‘আল কুরআনের আলোকে হজ্জ: বিশ্বপ্রভুর প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত মাসসমূহে মানব কল্যাণে নিবেদিত বার্ষিক বিশ্ব সম্মেলন’ নামটি থেকেই কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে যে, বইটি হজ্জ সম্পর্কে গতানুগতিক তথ্য উপস্থাপনার জন্য রচিত কোনো বই নয়। এ বইটিতে আল কুরআনের আলোকে হজ্জের অর্থ, উদ্দেশ্য, গুরুত্ব, পদ্ধতি, হজ্জের সময়কাল, হজ্জের ব্যবস্থাপনা এবং হজ্জের সাথে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কা’বা ও আল মাসজিদুল হারামের বিষয়ে গবেষণামূলক তথ্য উপাত্ত উপস্থাপিত হয়েছে।
হজ্জ একটি বার্ষিক ও বৈশ্বিক সম্মেলন যার সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত রয়েছে বিশ্বপ্রভুর প্রতিষ্ঠান, পরিজ্ঞাত মাসসমূহ, মানবজাতির কল্যাণ। সংক্ষেপে বলা যায়, হজ্জ হলো ‘বিশ্ব কল্যাণ সম্মেলন’। বিশ্বপ্রভুর প্রতিষ্ঠান এবং পরিজ্ঞাত মাসসমূহের সাথে মানবজাতির এবং বন্য পশুদেরও নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধ জীবনের স্বর্গীয় প্রত্যাদেশভিত্তিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বশীলতা নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। হজ্জ শুধুমাত্র মুসলিম উম্মাহর জন্য নয়, বরং এটা সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশ্যে বিঘোষিত একটি সম্মেলন। হজ্জের ব্যবস্থাপনার দিকগুলোও নিছক বাহ্যিক কর্মযজ্ঞ নয়, বরং তার মধ্যে প্রকৃত কল্যাণ ব্রতের প্রতিশ্রুতি নিহিত রয়েছে, যে প্রতিশ্রুতি এবং প্রকৃত উদ্দেশ্য পরিপূরণ ব্যতীত নিছক ব্যবস্থাপনার দায়-দায়িত্ব পালনকারীরা কোনো বস্তুনিষ্ঠ কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারে না। হজ্জ ও এর ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত এরূপ তথ্য কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও সাধারণভাবে মুসলিমদের মধ্যেও বর্তমানে এ চেতনাবোধ জাগ্রত দেখা যায় না এবং তাই বিশ্বমানবতাও এর প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত। এ বিষয়গুলো এ বইয়ে তথ্যভিত্তিক বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
সাধারণভাবে হজ্জ শব্দটি শুনলে বর্তমানে হজ্জের যে চিত্র ফুটে উঠে এবং কুরআনে হজ্জের যে চিত্র অংকন করা হয়েছে তথা হজ্জের বিষয়ে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এ দুয়ের মধ্যে অত্যন্ত বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। কুরআনে হজ্জের অনুষ্ঠানের দিক অত্যন্ত সামান্য এবং তাও হজ্জের মূল উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিশীল করেই প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে হজ্জ নিতান্ত অনুষ্ঠানসর্বস্ব বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুরআনে হজ্জের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে যে মানব কল্যাণ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে সেটা কিভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে তা সমকালীন বাস্তবতার ভিত্তিতে নিরূপণের জন্য হজ্জে অংশগ্রহণকারী ও এর আয়োজকদের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, এ বিষয়টিকে গৌন গুরুত্ব দেয়ার অবকাশ আছে। বরং হজ্জের উদ্দেশ্য অর্জনই হজ্জের সবচেয়ে মুখ্য গুরুত্বের দিক। তাই সাধ্যমতো সর্বোচ্চ উত্তমভাবে এ উদ্দেশ্য অর্জনে ভূমিকা পালন করা বাঞ্চনীয়। এ বিষয়ে বইটিতে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন দিকের বিশ্লেষণ সাপেক্ষে বাস্তবভিত্তিক প্রস্তাবনাও উপস্থাপিত হয়েছে।
হজ্জের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন আয়াতে যে শাশ্বত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তার তথ্য সমন্বয়ের মাধ্যমে যথাযথ উপলব্ধির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো ক্ষেত্রে ত্রুটি থেকে যাওয়া অসম্ভব নয়। তাই আয়াতভিত্তিক চিন্তা-গবেষণা অব্যাহত রেখে যদি অধিকতর যাচাইয়ে কোনো ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি চিহ্নিত হয় তাহলে অবশ্যই তা পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করা হবে, ইনশাআল্লাহ।
মানবজাতির জন্য নাযিলকৃত বিধানগ্রন্থ কুরআন যা নাজিল করার উদ্দেশ্য উল্লেখ করে আল্লাহ একে অভিহিত করেছেন মানবজাতির জন্য পথনির্দেশক, আলোকবর্তিকা, উপদেশগ্রন্থ প্রমুখ অভিধায়। এই গ্রন্থে আমরা কিছু অপরিবর্তনীয়, অলংঘনীয় সত্যের ও সৎকাজের শিক্ষা যেমন পাই, তেমনি পাই মানব সমাজের কল্যাণমুখী কিছু নির্দেশ এবং যে কার্যকলাপ ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের জন্য ক্ষতিকর তা বর্জনের আদেশ।
কুরআন বিধানগ্রন্থটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এবং বারংবার পড়লে একজন পাঠকের জন্য এটা বোঝা কঠিন হবে না যে, কুরআনে আইন-কানুন (Legal) সর্ম্পকিত বিষয় ও আয়াত খুবই সীমিত। উত্তরাধিকার, বিয়ে ও বিয়ের বিচ্ছেদ, ঋণ গ্রহণে লিখিত স্বাক্ষী রাখা এরকম হাতে গোনা কয়েকটি বিষয় ছাড়া প্রকৃত অর্থে লিগ্যাল কোড কুরআনে খুব বেশি নেই। কুরআনের ৬২৩৬টি আয়াতের মধ্যে মাত্র ২০০টি হলো আইনী বিষয়ের আয়াত (শতকরা হিসাবে মাত্র ৩.২% আয়াত) যার মধ্যে কেবলমাত্র ৮০টি আয়াত (শতকরা হিসাবে মাত্র ১.৩% আয়াত) ব্যক্তিগত আইনী (Personal Law) বিষয়ে। অনেক আইনী বিষয়েই কুরআনে আল্লাহ কোনো নির্দেশনা দেননি। এর তাৎপর্য এই যে, কুরআন কঠোরভাবে (strictly) কোনো আইনের গ্রন্থ নয়।
হাতে গোনা যাবে এরকম কিছু আইনী তাৎপর্যবহনকারী বিষয় ছাড়া ছাড়া এর বাইরে রয়েছে কিছু নৈতিক আদেশ-নিষেধ সূচক নির্দেশ যেমন: পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার, সুন্দর করে কথা বলা, দান করা, হত্যা না করা, সত্য সাক্ষ্য দেওয়া ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকা, অবৈধ যৌন সম্পর্ক ও অশ্লীলতা পরিহার করা, মিথ্যা কথা না বলা, ওজনে / মাপে কম না দেওয়া, চুরি না করা, অন্যের অধিকার রক্ষা করা, প্রতিশ্রুতি দিলে তা পালন করা, অন্যদের সাথে পরামর্শ করা, মন্দ কথার প্রচার না করা ইত্যাদি।
লক্ষণীয় যে এই নৈতিক আদেশ নিষেধ মানবজাতির কাছে তথা সকল মানুষের বিবেকের কাছে এমনিতেও করণীয় ও বর্জণীয়। ধর্ম অর্থে আমরা যা বুঝি যেমন: খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু, শিখ - পৃথিবীর সকল ধর্মাদর্শেই কিন্তু এই নৈতিক আদর্শগুলো পাওয়া যাবে। অর্থাৎ এগুলো সার্বজনীন এবং কুরআনের মাধ্যমেই যে এগুলো প্রথমবারের মতো মানবজাতি জেনেছে এরকমটি নয়।
আর রয়েছে বিশ্বাসের কিছু বিষয় যেমন: এক স্রষ্টায় বিশ্বাস, আখিরাতের বিচার ও জবাব দিহিতা, স্রষ্টার তরফ থেকে নাযিল হওয়া বিধান, স্রষ্টার নির্দেশপালনকারী ফেরেশতায় বিশ্বাস ইত্যাদি। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের সাথে তুলনা করলে এই বিশ্বাসের উপাদানগুলোও সনাতন ও সূদীর্ঘকালের লালিত।
ধর্ম বলতে আমরা অনেকেই কেবল ধর্মে প্রচলিত কিছু আচার অনুষ্ঠান বুঝে থাকি। এই আচার অনুষ্ঠান বা রিচুয়ালের মাধ্যমে আমরা ধর্মের বাহ্যিক দিকের সাথেই মূলত পরিচিত হই বলে সেটাকেই ধর্মের প্রধানতম পরিচয় বা চিহ্ন হিসেবে জানি। কিন্তু কুরআনে দ্বীন শব্দের মাধ্যমে যে জীবনাচার ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার সাথে আমাদের পরিচয় হয় সেখানে আচার অনুষ্ঠান বা রিচুয়ালের স্থান যেমন একেবারে অনুপস্থিত তা নয়, তেমনি দ্বীন বলতে যা বুঝায় তা কখনোই আচার অনুষ্ঠান সর্বস্বও নয়, ব্যাপকও নয়।
কুরআনে বর্ণিত স্রষ্টায় আত্মসমর্পিতদের জীবনে ও জীবনব্যবস্থায় ধর্মীয় রিচুয়াল বা অনুষ্ঠানের পরিধি খুব সীমিত এবং ক্ষেত্র বিশেষে খুব মিনিমালিস্ট নির্দেশনা বিশিষ্ট; এবং সেখানেই শেষ নয় - সে রিচুয়াল বা অনুষ্ঠান পালনে কেউ যদি স্রষ্টার নির্দেশিত উপায়ে, সময়ে না পালন করতে পারেন, তার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন বিকল্প ব্যবস্থা বলে দেওয়া আছে। আর এ সব কিছুর পরেও স্রষ্টা বলছেন দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের কোনো কষ্ট দেওয়া আল্লাহর বিধান নয় এবং দ্বীনের ক্ষেত্রে কোনো সংকীর্ণতা নেই।
আরো লক্ষণীয় যে কুরআনে অহেতুক, অর্থহীন কোন রিচুয়াল বা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নেই। যদি কোনো রিচুয়ালের স্থান কুরআনে থাকে, তবে সেটা যে অর্থবহ ও বিশেষ কল্যাণ উপার্জনের উদ্দেশ্যে হবে তাতে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়, কেননা মঙ্গলময় স্রষ্টার প্রতিটি নির্দেশনা সেরূপটি হবে এটাই বাস্তবতা। কুরআনে যে কয়েকটি আচার অনুষ্ঠান এসেছে তাতেও ব্যাপক প্রশস্ততা ও ছাড় রয়েছে। অন্যদিকে কুরআনে ধর্মের নামে, প্রথা ও বাপ দাদার ঐতিহ্যের নামে প্রচলিত বেশ কয়েকটি আচার অনুষ্ঠানকে নিন্দা করা হয়েছে।
ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে কুরআনে এসেছে:
সালাত কায়েম করা এবং সালাত একটি বহুমাত্রিক বিষয় হিসেবে এসেছে যার মধ্যে আচার অনুষ্ঠান খুব অল্পই একটি অংশ। বরং জোর দেওয়া হয়েছে সালাত 'কায়েম' বা প্রতিষ্ঠার উপর, যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলো ব্যক্তিগত সালাত এবং সামষ্টিক সালাতের অনুষ্ঠান। কিন্তু বৃহৎ অর্থে সালাত কায়েম অর্থ স্রষ্টার বিধান অনুসারে সমাজে মানদন্ড স্থাপন, বিধানের অনুসরণ এবং অনুসরণের পরিবেশ সৃষ্টি।
জাকাত আদায় করার ক্ষেত্রেও এর মূল স্পিরিট হলেো পবিত্রতা অর্জন। পবিত্রতা অর্জন, তাকওয়া অর্জন একজন ব্যক্তির জন্য একক হলেও, একটি সমাজ যদি নৈতিক মানদন্ডে সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে থাকে, তার মধ্যে একজন ভালো মানুষের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও পদচারণ কঠিন। সমাজে সবাই যদি অন্যের হক নষ্ট করে, তখন ব্যক্তিরও শান্তি ও সমৃদ্ধি নষ্ট হয়। এ কারণেই জাকাতের অর্থনৈতিক মাত্রার মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা ও শ্রেণী বিভেদকে সীমিত রাখার প্রচেষ্টা এবং সেখানেই সাদাকাহ ও জাকাতের প্রয়োগ।
সিয়াম পালনের যে ধর্মীয় নিদের্শ আছে সেটিরর পেছনেও আছে অর্থপূর্ণ প্রচেষ্টা ও সংযম সাধনা যার শুরু দৈহিক হলেও এর চূড়ান্ত লক্ষ্য কিন্তু তাকওয়া বা মানসিক ও আত্নিক।
অন্যদিকে ধর্মের নামে, প্রথা হিসাবে ও বাপ দাদার ঐতিহ্যের নামে প্রচলিত যেসব আচার অনুষ্ঠানকে নিন্দা করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে:
এটা খুবই স্বত:সিদ্ধ বিষয় যে, যিনি বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রা; আসমান ও জমীনে যা আছে তার সবই যাঁর এবং যিনি সব কিছু থেকে অমুখাপেক্ষি; চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী - সৃষ্টির তরফ থেকে কোনো ধরনের রিচুয়াল বা অনুষ্ঠান তঁর প্রয়োজন হয় না।
কুরআনে আমরা এর প্রমাণ হিসেবে পড়ি:
“পূর্ব ও পশ্চিমে মুখ ফেরানোয় কোনো পূণ্য নেই…” অর্থাৎ কেবলমাত্র অনুষ্ঠান পালনের জন্য আচার অনুষ্ঠানের কোনো মূল্য স্রষ্টার কাছে নেই এবং সেটাই স্বাভাবিক।
ঐ একই আয়াতে স্রষ্টা বলছেন, "পূণ্য হলো: স্রষ্টায় বিশ্বাস, আখেরাতে, ফেরেশতাগণে, স্রষ্টার নাযিলকৃত বিধানে ও বার্তাবাহকদের প্রতি বিশ্বাস; যারা স্রষ্টার প্রেমে ধন সম্পদের প্রতি আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও তা আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন, দরিদ্র, পথিক ও ভিক্ষুকদেরকে এবং দাসত্ব মোচনের জন্য ব্যয় করে, আর সালাত প্রতিষ্ঠিত করে ও যাকাত প্রদান করে এবং অঙ্গীকার করলে তা পূরণ করে এবং যারা অভাবে ও ক্লেশে এবং যুদ্ধকালে ধৈর্যশীল তারাই সত্য পরায়ণ এবং তারাই ধর্মভীরু।” (২:১৭৭)
আল্লাহর কাছে ওগুলোর (কুরবানীর পশুগুলোর) না গোশত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পার এজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন, কাজেই সৎকর্মশীলদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও। (২২:৩৭)
সুতরাং প্রচলিত 'ধর্মে' আমরা যে সব আচার আচরণের অতিরঞ্জন ও অনুষ্ঠানের প্রতি অস্বাভা্বিক যে গুরুত্ব দেখি, সেই বিষয়টি কিন্তু কুরআনে লক্ষ করি না। বরং কুরআনে যে সামান্য কয়েকটা আচরণকে উৎসাহিত ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোতেও অনেক প্রশস্ততা দেওয়া হয়েছে, দেয়া হয়েছে বিকল্প। যেমন রমজানে রোজা না করতে পারলে গরীবদের সাধ্যমতো খাওয়ানো, হজ্জ অল্প কয়েকদিনে সম্পন্ন করলে কোনো দোষ নেই, হজ্জে হাদিয়া দিতে না পারলে রোযা রেখে তার ক্ষতিপূরণ করা, সালাতে দাঁড়ানোর পূর্বে পানি না পেলে উচ্চভূমিতে তথা পরিস্কার মাটিতে বা বালিতে বিকল্প পরিচ্ছন্নতার চর্চা ইত্যাদি সবই সেই দ্বীনে কোনো সংকীর্ণতা না রাখা এবং আচরণের প্রশস্ততা প্রদান ও জীবনাচরন সহজ করার উদাহরণ। আরো উদাহরণ রয়েছে সাধ্যমতো সৎকাজ করা, সাধ্যমত তাকওয়া অর্জনে চেষ্টা চালানোর নির্দেশ।
যে রাসূলের কাছে কুরআন নাযিল ও সালাত কায়েমের মতো গুরুভার অর্পিত ছিলো, তাকে পর্যন্ত আল্লাহ বলেছেন, ‘অত:পর যতটুকু সহজ হয় কুরআন ততটুকু পাঠ করো’। এটি কিন্তু কুরআনে আচার অনুস্ঠান সম্পর্কে স্বয়ং স্রষ্টার দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার ক্ষেত্রে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
কুরআনে হাজারটা মাসলা মাছায়েল খুঁজলে পাওয়া যাবে না। কুরআনে এটা কিভাবে করবো, ওটা কিভাবে করবো এরকম শত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার গ্রন্থ নয়। বরং কুরআনে এ ধরনের অহেতুক, অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের ব্যাপারে এক ধরনের বিশেষ শিক্ষা আছে নবী মুসা আ. ও তার কওম তথা বনী ইসরাইলের মধ্যে একটি কথোপকথনের আয়াতসমূহে। এটিও এ্যান্টি-রিচুয়াল শিক্ষারই আয়াতমালা যেখানে একটি নির্দিষ্ট কাজের বিপরীতে স্রষ্টা মুসা আ. কে বললেন যে তার স্বজাতিকে গরু যবেহ করতে (২:৬৭)। তারা সেই সহজ নির্দেশ না পালন করে মুসাকে বারবার প্রশ্নের বাণে জর্জরিত করে। কি গরু, কেমন দেখতে গরু, কি রং, বয়স কেমন, সব গরু তাদের কাছে নাকি একই রকম লাগে এরকম অনেক বাহানা ইত্যাদি ইত্যাদি।
মুসার মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ বনাম মুসার কওমের যে প্যাঁচাপেচির মনোভাব (attitude) - এই দুটির মধ্যে প্রতিতুলনা করলে আমরা কুরআনের মূলনীতি ও মিনিমালিজম বনাম রিচুয়াল ও মাসলামাসায়েলের ঘরানা বুঝতে পারা সম্ভব। আমাদের অনেক কুরআনের পাঠক অথবা পাঠকদাবীদারদের একটি কথা হলো, কুরআনে তো এটা কিভাবে করবো নেই, ওটা কিভাবে করবো নেই। আসলে কুরআনের যে নীতি ও দর্শন তাতে মানব সমাজের এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তার জীবনে যা যা করবে বা যা যা পরিস্থিতির সন্মুখিন হবে সেগুলোর প্রত্যেকটি তুলে ধরে সেটাতে কী করণীয় - এমনটি বলার গ্রন্থ নয়। এটি মৌলিক বিষয়ের মূলনীতিগুলো (principles) ও মানদন্ড ঠিক (setting the criteria) করে দেওয়ার গ্রন্থ। যে কারণে এর নাম ফুরকান বা মানদন্ড।
ভাত খাওয়া যাবে নাকি গমের রুটি খেতে হবে, রাস্তা পার হওয়ার সহী তরিকা অথবা সালাতে হাত কোথায় বাধা হবে - এ ধরনের বিষয় স্রষ্টার বিধান গ্রন্থের বিষয় নয়। স্থান, কাল পাত্র ভেদে মানুষ বিচিত্র ধরনের অসংখ্য খাবার খাবে। এর মধ্যে মাত্র অল্প কয়েকটি সুনির্দিষ্ট খাবারকে নিষিদ্ধ করে বাকি সব কিছুকে হালাল করে দিয়েছে কুরআন। আর খাবারের মূলনীতি বলার সময়ে ঘোষণা দিয়েছে: যা কিছু সৎ উপার্জনের (হালাল) এবং যা ভালো / পরিচ্ছন্ন (তাইয়েব) তা খাও। কথা এখানেই শেষ।
অন্য অনেক বিষয়েই আমরা এই ধরনের বিষয়টাই দেখতে পাবো যে, কুরআন মূলনীতি বলে দিয়েছে, ডিটেইলস মানুষের বিবেক, সময়, সামাজিক বিধান, অভ্যাস ও নিজস্ব বিচারের কাছে ছেড়ে দিয়েছে। নারীর পোশাক নিয়ে অনেক মুসলিম সমাজে অনেক বাড়াবাড়ি দেখা যায়। কুরআন কিন্তু মডেস্ট বা শালীনতার কিছু প্রিন্সিপ্যাল উল্লেখ করে এবং নারীর কিছু শালীন আচরণের নির্দেশনা দিয়েই বাকিটা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও রুচির কাছে ছেড়ে দিয়েছে। কেননা পোশাক শালীন হওয়াটাই কাম্য, সেটা চীনা কালচার হোক, ভারতীয়, ইউরোপিয় বা আফ্রিকান হোক। পোশাকের পাশাপাশি দৃষ্টির ও মনোভাবের বিষয়ে কুরআনের মূলনীতি খুব পরিস্কার। দৃষ্টি সংযত করা। এই মূলনীতি না মানা হলে একজন নারীকে যত প্যাঁচের কাপড় আর আপাদমস্তক যত ঢাকাই হোক না কেন, অসংযত দৃষ্টির পুরুষ তার কদর্য মনে অনেক কিছুর কল্পনাই করবে। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে সমাজে দেখতে পাই।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। উদ্দেশ্যবিহীন ও অর্থহীন রিচুয়াল বা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। কুরআনে আমরা কোন উদ্দেশ্যবিহীন রিচুয়াল বা আচার-অনুষ্ঠান পাই না। যে কয়টি আচার অনুষ্ঠান পালনের নির্দেশ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হলো হজ্জ। এই বইয়ে হজ্জের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কুরআনে স্রষ্টা কি বলেছেন যদি আমরা তা দেখি তাহলে দেখা যাবে হজ্জের উদ্দেশ্য হলো মানবকল্যাণ। হজ্জের অর্থ হলো সমাবেশ, এক স্থানে কোনো উদ্দেশ্যে মিলিত হওয়া, সমাবর্তন ইত্যাদি।
যখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের ডিগ্রি প্রদানের সমাবর্তন অনুষ্ঠান করা হয়, তার একটা প্রধান উদ্দেশ্য থাকে যেটি হলো- ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা ডিগ্রি পেতে যাচ্ছে, তাদের সেই ডিগ্রির সনদ গ্রহণ করা। এখন এই উদ্দেশ্য যদি কেউ ভুলে যায় এবং তারপরেও যদি প্রতিবছর কিছু ছেলে মেয়ে ক্যাম্পাসে সমাবশে করে এবং সেটাকে সমাবর্তন নাম দেয়; কিন্তু ডিগ্রি প্রদানের মূল কাজের কিছুই না করে; সেই সমাবর্তনকে কি আমরা সমাবর্তন বলতে পারবো? সেটা কি Graduation Ceremony থাকবে?
কুরআনের আলোকে হজ্জের পর্যালোচনা করতে গিয়ে তেমনটিই পরিলক্ষিত হবে এবং পাঠকরা এই্ বইটি পাঠ করার পর কুরআনে হজ্জের আয়াতসমূহ বারবার অধ্যায়ন করতে গেলে একই সত্য উপলব্ধি করবেন, এটাই আমাদের বিশ্বাস। কুরআনে হজ্জের বিষয়ে যে অনেক আয়াত্ এসেছে তা নয়। কুরআনে হজ্জের আচার অনুষ্ঠান সর্ম্পকিত আয়াত সীমিত এবং তাতে রিচুয়ালের দিকটিও উল্লেখযোগ্যভাবে অল্প কয়েকটি আয়াতে সীমাবদ্ধ। কিন্তু পর্যাপ্ত।
এর কারণ হলো কুরআনে মূলনীতি বলে দেওয়ার পর নির্বাহী সিদ্ধান্তে, কমিউনিটির মধ্যে পরামর্শে, নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে সময়োপযোগি কাজ করা হবে, সে অনুসারে স্রষ্টার অনুগ্রহ অনুসন্ধান করা হবে, কল্যাণের ও মঙ্গলের দিক অনুসন্ধান করা হবে এমনটাই কাম্য। এটাই হওয়া উচিত এবং কুরআনে মৌলিক বিধান দিয়ে বাস্তবায়ন সম্পর্কীয় বিষয়াদিতে পরামর্শের নির্দেশনা দেয়ার তাৎপর্য।
হজ্জের বিষয়ে পরিতাপের বিষয় মুসলিম কমিউনিটির বিশেষ ব্লাইন্ডস্পট তৈরী হয়েছে। প্রথমত: কুরআন থেকে হজ্জের শিক্ষার বিষয়ে তার অজ্ঞতা এখানে দায়ী। দ্বিতীয়ত: হজ্জের কারণ, উদ্দেশ্য এবং হজ্জের মাধ্যমে মানবজাতির কল্যাণ বিষয়ে সে কিভাবে সাক্ষী হবে সে সম্পর্কে দীর্ঘদিনের নিস্ক্রিয়তা যে এই আচার অনুষ্ঠানকে কেবলই অনুষ্ঠানে পর্যবসিত করেছে সে বিষয়ে তার কোনো চিন্তা ভাবনা না থাকা।
হজ্জ কার জন্য, হজ্জে কি হওয়ার কথা, হজ্জের মাধ্যমে মানবকল্যাণ হাসিল কিভাবে হবে, হজ্জের মাস হলো ইউনিভার্সাল যুদ্ধ বিরতি ও প্রকৃতির বিশ্রামের সময় - এই প্রত্যেকটা প্রশ্ন ও বিষয়ে মুসলিম জাতি ও বিশ্বকে নতুন করে কুরআনের শিক্ষা মনে করিয়ে দেওয়া জরুরী। যারা নিজেদেরকে স্রষ্টার বিশ্বাসী ও তাঁর বিধানের প্রতি আত্মসমর্পনকারী (মুসলিম) বলে দাবি করে, তারা হবে মানবজাতির জন্য সাক্ষী, স্রষ্টার বিধানের প্রচারকারী। এই কল্যাণের সাক্ষ্য ও বিধান প্রচারের অন্যতম বড় আয়োজন হওয়ার কথা ছিলো হজ্জ, যেখানে পৃথিবীর সকল বিশ্বাসীরা আসবে, এক স্রষ্টার ও এক মানবসমাজের ঐক্যের সৌন্দর্য্য তারা দেখবে, এখানে পারস্পরিক চেনা জানা, কল্যাণের বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে, পক্ষে বিপক্ষে বিতর্ক উপস্থাপন হবে (হজ্জের অন্যতম মূল অর্থ হলো তর্ক বিতর্ক), স্থানীয় অস্থানীয় কোনো বিভেদ থাকবে না, প্রত্যেক আগত মেহমানের আাতিথেয়তা হবে - এসবই কুরআনে হজ্জের শিক্ষায় আমরা পাই।
হজ্জকে ধর্মীয় রিচুয়াল হিসেবে না দেখে কুরআনের আলোতে দেখলে আমরা এটিকে দেখতে পাই এক স্রষ্টার এক মানবসমাজের এক মিলনমেলায়। এই মিলনমেলা কেবল ঘুরাঘুরির নয়, কেবল অর্থহীন কিছু কাজ নয়, বরং এটি মানব সমাজের সর্বোচ্চ কল্যাণের কাজগুলো করার স্থান। হজ্জের সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িত মানবসমাজের শান্তি ও নিরাপত্তা।
এই বইতে এই বিষয়গুলোই উঠে এসেছে। হজ্জ যেমন কেবলমাত্র কোনো বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠি বা ধর্মীয় মতাদর্শের মানুষের জন্য নয়, মানব জাতির জন্য - আমরা আশা রাখি যেকোনো ধর্মবিশ্বাসের মানুষই এই বইটি পড়ে উপকৃত হতে পারেন। সাধারণ মুসলিম এবং বিশেষ করে যারা কুরআনের শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী তারা এই বই থেকে প্রচুর চিন্তার খোরাক পাবেন বলে আশা করি, যা আপনাদের আবার এবং বারবার কুরআন পাঠে আগ্রহী ও উৎসাহী করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
হজ্জের সাথে সর্ম্পকিত কুরআনের আয়াতসমূহ অধ্যায়নের সময়ে আমরা বেশ কিছু নতুন উপলব্ধিতে উপনীত হয়েছি যার মধ্যে উল্লেখযৈাগ্য হলো: হারাম মাসে যে কোনো ধরনের যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে বিরত থাকার শিক্ষা, যা আমরা এখন আর নেই না। এর ভিতরে যুদ্ধ করাকে আল্লাহ চরম গুনাহ বলেছেন, অথচ মুসলিম জিও পলিটিক্যাল বোধে এই কুরআনিক নির্দেশ অদ্ভুতভাবে অনুপস্থিত।
হুরুমুন তথা, হারাম মাসসমূহের মধ্যে স্থলভাগে সকল শিকার নিষিদ্ধ - সবার জন্য। এটি আমাদের জন্য একটি রোমাঞ্চকর আবিষ্কার ছিলো যাতে অন্যান্য আন্তর্জাতিক কুরআনিক স্কলারদের এনালাইসিসের মাধ্যমেও একই স্বীকৃতি পাওয়া গেছে। হারাম মাসগুলোর গননা কখন থেকে শুরু হবে এবং সেটি যে প্রাকৃতিক ঋতু ও বসন্তের সাথে নির্ভরশীল যখন পশুপাখিরা তাদের প্রজনন ও শিশুদের লালনপালন করে, এই মিসিং লিংকটি আমরা মনে করি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা। ক্বালাইদ শব্দটির ট্রাডিশনাল অর্থ করা হয় গলায় মালা পরানো পশু যা কা’বায় নেওয়া হয়, অথচ এটি একটি ভুল ধারণা এবং কা’বায় এ ধরনের অনুশীলন এখনও যেমন নেই, আগেও ছিলো না। যে পশু হাদিয়া হিসেবে কা’বায় পৌছানো হতো, তাকে ডেকোরেশন করা হলেও এর জন্য আলাদা উল্লেখের কোনো প্রয়োজন কনটেক্সট অনুসারে পরিলক্ষিত হয় না। প্রকৃত বিশ্লেষণে ক্বালাইদ অর্থ বিশেষ প্রতিনিধি এবং সেটা মানব প্রতিনিধি যারা ব্যাজ বা প্রতীক বা পতাকা বহন করে ভিন্ন ভিন্ন জাতির যারা হজ্জে উপস্থিত হবে।
আর সামগ্রিকভাবে কুরআনের আলোকে হজ্জকে পুনরায় অধ্যায়ন করতে গিয়ে আমরা যেটা বুঝেছি তা হলো হজ্জ মানবজাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে এবং খুবই বাস্তবমুখি একটি আচার অনুষ্ঠান। কোনো অর্থহীন বিষয় নয়। বর্তমান হজ্জ সেই অর্থহীনতায় বর্জবসিত হয়েছে অনেক কাল আগে থেকে। কিন্তু কুরআনে আয়াতিক বিশ্লেষণে হজ্জের উদ্দেশ্যেপূর্ণ ভাবগাম্ভির্যতা বোঝা যায়।
হজ্জ বিষয়ে আল কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে যে ধারণা বা রূপরেখা পাওয়া যায় তার অনুসন্ধান এবং এ বিষয়ে অনুধাবন ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে উপলব্ধির শেয়ারের জন্য বইটি রচিত হয়েছে। কুরআনের আয়াত বিশ্বপ্রভুর পক্ষ থেকে বিশ্বজনীন সত্য তথ্য ও বিধি-বিধান নির্দেশ করে। কিন্তু আয়াত অনুধাবনের ও সেই প্রেক্ষিতে কার্যক্রম সম্পাদনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে আমাদের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, আবার সেই সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে উঠার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখাও আমাদের দায়িত্ব। তাই যদি কোনো আয়াতের বক্তব্য দ্বারা বইটিতে উপস্থাপিত কোনো তথ্যে কোনো ত্রুটি চিহ্নিত হয়, তাহলে পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধন করতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বইটিতে কুরআনের আয়াতসমূহের অনুবাদের ক্ষেত্রে আরবী মূল শব্দের যথাসম্ভবব কাছাকাছি বাংলা শব্দ চয়ন করার এবং প্রসঙ্গ অনুসারে প্রযোজ্য শব্দার্থকে প্রাধান্য দেয়ার দিকে লক্ষ রাখা হয়েছে।
মানবজাতিকে তার প্রকৃত পরিচয়, বিশ্বপ্রভু ও বিশ্বজগতের সাথে তার সম্পর্ক এবং তার জীবনের মূল দায়দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার বিষয়ে অজ্ঞতার অন্ধত্ব ও অন্ধকার থেকে মুক্ত করে আলোর দিকে ও ভালোর দিকে নিয়ে আসার জন্য স্রষ্টা তাঁর কিতাব বা আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। এ কিতাব শুধুমাত্র ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক পাঠ করার জন্য নয়, বরং বুঝে পড়া ও তা নিয়ে চিন্তাগবেষণা করা এবং জীবনে বাস্তবায়ন করার জন্য, কুরআন থেকে আমরা এ শিক্ষাই পেয়ে থাকি। এ প্রেক্ষিতে কুরআন গবেষণা ও এর প্রায়োগিক তাৎপর্যকে অনুসরণ করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস হিসেবে ‘দি ইনস্টিটিউট ফর কুরআনিক রিসার্চ এন্ড এ্যাপ্লিকেশন’ বা ইক্বরার পদযাত্রা। এরই ধারাবাহিকতায় ‘আল কুরআনের আলোকে হজ্জ’ বইটি ইক্বরার পক্ষ থেকে একটি গবেষণাকর্ম ও প্রকাশনা। কুরআন চর্চার এ প্রয়াস অব্যাহত রাখতে সকল শুভাকাঙ্খীর আন্তরিক পরামর্শ ও সহযোগিতা কাম্য এবং এজন্য আমরা স্রষ্টার সাহায্য প্রার্থনা করি এবং তাঁর দিকনির্দেশনাই আমাদের পাথেয়।
১. সাধারণত হজ্জ শব্দের অর্থ করা হয় ‘তীর্থস্থানে গমন’। যদিও এ অর্থটিও হজ্জ শব্দের অর্থের অন্তর্ভুক্ত, তবুও হজ্জের তাৎপর্য এর চেয়ে ব্যাপক। হজ্জ বিশ্বজনীন মানবজাতির সমাবর্তন, যাতে তারা কল্যাণ উদ্দেশ্যে একত্রিত হবে এবং মানবকল্যাণমুখী মতাদর্শ বিষয়ে বিভিন্ন যুক্তির (হুজ্জাত) উপস্থাপন করবে, কিন্তু তা এরূপ স্তরে থাকতে হবে যে, যেন তা পারস্পরিক বিতর্কে (জিদাল) রূপ নিতে না পারে, বরং তার উদ্দেশ্য হবে কোনো সাধারণ বা মতৈক্যের স্থানে পৌঁছে ঐ ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মিলিত কার্যক্রম করা।
২. হজ্জের হেডকোয়ার্টার বা সমাবর্তন কেন্দ্র হিসেবে পবিত্র ও সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠান (আল মাসজিদুল হারাম) প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর তরফ থেকে নবী ইব্রাহীম আ.কে নির্দেশিত স্থান হলো বাক্কা, যা মাক্কার অভ্যন্তরে রয়েছে এবং যার আঙ্গিনায় ‘আল মাসজিদুল হারাম’ বা ‘সংরক্ষিত মাসজিদ’ (সংরক্ষিত পবিত্র প্রতিষ্ঠান) রয়েছে। এই বিশ্বকেন্দ্র বা পবিত্র প্রতিষ্ঠানই হজ্জের নির্দিষ্ট স্থান।
৩. হজ্জের সুনির্দিষ্ট সময়কাল রয়েছে যে সময়টি (সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানের ভৌগোলিক অবস্থান সাপেক্ষে) বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্যও সংরক্ষিত সময় এবং সেই সাথে তা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ বিরতি (Universal Ceasefire) পালনেরও সময়। সংরক্ষিত মাসসমূহকে কুরআনে ‘হুরুম’ বলা হয়েছে। ‘হুরুম’ বা হারাম (সংরক্ষিত) মাসসমূহ হলো ধারাবাহিক চারটি মাস, যার মধ্যে প্রথমটিতে সিয়াম এবং পরের তিনটিতে হজ্জ সম্পাদিত হবে। অন্যকথায় প্রথম সংরক্ষিত মাসটি হলো রমাদানের মাস এবং পরের তিনটি মাস হলো রমাদানের পরবর্তী তিনটি সংরক্ষিত মাস। রমাদানের মাস বলতে ঐ মাসকে বুঝায় যার মাধ্যমে বন্য প্রাণীর সংরক্ষণের জন্য শিকার বিরতির মাস শুরু হওয়ার অভিলক্ষণ পরিলক্ষিত (শাহিদা) হয়। অবশ্য (কা’বার ভৌগোলিক অবস্থান সাপেক্ষে) ভিন্ন গোলার্ধে ভিন্ন সময় বন্য পশু শিকার বিরতি ও যুদ্ধ বিরতির সংরক্ষিত মাসসমূহ পালিত হবে। সংরক্ষিত মাস মানুষের জন্য অহিংসা পালনের এবং প্রাকৃতিক বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণের (wildlife preservation) সুনির্দিষ্ট সময়।
৪. হজ্জের উদ্দেশ্য মানব কল্যাণ যা সময় ও যুগোপযোগি হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য হজ্জ করতে বলা হয়েছে কিন্তু কিভাবে উদ্দেশ্য অর্জনের কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে সেটা হজ্জের আয়োজক ব্যবস্থাপনা পরিষদ ও অংশগ্রহণকারীদের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে।
৫. হজ্জের ব্যবস্থাপনার জন্য আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা পরিষদের ভূমিকা পালন করতে হবে। হজ্জের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে হজ্জের জন্য হাদিয়া বা উপহারকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই হাদিয়ার মাধ্যমে হজ্জে আগত ব্যক্তিদের খাবার ও পানীয় সহ আতিথেয়তার ব্যবস্থাপনা ও তাদের পাথেয়র ব্যবস্থা করতে হবে। বাস্তব অবস্থার উপর ভিত্তি করে আয়োজক কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত হারে অংশগ্রহণকারীদের হাদিয়া দিতে হবে। যদি তা দেয়া সম্ভব না হয় তাহলে অপারগতার জন্য আল মাসজিদুল হারামের এলাকায় বাসিন্দা নয় এমন বহিরাগতরা হজ্জের সময় তিনদিন এবং ফিরে গিয়ে সাতদিন সিয়াম পালন করতে হবে।
৬. যে সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানে হজ্জ সম্পাদিত হবে তার ভূমিকা হলো তা বিশ্বব্যাপী মানবজাতির জন্য কল্যাণকর ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠার (ক্বিয়াম) মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে, সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সমৃদ্ধির সম্প্রসারণ করবে, হিদায়াত তথা একত্ববাদের প্রচার-প্রসারে কাজ করবে, ফিতনা-ফাসাদ ও জুলুম প্রতিরোধ করবে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। আল মাসজিদুল হারামে এর ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত (আকিফ / কর্মচারী প্রশাসন) ও এতে গমনাগমনকারীদের নিরাপত্তা লাভ ও মতপ্রকাশের সমান অধিকার রয়েছে।
৭. হজ্জের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে এ সময়কালে নির্দিষ্ট স্থানে (কা’বার সন্নিকটে বা নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায়) আল্লাহর নাম নিয়ে পশু উৎসর্গ করতে হবে, ঐ পশুগুলোর রক্ত ও গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছবে না, বরং এ নির্দেশ পালনের মাধ্যমে আল্লাহ সচেতনতা তৈরি হলে সেটাই আল্লাহর কাছে পৌঁছবে। তাই ঐ উৎসর্গিত পশুর গোশতের বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, তা থেকে নিজেরা খেতে হবে এবং যারা আবেদন করে না ও যারা আবেদন করে উভয় শ্রেণির মানুষকে তা থেকে খাওয়াতে হবে।
৮. হজ্জের সময় আরাফাতে একত্রিত হওয়াকে শ্রেণি-নির্বিশেষে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আরাফাত বলতে বুঝায় পরিচিতির স্থান। এ নির্দেশের মাধ্যমে বস্তুত মানবজাতির মধ্য থেকে হজ্জে অংশগ্রহণকারীরা তাদের ক্বালায়িদ বা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরস্পর পরিচিত হওয়ার নির্দেশনা প্রতীয়মান হয়। সেই সাথে এর মাধ্যমে শ্রেণিবাদকে দারুণভাবে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। এই পরিচিতি বলতে শুধুমাত্র নাম-ধাম জানার পরিচিতিকে বুঝায় না, বরং এর দ্বারা বিভিন্ন দেশ ও ভাষাগোষ্ঠীর সভ্যতা-সংস্কৃতির বৈচিত্র্য, তাদের সুবিধা-অসুবিধা, আবিষ্কার-উদ্ভাবন, বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলার পদ্ধতি, পারস্পরিক সহযোগিতার উপায়-উপকরণ ইত্যাদি সকল কিছুর সাথে পরিচিতিকে বুঝায়। এই পরিচিতি অনুষ্ঠান হলো হজ্জের উদ্দেশ্য (কল্যাণ) অর্জনে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানোর অন্যতম উপায়।
৯. হজ্জের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য হজ্জের সমাবর্তন প্রতিষ্ঠান আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনা পরিষদকে মুসলিম উম্মাহর উলিল আমরের নিয়ন্ত্রণাধীন নির্বাচিত মু’মিনদের মাধ্যমে পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে মক্কা এবং মক্কার বাইরের তথা পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের প্রতিনিধি থাকার অধিকার থাকবে। এ লক্ষ্যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আল মাসজিদুল হারামের ‘খাদেমুল হারাম’ হওয়ার দায়িত্ব ‘ওআইসি’ বা এ ধরনের কোনো অংশগ্রহণমূলক সংস্থার নিকট প্রত্যর্পণ করা প্রয়োজন।
১০. আল মাসজিদুল হারামের কাছে বা হজ্জ অনুষ্ঠানে সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-দেশ-ভাষা ও পেশার মানুষের যাওয়ার অধিকার রয়েছে। তবে মুশরিকদের জন্য তথা যারা আল্লাহকে একমাত্র নিরঙ্কুশ (Sole Supreme) স্রষ্টা ও প্রতিপালক, বিধানদাতা ও চূড়ান্ত বিচারক হিসেবে গ্রহণ করবে না তাদের জন্য এর অনুমতি নেই। অন্য কথায় কেউ ধর্ম বিষয়ে নিরপেক্ষ হতে পারে, আল্লাহর যে কোনো কিতাব বা তার অংশবিশেষের ধারক-বাহক হতে পারে, কিন্তু আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনা বা অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী হতে হলে সে একত্ববাদ মতাদর্শের বিরোধী হতে পারবে না। মুশরিকরা যদি চুক্তিবদ্ধ হয় এবং চুক্তি লঙ্ঘন না করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া যাবে না। যদি তারা আশ্রয় চায় তাহলে আশ্রয় দিতে হবে এবং তাদেরকে তাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতে হবে। যদি মুশরিকরা চুক্তি লঙ্ঘন করে আক্রমণ করে তাহলে তাদেরকে পাল্টা আক্রমণ করা যাবে এবং যদি তারা ফিতনার সৃষ্টি করে তথা মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে তাহলে ঐ ফিতনার অবসান না হ্ওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম করতে হবে।
আল কুরআনের আলোকে হজ্জের বিধান বুঝার জন্য প্রাসঙ্গিক আয়াতসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
হজ্জ প্রতিষ্ঠানের আদিকথা ও কেন্দ্রীয় গুরুত্ব
إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِّلْعَالَمِينَ
৩:৯৬ :: নিশ্চয় বাক্কাতে মানবজাতির জন্য আদি প্রতিষ্ঠান (আওয়ালা বাইত) স্থাপন করা হয়েছে যা বিশ্ববাসীর জন্য সমৃদ্ধিময় (মুবারাক) এবং পথনির্দেশ (হুদা)।
فِيهِ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ مَّقَامُ إِبْرَاهِيمَ وَمَن دَخَلَهُ كَانَ آمِنًا وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ
৩:৯৭ :: তার ক্ষেত্রে (অর্থাৎ আদিগৃহের ক্ষেত্রে) স্পষ্ট প্রমাণবহ নিদর্শনসমূহ রয়েছে। (যেমন তার সাথে সম্পর্কিত) মাক্বামে ইবরাহীম (ইবরাহীমের আদর্শগত অবস্থান)। আর যে তাতে (অর্থাৎ ঐ প্রতিষ্ঠানে) প্রবেশ করবে সে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত হবে। আর আল্লাহর (সন্তুষ্টি অর্জনের) উদ্দেশ্যে মানুষের উপর দায়িত্ব হচ্ছে, এ প্রতিষ্ঠানের হজ্জ করা (অর্থাৎ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা), যে তাতে পৌঁছার উপায়-উপকরণের সামর্থ্য রাখে। আর যে কুফর করে (সত্যকে অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান করে) তবে নিশ্চয় আল্লাহ বিশ্ববাসীর থেকে অমুখাপেক্ষী।
وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَن لَّا تُشْرِكْ بِي شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ
২২:২৬ :: আর (উল্লেখ্য) যখন আমি ইবরাহীমের জন্য আল বাইতের (অর্থাৎ পবিত্র প্রতিষ্ঠানের) স্থান চিহ্নিত করে দিয়েছি, এ মর্মে যে, আমার সাথে কাউকে শরিক (অংশীদার) সাব্যস্ত করো না এবং আমার (নির্ধারিত) প্রতিষ্ঠানকে পরিচ্ছন্ন রাখো তাওয়াফকারীদের জন্য (যারা এতে আগমন ও আবর্তন করবে), ক্বিয়ামকারীদের জন্য (যারা এর নীতি আদর্শ বাস্তবায়ন করবে), রুকূকারীদের জন্য (যারা এর আদর্শের প্রতি বিনত হবে) এবং সাজদাহকারীদের জন্য (যারা এর নীতিমালা মেনে নেবে ও সম্মান দেখাবে)।
وَأَذِّن فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَىٰ كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ
২২:২৭ :: আর মানবজাতির মধ্যে হজ্জের ঘোষণা দাও। তারা তোমার ঘোষণার প্রেক্ষিতে আসবে পদচারী হয়ে এবং সর্বপ্রকার সপ্রস্তুত বাহনের উপর আরোহন করে। তারা আসবে সর্বপ্রকার দূর-দূরান্তের পথ থেকে।
وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ مَثَابَةً لِّلنَّاسِ وَأَمْنًا وَاتَّخِذُوا مِن مَّقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى وَعَهِدْنَا إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ
২:১২৫ :: আর (উল্লেখ্য) যখন আমি ‘আল বাইত’কে (অপ্রতিম/অনন্য প্রতিষ্ঠানকে) স্থাপন করেছি মানবজাতির জন্য সমাবর্তনস্থল / পুরস্কার বিতরণস্থলরূপে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থারূপে। আর তোমরা ইবরাহীমের আদর্শগত অবস্থানকে (মাক্বামে ইবরাহীম) সালাত সম্বলিত নীতি-ব্যবস্থাপনা (মুসল্লা) হিসেবে গ্রহণ করো। আর আমি ফরমান দিয়েছি ইবরাহীমকে এবং ইসমাইলকে (এ মর্মে) যে, আমার (নির্ধারিত) প্রতিষ্ঠানকে পরিচ্ছন্ন রাখো তাওয়াফকারীদের জন্য (যারা এতে আগমন ও আবর্তন করবে), ই’তিকাফকারীদের জন্য (যারা এতে ধ্যানে নিমগ্ন হবে), রুকূকারীদের জন্য (যারা এর আদর্শের প্রতি বিনত হবে) এবং সাজদাহকারীদের জন্য (যারা এর নীতিমালা মেনে নেবে ও সম্মান দেখাবে)।
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَـٰذَا بَلَدًا آمِنًا وَارْزُقْ أَهْلَهُ مِنَ الثَّمَرَاتِ مَنْ آمَنَ مِنْهُم بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ قَالَ وَمَن كَفَرَ فَأُمَتِّعُهُ قَلِيلًا ثُمَّ أَضْطَرُّهُ إِلَىٰ عَذَابِ النَّارِ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ
২:১২৬ :: আর (উল্লেখ্য) যখন, ইবরাহীম বললো, “হে আমার প্রভু এটিকে একটি নিরাপদ নগর বানিয়ে দিন এবং এর অধিবাসীদেরকে ফলফলাদি দ্বারা জীবিকা দান করুন তাদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনে”। তিনি (আল্লাহ) বললেন, “আর যে কুফর (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান করে) আমি তাদেরকেও কিছু ভোগসামগ্রী দিবো তারপর জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করবো, আর তা কত নিকৃষ্ট গন্তব্য!”।
وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
২:১২৭ :: আর (উল্লেখ্য) যখন ইবরাহীম ও ইসমাইল ‘আল বাইতের’ (পবিত্র প্রতিষ্ঠানের) ভিত উঠাচ্ছিলো, (তখন তারা প্রার্থনা করেছিলো), “আমাদের প্রভু, আমাদের থেকে (কৃত সেবাকর্মকে) কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ”।
رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا إِنَّكَ أَنتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ
২:১২৮ :: আমাদের প্রভু, আমাদের উভয়কে আপনার প্রতি আত্মসমর্পিত রাখুন এবং আমদের বংশধরদের থেকে আপনার প্রতি আত্মসমর্পিত একটি জাতি গড়ে তুলুন। আর আমাদেরকে আমাদের করণীয় রীতি-নীতি দেখিয়ে দিন। আর আমাদের তাওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি তাওবা কবুলকারী, দয়ালু।
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَـٰذَا الْبَلَدَ آمِنًا وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَن نَّعْبُدَ الْأَصْنَامَ
১৪:৩৫ :: আর (উল্লেখ্য) যখন, ইবরাহীম বললো, “হে আমার প্রভু! এটিকে নিরাপদ নগর বানিয়ে দিন এবং আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখুন।
رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِّنَ النَّاسِ فَمَن تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
১৪:৩৬ :: হে আমার প্রভু, নিশ্চয় সেগুলো অধিকাংশ মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করে সেই আমার দলভুক্ত। আর যে আমাকে অমান্য করে তবে নিশ্চয় তুমি তো ক্ষমাশীল, দয়াশীল।
رَّبَّنَا إِنِّي أَسْكَنتُ مِن ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيْرِ ذِي زَرْعٍ عِندَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُوا الصَّلَاةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِي إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُم مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُونَ
১৪:৩৭ :: হে আমাদের প্রভু, নিশ্চয় আমি পুনর্বাসিত করলাম আমার সন্তানদের একাংশকে শস্যক্ষেতহীন উপত্যকায়, তোমার সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানের কাছে, হে আমাদের প্রভু, যেন তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে। সুতরাং আপনি লোকদের অন্তরকে তাদের প্রতি অনুরাগী করে দিন এবং তাদেরকে ফলফলাদি থেকে জীবিকা প্রদান করুন, যেন তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
لِإِيلَافِ قُرَيْشٍ
১০৬:১ :: যেহেতু কুরাইশকে প্রথাগত প্রণোদনা সুবিধা দেয়া হয়েছে।
إِيلَافِهِمْ رِحْلَةَ الشِّتَاءِ وَالصَّيْفِ
১০৬:২ :: তাদেরকে শীত ও গ্রীষ্মের বাণিজ্য সফরে প্রথাগত প্রণোদনা সুবিধা দেয়া হয়েছে।
فَلْيَعْبُدُوا رَبَّ هَـٰذَا الْبَيْتِ
১০৬:৩ :: সুতরাং তারা যেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রভুর দাসত্ব করে।
الَّذِي أَطْعَمَهُم مِّن جُوعٍ وَآمَنَهُم مِّنْ خَوْفٍ
১০৬:৪ :: যিনি তাদেরকে ক্ষুধা থেকে বাঁচিয়ে অন্নসংস্থান করেছেন এবং তাদেরকে ভয় থেকে বাঁচিয়ে নিরাপত্তা দিয়েছেন।
قَدْ نَرَىٰ تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ وَإِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّهِمْ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُونَ
২:১৪৪ :: নিশ্চয় আমি আকাশের দিকে তোমার বারবার মুখ ফিরানো দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং নিশ্চয় আমি তোমাকে ঐ কিবলার দিকে মুখ ফিরিয়ে দিচ্ছি যাতে তুমি সন্তুষ্ট হবে। সুতরাং তুমি আল মাসজিদুল হারামের দিকে তোমার মুখ ফিরাও। এবং তোমরা যেখানেই থাকো, সেটার দিকে তোমাদের মুখ ফিরাও। আর নিশ্চয় যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিলো তারা জানে যে, তা তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে সত্য। আর তারা যা করে আল্লাহ তা সম্পর্কে উদাসীন নন।
وَلَئِنْ أَتَيْتَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ بِكُلِّ آيَةٍ مَّا تَبِعُوا قِبْلَتَكَ وَمَا أَنتَ بِتَابِعٍ قِبْلَتَهُمْ وَمَا بَعْضُهُم بِتَابِعٍ قِبْلَةَ بَعْضٍ وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُم مِّن بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ إِنَّكَ إِذًا لَّمِنَ الظَّالِمِينَ
২:১৪৫ :: আর নিশ্চয় যদি তুমি যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিলো তাদের কাছে সব নিদর্শন নিয়ে আসো তা সত্ত্বেও তারা তোমার ক্বিবলাকে অনুসরণ করবে না। আর তুমিও তাদের ক্বিবলার অনুসারী হবে না। আর তাদেরকে কোনো পক্ষ অন্য পক্ষের ক্বিবলার অনুসারী নয়। আর নিশ্চয় যদি তোমার কাছে জ্ঞান আসার পরও তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো তবে নিশ্চয় তুমি তখন তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ وَإِنَّ فَرِيقًا مِّنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ
২:১৪৬ :: যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছিলাম তারা সেটাকে সেভাবেই চিনে যেভাবে তারা তাদের পুত্রদেরকে চিনে। আর নিশ্চয় তাদের মধ্যকার একটি দল জেনে বুঝে সত্যকে গোপন করে।
الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ
২:১৪৭ :: সত্য তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে। সুতরাং তুমি সন্দেহবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
وَلِكُلٍّ وِجْهَةٌ هُوَ مُوَلِّيهَا فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ أَيْنَ مَا تَكُونُوا يَأْتِ بِكُمُ اللَّهُ جَمِيعًا إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
২:১৪৮ :: প্রত্যেকেরই অভিমুখ রয়েছে যেদিকে সে মুখ ফিরায়। সুতরাং তোমরা কল্যাণকর্মে অগ্রগামী হও। যেখানেই তোমরা থাকো তিনি তোমাদের সকলকে একত্রে নিয়ে আসবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।
وَمِنْ حَيْثُ خَرَجْتَ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِنَّهُ لَلْحَقُّ مِن رَّبِّكَ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ
২:১৪৯ :: আর যেখান থেকেই তুমি বের হও, আল মাসজিদুল হারামের দিকে তোমার মুখ ফিরাও। আর নিশ্চয় তা তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে সত্য। আর তোমরা যা করো আল্লাহ তা সম্পর্কে উদাসীন নন।
وَمِنْ حَيْثُ خَرَجْتَ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَيْكُمْ حُجَّةٌ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِي وَلِأُتِمَّ نِعْمَتِي عَلَيْكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ
২:১৫০ :: আর যেখান থেকেই তুমি বের হও, আল মাসজিদুল হারামের দিকে তোমার মুখ ফিরাও। আর যেখানেই তোমরা থাকো, সেটার দিকেই তোমাদের মুখ ফিরাও। যেন তোমাদের বিপক্ষে মানুষের কোনো যুক্তিপ্রমাণ (হুজ্জাত) না থাকে। তবে তাদের মধ্য থেকে যারা যুলুম করেছে তাদের বিষয় ভিন্ন। সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, আর আমাকেই ভয় করো। আর যেন আমি তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করি এবং যেন তোমরা হিদায়াত পেতে পারো।
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
১৭:১ :: পবিত্র মহিমান্বিত সেই সত্তা, যিনি তাঁর এক বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন আল মাসজিদুল হারাম (সংরক্ষিত মাসজিদ) থেকে আল মাসজিদুল আক্বসাতে (অত্যন্ত দূরবর্তী মাসজিদে), যেটির (আল মাসজিদুল আক্বসার) চারপাশকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন, যাতে তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
وَالطُّورِ
৫২:১ :: শপথ তূরের।
وَكِتَابٍ مَّسْطُورٍ
৫২:২ :: এবং লিপিবদ্ধ কিতাবের।
فِي رَقٍّ مَّنشُورٍ
৫২:৩ :: (যা লিপিবদ্ধ) উন্মুক্ত চর্মপত্রে (on an unrolled parchment)।
وَالْبَيْتِ الْمَعْمُورِ
৫২:৪ :: এবং ‘আল বায়তুল মা’মূরের’ (আবাদকৃত প্রাণবন্ত প্রতিষ্ঠানের)।
وَأَوْحَيْنَا إِلَىٰ مُوسَىٰ وَأَخِيهِ أَن تَبَوَّآ لِقَوْمِكُمَا بِمِصْرَ بُيُوتًا وَاجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ قِبْلَةً وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ
১০:৮৭ :: আর আমি মূসাকে ও তার ভাইকে ওহী করেছিলাম (এ মর্মে) যে, “তোমরা দুজন তোমাদের কওমের জন্য মিসরে কয়েকটি গৃহ স্থাপন করো এবং তোমাদের গৃহসমূহকে কিবলা (কেন্দ্র, Center) বানাও এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করো এবং মু’মিনদেরকে সুসংবাদ দাও”।
فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَن تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ
২৪:৩৬ :: (তাঁর নূরের দিকে হিদায়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তি পাওয়া যায়) সেই ঘরগুলোতে, আল্লাহ অনুমতি দিয়েছেন যেগুলোকে সমুন্নত করতে এবং তাতে তাঁর নাম স্মরণ / আলোচনা করতে। তার তাতে তাঁর পবিত্রতা জ্ঞাপন করে সকালে ও বিকালে।
হজ্জের উদ্দেশ্য ও সংহতিমূলক আচারঅনুষ্ঠান / করণীয়
وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلَّهِ فَإِنْ أُحْصِرْتُمْ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ وَلَا تَحْلِقُوا رُءُوسَكُمْ حَتَّىٰ يَبْلُغَ الْهَدْيُ مَحِلَّهُ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوْ بِهِ أَذًى مِّن رَّأْسِهِ فَفِدْيَةٌ مِّن صِيَامٍ أَوْ صَدَقَةٍ أَوْ نُسُكٍ فَإِذَا أَمِنتُمْ فَمَن تَمَتَّعَ بِالْعُمْرَةِ إِلَى الْحَجِّ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ فِي الْحَجِّ وَسَبْعَةٍ إِذَا رَجَعْتُمْ تِلْكَ عَشَرَةٌ كَامِلَةٌ ذَٰلِكَ لِمَن لَّمْ يَكُنْ أَهْلُهُ حَاضِرِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
২:১৯৬ :: আর তোমরা আল্লাহর (সন্তুষ্টি অর্জনের) উদ্দেশ্যেই হজ্জ ও উমরা পূর্ণ করো। তবে যদি তোমরা বাধাপ্রাপ্ত হও, তাহলে হাদিয়া (উপহার) হিসেবে যা সহজ হয় (তাই যথেষ্ট)। আর তোমরা মাথামুণ্ডন করো না যতক্ষণ না হাদিয়া (উপহার) যথাস্থানে পৌঁছে। তোমাদের মধ্য থেকে যে অসুস্থ হয় বা তার মাথায় কষ্টদায়ক কিছু হয় তাহলে ফিদইয়া (বিকল্প মুক্তিপণ) হবে সিয়াম করা (অর্থাৎ রোজা রাখা) বা সদাকক্বাহ দেয়া বা নুসুক করা (অর্থাৎ ধর্মীয় বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে পশু উৎসর্গ ও সংহতিমূলক রীতি পালন করা)। অন্যদিকে যখন তোমরা নিরাপদ থাক তখন যে ব্যক্তি হজ্জ পর্যন্ত উমরা করার সুযোগ নেয়, তাহলে হাদিয়া (উপহার) হিসেবে যা সহজ হয় (তাই যথেষ্ট)। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তা পায় না (অর্থাৎ হাদিয়া পায় না বা হাদিয়া দেয়াতে অংশগ্রহণের সামর্থ্য পায় না) তাহলে (দায়িত্ব হচ্ছে) হজ্জের মধ্যে তিন দিন সিয়াম করা (রোজা রাখা) এবং সাতদিন যখন তোমরা ফিরে যাবে তখন। (তার ক্ষেত্রে) উহাই পরিপূর্ণ দশ। এ অবকাশ তার জন্য যার পরিবার পরিজন আল মাসজিদুল হারামের উপস্থিতি নয় (অর্থাৎ হারাম এলাকার বাসিন্দা নয়)। তোমরা আল্লাহ সচেতন হও। আর জেনে রাখো যে, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।
الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَّعْلُومَاتٌ فَمَن فَرَضَ فِيهِنَّ الْحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي الْحَجِّ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ يَعْلَمْهُ اللَّهُ وَتَزَوَّدُوا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَىٰ وَاتَّقُونِ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ
২:১৯৭ :: হজ্জ সুপরিজ্ঞাত মাসসমূহে। সুতরাং যে ঐ মাসগুলোর মধ্যে হজ্জ করা স্থির করে, তবে সে হজ্জের মধ্যে আবেগ উদ্দীপক দাম্পত্য ঘনিষ্ঠতা করবে না এবং বিধি-লংঘন ও দুষ্কর্ম করবে না এবং বাক-বিতণ্ডা করবে না। আর তোমরা যা কিছু কল্যাণকর্ম কর আল্লাহ তা জানেন। আর তোমরা পাথেয় নাও। আর নিশ্চয় আল্লাহ সচেতনতার পাথেয় সর্বোত্তম। আর আল্লাহ সচেতন হও, হে চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ!
لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَن تَبْتَغُوا فَضْلًا مِّن رَّبِّكُمْ فَإِذَا أَفَضْتُم مِّنْ عَرَفَاتٍ فَاذْكُرُوا اللَّهَ عِندَ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ وَاذْكُرُوهُ كَمَا هَدَاكُمْ وَإِن كُنتُم مِّن قَبْلِهِ لَمِنَ الضَّالِّينَ
২:১৯৮ :: যদি তোমরা তোমাদের প্রভুর অনুগ্রহ তালাশ করো(১) তাতে তোমাদের গুনাহ নেই। তারপর যখন তোমরা আরাফাত থেকে (আল মাসজিদুল হারামের দিকে) যাত্রা করো তখন আল মাশআরুল হারামের কাছে আল্লাহর যিকির (স্মরণ) করো। আর তোমরা তাঁর যিকির (স্মরণ) করো যেভাবে তিনি তোমাদেরকে পথনির্দেশ করেছেন। আর ইতোপূর্বে তোমরা তো বিভ্রান্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে।
(১) অর্থাৎ অর্থনৈতিক উপার্জন করো
ثُمَّ أَفِيضُوا مِنْ حَيْثُ أَفَاضَ النَّاسُ وَاسْتَغْفِرُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
২:১৯৯ :: আবার উল্লেখ্য, তোমরা (আল মাসজিদুল হারামের দিকে) যাত্রা করো, যেখান থেকে (হজ্জকারী অন্য) মানুষেরা যাত্রা করে(২)। আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিম্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াশীল।
(২) অর্থাৎ তোমরা সর্বসাধারণ হজ্জকারীদের সাথে সংহতি বজায় রেখে আরাফাত থেকেই যাত্রা করো
فَإِذَا قَضَيْتُم مَّنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَذِكْرِكُمْ آبَاءَكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْرًا فَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ
২:২০০ :: তারপর যখন তোমরা তোমাদের মানাসিক (হজ্জ উপলক্ষ্যে পশু উৎসর্গসহ সংহতিমূলক রীতিনীতি) সম্পন্ন করবে, তখন (হজ্জের শেষ কর্মসূচী হিসেবে আল মাসজিদুল হারামের কাছে) তোমরা আল্লাহর যিকির (স্মরণ) করো যেমন তোমরা তোমাদের বাপদাদাদের যিকির (স্মরণ) করতে বা তার চেয়ে দৃঢ়তর যিকির (স্মরণ)। আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যে বলে, “হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে দুনিয়াতেই দান করুন”। আর তার জন্য আখিরাতে পুরস্কারের কোনো অংশ নেই।
وَمِنْهُم مَّن يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
২:২০১ :: আর তাদের মধ্যে এমন লোকও আছে যে বলে, “হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান করুন এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান করুন এবং (দোযখের) আগুন থেকে রক্ষা করুন”।
أُولَـٰئِكَ لَهُمْ نَصِيبٌ مِّمَّا كَسَبُوا وَاللَّهُ سَرِيعُ الْحِسَابِ
২:২০২ :: তারা যা (পুণ্য) উপার্জন করেছে তার প্রাপ্য অংশ তাদেরই। আর আল্লাহ হিসাবকরণে দ্রুততম।
وَاذْكُرُوا اللَّهَ فِي أَيَّامٍ مَّعْدُودَاتٍ فَمَن تَعَجَّلَ فِي يَوْمَيْنِ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ وَمَن تَأَخَّرَ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ لِمَنِ اتَّقَىٰ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ
২:২০৩ :: আর (হজ্জের শেষ কর্মসূচী হিসেবে আল মাসজিুল হারামের কাছে) তোমরা (সহজেই) গণনাযোগ্য দিনসমূহে আল্লাহর যিকির (স্মরণ) করো। তবে যে তাড়াতাড়ি করে (নিজ দেশে ফিরে যায়) দুই দিনে, তার উপর কোনো পাপ বর্তাবে না, আর যে বিলম্ব করে তার উপরও কোনো পাপ বর্তাবে না। এটা তার জন্য যে আল্লাহ সচেতন থাকে। আর তোমরা আল্লাহ সচেতন থাকো। আর জেনে রাখো যে, নিশ্চয় তোমাদেরকে তাঁর দিকেই হাশর / সমবেত করা হবে।
وَمِنَ النَّاسِ مَن يُعْجِبُكَ قَوْلُهُ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيُشْهِدُ اللَّهَ عَلَىٰ مَا فِي قَلْبِهِ وَهُوَ أَلَدُّ الْخِصَامِ
২:২০৪ :: আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে যে পার্থিব জীবন সম্বন্ধে তার বক্তব্যে তোমাকে চমৎকৃত করে আর তার মনে যা আছে তার (নিষ্কলুষতা ও নিষ্ঠার) উপর আল্লাহকে স্বাক্ষী রাখে। অথচ সে (সত্য, ন্যায় ও মানবতার প্রতি) সবচেয়ে ভীষণ বিরুদ্ধবাদী।(৩)
(৩) এ আয়াতে হজ্জের সমাবর্তনে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের ইঙ্গিত রয়েছে।
وَإِذَا تَوَلَّىٰ سَعَىٰ فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا وَيُهْلِكَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْفَسَادَ
২:২০৫ :: আর যখন সে (তার জন্য সুবিধাজনক অবস্থানে) ফিরে যায় তখন সে প্রচেষ্টা চালায় (দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লুটপাট ও বিভিন্ন বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে) পৃথিবীতে নৈরাজ্য-বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে এবং ফসলের ক্ষেত এবং (মানুষের ও জীবজন্তুর) বংশ ধ্বংস করতে। আর আল্লাহ নৈরাজ্য-বিশৃংখলা পছন্দ করেন না।
وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللَّهَ أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْإِثْمِ فَحَسْبُهُ جَهَنَّمُ وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ
২:২০৬ :: আর যখন তাকে বলা হয়, “আল্লাহ সচেতন হও”, তখন তার আত্মাভিমান তাকে (আরও) অনাচারে লিপ্ত করে। সুতরাং তার জন্য জাহান্নাম যথেষ্ট। আর তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট অবস্থিতি।
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ
২:২০৭ :: আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণে নিজেকে বিক্রয় (নিবেদিত) করে দেয়। আর আল্লাহ (তাঁর) বান্দাদের প্রতি স্নেহশীল।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ
২:২০৮ :: হে মু’মিনগণ, তোমরা সামগ্রিকভাবে ইসলামে (আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পন ও শান্তিপ্রক্রিয়ায়) প্রবেশ কর। আর তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের স্পষ্ট শত্রু।
فَإِن زَلَلْتُم مِّن بَعْدِ مَا جَاءَتْكُمُ الْبَيِّنَاتُ فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
২:২০৯ :: সুতরাং যদি তোমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ আসার পরেও তোমরা বিচ্যুত হও তাহলে জেনে রাখো যে, নিশ্চয় আল্লাহ মহাশক্তিমান ও মহাবিজ্ঞ।
وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَن لَّا تُشْرِكْ بِي شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ
২২:২৬ :: আর (উল্লেখ্য) যখন আমি ইবরাহীমের জন্য আল বাইতের (অর্থাৎ পবিত্র প্রতিষ্ঠানের) স্থান চিহ্নিত করে দিয়েছি, এ মর্মে যে, আমার সাথে কাউকে শরিক (অংশীদার) সাব্যস্ত করো না এবং আমার (নির্ধারিত) প্রতিষ্ঠানকে পরিচ্ছন্ন রাখো তাওয়াফকারীদের জন্য (যারা এতে আগমন ও আবর্তন করবে), কিয়ামকারীদের জন্য (যারা এর নীতি আদর্শ বাস্তবায়ন করবে), রুকূকারীদের জন্য (যারা এর আদর্শের প্রতি বিনত হবে) এবং সাজদাহকারীদের জন্য (যারা এর নীতিমালা মেনে নেবে ও সম্মান দেখাবে)।
وَأَذِّن فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَىٰ كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ
২২:২৭ :: আর মানবজাতির মধ্যে হজ্জের ঘোষণা দাও। তারা তোমার ঘোষণার প্রেক্ষিতে আসবে পদচারী হয়ে এবং সর্বপ্রকার সপ্রস্তুত বাহনের উপর আরোহন করে। তারা আসবে সর্বপ্রকার দূর-দূরান্তের পথ থেকে।
لِّيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ
২২:২৮ :: এ উদ্দেশ্যে যে, যেন তারা তাদের কল্যাণ প্রত্যক্ষ (অর্জন) করতে পারে এবং যেন তারা আল্লাহ তাদেরকে বাহীমাতুল আনআম (অর্থাৎ গবাদি পশু প্রকৃতির বিচরণশীল চতুষ্পদ পশুসমূহ) থেকে যা জীবনোপকরণ হিসেবে দিয়েছেন তার উপর সুপরিজ্ঞাত দিনসমূহে (অর্থাৎ হজ্জের দিনসমূহে) আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে (অর্থাৎ হজ্জ উপলক্ষ্যে আল্লাহর নামে পশু জবেহ করার জন্য)। তারপর তোমরা তা থেকে নিজেরা খাও এবং সংকটাপন্ন অভাবগ্রস্তদেরকে খাওয়াও।
ثُمَّ لْيَقْضُوا تَفَثَهُمْ وَلْيُوفُوا نُذُورَهُمْ وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ
২২:২৯ :: তারপর (হজ্জ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে) তারা তাদের পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচী সম্পন্ন করতে হবে এবং তাদের মানত (অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো বিশেষ কল্যাণকর্মের জন্য তাদের সংকল্প / অঙ্গীকার বা Pledge) পূর্ণ করতে হবে এবং সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার প্রতীকবহ চিরায়ত মহতী প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ (গমনাগমন) করতে হবে।
ذَٰلِكَ وَمَن يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ عِندَ رَبِّهِ وَأُحِلَّتْ لَكُمُ الْأَنْعَامُ إِلَّا مَا يُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّورِ
২২:৩০ :: এটাই বিধান। আর যে আল্লাহর নির্ধারিত হুরুমাতের (অর্থাৎ মর্যাদাপূর্ণ নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের) মর্যাদা রক্ষা করে তার প্রভুর কাছে সেটাই তার জন্য কল্যাণকর। আর তোমাদের জন্য গবাদি পশুকে হালাল করা হয়েছে, যা তোমাদের কাছে (হারাম হিসেবে) তিলাওয়াত করা হয়েছে তা ছাড়া। সুতরাং তোমরা পূজার মূর্তিসমূহের অপবিত্রতাকে পরিহার করো (অর্থাৎ পূজার মূর্তিসমূহ অপবিত্র, তাই তোমরা তা পরিহার করো) এবং মিথ্যাবাদিতা পরিহার করো।
حُنَفَاءَ لِلَّهِ غَيْرَ مُشْرِكِينَ بِهِ وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ
২২:৩১ :: আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হয়ে, তাঁর সাথে কাউকে শরিককারী (অংশীদার সাব্যস্তকারী) না হয়ে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক (অংশীদার সাব্যস্ত) করে, সে যেন আকাশ থেকে পড়ে গেলো তারপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোনো সুদূর স্থানে ফেলে দিলো।
ذَٰلِكَ وَمَن يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ
২২:৩২ :: এটাই বিধান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে নির্ধারিত নিদর্শনসমূহের মর্যাদা রক্ষা করে তবে নিশ্চয় তা তাদের মন-মস্তিষ্কের আল্লাহ সচেতনতার প্রমাণবহ।
لَكُمْ فِيهَا مَنَافِعُ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى ثُمَّ مَحِلُّهَا إِلَى الْبَيْتِ الْعَتِيقِ
২২:৩৩ :: সেগুলোতে (অর্থাৎ গবাদি পশুগুলোতে) তোমাদের জন্য সুনির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত (অর্থাৎ হজ্জ উপলক্ষ্যে যথাস্থানে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত) বিভিন্ন উপকারলাভের সুযোগ রয়েছে। তারপর তার (জমা দেয়ার) যথাস্থান হচ্ছে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার প্রতীকবহ চিরায়ত মহতী প্রতিষ্ঠানের সন্নিকটে।
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِّيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَـٰهُكُمْ إِلَـٰهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ
২২:৩৪ :: আর প্রত্যেক উম্মাতের জন্যই আমি মানছাক (অর্থাৎ ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে পশু উৎসর্গসহ সংহতিমূলক রীতি) নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা আল্লাহ তাদেরকে বাহীমাতুল আনআম (অর্থাৎ গবাদি পশু প্রকৃতির বিচরণশীল চতুষ্পদ পশুসমূহ) থেকে যা জীবনোপকরণ হিসেবে দিয়েছেন তার উপর আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে (অর্থাৎ আল্লাহর নামে পশু জবেহ করার জন্য)। তোমাদের ইলাহ (সর্বময় প্রয়োজন পূরণকারী, সার্বভৌমত্বের অধিকারী ও উপাস্য) একক ইলাহ। সুতরাং তাঁরই উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণ করো। আর (আল্লাহর প্রতি) বিনীতদেরকে সুসংবাদ দাও।
الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَالصَّابِرِينَ عَلَىٰ مَا أَصَابَهُمْ وَالْمُقِيمِي الصَّلَاةِ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ
২২:৩৫ :: যারা এমন যে, যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের মন কেঁপে উঠে। আর তাদের উপর যে বিপদাপদ আপতিত হয় সে বিষয়ে ধৈর্যশীল হয় এবং সালাত প্রতিষ্ঠাকারী হয় এবং আমি তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দিয়েছি তা থেকে (নিজ প্রয়োজনের পাশাপাশি পরার্থে) ব্যয় করে।
وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّن شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا صَوَافَّ فَإِذَا وَجَبَتْ جُنُوبُهَا فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ كَذَٰلِكَ سَخَّرْنَاهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
২২:৩৬ :: আর কুরবানির উপযোগী মাংসল পশুসমূহকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নির্ধারিত নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। সেগুলোর মধ্যে তোমাদের জন্য ব্যাপক কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং তোমরা সেগুলোর উপর আল্লাহর নাম স্মরণ করো (উৎসর্গের জন্য) সারিবদ্ধ করা অবস্থায়। তারপর যখন সেগুলোর পার্শ্বদেশ (মাটিতে) ঠেকে যায় (অর্থাৎ নিষ্প্রাণ হয়ে যায়) তখন তা থেকে তোমরা খাও এবং যারা আবেদন করে না এরূপ অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও এবং যারা আবেদন করে এরূপ অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও। এভাবে আমি সেগুলোকে তোমাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত করেছি যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।
لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَـٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ
২২:৩৭ :: আল্লাহর কাছে সেগুলোর গোশত(৪) ও রক্ত পৌঁছে না(৫), বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের আল্লাহ সচেতনতা। এভাবে তিনি সেগুলোকে তোমাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত করেছেন যেন তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে পারো, তাঁর হিদায়াত অনুযায়ী। আর উত্তম আচরণকারীদেরকে সুসংবাদ দাও।
(৪) অর্থাৎ উৎসর্গকৃত পশুগুলোর
(৫) অর্থাৎ মূল্যায়ন পায় না
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ أُحِلَّتْ لَكُم بَهِيمَةُ الْأَنْعَامِ إِلَّا مَا يُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ غَيْرَ مُحِلِّي الصَّيْدِ وَأَنتُمْ حُرُمٌ إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ مَا يُرِيدُ
৫:১ :: হে মু’মিনগণ, তোমরা (সব ধরনের প্রতিশ্রুতির) বন্ধনসমূহ পূর্ণ করো। তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে বাহীমাতুল আনআম (অর্থাৎ গবাদি পশু প্রকৃতির বিচরণশীল চতুষ্পদ পশুসমূহ), তোমাদের কাছে যেগুলোর (হারাম হওয়ার ব্যাপারে) তিলাওয়াত করা হচ্ছে সেগুলো ছাড়া। তবে হুরুমে (হারাম মাসসমূহে) থাকা অবস্থায় (স্থলভাগের) শিকারকারী হওয়া যাবে না। নিশ্চয় আল্লাহ যেরূপ (বিধান দেয়ার) ইচ্ছা করেন, সেরূপ বিধান দেন।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُحِلُّوا شَعَائِرَ اللَّهِ وَلَا الشَّهْرَ الْحَرَامَ وَلَا الْهَدْيَ وَلَا الْقَلَائِدَ وَلَا آمِّينَ الْبَيْتَ الْحَرَامَ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِّن رَّبِّهِمْ وَرِضْوَانًا وَإِذَا حَلَلْتُمْ فَاصْطَادُوا وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ أَن صَدُّوكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَن تَعْتَدُوا وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
৫:২ :: হে মু’মিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নির্ধারিত নিদর্শনসমূহকে এবং কোনো হারাম মাসকে (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাসকে) এবং হাদিয়াকে (উপহারকে) এবং কালায়িদকে (বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধিদেরকে) অবমাননা / অবমূল্যায়ন করো না। আর আল বাইতুল হারামের (সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানের) অভিযাত্রীদেরকেও অবমাননা করো না, যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে। আর যখন তোমরা হুরুম (হারাম মাসসমূহ) এর বাহিরে থাকো তখন (স্থলভাগের) শিকার করতে পার। আর কোনো সম্প্রদায়ের এরূপ শত্রুতা যে, তারা তোমাদেরকে আল মাসজিদুল হারামে গমনে বাধা দিয়েছিল, তা যেন তোমাদেরকে অপরাধপ্রবণ না করে যে, তোমরা বাড়াবাড়ি করে ফেল। আর তোমরা সদাচার ও আল্লাহ সচেতনতার বিষয়ে একে অন্যকে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালংঘনের কাজে একে অন্যকে সহযোগিতা করো না।(৬) আর আল্লাহ সচেতন হও। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।
(৬) আয়াতটি থেকে বুঝা যায় যে, ভালো কাজে সহযোগিতা করা হজ্জের অন্যতম উদ্দেশ্য। তাই এ উপলক্ষে Cooperation Council গঠন ও পরিচালনা করা যেতে পারে।
جَعَلَ اللَّهُ الْكَعْبَةَ الْبَيْتَ الْحَرَامَ قِيَامًا لِّلنَّاسِ وَالشَّهْرَ الْحَرَامَ وَالْهَدْيَ وَالْقَلَائِدَ ذَٰلِكَ لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
৫:৯৭ :: আল্লাহ (নীতি ব্যবস্থাস্বরূপ) নির্ধারণ করেছেন আল কা’বাতাল বায়তাল হারামকে (অর্থাৎ কা’বাকে) এবং হারাম মাসকে (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাসকে) এবং (কা’বায় পৌঁছানোর) হাদিয়াকে (উপহারকে) এবং কালায়িদকে (অর্থাৎ বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধিদেরকে) মানবজাতির জন্য (কল্যাণকর ব্যবস্থার উপর) ক্বিয়াম (দাঁড়ানো / প্রতিষ্ঠা) হিসেবে। এটা এজন্য যে, যেন তোমরা জানতে পারো যে, নিশ্চয় আল্লাহ আকাশমণ্ডলীতে যা আছে এবং পৃথিবীতে যা আছে তার সবই জানেন। এবং নিশ্চয় আল্লাহ সকল বিষয়ে জ্ঞানী।
إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَائِرِ اللَّهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَا وَمَن تَطَوَّعَ خَيْرًا فَإِنَّ اللَّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ
২:১৫৮ :: নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর (স্থাপিত) নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে আল বাইতের (অর্থাৎ কা’বার) হজ্জ করে বা উমরা করে সে এ দুটিতে তাওয়াফ (গমনাগমন) করাতে গুনাহ নেই। যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কল্যাণকর কাজ করে (হজ্জের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে) তবে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয় আল্লাহ কৃতজ্ঞতার মূল্যায়নকারী এবং সর্বজ্ঞ।
মাস গণনা এবং (যুদ্ধ ও শিকার বিরতির জন্য) সংরক্ষিত / পবিত্র (হারাম) মাস চিহ্নিত করণ
হারাম মাসের করণীয়, বর্জনীয় ও অনুমতিসমূহ
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنفُسَكُمْ وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَافَّةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَافَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ
৯:৩৬ :: নিশ্চয় আল্লাহর কাছে মাসের গণনা (প্রতি বর্ষে) ১২ মাস। আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। সেগুলোর মধ্য থেকে ৪টি হারাম মাস (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধবিরতির ও সংরক্ষিত মাস)। এটাই সঠিক ব্যবস্থা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। সুতরাং সেগুলোর মধ্যে (যুদ্ধ করে বা সংশ্লিষ্ট নিষিদ্ধতা লংঘন করে) তোমাদের নিজেদের উপর জুলুম করো না। আর মুশরিকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করো যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে। আর জেনে রাখো যে, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের (অর্থাৎ আল্লাহ সচেতনদের) সাথে থাকেন।
إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْرِ يُضَلُّ بِهِ الَّذِينَ كَفَرُوا يُحِلُّونَهُ عَامًا وَيُحَرِّمُونَهُ عَامًا لِّيُوَاطِئُوا عِدَّةَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ فَيُحِلُّوا مَا حَرَّمَ اللَّهُ زُيِّنَ لَهُمْ سُوءُ أَعْمَالِهِمْ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ
৯:৩৭ :: নিশ্চয় নাসী (অর্থাৎ হারাম মাসের রদবদল) কুফরের ক্ষেত্রে একটি বৃদ্ধি (অর্থাৎ নাসী দ্বারা কুফর বৃদ্ধি পায়)। তারা সেটাকে এক চান্দ্রবর্ষে হালাল সাব্যস্ত করে এবং অন্য চান্দ্রবর্ষে হারাম সাব্যস্ত করে, ঐ গণনাকে মিল করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য যা (যত মাসকে) আল্লাহ হারাম করেছেন। এভাবে তারা সেটাকে (ঐ কাজকে) হালাল করে যা আল্লাহ হারাম করেছেন। তাদের জন্য তাদের মন্দকর্মসমূহকে শোভিত করা হয়েছে। আর আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে (সঠিক বিধানকে প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে) পথনির্দেশ করেন না।
فَرِحَ الْمُخَلَّفُونَ بِمَقْعَدِهِمْ خِلَافَ رَسُولِ اللَّهِ وَكَرِهُوا أَن يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَقَالُوا لَا تَنفِرُوا فِي الْحَرِّ قُلْ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرًّا لَّوْ كَانُوا يَفْقَهُونَ
৯:৮১ :: (হারাম মাসসমূহে পরে, যুদ্ধাভিযানের সময়) যারা আল্লাহর রসূলের সাথে না গিয়ে পেছনে থেকে গেলো, তারা বসে থাকার কারণে আনন্দবোধ করলো এবং তারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ও জীবন দ্বারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করাকে অপছন্দ করলো। আর তারা বললো, “প্রচণ্ড গরমের মধ্যে অভিযানে বের হয়ো না”। বলো, “জাহান্নামের আগুনই প্রচণ্ডতম গরম”। যদি তারা বুঝতো!
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الشَّهْرِ الْحَرَامِ قِتَالٍ فِيهِ قُلْ قِتَالٌ فِيهِ كَبِيرٌ وَصَدٌّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ وَكُفْرٌ بِهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِخْرَاجُ أَهْلِهِ مِنْهُ أَكْبَرُ عِندَ اللَّهِ وَالْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ الْقَتْلِ وَلَا يَزَالُونَ يُقَاتِلُونَكُمْ حَتَّىٰ يَرُدُّوكُمْ عَن دِينِكُمْ إِنِ اسْتَطَاعُوا وَمَن يَرْتَدِدْ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَـٰئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأُولَـٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
২:২১৭ :: তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে হারাম মাস (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাস) সম্পর্কে, সেটাতে যুদ্ধ করা প্রসঙ্গে। বলো, “সেটাতে (তথা কোনো হারাম মাসে) যুদ্ধ করা অনেক বড় গুনাহ। আর আল্লাহর পথ থেকে বাধা দেয়া ও তাঁর প্রতি কুফর (অবিশ্বাস ও অকৃতজ্ঞতা) করা এবং আল মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দেয়া এবং সেটার যথোপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে তা থেকে বহিষ্কার করা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় গুনাহ। আর ফিতনা (ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ এবং ভিন্ন জীবনব্যবস্থা অবলম্বনের কারণে নির্যাতন) হত্যার চেয়েও গুরুতর গুনাহ। আর তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে থামবে না, যতক্ষণ না তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে, যদি তাদের সাধ্যে কুলায়। আর তোমাদের মধ্য থেকে যে তার দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) থেকে ফিরে যাবে তারপর কাফির (সত্য প্রত্যাখ্যানকারী) অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করবে, তারাই এমন লোক যাদের আমলসমূহ দুনিয়াতে ও আখিরাতে বরবাদ হয়ে যাবে। আর তারাই (দোযখের) আগুনে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। তারা তাতে স্থায়ী হবে।
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ وَلَيْسَ الْبِرُّ بِأَن تَأْتُوا الْبُيُوتَ مِن ظُهُورِهَا وَلَـٰكِنَّ الْبِرَّ مَنِ اتَّقَىٰ وَأْتُوا الْبُيُوتَ مِنْ أَبْوَابِهَا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
২:১৮৯ :: তারা তোমাকে উৎসর্গের ঘোষণা সম্পর্কিত সরু চাঁদসমূহ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বলো, তা মানবজাতির (মাস চিহ্নিতকরণের সাধারণ সুবিধার) এবং হজ্জের জন্য সময় নির্ধারণের উপায়। তোমরা পেছন দিক দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার মধ্যে কোনো পুণ্য নেই। বরং পুণ্য তারই হয় যে আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন করে। আর তোমরা (সদর) দরজা দিয়েই ঘরে প্রবেশ করো। আর আল্লাহ সচেতন হও যেন তোমরা সফলতা লাভ করতে পারো।
وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ
২:১৯০ :: আর তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো তাদের বিরুদ্ধে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তবে সীমালংঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালংঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না।
وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُمْ وَأَخْرِجُوهُم مِّنْ حَيْثُ أَخْرَجُوكُمْ وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ وَلَا تُقَاتِلُوهُمْ عِندَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ حَتَّىٰ يُقَاتِلُوكُمْ فِيهِ فَإِن قَاتَلُوكُمْ فَاقْتُلُوهُمْ كَذَٰلِكَ جَزَاءُ الْكَافِرِينَ
২:১৯১ :: (যুদ্ধ পরিস্থিতিতে) তোমরা তাদেরকে হত্যা কর (যুদ্ধক্ষেত্রের) যেখানেই তোমরা তাদের নাগাল পাও। আর তোমরা তাদেরকে বের করে দাও যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে। ফিতনা (অর্থাৎ ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ এবং ভিন্ন ধর্ম অবলম্বনের কারণে নির্যাতন) হত্যার চেয়ে গুরুতর। তোমরা আল মাসজিদুল হারামের কাছে তাদের সাথে যুদ্ধ করো না যতক্ষণ না তারা তাতে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে। কিন্তু যদি তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাহলে তাদেরকে হত্যা কর। (অর্থাৎ তাদেরকে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিহত করো এবং আন্তর্জাতিক আদালত প্রতিষ্ঠা করে বিচারিক প্রক্রিয়ায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করো)। এরূপই (যুদ্ধের নৈতিক বিধি প্রত্যাখ্যানকারী) কাফিরদের প্রতিফল।
فَإِنِ انتَهَوْا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
২:১৯২ :: তারপর যদি তারা বিরত হয় তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াশীল।
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ فَإِنِ انتَهَوْا فَلَا عُدْوَانَ إِلَّا عَلَى الظَّالِمِينَ
২:১৯৩ :: তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যতক্ষণ না ফিতনার (অর্থাৎ ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের এবং ভিন্ন ধর্ম অবলম্বনের কারণে নির্যাতনের) অবসান হয় এবং জীবনব্যবস্থা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য হয় (অর্থাৎ আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মীয় স্বাধীনতার অবকাশসম্পন্ন এবং আল্লাহ প্রদত্ত ব্যবস্থার আওতায় নিয়ন্ত্রিত হয়)। তারপর যদি তারা বিরত হয় তাহলে যালিমদের উপর ছাড়া কোনো বাড়াবাড়ি নয়।
الشَّهْرُ الْحَرَامُ بِالشَّهْرِ الْحَرَامِ وَالْحُرُمَاتُ قِصَاصٌ فَمَنِ اعْتَدَىٰ عَلَيْكُمْ فَاعْتَدُوا عَلَيْهِ بِمِثْلِ مَا اعْتَدَىٰ عَلَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ
২:১৯৪ :: হারাম মাসের ক্ষেত্রে ঐ হারাম মাস (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাস) এবং সমস্ত হুরুমাত (অর্থাৎ মর্যাদাপূর্ণ নিষিদ্ধ বিষয়) কিসাসের অন্তর্ভুক্ত (অর্থাৎ এক পক্ষ কর্তৃক অবমাননার কারণে বিপরীত পক্ষ কর্তৃক অনুরূপ অবমাননার প্রতি অনাপত্তির অবকাশ তৈরি হয়।)। সুতরাং যে তোমাদের উপর আক্রমণ করবে তোমরাও তার উপর প্রতিআক্রমণ করবে যেরূপ সে তোমাদের উপর আক্রমণ করেছে। তোমরা আল্লাহ সচেতন হও আর জেনে রাখো যে, নিশ্চয় আল্লাহ সচেতনদের সাথেই আল্লাহ আছেন।(৭)
(৭) এর দ্বারা বুঝায়, কোনো হারাম মাসে তথা বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাসে যদি কোনো পক্ষ অন্য পক্ষের উপর আক্রমণ করে বসে তবে আক্রান্ত পক্ষও ঐ মাসে আক্রমণকারী পক্ষকে প্রতিআক্রমণ করার অধিকার পাবে। অনুরূপভাবে যদি কোনো পক্ষ অন্য পক্ষের মর্যাদাপূর্ণ নিষিদ্ধ বিষয়ের তথা সম্মানীয় ও গোপনীয় বিষয়ের মর্যাদা রক্ষা না করে তবে তারা নিজেদের অনুরূপ মর্যাদাপূর্ণ নিষিদ্ধ বিষয়ের তথা সম্মানীয় ও গোপনীয় বিষয়ের মর্যাদা রক্ষার জন্য দাবি করার অধিকার হারাবে।
وَأَنفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
২:১৯৫ :: আর তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করো। আর তোমরা তোমাদের নিজেদের হাতে তোমাদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না। আর তোমরা উত্তম আচরণ করো। নিশ্চয় আল্লাহ উত্তম আচরণকারীদেরকে ভালবাসেন।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَيَبْلُوَنَّكُمُ اللَّهُ بِشَيْءٍ مِّنَ الصَّيْدِ تَنَالُهُ أَيْدِيكُمْ وَرِمَاحُكُمْ لِيَعْلَمَ اللَّهُ مَن يَخَافُهُ بِالْغَيْبِ فَمَنِ اعْتَدَىٰ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌ
৫:৯৪ :: হে মু’মিনগণ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে (হারাম মাসসমূহে স্থলভাগের) কিছু শিকারের বিষয়ে পরীক্ষা করবেন, তোমাদের হাত ও বর্শা যার নাগাল পায়, যেন আল্লাহ স্পষ্ট করতে পারেন কে তাঁকে অদেখা সত্ত্বেও ভয় করে। সুতরাং এরপরও (অর্থাৎ স্পষ্টভাবে জানানোর পরও) যে সীমালংঘন করবে তার জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقْتُلُوا الصَّيْدَ وَأَنتُمْ حُرُمٌ وَمَن قَتَلَهُ مِنكُم مُّتَعَمِّدًا فَجَزَاءٌ مِّثْلُ مَا قَتَلَ مِنَ النَّعَمِ يَحْكُمُ بِهِ ذَوَا عَدْلٍ مِّنكُمْ هَدْيًا بَالِغَ الْكَعْبَةِ أَوْ كَفَّارَةٌ طَعَامُ مَسَاكِينَ أَوْ عَدْلُ ذَٰلِكَ صِيَامًا لِّيَذُوقَ وَبَالَ أَمْرِهِ عَفَا اللَّهُ عَمَّا سَلَفَ وَمَنْ عَادَ فَيَنتَقِمُ اللَّهُ مِنْهُ وَاللَّهُ عَزِيزٌ ذُو انتِقَامٍ
৫:৯৫ :: হে মু’মিনগণ, তোমরা হারাম মাসসমূহে থাকা অবস্থায় (স্থলভাগের) শিকারকে হত্যা করো না। তোমাদের মধ্যে যে ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে হত্যা করে তার জরিমানা হচ্ছে যে পশুকে সে হত্যা করেছে গবাদি পশুর মধ্য থেকে তার মতো একটি পশু। সেটা (অর্থাৎ ঐ ধরনের গবাদি পশু) নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দিবে তোমাদের মধ্যকার দুজন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি। সেটাকে হাদিয়া (উপহার) হিসেবে কা’বায় পৌছাতে হবে। অথবা তার কাফফারা (ক্ষতিপূরণ) হবে (সমমূল্য দ্বারা যতজনকে মধ্যম মানের খাদ্য খাওয়ানো যেতে পারে ততজন) মিসকীনকে খাওয়ানো অথবা সমসংখ্যক সিয়াম পালন করা। (এটা এজন্য যে,) যেন সে তার কাজের পরিণামের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। (এ বিধান নাজিলের) আগে যা হয়ে গিয়েছিলো সে বিষয়ে আল্লাহ উদারতা দেখিয়েছেন। আর যে পুনরাবৃত্তি করবে আল্লাহ তাকে দণ্ড দিবেন। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান ও মহাদণ্ডদাতা।
أُحِلَّ لَكُمْ صَيْدُ الْبَحْرِ وَطَعَامُهُ مَتَاعًا لَّكُمْ وَلِلسَّيَّارَةِ وَحُرِّمَ عَلَيْكُمْ صَيْدُ الْبَرِّ مَا دُمْتُمْ حُرُمًا وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ
৫:৯৬ :: তোমাদের জন্য জলভাগের শিকার করা ও তা খাওয়া হালাল করা হয়েছে, তোমাদের (আবাসে) ভোগের জন্য এবং কাফেলার ভোগের জন্য। আর তোমাদের জন্য স্থলভাগের শিকার হারাম করা হয়েছে, যতক্ষণ তোমরা হারাম মাসসমূহে থাকো। আর আল্লাহকে ভয় করো যার দিকে তোমাদেরকে হাশর / সমবেত করা হবে।
جَعَلَ اللَّهُ الْكَعْبَةَ الْبَيْتَ الْحَرَامَ قِيَامًا لِّلنَّاسِ وَالشَّهْرَ الْحَرَامَ وَالْهَدْيَ وَالْقَلَائِدَ ذَٰلِكَ لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
৫:৯৭ :: আল্লাহ (নীতি ব্যবস্থাস্বরূপ) নির্ধারণ করেছেন আল কা’বাতাল বায়তাল হারামকে (অর্থাৎ কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান কা’বাকে) এবং হারাম মাসকে (অর্থাৎ বিধিবদ্ধ যুদ্ধ বিরতির ও সংরক্ষিত মাসকে) এবং (কা’বায় পৌঁছানোর) হাদিয়াকে (উপহারকে) এবং কালায়িদকে (অর্থাৎ বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধিদেরকে) মানবজাতির জন্য (কল্যাণকর ব্যবস্থার উপর) ক্বিয়াম (দাঁড়ানো/ প্রতিষ্ঠা) হিসেবে। এটা এজন্য যে, যেন তোমরা জানতে পারো যে, নিশ্চয় আল্লাহ আকাশমণ্ডলীতে যা আছে এবং পৃথিবীতে যা আছে তার সবই জানেন। এবং নিশ্চয় আল্লাহ সকল বিষয়ে জ্ঞানী।
বায়তুল হারামের (পবিত্র প্রতিষ্ঠানের) তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনা
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّن مَّنَعَ مَسَاجِدَ اللَّهِ أَن يُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ وَسَعَىٰ فِي خَرَابِهَا أُولَـٰئِكَ مَا كَانَ لَهُمْ أَن يَدْخُلُوهَا إِلَّا خَائِفِينَ لَهُمْ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَلَهُمْ فِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ
২:১১৪ :: আর তার চেয়ে বড় যালিম কে হতে পারে যে আল্লাহর মাসজিদসমূহের ক্ষেত্রে মানা করে তাতে তাঁর নামের স্মরণ করতে আর সেটার প্রকৃতিকে বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা করে। তারাই ঐসব লোক যাদের জন্য অবকাশ নেই যে, তারা তাতে প্রবেশ করবে, শংকিত হয়ে থাকা ছাড়া। তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়াতে লাঞ্চনা এবং তাদের জন্য রয়েছে আখিরাতে মহাশাস্তি।
وَمَا لَهُمْ أَلَّا يُعَذِّبَهُمُ اللَّهُ وَهُمْ يَصُدُّونَ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَا كَانُوا أَوْلِيَاءَهُ إِنْ أَوْلِيَاؤُهُ إِلَّا الْمُتَّقُونَ وَلَـٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
৮:৩৪ :: তাদের কী (ওজর) আছে যে, আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না, এ সত্ত্বেও যে, তারা আল মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দিচ্ছে এবং তারা তো এটার মুতাওয়াল্লী (তত্ত্বাবধায়ক) হওয়ার উপযুক্তও নয়, নিশ্চয় আল্লাহ সচেতনরা ছাড়া অন্যরা এটার মুতাওয়াল্লী (তত্ত্বাবধায়ক) হওয়ার উপযুক্ত নয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জ্ঞানার্জন করে না।
مَا كَانَ لِلْمُشْرِكِينَ أَن يَعْمُرُوا مَسَاجِدَ اللَّهِ شَاهِدِينَ عَلَىٰ أَنفُسِهِم بِالْكُفْرِ أُولَـٰئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ وَفِي النَّارِ هُمْ خَالِدُونَ
৯:১৭ :: মুশরিকদের অধিকার নেই যে, তারা আল্লাহর মাসজিদসমূহের ব্যবস্থাপনা করবে। অথচ তারা নিজেরাই নিজেদের কুফরের (আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য অনুসরণের) স্বাক্ষ্য দেয়। তারাই এমন লোক যাদের আমলসমূহ বরবাদ হয়ে গেছে। আর তারা (জাহান্নামের) আগুনে স্থায়ী হবে।
إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ فَعَسَىٰ أُولَـٰئِكَ أَن يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ
৯:১৮ :: নিশ্চয় তারাই আল্লাহর মাসজিদসূহের ব্যবস্থাপনা করবে (ব্যবস্থাপনার অধিকার রাখে) যারা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায় যে, তারাই পথনির্দেশ গ্রহণকারীদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
أَجَعَلْتُمْ سِقَايَةَ الْحَاجِّ وَعِمَارَةَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ كَمَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَجَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَوُونَ عِندَ اللَّهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
৯:১৯ :: তোমরা কি হাজীদেরকে পানি পান করানো এবং আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনা করাকে ঐ ব্যক্তির কাজের সমান বিবেচনা করেছো যে আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান করে এবং (এর ভিত্তিতে) আল্লাহর পথে (তথা আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-ব্যবস্থা বাস্তবায়নে) সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে। তারা আল্লাহর কাছে সমান নয়। আর আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।
الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِندَ اللَّهِ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ
৯:২০ :: যারা ঈমান এনেছে এবং হিজরাত করেছে এবং আল্লাহর পথে (তথা আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-ব্যবস্থা বাস্তবায়নে) তাদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছে আল্লাহর দৃষ্টিতে তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ। আর তারাই সফল।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ فَلَا يَقْرَبُوا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ بَعْدَ عَامِهِمْ هَـٰذَا وَإِنْ خِفْتُمْ عَيْلَةً فَسَوْفَ يُغْنِيكُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ إِن شَاءَ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
৯:২৮ :: হে মু’মিনগণ, নিশ্চয় মুশরিকগণ (মানসিকভাবে) অপবিত্র। সুতরাং তারা যেন তাদের এই চান্দ্রবর্ষের / চান্দ্রসৌরবর্ষের পরে আর আল মাসজিদুল হারামের কাছে আসতে না পারে। আর যদি তোমরা দরিদ্রতার আশংকা করো, তবে শীঘ্রই আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ দ্বারা স্বচ্ছল করে দিবেন, যদি তিনি ইচ্ছা করেন। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও মহাবিজ্ঞ।
بَرَاءَةٌ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ
৯:১ :: এটা সম্পর্কচ্ছেদ আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে তাদের থেকে যে মুশরিকদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে।
فَسِيحُوا فِي الْأَرْضِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ وَأَنَّ اللَّهَ مُخْزِي الْكَافِرِينَ
৯:২ :: এ মর্মে যে, “তোমরা (মুশরিকরা) এই ভূখণ্ডে (হারাম) চার মাসে চলাফেরা করো। আর জেনে রাখো যে, নিশ্চয় তোমরা আল্লাহকে অক্ষমকারী নও। আর নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদেরকে (সত্য অবিশ্বাসী ও প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে) লাঞ্চনাকারী।
وَأَذَانٌ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ أَنَّ اللَّهَ بَرِيءٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ وَرَسُولُهُ فَإِن تُبْتُمْ فَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَإِن تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ وَبَشِّرِ الَّذِينَ كَفَرُوا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
৯:৩ :: আর সাধারণ ঘোষণা বিঘোষিত হবে আল্লাহর ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে মানবজাতির সামনে ইয়াওমাল হাজ্জিল আকবারে (অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ হজ্জের দিনে) এই মর্মে যে, “নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর রসূল মুশরিকদের থেকে সম্পর্কমুক্ত। সুতরাং যদি তোমরা (মুশরিকরা) তাওবা করো তাহলে তা তোমাদের জন্যই কল্যাণকর। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে রাখো, তাহলে জেনে রাখো যে, নিশ্চয় তোমরা আল্লাহকে অক্ষমকারী নও।” আর যারা কুফর (অর্থাৎ সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান) করেছে তাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তির (অর্থাৎ জাহান্নামের) সংবাদ দাও।
إِلَّا الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ ثُمَّ لَمْ يَنقُصُوكُمْ شَيْئًا وَلَمْ يُظَاهِرُوا عَلَيْكُمْ أَحَدًا فَأَتِمُّوا إِلَيْهِمْ عَهْدَهُمْ إِلَىٰ مُدَّتِهِمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ
৯:৪ :: কিন্তু মুশরিকদের মধ্য থেকে যাদের সাথে তোমরা চুক্তি করেছো তারপর তারা তা কিছুমাত্র ভঙ্গ করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেনি। সুতরাং তোমরা তাদের সাথে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ করো। নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে [আল্লাহ সচেতনদেরকে] ভালবাসেন।
فَإِذَا انسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدتُّمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِن تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
৯:৫ :: তারপর যখন হারাম মাসসমূহ (বিধিবদ্ধ যুদ্ধবিরতির ও সংরক্ষিত মাসসমূহ) অতিবাহিত হয়ে যাবে তখন তোমরা মুশরিকদেরকে (হারাম এলাকার) যেখানেই পাও (সম্মুখ যুদ্ধে / এনকাউন্টারে) হত্যা করো এবং তাদেরকে (সরাসরি) ধরে ফেলো এবং তাদেরকে অবরোধ ও (অগ্রাভিযান ও পারস্পরিক যোগাযোগে) বাধাগ্রস্ত করো এবং তাদেরকে (গেরিলা হামলা ও আচমকা ধরার) জন্য প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওঁৎ পেতে বসো। তবে যদি তারা তাওবাহ করে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত প্রদান করে তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াশীল।
وَإِنْ أَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّىٰ يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَّا يَعْلَمُونَ
৯:৬ :: আর যদি মুশরিকদের মধ্য থেকে কেউ তোমার কাছে আশ্রয় চায় তাহলে তাকে আশ্রয় দাও, যতক্ষণ না সে আল্লাহর বাণী (আল কুরআন) শুনে, তারপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দাও। এটা এজন্য যে, তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা সঠিক জ্ঞান রাখে না।
كَيْفَ يَكُونُ لِلْمُشْرِكِينَ عَهْدٌ عِندَ اللَّهِ وَعِندَ رَسُولِهِ إِلَّا الَّذِينَ عَاهَدتُّمْ عِندَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ فَمَا اسْتَقَامُوا لَكُمْ فَاسْتَقِيمُوا لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ
৯:৭ :: আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে কিভাবে মুশরিকদের জন্য কোনো চুক্তি বহাল থাকবে? তাদের সাথে ছাড়া, যাদের সাথে তোমরা আল মাসজিদুল হারামের প্রাঙ্গনে চুক্তি করার পর (তারা তা ভঙ্গ করে নি), সুতরাং যতক্ষণ তারা তোমাদের জন্য (চুক্তির উপর) প্রতিষ্ঠিত থাকে, তোমরাও তাদের জন্য (চুক্তির উপর) প্রতিষ্ঠিত থাক। নিশ্চয় আল্লাহ তো আল্লাহ সচেতনদেরকেই ভালবাসেন।
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ الَّذِي جَعَلْنَاهُ لِلنَّاسِ سَوَاءً الْعَاكِفُ فِيهِ وَالْبَادِ وَمَن يُرِدْ فِيهِ بِإِلْحَادٍ بِظُلْمٍ نُّذِقْهُ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ
২২:২৫ :: নিশ্চয় যারা কুফর (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান) করেছে এবং আল্লাহর পথ থেকে বাধা দেয় এবং আল মাসজিদুল হারাম থেকেও বাধা দেয়, যেটাকে আমি সেটার ক্ষেত্রে আত্মনিয়োজিত / স্থানীয়দের(৮) জন্য এবং সেটাতে গমনাগমনকারী / অস্থানীয়দের জন্য (প্রবেশাধিকার, নিরাপত্তা বিধান ও বরকত বণ্টন বিষয়ে) সমান করেছি, এবং যে তাতে তথ্যবিকৃতি ঘটাতে ইচ্ছা করে আমি তাকে কষ্টদায়ক শাস্তির (অর্থাৎ জাহান্নামের) স্বাদ আস্বাদন করাবো।
(৮) আকিফ বলতে বুঝায় আল মাসজিদুল হারামে ই’তিকাফকারী বা ধ্যানমগ্ন ও আত্মনিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ। এখানে পরবর্তী শব্দ গমনাগমনকারীর তুলনায় আকিফ বলতে বিশেষ করে স্থানীয়ভাবে বসবাসরত কর্মচারী প্রশাসনকে বুঝায়।
وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَكُفْرًا وَتَفْرِيقًا بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ وَإِرْصَادًا لِّمَنْ حَارَبَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ مِن قَبْلُ وَلَيَحْلِفُنَّ إِنْ أَرَدْنَا إِلَّا الْحُسْنَىٰ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ
৯:১০৭ :: আর যারা মাসজিদকে গ্রহণ করেছে ক্ষতি সাধন, কুফর (সত্য প্রত্যাখ্যান) এবং মু’মিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার (তথা ঐক্যের মূলনীতিকে উপেক্ষা করার) উদ্দেশ্যে এবং সেই ব্যক্তির ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে যে আগে থেকেই আল্লাহর এবং তাঁর রসূলের (উপস্থাপিত মতাদর্শের) সাথে সাংঘর্ষিকতায় লিপ্ত হয়েছে। আর তারা কসম করে বলবে, “আমরা উত্তম কিছু করা ছাড়া অন্যরূপ ইচ্ছা করি নি”। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।
لَا تَقُمْ فِيهِ أَبَدًا لَّمَسْجِدٌ أُسِّسَ عَلَى التَّقْوَىٰ مِنْ أَوَّلِ يَوْمٍ أَحَقُّ أَن تَقُومَ فِيهِ فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَن يَتَطَهَّرُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ
৯:১০৮ :: তুমি কখনোই তাতে (তথা তাদের অধিগৃহীত মাসজিদে) দাঁড়াবে না। নিশ্চয় যে মাসজিদ প্রথম দিন থেকেই স্থাপিত হয়েছে আল্লাহ সচেতনতার উপর (ভিত্তি করে), সেটাই অধিক উপযোগিতা রাখে যে, তুমি সেটাতেই দাঁড়াবে। সেটাতে ঐ লোকেরা (আত্মনিয়োজিত) রয়েছে যারা পছন্দ করে যে, তারা (জীবন যাপনের ক্ষেত্রে) পবিত্রতা অর্জন করবে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকেই ভালবাসেন।
وَهُوَ الَّذِي كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ عَنْهُم بِبَطْنِ مَكَّةَ مِن بَعْدِ أَنْ أَظْفَرَكُمْ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرًا
৪৮:২৪ :: আর তিনিই সেই সত্তা যিনি মাক্কার অভ্যন্তরে তাদের হাতকে তোমাদের থেকে এবং তোমাদের হাতকে তাদের থেকে বিরত রেখেছিলেন; এ সত্ত্বেও যে, তোমাদেরকে সক্ষমতা দেয়া হয়েছিল তাদেরকে পরাস্ত করার জন্য। আর তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।
هُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَالْهَدْيَ مَعْكُوفًا أَن يَبْلُغَ مَحِلَّهُ وَلَوْلَا رِجَالٌ مُّؤْمِنُونَ وَنِسَاءٌ مُّؤْمِنَاتٌ لَّمْ تَعْلَمُوهُمْ أَن تَطَئُوهُمْ فَتُصِيبَكُم مِّنْهُم مَّعَرَّةٌ بِغَيْرِ عِلْمٍ لِّيُدْخِلَ اللَّهُ فِي رَحْمَتِهِ مَن يَشَاءُ لَوْ تَزَيَّلُوا لَعَذَّبْنَا الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
৪৮:২৫ :: তারাই এমন লোক যারা কুফর (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান) করেছে এবং তোমাদেরকে আল মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দিয়েছে এবং (কা’বায় পৌঁছানোর) হাদিয়াকে (উপহারকে) সেটার যথাস্থানে পৌঁছানো থেকে আটকে দেয়া হয়েছে। আর যদি না থাকতো এমন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারী, যাদেরকে তোমরা (মু’মিন হিসেবে) জানতে না, তাই তোমরা তাদেরকে পর্যুদস্ত করতে, তাই তাদের প্রেক্ষিতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কলংকযুক্ত হতে, (তাহলে তিনি বিরত রাখতেন না)। (তিনি বিরত রেখেছিলেন) যেন আল্লাহ তাকে তাঁর রহমতের মধ্যে প্রবেশ করান যাকে তিনি ইচ্ছা করেন। যদি তারা পৃথক থাকতো তাহলে আমি (যুদ্ধ থেকে বিরত না রেখে) তাদের মধ্যকার কাফিরদেরকে (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে) কষ্টদায়ক শাস্তি দিতাম।
إِذْ جَعَلَ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي قُلُوبِهِمُ الْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ فَأَنزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَىٰ رَسُولِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَلْزَمَهُمْ كَلِمَةَ التَّقْوَىٰ وَكَانُوا أَحَقَّ بِهَا وَأَهْلَهَا وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا
৪৮:২৬ :: যখন কাফিরেরা (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যানকারীরা) তাদের অন্তরে উগ্রতা জাগিয়ে তুললো, জাহেলিয়াতের উগ্রতা, তখন আল্লাহ তাঁর রসূলের ও মু’মিনদের উপর প্রশান্তি নাজিল করলেন এবং তাদের জন্য কালিমাতুত তাক্বওয়াকে (আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বনের নির্দেশ বাণীকে) অপরিহার্যরূপে কার্যকর করে দিলেন। আর তারাই ছিল এর সবচেয়ে বেশি হক্বদার এবং এর যোগ্য অধিকারী। আর আল্লাহ সকল বিষয়ে জ্ঞানী।
لَّقَدْ صَدَقَ اللَّهُ رَسُولَهُ الرُّؤْيَا بِالْحَقِّ لَتَدْخُلُنَّ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ إِن شَاءَ اللَّهُ آمِنِينَ مُحَلِّقِينَ رُءُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ لَا تَخَافُونَ فَعَلِمَ مَا لَمْ تَعْلَمُوا فَجَعَلَ مِن دُونِ ذَٰلِكَ فَتْحًا قَرِيبًا
৪৮:২৭ :: নিশ্চয় (এ বিরতির মাধ্যমে প্রকৃত প্রস্তাবে) আল্লাহ তাঁর রসূলকে (তার দেখা) স্বপ্নটিকে যথাযথভাবে সত্যে পরিণত করে দিয়েছেন। ইনশাআল্লাহ (আল্লাহ চাহেন তো) তোমরা অবশ্যই আল মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদ অবস্থায়, (তোমাদের অনেকে) মাথা মুণ্ডন করে এবং (তোমাদের অনেকে) চুল ছেঁটে। তোমরা ভয় পাবে না। তোমরা যা জানতে না তিনি তা জানতেন। তাই তিনি তা ছাড়াও (অর্থাৎ পরবর্তীতে নিরাপদে হজ্জ করার সুযোগ দান ছাড়াও) একটি নিকটবর্তী বিজয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
বিবিধ
قَالَ إِنِّي أُرِيدُ أَنْ أُنكِحَكَ إِحْدَى ابْنَتَيَّ هَاتَيْنِ عَلَىٰ أَن تَأْجُرَنِي ثَمَانِيَ حِجَجٍ فَإِنْ أَتْمَمْتَ عَشْرًا فَمِنْ عِندِكَ وَمَا أُرِيدُ أَنْ أَشُقَّ عَلَيْكَ سَتَجِدُنِي إِن شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّالِحِينَ
২৮:২৭ :: সে (অর্থাৎ মেয়ে দুটির পিতা) বললো, “নিশ্চয় আমি ইচ্ছা করি যে, আমি তোমার সাথে আমার এ দুই কন্যার একজনকে বিবাহ দিবো, এ শর্তে যে, তুমি (মূসা) আমার মজুরি/চাকুরি করবে আট হিজাজ (অর্থাৎ আট হজ্জ মওসুম বা আট চান্দ্রবর্ষ)। আর যদি তুমি দশ বর্ষ পূর্ণ করো তা হবে তোমার পক্ষ থেকে। আর আমি তোমাকে কষ্টে রাখার ইচ্ছা করি না। ইনশাআল্লাহ (অর্থাৎ আল্লাহ চাহেন তো) তুমি আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে পাবে।
‘হজ্জ’ حَجُّ শব্দটি এসেছে ‘হাজ্জা’ حَجَّ ক্রিয়া থেকে। ‘হাজ্জা’ ক্রিয়ার অর্থ হলো- কোনো কিছুর উদ্দেশ্য স্থির করা, তীর্থস্থানে যাওয়ার ইচ্ছা করা, সমাবর্তন করা, সম্মেলন করা, সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা, একই বিন্দুতে মিলিত হওয়া, যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সমাধান করা। আল কুরআনে বর্ণিত সময়ে ও নিয়মে কা’বায় উপস্থিত হয়ে সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পরিপালন করাকে হজ্জ বলে। হজ্জে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার জন্য আলোচনা ও যুক্তি উপস্থাপন (হুজ্জাত) করা সঙ্গত কিন্তু দুই অনমনীয় পক্ষে বিভক্ত হয়ে বিতর্ক (জিদাল) করা সঙ্গত নয়।
হজ্জের জন্য নির্দিষ্টকৃত মাসসমূহে ছাড়া অন্য কোনো মাসে (ব্যক্তিগতভাবে) আল বায়তুল হারাম পরিভ্রমন করা এবং হজ্জের অনুরূপ কার্যক্রম সম্পাদন করাকে উমরাহ বলে। যেমন হজ্জ এবং উমরাহ উভয়টির ক্ষেত্রে হাদিয়া পৌঁছানো বাধ্যতামূলক (২:১৯৬)। হজ্জ ও উমরাহর আরেকটি পার্থক্য হচ্ছে হজ্জ হচ্ছে নির্ধারিত মাসসমূহে সমষ্টিগত প্রোগ্রাম, অন্যদিকে উমরাহ হচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে সম্পাদনযোগ্য প্রোগ্রাম। অবশ্য উমরাহর সময়ও যাদেরকে উমরাহ করা অবস্থায় পাওয়া যাবে তাদের সাথে সংহতি বজায় রাখতে হবে।
‘উমরাহ’ عُمْرَة শব্দটি এসেছে ‘আমারা’ عَمَرَ ক্রিয়া থেকে। ‘আমারা’ ক্রিয়ার অর্থ হলো- পরিদর্শন করা, পরিভ্রমণ করা, বয়স অতিবাহিত করা, বসবাস করা, জনবসতি গড়া, আবাদ করা, বিনির্মাণ করা, শোভামণ্ডিত করা, সজীবতা আনয়ন করা। হজ্জ ও উমরাহর পার্থক্য হচ্ছে সামর্থ্য থাকলে (অন্তত একবার) হজ্জ করা ফরজ, কিন্তু উমরা করা ফরজ নয়। হজ্জ ও উমরা উভয়টি পূর্ণ করতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চুড়ান্ত উদ্দেশ্যে।
হজ্জের প্রতিষ্ঠান এবং সেটার উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম সম্পর্কে বুঝার জন্য ‘কা’বা, আল বাইত ও আল মাসজিদুল হারাম সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।
কা’বা ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ৫:৯৫:২৬, ৫:৯৭:৩।
‘আল বাইত’ ব্যবহৃত হয়েছে স্থানে: ৭ স্থানে: ২:১২৫:৩, ২:১২৭:৬, ২:১৫৮:৯, ৩:৯৭:১৪, ৮:৩৫:৫, ২২:২৬:৫, ১০৬:৩:৪। একে ‘আল হারাম’ (সংরক্ষিত) বিশেষণ যোগ করে ‘আল বাইতুল হারাম’ (সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠান) বলা হয়েছে ২ স্থানে: ৫:২:১৭, ৫:৯৭:৪। এছাড়া একে ‘আওয়ালা বাইত’ (প্রথম প্রতিষ্ঠান) বলা হয়েছে ১ স্থানে: ৩:৯৬:৩। ‘আল বাইতিল আতীক্ব’ (প্রাচীন, চিরায়ত ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান) বলা হয়েছে ২ স্থানে: ২২:২৯:৭, ২২:৩৩:১০। ‘আল বাইতুল মা’মূর’ (আবাদকৃত, সঞ্জীবিত, প্রাণবন্ত প্রতিষ্ঠান) বলা হয়েছে ১ স্থানে: ৫২:৪:১।
কা’বা বা আল বাইতকে আল্লাহ ‘বাইতিয়া’ (আমার বাইত) বলে উল্লেখ করেছেন মর্মে এসেছে ২ স্থানে: ২:১২৫:১৮, ২২:২৬:১২ এবং ইবরাহীম (সা.) ‘বাইতিকাল মুহাররাম’ (আপনার সংরক্ষিত বাইত) বলে উল্লেখ করেছেন মর্মে এসেছে ১ স্থানে: ১৪:৩৭:১১।
ক্বিবলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত একাধিক বাইতকে বুঝাতে ‘বুয়ূত’ (বাইতসমূহ / প্রতিষ্ঠানসমূহ) ব্যবহৃত হয়েছে ২ স্থানে: ১০:৮৭:৯, ২৪:৩৬:২।
‘আল বাইতুল হারাম’ এর প্রাঙ্গনে এর পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার জন্য যে প্রতিষ্ঠান তাকে ‘আল মাসজিদুল হারাম’ বলা হয়। ‘আল মাসজিদুল হারাম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১৫ স্থানে: ২:১৪৪:১৩, ২:১৪৯:৭, ২:১৫০:৭, ২:১৯১:১৫, ২:১৯৬:৬৫, ২:২১৭:১৭, ৫:২:৩৪, ৮:৩৪:৯, ৯:৭:১৩, ৯:১৯:৫, ৯:২৮:৯, ১৭:১:৭, ২২:২৫:৮, ৪৮:২৫:৬, ৪৮:২৭:৮।
কা’বা, আল বাইত ও আল মাসজিদুল হারাম সম্পর্কিত আয়াতের সমন্বিত তালিকা নিম্নরূপ:
২:১২৫, ২:১২৭, ২:১৪৪, ২:১৪৯, ২:১৫০, ২:১৫৮, ২:১৯১, ২:১৯৬, ২:২১৭, ৩:৯৬, ৩:৯৭, ৫:২, ৫:৯৫, ৫:৯৭, ৮:৩৪, ৮:৩৫, ৯:৭, ৯:১৯, ৯:২৮, ১০:৮৭, ১৪:৩৭, ১৭:১, ২২:২৫, ২২:২৬, ২২:২৯, ২২:৩৩, ২৪:৩৬, ৪৮:২৫, ৪৮:২৭, ৫২:৪, ১০৬:৩।
কা’বা হচ্ছে বাইতুল্লাহ তথা আল্লাহর নির্ধারিত স্থানে আল্লাহর নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান, মানবজাতির জন্য প্রতিষ্ঠিত আওয়ালা বাইত বা আদি গৃহ (প্রথম প্রতিষ্ঠান), বাইতুল আতিক বা সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার প্রতীকবহ চিরায়ত মহতী প্রতিষ্ঠান, আল বাইত বা পবিত্র প্রতিষ্ঠান, আল বাইতুল হারাম বা বিশেষ সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠান। আল্লাহর নির্দেশিত স্থানে নবী ইবরাহীম ও ইসমাইল (সালামুন আলাইহিম) আল বাইত (কা’বা) নির্মাণ / পুন:নির্মাণ করেন।
কা’বাকে ঘিরে প্রতিষ্ঠিত মাসজিদটিকে বা প্রতিষ্ঠানকে আল মাসজিদুল হারাম বলা হয়। কা’বা ও আল মাসজিদুল হারামের চতুর্দিকের এলাকাকে হারাম বা সংরক্ষিত এলাকা বলা হয়। এ এলাকাটিকে নবী ইবরাহীম তাঁর আদর্শিক অবস্থান গ্রহণের অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন, যার ফলে এটার ক্ষেত্রে মাক্বামে ইবরাহীম বা ইবরাহীমের আদর্শিক অবস্থানকে একটি নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হজ্জের সময় হজ্জকারীরা এ অনুভূতি পেতে পারে যে, তারা এমন এক প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করছে যার সাথে ইবরাহীমের আদর্শিক অবস্থান জড়িত রয়েছে।
কা’বা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হচ্ছে একে মানবজাতির জন্য বিশ্বকেন্দ্র হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে এবং এই প্রেক্ষিতে হজ্জ উপলক্ষে কা’বায় তাওয়াফ বা গমানগমন ও সমাবর্তন করতে হয়। এটি প্রতিষ্ঠার আরো উদ্দেশ্য হচ্ছে এটি হবে মানবজাতির জন্য সমাবর্তনস্থল, পুরস্কার বিতরণস্থল, নিরাপত্তাব্যবস্থা, বরকতময় এবং হিদায়াত। অর্থাৎ মানবজাতি এখানে হজ্জের সময় সমাবর্তন করবে, এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানবজাতির জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে, এর মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে বরকত বা সমৃদ্ধি পৌঁছে দিতে হবে এবং এটি হবে তাদের একত্ববাদী উপাসনা ও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় জীবন চেতনার শিক্ষামূলক হিদায়াত বা পথনির্দেশ।
আল্লাহর পক্ষ থেকে “কা’বা ঘোষণা” হচ্ছে- “যে এ গৃহে বা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করবে সে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত হবে”। অর্থাৎ এটা আল্লাহর একটি আদেশ। যে ব্যক্তি কা’বায় প্রবেশ করবে বা এ প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে তার সদস্যপদ লাভ করবে তার অধিকার হচ্ছে নিরাপত্তা প্রাপ্তি আর আল মাসজিদুল হারামের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বশীলদের কর্তব্য হচ্ছে তার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
মানুষ যদি আল্লাহর এ আদেশ কার্যকর না করে তাহলে এ নিরাপত্তা বাস্তবে থাকবে না। কিন্তু তখনো এ ঘোষণা ভুল বলে চিহ্নিত হবে না। কারণ আল বাইত এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে প্রতিষ্ঠান, নিছক ইট পাথরের ঘর নয়। মানুষ যদি এটাকে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যকর করতে না পারে তাহলে এটা বাস্তবে প্রতিষ্ঠান হিসেবে থাকবে না বা কেউ এ প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেছে বলার অবকাশ থাকে না। এ ঘোষণার সহজ তাৎপর্য হচ্ছে আল মাসজিদুল হারামে প্রবেশকারীদের এবং এর প্রতি স্বীকৃতির মাধ্যমে এর সমর্থক হওয়া ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এর পক্ষ থেকে একটি বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদ থাকতে হবে। আর যারা কা’বার নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাবে, আল মাসজিদুল হারামের কাছে কোনো পক্ষের উপর আক্রমণ করবে তাদেরকে প্রতিহত করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক আদালত প্রতিষ্ঠা করে তাদেরকে দমন ও দণ্ডিত করতে হবে।
নবী ইবরাহীমকে কা’বা প্রতিষ্ঠা করে মানবজাতির উদ্দেশ্যে এর হজ্জ করার জন্য ঘোষণা দিতে বলা হয়েছে। হজ্জের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে এতে মানবজাতি তাদের কল্যাণ প্রত্যক্ষ বা অর্জন করবে এবং আল্লাহর নামে পশু উৎসর্গ করে আল্লাহ সচেতনতার শিক্ষা নিবে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করবে এবং ঐ পশুর গোশত থেকে নিজে খাবে এবং অন্যদেরকে খাওয়াবে, যারা অভাবগ্রস্ত এবং আবেদন করে না বা আবেদন করে।
হজ্জ উপলক্ষে কা’বায় হাদিয়া পৌঁছানোকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ব্যবস্থাকে প্রথমে হাদিয়ার কেন্দ্রীকরণ এবং তারপর বিকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী কল্যাণ কর্ম পরিচালনার উপায়ে পরিণত করা হয়েছে।
বাইতুল্লাহর হজ্জ প্রসঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হচ্ছে বাক্কা ও মাক্কা চিহ্নিতকরণ এবং বাক্কা ও বাকার সম্পর্ক বা পার্থক্য। নিম্নে এ দুটি বিষয় আলোচনা করা হলো।
৩:৯৬ আয়াত অনুযায়ী, আদিগৃহ তথা কা’বা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বাক্কায়। আবার ৪৮:২৪-২৭ আয়াত অনুযায়ী, আল মাসজিদুল হারামের অবস্থান হচ্ছে মাক্কার অভ্যন্তরে। এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন তৈরি হয় যে, বাক্কা ও মাক্কা কি একই স্থানের দুটি নাম নাকি এ দুটি হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি স্থান?
একটি অভিমত হলো, বাক্কাকে মাক্কা বা মাক্কাকে বাক্কা লেখা যায়। কারণ আরবিতে ‘বা’ এবং ‘কাফ’ হরফকে একটির বদলে অন্যটি লেখা যায়। আবার কারো মতে, বাক্কা ও মাক্কা একই স্থানের দুটি নাম অথবা বাক্কা হচ্ছে মাক্কার পূর্বনাম।
প্রথম অভিমতটির পর্যালোচনায় বলা যায় যে, ‘বা’ এবং ‘কাফ’ এর মধ্যে অন্ত:পরিবর্তনের রীতি সেক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয় যেক্ষেত্রে অর্থগত অভিন্নতা রক্ষা করা যায়। তবে ‘বাক্কাতা’ ও ‘মাক্কাতা’ সেরূপ শব্দ কিনা তা নিশ্চিত নয়। শব্দমূল বিবেচনায় ‘মাক্কাতা’ এবং ‘বাক্কাতা’ দুটি বিশুদ্ধ আরবি শব্দ। ‘মাক্কাতা’ এর শব্দমূল হচ্ছে ‘মীম কাফ কাফ’ এবং এর প্রধান অর্থ হচ্ছে ‘পানি সংকট’। আর ‘বাক্কাতা’ এর শব্দমূল হচ্ছে ‘বা কাফ কাফ’ এবং এর প্রধান অর্থ হচ্ছে ‘জনসমাগম’। শব্দার্থ অনুসারে প্রতীয়মান হয় যে, ‘মাক্কা’ নামকরণ হয়েছে সম্ভবত পানি সংকটের প্রেক্ষিতে বা মরুভূমি হওয়ার প্রেক্ষিতে এবং ‘বাক্কা’ নামকরণ হয়েছে সম্ভবত জনসমাগমের কোনো উদ্দেশ্য বা প্রক্রিয়া জড়িত থাকার প্রেক্ষিতে। যদি ‘বাক্কা’ ও ‘মাক্কা’ একই শব্দের দুটি শব্দরূপ হয়, তাহলেও ৩:৯৬ আয়াতে ‘বাক্কা’ ব্যবহৃত হয়েছে বিধায় সেক্ষেত্রে ‘বাক্কা’ পড়তে ও লিখতে হবে এবং ৪৮:২৪ আয়াতে ‘মাক্কা’ ব্যবহৃত হয়েছে বিধায় সেক্ষেত্রে ‘মাক্কা’ পড়তে ও লিখতে হবে। আর এটাই স্বত:সিদ্ধ বিষয় যে, অবশ্যই কোনো না কোনো যৌক্তিক কারণে এক স্থানে ‘বাক্কা’ এবং অন্য স্থানে ‘মাক্কা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রসঙ্গানুসারে বাক্কার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দ হলো ‘বিবাক্কাতা’ (অর্থাৎ বাক্কাতে) এবং মাক্কার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দ হলো ‘বিবাতনি মাক্কাতা’ (অর্থাৎ মাক্কার পেটে বা ভিতরে)। এ দুটি বর্ণনাভঙ্গির মাধ্যমে বাক্কার চেয়ে মাক্কা আরো প্রশস্ত বলে বুঝা যায়। বর্ণনাভঙ্গির পার্থক্য অনুসারে ‘বাক্কা’ ও ‘মাক্কা’ সমানায়তন স্থানকে নির্দেশ না করায় ‘বাক্কা’ ও ‘মাক্কা’কে একই স্থানের দুটি নাম বা দুটি বিশেষণ হিসেবে প্রতীয়মান হয় না। একই যুক্তিতে “বাক্কা হচ্ছে মাক্কার প্রাচীন নাম” কথাটিও যথাযথ বলে প্রতীয়মান হয় না। বরং এ সম্ভাবনাই সমধিক যে: “বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ঢাকায় অবস্থিত” এবং “বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত” এ দুটি কথা যেমন একই সাথে সঠিক, কিন্তু ঢাকা এবং শেরে বাংলা নগর হুবহু এক নয়; তেমনি আল মাসজিদুল হারাম মাক্কায় অবস্থিত, তবে মাক্কার মধ্যকার বাক্কায় অবস্থিত। অর্থাৎ বাক্কা আছে মাক্কার মধ্যে, তবে বাক্কা এবং মাক্কা হুবহু এক নয়। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, যেখানে কা’বা স্থাপন করা হয়েছে তাকে ‘বাক্কা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, অর্থাৎ বাক্কা হচ্ছে কা’বার আঙ্গিনা। তবে বিষয়টি আরো তথ্যানুসন্ধানের ও পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
আরেকটি অভিমত হচ্ছে ‘বাক্কা’ কোনো স্থানই নয়, বরং এর অর্থ হচ্ছে ‘ক্রন্দন’ এবং যেহেতু হজ্জের সময় লোকে কা’বায় কান্নাকাটি করে তাই বলা হয়েছে ‘আদিগৃহ বাক্কার সাথে তৈরি করা হয়েছে’। কিন্তু এ অভিমতও গ্রহণযোগ্য নয। কারণ ‘বাক্কা’ এর অর্থ ক্রন্দন নয়, যে বিষয়ে পরবর্তী পয়েন্টে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। ৩:৯৬ আয়াতে কা’বা স্থাপনের প্রসঙ্গে ‘বিবাক্কাতা’ বলা হয়েছে। সুতরাং ভাষারীতি অনুসারে বাক্কা হয় কোনো নির্মাণ প্রযুক্তি বা উপকরণ হতে হবে অথবা কোনো স্থান হতে হবে যেখানে কা’বাকে স্থাপন করা হয়েছে। অনুরূপভাবে ‘মাক্কা’ অর্থ ‘পানি সংকট’ হলেও ৪৮:২৪ আয়াতের অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ পানি সংকটের মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতি ঘটিয়েছেন। বরং সেখানে বলা হয়েছে ‘বিবাতনি মাক্কাতা’ বা ‘মাক্কার পেটে বা ভিতরে’ যুদ্ধ বিরতি ঘটিয়েছেন। এক্ষেত্রে শাব্দিক অর্থ নিলে কথাটি দাঁড়ায় ‘পনি সংকটের পেটে বা ভিতরে’ যুদ্ধ বিরতি ঘটিয়েছেন। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ‘বাক্কাতা’ শব্দটির মতো ‘মাক্কাতা’ শব্দটিও স্থানের নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
আরবি বাক্কাতা (বাক্কা) শব্দটিকে হিব্রু বাকা শব্দের সমার্থক হিসেবে ধরা হয়। এ সম্পর্কিত পর্যালোচনায় উল্লেখ্য যে, বাক্কাতা (বাক্কা) একটি বিশুদ্ধ আরবি শব্দ যার শব্দমূল হচ্ছে ‘বা কাফ কাফ’। ‘বাক্কাতা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘জনসমাগম’। অন্যদিকে হিব্রু ‘বাকা’ (בכא) শব্দটির শব্দমূল হচ্ছে ‘বা কাফ আলিফ’(৯) । হিব্রু ‘বাকা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘ক্রন্দন’। শব্দার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে আরবি ‘বাক্কা’ শব্দ এবং হিব্রু ‘বাকা’ শব্দের মধ্যে মিল দেখা যায় না। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে আরো তথ্যানুসন্ধান ও পর্যালোচনা প্রয়োজন। একটি অভিমত হলো প্রাচীন হিব্রুতে ‘বাকা’ এবং ‘বাক্কা’ একই অক্ষর দ্বারা লিখা হতো। সেই হিসেবে Book of Psalms Chapter 84:6 এ উল্লেখিত যে শব্দটিকে ‘বাকা’ হিসেবে ধরা হয় তা যদি ‘বাক্কা’ হয়, তাহলে আরবি এবং হিব্রু উভয় ভাষায় একই স্থানকে একই বাক্কা শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে এবং উভয় ভাষায় শব্দ দুটির মূল অক্ষরসমূহ এবং তার অর্থ একই হিসেবে প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে হিব্রু বাকা শব্দের যে অর্থ করা হয় (ক্রন্দন), আরবি বাকা শব্দের অর্থও তা (ক্রন্দন)। আরবি বাকা শব্দের শব্দমূল হচ্ছে ‘বা কাফ ইয়া’।
(৯) http://www.al-mawrid.org/index.php/articles/view/the-actual-site-of-baca-bakkah
কা’বা প্রতিষ্ঠার অঞ্চল হিসেবে ‘বাক্কা’ এর কথা বলা হয়েছে এবং Book of Psalms Chapter 84:6 এ উল্লেখিত হিব্রু ‘বাকা’ শব্দটি ‘বাক্কা’ শব্দের সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করলে তথা ‘বাকা’ হিসেবে পরিচিত হওয়া স্থানটিই ‘বাক্কা’ হলে, বাক্কার ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ে আরো তথ্যানুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।(১০)
(১০) ইসলামী ইতিহাসের দুইজন সাম্প্রতিক সময়ের স্কলার টম হল্যান্ড এবং প্যাট্রিশিয়া ক্রোন - এর মতে বাক্কা সিরিয়া-লেভান্ত অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তারা “বাক্কা এবং মক্কা যে একই স্থান নয়”- এই মতের সমর্থন করে। তাদেরসহ আরো কিছু স্কলারের বিশ্লেষণানুসারে ইব্রাহিম আ. কখনো বর্তমান মক্কায় আসেননি বরং তার অবস্থান ছিলো সিরিয়ার দিকে এবং প্রথম কিবলা সে অঞ্চলের কোথাও অবস্থিত। তবে এ বিষয়টি এখনো পুরোপুরি মীমাংসিত নয়।
আল কুরআন অনুসারে যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে দুই ধরনের উদ্দেশ্য প্রতীয়মান হয়। একটি হচ্ছে চূড়ান্ত উদ্দেশ্য এবং অন্যটি হচ্ছে সুনির্দিষ্ট কার্যগত উদ্দেশ্য। আল কুরআনের আলোকে হজ্জের উদ্দেশ্য হিসেবে যা স্থির করতে হবে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
১। চূড়ান্ত উদ্দেশ্য (Ultimate Aim)
হজ্জের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
২। সুনির্দিষ্ট কার্যগত উদ্দেশ্য (Specific Functional Objective)
হজ্জের সুনির্দিষ্ট কার্যগত উদ্দেশ্য নিম্নরূপ:
ক. মানবজাতির কল্যাণ প্রত্যক্ষ ও অর্জন করা
খ. হজ্জ উপলক্ষে আল্লাহর নামে পশু উৎসর্গ করা
নিম্নে হজ্জের সাধারণ চূড়ান্ত উদ্দেশ্য এবং সুনির্দিষ্ট কার্যগত উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করা হলো।
মানবজীবনের যাবতীয় কাজের সাধারণ চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। কারণ আল্লাহ যথাযথ জ্ঞানের ভিত্তিতে সত্য ও ন্যায়সঙ্গতভাবে মানুষের জন্য কল্যাণ হতে পারে এরূপ নির্দেশনাই প্রদান করেছেন এবং তাই আল্লাহ তাঁর নির্দেশনামতো কার্যক্রম সম্পাদন করলে সন্তুষ্ট হন। তাঁর নির্দেশনাকে উপেক্ষা করলে তাতে স্বীয় প্রভুর প্রতি মানুষের অবিশ্বাস ও অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায় এবং সত্য ও ন্যায়ের লংঘনের মাধ্যমে জুলুমের উদ্ভব ঘটে, তাই তিনি তাতে অসন্তুষ্ট হন। মানবজাতির কল্যাণার্থে সঠিক ধর্মকেন্দ্র ও বিশ্বজনীন সমষ্টিগত কর্মকেন্দ্র হিসেবে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে এর হজ্জ করার জন্য মানবজাতির প্রতি নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এ হজ্জের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হতে হবে তাঁর নির্দেশনার অনুসরণের মাধ্যমে তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জন করা। এটিই একজন বিশ্বাসী ব্যক্তির জীবনের জন্য প্রকৃত চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য। অন্য যে কোনো চূড়ান্ত উদ্দেশ্য তাকে সত্য প্রত্যাখ্যানকারীতে এবং ক্ষতিগ্রস্ততায় নিপতিত করে। মানুষ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাঁর নির্দেশনাকে অনুসরণ না করে অস্বীকার ও অকৃতজ্ঞ হয় তাতে আল্লাহর কোনো ক্ষতি নেই, তিনি বিশ্ববাসীর থেকে অমুখাপেক্ষী।
হজ্জ সম্পাদনের জন্য মানুষকে নিজ আবাস থেকে বের হয়ে আল্লাহর নির্দেশিত ও অনুমোদিত পবিত্র প্রতিষ্ঠানে হাজিরা দিতে হয়। হজ্জের একটি আধ্যাত্মিক মাত্রা হলো এই যে এই তীর্থ যাত্রা মানুষকে তার স্রষ্টার উদ্দেশ্যে যে অন্তিম যাত্রা যেখানে স্রষ্টার সামনে তাকে হাজির হতে হবে, যেখানে মানবজাতির সকল সদস্যের সকলকেই উপস্থিত হতে হবে - কোন ব্যত্যয় ছাড়া - হজ্জ যেন তারই এক ড্রেস রিহার্সাল। এটা পার্থিব জীবনের সমাপ্তিতে আল্লাহর সামনে হাশর বা সমবেত হওয়ার ভবিষ্যত ঘটিতব্য বিষয়ের ধারণাকে মন-মস্তিষ্কে উদ্ভাসিত করে তোলে। আর এভাবেও এটি সেদিন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকারীদের কাতারে দাঁড়াতে সক্ষম হওয়ার জন্য হজ্জে নিজের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যকে স্থির করে দেয়।
কুরআনে হজ্জের সুনির্দিষ্ট কার্যগত উদ্দেশ্য হিসেবে দুটি উদ্দেশ্যকে নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা: (১) মানবজাতির কল্যাণ প্রত্যক্ষ ও অর্জন করা (২) হজ্জ উপলক্ষে আল্লাহর নামে পশু উৎসর্গ করা। নিম্নে এ দুটি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ক. মানবজাতির কল্যাণ অর্জন করা
মানবজাতির কল্যাণ একটি ব্যাপক বিষয়। হজ্জের মাধ্যমে কিভাবে মানবজাতির কল্যাণ অর্জিত হয় তার প্রধান দুটি দিক রয়েছে।
(১) একত্ববাদ ও ঐক্যবদ্ধতা
আল্লাহর নির্দেশনা মোতাবেক তাঁর নির্দেশ অনুসারে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে হজ্জ করা হচ্ছে সমগ্র মানবজাতির একত্ববাদী উপাসনার কর্তব্য পালনের অন্যতম নিদর্শন। সমগ্র জীবন যাপন পদ্ধতিতে এই একত্ববাদী উপাসনা বজায় রাখার শিক্ষা গ্রহণ ও বাস্তবায়নই মানবজাতির প্রকৃত কল্যাণ অর্জনের উপায়। এছাড়া হজ্জের মাধ্যমে মানবজাতির ঐক্যবদ্ধতা সৃষ্টি ও সুদৃঢ় হয়। এটিও বিশ্বজনীন মানবকল্যাণের অন্যতম উপায়। একত্ববাদ, একক মানব পরিবারের শিক্ষাকেও ধারন করে; যার তাৎপর্য হলো মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই, থাকতে পারেনা। সকল মানুষ আদমের সন্তান, আল্লাহর বান্দা। তার গায়ের রঙ, মুখের ভাষা, অর্থনৈতিক অবস্থা, দেশ, সম্প্রদায়, জাতিগত ভিন্নতা, রাজনৈতিক পরিচয় এর কোনটাই একজনকে অন্যের থেকে বৈষম্য করতে পারে না। হজ্জের মাধ্যমে এক ও অদ্বিতীয় স্রষ্টার সাথে সাথে মানবসমাজের এক ও অভিন্ন রূপকেও এটি তুলে ধরার ভূমিকা পালন করে থাকে।
(২) ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানগত কল্যাণ এবং পরিস্থিতি পুনর্গঠন
২২:২৭-২৮ আয়াতে উল্লেখিত মানবজাতির জন্য কল্যাণসমূহ বলতে বুঝায় হজ্জের সমস্ত কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্জিত কল্যাণসমূহ। প্রথমত আরাফাতে একত্রিত হওয়ার সময়টিকে পারস্পরিক পরিচিতি ও বিশ্ব জনকল্যাণে কর্মসূচী গ্রহণ করা যেতে পারে তথা দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য ও তা শ্রবণ ও আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কল্যাণকে বাড়ানো যেতে পারে। আরাফাতে সমকালীন বিশ্বপরিস্থিতি সাপেক্ষে কয় ধরনের সভার আয়োজন করা হবে তা একটি নির্বাহী বিষয়। আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন যে, আরাফাতে সমবেত হতেই হবে। এর নামকরণ করা হয়েছে ‘আরাফাত’ তথা ‘বিভিন্ন ধরনের পরিচিতি লাভের স্থান’। সুতরাং এতে একত্রিত হওয়া ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরনের পরিচিতির বিষয় রয়েছে, তাদের জাতিগত, ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, সমকালীন আর্থ-সমাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিগত, শিক্ষা-চিকিৎসা-নিরাপত্তার ব্যবস্থাগত, বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতাগত, আবিষ্কার-উদ্ভাবন যোগ্যতা ও যোগাযোগ প্রযুক্তিগত ইত্যাদি পরিচিতি লাভের জন্য আরাফাতকে কাজে লাগাতে হবে। এই পরিচিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন জাতিসত্ত্বা থেকে যারা উপস্থিত হবেন, তাদের প্রতিনিধিরা এই পরিচিতি সভায় মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।
এছাড়া সূরা তাওবার আয়াতসমূহ প্রমাণ করে যে, হজ্জের সময় বিশ্ব রাজনীতির একটা যুগান্তকারী ঘোষণা বিঘোষিত হয়েছে যে, মুশরিকদেরকে যুদ্ধ বিরতি ও যুদ্ধ নিষিদ্ধ হারাম মাসগুলো শেষ হওয়া পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হলো, এ হারাম মাসগুলোর পর, অর্থাৎ হজ্জের মাসসমূহের পর তথা ঐ চান্দবর্ষ শেষ হবার পর তারা আর আল মাসজিদুল হারামের কাছে আসতে পারবে না। এ ঘোষণার প্রেক্ষিতে যে দিন এ ঘোষণা বিঘোষিত হয়েছে সেদিনকে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হজ্জের দিন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে স্পষ্ট যে, হজ্জ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশ্বজনীন ঘোষণারও অন্যতম মাধ্যম।
সুতরাং হজ্জের মাধ্যমে কল্যাণ উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিসেবে ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানগত কল্যাণ এবং পরিস্থিতি পুনর্গঠনের সুযোগ অর্জনকেও বিশেষ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা উচিত।
খ. হজ্জ উপলক্ষে আল্লাহর নামে পশু উৎসর্গ করা
হজ্জের সুনির্দিষ্ট কার্যগত উদ্দেশ্য হিসেবে দ্বিতীয় যে উদ্দেশ্যটি বলা হয়েছে তা হলো হজ্জ উপলক্ষে আল্লাহর নামে পশু উৎসর্গ করা। হজ্জ উপলক্ষে আল্লাহর নামে পশু উৎসর্গের তাৎপর্য নিম্নরূপ:
১. খাদ্য সংস্থান
মানুষের প্রধান চাহিদা হচ্ছে খাদ্য এবং যখন কারো কাছে হাদিয়া হিসেবে খাদ্য পৌঁছানোর বিষয় থাকে তখন এক্ষেত্রে প্রধান বিকল্প হচ্ছে গোশত।এই প্রেক্ষিতে হজ্জ উপলক্ষ্যে আল্লাহর নামে পশু উৎসর্গের উদ্দেশ্য নির্ধারণের কার্যকারণ উপলব্ধি করা যেতে পারে। হজ্জ উপলক্ষে সমাগত বিপুল সংখ্যক হজ্জকারী এবং তার পাশাপাশি আরো লোকজনের জন্য খাদ্য সংস্থানের আয়োজনের ক্ষেত্রে এই পশু উৎসর্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেহেতু আল্লাহর নামে পশু উৎসর্গ হজ্জের একটি উদ্দেশ্য, তাই হাদিয়া হিসেবে কুরবানির পশু অবশ্যই অন্যতম হাদিয়া হিসেবে সাব্যস্ত হয়। হজ্জে পশু কুরবাণী আরো একটি বিষয়কে তাৎপর্যমন্ডিত করে যা হলো মেহমানদারী। অর্থাৎ হজ্জে যারা উপস্থিত হবে তাদেরকে সমবেতভাবে মেহমানদারী করানো হবে হজ্জের ব্যবস্থাপনা পক্ষ থেকেই।
২. আল্লাহ সচেতনতা
হজ্জ উপলক্ষে আল্লাহর নামে যে পশুগুলোকে উৎসর্গ করা হয় তার রক্ত বা গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না বরং ঐ উৎসর্গের মাধ্যমে আল্লাহ সচেতনতার চর্চা হলে তা-ই আল্লাহর কাছে পৌঁছে। তাই যদি পশু উৎসর্গের মাধ্যমে আল্লাহ সচেতনতা অর্জিত না হয় তাহলে নিছক পশু উৎসর্গ করা একটি অনর্থক বিষয়ে পরিণত হতে বাধ্য।
যেহেতু আল্লাহর নামে পশু উৎসর্গ করলে তার রক্ত ও গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না তাই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, উৎসর্গকৃত পশুর গোশত নিজেরা খাও এবং অন্যদেরকে খাওয়াও যারা অভাবগ্রস্ত, যারা আবেদন করে না এবং যারা আবেদন করে। হজ্জ যেহেতু মানবজাতির সকলের জন্য এবং এখানে একক স্রষ্টার নামে উৎসর্গকৃত পশুর খাদ্য সকলকে বিতরনের মাধ্যমে অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে এক ও অদ্বীতিয় স্রষ্টার আনুগত্যের একটি দিকও সাবর্জনীনতা লাভ করে।
আল্লাহর হিদায়াত অনুসারে পশু থেকে উপকার লাভ এবং তাকে আল্লাহর নামে জবেহ করা এবং তা থেকে নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি অভাবগ্রস্তদেরকে খাওয়ানো হচ্ছে এই স্বীকৃতির মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের একটি উপায় যে, আল্লাহর বিধান ও অনুমোদনই যাবতীয় অধিকারের উৎস। আল্লাহ যদি অধিকার না দিতেন তাহলে আমরা পশুর গোশতকে আমাদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা বৈধ হতো না। যাবতীয় অধিকার আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং তিনি আমাদেরকে অধিকার দিয়েছেন তাঁর নাম স্মরণ করে পশু জবেহের মাধ্যমে সেই পশুর গোশতকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার জন্য। আমরা যখন এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আল্লাহর নামে পশু উৎসর্গ করি তখন তা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি উপায় হয় এবং এর মাধ্যমে আমাদের আল্লাহ সচেতনতার চর্চা হয়।