বিবাহ

আল কুরআনের আলোকে বিবাহ

মানব সভ্যতা বিনির্মাণে মজবুত চুক্তি

তালাকপ্রাপ্তা ও বিধবার পুন:বিবাহের ক্ষেত্রে ইদ্দাতের শর্ত

২:২২৮, ২:২৩৪, ৩৩:৪৯, ৬৫:১, ৬৫:৪-৬ প্রভৃতি আয়াতে তালাকপ্রাপ্ত ও বিধবার পুন:বিবাহের ক্ষেত্রে ইদ্দাতের শর্ত দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তালাকপ্রাপ্তা ও বিধবা পুন:বিবাহ করার আগে তাদেরকে তাদের ইদ্দাত (বিধিবদ্ধ অপেক্ষার সময়কাল) অতিবাহিত করতে হবে।

আয়াতগুলো থেকে জানা যায় যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তালাকপ্রাপ্তার ইদ্দাত নিম্নরূপ:

(ক) সাধারণ অবস্থায় ইদ্দাত হলো তিন কুরু বা তিনটি পূর্ণ সময়ান্ত হায়েজ বা রজ:স্রাব।

(খ) যেসব বয়স্ক মহিলার হায়েজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে তাদের ক্ষেত্রে ইদ্দাত হলো তিনমাস।

(গ) যাদের কোনো জটিলতার কারণে রজ:স্রাব হয়নি তাদের ইদ্দাত হলো তিনমাস।

(ঘ) গর্ভবতী নারীর ইদ্দাত হলো সন্তান প্রসব পর্যন্ত।

(ঙ) বিয়ের পর স্ত্রীকে স্পর্শ করার আগে তালাক দিলে তার ইদ্দাত নেই।

আর বিধবাদের ক্ষেত্রে ইদ্দাত নিম্নরূপ:

(ক) অগর্ভবতী বিধবার ইদ্দাত হলো (যেদিন তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে সেদিন থেকে) চার মাস দশ দিন। যদি সে তালাকপ্রাপ্তা হয় এবং তালাকের ইদ্দাত চলাকালে (ইদ্দাত সমাপ্তির পূর্বে) তার স্বামীর মৃত্যু হয়, তাহলেও তার স্বামীর মৃত্যুর দিন থেকে তার চার মাস দশ দিনের ইদ্দাত শুরু হবে।

(খ) গর্ভবতী নারীর ইদ্দাত হলো সন্তান প্রসব পর্যন্ত’ ধারাটি গর্ভবতী বিধবার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে, সে তালাকপ্রাপ্তা হোক বা সাধারণ বিধবা হোক।

ইদ্দাতকাল অতিবাহিত হওয়ার পর তালাকপ্রাপ্তা ও বিধবা নারী নিজ ইচ্ছা ও পছন্দ অনুসারে বিবাহ করতে পারবে, এতে কেউ বাধা দেয়া সঙ্গত নয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ২:২৪০ আয়াত অনুযায়ী, ইদ্দাত শেষে বিধবা নারী অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে, তবে যদি সে অন্যত্র বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ না হয় বা স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে না যায়, তাহলে তার স্বামীর মৃত্যুর পরবর্তী এক বছরের মধ্যে তাকে তা থেকে বের করে দেয়া যাবে না, বরং ভরণপোষণ দিতে হবে।

বিবাহের বন্ধন (উক্বদাতুন নিকাহ) কার হাতে?

২:২৩৭ আয়াতে একটি নির্দেশনা প্রসঙ্গে “আল্লাযী বিয়াদিহি উক্বদাতুন নিকাহ” (যার হাতে বিবাহের বন্ধন) কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতটির নির্দেশনা হলো: বিয়ের পর দেনমোহর ধার্য করার পরে কিন্তু স্পর্শ করার আগে তালাক দিলে অর্ধেক দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে যদি স্ত্রী অনুকম্পা প্রকাশ করে কম নেয় বা ছেড়ে দেয় অথবা স্বামী অনুকম্পা করে বেশি দেয় বা পূর্ণ পরিমাণ দেয় সেটা ভিন্ন কথা। অথবা স্ত্রীর পক্ষ থেকে যার হাতে বিয়ের বন্ধন তথা তালাক বিভাগের কর্মকর্তা বা আইনগত অভিভাবকও দেনমোহরের পরিমাণ কম করতে পারে। অবশ্য স্বামীরা যদি বেশি দেয় সেটাই উত্তম বলা হয়েছে।

আয়াতটিতে ব্যবহৃত ‘যার হাতে বিয়ের বন্ধন’ শর্তটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে স্বামী বা তালাক বিভাগের কর্মকর্তা বা আইনগত অভিভাবক। কারণ আয়াতটিতে এ শর্তের পূর্বাপর অংশে স্বামীদেরকে ‘তোমরা’ শব্দ দ্বারা উল্লেখ করা হয়েছে। তাই ‘যার হাতে বিয়ের বন্ধন’ এর মাধ্যমে শুধুমাত্র স্বামীকে নির্দিষ্ট করা যায় না। তবে যেহেতু স্বামী তালাক দিতে পারে তাই তার হাতেও বিয়ের বন্ধন নির্ভর করে। আবার স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে তালাক দিতে পারে বিধায় তালাক বিভাগের কর্মকর্তার হাতেও বিয়ের বন্ধন নির্ভর করে। এছাড়া কোনো আইনগত অভিভাবক থাকলে যিনি বিয়ে বন্ধন টিকে থাকবে নাকি ছিন্ন করা হবে এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দেয়ার অবস্থানে থাকেন তবে সেই আইনগত অভিভাবকের উপরও বিয়ের বন্ধন নির্ভর করে। এজন্য আয়াতটিতে ব্যবহৃত ‘যার হাতে বিয়ের বন্ধন’ এর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সাপেক্ষে এই বিভিন্ন অবস্থা সম্ভব।

‘মা মালাকাত আইমান’কে বিবাহ করার প্রসঙ্গ

কুরআনে বিবাহের বিধানের মধ্যে দাস-দাসীর বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। কুরআনের বস্তুনিষ্ঠ অধ্যয়নের পরিবর্তে এক শ্রেণির মোল্লার অপব্যাখ্যার ভিত্তিতে একটি ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, ইসলামে দাসীদের সাথে বিয়ে ছাড়াই দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। অথচ কুরআন থেকে এটা স্পষ্ট যে, নারী-পুরুষের মধ্যে যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে শুধুমাত্র বিয়ের মাধ্যমে, অন্য কোনোভাবে নয়। বিয়ে ছাড়া যৌনসম্পর্ক যদি নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্মতিক্রমেও ঘটে তবুও তা অবৈধ এবং সেটা ব্যভিচার নামে অভিহিত, যা একটি দণ্ডযোগ্য সামাজিক অপরাধ। স্বাধীন-স্বাধীনা বা দাস-দাসী কেউ এ বিধানের বাহিরে নয় এবং দাসীর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তাকে বিয়ে করতে হবে এবং তার জন্য বিধিবদ্ধ মোহরানাও প্রদান করতে হবে।

কুরআনে দাস-দাসীকে ব্যাপকভাবে ‘মা মালাকাত আইমান’ শব্দের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে ‘মা মালাকাত আইমান’ শব্দের অর্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কেও জানা প্রয়োজন। তাই দাস-দাসী ও ‘মা মালাকাত আইমান’ এবং তাদেরকে বিয়ে করার প্রসঙ্গে উল্লেখিত নির্দেশনার বিভিন্ন দিক নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো।

স্বাধীন নারী-পুরুষ ও দাস-দাসী বুঝাতে ব্যবহৃত শব্দাবলির তাৎপর্য

তৎকালীন দাসপ্রথাকে শক্তিপ্রয়োগে উৎখাত করার পরিবর্তে কুরআনে দাসমুক্তির জন্য বিশেষ নির্দেশনা প্রদান ও সংস্কার কর্মনীতির প্রবর্তন করা হয়। তাই স্বাধীন নারী-পুরুষ ও দাস-দাসী বুঝাতে বিভিন্ন শব্দাবলি ব্যবহৃত হয় এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় নির্দেশ ও নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এই প্রেক্ষিতে কুরআনে স্বাধীনা নারী ও দাসী প্রসঙ্গে থাকা শব্দগুলোর তাৎপর্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

স্বাধীনা নারী বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত মূল শব্দটি হচ্ছে ‘মুহসনাত। আর দাসী বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত মূল শব্দটি হচ্ছে ‘আমাতুন’ (বহুবচনে ইমাউন)। অন্যদিকে ‘মুহসনাত এর বিপরীতে ‘মা মালাকাত আইমান’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে (৪:২৪-২৫)। আবার ‘মা মালাকাত আইমান শব্দগুচ্ছ ‘আজওয়াজ’ এর বিপরীতেও ব্যবহৃত হয়েছে (২৩:৫-৭, ৭০:২৯-৩১)। নিম্নে এসব শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হওয়া আয়াতগুলোর বক্তব্যস্থান / বক্তব্য কাঠামো অনুসারে শব্দগুলো যে ধরনের অর্থ প্রকাশ করে তা উল্লেখ করা হলো।

১. মুহসনাত শব্দটি যেসব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো হলো: (ক) সতী নারী, হোক বিবাহিত বা অবিবাহিত, হোক স্বাধীনা বা ‘মা মালাকাত আইমান’; (খ) স্বাধীনা নারী, হোক বিবাহিত বা অবিবাহিত। (গ) স্বাধীনা অবিবাহিতা / তালাকপ্রাপ্তা / বিধবা নারী।

যখন বলা হয় যে, “মুহসনাত নারী হারাম কিন্তু মা মালাকাত আইমান নয়” তখন এর অর্থ হচ্ছে স্বাধীনা বিবাহিতা (সধবা) নারীকে বিয়ে করা হারাম, কিন্তু সধবা ‘মা মালাকাত আইমানকে বিবাহ করা হারাম নয়।

যখন বলা হয় যে, মুহসনাতকে বিয়ে করতে না পারলে সে ‘মা মালাকাত আইমান’ নারীকে তার আহলের/ অভিভাবকের অনুমতিক্রমে বিবাহ করবে, তখন এর অর্থ হচ্ছে স্বাধীনা অবিবাহিতা /তালাকপ্রাপ্তা / বিধবা নারীকে বিয়ে করতে না পারলে সে ‘মা মালাকাত আইমান’ নারীকে বিয়ে করবে তার অভিভাবকের অনুমতিক্রমে।

মা মালাকাত আইমান’ যখন বিবাহিত হয়, তখন সে ‘মুহসনাত মা মালাকাত আইমান’ হয়, তথা ‘বিবাহিত ও স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মা মালাকাত আইমান’ হয়। তারপর যদি সে অশ্লীল কাজ করে তবে তার শাস্তি হচ্ছে ‘মুহসনাতের অর্ধেক’ তথা ‘স্থায়ী স্বাধীনা নারীর অর্ধেক, সে স্বাধীনা নারী বিবাহিতা হোক, বা অবিবাহিতা হোক’।

একজন পুরুষের জওজ বলতে বুঝায় তার স্ত্রীকে তথা বিবাহিতা স্বাধীনা নারীকে (মুহসনাত মুহসনাতকে)।

২. আমাতুন (বহুবচনে ইমায়ি) অর্থ হচ্ছে ‘দাসী’ (২:২২১, ২৪:৩৩)। ২৪:৩৩ আয়াতে আছে ‘ইমায়িকুম যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘তোমাদের দাসী’। এখানে তোমাদের দাসী মানে তোমাদের সমাজস্থ দাসী। অর্থাৎ বৃহত্তর পরিসরে সমাজকে তাদের নিজেদের বলয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে মু’মিনদের নিজেদের সরাসরি আয়ত্তে যারা আছে তাদেরকে বলা হয়েছে ‘মা মালাকাত আইমান’ (২৪:৩৩), যাদেরকে মুক্ত করে দেয়ার প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছিল। আর সমাজে অন্য যাদের অধীনে তখনো দাসী ছিল তাদের থেকে জোর করে দাসদাসীদেরকে দাসত্ব মুক্ত করানো হয় নি, বরং মু’মিনরা ক্রয়ে অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে দাসদাসীকে মুক্ত করার ফর্মুলাই দেয়া হয়েছে, যাতে সমাজ সংস্কার হয়, গঠনমূলক পরিবর্তন হয়, ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়ায় বিপ্লব না হয়। কিন্তু মু’মিনরা কাউকে নিজের আবদ/ দাস এবং আমাত/ দাসী বানিয়ে রাখতে পারে না, কারণ আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষ ও জিনকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত/ দাসত্ব করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে (৫১:৫৬)।

মা মালাকাত আইমান’ শব্দের তাৎপর্য: এর দ্বারা কাদেরকে বুঝায়?

‘মা মালাকাত আইামান এর অর্থ নির্ণয়ের জন্য যা জানা প্রয়োজন তা হলো, ‘মা মালাকাত আইমানের দুটি বিশেষ অবস্থা হলো:

(১) ‘মা মালাকাত আইমান’ হলো তারা যারা অপ্রাপ্তবয়স্ক বালকদের মতো স্তরে রয়েছে (২৪:৫৮)।

(২) ‘মা মালাকাত আইমানকে স্বাধীনভাবে উপার্জনের সীমিত সুযোগ দিয়ে তার যোগ্যতার বিকাশের সুযোগ দিতে হবে যাতে সে স্বাধীন হবার জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায় (২৪:৩৩)।

সুতরাং ‘মা মালাকাত আইমান এর মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যথা: (ক) মু’মিনদের কাছে থাকা তাদের পূর্ববর্তী ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী, (খ) যুদ্ধবন্দী নারী-পুরুষদের মধ্য থেকে যাদেরকে কোনো মু’মিনের তত্ত্বাবধানে দেয়া হয়েছে, কারণ তাদের মধ্যে তখনো স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের যোগ্যতা তৈরি হয়নি, (গ) অনুরূপভাবে কাফির আত্মীয়দেরকে ত্যাগ করে হিজরত করে আসা নারী-পুরুষদের মধ্য থেকে যাদেরকে কোনো মু’মিনের তত্ত্বাবধানে দেয়া হয়েছে, কারণ তাদের মধ্যে তখনো স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের যোগ্যতা তৈরি হয়নি। এ বিষয়টি পরবর্তী ‘আনুষঙ্গিক ধারাসমূহ’ অনুচ্ছেদের আলোচনায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হবে।

‘মা মালাকাত আইমান শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘যাদেরকে অধিকৃত করেছে তোমাদের ডানহাতসমূহ’। ডানহাত কথাটি ইতিবাচক তৎপর্য বহন করে, যার অর্থ হচ্ছে নিরাপত্তা বিধানের প্রতিশ্রুতি দানকারী বা চুক্তি সম্পাদনকারী শক্তিসম্পন্ন হাত। এভাবে মু’মিনদের নিজেদের আওতাধীনে থাকা তৎকালীন দাস-দাসী যেন একটা নিরাপত্তা বলয়ে থাকে এবং যেন তাদের যোগ্যতার সমৃদ্ধি সাধনের মাধ্যমে তাদেরকে মুক্ত করে দেয়া যায় বা তাদেরকে বিয়ে করে নিয়ে স্বাধীনা করে দেয়া যায় সেরূপ বিধানও প্রদান করা হয়েছে।

মা মালাকাত আইমানুকুম’ এর একটি অবস্থা হচ্ছে ‘আল্লাযীনা আক্বাদাত আইমানুকুম’ (তোমাদের ডানহাত যাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, দ্র: ৪:৩৩)। সুতরাং ‘মা মালাকাত আইমান’কে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য উপযুক্ত হয় এরূপ পরিমিত পরিমাণে (নাসীব) প্রদান করতে হবে।

‘মা মালাকাত আইমান কথাটি নিরাপত্তাবিধানের অর্থে মানবসম্পদের মালিকানার সাথে জড়িত, তাদের ব্যক্তিসত্তাকে বস্তুসত্তার মতো সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে তার মালিক হয়ে যাওয়া হিসেবে সাব্যস্ত নয়। তাই ‘মামলূকুকুম’ বা ‘তোমাদের অধিকৃত’ বলার পরিবর্তে বলা হয়েছে ‘মা মালাকাত আইমানুকুম’ তথা ‘যাদেরকে তোমাদের ডান হাত নিরাপত্তা প্রদানের প্রতিশ্রুতির আওতায় অধিকৃত করেছে’।

মা মালাকাত আইমানের’ সাথে দৈহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিবাহের আবশ্যকতা

প্রচলিত ধারণা হলো ‘মা মালাকাত আইমান নারীকে বিয়ে করা ছাড়াই তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার অনুমতি রয়েছে এবং এ বিষয়ে তথ্যসূত্র হিসেবে ২৩:৫-৭ ও ৭০:২৯-৩১ আয়াতের উল্লেখ করা হয়। অথচ এ প্রচলিত ধারণা সম্পূর্ণরূপে কুরআনবিরুদ্ধ ধারণা। আল কুরআনে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ককে যিনা হিসেবে সাব্যস্ত করে তাকে একটি ফৌজদারি অপরাধের অন্তর্ভুক্ত করে দণ্ডবিধি দেয়া হয়েছে। ৪:৩ এবং ৪:২৪-২৫ আয়াত অনুসারে ‘মা মালাকাত আইমানকে বিয়ে করা ছাড়া তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা নিষিদ্ধ। তাই নিম্নে ২৩:৫-৭ এবং ৭০:২৯-৩১ আয়াতের প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।

২৩:৫-৭ :: এবং যারা তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী (সংরক্ষণকারী)। তাদের স্বাধীনা স্ত্রী এবং ‘মা মালাকাত আইমান’ স্ত্রী (যাদেরকে তাদের প্রতিশ্রুতি ও নিরাপত্তা প্রদায়ক ডানহাত পূর্ণরূপে অধিকৃত করেছে এরূপ স্ত্রী) প্রসঙ্গে ছাড়া। এক্ষেত্রে তারা নিন্দিত হবে না। সুতরাং যারা সেটার বাইরে কাউকে তালাশ করবে, তারাই সীমালংঘনকারী হবে।

৭০:২৯-৩১ :: এবং যারা তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী (সংরক্ষণকারী)। তাদের স্বাধীনা স্ত্রী এবং ‘মা মালাকাত আইমান’ স্ত্রী (যাদেরকে তাদের প্রতিশ্রুতি ও নিরাপত্তা প্রদায়ক ডানহাত পূর্ণরূপে অধিকৃত করেছে এরূপ স্ত্রী) প্রসঙ্গে ছাড়া। এক্ষেত্রে তারা নিন্দিত হবে না। সুতরাং যারা সেটার বাইরে কাউকে তালাশ করবে, তারাই সীমালংঘনকারী হবে।

আয়াতসমূহের তাৎপর্য নির্ণয়র জন্য প্রথমেই জ্ঞাতব্য যে, ‘মা মালাকাত আইমানুকুম শব্দগুচ্ছের দুটি অর্থ রয়েছে। বৃহত্তর পরিসরে এর অর্থ হচ্ছে, তোমাদের (মু’মিনদের) তত্ত্বাবধানে থাকা ‘মা মালাকাত আইমান। আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে সীমিত পরিসরে তথা বক্তব্য প্রসঙ্গ অনুসারে ‘তোমাদের (মু’মিনদের) নিজ নিজ বিবাহকৃত মা মালাকাত আইমান। এর প্রমাণ হচ্ছে, ‘আজওয়াজুকুম শব্দটিরও দুটি অর্থ আছে। বৃহত্তর পরিসরে এর অর্থ হচ্ছে, ‘তোমাদের (পুরুষদের) সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ বা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার যোগ্য জোড়া শ্রেণি / পরিপূরক শ্রেণি নারীগণ’। অর্থাৎ এক্ষেত্রে নারী পুরুষ নিয়ে সাধারণ বক্তব্য দেয়া হয়, কিন্তু এই আজওয়াজকে যৌন সম্পর্কে পেতে হলে তাকে বিয়ে করে নিজের বিবাহকৃত আজওয়াজে পরিণত করতে হবে (এ বিষয়ে ৩০:২১ আয়াত দ্রষ্টব্য)। আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে সীমিত পরিসরে তথা বক্তব্য প্রসঙ্গ অনুসারে ‘তোমাদের নিজ নিজ বিবাহকৃত স্বাধীনা নারীগণ’ (এ বিষয়ে ৪:১২ আয়াত দ্রষ্টব্য) ।

২৩:৫-৭ এবং ৭০:২৯-৩১ আয়াতে “মা মালাকাত আইমানুহুম” শব্দগুচ্ছ “তাদের বিবাহিত মা মালাকাত্ আইমান” অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। এ আয়াতসমূহে ‘আজওয়াজ’ বলতে ‘মুহসনাত মুহসনাত’ তথা বিবাহকৃত স্বাধীনা নারী এবং ‘মা মালাকাত আইমান’ বলতে ‘মুহসনাত মা মালাকাত আইমান’ তথা ‘বিবাহকৃত মা মালাকাত আইমানকে’ বুঝানো হয়েছে। ‘মা মালাকাত আইমানকে বিবাহ করলে সে ‘মুহসনাত তথা স্বাধীনা হয়ে যায়’ কিন্তু তার পূর্ববর্তী অবস্থা বিবেচনায় রেখে তার জন্য অশ্লীল আচরণে পূর্ব থেকেই স্বাধীনা এরূপ নারীর অর্ধেক শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে (৪:২৫)। আর তাই তাকে বিবাহকৃত অবস্থায়ও ‘মা মালাকাত আইমান’ শব্দগুচ্ছ দ্বারাই উল্লেখ করা হয়েছে।

মা মালাকাত আইমানকে বিয়ের প্রসঙ্গে আনুষঙ্গিক ধারাসমূহ

(১) যদি নিজেই ‘মা মালাকাত আইমানের’ আহল বা অভিভাবক হয়, তাহলে শুধু ‘মা মালাকাত  আইমানের’ সম্মতিক্রমে তাকে বিবাহ করতে পারবে। আর যেখানে “তোমাদের মা মালাকাত আইমানকে তার আহলের অনুমতিক্রমে বিবাহ করো” বলা হয়েছে, তার অর্থ হলো, মু’মিনদের অভিভাবকত্বে থাকা ‘মা মালাকাত আইমান’ কিন্তু যে মু’মিনের বিবাহের প্রসঙ্গ আলোচিত স্বয়ং তার অভিভাবকত্বে নয়, বা সে নিজে তার আহল/ অভিভাবক নয়। যেহেতু সে মুহসনাত বা স্বাধীনা নারীকে বিবাহের সামর্থ্য নেই বা সেরূপ স্বচ্ছল নয়, তাই তার অভিভাবকত্বে আগে থেকে ‘মা মালাকাত আইমান’ থাকা সম্ভবও নয়।

(২) ৫৯:৬-৭ আয়াত অনুযায়ী যুদ্ধ ছাড়াই কাফিরদের থেকে যে সম্পদ রসূল ও মু’মিনদের অধিকৃত হয়েছে সেটাকে “আল্লাহ রসূলকে ফায় দিয়েছেন” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ৩৩:৫০ আয়াতে রসূলের “মা মালাকাত ইয়ামীন (ডান হাত যাকে অধিকৃত করেছে) সম্পর্কেও বলা হয়েছে, “যাদেরকে আল্লাহ রসূলকে ফায় দিয়েছেন”। সুতরাং “ফায় হলো সেই সম্পদ যা যুদ্ধ ছাড়াই কাফিরদের থেকে মু’মিনদের হস্তগত হয়। অনুরূপভাবে “ফায়” হলো সেই লোকজন যারা প্রথমে কাফিরদের কাছে ছিল, কিন্তু পরে তাদেরকে পরিত্যাগ করে মু’মিনদের কাছে চলে এসেছে। আমরা ৬০:১০-১১ আয়াতে এর প্রমাণ পাই যে, অনেক স্ত্রীলোক তাদের কাফির স্বামীর সাথে আনুষ্ঠানিক তালাক ছাড়াই তাদেরকে পরিত্যাগ করে মু’মিনদের কাছে চলে এসেছে। এ ধরনের নারীদের মধ্য থেকে কাউকে যখন কোনো মু’মিনের পূর্ণকালীন তত্ত্বাবধানে দেয়া হয় তখন সে ঐ মু’মিনের “মা মালাকাত আইমান হিসেবে সাব্যস্ত হয়।

এই প্রেক্ষিতে যে সধবা মা মালাকাত আইমানকে বিয়ে করা যাবে সে হলো যার স্বামীর সাথে তার বাস্তব দূরত্ব তৈরি হয়েছে, কিন্তু আনুষ্ঠানিক বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে নি। কারণ নারীর ক্বাওয়াম/ দায়িত্বশীল একাধিক হবে না, তাই মা মালাকাত আইমান সধবা নারীর স্বামীর সাথে বাস্তব সম্পর্ক বজায় থাকা অবস্থায় তাকে বিয়ে করা যাবে না। আবার বিয়ে করার পর সে নতুন করে ‘মুহসনাত’ (বিবাহিতা ও স্বাধীনা) হয়ে যাবে, সুতরাং এই বিয়ের বৈধতা একবারই প্রযোজ্য, দ্বিতীয়বার প্রযোজ্য নয়।

(৩) পিতা তার যে ‘মা মালাকাত আইমানকে বিয়ে করবে, বিয়ের পরে তাকে তালাক দিলেও বা পিতার মৃত্যু ঘটলেও সে নারী পুত্রের জন্য মা ও মুহাররমা (যাকে বিয়ে করা হারাম বা অবৈধ এরূপ) হিসেবে সাব্যস্ত হবে (৪:২২)। আর যারা মনে করেন যে, নিকাহ মানে যৌন সম্পর্ক, এজন্য বিয়ে আবশ্যক নয়, তাদের মতবাদ কুরআনের জিনা (ব্যভিচার) ও তালাক সম্পর্কিত বিধি-বিধানের বিরোধী। (দ্র. ৩৩:৪৯)। সুতরাং ‘মা মালাকাত আইমানকে’ বিয়ে করার পর সে পুরুষটির স্বাধীনা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানেরও সৎমা হয়ে যায়।

(৪) “যে ব্যক্তি ‘মুহসনাতকে (স্বাধীনা অবিবাহিতা/তালাকপ্রাপ্তা/বিধবা নারীকে) বিবাহ করার সামর্থ রাখে না সে ‘মা মালাকাত আইমানকে বিবাহ করবে” (দ্র: ৪:২৫) নির্দেশনাটির দ্বারা এ কথা বুঝায় না যে, ‘মুহসনাতকে বিবাহ করার সামর্থ থাকলে ‘মা মালাকাত আইমানকে বিবাহ করা যাবে না। বরং এ কথার কারণ হচ্ছে- সাধারণত স্বাধীন পুরুষের প্রবণতা থাকে মুহসনাতকে বিবাহ করার জন্য। কিন্তু যে ব্যক্তি মুহসনাতকে বিবাহ করার সামর্থ রাখে না সে যেন মুহসনাতকেই বিবাহ করার মানসিকতা লালন করতে না থাকে বরং তার উচিত ‘মা মালাকাত আইমানকে’ বিবাহ করা। যেহেতু ‘মুহসনাত ও ‘মা মালাকাত আইমান’ উভয়ে ঈমান অবলম্বনের দিক থেকে সমমর্যাদার। এছাড়া, ৪:৩ ও ৩৩:৫০ আয়াতে কোনোরূপ শর্ত ছাড়াই স্বাধীনা নারী ও ‘মা মালাকাত আইমানকে বিবাহ করার সমান সুযোগ দেয়া হয়েছে। এমনকি ২৪:৩২ ও ২:২২১ আয়াত অনুসারে দাস-দাসীকে বিবাহ করাও মহৎ গুণ।

(৫) ৪:২৫ আয়াতে যে সবর করার কথা বলা হয়েছে ২৪:৩৩ আয়াত অনুসারে উহার সম্পর্ক হচ্ছে ঐ ব্যক্তির স্বীয় অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার সাথে। যে মুহসনাতকে বিবাহ করার সামর্থ রাখে না কিন্তু ‘মা মালাকাত আইমানকে’ বিবাহ করার সামর্থ রাখে সে ‘মা মালাকাত আইমানকে বিবাহ করবে। যে মুহসনাতকে বিবাহ করার সামর্থ রাখে সে মুহসনাতকে বা ‘মা মালাকাত আইমানকে’ বিবাহ করবে। আর যে শুধু ‘মা মালাকাত আইমানকে বিবাহ করার সামর্থ রাখে সেও  ‘মা মালাকাত আইমানকে বিবাহ করার তুলনায় অধিকতর সামর্থ্য  অর্জনের পর ‘মুহসনাতকে’ বা ‘মা মালাকাত আইমানকে, যাকে সে বিবাহ করতে চায়, বিবাহ করা তার জন্য অধিকতর কল্যাণকর।

মনে রাখতে হবে যে, সব মুহসনাতই ‘মা মালাকাত আইমানের’ চেয়ে ভাল, তা নয়। বরং কিছু ‘মা মালাকাত আইমান’ মুহসনাতের চেয়ে ভাল হয়। কিন্তু ‘মা মালাকাত আইমানের’ পরিস্থিতিগত জটিল অবস্থান বিবেচনায় তার অশ্লীল কাজের ক্ষেত্রে তার শাস্তি মুহসনাতের তুলনায় অর্ধেক ধার্য করা হয়েছে। আয়াতের বক্তব্য এরূপ নয় যে, ‘মা মালাকাত আইমানের তুলনায় মুহসনাতকে বিবাহ করা অধিক উত্তম।

অনেকে ৪:২৫ এর শেষ অংশের ‘যালিকা’ সর্বনামের ভুল ব্যাখ্যা করে থাকে, যা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। অথচ ‘যালিকা দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে ২৪:৩৩ আয়াতের প্রথম অংশ পড়লে তা বুঝতে কোনো জটিলতা থাকে না। আয়াতটির সাপেক্ষে এবং অন্যান্য আয়াতের তথ্য সমন্বয়ের ভিত্তিতে বুঝা যায় যে, ৪:২৫ আয়াতে ‘যালিকা অর্থ হচ্ছে ‘অধিকতর সামর্থ্য অর্জনের আগেই বিবাহ করা’। এটি তাদের জন্য ব্যবস্থাপত্র যারা আত্মসংযম হারানোর ভয় আছে।

স্বাধীনা ও ‘মা মালাকাত আইমান’ নারীর পার্থক্যের বাস্তব কার্যকারণ

আমাত (দাসী) এবং “মা মালাকাত আইমান” নারীকে স্বাধীনা নারীদের থেকে স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের প্রসঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে বিধানগত ভিন্নতা রয়েছে।

সর্বপ্রধান দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয় হলো, ‘মা মালাকাত আইমান’ এবং সমাজস্থ  দাস-দাসীকে মু’মিন হিসেবে স্বাধীন নারী-পুরুষের সমমর্যাদা (আদর্শিক ও মানবিক মর্যাদা) দেয়া হয়েছে। আদর্শগতভাবে মু’মিন দাস ও দাসীকে মুশরিক স্বাধীন পুরুষ ও নারীর চেয়ে উত্তম হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। কারণ একজন মুশরিক আল্লাহর সত্তা, গুণাবলি, ক্ষমতা ও অধিকারে অংশীদার স্থাপন করে, যেখানে একজন মু’মিন এসব ক্ষেত্রে আল্লাহর একত্বের প্রতি বিশ্বাসী।

মু’মিনদের দায়িত্ব হলো তারা স্বীয় অর্থব্যয়ের মাধ্যমে দাসত্বের জিঞ্জিরে আবদ্ধ ঘাড়কে তথা দাস-দাসীকে মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট থাকবে, যা তাদের পুণ্যকর্ম ও সৎকাজে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র।

‘মা মালাকাত আইমান’ যেন স্বাধীনভাবে কিছু জীবিকা উপার্জন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন করে নিজের ও সমাজের কল্যাণের জন্য কাজে আসতে পারে সে সুব্যবস্থা করে তাকে স্বাধীন হয়ে যাওয়ার যুক্তিসঙ্গত প্রক্রিয়া হিসেবে অভিভাবকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সুব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া মু’মিন সমাজের উপর দাস-দাসীদের জন্যও উপযুক্ত জীবনসঙ্গী খুঁজে পাওয়ার সুযোগ তৈরিতে তাকে সাহায্য করার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।

স্বাধীনা স্ত্রী ও ‘মা মালাকাত আইমান’ স্ত্রীকে আলাদাভাবে উল্লেখ করার তথা স্বাধীনা ও ‘মা মালাকাত আইমান’ নারীর মধ্যে পার্থক্য করার অন্যতম কার্যকারণ হলো ‘মা মালাকাত আইমান’ নারীর ক্ষেত্রে দণ্ডবিধি হ্রাসের বিধান। এক্ষেত্রে ‘মা মালাকাত আইমানের’ তুলনামূলক নাজুক সামাজিক জীবন পদ্ধতির বিবেচনায় তাদের প্রতি বিশেষ মহানুভবতা প্রদর্শন করা হয়েছে।

শেষ কথা

আল কুরআনের আলোকে বিবাহ মানব সভ্যতার জন্য একটি মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন এক ব্যক্তি থেকে এবং তার থেকে বা তার সমজাতীয় উপাদান থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন, যেন তারা পরস্পরের নিকট শান্তি ও স্বস্তি পায়। তাদের পরস্পরের মিলনের মাধ্যমে মানববংশের গতিধারা সূচিত হয়েছে। তারপর আল্লাহ মানুষকে বংশগত ও বৈবাহিক সম্পর্কযুক্ত করেছেন। তিনি মানব সভ্যতার স্থিতিশীলতা ও সুষ্ঠু বিকাশের জন্য বিবাহের বিধিবিধান প্রদান করেছেন। তাঁর নাযিলকৃত সর্বশেষ গ্রন্থের (কুরআনের) মাধ্যমে তিনি বিবাহের চূড়ান্ত নির্দেশনা প্রদান করেছেন। কাদেরকে বিবাহ করা যাবে না, বিবাহের শর্তসমূহ, বর কর্তৃক কনেকে মোহরানা প্রদান করার বিধান, বর-কনের উপযুক্ত বয়স, বিবাহ ছাড়া দৈহিক সম্পর্কের অবৈধতা ও সেটাকে সামাজিক অপরাধ সাব্যস্ত করে তার জন্য দণ্ডবিধি, বিবাহকে মজবুত চুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠাকরণ, ইয়াতীমদের প্রতি সর্বাধিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে প্রয়োজনে ইয়াতীম ছেলেমেয়ে থাকা বিধবাদেরকে বিবাহের নির্দেশ, পুরুষেরা পরিবারের ভরণপোষণের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল বিধায় অর্থনৈতিক সামর্থ্যের পূর্বে সংযম অবলম্বনের নির্দেশ, বিবাহে অভিভাবকদের অভিভাবকসুলভ উত্তম ভূমিকা, যাদের বিবাহ হচ্ছে না এরূপ অবিবাহিত নারী-পুরুষ, বিধবা, বিপত্নীক ও তালাকপ্রাপ্তাদের বিয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবক ও সমাজের উদ্যোগী ভূমিকা পালন, সচ্চরিত্র দাস-দাসীদেরও বিয়ের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি বিধিবিধানের মাধ্যমে কুরআনে বিবাহের সাথে সম্পর্কিত সকল মৌলিক নির্দেশ ও নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। যদি কোনো বাস্তবসম্মত কারণে বিবাহের বন্ধন অটুট রাখা সম্ভব না হয় তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া বা তালাকের ক্ষেত্রেও কুরআনে পরিপূর্ণ বিধিব্যবস্থা প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং কুরআনে বৈবাহিক সম্পর্কের সূচনা, ধারাবাহিকতা এবং প্রয়োজনে পরিসমাপ্তি পর্যন্ত সকল বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্বারোপের মাধ্যমে মানব সভ্যতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যৌক্তিক, ভারসাম্যপূর্ণ ও কল্যাণকর বিধান প্রদান করা হয়েছে। মানব সভ্যতার অধঃপতন প্রতিরোধের জন্য এবং মানব সভ্যতার স্থিতিশীলতা ও সুষ্ঠু বিকাশের জন্য, সর্বোপরি মানব সমাজে প্রকৃত শান্তি, স্বস্তি ও কল্যাণ নিশ্চত করতে হলে কুরআনের আলোকে বিবাহের নির্দেশনা যথাযথভাবে পরিপালন করা অত্যাবশ্যক।

পরিশিষ্ট ১

মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ কর্তৃক বাল্যবিয়ে করার ভুল ধারণার অপনোদন

“মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ও তাঁর স্ত্রী আয়েশার আয়েশার বিয়ের সময় নবীপত্নী আয়েশার বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর তথা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে করেছেন” মর্মে একটি বড় ধরনের ভুল ধারণা সমাজে প্রচলিত রয়েছে। যেহেতু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ শুধুমাত্র কুরআন অনুসরণ করেছেন, তিনি কুরআনের বিধি-বিধান লঙ্ঘন করেননি, তাই তিনি বাল্যবিয়ে করতে পারেন না এবং করেননি।

মুহাম্মাদুর রসূল্লাহর কর্তৃক তাঁর স্ত্রী আয়েশাকে তার বাল্যবয়সে বিয়ে করা সম্পর্কিত ধারণাটি কিভাবে গড়ে উঠেছে এবং কেন তা একটি ভুল প্রচারণা নিম্নে তার তথ্যভিত্তিক আলোচনা উপস্থাপিত হলো।

এ বিষয়ে যে তথ্যগুলো প্রয়োজন তাহলো:

ক. মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ কত বছর বেঁচে ছিলেন?

খ. তিনি কত বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করেন?

গ. তিনি কত বছর বয়সে হিজরত করেন?

ঘ. তিনি হিজরতের কত বছর আগে হযরত আয়েশাকে বিয়ে করেন? এবং তার কত বছর পর তার সাথে বাসর করেন?

ঙ. হযরত আয়েশা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর নবুয়াতের আগে না পরে জন্মগ্রহণ করেন?

চ. হযরত আয়েশা ইসলাম গ্রহণের দিক থেকে নবুয়াতের প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেছেন না এর চেয়ে অনেক দেরিতে?

ছ. অন্য কারো বয়সের সাথে তুলনা করে হযরত আয়েশার বয়স নির্ণয় করা সম্ভব কিনা?

নিম্নে এ প্রশ্নগুলোর সাথে সম্পর্কযুক্ত তথ্য উল্লেখ করা হলো:

‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ যখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর মৃত্যু হয় তখন তাঁর বয়স হয়েছিল তেষট্টি বছর। ইব্‌ন শিহাব বলেন, সা’ঈদ ইবনুল মুসায়্যিব এভাবেই আমার কাছে বর্ণনা করেন।(৫)

(৫) বুখারী:৩৫৩৬, http://ihadis.com/books/bukhari/hadis/3536

ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর উপর যখন (ওয়াহী) নাযিল করা হয় তখন তাঁর বয়স ছিল চল্লিশ বছর। অতঃপর তিনি মক্কায় তের বছর অবস্থান করেন। অতঃপর তাকেঁ হিজরত করার আদেশ দেয়া হয়। তিনি হিজরত করে মদীনায় চলে গেলেন এবং সেখানে দশ বছর অবস্থান করলেন, তারপর তাঁর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত্যু হয়।(৬)

(৬) বুখারী:৩৮৫১, http://ihadis.com/books/bukhari/hadis/3851

সুতরাং নবীর সাথে তাঁর স্ত্রী আয়েশার বিয়ে হয় হিজরতের এক বছর আগে বা নবুয়তী দ্বাদশ বর্ষে এবং তাঁদের বাসর উদযাপিত হয় হিজরী দ্বিতীয় বর্ষে।

হিশাম (ইবনে উরওয়া) এর পিতা/ আবু হিশাম/ উরওয়া হতে থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর মদীনার দিকে বের হওয়ার তিন বছর আগে খাদীজাহ (রাঃ) - এর মৃত্যু হয়। তারপর দু’বছর অথবা এর কাছাকাছি সময় অতিবাহিত করে তিনি ‘আয়িশা (রাঃ) - কে বিবাহ করেন। যখন তিনি ছিলেন ছয় বছরের বালিকা। তারপর নয় বছর বয়সে বাসর উদ্‌যাপন করেন।(৭)

(৭) বুখারী:৩৮৯৬, http://ihadis.com/books/bukhari/hadis/3896

যে বিষয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে তাহলো, বিয়ের সময় নবীপত্নী আয়েশার বয়স ছয় বছর ছিল এবং বাসরকালে নয় বছর ছিল তথ্যটি সঠিক কিনা?

এ বিষয়ে প্রথমেই জানা প্রয়োজন যে, আরবি শব্দ ছিত্তা অর্থ ছয় এবং তিসয়া অর্থ নয়। অন্যদিকে ছিত্তা আশারা অর্থ ষোল এবং তিসয়া আশারা অর্থ উনিশ। সুতরাং সিত্তা আশারা (ষোল) শব্দটি থেকে ভুলক্রমে আশারা (দশ) বাদ গেলে তা সিত্তা (ছয়) হয়ে যায় এবং তিসয়া আশারা (উনিশ) শব্দটি থেকে আশারা (দশ) বাদ গেলে তিসয়া (নয়) হয়ে যায়। সুতরাং হাদীসের রাবী (বর্ণনাকারী) কোনোক্রমে ভুলে আশারা শব্দটি উল্লেখে ত্রুটি করার কারণে ষোল এর স্থলে ছয় এবং উনিশ এর স্থলে নয় হয়ে গেছে কিনা তা যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

বিশেষ করে এ হাদীসের রাবী (বর্ণনাকারী) হিশাম ইবনে উরওয়া সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তার জীবনের প্রথম ৭১ (একাত্তর) বছর মদিনায় কাটান এবং তারপর মদিনা থেকে ইরাক চলে যান। ইরাক চলে যাওয়ার পর তার স্মৃতিশক্তিতে ত্রুটি দেখা দেয়, ফলে তাঁর বর্ণনায় অনেক কিছু উল্টাপাল্টা হয়ে যেতো। তাই তার থেকে কোনো ইরাকী রাবি যত হাদিসই বর্ণনা করবে, সেগুলো গ্রহণযোগ্য হবে না। হযরত আয়েশার বিয়ে ও বাসর সম্পর্কে তাঁর বর্ণিত হাদীসের কোনো রাবী মদিনাবাসী নয়, বরং সকলেই ইরাকের অধিবাসী। সুতরাং হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ী তাঁর এ হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। (তথ্যসূত্র: তাহযীবুত তাহযীব, লেখক ইবনে হাজার আসকালানী, বইটি রিজালশাস্ত্র বা হাদীস বর্ণনাকারীদের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে লিখিত)

তাবারী বর্ণিত একটি ভাষ্যমতে, হজরত আবু বকরের (রা.) চার সন্তানেরই জন্ম হয়েছিল আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগে তথা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর নবুয়াত লাভের পূর্বে। (তথ্যসূত্র: Tarikhu'l-umam wa'l-mamlu'k, Al-Tabari, Vol 4, Pg 50, Arabic, Dara'l-fikr, Beirut, 1979)

সীরাতে ইবনে হিশামের তথ্য অনুযায়ী, হযরত আয়েশা হলেন ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে ২০তম বা ২১ তম। (তথ্যসূত্র: Al-Sirah al-Nabawiyyah, Ibn Hisham, Vol 1, Pg 227 - 234, Arabic, Maktabah al-Riyadh al-hadithah, Al-Riyadh)

হযরত আয়েশার বোন হযরত আসমা ছিলেন তাঁর চেয়ে দশ বছরের বড় (তথ্যসূত্র: Al- Bidayah wa’l- nihayah, Ibn Kathir, Vol 8, Pg 371, Arabic, Dar al-fikr al-arabi, Al-jizah, 1933).

হযরত আসমা একশত বছর বেঁচেছিলেন এবং ৭৩ বা ৭৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। (তথ্যসূত্র: Taqribu’l-tehzib, Ibn Hajar Al- Asqalani, Pg 654, Arabic, Bab fi’l-nisa’, al- harfu’l-alif, Lucknow)

উপরিউক্ত হিসাব অনুসারে হযরত আয়েশার বিয়ের সময় (হিজরতের এক বছর আগে বা নবুয়াতের দ্বাদর্শ বর্ষে) তাঁর বয়স ছিল ষোল বছর এবং বাসর উদযাপনের সময় (দ্বিতীয় হিজরীতে) তাঁর বয়স ছিল উনিশ বছর এবং রসূলের ওফাতের সময় তাঁর বয়স ছিল আটাশ বছর।

তবে আরো বিভিন্ন বর্ণনাসূত্রের ভিত্তিতে বিয়ের সময় হযরত আয়েশার বয়স নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে, যাতে তাঁর বয়স ছয় থেকে উনিশ বছর এর মধ্যে বিভিন্নরূপ বর্ণিত হয়েছে।(৮)

(৮) হযরত আয়েশার বয়স নির্ণয়ের জন্য প্রাসঙ্গিক সীরাতগ্রন্থ, তারিখ / ইতিহাসগ্রন্থ ও রিজালশাস্ত্রীয় গ্রন্থের রেফারেন্স গ্রহণ করা হয়েছে https://www.islamawareness.net/FAQ/what_was_ayesha.html লিংক থেকে।

প্রকৃতপক্ষে কারো বয়সের যথাযথ হিসাব সংরক্ষণ করা সহজ ছিল না। কারণ হাদীস ও ইতিহাস অনুযায়ী তৎকালীন সময়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হতো না, বরং কোনো বিখ্যাত ঘটনার সাথে মিল করে অন্যান্য সাধারণ ঘটনার বছর হিসাব করা হতো। সুতরাং হযরত আয়েশার বিয়ের বয়স সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য থাকা সত্ত্বেও ছয় বছর বয়স সম্পর্কিত একটিমাত্র কথা ছড়িয়ে দেয়া ধর্মের অপব্যবহারের এবং ধর্মবিরুদ্ধ প্রচারণার উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে প্রতীয়মান হয়।

“মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ হযরত আয়েশাকে বিয়ে করার সময় হযরত আয়েশার বয়স ছয় বছর ছিল ও বাসরের সময় হযরত আয়েশার বয়স নয় বছর ছিল” মর্মে যে হাদীস তাতে হযরত আয়েশা থেকে উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে মাঝে সনদ বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। আবার হাদীসটির প্রতিটি বর্ণনাসূত্রে মধ্যবর্তী একজন রাবী (বর্ণনাকারী) হিশাম ইবনে উরওয়া সম্পর্কে স্মৃতিভ্রমের অভিযোগ রয়েছে এবং উল্টাপাল্টা বলে ফেলার অভিযোগ রয়েছে। তাই তিনি ষোলকে ছয় এবং উনিশকে নয় বলা অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে প্রতীয়মান হয়।

অন্যদিকে হযরত আয়েশার বিয়ের সময় (নবুয়াতের দ্বাদর্শ বর্ষে) তাঁর বয়স ষোল বছর হওয়া এবং বাসরের সময় (দ্বিতীয় হিজরীতে) তাঁর বয়স উনিশ বছর হওয়ার পর্যাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র রয়েছে। যেমন বিভিন্ন হাদীসগ্রন্থ ও ইতিহাসগ্রন্থের তথ্যসূত্রে জানা যায় যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা) তেষট্টি বছর বয়সে ওফাত বরণ করেন, তিনি তাঁর চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করেন এবং তারপর তের বছর মক্কায় অবস্থান করেন, তিপ্পান্ত বছর বয়সে হিজরত করেন, তারপর দশ বছর জীবিত ছিলেন, এর মধ্যে হিজরতের তিন বছর আগে তাঁর প্রথম স্ত্রী হযরত খাদিজা ওফাত বরণ করেন, তার দুই বছর পরে তথা হিজরতের এক বছর আগে তথা নবুওয়াতের দ্বাদর্শ বর্ষে তথা রসূলের বায়ান্ন বছর বয়সে তিনি হযরত আয়েশাকে বিয়ে করেন, তার তিন বছর পরে, তথা হিজরাতের দ্বিতীয় বর্ষে হযরত আয়েশার সাথে তাঁর বাসর হয়, ঐ বছর তথা হিজরী দ্বিতীয় বর্ষে বদর যুদ্ধ হয়, বদর যুদ্ধে হযরত আয়েশা অংশগ্রহণ করেন (দ্র. মুসলিম:৪৫৯৪), ঐ সময় পনের বছরের নিচে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি ছিল না (দ্র. বুখারী:৪০৯৭), হযরত আয়েশাসহ তাঁর সব ভাইবোনের জন্ম নবুওয়াতের আগে হয়েছে, তিনি বয়সে তাঁর বোন আসমার চেয়ে দশ বছরের ছোট, নবুয়াতের সময় হযরত আসমার বয়স ছিল চৌদ্দ বছর, হযরত আয়েশা ছিলেন বিশতম ইসলাম গ্রহণকারী ইত্যাদি। এসব বর্ণনা হযরত আয়েশার বয়স বিয়ের সময় ষোল বছর হওয়াকে এবং বাসরের সময় উনিশ বছর হওয়াকে সমর্থন করে।

সর্বোপরি যেহেতু কুরআন অনুযায়ী বাল্যবিবাহ অবৈধ সেহেতু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ কর্তৃক বাল্যবিবাহ করা অসম্ভব। সেই সাথে তিনি হযরত আয়েশাকে বিয়ে করার সময় হযরত আয়েশার বয়স ছয় বা সাত বছর থাকার বিবরণগুলো ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে ত্রুটিপূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

পরিশিষ্ট ২

হিল্লা বিয়ের অবৈধতা

ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ‘হিল্লা বিয়ে’ নামে একটি জঘন্য কুপ্রথা চালু করা হয়েছিল, সম্প্রতি আইনগত কারণে যার চর্চা কমে গেছে, তবে একেবারে বন্ধ হয়নি। এখনো যেখানে আইন-শৃঙ্খলা লঙ্ঘনের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করে সেখানে মোল্লাশ্রেণি এই কুপ্রথার চর্চা করে থাকে। ‘হিল্লা বিয়ে’ বলতে বুঝানো হয়, যখন কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার জন্য তিনবার তালাক শব্দ উচ্চারণ করে তখন নারীটিকে তার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে অন্য কোনো পুরুষের সাথে নারীটিকে অন্তত এক রাতের জন্য বিয়ে দেয়া হয় এবং তারপর ঐ দ্বিতীয় পুরুষটি নারীটিকে তালাক দেয় এবং এভাবে নারীটির ‘হিল্লা’ হয়, যার মাধ্যমে সে তার প্রথম স্বামীর কাছে ফেরত যেতে পারে।

কুরআনে ‘হিল্লা বিয়ে’র কোনো অনুমোদন নেই, বরং কুরআনে বিয়ের যেসব বিধিনিষেধ বর্ণিত হয়েছে সে অনুসারে ‘হিল্লা বিয়ে’ সম্পূর্ণ অবৈধ।

হিল্লা বিয়ে নামক অবৈধ বিয়ের পক্ষে আল কুরআনের ২:২৩০ আয়াতের অপব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। নিম্নে আয়াতটি এবং হিল্লা বিয়ের অবৈধতা সম্পর্কে আলোকপাত করা করা হলো।

২:২৩০ :: অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয় তাহলে এরপরে (অর্থাৎ তৃতীয়বার তালাকের পরে) সে নারী তার জন্য বৈধ হবে না, যতক্ষণ না সে নারী অন্য কাউকে বিয়ে করে এবং সে (অর্থাৎ পরবর্তী স্বামী) তাকে তালাক দেয়। তখন যদি তারা দুজন (অর্থাৎ নারীটি এবং তাকে পূর্বে তালাক দেয়া স্বামী) আল্লাহর সীমাসমূহ প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারবে বলে ধারণা করে তবে তারা পুনরায় বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াতে তাদের দুজনের কোনো গুনাহ হবে না। এগুলো আল্লাহর সীমা। তিনি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন।

ফতোয়াবাজরা ‘হিল্লা বিবাহ’ নামক সাজানো বিবাহের পক্ষে এ আয়াতাটির অপব্যাখ্যা করে থাকে, যার মাধ্যমে তারা আল্লাহর আয়াতকে হাসি তামাশার বিষয় বানিয়ে দেয়। অথচ এই আয়াতটিতে যা বলা হয়েছে, তাতে যার ক্ষেত্রে দুইবারের স্বাভাবিক তালাক কার্যকর হওয়ার পর তৃতীয়বার তালাকের ঘটনা ঘটেছে, তার ক্ষেত্রে তার স্ত্রীকে তার জন্য আর হালাল রাখা হয়নি এ শর্ত ছাড়া যে, যদি ঐ স্ত্রী স্বেচ্ছায় অন্য কাউকে বিবাহ করে এবং যদি কখনো সেই দ্বিতীয় স্বামীও তাকে তালাক দেয় (বা মৃত্যুবরণ করে) তাহলে ঐ স্ত্রী এবং তার প্রথম স্বামী উভয়ে আবার দাম্পত্য সম্পর্কে ফিরে যেতে চাইলে তখন তারা আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। এটা এমন এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া যার কারণে এরূপ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রথম স্বামী আর তার স্ত্রীকে ফেরত পাওয়ার সুযোগ ঘটবে না।

বস্তুত তালাক যেন একটা যাচ্ছে তাই খেলায় পরিণত হতে না পারে সেজন্যই এ ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে যা সবার জন্যই কল্যাণকর। কিন্তু তাকে ফতোয়াবাজরা একটা সাজানো নাটকে পরিণত করে আল্লাহর দেয়া ব্যবস্থার অবমাননা করছে এবং জ্বেনায় লিপ্ত হচ্ছে বা করছে। সুতরাং প্রচলিত হিল্লা বিয়ে হালাল বা বৈধ নয়, বরং প্রচলিত হিল্লা বিয়ে হারাম বা অবৈধ। আল্লাহ এখানে তৃতীয়বার তালাকপ্রাপ্তাকে তালাকদাতা স্বামীর জন্য বৈধ হওয়ার যে শর্ত দিয়েছেন তাকে নিয়ে এরূপ সাজানো নাটক মঞ্চায়ন আল্লাহর আয়াতসমূহকে হাসি তামাশার বিষয় হিসাবে গ্রহণ করা ছাড়া আর কিছুই নয়, যে ব্যাপারে পরবর্তী আয়াতটিতে (২:২৩১) নিষেধ করা হয়েছে।

২:২৩০ আয়াতের শুরু ‘ফাইন’ তথা ‘তারপর যদি’ এর মাধ্যমে, তাই এটি ‘আত তালাকু মাররাতান’ (২:২২৯) এর সাথে সম্পর্কিত হয়ে সাধারণ তালাকের ব্যতিক্রম অবস্থা প্রকাশ করছে। এখানে ‘মিম বা’দু’ বা ‘পরবর্তীতে’ বলতে বুঝানো হচ্ছে ‘তৃতীয়বার তালাক দিলে’। এরপর ২:২৩১ আয়াতে ‘ওয়া ইযা’ শব্দের মাধ্যমে আবার স্বাভাবিক তালাকের বিষয় আবর্তিত হয়েছে এবং বক্তব্য সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। ২:২৩০ আয়াতটি অস্বাভাবিক তথা তৃতীয় তালাকের সাথে সম্পর্কিত একমাত্র ব্যতিক্রমমূলক বিধান। ২:২৩০ আয়াতের বক্তব্য শুধুমাত্র তৃতীয় তালাকের পরে ইদ্দাতকালে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগকে বা ইদ্দাত পরবর্তীতে বিশেষ শর্তপূরণ ব্যতীত পুনর্বিবাহের সুযোগকে রহিত করেছে, এই ব্যতিক্রম ছাড়া ইদ্দাত বা ইদ্দাত সম্পর্কিত অন্যান্য ধারাকে রহিত করেনি।

পরিশিষ্ট ৩

মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ কর্তৃক তাঁর পালক পুত্র জায়েদের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করার কারণ

৩৩:৩৭-৪০ আয়াতে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ কর্তৃক তাঁর পালকপুত্র জায়েদের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করার প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছে।

৩৩:৩৭ :: আর (স্মরণ করো) যখন তুমি তাকে বলেছিলে যাকে আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন আর যাকে তুমিও অনুগ্রহ করেছো, ‘রেখে দাও তোমার কাছে (= তোমার বিবাহ বন্ধনে) তোমার স্ত্রীকে। আর তুমি আল্লাহকে ভয় করো’। আর যা তুমি গোপন রেখেছিলে তোমার নফসে আল্লাহ উহার প্রকাশকারী। আর তুমি মানুষকে ভয় করছিলে। অথচ আল্লাহই অধিক হক্বদার যে, তুমি তাঁকে ভয় করবে। তারপর যখন যায়েদ তার থেকে প্রয়োজনীয়তাবোধ সমাপ্ত করে ফেললো (তালাক দিলো), তখন আমরা তোমার সাথে তার নিকাহ/ বিবাহ দিলাম; যেন না থাকে মু’মিনদের উপর কোনরূপ সংকীর্ণতা তাদের মুখ ডাকা (পালক) পুত্রদের (তালাকপ্রাপ্তা) স্ত্রীদের (বিবাহ করার) ব্যাপারে, যখন তারা তাদের থেকে প্রয়োজনীয়তাবোধ সমাপ্ত করে ফেলে (তালাক দেয়)। আর আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়িত/ কার্যকর হয়েই থাকে।

৩৩:৩৮ :: নবীর উপর কোন সংকীর্ণতা নেই ঐ বিষয়ে যা আল্লাহ তার জন্য ফরজ/ আবশ্যকীয় করেছেন। ইহাই আল্লাহর সুন্নাত, তাদের (= সেই নবীদের) ব্যাপারেও (ছিলো), যারা আগে গত হয়ে গেছে। আর আল্লাহর আদেশ চূড়ান্ত নির্ধারণে নির্ধারিত হয়ে থাকে।

৩৩:৩৯ :: যারা আল্লাহর রিসালাতসমূহ/ বার্তাসমূহ পৌঁছে দিতো আর তাঁকে ভয় করতো। আর কাউকেই ভয় করতো না, আল্লাহকে ছাড়া। আর হিসাবগ্রহণকারী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট।

৩৩:৪০ :: মুহাম্মাদ নয় তোমাদের মধ্য থেকে কোন পুরুষের পিতা। কিন্তু সে আল্লাহর রসূল আর খাতামান নাবিয়্যীন/ শেষ নবী। আর আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞানী।

উপরোল্লোখিত আয়াতসমূহ থেকে জানা যায় যে:

১. যায়েদ ছিল মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পালক পুত্র, যার উপর আল্লাহ ও তাঁর রসূল অনেক অনুগ্রহ করেছেন। (৩৩:৩৭)

২. যায়েদ এবং তার স্ত্রীর মধ্যে যখন বিবাহ-বিচ্ছেদের মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে তখন আল্লাহ মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর উপর ফরজ করেছেন যে, যদি যায়েদ তার স্ত্রীকে তালাক দেয়, তাহলে তিনি তাকে বিয়ে করতে হবে। (৩৩:৩৮)

৩. যায়েদ তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ লোকলজ্জার ভয়ে যায়েদকে তালাক না দেয়ার উপদেশ দিলেন। অথচ এক্ষেত্রে তাঁর উচিত ছিল আল্লাহকেই ভয় করা। এ থেকে বুঝা যায় যে, যদি যায়েদ তার স্ত্রীকে তালাক না দেয়, তাহলে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ঐ নারীকে বিয়ে করার আবশ্যকতা থাকবে না বিধায় রসূল তাকে এরূপ উপদেশ দিয়েছেন। কারণ অন্যথায় তাকে বিয়ে করার মাধ্যমে রসূলকে লোকলজ্জার মধ্যে পড়তে হবে বলে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি বিষয়টি তাঁর মনে গোপন রেখেছিলেন, যা আল্লাহ আয়াতের মাধ্যমে প্রকাশ করে দিয়েছেন। (৩৩:৩৭)

৪. যায়েদের স্ত্রীর উপর থেকে যায়েদের সকল প্রয়োজনীয়তাবোধ ফুরিয়ে গিয়েছিল। (৩৩:৩৭)

৫. পরবর্তীতে যায়েদ যখন তার স্ত্রীকে তালাক দিলো তখন আল্লাহ মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর সাথে তার বিয়ে দিলেন। (৩৩:৩৭)

৬. এ বিয়ের উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর বিধান অনুযায়ী যেহেতু পালক পুত্র প্রকৃত পুত্রের মতো নয়, তাই তার স্ত্রীকে বিয়ে করা আল্লাহ হারাম করেন নি, এমতাবস্থায় লোকদের মধ্যে এ ধরনের বিয়ের ক্ষেত্রে যে সামাজিক অন্যায় মনস্তাত্বিক চাপ বা সংকীর্ণতা থাকে, তা নিরসন করে একমাত্র আল্লাহর বিধানই চূড়ান্ত মাপকাঠি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। রসূল এরূপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মাধ্যমে অন্য মু’মিনদের জন্য এরূপ বিয়ের ক্ষেত্রে সংকীর্ণতা অপসারিত হয়েছে। (৩৩:৩৭)

৭. মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ কোনো পুরুষ সন্তানের পিতা নন। তাই তিনি যাকে বিয়ে করেছেন সে তাঁর পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী নয়। অন্য কথায়, পালক পুত্র প্রকৃত পুত্রের মতো হিসেবে বিবেচ্য হবে না। এমতাবস্থায়, যারা রসূলের এ কাজকে সমালোচনা করে বা করবে তাদের সমালোচনা ভিত্তিহীন ও অসার। (৩৩:৪০)

৮. রসূল যেহেতু রসূল, তাই যেকোনো কুসংস্কার দূর করার ক্ষেত্রে তাঁর উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ কোনো কাজকে ফরজ করে দেয়া হলে তিনি তা করতে বাধ্য। (৩৩:৪০)

৯. যেহেতু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ শেষ নবী, তাই তাঁর বাস্তব কাজের মাধ্যমেই এ কুসংস্কারকে সম্পূর্ণভাবে মোকাবেলা করা প্রয়োজন ছিল। (৩৩:৪০)

পরিভাষা

উক্বদাতুন নিকাহ  عُقْدَةُ ال‍‍نِّكَاحِ : উক্বদাতুন নিকাহ কথাটির অর্থ হচ্ছে ‘বিবাহের বন্ধন’। নিকাহ বা বিবাহ হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ধর্ম নির্দেশিত সামাজিক চুক্তি। বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে ‘বৈবাহিক বন্ধন’ তৈরি হয় তাকে ‘উক্বদাতুন নিকাহ’ বলে।

তালাক  طَلَاق : তালাক শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘প্রত্যাখ্যান, বর্জন’। শব্দটি সাধারণত ‘বিবাহ বিচ্ছেদ’ বুঝাতে প্রয়োগ করা হয়। তবে কুরআন অনুযায়ী তালাক দেয়ার সাথে সাথে চূড়ান্তভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না। বরং তালাকের প্রাথমিক কার্যকারিতা হচ্ছে স্ত্রীলোককে ইদ্দাত পালন করতে হয়। আর তালাকের চূড়ান্ত কার্যকারিতা হচ্ছে ইদ্দাত শেষে মুফারাক্বাত বা চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতা ঘটে।

ফারীদাহ  فَرِيضَة : ফারীদাহ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘আবশ্যিক নির্ধারণ’। বিবাহের একটি বিধান হিসেবে স্ত্রীকে যে পারিতোষিক বা মোহরানা দিতে হয় সূরা নিসার ২৪ আয়াতে তাকে ‘উজূরাহুন্না ফারীদাহ (অর্থাৎ আবশ্যিক পারিতোষিক) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানে সংক্ষেপে ‘ফারীদাহ শব্দটি মোহরানা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

সদুক্বাত  صَدُقَات : সদুক্বাত শব্দটি সদাক্বাহ (সম্প্রদানমূলক অনুদান) এর সমার্থক শব্দ। তবে সদুক্বাত শব্দটি বিয়েতে কনেকে প্রদেয় মোহরানা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। উৎপত্তিগত অর্থে সদাক্বাহ ও সদুক্বাত শব্দগুলো ‘সত্যাগ্রহের প্রমাণবহ প্রদেয়’ বুঝায়। যেহেতু আল্লাহর বিধানে স্ত্রীদের জন্য মোহরানা নির্ধারণকে আবশ্যিক করা হয়েছে তাই তাদের জন্য এটা আবশ্যকীয় বৈবাহিক উপহার এবং সত্যনিষ্ঠার সাথে তাদেরকে এ উপহার প্রদান করতে হবে।

আন নিসা’ النِّسَاء : ‘আন নিসা শব্দটির শাব্দিক অর্থ হলো ‘নারীগণ’। ‘আন নিসা শব্দটি Context অনুসারে কখনো স্ত্রীদেরকে বুঝাতে, কখনো কন্যাদেরকে বা বোনদেরকে বুঝাতেও ব্যবহৃত হয়। যেমন, ২:১৮৭ আয়াতে ‘নিসায়িকুম শব্দটির অর্থ হলো ‘তোমাদের স্ত্রীগণ’। আবার ৪:১১ আয়াতে ‘নিসা’ শব্দটি কন্যাদেরকে বুঝাতে এবং ৪:১৭৬ আয়াতে ‘নিসা’ শব্দটি বোনদেরকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। ৪:৩ আয়াতে ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের প্রতি যথাযথ সুবিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে তাদের মায়েদেরকে তথা ইয়াতীম ছেলেমেয়ে থাকা বিধবাদেরকে বিয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং তাদেরকে ‘আন নিসা শব্দ দ্বারা উল্লেখ করা হয়েছে। ৪:১২৭ আয়াতে ইয়াতীম ছেলেমেয়েদেরকে তাদের সাথে সম্পর্কিত করে ‘ইয়াতামান নিসা (নারীগণের ইয়াতিম ছেলেমেয়ে) শব্দে উল্লেখের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় যে, এই নারীগণ হলো ‘ইয়াতীম ছেলেমেয়ের মা’ অর্থাৎ তারা হলো ‘ইয়াতীম ছেলেমেয়ে থাকা বিধবা নারী’। সুতরাং ইয়াতীম সমস্যার সমাধানের একটি পদ্ধতি হিসেবে ‘বিধবা বিবাহের’ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

কুরু  قُرُوء : কুরু শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘স্বাভাবিক অবস্থার ছেদমূলক পরিবর্তিত অবস্থা’। শব্দটি ব্যবহৃত হয় স্ত্রীলোকের হায়েজ বা রজ:স্রাবকাল বুঝানোর জন্য। কারণ স্বাভাবিক পরিচ্ছন্ন অবস্থা (তুহর) এর সাপেক্ষে এটি একটি পরিবর্তিত অবস্থা। সংক্ষেপে কুরু বলতে তালাক পরবর্তী হায়েজকে বুঝানো হয়। তালাকপ্রাপ্তার অপেক্ষাকাল হচ্ছে তিন কুরু তথা তালাক পরবর্তী তিনটি পূর্ণ সময়ান্ত হায়েজ।

আহলে কিতাব أَهْلُ الْكِتَاب : ‘আহলে কিতাব শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘কিতাব সম্পর্কীয় পরিবার, কিতাবের বলয়ে থাকা ব্যক্তিবর্গ, কিতাবের অনুসারী’। কুরআন নাযিলের সমকালে যারা অকিতাবী’ ছিল তাদেরকে ‘উম্মীয়্যূন শব্দ দ্বারা চিহ্নিত করা হতো এবং যারা ‘পূর্ববর্তী কিতাবের অনুসারী’ ছিল তাদেরকে ‘আহলে কিতাব বলে চিহ্নিত করা হতো। আহলে কিতাবের দাবি ছিল যে, উম্মীদের প্রতি তাদের তেমন কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। কুরআনে আহলে কিতাবকে ‘আহলে কিতাব হিসেবে এবং উম্মীদেরকে ‘উম্মী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে উম্মীদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আহলে কিতাব ও উম্মীদের মধ্য থেকে যারাই কুরআনের প্রতি ঈমান এনেছে তাদেরকে ‘মু’মিন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং কুরআনের পরিভাষা অনুসারে ‘আহলে কিতাব শব্দের প্রায়োগিক অর্থ হলো ‘কুরআনের পূর্ববর্তী কিতাবের অনুসারী’। কুরআনে আহলে কিতাবকে ঈমানের আহবান জানানো হয়েছে। আবার মু’মিনদের জন্য আহলে কিতাবের খাদ্য গ্রহণ এবং তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনকে বৈধ করা হয়েছে।

মুশরিক  مُشْرِك : ‘মুশরিক শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘অংশী সাব্যস্তকারী, অংশীবাদী’। শব্দটির প্রায়োগিক অর্থ হলো, ‘কাউকে আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারের কোনো ক্ষেত্রে কোনোরূপ অংশীদার সাব্যস্তকারী’। আল্লাহর সাথে শিরক বা অংশী স্থাপনের কিছু দিক হলো: আল্লাহর সাথে কারো বংশীয় সম্পর্ক স্থাপন করা, কাউকে কোনোক্ষেত্রে কোনো অংশে স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করার মতো অলৌকিক শক্তির অধিকারী মনে করা, আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়ার ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা পালনকারী বলে সাব্যস্ত করা, আল্লাহর নিকট শাফায়াত করার বা শাফায়াত দ্বারা উপকৃত করার অধিকারী মনে করা, অলৌকিকভাবে কোনো ইষ্ট-অনিষ্ট সাধনের ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করা, অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন হিসেবে প্রার্থনা, ভক্তি ও উপাসনা লাভের অধিকারী মনে করা বা প্রার্থনা পূরণের ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করা, জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো মূল বিধান প্রণয়ন বা প্রদানের অধিকারী মনে করা ইত্যাদি। মু’মিনদের জন্য মুশরিক নারী-পুরুষকে বিবাহ করা অবৈধ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা শিরক ত্যাগ করে।

মুহসনাত  مُحْصَنَات : ‘মুহসনাত’ শব্দটির শাব্দিক অর্থ হলো ‘কোনো দুর্গে সংরক্ষণপ্রাপ্তা’। শব্দটির প্রায়োগিক অর্থ বিভিন্ন Context অনুসারে ‘সচ্চরিত্রা, বিবাহিতা, স্বাধীনা’। অর্থাৎ ‘চারিত্রিক পরিবেশের দুর্গে সংরক্ষিতা, বৈবাহিক দুর্গে সংরক্ষিতা এবং স্বাধীনতার দুর্গে সংরক্ষিতা’। কুরআনে শব্দটি এই বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘স্বাধীনা’ অর্থে শব্দটি ‘মা মালাকাত আইমান (যাকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতির আওতায় অধীনস্থ রাখা হয়েছে, যে অন্যের অধীনস্থ ও সংরক্ষণের আওতায় রয়েছে) শব্দের বিপরীতে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে লক্ষণীয় যে, ‘মুহসনাত ও ‘মা মালাকাত আইমান উভয়ের মধ্যে সংরক্ষণের মধ্যে থাকার দিক থেকে সেতুবন্ধন রয়েছে। পার্থক্য হলো, ‘মুহসনাত সংরক্ষিত থাকার ক্ষেত্রে সে নিজে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে, কিন্তু ‘মা মালাকাত আইমান সংরক্ষিত থাকার ক্ষেত্রে তার নিজের ভূমিকা গৌণ পর্যায়ের।

মা মালাকাত আইমান  مَا مَلَكَتْ أَيْمَان : ‘মা মালাকাত আইমান’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘ডানহাত যাদেরকে অধীনস্থ করেছে’। কুরআনে ‘আইমান’ বা ‘ডানহাত’ শব্দটি অনেক স্থানে ‘প্রতিশ্রুতি ও শপথ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, ২:২২৪-২২৫, ৫:১০৮, ৯:১২ আয়াত। ডানহাত শক্তির প্রতীক হলেও তা দ্বারা নিরাপত্তা প্রদানের শক্তিকে বুঝায় অর্থাৎ ডানহাত শব্দটি ইতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই ‘মা মালাকাত আইমান শব্দের প্রায়োগিক অর্থ হলো ‘যাদেরকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি প্রদায়ক ডানহাত পূর্ণকালীন সেবক/সেবিকা হিসেবে অধীনস্থ করেছে’। ‘মা মালাকাত আইমানকে বিয়ে করতে হলে যার অভিভাবকত্বের অধীনে রয়েছে তার অনুমতি নিতে হবে। আর নিজের অধীনস্থ হলেও তার সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে তাকে বিয়ে করতে হবে। কারণ কুরআনে স্বাধীনা নারীদের মতোই ‘মা মালাকাত আইমানকে’ও বিয়ে করার শর্তেই বৈধ করা হয়েছে (৪:৩, ৪:২৪-২৫)।

আমাতুন  أَمَةٌ : ‘আমাতুন (বহুবচনে ইমায়ি) শব্দের অর্থ হলো ‘দাসী’। শব্দটির পুংলিঙ্গ হলো ‘আবদ (দাস)। কুরআন অনুযায়ী ‘মানুষ ও জিনকে একমাত্র আল্লাহর দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে’ (৫১:৫৬)। সুতরাং কোনো মানুষ অন্য মানুষের দাস নয় এবং কাউকে নিজের দাস বানানো বৈধ নয়। তা সত্ত্বেও যখন কোনো সমাজে দাস প্রথা চালু হয়ে যায় এবং দাস বেচাকেনা চলে তখন ঐ সমাজের দাস-দাসীকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য বাস্তবসম্মত সংস্কার কর্মসূচীর বিকল্প নেই। এই প্রেক্ষিতে কুরআনে দাসমুক্তির জন্য বাস্তবসম্মত নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সমাজস্থ বা নিজের অধীনস্থ দাস-দাসীকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে নির্দেশ ও নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। কুরআন অনুযায়ী, একজন মু’মিন দাস বা দাসী একজন মুশরিকের (আল্লাহর সাথে বা তাঁর বিধানের সাথে অংশীবাদী) তুলনায় উত্তম। তাই মুশরিক যে ধরনের পার্থিব মর্যাদা ও সহায়সম্পদের মালিক হোক না কেন তার চেয়ে কোনো মু’মিন দাস বা দাসীকে বিয়ে করাও উত্তম। কুরআনে সচ্চরিত্র-সচ্চরিত্রা দাস-দাসীকে বিয়ে করানোর জন্যও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মু’মিনদের নিকট থাকা দাস-দাসীও তাদের ‘মা মালাকাত আইমান (যাদেরকে তাদের ডান হাত নিরাপত্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতির আওতায় অধীনস্থ করেছে বা আশ্রয় দিয়েছে) এর অন্তর্ভুক্ত।

মাহীদ / মাহীজ (হায়েজ)  مَحِيض /حَيض : মাহীদ/মাহীজ বা হায়েজ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘স্ত্রীলোকের মাসিক রজ:স্রাব’। তালাকপ্রাপ্তার ইদ্দাত পালনের ক্ষেত্রে হায়েজের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

ইদ্দাত  عِدَّة : ইদ্দাত শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘গণনা করা, তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর অন্যত্র বিয়ে করার পূর্বে অপেক্ষা করার সময়কাল’। কুরআনে ইদ্দাতের বা অপেক্ষাকালের সময়সীমা এবং ঐ সময়সীমায় করণীয় সম্পর্কে যেসব নির্দেশ দেয়া হয়েছে তালাক কার্যকর করার ক্ষেতে তা যথাযথভাবে পরিপালন করার উপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

আশুদ্দা  أَشُدَّ : ‘আশুদ্দা’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘যৌবনকাল, জৈবিক প্রক্রিয়াগত শক্তির পরিপক্কতার বয়স, স্থিতিশীল শক্তিসামর্থ্যের বয়স’। কুরআনে ইয়াতীম ছেলেমেয়েদেরকে তাদের সম্পদ তারা ‘বালাগান নিকাহ’ বা ‘বিবাহের বয়সে পৌঁছার’ পর প্রত্যর্পণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই নির্দেশ ভিন্নভাবে দেয়া হয়েছে তারা তাদের যৌবন বয়সে পৌঁছার পর প্রত্যর্পণ করার নির্দেশের মাধ্যমে। সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় যে, বিয়ের বয়স হলো যৌবনকাল। অন্য কথায় কোনো ছেলে বা মেয়ের বয়ঃসন্ধিকাল শেষ হলে তারপর তার বিয়ের বয়স হয়।

মীছাক্বান গালীযা  ميثاقا غليظا : ‘মীছাক্বান গালীযা’ শব্দের অর্থ হলো ‘মজবুত চুক্তি’। ৪:২১ আয়াতে বিয়েকে ‘মজবুত চুক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্য কথায়, আল্লাহর বিধান অনুসারে বিয়ে কোনো হালকা বিষয় নয়, এটি একটি চুক্তি এবং চুক্তি হিসেবে তা অত্যন্ত মজবুত। বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি সুদৃঢ় প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়। সুতরাং কোনো বাস্তবসম্মত কারণে বিয়ের বন্ধন অব্যাহত রাখা সম্ভব না হলে সেক্ষেত্রেও পারস্পরিক আচরণ এমন হতে হবে যেন এ মজবুত চুক্তির মর্যাদা রক্ষা পায়। যেহেতু একটি ‘মজবুত চুক্তি’ তাই বিয়ের ক্ষেত্রে চুক্তির জন্য যেমন দুইজন সাক্ষীর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তেমনি দুজন সাক্ষীর ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া বিয়ে হতে হবে স্থায়ী সম্পর্কের অভিপ্রায়সম্পন্ন, যদিও কোনো বাস্তবসম্মত কারণ তৈরি হলে বিয়ে বিচ্ছেদের সুযোগ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিয়ে এমন এক মজবুত চুক্তি যার মাধ্যমে মানব সভ্যতার গঠন ও ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। মানুষের পারস্পরিক যত চুক্তি সম্পাদিত হয় এর মধ্যে ‘বিবাহ’ অন্যতম বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

হেবা  هِبَة : হেবা শব্দের অর্থ হলো ‘দান, কোনো বিনিময় গ্রহণ ছাড়া কোনো সম্পদ হস্তান্তর করা’। সূরা আহযাব ৩৩:৫০ আয়াতে নবীর কাছে কোনো নারী নিজেকে ‘হেবা করলে তাকে বিয়ে করা নবীর জন্য বৈধ করা হয়েছে, কিন্তু মু’মিনদের জন্য নারীর হেবার ভিত্তিতে বিবাহের অবকাশ নেই, বরং তারা কোনো নারীকে বিয়ের জন্য ‘মোহরানা’ প্রদান এর শর্ত বহাল থাকবে।  এ থেকে স্পষ্ট যে, যে নারী নবীর কাছে নিজেকে হেবা করেছে তার তাৎপর্য হলো সে বিয়ের বিনিময়ে প্রযোজ্য মোহরানার দাবি অগ্রিম ছেড়ে দিচ্ছে। মু’মিনদের জন্য এভাবে অগ্রিম মোহরানার দাবি ছেড়ে দেয়ার বিষয়টিকে গ্রহণ করে নিয়ে কোনো নারীকে বিয়ে করার সুযোগ নেই।

মুফারাক্বাত  مُفَارَقَة : মুফারাক্বাত শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পৃথক করে দেয়া, চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতা, বিবাহ বিচ্ছেদ’। তালাকের প্রসঙ্গে শব্দটি ইদ্দাতকালে স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নিলে ইদ্দাত শেষে স্বাক্ষী রেখে বিদায় দেয়া ও দাম্পত্য সম্পর্কের চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতার অর্থ প্রকাশ করে। সূরা তালাকের ২য় আয়াতে এ শব্দ থেকে গঠিত ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়েছে।

ইমছাক্ব  اِمْسَاك : ইমছাক্ব শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘রেখে দেয়া, বহাল রাখা, কোনো বন্ধনে আটকে রাখা’। তালাকের প্রসঙ্গে শব্দটি তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে তার ইদ্দাতকালের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্কে ফিরিয়ে নেয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তালাক অর্থই যে অতিআবশ্যকভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ নয়, বরং স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক সমঝোতায় আবার স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, ইমছাক্ব শব্দটি তারই নির্দেশক।

বিগায়ি  بِغَاءِ : বিগায়ি শব্দের অর্থ ‘পতিতাবৃত্তি, পতিতা হওয়া’। কোনো নারীকে বিয়ে না করে সম্ভোগের পাত্রীতে পরিণত করার মানে হলো তাকে পতিতা বানানো, তার বিনিময়ে তাকে কোনো অর্থসম্পদ দেয়া হোক বা না হোক। ২৪:৩৩ আয়াতে যুবতীদেরকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। আরো জানানো হয়েছে যে, যদি তাদেরকে কেউ পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে তাহলে (যাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে) তাদের প্রতি আল্লাহ ক্ষমাশীল। সুতরাং যারা বাধ্য করবে তারাই অপরাধী হবে, যাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে তারা অপরাধী সাব্যস্ত হবে না।

জ্বিনা  زِنَي  : জ্বিনা শব্দের অর্থ হচ্ছে ব্যভিচার, বিবাহ বহির্ভুত যৌন সম্পর্ক, অনৈতিক সর্ম্পক স্থাপন করা। কুরআনে জ্বিনাকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে দণ্ডবিধি দেয়া হয়েছে।

হুলুম  حُلُم : হুলুম শব্দের অর্থ হলো ‘বয়ঃসন্ধিকাল’। য়ঃসন্ধিকাল হলো কৈশোর ও যৌবনের মধ্যবর্তী পর্যায়। সাধারণত ছেলেদের বীর্যস্খলন শুরু হওয়া এবং মেয়েদের মাসিক রজ:স্রাব শুরু হওয়াকে বয়সন্ধিকালে পৌঁছার (সাবালক বা সাবালিকা হওয়ার) লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়। অবশ্য কারো কারো ক্ষেত্রে কোনো কারণে বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতে বীর্যস্খলন বা রজ:স্রাব নাও হতে পারে, সেক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছার বিষয়টি অন্যান্য লক্ষণ দ্বারা চিহ্নিত হয়। কোনো ছেলে বা মেয়ের দৈহিক উচ্চতা বৃদ্ধির সমাপ্তির মাধ্যমেই বয়ঃসন্ধিকালের তথা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার জৈবিক প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে।

রুশদা  رُشْدَ : রুশদা শব্দের অর্থ হলো ‘সঠিক বোধবুদ্ধি’। ৪:৫-৬ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যারা নির্বোধ তাদের হাতে তাদের সম্পদ তুলে দেয়া যাবে না, তবে তাদের সম্পদ থেকে তাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ইয়াতীমের সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক বা ব্যবস্থাপনাকারী অভিভাবক ইয়াতীমকে তার সম্পদ প্রত্যর্পণ করতে হবে যখন ইয়াতীম ছেলেমেয়ে ‘বিয়ের বয়সে’ পৌঁছবে, তখন যদি তাদের মধ্যে ‘রুশদা’ রয়েছে বলে লক্ষণ প্রকাশ পায়। সুতরাং বক্তব্য প্রসঙ্গ অনুসারে এক্ষেত্রে রুশদা বলতে সম্পদের সঙ্গত ব্যবস্থাপনার বোধবুদ্ধিকে বুঝায়। তারা বিয়ের বয়সে পৌঁছার পর তাদের মধ্যে সম্পদের সঙ্গত ব্যবস্থাপনা মানসিক ও জ্ঞানগত যোগ্যতা সৃষ্টি হয়েছে কিনা তা যাচাই করে দেখতে হবে। যদি শারীরিকভাবে যৌবনে উপনীত হওয়ার পাশাপাশি সম্পদের সঙ্গত ব্যবস্থাপনার জ্ঞানও তৈরি হয় তাহলেই তাদেরকে তাদের সম্পদ প্রত্যর্পণ করা হবে এবং তারা বিয়ের জন্য উপযুক্ত হিসেবে সাব্যস্ত হবে। যেহেতু স্বামী তার স্ত্রীর বিষয়ে সামগ্রিক দায়িত্বশীল ও তার জন্য ব্যয়ভার বহন করতে হয়, তাই সম্পদের সঙ্গত ব্যবস্থাপনার যোগ্যতার বিষয়টি বিশেষভাবে ছেলেদের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য।

ইয়াতীম  يَتِيم : ইয়াতীম শব্দের অর্থ হলো ‘পিতৃহীন শিশু বা বালক’। শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গ ‘ইয়াতীমা’ অর্থ ‘পিতৃহীনা শিশু বা বালিকা’। ইয়াতীম শব্দের বহুবচন ‘ইয়াতামা’ অর্থ ‘ইয়াতীম ছেলেমেয়ে’। কুরআনে ইয়াতীম ছেলেমেয়ের প্রতি সুবিচার ও সদাচারের জন্য অনেক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইয়াতীমের সম্পদের ব্যবস্থাপনা। এ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত অভিভাবক যদি দরিদ্র হয় তাহলে তার সম্পদ থেকে ব্যবস্থাপনার জন্য একটি ন্যায্য ফী গ্রহণ করতে পারবে। ইয়াতীম ছেলেমেয়ে যখন বিয়ের বয়সে তথা যৌবনে পৌঁছবে বা তাদের বয়ঃসন্ধিকাল শেষ হবে তখন তাদের মধ্যে সম্পদের সঙ্গত ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা যাচাইপূর্বক তাদেরকে তাদের সম্পদ প্রত্যর্পণ করতে হবে। ইয়াতীম ছেলেমেয়েদের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত  করার প্রয়োজনে ইয়াতীম ছেলেমেয়ে থাকা বিধবা নারীদেরকে বিয়ে করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এভাবে ইয়াতীম ছেলেমেয়েকে নিজের ছেলেমেয়ে বানিয়ে নেয়ার মাধ্যমে তাদের প্রতি আরো উত্তমভাবে দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করা সম্ভব হতে পারে। ইয়াতীম ছেলেমেয়ের প্রতি সদয় আচরণের উপর অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।