উলিল আমর

আল কুরআনের আলোকে উলিল আমর

মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সমষ্টিগত দায়িত্ব পালনে নেতৃত্ব ও মান্যতার নির্দেশনা

মু’মিনদের সমষ্টিগত বিষয়ের (আমরিন জামিয়িন) কিছু ক্ষেত্র

‘আমরিন জামিয়িন’ অর্থ ‘সমষ্টিগত বিষয় ও কার্যক্রম’। অর্থাৎ যে কাজ অনেকে মিলে সমষ্টিগতভাবে করা হয় বা করতে হয় এবং যে বিষয়টি কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয় নয় বরং অন্যদের সাথে সম্পর্কিত বিষয় তাকে ‘আমরিন জামিয়িন’ বা সমষ্টিগত বিষয় ও কাজ বলে। উলিল আমর নির্বাচনের বিষয়টি মুসলিম উম্মাহর সমষ্টিগত বিষয়াদি ও কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত। তাই নিম্নে মু’মিনদের সমষ্টিগত বিষয়ের (আমরিন জামিয়িন) উদাহরণ হিসেবে প্রাসঙ্গিক কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হলো:

২৪:৬২ :: নিশ্চয় মু’মিন তারাই যারা ঈমান (বিশ্বাস) করেছে আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলের প্রতি এবং যখন তারা তার সাথে থাকে কোনো সমষ্টিগত বিষয় বা কার্যক্রমে (আমরিন জামিয়িন), তখন তারা চলে যায় না, যতক্ষণ না তার থেকে অনুমতি চায়। নিশ্চয় যারা তোমার অনুমতি চায়, তারাই সেসব লোক যারা ঈমান (বিশ্বাস) করে আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলের প্রতি। সুতরাং যখন তারা তোমার অনুমতি চায়, তাদের কোনো ব্যাপারে (প্রয়োজন থাকায়), তখন তুমি অনুমতি দাও, (বাস্তবসম্মতভাবে) তাদের মধ্য থেকে যাকে তুমি ইচ্ছা করো। আর তুমি তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।

৫৮:১১ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যখন (রসূল বা উলিল আমরের পক্ষ থেকে) তোমাদেরকে বলা হয়, মজলিশে অন্যদের জন্য স্থান প্রশস্ত করে দাও, তখন তোমরা স্থান প্রশস্ত করে দেবে, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে স্থান প্রশস্ত করে দেবেন। আর যখন বলা হয়, উঠে আসো/ উঠে যাও, তখন উঠে আসবে/ উঠে যাবে। তোমাদের মধ্যকার যারা ঈমান রাখে এবং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে বহুস্তর মর্যাদায় উন্নীত করবেন। আর তোমরা যা করো আল্লাহ তার খবর রাখেন।

৪৮:১১ :: যেসব আ’রববাসী পেছনে রয়ে গিয়েছিলো তারা বলবে, “আমাদের ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন আমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছিলো। সুতরাং আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।” তারা মুখে এমন কথা বলে থাকে যা তাদের অন্তরে নেই। তাদের বলো, “আল্লাহ তোমাদের কারো কোনো অমঙ্গল বা মঙ্গল সাধনের ইচ্ছা করলে কে তাঁকে নিবৃত্ত করার ক্ষমতা রাখে?” বস্তুত তোমরা যা করো আল্লাহ তার খবর রাখেন।

৬১:৪ :: নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা তাঁর পথে (তাঁর বিধান বাস্তবায়নের ও জুলুম প্রতিরোধের জন্য) সারিবদ্ধভাবে (ঐক্যবদ্ধ ও শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে) যুদ্ধ করে, যেন তারা সীসাঢালা প্রাচীর।

৪২:১৩ :: তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য দ্বীনের পর্যায়ভুক্ত সেই মূল বিধানই প্রদান করেছেন, যা তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং যা আমরা তোমার প্রতি ওয়াহী (অনুপ্রেরণা দান) করেছি এবং যার প্রতি আমি ইবরাহীমকে নির্দেশ প্রদান করেছিলাম এবং মূসাকে ও ঈসাকে, এ মর্মে যে, “তোমরা দ্বীনকে ক্বায়েম/প্রতিষ্ঠা/বাস্তবায়ন করো এবং সেই ক্ষেত্রে (দ্বীন ক্বায়েমের পথে) পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না”। তোমরা মুশরিকদেরকে (আল্লাহর একত্ববাদী দ্বীনের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকার) যে দিকে আহবান করছো তা তাদের নিকট বড়ই দুঃসহ হয়ে গেছে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাঁর দিকে নিয়ে আসার জন্য বাছাই করেন এবং তিনি তাকেই পথনির্দেশ করেন যে (পথনির্দেশের সন্ধানে) অভিমুখী হয়।

৮:৩৯ :: আর তোমরা তাদের (কাফিরদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, যতক্ষণ না ফিতনার (ধর্মীয় কারণে নির্যাতন) অবসান হয় এবং দ্বীনের (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থার) প্রত্যেক ক্ষেত্রে তা আল্লাহর জন্য (সুনিয়ন্ত্রিত) হয়ে যায় (তথা আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মীয় স্বাধীনতা পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়)। তারপর যদি তারা বিরত হয়, তাহলে তোমরা যা করো আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।

৪:৭৫ :: আর তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছো না অথচ নিপীড়িত হচ্ছে দুর্বল নারী-পুরুষ ও শিশুরা, যারা বলছে, “আমাদের প্রভু, আমাদেরকে এ জনপদ থেকে নিস্তার দিন যার শাসকরা যালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে অভিভাবক নির্ধারণ করুন এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে সাহায্যকারী নির্ধারণ করুন।

৬০:১০ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যখন তোমাদের কাছে মু’মিন নারীরা হিজরত করে আসবে, তোমরা তাদেরকে পরীক্ষা করবে। আল্লাহ তাদের ঈমান সম্পর্কে অধিক জানেন। অতঃপর যদি তোমরা (তোমাদের সাধ্য অনুসারে) জানো যে, তারা মুমিন নারী, তাহলে তাদেরকে কাফিরদের নিকট ফেরত পাঠিও না। (কাফিরদেরকে ছেড়ে চলে আসার প্রেক্ষিতে) তারা কাফিরদের জন্য হালাল নয় এবং কাফিররাও তাদের জন্য হালাল নয়। তারা (তাদের কাফির স্বামীরা) যা (মোহরানাবাবদ) ব্যয় করেছে, তা তাদেরকে ফিরিয়ে দাও। তোমাদের উপর দোষ নেই যে, তোমরা তাদেরকে বিয়ে করবে, যখন তোমরা তাদেরকে তাদের পারিতোষিক (মোহরানা) প্রদান করো। আর তোমরা কাফির নারীদেরকে (তারা কাফিরদের কাছে চলে যেতে ইচ্ছুক হওয়া সত্ত্বেও) বৈবাহিক বন্ধনে আটকে রেখো না। তোমরা যা (মোহরানা বাবদ) ব্যয় করেছো, তা তোমরা (কাফিরদের কাছে) ফেরত চাও। আর তারা (কাফিররা) যা (মোহরানা বাবদ) ব্যয় করেছে, তা তারা (তোমাদের কাছে) ফেরত চেয়ে নিক। এটাই আল্লাহর হুকুম (বিধান)। তিনি তোমাদের মধ্যে ফায়সালা করেন। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

৬০:১১ :: আর যদি তোমাদের স্ত্রীদের থেকে কিছু কাফিরদের কাছে তোমাদের হাতছাড়া হয়ে থাকে (অর্থাৎ তোমাদের কারো কাফির স্ত্রী তোমাদেরকে ছেড়ে কাফিরদের কাছে চলে গেলে যদি তাকে দেয়া মোহরানা কাফিরদের থেকে ফেরত পাওয়া না যায়), তারপর তোমরা (মু’মিনরা) সুযোগ পাও, তাহলে তোমরা (মু’মিনরা) যাদের স্ত্রীরা চলে গেছে (অর্থাৎ যে মু’মিনদের কাফির স্ত্রীরা তাদেরকে ছেড়ে কাফিরদের কাছে চলে গেছে), তাদেরকে উহার সমপরিমাণ প্রদান করো যা তারা ব্যয় করেছে (অর্থাৎ ঐ মু’মিনরা তাদের স্ত্রীদেরকে মোহরানা বাবদ যা ব্যয় করেছিলো, তার সমপরিমাণ তাদেরকে প্রদান করো)। আর আল্লাহর প্রতি সচেতন থাকো, যাঁর প্রতি তোমরা বিশ্বাসী।

৫৯:৭ :: আল্লাহ তাঁর রসূলের কাছে জনপদবাসীর কাছ থেকে যা ফায়স্বরূপ দিয়েছেন, তা আল্লাহর জন্য এবং রসূলের জন্য এবং আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং ইয়াতিম ছেলেমেয়েদের জন্য এবং মিসকীনদের জন্য এবং ইবনে সাবীলের (ছিন্নমূলের/বাস্তুহারাদের/উদ্বাস্তুদের) জন্য। যেন সম্পদ তোমাদের মধ্য থেকে শুধু ধনীদের মধ্যে আবর্তিত/পুঞ্জিভুত না হয়। আর রসূল (নির্বাহী সিদ্ধান্তে) তোমাদেরকে যা দেয় তোমরা তা গ্রহণ করো এবং সে (নির্বাহী নিষেধাজ্ঞারূপে) তোমাদেরকে যা থেকে নিষেধ করে তোমরা তা থেকে বিরত থাকো।আর তোমরা আল্লাহ সচেতন হও, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।

৫৯:৮ :: (এ সম্পদ) মুহাজির অভাবগ্রস্তদের জন্য যাদেরকে তাদের বাড়িঘর ও মালসম্পদ থেকে উৎখাত করা হয়েছে। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি তালাশ করে এবং তারা আল্লাহকে ও তাঁর রসূলকে সাহায্য করে আর তারাই সত্যবাদী (Sincere)।

৫৯:৯ :: আর (এ সম্পদ তাদের জন্যও) যারা তাদের আগে থেকেই এ রাষ্ট্রে বসবাস করে আসছে এবং ঈমান এনেছে। তারা তাদেরকে ভালোবাসে যারা তাদের কাছে হিজরাত করে এসেছে। আর তারা তাদেরকে (মুহাজিরদেরকে) যা দেয়া হয় তাতে তাদের অন্তরে কোনো ঈর্ষা রাখে না এবং তারা তো নিজেদের উপরে তাদের (মুহাজিরদের) প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয় যদিও তাদের (নিজেদের) সাথে অভাব লেগে থাকে। আর যাকে তার মনের সংকীর্ণতা (স্বার্থপরতা, লোভ, কৃপণতা, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি) থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই সফল।

৫৯:১০ :: আর (এ সম্পদ তাদের জন্যও) যারা তাদের পরে এসেছে, এ অবস্থায় যে, তারা বলে, “হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে এবং আমাদের যে ভাইয়েরা ঈমানের ভিত্তিতে আমাদের সাবেক্ব (অগ্রগামী ও অতীত) হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রতি আমাদের অন্তরে কোনো অশোভন মনোভাব থাকতে দিবেন না। আমাদের প্রভু, নিশ্চয় আপনি স্নেহশীল ও দয়ালু”।

৯:১২২ :: মু’মিনদের জন্য সুসঙ্গত নয় যে, তারা সবাই একসাথে বের হয়ে পড়বে। তবে কেন এমন হয় না যে, তাদের প্রত্যেক পৃথক বিভাগ থেকে একটি দল বের হবে যেন তারা দ্বীনের বিষয়ে গভীর উপলব্ধি অর্জন (তাফাক্বক্বুহ) করতে পারে এবং (তা প্রয়োগ করে) তাদের ক্বওমকে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে, যেন তারা (তাদের ক্বওম) সচেতন হতে পারে।

২:১৭৮-১৭৯ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের উপর হত্যার দণ্ডবিধি হিসেবে ক্বিসাস (হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া) বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। হত্যাকারী স্বাধীন ব্যক্তি হলে ঐ স্বাধীন ব্যক্তিই দণ্ড পাবে, হত্যাকারী দাস হলে ঐ দাসই দণ্ড পাবে, হত্যাকারী নারী হলে ঐ নারীই দণ্ড পাবে। তবে যাকে তার ভাইয়ের (নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের) পক্ষ থেকে ক্ষমা করে দেয়া হয়, তখন একটি ন্যায়সঙ্গত অনুসরণ (পর্যবেক্ষণ) এবং তার দিকে (নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের দিকে) সদ্ভাবস্পন্ন ও উত্তম ধরনের (রক্তপণ) আদায় (প্রযোজ্য হবে)। এটা তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে একটি (দণ্ডবিধির) লঘুকরণ এবং দয়া। সুতরাং তারপর যে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ি করবে, তার জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। আর তোমাদের জন্য ক্বিসাসের (অন্যায় হত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ডের) মধ্যে জীবন/আয়ু রয়েছে, হে চিন্তাশক্তির অধিকারীরা, যেন তোমরা স্রষ্টা সচেতন হতে পারো।

২৪:২ :: ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী, তাদের প্রত্যেককে একশতটি ‘চামড়ায় আঘাত’ করো। আর আল্লাহর দ্বীন (বিধান) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি স্নেহ যেন তোমাদেরকে প্রভাবিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখো। আর যেন মু’মিনদের মধ্য থেকে একটি দল তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।

৯:১৮ :: নিশ্চয় তারাই আল্লাহর মাসজিদসূহের ব্যবস্থাপনা করবে (ব্যবস্থাপনার অধিকার রাখে) যারা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায় যে, তারাই পথনির্দেশ গ্রহণকারীদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

৫:১০৬ :: হে মু’মিনগণ, যখন তোমাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু সন্নিকটে এসে যায় তখন তোমরা ওয়াসিয়্যাত করার সময় তোমাদের মধ্য থেকে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখো। অথবা যদি তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং এ অবস্থায় তোমাদের কাছে মৃত্যুর মুসিবত এসে পড়ে তাহলে (তোমাদের নিজেদের মধ্যকার লোক না পেলে) তোমাদের বাইরের (তথা অন্য অঞ্চলের) দুইজনকে সাক্ষী রাখো। তাদের দুইজনকে সালাতের পরে অপেক্ষমান রাখবে। যদি তোমরা সন্দেহ করো তবে তারা উভয়ে আল্লাহর নামে কসম করবে: “আমরা কোনো মূল্যেই তা (তথা সাক্ষ্য) বিক্রয় করবো না, যদিও আত্মীয় হয় আর আমরা আল্লাহর নির্দেশিত সাক্ষ্যকে গোপন করবো না। নিশ্চয় তাহলে আমরা অপরাধীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।”

৫:১০৭ :: তারপর যদি লক্ষণ পাওয়া যায় যে, তারা দুজন অপরাধমূলক দাবি করেছে (তথা সাক্ষ্যে হেরফের করেছে), তাহলে তাদের দুজনের দাবিগত অবস্থানের বিপরীতে অন্য দুজন দাঁড়াবে, যারা হবে তাদের (সাক্ষ্যের) বিপক্ষে অধিকার দাবিকারীদের মধ্য থেকে এবং ঘনিষ্ঠতর/অগ্রাধিকারী। তারপর তারা আল্লাহর নামে কসম করবে: “আমাদের সাক্ষ্য তাদের দুইজনের সাক্ষ্যের চেয়ে অধিক যথাযথ। আর আমরা সীমালংঘন করিনি। নিশ্চয় তাহলে আমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।”

৫:১০৮ :: এ পদ্ধতিই (এ সম্ভাবনার) নিকটতম যে, তারা সঠিক রূপেই সাক্ষ্য দিবে অথবা তারা ভয় করবে যে, তাদের শপথের পরে তাদের শপথকে রদ করা হবে। আর তোমরা আল্লাহ সচেতন হও এবং (যথানিয়মে) শুনো। আর নিশ্চয় আল্লাহ নীতি বিচ্যুত সম্প্রদায়কে পথনির্দেশ করেন না।

৬২:৯ :: হে যারা বিশ্বাস করেছো, যখন ইয়াওমুল জুমুআতে (জমায়েতের দিনে) সালাতের জন্য (তোমাদেরকে) ডাকা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও এবং ব্যবসা কার্যক্রম (তথা পেশাগত কর্ম) ত্যাগ করো। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জানো।

৪৯:৯-১০ :: আর যখন মু’মিনদের দুই দল পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন তোমরা (মু’মিনদের নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষ) তাদের উভয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। তবে যদি তাদের একদল (আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে) অন্য দলের উপর বাড়াবাড়ি করতে থাকে, তাহলে তোমরা সেই বাড়াবাড়িকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। তারপর যদি তারা ফিরে আসে, তাহলে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মীমাংসা করে দাও এবং ন্যায়বিচার করো। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদেরকে ভালোবাসেন। নিশ্চয় মু’মিনরা ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও এবং আল্লাহর প্রতি সচেতন থাকো, যেন তোমাদেরকে অনুগ্রহ করা হয়।

১৬:৯০ :: নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন আদল (ন্যায় আচার, ন্যায় বিচার ও ক্ষতিপূরণ) এবং ইহসান (উত্তম আচরণ, পরোপকার ও পরার্থে ত্যাগ স্বীকার) এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার জন্য এবং তিনি তোমাদেরকে নিষেধ করেন অশ্লীল ও অন্যায় এবং সীমালঙ্ঘন করা থেকে। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যেন তোমরা সদা স্মরণ রাখতে পারো।

উপরোল্লেখিত ২৪:৬২ আয়াতে ‘আমরিন জামিয়িন’ (সমষ্টিগত বিষয়াদি ও কার্যক্রম) সম্পর্কিত নির্দেশনাটিতে বলা হয়েছে যে, তারাই প্রকৃত মু’মিন যারা যখন কোনো সমষ্টিগত বিষয়াদি ও কার্যক্রমের জন্য রসূলের সাথে থাকে, তখন বিনা অনুমতিতে চলে যায় না। তারা তাদের কোনো বাস্তব প্রয়োজনের কারণে যাওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই অনুমতি চায়। আর অনুমতি চাওয়ার পর রসূল যদি বাস্তবস্মত কারণে তাকে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার ইচ্ছা করেন তাহলে তিনি তাকে সেই অনুমতি প্রদান করবেন। এভাবে মু’মিনদেরকে সমষ্টিগত কার্যক্রম পরিচালনা পদ্ধতি এবং শৃঙ্খলা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া হয়েছে।

সমষ্টিগত বিষয়াদি ও কার্যক্রম (আমরিন জামিয়িন) এবং এজন্য উলিল আমর নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য একটি দৃষ্টিকোণ হতে পারে আমাদের বিভিন্ন করণীয় বিষয়ের মৌলিক ধরন চিহ্নিত করা। আমাদের মনোভাব ও কাজকে আমরা অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী এ দুভাগে ভাগ করতে পারি। অন্তর্মুখী বলতে আমাদের মনোভাব ও ব্যক্তি চরিত্র গঠনের দিকটিকে বুঝায়। আর বহির্মুখী বলতে একজন মানুষ হিসাবে অন্য মানুষদের সাথে যে সম্পর্ক ও আচরণ উহাকে বুঝায়। এ বহির্মুখী কাজগুলোকে আবার দুভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত সাধারণ লেন-দেন, কায়-কারবার এবং দ্বিতীয়ত সাংগঠনিকতা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম।

গঠনিকতা ও সাংগঠনিক কার্যক্রমেরও আবার অন্ত:স্থ ও বহি:স্থ দুটো দিক রয়েছে। অন্ত:স্থ বিষয় বলতে সংগঠনের সদস্যদের নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক ও সমস্যা সমাধানকে বুঝায়। বহি:স্থ বিষয় বলতে সংগঠনের বাহিরের লোকদের প্রতি আচরণ, আহবান, ইতিবাচক সাড়াদানকারীদেরকে সংগঠননভুক্তকরন এবং বিরোধিতাকারীদের পক্ষ থেকে তৈরি হওয়া সমস্যার সমাধানকে বুঝায়। আমাদের এ বহির্মুখী কাজের সাথে, সামষ্টিক ব্যাপারের সাথে জামিয়ার বিষয়টি এবং উলিল আমরের বিষয়টি জড়িত। উলিল আমরের প্রয়োজন হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর সামষ্টিক ব্যবস্থাপনা ও সাংগঠনিক পরিচালনার জন্য তথা অন্ত:স্থ ও বহি:স্থ সমস্যা সমাধানের জন্য।

সাংগঠনিক কাঠামোর মাধ্যমে সমষ্টিগত সমস্যা সমাধান ও উন্নয়ন প্রচেষ্টার বাস্তব উদাহরণ হিসেবে আমরা লক্ষ্য করতে পারি ‘রাষ্ট্র’, ‘ধর্মসভা’ এবং বিভিন্ন ‘রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক সংগঠন-সংস্থা’। ধর্মসভার দিক থেকে খৃস্টানদের মধ্যে ও কাদিয়ানীদের মধ্যে সাংগঠনিক কাঠামোর মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা সমাধান ও উন্নয়নমূলক কাজের ক্ষেত্রে বাস্তব কর্মতৎপরতার কথা জানা যায়। মনে করুন একজন খৃস্টানের চাকুরি প্রয়োজন। সে তার এ প্রয়োজনের কথা পাদ্রির নিকট পেশ করে অথবা পাদ্রিও তার ধর্মসভার খোঁজখবর রাখে। তারপর সে যখন ধর্মসভায় এটা জানিয়ে দেয়, তখন সবাই এ বিষয়ে খোঁজখবর নেয় এবং অনতিবিলম্বে একটি ব্যবস্থা হয়ে যায়। তাদের নিজেদের মধ্যকার বিবাদ-বিসম্বাদ সাধারণত তারা নিজেরাই মীমাংসা করে। আল্লাহর কিতাবের মাধ্যমে জানানো তথ্য ও বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় তাদের বিচ্যুতি রয়েছে তা এখানে আলোচ্য নয়। তবে সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনার জন্য প্রত্যেক এলাকায় একটা একীভূত ধর্মসভা যা একটা বিশ্বজনীন মূল ধর্মসভার অধস্তন হিসেবে কার্যকর থাকবে, এরূপ পদ্ধতি অবলম্বনের ক্ষেত্রে তারা সঠিক ব্যবস্থাই বজায় রেখেছে।

বস্তুত যেকোনো রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক সংগঠন-সংস্থাও ‘নেতৃত্ব-আনুগত্য পদ্ধতিভিত্তিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা’ অবলম্বন করে থাকে, যদিও অনেক ক্ষেত্রে তা আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত, বরং তারা নিজেদের পার্থিব শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের জন্য এ ব্যবস্থা কার্যকর রাখে। আর মু’মিনদেরকে এ একই ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে, আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের জন্য। যেমন, ৮:৭২ আয়াতে বলা হয়েছে, “আর যারা কুফর করেছে তারা একে অন্যের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ। যদি তোমরা (নিজেদের মধ্যে) তা (সেই একই নীতি) পালন না কর, তবে পৃথিবীতে ফিতনা ও মহাবিপর্যয় দেখা দিবে”। এ বন্ধুত্বের একটি উদাহরণ হচ্ছে, একজন কাফির একটি দোকান দিলে অন্য কাফিররা চেষ্টা করে তার দোকান থেকেই কেনাকাটা করতে। তাহলে মু’মিনরা একে-অন্যের ভাই ও বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও যদি এ বিষয়ে আন্তরিক না হয়, সেটা কোনভাবেই শোভনীয় হতে পারে না।

অনুরূপভাবে আল্লাহর কিতাবে এমন অনেক বিধান রয়েছে যা ব্যক্তিগতভাবে সম্পাদনের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং তা সমষ্টিগত বিষয় যেক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে সেই কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ও ব্যবস্থাপনার অধীনে তা সম্পাদন করতে হয়। উপরে উল্লেখিত আয়াতসমূহে আমরা এর কিছু দৃষ্টান্ত পাই। যেমন: দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও জুলুম প্রতিরোধের জন্য সংগ্রাম, হিজরাত করে আসা মু’মিন নারী-পুরুষের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, সম্পদের বণ্টন, শিক্ষামূলক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, বিভিন্ন অপরাধের দন্ডবিধি কার্যকরকরণ, মাসজিদের ব্যবস্থাপনা এবং তাতে মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টন ও জুময়ার সালাতের আয়োজন, মু’মিনদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসন এবং আদল (ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ) ও ইহসান (পরোপকার ও সমাজ কল্যাণ) প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন ইত্যাদি।

পরিশেষে বলা যায় যে, আল কুরআনে মু’মিনদেরকে ‘জামিয়া বা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরা এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হওয়ার নির্দেশ রয়েছে, মুসলিম উম্মাহ হিসেবে মানবজাতির কল্যাণের জন্য উদ্ভব ঘটানোর মাধ্যমে তাদেরকে যে নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব ও দায়-দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে তা যথানিয়মে পালন করার জন্য তাদের মধ্যে একটি নির্বাহী দায়িত্ব পালনকারী পরিষদের তথা উলিল আমর নির্ধারণ করার নির্দেশনা রয়েছে। এবং উলিল আমর নির্ধারণ এবং উলিল আমরের নির্বাহী দায়-দায়িত্ব পালন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে শূরা বা পরামর্শভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ রয়েছে। এ নির্দেশসমূহ থেকে এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, সাংগঠনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠাকরণ এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচন মু’মিনদের জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বা আবশ্যিক দায়িত্ব।

নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক বিপর্যয় প্রতিরোধে সমষ্টিগত কার্যক্রম

নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক বিপর্যয়ের চিত্র দেখে অনেক সময় মু’মিনদের মধ্যে সমষ্টিগত কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ভালো কিছুর সম্ভাবনা সম্পর্কে হতাশাবোধের সৃষ্টি হয়। এ হতাশা থেকে সমষ্টিগত কার্যক্রম পরিহার করে শুধু ব্যক্তিগতভাবে আত্মশুদ্ধিকে একমাত্র করণীয় হিসেবে গ্রহণ করার মনোভাব তৈরি হয়। এর মাধ্যমে শয়তান দুই ধরনের সুবিধা অর্জন করতে পারে, প্রথমত: সে মন্দের সম্প্রসারণ ঘটাতে পারে, এবং দ্বিতীয়ত: যারা মন্দ প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করার কথা তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে তাদের কর্তব্যকর্ম থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে।

বস্তুত মানবজাতির ইতিহাসের প্রারম্ভেই শয়তান আল্লাহকে বলেছিলো যে, “তারপর আমি তাদের (আদম সন্তানদের) সামনে থেকে আসবো, পেছন থেকে আসবো, ডান দিক থেকে আসবো এবং বাম দিক থেকেও আসবো। আর আপনি তাদের অধিকাংশকেই (আপনার প্রতি) কৃতজ্ঞ পাবেন না।” (৭:১৭)

শয়তানের এ মিশন বাস্তবায়নে সে চতুর্মুখী হামলা অব্যাহত রেখেছে। সে যেকোনো ভালো তৎপরতাকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য সামনে থেকে আসে তথা তার বন্ধু কাফিরদের মাধ্যমে সৎ কর্মপ্রচেষ্টা অবলম্বনকারী মু’মিনদের উপর প্রত্যক্ষ হামলা করে। কখনো সে পেছন থেকে আসে তথা মু’মিনদের বিরুদ্ধে অপবাদ-অপপ্রচার চালায়। আবার সে অনেক সময় ডান দিক থেকে আসে তথা ধর্মের লেবাসে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এছাড়া সে অনেক সময় বাম দিক থেকে আসে তথা সরাসরি অধর্ম বা অনৈতকতা, অন্যায় ও অশ্লীল কাজের প্রতি চাকচিক্য ও মোহ সৃষ্টি করার মাধ্যমে মানুষকে সেদিকে টেনে নিতে চেষ্টা করে।

এমতাবস্থায় শয়তানের চতুর্মুখী হামলায় কখনো কখনো সমাজে ব্যাপকভাবে নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় পাপ কাজ করা খুবই সহজ এবং ভালো কাজ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। তখন সমাজ সংস্কারের চেষ্টাও অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। বরং কখনো তো এমন অবস্থা দেখা দেয় যে, সমাজ সংসারে অবস্থানরত অবস্থায় সত্যের সিপাহীদেরকে নিজেদের চরিত্র বজায় রাখার ক্ষেত্রেই কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। এরূপ অবস্থায় অনেকে হতাশ হয়ে পড়ে এবং সমাজ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো নিরিবিলি স্থানে নিজ নিজ ঈমান ও চরিত্র রক্ষার বিষয়কে উত্তম সাব্যস্ত করে।

কিন্তু এরূপ নাজুক অবস্থাতে খুব সতর্কতার সাথে জীবন যাপন পদ্ধতি অবলম্বন করা যেমন জরুরি, তেমনি এটাও মনে রাখতে হবে যে, মু’মিনদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে ঈমানের ভিত্তিতে সমাজ সংশোধনে ভূমিকা রাখার জন্য। এ কাজে নিজেদের ঈমান ও চরিত্র এমন পুঁজিস্বরূপ যা বিনিয়োগ করে তারা সমাজের কল্যাণকে লাভ হিসেবে পেতে চায়। পুঁজি বিনিয়োগ যেমন লাভজনক হতে পারে, তেমনি তাতে ক্ষতিরও ঝুঁকি থাকে, তবুও তা বাজারে আবর্তিত রাখতে হয় এবং ক্ষতি এড়ানোর জন্য সাবধান থাকতে হয়। অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে, ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে থাকা বাতি যেমন সাধারণ পথিকদের জন্য কাজে আসে না, তেমনি নিজেদেরকে সমাজ থেকে পৃথক করে নিলে নিজেদের কথা ও কাজের মাধ্যমে সমাজের সামনে সত্যের সাক্ষ্য প্রদানের দায়িত্ব পালন করা যায় না।

আরেকটি বিষয় হলো, কোনো এলাকায় মহামারী দেখা দিলে তা মোকাবেলা তথা তা থেকে নিজেদেরকে ও অন্যদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র নিজেদেরকে ঐ এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া যেমন একদিকে সমাজের প্রতি দায়িত্বহীন আচরণ, তেমনি অন্যদিকে ঐ মহামারী ক্রমে আরো বৃদ্ধি পেয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক বিপর্যয় প্রতিরোধের জন্য মু’মিনদের যে সমষ্টিগত দায়িত্ব রয়েছে তা থেকে উদাসীন থাকার কোনো অবকাশ নেই। আর এ দায়িত্ব সুশৃঙ্খলভাবে পালনের জন্য ‘উলিল আমর’ নির্ধারণের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে।

নিজেরা অন্যায় থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি অন্যদেরকে অন্যায় থেকে বিরত রাখার দায়িত্ব এবং সেই দায়িত্ব পালন না করার পরিণতি সম্পর্কে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষনীয়:

৮:২৫ :: আর তোমরা সেই ফিতনা (শাস্তি) থেকে সাবধান হও, যা তোমাদের মধ্য থেকে যারা জুলুম করেছে শুধুমাত্র তাদের উপরেই আপতিত হবে না। আর জেনে রেখো যে, আল্লাহ শাস্তিদানে খুবই কঠোর।

৫:৭৮-৭৯ :: বানী ইসরাইলের মধ্যে যারা কুফর করেছে তাদেরকে দাউদ এবং ঈসা ইবনে মারইয়ামের জবানে অভিশাপ দেয়া হয়েছে। এটা এজন্য যে, তারা অবাধ্যতা করেছিলো এবং তারা সীমালঙ্ঘন করেতো। তারা একে অন্যকে মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতো না, ফলে তারা তা করতে থাকতো। কতো নিকৃষ্ট, যা তারা করতো!

৫:৬৩ :: কেন তাদের আহবার ও রুহবান (ধর্মীয় পণ্ডিত ও সন্ন্যাসীরা) তাদেরকে পাপ কথা বলা থেকে এবং অবৈধ ভক্ষণ থেকে নিষেধ করে না? তারা যা করে আসছে তা কতইনা নিকৃষ্ট!

১১:১১৬ :: তোমাদের পূর্ব যুগের লোকদের মধ্যে এমন লোকেরা কেন অবশিষ্ট থাকে নি, যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি থেকে বিরত রাখতো, তাদের মধ্যকার অল্পকিছুসংখ্যক ছাড়া, যাদেরকে আমরা নাজাত দিয়েছিলাম। আর যারা জুলুম করেছিলো তাদেরকে যে বিলাসব্যসন দেয়া হয়েছিলো তারা তার পেছনেই পড়ে ছিলো, আর তারা ছিলো অপরাধী।

৭:১৬৪-১৬৫ :: আর যখন তাদের মধ্য থেকে একটি দল (অন্য দলকে) বললো, “কেন তোমরা তাদেরকে উপদেশ দিচ্ছো যাদেরকে (তাদের পাপের কারণে) আল্লাহ ধ্বংস করবেন অথবা কঠিন শাস্তি দিবেন?” তারা বললো, “তোমাদের প্রভুর কাছে (দায়িত্ব পালন না করার) অভিযোগ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এবং যেন তারা স্রষ্টা-সচেতন হতে পারে।” তারপর যখন তারা তাদেরকে যে স্মরণীয় উপদেশ দেয়া হয়েছিলো তা ভুলে গেলো, তখন আমরা তাদেরকে নাজাত দিলাম যারা মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতো এবং যারা জুলুম করতো তাদেরকে নিকৃষ্ট শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলাম, কারণ তারা অবাধ্য হয়ে গিয়েছিলো।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের আলোকে বলা যায় যে, সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক বিপর্যয় দেখা দিলে মু’মিনরা ঐ সমাজে তাদের সমষ্টিগত কার্যক্রমের মাধ্যমে যথাসাধ্য ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায় প্রতিরোধের দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। কোনো সমাজে সাধ্যমতো কাজ করার পরও কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা না গেলে এবং অন্যত্র একটি আদর্শ সমাজ গঠনের সুযোগ তৈরি হলে অবশ্যই সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে এবং এমনকি কখনো কখনো দ্বীনের খাতিরে হিজরাত অপরিহার্য হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু যথাসাধ্য দায়িত্ব পালনের সুযোগকে উপেক্ষা করে সমষ্টিগত কার্যক্রম পরিহার করা যেতে পারে না।

নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো : বাস্তব উপযোগিতা বিশ্লেষণ

“উলিল আমর বা নেতা নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতি” বিষয়টি একটি বহুমাত্রিক সম্পর্কযুক্ত আলোচ্য বিষয়। নেতা নির্বাচনের অর্থ হলো একটি নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো বা সাংগঠনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠাকরণ। পারিপার্শ্বিক বাস্তবতায় সাংগঠনিক কাঠামোর অস্তিত্ব ও গুরুত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নেতা নির্বাচন বা সাংগঠনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায়। এছাড়া যারা আল কুরআন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছেন তাদের মধ্যকার মতভেদ নিরসনে এবং আল কুরআনের বিধানাবলীর বাস্তবায়ন বা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও এরূপ সাংগঠনিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয় বা অন্য কথায় বলা যায়, আশাবাদ পোষণ করা হয় যে, এরূপ সাংগঠনিক কাঠামো বা নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো এসব সমস্যার সমাধান করবে।

পক্ষান্তরে কিছু বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা তথা প্রকৃত কার্যকর ও স্থায়ী সাংগঠনিক কাঠামো না হলেও মূলত: প্রত্যেক মূল আহবায়ক বা প্রাগ্রসর গবেষকের সাথে সম্পৃক্তদের যে একটি সংঘবদ্ধতার কাঠামো গড়ে উঠে তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং বাস্তবসম্মত ও যুক্তিপূর্ণ অভিযোগ-আপত্তির প্রেক্ষিতে বা সূক্ষ্ম বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গিতে সাংগঠনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠাকরণের বাস্তব উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে।

মুসলিম উম্মাহর জন্য নেতা নির্বাচন বা সাংগঠনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক কিছু প্রশ্ন হলো: আসলেই কি সাংগঠনিক কাঠামো কোনো অনিবার্য প্রয়োজনীয় বিষয়? এটি বাস্তব সমস্যার সমাধানে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নাকি নতুন সমস্যার উদ্ভবের নামান্তর? এটি কি ঐক্যবদ্ধতা আনয়নে সক্ষম নাকি ঐক্যহীনতা ও পারস্পরিক অভিযোগের ক্ষেত্রকে বাড়িয়ে তুলবে? এটি দ্বীনের ক্ষেত্রে কোনো জরুরি বিষয় নাকি প্রত্যেক ব্যক্তি দ্বীনী ব্যক্তিত্ব অর্জনই দ্বীনের দাবি এবং প্রচলিত সমাজ রীতিতে চলমান নেতৃত্ব ধারার কাছে ইসলাম বাস্তবায়নের আহবান জানানো এবং তারা সাড়া দিলে ভালো, না দিলে নিজ নিজ ব্যক্তিজীবনে ইসলাম মেনে চলাই সঠিক কর্মনীতি? ইসলামে কি আসলেই রাষ্ট্র কাঠামোর মতো সাংগঠনিক কাঠামোর কোনো মূল্য আছে নাকি ব্যক্তিগত ব্যক্তিত্বই প্রকৃত মূল্যের অধিকারী? সাংগঠনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার পেছনে নেতাগিরির অভিলাষ এবং এর মাধ্যমে কাঠামোর বাহিরে যারা থাকবে তাদের প্রতি বৈষম্য বা অবমূল্যায়নের এবং তাদের প্রতি অসঙ্গত অভিযোগ আরোপের সম্ভাবনার বিষয়গুলো উপেক্ষা করা যেতে পারে কি? সাংগঠনিক কাঠামোর মাধ্যমে একটা দ্বন্দ্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি এবং সাংগঠনিক কাঠামোর নেতৃত্ব স্তরের কর্তৃক অন্যদের উপর স্বীয় মতবাদ চাপিয়ে দেয়া এবং স্বীয় মতবাদ দ্বারা বিচার পদ্ধতি চালু করার যে ধারা জারি হবে তা দ্বীনের ব্যাপকতাসম্পন্ন ও প্রক্রিয়াশীল ব্যবস্থা, ব্যক্তিস্বাধীনতা বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিক আত্মবিকাশ ও সমাজ সংস্কারের স্বাভাবিক ক্রমধারার পথে প্রতিবন্ধকতা আরোপ করার একটা উপায়ে পরিণত হবার যে অশুভ সম্ভাবনা রয়েছে এ কথা অস্বীকার করা যেতে পারে কি? সাংগঠনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠাকরণের আগে আত্মগঠন বা ব্যক্তিজীবনে ইসলাম পরিপালনের উপর গুরুত্ব দেয়াই কি বেশি যথাযথ নয়? বা, ব্যক্তিজীবনে ইসলাম বাস্তবায়নই কি সাংগঠনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠাকরণের সঠিক উপায় ও পূর্বশর্ত নয়?

উপরোল্লেখিত প্রশ্নগুলোর প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মুসলিম উম্মাহর সাংগঠনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা বা নেতা নির্বাচনের বিষয়টি এমনভাবে বিবেচনা করতে হবে যে, যেন তাতে এ বিষয়ে কুরআনের নির্দেশনার যথাযথ প্রয়োগ হয় এবং সেই সাথে এর পক্ষে-বিপক্ষে থাকা ইতিবাচক-নেতিবাচক সম্ভাবনার সঠিক সমাধানও উপলব্ধি করা যায়।

এ বিষয়ে সর্বপ্রথম উদ্দেশ্যের প্রশ্নটি বিবেচ্য। একটি কাজের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিবেচিত হয়ে থাকে। ১. সত্য ও ন্যায়ের মানদণ্ডে কাজটির বিষয়গত ধরন, ২. কাজটির উদ্দেশ্য এবং ৩. কাজটির কার্যকারণ ও ফলাফল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চুরি করাকে সবাই একবাক্যে একটি মন্দকাজ হিসেবে বিবেচনা করেন। অর্থাৎ বিষয়গত ধরন হিসেবে এটি মন্দ হিসেবে সাব্যস্ত। তারপর চুরি করার উদ্দেশ্য যদি হয় ধনীর সম্পদ চুরি করে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিবে, তবুও তা গ্রহণযোগ্য নয়, এবং এ অগ্রহণযোগ্যতার পেছনে যুক্তিসঙ্গত উত্তর রয়েছে। এখন কাজটির কার্যকারণ ও ফলাফলের প্রশ্ন। যদি কেউ কোনো কাজের সুযোগ পায় নি, কোনোভাবে কারো থেকে সহযোগিতা পায় নি এবং কোথাও আর্জি পেশ করেও এর সমাধান পায় নি, অত:পর ক্ষুধার জ্বালায় চুরি করেছে। তাহলে এ অবস্থায় তার এ কাজকে সাধারণ বিবেচনার চেয়ে ভিন্নভাবে বিবেচনা করা হবে, এটাই স্বাভাবিক। আর ফলাফলের ক্ষেত্রে, কেউ চুরি করার পর তার ফলাফল হিসেবে কী পরিমাণ মন্দ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে সেটা তার অপরাধের ওজন বা ভারকে বাড়িয়ে দিবে, এটাই স্বাভাবিক।

এবার মন্দ কাজের বিপরীতে ভালো কাজের উদাহরণ দেয়া যাক। কেউ যদি সালাত করে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে, তাহলে তার সালাত করা আর ভালো কাজ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয় না। এখন কোনো সমাজে যদি এরূপ সালাতকারীর সংখ্যা বেড়ে যায় তাহলে তার কারণে অন্যরা যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে, আমরা সালাত করাই ছেড়ে দেবো, তা কি গ্রহণযোগ্য হবে? ঠিক এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, যদি কুরআনী মানদণ্ডে পরামর্শ ভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠাকরণ একটি করণীয় কাজ হিসেবে সাব্যস্ত হয়, তবে এর সঠিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে এবং যারা এ বিষয়টির অপব্যবহার করছে বা করবে তাদেরকে কুরআনের নির্দেশিত পদ্ধতিতে মোকাবিলা করতে হবে। তাহলে এক্ষেত্রে যেসব দ্বিধাদ্বন্দ্ব সামনে আসছে তার যথাযথ সমাধানও খুঁজে পাওয়া বা বুঝে নেওয়া যাবে।

একই ধরনের কাজের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি/উদ্দেশ্যগত তারতম্যকে বিবেচনা করে কাজটি গ্রহণযোগ্য বা অগ্রহণযোগ্য বলে সাব্যস্ত হতে পারে। যেমন: “অন্যায়ভাবে কারো বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য গোয়েন্দাগিরি” এবং “কারো অন্যায় হস্তক্ষেপের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য গোয়েন্দাগিরি” একইভাবে মূল্যায়িত হয় না। অনুরূপভাবে “সুবিধাবাদী মনোভাবে মুখে নিজ বিশ্বাসের বিপরীত বলা” এবং “অন্যায়ভাবে কারো উপর চাপিয়ে দেয়া অসুবিধা থেকে বাঁচার জন্য মুখে নিজ বিশ্বাসের বিপরীত বলা” একইভাবে মূল্যায়িত হয় না। সুতরাং কোনো বিষয়ের গ্রহণযোগ্যতা তার উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি অনুসারে নির্ণয় করা উচিত। বিশেষ করে যেক্ষেত্রে একটি বিষয় কোনো সদুদ্দেশ্যে অপরিহার্য সেটাকে বিকৃতি থেকে রক্ষার জন্য সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন, কিন্তু বিষয়টিকে সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা যেতে পারে না। আর তাই সন্দেহ, সমালোচনা ও সংকটের আশংকা সত্ত্বেও মুসলিম উম্মাহর মধ্যে নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো প্রতিষ্ঠা ও সমষ্টিগত কার্যক্রম পরিচালনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যেহেতু কুরআনে এ বিষয়ে নির্দেশ রয়েছে এবং অবশ্যই এই নির্দেশের বাস্তবায়ন মানব সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ও কল্যাণের জন্য একান্ত আবশ্যক।

আলোচ্য বিষয়ে যেসব মু’মিনদের মধ্যে নিষ্পৃহতা কাজ করে তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, আল কুরআন অনুযায়ী ঈমান ও আমলে সালেহ (বিশ্বাস ও সৎকর্ম) করলেই জান্নাত পাওয়া যাবে। তাই অনেকে এ বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন না এবং সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে দলাদলি বাড়বে নাকি কমবে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আত্মসাতের ঘটনা ঘটবে কিনা এবং নেতৃত্বের পক্ষ থেকে নিজেদের বুঝ-ব্যবস্থা অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়া হবে কিনা এসব সংশয় থেকে এ বিষয়ে নিষ্পৃহ থাকাকেই উত্তম মনে করেন। অথচ এ বিষয়টি যেহেতু আল কুরআনের একটি নির্দেশ তাই এটিও যে আমলে সালেহের অন্তর্ভুক্ত এবং এটি ছাড়া জান্নাতের নিশ্চয়তা নেই, তাঁরা কুরআনী মানদণ্ডে তা যাচাই করার কাজটুকু করেন না। আর অন্য যেসব সংশয়-আশংকা, তার প্রতিটি সম্ভাব্য সমস্যার সমাধান আল কুরআন কিভাবে উপস্থাপন করেছে সেটাই আমাদের অনুসন্ধান ও অবলম্বন করা কর্তব্য, নিতান্ত সমস্যার আশংকার কারণে করণীয় সম্পাদন থেকে নিষ্ক্রিয় থাকা উচিত নয়।

সাধারণত সাংগঠনিক নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো পছন্দ না করার একটি কারণ হলো: অনেকে তাদের কাজকর্মের উপর অন্যের বিধি-নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ বা কাউকে কৈফিয়ত দেয়া পছন্দ করে না, একে তারা ব্যক্তি-স্বাধীনতার পরিপন্থী মনে করে। আর নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো অপছন্দ করার দ্বিতীয় কারণ হলো: স্বৈরতান্ত্রিক অপশাসনের অভিজ্ঞতার ফলে নেতৃত্ব ব্যবস্থার প্রতি অনীহা। কিন্তু এ দুটি বিষয় নেতৃত্বের অপপ্রয়োগের বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার নীতি প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করা উচিত, স্বয়ং নেতৃত্ব ব্যবস্থার অবসান ঘটানোর দিকে নয়। কারণ ব্যক্তি-স্বাধীনতা অবশ্যই নৈতিক মূল্যমানভিত্তিক নিয়ম-নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। অন্যথায় মানব সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। অনুরূপভাবে অপশাসনের বিপরীতে ইনসাফ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্যও নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই নেতৃত্ব যেন অপশাসন দ্বারা কলুষিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, কিন্তু স্বয়ং নেতৃত্ব ব্যবস্থাকে অস্বীকৃতি জানানো সঠিক কর্মপন্থা নয়।

আল্লাহ যদি বলতেন যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ কোনোভাবেই কোনো আদেশ দিতে পারবে না, তাহলে আল্লাহ ছাড়া কারো আদেশ পালন করা হতো শিরক। কিন্তু আল্লাহ মানুষকে একটা নির্বাহী জীবন রীতির উপর সৃষ্টি করেছেন, যেখানে তার কর্ম সম্পাদনে ঊর্ধ্বতন বা কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি সৃষ্টি হয়, এবং তার শৃংখলার স্বার্থে তাকে নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো রক্ষা করতে হয়। এখন এই সকল আনুগত্য হয়ে যায় আল্লাহর আনুগত্যের অধীন, যদি তা হয় আল্লাহর আনুগত্যের সীমারেখা লংঘন না করে। অর্থাৎ যেক্ষেত্রে আল্লাহর কোনো আদেশ আছে তাতে অন্য কেউ অন্য কোনো আদেশ দিতে পারবে না, আল্লাহর সীমারেখার মধ্যে নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো রক্ষা করাই হবে যাবতীয় আদেশের সীমাবদ্ধ অবস্থান। যেখানে আল্লাহর আদেশ হচ্ছে স্থায়ী গুরুত্বসম্পন্ন, সেখানে আল্লাহর আদেশের সীমারেখায় অন্য আদেশ হতে পারে অস্থায়ী/ পরিবর্তনশীল ধরনের। আর যে আদেশের মূল লক্ষ্য হবে আল্লাহর আদেশকে নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা, সেরূপ আদেশ কাঠামোই হচ্ছে ‘উলিল আমর’ তথা “সাংবিধানিক বিধান কার্যকর করার উদ্দেশ্যে পরিগঠিত নির্বাহী আদেশ দানের অধিকারী ব্যক্তিসত্তার” নির্ধারণ। উলিল আমর হচ্ছেন সেই ব্যক্তিসত্তা যিনি মু’মিনদের মধ্য থেকে পরামর্শক্রমে নির্ধারিত এবং আল কুরআনের ভিত্তিতে মু’মিনদেরকে পরিচালনার কর্তৃত্বসম্পন্ন, যাঁর কাছে নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-ভার অর্পণ করতে হবে এবং যিনি আল কুরআনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অনুসারে সমাজে সম্পদের সঠিক বণ্টনের দায়-দায়িত্ব পালন করবেন।

আল কুরআনের দাবি হলো কোনো মানুষ না অন্য মানুষের প্রভু বা বিধাতা সেজে বসতে পারবে আর না অন্য মানুষকে নিজের প্রভু বা বিধাতা হিসেবে মেনে নিতে পারবে। বরং তারা সবাই আল্লাহর দাসত্বকারী হবে এবং একমাত্র আল্লাহই তাদের সবার একক প্রভু। সুতরাং মানুষের মধ্যে যে নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো গড়ে উঠবে তা শুধুমাত্র তাদের সমষ্টিগত কার্যক্রমকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে পরিচালনার জন্য হতে হবে। আর তাই উলিল আমরকে অবশ্যই দুটি প্রধান শর্ত পূরণ করতে হবে: (১) আল কুরআনে থাকা বিধানকেই মূল বিধান হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং কোনোক্রমে তা লঙ্ঘন করা যাবে না এবং (২) ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি বা প্রবৃত্তি অনুসারে পরিচালনা করতে পারবে না, বরং আদেশ বা সিদ্ধান্তের পিছনে সমষ্টিগত কল্যাণের উপযোগিতা থাকতে হবে।

সাংগঠনিক কাঠামোবদ্ধভাবে কার্যক্রম সম্পাদনের ক্ষেত্রে একটি আপত্তি হলো: এর মাধ্যমে নেতৃত্ব দানকারীরা নিজেদের বুঝ অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। এ আপত্তির জবাবে বলা যায় যে, যেক্ষেত্রে উপলব্ধির পার্থক্য রয়েছে সেক্ষেত্রে কীভাবে সমাধানে পৌঁছা যাবে সেজন্য কুরআনে থাকা নির্দেশনার অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই মু’মিনদের মধ্যে উপলব্ধির ভিন্নতা থাকবে এবং তার কোনো সমাধান পদ্ধতিও অবলম্বন করা হবে না এবং কোনো ক্ষেত্রেই কোনো সমষ্টিগত বিধান বাস্তবায়নও করা হবে না- কুরআনে বর্ণিত বিধানসমূহ কি সত্যি এরূপ প্রকৃতির? আর যদি বিধানসমূহ এরূপ প্রকৃতির হয়ে থাকে তাহলে ঐ বিধানসমূহের বাস্তব উপযোগিতা কী? বস্তুত কিছু লোক অযৌক্তিকভাবে ভিন্নরূপ উপলব্ধির কথা বলে বিধায় (যেমন আইনকে রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করা, অথচ আইন রূপক ভাষায় দেয়া যৌক্তিক নয়) যারা কোনো বিধানকে সুষ্পষ্ট হিসেবে অনুধাবন করবে তারাও তা প্রয়োগ না করা যৌক্তিক হতে পারে না।

যারা কোনো কাজকে এগিয়ে নিতে সক্রিয় হয় তাদের কাজে কখনো ভুল-ভ্রান্তিও হয়ে যায়। এক্ষেত্রে অবশ্যই সঠিক ব্যবস্থার মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত দোষ এবং অনিচ্ছাকৃত ভুল উভয়টির মোকাবেলার প্রক্রিয়া বজায় রাখতে হবে। আল্লাহর উপর ভরসা করে যথাসাধ্য সঠিকভাবে কাজ করে যেতে হবে, যারা অযথা সমালোচনা করে তাদের সমালোচনায় হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। বস্তুত অযথা অভিযোগকারীরা পিছে পড়ে থাকবে এবং যারা আল্লাহর উপর ভরসা রেখে সঠিক পদ্ধতিতে নিজেদেরকে সংশোধনের মাধ্যমে সক্রিয় থাকে তারাই সফলতার দিকে এগিয়ে যাবে। বস্তুত কোনো ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি ভাবও গ্রহণযোগ্য নয় আবার উদাসীনতা ও অলসতাও গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআন থেকে জানা যায় যে, যারা প্রতিরোধযুদ্ধের জন্য পীড়াপীড়ি করেছিল, তার নির্দেশ আসার পর তারাই পলায়নী মনোভাব দেখিয়েছিল। সুতরাং এ ধরনের লোকদের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে কুরআনের শিক্ষা ও বাস্তব পরিস্থিতির দাবি অনুসারে বিচক্ষণতার সাথে সমষ্টিগত কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো বা সমষ্টিগত কার্যক্রম শুধুমাত্র পারস্পরিক দ্বন্দ্ব হলে তা নিরসনের জন্য নয়, বরং নৈতিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচী বাস্তবায়নও এর অন্যতম উদ্দেশ্য। যারা মনে করেন যে, কোনোরূপ সাংগঠনিক পদ্ধতি ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে আত্মশুদ্ধি অবলম্বনের মাধ্যমে পরকালের প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন তাঁরা আত্মশুদ্ধির ক্ষেত্রে সাংগঠনিক প্রচেষ্টার ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন নন। বস্তুত মু’মিনদের সাংগঠনিক কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তা নৈতিক পরিশুদ্ধির কারখানা হিসেবে কাজ করবে।

“হে নবী, মু’মিন পুরুষদেরকে বলুন যেন তারা স্বীয় দৃষ্টি সংযত করে, ….. হে নবী, মু’মিন নারীদেরকে বলুন যেন তারা স্বীয় দৃষ্টি সংযত করে …..।” (২৪:৩০-৩১)। নবীর কাছ থেকে এ ধরণের কথা শুনে তা অনুযায়ী নিজেদেরকে সংশোধন করার জন্যই মু’মিনরা নবীর কাছে ভিড় জমাতো।

কেউ যদি মনে করে যে, ‘আমি আত্মসংশোধিত, আমাকে কোনো পারস্পরিক সংশোধনী প্রক্রিয়া দ্বারা সংশোধিত হতে হবে না’ তাহলে তা তার আত্মসংশোধিত না হওয়ারই প্রমাণবহ। কারণ এরূপ ধারণা এক প্রকার অহংকার অথচ প্রকৃত আত্মসংশোধিত ব্যক্তি অহংকারী হতে পারে না। এছাড়া আত্মসংশোধন একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া, এ মুহুর্তে আমি কোনো একটি দোষ থেকে মুক্ত থাকার মানে এ নয় যে, আমি কখনোই ঐ দোষে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ মুহুর্তে আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার মানে এ নয় যে, আমার প্রতিজ্ঞা কখনোই দুর্বল হবে না। এ মুহুর্তে কোনো বিষয়ে আমার জ্ঞান সক্রিয় থাকার মানে এ নয় যে, আমার এ জ্ঞান কখনোই অসচেতনার দ্বারা নিষ্ক্রিয় হবে না। সুতরাং আত্মসংশোধনের কারখানা এ জন্য যে, উহা আমার মধ্যে একটা প্রবাহ সৃষ্টি করবে এবং আমার যোগ্যতাকে বাড়িয়ে দিবে। এটা হচ্ছে জ্ঞানের সাধনার দ্বারা জ্ঞান বৃদ্ধির প্রচেষ্টার মতো। যথার্থ জ্ঞানীরা বিনয়ী হয় এবং জ্ঞানের বড়াই তারাই করে যারা জ্ঞানের গভীরতা থেকে বঞ্চিত, শুধু কতক জ্ঞানগত স্থূল উপাত্ত যাদের মস্তিষ্ককে দেমাগী বানিয়ে দিয়েছে।
যারা আদব জানে ও রক্ষা করে তারাই আরো ভালভাবে আদব শিক্ষার জন্য নৈতিকতা ও শিষ্টাচার শিক্ষা কেন্দ্রে জড়ো হয়। আর যারা বেয়াদব তাদেরকে তো আদব শিখাতে হয় শাস্তিদানের মাধ্যমেই। যারা মনে করে যে, “আমি যথেষ্ট আদব জানি এবং আদব প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবেই জানে, তাই আদব শিখার ব্যবস্থা অপ্রয়োজনীয়, অন্তত আমার জন্য” আসলে তারা যথার্থ আদব জানে না এবং যতটুকু জানে তাও রক্ষা করতে পারে না।

সমষ্টিগত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সমাজ সংশোধনের ক্ষেত্রে যারা সক্রিয় থাকবে তাদের আত্মসংশোধনের দিকটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং এজন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করার কাজে সমষ্টিগত যোগাযোগ ও কর্মসূচীকে কাজে লাগাতে হবে। কারণ যারা সমষ্টিগত কার্যক্রমের জন্য সম্মিলিত হয় তাদের অনেকে আত্মসংশোধনের চেয়ে সমাজ সংশোধনের দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে থাকে। অথচ সমাজ সংশোধন তো অবশ্যই করণীয়। কিন্তু উহার স্তরগত অবস্থান হচ্ছে তা দ্বিতীয় স্তরের বিষয়। দ্বিতীয় স্তর বলতে গৌন স্তর নয়, বরং ধাপের পূর্বাপর বুঝানো হয়েছে। আগে নিজে সম্পূর্ণ সংশোধিত হই পরে সমাজ সংশোধন বিষয়টি তা নয়। আগে জানবো, পরে মানবো মানে এ নয় যে, পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় আগে জানা শেষ হবে, তারপর একটা একটা করে মানা হবে, বরং এর অর্থ আগে কোনো একটি বিষয়ে ভালভাবে জানবো, পরে তা মানবো, আবার সেই সাথে আরো আরো বিষয়ের ক্ষেত্রেও এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে। অনুরূপভাবে, আত্মসংশোধন ও সমাজ সংশোধনের বিষয়টিতেও এ একই কথা। কোনো একটি বিষয়ে নিজের দোষ থাকতে সে একই দোষে অন্যকে সমালোচনা করা যায় না, অন্যের দোষ সংশোধনের চেষ্টা করা যায় না। তবে নিজের যে দোষ আছে তা থেকে অন্যকে সংশোধন না করলেও নিজের নেই এমন দোষ থেকে অন্যকে সংশোধন করার ক্ষেত্রেও বিবেচ্য বিষয় হলো, যদি আমার জানাই থাকে যে, আমার এ দোষটি নেই ঠিকই তবে অন্য একটি বড় দোষ আমি লালন করছি তাহলে কেন আমি সে দোষ থেকে নিজেকে মুক্ত না করে সেই দোষটি না হলেও অন্য একটি দোষ থেকে অন্য লোককে সংশোধনে ব্রতী হচ্ছি? এভাবে আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে একদিকে নিজের দোষ সংশোধনের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে এবং সেই সাথে এবং অবশ্যই দ্বিতীয় স্তরের বিষয় হিসাবে সমাজ সংশোধনের প্রয়াসও অব্যাহত থাকবে। আর এক্ষেত্রে নিজেদেরকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য সমষ্টিগত যোগাযোগ ও কর্মসূচীকেও কাজে লাগাতে হবে।

সমষ্টিগত কার্যক্রমের ক্ষেত্রে একটি সংকট হিসেবে দেখা যায় ‘অন্যকে সমালোচনা ও অপরাধী সাব্যস্ত করার প্রবণতা’। বস্তুত আমাদের উচিত প্রথমত আত্মসমালোচনা ও নৈতিকভাবে আত্মগঠন। তারপর অন্যের সমালোচনা হতে পারে তাদেরকে সংশোধনের জন্য এবং সামাজিক সচেতনতা তৈরির জন্য, বিদ্বেষ সৃষ্টির জন্য নয়। আমরা অনেক সময় বাহ্যত অপরাধে জড়িত ব্যক্তির সামগ্রিক প্রেক্ষাপট জানি না। তাই কোনো ব্যক্তিকে অপরাধী হিসাবে নির্দিষ্ট করা আমাদের কাজ নয়। বিচার এলে বিচারক তথ্য প্রমাণ সাপেক্ষে বিচার করবেন। নিজেদের সাংগঠনিক বলয়ে থাকা কোনো ব্যক্তির সংশোধনী অকার্যকর হলেও তার সাথে সম্পর্কহীন হওয়া যাবে না – দুষ্কৃতিকারী না হলে এবং তার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরী হয়ে না পড়লে। নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তির নৈতিক বিচ্যুতি তার নেতৃত্ব বজায় থাকার ক্ষেত্রে আপত্তির যৌক্তিক কারণ। নেতৃত্বহীন সাধারণ ব্যক্তির নৈতিক বিচ্যুতি বিচার সাপেক্ষ এবং মোনাফেকের প্রমাণিত মোনাফেকির বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, যেহেতু আমাদের কাছে কোনো ব্যক্তির বিষয়ে ওহী নাযিল হয় না, তাই আমাদের যাবতীয় মূল্যায়ন সাধ্যসীমায় সাংবিধানিক নীতির প্রয়োগ নির্ভর কিন্তু চূড়ান্ত নিখুঁত হিসাব আল্লাহই করবেন তাঁর শেষ বিচারের মাধ্যমে।

অলস, নিস্পৃহ, নিষ্ক্রিয়, নিষ্ঠাহীন, ত্যাগবিমুখ, দায়িত্ব পালনে উদ্যোগহীন, পারস্পরিক সহযোগিতায় অনগ্রসর, পরোপকারে পশ্চাদপদ, আন্তঃব্যক্তিক দ্বন্দ্বে জড়িত, নিতান্ত অভিযোগপ্রবণ – অভিন্ন আদর্শের বলয়ে থাকা এমন ব্যক্তিদের প্রতি অভিযোগ ও অভিমান যেন তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার ও তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার নিয়ামক না হয়। আমরা যাদের থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পাব না তারাও আমাদের বৃত্তে থাকবে যতক্ষণ তারা উম্মাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা ষড়যন্ত্র করবে না। অন্যদের সক্রিয়তা যেন আমার সক্রিয়তার শর্ত না হয়।

‘জ্ঞান, সম্পদ, সামাজিক সম্মান ও পেশাগত অবস্থানের অহংকার’, ‘শুনা ও শুনানোর ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতি’, ‘কিছু তথ্য (তা যতই মৌলিক হোক) যাদের কাছে এখনো সঠিকভাবে পৌঁছেনি বা পৌঁছলেও পূর্বতন ভুল তথ্যসমূহের প্রভাবে যারা দ্রুত গ্রহণ করতে পারেনি তাদেরকে হেয় করা ও প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত করা’, ‘যোগ্যতা নির্বিশেষে নিজের উপর অন্যের নেতৃত্ব মানতে অনীহাবশত ও অস্বাভাবিকভাবে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়’ ইত্যাদি সাধারণ নৈতিকতার পরিপন্থী। সুতরাং কোনো প্রকৃত মু’মিনের ব্যক্তিচরিত্র এরূপ হতে পারে না। যদি কেউ সত্যিকার উত্তম পরিচালনার জন্য নিজেকে নেতৃত্বের যোগ্য মনে করে তবে উম্মাহর সামনে তা উপস্থাপন করতে পারে এবং স্বাভাবিকভাবে (পক্ষপাত ব্যতীত) উম্মাহর সম্মতি প্রাপ্ত হলে ভালো, নাহলেও তা যেন ক্ষোভ, অভিমান, অভিযোগ ও অপমানবোধের কারণ না হয়।

দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা) বাস্তবায়নের জন্য যে মৌলিক সাংগঠনিক কাঠামো সেটি ‘পারস্পরিক সেবার বিনিময়ে উপার্জনমূলক প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাঠামো’র অনুরূপ নয়। তাই এক্ষেত্রে যে পরামর্শভিত্তিক প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব গঠন করতে হয় তার ধরন ও কার্যক্রম আদর্শগত ঐক্যের স্বাভাবিক প্রেরণার সাথে সম্পর্কিত। অনুরূপভাবে এই সংঘবদ্ধতার বিস্তার ও কর্মসূচী বাস্তবায়নও অন্যান্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা-সংগঠনের চেয়ে ভিন্নরূপ। যেমন এখানে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি সম্পূর্ণত যারা স্বেচ্ছায় দ্বীন ইসলামের দাওয়াতে সাড়া দেবে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া না পাওয়ার সাথে সম্পর্কিত, যেক্ষেত্রে দাওয়াতদানকারীর পক্ষ থেকে কিছুই করার নেই। অনুরূপভাবে কোনো স্থানে কীরূপ সময়ের ব্যবধানে মুসলিম উম্মাহর ক্ষমতায়ন ঘটবে বা আদৌ ঘটবে কিনা সেক্ষেত্রেও কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ বা অনুমান করা সম্ভব নয়। কারণ এ বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে মু’মিনদের নিজেদের মতাদর্শগত প্রেরণার দৃঢ়তা ও নির্দেশনাসমূহের উত্তম অনুসরণ এবং সংশ্লিষ্ট জনপদের জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থনের উপর নির্ভর করে। এ বিষয়ে সঠিক সচেতনতার অভাবও সংঘবদ্ধ কর্মসূচী অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে হতাশা সৃষ্টির কারণ হয়ে থাকে।

সকল প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সঠিক বিশ্বাস, অব্যাহত প্রচেষ্টা ও আশাবাদই ইতিবাচক কর্মনীতি। সুতরাং উপরোল্লেখিত বিষয়গুলোতে সঠিক নীতির চর্চা নিশ্চিত করতে পারলে আশা করা যায় যে, সমষ্টিগত কার্যক্রমের জন্য নেতৃত্ব-আনুগত্য কাঠামো প্রতিষ্ঠার সংকট মোকাবেলা এবং সেটাকে সঠিক উদ্দেশ্য ও কল্যাণকর উপায়ে পরিচালিত করা সম্ভব হতে পারে।

উলিল আমর বনাম ইমাম, খলিফা ও সুলতান প্রসঙ্গ

উলিল আমর সম্পর্কিত নির্দেশনা থেকে স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায় যে, উলিল আমর হলো রসূলের অনুপস্থিতিতে ও তাঁর ওফাতের পরবর্তীতে মুসলিম উম্মাহকে পরিচালনার জন্য মুসলিম উম্মাহর পরামর্শক্রমে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। আবার ‘ইমাম, খলিফা ও সুলতান’ শব্দ তিনটি নেতৃত্ব প্রসঙ্গে বহুল ব্যবহৃত। এই প্রেক্ষিতে এ অধ্যায়ে ‘ইমাম, খলিফা ও সুলতান’ প্রসঙ্গে স্পষ্ট ধারণা অর্জনের জন্য এ বিষয়ে আলোকপাত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে আশা করা যায় যে, উলিল আমর নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনুধাবন এবং পদ্ধতি নির্ণয়ে এসব শব্দের প্রাসঙ্গিকতা কী এবং কিভাবে তা অনুধাবন করা সহজ হবে।

(ক) ইমাম প্রসঙ্গ

নবী প্রথার সমাপ্তির পর কুরআনের বিধিবিধান বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম উম্মাহর পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ কে হবে, এ প্রশ্নের উত্তরে একটি দাবি বা উপলব্ধি হলো, আল্লাহর মনোনীত ইমামগণই এ দায়িত্ব পালন করবেন এবং তাই এরূপ ইমামকে গ্রহণ করে তার অধীনে পরিচালিত হতে হবে। তাই কুরআনের আলোকে ‘ইমাম’ বিষয়ে তথ্যগত সিদ্ধান্তের জন্য নিম্নে ইমাম (এবং এর বহুবচন আয়িম্মাহ) সম্পর্কিত আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হলো।

২:১২৪ :: আর উল্লেখ্য, যখন ইবরাহীমকে তার প্রভু কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর সে তা পূর্ণ করলো (পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো)। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে মানুষের জন্য ‌ইমাম (অনুসরণীয়, নেতা) মনোনীত করেছি’। সে বললো, ‘আমার বংশধরদের থেকেও’? তিনি বললেন, ‘আমার প্রতিশ্রুতি (তাদের মধ্যকার) যালিমদের প্রতি প্রযোজ্য হবে না’।

৯:১২ :: আর যদি তারা তাদের চুক্তির পর তাদের শপথ ভঙ্গ করে এবং তোমাদের দীন সম্পর্কে কটূক্তি করে, তাহলে তোমরা কুফরের ইমামদের (নেতাদের) বিরুদ্ধে লড়াই করো, নিশ্চয় তাদের কাছে শপথ বলে কিছু নেই। (সুতরাং লড়াই করো), যেন তারা বিরত হয়।

১১:১৭ :: তবে কি (সমান হতে পারে) যে তার প্রভুর পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণের উপর রয়েছে এবং তা (ঐ স্পষ্ট প্রমাণ) আবৃত্তি করে তাঁর পক্ষ থেকে একজন সাক্ষী এবং তার পূর্ব থেকে রয়েছে মূসার কিতাব ইমাম (মূল বিধান) হিসেবে এবং রহমত হিসেবে; তারাই সেটার প্রতি (ঐ স্পষ্ট প্রমাণের প্রতি) ঈমান রাখে। আর যে সকল দল সেটার প্রতি (ঐ স্পষ্ট প্রমাণের প্রতি) কুফর করে, তার জন্য প্রতিশ্রুত স্থান হলো (জাহান্নামের) আগুন। সুতরাং তুমি এর মধ্য থেকে কোনো বিষয়ে সন্দেহের মধ্যে থেকো না। নিশ্চয় তা তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে সত্য। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ঈমান আনে না।

১৫:৭৯ :: সুতরাং আমি তাদের থেকে প্রতিশোধ নিলাম। আর এ দুটি (জনপদ- কওমে লূত ও আসহাবুল আয়কার ধ্বংসস্তুপ) সুস্পষ্ট ইমামের (প্রধান পথের) পাশেই রয়েছে।

১৭:৭১ :: সেদিন আমি প্রত্যেক মানবদলকে তাদের ইমামসহ (অনুসরণকৃত নেতাসহ) ডাকবো। তারপর যাকে তার কিতাব (আমলনামা) ডানহাতে দেয়া হবে, তারা তাদের কিতাব (আমলনামা) পড়বে এবং তাদের প্রতি সামান্যও যুলুম করা হবে না।

২১:৭৩ :: আর আমি তাদেরকে (ইবরাহীম, লূত, ইসহাক, ইয়াকুব প্রমুখকে) ইমাম (অনুসরণীয়, নেতা) বানিয়েছিলাম। তারা আমার আদেশের মাধ্যমে সঠিক পথ প্রদর্শন করতো এবং আমি তাদেরকে ওয়াহী করেছিলাম কল্যাণকর্ম সম্পাদনের জন্য এবং সালাত প্রতিষ্ঠার জন্য এবং যাকাত প্রদানের জন্য। আর তারা ছিলো আমারই দাসত্বকারী।

৫:৭৪ :: আর যারা (দয়াময়ের বান্দাগণ) বলে, “আমাদের প্রভু! আমাদেরকে এমন স্ত্রী/স্বামী ও সন্তানাদি দান করুন যাদেরকে দেখে আমদের চোখ প্রশান্তি পায়, আর আমাদেরকে স্রষ্টা সচেতনতা অবলম্বনকারীদের ইমাম (অনুসরণযোগ্য, অগ্রগামী) বানিয়ে দিন।

২৮:৫ :: আর আমি ইচ্ছা করলাম, পৃথিবীতে যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল (বানী ইসরাইল) তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে এবং তাদেরকে ইমাম (নেতা) বানাতে এবং তাদেরকে উত্তরাধিকারী বানাতে।

২৮:৪১ :: আর আমি তাদেরকে (ফিরআউন ও তার পরিষদকে) ইমাম (কাফিরদের নেতা) বানিয়েছিলাম, যারা (জাহান্নামের) আগুনের দিকে ডাকতো। আর কিয়ামাত দিবসে তাদেরকে সাহায্য করা হবে না।

৩২:২৪ :: আর আমি তাদের (বনী ইসরাইলের) মধ্য থেকে ইমাম (অনুসরণীয়, নেতা) বানিয়েছিলাম, যারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথপ্রদর্শন করতো। যখন তারা ধৈর্যশীলতা অবলম্বন করতো এবং আমার আয়াতের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিল।

৩৬:১২ :: নিশ্চয় আমিই মৃতকে জীবিত করি। আর লিখে রাখি যা তারা আগে সম্পাদন করে এবং যা তারা প্রভাব-প্রতিক্রিয়া রেখে যায়। আর সব কিছুই আমি সুস্পষ্ট ইমামের (প্রধান নিবন্ধন বইয়ের) মধ্যে সংখ্যায়িত (লিপিবদ্ধ) করে রেখেছি।

৪৬:১২ :: আর এর পূর্ব থেকে মূসার কিতাব রয়েছে ইমাম (মূল বিধান) ও রহমতস্বরূপ। আর এ কিতাব (কুরআন) তার সত্যায়নকারী, আরবি ভাষায়, যারা যুলুম করে তাদেরকে সতর্ক করার জন্য এবং উত্তম কর্ম সম্পাদনকারীদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ।

আলোচনা: ইমাম শব্দের মূল অর্থ হলো ‘যাকে সামনে রাখা হয়’। ইমাম শব্দটি ব্যক্তি, বস্তু ও স্থান প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে মুত্তাকীদের নেতাকেও ইমাম বলা হয়েছে এবং কাফিরদের নেতাকেও ইমাম বলা হয়েছে। নবী-রসূলগণ আল্লাহর মনোনীত ইমাম। এছাড়া যারাই মু’মিনদের বা কাফিরদের ইমাম হয়, তাদেরকে আল্লাহ মু’মিনদের বা কাফিরদের ইমাম বানিয়েছেন হিসেবে সাব্যস্ত হবে। তবে আল্লাহ ইমাম মনোনীত করার বিষয়টি তাঁর সুনির্দিষ্ট ঘোষণার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে আবার মু’মিনরা মুত্তাক্বী বা আল্লাহ-সচেতনদের ইমাম বা অগ্রগামী হওয়ার প্রার্থনা ও প্রচেষ্টার ফলাফলস্বরূপ তাদেরকে আধ্যাত্মিক গুণাবলিতে সমৃদ্ধ করার সাথেও সম্পর্কিত হতে পারে। যেমন তিনি নবী ইবরাহীমকে ইমাম বানানোর বিষয়টি ঘোষণা করেছেন এবং এটাকে তাঁর প্রতিশ্রুতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং সেই প্রতিশ্রুতি অনুসারে লূত, ইসহাক্ব, ইয়াক্বুব প্রমুখ নবীদেরকেও ইমাম বানিয়েছেন।

আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাবকেও ইমাম বলা হয়, যেহেতু তা সামনে রেখে জীবন যাপন করতে হয়। প্রধান পথকেও ইমাম বলা হয়, যেহেতু সেই পথকে সামনে রেখে শাখা পথগুলোকে চিহ্নিত করা হয়। আমলনামাসমূহের আর্কাইভকেও ইমাম বলা হয়, যেহেতু সেটার সাথে সম্পর্কিত করে প্রত্যেকের আমলনামায় থাকা কাজের মূল্যমান নির্ধারিত হবে যে, সে যে আমল করে মৃত্যুবরণ করেছিল তারপর তা কতটুকু প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
নিজেদেরকে মুত্তাকীদের ইমাম বানানোর জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা শিখানো হয়েছেে। সুতরাং মুত্তাকীদের ইমাম বলতে ‘মুত্তাকীদের অনুসরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব ও মুত্তাক্বী হিসেবে অগ্রগামী’ হওয়া বুঝায়।

ক্বিয়ামাত দিবসে প্রত্যেক মানবদলকে তাদের ইমামসহ আহবান করা হবে। যেমন, ফেরাউন যেহেতু কাফিরদের ইমাম ছিল, তাই সে তার অনুসরণকারী জনগোষ্ঠীর সামনে থাকবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ইমামসহ আহবানের একটি দিক হতে পারে যে জনগোষ্ঠী কোনো ব্যক্তিকে ইমাম হিসেবে অনুসরণ করে তাদেরকে যেমন সেই ইমামসহ আহবান করা হবে, তেমনি যে জনগোষ্ঠী কোনো বিশেষ সংবিধান, গ্রন্থ, চার্টার বা দফাকে সামনে রেখে তার সামগ্রিক কর্মকাণ্ডকে পরিচালিত করে তাকে সেই বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করে আহবান করা হবে।

১১:৯৬-৯৯ :: আর আমি মূসাকে প্রেরণ করেছি আমার আয়াতসমূহ ও সুস্পষ্ট প্রমাণসহ। ফিরআউন ও তার নির্বাহী পরিষদের কাছে। অতঃপর তারা ফিরআউনের নির্দেশ ও কার্যনীতি অনুসরণ করলো। অথচ ফিরআউনের নির্দেশ ও কার্যনীতি সত্যভিত্তিক ছিল না। সে ক্বিয়ামাত দিবসে তার ক্বওমের সামনে থাকবে এবং তাদেরকে (জাহান্নামের আগুনে) উপনীত করবে। আর যেখানে তারা উপনীত হবে তা কত নিকৃষ্ট উপনীত হওয়ার স্থান! এ দুনিয়াতেও তাদেরকে অভিশাপ তাড়া করেছে এবং ক্বিয়ামাত দিবসেও। কী নিকৃষ্ট প্রতিদান, যা তাদেরকে দেয়া হবে!

সুতরাং ভালো কাজের ক্ষেত্রে এবং মন্দ কাজের ক্ষেত্রে যাদেরকে সামনে রেখে বা যাদের আদর্শ (ideology) ও নির্দেশ (instruction) অনুসরণ করে জীবন যাপন ও কার্যক্রম করা হয় তারাই হলো ‘ইমাম’। মু’মিনরা চেষ্টা করবে ঈমান ও সৎকর্মের ক্ষেত্রে ইমাম বা অনুসরণযোগ্য হওয়ার জন্য। আর স্বভাবতই তাদের সমষ্টিগত কার্যক্রমের পরিচালনা পর্যায়ের দায়-দায়িত্বের জন্য যে উলিল আমর নির্বাচনের বিষয় রয়েছে, সেক্ষেত্রেও তারা তাদের মধ্যে যাদেরকে ইমাম হিসেবে দেখতে পাবে অর্থাৎ ঈমানদারি ও সৎকর্মের ক্ষেত্রে অনুসরণযোগ্য দেখতে পাবে, তাদের মধ্য থেকেই ‘উলিল আমর’ নির্বাচনের চেষ্টা করবে। মু’মিনদের একটি প্রার্থনার বিষয় হলো যেন আল্লাহ তাকে মুত্তাক্বীদের ইমাম (স্রষ্টা-সচেতনদের অগ্রগামী) বানিয়ে দেন।

উলিল আমর ও ইমামের একটি পার্থক্য হতে পারে: উলিল আমর হয় পরিচালনাগত কর্তৃত্বের অধিকারী। কিন্তু ইমাম পরিচালনাগত কর্তৃত্বের অধিকারী হতেও পারেন, নাও হতে পারেন, কিন্তু জনমনে তাঁর কাজের প্রভাব থাকে এবং তাঁকে অনুসরণ করা হয়। উলিল আমর শৃঙ্খলাগত কারণে কাউকে নিজেদের কর্তৃত্ব অর্পণের সাথে সম্পর্কিত।

ফেরাউন একই সাথে কুফর বা সত্য প্রত্যাখ্যান করার দিক থেকে অগ্রগণ্য ছিল এবং একজন শাসক ছিল। এছাড়া কাফিরদের ইমামদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নির্দেশনা রয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, শাসনগত নেতা এবং অনুশাসনগত বা মতাদর্শগত অনুপ্রেরণাদায়ক নেতা উভয়ই ইমাম হিসেবে পরিগণ্য হতে পারে। অনুরূপভাবে মু’মিনদের উলিল আমরও মু’মিনদের ইমাম হিসেবে পরিগণ্য হতে পারে। তবে উলিল আমরের সাথে তানাযা’ বা মতবিরোধ হতে পারে এবং প্রয়োজনে উলিল আমরের অপসারণ বা পরিবর্তন ঘটতে পারে। এই প্রেক্ষিতে উলিল আমর এবং যাকে আল্লাহ মুত্তাকীদের ইমামে পরিণত করেন এ দুই বিষয়ের মধ্যে একটা পার্থক্যও থেকে যায়। যেমন নিজেকে মুত্তাকীদের ইমাম হিসেবে দাবি করার চেয়ে মুত্তাকীদের ইমাম হওয়ার জন্য ঈমান ও সৎকর্মে অগ্রবর্তী হওয়ার চেষ্টা করা স্বাভাবিক, তেমনি নিজেদের মধ্য থেকে যাদেরকে মুত্তাকীদের ইমাম হিসেবে সাধ্যমতো বাহ্যজ্ঞানে পাওয়া যায়, তাদের মধ্য থেকেই উলিল আমর নির্বাচন করা এবং তাদের থেকেই অনুপ্রেরণা, উপলব্ধিগত সমৃদ্ধির সহযোগিতা এবং সুপরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।

পরিশেষে বলা যায় যে, ইমাম শব্দটি প্রধানত প্রভাবের সাথে এবং উলিল আমর শব্দটি প্রধানত আদেশ প্রদানের কর্তৃত্বের সাথে সম্পর্কিত। একজন ব্যক্তি যখন মুত্তাকীদের ইমাম বা অগ্রগামী তথা অধিকতর মুত্তাকী হবে, তখন সে অন্যান্যদেরকে আল্লাহর বিধান অনুসারে পথনির্দেশ করবে এবং অন্যরাও স্বভাবত তার কাছ থেকে পথনির্দেশ গ্রহণ করবে। এটা একটা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক বাস্তবতায় পরিণত হবে। অনেক সময় একজন নৈতিক প্রভাবসম্পন্ন নাগরিককেও কর্তৃত্বসম্পন্ন পরিষদ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

সাধারণত একজন উলিল আমর একজন ইমাম হবেন এটাই স্বাভাবিক বাস্তবতায় পরিণত হওয়ার কথা। অন্যকথায় একজন ইমামকেই পরামর্শক্রমে উলিল আমর হিসেবে নির্ধারণ করা হবে, এটাই স্বাভাবিকভাবে ঘটবে। তবে একজন উলিল আমরের চেয়েও কোন আনুগত্যকারী (মা’মূর) মু’মিন অধিকতর বড় ইমাম হতে পারেন, এটাও অসম্ভব নয়। কারণ উলিল আমরকে মু’মিনরা পরামর্শক্রমে নির্ধারণ করবে এবং এতে তাদের সাধ্যমতো বিবেচনা ও বাহ্যিক জ্ঞানই বিষয়টির নিয়ামক বিধায় তাতে অনিচ্ছাকৃত দুর্বলতা থাকা অসম্ভব নয়। সর্বোপরি, আমাদের সকলকে প্রার্থনা করতে হবে, আমরা সবাই যেন মুত্তাকীদের ইমাম হতে পারি।

(খ) খলীফা প্রসঙ্গ

খলীফা শব্দের অর্থ ‘প্রতিনিধি, স্থলাভিষিক্ত’। কেউ যখন কারো অনুপস্থিতিতে তার প্রতিনিধিত্ব করে তখন তাকে খলীফা বলা হয়। আবার যখন কেউ পূর্ববর্তী কাউকে হটিয়ে বা তার অপসারণের পর ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ত হয়, তাকেও খলীফা বলা হয়। মানুষকে পৃথিবীতে খলীফা বানানো হয়েছে অর্থাৎ পৃথিবীর বস্তুজগত ও প্রাণীজগতের উপর তাকে বিশেষ ধরনের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। যখন পৃথিবীতে মানুষের সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রে কর্তৃত্বশীল শাসকবর্গ জুলুম করে তখন এক পর্যায়ে তাদেরকে অপসারিত করে মুসলিম উম্মাহকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা হয়। এর মাধ্যমে মুসলিমরা এবং তাদের নেতৃত্ব দানকারী রসূল বা উলিল আমর খলীফা হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে। অন্য কথায়, মুসলিম উম্মাহর খেলাফত রাষ্ট্রে উলিল আমর একই সাথে মুসলিম উম্মাহর উলিল আমর হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রাষ্ট্রের (মুলক) রাষ্ট্রপতি (মালিক) এবং খলীফা হিসেবেও আখ্যায়িত হতে পারেন। নিম্নে ‘খলীফা’ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হলো:

২:৩০ :: আর যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদেরকে বললেন, “নিশ্চয় আমি ‘পৃথিবীতে খলীফা’ বানাবো।”। তারা বললো, “আপনি কি তাতে এমন কাউকে নিযুক্ত করবেন যে তাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত করবে?, আর আমরা তো আপনার প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করছি এবং আপনার মাহাত্ম্য বর্ণনা করছি।” তিনি (আল্লাহ) বললেন, “নিশ্চয় আমি জানি, যা তোমরা জান না।”

২:২৫১ :: তারপর তারা আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদেরকে পরাজিত করলো এবং দাউদ জালুতকে হত্যা করলো। আর আল্লাহ তাকে রাজত্ব/ রাষ্ট্রক্ষমতা ও বিচক্ষণতা দিয়েছেন এবং তাকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা তিনি ইচ্ছা করেছেন। আর যদি আল্লাহ মানুষের কাউকে অন্য কারো দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে পৃথিবীতে ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টি হতো। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি অনুগ্রহশীল।

৩৮:২৬ :: হে দাউদ, নিশ্চয় আমি তোমাকে পৃথিবীতে/ভূখণ্ডে খলীফা বানিয়েছি। সুতরাং তুমি মানুষের মধ্যে সঠিকভাবে বিচার-ফায়সালা করো। আর তুমি প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তাহলে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে পথভ্রষ্ট করে দেবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে পথভ্রষ্ট হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি, তারা হিসাব দিবসকে ভুলে থাকার কারণে।

৬:১৬৫ :: আর তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে খলীফা বানিয়েছেন। এবং তিনি তোমাদের এককে অপরের তুলনায় যোগ্যতা-সামর্থ্য ও সুযোগ-সুবিধার বিভিন্ন মাত্রায় উন্নীত করেছেন। যেন তোমাদেরকে যা (কম বা বেশি) দেয়া হয়েছে তা অনুসারে (তা যথাযথভাবে বিবেচনায় রেখে) / তার ক্ষেত্রে (দায়িত্বশীলতার) পরীক্ষা নিতে পারেন। নিশ্চয় তোমার প্রভু (দায়িত্বহীন আচরণের) শাস্তিদানে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণকারী এবং নিশ্চয় তিনি (অনুতপ্তদের প্রতি) ক্ষমাশীল ও দয়ালু।

১০:১৩-১৪ :: আর নিশ্চয় আমরা তোমাদের পূর্বে বহু জনপদকে ধ্বংস করেছি যখন তারা জুলুম করেছিলো। অথচ তাদের কাছে রসূলগণ স্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণাদি সহকারে এসেছিল, কিন্তু তারা ঈমান আনার ছিল না। এভাবেই আমরা অপরাধী জনগোষ্ঠীকে প্রতিফল দিয়ে থাকি। তারপর আমরা তোমাদেরকে তাদের পরে পৃথিবীতে খলীফা বানিয়েছি, তোমরা কীরূপ কর্ম সম্পাদন করো তা লক্ষ্য/পর্যবেক্ষণ করার জন্য।

১০:৭৩ :: তারপর তারা তাকে (নূহকে) মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল। তারপর আমরা তাকে এবং যারা তার সাথে (তার আহবানে সাড়া দানকারী) ছিল তাদেরকে নৌকায় আরোহণ করিয়ে উদ্ধার করেছিলাম এবং তাদের খলীফা বানিয়েছিলাম এবং যারা আমাদের আয়াতসমূহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল তাদেরকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। সুতরাং দেখ যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল (তা সত্ত্বেও সতর্ক না হওয়ায়) তাদের পরিণাম কী হয়েছিল।

৩৫:৩৯ :: তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে খলীফা বানিয়েছেন। সুতরাং যে কুফর (সত্য প্রত্যাখ্যান) করবে তার সত্য প্রত্যাখ্যানের জন্য সে নিজেই দায়ী হবে। কাফিরদের জন্য তাদের কুফর তাদের প্রতিপালকের নিকট শুধু ক্রোধই বৃদ্ধি করে, আর কাফিরদের জন্য তাদের কুফর শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি করে।

৭:৬৯ :: তোমরা কি বিস্মিত হচ্ছো যে, তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্য থেকে এক পুরুষের মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে স্মরণীয় উপদেশ এসেছে। স্মরণ করো যখন তিনি তোমাদেরকে নূহের ক্বওমের পরে খলীফা বানিয়েছেন, এবং তোমাদেরকে দৈহিক গঠনগত বলিষ্ঠতায় সমৃদ্ধ করেছেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো, যেন তোমরা সফলতা লাভ করতে পারো।

৭:৭৪ :: আর স্মরণ করো যখন তিনি তোমাদেরকে আদ সম্প্রদায়ের পরে খলীফা বানিয়েছেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে বসতি দিয়েছেন/ সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তোমরা এর সমতল অঞ্চলে অট্টালিকা বানাচ্ছো এবং পাহাড় কেটে আবাসগৃহ নির্মাণ করছো। সুতরাং তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো এবং পৃথিবীতে বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হয়ে বিচরণ করো না।

২৭:৬২ :: নাকি তিনি (শ্রেষ্ঠ), যিনি নিরূপায়ের প্রার্থনায় সাড়া দেন যখন সে তাঁকে ডাকে এবং তার মন্দ অবস্থা দূর করেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে খলীফা বানিয়েছেন? আল্লাহর সাথে কোনো ইলাহ (সার্বভৌম এবং অলৌকিক ক্ষমতায় প্রয়োজন পূর্ণকারী ও উপাস্য) আছে কি? তোমরা অতি অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাকো।

৭:১৪২ :: আর আমি মূসাকে ত্রিশ রাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম এবং সেটাকে দশ (রাত) দ্বারা পরিপূর্ণ করেছিলাম, ফলে তোমার প্রভুর নির্ধারিত সময়সীমা হলো ‘চল্লিশ রাত’। এবং মূসা তার ভাই হারূনকে বলেছিলো, “আমার ক্বওমের মধ্যে আমার প্রতিনিধিত্ব করো (খলীফা হিসেবে কাজ করো) এবং সংশোধন করো এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পথ অনুসরণ করো না।”

৭:১৫০ :: আর যখন মূসা তার জনগোষ্ঠীর নিকট রাগান্বিত ও বিক্ষুব্ধ অবস্থায় ফিরে গেলো, তখন বললো, “আমার পরে তোমরা আমার (খলীফা হিসেবে) কী মন্দ প্রতিনিধিত্ব করেছো! তোমাদের প্রভুর (পক্ষ থেকে উপাসনা পদ্ধতির) আদেশ আসার আগেই তোমরা (মনগড়াভাবে উপাসনা করতে) তাড়াহুড়া করলে?” আর সে ফলকগুলো ফেলে দিলো আর তার ভাইয়ের মাথা ধরে নিজের দিকে টেনে আনতে লাগলো। সে (হারুন) বললো, “হে আমার মায়ের ছেলে (সহোদর ভাই), এ জাতি আমাকে দুর্বল মনে করেছে এবং আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে। সুতরাং তুমি আমার ব্যাপারে শত্রুদেরকে আনন্দিত করো না এবং আমাকে জালিম ক্বওমের অন্তর্ভুক্ত সাব্যস্ত করো না।”

৭:১৬৯ :: তারপর তাদের স্থলাভিষিক্ত হলো (অযোগ্য) স্থলাভিষিক্তরা এবং তারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হলো। কিন্তু তারা এই দুনিয়ার স্বার্থই হাসিল করলো এবং বললো, আমাদেরকে ক্ষমা করা হবে। অথচ যদি তাদের কাছে আবারো উহার অনুরূপ স্বার্থ আসে, তারা আবারও তা-ই হাসিল করে। তাদের নিকট হতে কি কিতাবের প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়নি যে, আল্লাহর নামে সত্য ছাড়া কিছুই বলবেনা? বস্তুত কিতাবে যা রয়েছে তা তারা অধ্যয়নও করে থাকে। যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য পরকালের আবাসই উত্তম, তোমরা কি বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করবে না?

১৯:৫৯ :: তারপর তাদের স্থলাভিষিক্ত হলো (অযোগ্য) স্থলাভিষিক্তরা, তারা সালাতকে নষ্ট করলো এবং কামনা-বাসনার অনুসরণ করলো। সুতরাং শীঘ্রই তারা মন্দ শাস্তির সম্মুখীন হবে।

৪৩:৬০ :: আর যদি আমি ইচ্ছা করতাম তাহলে তোমাদের পরিবর্তে ফেরেশতাদেরকে নিযুক্ত করতে পারতাম, পৃথিবীতে যারা (তোমাদের) ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ত (খলীফা) হতো।

৬:১৩৩ :: আর তোমার রব অমুখাপেক্ষী, দয়ালু। যদি তিনি চান, তোমাদেরকে সরিয়ে নেবেন এবং তোমাদের পরে যাদেরকে ইচ্ছে স্থলাভিষিক্ত (খলীফা) বানাবেন, যেমন তিনি তোমাদেরকে অন্য কওমের বংশ থেকে সৃষ্টি করেছেন।

৭:১২৯ :: তারা (বনী ইসরাইল) বললো, “আমরা নির্যাতিত হয়েছে তুমি (মূসা) আমাদের কাছে আসার আগেও এবং তুমি আমাদের কাছে আসার পরেও (নির্যাতিত হচ্ছি)। সে (মূসা) বললো, “আশা করা যায় তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের শত্রুদেরকে ধ্বংস করে দিবেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে খলীফা বানাবেন। তারপর তিনি লক্ষ্য/পর্যবেক্ষণ করবেন তোমরা কিরূপ কর্ম সম্পাদন করো।”

১১:৫৭ :: যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে আমি তো তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি, আমাকে তোমাদের প্রতি যা সহকারে প্রেরণ করা হয়েছে। আর আমার প্রভু তোমাদের ভিন্ন অন্য ক্বওমকে খলীফা বানাবেন। আর তোমরা তাঁর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয় আমার প্রভু সবার ও সবকিছুর রক্ষণাবেক্ষণকারী।

২৪:৫৫ :: তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে এ মর্মে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি নিশ্চিতভাবে তাদেরকে পৃথিবীর ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ততা (খিলাফাত) প্রদান করবেন, যেমন তিনি ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ততা প্রদান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দীনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তিনি তাদের ভয়-ভীতি শান্তি-নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা আমারই ইবাদাত (দাসত্ব-উপাসনা) করবে, আমার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করবে না। আর এরপর যারা কুফর করবে তারা ফাসিক (অবাধ্য)।

৫৭:৭ :: তোমরা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনো। আর তোমরা (পরার্থে) ব্যয় করো যেসগুলোর উপর আমরা তোমাদেরকে খলীফা (ব্যয়-ব্যবহারের ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ত) বানিয়েছি। তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনে ও (পরার্থে) ব্যয় করে তাদের জন্য রয়েছে বড় ধরনের পুরস্কার।

(গ) সুলতান প্রসঙ্গ

শাসক বা কর্তৃপক্ষকে বুঝানোর জন্য যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে ‘সুলতান’ শব্দটিও রয়েছে। এ শব্দটি কুরআনে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে যার মধ্যে ‘শক্তি, ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব’ অর্থটিও রয়েছে। কিন্তু কুরআনে এ শব্দটি শাসককে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়নি। এ থেকে বুঝা যায় যে, শাসককে বুঝাতে ‘সুলতান’ শব্দের ব্যবহার একটি পরবর্তীকালীন চর্চা, আদি অর্থে শব্দটি শাসককে নয়, বরং শাসকের হাতে থাকা শাসনক্ষমতা বা তার শাসনক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার সহায়ক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক শক্তিকে বুঝায়। কুরআনে ‘সুলতান’ শব্দটি ‘যুক্তিপ্রমাণ, দায়মুক্তি সনদ, শক্তি এবং রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক শক্তি’ ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। শব্দটি যেসব আয়াতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বমূলক শক্তি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা উল্লেখ করা হলো:

৪:৯০ :: কিন্তু তাদেরকে (আক্রমণ) নয় যারা এমন কোনো ক্বওমের সাথে সংযুক্ত হয় তোমাদের ও যাদের মধ্যে (অনাক্রমণ) চুক্তি রয়েছে অথবা যারা (যেসব মুনাফিক্বরা) তোমাদের কাছে এমনভাবে আসে যে, তাদের অন্তর সংকুচিত/বাধাগ্রস্থ হয় তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অথবা তাদের ক্বওমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাদেরকে তোমাদের উপর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দিতে পারতেন। তাহলে তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো। সুতরাং যদি তারা তোমাদের থেকে সরে দাঁড়ায়, তাহলে তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো না। আর তারা তোমাদের কাছে শান্তিচুক্তি প্রস্তাব করলে, তাহলে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে (ব্যবস্থা গ্রহণের) কোনো পথ রাখেন নি।

৫৯:৬ :: আল্লাহ তাঁর রসূলকে তাদের (বিদ্রোহী আহলে কিতাবের) কাছ থেকে যে ফায় (যুদ্ধ ছাড়াই করায়ত্তে এসে যাওয়া সম্পদ) দিয়েছেন, তার জন্য তোমরা ঘোড়াও দৌড়াওনি আর উটেও চড়নি। কিন্তু আল্লাহ তাঁর রসূলকে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দান করেন, যাদের উপর তিনি ইচ্ছা করেন। আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ের নিয়ম নির্ধারণকারী ও নিয়ন্ত্রণকারী।

১৭:৮০ :: বলো, হে আমার প্রভু, যেখানে গমন সত্যের দাবি সেখানে আমাকে গমন করান এবং যেখান থেকে নির্গমন সত্যের দাবি সেখান হতে আমাকে নির্গমন করান এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাকে (কার্য নির্বাহের) সহায়ক কর্তৃত্বমূলক শক্তির (সুলতানান নাসীরা) ব্যবস্থা করে দিন।

এছাড়াও সুলতান শব্দটি নিম্নরূপ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে:

(১) যুক্তিপ্রমাণ বা সনদ অর্থে : ৩:১৫১, ৪:১৫৩, ৬:৮১, ৭:৩৩, ৭:৭১, ১০:৬৮, ১১:৯৬, ১২:৪০, ১৮:১৫, ২২:৭১, ২৩:৪৫, ২৮:৩৫, ৩০:৩৫, ৩৭:১৫৬, ৪০:২৩, ৪০:৩৫, ৪০:৫৬, ৪৪:১৯, ৫১:৩৮, ৫২:৩৮, ৫৩:২৩।
(২) প্রত্যক্ষ প্রমাণ অর্থে : ১৪:১০, ১৪:১১।
(৩) যুক্তিপ্রমাণ বা উপযুক্ত কারণ অর্থে : ২৭:২১।
(৪) দায়মুক্তি সনদ, অধিকার, ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব অর্থে : ৪:৯১।
(৫) অভিযোগের প্রমাণ অর্থে : ৪:১৪৪।
(৬) প্রতিবিধান, প্রতিকার বা প্রতিশোধের অধিকার অর্থে : ১৭:৩৩।
(৭) শক্তি, ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব অর্থে : ১৪:২২, ১৫:৪২, ১৬:৯৯, ১৬:১০০, ১৭:৬৫, ৩৪:২১, ৩৭:৩০, ৫৫:৩৩, ৬৯:২৯।

মুসলিম উম্মাহর জামিয়া বা ঐক্যের দায়িত্ব এবং দলাদলি বা পরস্পর বিচ্ছিন্নতার নিষেধাজ্ঞা

মুসলিম উম্মাহর জামিয়া বা ঐক্যের দায়িত্ব ও প্রক্রিয়া এবং ইফতিরাক্ব বা দলাদলির নিষিদ্ধতার বিষয়টি উলিল আমর নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। এ বিষয়টির গভীর অনুধাবনের জন্য ‘উম্মাহ’ এবং ‘জামিয়া’ সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করা প্রয়োজন। তাহলে মুসলিম উম্মাহর জামিয়া সম্পর্কিত দায়িত্ব ও তার বাস্তব পদ্ধতি অবলম্বনের জন্য উলিল আমর নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতি নির্ণয় করা সহজ হতে পারে। তাই এ বিষয়গুলোতে আলোকপাত করা হলো:

উম্মাহ

উম্মাহ শব্দটি একাধিক বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে। যেমন, ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি হওয়া, ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টি, একাধিক গ্রুপে বিভক্ত জনসমষ্টির প্রত্যেক গ্রুপের ঐক্যবদ্ধ অবস্থা, সামাজিক দূরত্ব সত্ত্বেও বৈশিষ্ট্যগত ঐক্যের প্রেক্ষিতে একই প্রজাতি বা আদর্শবদ্ধ (মনস্ত্বাত্বিক সম্পর্কে জড়িত) সত্তাগত দল, একটি আদর্শিক জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত জাতির আদর্শের ধারক একক ব্যক্তিত্ব যা জাতির প্রতিটি সদস্যের ঐক্যবদ্ধতার প্রতীক। এছাড়া উম্মাহ বলতে কালগত ভিন্নতার উম্মাহ এবং একই কালের ভিন্ন ভিন্ন উম্মাহকেও বুঝায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উম্মাত শব্দটির বহুবচন হলো ‘উমাম’ (উম্মাতসমূহ)।

উম্মাহ (বা উম্মাত) শব্দের বিভিন্ন ব্যবহার:

(১) বিভিন্ন প্রাণী প্রজাতি অর্থে : ৬:৩৮
(২) কালগত শ্রেণিবিভাগ তথা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কালের উম্মাহ : ৭:৩৪, ১০:৪৯, ১৫:৫, ২৩:৪৩, ৩৫:২৪, ৬:৪২, ১৩:৩০, ১৬:৬৩, ২৯:১৮, ৪১:২৫, ৪৬:১৮, ২:১৩৪, ২:১৪১।
(৩) একই সমকালের বিভিন্ন উম্মাহ ৬:১০৮, ১৬:৯২, ৭:১৬৮, ৩৫:৪২।
(৪) কোনো একই কাজে (যেমন পশুকে পানি করানোতে) রত একদল লোক : ২৮:২৩।
(৫) সমকালীন একই বংশের গোত্রসমূহ : ৭:১৬০।
(৬) একই মতাদর্শের অনুসারী : ৪৩:২২, ৪৩:২৩। (আলা উম্মাতিন = একই উম্মাতের উপর থাকা, ভিন্ন ভিন্ন উম্মাত না হওয়া)
(৭) বিশেষ আদর্শিক বৈশিষ্ট্য ধারণকারী জাতিসত্তা : ২:১২৮ (উম্মাতাম মুসলিমাতান বা আল্লাহর বিধান গ্রহণকারী আত্মসমর্পিত উম্মাহ), ২:১৪৩ (উম্মাতান ওয়াসত্বান বা মধ্যমপন্থী উম্মাহ), ৩:১১০ (খাইরা উম্মাহ বা নৈতিকতা ও মতাদর্শগত শ্রেষ্ঠ উম্মাহ)
(৮) মতাদর্শগত জাতিসত্তার সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যের ধারক-বাহক ব্যক্তিত্ব (১৬:১২০)

মতাদর্শ ও জীবনব্যবস্থার দিক থেকে মানবজাতির ঐক্যবদ্ধতার মূলনীতি হলো ‘তাওহীদ’ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাঁরই বিধান অনুসারে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। এই প্রেক্ষিতে মানবজাতি শুরুতে ‘উম্মাতান ওয়াহিদাতান’ বা ‘একক জাতিসত্তা’ ছিল (২:২১৩, ১০:১৯)। কিন্তু বর্তমানে মানবজাতি একক জাতিসত্তা নয়, বরং আদর্শিকভাবে তারা বিভিন্ন উম্মাহতে বিভক্ত। যদি সবাই একই উম্মাহ তথা কাফির হয়ে যাওয়ার আশংকা না থাকতো তাহলে কাফিরদেরকে পৃথিবীতে প্রচুর সুখ-সম্ভোগের সুবিধা দেয়া হতো। এ প্রসঙ্গে দ্র: ৫:৪৮, ১১:১১৮, ১৬:১২০, ৪২:৮, ৪৩:৩৩। কিন্তু নবী-রসূলগণ সকলেই একই উম্মাহ ছিলেন তথা তাঁরা সবাই ‘উম্মাতাম মুসলিমাতান’ বা ‘আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পিত’ ছিলেন (২১:৯২, ২৩:৫২)।

সুতরাং মুসলিম উম্মাহ বিশ্বজনীনভাবে একটি একক জাতিসত্তা। তবে নিয়মতান্ত্রিক কর্তৃত্ব সহকারে মুসলিম উম্মাহর প্রতিনিধিত্বকারী মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেও ‘উম্মাহ’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে (৩:১০৪)। বস্তুত ‘উম্মাহ’ শব্দের সাধারণ প্রয়োগ অনুসারে একটি আদর্শিক উম্মাহর অনুমোদিত কাঠামোতে কর্মবিভাজনগত একাধিক উম্মাহ (কর্মদল/টীম) হতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাদের সবাই একই মতাদর্শগত ‘একক উম্মাহ বা জাতিসত্তা’ এর অন্তর্ভুক্ত হিসেবে থাকতে হবে।

জামিয়া

সাধারণত জামিয়া মানে সকল, সকলে একত্রে; কিন্তু যখন অনেকে একত্র হয় কোনো একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচীর উপর ভিত্তি করে তখন এর মধ্যে সংঘবদ্ধতার বিষয় বুঝানো হয়। নিম্নে সংঘবদ্ধতার বুঝাতে জামিয়া শব্দের ব্যবহার উল্লেখ করা হলো।

৩:১০৩ :: আর তোমরা জামিয়া/ সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর স্মরণ করো তোমাদের উপর আল্লাহর নেয়ামতকে, যখন তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু, তারপর তিনি (ঈমানের প্রেক্ষিতে) তোমাদের অন্তরে প্রীতির সঞ্চার করেন, তাই তোমরা তাঁর অনুগ্রহে ভাই ভাই হয়ে গেলে। আর তোমরা ছিলে অগ্নিকুণ্ডের কিনারায়, তারপর তিনি তোমাদেরকে সরিয়ে এনেছেন তা থেকে। এভাবেই আল্লাহ স্পষ্টভাবে বিশদ বর্ণনা করেন তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ যেন তোমরা হিদায়াত পেতে পার।

৫৯:১৪ :: তারা ঐক্যবদ্ধভাবে তোমাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল/ সশস্ত্র সংগ্রাম করবে না দুর্গ পরিবেষ্টিত জনপদের মধ্যে ছাড়া অথবা প্রাচীরসমূহের পিছনে থেকে ছাড়া। তাদের মধ্যে তাদের (পারস্পরিক) বিরুদ্ধতা প্রবল। তুমি তাদেরকে ধারণা করো ঐক্যবদ্ধ। অথচ তাদের অন্তরসমূহ বিভক্ত। উহা এ কারণে যে, তারা এমন ক্বওম যারা আকল/ বিবেক-বুদ্ধি/ common sense প্রয়োগ করে না।

৫৪:৪৪ :: নাকি তারা বলে, “আমরা সংঘবদ্ধ দল, নিজেদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম”?

উপরোল্লেখিত তিনটি আয়াতের প্রথমটিতে জামিয়া শব্দটির বিপরীতে আনা হয়েছে তাফাররক্বূ বা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। আর দ্বিতীয়টিতে জামিয়া শব্দের বিপরীতে আনা হয়েছে ‘ক্বূলূবুহুম শাত্তা’ বা ‘তাদের অন্তরসমূহ বিভক্ত বা পরস্পরের প্রতি মিল-মহব্বতমুক্ত’। আর তৃতীয় আয়াতে যারা সংঘবদ্ধতার শক্তির মাধ্যমে নিজেদের প্রতিরক্ষায় সক্ষম এমন সংঘবদ্ধতার জন্য ‘জামী’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং কিছু লোক কোনো কর্মসূচীর ক্ষেত্রে একসাথে কাজ করার ক্ষেত্রে জামিয়া বলতে বুঝায় তাদের দিলের মিল থাকা এবং ঐক্যবদ্ধতা বা সাংগঠনিকতা থাকা তথা সংঘবদ্ধতা। উচ্ছৃংখল ও বেকুব জনতার ভিড়কে কখনো জামিয়া বলা হয় না।

মুসলিম উম্মাহর জামিয়া হতে হবে আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে এবং অমুসলিমদের থেকে স্বতন্ত্র

মুসলিম উম্মাহ যে জামিয়া বা সংঘবদ্ধতা অবলম্বন করবে তা হতে হবে আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে। তাই যারা এ নীতিতে আসবে না সেই কাফির-মুশরিকদের সাথে ঐক্য নয় এবং তাদের নেতৃত্বকে নিজেদের নেতৃত্ব হিসেবে গ্রহণ নয়, বরং মু’মিনদের ঐক্য ও মু’মিন নেতৃত্ব গ্রহণই জামিয়া বা সংঘবদ্ধতার মূলনীতি হবে। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

২:২৫৬ :: দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় হিদায়াত স্পষ্ট হয়েছে ভ্রষ্টতা থেকে। অতএব, যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। যারা ঈমান আনে আল্লাহই তাদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসেন। আর যারা কুফ করে তাদের অভিভাবক তাগুত, তারা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, তারা তাতে স্থায়ী হবে।

৫৮:১৯-২২ :: শয়তান তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে, ফলে তাদেরকে আল্লাহর স্মরণ (বা আল্লাহর প্রেরিত স্মারক) ভুলিয়ে দিয়েছে। তারাই ‘হিজবুশ শয়তান’ (শয়তানের মিশনারি দল)। নিশ্চয় শয়তানের দল ক্ষতিগ্রস্ত। নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধিতা করে তারাই চরম অপমানিত। আল্লাহ লিখে রেখেছেন যে, নিশ্চয় আমি এবং আমার রসূলগণই বিজয়ী থাকবো। নিশ্চয় আল্লাহ মহাশক্তিমান মহাপরাক্রমশালী। যারা আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনে এমন ক্বওমকে তুমি এরূপ পাবে না যে, তারা এমন লোকদেরকে ভালবাসে যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধিতা করে, হোক তারা তাদের পিতা বা পুত্র বা ভাই বা স্বগোত্রীয়। এমন লোকদের অন্তরেই আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে রুহ (আধ্যাত্মিক প্রেরণা) দ্বারা শক্তি যুগিয়েছেন। এবং তিনি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন যার নিচ অংশে নদী বয়ে যায়। তারা তাতে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট। তারাই ‘হিজবুল্লাহ’ (আল্লাহর দল)। জেনে রেখ, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম।

৭:৩ :: তোমরা তা-ই অনুসরণ করো যা তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে নাযিল করা হয়েছে এবং তা বাদ দিয়ে (তথা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের সাথে সম্পর্কহীন) বিভিন্ন আওলিয়ার (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) অনুসরণ করো না।

৩৬:২১ :: তোমরা তাদেরকেই অনুসরণ করো যারা (বালাগ তথা দ্বীনের তথ্য প্রচারের) জন্য পারিশ্রমিক চায় না এবং যারা হিদায়াতপ্রাপ্ত।

৯:২৩ :: হে যারা ঈমান এনেছো তোমাদের পিতা ও ভাইদেরকেও আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমানের চেয়ে কুফরকে ভালবাসে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে আওলিয়া হিসেবে গ্রহণ করবে, তারাই যালিম।

৩:২৮ :: মু’মিনরা যেন মু’মিনদেরকে ছাড়া কাফিরদেরকে আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ না করে। আর যে ব্যক্তি এরূপ করে (তথা কাফিরদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে) তার সাথে কোনো ক্ষেত্রে আল্লাহর সম্পর্ক নেই, এছাড়া যে, তোমরা তাদের (নির্যাতন) থেকে আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে (বাহ্যত) এরূপ করো। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নিজের বিষয়ে সচেতন করছেন। আর আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন।

৪:১৩৯ :: যারা মু’মিনদেরকে ছাড়া কাফিরদেরকে আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করে, তারা কি তাদের কাছে সম্মান তালাশ করে? তবে (জেনে রেখো) সমস্ত সম্মান আল্লাহরই আয়ত্তে।

৪:১৪৪ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা মু’মিনদেরকে ছাড়া কাফিরদেরকে আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমরা কি আল্লাহর কাছে তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুস্পষ্ট প্রমাণ পেশ করতে চাও?

৫:৮০ :: তাদের অনেককে তুমি যারা কুফর করে তাদেরকে আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করতে দেখবে। তাদের স্বীয় সত্তা তাদের জন্য যা আগেই পাঠিয়েছে (তথা তাদের কৃতকর্ম) কতই না নিকৃষ্ট! বিষয় এই যে, আল্লাহ তাদের উপর ক্রোধান্বিত হয়েছেন এবং তারা শাস্তির মধ্যে স্থায়ী হবে।

৫:৫১ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা ইয়াহুদ ও নাসারাকে আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা একে অন্যের আওলিয়া। আর তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে আওলিয়া হিসেবে গ্রহণ করবে, তারাই তাদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে সাব্যস্ত হবে। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম ক্বওমকে হিদায়াত করেন না।

৫:৫৭ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যকার যারা তোমাদের দ্বীনকে কৌতুক ও খেলার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছে তাদেরকে এবং কাফিরদেরকে তোমরা আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) হিসেবে গ্রহণ করবে না। আর তোমরা আল্লাহর প্রতি সচেতন থেকো, যদি তোমরা মু’মিন হও।

২:১২০ :: আর ইয়াহূদ ও নাসারা (খৃস্টান) কখনো তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাতের (ধর্মাদর্শের প্রকৃতি) অনুসরণ কর। বলো, ‘নিশ্চয় আল্লাহর হিদায়াতই হিদায়াত’ আর যদি তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ কর তোমার কাছে যে জ্ঞান এসেছে তার পর, তাহলে আল্লাহর বিপরীতে তোমার কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী থাকবে না।

২:১৪০ :: নাকি তোমরা বলছ, ‘নিশ্চয় ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানেরা ছিল ইয়াহূদী কিংবা নাসারা? বল, ‘তোমরা অধিক জ্ঞাত নাকি আল্লাহ’? আর তার চেয়ে অধিক যালিম কে, যে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার কাছে যে সাক্ষ্য রয়েছে তা গোপন করে? আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।

২:১৪৫ :: আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তুমি যদি তাদের নিকট সব নিদর্শন নিয়ে আস, তারা তোমার কিবলার অনুসরণ করবে না আর তুমিও তাদের কিবলার অনুসরণকারী নও এবং তারা একে অপরের কিবলার অনুসরণকারী নয়। আর যদি তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ কর তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর, তবে নিশ্চয় তুমি তখন যালিমদের অন্তর্ভুক্ত।

৫৮:১৪ :: তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করো নি, যারা এমন ক্বওমকে আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) বানায় যাদের প্রতি আল্লাহ রাগান্বিত হয়েছেন। তারা (এই মুনাফিক্বরা) না তোমাদের লোক আর না তাদের লোক। আর তারা জেনে শুনে মিথ্যা শপথ করে।

৬০:১৩ :: হে যারা ঈমান এনেছো তোমরা এমন ক্বওমকে আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) বানাবে না যাদের উপর আল্লাহ রাগান্বিত হয়েছেন। নিশ্চয় তারা আখিরাতের বিষয়ে সেরূপ নিরাশ হয়েছে যেমন কাফিররা কবরবাসীদেরকে ফিরে পাবার ব্যাপারে নিরাশ হয়েছে।

৬০:৯ :: নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন তাদেরকে আওলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অভিভাবক) বানাতে, যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে এবং তোমাদেরকে তোমাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে বের করে দেয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে। আর যারা তাদেরকে আওলিয়া বানাবে তারাই যালিম।

৮:৩৪-৩৫ :: আর তাদের জন্য কী কারণ রয়েছে যে, আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না, অথচ তারা আল মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দেয় অথচ তারা উহার আওলিয়া (তত্ত্বাবধায়ক) নয়। নিশ্চয় যারা স্রষ্টা-সচেতন তারা ছাড়া কেউ উহার আওিলয়া (তত্ত্বাবধায়ক) নয়, কিন্তু তাদের অধিকাংশ (এ প্রকৃত তথ্যের) জ্ঞান রাখে না। আর ‘আল বাইতের’ (কা’বা ঘরের) কাছে তাদের সালাত উলুধ্বনি ও হাততালি ছাড়া কিছুই নয় (তথা তাদের সালাত অর্থহীন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে)। (তাদেরকে বলা হবে), “তোমরা যে কুফর করতে সেজন্য শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করো।”

৯:১৮ :: নিশ্চয় তারাই আল্লাহর মাসজিদসূহের ব্যবস্থাপনা করবে (ব্যবস্থাপনার অধিকার রাখে) যারা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায় যে, তারাই পথনির্দেশ গ্রহণকারীদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

৯:১০৭ :: আর যারা মাসজিদকে গ্রহণ করেছে ক্ষতি সাধন, কুফর (সত্য প্রত্যাখ্যান) এবং মু’মিনদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করার (তথা ঐক্যের মূলনীতিকে উপেক্ষা করার) উদ্দেশ্যে এবং তাদের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে যারা আগে থেকেই আল্লাহর এবং তাঁর রসূলের (উপস্থাপিত মতাদর্শের) সাথে সাংঘর্ষিকতায় লিপ্ত হয়েছে। আর তারা কসম করে বলবে, “আমরা উত্তম কিছু করা ছাড়া অন্যরূপ ইচ্ছা করি নি”। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।

৯:১০৮ :: তুমি কখনোই তাতে (তথা তাদের অধিগৃহীত মাসজিদে) দাঁড়াবে না। নিশ্চয় যে মাসজিদ প্রথম দিন থেকেই স্থাপিত হয়েছে আল্লাহ সচেতনতার উপর (ভিত্তি করে), সেটাই অধিক উপযোগিতা রাখে যে, তুমি সেটাতেই দাঁড়াবে। সেটাতে ঐ লোকেরা (আত্মনিয়োজিত) রয়েছে যারা পছন্দ করে যে, তারা (জীবন যাপনের ক্ষেত্রে) পবিত্রতা অর্জন করবে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকেই ভালবাসেন।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মু’মিনরা তাদের জামিয়াকে স্বতন্ত্র রাখতে হবে, তারা মু’মিন ছাড়া অন্যদেরকে তাদের বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে না। আহলে কিতাবের কোনো ফিরক্বার আনুগত্য করতে পারবে না। কাফিরদের আনুগত্য করতে পারবে না। এক কথায়, মু’মিনদের ঐক্যবদ্ধতা ও পারস্পরিক অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব ও অভিভাবকত্ব হবে ঈমানের ভিত্তিতে।

মু’মিন হওয়া কোনো জন্মগত বিষয় নয়। যে কেউ মুহুর্তের মধ্যে ঈমানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মাধ্যমে মু’মিন হতে পারে। তাই মু’মিনরা যারা মু’মিন নয় তাদের থেকে পৃথক থাকার বিষয়টিকে এক প্রকার অনৈক্য হিসেবে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এটাই মু’মিনদের কর্তৃক দ্বীন চর্চার ক্ষেত্রে ফিরক্বায় ফিরক্বায় বিভক্ত হওয়া থেকে মুক্ত থাকার একমাত্র পথ। আর অন্য যারা সঠিক দ্বীনের ক্ষেত্রে ‘জামিয়া’ বা ঐক্য অবলম্বন করতে চায় তাদেরকে তাদের সব ফিরক্বা ত্যাগ করে এই মূলনীতি ‘বিহাবলিল্লাহি’ (আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে) এর মধ্যে চলে আসতে হবে, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের মধ্যে প্রকৃত ঐক্য তৈরি হয়ে যাবে।

সুতরাং জামিয়া বা ঐক্যের অর্থ কোনোক্রমে মু’মিন ও কাফির-মুশরিকদের ঐক্য নয়, বরং এর অর্থ হলো ‘মু’মিনদের মধ্যকার ঐক্য’। আর ঐক্যের মূলসূত্র হলো ‘বিহাবলিল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে’ ঐক্য। এটা ছাড়া কোনো ঐক্য বাহ্যত ঐক্য হলেও তাতে ক্বলবসমূহ পরস্পরের প্রতি সম্প্রীতি এবং মতাদর্শ ধারণের দিক থেকে ‘শাততা’ বা ‘বিচ্ছিন্ন’ই থাকবে। ঐক্যের প্রকৃত পথ একটিই, আর তা হলো ‘তাওহীদের ভিত্তিতে ঐক্য’। শিরক, কুফর, নিফাক প্রকৃত ঐক্য অর্জনে সক্ষম নয়।

যারা মুনাফিক্ব হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায় তাদের প্রতিষ্ঠিত মাসজিদে এবং অনুরূপভাবে যেসব মাসজিদে কাফির-মুশরিকরা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে অধিষ্ঠিত রয়েছে সেইসব মাসজিদে সালাতের জন্য দাঁড়ানো যাবে না এবং যারা স্পষ্টভাবে আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের সাথে সম্পর্কহীন তাদেরকে অনুসরণ করা যাবে না। অর্থাৎ যারা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবকে দ্বীনের একমাত্র দলীল হিসেবে বিশ্বাস ও গ্রহণ করে না তাদের সাথে ঐক্য হতে পারে না, যদিও তারা নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করে ও সালাত সম্পাদন করে। বস্তুত তাদের সালাত অর্থহীন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। সুতরাং যদিও ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের মাসজিদকেই প্রকৃত মাসজিদ হিসেবে দাবি করবে, তবুও যারা প্রকৃত মু’মিন তারা দেখবে যে, কারা আল কুরআনে থাকা ঐক্যের নীতি (বিহাবলিল্লাহি জামিয়া) এর সঠিক চর্চা করছে, তারা সেই মাসজিদকেই অবলম্বন করবে।

তবে এর মানে এ নয় যে, কাফির ও মুশরিকদের সাথে কোনোরূপ বাড়াবাড়ি করতে হবে অথবা তাদের সাথে কোনোরূপ সামাজিক সম্পর্ক-সম্পৃক্ততা থাকবে না। বরং তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষণীয়:

৪:১৪০ :: আর তিনি কিতাবের মধ্যে তোমাদের জন্য নাযিল করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে যে আল্লাহর আয়াতের প্রতি কুফর করা হচ্ছে এবং তার প্রতি উপহাস করা হচ্ছে, তাহলে তাদের সাথে বসবে না যতক্ষণ না তারা তা ভিন্ন অন্য বিষয়ের আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়, অন্যথায় তোমরা নিশ্চয় তখন তাদের মতো হয়ে যাবে। নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদেরকে ও মুনাফিকদেরকে একত্রিতভাবে জাহান্নামে একত্র করবেন।

৬:৬৮-৬৯ :: যখন তুমি তাদেরকে দেখবে যারা আমাদের আয়াতসমূহের বিষয়ে নিছক সমালোচনা করে, তখন তুমি তাদেরকে উপেক্ষা করে চলো, যতক্ষণ না তারা তা ভিন্ন অন্য বিষয়ের আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়, আর যদি শয়তান তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তাহলে স্মরণ হওয়ার পর জালিম কওমের সাথে বসো না। আর যারা স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করে তাদের উপর তাদের (আল্লাহর আয়াতের সমালোচনাকারীদের) কোনোরূপ হিসাব দেয়ার দায়িত্ব বর্তাবে না, কিন্তু তাদেরকে উপদেশ দেয়ার দায়িত্ব রয়েছে যেন তারা স্রষ্টা-সচেতন হতে পারে।

৫:২ :: হে মু’মিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নির্ধারিত নিদর্শনসমূহকে এবং কোনো হারাম মাসকে (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাসকে) এবং হাদিয়াকে (উপহারকে) এবং কালায়িদকে (বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধিদেরকে) অবমাননা / অবমূল্যায়ন করো না। আর আল বাইতুল হারামের (সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানের) অভিযাত্রীদেরকেও অবমাননা করো না, যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে। আর যখন তোমরা হুরুম (হারাম মাসসমূহ) এর বাহিরে থাকো তখন (স্থলভাগের) শিকার করতে পার। আর কোনো সম্প্রদায়ের এরূপ শত্রুতা যে, তারা তোমাদেরকে আল মাসজিদুল হারামে গমনে বাধা দিয়েছিল, তা যেন তোমাদেরকে অপরাধপ্রবণ না করে যে, তোমরা বাড়াবাড়ি করে ফেল। আর তোমরা সদাচার ও আল্লাহ সচেতনতার বিষয়ে একে অন্যকে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালংঘনের কাজে একে অন্যকে সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহ সচেতন হও। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।

৫:৮ :: হে যারা ঈমান করেছো, আল্লাহর জন্য ন্যায় সাক্ষ্যদাতা হিসেবে দণ্ডায়মান হও। আর যেন তোমাদেরকে কোনো জনগোষ্ঠী কর্তৃক কৃত শত্রুতা অপরাধপ্রবণ না করে যে, তোমরা ন্যায় বিচার করবে না। ন্যায় বিচার করো, সেটাই তাক্বওয়ার (স্রষ্টা সচেতনতার) নিকটতর। আর আল্লাহর সম্পর্কে সচেতন হও। নিশ্চয় তোমরা যা করো সেই বিষয়ে আল্লাহ অবহিত।

৬০:৮ :: ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা (দ্বীন) অবলম্বনের ব্যাপারে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেনি, আর তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ী থেকে বের করে দেয়নি তাদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করতে ও ন্যায়নিষ্ঠ আচরণ করতে আল্লাহ নিষেধ করেননি। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন।

৬:১০৮ :: আর তোমরা তাদেরকে গালমন্দ করো না, আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তারা ডাকে, ফলে তারা গালমন্দ করবে আল্লাহকে, শত্রুতা পোষণ করে অজ্ঞতাবশত। এভাবেই আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য তাদের কর্ম শোভিত করে দিয়েছি। তারপর তাদের রবের কাছে তাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর তিনি জানিয়ে দেবেন তাদেরকে, যা তারা করত।
উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের আলোকে বলা যায় যে, মু’মিনরা তাদের স্বতন্ত্র জামিয়া বা ঐক্যের মাধ্যমে ধর্মীয় ও সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেই সাথে যেসব কাফির-মুশরিকরা তাদের উপর কোনো বাড়াবাড়ি করে না তাদের প্রতি কোনোরূপ বিরূপ আচরণ বা অন্যায় করতে পারবে না। বরং মু’মিনদেরকে সর্বক্ষেত্রে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে। আর এ থেকে ‘উলিল আমর’ প্রসঙ্গেও এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, মু’মিনদের সংঘবদ্ধ কার্যক্রম সম্পাদনের জন্যই ‘উলিল আমর’ নির্ধারণ করতে হবে এবং যথানিয়মে তার আনুগত্য করতে হবে।

ইখতিলাফ বা মতভেদের উৎপত্তি এবং যুক্তিপ্রমাণভিত্তিক ও চূড়ান্ত সমাধান সম্পর্কিত নির্দেশনা

মুসলিম উম্মাহর স্বতন্ত্র একক জাতিসত্তা বজায় রেখে তাদের নিজেদের স্বতন্ত্র নেতৃত্ব পরিগঠনের বিষয়টির মৌলিক কারণ হলো যদিও বিশ্বব্যাপী মানবজাতি একক জাতিসত্তা তবুও আদর্শিকভাবে তারা বিভিন্ন জাতিসত্তায় বিভক্ত হয়ে রয়েছে। এমতাবস্থায় তাদেরকে একক জাতিসত্তায় পরিণত হওয়ার উপায় আদর্শগত আপোষ নয়, বরং সমগ্র মানুষকে তাদের সবার একমাত্র রব বা প্রতিপালকের ইবাদাত বা দাসত্ব ও উপাসনার দিকে আহবান। এই আহবানে সাড়াদানের মাধ্যমেই একক জাতিসত্তায় পরিণত হতে পারবে অথবা এ আহবানে যারা সাড়া দেবে তারাই ‘একক জাতিসত্তা’ হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

আল কুরআন থেকে জানা যায় যে, শুরুতে মানবজাতি তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদের ভিত্তিতে ‘উম্মাতান ওয়াহিদাতান’ বা ‘একক জাতিসত্তা’ হিসেবে ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা ইখতিলাফ বা মতভেদ করলো এবং বিভিন্ন জাতিসত্তায় বিভক্ত হয়ে গেলো। তখন এ মতভেদের সমাধানের জন্য তথা তাওহীদের ভিত্তিতে মানবজাতিকে পুনরায় একক জাতিসত্তায় একীভূত হওয়ার পথনির্দেশ দেয়ার জন্য নবী-রসূলদের কাছে আল্লাহ কিতাব নাযিল করেছেন। কিন্তু কিতাবের মাধ্যমে স্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণ এসে যাওয়ার পরও এবং আল্লাহর কিতাবে কোনো ইখতিলাফ বা মতভেদের বিষয় (স্ববিরোধ) না থাকা সত্ত্বেও মানুষ সে সম্পর্কে ইখতিলাফ করেছে, এমনকি আহলে কিতাব বা কিতাবের অনুসারীরাও স্পষ্ট জ্ঞান আসার পরও পারস্পরিক জিদবশত কিতাবের মধ্যকার বিষয়ে ইখতিলাফ বা মতভেদ করেছে। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাদেরকে কিতাবের মাধ্যমে প্রকৃত পথনির্দেশ করেন যারা যথাযথভাবে ঈমান আনে এবং প্রকৃত সত্যের সন্ধানে কিতাবের যথাযথ অধ্যয়ন করে। কিন্তু যারা ইখতিলাফ বা মতভেদ বজায় রাখে তাদের এই মতভেদের বিষয় যে সঠিক ছিল না কিয়ামাতের দিন আল্লাহ চূড়ান্ত বিচারে তার অনিবার্য সমাধান করে দিবেন। আল্লাহর কিতাবকে যারা যাবতীয় ইখতিলাফের সমাধানের একমাত্র সূত্র হিসেবে স্বীকার করে নেবে তারা স্থান-কালের পার্থক্য সত্ত্বেও ‘উম্মাতান ওয়াহিদাতান’ বা ‘একক জাতিসত্তা’ হিসেবে সাব্যস্ত হবে। এ প্রসঙ্গে নিম্নে ইখতিলাফ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হলো:

৪:৮২ :: তবে কি তারা কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না? যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে নাযিল হতো, তাহলে তারা তাতে অনেক ইখতিলাফ (স্ববিরোধ, বৈপরীত্য) পেতো।

২:১৭৬ :: তা এজন্য যে, আল্লাহ সত্যসহ/ যথাযথভাবে/ বাস্তবসম্মতভাবে কিতাব নাযিল করেছেন। আর যারা কিতাবের মধ্যকার বিষয়ে ইখতিলাফ (মতভেদ) করে তারা সুদূর বিরোধে রয়েছে।

২:১১৩ :: ইয়াহুদ সম্প্রদায় বলেছে যে, নাসারা সম্প্রদায়ের কোনো ভিত্তি নেই। আর নাসারা সম্প্রদায় বলেছে যে, ইয়াহুদ সম্প্রদায়ের কোনো ভিত্তি নেই। অথচ তারা কিতাব তিলাওয়াত করছে (তা সত্ত্বেও তারা সাম্প্রদায়িকতা প্রদর্শন করছে)! এভাবেই তাদের কথার মতোই তারাও বলে যারা কিতাবের কোনো জ্ঞান রাখে না। সুতরাং তারা যেসব বিষয়ে ইখতিলাফ (মতভেদ) করছে আল্লাহ ক্বিয়ামাত দিবসে তার চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেবেন।

২:২১৩ :: মানুষ ছিল এক উম্মত। অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে নবীদেরকে প্রেরণ করলেন এবং সত্যসহ তাদের সাথে কিতাব নাযিল করলেন, যাতে মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যে বিষয়ে তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করত। আর যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরেও ইখতিলাফ (মতভেদ) করেছিল তারা শুধুমাত্র পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষবশত তা করেছিল। অতঃপর আল্লাহ নিজ অনুমতিক্রমে (তাঁর অনুমোদিত পন্থায়) মুমিনদেরকে হিদায়াত দিলেন যে বিষয়ে তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করছিল। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন।

২:২৫৩ :: ঐ রাসূলগণ, আমি তাদের কাউকে কারো উপর বিশেষত্ব দিয়েছি, তাদের মধ্যে কারো সাথে আল্লাহ ব্যাপক বাক্যালাপ করেছেন এবং কাউকে বহুস্তর মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। আর আমি ঈসা ইবনে মারয়ামকে দিয়েছি সুস্পষ্ট প্রমাণাদি এবং আমি তাকে শক্তিশালী করেছি রূহুল কুদুস (পবিত্র আত্মা) এর মাধ্যমে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তাদের পরবর্তীরা লড়াই করতো না, তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণসমূহ আসার পর। কিন্তু তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করেছে। ফলে তাদের মধ্যে কেউ ঈমান এনেছে, আর তাদের কেউ কুফর করেছে। আর আল্লাহ যদি চাইতেন, তাহলে তারা লড়াই করত না। কিন্তু আল্লাহ যা চান, তা করেন।

৩:১৯ :: নিশ্চয় আল্লাহর নিকট দীন হচ্ছে ইসলাম। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের নিকট জ্ঞান আসার পরই তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করেছে, পরস্পর বিদ্বেষবশত। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফর করে, নিশ্চয় আল্লাহ হিসাবকরণে দ্রুত।

৩:৫৫ :: যখন আল্লাহ বললেন, “হে ঈসা, নিশ্চয় আমি তোমার ওফাত (মৃত্যু) ঘটাবো এবং আমার দিকে সমুত্থান করবো (আমি তোমাকে আমার দিকে উঠিয়ে নিবো, উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করবো), এবং যারা কুফর করেছে তাদের থেকে তোমাকে পরিচ্ছন্ন করবো এবং যারা তোমার অনুসরণ করেছে তাদেরকে যারা কুফর করেছে তাদের তুলনায় ক্বিয়ামাত দিবস পর্যন্ত উপরে রাখবো। তারপর আমারই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল, তারপর তোমরা যে বিষয়ে ইখতিলাফ (মতভেদ) করতে আমি সেই বিষয়ে তোমাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেবো।

৩:১০৫ :: আর তাদের মতো হয়ো না যারা বিভিন্ন ফিরক্বায় বিভক্ত হয়ে গেছে এবং তাদের নিকট স্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণ এসে যাওয়ার পর ইখতিলাফ (মতভেদ) করেছে। আর তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে।

৪:১৫৭ :: এবং তাদের এ কথার কারণে যে, ‘আমরা আল্লাহর রাসূল মারইয়াম পুত্র ঈসা মাসীহকে হত্যা করেছি’। অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি এবং তাকে শূলেও চড়ায়নি। বরং তাদের জন্য (এর) সদৃশ করা হয়েছিল। আর নিশ্চয় যারা তাতে ইখতিলাফ (মতভেদ) করেছিল, অবশ্যই তারা তার ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে ছিল। ধারণার অনুসরণ ছাড়া এ ব্যাপারে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করেনি।

৫:৪৮ :: আর আমি তোমার উপর সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি, তার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবসমূহের সমর্থক (Confirmer) ও পর্যবেক্ষক-নিয়ন্ত্রক (Watcher) রূপে। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরীআত (মৌলিক বিধি) ও মিনহাজ (উন্মুক্ত পন্থা) এবং আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে (জবরদস্তিমূলকভাবে) তোমাদেরকে এক উম্মত বানাতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। সুতরাং তোমরা উত্তম-কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহরই দিকে তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন, যা নিয়ে তোমরা ইখতিলাফ (মতভেদ) করতে।

৬:১৬৪ :: বলো, “আমি কি আল্লাহ ছাড়া আর কোনো রব (প্রতিপালক, বিধাতা) খুঁজবো? তিনিই তো প্রত্যেক সত্তার রব (প্রতিপালক, বিধাতা)। প্রত্যেক ব্যক্তিসত্তা যা উপার্জন করে তার উপরই তার দায়ভার বর্তায়। আর কোনো বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না। তারপর তোমাদের রবের (প্রতিপালক, বিধাতা) দিকেই তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল। তারপর তিনিই তোমাদেরকে সেই বিষয়ে (সমাধান) জানিয়ে দিবেন যেসব বিষয়ে তোমরা ইখতিলাফ (মতভেদ) করতে।

৮:৪২ :: (স্মরণ করো) যখন তোমরা ছিলে নিকটতর প্রান্তে আর তারা ছিলো দূরবর্তী প্রান্তে। আর (তাদের) কাফেলা ছিলো তোমাদের চেয়ে নিম্নভূমিতে। আর যদি তোমরা পারস্পরিক ওয়াদাক্রমে (= পরামর্শক্রমে) এটি নির্ধারণ করতে, তাহলে নিশ্চয় তোমরা ইখতিলাফ (মতভেদ) করতে এ সময় নির্ধারণের ব্যাপারে {= পরামর্শের ভিত্তিতে পূর্ব পরিকল্পনার মাধ্যমে রণকৌশল নির্ধারণ করলে তোমরা এখনই যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না।} কিন্তু তা ঘটেছে এজন্য যে, যেন আল্লাহ ফায়সালা করেন এমন একটি ব্যাপারে যা কার্যকর হয়েছে। (আর তা হচ্ছে) যেন ধ্বংস হয়ে যায় যে ধ্বংস হওয়ার যোগ্য স্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে, আর যেন জীবিত থাকে যে জীবিত থাকার যোগ্য স্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে। আর নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।

১০:১৯ :: মানবজাতি ছিল একক জাতিসত্তা (উম্মাতান ওয়াহিদাতান)। তারপর তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করলো। আর যদি তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে (ফায়সালা সম্পর্কিত) পূর্বঘোষণার বাণী না থাকতো, তাহলে তারা যেসব বিষয়ে ইখতিলাফ (মতভেদ) করছে সেগুলোর অনিবার্য ফায়সালা করে দেয়া হতো।

১০:৯৩ :: আর নিশ্চয় আমরা বানী ইসরাইলকে সত্যসঙ্গত আবাসভূমিতে বসবাস করিয়েছি এবং তাদেরকে পবিত্র ও উৎকৃষ্ট জীবিকা দিয়েছি। তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করে নি, যতক্ষণ না তাদের কাছে (আসমানী কিতাবের) জ্ঞান এসেছে। নিশ্চয় তোমার প্রভু তাদের মধ্যে ক্বিয়ামাত দিবসে অনিবার্য ফায়সালা করে দেবেন যেসব বিষয়ে তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করতো।

১১:১১০ :: আর নিশ্চয় আমরা মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম। তারপর তারা তার ক্ষেত্রে ইখতিলাফ (মতভেদ) করলো। আর যদি তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে (ফায়সালা সম্পর্কিত) পূর্বঘোষণার বাণী না থাকতো, তাহলে তাদের মধ্যে অনিবার্য ফায়সালা করে দেয়া হতো। আর নিশ্চয় তারা এ বিষয়ে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে।
১১:১১৮ :: আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে মানবজাতিকে একক জাতিসত্তা (উম্মাতান ওয়াহিদাতান) বানিয়ে রাখতেন। আর তারা ইখতিলাফকারী (মতভেদকারী) হওয়া থেকে বিরত থাকবে না।

১৬:৩৮-৩৯ :: তারা দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর কসম করে বলে, “যে মৃত্যুবরণ করে আল্লাহ তাকে পুনরুত্থিত করবেন না।” কেন নয়? আল্লাহর ওয়াদা সত্য। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ (সত্য জানার সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন না করার কারণে) জানে না। (তিনি মৃতদেরকে পুনর্জীবিত করবেন) যেন তিনি তাদের কাছে স্পষ্ট করে দেন যেসব বিষয়ে তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করছে এবং যেন কাফিররা জানতে পারে যে, নিশ্চয় তারা ছিল মিথ্যাবাদী।

১৬:৬৪ :: আর আমি তোমার কাছে এ উদ্দেশ্যে ছাড়া কিতাব নাযিল করি নি যে, তুমি (কিতাবের তথ্যের মাধ্যমে) তাদের জন্য সেসব বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য প্রকাশ করবে, যেগুলোতে তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করে এবং (তা হবে) হিদায়াত ও রহমাত সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা ঈমান আনে।

১৬:৯২ :: আর তোমরা সেই নারীর মতো হয়ো না যে পাক খুলে দিয়েছে তার সুতাকে মজবুত করে পাক দেয়ার পরে। (এভাবে যে) তোমরা গ্রহণ করছো তোমাদের প্রতিশ্রুতিকে পরস্পরের মধ্যে প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে, যেন এক পক্ষ অন্য পক্ষের তুলনায় (অন্যায্যভাবে) স্বার্থসিদ্ধিতে অধিকতর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে। নিশ্চয় আল্লাহ সেটার মাধ্যমে (অর্থাৎ প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে) তোমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেন। আর নিশ্চয় তিনিই তোমাদের জন্য কিয়ামাত দিবসে তোমাদের ইখতিলাফের (মতভেদ) বিষয়ে (কে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত তা) স্পষ্ট করে দিবেন (তাই সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে দাবি করে অন্যায় উপায় অবলম্বন করা গ্রহণযোগ্য নয়)।

১৬:১২৪ :: প্রকৃতপক্ষে সাবতের (বিশ্রাম দিবসের) বিধান তাদের উপর বাধ্যতামূলক করা হয়েছিলো যারা তা পালনের বিষয়ে ইখতিলাফ (মতভেদ) করেছিলো। এবং নিশ্চয় তোমার প্রভু তাদের মধ্যে তারা যে বিষয়ে ইখতিলাফ (মতভেদ) করেছিলো ক্বিয়ামাত দিবসে তার ফায়সালা করে দিবেন।

১৯:৩৭ :: তারপর তারা বিভিন্ন দল তাদের পরস্পরের মধ্যে ইখতিলাফ (মতভেদ) করেছে। সুতরাং যারা কুফর করেছে তাদের জন্য মহাদিবসের (ক্বিয়ামাত) প্রত্যক্ষকাল থেকে দুর্ভোগ!

২২:৬৯ :: আল্লাহ ক্বিয়ামাত দিবসে তোমাদের মধ্যে অনিবার্য ফায়সালা করে দেবেন, যেসব বিষয়ে তোমরা ইখতিলাফ (মতভেদ) করতে।

২৭:৭৬ :: নিশ্চয় এই কুরআন বানী ইসরাইলের সামনে তাদের অনেক ইখতিলাফের (মতভেদ) বিষয়ে সঠিক বৃত্তান্ত বিবৃত করে।

৩২:২৫ :: নিশ্চয় তোমার প্রভু ক্বিয়ামাত দিবসে তাদের মধ্যে অনিবার্য ফায়সালা করে দেবেন যেসব বিষয়ে তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করতো।

৩৯:৩ :: আল্লাহর জন্যই কি খালেস/একনিষ্ঠ দ্বীন/জীবননীতি নয়? আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য আওলিয়া (অভিভাবক) গ্রহণ করে তারা বলে, “আমরা এজন্য ছাড়া তাদের ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করি না যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর দিকে নিকটবর্তী করে দেবে।” নিশ্চয় আল্লাহ তাদের মধ্যে অনিবার্য ফায়সালা করে দেবেন যেসব বিষয়ে তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করছে। নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত করেন না যে মিথ্যাবাদী কাফির।

৩৯:৪৬ :: বলো, হে আল্লাহ! আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা! দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী, আপনিই আপনার বান্দাদের মধ্যে অনিবার্য ফায়সালা করে দেবেন, যেসব বিষয়ে তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করছে।

৪১:৪৫ :: আর নিশ্চয় আমরা মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম। তারপর সেটার বিষয়ে ইখতিলাফ (মতভেদ) করা হয়েছিল। আর যদি তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে (ফায়সালা সম্পর্কিত) পূর্বঘোষণার বাণী না থাকতো, তাহলে তাদের মধ্যে অনিবার্য ফায়সালা করে দেয়া হতো। আর নিশ্চয় তারা এ বিষয়ে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে।

৪২:১০ :: আর যেসব বিষয়ে তোমরা ইখতিলাফ (মতভেদ) করো, সেটার ফায়সালা আল্লাহর কাছে। সেই আল্লাহই আমার প্রভু, আমি তাঁর উপরই ভরসা করি এবং তাঁর দিকেই অভিমুখী।

৪৩:৬৩ :: আর যখন ঈসা স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ এসেছিলো, সে বলেছিলো, অবশ্যই আমি তোমাদের কাছে প্রজ্ঞাসহ এসেছি এবং যে তোমরা যেসব বিষয়ে ইখতিলাফ (মতভেদ) করছো তার কিছু বিষয়ে তোমাদের কাছে স্পষ্ট তথ্য প্রকাশ করতে পারি। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো।

৪৩:৬৫ :: তারপর তারা বিভিন্ন দল তাদের পরস্পরের মধ্যে ইখতিলাফ (মতভেদ) করেছে। সুতরাং যারা যুলুম করেছে তাদের জন্য কষ্টদায়ক দিবসের শাস্তির দুর্ভোগ!

৪৫:১৭ :: আর আমরা তাদেরকে সঠিক বিষয়ের ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণাদি দিয়েছিলাম। তারপর তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করেনি এছাড়া যে, তাদের কাছে জ্ঞান এসেছিল (কিন্তু) তারা পরস্পরের উপর বাড়াবাড়ির জন্যই (মতভেদ করেছিল)। নিশ্চয় তোমার প্রভু ক্বিয়ামাত দিবসে তাদের মধ্যে সেসব বিষয়ে অনিবার্য ফায়সালা করে দেবেন যেসব বিষয়ে তারা ইখতিলাফ (মতভেদ) করছিল।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীতে জোর করে মতভেদ নিরসন করা যাবে না এবং সঠিক তথ্য স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হওয়ার পরও মতভেদ নিরসন হবে না। কারণ এখানে সঠিক তথ্য স্পষ্ট হওয়ার পরও লোকেরা একে অন্যের উপর জিদবশত মতভেদ বজায় রাখবে। আল্লাহ ক্বিায়ামাতের দিন সবাই অনিবার্যভাবে মেনে নিতে বাধ্য হবে এরূপভাবে মতেভদ নিরসন করে দেবেন। অন্যদিকে পৃথিবীতে মু’মিনদেরকে আল্লাহর কিতাবের আয়াতের স্পষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মতভেদের বিষয়ে সঠিক তথ্য জেনে নিয়ে নিজেদের মধ্যে তা চর্চা করতে হবে এবং অন্যদের সামনে কিতাবের তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তা তুলে ধরতে হবে, তারা তা মেনে নিক অথবা না নিক। আর এরি প্রেক্ষিতে মু’মিনরা যাবতীয় মতভেদের বিষয়ে আল্লাহর কিতাবের ভিত্তিতে সঠিক সমাধানে উপনীত হওয়ার এবং সঠিকভাবে আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের ঐক্যবদ্ধ কর্মপ্রচেষ্টা চালু রাখতে হবে।

দ্বীনের (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থার) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাফরীক্ব (বিভক্তি বা বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি) ও তাফাররুক্বের (পরস্পর বিচ্ছিন্নতা) নিষেধাজ্ঞা এবং ঐক্যের মূলনীতি

৬:১৫৯ :: নিশ্চয় যারা দ্বীনকে (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থাকে) বিভিন্নভাবে বিভক্ত করেছে এবং অনেক দল হয়ে গেছে, তাদের সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের ব্যাপার আল্লাহ্‌র নিকট সোপর্দ। তারপর তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিবেন সে সম্পর্কে যা কিছু তারা করছিল।

৯:১০৭ :: আর যারা মাসজিদকে গ্রহণ করেছে ক্ষতি সাধন, কুফর (সত্য প্রত্যাখ্যান) এবং মু’মিনদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করার (তথা ঐক্যের মূলনীতিকে উপেক্ষা করার) উদ্দেশ্যে এবং তাদের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে যারা আগে থেকেই আল্লাহর এবং তাঁর রসূলের (উপস্থাপিত মতাদর্শের) সাথে সাংঘর্ষিকতায় লিপ্ত হয়েছে। আর তারা কসম করে বলবে, “আমরা উত্তম কিছু করা ছাড়া অন্যরূপ ইচ্ছা করি নি”। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।

৩০:৩০-৩২ :: সুতরাং তোমার মুখমণ্ডলকে/সত্তাকে দ্বীনের (জীবনব্যবস্থার) জন্য একনিষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠা করো। এটাই আল্লাহর ফিতরাত (নির্ধারিত প্রকৃতি) যার উপযোগী করে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোনো বদল নেই। এটাই সঠিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত জীবনব্যবস্থা। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জ্ঞানার্জন করে না। তাঁরই অভিমুখী হও এবং তাঁর প্রতি সচেতন থাকো এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করো এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। যারা নিজেদের দীনকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে এবং নিজেরাও বিভিন্ন দল হয়ে গেছে। প্রত্যেক মিশনারি দল নিজেদের কাছে যা আছে তা নিয়ে উৎফুল্ল।

৩:১০৩ :: আর তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধরো (বা, আল্লাহর রজ্জুর মাধ্যমে গঠিত সংঘকে আঁকড়ে ধরো) এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না এবং তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামাতকে স্মরণ করো, যখন তোমরা পরস্পরের শত্রু ছিলে তারপর তিনি তোমাদের অন্তরসমূহকে সম্প্রীতিপূর্ণ করেছেন, ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পরের ভাই হয়ে গেলে, আর তোমরা ছিলে অগ্নিকুণ্ডের কিনারায়, তারপর তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বিশদ বর্ণনা করেন, যেন তোমরা সঠিক পথনির্দেশ পেতে পারো।

৩:১০৫ :: আর তাদের মতো হয়ো না যারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তাদের নিকট স্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণ এসে যাওয়ার পর ইখতিলাফ (মতভেদ) করেছে। আর তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে।

৬:১৫৩ :: এই হলো আমার সঠিক-সরল পথ, তোমরা এটাকে অনুসরণ করো, এবং তোমরা অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, নতুবা সে পথগুলো তোমাদেরকে তাঁর (আল্লাহর) পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। এভাবে তিনি (আল্লাহ) তোমাদেরকে নির্দেশ দেন, যেন তোমরা স্রষ্টা-সচেতন হতে পারো।

৪২:১৩ :: তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য দ্বীনের পর্যায়ভুক্ত সেই মূল বিধানই প্রদান করেছেন, যা তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং যা আমরা তোমার প্রতি ওয়াহী (অনুপ্রেরণা দান) করেছি এবং যার প্রতি আমি ইবরাহীমকে নির্দেশ প্রদান করেছিলাম এবং মূসাকে ও ঈসাকে, এ মর্মে যে, “তোমরা দ্বীনকে ক্বায়েম/প্রতিষ্ঠা/বাস্তবায়ন করো এবং সেই ক্ষেত্রে (দ্বীন ক্বায়েমের পথে) পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না”। তোমরা মুশরিকদেরকে (আল্লাহর একত্ববাদী দ্বীনের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকার) যে দিকে আহবান করছো তা তাদের নিকট বড়ই দুঃসহ হয়ে গেছে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাঁর দিকে নিয়ে আসার জন্য বাছাই করেন এবং তিনি তাকেই পথনির্দেশ করেন যে (পথনির্দেশের সন্ধানে) অভিমুখী হয়।

৪২:১৪ :: আর তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়নি এছাড়া যে, তাদের কাছে জ্ঞান এসেছিল (কিন্তু) তারা পরস্পরের উপর বাড়াবাড়ির জন্যই (পরস্পর বিচ্ছিন্ন করেছিল)। আর যদি তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট সময়কালে (ফায়সালা সম্পর্কিত) পূর্বঘোষণার বাণী না থাকতো, তাহলে তাদের মধ্যে অনিবার্য ফায়সালা করে দেয়া হতো। আর নিশ্চয় তাদের পরে যাদেরকে কিতাবের উত্তরাধিকারী করা হয়েছিলো তারা তার প্রতি বিভান্তিকর সন্দেহে রয়েছে।
৯৮:৪ :: আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিলো তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়নি তাদের কাছে (সঠিক তথ্যের) স্পষ্ট প্রমাণাদি আসার পরে (পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়া) ছাড়া।

২৩:৫১-৫৩ :: হে রসূলগণ! তোমরা পবিত্র ও উৎকৃষ্ট খাদ্য থেকে খাও এবং সৎকর্ম সম্পাদন করো। নিশ্চয় তোমরা যা করো আমি সেই বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত। আর নিশ্চয় তোমাদের এই উম্মাত হলো ‘একক উম্মাত’ (তথা সকল রসূল একই মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত)। আর আমি তোমাদের প্রভু। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি সচেতন থাকো।” তারপর তারা (রসূলদের অনুসারীরা) নিজেদের (দ্বীন সম্পর্কিত) বিষয়কে বহুভাগে কেটে নিয়েছে। প্রত্যেক মিশনারি দল তাদের কাছে যা আছে তা নিয়েই উৎফুল্ল।

৩:২০ :: তারপর যদি তারা তোমার সাথে বিতর্ক করো, তাহলে বলো, “আমি আমার সত্তাকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সমর্পিত করেছি এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও।” আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে এবং উম্মীদেরকে (তথা যাদেরকে কিতাবধারী নয় তাদেরকে) বলো, “তোমরা কি নিজেদেরকে সমর্পিত করছো?” তারপর যদি তারা নিজেদেরকে সমর্পিত করে, তাহলে তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তোমার উপর শুধু বালাগ বা প্রচারের দায়িত্ব। আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি পর্যবেক্ষক।

৩:৬৪ :: বলো, হে আহলে কিতাব, এসো সেই কথার দিকে যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান। তা এই যে, “আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা/পুজা) করবো না এবং তাঁর সাথে কাউকে অংশী স্থাপন করবো না, আর আমরা আল্লাহকে ছাড়া আমাদের একে অপরকে রব (বিধানদাতা, প্রভু) হিসেবে গ্রহণ করবো না।” তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে বলো, “আমাদের বিষয়ে সাক্ষী থাকো যে, আমরা মুসলিম (আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণকারী)।”

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যারা দ্বীন ইসলামকে অখন্ডভাবে বা সামগ্রিকভাবে অনুসরণ করার পরিবর্তে এর ভিন্ন ভিন্ন রূপ বানিয়েছে এবং তার ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তারাই বিচ্ছিন্নতাবাদী। তবে এর মানে এ নয় যে, দ্বীনের আলোকে সামাজিক বিভিন্ন কর্মসূচী সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন দল হতে পারবে না। বরং এর মানে যারা ঐ রূপকেই দ্বীনের একমাত্র রূপ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এভাবে অন্যদের থেকে পৃথক দল হয়, তারাই ঐক্য বিনষ্টকারী। অন্যদিকে ঐক্যের ডাক দিতে হবে তাওহীদ বা একত্ববাদের ভিত্তিতে। যার মূল কথা হলো: আল্লাহ ছাড়া কারো দাসত্ব, উপাসনা বা পুজা করা যাবে না, আল্লাহর সাথে কাউকে অংশী স্থাপন করা যাবে না, আল্লাহ ছাড়া একে অন্যকে প্রভু বা বিধানদাতা হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না, না নিজে অন্য কারো প্রভু বা বিধানদাতা সেজে বসা যাবে আর না অন্য কাউকে প্রভু বা বিধানদাতা হিসেবে মেনে নেয়া যাবে এবং একমাত্র আল্লাহর প্রতি নিজেদের সত্তাকে সমর্পিত করে দিতে হবে। আর যারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজেদেরকে সমর্পিত করে দেয় তথা একমাত্র আল্লাহর বিধানকেই নিজেদের জন্য শাশ্বত ও মূল বিধান হিসেবে মেনে নেয় তারাই মুসলিম। এই প্রেক্ষিতে অন্যদেরকে মুসলিম হওয়ার জন্য আহবান করতে হবে এবং তারা সাড়া না দিলে নিজেদের আদর্শগত পরিচয় হিসেবে ‘মুসলিম’ হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দিতে হবে।

আল কুরআনকে দ্বীনের একমাত্র দলীল হিসেবে গ্রহণকারী বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এবং ‘এক জাতি এক দল’ নীতির বাস্তবায়নের উদ্যোগ:

আল কুরআনকে দ্বীনের একমাত্র দলীল হিসেবে গ্রহণকারী বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও কর্মতৎপর রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে জনাব তৈয়াবুর রহমান গোপালগঞ্জী (১৯৩৮-২০১৩) ‘মুসলিমূন’ বা ‘উম্মাতাম মুসলিমাতান’ (মুসলিম উম্মাহ) নামে একটি বিশ্বজনীন জাতিসত্তা হিসেবে ‘এক জাতি এক দল’ নীতিতে নিজেদের পরিচয় প্রদানসহ সাংগঠনিক কাঠামোবদ্ধ হওয়ার আহবায়ক হয়ে ‘উলিল আমর’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি নির্বাহী সিদ্ধান্তক্রমে একটি বাইয়াতনামা, একটি পতাকা, একটি ব্যানার এবং ‘ওয়ার্ল্ড আল কুরআন রিসার্চ সেন্টার’ (প্রতিষ্ঠাকাল : ১৯৮১) নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা (যাতে সমকালীন প্রধান উলিল আমর পদাধিকারবলে প্রধান পরিচালক হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকবেন) এবং সেটার জন্য একটি ভবনের নকশা প্রণয়ন করে গেছেন।

তিনি মুসলিম উম্মাহর জামিয়া পুনর্গঠনের বাস্তবসম্মত পদ্ধতি সম্পর্কে বলেছিলেন যে, যখন আল কুরআনকে একমাত্র দ্বীনের দলিল হিসেবে বিশ্বাসকারী ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনের পারস্পরিক পরিচিতি ঘটবে তখন তারা একই মূল কাঠামোতে একীভূত হয়ে যেতে হবে, তারপর উলিল আমরের অনুমোদনক্রমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পারস্পরিক সহযোগিতামূলকভাবে কর্মতৎপর থাকতে পারে, যেমন একটি রাষ্ট্রে সরকারের অনুমোদনক্রমে অনেক সামাজিক সংস্থা কর্মতৎপর থাকতে পারে। এছাড়া প্রয়োজনসাপেক্ষে পরামর্শক্রমে সাংগঠনিক কাঠামোতে নেতৃত্বেও পরিবর্তন আসতে পারে বা প্রয়োজনীয় সমন্বয় হতে পারে। একই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে অনেক স্থানীয় বা টীমভিত্তিক নেতৃত্বের বিন্যাস হতে পারে। বিভিন্ন এলাকায় কুরআনকেন্দ্রিক যেসব ফোরাম রয়েছে, এ নীতিটি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার কার্যকর উপায় হতে পারে।

ইসলামী জীবনব্যবস্থা অনুসরণের কেন্দ্রগত ও পরিধিগত বিষয়

ইসলামী জীবনব্যবস্থা অনুসরণের কেন্দ্রগত বিষয় হচ্ছে এ সিদ্ধান্ত যে, শুধুমাত্র আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবকে তথা বর্তমানে আল কুরআনকেই দ্বীনের একমাত্র দলীল হিসেবে গ্রহণ করা হবে। এ প্রসঙ্গে ২:১১১, ২১:২৪, ২৩:১১৭, ২৭:৬৪, ২২:৮, ৩১:২০, ৬:১৫৫-১৫৭, ২৯:৫১, ৩৫:৪০, ৩৭:১৫১-১৫৭, ৪৩:১৯-২৪, ৪৬:৪, ৬৮:৩৫-৪০ আয়াতসমূহ লক্ষণীয়, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আসমানী কিতাব থেকেই ধর্মীয় বক্তব্যের প্রমাণ দিতে হবে। এছাড়া ২:২, ২:১৮৫, ২৫:১, ১৮:১, ১০:৩৭, ৪১:৪১-৪২, ১৫:৯, ৭:৩, ৬:১৯, ৬:১১৪-১১৫, ১২:১১১, ৭:৫২, ২৫:৩৩, ১৮:৫৪, ৩০:৫৮, ৩৯:২৭-২৮, ২৯:৫১, ১৬:৮৯ আয়াতসহ আরো অনেক আয়াত থেকেও একমাত্র আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব আল কুরআনকেই হিদায়াতের ও এবং এর আলোচ্য বিষয়াবলির ব্যাখ্যার এবং সত্যাসত্য নির্ণয়ের যথেষ্ট ও পরিপূর্ণ উৎস হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশনা রয়েছে, যা যাবতীয় সন্দেহমুক্ত ও চির-সুরক্ষিত এবং বক্রতামুক্ত ও সর্ববিধ মাসালা বা উদাহরণসমৃদ্ধ।

তারপর সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ্জসহ যাবতীয় বিধি বিধান হচ্ছে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পরিধিগত বিষয়।
সুতরাং মুসলিম বা আত্মসমর্পিত হওয়ার প্রায়োগিক মূলনীতি হচ্ছে যাবতীয় বিধানের সাংবিধানিক রূপরেখা শুধুমাত্র কুরআন থেকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। যারা এ সিদ্ধান্তে একমত তারা বিচ্ছিন্ন হবে না, যদিও পরিধিগত বিষয়ে বিস্তারিত রূপরেখা নির্ণয়ে তাদের সাময়িক মতভেদ (কুরআনের বক্তব্য অনুধাবনগত পার্থক্যের কারণে) সৃষ্টি হয়। তারা তাদের এরূপ মতভেদ নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আর মূলনীতিতে পার্থক্য হয়ে গেলে তথা কেউ আল কুরআন ছাড়াও অন্য কিছুকে দলীল সাব্যস্ত করলে সে মুসলিম উম্মাহর সদস্য তথা মুসলিম হবে না বা থাকবে না। মুসলিম উম্মাহ হচ্ছে কুরআনকে একমাত্র সংবিধান, উলিল আমরকে সরকার এবং মসজিদকে রাজধানী হিসেবে গ্রহণকারী উম্মাহ। এটা মূলনীতিগত সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তে একমত থাকা অবস্থায় কাউকে মুসলিম উম্মাহর বাহিরে সাব্যস্ত করার অবকাশ নেই।

মুসলিম উম্মাহর বিশ্বজনীন নেতৃত্ব কাঠামো

মুসলিম উম্মাহ ও এর জামিয়া মতাদর্শগতভাবে বিশ্বব্যাপী একটিই জাতিসত্তা, একটিই জাতীয় দল।

৩:১০৩ আয়াতে মু’মিনদেরকে জামিয়া বা সংঘবদ্ধ হয়ে ‘আল্লাহর রজ্জুকে’ আঁকড়ে ধরার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং ৪:৫৯ আয়াতে ঈমানের দাবি পূরণের জন্য ‘আল্লাহ, রসূল ও উলিল আমরের আনুগত্যের’ যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা পরিপালনের জন্য যদি সারা বিশ্বে মাত্র তিনজন মু’মিনও থাকে, তাহলেও তারা ‘উলিল আমর’ নির্ধারণ করে তার আওতায় সংঘবদ্ধ থাকতে হবে এবং তার দ্বারা নির্বাহীভাবে পরিচালিত হতে হবে, তার কাছে নিজেদের নেয়ামতের বণ্টন সম্পর্কিত ক্ষমতা অর্পণ করতে হবে, তার নিকট নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার অর্পণ করতে হবে।

একই রাষ্ট্রে সাংগঠনিকতার বহুত্ববাদ গ্রহণযোগ্য নয়। শুধুমাত্র ভৌগোলিক রাজনৈতিক/ভূ-রাজনৈতিক জটিলতার সাপেক্ষে বাস্তব কারণে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রে ভিন্ন ভিন্ন মুসলিম উম্মাহ সংগঠন অনুমোদিত, যাদের মধ্যে ঈমানের ভ্রাতৃত্ব ও একক আদর্শ থাকবে, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন নেতা ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের নেতৃত্ব দিবেন। যতটুকুতে ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা দূর হবে ততটুকুতে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এটা ভিন্ন কথা যে একক নেতৃত্বের অধীনে বিভিন্ন সংগঠন ও সাংগঠনিক নেতৃত্ব হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠনকে একীভূতকরণের মাধ্যমে এই একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য প্রক্রিয়া চালু থাকতে পারে তথা অন্তর্বর্তীকালে বহু সংগঠন থাকতে পারে। এই অন্তর্বর্তীকালের সময়সীমা অনির্দিষ্ট। সুতরাং ‘জামিয়া’ বা ঐক্যের প্রচেষ্টা একটি চলমান শর্ত হিসেবে কার্যকর থাকতে পারে।

৮:৭২ আয়াতে বাস্তব কাজের সুবিধা অসুবিধার প্রেক্ষিতে যারা হিজরত করতে পারে নি এমন মু’মিনদের বাস্তব অভিভাবকত্ব থেকে রসূল ও হিজরতকারী মু’মিনদেরকে নিষ্কৃতি দেয়া হয়েছে। এর মানে হলো যারা হিজরত করতে পারে নি সেই মু’মিনরা রসূলের প্রতি ঈমান রাখবে কিন্তু বাস্তবে রসূল তাদের অভিভাবকত্ব করা সম্ভব ছিল না আর তেমনি তারাও কোনো পরিচালনাগত নির্দেশ না পাওয়ায় সেই অনুযায়ী আনুগত্যের বাস্তব সুযোগ ছিল না। এরপর তাদের নিজেদের মধ্যেও বাস্তবসঙ্গত কারণে কোনো উলিল আমর নির্ধারণ ও ‘আমরিন জামিয়িন’ বা ‘সমষ্টিগত কর্মকাণ্ড’ পরিচালনা করা সম্ভব নাও হতে পারে। এমতাবস্থায় তাদের মধ্যে মানসিক ঐক্য থাকবে, মু’মিনদের পারস্পরিক সম্প্রীতি থাকবে, কিন্তু সমষ্টিগতভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা সুযোগ তৈরি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নাও থাকতে পারে। বাস্তব পরিস্থিতিগত কারণে এভাবে যৌথভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনার ‘জামিয়া’ বা ‘সাংগঠনিকতা’ না থাকলে তা দোষনীয় নয়।

অনুরূপভাবে বর্তমানেও একাধিক অঞ্চলে যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়ার সুযোগ না থাকলে স্বতন্ত্র সাংগঠনিক কাঠামো ও নেতৃত্ব থাকা সম্ভব, যাদের নীতিগত অবস্থান হবে এরূপ যে, যখনি তাদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে তখন তাদের মধ্যে বৃহত্তর সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে উঠবে, যাতে একটি মূল নেতৃত্বের আওতাধীনে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

অতীতে একই সাথে বহু অঞ্চলে বহু নবী-রসূল প্রেরণ করা হয়েছে এবং প্রত্যেক নবী-রসূল প্রধানত নিজ নিজ দায়িত্বপ্রাপ্ত অঞ্চলেই কাজ করেছেন। আঞ্চলিক যোগাযোগব্যবস্থার দুর্বলতাকালীন সময়ের জন্যই এটাই অবলম্বনযোগ্য মডেল হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

তবে সর্বশেষ নবীকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রসূল হিসেবে প্রেরণের মাধ্যমে বিশ্বজনীন একক নেতৃত্বব্যবস্থা উন্নয়নের নির্দেশনা রয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে যত বেশি অঞ্চলকে একক নেতৃত্বের আওতায় আনা সম্ভব হতে পারে, তাতে মূলগতভাবে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যদিও কাজের সুবিধার জন্য ঐ একক কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে ভিন্ন ভিন্ন স্থানীয় নেতৃত্ব বজায় থাকবে।

অভিন্ন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও বিভিন্ন নির্বাহী ব্যবস্থা

মানবজাতির তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রেক্ষিতে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সভ্যতাসমূহের একক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আর এই প্রেক্ষিতে যত বেশি পরিমাণে এই ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটবে তত বেশি পরিমাণে অভিন্ন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ক্রমবিকাশ ঘটবে। কিন্তু এর মানে কোনোক্রমে এই নয় যে, এর মাধ্যমে বিভিন্ন সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটিয়ে সমগ্র বিশ্বকে একক সভ্যতায় পরিণত করা হবে। কারণ মহান আল্লাহ মানবজাতিকে একটিমাত্র দাম্পত্য সম্পর্ক থেকে সৃষ্টি করলেও তিনি তাদেরকে বিভিন্ন সভ্যতায় বিভক্ত করেছেন যেন তাদের মধ্যে পারস্পরিক পরিচিতি ঘটতে পারে, সভ্যতাসমূহের মধ্যে লেনদেনের সম্পর্ক তৈরি হয়, যোগাযোগ এবং সেবার বিনিময় ঘটে। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতটি লক্ষণীয়:

৪৯:১৩ :: হে মানুষ, নিশ্চয় আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে, আর আমরা তোমাদেরকে পরিণত করেছি বিভিন্ন শাখায় (সভ্যতায়) ও প্রশাখায় (সম্প্রদায় ও গোত্রে), যেন তোমরা একে অন্যকে চিনতে পারো। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে মর্যাদাবান যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে স্রষ্টা-সচেতন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ সম্যক অবগত।

সুতরাং বিশ্বজনীন অভিন্ন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অর্থ এ নয় যে, সমগ্র বিশ্বে ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতিগত পার্থক্য সত্ত্বেও সর্বত্র একই নির্বাহী ব্যবস্থায় পরিচালিত হবে। বরং অবশ্যই প্রত্যেক সভ্যতার জন্য যথোপযোগী স্বতন্ত্র ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালনা পদ্ধতির প্রয়োজন হবে এবং বাস্তবসঙ্গত কারণে তাদের স্বতন্ত্র স্থানীয় নেতৃত্বেরও প্রয়োজন হবে।

অভিন্ন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে যেমন ভাষাগত ভিন্নতাকে মিটিয়ে দিয়ে বিশ্বজনীনভাবে একক ভাষা প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ নেয়া হবে না, তেমনি প্রশাসনিক ও যোগাযোগ সুবিধার জন্য যে ভৌগোলিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে সেগুলোকেও নিশ্চিহ্ন করা হবে না। বরং প্রয়োজনে ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক অঞ্চলের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে পারে, সীমানা পুননির্ধারণ বা পুন:বিন্যাস হতে পারে কিন্তু কোনোক্রমেই অঞ্চল বিভাজন পদ্ধতিকে পরিহার করা যেতে পারে না।

সংক্ষেপে বলা যায় মুসলিম উম্মাহর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে এক বিশ্বে এক বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, যাতে বর্তমান রাষ্ট্রগুলো হবে এ বিশ্বরাষ্ট্রের উপরাষ্ট্র। অর্থাৎ বর্তমান রাষ্ট্রগুলোর বিলুপ্তি ঘটবে না, কিন্তু তা একই মূল রাষ্ট্রের অধীনে পরিচালিত হবে, ফলে বর্ণ, গোত্র, পেশা, ভাষা ও দেশীয় সীমানাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ফলে মানবজাতির মধ্যে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসন করা যাবে। যতদিন সমগ্র বিশ্বব্যাপী এরূপ রাষ্ট্রব্যবস্থা কার্যকর করা যাবে না, ততদিন যতগুলো মুসলিম শাসনাধীন রাষ্ট্র আছে সেগুলোকে নিয়ে এরূপ একরাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামী আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল

মুসলিম উম্মাহ হলো এমন একটি জাতিসত্তা যার একক সংবিধান হলো আল কুরআন, একক সাংবিধানিক কেন্দ্র হলো ‘মাসজিদ’ এবং একক পদসোপানক্রমিক নেতৃত্ব হলো ‘রসূল ও উলিল আমর’। মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ উলিল আমরের অনুমোদন সাপেক্ষে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও গবেষণামূলক সংস্থা গঠন, পরিচালনা বা তাতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যা একটি নির্বাহী কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। অনুরূপভাবে মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে অনুমোদিত কোনো রাজনৈতিক দল ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য জনগণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে অথবা গণদাবি/গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে।
উম্মাহর সাধারণ শাসন যে মূল নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত তার অনুমোদনক্রমে কোনো নির্দিষ্ট বিভাগে (যেমন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে) অন্য কোনো নেতৃত্ব-পরিষদের স্বায়ত্তশাসন বা সাধারণত স্বাধীনভাবে (যতক্ষণ বিশেষ আপত্তি তৈরি না হয়) সিদ্ধান্ত গ্রহণ আপত্তিজনক নয়।

তবে রাজনৈতিক দলকে আর্থ-সামাজিক সংস্থা-সংগঠন বা শিক্ষা ও গবেষণামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনা করা যায় না। যেহেতু ইসলামী আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহসহ রাষ্ট্রের জনসাধারণকে পরিচালনার কাজে নিয়োজিত থাকতে সচেষ্ট, তাই এক্ষেত্রে একাধিক রাজনৈতিক দলের অর্থ হলো পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যা মুসলিম উম্মাহর জামিয়াকে এবং একক নেতৃত্ব কাঠামোকে বিনষ্ট করে। তাই মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে একাধিক রাজনৈতিক দল হতে পারে না, বরং একটিমাত্র রাজনৈতিক দল অনুমোদিত হতে পারে, মুসলিম উম্মাহর ‘উলিল আমর’ যে রাজনৈতিক দলের প্রধান হবেন অথবা যে রাজনৈতিক দলের প্রধান ব্যক্তি ‘উলিল আমরের নেতৃত্বাধীন’ হবেন।

মুসলিম উম্মাহর মধ্যে পরস্পর স্বতন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন ‘জামিয়া’ এবং ‘সমন্বয় প্রচেষ্টারত জামিয়া’

মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে ‘বিহাবলিল্লাহি জামিয়া’ তথা ‘আল্লাহর রজ্জুর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধতা ও সংঘবদ্ধতার’ নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাফাররুক্ব বা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এখন বাস্তবে এমনটি হওয়া সম্ভব যে, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে পরস্পর স্বতন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন ‘জামিয়া’ বা ‘সংঘ’ তৈরি হয়েছে এবং তাদের প্রত্যেকে নিজেদেরকেই ‘বিহাবলিল্লাহি জামিয়া’ বলে দাবি করছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের প্রত্যেক সংঘই ‘বিহাবলিল্লাহি জামিয়া’ হয়ে থাকে, তাহলে পারস্পরিক পরিচিতি ঘটার পর তাদের মধ্যে পুনরায় ‘জামিয়া’ হতে হবে তথা তারা একটি বৃহত্তর জামিয়া গড়ে তুলতে হবে।

কিন্তু যখন প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র জামিয়া নিজেদেরকে ‘বিহাবলিল্লাহি জামিয়া’ দাবি করার পাশাপাশি অন্যদের ক্ষেত্রে আপত্তি করে যে, তারা ‘বিহাবলিল্লাহ’ থেকে বিচ্যুত, তখন তাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় আল্লাহর কিতাবের মাধ্যমে এ সম্পর্কিত মতভেদ নিরসনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা। কিন্তু যদি এ নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, তাহলে মু’মিনদের মধ্য থেকে একটি সমন্বয়কারী পক্ষ তাদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী দ্বন্দ্বের সমাধান ও মীমাংসার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তারা তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে যতক্ষণ সমন্বয়ের সম্ভাবনা থাকবে।

যদি উভয় পক্ষের মধ্যে কিছু ভুল বুঝাবুঝির বিষয় থাকে, তাহলে সময়ের ব্যবধানে তাদের ঐক্য সম্ভব। আর যদি কোনো পক্ষ আল্লাহর বিধানের প্রতি সত্যিকার আন্তরিকতা না রেখে থাকে এবং সেটাকে সত্যিকারার্থে সিদ্ধান্তের উপায় হিসেবে গ্রহণ না করে তাহলে ঐক্য হবে না এবং সে অবস্থায় যারা সত্যিকারার্থে আল্লাহর বিধানকে গুরুত্ব দেয় না কিন্তু নিজেদেরকে মু’মিন দাবি করে তারা ‘মুনাফিক’ ছাড়া কিছু নয়। মুনাফিক্বরাও নিজেদেরকে ‘মু’মিন’ ও ‘মু’মিনদের জামিয়া’ হিসেবে দাবি করতে পারে, কিন্তু যতক্ষণ তারা কোনো ফৌজদারি অপরাধ করবে না, ততক্ষণ মু’মিনরা তাদেরকে আঘাত করতে পারবে না, বরং তারা কুরআন অনুসারে নিজেদের কাজ করে যেতে হবে।
সুতরাং যখন দ্বন্দ্বের উভয় পক্ষ আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী সমাধানের ক্ষেত্রে নিষ্ঠাহীনতার প্রকাশ ঘটায় তখন তাদের উভয়কে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দিয়ে সমন্বয় উদ্যোগ গ্রহণকারী তৃতীয় পক্ষই মুসলিম উম্মাহর প্রকৃত জামিয়া বা সংঘ হিসেবে ভূমিকা পালনে সক্রিয় হতে হবে। আর যদি মু’মিনদের মধ্যকার দুই পক্ষ পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের মধ্যে আল্লাহর কিতাবের ভিত্তিতে মীমাংসা করে দিতে হবে। কিন্তু যদি কোনো পক্ষ বাড়াবাড়ি করে তাহলে ঐ বাড়াবাড়িকারী পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াত লক্ষণীয়:

৪৯:৯-১০ :: আর যখন মু’মিনদের দুই দল পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন তোমরা (মু’মিনদের নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষ) তাদের উভয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। তবে যদি তাদের একদল (আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে) অন্য দলের উপর বাড়াবাড়ি করতে থাকে, তাহলে তোমরা সেই বাড়াবাড়িকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। তারপর যদি তারা ফিরে আসে, তাহলে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মীমাংসা করে দাও এবং ন্যায়বিচার করো। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদেরকে ভালোবাসেন। নিশ্চয় মু’মিনরা ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও এবং আল্লাহর প্রতি সচেতন থাকো, যেন তোমাদেরকে অনুগ্রহ করা হয়।

>>  পরবর্তী পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য ক্লিক করুন