যাকাত

আল কুরআনের আলোকে যাকাত - যাকাত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমিত নয়

নৈতিকতাভিত্তিক উন্নয়ন ও পরিশুদ্ধতার নির্দেশনা

আতাল মাল ও আতায যাকাতের সম্পর্ক

২:১৭৭ আয়াতে ‘পুণ্য বা ভালো কাজের তালিকা’ প্রসঙ্গে ‘আতাল মাল’ এবং ‘আতায যাকাত’ এর বিষয়টি স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখিত হয়েছে। ‘আতাল মাল’ প্রসঙ্গটিতে বলা হয়েছে, ‘তার মহব্বতের মাল দান করে আত্মীয়-স্বজনকে, ইয়াতীমদেরকে, অভাবগ্রস্তদেরকে এবং ছিন্নমূলকে / উদ্বাস্তুকে / বাস্তুহারাকে (ইবনে সাবীলকে) এবং সাহায্যপ্রার্থীকে এবং কারো ঘাড়কে (দাসত্ব থেকে) মুক্ত করার ক্ষেত্রে’। তারপর আবার স্বতন্ত্রভাবে আক্বামাস সালাত ও আতায যাকাত এর প্রসঙ্গটি এসেছে। অর্থাৎ এরপর বলা হয়েছে, ‘এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত (পরিশুদ্ধতামূলক প্রদেয়/যোগান) প্রদান / সরবরাহ করে’। এ থেকে বুঝা যায় যে, ‘আতাল মাল’ এবং ‘আতায যাকাত’ দুটি আলাদা বিষয়।

অন্যদিকে, ৯২:১৭-১৯ ও ৩০:৩৯ আয়াত থেকে যাকাত বাবদ মালসম্পদ দান করার বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, যাকাতের সাথে অর্থনৈতিক দায়িত্ব হিসেবে মালসম্পদ দান করার বিষয়টির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

বস্তুত আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, উদ্বাস্তু, সাহায্যপ্রার্থী এবং দাসমুক্তি ইত্যাদির জন্য তথা অন্যদের আল্লাহ প্রদত্ত হক্ব পরিপূরণার্থে যে ‘আতাল মাল’ করা হয় তা এবং বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখিত সদাক্বাত প্রদান করার নির্দেশনা একই বিষয়কে দুটি ভিন্নরূপে উপস্থাপন করে। তাই ‘আতাল মাল’ ও ‘আতায যাকাত’ এর সম্পর্ক ও পার্থক্য প্রসঙ্গে পূর্বে উল্লেখিত ‘যাকাত ও সদাক্বাতের সম্পর্ক ও পার্থক্য’ এর আলোচনাটি প্রযোজ্য।

যাকাত ও রিবার মধ্যে পার্থক্য

রিবা (সুদ) হলো পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল ভিত্তি। এতে নিজ উপার্জিত মালসম্পদে অন্যের অধিকার স্বীকার করা হয় না এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমান বিনিময় ফেরত পাওয়া ছাড়া কোনো অনুদানকে ঐচ্ছিক হিতাকাঙ্খার পরিবর্তে দায়িত্ব বলে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পুঁজিকে একটা নিশ্চিত নির্ধারিত সময়মূল্যসহ ফেরতযোগ্য হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়।

অন্যদিকে কুরআন যে অর্থনীতির নির্দেশনা দিয়েছে তা হলো ন্যায্য অর্থনৈতিক বিনিময় ব্যবস্থা এবং পরার্থপরতার অর্থনীতি। ন্যায্য বিনিময় ব্যবস্থা বলতে বুঝায় ন্যায্য দরদামভিত্তিক লেনদেন, যেখানে চাহিদা ও যোগানের ক্ষেত্রে ধোঁকা বা ঠকানোর কোনো প্রক্রিয়া জড়িত থাকবে না, বরং পারস্পরিক স্বচ্ছ সম্মতির ভিত্তিতে লেনদেন হবে এবং পুঁজির বিনিয়োগ হবে লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্বের শর্তে। এই শর্ত পরিপূরণ করে লাভ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে যে কারবার পরিচালনা করা হয়, কুরআনের ভাষায় সেটাকেই ‘বাইয়ুন’ বা ‘ব্যবসা’ বলা হয়। কুরআনে ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করা হয়েছে। আর পরার্থপরতার অর্থনীতির আওতায় সদাক্বাত ও যাকাতের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সদাক্বাত হলো অন্যের প্রতি নৈতিক দায়িত্ববোধের ভিত্তিতে ছাড় ও অনুদান (সদাক্বাত) প্রদান করা। আর যাকাত হলো নিজেকে মনস্তাত্ত্বিক সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করার জন্য ও সমাজদেহের সুষম পরিপুষ্টির বা সুষ্ঠু সমাজ উন্নয়নের জন্য অনুদান (যাকাত) প্রদান করা।

আল্লাহর বিবেচনায় সুদ বৃদ্ধি পায় না, বরং যাকাত বৃদ্ধি পায় এবং আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন, সদাক্বাতকে বিকশিত করেন (৩০:৩৯, ২:২৭৮)।

এটা স্বত:সিদ্ধ যে, কেউ যদি চুরি করে তবে তাতে তার হাতে কোনো সম্পদ যোগ হলেও প্রকৃতপক্ষে সে সম্পদ তার নয়, তাতে তার জন্য বৈধতা নেই। তেমনি সুদের মাধ্যমে বাহ্যত সম্পদ বাড়লেও তাতে মূলত অন্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার সম্পদ হরণ করা হয়, তাতে সুদগ্রহীতার জন্য বৈধতা নেই। কেউ যদি কোথাও ১০০ টাকা রেখে দেয় ১০ বছর পরও তা ১০০ টাকাই থাকবে, বাড়বে না। কিন্তু যদি ১০০ টাকা মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করে ব্যবসায়ের মাধ্যমে লাভ হয়, তা হয় টাকাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি শ্রম ও সময় দেয়ার কারণে। সুতরাং যদি বিনিয়োগকৃত টাকার লাভ নিতে হয়, তবে অবশ্যই তা কাজে লাগিয়ে করা ব্যবসায়ের লোকসানের ঝুঁকিও নিতে হবে। কারণ লোকসান তো মূলত ‘ঋণাত্মক লাভ’ ছাড়া কিছু নয়।

এছাড়া সুদ বাস্তবেই নৈতিক-প্রাকৃতিক নিয়মে এক পর্যায়ে নিশ্চিহ্ন হয় এবং যাকাত ও সদাক্বাত বিকশিত হয়। কারণ সুদ অর্থনীতিতে বিভিন্ন কুফলের এবং যাকাত ও সদাক্বাত বিভিন্ন সুফলের সৃষ্টি করে। যেমন, সুদ প্রকৃত প্রয়োজনীয় ও উপকারী জিনিসের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, ব্যবসায়ে লোকসান হলেও সুদ দিতে হয় বিধায় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে, মন্দার সময় সুদী ঋণের ঘাটতি ঘটে এবং অধিকতর মন্দার সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে যাকাত ও সদাক্বাতের মাধ্যমে সবাই অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করতে পারে, সবার স্বচ্ছলতা ফিরে আসে এবং সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

যাকাত এর একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ যার মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয় এবং বারবার আয় ও জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় হয় একে বর্তমানে ওয়াক্বফ বলা হয়। ওয়াক্বফ শব্দটির শব্দমূল ওয়াও ক্বফ ফা এবং শব্দটির অর্থ হলো ‘থামানো’। এ শব্দ থেকে গঠিত ‘উক্বিফূ’ ও ‘ওয়াক্বিফূ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তিন স্থানে: ৬:২৭:৪, ৬:৩০:৪, ৩৭:২৪:১। এবং মাওক্বূফূন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এক স্থানে: ৩৪:৩১:১৬। কুরআনে সদাক্বাহ / যাকাত / ইনফাক্বের এ খাতকে ওয়াক্বফ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়নি। বরং এটা যাকাতের অন্তর্ভুক্ত। কোনো সম্পদকে স্থায়ীভাবে বা বারবার মানবিক কল্যাণে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে স্বত্ব ত্যাগ করে প্রাতিষ্ঠানিকরূপে অনুদান করা এবং উত্তরোত্তর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হওয়ার মতো কোনো আর্থসামাজিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে স্বত্বত্যাগ করে অনুদান করা হলো যাকাতের একটি প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি। এরূপ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে সমাজে বেকারত্ব নিরসন, উৎপাদন বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির বণ্টন ঘটতে পারে, যার দ্বারা পরোক্ষভাবে যাকাত প্রদানকারীও উপকৃত হতে পারে।

কুরআনে রিবার (সুদ) বিপরীতে বাইয়ুন এবং সদাক্বাত ও যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি চর্চার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বাইয়ুন হলো রিবার বিপরীতে নিজের বৈধ উপার্জনমূলক ব্যবসায়, যার মাধ্যমে বৈধভাবে ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জিত হয়। অন্যদিকে সদাক্বাত ও যাকাত হলো পরার্থপরতার অর্থনীতি, যাতে নিজের বৈধ মালসম্পদ থেকে অন্যদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যয় ও অনুদান করা হয়, এর মাধ্যমে সমাজ-সমষ্টিগত অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জিত হয়।

যাকাত ও সালাতের মধ্যে সম্পর্ক

যাকাত সম্পর্কিত অনেক আয়াতে একসাথে সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আবার বলা হয়েছে যে, প্রকৃত সালাতকারীগণ যাকাতের জন্য সক্রিয় থাকে। সুতরাং সালাতের সাথে যাকাত অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর বিধানের নিবিড় অনুসরণের প্রত্যয় প্রকাশ পায় আর এটি যাকাত তথা আত্মশুদ্ধি ও সমাজের পরিশুদ্ধিতার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালনে বাধ্য করে। সালাত প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি যাকাত প্রদান বা যাকাতে সক্রিয় থাকার নির্দেশের একটি তাৎপর্য হলো: আল্লাহর কোনো বিধান পালন যেন কোনো কাঠামোগত বা বাহ্যিক দিক থেকে বিধানের অনুবর্তিতা হিসেবে সাব্যস্ত না হয় বরং তা আল্লাহ যে পরিশুদ্ধতার নির্দেশ দিয়েছেন তা সহকারে এবং তাতে উত্তরোত্তর অগ্রগতির জন্য সক্রিয় থেকে সম্পাদিত হতে হবে। যাকাত বা পরিশুদ্ধতা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমিত নয়, আবার অর্থনৈতিক দিকটিও এর অন্তর্ভুক্ত। সালাত ও যাকাতকে দ্বীন ইসলামের দুটি মৌলিক কর্মকাঠামো হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে এবং তাই বিভিন্ন আয়াতে সালাত প্রতিষ্ঠা ও যাকাত প্রদানের বিষয়টি একটি কার্যগত জোড়া নির্দেশ হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে এবং যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করবে ও যাকাত প্রদান করবে তাদেরকে দ্বীনী ভাই হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক দুটি আয়াত হলো ৯৮:৫ ও ৯:১১।

যাকাত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমিত বিষয় নয় বরং সামগ্রিক পরিশুদ্ধতার নির্দেশনা

যাকাত সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে দেখা যায় যে, যারা নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ বলে দাবি করে তাদের সমালোচনায় বলা হয়েছে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পরিশুদ্ধ করেন; আবার বলা হয়েছে, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে সেই সফলতা লাভ করবে। সুতরাং আল্লাহ তাকেই পরিশুদ্ধ করেন যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য আল্লাহর সাহায্যের উপর ভরসা করে প্রচেষ্টা করে। আর এরূপ ব্যক্তিই নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে সক্ষম হয়। সুতরাং নিজেকে পরিশুদ্ধ বলে দাবি করা সঙ্গত নয়, বরং নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই মানুষের করণীয়। সেই সাথে অন্যদেরকেও আল্লাহর আয়াতের ভিত্তিতে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও উপদেশের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করার কাজে ভূমিকা পালন করা যেতে পারে। যেমন, রসূলের একটি অন্যতম দায়িত্ব ছিলো, মু’মিনদেরকে চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে পরিশুদ্ধ করা। অবশ্য এ দায়িত্ব তাদের প্রতি যারা নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করার আগ্রহ রাখে। অন্যদিকে যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে চায় না, তাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য উপর্যুপরি উপদেশ প্রদানের দায়ভার থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

পরিশুদ্ধতার জন্য কুরআনে অনেক পন্থা-পদ্ধতি দেয়া হয়েছে। যেমন, তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর ইদ্দাত শেষে সে অন্য কোনো পুরুষকে স্বামী হিসেবে পছন্দ করলে তথা অন্যত্র পুনর্বিবাহের ইচ্ছা করলে তাতে বাধা প্রদান করা যাবে না। কারো গৃহে তার অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যাবে না, এমনকি সে যদি ফিরে যেতে বলে তবে ফিরে যেতে হবে। মু’মিন পুরুষ ও নারীরা তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করতে হবে এবং দৃষ্টিকে সংযত করতে হবে।

পরিশুদ্ধতার উপায় হলো, আল্লাহ সচেতন হওয়া, শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ না করা, অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত থাকা এবং কবীরা গুনাহ বা বড় বড় অপরাধ থেকে মুক্ত থাকা।

আল্লাহ যাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন তারা হলো যারা আল্লাহর কিতাবের তথ্য গোপন করে এবং আল্লাহর কিতাবকে তুচ্ছমূল্যে বিক্রয় করে তথা পার্থিব বিনিময়ের বস্তু বা উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে এবং সর্বোপরি তুচ্ছমূল্যের বিনিময়ে তথা পার্থিব স্বার্থে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ও নিজেদের পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি পালন থেকে বিরত থাকে।

যাকাত সম্পর্কিত এ সকল তথ্য থেকে স্পষ্ট যে, যাকাত শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমিত কোনো বিষয় নয়, বরং এটি হলো সামগ্রিক পরিশুদ্ধতার নির্দেশক। চিন্তা ও বিশ্বাস, কথা ও কাজ এবং ব্যক্তি ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে পরিশুদ্ধতা অর্জনের জন্য কার্যকর উপায় অবলম্বনে সক্রিয় থাকাকেই ‘যাকাতের ক্ষেত্রে সক্রিয়তা’ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং এটাকে সফলকাম মু’মিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

নৈতিকতাভিত্তিক উন্নয়ন অর্থনীতি বা যাকাতের ক্ষেত্রে উলিল আমরের ভূমিকা

মু’মিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “তারা যাকাতে সক্রিয় থাকে”। রসূলের একটি দায়িত্ব হলো, “মু’মিনদেরকে পরিশুদ্ধ করা”। মু’মিনরা পরিশুদ্ধতার জন্য সদাক্বাত করে থাকে এবং মু’মিনদেরকে পরিশুদ্ধ করার জন্য তিনি তাদের থেকে সদাক্বাত গ্রহণ করেন এবং কুরআনে বর্ণিত খাতগুলোতে বণ্টন করেন। মু’মিনরা ইনফাক্ব বা নৈতিক দায়িত্বশীলতার ভিত্তিতে ব্যয় হিসেবে ‘আফওয়া’ (উদারতাপূর্ণ প্রদেয়) প্রদান করে এবং রসূল মু’মিনদের থেকে ঐ আফওয়া গ্রহণ করেন। এভাবে যাকাত বা পরিশুদ্ধতামূলক ও নৈতিকতাভিত্তিক উন্নয়ন অর্থনীতিতে মু’মিনরা এবং তাদের ব্যবস্থাপক হিসেবে রসূল ভূমিকা পালন করেন। রসূল যখন যেখানে থাকবেন না সেখানে রসূলের পক্ষ থেকে এই সমষ্টিগত পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালনকারী কর্তৃপক্ষকে ‘উলিল আমর’ বলা হয় (৪:৫৯, ৪:৮৩)।

কুরআনের সামগ্রিক অর্থনৈতিক নির্দেশনা থেকে মু’মিনদের উলিল আমর (Central Authority) কর্তৃক যাকাতের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের অর্থনৈতিক মাত্রা কিরূপ হতে পারে তা নির্ণয় করা খুবই সহজ। যেমন, আল কুরআনে কালো টাকা সাদা করার তথা অবৈধ সম্পদের অংশবিশেষ প্রত্যাবর্তন করে বাকিটুকু ভোগদখল করার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। তাই রসূল বা উলিল আমর কর্তৃক যাকাত করার প্রথম স্তরে রয়েছে অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পদক্ষেপ। কোনো ব্যক্তির নিকট যদি কোনো অবৈধ সম্পদ থাকে, তাহলে সে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে হলে সর্বপ্রথম ঐ অবৈধ সম্পদ সম্পূর্ণভাবে (১০০%) ছেড়ে দিতে হবে। কারণ এর কোনো অংশ রেখে দিয়ে পরিশুদ্ধতা লাভ করা সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে রসূল বা উলিল আমরও সমাজকে অর্থনৈতিকভাবে পরিশুদ্ধ করার ক্ষেত্রে যাদের কাছে অবৈধ সম্পদ রয়েছে তাদের সম্পূর্ণ অবৈধ সম্পদকে বাজেয়াপ্ত করবেন।

৫৯:৭ আয়াতে বণ্টনপদ্ধতির মৌলিক উদ্দেশ্য হিসেবে জানানো হয়েছে যে, “যেন সম্পদ কেবল সম্পদশালীদের মধ্যে পুঞ্জিভূত না হয়”। সম্পদ কেবল সম্পদশালীদের মধ্যে পুঞ্জিভূত হওয়াকে বলা যেতে পারে দেহের কোথাও রক্ত আটকে যাওয়ার মতো অসুস্থতা বা একটি অর্থনৈতিক অপরিশুদ্ধতা, তা রোধ করাই অর্থনৈতিক যাকাতের একটি দিক। তাই সম্পদ যেন শুধু ধনীদের মধ্যে পুঞ্জিভূত না হয় বরং সর্বসাধারণের কল্যাণে আসে সেজন্য এবং আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠার কোনো কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনসাপেক্ষে ক্ষতিপূরণ দিয়ে সম্পদ অধিগ্রহণ করা যেতে পারে। ৪:২৯ আয়াতে বর্ণিত নির্দেশনার একটি দিক হচ্ছে, অসঙ্গত কারণ, উদ্দেশ্য বা উপায়ে (বিল বাতিল) কারো মালসম্পদ অধিগ্রহণ করা যাবে না। সুতরাং সঙ্গত কারণে বা বাস্তবসঙ্গত যৌক্তিকতা তৈরি হলে উলিল আমর কারো মালসম্পদ অধিগ্রহণ করতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে তেজারত বা লেনদেন হতে হবে তথা অধিগ্রহণের বিপরীতে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অধিগ্রহণের বিপরীতে অন্তত তিন গুণ বেশি মূল্য ক্ষতিপূরণ দেয়ার রীতি বিভিন্ন দেশে প্রচলিত রয়েছে, যা একটি ভালো রীতি হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে।

কুরআনের শিক্ষা ও বাস্তবতার তথ্য সমন্বয়ের ভিত্তিতে সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উলিল আমরের ভূমিকা বা নির্বাহী কার্যপ্রণালী সম্পর্কে নিম্নে কতিপয় প্রস্তাবনা উল্লেখ করা হলো:

যখন উলিল আমর দেখবেন যে, কেউ অতিরিক্ত ভূমি ইত্যাদির মালিক হয়ে তা সমাজ কল্যাণে কাজে না লাগিয়ে নিজের আমোদ আংগিনা তৈরি করে রাখছে, তখন তিনি সামাজিক পরিশুদ্ধির খাতিরে ক্ষতিপূরণ দিয়ে তা অধিগ্রহণ করতে পারেন। কোথায় কী উৎপাদন করা হবে এবং কোন ধরনের পণ্য বা সেবা সরবরাহ করা যাবে তা নির্ধারণে উলিল আমরকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সাংবিধানিক নির্দেশনা বাস্তবায়নের নির্বাহী পদক্ষেপের বিষয়গুলো পরামর্শক্রমেই সম্পাদিতব্য (৩:১৫৯, ৪২:৩৮)। তাই যাকাতে সক্রিয়তার কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শক্রমে পরিবর্তনশীল নির্বাহী সিদ্ধান্ত হিসেবে একটা নির্দিষ্ট সীমার বাহিরে কেউ ভূমিসত্ত্ব ধরে রাখতে পারবে না এরূপ সীমা নির্দিষ্ট করা, প্রযুক্তি ও শ্রমের সমন্বয় সাধন করা, শ্রমিকসংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকারত্ব সমস্যা দূরীকরণের উপায় হিসেবে প্রয়োজনে শ্রমঘণ্টা কমিয়ে দেয়া, ন্যায্য মজুরি হার নির্ধারণ করা, ক্রয়-বিক্রয় ইত্যদি ক্ষেত্রে ক্রেতার বা বিক্রেতার একচেটিয়া কারবারকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন বা মুক্তবাজার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সাময়িক বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি উলিল আমরের নির্বাহী অধিকার বা ক্ষমতা চর্চার বৈধতা ও দায়-দায়িত্বের সাথে জড়িত রয়েছে।

পরিশুদ্ধ এবং নৈতিকতাভিত্তিক উন্নয়ন অর্থনীতির জন্য উলিল আমরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো: অশ্লীল ও ক্ষতিকর অবৈধ পণ্য ও সেবার উৎপাদন ও সরবরাহ প্রতিরোধ, নকল ও ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও বিতরণ প্রতিরোধ, অনুৎপাদনশীল ও অপচয়মূলক খাতে বিনিয়োগ প্রতিরোধ, বিলাসদ্রব্যের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ, মূল্য বৃদ্ধিকারক তথা অস্বাভাবিক মুনাফাবৃদ্ধির জন্য আন্ত:প্রাতিষ্ঠানিক অধিগ্রহণ ও একীভূতকরণ নিয়ন্ত্রণ, কোন ধরনের পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে কমসংখ্যক উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দিতে হবে এবং কোন ধরনের পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে বেশিসংখ্যক উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দিতে হবে এবং কোন ধরনের পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে সরকারকেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে সামগ্রিক জনকল্যাণের দিকে লক্ষ রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ইত্যাদি।

নৈতিকতাভিত্তিক উন্নয়ন অর্থনীতির জন্য নৈতিক ও কর্মমুখী শিক্ষা-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাও উলিল আমরের অন্যতম দায়িত্ব। যখন অগ্রাধিকারের প্রশ্ন দেখা দিবে তখন তুলনামূলকভাবে কম প্রয়োজনীয় পণ্য বা সেবার সরবরাহ স্থগিত রেখে অতি আবশ্যক পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য উলিল আমরের আরো দায়িত্ব হলো: কর আরোপের ক্ষেত্রে আয়, উৎপাদন ও আমদানির খাতসমূহে করভারের (Burden of Tax) ন্যায্যতা নিশ্চিত করা (৮),  সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তব প্রয়োজন ও অঞ্চলগত ন্যায্য বণ্টন ভিত্তিক অগ্রাধিকার নিরূপণ করা, বিভিন্ন আর্থিক খাতে ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা, সেনাবাহিনীকে অলস বসিয়ে না রেখে যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া অন্য সময়ে জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচীতে নিয়োজিত রাখা, বাস্তবসম্মতভাবে আবশ্যিক ন্যুনসীমায় নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পরিপূরণ নিশ্চিত করা, বাস্তব উপযোগিতা বা সম্ভাব্য ফলাফল বিবেচনায় সঙ্গতভাবে জাতীয়করণ ও বেসরকারিকরণের ভারসাম্য রক্ষা করা, কর্মক্ষমদের ইচ্ছাকৃত বেকারত্ব প্রতিরোধ ও অনিচ্ছাকৃত বেকারত্ব নিরসনের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা ইত্যাদি। উন্নয়ন অর্থনীতির উদ্দেশ্য হবে, সক্ষম সবার হাতে কাজ চাই, সক্ষম অসক্ষম নির্বিশেষে সবার মুখে ভাত চাই।

(৮) যেমন গরীবের আয়ের উপর ধার্যকৃত কর ধনীর উপর ধার্যকৃত করের তুলনাম কম হবে, বিলাস দ্রব্যের তুলনায় নিত্য প্রয়োজনীয় ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের উৎপাদন ও আমদানির উপর ধার্যকৃত কর কম হবে।

নৈতিক মূল্যবোধের সর্বোৎকৃষ্ট স্তর হলো: যোগ্যতা অনুযায়ী সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন এবং নিজ প্রয়োজনের অতিরিক্তটুকু অন্যদের জন্য ছেড়ে দেয়া। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সবাই যোগ্যতা অনুযায়ী দেবে ও প্রয়োজন অনুযায়ী নেবে, এ নিয়মকে প্রয়োগ করা বাস্তবসম্মত নয়। কারণ বাস্তবে সব মানুষ নৈতিকতার এ সর্বোৎকৃষ্ট স্তরে উন্নীত নয়। তাই এরূপ নিয়ম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কার্যকর করা সম্ভব নয়। আবার সবার থেকে বাধ্যতামূলকভাবে শ্রম আদায় এবং উৎপাদিত সম্পদের হবহু সমবণ্টনও বাস্তবসম্মত নয়। বরং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যে সমতা রক্ষা করা সম্ভব তা হলো একই কর্মবিভাগের একই পদক্রমের জন্য একই চাহিত যোগ্যতার ভিত্তিতে যাচাই করে নিয়োগ এবং তাদেরকে একইভাবে পারিশ্রমিক প্রদান। অন্য কথায়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যে নিয়ম অনুসরণ করা প্রয়োজন তা হলো: প্রয়োজনের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাহিত যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মে নিয়োগ, কর্মের নির্ধারিত ধরন বা মানক্রম অনুসারে বেতন, বেতন অনুসারে কর এবং সরকারি কর্মে নিযুক্তদেরকে পরিবারে নির্ভরশীল সদস্যসংখ্যা হিসেবে ভাতা। এভাবে কর্মে নিয়োগ ও বেতন-ভাতার পর যারা বিভিন্ন বাস্তবসঙ্গত কারণে পিছিয়ে থাকবে তাদেরকে মানবিক সহায়তা দেয়ার জন্য যারা জীবিকার ক্ষেত্রে প্রাচুর্য পায় তাদের থেকে এক্সট্রা কিছু গ্রহণ করা মানব কল্যাণভিত্তিক রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থার অন্যতম মূলনীতি। সুতরাং বণ্টন হলো দুই স্তর বিশিষ্ট: (১) চুক্তিভিত্তিক প্রাপ্য অনুসারে বণ্টন (২) মানবিক সহায়তার জন্য বিশেষ অনুদান সংগ্রহ ও বণ্টন।

সম্ভাব্য ব্যয় (রাজস্ব ব্যয়, উন্নয়ন ব্যয়, নিরাপত্তা ব্যয়, দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পে ব্যয়, বিভিন্ন ভাতায় ব্যয় ইত্যাদি) এবং তা নির্বাহ করার জন্য নাগরিকদের আয় বিবেচনা করে কিভাবে করসীমা বা বিভিন্ন আয়স্তরে করের হার নির্ধারণ করা হবে উলিল আমরকে সে বিষয়ে পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে এবং গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে ন্যায্য কর প্রদান করা উলিল আমরের আনুগত্যের একটি বাস্তব রূপ। সুতরাং ব্যক্তিগতভাবে যাকাত খাতে ব্যয়ের পাশাপাশি সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনায় সুষম উন্নয়ন অর্থনীতির জন্য পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং উলিল আমরের আনুগত্যের ধারাসমূহের বাস্তবায়নের মাধ্যমে মু’মিনগণ ও তাদের উলিল আমর যাকাতের ক্ষেত্রে সদা সক্রিয় থাকবে।

যাকাতের নিসাব বিষয়ক বিভ্রান্তি

যাকাতের নিসাবের অর্থ ও ভিত্তি

কারো কাছে কত সময় পর্যন্ত কোন ধরনের সম্পদ কত পরিমাণ জমা থাকলে কত ভাগ যাকাত প্রদান করতে হবে তার হিসাবকে যাকাতের নিসাব বলা হয়। যাকাতের নিসাব সম্পর্কিত ধারণাটি হাদীসগ্রন্থ ও ফিক্বাহগ্রন্থের উপর নির্ভরশীল।

হাদীসগ্রন্থ ও ফিক্বাহগ্রন্থ অনুযায়ী যাকাতের নিসাব সম্পর্কিত মূলকথা হলো: কারো কাছে চান্দ্রবর্ষের এক বছর পর্যন্ত অন্তত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা অন্তত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা তার সমমূল্যের সঞ্চিত সম্পদ থাকলে তাকে তা থেকে ২.৫% (শতকরা আড়াই টাকা) যাকাত প্রদান করতে হবে। স্বর্ণ ও রূপার ক্ষেত্রে নিসাব আলাদা এবং তাই কারো কাছে স্বর্ণও থাকলে এবং রূপাও থাকলে যদি স্বর্ণের নিসাব মিলে তবে স্বর্ণের যাকাত দিতে হবে, যদি রূপার নিসাব মিলে তবে রূপার যাকাত দিতে হবে, যদি উভয়টির নিসাব মিলে তবে উভয়টির যাকাত দিতে হবে। কিন্তু স্বর্ণ ও রূপার সম্মিলন ঘটিয়ে কোনো নিসাব হবে না। যেমন কারো কাছে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের কাছাকাছি আছে এবং সেই সাথে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপারও কাছাকাছি আছে তাহলেও সে যাকাত প্রদান করা লাগবে না। আবার গবাদি পশুর ক্ষেত্রে নিসাব পরিমাণ পশুসংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন হিসাব রয়েছে এবং তা উট, গরু-মহিষ এবং ছাগল-ভেড়া এ তিনভাগে বিভক্ত। অর্থাৎ পূর্ণ এক বছর কী পরিমাণ উট থাকলে কয়টি উট, কী পরিমাণ গরু-মহিষ থাকলে কয়টি গরু-মহিষ এবং কী পরিমাণ ছাগল-ভেড়া থাকলে কয়টি ছাগল-ভেড়া যাকাত প্রদান করতে হবে সেক্ষেত্রে অনেক জটিল হিসেব নিকেশ রয়েছে। তাই জটিলতা এড়ানোর জন্য এখানে তা উল্লেখ করা হলো না। আবার ফল-ফসলের (দুটি খাদ্যশস্য গম ও যব এবং দুটি ফলমূল খেজুর ও আঙ্গুর) ক্ষেত্রে যাকাতের দুই ধরনের হার আছে। যদি বৃষ্টির পানিতে উৎপাদন হয় তাহলে উশর বা ১০% এবং যদি কৃত্রিম সেচ প্রয়োজন হয় তাহলে নিসফে উশর বা ৫% যাকাত দিতে হবে। এছাড়া রয়েছে যাকাতুল ফিতর / সদাক্বাতুল ফিতর (ফিতরা) এর বিধান। ফিতরা হলো ঈদুল ফিতরের দিন সক্ষম ব্যক্তি নিজ পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুপাতে আড়াই কেজি করে গম, যব, খেজুর ও আঙ্গুর (বা কিসমিস) এ চারটি খাদ্যশস্য ও ফলমূল থেকে সদাক্বাত হিসেবে প্রদান করতে হবে।

হাদীসগ্রন্থ ও ফিক্বাহগ্রন্থ অনুযায়ী নিসাবের সময়সীমার ব্যাখ্যা হলো: কারো কাছে যেদিন নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ বা রূপা বা সঞ্চিত সম্পদ হবে সেদিন থেকে পূর্ণ এক বছর ঐ নিসাব পরিমাণ সম্পদ তার কাছে সঞ্চিত থাকতে হবে। যদি এক বছর পূর্ণ হওয়ার মাঝে তাতে ঘাটতি হয়, তারপর আবার পূর্ণ হয় তাহলে আবার যেদিন পূর্ণ হলো সেদিন থেকে হিসাব গণনা শুরু হবে এবং পূর্বের হিসাব বাদ যাবে।

যে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক যাকাত প্রদানের দায়িত্বও তারই। তাই যদি স্বামী নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে যাকাত প্রদান করা স্বামীর দায়িত্ব এবং যদি স্ত্রী নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে যাকাত প্রদান করা স্ত্রীর দায়িত্ব। স্বামী ও স্ত্রীর সম্পদকে একত্র করে নিসাব পরিমাণ কিনা তা হিসাব করতে হবে না।

যাকাত আদায় বিষয়ে বেশ কিছু মতভেদ রয়েছে। প্রধান মতভেদের ক্ষেত্রসমূহ নিম্নরূপ:

১. সঞ্চিত সম্পদের নিসাব বা মূল্য নির্ধারণে স্বর্ণের হিসাবকে ভিত্তি ধরা হবে নাকি রূপার হিসাবকে ভিত্তি ধরা হবে তা নিয়ে মতভেদ আছে।

২. কোনো অলংকারের মধ্যে স্বর্ণ বা রূপা থাকলে সেটার যাকাত দিতে হবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে যদি সেটার যাকাত দিতে হয় তাহলে যে অলংকারের মধ্যে স্বর্ণ আছে সেটা স্বর্ণের নিসাবের মধ্যে যোগ হবে, অনুরূপভাবে যে অলংকারের মধ্যে রূপা আছে সেটা রূপার নিসাবের মধ্যে যোগ হবে।

৩. ব্যবসায়িক পণ্যের উপর যাকাত দিতে হবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে যাকাত দিলে স্বর্ণ বা রূপার নিসাবের ভিত্তিতে হিসাব করতে হবে, এ দুটির কোনটির নিসাবের সাথে মিল করে হিসাব করা হবে তা নিয়েও মতভেদ আছে। আবার সঞ্চিত সম্পদ ও ব্যবসায়িক পণ্যের ক্ষেত্রে কী কী বিবেচনা করতে হবে তা নিয়েও বিভিন্ন মতভেদ আছে।

৪. পশুর ক্ষেত্রে যে পশুর যাকাত সেই পশু দিয়ে দিতে হবে কিনা যেমন গরুর যাকাত গরু দিয়ে, ছাগলের যাকাত ছাগল দিয়েই দিতে হবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে।

৫. নিসাব নির্ধারণের ক্ষেত্রে উট এবং গরু-মহিষ এবং ভেড়া-ছাগল এ তিন শ্রেণির কোনোটির সাথে অন্যটিকে মিলানো যাবে না। অনুরূপভাবে ফল-ফসলের ক্ষেত্রে একটির সাথে অন্যটিকে মিলিয়ে নিসাব নির্ধারণ করা যাবে কিনা, যেমন গমের সাথে যবকে মিলিয়ে বা খেজুরের সাথে আঙ্গুরকে মিলিয়ে যৌথভাবে নিসাব নির্ধারণ করা যাবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে।

৬. গবাদি পশু এবং খাদ্যশস্য ও ফলমূলের ক্ষেত্রে মূল্য দ্বারা যাকাত পরিশোধ করা যাবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে।

৭. গম, যব, খেজুর ও আঙ্গুর ছাড়া অন্য কোনো খাদ্যশস্য ও ফলমূলের যাকাত প্রদান করতে হবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে।

৮. ফসল উৎপাদনের ব্যয় (চাষ, সার, কীটনাশক, বপন ও কর্তন ইত্যাদি খরচ) উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ থেকে বাদ যাবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে।

৯, যাকাতের নিসাব ১ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে যাকাত আদায় করা বৈধ কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে।

১০. কাউকে ঋণ দেয়ার হলে ঋণদাতার নিসাবের মধ্যে ঐ পরিমাণ হিসাব করা হবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে। এমনকি ঋণ ফেরত পাওয়ার পর তা ঋণ দেয়ার তারিখ থেকে নিসাব সাব্যস্ত হবে নাকি ফেরত পাওয়ার তারিখে নিসাব গণনা শুরু হবে তা নিয়ে মতভেদ আছে।

১১. উত্তরাধিকার বণ্টনের সময় মৃত ব্যক্তির অনাদায়ী যাকাত আদায় করতে হবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে।

১২. ইয়াতিমের সম্পদ থেকে যাকাত দিতে হবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে।

১৩. মাসজিদ, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, কালভার্ট করার জন্য যাকাত প্রদান করা যাবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে।

১৪. অমুসলিমকে যাকাত দেয়া যাবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে।

হাদীসগ্রন্থ ও ফিক্বাহগ্রন্থ অনুযায়ী যেসব জিনিসকে যাকাত বহির্ভুত সম্পদ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয় তা নিম্নরূপ:

খাবার ও পানীয়, কাপড়-চোপড় ও জুতা, যে অলংকারের মধ্যে স্বর্ণ বা রূপা নেই এমন অলঙ্কার (তাতে ডায়মন্ড, প্লাটিনাম, মণি-মুক্তা-ইয়াকুত যাই থাকুক), জমি, শস্যক্ষেত, বাড়ি-ঘর, দালানকোঠা, আবাসিক ভবন (নিজে থাকা হোক বা ভাড়া দেয়া হোক), আসবাবপত্র (যেমন খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, ফ্রিজ, আলমারি ইত্যাদি), তৈজসপত্র ও গার্হস্থ্য সামগ্রী (যেমন, হাড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, গ্লাস ইত্যাদি), অস্ত্রশস্ত্র, বই-পুস্তক, গৃহপালিত পাখি, হাঁস-মুরগি, দোকানঘর (নিজে ব্যবহার করা হোক বা ভাড়া দেয়া হোক), দোকানঘরের ডেকোরেশন, আলমারি, তাক ইত্যাদি, গুদাম, কারখানা, কারখানার যন্ত্রপাতি (কাজের যন্ত্র, যন্ত্রাংশ বা কলকব্জা), হাতিয়ার, অফিসের সরঞ্জামাদি, যানবাহনের গাড়ি, বাস, ট্রাক, নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ, বিমান ইত্যাদি (যদিও তা ভাড়া দেয়া হয়), যানবাহনের বা চাষাবাদের পশু (যেমন উট যদি বাহনের কাজে লাগানো হয় এবং গরু যদি চাষাবাদের কাজে লাগানো হয়), ঘোড়া, গাধা, খরগোশ ও অন্যান্য প্রাণী (অর্থাৎ উট, গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়া ছাড়া অন্যান্য প্রাণী), ঋণ পরিশোধের জন্য জমাকৃত অর্থ, গৃহীত ঋণ তা ব্যবসায় বা শিল্পে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে গৃহীত হলেও, শাক-সব্জি, তরি-তরকারি, আম-কাঁঠাল-লিচু, বনজ বৃক্ষ, ঘাস, নলখাগড়া ইত্যাদি। এছাড়া  উট, গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া যদি বছরের অর্ধেকের বেশি সময় মুক্তভাবে চারণভূমিতে খাদ্য গ্রহণ না করে তাহলে সেই উট, গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়ার যাকাত দেয়া লাগবে না।

যাকাতের নিসাব বিষয়ক পর্যালোচনা

মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর সমকালে যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য সমষ্টিগত সদাক্বাত ব্যবস্থাপনা হিসেবে যেভাবে সদাক্বাতের হার নির্ধারণ করেছিলেন বলে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে বিবরণ পাওয়া যায় তা থেকে যাকাতের নিসাব সম্পর্কিত ধারণা তৈরি হয়েছে এবং সেটাকে যাকাতের স্থায়ী নিসাব হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। অথচ কুরআনে যাকাতের এরূপ কোনো নিসাব নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি বিধায় এটা নিশ্চিত যে, যাকাতের কোনো স্থায়ী নিসাব নেই। এমতাবস্থায়, হাদীসগুলোতে উল্লেখিত নিসাব রসূলের সমকালীন অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে সমষ্টিগত সদাক্বাত ব্যবস্থাপনার একটি বিবরণ মাত্র। বর্তমানে সমকালীন উলিল আমর পরামর্শক্রমে এবং বর্তমান বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিবেচনা সাপেক্ষে ঐ নিসাব কার্যকর করতে পারেন অথবা নতুনভাবে নিসাব নির্ধারণ করতে পারেন। কারণ কোনো অস্থায়ী ব্যবস্থাকে স্থায়ী বিধান হিসেবে গ্রহণ করা যায় না এবং যাবতীয় স্থায়ী বিধান আল কুরআনে উল্লেখিত রয়েছে। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ যদি বর্তমানে জীবিত থাকতেন তাহলে তিনি নিজেই বর্তমান প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। কারণ কুরআনে নির্বাহী বিষয়সমূহে পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি অবলম্বনের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে (সূরা আলে ইমরান ৩:১৫৯, সূরা শূরা ৪২:৩৮)।

পরামর্শভিত্তিক নির্বাহী সিদ্ধান্তে সমষ্টিগত সদাক্বাত ব্যবস্থাপনার কোনো নিসাব নির্ধারণ করলেও তার মাধ্যমে যাকাতের সমগ্র দায়িত্ব পালন সম্পন্ন হয়ে যায় না, বরং সমষ্টিগত প্রদান ও তার বণ্টন সম্পর্কিত ফরজ (৯:৬০, ৯:১০৩) পালিত হয়, যার পরেও যাকাতের জন্য আরো দান-অনুদানের বিষয় রয়েছে (৯২:১৭-২১)।

শুধুমাত্র সমষ্টিগত সদাক্বাত ব্যবস্থাপনার জন্য সমকালীন প্রেক্ষাপটে নির্বাহী ব্যবস্থা হিসেবে যে নিসাব নির্ধারণ করা হয়েছিলো বলে হাদীস বা ইতিহাসমূলক বিবরণ পাওয়া যায়, কুরআনে নির্দেশিত যাকাত বলতে সেই নিসাবকে নির্দিষ্ট করা একটি বিভ্রান্তি ছাড়া কিছু নয়। কারণ যাকাত সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে যাকাতের বিষয়ে যে সামগ্রিক নির্দেশনা, তাৎপর্যগত ব্যাপকতা এবং এজন্য সমষ্টিগত সদাক্বাত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে যুগোপযোগী নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবকাশ পাওয়া যায়, কোনো নিসাবকে স্থায়ী বিধান সাব্যস্ত করা সেটার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যাকাত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর সময় থেকে শুরু হওয়া কোনো বিষয় নয়। বরং কুরআন থেকে জানা যায় যে, পূর্ববর্তী আহলে কিতাবদেরকেও যাকাতের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো (৯৮:৫), বনী ইসরাইলকে যাকাতের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো (২:৮৩, ৫:১২), নবী ইবরাহীম, লূত, ইসহাক, ইয়াকূব প্রমুখ যাকাতের জন্য নির্দেশ দিতেন (২১:৭৩),নবী ইসমাইল কর্তৃক পরিবার পরিজনকে যাকাতের জন্য নির্দেশ (১৯:৫৫),নবী ঈসাকে যাকাতের নির্দেশ (১৯:৩১)। আর তাই বলা হয়েছে যে, ইয়াহুদদের মধ্যে যারা জ্ঞানে সুগভীর এবং মু’মিনদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তারা যাকাত প্রদান করে। (৪:১৬২)।

আল কুরআনে ইনফাক্বের তথা যাকাত, সদাক্বাত ইত্যাদি বাবদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে যেসব নির্দেশনা রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে: সম্পদশালীদের সম্পদে বঞ্চিত ও প্রার্থীদের অধিকারের স্বীকৃতি, স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল উভয় অবস্থায় দান করা, রাতে-দিনে এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে দান করা, দান করার ক্ষেত্রে এতটুকু মধ্যমপন্থা অবলম্বন যেন তাতে কৃপণতার বিপরীত হওয়ার পাশাপাশি নিজেও অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়ার অবস্থায় পতিত হওয়া থেকে মুক্ত থাকার অবকাশ থাকে, নিজের চেয়ে অন্যের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং উদারতাপূর্ণ পরিমাণে, উপার্জন, ফল-ফসল ও সর্বপ্রকার মালসম্পদ থেকে নিজ পছন্দের ও উৎকৃষ্ট মানের সম্পদ ব্যয় করা।

এমতাবস্থায় কতটুকু সম্পদ কত সময় হাতে থাকলে সেটাকে সম্পদ পুঞ্জিভুতকরণ বলে ধরা হবে এবং সম্পদ পুঞ্জিভুতকরণ প্রতিরোধ করার জন্য তা থেকে কোনো নির্দিষ্ট হারে সমষ্টিগত সদাক্বাত ব্যবস্থাপনায় কোনো নির্দিষ্ট হারে সদাক্বাত ধার্য করা হবে সেটা একটি নির্বাহী সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে সঞ্চিত সম্পদ থেকে এভাবে সদাক্বাত গ্রহণ করার বিষয়টি একটি দ্বিতীয় স্তরের আদায়যোগ্য সদাক্বাত হতে পারে, প্রথম স্তরের আদায়যোগ্য সদাক্বাত তো আয়ের দিনই আদায় করা কর্তব্য। কারণ সূরা আনআমের ৬:১৪১ আয়াতে ফল-ফসল আহরণের দিন তথা আয়ের দিন সেটার হক্ব আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিম্নে আয়াতটির অনুবাদ উল্লেখ করা হলো:

৬:১৪১ :: আর তিনিই সেই সত্তা যিনি উৎপাদন করেছেন এমন গাছের বাগানসমূহ যা মাচার উপর চড়ানো (অর্থাৎ লতাজাতীয়) এবং যা মাচার উপর চড়ানো নয় (অর্থাৎ কান্ডজাতীয়) এবং খেজুর গাছ এবং ক্ষেতের ফসল, যা থেকে বিভিন্ন প্রকার খাদ্য যোগাড় হয়, এবং যায়তূন / জলপাই ও আনার / ডালিম; যা একে অন্যের সদৃশও হয়, আবার একে অন্যের বিসদৃশও হয়। তোমরা সেগুলোর ফল খাও যখন তা ফল দেয়। আর ফল-ফসল আহরণের দিন সেটার হক্ব (অর্থাৎ সেটার উপর আল্লাহর ঘোষিত হক্ব) প্রদান করো। আর তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে ভালোবাসেন না।

সুতরাং সুতরাং ফল-ফসল আহরণের দিন সেটার হক্ব আদায়ের অংশ হিসেবে সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনায় আদায়কৃত সদাক্বাতও আদায় করা যেতে পারে। আবার আহরিত ফল-ফসল থেকে বাগানে উপস্থিত হওয়া মিসক্বীনদেরকেও দান করা কর্তব্য, যেমন আমরা সূরা ক্বলমে ৬৮:১৭-৩৩ আয়াতে বর্ণিত বাগান মালিকদের ঘটনা থেকে শিক্ষা পেয়ে থাকি। নিম্নে আয়াতসমূহের অনুবাদ উল্লেখ করা হলো:

৬৮:১৭-৩৩ :: আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি যেমন আমি বাগান মালিকদেরকে পরীক্ষা করেছিলাম।যখন তারা ক্বসম করেছিলো যে, নিশ্চয় তারা সকালে বাগানের ফল আহরণ করবে। আর তারা (তাদের এ কথার মধ্যে) কোনো ব্যতিক্রম রাখেনি। তারপর তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে এক ঘূর্ণি হানা দিলো, যখন তারা ঘুমন্ত ছিলো। সুতরাং তা পূর্বেই কর্তিত ফলের মতো (বিবর্ণ) হয়ে গেলো। তারপর তারা সকালে পরস্পরকে ডেকে নিলো। এ মর্মে যে, যদি তোমরা ফল আহরণকারী হতে চাও, তবে সকাল সকাল ক্ষেতে (বাগানে) চলো। তখন তারা চুপে চুপে কথা বলে চলছিলো। এ মর্মে যে, যেন আজ তোমাদের কাছে তাতে কোনো মিসকীন প্রবেশ করতে না পারে। আর তারা সকাল সকাল চলেছিলো যেন তারা এরূপ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে সক্ষম হয়।

তারপর যখন তারা তা দেখলো, তখন বললো, “নিশ্চয় আমরা পথভ্রষ্ট (ভুল পথে চলে এসেছি)”। (বিষয়টি বুঝতে পারার পরে বললো,) “বরং আমরা বঞ্চিত”।  তাদের মধ্যকার মধ্যমপন্থী ব্যক্তিটি বললো, “আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, যদিও তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা জ্ঞাপন না করো (তবুও কি তোমাদের প্রয়াস ফলপ্রসূ হবে)”? তখন তারা বললো, “পবিত্র আমাদের প্রভু। নিশ্চয় আমরা যালিম ছিলাম”। তারপর তারা পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করতে মুখোমুখি হলো। তারা বললো, “হায়! দুর্ভোগ আমাদের, নিশ্চয় আমরা সীমালংঘনকারী ছিলাম। আশা করা যায়, আমাদের প্রভু আমাদেরকে এর বদলে এর চেয়ে উত্তম দিবেন। নিশ্চয় আমরা আমাদের প্রভুর দিকে আশাবাদের সাথে অভিমুখী হলাম”। শাস্তি এরূপই। আর আখিরাতের শাস্তি আরো বড়, যদি তারা জানতো!

সুতরাং উপরিউক্ত আয়াতসমূহের ভিত্তিতে জানা যায় যে, সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনায় সদাক্বাত প্রদান বা আদায় ও বণ্টন যেমন ফরজ (৯:৬০), তেমনি তার পরেও সাধ্যমতো মিসকীনদেরকে দেয়ার দায়িত্ব বহাল থাকে, যা ব্যক্তিগত অবস্থা ও বিবেচনা অনুসারে প্রদান করা যেতে পারে।

যাকাতের নিসাব বিষয়ক পর্যালোচনায় লক্ষণীয় যে, (১) কোনো ব্যক্তির কাছে এক বছর পর্যন্ত সঞ্চিত সম্পদ থাকলে তার উপর যাকাত ধার্য করা হয়, (২) এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে যাকাত আদায় বৈধ কিনা তা নিয়েও মতভেদ করা হয়, (৩) বছরের মধ্যবর্তীতে নিসাব থেকে হ্রাস পেলে হিসাব বাদ যায় আবার কখনো নিসাব পূর্ণ হলে তখন থেকে বর্ষ গণনা শুরু করতে হয় এবং (৪) স্বামী ও স্ত্রীর সম্পদ যৌথভাবে নিসাব পরিমাণ কিনা তা হিসাব করার অবকাশ নেই। এমতাবস্থায় ইচ্ছা করলেই বছর পূর্তির আগে নিজ নিসাবকে হ্রাস করে, যেমন স্ত্রীকে কিছু অংশ দিয়ে দেয়া, ব্যবসায়ের পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করা ইত্যাদি মাধ্যমে যাকাত প্রদানের দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে যাওয়া যায়। এ থেকে বুঝা যায় যে, উপলব্ধিগত বিভ্রান্তি থেকেই নিসাবের এ ধারণাটা জন্ম নিয়েছে।

এক বছরে একবার কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় সদাক্বাত সংগ্রহ করা এবং বছর পূর্তির আগে একই বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার সদাক্বাত সংগ্রহ না করার নির্বাহী রীতি থেকে এ ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ব্যক্তির হাতে নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর ধরে সঞ্চিত অবস্থায় থাকতে হবে। অথচ বিষয়টি সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনায় সদাক্বাত সংগ্রহের সাথে সম্পর্কিত বিষয় হওয়া স্বাভাবিক, বছরে যতবারই ফলন হোক না কেন প্রধান শস্যের উপর ভিত্তি করে একবারের ফলন থেকে সদাক্বাত সংগ্রহ করা হয় এবং অন্যান্যবারের ফলন থেকে ব্যক্তি নিজে ব্যক্তিগতভাবে সদাক্বাত প্রদানের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়, তা তার থেকে সংগ্রহ করা হয় না।

সমষ্টিগত সদাক্বাত তহবিলে সদাক্বাত সংগ্রহ করা এবং ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন সময় ফক্বির মিসকীনকে সদাক্বাত প্রদান করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রচলিত নিসাবের ধারণাতে এ পার্থক্যকে বিবেচনা করা হয়নি। অন্য কথায় তৎকালীন পরিস্থিতি সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল নির্বাহী সিদ্ধান্তে সমষ্টিগতভাবে যে নিয়মাবলি অনুসরণ করে সদাক্বাত সংগ্রহ করা হতো একদিকে অনেক ক্ষেত্রে সে নিয়মগুলো বুঝার ক্ষেত্রে ভুল করা হয়েছে আবার অন্যদিকে সেটাকে ভুলক্রমে সব স্থানের ও কালের জন্য স্থায়ী নিসাব হিসেবে ধারণা করা হয়েছে। যেমন গম ও যবের থেকে যাকাত দিতে হবে, ধানের থেকে যাকাত দিলে হবে না এরূপ সিদ্ধান্ত সংকীর্ণ উপলব্ধিরই ফল।

সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে, যাকাতের নিসাব বিষয়ক ধারণা মৌলিকভাবেই একটি বিভ্রান্তি। আল কুরআনে যাকাতের নিসাব বলতে কিছু নেই।

শেষকথা

পরিশেষে বলা যায় যে, আল কুরআনের আলোকে যাকাত বলতে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দায়িত্বকে বুঝায় না, বরং চিন্তা-চেতনা, ধারণা-বিশ্বাস, মানসিকতা ও কর্মকাণ্ডে বা জীবনের সকল ক্ষেত্রে পরিশুদ্ধতা অর্জনকে বুঝায়। ‘আতুয যাকাত’ তথা ‘যাকাত প্রদান করো’ বা ‘যাকাত সরবরাহ করো’ এর একটি তাৎপর্য হলো আত্মশুদ্ধি, সামাজিক পরিশুদ্ধতা এবং নৈতিকতাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক প্রদেয় প্রদান করা, পরার্থপরতা ও নৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নিজ নিজ সামর্থ্য ও দক্ষতা অনুসারে অর্থ, সময়, শ্রম ও মেধাগত যোগ্যতা শেয়ার করা।

দুঃখজনক বাস্তবতা হলো বর্তমানে যাকাতকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক যাকাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে এবং সেক্ষেত্রেও ধারণা করা হয় যে, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ সঞ্চিত থাকলে তাতে নির্দিষ্ট হারে যাকাত দিতে হবে এবং তাহলেই কুরআনে বর্ণিত যাকাত প্রদানের দায়িত্ব পালন হয়ে যাবে। আরো বলা হয় যে, যেহেতু কত সময় সঞ্চিত থাকলে কত পরিমাণে সঞ্চিত থাকলে কোন ধরনের সম্পদে কত ভাগ যাকাত প্রদান করতে হবে তা কুরআনে নেই বিধায় হাদীসগ্রন্থ থেকে এ বিধান গ্রহণ করতে হবে এবং সেটাকেই ‘যাকাত প্রদান করা’র ব্যাখ্যা বলে প্রতিপন্ন করতে হবে। অথচ আল কুরআন অনুসারে আল কুরআনে প্রয়োজনীয় সকল বিধি-বিধান বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং কোনো বিষয়ে আল কুরআনে কোনো ধারা উপধারা নির্দিষ্ট করে না দেয়ার অর্থ হলো সে বিষয়ে নির্দিষ্টতা না থাকাটাই বিধান বা তাতে মানুষকে নির্বাহী স্বাধীনতা দেয়াটাই বিধান। আল্লাহ যদি কোনো বিষয়ে কোনো কিছু সুনির্দিষ্ট করে না দেন, তাহলে রসূল তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে পারেন না তথা আল্লাহর বিধানের পাশাপাশি রসূল নিজেও কোন বিধান দিতে পারেন না এবং দেননি। এমতাবস্থায় হাদীসগ্রন্থে থাকা কোনো ব্যবস্থা যদি সত্যিই রসূলের সময় সেভাবে কার্যকর হয়ে থাকে তবে সেটা হলো সমকালীন প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রসূলের নির্বাহী সিদ্ধান্ত, আর নির্বাহী সিদ্ধান্ত মাত্রই পরিস্থিতি সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল বিষয়। তাই নির্বাহী সিদ্ধান্ত হওয়ার উপযোগী বিষয়ে কুরআনে কোনো স্থায়ী বিধান নির্দিষ্ট করে দেয়ার পরিবর্তে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআনে সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনায় সদাক্বাত আদায় ও বণ্টন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনায় সংগৃহীত সদাক্বাত কারা কারা পাবে তা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, কিন্তু তা কি হারে আদায় করা হবে তা নির্বাহী সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তাই রসূল তৎকালীন পরিস্থিতি সাপেক্ষে তা নির্ধারণ করে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক এবং বর্তমানে বর্তমান পরিস্থিতি সাপেক্ষে পরামর্শক্রমে উলিল আমর সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনায় সদাক্বাত আদায়ের নিয়মাবলি নির্ধারণ করবেন।

উপদেশ বাস্তবায়ন সহজ হওয়ার উপযোগী করেই আল কুরআনে শব্দচয়ন ও বাক্য রচনা করা হয়েছে। তাই যাকাত সম্পর্কে আল কুরআনে যা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করলে এর বাস্তব প্রয়োগ বুঝা মোটেই কঠিন নয়। যেহেতু ‘যাকাত’ শব্দের অর্থের মধ্যে (পরিশুদ্ধতা, উন্নয়ন) এর বাস্তবায়নের উপায়-পদ্ধতির ব্যাপকতা ও প্রশস্ততার ধারণা স্বত:সিদ্ধভাবে নিহিত রয়েছে, তাই স্বতন্ত্রভাবে এর জন্য বিভিন্ন ধারা উপধারা নির্দিষ্ট করে দেয়ার প্রয়োজন ছিলো না। এজন্য ‘আতুয যাকাত’ (যাকাত প্রদান করো / যাকাত সরবরাহ করো) আদেশের মধ্যে এবং “মু’মিনরা যাকাতে সক্রিয় থাকে” বৈশিষ্ট্য বর্ণনার মধ্যে এবং “যে নিজের যাকাত করে সেই সফল” বাক্যের মধ্যে যে নির্দেশ ও উপদেশ নিহিত রয়েছে তা বাস্তবায়নের নির্দেশনার জন্য এ বাক্যগুলো স্বয়ং যথেষ্ট।

নিজের যাকাত করা বা আত্মশুদ্ধির তাৎপর্য হলো মনের সংকীর্ণতা (স্বার্থপরতা, কৃপণতা, লোভ, পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা-বিদ্বেষ প্রভৃতি) থেকে মুক্ত থাকা, অংশীবাদিতা, কপটতা, অবাধ্যতা, অহংকার, মিথ্যাবাদিতা ও অশ্লীলতা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকা। সুতরাং যাকাতের জন্য সক্রিয় থাকার ক্ষেত্রে এসব নৈতিক ত্রুটি থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং সেই সাথে সমাজকে রক্ষা করার জন্য নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা করাকে বুঝায়। যাকাতভিত্তিক অর্থনীতিকে বলা যেতে পারে ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’। যাকাতভিত্তিক অর্থনীতির প্রতিষ্ঠায় মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সদস্য যেমন সাধ্যমতো ভূমিকা পালন করবে, তেমনি তাদের উলিল আমর (Central Authority) এক্ষেত্রে শৃঙ্খলা-বিধান ও নেতৃত্বমূলক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভূমিকা পালন করবেন। সমাজে নৈতিক শিক্ষা-প্রশিক্ষণের ব্যাপক প্রসার ঘটানোর পাশাপাশি সুষম উন্নয়ন অর্থনীতি বাস্তবায়নে আল কুরআনের শিক্ষা অনুসারে সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি-জালিয়াতি, মদ-জুয়া-অশ্লীলতা প্রভৃতি প্রতিরোধ করে কল্যাণ অর্থনীতির বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবেন।

যুগে যুগে আল্লাহ প্রদত্ত জীবনব্যবস্থার মূল দাবি ছিলো, একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করা, সালাত তথা তাঁর বিধানের নিবিড় অনুসরণমূলক কর্মপদ্ধতি প্রতিষ্ঠা এবং যাকাত তথা নিজেদের আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতা ও নীতি-নৈতিকতার সাথে সামঞ্জস্যশীল উন্নয়ন অর্থনীতি-রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের জন্য অবদান রাখা। তাই যথাযথ নৈতিক ভিত্তির উপর মানব সভ্যতার উন্নয়ন সাধনের জন্য এবং যাবতীয় ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার এবং অন্যায় ও অশ্লীলতামুক্ত সমাজ বিনির্মাণের জন্য আল কুরআনের নির্দেশনা অনুসারে যাকাতে সক্রিয় থাকা অত্যাবশ্যক।

পরিশিষ্ট ১

ইনফাক্ব এর নির্ঘণ্ট (Concordance)

ইনফাক্ব (ও এর প্রতিশব্দ নাফাক্বাহ) ক্রিয়ারূপ ৪ (আনফাক্বা) এর সাথে সম্পর্কিত। তাই ইনফাক্ব শব্দটির নির্ঘন্ট (Concordance) হিসেবে ক্রিয়ারূপ ৪ থেকে গঠিত বিভিন্ন শব্দরূপসহ ইনফাক্ব শব্দটি যেসব স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে নিম্নে তার তালিকা দেয়া হলো:

(ক) ইনফাক্ব শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ১৭:১০০:১১।

(খ) নাফাক্বাহ (বহুবচনে নাফাক্বাত) ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ২:২৭০:৪, ৯:৫৪:৬, ৯:১২১:৩।

(গ) মুনফিক্বীন (ইনফাক্বকারী) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩:১৭:৪।

(ঘ) আনফাক্বা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪) ব্যবহৃত হয়েছে ৬৮ স্থানে: ২:৩:৮, ২:১৯৫:১, ২:২১৫:৩, ২:২১৫:৬, ২:২১৯:১৭, ২:২৫৪:৪, ২:২৬১:৩, ২:২৬২:২, ২:২৬২:১১, ১:২৬৪:১০, ২:২৬৫:৩, ২:২৬৭:৪, ২:২৬৭:১৮, ২:২৭০:২, ২:২৭২:১০, ২:২৭২:১৫, ২:২৭২:২১, ২:২৭৩:২৪, ২:২৭৪:২, ৩:৯২:৫, ৩:৯২:৯, ৩:১১৭:৩, ৩:১৩৪:২, ৪:৩৪:১২, ৪:৩৮:২, ৪:৩৯:৮, ৫:৬৪:১৪, ৮:৩:৬, ৮:৩৬:৬, ৮:৩৬:১০, ৮:৬০:২৩, ৮:৬৩:৫, ৯:৩৪:২২, ৯:৫৩:২, ৯:৫৪:১৯, ৯:৯১:১৩, ৯:৯২:২৩, ৯:৯৮:৬, ৯:৯৯:১০, ৯:১২১:২, ১৩:২২:৮, ১৪:৩১:৩, ১৬:৭৫:১৬, ১৮:৪২:৮, ২২:৩৫:১৫, ২৫:৬৭:৩, ২৮:৫৪:১২, ৩২:১৬:১১, ৩৪:৩৯:১৩, ৩৫:২৯:৮, ৩৬:৪৭:৪, ৪২:৩৮:১১, ৪৭:৩৮:৪, ৫৭:৭:৪, ৫৭:৭:১২, ৫৭:১০:৪, ৫৭:১০:১৬, ৫৭:১০:২৬, ৬০:১০:২৯, ৬০:১০:৪৪, ৬০:১০:৪৭, ৬০:১১:১৫, ৬৩:৭:৫, ৬৩:১০:১, ৬৪:১৬:৭, ৬৫:৬:১৫, ৬৫:৭:১, ৬৫:৭:১০।

ইনফাক্ব সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত তালিকা নিম্নরূপ: ২:৩, ২:১৯৫, ২:২১৫, ২:২১৯, ২:২৫৪, ২:২৬১, ২:২৬২, ১:২৬৪, ২:২৬৫, ২:২৬৭, ২:২৭০, ২:২৭২, ২:২৭৩, ২:২৭৪, ৩:১৭, ৩:৯২, ৩:১১৭, ৩:১৩৪, ৪:৩৪, ৪:৩৮, ৪:৩৯, ৫:৬৪, ৮:৩, ৮:৩৬, ৮:৬০, ৮:৬৩, ৯:৩৪, ৯:৫৩, ৯:৫৪, ৯:৯১, ৯:৯২, ৯:৯৮, ৯:৯৯, ৯:১২১, ১৩:২২, ১৪:৩১, ১৬:৭৫, ১৭:১০০, ১৮:৪২, ২২:৩৫, ২৫:৬৭, ২৮:৫৪, ৩২:১৬, ৩৪:৩৯, ৩৫:২৯, ৩৬:৪৭, ৪২:৩৮, ৪৭:৩৮, ৫৭:৭, ৫৭:১০, ৬০:১০, ৬০:১১, ৬৩:৭, ৬৩:১০, ৬৪:১৬, ৬৫:৬, ৬৫:৭।

পরিশিষ্ট ২

সদাক্বাত  এর নির্ঘণ্ট (Concordance)

সদাক্বাত শব্দটির শব্দমূল হচ্ছে সদ দাল ক্বফ যা থেকে গঠিত শব্দগুলোর অর্থ হলো, সত্য বলা, সত্য করা, সত্য সাব্যস্ত করা, সত্য প্রতিপাদন করা, দান-সদাক্বাহ করা। উৎপত্তিগত অর্থ অনুসারে সদাক্বাতের তাৎপর্য হচ্ছে, ‘সত্য ব্যবস্থাকে মেনে নেয়ার প্রমাণস্বরূপ বিশেষ আর্থিক প্রদেয় যা (যে প্রদেয়) কিছু বিশেষ ধারার মাধ্যমে প্রযুক্ত হয় এবং কিছু বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত প্রাপককে প্রদান করতে হয়’। বাংলা আধ্যাত্মিক ও সামাজিক পরিভাষায় সত্যাগ্রহ সদাক্বাতের কাছাকাছি অর্থ ধারণ করে।

সদাক্বাহ (ও এর প্রতিশব্দ সদুক্বাহ) ক্রিয়ারূপ ৫ (তাসাদ্দক্বা) এর সাথে সম্পর্কিত। তাই সদাক্বাহ শব্দটির নির্ঘন্ট (Concordance) হিসেবে ক্রিয়ারূপ ৫ থেকে গঠিত বিভিন্ন শব্দরূপসহ সদাক্বাহ শব্দটি যেসব স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে নিম্নে তার তালিকা দেয়া হলো:

(ক) সদাক্বাহ ও সদাক্বাত (একবচন ও বহুবচনে) ব্যবহৃত হয়েছে ১৩ স্থানে: ২:১৯৬:৩১, ২:২৬৩:৬, ২:২৬৪:৬, ২:২৭১:৩, ২:২৭৬:৫, ৪:১১৪:১০, ৯:৫৮:৫, ৯:৬০:২, ৯:৭৯:৭, ৯:১০৩:৪, ৯:১০৪:১১, ৫৮:১২:১১, ৫৮:১৩:৭।

(খ) সদুক্বাত (সদুক্বাহ এর বহুবচন, নারীদেরকে প্রদেয় মোহরানা বুঝাতে) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৪:৪:৩।

(গ) মুতাসদ্দিক্বীন, মুতাসদ্দিক্বাত (কর্তা, পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ, ক্রিয়ারূপ- ৫) ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ১২:৮৮:২১, ৩৩:৩৫:১৪, ৩৩:৩৫:১৫।

(ঘ) মুসসদ্দিক্বীন, মুসসদ্দিক্বাত (কর্তা, পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ, ক্রিয়ারূপ-৫) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৫৭:১৮:২, ৫৭:১৮:৩।

(ঙ) তাসাদ্দাক্বা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ-৫) ব্যবহৃত হয়েছে ৬ স্থানে: ২:২৮০:৯, ৪:৯২:২২, ৫:৪৫:১৮, ৯:৭৫:৯, ১২:৮৮:১৬, ৬৩:১০:১৮।

সদাক্বাহ সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত তালিকা নিম্নরূপ: ২:১৯৬, ২:২৬৩, ২:২৬৪, ২:২৭১, ২:২৭৬, ২:২৮০, ৪:৪, ৪:৯২, ৪:১১৪, ৫:৪৫, ৯:৫৮, ৯:৬০, ৯:৭৫, ৯:৭৯, ৯:১০৩, ৯:১০৪, ১২:৮৮, ৩৩:৩৫, ৫৭:১৮, ৫৮:১২, ৫৮:১৩, ৬৩:১০।

পরিশিষ্ট ৩

যাকাতের অর্থনৈতিক দিকের আলোচনা প্রসঙ্গে আনফাল, মাগানিম ও ফায় সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন। কারণ আনফালমাগানিম ও ফায়ের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বণ্টন পদ্ধতি প্রদান করা হয়েছে। তাই নিম্নে এ তিনটি শব্দ ও ধারণা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

আনফাল

আনফাল সম্পর্কে আল কুরআনে একটিমাত্র আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নে আয়াতটির অনুবাদ দেয়া হলো:

৮:১ :: তারা তোমাকে আনফাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, “আনফাল হলো আল্লাহর জন্য এবং রসূলের জন্য। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের মধ্যকার অবস্থাকে সংশোধন করো এবং আল্লাহর ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মু’মিন (বিশ্বাসী) হও”।

আনফাল শব্দটি হচ্ছে ‘নাফাল (নফল) শব্দের বহুবচন। নাফাল বা আনফাল হচ্ছে ‘মূলের পর অতিরিক্ত’। নাফাল এর একটি প্রতিশব্দ হচ্ছে নাফিলাহ’। নাফিলাহ শব্দটির ব্যবহার থেকে এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করা যেতে পারে। ১৭:৭৯ আয়াতে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর জন্য ১৭:৭৮ আয়াতে বর্ণিত মূল দায়িত্ব (যা অন্যদের জন্যও প্রযোজ্য) এর অতিরিক্ত একটি দায়িত্ব হিসেবে তাহাজ্জুদ এর আদেশ দেয়া হয়েছে। আর ২১:৭২ আয়াতে নবী ইবরাহীমের পুত্র ইসহাক-এর পুত্র ইয়াকুবকে নবী ইবরাহীমের জন্য ‘মূল পুত্রের অতিরিক্ত পুত্র তথা প্রপুত্র’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য কথায়, প্রপুত্র হচ্ছে পুত্রতুল্য, কিন্তু মূল পুত্র নয়, বরং মূলের পর অতিরিক্ত (তথা দ্বিতীয় স্তরের)। আয়াতটিতে সন্তানকে ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া (দান)’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তেমনি আনফাল শব্দটি হচ্ছে ‘মূলের পর অতিরিক্ত’। কিন্তু এক্ষেত্রে, ‘মূল’ কি আর ‘মূলের পর অতিরিক্ত’ কি? এটিই নির্ণেয় প্রশ্ন।

আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা আছে সবকিছুর মালিকানা আল্লাহর (২:২৫৫, ২:২৮৪, ৩:১০৯,৩:১৮০, ১০:৫৫, ১০:৬৬, ৫৩:৩১ প্রভৃতি), মানুষকে তাতে আমানতমূলক (২:২৮৩, ৩৩:৭২) মালিকানা দেয়া হয়েছে - (৩৬:৭১-৭৩, ৫৭:৭ প্রভৃতি), যেহেতু পৃথিবীর সবকিছু মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে (২:২৯), তথা মানুষ বিধি-সঙ্গতভাবে (আমানতদারিতা রক্ষা করে) এসব সম্পদ ভোগ-ব্যবহার করবে। এই মালিকানা সৃষ্টি হয় আল্লাহর বিধানের মাধ্যমে (৭:৩২, ৪:১১, ৪:২৯, ৪:৩৩ প্রভৃতি) এবং রসূলের নির্বাহী অনুমোদন ও বণ্টনের মাধ্যমে (৫৯:৭), কারণ আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত রসূলকে এজন্যই প্রেরণ করা হয়, যেন মানুষ তাঁর আনুগত্য করে (৪:৬৪)।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর পক্ষ থেকে নবী প্রথার সমাপ্তিতে (৩৩:৪০) মানুষের সামষ্টিক বিষয়াদিতে তাঁর বিধানের নির্বাহী দায়িত্ব পালনের জন্য মু’মিনদের পরামর্শক্রমে (৪২:৩৮) তাদের দ্বারা (পরিচালনা দায়িত্বের) আমানত অর্পণের মাধ্যমে (৪:৫৮) তাদের মধ্যকার উলিল আমর প্রথা (৪:৫৯) প্রবর্তন করেছেন। [অবশ্য যারা স্বেচ্ছায় এ ব্যবস্থার অধীনে আসবে না তারা ফাসাদ বা সামাজিক নৈরাজ্যসৃষ্টি না করার শর্তে তাদের দ্বীন / ব্যবস্থা স্বতন্ত্রভাবে পরিপালনের ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে, ২:২৫৬, ৫:৩৩, ১০৯:৬। ব্রিটিশ ভারতে হিন্দুদের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকলেও সতীদাহ প্রথার অনুমোদন ছিল না, এটিকে সামাজিক অপরাধ ছাড়া অন্যক্ষেত্রে ধর্মীয় স্বাধীনতার একটি উদাহরণ বলা যেতে পারে।]।

এমতাবস্থায়, আল্লাহর বিধান অনুসারে রসূল বা উলিল আমর মালিকানা চর্চার জন্য যে অনুমোদন প্রক্রিয়ায় সম্পদের বণ্টন করেন / ব্যক্তিমালিকানার স্বীকৃতি দেন, তাতে (শর্তসাপেক্ষে) ব্যক্তিগত ভোগ-বণ্টনের জন্য যে সম্পদকে বণ্টন করা হয়, সেটাই হলো ‘মূল’। আর ঐ সম্পদ বণ্টনের বাহিরে যে সম্পদ সর্বসাধারণের সাধারণ সম্পদ হিসেবে থেকে যায়, সেটাই হলো আনফাল

আনফালের ধারণা অনুধাবনের জন্য একটি উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। ভূমির প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ইন্নাল আরদা লিল্লাহ  অর্থাৎ “(অন্য সবকিছুর মতোই) ভূমির মালিকানা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই” (৭:১২৮) এবং তিনি পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন সৃষ্টজীবের জন্য (৫৫:৫৬)। এখন এখানে মানুষের ব্যক্তিগত অবস্থান / প্রাইভেসির প্রয়োজনে ও চাষাবাদের জন্য, শিল্প-কারখানা ইত্যাদি স্থাপনের জন্য তাতে (আমানতদারি) ব্যক্তিমালিকানার অনুমোদন দেয়া হয় (২৪:২৭-২৯, ২:২৬৭, ৬:১৪১ প্রভৃতি)। একটা অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ও পরবর্তীতে উত্তরাধিকার ও হস্তান্তর (বিক্রয়, ওসিয়ত, হেবা) প্রক্রিয়ায় এ আমানতদারি মালিকানার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এখন এই বণ্টনের বাহিরে যে সম্পদ সর্বসাধারণের জন্য রয়ে যাবে, যেমন ভূমির মধ্যে যেটাকে আমরা বর্তমানে ‘খাস জমি’ বলে থাকি, এটা হলো আনফাল

আনফালের আরো উদাহরণ হিসেবে সমুদ্র সম্পদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেহেতু সমুদ্রের জীব তথা জলাশয়, নদী ও খালবিলের শিকার হালাল করা হয়েছে (৫: ৯৬, ৩৫: ১২)। তাই পুকুর / ক্ষুদ্র জলাশয় যা ব্যক্তিমালিকানায় দেয়া হয় তা ছাড়া সাধারণভাবে সাগর, নদী এগুলো হলো ‘আনফাল যাতে শিকারের অনুমোদন থাকবে, কিন্তু ব্যক্তিগত সীমানা নির্ধারণ করা হবে না। অর্থাৎ আনফাল থেকে যে ধরনের শর্ত সাপেক্ষে সাধারণ শ্রম বিনিয়োগের ও তার ফল ভোগের অনুমতি দেয়া হয়, যেমন নদীতে মাছ ধরা ও তা বিক্রি করা, সেভাবে তা করা যাবে, কিন্তু সেখানে কোন নিজস্ব সীমানা তৈরি করে নেয়া যাবে না। সুতরাং রাষ্ট্রীয় সমুদ্রসীমা থেকে যা পাওয়া যাবে, তার একটা অংশ বিশ্বরাষ্ট্র ফান্ডে জমা দিতে হবে। আনফাল থেকে কোনো ব্যক্তিকে উপার্জন বা আহরণ করার অনুমোদন দিলে তাতে সে যা লাভ করে তা হলো মাগানিম। তাই যে ব্যক্তি নদী বা সমুদ্রে মাছ ধরবে সে তা থেকে ২০% প্রদান করতে হবে, যে ব্যক্তি বন থেকে গাছ কাটবে বা মধু সংগ্রহ করবে সে তা থেকে ২০% দিতে হবে। এ বিষয়টি পরবর্তী অনুচ্ছেদে আরো বিস্তারিতভাবে আলোচিত হবে।

সাধারণ নিয়মানুসারে কোনো ভূমি বণ্টন করা হলো, কিন্তু তাতে কোনো ‘খনি’ পাওয়া গেলো। তাহলে এই খনি সাধারণভাবে প্রাথমিক বণ্টনে ব্যক্তিগত আওতায় ভূমি-সম্পদের মালিকানা ভোগের অনুমোদনরূপে যে ভূমি বণ্টিত হয়েছে, তার চেয়ে ‘বিশেষ বাড়তি কিছু’, তথা আনফাল হিসেবে সাব্যস্ত হবে। কোনো সামষ্টিক সম্পদ থেকে (যা যৌথ অংশীদারিত্বের সম্পদ নয়, বরং খাসজমির মতো সাধারণ সামষ্টিক সম্পদ) যদি কোনো বাড়তি আয় হয়, তাও হবে আনফাল

প্রচলিত ধারণায় আনফাল এবং গনিমতকে সমার্থক শব্দ মনে করা হয়। কিন্তু আল কুরআনে আনফাল এবং গনিমতের সম্পদের বণ্টন বিধি ভিন্ন। সুতরাং আনফাল এবং গনিমত সমার্থক মনে করা সঠিক নয়। বরং গনিমত এবং ফায় উভয়টিতে আনফাল থাকতে পারে বা তা থেকে আনফাল পাওয়া যেতে পারে। যেমন, গনিমত বা ফায় বন্টন করা হলো, তারপর তার মধ্যকার একটি ভূমিখণ্ডে ‘খনি’ পাওয়া গেল, তাহলে ঐ ‘খনি’ হলো আনফাল। কিন্তু গনিমত মাত্রেই আনফাল, তা নয়। (গনিমত ও ফায় এর ধারণা এ অধ্যায়েই পরবর্তী পরিচ্ছেদে আলোচনা করা হয়েছে)।

আনফাল প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “আনফাল হচ্ছে আল্লাহর জন্য এবং রসূলের জন্য”। এখানে, রসূলের জন্য মানে যদি হয় রসূলের জন্য কোনো ব্যক্তিগত অংশ যা তিনি ব্যবহার করবেন, তাহলে, আল্লাহর জন্যও ব্যক্তিগত অংশের প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায়। আল্লাহর ব্যক্তিগত অংশ আল্লাহকে কিভাবে দেয়া যাবে? আল্লাহ সেটা নিয়ে কি করবেন? যদি বলা হয়, দরিদ্রদেরকে দিলেই আল্লাহকে দেয়া হবে, সেটাও ভুল হবে। কারণ ৮:৪১ আয়াতেও মাগানিমের বণ্টন সম্পর্কে “আল্লাহর জন্য ও রসূলের জন্য” ধারাটি বলা হয়েছে, তারপর সেক্ষেত্রে ওয়াল মাছাকিনি বা ‘মিসকীনদের জন্য’ ধারাটি আলাদাভাবে বলা হয়েছে। সুতরাং ‘আল্লাহকে দেয়ার ব্যাখ্যা হলো দরিদ্রদেরকে দেয়া’, এ বাখ্যাটি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ‘আল্লাহর জন্য দেয়ার’ ব্যাখ্যা বুঝার জন্য অন্যান্য আয়াতের মাধ্যমে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন।

বিভিন্ন আয়াতের ভিত্তিতে চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে বুঝা যায় যে, ‘আল্লাহর জন্য ও রসূলের জন্য’ ধারাটিতে একটি একক খাতকে নির্দেশ করা হয়েছে। আমরা যদি নিম্নোক্ত কয়েকটি বক্তব্য-স্থানের কথা চিন্তা-ভাবনা করে দেখি যে, ৫:৩৩ আয়াতে ‘আল্লাহর বিরুদ্ধে ও রাসূলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার’ মানে কি? ২:২৭৯ আয়াতে ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং রসুলের পক্ষ থেকে সংগ্রামের ঘোষণার’ মানে কি? ৯:১ ও ৯:৩ আয়াতে ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে ও রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্কচ্ছেদ এবং ঘোষণার’ মানে কি? ৯:৫৯ আয়াতে ‘আল্লাহ যা দেন ও রসূল যা দেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ ও রসূলের পক্ষ থেকে অনুগ্রহের’ মানে কি?, তাহলে বিষয়টি বুঝতে আমাদের জন্য সহজ হবে।

আল্লাহ হলেন মানবজাতির জন্য একমাত্র নির্ভুল সংবিধানের প্রণেতা এবং রসূল হলেন মানব সমাজে ঐ সংবিধানের বাস্তবায়নকারী কর্তৃত্ব। সুতরাং ‘আল্লাহর জন্য ও রাসূলের জন্য’ ধারাটির অর্থ হলো: দ্বীনে হক্ব ভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্য। অর্থাৎ এ খাতের অর্থসম্পদ মুসলিম উম্মাহর জাতীয় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে রিজার্ভ ফান্ড হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে,যা আল্লাহ প্রদত্ত সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত ও রাসূলের গৃহীত নির্বাহী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য যখনই কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে ব্যয় করা হবে। উল্লেখ্য, রসূলের অনুপস্থিতিতে বা অবর্তমানে রসূলের পক্ষ থেকে নির্বাহী দায়িত্ব পালনের জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন উলিল আমর

পরিশেষে বলা যায়, উপার্জন, বিনিময়, উত্তরাধিকার বা উপহারের মাধ্যমে যে সম্পদ বণ্টিত হয় তার বাহিরে অবণ্টিত জনসম্পদই আনফাল। অনুরূপভাবে মাগানিম বা যুদ্ধলভ্য সম্পদ থেকে যা জনসম্পদ (Public wealth or Commonwealth) হিসেবে সাব্যস্ত করা হয় সেটাও আনফাল। আনফালের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আনফালই আল্লাহর জন্য ও রসূলের জন্য তথা ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থাপনার জন্য সংরক্ষিত। জনসম্পদকে ব্যাপকভাবে বেসরকারিকরণ করা যাবে না এবং তা থেকে বাস্তব প্রয়োজনে বেসরকারিকরণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বা উলিল আমরের পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য। বন, সমুদ্র, খনি প্রভৃতি আনফালের অন্তর্ভুক্ত, যা থেকে কিছু উৎপাদন বা আহরণের অনুমতি প্রদান করলে উৎপাদিত বা আহরিত সম্পদ মাগানিম হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

মাগানিম (গনিমত)

মাগানিম (مَغَانِمُ) শব্দটি হচ্ছে মাগনাম শব্দের বহুবচন। মাগনাম এবং গনিমত শব্দ দুটি সমার্থক শব্দ। আল কুরআনে গনিমত শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি, আল কুরআনে ব্যবহৃত শব্দটি হচ্ছে মাগানিম (৪:৯৪, ৪৮:১৫, ৪৮:১৯, ৪৮:২০)। এ মাগানিমের বিষয়ে ক্রিয়াপদে গানিমতুম’ বা ‘যা তোমরা মাগানিম পেয়েছো’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৮:৪১ ও ৮:৬৯ আয়াতে।

মাগানিম শব্দটির অর্থ হলো ‘কোনো বিশেষ শর্তে (যেমন আবাদ করা, আহরণ করা বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ) যে সাধারণ সম্পদে অধিকার স্বীকৃত হয়, যুদ্ধলব্ধ / যুদ্ধলভ্য শত্রুসম্পদ তথা শত্রুরা যুদ্ধক্ষেত্রে যা ফেলে গেছে বা হারিয়েছে, বিনা কষ্টে অর্জিত সম্পদ, অর্জন বা লাভ’। মাগানিম (গনিমত) এর একটি অর্থ হচ্ছে যুদ্ধলব্ধ / যুদ্ধলভ্য শত্রুসম্পদ (যা যুদ্ধক্ষেত্রে পাওয়া যায় বা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় শত্রুরা রেখে যায়)। আরবি একই শব্দ এরূপ দ্বিমাত্রিক অর্থ প্রকাশ করতে পারে। এ প্রেক্ষিতে, মাগানিম অর্থ হচ্ছে, ঐ শত্রুসম্পদ যা যুদ্ধের মাধ্যমে ইতোমধ্যে লাভ করা হয়েছে অথবা যা যুদ্ধের মাধ্যমে লাভ করা যেতে পারে। অন্য কথায়, মাগানিম শব্দটি দ্বিবিধ অর্থ প্রকাশক: (ক) যুদ্ধলব্ধ সম্পদ (খ) যুদ্ধলভ্য সম্পদ।

মাগানিম (গনিমত) সম্পর্কে ব্যাপক ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে এবং ভুল ধারণার কারণে অনেকের মনে এ বিষয়ে যৌক্তিকভাবে কিছু প্রশ্নও তৈরি হয়। এসব প্রশ্ন ও ভুল ধারণার অপনোদনের জন্য প্রয়োজন সরাসরি কুরআনের আয়াতে বর্ণিত যুদ্ধের কারণ, শর্ত এবং যুদ্ধসংক্রান্ত ন্যায়-নীতি বিষয়ক নির্দেশগুলো সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হওয়া। তবে এ নিবন্ধে আল কুরআনের যুদ্ধনীতি বিষয়ক ধারা নয়, বরং অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত মাগানিমের বণ্টন সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

আমরা প্রথমে ‘মাগানিম’ শব্দ ধারণকারী আয়াত চারটি এবং পরে মাগানিম বণ্টন ও বণ্টিত মাগানিম ভোগ-ব্যবহার সম্পর্কিত আয়াত দুটি সম্পর্কে আলোচনা করবো।

৪:৯৪ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যখন তোমরা আল্লাহর পথে সফর করো, তখন তোমরা (কে শত্রু কে মিত্র তার) সুস্পষ্টতা নির্ণয় করো / যাচাই করে নাও। আর যে তোমাদেরকে সালাম জানায় (যাচাই ছাড়াই) তাকে বলো না যে, “তুমি মু’মিন নও”। তোমরা দুনিয়ার সম্পদ অন্বেষণ কর! তবে আল্লাহর কাছে (তত্ত্বাবধানে) অনেক মাগানিম (যুদ্ধলভ্য সম্পদ) আছে। তোমরাও এর পূর্বে এ রকমই ছিলে (অর্থাৎ তোমারাও তাদের মতই তোমাদের ঈমানকে তোমাদের কওম থেকে গোপন করতে)। তারপর আল্লাহ তোমাদের উপর অনুগ্রহ করলেন। সুতরাং তোমরা (কে শত্রু কে মিত্র তার) সুস্পষ্টতা নির্ণয় করো / যাচাই করে নাও। নিশ্চয় তোমরা যা করো আল্লাহ তা সম্পর্কে সম্যক অবগত।

৪৮:১৫ :: শীঘ্রই পিছনে থেকে যাওয়া লোকেরা বলবে, যখন তোমরা মাগানিম (যুদ্ধলভ্য সম্পদ) সংগ্রহ করার জন্য যেতে থাকবে, “আমাদেরকে যেতে দাও। আমরা তোমাদের অনুসরণ করবো”। তারা আল্লাহর বাণীকে বদলে দিতে চায় (বস্তুত যা অসম্ভব)। বলো, “তোমরা কখনোই আমাদের অনুসরণ করবে না। আল্লাহ আগেই আমাদেরকে তা বলে দিয়েছেন”। তারপর তারা শীঘ্রই বলবে, “বরং তোমরাই আমাদেরকে হিংসা করছো”। বরং তারা খুবই কম বুঝে।

৪৮:১৯ :: আর অনেক মাগানিম (যুদ্ধলভ্য সম্পদ), তারা (মু’মিনরা) তা গ্রহণ করবে। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।

৪৮:২০ :: আর আল্লাহ তোমাদেরকে অনেক মাগানিমের (যুদ্ধলভ্য সম্পদের) ওয়াদা দিয়েছেন, তোমরা তা গ্রহণ করবে। তবে তিনি তোমাদেরকে ত্বরান্বিতভাবে এটি (প্রশান্তি) দিলেন। আর তিনি তোমাদের থেকে লোকদের হাতসমূহকে নিবারিত রেখেছেন। আর যেন তা মু’মিনদের জন্য একটি নিদর্শন হয়। আর তিনি তোমাদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত পথে পথনির্দেশ করেন।

গনিমত প্রসঙ্গে গনিমত বলতে ‘যুদ্ধলভ্য / যুদ্ধলব্দ সম্পদ’ বুঝায় নাকি ‘বিনা কষ্টে প্রাপ্ত সম্পদ’ বুঝায়?- এ প্রশ্নটি তৈরি হয়। কারণ, আরবি ভাষার অভিধানে এ শব্দটির এ দুটি অর্থ পাওয়া যায়। এখন এর সমাধান কি? একটি আরবি শব্দ যেসব অর্থে ব্যবহৃত হয় তার সব বিবেচনা করা যেতে পারে, কিন্তু আল কুরআনে কোন অর্থে ব্যবহৃত তা আল কুরআনের প্রয়োগসমূহ যাচাই করে নির্ণয় করতে হবে। আরবি শব্দগুলো তার যে মৌলিক অর্থে প্রচলিত হয়েছে সে অর্থেই আল কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে কালের বিবর্তনে একটি শব্দ আরো নতুন নতুন অর্থে প্রয়োগ হতে থাকে।

উপরের চারটি আয়াতের পূর্বাপর আয়াতসমূহসহ অধ্যয়ন করলে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মাগানিম হচ্ছে যুদ্ধলভ্য / যুদ্ধলব্ধ সম্পদ। “আল্লাহর কাছে (তত্ত্বাবধানে) অনেক মাগানিম আছে” তথ্যটির মধ্যে অর্থনীতির মৌলিক নীতি বিদ্যমান রয়েছে। সম্পদ তো মূলত আল্লাহরই। মানুষ তো আমানদারিত্বমূলক মালিকানা ভোগ করছে। এখন যারা দ্বীনে হককে ঠেকানোর জন্য যুদ্ধ করে সে কাফিররা যুদ্ধক্ষেত্রে যে সম্পদ হারায় তার উপর তাদের (কাফিরদের) অধিকার আল্লাহর পক্ষ থেকে বাজেয়াপ্ত হয়ে তাতে মু’মিনদেরকে অধিকার প্রদান করা হয়েছে, মু’মিনদেরকে তা হস্তগত করার জন্য সনদ দেয়া হয়েছে। এজন্য বলা হয়েছে, এমন অনেক সম্পদ রয়েছে, যা তোমরা জিহাদের মাধ্যমে অর্জন করতে পারবে, তা আল্লাহর কাছে (তত্ত্বাবধানে) রয়েছে। সুতরাং তোমরা পার্থিব সম্পদের জন্য আকৃষ্ট না হয়ে পরকালকে অগ্রাধিকার দাও, জিহাদ (ন্যায় প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা) থেকে পলায়ন করো না, তাহলে পরকাল তো পাবেই, পৃথিবীতেও তোমাদের উপার্জিত সম্পদের পাশাপাশি অনেক মাগানিম (অন্যায় যুদ্ধে জড়িতদের হারানো সম্পদ) যোগ হয়ে তোমাদের প্রাচুর্য আসবে। অন্য কথায় তুমি যদি দুনিয়ার সম্পদ চাও, তাহলে দুনিয়ার সম্পদ হয়তো পেতে পারো, কিন্তু আখিরাত পাবে না, আর যদি আখিরাত চাও, তবে আখিরাত তো পাবেই, দুনিয়াতেও তোমাদের বৈধ উপার্জনে প্রাপ্ত সম্পদের পাশাপাশি অনেক সম্পদ তোমরা অর্জন করতে পারবে, যা এখন তোমাদের প্রতি শত্রুতা পোষণকারীদের বা দ্বীনে হক্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্তদের দখলে কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তা তাদের হাতছাড়া হলে সেগুলোর উপর তাদের অধিকারের পরিবর্তে তোমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। পক্ষান্তরে যদি তোমরা শত্রু-মিত্র নির্বিচারে কাউকে শত্রুদের চর বা শত্রুসেনা আখ্যা দিয়ে তার সম্পদ কেড়ে নিতে চাও, তবে এর মাধ্যমে তোমাদের দুনিয়ার সম্পদ হয়তো অর্জন করতে পারবে, কিন্তু তা হবে সম্পূর্ণ অবৈধ এবং তার কারণে তোমরা আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে। অন্যদিকে তোমাদেরকে আক্রমণকারী শত্রুদের থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাপ্ত সম্পদ যদি তোমাদের কাঙ্ক্ষিত হয়, তবে সেরূপ অনেক সম্পদ আল্লাহর তত্ত্বাবধানে আছে, তোমরা (তোমাদের মধ্যকার জীবিত থাকবে তারা) যথাসময়ে তা পাবে। তবে শর্ত হচ্ছে, মাগানিম যেন তোমাদের যুদ্ধের উদ্দেশ্য না হয়, বরং আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠাই (ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিবেশ গঠনই) তোমাদের উদ্দেশ্য হতে হবে, অন্যথায় তোমাদের মধ্যকার যারা নিতান্তই যে যুদ্ধে মাগানিম পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চায়, বস্তুত তাদের মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতির কারণে সেরূপ অনেক যুদ্ধেও তারা সামান্য বিপদের আভাস পেলেই অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকবে, যা আল্লাহর বাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা, যার কোনো বদল সম্ভব নয়।

মাগানিম বণ্টন ও বণ্টিত মাগানিম ভোগ-ব্যবহার সম্পর্কিত আয়াতসমূহ

৮:৪১ :: আর তোমরা জেনে রাখো, নিশ্চয় তোমরা মাগানিম (যুদ্ধলভ্য সম্পদ) হিসেবে যা লাভ করেছো যে কোনো কিছু থেকে, নিশ্চয় তাতে পাঁচ ভাগের এক ভাগ আল্লাহর জন্য এবং রসূলের জন্য; এবং (তোমাদের সহযোগিতা পাওয়ার হক্বদার হয়ে যাওয়া) আত্মীয় স্বজনদের জন্য, এবং ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের জন্য এবং মিসকীনদের জন্য এবং ইবনের সাবীলের (ছিন্নমূলদের / বাস্তহারাদের / উদ্বাস্তুদের) জন্য। যদি তোমরা ঈমান এনে থাকো আল্লাহর প্রতি এবং সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করে দেয়ার দিনে, যেদিন দুটি সেনাবাহিনী পরস্পরের মোকাবেলায় মুখোমুখি হয়েছে সেদিন, আমি আমার বান্দার উপর যা নাযিল করেছি তাতে। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।

৮:৬৯ :: সুতরাং তোমার খাও যা তোমরা মাগানিম (যুদ্ধলভ্য সম্পদ) থেকে পেয়েছো (অর্থাৎ মাগানিমের বণ্টনের মাধ্যমে যা পেয়েছো তা), বৈধ ও পবিত্ররূপে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।

৮:৪১ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘গানিমতুম মিন শাইয়িন’ অর্থাৎ ‘যা কিছু তোমরা যুদ্ধলভ্য সম্পদ পেয়েছো, যে কোনো কিছু থেকে’। অর্থাৎ তা হোক ঘোড়া, হোক ভেড়া আর হোক অন্য কিছু, যে জিনিসই হোক না কেন। যুদ্ধে যা পাওয়া যাবে তার ২০% নির্দিষ্ট খাতগুলোতে দিয়ে, বাকি ৮০% যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সবাই, এমনকি যে যোদ্ধাদের জন্য রান্নাবান্না করেছে, সরাসরি যুদ্ধ করেনি সেসহ সবাই, সমহারে পাবে।

নিম্নোক্ত কারণসমূহের প্রেক্ষিতে স্বত:সিদ্ধভাবে বুঝা যায় যে, মাগানিমের পাঁচ ভাগের চার ভাগ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সবার মধ্যে সমহারে বণ্টিত হবে:

(ক) যেখানে আলাদা আলাদা অংশ বলা থাকে না, সেখানে সমহারে বণ্টনই স্বাভাবিক ও স্বত:সিদ্ধ হয়।

(খ) যুদ্ধের উদ্দেশ্য যে ব্যক্তি যা সংগ্রহ করতে পারবে সে সেটা পাওয়া নয়, বরং জুলুমের প্রতিরোধ এবং শত্রু সম্পত্তি কোন উপার্জন নয়, এটাতে আল্লাহ অনুমোদন না দিলে এটা বৈধই হতো না।

(গ) যেটা ব্যক্তিগত শ্রমভিত্তিক উপার্জনের বিষয় নয়, সামষ্টিক অংশগ্রহণের সামষ্টিক অর্জন, সেটা সমবায়ভিত্তিক সমহারে বণ্টনই নিতান্তই স্বাভাবিকতা।

মাগানিম বণ্টনের খাতসমূহ

মাগানিম বণ্টনের পাঁচটি খাত রয়েছে। নিম্নে খাতসমূহ উল্লেখ করা হলো:

প্রথম খাত হলো, ‘আল্লাহর জন্য ও রসূলের জন্য’। এ কথাটির অর্থ আমরা আনফাল প্রসঙ্গেই আলোচনা করেছি। এ খাতসহ বাকি খাতগুলোতে ২০% এর মধ্যকার বণ্টন হবে বাস্তব পরিস্থিতির পর্যালোচনা সাপেক্ষে পরামর্শক্রমে।

দ্বিতীয় খাত হলো, ‘এবং আত্মীয় স্বজনের জন্য’। সাধারণত এর অনুবাদ করা হয়, ‘তাঁর (রসূলের) নিকটাত্মীয় স্বজনের জন্য’। কিন্তু এ অনুবাদ শুদ্ধ নয়। কারণ আয়াতে হি বা ‘তাঁর’ সর্বনাম ব্যবহৃত হয়নি। তাই এটা ‘রসূলের নিকটাত্মীয়দের জন্য’ বলে নির্দিষ্ট করার অবকাশ নেই। বরং এটি আয়াতে উল্লেখিত গানিমতুম এর তুম এর সাথে সম্পর্কিত, অর্থাৎ তোমরা যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছো তোমাদের সহযোগিতা পাওয়ার হক্বদার হয়ে যাওয়া আত্মীয় স্বজনের জন্য। এর দ্বারা বিশেষ করে যুদ্ধে নিহত হওয়াদের পরিবার-পরিজনকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদেরই আত্মীয়-স্বজন বলে সাব্যস্ত। (উল্লেখ্য যিল ক্বুরবা শব্দটি তুলনামূলক দূরবর্তী আত্মীয় স্বজনকেও অন্তর্ভুক্ত করে, ৪:৮)। বস্তুত যে সকল পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অভাব ঘটেছে বা আয় -ব্যয়ের সংকুলান হচ্ছে না এমন সব পরিবারই ‘আত্মীয়-স্বজনের’ অন্তর্ভুক্ত হবে।

তৃতীয় খাত হলো, ‘ইয়াতীম ছেলেমেয়ে’। এর মধ্যে যুদ্ধে নিহত হওয়াদের ইয়াতীম ছেলেমেয়েও অন্তর্ভুক্ত এবং অন্যান্য ইয়াতীম ছেলেমেয়েও অন্তর্ভুক্ত।

চতুর্থ খাত হলো, ‘মিসকীন’ বা দুঃস্থ-অসহায়।

পঞ্চম খাত হলো, ইবনে সাবীল তথা ছিন্নমূল, বাস্তুহারা, উদ্বাস্তু।

মাগানিমের অর্থ নির্ণয়ে ভিন্নমতের পর্যালোচনা

অনেকে মাগানিমের/ গনিমতের ভিন্ন অর্থ করার মাধ্যমে দাবি করেন যে, গনিমত হলো বিনা কষ্টে প্রাপ্ত সম্পদ, যে কোনো আয়-উপার্জন। তাই প্রত্যেক ব্যক্তি তার উপার্জন থেকে ২০% যাকাত হিসেবে দিতে হবে। নিচে এ মতের পর্যালোচনা করা হলো।

প্রথমে ‘মাগানিম’ শব্দ প্রসঙ্গে এ মতের উদ্ভবের কারণ নির্ণয় করা প্রয়োজন। মাগানিম বা গণিমত শব্দের তিনটি অর্থ আছে, যথা: (ক) কোনো বিশেষ শর্তে (যেমন আবাদ করা, আহরণ করা বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ) যে সাধারণ সম্পদে অধিকার স্বীকৃত হয়, (খ) যুদ্ধলভ্য/ যুদ্ধলব্ধ সম্পদ  (গ) বিনা কষ্টে প্রাপ্ত সম্পদ, অর্জন বা লাভ। অন্য ভাষার মতো আরবি ভাষায়ও একই শব্দ কালের আবর্তে বিভিন্ন  অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকে। কিন্তু কুরআনে ব্যবহৃত শব্দের কুরআনিক ব্যবহারগত অর্থ নির্ণিত হবে, কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে। অভিধানে থাকা বিভিন্ন অর্থ দেখা যাবে, কিন্তু তার কোন অর্থটিতে কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে তা আল কুরআনে শব্দটির নির্ঘন্ট (Concordance) অনুসারে যাচাই করে নিতে হবে।

কুরআনের যেসব আয়াতে মাগানিম শব্দ ব্যবহার হয়েছে তার সামগ্রিক অধ্যয়ন থেকে শব্দটি কুরআনে প্রথম দুটি অর্থে তথা  (ক) কোনো বিশেষ শর্তে (যেমন আবাদ করা, আহরণ করা বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ) যে সাধারণ সম্পদে অধিকার স্বীকৃত হয়, (খ) যুদ্ধলভ্য / যুদ্ধলব্ধ সম্পদ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। যুদ্ধে লাভ করা এবং বিনা কষ্টে লাভ করা দুটি ভিন্ন ধরনের বিষয়। এছাড়া শত্রুপক্ষ পরিস্থিতি সাপেক্ষে যুদ্ধ না করে পালিয়ে গেলে তাদের যে পরিত্যক্ত সম্পদ হস্তগত হয় সেটাকে ফায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (ফায় সম্পর্কে পরের অনুচ্ছেদে আলোচিত হয়েছে)।

উপার্জন, ব্যবসায়ের প্রকৃত লাভ এবং বিনা কষ্টে লাভ বা অযাচিত প্রাপ্তি প্রভৃতিও ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বিষয়। পারিশ্রমিকরূপে পাওয়া উপার্জন এবং ব্যবসায়ের প্রকৃত লাভকেও (নিট লাভ) সমতুল্য সাব্যস্ত করা যায় না। আবার ব্যবসায়ের নিট লাভ এবং কারো থেকে কিছু উপহারস্বরূপ পেলে সেই অযাচিত প্রাপ্তিকেও সমতুল্য বলা যায় না। কুরআনে ফল-ফসল আহরণের দিন বা আয়ের দিন হক্ব আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে কিন্তু তাতে উপার্জন বা নিট লাভ বা উদ্বৃত্ত প্রভৃতি কোনো কিছুর উপর ভিত্তি করে কত হারে হক্ব আদায় করতে হবে তা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি।

উপার্জনের বিষয়ে একটি নির্দেশনা হলো, পুরুষ যা উপার্জন করে তা তার এবং নারী যা উপার্জন করে তা তার (৪:৩২)। এছাড়া উপার্জন থেকে এবং জমি থেকে উৎপন্ন ফল-ফসল থেকে ব্যয় করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে (২:২৬৭)। বরং সর্বপ্রকার মালসম্পদ থেকে ব্যয় করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে (২:২৭৪)।

তাই মাগানিম শব্দটিকে (ক) কোনো বিশেষ শর্তে (যেমন আবাদ করা, আহরণ করা বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ) যে সাধারণ সম্পদে অধিকার স্বীকৃত হয়, (খ) যুদ্ধলভ্য / যুদ্ধলব্ধ সম্পদ’ ছাড়া অন্য অর্থে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আয়াতসমূহের পূর্বাপর আলোচ্য বিষয় (Context) এর সাথে সামঞ্জস্যহীনতা দেখা দেয়। এছাড়া সেক্ষেত্রে পারিশ্রমিকবাবদ উপার্জন / আয় এবং ব্যবসায়ের নিট লাভের মধ্যে কিভাবে সমন্বয় করা হবে, সেটাও অনির্ণেয় থেকে যায়। আবার তাতে যাকাত-সদাক্বাত-ইনফাক্ব সম্পর্কিত সাধারণ নির্দেশনার সাথেও অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন মাগানিম বণ্টনের জন্য পাঁচটি খাতের নির্দেশনা রয়েছে অথচ সদাক্বাত বণ্টনের জন্য আটটি খাতের নির্দেশনা রয়েছে। মাগানিমের ক্ষেত্রে পাঁচ ভাগের এক ভাগ প্রদান করার নির্দেশ রয়েছে, কিন্তু ইনফাক্ব বা সদাক্বাতের ক্ষেত্রে এরূপ কোনো হার সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি, বরং মধ্যমপন্থা ও উদারতার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং সদাক্বাতের পরে খোঁটা দেয়ার চেয়ে সদাক্বাত দিতে না পারলেও সুন্দর কথা বলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

বস্তুত মাগানিমের অর্থ হিসেবে ‘যুদ্ধলব্ধ বা যুদ্ধলভ্য সম্পদ’ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যে আপত্তিটি উত্থাপিত হয় তাহলো, ‘তাহলে কি আল্লাহ যুদ্ধলভ্য সম্পদ গ্রহণ বা যুদ্ধ বজায় রাখার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছেন? তবে কি মুসলিমদের সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যুদ্ধলভ্য সম্পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ?’

এ প্রশ্নের জবাবে বলা যেতে পারে, কুরআনের শিক্ষানুসারে, যুদ্ধের উদ্দেশ্য যুদ্ধলভ্য সম্পদ নয়, বরং মুসলিমদের যুদ্ধ হবে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ বা অন্যায় যুদ্ধের মোকাবেলা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ। তবে যুদ্ধে প্রাপ্ত শত্রুসম্পদকে বৈধ করা হয়েছে এবং যুদ্ধলভ্য সম্পদ পেলে সেটা কিভাবে বণ্টন করতে হবে সেই বিধি-বিধান দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর দ্বারা কোনোক্রমেই এটা বুঝায় না যে, মুসলিমদের সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যুদ্ধলভ্য সম্পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বরং এর দ্বারা যুদ্ধলভ্য সম্পদ পেলে তার বণ্টনের নিয়মকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বুঝায়।

যুদ্ধলভ্য সম্পদ ২০% নির্দিষ্ট খাতগুলোতে বণ্টনের জন্য দিয়ে দেয়ার পর তা ঐ নির্দিষ্ট খাতগুলোতেই বণ্টিত হবে। বাকি ৮০% যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বণ্টিত হবে, তাদের মধ্য থেকে কেউ স্বচ্ছল হোক বা অস্বচ্ছল হোক, এটা তাদের উপার্জনের অতিরিক্ত একটি বাড়তি প্রাপ্তি। যেহেতু যুদ্ধলভ্য সম্পদ কোনো উপার্জন নয়, তাই এটিকে যাবতীয় উপার্জনের ক্ষেত্রে হুবহু প্রয়োগ করা সঠিক হবে বলে প্রতীয়মান হয় না। কারণ নিজ উপার্জন থেকে ২০% ছেড়ে দেয়া এবং ৮০% নিজের জন্য রেখে দেয়াকে যুদ্ধলভ্য সম্পদের ২০% ছেড়ে দিয়ে ৮০% যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বণ্টনের সমতুল্য সাব্যস্ত করা যেতে পারে না।

উপার্জনের ক্ষেত্রে, একজন ব্যক্তি যদি কম উপার্জন করতে পারে, তার ২০% দিয়ে দেয়া অন্য একজন ব্যক্তি যে অনেক বেশি উপার্জন করতে পারে তার ৮০% দিয়ে দেয়ার চেয়েও মানের দিক থেকে বেশি হতে পারে বা অবশিষ্টাংশ দ্বারা নিজ সংসার-ব্যয় নির্বাহ করা কষ্টকর হয়ে পড়তে পারে। এছাড়া যে ব্যক্তির উপার্জন তার নিজের জন্য যথেষ্ট নয়, সে উপার্জন সত্ত্বেও ফক্বির। আর সদাক্বাহ বণ্টনের প্রথম খাতই হলো ফক্বিরদেরকে সদাক্বাহ দেয়া (৯:৬০)। এমতাবস্থায় কতটুকু উপার্জন করলে উপার্জনের কত ভাগের কত ভাগ ফক্বির মিসকীন প্রমুখের হক্ব আদায়ের জন্য দিতে হবে তা সর্বপ্রকার উপার্জনকারীদের জন্য একটিমাত্র হার হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়া যৌক্তিক কিনা তা বাস্তবসম্মত পর্যালোচনার অবকাশ রাখে।

মাগানিম শব্দের প্রথম অর্থের প্রেক্ষিতে যে ব্যক্তি কোনো পতিত জমিতে লাঙ্গল লাগিয়ে সেটিকে আবাদ করেছে সেটিতে বা সেটির ফসলে তাকে মালিকানা দেয়া হবে এবং সে তা থেকে ২০% প্রদান করতে হবে, যে ব্যক্তি নদী বা সমুদ্রে মাছ ধরবে সে তা থেকে ২০% প্রদান করতে হবে, যে ব্যক্তি বন থেকে গাছ কাটবে বা মধু সংগ্রহ করবে সে তা থেকে ২০% দিতে হবে।

মাগানিমের উপর নির্ধারিত হার কুরআনে বর্ণিত একমাত্র হার হওয়ার কারণে এই হারকে সমষ্টিগত সদাক্বাত ব্যবস্থাপনায় কার্যকরযোগ্য সর্বোচ্চ হার (একমাত্র হার নয়) হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ সমকালীন অর্থনৈতিক বাস্তবতায় যে অর্থনৈতিক উপার্জনসীমার নিচে কেউ ফক্বির বলে গণ্য হতে পারে তার উপরের বিভিন্ন স্তরের আয়সীমায় বিভিন্ন সদাক্বাত আরোপ করা যেতে পারে, যেখানে সর্বোচ্চ স্তরের আয়সীমায় ২০% ধার্য করা যেতে পারে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে সূত্রটি হতে পারে, (ঐ স্তরের ব্যক্তির বাস্তব আয় - দারিদ্রসীমা) * ২০% ।

তবে কোন স্তরের আয়সীমায় শতকরা কত ভাগ ধার্য করা হবে সেটি উলিল আমর বাস্তব পরিস্থিতির পর্যালোচনাসম্পন্ন পরামর্শক্রমে নির্ধারণ করবেন। সমষ্টিগত সদাক্বাত ব্যবস্থাপনায় ২০% পরিশোধ করার পরও কোনো ব্যক্তি যাকাত বাবদ ব্যক্তিগতভাবে স্বেচ্ছায় তার নিজ পরিস্থিতি অনুসারে আরো সদাক্বাত করতে পারেন, যা সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনার সদাক্বাতের সাধারণ নিয়মের সাথে সম্পর্কিত নয়।

আবার উলিল আমর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব পেলে সর্বোচ্চ ২০% ধার্য করার এ মডেলকে জিযইয়ার (রাষ্ট্রীয় করের) ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। জিযইয়া প্রসঙ্গটি পরবর্তী নিবন্ধে আলোচিত হবে। জিযইয়া বা ‘নাগরিকের প্রদেয় কর’ থেকে অন্যান্য ব্যয়ের পাশাপাশি প্রত্যেক পরিবার প্রধানের উপর নির্ভরশীল সদস্যসংখ্যা অনুপাতে বাস্তবসম্মত পরামর্শক্রমে নির্বাহী সিদ্ধান্ত অনুসারে নির্ধারিত ভাতা প্রদান করলে তা নি:সন্দেহে অর্থনৈতিক যাকাত তথা পরিশুদ্ধতা ও সুষম উন্নয়ন সাধনে বা স্বনির্ভর-স্বাবলম্বি-সমৃদ্ধ জাতি গঠনে আশ্চর্য ও অনুকরণীয় ভূমিকা পালন করবে।

ফায়

ফায় অর্থ হলো ‘যুদ্ধ ছাড়াই অর্জিত শত্রুসম্পদ’ অর্থাৎ শত্রু যখন যুদ্ধ না করেই পালিয়ে যায় তখন তাদের যে সম্পদ রেখে যায় সেটাই হলো ফায়। ফায়য়ের সংজ্ঞা এবং বণ্টন সম্পর্কিত আয়াতগুলো (সূরা হাশর ৫৯:৬-১০) নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:

৫৯:৬ :: আর আল্লাহ তাঁর রসূলের কাছে তাদের থেকে যা ফায়স্বরূপ দিয়েছেন, তোমরা সেটার ব্যাপারে কোনো ঘোড়া দৌড়াওনি এবং কোনো উটেও চড়নি। কিন্তু আল্লাহ তাঁর রসূলদেরকে যাকে তিনি ইচ্ছা করেন ছাড়পত্র/শক্তি দেন। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।

৫৯:৭ :: আল্লাহ তাঁর রসূলের কাছে জনপদবাসীর কাছ থেকে যা ফায়স্বরূপ দিয়েছেন, তা আল্লাহর জন্য এবং রসূলের জন্য এবং আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং ইয়াতিম ছেলেমেয়েদের জন্য এবং মিসকীনদের জন্য এবং ইবনে সাবীলের (ছিন্নমূলের/বাস্তুহারাদের/উদ্বাস্তুদের) জন্য। যেন সম্পদ তোমাদের মধ্য থেকে শুধু ধনীদের মধ্যে আবর্তিত/পুঞ্জিভুত না হয়। আর রসূল (নির্বাহী সিদ্ধান্তে) তোমাদেরকে যা দেয় তোমরা তা গ্রহণ করো এবং সে (নির্বাহী নিষেধাজ্ঞারূপে) তোমাদেরকে যা থেকে নিষেধ করে তোমরা তা থেকে বিরত থাকো।আর তোমরা আল্লাহ সচেতন হও, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।

৫৯:৮ :: (এ সম্পদ) মুহাজির অভাবগ্রস্তদের জন্য যাদেরকে তাদের বাড়িঘর ও মালসম্পদ থেকে উৎখাত করা হয়েছে। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি তালাশ করে এবং তারা আল্লাহকে ও তাঁর রসূলকে সাহায্য করে আর তারাই সত্যবাদী (Sincere)।

৫৯:৯ :: আর  (এ সম্পদ তাদের জন্যও) যারা তাদের আগে থেকেই এ রাষ্ট্রে বসবাস করে আসছে এবং ঈমান এনেছে। তারা তাদেরকে ভালোবাসে যারা তাদের কাছে হিজরাত করে এসেছে। আর তারা তাদেরকে (মুহাজিরদেরকে) যা দেয়া হয় তাতে তাদের অন্তরে কোনো ঈর্ষা রাখে না এবং তারা তো নিজেদের উপরে তাদের (মুহাজিরদের) প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয় যদিও তাদের (নিজেদের) সাথে অভাব লেগে থাকে। আর যাকে তার মনের সংকীর্ণতা (স্বার্থপরতা, লোভ, কৃপণতা, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি) থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই সফল।

৫৯:১০ :: আর (এ সম্পদ তাদের জন্যও) যারা তাদের পরে এসেছে, এ অবস্থায় যে, তারা বলে, “হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে এবং আমাদের যে ভাইয়েরা ঈমানের ভিত্তিতে আমাদের সাবেক্ব (অগ্রগামী ও অতীত) হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রতি আমাদের অন্তরে কোনো অশোভন মনোভাব থাকতে দিবেন না। আমাদের প্রভু, নিশ্চয় আপনি স্নেহশীল ও দয়ালু”।

পরিশিষ্ট ৪

আজর

আজর হলো কাউকে তার চুক্তিভিত্তিক পারিশ্রমিক দেয়া অথবা কোনো সেবার কারণে কোনো পারিতোষিক দেয়া। উম্মাহর নেতৃবর্গ / রাষ্ট্রীয় নির্বাহী কার্যনির্বাহক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুনির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডের জন্য নিয়োজিত হওয়ার প্রেক্ষিতে প্রদেয় পারিতোষিক বা ভাতাও আজর। বিয়েতে নারীর সম্মতির বিনিময়ে প্রদেয় পারিতোষিক (যাকে সাধারণত মোহরানা বলা হয়) তাকেও আজর বলা হয়েছে। প্রতিযোগিতায় বিজয় লাভের পুরস্কারকেও আজর বলা হয়। আজর শব্দের বহুবচন হলো উজূর

নিম্নে আল কুরআনে আজর শব্দের বিভিন্ন ব্যবহার উল্লেখ করা হলো-

(ক) আল্লাহর কিতাব, ওহী বা আয়াতের বালাগ / প্রচার করার বিনিময়ে কোনো পারিতোষিক বা পারিশ্রমিক নেয়া যাবে না, নবী-রসূলগণ তা চাননি এবং নেননি, যারা বালাগের প্রতিদান চান না সেই নবী-রসূলগণই অনুসরণের যোগ্য; এ মর্মে যেসব আয়াতে আজর শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো- ৬:৯০, ১০:৭২, ১১:২৯, ১১:৫১, ১২:১০৪, ২৫:৫৭, ২৬:১০৯, ২৬:১২৭, ২৬:১৪৫, ২৬:১৬৪, ২৬:১৮০, ৩৪:৪৭, ৩৬:২১, ৩৮:৮৬, ৪২:২৩, ৫২:৪০, ৬৮:৪৬।

(খ) বিজয়ের জন্য পুরস্কার অর্থে- ৭:১১৩, ২৬:৪১।

(গ) মজুরি-পারিশ্রমিক বা পারিতোষিক- ১৮:৭৭, ২৮:২৫।

(ঘ) বিয়েতে নারীর সম্মতির বিনিময়ে পারিতোষিক বা পুরস্কার (যাকে সাধারণত মোহরানা বলা হয়)- ৪:২৪, ৪:২৫, ৫:৫, ৩৩:৫০, ৬০:১০।

(ঙ) সন্তানকে স্তন্য পান করানোর পারিতোষিক বা পুরস্কার- ৬৫:৬।

আজর শব্দ থেকেই মজুর বা শ্রমিক গঠিত। ২৮:২৬ আয়াতে মজুর নিযুক্ত করা (ইছতাজির, ইছতাজারতা) এবং ২৮:২৭ আয়াতে মজুর হিসেবে কাজ করা (তাজুরা)-এর প্রসঙ্গ এসেছে।

এছাড়া ঈমান ও আমলে সালেহের জন্য (বিশ্বাস ও সৎকর্মের জন্য) মানুষকে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে পুরস্কার দেয়া হবে তাকেও আজর শব্দে উল্লেখ করে অনেক আয়াত রয়েছে।

সুতরাং বাইতুল মাল তথা উম্মাহর সমষ্টিগত তহবিল বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে নিযুক্ত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তাদের বেতন-ভাতা, পারিশ্রমিক-পারিতোষিক বাবদ যা দেয়া হবে তা আজর হিসেবে সাব্যস্ত হবে। ন্যায্য ও নির্ধারিত আজর পরিশোধ করা সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যা বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে।

খারাজ/ খারজ

খারাজ বা খারজ (খরজ / খরচ) হলো কোন সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী বা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যা খরচ হবে সে ব্যয়ভার বহনের জন্য কৃত খরচ। তা হোক দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচীর কোন প্রকল্প (Project) অথবা হোক উন্নয়নমূলক কোনো কাজ যেমন হাসপাতাল, রাস্তাঘাট ইত্যাদি অথবা রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা কর্মসূচী বাস্তবায়ন ব্যয়।

খারজ/ খারাজ শব্দ নিম্নে উল্লেখিত দুটি আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে:

১৮:৯৪ :: তারা বললো, “হে যুলক্বারনাইন, নিশ্চয় ইয়াজূজ ও মাজূজ পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। সুতরাং আমরা কি আপনাকে খরচ দিবো এ বিষয়ে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটি প্রাচীর বানিয়ে দিবেন?

২৩:৭২ :: নাকি তুমি তাদের কাছে চাচ্ছো (বালাগের কাজের জন্য) কোনো খরচ? তবে তোমার প্রভুর দেয়া খরচই উত্তম। আর তিনিই উত্তম রিযিক্বদাতা।

সুতরাং ওয়াজ নসিহত করার জন্য কোনো বিনিময় এবং তার জন্য যাতায়াতবাবদ কোনো খরচ দাবি করা যাবে না। এক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান অনুসারে নিজের সামর্থ্য অনুসারে খরচ করে দায়িত্ব পালন করতে হবে। দূরবর্তী কেউ ওয়াজ নসিহত শুনতে চাইলে এবং নিজের পক্ষ থেকে সেখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে আর্থিক সামর্থ্যের অভাবই তাতে উপস্থিতির ক্ষেত্রে ওজর হলে তা প্রকাশ করা এবং আয়োজকরা নিজেদের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছায় খরচ বহন করা ভিন্ন বিষয়।

খারাজ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হলো, “অমুসলিমদের থেকে গৃহীত ভূমিকরকে খারাজ বলে”। কিন্তু উপরিউক্ত আয়াতসমূহের বক্তব্য অনুসারে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, খারাজ সম্পর্কিত এ প্রচলিত ধারণাটি সঠিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।

খারাজ সম্পর্কিত আয়াতের শিক্ষা অনুসারে, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকদের কাছ থেকে গৃহীত নিয়মিত কর দ্বারা ব্যয়নির্বাহ সম্ভব না হলে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের জন্য প্রয়োজন সাপেক্ষে যথাযথ খরচবাবদ বিশেষ কর ধার্য করা যাবে বা নাগরিকদের স্বত:স্ফূর্তভাবে দেয়া চাঁদা গ্রহণ করা যাবে এবং এক্ষেত্রে মুসলিম বা অমুসলিম বিবেচনায় কোনো বৈষম্যের অবকাশ নেই। তবে যদি বিশেষ কর ধার্য করা ছাড়াই কোনো উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় সেক্ষেত্রে অযথা কর ধার্য করা সমীচীন হবে না।

জিযইয়া

জিযইয়া  শব্দটির শব্দমূল হচ্ছে জীম যা ইয়া। এ শব্দ থেকে গঠিত দুটি শব্দ হচ্ছে, জাযা ও জিযইয়া ।

জাযা শব্দটির দুটি অর্থ রয়েছে, যথা- (ক) প্রতিফল (পুরস্কার বা শাস্তি)। যেমন, ৩:১৩৬ আয়াতে পুরস্কার অর্থে এবং ৪:৯৩ আয়াতে আয়াতে শাস্তি অর্থে জাযা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। (খ) জরিমানা। যেমন, ৫:৯৫ আয়াতে ‘জরিমানা’ অর্থে জাযা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

জাযা শব্দটির মতোই সমার্থকভাবে তবে কিছুটা ভিন্ন তাৎপর্য প্রকাশের জন্য জিযইয়া শব্দটি ব্যবহৃত হয় যার দুটি অর্থ রয়েছে, যথা- (ক) সামগ্রিক নাগরিক সুবিধার বিপরীতে প্রদেয় ‘কর’, যা আজর এবং খারাজ তথা রাজস্ব ব্যয়, উন্নয়ন ব্যয় এবং বিভিন্ন কল্যাণমুখী প্রকল্প ব্যয় হিসেবে তথা রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যাদি সম্পন্ন করতে ব্যয় করা হবে। (খ) (যুদ্ধের) ক্ষতিপূরণ বা যুদ্ধজনিত ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য গৃহীত অর্থদণ্ড। প্রথমটিকে সাধারণ জিযইয়া এবং দ্বিতীয়টিকে বিশেষ জিযইয়া  বলা যেতে পারে। কারণ দ্বিতীয়টির উদ্ভব ঘটে যখন নাগরিকদের কোনো গোষ্ঠী অন্যায় বিদ্রোহ করে অথবা কোন বহি:শক্তি রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার জন্য আক্রমণ করে।

সুতরাং ধর্মীয় ও নৈতিক বিধি মোতাবেক যে ব্যয় বা অনুদান করা হয়, যা রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আদায়যোগ্য নয় বা অর্থদণ্ড নয়, জিযইয়া তা থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। অর্থাৎ জিযইয়া হলো রাষ্ট্র কর্তৃক মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে নাগরিকের উপর আরোপিত ‘কর’ (Tax) এবং বিশেষ ক্ষেত্রে অর্থদণ্ড।

আল কুরআনে জিযইয়া সম্পর্কিত আয়াত

আল কুরআনে নিম্নের আয়াতটিতে জিযইয়া প্রসঙ্গটি এসেছে:

৯:২৯ :: তোমরা যুদ্ধ করো যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের মধ্য থেকে তাদের বিরুদ্ধে (সেই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে) যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে না এবং আখিরাত দিবসের প্রতিও (ঈমান রাখে) না, এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা হারাম (নিষিদ্ধ) করেছেন সেটাকে হারাম করে না (নিষিদ্ধ বলে সাব্যস্ত ও কার্যকর করে না) এবং সঠিক জীবনবিধানকে নিজেদের জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করে না; যতক্ষণ না তারা তাদের স্বহস্তে জিযইয়া (সামগ্রিক নাগরিক সুবিধার বা রাষ্ট্রীয় জিম্মাদারির বিপরীতে প্রদেয় ‘কর’ / অন্যায় যুদ্ধ করার কারণে সংঘটিত ক্ষয়ক্ষতির জরিমানা) প্রদান করে, এ অবস্থায় যে, তারা ক্ষুদ্রশক্তি হয়ে থাকে।

আল কুরআনের শিক্ষা অনুসারে জিযইয়া সম্পর্কে ভুল ধারণার অপনোদন

৯:২৯ আয়াতটির উদ্ধৃতি দিয়ে প্রচলিত ধারণা হলো, ইসলামী রাষ্ট্রে শুধুমাত্র অমুসলিমদের উপর আরোপিত বিশেষ কর হচ্ছে জিযইয়া। নিম্নে এ প্রচলিত ধারণাটির পর্যালোচনা এবং এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করা হলো।

প্রচলিত ধারণাটি ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে আল কুরআনের নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক, তাই এটি গ্রহণযোগ্য নয়। ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে আল কুরআনের নির্দেশনা হচ্ছে, দ্বীন গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বা মু’মিন হওয়ার জন্য কোন বলপ্রয়োগ নেই, যার ইচ্ছা সত্যকে গ্রহণ করবে (২:২৫৬, ১০:৯৯, ১৮:২৯, ৮৮:২১-২২ ইত্যাদি), যার যার দ্বীন সে সে পালন করবে (১০৯:৬), যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে এবং যারা উম্মী (অ-আহলে কিতাব) তাদের নিকট ইসলামের বালাগ / প্রচার করাই কর্তব্য, (মুসলিম হওয়ার জন্য বাধ্য করা যাবে না) (৩:২০)। এরূপ আরো অনেক আয়াত আছে, যাতে অন্যরা আল্লাহর আয়াত নিয়ে সমালোচনা করলে তাদেরকে উপেক্ষা করতে বলা হয়েছে কিন্তু যুদ্ধ করতে নয়, বরং তারা সমালোচনা বন্ধ করে অন্য প্রসঙ্গে গেলে তাদের সাথে সাধারণ সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা যাবে (৪:১৪০), যদিও মু’মিনদের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব বিশ্বাসভিত্তিক তথা মু’মিনদের সাথেই (৩:২৮, ৩:১১৮) কিন্তু যারা আক্রমণকারী নয় তাদের সাথে সাধারণ সদাচার করতে এবং ন্যায়বিচার করতে বলা হয়েছে (৬০:৮), যারা চুক্তিবদ্ধ হতে চায় তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে এবং যদি তারা চুক্তিভঙ্গ করার সম্ভাবনা না থাকে সেক্ষেত্রে চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করতে বলা হয়েছে (৮:৫৬-৬২) চুক্তিবদ্ধ সম্প্রদায়কে আক্রমণ থেকে বিরত থাকাকে তাদের মধ্যে অবস্থানকারী মুসলিমদের স্বার্থের তুলনায় অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে (৪:৯০-৯১, ৮:৭২)। সর্বোপরি মু’মিনরা শান্তিস্থাপন প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণরূপে দাখিল হতে বলা হয়েছে (২:২০৮), মন্দের জবাব ভালো দিয়ে দিতে বলা হয়েছে (৪১:৩৪), সমান শাস্তি হতে পারে কিন্তু সবর করাই উত্তম (১৬:১২৬)।

জিযইয়ার বিষয়ে প্রকৃত তথ্য

এ আয়াতটিতে (৯:২৯) ‘যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে’ তাদের মধ্যকার একটি অংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশ রয়েছে, তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখসহ এবং যুদ্ধ কতক্ষণ করতে হবে তার নির্দেশনাসহ। আয়াতটির পূর্ববর্তী ২৮টি আয়াতে মুশরিকদের একটি অংশের বিরুদ্ধে (যারা বারবার চুক্তিভঙ্গ করেছে) যুদ্ধ করার বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর মুশরিকদের মধ্যকার যারা চুক্তি ভঙ্গ করেনি, তাদের সাথে চুক্তি অনুসারে আচরণ করতে আদেশ রয়েছে। তারপর ৯:২৯ আয়াতে ‘যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে’ তাদের একটি অংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা (ক) নিজ হাতে জিযইয়া  দেয় এবং (খ) তারা ক্ষুদ্রশক্তিগণ হয়ে থাকে।

এতে আহলে কিতাবের মধ্যকার যে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ দেয়া হয়েছে তাদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা হারাম করেছেন সেটাকে হারাম সাব্যস্ত করে না এবং সঠিক জীবনবিধানকে নিজেদের জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করে না। কিন্তু তারা ঈমান আনা এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা হারাম করেছেন সেটাকে হারাম হিসেবে কার্যকর করা এবং সঠিক জীবনবিধানকে নিজেদের জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে আদেশ দেয়া হয়নি। বরং তারা নিজ হাতে জিযইয়া দেয়া এবং ক্ষুদ্রশক্তি হয়ে থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঈমান না রাখা এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম না করা এবং সঠিক জীবনবিধানকে নিজেদের জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ না করার কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়নি, বরং এটা তাদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারা জিযইয়া দিতে অস্বীকার করা এবং নিজেদেরকে ক্ষুদ্রশক্তির বিপরীতে বৃহৎশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা তথা রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কারণে।

আল কুরআনে মুসলিমদের প্রতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মৌলিক নির্দেশনা হলো শান্তিপ্রক্রিয়া প্রতিস্থাপন (২:২০৮), ফিতনার অবসান তথা ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা (২:১৯৩, ৮:৩৯, ২:২৫৬, ১০৯:৬), মানবকল্যাণে নেতৃত্ব দেয়া এবং ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ (৩:১১০, ২২:৪১)। এটা স্বত:সিদ্ধ যে, ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকলেও রাষ্ট্রের মূল নেতৃত্ব যাদের হাতে থাকে, তারাই হয় কাবীর / বৃহৎশক্তি এবং অন্যরা হয় সগীর / ক্ষুদ্রশক্তি। বৃহৎশক্তি যদি মুসলিমরা হয় তাহলে তারা কিভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে তা ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে। তবে ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে উঠবে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে, মুসলিমরা যখন ঈমান ও আমলে সালেহের মাধ্যমে যোগ্য হয়ে উঠবে, তখন আল্লাহ তাদেরকে খিলাফত / ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার ব্যবস্থা করে দিবেন (২৪:৫৫)। মুসলিম উম্মাহর পরিচালিত রাষ্ট্র কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, তারা ঈমানের ভিত্তিতে এবং ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে (৩:১১০)। তাই মুসলিম উম্মাহর খেলাফত রাষ্ট্রে যারা রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে তাদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশনা রয়েছে (৫:৩৩)।

৯:১-২৮ আয়াতে তৎকালীন বারবার চুক্তি লংঘনকারী মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নির্দেশনা দেয়ার পর ৯:২৯ আয়াতে ‘যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে’ তাদের একটি অংশের বিষয়ে যুদ্ধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশনায় শেষ কথা হলো তারা যখন সগীরুন / ক্ষুদ্রশক্তি হিসেবে থাকতে সম্মত হয়ে যাবে, তখন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে। অর্থাৎ যখন তারা বিদ্রোহ ত্যাগ করে রাষ্ট্রকর্তৃত্বের আনুগত্য করবে তখন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে। তাদের বিদ্রোহের প্রসংগে বা তারা অন্যায়ভাবে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করার কারণে জিযইয়ার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, তারা যখন স্বহস্তে জিযইয়া  দিবে তখন যুদ্ধ সমাপ্তি ঘটবে। এ কথার স্বত:সিদ্ধ তাৎপর্য হলো: (ক) তারা সামগ্রিক নাগরিক সুবিধার বিপরীতে প্রদেয় ‘কর’ দিবে, যা তারা বিদ্রোহ ত্যাগ করে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তনের প্রমাণস্বরূপ হবে এবং (খ) বিশেষ করে যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাদের বিদ্রোহাত্মক যুদ্ধের কারণে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এজন্য তারা ক্ষতিপূরণমূলক জরিমানা দেয়াও জিযইয়ার অংশ হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

সুতরাং জিযইয়া  দেয়া হলো স্বাভাবিক (অ-বিদ্রোহী) নাগরিক হিসেবে সাধারণ নাগরিক দায়িত্ব। জিযইয়া  শব্দটির উৎপত্তিগত অর্থ অনুসারে এবং আল কুরআনে থাকা ধর্মীয় স্বাধীনতার নীতির প্রেক্ষিতে, জিযইয়া  শুধুমাত্র অমুসলিম নাগরিকদের উপর প্রযোজ্য ‘কর’ হওয়ার ধারণাটি সঠিক নয়। বরং (সাধারণ) জিযইয়া হলো মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের উপর প্রযোজ্য সামগ্রিক নাগরিক সুবিধার বিপরীতে রাষ্ট্রীয় তহবিলে প্রদেয় ‘কর’, যা রাষ্ট্রকর্তৃত্বের পক্ষ থেকে বৈধ বলপ্রয়োগমূলকভাবে বা অনাদায়ে জরিমানা বা শাস্তির মাধ্যমে আদায়যোগ্য; যেমন আধুনিক সময়ে প্রদেয় ‘কর’ না দিলে জেল জরিমানা হওয়ার আইন রয়েছে। এটি কোনো ধর্মীয় বৈষম্যমূলক বা ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণমূলক ‘কর’ নয়। তেমনি যে কোনো জায়গায়, যেমন গ্রামে গঞ্জে, শহরে নগরে, বন্দরে, যে কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় ভাষা, বর্ণ, গোত্র, পেশা, সীমানাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে বা যে কোনো অন্যায় স্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে তথা অন্যায়ভাবে অন্য কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের উপরে যুদ্ধবিগ্রহ, মারামারি হানাহানি, ফেতনা ফাসাদ চাপিয়ে দিলে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করার চিরন্তন বিধিই হচ্ছে (বিশেষ) ‘জিযইয়া’ বা ‘ক্ষতিপূরণমূলক জরিমানা’ আদায় করা।

‘জিযইয়া হলো যিম্মিদের থেকে গৃহীত কর’ তথ্যটির পর্যালোচনা

জিযইয়া প্রসঙ্গে প্রচলিত সংক্ষিপ্ত তথ্য হলো ‘জিযইয়া হলো যিম্মিদের থেকে গৃহীত কর’। এ ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচলিত আছে যে, ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদেরকে যিম্মী বলা হয় এবং যিম্মীদের থেকে তথা অমুসলিমদের থেকে গৃহীত করকে জিযইয়া বলে। অন্যদিকে মুসলিমরা যেহেতু যাকাত প্রদান করে তাই তাদের থেকে জিযইয়া আদায় করা হবে না। মুসলিমদের থেকে জিযইয়া আদায় না করার দলীল হিসেবে একটি হাদীস উপস্থাপিত হয়। হাদীসটি নিম্নরূপ:

ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ একই লোকালয়ে দু’টি কিবলার সুযোগ নেই এবং মুসলমানদের ওপর কোনো জিযইয়া নেই (তিরমিজি:৬৩৩)।

যিম্মী শব্দটির অপপ্রয়োগজনিত অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘যাকে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আটকে রাখা হয় বা তার স্বাধীনতা হরণ করা হয়’’। অথচ প্রকৃত পক্ষে ‘যিম্মী’ শব্দটির মূল রূপ হলো ‘আহলে যিম্মাহ যে যিম্মাহদারির / সুরক্ষা প্রদানের আওতায় রয়েছে, যে সুরক্ষা চুক্তিতে আবদ্ধ’’’।

যিম্মাহ শব্দটির শব্দমূল হলো যাল মীম মীম। এ শব্দমূল থেকে কুরআনে দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। একটি হলো যাম্মাহু (সে তাকে তিরস্কৃত করেছে) ক্রিয়া থেকে গঠিত ‘মাযমূম’ শব্দ, যার অর্থ হলো ‘তিরস্কৃত’। ‘মাযমূম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৩ স্থানে: ১৭:১৮:১৭, ১৭:২২:৮, ৬৮:৪৯:১০। আর এ শব্দমূল থেকে গঠিত দ্বিতীয় শব্দটি ‘আযাম্মাহু’ (সে তার থেকে সুরক্ষা চুক্তি গ্রহণ করলো) ক্রিয়া থেকে গঠিত এবং শব্দটি হলো ‘যিম্মাহ’, যার অর্থ হলো ‘সুরক্ষা চুক্তি / সন্ধি’। যিম্মাহ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৯:৮:১০, ৯:১০:৭।

যিম্মাহ শব্দ ধারণকারী আয়াত দুটির বক্তব্য নিম্নরূপ:

৯:৮ :: কিরূপে (মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক রাখা যাবে)? অথচ যদি তারা তোমাদের উপর বিজয়ী থাকে, তারা তোমাদের বিষয়ে সাধারণ আত্মীয়তারও মর্যাদা রাখে না এবং সুরক্ষা চুক্তিরও মর্যাদা রাখে না। তারা মুখের কথায় তোমাদেরকে সন্তুষ্ট করে অথচ তাদের অন্তর তা অস্বীকার করে আর তাদের অধিকাংশই নীতিহীন।

৯:১০ :: তারা মু’মিনদের বিষয়ে সাধারণ আত্মীয়তারও মর্যাদা রাখে না এবং সুরক্ষা চুক্তিরও মর্যাদা রাখে না। আর তারাই সীমালংঘনকারী।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, কুরআনে যিম্মাহ শব্দটি দুইবার ব্যবহৃত হয়েছে এবং উভয় অবস্থায় মুসলিমদেরকে যিম্মী হিসেবে চিহ্নিত করে মুশরিকরা বিজয়ী থাকা অবস্থায় তারা মু’মিনদের বিষয়ে যিম্মাদারির দায়িত্ব পালন না করার বিষয় প্রসঙ্গে বক্তব্য এসেছে।

সুতরাং বাস্তব তথ্য হলো, রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীলদের সাথে সকল নাগরিকই সুরক্ষা চুক্তিতে আবদ্ধ এবং কর্তৃত্বশীলরা ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকেই সুরক্ষা দেয়া উচিত। সেই প্রেক্ষিতে মু’মিনরাও যিম্মী তথা সাধারণ নাগরিক পর্যায়ে থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রীয় কর্তত্বশীলদেরকে জিযইয়া দিবে যদিও তারা মুশরিক হয়। আর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বশীলদের উচিত মু’মিনদেরকেও নাগরিক সুবিধা প্রদান করা এবং তাদের শরিয়াহ ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ প্রদান করা।

অনুরূপভাবে যখন মু’মিনরা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারী হয় তখন মু’মিনদের কাছে মু’মিন মুশরিক সব নাগরিকই যিম্মী বা সুরক্ষা প্রাপ্তির অধিকারী। আর এ যিম্মাদারি পালনের জন্য সব নাগরিক জিযইয়া প্রদানে দায়বদ্ধ। তাই যারা জিযইয়া দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবে তারা মূলত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী। এমতাবস্থায় তারা ক্ষুদ্রশক্তি হয়ে থাকবে এরূপ অঙ্গীকারের প্রতীক হিসেবে স্বহস্তে জিযইয়া প্রদান শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। কারণ অন্যথায় রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে।

যিম্মাহ ও জিযইয়া প্রসঙ্গে থাকা আল কুরআনের আয়াতসমূহের ভিত্তিতে পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমানদের উপর জিযইয়া নেই মর্মে যে হাদীসটি প্রচলিত আছে সেটি রসূলুল্লাহ (সা.) এর হাদীস নয়, বরং এটি ভুলভাবে তাঁর নামে প্রচারিত হয়েছে। বস্তুত শুধুমাত্র অমুসলিমরাই যিম্মী নয় এবং জিযইয়া কোনো ধর্মীয় কর নয়, যা শুধুমাত্র অমুসলিমদের নিকট থেকে আদায়যোগ্য। বরং জিযইয়া হলো ‘নাগরিক সুবিধার বিপরীতে রাষ্ট্রীয় তহবিলে প্রদেয় কর’ এবং এটি মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার থেকে আদায়যোগ্য। আর জিযইয়া যেহেতু ধর্মীয় কর নয়, তাই জিযইয়া দিতে অস্বীকৃতির প্রেক্ষিতে জিযইয়া দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাও কোনো ধর্মীয় বাড়াবাড়ি নয়।

জিযইয়া ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য হলো,আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে অনুদান বা যাকাত প্রদান না করার কারণে কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অবকাশ নেই, কিন্তু জিযইয়া বা ‘নাগরিক সুবিধার বিপরীতে রাষ্ট্রীয় তহবিলে প্রদেয় কর’ দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে সেই রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অবকাশ রয়েছে। যাকাত বাবদ কোনো অনুদানে বাধ্য না করার ক্ষেত্রে কোনো পার্থিব দণ্ডবিধি না থাকার কারণ হলো: ‘ধর্মীয় বিষয়ে কোনো বলপ্রয়োগ নেই’ (২:২৫৬)।

পরিভাষা

আজর اَجْرُ : আজর শব্দের অর্থ হলো, ‘পারিশ্রমিক, পারিতোষিক, প্রতিফল’। আজরের বিষয়ে প্রধান নির্দেশনা হলো, আল কুরআনের বালাগ (প্রচার) করার বিনিময়ে কোনো আজর বা পারিশ্রমিক-পারিতোষিক গ্রহণ (দাবি) করা যাবে না। তবে পারস্পরিক উপকারমূলক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে কেউ কাউকে কোনো পারিতোষিক দেয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। আর যদি কাউকে কোনো সুনির্দিষ্ট দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয় তাহলে তাকে চুক্তি অনুসারে পারিশ্রমিক দেয়া কর্তব্য। বিয়েতে স্ত্রীকে যে মোহরানা দিতে হয় সেটাকে আজর তথা পারিতোষিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে সেটা আবশ্যকীয় বা ফরজ পারিতোষিক। কারণ এক্ষেত্রে একচেটিয়াভাবে স্ত্রীকে পারিতোষিক দেয়ার বিষয়টি আল্লাহর বিধানের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে। যারা স্বপ্রণোদিতভাবে দ্বীনের কাজে আটকে যায় অথবা যাকে কোনো নির্দিষ্ট কাজের জন্য পরামর্শক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নিযুক্ত করা হয় এবং সেজন্য তার উপার্জন সীমিত হয়ে যায় বা তার দ্বারা তা সম্ভব না হয় এরূপ ব্যক্তিকে সদাক্বাত দেয়ার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। যদি কাউকে কোনো সুনির্দিষ্ট কাজে পরামর্শের ভিত্তিতে নিযুক্ত করা হয় সেক্ষেত্রে পরামর্শ অনুসারে তাকে কোনো নির্ধারিত হারে সদাক্বাত প্রদান করা যেতে পারে। এটাকে আজর বা পারিশ্রমিক বলা যেতে পারে না, কারণ এক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজে কোনো নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের প্রার্থী নয় বা বিনিময় ছাড়াও সে সাধ্যমতো কাজটি করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকে। এ বিষয়ে সদাক্বাত আদায়ের দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকেও সদাক্বাত বণ্টনের একটি খাত হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়ার বিষয়টি লক্ষণীয়।

আনফাল أَنْفَال : আনফাল শব্দটির অর্থ হলো ‘মূল বণ্টনের অতিরিক্ত মালসম্পদসমূহ’। মালসম্পদের মধ্যে আল্লাহর বিধান অনুসারে যা বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বণ্টিত হয়ে যায়, তারপর যা অবণ্টিত থেকে যায়, সেটাই আনফাল। অন্য কথায়, আনফাল মানে হলো জনসম্পদ (Public Property, Commonwealth)। যুদ্ধলভ্য মালসম্পদের (মাগানিমের) মধ্য থেকে যেটাকে মাগানিম হিসেবে বণ্টন করা হয়েছে তার থেকে আনফালকে বা জনসম্পদ হিসেবে সাব্যস্ত করা মালসম্পদকে পৃথক রাখা হয়েছিলো। সেই প্রেক্ষিতে আনফালের বণ্টন নিয়ে জিজ্ঞাসার ভিত্তিতে জানানো হয়েছে যে, “আনফাল আল্লাহর জন্য ও রসূলের জন্য”। কুরআনে “আল্লাহর জন্য ও রসূলের জন্য” একটি বাগধারা হিসেবে ব্যবহৃত যার অর্থ হলো ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বাত্মক কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ (Central Authority / Governing Entity)। এর মাধ্যমে বুঝানো হয় যে, জনসম্পদকে ব্যাপকভাবে বেসরকারিকরণ করা যাবে না। ব্যাপক বেসরকারিকরণ মানুষকে মুনাফা বৃদ্ধির প্রবণতা ও সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যায়, যেখানে প্রকৃত সার্ভিস বা পরিষেবার বিনিময়ে নাগরিককে উত্তরোত্তর খরচ বৃদ্ধি করতে হয়। আধুনিক সময়ে এর উদাহরণ হলো প্রাইভেট শিক্ষা, প্রাইভেট চিকিৎসাখাত ইত্যাদি। জনসম্পদের ব্যবস্থাপনা, ব্যয়-বণ্টন বা বেসরকারিকরণ সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের সুবিধার্থে রসূলের নির্বাহী সিদ্ধান্তক্রমে নির্ধারিত হবে। রসূলের অবর্তমানে মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্বপালনকারীকে ‘উলিল আমর’ (নির্দেশদাতা) বলা হয়। সেই প্রেক্ষিতে বর্তমানে উলিল আমর পরামর্শক্রমে আনফালের বিষয়ে বেসরকারিকরণ ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। আনফালের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে নতুন অধিগত ভূমি, খনিজ সম্পদ, বন ও সমুদ্র সম্পদ ইত্যাদি। অর্থাৎ বন থেকে বা সমুদ্র থেকে অনুমোদিত সীমায় কিছু আহরণ করা যাবে কিন্তু বনের বা সমুদ্রের কোনো অংশের সরাসরি মালিকানা ব্যক্তিপর্যায়ে বিতরণ করা সঙ্গত হবে না। বন বা সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদ থেকে এক পঞ্চমাংশ কেন্দ্রীয় বাইতুল মালে (Central Treasury) জমা দিতে হবে, যা মাগানিমের বণ্টন খাতে বণ্টিত হবে।

আতা آتَى : আতা শব্দটির অর্থ হলো: প্রদান করা, কারো কাছে কিছু পৌঁছা বা পৌঁছানো, নিজের মধ্যে থাকা (ভালো) কিছুকে সামনে নিয়ে আসা, সরবরাহ করা / যোগান দেয়া (Provide), নিবেদন / অর্পণ করা (Offer)। এটি বস্তুগত জিনিসের সাথেও সম্পর্কিত হতে পারে, যেমন আতাল মাল অর্থ হলো ‘সম্পদ প্রদান করা’। আবার অবস্তুগত / বিমূর্ত  বিষয়ের সাথেও সম্পর্কিত হতে পারে, যেমন আতায যাকাত অর্থ হলো ‘পরিশুদ্ধতা, নৈতিক গুণের উৎকর্ষ এবং আত্মিক ও সার্বিক সুষ্ঠু উন্নয়ন প্রদান (নিশ্চিত) করা’। লিয যাকাতি ফায়িলূন এর অর্থ হলো ‘যাকাতের জন্য সক্রিয় থাকা’। যাকাতের জন্য সক্রিয়তার দুটি দিক রয়েছে, একটি হলো নিজের যাকাত বা পরিশুদ্ধি এবং অন্যটি হলো অন্যদের যাকাত বা পরিশুদ্ধি। তাই আতায যাকাত বলতে বুঝায়: নিজের পরিশুদ্ধতার খাতিরে পরিবেশের পরিশুদ্ধতার ক্ষেত্রেও কাজ করা এবং নিজের আত্মিক ও সার্বিক উন্নয়নের খাতিরে সর্বসাধারণের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অংশগ্রহণ করা।

ইনফাক্ব إنفاق‎ : ইনফাক্ব শব্দটির অর্থ হলো ‘ব্যয়’। তবে ব্যয় বলতে কৃপণতা ও অপচয় না করে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের পাশাপাশি বিশেষ করে আল্লাহর নির্দেশিত বিভিন্ন খাতে যেমন আল্লাহর দীনের প্রচার-প্রতিষ্ঠা ও সমাজের দুঃস্থ-অসহায়দের জন্য, আত্মীয়-স্বজনের অধিকার পূরণের জন্য দান করাকেও বুঝায়। কুরআন নির্দেশিত যাবতীয় ব্যয়ের খাতে ব্যয় করাকে ইনফাক্ব বলা হয়। কুরআনে রাতে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে, স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল অবস্থায়, মধ্যম পন্থায়, উপার্জন ও জমিতে উৎপন্ন ফল ফসল থেকে এবং সর্বপ্রকার মালসম্পদ থেকে উৎকৃষ্ট মানের অর্থসম্পদ উদারতাপূর্ণভাবে ব্যয় করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কুরআন অনুযায়ী ইনফাক্ব করার ক্ষেত্রে শয়তান দরিদ্র হয়ে যাওয়ার আশংকা জাগিয়ে তুলে কিন্তু আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অনুসারে মু’মিনরা এর মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ ও প্রকৃত (ন্যায়সঙ্গত) সমৃদ্ধির বিষয়ে নিশ্চিত বিশ্বাস পোষণ করে।

দাসাত (দাসসা) دَسَوٰة : দাসাত শব্দটির অর্থ হলো ‘কলুষিত করা, অবদমিত করা, উন্নয়নশীল না হওয়া’। দাসাত শব্দটি যাকাত শব্দটির বিপরীত শব্দ। দাসাত শব্দটির শব্দমূল হলো দাল ছীন ওয়াও, যেমন যাকাত শব্দটির শব্দমূল যা কাফ ওয়াও। সূরা শামস ৯১:৯-১০ আয়াতে যাকাত শব্দ থেকে গঠিত ক্রিয়ারূপ-২ যাক্কা এবং দাসাত শব্দ থেকে গঠিত ক্রিয়ারূপ-২ ‘দাসসা শব্দ দুটিকে বিপরীত শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আয়াত দুটির বক্তব্য হলো “নিশ্চয় সেই সফল হলো যে নিজেকে যাকাত (পরিশুদ্ধ ও আত্মিক গুণাবলিতে বিকশিত) করলো। আর নিশ্চয় সেই ব্যর্থ হলো যে নিজেকে দাসাত (কলুষিত ও আত্মিক গুণাবলিতে অবদমিত) করলো”। প্রকৃতপক্ষে কোনো ব্যক্তি নিজের যাকাত বা আত্মিক উন্নয়ন ও পরিশুদ্ধতার জন্য সচেষ্ট না থাকলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নিজের দাসাত বা বা আত্মিক অবদমন ও কলুষতাতে জড়িয়ে যাবে। যেমন কোনো বস্তুকে পরিচ্ছন্ন করার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা করতে হয় কিন্তু বিশেষ কোনো উদ্যোগ ছাড়াও শুধুমাত্র পরিচ্ছন্নতার কাজ থেকে বিরত থাকলে তা অপরিচ্ছন্ন হতে থাকে। তাই আত্মিক অবদমন ও কলুষতা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হলো যাকাত তথা আত্মিক উন্নয়ন ও পরিশুদ্ধতার জন্য সদা সচেষ্ট থাকা।

তাহারাত طَهَارَة : তাহারাত শব্দটির অর্থ হলো ‘পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও কলুষতামুক্ত থাকা’। শব্দটি শারীরিক বা বস্তুগত পবিত্রতা, বিশ্বাসগত পবিত্রতা, চরিত্রগত পবিত্রতা এবং পদ্ধতিগত পবিত্রতা ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাহারাত এবং যাকাতের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। তাই ২:২৩২, ৯:১০৩ আয়াতে দেখা যায় যে, একই বিষয়কে যাকাত ও তাহারাত উভয়টির উপায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহারাত একটি নেতিবাচক গুণ যা দ্বারা বুঝায় ময়লা-আবর্জনা ও নোংরামি থেকে মুক্ত থাকা। অন্যদিকে যাকাত একটি ইতিবাচক গুণ যা দ্বারা বুঝায় পরিচ্ছন্ন অবস্থায় অধিকতর উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি।

খারাজ خَرَاج : খারাজ শব্দের অর্থ হলো ‘খরচ’। খারাজ বলতে বুঝায় কোনো নির্দিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে যে নির্দিষ্ট পরিমাণ খরচ হয়। যেমন কোনো কাজে কোথাও যাতায়াত করলে যাতায়াত বাবদ সুনির্দিষ্টভাবে যা খরচ হয় সেটাই ‘যাতায়াত খরচ’ (খারাজ)। দ্বীনের বালাগ (প্রচার) তথা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ সাধ্যমতো কাজ করতে দায়িত্বশীল। তাই কোথাও যাতায়াতের জন্য নিজের সামর্থ্য না থাকলে দায়িত্বও নেই। এজন্য কারো কাছে যাতায়াত খরচ চাওয়ারও অবকাশ নেই। তবে যদি পরামর্শক্রমে কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে আয়োজক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যাতায়াত খরচ দেয়, সেটা ভিন্ন বিষয়। অপরদিকে যাতায়াত খরচ নিজেই নির্বাহ করা সম্ভব এমতাবস্থায় যাতায়াত খরচের বিনিময়ে কোথাও উপস্থিত হয়ে ওয়াজ নসিহত করা বৈধ নয়। উন্নয়ন অর্থনীতির বাস্তবায়নের জন্য কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে যা খরচ হবে তা নাগরিকদের থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে। তবে যদি রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে উন্নয়ন ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয় সেক্ষেত্রে নতুন করে করারোপ করা সঙ্গত নয়।

জিযইয়া جِزْيَة : জিযইয়া শব্দটির অর্থ হলো ‘নাগরিক সুবিধার বিপরীতে প্রদেয় রাষ্ট্র নির্ধারিত কর, কোনো জনগোষ্ঠীর উপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে তাতে যা ক্ষয়ক্ষতি হয় তার ক্ষতিপূরণমূলক জরিমানা’। প্রথমটিকে অর্থাৎ নাগরিক করকে নিয়মিত / সাধারণ জিযইয়া এবং দ্বিতীয়টিকে অর্থাৎ জরিমানাকে অনিয়মিত / বিশেষ জিযইয়া বলা যেতে পারে। প্রত্যেক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সাথে নাগরিক সাধারণ জিম্মাহ তথা সুরক্ষা চুক্তিতে আবদ্ধ। রাষ্ট্রীয় কর্তত্বের পক্ষ থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা কর্তব্য। আর এই সুরক্ষার সার্বিক ব্যবস্থাপনা কার্যকর করার জন্য নাগরিকরা রাষ্ট্র নির্ধারিত নাগরিক কর প্রদান করাও নাগরিকদের দায়িত্ব। যখন নাগরিকদের কোনো বিচ্ছিন্ন গ্রুপ বিদ্রোহাত্মক আচরণের প্রতীক হিসেবে জিযইয়া দেয়া বন্ধ করে দেয় তখন তারা সামগ্রিক নাগরিক সুবিধা পাওয়ার অধিকার হারায় এবং সেই প্রেক্ষিতে তাদের বিদ্রোহের মোকাবেলায় তারা পুনরায় জিযইয়া দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা একটি বাস্তবম্মত নির্দেশনা। এই প্রেক্ষিতে কুরআনে জিযইয়া দিতে অসম্মতি প্রকাশকারী বিদ্রোহী আহলে কিতাবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশনা এসেছে। কিন্তু এটা কোনোক্রমে ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণমূলক যুদ্ধ নয়। কারণ কুরআনে ধর্মীয় স্বাধীনতার মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের নির্দেশনা রয়েছে। কারো ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করা আল কুরআনের শিক্ষা পরিপন্থী। ইসলামী রাষ্ট্রে যেমন মুসলিম-অমুসলিম সকলকে জিযইয়া দিতে হবে, অমুসলিমদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীনে বসবাসকারী মুসলিমরাও তেমনি জিযইয়া দিবে, কারণ কুরআন অনুসারে অমুসলিমদেরও উচিত যখন তারা কর্তৃত্বে থাকে, তখন যেন মু'মিনদের প্রতি জিম্মাদারির মর্যাদা রক্ষা করে।

মাগানিম مَغَانِم : মাগানিম শব্দটির অর্থ হলো ‘কোনো বিশেষ শর্তে (যেমন আবাদ করা, আহরণ করা বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ) যে সাধারণ সম্পদে অধিকার স্বীকৃত হয়, যুদ্ধলব্ধ / যুদ্ধলভ্য শত্রুসম্পদ তথা শত্রুরা যুদ্ধক্ষেত্রে যা ফেলে গেছে বা হারিয়েছে, বিনা কষ্টে অর্জিত সম্পদ, অর্জন বা লাভ’।  কুরআনে মাগানিম শব্দটি প্রথম দুটি অর্থে তথা মাগানিম শব্দটির অর্থ হলো ‘কোনো বিশেষ শর্তে (যেমন আবাদ করা, আহরণ করা বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ) যে সাধারণ সম্পদে অধিকার স্বীকৃত হয়, যুদ্ধলব্ধ / যুদ্ধলভ্য শত্রুসম্পদ তথা শত্রুরা যুদ্ধক্ষেত্রে যা ফেলে গেছে বা হারিয়েছে’ অর্থে প্রয়োগ হয়েছে বলে শব্দটি ধারণকারী আয়াতসমূহের পূর্বাপর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে (Context) প্রতীয়মান হয়। কুরআন অনুযায়ী মু’মিনরা আত্মরক্ষামূলক / প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধে বা কোনো অত্যাচারিত জনগোষ্ঠীকে উদ্ধারের জন্য ন্যায়যুদ্ধে বিজয়ী হলে পরাজিত শত্রুপক্ষের যে সম্পদ হস্তগত হয় তাতে তাদেরকে অধিকার প্রদান করা হয়েছে। তবে এ যুদ্ধলভ্য সম্পদ কোনোক্রমেই যুদ্ধের উদ্দেশ্য হতে পারবে না এবং সম্পদ হস্তগত করার জন্য কোনো নীতি বহির্ভুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না। কুরআনে যুদ্ধের ন্যায়নীতি হিসেবে বিভিন্ন ধারা প্রদান করা হয়েছে; যেমন: যারা আক্রমণকারী তাদেরকে পাল্টা আক্রমণ করা কিন্তু তারা অস্ত্র সংবরণ করলে তাদেরকে বন্দী করে পরে প্রয়োজনসাপেক্ষে বন্দী বিনিময় অথবা যুক্তিসঙ্গত সময়ে অনুকম্পারূপে মুক্ত করে দেয়া, বেসামরিকদেরকে হামলা না করা এবং আশ্রয় প্রার্থীদেরকে আশ্রয় দেয়া ও নিরাপত্তা দেয়া, যারা আক্রমণ করেছে তাদের প্রতিও সীমালংঘন না করা ইত্যাদি। যুদ্ধের এসব ন্যায়নীতিকে অনুসরণ করতে হবে। তারপর যুদ্ধলভ্য যে সম্পদ পাওয়া যাবে তাও যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা সম্পূর্ণভাবে ভোগ করবে না বরং এর পাঁচ ভাগের এক ভাগ ‘আল্লাহ ও তাঁর রসূলের জন্য’ তথা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য এবং তাদের উপর নির্ভরশীল থাকা আত্মীয়দের জন্য এবং ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের জন্য এবং অভাবগ্রস্তদের জন্য এবং ছিন্নমূল / উদ্বাস্তু / বাস্তুহারাদের জন্য ব্যয় করতে হবে। অনুরূপভাবে মাগানিম হিসেবে কোনো পতিত জমিকে আবাদ করা, বন থেকে কাঠ ও মধু সংগ্রহ করা, সমুদ্র থেকে কিছু আহরণ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ২০% এই খাতগুলোতে প্রদান করা জরুরি।

ফায় فَيْء : ফায় শব্দের অর্থ হলো ‘যুদ্ধ ছাড়াই শত্রুপক্ষ থেকে পাওয়া সম্পদ’। কখনো কখনো এমন পরিস্থিতি আসা সম্ভব যে, ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণকারীদেরকে বা বিদ্রোহীদেরকে প্রতিহত করার জন্য অগ্রাভিযান পরিচালনা করলে শেষ পর্যন্ত আক্রমণকারীরা পালিয়ে গেছে বা পিছু হটে গেছে। এমতাবস্থায় তারা যে মালসম্পদ রেখে যায় সেটাকে ফায় বলা হয়। ফায় বণ্টনের জন্য সূরা হাশরে সুনির্দিষ্ট বণ্টনবিধি প্রদান করা হয়েছে। ফায় এর সম্পদ যেসব খাতে নির্দিষ্ট করা হয়েছে তা হলো: (১) আল্লাহর জন্য ও রসূলের জন্য অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বাত্মক কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে ব্যয়-বণ্টনের জন্য সংরক্ষিত খাত (২) যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো তাদের আত্মীয়-স্বজন বা তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া আত্মীয়-স্বজন (৩) ইয়াতীম ছেলেমেয়ে (৪) মিসকীন বা অভাবগ্রস্ত (৫) ইবনে সাবীল বা ছিন্নমূল / বাস্তুহারা / উদ্বাস্তু (৬) মুহাজির (৭) আনসার (৮) পরবর্তীতে ঈমান গ্রহণকারী।

সদাক্বাত صَدَقَة‎ : সদাক্বাত শব্দটির অর্থ হলো ‘স্বীকৃত প্রাপ্য পরিশোধমূলক অনুদান প্রদান করা’। অর্থাৎ সাধারণভাবে দান শব্দটি যেরূপ কাউকে দয়া করে কিছু দেয়ার অর্থে প্রচলিত, যাতে যে ব্যক্তি দিচ্ছে সে নিজেকে বড় বলে এবং যে ব্যক্তি নিচ্ছে সে নিজেকে ছোট বলে অনুভব করার মতো মনোভাবের উদ্ভব ঘটতে পারে, কুরআনে বর্ণিত সদাক্বাত সেরূপ নয়। বরং এতে সদাক্বাত হলো আল কুরআন উপস্থাপিত জীবনব্যবস্থাকে গ্রহণ করার দাবিতে সত্যবাদী হওয়ার প্রমাণস্বরূপ আল্লাহ যাদেরকে সম্পদের প্রাপক হিসেবে বিশেষ ঘোষণা দিয়েছেন তাদেরকে তাদের অধিকার পরিপূরণের জন্য অনুদান প্রদান করা। এ অনুদান ক্ষেত্রবিশেষে উভয়পক্ষের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমেও নির্ধারিত হতে পারে। যেমন আল্লাহর বিধান অনুসারে স্ত্রীকে মোহরানা দেয়া স্বামীর উপর একটি আবশ্যকীয় দায়িত্ব। এই মোহরানাকে সদুক্বাত বলেও চিহ্নিত করা হয়েছে। আর মোহরানার পরিমাণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে (বা তাদের পরিবারের দায়িত্বশীলদের মধ্যে) পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে থাকে। আল্লাহর ঘোষণা অনুসারে মু’মিনদের কাছে পরিজ্ঞাত যে, তাদের সম্পদে বঞ্চিত ও প্রার্থীদের হক্ব রয়েছে। এমতাবস্থায় এ হক্ব পরিপূরণের জন্য তারা সদাক্বাত করে থাকে। সদাক্বাত প্রকাশ্যে করাও উত্তম আর গোপনে দরিদ্রদের কাছে পৌঁছে দেয়া আরো উত্তম। সদাক্বাত করতে না পারলে সুন্দরভাবে কথা বলতে হবে। সদাক্বাত করে তার বিনিময় চাওয়া যাবে না বা বিনিময়স্বরূপ কোনো পরিশ্রম করিয়ে কষ্ট দেয়া যাবে না আবার খোঁটাও দেয়া যাবে না। ব্যক্তিগতভাবে এরূপ সদাক্বাতের পাশাপাশি সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনায় সদাক্বাত আদায় এবং তা নির্দিষ্ট খাতসমূহে বণ্টন করাকে ফরজ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সদাক্বাতের পরিমাণ যেমন সদাক্বাতকারীদের ইচ্ছার ভিত্তিতে হতে পারে, তেমনি যদি পরামর্শভিত্তিক কোনো ন্যুনতম পরিমাণকে নির্বাহীভাবে নির্ধারণ করা হয় তবে সেটা দেয়াটা কর্তব্য বলে সাব্যস্ত হবে।

যাকাত زَكَوٰة : যাকাত শব্দটির অর্থ হলো ‘পরিশুদ্ধতা, উন্নয়ন’। প্রথম অর্থটির ভিত্তিতে দ্বিতীয় অর্থটির বিস্তৃত রূপ হলো ‘নৈতিকতাভিত্তিক উন্নয়ন’। একটি আরবি প্রবাদ আছে “আল ইলমু ইয়াযকু আলাল ইনফাক্ব” যার অর্থ হলো, “বিতরণ করলে জ্ঞান বৃদ্ধি পায়”। আবার যাকায যারউ” বাক্যটির অর্থ হলো অর্থ “চারাটি বৃদ্ধি পেলো”। ১৮:১৯ আয়াতে আছে “ফালইয়ানজুর আইয়ুহা আযকা ত্বয়ামান”, যার অর্থ হলো, “সে যেন লক্ষ করে কোন খাদ্যটি সবচেয়ে সুস্বাদু পুষ্টিকর ও বিশুদ্ধ?”। উর্বর জমিকে ‘আরদুন যাকিয়্যাহ’ বলা হয়। এসব প্রেক্ষিতে যাকাত বলতে ‘পরিশুদ্ধতা এবং অন্যকে সমৃদ্ধ করার উপযোগী গুণে সমৃদ্ধতা’কে বুঝায়। যাকাত বা পরিশুদ্ধতা অর্জনে সক্রিয়তা মু’মিনদের অন্যতম গুণ এবং যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে সেই সফল হবে। আত্মশুদ্ধি বা যাকাত অর্জনের জন্য মু’মিনরা দুঃস্থ ও অভাবগ্রস্তদেরকে দান করে। আল কুরআনে ‘যাকাত প্রদান করাকে’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ‘যাকাত প্রদান করা’র বিস্তৃত রূপ হলো সমাজের নৈতিক ও সামগ্রিক সুষম উন্নয়নের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতা-সামর্থ্য অনুসারে উদারভাবে অংশগ্রহণ করা। এর অন্যতম একটি দিক হলো যারা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে আছে তাদের প্রতি আর্থিক দায়িত্ব পালন এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক অনুদান প্রদান করা। অর্থনৈতিক যাকাত হিসেবে যারা অনুদান করে আল্লাহর অনুগ্রহে তারাই প্রকৃত ও স্থায়ী সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। তবে আল কুরআনে যাকাত বলতে শুধু অর্থনৈতিক প্রদেয় প্রদানকে বুঝায় না, বরং যাকাতের ব্যাপক তাৎপর্য হলো চিন্তা-চেতনা ও সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে পরিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা।

যিম্মাহ ذِمَّة : যিম্মাহ শব্দের অর্থ হলো ‘সুরক্ষা চুক্তি’। এ শব্দটি বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় কর্তত্বের সাথে নাগরিকদের সুরক্ষা চুক্তিকে বুঝায়। অর্থাৎ এটা স্বত:সিদ্ধ যে, রাষ্ট্র হলো এক ধরনের সুরক্ষা চুক্তির ফল, যাতে নাগরিকগণ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সাথে সুরক্ষা চুক্তিকে আবদ্ধ। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের দায়িত্ব হলো যিম্মাহ তথা সুরক্ষা চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করা তথা নাগরিকদেরকে সুরক্ষা দেয়া, তারা যে ধর্মের অনুসারী হোক না কেন। কুরআনে মুশরিকদের সমালোচনা করা হয়েছে যে, যখন তারা প্রাধান্য বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও বিজয় লাভ করে তখন তারা মু’মিনদের প্রতি যিম্মাহ বা সুরক্ষা চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করে না। সুতরাং এর বিপরীতে মু’মিনদের বৈশিষ্ট্য হবে, যখন তারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব লাভ করবে তখন তারা মু’মিন-মুশরিক নির্বিশেষে সব নাগরিকের প্রতি যিম্মাদারির দায়িত্ব পালন করবে বা সুরক্ষা চুক্তির মর্যাদা দিবে তথা সব নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। যারা যিম্মাহ বা সুরক্ষা চুক্তিতে আবদ্ধ তাদেরকে আহলে যিম্মাহ বা যিম্মী বলা হয়। অন্য কথায়, রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে যিম্মী কথাটির অর্থ হলো ‘নাগরিক’। সুতরাং কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলেই যিম্মী বলে সাব্যস্ত। বর্তমানে যিম্মী শব্দটিকে তার প্রকৃত অর্থ থেকে বিকৃত হয়ে অপপ্রয়োগ করা হয়ে থাকে। বর্তমানে যেভাবে কাউকে মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হবে মর্মে আটকে রাখলে তাকে যিম্মী বলা হয়, এটা একটা অনৈতিক কর্মকাণ্ড। এই সব অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে মোকাবেলা করে মানবতার কল্যাণের লক্ষ্যে প্রকৃত যিম্মাদারি তথা সুরক্ষা নিশ্চিতকরণমূলক দায়িত্ব পালনে মু’মিনদেরকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।