আল কুরআনের আলোকে ওয়াসিয়্যাত বইটিতে সম্পদ বণ্টনের একটি আবশ্যকীয় বিধান হিসেবে ওয়াসিয়্যাতের গুরুত্ব ও এর নিয়ম-কানুন সম্পর্কে আল কুরআনের আলোকে আলোচনা করা হয়েছে। ওয়াসিয়্যাত সম্পর্কে প্রচলিত দুটি ধারণা হলো: ওয়াসিয়্যাত বা উইল (Will) করা ব্যক্তির ঐচ্ছিক বিষয়, এটি বাধ্যতামূলক নয় এবং কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার যেসব ওয়ারিসের জন্য কুরআনে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি রয়েছে তথা পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, স্বামী/স্ত্রী ও ভাই-বোন, তাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা হারাম। অথচ প্রচলিত এ দুটি ধারণাই সম্পূর্ণরূপে কুরআন-বিরুদ্ধ ধারণা। মহান আল্লাহ আল কুরআনে ওয়াসিয়্যাতকে একটি বাধ্যতামূলক বিধান হিসেবে বিধিবদ্ধ করেছেন এবং তিনি যাদের জন্য মৃত্যু পরবর্তীতে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টনবিধি উল্লেখ করেছেন, তাদেরকেই ‘আক্বরাবূন’ বা ‘সবচেয়ে নিকটবর্তী আত্মীয়’ হিসেবে উল্লেখ করে তাদের জন্যই ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক হিসেবে বিধিবদ্ধ করেছেন। বইটিতে এ বিষয়টি আল কুরআন থেকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
আল কুরআনে থাকা ওয়াসিয়্যাতের আবশ্যকীয় বা অবশ্যই করণীয় বিধানের আয়াতটি থেকে যে কেউ ওয়াসিয়্যাত বাধ্যতামূলক হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে জানতে পারে। কিন্তু ওয়াসিয়্যাতকে ঐচ্ছিক সাব্যস্ত করার জন্য দাবি করা হয় যে, আল কুরআনের ওয়াসিয়্যাত সম্পর্কিত আয়াতটি উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির আয়াত (সূরা নিসার ১১-১২ আয়াত) নাযিলের পর মানছুখ বা রহিত হয়ে গেছে। অথচ কুরআনের কোনো আয়াতে ওয়াসিয়্যাত বিধিবদ্ধ করার আয়াতটিকে (সূরা বাক্বারাহর ১৮০ আয়াত) রহিত হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া সূরা নিসার ১১-১২ আয়াতে চার (৪) বার উল্লেখ করা হয়েছে যে, উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী সম্পদ বণ্টিত হবে মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ ও ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ করার পরে। বইটিতে এ বিষয়ে ওয়াসিয়্যাত ও উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির তুলনামূলক অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
ওয়াসিয়্যাতের বিধান সম্পর্কিত আয়াতসমূহে থাকা ওয়াসিয়্যাত সম্পর্কিত বিভিন্ন নিয়ম-কানুন নিয়ে বইটিতে যথাসম্ভব আলোকপাত করা হয়েছে। ওয়াসিয়্যাতের বাধ্যতামূলক বিধানকে ঐচ্ছিক সাব্যস্ত করায় মানবজাতি বিধানটির কল্যাণ থেকে ভীষণভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। আশা করা যায় যে, সম্পদ বণ্টনের এ সুষ্ঠু পদ্ধতিমূলক বিধানটি সমাজে পুনরায় চালু করার ক্ষেত্রে বইটি কুরআন মানতে আগ্রহী প্রত্যেকের জন্য একটি ‘কুরআনভিত্তিক আলোচনা ও নির্দেশনার সংকলন’ হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া সম্পদ বণ্টন সম্পর্কিত আইন-কানুন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ওয়াসিয়্যাতের বিধানটিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে বইটি আইন-প্রণেতা এবং আইন বিষয়ক শিক্ষা ও বাস্তবায়নের সাথে সম্পর্কিত সকলের জন্যও একটি সহায়ক উপকরণ হতে পারে।
কুরআনের আলোকে পর্যালোচনার মাধ্যমে বইটিতে কোনো ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি চিহ্নিত হলে তা পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করা হবে, ইনশাআল্লাহ।
১. কারো মৃত্যু আসন্ন হলে বা বার্ধক্যের পরিণত অবস্থায় তার উপর পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা বাধ্যতামূলক (ফরযিয়াত)।
২. ওয়াসিয়্যাতের ব্যাপারে কুরআনে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার পরিস্থিতি ও ন্যায়সঙ্গত বিবেচনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো ন্যুনতম পরিমাণ বা কাকে কতটুকু দিতে হবে তার সীমাবদ্ধতা বা সুনির্দিষ্টকরণ নেই।
৩. মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন করা সঙ্গত নয়। তবে যদি ওয়াসিয়্যাতকারীর পক্ষ থেকে কোনো পক্ষপাতিত্ব বা কাউকে অন্যায্যভাবে বঞ্চিত করার আশংকা হয়, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে দেয়াতে কোনো দোষ নেই।
৪. ওয়াসিয়্যাত কার্যকর করার ক্ষেত্রে মূল দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের মাধ্যমে যাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়েছে তাদের মধ্যকার বা তাদের সপক্ষে আপত্তিকারীদের মধ্য থেকে অগ্রাধিকারের যোগ্য দুইজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিলে ঐ ওয়াসিয়্যাত রহিত হয়ে যাবে তথা কার্যকর হবে না, বরং সম্পূর্ণ সম্পত্তি উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুসারে হিসেবে বণ্টিত হবে।
৫. বিধবা নারীদের জন্য আল্লাহ স্বয়ং একটি ওয়াসিয়্যাত করেছেন যে, তাদেরকে এক বছর ভরণপোষণ দিতে হবে এবং ঘর থেকে বের করে দেয়া যাবে না।
৬. মৃত্যু পরবর্তী সম্পদের উত্তরাধিকার (তুরাস) বণ্টন হবে ওয়াসিয়্যাত (যদি থাকে) ও ঋণ (যদি থাকে) পরিশোধের পর।
ওয়াসিয়্যাতের বিধান আল কুরআনে উল্লেখিত একটি বাধ্যতামূলক বিধান। কুরআনে ওয়াসিয়্যাতের বিধান সম্পর্কিত আয়াতসমূহ হচ্ছে ২:১৮০-১৮২, ৫:১০৬-১০৮, ২:২৪০, ৪:১১-১২।
৪:১১-১২ আয়াতে চারবার বলা হয়েছে যে, উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি কার্যকর হবে ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের পরে। আর এ প্রসঙ্গে ৪:১৩-১৪ আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর দেয়া সীমাসমূহ তথা উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধির কোনো ধারা বা শর্ত লংঘন করলে জাহান্নামে যেতে হবে এবং চিরকাল থাকতে হবে।
মৃত ব্যক্তির সম্পদ বন্টনের ব্যবস্থা হিসাবে ওয়াসিয়্যাতের বিধানই প্রাথমিক গুরুত্বসম্পন্ন (সূরা বাকারা ২:১৮০-১৮২)। ওয়াসিয়্যাতের মাধ্যমেই প্রত্যেক ব্যক্তির বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে তার জন্য যথাযথ অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে সে তার নিকটতম আত্মীয়দের বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে নির্ধারণ করতে পারবে যে, কার জন্য কতটুকু ওয়াসিয়্যাত করে যাওয়া উচিত। যেমন: এর মাধ্যমে কোনো সন্তান কম বয়সী বা অপ্রতিষ্ঠিত থাকলে তাকে অধিক সম্পদ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু যদি কেউ ওয়াসিয়্যাত না করে থাকে বা যদি তার ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের পর কোনো সম্পদ থাকে তাহলে ঐ অবশিষ্ট সম্পদের ক্ষেত্রেই উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি প্রযোজ্য (সূরা নিসা ৪: ১১-১২)। উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিতে দুটি পুত্র তাদের বয়স, সম্পদ ইত্যাদির পার্থক্য সত্ত্বেও পরস্পরের সমান অংশ পাবে। কিন্তু পুত্র, কন্যা, স্বামী/স্ত্রী, পিতা, মাতা, ভাই, বোন এক শ্রেণি অন্য শ্রেণি থেকে ভিন্ন ভিন্ন নির্ধারিত অনুপাতে পাবে, সকল শ্রেণি সমানুপাতে পাবে না। উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিতে আল্লাহ যার জন্য যে আনুপাতিক ভগ্নাংশ নির্ধারণ করেছেন সেটাই তার প্রাপ্য অধিকার।
ওয়াসিয়্যাত ও উত্তরাধিকারের বিধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক ভারসাম্যের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। একজন ব্যক্তি তার জীবিতকালে তার উপার্জিত বা প্রাপ্ত সম্পদের আমানতদার মালিক এবং তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যে, সে তার মৃত্যুর পূর্বে তার সম্পদের বিষয়ে ওয়াসিয়্যাত করে যাবে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার পরিত্যক্ত সম্পদ মহাবিশ্বের যাবতীয় সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত (তথা উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি) অনুযায়ী (মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ, মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণ ও উত্তরাধিকারের বিধান পালনার্থে) বন্টিত হবে। এই প্রেক্ষিতে ৪:১২ আয়াতে ’উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি’কে আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে একটা শর্তসাপেক্ষ দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন: উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুসারে, এক পুত্র পাবে দুই কন্যার সমানুপাতিক। এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে এ নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল বিধান হচ্ছে, যদি পিতা-মাতা সন্তানের উপর নির্ভরশীল হয় সে অবস্থায় তাঁদের সেবা ও সহযোগিতা করতে সক্ষম হলে একটি পুত্রকে দুইটি কন্যার সমানুপাতে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে অধিকার ও দায়িত্বের এই অনুপাতের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো, দুটি পুত্র তাদের বয়স ও সামর্থ্যের পার্থক্য সত্ত্বেও পরস্পর সমানুপাতে উত্তরাধিকার লাভ করে, যেখানে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অবশ্যই ঐ পার্থক্য একটি বাস্তব অনুঘটকে (Factor) পরিণত হবে। উত্তরাধিকারের প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে মোটাদাগে প্রাপকের শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে (পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রী, ভাই, বোন), কিন্তু একই শ্রেণির সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন অবস্থার তারতম্য (যেমন, বয়স ও সামর্থ্য) অনুসারে পার্থক্য করা হয়নি। কারণ এক্ষেত্রে এরূপ তারতম্যের কোনো সুনির্দিষ্টতা নেই বরং তা পরিস্থিতি সাপেক্ষ বিষয় বিধায় তা স্থায়ী বিধানে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে অনুপযোগী। এরূপ বাস্তবসম্মত তারতম্য বিবেচনায় সম্পদের বণ্টন নিশ্চিত করার ব্যবস্থাপনা হিসেবে উত্তরাধিকারের বিধানে প্রথমে ওয়াসিয়্যাতের বিধান পরিপূরণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
ওয়াসিয়্যাতের বিধান আল কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত একটি বাধ্যতামূলক বিধান হওয়া সত্ত্বেও সমাজে এটিকে ঐচ্ছিক বিবেচনা করা হয় বিধায় এবং উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধিতে যে নিকটতম আত্মীয়দেরকে অংশ প্রদান করা হয়েছে তাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা যাবে না বলে প্রচারিত থাকায় মানব সমাজ আল্লাহর বিধানের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই বইটি রচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে ওয়াসিয়্যাতের বিধান পরিপালনের আবশ্যকতা আলোচনার মাধ্যমে সমাজ কল্যাণের সর্বোত্তম ব্যবস্থা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। সেই সাথে কুরআনে প্রদত্ত ওয়াসিয়্যাতের বাধ্যতামূলক বিধান লংঘন করলে জাহান্নামে যেতে হবে বিধায় তা থেকে সতর্ক থাকা ও সতর্ক করা।
সূরা বাক্বারাহ ২:১৮০-১৮২
كُتِبَ عَلَيْكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ إِن تَرَكَ خَيْرًا الْوَصِيَّةُ لِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ بِالْمَعْرُوفِ حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِينَ
২:১৮০ :: তোমাদের উপর বিধিবদ্ধ করা হলো যে, তোমাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু সন্নিকটে এসে গেলে যদি সে সম্পদ রেখে যায় তবে সে তার পিতা-মাতার জন্য এবং অন্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ন্যায়সঙ্গত ওয়াসিয়্যাত করতে হবে। এটা আল্লাহ সচেতনদের উপর দায়িত্ব।
فَمَن بَدَّلَهُ بَعْدَ مَا سَمِعَهُ فَإِنَّمَا إِثْمُهُ عَلَى الَّذِينَ يُبَدِّلُونَهُ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
২:১৮১ :: তারপর যে ব্যক্তি তা শুনার পর সেটাকে (তথা ওয়াসিয়্যাতকে) বদলে দেয়, তবে সেটার (তথা বদল করার) অপরাধ বদলকারীদের উপর বর্তাবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
فَمَنْ خَافَ مِن مُّوصٍ جَنَفًا أَوْ إِثْمًا فَأَصْلَحَ بَيْنَهُمْ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
২:১৮২ :: তবে যে ব্যক্তি ওয়াসিয়্যাতকারী কর্তৃক পক্ষপাতিত্ব হয়েছে বা/এবং (বঞ্চিত করার) অপরাধ হয়েছে বলে আশংকা করে, তারপর সে তাদের মধ্যে(১) বিষয়টি সংশোধন করে দেয় তাহলে এতে তার অপরাধ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াশীল।
(১) অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ে ওয়াসিয়্যাতকারী ও ওয়াসিয়্যাতকৃতদের মধ্যে। যদি ওয়াসিয়্যাতকারীর মৃত্যু ঘটে তবে ওয়াসিয়্যাতকৃত বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে।
সূরা মায়িদাহ ৫:১০৬-১০৮
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا شَهَادَةُ بَيْنِكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ حِينَ الْوَصِيَّةِ اثْنَانِ ذَوَا عَدْلٍ مِّنكُمْ أَوْ آخَرَانِ مِنْ غَيْرِكُمْ إِنْ أَنتُمْ ضَرَبْتُمْ فِي الْأَرْضِ فَأَصَابَتْكُم مُّصِيبَةُ الْمَوْتِ تَحْبِسُونَهُمَا مِن بَعْدِ الصَّلَاةِ فَيُقْسِمَانِ بِاللَّهِ إِنِ ارْتَبْتُمْ لَا نَشْتَرِي بِهِ ثَمَنًا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَىٰ وَلَا نَكْتُمُ شَهَادَةَ اللَّهِ إِنَّا إِذًا لَّمِنَ الْآثِمِينَ
৫:১০৬ :: হে মু’মিনগণ, যখন তোমাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু সন্নিকটে এসে যায় তখন তোমরা ওয়াসিয়্যাত করার সময় তোমাদের মধ্য থেকে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখো। অথবা যদি তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং এ অবস্থায় তোমাদের কাছে মৃত্যুর মুসিবত এসে পড়ে তাহলে (তোমাদের নিজেদের মধ্যকার লোক না পেলে) তোমাদের বাইরের (তথা অন্য অঞ্চলের) দুইজনকে সাক্ষী রাখো। তাদের দুইজনকে সালাতের পরে অপেক্ষমান রাখবে। যদি তোমরা সন্দেহ করো তবে তারা উভয়ে আল্লাহর নামে কসম করবে: “আমরা কোনো মূল্যেই তা (তথা সাক্ষ্য) বিক্রয় করবো না, যদিও আত্মীয় হয় আর আমরা আল্লাহর নির্দেশিত সাক্ষ্যকে গোপন করবো না। নিশ্চয় তাহলে আমরা অপরাধীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।”
فَإِنْ عُثِرَ عَلَىٰ أَنَّهُمَا اسْتَحَقَّا إِثْمًا فَآخَرَانِ يَقُومَانِ مَقَامَهُمَا مِنَ الَّذِينَ اسْتَحَقَّ عَلَيْهِمُ الْأَوْلَيَانِ فَيُقْسِمَانِ بِاللَّهِ لَشَهَادَتُنَا أَحَقُّ مِن شَهَادَتِهِمَا وَمَا اعْتَدَيْنَا إِنَّا إِذًا لَّمِنَ الظَّالِمِينَ
৫:১০৭ :: তারপর যদি লক্ষণ পাওয়া যায় যে, তারা দুজন অপরাধমূলক দাবি করেছে (তথা সাক্ষ্যে হেরফের করেছে), তাহলে তাদের দুজনের দাবিগত অবস্থানের বিপরীতে অন্য দুজন দাঁড়াবে, যারা হবে তাদের (সাক্ষ্যের) বিপক্ষে অধিকার(২) দাবিকারীদের মধ্য থেকে এবং ঘনিষ্ঠতর/অগ্রাধিকারী(৩)। তারপর তারা আল্লাহর নামে কসম করবে: “আমাদের সাক্ষ্য তাদের দুইজনের সাক্ষ্যের চেয়ে অধিক যথাযথ। আর আমরা সীমালংঘন করিনি। নিশ্চয় তাহলে আমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।”
(২) তথা পরিত্যক্ত সম্পদের অধিকার বা সাক্ষ্যের অধিকার।
(৩) তথা মৃত ব্যক্তির আত্মীয়তায় ও উত্তরাধিকারের প্রশ্নে অগ্রাধিকারী [বা সাক্ষ্যদানের অধিক উপযুক্ত]।
ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَن يَأْتُوا بِالشَّهَادَةِ عَلَىٰ وَجْهِهَا أَوْ يَخَافُوا أَن تُرَدَّ أَيْمَانٌ بَعْدَ أَيْمَانِهِمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاسْمَعُوا وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
৫:১০৮ :: এ পদ্ধতিই (এ সম্ভাবনার) নিকটতম যে, তারা সঠিক রূপেই সাক্ষ্য দিবে অথবা তারা ভয় করবে যে, তাদের শপথের পরে(৪) তাদের শপথকে(৫) রদ করা হবে। আর তোমরা আল্লাহ সচেতন হও এবং (যথানিয়মে) শুনো। আর নিশ্চয় আল্লাহ নীতি বিচ্যুত সম্প্রদায়কে পথনির্দেশ করেন না।
(৪) তথা পরবর্তী দুইজন সাক্ষীর শপথের পরে।
(৫) তথা পূর্ববর্তী মূল দুইজন সাক্ষীর শপথকে।
সূরা বাক্বারাহ ২:২৪০
وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا وَصِيَّةً لِّأَزْوَاجِهِم مَّتَاعًا إِلَى الْحَوْلِ غَيْرَ إِخْرَاجٍ فَإِنْ خَرَجْنَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِي مَا فَعَلْنَ فِي أَنفُسِهِنَّ مِن مَّعْرُوفٍ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
২:২৪০ :: তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদের স্ত্রীদেরকে রেখে মৃত্যুবরণ করে তাদের স্ত্রীদের বিষয়ে (মৃত স্বামীর পরিবার পরিজন বা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি) ওয়াসিয়্যাত হচ্ছে, এক বছর পর্যন্ত তাদের স্ত্রীদেরকে ভরণ পোষণ দিতে হবে এবং ঘর থেকে বের করে দেয়া যাবে না। তবে যদি তারা নিজেরাই বেরিয়ে যায় তাহলে সেক্ষেত্রে তারা ন্যায়সঙ্গতভাবে নিজেদের ক্ষেত্রে যা করে সে বিষয়ে তোমাদের দোষ নেই। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।
সূরা নিসা ৪:১১-১৪
يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنثَيَيْنِ فَإِن كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِن كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِن كَانَ لَهُ وَلَدٌ فَإِن لَّمْ يَكُن لَّهُ وَلَدٌ وَوَرِثَهُ أَبَوَاهُ فَلِأُمِّهِ الثُّلُثُ فَإِن كَانَ لَهُ إِخْوَةٌ فَلِأُمِّهِ السُّدُسُ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِي بِهَا أَوْ دَيْنٍ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ لَا تَدْرُونَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعًا فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا
৪:১১ :: আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের মধ্যকার (উত্তরাধিকার বণ্টন) বিষয়ে ওয়াসিয়্যাত করছেন: এক পুরুষের জন্য দুই নারীর অংশের অনুরূপ। তারপর (পরবর্তী ধারা হলো), যদি তারা (তথা সন্তানরা) হয় নারীরাই, অন্যুন দুই (তথা দুইয়ের বেশি বা অন্তত দুইজন), তাহলে তাদের জন্য যা সে (তথা মৃত ব্যক্তি) ছেড়ে গিয়েছে তার তিন ভাগের দুই ভাগ (২/৩)। আর যদি সে (তথা সন্তান) হয় একজনই (নারী), তাহলে তার জন্য দুই ভাগের এক ভাগ (১/২)।
আর তার (তথা মৃত ব্যক্তির) পিতা-মাতা দুইজনের মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্য (/তাদের দুইজনের মধ্য থেকে যেই থাকুক তার জন্য) যা সে ছেড়ে গিয়েছে তা থেকে ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬), যদি তার কোনো সন্তান থাকে। তবে যদি তার কোনো সন্তান না থাকে আর তার পিতা-মাতা তার উত্তরাধিকারী হয়, তাহলে তার মাতার জন্য তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩)। তবে যদি তার ভাই-বোন থাকে, তাহলে তার মাতার জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬)।
(এভাবে উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) তার কৃত ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ বা/এবং ঋণ পরিশোধের পরে।
তোমরা জানো না তোমাদের পিতাগণ ও পুত্রগণের মধ্যে কে তোমাদের জন্য উপকার সাধনে অধিক নিকটবর্তী হবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আবশ্যিক বিধান। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।
وَلَكُمْ نِصْفُ مَا تَرَكَ أَزْوَاجُكُمْ إِن لَّمْ يَكُن لَّهُنَّ وَلَدٌ فَإِن كَانَ لَهُنَّ وَلَدٌ فَلَكُمُ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْنَ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِينَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ وَلَهُنَّ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْتُمْ إِن لَّمْ يَكُن لَّكُمْ وَلَدٌ فَإِن كَانَ لَكُمْ وَلَدٌ فَلَهُنَّ الثُّمُنُ مِمَّا تَرَكْتُم مِّن بَعْدِ وَصِيَّةٍ تُوصُونَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ وَإِن كَانَ رَجُلٌ يُورَثُ كَلَالَةً أَوِ امْرَأَةٌ وَلَهُ أَخٌ أَوْ أُخْتٌ فَلِكُلِّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا السُّدُسُ فَإِن كَانُوا أَكْثَرَ مِن ذَٰلِكَ فَهُمْ شُرَكَاءُ فِي الثُّلُثِ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصَىٰ بِهَا أَوْ دَيْنٍ غَيْرَ مُضَارٍّ وَصِيَّةً مِّنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَلِيمٌ
৪:১২ :: আর তোমাদের জন্য যা তোমাদের স্ত্রীগণ রেখে গিয়েছে তার দুই ভাগের এক ভাগ (১/২), যদি তাদের কোনো সন্তান না থাকে। তবে যদি তাদের কোনো সন্তান থাকে, তাহলে তোমাদের জন্য যা তারা ছেড়ে গিয়েছে তা থেকে চার ভাগের এক ভাগ (১/৪)। (এভাবে উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) তাদের কৃত ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ বা/এবং ঋণ পরিশোধের পরে।
আর তাদের জন্য (তথা তোমাদের স্ত্রীদের জন্য) যা তোমরা ছেড়ে গিয়েছো তা থেকে চার ভাগের এক ভাগ (১/৪), যদি তোমাদের কোনো সন্তান না থাকে। তবে যদি তোমাদের কোনো সন্তান থাকে, তাহলে তাদের জন্য যা তোমরা ছেড়ে গিয়েছো তা থেকে আট ভাগের এক ভাগ (১/৮)। (এভাবে উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) তোমাদের কৃত ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ বা/এবং ঋণ পরিশোধের পরে।
আর যদি কোনো পুরুষ বা নারী এরূপ হয় যে, তাকে পূর্বসূরী করা হয় (তথা তার উত্তরসূরী থাকে), (এবং) সে (তথা ঐ মৃত ব্যক্তি- পুরুষ বা নারী) কালালাহ হয়(৬) এবং তার একজন ভাই বা/এবং একজন বোন থাকে, তাহলে তাদের দুইজনের মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্য (/তাদের দুইজনের মধ্যে যেই থাকুক তার জন্য) ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬)। তবে যদি তারা (তথা ভাই/বোন) এর চেয়ে বেশি হয় (তথা একাধিক হয়), তাহলে তারা তিনভাগের এক ভাগে (১/৩) অংশীদার হবে। (এভাবে উত্তরাধিকার বণ্টন করতে হবে) কৃত ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ বা/এবং ঋণ পরিশোধের পরে।
(৬) তথা তার সাথে তার ভাইবোনের উত্তরাধিকার প্রাপ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়।
অক্ষতিকর উপায়ে(৭)। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ওয়াসিয়্যাত (তথা বিশেষ নির্দেশ)। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সহনশীল।
(৭) তথা যেন কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এমনভাবে বণ্টন করতে হবে।
تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
৪:১৩ :: এগুলো আল্লাহপ্রদত্ত সীমাসমূহ। আর যে আল্লাহর এবং তাঁর রসূলের আনুগত্য করে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার নিচ অংশে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। তারা তাতে স্থায়ী হবে। এটাই মহাসফলতা।
وَمَن يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُّهِينٌ
৪:১৪ :: আর যে আল্লাহকে ও তাঁর রসূলকে অমান্য করে এবং তাঁর প্রদত্ত সীমাসমূহ লংঘন করে, তিনি তাকে আগুনে (তথা জাহান্নামে) প্রবেশ করাবেন। সে তাতে স্থায়ী হবে। আর তার জন্য অপমানকর শাস্তি রয়েছে।
ওয়াসিয়্যাত শব্দের শব্দমূল হচ্ছে ‘ওয়াও সদ ইয়া’। ওয়াসিয়্যাত শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বিশেষ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশ, স্বীয় মৃত্যু পরবর্তীতে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে অগ্রিম নির্দেশনা’। ওয়াসিয়্যাত শব্দটি বিভিন্ন শব্দরূপে কুরআনে যেসব স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো। আয়াত রেফারেন্সের প্রথম সংখ্যাটি সূরা নম্বর, দ্বিতীয় সংখ্যাটি আয়াত নম্বর এবং তৃতীয় সংখ্যাটি আয়াতের মধ্যে শব্দের ক্রমিক সংখ্যা নিদের্শক।
(১) ওয়াসিয়্যাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৮ স্থানে: ২:১৮০:১০, ২:২৪০:৬, ৪:১১:৫১, ৪:১২:২১, ৪:১২:৪৫, ৪:১২:৭৬, ৪:১২:৮৩, ৫:১০৬:১১।
(২) ওয়াসসা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ২, অর্থ: পরিস্থিতি নির্বিশেষে মৌলিক নির্দেশ দেয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ১১ স্থানে: ২:১৩২:১, ৪:১৩১:৯, ৬:১৪৪:২১, ৬:১৫১:৩৯, ৬:১৫২:৩২, ৬:১৫৩:১৪, ২৯:৮:১, ৩১:১৪:১, ৪২:১৩:৬, ৪২:১৩:১৩, ৪৬:১৫:১।
(৩) তাওসিয়াহ (ক্রিয়াবিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ২, অর্থ: পরিস্থিতি নির্বিশেষে মৌলিক নির্দেশ) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ৩৬:৫০:৩।
(৪) আওসা (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৪, অর্থ: বিশেষ বিষয়ে বা বিশেষ পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কিত আগাম নির্দেশ দেয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ৬ স্থানে: ৪:১১:১, ৪:১১:৫২, ৪:১২:২২, ৪:১২:৪৬, ৪:১২:৭৭, ১৯:৩১:৬।
(৫) মূসিন (কর্তৃবিশেষ্য, ক্রিয়ারূপ ৪, অর্থ: বিশেষ পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কিত আগাম নির্দেশকারী, স্বীয় মৃত্যু পরবর্তীতে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে অগ্রিম নির্দেশনাকারী, ওয়াসিয়্যাতকারী) ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে: ২:১৮২:৪।
(৬) তাওয়াসাও (ক্রিয়া, ক্রিয়ারূপ ৬, অর্থ: পরস্পরকে উপদেশ দেয়া) ব্যবহৃত হয়েছে ৫ স্থানে: ৫১:৫৩:১, ৯০:১৭:৬, ৯০:১৭:৮, ১০৩:৩:৬, ১০৩:৩:৮।
কুরআনে ওয়াসিয়্যাতের বিধান সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে এ বিষয়ে যা বুঝা যায় তার বিভিন্ন দিক নিম্নে আলোচনা করা হলো।
সূরা বাকারা ২:১৮০-১৮২ আয়াতে ওয়াসিয়্যাতকে বাধ্যতামূলক হিসেবে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে এবং সূরা মায়িদাহ ৫:১০৬-১০৮ আয়াতে ওয়াসিয়্যাতের সাক্ষ্য সম্পর্কিত বিধান বর্ণিত হয়েছে। ওয়াসিয়্যাতকে বাধ্যতামূলক করার কারণ অনুধাবন করা প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের জন্য অত্যন্ত সহজ একটি বিষয়। যাঁর সম্পদ তিনি যদি ন্যায়সঙ্গতভাবে তথা বাস্তব অবস্থার ন্যায়সঙ্গত বিবেচনার ভিত্তিতে তাঁর পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ওয়াসিয়্যাত করে যান তবে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস পাবে, সম্পদের সুষম বণ্টন হবে এবং প্রত্যেকে যথাযথভাবে প্রয়োজনীয় সম্পদের উপযোগিতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পাবে। এক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত বিবেচনা ওয়াসিয়্যাতকারীর বিবেকের উপর নির্ভরশীল এবং বাস্তব অবস্থার পরিপেক্ষিতে নিজ বিবেকের অনুসরণই তার করণীয়। ওয়াসিয়্যাতের ব্যবস্থা না থাকার অপকারিতা তথা ওয়াসিয়্যাতের উপকারিতা একটি অত্যন্ত স্বত:সিদ্ধ স্পষ্ট বিষয়।
সূরা বাকারায় ওয়াসিয়্যাতকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং সূরা নিসায় উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একটি দাবি করা হয় যে, প্রথমে ওয়াসিয়্যাতের বিধানকে ফরজ করা হয়েছিলো এবং পরে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধিকে ফরজ করা হয়েছে এবং এভাবে পরেরটি প্রথমটিকে রহিত করে দিয়েছে। অর্থাৎ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি নাজিলের পর ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হয়ে গেছে। অথচ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির আয়াত ৪:১১ ও ৪:১২তে একবার, দুইবার নয়; বরং পরপর চারবার বলা হয়েছে যে, উত্তরাধিকারের বণ্টন হবে ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ এবং ঋণ পরিশোধের পরে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ওয়াসিয়াতের বিধান এবং উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি পরস্পর সাংঘর্ষিক নয় এবং একটি অন্যটিকে রহিত করে না এবং ওয়াসিয়্যাতের পরে থাকা অবশিষ্ট সম্পদেই উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি ফরজ হিসেবে কার্যকর হবে। সুতরাং ওয়াসিয়্যাতের বিধানকে রহিত বলা একটি বিভ্রান্তি ছাড়া কিছু নয়। বরং আল কুরআন স্ববিরোধমুক্ত, এর কোনো আয়াত কখনো মানছুখ (রহিত) হয়নি।
যদি কারো আকস্মিক মৃত্যু হয় এবং এজন্য ওয়াসিয়্যাত করা সম্ভব না হয় অথবা যদি কেউ ওয়াসিয়্যাত করা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করে, সেক্ষেত্রে ওয়াসিয়্যাত না থাকার কারণে সম্পূর্ণ সম্পদ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টিত হবে।
ওয়াসিয়্যাত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং শর্ত দেয়া হয়েছে ওয়াসিয়্যাত করতে হবে ন্যায়সঙ্গতভাবে (বিল মা’রূফ)। আর ওয়াসিয়্যাতকারী যেভাবে ওয়াসিয়্যাত করেছে তাতে কোনো পরিবর্তন করা অপরাধ এবং যারা তা করবে তারা এ অপরাধে অপরাধী হবে। ওয়াসিয়্যাত করার ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি বজায় রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে এ স্বীকৃতি নিহিত রয়েছে যে, মানুষ ইচ্ছা করলে তার পক্ষে ন্যায়নীতি বজায় রেখে ওয়াসিয়্যাত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ওয়াসিয়্যাতকারীকে তার পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়দের মধ্যে প্রত্যেকের বাস্তব অবস্থা বিবেচনা সাপেক্ষে কার জন্য কতটুকু ওয়াসিয়্যাত করা ন্যায়সঙ্গত হবে তা নির্ধারণের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। সুতরাং ওয়াসিয়্যাতকারীকে সাবধান থাকতে হবে, যেন সে ন্যায়নীতির লঙ্ঘন না করে। পিতা-মাতা ও নিকটতম আত্মীয়দের বাস্তব অবস্থার তারতম্য বিবেচনায় যাকে যেভাবে দেয়া কল্যাণকর ও সঙ্গত হয় সেদিকে লক্ষ্য না রেখে কারো প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে তাকে বেশি দিলে বা কারো প্রতি মনোমালিন্যের কারণে তাকে বঞ্চিত করলে তা ন্যায়সঙ্গত ওয়াসিয়্যাত হবে না।
যদি কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ আশংকা করে যে, ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে ওয়াসিয়্যাতকারীর পক্ষ থেকে কোনো পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে বা কাউকে তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার অপরাধ হয়েছে, তাহলে সে প্রথম পর্যায়ে ওয়াসিয়্যাতকারীর এবং ওয়াসিয়্যাতকৃতদের মধ্যে এবং (ইতোমধ্যে ওয়াসিয়্যাতকারীর মৃত্যু হলে) দ্বিতীয় পর্যায়ে ওয়াসিয়্যাতকৃত বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বিষয়টি উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে একটা সমঝোতায় পৌঁছালে এতে ঐ মীমাংসাকারীর উপর কোনো পাপ বা অপরাধ বর্তাবে না।
ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে কার জন্য কী ওয়াসিয়্যাত করবে বা কাকে কতটুকু দিতে হবে তা নির্দিষ্ট নয় বরং তা ওয়াসিয়্যাতকারীর স্বীয় ন্যায়সঙ্গত বিবেচনার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে কাকে কতটুকু দিলে তার প্রতি পক্ষপাতিত্ব হয় বা কাকে কতটুকু দিলে তার ন্যায্য পাওনা থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয় সেটা গাণিতিকভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়ার মতো কোনো বিষয় নয় বরং এটা একটা পরিস্থিতি-সাপেক্ষ বিষয় এবং মানুষ তার বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে।
ওয়াসিয়্যাতকারীর নিকটতম আত্মীয়দের পক্ষ থেকে ওয়াসিয়্যাকারীর ওয়াসিয়্যাতে পক্ষপাতিত্বের বা কাউকে ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে ওয়াসিয়্যাত শ্রবণকারী বা যে কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বিষয়টির সংশোধনের জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে পারেন। কুরআনে এই অনুমতি এবং নির্দেশনা স্পষ্ট।
ওয়াসিয়্যাতকারীর ওয়াসিয়্যাতে ন্যায়নীতির লঙ্ঘন হয়েছে বলে আশংকা করলে আশংকাকারী ব্যক্তি তা সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে দেয়াতে দোষ নেই। এটি থেকে স্পষ্ট যে, কেউ দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বা নিজের কাছে বাস্তব পরিস্থিতিগত পরিবর্তন বা কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে ওয়াসিয়্যাতের সংশোধন প্রয়োজন বলে অনুভূত হলে ওয়াসিয়্যাতকারীর জীবদ্দশায় তার দ্বারাই নিজ ওয়াসিয়্যাতের সংশোধন করা যেতে পারে।
২:১৮০-১৮২ আয়াতে যাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তারা হলো ‘পিতা-মাতা এবং অন্য নিকটতম আত্মীয়স্বজন’। এ বিষয়ে ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে ‘লিল ওয়ালিদায়নি ওয়াল আক্বরাবীনা’। ওয়ালিদায়ন শব্দের অর্থ হচ্ছে পিতা-মাতা। আর আক্বরাবূন শব্দটি এসেছে ‘ক্বারীব’ শব্দ থেকে। ক্বারীব শব্দের অর্থ ‘নিকটবর্তী’। আক্বরাবূন শব্দের অর্থ ‘সবচেয়ে নিকটবর্তী’। ‘আক্বরাবূন’ শব্দটি কুরআনের ৭ স্থানে ‘সবচেয়ে নিকটবর্তী আত্মীয়’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে: ২:১৮০:১২, ২:২১৫:১০, ৪:৭:৬, ৪:৭:১২, ৪:৩৩:৭, ৪:১৩৫:১৪, ২৬:২১৪:৩।
সূরা নিসা ৪:১১-১২ ও ৪:১৭৬ আয়াতে যাদের জন্য উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি দেয়া হয়েছে ৪:৭ আয়াতে তাদেরকেই পরস্পরের আক্বরাবূন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ‘সবচেয়ে নিকটবর্তী আত্মীয়’ অর্থে ‘আক্বরাবীন’ হচ্ছে পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রী, ভাই, বোন।
পুত্র-কন্যা এর মতো পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রীও পুত্র-কন্যা তুল্য হিসেবে এবং পিতা-মাতার মতো দাদা-দাদী, নানা-নানীও পিতা-মাতা তুল্য হিসেবে আক্বরাবূন এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন ১২:৬ আয়াতে নবী ইয়াকুবের উক্তিতে নবী ইবরাহীম ও ইসহাককে নবী ইউসুফের দুইজন পিতৃপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে ‘আবাওয়ায়কা’ তথা ‘তোমার দুই পিতৃপুরুষ’। অন্য কথায় নবী ইউসুফের দাদা (ইসহাক) ও দাদার পিতাকে (ইবরাহীম) তাঁর দুইজন পিতৃপুরুষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ৪:২২-২৩ আয়াতে বিবাহ সম্পর্কিত বিধি-নিষেধ উল্লেখ করার ক্ষেত্রে ‘আবাউ’ শব্দের মধ্যে পিতা, দাদা, নানা প্রমুখ এবং ‘উম্মাহাত’ শব্দের মধ্যে মাতা, দাদী, নানী প্রমুখ এবং ‘বানাত’ শব্দের মধ্যে কন্যা, পৌত্রী, দৌহিত্রী প্রমুখ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সুতরাং ‘আক্বরাবূন’ হচ্ছেন পিতা, মাতা, দাদা, দাদী, নানা, নানী, পুত্র, কন্যা, পৌত্র, পৌত্রী, দৌহিত্র, দৌহিত্রী, স্বামী/স্ত্রী, ভাই, বোন। পিতা-মাতা আক্বরাবূন হলেও তাঁদের কথা প্রথমে স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করায় ‘লিল ওয়ালিদায়নি ওয়াল আক্বরাবীন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পিতা-মাতা ও অন্যান্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য’।
পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়রা ছাড়া অন্যান্য সাধারণ আত্মীয়দের জন্য বা অন্য কারো জন্য ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি, সুতরাং তা ঐচ্ছিক। নিকটতম আত্মীয়দের পাশাপাশি অন্যদের জন্যও ওয়াসিয়্যাত করার ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে নিকটতম আত্মীয়দের সকলে স্বচ্ছল হলে এবং সে অবস্থায় সম্পদ অন্য কারো জন্য ওয়াসিয়্যাত করতে হলে অবশ্যই নিকটতম আত্মীয়দের অনাপত্তি/সম্মতি গ্রহণ করতে হবে। তাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করার কারণে তাদেরকে অগ্রাহ্য না করাই বাঞ্ছনীয়। বরং তারা যদি অনাপত্তি ও সম্মতি জানায় সে ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ সম্পদ অন্য কারো জন্য ওয়াসিয়্যাত করা সঙ্গত হবে, অন্যথায় নয়।
এক নজরে যাদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা বাধ্যতামূলক | |
পিতা | মাতা |
দাদা/ দাদার পিতা | নানা/ নানার পিতা |
দাদী/ দাদীর মাতা | নানী/ নানীর মাতা |
পুত্র/ পুত্রগণ | কন্যা/ কন্যাগণ |
পুত্রের পুত্র (পৌত্র/ পোতা) | কন্যার পুত্র (দৌহিত্র/ নাতি) |
পুত্রের কন্যা (পৌত্রী/ পুতিন) | কন্যার কন্যা (দৌহিত্রী/ নাতিন) |
স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামী | স্বামীর ক্ষেত্রে স্ত্রী |
ভাই | বোন |
আল কুরআনে কোনো আয়াতে কাউকে ত্যাজ্য পুত্র করার অনুমোদন দেয়া হয়নি। প্রশ্ন হতে পারে যে, যদি কাউকে ত্যাজ্য পুত্র করার বিষয়ে কুরআন নীরব থাকে, সেক্ষেত্রে এটাকে ‘অনুমোদন’ বলে ধরা যেতে পারে কিনা? এর জবাবে জ্ঞাতব্য যে, ৮:৭৫, ৩৩:৬, ৪:৭ ও ৪:৩৩ আয়াত অনুযায়ী সন্তানরা তাদের পিতা-মাতার সম্পদের উত্তরাধিকারী হবে। সুতরাং এ আয়াতসমূহের ভিত্তিতে স্পষ্ট হয় যে, কাউকে ত্যাজ্য-পুত্র বলে ঘোষণা দিয়ে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা আল কুরআন পরিপন্থী ও অবৈধ।
তা সত্ত্বেও যদি কোনো পিতা তার সন্তানকে ত্যাজ্য পুত্র করে এবং উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার ওয়াসিয়্যাত করে যায় তাহলে ঐ পুত্র এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বসম্পন্নদের নিকট অন্যায্যতার অভিযোগ এবং ওয়াসিয়্যাত অনুযায়ী বণ্টনের ক্ষেত্রে সংশোধনীর জন্য আবেদন করতে পারবে। অন্যদিকে যদি ওয়াসিয়্যাতের সাক্ষীরা ত্যাজ্য পুত্রের বিষয়টি উত্থাপন করে সে অবস্থায় ঐ পুত্রের যথার্থ হক্ব বিবেচনায় তার ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্য অগ্রাধিকার পাবে। এ বিষয়ে ২:১৮০-১৮২ এবং ৫:১০৬-১০৮ আয়াত দ্রষ্টব্য।
প্রচলিত ধারণা হচ্ছে ৪:১১-১২ আয়াতের দ্বারা ২:১৮০-১৮২ আয়াত মানছুখ (রহিত) হয়ে গেছে। অর্থাৎ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধির মাধ্যমে ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হয়ে গেছে। এ বিষয়ে একটি যুক্তি হচ্ছে, যেহেতু ৪:১১ আয়াত ‘ইউসীকুমুল্লাহু’ (আল্লাহ তোমাদেরকে ওয়াসিয়্যাত করছেন) বাক্যাংশ দ্বারা শুরু হয়েছে এবং ৪:১২ আয়াতেও বলা হয়েছে ‘ওয়াসিয়্যাতাম মিনাল্লাহ’ (এটা আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত), তাই এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ যাদের জন্য উত্তরাধিকারের অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন বা যাদেরকে ওয়ারিস করেছেন তাদের জন্য কোনো ওয়াসিয়্যাত করা যাবে না। অর্থাৎ দাবি করা হয় যে, বর্তমানে ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাত বৈধ নয়।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, ওয়াসিয়্যাতের বিধান হাদীস দ্বারা রহিত হয়েছে। হাদীস থেকে জানা যায় যে, ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা যাবে না তবে ওয়ারিস ছাড়া অন্যদের জন্য নিজ সম্পদের এক তৃতীয়াংশ বা এক চতুর্থাংশ ওয়াসিয়্যাত করা যাবে।
ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হওয়ার প্রচলিত দাবির উত্তর হচ্ছে, ৪:১১ ও ৪:১২ আয়াতে আল্লাহ চারবার বলেছেন, “উত্তরাধিকার বন্টিত হবে ওয়াসিয়্যাতের দাবি পুরণ ও ঋণ পরিশোধের পর”। তাই এ আয়াতগুলোতে ওয়াসিয়্যাতকে বা ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাতকে অবৈধ করা হয়নি। বরং ২:১৮০-১৮২ আয়াত অনুসারে পিতা-মাতা ও অন্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য তথা ওয়ারিসদের জন্যই ওয়াসিয়্যাত করাকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং এ অবস্থায় “ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাত রহিত হয়ে গেছে তবে ওয়ারিস ছাড়া অন্যদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করা যাবে” এরূপ দাবি করা আয়াতের বিধানকে অগ্রাহ্য করার শামিল।
আর হাদীস দ্বারা ওয়াসিয়্যাতের বিধান ওয়ারিসদের জন্য রহিত হওয়ার দাবিও একটি অসঙ্গত দাবি। কারণ রসূলের কাজ ছিলো কুরআনের অনুসরণ করা(৮) , কুরআনের কোনো বিধানকে রহিত করা নয়। আর আল্লাহ কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে একটি বিধান দিবেন অথচ কুরআন বহির্ভুত ওহীয়ে গায়রে মাতলুর (অপঠিত ওহী) মাধ্যমে তা রহিত করবেন যে রহিতকারী তথ্যটি হাদীস থেকে পাওয়া যাবে, এটি কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য দাবি নয়। কারণ নিশ্চিত তথ্যকে কোনো অনিশ্চিত তথ্যের দ্বারা রহিত করা একটি অযৌক্তিক পদ্ধতি। আর নিশ্চয় আল্লাহ অযৌক্তিক পদ্ধতিতে কাজ করার ত্রুটি থেকে পবিত্র।
(৮) তোমার রবের কাছ থেকে তোমার প্রতি যা ওহী করা হয়েছে তুমি তারই অনুসরণ করো, তিনি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং অংশীবাদীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। ৬:১০৬
হে নবী বলো, “... আমি আমার প্রতি যা ওহী করা হয় শুধু তারই অনুসরণ করি। আর আমি তো এক স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র”। ৪৬:৯
যদি এ কথা সঠিকও হয় যে, রসূলুল্লাহ (সালামুন আলাইহি) কোনো ব্যক্তিকে তার বিশেষ পরিস্থিতি-সাপেক্ষে এক তৃতীয়াংশের বেশি বা এক চতুর্থাংশের বেশি ওয়াসিয়্যাত করতে নিষেধ করেছিলেন, তবে তা ঐ ব্যক্তির সাথেই সংশ্লিষ্ট এবং সে নিষেধাজ্ঞার কারণ তার ওয়ারিস যেন ঐ ওয়াসিয়্যাতের কারণে বঞ্চিত না হয়। অন্যদিকে ওয়ারিসদের জন্য ওয়াসিয়্যাত করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সম্পত্তিও ওয়াসিয়্যাত করা যাবে। কিন্তু ওয়ারিসদেরকে বঞ্চিত করে বা তাদের সম্মতি ছাড়া অন্যদের জন্য সম্পূর্ণ সম্পত্তি ওয়াসিয়্যাত করা বৈধ নয়। কারণ আল্লাহ ওয়ারিসদের মধ্যে বণ্টনের জন্য ওয়াসিয়্যাত করাকে স্বাভাবিক মৃত্যুর সন্নিকটে থাকা ব্যক্তির উপর বাধ্যতামূলক করেছেন।
যদি ওয়ারিসদের জন্য কৃত ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের পর কোনো সম্পদ অবশিষ্ট না থাকে তাহলে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী উত্তরাধিকার বন্টিত হবে না। এক তৃতীয়াংশের বেশি বা এক চতুর্থাংশের বেশি ওয়াসিয়্যাত করতে নিষেধ করার হাদীসটি থেকে এ শিক্ষা নেয়া যায় যে, ওয়ারিস ছাড়া অন্যদের জন্য কোনো নফল ওয়াসিয়্যাত করলে তা যেন এক তৃতীয়াংশের বেশি বা এক চতুর্থাংশের বেশি না হয়। এছাড়া সম্পত্তি যদি অত্যন্ত কম হয়, তবে শুধুমাত্র ওয়ারিসদের জন্যই ওয়াসিয়্যাত করা একটি স্বাভাবিক বিষয়।
ওয়াসিয়্যাতের পরে যা থাকবে তা উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টিত হবে। এটি অত্যন্ত যৌক্তিক একটি ব্যবস্থাপনা। ওয়ারিসদের জন্য সমস্ত সম্পদ ওয়াসিয়্যাত করার চেয়ে অংশবিশেষ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টনের জন্য রেখে দেওয়া উত্তম। কারণ এটা স্বত:সিদ্ধ বাস্তবতা যে, সমস্ত সম্পদ ওয়াসিয়্যাত করে গেলে ওয়াসিয়্যাতকারীর নিজস্ব জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার আশংকাকে উপেক্ষা করা যায় না।
মৃত্যু নিকটবর্তী ব্যক্তির উপর ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কারণ যখন স্বাভাবিকভাবে বুঝা যায় যে, কোনো ব্যক্তি মৃত্যু নিকটবর্তী অবস্থায় রয়েছে, তখন সে ঐ সময়ের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ওয়াসিয়্যাত করতে পারবে। অন্যদিকে তুলনামূলক মধ্যবয়স্কদের উপর বা সম্পূর্ণ সুস্থ সবল অবস্থায় ওয়াসিয়্যাত করাকে বাধ্যতামূলক করা হলে পরবর্তী বাস্তব পরিস্থিতিগত বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের ফলে কৃত ওয়াসিয়্যাত ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে বলে সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো। সুতরাং মধ্যবয়স্কদের উপর বা সম্পূর্ণ সুস্থ সবল অবস্থায় ওয়াসিয়্যাত বাধ্যতামূলক করা হয়নি, বরং তারা ওয়াসিয়্যাত করা ঐচ্ছিক বিষয়।
২:২৮২ আয়াত অনুযায়ী দাইন বা ঋণের ক্ষেত্রে লিখিত প্রমাণ ও দুইজন সাক্ষী রাখাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু ৫:১০৬ আয়াত অনুযায়ী ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে শুধু দুইজন সাক্ষী রাখাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২:১০৮০-১৮১ আয়াত থেকেও বুঝা যায় যে, মৌখিক ওয়াসিয়্যাতকে যথেষ্ট সাব্যস্ত করা হয়েছে, লিখিত প্রমাণকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। এর কারণ হতে পারে মৃত্যু আসন্ন ব্যক্তির কৃত ওয়াসিয়্যাত লিখিতভাবে করাকে বাধ্যতামূলক করা হলে তা সাধারণত বাস্তবসম্মত হতো না, যেমন: অনেক ব্যক্তি নিজে শিক্ষিত নাও হতে পারে অথবা অসুস্থ অবস্থায় থাকা এবং আশেপাশে লিখে দেওয়ার মতো ব্যক্তির উপস্থিত না থাকার সম্ভাবনা ইত্যাদি। তবে ২:২৮২ আয়াতের শিক্ষানুসারে বলা যায় যে, যদিও বাস্তবসম্মত কারণে বাধ্যতামূলক করা হয়নি, তবুও সুযোগ থাকলে লিখিতভাবে ওয়াসিয়্যাত করাই স্বাভাবিক এবং কার্যকারিতার জন্য উত্তম। আর কুরআনের সার্বিক শিক্ষানুসারে যেখানে অধিক উপযুক্ত, অধিক মঙ্গলজনক এবং অধিক ন্যায়সঙ্গক উপায় অবলম্বন করা সম্ভব, সেখানে তা কার্যকর করাই উত্তমকর্ম সম্পাদনকারী ¯্রষ্টাসচেতন বিশ^াসীদের করণীয়।
৫:১০৬ আয়াতে ওয়াসিয়্যাত করার বিষয়ে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং ওয়াসিয়্যাতের বিধানের একটি অন্যতম ধারা হচ্ছে ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখতে হবে।
৫:১০৬ আয়াতে ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে সাক্ষী রাখার নির্দেশের দ্বিতীয় ধারা হচ্ছে যদি নিজ এলাকা থেকে দূরদেশে বা প্রবাসে ভ্রমণ করা কালে মৃত্যুর মুসিবত এসে পড়ে তথা অপ্রত্যাশিত হঠাৎ মৃত্যু এসে পড়ে এবং এ অবস্থায় নিজ অঞ্চলের লোক পাওয়া না যায় তাহলে অন্য অঞ্চলের বা প্রবাসী দুইজনকে সাক্ষী রাখতে হবে।
৫:১০৬ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে যে দুইজন ব্যক্তি সাক্ষী তাদেরকে সালাতের পরে অপেক্ষমান রাখতে হবে অর্থাৎ সালাতের পরে সাক্ষ্য গ্রহণ ও ওয়াসিয়্যাতের ভিত্তিতে বণ্টন করতে হবে। সুতরাং ওয়াসিয়্যাতের বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ বা ওয়াসিয়্যাতের ভিত্তিতে বণ্টনের সময় হচ্ছে সালাতের পরে। এ থেকে এটাও বুঝা যায় যে, সালাতের স্থান (মাসজিদ) শুধু আনুষ্ঠানিক সালাতের জন্যই নির্ধারিত নয়, বরং উলিল আমরের (Central Authority) কার্যালয় হিসাবে সেখানে সালাতের পরে উত্তরাধিকারের বণ্টনের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহারিক গুরুত্ব রয়েছে। অর্থাৎ মাসজিদ একই সাথে বহুবিধ মাত্রার কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুও বটে।
৫:১০৬ আয়াতের শেষ নির্দেশনা হলো, যদি সাক্ষীদের বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হয় তাহলে তারা আল্লাহর নামে কসম করে বলবে যে, “আমরা কোনো মূল্যেই সাক্ষ্য গোপন করবো না, যদিও এর মাধ্যমে উপকারভোগী আমাদের আত্মীয় হয় এবং আল্লাহর নির্দেশিত সাক্ষ্যকে গোপন করবো না। নিশ্চয় এগুলো করলে আমরা অপরাধীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।” এই সাক্ষ্যের ভাষা এই সচেতনতার শিক্ষা প্রদান করে যে, আত্মীয়তার বন্ধন যেন ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষপাতমূলক অন্যায় সাক্ষ্য ও আচরণকে প্রভাবিত না করে। মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়াই কেবল নয়, জানার পরে সত্য সাক্ষ্য গোপন করাও অবৈধ।
৫:১০৭-১০৮ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যদি সাক্ষীদ্বয় সাক্ষ্য হেরফের করার অপরাধে জড়িত হয়েছে বলে লক্ষণ পাওয়া যায় তাহলে এমন দুইজন ব্যক্তি মূল দুইজন সাক্ষীর দাবিগত অবস্থানের বিপরীতে সাক্ষ্য দিতে দাঁড়াবে যারা তাদের সাক্ষ্যের বিপক্ষে (পরিত্যক্ত সম্পদের বা সাক্ষ্যদানের) অধিকার দাবিকারীদের অন্তর্ভুক্ত এবং যারা মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অধিক ঘনিষ্ঠ/অগ্রাধিকারী বা মূল সাক্ষীদ্বয়ের সাক্ষ্যে গরমিল চিহ্নিত করতে পারার প্রেক্ষিতে সাক্ষ্যদানের অধিক যোগ্য। আপত্তিকারীদের অন্তর্ভুক্ত এই দুইজন সাক্ষীকে আল্লাহর নামে কসম করে বলতে হবে, “আমাদের সাক্ষ্য তাদের দুইজনের সাক্ষ্যের চেয়ে অধিক যথাযথ। আর আমরা সীমালংঘন করিনি। নিশ্চয় তা করলে আমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।”
এভাবে আপত্তিকারীদের অন্তর্ভুক্ত দুইজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিলে মূল দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যকে অগ্রাহ্য করা হবে। অর্থাৎ এরূপ পাল্টাপাল্টি দুই ধরনের সাক্ষ্যের প্রেক্ষিতে ঐ ওয়াসিয়্যাত রহিত হয়ে যাবে। মূল দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্য রহিত হওয়ার কারণে তাদের সাক্ষ্যের উপর ভিত্তিশীল ওয়াসিয়্যাতকে হুবহু বাস্তবায়ন করা যাবে না। বরং এ অবস্থায় ঐ দাবিকৃত ওয়াসিয়্যাতের মাধ্যমে যাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়েছে তাদের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থরক্ষার উপযোগী করে তার মীমাংসা করা যেতে পারে। কেননা মূল দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের প্রতি আপত্তির প্রেক্ষিতে পরবর্তী দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যকে অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এছাড়া ২:১৮২ আয়াতে ওয়াসিয়্যাতকারীর ওয়াসিয়্যাতের মাধ্যমে কোনো পক্ষপাতিত্ব বা বঞ্চিত করার পাপ হয়েছে বলে আশংকা করলে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে দেয়ার মধ্যে কোনো দোষ নেই বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যদি কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা সম্ভব না হয় তাহলে মৃত ব্যক্তির সমস্ত পরিত্যক্ত সম্পত্তি উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টন করতে হবে।
২:২৪০ আয়াতে আল্লাহতায়ালা বিধবাদের জন্য একটি ওয়াসিয়্যাত করেছেন তথা বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন। তা হলো: বিধবা নারীদেরকে তাদের গৃহ থেকে তথা মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব থেকে তারা যে গৃহে বসবাস করছিলো তা থেকে এক বছর পর্যন্ত বের করে দেয়া যাবে না। সেটি তাদের নিজেদের গৃহ হোক বা তাদেরকে বসবাস করতে দেয়া স্টাফ কোয়ার্টার হোক উভয় ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের পুনর্বাসনের সুব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত সময় সুযোগ লাভ করবে। এ একবছর সময়কালে তাদেরকে ভরণ পোষণও দিতে হবে। এ ওয়াসিয়্যাতকে কে কার্যকর করতে হবে তা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কুরআনের সাধারণ শিক্ষা অনুসারে বুঝা যায় যে, এটি প্রাথমিকভাবে মৃত ব্যক্তির পরিবার পরিজনের দায়িত্ব এবং প্রয়োজনসাপেক্ষে বৃহৎ পরিসরে সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর এ দায়িত্ব অর্পিত হবে। ২:১৩৪ আয়াত অনুযায়ী বিধবা নারীদের সাধারণ ইদ্দাত (প্রতীক্ষার সময়কাল) ৪ মাস ১০ দিন, তবে ৬৫:৪ আয়াত অনুযায়ী গর্ভবতী হলে সেক্ষেত্রে ইদ্দাত হলো সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত। ইদ্দাতকাল পূর্ণ হলে ১ বছর সময়ের আগেও বিধবা নারী স্বেচ্ছায় বের হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা বেরিয়ে গেলে এবং নিজেদের জন্য ন্যায়সঙ্গতভাবে কিছু করার সিদ্ধান্ত নিলে (যেমন বিবাহ ও নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা) তাতে অন্যরা দোষী হবে না। অন্য কথায় ইদ্দাত শেষে কিন্তু এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কোনো বিধবা নারী সম্পূর্ণ নিজ ইচ্ছায় বের হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে এক বছর পূর্ণ হতে বাকি থাকা সময়সীমাতে তাদেরকে পূর্ব গৃহে থাকতে দেয়া ও ভরণপোষণ দেয়ার বাধ্যবাধকতা প্রযোজ্য হবে না।
২:২৪০ আয়াতটির প্রচলিত অনুবাদ ও ব্যাখ্যা হচ্ছে, এখানে যারা মৃত্যুবরণ করে তাদেরকে নিজেদের স্ত্রীদের বিষয়ে এক বছরের ভরণ পোষনের জন্য পরিবারের সদস্যদের কাছে ওয়াসিয়্যাত করে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ অনুবাদ বা ব্যাখ্যাটি সঠিক নয়। কারণ যে আয়াতে মৃত্যু আসন্ন ব্যক্তির উপর ওয়াসিয়্যাত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে (২:১৮০) সেটির বাক্য বিন্যাস হলো, “কুতিবা আলাইকুম ইযা হাদারা আহাদুকুমুল মাওতু...’’(যখন তোমাদের কেউ মৃত্যুর সন্নিকটে হাজির হয় তখন তার উপর বিধিবদ্ধ করা হলো যে, .....)। কারো উপর কিছু বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে আরবি ভাষায় ও কুরআনে এরূপ বাক্য বিন্যাসই অবলম্বন করা হয়। পক্ষান্তরে ২:২৪০ আয়াতে বলা হয়েছে, “ওয়াল্লাযীনা ইউতাওয়াফফাওনা মিনকুম ওয়া ইয়াযারূনা আজজওয়াজান.....”(আর যারা তাদের স্ত্রীদেরকে ছেড়ে মৃত্যুবরণ করে তথা যারা মৃত্যুবরণ করে এবং তাদের স্ত্রীরা জীবিত থাকে,.......) । আয়াতটিতে যারা স্ত্রী রেখে মারা যাবে তাদের সাথে সম্পর্কিত করে কিছু বলা হয়েছে কিন্তু তাদের উপর কোনো দায়িত্ব বলা হয়নি। আয়াতটির পরবর্তী অংশে উল্লেখিত হয়েছে “ওয়াসিয়াতাল লিআজওয়াজিহিম” (তাদের স্ত্রীদের জন্য ওয়াসিয়্যাত)। অর্থাৎ আয়াতটিতে তাদের স্ত্রীদের বিষয়ে কিছু বলা হয়েছে এবং যা বলা হয়েছে তা হলো ‘ওয়াসিয়্যাত’। অন্য কথায়, তাদের স্ত্রীদের জন্য ‘ওয়াসিয়্যাত’ হিসেবে কিছু বলা হয়েছে। কথাটির সহজ তাৎপর্য হলো “তাদের স্ত্রীদের জন্য ওয়াসিয়্যাত উপস্থাপন/প্রদান করা হয়েছে”। বাক্যটিতে ‘ওয়াসিয়্যাত’ শব্দটি কর্ম (Object) হিসেবে রয়েছে। বাক্যটিতে ‘ওয়াসিয়্যাত’ শব্দটির মাধ্যমে “তাদের স্ত্রীদের জন্য কী রয়েছে বা কী দেয়া হয়েছে?”- এ প্রশ্নটিরই উত্তর (কর্ম/Object) উল্লেখ করা হয়েছে। ‘ওয়াসিয়্যাত’ শব্দের একটি অর্থ হলো ‘বিশেষ নির্দেশ’। বাক্যটিতে ওয়াসিয়্যাতের ‘কর্তা’ (Subject) কে, তা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু “ওয়াসিয়্যাত হচ্ছে/ ওয়াসিয়্যাত করা হলো .....” বক্তব্যভঙ্গি থেকে স্বত:সিদ্ধভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এটি আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত বা বিশেষ নির্দেশ।
‘আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত’ শব্দটি কারো কারো জানা নাও থাকতে পারে। তাই উল্লেখ্য যে, ৪:১১ আয়াতে উত্তরাধিকার বণ্টন সম্পর্কিত বক্তব্য শুরু করা হয়েছে ‘ইউসীকুমুল্লাহু’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ তোমাদেরকে ওয়াসিয়্যাত করছেন’ বক্তব্যের মাধ্যমে এবং ৪:১২ আয়াতে উত্তরাধিকারের নির্ধারিত সম্পূর্ণ বণ্টন বিধিকেই চিহ্নিত করা হয়েছে “ওয়াসিয়্যাতাম মিনাল্লাহ” বা “আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ওয়াসিয়্যাত” হিসেবে। এ আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ বিষয়টি স্পষ্ট করা যে, ২:২৪০ আয়াতে প্রদত্ত বিধান “বিধবা নারীদেরকে মৃত ব্যক্তির অন্যান্য ওয়ারিসরা বা সমাজ ও রাষ্ট্র এক বছর ভরণ পোষণ দিতে হবে, অবশ্য যদি এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে তারা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেদেরকে নতুন বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ করে তবে এই ভরণ পোষণ এক বছর পূর্ণ হওয়ার প্রয়োজন হবে না বরং তারা নতুন বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া পর্যন্ত হলেই চলবে”- এটি হচ্ছে আল্লাহর ওয়াসিয়্যাত।
সুতরাং মৃত ব্যক্তিকে তার স্ত্রীর জন্য ওয়াসিয়্যাত করার আদেশ দেয়া হয়েছে, তাই মৃত ব্যক্তি এরূপ ওয়াসিয়্যাত করে গেলে তা বাস্তবায়ন করা হবে, অন্যথায় বাস্তবায়ন করা হবে না; এ ধারণাটি সঠিক নয়। বরং প্রত্যেক বিধবার ক্ষেত্রে এ ওয়াসিয়্যাত বা বিশেষ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রচলিত একটি দাবি হচ্ছে ২:২৪০ আয়াতটি ২:২৩৪ আয়াত এবং ৪:১২ আয়াতের মাধ্যমে মানছুখ বা রহিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ বিধবাদেরকে এক বছর ভরণপোষণ দেয়া এবং ঘর থেকে বের করে না দেয়ার বিধান রহিত হয়ে গেছে। নিম্নে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হলো।
২:২৩৪ আয়াত দ্বারা ২:২৪০ আয়াতটি রহিত হয়েছে কিনা তা বুঝার জন্য নিচে ২:২৩৪ আয়াতের অনুবাদ উল্লেখ করা হলো।
২:২৩৪ :: তোমাদের মধ্য হতে যারা স্ত্রীদেরকে রেখে মারা যাবে সে অবস্থায় স্ত্রীরা নিজেদেরকে চার মাস দশ দিন অপেক্ষায় রাখবে। তারপর যখন তাদের (ইদ্দাতের) নির্ধারিত শেষ সীমায় পৌঁছে, তখন তারা নিজেদের সম্বন্ধে ন্যায়সঙ্গতভাবে যা করবে তাতে তোমাদের কোনো দোষ নেই। আর তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ সে বিষয়ে পরিজ্ঞাত।
আয়াতটিতে (২:২৩৪) বিধান দেয়া হয়েছে যে, বিধবাদের ইদ্দাতকাল চারমাস দশদিন। এরপর তারা অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। এ আয়াতটির মাধ্যমে ২:২৪০ আয়াতে বর্ণিত বিধবাকে এক বছরের ভরণপোষণের জন্য যে বিধানটি দেয়া হয়েছে তা রহিত হয়ে গেছে বলে দাবি করা সঠিক নয়। কারণ দুটি বিষয় পরস্পর স্বতন্ত্র। এছাড়া ইদ্দাতকাল শেষ হলে যদি এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে বিধবা নারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাহলে ভরণ পোষণ এক বছর পূর্ণ করা লাগবে না বরং নতুন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া পর্যন্ত হলেই চলবে, তাও ২:২৪০ আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে। এমতাবস্থায় দুটি আয়াত পরস্পর সম্পূরক, আয়াতদ্বয়ে কোনো বৈপরীত্য নেই, সুতরাং এর একটি দ্বারা অন্যটি রহিত হওয়ার মতবাদটি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।
৪:১২ আয়াতে বর্ণিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধিতে বিধবা নারীকে উত্তরাধিকারের অংশীদার করাতে ২:২৪০ আয়াতটি রহিত হয়ে গেছে বলে কৃত দাবিটিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ দেনমোহর দেয়ার পাশাপাশি যেমন স্বামীর উপর ভরণপোষনের দায়িত্ব থাকে, এর একটি অন্যটিকে রহিত করে না; তেমনি বিধবা নারী তার স্বামীর উত্তরাধিকার পাওয়া সত্তে¦ও স্বতন্ত্রভাবে এক বছরের ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার রাখে, এর একটি অন্যটিকে রহিত করে না। উভয়টি আল্লাহর বিধান, এর কোনোটিই রহিত নয় এবং তাই উভয় বিধানই কার্যকর বা বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যক।
পরিশেষে বলা যায় যে, ওয়াসিয়্যাতের বিধান এবং উত্তরাধিকারের বিধান উভয়টি ফরজ বা বাধ্যতামূলক হিসেবে বাস্তবায়ন করতে হবে। উত্তরাধিকারের বিধানের পরে ওয়াসিয়্যাতের বিধান রহিত হয়ে যাওয়ার মতবাদ একটি ভ্রান্ত মতবাদ। বরং ওয়াসিয়্যাত পরিপূরণের পরে উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হযেছে। বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, পুত্র-কন্যা, পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রী, স্বামী/স্ত্রী এবং ভাই-বোনদের জন্য ন্যায়সঙ্গতভাবে এবং দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রেখে ওয়াসিয়্যাত করতে হবে। যদি ওয়াসিয়্যাতকারী ওয়াসিয়্যাতের ক্ষেত্রে কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছে বা কাউকে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছে বলে আশংকা হয়, সেক্ষেত্রে অন্যরা কোনো মীমাংসার জন্য ভূমিকা রাখলে তথা উদ্বুদ্ধ করলে তা দোষনীয় নয়। সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ওয়াসিয়্যাতকে কার্যকর করতে হবে, সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণ না পেলে দাবিকৃত ওয়াসিয়্যাত কার্যকর হবে না, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে দেয়ার মাধ্যমে ওয়াসিয়্যাতের সংশোধিত রূপ কার্যকর করা যাবে এবং সমঝোতা সম্ভব না হলে মৃতের সমস্ত পরিত্যক্ত সম্পদ উত্তরাধিকারের নির্ধারিত বণ্টন বিধি অনুযায়ী বণ্টন করতে হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন, সম্পদের সুষম বণ্টন, সামাজিক বিবাদ বিসম্বাদ হ্রাস করা এবং ব্যাপক সমাজ কল্যাণের জন্য কুরআনে প্রদত্ত ওয়াসিয়্যাতের বিধান পরিপালন করা অত্যাবশ্যক।
এ বইটিতে উল্লেখিত ওয়াসিয়্যাতের বিধান অনুধাবনের সাথে সম্পর্কিত কুরআনিক পরিভাষাসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাঠকের সুবিধার্থে এখানে (বাংলা বর্ণানুক্রমে) তুলে ধরা হলো:
আক্বরাবূন أَقْرَبُونَ : ‘আক্বরাবূন’ শব্দটি ‘আক্বরাব’ শব্দের বহুবচন। ‘আক্বরাব’ শব্দটি ‘ক্বারীব’ শব্দের কম্পারেটিভ ও সুপারলেটিভ ডিগ্রী। ‘ক্বারীব’ শব্দের অর্থ হলো ‘নিকটবর্তী’। সুতরাং ‘আক্বরাব’ শব্দের অর্থ হলো ‘নিকটতম’। শব্দটি ‘নিকটতম আত্মীয়’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধিতে শব্দটি ‘নিকটতম আত্মীয়’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআন অনুসারে যাদের মধ্যকার কেউ জীবিত থাকলে তাদের মধ্যে মৃত ব্যক্তির সমস্ত উত্তরাধিকার বণ্টিত হবে তাদেরকে ‘আক্বরাবূন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন ‘রক্তসম্পর্কের আত্মীয়’। তাঁরা হলেন: পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বোন। আর বৈবাহিক সম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে শুধুমাত্র স্বামীর ক্ষেত্রে স্ত্রী এবং স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দাদা, দাদী ও নানা, নানী পিতা-মাতার সূত্রে ঊর্ধ্বতন বিধায় তাঁরা দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূন। অনুরূপভাবে পোতা, পুতিন, নাতি, নাতিন পুত্র-কন্যার সূত্রে অধ:স্তন বিধায় তারা দ্বিতীয় স্তরের আক্বরাবূন।
ওয়াসিয়্যাত وَصِيَّةُ : ‘ওয়াসিয়্যাত’ শব্দের অর্থ হলো: বিশেষ নির্দেশ, নাজুক পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে অগ্রিম নির্দেশনা, স্বীয় মৃত্যু পরবর্তীকালে সম্পদের বণ্টনের বিষয়ে নির্দেশনা। ইংরেজি পরিভাষায় একে উইল (Will) বলা হয়।
৪:১১ আয়াতে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কে কতটুকু পাবে তার উল্লেখ শুরু করা হয়েছে ‘ইউসীকুমুল্লাহু’ (আল্লাহ তোমাদেরকে ওয়াসিয়্যাত করছেন) বাক্যের মাধ্যমে। ৪:১২ আয়াতে উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধিকে ‘ওয়াসিয়্যাতাম মিনাল্লাহ’ (আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ওয়াসিয়্যাত/বিশেষ নির্দেশ) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২:২৪০ আয়াতে আল্লাহর একটি ওয়াসিয়্যাত উল্লেখ করা হয়েছে বিধবা নারীদেরকে এক বছর তাদের গৃহ থেকে বের করে না দিয়ে ভরণপোষণের ব্যবস্থা করার জন্য। এ ওয়াসিয়্যাত কে কার্যকর করবে তা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এ থেকে স্বত:সিদ্ধভাবে বুঝা যায় যে, এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক দায়িত্ব হলো মৃত ব্যক্তির পরিবার পরিজনের এবং প্রয়োজনে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এ ওয়াসিয়্যাত প্রযোজ্য হবে।
২:১৮০ আয়াতে যদি কোনো ব্যক্তি বার্ধক্য অবস্থায় বা এমন অবস্থায় উপনীত হলে যাতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সে মৃত্যুর সন্নিকটে রয়েছে বলে ধারণা হয় তার উপর তার পিতা-মাতা ও অন্যান্য নিকটতম আত্মীয়দের জন্য ওয়াসিয়্যাত (Will) করে যাওয়াকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। উত্তরাধিকারের বণ্টন বিধিতে যে উত্তরাধিকারীদের জন্য যে আনুপাতিক অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে সেটা কার্যকর করতে হবে মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাতের দাবি পূরণ এবং ঋণ পরিশোধের পরে।
দাইন دَيْن : ‘দাইন’ শব্দটির অর্থ হলো ‘ঋণ, দেনা’। ২:২৮২ আয়াতে ঋণ লেনদেন সম্পর্কিত বিধি-বিধান দেয়া হয়েছে। ঋণ লেনদেন লিখিত এবং পরিশোধের সময়সীমা নির্দিষ্টকৃত হতে হবে। তবে যদি বাস্তবসম্মত অসুবিধার কারণে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে ঋণ প্রাপককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ঋণ ফেরত দেয়ার মতো স্বচ্ছলতা পর্যন্ত অবকাশ দেয়ার জন্য। যদি কোনো ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তবে তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে প্রথমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে এবং মৃত ব্যক্তির ওয়াসিয়্যাত থাকলে তার দাবি পূরণ করতে হবে। তারপর বাকি সম্পদ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নির্ধারিত হারে বণ্টন করতে হবে।
যিল ক্বুরবা/ উলুল ক্বুরবা ذِي الْقُرْبَىٰ / أُولُو الْقُرْبَىٰ : ‘যিল ক্বুরবা’ শব্দটির অর্থ হলো ‘আত্মীয়তার/নৈকট্যের অধিকারী’। ‘যিল ক্বুরবা’ শব্দের বহুবচন হলো ‘উলুল ক্বুরবা’। ‘আক্বরাবূন’ (সবচেয়ে নিকটতম আত্মীয়গণ) তথা যাদের জন্য উত্তরাধিকার নির্ধারিত তারা ছাড়া অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনকে ‘উলিল ক্বুরবা’ বলা হয়। ৪:৮ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে (আক্বরাবূনের মধ্যে) উত্তরাধিকার বণ্টনকালে যেসব ‘উলুল ক্বুরবা’ (উত্তরাধিকারী নন এমন আত্মীয়-স্বজন) উপস্থিত হবেন তাঁদের সাথে ন্যায়সঙ্গত ও ভদ্রোজনোচিত কথা বলতে হবে এবং তাঁদেরকেও উপজীবিকাস্বরূপ পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে কিছু দিতে হবে। আক্বরাবূনের মধ্য থেকে কেউ জীবিত না থাকলে উলিল আমর (Central Authority) উপযুক্ত ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শক্রমে মৃত ব্যক্তির ‘উলুল ক্বুরবার’ মধ্যে তা বণ্টন করতে পারেন অথবা অংশবিশেষ বা প্রয়োজনে সম্পূর্ণ সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করতে পারেন। এরূপ ক্ষেত্রে উলিল আমরের কল্যাণকর সিদ্ধান্তের আনুগত্য করতে হবে।