আল কুরআনের আলোকে ঈমান

বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও অতীন্দ্রিয় সত্যের প্রতি প্রত্যয়

আল্লাহর প্রতি ঈমান

আল্লাহর পরিচয়

১১২:১-৪ :: বলো, তিনি আল্লাহ, একজনই। তিনি কারো প্রতি মুখাপেক্ষী নন কিন্তু সবাই তাঁর প্রতি মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি। তাঁর মতো কেউই নেই।

২:২৫৫ :: আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ (সার্বভৌম ও সর্বময় প্রয়োজনপূরণকারী উপাস্য) নেই। তিনি চিরজীবনের অধিকারী, চির প্রতিষ্ঠিত সত্তা। তন্দ্রা ও নিদ্রা তাঁকে স্পর্শ করে না। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে সবই তাঁর। কে আছে এমন, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে? তাদের সম্মুখের (বর্তমান, ভবিষ্যত ও প্রকাশ্য) এবং পশ্চাতের (অতীত ও অপ্রকাশ্য) সবই তিনি জানেন। একমাত্র তিনি যতটুকু ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত, তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ত করতে পারে না। তাঁরই ক্ষমতার ব্যাপ্তি পরিব্যাপ্ত রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে এবং এতদুভয়ের সংরক্ষণে তাঁকে বিব্রত হতে হয় না। তিনিই সর্বোচ্চ, মহীয়ান।

১৪:১০ :: তাদের রসূলগণ বলেছিল, ‘আল্লাহ সম্পর্কে সন্দেহ? তিনিই তো আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, তিনি তোমাদেরকে ডাকছেন তোমাদের অপরাধ মার্জনা করার জন্য আর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদেরকে অবকাশ দেয়ার জন্য।’...

৫২:৩৫-৩৬ :: তারা কি অস্তিত্বহীন কিছুর পক্ষ থেকে সৃষ্টি হয়েছে, না তারাই স্রষ্টা? তারা কি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছে? বরং তারা দৃঢ় বিশ্বাস করে না।

২:১১৭ :: তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা। আর যখন তিনি কোনো বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তখন সেজন্য বলেন ‘হও’, ফলে তা হয়।

আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহসহ সমগ্র কুরআনে অসংখ্য আয়াতে আল্লাহর সত্তা, গুণাবলি ও অধিকার বর্ণনার মাধ্যমে তাঁর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহর অস্তিত্বের পক্ষে মানুষের সহজাত যুক্তিবোধকে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়েছে যে, তাঁর অস্তিত্বকে কিভাবে অস্বীকার করা যেতে পারে যিনি সৃষ্টি করেছেন, যাঁর কথা বাদ দিলে সৃষ্টির কোনো উৎসই থাকে না, সৃষ্টির অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে, সকল সৃষ্টির আদি কারণ হলো একজন ইচ্ছাময়, জ্ঞানী, করুণাময় ও শক্তিমান স্রষ্টার ইচ্ছা। মানুষ তার চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা সৃষ্টিরহস্যের নিদর্শন থেকে স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। এছাড়া স্রষ্টার অস্তিত্বের স্বীকৃতি তার মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে, যে বিষয়ে সন্দেহ করাটাই প্রশ্নবিদ্ধ যে, সন্দেহের কি কারণ থাকতে পারে?

আল্লাহর একত্বের যুক্তিপ্রমাণ

১৬:১৭ :: যিনি সৃষ্টি করেন তিনি কি তার মতো যে সৃষ্টি করে না? তবে কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?

১৬:৭৪ :: কাজেই কারো সাথে আল্লাহর তুলনা দিও না। আল্লাহ জানেন, আর তোমরা জানো না।

৩৪:২২ ::বলো, ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ইলাহ মনে করতে তাদেরকে আহবান করো। তারা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে অণু পরিমাণ কোনো কিছুরও মালিক নয়। আর এ দু’য়ের মধ্যে তাদের কোনো অংশীদারিত্ব নেই এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ তাঁর সাহায্যকারীও নয়।

১৭:১১১ :: বলো, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি এবং তাঁর শাসনকর্তৃত্বে কোনো অংশীদার নেই এবং দুর্বলতাজনিত কোনো বন্ধু নেই (অর্থাৎ তাঁর কোনো দুর্বলতাই নেই) এবং পূর্ণ শ্রেষ্ঠত্বে তাঁরই শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো।

৪৬:৪ :: বলো, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তাদের কথা ভেবে দেখেছ কি? তারা পৃথিবীতে কি সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও অথবা আকাশমন্ডলীতে তাদের কোনো অংশীদারীত্ব আছে কি? পূর্ববর্তী কোনো কিতাব অথবা কোনো জ্ঞানগত নিদর্শন থাকলে তা তোমরা আমার নিকট উপস্থিত কর - যদি তোমরা সত্যবাদী হও।

৩৫:২ :: আল্লাহ মানুষের জন্য তাঁর অনুগ্রহ থেকে যা খুলে দেন তা নিবারণ করার কেউ নেই। আর তিনি যা বারিত করেন অতঃপর কেউ তা প্রেরণ করতে পারে না। তিনি মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রজ্ঞাময়।

৭:১৯৪ :: আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাক তারা তোমাদের মত বান্দা। সুতরাং তোমরা তাদেরকে ডাক, অতঃপর তারা যেন তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।

২২:৭৩ :: হে মানুষ, একটি উপমা পেশ করা হল, মনোযোগ দিয়ে তা শোনো, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না। যদিও তারা এ উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়। আর যদি মাছি তাদের কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেয়, তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না। অন্বেষণকারী ও যার কাছে অন্বেষণ করা হচ্ছে উভয়েই দুর্বল।

২১:২২-২৩ :: যদি আকাশ ও পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া আরো ইলাহ থাকতো তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেতো, সুতরাং তারা যা বলে, আরশের প্রভু আল্লাহ তা থেকে পবিত্র। তিনি যা করেন সে বিষয়ে তিনি (কারো কর্তৃক) জিজ্ঞাসিত হবেন না এবং তারা যা করে সে বিষয়ে তারা (তাঁর কর্তৃক) জিজ্ঞাসিত হবে।

১৭:৪২-৪৩ :: বলো, ‘তাঁর সাথে যদি আরো ইলাহ থাকতো, যেমন তারা বলে, তবে তারা আরশের অধিপতি পর্যন্ত পৌঁছার পথ তালাশ করতো’। তিনি পবিত্র ত্রুটিমুক্ত, তারা যা বলে তা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে, সমুচ্চ, সুমহান।

২৩:৯১ :: আল্লাহ কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি, তাঁর সাথে অন্য কোনো ইলাহ নেই। (যদি থাকতো) তবে প্রত্যেক ইলাহ নিজের সৃষ্টিকে নিয়ে পৃথক হয়ে যেতো এবং একে অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতো; তারা যা বর্ণনা করে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র।

৩০:২৮ :: তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে একটি উপমা বর্ণনা করেছেন; আমি তোমাদেরকে যে জীবিকা দিয়েছি তাতে তোমাদের তোমাদের অধিকারভুক্তরা (দাসদাসী) কি অংশীদার? ফলে তোমরা কি এ বিষয়ে সমান? তোমরা কি তাদেরকে তেমনভাবে ভয় করো যেমনভাবে তোমাদের পরস্পরকে ভয় করো? এভাবেই আমি আয়াতসমূহ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করি সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগ করে।

১৬:৭১ :: আল্লাহ জীবনোপকরণে তোমাদের একজনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে তারা তাদের অধীনস্থ দাস দাসীদেরকে নিজেদের জীবনোপকরণ হতে এমন কিছু দেয় না যাতে তারা এ বিষয়ে সমান হয়ে যায়; তাহলে কি তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে?

১৮:১০২ :: যারা কুফর করছে, তারা কি মনে করেছে যে, তারা আমার পরিবর্তে আমার বান্দাদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করবে? নিশ্চয় আমি জাহান্নামকে কাফিরদের আপ্যায়নের জন্য প্রস্তুত করছি।

১২:৩৯-৪০ :: (ইউসুফ বললো-) হে আমার কারাসঙ্গীদ্বয়, ভিন্ন ভিন্ন প্রভু ভালো নাকি একমাত্র মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ? তোমরা তো দাসত্ব ও উপাসনা করছো না এমন কতগুলো নামের ছাড়া যা তোমরা ও তোমাদের বাপদাদারা নামকরণ করেছো, যার পক্ষে আল্লাহ কোনো প্রমাণ নাযিল করেননি। নিশ্চয় হুকুম / বিধান দানের ক্ষমতা ও অধিকার শুধু আল্লাহর। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁর ছাড়া কারো দাসত্ব-উপাসনা করো না। এটা সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত জীবনব্যবস্থা। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই জ্ঞান অর্জন করে না।

আলোচনা: উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে জানা যায় যে, যেহেতু আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সাথে তুলনীয় নন, তাই বান্দাদের মধ্যে যেরূপ বিষয় হয়ে থাকে তার সাথে তুলনা করে আল্লাহর বিষয়ে অংশীদারিত্বের চিন্তা করা একটি মৌলিক বিভ্রান্তি। যেমন মানুষের মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে বিধায় সে রাজত্বে অন্যদেরকে অংশীদার করতে হয়, তাদেরকে সে সমান অংশ না দিলেও ক্ষমতার কিছু অংশ দিতে হয় এবং দুর্বলতাজনিত কারণে তাদেরকে বন্ধু বানাতে হয়। তবে যেহেতু মূল ক্ষমতার ক্ষেত্রে সমান অংশীদারিত্ব হতে পারে না, তাই এক্ষেত্রে তারা পরস্পরকে ভয় করে। কিন্তু আল্লাহ যেহেতু একাই স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক, যাবতীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে, তাই তাঁর ক্ষেত্রে কোনো অংশীদার থাকার অবকাশ নেই, তিনি একাই উপাস্য আর বাকি সবাই তাঁর বান্দা, তিনি তাঁর কোনো বান্দাকে তাঁর ক্ষমতার কোনো অংশে কোনোরূপভাবে অংশীদার করেন না, তাই তাঁর সাথে অন্য কাউকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করার কোনো যুক্তি নেই। মানুষদের নিজেদের একটি কর্মকাণ্ডও এ ক্ষেত্রে যুক্তি উপলব্ধির জন্য কাজে আসে। তা হলো, তারা তাদের দাসদাসীকে তাদের জীবিকা থেকে এমনভাবে অংশীদার করে না যে, তারাও তাদের মতো স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায়। অবশ্য এক্ষেত্রে তাদের এ আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ তারা নিজেরাই ঐ জীবিকার স্বয়ং মালিক নয়, বরং এটা আল্লাহই তাদেরকে দিয়েছেন। অন্যদিকে আল্লাহর ক্ষেত্রে তাঁর বান্দাদের কাউকে নিজের ক্ষমতায় অংশীদার না করা সম্পূর্ণভাবে যৌক্তিক। আল্লাহর একত্বের আরো কিছু যুক্তিপ্রমাণ হলো: যদি একাধিক ইলাহ হতো তাহলে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী বিশৃঙ্খল হয়ে পড়তো এবং প্রত্যেক ইলাহ নিজ নিজ সৃষ্টিকে নিয়ে আলাদা হয়ে যেতো এবং একে অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করতো এবং প্রত্যেকেই আরশের দখল নিতে চেষ্টা করতো, কারণ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ক্ষমতা চর্চা করার জন্য সার্বভৌম হওয়ার বিকল্প নেই। আর মানুষ একাধিক ইলাহ গ্রহণ না করে একজনকেই মাত্র ইলাহ হিসেবে গ্রহণের ক্ষেত্রে এটাও যৌক্তিকভাবে বিবেচনাযোগ্য যে, কোনো দাসের একাধিক প্রভু থাকা ভালো নাকি একজনমাত্র ইলাহ থাকা ভালো? সুতরাং মানুষের জন্য স্বত:সিদ্ধ যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হলো, একমাত্র আল্লাহকেই চূড়ান্ত হুকুম দানের ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে গ্রহণ করা।

আল্লাহর গুণাবলি

আল্লাহর সত্তার সাথে সম্পর্কিত গুণাবলি:

আল্লাহর অনেক গুণ রয়েছে যা তাঁর সত্তার সাথে সম্পর্কিত অর্থাৎ তা কখনো তাঁর সত্তা থেকে পৃথক হয় না। যেমন, তাঁর ক্ষমতা, এমনটি সম্ভব নয় যে, তিনি কখনো ক্ষমতাবান থাকবেন এবং কখনো ক্ষমতাবান থাকবেন না। বরং তিনি সবসময় ক্ষমতাবান। বিভিন্ন আয়াত থেকে আল্লাহর সত্তার সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন গুণাবলি সম্পর্কে জানা যায়। যেমন: (৩)

১. হায়াত (জীবন): আল্লাহ চিরজীবনের অধিকারী। (২:২৫৫, ৩:২, ২৫:৫৮, ৪০:৬৫)

২. ক্বুদরত (ক্ষমতা): আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা করার ক্ষমতার ধারক। (২:২০, ৬:৩৭, ১৮:৪৫)

৩. ইলম (জ্ঞান): আল্লাহ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত এবং অন্যদের কাছে প্রকাশ্য ও গোপন সকল কিছুই জানেন। (২:২৯, ৬:৩৭, ৫:১০৯, ১১:৩১)

৪. সামায়াত (শুনা): আল্লাহ শ্রবণের অধিকারী। (২:১৮১)

৫. বাসারাত (দেখা) ও আইন (চোখ): আল্লাহ দর্শনের অধিকারী এবং সবকিছুই তাঁর চোখের সামনে আছে। (২:৯৬, ২০:৩৯)

৬. ইরাদা (ইচ্ছা): আল্লাহ ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। (২:১৮৫)

৭. নাফস (সত্তা): আল্লাহ পরম সত্তার অধিকারী। (৩:৩০, ৫:১১৬, ৬:১২, ৬:৫৪)

৮. ওয়াজহু (চেহারা, সত্তা, সন্তুষ্টি): যেদিকেই মুখ ফিরানো হোক সেদিকেই আল্লাহর সত্তা বিরাজিত। (২:১১৫, ২:২৭২, ২৮:৮৮, ৫৫:২৭)

৯. ইয়াদ (হাত): কল্যাণ ও অনুগ্রহ আল্লাহর হাতে। (৩:২৬, ৩:৭৩)

১০. উলূ (ঊর্ধ্বত্ব/ ঊর্ধ্বে অবস্থান): আল্লাহ সবার ঊর্ধ্বে রয়েছেন। (১৭:৪৩, ২:২৫৫, ১৩:৯, ৬:১০০)

১১. সর্বব্যাপীতা ও নৈকট্য: আল্লাহ সর্বব্যাপী এবং তাই সবার অত্যন্ত নিকটে। (২:১১৫, ২:২৫৫, ২:১৮৬, ৫০:১৬, ৫৬:৮৫)

১২. ইসতিওয়া (আরশের উপর অধিষ্ঠিত হওয়া): আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আরশের উপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তথা নিয়ন্ত্রণ ও কার্যপরিচালার্থে স্বীয় রাজাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। (৭:৫৪)

(৩) তথ্যসূত্র হিসেবে পয়েন্টভিত্তিক এক বা একাধিক আয়াত নাম্বার উল্লেখ করা হলো। একাধিক আয়াতের ক্ষেত্রে সাধারণত আরবি শব্দের একাধিক শব্দরূপ বিবেচনা করা হয়েছে।

আল্লাহর কর্মের সাথে সম্পর্কিত গুণাবলি:

আল্লাহর এমন অনেক গুণ রয়েছে যা তাঁর কর্মের সাথে সম্পর্কিত। এগুলো তাঁর ইচ্ছাধীন বিষয়। যেমন, তিনি যখন ইচ্ছা কারো সাথে কথা বলবেন এবং যখন ইচ্ছা তার সাথে কথা বলা থেকে বিরত থাকবেন। বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহর কর্মের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন গুণাবলি সম্পর্কে জানা যায়। যেমন:

১. লিখনি: আল্লাহ মহাবিশ্বের সকল কিছুর অনিবার্য নিয়মাবলি বা কারণ ও ফলাফল বিধি লিখে রেখেছেন। (৬:৫৯, ৯:৫১)

২. আল্লাহ সৃষ্টিকে অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্বে এনেছেন এবং সৃষ্টির পুনরাবৃত্তি ঘটান। (১৯:৯, ১৯:৬৭, ১০:৪, ৮৫:১৩, ২:১১৭, ৬:১০২, ১৫:৮৬, ৫৯:২৪)

৩. আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন নবসৃষ্টি করেন এবং বিভিন্ন কিছুর উদ্ভাবন ও তার বিভিন্ন সংমিশ্রণ তৈরি করেন। (৩:৪৭, ৫:১৭, ২৪:৪৫, ২৮:৬৮, ২৪:৪৫, ৩৫:১)

৪. আল্লাহ জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেন, তিনিই জীবন ও মৃত্যু দেন। (৬৭:২, ৪০:৬৮)

৫ আল্লাহ জীবিকা প্রদান করেন। (৫১:৫৮, ১১:৬)

৬. কালাম (কথা বলা): আল্লাহ যখন ইচ্ছা কথা বলেন। (২:২৫৩)

৭. গাদাব (ক্রোধ) ও শাস্তি প্রদান: আল্লাহ তাঁর অবাধ্যদের প্রতি ক্রোধান্বিত হন এবং তাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন। (৬০:১৩)

৮. রিদা (সন্তুষ্টি), মহব্বত (ভালবাসা) এবং ক্ষমা করা ও দয়া: আল্লাহ তাঁর অনুগতদের প্রতি সন্তুষ্ট হন, তাদেরকে ভালবাসেন, ক্ষমা করেন এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করেন। (৫:১১৯, ২:১৯৫, ২০:৮২, ৬:১৪৭)।

আল্লাহর গুণাবলির কয়েকটি বিশেষ দিক

(১) সত্তা, গুণক্ষমতা ও বিধানে অদ্বিতীয়, অতুলনীয় ও ত্রুটিমুক্ত, সীমাবদ্ধতা মুক্ত

[আল্লাহ ইচ্ছাময়-ক্ষমতাধর অস্তিত্ব কিন্তু তিনি দেহ ও লিঙ্গ ইত্যাদি সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত, তাঁর কোনো পিতামাতা, পুত্র-কন্যা, স্ত্রী/স্বামী নেই, সুতরাং তাঁর ভাইবোন বা অন্য আত্মীয়ের প্রশ্নেরও অবকাশ নেই]

(২) অনাদিত্ব-অনন্ততা

(৩) অমুখাপেক্ষিতা এবং তাঁর প্রতি সকলের মুখাপেক্ষিতা

(৪) দয়া, জ্ঞান ও ক্ষমতা দ্বারা সবকিছুকে পরিবেষ্টন, দৃষ্টি দ্বারা সবাইকে অবধারণ এবং সবার সবচেয়ে নিকটে থাকা

(৫) বিধান / আদেশ-নিষেধ-অনুমতি প্রদান, কিতাব নাযিল ও রসূল প্রেরণ

(৬) ফেরেশতাদেরকে নিযুক্ত করা

(৭) প্রতিপালন, বিধান নির্ধারণ, নিয়ন্ত্রণ, জীবন-মৃত্যু সৃষ্টি ও পরিচালনা

(৮) কর্মফল প্রদান ও প্রার্থনা পূরণ ((তিনি বিশ্বাসীদের প্রার্থনায় সাড়া দেন, তবে সর্বক্ষেত্রে মানুষ যা চাই তাই পায় না, জলে-স্থলে মানুষের যে বিপদাপদ তা তাদের নিজ হাতের উপার্জন, আল্লাহ অনেক কিছু ক্ষমা/রোধ করে দেন, মানুষের জন্য (পুরস্কার বা শাস্তি হিসেবে) তা ছাড়া কিছুই নেই, যার জন্য সে নিজে কর্মপ্রচেষ্টা করে)

(৯) ন্যায়বিচার ও দয়া, ক্ষমা ও শাস্তি প্রদান

(১০) প্রশ্নের ঊর্ধ্বে, স্বয়ং অধিকারের উৎস, পরম যৌক্তিকতাসহ কর্মসম্পাদন, ভুল করেন না ও ভুলে যান না

[সুতরাং আমাদেরকে সৃষ্টি করার এবং ক্ষুধা ও খাদ্য ইত্যাদি দেয়ার কী প্রয়োজন ছিলো অথবা যারা স্রষ্টার বিধান অমান্য করবে তাদেরকে সৃষ্টি করার কী প্রয়োজন ছিলো ইত্যাদি প্রশ্ন করা অসঙ্গত এবং আল্লাহর বিষয়ে আপত্তিকর বিতর্ক হিসেবে সাব্যস্ত। বলা হয়েছে, আল্লাহর বিষয়ে বিতর্ক?, এছাড়া আল্লাহকে যেভাবে মর্যাদা দেয়া উচিত এটা তার বিপরীত।]

(১১) সত্তাগতভাবে গুপ্ত, গুণগত পরিচয়ে প্রকাশ্য

(১২) সর্বব্যাপী।

(১৩) সবকিছুকে পরিবেষ্টনকারী।

(১৪) মহাবিশ্বের রাজত্বের একমাত্র রাজা, সার্বভৌম, সর্বময় প্রয়োজন পূরণকারী, একমাত্র উপাস্য।

আল্লাহর গুণাবলি উপলব্ধিতে মানবীয় সীমাবদ্ধতা

শুধুমাত্র আল্লাহর অস্তিত্ব থাকা এবং তাঁর জন্য উল্লেখিত গুণসমূহের বিষয়ে যৌক্তিকতা অনুধাবন ও তার বাস্তবতা / সত্যতা অনুভব করা আমাদের পক্ষে সম্ভব কিন্তু তাঁর গুণসমূহকে যথাযথভাবে অনুভব করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ সেটা আমাদের অভিজ্ঞতার বাহিরের বিষয়। সুতরাং আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে যেসব বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার না করার ফলশ্রুতি বলা যেতে পারে। এসব বিষয়ে যা কুরআনে নেই এমন কোনো বিতর্কে জড়িয়ে কোনো একটি মতে উপনীত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যেমন আল্লাহ সাকার না নিরকার? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আমাদের প্রয়োজন নেই। কারণ কোনো আয়াতে আল্লাহকে সাকার বা নিরাকার কিছুই বলা হয়নি।

আল্লাহর গুণাবলির বিষয়ে আল্লাহর জানানো কিতাবের তথ্যের বাহিরে নিজেদের মনগড়া দাবির মাধ্যমে যে বিভ্রান্তিকর শিরকমিশ্রিত ঈমানের উদ্ভব ঘটেছে তা হলো সর্বেশ্বরবাদ। অথচ কুরআন অধ্যয়ন করলে যে কারো পক্ষে স্পষ্টভাবে বুঝা সম্ভব যে, সবকিছু আল্লাহর, কিন্তু সবকিছু আল্লাহ নয়। সুতরাং আল্লাহ সবকিছুর সবকিছু হিসেবে থাকা অর্থে সর্বত্র বিরাজমান নন, যদিও তিনি সর্বব্যাপী কিন্তু তা সত্ত্বেও সৃষ্টি ও স্রষ্টা স্বতন্ত্র, উভয়ে একাকার নয়। আল্লাহর সত্তার স্বরূপ ও সত্তাগত অবস্থান আমাদের অতীন্দ্রীয় বিষয়। আর তাই তার কোনো স্বরূপ নির্ধারণ করে সেটাকে যৌক্তিক সাব্যস্ত করার প্রশ্ন নেই।

কেউ কেউ একটি বক্র প্রশ্নের অবতারণা করে যে, সর্বব্যাপী এবং সবকিছুকে পরিবেষ্টনকারী হওয়ার মধ্যে স্ববিরোধ রয়েছে কিনা? যেমন, যদি সবকিছুকে পরিবেষ্টনকারী হয়, তবে সর্বব্যাপী হওয়া সম্ভব কিনা? এ ধরনের প্রশ্ন আল্লাহর গুণকে সীমাবদ্ধতার মাধ্যমে অনুধাবন চেষ্টার ফল। মূলত তিনি সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে, তাই একই সাথে উভয় গুণই সত্য।

অনুরূপভাবে আল্লাহ সর্বব্যাপী হওয়া সত্ত্বেও তিনি আকাশে বা আকাশের উপর আছেন বলার তাৎপর্য নিয়েও বিভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয়। অথচ এটা একটা ভাষাগত অভিব্যক্তি, যা আল্লাহর গুণগত ঊর্ধ্বত্বকে ভাষাগতভাবে আকাশের সাথে সম্পর্কিত করে, যার বাগর্থ হলো তিনি সবার ঊর্ধ্বে আছেন, স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে আছেন। তেমনি রসূল আকাশের দিকে তাকানোর (২:১৪৪) কারণ হলো আল্লাহর প্রতি মর্যাদাপূর্ণ অভিব্যক্তিস্বরূপ ঊর্ধ্ব দিকে তাকানো, যদিও আল্লাহ দিকের সাথে সম্পর্কিত নন, তবে মনোদৈহিক অভিব্যক্তিতে নিম্ন ও ঊর্ধ্বের মধ্য থেকে ঊর্ধ্ব দিকের সাথে সম্পর্কিত করা আল্লাহর গুণগত ঊর্ধ্বত্বের প্রতি মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

আল্লাহর আমর ও খালক্ব এবং খালক্বের বিষয়ে অপরির্তনীয়তা

আমর মানে আদেশ ও সিদ্ধান্তকর বিষয় এবং খালক্ব মানে সৃষ্টি। আদেশও আল্লাহর এবং সৃষ্টিও আল্লাহর। আমর হলো বিশ্বজগতের যাবতীয় বিষয়ের পরিকল্পনা, প্যার্টান বা ডিজাইন এবং খালক্ব হলো সেই অনুসারে সব কিছুর সৃষ্টি বা বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করা। (প্রাসঙ্গিক আয়াত ৭:৫৪, ৩৩:৩৮, ৪০:৬৮)।

‘আল্লাহর খালক্বের কোনো বদল নেই’ (৩০:৩০) কথাটির তাৎপর্য হলো, অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যের জন্য যা সৃষ্টি করা হয়েছে সে উদ্দেশ্যের জন্য তাই লাগবে এবং যে উদ্দেশ্যে যা সৃষ্টি করা হয়েছে সে উদ্দেশ্যেই তা প্রয়োগ করা যথাযথ। সকল অপ্রাণ ও সপ্রাণ সৃষ্টি বিভিন্ন শ্রেণিগত সৃষ্টিপ্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল অলংঘনীয় নীতিমালার সাথে সম্পর্কিত। যেমন, সপ্রাণ সৃষ্টির শরীরের কোষের গঠন ও ভিতরের মূল পরিচালনা পদ্ধতি, কর্মপদ্ধতির বিষয়ে মানিসক বোধি ও সজ্ঞা, রোগ প্রতিরোধের জন্মগত ক্ষমতা, বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা ও নিয়ম, বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা ও খাদ্যের মৌলিক উপাদান, দলবদ্ধভাবে জীবন যাপন পদ্ধতি ইত্যাদিতে নীতিগত সামঞ্জস্য রয়েছে। তাই সৃষ্টি প্রকৃতি নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে তা থেকে সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী মানুষ তাদের জীবন পদ্ধতির ক্ষেত্রে সঠিক জ্ঞান অর্জনের উপাদান খুঁজে পাবে।

আল্লাহর কালিমাত ও সুন্নাত

আল্লাহর কালিমাত বা মূল বাণীর বদল হতে পারে না। আল্লাহর নাযিলকৃত পরবর্তী কিতাবের কোনো আয়াত দ্বারা পূর্ববর্তী কিাতবের কোনো আয়াতের বদল বা রহিতকরণ হতে পারে, কিন্তু তার মাধ্যমে আল্লাহর কালিমাতের বদল হয় না, কারণ প্রতিটি কিতাব বা তার আয়াত তার নিজস্ব অবস্থানের (নির্দিষ্ট সময়সীমার বা বিষয়বস্তুগত পরিসরের) জন্য স্বপ্রতিষ্ঠিত এবং এভাবে পরবর্তী আয়াতটির মাধ্যমে যে বদল ঘটে তা কালিমাতের বদল হিসেবে সাব্যস্ত হবে না। বলা হয়েছে যে, ‘তোমার নিকট তোমার প্রভুর ওহিকৃত কিতাব অধ্যয়ন করো। তাঁর কালিমাত বদল করার কেউ নেই এবং তুমি তাঁকে ছাড়া কোনো আশ্রয় পাবে না (১৮:২৭)। এ থেকেও বুঝা যায় যে, কোনো আয়াত অন্য আয়াত দ্বারা বদল বা রহিত হওয়ার বিষয়টি একই কিতাবের মধ্যকার বিষয় নয়।

অনুরূপভাবে আল্লাহ কোনো ক্ষেত্রে কোনো বাহ্যিক অবস্থার বা কারণ ও ফলাফল (Cause and effect) বিধির পরিবর্তন করলেও তাতে আল্লাহর সুন্নাতের বদল হয় না। কারণ আল্লাহর সুন্নাত বা মূলনীতির অপরিবর্তনীয়তা কোনো বাহ্যিক অবস্থা বা কারণ ও ফলাফল (Cause and effect) বিধির ব্যতিক্রমের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং ঐ ব্যতিক্রমের মাধ্যমে আল্লাহর কোনো গুণের কার্যগত পরিবর্তন না হওয়ার সাথে সম্পর্কিত। যেমন, ন্যায়বিচার আল্লাহর একটি গুণ, কোনো জাতিকে তাদের অবস্থা অনুসারে কিছু বিধান দেয়া এবং অন্য জাতিকে তাদের অবস্থা অনুসারে অন্য কিছু বিধান দেয়ার মাধ্যমে যতক্ষণ ন্যায়বিচার গুণের মধ্যে কোনো তারতম্য ঘটে না ততক্ষণ এরূপ ব্যতিক্রম আল্লাহর সুন্নাতের ব্যতিক্রম নয়। পক্ষান্তরে যদি তার মাধ্যমে আল্লাহর ন্যায়বিচার গুণের পরিবর্তন ঘটার মতো ঘটনা ঘটতো তা আল্লাহর সুন্নাতের পরিবর্তন হিসেবে গণ্য হতো, কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। সুতরাং আল্লাহর সুন্নাতের কোনো ব্যতিক্রম, পরিবর্তন বা বদল নেই।

আল্লাহর রুহ ও ফিতরাত

রুহ হলো আল্লাহর আদেশঘটিত ‘বিশেষ ইচ্ছা নির্বাহক আত্মা’। মানুষের মধ্য রুহ ফুঁকে দেয়া হয়েছে এবং এ রুহ হলো মানুষের কাছে আমানত, যার মাধ্যমে সে পৃথিবীতে বিশেষ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, যা বহুমুখী গুণসম্পন্ন এবং স্বীয় দুর্বলতাকে অতিক্রম করে ব্যাপক নিয়ন্ত্রণশক্তির অধিকারী হওয়ার উপযোগী প্রকৃতি / ফিতরাতকে ধারণ করেছে।

‘আল্লাহর ফিতরাত যার উপর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে’ কথাটির অর্থ হলো আল্লাহর নির্ধারিত ফিতরাত যার উপর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটাকেই উৎকর্ষিত ও সঠিক পথে বিকশিত করার জন্য তার সাথে সঙ্গতিশীল ও তার মাধ্যমে অর্জনীয় অবস্থার জন্য মানুষকে আল্লাহ তাঁর বিধানের মাধ্যমে সঠিক ব্যবস্থা প্রদান করেছেন।

তবে এটা কোনোভাবে বলা যেতে পারে না যে, মানুষের ফিতরাত এবং আল্লাহর ফিতরাত একই রকম বা আল্লাহর সিফাতই মানুষের সিফাত। বরং বিষয় হলো, আল্লাহর সিফাতকে বুঝানোর জন্য মানুষের যে সিফাতগুলোকে দিয়ে কাছাকাছি ধারণা দেয়া সম্ভব সেগুলোকে উল্লেখ করা হয়েছে, যথা: শুনা ও দেখা। একদিকে যেমন শুনা ও দেখা গুণের মাধ্যমে আল্লাহর এ গুণ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে তা কোনোভাবে ঠিক মানুষের শুনা ও দেখার সাথে তুলনীয় নয়। না মাধ্যমের দিক থেকে না সীমার দিক থেকে। যেমন মানুষ চোখের মাধ্যমে দেখে, কিন্তু আল্লাহ আমাদের মতো চোখের মাধ্যমে দেখতে হবে তা নয়, যদিও বাগর্থে বলা যেতে পারে যে, আল্লাহর চোখের সামনে থাকা। কোনোভাবে আল্লাহর চোখ কথাটি আমাদের চোখের সাথে তুলনীয় নয় বা আক্ষরিকভাবে অনুধাবনের উপযুক্ত নয়, বরং এটা বাগর্থ। আবার আল্লাহ একই সাথে সব দেখেন এবং অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত এবং প্রকাশ্য ও গোপন সবই দেখেন। যাই হোক, বিষয়টি হলো, এগুলো মুতাশাবিহাত, যা বাগর্থে গুণবাচক, আক্ষরিক অর্থে ধর্তব্য নয়। আল্লাহর সেই গুণসমূহকেই উল্লেখ করা হয়েছে যা মানুষের পক্ষে বুঝা সম্ভব, কারণ তা সীমিত পরিসরে মানুষের মধ্যেও রয়েছে। আর এই গুণসমূহকে সঠিক নিয়মে বিকশিত করার দায়িত্বই মানুষের জন্য আমানত।

মানুষের ফিতরাত বলতে তা বুঝায় না ফিতরাতের প্রভাবে মানুষ বাহ্যত যে কাজটি করে, বরং কাজের পেছনে থাকা কারণমূলক গুণটিই ফিতরাত। যেমন, শিশু আগুনে হাত দেয়া ফিতরাত নয়, বরং সৌন্দর্যের প্রতি ও অজানাকে জানার প্রতি আকর্ষণই ফিতরাত, যার প্রভাবে সে আগুনে হাত দেয়। মানুষ যখন মিথ্যা বলে তখন ঐ মিথ্যা বলা তার ফিতরাত নয়, বরং আত্মস্বার্থই সে ফিতরাত যার জন্য সে মিথ্যা বলে। সুতরাং ফিতরাতের প্রকাশমান রূপ স্বয়ং ফিতরাতের হুবহু প্রতিনিধিত্ব করে না। কারণ ফিতরাতের প্রকাশমান রূপ হাওয়া বা প্রবৃত্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিকৃতভাবে প্রকাশিত হতে পারে (যেমন, স্বার্থবোধ স্বার্থপরতায় রূপ নিতে পারে) অথবা বিবেকবুদ্ধি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বচ্ছভাবে প্রকাশিত হতে পারে। অন্য কথায়, প্রবৃত্তি দ্বারা প্রভাবিত হলে ফিতরাত/মানব প্রকৃতি তার স্বচ্ছ অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয় এবং তা বিকৃত হয়ে যায়, অন্যদিকে বিবেকসঙ্গতভাবে বিকশিত হলে সেটাই মানবপ্রকৃতির সুষ্ঠু প্রকাশ হিসেবে সাব্যস্ত হয়। ফিতরাতের সুষ্ঠু বিকাশের নির্দেশনা ও বিধানই মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত দীন বা জীবনব্যবস্থা। ‘রুহ’ নামক আমানাতের সঠিক ব্যবহার এবং ফিতরাতের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য দীন ইসলাম বা আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণমূলক বিধান অনুসারে জীবন পরিচালনা করা আবশ্যক।

আল্লাহর সৃষ্টি, ইচ্ছা ও অনুমতি, নির্ধারণ, লেখা ও জানার সাথে মানুষের কর্ম ও কর্মফলের সম্পর্ক

এ বিষয়টিকে সাধারণত ‘তাক্বদীরের প্রতি ঈমান’ বলা হয়, কিন্তু কুরআনে ঈমান সম্পর্কিত বিষয়সমূহের মধ্যে ‘তাক্বদীরের প্রতি ঈমান’ কথাটি স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয়নি, বরং এটাকে আল্লাহর প্রতি ঈমানের মধ্যে অন্তর্নিহিত রাখা হয়েছে। এ বিষয়টির ৬টি প্রধান দিক রয়েছে, যথা:

ক. আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা, মানুষের কর্মও এর অন্তর্ভুক্ত।

খ. আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতি ছাড়া কিছুই হয় না, মানুষের ইচ্ছাও এর অন্তর্ভুক্ত। মানুষের জন্ম-মৃত্যু, জীবিকা, জ্ঞান, ঈমান, আমল সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতির সাথে সম্পর্কিত। তিনি যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন ও শাস্তি দেন এবং যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন ও ক্ষমা করেন। তিনিই কাফিরদের চোখ, কান ও অন্তরে মোহর করে দিয়েছেন।

গ. আল্লাহ সবকিছুর জন্য তাক্বদীর বা নির্ধারণ রেখেছেন, কেউ তার ব্যতিক্রম করতে পারে না।

ঘ. আল্লাহ সবকিছু লিখে রেখেছেন, তাই মানুষের জীবনে যে বিপদাপদ পতিত হয় তার সবই লেখা আছে এবং তা আল্লাহর অনুমতিতে হয়।

ঙ. আল্লাহ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সবই জানেন। কোনো ক্ষেত্রে কখনো তাঁর জানার ব্যতিক্রম কিছুই হবে না।

চ. মানুষ স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতার অধিকারী, যেজন্য সে পুরস্কার বা শাস্তি পাবে।

আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে উপরোল্লেখিত তথ্যের সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধি না করলে এর মধ্য থেকে ‘ক’ থেকে ‘ঙ’কে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ‘চ’কে তার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হিসেবে মনে হতে পারে। তাই এ বিষয়ে সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধির জন্য নিম্নে প্রতিটি তথ্যের ভিত্তি হিসেবে থাকা কিছু আয়াত উল্লেখ করা হলো:

[ক]

৩৭:৯৬ :: আর আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা যা করো তাও (তিনিই সৃষ্টি করেছেন)।

আলোচনা: আমরা যেমন আল্লাহর সৃষ্টি তেমনি আমাদের কর্মসমূহও আল্লাহর সৃষ্টি। কারণ আল্লাহ প্রদত্ত কর্মক্ষমতা প্রয়োগ করেই আমাদের কর্মসমূহ সম্পাদিত হয়।

[খ]

৭৬:২৯-৩১ :: এটা এক উপদেশ, কাজেই যার ইচ্ছে সে (এ উপদেশ মান্য ক’রে) তার প্রতিপালকের পথ ধরুক। আর আল্লাহ ইচ্ছা করা ছাড়া তোমরা ইচ্ছা কর না। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ। তিনি যাকে ইচ্ছা তাঁর রহমতে প্রবেশ করান এবং যালিমদের জন্য তিনি প্রস্তুত রেখেছেন যন্ত্রণাদায়ক আযাব।

৮১:২৭-২৯ :: এটা বিশ্ববাসীদের জন্য উপদেশ ছাড়া অন্যরূপ নয়। তোমাদের মধ্যে যে সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথে চলতে চায় তার জন্য। আর বিশ্বপ্রভু আল্লাহ ইচ্ছা করা ছাড়া তোমরা ইচ্ছা কর না।

৭৪:৫৬ :: আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না, তিনিই ভয়ের যোগ্য, তিনিই ক্ষমা করার অধিকারী।

৪২:৪৯-৫০ :: আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা করেন তা-ই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা করেন কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা করেন পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা করেন বন্ধ্যা করেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।

৩:১৪৫ :: আর কোন প্রাণী আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মুত্যুবরণ না, তা (আল্লাহর অনুমতি) মেয়াদসম্পন্ন বিধান / লিখন। আর যে দুনিয়ার পুরস্কার চায়, আমি তা থেকে তাকে দেই, আর যে আখিরাতের পুরস্কার চায়, আমি তা থেকে তাকে দেই এবং শীঘ্রই আমি কৃতজ্ঞদেরকে (কৃতজ্ঞতার) প্রতিফল দেব।

৩৫:১১ :: আর আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে তারপর শুক্রবিন্দু থেকে তারপর তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর জ্ঞাতসারে ছাড়া কোনো নারী তার গর্ভে কিছু ধারণ করে না এবং এবং প্রসব করে না। আর কিতাবের লেখা অনুযায়ী ছাড়া কোনো বয়স্ক ব্যক্তিকে আরো আয়ু দেয়া হয় না বা তার আয়ু থেকে (আয়ু) কমানো হয় না। নিশ্চয় তা (কিতাবে লিখে রাখা) আল্লাহর জন্য সহজ।

৪২:১২ :: আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর চাবি তাঁরই আয়ত্তে রয়েছে। তিনি যাকে ইচ্ছা করেন জীবিকা বর্ধিত করে দেন এবং (যাকে ইচ্ছা করেন জীবিকা) নির্ধারিত পরিমাণমতো দেন। নিশ্চয় তিনি সব বিষয়ে জ্ঞানী।

১৩:২৬ :: আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন জীবিকা বর্ধিত করে দেন এবং (যাকে ইচ্ছা করেন জীবিকা) নির্ধারিত পরিমাণমতো দেন। আর তারা পার্থিব জীবন নিয়ে উল্লসিত, অথচ আখিরাতের তুলনায় পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী ভোগসামগ্রী ছাড়া কিছু নয়।

[অর্থাৎ কাউকে তার কোনো নৈতিক গুণের কারণে বা অন্য কোনো কারণে তথা তার নিজের বা সমাজ সমষ্টির কোনো কল্যাণার্থে তার চেষ্টা সাধনা অনুযায়ী ও প্রাকৃতিক কারণ ও ফলাফল বিধির আওতায় তার যা প্রাপ্য তার চেয়ে বেশি প্রদান করেন, অন্যদিকে কাউকে শুধু তা-ই প্রদান করেন যা প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণ অনুসারে সে পেতে পারে।]

২:২৫৫ :: … একমাত্র তিনি যতটুকু ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত, তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ত করতে পারেনা। …

১০:৯৯-১০০ :: যদি তোমার প্রভু ইচ্ছা করতেন তাহলে পৃথিবীতে যারা আছে তাদের সকলে একত্রে ঈমান আনতো। তবে কি মানুষকে জবরদস্তি করবে যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে? আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ ঈমান আনা সম্ভব নয়। আর যারা সহজাত বিচারবুদ্ধি বা Common sense প্রয়োগ করে না আল্লাহ তাদের উপর কলুষতা চাপিয়ে দেন।

৬:১১১ :: যদি আমি তাদের কাছে ফেরেশতাদের অবতীর্ণ করতাম আর মৃতরা তাদের সাথে কথা বলতো আর আমি তাদের সামনে সবকিছু সমবেত করতাম তবুও আল্লাহর ইচ্ছে ব্যতীত তারা ঈমান আনত না, কিন্তু (এটার পদ্ধতিগত কারণ হলো) তাদের অধিকাংশই মূর্খতা (বিবেক বহির্ভুত চিন্তাধারা ও আচরণ) অবলম্বন করে।

৬:১১২ :: আর এভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর শত্রু করেছি মানুষ ও জিনের মধ্য থেকে শয়তানদেরকে, তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে একে অপরকে চাকচিক্যপূর্ণ কথার কুমন্ত্রণা দেয় এবং তোমার রব যদি চাইতেন, তবে তারা তা করত না। সুতরাং তুমি তাদেরকে ও তারা যে মিথ্যা রটায়, তা ত্যাগ কর।

৬:১৩৭ :: আর এভাবে অনেক মুশরিকের জন্য তাদের শরীকরা তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করা শোভিত করেছে, যাতে তাদেরকে ধ্বংস করতে পারে এবং তাদের নিকট তাদের দীনকে সংশয়পূর্ণ করতে পারে। আর আল্লাহ যদি চাইতেন, তারা তা করত না। সুতরাং তারা যে মিথ্যা বানায়, তা নিয়ে তুমি তাদেরকে থাকতে দাও।

৬:৩৯ :: যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে তারা বধির ও বোবা, গভীর অন্ধকারে রয়েছে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা করেন সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথে স্থাপন করেন।

১৬:৯৩ :: আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে অবশ্যই তাদেরকে এক উম্মাত করতেন। কিন্তু তিনি যাকে ইচ্ছা করেন পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা করেন সঠিক পথে পরিচালিত করেন। আর তোমরা যা করো সে সম্পর্কে অবশ্যই তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে।

২:২৮৪ :: আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা আছে সবই আল্লাহর আয়ত্তে। আর যদি তোমরা তোমাদের মনে যা আছে তা প্রকাশ করো অথবা তা গোপন করো (উভয় অবস্থায়) আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নিবেন। তারপর তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবেন। আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।

২:৬-৭ :: নিশ্চয় যারা কুফর করে তাদের জন্য সমান যে, তুমি কি তাদেরকে সতর্ক করো নাকি তুমি তাদেরকে সতর্ক করো নাই। তারা ঈমান আনবে না। আল্লাহ তাদের অন্তরসমূহের উপর এবং তাদের শ্রবণশক্তির উপর মোহর করে দিয়েছেন। আর তাদের দৃষ্টিসমূহের উপর পর্দা পড়ে গেছে। আর তাদের জন্য আছে মহাশাস্তি।

৬:২৫ :: আর তাদের কেউ তোমার প্রতি কান পেতে শোনে, কিন্তু আমি তাদের অন্তরের উপর রেখে দিয়েছি আবরণ যেন তারা অনুধাবন না করে, আর তাদের কানে রয়েছে বধিরতা। আর যদি তারা প্রতিটি আয়াতও দেখে, তারা তার প্রতি ঈমান আনবে না; এমনকি যখন তারা তোমার কাছে এসে বাদানুবাদে লিপ্ত হয়, যারা কুফর করেছে তারা বলে, ‘এটা পূর্ববর্তীদের উপকথা ছাড়া কিছুই নয়।’

৪৫:২৩ :: তবে তুমি কি তাকে লক্ষ্য করেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে তার ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ সজ্ঞানে তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন এবং তিনি তার কান ও অন্তরে মোহর করে দিয়েছেন। আর তার চোখের উপর পর্দা রেখে দিয়েছেন। অতএব আল্লাহর পর কে তাকে হিদায়াত করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?

[গ]

২৫:২ :: যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্বের অধিকারী; তিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি; রাজত্বে তাঁর কোনো অংশীদার নেই। তিনি সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন, সেইসাথে তার তাক্বদীর (প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণ) করে দিয়েছেন।

[তাকদীর নির্ধারণ বলতে বুঝায় গঠন উপাদানসমূহ ও তার অনুপাত নির্ধারণ, বিভিন্ন ধরনের কর্মক্ষমতার সীমা নির্ধারণ, কর্মপদ্ধতির নিয়ম নির্ধারণ ইত্যাদি।]

৬:৯৬ :: আর তিনি (আল্লাহ) রাত্রিকে আরামদায়ক এবং সূর্য ও চন্দ্রকে হিসাবস্বরূপ (বর্ষ ও তিথি গণনার সহায়ক) বানিয়েছেন। এ হচ্ছে মহাপরাক্রান্ত মহাজ্ঞানীর নির্ধারণ (তাঁর নির্ধারিত প্রাকৃতিক বিধান)।

৩৬:৩৮-৩৯ :: আর সূর্য ভ্রমণ করে তার নির্দিষ্ট পথে, এটা মহাপরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ (আল্লাহ)-র নির্ধারণ।

৫৪:৪৯ :: নিশ্চয় আমি সবকিছু কদর / প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণসহ সৃষ্টি করেছি।

৬৫:৩ :: আর তাকে এমন উপায়/উৎস থেকে জীবিকা দিয়ে থাকি যা সে হিসাবও করেনি। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর কাজকে পরিপূর্ণতায় পৌছান। নিশ্চয় আল্লাহ সকল কিছুর বিষয়ে প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণ করেছেন।

৪২:২৭ :: আর যদি আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে জীবিকা প্রশস্ত করে দিতেন তাহলে তারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতো। কিন্তু তিনি যা ইচ্ছা করেছেন সেই প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণের মাধ্যমে অবতীর্ণ করেন। নিশ্চয় তিনি তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে পূর্ণ অবগত, সম্যক দ্রষ্টা।

[ঘ]

৫৭:২২ :: পৃথিবীতে এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যে কোনো মুসিবত আপতিত হয় না, তা সংঘটনের পূর্বেই কিতাবে লিখে রাখা বিধি অনুযায়ী ছাড়া। নিশ্চয় তা (লিখে রাখা) আল্লাহর জন্য সহজ।

৬:৫৯ :: আর তাঁর কাছে রয়েছে গায়েবের চাবিসমূহ, তিনি ছাড়া এ বিষয়ে কেউ জানে না এবং তিনি জানেন স্থলভাগে ও জলভাগে যা কিছু আছে। আর কোনো পাতা ঝরে না এছাড়া যে তিনি তা জানেন এবং পৃথিবীর অন্ধকারে কোনো দানা নেই, না কোনো ভেজা এবং না কোনো শুষ্ক কিছু, এছাড়া যে তা হয় না স্পষ্ট কিতাবে লিখিত বিধি অনুযায়ী ছাড়া।

৯:৫১ :: বলো, আল্লাহ আমাদের জন্য যা লিখেছেন তা অনুযায়ী ছাড়া আমাদের উপর কোনো বিপদ আপতিত হয় না। তিনিই আমাদের অভিভাবক। আর মু’মিনগণ আল্লাহর উপরই ভরসা করুক।

৬৪:১১ :: আল্লাহর অনুমতি ছাড়া আমাদের উপর কোনো মুসিবত আপতিত হয় না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে তিনি তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালনা করেন। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞানী।

[ঙ]

৩:২৯ :: বলো, যদি তোমরা তোমাদের মনে যা আছে তা গোপন করো অথবা প্রকাশ করো (উভয় অবস্থায়) আল্লাহ তা জানেন। আর আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা আছে তার সবই তিনি জানেন। আর তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।

[চ]

১৮:২৯ :: আর বল, ‘সত্য তোমাদের রবের পক্ষ থেকে। সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে যেন ঈমান আনে এবং যে ইচ্ছা করে সে যেন কুফরী করে। নিশ্চয় আমি যালিমদের জন্য আগুন প্রস্ত্তত করেছি, যার প্রাচীরগুলো তাদেরকে বেষ্টন করে রেখেছে। যদি তারা পানি চায়, তবে তাদেরকে দেয়া হবে এমন পানি যা গলিত ধাতুর মত, যা চেহারাগুলো ঝলসে দেবে। কী নিকৃষ্ট পানীয়! আর কী মন্দ আশ্রয়স্থল!

৪১:৪০ :: যারা আমার আয়াতসমূহের অর্থকে ভিন্নপথে পরিচালিত করে, তারা আমার থেকে লুক্কায়িত নয়। যাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে সেই উত্তম না ঐ ব্যক্তি যে ক্বিয়ামতের দিন সম্পূর্ণ নিরাপদ অবস্থায় আসবে? তোমরা যা ইচ্ছা হয় সেরূপ কাজ করো। তোমরা যা আমল করো নিশ্চয় তিনি তার সম্যক দ্রষ্টা।

৩:১৫২ :: … তোমাদের মধ্যে এমন লোক আছে যে দুনিয়ার (সুখ সম্পদ পেতে) ইচ্ছা করে এবং তোমাদের মধ্যে এমন লোক আছে যে আখিরাতের (সুখ সম্পদ পেতে) ইচ্ছা করে। …

১৭:১৯ :: যে ব্যক্তি আখিরাতের (সাফল্য পেতে) ইচ্ছা করলো এবং সেজন্য ঠিক সেভাবে চেষ্টা সাধনা করলো যেরূপ চেষ্টা সাধনা করা প্রয়োজন, আর সে মু’মিন, তাহলে তাদের (এ ধরনের লোকদের) চেষ্টা সাধনার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানো হবে (এর উপযুক্ত প্রতিদান প্রদান করা হবে)।

১৩:১১ :: মানুষের জন্য রয়েছে, সামনে ও পেছনে, একের পর এক আগমনকারী প্রহরী, যারা আল্লাহর নির্দেশে তাকে হেফাযত করে। নিশ্চয় আল্লাহ কোন কওমের অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আর যখন আল্লাহ কোন জাতির মন্দ চান, তখন তা প্রতিহত করা যায় না এবং তাদের জন্য তিনি ছাড়া কোন অভিভাবক নেই।

৭৪:৩৭-৩৮ :: তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে সে এগিয়ে যাবে অথবা (যে ইচ্ছা করে) সে পিছিয়ে যাবে। প্রতিটি ব্যক্তিই সে যা উপার্জন করে সেজন্য (তথা নিজ কৃতকর্মের জন্য) দায়ী।

৭:৯৬ :: যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ঈমান আনতো এবং স্রষ্টা সচেতনতা অবলম্বন করতো তবে আমি তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর (সুখময় উপকরণের) সমৃদ্ধি উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা অবিশ্বাস করলো। কাজেই আমি তাদের কর্ম অনুযায়ী ফল দান করলাম।

৫৩:৩৯ :: আর এই যে, মানুষ যেজন্য চেষ্টা সাধনা করে তা ছাড়া তার জন্য কিছু (প্রতিফল, পারিশ্রমিক, পুরস্কার / শাস্তি) নেই।

৪২:৩০ :: আর তোমাদের উপর যে মুসিবতই আরোপিত হয় তা তো সেটাই যা তোমাদের হাতসমূহের উপার্জন (কৃতকর্মের ফল)। আর তিনি (আল্লাহ) অনেক (বিপদাপদ) ঘটতে দেন না।

৩০:৪১ :: মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে যাতে তিনি তাদেরকে তাদের কোন কোন কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা (অসৎ পথ হতে) ফিরে আসে।

৬:১৬৪ :: বল, ‘আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন প্রভু অনুসন্ধান করবো অথচ তিনি সব কিছুর প্রভু? আর প্রতিটি ব্যক্তি যা অর্জন করে, তা শুধু তারই উপর বর্তায় (প্রত্যেকে নিজ কৃতকর্মের ফলই ভোগ করবে)। আর কোনো ভারবহনকারী অন্যের ভার বহন করবে না। অতঃপর তোমাদের রবের নিকটই তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল। সুতরাং তিনি তোমাদেরকে সেই সংবাদ দেবেন, যাতে তোমরা মতবিরোধ করতে।

এ বিষয়টির সঠিক উপলব্ধির জন্য লক্ষণীয় আরো কিছু আয়াত:

৯৮:৫ :: আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়; আর এটিই হল সঠিক দীন।

৭:২৮ :: আর যখন তারা (ধর্মীয় রীতির নামে) অশ্লীল কাজ করে তখন বলে, ‘আমরা এর উপর (এরূপ রীতির উপর) আমাদের বাপদাদাদেরকে পেয়েছি এবং আল্লাহ আমাদেরকে এর নির্দেশ দিয়েছেন’। বল, ‘নিশ্চয় আল্লাহ অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেন না। তোমরা কি আল্লাহর ব্যাপারে এমন কিছু বলছো, যা (সত্য কিনা) তোমরা জানো না’?

২২:৪৬ :: তবে কি তারা পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি? তাহলে তাদের এমন ক্বলব/মন হতো যা দিয়ে তারা common sense ব্যবহার করতে পারতো (common sense ব্যবহার করে সাধারণ জ্ঞান অর্জন করতে পারতো) এবং এমন কান হতো যা দিয়ে তারা (সঠিক তথ্য) শুনতো। সুতরাং নিশ্চয় উহা তো (এই বাস্তবতার প্রতিফলন যে, এক্ষেত্রে) চোখ অন্ধ নয়, কিন্তু মনই অন্ধ হয়, যা আছে স্নায়ুকেন্দ্ররূপ সম্মুখ মস্তিষ্কের অগ্রভাগে।

৯২:৫-১০ :: সুতরাং যে দান করেছে এবং আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন করেছে এবং সত্যসুন্দর ব্যবস্থাকে প্রত্যয়ন করেছে, আমি তাকে (বিবেকসঙ্গত) সহজ পথের জন্য সহজ করে দেবো। আর যে কৃপণতা করেছে এবং বেপরোয়া হয়েছে এবং সত্যসুন্দর ব্যবস্থাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে, আমি তাকে (বিবেকবিরুদ্ধ হওয়া) কঠিন পথের জন্য সহজ করে দেবো (সে সহজে নৈতিকতাকে লংঘন করে চলতে থাকবে)।

৭:১৮৮ :: বলো, ‘আমি আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আমার কোনো উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখি না। আর যদি আমি গায়েব জানতাম তাহলে অনেক কল্যাণ পেতে পারতাম এবং আমাকে কোনো ক্ষতি স্পর্শ করতো না। আমিতো একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা ঈমান আনে।

১৮:২৩-২৪ :: কোনো বিষয় সম্পর্কে কখনও এরকম বলো না যে, আগামীকাল আমি কাজটি (শতভাগ সঠিকভাবে) করবো। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া (তা হবার নয়); ভুলবশত কখনও এরকম বলে ফেললে তোমার প্রভুকে স্মরণ করবে এবং বলবে- আশা আছে আমার প্রভু কাজটির (শতভাগ) সঠিক পথের কাছাকাছি অবস্থানের দিকে আমাকে পথ দেখাবেন।

৪০:৬০ :: তোমাদের প্রভু বলেন, “আমাকে (যথানিয়মে) ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে (যথানিয়মে) সাড়া দেবো। নিশ্চয় যারা তাদের অহংকারের কারণে আমাকে ডাকে না, তারা অবশ্যই জাহান্নামে অপমানিত হয়ে প্রবেশ করবে।”

১৯:২০-২১ :: সে (মারইয়াম) বললো, কী করে আমার সন্তান হবে অথচ কোনো মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি আর আমি সীমালংঘনকারীও নই। সে (ফেরেশতা) বললো, “এরূপই হবে। তোমার প্রভু বলেন, এটা আমার জন্য সহজ। আর তা এজন্য যে, আমি তাকে মানবজাতির জন্য একটি নিদর্শন বানাবো এবং আমার পক্ষ থেকে একটি অনুগ্রহ। আর এটি একটি সিদ্ধান্তকৃত বিষয়।

২০:৩৯ :: (মূসার মাকে ওহী করা হয়েছে) এ মর্মে ‘যে, তুমি তাকে সিন্ধুকের মধ্যে রেখে দাও। তারপর তা দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও। যেন দরিয়া তাকে তীরে ঠেলে দেয়। ফলে তাকে আমার শত্রু ও তার শত্রু নিয়ে নেবে। আর আমি আমার পক্ষ থেকে তোমার প্রতি ভালবাসা ঢেলে দিয়েছিলাম, যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও’।

২১:৬৯ :: আমি বললাম, হে আগুন, তুমি ইবরাহীমের জন্য শান্তিময় শীতল হও’।

৬:১৬৫ :: আর তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছেন। এবং তিনি তোমাদের এককে অপরের তুলনায় যোগ্যতা-সামর্থ্য ও সুযোগ-সুবিধার বিভিন্ন মাত্রায় উন্নীত করেছেন। যেন তোমাদেরকে যা (কম বা বেশি) দেয়া হয়েছে তা অনুসারে (তা যথাযথভাবে বিবেচনায় রেখে) / তার ক্ষেত্রে (দায়িত্বশীলতার) পরীক্ষা নিতে পারেন (এবং তা বিবেচনায় রেখে সে অনুসারে তোমাদের পরীক্ষা নিতে পারেন)। নিশ্চয় তোমার প্রভু (দায়িত্বহীন আচরণের) শাস্তিদানে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণকারী এবং নিশ্চয় তিনি (অনুতপ্তদের প্রতি) ক্ষমাশীল ও দয়ালু।

সামগ্রিক আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ মানুষ ও মানুষের কর্মের স্রষ্টা। কারণ মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত কর্মক্ষমতা প্রয়োগ করেই কর্ম সম্পাদন করে।

আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতি ছাড়া কিছুই হয় না। তবে সর্বক্ষেত্রে তা তাৎক্ষণিক ইচ্ছা ও অনুমতির সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং তিনি বিভিন্ন অনুঘটক (Factor) সহ বিভিন্ন ঘটনা ও তার ফলাফলের বিভিন্ন অবস্থা প্রোগ্রাম করে রেখেছেন, যাকে তাঁর অতাৎক্ষণিক ইচ্ছা ও অনুমতি বলা যায়। তিনি তাৎক্ষণিক ইচ্ছা করলে তাঁর তৈরি কারণ ও ফলাফল বিধির পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। মানুষের জন্ম, মৃত্যু, জ্ঞান, জীবিকা এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলাফলের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে আল্লাহর অতাৎক্ষণিক ইচ্ছা ও বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁর তাৎক্ষণিক ইচ্ছা কার্যকর রয়েছে। মানুষ যদি তাঁর অতাৎক্ষণিক ইচ্ছা অনুযায়ী তথা তাঁর তৈরি করে রাখা প্রাকৃতিক নিয়ম বা কারণ ও ফলাফল বিধি অনুযায়ী কোনো কাজ করে তাহলে সে ঐ কাজটিতে সফল হয়, অন্যথায় সে তাতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে আল্লাহর নিকট যথানিয়মে প্রার্থনা (প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে যথাসাধ্য চেষ্টা করার পাশাপাশি প্রার্থনা এবং সঙ্গত ও কল্যাণকর বিষয়ে প্রার্থনা) করে তাহলে আল্লাহ সেই প্রার্থনা কবুল করে থাকেন এবং এছাড়াও মানুষের ভুল কর্মকাণ্ডের ফলে যেসব বিপদাপদ হওয়ার কথা নিজ অনুগ্রহে আল্লাহ তার অনেক কিছু রদ করে দেন।

‘আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া মানুষ ইচ্ছা করে না’ তথ্যটির অর্থ হলো আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষ সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হয়েছে, অন্যথায় সে স্বাধীনভাবে কোনো ইচ্ছাই করতে পারতো না। তবে ঐ সীমিত স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সে দায়ী, যেহেতু ঐ সীমিত ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে তার ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ করে থাকে।

‘আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ ঈমান আনতে পারে না’ তথ্যটির অর্থ হলো আল্লাহর তৈরি ঈমান আনার নিয়ম অনুসরণ ছাড়া কেউ ঈমান আনতে পারে না। আর তিনি নিয়মটি জানিয়ে দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ প্রদত্ত Common sense প্রয়োগের মাধ্যমে তা অনুসারে সিদ্ধান্ত না নিয়ে প্রবৃত্তিতাড়িত সিদ্ধান্ত নেয় এবং সত্যকে অস্বীকার করে তারপর তার মধ্যে সত্যকে গ্রহনের যোগ্যতা হ্রাস পায় এবং এর ফলস্বরূপ সে ঈমান আনতে পারে না।

সুতরাং আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষ ঈমান আনে কিন্তু সে ইচ্ছা এমন যে, সে ঈমানের ক্ষেত্রে নিজ ইচ্ছায় আল্লাহর তৈরি নিয়ম অনুসরণ করে ঈমান আনে অথবা কুফর করে।

অনুরূপভাবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়াত দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে পথভ্রষ্ট করেন, কিন্তু আল্লাহর এ ইচ্ছা তাঁর ন্যায়নীতিকে লংঘন করে হয় না, বরং তিনি তাঁর ইচ্ছা তাঁর স্বরচিত একটি নীতিমালা অনুসারে কার্যকর করেন। আর তাহলো যে ব্যক্তি আল্লাহর অভিমুখী হয়, যে নিজে হিদায়াত পেতে চায় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দান করেন। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি নিজ ইচ্ছায় হিদায়াত না পাওয়ার মতো পথ অবলম্বন করেন আল্লাহ সজ্ঞানে তাকে পথভ্রষ্ট করেন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজে হিদায়াত চায় না আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না।

আল্লাহ কাফিরদের চোখ, কান, অন্তরে মোহর মেরে দেন তাই তারা কুরআনের সত্য দেখে না, শুনে না ও বলে না। কিন্তু আল্লাহ কোনো কারণ ও নিয়ম ছাড়া তাদের চোখ, কান ও অন্তরে মোহর মেরে দেন না। বরং প্রথমে তারা কুরআনের সত্য দেখা, শুনা ও বুঝার জন্য মনোযোগ দেয় না বরং এর বিপরীত বিষয়ে মনোযোগ দেয়, তাই তাদের পক্ষে কুরআনের সত্য দেখা, শুনা ও বুঝা অসম্ভব হয়ে পড়ে তথা তাদের চোখ, কান ও অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে চোখ, কান ও অন্তরে মোহর মেরে দেয়ার ঘটনা প্রথমে ঘটে না। বরং প্রথমে তারা কুফর করে এবং সেই কারণে ফলাফলস্বরূপ তাদের চোখ, কান ও অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়। তারপর তার কারণে ফলস্বরূপ তারা আর ঈমান আনে না।

আল্লাহ সবকিছুর তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছেন, কেউ যার ব্যতিক্রম করতে পারে না। এই প্রাকৃতিক নিয়মে কোনো বিষয়ে হ্রাস-বৃদ্ধির নিয়ম ও সীমাও নির্ধারিত রয়েছে। মানুষ চোখ দ্বারা দেখবে, কান দ্বারা শুনবে, এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। আবার সে চোখ দ্বারা কতটুকু কাছের বা দূরের জিনিস এবং কতটুকু ছোটো বা বড় জিনিস দেখবে এবং তার দৃষ্টিসীমা কতটুকু সম্প্রসারিত বা সংকুচিত হবে তারও বিভিন্ন সীমা নির্ধারিত। তাই মানুষ চোখ দিয়ে শুনবে না বা কান দিয়ে দেখবে না। কিন্তু চোখ দিয়ে আগ্রহ সহকারে ভালো কিছু দেখবে নাকি মন্দ কিছু দেখবে এক্ষেত্রে সে স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতার অধিকারী। কোনো কাজ কীভাবে করলে তা কীরূপ সফল হবে বা কীভাবে করলে তা কীরূপ ব্যর্থ হবে তার নিয়মও নির্ধারিত এবং এতে বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে।

কোনো ঘটনার বা কোনো কাজের সফলতা বা ব্যর্থতার পিছনে কাজটির পদ্ধতিগত বিষয় ছাড়াও তাতে প্রভাবিতকারী বিভিন্ন অনুঘটক (Factor) কাজ করে থাকে, যার সবকিছু মানুষের জ্ঞাত নয়, বরং বিজ্ঞান গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন ফ্যাক্টর সম্পর্কে তার জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। প্রাকৃতিক বিষয় ছাড়াও বিভিন্ন মানবীয় বিষয় যেমন বিভিন্ন মানুষের ভূমিকা এবং তাদের যোগ্যতা, জ্ঞান-নিষ্ঠা-সাহসিকতা প্রভৃতিরও বিভিন্ন মাত্রার সংমিশ্রণের ফলে বিভিন্নরূপ ফলাফল ঘটে থাকে। মানুষের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার সীমা, ধরন ও ফলাফল নির্ধারণে সামগ্রিকভাবে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ ও ব্যবস্থা এবং তার অনুকূলে বা প্রতিকূলে উপস্থিত বিভিন্ন কর্মপ্রচেষ্টার সম্মিলিত প্রভাব বিদ্যমান থাকে।

আল্লাহ সকল ঘটনার কারণ ও ফলাফল বিধি লিখে রেখেছেন যাতে কোনো বিষয়ে বিভিন্ন কারণে বিভিন্নরূপ ফলাফলের সকল সূত্র বা নিয়ম লিপিবদ্ধ রয়েছে। আর সর্বোপরি রয়েছে আল্লাহ কোনো কারণে তাতে উপস্থিত হস্তক্ষেপ করা না করার বিষয়ে তাঁর সাধারণ (হস্তক্ষেপ না করার) ও বিশেষ (ন্যায়সঙ্গতভাবে হস্তক্ষেপ করার) ইচ্ছার উপস্থিতি। তাই মানুষের উপর কোনো বিপদাপদ আপতিত হোক বা না হোক এবং কারো সন্তানাদি জন্মগ্রহণ করুক বা না করুক এবং কারো আয়ুর হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটুক বা না ঘটুক সবই আল্লাহর লিখে রাখা কিতাব অনুযায়ী হয়। যেমন তাতে মৃত্যুর জন্য যে সকল ফ্যাক্টরের সমন্বয়ের যতগুলো অবস্থান রয়েছে তার যে অবস্থানেই কেউ উপনীত হোক ঐ অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটবে। কেউ যেমন তার সাধারণ বয়ঃবৃদ্ধিক্রমের (Aging Process) নিয়মানুসারে তার জীবনকোষ যখন স্বাভাবিকভাবে অকার্যকর হয়ে যাওয়ার সময় মৃত্যুবরণ করতে পারে, তেমনি কেউ ঐ সময়ের আগে মৃত্যু ঘটানোর মতো কোনো অনুঘটকের উপস্থিতির কারণে নিহত হওয়ার মাধ্যমেও মুত্যুবরণ করতে পারে। উভয় অবস্থায় সে তার জন্য নির্ধারিত নিয়মে উপস্থিত মুত্যুমুহুর্তেই মৃত্যু বরণ  করে, তার আগেও নয়, পরেও নয়।

এক কথায় কোনো ঘটনা ঘটার একটিমাত্র কারণ ও একটিমাত্র ফলাফল লেখা আছে এমন নয়। বরং একটি ঘটনার জন্য একাধিক কারণ এবং একাধিক ফলাফল রয়েছে। এর প্রমাণ হলো রসূলকে কোনো কাজ শতভাগ সঠিকভাবে করার কাছাকাছি পথের দিকে তাঁকে পথনির্দেশ করার জন্য প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। আবার বলা হয়েছে যে, তিনি যেন বলেন যে, যদি তিনি গায়েব জানতেন তাহলে তিনি অনেক কল্যাণ লাভ করতে পারতেন এবং কোনো ক্ষতি তাঁকে স্পর্শ করতে পারতো না। অর্থাৎ আল্লাহ যা নির্ধারণ করে রেখেছেন তা কোনো একটি ঘটনা দৈবাৎ ঘটার বিষয় নয় যে, তা কোনো ক্রমে পরিবর্তনশীল নয়; বরং তা হলো- কোনো ঘটনার জন্য বিভিন্ন কারণ এবং তার বিভিন্ন ফলাফল। আর তাই তা সরাসরি জানতে পারলে রসূল অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলগুলো রোধ করার জন্য কার্যকর কারণকে অবলম্বন করতে পারতেন। এছাড়া এ থেকেও এটা বুঝা যায় যে, মু’মিনদের দুর্বলতাজনিত অবস্থায় তারা দ্বিগুণ কাফিরের মোকাবিলা করতে পারবে এবং সুদৃঢ় ঈমানের স্তরে তারা দশুগুণ কাফিরের মোকাবিলায় বিজয়ী হবে (৮:৬৫-৬৬)।

আল্লাহর নির্ধারণের একটি দিক হলো সমস্ত সৃষ্টির জন্য যেসব প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে এবং তা যথারীতি অপরিবর্তনীয়ভাবে কার্যকর রয়েছে। যেমন, চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্ব ও ঘূর্ণন, জীবের জৈবিক গঠন ও জৈবিক প্রক্রিয়া। জীবের জৈবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা মৃত্যুকে কোনো জীব এড়িয়ে যেতে সক্ষম নয়। সুতরাং জীবকে মৃত্যুবরণ করতে হবে এটাও একটা নির্ধারণ। জন্মের ক্ষেত্রটিতেও যে জন্মগ্রহণ করছে তার ইচ্ছা বা পছন্দের কোনো সম্পর্ক নেই। জৈবিক প্রক্রিয়া ছাড়াও সহজাত মনস্তত্ত্ব প্রবৃত্তির প্রতিক্রিয়া যেমন খাদ্য অনুসন্ধান, আনন্দ-বেদনা, রাগের সময় যৌক্তিকতা বোধের হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি।

মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতিতে নৈতিক চেতনার দিকও নির্ধারণ করা হয়েছে, যেমন মন্দ কাজ করলে বিবেক তিরস্কার করে। আবার সে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়লে সত্য থেকে অন্ধ হয়ে যায়। এগুলো মনস্তত্বের জন্য আল্লাহর নির্ধারণ। কিন্তু মানুষকে প্রদত্ত মনস্তাত্ত্বিক নির্ধারণের মধ্যে তার সীমিত ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতার দিকটিও অন্তর্ভুক্ত। তাই তার নৈতিক ক্ষেত্রেও দুই ধরনের বিষয় থেকে সে কোনো একটিকে বিকশিত করা এবং অন্যটিকে অবদমিত করার চর্চা করতে পারে। এর সাথে সম্পর্কিত নির্ধারণ হলো ভালো কাজ করতে করতে ভালো কাজই সহজ অনুভূত হয় এবং মন্দ কাজ করতে করতে মন্দ কাজই সহজ অনুভূত হয়। এই প্রকৃতি নির্ধারণের বিষয়টির একটি উদাহরণ হলো কুফরের ফলে ঈমান আনার ক্ষমতা রহিত হওয়াকে অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হিসেবে উল্লেখ করা।

আল্লাহ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সবই জানেন কিন্তু তাঁর জানার কারণে কোনো ঘটনা সেভাবে ঘটছে তা নয়, বরং ঘটনা ঘটছে তাঁর তৈরি সকল কারণ ও ফলাফল বিধি অনুসারে এবং ঐ নীতির পাশাপাশি তাঁর নিজের বিষয়ে নিজের তৈরি নীতিমালা অনুযায়ী তাঁর বিভিন্ন ধরনের তাৎক্ষণিক ইচ্ছা বা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। আর আল্লাহ তাঁর স্বীয় গুণগত কারণে তা পূর্ব থেকে জানেন। যেহেতু আল্লাহ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত এবং প্রকাশ্য ও গোপন সবই জানেন, তাই তাঁর দেয়া বিধানই সঠিক বিধান। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী কৃত কাজের ফলে সুফল পাওয়া যাবে এবং তাঁর বিধান লংঘন করে কৃত কাজের কুফলও ভোগ করতে হবে। সুতরাং আমাদের কাজকে তাঁর জানা প্রভাবিত করে না, বরং আমরা যাই করি না কেন তাতে আমাদের সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতা প্রয়োগের কারণে আমরা দায়ী এবং আল্লাহ নিজ গুণে তা পূর্ব থেকে জানেন। সুতরাং আল্লাহ পূর্ব থেকে জানা আমাদেরকে আমাদের কৃতকর্মের জন্য দায়ী হওয়া থেকে নিষ্কৃতি দেয় না। আল্লাহ পূর্ব থেকে জানা সত্ত্বেও আমরা যেমন আমাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, যোগাযোগ, বিবাহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাজ করে থাকি, তেমনি তিনি পূর্ব থেকে জানার বিষয়টি আমাদের জন্য এসব কাজ তাঁর বিধানসঙ্গত কাজ করা থেকে বিরত থাকার কোনো অজুহাত হতে পারে না। বরং যদি তিনি যা জানেন তাই তো হবে বলে আমরা তাঁর বিধান লংঘন করি তাহলে তিনি পূর্ব থেকেই জানেন যে, আমরা কে কে তা লংঘন করবো। অনুরূপভাবে আমরা যদি তাঁর বিধান অনুসরণ করি তাহলে তিনি পূর্ব থেকেই জানেন যে, আমরা কে কে তাঁর বিধান অনুসরণ করবো। আমাদের কোনো সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তাঁর পূর্ব জানাকে রোধ করা সম্ভব নয়, কারণ তাঁর পূর্বজ্ঞান তাঁর স্বয়ং গুণ। সুতরাং আমরা যা করবো তার মাধ্যমে আমরা দায়ী হবো এবং পুরস্কার বা শাস্তি পাবো। তাঁর পূর্বজ্ঞান আমাদেরকে আমাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করা থেকে নিষ্কৃতি দিবে না। আমাদের কর্ম ও কর্মফল যেমন তাঁর পূর্বজ্ঞানে রয়েছে, তেমনি আমাদের কর্ম অনুযায়ীই আমাদের কর্মফল হবে, এ উভয় বিষয় একই সাথে সত্য।

আল্লাহ মানুষের জীবনে তাঁর যেসব বিশেষ ইচ্ছার প্রকাশ ঘটান, যা নিতান্ত প্রাকৃতিকভাবে সংঘটিতব্য বিষয় নয়, তার মধ্যে একটি হলো তিনি কিছু মানুষকে রসূল নিযুক্ত করে তাদের কাছে কিতাব প্রেরণ করেছেন। এটা মানুষের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ, যার মাধ্যমে তিনি মানুষকে বিশেষভাবে পথনির্দেশ করেছেন। আবার তিনি সীমালংঘনকারী জাতিকে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে ধ্বংস করে দেন, কিন্তু তাদেরকে জোর করে বিশ্বাসীতে পরিণত করেন না। তিনি নবী রসূলদের মাধ্যমে কিছু অলৌকিক কার্য ঘটিয়েছেন, কিন্তু সেটাকে বিশ্বাসের জন্য অনিবার্য উপকরণ করেননি, বরং শুধুমাত্র বিশ্বাসের ক্ষেত্রে উৎসাহিত করার জন্য কাজে লাগিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহ মানুষকে যে নৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছেন তাতে হস্তক্ষেপ করেন না।

মানবজীবনে যা কিছু ঘটনা ঘটে এর অনেক কিছুর ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজের পছন্দক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন সে কোথায় জন্মগ্রহণ করবে, কীরূপ মেধার অধিকারী হবে, সেখানে পূর্ব থেকে কোন ব্যবস্থার পাশাপাশি উপস্থিত অন্যান্য লোকদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মিথস্ক্রিয়া কী হবে ইত্যাদি। সুতরাং এসব অনুঘটকের প্রভাবে ব্যক্তির কাজ ও তার ফলাফল যতটুকু প্রভাবিত হয় সেজন্য সে দায়ী হবে না। বরং প্রাকৃতিক ও সামাজিক এসব পরিস্থিতিগত উপাদানগুলোর উপস্থিতিতে নৈতিক ও কার্যকর পদ্ধতিগত যে সিদ্ধান্ত সে নিজে গ্রহণ করে এবং সেজন্য সে প্রচেষ্টা করে তার ভালো মন্দ উপযোগিতার জন্যই সে দায়ী হবে। প্রত্যেককে যেসব সুযোগ সুবিধা ও যোগ্যতা সামর্থ্য দেয়া হয়েছে তার কম বা বেশি বিবেচনায় রেখে সে পরীক্ষা দিচ্ছে এবং এর সঠিক বিবেচনাসহ তার নৈতিক ফলাফল তথা পুরস্কার বা শাস্তি নির্ধারিত হবে।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, পার্থিব জীবনে মানুষ যত ধরনের বিপদ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় সেটাকে মানবীয় দুর্বলতা এবং মানবীয় কৃতকর্মের ফল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণ অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, এর অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজে দায়ী নয়। যেমন একটি গাড়ি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে চালকের অসতর্কতার জন্য যাত্রী দায়ী নয় এবং অন্য এক চালকের অসতর্কতার জন্য অন্য চালক দায়ী নয়। এরূপ ক্ষেত্রে মানবজাতিকে সমষ্টিগতভাবে সম্বোধন করা হয়, কারণ তারা পরস্পরের দ্বারা এমনভাবে যুক্ত যে, একজনের কাজের প্রভাব অন্য জনের উপর পড়ে থাকে। তাই এ ধরনের পরিস্থিতিগুলো মোকাবিলার জন্য তাদেরকে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগী হতে হবে। তবে নৈতিক দায় বিচারের ক্ষেত্রে একজনের দায়ভার অন্যজন বহন করবে না।

আল্লাহর ইচ্ছা ও কর্মের বিষয় সম্পর্কিত আয়াতসমূহ অনুধাবনের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, তিনি তাঁর সার্বভৌম অবস্থান থেকে এ বিষয়ে কথা বলছেন। আল্লাহর তৈরি নিয়ম ও তাঁর অনুমোদন বা ইচ্ছার বাহিরে কোনো ঘটনা ঘটে না। অন্যভাবে বলা যায়, তিনিই সকল ঘটনা ঘটান তাঁর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মে বা তাঁর অনুমোদন ও ইচ্ছাক্রমে। তাই সকল ঘটনার বিষয়ে বলা যায় যে, তিনিই তা ঘটান তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বা অতাৎক্ষণিকভাবে নির্ধারণ করে রাখা প্রাকৃতিক নিয়মের মাধ্যমে। যেমন আল্লাহর তৈরি নিয়মে চাঁদ তার তিথিসমূহ অতিক্রম করে পুরনো খেজুর ডালের আকৃতি ধারণ করে। এ বিষয়টিকে আল্লাহ বলেন যে, আমি চাঁদকে তার তিথিসমূহ অতিক্রম করিয়ে পুরনো খেজুর গাছের আকৃতিতে ফিরিয়ে আনি।

আল্লাহ মানুষকে জীবিকা, ক্ষমতা প্রভৃতি কম-বেশি দিয়ে থাকেন তাঁর ইচ্ছায় কার্যকর প্রাকৃতিক ও নৈতিক নিয়মের আওতায়, যাতে ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের একটি ভূমিকা বিদ্যমান থাকে। এতে ব্যক্তি ভালো বা মন্দ যে নৈতিক নিয়মেই কাজ করুক যদি সে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে থাকা অবকাশ অনুযায়ী কম বা বেশি প্রাপ্তির নিয়মানুযায়ী কাজ করে সেটাও একটি ভূমিকা রাখে। সুতরাং কেউ যদি অন্যায় পথে বেশি সম্পদের মালিক হয়, তাও তাকে আল্লাহই দিয়েছেন আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায়। আল্লাহ কাউকে তার অন্যায় প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে কোনো সম্পদ দিলে সেটা আল্লাহর দেয়া হলেও তাতে আল্লাহ বৈধতা দেননি। কারণ আল্লাহ অন্যায় কাজকে অবৈধ করেছেন। এমতাবস্থায় মু’মিনরা যদি ন্যায় পথে প্রচেষ্টা করে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি অনুসারে তুলনামূলক কম অর্জন করতে পারে, তা সত্ত্বেও তাদেরকে পবিত্র সম্পদে পরিতুষ্ট থাকার এবং বৈধ পথেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং নিজেদের বঞ্চিত থাকার আক্ষেপস্বরূপ কাফিরদের অধিক সম্পদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে নিষেধ করা হয়েছে।

আল্লাহর ইচ্ছার বিভিন্ন পর্যায়

আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কিত বিভিন্ন আয়াত নিয়ে যুক্তি বিন্যাস পদ্ধতিতে চিন্তা গবেষণার মাধ্যমে আল্লাহর ইচ্ছার প্রকাশকে বিভিন্ন পর্যায়ের সাথে সম্পর্কিত করে বুঝা যেতে পারে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:

। প্রাথমিক সৃষ্টিগত গঠন ও শৃঙ্খল সম্পর্কিত এবং প্রাকৃতিক নিয়মরূপ অতাৎক্ষণিক ইচ্ছা: আল্লাহ তাঁর স্বয়ং অধিকারের ভিত্তিতে এরূপ ইচ্ছার মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির প্রাণী সৃষ্টি করেছেন, তাদের লিঙ্গ নির্ধারণ করেছেন, বাস্তুসংস্থানমূলক খাদ্য শৃঙ্খল সৃষ্টি করেছেন ইত্যাদি। তিনি প্রতিটি সৃষ্টির যে মূল রূপ সৃষ্টি করেছেন সেটাই তার স্বাভাবিক ও সর্বোত্তম রূপ। তবে তাঁর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মরূপে কার্যকর কারণ ও ফলাফল বিধিতে থাকা নেতিবাচক সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে অস্বাভাবিকতার উদ্ভব ঘটে, যেমন কেউ জন্মান্ধ রূপে জন্মগ্রহণ করে। স্বাভাবিক উপলব্ধি ও গবেষণার মাধ্যমে মানুষ স্বাভাবিকতা ও অস্বাভাবিকতা নির্ণয় করতে পারে এবং প্রাকৃতিক নিয়মের গবেষণার মাধ্যমে অস্বাভাবিক অবস্থার চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াও মানুষের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।

প্রাকৃতিক নিয়মরূপে কার্যকর আল্লাহর অতাৎক্ষণিক ইচ্ছার ভিত্তিতে মানুষ চোখ দিয়ে দেখবে, কান দিয়ে শুনবে ইত্যাদি বিষয় নির্ধারিত হয়েছে। জন্ম-মৃত্যু ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সংঘটনের ক্ষেত্রে মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মে আবদ্ধ। তবে প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায় কোনো বিকল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মানুষ বিভিন্নভাবে দায়বদ্ধ। যেমন, আত্মহত্যা করা বা কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত হয়।

। নিয়ন্ত্রণমূলক তাৎক্ষণিক ইচ্ছা ও নির্দেশনা প্রদানমূলক ইচ্ছা: প্রাকৃতিক নিয়মানুযায়ী সংঘটিতব্য অনেক বিষয়কে আল্লাহ তাঁর তাৎক্ষণিক ইচ্ছার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেন। কোনো অলৌকিক নিদর্শন প্রকাশ এবং কোনো জাতিকে তার সীমালংঘনের প্রেক্ষিতে ধ্বংস করে দেয়ার সিদ্ধান্তও এরূপ ইচ্ছার অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া তিনি নবী-রসূল মনোনীত করে কিতাব নাযিলের মাধ্যমে তাঁর আদেশ-নিষেধ ও অনুমোদন বিষয়ক নির্দেশনা প্রদান করেছেন।

। ন্যায় বাস্তবায়নমূলক বিচারিক ইচ্ছা: এরূপ ইচ্ছার মাধ্যমে সকল শর্তে হুবহু অভিন্ন মনোভাবসম্পন্ন ও কর্মসম্পাদনকারীর পুরস্কার বা শাস্তিও হুবহু অভিন্ন হবে। আল্লাহ কারো প্রতি সামান্য জুলুমও করেন না।

জাগতিক ঘটনাবলিতে আল্লাহর হস্তক্ষেপের অন্তর্নিহিত রহস্য

সূরা কাহাফে ৬০-৮২ আয়াতে রসূলুল্লাহ মূসাকে জাগতিক ঘটনাবলিতে আল্লাহর হস্তক্ষেপের অন্তর্নিহিত রহস্যের কিছু জ্ঞান প্রদানের বর্ণনা রয়েছে। তা থেকে জানা যায় যে, জাগতিক ঘটনাবলিতে আল্লাহর হস্তক্ষেপের পেছনে কোনো না কোনো কল্যাণকর কারণ নিহিত থাকে।

সূরা কাহাফে বর্ণিত ‘বালকের হত্যার’ সাথে সম্পর্কিত কিছু তথ্য

সূরা কাহাফে জাগতিক ঘটনাপ্রবাহে আল্লাহর হস্তক্ষেপের বিষয়ে রসূলুল্লাহ মূসার অভিজ্ঞতা অর্জন মূলক ভ্রমণে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ‘বালকের হত্যা’ সম্পর্কিত ঘটনাটির কিছু বিশেষ দিক লক্ষণীয়। ঘটনাটিতে একটি বালককে আল্লাহর সিদ্ধান্তক্রমে হত্যা করা হয় এজন্য যে, সে কাফির হয়ে তার মু’মিন পিতামাতাকে কষ্ট দেয়ার সম্ভাবনা ছিলো। এক্ষেত্রে প্রথম জ্ঞাতব্য বিষয় হলো, আল্লাহর এরূপ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য কর্মরত তাঁর বান্দাদেরকে ফেরেশতা বলা হয়। এ ঘটনার মধ্যে জাগতিক ঘটনাবলির নিয়ন্ত্রণে আল্লাহর হস্তক্ষেপের তাৎপর্য সম্পর্কিত অনেক তথ্য নিহিত রয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:

১। কাউকে বিশেষ অনুগ্রহ করার জন্য ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যেমন বালকটির পিতামাতাকে বিশেষ অনুগ্রহ করার জন্য বালকটিকে হত্যা করা হয়েছে। এখানে বালকটিকে হত্যা করা হয়েছে, তাকে বাঁচিয়ে রেখে তার কুফরের মনোভাবকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পাল্টে দেয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়নি। কারণ ব্যক্তির ভালো-মন্দ মনোভাব তার নিজেকেই পরিবর্তন করতে হয়, সেটাকে নিয়ন্ত্রণমূলক পদ্ধতিতে পরিবর্তিত করা হয় না।

২। কার্যকারণের পরিবর্তনের মাধ্যমে ঘটনাপ্রবাহে পরিবর্তন ঘটে। যেমন বালকটিকে হত্যা করায় বেঁচে থাকলে সে যে কুফর করতো তার সংঘটনকে প্রতিহত করা হয়েছে। তাকে হত্যা করায় তার মৃত্যু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তার অনুপস্থিতি এবং তাকে হত্যা না করলে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভূমিকা এ দুটি বিষয়ের ভিন্নরূপতা একটি অনিবার্য বিষয়। আল্লাহ জানতেন যে, তাঁর নির্দেশে বালকটিকে অগ্রিম হত্যা করা হবে এবং তাই সে বড় হয়ে কুফর করার ঘটনা ঘটবে না। সুতরাং যদি তাকে বাঁচিয়ে রাখা হতো তাহলে সে কুফর করতো সম্ভাবনাটি তার মধ্যে প্রস্ফুটন উন্মুখ ভাব অবস্থায় বিদ্যমান ছিলো বা এমন ফ্যাক্টর তাকে প্রভাবিত করেছিলো যার ফলে স্বাধীনভাবে কুফরের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই সে কুফর করার সম্ভাব্য অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলো।

৩। বালকটিকে হত্যা করা একটি ঘটনাক্রম ছিলো, কোনো অগ্রিম শাস্তি নয়। কারণ কেউ বাস্তবে কোনো কাজ সম্পাদনের পূর্বে তাকে সে বিষয়ে শাস্তি দেয়া হয় না, বরং কৃতকর্মের জন্যই শাস্তি দেয়া হয়। এ ঘটনার মাধ্যমে বালকটির পিতামাতার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করা হয়েছে।

৪। যারা বড় হওয়ার পর কুফর করে তারা প্রশ্ন করার অবকাশ নেই যে, কেন তাদেরকে এ বালকটির মতো কুফর করার আগেই হত্যা করা হলো না। কারণ তারা স্বাধীন ইচ্ছাতেই কুফর করেছে বিধায় তারা দায়ী হবে। যে ব্যক্তিকে যে অবস্থানে রাখা বা পৌঁছানো হয় সে সেই অবস্থান সাপেক্ষ বিচারযোগ্য হবে। প্রত্যেকে নিজ স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষতার প্রয়োগের জন্য দায়ী হবে, তার উপর অনিবার্যভাবে আরোপিত পরিস্থিতির জন্য নয়।

আল্লাহর ইচ্ছায় রাষ্ট্রক্ষমতার উত্থান পতন এবং যাবতীয় বিশৃঙ্খলাকে একটি মৌলিক শৃঙ্খলা বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ

৩:২৬ :: বলো, হে আল্লাহ, সমুদয় রাজ্যের রাজা, আপনি যাকে ইচ্ছা করেন তাকে রাজত্ব দান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছা করেন রাজত্ব কেড়ে নেন এবং যাকে ইচ্ছা করেন তাকে সম্মানিত করেন এবং যাকে ইচ্ছা করেন তাকে অপমানিত করেন। আপনার হাতেই সমুদয় কল্যাণ। নিশ্চয় আপনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান।

২:২৫১ :: সুতরাং তারা (তালুতের সেনাদল) আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদেরকে (জালুতের সেনাদলকে) পরাভূত করলো এবং দাউদ জালুতকে হত্যা করলো। আর আল্লাহ তাকে (দাউদকে) রাজত্ব ও বিচক্ষণতা দান করলেন এবং যা (শিক্ষা দিতে) ইচ্ছা করলেন তা শিক্ষা দান করলেন। আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ জগদ্বাসীর প্রতি অনুগ্রহশীল।

২২:৪০ :: যাদেরকে তাদের নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধু এ কারণে যে,তারা বলে,‘রব্বুনাল্লাহ’ (আল্লাহ আমাদের প্রভু)। আর যদি আল্লাহ (তাঁর বিধানের বা প্রাকৃতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে) মানুষকে প্রতিহত না করতেন তাদের একদল দ্বারা অন্য দলকে, তাহলে অবশ্যই বিধ্বস্ত করা হতো আশ্রম/মঠ (সওয়ামি’), আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বাণিজ্যকেন্দ্র (বিয়া’), উপাসনালয় (সালাওয়াত) এবং মাসাজিদ যেগুলোতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন যে তাঁকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমতাবান, শক্তিমান।

৪৭:৭ :: হে যারা ঈমান করেছো, যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো (আল্লাহর দ্বীনের বাস্তবায়নে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করো) তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পদক্ষেপকে দৃঢ় (বিজয়োপযোগী) করবেন।

৪:৭৫ :: তোমাদের কী হলো যে, তোমরা লড়াই করবে না আল্লাহর পথে এবং ঐ অসহায় নরনারী এবং শিশুগণের জন্য যারা বলে, “হে আমাদের প্রভু, এ জনপদ থেকে- যার শাসকরা জালিম- আমাদেরকে উদ্ধার করুন এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য অভিভাবকের ব্যবস্থা করুন এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারীর ব্যবস্থা করুন’।

১০:১১ :: যদি আল্লাহ মানুষের অকল্যাণ তরান্বিত করতেন যেভাবে তারা তাদের কল্যাণ তরান্বিত করতে আগ্রহী, তাহলে অবশ্যই তারা ধ্বংস হয়ে যেত। সুতরাং যারা আমার সাক্ষাতের আশা রাখে না, আমি তাদেরকে তাদের অবাধ্যতার মধ্যে ঘুরপাক খেতে ছেড়ে দিই।

৭:১৬৫ :: অতঃপর যে উপদেশ তাদেরকে দেয়া হয়েছিল, যখন তারা তা ভুলে গেল তখন আমি মুক্তি দিলাম তাদেরকে যারা মন্দ হতে নিষেধ করে। আর যারা যুলম করেছে তাদেরকে কঠিন আযাব দ্বারা পাকড়াও করলাম। কারণ, তারা পাপাচার করত।

৮:২৫ :: তোমরা সেই ফিতনাকে ভয় কর যা তোমাদের মধ্যকার শুধুমাত্র যালিম ও পাপিষ্ঠদেরকেই বিশেষভাবে ক্লিষ্ট করবেনা। তোমরা জেনে রেখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তি দানে খুবই কঠোর।

১৬:৬১ :: আর আল্লাহ যদি মানুষকে তাদের যুলমের কারণে (অনতিবিলম্বে) পাকড়াও করতেন, তবে তাতে (পৃথিবীতে) কোনো বিচরণকারী প্রাণীকেই ছাড়তেন না। তবে আল্লাহ তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দেন। যখন তাদের নির্দিষ্ট সময় চলে আসে, তখন এক মুহূর্তও পেছাতে পারে না, এবং আগাতেও পারে না।

আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ আরো বিভিন্ন আয়াত থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে পরীক্ষা করছেন, ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছেন। এই প্রেক্ষিতে অনেকে যুলুম করার সুযোগ পায়। কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে অনতিবিলম্বে ধ্বংস করে দেন না। বরং তাদের যুলুমের কারণে অনেক অসহায় ব্যক্তি কষ্ট পেলেও তিনি তা থেকে তাদেরকে উদ্ধারের জন্য তাঁর প্রতি বিশ্বাসীদেরকে লড়াই করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন কিন্তু সরাসরি হস্তক্ষেপে তাদেরকে সহসা উদ্ধার করেন না। অন্যদিকে যদি সেখানে সংশোধনকামী লোকেরা থাকে তা সত্ত্বেও জালিমরা উপদেশ লংঘন করতে থাকে তাহলে এক পর্যায়ে তিনি তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। আর তিনি ন্যায়পন্থীদেরকে উদ্ধার করেন। কিন্তু যদি সেখানে অন্যায় থেকে বাধাদানকারী কেউ না থাকে, তাহলে তিনি এমন আযাব দেন যাতে অন্যায়কারীদের পাশাপাশি যারা নিজেরা সরাসরি ঐ অন্যায়ে জড়িত ছিল না, কিন্তু বাধাও দেয়নি তাদেরকেসহ ধ্বংস করে দেন। এছাড়া আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে জালিমের জুলুমের প্রতিকার এভাবেও হয় যে, মানুষের একদল দ্বারা অন্যদলকে প্রতিহত করা হয়। এসব কল্যাণময় নীতিমালার মাধ্যমে আল্লাহর ইচ্ছায় রাষ্ট্রক্ষমতায় উত্থান পতন হয় এবং যাবতীয় বিশৃঙ্খলাকে একটি মৌলিক শৃঙ্খলা বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

আল্লাহর মাহাত্ম্য এবং তাঁর অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা

এ পর্যায়ে উপরোল্লেখিত সামগ্রিক আলোচনার প্রেক্ষিতে আল্লাহর মাহাত্ম্য এবং তাঁর অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা-প্রশংসা সম্পর্কে কিছু বিশেষ পয়েন্ট ভিত্তিক চিন্তা গবেষণামূলক উপলব্ধি তুলে ধরা হলো, যেন ঈমানের সাথে সম্পর্কিত এ বিষয়গুলোতে আমরা ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত মনোভাব থেকে মুক্ত থাকা সহজ হয়।

ক্ষুধা এবং খাদ্য আল্লাহর দুটি নেয়ামত বা অনুগ্রহ, যার জন্য তাঁর প্রশংসা করতে হবে, কারণ ক্ষুধার কারণে খাদ্যের স্বাদ পাওয়া যায় আর খাদ্যের মাধ্যমে ক্ষুধার নিবারণ হয়। উভয় নেয়ামতের শোকর হলো ক্ষুধা নিবারণের জন্য বৈধ প্রচেষ্টায় খাদ্য সংগ্রহ এবং খাদ্য সংগ্রহের ক্ষমতায় তারতম্যের ভিত্তিতে অধিক খাদ্য সংস্থানের ক্ষেত্রে যাদের দ্বারা কম খাদ্য সংস্থান সম্ভব হয়েছে তাদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করা। কাদের পক্ষে কতটুকু ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাদ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা হবে সেটা কার্যকর প্রাকৃতিক নিয়ম ও মানুষের অনুসৃত নৈতিক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। আল্লাহ জীবিকার ব্যবস্থা করেছেন এ দ্বিবিধ পরিস্থিতির সংমিশ্রিত অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল পর্যায়ে। আবার পৃথিবীর জীবনকে পরীক্ষাকাল করা হয়েছে। সুতরাং এখানে জীবিকার বাস্তব হ্রাসবৃদ্ধি এবং অনুরূপ বিভিন্ন অবস্থার জন্য আল্লাহর উপর কোনো অভিযোগ আরোপিত হতে পারে না, বরং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী নিজেদের দায়িত্ব পালন থেকে বিচ্যুত হলে আল্লাহর কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হতে হবে। একটি বাঘ একটি হরিণকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা নিয়ে যেমন আল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যেতে পারে না, তেমনি যে শিশুকে জাহিলিয়াতের যুগে তার পিতা অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে সে শিশুকে কেন তার পিতা হত্যা করতে পারলো সে প্রশ্নে আল্লাহর উপর অভিযোগ করা যেতে পারে না। মানুষ স্বীয় মৃত্যু পর্যন্ত প্রাকৃতিক ও নৈতিক নিয়মের আওতায় থাকা বিভিন্ন পরিস্থিতি সাপেক্ষে আল্লাহর অনুগ্রহ পেয়ে থাকে। সর্বোত্তম পর্যায়ে আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়ার উপায় হলো সর্বোত্তম পর্যায়ে আল্লাহর দেওয়া নৈতিক বিধানের বাস্তবায়ন করা। আর পৃথিবীতে যাকে যে ধরনের অনুগ্রহ কম বা বেশি করা হয়েছে তা কাজে লাগিয়ে মানুষ নিজ ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতায় যেরূপ কাজ করবে তদনুসারে সে পুরস্কার বা শাস্তি পাবে।

আল্লাহর অধিকার সম্পর্কিত বিশ্বাস: ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) একমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য

৪০:৬৫ :: তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। সুতরাং তোমরা দীনকে তাঁর জন্য একনিষ্ঠ করে তাঁকে ডাকো। জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই সমস্ত প্রশংসা।

৯৮:৫ :: আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত (দাসত্ব) করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়; আর এটিই হল সঠিক দীন।

৫১:৫৬-৫৭ :: আমি মানুষকে ও জিনকে আমার ইবাদাত করা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি। আমি তাদের কাছে কোনো রিয্ক চাই না; আর আমি চাই না যে, তারা আমাকে খাবার দিবে। নিশ্চয় আল্লাহ, তিনিই তো রিযিকদাতা, প্রবল শক্তিধর, পরাক্রমশালী।

২:২১ :: হে মানুষ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদাত করো, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকেও সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা সঠিক সচেতনতা অবলম্বন করতে পারো।

২২:১১ :: মানুষের মধ্যে এমনও আছে যারা প্রান্তিকতায় দাঁড়িয়ে দ্বিধার সাথে আল্লাহর ‘ইবাদাত করে। অতঃপর তার কল্যাণ হলে তা নিয়ে সে তৃপ্ত থাকে, আর কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হলে সে তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে দুনিয়াতেও আর আখিরাতেও- এটাই হল স্পষ্ট ক্ষতি।

আলোচনা: মানুষের উপর আল্লাহর অধিকার হলো মানুষ শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করবে। আল্লাহর ইবাদাতের সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহ দুই ধরনের। কিছু বিষয় রয়েছে যা মানুষ শুধুমাত্র অলৌকিক, অপ্রতিরোধ্য বা ঐশ্বরিক শক্তি ও ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস থেকে বা উপাসনামূলকভাবে সম্পাদন করে। যেমন, দোয়া, মানত, কুরবানি ইত্যাদি। আবার কিছু বিষয় রয়েছে যা জাগতিকভাবেও করা হয়, যেমন প্রশংসা, ভয়, আনুগত্য ইত্যাদি। এ ধরনের বিষয়গুলো কখন জাগতিক পর্যায়ের আর কখন উপাসনামূলক তা মনোভাবের উপর এবং ভক্তি ও বিনয়ের ধরন অনুসারে নির্ধারিত হয়। যেমন, যখন কেউ কোনো ব্যক্তির কাছে সাধারণ কোনো বিষয়ে সাহায্য চায় যা মূলত পারস্পরিক সাহায্য পর্যায়ের বিষয় তা হলো লৌকিক সাহায্য প্রার্থনা। অন্যদিকে যখন কোনো ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির কাছে সাহায্য চায়, সেখানে সে মনে করে যে ঐ মৃত ব্যক্তি কোনো অলৌকিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছে যে তাকে সাহায্য করতে সক্ষম। এরূপ সাহায্য প্রার্থনা ইবাদাতমূলক সাহায্য প্রার্থনা। আর ইবাদাতমূলক সাহায্য প্রার্থনা (অলৌকিক ক্ষমতায় সাহায্য করার জন্য প্রার্থনা) একমাত্র আল্লাহর কাছেই করতে হবে, অন্য কারো কাছে এরূপ প্রার্থনা করলে তাতে আল্লাহর সাথে শিরক (অংশীদার সাব্যস্ত) করা হয়।

আল্লাহর ইবাদাতের বিভিন্ন দিক

১। কৃতজ্ঞতা, প্রশংসা ও পবিত্রতা জ্ঞাপন

২:১৫২ :: তোমরা আমাকে স্মরণ করো আমি তোমাদেরকে স্মরণ করবো। আর আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো এবং আমার প্রতি কুফর করো না (অকৃতজ্ঞ হয়ো না)।

২৭:৫৯ :: বলো, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর মনোনীত বান্দাদের প্রতি সালাম (শান্তি)। আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, নাকি তারা যাদেরকে শরীক করে তারা?

২৫:৫৮ :: তুমি নির্ভর কর তাঁর উপর যিনি চিরঞ্জীব, যাঁর মৃত্যু নেই এবং তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো। তিনি তাঁর বান্দাদের পাপ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত।

৪:১৭১ :: হে কিতাবীগণ, তোমরা তোমাদের দীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহর উপর সত্য ছাড়া অন্য কিছু বলো না। মারইয়ামের পুত্র মাসীহ ঈসা কেবলমাত্র আল্লাহর রাসূল ও তাঁর কালিমা, যা তিনি প্রেরণ করেছিলেন মারইয়ামের প্রতি এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন এবং বলো না, 'তিন'। তোমরা বিরত হও, তা তোমাদের জন্য উত্তম। আল্লাহই কেবল এক ইলাহ, তিনি পবিত্র মহান এ থেকে যে, তাঁর কোন সন্তান হবে। আসমানসূহে যা রয়েছে এবং যা রয়েছে যমীনে, তা আল্লাহরই। আর কর্মবিধায়ক হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।

২। ভয়

ক. কল্পিত ইলাহদেরকে ভয় না করে আল্লাহকে ভয় করা

১৬:৫১ :: আর আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা দুই ইলাহ গ্রহণ করো না। তিনি তো কেবল এক ইলাহ। সুতরাং তোমরা আমাকেই ভয় কর।’

৩৯:৩৬-৩৮ :: আল্লাহ কি তাঁর বান্দাহর জন্য যথেষ্ট নন? অথচ তারা তোমাকে আল্লাহর পরিবর্তে যারা তাদের ভয় দেখায়। আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার জন্য কোনো পথ-প্রদর্শক নেই। এবং আল্লাহ যাকে হিদায়াত করেন তার জন্য কোনো পথভ্রষ্টকারী নেই। আল্লাহ কি পরাক্রমশালী, দণ্ডবিধায়ক নন? তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ’। তুমি বলো, তোমরা কি ভেবে দেখেছো, আল্লাহ আমার অনিষ্ট চাইলে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চাইলে তারা কি সে অনুগ্রহ রোধ করতে পারবে? বলো, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট’। নির্ভরকারীগণ আল্লাহর উপরই নির্ভর করে।

৬:৮০-৮১ :: তার সম্প্রদায় তার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হলো। সে বললো, তোমরা কি আল্লাহ সম্বন্ধে আমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হবে? তিনি তো আমাকে সৎপথে পরিচালিত করেছেন। তোমরা যাদেরকে তাঁর সাথে শরীক করো আমি তাদেরকে ভয় করি না। তবে আমার প্রতিপালক যদি কিছু ইচ্ছা করেন। (অর্থাৎ এ সকল উপাস্য আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে বলে আমি ভয় পাই না, আমার যদি কোনো ক্ষতি বা বিপদ হয়, তবে আল্লাহর ইচ্ছাতেই হবে, তোমাদের উপাস্যদের ইচ্ছাতে নয়)। সবকিছুই আমার প্রতিপালকের জ্ঞানায়ত্ত, তবে তি তোমরা অবধান করো না? তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরীক করো, আমি তাদেরকে কিভাবে ভয় করবো? অথচ আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করার কোনোরূপ অনুমতি প্রদান না করা সত্ত্বেও তোমরা আল্লাহর সাথে শরীক করতে ভয় পাও না? তাহলে তোমাদের যদি জ্ঞান থাকে তবে বলো তো কোন দল নিরাপত্তা লাভের যোগ্য?

২:৪১ :: আর তোমাদের সাথে যা আছে (পূর্বে নাযিলকৃত কিতাব) তার সত্যায়নকারীস্বরূপ আমি যা নাযিল করেছি (কুরআন) তোমরা তার প্রতি ঈমান আনো এবং তোমরাই তার প্রতি প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। আর তোমরা আমার আয়াতসমূহ সামান্যমূল্যে বিক্রি করো না এবং কেবল আমাকেই ভয় করো।

খ. কাফিরদেরকে ভয় না করে আল্লাহকে ভয় করা

৩:১৭৫ :: নিশ্চয় শয়তান তোমাদেরকে তার বন্ধুদের (তাগুত ও কাফিরদের) ভয় দেখায়। সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় করো না আর আমাকেই ভয় করো, যদি তোমরা মু’মিন হও।

৪:৭৭ :: তুমি কি তাদেরকে দেখোনি যাদেরকে বলা হয়েছিল, ‘তোমরা তোমাদের হস্ত সংবরণ কর, সালাত কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান করো?’ অতঃপর যখন তাদেরকে যুদ্ধের বিধান দেয়া হল তখন তাদের একদল মানুষকে ভয় করছিল আল্লাহকে ভয় করার মত অথবা তার চেয়েও বেশী এবং বললো, ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান কেন দিলেন? আমাদেরকে কিছু দিনের অবকাশ কেন দিলেন না?’ বলো, ‘পার্থিব ভোগ সামান্য এবং যে স্রষ্টা সচেতনতা অবলম্বন করে তার জন্য আখেরাতই উত্তম। আর তোমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও যুলুম করা হবে না।’

৯:১৩ :: কেন তোমরা সেই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করবে না যারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে, যারা রসূলকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল? প্রথমে তারাই তোমাদেরকে আক্রমণ করেছিল। তোমরা কি তাদেরকে ভয় কর? তোমরা যাকে ভয় করবে তার সবচেয়ে বেশি হকদার হলেন আল্লাহ যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাক।

আলোচনা: আল্লাহর বিধানে কাফিরদের নির্যাতনের ভয়ে বাহ্যত মুখে কুফরী বাক্য উচ্চারণ করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তাই আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধাচরণ না করে বরং আল্লাহর বিধানের অনুমোদনের প্রেক্ষিতে এরূপ ভয়কে ভয়ের ক্ষেত্রে শিরক হিসেবে সাব্যস্ত করা হবে না। যখন কাফিরদের ভয়ে অবলীলায় আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা হয় সেটাই আপত্তিকর সাব্যস্ত হবে। আর আল্লাহর সাথে সাংঘর্ষিক পর্যায়ে না হয়ে সাধারণ জাগতিক পর্যায়ে সাবধানতা অবলম্বনের সাথে সম্পর্কিত যে ভয়, কাফিরদের এরূপ কোনো আক্রমণের ভয় করা দোষনীয় নয়, বরং এরূপ ভয়ের প্রেক্ষিতে সাবধানতা অবলম্বন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

৩। ভালবাসা

২:১৬৫ :: আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালবাসার মত ভালবাসে। আর যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর জন্য ভালবাসায় দৃঢ়তর। আর যদি যালিমগণ দেখতো- যখন তারা আযাব দেখবে (তখন যেমন বুঝতে পারবে) যে, নিশ্চয় সকল শক্তি আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আল্লাহ আযাব দানে কঠোর!

৯:২৪ :: বলো, ‘যদি তোমাদের পিতারা, আর তোমাদের সন্তানেরা, আর তোমাদের ভাইয়েরা, আর তোমাদের স্ত্রীরা, আর তোমাদের গোষ্ঠীর লোকেরা আর ধন-সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর ব্যবসা তোমরা যার মন্দার ভয় করো, আর বাসস্থান যা তোমরা ভালবাস, এসব যদি তোমাদের নিকট প্রিয়তর হয় আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করা হতে, তাহলে অপেক্ষা করো যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর চূড়ান্ত ফয়সালা তোমাদের কাছে নিয়ে আসেন। আর আল্লাহ অবাধ্য আচরণকারীদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না।

৪। আল্লাহর বিধানকেই মূল বিধান হিসেবে মানা

৬:১২১ :: আর তোমরা তা থেকে আহার করো না, যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি এবং নিশ্চয় তা সীমালঙ্ঘন এবং শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে প্ররোচনা দেয়, যাতে তারা তোমাদের সাথে বিবাদ করে। আর যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তবে নিশ্চয় তোমরা মুশরিক।

৫:৫০ :: তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিধান চায়? আর বিশ্বাসগত নিশ্চয়তাবোধ অবলম্বনকারীদের জন্য বিধান দানে আল্লাহর চেয়ে উত্তম আর কে?

১০:৫৯ :: বলো, ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছো, আল্লাহ তোমাদের জন্য যে রিয্ক নাযিল করেছেন, পরে তোমরা তার কিছু বানিয়েছ হারাম ও হালাল’। বলো, ‘আল্লাহ কি তোমাদেরকে অনুমতি দিয়েছেন, নাকি আল্লাহর উপর তোমরা মিথ্যা রটাচ্ছো’?

৫। ইবাদাতমূলক সাজদাহ

৪১:৩৭ :: আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন, সূর্য ও চাঁদ । তোমরা না সূর্যকে সিজদা করবে, না চাঁদকে। আর তোমরা আল্লাহকে সিজদা করো যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদাত করো।

৬। ভরসা

৩:১৬০ :: আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করলে তোমাদের উপর জয়ী হবার কেউ থাকবে না। আর তিনি তোমাদেরকে সাহায্য না করলে, তিনি ছাড়া কে এমন আছে যে তোমাদেরকে সাহায্য করবে? সুতরাং মুমিনগণ আল্লাহর উপরই ভরসা করুক।

৫:১১ :: হে মুমিনগণ, তোমরা স্মরণ কর তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামত, যখন একটি কওম তোমাদের প্রতি তাদের হাত প্রসারিত করতে মনস্থ করলো; কিন্তু তিনি তাদের হাতকে তোমাদের থেকে নিবৃত্ত রাখলেন। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আল্লাহর উপরই মুমিনরা ভরসা করা উচিত।

৯:৫১ :: বলো, ‘আমাদেরকে শুধু তা-ই আক্রান্ত করবে যা আল্লাহ আমাদের জন্য লিখে রেখেছেন। তিনিই আমাদের অভিভাবক, আর আল্লাহর উপরই যেন মুমিনরা ভরসা করে’।

৭। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া

৩৯:৫৩ :: বলো (আমার এ কথা), ‘হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’।

১৫:৫৬ :: সে (ইবরাহীম) বলল, ‘পথভ্রষ্টরা ছাড়া আর কে তার প্রতিপালকের রহমাত থেকে নিরাশ হয়?’

১২:৮৭ :: (ইয়াকুব বললো), ‘হে আমার ছেলেরা, তোমরা যাও এবং ইউসুফ ও তার ভাইয়ের খোঁজ খবর নাও। আর তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, কেননা কাফির কওম ছাড়া কেউই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না’।

৮। দোয়া

৪০:৬০ :: আর তোমাদের প্রভু বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহঙ্কার বশতঃ আমার ইবাদাত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’

৭:৫৬ :: আর তোমরা পৃথিবীতে (কোনো ভূখন্ডে) সংশোধন নীতি গৃহীত হবার পর (শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পর) তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। এবং ভয় ও আশা সহকারে তাঁকে (আল্লাহকে) ডাকো। নিশ্চয় আল্লাহর রহমত উত্তম আচরণকারীদের নিকটবর্তী।

২৯:৬৫ :: তারা যখন নৌযানে আরোহণ করে, তখন তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে স্থলে পৌঁছে দেন, তখনই তারা শিরকে লিপ্ত হয়।

৩১:৩২ :: আর যখন ঢেউ তাদেরকে ছায়ার মত আচ্ছন্ন করে নেয়, তখন তারা একনিষ্ঠ অবস্থায় আনুগত্যভরে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে পৌঁছে দেন, তখন তাদের কেউ কেউ (ঈমান ও কুফরীর) মধ্যপথে থাকে। আর বিশ্বাসঘাতক ও কাফির ব্যক্তি ছাড়া কেউ আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করে না।

৯। মানত কুরবানিতে শিরক না করা

৬:১৩৬ :: আর আল্লাহ যে শস্য ও চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, সেখান থেকে তারা আল্লাহর জন্য একটি অংশ নির্ধারণ করে। অতঃপর তাদের ধারণা অনুসারে তারা বলে, ‘এটি আল্লাহর জন্য এবং এটি আমাদের শরীকদের জন্য।’ অতঃপর যা তাদের শরীকদের জন্য, তা আল্লাহর নিকট পৌঁছে না, আর যা আল্লাহর জন্য তা তাদের শরীকদের নিকট পৌঁছে যায়। তারা যে ফয়সালা করে, তা কতই না মন্দ!

১৬:৫৬ :: আর আমি তাদেরকে যে রিয্ক দিয়েছি, তার একটি অংশ তারা নির্ধারণ করে এমন সত্তার জন্য, যার ব্যাপারে তারা জানে না। আল্লাহর কসম! তোমরা যে মিথ্যা রটাচ্ছো সে ব্যাপারে তোমাদেরকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে।

১০। আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাবের কিছুই অপছন্দ না করা

৪৭:৮-৯ :: যারা কুফর করেছে তাদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ এবং তিনি তাদের কাজ ব্যর্থ করে দিবেন। তা এজন্য যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তারা তা অপছন্দ করে। অতএব তিনি তাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করে দিয়েছেন।

১১। আল্লাহর আয়াতের সমালোচনাকারীদেরকে এড়িয়ে চলা

৬:৬৮ :: আর যখন তুমি তাদেরকে দেখো, যারা আমার আয়াতসমূহ নিয়ে সমালোচনায় রত আছে, তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, যতক্ষণ না তারা অন্য কথাবার্তায় লিপ্ত হয়। আর যদি শয়তান তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণের পর যালিম সম্প্রদায়ের সাথে বসো না।

৪:১৩৮-১৪০ :: মুনাফিকদের সংবাদ দাও যে, নিশ্চয় তাদের জন্যই রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। যারা মুমিনদের পরিবর্তে কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারা কি তাদের কাছে সম্মান চায়? অথচ সম্মান তো আল্লাহরই আয়ত্তে। আর তিনি তো কিতাবে তোমাদের প্রতি নাযিল করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করা হচ্ছে এবং সেগুলো নিয়ে উপহাস করা হচ্ছে, তাহলে তোমরা তাদের সাথে বসবে না, যতক্ষণ না তারা অন্য কথায় নিবিষ্ট হয়, তা না হলে তোমরাও তাদের মত হয়ে যাবে। নিশ্চয় আল্লাহ মুনাফিক ও কাফিরদের সকলকে জাহান্নামে একত্রকারী।

১২। সন্দেহ পোষণ না করা

১৮:৩৫-৩৭ :: এভাবে নিজের প্রতি জুলুম করে সে তার উদ্যানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমি মনে করি না যে, এ কখনো ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি মনে করি না যে, কিয়ামত হবে, আর যদি আমি আমার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবৃত্ত হই-ই (কিয়ামত যদি হয়-ই) তবে আমি নিশ্চয় এর চেয়ে উৎকৃষ্ট স্থান লাভ করব।’ তদুত্তরে তার বন্ধু তাকে বলল, ‘তুমি কি তাঁর প্রতি (সন্দেহ পোষণের মাধ্যমে) কুফর করছ যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে এবং পরে শুক্র হতে এবং তার পর পূর্ণাংগ করেছেন তোমাকে মনুষ্য আকৃতিতে?

শিরকের পেছনে থাকা বিভিন্ন ধারণার অসারতা

১। আল্লাহর সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক কল্পনা

২১:২৬-২৯ :: তারা বলে, ‘দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন।’ তিনি পবিত্র, মহান! তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। তারা আগে বেড়ে কথা বলে না; তারা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে। তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত। তিনি যাদের প্রতি সন্তুষ্ট তাদের ছাড়া আর কারো জন্য তারা সুপারিশ করে না এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। তাদের মধ্যে যে বলবে ‘আমিই ইলাহ আল্লাহ ব্যতীত’, তাকে আমি প্রতিফল দিব জাহান্নাম; এভাবেই আমি জালিমদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি।

৩৭:১৫৮ :: আর তারা আল্লাহ ও জিন জাতির মধ্যে একটা বংশসম্পর্ক সাব্যস্ত করেছে, অথচ জিন জাতি জানে যে, নিশ্চয় তাদেরকেও উপস্থিত করা হবে।

২। আল্লাহ মানবীয় সাকার রূপে জন্মগ্রহণ বা আত্মপ্রকাশ করার অথবা কেউ আল্লাহর সাথে মিলে একাকার হয়ে যাওয়ার ধারণা

৫:৭২ :: অবশ্যই তারা কুফর করেছে, যারা বলেছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ হচ্ছেন মারইয়াম পুত্র মাসীহ’। আর মাসীহ বলেছে, ‘হে বনী ইসরাঈল, তোমরা আমার প্রভু ও তোমাদের প্রভু আল্লাহর ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করো’। নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার উপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা আগুন। আর যালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই।

৩। মধ্যস্থতাকারী হয়ে নৈকট্যে পৌঁছে দেয়ার ধারণা

১৭:৫৭ :: বলো, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে (ইলাহ) ধারণা কর তাদেরকে আহবান কর, তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার অথবা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই।’ তারা যাদেরকে আহবান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য (ওসীলা) সন্ধান করে, কে কত বেশি নিকটতর হতে পারে, তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ।

৪। শাফায়াতকারী সাব্যস্ত করা

৩৯:৩ :: জেনে রেখ, খালেস দ্বীন কেবল আল্লাহরই জন্য। যারা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে অভিভাবক বানিয়ে নিয়েছে তারা বলে- আমরা তাদের ‘ইবাদাত একমাত্র এ উদ্দেশ্যেই করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছে দেবে। (সত্য পথ থেকে সরে গিয়ে মিথ্যে পথ ও মতের জন্ম দিয়ে) তারা যে মতভেদ করছে, আল্লাহ তার চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যেবাদী ও কাফির আল্লাহ তাকে সঠিক পথ দেখান না।

৩৯:৪৩-৪৪ :: তবে কি তারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে সুপারিশকারী ধরেছে? বলো, তাদের কোনো ক্ষমতা না থাকলেও এবং তারা না বুঝলেও? বলো, সকল সুপারিশ আল্লাহরই ইখতিয়ারে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই; অতপর তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যানীত হবে।

৫। রাজত্বে অংশীদার মনে করা বা ভালো মন্দ করতে পারার অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করা

৪৬:৪ :: বল, ‘তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তাদের কথা ভেবে দেখেছ কি? তারা পৃথিবীতে কী সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও, অথবা আকাশমণ্ডলীতে তাদের কোনো অংশীদারিত্ব আছে কি? পূর্ববর্তী কোনো কিতাব অথবা পরম্পরগত কোনো জ্ঞান থাকলে তা তোমরা আমার নিকট উপস্থিত কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।”

১৭:১১১ :: “বলো, ‘প্রশংসা আল্লাহরই যিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি, তাঁরা ক্ষমতায়-রাজত্বে কোনো শরীক নেই এবং যিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না যে- কারণে তাঁর অভিভাবকের বা সাহায্যকারীর প্রয়োজন হতে পারে। সুতরাং সসম্ভ্রমে তাঁর মাহাত্ম্য ঘোষণা করো।”

৩৪:২২ :: “বলো, ‘তোমরা আহবান করো তাদেরকে যাদেরকে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে (ইলাহ) মনে করতে, তারা আকাশ-মণ্ডলী এবং পৃথিবীতে অণুপরিমাণ কিছুর মালিক নয় এবং এতদুভয়ে তাদের কোনো অংশও নেই এবং তাদের কেউ মহান আল্লাহর সহায়কও নয়।”

৩৫:১৩ :: তিনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান আর তিনিই সূর্য ও চাঁদকে বশীভূত করে দিয়েছেন; প্রত্যেকে পরিভ্রমণ করছে একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত। তিনিই আল্লাহ তোমাদের প্রতিপালক। রাজত্ব-মালিকানা তাঁরই। এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো খেজুরের আঁটির আবরণেরও মালিক নয়।”

৩৯:৩৮ :: যদি এদেরকে জিজ্ঞাসা করো: আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? এরা উত্তরে অবশ্যই বলবে- আল্লাহ। বলো, তোমরা বলো তো, যদি আল্লাহ আামার কোনো অনিষ্ট করতে চান তাহলে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকছো তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি যদি আমাকে অনুগ্রহ করতে চান তাহলে কি তারা সে অনুগ্রহকে রোধ করতে পারবে? বলো, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট । নির্ভরকারীগণ যেন তাঁর উপরই নির্ভর করে।

৬। গায়েবের জ্ঞান থাকার ধারণা

৬:৫৯ :: আর তাঁর কাছে রয়েছে গায়েবের চাবিসমূহ, তিনি ছাড়া এ বিষয়ে কেউ জানে না এবং তিনি জানেন স্থলভাগে ও জলভাগে যা কিছু আছে। আর কোনো পাতা ঝরে না এছাড়া যে তিনি তা জানেন এবং পৃথিবীর অন্ধকারে কোনো দানা নেই, না কোনো ভেজা এবং না কোনো শুষ্ক কিছু, এছাড়া যে তা হয় না স্পষ্ট কিতাবে লিখিত বিধি অনুযায়ী ছাড়া।

২৭:৬৫ :: বল, ‘আল্লাহ ছাড়া আসমানসমূহে ও যমীনে যারা আছে তারা গায়েব জানে না। আর কখন তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে তা তারা অনুভব করতে পারে না’।

৩৪:১৪ :: তারপর যখন আমি সুলাইমানের মৃত্যুর ফয়সালা করলাম তখন মাটির পোকা জিনদেরকে তার মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করল, যা তার লাঠি খাচ্ছিল। অতঃপর যখন সে পড়ে গেল তখন জিনরা বুঝতে পারল যে, তারা যদি গায়েব জানত তাহলে তারা লাঞ্ছনাদায়ক আযাবে থাকতো না।

আলোচনা: শিরক করার পেছনে একটি মনস্তত্ত্ব হলো আল্লাহ রসূলের কাছে ওহী বা কিতাবের মাধ্যমে যা জানিয়েছেন তার বাহিরেও কেউ কেউ কোনোভাবে গায়েবের ইলম জানতে পারে বলে মনে করা। জিনদের সম্পর্কেও কেউ কেউ এরূপ ধারণা পোষণ করে যে, তারা গায়েব বা ভবিষ্যৎ জ্ঞান জ্ঞান রাখে। এছাড়া কেউ কেউ এরূপ ধারণাও পোষণ করে যে, আল্লাহ কাউকে গায়েবের ইলম জানিয়ে দিয়েছেন। উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহে এসব ধারণাকে নাকচ করে দেয়া হয়েছে।

৭। রসূল ও ধর্মীয় পণ্ডিতদের বিষয়ে অতিভক্তি

৩:৭৯-৮০ :: কোনো মানুষের পক্ষে সঙ্গত নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমাত ও নবুওয়াত দান করার পর সে মানুষকে বলবে, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদাতকারী হওয়ার পরিবর্তে আমার ইবাদাতকারী (দাসত্ব ও উপাসনাকারী) হয়ে যাও। কিন্তু (তার কথা তো হবে), “তোমরা রব্বানী (রবের বিধান দ্বারা কর্মসম্পাদনকারী) হয়ে যাও, কিতাব শিক্ষাদানের এবং সেটার অধ্যয়নের মাধ্যমে।” আর সে ফেরেশতাগণকে ও নবীগণকে বিধাতা হিসেবে মেনে নিতে তোমাদেরকে নির্দেশ দিবে না। এটা কি সম্ভব যে, তোমরা তো হবে মুসলিম (আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী) অথচ তারপরও সে-ই তোমাদেরকে কুফর করার নির্দেশ দিবে?

৯:৩১ :: তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ধর্মীয় পণ্ডিতদেরকে ও সন্ন্যাসীদেরকে তাদের বিধাতা বানিয়ে নিয়েছে এবং মারাইয়াম পুত্র মাসীহকেও। অথচ তাদেরকে এক ইলাহের ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করতে আদেশ দেয়া হয়নি। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তারা যে শিরক (অংশীদার স্থাপন) করে তা থেকে তিনি পবিত্র।

[1] তথ্যসূত্র হিসেবে পয়েন্টভিত্তিক এক বা একাধিক আয়াত নাম্বার উল্লেখ করা হলো। একাধিক আয়াতের ক্ষেত্রে সাধারণত আরবি শব্দের একাধিক শব্দরূপ বিবেচনা করা হয়েছে।

>>  পরবর্তী পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য ক্লিক করুন