়া কারবারের অপপ্রভাবের মাধ্যমে) বিনিময়ের নামে বা কোনো বিনিময়ের সাথে বিনিময়হীন আদান-প্রদানও ঘটে, সেটাই রিবা ।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি এমন হয় যে, ক এর বই ও কলম প্রয়োজন এবং খ এর ব্যাগ প্রয়োজন, তাই উভয়ে তাদের চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে এভাবে বিনিময় করে নিলো, তাহলে এতে কোনো বিনিময়হীন আদান-প্রদান তথা রিবা নেই।
কিন্তু যদি এমন হয় যে, ক যে ধরনের ব্যাগ খ-কে দিলো এক সময় খ সেটার চেয়ে বেশি দামের ব্যাগ ক-কে ফেরত দিতে হবে বা একাধিক ব্যাগ ফেরত দিতে হবে বা সেরকম একটি ব্যাগের সাথে একটি কলম ফেরত দিতে হবে, এ শর্ত হলে এখানে বিনিময়ের মধ্যে (বাধ্যবাধকতা সহকারে) বিনিময়হীন আদান-প্রদান আছে তথা সুদ বা রিবা আছে।
সুতরাং ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে চাহিদা-যোগানের প্রেক্ষিতে ভিন্নজাতীয় পণ্যের মধ্যে মূল্যমানের সমতা তৈরির পরিবর্তে সমজাতীয় পণ্যের অসম বিনিময়মূলক আদান-প্রদান সংঘটিত হলে সেটা ব্যবসা (বাই’) হিসেবে সাব্যস্ত হবে না বরং রিবা হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
কোনো ব্যক্তি ১০০০ টাকা দামে কোনো ব্যাগ কিনে ১১০০ টাকায় বিক্রয় করলে বা নগদ ১০০০ টাকা দামের ব্যাগ বাকিতে ১১০০ টাকায় বিক্রয় করলে উভয় অবস্থায় ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা সংঘটিত হয়। এতে দ্রব্যের হস্তান্তর ঘটে, ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে পারস্পরিক সন্তুষ্টিপূর্ণ সম্মতি ও সমঝোতাক্রমে চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য স্থাপিত হয়, বাকিতে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে ঝুঁকি গ্রহণ করে যে, পরিশোধকালীন সময়ের মধ্যে দ্রব্যমূল্য আরো বাড়তে বা কমতে পারে এবং সেই সাথে তারা দ্রব্য ও অর্থের ব্যবহার ও আবর্তনের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে, কারণ এর মাধ্যমে ক্রেতা দ্রব্য ব্যবহারের অগ্রিম সুযোগ পায় এবং বিক্রেতা বা উৎপাদক কর্তৃক নতুন দ্রব্যের যোগান বা উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়, যাতে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া স্বাভাবিক থাকে, ক্রেতা যতটুুকু অতিরিক্ত মূল্য গ্রহণ করে তা একবারেই করে থাকে এবং তারপর বাস্তবসঙ্গত কারণে পরিশোধের সময়সীমা বেড়ে গেলেও আর বাড়তি মুল্য সংযোজনের সুযোগ থাকে না। অথচ যখন ১০০০ টাকা ১০% রিবার শর্তে বিনিয়োগ করা হয়, তখন ঋণ গ্রহণকারী ঐ টাকাকে ব্যবসায়ে কাজে লাগিয়ে তা দ্বারা লাভ বা লোকসান হতে পারে, অথচ লাভ হোক বা লোকসান হোক উভয় অবস্থায় মূলধন সরবরাহকারীকে মূলধনের পাশাপাশি রিবা প্রদান করতে হয় এবং সময় ব্যবধান যত বাড়তে থাকে এই রিবার পরিমাণও একই শর্তে বাড়তে থাকে। সুতরাং বাহ্যত ১০০০ টাকা ধার দিয়ে ১১০০ টাকা ফেরত নেয়াকে ১০০০ টাকার ব্যাগ বাকিতে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ১১০০ টাকায় বিক্রয়ের মতো মনে হলেও যথাযথভাবে লক্ষ্য করলে এ দুটি বিষয়ের পার্থক্য স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।
চতুর্থত : ব্যবসায়ে বিক্রেতা ক্রেতা থেকে একবারেই মুনাফা অর্জন করে অথবা বাকিতে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে একটি মেয়াদ নির্দিষ্ট করা হয় এবং বাকির কারণে বিক্রিত পণ্যের মূল্য তুলনামূলক বেশি ধরা হলেও একটি মূল্যই নির্দিষ্ট হয়, তারপর মূল্য পরিশোধে বিলম্ব হলেও পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কোনো সুযোগ থাকে না। অন্যদিকে রিবার ক্ষেত্রে প্রদত্ত মূলধন সময়ের ব্যবধানে বৃদ্ধি পায় তথা সুদসহ আসল ফেরত দিতে হয় এবং সুদাসল ফেরত দিতে যত দেরি হয় আসলের সাথে নির্ধারিত হারে তত বেশি সুদ যুক্ত হতে থাকে। আর চক্রবৃদ্ধি সুদের ক্ষেত্রে সুদাসলকে আসল ধরে আরো অতিরিক্ত সুদ যুক্ত হতে থাকে।
পঞ্চমত : ব্যবসায়ের অংশীদারদের মধ্যে লাভ ও ক্ষতির বণ্টন হয়। অন্যদিকে রিবার ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করলেও এর সম্পূর্ণ ঝুঁকি সে একাই বহন করে এবং ব্যবসায়ে লাভ হোক অথবা লোকসান হোক উভয় অবস্থায় ঋণদাতাকে তার মূলধন এবং সময়ের ব্যবধান অনুসারে মূলধনের উপর সুদ বা রিবা প্রদান করতে হয়। আর ঋণদাতা লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্ব ছাড়া তার প্রদত্ত মূলধন এবং সেই সাথে বাড়তি সুদ গ্রহণ করে।
রিবা হলো ঋণভিত্তিক অর্থায়ন তথা কাউকে ঋণ দিয়ে ঋণের বিপরীতে সুদসহ প্রত্যাবর্তন, তা সাধারণ প্রয়োজনে ঋণ দেয়া হোক অথবা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঋণ দেয়া হোক। আবার ব্যবসায়িক প্রয়োজনে দেয়া ঋণের ক্ষেত্রে ঋণগ্রহণকারী লাভবান হোক অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হোক উভয় অবস্থায় সে সুদসহ ফেরত ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সুদের হার নির্ধারণ করা হয় ঋণ বাজারের সম্ভাব্য উঠানামার উপর ভিত্তি করে বা সহনীয় মাত্রা হিসেবে ধরে নেয়া কোনো নির্ধারিত হারে। ঋণভিত্তিক অর্থায়ন (রিবা) বৈধ নয়, কারণ ঋণ ঋণদাতার হাতছাড়া হয়ে ঋণগ্রহীতার (প্রত্যাবর্তনের) দায়বদ্ধতাসম্পন্ন বাস্তব সম্পদে পরিণত হয়। অন্য কথায় ঋণ ঋণদাতার জন্য বিমূর্ত সম্পদে পরিণত হয়, যা সে ভোগ ও ব্যবহার করতে এবং তার মূল্যমান হ্রাস-বৃদ্ধি করতে সক্ষম নয়, যতক্ষণ না সে তা ফেরত পাবে।
ঋণভিত্তিক অর্থায়নের (রিবা) বিপরীতে ইসলামী অর্থায়ন হচ্ছে একটি বাস্তব সম্পদভিত্তিক (প্রকৃত পণ্য ও সেবা) অর্থায়ন। এরূপ অর্থায়নে নির্দিষ্ট মূল্যে বিলম্বিত মূল্য পরিশোধের ভিত্তিতে পণ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে নগদ পরিশোধের মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য নির্দিষ্ট করা হতে পারে। এ বিষয়টিকে রিবার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা রিবার সমতুল্য হিসেবে দাবি করেন। এর সপক্ষে এমন কিছু যুক্তি রয়েছে যার ফলে এটিকে ঋণভিত্তিক অর্থায়ন বা রিবার মতো বলে ধারণাগত বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। অথচ এরূপ ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও রিবা দুটি ভিন্ন ধরনের বিষয়, যার ফলে এরূপ ব্যবসায়ের সাথে মিলসম্পন্ন দাবি করে রিবাকে বৈধতা দেয়ার অবকাশ নেই (এবং অনুরূপভাবে এরূপ ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে অবৈধ দাবি করার অবকাশ নেই)।
বিলম্বিত বা অঙ্গীকারকৃত পরিশোধের জন্য কোনো সম্পদ বিক্রয় বা সেবা প্রদান তথা তাৎক্ষণিক বা অগ্রিম সরবরাহ করার উদাহরণ হিসেবে কোনো পাইকারি বিক্রেতা কর্তৃক কয়েক মাসের বাকিতে খুচরা বিক্রেতার কাছে পণ্য সরবরাহ এবং মাস শেষে মজুরি নেয়ার শর্তে শ্রম সেবা সরবরাহকে উল্লেখ করা যেতে পারে।
বিলম্বিত পরিশোধে বাড়তি মূল্যের বিনিময়ে পণ্য বিক্রয়ের সাথে রিবার যে বাহ্যিক মিল দেখা যায় তা নিম্নরূপ:
১. রিবার ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা প্রথমে ঋণদাতার কাছ থেকে ঋণবাবদ আর্থিক মূলধন প্রাপ্ত হন এবং পরবর্তীতে পরিশোধ করেন তথা একটি ঋণ তৈরি হয়। অনুরূপভাবে বিলম্বিত পরিশোধের শর্তে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতা প্রথমে বিক্রেতা থেকে সম্পদ বা পণ্য প্রাপ্ত হন এবং পরবর্তীতে মূল্য পরিশোধ করেন তথা একটি ঋণ তৈরি হয়।
ঋণগ্রহীতা ঋণদাতাকে ঋণ পরিশোধের সময় যে সুদ প্রদান করেন, ক্রেতা যদি বিলম্বিত পরিশোধের জন্য নগদ মূল্যের চেয়ে বেশি পরিশোধ করেন তবে ঐ বাড়তি মূল্য সুদের অনুরূপ এবং সুদের সমপরিমাণ হতে পারে।
২. ঋণদাতা ঋণগ্রহীতা থেকে যে সুদ পান তা পেয়ে থাকেন ঋণপ্রাপ্তি ও ঋণ পরিশোধের মধ্যকার সময় ব্যবধানের ক্ষতিপূরণ বা সময় মূল্য হিসেবে। তেমনি ক্রেতা যদি বিলম্বিত পরিশোধের জন্য নগদ মূল্যের চেয়ে বেশি পরিশোধ করেন তবে ঐ বাড়তি মূল্যও সময় ব্যবধানের ক্ষতিপূরণ/প্রতিদান বা সময় মূল্য হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে।
আমরা যদি উপরোক্ত সামঞ্জস্যগুলোর বিষয়ে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখবো যে, প্রকৃতপক্ষে এ সামঞ্জস্যগুলো নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ত্রুটি রয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, বস্তুত বিলম্বিত পরিশোধে বাড়তি মূল্যের বিনিময়ে পণ্য বিক্রয়ের সাথে রিবার সামঞ্জস্য নেই। নিম্নে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হলো:
১. কুরআনে ঋণ তৈরি হওয়া বা ঋণ আদান-প্রদান করাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। রিবার ক্ষেত্রে প্রদত্ত আর্থিক ঋণ নিজে থেকে বাড়তি কিছু (সুদ) উৎপাদন করতে পারে হিসেবে ধরা হয়। আবার তার একটি কাল্পনিক মূল্য (সুদের হার) ধার্য করা হয়। অথচ আর্থিক ঋণ বাড়তি কিছু (সুদ) উৎপাদন করতে সক্ষম নয়। সুতরাং সুদ সম্পূর্ণরূপে একটি অসত্য দাবি ছাড়া কিছু নয়।
অন্যদিকে বিলম্বিত মূল্য পরিশোধযোগ্য পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে ঋণ সৃষ্টি এবং ঋণের পাশাপাশি বাড়তি মূল্য আরোপ করাকে ভাড়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা যেতে পারে, যদিও তা সরাসরি ভাড়া নয়। তাই আর্থিক ঋনের পরিবর্তে যদি ভাড়া বাবদ গৃহীত জিনিস ব্যবহারের পর তা নি:শেষ না হয়ে থেকে যায় এবং সেটাই সম্পদের মূল মালিককে প্রত্যাবর্তন করা যায় তাহলে তার ভাড়া বাবদ মালিককে যা দেয়া হবে তার মাধ্যমে রিবা হবে না, বরং ব্যবসা হবে। প্রকৃতপক্ষে ভাড়া না ক্রয়-বিক্রয় আর না ঋণ, কারণ এতে সম্পদের মালিকানার কোনোরূপ হস্তান্তর হয় না, কিন্তু ভাড়া গ্রহীতা সম্পদ থেকে উপযোগ লাভ করতে পারে, যার বিনিময়ে সে ভাড়া প্রদান করে।
বস্তুত বিলম্বিত মূল্য পরিশোধযোগ্য পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে যে ঋণ সৃষ্টি হয় তাতে ঋণের পাশাপাশি বাড়তি মূল্য নির্ধারণ করা হয় না, বরং নগদ মূল্যের চেয়ে বিলম্বিত পরিশোধের জন্য বাড়তি মূল্য নির্ধারণ করার অর্থ হলো এর মাধ্যমে ভোক্তা যে উপযোগ পাবে সেই উপযোগ বিবেচনায় পণ্যমূল্য-ই বেশি ধার্য করা এবং ঐ বেশি পণ্যমূল্য-ই ভোক্তা বা ক্রেতার কাছে ঋণ হিসেবে থাকে।
কিন্তু আর্থিক ঋণের ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার উপযোগ বিবেচনা করে ঋণের সাথে সুদ যোগ করার অর্থ হলো ‘অর্থ’ নিজে থেকে বৃদ্ধি পেয়ে যাওয়া। অথচ ঋণদাতার অর্থ ঋণের মাধ্যমে তার বিমূর্ত সম্পদে পরিণত হয়, যার হ্রাস-বৃদ্ধির উপর তার অবদান থাকে না। তাই তা থেকে ঋণগ্রহীতা উপযোগ লাভ করলেও তা থেকে ঋণদাতা কিছু প্রাপ্য হয় না। যে দ্রব্য ব্যবহারে নি:শেষ হয়ে যায় এমন সকল দ্রব্যকে সেই সমজাতীয় দ্রব্য দ্বারা বিনিময়ের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। যেমন কাউকে ঋণ হিসেবে ১০টি আপেল দিলে এবং আপেল দ্বারাই ঋণ পরিশোধ করতে হলে ১০টি আপেলই পরিশোধ করতে হবে, তার চেয়ে বেশি নয়। যদিও ঋণগ্রহীতা ঋণদাতা থেকে তাৎক্ষণিকভাবে আপেলের উপযোগ লাভ করেছে।
২. আর্থিক ঋণ বা লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্ব ছাড়াই মূলধন প্রদান করে সুদ গ্রহণ করা যে অর্থমূল্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয় ইতোপূর্বে তা আলোচিত হয়েছে। সময়ের ব্যবধানকে বিবেচনায় নিয়ে অধিক পণ্যমূল্য ধার্য করার বিষয়টি ‘অর্থের সময়মূল্যের’ অনুরূপ নয়। কারণ অর্থ ও পণ্যের প্রকৃতিগত ভিন্নতার কারণে অর্থের সময়মূল্য ধারণাটি সঠিক নয়। তা সত্ত্বেও অর্থের সময়মূল্য হিসেবে ‘সুদ’ ধার্য করা হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ান্তে সুদসহ আসল ফেরত দেয়া সম্ভব না হলে অতিরিক্ত সময়ের জন্য একই নিয়মে সুদের পুনরাবর্তন ঘটে। এতে মূলধনের উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট হারে সুদ বাড়তে থাকে। এভাবে অর্থ কোনো মূল্য সৃষ্টি না করা সত্ত্বেও ‘সময়মূল্যের’ নামে একজন সম্পদ থেকে অন্যজনের কাছে সম্পদের স্থানান্তর ঘটায়। এভাবে ঋণগ্রহীতাকে ঋণবাবদ প্রদত্ত অর্থের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে তার শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত সম্পদের একটা অংশ ঋণবাবদ প্রদত্ত অর্থের সমমূল্যের অতিরিক্ত (সুদ) হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়, যারা ধারাবাহিকতা তার আপাত উন্নতিকে আরো দুর্গতিতে পরিণত করতে পারে।
অন্যদিকে ব্যবসায়ে সময়ের ব্যবধানে অধিক পণ্যমূল্য ধার্য করা হলেও তা একবারেই ও একটিমাত্র সময়সীমার সাথে সম্পর্কিত করে ধার্যকৃত হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ান্তে মূল্য পরিশোধে ব্যর্থ হলেও নতুন করে ঐ পণ্যমূল্যকে বৃদ্ধি করার সুযোগ নেই। অন্যথায় তা রিবা হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
যেহেতু ধারে বিক্রয়কৃত (অর্থাৎ বিলম্বে মূল্য পরিশোধের শর্তে বিক্রয়কৃত) পণ্যের মূল্য পণ্যমূল্য হ্রাস-বৃদ্ধির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বা চাহিদা-যোগানের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় এবং এটা একই নিয়মে ‘অর্থ’ স্বয়ং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে যাওয়ার থেকে ভিন্ন প্রকৃতির, তাই এটিকে রিবার মতো বলা যেতে পারে না। অর্থের বিনিময়ে অর্থ আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বা ঋণের ক্ষেত্রে ‘অর্থমূল্য’ হ্রাস-বৃদ্ধি করার জন্য চাহিদা-যোগানের বিধি প্রযোজ্য নয়, কারণ অর্থ স্বয়ং অর্থের বিনিময়ে বিক্রয়যোগ্য কোনো পণ্য নয়, বরং অর্থ হলো পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণের ও নির্ধারিত মূল্য ধারণের স্বীকৃত মাধ্যম। অর্থ এমন কোনো বস্তু নয়, যা ব্যয় না করে তার উপযোগ গ্রহণ করা যায়। তাই অর্থ ঋণ দিয়ে তার সমমূল্যের চেয়ে বাড়তি কোনো অংশ (রিবা) দাবি করার কোনো যুক্তিসঙ্গত ও নৈতিক ভিত্তি নেই।
‘বিলম্বিত পরিশোধে বাড়তি মূল্যের বিনিময়ে পণ্য বিক্রয়’ এবং ‘অগ্রিম পরিশোধে (বিলম্বে পণ্য নেয়া) কম মূল্যের বিনিময়ে পণ্য ক্রয়’ দুটি স্বাভাবিক বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া তথা এর একটি যেই যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য, অন্যটিও সেই যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য। অন্যভাবে বলা যায়, এর একটি গ্রহণযোগ্য হলে, বিপরীতক্রমে অন্যটিও গ্রহণযোগ্য হবে। তাই একটির জন্য উল্লেখিত যুক্তিই অন্যটির জন্যও প্রযোজ্য। উভয়টিতে পণ্য ও মূল্যের বিনিময় ঘটে। পক্ষান্তরে রিবার ক্ষেত্রে অর্থের সাথে অর্থের বিনিময় ঘটে, যাতে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার থেকে প্রদত্ত ঋণের (মূলধনের) সাথে একটি বাড়তি অংশ (রিবা) গ্রহণ করে থাকে। তাই এ দুটি ব্যবসায়িক পদ্ধতির সাথে রিবার সাদৃশ্যাত্মক নয় এবং এসব ব্যবসায়িক কার্যক্রমে ক্রেতা বা বিক্রেতা যে মুনাফা লাভ করে (যা পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত নয়), রিবাকে তার সমতুল্য সাব্যস্ত করা যায় না।
রিবাকে ‘অর্থের সময়মূল্য’ বলে দাবি করা হয়। এ সময়ে এ নির্ধারিত পরিমাণে অর্থের মূল্য বেড়েছে বিধায় নয়, বরং এ সময় প্রদত্ত পুঁজিকে নিজের আয়ত্তের বাহিরে রাখায় সরাসরি নিজের কাজে লাগানো যায় নি বিধায় এই সময় বিরতির তথা নগদ পছন্দের বা নিজে ভোগের থেকে নিবৃত্ত থাকার উপর ভিত্তি করে এই ‘অর্থের সময়মূল্য’ বা রিবা গ্রহণ করা হয়।
“অর্থের সময়মূল্য” তত্ত্বে নগদ অর্থকে ভবিষ্যত অর্থের চেয়ে বেশি মূল্যবান হিসেবে ধরা হয় এবং তাই যে নগদ অর্থ ঋণ দেয়া হচ্ছে তা ভবিষ্যতে সুদসহ ফেরত দেয়ার দাবি জানানো হয়, যেন ঐ ভবিষ্যত সুদাসল বর্তমানের আসলের সমান মূল্যের হতে পারে। যে কারণে বর্তমান অর্থের মূল্যকে ভবিষ্যতের অর্থের মূল্যের চেয়ে বেশি ধরা হয় তা হলো: (ক) ভবিষ্যত অনিশ্চিত বা সংশয়পূর্ণ হওয়ায় বর্তমান ভোগ ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ভোগের চেয়ে মূল্যবান বা বর্তমান অর্থের মূল্য ভবিষ্যত অর্থের মূল্যের চেয়ে বেশি। (খ) বর্তমানের কোনো প্রয়োজন পূর্ণ হওয়া না হওয়া অধিক মূল্যবান, কারণ ভবিষ্যতে ঐ প্রয়োজন বা অভাব নাও থাকতে পারে।
তাই এ তত্ত্ব অনুযায়ী, সময় ব্যবধানের উপর ভিত্তি করে বর্তমানের অর্থের মূল্য এবং ভবিষ্যতের অর্থের মূল্যের মধ্যে পার্থক্য হয়ে থাকে এবং বর্তমানের অর্থের মূল্য অধিক হয়ে থাকে। সময় ব্যবধান যত কম হবে বর্তমান ও ভবিষ্যত অর্থের মূল্যের পার্থক্যও তত কম হবে। আবার সময় ব্যবধান যত বেশি হবে বর্তমান ও ভবিষ্যত অর্থের মূল্যের পার্থক্যও তত বেশি হবে। আর নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানের বিপরীতে যে বাড়তি অর্থ বা রিবা ধার্য করা হয়, সেটা বর্তমান ও ভবিষ্যত অর্থ মূল্যের পার্থক্যের সমান হয়ে থাকে।
এ মূল্যগত পার্থক্য বা রিবা ভবিষ্যত সময় ব্যবধানের পরে নয়, বরং ঋণ দেয়া-নেয়ার সময়ই ধার্য করা হয় এবং এ পার্থক্যের পরিমাণ বা রিবার হার তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যথা : (ক) সুদে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার চাহিদা ও যোগান, (খ) অর্থবাজারের সমকালীন সুদের হার সম্পর্কিত তথ্য এবং (গ) সুদের সর্বোচ্চ হার সম্পর্কে সরকারের আইনগত অনুমোদন।
এ বিষয়টির বাস্তব পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, “অর্থের সময়মূল্য তত্ত্বটি” বাস্তবতার খণ্ডিত বা একদেশদর্শী বিশ্লেষণ এবং অনৈতিক মনস্তত্ত্বের প্রতি সমর্থন থেকে উদ্ভুত এবং তা কোনোক্রমেই ন্যায়সঙ্গত নয়। কারণ “বাস্তবে মানুষ বর্তমানকে ভবিষ্যতের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান মনে করে এবং বর্তমানের ভোগকেই সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেয়”- তথ্যটি কোনো সার্বজনীন সত্য নয়। বাস্তবে মানুষ তাদের অর্জিত সম্পদের একটি অংশ নগদ প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্যয় করার পাশাপাশি এমনকি কখনো কখনো কিছু নগদ প্রয়োজনকে অপূর্ণ রেখে হলেও ভবিষ্যতের প্রয়োজন পূরণের জন্য এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চিত বা সম্ভাব্য প্রয়োজনকে মোকাবিলার জন্য সঞ্চয় করে রাখতে চায়। এক্ষেত্রে বর্তমানের সকল চাক্ষুস প্রয়োজন পূরণের চেয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রয়োজন পূরণের বিষয়টি অধিক গুরুত্ব লাভ করে।
তারপর “অর্থের সময়মূল্য” তত্ত্বে বর্তমান ও ভবিষ্যত সময়ের পার্থক্য যত বাড়তে থাকে বর্তমান অর্থের মূল্য তত বেশি বাড়তে থাকে। এ হিসেবে আজকের ১০০ টাকার মূল্য যদি ১ বছর পরের তুলনায় ৯ টাকা বেশি হয়ে থাকে, তাহলে তা ১০ বছর পরের তুলনায় ৯০ টাকা বেশি হবে। এ বিষয়টিকে বিপরীতভাবে বললে দাঁড়ায় আজকের ১০০ টাকার চেয়ে ১০ বছর আগের ১০০ টাকার মূল্য ৯০ টাকা বেশি। (এক্ষেত্রে ধরে নেয়া হচ্ছে যে, যদি মুদ্রাস্ফীতি না ঘটে)। একইভাবে ২০ বছর আগের ১০০ টাকার মূল্য ১৮০ টাকা বেশি। কিন্তু এটা কোনোক্রমে বাস্তবসঙ্গত কথা নয় যে, পূর্বে যে উদ্বৃত্ত টাকা ঋণ দেয়া হলো, যা ঋণ না দিলে তা দিয়ে তখন অন্য কোনো প্রয়োজন পূর্ণ করা যেতো, সেটা বর্তমানের কোনো প্রয়োজন পূরণের চেয়ে এরূপ মূল্যবান হিসেবে সাব্যস্ত হবে এবং সে সময়টি যত বেশি অতীত হবে, তার অর্থের মূল্য তত বেশি হতে থাকবে। (আবারো উল্লেখ্য যে, ধরে নেয়া হচ্ছে, ইতোমধ্যে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে নি)।
আবার ঋণ দেয়ার সময়ই সুদের হার নির্ধারণ করা হয়, পরবর্তীতে অর্থনৈতিক অবস্থার যত পরিবর্তনই ঘটুক না কেন, ১ বছর সময় ব্যবধানের জন্য যে সুদ ধার্য করা হয়, পরবর্তী বছরগুলোতে তা গুণিতক হারে বাড়তে থাকে। অর্থাৎ “অর্থের সময়মূল্য” অন্য কোনো অবস্থার উপর নয়, শুধুমাত্র ঋণ পরিশোধের সময় ব্যবধানের বিপরীতে ঋণদাতার পক্ষ থেকে একটি বাড়তি পরিমাণ-যার কোনো কাউন্টার ভ্যালু নেই- পাওয়ার অন্যায় আবদারের উপর নির্ভর করে মাত্র।
“অর্থের সময়মূল্য” ন্যায়সঙ্গত হিসেবে সাব্যস্ত হতো যদি তা “মুদ্রাস্ফীতির হারের সমান” হিসেবে ধার্য করা হতো। বস্তুত সময়ের ব্যবধানে মুদ্রাস্ফীতির ভিত্তিতে অর্থের মূল্যমানের যে পার্থক্য ঘটে সেই সমান হারে সুদের লেনদেন রিবা হিসেবে সাব্যস্ত হবে না। অবশ্য কৃত্রিমভাবে মুদ্রাস্ফীতি ঘটালে তাতে স্বল্প আয়ের ক্রেতা, ভোক্তা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা রিবার শিকার হয়। কারণ সেক্ষেত্রে বড় পুঁজিপতিদের কাছেই অধিক অর্থ পুঞ্জিভুত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। বস্তুত কৃত্রিমভাবে মুদ্রাস্ফীতি না ঘটালে বা বাজারে মুদ্রার পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকলে কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতা ও পণ্যের সংখ্যা ও পরিমাণ বাড়লে, অতীতের অর্থের চেয়ে বর্তমানের অর্থের এবং বর্তমানের অর্থের চেয়ে ভবিষ্যতের অর্থের মূল্য বাড়বে। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে বর্তমানের ১০০ টাকার মূল্য ১ বছর পরবর্তী ১১০ টাকার সমান না হয়ে বরং ৯০ টাকার সমান হতে পারে। এ বিষয়টি তথাকথিত “অর্থের সময়মূল্য” তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র এবং তা কোনো পক্ষের অন্যায় আবদার নয়, বরং অর্থনীতির স্বাভাবিক অবস্থার ফলশ্রুতি।
“অর্থের সময়মূল্য তত্ত্বে” ধরে নেয়া হয় যে, ঋণদাতা ঋণ দেয়ার মাধ্যমে “সময় বিনিয়োগ” করে থাকে, তাই সে তার প্রদত্ত ঋণের পাশাপাশি ঐ “সময় ব্যবধানের মূল্য” হিসেবে একটি লাভ বা রিবা গ্রহণ করে, যাকে “ঋণ বাবদ প্রদত্ত অর্থের সময় মূল্য” বলা যেতে পারে। অথচ সে কোনো “সময় বিনিয়োগ” করে না, বরং একটি “অপেক্ষার সময়কাল” অতিবাহিত করে মাত্র। ঋণগ্রহীতাই ঋণের অর্থের পাশাপাশি সময় বিনিয়োগ করে। আবার সময় বিনিয়োগ করা হলে তা যেমন লাভজনক হতে পারে তেমনি লোকসানও হতে পারে তথা বাস্তবে সময়মূল্য নেতিবাচকও হতে পারে। সময় ও পুঁজির সাথে শ্রম যুক্ত হয়ে বিভিন্ন ফ্যাক্টরের ভিত্তিতে লাভ-ক্ষতির উদ্ভব ঘটে। নিছক সময় ও পুঁজি কোনো লাভজনক বিষয় নয়। তাই “নগদ পছন্দ থেকে নিবৃত্ত থাকার” উপর ভিত্তি করে ‘অর্থের সময়মূল্য’ হিসেবে পুঁজির সাথে সুদ (রিবা) গ্রহণ করা গ্রহণযোগ্য বা ন্যায়সঙ্গত নয়।
রিবা প্রসঙ্গে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, মূল্যমানের হ্রাসবৃদ্ধি সাপেক্ষে রিবার অবস্থান বা মূল্যায়ন কিরূপ হবে? এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর বুঝার জন্য তা ২:২৮২ আয়াতে বর্ণিত দাইন এবং তাবাইয়া’ (বাইয়ে মুশারাকা/ অংশগ্রহণমূলক ব্যবসায়) এর প্রেক্ষিতে বুঝতে হবে। তাই নিম্নে দাইন ও তাবাইয়া’ (বাইয়ে মুশারাকা/ অংশগ্রহণমূলক ব্যবসায়) সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ক. সুদমুক্ত দাইন (ঋণ লেনদেন ও ধারে ক্রয়-বিক্রয়)
দাইন (আবশ্যিক পরিশোধযোগ্য ঋণ ও ধারে ক্রয়-বিক্রয়) এর ক্ষেত্রে ২:২৮২ আয়াত অনুযায়ী আল কুরআনের নির্দেশনা হলো: মুদ্রা বা দ্রব্যের পরিমাণ কম বা বেশি যাই হোক না কেন, দুইজন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দুজন নারীকে সাক্ষী রাখা আবশ্যক এবং উভয়ের মধ্যে শর্ত স্থিরিকৃত করে তা লিখে রাখা আবশ্যক।
এ নির্দেশনা বাস্তবায়নার্থে মানবীয় নির্বাহী রীতি অনুসারে সাধারণত ঋণের ক্ষেত্রে লিখে রাখার বিষয়াবলি নিম্নরূপ হতে পারে:
১. কে টাকা দিল?
২. কাকে টাকা দিল?
৩. কত টাকা দিল?
৪. কবে টাকা দিল?
৫. কত সময়ের জন্য টাকা দিল?
৬. দুটি শর্তের কোন শর্তে টাকা দিল?
(ক) সময়ের ব্যবধানে টাকার মানের পরিবর্তন যাই হোক না কেন হুবহু সমান পরিমাণ (১০০ টাকা = ১০০ টাকা) ফেরত দেয়া হবে, নাকি (খ) উভয় পক্ষের সম্মতিতে কোনো একটি জিনিসকে মূল্যমানের ভিত্তি বানিয়ে নিয়ে তার সাপেক্ষে সমমূল্য ফেরত দেয়া হবে। যেমন, যদি বর্তমানে ১০০ টাকায় ২ কেজি মিনিকেট চাল পাওয়া যায়, তবে ফেরতকালীন সময়ে ২ কেজি মিনিকেট চালের দাম ১১০ টাকা হলে ১১০ টাকা ফেরত দেয়া হবে, অন্যদিকে তখন ২ কেজি মিনিকেট চালের দাম ৯০ টাকা হলে ৯০ টাকা ফেরত দেয়া হবে।
সুতরাং আধুনিক অর্থব্যবস্থায় সুদের (Interest) ক্ষেত্রে রিবা থেকে মুক্ত থাকার জন্য সুদের হারকে মুদ্রাস্ফীতির হারের সমান হতে হবে বা সুদের হারকে মুদ্রাস্ফীতির হারের সাথে সমন্বয় করতে হবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, কোনো প্রতিষ্ঠান যদি মুদ্রাস্ফীতির হার অনুসারে সুদের হার নির্ধারণ করে তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ গ্রহণের ও ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন সুদের হার নির্ধারণ করার অবকাশ নেই। সুতরাং ঋণ গ্রহণের ও ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন সুদের হার নির্ধারণের মাধ্যমে যে বাড়তি সুদ পাওয়া যায়, সেটা মুনাফা নয়, বরং সেটা রিবা।
সমজাতের জিনিস পরিশোধের শর্তে ধার নেয়ার ক্ষেত্রে পরিশোধের সময় সমজাতের জিনিস মান এবং পরিমাপ বা পরিমাণেও সমান হতে হবে। তবে সময়ের ব্যবধানে সমজাতের সমমানের জিনিসের মূল্যমানে তারতম্য ঘটলে পরিমাপ বা পরিমাণেও তারতম্য ঘটতে পারবে, যদি ধারের সময় সেরূপ চুক্তি করা হয়।
৭. পরিশোধ পদ্ধতি- এককালীন না কিস্তিভিত্তিক?
৮. কোন ব্যক্তিরা সাক্ষী ছিল? ইত্যাদি।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, যখন ঋণের ক্ষেত্রে লিখে রাখা ও সাক্ষী রাখার বিষয় থাকে না এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে না অর্থাৎ যে ধরনের ঋণ লেন-দেন এমনভাবে সংঘটিত হয় যে, ঋণগ্রহীতা যখন সুবিধা করতে পারবে তখন পরিশোধ করবে এবং অন্যথায় পরিশোধ না করলেও চলবে, এছাড়া সে পারলে স্বেচ্ছায় বেশিও পরিশোধ করতে পারে, সেই ধরনের ঋণকে ‘ক্বারদ’ (কর্জ) বলে। কর্জের পরিমাণ কম হোক বা বেশি হোক তা লিখে রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। অন্য কথায়, কর্জ এমন বিষয় যার লেনদেনের বিষয়ে কোনো মামলা দায়ের করা যেতে পারে না। অন্যদিকে যদি অবশ্য পরিশোধযোগ্য ঋণের বিষয় হয়, তা হচ্ছে দাইন (দেনা), আর তাই এর পরিমাণ যত কমই হোক না কেন, তা লিখে রাখতে হবে এবং সেজন্য সাক্ষী রাখতে হবে, তার মেয়াদ নির্দিষ্ট করতে হবে এবং শর্তাবলীও নির্দিষ্ট করতে হবে। বাংলা ভাষায় দাইন ও ক্বারদকে ‘দেনা’ ও ‘কর্জ’ বলা হয়।
(খ) সুদমুক্ত তাবাইয়া’ (অংশীদারিত্বের ব্যবসা)
সুদমুক্ত তাবাইয়া’ বা অংশীদারিত্বের ব্যবসা সম্পর্কে আলোচনার প্রথমে তিজারাত ও বাইয়ুনের পার্থক্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো। ২৪:৩৭ ও ২:২৮২ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তিজারাত ও বাইয়ুনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তিজারাত ও বাইয়ুন এর পার্থক্য হচ্ছে, তিজারাত হলো সাধারণ ব্যবসা/ কেনাবেচা/ লেনদেন এবং বাইয়ুন হচ্ছে চুক্তিভিত্তিক কার্যক্রমসম্পন্ন ব্যবসা। অর্থাৎ যে ধরনের ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসা কার্যক্রমে প্রামাণ্য লেনদেন সংঘটিত হওয়ার শর্ত রয়েছে সেটাকেই বাইয়ুন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিজারাত নগদও হতে পারে, বাকিও হতে পারে। নগদ ক্ষেত্রে না লিখলেও সমস্যা নেই, তার মানে বাকির ক্ষেত্রে লিখে রাখতে হবে।
বাইয়ুন যেমন একক মালিকানাধীন ব্যবসা হতে পারে, তেমনি হতে পারে তাবাইয়া’/ বাইয়ে মুশারাকা/ অংশগ্রহণমূলক/ অংশীদারিত্বমূলক/ অংশীদারসম্পন্ন/ যৌথ মালিকানাধীন ব্যবসা। এ অংশগ্রহণ পুঁজি বা শ্রম যেভাবেই অংশগ্রহণ হোক না কেন। আর তাবাইয়া’/ বাইয়ে মুশারাকার ক্ষেত্রে সাক্ষী রাখা বাধ্যতামূলক। (২:২৮২)
তাবাইয়া’/ বাইয়ে মুশারাকা মূলত ‘দাইন ফিল বাই’ অর্থাৎ ‘ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে পারস্পরিক দেনা’এর উদ্ভব ঘটায়। সুতরাং এখানেও দাইনের যাবতীয় শর্ত প্রযোজ্য হবে। শুধু ‘বাই’ বা ‘ব্যবসা’ হওয়ার কারণে এখানে ব্যবসায়ের সাথে সম্পর্কিত কিছু বিষয় প্রযোজ্য হবে। যেমন:
১. অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের সবাইকে লাভ-ক্ষতির ঝুঁকি বহন করতে হবে, অর্থাৎ সুদমুক্ত মুনাফা বণ্টিত হবে। যেমন ১০০ টাকায় ১ বছরে ৫ টাকা বেশি পাওয়া যাবে, এমন নয়, বরং বাস্তবে যত টাকা মুনাফা (বা ঋণাত্মক মুনাফা/ লোকসান) হয় তাকে বণ্টন করা হবে অংশীদারদের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে সুদের মতো বণ্টিত হলেও বছরান্তে/ কোনো নির্দিষ্ট সময়ান্তে বাস্তব হিসাবের ভিত্তিতে সুদমুক্ত বণ্টন সমন্বয় করতে হবে।
২. একটি চুক্তিপত্রের মাধ্যমে শরিকানা ব্যবসা শুরু হবে, যাতে সাধারণত কিছু বিষয় লেখা থাকা প্রয়োজন বলে মানবীয় বিবেক-বুদ্ধিতে উপলব্ধ তথা নির্বাহী রীতিতে অনুশীলিত হয়, যথা:
(ক) অংশীদারদের নাম,
(খ) তাদের প্রদত্ত মূলধনের পরিমাণ,
(গ) তাদের প্রত্যেকের দায়-দায়িত্ব,
(ঘ) প্রয়োজনে অধিক মূলধন সংগ্রহের প্রক্রিয়া,
(ঙ) লভ্যাংশ (লোকসান মানে ঋণাত্মক লভ্যাংশ) বণ্টনের হার ও প্রক্রিয়া,
(চ) অংশীদারিত্ব প্রত্যাহার বা হস্তান্তর ও নতুন অংশীদার গ্রহণের শর্ত ইত্যাদি।
৩. উদ্যোক্তারাও তথা সংগঠন বা ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত পুঁজি বিনিয়োগকারী ও শ্রম বিনিয়োগকারী অংশীদারেরাও নিয়োগকৃত শ্রমিকদের মতোই তাদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের বিপরীতে সুনির্দিষ্ট পারিশ্রমিক পেতে পারেন, যা ব্যয়ের খাতে হিসাব হবে, লভ্যাংশ বণ্টনের খাতে নয়।
৪. পূর্বানুমানের তুলনায় অতিরিক্ত লাভ হলে নিয়োগকৃত শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্ট, ইনসেনটিভ ও বোনাস দিয়ে উদ্যোক্তা তথা সংগঠন বা ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত পুঁজি বিনিয়োগকারী ও শ্রম বিনিয়োগকারী অংশীদারদের মধ্যে চুক্তি অনুসারে মুনাফা বণ্টন করতে হবে। অনুরূপভাবে লোকসানের ক্ষেত্রেও পুঁজি বিনিয়োগকারী ও শ্রম বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে চুক্তির শর্তানুসারে লোকসানের বণ্টন হবে।
সর্বোপরি চুক্তির শর্তসমূহ ন্যায়সঙ্গত হতে হবে, যাতে কোনোভাবে কোনো পক্ষ অপরপক্ষের তুলনায় ‘বাড়তি সুবিধা’ গ্রহণ না করে, কারণ ‘বাড়তি সুবিধা’ গ্রহণই রিবা।
অবশ্য এটা প্রণিধানযোগ্য যে, মেধাশ্রম ও কায়িক শ্রমের গুরুত্বের স্তরানুসারে একজন উচ্চস্তরের কর্মকর্তা তুলনামূলক পরবর্তী ধাপের কর্মকর্তার তুলনায় অধিক পারিশ্রমিক পাওয়াকে ‘বাড়তি সুবিধা’ বলা হয় না। বরং ‘বাড়তি সুবিধা’ বা রিবা বলতে বুঝায় কাউকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে নিবৃত্ত করার মাধ্যমে অন্য কেউ তা থেকে সুবিধা গ্রহণ করা।
সুতরাং যে টাকা কাউকে বাইয়ের/ ব্যবসায়ের জন্য দেয়া হয় কিন্তু মুশারাকা/ অংশীদারিত্ব হিসেবে নয়, শুধু দাইন হিসেবে, সেক্ষেত্রে ঐ মূলধনদাতা লভ্যাংশ (বা লোকসান) পাবে না, শুধু মূলধন ফেরত পাবে। অন্য কথায়, বিনিয়োগ হিসেবে দিতে হলে তা হতে হবে তাবাইয়া’/ বাইয়ে মুশারাকা তথা সেক্ষেত্রে ব্যবসায়ের লাভ বা লোকসান উভয়টিকে স্বীকার করতে হবে।