তালাক শব্দটি আমাদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ অর্থে প্রচলিত। আল কুরআনে তালাকের যে বিধি-বিধান দেয়া হয়েছে তাতে তালাক শুধুমাত্র মুখে উচ্চারণের কোনো বিষয় নয় বরং এটি একটি আইনগত প্রক্রিয়া। তালাক সম্পর্কে আমাদের সমাজে আল কুরআনের আলোকে সঠিক উপলব্ধির অভাবে এ সম্পর্কিত বিধি-বিধান যথাযথভাবে পরিপালন করা হয় না। ফলে তালাক সংক্রান্ত ব্যাপক পারিবারিক ও সামাজিক সংকটের সৃষ্টি হয়। আল কুরআনের আলোকে তালাকের বিধি-বিধান সম্পর্কে আলোকপাত করে বিশ^প্রভুর বিধান জানা ও মানার অনুপ্রেরণা এবং এর মাধ্যমে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের উপায় অবলম্বনের উদ্দেশ্যে বইটি রচনা করা হয়েছে।
তালাক একটি সামাজিক ও আইনগত বিষয় হওয়ায় বইটি রচিত হয়েছে সমাজকর্মী, আইনজ্ঞ, আইন বিভাগের অধ্যাপক ও অধ্যয়নশীল শিক্ষার্থীবৃন্দ, আইনজীবি, নারী অধিকার বিষয়ে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, আইন প্রণয়নে সম্পৃক্ত মাননীয় সংসদ সদস্য ও সচিববৃন্দ এবং যারা বিষয়টি জানতে ও তার ভিত্তিতে সমাজ কল্যাণে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী এবং সেই সাথে যেসব নারী-পুরুষ সংসার জীবনে কোনো তিক্ততার কারণে তালাকের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন এমন সকলের জন্য।
আল কুরআন অনুসারে মু’মিনরা তাদের কার্যক্রমে (তথা কুরআনে বর্ণিত বিধি-বিধান অনুধাবন ও অনুশীলন এবং বিভিন্ন নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণ - এ দ্বিবিধ ক্ষেত্রে) পরামর্শ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে (৪২:৩৮)। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বইটিকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি বিশ্লেষণাত্মক ধারা বিবরনী হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়া বইটি কুরআনের বিধি-বিধানের যৌক্তিকতা বিষয়ে একটি সাক্ষ্য। যারা এ বিষয়ে পারস্পরিক উপলব্ধির শেয়ারকে অনুধাবন যোগ্যতা উন্নয়নের কার্যকর উপায় হিসেবে অবলম্বনের স্তরে রয়েছেন বইটি তাদের কাজে আসতে পারে। বইটিতে উল্লেখিত আয়াতসমূহ মহান আল্লাহর নাজিলকৃত শাশ^ত সত্যের ধারক। লেখকের আলোচনার অংশটি অবশ্যই আল কুরআনের আয়াতসমূহের দ্বারা যাচাইযোগ্য এবং সেই সাথে যদি কোথাও বিশ্লেষণগত ত্রুটি ধরা পড়ে তাহলে পরবর্তী সংস্করণে সংশোধনযোগ্য।
১. ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়। অথচ কুরআনের বিধান অনুযায়ী তালাকের সাথে সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না। বরং হঠকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দ্রæত বিবাহ বিচ্ছেদকে সুস্পষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তালাক কার্যকর করতে হবে ইদ্দাতের (সুনির্দিষ্ট অপেক্ষার সময়) শর্ত পূরণ করে। ইদ্দাত অতিবাহিত হবার পর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, একে মুফারাক্বাত বলা হয়।
২. আমাদের সমাজে ‘তিন তালাক’ শব্দটি অত্যন্ত পরিচিত। অথচ কুরআনে স্বাভাবিক তালাকের সংখ্যা হিসেবে ‘আত তালাক্বু মাররাতান’ বা ‘তালাক দুইবার’ কথাটি বলা হয়েছে যার পরে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে সম্মত হলে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উৎসাহ ও অনুমোদন কুরআনে রয়েছে। এরপরে তৃতীয়বার তালাক হচ্ছে অস্বাভাবিক তালাক যার পর বিশেষ শর্ত পূরণ ছাড়া তালাকপ্রাপ্তাকে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে না।
৩. তালাক নিছক শব্দ উচ্চারণের বিষয় নয় বরং তালাক হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া। দুজন ন্যায়পরায়ণ স্বাক্ষী রেখে ইদ্দাতের বিধি বিধানের দিকে লক্ষ্য রেখে তালাক কার্যকর করতে হবে। এছাড়া তালাকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে মীমাংসার উদ্যোগ নিতে স্বামীর পরিবারের একজন ও স্ত্রীর পরিবারের একজন বিচক্ষণ সালিশদার নিযুক্ত করতে হবে।
৪. সাধারণত মনে করা হয় যে, দুইবার বা তিনবার তালাক দিতে হবে। অথচ বাস্তবে একবার তালাক দিলেই তাতে তালাক হয়ে যায়। স্বাভাবিক তালাক দুইবার কথাটির অর্থ দুইবার তালাক দিতে হবে এমন নয়।
৫. প্রচলিত হিল্লা বিয়ে একটি কুরআন পরিপন্থী কুপ্রথা। এর মাধ্যমে আল্লাহর আয়াতকে হাসি তামাশার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। প্রচলিত হিল্লা বিয়ে আল কুরআন অনুসারে সম্পূর্ণ অবৈধ।
৬. ইদ্দাতকালে স্ত্রীকে স্বামীর সমান মানসম্পন্ন গৃহে রাখতে হবে, সাধ্যমতো স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে হবে, স্ত্রীকে দেয়া মোহরানার কোনো অংশ ফেরত নেয়া যাবে না এবং ইদ্দাতশেষে স্ত্রীকে উত্তমভাবে সাধ্যমতো কিছু ভোগসামগ্রী দিয়ে বিদায় দিতে হবে।
৭. স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে তালাক দিতে পারে এবং সেক্ষেত্রে ফিদইয়াস্বরূপ দেনমোহরের কিছু অংশ ফেরত দিতে হয়। এছাড়া স্ত্রীর স্পষ্ট অশ্লীলতার কারণে তালাক দিলে সেক্ষেত্রেও স্বামী ক্ষতিপূরণ হিসাবে দেনমোহরের কিছু অংশ ফেরত পেতে পারে।
৮. কুরআনে পারিবারিক সহিংসতার কোন স্থান নেই। আয়াতের ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে অনেকে তালাক সর্ম্পকিত আয়াতে ব্যবহৃত ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ (তাদেরকে দরবুন করো) এর অর্থ করে থাকেন আঘাত বা মৃদু আঘাত করা, যা এখানের কনটেক্সট বা পরিপ্রেক্ষিত ও আইনী প্রয়োগের পরিপন্থী। বরং বিশ্লেষণে ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ অর্থ ‘তাদেরকে আঘাত / প্রহার করো’ হতে পারে না বরং সাধারণভাবে কোন ব্যক্তিকে দরাবা করার অর্থ হচ্ছে তাকে তথা তার সাথে সম্পর্কিত বিষয়কে সামনে উপস্থাপন করা।
৯. ‘যিহার’ কে অবৈধ করার মাধ্যমে কার্যত হঠকারী আচরণস্বরূপ কেবলমাত্র মুখে উচ্চারণ করে তালাক কার্যকরের যেকোনো প্রচলন অবৈধ করা হয়েছে।
১০. লিআনের শিক্ষা এই যে স্বামী তার স্ত্রীকে ব্যভিচারের দায়ে দায়ী করলে স্বাক্ষী না থাকলে স্ত্রীর স্বাক্ষ্যই অগ্রাধিকার পাবে।
তালাক (আভিধানিক অর্থ প্রত্যাখ্যান, বর্জন, repudiation) শব্দটি আমাদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ অর্থে প্রচলিত। আল কুরআনে তালাকের যে বিধি-বিধান দেয়া হয়েছে তাতে তালাক শুধুমাত্র মুখে উচ্চারণের কোনো বিষয় নয় বরং এটি একটি আইনগত প্রক্রিয়া যা দুইজন ন্যায়পরায়ণ স্বাক্ষী রেখে সম্পন্ন করতে হয়। তালাকের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না, বরং বিবাহ বিচ্ছেদের বিশেষ প্রক্রিয়ার সূচনা হয়। তালাকের প্রাথমিক কার্যকারিতা হচ্ছে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিধিমতো ইদ্দাত তথা বাধ্যতামূলক প্রতীক্ষার সময়কাল অতিবাহিত করতে হয়, ঐ সময়কাল অতিবাহিত হয়ে গেলে ঐ পর্বের তালাক বা বিবাহ-বিচ্ছেদ কার্যকর হয়ে যায়। আল কুরআনে তালাকের পূর্বাপর করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন বিধি-বিধান দেয়া হয়েছে, যাতে পুরুষের উপর এমন অনেক দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে যা নিতান্তই নারী অধিকারের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় মানবিক বিধি-বিধান।
তালাক সম্পর্কে আমাদের সমাজে আল কুরআনের আলোকে সঠিক উপলব্ধির অভাবে এ সম্পর্কিত বিধি-বিধান যথাযথভাবে পরিপালন করা হয় না। ফলে তালাক সংক্রান্ত ব্যাপক পারিবারিক ও সামাজিক সংকটের সৃষ্টি হয়। তালাক না হওয়া সত্ত্বেও তালাক হয়েছে মনে করায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে একসাথে তিন তালাক হয়ে গেছে মনে করায় অনেক স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ককে পুনরায় স্বাভাবিক করতে চাইলেও তার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এবং সুযোগ পেলে কিছু ফতোয়াবাজ হিল্লা বিয়ে নামে কুরআন বিরুদ্ধ একটি বিয়ে প্রথার প্রচলনের মাধ্যমে নারীর অবমাননা করে থাকে। তালাকের বিধি-বিধানের সঠিক চর্চার অভাবে তালাকপ্রাপ্তা নারীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আল কুরআনের আলোকে তালাকের বিধি-বিধান সম্পর্কে আলোকপাত করে বিশ্বপ্রভুর বিধান জানা ও মানার অনুপ্রেরণা এবং এর মাধ্যমে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের উপায় অবলম্বনের উদ্দেশ্যে বইটি রচনা করা হয়েছে।
তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ একটি অনাকাংখিত বিষয় হলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেরও একটি ক্রমবর্ধমান ও আলোচিত বিষয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিবিএসের রিপোর্ট অনুসারে গত এক দশকে বাংলাদেশে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অন্যতম জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুসারে(১) : “তালাকের প্রবণতা সারা দেশের হিসাবেও বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত সাত বছরে তালাকের প্রবণতা ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে তালাক বেশি হচ্ছে। গত (২০২০ সালের) জুন মাসে প্রকাশিত বিবিএসের দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের ফলাফলে এ চিত্র পাওয়া গেছে”।
(১) ঢাকায় দিনে ৩৯ তালাক, সামছুর রহমান, ২২ ডিসেম্বর ২০২০, প্রথম আলো
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী তালাকের নোটিশ ঢাকার সিটি করপোরেশনের মেয়রের কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সিটি করপোরেশনের রেকর্ড অনুসারে বিগত ছয় বছরে প্রায় ৫০,০০০ তালাকের আবেদন রয়েছে যার অর্থ হলো প্রতি এক ঘন্টায় একটি করে আবেদন জমা পড়ে। আগের তুলনায় এখন নারীরা তালাক প্রদানে অনেকাংশেই এগিয়ে। ঢাকা সিটি করপোরেশনে ২০১৯ সালের হিসাব অনুসারে প্রায় ৭০ শতাংশ তালাকই স্ত্রীর পক্ষ থেকে। সাম্প্র্রতিক সময়ে নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা এবং একই সাথে পুরুষ (ও নারীদের) তরফ থেকে অনিয়ন্ত্রিত এবং ক্ষেত্র বিশেষে অনৈতিক জীবনযাপন তালাকের কারণকে হয়তো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তালাকের কারণ যাই হোক না কেন এবং যে কোন পক্ষ তালাক প্রদান করুক না কেন, এটি একটি আইনি বিষয়। বিয়ে মানুষের পারিবারিক জীবনের সুখ ও শান্তির সাথে সর্ম্পকিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই বিবাহ বিচ্ছেদ পারিবারিক জীবনের উপরে ভীষণভাবে প্রভাবশালী একটি ঘটনা। মানুষের জীবনে স্ট্রেস বা মানসিক পীড়নের পরিমাপের জন্য মনস্তত্ববিদেরা যে স্কেল আবিষ্কার করেছেন, সেই স্কেল অনুসারে একজন মানুষের জীবনে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে মানসিক পীড়নের যে ভার তা ১০০ এর মধ্যে ৭৩। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে মানুষের জীবনে যত ধরনের মানসিক অশান্তি ঘটতে পারে তার মধ্যে তীব্রতার দিক থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের অবস্থান দ্বিতীয়। সুতরাং এটা বলা যায় মানুষের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের সুখ-শান্তি এবং তার অভাব - এ দিক থেকে দেখলে বিবাহ বিচ্ছেদ একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তালাকের সাথে যে বিষয়গুলো চলে আসে তা হলো তালাকের কারণ বা বিরোধের নিষ্পত্তি, উভয়ে উভয়কে সময় দিয়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবনা চিন্তার সুযোগ, আপোষ মীমাংসার চেষ্টা, স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি দায়িত্ববোধ, বিশেষ করে স্ত্রীকে প্রদেয় দেনমোহর, ভরণপোষণ এবং সন্তান থাকলে তার খরচ ইত্যাদি। এ কারণেই তালাকের আইনি ডাইমেনশন রয়েছে।
আল কুরআন স্রষ্টার তরফ থেকে মানবজাতির জন্য নাযিল করা সার্বজনীন মহাবিধান যার মধ্যে মানুষের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়কেই সম্বোধন করা হয়েছে। তারই একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো কুরআনে তালাক বিষয়ের বিধান, যা অল্প কিছু আয়াতের মাধ্যমে আপাত কঠিন একটি বিষয়ের সার্বজনীন ও সকল কাল ও স্থানের প্রযোজ্য বিধানকে ধারণ করে। কুরআনের তালাকের আয়াতগুলো অধ্যয়ন করলে আমরা দেখতে পাই সেখানে নারীর অধিকার রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মানুষকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সভ্য আচরণের শিক্ষা।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে আমরা যদি বিবাহ বিচ্ছেদের ইতিহাসের দিকে মনোযোগ দেই তাহলে দেখা যায় যে: সবচেয়ে প্রাচীন ও লিপিবদ্ধ আইন হিসাবে এটি পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৬০ সালে ব্যাবিলনে, রাজা হাম্মুরাবির শাসনামলে যিনি প্রায় ২৮২টি আইনের ধারা পাথরে খোদাই করার উদ্যোগ নেন যার মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের বিধানও ছিলো। সে সময়ে একজন ব্যক্তি কেবলমাত্র “তুমি আমার স্ত্রী নও” এরকম ঘোষণা দিয়েই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারতো এবং এর সাথে তাকে একটি জরিমানা দণ্ড প্রদান এবং স্ত্রীকে তার প্রাপ্য মোহর ফিরিয়ে দিতে হতো। অন্যদিকে স্ত্রী যদি বিবাহ বিচ্ছেদ কামনা করতো তাহলে তাকে অভিযোগ দায়ের করতে হতো।
যে কুরআনে এখন থেকে প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বেই তালাকের পর্যাপ্ত, সার্বজনীন ও নারীর প্রতি সর্বোচ্চ অধিকার সংরক্ষণ করে বিধান পাওয়া যাচ্ছে তার বিপরীতে আধুনিক বিশ্বে বিবাহ বিচ্ছেদের স্ট্যান্ডার্ড ও প্রচলিত বিধান পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত। এটি বড়ই পরিতাপের বিষয় যে মুসলিম বিশ্ব কুরআনের সাথে তাদের সুসম্পর্ক না রাখতে পারার ফলে তালাকের যে সার্বজনীন ও সভ্য বিধান কুরআনে রয়েছে সেটিকে সঠিকভাবে জানার ব্যপারে চরম উদাসীনতা যেমন রয়েছে আবার সেই তালাকের বিধানকে সঠিক বুঝের অভাবে সেটিকে আংশিকভাবে হলেও বিকৃত করার দায়ে অভিযুক্ত।
সংক্ষেপে বিবাহ বিচ্ছেদের আধুনিক আইনের ইতিহাস যদি আমরা পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাই যে ডিভোর্স প্রথম যেসব ইউরোপিয়ান দেশে আইনি স্বীকৃতি পায় সেগুলো হলো: ফ্রান্সে ১৭৬২ সালে, কিন্তু আবার সেটিকে বেআইনী ঘোষণা করা হয় ১৮১৬ সালে; জার্মানীতে ১৮৭৫ সালে; আয়ারল্যান্ডে ১৯৯৭ সালে; ইটালীতে ১৯৭৪ সালে এবং স্পেনে ১৯৮১ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে বিবাহবিচ্ছেদকে প্রথম আইনানুগ করা হয় ১৭০১ সালে এবং এরপর দক্ষিণ ক্যারোলিনাতে ১৯৪৯/১৯৫০ সালে। ক্যালিফোর্নিয়া “নো-ফল্ট” ডিভোর্স আইন পাস করে ১৯৭০ সালে। লক্ষণীয় যে কুরআনে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে ডিভোর্সের সুযোগ কুরআন নাযিলের সময় থেকেই বিদ্যমান।
খ্রিস্টান ক্যাথলিক চার্চের ধর্মীয় বিধান অনুসারে বিয়ে আজীবন এবং সেখানে বিবাহ বিচ্ছেদ স্বাভাবিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণেই খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী দুনিয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে এক ধরনের অননুমোদন চলে এসেছে ১৮০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত। এর পূর্বে চার্চ বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতো এবং খুব বিশেষ কারণ ছাড়া বিয়ে বিচ্ছেদের অনুমতি দিতো না। তারপরেও সেই বিচ্ছেদের আবেদন কেবলমাত্র সমাজের প্রভাবশালী ও বিত্তশালীদের জন্যই সম্ভব ছিলো, সাধারণ মানুষের জন্য নয়।
আমরা যদি ইসলামের মূল রেফারেন্স হিসাবে কুরআনকে নেই এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করি যে - যে বিষয়ে কুরআনে সম্পূর্ণ সমাধান পাওয়া যাবে সে বিষয়ে এর বাইরে কোন উৎসকে গ্রহণ করা হবে না, সেক্ষেত্রে আমরা দেখবো যে তালাক প্রসঙ্গে কুরআনের আয়াতসমূহ অধ্যয়ন করলে সার্বজনীন বিধান পাওয়া সম্ভব। এই গ্রন্থের মাধ্যমে সেই বিষয়টিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। তালাক সর্ম্পকিত আয়াতের সংখ্যা যে খুব বেশি তা নয়, মাত্র ৩১টি যেখান থেকে একজন ব্যক্তির তালাক বিষয়ে স্রষ্টার বিধানের মূলনীতিগুলো গ্রহণ করা মোটেও কঠিন কিছু নয়।
কুরআন সেই বিধান গ্রন্থ যার বিশুদ্ধতা ও উৎস সম্পর্কে বিশ্বস্রষ্টার নিজস্ব প্রতিশ্রুতি রয়েছে যা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন ধর্মীয় গ্রন্থ বা বিধানে লক্ষণীয় নয়। কুরআনের বিশুদ্ধতা যেভাবে প্রশ্নাতীত এর বাইরে আর কোন উৎস সেভাবে প্রশ্নাতীত নয় অথবা বিভিন্ন সময় ও স্থানের মানুষের নিজস্ব ধ্যানধারণা দ্বারা কলুষিত হওয়ার উর্দ্ধে নয়। কুরআনের বাইরে যেসব উৎসকে ঐতিহ্য ও পরম্পরাগতভাবে মুসলিম সমাজ তার আইন প্রণয়নে ব্যবহার করেছে তার মধ্যে রয়েছে হাদীস, ইজমা ও কিয়াস। কুরআনকে উপক্ষো করে হাদীস, ইজমা ও কিয়াসে যাওয়া কুরআনের নির্দেশের পরিপন্থী, কেননা কুরআনে যে বিষয়কে স্পষ্ট করা হয়েছে সে বিষয়ে রাসুলেরও ভিন্ন বিধান দেওয়ার কোনো অবকাশ ছিলো না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি তালাকের মতো বিষয়টি নিয়ে কুরআনের আয়াতগুলোর বস্তুনিষ্ঠ ও প্রায়োগিক অধ্যয়ন করি তাহলে এটি প্রতীয়মান হতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না যে, তালাকের যত ধরনের আইনি ডাইমেনশন রয়েছে এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক দিকের বিবেচনাসহ তার সব কিছুই কুরআনে এসেছে। এই গ্রন্থে পাঠক তারই প্রমাণ পাবেন বলে আশা রাখা হচ্ছে।
কুরআন যেমন মানব জাতির জন্য বিশ^জগতের সর্বশক্তিমান প্রতিপালক ও একমাত্র বিধানদাতার তরফ থেকে বিধানগ্রন্থ, ঠিক তেমনি এর আয়াতসমূহ বক্রতা বর্জিত এবং সুস্পষ্ট যা বোঝার জন্য ¯স্রষ্টা মানুষকে যে স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি ও বিবেক দিয়েছেন সেটিই যথেষ্ট। এই বইটি উপস্থাপনা করার উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে: স্রষ্টার বিধানকে বোঝার চেষ্টা, তালাক বিষয়টি নিয়ে অধ্যয়ন, অনুধাবন এবং সার্বজনীন বোঝার উপযোগী করে একটি অধ্যয়ন সহায়িকা প্রস্তুত করা। আমরা বিশ্বাস করি এই বইটি পাঠের মাধ্যমে সাধারণ পাঠকরা তালাকের বিধানগুলো বুঝতে পারবেন এবং তালাক প্রদান ও তারপরে এর কার্যকর করার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে যেসব অজ্ঞানতা প্রসূত ধারণা রয়েছে সেগুলো অতিক্রম করতে সক্ষম হবেন। তালাকের ব্যাপারে কুরআন খুবই উদার; তালাক স্বাভাবিকভাবে দুইবার দেওয়া যায় এবং তারপরও স্বাভাবিক বৈবাহিক সম্পর্ক চাইলে দুইজনে বজায় রাখতে পারে, এ বিষয়গুলো আমরা অনেকেই জানি না। তালাক কোন উচ্চারণের বিষয় নয় এবং তিন বার তালাক বললেই তালাক হয় না। হিল্লা বিয়ে অকুরআনিক এবং সম্পূর্ণ অবৈধ একটি চর্চা যা কুরআন কখনোই সমর্থন করে না, বরং এটি কুরআনের একটি আয়াতের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার মাত্র।
কুরআন কখনোই নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে সর্মথন করে না। এই প্রেক্ষাপটেও একটি বহুলভাবে ব্যবহৃত অথচ ভুল অনুবাদের প্রসঙ্গ এই বইটিতে উঠে এসেছে এবং সংকলক যথার্থভাবেই দেখাতে সক্ষম হয়েছে কেন প্রচলিত অর্থটি অগ্রহণযোগ্য।
এই বইয়ে ব্যবহৃত কুরআনের আয়াতমূহ অনুবাদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংকলকের নিজস্ব অনুবাদ অনুসরণ করা হয়েছে যেখানে আরবী মূল শব্দের যথাসম্ভব কাছাকাছি বাংলা শব্দ চয়ন এবং প্রসঙ্গানুসারে প্রযোজ্য শব্দার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
বইটির রিভিউয়ের ক্ষেত্রে আমরা কৃতজ্ঞ কুরআন গবেষক আবু সাঈদ খানসহ অন্যান্য সহযোগীদের যারা তাদের মূল্যবান পর্যবেক্ষণ এবং পরামর্শ দিয়ে বইটিকে সম্পূর্ণ করতে সহায়তা করেছেন।
আল কুরআন অনুসারে মু’মিনরা তাদের কার্যক্রমে (তথা কুরআনে বর্ণিত বিধি-বিধান অনুধাবন ও অনুশীলন এবং বিভিন্ন নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণ - এ দ্বিবিধ ক্ষেত্রে) পরামর্শ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে (৪২:৩৮)। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বইটিকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি বিশ্লেষণাত্মক ধারা বিবরনী হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়া বইটি কুরআনের বিধি-বিধানের যৌক্তিকতা বিষয়ে একটি সাক্ষ্য। যারা এ বিষয়ে পারস্পরিক উপলব্ধির শেয়ারকে অনুধাবন যোগ্যতা উন্নয়নের কার্যকর উপায় হিসেবে অবলম্বনের স্তরে রয়েছেন বইটি তাদের কাজে আসতে পারে। বইটিতে উল্লেখিত আয়াতসমূহ মহান আল্লাহর নাজিলকৃত শাশ^ত সত্যের ধারক। লেখকের আলোচনার অংশটি অবশ্যই আল কুরআনের আয়াতসমূহের দ্বারা যাচাইযোগ্য এবং সেই সাথে যদি কোথাও বিশ্লেষণগত ত্রæটি ধরা পড়ে তাহলে পরবর্তী সংস্করণে সংশোধনযোগ্য।
বইটি ‘দি ইন্সটিটিউট ফর কুরআনিক রিসার্চ এন্ড এ্যাপ্লিকেশন’ বা ইক্বরার একটি প্রয়াস। কুরআন মহাগ্রন্থ যে কেবলমাত্র ধমীর্য় ও আনুষ্ঠানিক পাঠ করার জন্য নয়, বরং আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শনসমূহ নিয়ে গবেষণা, অধ্যয়ন ও আমাদের সামগ্রিক জীবনে প্রয়োগ করার বিষয় - এই উপলব্ধিই ইক্বরার পাথেয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় এই ইনস্টিটিউট স্রষ্টার সাহায্য প্রত্যাশা করে কুরআনের চর্চায় নিবেদিত থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
সাদিক মোহাম্মদ আলম
প্রতিষ্ঠাতা, ইক্বরা
৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১
মিরপুর, ঢাকা
আল কুরআনের আলোকে তালাকের বিধান বিশ্লেষণের জন্য প্রথমে তালাকের সাথে সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সরল অনুবাদ উল্লেখ করা হলো।
لِّلَّذِينَ يُؤْلُونَ مِن نِّسَائِهِمْ تَرَبُّصُ أَرْبَعَةِ أَشْهُرٍ فَإِن فَاءُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
২:২২৬ :: যারা নিজেদের স্ত্রীদের হতে পৃথক থাকার শপথ করে তারা চার মাস প্রতীক্ষা করবে, যদি তারা ফিরে আসে, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
وَإِنْ عَزَمُوا الطَّلَاقَ فَإِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
২:২২৭ :: পক্ষান্তরে যদি তারা তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা।
وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ وَلَا يَحِلُّ لَهُنَّ أَن يَكْتُمْنَ مَا خَلَقَ اللَّهُ فِي أَرْحَامِهِنَّ إِن كُنَّ يُؤْمِنَّ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَبُعُولَتُهُنَّ أَحَقُّ بِرَدِّهِنَّ فِي ذَٰلِكَ إِنْ أَرَادُوا إِصْلَاحًا وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
২:২২৮ :: তালাকপ্রাপ্তা নারীরা তিন কুরু (অর্থাৎ তিনটি পূর্ণ সময়ান্ত হায়েজ) পর্যন্ত প্রতীক্ষা করবে। আর যদি তারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে তাহলে আল্লাহ তাদের গর্ভে যা সৃষ্টি করেছেন তা গোপন করা তাদের পক্ষে বৈধ নয়। তাদের স্বামীরা যদি সংশোধনের ইচ্ছা করে তাহলে তারা উক্ত সময়ের মধ্যে তাদেরকে দাম্পত্য সম্পর্কে ফিরিয়ে নেয়ার অধিক হকদার। আর নারীদের অধিকার রয়েছে যেমন তাদের উপর পুরুষদের অধিকার রয়েছে। আর নারীদের উপর পুরুষদের (অধিকার ও পদমর্যাদাগত) উচ্চমান রয়েছে। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান ও মহাবিজ্ঞ।
الطَّلَاقُ مَرَّتَانِ فَإِمْسَاكٌ بِمَعْرُوفٍ أَوْ تَسْرِيحٌ بِإِحْسَانٍ وَلَا يَحِلُّ لَكُمْ أَن تَأْخُذُوا مِمَّا آتَيْتُمُوهُنَّ شَيْئًا إِلَّا أَن يَخَافَا أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا فِيمَا افْتَدَتْ بِهِ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَعْتَدُوهَا وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ اللَّهِ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
২:২২৯ :: তালাক দুই দফা, তারপর (এ দুইবারের প্রত্যেক বারের পর তোমাদের জন্য সুযোগ আছে যে) তোমরা স্বীয় স্ত্রীদেরকে ন্যায়সঙ্গতভাবে রেখে দিবে অথবা উত্তম আচরণের সাথে বিদায় দিবে। আর তোমরা তাদেরকে দেনমোহর বাবদ যা কিছু দিয়েছো তা থেকে কিছু ফেরত নেয়া তোমাদের জন্য বৈধ নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়েছে যে, যদি স্বামী স্ত্রী উভয়ে আল্লাহর সীমাসমূহ রক্ষা করতে পারবে না বলে আশংকা করে তখন যদি তোমরাও আশংকা করো যে তারা উভয়ে (যৌথভাবে) আল্লাহর সীমাসমূহ রক্ষা করতে পারবে না, তখন স্ত্রী (তালাক সংঘটনের জন্য) দেনমোহরের কোনো অংশ ফিদইয়াস্বরূপ ফিরিয়ে দিলে তাতে তাদের উভয়ের জন্য কোনো দোষ নেই। এগুলো আল্লাহর সীমা, তোমরা তা লংঘন করো না। আর যারা আল্লাহর সীমা লংঘন করে তারাই জালিম।
فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِن بَعْدُ حَتَّىٰ تَنكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَن يَتَرَاجَعَا إِن ظَنَّا أَن يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
২:২৩০ :: অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয় তাহলে এরপরে (অর্থাৎ তৃতীয়বার তালাকের পরে) সে নারী তার জন্য বৈধ হবে না, যতক্ষণ না সে নারী অন্য কাউকে বিয়ে করে এবং সে (অর্থাৎ পরবর্তী স্বামী) তাকে তালাক দেয়। তখন যদি তারা দুজন (অর্থাৎ নারীটি এবং তাকে পূর্বে তালাক দেয়া স্বামী) আল্লাহর সীমাসমূহ প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারবে বলে ধারণা করে তবে তারা পুনরায় বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াতে তাদের দুজনের কোনো গুনাহ হবে না। এগুলো আল্লাহর সীমা। তিনি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন।
وَإِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَبَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمْسِكُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ أَوْ سَرِّحُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ وَلَا تُمْسِكُوهُنَّ ضِرَارًا لِّتَعْتَدُوا وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ وَلَا تَتَّخِذُوا آيَاتِ اللَّهِ هُزُوًا وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَمَا أَنزَلَ عَلَيْكُم مِّنَ الْكِتَابِ وَالْحِكْمَةِ يَعِظُكُم بِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
২:২৩১ :: যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দাও (প্রথমবার বা দ্বিতীয়বার) এবং তারা তাদের (ইদ্দাতের) নির্ধারিত শেষ সীমায় পৌঁছে, তখন হয় তাদেরকে ন্যায়সঙ্গতভাবে রেখে দাও, না হয় ন্যায়সঙ্গতভাবে বিদায় দাও। আর তাদেরকে যাতনা দেয়ার উদ্দেশ্যে ফিরিয়ে নিয়ে আটকে রেখো না। কেননা এতে বাড়াবাড়ি করা হয়। আর যে এরূপ করে সে অবশ্যই তার নিজ সত্তার প্রতিই জুলুম করে। আর তোমরা আল্লাহর আয়াতসমূহকে হাসি তামাশার বিষয় হিসাবে গ্রহণ করো না। আর তোমরা স্মরণ রেখো আল্লাহ তোমাদের উপর যে অনুগ্রহ করেছেন তা এবং তিনি কিতাব ও হিকমাত থেকে তোমাদের উপর যা নাজিল করেছেন তা। তিনি তা দ্বারা তোমাদেরকে উপদেশ দেন। আর তোমরা আল্লাহ সচেতন হও। আর নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞানী।
وَإِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَبَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا تَعْضُلُوهُنَّ أَن يَنكِحْنَ أَزْوَاجَهُنَّ إِذَا تَرَاضَوْا بَيْنَهُم بِالْمَعْرُوفِ ذَٰلِكَ يُوعَظُ بِهِ مَن كَانَ مِنكُمْ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَٰلِكُمْ أَزْكَىٰ لَكُمْ وَأَطْهَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
২:২৩২ :: আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দাও তারপর তারা তাদের (ইদ্দাতের) নির্ধারিত শেষ সীমায় পৌঁছে, তখন তোমরা তাদেরকে তাদের (প্রস্তাবিত) স্বামীকে বিবাহ করতে বাধা দিও না, যখন তারা পরস্পরে ন্যায়সঙ্গতভাবে সম্পর্ক স্থাপনে সম্মত হয়। এ উপদেশ তাকে দেয়া হচ্ছে তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে। এটাই তোমাদের জন্য সবচেয়ে পরিশুদ্ধ ও সবচেয়ে পবিত্র নিয়ম। আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না।
وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَن يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ لَا تُكَلَّفُ نَفْسٌ إِلَّا وُسْعَهَا لَا تُضَارَّ وَالِدَةٌ بِوَلَدِهَا وَلَا مَوْلُودٌ لَّهُ بِوَلَدِهِ وَعَلَى الْوَارِثِ مِثْلُ ذَٰلِكَ فَإِنْ أَرَادَا فِصَالًا عَن تَرَاضٍ مِّنْهُمَا وَتَشَاوُرٍ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا وَإِنْ أَرَدتُّمْ أَن تَسْتَرْضِعُوا أَوْلَادَكُمْ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِذَا سَلَّمْتُم مَّا آتَيْتُم بِالْمَعْرُوفِ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
২:২৩৩ :: যে পিতা ইচ্ছা রাখে যে, তার সন্তান পূর্ণ মেয়াদ দুধ পান করুক, সেক্ষেত্রে মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দুই বছর দুধপান করাবে। এ অবস্থায় পিতার দায়িত্ব হচ্ছে তাদেরকে ন্যায়সঙ্গতভাবে জীবিকা ও পোশাকাদি দিতে থাকবে। আর কারো প্রতি তার সামর্থ্য ব্যতীত বোঝা চাপানো যাবে না। মাকেও এ প্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না যে, সন্তান তারই; আর পিতাকেও এ প্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না যে, সন্তান তারই। আর দুধপান করানো মায়ের এ অধিকার যেমন সন্তানের পিতার উপর তেমনি সমান পরিমাণে তার ওয়ারিসদের উপরও বর্তাবে। তারপর যদি (পিতা-মাতা) উভয়ে পারস্পরিক সম্মতি ও পরামর্শক্রমে (পূর্ণ মেয়াদের পূর্বে) সন্তানকে দুধ ছাড়াতে ইচ্ছা করে তাহলে তাতে তাদের কারো গুনাহ নেই। আর যদি তোমরা ইচ্ছা করো যে, তোমরা অন্য কোনো নারী দ্বারা তোমাদের সন্তানদেরকে দুধপান করাবে তাহলে তোমরা তাদেরকে ন্যায়সঙ্গতভাবে খরচাদি দিয়ে তার হাতে অর্পণ করা সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে এতে তোমাদের গুনাহ নেই। আর আল্লাহ সচেতন হও। আর নিশ্চয় তোমরা যা করো আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।
وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا يَتَرَبَّصْنَ بِأَنفُسِهِنَّ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا فَإِذَا بَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا فَعَلْنَ فِي أَنفُسِهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
২:২৩৪ :: তোমাদের মধ্য হতে যারা স্ত্রীদেরকে রেখে মারা যাবে সে অবস্থায় স্ত্রীরা নিজেদেরকে চার মাস দশ দিন অপেক্ষায় রাখবে। তারপর যখন তাদের (ইদ্দাতের) নির্ধারিত শেষ সীমায় পৌছে, তখন তারা নিজেদের সম্বন্ধে ন্যায়সঙ্গতভাবে যা করবে তাতে তোমাদের কোনো গুনাহ নেই। আর তোমরা যা কিছু করছ, আল্লাহ সে বিষয়ে পরিজ্ঞাত।
وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا عَرَّضْتُم بِهِ مِنْ خِطْبَةِ النِّسَاءِ أَوْ أَكْنَنتُمْ فِي أَنفُسِكُمْ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ سَتَذْكُرُونَهُنَّ وَلَـٰكِن لَّا تُوَاعِدُوهُنَّ سِرًّا إِلَّا أَن تَقُولُوا قَوْلًا مَّعْرُوفًا وَلَا تَعْزِمُوا عُقْدَةَ النِّكَاحِ حَتَّىٰ يَبْلُغَ الْكِتَابُ أَجَلَهُ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي أَنفُسِكُمْ فَاحْذَرُوهُ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ حَلِيمٌ
২:২৩৫ :: আর তোমরা (বিধবা) নারীদের বিয়ে প্রসঙ্গে তোমাদের কথাবার্তায় যা প্রকাশ কর বা নিজেদের মনে তা গোপন রাখ সে বিষয়ে তোমাদের উপর গুনাহ নেই। আল্লাহ জানেন যে, তোমরা তোমাদের আলোচনায় তাদের বিষয় রাখবে। কিন্তু তোমরা তাদেরকে গোপনে ওয়াদা দিও না। কিন্তু তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদের সাথে কথা বলতে পারবে। আর যতক্ষণ না বিধিবদ্ধ বিষয় (অর্থাৎ ইদ্দাত) তার শেষ সীমায় পৌছে ততক্ষণ তোমরা বিয়ের সিদ্ধান্ত করো না। আর জেনে রাখ যে, তোমাদের মনে কী আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তোমরা তাঁর প্রতি সচেতন থেকো। আর জেনে রাখ যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও সহনশীল।
لَّا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِن طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ مَا لَمْ تَمَسُّوهُنَّ أَوْ تَفْرِضُوا لَهُنَّ فَرِيضَةً وَمَتِّعُوهُنَّ عَلَى الْمُوسِعِ قَدَرُهُ وَعَلَى الْمُقْتِرِ قَدَرُهُ مَتَاعًا بِالْمَعْرُوفِ حَقًّا عَلَى الْمُحْسِنِينَ
২:২৩৬ :: যদি (বিশেষ কোনো কারণে) তোমরা স্ত্রীদেরকে স্পর্শ করার আগে এবং দেনমোহর ধার্য করার আগে তালাক দাও তাতে তোমাদের গুনাহ নেই। তবে এ অবস্থায় তোমাদের তাদেরকে ভোগসামগ্রী দিতে হবে। স্বচ্ছল তার সাধ্যমতো এবং অস্বচ্ছল তার সাধ্যমতো। ন্যায়সঙ্গত ভোগসামগ্রী। এটা উত্তম আচরণকারীদের উপর একটি দায়িত্ব।
وَإِن طَلَّقْتُمُوهُنَّ مِن قَبْلِ أَن تَمَسُّوهُنَّ وَقَدْ فَرَضْتُمْ لَهُنَّ فَرِيضَةً فَنِصْفُ مَا فَرَضْتُمْ إِلَّا أَن يَعْفُونَ أَوْ يَعْفُوَ الَّذِي بِيَدِهِ عُقْدَةُ النِّكَاحِ وَأَن تَعْفُوا أَقْرَبُ لِلتَّقْوَىٰ وَلَا تَنسَوُا الْفَضْلَ بَيْنَكُمْ إِنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
২:২৩৭ :: আর যদি তোমরা তাদেরকে তালাক দাও তাদেরকে স্পর্শ করার আগে আর তাদের জন্য দেনমোহর ধার্য করার পরে তাহলে ধার্যকৃত দেনমোহরের অর্ধেক তাদেরকে দিতে হবে। কিন্তু যদি স্ত্রী অনুগ্রহ করে (অর্থাৎ কম নেয়) অথবা যার হাতে বিবাহের বন্ধন (অর্থাৎ স্বামী বা তালাক বিভাগের কর্মকর্তা বা আইনগত অভিভাবক) সে যদি অনুগ্রহ করে তা ভিন্ন কথা। অবশ্য তোমরা (অর্থাৎ পুরুষরা) অনুগ্রহ করলে (অর্থাৎ বেশি বা পূর্ণ পরিমাণ দিলে) তা আল্লাহ সচেতনতার নিকটতর। আর তোমরা তোমাদের পরস্পরের মধ্যে অনুগ্রহপূর্ণ আচরণ করতে ভুলে যেও না। নিশ্চয় তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।
حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَىٰ وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ
২:২৩৮ :: তোমরা সালাতসমূহের প্রতি হেফাজতকারী (যত্নশীল) হও এবং (বিশেষভাবে) মধ্যবর্তী / কেন্দ্রস্থ সালাতের প্রতি এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দাঁড়াও।
فَإِنْ خِفْتُمْ فَرِجَالًا أَوْ رُكْبَانًا فَإِذَا أَمِنتُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَمَا عَلَّمَكُم مَّا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ
২:২৩৯ :: যদি তোমরা (স্বাভাবিক নিয়মে সালাত হেফাযত করতে না পারার) ভয় করো, তবে পদচারী হও বা আরোহী হও (চলন্ত অবস্থায় সালাত করে নাও / যথাসম্ভব উপায়ে হিজরত করো)। তারপর যখন তোমরা নিরাপদ হও তখন আল্লাহকে স্মরণ কর যেভাবে তিনি তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা তোমরা জানতে না।
وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا وَصِيَّةً لِّأَزْوَاجِهِم مَّتَاعًا إِلَى الْحَوْلِ غَيْرَ إِخْرَاجٍ فَإِنْ خَرَجْنَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِي مَا فَعَلْنَ فِي أَنفُسِهِنَّ مِن مَّعْرُوفٍ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
২:২৪০ :: তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদের স্ত্রীদেরকে রেখে মৃত্যুবরণ করে তাদের স্ত্রীদের বিষয়ে (মৃত স্বামীর পরিবার পরিজন বা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি) ওয়াসিয়াত হচ্ছে, এক বছর পর্যন্ত তাদের স্ত্রীদেরকে ভরণ পোষণ দিতে হবে এবং ঘর থেকে বের করে দেয়া যাবে না। তবে যদি তারা নিজেরাই বেরিয়ে যায় তাহলে সেক্ষেত্রে তারা ন্যায়সঙ্গতভাবে নিজেদের ক্ষেত্রে যা করে সে বিষয়ে তোমাদের গুনাহ নেই। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান ও মহাবিজ্ঞ।
وَلِلْمُطَلَّقَاتِ مَتَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِينَ
২:২৪১ :: তালাকপ্রাপ্তা নারীদেরকে ন্যায়সঙ্গত (অর্থাৎ যথাসাধ্য) ভোগসামগ্রী দান করা মুত্তাকীদের কর্তব্য।
كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
২:২৪২ :: এভাবেই আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ, যাতে তোমরা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করতে পার।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَطَلِّقُوهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ وَأَحْصُوا الْعِدَّةَ وَاتَّقُوا اللَّهَ رَبَّكُمْ لَا تُخْرِجُوهُنَّ مِن بُيُوتِهِنَّ وَلَا يَخْرُجْنَ إِلَّا أَن يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ اللَّهِ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ لَا تَدْرِي لَعَلَّ اللَّهَ يُحْدِثُ بَعْدَ ذَٰلِكَ أَمْرًا
৬৫:১ :: হে নবী, যখন তোমরা নারীদেরকে তালাক দাও তখন তাদেরকে ইদ্দাতের শর্ত পূরণ করে তালাক দিও। আর তোমরা ইদ্দাত গণনা করো। আর আল্লাহকে ভয় করো যিনি তোমাদের প্রতিপালক। স্পষ্ট অশ্লীল কাজে লিপ্ত হওয়া ছাড়া (প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে) তোমরা তাদেরকে তাদের ঘর থেকে বের করে দিও না, আর (কোনো যথার্থ কারণ ছাড়া) তারাও যেন বের না হয়। আর এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। আর যে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘন করে নিশ্চয় সে নিজ সত্তার উপরই জুলুম করে। তুমি জান না হয়তো এরপর আল্লাহ কোনো (মীমাংসার) উপায়ের উদ্ভব ঘটাবেন।
فَإِذَا بَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمْسِكُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ أَوْ فَارِقُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ وَأَشْهِدُوا ذَوَيْ عَدْلٍ مِّنكُمْ وَأَقِيمُوا الشَّهَادَةَ لِلَّهِ ذَٰلِكُمْ يُوعَظُ بِهِ مَن كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًا
৬৫:২ :: সুতরাং যখন তারা তাদের (ইদ্দাতের) নির্ধারিত শেষ সীমায় পৌঁছে যায় তখন তাদেরকে ন্যায়সঙ্গতভাবে রেখে দাও অথবা তাদেরকে ন্যায়সঙ্গতভাবে পৃথক করে দাও। আর (তালাক, ইমছাক বা রেখে দেয়া এবং মুফারাক্বাত বা বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার ক্ষেত্রে) তোমরা তোমাদের মধ্য থেকে দুজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখ। আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাক্ষ্যকে প্রতিষ্ঠা কর। এ উপদেশ তাকে দেয়া হচ্ছে যে আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে। আর যে আল্লাহ সচেতন হয় তিনি তার জন্য (সংকট থেকে) বের হবার উপায় করে দিবেন।
وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا
৬৫:৩ :: আর তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দিবেন যা সে হিসাবও করে নি। আর যে আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর কাজ সম্পন্ন করেই থাকেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছুর জন্য প্রাকৃতিক বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
وَاللَّائِي يَئِسْنَ مِنَ الْمَحِيضِ مِن نِّسَائِكُمْ إِنِ ارْتَبْتُمْ فَعِدَّتُهُنَّ ثَلَاثَةُ أَشْهُرٍ وَاللَّائِي لَمْ يَحِضْنَ وَأُولَاتُ الْأَحْمَالِ أَجَلُهُنَّ أَن يَضَعْنَ حَمْلَهُنَّ وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا
৬৫:৪ :: আর তোমাদের নারীদের মধ্য থেকে যারা মাসিক রজ:স্রাব থেকে নিরাশ হয়েছে, (তাদের ইদ্দাতের প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতি সম্পর্কে) যদি তোমরা সন্দেহ করো, তাহলে (জেনে নাও যে), তাদের ইদ্দাত হচ্ছে তিন মাস। আর তাদের জন্যও (ইদ্দাত হচ্ছে তিনমাস) যাদের (কোনো জটিলতার কারণে) মাসিক রজ:স্রাব হয়নি। আর গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে তাদের (ইদ্দাতের) নির্ধারিত শেষ সময়সীমা হচ্ছে তাদের সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত। আর যে আল্লাহ সচেতন হয় তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।
ذَٰلِكَ أَمْرُ اللَّهِ أَنزَلَهُ إِلَيْكُمْ وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهِ وَيُعْظِمْ لَهُ أَجْرًا
৬৫:৫ :: এটা আল্লাহর আদেশ, তিনি তোমাদের প্রতি তা নাজিল করেছেন। আর যে আল্লাহ সচেতন হয় তিনি তার থেকে তার মন্দসমূহকে মোচন করে দেবেন। আর তিনি তার প্রতিফলকে মানসম্মত করবেন।
أَسْكِنُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ سَكَنتُم مِّن وُجْدِكُمْ وَلَا تُضَارُّوهُنَّ لِتُضَيِّقُوا عَلَيْهِنَّ وَإِن كُنَّ أُولَاتِ حَمْلٍ فَأَنفِقُوا عَلَيْهِنَّ حَتَّىٰ يَضَعْنَ حَمْلَهُنَّ فَإِنْ أَرْضَعْنَ لَكُمْ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ وَأْتَمِرُوا بَيْنَكُم بِمَعْرُوفٍ وَإِن تَعَاسَرْتُمْ فَسَتُرْضِعُ لَهُ أُخْرَىٰ
৬৫:৬ :: তোমরা তোমাদের সামর্থ্য অনুসারে যে ধরনের বাসস্থানে বসবাস করো তাদেরকে সে ধরনের বাসস্থানে বসবাস করতে দাও। আর তোমরা তাদেরকে সংকটে ফেলে কষ্ট দিও না। আর যদি তারা গর্ভবতী হয়, তাহলে তারা সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত তাদের জন্য ব্যয় করো। তারপর যদি তারা তোমাদের সন্তানদেরকে দুধপান করায়, তাহলে তাদেরকে তাদের পারিতোষিক দাও আর (সন্তানের কল্যাণ সম্পর্কে) তোমরা নিজেদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে পরামর্শ কর। আর যদি তোমরা পরস্পরে কঠোরতা কর, তাহলে তার পক্ষে (অর্থাৎ পিতার পক্ষ থেকে নিযুক্তি ও পারিতোষিকের ভিত্তিতে) অন্য কোনো নারী শিশুকে দুধপান করাবে।
لِيُنفِقْ ذُو سَعَةٍ مِّن سَعَتِهِ وَمَن قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللَّهُ لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا سَيَجْعَلُ اللَّهُ بَعْدَ عُسْرٍ يُسْرًا
৬৫:৭ :: স্বচ্ছল ব্যক্তি যেন তার স্বচ্ছলতা অনুযায়ী ব্যয় করে আর যাকে তার রিজিক পরিমিত করে দেয়া হয়েছে সেও যেন আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তা অনুযায়ী ব্যয় করে। আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে তার সাধ্যের চেয়ে বেশি দায়িত্বভার অর্পণ করেন না। আল্লাহ কঠিনতার পর শীঘ্রই সহজতার উদ্ভব ঘটাবেন।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نَكَحْتُمُ الْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ طَلَّقْتُمُوهُنَّ مِن قَبْلِ أَن تَمَسُّوهُنَّ فَمَا لَكُمْ عَلَيْهِنَّ مِنْ عِدَّةٍ تَعْتَدُّونَهَا فَمَتِّعُوهُنَّ وَسَرِّحُوهُنَّ سَرَاحًا جَمِيلًا
৩৩:৪৯ :: হে মু’মিনগণ, যখন তোমরা কোনো মু’মিন নারীকে বিবাহ করো, তারপর তোমরা তাদেরকে স্পর্শ করার আগেই তাদেরকে তালাক দাও, তখন তোমাদের জন্য তাদের উপর ইদ্দাত পালনের দায়িত্ব আরোপের কোনো অধিকার নেই, যা তোমরা গণনা করবে। (অর্থাৎ এ ধরনের তালাকপ্রাপ্তার জন্য কোনো ইদ্দাত নেই)। তবে তাদেরকে (কিছু) ভোগসামগ্রী দিয়ে দাও আর তাদেরকে সুন্দরভাবে বিদায় দাও।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَحِلُّ لَكُمْ أَن تَرِثُوا النِّسَاءَ كَرْهًا وَلَا تَعْضُلُوهُنَّ لِتَذْهَبُوا بِبَعْضِ مَا آتَيْتُمُوهُنَّ إِلَّا أَن يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍ وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِن كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا
৪:১৯ :: হে মু’মিনগণ, তোমাদের জন্য বলপ্রয়োগপূর্বক নারীদের ওয়ারিস হওয়া বৈধ নয়। আর তোমরা তাদেরকে (দেনমোহর বাবদ) যা দিয়েছো তার কোনো অংশ কেড়ে নেয়ার জন্য তাদেরকে (সামাজিক কর্মকান্ডে) বাধা দিও না। কিন্তু তারা স্পষ্ট অশ্লীলতায় জড়িত হলে (বাধা দিতে ও দেনমোহরের অংশবিশেষ ফেরত নিয়ে তালাক দিতে পারবে)। আর তোমরা তাদের সাথে জীবন যাপন করো ন্যায়নীতি অনুযায়ী। যদি তোমরা কোনো কারণে তাদেরকে অপছন্দ কর, তাহলে হতে পারে যে, তোমরা অপছন্দ করছো এক সত্তাকে (অর্থাৎ নিজের স্ত্রীকে) অথচ আল্লাহ রেখেছেন তার মধ্যে অনেক কল্যাণ। (অর্থাৎ কোনো স্ত্রীর একটি বিষয় অপছন্দের হলেও সামগ্রিকভাবে তার মধ্যে অনেক কল্যাণ থাকা সম্ভব)।
وَإِنْ أَرَدتُّمُ اسْتِبْدَالَ زَوْجٍ مَّكَانَ زَوْجٍ وَآتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنطَارًا فَلَا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئًا أَتَأْخُذُونَهُ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُّبِينًا
৪:২০ :: আর যদি তোমরা আগের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তার বদলে অন্য স্ত্রী পেতে চাও, সেক্ষেত্রে তোমরা তাদের একজনকে (তথা আগের স্ত্রীকে) অঢেল সম্পদ দিয়ে থাকলেও তা থেকে কিছুই ফেরত নিও না। তোমরা কি গ্রহণ করবে (তথা ফিরিয়ে নিবে) অপবাদ দিয়ে আর স্পষ্ট পাপে জড়িত হয়ে?
وَكَيْفَ تَأْخُذُونَهُ وَقَدْ أَفْضَىٰ بَعْضُكُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ وَأَخَذْنَ مِنكُم مِّيثَاقًا غَلِيظًا
৪:২১ :: আর তোমরা তা কিরূপে ফেরত নিবে অথচ তোমরা একে অন্যের সাথে একান্তে মিলিত হয়েছো? আর তারা তোমাদের থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে।
الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ وَبِمَا أَنفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِّلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيرًا
৪:৩৪ :: পুরুষরা নারীদের উপর সামগ্রিক দায়িত্বশীল। এজন্য যে আল্লাহ তাদের এককে অন্যের উপর বিশিষ্টতা দিয়েছেন এবং এজন্য যে পুরুষরা তাদের সম্পদ থেকে (নারীদের জন্য) ব্যয় করে। সুতরাং সৎকর্মশীলা নারীরা বিনয়ী হয় এবং আল্লাহর হেফাজতের আওতায় অদৃশ্যে থাকা বিষয়ের (স্বীয় সতীত্ব ও সন্তানের পিতৃপরিচয়গত বিষয়ের) সংরক্ষণকারিনী হয়। আর যাদের ব্যাপারে তোমরা আশংকা করো যে, তারা দাম্পত্য চুক্তি লংঘন করছে, তাদেরকে উপদেশ দাও এবং তাদেরকে বিছানায় পরিত্যাগ করো এবং তাদেরকে (বিছানায় একা রেখে দেয়া থেকে) ভিন্ন অবস্থায় বের করে আনো (অর্থাৎ সম্পর্ককে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনো)/ তাদেরকে (সমাধানে সম্পর্কিত হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের) সামনে উপস্থাপন কর। তারপর যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করে, তাহলে তোমরা তাদের বিপক্ষে অন্য কোনো ব্যবস্থা তালাশ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বোচ্চে অধিষ্ঠিত, সর্বশ্রেষ্ঠ।
وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِّنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِّنْ أَهْلِهَا إِن يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا
৪:৩৫ :: আর যদি তোমরা আশংকা করো যে, তাদের দুজনের মধ্যে (অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে) বিরোধ ঘটেছে, তাহলে তোমরা পুরুষটির পরিবার পরিজন থেকে একজন বিচক্ষণ মীমাংসাকারী আর নারীটির পরিবার পরিজন থেকে একজন বিচক্ষণ মীমাংসাকারী নিযুক্ত করো(২) । যদি তারা (স্বামী-স্ত্রী) দুজনই সংশোধনের মনোবৃত্তি রাখে তাহলে আল্লাহ তাদের দুজনের মধ্যে মিলমিশ তৈরি হওয়ার তাওফিক দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত।
(২) এই মীমাংসাকারী পরিবারের সদস্যভুক্ত যেমন হতে পারে, তেমনি পরিবারের পক্ষ থেকে নিযুক্ত পারিবারিক আইনজীবী হওয়ারও সুযোগ রয়েছে।
وَإِنِ امْرَأَةٌ خَافَتْ مِن بَعْلِهَا نُشُوزًا أَوْ إِعْرَاضًا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَن يُصْلِحَا بَيْنَهُمَا صُلْحًا وَالصُّلْحُ خَيْرٌ وَأُحْضِرَتِ الْأَنفُسُ الشُّحَّ وَإِن تُحْسِنُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا
৪:১২৮ :: আর যদি কোনো স্ত্রী তার স্বামীর পক্ষ থেকে দাম্পত্য চুক্তি লংঘনের (অর্থাৎ ইনসাফপূর্ণ আচরণে ব্যত্যয় ঘটার) অথবা উপেক্ষার আশংকা করে তাহলে তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করে নিলে তাদের দুজনের কোনো গুনাহ হবে না। আর মীমাংসাই উত্তম। আর মানবমনে সংকীর্ণতা বিদ্যমান রয়েছে। আর যদি তোমরা উত্তম কাজ করো ও আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন কর তবে তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা সম্যক অবগত।
وَلَن تَسْتَطِيعُوا أَن تَعْدِلُوا بَيْنَ النِّسَاءِ وَلَوْ حَرَصْتُمْ فَلَا تَمِيلُوا كُلَّ الْمَيْلِ فَتَذَرُوهَا كَالْمُعَلَّقَةِ وَإِن تُصْلِحُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَّحِيمًا
৪:১২৯ :: আর তোমরা স্ত্রীদের মধ্যে হুবহু আদল (ইনসাফ) করতে সক্ষম হবে না যদিও তোমরা প্রয়াস পাও। সুতরাং তোমরা কারো দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড়ো না যার ফলে তাকে (অর্থাৎ অন্য স্ত্রীকে) ঝুলন্ত অবস্থার মতো রাখা হয়। আর যদি তোমরা আত্মসংশোধন করো এবং আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন করো তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াশীল।
وَإِن يَتَفَرَّقَا يُغْنِ اللَّهُ كُلًّا مِّن سَعَتِهِ وَكَانَ اللَّهُ وَاسِعًا حَكِيمًا
৪:১৩০ :: আর যদি (ন্যায়সঙ্গত কারণে) স্বামী-স্ত্রী দুজন বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করে তাহলে আল্লাহ প্রত্যেককে তাঁর প্রাচুর্য দিয়ে অভাবমুক্ত করবেন। আর আল্লাহ ব্যাপকত্বের অধিকারী ও মহাবিজ্ঞ।
উল্লেখিত আয়াতসমূহের ভিত্তিতে কুরআনে তালাকের বিধান ও নারী অধিকারের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় যে সকল নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে নিম্নে তার বিভিন্ন দিক বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
তালাক সম্পর্কিত আয়াতসমূহের মধ্যে ২:২২৮ আয়াতে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্বের তুলনামূক অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। তালাক সম্পর্কিত বিভিন্ন বিধি-বিধান আলোচনার পূর্বে এ বিষয়টিতে আলোকপাত করা প্রয়োজন।
আয়াতটিতে বলা হয়েছে, “আর নারীদের অধিকার রয়েছে যেমন তাদের উপর পুরুষদের অধিকার রয়েছে। আর নারীদের উপর পুরুষদের (অধিকার ও পদমর্যাদাগত) উচ্চমান রয়েছে। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান ও মহাবিজ্ঞ।”
কুরআনের বিধি-বিধান প্রকৃতিগত, বাস্তবভিত্তিক। তাই কুরআনে পুরুষকে যে ধরনের দায়িত্ব ও অধিকার দেয়া হয়েছে তাতে সে কিছু উচ্চমাত্রার সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। যেমন নারীর দায়িত্বশীল (ক্বাওয়াম) হিসেবে দায়িত্ব পালন, শর্তসাপেক্ষে একাধিক বিয়ে করতে পারার অবকাশ, নারীকে সরাসরি তালাক দিতে পারার ক্ষমতা এবং পুরুষের জন্য ইদ্দাতের বিধান না থাকা। এগুলো নারীর অধিকারকে ক্ষুন্ন করে না বরং এর প্রতিটির বিপরীতে নারীর অধিকার সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন শর্ত বা দায়িত্ব রয়েছে। পুরুষকে এসব অধিকার, পদমর্যাদা বা সুবিধা দেয়া হয়েছে প্রকৃতিগত বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নারী-পুরুষের দাম্পত্য জীবন ও তার মাধ্যমে সমাজ জীবনকে বাস্তবসম্মত কল্যাণকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুব্যবস্থিত করার জন্য। তাই নারীকে তার প্রকৃতিগত দায়িত্ব পালনের জন্য সার্বিক সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে দেয়ার ক্ষেত্রে পুরুষকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা উচিত।
যেহেতু পুরুষ স্বীয় শক্তিবলে নিজ অধিকার আদায় করতে সক্ষম, তাই তার উচিত নারীর অধিকার আদায়ে যেন কোন ত্রুটি হয়ে না যায় সে বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হওয়া। কারণ আল্লাহ শক্তি দেন তার অপব্যবহারের জন্য নয়, বরং উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে দায়িত্বশীলতার জন্য। সুতরাং পুরুষের প্রাপ্ত এ দারাজাতের জন্য তার তুলনামূলক অধিক দায়িত্বসচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। তাকে বুঝতে হবে যে, প্রকৃতিগতভাবে সে একটি উচ্চপর্যায়ের সুযোগ-সুবিধার অধিকারী যার কারণে তাকে এর ন্যায়সঙ্গত ব্যবহারের প্রশ্নে বিশেষ জবাবদিহিতা করতে হবে। সুতরাং নারী যদি কিছু ভুল করে ফেলে পুরুষকে তা যথাসম্ভব ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে এবং নারীর প্রতি তুলনামূলক অধিক প্রেমময়-সহনশীল হতে হবে।
সর্বোপরি উভয়কে মনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ মহাশক্তিশালী ও মহাবিজ্ঞ। তিনি বিজ্ঞতাপূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবেই স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কেউ তার দায়িত্ব পালনে বা অন্যের অধিকার পরিপূরণে অবহেলা করলে তিনি তাকে কঠোর শাস্তি দিবেন।
সুরা নিসার ৩৪ আয়াতে কোনো স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি দাম্পত্য চুক্তি লংঘনের আশংকা করলে কী করতে হবে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশনা অনুসরণ করলে অযথা তালাক সংঘটনের পরিমাণ কমে যাবে, পারিবারিক ব্যবস্থা মজবুত হবে এবং সামাজিক সংহতি বজায় থাকবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এ আয়াতকে অনেকে কুরআনে স্ত্রী প্রহারের বৈধতা দেয়া হয়েছে মর্মে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন। আয়াতটিতে ব্যবহৃত যে শব্দটির উপর ভিত্তি করে দাবিটি করা হয় তা হলো, ‘ওয়াদরিবূহুন্না’, যার একটি শাব্দিক অনুবাদ হতে পারে, ‘আর তাদেরকে বিচলিত / প্রহার কর’। কিন্তু এ আয়াতে শব্দটি কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা বুঝতে হবে আয়াতটির বিষয়বস্তু এবং আল কুরআনে এ বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কিত ধারাসমূহ এবং ‘দরাবা’ শব্দের প্রায়োগিক অর্থসমূহের কোনটি কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, এ দুটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে।
এখানে দাম্পত্য চুক্তি লংঘনের আশংকার উপর ভিত্তি করে স্বামীকে স্ত্রীর সংশোধনের জন্য তিনটি ব্যবস্থা অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যথা : (১) তাদেরকে উপদেশ দেয়া, (২) তাদেরকে বিছানায় রেখে নিজে ভিন্ন বিছানা বা শয্যা গ্রহন করা যেমন: অন্য ঘরে বা ফ্লোরে শুয়ে থাকা, (৩) তাদেরকে ‘দরবুন’ করা (যা আমাদের বিশ্লেষণীয় বিষয়)।
প্রথম কথা হচ্ছে, আশংকার উপর ভিত্তি করে কখনো শাস্তি হতে পারে না। এমনকি আশংকাবশত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। যেমন ৪:৯৪ আয়াত অনুযায়ী, সন্দেহবশত যাচাই ছাড়া কাউকে মু’মিন নয় বলে সাব্যস্ত করা যাবে না। আবার ৪৯:৬ আয়াত অনুযায়ী, যাচাই ছাড়া কোনো সংবাদের উপর ভিত্তি করে কারো বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া যাবে না। ৪৯:১২, ১০:৩৬, ১০:৬৬, ৫৩:২৩ আয়াত অনুযায়ী, অনুমানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ৪:১৯ আয়াত অনুযায়ী, স্ত্রীর কোনো দিক অপছন্দের হলেও অন্য দিক কল্যাণকর হতে পারে, তাই তার সাথে ন্যায়সঙ্গতভাবে (বিল মা’রুফ) বসবাস ও আচরণ করতে হবে। ৬৪:১৪ আয়াত অনুযায়ী, স্ত্রী শত্রু বা শত্রু-ভাবাপন্ন হলেও (তালাক দেয়ার অপরিহার্য এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি না হলে) তাকে ক্ষমা করে দিতে হবে। সুতরাং যে স্ত্রী শত্রু নয়, তার সামান্য অবাধ্যতাকে মেনে নিতে হবে। মেনে নিতে না পারলে সম্পর্ক ছিন্ন হবে। কিন্তু শারীরিক আঘাত করে সম্পর্ক ধরে রাখার কোন নির্দেশনা আল্লাহ দেন নি। এ ধরনের নির্দেশনা যেমন দাম্পত্য কলহের নিষ্পত্তির জন্য বাস্তব সম্মত নয়, ঠিক তেমনি এটি স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যকার ভালোবাসা ও দয়ার যে সম্পর্ক, যেটিকে আল্লাহ চিহ্নিত করেছেন তাঁর নিদর্শনের অংশ হিসেবে (৩০:২১) সেটিরও পরিপন্থী হয়ে দাড়ায়।
স্ত্রী যদি সরাসরি জি¦নাতে বা ব্যাভিচারে লিপ্ত হয় এবং সেক্ষেত্রে স্বামী একমাত্র স্বাক্ষী হয় তাহলে সে অবস্থায়ও তাকে শাস্তি দেয়ার সুযোগ নেই, বরং অপবাদ দিলে (অভিযোগ করলে) বিষয়টি আদালতে গড়াবে, আদালতে ছাড়া অভিযোগের প্রচার করা যাবে না (২৪:৬-১০)। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক এক মজবুত চুক্তি (৪:২১)। এখানে স্বামীকে পারিবারিক ব্যবস্থাপনাগত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কিন্তু সে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে স্ত্রীর সাথে পরামর্শের মাধ্যমে (৪২:৩৮, ২:২৩৩)।
দাম্পত্য চুক্তি লংঘনের আশংকা হলে, যেমন স্ত্রী পরকিয়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে বলে আশংকা হলে সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন আশংকার উপর ভিত্তি করে শাস্তি দেয়া বা আদালতে অভিযোগ দায়ের করা যায় না, এছাড়া এর উপর ভিত্তি করেই বিষয়টি সর্বসমক্ষে নিয়ে আসাও সঠিক নয়। অন্যদিকে আশংকার উপর ভিত্তি করে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াও সঠিক নয়। আবার আশংকাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়াও সহজ বা স্বাভাবিক নয়। আশংকা সমূলক হোক বা অমূলক হোক, সেটার নিরসনের জন্য এবং আশংকা গাঢ় হয়ে থাকলে স্ত্রীর সংশোধনের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আয়াতটিতে সে নির্দেশনাই রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ আয়াতে ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ (তাদেরকে দরবুন করো) এর অর্থ কী? এ বিষয়ে প্রথমেই উল্লেখ্য যে, ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ উপদেশমূলক বাক্যে ব্যবহৃত ক্রিয়াটির মূলরূপ হচ্ছে ‘দরাবা’ (সে দরবুন করেছে)। ‘দরাবা’ ক্রিয়া ও এর ক্রিয়াবিশেষ্য ‘দরবুন’ আল কুরআনে মোট ৫৮ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। তার মধ্যে আলোচ্য আয়াতটি (৪:৩৪) ছাড়া অন্য স্থানগুলোতে শব্দটি যেসব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
১. উপস্থাপন করা অর্থে ২৯ স্থানে: ২:২৬:৬, ১৩:১৭:২৪, ১৩:১৭:৪০, ১৪:২৪:৪, ১৪:২৫:৭, ১৪:৪৫:১২, ১৬:৭৪:২, ১৬:৭৫:১, ১৬:৭৬:১, ১৬:১১২:১, ১৭:৪৮:৩, ১৮:৩২:১, ১৮:৪৫:১, ২২:৭৩:৩, ২৪:৩৫:৪১, ২৫:৯:৩, ২৫:৩৯:২, ২৯:৪৩:৩, ৩০:২৮:১, ৩০:৫৮:২, ৩৬:১৩:১, ৩৬:৭৮:১, ৩৯:২৭:২, ৩৯:২৯:১, ৪৩:১৭:৫, ৪৭:৩:১৫, ৫৯:২১:১৫, ৬৬:১০:১, ৬৬:১১:১।
২. (কাউকে বা কারো সাথে সম্পর্কিত বিষয়কে অন্যদের) সামনে উপস্থাপন করা অর্থে ২ স্থানে: ৪৩:৫৭:২, ৪৩:৫৮:৭।
৩. আঘাত করা অর্থে ৯ স্থানে: ২:৬০:৬, ৭:১৬০:১৩, ৮:১২:১৭, ৮:১২:২০, ৮:৫০:৮, ২৬:৬৩:৫, ৩৭:৯৩:৩, ৪৭:৪:৫, ৪৭:২৭:৫।
৪. সমাধান করা অর্থে ১ স্থানে: ২:৭৩:২।
৫. (ঘরদোর) ঝাড়– দেয়া অর্থে ১ স্থানে: ৩৮:৪৪:৪।
৬. পদচালনা / নৃত্য করা অর্থে ১ স্থানে: ২৪:৩১:৬৪।
৭. চাপিয়ে দেয়া অর্থে ৩ স্থানে: ২:৬১:৩৭, ৩:১১২:১, ৩:১১২:১৮।
৮. ভ্রমণ করা অর্থে ৬ স্থানে: ২:২৭৩:৯, ৩:১৫৬:১১, ৪:৯৪:৫, ৪:১০১:২, ৫:১০৬:২২, ৭৩:২০:৩৭।
৯. কোথাও কিছু রাখা বা কাউকে কোনো অবস্থায় রাখা অর্থে ২ স্থানে: ১৮:১১:১, ২৪:৩১:১৫।
১০. নির্মাণ বা স্থাপন করা অর্থে ২ স্থানে: ২০:৭৭:৮, ৫৭:১৩:১৬।
১১. প্রত্যাহার করে নেয়া অর্থে ১ স্থানে: ৪৩:৫:১।
প্রচলিত ভুল ধারণা হলো উপরে উল্লেখিত অর্থগুলোর মধ্য থেকে ‘আঘাত করা’ অর্থে ৪:৩৪ আয়াতে ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ ‘আঘাত করা’ অর্থে যত আয়াতে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে কোথায় (কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে কোন অঙ্গে) এবং কি দ্বারা আঘাত করা হবে তা উল্লেখ রয়েছে। তাই এ আয়াতে (৪:৩৪) ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ অর্থ ‘তাদেরকে আঘাত / প্রহার করো’ হতে পারে না।
অন্যদিকে ৪৩:৫৭-৫৮ আয়াতে ‘দরাবা’ শব্দের ব্যবহার থেকে স্পষ্ট হয় যে, সাধারণভাবে কোনো ব্যক্তিকে দরাবা করার অর্থ হচ্ছে তাকে তথা তার সাথে সম্পর্কিত বিষয়কে অন্যদের সামনে উপস্থাপন করা। নিম্নে আয়াত দুটি উল্লেখ করা হলো।
৪৩:৫৭ :: যখন ইবনে মারইয়ামকে (অর্থাৎ ঈসাকে বা ঈসার বিষয়কে) (জনতার) সামনে উপস্থাপন করা হলো [দুরিবা-ব্নু মারইয়ামা] দৃষ্টান্তরূপে, তখনি তোমার সম্প্রদায় সেই প্রেক্ষিতে হট্টগোল করতে লাগলো।
৪৩:৫৮ :: আর তারা বললো, “আমাদের ইলাহগণ উত্তম, নাকি সে?” নিছক তর্কের জন্য ছাড়া তারা তোমার সামনে তাকে (অর্থাৎ তার বিষয়কে) উপস্থাপন করেনি [মা দরাবূহু]। বস্তুত তারা ঝগড়াকারী সম্প্রদায়।
সুতরাং ৪৩:৫৭-৫৮ আয়াতে ‘দরাবা’ শব্দের ব্যবহারের ভিত্তিতে স্পষ্ট হয় যে, ৪:৩৪ আয়াতে ব্যবহৃত ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ শব্দের সঠিক অর্থ হচ্ছে ‘তাদেরকে তথা তাদের সাথে সম্পর্কিত বিষয়কে সামনে উপস্থাপন করো’।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, একটি দাবি হচ্ছে, ‘দরাবা’ শব্দের অর্থ হিসেবে ‘উপস্থাপন করা’ অনুবাদ করা হয় যদি এর কর্ম হিসেবে ‘মাছাল’ বা ‘দৃষ্টান্ত’ শব্দটি আসে। এ দাবির জবাবে বলা যায়, ৪৩:৫৭ আয়াতে ‘মাছাল’ শব্দটি আসলেও তা কর্ম (Object) হিসেবে নয়, বরং হাল বা অবস্থা হিসেবে এসেছে। এছাড়া ৪৩:৫৮ আয়াতে ‘মাছাল’ শব্দটি ছাড়াই ঈসাকে ‘দরাবা করা’ বুঝাতে ‘দরাবূহু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, ১৩:১৭ আয়াতে ‘মাছাল’ শব্দটি ছাড়াই “ইয়াদরিবুল্লাহুল হাক্বক্বা ওয়াল বাতিলা” বাক্যে ‘উপস্থাপন করা’ অর্থে ‘দরাবা’ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে।
এছাড়া ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ কথাটির আরেকটি অর্থ হতে পারে “তাদেরকে বিছানায় পরিত্যাগ করো এবং তাদেরকে (বিছানায় একা রেখে দেয়া থেকে) ভিন্ন অবস্থায় বের করে আনো (অর্থাৎ সম্পর্ককে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনো)।” কারণ পূর্ববর্তী “ওয়াহজুরূহুন্না ফিল মাদাজি’” এর প্রেক্ষিতে ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ এর পর “আন মাদাজি’” (বিছানা থেকে) শব্দটি উহ্য (Non expressed) আছে হিসেবে উপলব্ধ (Understood)। অর্থাৎ বিছানায় একা রেখে দেয়ার পরবর্তীতে আবার সে অবস্থা থেকে ভিন্ন অবস্থায় বের করে আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর একটি তাৎপর্য হতে পারে তাকে সম্পর্কের স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনা এবং অন্য একটি তাৎপর্য হতে পারে তাদের বিষয়টি অন্দরমহল বা আধুনিক পরিভাষায় বেডরুমে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং পরিবার পরিজনের অন্য যারা সমাধানে সম্পর্কিত হওয়ার যোগ্য তাদের সামনে উপস্থাপন করা।
৪:৩৪ আয়াতে ব্যবহৃত “ওয়াদরিবূহুন্না” শব্দের অর্থ “তাদেরকে (অর্থাৎ স্ত্রীদেরকে) মৃদু প্রহার করো” হিসেবে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে একটি দাবি হচ্ছে, ‘দরাবা’ শব্দের মূল অর্থ হলো ‘সে মুদু প্রহার করেছে’ এবং যদি প্রচণ্ড প্রহারের বিষয় হয় তবে হয়তো ‘দররাবা’ (ক্রিয়ারূপ ২) ব্যবহৃত হয়, নয়তো ‘দরাবা’ শব্দটির পর আধিক্যবাচক কোনো শব্দ বা ‘দরবান’ ক্রিয়াবিশেষ্য ব্যবহৃত হয়। এ দাবির জবাবে বলা যায়, দ্বিতীয় তথ্যটি সঠিক হলেও প্রথম কথাটি সঠিক নয়। বরং শুধু ‘দরাবা’ (ক্রিয়ারূপ ১) ব্যবহারের অর্থ হলো প্রহারের মাত্রা মৃদু না তীব্র তা অনির্দিষ্ট হওয়া, নিশ্চিতভাবে মৃদুমাত্রা হওয়া নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আল কুরআনে আলোচ্য আয়াতটি (৪:৩৪) ছাড়া অন্য যেসব স্থানে ‘প্রহার করা’ অর্থে ‘দরাবা’ (ক্রিয়ারূপ ১) ব্যবহৃত হয়েছে তার কোথাও মৃদু আঘাত বুঝানো হয়নি, বরং প্রবল আঘাত করার কথাই বুঝানো হয়েছে। সুতরাং ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ শব্দের মাধ্যমে আসলে ‘মিসওয়াক (বা টুথব্রাশ) এর মতো হালকা কিছু দিয়ে মৃদু আঘাত করার’ অর্থে স্ত্রীদেরকে প্রহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে দাবি করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
প্রকৃতপক্ষে পরিবারকে রাষ্ট্রের একটি ক্ষুদ্র নমুনা সাব্যস্ত করা মৌলিকভাবে যথাযথ হলেও তা সব দিক ও বিভাগের একই রূপ সামঞ্জস্য তৈরি করে না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক পরস্পরের জোড়া হিসেবে হওয়ায় পরিবারে তাদের মর্যাদাগত অবস্থান প্রায় সমপর্যায়ের। এতে স্বামী শৃঙ্খলাগত কারণে প্রধান হলেও তা দৈহিক দণ্ড কার্যকর করার মতো বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন নয়, বরং তার কাছে যদি স্ত্রীর অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ থাকে তা আদালতে পেশ করতে হবে, নিজে বিচারক হতে পারবে না। সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, পারিবারিক বলয়ে স্ত্রীকে প্রহার করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে মর্মে দাবি করাটা কুরআনের সামগ্রিক নির্দেশনার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়।
সর্বোপরি ২:১২৯ আয়াতের নির্দেশনা হচ্ছে, স্ত্রীকে যাতনা দিয়ে দাম্পত্য সম্পর্কে আটকে রাখা সমুচিত নয়। আবার ৪:১২৮-১৩০ আয়াতে কোনো স্ত্রী তার স্বামীর পক্ষ থেকে দাম্পত্য চুক্তি লংঘনের আশংকা করলে সে অবস্থায় স্ত্রী তার স্বামীর সাথে একটা সমঝোতায় যাওয়ার এবং দুজনে সমঝোতায় পৌঁছতে না পারলে পারস্পরিক সিদ্ধান্তক্রমে দাম্পত্য সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশনা রয়েছে। অনুরূপভাবে কোনো স্বামী তার স্ত্রীর কর্তৃক দাম্পত্য চুক্তি লংঘনের আশংকা করলে সে অবস্থায়ও শেষ পর্যায়ে আবার সম্পর্কের স্বাভাবিকতার মাধ্যমে সংশোধনের শেষ চেষ্টা করা অথবা অন্যদের সামনে বিষয়টা নিয়ে এসে সম্পর্ক রক্ষা করা বা বিচ্ছিন্ন করার চূড়ান্ত পর্যায়ের সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশনাই অন্যান্য নির্দেশনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধের আশংকা করলে তখন মুসলিম সমাজের ভূমিকা কী হবে সে সম্পর্কে ৪:৩৫ আয়াতে নির্দেশনা রয়েছে। তা হলো- স্বামীর পরিবার পরিজনের মধ্য থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার পরিজনের মধ্য থেকে একজনকে হাকাম তথা বিচক্ষণ মীমাংসাকারী হিসেবে নিযুক্ত করতে হবে। তারা প্রথমে চেষ্টা করবে উভয় পক্ষের মধ্যে সংশোধন করে দেয়ার জন্য। যদি তাদের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, তারপর তালাক প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। যদি তালাকের পূর্বে এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তাহলে তালাকের পরিমাণ যে অনেক কমে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
৪:১২৮-১৩০ আয়াতের নির্দেশনা হচ্ছে, স্ত্রী যদি আশংকা করে যে তার স্বামী কর্তৃক দাম্পত্য চুক্তি লংঘন হচ্ছে তথা ইনসাফপূর্ণ আচরণে ব্যত্যয় ঘটছে বা সে তাকে উপেক্ষা করছে তাহলে এক্ষেত্রে তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করে নিলে তাদের গুনাহ হবে না। এক্ষেত্রে জানানো হয়েছে যে, অন্তত এতটুকু ইনসাফ করতে হবে যে, তাতে কারো দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড়েছে (পক্ষপাত) এবং অন্য কাউকে ঝুলিয়ে রেখেছে (অবজ্ঞা ও অবহেলা) এমন না হয়। তবে যদি সমাধান সম্ভব না হয় তথা ন্যায়সঙ্গত কারণে স্বামী-স্ত্রী দুজন বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করে তাহলে তাদের এককে অপরের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।
তালাকের জন্য অবশ্যই মজবুত যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে হবে। কারণ ৪:২১ আয়াতে বিবাহকে ‘দৃঢ় অঙ্গীকার’ (মীছাক্বান গালীযা) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং এই দৃঢ় অঙ্গীকার প্রত্যাহারের জন্যও অবশ্যই দৃঢ় কারণ থাকতে হবে।
২:২২৬ আয়াতে দাম্পত্য মনোমালিন্যের প্রেক্ষিতে স্বামী যদি স্ত্রীমিলন থেকে বিরত থাকার শপথ (ঈলা) করে তাহলে তাকে চার মাসের অবকাশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এরূপ শপথের মাধ্যমে চার মাসের অধিক স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্ক থেকে বিরত থাকা বৈধ নয়। তারপর হয় স্ত্রীর সাথে স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনে ফিরে যেতে হবে, না হয় তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেননা অন্যথায় স্ত্রীকে দৌদুল্যমান অবস্থায় রাখা হয় এবং সেটি স্ত্রীর মর্যাদাক্ষুন্নকারী ও দাম্পত্য সম্পর্কের স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে যায়। যদি স্বামী এ দুটির কোনোটি না করে তাহলে স্ত্রী চাইলে আদালতের মাধ্যমে তালাক দিতে পারে।
কুরআনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক রক্ষার জন্য অনেক বিধান দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনে চূড়ান্ত স্তরে তথা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যখন একান্তই তিক্ত হয়ে পড়ে তখন তালাকের ব্যবস্থা রয়েছে, যা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে।
স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেয়ার অধিকার রাখে। স্ত্রী সরাসরি তালাক দেয়ার অধিকার রাখে না, সে আদালতের মাধ্যমে তালাক দিতে পারবে। নবী বা উলিল আমরের (Central Authority) পক্ষ থেকে নিযুক্ত হাকামগণ (যারা স্বামী-স্ত্রীর পরিবার পরিজন থেকে নিযুক্ত হবেন) বা সরকারের তালাক বিভাগের নিযুক্ত কর্মকর্তা স্ত্রীর আবেদনের প্রেক্ষিতে ক্ষেত্রবিশেষে তালাক ঘটিয়ে দেয়ার বা বিবাহ বন্ধনের কার্যকারিতা রহিত করার অধিকার রাখেন। তবে কুরআনের বক্তব্যভঙ্গিতে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক মীমাংসাপ্রচেষ্টা এবং তাতে জটিলতা অনুভব করলে পারস্পরিক আলোচনামূলক সিদ্ধান্তক্রমে সংঘটিত তালাককেই অধিক সমর্থন দেয়া হয়েছে (সর্ম্পকিত আয়াতসমূহ ২:২২৯, ২:২৩৭, ৪:১৯-২১, ৪:৩৫, ৪:১৩০, ৬৫:১)।
স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে তালাক দিতে পারে তথা স্ত্রীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত তালাক ঘটাতে পারে। কিন্তু স্বামী নিজ সিদ্ধান্তে সরাসরি তালাক দিতে পারে। প্রশ্ন হলো, স্বামীর হাতে সরাসরি তালাক দেয়ার ক্ষমতা রাখার যৌক্তিকতা কী? প্রাসঙ্গিক আয়াতসমূহের বক্তব্য বিষয় ও বাস্তবতার সমন্বয়ে চিন্তা করলে এর যে যৌক্তিকতা বুঝা যায় নিচে তা উল্লেখ করা হলো:
(১) স্ত্রীর হাতে সরাসরি তালাক দেয়ার ক্ষমতা রাখলে পরিবারের অস্থিতিশীলতা ও স্বামীর আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি ছিল।
(২) স্বামী বা স্ত্রী কারো হাতে সরাসরি তালাক দেয়ার ক্ষমতা না দিয়ে তালাকের জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ঐকমত্যকে শর্ত করলে তা যথাযথ ব্যবস্থা হতো না। কেননা, কার্যত এ ধরনের ঐকমত্য অনেকটাই অসম্ভব, যেহেতু তালাকের কারনটিই হলো উভয়ের মধ্যে মনোমালিন্য ও বিরোধ। উভয়ের ঐকমত্যে তালাক হলে তা অবশ্যই উত্তম পরিস্থিতি, কিন্তু সেটাকে শর্ত করা সঠিক হতো না।
(৩) স্ত্রীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত তালাক সংঘটনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে আদালতের হাতে ক্ষমতা অর্পণ বা আদালতের স্বপ্রণোদিত হস্তক্ষেপে তালাকের ব্যবস্থা রাখা যৌক্তিক হতো না। কেননা বিয়ে যেমন বর-কনের নিজেদের চুক্তির বিষয়, তালাক বা চুক্তি প্রত্যাখ্যানও তাদের দুজনের মধ্যকার বিষয় হওয়াই সঙ্গত। এছাড়া সেক্ষেত্রে অযথা স্বামী-স্ত্রীর অনেক গোপন বিষয় আদালতে ও জনসম্মুখে চলে আসতো। আবার এ সম্ভাবনাও ছিল যে, আদালত শুধুমাত্র ব্যভিচারের মতো চরম পর্যায় ছাড়া অনুমতি দিতে চাইতো না। অথচ তালাকের পিছনে অন্যবিধ যৌক্তিক কারণও থাকা সম্ভব।
(৪) ‘দায়ের ভিত্তিতে আয়ের ব্যবস্থা’ নীতি অনুসারে স্বামীকে পরিবারের ভরণপোষণ নির্বাহ করতে উপার্জনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। আর উপার্জিত আয় থেকে পরিবারের ভরণপোষণে ব্যয় করতে হয়। সেই সাথে তালাক পরবর্তীতেও স্বামীকে তালাকপ্রাপ্তার ইদ্দাতকালে তার জন্য ব্যয় করতে হবে এবং প্রদত্ত দেনমোহর থেকে কিছু ফেরত নিতে পারবে না; এরূপ বিধান বর্ণিত হয়েছে। তাই স্বামীরা তালাক দেয়ার ক্ষেত্রে পরিণাম চিন্তা বেশি করাই স্বাভাবিক। যদিও এটা অসম্ভব নয় যে, স্বামী সীমা অতিক্রম করতে পারে এবং নিতান্ত নতুন বিয়ের উদ্দেশ্যে তালাক দিতে পারে বা রাগের মাথায় তালাক দিতে পারে। তবুও এটাই বাস্তবসম্মত যে, তুলনামূলক কম ক্ষতির ঝুঁকি অনুসারেই ক্ষমতার আমানত অর্পিত হয়।
তালাক প্রতিরোধে ৪:১৯ আয়াতে কুরআনের মর্মস্পর্শী বাণীটি অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখবে যদি মু’মিনরা তা অনুভব করে। আয়াতটিতে বলা হয়েছে, আর তোমরা তাদের সাথে জীবন যাপন করো ন্যায়নীতি অনুযায়ী। যদি তোমরা কোনো কারণে তাদেরকে অপছন্দ কর, তাহলে হতে পারে যে, তোমরা অপছন্দ করছো এক সত্তাকে (নিজের স্ত্রীকে) অথচ আল্লাহ রেখেছেন তার মধ্যে অনেক কল্যাণ (অর্থাৎ কোনো স্ত্রীর একটি বিষয় অপছন্দের হলেও সামগ্রিকভাবে তার মধ্যে অনেক কল্যাণ থাকা সম্ভব)।
৬৫:১ আয়াতে বলা হয়েছে, তালাক দিতে হবে ইদ্দাতের শর্ত পূরণ করে। এ বিষয়টির তাৎপর্য উপলব্ধির জন্য প্রথমত ইদ্দাত (তালাকপ্রাপ্তা অন্যত্র বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে অপেক্ষার সময়কাল) সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। ২:২২৮ আয়াতে বলা হয়েছে তালাকপ্রাপ্তাগণ তিন কুরু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কুরু শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘স্বাভাবিক অবস্থা (তুহর) এর বিপরীত পরিবর্তিত অবস্থা তথা পূর্ণ সময়ান্ত হায়েজ’। আলোচ্য আয়াতে কুরু বলতে হায়েজ বুঝানো হয়েছে এটিই যৌক্তিক তথ্য। তদুপরি এখানে কুরু বলতে যে হায়েজ বুঝানো হয়েছে তার প্রমাণ হলো- গর্ভে যা আছে সে তথ্য লুকাতে নিষেধ করা হয়েছে, আর হায়েজ দ্বারাই বুঝা যায়, গর্ভ সঞ্চার হয়েছে কিনা। এটা থেকে সাধারণভাবেই বুঝা যায়, তালাক দিতে হবে তুহরে অর্থাৎ হায়েজমুক্ত অবস্থায়। আর তালাক যদি তুহরে দিতে হয় তাহলে কুরু বলতে হায়েজ বুঝানো হয়েছে এতে আর কোনো সংশয়ের অবকাশ থাকে না। কারণ তুহরের সাপেক্ষে হায়েজই হচ্ছে পরিবর্তিত অবস্থা। তিনটি হায়েজ শব্দটির পরিবর্তে তিনটি কুরু বলার কারণ হতে পারে, বস্তুত ‘তিনটি হায়েজ’ শব্দটি যথাযথ শব্দ নয়, কারণ হায়েজ অর্থ রজ:স্রাব, অনেক নারীর রজ:স্রাব অনিয়মিত বা কখনো দিনের গননার দিক থেকে হেরফের হতে পারে আর তিনটি রজ:স্রাব শব্দটি যথাযথ অর্থবোধক নয়। তাই তিনটি হায়েজকে বুঝানোর জন্য ‘তিনটি কুরু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
এছাড়া ২:২২৮ ও ৬৫:৪ আয়াতের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে ‘তিনটি কুরু’ এর ইদ্দাত পালন হায়েজের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। কেননা, ৬৫:৪ আয়াতে যাদের হায়েজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং কোনো জটিলতার কারণে যাদের হায়েজ হয়নি, এই দুই গ্রুপের স্ত্রীদের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে ‘তিন মাস’ ইদ্দাত পালনের বিধান দেয়া হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, যাদের নিয়মিত হায়েজ হয়, হায়েজের প্রেক্ষিতেই তাদের ইদ্দাতের হিসাব করতে হবে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে তালাকপ্রাপ্তার ইদ্দাত নিম্নরূপ:
(ক) সাধারণ অবস্থায় ইদ্দাত হচ্ছে তিন কুরু বা তিনটি পূর্ণ সময়ান্ত হায়েজ (২:২২৮)।
(খ) যেসব বয়স্ক মহিলাদের হায়েজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে তাদের ক্ষেত্রে ইদ্দাত হচ্ছে তিনমাস (৬৫:৪)।
(গ) যাদের কোনো জটিলতার কারণে রজ:স্রাব হয়নি তাদের ইদ্দাত হচ্ছে তিনমাস (৬৫:৪)।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এ ধারাটি থেকে কেউ কেউ বাল্যবিয়েকে বৈধ মনে করেন। অথচ তাঁদের অনুমান ভুল। কারণ ৪:৬ আয়াত অনুযায়ী বিয়ের একটি জৈবিক বয়স আছে, যার সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশেরও সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং হায়েজ শুরু হওয়ার আগে তো নয়ই এমনকি হায়েজ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই যে বিয়ের বয়স হয় তাও নয়। বরং জৈবিক তত্ত্বানুসারে একটি ছেলে বা মেয়ের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার জৈবিক প্রক্রিয়ার সমাপ্তিতেই যৌবনের স্থিতিশীলতা তথা বিয়ের বয়স হয়।
(ঘ) গর্ভবতী নারীর ইদ্দাত হচ্ছে সন্তান প্রসব পর্যন্ত (৬৫:৪)। ২:২২৮ আয়াতে নারীদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন তাদের গর্ভের বিষয় গোপন না করে।
(ঙ) আর বিধবাদের ইদ্দাত নিম্নরূপ:
১. অগর্ভবতী বিধবার ইদ্দাত হলো (যেদিন তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে সেদিন থেকে) চার মাস দশ দিন। যদি সে তালাকপ্রাপ্তা হয় এবং তালাকের ইদ্দাত চলাকালে (ইদ্দাত সমাপ্তির পূর্বে) তার স্বামীর মৃত্যু হয়, তাহলেও তার স্বামীর মৃত্যুর দিন থেকে চার মাস দশ দিনের ইদ্দাত পালন করতে হবে।
২. গর্ভবতী নারীর ইদ্দাত হলো সন্তান প্রসব পর্যন্ত, ধারাটি গর্ভবতী বিধবার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে, সে তালাকপ্রাপ্তা হোক বা সাধারণ বিধবা হোক।
(চ) বিয়ের পর স্ত্রীকে স্পর্শ করার আগে তালাক দিলে তার ইদ্দাত নেই (৩৩:৪৯)। তবে ঐ স্ত্রীকেও কিছু ভোগসামগ্রী দিয়ে দিতে হবে (২:২৩৬)।
(ছ) তৃতীয়বার তালাকের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটলে ২:২৩০ আয়াতের নির্দেশনার বাহিরে ঐ স্বামী-স্ত্রীর পুনর্বিবাহ বৈধ নয়। তবে এক্ষেত্রেও ইদ্দাত পালন করতে হবে। স্ত্রী যদি দেনমোহরের কিছু অংশ ফেরত দিয়ে তথা আদালতের মাধ্যমে তালাক দেয়, যাকে প্রচলিত সমাজে খোলা তালাক (Khul', Mutual divorce) বলে, সেক্ষেত্রেও ইদ্দাত পালন করতে হবে। এর একটি কারণ হলো ইদ্দাত পালনের সাথে গর্ভাবস্থা স্পষ্ট হওয়ার সম্পর্ক রয়েছে।
৬৫:১ আয়াতে নির্দেশিত “তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে চাও তখন তাদেরকে তালাক দাও তাদের ‘ইদ্দাতের শর্ত পূরণ করে’” কথাটির দ্বিমাত্রিক তাৎপর্য রয়েছে। যথা:
(১) হায়েজ অবস্থায় তালাক দেয়া যাবে না। কারণ তাহলে তিন কুরুর হিসাব যথাযথ হবে না। ‘ইদ্দাতের শর্ত পূরণ করে তালাক’ বাক্যাংশটির অর্থ- তালাকপ্রাপ্তা যাতে যথানিয়মে ইদ্দাত পালন করতে পারে সেই শর্ত পূরণ করে তালাক দেয়া। অর্থাৎ তালাক এমন সময় দেয়া যাতে তাদের ইদ্দাত পালন শুরু করতে পারে। আর তা হচ্ছে তুহর অবস্থায় তালাক দেয়া যাতে তালাকপ্রাপ্তা তিন কুরু (অর্থাৎ যে অবস্থায় তালাক দিতে হয় তার সাপেক্ষে / স্বাভাবিক অবস্থা তথা তুহর সাপেক্ষে যা পরিবর্তিত অবস্থা বলে গণ্য হয় তিনবার ঐ অবস্থা তথা তালাক পরবর্তী তিনটি হায়েজ অতিক্রম) পর্যন্ত ইদ্দাত পালন করার বিধান সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হতে পারে। সুতরাং এ আয়াতের বিধান হচ্ছে হায়েজ অবস্থায় তালাক দেয়া যাবে না তথা তালাকের পদ্ধতি হচ্ছে তালাক দিতে হবে তুহর অবস্থায়।
তুহর (পরিচ্ছন্ন) অবস্থায় স্ত্রীমিলন থেকে বিরত থেকে তালাক দিতে হবে অথবা স্ত্রীমিলন হলে সেক্ষেত্রে গর্ভের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে তালাক দেয়াকে উত্তম সাব্যস্ত করতে হবে। কারণ অগর্ভবতী ও গর্ভবতী নারীর ইদ্দাত পরস্পর স্বতন্ত্র। এক্ষেত্রে ২:২২৮ আয়াতে নারীদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন গর্ভের বিষয় গোপন না করে।
যদি তুহর অবস্থায় স্ত্রীমিলনের পরে গর্ভসঞ্চারের বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে তালাক দেয়া হয়, তাহলে প্রাথমিকভাবে ‘তিন কুরুর’ ইদ্দাত গণনা শুরু করা হলেও যখন গর্ভের বিষয়টি জানা যাবে, তখন ইদ্দাতের সময়কালকে সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত প্রলম্বিত করতে হবে।
(২) ইদ্দাত সম্পর্কিত বিধি বিধান পরিপালন নিশ্চিত করে তালাক কার্যকর করতে হবে।
২:২২৮ আয়াতে স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে যে, ইদ্দাতের ভিতরে যদি স্বামী সংশোধনপ্রয়াসী হয়ে স্ত্রীকে স্বাভাবিক বৈবাহিক সম্পর্কে ফিরিয়ে নিতে চায়, তবে স্বামী এজন্য অধিক হকদার যে, স্ত্রী স্বামীর সাথে স্বাভাবিক বৈবাহিক সম্পর্কে ফিরে যাবে, স্বামী তালাক দিয়েছে বলে রাগবশত স্বামীর ইচ্ছায় সাড়া না দিয়ে ইদ্দাত শেষে অন্য স্বামীর সাথে বৈবাহিক জীবন সূচনা করার ইচ্ছা রাখবে না। স্ত্রীকে যেন বুঝানো হচ্ছে যে, স্বামী চাইলে যাতে ফিরিয়ে নিতে পারে এজন্য ইদ্দাতের যে বিধান দেয়া হয়েছে তা আসলে স্বামীর একটা অধিকারও বটে। কেননা এ স্বামীর অনেক অবদান তার প্রতি রয়েছে, আর সে তালাক দিলেও এখন তো তার মধ্যে সংশোধনী মনোবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। পক্ষান্তরে যদি তার সাথে মনোমালিন্য হয়েছে বলে বা সে তালাক দিয়েছে বলে গোস্বা করে স্বামী স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্কে ফিরে যেতে চাওয়া সত্ত্বেও তাতে সাড়া না দিয়ে ইদ্দাত অতিক্রম করে অন্য কারো সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার চিন্তা করা হয়, তবে সে অজানা বা নতুন ব্যক্তি তো এমন নয় যে, বর্তমান স্বামীর তুলনায় যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া অধিকতর সঠিক হওয়ার মত কোনো অবদান তার আছে।
আর ইদ্দাতকালে পুরুষের দায়িত্ব হচ্ছে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে সেরূপ সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ঘরে থাকতে দিবে যেরূপ সুযোগ সুবিধাসম্পন্ন ঘরে নিজে থাকে এবং স্পষ্ট অশ্লীল কাজে লিপ্ত হওয়া ছাড়া তাকে বের করে দেয়া যাবে না (এবং স্ত্রীদেরকেও উপদেশ দেওয়া হয়েছে যেন কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া তারা নিজেরাও বেরিয়ে না যায়) এবং তাদের জন্য ব্যয়ভার বহন করতে হবে এবং তাদেরকে ন্যায়সঙ্গত ও সাধ্যমতো ভোগসামগ্রী দিতে হবে।
আর যে নারীকে স্পর্শ করার আগে তালাক দেয়া হয়েছে তার ইদ্দাত না থাকলেও তাকেও বিদায়ের সময় সাধ্যমতো ভোগসামগ্রী দিতে হবে।
ইদ্দাতকাল অতিবাহিত হওয়ার পর তালাকপ্রাপ্তা ও বিধবা নারী নিজ ইচ্ছা ও পছন্দ অনুসারে বিবাহ করতে পারবে, এতে কেউ বাধা দেয়া সঙ্গত নয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ২:২৪০ আয়াত অনুযায়ী, ইদ্দাত শেষে বিধবা নারী অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে, তবে যদি সে অন্যত্র বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ না হয় বা স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে না যায়, তাহলে তার স্বামীর মৃত্যু পরবর্তী এক বছরের মধ্যে তাকে তা থেকে বের করে দেয়া যাবে না, বরং ভরণপোষণ দিতে হবে।
তালাক সম্পর্কিত বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় ৬৫:২ আয়াতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ সচেতন হবে (তথা তালাকের বিধি-বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করবে) আল্লাহ তাকে (দাম্পত্য সম্পর্কের সংকটসহ বিভিন্ন) সংকট থেকে উত্তরণের উপায় বের করে দিবেন।
সুতরাং তালাক সম্পর্কিত বিধি-বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করলে একদিকে যেমন তালাকের পরিমাণ হ্রাস পাবে, অন্যদিকে তেমনি তালাক ঘটার পরেও অনেক দাম্পত্য সম্পর্কের চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটা থেকে রক্ষা পাবে।
ইদ্দাতকালের আজাল বা নির্দিষ্ট শেষ সময়সীমা পূর্ণ হলে হয় স্ত্রীকে উত্তমভাবে রেখে দিতে হবে অথবা উত্তমভাবে বিদায় দিতে হবে। তাদেরকে কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে রেখে দেয়া যাবে না। আর ৬৫:১-২ আয়াত অনুযায়ী তালাক, ইমছাক্ব / রেখে দেয়া অথবা মুফারাক্বাত / পৃথক করে দেয়ার ক্ষেত্রে দুজন ন্যায়নিষ্ঠ তথা পক্ষপাতমুক্ত ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখতে হবে, নাহলে এর কোনোটি গ্রহণযোগ্য হবে না।
২:২২৯ আয়াতে বলা হয়েছে ‘আত তালাকু মাররাতান’ বা ‘তালাক দুইবার’। তারপরপরই বলা হয়েছে, ‘তারপর হয় ন্যায়ানুগভাবে রেখে দিবে অথবা উত্তমভাবে বিদায় দিবে’। ২:২৩০ আয়াতের তথ্যের সমন্বয়ের ভিত্তিতে এ কথার অর্থ হচ্ছে, ‘যেরূপ তালাকের পর ন্যায়ানুগভাবে রেখে দেয়া অথবা উত্তমভাবে বিদায় দেয়ার অবকাশ আছে এরূপ স্বাভাবিক তালাক দুইবার’।
আমাদের সমাজে তালাকের পদ্ধতি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে তালাক শব্দটা তিনবার বললে বা ‘এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক’ বললে ঐ তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী তার স্বামীর জন্য বৈধ থাকে না। তখন তাকে ফিরিয়ে নেয়ার সুবিধা পেতে হলে অন্য কারো সাথে অন্তত এক রাতের জন্য বিয়ে দিতে হয় এবং এমন ফতোয়াও আছে যে, সেই দ্বিতীয় স্বামীর সাথে যৌনমিলন হওয়া জরুরি। তারপর ঐ দ্বিতীয় স্বামী তালাক দেয় এবং তারপর তাকে প্রথম স্বামীর জন্য বৈধ বলা হয়। অনেক সময় ফতোয়াবাজরা নিজেরাই ঐ দ্বিতীয় স্বামী হবার সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। এ ধরনের বিয়েকে হিল্লা বিয়ে বলা হয়, যা সম্পূর্ণত কুরআন পরিপন্থী।
ধারণা করা হয় যে, একসাথে তিন তালাক না বলে এক তালাক বললে ইদ্দাত ও ইদ্দাত পরবর্তী বিয়ের সুযোগ থাকে এবং সেইসাথে দ্বিতীয় তালাক দেয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু একসাথে দুই তালাক বললে তারপর আর ফিরিয়ে নেয়ার মতো তালাক দেয়ার সুবিধা থাকে না। তাই একবার এক তালাক দিয়ে স্ত্রী মাসিক রজ:স্রাব থেকে মুক্ত হবার পর দ্বিতীয় তালাক দেয়া উত্তম বলে মতপ্রকাশ করা হয়। যারা একসাথে তিন তালাক বললেও তাতে এক তালাকই হয় বলে মতপ্রকাশ করেন তাদের মধ্যেও কেউ কেউ বলেন যে, তালাকের নিয়ম হচ্ছে প্রথম তালাকের পর স্ত্রী একবার রজ:স্রাব থেকে মুক্ত হলে তখন দ্বিতীয় তালাক দেয়া।
অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে: তালাক তো এরূপ কিছু নয় যে, কেউ বলল ‘তালাক, তালাক, তালাক’ বা ‘এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক’ আর গণনা করতে হবে সে তালাক শব্দটা কয়বার বলল। বরং বিষয়টা হচ্ছে, তালাক মানে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়ার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা। কেউ দুজন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিকে স্বাক্ষী রেখে তার স্ত্রীকে তার তুহরকালে (হায়েজমুক্ত অবস্থায়) তালাক দিতে পারে। সে তালাক শব্দটা একবার বলল কি একশতবার বলল এটা কোন বিষয়ই নয়। কারণ, যদি একসাথে দুই বা তিনবার তালাক শব্দটা বললে দুই বা তিন তালাক হয়ে যায় তাহলে তো প্রথমবারের ইদ্দাত পালন করা সম্ভব হলো না। অথচ কুরআনে বলা হয়েছে তালাকপ্রাপ্তাকে ইদ্দাতের শর্ত পূরণ করে তালাক দিতে হবে এবং তালাকপ্রাপ্তা ইদ্দাত পালন করতে হবে। সুতরাং ‘তালাক দুইবার’ কথাটির অর্থ যদি তালাক শব্দটি দুইবার বলার বিষয় না হয়ে তালাক নামক বিবাহ বিচ্ছেদের আইনগত প্রক্রিয়াটি দুইবার বুঝানো হয়, তাহলেই কেবল প্রত্যেক বারের তালাকে ইদ্দাত পালন করা সম্ভব। সুতরাং কোনো ব্যক্তি তিন বা ত্রিশ যতসংখ্যায়ই তালাক শব্দটা বলুক না কেন তাকে একবারের তালাক গণ্য করতে হবে। কেননা তালাক প্রক্রিয়া ছাড়া হতে পারে না এবং ইদ্দতের শর্তপূরন সেক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সূরা মুলকের ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘চুম্মারজিয়িল বাসারা কাররাতাইন’ (তারপর তুমি তোমার দৃষ্টিকে ফিরাও দ্বিতীয়বার, অর্থাৎ একবারের পর আরেকবার)। এখানে দৃষ্টি ফেরানো মানে পর্যবেক্ষণ, নিছক চোখের পলক ফেলা নয়, একবারের পর্যবেক্ষণে হাজারবার পলক পড়লেও তা একবার দৃষ্টি ফেরানো হিসেবে গণ্য হবে। ঠিক তেমনি ‘আততালাকু মাররাতান’ মানে তালাক দুইবার, একবারের পর আরেকবার- পদ্ধতি ও প্রকৃতিতে, নিছক শব্দ উচ্চারণের দিক থেকে নয়। প্রথম যখন তালাক দেয়া হলো তখন তালাক শব্দটা একবার বলা হোক কি একশতবার বলা হোক উভয় অবস্থায় মূলত: তালাক দেয়ার ঘটনাটি ঘটল প্রথমবারের মত।
‘মাররাত’ শব্দের নির্ঘণ্ট যাচাই করলে ‘আত তালাক্বু মাররাতান’ (তালাক দুই বার) বলতে কী বুঝায় তা স্পষ্টভাবে বুঝা যেতে পারে। নিম্নে ‘মাররাত’ (বার/ time) শব্দের নির্ঘণ্ট উল্লেখ করা হলো:
‘মাররাত’ শব্দের নির্ঘণ্ট :
মাররাত (একবার) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে:
৯:১২৬।
মাররাতান (দুইবার) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৬ স্থানে:
২:২২৯, ৯:১০১, ৯:১২৬, ১৭:৪, ২৮:৫৪, ৩৩:৩১।
ছালাছা মাররাত (তিনবার) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে:
২৪:৫৮।
ছাবয়ীনা মাররাত (সত্তর বার) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে:
৯:৮০।
আওয়ালা মাররাত (প্রথম বার) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৯ স্থানে:
৬:৯৪, ৬:১১০, ৯:১৩, ৯:৮৩, ১৭:৭, ১৭:৫১, ১৮:৪৮, ৩৬:৭৯, ৪১:২১।
মাররাতান উখরা (অন্য একবার) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১ স্থানে:
২০:৩৭।
কুল্লু মাররাত (প্রত্যেক বার)
৮:৫৬।
উপরোল্লেখিত নির্ঘণ্ট যাচাই করলে বুঝা যায় যে, দুই বার বলতে বুঝায় কোনো কিছু একবার হওয়ার পর আরো একবার হওয়া। এর দ্বারা একই কাজকে দুটি ধাপে সম্পন্ন করা বুঝায় না। যেহেতু তালাকপ্রাপ্তাকে ইদ্দাতের শর্ত পূরণ করে তালাক দিতে হবে তথা তালাকপ্রাপ্তা ইদ্দাত পালন করতে হবে এবং ইদ্দাতের সময়কাল গণনা করতে হবে এবং ইদ্দাতের মধ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে, কাজেই তালাক দুইবার বলতে বুঝায় প্রতিবারের তালাক সম্পন্ন হবে এ সমগ্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সুতরাং কোনোভাবে ‘এক তালাক, দুই তালাক’ বা ‘তালাক তালাক’ শব্দ বললে তাতে ‘তালাক দুইবার’ এর বিধান পালন হয় না। বরং একবারের তালাকে ‘তালাক’ শব্দটি যতবারই উচ্চারণ করা হোক না কেন, তা একবারের তালাক হিসেবেই সাব্যস্ত হবে, একাধিক তালাক হিসেবে নয়।
যারা মনে করেন তালাক দেয়ার নিয়ম হচ্ছে তিন তুহরে তিন তালাক, তাদের এ ধারণা যে কুরআনের আলোকে ভুল এ বিষয়টির প্রমাণ হচ্ছে, কুরআনে বলা হয়েছে তালাকদাতা তালাকপ্রাপ্তাকে ইদ্দাতের সময়কালের ভিতরে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অধিক হকদার যদি সে সংশোধন করতে চায়। পক্ষান্তরে তাঁদের মত মানলে সে ফেরতই নেবে দ্বিতীয় তুহরে আরেকটি তালাক দেয়ার জন্য। সুতরাং এটা ঠিক এমন একটা ব্যাপার যে, কোনো পুরুষ যেন একজন নারীকে বলছে, ‘এসো আমি তোমাকে বিবাহ করি যেন আমি তোমাকে তালাক দিতে পারি’। সুতরাং তিন তুহরে তিন তালাক দিতে হবে এটা যে কত বড় ভ্রান্তি তা এখান থেকেই পরিস্কার হয়ে যায়। প্রকৃত ব্যাপার হল, শর্ত পূরণ করে তথা স্ত্রীর তুহর অবস্থায় দুজন ন্যায়পরায়ন স্বাক্ষী রেখে একবার তালাক দিলেই তালাক হয়ে যায়।
তারপর স্ত্রীর কর্তব্য হলো ইদ্দাত পালন করা। এটাই তালাকের প্রাথমিক কার্যকারিতা। ইদ্দাতকালে স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নিলে তারা দাম্পত্যমিলন থেকে বিরত থাকবে। অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলে দুজনকে স্বাক্ষী রাখতে হবে। এ ফিরিয়ে নেয়া বা দাম্পত্য সম্পর্কে রেখে দেয়ার অবকাশ ইদ্দাত পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত। ইদ্দাত পূর্ণ হয়ে গেলে স্ত্রী অন্যত্র বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে এবং সেক্ষেত্রে পূর্ব স্বামী বাধা দিতে পারবে না। অন্যদিকে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে সম্মত হলে নিজেদের মধ্যে পুনর্বিবাহ করতে পারবে।
তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে ইদ্দাতের মধ্যে ফিরিয়ে নিলে বা ফিরিয়ে না নেয়ায় তার ইদ্দাতশেষে তার সম্মতিক্রমে পুনর্বিবাহ করলে, তখন এ স্বামী তাকে আবার একই পদ্ধতিতে আরো একবার তালাক দিতে পারবে। যদি এভাবে দ্বিতীয়বারও তালাক দেয়া হয়, তাহলে আবার পূর্বের মত ইদ্দাত পালন এবং ইদ্দাতকালে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার বা ইদ্দাত শেষে পুনরায় বিবাহ করার সুযোগ আছে।
এভাবে দ্বিতীয়বার ফিরিয়ে নিলে বা পুনর্বিবাহ করলে তখন সে স্বামী আবার যদি তাকে তালাক দেয়, যার সম্ভাবনা নিতান্তই অনেক কম, তবে তা হবে অস্বাভাবিক তালাক এবং ঐ তালাক দেয়া স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহ করা বৈধ হতে পারে কেবলমাত্র সূরা বাকারার ২৩০ নং আয়াতে বর্ণিত শর্তপূরণ হলে।
হিল্লা বিয়ে নামক অবৈধ বিয়ের পক্ষে আল কুরআনের ২:২৩০ আয়াতের অপব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। নিম্নে আয়াতটি এবং হিল্লা বিয়ের অবৈধতা সম্পর্কে আলোকপাত করা করা হলো।
২:২৩০ :: অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয় তাহলে এরপরে (অর্থাৎ তৃতীয়বার তালাকের পরে) সে নারী তার জন্য বৈধ হবে না, যতক্ষণ না সে নারী অন্য কাউকে বিয়ে করে এবং সে (অর্থাৎ পরবর্তী স্বামী) তাকে তালাক দেয়। তখন যদি তারা দুজন (অর্থাৎ নারীটি এবং তাকে পূর্বে তালাক দেয়া স্বামী) আল্লাহর সীমাসমূহ প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারবে বলে ধারণা করে তবে তারা পুনরায় বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াতে তাদের দুজনের কোনো গুনাহ হবে না। এগুলো আল্লাহর সীমা। তিনি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন।
এ আয়াতের অপব্যাখ্যা করে ফতোয়াবাজরা ‘হিল্লা বিবাহ’ নামে এমন একটা জঘন্য কুপ্রথা চালু করেছে যে, তালাকপ্রাপ্তা নারীকে এক রাতের জন্য অন্য একজনের সাথে বিবাহ দিয়ে এবং কারো কারো ক্ষেত্রে এমনকি তাকে সহবাসে বাধ্য করে তারপর তালাকের ব্যবস্থা করে এরপর পূর্বতন স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ নতুন বিবাহটা হয় একটা সাজানো নাটক। আর এটাকে তারা এই আয়াতের ব্যাখ্যা হিসাবে দাবি করে থাকে এবং এভাবে আল্লাহর আয়াতকে হাসি তামাশার বিষয় বানিয়ে দেয়।
অথচ এই আয়াতটিতে যা বলা হয়েছে, তাতে যার ক্ষেত্রে দুইবারের স্বাভাবিক তালাক কার্যকর হওয়ার পর তৃতীয়বার তালাকের ঘটনা ঘটেছে, তার ক্ষেত্রে তার স্ত্রীকে তার জন্য আর হালাল রাখা হয়নি এ শর্ত ছাড়া যে, যদি ঐ স্ত্রী স্বেচ্ছায় অন্য কাউকে বিবাহ করে এবং যদি কখনো সেই দ্বিতীয় স্বামীও তাকে তালাক দেয় (বা মৃত্যুবরণ করে) তাহলে ঐ স্ত্রী এবং তার প্রথম স্বামী উভয়ে আবার দাম্পত্য সম্পর্কে ফিরে যেতে চাইলে তখন তারা আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। এটা এমন এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া যার কারণে এরূপ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রথম স্বামী আর তার স্ত্রীকে ফেরত পাওয়ার সুযোগ ঘটবে না।
বস্তুত তালাক যেন একটা যাচ্ছে তাই খেলায় পরিণত হতে না পারে সেজন্যই এ ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে যা সবার জন্যই কল্যাণকর। কিন্তু তাকে ফতোয়াবাজরা একটা সাজানো নাটকে পরিণত করে আল্লাহর দেয়া ব্যবস্থার অবমাননা করছে এবং জ্বেনায় লিপ্ত হচ্ছে বা করছে। সুতরাং প্রচলিত হিল্লা বিয়ে হালাল বা বৈধ নয়, বরং প্রচলিত হিল্লা বিয়ে হারাম বা অবৈধ। আল্লাহ এখানে তৃতীয়বার তালাকপ্রাপ্তাকে তালাকদাতা স্বামীর জন্য বৈধ হওয়ার যে শর্ত দিয়েছেন তাকে নিয়ে এরূপ সাজানো নাটক মঞ্চায়ন আল্লাহর আয়াতসমূহকে হাসি তামাশার বিষয় হিসাবে গ্রহণ করা ছাড়া আর কিছুই নয়, যে ব্যাপারে পরবর্তী আয়াতটিতে (২:২৩১) নিষেধ করা হয়েছে।
২:২৩০ আয়াতের শুরু ‘ফাইন’ তথা ‘তারপর যদি’ এর মাধ্যমে, তাই এটি ‘আত তালাকু মাররাতান’ (২:২২৯) এর সাথে সম্পর্কিত হয়ে সাধারণ তালাকের ব্যতিক্রম অবস্থা প্রকাশ করছে। এখানে ‘মিম বা’দু’ বা ‘পরবর্তীতে’ বলতে বুঝানো হচ্ছে ‘তৃতীয়বার তালাক দিলে’। এরপর ২:২৩১ আয়াতে ‘ওয়া ইযা’ শব্দের মাধ্যমে আবার স্বাভাবিক তালাকের বিষয় আবর্তিত হয়েছে এবং বক্তব্য সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। ২:২৩০ আয়াতটি অস্বাভাবিক তথা তৃতীয় তালাকের সাথে সম্পর্কিত একমাত্র ব্যতিক্রমমূলক বিধান। ২:২৩০ আয়াতের বক্তব্য শুধুমাত্র তৃতীয় তালাকের পরে ইদ্দাতকালে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগকে বা ইদ্দাত পরবর্তীতে বিশেষ শর্তপূরণ ব্যতীত পুনর্বিবাহের সুযোগকে রহিত করেছে, এই ব্যতিক্রম ছাড়া ইদ্দাত বা ইদ্দাত সম্পর্কিত অন্যান্য ধারাকে রহিত করেনি।
(ক) বিয়ের পর স্পর্শ করার আগে ও দেনমোহর ধার্য করার আগে তালাক দিলে দেনমোহর বাবদ কিছু দেয়া বাধ্যতামূলক নয় (২:২৩৬)।
(খ) বিয়ের পর দেনমোহর ধার্য করার পরে কিন্তু স্পর্শ করার আগে তালাক দিলে অর্ধেক দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে যদি স্ত্রী অনুকম্পা প্রকাশ করে কম নেয় বা ছেড়ে দেয় অথবা স্বামী অনুকম্পা করে বেশি দেয় বা পূর্ণ পরিমাণ দেয় সেটা ভিন্ন কথা। অথবা স্ত্রীর পক্ষ থেকে যার হাতে বিয়ের বন্ধন তথা তালাক বিভাগের কর্মকর্তা বা আইনগত অভিভাবকও দেনমোহরের পরিমাণ কম করতে পারে। অবশ্য স্বামীরা যদি বেশি দেয় সেটাই উত্তম বলা হয়েছে (২:২৩৭)।
উল্লেখ্য, ২:২৩৭ আয়াতে ব্যবহৃত ‘যার হাতে বিয়ের বন্ধন’ শর্তটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে স্বামী বা তালাক বিভাগের কর্মকর্তা বা আইনগত অভিভাবক। কারণ আয়াতটিতে এ শর্তের পূর্বাপর অংশে স্বামীদেরকে ‘তোমরা’ শব্দ দ্বারা উল্লেখ করা হয়েছে। তাই ‘যার হাতে বিয়ের বন্ধন’ এর মাধ্যমে শুধুমাত্র স্বামীকে নির্দিষ্ট করা যায় না। তবে যেহেতু স্বামী তালাক দিতে পারে তাই তার হাতেও বিয়ের বন্ধন নির্ভর করে। আবার স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে তালাক দিতে পারে বিধায় তালাক বিভাগের কর্মকর্তার হাতেও বিয়ের বন্ধন নির্ভর করে। এছাড়া কোনো আইনগত অভিভাবক থাকলে যিনি বিয়ে বন্ধন টিকে থাকবে নাকি ছিন্ন করা হবে এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দেয়ার অবস্থানে থাকেন তবে সেই আইনগত অভিভাবকের উপরও বিয়ের বন্ধন নির্ভর করে। এজন্য আয়াতটিতে ব্যবহৃত ‘যার হাতে বিয়ের বন্ধন’ এর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সাপেক্ষে এই বিভিন্ন অবস্থা সম্ভব।
(গ) স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাক হলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী দেনমোহরের কিছু অংশ ফেরত দিতে হবে (২:২২৯)।
(ঘ) স্বামী যদি স্ত্রীর স্পষ্ট অশ্লীলতার বিষয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে তালাক দেয় তবে সে দেনমোহরের কিছু অংশ ফেরত পেতে পারবে। তবে এজন্য কোনো স্বামী যেন নিজ স্ত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বাক্ষী দাঁড় করিয়ে অপবাদ দিয়ে পাপিষ্ঠ না হয় সেজন্য অত্যন্ত শক্তভাবে সতর্ক করা হয়েছে (৪:১৯)।
৪:১৯ আয়াতে বলা হয়েছে, বলপ্রয়োগ করে নারীদের ওয়ারিস হওয়া বৈধ নয়। অর্থাৎ কোনো নারীর সম্পত্তির এবং ব্যক্তিসত্তাগত যোগ্যতা ও সিদ্ধান্তক্ষমতার ওয়ারিস / উত্তরাধিকারী / দখলদার হওয়ার জন্য কোনো নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করে কৃত্রিম সম্মতি আদায় করে বিবাহ করা বা কোনো নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ রাখা বা কোনো নারীকে বিবাহ করা থেকে বিরত রাখা বা কোনো নারীর সম্পদ কেড়ে নেয়া বা সে নিজে থেকে দিয়ে দিতে তাকে বাধ্য করা বা কোনো নারীকে তার সম্পদ তার ইচ্ছানুসারে বৈধ খাতে ব্যয়ে বাধা দেয়া বা অন্যায়ভাবে তার যোগ্যতা অনুসারে কাজ করতে তাকে বাধা দেয়া বা নিজেদের ইচ্ছামতো কোনো কাজে নিযুক্ত হতে বাধ্য করা ইত্যাদি তোমাদের জন্য বৈধ নয়। মিথ্যা অপবাদের মাধ্যমে তালাক দিয়ে দেনমোহরের কোনো অংশ ফেরত নেয়াও অবৈধভাবে নারীদের সম্পদের ওয়ারিস হওয়ার একটি রূপ।
২:২৩৩ ও ৬৫:৬ আয়াতে তালাক পরবর্তীতে দুগ্ধপোষ্য সন্তানের দুধপান ও কল্যাণ ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শিশুর দুধপানের পূর্ণ মেয়াদ দুই বছর। যদি শিশুর মা তাকে দুধপান করায় তবে দুধপান করানোর সময়কালে ঐ মায়ের ভরণপোষণের খরচাদি নির্বাহ করবে শিশুর বাবা। ইতোমধ্যে শিশুর পিতার মৃত্যু হলে তার অন্যান্য ওয়ারিসদের উপর এ দায়িত্ব বর্তাবে। তবে তারা পরামর্শক্রমে অথবা তাদের মধ্যে ঐকমত্য না হলে সেক্ষেত্রে শিশুকে কোনো দুধমা দুধপান করাবে। সেক্ষেত্রে ঐ দুধমাকে ঐ সময়কাল পর্যন্ত ন্যায্য ভরণপোষণ দিতে হবে এবং দুধমাকে পারিতোষিক প্রদানের দায়িত্ব শিশুর পিতার। অবশ্য শিশুর পিতামাতা পরামর্শক্রমে যৌথ সম্মতির ভিত্তিতে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্বেও সন্তানকে দুধপান ছাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সর্বোপরি সন্তানের ভবিষ্যৎ কল্যাণের ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। পিতাকেও সন্তান তারই হওয়ার প্রেক্ষিতে কষ্ট দেয়া যাবে না এবং মাতাকেও সন্তান তারই হওয়ার প্রেক্ষিতে কষ্ট দেয়া যাবে না। সুতরাং তালাকের পরবর্তীতে সন্তান কত সময় কার কাছে থাকবে তা পরামর্শক্রমে নির্ধারণ করতে হবে।
কুরআনে প্রদত্ত তালাক সম্পর্কিত বিধি-বিধানের যথাযথ জ্ঞান ও তার সঠিক প্রয়োগের অভাবে সমাজে তালাক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। অথচ কুরআনের বিধি-বিধান সঠিকভাবে জানলে ও পরিপালন করলে তালাকের পরিমাণ যেমন হ্রাস পেতো তেমনি নারী অধিকারের ন্যায্যতাও রক্ষা পেতো। কেননা কুরআনে একদিকে যেমন তালাক থেকে নিবৃত্তকরণে সামাজিক দায়বদ্ধতার দিক-নির্দেশনা রয়েছে, তেমনি অন্যদিকে তালাকের পরবর্তীতে যেসব বিধি-বিধান পালন করতে হয় তাতে নারীর সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। তালাক সংক্রান্ত সামাজিক সংকট নিরসনে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কাউন্সিলর হিসাবে যেসব ব্যক্তিবর্গ এবং সামাজিক সংগঠন কাজ করেন তারা এক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা পালনার্থে কুরআনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ স্কলারদের নিয়ে কুরআন কাউন্সেলিং সেল গঠন করতে পারেন। এক্ষেত্রে তারা যেমন নিজেদের মধ্যকার সংশ্লিষ্ট কুরআন গবেষকদেরকে কাজে লাগাতে পারেন তেমনি যারা কুরআনের যথাযথ জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত এমন স্কলারদের সহযোগিতাও গ্রহণ করতে পারেন। যদি এভাবে কুরআন কাউন্সেলিং করা যায় তবে তালাক সংক্রান্ত সামাজিক সংকট নিরসনে তা নি:সন্দেহে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
কুরআনের আলোকে তালাকের বিধান যথাযথভাবে পরিপালন করলে বর্তমানে যেভাবে সামান্য কারণে সংসার ভেঙ্গে যায় এবং তালাক না হওয়া সত্তে¡ও তালাক হয়েছে মর্মে ফতোয়া দেয়ার কারণে অনেকের সংসার নষ্ট হয় সেটা হ্রাস পাবে। হিল্লা বিয়ের নামে যে জঘন্য কুপ্রথা সমাজে চালু আছে তা বন্ধ হবে এবং তৃতীয়বারের তালাকের পর যে কঠিন শর্ত পূরণ হওয়া ছাড়া ঐ স্ত্রীকে পুনর্বিবাহ সম্ভব নয় - যে শর্ত পূরণ অনেকটাই অসম্ভব, সেজন্য তৃতীয়বারের তালাকের সম্ভাবনা অত্যন্ত কমে যাবে। বাস্তবসম্মত কারণে কিছু তালাক ঘটলেও নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। তালাক কুরআনে অনুমোদিত একটি বিবাহ বিচ্ছেদ পদ্ধতি, যা দুর্বিসহ দাম্পত্য সংকটের সমাধানের একটি অনন্যোপায় ব্যবস্থামাত্র। তালাক মাত্রেই নিন্দনীয় কোনো বিষয় নয়। তবে অযৌক্তিক কারণে তালাক ঘটার বিষয়টি প্রতিরোধে এবং তালাকের ঘটনায় নারী অধিকারের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় কুরআনের বিধানের যথাযথ অনুসরণ অত্যাবশ্যক।
যেহেতু যিহার এবং লিআন তালাকের সাথে প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত দুটি বিষয় তাই নিম্নে এ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হলো।
যিহার শব্দের অর্থ হলো ‘স্ত্রীকে মায়ের মতো বলে প্রকাশ করা, স্ত্রীকে মায়ের মতো বলা’। সাধারণ তালাকের পরিবর্তে স্ত্রীকে নিজের জন্য হারাম করে নেয়ার জন্য তথা জঘন্য ধরনের তালাক দেয়ার জন্য এরূপ করা হতো।
এখানে যিহার সম্পর্কিত আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হলো।
আহযাব ৩৩:৪
مَّا جَعَلَ اللَّهُ لِرَجُلٍ مِّن قَلْبَيْنِ فِي جَوْفِهِ وَمَا جَعَلَ أَزْوَاجَكُمُ اللَّائِي تُظَاهِرُونَ مِنْهُنَّ أُمَّهَاتِكُمْ وَمَا جَعَلَ أَدْعِيَاءَكُمْ أَبْنَاءَكُمْ ذَٰلِكُمْ قَوْلُكُم بِأَفْوَاهِكُمْ وَاللَّهُ يَقُولُ الْحَقَّ وَهُوَ يَهْدِي السَّبِيلَ
৩৩:৪ :: আল্লাহ কোনো পুরুষের ভিতরে দুটি কলবের ব্যবস্থা করেননি। আর তিনি তোমাদের যে স্ত্রীদেরকে তোমরা যিহার কর (অর্থাৎ মায়ের মতো হিসেবে প্রকাশ কর) তাদের কাউকে তোমাদের মা বানিয়ে দেননি। আর তিনি তোমাদের পালিত পুত্রদেরকেও তোমাদের পুত্র বানিয়ে দেননি। এসব তো তোমাদের মুখের কথা মাত্র। আর আল্লাহ সত্য কথা বলেন। আর তিনি সঠিক পথের নির্দেশনা দেন।
মুজাদালা ৫৮:১-৪
قَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ الَّتِي تُجَادِلُكَ فِي زَوْجِهَا وَتَشْتَكِي إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ يَسْمَعُ تَحَاوُرَكُمَا إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ
৫৮:১ :: নিশ্চয় আল্লাহ শুনেছেন সে নারীর কথা যে তোমার সাথে তার স্বামীর ব্যাপারে বিতর্ক করেছে আর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছে। আর আল্লাহ তোমাদের দুজনের কথোপকথন শুনছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।
الَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنكُم مِّن نِّسَائِهِم مَّا هُنَّ أُمَّهَاتِهِمْ إِنْ أُمَّهَاتُهُمْ إِلَّا اللَّائِي وَلَدْنَهُمْ وَإِنَّهُمْ لَيَقُولُونَ مُنكَرًا مِّنَ الْقَوْلِ وَزُورًا وَإِنَّ اللَّهَ لَعَفُوٌّ غَفُورٌ
৫৮:২ :: তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদের স্ত্রীকে যিহার করে (অর্থাৎ মায়ের মতো হিসাবে প্রকাশ করে) তাদের স্ত্রীরা তাদের মা হয়ে যায় না। যারা তাদেরকে জন্ম দিয়েছে তারা ছাড়া কেউ তাদের মা নয়। আর নিশ্চয় তারা তো অত্যন্ত মন্দ ও অসত্য কথাই বলছে। আর নিশ্চয় আল্লাহ উদার ক্ষমাশীল।
وَالَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِن نِّسَائِهِمْ ثُمَّ يَعُودُونَ لِمَا قَالُوا فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مِّن قَبْلِ أَن يَتَمَاسَّا ذَٰلِكُمْ تُوعَظُونَ بِهِ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
৫৮:৩ :: আর যারা তাদের স্ত্রীকে যিহার করে (অর্থাৎ মায়ের মতো হিসাবে প্রকাশ করে), তারপর তারা যা বলেছিল তা থেকে ফিরে যায় (অর্থাৎ স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতে চায়), তারা স্ত্রীমিলনের আগে একজন দাসকে মুক্ত করতে হবে। তোমাদেরকে এ উপদেশ দেয়া হচ্ছে। আর তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা সম্যক অবগত।
فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ مِن قَبْلِ أَن يَتَمَاسَّا فَمَن لَّمْ يَسْتَطِعْ فَإِطْعَامُ سِتِّينَ مِسْكِينًا ذَٰلِكَ لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٌ
৫৮:৪ :: কিন্তু যে সেই সামর্থ্য পায় না তবে সে স্ত্রীমিলনের আগে ধারাবাহিকভাবে দুই মাস সিয়াম পালন করবে। কিন্তু যে তা পারবে না তবে সে ষাটজন মিসকীনকে আহার করাবে। এটাই বিধান, যেন তোমরা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস করো। আর এগুলো আল্লাহর সীমা। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি ।
আলোচনা
যিহার সম্পর্কিত আয়াতের একটি শিক্ষা এই যে বিভিন্ন কালচারে বা স্থান ও কালের তারতম্য অনুসারে মৌখিক তালাক প্রদানের যেকোনো ধরনের প্রথা বা প্রচলন থাকুক না কেন, শুধুমাত্র মুখে উচ্চারণের মাধ্যমে তালাক অবৈধ। বৈবাহিক জীবনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যথাযথ প্রক্রিয়া, নিয়মানুবর্তিতা ও আনুষঙ্গিক বিবেচনা ব্যতীত কেবল মুখের কথায় বিচ্ছিন্নকরণ কখনোই স্বাভাবিক হতে পারে না, অত:পর আল্লাহর বিধানেও সেটি অগ্রহণযোগ্য।
লিআন শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘আল্লাহর লা’নত কামনা করা’। যখন স্বামী তার স্ত্রীর বিষয়ে (বা স্ত্রী তার স্বামীর বিষয়ে) ব্যাভিচারের অভিযোগ দায়ের করে অথচ সে নিজে ছাড়া অন্য কোনো স্বাক্ষী নেই তখন এ মামলার নিষ্পত্তি কীভাবে হবে সে নির্দেশনাকেই লিআন বলে। নিম্নে লিআন সম্পর্কিত আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হলো।
নূর ২৪: ৬-১০
وَالَّذِينَ يَرْمُونَ أَزْوَاجَهُمْ وَلَمْ يَكُن لَّهُمْ شُهَدَاءُ إِلَّا أَنفُسُهُمْ فَشَهَادَةُ أَحَدِهِمْ أَرْبَعُ شَهَادَاتٍ بِاللَّهِ إِنَّهُ لَمِنَ الصَّادِقِينَ
২৪:৬ :: আর যারা তাদের স্ত্রীদেরকে ব্যাভিচারের অপবাদ দেয়, আর তাদের অভিযোগের পক্ষে তারা নিজেরা ছাড়া কোনো স্বাক্ষী থাকে না, তবে তাদের একেক জন (অর্থাৎ অভিযোগকারী স্বামী) আল্লাহর নামে চারবার স্বাক্ষ্য দিবে, এ মর্মে যে, নিশ্চয় সে সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত।
وَالْخَامِسَةُ أَنَّ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَيْهِ إِن كَانَ مِنَ الْكَاذِبِينَ
২৪:৭ :: আর পঞ্চমবার এ মর্মে যে, তার নিজের উপর আল্লাহর লা’নত পড়–ক যদি সে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়।
وَيَدْرَأُ عَنْهَا الْعَذَابَ أَن تَشْهَدَ أَرْبَعَ شَهَادَاتٍ بِاللَّهِ إِنَّهُ لَمِنَ الْكَاذِبِينَ
২৪:৮ :: আর এভাবে নারীটির শাস্তি রহিত হয়ে যাবে যে, সে আল্লাহর নামে চারবার স্বাক্ষ্য দিবে, এ মর্মে যে, নিশ্চয় সে (অর্থাৎ অভিযোগকারী পুরুষটি) মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত।
وَالْخَامِسَةَ أَنَّ غَضَبَ اللَّهِ عَلَيْهَا إِن كَانَ مِنَ الصَّادِقِينَ
২৪:৯ :: আর পঞ্চমবার এ মর্মে যে, তার নিজের উপর আল্লাহর গযব পড়ুক, যদি সে (অর্থাৎ পুরুষটি) সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়।
وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ وَأَنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ حَكِيمٌ
২৪:১০ :: আর যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকতো, (তাহলে তোমরা বড়ই জটিলতায় পড়ে যেতে)। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাওবা কবুলকারী ও মহাবিজ্ঞ।
আলোচনা
(ক) সহজেই বুঝা যাচ্ছে এখানে মামলা ডিসমিস। সুতরাং পুরুষটিকেও মিথ্যাবাদী বলা যাবে না এবং নারীটিকেও অসতী বলা যাবে না। এর মাধ্যমে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায় বলা হয়নি। এরপর তারা দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখবে কিনা এটা তাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার। যদি স্ত্রী সত্যি অনৈতিক আচরণ (যেমন: জ্বিনা, ব্যাভিচার) করে থাকে তাহলে স্বামী তাকে এভাবে সমাধান হয়ে যাওয়া অভিযোগটিতে অভিযুক্ত করা ছাড়াই তালাক দিতে পারে।
(খ) যদি কোনো স্ত্রী তার স্বামীর ব্যাপারে অনুরূপ অভিযোগ করে তবে তার ব্যাপারেও একইরূপ বিধান। কারণ, একটি বিষয়ে দুটি দিক থাকলে তার একটি প্রসঙ্গে কোনো কথা বললে ও বিপরীত প্রসঙ্গে কিছু না বললে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেক্ষেত্রেও একইরূপ কথা কার্যকর হয়। তাই সে বিষয়টি আলাদাভাবে বলার প্রয়োজন থাকে না।
(গ) লক্ষণীয় যে আল কুরআন তালাকের সকল বিধানে নারীর কল্যাণ ও অধিকারকে সর্বাবস্থায় অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। তালাকের অন্যতম শক্ত কারণ যেখানে একে অন্যের প্রতি অবৈধ সম্পর্কের অভিযোগ, সেখানে উপযুক্ত স্বাক্ষীর অবর্তমানে স্বামীর স্বাক্ষ্যের পরে শেষ কথা বলার ও স্বাক্ষ্যের অধিকার নারীকে প্রদান করে এক্ষেত্রেও কুরআনে নারীর অধিকারই যে অগ্রগণ্য সেটিই প্রমাণ করে।
এই বইটিতে উল্লেখিত আয়াতসমূহে তালাক ও বৈবাহিক জীবনের সাথে সর্ম্পকিত কুরআনিক পরিভাষা সমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাঠকের সুবিধার্থে এখানে তুলে ধরা হলো।
হুদুদুল্লাহ حُدُودُ اللَّه : হুদুদুল্লাহ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘আল্লাহর নির্ধারিত সীমাসমূহ’। সূরা তালাকের প্রথম আয়াতে তালাক সম্পর্কিত বিধিবিধানকে ‘হুদুদুল্লাহ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
উক্বদাতুন নিকাহ عُقْدَةُ النِّكَاحِ : উক্বদাতুন নিকাহ কথাটির অর্থ হচ্ছে ‘বিবাহের বন্ধন’। নিকাহ বা বিবাহ হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ধর্ম নির্দেশিত সামাজিক চুক্তি। বিবাহের মাধ্যমে যে ‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক’ তৈরি হয় তাকে ‘উক্বদাতুন নিকাহ’ বলে।
ঈলা اِيلَاء : ঈলা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘স্ত্রীমিলন থেকে বিরত থাকার শপথ করা’। দাম্পত্য মনোমালিন্যের প্রেক্ষিতে কোনো স্বামী এরূপ শপথ করলে তাকে চারমাসের অবকাশ দেয়া হয়েছে যেন সে এর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, চারমাস অতিবাহিত হওয়ার পর বিরত থাকার সুযোগ নেই। তখন হয় সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হবে, না হয় তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তালাক طَلَاق : তালাক শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘প্রত্যাখ্যান, বর্জন’। শব্দটি সাধারণত ‘বিবাহ বিচ্ছেদ’ বুঝাতে প্রয়োগ করা হয়। তবে কুরআন অনুযায়ী তালাক দেয়ার সাথে সাথে চূড়ান্তভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না। বরং তালাকের প্রাথমিক কার্যকারিতা হচ্ছে স্ত্রীলোককে ইদ্দাত পালন করতে হয়। আর তালাকের চূড়ান্ত কার্যকারিতা হচ্ছে ইদ্দাত শেষে মুফারাক্বাত বা চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতা ঘটে।
ইদ্দাত عِدَّة : ইদ্দাত শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘গণনা করা, তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর অন্যত্র বিয়ে করার পূর্বে অপেক্ষা করার সময়কাল’। কুরআনে ইদ্দাতের বা অপেক্ষাকালের সময়সীমা এবং ঐ সময়সীমায় করণীয় সম্পর্কে যেসব নির্দেশ দেয়া হয়েছে তালাক কার্যকর করার ক্ষেতে তা যথাযথভাবে পরিপালন করার উপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
কুরু قُرُوء : কুরু শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘স্বাভাবিক অবস্থার ছেদমূলক পরিবর্তিত অবস্থা’। শব্দটি ব্যবহৃত হয় স্ত্রীলোকের হায়েজ বা রজ:স্রাবকাল বুঝানোর জন্য। কারণ স্বাভাবিক পরিচ্ছন্ন অবস্থা (তুহর) এর সাপেক্ষে এটি একটি পরিবর্তিত অবস্থা। সংক্ষেপে কুরু বলতে তালাক পরবর্তী হায়েজকে বুঝানো হয়। তালাকপ্রাপ্তার অপেক্ষাকাল হচ্ছে তিন কুরু তথা তালাক পরবর্তী তিনটি পূর্ণ সময়ান্ত হায়েজ।
মাহীদ / মাহীজ (হায়েজ) مَحِيض /حَيض : মাহীদ / মাহীজ বা হায়েজ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘স্ত্রীলোকের মাসিক রজ:স্রাব’। তালাকপ্রাপ্তার ইদ্দাত পালনের ক্ষেত্রে হায়েজের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।
তুহর طُهر : তুহর শব্দের অর্থ ‘পরিচ্ছন্ন অবস্থা’। স্ত্রীলোকের ক্ষেত্রে এটি হায়েজমুক্ত (রজ:স্রাবমুক্ত) সময়কালকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। ইদ্দাতের শর্ত পূরণ করে তালাক দেয়ার নির্দেশ পালনের উপায় হচ্ছে তুহর অবস্থায় তালাক দেয়া।
ইমছাক্ব اِمْسَاك : ইমছাক্ব শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘রেখে দেয়া’ বা ‘বহাল রাখা’। তালাকের প্রসঙ্গে শব্দটি তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে তার ইদ্দাতকালের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্কে ফিরিয়ে নেয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তালাক অর্থই যে অতিআবশ্যকভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ নয়, বরং স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক সমঝোতায় আবার স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, ইমছাক্ব শব্দটি তারই নির্দেশক।
মুফারাক্বাত مُفَارَقَة : মুফারাক্বাত শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পৃথক করে দেয়া, চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতা’। তালাকের প্রসঙ্গে শব্দটি ইদ্দাতকালে স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নিলে ইদ্দাত শেষে স্বাক্ষী রেখে বিদায় দেয়া ও দাম্পত্য সম্পর্কের চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতার অর্থ প্রকাশ করে। সূরা তালাকের ২য় আয়াতে এ শব্দ থেকে গঠিত ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়েছে।
ফিদইয়া فِدْيَة : ফিদইয়া শব্দের অর্থ হলো ‘মুক্তিপণ’। তালাকের ক্ষেত্রে যদি স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে তার স্বামীকে তালাক দেয় তাহলে সে দেনমোহরের একটা অংশ ফিরিয়ে দিতে হয়, একে ফিদইয়া বলা হয়েছে।
মাতা’ مَتٰع : মাতা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘ভোগসামগ্রী, ভরণ পোষন’। স্বামী তার স্ত্রীর জন্য যা খরচ করে তাকে মাতা’ বলা হয়। এছাড়া তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিদায় দেয়ার সময় মাতা’ হিসেবে সাধ্যমতো কিছু দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মা’রূফ مَعرُوف : মা’রূফ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পরিচিত, ন্যায়সঙ্গত কাজ বা পদ্ধতি’। ন্যায়কাজ মানুষের বিবেকের অত্যন্ত পরিচিত বিধায় ন্যায়কাজ বুঝাতে বা ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতি বুঝাতে মা’রূফ শব্দ ব্যবহৃত হয়। স্ত্রীর সাথে মা’রূফভাবে বসবাস করা, স্ত্রীকে মা’রূফভাবে মাতা’ / ভরণপোষণ দেয়া এবং তালাকপ্রাপ্তাকে মা’রূফভাবে ফিরিয়ে নেয়া বা ইদ্দাতশেষে মা’রূফভাবে পৃথক করে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তালাক ও এই সম্পর্কিত বিধিবিধানে বারবার মা’রূফ শব্দটির উপরে কুরআনে জোর এসেছে।
ফারীদাহ فَرِيضَة : ফারীদাহ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘আবশ্যিক’। বিবাহের একটি বিধান হিসেবে স্ত্রীকে যে পারিতোষিক বা দেনমোহর দিতে হয় সূরা নিসার ২৪ আয়াতে তাকে ‘উজূরাহুন্না ফারীদাহ’ (অর্থাৎ আবশ্যিক পারিতোষিক) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানে সংক্ষেপে ‘ফারীদাহ’ শব্দটি দেনমোহর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
দরাবা ضَرَبَ : দরাবা ক্রিয়াটির অর্থ হচ্ছে ‘আঘাত করা, বিচলিত করা, ভ্রমণ করা, সামনে উপস্থাপন করা, দৃষ্টান্ত পেশ করা, উদাহরণ উপস্থাপন করা, কাউকে কোনো অবস্থায় রাখা বা কোনো অবস্থা থেকে বের করে আনা, কোথাও কিছু রাখা, প্রত্যাহার করে নেয়া’। দাম্পত্য সমস্যা সমাধানের জন্য দেয়া নির্দেশনার ক্ষেত্রে এর অর্থ হচ্ছে সমাধানে সম্পর্কিত হবার যোগ্য ব্যক্তিদের সামনে উপস্থাপন করা।
জ্বিনা زِنَي : জ্বিনা শব্দের অর্থ হচ্ছে ব্যভিচার, বিবাহ বহির্ভুত যৌন সম্পর্ক, অনৈতিক সর্ম্পক স্থাপন করা। কুরআনে জ্বিনাকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে দণ্ডবিধি দেয়া হয়েছে।
যিহার ظِهَار : যিহার শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘ভিন্নরূপে প্রকাশ করা’। শব্দটি তালাকের সাথে সম্পর্কিত। প্রায়োগিকভাবে এর অর্থ হচ্ছে ‘স্ত্রীকে মা হিসেবে প্রকাশ করা, স্ত্রীকে মায়ের মতো বলা’। এটি কুরআন নাজিলের সমসাময়িক সময়ে তালাক দানের একটি কুপ্রথা ছিল। বস্তুত এর মাধ্যমে স্ত্রী কোনক্রমেই মায়ের মতো হয়ে যায় না, তথা দাম্পত্য সম্পর্ক অবৈধ হয় না, এ সত্যটিকে আল কুরআনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সেই সাথে এরূপ মন্দ ও অসত্য কথার শাস্তিস্বরূপ কেউ যিহার করলে স্ত্রীর সাথে স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরে যাওয়ার আগে দাসমুক্তি অথবা ধারাবাহিকভাবে দুই মাস রোজা রাখা বা ষাটজন মিসকীনকে আহার করানোর বিধান দেয়া হয়েছে।
লিআন لِعَان : লিআন শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘আল্লাহর লা’নত কামনা করা’। যখন স্ত্রীর বিষয়ে স্বামী বা স্বামীর বিষয়ে স্ত্রী ব্যাভিচারের অভিযোগ আনে, অথচ নিজে ছাড়া অন্য কোন স্বাক্ষী নেই তখন যে পদ্ধতির মাধ্যমে এ অভিযোগের নিষ্পত্তি হবে তাকে লিআন বলে। এ পদ্ধতিতে স্বামী চারবার আল্লাহর নামে কসম খেয়ে নিজেকে সত্যবাদী বলে দাবি করে মিথ্যাবাদীর প্রতি আল্লাহর লা’নত কামনা করে। স্ত্রীও যদি একইভাবে কসম করে ও লা’নত কামনা করে তাহলে সে নিষ্কৃতি পাবে। স্ত্রীর অভিযোগের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা।
দারাজাত دَرَجَةٌ : দারাজাত শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘উচ্চমান’। শব্দটি উচ্চ মর্যাদাগত মান, অধিকারগত উচ্চমান এবং সুবিধাগত অবস্থান বুঝায়। ২:২২৮ আয়াতে বলা হয়েছে: নারীদের অধিকার রয়েছে যেমন তাদের দায়িত্ব রয়েছে এবং নারীদের উপর পুরুষদের দারাজাত রয়েছে। আল কুরআনের আলোকে মানুষের দারাজাত দুই শ্রেণিতে বিভক্ত: (ক) প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনাগত উদ্দেশ্য সম্বলিত পরীক্ষামূলকভাবে প্রদত্ত দারাজাত তথা প্রকৃতিগত সুবিধাসম্পন্ন ও পদমর্যাদাগত উচ্চমাত্রা। (খ) ফলাফলমূলক দারাজাত তথা মানুষের কর্ম অনুসারে আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীতে ও আখিরাতে পুরস্কার হিসেবে দেয়া দারাজাত, যা বিচারিক সিদ্ধান্ত হওয়ায় কাউকে প্রাপ্যের চেয়ে কম দিয়ে কারো প্রতি জুলুম করা হবে না। ২:২২৮ আয়াতটি নারী-পুরুষের পার্থিব জীবন নির্বাহে পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কিত। এখানে দারাজাত শব্দটি কর্মের পুরস্কার হিসেবে দেয়া কোনো মর্যাদায় নারী-পুরুষের তারতম্য প্রকাশ করে না, বরং এখানে দারাজাত শব্দটি প্রথম প্রকারের তথা পরীক্ষামূলক দারাজাত বা প্রকৃতিগত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার প্রেক্ষিতে প্রাপ্ত অধিকার ও পদমর্যাদাগত দারাজাতকে প্রকাশ করে। অন্য কথায়, নারীর উপর পুরুষের দারাজাত থাকার অর্থ হচ্ছে পুরুষকে প্রকৃতিগত অবস্থান বিবেচনায় ন্যায়সঙ্গত যেসব অধিকার ও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাতে সে উচ্চমানে অবস্থান করে, যা তার জন্য বিশেষ জবাবদিহিতার কারণে পরিণত হবে।
নুশুয نُشُوزَ : নুশুয শব্দের শব্দমূল হচ্ছে ‘নুন শীন যা’। শব্দমূলের অর্থ হচ্ছে ‘উঠা’। কিন্তু এই শব্দমূল থেকে গঠিত ‘নুশুয’ শব্দটি শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। অন্য কথায় এর অর্থ হচ্ছে ‘দাম্পত্য চুক্তি লংঘন’ যা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন অন্যত্র অনৈতিক সম্পর্ক, অস্বাভাবিক আচরন, একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্ত্রীদের মধ্যে স্বামীর বৈষম্য সৃষ্টি। ৪:৩৪ আয়াতে যখন কোনো স্বামী আশংকা করে যে তার স্ত্রী নুশুয করছে সে প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে। ৪:১২৮ আয়াতে যখন কোনো স্ত্রী আশংকা করে যে তার স্বামী নুশুয করছে সে প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে। নুশুয শব্দটি আল কুরআনে এ দুটি আয়াতেই উল্লেখ করা হয়েছে।