তাক্বদীর

বইটির পিডিএফ কপি ডাউনলোড

তাক্বদীর শব্দের প্রায়োগিক অর্থ : ভাগ্য না প্রাকৃতিক আইন?

সৃষ্টিজগতে বিশ্বপ্রভুর প্রাকৃতি নিয়ম নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ

তাক্বদীর শব্দের প্রায়োগিক অর্থ : ভাগ্য না প্রাকৃতিক আইন?

কুরআনে ব্যবহার অনুসারে তাক্বদীর শব্দের বিভিন্ন অর্থ

তাক্বদীর শব্দ ধারণকারী আয়াতসমূহ থেকে লক্ষ্য করা যায় যে, ক্বদর বা তাক্বদীর শব্দটি একটি বহু অর্থবোধক শব্দ। যেমন : মর্যাদা দান, নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ও সক্ষমতা এবং প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণ ইত্যাদি। বাক্যে প্রয়োগ অনুসারে বিভিন্ন স্থানে এ শব্দটি যেসব অর্থবোধকতা তৈরি করে তা হলো : (ক) মর্যাদা দান বা মূল্যায়ন, মূল্য (Value) নির্ধারণ, প্রাকৃতিক পরিমাপ। (খ) শক্তি-ক্ষমতা ও সক্ষমতা (গ) প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নির্ধারিত পরিমাণ (ঘ) প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নির্ধারিত যথোপযোগী সময় (ঙ) প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ (চ) প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নির্ধারণ (ছ) নির্ধারিত প্রাকৃতিক আইন বা নির্ধারিত প্রাকৃতিক ব্যবস্থা (জ) নিয়ামকরূপে নির্ধারণ (ঝ) মূল্যায়নমূলক কথা নির্ধারণ, ইত্যাদি।

তাক্বদীর শব্দের যে অর্থটি সমাজে বহুল প্রচলিত তা হলো: ভাগ্য। কিন্তু কুরআনে শব্দটি ভাগ্য অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। বরং কুরআনে শব্দটি শব্দটির মূল অক্ষরসমূহ (Root Letters) অনুসারে ব্যুৎপত্তিগত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। তাক্বদীর শব্দের মূল অক্ষরসমূহ হলো ‘ক্বফ দাল র’। এই মূল অক্ষরসমূহ থেকে গঠিত শব্দমূলের মৌলিক সাধারণ অর্থ হলো ‘মূল্য, মর্যাদা, পরিমাপ-পরিমাণ, নিয়ম কানুন, প্রভাবক বা নিয়ামক, শক্তি-সক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ইত্যাদি ধারণ বা নির্ধারণ করা’। অন্যদিকে ‘ভাগ্য’ শব্দটি পরবর্তীতে প্রচলিত হওয়া একটি ভুল অর্থ। অর্থাৎ তাক্বদীর শব্দটি পরবর্তীতে ‘ভাগ্য’ অর্থে ভুলভাবে প্রচলিত হয়েছে।

তাক্বদীরকে ‘ভাগ্য’ অর্থে অনুধাবনের অগ্রহণযোগ্যতা

পরবর্তীতে প্রচলিত ‘ভাগ্য’ অর্থটি কুরআনে ব্যবহৃত ‘তাক্বদীর’ শব্দের অর্থ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ:

১. সেক্ষেত্রে মানুষকে কোনো আদেশ-নিষেধ করা, আদেশ পালন করলে পুরস্কারের আশ্বাস এবং নিষিদ্ধ কাজ করলে শাস্তির ধমক দেয়া, নবী-রসূল প্রেরণ ও কিতাব (কুরআন) নাজিল করা, ঈমান আনতে বলা, ভালো কাজ করতে বলা এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার কথা বলা সম্পূর্ণ অর্থহীন বিষয়ে পরিণত হয়। এবং মানুষকে প্রশংসা ও নিন্দা বা পুরস্কার ও শাস্তি দেয়ার কোনো যৌক্তিকতাই থাকে না। বিশেষ করে মন্দ কাজের জন্য দায়ী করা ও শাস্তি দেয়া অন্যায়-অত্যাচার ও অবিচার হিসেবে সাব্যস্ত হয়। এগুলো প্রমাণ করে যে, মানুষ ভাগ্য অনুসারে কর্ম সম্পাদন করে না, বরং তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তি প্রয়োগ করে কর্মসম্পাদন করে।

২. সেক্ষেত্রে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও কর্মক্ষমতার স্বাধীনতার কোনো স্থান ও মূল্য থাকে না। আর মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও কর্মক্ষমতার স্বাধীনতার স্থান ও মূল্য না থাকলে মানুষকে তার কাজের জন্য দায়ী করা যেতে পারে না এবং পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া যেতে পারে না। এছাড়া আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমরা আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও কর্মক্ষমতা অনুভব করি, তা যতই সীমিত পরিসরে হোক না কেন। এছাড়া মানুষের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার ধরনের ভিত্তিতে কোনো কাজের সাফল্য-ব্যর্থতা ও সাফল্য-ব্যর্থতার মাত্রা নির্ভর করে। আর যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার স্বাধীন ইচ্ছার ভূমিকা থাকে না, তা যে ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণেই হোক না কেন, সেক্ষেত্রে আমরা সেই ব্যক্তিকে তার কোনো বাধ্য হয়ে বা মস্তিস্ক বিকৃতিজনিত কারণে করা কাজের জন্য দায়ী করি না।

৩. সেক্ষেত্রে অযথা কুরআনের আয়াতসমূহের মধ্যে স্ববিরোধ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। অথচ কুরআনে কোনো স্ববিরোধ বা বৈপরীত্য নেই। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াত দুটি প্রণিধানযোগ্য।

৪:৮২ :: আর তা (কুরআন) যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট থেকে আসতো তবে নিঃসন্দেহে তারা তাতে অনেক বৈপরীত্য বা স্ববিরোধ পেতো।

২:১৭৬ :: আর নিশ্চয় যারা কিতাবের মধ্যে বৈপরীত্য বা স্ববিরোধ সাব্যস্ত করেছে তারা অবশ্যই জেদের বশবর্তী হয়ে (সত্য হতে) অনেক দূরে চলে গেছে।

যখন কোনো বিষয়ে একটি বক্তব্যের সাথে অন্য বক্তব্যের বাহ্যিক বিরোধ দেখা যায় কিন্তু গভীর পর্যবেক্ষণে বুঝা যায় যে, এর মধ্য থেকে একটি বক্তব্যকে প্রাথমিকভাবে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, যার একটি অন্য বক্তব্যের সম্পূরক, তাহলে বক্তব্য দুটিকে সম্পূরক অর্থে গ্রহণ করতে হয়। এক্ষেত্রে যে ধরনের ব্যাখ্যা বৈপরীত্য সৃষ্টি করে তা ত্যাগ করতে হয়। শুধুমাত্র যখন দুটি বক্তব্যের মধ্যে কোনোভাবে সমন্বয় সম্ভব হয় না বা সমন্বয়টি নিতান্তই কৃত্রিম হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার যোগ্য, সেইক্ষেত্রে বক্তব্য দুটিকে পরস্পর ভিন্ন বলা যেতে পারে।

কুরআন অধ্যয়নের একটি অন্যতম মূলনীতি হলো ‘তাসরীফ’ বা একই বিষয়ের আয়াতসমূহকে সমন্বিতভাবে অধ্যয়ন করা। এতে বাহ্যত একই বিষয়ে দুটি আয়াতে দুটি ভিন্ন ধরনের কথা বলা হয়েছে হিসেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, একটি আয়াতে কোনো বিষয়ের চূড়ান্ত স্তর সম্পর্কে বলা হয়, যেখানে অন্য আয়াতে তার কোনো শর্তাধীন স্তর সম্পর্কে বলা হয়। যে আয়াতে কোনো শর্তসাপেক্ষে কোনো কথা বলা হয়, সেখানে শর্তটিকে বিবেচনায় নিলে দেখা যায় যে, বক্তব্যগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।

আরেকটি বিষয় হলো, বক্তব্যের প্রেক্ষিত বা পরিবেশগত অর্থ। একটি বাক্য দুই স্থানে দুটি ভিন্ন অর্থের বক্তব্যকে ধারণ করতে পারে, যেটাকে প্রেক্ষিতগত বা পরিবেশগত অর্থ বলা যেতে পারে। তাই এই প্রেক্ষিতগত বা পরিবেশগত অর্থকে বিবেচনায় না নিলে বাহ্যিক বৈপরীত্য দেখা যায়। কিন্তু প্রেক্ষিতগত বা পরিবেশগত অর্থকে বিবেচনায় নিলে দেখা যায় যে, বক্তব্যগুলো পরস্পর-বিপরীত নয়। তাক্বদীর (প্রাকৃতিক আইন) ও ভাগ্যবাদ সম্পর্কিত কোনো কোনো আয়াতের ক্ষেত্রে এ মূলনীতিটি প্রযোজ্য।

তাকদীর শব্দের অর্থ ‘ভাগ্য’ ধরা হলে কুরআনের আয়াতসমূহে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য সাব্যস্ত হয়। অথচ কুরআনে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য নেই। যেমন: এটা সম্ভব নয় যে, কুরআনে একই সাথে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাকে সমর্থন ও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে (যদিও অগভীর অধ্যয়নের কারণে বাহ্যত এমনটি মনে হতে পারে)। তাই ‘তাক্বদীর’ শব্দের অর্থ হিসেবে ‘ভাগ্য’ গ্রহণযোগ্য নয়।

৪. এছাড়া ‘ভাগ্য’ অর্থটি কোনো আয়াতের বক্তব্যের মধ্যে খাপ খায় না।

তাক্বদীর শব্দের অর্থ ‘ভাগ্য’ করাতে যেসব প্রশ্ন তৈরি হয় সেগুলোর জবাব দিতে ব্যর্থ হয়ে বলা হয় যে, তাক্বদীর সম্পর্কে প্রশ্ন ও আলোচনা করা উচিত নয়। কারণ এ ধরনের আলোচনার ফলে মানুষ গোমরাহ হয়ে যায়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, যারা এ ধরনের ফতোয়া দেন, তারাই আবার তাক্বদীর নিয়ে অনেক আলোচনা করেন এবং পরস্পর বিপরীত মতবাদে বিভক্ত হয়ে পরস্পরকে প্রশ্ন উত্থাপন করেন ও পরস্পরের প্রশ্নের উত্তর দেন। বস্তুত এ ধরনের কথা হলো ধর্মের নামে যা বলা হয় তা যতই স্ববিরোধপূর্ণ হোক না কেন তা বিনাপ্রশ্নে মেনে নেয়ার জন্য চাপিয়ে দেয়ার একটা কৌশলমাত্র।

বস্তুত তাক্বদীরকে ‘ভাগ্য’ অর্থে অনুধাবনের কোনো অবকাশ নেই বা তাক্বদীরকে ভাগ্য অর্থে অনুধাবন গ্রহণযোগ্য নয়।

তাক্বদীরকে ‘আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন’ অর্থে অনুধাবনের গ্রহণযোগ্যতা

তাক্বদীরকে ‘আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন’ অর্থে অনুধাবন সকল বিচারে গ্রহণযোগ্য। কারণ :

১. সবকিছু আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী সংঘটিত হয় এবং আল্লাহ ছাড়া কেউ তা পরিবর্তন করতে পারে না। এই তথ্য আল্লাহর কর্তৃত্বে বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত। আবার এই তথ্যের মধ্যে মানুষের ইচ্ছা, কর্মপ্রচেষ্টা, নিষ্ঠা, ধৈর্য্য, সাহসিকতা, কর্মকৌশল ইত্যাদির স্বীকৃতি রয়েছে।

২. এই উপলব্ধি অনুসারে, কর্মফলের জন্যে মানুষ দায়ী তথা কর্মের ভিত্তিতে পরীক্ষা নিয়ে মানুষকে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া ন্যায়সঙ্গত।

৩. এই উপলব্ধি অনুসারে, তাক্বদীর সম্পর্কিত আয়াতসমূহ পরস্পর সম্পূরক।

সুতরাং তাক্বদীর বলতে বুঝায়- আল্লাহ সবকিছুর জন্য পরিমাপ ও মান নির্ধারণ করেন, যা সেই অনুযায়ী কাজ করে এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণ প্রতিটি সত্তা, বিষয় বা জিনিসের উপর বিস্তৃত। যেমন : আল্লাহর নির্ধারিত প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী আমরা চোখ দিয়ে দেখি, কান দিয়ে শুনি, জিহবা দিয়ে স্বাদ আস্বাদন করি, নাক দিয়ে ঘ্রাণ লাভ করি। আবার আমরা চোখ দিয়ে কতটুকু ছোট বা বড়ো এবং কাছের বা দূরের জিনিস দেখবো তাও প্রাকৃতিক অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। এছাড়া, প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী প্রতিটি কাজের জন্য উপযুক্ত সময় ও সময়সীমা রয়েছে। যেমন : গর্ভস্থ সন্তান প্রসবের জন্য নয় মাস দশ দিন বা তার কিছু কম-বেশি সময় লাগে। প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী উপযুক্ত সময়ের আগে কোনো কাজ সুসম্পন্ন হয় না। আবার কিছু ক্ষেত্রে উপযুক্ত সময় চলে গেলে তার জন্য আর সময় পাওয়া যায় না বা কাজটি সাধিত হয় না। এভাবে ‘তাক্বদীর’ শব্দটির দ্বারা বুঝায় বিভিন্ন বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত প্রাকৃতিক আইন।

তাক্বদীর বিশ্বাসের বিষয় নয়। ‘সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয়’ এটা যেমন বিশ্বাসের বিষয় নয়, তাক্বদীরও অনুরূপ। তাই কুরআনের কোনো আয়াতে তাক্বদীরে বিশ্বাস করতে বলা হয় নি। তাক্বদীর সুপরিজ্ঞাত বা জানা-বোঝার উপযোগী বিষয়। তাই সৃষ্টিজগতে ক্রিয়াশীল ‘কারণ ও ফলাফল নীতি’ নিয়ে যত বেশি গবেষণা করা হবে তত বেশি তাক্বদীর সম্পর্কে জ্ঞানের বৃদ্ধি ঘটবে এবং তাক্বদীরের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।

তাক্বদীর বলতে প্রাকৃতিক আইনকে বুঝানোর কতিপয় উদাহরণ

তরল জল হিমাঙ্কে বরফে রূপান্তরিত হয় এবং একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বিপরীত হয়। এটির আকার যে পাত্রে রয়েছে তার সাথে খাপ খায়। উচ্চ তাপমাত্রা জলকে বাষ্পে পরিণত করে যা বাতাসের চেয়ে হালকা হওয়ায় মেঘের মতো উপরে উঠে যায়। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায়, মেঘগুলি আবার জলে বা তরলে পরিণত হয়ে যায়, যা বাতাসের চেয়ে ভারী হওয়ায় বৃষ্টি হয়ে পড়ে। সঠিক পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি তৃষ্ণা নিবারণকারী ও জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অন্যদিকে পানিতে ডুবে মানুষের মৃত্যু ঘটে। এসব হলো পানির সাথে সম্পর্কিত তাক্বদীর বা ‘প্রাকৃতিক আইন’।

তাহলে পানির জন্য আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন হলো, তা গরম হলে বাষ্প হবে, ঠাণ্ডা হলে বরফ হবে। সুতরাং পানিকে গরম করে বরফ বানানো যায় না। অর্থাৎ প্রাকৃতিক আইনকে লঙ্ঘন করা যায় না। কুরআন আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেয় যে, এই অলঙ্ঘনীয় আইনের প্রণেতা হলেন আল্লাহ। সুতরাং তাক্বদীর সম্পর্কিত বিশ্বাসের বিষয় হলো, আল্লাহই তাক্বদীর তৈরি করেছেন। তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক আইন আমরা পর্যবেক্ষণ করি বা এর অভিজ্ঞতা লাভ করি। কিন্তু কুরআন এ আইনের প্রণেতা হিসেবে আল্লাহর পরিচয় প্রকাশ করে।

বস্তুত তাকদীর হলো প্রকৃতির নিয়ম যা মানুষের গৃহীত কর্মের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়। যেমন, যে ব্যক্তি আগুনে হাত দেয় তাক্বদীর অনুসারে তার হাত পুড়ে যাবে। সেই পোড়াকে যখন মলম দিয়ে চিকিৎসা করা হয়, তখন তাক্বদীর অনুসারে তার জ্বালা-পোড়ার উপশম হয়।

যদি কেউ মহামারী-সংক্রমিত এলাকায় থাকে, তবে তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী সে সংক্রমিত হয়। কিন্তু কেউ যদি মহামারী-আক্রান্ত এলাকা থেকে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বা নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তরিত হয়, তাহলে তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী সংক্রমণজনিত অসুস্থতা এড়ানো যায়।

অতএব, ‘তাক্বদীর’ বা প্রাকৃতিক আইনের বিষয়ে সঠিক ধারণা পোষণকারীরা তাদের জন্য সঠিক কাজ বেছে নিতে পারে কিন্তু ভাগ্যবাদীরা তাদের অবস্থার পরিবর্তনের অধীন হয়ে যায়।

বস্তুত সব কিছুর সৃষ্টি, বিকাশ ও লয়ের জন্য প্রাকৃতিক আইন নির্ধারিত রয়েছে।

২৫:২ :: তাঁরই জন্য আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব। আর তিনি গ্রহণ করেন নি কোনো সন্তান। আর রাজত্বে তাঁর কোনো শরিক/ অংশীদার নেই। আর তিনি সৃষ্টি করেছেন সবকিছুকে। তারপর উহার প্রাকৃতিক আইন (natural law) নির্ধারণ করেছেন।

নিম্নে বিভিন্ন জিনিসের সাথে সম্পর্কিত প্রাকৃতিক আইনের বিষয়ে কুরআন থেকে কিছু উদাহরণ উল্লেখ করা হলো :

১. ভ্রুণের সাথে সম্পর্কিত তাক্বদীর প্রসঙ্গে

৭৭:২০-২৩ :: আমরা কি তোমাদেরকে সৃষ্টি করিনি তুচ্ছ পানি থেকে? তারপর আমরা তা স্থাপন করেছিলাম সংরক্ষিত/ নিরাপদ স্থানের মধ্যে? একটি সুপরিজ্ঞাত বা জানা-বোঝার উপযোগী প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নির্ধারিত যথোপযোগী সময় (স্বাভাবিক গর্ভধারণ কাল) পর্যন্ত। সুতরাং আমরা প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণে সক্ষম হয়েছিলাম। সুতরাং কত উত্তম ক্ষমতাবান প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণকারী!

১৩:৮ :: আল্লাহ জানেন যা গর্ভে ধারণ করে প্রত্যেক (গর্ভবতী) নারী, আর আর গর্ভসমূহে (ভ্রুণের অংগ-প্রত্যংগ, শক্তি-সামর্থ, যোগ্যতা ও মানসিক ক্ষমতার) যা হ্রাস পায় আর যা বৃদ্ধি পায়, আর প্রত্যেক বিষয়ই তাঁর কাছে (নির্ধারিত) আছে প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নির্ধারিত (সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ) পরিমাণ/ মাত্রা সহকারে।

২. বৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত তাক্বদীর প্রসঙ্গে

৪৩:১১ :: আর যিনি নাযিল/ বর্ষণ করেছেন আকাশ থেকে (বৃষ্টির) পানি, নির্ধারিত প্রাকৃতিক আইন (natural law) অনুযায়ী। তারপর আমরা সঞ্জীবিত করি উহার মাধ্যমে মৃত/ শুষ্ক ভূখন্ডকে। এভাবে তোমাদেরকে বের করা হবে।

২৩:১৮ :: আর আমরা নাযিল/ বর্ষণ করেছি আকাশ থেকে (বৃষ্টির) পানি, নির্ধারিত প্রাকৃতিক আইন (natural law) অনুযায়ী। তারপর আমরা তা সংরক্ষণ করি পৃথিবীতে। আর নিশ্চয় আমরা উহাকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই সক্ষম।

১৩:১৭ :: তিনি নাযিল/ বর্ষণ করেন আকাশ থেকে বৃষ্টির পানি, ফলে প্লাবিত হয় উপত্যকাসমূহ তার প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নির্ধারিত পরিমাণমতো। তারপর বহন করে প্লাবন, (বহন করে) ফেনাকে, উপরিভাগে। আর উহার উপরও (ফেনা হয়) যেসব ধাতুকে তারা প্রজ্জ্বলিত করে আগুনের মধ্যে, এ উদ্দেশ্যে যে তা দিয়ে বানাতে চায় অলংকার বা তার মতো কোন তৈজসপত্র। এভাবেই আল্লাহ দৃষ্টান্ত পেশ করেন হক ও বাতিলের/ সঠিক ও বেঠিকের/ যৌক্তিক ও অযৌক্তিকের। তারপর ফেনা চলে যায় অকেজো হয়ে। আর যা মানুষের জন্য উপকারী তা টিকে থাকে পৃথিবীতে। এভাবেই আল্লাহ পেশ করেন আমছাল/ দৃষ্টান্তসমূহ।

৩. চন্দ্র-সূর্য ও দিন-রাতের সাথে সম্পর্কিত তাক্বদীর

১০:৫ :: তিনিই সেই সত্তা, যিনি সূর্যকে করেছেন দিয়াউন/ তেজস্বী আলোকময়, আর চাঁদকে করেছেন নূর/ স্নিগ্ধ আলোকময়। আর উহার জন্য প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নির্ধারণ করেছেন মনজিলসমূহ। যেন তোমরা জানতে পারো বছরসমূহের গণনা আর (তারিখের) হিসাব। আল্লাহ সৃষ্টি করেননি এসবকিছু উদ্দেশ্যহীনভাবে। তিনি তফসীল আকারে বিস্তারিত বর্ণনা করেন আয়াতসমূহকে এমন কওমের জন্য, যারা জ্ঞান রাখে।

৩৬:৩৮ :: আর সূর্য, উহা আবর্তন করে উহার নির্দিষ্ট অবস্থানে (কক্ষপথে)। উহা আযীয/ মহাশক্তিমান ও আলীম/ মহাজ্ঞানী সত্তার নির্ধারিত প্রাকৃতিক আইন।

৭৩:২০ :: নিশ্চয় তোমার রব জানেন যে, তুমি কিয়াম কর/ দাঁড়িয়ে থাক রাতের প্রায় তিনভাগের দুই ভাগ, আর (কখনো) উহার অর্ধেক, আর (কখনো) উহার তিনভাগের এক ভাগ। আর যারা তোমার সাথে আছে তাদের একটি দলও (অনুরূপ করে)। আর আল্লাহই প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নির্ধারিত পরিমাণমতো করেন রাতকে ও দিনকে। …

৬:৯৬ :: তিনিই প্রভাতের উদ্ভাবক/ উন্মেষক/ বাহির করনেওয়ালা। আর তিনি রাতকে বানিয়েছেন বিশ্রামের সময় আর সূর্য ও চাঁদকে করেছেন হিসাবের উপায়। উহা আযীযুল আলীম/ মহাশক্তিমান মহাজ্ঞানীর (আল্লাহর) নির্ধারিত তাকদীর/ প্রাকৃতিক আইন (natural law)।

৪. আকাশের সাথে সম্পর্কিত তাক্বদীর

৪১:১২ :: তারপর সেগুলোকে পরিণত করেছেন সাত আকাশে দুইদিনে। আর ওহী করেছেন প্রত্যেক আকাশে উহার জন্য প্রযোজ্য বিধি-ব্যবস্থা। আর আমরা সুসজ্জিত করেছি দুনিয়ার আকাশকে প্রদীপমালা (= তারকারাজি) দিয়ে। আর সুসংরক্ষিত করে। উহা আযীয/ মহাশক্তিমান ও আলীম/ মহাজ্ঞানী সত্তার (= আল্লাহর) নির্ধারিত প্রাকৃতিক ব্যবস্থা।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, তাক্বদীর হলো বিভিন্ন জিনিসের সাথে সম্পর্কিত প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণ। কুরআনে সরাসরি 'তাক্বদীর' শব্দটি ৫টি আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে। ৬:৯৬, ২৫:২, ৩৬:৩৮, ৪১:১২, ৭৬:১৬। এর মধ্যে প্রথম চারটি উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। আর শেষ আয়াতটিতে (৭৬:১৬) মানুষের চাহিদাগত প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী কোনো কিছুকে যথাযথভাবে নির্ধারণ করা ও তদনুসারে পরিবেশন করা বুঝাতে 'তাক্বদীর' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

৭৬:১৫-১৬ :: আর ঘোরানো হবে তাদের কাছে রূপার পেয়ালা আর মগ, যা স্বচ্ছ কাঁচের হবে। রূপার স্বচ্ছ কাঁচ, তারা উহাকে (চাহিদাগত) প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নির্ধারিত পরিমাণমতো (পরিবেশন) করবে, যথাযথ নির্ধারণের মাধ্যমে।

সুতরাং ‘তাক্বদীর’ শব্দের সকল প্রয়োগ অনুসারে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তাক্বদীর বলতে ‘ভাগ্য’কে নয়, বরং আল্লাহ কর্তৃক সেট করা প্রাকৃতিক আইন এবং তদনুসারে কোনো কিছু নির্ধারণ করাকে বুঝায়। আল্লাহ সবার বা সবকিছুর জন্য প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণ করেছেন। অর্থাৎ তিনি সেগুলোর গঠন উপাদানসমূহ ও তার অনুপাত, বিভিন্ন ধরনের কর্মক্ষমতার সীমা এবং কর্মপদ্ধতির নিয়ম ইত্যাদি নির্ধারণ করেছেন।

তাক্বদীরের মূলতত্ত্ব

প্রাকৃতিক আইন অনুসারে সংঘটিত কর্মকে আল্লাহর কর্ম হিসেবে উপস্থাপন

তাক্বদীর সম্পর্কিত বক্তব্যসমূহের সঠিক উপলব্ধির জন্য আল্লাহর বক্তব্য উপস্থাপনের একটি বিশেষ শৈলী (স্টাইল) বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। তা হলো: প্রাকৃতিক আইন অনুসারে সংঘটিত কর্মকে আল্লাহর কর্ম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। মহান আল্লাহ নিজেই প্রকৃতির স্রষ্টা। যখন আল্লাহ বলেন যে, তিনি এরূপ কাজ করেন, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা দ্বারা তাঁর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত বা হস্তক্ষেপকে বুঝায় না; বরং তা দ্বারা বুঝায় যে, তিনি অতাৎক্ষণিকভাবে নির্ধারণ করে রাখা প্রাকৃতিক আইনের মাধ্যমে এরূপ কাজ করেন। যেমন আল্লাহর তৈরি নিয়মে চাঁদ তার তিথিসমূহ অতিক্রম করে পুরনো খেজুর ডালের আকৃতি ধারণ করে। এ বিষয়টিকে আল্লাহ বলেন যে, আমি চাঁদকে তার তিথিসমূহ অতিক্রম করিয়ে পুরনো খেজুর গাছের আকৃতিতে ফিরিয়ে আনি। মানুষের মধ্যে যেসব প্রাকৃতিক সম্ভাবনা দেয়া হয়েছে সে যদি প্রাকৃতিক আইন অনুসারে তা অর্জন করে, তাহলে সেটাকে আল্লাহ-প্রদত্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এভাবে মানুষ যখন প্রকৃতি থেকে কোনো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে, তখন আল্লাহই তাকে ঐ প্রশিক্ষণ দিয়েছেন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষ্যণীয় :

২৬:৭৮-৮১ :: যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন তারপর তিনিই আমাকে সঠিক পথপ্রদর্শন করেন। আর তিনিই আমাকে খাদ্য খাওয়ান ও আমাকে পানীয় পান করান। আর যখন আমি অসুস্থ হই তখন তিনিই আমাকে সুস্থ করেন। আর তিনিই আমাকে মৃত্যু দেবেন তারপর আবার আমাকে পুনর্জীবিত করবেন।

৫৫:১-৪ :: দয়াময়। তিনি কুরআন শিখিয়েছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি তাকে স্পষ্ট ভাষায় মনোভাব ব্যক্ত করা শিখিয়েছেন।

৯৬:৪ :: যিনি কলমের মাধ্যমে শিখিয়েছেন।

৫:৪ :: তারা তোমাকে প্রশ্ন করে, তাদের জন্য কী বৈধ করা হয়েছে? বল, ‘তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে সব ভাল বস্তু এবং শিকারী পশু-পাখী, যাদেরকে তোমরা শিকার করার প্রশিক্ষণ দিয়েছ; সেগুলোকে তোমরা শেখাও, যা আল্লাহ তোমাদেরকে শিখিয়েছেন; সুতরাং তোমরা তা থেকে খাও, সেগুলো যা তোমাদের জন্য ধরে এনেছে এবং তাতে তোমরা আল্লাহর নাম স্মরণ কর আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ হিসাব গ্রহণে দ্রুত।

৬৭:১৯ :: তারা কি ভেবে দেখে না তাদের উপরে (বায়ুমণ্ডলের একটি স্তরে) উড়ন্ত পাখিগুলোর অবস্থা? যেগুলো পাখা বিস্তার করে/ ডানা মেলে দেয় ও সংকুচিত করে/ গুটিয়ে নেয় (তথা ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে)? তাদেরকে কেউ ধরে রাখে না রহমান/ দয়াময় ছাড়া। নিশ্চয় তিনি সবকিছুর সম্যক দ্রষ্টা।

১৬:৭৯ :: তারা কি ভেবে দেখে না উড়ন্ত পাখিদের অবস্থা? তিনি তাদেরকে (একটি নিয়মের অধীনে) নিয়োজিত/ নিয়ন্ত্রিত করেন আকাশের মহাশূন্যে। তাদেরকে কেউ ধরে রাখে না আল্লাহ ছাড়া। নিশ্চয় উহাতে আছে নিদর্শনসমূহ সেই কওমের জন্য যারা (নিদর্শনের ভিত্তিতে স্রষ্টার অস্তিত্বে) বিশ্বাস করে।

আলোচনা : উপরোল্লেখিত শেষ দুটি আয়াতে উড়ন্ত পাখির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিছু কথা বলা হয়েছে। নিম্নে আয়াতদুটিতে বর্ণিত উড়ন্ত পাখির সাথে সম্পর্কিত কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো-
৬৭:১৯ আয়াতে বর্ণিত উড়ন্ত পাখির সাথে সম্পর্কিত তথ্য :
অবস্থান: ‘তাদের ওপরে’ অর্থাৎ, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একটি স্তরে, যেখানে বায়ুচাপ ও অক্সিজেন বিদ্যমান থাকায় জীবনধারণ সম্ভব।

ধরন ও মাধ্যম: ‘ডানা মেলে ধরে ও ডানা গুটিয়ে নিয়ে’ অর্থাৎ তারা ডানা মেলে উড়তে পারে অথবা ডানা গুটিয়ে বা ডানা ঝাপটিয়ে উড়তে পারে। সুতরাং মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে ওড়ার সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যম হলো ডানা মেলা এবং গুটানো।

১৬:৭৯ আয়াতে বর্ণিত উড়ন্ত পাখির সাথে সম্পর্কিত তথ্য:

অবস্থান: ‘আকাশের শূন্যগর্ভে’—শব্দটি ভূপৃষ্ঠ বা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আকাশের সর্বোচ্চ স্তরকে অন্তর্ভুক্ত করে।
ধরন ও মাধ্যম: নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রিত/ নিয়ন্ত্রণাধীন। এতে পাখির দেহে এবং বায়ুস্রোতে আল্লাহ তাআলার সেট করে দেওয়া ফাংশনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে পাখিরা উড়তে পারে। পাখির আকাশে ওড়া এবং শূন্যে ভেসে বেড়ানোর জন্য দুটি উপাদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক. হালকা ওজনের হওয়া এবং দুই. অতিমাত্রায় শক্তি ও বলপ্রয়োগ করা। এ ছাড়া দুটি ডানাও থাকা চাই, যা পাখিকে সহজভাবে আকাশে উড়তে এবং শূন্যে ভেসে বেড়াতে সহায়তা করে।

উপরোল্লেখিত আয়াত দুটিতে বলা হয়েছে আল্লাহই উড়ন্ত পাখিগুলোকে শূন্যলোকে বা বাতাসে ধরে রাখেন, যেন সেগুলো পড়ে না যায়।

যেহেতু আল্লাহ সেগুলোকে বাতাসে উড়ার জন্য প্রস্তুত ও উপযুক্ত করেছেন, জৈবিক প্রোগ্রামের মাধ্যমে উড়ার পদ্ধতি বা কৌশল শিখিয়েছেন যার ফলে সেগুলো ডানা মেলে ও গুটিয়ে নেয়, যেমন কোনো সাঁতারু পানিতে সাঁতার কাটার সময় করে থাকে। এছাড়া তিনি মধ্যাকর্ষণ এবং বায়ুপ্রবাহ বা বায়ুস্রোতকে সেগুলোকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখার অনুকূল করেছেন। সুতরাং বলা হয়েছে যে, আল্লাহ পাখিগুলোকে শূন্যলোকে ধরে রাখেন। কিন্তু এ কথাটির মাধ্যমে কোনোভাবে এটা বুঝায় না যে, আল্লাহ সেগুলোকে হাত দ্বারা ধরে রাখেন। বরং তিনি তাঁর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মের মাধ্যমে সেগুলোকে ধরে রাখেন ও সুরক্ষা দেন।

সুতরাং উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্ট যে, যা প্রকৃতির মেকানিজম বা সিস্টেমে সংগঠিত, তা আল্লাহর ভাষায় “আল্লাহর দ্বারা” সংগঠিত।

অথচ আয়াতসমূহের যথাযথ অধ্যয়নপদ্ধতি অবলম্বন না করে তাক্বদীর সম্পর্কিত অনেক আয়াতের সঠিক ভাবগত অর্থ গ্রহণ করার পরিবর্তে আক্ষরিকতাবাদী মনোভাবের ভিত্তিতে সেগুলোকে এমন বিক্ষিপ্তভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যা ভাগ্যবাদকে সমর্থন করে। অন্যদিকে আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন ও যৌক্তিক অর্থতাত্ত্বিক পদ্ধতি অবলম্বনে ভাবগত তাৎপর্য অনুধাবন করলে তাতে ভাগ্যবাদের পরিবর্তে আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মের তথ্য প্রকাশ পায়।

প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী যা হয় সেটা আল্লাহর ইচ্ছা বা অনুমতিতে হয় বা আল্লাহ তা সংঘটন করেন বলে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রকাশ করা এবং প্রাকৃতিক আইন যে আল্লাহর প্রণীত সেই বিষয়টিকে তুলে ধরা। আল্লাহ একটি কাজ করেন কথাটির অর্থ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মের মাধ্যমে কাজটি করেন বা কাজটি তাঁর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মে সংঘটিত হয়।

তাক্বদীর বা মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ও তার নিয়ন্ত্রণে ফেরেশতাদের ভূমিকা

তাক্বদীরের ক্ষেত্রে ফেরেশতাদের ভূমিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ কুরআনে দেখা যায় যে, অনেক ক্ষেত্রে একই কাজকে কখনো আল্লাহর কর্ম হিসেবে এবং কখনো ফেরেশতাদের কর্ম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই অনেকে এ বিষয়টিকে তাক্বদীর সম্পর্কিত একটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। বস্তুত আল্লাহ রব্বুল আলামীন যা করেন অনেক ক্ষেত্রে তা ফেরেশতাদের মাধ্যমে করে থাকেন, তথা ফেরেশতারা তাঁর নির্দেশক্রমে তা করে থাকে। ফেরেশতারা হচ্ছে মহাশ্বের ব্যবস্থাপনায় আল্লাহর নিযুক্ত কর্মচারী। আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশের বাস্তবায়নই তাদের কাজ। প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায় যেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয় তাছাড়া এমন অনেক কিছু রয়েছে যাতে প্রাকৃতিক নিয়মে বিভিন্ন বিকল্প কারণের সংমিশ্রণে বহুবিধ সম্ভাবনার বিষয় রয়েছে, সেক্ষেত্রে ফেরেশতারা তাদের ভূমিকা পালন করে। নিম্নে এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু আয়াত উপস্থাপন করা হলো-
.
.

তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক আইন সম্পর্কিত মৌলিক তথ্য

আল্লাহ তায়ালা পরিকল্পিতভাবে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবেই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এবং এ মহাবিশ্ব আল্লাহর তৈরি প্রকৃতির আইন অনুসারে কাজ করে। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সবকিছু প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলে বা মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘটনা সাধারণত প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে সংঘটিত হয়। এটিকে ‘কারণ ও প্রভাবের আইন’ বা ‘কারণ ও ফলাফল বিধি’ বলা হয়। আর এটাই তাক্বদীর তথা আল্লাহ কর্তৃক প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণ।

সমস্ত সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে এবং তা যথারীতি অপরিবর্তনীয়ভাবে কার্যকর রয়েছে। যেমন, চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্ব ও ঘূর্ণন, জীবের জৈবিক গঠন ও জৈবিক প্রক্রিয়া। জীবের জৈবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা মৃত্যুকে কোনো জীব এড়িয়ে যেতে সক্ষম নয়। সুতরাং জীবকে মৃত্যুবরণ করতে হবে এটাও একটা নির্ধারণ। জন্মের ক্ষেত্রটিতেও যে জন্মগ্রহণ করছে তার ইচ্ছা বা পছন্দের কোনো সম্পর্ক নেই। জৈবিক প্রক্রিয়া ছাড়াও রয়েছে সহজাত মনস্তত্ত্ব প্রবৃত্তির প্রতিক্রিয়া যেমন খাদ্য অনুসন্ধান, আনন্দ-বেদনা, রাগের সময় যৌক্তিকতা বোধের হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি।

সৃষ্টিজগতের অংশ হিসেবে মানুষও ‘প্রকৃতির আইনের’ অধীন। মানুষের জীবনের দুটি দিক রয়েছে। একটি হল ভৌতিক, বাকি মহাবিশ্বের মতো, প্রকৃতির ভৌত নিয়মের সাপেক্ষে। উদাহরণস্বরূপ: মানুষ খাদ্য গ্রহণ, হজম, মলত্যাগ, ঘুম, জাগ্রততা, অসুস্থতা, স্বাস্থ্য, প্রজনন, আগ্রাসন, স্ব-সংরক্ষণ ও মৃত্যু ইত্যাদি বিষয়ে অন্যান্য প্রাণীর মতো একইভাবে প্রাকৃতিক কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়।

আর মানব জীবনের অন্য দিকটি হচ্ছে তার ব্যক্তিত্বের দিক, যা শারীরিক আইনের অধীন নয়। তা সত্ত্বেও, এটির একটি আলাদা আইন রয়েছে যা ‘স্থায়ী মূল্যবোধ’-কে ধারণ করে। মূল্যবোধ সততা, সত্যবাদিতা, ভাল বা খারাপ এবং সঠিক বা ভুলের মানগুলির সাথে মোকাবিলা করে। এই মানগুলি মানব চরিত্রে প্রতিফলিত হয়। এই মূল্যবোধ অনুসরণের ক্ষেত্রে মানুষ স্বাধীনতার অধিকারী, কিন্তু সে তা অনুসরণ করলে তার চরিত্র উন্নত হবে, অন্যদিকে তা লঙ্ঘন করলে তার চরিত্রের অবনতি ঘটবে। সুতরাং, স্থায়ী মূল্যবোধ মানুষের ব্যক্তিত্বের উপর কাজ করে ঠিক যেমন তার শরীরের উপর শারীরিক আইন কাজ করে। উভয় ক্ষেত্রেই কারণ ও প্রভাবের প্রাকৃতিক আইন কার্যকর রয়েছে, যা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত।

মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতিতে নৈতিক চেতনার দিকও নির্ধারণ করা হয়েছে, যেমন মন্দ কাজ করলে বিবেক তিরস্কার করে। আবার সে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়লে সত্য থেকে অন্ধ হয়ে যায়। এগুলো মনস্তত্বের জন্য আল্লাহর নির্ধারণ। কিন্তু মানুষকে প্রদত্ত মনস্তাত্ত্বিক নির্ধারণের মধ্যে তার সীমিত ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতার দিকটিও অন্তর্ভুক্ত। তাই তার নৈতিক ক্ষেত্রেও দুই ধরনের বিষয় থেকে সে কোনো একটিকে বিকশিত করা এবং অন্যটিকে অবদমিত করার চর্চা করতে পারে। এর সাথে সম্পর্কিত নির্ধারণ হলো ভালো কাজ করতে করতে ভালো কাজই সহজ অনুভূত হয় এবং মন্দ কাজ করতে করতে মন্দ কাজই সহজ অনুভূত হয়। এই প্রকৃতি নির্ধারণের বিষয়টির একটি উদাহরণ হলো কুফরের ফলে ঈমান আনার ক্ষমতা রহিত হওয়াকে অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হিসেবে উল্লেখ করা।

সুতরাং মানুষের শারীরিক দিক যেমন স্থায়ী প্রকৃতির আইনের অধীন, তেমনি তার আধ্যাত্মিক দিকও স্থায়ী মূল্যবোধ ও নীতিমালার অধীন। এসব মূল্যবোধ ও নীতিমালা আল্লাহ নবী-রসূলের কাছে ওহী ও কিতাব নাযিল করে মানুষকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। সর্বশেষ নাযিলকৃত কিতাব আল কুরআনে তা স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত আছে।

মানুষ তার সাধ্যসীমায় কর্মের স্বাধীনতা বা ইচ্ছার স্বাধীনতা বা সিদ্ধান্তের স্বাধীনতার অধিকারী। তবে মানুষের প্রতিটি কাজ, এমনকি তার চিন্তাভাবনাও একটি ফলাফল উৎপন্ন করে। এটিকে ‘কর্মের ফলাফলের আইন’ বা ‘প্রত্যাবর্তনের আইন’ (ল অব রিটার্নস / Law of returns) বলা যেতে পারে।

অর্থাৎ মানুষ একটি দায়িত্বশীল সত্তা, যে তার সীমিত স্বাধীন পছন্দের ক্ষেত্রে সঠিক ও ভুলের মধ্য থেকে সে কী করবে তা পছন্দ করার স্বাধীনতা উপভোগ করে। কিন্তু সে যা-ই পছন্দ করবে তাকে সেটার জন্য আল্লাহর কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত ফলাফল বা পরিণতি ভোগ করতে হবে, তার অন্যথা হবে না। অর্থাৎ যদি সে ‘ক’ পছন্দ করে তাহলে সে ঐ পরিণতিতে পৌঁছবে যা ‘ক’ এর ফলাফল হিসেবে নির্ধারিত এবং যদি সে ‘খ’ পছন্দ করে তাহলে সে ঐ পরিণতিতে পৌঁছবে যা ‘খ’ এর ফলাফল হিসেবে নির্ধারিত। যেমন: সে যদি বিষ পছন্দ করে, তবে তাকে বিষক্রিয়ার ফলাফল ভোগ করতে হবে। সে যা পছন্দ করবে, তার ফলাফল পরিবর্তন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এটি কর্মের ফলাফলের আইন, যা ধ্রুবক এবং দৃঢ়। অন্য কথায় বলা যায়, ‘তোমরা যা বপন করবে তাই কাটবে’- এটাই কর্ম ও কর্মফলের সাধারণ সূত্র।

আল্লাহ যেসব প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছেন, কেউ তার ব্যতিক্রম করতে পারে না। এই প্রাকৃতিক নিয়মে কোনো বিষয়ে হ্রাস-বৃদ্ধির নিয়ম ও সীমাও নির্ধারিত রয়েছে। মানুষ চোখ দ্বারা দেখবে, কান দ্বারা শুনবে, এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। আবার সে চোখ দ্বারা কতটুকু কাছের বা দূরের জিনিস এবং কতটুকু ছোটো বা বড় জিনিস দেখবে এবং তার দৃষ্টিসীমা কতটুকু সম্প্রসারিত বা সংকুচিত হবে তারও বিভিন্ন সীমা নির্ধারিত। তাই মানুষ চোখ দিয়ে শুনবে না বা কান দিয়ে দেখবে না। কিন্তু চোখ দিয়ে আগ্রহ সহকারে ভালো কিছু দেখবে নাকি মন্দ কিছু দেখবে এক্ষেত্রে সে স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতার অধিকারী। কোনো কাজ কীভাবে করলে তা কীরূপ সফল হবে বা কীভাবে করলে তা কীরূপ ব্যর্থ হবে তার নিয়মও নির্ধারিত এবং এতে বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে।

‘প্রকৃতির আইন’ হলো ‘যদি এটা ঘটে, তা ঘটবেই’ এর সূত্র। মহাবিশ্ব পরিচালনার নীতিমালা, প্রোগ্রাম বা প্রাকৃতিক আইন অপরিবর্তনীয় এবং তা সমগ্র মহাবিশ্বের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ একটি ‘কারণ’ যখনই এবং যেখানেই প্রযোজ্য সকল শর্তে অভিন্ন হবে, তখন সেখানে তা ঠিক একই ‘প্রভাব’ তৈরি করবে। বস্তুত প্রকৃতির আইনের স্থায়ীত্ব বিজ্ঞানের ভিত্তি প্রদান করে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের বিস্ময়কর মহাবিশ্বের সমগ্র কাঠামো প্রকৃতির নিয়মের স্থায়ীত্ব, ধারাবাহিকতা ও নির্ভরযোগ্যতার উপর দাঁড়িয়ে আছে।

মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অধ্যয়ন এবং অভিজ্ঞতা (তথা বিজ্ঞান গবেষণা) দ্বারা প্রকৃতির আইন বা মহাবিশ্বের ভৌত নিয়ম আবিষ্কারের সম্ভাবনা নিয়ে, যা তাকে প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগাতে সক্ষম করে। আল্লাহ প্রকৃতির উপাদানসমূহ ও তার বিভিন্ন ধরনের সংমিশ্রণের মাধ্যমে তথা নির্দিষ্ট পরিমাপ অনুযায়ী উপাদানের সঠিক ভারসাম্য ও অনুপাতের সাথে বিভিন্ন কিছু তৈরি করেছেন। আবার মানুষকেও তিনি প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত উপাদানকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক অনুপাতে ব্যবহার করে নতুন কিছু তৈরি করার যোগ্যতা দিয়েছেন। এই বিশেষ অর্থে মানুষকেও সৃষ্টিকারী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর আল্লাহই আদি ও সর্বোত্তম সৃষ্টিকর্তা (২৩:১৪, ৩৭:১২৫, ৩৫:১)।

কোনো ঘটনার বা কোনো কাজের সফলতা বা ব্যর্থতার পিছনে কাজটির পদ্ধতিগত বিষয় ছাড়াও তাতে প্রভাবিতকারী বিভিন্ন অনুঘটক (Factor) কাজ করে থাকে, যার সবকিছু মানুষের জ্ঞাত নয়, বরং বিজ্ঞান গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন ফ্যাক্টর সম্পর্কে তার জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। প্রাকৃতিক বিষয় ছাড়াও বিভিন্ন মানবীয় বিষয় যেমন বিভিন্ন মানুষের ভূমিকা এবং তাদের যোগ্যতা, জ্ঞান-নিষ্ঠা-সাহসিকতা প্রভৃতিরও বিভিন্ন মাত্রার সংমিশ্রণের ফলে বিভিন্নরূপ ফলাফল ঘটে থাকে। মানুষের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার সীমা, ধরন ও ফলাফল নির্ধারণে সামগ্রিকভাবে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ ও ব্যবস্থা এবং তার অনুকূলে বা প্রতিকূলে উপস্থিত বিভিন্ন কর্মপ্রচেষ্টার সম্মিলিত প্রভাব বিদ্যমান থাকে।

আল্লাহ সেই চিরজীবন্ত ও স্থায়ী সত্তা, যিনি তাঁর পরম ক্ষমতাবলে প্রকৃতির আইন প্রণয়ন করেছন এবং তার উপর নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতার অধিকারী।

যদি কখনো প্রাকৃতিক আইনকে স্থগিত করা হয়, যেমন: নবী ইবরাহীমের ক্ষেত্রে আগুনের দহন ক্ষমতাকে স্থগিত করা হয়েছে, তাহলেও ঐ নির্দিষ্ট সময়সীমা বা স্থানের বাহিরে প্রাকৃতিক আইন একইভাবে কাজ করে।

অবশ্য আরেকটি উপলব্ধি হলো আল্লাহ তাঁর বিশেষ ইচ্ছার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও প্রাকৃতিক আইনের বিশেষ কোনো সূত্রকেই প্রয়োগ করেন। সুতরাং আগুন তার দহনশক্তি হারানোর জন্য যে প্রাকৃতিক সূত্র রয়েছে আল্লাহ তাঁর বিশেষ ইচ্ছায় তা প্রয়োগ করেছিলেন এবং মানুষের পক্ষে ঐ সূত্র আবিষ্কার করা সম্ভব হতে পারে যে, কিভাবে কোনো সময় বা স্থানে আগুনের দহনক্ষমতা স্থগিত করা যায়, এমনকি আগুনকে শান্তিদায়ক ঠাণ্ডা অবস্থায় রূপান্তরিত করা যায়।
তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক আইন সম্পর্কিত মৌলিক তথ্যসমূহ সংক্ষেপে নিম্নরূপ :

১. মানুষের করা কাজের ভালো ও মন্দ ফলাফল, জীবন ও মৃত্যু, বেহেশত ও দোযখ পাওয়া না পাওয়া এবং মহাবিশ্বের সকল বিষয়ের ব্যাপারে, মহান আল্লাহ পূর্ব থেকে পৃথক প্রাকৃতিক আইন (Natural law) তৈরি করে রেখেছেন।

২. মানুষের জীবনে এবং মহাবিশ্বে সংঘটিত হওয়া সকল ঘটনা- দূর্ঘটনা ঐ প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী সংঘটিত হয়।

৩. মানুষ বা অন্য কোনো সৃষ্টির পক্ষে ঐ প্রাকৃতিক আইন পরিবর্তন করা সম্ভব হয়। শুধু আল্লাহ তা’য়ালা চাইলে তা পরিবর্তন করতে পারেন।

৪. মানুষের কৃত কাজে সফল হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপারে ঐ প্রাকৃতিক আইনে মানুষের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টা, নিষ্ঠা, ধৈর্য, সাহসিকতা, কর্মকৌশল ইত্যাদি এবং আল্লাহর নির্দিষ্ট করা ও জানা কিন্তু মানুষের জানা ও অজানা অসংখ্য বিষয় (Factor) রয়েছে।

৫. তাই মানুষ কোনো কাজে সফল হওয়ার পদ্ধতি হচ্ছে : নিজ ইচ্ছায়, জেনে বা না জেনে আল্লাহর তৈরী করে রাখা সফল হওয়ার প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী কাজ করা। এবং মানুষ কোনো কাজে ব্যর্থ হওয়ার পদ্ধতি হচ্ছে : নিজ ইচ্ছায়, জেনে বা না জেনে আল্লাহর তৈরী করে রাখা ব্যর্থ হওয়ার প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী কাজ করা।

তাক্বদীর সম্পর্কিত ‘গায়েব’ প্রাকৃতিক আইনের প্রমাণ দেয় এবং ভাগ্যবাদকে নাকচ করে

৭:১৮৮ :: বলো, ‘আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ছাড়া আমি আমার নিজের জন্যও কোনো উপকার বা অপকার করার ক্ষমতা রাখি না। আর যদি আমি গায়েব জানতাম, তাহলে আমি হাসিল করতাম অনেক কল্যাণ, আর আমাকে কোনো অকল্যাণ স্পর্শ করতো না। আমি যারা ঈমান আনে সেই কওমের জন্য একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা বৈ অন্যরূপ নই।

উপরোল্লেখিত আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, গায়েবের জ্ঞান থাকলে মানুষের পক্ষে অকল্যাণ প্রতিরোধ ও কল্যাণ অর্জনে স্বীয় ভূমিকা পালন করা সম্ভব হতো। এ থেকে বুঝা যায় যে, তাক্বদীর হিসেবে যা আছে তা কার্যকারণের ফ্যাক্টর, তা কোনো কার্যকারণ-নিরপেক্ষ স্থির নির্ধারণ নয়। আল্লাহর ‘জ্ঞান বা জানা’ এর প্রেক্ষিতে বলা যায়, বাস্তবে কী ঘটবে তা আল্লাহ পূর্ব থেকে জানেন, কিন্তু আল্লাহর ‘নির্ধারণ’ এর প্রেক্ষিতে বলা যায়, যা কিছু ঘটছে তার প্রাথমিক নিয়ামক হচ্ছে আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন, যা যথাযথভাবে অনুসরণের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ করা যেতে পারে এবং বিপরীতক্রমে ব্যর্থতাই স্বাভাবিক পরিণতি। সুতরাং তাক্বদীর সম্পর্কিত গায়েব প্রাকৃতিক আইনের প্রমাণ দেয় এবং ভাগ্যবাদকে নাকচ করে।

তাক্বদীরে সম্পর্কিত দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণ :

১. ন্যায়-অন্যায় সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে আল্লাহর ও মানুষের কর্মের অবস্থানগত পার্থক্য বুঝতে না পারা। এই প্রেক্ষিতে অনেকে কর্মফল, জীবিকা ও বিপদাপদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আল্লাহর নামে অভিযোগ আরোপ করে থাকে।
২. আল্লাহ্‌র ইচ্ছা এবং সন্তুষ্টির মধ্যে পার্থক্য না করা : যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি নেই তা সংঘটনে আল্লাহর ইচ্ছা থাকতে পারে বিষয়টি বুঝতে না পারা।
৩. আল্লাহর ব্যবস্থাপনার রহস্য উদঘাটনে মানুষের ব্যর্থতা।

যেমন, ফেরেশতারা মানুষ সৃষ্টির রহস্য জানতো না, তেমনি মানুষও আল্লাহর অনেক কাজের রহস্য সম্পর্কে জানে না।

২:৩০ :: আমি জানি, যা তোমরা জান না।

২:২১৬ :: তোমরা এমন কিছু বিষয় অপছন্দ কর, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। পক্ষান্তরে তোমরা এমন কিছু পছন্দ কর, যা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না।

উপরোল্লেখিত বিষয়গুলো নিয়ে ‘আল্লাহর ইচ্ছা’ এবং ‘আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞান ও মানুষের কর্মফল’ অধ্যায় দুটিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, তাক্বদীর বিষয়টিকে নিয়ে যেসব দার্শনিক জটিলতা ও ধর্মতাত্ত্বিক জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে, তা তাক্বদীরকে ‘ভাগ্যবাদ’ অর্থে অনুধাবনের বা প্রচারের কারণে উদ্ভুত হয়েছে। বস্তুত তাক্বদীর হলো মহাবিশ্বের ব্যবস্থাপনায় আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ। এতে মানুষকে ইচ্ছা ও কর্মের সীমিত স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। ঈমান ও কুফরের ক্ষেত্রে বা হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতার ক্ষেত্রে সে পূর্ণ স্বাধীনতার অধিকারী এবং সে তার স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মশক্তি প্রয়োগ করে এ দুটির যা অবলম্বন করবে তাকে অনিবার্যভাবে তার সুফল বা কুফল ভোগ করতে হবে।

তাক্বদীরের প্রচলিত ধারণা বা ভাগ্যবাদ ও এর কুফল

তাক্বদীরের প্রচলিত ধারণা বা ভাগ্যবাদ

তাক্বদীর শব্দের প্রচলিত অর্থ হলো ‘ভাগ্য’ (কে কী করবে এবং তার কী পরিণতি বা ফলাফল লাভ করবে বা কার জীবনে কী ঘটবে)। তাক্বদীরের প্রচলিত ধারণা হলো ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত ও অপরিবর্তনীয় বা কপালের লিখন যায় না খণ্ডন। এর বিস্তৃত রূপ হলো :

১. ঈমান আনা ও আমল করার ক্ষেত্রে মানুষ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তির অধিকারী নয়। বরং মানুষ সম্পূর্ণত বাধ্যগত জীব এবং সে যা কিছু করছে বস্তুত তাকে দিয়ে তা করিয়ে নেয়া হচ্ছে, সে একটি নাটকে বাধ্যতামূলক চরিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছে মাত্র। এ ধারণার প্রেক্ষিতে কবি লিখেছেন ‘ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ, যেমনি নাচাও তেমনি নাচি পুতুলের কী দোষ!’।

ভাগ্যবাদ অনুযায়ী, হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতা এবং তার ফলে জান্নাত ও জাহান্নাম প্রাপ্তি পূর্বনির্ধারিত ও অপরিবর্তনীয়। এমনকি কোনো ব্যক্তির জন্য আল্লাহ জাহান্নাম নির্ধারণ করলে সে সৎকর্মের মাধ্যমে জান্নাতের কাছাকাছি যাওয়ার পরও শেষ দিকে ভাগ্যের প্রভাবে মন্দ কর্ম করে জাহান্নামের উপযুক্ত হয়ে যাবে। এমনকি কোনো ব্যক্তি সৎকর্ম করা সত্ত্বেও আল্লাহ তাকে জাহান্নাম দিতে পারেন, কারণ আল্লাহ তাকে জান্নাত দিতে বাধ্য নন।

২. মানুষের সকল কাজের ভাগ্য তথা পরিণতি ও ফলাফল আল্লাহ কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত। অর্থাৎ একটি কাজ যত সঠিক বা অসঠিক উপায়ে করা হোক না কেন, আল্লাহ যা নির্ধারণ করে রেখেছেন তা-ই হবে। যেমন যত উপযুক্ত চিকিৎসাই হোক না কেন রোগীর ভাগ্যে যদি আরোগ্য নির্ধারণ করা না থাকে, তাহলে রোগী আরোগ্য লাভ করবে না। অনুরূপভাবে যথাযথ চিকিৎসা না করলেও রোগীর ভাগ্যে যদি আরোগ্য লেখা থাকে, তাহলে রোগী আরোগ্য লাভ করবে।

এমনকি কাজটি কিভাবে করা হবে তাও ভাগ্যে নির্ধারিত রয়েছে। ভাগ্যে যদি লেখা থাকে সে সঠিক কিছু করবে, তাহলে তা কখনই ভুল হতে পারে না। পক্ষান্তরে ভাগ্যে যদি লেখা থাকে সে ভুল করবে, তাহলে তা কখনই সঠিক হতে পারে না।

৩. মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর একটিমাত্র স্থান, সময় ও কারণ আল্লাহ কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত। ঐ স্থানে, ঐ সময়ে এবং ঐ কারণেই সে মৃত্যুবরণ করবে।

৪. মানুষের বিয়ে-শাদি ও সন্তানাদি, সম্পদ ও জীবিকা, সম্মান ও ক্ষমতা ইত্যাদি আল্লাহ কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত। অর্থাৎ কার সাথে কার বিয়ে হবে, কার সন্তান হবে বা হবে না বা কতটি সন্তান হবে, কে কতটুকু সম্পদ ও জীবিকা পাবে, কে সম্মানিত হবে বা ক্ষমতার অধিকারী হবে এগুলো আল্লাহ পূর্বনির্ধারিত করে রেখেছেন। এক্ষেত্রে মানুষের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টায় কিছু আসে যায় না। যার ভাগ্যে যা নির্ধারিত আছে সেটাই হবে।

৫. প্রচলিত ভাগ্য বিশ্বাসে একদিকে মনে করা হয় যে, পৃথিবীতে কোনো ক্ষেত্রে এমনকি নিজের কোনো বিষয়েও মানুষের কোনো ভূমিকা নেই। একজনের জীবনের প্রতিটি ঘটনা তার জন্মের আগেই পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্য অনুসারে ঘটে থাকে এবং তা অপরিবর্তনীয়। আল্লাহ তাঁর নিজের ইচ্ছায় দারিদ্র্য বা বিত্তশালিতা, সম্মান বা অসম্মান, স্বাস্থ্য বা অসুস্থতা, জীবন বা মৃত্যু ইত্যাদি প্রদান করেন। কোনো মানুষের প্রচেষ্টা ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। অতএব, মানুষের উচিত হবে নির্দ্বিধায় বিনীতভাবে আল্লাহর কর্তৃক নির্ধারিত তাদের ভাগ্যকে গ্রহণ করা। তাহলে সে আল্লাহর প্রিয় বা নিকটবর্তী হতে পারে!

অন্যদিকে মনে করা হয় যে, পৃথিবীতে কোনো ক্ষেত্রে এমনকি নিজের কোনো বিষয়েও মানুষের কোনো ভূমিকা নেই। মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘটনা তখনই ঘটে ঠিক যে মুহুর্তে আল্লাহ আদেশ বা অনুমতি দেন। অর্থাৎ আল্লাহর তাৎক্ষণিক ইচ্ছায় সবকিছু সংঘটিত হয়।

৬. তাক্বদীরের সাথে সম্পর্কিত দুটি মৌলিক বিষয় হলো : (ক) সবকিছু পূর্বেই ভাগ্যলিপিতে লিখে রাখা হয়েছে। যে মানুষের জন্য ভালো কাজ ও জান্নাত লেখা হয়েছে সে ভালো কাজ করবে ও জান্নাত পাবে। আর যে মানুষের জন্য মন্দ কাজ ও জাহান্নাম লেখা হয়েছে সে মন্দ কাজ করবে ও জাহান্নামে যাবে।

(খ) সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতিতে হয়। যেমন : কোনো ব্যক্তি আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতি ছাড়া ঈমান আনতে পারে না। আর এর দ্বারা ভাগ্যবাদে যে তাৎপর্য নেয়া হয়েছে তা হলো একজন ব্যক্তি ঈমান আনলে তা আল্লাহর তাৎক্ষণিক ইচ্ছা ও অনুমতিতে হয়ে থাকে।

তাক্বদীরের প্রচলিত ধারণা বা ভাগ্যবাদের কুফল

১. ভাগ্য বিশ্বাসী ব্যক্তি কোনো কাজে ব্যর্থতার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান ও প্রতিকারের চেষ্টার পরিবর্তে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয় এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

২. ভাগ্য বিশ্বাসী ব্যক্তিদের পক্ষে কোনো কাজে সফলতার সঠিক উপায় অন্বেষণ এবং আবিষ্কার করা সম্ভব নয়।

৩. কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করা বা ঝুঁকে নেয়া লাগে এমন সৎকর্মে মানুষ উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। যেহেতু ভাগ্য বিশ্বাস অনুসারে, যত কষ্টই করা হোক, ভাগ্যে যা আছে সেটাই হবে, তা পরিবর্তন করা যাবে না।

৪. ভাগ্য বিশ্বাসীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানগত গবেষণায় এবং আবিষ্কার-উদ্ভাবনে পিছিয়ে যায়। যেমন তারা ভাবে যে, রোগীর ভাগ্যে যা আছে তা-ই হবে, তাই তারা নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি বা ঔষধ আবিষ্কারে সচেষ্ট হয় না। অনুরূপভাবে তারা ভাবে যে, উন্নত যুদ্ধাস্ত্র থাকলেও যুদ্ধের ফল যা হবে, উন্নত মানের যুদ্ধাস্ত্র ছাড়াও যুদ্ধের ফল তা-ই হবে। তাই তারা উন্নত যুদ্ধাস্ত্র তৈরি ও সংগ্রহ করাকে এবং সেজন্য সময় ও শ্রম দেয়া বা অর্থ ব্যয় করাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। এর ফলে তারা জ্ঞান-গবেষণা থেকে শুরু করে সামরিক - সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে ও পরাজিত হয়।

৫. ভাগ্য বিশ্বাসের কারণে ধারণা করা হয় যে, মানুষ যেমন আমলই করুক না কেন, ভাগ্যে জান্নাত থাকলে জান্নাত পাবে আর জাহান্নাম থাকলে জাহান্নাম পাবে। তাই ভাগ্য বিশ্বাসীরা মন্দ কাজ করতে ইতস্তত করে না এবং দুষ্ট লোকেরা তাদের মন্দ কাজের জন্য ভাগ্যের দোহাই দেয়।

৬. ভাগ্য বিশ্বাসী ব্যক্তি সঠিক প্রস্তুতি ও পদ্ধতি ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। কারণ সে মনে করে ভাগ্যে যা আছে তা-ইতো হবে, ভাগ্যে যদি মৃত্যু বা দুর্ঘটনা থাকে সেটা কোনোভাবে ঠেকানো যাবে না আর ভাগ্যে যদি মৃত্যু বা দুর্ঘটনা না থাকে, তাহলে তা হতে পারে না। এভাবে সে নিজেই নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

৭. অনেকে কুরআনে থাকা আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে চেষ্টা করেন কিন্তু ভাগ্যবাদের বিষয়টিতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বেও ভুগে থাকেন।

ভাগ্যের মৌলিক ধারণা যা ভাগ্যবাদে পরিণত হয়েছে এবং তার পর্যালোচনা

একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হলো। মুহুর্তেই আকাশ-বাতাস ভারী হতে লাগলো স্বজনদের কান্নার রোলে। একই বগিতে থেকে কেউ বেঁচে গিয়ে নবজীবন পেলো আর কেউ বা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলো। যারা বেঁচে গেলো তারা সৌভাগ্যবান এবং যারা নিহত বা গুরুতর আহত হলো তারা দুর্ভাগ্যবান। আর এই ঘটনা বা দুর্ঘটনাটি ও তার পরিণতি হলো ভাগ্য। ‘ভাগ্য’ শব্দটি সাধারণভাবে এরূপ ভাবধারাকেই চিহ্নিত করে। আর এই ‘ভাগ্য’ ধারণাটি শেষ পর্যন্ত বিশেষ রূপলাভ করে প্রচলিত ‘ভাগ্যবাদ’ তৈরি হয়েছে। যাতে ধারণা করা হয়েছে যে, এই ভাগ্য (যারা সৌভাগ্যবান হলো ও যারা দুর্ভাগ্যবান হলো তাদের এ পরিণতি) একটি পূর্বলিখন (যাকে ললাট বা কপালের লিখনও বলা হয়), যা অবশ্যম্ভাবী ও অপরিবর্তনীয় ছিলো, যা ঘটার ছিলো ও ঘটেছে, যার ব্যতিক্রম সম্ভব ছিলো না ও হয় নি। নিম্নে আমরা ভাগ্যের মৌলিক ধারণাভিত্তিক দুটি সংজ্ঞা ও তার পর্যালোচনা পেশ করছি।

[১] অপ্রত্যাশিত ঘটনা বা ফলাফলই ভাগ্য

ভাগ্য সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা হলো আমরা যা করি তার প্রত্যাশিত ফল লাভ করা ভাগ্য নয়, বরং তার অপ্রত্যাশিত ফল পাওয়াই ভাগ্য। যেমন, কেউ কম পড়ালেখা করেও পরীক্ষায় ভালো ফল লাভ করা অথবা বেশি পড়ালেখা করেও ফল বিপর্যয় হওয়া হলো ভাগ্য। অন্যদিকে যে কম পড়ালেখা করেছে বিধায় খারাপ ফল পেয়েছে অথবা বেশি পড়ালেখা করেছে বিধায় ভালো ফল লাভ করেছে সেটা ভাগ্য নয়। অথচ একইসাথে তারা বিশ্বাস করে যে, সকল কাজের ভাগ্য আল্লাহ পূর্বে নির্ধারণ করে রেখেছেন। সুতরাং চূড়ান্ত কথা একই হয় যে, একজন ব্যক্তি ভালোভাবে পড়ালেখা করে ভালো ফলও পেতে পারে, আবার তার ফল বিপর্যয়ও হতে পারে এবং এ দুটির যা-ই হোক, তা তার ভাগ্য এবং তা পূর্বনির্ধারিত।

প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন একজন ব্যক্তি ভালোভাবে পড়ালেখা করবে, যেখানে সে ভালোভাবে পড়ালেখা করুক বা না করুক উভয় অবস্থায় পূর্ব নির্ধারিত ফলাফল অর্জন করবে?

বস্তুত ভালোভাবে পড়ালেখা করলে ভালো ফলাফল অর্জন করা যাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন ভালোভাবে পড়ালেখা করা সত্ত্বেও ভালো ফলাফল অর্জিত হয় না, তার কারণ পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য নয়, বরং প্রাকৃতিক আইনের আওতায় কার্যকর বিভিন্ন ফ্যাক্টর। যেমন পরীক্ষক কর্তৃক সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করা (যা পরীক্ষকের অন্যায়), ভালোভাবে পড়ালেখা করা সত্ত্বেও অসুস্থতাজনিত কারণে পরীক্ষায় ভালোভাবে লিখতে না পারা, ভালোভাবে পড়ালেখা করা সত্ত্বেও যেগুলোকে কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সেরূপ প্রশ্ন থাকা ইত্যাদি। বস্তুত পার্থিব জীবনে আমরা যখন প্রত্যাশিত ফল পাই না তা আমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ হয়ে থাকে। এছাড়া যখন আমরা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি কিছু পাই, তা হতে পারে আমাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ।

যখন আপনি সবকিছুকে পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য মনে করবেন, তখন আপনার কাছে মনে হবে আল্লাহ অযথাই কাউকে কিছু থেকে বঞ্চিত করেছেন এবং কাউকে কোনো ক্ষেত্রে অধিক দান করেছেন। এমনকি আপনি এই কম-বেশি দানকে পরীক্ষা হিসেবেও দেখার সুযোগ নেই। কারণ ভাগ্য বিশ্বাস অনুসারে আমরা যা-ই লাভ করি তাই ভাগ্যের বিষয়, সেখানে পরীক্ষার অবকাশ কোথায়?

অন্যদিকে যখন আপনি বুঝবেন যে, তাক্বদীর হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত প্রাকৃতিক আইন এবং তাক্বদীর অনুসারে যা ঘটে তার অনেক ক্ষেত্রে আমরা নিজেরা দায়ী এবং অনেক ক্ষেত্রে আমরা অন্যদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মিথস্ক্রিয়ার আওতায় বিভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই। তখন আপনি এ বিষয়টিকে পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন এবং আল্লাহর অনুগ্রহকে অনুভব করবেন। সেক্ষেত্রে আপনি সবর ও শোকর অবলম্বন করতে পারবেন। আপনি আপনার সাধ্যমতো উপায় অবলম্বন ও আল্লাহর উপর ভরসা করতে পারবেন। বস্তুত আমরা উত্তম কিছু অর্জনের জন্য আমাদের করণীয় এবং যা কিছু ফলাফল আমরা পাই তার প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী। আমাদের সাধ্যসীমার বাহিরে কোনো বিষয়ের জন্য আমাদের উপর দায়ভার বর্তায় না। পার্থিব জীবন পরীক্ষার কাল এবং আখিরাতেই চূড়ান্ত ফলাফল। সেই চূড়ান্ত ফলাফলে আমরা শুধু আমাদের পাপ-পুণ্যের দায়ভার অনুসারেই পুরস্কার বা শাস্তি লাভ করবো।

[২] স্বীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরের ঘটনাই ভাগ্য

ভাগ্য বা নিয়তি সম্পর্কে আরেকটি ধারণা হলো, যে বিষয়ে আমাদের ইচ্ছা বা পছন্দের স্বাধীনতা নেই, সেটাই ভাগ্য বা নিয়তি। যেমন- আমি কোথায় জন্মগ্রহণ করবো? আমার বাবা-মা কে হবে? আমার লিঙ্গ কী হবে? আমার মাতৃভাষা কী হবে? আমার উপর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দুর্ঘটনা ইত্যাদি। এগুলো আমাদের ভাগ্য বা নিয়তির কারণে সংঘটিত হয়, যেখানে আমাদের কোনো হাত নেই। যখন গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটে তা চালকের ভুলে হোক বা নিতান্তই দুর্ঘটনাস্বরূপ হোক, তখন হতাহত যাত্রীদের জন্য এটা ভাগ্য বা নিয়তি।

বস্তুত উপরোক্ত নিয়মেও ভাগ্য বা নিয়তিকে স্বীকার করার অবকাশ নেই। কারণ ভাগ্য বা নিয়তি বলতে বুঝানো হয় যে, আল্লাহ এটাই লিখে রেখেছিলেন তাই এর অন্যথা হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিলো না। কিন্তু বিষয়গুলো সেরূপ নয়। জন্মের বিষয়টিই ধরা যাক। আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে নারী-পুরুষের মিলনের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম হয়। যদি জন্মদাতা-জন্মদাত্রী নারী-পুরুষ পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, তাহলে তা তাদের বৈধ কর্ম, অন্যথায় তা তাদের অবৈধ কর্ম। উভয় অবস্থায় জন্মের বিষয়ে জন্মগ্রহণকারী সন্তান দায়ী নয়। আবার বিবাহিত নারী-পুরুষ সন্তান গ্রহণ করা বা না করার বিষয়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে। এখন প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায় যখন কোনো মানব-সন্তানের জন্ম হয়, তখন সে একজন মানুষ হিসেবে মানুষের উপর প্রযোজ্য জীবন-পদ্ধতি ও মূল্যবোধ অবলম্বনের মধ্য দিয়ে যায়। অর্থাৎ সে মানবীয় জীবনধারা অতিবাহিত করে এবং একজন মানুষ হিসেবে অধিকার ও দায়িত্বের আওতায় আসে। এক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি কোথায় জন্মগ্রহণ করবে তা তার নিজের উপর নির্ভর করে না, কিন্তু তা তার জন্য ভাগ্য বা নিয়তি হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়া বিষয়ও নয়। বরং তা আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায় সংঘটিত একটি ঘটনাক্রম। তার জন্ম যদি তার জন্মদাতা-জন্মদাত্রীর অবৈধ মিলনের মাধ্যমে হয়, তবে তারা সেজন্য দোষী, অন্যথায় তারা নির্দোষ; কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সে নিজে সে জন্য দায়ী নয়। সেই সাথে তার জন্ম সম্পর্কে আল্লাহ পূর্ব থেকে জানেন এবং তাঁর সিদ্ধান্তক্রমে প্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক নিয়মের মাধ্যমেই তার জন্ম। জন্মস্থান, জন্মকাল, জন্মদাতা, জন্মদাত্রী, লিঙ্গ, ভাষা ইত্যাদি সে নিজে তার জন্য বাছাই করে নি, কিন্তু এগুলো যা সে জন্মগতভাবে পেয়েছে তা আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায় সে পেয়েছে এবং এগুলোর প্রেক্ষিতে তার জীবনকালে সে জীবনাচার করে, যেখানে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় রয়েছে, সেক্ষেত্রেই সে দায়ী। সহজ কথায়, যা সে নিজের জন্য বাছাই করে নি, সেজন্য সে দায়ী নয়, কিন্তু তা তার ভাগ্য বা নিয়তিও নয়, বরং তা প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায় সংঘটিত সাধারণ ঘটনাক্রম, যাতে অন্যদের সম্মিলিত ক্রিয়ারও ভূমিকা রয়েছে এবং বিভিন্ন উপাদান-সংগঠন সূত্রেরও ভূমিকা রয়েছে। যেখানে ভূমিকা থাকা কোনো ব্যক্তির ভিন্নরূপ ক্রিয়ার কারণে ভিন্ন কিছু হওয়া অসম্ভব ছিলো না। অন্যদিকে এটিকে ভাগ্য বা নিয়তি বললে কোনোক্রমেই যা ঘটেছে তা ছাড়া ভিন্ন কিছু ঘটতে পারার কোনো সম্ভাবনা ছিলো বলে স্বীকার করা হয় না।

কোনো ঘটনার পেছনে আমার ভূমিকা না থাকলে সেজন্য আমি দায়ী নই। কিন্তু যদি এরূপ ঘটনাকে ভাগ্য বা নিয়তি বলা হয়, তবে সেক্ষেত্রে অন্য কাউকেও কোনোক্রমে দায়ী করা যেতে পারে না। অথচ একটি ঘটনার জন্য আমি দায়ী না হওয়ার মানে এ নয় যে, সেজন্য কেউ দায়ী হতে পারে না। প্রত্যেকটি দুর্ঘটনা কোনো না কোনোভাবে সঠিক অবস্থানের বিচ্যুতির ফল। আর প্রত্যেকটি বিচ্যুতিই কারো না কারো ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের ফল। যখন ভাগ্য বা নিয়তির কথা বলা হয়, তখন ধরে নেয়া হয় যে, যা যেভাবে আছে তা সেভাবে থাকাই ভাগ্য বা নিয়তি, যদি তা বদলানোর কোনো সাধ্য আমার না থাকে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক নিয়মের বিষয়টি এমন যে, যা যেভাবে আছে অনেক ক্ষেত্রে তার পরিবর্তন সম্ভব এবং সেজন্য ব্যবস্থার পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে। হয়তো কোনো ব্যবস্থা আমার একার পক্ষে পরিবর্তন সম্ভব নয়, কিন্তু আমিসহ অনেকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা পরিবর্তন সম্ভব হতে পারে। অথবা হতে পারে আমি যেভাবে চলছি সেভাবে তা পরিবর্তনে আমার পক্ষে ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়, কিন্তু আমার কর্মপরিকল্পনা পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি ব্যবস্থাকে পরিবর্তনে আমি মুখ্য ভূমিকা পালন করা সম্ভব। সুতরাং ভাগ্যবাদ মানুষকে নিষ্ক্রিয় বা প্রচেষ্টা-বিমুখ করে, কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়ম ও কর্মবাদ মানুষকে ইতিবাচক কর্মপ্রচেষ্টায় অনুপ্রাণিত করে।

বস্তুত ভাগ্য বা নিয়তি নয়, বরং সকল ঘটনা আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায় সংঘটিত হয়, যাতে মানুষের সীমিত স্বাধীন কর্মক্ষমতা রয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে তার ইচ্ছা ও পছন্দের অবকাশ আছে, কিছু ক্ষেত্রে তার স্বীয় ভূমিকা নেই, কিন্তু অন্যদের মিথস্ক্রিয়ার ফলে তা তার উপর আবর্তিত হয় এবং তার সামনে সংঘটিত ঘটনাগুলোতে তার ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বা ভূমিকার ভিত্তিতে তার মূল্যায়ন হয়। এবং সর্বোপরি সকল বিষয়ে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত ন্যায়নীতি বজায় রেখে তাঁর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা প্রয়োগ করেন।

ভাগ্যবাদের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত উদাহরণ ও তার পর্যালোচনা

ভাগ্যবাদের প্রমাণ হিসেবে কিছু উদাহরণ উপস্থাপন করা হয়। যেমন-
(১) জন্ম ও জিনগত অবদান (অপরিবর্তনীয়)
(২) ধনী বা গরীব পরিবারে জন্মগ্রহণ করা (সৌভাগ্যজনক বা দুর্ভাগ্যজনক)
(৩) একটি মূল্যবান বস্তু বা বিষয় খুঁজে পাওয়া (অননুমেয়)
(৪) নেতিবাচক যৌক্তিক অনুমান সত্ত্বেও ইভেন্টে জয়ী হওয়া (অপ্রত্যাশিত)
(৫) না জানা সত্ত্বেও ক্যুইজের সঠিক উত্তর অনুমান করা অথবা জুয়া বা লটারিতে জিতে যাওয়া (কাকতালীয়)
(৬) দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া বা শেষ মুহুর্তে একটি দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া (পরিস্থিতিগত)
(৭) মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া (সংবেদনশীল)

উপরোল্লেখিত বিষয়গুলোকে ভাগ্যবাদের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও বাস্তবে তা ভাগ্যবাদের প্রমাণ নয়। কারণ এগুলো কোনো ব্যক্তির স্বীয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঘটলেও তা প্রাকৃতিক আইনের অধীনেই ঘটেছে। যেক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বীয় অবদান নেই সেক্ষেত্রে সে দায়ী নয়। আর এর কোনোটি তার জন্য পরীক্ষা এবং কোনোটি তার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহস্বরূপ। আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায় কোনো ব্যক্তি জেনে বা না জেনে এমন কাজ করতে পারে যার ফলে সে কোনো কিছু পায় বা হারায়। এছাড়া এক ব্যক্তির ভুলের কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে কোনো কাজে ব্যক্তির স্বীয় ভূমিকা ও তার ধরন অনুসারে সে দায়ী হবে এবং এজন্য সে পুরস্কার বা শাস্তিযোগ্য হবে। কোনো কিছু কোনো ব্যক্তির স্বীয় ভূমিকায় না ঘটার মানেই এ নয় যে, তা ঘটার বিষয়টি আল্লাহ ভাগ্য বা নিয়তি হিসেবে পূর্ব নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। বরং বিষয়টি আল্লাহর নির্ধারণকৃত প্রাকৃতিক আইনের আওতায় সংঘটিত একটি বিষয়, যেখানে বিভিন্ন ফ্যাক্টর কাজ করেছে এবং কোনো ফ্যাক্টরের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটলে ঘটনাটি অন্যরূপ হতো। যে দুর্ঘনাটি তার ওপর আপতিত হয়, এটার জন্য সে নিজে সরাসরি দায়ী না হলে এটা তার ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। অন্যদিকে প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায় হয়তো কোনো দুর্ঘটনা ঘটার কথা ছিলো, কিন্তু শেষ মুহুর্তে আল্লাহর রহমতে ব্যক্তি তা থেকে বেঁচে গেলো। এটা তার জন্য পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্য নয়, বরং এটা ঐ ঘটনাটির ওপর আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ এবং তার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ।

পরিবর্তনীয় ও অপরিবর্তনীয় ভাগ্যবাদ

ভাগ্যবাদকে বিশ্বাসযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য করার জন্য ভাগ্যবাদের যেই রূপটি তৈরি করা হয়েছে তা হলো- ভাগ্য দুই প্রকার, যথা : (১) পরিবর্তনীয় ভাগ্য ও (২) অপরিবর্তনীয় ভাগ্য।

বলা হয় যে, যে ভাগ্য কোনোক্রমে পরিবর্তন হবে না তা হলো অপরিবর্তনীয় ভাগ্য, আর যে ভাগ্য দোয়া বা কর্মের কারণে পরিবর্তন হতে পারে তা হলো পরিবর্তনীয় ভাগ্য। যেমন, কোনো ব্যক্তি কোথায় জন্মগ্রহণ করবে, তার পিতা-মাতা কে হবে, তার লিঙ্গ কী হবে এগুলোর ক্ষেত্রে সে কিছুই করতে পারে না, সুতরাং নিশ্চিতভাবে এগুলো অপরিবর্তনীয় ভাগ্য। অন্যদিকে সন্তান, সম্পদ, কর্মফল ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার দোয়া ও কর্মের কারণে তার ভাগ্যলিপিতে থাকা ভাগ্যের পরিবর্তন হতে পারে।

প্রশ্ন হলো, যদি কারো ভাগ্যে কিছু লেখা হয়ে থাকে এবং পরবর্তীতে তার দোয়া বা কর্মের কারণে তা বদলে যায়, তাহলে ঐ লেখার কী মূল্য থাকলো? আল্লাহ যেহেতু অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সব জানেন তখন তিনি কীভাবে এমন কিছু ভাগ্য হিসেবে লিখে থাকবেন, যা আসলে তার ভাগ্যে ঘটবে না, এজন্য যে, সে দোয়া করবে বা এমন কর্ম করবে যা তার ভাগ্যে থাকা নির্ধারণকে পরিবর্তন করে দেবে? এ অবস্থায় তো তার ভাগ্য হিসেবে প্রথমে যা লেখা হয়েছিলো তা তার ভাগ্য হিসেবে বহাল থাকলো না বা তার ভাগ্য হলো না।

বস্তুত ভাগ্য এমন একটি ধারণা যাকে পরিবর্তনীয় ও অপরিবর্তনীয় এই দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে না, ভাগ করলে তা একটি স্ববিরোধ হিসেবে সাব্যস্ত হয়। ভাগ্য নিতান্ত অপরিবর্তনীয়তার ধারণাকে সমর্থন করে, পরিবর্তনশীলতাকে নয়।

বস্তুত ভাগ্যবাদ কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য মতবাদ নয়। বরং তাক্বদীর হলো প্রাকৃতিক আইন, প্রাকৃতিক নিয়ম বা প্রাকৃতিক ব্যবস্থা, যেখানে এক বা একাধিক কারণে প্রাকৃতিক নিয়মে এক বা একাধিক ফলাফল উৎপন্ন হওয়ার অনিবার্য সম্ভাবনা বিদ্যমান রয়েছে এবং এই প্রাকৃতিক আইন, নিয়ম বা ব্যবস্থা আল্লাহর কর্তৃক নির্ধারিত। এই কারণ ও ফলাফল বিধির মধ্যে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, কর্মের ধরন ইত্যাদিও বিভিন্ন অনুঘটক হিসেবে কার্যকর হওয়ার অবকাশ রয়েছে। এমতাবস্থায়, মানবজীবনে কোনো বিষয়ে নিজের কর্মের মাধ্যমে বা অন্যদের কর্মের মিথক্রিয়ার প্রভাবে কোনো কিছু একভাবে বা অন্যভাবে ঘটতে পারে, একটি অবস্থা একইরূপে অব্যাহত থাকে বা পরিবর্তিত হয়। সর্বোপরি আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন অনুসারে কোনো অবস্থায় কোনো কিছু যেভাবে ঘটার কেউ তা পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না। শুধুমাত্র আল্লাহ চাইলে তাঁর তৈরি প্রাকৃতিক আইনকে সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে কোনো কিছুকে তাঁর বিশেষ ইচ্ছা অনুসারে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

“আল্লাহ কর্তৃক তাঁরই লিখে দেয়া পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যকে পরিবর্তন করা” এবং “আল্লাহ কর্তৃক তাঁরই লিখে দেয়া পূর্বনির্ধারিত প্রাকৃতিক আইনকে পরিবর্তন করা”- ধারণা দুটির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যখন ধারণা করা হয় যে, আল্লাহ ভাগ্য লিখে দিয়েছেন এবং তিনি মানুষের কোনো দোয়া বা কর্মের কারণে তা পরিবর্তন করতে পারেন, তখন একদিকে মানুষের ঐ দোয়া বা কর্মও ভাগ্যে থাকার কারণেই সংঘটিত হয়, অন্যদিকে এর ফলে ভাগ্যের পরিবর্তন হয় বিধায় পূর্বলিখিত ভাগ্য বহাল না থেকে ভুল হিসেবে সাব্যস্ত হয়। অথচ যখন ধারণা করা হয় যে, আল্লাহ প্রাকৃতিক আইন লিখে দিয়েছেন এবং তিনি মানুষের দোয়া বা কর্মের কারণে বা নিজ অনুগ্রহে তা পরিবর্তন করতে পারেন, তখন তাতে সবকিছুর উপর আল্লাহর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রমাণিত হয়, কিন্তু তাতে ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উত্থাপিত আপত্তির মতো কোনো আপত্তি উত্থাপিত হতে পারে না।

পরিশেষে বলা যায় যে, সকল বিবেচনায় প্রচলিত ভাগ্যবাদ একটি অগ্রহণযোগ্য মতবাদ এবং এটি কোনোক্রমে কোনো সুফল বয়ে আনে না। অন্যদিকে যখন আমরা তাক্বদীর বলতে আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন ও তাঁর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকে বুঝি, তখন তা আমাদেরকে সঠিক নিয়মে কার্যসম্পাদন করে তার সুফল পেতে সাহায্য করে এবং আমাদের অনিচ্ছাকৃতি ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অজ্ঞাত অনুঘটকসমূহের প্রভাবে কোনো দুর্ঘটনা হওয়া থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর প্রতি ভরসা ও তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে অনুপ্রেরণা যোগায়।

মুসলিম বিশ্বাসে তাক্বদীর ধারণাটির অদৃষ্টবাদে পরিণত হওয়ার ইতিহাস

ভাগ্যবাদের উৎপত্তি : কুরআন নাযিলের পূর্বকালেই ভাগ্যবাদের প্রচলন

কুরআন নাযিলকালেও বাধ্যবাধকতা বা ভাগ্যের ধারণা প্রচলিত ছিলো, এমনকি কুরআন নাযিলের পূর্বকালেই ভাগ্যবাদের উৎপত্তি হয়েছে এবং কুরআন ভাগ্যবাদের প্রতিবাদ করে। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতগুলো লক্ষ্যণীয় :

৬:১৪৮-১৪৯ :: যারা শিরক করেছে তারা বলবে, “যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে আমরা ও আমাদের পূর্বপুরুষগণ শিরক করতাম না এবং কোনো কিছুই হারাম করতাম না।” এভাবে তাদের পূর্ববর্তীগণও মিথ্যারোপ করেছিলো। অবশেষে তারা আমার শাস্তি ভোগ করেছিলো। বলো, “তোমাদের নিকট কোনো জ্ঞান আছে কি? থাকলে তা আমার নিকট পেশ করো। তোমরা তো শুধু কল্পনারই অনুসরণ করো এবং শুধু মনগড়া কথা বলো।” বলো, “চূড়ান্ত যুক্তিপ্রমাণ তো আল্লাহরই আয়ত্তে। যদি তিনি ইচ্ছা করতেন, তাহলে অবশ্যই তোমাদের সকলকে হিদায়াত দান করতেন।”

১৬:৩৫-৩৬ :: মুশরিকরা বলবে, “যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে আমরা ও আমাদের পূর্বপুরুষরা তাঁর ছাড়া কারো ইবাদাত করতাম না এবং তাঁকে ছাড়া (তাঁর বিধানের বাইরে) কোনো কিছুকে হারাম করতাম না।” তাদের পূর্ববর্তীরাও এরূপই করতো। তবে কি স্পষ্ট প্রচার ছাড়া রসূলদের কোনো দায়িত্ব আছে? আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং পরিহার কর তাগূতকে। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ কাউকে হিদায়াত দিয়েছেন এবং তাদের মধ্য থেকে কারো উপর পথভ্রষ্টতা সাব্যস্ত হয়েছে। সুতরাং তোমরা যমীনে ভ্রমণ কর অতঃপর দেখ, অস্বীকারকারীদের পরিণতি কীরূপ হয়েছে।

৪৩:২০-২১ :: তারা বলে, “যদি দয়াময় (আল্লাহ) ইচ্ছা করতেন তাহলে আমরা তাদের (ফেরেশতাদের) ইবাদাত করতাম না।” এ বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। তারা তো কেবল মনগড়া কথা বলে। আমি কি তাদেরকে কুরআনের পূর্বে কোনো কিতাব দিয়েছি যা তারা দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছে? বরং তারা বলে, “আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি এক মতাদর্শের অনুসারী এবং আমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।”

৩৬:৪৭ :: যখন তাদেরকে বলা হয়, “আল্লাহ তোমাদেরকে যে জীবনোপকরণ দিয়েছেন তা থেকে ব্যয় করো।” তখন কাফিরগণ মু’মিনগণকে বলে, “আমরা কি তাদেরকে খাওয়াবো, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে যাদেরকে তিনিই খাওয়াতেন? তোমরা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছো।”

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে-
১. আরবের মুশরিকরা আল্লাহর ইচ্ছায় সবকিছু সংঘটিত হওয়ার বিষয় বিশ্বাস করতো এবং আল্লাহকে রহমান (দয়াময়) হিসেবে উল্লেখ করতো, তা সত্ত্বেও তারা মুশরিক।

২. তারা শিরক করার জন্য আল্লাহর ইচ্ছার দোহাই দিতো। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করতো যে, সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। তাই তারা শিরক করছে আল্লাহর ইচ্ছায়। সুতরাং শিরক করার জন্য তাদেরকে দায়ী করা যায় না। কারণ আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে শিরক থেকে বিরত রাখতে পারতেন। অর্থাৎ (ক) আল্লাহই ইচ্ছা করে তাদেরকে শিরক করিয়ে নিচ্ছেন, অথবা (খ) আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে শিরক থেকে বিরত রাখতেন এবং তারা শিরক করতো না। যেহেতু আল্লাহ তাদেরকে শিরক থেকে বিরত রাখেন নি, সুতরাং আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন যে, তারা শিরক করুক।

৩. আরবের মুশরিকরা শিরক করার পক্ষে তাদের ভাগ্য বিশ্বাসকে উল্লেখ করতো যে, তারা ও তাদের পূর্বপুরুষরা আল্লাহর ইচ্ছাক্রমেই শিরক করতো, তাই এজন্য তারা দায়ী হতে পারে না। অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে, তারা তাদের পূর্বপুরুষদেরকে যে মতাদর্শে পেয়েছে তারা স্বেচ্ছায় ঐ মতাদর্শকে গ্রহণ করে নিয়েছে, এজন্য আল্লাহ তাদেরকে নির্দেশও দেন নি, বাধ্যও করেন নি। সুতরাং তাদের ভাগ্য বিশ্বাস একটি বিভ্রান্তি এবং তাই ভাগ্যের দোহাই দেয়া সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তাদের ধারণাকে জ্ঞান ছাড়া নিছক আন্দায-অনুমানের অনুসরণ, মনগড়া বিষয় এবং মিথ্যারোপ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

৪. পূর্ববর্তী যুগে তাদের পিতৃপুরুষরাও অনুরূপ বিভ্রান্তিকর ধারণা পোষণ করতো।

৫. ভাগ্যের দোহাই দিয়ে তারা তাদের নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালনেও অস্বীকৃতি জানাতো। যেমন: তারা দাবি করতো যে, যারা অভাবগ্রস্ত রয়েছেন এটাই তাদের ভাগ্য, চাইলে আল্লাহই তাদেরকে খাওয়াতেন। যেহেতু তিনি তাদেরকে অভাবগ্রস্ত রেখেছেন, তাই এখানে কারো কিছু করণীয় নেই। ভাগ্য বিশ্বাসকে সঠিক ধরে নিয়ে তারা নৈতিক কর্তব্য সম্পাদনের নির্দেশকে বিভ্রান্তি হিসেবে দাবি করেছে। প্রকৃতপক্ষে নৈতিক কর্তব্য পালনের নির্দেশ যথার্থ এবং ভাগ্য বিশ্বাসই বিভ্রান্তি।

কুরআন নাযিলের পরবর্তীতে মুসলিম সমাজে ভাগ্যে বিশ্বাস তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস

কুরআনের মাধ্যমে ভাগ্য বিশ্বাসের অপনোদন করা সত্ত্বেও পরবর্তীতে মুসলিম সমাজকে প্রধানত পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পেছনে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে বা তারা পেছনে ফিরে গেছে। অর্থাৎ মুসলিম সমাজ কুরআনের তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক আইনের ধারণাকে পরিহার করে ভাগ্যের ধারণাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। অবাক করা বিষয় হলো, স্বয়ং তাক্বদীর শব্দটি যা ভাগ্য বিশ্বাসকে রহিত করে সেই শব্দটিকেই ‘ভাগ্য’ অর্থে চালু করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কুরআনে থাকা তাক্বদীর শব্দ ধারণকারী আয়াতসমূহ ‘ভাগ্য’ বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে। তাই মুসলিমরা যদি কুরআনভিত্তিক বিশ্বাস অবলম্বন করতে চায়, তাহলে তা তাদের জন্য মোটেই কঠিন নয়। কুরআন স্পষ্টভাবে ভাগ্যকে অস্বীকার করে এবং তাক্বদীর শব্দের মাধ্যমে ‘প্রাকৃতিক আইন’কে উপস্থাপন করে।

যতক্ষণ কুরআনকে দ্বীন ইসলামের একমাত্র দলীল হিসেবে গ্রহণ ও প্রয়োগ করা হয়, ততক্ষণ মুসলিম বিশ্বে বাধ্যতা বা ভাগ্য ধারণাটির প্রচলন সম্ভব নয়। কারণ কুরআন এটিকে স্পষ্টভাবে শিরক ও ভিন্নমত (কুফর) ঘোষণা করেছে।
কিন্তু যখন বার্তা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোরানকে সামনে না রেখে বরং পেছনে ঠেলে দেওয়া হয় এবং খিলাফতের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের সজাগ দৃষ্টি আর থাকে না, তখন মুসলিম মন-মানসে বিভিন্ন কুরআন-বিরোধী ধারণার অনুপ্রবেশ ঘটে ও তা কলুষিত হয়। ভাগ্য বিশ্বাস এরূপই একটি ভ্রান্ত মতবাদ।

ভাগ্যবাদের উৎপত্তি ও প্রচলনের পেছনে যেসব কারণ ক্রিয়াশীল রয়েছে তা অনুসন্ধান করলে নিম্নোক্ত কারণগুলো পাওয়া যায়-
(১) হতাশাবাদী, ধর্মান্ধ ও ধর্মের অপব্যবহারকারী দুষ্ট লোকদের মনস্তত্ত্ব
(২) রোম ও পারস্য তথা অমুসলিমদের ষড়যন্ত্র
(৩) প্রচলিত হাদীস : তাক্বদীর নিয়ে নবী আদম ও মূসা (আ.) এর বিতর্ক এবং অন্যান্য
(৪) শাসকদের ছত্রছায়ায় মোল্লাতন্ত্রের ভূমিকা : কুরআনবিরুদ্ধ ভাগ্যবাদের প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়া
নিম্নে কারণগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

১. হতাশাবাদী, ধর্মান্ধ ও ধর্মের অপব্যবহারকারী দুষ্ট লোকদের মনস্তত্ত্ব

মানুষ যখন হতাশায় নিপতিত হয়, তখন সে অদৃষ্টবাদ, ভাগ্য বা নিয়তির দোহাই দিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চায়। ধর্মের নামে যখন ভাগ্যবাদের প্রচার করা হয় তখন ধর্মান্ধ লোকগুলো কোনোরূপ যাচাই ছাড়াই সেটাকে অন্ধভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস হিসেবে গ্রহণ করে। আবার ধর্মের অপব্যবহারকারী দুষ্ট লোকেরা তাদের ধর্মহীন কাজের জন্য বা ধর্মচর্চা শুরু করার আগে যেসব অপকর্ম করেছে সেগুলোর ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য ভাগ্যবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। এভাবে হতাশাবাদী, ধর্মান্ধ ও ধর্মের অপব্যবহারকারী দুষ্ট লোকদের মনস্তত্ত্ব ভাগ্যবাদের উৎপত্তি ও প্রচলনের অন্যতম কারণ হিসেবে ক্রিয়াশীল রয়েছে।

২. রোম ও পারস্য তথা অমুসলিমদের ষড়যন্ত্র

কুরআনের মাধ্যমে আরব মুসলিমদের মন ও হৃদয়ে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছিলো, যা তাদের জীবনের একটি উচ্চতর উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করার এবং এমনকি মৃত্যুবরণ করার ইচ্ছা ও উদ্দীপনা দিয়েছে। এই ধরনের অনুভূতি মানুষকে অজেয় করে তোলে। এর ফলে ইসলামের উষালগ্নে মুসলিমদের ক্রমবর্ধমান শক্তি মূর্তিপূজক এবং ইহুদি-খ্রিস্টানদের জন্য একটি প্রচণ্ড আঘাত ছিল। কিন্তু তারা তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া বা মুসলিম জাতিকে সবচেয়ে অধ:পতিত করার জন্য সর্বাপেক্ষা কার্যকর উপায় অবলম্বন বা কৌশল প্রয়োগ করতে চেয়েছিলো।

রোমান ও পার্সিয়ান উভয়েই ভালোভাবে জানতো যে, মুসলিমদের শক্তির উৎস হচ্ছে কুরআনের বৈপ্লবিক দর্শন, যাতে মানুষের ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা এবং কর্মের দায়বদ্ধতা প্রস্তাব করা হয়। তাই তারা তাদেরকে কুরআনের চিন্তাদর্শন থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ও কাজ শুরু করে। মুসলমানদের মধ্যে বসতি স্থাপন করে, পার্সিয়ানরা তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা (ভাগ্যবাদ) খুব সূক্ষ্মভাবে প্রচার করতে শুরু করে। ইসলামের বিকৃতি শুরু হয়েছিল পারসিকদের দ্বারা তাকদীরের দর্শনকে ভাগ্য বা নিয়তি দ্বারা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে।

খ্রিস্টানদের আদিপাপে বিশ্বাস যে, আদম ও হাওয়ার দ্বারা সংঘটিত পাপের কারণে মানুষ জন্মগতভাবে পাপী। এটা মানুষকে পাপী হিসেবে সাব্যস্ত করতে বাধ্য করে বা জন্মগত ভাগ্যকে সমর্থন দেয়। আবার ইহুদিদের মধ্যেও ভালো ও মন্দের দ্বৈতবাদের ধারণা ছিলো। ভাগ্যবাদে এসব বিশ্বাসের প্রভাব রয়েছে। ইহুদি-খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্রকে মুসলিম সমাজে ভাগ্যবাদের প্রচার-প্রসারের অন্যতম কারণ বলা যেতে পারে।

মুসলিম সমাজে ভাগ্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে একদিকে যেমন তাদের মধ্যে দার্শনিক যুক্তিচর্চার অবদান রয়েছে, তেমনি কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের অগভীর অধ্যয়নের সুযোগকে কাজে লাগানো হয়েছে এবং ধর্মগুরুরা এটাই বুঝিয়েছে যে, কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ভাগ্যবাদের সমর্থন করে। সেইসাথে মুসলিম সমাজে ভাগ্যবাদকে প্রতিষ্ঠার জন্য কুরআনের পাশাপাশি হাদীসকেও ইসলামের উৎস ও দলীল হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং রসূলের নামে এমন অনেক হাদীস তৈরি করা হয়েছে যা ভাগ্যবাদকে সমর্থন করে।

৩. হাদীস : ইসলামের কথিত দ্বিতীয় উৎস, যা মুসলিম ধর্মসমাজে ভাগ্যসহ সকল কুরআনবিরুদ্ধ মতবাদের উৎস
আল কুরআন দ্বীন ইসলামের একমাত্র চূড়ান্ত উৎস। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ একমাত্র কুরআনের অনুসারী ছিলেন। তিনি নিজে থেকে দ্বীনের কোনো চূড়ান্ত ধারণা বা চিরন্তন বিধান প্রণয়ন করেন নি। যতদিন কুরআনকে এভাবে গ্রহণ করা হবে ততদিন ইসলাম বিরোধী কোনো ধারণা মুসলিম সমাজে চালু করা সম্ভব নয়। ষড়যন্ত্রকারীরা এই ভিত্তিকে আক্রমণ করেছিল এবং এই ধারণা প্রচার করেছিল যে 'দীনের' চূড়ান্ত কর্তৃত্ব একা কুরআন নয়। এর সাথে এর একটি উপমা (মেছাল) রয়েছে - রাসূলের হাদীস।

দাবি করা হয়েছে যে, হাদীস হলো কুরআনের ব্যাখ্যা এবং একই সাথে তা হলো একটি গোপন বা অপঠিত ওহী। আরো দাবি করা হয়েছে যে, যদি কুরআন ও হাদীসে পরস্পর বৈপরীত্য দেখা যায়, তাহলে এর একটি দ্বারা অন্যটি রহিত হবে। এক্ষেত্রে দুটি ভিন্নমত চালু করা হয়েছে যে, কুরআন দ্বারা হাদীস রহিত হবে বা হাদীস দ্বারা কুরআন রহিত হবে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, কুরআন দ্বারা হাদীস রহিত হওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে হাদীস দ্বারা কুরআনকে রহিত করা হয় এবং কুরআনের পরিবর্তে হাদীসের তথ্য ও বিধানই প্রতিষ্ঠিত করা হয়। কুরআনকে শুধুমাত্র বাহ্যিক সম্মান দেখানো বা বায়বীয় পুণ্যের জন্য অধিকাংশ সময় চিন্তাভাবনা ছাড়া (না বুঝে) আবৃত্তি করার কিতাবে পরিণত করা হয়েছে। এভাবে কুরআনের আইনগত মর্যাদাকে অবমাননা করা হয়েছে।

রসূল মুসলমানদেরকে তার হাদীসের কোনো সংগ্রহ দেননি। তিনি কেবলমাত্র কুরআন (সম্পূর্ণ এবং যথাযথভাবে সাজানো) দিয়েছেন, যা আজও আমাদের কাছে ঠিক সেভাবেই রয়েছে।

মুসলিম জাতির ইতিহাসে প্রথম চার খলিফা বা অন্য কোনো সাহাবী তাঁর হাদীস সংকলন করেন নি। এমনকি প্রথম দুই খলিফা তাদের সময়কালে তা লেখা ও উদ্ধৃতি দেয়াও নিষিদ্ধ করেছিলেন।

কিন্তু পরবর্তীতে হাদীস সংকলনের মাধ্যমে ইসলামের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্রটি করা হয়। প্রচলিত হাদীসগ্রন্থগুলো রসূলের ওফাতের দুইশ’ বছর পর মূলত মৌখিক বর্ণনাধারার ভিত্তিতে সংকলিত হয়। এটা কোনোরূপ বিচারেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। না ধর্মীয় বিচারে, আর না একাডেমিক বা ঐতিহাসিক বিচারে।
অথচ প্রচলিত হাদীসগ্রন্থগুলোর মধ্যকার কোনো হাদীসকে (বিশেষ করে সুন্নীদের কাছে তারা যে ছয়টি হাদীসকে সিহাহ সিত্তা বলে তার কোনো হাদীসকে এবং অনুরূপভাবে শিয়াদের কাছে তাদের সংকলিত হাদীসগ্রন্থগুলোর কোনো হাদীসকে) প্রত্যাখ্যান করলে তাকে হাদীস অস্বীকারকারী হিসেবে নিন্দা করা হয়। অর্থাৎ নির্বিচারে এসব হাদীসগ্রন্থগুলোর হাদীস স্বীকার করাই বাহবা পাওয়ার উপায়ে পরিণত হয়।

অথচ হাদীসগ্রন্থগুলোর সংকলকদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বুখারী প্রায় ছয় লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করে তার মধ্য থেকে সাত হাজার হাদীসকে সহীহ বা শুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যদিও এটি তাঁর ব্যক্তিগত বিবেচনা, এ বিষয়ে তাঁকে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে কোনো কর্তৃত্ব দেয়া হয় নি। তবুও তাঁর ব্যক্তিগত বিবেচনাকে অন্যরা বিনাপ্রশ্নে মেনে চলতে হবে বলে দাবি করা হয়।

মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর প্রতি সর্বসাধারণ ধর্মাচারীদের যে আবেগের আতিশয্য, যার ফলে তাদের সামনে কোনো পাথর নিয়ে তার উপর রসূল পা পড়েছিলো বললে তারা ঐ পাথরে চুমু দেয়া শুরু করে, এর উপর ভিত্তি করেই হাদীসকে মুসলিম সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছে। আর এভাবে হাদীসের নামে ইসলামবিরোধী ধ্যান-ধারণা ও বিধি-নিষেধকে ধর্মীয় আবরণে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।

কুরআনের প্রচলিত তাফসীরগ্রন্থগুলোও হাদীস দ্বারা প্রভাবিত এবং পূর্ববর্তী তাফসীরের অনুকরণেই পরবর্তী তাফসীর রচিত হয়েছে। কারণ রসূলের নামে যা কিছু হাদীস রচনা করা হয়েছে সেগুলোর সাথে ভিন্নমত পোষণ করাকে পাপ হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু হাদীসটি সত্যি রসূলের কিনা তা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বর্ণনাকারীর প্রতি ভক্তি এবং অন্ধ অনুসরণকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেমন বর্ণনাকারী হিসেবে তাবারী বা বুখারীকে নির্ভরযোগ্য মেনে নেয়া হয়েছে এবং তাঁরা যাদেরকে নির্ভরযোগ্য মনে করেছেন তাদেরকে নির্ভরযোগ্য মেনে নেয়া হয়েছে। কিন্তু স্বয়ং তাবারী বা বুখারীকে কেন নির্ভরযোগ্য হিসেবে মেনে নিতে হবে সেই প্রশ্ন তোলাকে সঙ্গত মনে করা হয় না। এছাড়া তাবারী বা বুখারী যেভাবে সনদ বা রিওয়ায়াত (বর্ণনাধারা) বিশ্লেষণ করাকে হাদীস গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান মনে করেছেন, তাবারী বা বুখারীর পর বর্তমান পর্যন্ত সেভাবে কোনো হাদীস কোন সনদে এসেছে সেটা সন্ধান করা হয় না। এভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হাদীস ও সেই হাদীসভিত্তিক তাফসীর প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে তাক্বদীরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ধারণার প্রচলন করা হয়েছে।

ভাগ্যবাদের উৎস হিসেবে হাদীসের উদাহরণ :

ঈমানের বিষয়বস্তু : ৫টি না ৬টি?

কুরআন একজনের দৃঢ় বিশ্বাসের মূল বিষয়বস্তুসমূহ স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করেছে। দৃঢ় বিশ্বাসের পাঁচটি বিষয়বস্তু হল আল্লাহ, ফেরেশতা, রসূল, কিতাব এবং পরকাল (২:১৭৭)। এগুলোর যেকোনো একটিকে অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যানকারীকে কাফির বলা হয় (৪:১৩৬)। কিন্তু তারপর হাদীসের মাধ্যমে একটি ষষ্ঠ বিষয়বস্তু সংযোজন বা চালু করা হয়েছে - তাকদীর।

ইবনে ওয়াইলমি বর্ণনা করেছেন: 'ইবনে আবি কাব আমার কাছে এসেছিলেন এবং আমি তাকে তাকদীর সম্পর্কে আমার কিছু সন্দেহের কথা বলেছিলাম এবং আমার সন্দেহ দূর করার আশায় তাকে হাদীস বর্ণনা করতে বলেছিলাম। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ যদি মানুষের উপর বিপদ-আপদ পাঠাতেন, তবে তিনি অত্যাচারী হতেন না। তিনি যদি করুণাময় হতেন, তবে তাঁর দানশীলতা নিঃসন্দেহে মানুষের কাজকে ছাড়িয়ে যেত। আপনি যদি উহাদের (পাহাড়ের) সমপরিমাণ স্বর্ণ দান খয়রাত করেন তবে আপনার আমল গ্রহণযোগ্য হবে না যতক্ষণ না আপনি সম্পূর্ণরূপে তাকদীর গ্রহণ করবেন। আপনাকে বুঝতে হবে যে আপনার কাছে যা পৌঁছেছে, তাই হতে হবে; এবং আপনি যা পাননি, তাই হতে হবে. আপনি যদি তাকদীরের এই ধারণার পরিপন্থী কিছু বিশ্বাস করেন তবে আপনি জাহান্নামের আগুনে পুড়বেন! ইবনে ওয়াইলিম আরও বর্ণনা করেছেন: 'ইবনে আবি কা'ব শোনার পর, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের কাছে গিয়েছিলাম যিনি একই কথা বলেছিলেন। অতঃপর আমি হুযাইফা বিন আল ইয়ামানের কাছে গেলাম যিনি একই কথা বললেন। তারপর আমি যায়েদ ইবনে সাবিতের কাছে গেলাম এবং তিনি একইভাবে রাসূলের রেওয়ায়েতটি উদ্ধৃত করলেন। (আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজা)।

তাক্বদীর সম্পর্কে কুরআনে যা আছে (প্রত্যেক জিনিসের জন্য প্রাকৃতিক আইন রয়েছে) তা একটি স্মরণীয় বিষয় মাত্র, তাতে বিশ্বাসের প্রশ্ন তৈরি হয় না, কারণ তা মানুষের একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা।

কিন্তু হাদীসে তাক্বদীরকে বিশ্বাসের বিষয়ে পরিণত করার পাশাপাশি তাক্বদীরের তাৎপর্যকে কলুষিত করে, ভাগ্য দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। তারপর ধর্মগুরুদের সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক কর্তৃত্বচর্চায় ভাগ্যবাদকে প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে তাক্বদীর অস্বীকারকারী এবং এভাবে মুরতাদ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। আর ধর্মগুরুরা হাদীসের নামে এ বিধানও বানিয়েছে যে, মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, যদিও এরূপ শাস্তিবিধানও কুরআনবিরুদ্ধ আইন। সুতরাং ভাগ্যবাদের প্রতিষ্ঠা শুধুমাত্র বিভ্রান্তিকর হাদীসের মাধ্যমেই ঘটে নি, বরং সেজন্য মুসলিম ইতিহাসে রক্তপাতের ঘটনাও ঘটেছে।

তাক্বদীর নিয়ে নবী আদম ও মূসা (আ.) এর বিতর্ক

তাক্বদীর বলতে ভাগ্য বুঝানোর ধারণাটি যেভাবে তৈরি হয়েছে সেক্ষেত্রে হাদীসে বর্ণিত নবী আদম ও মূসার বিতর্ক অন্যতম উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছে। নিম্নে ঘটনাটি উল্লেখ করা হলো :

আদম (আ) এবং মূসা (আ)-এর মধ্যে একটু কথা কাটাকাটি হয়। তখন মূসা (আ) তাকে বলেন, আপনি আমাদের পিতা, আপনি আমাদেরকে হতাশ করে জান্নাত থেকে বের করে এনেছেন?! আদম (আ) মূসা (আ)-কে বললেন, তুমি মূসা! তোমাকে আল্লাহ তার সাথে কথা বলার জন্য নির্বাচন করেছেন। তিনি তোমার জন্য নিজ হাতে তাওরাত লিখে দিয়েছেন। আমাকে সৃষ্টির চল্লিশ বছর পূর্বে আল্লাহ আমার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন, তুমি কি সে বিষয়ে আমাকে ভর্ৎসনা করছো?! নবী (স) বলেন, “আদম (আ) মূসা (আ)-এর উপর বিজয়ী হয়ে গেলেন”।

ভাগ্যবাদ সমর্থনকারী অন্যান্য হাদীস

১। সর্বশক্তিমান আল্লাহ মহাবিশ্ব সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর আগে, যখন তাঁর আরশ পানির উপর ছিলো, সমস্ত প্রাণীর ভাগ্য লিখেছিলেন। (মুসলিম)

২। সবকিছুই ভাগ্যের অধীন, এমনকি জ্ঞান ও মুর্খতা। (মুসলিম)

৩। তোমাদের প্রত্যেকের ভাগ্যে জান্নাত বা জাহান্নাম পূর্বনির্ধারিত। (বুখারী ও মুসলিম)

৪। অবশ্যই কেউ ব্যভিচার করবে, যতটুকু আল্লাহ লিখে রেখেছেন। (বুখারী ও মুসলিম)

৫। আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর ডান হাত দিয়ে তার পিঠে আদর করেছেন এবং তার পিঠ থেকে তার বংশ সৃষ্টি করেছেন, এবং বলেছেন, “আমি তাদেরকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেছি, তাই তারা সে অনুযায়ী আচরণ করবে।” তিনি আবার আদমকে আদর করলেন। ফিরে এসে তার বংশ সৃষ্টি করে বললেন, “আমি তাদেরকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি, তাই তারা সে অনুযায়ী কাজ করবে।” একথা শুনে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাহলে আমল করে লাভ কি?”, উত্তরে রাসুল বললেন, “আল্লাহ যখন কাউকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেন, তখন তাকে সে অনুযায়ী কাজ করানো হয়। একইভাবে, তিনি যখন জাহান্নামের জন্য কাউকে সৃষ্টি করেন, তখন তাকে সেই অনুযায়ী কাজ করানো হয়। অতঃপর তিনি সে অনুযায়ী তাদেরকে জান্নাত বা জাহান্নামে পাঠান।” (মালিক, তিরমিযী, আবু দাউদ)

৬। একবার রাসূল (তাঁর বাড়ি থেকে) দুটি বই নিয়ে বের হলেন। তিনি আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমরা কি এই বইগুলো সম্পর্কে জানো?” আমরা বললাম, “আমরা জানি না, হে আল্লাহর রাসূল!”, তিনি তাঁর ডান হাতে বইটির দিকে ইশারা করে বললেন, “এই বইটি আল্লাহর পক্ষ থেকে। এতে জান্নাতের জন্য নির্ধারিত ব্যক্তিদের নাম রয়েছে। এতে কিছু যোগ করা হবে না, মুছে ফেলা হবে না।” তারপর তিনি বাম হাতে থাকা বইটির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “এই বইটিও আল্লাহর পক্ষ থেকে, এতে জাহান্নামের নিয়তকারীদের নাম রয়েছে। এতে কিছু যোগ করা হবে না বা মুছে ফেলা হবে না।”

৭। আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাদের প্রত্যেকের জন্য পাঁচটি ক্ষেত্রে তাঁর কাজ করেছেন এবং ইতিমধ্যেই শেষ করেছেন, অর্থাৎ সেগুলি তার ভাগ্য হিসাবে লেখা হয়েছে: তার সময় (বয়স), তার ভাল বা খারাপ কাজ, তার আবাসস্থল, তার প্রত্যাবর্তন (জান্নাত বা জাহান্নাম) এবং তার জীবিকা। (আহমদ)

ভাগ্য সম্পর্কিত হাদীসের রক্ষাকবচ হিসেবে হাদীস

ভাগ্য সম্পর্কিত হাদীসগুলোকে প্রশ্ন, আপত্তি ও সমালোচনা থেকে রক্ষা করার জন্যও উপযুক্ত হাদীস তৈরি করা হয়েছে। তার একটি নিম্নরূপ :

আবু হুরায়রা বর্ণনা করেন: ‘আমরা তাকদীরের প্রশ্নে আলোচনা করছিলাম যখন রাসূল (সা) এলেন। আমাদের আলোচনা শুনে মুখ লাল হয়ে গেল – যেন ডালিমের রসে ভরা – এবং বললেন, “তোমাকে যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এটা কি তাই? এটা কি আমার মিশন? অতীতের লোকেরা যখন এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছিল তখন তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমি আপনাকে শপথের অধীনে রেখেছি, এবং আমি এটি আবারও করি, প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা, তর্ক বা কথা বলার জন্য কখনই নয়।" (তিরমিযী)

ভাগ্যবাদ প্রতিষ্ঠার পেছনে শাসকদের ছত্রছায়ায় মোল্লাতন্ত্রের ভূমিকা : কুরআনবিরুদ্ধ ভাগ্যবাদের প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়া

ধর্মীয় স্বার্থান্বেষী মোল্লাতন্ত্র তাক্বদীরের সঠিক ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারে না। দুঃখজনকভাবে তারা চায় না যে তাক্বদীর বলতে ‘প্রাকৃতিক আইন’কে বুঝার উপলব্ধিটি জনপ্রিয় হোক। কারণ এটি মানুষ এবং আল্লাহর মধ্যে তাদের 'মধ্যস্থতাকারী' হওয়ার সুবিধাজনক অবস্থানকে হুমকির মুখে ফেলে। পক্ষান্তরে ‘ভাগ্যবাদ’ তাদেরকে মানুষের উপর কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে দেয়। এ কারণেই তারা স্বৈরাচার ও বংশগত রাজতন্ত্রের ধারণা প্রচার করেছিলো। ‘ভাগ্যবাদ’ অনুসারে রাজাদেরকে পৃথিবীতে আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্যক্রমে শাসনক্ষমতার অধিকারী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়, যারা কোনো নীতিমালা দ্বারা আবদ্ধ নয়, বরং নিতান্ত স্বেচ্ছাচারী হতে পারে। এভাবে গণমানুষের উপর তাদের অন্যায় ব্যবস্থা বা শাসন-শোষণকে দীর্ঘস্থায়ী করার বন্দোবস্ত করা হয়। তাক্বদীরের ভুল ব্যাখ্যার কারণে স্বাধীনচেতা মানুষ ‘ভাগ্যের’ বন্দী হয়ে যায়। মোল্লাতন্ত্র তাদেরকে ধারণা দেয় যে, শাসকরা তাদের উপর যে নিপীড়ন চালায়, তারা যে সামাজিক সমস্যা ও ব্যক্তিগত দুর্দশায় পতিত হয় এর সবকিছুকে ধৈর্য্য ধরে ভাগ্য হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। এভাবে ফেরাউনি শক্তি সবসময় যাদুকর-পাদরিদের সহযোগিতা নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জনবিদ্রোহ রোধ করার সুযোগ নিয়েছে। অথচ কুরআনের ঘোষণা হলো, “তোমাদের উপর যা কিছু বিপর্যয় আসে, তা তোমাদের নিজেদের হাতের অর্জন।” তা একান্ত ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা হোক, বা সম্মিলিত দায়বদ্ধতা হোক। সুতরাং কুরআনের ঘোষিত বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে ভাগ্যের ধারণা একটি ষড়যন্ত্র, আর এ ষড়যন্ত্রের হোতা হচ্ছে যৌথভাবে স্বৈরশাসক ও পুরোহিত সম্প্রদায়। আর এর কারণ হলো মোল্লাতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রের ঠেসমূল হিসেবে কাজ করে আর স্বৈরতন্ত্র মোল্লাতন্ত্রের মাথার ছাদ হিসেবে কাজ করে।

প্রশ্ন হলো, যখন কুরআনবিরুদ্ধ ভাগ্যবাদের ধারণা প্রচার করা হচ্ছিলো তখন মুসলিমদের মধ্যে এর কোনো প্রতিবাদ করা হয়েছিলো কিনা? এর জবাব হলো, অনেকে ভাগ্যবাদকে প্রত্যাখ্যান করে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁরা কুরআনকে দ্বীন ইসলামের একমাত্র চূড়ান্ত কর্তৃত্ব হিসেবে স্বীকার করে এর সঠিক অনুধাবনের জন্য বিবেক-বুদ্ধি ও যুক্তিবোধকে কাজে লাগানোর দাবি করেছিলেন। তাঁরা তুলে ধরেছিলেন যে, মানুষ জড় ও সাধারণ প্রাণীকুলের চেয়ে উচ্চস্তরের জীব, যাদের ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা রয়েছে, আর তাই সে তার কর্মের জন্য দায়ী। তাদেরকে সঠিক কর্মনীতির বিষয়ে সচেতন এবং ইচ্ছাকৃত সমাজ-সংগঠনের মাধ্যমে সুখী-সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল জীবনের পথনির্দেশ প্রদানের জন্য যুগে যুগে নবী-রসূল ও আসমানী কিতাব প্রেরণ করা হয়েছে।
কর্মের দায়বদ্ধতার যৌক্তিক দাবিকে প্রতিহত করার জন্য যারা ভাগ্যবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাদেরকে ‘মুতাযিলা’ ও ‘ক্বাদারিয়্যাহ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এমনভাবে এ শব্দগুলোকে সমাজে পেশ করা হয়েছে যে, কাউকে এ নামে আখ্যায়িত করার মানেই দাঁড়ায় তারা নাস্তিকদের মতোই ধর্মবিরোধী বা ধর্মের নামে বহুল প্রচলিত আক্বীদার বিরোধী। ভাগ্যবাদীরা মানুষকে ফতোয়া দিয়েছে যে, যারাই ক্বাদার বা কর্মের দায়বদ্ধতার কথা বলবে তাদের কথা শুনা যাবে না বা তা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া যাবে না, বরং তাদেরকে পরিত্যাগ করতে হবে। তারা এ ফতোয়া ছড়িয়েছিলো ধর্মের নামে লেবাস পরিধানের মাধ্যমে। সেই সাথে কেউ যেন প্রশ্ন তুলতে না পারে যে, কেন ক্বাদারিয়্যাহ নামে লেবেলকৃত ব্যক্তিদের কথাকে যাচাই করে গ্রহণ করা যাবে না?- সেজন্য তারা হাদীস তৈরি করেছে যেখানে দাবি করা হয়েছে যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ‘ক্বাদারিয়্যাহ’কে মাজুস বা অগ্নিউপাসকদের সমতুল্য আখ্যা দিয়ে গেছেন। অথচ যাদেরকে ‘ক্বাদারিয়্যাহ’ আখ্যা দেয়া হয়, তারা নিজেরা নিজেদেরকে এ নামে আখ্যায়িত করে নি, বরং এটা তাদের প্রতিপক্ষের দেয়া নাম। পরিস্থিতি এত ভয়াবহ হয়েছে যে, কাউকে ‘ক্বাদারিয়্যাহ’ আখ্যায়িত করার মানে দাঁড়ায় তাকে ‘মুরতাদ’ হিসেবে চিহ্নিত করা। আর বানোয়াট হাদীসের মাধ্যমে ‘মুরতাদ’ এর শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধানকে ‘শরিয়া বা শরয়ী আইন’ নামে প্রবর্তন করা হয়েছে, যা একটি কুরআন বিরুদ্ধ আইন।

এমনকি এখন পর্যন্ত যুক্তির কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য ‘মুতাযিলা’ লেবেলটি ব্যবহার করা হয়। যারাই কুরআনকে দ্বীন ইসলামের একমাত্র দলীল হিসেবে বিশ্বাস করেন তাদেরকে ‘আহলে কুরআন’ ও ‘মুতাযিলা’ নামে আখ্যায়িত করা হয় এবং বিরাট সংখ্যক আলেমের ফতোয়ায় তাদেরকে ‘কাফির’ বলে ফতোয়া দেয়া হয়। এভাবে ধর্মের নামে অধর্মের চর্চা করা হয়, ধর্মের লেবাসে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে বাতিল করা হয়, কুসংস্কারকে ধর্মের কথা ও আচার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, গণমানুষের মধ্যে ধর্মান্ধতা, অন্ধ অনুসরণ ও ধর্মীয় উগ্রতা তৈরি করা হয়। মানুষের উপর প্রভুত্ব বিস্তার, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণের উদ্দেশ্যেই ধর্মের নামে ভাগ্যবাদ এবং অন্যান্য কুপ্রথা ও তথাকথিত শরিয়া আইন চালু করা হয়।

ভাগ্যবাদের প্রভাবে আয়াতের বক্তব্য অনুধাবনের ক্ষেত্রে গভীর চিন্তার বিচ্যুতি ও নিষ্ঠাপূর্ণ অধ্যয়নের অভাব :

তাক্বদীর সম্পর্কিত বক্তব্যসমূহের আপাতঃ স্ববিরোধের পর্যালোচনা

পরিশেষে আরেকটি দিক অত্যন্ত বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে। তা হলো, কুরআন অবিকৃত থাকা সত্ত্বেও বানোয়াট হাদীসের মাধ্যমে কিভাবে তাক্বদীরকে তথাকথিত ভাগ্য অর্থে পর্যবসিত করা এবং ভাগ্যবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হলো? কেন ঈমানের দাবিদার ব্যক্তিরা বা কুরআনের যে কোনো পাঠক এ বিষয়টিকে এক বাক্যে পরিহার করতে পারলো না? এর অন্যতম একটি কারণ হলো, ভাগ্যবাদের প্রভাবে ভাগ্যবাদকে মোকাবেলা করে এরূপ আয়াতের বক্তব্য অনুধাবনের ক্ষেত্রে গভীর চিন্তার বিচ্যুতি ঘটেছে। বস্তুত নিষ্ঠাপূর্ণ অধ্যয়নের অভাব তথা ভাসাভাসাভাবে পাঠের ফলে কিছু আয়াতকে ভাগ্যবাদের সমর্থনকারী মনে হতে পারে। আর মোল্লারা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে। এর ফলে তাক্বদীর সম্পর্কিত আয়াতসমূহের মধ্যে আপাতঃ স্ববিরোধ পরিলক্ষিত হয়। অথচ প্রকৃতপক্ষে কুরআনের বক্তব্যসমূহে কোনো স্ববিরোধ নেই। যে আয়াতগুলোকে বাহ্যত ভাগ্যবাদের সমর্থনকারী মনে করা হয়, প্রকৃতপক্ষে তাতে ভাগ্যবাদের সমর্থন নেই, বরং তা প্রাকৃতিক আইনকেই উপস্থাপন করে।
এ সংকলনগ্রন্থের পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে তাক্বদীরের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনায় কুরআনের আয়াতে তাক্বদীর সম্পর্কিত বক্তব্যসমূহের আপাতঃ স্ববিরোধের পর্যালোচনা বা প্রকৃত তথ্য উপস্থাপিত হবে।

>>  পরবর্তী পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য ক্লিক করুন