আল কুরআনের আলোকে ঈমান

বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও অতীন্দ্রিয় সত্যের প্রতি প্রত্যয়

আখিরাতের প্রতি ঈমান

আখিরাতের প্রতি ঈমানের প্রয়োজনীয়তা

২৩:১১৫ :: তোমরা কি মনে করেছো যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক ও উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনা হবে না?

৭৫:৩৬ :: মানুষ কি মনে করে যে, তাকে নিরর্থক ছেড়ে দেয়া হবে?

৩০:৭-৮ :: তারা পার্থিব জীবনের বাহ্যদিক সম্পর্কে জানে, কিন্তু তারা আখিরাতের বিষয়ে অসচেতন। তারা কি নিজেদের মধ্যে ভেবে দেখে না? আল্লাহ আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা আছে সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে এবং এক নির্দিষ্ট কালের জন্য। কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেকেই তাদের প্রতিপালকের সাক্ষাত (তাঁর কাছে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হওয়া) সম্পর্কে অবিশ্বাসী।

৪৪:৩৮-৪০ :: আর আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা আছে তা খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি এতদুভয়কে অযথা সৃষ্টি করিনি। কিন্তু তাদের অধিকাংশই ঈমান আনে না। নিশ্চয় ফায়সালার দিবসটি তাদের সকলের জন্য এক নির্ধারিত সময়।

১০:৭-৮ :: নিশ্চয় যারা আমার সাক্ষাতের আশা রাখে না এবং দুনিয়ার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট আছে ও তা নিয়ে পরিতৃপ্ত রয়েছে। আর যারা আমার নিদর্শনাবলী হতে অসচেতন। তারা যা (যে পাপ) উপার্জন করতো, তার কারণে আগুনই হবে তাদের ঠিকানা।

৭৫:২০-২১ :: না (তোমাদের চিন্তাধারা সঠিক নয়)। বরং (চিন্তাধারার সঠিকত্ব বিবেচনা ছাড়াই) তোমরা নগদ ফলাফলকেই ভালবাস এবং আখিরাতকে উপেক্ষা করো।

৮৭:১৬-১৭ :: বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছো। অথচ আখিরাতই উত্তম এবং অধিক স্থায়ী।

৭:৫১ :: তারা নিজেদের দীনকে ক্রীড়া-কৌতুকের বস্তুতে পরিণত করেছিল এবং পার্থিব জীবন তাদেরকে ধোকায় ফেলে রেখেছিল। সুতরাং আজ আমি তাদেরকে তেমনিভাবে ভুলে থাকব যেমনিভাবে তারা এই দিনের সাক্ষাতের কথা ভুলে গিয়েছিল এবং যেমনভাবে তারা আমার নিদর্শন ও আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছিল।

২৮:৭৯-৮০ :: অতঃপর সে তার কওমের সামনে জাঁকজমকের সাথে বের হলো। যারা দুনিয়ার জীবন চাইত তারা বললো, ‘আহা! কারূনকে যেমন দেয়া হয়েছে আমাদেরও যদি তেমন থাকতো! নিশ্চয় সে বিরাট সম্পদশালী।’ আর যারা জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছিল, তারা বললো, ‘ধিক তোমাদেরকে! তার জন্য আল্লাহর প্রতিদানই উত্তম যে ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে। আর তা শুধু সবরকারীরাই পেতে পারে।’

২৭:৪ :: যারা আখিরাতে বিশ্বাস করেনা তাদের দৃষ্টিতে তাদের কাজকে আমি শোভন করেছি, ফলে তারা বিভ্রান্তিতে ঘুরে বেড়ায়।

১৮:১০৩-১০৫ :: বলো, “আমি কি তোমোদেরকে কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সংবাদ দিবো? যাদের প্রচেষ্টা দুনিয়ার জীবনে ভ্রান্তভাবে পরিচালিত হয়েছে অথচ তারা হিসেব করছে যে, তারা চমৎকার ফলাফলের কর্ম উৎপাদন করছে”। তারাই সেসব লোক, যারা তাদের প্রভুর আয়াতসমূহ এবং তাঁর সাথে সাক্ষাতকে অস্বীকার করেছে। ফলে তাদের সকল আমল নিষ্ফল হয়ে গেছে। সুতরাং আমি তাদের জন্য কিয়ামতের দিন কোনো ওজনের ব্যবস্থা রাখবো না।

৭:১৪৬-১৪৭ :: যারা অন্যায়ভাবে পৃথিবীতে অহঙ্কার করে আমার আয়াতসমূহ থেকে তাদেরকে আমি অবশ্যই ফিরিয়ে রাখবো। আর তারা সকল আয়াত দেখলেও তাতে ঈমান আনবে না এবং তারা সঠিক পথ দেখলেও তাকে পথ হিসাবে গ্রহণ করবে না। আর তারা ভ্রান্ত পথ দেখলে তা পথ হিসাবে গ্রহণ করবে। এটা এ জন্য যে, তারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং সে সম্পর্কে তারা অসচেতন ছিল। আর যারা আমার আয়াতসমূহ ও আখিরাতের সাক্ষাতকে অস্বীকার করেছে তাদের কর্মসমূহ বিনষ্ট হয়ে গেছে। তারা যা করে তদনুযায়ী তাদের প্রতিদান দেয়া হবে।

১৬:২২ :: তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। অতঃপর যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর অস্বীকারকারী এবং তারা অহঙ্কারী।

৩৯:৪৫ :: যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না, এক আল্লাহর কথা বলা হলে তাদের অন্তর সঙ্কুচিত হয়ে যায়। আর আল্লাহ ছাড়া অন্য উপাস্যগুলোর কথা বলা হলে তখনই তারা আনন্দে উৎফুল্ল হয়।

২৮:৩৯ :: আর ফির‘আউন ও তার সেনাবাহিনী অন্যায়ভাবে যমীনে অহঙ্কার করেছিল এবং তারা মনে করেছিল যে, তাদেরকে আমার নিকট ফিরিয়ে আনা হবে না।

৮৩:১-৫ :: দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। যারা লোকের নিকট থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় নেয়। এবং যখন তাদেরকে মেপে বা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়। তারা কি ধারণা রাখে না যে, তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে, এক মহাদিবসে (শেষ বিচারের দিন)?

৮৩:১০ :: সেদিন দুর্ভোগ মিথ্যা সাব্যস্তকারীদের জন্য। যারা শেষ বিচার দিবসকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে। আর সকল সীমালঙ্ঘনকারী পাপাচারী ছাড়া কেউ সেটাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে না।

আলোচনা: পৃথিবীতে মানুষ ভালো-মন্দ যা কাজ করছে তার পরিপূর্ণ নৈতিক ফলাফল পৃথিবীতে সংঘটিত হয় না। এতে প্রাথমিকভাবে প্রাকৃতিক নিয়মের ফলাফল সরাসরি সংঘটিত হয়, কিন্তু নৈতিক নিয়মের ফলাফলের ক্ষেত্রে পার্থিব জীবন চূড়ান্ত নয়। তাই আখিরাতে বিশ্বাস ছাড়া পার্থিব জীবন সঠিক অর্থবহ হয় না। এমতাবস্থায় নৈতিক কাজের যথাযথ প্রেরণা অব্যাহত থাকাও সম্ভব হয় না। সুতরাং আখিরাতে বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না আখিরাতের প্রতি অবিশ্বাসের ফলে তাদের চরিত্র মন্দ হতে থাকে। অনুরূপভাবে আখিরাতে বিশ্বাস মানুষকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী করে, কারণ সে জানে যে, মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত হয়ে একদিন তাকে তার প্রভুর সামনে তার প্রতিটি কাজের হিসেবে দিতে হবে এবং তার কর্মফল হিসেবে জান্নাত বা জাহান্নাম হবে তার শেষ ঠিকানা। অবশ্য আখিরাতে ঈমানের দাবি করলেই চরিত্র উত্তম হয়ে যায় না, আখিরাতের প্রতি সত্যিকার বিশ্বাসই উত্তম চরিত্র সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। সর্বোপরি যেহেতু পৃথিবীর জীবন নিরর্থক ও উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করা হয়নি, বরং এটি মানুষের জন্য একটি কে কিরূপ কর্ম করে তার পরীক্ষাকাল, তাই আখিরাত একটি অনিবার্য বাস্তবতা। তাই মানুষের সমগ্র কর্মজীবনকে সঠিকপথে পরিচালিত করতে আখিরাতে বিশ্বাস করা অত্যাবশ্যক।

দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে তুলনা ও অগ্রাধিকার

২৯:৬৪ :: আর (আখিরাতের তুলনায়) এ দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং নিশ্চয় আখিরাতের নিবাসই হলো প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত।

৫৭:২০ :: তোমরা জেনে রাখ যে, (আখিরাতের তুলনায়) দুনিয়ার জীবন ক্রীড়া কৌতুক, শোভা-সৌন্দর্য, তোমাদের পারস্পরিক গর্ব-অহঙ্কার এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে আধিক্যের প্রতিযোগিতা মাত্র। এর উপমা হল বৃষ্টির মত, যার উৎপন্ন ফসল কৃষকদেরকে আনন্দ দেয়, তারপর তা শুকিয়ে যায়, তখন তুমি তা হলুদ বর্ণের দেখতে পাও, তারপর তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। আর আখিরাতে আছে কঠিন আযাব এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর দুনিয়ার জীবনটা তো ধোঁকার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।

৩:১৮৫ :: প্রতিটি প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর ‘অবশ্যই কিয়ামতের দিনে তাদের প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে দেয়া হবে। সুতরাং যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে-ই সফলতা পাবে। আর দুনিয়ার জীবন শুধু ধোঁকার সামগ্রী।

৪:৭৭ :: তুমি কি তাদেরকে দেখোনি যাদেরকে বলা হয়েছিল, ‘তোমরা তোমাদের হস্ত সংবরণ কর, সালাত কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান করো?’ অতঃপর যখন তাদেরকে যুদ্ধের বিধান দেয়া হল তখন তাদের একদল মানুষকে ভয় করছিল আল্লাহকে ভয় করার মত অথবা তার চেয়েও বেশী এবং বললো, ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান কেন দিলেন? আমাদেরকে কিছু দিনের অবকাশ কেন দিলেন না?’ বলো, ‘পার্থিব ভোগ সামান্য এবং যে স্রষ্টা সচেতনতা অবলম্বন করে তার জন্য আখেরাতই উত্তম। আর তোমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও যুলুম করা হবে না।’

৯:৩৮ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের কী হল, যখন তোমাদের বলা হয়, আল্লাহর পথে বের হও, তখন তোমরা পৃথিবীর প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়? তবে কি তোমরা আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে সন্তুষ্ট হলে? অথচ দুনিয়ার জীবনের ভোগ-সামগ্রী আখিরাতের তুলনায় একেবারেই নগণ্য।

৯:৮১ :: পেছনে থাকা লোকগুলো আল্লাহর রাসূলের বিপক্ষে বসে থাকতে পেরে খুশি হলো, আর তারা অপছন্দ করল তাদের মাল ও জান নিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করতে এবং তারা বললো, ‘তোমরা গরমের মধ্যে বের হয়ো না’। বলো, ‘জাহান্নামের আগুন অধিকতর গরম’। যদি তারা বুঝতো!

১১:১১৬ :: সুতরাং তোমাদের পূর্বের প্রজন্মসমূহের মধ্যে এমন প্রজ্ঞাবান কেন হয়নি, যারা পৃথিবীতে ফাসাদ-বিপর্যয় করা থেকে নিষেধ করতো? অল্প সংখ্যক ছাড়া, যাদেরকে আমি তাদের মধ্য থেকে নাজাত দিয়েছিলাম। আর যারা যুলম করেছে, তারা (পার্থিব) বিলাসিতার পেছনে পড়ে ছিল এবং তারা ছিল অপরাধী।

৩৯:১৫ :: অতএব তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য যা কিছুর ইচ্ছা ইবাদাত (দাসত্ব-উপাসনা) কর। বলো, ‘নিশ্চয় তারা ক্ষতিগ্রস্ত যারা কিয়ামত দিবসে নিজদেরকে ও তাদের পরিবারবর্গকে ক্ষতিগ্রস্ত পাবে। জেনে রেখ, এটাই স্পষ্ট ক্ষতি’।

৭৯:৩৭-৪১ :: সুতরাং যে সীমালংঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়, জাহান্নামই হবে তার আবাস। আর যে নিজ প্রভুর সামনে দাঁড়াবার ভয় রাখে এবং নিজের সত্তাকে প্রবৃত্তি অনুসারে চলা থেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।

৩:১৯৬-১৯৮ :: যারা কুফর করেছে, দেশে দেশে তাদের অবাধ বিচরণ যেন কিছুতেই তোমাকে প্রতারিত না করে। সামান্য ভোগ! তারপর জাহান্নাম তাদের আবাস, আর কী নিকৃষ্ট সে বিছানা! কিন্তু যারা তাদের প্রভুর প্রতি সচেতন থাকে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশে প্রবাহিত হবে নহরসমূহ, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে মেহমানদারী। আর আল্লাহর নিকট যা রয়েছে সৎকর্মশীলদের জন্য সেটাই উত্তম।

৫৩:২৪-২৫ :: মানুষ যা চায় তা-ই পায়? বস্তুত ইহকাল ও পরকাল আল্লাহরই আয়ত্তে।

২২:১১ :: মানুষের মধ্যে এমনও আছে যারা প্রান্তিকতায় দাঁড়িয়ে দ্বিধার সাথে আল্লাহর ‘ইবাদাত করে। অতঃপর তার কল্যাণ হলে তা নিয়ে সে তৃপ্ত থাকে, আর কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হলে সে তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে দুনিয়াতেও আর আখিরাতেও- এটাই হল স্পষ্ট ক্ষতি।

আখিরাত (পরকাল) অস্বীকারকারীদের উক্তি

৪৪:৩৪-৩৫ :: নিশ্চয় তারা (কাফিরগণ) বলে, নিশ্চয় আমাদের এ প্রথম মৃত্যু ছাড়া আর কিছু নেই এবং আমরা পুনরুত্থিত হবো না’।

৪৫:২৪ :: আর তারা বলে, ‘দুনিয়ার জীবনই আমাদের একমাত্র জীবন। আমরা মরি ও বাঁচি এখানেই। আর কাল-ই কেবল আমাদেরকে ধ্বংস করে।’ বস্তুত এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই। তারা শুধু ধারণাই করে।

২৭:৬৫-৬৬ :: বলো, আল্লাহ ছাড়া আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যারা আছে তারা গায়েব জানে না। আর কখন তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে তা তারা অনুভব করতে পারে না। বরং আখিরাত সম্পর্কিত তাদের জ্ঞানের সীমা শেষ, বরং এ ব্যাপারে তারা সন্দেহের মধ্যে আছে, বরং এ বিষয়ে তারা অন্ধ।

৩২:১০ :: আর তারা বলে, ‘আমরা যখন মাটিতে মিশে যাব তখন কি আবার নতুন সৃষ্টি হবো’? বরং তারাতো তাদের প্রভুর মুখোমুখি হওয়ার প্রতি অস্বীকারকারী।

৩৭:১৬ :: (কাফিররা বলে,) ‘আমরা যখন মরে যাবো এবং মাটি ও হাড়ে পরিণত হব তখনও কি আমরা পুনরুত্থিত হব’?

৩৭:৫৩ :: (কাফিররা বলে,) আমরা যখন মরে যাব এবং মাটি ও হাড়ে পরিণত হব তখনও কি আমাদেরকে কর্মফল দেয়া হবে?

১৭:৪৯ :: তারা বলেঃ আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হলেও কি নতুন সৃষ্টি রূপে পুনরুত্থিত হব?

৫০:৩ :: (কাফিররা বলে,) আমরা যখন মরে যাব আর মাটি হয়ে যাব (তখন আমাদেরকে আবার আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে)? এ ফিরে যাওয়াটা তো বহু দূরের ব্যাপার।

৩৬:৭৮ :: সে (আমার সৃষ্টির সাথে) আমার তুলনা করে, অথচ সে তার নিজের সৃষ্টির ব্যপারটি ভুলে যায় (যে তাকে আমিই সৃষ্টি করেছি)। সে বলে, ‘হাড়গুলোকে কে আবার জীবন্ত করবে যখন তা পচে গলে যাবে?’’

আখিরাতের (পরকালের) সম্ভবপরতা বুঝার জন্য কিছু আয়াত

৫০:৪ :: আমি জানি মাটি তাদের কতটুকু ক্ষয় করে আর আমার কাছে আছে এক কিতাব যা (সব কিছুর পূর্ণ বিবরণ) সংরক্ষণ করে।

৬:৫৯ :: আর তাঁর কাছে রয়েছে গায়েবের চাবিসমূহ, তিনি ছাড়া এ বিষয়ে কেউ জানে না এবং তিনি জানেন স্থলভাগে ও জলভাগে যা কিছু আছে। আর কোনো পাতা ঝরে না এছাড়া যে তিনি তা জানেন এবং পৃথিবীর অন্ধকারে কোনো দানা নেই, না কোনো ভেজা এবং না কোনো শুষ্ক কিছু, এছাড়া যে তা হয় না স্পষ্ট কিতাবে লিখিত বিধি অনুযায়ী ছাড়া।

৭৫:৩-৪ :: মানুষ কি মনে করে যে, আমি কখনই তার অস্থিসমূহ একত্র করবো না? কেন নয়? আমি তার আংগুলের অগ্রভাগসমূহও পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম।

১৭:৫০-৫১ :: বলো, “তোমরা পাথর হয়ে যাও কিংবা লোহা; অথবা এমন কোন সৃষ্টি, যা তোমাদের অন্তরে বড় মনে হয়।” শীঘ্রই তারা বলবে, ‘কে আমাদেরকে সৃষ্টির পুনরাবৃত্তি করবে?’ বলো, “যিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন।” অতঃপর তারা তোমার সামনে মাথা নাড়বে এবং বলবে, ‘এটা কবে হবে?’ বলো, “আশা করা যায় যে, তা নিকটবর্তী।”

২৩:১৫-১৬ :: এরপর অবশ্যই তোমরা মরবে। তারপর নিশ্চয় তোমরা কিয়ামাত দিবসে পুনরুত্থিত হবে।

২৯:১৯-২০ :: তারা কি দেখে না, আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টির সূচনা করেন? তারপর তিনি তার পুনরাবৃত্তি করবেন। নিশ্চয় এটি আল্লাহর জন্য সহজ। বলো, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো, অতঃপর লক্ষ্য কীভাবে তিনি সৃষ্টির সূচনা করেন, তারপর আল্লাহ পরবর্তী সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

৩০:২৭ :: আর তিনিই সৃষ্টির সূচনা করেন তারপর তিনিই এর পুনরাবৃত্তি করবেন। আর এটা তো তাঁর জন্য অতি সহজ। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মর্যাদা তাঁরই এবং তিনি মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।

৫০:১৫ :: আমি কি প্রথমবার সৃষ্টি করেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি? বরং তারা নতুন করে সৃষ্টির বিষয়ে সন্দেহে রয়েছে।

৪৬:৩৩ :: তারা কি দেখে না যে, নিশ্চয় আল্লাহ, যিনি আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন আর এগুলোর সৃষ্টিতে তিনি ক্লান্ত হননি, তিনি মৃতদেরকে জীবন দিতে সক্ষম? কেন নয়? নিশ্চয় তিনি সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।

৩৬:৭৯ :: বল, ‘যিনি প্রথমবার এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন তিনিই সেগুলো পুনরায় জীবিত করবেন। আর তিনি সকল সৃষ্টি সম্পর্কেই সর্বজ্ঞাত।

৩০:১৯ :: তিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন। আর তিনি যমীনকে জীবিত করেন তার মৃত্যুর পর। আর এভাবেই তোমাদেরকে বের করা হবে।

৩৬:৩৩ :: আর মৃত যমীন তাদের জন্য একটি নিদর্শন, আমি তাকে জীবিত করেছি এবং তা থেকে শস্যদানা উৎপাদন করেছি। অতঃপর তা থেকেই তারা খায়।

৩০:৫০ :: অতএব তুমি আল্লাহর রহমতের চি‎হ্নসমূহের প্রতি দৃষ্টি দাও। কিভাবে তিনি যমীনের মৃত্যুর পর তা জীবিত করেন। নিশ্চয় এভাবেই তিনি মৃতকে জীবিতকারী এবং তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান।

৭৫:৩৬-৪০ :: মানুষ কি মনে করে যে, তাকে নিরর্থক ছেড়ে দেয়া হবে? সে কি স্খলিত শুক্রবিন্দু ছিল না? তারপর সে হলো আলাক্বাহ (মায়ের জরায়ুতে লেগে থাকা ভ্রুণ), অতঃপর তিনি (আল্লাহ) তাকে (পূর্ণ আকৃতিতে) সৃষ্টি করলেন ও সুবিন্যস্ত করলেন। অতঃপর তিনি তার সমজাতীয় উপাদান হতে সৃষ্টি করেন যুগল নর ও নারী। সেই তিনিই কি মৃতদের জীবিত করতে সক্ষম নন?

১৯:৬৬-৬৭ :: আর মানুষ বলে, “যখন আমি মরে যাবো তখন আমাকে কি জীবিত করে বের করা হবে?:” মানুষ কি স্মরণ করে না যে, আমি ইতোপূর্বে তাকে সৃষ্টি করেছি অথচ সে কিছুই ছিলো না?

১৬:৩৮ :: তারা দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর শপথ করে বলেঃ যার মৃত্যু হয় আল্লাহ তাকে পুনরুজ্জীবিত করবেননা। কেন নয়? তার নিজের উপরে করা ওয়াদা তিনি সত্যে রূপ দেবেন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষই জ্ঞানার্জন করে না।

২১:১০৪ :: যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম সেই একই প্রক্রিয়ায় পুনরায় সৃষ্টি করবো। প্রতিশ্রুতি পালন আমার কর্তব্য, নিশ্চয় আমি তা পালন করবোই।

জীবন-মুত্যু পরিকল্পিত সৃষ্টি, মুত্যু মুহুর্তের দৃশ্যপট এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য ও নির্দেশনা

২:২৮ :: কিভাবে তোমরা আল্লাহর প্রতি কুফর (অবিশ্বাস) করবে, অথচ তোমরা ছিলে মৃত, তিনিই তোমাদেরকে জীবন দিয়েছেন, তারপর তোমাদেরকে মৃত্যু দিবেন, তারপর আবার তোমাদেরকে জীবিত করবেন, তারপর তাঁর দিকেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।

৪০:১১ :: তারা বলবে, আমাদের প্রভু! আপনি আমাদেরকে দুইবার মৃত রেখেছেন এবং দুইবার জীবন দিয়েছেন। অতঃপর আমরা আমাদের অপরাধ স্বীকার করছি। অতওব, (জাহান্নাম থেকে) বের হওয়ার কোনো পথ আছে কি?

৬৭:২ :: যিনি (আল্লাহ) মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলার জন্য যে, তোমাদের মধ্যে কে উত্তম কর্ম সম্পাদন করে? আর তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।

২৯:৫৭ :: প্রত্যেক প্রাণীই মুত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে। তারপর আমার দিকেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে আনা হবে।

৩৩:১৬ :: বলো, ‘যদি তোমরা মৃত্যু অথবা হত্যার ভয়ে পালাতে চাও তবে পালানো তোমাদের কোনো উপকারে আসবে না। আর সে ক্ষেত্রে তোমাদেরকে (জীবনসামগ্রী) উপভোগ করতে দেয়া হবে না, সামান্যকাল ছাড়া।

৪:১৭-১৮ :: অবশ্যই আল্লাহ তাদের তাওবাহ কবুল করবেন, যারা মুর্খতাবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে, এরাই হল সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন; আল্লাহ মহাজ্ঞানী মহাবিজ্ঞ। আর এমন লোকদের জন্য কোনো ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমনকি যখন মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকে - আমি এখন তওবা করছি। আর তাদের জন্যও তাওবাহ নেই যারা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।

২২:৫৮ :: আর যারা আল্লাহর পথে হিজরত করে, অতঃপর নিহত হয় কিংবা মারা যায়, তাদেরকে অবশ্যই আল্লাহ উত্তম রিয্ক দান করবেন। আর নিশ্চয় আল্লাহই সর্বোৎকৃষ্ট রিয্কদাতা।

৭:২৫ :: তিনি বললেন, ‘তোমরা তাতে (পৃথিবীতে) জীবন যাপন করবে এবং তাতে মারা যাবে। আর তা থেকে তোমাদেরকে বের করা হবে’।

২০:৫৫ :: মাটি থেকেই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, মাটিতেই আমি তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেবো এবং মাটি থেকেই তোমাদেরকে পুনরায় বের করবো।

৩১:৩৪ :: নিশ্চয় আল্লাহর নিকট কিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। আর তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং জরায়ূতে যা আছে, তা তিনি জানেন। আর কেউ জানে না আগামীকাল সে কী অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন্ স্থানে সে মারা যাবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।

৩:১৫৮ :: আর যদি তোমরা মারা যাও অথবা তোমাদেরকে হত্যা করা হয়, তবে তোমাদেরকে আল্লাহর নিকটই সমবেত করা হবে।

৪৭:৩৪ ::নিশ্চয়ই যারা কুফর করেছে এবং আল্লাহর পথে বাধা দিয়েছে, তারপর কাফির অবস্থায়ই মারা গেছে, আল্লাহ কখনই তাদের ক্ষমা করবেন না।

৩:১৫৭ :: আর যদি তোমরা আল্লাহর পথে নিহত হও বা মৃত্যুবরণ করো, তাহলে অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও দয়া তারা যা জমা করে তা থেকে উত্তম।

৪:৯৭ :: নিশ্চয় যারা নিজদের প্রতি যুলমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, ‘তোমরা কী অবস্থায় ছিলে’? তারা বলে, ‘আমরা যমীনে দুর্বল ছিলাম’। ফেরেশতারা বলে, ‘আল্লাহর যমীন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে’? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল।

৩:১০২ :: হে যারা ঈমান এনছো, আল্লাহকে যথাযথভাবে (তথা সর্বোচ্চ সাধ্যমতো) ভয় করো এবং মুসলিম (আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী) অবস্থায় ছাড়া মৃত্যুবরণ করো না।

বারযাখ

২৩:৯৯-১০০ :: অবশেষে যখন তাদের কারো মৃত্যু আসে, সে বলে, ‘হে আমার প্রভু, আমাকে ফেরত পাঠান, যেন আমি সৎকাজ করতে পারি যা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম।’ কখনো নয়, এটি একটি বাক্য মাত্র, যা সে বলবে। যেদিন তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে সেদিন পর্যন্ত তাদের সামনে থাকবে বারযাখ (অন্তরাল)।

ক্ববর

৯:৮৪ :: আর তাদের (মুনাফিকদের) কেউ মৃত্যুবরণ করলে তুমি কখনো তার ব্যাপারে সালাত (আনুকূল্য প্রদর্শন) করবে না এবং তার কবরের পাশেও দাঁড়াবে না, এমতাবস্থায় যে, (তোমার জানামতে) সে ফাসেক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে।

২২:৭ :: আর কিয়ামত আসবেই, এতে কোনো সন্দেহ নেই এবং কবরে যারা আছে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে পুনরুত্থিত করবেন।

৩৫:২২ :: আর জীবিত ও মৃত সমান নয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন শোনান; যারা ক্ববরে আছে তুমি তাদেরকে শোনাতে পার না।

৬০:১৩ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা সেই সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব করো না, যাদের প্রতি আল্লাহ রাগান্বিত হয়েছেন। তারা তো আখিরাত সম্পর্কে নিরাশ হয়ে পড়েছে, যেমনিভাবে কাফিররা কবরবাসীদের সম্পর্কে নিরাশ হয়েছে।

৮০:১৭-২২ :: (ঐ) মানুষ ধ্বংস হোক! যে কিনা বড়ই অবিশ্বাসী-অকৃতজ্ঞ! তিনি তাকে কোন বস্তু থেকে সৃষ্টি করেছেন? শুক্রবিন্দু থেকে তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তার প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তারপর তাকে (মাতৃগর্ভ থেকে বের হওয়ার ও জীবনে চলার) পথ সহজ করে দিয়েছেন। তারপর তাকে মৃত্যু দেন এবং কবরস্ত কবরস্থ করেন। তারপর যখন চাইবেন তাকে পুনর্জীবিত-পুনরুত্থিত করবেন।

৮২:৪ :: আর যখন কবরসমূহকে উন্মোচিত করা হবে।

১০০:৯ :: তবে কি সে জানে না, যখন কবরে যা আছে সব উন্মোচিত করা হবে?

১০২:১-২ :: প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে (জীবনের প্রকৃত তাৎপর্য) মোহাচ্ছন্ন রাখে। যতক্ষণ না তোমরা কবর পর্যবেক্ষণ (যিয়ারত) করো।

আলোচনা: ক্ববর সম্পর্কিত আয়াতসমূহে ক্ববরে সওয়াল জওয়াব বা ক্ববর আযাবের কোনো তথ্য নেই। অবশ্য নিম্নের আয়াতটিতে ফিরআউন এবং তার পরিষদবর্গকে সকাল-সন্ধ্যায় জাহান্নামের আগুনের সামনে নেয়া হয় (জাহান্নাম দেখানো হয়) মর্মে বিবৃতি রয়েছে।

৪০:৪৫-৪৬ :: অতঃপর তাদের ষড়যন্ত্রের অশুভ পরিণাম থেকে আল্লাহ তাকে রক্ষা করলেন আর ফির‘আউনের অনুসারীদেরকে ঘিরে ফেললো নিকৃষ্ট আযাব। তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় (জাহান্নামের) আগুনের সামনে উপস্থিত করা হয়, আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে (সেদিন ঘোষণা করা হবে), ‘ফির‘আউনের অনুসারীদেরকে কঠোরতম আযাবে প্রবেশ করাও।’

আলোচনা: ফিরআউন নিজেকে রব, মালিক ও ইলাহ দাবি করেছিলো (৭৯:২৪, ৪৩:৫১, ২৬:২৯)। সুতরাং ফিরআউন ও তার অনুসারীগণ অতিবড় খোদাদ্রোহী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ছিলো। এ প্রেক্ষিতে তাদের প্রসঙ্গে কিয়ামাতের পূর্ব পর্যন্ত সকাল সন্ধ্যায় তাদেরকে জাহান্নামের আগুন দেখানোর মানসিক শাস্তি দেয়ার বিষয়টি সাধারণ পর্যায়ের কাফিরদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং সাধারণ পর্যায়ের কাফিররা কবরে ঘুমন্ত সদৃশ মৃত অবস্থায় আছে। এটি বুঝা যায়, ৩৬:৫১-৫২ আয়াতসহ বিভিন্ন আয়াতে সাধারণ কাফির ও অপরাধীদের প্রসঙ্গে থাকা উক্তি থেকে। নিম্নে ৩৬:৫৩-১-৫২ আয়াতের অনুবাদ উল্লেখ করা হলো:

৩৬:৫১-৫২ :: আর শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, তখনি তারা কবর থেকে তাদের প্রভুর দিকে বংশানুক্রমে ছুটে আসবে। তারা (কাফিরগণ) বলবে, ‘হায় আমাদের দুর্ভোগ! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উঠালো’? (তাদেরকে বলা হবে) ‘এটা তো তা যার ওয়াদা পরম করুনাময় করেছিলেন এবং রাসূলগণ সত্য বলেছিলেন’।

ক্বিয়ামাত

ইয়াওমুল ক্বিয়ামাত অর্থ হলো ‘জবাবদিহিতার জন্য দণ্ডায়মান হওয়ার দিন’। মানুষের শেষ বিচারের জন্য বর্তমান আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে মহাপ্রলয়ের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়ে আবার নতুন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তাতে মানুষের পুনরুত্থান ও বিচারের মাধ্যমে তাকে পুরস্কার বা শাস্তি প্রদানের পুরো সময়কালকে ইয়াওমুল ক্বিয়ামাত বলা হয়। যেসব আয়াতে ইয়াওমুল ক্বিয়ামাত শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ:

২:৮৫, ২:১১৩, ২:১৭৪, ২:২১২, ৩:৫৫, ৩:৭৭, ৩:১৬১, ৩:১৮০, ৩:১৮৫, ৩:১৯৪, ৪:৮৭, ৪:১০৯, ৪:১৪১, ৪:১৫৯, ৫:১৪, ৫:৩৬, ৫:৬৪, ৬:১২, ৭:৩২, ৭:১৬৭, ৭:১৭২, ১০:৬০, ১০:৯৩, ১১:৬০, ১১:৯৮, ১১:৯৯, ১৬:২৫, ১৬:২৭, ১৬:৯২, ১৬:১২৪, ১৭:১৩, ১৭:৫৮, ১৭:৬২, ১৭:৯৭, ১৮:১০৫, ১৯:৯৫, ২০:১০০, ২০:১০১, ২০:১২৪, ২১:৪৭, ২২:৯, ২২:১৭, ২২:৬৯, ২৩:১৬, ২৫:৬৯, ২৮:৪১, ২৮:৪২, ২৮:৬১, ২৮:৭১, ২৮:৭২, ২৯:১৩, ২৯:২৫, ৩২:২৫, ৩৫:১৪, ৩৯:১৫, ৩৯:২৪, ৩৯:৩১, ৩৯:৪৭, ৩৯:৬০, ৩৯:৬৭, ৪১:৪০, ৪২:৪৫, ৪৫:১৭, ৪৫:২৬, ৪৬:৫, ৫৮:৭, ৬০:৩, ৬৮:৩৯, ৭৫:১, ৭৫:৬।

সায়াত (ঘণ্টা, শেষ ঘণ্টা, প্রলয়কাল)

মহাপ্রলয় বুঝাতে কুরআনে সাধারণত ‘সায়াত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ‘সায়াত’ শব্দের অর্থ হলো ‘ঘণ্টা’। কিন্তু শব্দটি ‘শেষ ঘণ্টা’ বুঝাতে বহুল প্রচলিত। কুরআনে ‘ঘণ্টা’ এবং ‘শেষ ঘণ্টা তথা মহাপ্রলয়কাল’ উভয়টির জন্য সায়াত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ‘সায়াত’ শব্দটি মোট ৪৮ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। তা নিম্নরূপ:

৬:৩১:১০, ৬:৪০:৯, ৭:৩৪:৯, ৭:১৮৭:৩, ৯:১১৭:১১, ১০:৪৫:৭, ১০:৪৯:২০, ১২:১০৭:১০, ১৫:৮৫:১০, ১৬:৬১:২১, ১৬:৭৭:৭, ১৮:২১:১০, ১৮:৩৬:৩, ১৯:৭৫:১৮, ২০:১৫:২, ২১:৪৯:৭, ২২:১:৭, ২২:৭:২, ২২:৫৫:১০, ২৫:১১:৩, ২৫:১১:৭, ৩০:১২:৩, ৩০:১৪:৩, ৩০:৫৫:৩, ৩০:৫৫:৯, ৩১:৩৪:৫, ৩৩:৬৩:৪, ৩৩:৬৩:১৩, ৩৪:৩:৬, ৩৪:৩০:৮, ৪০:৪৬:৮, ৪০:৫৯:২, ৪১:৪৭:৪, ৪১:৫০:১৪, ৪২:১৭:১০, ৪২:১৮:১৯, ৪৩:৬১:৩, ৪৩:৬৬:৪, ৪৩:৮৫:১১, ৪৫:২৭:৭, ৪৫:৩২:৭, ৪৫:৩২:১৫, ৪৬:৩৫:১৯, ৪৭:১৮:৪, ৫৪:১:২, ৫৪:৪৬:২, ৫৪:৪৬:৪, ৭৯:৪২:৩।

সায়াত বা মহাপ্রলয় প্রসঙ্গে কুরআনের মৌলিক তথ্য হলো, মহাপ্রলয় অবশ্যই ঘটবে, এটি আল্লাহর প্রতিশ্রুত বিষয়। মহাপ্রলয়ের মাধ্যমে মহাকাশ ও বিশ্ব ধ্বংস করে দিয়ে তারপর আবার নতুন মহাকাশ ও বিশ্ব সৃষ্টি করা হবে, মানুষের শেষ বিচার সংঘটনের জন্য। মহাপ্রলয়ের নির্দিষ্ট সময একমাত্র আল্লাহর জানা আছে, তিনি তা প্রকাশ করেননি। মহাপ্রলয় নিকটবর্তী। তবে রসূল জানেন না তা কি অতি নিকটবর্তী নাকি এটা কিছুটা দূরে রাখা হয়েছে। মহাপ্রলয় চোখের পলকের ন্যায় আকস্মিকভাবে এসে পড়বে বা শুরু হয়ে যাবে ইত্যাদি।

ক্বিয়ামাতের আলামাত

ক্বিয়ামাতের আলামাত সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ের কথা বলা হয়। কুরআনে ক্বিয়ামাতের এসব আলামাতের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি, বরং ক্বিয়ামাতের বিষয় লোকেরা আগে থেকে টের পাবে না, বরং তা আকস্মিকভাবে সংঘটিত হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন আয়াত থেকে যেসব বিষয়কে ক্বিয়ামাতের দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

১। চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়া

২। বনী ইসরাইল পবিত্র ভূমিতে সমবেত হওয়া

৩। নবী ঈসার পুনরাগমন

৪। ইয়া’জুজ মা’জুজের মুক্তিলাভ ও পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া

৫। দাব্বাতাম মিনাল আরদ বা জমিন থেকে মানুষের সাথে কথা বলার মতো জন্তু বের হওয়া

৬। আকাশ ধোঁয়ায় ভরে যাওয়া

চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়া

৫৪:১-৩ :: মহাপ্রলয়কাল নিকটবর্তী হয়েছে এবং চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। আর যদি তারা কোনো নিদর্শন দেখে, তারা (সেটার শিক্ষা থেকে) বিমুখ থাকে এবং বলে, এটা চিরাচরিত যাদু/সম্মোহন/মোহাবিষ্ট হওয়ার মতো বিষয়। আর তারা (সঠিক তাৎপর্যকে) মিথ্যা সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। অথচ প্রত্যেকটি বিষয়ের জন্য নির্দিষ্ট কাল রয়েছে।

আলোচনা: আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। সাধারণত দাবি করা হয় যে, কাফিরদের জবাবে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ মু’জিজাস্বরূপ তাঁর আঙ্গুলের ইশারায় চন্দ্রকে বিদীর্ণ করেছেন। কিন্তু আয়াতে কাফিরদের দাবির প্রেক্ষিতে এটি ঘটানোর বিষয় উল্লেখ করা হয়নি এবং এটি মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ঘটিয়েছেন বা মু’জিজাস্বরূপ ঘটিয়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয়নি। বরং কুরআনের অন্যান্য আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে শুধুমাত্র একটি মু’জিজা দেয়া হয়েছে, আর তা হলো ‘আল কুরআন’। তাঁর জন্য মু’জিজা হিসেবে এটাকেই যথেষ্ট বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাঁর কাছে কাফিররা উপর্যুপরি বিভিন্ন মু’জিজা দাবি করলেও তাঁকে অন্য কোনো মু’জিজা দেয়া হয়নি (৫) । সুতরাং চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনাটি একটি নিদর্শন হলেও এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে সংঘটিত হয়েছে, এটি মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ কর্তৃক কোনো মু’জিজা প্রদর্শন হিসেবে সংঘটিত হয়নি। চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার প্রকৃত স্বরূপ কী, তা আমরা জানি না। হতে পারে, বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে এ সম্পর্কে কখনো জানা যাবে।

(৫) প্রাসঙ্গিক আয়াত ২৯:৫০-৫১, ৭:২০৩, ১৭:৯০-৯৪, ১৭:৫৯।

বনী ইসরাইল পবিত্র ভূমিতে একত্র হওয়া

১৭:১০৪ :: ইহার পর (ফিরআউন ও তার সঙ্গীদেরকে পানিতে ডুবিয়ে মারার পর) আমি বনী ইসরাইলকে বলেছি, “তোমরা পৃথিবীতে বসবাস করো। তারপর যখন আখিরাতের ওয়াদা এসে যাবে, তখন আমি তোমাদেরকে মিশ্র জোট আকারে নিয়ে আসবো”।

আলোচনা: আয়াতটিতে ফিরআউনকে ডুবিয়ে মারার পর বনী ইসরাইলকে যে নির্দেশ দেয়া ও তথ্য জানানো হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়েছে। তাদেরকে জানানো তথ্যটি হলো, যখন আখিরাতের ওয়াদা এসে যাবে তখন তাদেরকে মিশ্র জোট আকারে নিয়ে আসা হবে। এতে তাদেরকে মহাপ্রলয়ের আগে কোনো প্রতিশ্রুত ভূমিতে একত্রিত করার বিষয়টি নির্দিষ্ট করা হয়নি। এতে তাদেরকে মহাপ্রলয়ের পর আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার জন্য একত্রিত করার বিষয়টি বুঝারও অবকাশ আছে। আবার তারা মহাপ্রলয়ের পূর্বে কোনো একটি ভূখণ্ডে একত্রিত হওয়ার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত থাকা সম্ভব। কিন্তু এটাকে কিয়ামাতের লক্ষণ হিসেবে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি এবং তারা কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে বা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে এরূপ কোনো কথাও জানানো হয়নি। সুতরাং তারা যদি কোনো ভূখণ্ডে একত্রিত হয় এবং তা যদি এ আয়াতের একটি তাৎপর্য হয়, তাহলে তা একটি পূর্বঘোষিত বিষয়। কিন্তু সেটাকে কিয়ামাতের লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে বলে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়নি।

নবী ঈসা কি এখনো জীবিত এবং তাঁর পুনরাগমন কি ক্বিয়ামাতের আলামত?

এ বিষয়ে ৪:১৫৯ এবং ৪৩:৬১ আয়াতকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয় এবং বলা হয় যে, ৪:১৫৭-১৫৮ আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী নবী ঈসা মৃত্যুবরণ করেননি বরং আল্লাহ তাঁকে স্বশরীরে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং তিনি সেখানে আছেন এবং কিয়ামাতের আগে আসমান থেকে তিনি নেমে আসবেন তথা তাঁর পুনরায় আগমন ঘটবে এবং তাঁর পুনরাগমনের পরে ও তাঁর মৃত্যুর আগে সকল আহলে কিতাব তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং পুনরাগমনের মাধ্যমে তিনি হবেন কিয়ামাতের একটি নিশ্চিত আলামত।

৪:১৫৭-১৫৮ আয়াত বুঝার জন্য প্রথমে একই বিষয় সম্বলিত ৩:৫৫ আয়াতটি অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। আর ৩:৫৫ আয়াতের বক্তব্য সঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য ৫:১১৬-১১৭ আয়াত অধ্যয়ন করা জরুরি। তাই নিম্নে এ আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হলো।

৩:৫৫ :: যখন আল্লাহ বললেন, “হে ঈসা, নিশ্চয় আমি তোমার ওফাত (মৃত্যু) ঘটাবো এবং আমার দিকে সমুত্থান করবো (আমি তোমাকে আমার দিকে উঠিয়ে নিবো, উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করবো), এবং যারা কুফর করেছে তাদের থেকে তোমাকে পরিচ্ছন্ন করবো এবং যারা তোমার অনুসরণ করেছে তাদেরকে যারা কুফর করেছে তাদের তুলনায় ক্বিয়ামাত দিবস পর্যন্ত উপরে রাখবো। তারপর আমারই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল, তারপর তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করতে আমি সেই বিষয়ে তোমাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেবো।

৫:১১৬-১১৭ :: আর উল্লেখ্য, যখন আল্লাহ বলবেন, হে ঈসা ইবনে মারইয়াম, তুমি কি মানুষকে বলেছিলে, “আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার মাকেও দুই ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করো”? সে বলবে, “পবিত্রতা আপনার জন্য, এটা আমার জন্য সঙ্গত হতো না যে আমি বলবো যা বলার কোনো অধিকার আমার নেই। যদি আমি তা বলতাম, তবে আপনি তা জানতেন। আমার নিজের মধ্যে যা আছে তা আপনি জানেন। আর আপনার নিজের মধ্যে যা আছে আমি তা জানি না। নিশ্চয় আপনি গায়েবের বিষয়সমূহ পরিজ্ঞাত। আমি তাদেরকে কিছু বলিনি, আপনি আমাকে যা বলার জন্য আদেশ করেছেন তা ছাড়া। (আমার সেই কথা ছিলো) এ মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত (দাসত্ব-উপাসনা) করো, যিনি আমারও প্রভু এবং তোমাদেরও প্রভু’। আর আমি তাদের উপর সাক্ষী ছিলাম যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম। তারপর যখন আপনি আমার ওফাত (মৃত্যু) ঘটালেন, আপনিই ছিলেন তাদের উপর পর্যবেক্ষক। আর আপনি সকল বিষয়েই সাক্ষী”।

উপরোল্লেখিত দুটি আয়াতে নবী ঈসার ওফাতের বিষয়টি এসেছে। ‘ওফাত’ হলো ‘মাওত’ (মৃত্যু) শব্দের সমার্থক। ব্যক্তির মৃত্যুবরণকে ‘মাওত’ বলে এবং ব্যক্তির মৃত্যু ঘটানোকে ‘ওফাত’ বলে। ৩:৫৫ আয়াতে ‘ওফাত’ বুঝানোর জন্য যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো ‘মুতাওয়াফফী’ (ওফাত সংঘটনকারী)। আয়াতটিতে রয়েছে আল্লাহ বলেছেন যে, আল্লাহ নবী ঈসার ওফাত সংঘটনকারী অর্থাৎ তিনি নবীর ঈসার ওফাত ঘটাবেন। আর ৫:১১৭ আয়াতে ‘ওফাত’ বুঝানোর জন্য যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো ‘তাওয়াফফায়তানী’ (আপনি আমার ওফাত ঘটিয়েছেন)। অর্থাৎ নবী ঈসা বলবেন যে, আল্লাহ তাঁর ওফাত ঘটিয়েছেন, আর এই ওফাত ঘটানোর পরের বিষয়ের জন্য তিনি সাক্ষী নন, বরং আল্লাহই সেটার পর্যবেক্ষক এবং আল্লাহ সকল বিষয়ে সাক্ষী।

৩:৫৫ আয়াতের ‘মুতাওয়াফফীকা’ এবং ৫:১১৭ আয়াতের ‘তাওফফায়তানী’ শব্দ দুটির অর্থ বুঝার জন্য আরবি ভাষারীতির কিছু তথ্য জেনে রাখা প্রয়োজন। নিম্নে এ বিষয়টি আলোচনা করা হলো।

‘মুতাওয়াফফী’ এবং ‘তাওয়াফফায়তানী’ শব্দগুলো ‘ওয়া ফা ইয়া মূল অক্ষরসমূহ থেকে গঠিত।

ওয়া ফা ইয়া’ মূল অক্ষরসমূহ থেকে ক্রিয়ারূপ ২ ফা’’য়ালা থেকে গঠিত মাসদার (ক্রিয়াবিশেষ্য) বাবে তাফয়ীল এর অর্থ হলো ‘পূর্ণমাত্রায় দেয়া’। এর কর্তারূপ হচ্ছে ‘মুওয়াফফি’ (১১:১০৯)। এ ক্রিয়ারূপ যেসব আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো- ২:২৭২, ২:২৮১, ৩:২৫, ৩:৫৭, ৩:১৬১, ৩:১৮৫, ৪:১৭৩, ৮:৬০, ১১:১৫, ১১:১১১, ১৬:১১১, ২৪:২৫, ২৪:৩৯, ৩৫:৩০, ৩৯:১০, ৩৯:৭০, ৪৬:১৯, ৫৩:৩৭।

আর ‘ওয়া ফা ইয়া’ মূল অক্ষরসমূহ থেকে ক্রিয়ারূপ ৫ তাফা’’য়ালা থেকে গঠিত মাসদার (ক্রিয়াবিশেষ্য) বাবে তাফা’’উল এর অর্থ হলো ‘মৃত্যু ঘটানো’। এর কর্তারূপ হচ্ছে ‘মুতাওয়াফফি’ (৩:৫৫)। এ ক্রিয়ারূপ যেসব আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো- ২:২৩৪, ২:২৪০, ৩:১৯৩, ৪:১৫, ৪:৯৭, ৫:১১৭, ৬:৬০, ৬:৬১, ৭:৩৭, ৭:১২৬, ৮:৫০, ১০:৪৬, ১০:১০৪, ১২:১০১, ১৩:৪০, ১৬:২৮, ১৬:৩২, ১৬:৭০, ২২:৫, ৩২:১১, ৩৯:৪২, ৪০:৬৭, ৪০:৭৭, ৪৭:২৭।

৩:৫৫ আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ নবী ঈসাকে জানিয়েছেন যে, তিনি নবী ঈসার ওফাত ঘটাবেন এবং নবী ঈসাকে তাঁর দিকে সমুত্থিত করবেন বা উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করবেন। আবার উল্লেখ্য যে, এখানে প্রথমে ওফাত ঘটানোর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে এবং তারপরে নবী ঈসাকে আল্লাহর দিকে উঠিয়ে নেয়ার বা উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। যার অর্থ হলো, তাঁকে ওফাতের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে উঠিয়ে নেয়া হবে বা উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হবে। এর মাধ্যমে তাঁকে কাফিরদের থেকে নিষ্কলংক করা হবে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তাঁকে কাফিরদের বিভিন্ন অভিযোগ থেকে নিষ্কলংক করা হবে । ৪:১৫৭-১৫৮ আয়াতেও এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। তা থেকে বুঝা যায় যে, কাফিররা চেয়েছিলো তাঁকে সাধারণভাবে বা শুলে চড়িয়ে হত্যা করবে। কিন্তু  তারা তাঁকে সাধারণভাবে বা শুলে চড়িয়ে হত্যা করতে পারেনি। বরং আল্লাহ তাঁকে নিজের দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে স্বাভাবিক মৃত্যু দিয়েছেন, তিনি হত্যার কারণে বা শুলে চড়িয়ে হত্যার কারণে মৃত্যুবরণ করেননি। অন্যান্য আয়াত (২:৮৭, ২:২৫৩, ৫:১১০) থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তাঁকে রুহুল কুদস তথা জিবরীল ফেরেশতার (১৬:১০২)  দ্বারা শক্তি যুগিয়েছেন তথা সাহায্য করেছেন। আর এসবের মধ্যে এমন একটি বিষয়ও ঘটেছে যে, লোকেরা নবী ঈসাকেই শুলে চড়িয়ে হত্যা করেছে বলে যে রটনা বা প্রচারণা চালিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তা সঠিক ছিলো না।

৫:১১৬-১১৭ আয়াত থেকে জানা যায় যে, ক্বিয়ামাত দিবসে আল্লাহর করা প্রশ্নের জবাবে নবী ঈসা জানাবেন যে, তিনি তাদেরকে ত্রিত্ববাদের তথা আল্লাহকে ছাড়াও তাঁকে ও তাঁর মাকে ইলাহ বানিয়ে নেয়ার কথা বলেননি। এ বিষয়টি যদি ঘটে তা তাঁর ওফাতের পরের ঘটনা, যে বিষয়ে তিনি সাক্ষী নন। তিনি তো তাদের সাক্ষী ছিলেন যতদিন তিনি তাদের মধ্যে ছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁর ওফাত ঘটানোর পরে তারা কী করেছে সে বিষয়ে তিনি সাক্ষী নন।

৫:১১৬-১১৭ আয়াতের বক্তব্য অনুসারে রসূলুল্লাহ ঈসার ওফাত ইতোমধ্যে হয়ে গেছে এবং ওফাতের পরবর্তীতে তিনি পৃথিবীতে পুনরাগমনের ধারণা একটি ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। কারণ যদি তিনি মৃত্যুর পর তিনি পৃথিবীতে পুনরাগমন করেন তাহলে তাঁর এই বক্তব্য যথাযথ বক্তব্য হতে পারতো না।

৩:৫৫ আয়াতে উল্লেখিত “ইন্নী মুতাওয়াফফীকা ওয়া রফিউকা (নিশ্চয় আমি তোমার ওফাত ঘটাবো এবং তোমাকে আমার দিকে সমুত্থিত করবো) এবং ৪:১৫৮ আয়াতে উল্লেখিত “বার রফায়াল্লাহু ইলাইহি” (বরং আল্লাহ তাকে তাঁর দিকে সমুত্থিত করেছেন) বাক্য দুটির অর্থ হলো- আল্লাহ সম্মানজনক মৃত্যু দেয়ার মাধ্যমে রসূলুল্লাহ ঈসাকে তাঁর দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন/ উপরে উঠিয়েছেন/ উচ্চমর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯:৫৭ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা নবী ইদরীসকে “মাকানান আলিয়্যান বা উচ্চস্থানে রফা/ সমুত্থিত করেছেন। এর দ্বারা যেমন আল্লাহ নবী ইদরীসকে মৃত্যু দেয়া ছাড়াই আকাশে তুলে নেয়া বুঝায় না, বরং উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করা বুঝায়, তেমনি নবী ঈসাকেও ‘আল্লাহর দিকে সমুত্থিত করা’ বলতে তাঁকে আল্লাহর নৈকট্য তথা অনুগ্রহমূলক অবস্থানের দিকে, সম্মানজনক অবস্থানের দিকে সমুত্থিত করাকে বুঝানো হয়েছে।

৩৭:৯৯ আয়াতে নবী ইবরাহীম (সালামুন আলাইহি) এর উক্তি উল্লেখিত হয়েছে যে, “ওয়া ক্বলা, ইন্নী যাহিবুন ইলা রব্বী, ছাইয়াহদীনি। অর্থাৎ “সে (ইবরাহীম) বললো, ‘আমি আমার রবের দিকে গমনকারী, তিনি শীঘ্রই আমাকে পথ দেখাবেন’”। ‘ইলাল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর দিকে’ বলতে বুঝায় ‘আল্লাহর পছন্দনীয় ব্যবস্থার অনুবর্তিতার দিকে, আল্লাহর নৈকট্য সন্ধানের দিকে’। সুতরাং “বার রফায়াল্লাহু ইলাইহি” (৪:১৫৮) এর অর্থ এ নয় যে, আল্লাহর দিকে উঠিয়ে নেয়ার জন্য মৃত্যু ছাড়াই নবী ঈসাকে সশরীরে আকাশে তুলে নিতে হবে। বরং আগেই বলা হয়েছে তাকে ওফাত / মৃত্যু দেয়া হবে এবং তারপর বলা হয়েছে রফা/ উপরে উঠিয়ে নিয়েছেন (৩:৫৫)। সুতরাং আল্লাহ ইতোমধ্যে নবী ঈসাকে যেমন রফা’ (সমুত্থিত) করেছেন, তেমনি ওফাত বা মৃত্যুও ঘটিয়েছেন।

একটি দাবি করা হয় যে, নবী ঈসার ওফাত হয়েছে কিন্তু মাওত বা মৃত্যু হয়নি। যদি ওফাত ও মাওত আলাদা হয়, তাহলে ওফাত শব্দ প্রয়োগকৃত সবগুলো আয়াতে সেই অর্থই প্রয়োগ করতে হবে, যে অর্থ ঈসার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে। অথবা নবী ঈসার ক্ষেত্রে ওফাত শব্দটি মৃত্যু অর্থে ব্যবহার না করার প্রমাণ হিসেবে সুনিশ্চিত তথ্য উপস্থাপন করতে হবে।

১৯:৩৩ আয়াতে নবী ঈসার উক্তি হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে 'ওয়া ইয়াওমা আমূতু' অর্থাৎ “যেদিন আমি (ঈসা) মাওত বরণ করবো”। ৩:১৪৪, ৩:১৫৬, ৩:১৫৭, ৩:১৫৮ আয়াত অনুযায়ী ওফাত হওয়ার দুইভাবের যে কোনো একভাবে ওফাত হতে পারে, যথা ক্বাতল বা নিহত হওয়া এবং মাওত বা স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়া। ৩:১৪৪ অনুযায়ী মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহর পূর্ববর্তী সকল রসূল খালাত/ গত হয়েছেন, হয় ক্বাতলের মাধ্যমে, না হয় মাওতের মাধ্যমে। যাদেরকে আল্লাহর পথে থাকায় ক্বাতল করা হয় তাদেরকে মাওতের সাথে সম্পর্কিত না করে আলাদাভাবে বলা হয় (৩:১৬৯), সেটি একটি ভিন্ন ও বিশেষ প্রসংগ, যাতে বলা হয়েছে যে, তারা অন্যান্য মৃতদের মতো মৃত নয়, বরং তারা জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত, অবশ্য বারযাখ বা অন্তরালের (ভিন্ন ডাইমেনশনে থাকার) কারণে আমরা তা অনুভব করা সম্ভব নয়।

৩:৫৫, ৫:১১৬-১১৭, ৩:১৪৪ ও ১৯:৩৩ আয়াতগুলোর সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, মাওতের (স্বাভাবিক মৃত্যুবরণের) মাধ্যমে রসূলুল্লাহ ঈসার ওফাত হয়েছে এবং ওফাত পরবর্তীতে তিনি পুনরায় পৃথিবীতে আগমনের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে একটি ভ্রান্ত মতবাদ।

রসূলুল্লাহ ঈসা যে ক্বিয়ামাতের আগে আর পৃথিবীতে ফিরে আসবেন না তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ হচ্ছে-

(১) ৫:১১৬-১১৭ আয়াতে বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী ঈসার ওফাতের পর যারা তাঁকে ও তাঁর মাকে ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে (ত্রিত্ববাদ), এ বিষয়টি ঈসার ওফাতের পরের ঘটনা, যে বিষয়ে তিনি স্বাক্ষী নন। যদি তিনি আবার আসেন তবে তাঁর এ জবাব মিথ্যা হয়ে যায়, কারণ ওফাতের পর তিনি আবার এসে এ বিষয়ে স্বাক্ষী হয়ে যান। অথচ আল্লাহ তাঁর জবাবকে যেভাবে উল্লেখ করেছেন তাতে তাঁর জবাব যথাযথ গ্রহণযোগ্য তথা সত্য। তাই তিনি যে আবার আসবেন না তা প্রমাণিত।

(২) কুরআনের একটি আয়াতও নেই যাতে বলা হয়েছে তিনি আবার আসবেন।

(৩) ৫:১১০ আয়াতে আল্লাহ নবী ঈসাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন বলে উল্লেখ করবেন তার মধ্যে আছে তাওরাত ও ইনজীল, যেমন ৩:৪৮ আয়াতেও সুসংবাদ উল্লেখিত হয়েছিল। যদি ঈসা আবার আসেন তাহলে তিনি কুরআনও শিক্ষা পাওয়ার কথা। কিন্তু তা নেই। সুতরাং তিনি আবার আসার ধারণাটি কুরআন দ্বারা সমর্থিত নয়।

(৪) ১৯:১৫ ও ১৯:৩৩ আয়াত অনুযায়ী নবী ইয়াহইয়া ও নবী ঈসার প্রতি তাঁদের জন্মদিন, মৃত্যুদিন ও (মৃত্যু পরবর্তী) পুনরুত্থান দিবসে সালাম / শান্তি। যদি তাঁরা বা তাঁদের একজন আবার পৃথিবীতে আসেন, তবে এখানে সেই পৃথিবীতে দ্বিতীয় আগমনের দিনও সালাম হওয়ার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব হতে পারতো বা তাঁকে এ বিষয়টিও উল্লেখের মাধ্যমে একবার ওফাতের পরে পৃথিবীতে তাঁর পুনরায় আগমনকে সমর্থন জ্ঞাপন করা যেতো। কিন্তু তা করা হয় নি। আবার অন্য কোনো আয়াতেও তিনি পৃথিবীতে আবার ফিরে আসবেন বলে জানানো হয়নি। সুতরাং তাঁর ওফাতের পরে পৃথিবীতে তাঁর পুনরায় আসার ধারণাটি কুরআন সমর্থিত নয়।

(৫) যদি তিনি পৃথিবীতে আবার ফিরে আসেন তবে মুহাম্মাদ (সালামুন আলাইহি) শেষ নবী না হয়ে তিনি শেষ নবী হয়ে যান। এর মাধ্যমে কুরআনের ঘোষনা অকার্যকর হয়ে যায়, যা অসম্ভব। সুতরাং তিনি আর আসবেন না।

(৬) বলা হয়, তিনি আসবেন নবী মুহাম্মাদের উম্মাত হয়ে। কিন্তু কুরআন অনুযায়ী উম্মাত হয় আদর্শভিত্তিক, যেমন উম্মাতান ওয়াসাতান (মধ্যমপন্থী/ভারসাম্যপূর্ণ নীতির অনুসারী উম্মাহ), উম্মাতান মুসলিমাতান (আল্লাহর প্রতি আ্ত্মসমর্পিত উম্মাহ) ইত্যাদি। কিন্তু উম্মাতে মূসা, উম্মাতে ঈসা, উম্মাতে মুহাম্মাদ এসব হচ্ছে কুরআন বিরোধী ধারণা। এছাড়া যদি তিনি নবী হিসেবে না এসে সাধারণ মানুষ হিসেবে আসেন তবে এটা তাঁর প্রমোশন না ডিমোশন? বলা হয়, এখনকার সাধারণ মুসলমানের সম্মান মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর আগের নবীদের চেয়ে বেশি। অথচ কুরআন অনুযায়ী, নবীদের মধ্যে পার্থক্য করা যাবে না। জন্মের মধ্যে কোন শ্রেষ্ঠত্ব অশ্রেষ্ঠত্বের কিছু নেই। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পথ হচ্ছে কর্ম। আর নবীদের শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে তারা আল্লাহ কর্তৃক সরাসরি মনোনীত (মুস্তফা) বিধায়। সারকথা হচ্ছে নবী ঈসা আবার আসা তাঁর নবুয়াতি মর্যাদার খেলাফ। সুতরাং তিনি আর আসার ধারণাটি সত্য নয়।

(৭) নবী ঈসার পুনরাগমন সম্পর্কিত উপকথাসমূহে তিনি পৃথিবীতে আবার ফিরে এসে যেভাবে অলৌকিক শক্তিবলে শুধু চোখ দিয়ে তাকালেই যতদূর তাঁর চোখ যাবে ততদূরের সব ইহুদি পানিতে লবণ গলে যাবার ন্যায় গলে যাবে বলে গালগল্প প্রচলিত আছে, কুরআনে শত্রুদের মোকাবেলার জন্য এরূপ কোনো দৃষ্টান্ত ও নির্দেশনা নেই। বরং এতে সাধ্যমতো প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে, বাস্তব যুদ্ধকৌশল এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত ন্যায়নীতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং জানানো হয়েছে যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ মৃত্যুবরণ বা নিহত হলেও মু’মিনরা পিছনে ফিরে যেতে পারবে না। তার মানে মু’মিনরা কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে যেতে হবে। এছাড়া রসূলুল্লাহ ঈসা সম্পর্কে যে যুদ্ধপদ্ধতি অবলম্বনের কথা বলা হয়, তাঁর সমকালেও তিনি হাওয়ারীদেরকে নিয়ে এরূপ কোনো যুদ্ধপদ্ধতি অবলম্বন করেননি। সুতরাং এভাবে সকল ইহুদিকে অলৌকিক শক্তিবলে হত্যা করে বিশ্বব্যাপী ইসলাম কায়েমের জন্য নবী ঈসাকে আবার পৃথিবীতে ফেরত পাঠানোর ধারণা কুরআনের শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, একদিকে এসব উপকথায় বলা হয় যে, নবী ঈসা ক্বিয়ামাতের আগে পৃথিবীতে আবার ফিরে এসে চোখের দৃষ্টি দিয়ে সব ইহুদিকে পানিতে লবণ গলে যাওয়ার মতো করে গলিয়ে ফেলবেন এবং মুসলিমরাও তাদেরকে কচুকাটা করবে আর পাহাড়, টিলা, গাছ, দেয়াল সবকিছু তাদেরকে বলে দেবে কোথায় ইহুদিরা লুকিয়ে আছে। অন্যদিকে বলা হচ্ছে যে, ইহুদিরা সবাই তখন নবী ঈসার প্রতি ঈমান আনবে। এ দুটি কথার মধ্যে যে স্ববিরোধ রয়েছে তাও ধারণাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

(৮) মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পর আর আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত কোনো নবী বা রসূল নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর মধ্য থেকে তাদের পরামর্শের মাধ্যমে দায়িত্বপ্রাপ্ত উলিল আমরই কুরআন বিধান অনুযায়ী ও নির্বাহী ক্ষেত্রে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মুসলিম উম্মাহকে পরিচালনা করবেন। এ বিষয়টিও প্রমাণ করে যে, ঈসা নবীর পুনরাগমনসহ তথাকথিত বারো ইমামের শেষ ইমাম হিসেবে ইমাম মেহেদি সম্পর্কিত দর্শন এবং সর্বকালের সর্বসেরা কাফির অলৌকিক শক্তিপ্রাপ্ত দাজ্জালের কাহিনীর কোনো বাস্তবতা নেই।

নবী ঈসার পুনরাগমনের তথ্যসূত্র হিসেবে উপস্থাপিত আয়াতসমূহের (৪:১৫৯, ৪৩:৬১) তাৎপর্য

এ প্রসঙ্গে প্রথম তথ্যসূত্র হিসেবে ৪:১৫৯ আয়াতের উল্লেখ করা হয়। আয়াতটির তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য ৪:১৫৩-১৬২ আয়াত একসাথে অধ্যয়ন করতে হবে, যেন এর বক্তব্য প্রসঙ্গ (Context) এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে তা অনুধাবন করা যেতে পারে। কারণ আয়াতটিতে উল্লেখিত নামপুরুষ-পুংলিঙ্গ-একবচন এর সর্বনাম এবং ক্রিয়াপদের অর্থ অনুধাবনের জন্য এর পূর্বাপর আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়তে হবে।

৪:১৫৩ :: আহলে কিতাব তোমার নিকট চায় যে, আকাশ থেকে তুমি তাদের উপর একটি কিতাব নাযিল করো। অথচ তারা মূসার কাছে এর চেয়ে বড় কিছু চেয়েছিল, যখন তারা বলেছিল, ‘আমাদেরকে প্রকাশ্যে আল্লাহকে দেখাও’। ফলে তাদেরকে তাদের অন্যায়ের কারণে বজ্র পাকড়াও করেছিল। অতঃপর তারা বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করলো, তাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণসমূহ আসার পরও। তারপর আমি তা ক্ষমা করে দিয়েছিলাম এবং মূসাকে দিয়েছিলাম সুস্পষ্ট প্রমাণ।

৪:১৫৪ :: আর তাদের অঙ্গীকার গ্রহণের জন্য তূরকে তাদের উপর তুলে ধরেছিলাম এবং তাদেরকে বলেছিলাম, ‘দরজায় প্রবেশ কর সাজদাহ-অবনত হয়ে’। তাদেরকে আমি আরও বলেছিলাম, ‘বিশ্রাম দিবস (শনিবার) এর বিধি-বিধানের সীমালঙ্ঘন করো না’ এবং আমি তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলাম।

৪:১৫৫ :: অতঃপর তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে এবং আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফর করার কারণে এবং অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যা করার কারণে এবং এ কথা বলার কারণে যে, ‘আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত’। বরং আল্লাহ তাদের কুফরের কারণে অন্তরের উপর মোহর এঁটে দিয়েছিলেন। সুতরাং স্বল্পসংখ্যক ছাড়া তারা ঈমান আনবে না।

৪:১৫৬ :: এবং তাদের কুফরের কারণে এবং মারইয়ামের উপর অতি বড় অপবাদ দেয়ার কারণে।

৪:১৫৭ :: এবং তাদের এ কথার কারণে যে, ‘আমরা আল্লাহর রাসূল মারইয়াম পুত্র ঈসা মাসীহকে হত্যা করেছি’। অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি এবং তাকে শূলেও চড়ায়নি। বরং তাদের জন্য (এর) সদৃশ করা হয়েছিল। আর নিশ্চয় যারা তাতে মতবিরোধ করেছিল, অবশ্যই তারা তার ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে ছিল। ধারণার অনুসরণ ছাড়া এ ব্যাপারে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করেনি।

৪:১৫৮ :: বরং আল্লাহ তাকে তাঁর দিকে (আল্লাহর দিকে, তাঁর নৈকট্য ও অনুগ্রহমূলক অবস্থানের দিকে) সমুত্থিত করেছেন (মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন)। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।

৪:১৫৯ :: আর আহলে কিতাবের মধ্য থেকে কিছু নেই এ ছাড়া যে, সে অবশ্যই উহার প্রতি (ঈসা সম্পর্কিত প্রকৃত তথ্যের প্রতি) ঈমান আনবে তার (নিজের) মৃত্যুর পূর্বেই, এবং ক্বিয়ামাতের দিন সে (ঈমান আনা আহলে কিতাব) তাদের ব্যাপারে (অন্যান্য আহলে কিতাবের ব্যাপারে) সাক্ষী হবে।

৪:১৬০ :: সুতরাং ইয়াহূদীদের যুলমের কারণে আমি তাদের উপর উত্তম খাবারগুলো হারাম করেছিলাম, যা তাদের জন্য হালাল করা হয়েছিল এবং আল্লাহর পথ থেকে অনেককে তাদের বাধা প্রদানের কারণে।

৪:১৬১ :: আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল এবং অবৈধভাবে মানুষের সম্পদ খাওয়ার কারণে। আর আমি তাদের মধ্য থেকে কাফিরদের জন্য প্রস্তুত করেছি যন্ত্রণাদায়ক আযাব।

৪:১৬২ :: কিন্তু তাদের মধ্যে যারা জ্ঞানে পরিপক্ক তারা এবং মু’মিনগণ তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে আর তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে আর তারা নামায প্রতিষ্ঠাকারী ও যাকাত আদায়কারী এবং আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাসী; এদেরকেই আমি শীঘ্র মহাপুরস্কার দান করবো।

আলোচনা: ৫:১১৬-১১৭ আয়াত অনুযায়ী রসূলুল্লাহ ঈসা শুধুমাত্র তাঁর সমকালের তথা তাঁর ওফাত পূর্ববর্তীদের বিষয়ে সাক্ষী হবেন, তাঁর পরবর্তীকালের আহলে কিতাবের বিষয়ে তিনি সাক্ষী হবেন না। ১৬:৮৯ আয়াত অনুযায়ীও প্রত্যেক উম্মাতের মধ্য থেকে তাদের সমকালীন ব্যক্তিই সাক্ষী হিসেবে উত্থিত হবে। সুতরাং ৪:১৫৯ আয়াতে যে সাক্ষীর বিষয় বলা হয়েছে তিনি নবী ঈসা নন, বরং আয়াতটিতে আহলে কিতাবের মধ্য থেকে যে কেউ ঈমান আনবে তাকেই অন্যদের জন্য সাক্ষী হিসেবে অন্যদের জন্য উপস্থাপিত করা হবে মর্মে ব্যক্ত করা হয়েছে।

৪:১৫৩ আয়াতে আহলে কিতাব কর্তৃক মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর কাছে পেশকৃত দাবির জবাবে যে বক্তব্যধারা শুরু হয়েছে তার ধারাবাহিকতায় আহলে কিতাবের অতীতের বিভিন্ন বিষয়ের পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে। ৪:১৫৭-১৫৮ আয়াত অনুযায়ী যারা রসূলুল্লাহ ঈসাকে হত্যার দাবি করেছে তারা বস্তুত তাঁকে সাধারণভাবেও হত্যা করেনি এবং শুলে চড়িয়েও হত্যা করেনি। বরং এ বিষয়ে একটি সাদৃশ্যাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে তারা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে মাত্র। আর অন্য যারা এ বিষয়ে মতভেদ করেছে তারাও নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে মতভেদ করেনি, বরং তারাও সন্দেহের মধ্যে ছিলো। কিন্তু প্রকৃত কথা হলো রসূলুল্লাহ ঈসাকে কোনোভাবে হত্যা করা হয়নি। বরং আল্লাহ তাঁকে স্বাভাবিক ওফাত দিয়েছেন।

৪:১৫৭-১৫৮ আয়াতের ধারাবাহিকতায় ৪:১৫৯ আয়াতে বলা হয়েছে যে, আহলে কিতাবের মধ্য থেকে কিছু আছে, যারা অবশ্যই নিজের মৃত্যুর পূর্বে ঈসা সম্পর্কিত প্রকৃত তথ্যের উপর তথা কুরআনে বর্ণিত তথ্যের উপর ঈমান আনবে। আর কুরআনে বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী, নবী ঈসা আল্লাহর একজন বান্দা ও রসূল এবং তিনি অন্যদের পাপ মোচনের জন্য শূলে চড়েননি বা আত্মাহুতি দেননি, বরং আল্লাহ তাঁকে স্বাভাবিকভাবে ওফাত দিয়েছেন।

৪:১৫৯ আয়াতের ব্ক্তব্য বুঝার জন্য নিম্নে ব্যাকরণগত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হলো:

“ওয়া ইন মিন আহলিল কিতাবি ইল্লা লাইউমিনান্না বিহী”

ওয়া = আর।

ইন … ইল্লা = নেই এছাড়া যে,।

মিন আহলিল কিতাবি = আহলে কিতাবের মধ্য থেকে কিছু।

লাইউ’মিনান্না = সে অবশ্যই ঈমান আনবে।

বিহী = উহার প্রতি।

এখানে, ‘উহার প্রতি’ বলতে বুঝাচ্ছে, পূর্বের দুটি আয়াতে উল্লেখিত নবী ঈসার সাথে সম্পর্কিত তথ্যের প্রতি।

সুতরাং আয়াতটিতে সকল আহলে কিতাবই ঈমান আনবে এ কথা বলা হয়নি। এছাড়া এর পূর্ববর্তী ৪:১৫৫ আয়াতেই বলা হয়েছে যে, “ফালা ইউ’মিনূনা ইল্লা ক্বালীলা” (সুতরাং তাদের অল্পসংখ্যক ছাড়া ঈমান আনবে না)। সুতরাং এ আয়াতটিতে ঐ অল্পসংখ্যকের বিষয়েই বক্তব্য রাখা হয়েছে যে, তারা নিজ নিজ মৃত্যুর পূর্বে ঈমান আনবে।

‘ক্বাবলা মাওতিহী” = তার মৃত্যুর পূর্বে = নিজের মৃত্যুর পূর্বে।

এতে নবী ঈসার পুনরাগমনের পরে তখন যেসব আহলে কিতাব থাকবে তারা নবী ঈসার মৃত্যুর পূর্বে নবী ঈসার উপর ঈমান আনবে এ কথা বলা হয়নি। কারণ কোনো আয়াতেই তাঁর পুনরাগমনের বিষয় নেই এবং আয়াতটিতে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর সমকালে তাঁর কাছে যেসব আহলে কিতাব দাবি জানিয়েছিলো আকাশ থেকে কিতাব নাযিলের জন্য তাদের সামনে বক্তব্য উপস্থাপন করা হচ্ছে এবং বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় ৪:১৬২ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তাদের মধ্যে কিছু ‘রাছিখূনা ফিল ইলম বা জ্ঞানে সুগভীর ব্যক্তি আছে যারা এ ধরনের দাবির সাথে সম্পর্ক রাখে না, বরং তারা কুরআনের প্রতি এবং কুরআনের পূর্ববর্তী নাযিলকৃত কিতাবের প্রতি ঈমান আনে বা আনবে।

ওয়া = আর।

ইয়াওমাল ক্বিয়ামাতি = ক্বিয়ামাত দিবসে।

ইয়াকূনূ = সে হবে = ঈমান আনা আহলে কিতাব হবে।

আলাইহিম = তাদের উপর = যারা আকাশ থেকে কিতাব নাযিলের দাবি জানিয়েছিলো সেই আহলে কিতাব এবং যারা নবী ঈসার বিষয়ে কুরআনে বর্ণিত তথ্যের উপর ঈমান আনে না সেই আহলে কিতাবের উপর।

শাহীদা = সাক্ষী।

এ বিশ্লেষণ সঠিক হওয়ার যুক্তিপ্রমাণ হলো ১৬:৮৯, ২:১৪৩ ও ৫:১১৬-১১৭ আয়াতসমূহ, যাতে সমকালীন ব্যক্তিদের বিষয়েই সাক্ষী হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

“ওয়া ইন্নাহু লাইলমু লিস সায়াত (আর নিশ্চয় তা মহাপ্রলয়ের জ্ঞান)

নবী ঈসা ক্বিয়ামাতের আগে পৃথিবীতে ফিরে আসাকে ক্বিয়ামাতের আলামত হিসেবে যে আয়াতটিকে সরাসরি দলীল হিসেবে তুলে ধরা হয় তা হলো ৪৩:৬১। আয়াতটির প্রকৃত তাৎপর্য জানার জন্য তার পূর্বাপর যে আয়াতসমূহে নবী ঈসা ও সায়াত বা মহাপ্রলয় সম্পর্কিত আলোচনাটি উপস্থাপিত হয়েছে তা একসাথে অধ্যয়ন করতে হবে। আর তা হলো ৪৩:৫৭-৬৬ আয়াত।

৪৩:৫৭ :: যখন ইবনে মারইয়ামকে (অর্থাৎ ঈসাকে বা ঈসার বিষয়কে) (জনতার) সামনে উপস্থাপন করা হলো (দুরিবা-ব্নু মারইয়ামা) দৃষ্টান্তরূপে, তখনি তোমার সম্প্রদায় সেই প্রেক্ষিতে হট্টগোল করতে লাগলো।

৪৩:৫৮ :: আর তারা বললো, “আমাদের ইলাহগণ উত্তম, নাকি সে?” নিছক তর্কের জন্য ছাড়া তারা তোমার সামনে তাকে (অর্থাৎ তার বিষয়কে) উপস্থাপন করে নি (মা দরাবূহু)। বস্তুত তারা ঝগড়াটে সম্প্রদায়।

৪৩:৫৯ :: সে (ঈসা) তো একজন বান্দা ছাড়া অন্যরূপ নয়, আমি তাকে নিয়ামাত দান করেছিলাম এবং তাকে বানী ইসরাইলের জন্য দৃষ্টান্ত (মাছাল) বানিয়েছিলাম।

৪৩:৬০ :: আর যদি আমি ইচ্ছা করতাম তাহলে তাদের পরিবর্তে ফেরেশতাদেরকে নিযুক্ত করতে পারতাম, পৃথিবীতে যারা (তোমাদের) ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ত হতো।

৪৩:৬১ :: আর নিশ্চয় তা মহাপ্রলয়ের জ্ঞান। সুতরাং তোমরা তাতে (মহাপ্রলয় হওয়ার বিষয়ে) সন্দেহ করো না। এবং আমার অনুসরণ করো। এটাই সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথ।

৪৩:৬২ :: আর শয়তান যেন তোমাদেরকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে। নিশ্চয় সে তোমাদের সুষ্পষ্ট শত্রু।

৪৩:৬৩ :: আর যখন ঈসা স্পষ্ট প্রমাণসহ এলো, সে বললো, “নিশ্চয় আমি তোমাদের কাছে এসেছি হিকমাহ (বিজ্ঞতা, বিজ্ঞানময়তা) সহকারে এবং যেন আমি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করি তোমাদের কাছে যেসব বিষয়ে তোমরা মতভেদ করছো তার কিছু বিষয়। সুতরাং তোমরা আল্লাহর প্রতি সচেতন হও এবং আমার আনুগত্য করো।

৪৩:৬৪ :: নিশ্চয় আল্লাহ, তিনিই আমার প্রভু এবং তোমাদের প্রভু। সুতরাং তোমরা তাঁরই ইবাদাত (দাসত্ব-উপাসনা) করো। এটাই সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথ।

৪৩:৬৫ :: তারপর তাদের মধ্যকার বিভিন্ন দল মতভেদ করলো। সুতরাং যারা যুলুম করে তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক দিনের আযাবের দুর্ভোগ।

৪৩:৬৬ :: তারা কি অপেক্ষা করছে এছাড়া যে, আকস্মিকভাবে তাদের কাছে মহাপ্রলয় এসে পড়বে অথচ তারা টেরও পাবে না।

আলোচনা: ৪৩:৬৫ আয়াতে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, সায়াত বা মহাপ্রলয় আকস্মিকভাবে আসবে এবং তারা তা টেরও পাবে না। একই তথ্য আরো বিভিন্ন আয়াতেও জানানো হয়েছে। যেমন- ৬:৩১, ৭:১৮৭, ১২:১০৭, ২১:৪০, ২২:৫৫, ২৬:২০২, ২৯:৫৩, ৩৯:৫৫, ৪৭:১৮। সুতরাং ৪৩:৬১ আয়াতে নবী ঈসার পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে আসাকে ক্বিয়ামাতের আলামাত বলা হয়েছে বলে যে উপলব্ধি তা এ তথ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না। বিশেষ করে আয়াতটিতে নবী ঈসার কথা উল্লেখ করা হয়নি, তিনি পৃথিবীতে পুনরায় আগমন করার কথাও বলা হয়নি এবং তাঁর পুনরায় আগমন ক্বিয়ামাতের আলামাত হবে, এটিও উল্লেখ করা হয়নি।

তাহলে এ উপলব্ধির কারণ কী? আয়াতটিতে ব্যবহৃত ‘হু (সে, তা) সর্বনাম দ্বারা কাকে বা কী বুঝাচ্ছে এবং ‘ইলম (জ্ঞান) বলতে কী বুঝাচ্ছে এ দুটি প্রশ্নের উত্তর নির্ণয়ের জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে তার মাধ্যমে এ উপলব্ধি তৈরি হয়েছে। আয়াতটির পূর্বে নবী ঈসার প্রসঙ্গ থাকায় ‘হু (সে, তা) বলতে ‘সে’ বা ‘ঈসা’ হিসেবে ধরা হয়েছে। এরপর ‘ইলম (জ্ঞান) শব্দটিকে ‘আলামাত’ শব্দের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, কুরআনে ‘ইলম শব্দটি এ স্থানে (৪৩:৬১) ছাড়া আরও ১০৪ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে এবং প্রত্যেক স্থানে তা একটিমাত্র অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ ‘জ্ঞান’ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং এ স্থানেও শব্দটি ‘জ্ঞান’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সাব্যস্ত করা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত।

সুতরাং ৪৩:৬১ আয়াতে ‘ইলম (জ্ঞান) বলতে কী বুঝানো হয়েছে বা কোন বিষয়কে মহাপ্রলয়ের জ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে?- এ প্রশ্নের উত্তর নির্ণয় করার জন্য আয়াতসমূহ বারবার অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।

৪৩:৬১ আয়াতের পূর্বে ৪৩:৫৭-৫৯ আয়াতে নবী ঈসার প্রসঙ্গ রয়েছে এবং পরে ৪৩:৬৩--৬৫ আয়াতে ‘সায়াত’ বা ‘মহাপ্রলয়ের প্রসঙ্গ রয়েছে। কিন্তু ৪৩:৬০ আয়াতে ‘ফেরেশতাদের’ প্রসঙ্গ রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে মানুষের পরিবর্তে ফেরেশতাদেরকে ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ত করতে পারতেন, অর্থাৎ সেক্ষেত্রে মানুষ বর্তমানে যেরূপ স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারে সেটা অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে পড়তো। এর পরপরই ৪৩:৬১ আয়াতে বলা হয়েছে, “ইন্নাহু লাইলমু লিস সায়াত (নিশ্চয়ত সে/তা মহাপ্রলয়ের নিশ্চিত জ্ঞান)। এ আয়াতের আগে-পরে নবী ঈসা সম্পর্কে যা কিছু তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে তাতে দেখা যায় যে, (খ) মুশরিকরা ঈসার বিষয়টিকে ইলাহ (উপাস্য) বিষয়ক তর্কের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করেছে, যাতে তাদের বক্তব্য হলো, ঈসা উত্তম ইলাহ নাকি তাদের অন্যান্য ইলাহরা উত্তম? (খ) তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হলো যে, ঈসাকে একজন ইলাহ হিসেবে সাব্যস্ত করে এসব তর্ক অর্থহীন, কারণ ঈসা একজন বান্দামাত্র, যাকে বানী ইসরাইলের জন্য একটি দৃষ্টান্ত বানানো হয়েছিল এবং নিয়ামত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কাউকে আল্লাহর সৃষ্টিক্ষমতার বিশেষ দৃষ্টান্ত বানালেই সে ইলাহ হয়ে যায় না। (গ) নবী ঈসা বিজ্ঞতা, বিজ্ঞানময়তা ও (রিসালাতের) সুস্পষ্ট প্রমাণসহ উপস্থিত হয়ে নিজেকে আল্লাহর বান্দা হিসেবে এবং আল্লাহকে নিজের ও অন্যদের একমাত্র প্রভু হিসেবে মেনে নিয়ে একমাত্র আল্লাহরই দাসত্ব করার দাওয়াত দিয়েছেন।

এইসব আলোচনার মধ্যে ৪৩:৬০ আয়াতে বলা হয়েছে, “আর যদি আমি ইচ্ছা করতাম তাহলে তাদের পরিবর্তে ফেরেশতাদেরকে নিযুক্ত করতে পারতাম, পৃথিবীতে যারা (তোমাদের) ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ত হতো”। এ থেকে বুঝা যায় যে, মুশরিকরা তাদের ইলাহদের সাথে নবী ঈসাকে তুলনা করার ক্ষেত্রে ‘ফেরেশতা বনাম মানুষ’ এর তুলনাকেই তুলে ধরেছে। তাদের দৃষ্টিতে ‘ঈসা’ যেহেতু একজন মানুষ, তাই ‘ইলাহ’ হিসেবে সে তাদের ইলাহদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে না, কারণ তাদের ইলাহগণ হলো ‘ফেরেশতা’। ৪৩:৬০ আয়াতের বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষকে খিলাফাতে অভিষিক্ত করেছেন, যারা সীমিত পর্যায়ে স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাবে, যদিও তাদের মধ্যে দোষগুণের সম্ভাবনা রয়েছে, তবুও আল্লাহ পৃথিবীতে খিলাফাতের জন্য ফেরেশতাদেরকে নয়, মানুষদেরকেই নিযুক্ত করেছেন। এ থেকে আরেকটি বিষয়ও স্পষ্ট হয় যে, আল্লাহর মনোনীত হওয়ার জন্য মানুষকে ফেরেশতার স্তরে উন্নীত হওয়ার কোনো শর্ত নেই।

৪৩:৬০ আয়াতটির অধিকতর সমৃদ্ধ অনুধাবনের জন্য ১৭:৯৫ আয়াতও অধ্যয়ন করতে হবে, যাতে এ বিষয়টির আরেকটি দিক তুলে ধরা হয়েছে।

১৭:৯৫ :: বলো (তাদেরকে জানিয়ে দাও), যদি পৃথিবীতে ফেরেশতাগণ নিশ্চিন্তে চলাচল করতো তবে অবশ্যই আমি আকাশ থেকে তাদের জন্য (পথনির্দেশ অনুসরণের দৃষ্টান্তস্বরূপ) ফেরেশতা রসূল প্রেরণ করণ করতাম।

এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, ফেরেশতাদের পথনির্দেশ অনুসরণের দৃষ্টান্তস্বরূপ কোনো রসূল প্রেরণের বিষয় থাকলে ফেরেশতা রসূলই উপযোগী। আর যেহেতু পৃথিবীতে মানুষই নিশ্চিন্তে চলাচল করছে তাই তাদের জন্য পথনির্দেশ অনুসরণের দৃষ্টান্তস্বরূপ মানুষ রসূলই উপযোগী।

৪৩:৬০ আয়াতের বক্তব্যে মানুষের পরিবর্তে ফেরেশতাদেরকে পৃথিবীতে খিলাফাত বা ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ততার যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে তার ধারাবাহিকতায় ৪৩:৬১ আয়াতে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় তা মহাপ্রলয়ের নিশ্চিত জ্ঞান”। আয়াতটিতে মূলত ৪৩:৬০ আয়াতে যে তথ্য জানানো হয়েছে সে বিষয়টির সংঘটনকেই অর্থাৎ পৃথিবীতে ফেরেশতাদের প্রত্যক্ষ বিচরণকেই মহাপ্রলয়ের নিশ্চিত জ্ঞান বলা হয়েছে। বিষয়টি এ নয় যে, এটা একটা লক্ষণ হবে, বরং বিষয়টি হলো তা হবে প্রত্যক্ষ জ্ঞান। কারণ যেদিন ফেরেশতাদের এরূপ মোতায়েন ঘটবে সেদিনই মহাপ্রলয় সংঘটিত হবে। এ বিষয়টি বুঝার জন্য একই মূল বক্তব্য প্রকাশ করে এরূপ আয়াতসমূহ (১৫:৮, ১৬:৩৩, ২৫:২২) অধ্যয়ন করতে হবে।

১৫:৮ :: আমি যথার্থ কারণ ছাড়া ফেরেশতাদেরকে অবতারিত করি না। আর (ফেরেশতাদেরকে অবতীর্ণ করলে) তখন তারা অবকাশপ্রাপ্ত হবে না।

১৬:৩৩ :: তারা শুধু প্রতীক্ষা করে তাদের কাছে ফেরেশতাদের আগমনের অথবা তোমার প্রভুর (প্রলয় সম্পর্কিত) নির্দেশ আগমনের; আল্লাহ তাদের প্রতি কোনো যুলম করেননি, কিন্তু তারাই নিজেদের প্রতি যুলম করতো।

২৫:২২ :: যেদিন তারা ফেরেশতাদের দেখবে, সেদিন অপরাধীদের জন্য কোন সুসংবাদ থাকবে না। আর তারা (ফেরেশতাগণ) বলবে, ‘(স্থাপিত হলো) এক অনতিক্রম্য অন্তরাল’’।

উপরিউক্ত আয়াতসমূহ থেকে বুঝা যায় যে, মহাপ্রলয়ের দিন মানুষ ফেরেশতাদেরকে প্রত্যক্ষ করবে। অর্থাৎ মহাপ্রলয়ের দিন ফেরেশতাদের মোতায়েন ঘটবে এবং মানুষ নিশ্চিত হয়ে যাবে যে, মহাপ্রলয় এসেই গেছে এবং তখন তাদেরকে অবকাশ দেয়া হবে না এবং ফেরেশতারা বলবে যে, এক অনতিক্রম্য অন্তরাল স্থাপিত হয়ে গেলো, ভালোরা আর মন্দরা আর মিশ্রিত হবে না, ভালোদের পরিণতি ও মন্দদের পরিণতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ((প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২৫:২২ “হিজরান মাহজূরা” (এক অনতিক্রম্য অন্তরাল) বুঝার জন্য ২৫:৫৩ আয়াত দ্রষ্টব্য, যাতে একই শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে এবং বিষয়টির ব্যাখ্যা রয়েছে))।

সুতরাং ৪৩:৬১ আয়াতে নবী ঈসার উল্লেখ না থাকা সত্ত্বেও এবং তিনি ক্বিয়ামাতের পূর্বে পৃথিবীতে আবার ফিরে আসার কোনো তথ্য না থাকা সত্ত্বেও এবং ক্বিয়ামাতের ধীর-স্থির আলামত প্রকাশ হতে থাকার কোনো বর্ণনা না থাকা সত্ত্বেও আয়াতটির তথ্যসূত্র উল্লেখ করে ‘নবী ঈসা ক্বিয়ামাতের পূর্বে পৃথিবীতে ফিরে আসা হলো ক্বিয়ামাতের একটি আলামত’ এ কথা বলার কোনো অবকাশ নেই। বরং আয়াতটিতে “পৃথিবীতে ফেরেশতাদের প্রত্যক্ষ বিচরণ ক্বিয়ামাতের জ্ঞান হবে তথা যেদিন এ ঘটনা ঘটবে সেদিনই ক্বিয়ামাতের দিন হবে” এ তথ্যটিই দেয়া হয়েছে বলে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আয়াত ও পূর্বাপর প্রসঙ্গ থেকে প্রতীয়মান হয়।

ইয়া’জুজ মা’জুজ কি কিয়ামাতের আগে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে?

সূরা কাহাফ ১৮:৯৭-১০১

১৮:৯৭ :: তারপর তারা (অর্থাৎ ইয়া’জুজ ও মা’জুজ) সেটাকে (অর্থাৎ জুলকারনাইন কর্তৃক নির্মিত প্রাচীরকে) টপকাতেও সক্ষম হয় নি এবং ছিদ্র করতেও সক্ষম হয়নি।

১৮:৯৮ :: সে (অর্থাৎ জুলকারনাইন) বলেছিল, ‘এটা আমার প্রভুর পক্ষ থেকে (অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে) দয়া। তারপর যখন আমার প্রভুর ওয়াদা/ প্রতিশ্রুতি/ প্রতিশ্রুত সময় (অর্থাৎ আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন অনুসারে সেটার ধ্বংস হওয়ার অবধারিত সময়) আসবে, তখন তিনি সেটাকে (অর্থাৎ ঐ প্রাচীরকে) মাটির সমান করে দিবেন। আর আমার প্রভুর ওয়াদা/ প্রতিশ্রুতি/ প্রতিশ্রুত সময় (অর্থাৎ প্রতিটি বিষয়ের জন্য নির্ধারিত সময়কালের আবির্ভাব এবং পার্থিব জগতের চূড়ান্তস্তরে কিয়ামাতের আবির্ভাব) সত্য’।

১৮:৯৯ :: আর আমি সেদিন তাদেরকে এভাবে ছেড়ে দেবো যে, তাদের কেউ অন্য কারো মধ্যে ঢেউয়ের মতো করে আছড়ে পড়বে। আর শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে। তখন আমি তাদেরকে একত্রিত করবো।

১৮:১০০ :: আর আমি জাহান্নামকে কাফিরদের জন্য যথাযথ উপস্থাপনে উপস্থাপিত করবো।

১৮:১০১ :: যাদের চোখগুলো আমার (প্ররিত) স্মারক দেখা থেকে পর্দায় ঢাকা ছিলো আর যারা শুনতেও সক্ষম ছিলো না।

সূরা আম্বিয়া ২১:৯৫-৯৭

২১:৯৫ :: আর নিষিদ্ধ (অসম্ভব করা হয়েছে) সেই জনপদবাসীদের উপর যে জনপদবাসীদেরকেই আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, এই মর্মে যে, তারা (পুনর্জীবনে) ফিরে আসবে না।

২১:৯৬ :: ততক্ষন পর্যন্ত যখন ছেড়ে দেয়া হবে (ধ্বংসপ্রাপ্ত) ইয়া’জূজ ও মা’জূজকে আর তারা (তাদের অবস্থানের) প্রত্যেক উঁচু ভূমি থেকে বংশানুক্রমে ছুটে আসবে।

২১:৯৭ :: আর (যখন) নিকটবর্তী হবে যথাযথ ওয়াদা (শাস্তি বা কেয়ামত ১৯:৭৫), তারপর তখন কাফিরদের (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যানকারীদের) চোখসমূহ বিস্ফোরিত হবে। (তারা বলবে) ‘হায়, আমাদের আফসোস! নিশ্চয় আমরা এ ব্যাপারে উদাসীনতার মধ্যে ছিলাম। বরং আমরা ছিলাম যালিম’ (২১:১১-১৪, ২১:৪৬)।

ইয়া’জুজ মা’জুজের পরিচিতি

প্রচলিত ধারণা হলো ইয়া’জুজ মা’জুজ হচ্ছে একটা রাক্ষস জাতি যাদেরকে জুলকারনাইন একটি প্রাচীর নির্মাণের মাধ্যমে আটকে দিয়েছেন এবং কিয়ামাত পর্যন্ত সে জাতির উত্তর প্রজন্ম অনুরূপ রাক্ষস রূপেই জন্মগ্রহণ করতে থাকবে। তারপর কিয়ামাতের কয়েক বছর আগে তারা জিহ্বা দ্বারা চেটে চেটে প্রাচীরটি ছিদ্র করে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।

কিন্তু বাস্তবে যদি ইয়া’জুজ মা’জুজ এরূপ রাক্ষস জাতি হতো তাহলে জুলকারনাইন ঐ অঞ্চলে পৌঁছার আগেই তা বধ্যভূমিতে পরিণত হতো, তার অধিবাসীরা জুলকারনাইনের কাছে প্রতিকারের আবেদন করার জন্য বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না।

ঐ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে বাঁচানোর জন্য জুলকারনাইন দুই পাহাড়ের মাঝে একটি প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন মাত্র, কোনো বদ্ধ জেলখানা নির্মাণ করেন নি। সুতরাং ঐ কওমের পক্ষে ইয়া’জুজ মা’জুজের আক্রমণ থেকে বাঁচা সম্ভব হয়েছে ঠিকই কিন্তু তা ইয়া’জুজ মা’জুজ পৃথিবীর কোনো অঞ্চলেই যেতে পারা অক্ষম হওয়ার বিষয় ছিলো না।

আল কুরআনের আলোকে যা বুঝা যায় তা হলো ইয়া’জুজ মা’জুজ ছিলো মূলত মূলত ফাসাদ সৃষ্টিকারী দুইটি জনগোষ্ঠী, যাদের একটি সাম্রাজ্যবাদী এবং অন্যটি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ছিল বিধায় দুইটি বিপীত নামে খ্যাত হয়েছিল, যেমন জুলকারনাইন দুই যুগ পেয়েছিল বিধায় জুলকারনাইন বা দুই যুগওয়ালা নামে খ্যাত হয়েছিল।

যে ব্যক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে মীরজাফর বলা হয়, একই অর্থে ফাসাদ সৃষ্টিকারীদেরকে ইয়া’জুজ মা’জুজ বলা যেতে পারে। কিন্তু কাউকে মীরজাফর বললেই যেমন সে ইতিহাসের মীরজাফর হয়ে যায় না, তেমনি কোন জনগোষ্ঠীকে রূপকার্থে ইয়া’জুজ মা’জুজ বললেও তারা কুরআনে বর্ণিত ইয়া’জুজ মা’জুজ হিসেবে সাব্যস্ত হবে না।

জুলকারনাইন কর্তৃক নির্মিত প্রাচীর

ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদগণ ‘কৃষ্ণ সাগর ও কাসপিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী ককেশীয় অঞ্চলের ককেশাসের দক্ষিণে দাগিস্তানের দরবন্ধ ও দারিয়ালের মাঝখানে নির্মিত একটি প্রাচীরের’ কথা বলেন, যা ৫০ মাইল লম্বা, ২৯০ ফুট উঁচু এবং ১০ ফুট চওড়া ছিলো এবং কুরআন মাজিদে জুলকারনাইন কর্তৃক নির্মিত প্রাচীরের যে নির্মাণ প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে এই প্রাচীরটিতেই উহার চিহ্নসমূহ পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেন। যারা ‘চীনের প্রাচীর’কে ‘জুলকারনাইন কর্তৃক নির্মিত প্রাচীর’ বলে থাকেন তাঁদের কথা তথ্যনির্ভর নয়।

যারা মনে করেন কিয়ামাতের কয়েক বছর আগে ইয়া’জুজ মা’জুজ জিহ্বা দ্বারা চেটে চেটে ‘জুলকারনাইন কর্তৃক নির্মিত প্রাচীর’ ছিদ্র করে বেরিয়ে আসবে তাদের এ কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আল কুরআনের ভাষ্য হচ্ছে ইয়া’জুজ মা’জুজের পক্ষে সেটাকে ছিদ্র করা সম্ভব হয় নি কিন্তু প্রাচীরটি অন্য যে কোনো জিনিসের মতোই প্রাকৃতিকভাবে নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে ধ্বংসশীল।

আল্লাহর ওয়াদাকৃত সময়ে প্রাচীরটির ধ্বংস

১৮:৯৮ আয়াতে দুইবার ‘ওয়া’দু রব্বী তথা ‘আমার রবের ওয়াদা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয়বারে যে কিয়ামাতের বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কারণ সেটার সূত্র ধরে পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ কিয়ামাত দিবসের আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু প্রথমবার বলা হয়েছে যে, ‘আমার রবের ওয়াদা আসলে তিনি উহাকে ভূমিসাৎ করে দিবেন’। এ অংশে ‘ওয়াদু রব্বী’ বলতে ‘প্রাচীরটি আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইনে ধ্বংস হওয়ার সময়সীমার’ কথা বুঝানো হয়েছে। কারণ, আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইনে সব জিনিসের স্থায়ীত্বের সময়সীমা আছে। আর এখানে উক্তিটি জুলকারনাইনের এবং সে গায়েব জানার কথা নয় যে, সে উহার স্থায়ীত্বকাল কিয়ামাত পর্যন্ত বলে থাকবে, বরং সে সাধারণভাবে উহার জন্য আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইনে নির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত উহা টিকে থাকার কথাই বলে থাকবে।

‘আল্লাহর ওয়াদা’ বলতে শুধুমাত্র কিয়ামাতকেই বুঝায় না। বরং যখন যে প্রসঙ্গে বলা হয় তখন সেই প্রসঙ্গের সাথে সম্পর্কিত ওয়াদাকে বুঝায়। দেখুন- ২:২৬৮, ৩:১৯৪, ৪:৯৫, ৫:৯, ৬:১৩৪, ৭:৪৪, ৮:৭, ৯:৬৮, ৯:৭২, ১০:৪৬, ১৩:৩৫, ১৩:৪০, ১৪:২২, ১৯:৬১, ১৯:৭৫, ২০:৮৬, ২১:১০৩, ২১:১০৯, ২২:৭২, ২৩:৮৩, ২৩:৯৩, ২৩:৯৫, ২৪:৫৫, ২৫:১৫, ২৬:২০৬, ২৮:৬১, ৩৩:২২, ৩৬:৫২, ৩৬:৬৩, ৩৮:৫৩, ৪০:০৮, ৪০:৭৭, ৪১:৩০, ৪৩:৪২, ৪৩:৮৩, ৪৬:১৬, ৪৬:১৭, ৪৬:৩৫, ৪৭:১৫, ৪৮:২০, ৪৮:২৯, ৫০:৩২, ৫১:০৫, ৫১:৬০, ৫৭:১০, ৭০:৪২, ৭০:৪৪, ৭২:২৪, ৭২:২৫, ৭৭:০৭, ২:৫১, ৭:১৪২, ২০:৮০, ১১:১৭, ১১:৮১, ১৫:৪৩, ১৮:৪৮, ১৮:৫৮, ১৮:৫৯, ২০:৮৬, ২০:৯৭, ৫৪:৪৬, ৩:৯, ৩:১৯৪, ১৩:৩১, ৩৪:৩০, ৩৯:২০, ৩:১৫২, ৪:১২২, ৯:১১১, ১০:০৪, ১০:৫৫, ১১:৪৫, ১১:৬৫, ১৩:৩১, ১৪:২২, ১৪:৪৭, ১৬:৩৮, ১৭:০৫, ১৭:০৭, ১৭:১০৪, ১৭:১০৮, ১৮:২১, ১৮:৯৮, ১৯:৬১, ২০:৮৬, ২১:০৯, ২১:৯৭, ২১:১০৪, ২২:৪৭, ২৫:১৬, ২৮:১৩, ২৮:৬১, ৩০:০৬, ৩০:৬০, ৩১:০৯, ৩১:৩৩, ৩৫:৫, ৩৯:২০, ৩৯:৭৪, ৪০:৫৫, ৪০:৭৭, ৪৫:৩২, ৪৬:১৬, ৪৬:১৭, ৭৩:১৮।

ধ্বংসপ্রাপ্ত ইয়া’জুজ মা’জুজ এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত সব জনপদবাসীর একই দিনে পুনর্জীবনে প্রত্যাবর্তন

আল কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী যথাযথ তথ্য হচ্ছে ইয়া’জুজ মা’জুজ দুইটি ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি। এ বিষয়ে ১৮:৯৭ আয়াতে বলা হয়েছে যে, “তারপর তারা (অর্থাৎ ইয়া’জুজ মা’জুজ) সেটাকে (অর্থাৎ জুলকারনাইন কর্তৃক নির্মিত প্রাচীরকে) টপকাতেও সক্ষম হয় নি এবং ছিদ্র করতেও সক্ষম হয় নি”। তারা ধ্বংস হওয়ার পূর্বে কখনো জুলকারনাইন কর্তৃক নির্মিত প্রাচীরকে টপকাতে বা ছিদ্র করতে সক্ষম হয়নি।

আর ২১:৯৫-৯৬ আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী ইয়া’জুজ মা’জুজ তাদের অবস্থানের প্রত্যেক উচ্চভূমি থেকে বংশানুক্রমে ছুটে আসার পূর্ব পর্যন্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদবাসী পুনর্জীবনে প্রত্যাবর্তন করাকে নিষিদ্ধ তথা অসম্ভব করা হয়েছে। অন্য কথায়, যখন ইয়া’জুজ মা’জুজ তাদের অবস্থানের প্রত্যেক উচ্চভূমি থেকে বংশানুক্রমে ছুটে আসবে তখনি সকল ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদবাসী পুনর্জীবনে প্রত্যাবর্তন করবে। অন্য কথায় ইয়া’জুজ মা’জুজ অন্যান্য ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত এবং কিয়ামাত দিবসে ইয়া’জুজ মা’জুজ এবং অন্য সকল ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদবাসী পুনর্জীবনে প্রত্যাবর্তন করবে।

ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদবাসী প্রসঙ্গ এবং (কিয়ামাতের আগে) তাদের ফিরে না আসা এবং কিয়ামাতের আগে সকল জনপদের ধ্বংস

আল কুরআনে বহু জনপদবাসীকে তাদের জুলুমের কারণে ধ্বংস করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। (১০:১৩, ১৭:১৭, ১৮:৫৯, ১৯:৭৪, ১৯:৯৮, ২০:১২৮, ২১:৬, ২২:৪৫, ২৮:৪৩, ২৮:৫৮, ২৮:৭৮, ৩২:২৬, ৩৬:৩, ৩৮:৩, ৪৬:২৭, ৪৭:১৩, ৫০:৩৬)।

আবার বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ফেরাউনের সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা (৮:৫৪) এবং কওমে লূত নামক জনপদবাসীকে ধ্বংস করা (২৯:৩১)।

আল কুরআনে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, কোনো ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদবাসী (কিয়ামাতের আগে) কোনোক্রমেই ফিরে আসবে না। (৩৬:৩১)

আরো ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, কিয়ামাতের আগে সকল জনপদকেই ধ্বংস করা হবে। (১৭:৫৮)

সুতরাং ইয়া’জুজ মা’জুজ এবং অন্য সকল ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদবাসীর প্রত্যাবর্তন ঘটবে কিয়ামাত দিবসে, তার আগে নয়। সুতরাং কিয়ামাত দিবসের আগে না ইয়া’জুজ মা’জুজ ফিরে আসবে আর না কোনো ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদবাসী ফিরে আসবে। এ বিষয়টিই ২১:৯৫-৯৭ আয়াতে জানানো হয়েছে।

প্রশ্ন হতে পারে যে, কেন কোনো ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদবাসী কিয়ামাতের আগে ফিরে না আসার বিষয়টিকে ইয়া’জুজ মা’জুজের সাথে সম্পর্কিত করে উল্লেখ করা হয়েছে?

সূরা কাহাফ অধ্যয়ন করলে এ প্রশ্নটির জবাব অনুধাবন করা সহজ হয়। ইয়া’জুজ মা’জুজ এমন দুই সম্প্রদায় যাদের অরাজকতাকে প্রতিরোধ করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা না করে বরং তাদের আগমন প্রতিহত করতে দুই পাহাড়ের মাঝে প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। সেই ইয়া’জুজ মা’জুজও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এবং কিয়ামাতের পূর্বে ফিরে আসবে না এবং তারা যেদিন ফিরে আসবে সেই কিয়ামাত দিবসের আগে কোনো ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদবাসীই ফিরে আসা সম্ভব নয়, এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরার জন্যই ইয়া’জুজ মা’জুজকে সম্পর্কিত করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

ইয়া’জুজ মা’জুজ কিয়ামাতের আগে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার ধারণাটি একটি বিভ্রান্তি

সুতরাং আল কুরআনের ১৮:৯৭-১০১ এবং ২১:৯৫-৯৭ আয়াত অনুযায়ী চূড়ান্ত তথ্য হচ্ছে ইয়া’জুজ মা’জুজ কিয়ামাতের আগে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার ধারণাটি একটি বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয়। যারা এই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন তাদের তাফসীর ও অন্যান্য ধর্মীয় সাহিত্যেও সেই দাবির পাশাপাশি এ কথাও ছড়িয়ে আছে যে, ইয়া’জুজ মা’জুজ একটি অতীত সম্প্রদায়। এক্ষেত্রে তারা অতীতের বিভিন্ন সম্প্রদায়কে ইয়া’জুজ মা’জুজ হিসেবে চিহ্নিত করে। সুতরাং ইয়া’জুজের মা’জুজের বিষয়ে তাদের নীতিগত অবস্থান স্ববিরোধী। বাস্তবতা হচ্ছে ইয়া’জুজ মা’জুজ হচ্ছে আল কুরআনে উল্লেখিত দুইটি ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি এবং তাই ধ্বংসপ্রাপ্ত ইয়া’জুজ মা’জুজ কিয়ামাতের আগে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার কোনো অবকাশ নেই।

দাব্বাতাম মিনাল আরদ (পৃথিবী থেকে উদ্ভুত জন্তু)

এ বিষয়ে ২৭:৮২ আয়াতটিকে তথ্যসূত্র উপস্থাপন করা হয়। আয়াতটির তাৎপর্যের বিষয়ে আক্রম খাঁ তাঁর রচিত কুরআনের অনুবাদগ্রন্থে যে উপলব্ধি তুলে ধরেছেন সেটা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত হিসেবে প্রতীয়মান হয়। তাঁর উপস্থাপিত তাৎপর্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে এ বিষয়ে আরো বিস্তৃত গবেষণার মাধ্যমে কুরআন গবেষক তৈয়াবুর রহমান গোপালগঞ্জী এবং এ গন্থের মূল সংকলক যৌথভাবে যে নোট করেছি নিম্নে তা তুলে ধরা হলো:

২৭:৮২ :: আর যখন  (শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্তমূলক) বাণী (কার্যকর হওয়ার সময়) ঘনিয়ে আসে তাদের উপর, তখন আমরা বের করি তাদের জন্য ‘দাব্বাতাম মিনাল আরদ’/ ‘জমিন (জমিনী চিন্তাধারা) থেকে উদ্ভূত জন্তু’ ( = নিতান্ত বস্তুবাদী), যে তাদেরকে বলে ( = তাদের কাছে অপপ্রচার করে) যে, মানুষ আমাদের আয়াতসমূহের ( = আল্লাহর আয়াতসমূহের) প্রতি ইয়াকীন/ নিশ্চয়তার ধারণা রেখে আসছে না ( = ধর্মের যুগ শেষ হয়ে গেছে)”।

আলোচনাঃ (ক) এ আয়াতের ব্যাখ্যার নামে হাদীসের বরাতে অনেক আজগুবি, উদ্ভট ও পরস্পর সামঞ্জস্যহীন অনেক কথা বলা হয়ে থাকে। বলা হয় যে, কিয়ামতের আগে একটি লক্ষণ হিসাবে দাব্বাতুল আরদ নামে একটি অদ্ভুত জন্তু মাটি বা পাহাড় ভেদ করে বের হবে এবং চিৎকার করে বলবে ‘মানুষ আমার আয়াত বিশ্বাস করতো না’। এ বিবরনের উপর ভিত্তি করে নাস্তিকরা বলছে যে, ‘আল্লাহ মানুষ নবী-রসূলদেরকে পাঠিয়ে মানবজাতিকে সংশোধনের চেষ্টা করা সত্ত্বেও যখন তারা সংশোধিত হলো না তখন একটা জন্তুকেই আক্ষেপকারী/ সতর্ককারী (নবী/ রসূল?) করে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়, যা মানুষ নবী-রসূলদের প্রতি অপমানসূচক এবং এর মাধ্যমে আরো প্রমাণিত হয় যে, শেষ নবী বা রসূল মানুষ মুহাম্মাদ নয় বরং অদ্ভূত জন্তু দাব্বাতুল আরদ হচ্ছে শেষ নবী বা রসূল’। (নাউযুবিল্লাহ)। এছাড়া, এ বর্ণনার উপর ভিত্তি করে নাস্তিকরা আরো কিছু অসঙ্গত কথা বলছে যা অত্যন্ত অসঙ্গত হওয়ায় এখানে উল্লেখ করা হলো না। আবার সাম্প্রতিক কেউ কেউ নিজেকে ‘দাব্বাতুল আরদ’ নামে ঘোষণা দিয়ে বলছে যে, সেই শেষ যামানার সতর্ককারী(!) দাব্বাতুল আরদ’।

(খ) আয়াতটির শেষাংশে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘যে তাদেরকে বলবে যে, মানুষ নাকি আমার আয়াতের প্রতি ইয়াকীন রেখে আসছে না’। প্রশ্ন হচ্ছে এখানে ‘আমার আয়াত’ বলতে কার আয়াত বুঝানো হয়েছে? সহজ ও সঠিক উত্তর হচ্ছে ‘আল্লাহর আয়াত’। সুতরাং ‘দাব্বাতুম মিনাল আরদের’ প্রত্যক্ষ উক্তি হচ্ছে, ‘মানুষ আল্লাহর আয়াতে ইয়াকীন রেখে আসছে না’। অর্থাৎ আয়াতটিতে দাব্বাতুম মিনাল আরদের অপপ্রচারকে পরোক্ষ উক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, যদি একজন জমিদার বলেন যে, ‘শুনলাম একজন দুষ্ট লোক প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে, আমার জমিদারী নিলাম হয়ে গেছে’। এখানে ‘আমার জমিদারি’ মানে ‘জমিদারের জমিদারি’ কিন্তু ‘দুষ্ট লোকটির জমিদারি’ নয়। তদ্রূপ, এ আয়াতে (২৭:৮২) ‘আমার আয়াতসমূহ’ অর্থ ‘আল্লাহর আয়াতসমূহ’, ‘দাব্বাতুম মিনাল আরদের আয়াতসমূহ’ নয়।

(গ) সাধারণত এ আয়াতে ‘কওল শব্দের অনুবাদ ‘কেয়ামত’ শব্দ দিয়ে করা হয়। আসলে, এখানে ‘কওল’ শব্দের অর্থ ‘শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্তমূলক বাণী’। আর ‘কওল’ ঘনিয়ে আসা বলতে শুধুমাত্র কেয়ামত ঘনিয়ে আসা বুঝায় না। বরং যে কোন কওমের উপর শাস্তি ঘনিয়ে আসাও এর অন্তর্ভুক্ত। ‘শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্তমূলক বাণী’ অর্থে ‘কওল’ শব্দের সম্পূর্ণ তালিকা উপস্থাপন করলে তাতে এ বিষয়টি চূড়ান্তভাবে যাচাই করা সহজ হবে। ‘শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্তমূলক বাণী’ অর্থে ‘কওল’ শব্দ নিম্নের ১২ টি আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে, যথাঃ ১১:৪০, ১৭:১৬, ২৩:২৭, ২৭:৮২, ২৭:৮৫, ২৮:৬৩, ৩২:১৩, ৩৬:৭, ৩৬:৭০, ৩৭:৩১, ৪১:২৫, ৪৬:১৮।

(ঘ) এ আয়াতের অনুবাদে ‘দাব্বাতাম মিনাল আরদ’ শব্দের যে অর্থ করা হয়েছে তার সঠিকত্ব উপলব্ধির জন্য প্রথমে জেনে রাখতে হবে যে, ‘দাব্বাত (বহুবচনে দাওয়াব্বি)’ শব্দটি দ্বারা বুঝায় ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল জীব। ব্যাপকার্থে মানুষও দাব্বাতের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু মানুষ যেহেতু ‘খায়রুদ দাওয়াব্বি’, তাই তাকে সাধারণত: ‘দাব্বাত’ শব্দে উল্লেখ করা হয় না, শুধুমাত্র ক্ষেত্রবিশেষে উল্লেখ করা হয়। বিশেষ করে ৮:২২ আয়াতে যারা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করে না তাদেরকে এবং ৮:৫৫ আয়াতে যারা কাফির তাদেরকে ‘শাররাদ দাওয়াব্বি’ (নিকৃষ্ট জীব) বলা হয়েছে। সুতরাং যারা মু’মিন তারা হচ্ছে ‘খায়রুদ দাওয়াব্বি’ (উৎকৃষ্ট জীব)। ২৭:৮২ ও ৩৪:১৪ আয়াতে যথাক্রমে ‘দাব্বাতাম মিনাল আরদ’ এবং ‘দাব্বাতুল আরদ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ‘বস্তুবাদী চিন্তাধারায় লালিত পালিত লোক’দেরকে বুঝানোর জন্য। কারণ, ‘আরদ’ শব্দটি ‘পার্থিব স্বার্থ/ বস্তুবাদী চিন্তাধারা/ নিতান্ত পার্থিব জীবনের প্রতি আসক্তি’ বুঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে, যা ৭:১৭৫-১৭৬ আয়াতের মাধ্যমে সম্পূর্ণ স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। ৭:১৭৫-১৭৬ আয়াতে “যাদেরকে আয়াতের জ্ঞান দেয়া হয়েছিল কিন্তু তবুও পরবর্তীতে তারা আয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং ‘আখলাদা ইলাল আরদ’ ‘পার্থিব স্বার্থের/ বস্তুবাদী চিন্তাধারার দিকে ঝুঁকে যায় এমন লোক’ হয়ে যায়” তাদেরকে কুকুরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এর ভিন্নরূপ হচ্ছে ‘দাব্বাতাম মিনাল আরদ/ দাব্বাতুল আরদ’, যাদের জন্মই হয়েছে বস্তুবাদের গর্ভ থেকে। তারা জীবনের শুরু থেকে ধর্মবিরোধী ও বস্তুবাদী হিসাবে জীবন যাপন করে এবং আখিরাতকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র পার্থিব জীবনের ভোগবিলাসকে ও রং তামাশাকে জীবনের চরম লক্ষ্য বলে গ্রহণ করে।

(ঙ) আল কুরআনে ‘দাব্বাত শব্দ (একবচন ও বহুবচনে) ব্যবহৃত হয়েছ নিম্নের ১৮ টি আয়াতে, যথাঃ ২:১৬৪, ৬:৩৮, ৮:২২, ৮:৫৫, ১১:৬, ১১:৫৬, ১৬:৪৯, ১৬:৬১, ২২:১৮, ২৪:৪৫, ২৭:৮২, ২৯:৬০, ৩১:১০, ৩৪:১৪, ৩৫:২৮, ৩৫:৪৫, ৪২:২৯, ৪৫:৪।

দুখান বা ধোঁয়া

৪৪:১০ :: সুতরাং তুমি অপেক্ষা করো, যেদিন আকাশ স্পষ্ট ধোঁয়া নিয়ে আসবে,

৪৪:১১ :: তা মানুষকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। এটা হবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

৪৪:১২ :: (তারা বলবে,) আমাদের প্রভু, আমাদের থেকে শাস্তি সরিয়ে নিন, নিশ্চয় আমরা মু’মিন হবো।

৪৪:১৩ :: কোথায় তারা উপদেশ পাবে? অথচ তাদের কাছে এসেছে সুস্পষ্ট রাসূল।

৪৪:১৪ :: তারপর তারা তার থেকে বিমুখ হয়েছে এবং তারা বলেছে, ‘শিক্ষিত পাগল’।

৪৪:১৫ :: নিশ্চয় আমি শাস্তি অপসারণকারী আর নিশ্চয় তোমরা তোমাদের পূর্বাচরণ পুনরাবৃত্তিকারী।

আলোচনা: ৪৪:১০-১১ আয়াতকে কিয়ামাতের আলামাত হিসেবে আকাশ ধোঁয়ায় ভরে যাওয়ার তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়।  এ আয়াতগুলোর তথ্য হলো, যেদিন আকাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাবে তা হবে একটি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। এতে যেদিন শব্দটি সাধারণভাবে উল্লেখিত, যা সুনির্দিষ্টভাবে ক্বিয়ামাতের দিবসকে বা একটিমাত্র দিনকে বুঝায় না, বরং যে সকল দিনে এ ধরনের আযাব আসতে পারে, সেগুলোকে সাধারণভাবে প্রকাশ করে। এভাবে চূড়ান্ত পর্যায়ে ক্বিয়ামাতের দিনও এটি ঘটবে, যেদিন আর কোনো অবকাশ দেয়া হবে না। অন্যদিকে ক্বিয়ামাত দিবসের আগেও বিভিন্ন সময় এমনটি হতে পারে, কারণ এরপর ৪৪:১২-১৫ আয়াতে শাস্তিকে সরিয়ে নেয়ার জন্য কাফিরদের দোয়া এবং মু’মিন হবে বলে তাদের অসত্য ওয়াদা, আল্লাহ কর্তৃক তাদের শাস্তিকে কিছু সময়ের জন্য সরিয়ে নেয়া এবং তাদের কর্তৃক তাদের পূর্বের আচরণের পুনরাবৃত্তি করা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বোপরি, আয়াতটিতে আকাশ ধোঁয়ায় ভরে যাবার মাধ্যমে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির কথা বলা হলেও এটাকে ক্বিয়ামাতের আলামাত হিসেবে গ্রহণ করা বা যেদিন এমনটি ঘটবে তারপর অনিবার্যভাবে ক্বিয়ামাত সংঘটিত হয়ে যাওয়ার ধারণা করার জন্য কোনো নির্দেশনা নেই।

শিঙায় ফুঁ দেয়া

কিয়ামাত দিবসে প্রথমবার শিঙায় ফুঁ দেয়ার মাধ্যমে সবাই ভীতি-বিহবল হয়ে পড়া, দ্বিতীয়বার শিঙায় ফুঁ দেয়ার মাধ্যমে সকলে মূর্ছিত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ও মহাপ্রলয় সংঘটিত হওয়া এবং তৃতীয়বার ফুঁ দেয়ার মাধ্যমে নতুন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার জন্য সকলের পুনরুত্থান ঘটার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ১০টি আয়াতে শিঙায় ফুঁ দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতগুলো হলো- ৬:৭৩, ১৮:৯৯, ২০:১০২, ২৩:১০১, ২৭:৮৭, ৩৬:৫১, ৩৯:৬৮, ৫০:২০, ৬৯:১৩, ৭৮:১৮।

শিঙায় ফুঁ এর মাধ্যমে যে বিষয়গুলো ঘটবে অনেক আয়াতে তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু আয়াত হলো- ৮১:১-৬, ৮২:১-৩, ৭৯:৬-৯, ৭৭:৭-১৫, ৭৫:৬-১০, ১০১:১-৫, ৭০:৬-১০, ২২:১-২, ২০:১০৫-১০৭, ২৭:৮৮, ৫২:৯-১০, ৫৬:১-৬, ৭৮:১৯-২০, ৭৩:১৪, ৭৩:১৭-১৮, ২৫:২৫, ৫৫:৩৭-৩৮, ৮৩:৪-৬, ৩৬:৫১, ১৪:৪৮, ৩৯:৬৯, ১৮:৪৭, ২০:৫৫, ৯৯:১-৩, ৩৬:৫২ ইত্যাদি।

বিচার দিবসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

বিচার দিবসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সেদিনটি হবে সকলকে তাদের মৃত্যু পরবর্তী পুনর্জীবন দান করে পুনরুত্থিত করার দিন, প্রত্যেকের হিসাব গ্রহণের দিন, তাদের আমল ওজন করার দিন, তাদের আমল দেখাবার দিন, তাদের আমলনামা পাঠ করতে দেয়ার দিন, তাদের কর্মসমূহের বিষয়ে সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠার দিন।

সেদিন বিভিন্ন ধরনের সাক্ষ্য কায়েম করা হবে, যেমন- নবী-রসূলগণ সাক্ষী হবেন, এছাড়াও অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী মু’মিনরা সাক্ষী হবেন, ফেরেশতারা সাক্ষী হবেন, তাদের হাত-পা-চামড়াও সাক্ষ্য দিবে এবং শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাও সাক্ষ্য দিবে।

সেদিন ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। সেদিন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কথা বলতে পারবে না। সেদিন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ শাফায়াত করতে পারবে না। সেদিন ফেরেশতারা ও শাফায়াতকারীগণ শুধুমাত্র তাদের জন্য শাফায়াত করবে যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট। সেদিন শাফায়াত জালিমদের কোনো কাজে আসবে না। সেদিন প্রত্যেকে তাদের কর্ম অনুযায়ীই কর্মফল দেয়া হবে। কেউ কারো উপকারে আসবে না। কেউ অন্যের পাপের বোঝা বহন করবে না। সেদিন কোনো বিনিময় চলবে না। সেদিন কোনো ক্ষতিপূরণ চলবে না। সেদিন কোনো বন্ধুত্বও কাজে আসবে না। সেদিন কোনো কার্যকর শাফায়াতও নেই, অর্থাৎ সেদিন শাফায়াত দ্বারা কেউ উপকৃত হবে না, শাফায়াত মু’মিনদের প্রতি ফেরেশতাদের ও কল্যাণকামীদের একটি অভিব্যক্তি মাত্র, কিন্তু যে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য সে ছাড়া কেউ শাফায়াত দ্বারা উপকৃত হবে না। অর্থাৎ যে ব্যক্তি শাফায়াত ছাড়াও ক্ষমা পেতো, সেই শুধুমাত্র ক্ষমা পাবে, তাই শাফায়াতের কোনো বাস্তব কার্যকারিতা থাকবে না, অন্য কথায় বলা যায়, সেদিন যেমন কার্যকর বন্ধুত্ব থাকবে না,তেমনি কার্যকর শাফায়াতও থাকবে না। শাফায়াতের বিষয়টি বিস্তারিত বুঝার জন্য শাফায়াত সম্পর্কিত সকল আয়াত একসাথে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। আয়াতসমূহ হলো- ২:৪৮, ২:১২৩, ২:২৫৪, ৪:৮৫, ১৯:৮৭, ২০:১০৯, ৩৪:২৩, ৩৬:২৩, ৩৯:৪৪, ৪৩:৮৬, ৫৩:২৬, ৭৪:৪৮, ৬:৫১, ৬:৭০, ১০:৩, ৩২:৪, ৪০:১৮, ৬:৯৪, ৭:৫৩, ১০:১৮, ৩০:১৩, ৩৯:৪৩, ২৬:১০০, ২:২৫৫, ২১:২৮।

যে ব্যক্তি বিন্দু পরিমাণ সৎকর্ম করেছে তাকে তা দেখানো হবে। যে ব্যক্তি বিন্দু পরিমাণ অসৎকর্ম করেছে তাকেও তা দেখানো হবে। সেদিন কারো প্রতি বিন্দু পরিমাণও জুলুম করা হবে না, সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে। সেদিন প্রত্যেকের সকল আমলকে স্বতন্ত্রভাবে ওজন করা হবে। যারা কবীরা গুনাহ (যা থেকে কুরআনে নিষেধ করা হয়েছে এরূপ বড় বড় অপরাধ) থেকে মুক্ত বা তাওবা করে মৃত্যুবরণ করেছে তাদের ছোটোখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেয়া হবে। যাদের কবীরা গুনাহ থাকবে তারা জাহান্নামে যাবে, তারা তাদের ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত হবে না। যারা কোনো বড় রকম ভালো কাজই করেনি, চরম পর্যায়ের কাফির হিসেবে জীবন যাপন করেছে সেদিন তাদের জন্য কোনো ওজনই কায়েম করা হবে না, বরং তাদের আমলের ওজন ছাড়াই তাদেরকে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি দেয়া হবে।

সেদিন শিরকের গুনাহ ক্ষমা করা হবে না, কুফরের গুনাহ ক্ষমা করা হবে না এবং অনুরূপ যেসব বড় বড় পাপ আছে যেমন- যিনা বা ব্যভিচার, অন্যায় হত্যা, সুদ, উত্তরাধিকারের বিধান লংঘন ইত্যাদির জন্য চিরকাল জাহান্নামে থাকার শাস্তি ভোগ করতে হবে।

সেদিন যারা পুরস্কারযোগ্য কোনো ভালো কাজ নিয়ে উপস্থিত হবে, তাদেরকে দশগুণ পুরস্কার দেয়া হবে আর যারা শাস্তিযোগ্য কোনো মন্দ কাজ নিয়ে উপস্থিত হবে তাদেরকে তাদের মন্দ কাজের মাত্রা হিসেবে নির্ধারিত সমমাত্রার শাস্তি দেয়া হবে অর্থাৎ এক মাত্রা মন্দ কাজের জন্য এক মাত্রা শাস্তি।

সেদিন যাদের আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে তাদের থেকে সহজ হিসাব নেয়া হবে এবং তারা জান্নাতে যাবে। সেদিন যাদের আমলনামা বাম হাতে দেয়া হবে এবং যারা পিঠের পিছন দিক থেকে আমলনামা গ্রহণ করবে তাদের থেকে কঠিন হিসাব নেয়া হবে এবং তারা জাহান্নামে যাবে।

সেদিন মানুষকে তাদের আমলনামা পড়তে দেয়া হবে এবং বলা হবে নিজ নিজ হিসাব প্রদানে প্রত্যেকে নিজেই যথেষ্ট হবে যে, তার হিসাব অনুসারে সে ক্ষমা পাওয়ার আশা করতে পারে নাকি শাস্তিপ্রাপ্ত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। সেদিন প্রত্যেকে দেখবে যে, তাদের আমলনামায় ছোটো বড়ো কোনো কথা ও কাজই রেকর্ড করা থেকে বাদ পড়েনি।

সেদিন অপরাধীরা নিজ নিজ পাপের বোঝা বহন করবে (৬:৩১), কেউ কারো পাপের বোঝা বহন করবে না (৩৫:১৮, ৬:১৬৪, ১৭:১৫, ৩৯:৭, ৫৩:৩৮, ৩৫:১৮), তবে পথভ্রষ্টকারীরা পথভ্রষ্টদের বোঝা বহনে অংশীদার হবে (১৬:২৫)। সেদিন অন্ধ অনুসারী ও অনুসৃতদের মধ্যে তর্কবিতর্ক হবে তবে প্রত্যেককেই তাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে। সেদিন অপরাধীরা পরস্পরের শত্রু হয়ে যাবে এবং মুত্তাকীরা পরস্পরের বন্ধু হয়েই থাকবে।

সেদিন যাবতীয় নেয়ামতের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, ওয়াদা পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, জাহান্নামে প্রবেশের সময় অপরাধীদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে যে, তাদের কাছে কি সতর্ককারী ছিল না, যারা তাদেরকে সতর্ক করেছিল? সেদিনের বিভিন্ন জিজ্ঞাসা সম্পর্কে ৭:৬, ১৫:৯২, ১৬:৫৬, ১৬:৯৩, ১৭:৩৬, ২১:২৩, ২৯:১৩, ৩৪:২৫, ৮১:৮-৯, ১০২:৮ ১৭:৩৪, ৩৩:১৫, ৬৭:৮ ইত্যাদি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

সেদিন পুণ্যবানদের চেহারা আনন্দে শুভ্র হবে। সেদিন পাপীদের চেহারা ভীতি-বিহবলতায় কালো হবে। সেদিন পুণ্যবানদের সামনে ও ডানে আলো থাকবে। সেদিন অপরধীরা আলো থেকে বঞ্চিত হবে। যারা আল্লাহর স্মরণ থেকে, আল্লাহর দেয়া চিরস্মরণীয় তথ্য ও বিধি-বিধান থেকে অন্ধ ছিল, সেদিন তারা অন্ধ হয়ে উঠবে।

সেদিন আল্লাহর সাথে যাদেরকে শরিক করা হয়েছিল তারা মুশরিকদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে এবং তাদের থেকে উধাও হয়ে যাবে। সেদিন বিচার ফায়সালার পর শয়তান বলবে যে, সে মিথ্যা ওয়াদা দিয়েছিল। সেদিন শয়তান এবং যারা তার অনুসরণ করেছিল তারা একসাথে জাহান্নামে যাবে।

সেদিন মানুষ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত হবে, যারা আল্লাহর পথে অগ্রণী ছিলো, যারা ডানপন্থী ছিল এবং যারা বামপন্থী ছিল। যারা অগ্রণী ছিল তারা জান্নাতে যাবে, যারা ডানপন্থী ছিল তারাও জান্নাতে যাবে আর যারা বামপন্থী ছিল তারা জাহান্নামে যাবে।

সেদিন ষড়যন্ত্র ও বাকচাতুর্যের কোনো সুযোগ থাকবে না। সেদিন অপরাধীরা ফেরত পাঠানোর জন্য আবেদন করবে কিন্তু তাদের সে আবেদন নিষ্ফল হবে, আর ফিরে আসার সুযোগ ঘটবে না।

সেদিন যারা জাহান্নামে যাবে তারাই চির ব্যর্থ আর সেদিন যারা জান্নাতে যাবে তারাই চির সফল। জাহান্নামবাসীরা জাহান্নামে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি পাবে এবং তাদের শাস্তি কিছুমাত্র হ্রাস করা হবে না, বরং ক্রমে ক্রমে বাড়ানো হবে। অন্যদিকে জান্নাতবাসীরা জান্নাতে বিপুল সম্বর্ধনা পাবে, অফুরন্ত পুরস্কার পাবে এবং সেখানে তারা কোনো বেহুদা কথা শুনবে না, তাদের কোনো দুঃখ ও হতাশা থাকবে না। জান্নাতবাসীদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তির বারতা দেয়া হবে। তারা পরস্পরকে সালামের মাধ্যমে শুভ কামনা করবে এবং তারা আল্লাহর প্রশংসাসহ পবিত্র বর্ণনা করবে এবং তাদের শেষ কথা হবে ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য’।

এভাবে পরকালের বিচার প্রক্রিয়া ও তার ফলাফল সম্পর্কে সমগ্র কুরআনে অনেক তথ্য রয়েছে, কুরআন অধ্যয়ন করলে এর প্রায় সব সূরাতেই এর কিছু না কিছু তথ্য রয়েছে।

[1] প্রাসঙ্গিক আয়াত ২৯:৫০-৫১, ৭:২০৩, ১৭:৯০-৯৪, ১৭:৫৯।

শেষ কথা

পরিশেষে বলা যায় যে, ঈমান বলতে সাধারণভাবে যেরূপ সাধারণ ও যুক্তি বিবেচনা ছাড়া বিশ্বাসকে চিহ্নিত করা হয়, যাতে আল্লাহ ও ফেরেশতাদের অস্তিত্বকে এবং আখিরাত হবে বলে স্বীকার করা হয় এবং আল্লাহ কাউকে নবী-রসূল বানিয়ে তাদের নিকট কিতাব পাঠিয়েছেন বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়; কুরআনের আলোকে ঈমান বলতে এরূপ সাধারণ বিশ্বাসকে বুঝায় না। বাপ-দাদার ধর্মীয় বিশ্বাসের ঐতিহ্য অনুসারে বা জন্মসূত্রে কোনো ধর্মমতকে বিশ্বাস করাকে ঈমান বলা হলে, তাওহীদের উপর ঈমান আনা এবং শিরকের উপর ঈমান আনা উভয়টি সমান হয়ে যায়। অথচ শিরকের পক্ষে না আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো কিতাবের সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে আর না কোনো মানুষ শিরককে সত্য বলে জানতে পেরেছে এবং না বিবেকবুদ্ধি শিরকের পক্ষে কোনো প্রকৃত যুক্তি অবলম্বন করে। পক্ষান্তরে আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবসমূহে তাওহীদ সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, নবী-রসূলগণ জ্ঞানের ভিত্তিতে তাওহীদের সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং বিবেক-বুদ্ধিও তাওহীদকে প্রকৃত যুক্তিসিদ্ধ হিসেবে পায়। সুতরাং ঈমান প্রকৃত জ্ঞান ও যুক্তির উপর ভিত্তিশীল। তবে ঈমানের বিষয়টি বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতামূলক প্রমাণ নয় বা ল্যাবরেটরি টেস্টের বিষয় নয়। ঈমানের বিষয়টি নিদর্শনগত জ্ঞান ও যুক্তির উপর নির্ভরশীল। তাই ঈমানের বিষয়ে মানুষকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে। এ স্বাধীনতার দুটি তাৎপর্য রয়েছে, যেমন এর একটি দিক হলো: যারা ঈমানের বিষয়টি উপলব্ধি করতে দেরি হবে তারা যেন ঈমানে উপনীত হওয়ার জন্য নিদর্শনগত জ্ঞানচর্চার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসতে পারে এবং এজন্য পর্যাপ্ত সময় পেতে পারে। অন্যটি হলো: যাদেরকে কেউ যথানিয়মে ঈমানের দিকে আহবান করেছে এবং/বা তারা ঈমানের বিষয়টি বুঝতে পেরেছে, তা সত্ত্ব্বেও তারা প্রবৃত্তির অনুসরণ, বাপ-দাদার ঐতিহ্যপ্রীতি এবং পার্থিব স্বার্থবাদিতার সংকীর্ণতা প্রভৃতি কারণে ঈমান আনা থেকে বিরত থেকেছে, তাদেরকে তাদের এ অপরাধের জন্য আল্লাহ নিজেই দন্ড দিবেন, আল্লাহ প্রদত্ত স্বাধীনতার অবকাশ সত্ত্বেও অন্য কেউ তাদের উপর বলপ্রয়োগ করবে তা হতে পারে না।

ঈমান বলতে শুধুমাত্র আল্লাহ আছেন এরূপভাবে অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেয়াকে বুঝায় না। ইবলিশ শয়তানও মানে যে, আল্লাহ আছেন, তবুও সে মু’মিন (বিশ্বাসী) নয়, বরং কাফির (অবিশ্বাসী)। সুতরাং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখার অর্থ শুধুমাত্র তাঁর অস্তিত্বের স্বীকৃতি নয়, বরং তাঁর অস্তিত্ব্, গুণ-ক্ষমতা ও অধিকারের বিষয়ে এমন বিশ্বাস যা বাস্তব কাজের মাধ্যমে প্রমাণযোগ্য। যেমন, যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, মূল বিধান দেয়ার ক্ষমতা ও অধিকার শুধুমাত্র আল্লাহর, সে ব্যক্তির এ বিশ্বাসের প্রতিফলনস্বরূপ সে আল্লাহর বিধানকেই তার জন্য একমাত্র মূল বিধান হিসেবে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে। বাস্তব জীবনে আল্লাহর বিধানের প্রতি কোনোরূপ দায়িত্বশীলতা বজায় না রাখার দ্বারা বুঝায় যে, বস্তুত সে আল্লাহকে বিধানদাতা এবং নিজেকে বিধান পরিপালনের জন্য দায়বদ্ধ হিসেবে বিশ্বাস করে না। এক্ষেত্রে পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে কখনো বিচ্যুতি হওয়া অস্বাভাবিক না হলেও একজন মু’মিন এরূপ ক্ষেত্রে অনুতপ্ত হয়ে নিজেকে সংশোধন করে নিবে এবং আল্লাহর বিধান পরিপালনের দিকে ফিরে আসবে বা তাওবাহ করবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি হরহামেশা আল্লাহর বিধান লংঘন করে এবং এজন্য তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা কাজ করে না বা সে নিজেকে সংশোধনের কোনো প্রয়াস রাখে না, বস্তুত সে ঈমানের দাবিদার হতে পারে কিন্তু ঈমানদার হতে পারে না। একজন বেঈমান মাত্রেই তার প্রভুর প্রতি অকৃতজ্ঞ ও সত্য অস্বীকারকারী, সে কারো প্রতি প্রকৃত বিশ্বস্ত হতে পারে না। নিজের ও বিশ্বজগতের মধ্যে থাকা নিদর্শন এবং আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের তথ্য ও যুক্তিপ্রমাণের ভিত্তিতে ঈমান আনা বিবেক-বিকশিত মানুষের সর্বপ্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর তারাই ঈমান আনার দাবিতে সত্যবাদী যারা আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাবকেই তাদের দ্বীন বা জীবনব্যবস্থার একমাত্র দলীল হিসেবে গ্রহণ করে তথা আল্লাহর বিধানকেই তাদের জীবন পরিচালনার একমাত্র মূল বিধান হিসেবে গ্রহণ করে।

পরিভাষা

আখিরাত  آخِرَة : আখিরাত শব্দের অর্থ হলো ‘পরকাল’। শাব্দিকভাবে দেখলে প্রত্যেক পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় পরবর্তী সময় হলো ‘পরকাল বা আখিরাত’। কিন্তু পরিভাষায় মহাপ্রলয়ের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সমাপ্তির পর আবার নতুন মহাবিশ্ব সৃষ্টির মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতিকে পুনরুত্থিত করে স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক চূড়ান্ত বিচার কার্যকর করার কালকে আখিরাত বলে। আল্লাহর সামনে বিচার দিবসে জবাবদিহির জন্য দাঁড়াতে হবে এবং তিনি চূড়ান্ত বিচারের মাধ্যমে পার্থিব জীবনের সমগ্র কর্মকাণ্ডের ফলাফল হিসেবে পুরস্কার বা শাস্তি প্রদান করবেন, এই বিশ্বাসের মাধ্যমেই আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের পরিপূর্ণতা আসে। সঠিকভাবে আল্লাহ প্রদত্ত জীবনব্যবস্থার অনুসরণের জন্য আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমল  عَمَل : আমল শব্দের অর্থ হলো ‘কাজ’ এবং ‘আমলে সালেহ’ এর অর্থ হলো ‘সৎকর্ম, সংশোধনমূলক কাজ, যোগ্যতা অর্জনমূলক কাজ’। ঈমানের বিবেচনা ছাড়া সাধারণভাবে বিবেকসিদ্ধ ন্যায়কাজকে আমলে সালেহ বা সৎকর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু একজন মু’মিনের জন্য ঈমানের দাবি অনুসারে সম্পাদিত যাবতীয় কার্যাবলি ‘আমলে সালেহ’ এর অন্তর্ভুক্ত। প্রচলিত ধারণামতে আমলে সালেহ বা সংক্ষেপে আমল বলতে উপাসনামূলক কাজগুলোকে বুঝানো হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো মানুষ যত কাজ করে তার সবই আমল, এর মধ্যে যা ভালো কাজ তা হলো ‘আমলে সালেহ’ আর যা মন্দ কাজ তা হলো ‘আমলে ছাইয়িয়াত’। সুতরাং জান্নাতে যাওয়ার শর্ত হিসেবে যে ‘ঈমান ও আমলে সালেহ’ এর উল্লেখ করা হয়েছে তা সম্পাদন করতে হলে ঈমানের দাবি তথা কুরআনের বিধান অনুযায়ী সাধ্যমতো যাবতীয় সৎকর্ম সম্পাদন করতে হবে।

আল্লাহ  اللَّه : আল্লাহ শব্দটি গঠিত হয়েছে ‘আল + ইলাহ এর সন্ধি হিসেবে। ‘আল শব্দটি ‘পদাশ্রিত নির্দেশক’ (Definite Article)। আর ‘ইলাহ অর্থ হলো ‘সার্বভৌমত্বের অধিকারী, সর্বময় প্রয়োজন পূরণকারী ও উপাস্য’। শাব্দিক বিশ্লেষণে ‘আল্লাহ’ শব্দের অর্থ হলো ‘একমাত্র ইলাহ’। কিন্তু ‘আল্লাহ’ শব্দটি বিশ্বপ্রভুর একটি নাম বিধায়, ‘আল্লাহ’ শব্দটির মাধ্যমে মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা ও প্রতিপালককে বুঝানো হয়। আল্লাহ একমাত্র পরম সত্তা যিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন। তিনি ছাড়া আর কোনো সত্তা বা কোনো কিছুই ছিল না, সবকিছুই তিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি সমগ্র জগতের প্রতিপালক-প্রভু এবং তাঁর ইচ্ছা ও তাঁর তৈরি নিয়মেই সবার সৃষ্টি-বিকাশ-লয় সংঘটিত হয়। সমগ্র কুরআন জুড়ে আল্লাহর পরিচয় বিবৃত রয়েছে। সূরা ইখলাসে আল্লাহর পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে: “বলো, তিনি আল্লাহ, একক। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, অন্য সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেন না এবং কেউ তাঁকে জন্ম দেয়নি। তাঁর মতো কেউই নেই”।

ইয়াক্বীন  يَقِين : ইয়াক্বীন শব্দের অর্থ হলো ‘নিশ্চয়তাবোধ, নিশ্চিত বিষয়’। যেমন: আমরা নিশ্চয়তাবোধ করি যে, আমাদের সবারই মৃত্যু হবে। তাই মৃত্যু আমাদের কাছে একটি ইয়াক্বীন বা নিশ্চিত বিষয়। আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসকে ‘আখিরাতের প্রতি ইয়াক্বীন’ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। ২৭:১৩-১৪ আয়াত অনুসারে প্রতীয়মান হয় যে, ঈমান ও ইয়াক্বীনের মধ্যে ইয়াক্বীন প্রাথমিক পর্যায়ের বিষয় এবং ঈমান চূড়ান্ত পর্যায়ের বিষয়। তাই ফেরাউন ও তার ক্বওম অন্তরে ইয়াক্বীন পাওয়া সত্ত্বেও ঈমান আনেনি।

ঈমান  إِيمَانِ : ঈমান শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘বিশ্বাস’। তবে কুরআনে ঈমান বলতে সন্দেহাতীত দৃঢ় বিশ্বাসকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কুরআনের আলোকে ঈমান বলতে বুঝায় কুরআনে যেসকল সত্তা ও বিষয়বস্তুর প্রতি বিশ্বাস রাখার নির্দেশনা রয়েছে, যথা: আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর নবী-রসূলদের প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি; এসবের প্রতি কুরআনের বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বাস করা। এটাই ঈমানের পারিভাষিক অর্থ। অন্যদিকে শাব্দিক অর্থে কুরআনে বর্ণিত তথ্যের বিপরীতে কোনো সত্তা বা বিষয়বস্তুতে বিশ্বাস করাও ঈমান, যে ধরনের ঈমানকে ‘ঈমান বিল বাতিল’ বা ‘অগ্রহণযোগ্য ও অযৌক্তিক বিশ্বাস’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন অনুযায়ী ঈমান শুধুমাত্র বিশ্বাস নয়, বরং এমন বিশ্বাস, বিশ্বাসী ব্যক্তির নিজ চিন্তা, কথা ও কাজ যা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। আল্লাহ সম্পর্কে কুরআনে থাকা তথ্য অনুযায়ী একত্ববাদী বিশ্বাসই হলো ‘আল্লাহর প্রতি ঈমান’। অন্যদিকে শিরকমিশ্রিত ঈমান তথা শিরক (আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারের ক্ষেত্রে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা) সবচেয়ে বড় অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। তবে ঈমান আনা না আনার ক্ষেত্রে মানুষকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, সে নিজ ইচ্ছায় ঈমান আনবে বা কুফর করবে, তাকে এক্ষেত্রে বাধ্য করা যাবে না। যদি সে ঈমান আনে তাহলে সে এর সুফল পাবে আর যদি সে কুফর করে তাহলে সে এর কুফল ভোগ করবে। মানুষ যেন ঈমান আনতে পারে সেজন্য তাদেরকে কুরআনের তথ্য ও যুক্তিপ্রমাণ উপস্থাপন পদ্ধতি অবলম্বন করে ঈমানের দিকে আহবান করতে হবে। যাকে আল্লাহর আয়াতের মাধ্যমে ঈমানের দিকে আহবান করা হয় অথচ সে ঈমান আনে না, সে সবচেয়ে বড় জালিম হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

ওয়াহী  وَحْيٌ : ওয়াহী শব্দের অর্থ হলো ‘ইঙ্গিত’। কুরআনে ওয়াহী শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রকৃতিগতভাবে সৃষ্টিজগতে যে ইঙ্গিত কাজ করে সেটাকেও ওয়াহী বলা হয়েছে। যেমন, মৌমাছিকে মধু সংগ্রহের ওয়াহী করা হয়েছে। আবার আল্লাহর বিধান প্রবর্তনকে বা কিতাব নাযিলকেও ‘ওয়াহী করা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘আল্লাহর কিতাবের আয়াতকে’ ওয়াহী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যদিকে নবী-রসূলদের কাছে অবতীর্ণ কিতাবের বাহিরে কোনো মানুষকে কোনো বিশেষ বিষয়ে অলৌকিকভাবে কোনো কিছু জানিয়ে দেয়াকেও ‘ওয়াহী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আল্লাহর কিতাবে থাকা প্রত্যয়ন ব্যতীত কেউ অন্য কারো নিকট তার প্রতি ওয়াহী হয়েছে মর্মে দাবি করলে তাতে ঈমান আনার কোনো অবকাশ নেই। যে ব্যক্তির নিকট কোনো ওয়াহী করা হয়নি, অথচ সে ওয়াহীর দাবি করে তাকে সবচেয়ে বড় জালিম হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। ‘ওয়াহী’ শব্দটি সাধারণ অর্থেও প্রয়োগ করা হয়েছে। যেমন: শয়তান যে ধরনের কথা ছড়ায় সেটাকে শয়তানের ওয়াহী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিতাব  كِتَاب : কিতাব শব্দের অর্থ ‘লিখিত জিনিস, বই-পত্র, বিধানগ্রন্থ, বিধিবদ্ধ বিধান, লিখিত বা অলিখিত বিধান, কার্যবিবরণী, প্রাকৃতিক বিধি ইত্যাদি’। কিতাবের প্রতি ঈমান বলেতে বুঝায় আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের প্রতি ঈমান। মহান আল্লাহ যুগে যুগে মানুষের হিদায়াতের জন্য তাদের মধ্য থেকে যাদেরকে নবী-রসূল হিসেবে বাছাই করেছেন তাদের কাছে কিতাব নাযিল করেছেন। এ কিতাবসমূহের মধ্যে সর্বশেষ কিতাব হলো ‘আল কুরআন’। আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের বাহিরে দ্বীন ইসলামের বিষয়ে কোনো দলীল বিধানগত মর্যাদা পেতে পারে না। আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের বিধানই মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মূল বিধান হিসেবে সাব্যস্ত।

কুফর  كُفْر : কুফর শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘ঢেকে দেয়া’। পরিভাষায় ঈমান আনতে অস্বীকার করা, সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা, আল্লাহর বিধানকে অমান্য করা এবং আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতাকে কুফর বলা হয়। যে কুফর করে তাকে কাফির বলা হয়। কট্টরপন্থী কাফিররা আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বাধা দেয় এবং মু’মিনদের প্রতি তিরষ্কার ও নির্যাতন করে থাকে। এ ধরনের কাফিরদের থেকে মু’মিনদেরকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং তারা মু’মিনদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সাধারণ কাফির যারা মু’মিনদের উপর আক্রমণ করে না, তাদের প্রতি সদাচারমূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। যেহেতু ঈমান আনার ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ নেই, তাই কেউ চাইলে কুফর করতে পারে, এমনকি কেউ ঈমান আনার পর আবার কুফর করতে পারে, আবার ঈমান এনে আবার কুফর করতে পারে। যারা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে তারা ক্ষমার অযোগ্য হিসেবে সাব্যস্ত হবে এবং জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে।

ক্বিয়ামাত  قِيَامَة : ক্বিয়ামাত শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘জবাবদিহিতার জন্য দাঁড়ানো’। পরিভাষায় মৃত্যু পরবর্তী জীবনে আল্লাহর সামনে পার্থিব জীবনের সমগ্র কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জবাবদিহিতার জন্য দাঁড়ানোর বিষয়টি বুঝাতে ক্বিয়ামাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ক্বিয়ামাত বলতে মৃত্যু পরবর্তীতে দাঁড়ানোর বিষয়কে বুঝালেও সেই উদ্দেশ্যে মহাপ্রলয় ঘটানোকেও ক্বিয়ামাতের অংশ হিসেবে ধরা হয়। তাই ক্বিয়ামাত দিবস বলতে মহাপ্রলয় থেকে শুরু করে চূড়ান্ত বিচার পর্যন্ত সমগ্র সময়কালকে বুঝায়।

তাগুত  طَاغُوت : তাগুত শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রমকারী’। পরিভাষায় তাগুত বলতে বুঝায়: যে ব্যক্তি বা পরিষদ আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহর দাসত্ব করার পরিবর্তে নিজের দাসত্ব করতে বাধ্য করে, আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে নিজের বিধান পালনে বাধ্য করে, কাফিরদের উপর নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব বা শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনার পাশাপাশি তাদেরকে মু’মিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় নির্দেশনা দেয়। তাগুত মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করে তথা ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার একটি শর্ত হলো: তাগুতের প্রতি কুফর করা তথা তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করা, তাগুতের ইবাদাত-দাসত্ব বর্জন করা। কাফিররা তাগুতের পথে যুদ্ধ করে এবং মু’মিনরা আল্লাহর পথে তথা ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য জান ও মাল দ্বারা সংগ্রাম করে। তাগুতী অপশাসনের অপসারণের জন্য মু’মিনদের কর্মসূচী হলো: ঈমান ও আমলে সালেহ বা সৎকর্ম ও প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জনমূলক কাজের মাধ্যমে আত্মগঠন করা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যে ধর্মনিরপেক্ষ শাসক ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করে না, তাকে তাগুত আখ্যা দেয়া যায় না।

নিফাক্ব  نِفَاق : নিফাক্ব শব্দের অর্থ ‘দ্বিমুখীতা, কপটতা’। যারা বাহ্যত ঈমান আনে কিন্তু অন্তরে কুফর লুকায়িত রাখে তাদেরকে মুনাফিক্ব বলা হয়। মুনাফিক্ব হলো ‘গোপন কাফির’। যেহেতু তারা মু’মিনদের সাথে মিলেমিশে থাকে তাই তারা মু’মিনদের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর হয়ে থাকে। মু’মিনরা নিশ্চিত প্রমাণের অভাবে তাদেরকে মুনাফিক্ব হিসেবে সাব্যস্ত না করে মু’মিন হিসেবে সাব্যস্ত করতে পারে। তবে যদি কোনো বাস্তব কাজের মাধ্যমে কারো নিফাক্ব প্রমাণিত হয় তাহলে তখন তাকে মুনাফিক্ব হিসেবে সাব্যস্ত করতে হবে। যদিও অন্তরের অবস্থা আল্লাহই সম্পূর্ণ যথাযথভাবে জানেন, তবুও মু’মিনদেরকে বাস্তব কর্মভিত্তিক প্রমাণের উপর ভিত্তি করেই প্রয়োজন সাপেক্ষে তাদের শত্রু-মিত্র বা মুনাফিক্ব ও মু’মিন লোকদেরকে চিহ্নিত করতে হয়। একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে না পড়লে কাউকে মুনাফিক্ব হিসেবে সাব্যস্ত করার জন্য মু’মিনরা ব্যতিব্যস্ত হবে না। কারণ চূড়ান্ত বিচারে মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই কে মু’মিন আর কে মুনাফিক্ব তা চিহ্নিত করে পুরস্কার বা শাস্তি প্রদান করবেন। যারা মুনাফিক্ব তারা জাহান্নামের সবচেয়ে নিচু স্তরে থাকবে তথা সবচেয়ে চরম শাস্তি পাবে।

নবী  نَبِيّ : নবী শব্দের অর্থ হলো ‘সংবাদবাহক, উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত’। যাকে ‘নবুওয়াত’ বা ‘নবী হওয়ার প্রেক্ষিতে প্রাপ্ত দায়িত্ব নির্বাহ’ এর জন্য বাছাই করা হয় তাঁকে নবী বলে। আল্লাহ যুগে যুগে মানুষের মধ্য থেকে অনেককে নবী হিসেবে মনোনীত করেছেন বা দায়িত্ব প্রদান করেছেন, যাদের নিকট তিনি তাঁর কিতাব ওয়াহী বা নাযিল করেছেন। নবীদের মধ্যে সর্বশেষ হলেন মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সালামুন আলাইহি)। তাই তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যীন (শেষ নবী) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নবীপ্রথার সমাপ্তিতে ‘উলিল আমর (মু’মিনদের মধ্যকার তাদের দ্বারা নির্বাচিত নেতৃত্ব) প্রথা চালু করা হয়েছে। বর্তমানে কুরআনের আলোকে মুসলিম উম্মাহকে পরিচালনার জন্য তাদের মধ্যকার যোগ্য ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে পরামর্শের মাধ্যমে ‘উলিল আমর নিযুক্ত করতে হবে এবং পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যতক্ষণ তিনি কুরআনের আলোকে পরিচালনা করবেন ততক্ষণ তিনি উলিল আমর হিসেবে বহাল থাকতে পারবেন, অন্যথায় তাঁকে অপসারিত করে নতুন উলিল আমর নিযুক্ত করতে হবে।

ফুজূর  فُجُور : ফুজূর শব্দটির অর্থ হলো ‘নীতিহীনতা, সুনীতির লংঘন’। সূরা শামসের ৭-১০ আয়াতে মানবীয় মৌলিক প্রবণতা, যোগ্যতা ও কর্তব্য নির্দেশ করা হয়েছে, যা থেকে ফুজূরের স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, “শপথ মানবসত্তার এবং তাঁর, যিনি তাকে সঠিক গঠনে বিন্যস্ত করেছেন। তারপর তাকে বোধশক্তি দিয়েছেন কোন ধরনের আচরণ তার নীতিহীনতা এবং কোন ধরনের আচরণ তার সুনীতি রক্ষাকল্পে সাবধানতা। সুতরাং সেই সফল যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে এবং সেই ব্যর্থ যে নিজেকে কলুষিত করে”। সুতরাং কুরআন অনুযায়ী, মানুষের ব্যর্থতার মূল কারণ হলো ‘নীতিহীনতা’ জনিত কলুষতা। আল্লাহর বিধানগ্রন্থের মাধ্যমে মানুষকে নীতিহীনতা থেকে ফিরিয়ে যথার্থ নীতিবান মানুষে পরিণত করার শিক্ষা ও নির্দেশনাই প্রদান করা হয়েছে।

ফিতরাত  فِطْرَت : ফিতরাত শব্দের অর্থ হলো ‘কোনো কিছুর প্রকৃতি, যেমন: মানবপ্রকৃতি’। মানুষকে যে ফিতরাত বা মানবপ্রকৃতির উপর সৃষ্টি করা হয়েছে তার উপযোগী করেই তথা সেটিকে উৎকর্ষিত ও সঠিক পথে বিকশিত করার জন্য তার সাথে সঙ্গতিশীল করে জীবন বিধান প্রদান করা হয়েছে। তাই মানুষের কর্তব্য হলো আল্লাহ প্রদত্ত জীবনব্যবস্থার দিকে মুখ ফিরানো তথা এর যথাযথ অনুশীলন। অন্যদিকে সঠিক পথনির্দেশ অনুসরণ না করলে প্রবৃত্তির অনুসরণের মাধ্যমে মানবপ্রকৃতিতে বিকৃতি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ স্বীয় স্বার্থ রক্ষা করার প্রবণতা মানবপ্রকৃতির অংশ, কিন্তু এজন্য সঠিক পথনির্দেশের সীমারেখায় সচেষ্ট না থাকলে এই প্রকৃতিগত প্রবণতা তার প্রবৃত্তিতে তথা নীতিহীন চাহিদায় পরিণত হতে পারে এবং সে স্বার্থপরতার দোষে দুষ্ট হয়ে পড়বে। মানবপ্রকৃতির সুষ্ঠু বিকাশের জন্য মানুষকে বিবেকবুদ্ধি এবং বিধানগ্রন্থ দেয়া হয়েছে, যা যৌথভাবে প্রত্যেক মানুষকে তার স্বীয় সর্বোচ্চ সাধ্যসীমায় পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হতে সহায়তা করে।

মালায়িকা  مَلَائِكَة : মালায়িকা শব্দের অর্থ হলো ‘রাজ কর্মচারী’। পরিভাষায় বিশ্বসাম্রাজ্য পরিচালনায় মহান আল্লাহ যাদেরকে রাজকর্মচারী হিসেবে কর্মরত রেখেছেন তাদেরকে মালায়িকা বলা হয়। কুরআনে উপস্থাপিত তথ্য অনুসারে মালায়িকার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে, তাহলেই মালায়িকা সম্পর্কে যেসব ভুল ধারণার ভিত্তিতে শিরকের উদ্ভব ঘটে তা থেকে বেঁচে থাকা যাবে। যেহেতু কুরআনে মালায়িকা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে তাই সেসব তথ্যের ভিত্তিতে মালাইকা সম্পর্কে ঈমান রাখা অত্যাবশ্যক।

যন্নুন  ظَنّ : যন্নুন শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘ধারণা, অনুমান’। শব্দটি কখনো কখনো সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয় আবার অনেক ক্ষেত্রে ‘নিছক অনুমান’ (নেতিবাচক অনুমান) অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যখন ‘সত্যের বিপরীতে অনুমান’ প্রসঙ্গে বলা হয় তখন তা নেতিবাচক অর্থে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। অনুমান মানুষের চিন্তা ও কর্মের প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত একটি সাধারণ বিষয়। তবে অনুমানকে চূড়ান্ত ধরে নিয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্যের সীমালংঘন। তাই অনুমানকে যাচাই প্রক্রিয়ার জন্য কাজে লাগাতে হবে, চূড়ান্ত ধরে নিয়ে পদক্ষেপ নেয়া যাবে না। যেক্ষেত্রে নেতিবাচক অনুমান করার কোনো বিশেষ উপযোগিতা নেই, সেক্ষেত্রে অযথা নেতিবাচক অনুমান করা গুনাহের কাজে। তাই বলা হয়েছে যে, কিছু কিছু অনুমান গুনাহ। বিনা কারণে অনুমান করা থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, বেশি বেশি অনুমান করো না। ইতিবাচক অর্থে তথা ‘সাধারণ ধারণা’ অর্থে আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসকে ‘আখিরাতের প্রতি যন্নুন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ‘ধারণা, অনুমান’ শব্দটি কুরআনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

রসূল  رَسُول : রসূল শব্দের অর্থ হলো ‘বার্তাবাহক’। যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া ‘রিসালাত’ বা ‘বার্তা’ অনুসারে দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাঁকে রসূল বলা হয়। রসূল শব্দটি সাধারণ অর্থেও প্রয়োগ করা হয়েছে। যেমন: কোনো রাষ্ট্রপতি যদি কোনো রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেন তবে ঐ রাষ্ট্রদূত হলেন ঐ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একজন রসূল। এজন্য রসূলুল্লাহ ইউসুফের নিকট কারাগারে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য যে দূত এসেছিলো তাকে ‘রসূল’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে পরিভাষায় ‘রসূল’ শব্দটি মূলত ‘রসূলুল্লাহ’ (আল্লাহর রসূল) অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেহেতু কুরআনের পরে আর কোনো কিতাব নেই, আর কুরআনেও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পরে আর কোনো রসূলকে মনোনীত করা হবে মর্মে কোনো পূর্বঘোষণা নেই, তাই মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে ‘খাতামুর রুসুল শব্দের সরাসরি উল্লেখ না করা সত্ত্বেও তাঁর পরে আর কাউকে ‘রসূলুল্লাহ’ হিসেবে ঈমান আনার অবকাশ নেই। প্রত্যক্ষভাবে ‘খাতামুর রুসুল শব্দটি ব্যবহৃত না হলেও বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহই শেষ রসূল। ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ শব্দের মাধ্যমে ‘খাতামুর রুসুল শব্দটি স্বত:সিদ্ধভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় বিধায়, ‘খাতামুর রুসুল’ শব্দটি স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখের প্রয়োজনীয়তা ছিল না।

শাফায়াত  شَفَاعَة : শাফায়াত শব্দের অর্থ ‘জোড়বদ্ধতা, সহযোগি হওয়া, সুপারিশ করা’। শিরকের অন্যতম একটি দিক হলো মানুষ নিজে থেকে কাউকে আল্লাহর নিকট সুপারিশকারী সাব্যস্ত করে। কুরআনে কাউকে সুপারিশকারী সাব্যস্ত করাকে আল্লাহর শরিক সাব্যস্ত করা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কুরআনে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, সেই দিন কোনো সুপারিশ নেই এবং সুপারিশ একমাত্র আল্লাহর আয়ত্তে। সেদিন সুপারিশ কোনো উপকারে আসবে না। তবে আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন এবং যার কথা পছন্দ করবেন, যার জন্য অনুমতি দিবেন, সেক্ষেত্রে সুপারিশ হবে, যদিও তার মাধ্যমে কার্যত কোনো অপরাধী কিছুমাত্রও উপকৃত হবে না। সুতরাং বস্তুত সেদিন কোনো কার্যকর সুপারিশ নেই, যতটুকু সুপারিশের বিষয় ঘটবে তাতে সুপারিশকারীদের হিতকামিতা প্রকাশ পেলেও চূড়ান্ত অর্থে তা সুপারিশ বলে গ্রহণযোগ্য হবে না।

শিরক  شِرْك : শিরক শব্দের অর্থ হলো ‘অংশী স্থাপন করা, অংশীদার বানানো, অংশীদার সাব্যস্ত করা’। পরিভাষায় শিরক বলতে বুঝায়, “আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারের ক্ষেত্রে কাউকে কোনোরূপ অংশীদার সাব্যস্ত করা”। যেমন: কাউকে আল্লাহর পুত্রকন্যা সাব্যস্ত করা, কাউকে অলৌকিক ক্ষমতায় কোনরূপ স্বাধীন অংশপ্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করা, কাউকে কোনোরূপ মূল বিধান (যা অন্য বিধানের বিধানের অধীন নয় এরূপ বিধান) দেয়ার অধিকারী মনে করা ইত্যাদি। শিরকের সবচেয়ে প্রায়োগিক দিক হলো: আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাবের মাধ্যমে যে বিধান পাওয়া যায়, তার বাহিরে কেউ কোনো মূল বিধান রচনা বা প্রদান করার অধিকারী মনে করা বা তার দেয়া বিধানকে বা তার দেয়া বিধান মনে করে আল্লাহ প্রদত্ত বিধানগ্রন্থের বিধানের সাথে সমান গুরুত্ব প্রদান করা।

শাহাওয়াত  شَهَوَات : শাহাওয়াত শব্দের অর্থ হলো ‘কামনা-বাসনা, কামপ্রবৃত্তি’। শব্দটি সাধারণ ‘কামনা-বাসনা’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়, আবার ‘কুপ্রবৃত্তিজনিত কামনা’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। প্রসঙ্গ অনুসারে কোথায় কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা বুঝা যায়। ১৯:৫৮-৫৯ আয়াত অনুসারে, নবীদের অনুপস্থিতিতে পরবর্তীতে আসা উত্তর প্রজন্ম সালাতকে বিনষ্ট করেছে এবং ‘শাহাওয়াত’ বা ‘কামনা-বাসনার’ অনুসরণ করেছে। ১১:৮৭ আয়াত অনুযায়ী, রসূলুল্লাহ শোয়ায়েব যেভাবে সালাতকে উপস্থাপন করেছেন সেই প্রেক্ষিতে তাঁর কওমের লোকেরা তাঁকে প্রশ্ন করেছে যে, তাঁর সালাত কি তাদেরকে তাদের বাপদাদা যাদের দাসত্ব ও উপাসনা করতো সে ক্ষেত্রে এবং তাদের স্বেচ্ছাচারিতার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে নিষেধ করে?। সুতরাং ‘আল্লাহর বিধানকে বিবেচনা না করে নিছক নিজেদের কামনা-বাসনা অনুযায়ী কর্মকাণ্ড সম্পাদনই’ হলো সালাতকে নষ্ট করা। আর এ ধরনের কামনা-বাসনাকে ‘শাহাওয়াত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সায়াত  سَاعَة : সায়াত শব্দের অর্থ ‘ঘন্টা, শেষ ঘণ্টা, মহাপ্রলয়’। কুরআনে ব্যাপকভাবে মহাবিশ্বের মহাপ্রলয় বুঝাতে ‘সায়াত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। অন্য কথায়, ক্বিয়ামাত দিবসে মহাপ্রলয় সংঘটনের বিষয়টি বুঝানোর জন্য সায়াত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। তাই সাধারণত ‘ক্বিয়ামাত’ শব্দ দ্বারা ‘সায়াত’ শব্দের অনুবাদ করা হয়। সায়াত বা মহাপ্রলয় কবে সংঘটিত হবে তার সুনির্দিষ্ট সময় ব্যক্ত করা হয়নি, তবে এক সময় এই মহাবিশ্বকে ধ্বংস করে দেয়া হবে এবং পুনরায় নতুন মহাবিশ্বে পরিণত করা হবে, এ বিষয়ে বিশ্বাস রাখাকে অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে। সাধারণভাবে জানানো হয়েছে যে, সায়াত বা মহাপ্রলয় নিকটবর্তী এবং তা আকস্মিকভাবে সংঘটিত হবে।

হাওয়া  هَوَىٰ : হাওয়া শব্দের অর্থ হলো ‘প্রবৃত্তি’। কুরআনে ‘প্রবৃত্তির অনুসরণ করা, প্রবৃত্তিকে উপাস্য বানানো বা প্রবৃত্তি পুজা করা’ থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রবৃত্তির বিষয়টি এভাবে বুঝা যেতে পারে যে, আমাদের ক্ষুধা লাগলে আমরা খেতে চাই। আমাদের বিবেক বলে যে, খাবারটিতে আমাদের অধিকার তৈরি হতে হবে। তাই আমরা নিজের খাবার খেতে পারি, অন্যের দানকৃত খাবার খেতে পারি বা অন্যের থেকে কোনোভাবে বিনিময়ের মাধ্যমে খাবার সংগ্রহ করে খেতে পারি, বৈধ খাবার খেতে পারি। কিন্তু প্রবৃত্তি হলো ‘ক্ষুধা লেগেছে, তাই খাবার পেলে খেতে হবে, তাতে অধিকার আছে কিনা তা বা কোনো বৈধ পদ্ধতিতে অধিকার অর্জন করার বিষয়টি সে বিবেচনা করতে প্রস্তুত নয়’। এমতাবস্থায় বৈধতা বিবেচনা ছাড়াই খাবার পেলে খাওয়ার যে ইচ্ছা এটাই প্রবৃত্তি, আর এভাবে খাবার গ্রহণ করাই প্রবৃত্তির অনুসরণ। অন্যদিকে বৈধভাবে খাদ্য গ্রহণ করলে তাতে প্রবৃত্তির অনুসরণ হয় না, বরং বিবেকের অনুসরণ হয়।