মালাকগণের প্রতি বিশ্বাস মহাবিশ্বের ব্যবস্থাপনায় আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি ও তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দান করে। এটি আমাদেরকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত থেকে এ বিষয়ে সঠিক বিশ্বাসের সাথে যুক্ত রাখে। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের মাধ্যমে মালায়েকা সম্পর্কে জানা না যায়, ততক্ষণ মালায়েকার প্রতি বিশ্বাসের প্রশ্নও নেই। কিন্তু যখন আল্লাহর কিতাব পৌঁছে যায়, তখন তাতে উল্লেখিত মালায়েকা সম্পর্কিত তথ্যাদিও বিশ্বাসের বিষয়বস্তু হয়ে যায়।
আল্লাহ বিশ্বজগত পরিচালনায় যে পদ্ধতি অবলম্বন করছেন তাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মালায়েকা রোবটের মতো কর্মচারী হিসেবে স্বীয় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে অথচ একই সাথে স্বাধীনভাবে চিন্তা ও মতামত প্রকাশের মতো এবং মানুষের কাজের ভালো মন্দ বুঝে সে অনুযায়ী প্রার্থনা ও অন্যান্য ভূমিকা পালনের মতো বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতাসম্পন্ন এক অতিপ্রাকৃতিক সৃষ্টি। মালায়েকার অস্তিত্ত্ব সত্য কিন্তু মালায়েকা সম্পর্কে কল্পিত চিন্তাদর্শন সত্য নয়, যে কল্পনাপ্রসূত চিন্তাদর্শন থেকে শিরকের উদ্ভব ঘটেছে। তাই মালায়েকার বিষয়ে প্রকৃত তথ্য হিসেবে সেটাই বিশ্বাস অবলম্বন করতে হবে যা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের মাধ্যমে জানানো হয়েছে।
৪৩:১৯ :: আর তারা দয়াময় আল্লাহর বান্দা ফেরেশতাদেরকে নারী হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। তারা কি তাদের সৃষ্টি প্রত্যক্ষ করেছে? তাদের সাক্ষ্য অবশ্যই লিখে রাখা হবে এবং তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
৪০:৭-৮ :: যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা তার চতুর্পাশ্ব ঘিরে আছে তারা তাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসার সাথে এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মু’মিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, “হে আমাদের প্রতিপালক, আপনার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী। অতএব যারা তাওবাহ করে এবং আপনার পথ অবলম্বন করে আপনি তাদের ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা করুন। হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি তাদেরকে দাখিল করুন স্থায়ী জান্নাতে, যার প্রতিশ্রুতি আপনি তাদেরকে দিয়েছেন। এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নি ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরকেও। আপনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
৬৯:১৭ :: আর উহার (আকাশের) বিভিন্ন প্রান্তে ফেরেশতারা থাকবে। এবং সেদিন তোমার প্রভুর আরশ বহন করবে আটজন ফেরেশতা।
৩৯:৭৫ :: আর তুমি ফেরেশতাদেরকে আরশের চারপাশ ঘিরে তাদের প্রভুর প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করতে দেখতে পাবে। আর তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচার করে দেয়া হবে এবং বলা হবে ‘সকল প্রশংসা সৃষ্টিকুলের প্রভু আল্লাহর জন্য’।
২:২১০ :: তারা কি এরই অপেক্ষা করছে যে, মেঘের ছায়ায় আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ তাদের নিকট আগমন করবেন এবং সব বিষয়ের ফয়সালা করে দেয়া হবে। আর আল্লাহর নিকটই সব বিষয় প্রত্যাবর্তিত হবে।
২৫:২৫ :: আর সেদিন মেঘমালাসহ আকাশ বিদীর্ণ হবে এবং ফেরেশতাদেরকে দলে দলে অবতরণ করানো হবে।
৬৬:৬-৭ :: হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে বাঁচাও যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর; যেখানে রয়েছে কড়া ও কঠোর ফেরেশতাগণ, আল্লাহ তাদেরকে যে নির্দেশ দিবেন তারা তার অবাধ্য হবে না। আর তারা তা-ই করবে যা করতে তাদেরকে আদেশ করা হবে।
২১:১৯-২০ :: আকাশ ও পৃথিবীতে যারা আছে তারা তাঁরই। আর তাঁর সান্নিধ্যে যারা আছে তারা অহঙ্কারবশত তাঁর ইবাদাত করা হতে বিমুখ হয় না এবং ক্লান্তিও বোধ করে না। তারা দিন-রাত তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, তারা শৈথিল্য করে না।
৫১:৪ :: শপথ তাদের যারা নির্দেশ অনুসারে কর্মবণ্টন করে।
৩৫:১ :: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা, ফেরেশতাদেরকে রাসূলরূপে / বাণীবাহকরূপে নিযুক্তকারী, যারা দুই দুই, তিন তিন ও চার চার পাখাবিশিষ্ট। তিনি সৃষ্টির মধ্যে যা ইচ্ছা বৃদ্ধি করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান।
২২:৭৫ :: আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য থেকে রসূল মনোনীত করেন এবং মানুষের মধ্য থেকেও (রসূল মনোনীত করেন)। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
৮১:১৯-২১ :: নিশ্চয় তা (কুরআন) সম্মানিত রসূলের (জিবরীল ফেরেশতার) বলে যাওয়া বাণী। সে (জিবরীল ফেরেশতা) শক্তিশালী, আরশ অধিপতির (আল্লাহর) কাছে মর্যাদাপ্রাপ্ত। সেখানে (অন্যান্য ফেরেশতাদের কর্তৃক) তার আনুগত্য করা হয়। তারপর সে বিশ্বস্তও বটে।
৩৮:৬৭-৭২ :: বলো, উহা এক মহাসংবাদ। যা থেকে তোমরা বিমুখ (উদাসীন) হয়ে আছো। উর্ধ্বলোকে তাদের পারস্পরিক বাদানুবাদ সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞান ছিল না। আমার কাছে আসেনি এছাড়া যে, বস্তুত আমি স্পষ্ট সতর্ককারী। যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদেরকে বলেছিলেন যে, নিশ্চয় আমি মাটি থেকে মানুষ সৃজনকারী (সৃজন করতে যাচ্ছি)। তারপর যখন আমি তাকে সুবিন্যস্ত করবো এবং তার মধ্যে আমার রুহ থেকে ফুঁকে দিবো, তখন তোমরা তার প্রসঙ্গে সাজদাহ করবে।
১৩:১০-১১ :: তোমাদের মধ্যে যে কথা গোপন রাখে বা যে তা প্রকাশ করে, রাতে যে আত্মগোপন করে এবং দিনে যে প্রকাশ্যে বিচরণ করে, তারা সবাই আল্লাহ্র নিকট সমান। তার জন্য (মানুষের জন্য) রয়েছে, সামনে ও পেছনে, একের পর এক আগমনকারী প্রহরী, যারা আল্লাহর নির্দেশে তাকে হেফাযত করে। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো কওমের অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদেরকে পরিবর্তন করে। আর যখন আল্লাহ কোনো জাতির অকল্যাণ (শাস্তি) চান, তখন তা প্রতিহত করা যায় না এবং তাদের জন্য তিনি ছাড়া কোনো অভিভাবক নেই।
৮০:১০-১২ :: আর নিশ্চয় তোমাদের উপর নিযুক্ত রয়েছে (কর্মবিবরণীর) সংরক্ষকগণ। তারা সম্মানিত লেখকবৃন্দ। তোমরা যাই করো তারা তা জানে।
৫০:১৭--১৮ :: আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি, আর তার নফস তাকে যা মন্ত্রণা দেয় তাও আমি জানি। আমি তার গলার শিরা থেকেও নিকটবর্তী। যখন তার ডানে ও বামে বসা দুজন তথ্য গ্রহণকারী (ফেরেশতা কর্মবিবরণী লিপিবদ্ধ করার জন্য) গ্রহণ করে। সে কোনো কথাই উচ্চারণ করে না, তার নিকট কোনো সদাপ্রস্তুত পর্যবেক্ষক থাকা ছাড়া (অর্থাৎ তার প্রতিটি কথাই লিপিবদ্ধ হচ্ছে)।
২:১০২ :: আর তারা অনুসরণ করেছে, যা শয়তানরা সুলাইমানের রাজত্বে পাঠ করতো। আর সুলাইমান কুফর করেনি; বরং শয়তানরা কুফর করেছে। তারা মানুষকে যাদু শেখাতো এবং (তারা অনুসরণ করেছে) যা নাযিল করা হয়েছিল বাবেলের দুই ফেরেশতা হারূত ও মারূতের উপর। আর তারা কাউকে শেখাতো না যে পর্যন্ত না বলতো যে, ‘আমরা তো পরীক্ষা, সুতরাং তোমরা কুফর করো না’। এরপরও তারা তাদের কাছ থেকে শিখতো, যার মাধ্যমে তারা পুরুষ ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতো। অথচ তারা তার মাধ্যমে কারো কোনো ক্ষতি করতে পারতো না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। আর তারা শিখতো যা তাদের ক্ষতি করতো, তাদের উপকার করতো না এবং তারা অবশ্যই জানতো যে, যে ব্যক্তি তা ক্রয় করবে, আখিরাতে তার কোনো অংশ থাকবে না। আর তা নিশ্চিতরূপে কতই-না মন্দ, যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে। যদি তারা জানতো!
২:২৪৮ :: আর, তাদের নবী তাদেরকে বলেছিলেন, তার রাজত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের নিকট সেই সিন্ধুক আসবে যাতে তোমাদের প্রভুর পক্ষ হতে প্রশান্তি এবং মুসা ও হারুন বংশীয়গণ যা পরিত্যাগ করেছে তার অবশিষ্টাংশ থাকবে; ফেরেশতাগণ তা বহন করছে। তোমরা যদি মুমিন হও তবে নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে।’
৬:৬১ :: তিনি তাঁর বান্দাহদের উপর পূর্ণ কর্তৃত্বশীল, আর তিনি তোমাদের উপর রক্ষক নিযুক্ত করেন। অতঃপর তোমাদের কারো মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে আমার প্রেরিতগণ (ফেরেশতারা) তার মৃত্যু ঘটায়। নিজেদের কর্তব্য পালনে তারা বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে না।
৩২:১১ :: বলো, তোমাদের জন্য নিযুক্ত ‘মালাকুল মাওত’ (মৃত্যুর ফেরেশতা) তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। অবশেষে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যানীত হবে।
৫৩:২৬ :: আকাশে কত ফিরিশতা রয়েছে তাদের কোনো সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না যতক্ষণ না আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অনুমতি না দেন।
২১:২৬-২৯ :: তারা বলে, দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি পবিত্র, মহান। তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। তারা আগে বেড়ে কথা বলে না। তারা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে। তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত। তিনি যাদের প্রতি সন্তুষ্ট তাদের ছাড়া আর কারো জন্য তারা সুপারিশ করে না এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। তাদের মধ্যে যে বলবে ‘আমি ইলাহ, আল্লাহ ছাড়াও’, তাকে আমি প্রতিফল দিবো জাহান্নাম, এভাবেই আমি জালিমদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি।
৩:১৮ :: আল্লাহ্ সাক্ষ্য দেন যে, নিশ্চয় তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ্ নেই। আর ফেরেশতাগণ এবং জ্ঞানীগণও (এ সাক্ষ্য দেয়)। তিনি ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।
আলোচনা: উপরে উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে জানা যায় যে, ফেরেশতারা আল্লাহর দাসত্বকারী, তারা বিশ্বসাম্রাজ্যে আল্লাহর কর্মচারী। তারা আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা জ্ঞাপন করে এবং কখনো আল্লাহর আদেশের লংঘন করে না। ফেরেশতাদের সৃষ্টির মূল উপাদান এবং তাদের লিঙ্গ সম্পর্কে আমাদের কল্পনাভিত্তিক কোনো কথা বলার অবকাশ নেই। ফেরেশতারা স্বাধীনভাবে কোনো কাজ করার ক্ষমতা রাখে না। তারা আল্লাহর জানিয়ে দেয়া নিয়মেই তাঁর আদেশমতো সকল কাজ করে থাকে। তবে ফেরেশতাদের বুদ্ধিমত্তা রয়েছে এবং যখন তাদেরকে কোনো বিষয়ে মত প্রকাশের সুযোগ দেয়া হয় তখন তারা তা নিয়ে মত প্রকাশের জন্য পারস্পরিক বাদানুবাদ করা এবং নিজেদের বুদ্ধিমত্তা অনুসারে নিজেদের মত বা খটকার কথা প্রকাশের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ফেরেশতারা আল্লাহর অবাধ্যতা ও অহংকার করে না, এটাকে তাদের গুণবৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে। ফেরেশতারা আল্লাহর অনুমতিক্রমে ছাড়া এবং আল্লাহর পছন্দনীয় ব্যক্তিদের জন্য ছাড়া কোনো শাফায়াত বা সুপারিশ করে না। ফেরেশতাদের জন্যও এ নীতি প্রযোজ্য যে, তাদের মধ্য থেকে কেউ নিজেকে ইলাহ দাবি করলে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। অবশ্য তারা এক আল্লাহর সাক্ষ্য দেয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে, যা থেকে বুঝা যায়, বস্তুত ফেরেশতাদের মধ্য থেকে কেউ নিজেকে ইলাহ দাবি করার কথা নয়, কিন্তু এ সম্পর্কিত ধারাটি আল্লাহর শাস্তিনীতি সম্পর্কে স্পষ্টতার জন্য নির্ধারিত।
কিতাব শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘লিখিত জিনিস’। কিন্তু প্রায়োগিকভাবে শব্দটি শুধুমাত্র ‘লিখিত জিনিস’ অর্থে ব্যবহৃত হয় না। বরং কিতাব শব্দটি বহু অর্থবোধক শব্দ। কুরআনে ‘কিতাব’ শব্দটি দ্বারা বিভিন্ন বিষয়কে বুঝানো হয়েছে। যেমন:
১. মানুষের হিদায়াত বা পথনির্দেশের জন্য আল্লাহর নাজিলকৃত তথ্য ও বিধি-বিধান সম্বলিত গ্রন্থ, যা লিখিত আকারেও নাযিল হতে পারে আবার নাযিলের পরও লিখিত হতে পারে। (৪:১৩৬, ৬:৭, ৮০:১১-১৬)
২. আল্লাহর নির্ধারিত বিধান (২:২৩৫, ৪:২৪, ৪:১০৩, ৮:৬৮)
৩. প্রাকৃতিক নিয়মের কিতাব (৩:১৪৫, ৭:৩৭, ৬:৫৯, ১০:৬১, ১১:৬, ২২:৭০, ২৭:৭৫, ৩০:৫২, ৩৪:৩, ৩৫:১১, ৫৭:২২)
৪. সৃষ্টির প্রথম থেকে চলে আসা কিতাব (৯:৩৬, ১০:৩৮)
৫. উম্মুল কিতাব বা যে কিতাব থেকে প্রতি যুগের জন্য নির্ধারিত কিতাব এসেছে (১৩:৩৮-৩৯, ৪৩:৪)
৬. প্রত্যেকের পরিস্থিতিগত বিবরণ ও আমলনামা (২০:৫২, ২৩:৬২, ৪৫:২৮-২৯, ১৭:১৩-১৪, ১৮:৪৯, ৩৯:৬৯, ৬৯:১৯, ৬৯:২৫, ৭৮:২৯, ৮৩:৭, ৮৩:৯, ৮৩:১৮, ৮৩:২০, ৮৪:৭, ৮৪:১০)
৭. চুক্তিপত্র (২৪:৩৩)
৮. চিঠি (২৭:২৮-৩০)
কিতাবের প্রতি ঈমান বলতে মানুষের হিদায়াতের জন্য নবী-রসূলদের কাছে নাজিলকৃত কিতাব বা বিধানের প্রতি ঈমানকে বুঝায়।
কুরআন থেকে জানা যায় যে, মহান আল্লাহ মানবজাতির মতভেদের বিষয়ে সঠিক তথ্য জানিয়ে দেয়ার জন্য, হিদায়াত বা পথনির্দেশের জন্য, মানদণ্ড হিসেবে প্রয়োগের জন্য এবং স্রষ্টার পক্ষ থেকে নিশ্চিত তথ্য ও বিধান হিসেবে যুগে যুগে তাঁর মনোনীত নবী-রসূলদের কাছে কিতাব নাযিল করেছেন।
মানুষের বিবেকের মধ্যে সত্যকে অনুধাবনের ও গ্রহণের মতো মনস্তাত্বিক যোগ্যতা রয়েছে। মানুষের সামনে জ্ঞানের যেসব উপায় রয়েছে তা হলো- বিবেকবুদ্ধি, বৈজ্ঞানিক (বস্তুগত) প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্ত-অনুসিদ্ধান্ত এবং দার্শনিক (অবস্তুগত/ভাবগত) যুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত-অনুসিদ্ধান্ত। তবে সকল বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে নিজে থেকে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব নয়, বিশেষ করে অদৃশ্য বিষয়ে তা অনেক কঠিন। মানুষের বিবেক বিভিন্ন দুর্বলতা (জ্ঞানগত, প্রবৃত্তিগত, অন্যের প্রভাবগত) দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিবেকবুদ্ধি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে চলতে হয়। বিবেকবুদ্ধি দিয়ে সকল ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা সহজ নয় এবং কিছু ক্ষেত্রে স্থায়ী বিধান না হলে ন্যায়বিচার লংঘিত হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে স্থায়ী বিধান তার ভারসাম্যপূর্ণ স্থিতিশীলতা অর্জনে সহায়ক হয়। এসব কারণে কিতাবের মাধ্যমে বিবেকবুদ্ধিকে উৎকর্ষিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং বিবেকের নিকট বিশেষ দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা হয়েছে।
মানুষ বিবেক অনুযায়ী চলার পেছনে প্রধানত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত এটা মানব প্রকৃতির অংশ যে, তাকে বিবেক দেয়ার কারণে সে যুক্তিশীল ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ করে। দ্বিতীয়ত এটা তার দায়িত্ব যে, তার বিবেক তাকে যে দিকনির্দেশ করে সে সেটাকে অনুসরণ করবে। কিন্তু মূলগতভাবে মানুষ নিজে যেমন নিজের সৃষ্টিকর্তা নয়, তেমনি সে নিজের বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার বা বিধান রচনারও প্রকৃত ও পরম অধিকারী নয়। এছাড়া তার পক্ষে ভুল করা, ভুলে যাওয়া এবং বিবেক অবদমিত হওয়ার কারণে বিবেকহীন আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়া সম্ভব। সে নিজে থেকে কোনো বিষয় জানে না, তাকে অভিজ্ঞতা ও চিন্তাভাবনার মাধ্যমে জানতে হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে সে তার প্রকৃত কল্যাণকর উপায় সম্পর্কে জানে না এবং যা কল্যাণকর নয় সেটাকে কল্যাণকর ভেবে বসে। এই সকল কারণে কিতাব নাযিল করা অপরিহার্য ছিলো, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর স্বয়ং অধিকারের ভিত্তিতে, বিধান প্রণয়নের নিরঙ্কুশ অধিকারের ভিত্তিতে পথনির্দেশ করেছেন। তাই মানুষ যখন স্বাধীনভাবে তার জীবনপদ্ধতির জন্য কোনো ব্যবস্থাকে গ্রহণ করার মতো বয়সে বা অবস্থানে পৌঁছে তখন তার কর্তব্য হলো স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ করে সে আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব বা জীবনব্যবস্থাকে গ্রহণ করে নেবে। কিন্তু যদি সে তা গ্রহণ না করে সেই স্বাধীনতাও তার আছে কিন্তু সেটা পৃথিবীর জীবন পরীক্ষার কাল হওয়ার কারণে তাকে যে বিচারদিবসপূর্ব অবকাশমূলক স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে সেরূপ স্বাধীনতা। এটা এমন স্বাধীনতা নয়, যার প্রয়োগ সম্পর্কে তাকে বিচার দিবসে জবাবদিহি করতে হবে না।
অতীন্দ্রিয় সত্য (গায়ব) সম্পর্কিত যেসব বিষয়ের জ্ঞান যা মানবজীবনের কর্মনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিতাব ছাড়া শুধুমাত্র বিবেক দিয়ে সেসব বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হতো না। তাই কিতাবের প্রতি ঈমানের গুরুত্ব অপরিসীম। কিতাবের মাধ্যমে আল্লাহর জানিয়ে দেয়া তথ্য ছাড়া মানুষের পক্ষে শুধুমাত্র বিবেকবোধ বা নৈতিকতা দ্বারা তার জীবনব্যবস্থার কোনো চূড়ান্ত ভিত্তি ও প্রকৃতি নির্ধারণ করার সর্বোচ্চ ও শাশ্বত মানের উপায় নেই। উদাহরণস্বরূপ নিম্নোক্ত বিভিন্ন দিক থেকে বিষয়টিকে যাচাই করা যেতে পারে।
মানুষ মানুষের গোশত খাবে না কিন্তু সে কিছু পশু-পাখির গোশত খেতে পারবে, এই মানবাধিকার এবং পশু-পাখির উপর মানুষের অধিকার নির্ধারণ করে দেয়ার প্রকৃত কর্তৃত্ব কার?
কেউ তার নিজ বোনকে বিয়ে করতে পারবে না, এ বিষয়টি ওহীর ভিত্তি ছাড়া কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে এবং সবাইকে একই সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে আহবান করা হবে? এমনকি বিয়ে না করে ব্যভিচার করা যে সামাজিক অপরাধ এই অপরাধতত্ত্বের ভিত্তিকে কিভাবে সুসংহত করা হবে?
বস্তুত আল্লাহর সিদ্ধান্তই হালাল হারামের এবং যাবতীয় অধিকারের উৎস। যে বিষয় আল্লাহ তাঁর নাযিলকৃত ওহী বা কিতাবের মধ্যে হারাম করেননি তা হালাল। যে বিষয়ে তিনি কোনো বিধিনিষেধ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন সেটাই মূল বিধান, যার সীমারেখা লংঘন না করে মানুষ সমসাময়িক পরিস্থিতিগত প্রয়োজনে পরিবর্তনশীল বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার অধিকার রাখে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ মানুষকে যে বিবেকবুদ্ধি দিয়েছেন তার সত্যায়ন এবং বিবেকবোধ দ্বারা জানতে পারা যেসব বিষয়কে স্থায়ী মূল বিধানের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে সেগুলো পুনরুল্লেখসহ প্রয়োজনীয় বিধিবিধান দিয়ে কিতাব নাযিল করেছেন। যে বিষয়ে কিতাবের মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি তাতে বিবেকের সিদ্ধান্তকেই গ্রহণযোগ্য এবং পরিস্থিতি সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল হিসেবে সাব্যস্ত করা হবে।
যেসব বিষয়ে অনেক বিকল্প হতে পারতো (উত্তরাধিকারের বণ্টন, জেনাকারীর শাস্তি) সে বিষয়ে মানুষকে পরামর্শের উপর ছেড়ে দিলে সে একই সিদ্ধান্তে আসা কঠিন ছিলো এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সিদ্ধান্তে আসতে পারতো, তা হয়তো আল্লাহ যা জানিয়ে দিয়েছেন সেরূপ নাও হতে পারতো। তাই যেসব বিষয়ে কিতাবের মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে সেসব বিষয়ে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা কোনো মু’মিনের নেই, যদি সে মু’মিন থাকতে চায়।
কিতাবের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া কোনো বিষয়ে কারো স্বীয় যুক্তিবিদ্যার ফলাফল ভিন্নরূপ হলে সে কিতাবের প্রতি ঈমান প্রত্যাহার করতে পারে অথবা কিতাবের স্পষ্ট তথ্যের যৌক্তিকতার প্রতি বিশ্বাস অব্যাহত রেখে সেই যৌক্তিকতা উপলব্ধির চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কিতাবের কোনো তথ্যকে যৌক্তিক এবং কোনো তথ্যকে অযৌক্তিক সাব্যস্ত করার অর্থ হলো তাকে আল্লাহর কিতাব হিসেবে নাজিলকৃত বা সংরক্ষিত বলে বিশ্বাস না করা। বস্তুত আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তি বুঝতে পারি বা না পারি উভয় অবস্থায় স্রষ্টা সবকিছু যৌক্তিকভাবে সৃষ্টি করেছেন, অনুরূপভাবে তাঁর নাযিলকৃত কিতাবের সকল তথ্য ও বিধিবিধান যৌক্তিক, আমরা সব ক্ষেত্রে সে যুক্তি বুঝতে পারা সম্ভব নাও হতে পারে।
ঈমানের দাবি হলো, কুরআনে যে বিষয়ে কিছু নির্দিষ্ট করা হয়েছে (উত্তরাধিকার, জেনার শাস্তি) তার ব্যতিক্রম (যেমন ৯৯ বা ১০১ বেত্রাঘাত) করা যাবে না। এক্ষেত্রে যদি আল্লাহ নির্দিষ্ট না করতেন তাহলে বিবেক দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতো এবং সেক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধানে তা পরিবর্তিতও হতে পারতো। কিন্তু যেহেতু বিধান দেয়া হয়েছে সেহেতু এটাই মানতে হবে তাঁর বাধ্য হিসেবে এবং এটাই কল্যাণকর, কারণ আল্লাহ নিখুঁত জ্ঞানে তা নির্ধারণ করেছেন। এরূপ বিধান নির্ধারণ করে দেয়া আল্লাহর অনুগ্রহ এবং একবার তিনি বিধান নির্ধারণ করে দেয়ার পর তা মানা বাধ্যতামূলক।
যদি আল্লাহ শুধুমাত্র বিবেকের উপর মানুষকে ছেড়ে দিতেন তাহলে শুধুমাত্র বিবেক দ্বারা মানুষের বিচার হতো। মানুষকে হিদায়াত দেয়ার বিষয়ে আল্লাহ নিজের উপর যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন সেটা তাঁর অনুগ্রহ এবং তিনি মানুষকে যে হিদায়াত দান করেছেন তা অনুসরণ করা না করার ভিত্তিতেই তার বিচার হবে।
ইসলাম গ্রহণের প্রশ্নের বাহিরে সাধারণ পর্যায়ে বিবেক অনুসারে যে মানবাধিকার ও বিভিন্ন সদ্গুণাবলির প্রসঙ্গ এবং এসব বিষয়ে দীন ইসলামের যে বক্তব্য তার মধ্যে যেমন Common দিক রয়েছে, তেমনি Uncommon দিকও রয়েছে। কারণ এর প্রথমটির ভিত্তি হচ্ছে শুধুমাত্র বিবেক এবং দ্বিতীয়টির ভিত্তি হচ্ছে বিবেক ও আল্লাহর প্রত্যয়ন ও নির্দেশ- নির্দেশনা। তাই প্রথমটির চেয়ে দ্বিতীয়টির ভিত্তি অধিক স্থিতিশীল। উভয় ভিত্তির তারতম্যের কারণে এসবের স্বরূপেও কিছু পার্থক্য থাকে, যা সাধারণ বিশ্ববীক্ষা (World view) এবং ঈমানের ভিত্তিতে বিশ্ববীক্ষার (World view) পার্থক্যের সাথে সম্পর্কিত।
২:১৩৬ :: তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা নাযিল করা হয়েছে আমাদের উপর ও যা নাযিল করা হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানদের উপর আর যা প্রদান করা হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা প্রদান করা হয়েছে তাদের রবের পক্ষ হতে (অন্যান্য) নবীগণকে। আমরা তাঁদের কারো মধ্যে পার্থক্য করি না। আর আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী’।
আলোচনা: সকল কিতাবের (ঐশী বিধানের) প্রতি ঈমান রাখতে হবে। সকল কিতাবের নাম ও বিষয়বস্তু আমাদের জানা নেই। সুতরাং সকল কিতাবের প্রতি ঈমানের তাৎপর্য হলো যুগে যুগে আল্লাহ যে সকল নবী-রসূল মনোনীত করে তাঁদের নিকট কিতাব নাযিল করেছেন আমরা বিশ্বাস করি যে, সেই সকল কিতাব বা বিধানই আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্যসহ অবতীর্ণ হয়েছে। এর মধ্য থেকে কোনো কিতাবের নাম এবং তা যে রসূলের উপর নাযিল হয়েছে তা জানতে পারলে আমরা সেই তথ্যেও ঈমান রাখবো। আর কোনো কিতাব আমাদের কাছে পৌঁছলে আমরা ঐ কিতাবের বক্তব্য বিষয় বিশ্বাস ও অনুসরণ করবো।
২:১১৩ :: ইহুদীরা বলে ‘খৃষ্টানদের কোনো ভিত্তি নেই’। এবং খৃষ্টানগণ বলে, ‘ইয়াহুদীদের কোনো ভিত্তি নেই’। অথচ তারা কিতাব পাঠ করে। এভাবে যারা কিছুই জানে না তারাও অনুরূপ কথা বলে। সুতরাং যে বিষয়ে তাদের মতভেদ আছে, কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তার মীমাংসা করে দিবেন।
৭:১৬৯ :: অতঃপর তাদের পরে স্থলাভিষিক্ত হয়েছে এমন বংশধর যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছে, তারা এ নগণ্য (দুনিয়ার) সামগ্রী গ্রহণ করে এবং বলে, ‘শীঘ্রই আমাদের ক্ষমা করে দেয়া হবে’। বস্তুত যদি তার অনুরূপ সামগ্রী (আবারও) তাদের নিকট আসে তবে তারা তা গ্রহণ করবে। তাদের কাছ থেকে কি কিতাবের অঙ্গীকার নেয়া হয়নি যে, তারা আল্লাহর ব্যাপারে সত্য ছাড়া বলবে না? আর তারা এতে যা আছে, তা পাঠ করেছে এবং আখিরাতের আবাস তাদের জন্য উত্তম, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে। তোমরা কি বুঝ না?
১০:৯৪ :: সুতরাং আমি তোমার নিকট যা নাযিল করেছি, তা নিয়ে তুমি যদি সন্দেহে থাক, তাহলে যারা তোমার পূর্ব থেকেই কিতাব পাঠ করছে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর। অবশ্যই তোমার নিকট তোমার রবের পক্ষ থেকে সত্য এসেছে। সুতরাং তুমি সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
৫:৪৩ :: তারা কিভাবে তোমার উপর বিচারভার ন্যস্ত করবে যখন তাদের নিকট রয়েছে তাওরাত, যার মধ্যে আল্লাহর আদেশ বিদ্যমান? তারপরও তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তারা মু’মিন নয়।
৩:৯৩ :: তাওরাত অবতীর্ণ হওয়ার আগে ইসরাঈল নিজের জন্য যা হারাম করেছিলেন তা ব্যতীত বানী ইসরাইলের জন্য যাবতীয় খাদ্যই হালাল ছিলো। বলো, ‘যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে তাওরাত আনো এবং পাঠ করো’।
৫:৪৭ :: আহলে ইনজীল যেন আল্লাহ তাতে যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে বিচার করে। আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিচার করে না তারা ফাসিক (নীতিভ্রষ্ট, অবাধ্য)।
৫:৬৮ :: বল, ‘হে কিতাবীরা, তোমরা কোন ভিত্তির উপর নেই, যতক্ষণ না তোমরা তাওরাত, ইনজীল ও তোমাদের নিকট তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা কায়েম কর’। আর তোমার নিকট তোমার রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা তাদের অনেকের অবাধ্যতা ও কুফর বৃদ্ধি করবে। সুতরাং তুমি কাফির কওমের উপর হতাশ হয়ো না।
৫:১৩-১৫ :: সুতরাং তারা তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে আমি তাদেরকে লা‘নত দিয়েছি এবং তাদের অন্তরসমূহকে করেছি কঠোর। তারা শব্দগুলোকে আপন স্থান থেকে বিকৃত করে এবং তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছে, তার একটি অংশ তারা ভুলে গিয়েছে এবং তুমি তাদের থেকে খিয়ানত সম্পর্কে অবগত হতে থাকবে, তাদের অল্প সংখ্যক ছাড়া। সুতরাং তুমি তাদেরকে মার্জনা করো এবং এড়িয়ে যাও। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন। আর যারা বলে, ‘আমরা নাসারা’, আমি তাদের থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম। অতঃপর তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল, তারা তার একটি অংশ ভুলে গিয়েছে। ফলে আমি তাদের মধ্যে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত শত্রুতা ও ঘৃণা উসকে দিয়েছি এবং তারা যা করত সে সম্পর্কে অচিরেই আল্লাহ তাদেরকে অবহিত করবেন। হে কিতাবীগণ, তোমাদের নিকট আমার রাসূল এসেছে, কিতাব থেকে যা তোমরা গোপন করতে, তার অনেক কিছু তোমাদের নিকট সে প্রকাশ করছে এবং অনেক কিছু ছেড়ে দিয়েছে। অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে।
২:৭৫ :: তোমরা কি এ আশা করো যে, তারা তোমাদের কথায় ঈমান আনবে? অথচ তাদের একদল আল্লাহ্র বাণী শ্রবণ করে, তারপর তারা তা অনুধাবন করার পর বিকৃত করে, অথচ তারা জানে।
৩:৭৮-৭৯ :: তাদের মধ্যে একদল লোক আছেই যারা কিতাবকে জিহবা দ্বারা বিকৃত করে, যাতে তোমরা তাকে আল্লাহর কিতাবের অংশ মনে কর; কিন্তু তা কিতাবের অংশ নয়, এবং তারা বলে: ‘তা আল্লাহর পক্ষ থেকে’। কিন্তু তা আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত নয়। তারা জেনে বুঝে আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা বলে। কোনো মানুষের পক্ষে সঙ্গত নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমাত ও নবুওয়াত দান করার পর সে মানুষকে বলবে, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদাতকারী হওয়ার পরিবর্তে আমার ইবাদাতকারী (দাসত্ব ও উপাসনাকারী) হয়ে যাও। কিন্তু (তার কথা তো হবে), “তোমরা রব্বানী (রবের বিধান দ্বারা কর্মসম্পাদনকারী) হয়ে যাও, কিতাব শিক্ষাদানের এবং সেটার অধ্যয়নের মাধ্যমে।”
২:৭৯ :: সুতরাং তাদের জন্য দুর্ভোগ যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে তারপর বলে ‘এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে’, যাতে তারা তুচ্ছমূল্য ক্রয় করতে পারে। সুতরাং তাদের হাত যা লিখেছে তার জন্য তাদের দুর্ভোগ এবং তারা যা উপার্জন করেছে তার জন্য তাদের দুর্ভোগ।
আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে বুঝা যায় যে, যদিও কুরআন নাযিলের সমকালের তাওরাত ইনজীলের মধ্যে আল্লাহর নাযিলকৃত মূল শিক্ষা বিদ্যমান ছিলো তা সত্ত্বেও ঐ গ্রন্থগুলো সম্পূর্ণ ও অবিকৃত ছিল না। বরং আহলে কিতাব তাদের কাছে নাযিলকৃত কিতাবের কিছু অংশ হারিয়ে ফেলেছে ও ভুলে গেছে এবং বাকি অংশ থেকেও কিছু প্রকাশ করতো এবং কিছু গোপন রাখতো। আবার তারা যা প্রকাশ করতো তা পাঠ করার ক্ষেত্রেও কিছু ক্ষেত্রে জিহবা কুঞ্চিত করে এমন বিকৃতভাবে পাঠ করতো যে শব্দগুলো স্বস্থানে ঠিক থাকা সত্ত্বেও পাঠের মধ্যে বিকৃত হয়ে যেতো। এছাড়াও যা কিতাবের অংশ নয় এমন কিছু কথা তারা কিতাব পাঠের মধ্যে জুড়ে দিতো যার ফলে তাকেও কিতাবের অংশ মনে হয়। এমন কি তারা নিজের থেকে কিছু লিখে সেটাকেও আল্লাহর পক্ষ থেকে বলে চালিয়ে দিতো। কিন্তু এত কিছুর পরও তাতে আল্লাহর নাযিলকৃত কিছু অংশ বিদ্যমান রয়ে গিয়েছিলো যা কুরআনের সাথে সঙ্গতিশীল।
৫:৪৮ :: আর আমি তোমার উপর সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি, তার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবসমূহের সমর্থক (Confirmer) ও পর্যবেক্ষক-নিয়ন্ত্রক (Watcher) রূপে। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরীআত (মৌলিক বিধি) ও মিনহাজ (উন্মুক্ত পন্থা) এবং আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে (জবরদস্তিমূলকভাবে) তোমাদেরকে এক উম্মত বানাতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। সুতরাং তোমরা উত্তম-কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহরই দিকে তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন, যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে।
আলোচনা: কুরআনকেই পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের মধ্য থেকে আল্লাহর নাযিলকৃত সত্যের ধারক হিসেবে যেসব আয়াত বা শিক্ষা বিদ্যমান রয়েছে এবং অন্যদিকে যা কিছু পূর্ববর্তী কিতাবের নামে মানবীয় সংযোজন অথবা মানবীয় সংযোজনের সম্ভাবনাযুক্ত অথবা পূর্ববর্তী কিতাবের আয়াত হলেও তা রহিত এসব কিছু নির্ণয় করার ক্ষেত্রে প্রত্যয়নকারী ও পর্যবেক্ষক-নিয়ন্ত্রক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং পূর্ববর্তী কিতাবের মানবীয় সংস্করণ হিসেবে বর্তমানে ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্ট বাইবেল নামে যা ইয়াহুদ নাসারা ধারণ করে আছে কুরআনের সাথে সঙ্গতিশীল বিষয়গুলোতে তার অধ্যয়নের মাধ্যমে মু’মিনদের ও আহলে কিতাবের মধ্যে যা সমান তার উপর ভিত্তি করে তাদের নিকট ইসলামের আহবান জানাতে হবে।
২:১০৬ :: আমরা যে আয়াতই রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই সে জায়গায় তার চেয়ে ভালো অথবা তার অনুরূপ (আয়াত) নিয়ে আসি। তুমি কি জানো না যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান?
১৬:১০১ :: আর যখন আমি একটি আয়াতের স্থানে বদলস্বরূপ অন্য একটি নিয়ে আসি এবং আল্লাহ সর্বাধিক জ্ঞান রাখেন অবতীর্ণ করা বিষয় সম্পর্কে, (তখন) তারা বলে, তুমি তো কেবল মিথ্যা উদ্ভাবনকারী; কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।
১৩:৩৮-৩৯ :: আর আমি তোমার পূর্বে অনেক রসূলকে প্রেরণ করেছি। আর আমি তাদেরকে স্ত্রী ও সন্তানাদি দিয়েছি। কোনো রসূলের পক্ষে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো নিদর্শন নিয়ে আসা সম্ভব নয়। প্রত্যেক যুগের (নির্দিষ্ট সময়কাল) জন্য একটি কিতাব বরাদ্দ। আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা মুছে দেন এবং যা ইচ্ছা করেন তা প্রতিষ্ঠিত রাখেন; আর তাঁরই নিকট (লাওহে মাহফুজে) আছে উম্মুল কিতাব।
১৯:৫৮ :: উহারাই তারা যাদেরকে আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, যারা নবীদের অন্তর্ভুক্ত এবং যারা আদমের এবং যাদেরকে আমি নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম তাদের বংশদ্ভুত এবং ইবরাহীম ও ইসরাঈলের বংশদ্ভুত এবং যাদেরকে আমি পথ নির্দেশ করেছিলাম ও মনোনীত করেছিলাম তাদের অন্তর্ভুক্ত; তাদের নিকট দয়াময়ের আয়াত আবৃত্তি করা হলে তারা সাজদাহরত ও ক্রন্দনরত অবস্থায় পড়ে যেতো।
আলোচনা: এ আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, কুরআনের পূর্বের কিতাবের আয়াতকেও আয়াত বলা হয়।
৪৩:২-৪ :: শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। নিশ্চয় আমি উহাকে (সুস্পষ্ট কিতাবকে) নাযিল করেছি ‘আরবি কুরআন’ রূপে, যেন তোমরা বুঝতে পারো। আর নিশ্চয় উহা (সুস্পষ্ট কিতাব / কুরআন) আমার কাছে ‘উম্মুল কিতাবের মধ্যে’ রয়েছে, উহা সমুচ্চ, বিজ্ঞতাপূর্ণ।
আলোচনা: এ আয়াতসমূহ থেকে জানা যায় যে, কুরআন ‘উম্মুল কিতাবে’ সংরক্ষিত আছে। আর পূর্বে উল্লেখিত ১৩:৩৮-৩৯ আয়াত থেকে জানা যায় যে, প্রত্যেক কিতাবের যুগ নির্দিষ্ট আছে এবং এই কিতাবসমূহের জননী কিতাব (উম্মুল কিতাব) আল্লাহর কাছে আছে। একটি কিতাবের কোনো আয়াত পরবর্তী কিতাবে বহাল রাখা হয় বা তা রহিত করা হয়।
কুরআনসহ আল্লাহর নাযিলকৃত কোনো স্ববিরোধ নেই (৪:৮২, ২:১৭৬)। সুতরাং একই কিতাবের মধ্যে কোনো আয়াত অন্য আয়াতকে রহিত করে না বা তার কোনো আয়াত ভুলিয়ে দিয়ে অন্য আয়াত আনা হয় না। যেমন, কুরআনের বিষয়ে বলা হয়েছে যে, রসূল আল্লাহর ইচ্ছায় তথা আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে সাময়িকভাবে ভুলে যাওয়া ব্যতীত স্থায়ীভাবে কুরআনের কিছু ভুলে যাবেন না, কারণ তাঁকে তা বারবার পুন:আবৃত্তি করানো হবে (৭৫:১৬-১৭, ৮৭:৬-৭)। সর্বোপরি কুরআনের কোনো আয়াতকে রহিত সাব্যস্ত করে তার শিক্ষা অনুসরণ থেকে নিবৃত্ত থাকার পরিণামে সমস্ত আমল ব্যর্থ হয়ে যাবে (৪৭:২৫-২৮)। কুরআনের আয়াতমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং কুরআন চির সংরক্ষিত স্মারকগ্রন্থ (১১:১, ১৫:৯)।
৫২:৩৩-৩৪ :: নাকি তারা বলে, ‘সে (রসূল) এটা (কুরআন) বানিয়ে বলছে’? বরং তারা ঈমান আনে না। সুতরাং তারা রচনা করে আনুক এর অনুরূপ হাদীস (বাণী), যদি তারা সত্যবাদী হয়।
১৭:৮৮ :: বলো, ‘যদি সমগ্র মানবজাতি ও জিনজাতি এ কুরআনের অনুরূপ রচনা করার জন্য একত্রিত হয়, তবুও তারা এর অনুরূপ রচনা করতে পারবে না যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়’।
১১:১৩-১৪ :: নাকি তারা বলে, ‘সে (রসূল) এটা রচনা করেছে’? বল, ‘তাহলে তোমরা এর অনুরূপ দশটি সূরা (রচনা করে) নিয়ে আসো এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পার (সাহায্যের জন্য) ডাকো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’। অতঃপর তারা যদি তোমাদের আহবানে সাড়া না দেয়, তাহলে জেনে রাখো, এটা আল্লাহর জ্ঞান অনুসারেই নাযিল করা হয়েছে এবং তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। অতঃপর তোমরা কি মুসলিম (আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী) হবে?
১০:৩৭-৩৮ :: এ কুরআন তো এমন নয় যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ তা রচনা করতে পারবে; কিন্তু এটি (পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের) যা তার সামনে রয়েছে, তার সত্যায়ন এবং কিতাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, যাতে কোনো সন্দেহ নেই, যা জগতসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে। নাকি তারা বলে, ‘সে (রসূল) তা রচনা করেছে’? বলো, ‘তবে তোমরা তার মতো একটি সূরা (রচনা করে) নিয়ে আসো এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পারো (সাহায্যের জন্য) ডাকো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’।
২:২৩-২৪ :: আর আমি আমার বান্দার উপর যা নাযিল করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাক, তবে তোমরা তার মতো একটি সূরা নিয়ে আসো এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীদেরকে (সাহায্যের জন্য) ডাকো; যদি তোমরা সত্যবাদী হও। অতএব যদি তোমরা তা করতে না পারো- আর কখনো তোমরা তা করতে পারবে না- তাহলে (জাহান্নামের) আগুনকে ভয় কর যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর, যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য।
আলোচনা: আল কুরআন আরবি ভাষারীতিতে রচিত, যা শব্দচয়ন, বাক্য রচনা, বাক্য বিন্যাস, ছন্দ, উপমা প্রয়োগ, অর্থের গভীরতা, ব্যাপকতা ও সুনির্দিষ্টতা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে অতুলনীয় এবং এর সব দিক রক্ষা করে কুরআনের সবচেয়ে ছোট সূরার (তিন আয়াতবিশিষ্ট সূরা) অনুরূপ কোনো রচনা উপস্থাপন করাও অসম্ভব। কুরআনের সূরাসমূহে বিভিন্ন গাণিতিক প্যাটার্নও রয়েছে যা ক্রমান্বয়ে আবিষ্কৃত হচ্ছে। কুরআনে ছন্দ থাকা সত্ত্বেও তাতে আরবি কবিগণের অনুসৃত কোনো ছন্দের অনুসরণ করা হয়নি এবং এমন অনন্য ছন্দরীতি অনুসরণ করা হয়েছে যা বজায় রেখে কবিতার অন্যান্য শর্তসহ কবিতা রচনা করা যায় না। কবিতাকে আরবিতে ‘শে’র’ বলা হয়, যার অর্থ ‘আবেগপ্রধান (ছন্দায়িত) কথা’। কুরআনে ছন্দ এবং কুরআনের প্রতি আবেগ সৃষ্টিকারী কথা থাকলেও তা আবেগপ্রধান নয়। সুতরাং কবিতার মর্ম ও ছন্দরীতি কোনো দিক থেকে কুরআন কবিতা নয় (৩৬:৬৯)।
কুরআনের মতো কোনো গ্রন্থ রচনা করতে হলে তাতে কুরআনের মধ্যে পাওয়া বৈশিষ্ট্যগুলো থাকতে হবে। কুরআনের বিষয়ে জ্ঞানচর্চা ও অভিজ্ঞতা অনুসারে বলা যায় তাতে নিম্নরূপ বৈশিষ্ট্যগুলো থাকতে হবে-
(ক) তাতে প্রতিটি শব্দের ক্ষেত্রে বক্তব্য প্রকাশের জন্য সবচেয়ে যথাযথ শব্দ বাছাই করতে হবে। তার বক্তব্যভঙ্গিও ভাব প্রকাশের দিক থেকে বলিষ্ঠতার গুণসম্পন্ন হতে হবে। ভাষারীতির দিক থেকে সম্পূর্ণভাবে শুদ্ধতা ও উৎকর্ষ বজায় থাকতে হবে।
(খ) তাতে থাকা কোনো তথ্য ভুল প্রমাণিত হতে পারবে না এবং সহজবোধ্য ভাষারীতিতে উপস্থাপিত হতে হবে।
(গ) তাতে শব্দগুলোর অর্থগত ব্যাপকতার পাশাপাশি বক্তব্যের সামগ্রিকতার মধ্যে পরিপূর্ণতা থাকতে হবে।
(ঘ) তা যৌক্তিক চিন্তা-দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি, বিজ্ঞান সম্পর্কিত তথ্য ইত্যাদির প্রশস্ততার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
(ঙ) তা একই সাথে লিখিত রচনার ভাষারীতি ও বক্তব্যের ভাষারীতিতে উত্তীর্ণ হতে হবে। তাতে সম্বোধন, সর্বনাম, বক্তাপক্ষ, শ্রোতাপক্ষ ইত্যাদির পরিবর্তনের মাধ্যমে কখনো কাউকে প্রত্যক্ষ গুরুত্ব দিয়ে আবার কখনো পরোক্ষ গুরুত্ব দিয়ে বক্তব্য থাকা সত্ত্বেও তা পাঠের ক্ষেত্রে সাবলীলতা বজায় থাকতে হবে।
(চ) তাতে এমন অধ্যায়ও থাকতে হবে যাতে বহু বিষয় আলোচিত হয় এবং বিষয়ভিত্তিক আলোচনার পরিবর্তে এক বিষয়ের পরপর অন্য বিষয় চলে আসে, তারপর আবার পূর্বের বিষয় ফিরে আসে, একই প্রসঙ্গ বহুবার পুনরাবৃত্ত হয় অথচ তা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বক্তব্য কাঠামোতে প্রাসঙ্গিকভাবে সংযোজিত বলে প্রতীয়মান হয় এবং অধ্যায়টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বহুমাত্রিক বিষয়ের সমাবেশ সত্ত্বেও ও বিষয়ভিত্তিক বিন্যাস না থাকা সত্ত্বেও আলোচনার ধারাবাহিকতার একটা বিন্যাস বজায় থাকে।
(ছ) তা তার অনুরাগী ও বিরাগী উভয়কে দুটি ভিন্ন দিক থেকে আকৃষ্ট বা তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে হবে।
(জ) তা হুবহু মুখস্ত রাখা সহজ হবে এবং অনেকে তা হুবহু মুখস্ত রাখবে।
এখন কেউ যদি গুণমানহীন কিছু রচনা করে এনেই সেটাকে কুরআনের সমতুল্য বা কুরআনের চেয়েও উন্নত বলে দাবি করে তাহলে প্রত্যেকে নিজ অবস্থান থেকে সেটার মূল্যায়ন করতে হবে এবং সঠিকভাবে মূল্যায়নের জন্য কুরআনের ভাষারীতি সম্পর্কে বিভিন্ন অধ্যয়ন সম্পর্কেও অনুসন্ধান করা প্রয়োজন হবে। কেউ যদি যাচাই ছাড়াই কোনো গুণমানহীন কিছুকে গ্রহণ করে নেয়, সেটা তার নিজের ব্যর্থতা হিসেবেই পরিগণিত হবে। যেখানে কুরআনের সমকালের তথা আরবি সাহিত্যের স্বর্ণযুগের শ্রেষ্ঠ কবিগণ এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছে সেখানে সাহিত্য রচনার গুণমানে পিছিয়ে থাকা যারা এ বিষয়ে হৈ চৈ করে তাদের অবস্থা হলো ‘হাতি ঘোড়া গেল তল, পিঁপড়া বলে কত জল’।
২:১৮৫ :: রমাদানের মাস, যে মাসে আল কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানবজাতির জন্য হিদায়াত (পথনির্দেশ) ও পথনির্দেশ সম্পর্কিত স্পষ্ট (যৌক্তিক) প্রমাণ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী মানদণ্ড হিসেবে। …
৪:৮২ :: তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে না, যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হতো তবে তারা তার মধ্যে অনেক স্ববিরোধ পেতো।
২:১৭৬ :: এটা এজন্য যে, নিশ্চয় আল্লাহ যথাযথভাবে সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছেন এবং নিশ্চয় যারা কিতাবের মধ্যে স্ববিরোধ আবিষ্কার করেছে তারা সুদূর বিবাদে লিপ্ত।
আলোচনা: কোনো মানুষ দীর্ঘ বছর ধরে ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কোনো গ্রন্থের বিভিন্ন অংশ রচনা করবে এবং তখন তা প্রকাশও করতে থাকবে অথচ তাতে সময় ও পরিস্থিতিগত পার্থক্য সত্ত্বেও স্ববিরোধ থাকবে না এরূপ হওয়া অসম্ভব। আরেকটি বিষয় হলো, ভাসা ভাসাভাবে পড়লে বা চিন্তাশীলতার সাথে না পড়লে বাহ্যিকভাবে কোনো তথ্যের ক্ষেত্রে আপাত বৈপরীত্য পাওয়ার মানেই তাতে প্রকৃতপক্ষে বৈপরীত্য থাকা নয়। সঠিকভাবে আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কুরআনের স্ববিরোধ নেই, বরং এর প্রতিটি তথ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ।
৬:১৯ :: বলো, সাক্ষ্যদানে সর্বশ্রেষ্ঠ কে? বলো, আল্লাহ আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী। আর আমার নিকট এ কুরআন ওহী করা হয়েছে যেন আমি এর দ্বারা সতর্ক করি তোমাদেরকে এবং তাদেরকেও যাদের কাছে তা পৌঁছে যায়। তোমরা কি সাক্ষ্য দিচ্ছেো যে, আল্লাহ ছাড়াও আরো ইলাহ (সার্বভৌমত্বের অধিকারী, অলৌকিক ক্ষমতায় প্রয়োজন পূরণকারী ও উপাস্য) আছে? বলো, আমি সেই সাক্ষ্য দিই না। বলো, নিশ্চয় তিনি একমাত্র ইলাহ। আর তোমরা যে শিরক (অংশীদার স্থাপন) করো আমি তা থেকে মুক্ত।
১০:১৫ :: আর যখন তাদের সামনে আমার আয়াতসমূহ সুস্পষ্টরূপে পাঠ করা হয়, তখন, যারা আমার সাক্ষাতের আশা রাখে না, তারা বলে, ‘এটি ছাড়া অন্য কুরআন নিয়ে এসো। অথবা একে বদলাও’। বল, ‘আমার নিজের পক্ষ থেকে এতে কোন পরিবর্তনের অধিকার নেই। আমিতো শুধু আমার প্রতি অবতীর্ণ ওহীর অনুসরণ করি। নিশ্চয় আমি যদি রবের অবাধ্য হই তবে ভয় করি কঠিন দিনের আযাবের’।
১৫:১-২ :: আলিফ লাম-রা। এগুলো হলো কিতাব (মহাগ্রন্থ) ও সুস্পষ্ট কুরআনের আয়াতসমূহ। কখনো কখনো কাফিররা আকাঙ্ক্ষা করবে যে, তারা যদি মুসলিম হতো!
১৭:৯ :: নিশ্চয় এ কুরআন সবচেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত সত্যের পথনির্দেশ করে। আর সেই মু’মিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যারা সৎকর্ম করে, এ মর্মে (সুসংবাদ দেয়) যে, তাদের জন্য মহাপুরস্কার রয়েছে।
১৭:৪১ :: আর আমি এ কুরআনে বিভিন্ন ধরনের পুনরাবৃত্তি করেছি যেন তারা তা পুন:পুন স্মরণ রাখে ও উপদেশ গ্রহণ করে এবং এটা তাদের (কাফিরদের) মধ্যে পলায়নের মনোবৃত্তিই বাড়িয়ে দেয়।
১৭:১০৬ :: আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি খন্ড খন্ডভাবে যাতে তুমি তা মানুষের কাছে পাঠ করতে পারো ক্রমে ক্রমে; এবং আমি তা যথাযথভাবে অবতীর্ণ করেছি।
২৫:৩২ :: আর কাফিররা বলে, ‘তার উপর পুরো কুরআন একসাথে কেন নাযিল করা হল না? এটা এজন্য যে, আমি এর মাধ্যমে তোমার অন্তরকে সুদৃঢ় করব। আর আমি তার (নাযিলকালীন ও নাযিল উত্তর) পাঠবিন্যাস ঠিক করে দিয়েছি।
৩৬:৬৯ :: আর আমি তাকে কবিতা শিখাইনি আর তা তার জন্য শোভনীয়ও নয়। উহা তো স্মারক ও সুস্পষ্ট কুরআন।
১৮:১ :: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তাঁর বান্দার উপর কিতাব নাযিল করেছেন এবং তাতে রাখেননি কোনো বক্রতা ।
৩৯:২৮ :: কুরআন আরবী ভাষায়, বক্রতামুক্ত, যেন তারা স্রষ্টা সচেতন হতে পারে।
৪১:৩ :: এটা এমন কিতাব যার আয়াতসমূহকে (এর মধ্যে) ব্যাখ্যা করা হয়েছে, আরবি ভাষারীতিতে (নাযিলকৃত) কুরআন, সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা জ্ঞানার্জন করে।
৪১:৪২ :: তাতে (কুরআনে) কোনোভাবে বাতিল অনুপ্রবেশ করতে পারবে না (তাকে প্রতিহত করতে কোনোভাবে বাতিল আসতে পারবে না), না সেটার সামনে থেকে আর না সেটার পেছন থেকে। তা (কুরআন) মহাবিজ্ঞ মহাপ্রশংসিত সত্তার (আল্লাহর) পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।
৪১:৪৪ :: আমি যদি আজমী (অনারব) ভাষায় কুরআন নাযিল করতাম, তাহলে তারা বলত, “ইহার আয়াতগুলো বিশদভাবে বোধগম্যকরণ করা হয়নি কেন? কী আশ্চর্য যে, (কিতাবের ভাষা) আজমী (অনারব) অথচ (যে রসূলের উপর তা নাজিল হয়েছে তার ভাষা) আরবী! বলো, উহা (কুরআন) মু’মিনদের জন্যই পথনির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার কিন্তু যারা ঈমান আনে না তাদের কানে রয়েছে (সত্য কথা শুনার ব্যাপারে অনাগ্রহজনিত) বধিরতা এবং উহা তাদের উপর অন্ধত্বস্বরূপ হয়ে থাকে (তারা উহাতে দেখার মতো কিছুই পায় না)। তারা এমন লোক, যেন তাদেরকে বহুদূর থেকে ডাকা হচ্ছে (সে কারণে তারা শুনছে না)।
৪৭:২৪ :: তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না, নাকি তাদের মনের উপর রয়েছে অনেক তালা?
৫০:৪৫ :: এরা যা বলে আমি তা সবচেয়ে ভাল জানি। আর তুমি তাদের উপর কোন জোর- জবরদস্তিকারী নও। সুতরাং যে আমার ধমককে ভয় করে তাকে কুরআনের সাহায্যে উপদেশ দাও।
৫৪:১৭,২২,৩২,৪০ :: নিশ্চয় আমি কুরআনকে তথ্য স্মরণ ও উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ (সহজবোধ্য ও সহজলভ্য) করে দিয়েছি। সুতরাং উপদেশগ্রহণকারী কেউ আছে কি?
১৫:৯ :: নিশ্চয় আমিই এ স্মারক (কুরআন) নাযিল করেছি এবং নিশ্চয় আমিই এর সংরক্ষণকারী।
৩৯:৪১ :: নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি মানুষের জন্য যথাযথভাবে সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি; সুতরাং যে সৎপথ অবলম্বন করে, সে তা নিজের জন্যই করে এবং যে পথভ্রষ্ট হয় সে নিজের ক্ষতির জন্যই পথভ্রষ্ট হয়। আর তুমি তাদের তত্ত্বাবধায়ক নও।
১৬:৮৯ :: আর সেদিন (কিয়ামাত দিবসে) আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে তাদের উপর সাক্ষী উত্থিত করবো এব আমি তোমাকে তাদের উপর সাক্ষীরূপে আনবো। আর আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি, যা প্রতিটি বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনা, হিদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ।
৬:১১৪-১১৫ :: আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বিচারক হিসেবে তালাশ করব? অথচ তিনিই তোমাদের নিকট বিস্তারিত কিতাব নাযিল করেছেন। আর যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছিলাম তারা (তাদের মধ্যকার সত্যনিষ্ঠরা) জানে যে, তা তোমার রবের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে নাযিলকৃত। সুতরাং তুমি কখনো সন্দেহকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। আর প্রভুর বাণী সত্য ও ন্যায়ে পরিপূর্ণ হয়েছে। তাঁর বাণীর কোনো পরিবর্তনকারী নেই। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
২৯:৫১ :: এটা কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যা তাদের নিকট তিলাওয়াত করা হয়? নিশ্চয় এর মধ্যে রহমত এবং চিরস্মরণীয় তথ্য ও বিধিবিধান রয়েছে সেই কওমের জন্য, যারা ঈমান আনে।
৭:২-৩ :: এটি কিতাব, যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে। সুতরাং এর মাধ্যমে সতর্ক করতে তোমার মনে যেন কোনো সংকীর্ণতা না থাকে। তা মুমিনদের জন্য উপদেশ। তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা-ই অনুসরণ কর এবং তাঁকে ছাড়া অন্য অলি-আউলিয়ার (অভিভাবকের) অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ করো।
৭:৫২ :: আর আমি তাদের নিকট কিতাব (কুরআন) নিয়ে এসেছি যেটিকে আমি জ্ঞানের ভিত্তিতে ব্যাখ্যাসম্পন্ন করেছি, যারা ঈমান আনে সেই সম্প্রদায়ের জন্য তা হিদায়াত ও রহমত।
১১:১ :: এটি কিতাব, যার আয়াতসমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত ও বিস্তারিত ব্যাখ্যাকৃত করা হয়েছে, সবিশেষ অবহিত মহাবিজ্ঞ সত্তার পক্ষ থেকে।
১৪:১ :: আলিফ-লাম-রা; এই কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনো, পরাক্রমশালী সর্বপ্রশংসিতের পথের দিকে।
১৬:৬৪ :: আর আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করিনি এজন্য ছাড়া যে, যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে, তুমি (এর মাধ্যমে) তাদের কাছে তা (মতভেদের বিষয়ে সঠিক তথ্য) স্পষ্ট করে দেবে এবং (এটি) হিদায়াত ও রহমত সেই কওমের জন্য যারা ঈমান আনে।
১৮:২৭ :: তোমার নিকট তোমার প্রভুর ওহিকৃত কিতাব অধ্যয়ন করো। তাঁর কালিমাত বদল করার কেউ নেই এবং তুমি তাঁকে ছাড়া কোনো আশ্রয় পাবে না।
২১:১০ :: নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যাতে আছে তোমাদেরই স্মরণীয় তথ্য ও বিধান, তবুও কি তোমরা বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগ করবে না?
২৮:৮৬ :: আর তুমি আশা করছিলে না যে, তোমার প্রতি কিতাব (কুরআন) নাযিল করা হবে, বরং তা তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ। অতএব, তুমি কখনো কাফিরদের জন্য সহায়ক হয়ো না।
৩৮:২৯ :: আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় (সমৃদ্ধ) কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে এবং যাতে চিন্তাশক্তিসম্পন্নরা উপদেশ গ্রহণ করে।
২৯:৪৮ :: আর তুমি তো এর পূর্বে কোনো কিতাব পড়োনি এবং তোমার ডানহাতে তা (কিতাব) লিখোনি। তাহলেই বাতিলপন্থীরা সন্দেহ করতে পারতো!
৪২:৫২ :: এভাবে আমি তোমার কাছে আমার নির্দেশ থেকে ‘রূহ’কে ওহী করেছি। তুমি জানতে না কিতাব কী এবং ঈমান কী? কিন্তু আমি একে (রুহ তথা কুরআনকে) আলো বানিয়েছি, যার মাধ্যমে আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করি। আর নিশ্চয় তুমি সরল পথের দিক নির্দেশনা দাও।
৩:৭ :: তিনিই সেই সত্তা যিনি নাযিল করেছেন তোমার উপর ‘আল কিতাব’। তা থেকে রয়েছে ‘আয়াতুম মুহকামাত’ (সিদ্ধান্তপূর্ণ নিদর্শনসমূহ)। ঐগুলো ‘উম্মুল কিতাব’ (কিতাবের মা / মূল / কেন্দ্রীয় বক্তব্য)। আর অন্যগুলো ‘মুতাশাবিহাত’ (সাদৃশাত্মক / অনাক্ষরিক)। সুতরাং যাদের অন্তরসমূহে বক্রতা রয়েছে তারা অনুসরণ করে যা ঐগুলোর মধ্যকার সাদৃশাত্মকতা সম্পন্ন হয় (অনাক্ষরিক বক্তব্য), ফিতনা (নীতিগত অস্থিতিশীলতা) অনুসন্ধানে এবং সেটার তাভীল (পরম পরিণতিরূপ স্বরূপ) অনুসন্ধানে। আর সেটার তাভীল (পরম পরিণতিরূপ স্বরূপ) কেউই জানে না আল্লাহ ছাড়া। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা বলে, “আমরা এর প্রতি ঈমান (যুক্তিযুক্ত কারণে বিশ্বাস) করি। প্রত্যেকটি (উভয় প্রকার আয়াতই) আমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে। আর তাযাক্কুর (যথাযথ অনুধাবনসহ পুন:পুন: স্মরণীয় উপদেশ গ্রহণ) করে না উলুল আলবাব (চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ) ছাড়া অন্যরা।
৪:৪৭ :: হে আহলে কিতাব, তোমরা তার প্রতি ঈমান আনো যা আমি নাযিল করেছি (কুরআন) তোমাদের কাছে যা (যে কিতাব) রয়েছে তার প্রত্যয়নকারীরূপে। (তারা যেন ঈমান আনে) আমি চেহারাগুলোকে বিকৃত করে তা সেগুলোর পিছনের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার পূর্বে এবং আসহাবুস সাবতকে (বিশ্রাম দিবস শনিবারের বিধান লংঘনকারীদেরকে) যেভাবে লা’নত করেছিলাম সেভাবে লা’নত করার পূর্বে। আর আল্লাহর আদেশ কার্যকর হয়েই থাকে।
আলোচনা: আল কুরআনের সাথে সম্পর্কিত উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহ থেকে কুরআনের পরিচয় বৈশিষ্ট্য ও অপরিবর্তনীয়তা সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়। যেমন:
১। কুরআন মানবজাতির হিদায়াতের জন্য, তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে নিয়ে আসার জন্য নাযিল করা হয়েছে।
২। কুরআন সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী অর্থাৎ যেসব বিষয় কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক তা মিথ্যা আর যা কুরআনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তা সত্য। আর যেসব বিষয়ে কুরআনে কোনো বিধি-বিধান বা তথ্য জানানো হয়নি, সেক্ষেত্রে মানুষ তাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কাজ করবে।
৩। কুরআনের তথ্য ও বিধিবিধানে কোনো স্ববিরোধ নেই।
৪। রসূলের দায়িত্ব ছিলো তাঁর সমকালীন যাদেরকে সরাসরি সতর্ক করা সম্ভব তাদেরকে কুরআন দ্বারা সতর্ক করা এবং এছাড়াও যাদের কাছেই কুরআন পৌঁছে যাবে তাদেরকেও তিনি কুরআন দ্বারা সতর্ক করেছেন বলে সাব্যস্ত হবে।
৫। কিছু লোক কুরআনের পরিবর্তে ভিন্নরূপ কুরআন আনার জন্য বা কুরআনকে বদলে দেয়ার জন্য দাবি জানিয়েছিলো, কিন্তু রসূলের পক্ষে তা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
৬। কুরআন তথা কুরআনের আয়াতসমূহ সুষ্পষ্ট।
৭। কুরআন সবচেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত সত্যের পথনির্দেশ করে।
৮। কুরআনে পুনরাবৃত্তির উদ্দেশ্য হলো পুন:পুন স্মরণ রাখা ও উপদেশ গ্রহণ সহজ করা।
৯। কুরআন নাযিলের ক্ষেত্রে একটা নাযিলক্রম (ক্রমে ক্রমে নাযিল করার পদ্ধতি) অবলম্বন করার কারণ হলো তা মানুষের সামনে ক্রমে ক্রমে পাঠ করা এবং তা দ্বারা রসূল ও মু’মিনদের অন্তরকে সুদৃঢ় করা।
১০। কুরআন কোনো কবিতার গ্রন্থ নয়। কুরআনের সূরাগুলো কবিতা নয়।
১১। কুরআন বক্রতামুক্ত।
১২। কুরআন আরবি ভাষায় নাযিল করা হয়েছে, কারণ এটি যে রসূলের উপর নাযিল করা হয়েছে তাঁর এবং তাঁর কওমের তথা এটির প্রথম শ্রোতাপক্ষের ভাষা ছিল আরবি।
১৩। কুরআন স্বব্যাখ্যাত। কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে এর আয়াতসমূহের স্পষ্ট ব্যাখ্যা অনুধাবন করা সম্ভব।
১৪। কুরআনে কোনোভাবে বাতিল অনুপ্রবেশ করতে পারবে না এবং বাতিলের দ্বারা কুরআনের তথ্য ও বিধিবিধানের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
১৫। যারা কুরআনের প্রতি ঈমান আনে না তারা কুরআনে পড়ার মতো কিছুই দেখতে পায় না এবং তারা কুরআনের কথা শুনার ক্ষেত্রে বধির হয়ে থাকে।
১৬। কুরআন নিয়ে গবেষণা না করলে মনের উপর অনেক তালা পড়ে যায়।
১৭। রসূলকে কুরআন দ্বারাই উপদেশ দেয়ার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে।
১৮। কুরআনকে তথ্য স্মরণ ও উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজবোধ্য ও সহজলভ্য করে দেয়া হয়েছে।
১৯। আল্লাহ নিজেই কুরআনকে সংরক্ষণ করবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন।
২০। কুরআনে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সকল তথ্য ও বিধিবিধান স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
২১। কুরআন সুবিস্তারিত কিতাব, এর কোনো সূরাতে যা সংক্ষেপে বলা হয়েছে অন্যান্য সূরা ও আয়াত থেকে তার বিস্তারিত জানা যাবে।
২২। কুরআনে সত্য ও ন্যায়ের দিক থেকে মানুষের জন্য মৌলিক প্রয়োজনীয় তথ্য ও বিধিবিধানকে পরিপূর্ণ করে দেয়া হয়েছে।
২৩। কুরআনের মাধ্যমে জানানো বাণীসমূহের কোনো পরিবর্তন নেই।
২৪। তথ্য ও বিধিবিধান হিসেবে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য চিরস্মরণীয় বিষয় সম্বলিত প্রেরিত নিদর্শন হিসেবে কুরআন যথেষ্ট।
২৫। কুরআন দ্বারা সতর্ক করার ক্ষেত্রে মনের মধ্যে কোনো সংকীর্ণতা রাখা উচিত নয়।
২৬। একমাত্র আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব কুরআনের অনুসরণ করতে হবে এবং কুরআনের সাথে সঙ্গতিহীন তথ্য দেয় বা কোনো মূল বিধান দেয় এরূপ অলি আওলিয়া বা অভিভাবকদের অনুসরণ করা যাবে না।
২৭। কুরআন থেকে ধর্মাদর্শগত মতভেদের বিষয়গুলোতে সঠিক সমাধান সম্পর্কে জানা যায়, তবে তা গ্রহণ করা না করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাধীনতা রয়েছে বিধায় কিয়ামাত দিবসেই আল্লাহ চূড়ান্ত সমাধান জানিয়ে বিচার- ফায়সালা করবেন।
২৮। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ আশা করে ছিলেন না যে, তাঁর উপর কুরআন নাযিল করা হবে। তাঁর উপর কুরআন নাযিল করা হয়েছে বিধায় তিনি কুরআন প্রচার করেছেন, অন্যথায় তাঁর পক্ষে কুরআনের মতো কিছু উপস্থাপন করা সম্ভব হতো না।
২৯। কুরআনের আয়াতসমূহ সমৃদ্ধ এবং প্রত্যেকের উচিত তা নিয়ে চিন্তা গবেষণা করা।
৩০। কুরআন নাযিলের আগে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ কোনো কিতাব পড়েননি এবং তাঁর ডান হাত দ্বারা কোনো কিতাব লিখেননি।
৩১। কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত রুহ (বিশেষ আত্মা) এবং আলোস্বরূপ, যার মাধ্যমে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়াত করেন।
৩২। কুরআন নাযিল হওয়ার আগে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ কিতাব কী এবং ঈমান কী তা জানতেন না।
৩৩। কুরআনে দুই ধরনের আয়াত আছে। মুহকামাত তথা সিদ্ধান্তপূর্ণ আয়াত এবং মুতাশাবিহাত তথা সাদৃশাত্মক / অনাক্ষরিক অর্থবোধক আয়াত। যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা কুরআনের সকল আয়াতে ঈমান রাখে। কিন্তু যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে তারা কুরআনের মুহকামাত আয়াত বাদ দিয়ে মুতাশাবিহাত আয়াতের চূড়ান্ত স্বরূপ নির্ণয়ের জন্য এবং এটার বিষয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য তার পিছনে পড়ে থাকে। অথচ কুরআনের মুতাশাবিহাত আয়াতের চূড়ান্ত স্বরূপ একমাত্র আল্লাহ জানেন।
৩৪। আহলে কিতাবকে তাদের কিতাবসমূহের পাশাপাশি কুরআনের প্রতি ঈমান আনতে হবে।
সংক্ষেপে বলা যায়, আল কুরআন পরিপূর্ণ, যথেষ্ট, সুস্পষ্ট ও বক্রতামুক্ত, স্বব্যাখ্যাত, সহজ এবং একমাত্র সর্বজনীন ও শাশ্বত বিধানগ্রন্থ।
২২:৫২ :: আমি তোমার পূর্বে এমন কোনো রসূলও প্রেরণ করিনি এবং এমন কোনো নবীও প্রেরণ করিনি যার ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটেনি যে, যখন সে কোনো (আয়াতভিত্তিক) আকাঙ্ক্ষা করেছে, তখন শয়তান তার আকাঙ্ক্ষায় হস্তক্ষেপ করেছে। তারপর শয়তান যা প্রক্ষেপণ করেছে, আল্লাহ সেটা রহিত করে দিয়েছেন, সেই সাথে আল্লাহ তাঁর নিজ আয়াতসমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।
২২:৭৫ :: আল্লাহ রসূল মনোনীত করেন ফেরেশতাদের মধ্য থেকে এবং মানুষের মধ্য থেকে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
১২:৫০ :: আর মালিক (রাষ্ট্রপতি) বললো, ‘তোমরা তাকে (ইউসুফকে) আমার কাছে নিয়ে আসো’। তারপর যখন (রাষ্ট্রপতির) রসূল (দূত) তার কাছে আসলো, তখন সে (ইউসুফ) বললো, তুমি তোমার মনিবের নিকট ফিরে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করো, যে সব মহিলা নিজ নিজ হাত কেটে ফেলেছিল তাদের অবস্থা কী? নিশ্চয় আমার প্রভু তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত’।
৬:১৩০ :: ‘হে জিন ও মানব সমাজ, তোমাদের মধ্য থেকে কি তোমাদের নিকট রাসূলগণ আসেনি, যারা তোমাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ বর্ণনা করতো এবং তোমাদের এই দিনের সাক্ষাতের ব্যাপারে তোমাদেরকে সতর্ক করতো?’ তারা বলবে, ‘আমরা আমাদের নিজদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলাম।’ আর দুনিয়ার জীবন তাদেরকে প্রতারিত করেছে এবং তারা নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে যে, তারা ছিল কাফির।
৪৬:২৯-৩১ :: আর উল্লেখ্য, যখন আমি জিনদের একটি দলকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তারা কুরআন পাঠ শুনছিলো। যখন তারা তার কাছে উপস্থিত হলো, তখন তারা বললো, ‘চুপ করে শোনো। তারপর যখন পাঠ শেষ হলো তখন তারা তাদের কওমের কাছে সতর্ককারী হিসেবে ফিরে গেলো। তারা বললো, ‘হে আমাদের কওম, আমরা তো এক কিতাবের বাণী শুনেছি, যা মূসার পরে নাযিল করা হয়েছে। যা পূর্ববর্তী কিতাবকে সত্যায়ন করে আর সত্য ও সরল পথের প্রতি হিদায়াত করে’। ‘হে আমাদের কওম, আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনো, আল্লাহ তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। আর তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাব থেকে রক্ষা করবেন’।
২৫:২০ :: আর আমি তোমার পূর্বে যত নবী-রসূল পাঠিয়েছি, তারা সবাই আহার করতো এবং হাট-বাজারে চলাফেরা করতো। আমি তোমাদের একজনকে অপরজনের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ করেছি। তোমরা কি ধৈর্যধারণ করবে? আর তোমার প্রভু সর্বদ্রষ্টা।
৫:৭৫ :: মাসীহ ইবনে মারইয়াম একজন রাসূল ছাড়া আর কিছুই নয়; তার পূর্বে আরও বহু রাসূল গত হয়েছে, আর তার মা একজন সত্যবাদিনী, তারা উভয়ে খাবার খেতো। লক্ষ্য করো! আমি কিরূপে তাদের নিকট আয়াতসমূহ বর্ণনা করছি। আবার লক্ষ্য করো! তারা উল্টো কোন দিকে যাচ্ছে?
১৩:৩৮-৩৯ :: আর আমি তোমার পূর্বে অনেক রসূলকে প্রেরণ করেছি। আর আমি তাদেরকে স্ত্রী ও সন্তানাদি দিয়েছি। কোনো রসূলের পক্ষে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো নিদর্শন নিয়ে আসা সম্ভব নয়। প্রত্যেক যুগের (নির্দিষ্ট সময়কাল) জন্য একটি কিতাব (বিধান) বরাদ্দ। আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা মুছে দেন এবং যা ইচ্ছা করেন তা প্রতিষ্ঠিত রাখেন; আর তাঁরই নিকট (লাওহে মাহফুজে) আছে উম্মুল কিতাব।
১২:১০৯ :: আর আমি তোমার পূর্বেও জনপদবাসী থেকে পুরুষদেরকেই নবী-রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছি, যাদের উপর আমি ওহী নাযিল করতাম। তারা কি যমীনে বিচরণ করে না। তাহলে দেখতো, তাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের পরিণতি কিরূপ হয়েছে? আর যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য আখিরাতের আবাসনই উত্তম, তবুও কি তোমরা বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগ করো না?
৬:১২৪ :: আর যখন তাদের নিকট কোনো আয়াত আসে, তারা বলে, আমরা কখনই ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না আল্লাহর রাসূলদেরকে যা দেয়া হয়েছে আমাদেরকে তার অনুরূপ দেয়া হয়। আল্লাহ ভালো জানেন, তিনি কোথায় তাঁর রিসালাত অর্পণ করবেন। যারা অপরাধ করেছে, অচিরেই তাদেরকে আক্রান্ত করবে আল্লাহর নিকট লাঞ্ছনা ও কঠোর আযাব, কারণ তারা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করতো।
১৯:৫৮ :: উহারাই তারা যাদেরকে আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, যারা নবীদের অন্তর্ভুক্ত এবং যারা আদমের এবং যাদেরকে আমি নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম তাদের বংশদ্ভুত এবং ইবরাহীম ও ইসরাঈলের বংশদ্ভুত এবং যাদেরকে আমি পথ নির্দেশ করেছিলাম ও মনোনীত করেছিলাম তাদের অন্তর্ভুক্ত; তাদের নিকট দয়াময়ের আয়াত আবৃত্তি করা হলে তারা সাজদাহরত ও ক্রন্দনরত অবস্থায় পড়ে যেতো।
৪০:৭৮ :: আর অবশ্যই আমি তোমার পূর্বে অনেক রাসূল পাঠিয়েছি। তাদের মধ্যে কারো কারো কাহিনী আমি তোমার কাছে বর্ণনা করেছি আর কারো কারো কাহিনী তোমার কাছে বর্ণনা করিনি। আর কোনো রাসূলের পক্ষে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন নিদর্শন নিয়ে আসা সম্ভব নয়। তারপর যখন আল্লাহর নির্দেশ আসে তখন ন্যায়সঙ্গতভাবে ফয়সালা করা হয়। আর তখনই বাতিলপন্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৬:৩৬ :: আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ কাউকে হিদায়াত দিয়েছেন এবং তাদের মধ্য থেকে কারো উপর পথভ্রষ্টতা সাব্যস্ত হয়েছে। সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো অতঃপর দেখো সত্যকে মিথ্যা সাব্যস্তকারীদের পরিণতি কীরূপ হয়েছে।
২১:২৫ :: আর তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল আমি পাঠাইনি যার প্রতি আমি এই ওহী নাযিল করিনি যে, ‘আমি ছাড়া কোনো ইলাহ (সার্বভৌম ও অলৌকিক শক্তিতে প্রয়োজন প্রয়োজনপূরণকারী ও উপাস্য) নেই; সুতরাং তোমরা আমার ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করো।’
৬:৯০ :: এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত করেছেন। অতএব তাদের (অনুসৃত) হিদায়াত তুমি অনুসরণ করো। বলো, ‘আমি তোমাদের কাছে এর উপর কোন বিনিময় চাই না। এটা (কুরআন) তো বিশ্ববাসীর জন্য স্মারক (চিরস্মরণীয় তথ্য ও বিধান সম্বলিত গ্রন্থ)।
২:২১৩ :: মানুষ ছিল এক উম্মত। অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে নবীদেরকে প্রেরণ করলেন এবং সত্যসহ তাদের সাথে কিতাব নাযিল করলেন, যাতে মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত। আর তারাই তাতে মতবিরোধ করেছিল, যাদেরকে তা দেয়া হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষবশত। অতঃপর আল্লাহ নিজ অনুমতিতে মুমিনদেরকে হিদায়াত দিলেন যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছিল। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন।
৫৭:২৫ :: নিশ্চয় আমি আমার রাসূলদেরকে স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ পাঠিয়েছি এবং তাদের সাথে কিতাব ও (ন্যায়ের) মানদন্ড নাযিল করেছি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আমি আরো নাযিল করেছি লোহা, তাতে প্রচন্ড শক্তি ও মানুষের জন্য বহু কল্যাণ রয়েছে। আর যাতে আল্লাহ জেনে নিতে পারেন, কে না দেখেও তাঁকে ও তাঁর রাসূলদেরকে সাহায্য করে। অবশ্যই আল্লাহ মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী।
৯:৩৩ :: তিনিই (আল্লাহ) তাঁর রসূলকে প্রেরণ করেছেন পথনির্দেশ ও সঠিক জীবনব্যবস্থা (দীন) সহকারে, সেই জীবনব্যবস্থাকে প্রত্যেক প্রকার (ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ) জীবনব্যবস্থার উপর বিজয়ী করার জন্য; যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।
৪:৬৪ :: আর আমি যে কোনো রাসূল প্রেরণ করেছি তা কেবল এ জন্য, যেন আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদের আনুগত্য করা হয়। আর যদি তারা- যখন নিজদের প্রতি যুলম করেছিল তখন তোমার কাছে আসতো অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইত এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইতো তাহলে অবশ্যই তারা আল্লাহকে তাওবা কবূলকারী, দয়ালু পেতো।
৩৬:৩০ :: বান্দাহদের জন্য পরিতাপ! তাদের কাছে এমন কোনো রসূল আসেনি যাকে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেনি।
৪৩:৭ :: তাদের কাছে এমন কোনো নবী আসেনি যাকে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেনি।
২:৯১ :: আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তোমরা তার প্রতি ঈমান আনো’। তারা বলে, ‘আমাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে আমরা তা বিশ্বাস করি’। আর এর বাইরে যা আছে তারা তা অস্বীকার করে। অথচ তা সত্য, তাদের সাথে যা আছে তার সত্যায়নকারী। বল, ‘তবে কেন তোমরা আল্লাহর নবীদেরকে পূর্বে হত্যা করতে, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো’?
৫:৭০ :: অবশ্যই আমি বনী ইসরাঈলের অঙ্গীকার নিয়েছি এবং তাদের নিকট অনেক রাসূল পাঠিয়েছি। যখনই তাদের নিকট কোনো রাসূল এমন কিছু নিয়ে এসেছে, যা তাদের নফসের আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতিশীল হয় না, তখন তারা কতককে অস্বীকার করেছে এবং কতককে হত্যা করেছে।
২:১৩৬ :: তোমরা বলো, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা নাযিল করা হয়েছে আমাদের উপর ও যা নাযিল করা হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানদের উপর আর যা প্রদান করা হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা প্রদান করা হয়েছে তাদের রবের পক্ষ হতে (অন্যান্য) নবীগণকে। আমরা তাঁদের কারো মধ্যে পার্থক্য করি না। আর আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী’।
২:২৮৫ :: রসূল তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা তার উপর নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে এবং মু’মিনগণও ঈমান এনেছে। প্রত্যেকে ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি, তাঁর মালায়েকার (ফেরেশতাগণের) প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রসূলগণের প্রতি। (তারা বলে-) আমরা তাঁর রসূলগণের কারো মধ্যে পার্থক্য করি না। আর তারা বললো, আমরা শুনলাম ও মানলাম। সুতরাং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, আমাদের প্রভু, আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তন।
১৭:৫৫ :: আর তোমার প্রভু অধিক অবগত তাদের সম্পর্কে যারা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে রয়েছে। আর আমি তো কতক নবীকে কতকের উপর বিশেষত্ব দিয়েছি এবং দাঊদকে দিয়েছি যাবূর।
২:২৫৩ :: ঐ রাসূলগণ, আমি তাদের কাউকে কারো উপর বিশেষত্ব দিয়েছি, তাদের মধ্যে কারো সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং কারো কারো মর্যাদায় উঁচু করেছেন। আর আমি ঈসা ইবনে মারয়ামকে দিয়েছি সুস্পষ্ট প্রমাণাদি এবং আমি তাকে শক্তিশালী করেছি রূহুল কুদুস (পবিত্র আত্মা) এর মাধ্যমে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তাদের পরবর্তীরা লড়াই করতো না, তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণসমূহ আসার পর। কিন্তু তারা মতবিরোধ করেছে। ফলে তাদের মধ্যে কেউ ঈমান এনেছে, আর তাদের কেউ কুফর করেছে। আর আল্লাহ যদি চাইতেন, তাহলে তারা লড়াই করত না। কিন্তু আল্লাহ যা চান, তা করেন।
৪:১৫০-১৫৩ :: নিশ্চয় যারা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলগণের প্রতি কুফর করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলগণের মধ্যে (ঈমানের ক্ষেত্রে) পার্থক্য করার ইচ্ছা করে এবং বলে “আমরা তাঁদের কারো প্রতি ঈমান রাখি এবং কারো প্রতি কুফর করি এবং তারা এ দুয়ের মধ্যবর্তী কোনো পথ ধরতে চায়। তারাই পাক্কা কাফির। আর আমি কাফিরদের জন্য অপমানকর শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি। আর যারা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলগণের প্রতি ঈমান আনে এবং তাঁদের কারো মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে না, তাদেরকে শীঘ্রই তাদের পুরস্কার দেয়া হবে এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়।
৫:১০৯ :: (উল্লেখ্য) যেদিন আল্লাহ রাসূলগণকে একত্র করবেন, অতঃপর বলবেন, ‘তোমাদেরকে কী জবাব দেয়া হয়েছিল’? তারা বলবে, ‘আমাদের কোন ইলম নেই, নিশ্চয় আপনি গায়েবী বিষয়সমূহের সর্বজ্ঞানী’।
আলোচনা: উপরিউক্ত আয়াতসমূহ থেকে নবী-রসূল প্রসঙ্গে অনেক মৌলিক তথ্য জানা যায়। যেমন, নবী-রসূলদের সরাসরি সংখ্যা আমাদের অজানা থাকা, আল্লাহর দিকে আহবান এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকা, নবী-রসূলদের মধ্যে পার্থক্য না করা, কোনো নবী-রসূলকে আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহ দান এবং মর্যাদায় উঁচু করেছেন, তবে তাদের কার চেয়ে কে বেশি মর্যাদাবান বা কে কার তুলনায় অধিক অনুগ্রহপ্রাপ্ত; এভাবে চিহ্নিত করা নয়, বরং আমাদের পক্ষে যা সম্ভব বা যা আমাদের উচিত তা হলো- তাঁদের যার ক্ষেত্রে যে বৈশিষ্ট্য বা অনুগ্রহপ্রাপ্তির বিষয় কুরআন থেকে বুঝা যায় তার ক্ষেত্রে সে বৈশিষ্ট্য ও অনুগ্রহের বিষয়সহ তাঁকে স্মরণ করা কিন্তু সামগ্রিকভাবে কারো চেয়ে কাউকে নির্দিষ্ট করে শ্রেষ্ঠ হিসেবে চিহ্নিত না করা। বরং ঈমানের দাবি হলো তাঁদের কারো মধ্যে পার্থক্য না করে সবার প্রতি ঈমান রাখা এবং কোনোরূপ পার্থক্য ছাড়া তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রাখা ও তাঁদের প্রতি সালাম জানানো (সালামুন আলাল মুরছালীন)।
নবী-রসূলদের প্রতি ঈমান খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের নিকট স্বতন্ত্রভাবে কিতাব প্রেরণ করেননি। বরং তিনি তাঁর বাছাইকৃত ব্যক্তিদেরকে নবী-রসূল নিযুক্ত করে তাদের কাছে কিতাব নাযিল করেছেন। নবী-রসূলগণ সত্যনিষ্ঠ এবং মানুষের কল্যাণকামী ছিলেন। তাঁদেরকে আল্লাহর ওহী অনুযায়ী মানুষের জন্য (ঈমান ও সৎকর্মের ক্ষেত্রে) সুসংবাদদাতা এবং (কুফর ও অসৎকর্মের ক্ষেত্রে) সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁরা আল্লাহর বাণী প্রচারের বিষয়ে মানুষের কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিক, পারিতোষিক, বিনিময় বা খরচাদি চাইতেন না। তাঁরা মানুষকে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করার জন্য আহবান জানাতেন এবং তাদেরকে যাবতীয় অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিতেন। তাঁরা মানবজাতিকে জুলুম থেকে মুক্ত করার জন্য এবং তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। মানুষ হিসেবে মানবীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতেন, পানাহার করতেন, বাজারে যেতেন, হালাল জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাঁদের স্ত্রী-পুত্র পরিজন ছিল, তাঁরা যাদের প্রতি দায়-দায়িত্ব পালন করতেন, তাঁরা সমকালীন সমাজ বাস্তবতায় নিজেদের উত্তম ভূমিকা পালন করতেন। আর তাই তাঁরা মানবজাতির জন্য উত্তম আদর্শ হিসেবে গণ্য। তাঁরা জীবন উৎসর্গ করতে হলেও আল্লাহর বাণী প্রচারে হতোদ্যম হননি এবং যাবতীয় ভয়-ভীতি, দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে উপেক্ষা করে আল্লাহর বাণী প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। মানুষ হিসেবে ব্যক্তিগত জীবন যাপনে কোনো ভুল-ত্রুটি হয়ে গেলে তাঁরা সাথে সাথে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন এবং পরবর্তীতে আর ঐ একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতেন না। আল্লাহর বাণী প্রচারের ক্ষেত্রে তাঁরা কোনো ধরনের ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি দ্বারা তাড়িত হতেন না, আল্লাহর বাণীকে যথাযথভাবে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভিন্নরূপ কিছু করতেন না। তাঁরা কোনো ধরনের লোভ বা মোহের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করতেন না। তাঁরা একমাত্র আল্লাহর ওহীকে মূল অনুসরণীয় বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন বিধায় তাঁদের নৈতিক গুণাবলি ও অন্যদেরকে দেয়া উপদেশের মধ্যে সর্বক্ষেত্রে সামঞ্জস্য বজায় থাকতো। তাঁদের এসব বৈশিষ্ট্য এমন পর্যায়ে প্রতিভাত হতো যে, তাঁদের নবী-রসূল হওয়ার দাবির সত্যতার ক্ষেত্রে তা স্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে সাব্যস্ত হতো, যদিও এরূপ স্পষ্ট প্রমাণ অনুভব করার পরও যারা জালিম তারা নবী-রসূলদের প্রতি ঈমান আনতো না, এমনকি জালিম সম্প্রদায় অনেক নবী-রসূলকে হত্যা করেছে।
নবী-রসূল শব্দ সম্বলিত সকল আয়াত সমন্বিতভাবে অধ্যয়ন করলে বুঝা যায় যে, নবী ও রসূল একই মনোনীত ব্যক্তির দুটি নাম না। আল্লাহ কাউকে শুধু নবী হিসাবে মনোনীত করেন, কাউকে শুধু রসূল হিসাবে মনোনীত করেন এবং কাউকে নবী ও রসূল উভয় পদে মনোনীত করেন। তাই ‘সকল নবীই রসূল কিন্তু সকল রসূল নবী নন’ অথবা ‘সকল রসূলই নবী কিন্তু সকল নবী রসূল নন’ এ দুটি কথার একটিও গ্রহণযোগ্য নয়। সাধারণভাবে জানানো হয়েছে যে, নবীগণ ও রসূলগণ কিতাব পেয়েছেন (২:২১৩, ৫৭:২৫)। তবে ‘সকল নবীকে স্বতন্ত্র কিতাব দেয়া হয়েছে বা সকল রসূলকে স্বতন্ত্র কিতাব দেয়া হয়েছে’ এরূপ কোনো তথ্য জানানো হয়নি।
আল্লাহ যাদেরকে নবুওয়াত ও রিসালাতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন তাদেরকে নবী-রসূল বলা হয়। আবার বলা যায়, আল্লাহ যাদেরকে নবী-রসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন তারাই নবী-রসুল। নবী শব্দের বহুবচন ‘নবীয়্যূন’ ও ‘আম্বিয়া’, এবং রসূল শব্দের বহুবচন হলো ‘রুসুল’। আর নবী-রসূল উভয়কে ‘মুরছাল’ (প্রেরিত) বলা হয় এবং বহুবচনে ‘মুরছালূন’ বলা হয়। যিনি প্রধানত নবুয়াতের দায়িত্বপ্রাপ্ত তথা তাঁর অনুসারীদের সাথে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট থেকে আল্লাহর বিধানচর্চার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল তিনি নবী। আর যিনি প্রধানত রিসালাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত তথা তাঁর অনুসারীদের কাছে আল্লাহর বিধি-বিধান প্রচার করার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল তিনি রসূল। আর যাঁর উপর এ উভয় দায়িত্ব সমান বা প্রায় সমান পর্যায়ে ন্যস্ত, তিনি ‘রাসূলান নবী’ তথা তিনি একই সাথে রসূল ও নবী। আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো রসূল আগমন করলে তাকে সহায়তা করতে নবীদের থেকে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে। রসূলের আনুগত্য বলতে মূলগতভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে বালাগ বা তথ্য ও বিধিবিধান পৌঁছে দেয়ার প্রতিনিধিত্বমূলক অবস্থানের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে আনুগত্য করাকে বুঝায়। সেই সাথে রসূলের আনুগত্যের দ্বিতীয় দিক হলো, রসূল হিসেবে পদাধিকারবলে সমকালের মু’মিনদের কাছে মূল নেতৃত্বে সমাসীন থেকে তিনি যেসব নির্বাহী আদেশ জারি করেন তার আনুগত্য করা।
৩:৮১ :: “আর (উল্লেখ্য) যখন আল্লাহ (প্রত্যেক নবীকে নবুয়াতের দায়িত্ব প্রদানকালে) নবীদের মীছাক্ব/ অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, ‘তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমাত দিয়েছি তারপর যখন তোমাদের কাছে যা আছে তার সত্যতা প্রতিপাদনকারীরূপে কোনো রসূল আগমন করবে, তখন তোমরা তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করলে এবং এ সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে?’ তারা বলেছিলো (অর্থাৎ প্রত্যেক নবী নিজ নিজ নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনকালে বললো), ‘আমরা স্বীকার করলা”। তিনি বললেন, ‘তাহলে তোমরা সাক্ষী থাকো, আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী থাকলা”।
৩৩:৭-৮ :: “আর (উল্লেখ্য) যখন আমি নবীদের থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম এবং তোমার নিকট থেকেও এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা ইবনে মারইয়ামের নিকট থেকেও- তাদের নিকট থেকে আমি গ্রহণ করেছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার। সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার জন্য। তিনি কাফিরদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন মর্মন্তুদ শাস্তি।
আলোচনা: উপরোল্লেখিত দুটি আয়াতে নবী রসূলদের থেকে দুই ধরনের অঙ্গীকারের বিষয় আলোচিত হয়েছে। ৩:৮১ আয়াতে বর্ণিত অঙ্গীকার হলো, নবীগণ তাঁদের পরে কোনো রসূল আগমন করলে সেই রসূলের প্রতি ঈমান আনা ও তাঁকে সাহায্য করার বিষয়ে অঙ্গীকার। আর ৩৩:৭ আয়াতে নবীদের থেকে যে অঙ্গীকার গ্রহণের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে নবুয়াতের দায়িত্ব সম্পাদন এবং দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার বিষয়ে। এর প্রমাণ হচ্ছে ৩৩:৮ নং আয়াতটি, যাতে বলা হয়েছে, “সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার জন্য। তিনি কাফিরদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন মর্মন্তুদ শাস্তি”। অর্থাৎ যখন আল্লাহ কর্তৃক নবীদেরকে দ্বীনের ধারক, বাহক, প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাকারী হিসাবে (৪২:১৩) দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছে তখন তাঁরা যে অঙ্গীকার করেছেন তার ফলে পরবর্তীতে যাতে সেই দ্বীন গ্রহণ বা বর্জন করার ব্যাপারে তথা সত্যবাদীদেরকে ও মিথ্যাবাদীদেরকে পৃথক করার ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বাস্তব প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে; এটাই ছিলো এ অঙ্গীকারের প্রতিপাদ্য বিষয় বা মূল বিষয়বস্তু।
৪:৭৯ :: তোমার কাছে যে কল্যাণ পৌঁছে তা আল্লাহর (অনুগ্রহ) থেকে, আর যে অকল্যাণ তোমার কাছে পৌঁছে তা তোমার নিজের (দুর্বলতা) থেকে। আর আমি তোমাকে মানবজাতির জন্য রাসূলরূপে প্রেরণ করেছি এবং সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ যথেষ্ট।
৪:১৭০ :: হে মানুষ, অবশ্যই তোমাদের নিকট রাসূল এসেছে, তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে সত্য নিয়ে। সুতরাং তোমরা ঈমান আনো, তা তোমাদের জন্য উত্তম হবে। আর যদি কুফর কর, তবে নিশ্চয় আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা রয়েছে, তা আল্লাহর আয়ত্তে এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
৭:১৫৭-১৫৮ :: যারা অনুসরণ করে রাসূলের, যে উম্মী নবী (রসূলান নাবীয়্যাল উম্মীয়্যা) (৪) ; যার গুণাবলী তারা নিজদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় ও বারণ করে অসৎ কাজ থেকে এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তু হারাম করে। আর তাদের থেকে বোঝা ও শৃংখল- যা তাদের উপরে ছিল- অপসারণ করে। সুতরাং যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং তার সাথে যে আলো (কুরআন) নাযিল করা হয়েছে তা অনুসরণ করে তারাই সফলকাম। বলো, ‘হে মানুষ, আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল, যার রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ (সার্বভৌম ও অলৌকিক ক্ষমতায় প্রয়োজন পূর্ণকারী ও উপাস্য) নেই। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু দেন। সুতরাং তোমরা ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি ও তাঁর প্রেরিত উম্মী নবীর প্রতি, যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীসমূহের প্রতি ঈমান রাখে। আর তোমরা তার অনুসরণ করো, আশা করা যায়, তোমরা হিদায়াত লাভ করবে।
(৪) মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে ‘রসূলান নাবিয়্যাল উম্মীয়্যা’ হওয়ার তাৎপর্য: উম্মীদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, ‘তাদের মধ্যে আছে উম্মীগণ, যারা (আসমানী) কিতাবের জ্ঞান রাখে না’ (২:৭৮)। এছাড়া, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ‘তিনিই (আল্লাহ) উম্মীদের মধ্যে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন’ (৬২:২)। উম্মী বলতে বুঝায় যারা আহলে কিতাব (অর্থাৎ কুরআন নাযিলকালের প্রেক্ষিতে যারা পূর্ববর্তী কিতাবের অনুসারী) নয় (দেখুন ৩:২০, ৩:৭৫)। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ উম্মীদের মধ্য থেকে রসূল হয়েছেন বিধায় তাঁকে ‘রসূলান নাবিয়্যাল উম্মীয়্যা’ বলা হয়েছে (৭:১৫৭-১৫৮)।
২৫:১ :: তিনি বরকতময় যিনি তাঁর বান্দার উপর ফুরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী মানদণ্ড) নাযিল করেছেন যেন সে বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হতে পারে।
২৫:৫১-৫২ :: আর আমি ইচ্ছা করলে প্রতিটি জনপদে (স্বতন্ত্রভাবে) সতর্ককারী পাঠাতে পারতাম। সুতরাং কাফিরদের আনুগত্য করো না এবং তা (কুরআন) দ্বারা তাদের সাথে বড় ধরনের (বুদ্ধিবৃত্তিক) সংগ্রাম করো।
৩৪:২৮ :: আমিতো তোমাকে সমগ্র মানব জাতির প্রতি সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জ্ঞানার্জন করে না।
৬২:২-৩ :: তিনিই উম্মীদের মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে, যে তাদের কাছে তেলাওয়াত করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং তাদেরকে শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত। যদিও ইতঃপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল।
২১:১০৬-১০৭ :: নিশ্চয় এর মধ্যে (কুরআনে) (আল্লাহর) ইবাদাতকারী কওমের জন্য বার্তা রয়েছে। আমি তো তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।
৯:৬১ :: আর তাদের মধ্যে রয়েছে যারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে, “সে কান পাতলা (সবার কথা শুনে)”। বলো, “কান পাতলা হওয়া (সবার কথা শুনা) তোমাদের জন্য কল্যাণকর”। সে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং মু’মিনদের প্রতি আস্থা রাখে এবং সে তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনে তাদের জন্য রহমতস্বরূপ। আর যারা আল্লাহর রসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
২:১২৯ :: (ইবরাহীম ও ইসমাইল দোয়া করেছিলো): আমাদের প্রভু, তাদের মধ্যে তাদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করুন যে তাদের কাছে আপনার আয়াত তিলাওয়াত করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাহ (বিচক্ষণতা) শিক্ষা দিবে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবে। নিশ্চয় আপনি মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।
৭:২০৩ :: আর যখন তুমি তাদের কাছে পেশ করো না কোনো আয়াত/ নিদর্শন, তখন তারা বলে, “কেন তুমি নিজেই কোনটি বাছাই করে নাওনি?” বলো, “নিশ্চয় আমি উহারই অনুসরণ করি যা ওহী করা হয় আমার প্রতি আমার প্রভুর পক্ষ থেকে। ইহা (কুরআন) তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে চাক্ষুস প্রমাণ, পথনির্দেশ ও রহমতস্বরূপ, সেই কওমের জন্য যারা ঈমান আনবে”।
১০:১৫ :: আর যখন আবৃত্তি করা হয় তাদের কাছে আমার স্পষ্ট আয়াতসমূহ, তখন যারা (জবাবদিহিতার জন্য) আমার সাথে সাক্ষাত ঘটবে বলে আশা রাখে না তারা বলে, “নিয়ে আসো এ কুরআন ছাড়া অন্য কুরআন অথবা ইহাকে বদলে দাও/ ইহাতে পরিবর্তন করে নাও”। বলো, “আমার জন্য সম্ভব নয় যে, “আমি নিজের পক্ষ থেকে উহাকে বদলে দেবো। আমার কাছে যা ওহী করা হয় তা ছাড়া আমি কোনো কিছুর অনুসরণ করি না। নিশ্চয় আমি মহাদিবসের শাস্তির ভয় করি, যদি আমি আমার প্রভুর অবাধ্যতা করি।
৪২:৭ :: আর এভাবে আমি তোমার প্রতি আরবি ভাষায় কুরআনকে ওহী করেছি যেন তুমি জনপদসমূহের জননী এবং উহার চারিদিকে যারা আছে তাদেরকে সতর্ক করো। আর যেন তুমি একত্রিতকরণের দিনের বিষয়ে সতর্ক থাকো, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। (সেদিন) একদল যাবে জান্নাতে আর একদল যাবে সায়ীরে (জাহান্নামে)।
৫:৪৯-৫০ :: আর তুমি তাদের মধ্যে তার মাধ্যমে বিচার-ফয়সালা করো, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর তাদের থেকে সতর্ক করো। যেন আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তার কিছু থেকে তারা তোমাকে বিচ্যুত না করে। অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে জেনে রাখ যে, আল্লাহ তো তাদেরকে তাদের কিছু পাপের কারণেই আযাব দিতে চান। আর মানুষের অনেকেই ফাসিক। তারা কি তবে জাহিলিয়্যাতের বিধান চায়? আর নিশ্চিত বিশ্বাসী কওমের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক উত্তম?
৬:৫১ :: আর এ (কুরআন) দ্বারা তুমি তাদেরকে সতর্ক করো, যারা ভয় করে যে, তাদেরকে তাদের প্রভুর দিকে সমবেত করা হবে, (এ অবস্থায় যে) তিনি ছাড়া তাদের জন্য থাকবে না কোন সাহায্যকারী আর না সুপারিশকারী। যেন তারা স্রষ্টা সচেতন হতে পারে।
৫০:৪৫ :: এরা যা বলে আমি তা সবচেয়ে ভাল জানি। আর তুমি তাদের উপর কোন জোর- জবরদস্তিকারী নও। সুতরাং যে আমার ধমককে ভয় করে তাকে কুরআনের সাহায্যে উপদেশ দাও।
৩:১৫৯ :: তোমার প্রভুর দয়ায় তুমি তাদের প্রতি কোমল হয়েছো, আর যদি তুমি কঠোরচিত্ত হতে, তাহলে তারা তোমার চারপাশ থেকে সরে যেতো। সুতরাং তাদের প্রতি উদার হও এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং সমষ্টিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের সাথে পরামর্শ করো। তারপর যখন তুমি সিদ্ধান্ত করো তখন (তার বাস্তবায়নের বিষয়ে) আল্লাহর উপর ভরসা করো। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর উপর ভরসাকারীদেরকে ভালবাসেন।
৪২:৪৮ :: আর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে আমি তো তোমাকে তাদের রক্ষক হিসেবে পাঠাইনি। বাণী পৌঁছে দেয়াই তোমার দায়িত্ব। আর আমি যখন মানুষকে আমার রহমত আস্বাদন করাই তখন সে খুশি হয়। আর যখন তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের উপর কোন বিপদ আসে তখন মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ হয়।
৫:৬৭ :: হে রসূল, তুমি তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে তোমার কাছে যা নাযিল করা হয়েছে তা প্রচার করো। আর যদি তুমি তা না করো তাহলে তো তুমি তাঁর বার্তা প্রচার করলে না। আর আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করবেন মানুষের থেকে (অর্থাৎ মানুষ তোমাকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিবে ও তোমার প্রচারকার্যকে ব্যাহত করে দিবে এরূপ অপকৌশল থেকে)।
৪:১১৩ :: আর তোমার উপর যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া না হতো তবে তাদের মধ্য থেকে একদল তোমাকে পথভ্রষ্ট করার সংকল্প করেই ফেলেছিল! আর তারা নিজদের ছাড়া কাউকে পথভ্রষ্ট করে না এবং তারা তোমার (ঈমান ও আমলের) কোনই ক্ষতি করতে পারে না। আর আল্লাহ তোমার প্রতি নাযিল করেছেন কিতাব ও হিকমাত এবং তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন যা তুমি জানতে না। আর তোমার উপর আল্লাহর অনুগ্রহ রয়েছে মহান।
১৭:৭৩-৭৭ :: আর তাদের অবস্থা এমন ছিল যে, আমি তোমাকে যে ওহী দিয়েছি, তা থেকে তারা তোমাকে প্রায় ফিতনায় ফেলে দিয়েছিল, যাতে তুমি আমার নামে তা ছাড়া অন্য কিছু রচনা করো এবং তখন তারা অবশ্যই তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতো। আর আমি যদি তোমাকে অবিচল না রাখতাম, তবে অবশ্যই তুমি তাদের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়তে। তাহলে (তুমি ঝুঁকে পড়লে) আমি তোমাকে জীবনকালে দ্বিগুণ ও মৃত্যু (পরবর্তী) কালে দ্বিগুণ শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাতাম। তখন আমার বিরুদ্ধে তুমি কোনো সাহায্যকারী পেতে না। আর তাদের অবস্থা এমন ছিল যে, তারা তোমাকে যমীন থেকে উৎখাত করে দেবে, যাতে তোমাকে সেখান থেকে বের করে দিতে পারে এবং তখন তারা তোমার পরে স্বল্প সময়ই টিকে থাকতে পারবে। এটাই সুন্নাত তাদের থেকে চলে আসছে তোমার পূর্বে আমি আমার যেসব রসূলদেরকে প্রেরণ করেছি। আর তুমি আমার সুন্নাতে কোনো পরিবর্তন পাবে না।
আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ তাঁর কাছে নাযিলকৃত ওহী আল কুরআন দ্বারাই উপদেশ দান করতেন, সুসংবাদ ও সতর্ককরণ করতেন, তিনি কুরআন দ্বারাই বিচার-ফায়সালা করতেন, কুরআন তিলাওয়াত করতেন, কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী কিতাব (কুরআনের বিধিবিধান) ও হিকমাহ (কুরআনে থাকা বিজ্ঞতাপূর্ণ নিয়মপদ্ধতি) শিক্ষা দান করতেন এবং কুরআনের শিক্ষার মাধ্যমে লোকদেরকে পরিশুদ্ধ করতেন। তিনি শুধুমাত্র ওহীর অনুসরণ করতেন এবং যখন তিনি এ বিষয়টি অন্যদের কাছে ঘোষণা করতেন তখন তা দ্বারা তিনি কুরআনকেই সর্বজনীন অনুসরণীয় ওহী হিসেবে পেশ করেছেন। তিনি কুরআনের সীমানির্দেশ অনুসারে বাস্তব পরিস্থিতি তথা স্থান-কাল-পাত্র এবং প্রযুক্তি ও হাতিয়ার বিবেচনায় বিভিন্ন নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে মু’মিনদের সাথে পরামর্শ করতেন এবং সেসব পরামর্শকে বিবেচনায় রেখে যখন কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন তখন তার বাস্তবায়নে আল্লাহর উপরই ভরসা করতেন। তিনি মু’মিনদের সমাজ জীবনে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে আল্লাহর মনোনয়নের ভিত্তিতে মূল নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। তবে যারা তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে ঈমান আনতো না তাদের প্রতি শুধুমাত্র বালাগ বা প্রচার করে দেয়া ছাড়া তাঁর আর কোনো দায়িত্ব ছিলো না। কারণ তিনি তাদের প্রতি জবরদস্তিকারী ও রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে প্রেরিত হননি। তবে কাফিররা চেষ্টা করেছিলো তাঁকে দিয়ে কুরআন ছাড়া অন্য কিছু রচনা করিয়ে তা আল্লাহর নামে চালিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি তাদের এ চক্রান্তের দিকে ঝুঁকেননি, আর তাই কাফিরদের উত্তরোত্তর প্রচেষ্টাতে তিনি সেদিকে ঝুঁকার যে সম্ভাবনা ছিলো আল্লাহ তাঁকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। সুতরাং তিনি আমাদের জন্য চির স্মরণীয় তথ্য ও বিধি-বিধান সম্বলিত গ্রন্থ হিসেবে শুধুমাত্র তাঁর কাছে নাযিলকৃত আল কুরআন রেখে গেছেন। তাঁর আদর্শ অনুসরণে আমাদের কর্তব্য হলো কুরআনকে একমাত্র বিধানগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করা এবং যেসব বিষয়ে কুরআনে কোনো বিধান নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি সেক্ষেত্রে কুরআনের সীমারেখা লঙ্ঘন না করে সমষ্টিগত বিষয়ে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
৩:৩১-৩২ :: বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। বলো, আল্লাহর ও রসূলের আনুগত্য করো। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদেরকে ভালবাসেন না।
৪:৮০ :: যে রসূলের আনুগত্য করে সে আল্লাহরই আনুগত্য করে। আর যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আমি তোমাকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক করে প্রেরণ করিনি।
৪:৫৯ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রসূলের ও তোমাদের মধ্যকার উলিল আমরের (সমষ্টিগত বিষয়ে আদেশদানের অধিকারীদের) আনুগত্য করো। তারপর যদি কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতবিরোধ হয় তাহলে তা (ফায়সালার জন্য) আল্লাহর ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা আল্লাহর ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখো। এটাই (নীতি হিসেবে) উত্তম এবং পরিণতির দিক থেকেও সবচেয়ে সুন্দর, সর্বোত্তম।
৪:৬৫ :: সুতরাং না, তোমার বিধাতার কসম, তারা মু’মিন হবে না যতক্ষণ না তারা তাদের পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদের বিষয়ে তোমার নিকট বিচার মীমাংসার ভার অর্পণ করে, তারপর তারা তোমার বিচার / সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিজেদের মধ্যে কোনো সংকোচ-সংকীর্ণতা অনুভব না করে এবং তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে আত্মসমর্পণ বজায় না রাখে।
৪:৮৩ :: আর যখন তাদের কাছে আসে নিরাপত্তার অথবা আশংকার কোনো বিষয়, তখনি তারা উহা প্রচার করতে থাকে। অথচ যদি তারা তা পৌঁছে দিতো রসূলের দিকে এবং তাদের মধ্য থেকে হওয়া উলিল আমরের দিকে, তাহলে তা জানতে পারতো তাদের মধ্য থেকে থাকা ঐ ব্যক্তিরা যারা তথ্য যাচাই করে সঠিক সুপারিশ প্রণয়ন করতে পারে, আর যদি তোমাদের উপর আল্লাহর (ব্যাপক) অনুগ্রহ ও দয়া না থাকতো তাহলে তোমরা শয়তানের অনুসরণ করতে, অল্প কয়েকজন ছাড়া।
৩৩:৬ :: নবী মু’মিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও ঘনিষ্ঠতর এবং তার স্ত্রীগণ (আল্লাহর ঘোষণা অনুসারে) তাদের মা। আর আল্লাহর কিতাবের বিধান অনুযায়ী রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়গণ (সাধারণ দায়দায়িত্ব ও উত্তরাধিকারের প্রশ্নে) মু’মিনদের ও মুহাজিরদের চেয়েও একে অন্যের ঘনিষ্ঠতর। কিন্তু তোমরা তোমাদের বন্ধুদের বিষয়ে ন্যায়সঙ্গতভাবে যা করে থাকো তা (বিশেষ সহযোগিতা প্রদান ও ওয়াসিয়্যাতে অন্তর্ভুক্ত করা) ব্যতিক্রম। এটাই কিতাবে লিপিবদ্ধ করা হলো।
৩৩:৫৩ :: হে মু’মিনগণ, তোমরা নবীর গৃহসমূহে প্রবেশ করো না তোমাদেরকে অনুমতি দেয়া ছাড়া খাদ্য গ্রহণের জন্য তা প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়াই। কিন্তু যখন তোমাদেরকে দাওয়াত দেয়া হয় তখন (যথাসময়ে) প্রবেশ করো। তারপর যখন খাদ্যগ্রহণ শেষ করো, তখন তোমরা চলে যাও। আর তোমরা হাদীসের / কথার উদ্দেশ্যে মশগুল হয়ো না। নিশ্চয় এসব নবীকে কষ্ট দেয়। কিন্তু সে তোমাদের কাছে তা প্রকাশ করতে লজ্জিত হয়। আর আল্লাহ সত্য প্রকাশে লজ্জিত হন না। আর যখন তোমরা তাদের কাছে (তথা নবীর স্ত্রীদের কাছে) কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য বা জিনিসের প্রার্থী হও, তখন (ঘরের) পর্দার আড়াল থেকে প্রার্থিতা প্রকাশ করো। সেটাই অধিক পবিত্র নিয়ম তোমাদের মনের জন্য এবং তাদের মনের জন্য। আর তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূলকে কষ্ট দেয়া সঙ্গত নয়। আর এও সঙ্গত নয় যে, তোমরা তার পরবর্তীতে কখনো তার স্ত্রীদেরকে বিয়ে করবে। নিশ্চয় তা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত বড় পাপপ্রবণতা।
২৪:৬২ :: নিশ্চয় মু’মিনূন তারাই যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলের প্রতি আর যখন তারা থাকে তার সাথে কোন সমষ্টিগত কাজে, তখন তারা চলে যায় না যতক্ষণ না তার থেকে অনুমতি চায়। নিশ্চয় যারা তোমার অনুমতি চায় তারাই সেসব লোক যারা ঈমান রাখে আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলের প্রতি। সুতরাং যখন তারা তোমার অনুমতি চায় তাদের কোনো ব্যাপারে (প্রয়োজন থাকায়), তখন তুমি অনুমতি দাও তাদের মধ্য থেকে যাকে তুমি ইচ্ছা করো। আর তুমি তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
৪৯:৭ :: তোমরা (মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর সমকালীন মু’মিনরা) জেনে রাখো যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রসূল রয়েছেন, যদি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে তোমাদের মতামত/পরামর্শ মেনে নিতো, তবে তোমরাই কষ্টে পড়ে যেতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং হৃদয়গ্রাহী করেছেন এবং তোমাদের নিকট কুফর, ফিসক ও অবাধ্যতাকে অপ্রিয় করেছেন। আর (যারা এরূপ) তারাই সুপথ অবলম্বনকারী।
আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্ট হয় যে:
(১) রসূলের অনুসরণ করা আল্লাহর ভালবাসা পাওয়ার উপায়।
(২) রসূলের আনুগত্য করার মানে হলো আল্লাহরই আনুগত্য করা, কারণ আল্লাহই আদেশ দিয়েছেন রসূলের আনুগত্য করার জন্য। যেহেতু রসূল আল্লাহর নাযিলকৃত কুরআন অনুযায়ীই আদেশ দান করেন তাই তিনি সেটাই স্থায়ী মূল আদেশ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন যা কুরআনে রয়েছে এবং অন্যক্ষেত্রে তিনি কুরআনের সীমারেখা রক্ষা করে সমকালীন প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় নির্বাহী / পরিবর্তনীয় প্রকৃতির / অস্থায়ী আদেশ দিয়েছেন।
(৩) রসূল মু’মিনগণের নিকট নিজ জীবনের চেয়ে বেশি প্রিয়।
(৪) রসূলের স্ত্রীদেরকেও আল্লাহর ঘোষণার মাধ্যমে মু’মিনদের মায়ের মর্যাদা দেয়া হয়েছে এবং রসূলের পরে তাদের কাউকে বিয়ে করা মু’মিনদের জন্য অবৈধ করে দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত এটা শুধু তাদের নিজেদের মাতৃমর্যাদার সাথে তথা তাদের সাথে সম্পর্কিত বিষয়, যেহেতু আপন বোনকে যেমন বিয়ে করা নিষিদ্ধ রসূলের কন্যাগণকে মু’মিনদের জন্য সেভাবে বোন হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়নি, তাই রসূলের কন্যাগণের বিষয়ে তাঁর স্ত্রীদের মতো একই ধারা প্রযোজ্য নয়।
(৫) রসূল মু’মিনদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সকল পরামর্শ ও মতামতকে মেনে নেয়া সম্ভব নয়, বরং বাস্তব কল্যাণার্থেই অনেক ক্ষেত্রে মু’মিনদের পরামর্শের চেয়ে ভিন্নরূপ নির্বাহী সিদ্ধান্ত তিনি গ্রহণ করতে হয়েছিলো, সেক্ষেত্রেও তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নেয়াই মু’মিনদের কর্তব্য।
(৬) রসূলের আনুগত্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো রসূলের সমকালীন মু’মিনদের জন্য হুবহু প্রযোজ্য, পরবর্তীকালে যেহেতু রসূল অনুপস্থিত এবং তাই কোনো নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ঘোষণা করতে পারেন না, তাই বর্তমানে তাঁর রেখে যাওয়া তাঁর কাছে নাযিলকৃত কুরআনের আদেশ পালনই রসূলের আদেশ পালন হিসেবে সাব্যস্ত, যেহেতু কুরআনের আদেশগুলোই তিনি বাস্তবায়ন পর্যায়ে মূল আদেশ হিসেবে ব্যক্ত করতেন। অন্যদিকে রসূলের নির্বাহী আদেশ বাস্তবায়নের প্রসঙ্গে বর্তমানে প্রযোজ্য নীতি হলো: মু’মিনদের মধ্য থেকে ‘উলিল আমর’ নির্বাচিত করে তাঁর কুরআনসঙ্গত আদেশ পালন করা। কারণ যখন যেখানে রসূল উপস্থিত থাকবেন না তখন সেখানে উলিল আমরের আদেশই তাঁর পক্ষ থেকে আদেশ বলে সাব্যস্ত হয়।
৩৬:১-৫ :: ইয়া সীন। শপথ জ্ঞানগর্ভ কুরআনের। নিশ্চয় তুমি রসূলদের অন্তর্ভুক্ত। তুমি সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথের উপর রয়েছো। (কুরআন) মহাশক্তিমান, দয়ালুর অবতীর্ণ।
৬৮:১-৪ :: নূন। শপথ কলমের এবং যা তারা লিপিবদ্ধ করছে তার। তোমার প্রভুর অনুগ্রহে তুমি পাগল নও। আর নিশ্চয় তোমার জন্য রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার। আর নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।
৪৮:২৯ :: মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; পরস্পরের প্রতি সদয়, তুমি তাদেরকে রুকূকারী, সিজদাকারী অবস্থায় দেখতে পাবে। তারা আল্লাহর করুণা ও সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করছে। তাদের আলামত হচ্ছে, তাদের চেহারায় সিজদার চিহ্ন থাকে। এটাই তাওরাতে তাদের দৃষ্টান্ত। আর ইনজীলে তাদের দৃষ্টান্ত হলো একটি চারাগাছের মতো, যে তার কচিপাতা উদগত করেছে ও শক্ত করেছে, অতঃপর তা পুষ্ট হয়েছে ও স্বীয় কান্ডের উপর মজবুতভাবে দাঁড়িয়েছে, যা চাষীকে আনন্দ দেয়। যাতে তিনি তাদের দ্বারা কাফিরদেরকে ক্রোধান্বিত করতে পারেন। তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও মহাপ্রতিদানের ওয়াদা করেছেন।
৯:১২৮-১২৯ :: নিশ্চয়ই তোমাদের নিজদের মধ্য থেকে তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন, তা তার জন্য কষ্টদায়ক যা তোমাদেরকে পীড়া দেয়। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, অত্যন্ত দয়ালু। অতঃপর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে বলো, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ (সার্বভৌম, অলৌকিক ক্ষমতায় প্রয়োজন পূর্ণকারী ও উপাস্য) নেই। আমি তাঁরই উপর ভরসা করেছি। আর তিনিই মহান আরশের প্রভু’।
৪৭:১৯ :: অতএব তুমি জেনে রাখ যে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য উপাস্য নেই, আর তোমার ত্রুটির জন্যে তুমি ক্ষমা চাও, আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের জন্যেও। আর আল্লাহ্ জানেন তোমাদের গতিবিধি এবং তোমাদের অবস্থান।
৪৮:১-২ :: নিশ্চয় আমি তোমাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়। যেন আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করতে পারেন (যেন ক্ষমা লাভের সুযোগ পাও), তোমার যা কিছু ত্রুটি আগে হয়েছে এবং যা কিছু (ত্রুটি) পরে হয়েছে। এবং যেন তোমার প্রতি তাঁর নিয়ামত পূর্ণ করেন এবং তোমাকে সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথে পরিচালিত করেন।
আলোচনা: মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথে (সিরাতুল মুসতাক্বীমে) ছিলেন এবং তিনি উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি মু’মিনদের প্রতি কোমল এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর ছিলেন। তিনি মানুষের ভীষণ কল্যাণকামী ছিলেন। আল্লাহ তাঁর ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষমা চাওয়ার জন্য তাঁকে যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত পরিবেশগত সাহায্যও প্রদান করেছিলেন। তাঁর যা কিছু ভুল-ত্রুটি হয়েছিলো আল্লাহ ওহী নাযিল করে তা সংশোধন করে দিয়েছেন।
(১) সূরা আলে ইমরান ৩:১২৮-১২৯ আয়াত। ঘটনাক্রমে কাফিরদের প্রতি অভিশাপ দিলে আল্লাহ তা সংশোধন করে দেন।
(২) সূরা নিসা ৪:১০৫-১০৭ আয়াত। সাহাবীদের ভুল ইজতিহাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নবীও ভুলভাবে বাদী বা বিবাদীর সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। তখন আল্লাহ আয়াত নাযিল করে নবীকে নিবৃত্ত করে দেন এবং ভুল রায় দেয়া থেকে রক্ষা করেন।
(৩) সূরা আনফাল ৮:৬৭-৬৮ আয়াত। এ আয়াতে কাফিরদেরকে ভালোমতো পর্যুদস্ত করার আগেই তাদেরকে (স্বেচ্ছায় অস্ত্র না নামানো অবস্থায়) ফিদইয়ার বিনিময়ে মুক্তিদানের অভিপ্রায়ে (৪৭:৪) বন্দি করাকে (মু’মিনদের কর্তৃত্বশীল হিসেবে) রসূলের জন্য সঙ্গত হয়নি মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে।
(৪) সূরা তাওবা ৯:৪৩ আয়াত। এ আয়াতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে অব্যাহতির জন্য মুনাফিকদের আবেদন মঞ্জুর করার আগে তাদের অজুহাত সত্য কিনা তা যাচাই করে স্পষ্ট হওয়া ছাড়াই তাদেরকে অনুমতি দেয়া রসূলের জন্য সঙ্গত হয়নি মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে।
(৫) সূরা বনী ইসরাইল ১৭:৭৩-৭৫ আয়াত। মুনাফিকদের উপর্যুপরি আবদারের প্রেক্ষিতে তাদেরকে কিছুটা অবকাশ দেয়ার মতো কিছু বলার ব্যাপারে নবীর মধ্যে ভাবান্তর আসছিলো, কিন্তু আল্লাহর সাহায্যক্রমে তিনি তা থেকে বিরত হন। এটা ১২:২৪ আয়াতে বর্ণিত রসূলুল্লাহ ইউসুফের ভাবান্তরের অনুরূপ, তিনিও আল্লাহর সাহায্যক্রমে নিজ মনোভাবকে সঠিক অবস্থানে নিয়ে এসেছিলেন। ১৭:৭৩-৭৫ আয়াতে বলা হয়েছে যে, রসূল যদি ভাবান্তরকে কার্যে পরিণত করার দিকে অগ্রসর হতেন তাহলে তাঁকে জীবদ্দশায় ও মৃত্যুকালে দ্বিগুণ করে শাস্তি ভোগ করতে হতো। সুতরাং রসূল বস্তুত নিজেকে ঠিক অবস্থানে ধরে রেখেছেন এবং এক্ষেত্রে তিনি আল্লাহর সাহায্য পেয়েছিলেন। তাই এতে কার্যত তাঁর কর্তৃক গণ্য করার মতো ত্রুটি ঘটেনি, তা সত্ত্বেও এতটুকু ভাবান্তরের বিষয়টিও কুরআনে তুলে ধরা হয়েছে এবং এভাবে মূলত তিনি যে আল্লাহর সাহায্যক্রমে এ ধরনের ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত থেকেছেন সেটাই প্রমাণ করা হয়েছে।
(৬) সূরা আহযাব ৩৩:৩৭-৩৯ আয়াত। এ আয়াতে আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূলের জন্য ফরজকৃত বিষয়ের (‘যদি যায়েদ তার স্ত্রীকে তালাক দেয় তাহলে ঐ তালাকপ্রাপ্তা নারীকে বিয়ে করা রসূলের জন্য স্থিরীকৃত সিদ্ধান্ত’) অনুকূলে কথা বলার (‘এটা তোমার ইচ্ছাধীন বিষয়’) পরিবর্তে ‘তুমি দাম্পত্য সম্পর্কে রেখে দাও (তথা তালাক দিও না)’ বলা এবং ‘যায়েদ তাকে তালাক দিলে রসূল তাকে বিয়ে করতে হবে’ এই তথ্যটি প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার কারণে রসূলকে সংশোধনী দেয়া হয়েছে যে, এক্ষেত্রে রসূলের মনে লোকজনের পক্ষ থেকে অবজ্ঞার পাত্র হবার ভয় কাজ করছিলো, যা উচিত নয়, বরং তিনি শুধু আল্লাহকেই ভয় করা উচিত।
(৭) সূরা তাহরীম ৬৬:১ আয়াত। এ আয়াতে নবী আল্লাহর হালাল করা মধু বা কোনো হালাল খাদ্যকে তাঁর স্ত্রীদেরকে খুশি রাখতে যেয়ে নিজের জন্য হারাম করে নেয়ার বিষয়ে তাঁকে সংশোধনী দেয়া হয়।
(৮) সূরা আবাসা ৮০:১-১০ আয়াত। কতিপয় বিশেষ ব্যক্তির প্রতি মনোযোগের সাথে তাদের বুঝানোর সময় জনৈক অন্ধ ব্যক্তির কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসার জন্য রসূলের দিকে ছুটে আসলে তিনি ভুলক্রমে তার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন, আয়াতগুলোতে এ বিষয়ে তাঁকে সংশোধনী দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৬:৫২-৫৩ আয়াত থেকে জানা যায় যে, রসূলের মজলিস থেকে কিছু মু’মিনকে বের করে দিলে রসূলের সাথে বসতে রাজি আছে, এরূপ দাবির প্রেক্ষিতে এমনটি ঘটতে পারতো, কিন্তু তার আগেই আল্লাহ রসূলকে তা থেকে নিবৃত্ত করেন।
কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে রসূলের ত্রুটিসমূহের সংশোধনী দেয়ার মাধ্যমে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয় তাহলো:
(ক) রসূলের যেসব ত্রুটি ও তার সংশোধনী চিরন্তন বিধানগ্রন্থে উল্লেখের যোগ্য তা কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে। এর বাহিরে রসূলের কোনো কাজের বিবরণ, তাতে ত্রুটি হওয়া বা না হওয়া ইত্যাদি নিশ্চিতভাবে জানা পরবর্তীদের জন্য প্রয়োজনীয় নয়।
(খ) রসূল রোবট ছিলেন না যে, নির্বাহী ক্ষেত্রে তাঁর ব্যক্তিগত কোনো চিন্তাধারা, বুদ্ধি-বিবেচনা, কার্যক্রম নেই, সবকিছুই শুধু ওহী আসে আর তিনি নড়াচড়া করেন, ওহী নেই, তিনি নিশ্চল। বরং তাঁর নির্বাহী কার্যক্রমে তিনি কুরআনের অনুসরণ করেন, কিন্তু কোথাও মানবীয় ত্রুটি হয়ে গেলে কুরআন দ্বারাই সংশোধনী আসে। রসূলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো যেন তিনি পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সুতরাং নির্বাহী বিষয়ে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রের (কৃষি, বিজ্ঞান প্রযুক্তি, প্রকৌশলবিদ্যা ইত্যাদি) তাঁর অনুসারীদের মধ্যেও কেউ উত্তম পরামর্শ দেয়া সম্ভব। এমতাবস্থায়, রসূলের যাবতীয় নির্বাহী কাজ স্বতন্ত্র ওহীয়ে গায়রে মাতলুর মাধ্যমে হতো, তাই তাঁর কোনো ভুল নেই এবং প্রচলিত হাদীসগ্রন্থগুলোতে সব শুদ্ধ এ ধরনের জোড়াতালি কথাগুলো গ্রহণযোগ্য নয়।
কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর কাছে দুই ধরনের ওহী করা হয়েছে। যথা: (১) সেই ওহী যা কিতাবের অন্তর্ভুক্ত তথা কুরআন, (২) সেই ওহী যা কিতাবের অন্তর্ভুক্ত নয়। এই দ্বিতীয় প্রকারে ওহী এমনকি নবী-রসূলের বাহিরেও করা হয়েছিল। যেমন- রসূলুল্লাহ ঈসার মাকে ও মূসার মাকে তাঁরা (ঈসা ও মূসা) যে রসূল হবেন সে তথ্য অগ্রিম জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো (৩:৪৫-৪৯, ১৯:১৭-১৯, ২৮:৭)।
মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর কাছে কুরআনের বাহিরে যা ওহী হয়েছে তার ধরন হলো: [ক]. রসূলের নিতান্ত ব্যক্তিগত কোন সমসাময়িক বিষয় বা মুসলিম উম্মাহর সাথে সম্পর্কিত কোন সমসাময়িক বিষয়ে কোন তথ্য, যার মধ্য থেকে যেটি চিরন্তনভাবে পরবর্তীদের জানার উপযোগী হয়ে গেছে আল কুরআনে তার প্রসংগ আসার মধ্য দিয়ে তা ছাড়া বাকি কিছুর ব্যাপারে প্রচার, প্রসার, পরবর্তী সংকলন না উপযোগিতা রাখে আর না নিশ্চয়তা রাখে, এমন কিছুকে বর্তমানে ওহী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কোন সুযোগ নেই, কারণ এমন ওহী তাঁর পর্যন্তই ঘটনা শেষ, এখন তাকে ওহী হিসেবে জানার ও মানার দরকার হলে তা আল কুরআনে প্রসঙ্গক্রমে আনা হতো। [খ]. মুসলিম উম্মাহর জন্য কোন অধ্যাদেশমূলক ওহী, যাতে সাময়িকভাবে কোন বিধান দেয়া হয়েছিল, পরবর্তীতে তা আল কুরআনে সন্নিবেশিত করা হয়েছে, তাহলে তা নিশ্চিত, আর যদি আল কুরআনে সন্নিবেশিত না থাকে, তবে তার প্রচার, প্রসার, সংকলন এর উপযোগিতা ও নিশ্চয়তা নেই।
১। রসূলের সকল কথাই ওহী বলে দাবি করা
৫৩:৩-৪ :: সে (মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ) প্রবৃত্তি বশত উপস্থাপন করছে না। (যা সে উপস্থাপন করছে) তা ওহী ছাড়া কিছুই নয়, যা তার কাছে ওহী করা হয় (এবং সেই ওহীকেই সে উপস্থাপন করে)।
আলোচনা: আয়াতটিকে প্রচলিত হাদীসগ্রন্থও রসূলের কাছে ওহী হিসেবে দাবি করার জন্য দলীল হিসেবে সামনে আনা হয়। আয়াতটি প্রচলিত হাদীসগ্রন্থগুলোকে সত্যায়িত করে না। বরং আয়াতটির পূর্বাপর বাক্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, রসূলুল্লাহ মুশরিকদের কাছে যে ওহীকে অনুসরণের জন্য উপস্থাপন ও আহবান করেছেন এখানে সেই কুরআনের বিষয়েই বক্তব্য রাখা হয়েছে।
২। রসূল যা দিয়েছেন তা গ্রহণ করার নির্দেশ
৫৯:৭ :: আল্লাহ তাঁর রসূলের কাছে জনপদবাসীর কাছ থেকে যা ফায়স্বরূপ দিয়েছেন, তা আল্লাহর জন্য এবং রসূলের জন্য এবং আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং ইয়াতিম ছেলেমেয়েদের জন্য এবং মিসকীনদের জন্য এবং ইবনে সাবীলের (ছিন্নমূলের/বাস্তুহারাদের/উদ্বাস্তুদের) জন্য। যেন সম্পদ তোমাদের মধ্য থেকে শুধু ধনীদের মধ্যে আবর্তিত/পুঞ্জিভুত না হয়। আর রসূল (নির্বাহী সিদ্ধান্তে) তোমাদেরকে যা দেয় তোমরা তা গ্রহণ করো এবং সে (নির্বাহী নিষেধাজ্ঞারূপে) তোমাদেরকে যা থেকে নিষেধ করে তোমরা তা থেকে বিরত থাকো। আর তোমরা আল্লাহ সচেতন হও, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।
আলোচনা: আয়াতটির পূর্বাপর অংশ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আন্ডারলাইন করা অংশটুকুকে দলীল হিসেবে সামনে আনা হয়। অথচ সম্পূর্ণ আয়াতটি পড়লে স্পষ্ট যে, এখানে রসূলের নির্বাহী ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তিনি সম্পদ বণ্টনের সময় যাকে যা দেন সে তা-ই গ্রহণ করতে হবে এবং যা স্বত্বাধিকারে নেয়া থেকে বিরত থাকতে বলেন তা থেকে বিরত থাকতে হবে। বর্তমানে রসূল উপস্থিত না থাকায় রসূলের পক্ষ থেকে উলিল আমর কুরআনের সীমারেখা সংরক্ষণ করে সম্পদ বণ্টনের নীতিমালা বাস্তবায়ন করবেন। এর সাথে প্রচলিত হাদীসগ্রন্থগুলোকেও কুরআনের পাশাপাশি স্বতন্ত্র স্থায়ী বিধানগ্রন্থ হিসেবে মেনে নেয়ার কোনো অবকাশ নেই।
৩। আল্লাহ ও রসূলের অবাধ্য না হওয়া বা সিদ্ধান্তের ব্যতিক্রম না করা
৪:১৪ :: আর যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্য হবে এবং তাঁর (আল্লাহর) সীমারেখা লঙ্ঘন করবে তিনি তাকে (জাহান্নামের) আগুনে প্রবেশ করাবেন, সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার জন্য আছে লাঞ্চনাদায়ক শাস্তি।
৩৩:৩৬ :: আর কোনো মু’মিনের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোনো বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিলে সেই বিষয়ে ভিন্নরূপ (মত পোষণ ও কার্য সম্পাদন) করার ইখতিয়ার (স্বাধীনতা) নেই। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হয় সে স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হয়।
আলোচনা: আল্লাহর পক্ষ থেকে চিরস্মরণীয় বাণী কুরআনে সংরক্ষিত রয়েছে এবং কুরআনের পরে কোনো কিতাবে ঈমান রাখার জন্য নির্দেশ নেই, বরং যার কাছেই কুরআন পৌঁছবে তাকেই এর দ্বারাই স্মরণীয় বিষয় স্মরণ করতে হবে। রসূলের সিদ্ধান্ত হয় কুরআনের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়নমূলক সিদ্ধান্ত। তিনি কুরআনের আলোকে মু’মিনদেরকে পরিচালিত করতে গিয়ে যেসব সমকালীন অস্থায়ী নির্দেশ দিয়েছেন তা তাদের জন্য সরাসরি প্রযোজ্য ছিল, কিন্তু পরবর্তীদের জন্যও প্রযোজ্য বিষয় হলে আল্লাহ তা কুরআনে অন্তর্ভুক্ত করে দিতেন। সুতরাং এ আয়াতগুলোর বক্তব্য অবশ্য পালনীয়। অন্যদিকে এ আয়াতগুলোর সূত্র উল্লেখ করে প্রচলিত হাদীসগ্রন্থকে মেনে নেয়ার দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।
৪। আল্লাহ এবং তাঁর রসূল কোনো কিছুকে হালাল ও হারাম করা
৯:২৯ :: তোমরা যুদ্ধ করো যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের মধ্য থেকে তাদের বিরুদ্ধে (সেই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে) যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে না এবং আখিরাত দিবসের প্রতিও (ঈমান রাখে) না, এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা হারাম (নিষিদ্ধ) করেছেন সেটাকে হারাম করে না (নিষিদ্ধ বলে সাব্যস্ত ও কার্যকর করে না) এবং সঠিক জীবনবিধানকে নিজেদের জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করে না; যতক্ষণ না তারা তাদের স্বহস্তে জিযইয়া (সামগ্রিক নাগরিক সুবিধার বা রাষ্ট্রীয় জিম্মাদারির বিপরীতে প্রদেয় ‘কর’/ অন্যায় যুদ্ধ করার কারণে সংঘটিত ক্ষয়ক্ষতির জরিমানা) প্রদান করে, এ অবস্থায় যে, তারা ক্ষুদ্রশক্তি হয়ে থাকে।
আলোচনা: এ আয়াতে আল্লাহ ও রসূল যা হারাম করেন বলতে বুঝায়, যা আল্লাহ হারাম হিসেবে প্রণয়ন করেন এবং রসূল হারাম হিসেবে বাস্তবায়ন করেন। আয়াতটির মধ্যেই এ বিষয়ে ব্যাখ্যা রয়েছে। আয়াতটিতে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির আহলে কিতাবের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ ও রসূল যা হারাম করেন তাকে হারাম করে না। এখানে, তারাও হারাম করা না করার বিষয় এসেছে। অর্থাৎ তাদের উচিত ছিলো ‘আল্লাহ ও রসূল যা হারাম করেন, সেটাকে হারাম করা’। তারা ‘সেটাকে হারাম করা’ বলতে বুঝায়, ‘সেটাকে হারাম হিসেবে বাস্তবায়ন করা’। সুতরাং রসূল হারাম করার অর্থও হলো, ‘আল্লাহ যা হারাম করেন রসূলও সেটাকে হারাম হিসেবে বাস্তবায়ন করা বা বাস্তবায়ন করার জন্য নির্দেশ দেয়া’। এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন আমরা ৬৬:১ আয়াতে দেখতে পাই যে, রসূল নিজে থেকে কিছুই হারাম করার অধিকার রাখতেন না। নিম্নে আয়াতটির অনুবাদ দেয়া হলো:
৬৬:১ :: হে নবী, আল্লাহ তোমার জন্য যা হালাল করেছেন তুমি তা হারাম করছো কেন? তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাহিতেছ। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
৫। আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়া
৪:৫৯ আয়াতে মতবিরোধের বিষয় আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দিতে বলা হয়েছে। তা থেকে বুঝা যায় যে, উলিল আমরের সাথে মু’মিনদের মতবিরোধ হতে পারে, তার সমাধানের জন্য তা আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
এ বিষয়েও পূর্বোক্ত আলোচনা প্রযোজ্য। এ বিষয়টি রসূলের সমকালে হুবহু প্রযোজ্য ছিল। আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে দেয়ার অর্থ হলো আল্লাহর নাযিলকৃত কুরআনের আলোকে সমাধান করা। আর রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার মানে হলো, রসূল কুরআনের আলোকে সমাধান নির্দেশ করবেন এবং যদি কোনো বিষয়ে কুরআনে কিছু নির্দিষ্ট করে দেয়া না থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে রসূল সমকালীন প্রেক্ষাপটে কোনো সিদ্ধান্ত দিলে সেটাও অনুসরণ করতে হবে। বর্তমানে অন্যান্য উলিল আমরের সাথে মতবিরোধের বিষয় সর্বোচ্চ উলিল আমরের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে রসূলের প্রতিনিধির কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে। আর সর্বোচ্চ উলিল আমরের সাথে মতবিরোধ হলে তাতে রসূলের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মু’মিনদের মধ্য থেকে কোনো তৃতীয় নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন মীমাংসাকারী নিযুক্ত করতে হবে।
৬। রসূল কিতাবের ব্যাখ্যা করা
১৬:৪৩-৪৪ :: আমি তো তোমার পূর্বেও পুরুষদেরকেই নবী-রসূলরূপে প্রেরণ করেছি যাদের কাছে আমি ওহী করেছি। যদি তোমরা না জানো তবে আহলে যিকরকে (অর্থাৎ আহলে কিতাবকে) জিজ্ঞাসা করো। (তাদেরকে প্রেরণ করেছি) স্পষ্ট প্রমাণ ও পুস্তিকাসমূহসহ। আর আমি তোমার নিকট যিকর (অর্থাৎ কুরআন) নাযিল করেছি যেন তুমি মানুষের কাছে তাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করো, আর তারাও যেন তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে।
৩:১৮৭ :: আর স্মরণ কর, যখন আল্লাহ কিতাবপ্রাপ্তদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, ‘অবশ্যই তোমরা তা মানুষের নিকট স্পষ্টভাবে বর্ণনা করবে এবং তা গোপন করবে না’। কিন্তু তারা তা তাদের পেছনে ফেলে রাখে এবং তার বিনিময়ে ক্রয় করে তুচ্ছ মূল্য। অতএব তারা যা ক্রয় করে, তা কতইনা মন্দ!
আলোচনা: উপরিউক্ত আয়াতদ্বয় থেকে বুঝা যায় যে, বয়ান বা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা শুধু রসূলের কাজ নয়, বরং মু’মিনরাও একই যোগ্যতা ও দায়িত্ব রাখে। মু’মিনরাও মানুষের কাছে কুরআনকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে। সুতরাং ‘রসূল কুরআন বয়ান করার’ তথ্য সম্বলিত আয়াতের সূত্র উল্লেখ করে কোনো গ্রন্থকে কুরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ হিসেবে আবশ্যকীয় সাব্যস্ত করার কোনো অবকাশ নেই।
রসূল নিজের ভাষায় আল কুরআনের ব্যাখ্যামূলক যা বলেছেন তা পরবর্তীদের কাছে পৌঁছানোর বিষয় নয়, কারণ ব্যাখ্যার বিষয়বস্তু কুরআন থেকে এবং ব্যাখ্যা বহুমাত্রিক, তিনি যখন যা বলেছেন তা যখন সামনে যে ছিল তার বুঝের মাত্রা অনুসারে সমকালীন উদাহরণ দ্বারা, সমকালীন বাস্তবতার তথ্যসমৃদ্ধ, উহা স্থায়ী উপযোগিতা রাখে না, বরং একই বিষয়ে দুজন ব্যক্তির বুঝের মাত্রা অনুসারে তাঁর বক্তব্য পরিবর্তনশীল হওয়া স্বাভাবিক। যেহেতু কুরআনের ব্যাখ্যার উৎস কুরআনই, তাই প্রত্যেক সমকালীন বাস্তবতার সাথে সমন্বিতভাবেই তার ব্যাখ্যা বুঝা যাবে, কোন নির্দিষ্ট সময় রসূল বা অন্য কেউ যা আলোকপাত করবেন, তার কোন স্থায়ী উপযোগিতা থাকবে না।
সুতরাং হাদীসের নামে যা বলা হয়, তার মধ্য থেকে যা (১) আল কুরআনের সাথে মিল আছে (২) বাস্তবতার সাথে মিল আছে, রসূল (১) তা বলেছেন (২) অথবা তার অনুরূপ বলেছেন। কিন্তু (১) এরূপ হাদীসকে রসূলের সাথে সম্পৃক্ত করার নিশ্চয়তা নেই (২) তা দেখা যেতে পারে, কিন্তু দলিল হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে না।
৭। উত্তম আদর্শ (উসওয়াতুন হাসানা)
৩৩:২১ :: নিশ্চয় তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ (উসওয়াতুন হাসানাহ) আছে রাসূলুল্লাহর মধ্যে, তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও শেষদিনের আশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।
৬০:৪ :: নিশ্চয় তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ (উসওয়াতুন হাসানাহ) আছে ইবরাহীমের মধ্যে আর যারা তার সাথে ছিল তাদের মধ্যে। যখন তারা তাদের কওমকে বলেছিল, ‘নিশ্চয় আমরা তোমাদের থেকে সম্পর্কহীন আর তাদের থেকেও (সম্পর্কহীন) তোমরা যাদের ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) করো আল্লাহকে বাদ দিয়ে। আমরা কুফর / অস্বীকার করছি তোমাদের প্রতি আর সৃষ্টি হয়ে গেল আমাদের ও তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য যতক্ষণ না তোমরা ঈমান/ বিশ্বাস করবে আল্লাহর প্রতি তাঁর একত্ব স্বীকার করে। ইবরাহীমের এ উক্তি ছাড়া যা সে তার পিতাকে বলেছিল যে, ‘আমি আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। আর আমি কোন ক্ষমতা রাখি না আপনাকে আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচাতে কিছুমাত্রও’। (সে আরো বলেছিল,) ‘হে আমাদের রব, আপনারই উপর আমরা তাওয়াক্কুল/ ভরসা করছি আর আপনারই দিকে আমরা অভিমুখী আর আপনারই কাছে প্রত্যাবর্তনস্থল/ ফিরে যাবার স্থান।
আলোচনা: মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর মধ্যে যেমন উত্তম আদর্শ রয়েছে, তেমনি নবী ইবরাহীম ও তাঁর সঙ্গীদের মধ্যেও উত্তম আদর্শ রয়েছে। আর সূরা মুমতাহিনায় সেই উত্তম আদর্শের ব্যাখ্যও দেয়া হয়েছে। তাঁরা তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদভিত্তিক বিশ্বাস ও কর্ম অবলম্বন করেছেন, মুশরিকদের সাথে আদর্শগত চিরন্তন দ্বান্দ্বিক অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং ঈমানের খাতিরে সর্বোচ্চ উৎসর্গের নমুনা উপস্থাপন করেছিলেন। সুতরাং রসূলের উত্তম আদর্শ জানার জন্য কুরআন ছাড়া অন্য কোনো তথ্যসূত্রের সন্ধান করা আবশ্যক নয়, বরং কুরআনেই তাঁর উত্তম আদর্শের বর্ণনা বর্তমান রয়েছে।
সামগ্রিক আলোচনা: কুরআনের পরবর্তী কোনো কিতাবে ঈমান রাখার অবকাশ নেই। তাই যা কুরআনের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন কোনো তথ্য ও বিধানকে দ্বীনের দলীল হিসেবে মেনে নেয়ার সুযোগ নেই। রসূল কুরআনের সীমারেখার মধ্যে যা কিছু নির্বাহী আদেশ নিষেধ করেছিলেন তা তাঁর সমকালীনদের প্রতি তাঁর দায়িত্ব ছিল এবং যদি রসূল এখনো জীবিত থাকতেন তাহলে আমাদের প্রতিও তিনি অনুরূপ আদেশ দিতে পারতেন এবং আমাদের জন্য তা পালন করা সেভাবেই অত্যাবশ্যক হতো, যেভাবে তাঁর সমকালীনদের জন্য অত্যাবশ্যক ছিল। কুরআনে থাকা রসূলের আনুগত্য বিষয়ক ধারা পরবর্তীদের জন্যও এভাবে প্রযোজ্য কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগক্ষেত্র না থাকায় তা প্রত্যক্ষভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়, বরং বর্তমানে রসূলের পক্ষ থেকে একই দায়িত্ব মু’মিনদেরকে পালন করতে হবে কুরআনের আলোকে উলিল আমর নির্বাচিত করে সেই নেতৃত্ব-আনুগত্য পদ্ধতির মাধ্যমে।
বর্তমানে রসূলের কোনো নির্বাহী আদেশ ও তা বাস্তবায়নের প্রশ্ন না থাকার বিষয়টি বুঝার সুবিধার জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রসূলের মজলিশে তাঁর অনুমতি নেয়া ছাড়া উঠে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তিনি নেই, তাই সরাসরি তাঁর মজলিশও নেই এবং তিনি সরাসরি অনুমতি দেয়া ও সেই অনুমতি নিয়ে মজলিশ থেকে উঠার সুযোগও নেই। অনুরূপ দ্বিতীয় আরেকটি উদাহরণ হলো, রসূলের পরে তাঁর স্ত্রীদেরকে বিয়ে করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তাঁর কোনো স্ত্রী না থাকায় এ বিষয়ের প্রয়োগক্ষেত্র অনুপস্থিত। যদি তাঁরা জীবিত থাকতেন তাহলে আয়াতটির নিষেধাজ্ঞা যথানিয়মে বহাল রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে কুরআনের নির্দেশসমূহ রসূলের সমকালীনদের জন্য সম্পূর্ণভাবে হুবহু প্রযোজ্য ছিল, কিন্তু তাঁর পরবর্তীকালের জন্য তাতে শিক্ষা নিহিত রয়েছে কিন্তু প্রয়োগক্ষেত্রের অভাবের কারণে তার কিছু কিছু নির্দেশের হুবহু প্রয়োগের সুযোগ নেই। কিছু ক্ষেত্রে তার শিক্ষার রূপান্তরিত প্রয়োগ ঘটতে পারে, আর কিছু ক্ষেত্রে বিষয়টি তৎকালীন মু’মিনদের প্রতি নির্দেশ বা নির্দেশনা সম্পর্কিত জ্ঞান ও বিশ্বাসের বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যার মধ্যে এ তাৎপর্য নিহিত রয়েছে যে, যদি প্রয়োগক্ষেত্রের অভাব না ঘটতো তাহলে এখনো তা প্রযোজ্য হতো।
১৭:৯০-৯৪ :: আর তারা বলে, “‘আমরা তোমার প্রতি কখনো ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না তুমি আমাদের জন্য ভূমি থেকে একটি প্রস্রবণ উৎসারিত করবে। অথবা তোমার জন্য খেজুর ও আঙ্গুরের একটি বাগান হবে, অতঃপর তুমি তার মধ্যে প্রবাহিত করবে নদী-নালা। অথবা তুমি যেমনটি দাবি করো, সেই অনুযায়ী আকাশকে খন্ড-বিখন্ড করে আমাদের উপরে ফেলবে, অথবা আল্লাহ ও ফেরেশতাদেরকে আমাদের মুখোমুখি নিয়ে আসবে। ‘অথবা তোমার জন্য স্বর্ণের একটি ঘর হবে অথবা তুমি আকাশে উঠবে, কিন্তু তোমার উঠাতেও আমরা ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না তুমি (উপর থেকে) আমাদের প্রতি এক কিতাব নাযিল করবে যা আমরা পাঠ করবো”। বলো, “পবিত্র মহান আমার প্রভু! আমি তো একজন মানুষ-রাসূল ছাড়া কিছু নই”। আর যখন মানুষের নিকট হিদায়াত আসে তখন তারা ঈমান আনতে তাদেরকে বাধাগ্রস্ত করে না তাদের এ কথা ছাড়া যে, ‘আল্লাহ কি মানুষকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন’?
২৫:৬-৯ :: বলো, ‘যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর রহস্য জানেন তিনি এটি নাযিল করেছেন; নিশ্চয় তিনি অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ আর তারা বলে, ‘এ রাসূলের কী হল, সে আহার করে এবং হাটে-বাজারে চলাফেরা করে; তার কাছে একজন ফেরেশতা পাঠানো হলো না কেন, যে তাঁর সাথে সতর্ককারী হতো’? অথবা তাকে ধনভান্ডার ঢেলে দেয়া হয় না কেন অথবা তার জন্য একটি বাগান হয় না কেন যা থেকে সে খেতে পারে?’ যালিমরা বলে, ‘তোমরা শুধু এক যাদুগ্রস্ত লোকের অনুসরণ করছো’। দেখো, তোমার জন্য তারা কেমন উপমা পেশ করে; ফলে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে, সুতরাং তারা কোনো পথ পেতে সক্ষম হয় না।
১১:১২ :: তাহলে তুমি তোমার উপর অবতীর্ণ ওহীর কিছু বিষয় ছেড়ে দিতে পারো এবং তোমার বুক সঙ্কুচিত হতে পারে এ কারণে যে, তারা বলে, ‘কেন তার উপর ধন-ভান্ডার অবতীর্ণ হয়নি, কিংবা তার সাথে ফেরেশতা আসেনি’? তুমি তো শুধু সতর্ককারী আর আল্লাহ সব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক।
৬:৫০ :: বলো, ‘তোমাদেরকে আমি বলি না, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডারসমূহ রয়েছে এবং আমি গায়েব জানি না এবং তোমাদেরকে বলি না, নিশ্চয় আমি ফেরেশতা। আমি কেবল তাই অনুসরণ করি যা আমার কাছে ওহী প্রেরণ করা হয়’। বল, ‘অন্ধ আর চক্ষুষ্মান কি সমান হতে পারে? অতএব তোমরা কি চিন্তা করবে না?’
৭:১৮৮ :: বলো, ‘আমি আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আমার কোনো উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখি না। আর যদি আমি গায়েব জানতাম তাহলে অনেক কল্যাণ পেতে পারতাম এবং আমাকে কোনো ক্ষতি স্পর্শ করতো না। আমিতো একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা ঈমান আনে।
৪৬:৯ :: বলো, আমি রসূলদের মধ্যকার নতুন উদ্ভাবন নই। আমি জানি না আমার সাথে কী করা হবে এবং তোমাদের সাথে কী করা হবে? আমি আমার কাছে যা ওহী করা হয় তা ছাড়া কিছুই অনুসরণ করি না। আর একজন সস্পষ্ট সতর্ককারী ছাড়া অন্যরূপ নই।
৯:১০১ :: আর তোমাদের চারপাশে থাকা অশহরবাসীদের (আ’রাবের) মধ্যে অনেকেই মুনাফিক (গোপন কাফির) এবং শহরবাসীদের মধ্যেও অনেকে মুনাফিক। তারা নিফাকে (কপটতায়) পাকাপোক্ত হয়েছে। তোমরা তাদেরকে (মুনাফিক হিসেবে) জানো না, আমি তাদেরকে (মুনাফিক হিসেবে) জানি। শীঘ্রই আমি তাদেরকে দুইবার শাস্তি (পার্থিব কষ্ট ও মৃত্যুকালীন যন্ত্রণা) দেবো। তারপর তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে মহাশাস্তির (জাহান্নামের) দিকে।
৩:৪৪ :: উহা গায়েবের/ অদৃশ্য ঘটনার সংবাদসমূহ, তা আমরা তোমার প্রতি ওহী করছি। আর তুমি তাদের কাছে ছিলে না যখন তারা নিক্ষেপ করেছে তাদের কলমসমূহ (এটা ঠিক করার জন্য যে,) তাদের মধ্যে কে মারইয়ামের তত্ত্বাবধান/ দেখাশুনা করবে। আর তুমি তাদের কাছে ছিলে না যখন (কলম নিক্ষেপের আগে এ বিষয়ে ) তারা বাদানুবাদ করছিলো।
১২:১০২ :: ইহা গায়েবের সংবাদসমূহের অন্তর্ভুক্ত, আমরা উহা ওহী করছি তোমার প্রতি (মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর প্রতি)। আর তুমি ছিলে না তাদের সাথে যখন তারা (ইউসুফের বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা) ইজমা/ ঐক্যমত পোষণ করেছিলো তাদের কাজের বিষয়ে (ইউসুফকে কূপে ফেলে দেয়ার বিষয়ে), আর তারা কৌশল অবলম্বন করেছিলো।
৬:৫৭ :: বলো, ‘নিশ্চয় আমি আমার রবের পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণের উপর রয়েছি আর তোমরা তা অস্বীকার করছ। তোমরা যা নিয়ে তাড়াহুড়া করছ তা আমার কাছে নেই। হুকুম কেবল আল্লাহর কাছে। তিনি সত্য বর্ণনা করেন এবং তিনি সর্বোত্তম ফয়সালাকারী’।
১৭:৫৯ :: আর পূর্ববর্তীগণ কর্তৃক নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা সাব্যস্ত করাই আমাকে তা (কাফিরদের প্রত্যাশিত নিদর্শনাবলী) প্রেরণ থেকে বিরত রেখেছে। আমি সামূদ জাতির কাছে উটনী পাঠিয়েছিলাম এক প্রত্যক্ষ নিদর্শন হিসেবে। আর আমি প্রকৃত ভীতি প্রদর্শনের জন্য ছাড়া (আশ্বর্যান্বিত করে দেয়ার উদ্দেশ্যে) নিদর্শন প্রেরণ করি না।
২৯:৫০-৫১ :: আর তারা বলে, ‘তার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে নিদর্শনসমূহ নাযিল হয় না কেন’? বল, ‘নিদর্শনসমূহ তো আল্লাহর কাছে, আর আমি তো কেবল একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী’। তাদের জন্য কি এটাই যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার উপর কিতাব (কুরআন) নাযিল করেছি যা তাদের সামনে পাঠ করা হয়। নিশ্চয় এর মধ্যে রয়েছে রহমত এবং চিরস্মরণীয় তথ্য ও বিধিবিধান, মু’মিন কওমের জন্য।
২১:১০৮-১১১ :: বলো, ‘আমার প্রতি ওহী প্রেরণ করা হয় যে, তোমাদের ইলাহ একক ইলাহ। সুতরাং তোমরা কি আত্মসমর্পণকারী হবে’? তবে তারা মুখ ফিরিয়ে নিলে তুমি বলো, ‘আমি যথাযথভাবে তোমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছি। আর আমি জানি না তোমাদেরকে যে বিষয়ের ওয়াদা দেয়া হয়েছে তা কি নিকটবর্তী না দূরবর্তী। তিনি প্রকাশ্য কথা সম্পর্কেও জানেন এবং তোমরা যা গোপন করো তাও জানেন। আর আমি জানি না হয়তো তা তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা কিছু কালের জন্য উপভোগের সুযোগ।’
৬:১৭ :: আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোনো দুর্দশা দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনি ছাড়া তা দূরকারী কেউ নেই। আর যদি কোনো কল্যাণ দ্বারা স্পর্শ করেন তবে তিনিই তো সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
৩৯:৩০ :: নিশ্চয় তুমি মরণশীল এবং তারাও মরণশীল।
৩:১৪৪ :: আর মুহাম্মাদ একজন রাসূল ছাড়া অন্যরূপ নয়। নিশ্চয় তার পূর্বে অনেক রাসূল বিগত হয়েছে। যদি সে মারা যায় অথবা তাকে হত্যা করা হয়, তবে তোমরা কি তোমাদের পেছনে ফিরে যাবে ? আর যে ব্যক্তি পেছনে ফিরে যায়, সে কখনো আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আর আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদের প্রতিদান দেবেন।
২১:৩৪ :: তোমার পূর্বেও আমি কোনো মানুষকে স্থায়ী থাকার ব্যবস্থা করিনি। সুতরাং যদি তুমি মারা যাও, তবে কি তারা স্থায়ী হবে?
২৭:৮০, ৩০:৫২ :: নিশ্চয় তুমি মৃতকে শুনাতে পারবে না। আর বধিরকেও আহবান শুনাতে পারবে না, যখন তারা পেছন ফিরে চলে যায়।
৩৫:২২ :: আর জীবিত ও মৃতও সমান নয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন শোনান; যারা ক্ববরে আছে তুমি তাদেরকে শোনাতে পার না।
২:১৪৩ :: আর এভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মাহতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির উপর সাক্ষী / সাক্ষ্যদাতা হও, আর রসূল তোমাদের উপর সাক্ষী / সাক্ষ্যদাতা হয়। …
৩৩:৬ :: নবী মু’মিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও ঘনিষ্ঠতর এবং তার স্ত্রীগণ (আল্লাহর ঘোষণা অনুসারে) তাদের মা। আর আল্লাহর কিতাবের বিধান অনুযায়ী রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়গণ (সাধারণ দায়দায়িত্ব ও উত্তরাধিকারের প্রশ্নে) মু’মিনদের ও মুহাজিরদের চেয়েও একে অন্যের ঘনিষ্ঠতর। কিন্তু তোমরা তোমাদের বন্ধুদের বিষয়ে ন্যায়সঙ্গতভাবে যা করে থাকো তা (বিশেষ সহযোগিতা প্রদান ও ওয়াসিয়্যাতে অন্তর্ভুক্ত করা) ব্যতিক্রম। এটাই কিতাবে লিপিবদ্ধ করা হলো।
৩:৬৮ :: নিশ্চয় মানুষের মধ্য থেকে ইবরাহীমের ঘনিষ্ঠতর হলো তারাই যারা তাকে অনুসরণ করেছিলো এবং এই নবী (মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ) এবং যারা ঈমান এনেছে। আর আল্লাহ মু’মিনদের অভিভাবক।
আলোচনা: উপরে উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সম্পর্কে যেসব ভুল ধারণা ছড়ানো হয় তার সুস্পষ্ট জবাব জানা যায়। যেমন তিনি মানুষ ছিলেন কিনা, গায়েব জানেন কিনা, হায়াতুন্নবী বা মুত্যুহীন নবী কিনা, সর্বত্র হাজির নাজির কিনা, কিয়ামাত কবে হবে তা জানতেন কিনা, কারো মঙ্গলামঙ্গল করার ক্ষমতা রাখেন কিনা, কবর থেকে সব শুনেন কিনা ইত্যাদি।
রসূলকে সাক্ষী বলে উল্লেখ করায় কেউ কেউ বলে তিনি মুত্যুবরণ করেননি, অথচ একই আয়াতে (২:২৪৩) মু’মিনদেরকেও সাক্ষী বলা হয়েছে। সুতরাং এতে সাক্ষী বলতে সমকালীনদের কাছে ঈমানের সাক্ষ্য দেয়ার বিষয় বুঝানো হয়েছে। অনুরূপভাবে রসূলকে মু’মিনদের ঘনিষ্ঠতর বলার বিষয় উল্লেখ করেও কেউ কেউ একইরূপ দাবি করে। অথচ একই আয়াতে (৩৩:৬) মু’মিনদেরকেও একে অপরের ঘনিষ্ঠতর বলা হয়েছে। এমনকি ৩:৬৮ আয়াতে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে ও মু’মিনদেরকে তাঁদের বহু পূর্বে অতিক্রান্ত নবী ইবরাহীমের ঘনিষ্ঠতর বলা হয়েছে। সুতরাং ঘনিষ্ঠতর হওয়ার জন্য যার ঘনিষ্ঠতর তার সাথে উপস্থিত থাকার প্রয়োজনীয়তা নেই।
মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর কাছে আল কুরআন ছাড়া কোনো মু’জিজা দাবি করার জবাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, কুরআনই যথেষ্ট। অন্যদিকে কাফিরদের প্রত্যাশিত চাক্ষুস মু’জিজা কোনো আশ্চর্য কিছু দেখানোর উদ্দেশ্যে নয়, বরং চূড়ান্ত ভীতি প্রদর্শনের জন্য প্রেরণ করা হয় এবং পূর্বে সেরূপ মু’জিজাকে কাফিররা মিথ্যা সাব্যস্ত করার প্রেক্ষিতে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর কাছে সেরূপ মু’জিজা প্রেরণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং মু’জিজা হিসেবে কুরআনকেই যথেষ্ট বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। কুরআনই যথেষ্ট, যাতে চিরস্মরণীয় তথ্য ও উপদেশ রয়েছে এবং যা মু’মিনদের জন্য রহমতস্বরূপ।
৩৩:৪০ :: মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যকার কোনো পুরুষের পিতা নয়। বরং সে আল্লাহর রসূল এবং সর্বশেষ নবী। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞানী।
আলোচনা: খতমে নবুওয়াত শব্দের মাধ্যমে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সর্বশেষ নবী হওয়ার বিষয়টি সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে তাঁকে ‘সর্বশেষ রসূল’ হিসেবে সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। কুরআনের কোনো আয়াত নেই, যাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত হওয়া ছাড়া কাউকে নবী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে ১২:৫০ আয়াত অনুযায়ী ‘রসূল’ শব্দটি সাধারণভাবে ‘দূত’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়, যে কোনো মানুষের কাছে অন্য মানুষের কাছে কোনো বার্তা হুবহু পৌঁছে দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। আল্লাহর মনোনীত রসূল ছাড়াও কোনো জনসমষ্টির কাছে যে ব্যক্তি আল্লাহর কোনো বার্তা পৌঁছে দেবে, যে বার্তাটি সম্পর্কে ঐ জনসমষ্টি ঐ ব্যক্তির মাধ্যমেই জানতে পেরেছে, তাহলে সে ব্যক্তিটি সেই জনসমষ্টির কাছে রসূল বলে সাব্যস্ত হবে। তবে কেউ আল্লাহর মনোনীত রসূল হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য স্পষ্ট প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক, কারণ নবী-রসূলদেরকে স্পষ্ট প্রমাণসহ প্রেরণ করা হয়েছে।
বিভিন্ন আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, আল কুরআন আল্লাহর নাযিলকৃত সর্বশেষ কিতাব এবং মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ও তাঁর সাথে যাঁরা ছিলেন তাঁরা কুরআন প্রচারে সম্মিলিতভাবে কাজ করেছেন এবং যার কাছেই কুরআন পৌঁছে যাবে তাকে কুরআন দ্বারা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সতর্ক করছেন হিসেবে সাব্যস্ত হবে (যেমন, ৬:১৯)। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ যেমন তাঁর সমকালের লোকদের জন্য সত্যের সাক্ষ্যদাতা হয়েছিলেন, তেমনি তাঁর অনুসারীরাও অন্যদের সামনে সত্যের সাক্ষ্যদাতা হবে (২:১৪৩, ২২:৭৮); আর এভাবে তিনি সমগ্র মানবজাতির জন্য রসূল হওয়ার বিষয়টি প্রযোজ্য হবে। আল্লাহর পথে আহবান করা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ এবং তাঁর অনুসারীদের জন্য একই দায়িত্ব পালনের পথ (৪১:৩৩, ১২:১০৮, ৩:১০৪, ২৯:৪৬)। সুতরাং কুরআন প্রচারের জন্য আর কোনো রসূলের আবশ্যকতা নেই এবং কুরআন প্রচারের দায়িত্ব মু’মিনদের উপরই ন্যস্ত রয়েছে। কোনো রসূল আগমন করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে কিতাবের মধ্যে তার সত্যায়নের প্রয়োজনীয়তা থাকে (৪:৭৯)। যেহেতু কুরআনে মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পরবর্তী কোনো রসূলের বিষয়ে সত্যায়ন নেই এবং যেহেতু কুরআনের পরবর্তী কোনো কিতাবে ঈমান রাখার কথা বলা হয়নি, তাই আল্লাহর মনোনীত আর কোনো রসূল আগমনের কোনো প্রমাণ নেই। অন্যভাবে বলা যায় যে, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ যেমন সর্বশেষ নবী, তেমনি তিনিই আল্লাহর মনোনীত সর্বশেষ রসূল।
আল্লাহর মনোনীত রসূলগণ একই মূল সত্যকে তুলে ধরেছিলেন এবং তাদের ভূমিকা ছিল পারস্পরিক সহযোগিতামূলক, আর তাই স্থান-কালের নৈকট্য ও দূরত্ব উভয় অবস্থায় তাঁরা ছিলেন একই উম্মাহ। অন্যদিকে স্বঘোষিত রসূলগণের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব একটি অনিবার্য বাস্তবতা, যাদের প্রত্যেকে আলাদা ফিরক্বায় বিভক্ত থাকবে।
অসংখ্য মানুষ কুরআন প্রচারের অজুহাত দিয়ে নিজেকে আল্লাহর রসূল বলে দাবি করা শুরু করে দিলে ইসলামের ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। কারণ, কুরআন প্রচারের মাধ্যমে সকল মু’মিনই রসূল হয়ে গেলে রসূলের প্রসঙ্গে আল কুরআনে যা কিছু বিধি-বিধান আছে তার সবই অর্থহীন হয়ে যায়। একজন রসূলের প্রতি ঈমান রাখা এবং তাঁর আনুগত্য করা এবং নিজের জীবন উৎসর্গ করে হলেও তাঁর জীবন রক্ষার চেষ্টা করা ইত্যাদি বিষয় যা আল কুরআনে রসূলের অধিকার হিসাবে বর্ণিত হয়েছে তা পরিপূরণ ও বাস্তবায়ন করা ঈমানের শর্ত। তাই মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পর কোন রসূল আসার দাবি করা এমন কোন ছোটখাট ব্যাপার নয় যে, তা সত্ত্বেও ঈমানের কোন সমস্যা হয় না। যিনি রসূল তাঁকে রসূল হিসাবে বিশ্বাস না করলে এবং যিনি রসূল নন তাঁকে রসূল হিসাবে বিশ্বাস করলে ঈমান থাকবে না।
আল্লাহ যাদেরকে নবী-রসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন তাদের কাছে ওহী করেছিলেন এবং তাদেরকে প্রেরণ করেছেন যেন, মানুষ তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করে এবং তাদের আনুগত্য-অনুসরণ করে, তারা নিজেদেরকে বিশ্বস্ত রসূল হিসেবে দাবি জানিয়েছিলেন (১২:১০৯, ১৬:৪৩, ২১:৭, ৪:৬৪, ৪:৮০, ৩:৫০, ২৬:১০৫-১৭৯)।
পরিশেষে উল্লেখ্য যে, মিথ্যা ওহী দাবিদারদেরকে সবচেয়ে বড় জালিম হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াত দ্রষ্টব্য।
৬:৯২-৯৩ :: আর এটি একটি কিতাব, আমি তা নাযিল করেছি, বরকতময়, যা তাদের সামনে আছে তার সত্যায়নকারী। আর যাতে তুমি জনপদ জননী (উম্মুল কুরা) ও তার চারিদিকে যারা আছে তাদেরকে সতর্ক করো। আর যারা আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে তারা এ কিতাবের প্রতি ঈমান আনে এবং তারা তাদের সালাতের উপর যত্নবান থাকে। আর তার চেয়ে বড় জালিম কে হতে পারে যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে, অথবা বলে, ‘ওহী করা হয়েছে আমার প্রতি’ এ সত্ত্বেও যে, ওহী করা হয়নি তার প্রতি কিছুই; আর যে বলে, ‘শীঘ্রই আমিও নাযিল/ রচনা করবো যা আল্লাহ নাযিল করেছেন তার অনুরূপ’। আর যদি তুমি দেখতে যখন যালিমগণ থাকে মৃত্যু যন্ত্রণায় আর ফেরেশতাগণ তাদের হাতসমূহ প্রসারিত করে; (এবং বলে,) ‘তোমরা বের করো তোমাদের প্রাণসমূহ। আজ তোমাদেরকে প্রতিফল দেয়া হবে (মৃত্যুকালীন) অপমানকর আযাব, এ কারণে যে, তোমরা বলতে আল্লাহর ব্যাপারে অসত্য কথা, আর তোমরা তাঁর আয়াতের ব্যাপারে অহংকার করতে’।
আলোচনা: কুরআনে উল্লেখ নেই এমন কোনো ওহীর তথ্যে বা কুরআনের পরবর্তীকালে কারো নিকট কোনো কিছু ওহী করা হয়েছে মর্মে ঈমান আনার কোনো অবকাশ নেই।
উলিল আমর প্রসঙ্গ: মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পূর্বে আনুগত্য লাভের কেন্দ্রীয় সত্তা হিসেবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর সময় এসে আনুগত্যের কেন্দ্রীয় সত্তা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে আল্লাহকে, তাঁর রসূলকে ও উলিল আমরকে (৪:৫৯)।
যেহেতু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পর আর কোনো রসূল আসবেন না, তাই যেখানে রসূল উপস্থিত থাকবেন না সেখানে এবং তাঁর মৃত্যুর পর সবখানে উলিল আমরই আল কুরআন নামক সংবিধানের নির্বাহী দায়িত্ব পালন করবেন (৪:৫৮-৬৫)। কুরআনে উলিল আমরের ধারা সন্নিবেশিত করার মাধ্যমে নবী-রসূল প্রেরণের প্রথা সমাপ্ত করে উলিল আমর প্রথা প্রবর্তন করা হয়েছে। কুরআনে সন্নিবেশিত এ ধারার মাধ্যমে কুরআনের বিধি-বিধান বাস্তবায়নের নির্বাহী দায়িত্ব মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর মৃত্যুর পর উলিল আমরের কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে এবং এভাবে কুরআন কালাকালভেদী সংবিধান হিসেবে কার্যকর থাকবে।
সংবিধান একটি বস্তুসত্তা বিধায় কোন ব্যক্তিসত্তা বা নির্বাহী দায়িত্বশীল ছাড়া তা মানব সমাজে কার্যকর হতে পারে না। এজন্য পূর্বে আল্লাহ তাঁর কিতাব নাজিলের পাশাপাশি নবী-রসূলদেরকে উহার নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন। কিন্তু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর পর ঐ নির্বাহী ক্ষমতা উলিল আমরের উপর হস্তান্তর করা হয়েছে, যাঁরা আল কুরআনের আলোকে মুসলিম উম্মাহর মধ্য থেকে মুসলিম উম্মাহর সদস্যদের তথা মুসলিমদের পরামর্শের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন এবং আল কুরআন অনুসারে মুসলিম উম্মাহকে পরিচালনা করবেন, তাদের মধ্যে কুরআনের বন্টনবিধি অনুসারে নেয়ামতের বন্টন করবেন এবং কুরআনের দন্ডবিধি অনুসারে তাদের আভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-মীমাংসা করবেন।
ইমাম গ্রহণ প্রসঙ্গ: নবী প্রথার সমাপ্তির পর কুরআনের বিধিবিধান বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম উম্মাহর পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ কে হবে, এ প্রশ্নের উত্তরে একটি দাবি হলো, আল্লাহর মনোনীত ইমামগণই এ দায়িত্ব পালন করবেন। তাই কুরআনের আলোকে ‘ইমাম’ বিষয়ে তথ্যগত সিদ্ধান্তের জন্য নিম্নে ইমাম (এবং এর বহুবচন আয়িম্মাহ) সম্পর্কিত আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হলো।
২:১২৪ :: আর উল্লেখ্য, যখন ইবরাহীমকে তার প্রভু কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর সে তা পূর্ণ করলো। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে মানুষের জন্য ইমাম (নেতা) বানাব’। সে বললো, ‘আমার বংশধরদের থেকেও’? তিনি বললেন, ‘আমার প্রতিশ্রুতি (তাদের মধ্যকার) যালিমদের প্রতি প্রযোজ্য হবে না’।
৯:১২ :: আর যদি তারা তাদের চুক্তির পর তাদের শপথ ভঙ্গ করে এবং তোমাদের দীন সম্পর্কে কটূক্তি করে, তাহলে তোমরা কুফরের ইমামদের (নেতাদের) বিরুদ্ধে লড়াই করো, নিশ্চয় তাদের কাছে শপথ বলে কিছু নেই। (সুতরাং লড়াই করো), যেন তারা বিরত হয়।
১১:১৭ :: তবে কি (সমান হতে পারে) যে তার প্রভুর পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণের উপর রয়েছে এবং তা (ঐ স্পষ্ট প্রমাণ) আবৃত্তি করে তাঁর পক্ষ থেকে একজন সাক্ষী এবং তার পূর্ব থেকে রয়েছে মূসার কিতাব ইমাম (মূল বিধান) হিসেবে এবং রহমত হিসেবে; তারাই সেটার প্রতি (ঐ স্পষ্ট প্রমাণের প্রতি) ঈমান রাখে। আর যে সকল দল সেটার প্রতি (ঐ স্পষ্ট প্রমাণের প্রতি) কুফর করে, তার জন্য প্রতিশ্রুত স্থান হলো (জাহান্নামের) আগুন। সুতরাং তুমি এর মধ্য থেকে কোনো বিষয়ে সন্দেহের মধ্যে থেকো না। নিশ্চয় তা তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে সত্য। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ঈমান আনে না।
১৫:৭৯ :: সুতরাং আমি তাদের থেকে প্রতিশোধ নিলাম। আর এ দুটি (জনপদ- কওমে লূত ও আসহাবুল আয়কার ধ্বংসস্তুপ) সুস্পষ্ট ইমামের (প্রধান পথের) পাশেই রয়েছে।
১৭:৭১ :: সেদিন আমি প্রত্যেক মানবদলকে তাদের ইমামসহ (নেতাসহ) ডাকবো। তারপর যাকে তার কিতাব (আমলনামা) ডানহাতে দেয়া হবে, তারা তাদের কিতাব (আমলনামা) পড়বে এবং তাদের প্রতি সামান্যও যুলুম করা হবে না।
২১:৭৩ :: আর আমি তাদেরকে (ইবরাহীম, লূত, ইসহাক, ইয়াকুব প্রমুখকে) ইমাম (নেতা) বানিয়েছিলাম। তারা আমার আদেশের মাধ্যমে সঠিক পথ প্রদর্শন করতো এবং আমি তাদেরকে ওয়াহী করেছিলাম কল্যাণকর্ম সম্পাদনের জন্য এবং সালাত প্রতিষ্ঠার জন্য এবং যাকাত প্রদানের জন্য। আর তারা ছিলো আমারই দাসত্বকারী।
২৫:৭৪ :: আর যারা (দয়াময়ের বান্দাগণ) বলে, “আমাদের প্রভু! আমাদেরকে এমন স্ত্রী/স্বামী ও সন্তানাদি দান করুন যাদেরকে দেখে আমদের চোখ প্রশান্তি পায়, আর আমাদের স্রষ্টা সচেতনতা অবলম্বনকারীদের ইমাম (অনুসরণযোগ্য) বানিয়ে দিন।
২৮:৫ :: আর আমি ইচ্ছা করলাম, পৃথিবীতে যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে এবং তাদেরকে ইমাম (নেতা) বানাতে এবং তাদেরকে উত্তরাধিকারী বানাতে।
২৮:৪১ :: আর আমি তাদেরকে (ফিরআউন ও তার পরিষদকে) ইমাম (নেতা) বানিয়েছিলাম, যারা (জাহান্নামের) আগুনের দিকে ডাকতো। আর কিয়ামাত দিবসে তাদেরকে সাহায্য করা হবে না।
৩২:২৪ :: আর আমি তাদের (বনী ইসরাইলের) মধ্য থেকে নেতা বানিয়েছিলাম, যারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথপ্রদর্শন করতো। যখন তারা ধৈর্যশীলতা অবলম্বন করতো এবং আমার আয়াতের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিল।
৩৬:১২ :: নিশ্চয় আমিই মৃতকে জীবিত করি। আর লিখে রাখি যা তারা আগে সম্পাদন করে এবং যা তারা প্রভাব-প্রতিক্রিয়া রেখে যায়। আর সব কিছুই আমি সুস্পষ্ট ইমামের (প্রধান নিবন্ধন বইয়ের) মধ্যে সংখ্যায়িত (লিপিবদ্ধ) করে রেখেছি।
৪৬:১২ :: আর এর পূর্ব থেকে মূসার কিতাব রয়েছে ইমাম (মূল বিধান) ও রহমতস্বরূপ। আর এ কিতাব (কুরআন) তার সত্যায়নকারী, আরবি ভাষায়, যারা যুলুম করে তাদেরকে সতর্ক করার জন্য এবং উত্তম কর্ম সম্পাদনকারীদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ।
আলোচনা: ইমাম শব্দের মূল অর্থ হলো ‘যাকে সামনে রাখা হয়’। ইমাম শব্দটি ব্যক্তি, বস্তু ও স্থান প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে মুত্তাকীদের নেতাকেও ইমাম বলা হয়েছে এবং কাফিরদের নেতাকেও ইমাম বলা হয়েছে। নবী-রসূলগণ আল্লাহর মনোনীত ইমাম। এছাড়া যারাই মু’মিনদের বা কাফিরদের ইমাম হয়, তাদেরকে আল্লাহ মু’মিনদের বা কাফিরদের ইমাম বানিয়েছেন হিসেবে সাব্যস্ত হবে। তবে আল্লাহ ইমাম মনোনীত করার বিষয়টি তাঁর সুনির্দিষ্ট ঘোষণার সাথে সম্পর্কিত, যেমন তিনি নবী ইবরাহীমকে ইমাম বানানোর বিষয়টি ঘোষণা করেছেন এবং এটাকে তাঁর প্রতিশ্রুতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাবকেও ইমাম বলা হয়, যেহেতু তা সামনে রেখে জীবন যাপন করতে হয়। প্রধান পথকেও ইমাম বলা হয়, যেহেতু সেই পথকে সামনে রেখে শাখা পথগুলোকে চিহ্ণিত করা হয়। আমলনামাসমূহের আর্কাইভকেও ইমাম বলা হয়, যেহেতু সেটার সাথে সম্পর্কিত করে প্রত্যেকের আমলনামায় থাকা কাজের মূল্যমান নির্ধারিত হবে যে, সে যে আমল করে মৃত্যুবরণ করেছিল তারপর তা কতটুকু প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
নিজেদেরকে মুত্তাকীদের ইমাম বানানোর জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা শিখানো হয়েছেে। সুতরাং মুত্তাকীদের ইমাম বলতে ‘মুত্তাকীদের অনুসরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব’ হওয়া বুঝায়।
কিয়ামাত দিবসে প্রত্যেক মানবদলকে তাদের ইমামসহ আহবান করা হবে। যেমন, ফেরাউন যেহেতু কাফিরদের ইমাম ছিল, তাই সে তার অনুসরণকারী জনগোষ্ঠীর সামনে থাকবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ইমামসহ আহবানের একটি দিক হতে পারে যে জনগোষ্ঠী কোনো ব্যক্তিকে ইমাম হিসেবে অনুসরণ করে তাদেরকে যেমন সেই ইমামসহ আহবান করা হবে, তেমনি যে জনগোষ্ঠী কোনো বিশেষ সংবিধান, গ্রন্থ, চার্টার বা দফাকে সামনে রেখে তার সামগ্রিক কর্মকাণ্ডকে পরিচালিত করে তাকে সেই বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করে আহবান করা হবে।
১১:৯৬-৯৯ :: আর আমি মূসাকে প্রেরণ করেছি আমার আয়াতসমূহ ও সুস্পষ্ট প্রমাণসহ। ফিরআউন ও তার নির্বাহী পরিষদের কাছে। অতঃপর তারা ফিরআউনের নির্দেশ অনুসরণ করলো। অথচ ফিরআউনের নির্দেশ সত্যভিত্তিক ছিল না। সে ক্বিয়ামাত দিবসে তার ক্বওমের সামনে থাকবে এবং তাদেরকে (জাহান্নামের আগুনে) উপনীত করবে। আর যেখানে তারা উপনীত হবে তা কত নিকৃষ্ট উপনীত হওয়ার স্থান! এ দুনিয়াতেও তাদেরকে অভিশাপ তাড়া করেছে এবং ক্বিয়ামাত দিবসেও। কী নিকৃষ্ট প্রতিদান, যা তাদেরকে দেয়া হবে!
সুতরাং ভালো কাজের ক্ষেত্রে এবং মন্দ কাজের ক্ষেত্রে যাদেরকে সামনে রেখে বা যাদের আদর্শ অনুসরণ করে জীবন যাপন ও কার্যক্রম করা হয় তারাই হলো ইমাম। মু’মিনরা চেষ্টা করবে ঈমান ও সৎকর্মের ক্ষেত্রে ইমাম বা অনুসরণযোগ্য হওয়ার জন্য। আর স্বভাবই তাদের সমষ্টিগত কার্যক্রমের পরিচালনা পর্যায়ের দায়-দায়িত্বের জন্য যে উলিল আমর নির্বাচনের বিষয় রয়েছে, সেক্ষেত্রেও তারা তাদের মধ্যে যাদেরকে ইমাম হিসেবে দেখতে পাবে অর্থাৎ ঈমানদারি ও সৎকর্মের ক্ষেত্রে অনুসরণযোগ্য দেখতে পাবে, তাদের মধ্য থেকেই ‘উলিল আমর’ নির্বাচনের চেষ্টা করবে। কিন্তু মুত্তাকীদের ইমাম হওয়ার বিষয়টি দাবি করার বিষয় নয়, বরং এজন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার বিষয়।
[1] মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহকে ‘রসূলান নাবিয়্যাল উম্মীয়্যা’ হওয়ার তাৎপর্য: উম্মীদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, ‘তাদের মধ্যে আছে উম্মীগণ, যারা (আসমানী) কিতাবের জ্ঞান রাখে না’ (২:৭৮)। এছাড়া, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ‘তিনিই (আল্লাহ) উম্মীদের মধ্যে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন’ (৬২:২)। উম্মী বলতে বুঝায় যারা আহলে কিতাব (অর্থাৎ কুরআন নাযিলকালের প্রেক্ষিতে যারা পূর্ববর্তী কিতাবের অনুসারী) নয় (দেখুন ৩:২০, ৩:৭৫)। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ উম্মীদের মধ্য থেকে রসূল হয়েছেন বিধায় তাঁকে ‘রসূলান নাবিয়্যাল উম্মীয়্যা’ বলা হয়েছে (৭:১৫৭-১৫৮)।