আল কুরআনের আলোকে ঈমান

বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও অতীন্দ্রিয় সত্যের প্রতি প্রত্যয়

বইটি সম্পর্কে

আল কুরআনের আলোকে ঈমান বইটিতে ঈমানের প্রকৃত স্বরূপ, ঈমানের সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক, ঈমানের যৌক্তিকতা, ঈমান আনা না আনার বিষয়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা, সৎকর্মের পরকালীন মূল্যায়নের জন্য ঈমানের শর্ত, ঈমান না আনা বা কুফর এবং শিরকযুক্ত ঈমান বা শিরকের অপরাধ, ঈমানের সাথে আল্লাহর বিধান পরিপালনের সম্পর্ক, ঈমানের বিষয়বস্তু এবং প্রতিটি বিষয়ের বিশেষ বিশেষ দিকসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সাধারণত ঈমান সম্পর্কে লেখা বইসমূহকে ‘আক্বীদা শিরোনামে প্রকাশ করা হয় এবং তাতে যেসব ‘আক্বীদা’ উপস্থাপিত হয় তাতে কুরআনের আলোকে পর্যালোচনা করলে অনেক অসঙ্গতি ধরা পড়ে। তাই এ বইয়ে ঈমান সম্পর্কে কুরআনের আয়াত থেকে প্রাপ্ত তথ্যের একটি মৌলিক সংকলনের প্রয়াস নেয়া হয়েছে।

বইটিতে ঈমানের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে একটি সাধারণ তথ্য বিন্যাসের মাধ্যমে সাধারণভাবে অধিকাংশ মানুষ যেভাবে শিরকসম্পন্ন ঈমান রাখে (১২:১০৬), তা থেকে আত্মরক্ষা করে যথার্থভাবে তাওহীদে ঈমান রাখার জন্য কুরআনের ভিত্তিতে তাওহীদে বিশ্বাসের প্রকৃত স্বরূপ ও প্রয়োগ চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে অনাবশ্যক বিস্তৃত দার্শনিক যুক্তি-তর্কের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গে কুরআনের আয়াতসমূহের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হিসেবে যে সাধারণ অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তা উল্লেখ করার পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ভুল ধারণা অপনোদনের জন্য আয়াতভিত্তিক পর্যালোচনা করা হয়েছে।

যেহেতু আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান অনুযায়ী যাবতীয় সৎকর্মের মূল ভিত্তি হিসেবে ঈমানের অবস্থান বা ঈমান থাকার ও ঈমানের দাবি অনুযায়ী কর্ম সম্পাদনের শর্তেই যাবতীয় কার্যাবলির গ্রহণযোগ্যতা ও সার্বিক সুফল নির্ভরশীল, তাই কুরআনের আলোকে ঈমান বিষয়ক একটি মৌলিক সংকলন হিসেবে বইটি পাঠকের জন্য একটি সহায়ক সূত্র হিসেবে কাজে লাগবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়। যথাসাধ্য সতর্কতা সত্ত্বেও একটি মানবীয় উপলব্ধি প্রচেষ্টা ও তার শেয়ারিং হিসেবে বইটিতে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই বইটির কোনো স্থানে কোনো ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়লে, ইনশাআল্লাহ পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধন করে নেয়া হবে।

এ বইটিতে ঈমানের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়কে কুরআনের আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কুরআনে ঈমানের বিভিন্ন বিষয়ে যত তথ্য আছে সেগুলোকে একত্র করার পরিবর্তে সংক্ষেপে কিছু মূল বিষয়ে কুরআনের কিছু আয়াতসহ উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে, প্রাসঙ্গিক সকল আয়াতকে একত্রিত করা হয়নি। বইটি এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে কিন্তু বিস্তারিত তথ্যের জন্য সম্পূর্ণ কুরআন বারবার পড়ার কোনো বিকল্প নেই।

বইটিতে উপস্থাপিত প্রসঙ্গসমূহ সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে যে কোনো মানবীয় প্রয়াসের মতো এতেও কোনো ক্ষেত্রে কোনো তাৎপর্য উপলব্ধি ও তা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ভুল হওয়া সম্ভব। তাই যদি অধিকতর অধ্যয়নে কোনো ত্রুটি ধরা পড়ে বা কেউ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাহলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক আয়াতসমূহের দ্বারা যাচাই করে পরবর্তী সংস্করণ সম্পন্ন করা হবে, ইনশাআল্লাহ।

ভূমিকা

এক নজরে মূল প্রতিপাদ্য

১. ঈমান শব্দের অর্থ বিশ্বাস হলেও কুরআনে শব্দটি একটি বিশেষ পরিভাষা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনিক পরিভাষা অনুসারে মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও প্রতিপালকের অস্তিত্ব এবং গুণাবলি, ক্ষমতা ও অধিকারগত একত্বের অবস্থানসহ তাঁর প্রেরিত বিধানগ্রন্থ অনুসারে অতীন্দ্রিয় সত্য বিষয়ক তথ্যে দৃঢ় বিশ্বাসই ঈমান। ঈমানের জন্য এ বিষয়ে যুক্তিসঙ্গত জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সুতরাং ঈমানের জন্য মূলনীতি হলো যে বিষয়গুলোতে চূড়ান্ত জ্ঞান রয়েছে তার নিদর্শনের ভিত্তিতে আল্লাহর মনোনীত রসূলদের কাছে প্রেরিত বিধানগ্রন্থে বিশ্বাস স্থাপন করা এবং এরূপ কিতাবে বর্ণিত যাবতীয় তথ্যে বিশ্বাস করা এবং এরূপ বিধানগ্রন্থের দলীল ছাড়া কোনো তথ্যকে বিশ্বাসের বিষয়বস্তু না করা।

২. ঈমান শব্দটির পারিভাষিক অর্থ ‘নবী-রসূলদের কর্তৃক ওহীভিত্তিক উপস্থাপিত তথ্যে বা আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানগ্রন্থ অনুযায়ী বিশ্বাস’। তবে শব্দটি কোথাও কোথাও শাব্দিক অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, গ্রহণযোগ্য যুক্তির ভিত্তি ছাড়াই বা কোনো অযৌক্তিক বিষয়ে বিশ্বাস করাকে ‘ঈমান বিল বাতিল’ (অযৌক্তিক বিশ্বাস) বলা হয়েছে।

৩. ঈমান শব্দটির অর্থ বিশ্বাস হলেও এর দ্বারা শুধুমাত্র আল্লাহর অস্তিত্ব বা একত্বের প্রতি সাধারণ বিশ্বাস বা স্বীকৃতিকে বুঝায় না, বরং কোনোরূপ দ্বিধা-সন্দেহ ছাড়া দৃঢ় বিশ্বাস করা যার প্রেক্ষিতে বিশ্বাসের দাবি অনুযায়ী কাজ করার প্রতিশ্রুতি সৃষ্টি হয়, তাকেই ঈমান বলা হয়। তাই কোনো বিশেষ ওজর ছাড়াই স্রষ্টার আদেশ নিষেধ লংঘন করাকে বাস্তবে ঐ বিষয়ে ঈমান না থাকার প্রমাণ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

৪. মানুষকে ঈমানের বিষয়ে বলপ্রয়োগের অবকাশ নেই, এক্ষেত্রে প্রত্যেকে নিজ স্বাধীন ইচ্ছায় ঈমান আনা বা কুফর করার সুযোগ রয়েছে। কারো ক্ষেত্রে ঈমান আনার পরও আবার কুফরে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ ঈমানের বিষয়ে মানুষকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। তবে এ স্বাধীনতার প্রয়োগ করে ঈমান আনলে ও ঈমানের দাবি অনুযায়ী সৎকর্ম করলে সে দুনিয়া ও আখিরাতে সুফলপ্রাপ্ত হবে এবং ঈমান না আনলে সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঈমান না আনা একটি ধর্মীয় আচরণগত অপরাধ, যার জন্য তাকে আখিরাতে শাস্তি পেতে হবে, তবে পৃথিবীতে এ বিষয়ে স্বাধীনতা দেয়ার কারণে ধর্মীয় কারণে কোনো মানুষ বা কর্তৃপক্ষ অন্য মানুষকে শাস্তি দিতে পারবে না।

৫. আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যসীমার বাহিরে দায়ী করেন না। তিনি কারো উপর সামান্যতমও অবিচার করেন না। সুতরাং ঈমান ও সৎকর্মের বিচারের ক্ষেত্রে প্রত্যেককে যথাযথ ন্যায়বিচারের সাথে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া হবে। ঈমান আনা ও সৎকর্ম করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে দায়ী করার ক্ষেত্রে তার বাস্তব অবস্থা তথা জ্ঞানগত ও কর্মগত সাধ্যসীমা বা পরিবেশগত সুযোগ ও সামর্থ্যকে বিবেচনা করা হবে।

৬. ঈমানের একটি মূল বিষয় হলো আল্লাহর প্রেরিত সকল নবী-রসূল এবং তাঁর অবতীর্ণ সকল কিতাব বা বিধানগ্রন্থে বিশ্বাস রাখতে হবে। সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ এবং সর্বশেষ কিতাব আল কুরআন। আল কুরআন হলো এর পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যতা প্রতিপাদনকারী এবং মানবজাতির জন্য শাশ্বত বিধানগ্রন্থ। তাই আহলে কিতাব বা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের অনুসারীদেরকেও কুরআনের প্রতি ঈমান আনার আহবান করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে তাদেরকে আহবান করতে হবে ‘যা তাদের ও মু’মিনদের মধ্যে’ একই এরূপ বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে।

৭. একজন মু’মিনকে অবশ্যই মুসলিম তথা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী হতে হবে এবং একজন মুসলিম বা আল্লাহর আত্মসমর্পণকারীও ঈমান তথা দৃঢ় বিশ্বাসকে ধারণ করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। মু’মিনদের ধর্মাদর্শগত জাতীয় পরিচিতি বা নামকরণ করা হয়েছে ‘মুসলিম’। প্রত্যেক মু’মিনের কর্তব্য হলো যথাসাধ্য স্রষ্টা সচেতন থাকা এবং মুসলিম হিসেবে মৃত্যুবরণের ইচ্ছা ও চেষ্টা অব্যাহত রাখা।

৮. কুরআন অনুযায়ী ঈমানের বিষয় হলো: আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর নবী-রসূলদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং পরকালের প্রতি ঈমান। আল্লাহর প্রতি ঈমান হতে হবে শিরকমুক্ত। শিরক হলো আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারের ক্ষেত্রে কাউকে কোনোরূপ অংশী সাব্যস্ত করা। শিরকের অন্যতম প্রায়োগিক দিক হলো ‘জীবন ব্যবস্থার মূল বিধান হিসেবে আল্লাহর বিধানগ্রন্থের পাশাপাশি অন্য কোনো বিধানকে গ্রহণ করা’। অন্য কথায়, আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানগ্রন্থের বাহিরে কোনো কিছুকে দ্বীনের দলীল হিসেবে গ্রহণ করা।

প্রাথমিক কথা

ঈমানের বিষয়ে যারা বিভিন্ন সময় লিখেছেন তাদের প্রত্যেকের লেখাতেই কুরআনভিত্তিক অনেক তথ্য রয়েছে। তাই এ বিষয়ে লিখতে গেলে সাধারণভাবে এমন অনেক তথ্যই লেখা হবে যা সাধারণত কুরআনের পাঠকমাত্রই জানেন এবং এইসব গ্রন্থের পাঠকগণও বিষয়ভিত্তিক তা পেয়ে থাকেন ও জানেন। এ সত্ত্বেও এ বিষয়ে আলাদা গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা কী বা এ বইয়ের বিশেষত্ব কী? এটা একটা যৌক্তিক প্রশ্ন। এ বিষয়ে অনেক গ্রন্থ থাকলেও তাতে যেমন অনেক কুরআনভিত্তিক তথ্য রয়েছে তেমনি রয়েছে বিভিন্নধর্মী বিতর্কিত উপস্থাপনা, যার অনেক অনুসিদ্ধান্ত কুরআনের তথ্যের সাথে অসঙ্গতিশীল। তাই আমাদের সাধ্য অনুসারে এ বিষয়ের মৌলিক দিকগুলোতে কুরআনের তথ্যের সাধারণ সংকলন এ গ্রন্থটি রচনার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। আর সেই সাথে এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য হলো, যেসব বিষয়ে কুরআনের সাথে অসঙ্গতিশীল তথ্যকে ঈমানের বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে তাতে প্রাসঙ্গিক আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে সঠিক তথ্য তুলে ধরা।

ঈমানের সাথে সম্পর্কিত যেসব বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান কেন জরুরি তা সম্পর্কে বলতে হয়, যদি কুরআন দ্বারা যাচাই করে তার সমাধান করা না হয়, তাহলে ঐ বিষয়ে কোন তথ্যে ঈমান রাখা হবে তা অনির্ণিত থেকে যাবে। আর সঠিক তথ্য নির্ণয় ছাড়া তাতে ঈমান রাখা সম্ভব নয়। তাই সঠিক তথ্যে ঈমানের প্রয়োজনে বিতর্কিত প্রসঙ্গসমূহকে কুরআন দ্বারা যাচাই করা অত্যাবশ্যক।

ঈমানের সাথে সম্পর্কিত সকল আয়াতকে একসাথে সংকলন করা এ রচনার উদ্দেশ্য নয়, বরং এতে ঈমানের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলির বিভিন্ন দিক এবং ঐসব দিকের সাথে সম্পর্কিত কিছু কিছু আয়াত উপস্থাপন করা হয়েছে মাত্র। এতে ঈমানের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে একটি সাধারণ তথ্য বিন্যাসের মাধ্যমে সাধারণভাবে অধিকাংশ মানুষ যেভাবে শিরকসম্পন্ন ঈমান রাখে (১২:১০৬), তা থেকে আত্মরক্ষা করে যথার্থভাবে তাওহীদে ঈমান রাখার জন্য কুরআনের ভিত্তিতে তাওহীদে বিশ্বাসের প্রকৃত স্বরূপ ও প্রয়োগ চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

 এ বইটিতে যে দিকগুলো রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে তা হলো:

১. ঈমানের বিভিন্ন প্রসঙ্গকে কুরআনে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তার প্রধান দিকগুলো একসাথে পেয়ে যাওয়া- একটি উদ্দেশ্য হবে।

২. ঈমানের বিভিন্ন বিষয়ে আক্বীদা হিসেবে যেসব কুরআন বহির্ভুত বিষয়কেও প্রতিষ্ঠা করা হয় সেগুলো বাদ যাবে।

৩. ঈমানের বিষয় (যেমন আল্লাহর অস্তিত্ব) প্রমাণের জন্য যেসব দার্শনিক যুক্তিতর্কের অবতারণা করা হয় সেটা যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়া হবে, পক্ষান্তরে এ বিষয়ে কুরআনের বর্ণনাপদ্ধতিতে সংক্ষেপে তুলে ধরা হবে।

৪. ঈমানের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলিতে কুরআনভিত্তিক তথ্য উপস্থাপনার মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক ভুল ধারণা অপনোদনের চেষ্টা করা হবে।

৫. ঈমানের যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তার দিকের উপর গুরুত্ব দেয়া হবে এবং ‘বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের অধিকার’ এর প্রকৃত স্বরূপ চিহ্নিত করা হবে।

৬. চূড়ান্ত তথ্য হিসেবে কুরআনকেই মানদণ্ড হিসেবে প্রয়োগ এবং কুরআনে থাকা ঈমান বিষয়ক তথ্য ও বিধানগত বিষয়ই যে আমাদের জন্য চূড়ান্ত ও পরিপূর্ণ, এবং এ বিশ্বাস থেকে বিচ্যুতি মানেই ঈমান থেকে বিচ্যুতি তা তুলে ধরা হবে। ইনশাআল্লাহ।

আল কুরআনের আলোকে ঈমান প্রসঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে আল কুরআনের বক্তব্যধারা তুলে ধরা হয়েছে। কুরআনে যেমন ঈমানের স্বরূপ, প্রয়োজনীয়তা, যৌক্তিকতা, ঈমান না আনার কুফল ও শাস্তি ইত্যাদি প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে তেমনি ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, ঈমান আনতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না, ঈমান সম্পর্কিত তথ্যাদি স্পষ্ট করা হয়েছে এখন যার ইচ্ছা ঈমান আনবে এবং তার সুফল পাবে আবার যার ইচ্ছা কুফর করবে অর্থাৎ ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানাবে এবং তার স্বাভাবিক কুফলও সে ভোগ করবে। এমতাবস্থায়, কুরআনের তথ্যসমূহ নিজের কাছে স্পষ্ট হয়েছে কিনা এবং তার উপর ঈমান আনা যায় কিনা তা ব্যক্তির নিজ সিদ্ধান্তের বিষয়, এক্ষেত্রে কুরআনের ঈমান আনয়নকারী ব্যক্তি মাত্রই কুরআনের তথ্যগুলোকে স্পষ্ট ও যৌক্তিক বলে দাবি করবে এবং ঈমান প্রত্যাখ্যানকারীকে ভ্রান্ত হিসেবে সাব্যস্ত করবে কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা মেনে নিতে তাকে বাধ্য করবে না, তার উপর এ দাবিকে জোর করে চাপিয়ে দিবে না।

কুরআনের আলোকে জীবনের অর্থবহতা অনুসন্ধান, বিবেকের অনুসরণ এবং অন্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ন্যায়ভিত্তিক সম্পর্ক সংরক্ষণ এবং অন্যায়ের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার অনুভূতি, সর্বজনীন মর্যাদা এবং প্রভুর বিধান মানার মানসিকতা ও তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা এবং নিজের যোগ্যতার যথাসাধ্য প্রয়োগের মাধ্যমে সঙ্গতভাবে নিজের ও অন্যের প্রক্রিয়াশীল বস্তুগত ও অবস্তুগত সুখের সুব্যবস্থায় ভূমিকা পালন, এসব কিছু মানুষের জীবনের অত্যাবশ্যক অনুষঙ্গ।

কর্মের পেছনে ইচ্ছা, ইচ্ছার পেছনে প্রেরণা, সেই প্রেরণা হতে পারে ইতিবাচক বা নেতিবাচক, তার উৎস কী? স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতার প্রেক্ষিতে মানুষ কী করবে, কেন করবে এবং কিভাবে করবে? এগুলো মানব জীবনের সাথে সম্পর্কিত মৌলিক প্রশ্ন। এছাড়াও জীবন যাপনের স্বাভাবিক গতিপথে এক পর্যায়ে যে মৌলিক প্রশ্ন মানুষের মধ্যে জাগে তা হলো- পরম্পরাগত জ্ঞানের বুদ্ধিবৃত্তিক যাচাই এবং জীবনের প্রকৃত তাৎপর্য ও কার্যনীতির যৌক্তিক ভিত্তি অনুসন্ধান। মানুষ ও জগতের পারস্পরিক সম্পর্ক, জগতে মানুষের প্রকৃত মর্যাদা ও অবস্থান, অন্যান্য সৃষ্টির প্রতি আচরণের মূলনীতি, পারস্পরিক অধিকারের সীমা-পরিসীমা ও তার উৎস বা ভিত্তি, জীবনব্যবস্থা নির্ধারণের উপায় ইত্যাদি প্রশ্নকে মানুষ এড়িয়ে যেতে পারে না। সর্বাধিক গোড়ার প্রশ্ন হলো জীবন ও জগতের উৎস ও পরিণতি সম্পর্কিত প্রশ্ন। কারণ ও ফলাফলবিধি প্রত্যেক কার্য ও কারণকে স্বতন্ত্রভাবে একটা স্তর পর্যন্ত ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু সব কারণের সর্বপ্রথম গোড়ার কারণ কী? সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। আর এ পর্যায়ে এসে যৌক্তিক অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে একটিই উত্তর তৈরি হয় তা হলো সকল কারণের একমাত্র সর্বপ্রথম / আদি কারণ ‘স্রষ্টার ইচ্ছা / আদেশ’। এখানেই স্রষ্টার অস্তিত্ব ও একত্বের বিষয়ে ঈমানের প্রসঙ্গ অনিবার্যভাবে সামনে আসে।

বিবেকের সংরক্ষণের উপায় হলো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড পরিহার করা, যে কাজ আমি করছি তা অন্যে করার বিষয়ে একই স্ট্যান্ডার্ড মেনে নেয়া। যেমন, আমি কারো সম্পদ চুরি করলে অন্য কেউও আমার সম্পদ চুরি করবে তা তার দোষ নয়, এটা যদি মানতে না পারি, তার মানে চুরি করা দোষ এবং আমিও তা করতে পারি না। কুরআন আমাদের এই কথাই আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আমাদের এই বিবেক স্রষ্টার পক্ষ থেকে আমাদেরকে দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে। এভাবে আমরা নৈতিকতার স্থায়ী ভিত্তি সম্পর্কে জানতে পারি এবং সে বিষয়ে আমাদের ঈমানের দায়বদ্ধতা তৈরি হয়।

কুরআন অনুযায়ী মানুষ নিজের অজ্ঞতাকে মেনে নিতে অস্বীকার করার জিদ থেকে তার বস্তুগত জ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তি এবং পার্থিব জীবনের বাহ্যজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে সে অহংকারী হয়ে উঠে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করে বিধায় ঈমানের প্রতি কুফর করে। অথচ যৌক্তিকভাবে ঈমানের দোরগোড়ায় পৌঁছা এবং এরপর স্রষ্টার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ গ্রন্থে থাকা যাবতীয় তথ্য যা তার জ্ঞানসীমার বাহিরের বিষয়ে তাকে সম্পূরক বিশ্বাস ধারণ করতে নির্দেশ দেয় তাতে ঈমান রাখা তার কর্তব্য এবং ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করা তার স্রষ্টা ও প্রতিপালকের প্রতি তার চরম অবাধ্যতা এবং অত্যন্ত নিকৃষ্ট অপরাধ। কিন্তু বিশ্বাসের বিষয়টি কেউ কারো উপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। মানুষকে চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, এটা একই সাথে যুক্তির খাতিরে এবং একই সাথে স্বাধীনতার অপপ্রয়োগের মাধ্যমে ইচ্ছা করে সঠিক বিশ্বাস অবলম্বন না করার সম্ভাবনা সত্ত্বেও পৃথিবীতে অবকাশ দেয়ার জন্য ও পরস্পরের উপর বাড়াবাড়ি প্রতিরোধ করার জন্য। কুরআন অনুযায়ী শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ। তা সত্ত্বেও কুরআনে বিশ্বাসের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে এবং এ অপরাধের জন্য শাস্তির বিষয়টি আল্লাহ নিজে বিচার দিবসে কার্যকর করবেন বলে জানানো হয়েছে। পৃথিবীতে কোনো মানুষ অন্য মানুষকে ধর্মীয় কারণে শাস্তি দিতে পারবে না, যতক্ষণ না কোনো সামাজিক অপরাধ- যেমন কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, ব্যভিচার, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি সংঘটিত হয়।

কুরআনে বিশ্বাসের বিষয়ে সুস্পষ্ট যুক্তিভিত্তিক তথ্য উপস্থাপন সত্ত্বেও বিশ্বাস ও ধর্মাদর্শ সম্পর্কিত বক্তব্য উপস্থাপনের যে উদার নির্দেশনা উপস্থাপন করেছে তা অতুলনীয়। যেমন ৩৪:২৪-২৬ আয়াত লক্ষণীয়।

৩৪:২৪-২৬ :: বলো, কে আকাশমণ্ডলী ও পৃথবী থেকে তোমাদেরকে জীবিকা দেন? বলো, আল্লাহ। আর নিশ্চয় আমরা অথবা তোমরা সঠিক পথনির্দেশের উপর অথবা সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে। বলো, আমাদের অপরাধের জন্য তোমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে না এবং তোমরা যা করো সে সম্পর্কে আমাদেরকেও জবাবদিহি করতে হবে না। বলো, ‘আমাদের প্রভু আমাদেরকে একত্র করবেন। তারপর তিনি আমাদের মধ্যে সঠিকভাবে ফয়সালা করবেন। আর তিনিই শ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী ও সম্যক পরিজ্ঞাত’।

সুতরাং কুরআনে একদিকে বিশ্বাসের স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং অন্যদিকে অতীন্দ্রীয় সত্যের প্রতি প্রত্যয় রাখার আবশ্যকতা ব্যক্ত করা হয়েছে।

এ বইটিতে ঈমানের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়কে কুরআনের আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কুরআনে ঈমানের বিভিন্ন বিষয়ে যত তথ্য আছে সেগুলোকে একত্র করার পরিবর্তে সংক্ষেপে কিছু মূল বিষয়ে কুরআনের কিছু আয়াতসহ উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে, প্রাসঙ্গিক সকল আয়াতকে একত্রিত করা হয়নি। বইটি এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে কিন্তু বিস্তারিত তথ্যের জন্য সম্পূর্ণ কুরআন বারবার পড়ার কোনো বিকল্প নেই।

বইটিতে উপস্থাপিত প্রসঙ্গসমূহ সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে যে কোনো মানবীয় প্রয়াসের মতো এতেও কোনো ক্ষেত্রে কোনো তাৎপর্য উপলব্ধি ও তা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ভুল হওয়া সম্ভব। তাই যদি অধিকতর অধ্যয়নে কোনো ত্রুটি ধরা পড়ে বা কেউ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাহলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক আয়াতসমূহের দ্বারা যাচাই করে পরবর্তী সংস্করণ সম্পন্ন করা হবে, ইনশাআল্লাহ।

ঈমানের পরিচয়

কুরআনের বর্ণনায় ঈমানের প্রকৃতিগত অবস্থান

২:১৭৭ :: পুণ্য কাজ এ নয় যে, তোমরা পূর্ব ও পশ্চিম ক্বিবলার দিকে তোমাদের মুখ ফিরাও। কিন্তু পুণ্যকাজ সে-ই করে যে বিশ্বাস করে আল্লাহর প্রতি এবং আখিরাত দিবসের প্রতি এবং ফেরেশতাদের প্রতি এবং কিতাবের প্রতি এবং নবীগণের প্রতি এবং তার মহব্বতের মাল দান করে আত্মীয়-স্বজনকে, ইয়াতীমদেরকে, অভাবগ্রস্তদেরকে এবং ছিন্নমূলকে / উদ্বাস্তুকে / বাস্তুহারাকে (ইবনে সাবীলকে) এবং সাহায্যপ্রার্থীকে এবং কারো ঘাড়কে (দাসত্ব থেকে) মুক্ত করার ক্ষেত্রে। এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত প্রদান করে এবং তারা যখন প্রতিজ্ঞা করে সেই প্রতিজ্ঞা পূরণকারী এবং অর্থ-সংকটে, দু:খ-ক্লেষে ও সংগ্রাম সংকটের সময় সবরকারী। তারাই ঐসব লোক যারা সত্যবাদী এবং তারাই সত্যাগ্রহী, স্রষ্টা-সচেতন।

আলোচনা: ঈমান (বিশ্বাস) শব্দটি কুরআনে বর্ণিত একটি ধর্মীয় পরিভাষা। ঈমান শব্দের অর্থ হলো, ‘বিশ্বাস, আস্থা, বিশ্বস্ততাসূচক মনোভাব ও আচরণ’। প্রচলিত ধারণা অনুসারে সাধারণভাবে মনে হতে পারে যে, কুরআনে যা কিছু উল্লেখ করা হয়েছে যৌক্তিকতা বিবেচনা ছাড়াই তার প্রতি বিশ্বাস রাখাকে ঈমান বলে, যার কারণে মানুষ অলৌকিক সত্তায় ভক্তি করা এবং সেই ভক্তির ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি হলে তাতে তাঁর ক্রোধ হওয়ার ভয়জনিত কিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। কিন্তু কুরআনের আলোকে এ ধারণাটি যথার্থ নয়। যেমন উল্লেখিত আয়াতেও ঈমান ও ধর্মকর্মের গ্রহণযোগ্য স্বরূপ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আয়াতটিতে ঈমানের সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি প্রধান বিষয় লক্ষ করা যায়:

১। পূর্ব ও পশ্চিম ক্বিবলার দিকে মুখ ফিরানোর মধ্যে কোনো পুণ্য, কৃতিত্ব বা কল্যাণ নেই। অর্থাৎ অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধার্মিকতা, ধর্মীয় বিভাজন এবং সঠিক তাৎপর্য থেকে বিচ্যুত হয়ে বাহ্যিক দিককেই মূল বিষয় হিসেবে গ্রহণ করার মধ্যে কোনো পুণ্য, কৃতিত্ব বা কল্যাণ নেই।

আল্লাহর দৃষ্টিতে কে পূর্ব দিকে মুখ ফিরালো আর কে পশ্চিম দিকে মুখ ফিরালো তার বাহ্যিক দিকটি রক্ষা করার কোনো মূল্য নেই। বরং এ বিষয়ে থাকা অন্যান্য আয়াতসহ সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে বুঝা যায় যে, যেদিকেই চেহারা ফিরানো হবে সেদিকেই আল্লাহর সত্তা রয়েছে তথা আল্লাহ সকল দিককে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন, তিনি দিক, স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে। এমতাবস্থায়, তাঁর বিধানে যখন মানুষকে কোনো প্রতিষ্ঠানের দিকে মুখ ফিরানোর বা অভিমুখ হিসেবে গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়, তখন ঐ প্রতিষ্ঠানটির পূর্বে থাকা লোক সেদিকে মুখ ফিরালে তো পশ্চিমে মুখ ফিরানো হয় এবং পশ্চিমে থাকা লোক সেদিকে মুখ ফিরালে সে পূর্বে মুখ ফিরানো হয়। যেহেতু আল্লাহ দিকের ঊর্ধ্বে, তাই তাঁর দিকে ফিরার জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিকে বা কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দিকে ফিরা প্রয়োজনীয় নয়, বরং তাঁর ঐরূপ নির্দেশের উদ্দেশ্য হলো মানবজাতির মধ্যে ব্যবস্থাপনাগত শৃঙ্খলামাত্র, যার অর্থ কোনোক্রমে তাঁর দিকে মুখ ফিরানো হয়।

এমতাবস্থায় যারা এ অন্তর্নিহিত তাৎপর্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় এবং বাহ্যিক দিককেই ধর্মাচার মনে করে তথা অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধার্মিকতা প্রদর্শন করে এবং এটিকে কেন্দ্র করে পূর্বমুখী বা পশ্চিমমুখী ক্বিবলায় বিভক্ত হয়ে যায় তথা ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি করে এবং সর্বোপরি তাদের কার্যক্রমের পেছনে আল্লাহর অনুমোদন রয়েছে কিনা সেই বিবেচনা থেকে সরে পড়ে তারা কোনো পুণ্য, কৃতিত্ব বা কল্যাণ পেতে পারে না।

২। ঈমান বা বিশ্বাস একটি ‘বির’ বা কল্যাণমুখী কর্ম, অর্থাৎ মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়ের কর্মও ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত, যার উপর ভিত্তি করে সে পুণ্য বা কল্যাণের অধিকারী হয়।

৩। ঈমান বা বিশ্বাস বিষয়টি যেসব সত্তা বা বিষয়ের প্রতি সম্পর্কিত তা হলো: আল্লাহ, মালায়িকা, কিতাব, রসূলগণ এবং আখিরাত।

৪। আল্লাহর কাছে পুণ্য, কৃতিত্ব বা কল্যাণের জন্য ঈমানের পাশাপাশি সৎকর্ম, সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালন, মানবিক আচরণ, নৈতিক মনোবল ও নিষ্ঠা প্রভৃতি অপরিহার্য। ঈমান এবং সৎকর্ম একটি অন্যটির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।

ঈমান এবং আল্লাহর কিতাব বা বিধান বাস্তবায়নের সম্পর্ক

২:৮৪-৮৫ :: আর যখন আমি তোমাদের থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছিলাম (এ নির্দেশনার মাধ্যমে) যে, তোমরা নিজেদের রক্তপাত করবে না এবং তোমাদের কোনো লোককে তোমাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দিবে না, তারপর তোমরা তা স্বীকার করে নিয়েছো এবং তোমরাই এর সাক্ষী। তারপর তোমরাই তারা যারা তোমাদের নিজেদের লোককে হত্যা করছো এবং তোমাদের মধ্যকার এক দলকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছো তাদের বিরুদ্ধে পাপ ও সীমালঙ্ঘন সহকারে পরস্পরকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে। আর যদি তারা তোমাদের কাছে বন্দী হিসেবে আসে (তোমরা তাদেরকে বন্দী হিসেবে দেখতে পাও) তখন তাদেরকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণ প্রদান কর। তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে (কিছু বিধানে) ঈমান আনো এবং কিছু অংশকে (কিছু বিধানকে) কুফর / অবিশ্বাস ও অস্বীকার করো? তাহলে যারা (কিতাবের বিষয়ে) এরূপ আচরণ করে তাদের প্রতিফল পাথির্ব জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া আর কী হতে পারে? আর ক্বিয়ামাত দিবসে তাদেরকে কঠিন শাস্তির দিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। আর তোমরা যা করো আল্লাহ তা সম্পর্কে উদাসীন নন।

আলোচনা: আল্লাহর কিতাবের প্রতি ঈমান আনার দাবিদারদের কর্তৃক আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের কোনো কোনো বিধান বাস্তবায়ন করা এবং অন্য কোনো কোনো বিধান বাস্তবায়ন না করার অর্থ হলো কিতাবের কিছু বিধানের প্রতি ঈমান আনা এবং কিছু বিধানের প্রতি কুফর বা অবিশ্বাস-অস্বীকার করা। সুতরাং ঈমান বা বিশ্বাস যদিও মনের বিষয় কিন্তু তা এমন যে, বাস্তব কার্যক্রমে ঐ বিশ্বাসেরই প্রতিফলন ঘটে। সুতরাং কোনো বিধানকে অনুসরণ করা এবং কোনো বিধানকে অনুসরণ না করাকে কোনো বিধানে ঈমান আনা এবং কোনো বিধানে ঈমান না আনা হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

ঈমানের সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক

৪৭:৪৯ :: কাজেই জেনে নাও (এ বিষয়ে জ্ঞানার্জন করো) যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। এবং তুমি ক্ষমা চাও তোমার ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য এবং মু’মিন পুরুষ ও নারীদের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য। আর আল্লাহ তোমাদের গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে জানেন।

আলোচনা: জ্ঞানের সাথে ঈমান নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। তাওহীদের (আল্লাহর একত্ববাদ) জ্ঞানের জন্য একদিকে বিশ্বব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে নিদর্শননির্ভর যৌক্তিক জ্ঞানে উপনীত হওয়া এবং অন্যদিকে নাযিলকৃত আয়াত অধ্যয়নের মাধ্যমে এর প্রতিটি দিকের প্রকৃত জ্ঞান লাভ করা উভয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ জ্ঞান অর্জনে অবহেলা করা এ বিষয়ে জ্ঞানার্জন ও ঈমান রাখার প্রতি অবজ্ঞার সমতুল্য এবং এর মাধ্যমে এ বিষয়ে ঈমানের অনুপস্থিতি ঘটে থাকে।

এ আয়াতে ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই’ এ বিষয়ে জানার জন্য তথা জ্ঞান অর্জনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে এ জ্ঞান দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জ্ঞানার্জনের উপায় কী হতে পারে? আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা তথ্যকে সঠিক হিসেবে গ্রহণ করার উপায় হলো তথ্যটি যে আল্লাহর পক্ষ থেকে তা নিশ্চিত হওয়া। সুতরাং আমাদেরকে এ বিষয়ে সম্ভাব্য মানদণ্ড তথা ভিত্তিমূলক যুক্তির মাধ্যমে তা জানতে হবে এবং বাস্তব নিদর্শনসমূহ পর্যবেক্ষণ করে এ জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা তথ্যকে বাস্তব যুক্তিসিদ্ধ হিসেবে অনুধাবন করা যাবে এবং এভাবেই আল্লাহ একমাত্র ইলাহ হওয়ার বিষয়ে জ্ঞান অর্জিত হবে। ঐ অর্জিত জ্ঞানে দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হওয়ার নামই হলো ‘ঈমান’। তাই ঈমানের তথ্যের বিষয়ে জ্ঞানার্জনের বিকল্প নেই।

৩৯:৯ :: নাকি যে ব্যক্তি রাতের বিভিন্ন সময়ে সাজদাহবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে (সে তার সমান যে তা করে না)? বলো, যারা জানে এবং যারা জানেনা তারা কি সমান? বস্তুত চিন্তাশীলতার অধিকারীরাই উপদেশ গ্রহণ করে।

আলোচনা: ১। বস্তুগত জ্ঞানের বিষয়ে যারা সঠিক বস্তুগত জ্ঞান রাখে (তারা নাস্তিক হলেও) তারা ঐ বিষয়ে যারা সঠিক জ্ঞান রাখে না (এমনকি তারা আস্তিক হলেও) তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, এটাই বাস্তবতা।

২। অনুরূপভাবে বস্তুর বাস্তবতা যাই হোক না কেন ঐ বাস্তবতার সর্বপ্রথম / সর্বমূল কারণ হিসেবে তাওহীদের (আল্লাহর একত্ববাদের) বিষয়ে যারা তাওহীদের সঠিক জ্ঞান রাখে তারা (বস্তুর বস্তুগত বিশ্লেষণগত জ্ঞানে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও) যারা তাওহীদের জ্ঞান রাখে না (তারা বস্তুবিজ্ঞানে অত্যন্ত জ্ঞানী-বিজ্ঞানী হলেও) তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, এটাও সমানভাবে প্রকৃত সত্য।

উপরে বর্ণিত আয়াতটিতে জানানো হয়েছে যে, উপদেশ গ্রহণ করা (যেমন ঈমান আনা) তাদের পক্ষেই সম্ভব হয় যারা সত্যনিষ্ঠার সাথে চিন্তাশক্তির প্রয়োগ করে। সুতরাং সঠিক পদ্ধতিতে চিন্তাশক্তির প্রয়োগ করে যথাযথ জ্ঞান অর্জন এবং তার মাধ্যমেই প্রকৃত ঈমান আনয়ন করা সম্ভব।

জ্ঞান মানে কোনো বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা। কুরআনে ইলম বা জ্ঞান শব্দটি কখনো শাব্দিক অর্থে অর্থাৎ ‘কোনো বিষয়ের বাস্তব অবস্থা জানা’ অর্থে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে এবং কখনো ওহীর বিষয়াবলির সঠিক তথ্য জানাকেই ইলম হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। কুরআনের পারিভাষিক দিক থেকে একজন ব্যক্তি বস্তুগত জ্ঞানে অত্যন্ত জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও এর মাধ্যমে তাওহীদ ও দ্বীনে হক্বের যে নিদর্শনভিত্তিক (আয়াতভিত্তিক) জ্ঞান অর্জিত হওয়ার কথা তা অর্জিত না হলে তাকে অজ্ঞ হিসেবে চিহ্ণিত করা হয়েছে। আবার বিভিন্ন আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, একজন বস্তুবিজ্ঞানী ঈমান সম্পর্কিত জ্ঞানে ব্যর্থ হওয়া বা ঈমান না আনার পেছনে যে কারণটি দায়ী তা তার বস্তুগত জ্ঞানের অভাব নয়, বরং সত্য গ্রহণের মানসিকতার অভাব।

ঈমান বিল বাতিল বা অযৌক্তিক বিশ্বাস

১৬:৭১-৭৩ :: আল্লাহ তোমাদের কারো উপর অপর কাউকে জীবিকার ক্ষেত্রে বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন। তারপর যাদেরকে বিশেষ অনুগ্রহ করা হয়েছে তারা তাদের জীবিকা থেকে এমনভাবে তাদের ডানহাতের অধিকৃতদেরকে দেয় না যার ফলে তারা জীবিকার ক্ষেত্রে তাদের সমfন হয়ে যায়। (তাহলে আল্লাহ কি তাঁর কোনো দাসকে তাঁর ক্ষমতায় অংশীদার করতে পারেন? তবে তোমরা যেহেতু সম্পূর্ণ নিজ গুণে সম্পদের মালিক হওনি এমতাবস্থায় তোমাদের আচরণ প্রসঙ্গে প্রশ্ন হলো-) তবে কি তোমরা (স্বাভাবিক সরবরাহ রোধ করে) আল্লাহ প্রদ্ত্ত নিয়ামাতের স্বীকৃতি প্রদানে বিরুদ্ধতা করছো? আর আল্লাহ তোমাদের সমজাতীয় উপাদান থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের থেকে পৌত্র-পৌত্রাদির ব্যবস্থা করেছেন এবং (তোমাদের জন্য পরস্পরের সহযোগী) স্বেচ্ছাসেবকের ব্যবস্থা করেছেন। তবুও কি তোমরা অসত্য বিষয়ের প্রতি অযৌক্তিক বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করবে? আর তারা (অযৌক্তিক বিশ্বাসের ফলে) আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন সত্তার ইবাদাত করে যা তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী থেকে কোনো জীবিকা দেয়ার মালিক নয় এবং তারা (এ কাজে) সক্ষমও নয়।

২৯:৫২ :: বলো, আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। আকাশমণ্ডলীতে ও পৃথিবীতে যা আছে তিনি তা জানেন। আর যারা অসত্য বিষয়ে অযৌক্তিক বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস করে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।

২৯:৬৭ :: তারা কি দেখে না যে, আমি নিরাপদ হারামের (সংরক্ষিত অঞ্চলের) ব্যবস্থা করেছি অথচ উহার চতুর্দিকে যারা আছে তাদেরকে ছিনিয়ে নেয়া হয়? তবুও কি তারা অসত্য বিষয়ে অযৌক্তিক বিশ্বাস করবে এবং আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?

আলোচনা: আল্লাহ তাঁর কিতাবের মাধ্যমে যেসব তথ্য জানিয়েছেন সেগুলোতে বিশ্বাস রাখাই ঈমান। আবার ঈমান শব্দটির শাব্দিক অর্থের ভিত্তিতে প্রসঙ্গ অনুসারে অন্য ক্ষেত্রেও ঈমান বা বিশ্বাস শব্দটি প্রযোজ্য হতে পারে। যেমন, ঈমান বিল বাতিল বা অযৌক্তিক বিশ্বাস, অগ্রহণযোগ্য বিশ্বাস, ভুল বিষয়ে বিশ্বাস।

সঠিক জ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষ যে বিশ্বাস অর্জন করে সেটাই ঈমান বা যৌক্তিক বিশ্বাস। অন্যদিকে বিবেক বুদ্ধির যথাযথ প্রয়োগ ছাড়া তথা বাতিল বা অযৌক্তিকভাবে কোনো বিশ্বাস লালন করা সুস্থ বিবেক বুদ্ধির কাছেও গ্রহণযোগ্য নয় এবং কুরআনও সেটাকে বাতিল বা অগ্রহণযোগ্য বলেই সাব্যস্ত করে।

জ্ঞানের উৎসসমূহ এবং বিবেক-বুদ্ধি ও ঈমানের আন্তঃসম্পর্ক

৯১:৭-১০ :: শপথ মানবসত্তা ও সেই সত্তার যিনি তাকে সঠিক (শারীরিক ও মানসিক) গঠনে সুবিন্যস্ত করেছেন। তারপর তার নীতিহীনতা (ফুজুর) ও তার নৈতিক আচরণ সম্পর্কিত প্রবণতা, বোধি ও বৈকল্পিক ইচ্ছা অন্তর্নিহিত করে দিয়েছেন। নিশ্চয় সেই সফল হয়েছে যে নিজেকে পরিশুদ্ধ ও নৈতিক গুণে বিকশিত করেছে। আর নিশ্চয় সে ব্যর্থ হয়েছে যে নিজেকে কলুষিত ও নৈতিক গুণে অবদমিত করেছে।

আলোচনা: জ্ঞানের অন্যতম উৎস হলো বিবেক-বুদ্ধি। বিবেক-বুদ্ধির প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষ ভালো-মন্দ বুঝতে পারে এবং এর ধারাবাহিকতায় স্রষ্টা-সচেতনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে বিবেকবুদ্ধিকে অবদমিত করলে সে চিন্তা ও আচরণে কলুষিত হয়ে পড়ে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে ও তাঁর বিধি-বিধান মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানায়।

৬:১১১ :: যদি আমি তাদের কাছে ফেরেশতাদের অবতীর্ণ করতাম আর মৃতরা তাদের সাথে কথা বলতো আর আমি তাদের সামনে সবকিছু সমবেত করতাম তবুও আল্লাহর ইচ্ছে ব্যতীত তারা ঈমান আনত না, কিন্তু (এটার পদ্ধতিগত কারণ হলো) তাদের অধিকাংশই মূর্খতা (বিবেক বহির্ভুত চিন্তাধারা ও আচরণ) অবলম্বন করে।

আলোচনা: জাহিল বা মূর্খ হওয়ার কারণে তথা Common sense ব্যবহার না করে চলার কারণে অধিকাংশ লোক প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে পারে না এবং ঈমান আনতে পারে না।

২২:৪৬ :: তবে কি তারা পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি? তাহলে তাদের এমন ক্বলব / মন হতো যা দিয়ে তারা Common sense ব্যবহার করতে পারতো (Common sense ব্যবহার করে সাধারণ জ্ঞান অর্জন করতে পারতো) এবং এমন কান হতো যা দিয়ে তারা (সঠিক তথ্য) শুনতো। সুতরাং নিশ্চয় উহা তো (এই বাস্তবতার প্রতিফলন যে, এক্ষেত্রে) চোখ অন্ধ নয়, কিন্তু মনই অন্ধ হয়, যা আছে স্নায়ুকেন্দ্ররূপ সম্মুখ মস্তিষ্কের অগ্রভাগে।

আলোচনা: ভ্রমণ তথা বাস্তব বিষয় বা বাস্তব উদাহরণ দেখে তা থেকে শিক্ষা নেয়ার মাধ্যমে মানুষ কোনো কথা শুনার সময় তার সঠিক তাৎপর্য শুনতে তথা বুঝতে সক্ষম হয়। যে বিষয়ে বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে কোনোরূপ সম্ভাব্য পূর্বধারণাও অর্জিত হয় না, সে বিষয়ে বিবেকে তথ্যের অনুপস্থিতির কারণে মানুষ দেখেও দেখে না তথা সঠিক মর্ম উদ্ধার করতে সক্ষম হয় না। এ থেকে বুঝা যায় যে, সঠিক জ্ঞানের পূর্বশর্ত হলো বিবেকবুদ্ধি ব্যবহার করা।

৯৬:৪ :: যিনি (আল্লাহ) কলমের মাধ্যমে শিক্ষাদান করেছেন।

আলোচনা: কলম তথা লেখনির মাধ্যমে জ্ঞানের বিস্তার ঘটে। অর্থাৎ কোনো কিছু লিখে অনেক মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেয়া যায় এবং পরবর্তীকালের লোকদের কাছেও পূর্ববর্তী কালের লোকদের জ্ঞানের তথ্য পৌঁছে যায়। সুতরাং পড়ালেখার মাধ্যমে অর্জিত সাধারণ জ্ঞানের মাধ্যমে ব্যক্তির জ্ঞান বৃদ্ধি পায়।

২:১৮৫ :: রমাদানের মাস, যে মাসে আল কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানবজাতির জন্য হিদায়াত (পথনির্দেশ) ও পথনির্দেশ সম্পর্কিত স্পষ্ট (যৌক্তিক) প্রমাণ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী মানদণ্ড হিসেবে। …

৮:২৯ :: হে যারা ঈমান এনেছো যদি তোমরা আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন করো তাহলে তিনি তোমাদেরকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী মানদণ্ড দিবেন এবং তোমাদের থেকে তোমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ঢেকে দিবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ অনুগ্রহশীল, সুমহান।

আলোচনা: কুরআনকে সত্য মিথ্যার পার্থক্য করার মান নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে নাযিল করা হয়েছে। সুতরাং যে বিষয়ে কুরআনের সাথে সঙ্গতিশীল তা সত্য এবং যে বিষয় কুরআনের সাথে সঙ্গতিশীল নয় তা অসত্য। যেসব বিষয়ে কুরআনের কোনো বক্তব্য নেই, সেসব বিষয়ে মানুষ স্বাধীন, তবে সে বিষয়ে তাকে অবশ্যই কুরআনের বিভিন্ন শিক্ষার আলোকে এবং পরিস্থিতি বিশ্লেষণ সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোন সিদ্ধান্ত সঠিক হবে এবং কোন সিদ্ধান্ত ভুল হবে তা নির্ণয়ের জন্য মানুষকে যে সাধারণ মনস্তাত্ত্বিক শক্তি তথা বিবেক দেয়া হয়েছে, যদি কুরআনের বিধিবিধানের যথাযথ চর্চা করা হয়ে তাহলে ঐ বিবেক এমনভাবে উৎকর্ষিত হবে যে, তা সঠিক-অসঠিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য মানদণ্ডে পরিণত হবে। সুতরাং ঈমান ও স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করলে Common sense উৎকর্ষিত হয়ে কুরআনের শিক্ষার অনুকূলে ভূমিকা পালন করে, যে বিষয়ে কুরআনে বিধান দেয়া হয়েছে সেই বিষয়ে সর্বোত্তম পর্যায়ে ঐ বিধানের যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পারে, যে বিষয়ে কুরআনের মাধ্যমে কোনো বিধান নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি সেই বিষয়ে পরিস্থিতি সাপেক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাজে লাগে।

৬৭:১০ :: আর তারা (জাহান্নামবাসীরা) বলবে, যদি আমরা (রসূলদের কথা) শুনতাম অথবা আমাদের Common sense প্রয়োগ করতাম তাহলে আমরা জাহান্নামবাসী হতাম না।

আলোচনা: জাহান্নামবাসীদের এ বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, কাফিররা Common sense ব্যবহার না করায় ঈমান আনেনি। এ থেকে আরো বুঝা যায় যে, কাফিররা উপলব্ধি করবে এবং এটাই বাস্তবতা যে, যদি তারা তাদের Common sense প্রয়োগ করতো তাহলে তারা ঈমান আনতে পারতো এবং জাহান্নামবাসী হতো না। সুতরাং কাফিরদের Common Sense অবদমিত হলেও নি:শেষ হয়ে যায় না, ঐ অবদমিত Common senseকেও যদি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তা আবার উৎকর্ষিত হতে থাকে এবং তারা ঈমান আনতে পারে।

১০:১০০ :: আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো পক্ষে ঈমান আনা সম্ভব নয়। আর আল্লাহ তাদের উপরই মনস্তাত্ত্বিক কলুষতা (অনৈতিকতা ও কুফর) চাপিয়ে দেন যারা Common sense প্রয়োগ করে না।

আলোচনা: যারা Common sense প্রয়োগ করে না তাদের উপর মনস্তাত্ত্বিক কলুষতা চাপিয়ে দেয়া হয় এবং এর ফলস্বরূপ তারা ঈমান আনার অনুমতি থেকে বঞ্চিত হয় অর্থাৎ তারা ঈমান আনতে পারে না।

৩০:২৯ :: বরং যারা যুলুম করেছে তারা অজ্ঞতাকে অবলম্বনস্বরূপ (জ্ঞানের পরিবর্তে) তাদের প্রবৃত্তির (নীতিহীন কামনা-বাসনার) অনুসরণ করে। সুতরাং যাকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট রেখেছেন তাকে কে সঠিক পথে পরিচালিত করবে? আর তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।

আলোচনা: জ্ঞানের অনুসরণ না করে বা জ্ঞানের পরিবর্তে অজ্ঞতাকে অবলম্বন করে প্রবৃত্তির অনুসরণ বা নীতিহীন কামনা-বাসনার অনুসরণ করলে সে সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে না, সে পথভ্রষ্ট থেকে যায়।

৮:২২ :: নিশ্চয় আল্লাহর নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট পশু হিসেবে সাব্যস্ত সেই (সত্য কথা শুনার ব্যাপারে) বধির ও (সত্য কথা বলার ব্যাপারে) বোবা লোকেরা, যারা Common sense প্রয়োগ করে না।

৮:৫৫ :: বিচরণকারী প্রাণীদের মধ্যে তারাই তো আল্লাহ্‌র কাছে নিকৃষ্ট, যারা কুফর করেছে। সুতরাং তারা ঈমান আনবে না।

আলোচনা: যারা Common sense প্রয়োগ করে না এবং যারা ঈমান আনে না বা কুফর করে তারাই সর্বনিকৃষ্ট পশু।

৩০:৫৮-৫৯ :: আর আমি মানুষের জন্য এ কুরআনে সর্বপ্রকার উদাহরণ উপস্থাপন করেছি। আর যদি তুমি তাদের কাছে কোনো আয়াত নিয়ে আসো তাহলে যারা কাফির তারা বলে নিশ্চয় তোমরা বাতিলপন্থী। এভাবে আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর করে দিয়েছেন যারা জ্ঞান অর্জন করে না।

আলোচনা: বাতিলপন্থীরা হক্বপন্থীদেরকে বাতিলপন্থী বলে চিহ্নিত করে এবং আল্লাহর আয়াতের প্রতি ঈমান আনে না, কারণ তারা জ্ঞান অর্জন করে না বিধায় তাদের অন্তরে মোহর করে দেয়া হয়েছে। তাদের সামনে যে আয়াত উপস্থাপন করা হয় তার সত্যাসত্য উপলব্ধির জন্য যে জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন ছিলো, Common sense প্রয়োগ করে যেভাবে সেটার তথ্যের বিষয়ে সঠিক যুক্তিপদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন ছিলো তারা তা করে না।

৩৫:২৪ :: তারা বলে, ‘একমাত্র পার্থিব জীবনই আমাদের জীবন, আমরা মরি ও বাঁচি এবং মহাকাল/সময় আমাদেরকে ধ্বংস করে”। বস্তুত এ বিষযে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। তারা তো শুধু মনগড়া কথা বলে।

আলোচনা: যারা তাওহীদ ও আখিরাতকে অস্বীকার করে তাদের এ অস্বীকৃতির কারণ হলো তারা এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান রাখে না বরং মনগড়া কথা বলে।

৪৭:২৪ :: তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না? নাকি তাদের মনসমূহে অনেক তালা দেয়া আছে?

আলোচনা: কুরআনের উপর ঈমান আনা ও কুরআনের তথ্য অনুসরণের জন্য Common sense প্রয়োগ করে এর আয়াতসমূহ নিয়ে চিন্তাগবেষণা করা প্রয়োজন। যারা মনের উপর তালা ঝুলিয়ে দেয় অর্থাৎ মনের দুয়ার বন্ধ করে দেয় তাদের অন্তরে সত্য প্রবেশ করতে পারে না।

২:২১৯ :: তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে মাদক ও জুয়া সম্পর্কে। বলো ‘এ দুটোতে মানুষের জন্য অনেক অপকারিতা এবং কিছু ক্ষেত্রে উপকারিতা রয়েছে। এবং এ দুটির উপকারিতার চেয়ে অপকারিতাই বড়। এবং তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা পরার্থে কী ব্যয় করবে? বলো, উদারতাপূর্ণ প্রদেয়। এভাবে আল্লাহ তোমাদের নিকট তাঁর আয়াত স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যেন তোমরা (তা নিয়ে) চিন্তা গবেষণা করো।

আলোচনা: কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ যা জানিয়েছেন তা নিয়ে Common sense প্রয়োগ করে চিন্তা গবেষণা করতে হবে।

৩:৭ :: … আর চিন্তাশীলতার অধিকারী (চিন্তাশীলতা প্রয়োগকারী) ব্যক্তিগণ ছাড়া কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না।

আলোচনা: কুরআনের উপদেশ অনুধাবন ও তার অনুশীলনের জন্য Common sense ব্যবহার করে চিন্তাশীলতা বজায় রাখতে হয়।

৩:১৯০-১৯১ :: নিশ্চয় আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে চিন্তাশীলতার অধিকারীদের জন্য (চিন্তাশীলতা প্রয়োগকারীদের জন্য) নিদর্শন রয়েছে। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও তাদের পার্শ্বদেশসমূহের উপর (শুয়ে) আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। (তারা বলে-) আমাদের প্রভু, তুমি এসবকে উদ্দেশ্যহীন, অর্থহীন, বাস্তব উপযোগহীন ও অযৌক্তিকভাবে সৃষ্টি করোনি। তুমি ত্রুটিমুক্ত পবিত্র সত্তা। সুতরাং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।

আলোচনা: প্রকৃত চিন্তাশীল ব্যক্তি নিদর্শন থেকে জ্ঞান লাভ করে এবং ঈমান আনে ও সৃষ্টিরহস্য নিয়ে চিন্তা গবেষণা অব্যাহত রাখে।

২:১৬৪ :: নিশ্চয় আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে এবং মানুষের জন্য উপকারী জিনিস নিয়ে নদী-সমুদ্রে চলা নৌযানসমূহে এবং ঐ পানিতে (বৃষ্টিতে) যা আল্লাহ আকাশ থেকে বর্ষণ করেন তারপর তা দ্বারা শুষ্ক ভূমিকে প্রাণবন্ত করেন এবং তাতে সবরকম প্রাণীর বিস্তার ঘটান এবং বাতাসের প্রবাহে এবং আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে নিয়োজিত মেঘমালাতে Common sense প্রয়োগকারী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।

আলোচনা: যারা সঠিক জ্ঞান অর্জন ও সঠিক বিশ্বাস অবলম্বন করতে চায় তাদেরকে বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে Common sense প্রয়োগ করে চিন্তা ভাবনা করতে হবে।

৪১:৫৩ :: শীঘ্রই আমি বিশ্বজগতে ও তাদের নিজেদের মধ্যে আমার নিদর্শনসমূহ দেখাতে থাকবো যতক্ষণ না তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নিশ্চয় তা (কুরআন) সত্য। এটা কি যথেষ্ট নয় যে, তোমার প্রতিপালক সব কিছুর বিষয়ে সাক্ষী রয়েছেন?

আলোচনা: নিদর্শনের ভিত্তিতে অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যমেই কুরআনের সত্যতা স্পষ্ট হয়।

১৭:৩৬ :: যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই সে বিষয়ে (পক্ষে বা বিপক্ষে) লেগে যেও না (চূড়ান্ত অবস্থান নিও না, সঠিক তাৎপর্য না জেনে অন্ধ অনুসরণ করো না আবার অন্ধ বিরোধিতাও করো না)। নিশ্চয় কান, চোখ ও তথ্য বিশ্লেষণী মন, এগুলোর প্রত্যেকটির বিষয়ে কৈফিয়ত চাওয়া হবে।

আলোচনা: স্ব-যাচাই বা নিজের বিশ্লেষণী মনের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন করে সেই জ্ঞানের ভিত্তিতেই অনুসরণ করতে হবে, আপাত সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ধরে নিয়ে কোনো বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করা যাবে না।

৭:৫২ :: আর আমি তাদের নিকট কিতাব (কুরআন) নিয়ে এসেছি যেটিকে আমি জ্ঞানের ভিত্তিতে ব্যাখ্যাসম্পন্ন করেছি, যারা ঈমান আনে সেই সম্প্রদায়ের জন্য তা হিদায়াত ও রহমত।

১৩:৩৭ :: এভাবে আমি উহাকে (কুরআনকে) আরবী ভাষায় বিধান হিসেবে নাযিল করেছি। আর যদি তুমি তোমার কাছে যে জ্ঞান (কুরআনের তথ্য) এসেছে তারপর তাদের প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার অনুসরণ করো তাহলে আল্লাহর বিরুদ্ধে তোমার কোনো অভিভাবক ও পরিত্রাণকারী নেই।

১১:১৪ :: সুতরাং যদি তারা তোমাদের আহবানে সাড়া না দেয় তাহলে জেনে রাখো যে, তা (কুরআন) আল্লাহর জ্ঞান অনুসারে নাযিল করা হয়েছে এবং তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ (সার্বভৌম ও সর্বময় প্রয়োজনপূরণকারী উপাস্য) নেই। সুতরাং তোমরা কি মুসলিম (তাঁর কাছে আত্মসমর্পণকারী) হবে?

২২:৫৪ :: আর যেন যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তারা (তাদের প্রাপ্ত/অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে) জানতে পারে যে, তা (কুরআন) তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে সত্য, সুতরাং তারা তার প্রতি ঈমান আনে এবং তাদের অন্তরকে সেটার প্রতি বিনম্র করে দেয়া হয় এবং নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথের হিদায়াত করেন যারা ঈমান আনে।

আলোচনা: এসব আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে, ঈমানের তথ্য ও স্রষ্টার বিধান সম্পর্কিত জ্ঞানের উৎস হলো তাঁর নাযিলকৃত কিতাব।

১২:৩৯-৪০ :: (ইউসুফ বললো-) হে আমার কারাসঙ্গীদ্বয়, ভিন্ন ভিন্ন প্রভু ভালো নাকি একমাত্র মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ? তোমরা তো দাসত্ব ও উপাসনা করছো না এমন কতগুলো নামের ছাড়া যা তোমরা ও তোমাদের বাপদাদারা নামকরণ করেছো, যার পক্ষে আল্লাহ কোনো প্রমাণ নাযিল করেননি। নিশ্চয় হুকুম / বিধান দানের ক্ষমতা ও অধিকার শুধু আল্লাহর। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁর ছাড়া কারো দাসত্ব-উপাসনা করো না। এটা সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত জীবনব্যবস্থা। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই জ্ঞান অর্জন করে না।

৩৯:২৯ :: আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত পেশ করছেন, এক ব্যক্তি তার রয়েছে অনেক পরস্পরবিরোধী শরিক প্রভু, আর এক ব্যক্তি যে একজনমাত্র ব্যক্তির প্রতি সমর্পিত। তাদের দুজনের দৃষ্টান্ত কি সমান? সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। বরং তাদের অধিকাংশ জ্ঞানার্জন করে না।

৩:১৮ :: আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ (সার্বভৌম ও সর্বময় প্রয়োজন পূরণকারী উপাস্য) নেই। এবং ফেরেশতাগণ ও জ্ঞানী ব্যক্তিরাও এই সাক্ষ্যই দিয়েছে, যারা ন্যায়ের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ (সার্বভৌম ও সর্বময় প্রয়োজন পূরণকারী উপাস্য) নেই, যিনি মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।

২৭:৮৪-৮৫ :: যখন তারা সমাগত হবে তখন আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, “তোমরা কি আমার আয়াতসমূহকে (নির্দশনসমূহকে) মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলে অথচ তোমরা তা জ্ঞানায়ত্ত করতে পারোনি? নাকি তোমরা আরও কিছু করছিলে? সীমালংঘন হেতু তাদের উপর ঘোষিত শাস্তি এসে পড়বে, সুতরাং তারা (অজুহাত হিসেবে) কিছুই ব্যক্ত করতে পারবে না।

৫৩:২৯-৩১ :: যে আমার স্মারক (কুরআন) থেকে বিমুখ হয় এবং পার্থিব জীবন ছাড়া কিছু (পারলৌকিক সফলতা পেতে) ইচ্ছা করে না তাকে উপেক্ষা করো। এটাই তাদের জ্ঞানের দৌড়। নিশ্চয় তোমার প্রভু সবচেয়ে বেশি জানেন কে তাঁর পথ থেকে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে এবং তিনি সবচেয়ে বেশি জানেন কে হিদায়াত গ্রহণ করেছে। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা আছে সবই আল্লাহর, যেন যে মন্দ কাজ করে তিনি তাকে তার কর্মের প্রতিফল দেন এবং যে ভালো কাজ করে তিনি তাকে তার কর্মের প্রতিফল দেন।

১০:৩৮-৩৯ :: নাকি তারা বলে সে (রসূল) উহা (কুরআন) রচনা করেছে। তাহলে তোমরা এর অনুরূপ একটি সূরা আনো এবং (তোমাদের এ কাজে সহযোগিতার জন্য) আল্লাহ ছাড়া আর যাদেরকে ডাকতে সক্ষম হও ডেকে নাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। বরং তারা সেটাকেই মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে যার জ্ঞানকে তারা আয়ত্ত করতে পারেনি (প্রকৃত জ্ঞানের ভিত্তি ছাড়াই তারা মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে)। আর এখনো এর নিগূঢ় তাৎপর্য জ্ঞান তাদের নিকট আসেনি (তারা শুধুমাত্র বস্তুগত জ্ঞানের অধিকারী)। এভাবেই যারা তাদের পূর্বে ছিলো তারা মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলো। সুতরাং দেখো যালিমদের পরিণতি কী হয়েছিলো?

৩৫:৪০ :: বলো, তোমরা আল্লাহর সাথে শরীক বানিয়ে আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তাদের বিষয়ে ভেবে দেখছো কি? তারা পৃথিবীতে কিছু সৃষ্টি করে থাকলে তা আমাকে দেখাও। অথবা আকাশমণ্ডলীর সৃষ্টিতে তাদের কোনো অংশ আছে কি? নাকি আমি তাদেরকে কোনো কিতাব দিয়েছি যার প্রমাণের উপর তারা নির্ভর করে? বস্তুত জালিমরা একে অপরকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে।

৩৭:১৫৬-১৫৭ :: তোমাদের কাছে কি কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে? তাহলে তোমাদের (কাছে নাযিলকৃত) কিতাবটা নিয়ে এসো, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো।

সামগ্রিক আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্ট যে, কুরআনে ঈমানের জন্য জ্ঞান ও বিবেকবুদ্ধিকে অপরিহার্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। বিবেকবুদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আফালা তা’ক্বিলূন’ (তবে কি তোমরা বিবেক প্রয়োগ করবে না?)। কুরআনের তথ্য থেকে স্পষ্ট যে, যারা কাফির তারা বিবেক প্রয়োগ না করেই কাফির হয়, যেহেতু বিবেক অনুযায়ী, জ্ঞানগত ভিত্তি ছাড়া বা শুধুমাত্র জ্ঞানায়ত্ত না হওয়ার কারণে ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানানো যৌক্তিক নয়। অনুরূপভাবে যারা বিবেক বুদ্ধি প্রয়োগ করবে তারাই মু’মিন হবে। তাই বিবেক বুদ্ধি প্রয়োগ না করা এবং কুফর করা ব্যক্তিদেরকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট পশু বলা হয়েছে। অর্থাৎ বিবেক বুদ্ধি প্রয়োগ না করলে এবং ঈমান না করলে মানুষ আর তার উৎকৃষ্ট অবস্থানে থাকে না, বরং সে পশুতে পরিণত হয় এবং অন্যান্য পশু তো পশু হিসেবে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে, কিন্তু মানুষ নিকৃষ্ট পশু হিসেবে গণ্য হয়। সেই সাথে কুরআনে বিবেকের গম্য ও অগম্য ক্ষেত্রসমূহে ভুল-ভ্রান্তি থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

যেহেতু পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারণে বিবেকের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে তাই মানুষের বিবেকবুদ্ধিকে জাগ্রতকরণ এবং তার ওপর থেকে নেতিবাচক প্রভাবের আবরণ সরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণ ও কিতাব নাযিল করেছেন। এছাড়া বিবেকবুদ্ধির সাথে সঙ্গতিশীল এবং তার সর্বোচ্চ বিকাশের উপযোগী এবং তার ভারসাম্য স্থাপনকারী ও তাকে কিছু সুনির্দিষ্ট নীতি ও বিধানের মাধ্যমে সহায়তাকারী তথ্য ও বিধান সরবরাহ করা নবী-রসূল প্রেরণ ও কিতাব নাযিলের দ্বিতীয় কার্যকারণ।

বস্তুত মানুষ প্রথমে মাতৃগর্ভ থেকে প্রসূত হয় যখন সে জ্ঞানপ্রাপ্ত নয়। তারপর সে ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন তথ্য পেতে থাকে এবং তার মধ্যে থাকা জিজ্ঞাসা, চিন্তাশীলতা, যুক্তি আবিষ্কার, সৃজনশীলতা এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমেও সে বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করে। একটা পর্যায়ে তার মধ্যে ভালো-মন্দ বোধ সৃষ্টি হয়।

মানুষের জ্ঞানের উৎস হলো, প্রথমত: ইন্দ্রিয়ানুভূতিার বিভিন্নতা এবং বিষয়, ভাব ও বস্তুর ধারণা প্রকাশের জন্য নামকরণবিদ্যা ও ভাষার্থের বোধ (যেমন, কোনো বর্ণকে সাদা, কোনো বর্ণকে কালো হিসেবে চিহ্নিতকরণ, কোনো অনুভূতিকে আনন্দ এবং কোনো অনুভূতিকে দুঃখ নামে চিহ্নিতকরণ এবং মৌখিক ও লৈখিক ভাষার ব্যবহার) এবং সরাসরি বিবেক বুদ্ধি প্রয়োগ করা (যেমন সত্য বলাকে ভালো এবং মিথ্যা বলাকে মন্দ হিসেবে চিহ্নিতকরণ), দ্বিতীয়ত: বিবেক-বুদ্ধি ও সৃজনশীল চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করে অর্জিত সাধারণ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা এবং তৃতীয়ত: আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব অধ্যয়ন।

এটা একটা অনস্বীকার্য বাস্তবতা যে, মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে। অবশ্য প্রয়োজনীয় পর্যায়ে ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন উপায়ে প্রাকৃতিক নিয়মানুগ স্তর পর্যন্ত ঐ দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠার মতো যোগ্যতাও তাকে দেয়া হয়েছে। মানুষের দুর্বলতাগুলোর মধ্যে একটি হলো জ্ঞানগত দুর্বলতা। কোনো বিষয়ে জ্ঞানগত দুর্বলতার কারণে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছা হয়েছে পরে ঐ বিষয়ে জ্ঞান এসে গেলে সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মানুষের জ্ঞানগত দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতার প্রমাণ হলো তাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে তথ্য ও অভিজ্ঞতার অভাবে বা ভুল ধারণার প্রভাবে সে কোনো কিছুকে কল্যাণকর মনে করে অথচ পরবর্তীতে দেখা যায় যে, সেটা কল্যাণকর ছিলো না। সুতরাং সরল নীতি হলো জ্ঞানগত দুর্বলতার স্বীকৃতি দেয়া এবং জ্ঞানের অনুসরণ করা।

আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের সাহায্য ছাড়া শুধুমাত্র বিবেকবুদ্ধি দিয়ে সব বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। তাই কোনো বিষয়ে  জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও বা বিষয়টি জ্ঞানায়ত্ত করতে না পারা সত্ত্বেও কিতাবের তথ্যকে অস্বীকার করা একটি অপরাধ। এর মানে এ নয় যে, ‘হতে পারে’ এর উপর ভিত্তি করে বিশ্বাস করতে হবে। কারণ সেক্ষেত্রে যে কোনো ভুল বিষয়ও বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। বিশ্বাসের মূলনীতি হলো, নিদর্শনগত জ্ঞানের ভিত্তিতে বিশ্বাস করার নীতি অবলম্বন করতে হবে এবং সন্দেহবাদিতা (তথা সন্দেহ নিরসন পদ্ধতি অবলম্বনের পরিবর্তে সন্দেহের উপর স্থায়ী থাকার নীতি) অবলম্বন করা যাবে না। কাজেই মানুষের মৌলিক কর্মনীতি হওয়া উচিত সন্দেহ নিরসনে তথ্য যাচাই তথা তুলনামূলক বিশ্লেষণ পদ্ধতি অবলম্বন করা, প্রমাণিত তথ্যের সাথে সঙ্গতিহীন তথ্যকে বিশ্বাস না করা এবং জ্ঞানগত ভিত্তি তথা অকাট্য যুক্তি ছাড়া অবিশ্বাস না করা, বিশ্বাস বা অবিশ্বাস এর বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার পূর্ব পর্যন্ত নিরপেক্ষ থাকা এবং এ অবস্থায় যেরূপ আপাত সিদ্ধান্তের অনুসরণ ফলাফলের দিক থেকে সত্যের বিপরীত হলে ক্ষতিকর হবে বলে প্রতীয়মান হয়, সেরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণকে এড়িয়ে চলা।

বিবেক-বুদ্ধিও আল্লাহ প্রদত্ত যার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞানপ্রাপ্ত হয় এবং ওহীর মাধ্যমে নাযিলকৃত কিতাবও আল্লাহ প্রদত্ত যার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়। বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে মানুষ বিস্তারিত ভালো-মন্দ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় কিন্তু গায়ব সম্পর্কে বিবেকবুদ্ধি মৌলিক নির্দেশনা দিতে পারে, নিশ্চয়তার সাথে যথেষ্ট বা আবশ্যকীয় বিস্তারিত তথ্যে উপনীত হতে পারে না। প্রবৃত্তিতাড়িত না হয়ে স্বচ্ছভাবে বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগ করলে মানুষ সত্য ও ন্যায়ের মধ্যেই অবস্থান করতে সক্ষম হয়।

অন্যদিকে ওহীর মাধ্যমে নবী রসূলদের কাছে নাযিলকৃত কিতাবে বিবেকবুদ্ধি দ্বারা অর্জনযোগ্য জ্ঞানগত বিষয়াদিতে মৌলিক নির্দেশনা প্রদান করা হয় এবং সেই নির্দেশনার সীমারেখা লংঘন না করে বিবেকবুদ্ধি দ্বারা জীবন যাপনকেই স্রষ্টার পছন্দনীয় ব্যবস্থা হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়।

কোনো কিতাবকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বলে দাবি করলেই তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত হিসেবে সাব্যস্ত হবে না। বরং তা আল্লাহর কিতাব হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য একটি মৌলিক শর্ত হলো তার বক্তব্য বিবেকবুদ্ধির স্পষ্ট বিরুদ্ধ না হওয়া। তবে এক্ষেত্রে বিবেকবুদ্ধির প্রয়োগকারীকে প্রবৃত্তিতাড়িত না হয়ে সত্যাগ্রহী বা সত্যসন্ধানী ও সত্যনিষ্ঠ হতে হবে। বস্তুত বিবেকবুদ্ধি ও আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের মধ্যে তথ্যের পরিধিগত পার্থক্য ও আপাত ব্যতিক্রম থাকলেও স্পষ্ট বৈপরীত্য থাকা সম্ভব নয়। যেমন যদি কিতাবের নামে দাবি করা হয় যে, স্রষ্টা মানুষকে কোনো অন্যায় ও অশ্লীল কাজের নির্দেশ দিতে পারেন বা তাঁকে প্রতারিত করে তাঁর থেকে কল্যাণ অর্জন করা যেতে পারে তাহলে তা বিবেকবিরুদ্ধ বিধায় স্রষ্টার নাযিলকৃত কিতাব নয় বলে প্রমাণিত হবে।

অবশ্য কোনো কিতাবকে বিবেকবুদ্ধিসঙ্গত ও অন্য বহুবিধ যৌক্তিক কারণে স্রষ্টার প্রেরিত বলে বিশ্বাস করার বিষয়টিতে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে অর্থাৎ এটিকে ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি (Subjective view) বলে দাবি করার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় আদর্শগতভাবে মনস্তাত্ত্বিক দ্বান্দ্বিক অবস্থান এবং প্রত্যেক পক্ষ নিজেদের গৃহীত মতাদর্শের প্রকাশ ও বিকাশ সাধনের জন্য চেষ্টা করা একান্তই স্বত:সিদ্ধ বাস্তব বিষয়।

আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের মাধ্যমে মানুষকে অতীন্দ্রীয় (গায়েব) এর সাথে সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য বিস্তারিতভাবে জানানো হয়েছে, মানুষের বিবেকবুদ্ধি যে ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কিত বোধ রাখে তার মৌলিক বিষয়গুলোকে প্রত্যয়ন করা হয়েছে এবং তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে স্রষ্টার পক্ষ থেকে কিছু বিশেষ বিধান নির্দিষ্ট করে দিয়ে বাকি বিষয়গুলোতে বিবেকবুদ্ধিসঙ্গতভাবে চলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং স্রষ্টার উপাসনামূলক করণীয়সমূহও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সুতরাং একদিকে বিবেকবুদ্ধি দ্বারা কিতাবের যৌক্তিকতা বিচার করা যায় এবং অন্যদিকে কিতাবের দ্বারা বিবেক বুদ্ধির সত্যায়ন ও তার সঙ্গতিশীল প্রয়োজনীয় পরিমাণ বিস্তারিত তথ্য ও বিধিবিধান প্রদান করা হয়।

ঈমানের প্রায়োগিক স্বরূপ: শুনলাম ও মানলাম

২:২৮৫ :: রসূল তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা তার উপর নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে এবং মু’মিনগণও ঈমান এনেছে। প্রত্যেকে ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি, তাঁর মালায়েকার (ফেরেশতাগণের) প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রসূলগণের প্রতি। (তারা বলে-) আমরা তাঁর রসূলগণের কারো মধ্যে পার্থক্য করি না। আর তারা বললো, আমরা শুনলাম ও মানলাম। সুতরাং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, আমাদের প্রভু, আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তন।

৩:১৯৩ :: আমাদের প্রভু, আমরা এক আহবানকারীকে ঈমানের দিকে আহবান করতে শুনলাম যে, তোমরা তোমাদের প্রভুর প্রতি ঈমান আনো, সুতরাং আমরা ঈমান আনলাম, আমাদের প্রভু, সুতরাং আমাদের পাপ ক্ষমা করুন এবং আমাদের ত্রুটি বিচ্যুতি মোচন করুন এবং আমাদেরকে সৎকর্মশীলদের সঙ্গে শামিল করে মৃত্যু দান করুন।

৪:৪৬ :: ইয়াহুদীদের মধ্যে এমন আছে যারা আল্লাহর বাণীকে তার স্থানচ্যুত করে বিকৃত করে (interpret out of context) এবং তারা বলে ‘আমরা শুনলাম ও অমান্য করলাম’। এবং ‘শুনো না শুনার মতো’ এবং ‘আমাদের রাখাল হও’, (তারা এসব বলে) তাদের জিহবাকে কুঞ্চিত করে ও দ্বীনের প্রতি বিদ্রূপ / তাচ্ছিল্য করে। অথচ যদি তারা বলতো ‘আমরা শুনলাম ও মানলাম’, এবং “শুনো ও আমাদের প্রতি লক্ষ্য করো”, তাহলে তা তাদের জন্য উত্তম ও  সঠিক হতো। কিন্তু তাদের কুফরের কারণে আল্লাহ তাদেরকে লানত করেছেন, সুতরাং তাদের অল্পসংখ্যক ছাড়া ঈমান আনবে না।

৮:২১ :: আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা বলে ‘আমরা শুনলাম’, অথচ তারা শুনে না।

২৪:৫১ :: নিশ্চয় মু’মিনদের কথা তো এই হয় যে, যখন তাদের মধ্যে ফায়সালা করার জন্য তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে আহবান করা হয় তখন তারা বলে, ‘আমরা শুনলাম ও মানলাম’। আর তারাই সফল।

৭২:১৩ :: আর যখন আমরা পথনির্দেশ (কুরআন) শুনলাম তখন আমরা উহার প্রতি ঈমান এনেছি। আর যে তার প্রভুর প্রতি ঈমান আনে তাহলে তার (সৎকর্মের প্রতিফলের ক্ষেত্রে) ক্ষতি ও দ্বিধান্বিত/বিব্রত হওয়ার ভয় থাকবে না।

২:২১৬ :: তোমাদের উপর ন্যায়যুদ্ধের বিধান বিধিবদ্ধ করা হলো। অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। অথচ হতে পারে কোনো কিছু তোমাদের কাছে অপছন্দনীয় অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হতে পারে কোনো কিছু তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ (নিজে থেকে) জানেন এবং তোমরা (অভিজ্ঞতা ছাড়া নিজে থেকে) জানো না।

৩৮:২৭ :: আমি আকাশ ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী কিছুই উদ্দেশ্যহীন, অর্থহীন, বাস্তব উপযোগহীন ও অযৌক্তিকভাবে সৃষ্টি করিনি। অযৌক্তিকভাবে সৃষ্টির ধারণা কাফিরদের ধারণা। সুতরাং কাফিরদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের দুর্ভোগ।

৪১:৪২ :: তাতে (কুরআনে) কোনোভাবে বাতিল অনুপ্রবেশ করতে পারবে না (তাকে প্রতিহত করতে কোনোভাবে বাতিল আসতে পারবে না), না সেটার সামনে থেকে আর না সেটার পেছন থেকে। তা (কুরআন) মহাবিজ্ঞ মহাপ্রশংসিত সত্তার (আল্লাহর) পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।

২৫:৭৩ :: এবং যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিলে তার উপর অন্ধ এবং বধিরের মত (প্রতিক্রিয়ায়) পড়ে যায় না।

আলোচনা: ঈমানের প্রায়োগিক স্বরূপ হলো আল্লাহর বিধান শুনার পর কোনোরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা আপত্তি ছাড়া তা মেনে নেয়া। আমরা আগেই জেনেছি যে, ঈমানের শর্ত হলো বিবেকবুদ্ধির প্রয়োগ ও জ্ঞান। বস্তুত স্পষ্ট বিবেকবিরুদ্ধ কথাতেও ঈমান আনা হলো ‘ঈমান বিল বাতিল’ বা ‘অযৌক্তিক বিশ্বাস’, যে বিষয়কে কুরআনে আপত্তিকর সাব্যস্ত করা হয়েছে। কুরআনের দাবি অনুসারে বিবেকসঙ্গতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার নীতি অনুসরণ করলে মানুষ ঈমান আনতে সক্ষম হয় এবং বিবেকবিরুদ্ধ নীতিতে চললে মানুষ ঈমান আনতে ব্যর্থ হয়। সুতরাং আল্লাহ, তাঁর রসূল ও কিতাবের উপস্থাপিত তথ্যে ঈমান রাখার মূলনীতি হলো- ঈমানের মূল শর্ত পূর্ণ হওয়া তথা নিজের নিশ্চিত জ্ঞানের মাধ্যমে যাচাইকৃত তথ্যের ভিত্তিতে আল্লাহ এবং তাঁর কিতাব ও রসূলের প্রতি ঈমান আনার পর যে বিষয়টিতে নিজের নিশ্চিত জ্ঞান নেই সে বিষয়েও আল্লাহর কিতাবে থাকা তথ্য ও বিধানকেও বিশ্বাস করে শুনা ও মানা, তার অন্যথা না করা। এক্ষেত্রে এরূপ হতে পারে যে, কোনো তথ্য বা বিধানের তাৎপর্য স্পষ্ট কিন্তু কারণ ও ফলাফল অজানা, সেই অবস্থায়ও তাতে বিশ্বাস করতে হবে। অর্থাৎ যখন কিতাবে থাকা বাক্যটি বা নির্দেশটি স্পষ্ট কিন্তু কেন এ নির্দেশ দেয়া হলো বা এ নির্দেশ বাস্তবায়নের বাস্তব ফল কী হবে, তা অভিজ্ঞতার অভাবে বা গভীর বাস্তব বিশ্লেষণাত্মক জ্ঞানের অভাবে অজানা থাকে, সে অবস্থায়ও ঐ তথ্য ও নির্দেশের প্রতি ঈমান আনতে হবে। যখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোনো বিষয়ে সরাসরি ফায়সালা দেন তখন কোনো মু’মিনের সেক্ষেত্রে ভিন্নমতের বা ভিন্নরূপ করার কোনো অধিকার নেই।

বিশ্বাসের যৌক্তিকতা এবং আল্লাহর আদেশের যৌক্তিকতা অনুধাবনের মূলনীতি হলো, আংশিক বিশ্বাস ও অনুসরণের অবকাশ নেই, হয় আল্লাহ ও তাঁর কিতাবের প্রতি সরাসরি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা হবে, না হয় তা অবিশ্বাস হিসেবে সাব্যস্ত হবে। যদি বিশ্বাসে উপনীত হওয়ার জন্য বিবেকবুদ্ধির প্রয়োগ করে বিবেকবুদ্ধির নিকট স্বত:সিদ্ধ ও প্রমাণিত তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বাসে উপনীত হয়, তবে যেসব তথ্য বিবেকবুদ্ধির অগম্য বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত তার জন্য যৌক্তিক বলে বুঝতে পারার পরে মানবো এরূপ শর্তারোপ করা যায় না। অনুরূপভাবে কোনো বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর কিতাবে দেয়া হয়েছে বলে বুঝতে পারার পর নিজের কাছে যৌক্তিক মনে হলে তারপরে মানবো এ ধরনের শর্তারোপ করা যেতে পারে না। কারণ এরূপ কথার অর্থ হলো, আল্লাহ যে যৌক্তিক বিধানদাতা সে বিষয়ে অবিশ্বাস করা। বস্তুত নিজ জ্ঞানসীমায় যে বিষয়াবলির যৌক্তিকতা নির্ণয় সম্ভব সেরূপ সকল তথ্যকে কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া যৌক্তিক হিসেবে পাওয়ার প্রেক্ষিতে কুরআনকে আল্লাহর কিতাব হিসেবে বিশ্বাস করার পর এতে থাকা বাকি বাণী ও বিধানেও বিশ্বাস করতে হবে।

অবশ্য মু’মিন ব্যক্তি আবার কাফির হয়ে যাবে, মানুষ হিসেবে তার এ স্বাধীনতা আছে।  যদিও এর ফলস্বরূপ তাকে আখিরাতে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু যদি কাফির হওয়ার বিষয়টি তার কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতাজনিত কারণে হয়ে থাকে বা যে কারণেই হোক না কেন যদি পরবর্তীতে সে আবার মু’মিন হয়, সেটারও সুযোগ আছে। অবশ্য কুফরের এমন একটা চূড়ান্ত স্তর আছে যে পর্যায়ের কুফর করলে সেই ব্যক্তির অন্তরে মোহর পড়ে যায়, তারপর আর তার দ্বারা ঈমান আনা সম্ভব হয় না। একমাত্র আল্লাহই জানেন যে, কে ঐ পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং কে ঐ পর্যায়ে পৌঁছেনি।

আবার বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, মু’মিন ব্যক্তি আল্লাহর বিধান নামে কেউ তার নিকট কিছু বললেই আসলে আল্লাহ সে কথাটিই বলেছেন কিনা তা যাচাই ছাড়া বা আল্লাহর আয়াতের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবনের পূর্বেই দাবিকৃত বা অনুমানকৃত অর্থে তার প্রয়োগের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে বলা হয়নি, বরং প্রকৃতপক্ষে কথাটি আল্লাহর বাণীর সঠিক তাৎপর্য নাকি তাঁর বাণীর তাৎপর্য ভুলভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে তা যাচাই করে আসলে তিনি কী বলেছেন তা বুঝার পরই তাতে বিশ্বাস করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আর কোনো বিষয়ে সুস্পষ্ট উপলব্ধির পূর্বে আপাত উপলব্ধির প্রয়োগ যদি অকল্যাণকর হবে বলে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, তবে সেরূপ আপাত উপলব্ধির প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে।

ঈমান আনার বিষয়ে স্বাধীনতা এবং কুফরের স্বরূপ ও পরিণাম

১৮:২৯ :: আর বল, ‘সত্য তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে। সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে যেন ঈমান আনে এবং যে ইচ্ছা করে সে যেন কুফর করে। নিশ্চয় আমি যালিমদের জন্য আগুন প্রস্তুত করেছি, যার প্রাচীরগুলো তাদেরকে বেষ্টন করে রেখেছে। যদি তারা পানি চায়, তবে তাদেরকে দেয়া হবে এমন পানি যা গলিত ধাতুর মত, যা চেহারাগুলো ঝলসে দেবে। কী নিকৃষ্ট পানীয়! আর কী মন্দ আশ্রয়স্থল!

৪:১৩৭ :: নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে তারপর কুফর করেছে, তারপর ঈমান এনেছে, তারপর কুফর করেছে, তারপর কুফরকে বাড়িয়ে দিয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করার নন এবং তাদেরকে পথ প্রদর্শন করার নন।

৪:১৬৫ :: আর (পাঠিয়েছি) রাসূলগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, যাতে আল্লাহর বিপক্ষে রাসূলদের পর মানুষের জন্য কোন অজুহাত না থাকে। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় ।

৯৮:১-৩ :: কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফর করে তারা এবং মুশরিকরা (তাদের বিভ্রান্তি থেকে) বিমুক্ত হওয়া সম্ভব ছিলো না তাদের নিকট সুস্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণ না আসা পর্যন্ত। আল্লাহর পক্ষ থেকে এক রাসূল যে পবিত্র সহীফাসমূহ (কুরআনের বিভিন্ন সময় নাজিলকৃত আয়াতসমষ্টি) তিলাওয়াত করে। যাতে সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত বিধিবদ্ধ বিধানসমূহ রয়েছে।

৯৮:৬ :: নিশ্চয় আহলে কিতাবের মধ্যে যারা কুফর করেছে তারা এবং মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে থাকবে স্থায়ীভাবে। তারাই হল নিকৃষ্ট সৃষ্টি।

৬:১৩১ :: এটা এজন্য যে আল্লাহ কোন জনপদকে ধ্বংস করেন না অন্যায়ভাবে এবং (সত্যপথ কোনটি আর ভুলপথ কোনটি সেই সম্পর্কে) যখন তারা থাকে অসচেতন।

আলোচনা: ঈমান আনার ক্ষেত্রে মানুষ স্বাধীন। একজন ব্যক্তি একবার ঈমান আনতে পারে, আবার কুফর করতে পারে, আবার ঈমান আনতে পারে, আবার কুফর করতে পারে। তবে কুফরের পরিণাম হলো জাহান্নামের শাস্তি। কিন্তু কুফর বলতে কী বুঝায়? যখন কোনো ব্যক্তির কাছে স্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণ এসে যায়, রসূলের তিলাওয়াতকৃত আয়াতসমূহের মাধ্যমে যখন তার নিকট আল্লাহর বিপক্ষে অজুহাত পেশ করার মতো কোনো অবস্থা থাকে না, তখনও সে ঈমান না আনাই কুফর যার জন্য তাকে আখিরাতে শাস্তি পেতে হবে। যারা প্রকৃত সত্য সম্পর্কে এমন পর্যায়ে অসচেতন যে জন্য তাদেরকে দায়ী করা যায় না, ঐরূপ অবস্থায় সত্যের সাথে অসঙ্গতিশীল কোনো চিন্তা বা কাজের জন্য আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করেন না। সুতরাং যখন কোনো ব্যক্তি সত্য অস্বীকারের মাধ্যমে দায়ী হওয়ার পর্যায়ে অবস্থান করে ঐরূপ অবস্থায় সত্যের প্রতি অবিশ্বাস-অস্বীকারের জন্য এবং সত্য সম্পর্কে অসচেতন থাকার জন্যই সে শাস্তিযোগ্য সাব্যস্ত হবে।

যন্নূন (ধারণা)/ ইয়াক্বীন (নিশ্চয়তাবোধ) ও ঈমান

যন্নুূন মানে ধারণা, যা সত্যভিত্তিকও হতে পারে আবার সম্ভাবনামূলকও হতে পারে। যখন হক্ব বা সত্যের সাথে তুলনার্থে যন্নূন এর কথা বলা হয় তখন এর দ্বারা সম্ভাবনামূলক অনুমানকে বুঝানো হয়। আর ইয়াক্বীন অর্থ হলো ‘কোনো কিছুর সত্যতার নিশ্চয়তাবোধ’।

যন্নূন, ইয়াক্বীন ও ঈমান একই বিষয়ের তিনটি অবস্থা হিসেবেও অবস্থান করতে পারে, যেমন আখিরাতের প্রতি ইয়াক্বীন/নিশ্চয়তাবোধ (২:৪) এবং আল্লাহর সাক্ষাতের বিষয়ে যন্নুন/ধারণা (২:৪৬) মূলত আখিরাতের প্রতি ঈমান এর দুটি অবস্থা।

যন্নুন বা ধারণা এবং ইয়াক্বীন/নিশ্চয়তাবোধ এর পরেও কেউ কুফর করতে পারে, যেমন ফেরাউন ও তার দলবল (২৭:১৪)।

সুতরাং ইয়াক্বীন বা নিশ্চয়তাবোধ যখন আস্থা-বিশ্বাস তৈরি করে, যার ফলে বিশ্বস্ততামূলক আচরণ তৈরি হয় তখন সেটাকেই ঈমান বলে।

অবশ্য ঈমান আনয়নকারী ব্যক্তিকেও ঈমান আনতে বলা হয়েছে, যার মানে ঈমান এমন একটি বিষয় যা ক্রমে ক্রমে অধিকতর দৃঢ়তা লাভ করে (৪:১৩৬)।

অন্যদিকে যন্নুন বা ধারণা এবং ইয়াক্বীন/নিশ্চয়তাবোধের পরে ঈমান/দৃঢ় আস্থা-বিশ্বাস এর আগে কেউ ইসলাম/ আত্মসমর্পণ করতে পারে (৪৯:১৪)। এরূপ ব্যক্তিদেরকে বলা হয়েছে তারা যদি যথাবিধি আনুগত্য করে তাহলে তাদের আমলসমূহকে ব্যর্থ করা হবে না এবং এর মাধ্যমে তারা ঈমানের দিকে পরিচালিত হবে তথা এক পর্যায়ে ঈমান তাদের অন্তরে প্রবেশ করতে পারবে।

ঈমান এর মধ্যে আস্থা বিশ্বাস ও নিরাপত্তাবোধ এবং বিশ্বস্ততার অর্থ রয়েছে। যেমন আল্লাহর প্রতি ঈমান এর মানে হলো আল্লাহর অস্তিত্বকে বিশ্বাস করা, তাঁর প্রতি আস্থা রাখা বা তাঁর কারণে নিরাপত্তাবোধ তৈরি হওয়া এবং তাঁর প্রতি বিশ্বস্ততা রক্ষা করা হবে এরূপ বিশ্বাস লাভ করা।

একজন মু’মিন ব্যক্তিও ইসলাম/আত্মসমর্পণ করতে হবে এবং জারি রাখতে হবে (৩:১০২)।

সুতরাং ইসলাম ও ঈমান এর যে কোনোটি আগে-পরে হতে পারে। তবে ইসলাম যেখানে বিধি-বিধান মেনে নেয়ার নাম, ঈমান সেখানে অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাসের নাম। ঈমান থাকলে তার সাধারণ বহির্প্রকাশ হিসেবে ইসলাম থাকবে, আবার ইসলামের ক্ষেত্রে ত্রুটি বিচ্যুতির মাধ্যমেও ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে পারে। অর্থাৎ এর একটি অন্যটিকে প্রভাবিত করে। তাই ইসলামের পথ ধরে একজন ব্যক্তি ক্রমান্বয়ে ঈমান অর্জন করতে পারে (৪৯:১৭)। আবার ঈমানের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ইসলামের যথাযথ অনুসরণকারী হতে পারে। যেহেতু এর একটি অন্যটিকে প্রভাবিত করে, তাই মু’মিন ব্যক্তিকে মুসলিম অবস্থায় ছাড়া মরতে নিষেধ করা হয়েছে। শুধু তা নয়, মু’মিনদেরকে আবার ঈমান আনতে তথা ঈমানে দৃঢ়তা লাভ করতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

একজন যথাযথ মু’মিন একই সাথে মুসলিম এবং একজন যথাযথ মুসলিম একই সাথে মু’মিন হয়ে থাকে (১০:৪৮, ৩:৫২)। মু’মিনদের ধর্মাদর্শগত জাতীয় পরিচিতি ‘মুসলিম’ নামে (২২:৭৭-৭৮) এবং অন্যদেরকে আল্লাহর দিকে আহবানকারীরা নিজেদেরকে মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত বলে পরিচয় দিতে হবে (৪১:৩৩)। তবে একজন মুসলিম (আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী) নিজেকে (দৃঢ়) মুসলিম বানানোর জন্য প্রার্থনা করা উচিত (২:১৩১, ২:১২৮)।

প্রসঙ্গক্রমে রসূলের সমকালীন একটি পর্যায়ের আ’রাবদের প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা ইসলাম করেছে কিন্তু ঈমান তখনো তাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি। তাই তারা যেন ‘আমরা ঈমান এনেছি’ না বলে ‘আমরা ইসলাম করেছি’ বলে। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, কোনোক্রমে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বলা যাবে না (২:১৩৬, ৩:৮৪, ৫:৫৯, ৩:১৬, ৩:১৯৩, ৫:৮৩, ২৩:১০৯, ৩:৫২, ৫:১১১, ৭:১২০-১২১, ৭:১২৬, ২০:৭৩, ২৯:৪৬ ইত্যাদি) । এমনকি যারা নিজেদেরকে মু’মিন দাবি করে বা মু’মিন বলে পরিচয় দেয় তাদেরকে যাচাই ছাড়া ‘তোমরা মু’মিন নও’ বলে দেয়া যাবে না।

যন্নূন বা ধারণা সত্যের মোকাবেলায় মোটেই ফলপ্রসূ হয় না (১০:৩৬)। তাই যে যৌক্তকভাবে সত্যে উপনীত হয় এবং যে অনুমানের উপর প্রতিষ্ঠিত এ দুপক্ষের অবস্থান সমান নয়। অনুমানকে যাচাই করে নিতে হবে এবং যাচাই সাপেক্ষে বা সত্য সাক্ষের মাধ্যমে সত্যে উপনীত হওয়া যায়। এটা স্বতন্ত্র বিষয় যে, একবার যা সত্য বলে প্রতীয়মান হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরবর্তীতে তা অসত্য বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ স্বর্ণালী নিয়ম (যাচাই ও সাক্ষ্য গ্রহণ) ছাড়া মানুষের জন্য দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। ‘সন্দেহবাদিতা’ কখনো গ্রহণযোগ্য জীবনপদ্ধতি হতে পারে না। ‘সন্দেহ’ যাচাইয়ের পূর্ব ধাপ, কিন্তু সন্দেহ জিইয়ে রাখা এবং যাচাই পদ্ধতিতে কোনো বিষয়কে সত্য বলে সাব্যস্ত না করা একটি অপরাধ।

ঈমানের প্রয়োজনীয়তা এবং কুফরের ফলে কর্ম বিনষ্ট হওয়া ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত  হওয়ার কারণ

১০৩:১-৩ :: প্রবহমান সময়ের শপথ। নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তারা ছাড়া যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে এবং সত্য ও অধিকার বিষয়ে পরস্পরকে উদ্বুদ্ধ করে এবং ধৈয ও অধ্যবসায় বিষয়ে পরস্পরকে উদ্বুদ্ধ করে।

২৪:৩৯ :: যারা কুফরী করে, তাদের আমলসমূহ মরুভূমির মরীচিকা সদৃশ। পিপাসার্ত যাকে পানি মনে করে থাকে, কিন্তু সে সেটার নিকট উপস্থিত হলে সে সেখানে কাঙ্ক্ষিত কিছুই পায় না, কিন্তু  সে সেখানে পাবে আল্লাহকে। অতঃপর তিনি তার কর্মফল পূর্ণ মাত্রায় দিবেন; আল্লাহ হিসাবকরণে তৎপর।

৫৩:২৩ :: এগুলো তো কেবল কতকগুলো নাম যে নাম তোমরা আর তোমাদের বাপদাদারা রেখেছ, এর পক্ষে আল্লাহ কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। তারা তো শুধু অনুমান আর প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে, যদিও তাদের কাছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে পথ নির্দেশ এসেছে।

৫২:৩৫-৩৬ :: তারা কি অস্তিত্বহীন কিছুর পক্ষ থেকে সৃষ্টি হয়েছে, না তারাই স্রষ্টা? তারা কি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছে? বরং তারা দৃঢ় বিশ্বাস করে না।

৩৯:৭ :: তোমরা অকৃতজ্ঞ হলে আল্লাহ তোমাদের মুখাপেক্ষী নন, তিনি তাঁর বান্দাদের অকৃতজ্ঞতা পছন্দ করেননা। যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও তাহলে তিনি তোমাদের জন্য এটাই পছন্দ করেন। একের বোঝা অন্যে বহন করবেনা। অতঃপর তোমাদের প্রভুর নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন এবং তোমরা যা করতে তিনি তোমাদেরকে তা অবগত করাবেন। অন্তরে যা আছে তা তিনি সম্যক অবগত।

৪০:১০ :: নিশ্চয় কাফিরদেরকে বলা হবে, “ তোমাদের নিজেদের প্রতি তোমাদের ক্ষোভের চেয়ে আল্লাহর প্রসন্নতা আরো বড় ছিলো, যখন তোমাদেরকে ঈমানের দিকে আহবান করা হয়েছিলো এবং তোমরা তার প্রতি কুফর (অস্বীকার) করেছিলে”।

৭:৫৪ :: নিশ্চয় তোমাদের প্রভু আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশে (পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের গদিতে) অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি রাতকে দ্বারা দিনকে ঢেকে দেন। প্রত্যেকটি একে অপরকে দ্রুত অনুসরণ করে। আর (সৃষ্টি করেছেন) সূর্য, চাঁদ ও তারকারাজী, যা তাঁর নির্দেশে নিয়োজিত। জেনে রাখ, সৃষ্টি ও নির্দেশ তাঁরই। আল্লাহ মহান, যিনি সকল সৃষ্টির প্রভু।

৪২:২১ :: তাদের জন্য কি এমন কিছু শরীক আছে, যারা তাদের জন্য দীনের বিধান দিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? আর ফয়সালার ঘোষণা না থাকলে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েই যেত। আর নিশ্চয় যালিমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব।

২:২৫৬ :: দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় হিদায়াত স্পষ্ট হয়েছে ভ্রষ্টতা থেকে। অতএব, যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

১০:৯৯ :: তোমার প্রতিপালক ইচ্ছে করলে দুনিয়ার সমস্ত লোক অবশ্যই ঈমান আনত, তাহলে কি তুমি ঈমান আনার জন্য মানুষদের উপর জবরদস্তি করবে?

২:৩৯ :: আর যারা অবিশ্বাস করবে এবং আমার নিদর্শনসমূহে অসত্যারোপ করবে, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।

৪০:১৬-১৭ :: যে দিন লোকেরা (শেষ বিচারের জন্য) বের হয়ে আসবে। সে দিন আল্লাহর নিকট তাদের কিছুই গোপন থাকবে না। ‘আজ রাজত্ব কার’? প্রবল প্রতাপশালী এক আল্লাহর। এদিন প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের ফল দেয়া হবে; সেদিন কারও প্রতি যুলম করা হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ হিসাবকরণে তৎপর।

১১:১৫-১৬ :: যে কেউ দুনিয়ার জীবন ও তার শোভা কামনা করে, দুনিয়াতে আমরা তাদের কাজের পূর্ণ ফল দান করি এবং সেখানে তাদেরকে কম দেয়া হবে না। এরা এমন লোক যে, তাদের জন্য আখিরাতে জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নেই; আর তারা যা কিছু করছে তাও বিফল হবে।

২:২১৭ :: তারা তোমাকে হারাম মাস সম্পর্কে, তাতে লড়াই করা বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। বল, ‘তাতে লড়াই করা বড় পাপ; কিন্তু আল্লাহর পথে বাধা প্রদান, তাঁর সাথে কুফরী করা, মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দেয়া এবং তার অধিবাসীদেরকে তা থেকে বের করে দেয়া আল্লাহর নিকট অধিক বড় পাপ। আর ফিতনা হত্যার চেয়েও বড়’। আর তারা তোমাদের সাথে লড়াই করতে থাকবে, যতক্ষণ না তোমাদেরকে তোমাদের দীন থেকে ফিরিয়ে দেয়, তারা যদি পারে। আর যে তোমাদের মধ্য থেকে তাঁর দীন থেকে ফিরে যাবে, অতঃপর কাফির অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে, বস্তুত এদের আমলসমূহ দুনিয়া ও আখিরাতে বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং তারাই আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।

৭:১৪৭ :: আর যারা আমার আয়াতসমূহ ও আখিরাতের সাক্ষাতকে অস্বীকার করেছে তাদের কর্মসমূহ বিনষ্ট হয়ে গেছে। তাদেরকে কি তাদের কর্ম অনুযায়ী ছাড়া প্রতিফল দেয়া হবে? (অর্থাৎ তারা যা করে তদনুযায়ী তাদের প্রতিদান দেয়া হবে)।

১৪:১৮ :: যারা তাদের প্রতিপালককে কুফর করে তাদের কর্মসমূহের দৃষ্টান্ত হল সেই ছাইয়ের মত যা ঝড়ের দিনে বাতাস প্রচন্ড বেগে উড়িয়ে নিয়ে যায়। নিজেদের উপার্জনের কিছুই তারা কাজে লাগাতে পারে না। এটাই ঘোর বিভ্রান্তি।

১৮:১০৫ :: তারাই সেসব লোক, যারা তাদের প্রভুর আয়াতসমূহ ও তাঁর সাথে তাদের সাক্ষাতের ব্যাপারে কুফর করেছে। ফলে তাদের সকল আমল নিষ্ফল হয়ে গেছে; সুতরাং আমরা তাদের জন্য কেয়ামতের দিন কোনো ওজনের ব্যবস্থা রাখবো না।

৩৯:৬৫ :: আর অবশ্যই তোমার কাছে এবং তোমার পূর্ববর্তীদের কাছে ওহী পাঠানো হয়েছে যে, তুমি শিরক করলে তোমার কর্ম বিনষ্ট হবেই। আর অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

আলোচনা: মানুষের অস্তিত্ব এবং তার ধারণকৃত যোগ্যতাসমূহ কিছুই সে নিজে সৃষ্টি করেনি। এমতাবস্থায় স্বীয় মস্তিষ্ক ব্যবহার করে সে যেই বিবেকবুদ্ধি ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করে তার কিছুকেই স্বয়ং তার কৃতিত্ব বলা যেতে পারে না। তবে সে তার যোগ্যতাসমূহকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহারের জন্য পুরস্কৃত এবং নেতিবাচকভাবে ব্যবহারের জন্য তিরস্কৃত হওয়ার মতো স্বাধীনতার ধারক।

যেহেতু:

ক. মানুষের বিবেকবুদ্ধি ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা একটা সীমিত পর্যায় পর্যন্ত তাকে সঠিক ব্যবস্থার উপর উপনীত হতে সাহায্য করে,

খ. এই বিবেকবুদ্ধিও তাকে দেয়া হয়েছে, সে নিজেই নিজের মধ্যে বিবেকবুদ্ধি তৈরি করেনি,

গ. সঠিক জীবনব্যবস্থার জন্য শুধুমাত্র বিবেকবুদ্ধি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় বরং এক্ষেত্রে তার সীমাবদ্ধতা এবং এর বাস্তব প্রমাণস্বরূপ বিভিন্ন অনুমাননির্ভর মতভিন্নতা বিদ্যমান,

ঘ. সে নিজেই নিজেকে সৃষ্টি না করায় এবং নিষ্কাম নিরপেক্ষভাবে পূর্ণ জ্ঞানের ভিত্তিতে নিজের জন্য মূল বিধান রচনার যোগ্যতা ও অধিকার রাখে না,

ঙ. সৃষ্টিকর্তার দেয়া বিবেকবুদ্ধির মতোই তাঁর পক্ষ থেকে প্রেরিত ওহীভিত্তিক বিশ্বাস ও বিধান তার জন্য প্রকৃত ও ন্যায়সঙ্গত কল্যাণের জন্য অবশ্য পালনীয়,

চ. বিশ্বপ্রভু ও তাঁর বিধানের পরিচয় লাভের পর শুধুমাত্র দয়াময়, ন্যায়বিচারক ও সার্বভৌম স্রষ্টারই দাসত্ব করা তার জন্য প্রকৃত সত্যের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত পথ এবং এর বিপরীতে স্রষ্টাকে অবিশ্বাস করা বা তাঁর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করা ও তাঁর অবাধ্য হওয়া তার জন্য সবচেয়ে বড় অপরাধ;

সুতরাং জীবন জিজ্ঞাসার সঠিক জবাব অন্বেষণ এবং আল্লাহর নাযিলকৃত ওহীর জ্ঞানের ভিত্তিতে ঈমান এবং স্রষ্টার বিধানকেই একমাত্র মূল বিধান হিসেবে গ্রহণ করা মানুষের জন্য জীবনের সর্বপ্রধান কর্তব্য। তবে এ কর্তব্য বর্তায় বিবেক বুদ্ধির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে নিদর্শনগত জ্ঞান তথা সত্যের সন্ধান করে সত্যে উপনীত হলে বা কোনোভাবে ওহীর জ্ঞান পৌঁছলে সেটা সত্যিই ওহীর জ্ঞান কিনা তা যাচাই করে নিশ্চয়তাবোধ পেলে।

স্রষ্টা তাঁর কিতাব নাযিল করে এর প্রতি বিশ্বাসীদেরকে এর প্রচারের এবং স্রষ্টার দিকে আহবানের দায়িত্ব দিয়েছেন। অন্যদিকে যেহেতু তিনি কিতাব নাযিল করেছেন তাই কারো কাছে এ কিতাবের কোনো তথ্য পৌঁছা না পৌঁছা তার কাছে একটি অজুহাত হিসেবে গণ্য হতে পারে যদি সে স্রষ্টার কোনো বিধানগ্রন্থ রয়েছে কিনা এ বিষয়ে তার সাধ্যমতো সন্ধান করার পরও তা তার আয়ত্তে না এসে থাকে। অন্যথায় কেউ তার পর্যন্ত পৌঁছে দেয়নি এ অজুহাত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

ঈমান আনা মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব এবং ঈমান না আনা তথা কুফর (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান) করা তার প্রভুর সামনে তার অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত (যদিও এজন্য মানুষের কর্তৃক কোনো পার্থিব দন্ডবিধি প্রযোজ্য নয়, বরং ঈমান আনা না আনার ক্ষেত্রে মানুষকে বিশ্বাসের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে)। ঈমান না আনলে মানুষের পাথির্ব জীবনের কর্মকাণ্ডের যে স্বাভাবিক প্রতিফল তারা পাওয়ার কথা সে ক্ষেত্রে তাদেরকে মোটেই কম দেয়া হবে না,বরং তারা পার্থিব ফসল বা সুফল ঠিকঠাক পূর্ণমাত্রায় পেয়ে যাবে। কিন্তু আখিরাতের তাদের জন্য কোনো অংশ থাকবে না এবং ঈমান না আনার অপরাধের জন্য তারা জাহান্নামের শাস্তিপ্রাপ্ত হবে এবং তাদের অন্যান্য অপরাধ থাকলে সেটা বিবেচনায় তাদের শাস্তি বৃদ্ধি পাবে। তবে তারা তাদের কৃতকর্মেরই ফলাফল ভোগ করবে, তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না।

একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন হলো, ঈমান না আনলে সে ব্যক্তির সৎকর্মকে আখিরাতে পুরস্কার দেয়ার জন্য কবুল করা হয় না কেন এবং ঈমান না আনার কারণে আখিরাতে সে অপরাধী বলে সাব্যস্ত হবে এবং জাহান্নামের শাস্তি পাবে? এ প্রশ্নের জবাবে আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে নিম্নোক্ত যুক্তিগুলো অনুধাবন করা যায়:

১। ঈমান ছাড়া যেসব সৎকর্ম করা হয় পৃথিবীতে তার ফলাফল পাবে কিন্তু আখিরাতে তাদের ঐ কাজগুলোর মূল্যমান শূন্য। কারণ তারা তা স্রষ্টার আদেশের ভিত্তিতে করেনি, বরং তারা তা করেছে নিজেদের ব্যক্তিগত পছন্দকে মূল নিয়ামক হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে। এভাবে স্রষ্টার প্রতি অবিশ্বাস এবং তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণ থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে সে মূলত চিন্তাপরাধে জড়িত হয়েছে, সে অহঙ্কার করেছে, যা তার জন্য সম্পূর্ণ অনধিকার চর্চা ও সত্যের সাথে বিরোধিতা। তাই মূলনীতিগতভাবে সে সত্যের প্রতি নিষ্ঠাবান নয়, যা যে কোনো সৎকাজ করা ও না করার বিষয়টিকে যথাযথ ভিত্তি থেকে বিচ্যুত করে দিয়েছে। আর এজন্য তার এরূপ ভালো কাজ সত্ত্বেও সে আখিরাতের বিচারে একজন অপরাধী হিসেবেই সাব্যস্ত হবে।

২। মানুষের জ্ঞানগত ও বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে এবং নিজেই নিজেকে সৃষ্টি না করায় অধিকারগত প্রশ্নের ভিত্তিতে নিজের জন্য নিজেই মূল জীবন বিধান রচনার পরিবর্তে ঈমান অপরিহার্য। এই অপরিহার্য দায়িত্ব পালনকে অস্বীকার করার মাধ্যমে সে তার মানব প্রকৃতির অনিবার্য দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং মানুষ ও জগতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে অস্থিতিশীল নৈতিকতার সাধারণ সম্ভাবনাসূচক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করেছে।

৩। মানুষ সঠিক জীবনব্যবস্থার কল্যাণ লাভের জন্য ঈমান আনা অপরিহার্য। ঈমান না আনার অর্থ হলো স্রষ্টার প্রতি অকৃতজ্ঞতা এবং ঈমান আনার অর্থ হলো তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। আমাদের ঈমান আনাতে আল্লাহর নিজের কোনো প্রয়োজন নেই তথা তিনি আমাদের ঈমান আনার মুখাপেক্ষী নন। কিন্তু তিনি আমাদের জন্য অকৃতজ্ঞতাকে অপছন্দ করেন এবং কৃতজ্ঞতাকে পছন্দ করেন। যেহেতু আমাদের কৃতজ্ঞতা ও অকৃতজ্ঞতা তথা ঈমান আনা ও না আনার প্রভাব আমাদের কাজের উপর পড়ে, তাই ঈমান আনাকে কর্তব্য পালন এবং ঈমান না আনাকে অপরাধ সাব্যস্ত করে ঈমান আনার জন্য পুরস্কার এবং ঈমান না আনার জন্য শাস্তি দেয়া হবে।

৪। মনের উপর জোর করে ঈমান হয় না, তাই ঈমানের জন্য জোরপ্রয়োগ চলবে না। তবে যখন বিবেকবুদ্ধির দাবি অনুযায়ী কেউ ঈমান (বিশ্বাস) আনার জন্য দায়বদ্ধ হয়ে যায়, তখন ঈমান না আনা তার প্রভুর কাছে তার অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। কারণ সেক্ষেত্রে ঈমান না আনার কারণ হয়ে থাকে প্রবৃত্তির অনুসরণ বা সত্য গ্রহণে সদিচ্ছার অভাব, বাপদাদার ঐতিহ্যপ্রীতি, অধিকাংশ লোকের অনুসরণ, কোনো মানুষের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব, দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দান, অন্যের কথায় নিজ বিবেককে অবদমন ইত্যাদি।

ঈমান, ইসলাম ও দীনের সম্পর্ক এবং ঈমানের ভিত্তিতে মানুষের শ্রেণিবিভাগ

১০:১০৪-১০৯ :: বলো, হে মানুষ যদি তোমরা আমার দীনের (জীবনব্যবস্থার) প্রতি সংশয়যুক্ত হও, তবে জেনে রাখো তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদাত (দাসত্ব-উপাসনা) করো আমি তাদের ইবাদাত করি না। পরন্তু আমি ইবাদাত করি আল্লাহর, যিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটান এবং আমি মু’মিনদের অন্তর্ভুক্ত হবার জন্য আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি। আর এ মর্মেও যে, ‘তুমি একনিষ্ঠভাবে দীনে প্রতিষ্ঠিত হও এবং কখনোই মুশরিকদের (অংশীবাদীদের) অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে (অলৌকিকভাবে সাহায্যের জন্য) ডাকবে না, যে তোমার উপকারও করতে পারে না এবং অপকারও করতে পারে না, কারণ তা করলে (আল্লাহ ছাড়া কাউকে অলৌকিক সাহায্যের জন্য ডাকলে) তুমি অবশ্যই জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। এবং আল্লাহ তোমাকে ক্লেশ দিলে তিনি ছাড়া কেউ তা মোচনকারী নেই এবং তিনি তোমার মঙ্গল করতে ইচ্ছা করলে তাঁর অনুগ্রহ রদ করার কেউ নেই। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা মঙ্গল দান করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। বলো, হে মানুষ তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে তোমাদের কাছে সত্য এসেছে। সুতরাং যারা সৎপথ অবলম্বন করবে তারা তো নিজেদের কল্যাণের জন্যই সৎপথ অবলম্বন করবে। আর যারা পথভ্রষ্ট হবে, তারা পথভ্রষ্ট হবে নিজেদেরই ধ্বংসের জন্য এবং আমি (রসূল) তোমাদের উকিল নই। তোমার প্রতি যে ওহী করা হয়েছে তুমি সেটারই অনুসরন করো এবং তুমি ধৈর্য ধারণ করো, যে পর্যন্ত না আল্লাহ ফায়সালা করেন এবং আল্লাহই সর্বোত্তম বিধানদাতা।

২৮:৫২-৫৪ :: ইহার (কুরআনের) পূর্বে আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছিলাম, তারা (তাদের মধ্যকার সত্যনিষ্ঠরা) ইহাতে (কুরআনে) ঈমান আনে। যখন তাদের নিকট ইহা আবৃত্তি করা হয় তখন তারা বলে, “আমরা ইহাতে ঈমান এনেছি, নিশ্চয় ইহা আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত সত্য। আমরা তো পূর্বেও মুসলিম (আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণকারী) ছিলাম। তাদেরকে দুইবার পারিশ্রমিক দেয়া হবে, যেহেতু তারা ধৈর্যশীল এবং তারা ভালোর দ্বারা মন্দের মোকাবিলা করে এবং আমি তাদেরকে যে জীবিকা দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে”।

৩০:৩০-৩৪ :: সুতরাং তোমার মুখমণ্ডলকে/সত্তাকে দ্বীনের (জীবনব্যবস্থার) জন্য একনিষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠা করো। এটাই আল্লাহর ফিতরাত (নির্ধারিত প্রকৃতি) যার উপযোগী করে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোনো বদল নেই। (১) এটাই সঠিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত জীবনব্যবস্থা। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জ্ঞানার্জন করে না। তাঁরই অভিমুখী হও এবং তাঁর প্রতি সচেতন থাকো এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করো এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা নিজেদের দীনকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে এবং নিজেরাও বিভিন্ন দল হয়ে গেছে। প্রত্যেক মিশনারি দল নিজেদের কাছে যা আছে তা নিয়ে উৎফুল্ল। আর মানুষকে যখন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে তখন তারা তাদের প্রভুর প্রতি বিনীতভাবে ফিরে এসে তাকে ডাকে। তারপর যখন তিনি তাদের স্বীয় রহমত আস্বাদন করান, তখন তাদের মধ্যকার একটি দল তাদের প্রভুর সাথে শিরক করে। যাতে তাদেরকে আমরা যা দিয়েছি, তাতে তারা কুফর করে। কাজেই তোমরা ভোগ করে নাও, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে।

(১) অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যের জন্য যা সৃষ্টি করা হয়েছে সে উদ্দেশ্যের জন্য তাই লাগবে এবং যে উদ্দেশ্যে যা সৃষ্টি করা হয়েছে সে উদ্দেশ্যেই তা প্রয়োগ করা যথাযথ।

১০:১৯ :: মানুষ ছিলো একই উম্মাহ (জাতি)। তারপর তারা মতভেদ সৃষ্টি করে (বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত হয়েছে)। তোমার প্রভুর পূর্বঘোষণা না থাকলে তারা যেসব বিষয়ে মতভেদ করে সেগুলোর মীমাংসা হয়েই যেতো।

২:২১৩ :: মানুষ ছিল এক উম্মত। অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে নবীদেরকে প্রেরণ করলেন এবং সত্যসহ তাদের সাথে কিতাব নাযিল করলেন, যাতে মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত। আর তারাই তাতে মতবিরোধ করেছিল, যাদেরকে তা দেয়া হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষবশত। অতঃপর আল্লাহ নিজ অনুমতিতে মুমিনদেরকে হিদায়াত দিলেন যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছিল। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন।

৩:৮৫ :: আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দীন চায় তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

৩:১৯-২০ :: নিশ্চয় আল্লাহর নিকট দীন হচ্ছে ইসলাম। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের নিকট জ্ঞান আসার পরই তারা মতভেদ করেছে, পরস্পর বিদ্বেষবশত। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফর করে, নিশ্চয় আল্লাহ হিসাবকরণে দ্রুত। যদি তারা তোমার সাথে বিতর্ক করে, তবে তুমি বল, ‘আমি আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করলাম এবং আমার অনুসারীরাও’। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে এবং অকিতাবীদেরকে বল, ‘তোমরা কি ইসলাম গ্রহণ করেছ’? তখন যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তারা অবশ্যই হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর যদি ফিরে যায়, তাহলে তোমার দায়িত্ব শুধু পৌঁছিয়ে দেয়া। আর আল্লাহ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।

২:৬২ :: নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং যারা ইয়াহুদ হয়েছে এবং নাসারা এবং সাবিঊন, তাদের মধ্যকার যে-ই আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনবে এবং সৎকর্ম করবে তাদের পুরস্কার রয়েছে তাদের প্রভুর কাছে এবং তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।

৫:৬৯ :: নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং যারা ইয়াহুদ হয়েছে এবং সাবিঊন এবং নাসারা, তাদের মধ্যকার যেই আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনবে এবং সৎকর্ম করবে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।

৫:৪২-৪৩ :: তারা (ইয়াহুদ) মিথ্যা কথা শুনতে অভ্যস্ত, অবৈধ ভক্ষণে অভ্যস্ত। সুতরাং যদি তারা তোমার কাছে আসে তাহলে তুমি তাদের মধ্যে বিচার-মীমাংসা করে দাও, অথবা তাদের বিচার-মীমাংসা করার ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত থাকো (তাদের নিজেদের মধ্যকার বিচার-মীমাংসা তারা নিজেরাই করুক)। আর যদি তুমি তাদের বিচার-মীমাংসা করার ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত থাকো, তাহলে তারা তোমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না। আর যদি তুমি বিচার-মীমাংসা করো তাহলে তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত বিচার-মীমাংসা করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়বিচারকদেরকে ভালবাসেন।

৩:১১০ ::তোমরাই (মু’মিনগণ) হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের কল্যাণের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ন্যায় কাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে। আর যদি আহলে কিতাব ঈমান আনতো, তবে অবশ্যই তা তাদের জন্য কল্যাণকর হতো। তাদের মধ্যে কিছু আছে মু’মিন এবং তাদের অধিকাংশই ফাসিক।

২:৪১ :: আর তোমরা ঈমান আনো সেই কিতাবের প্রতি, যা তোমাদের নিকট যে কিতাব আছে তার প্রত্যয়নকারী এবং তোমরাই তার প্রতি প্রথম কাফির/ অবিশ্বাসী-অস্বীকারকারী-প্রত্যাখ্যানকারী হয়ো না এবং আমার আয়াতকে তুচ্ছ মূল্যের বিনিময়ে বিক্রয় করো না। আর তোমরা আমার প্রতি সচেতন থাকো।

২:১৩৫-১৩৭ : তারা বলে, ‘তোমরা ইয়াহূদ বা নাসারা হয়ে যাও তাহলে সঠিক পথ পাবে’। বল, ‘বরং একনিষ্ঠ হয়ে ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ করো আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’। তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা নাযিল করা হয়েছে আমাদের উপর ও যা নাযিল করা হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানদের উপর আর যা প্রদান করা হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা প্রদান করা হয়েছে তাদের রবের পক্ষ হতে নবীগণকে। আমরা তাদের কারো মধ্যে তারতম্য করি না। আর আমরা তাঁরই অনুগত’। অতএব যদি তারা ঈমান আনে, তোমরা যেরূপে তার প্রতি ঈমান এনেছ, তবে অবশ্যই তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা বিমুখ হয় তাহলে তারা রয়েছে কেবল বিরোধিতায়, তাই তাদের বিপক্ষে তোমার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

৫:৫ :: আজ তোমাদের জন্য বৈধ করা হল সমস্ত পরিচ্ছন্ন বস্তু এবং যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিলো তাদের খাবার তোমাদের জন্য বৈধ এবং তোমাদের খাবার তাদের জন্য বৈধ। আর মু’মিন সচ্চরিত্রা নারী এবং তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিলো তাদের সচ্চরিত্রা নারীদের সাথে তোমাদের বিবাহ বৈধ। যখন তোমরা তাদেরকে মোহর দেবে, বিবাহকারী হিসেবে, নিছক যৌনসম্পর্ক স্থাপনকারী বা গোপনপত্নী গ্রহণকারী হিসেবে নয়। আর যে ঈমানের সাথে কুফর করবে, অবশ্যই তার আমল বরবাদ হবে এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।

৩:১০০ :: হে যারা ঈমান এনেছো, যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, যদি তোমরা তাদের কোনো দলের আনুগত্য করো তাহলে তারা তোমাদের ঈমানের পর তোমাদেরকে কাফির অবস্থায় ফিরিয়ে নেবে।

৫:৫১ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা ইয়াহুদ ও নাসারাকে (প্রভাবিত হওয়ার ন্যায়) বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তাদের সাথে (প্রভাবিত হওয়ার ন্যায়) বন্ধুত্ব করবে নিশ্চয়ই সে তাদেরই মধ্যে গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না।

৪:১৪৪ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা মু’মিনদের পরিবর্তে কাফিরদেরকে তোমাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ পেশ করতে চাও?

৬০:৪-৯ :: ইবরাহীম ও তার সাথে যারা ছিল তাদের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। তারা যখন স্বীয় সম্প্রদায়কে বলছিল, ‘তোমাদের সাথে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যা কিছুর দাসত্ব-উপাসনা কর তা হতে আমরা সম্পর্কমুক্ত। আমরা তোমাদের প্রতি কুফর করছি এবং আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরন্তন (আদর্শগত) শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হলো, যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো। তবে স্বীয় পিতার প্রতি ইবরাহীমের উক্তিটি ব্যতিক্রম: ‘আমি অবশ্যই তোমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবো আর তোমার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আমি কোনো অধিকার রাখি না’। (তারা প্রার্থনা করেছিলো-) হে আমাদের প্রভু, আমরা আপনার ওপরই ভরসা করি, আপনারই অভিমুখী হই আর প্রত্যাবর্তন তো আপনারই কাছে। হে আমাদের প্রভু, আপনি আমাদেরকে কাফিরদের উৎপীড়নের পাত্র বানাবেন না। হে আমাদের প্রভু, আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, মহাবিজ্ঞ”। তোমরা যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রত্যাশা কর নিশ্চয়ই তাদের জন্য তাদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। কেহ মুখ ফিরিয়ে নিলে সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহতো অভাবমুক্ত, প্রশংসিত। আশা করা যায়, যাদের সাথে তোমাদের শত্রুতা রয়েছে আল্লাহ তাদের ও তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দিবেন; আল্লাহ সর্বশক্তিমান, পরম দয়ালু। দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেনি, আর তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ী থেকে বের করে দেয়নি তাদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করতে আর ন্যায়নিষ্ঠ আচরণ করতে আল্লাহ নিষেধ করেননি। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন। আল্লাহ তোমাদেরকে বস্তুত তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন যারা তোমাদের সঙ্গে দীনের ব্যাপারে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছে আর তোমাদেরকে বের করে দেয়ার ব্যাপারে সাহায্য করেছে। যারা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তারাই যালিম।

৭:৪২ :: যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, অবশ্য আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত পর্যায়ে দায়ভার অর্পণ করি না, তারাই ‘আসহাবুল জান্নাত’ (জান্নাতবাসী হবে)।

৭:৪৬-৪৯ :: (জান্নাত ও জাহান্নাম) উভয়ের মধ্যে রয়েছে অন্তরাল এবং আ’রাফে (পরিচিতিতে সীমাবদ্ধদের অবস্থানে) কিছু লোক থাকবে, যারা সকলকে তাদের লক্ষণ দ্বারা চিনবে। তারা জান্নাতবাসীদেরকে সম্বোধন করে বলবে, “তোমাদের উপর শান্তি হোক”। তারা (আ’রাফবাসীরা) তখনো তাতে (জান্নাতে) প্রবেশ করেনি, কিন্তু তারা আকাঙ্ক্ষা করে। যখন তাদের দৃষ্টি জাহান্নামবাসীদের দিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে তখন তারা বলবে, “হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে জালিমদের সঙ্গী করবেন না। আ’রাফবাসীগণ যে লোকদেরকে তাদের লক্ষণ দ্বারা (জাহান্নামবাসী হিসেবে) চিনবে, তাদেরকে সম্বোধন করে বলবে, “তোমাদের সংঘ ও তোমাদের অহংকার কোনো কাজে আসলো না। এরাই (এ জান্নাতবাসীরাই) কি তারা যাদের সম্বন্ধে তোমরা শপথ করে বলতে যে, আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবেন না’? (অথচ তোমাদের দাবির বিপরীতে তাদেরকেই বলা হচ্ছে-) ‘তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো, তোমাদের কোনো ভয় নেই এবং তোমরা দুঃখিতও হবে না’।

আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে জানা যায় যে, ঈমানের অনিবার্য প্রায়োগিক দিক হলো মানুষ শুধুমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানকে (দীনকে) গ্রহণ করে নিবে, এভাবে ইসলামকে তথা আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণকে নিজেদের জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করবে। এটাই আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য জীবনব্যবস্থা। যদি মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে এই একই জীবনব্যবস্থাকে গ্রহণ করে তাহলে তারা একই জাতিতে পরিণত হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে মানুষ তাদের জীবনব্যবস্থার ক্ষেত্রে মতভেদ করে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং প্রত্যেক বিচ্ছিন্ন দল নিজেদের কাছে যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট রয়েছে। যারা ঈমান আনবে তাদের দায়িত্ব হলো এভাবে দীনের ক্ষেত্রে মতভেদ ও বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরবে। তবে দীনের ক্ষেত্রে ও মানুষকে ঈমান আনার বিষয়ে বলপ্রয়োগের অবকাশ নেই। যার ইচ্ছা সে ঈমান আনবে এবং যার ইচ্ছা সে কুফর করবে। এছাড়া কিছু ব্যক্তি রয়েছে যারা সুবিধাবাদের ভিত্তিতে বাহ্যত ঈমান আনে অথচ তারা কাফির। আবার এমন ব্যক্তি রয়েছে যারা কাফিরদের বলপ্রয়োগের শিকার হওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে বাহ্যত কুফর করে অথচ তারা মু’মিন। এছাড়া এমন ব্যক্তি রয়েছে যাদের কাছে ঈমানের তথ্য স্পষ্ট না হওয়ায় তারা ঈমানও আনেনি আবার কুফর করার প্রশ্নও তৈরি হয়নি। আবার ঈমান আনা ও সৎকর্ম করার ক্ষেত্রেও মানুষকে তাদের সাধ্যসীমায় আসা সুযোগ বা সামর্থ্যের ভিত্তিতেই দায়ী করা হবে। সুতরাং যারা পূর্বের কিতাবে ঈমান এনেছিলো তাদেরকেও আহবান করা হয়েছে যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সর্বশেষ কিতাব ও রসূলের প্রতিও তারা ঈমান আনে। যদি তারা এ আহবানকে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তারাও কাফির হিসেবে সাব্যস্ত হবে। তবে তাদের মধ্যে যারা পূর্ব থেকে মুসলিম ও মু’মিন তারা এক পর্যায়ে এই কিতাব ও রসূলের প্রতিও ঈমান আনে। তবে এ কিতাব ও রসূলে ঈমান আনার পর্যায়ে উপনীত হওয়ার আগেও তাদের মধ্য থেকে যারা স্পষ্টত কুফর করে না তাদেরকে কাফির সাব্যস্ত করার অবকাশ নেই। বরং তাদের মধ্যেও একটা পর্যায় পর্যন্ত অনেকে মু’মিন ও মুসলিম হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার যোগ্য। তাই আহলে কিতাবের মধ্য থেকে যারা স্পষ্টত শিরক-কুফর করে না তাদের সাথে পারস্পরিক খাদ্যকে হালাল হিসেবে গ্রহণ এবং বৈবাহিক সম্পর্ককে হালাল করা হয়েছে। অবশ্য  নিজেদের ধর্মাদর্শের বিপরীতে গিয়ে আহলে কিতাবের কোনো দলের আনুগত্য করতে নিষেধ করা হয়েছে।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের ভিত্তিতে নিম্নে তিনটি বিশেষ পয়েন্টে আলোকপাত করা হলো:

(ক) ঈমানের ভিত্তিতে মানুষের শ্রেণিবিভাগ

প্রাসঙ্গিক আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে জানা যায় যে, ঈমানের ভিত্তিতে মানুষ তিন ভাগে বিভক্ত:

১) মু’মিন

২) কাফির

৩) না মু’মিন না কাফির

‘না মু’মিন না কাফির’ ব্যক্তিরা তিন ভাগে বিভক্ত:

১) দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকা সুবিধাবাদী লোক (সংশয়বাদী মুনাফিক)

২) দাওয়াত বা তথ্য প্রাপ্ত সাধারণ লোক

৩) দাওয়াত বা তথ্য অপ্রাপ্ত সাধারণ লোক

মুনাফিক দুই প্রকার:

১) গোপন কাফির

২) মু’মিন দাবিদার সেই অমু’মিন যে দ্বিধাদ্বন্দে থাকা সুবিধাবাদী লোক

‘মু’মিন’, ‘দাওয়াতপ্রাপ্ত সাধারণ না মু’মিন না কাফির’ ‘দাওয়াত অপ্রাপ্ত সাধারণ না মু’মিন না কাফির’ ব্যক্তিরা সত্য অনুসরণে দুর্বলতা কাটানোর শর্ত পূরণের ভিত্তিতে দুইভাগে বিভক্ত:

১) যারা সত্য অনুসন্ধানে উদ্যোগী এবং সত্য স্পষ্ট হওয়ার সাথে সাথে তা পালন করে। এরা সাধ্যমতো দায়িত্ব পালনকারী হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

২) যারা সত্যানুরাগী কিন্তু উদ্যোগী নয় বরং দীর্ঘকালীন পর্যবেক্ষণকারী এবং সত্য স্পষ্ট হওয়ার পর তা পালনে কিছুটা বিলম্ব করে। সূরা আ’রাফে জান্নাতপ্রাপ্তির আশাসহকারে আ’রাফে অবস্থানকারীদের প্রসঙ্গ থেকে তা এরূপ ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

(খ) কুরআন ও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর প্রতি ঈমান ছাড়া আহলে কিতাব জান্নাতে যাবে কিনা?

এ বিষয়ে কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে বুঝা যায় যে, আহলে কিতাবের মধ্যে কিছু আছে মু’মিন। এর মধ্যে দুই ধরনের মু’মিন অন্তর্ভুক্ত: (১) গোপন মু’মিন (২) কুরআন অনপেক্ষ মু’মিন অর্থাৎ যারা কুরআনে বিশ্বাস করার পর্যায়ে উপনীত হওয়ার আগে তাদের কাছে থাকা কিতাবের প্রতি মু’মিন অবস্থায় আছে।

কুরআন নাযিলের পর ‘আল্লাযীনা আমানূ’ বা ‘মু’মিন’ বলতে মূলগতভাবে তাদেরকেই বুঝানো হয় যারা কুরআনের প্রতি ঈমান এনেছে। যখন একই বক্তব্য কাঠামোতে ‘আল্লাযীনা আমানূ’ এর পাশাপাশি সমসাময়িক অন্যদের পরিচিতি হিসেবে ‘যারা ইয়াহুদ হয়েছে এবং নাসারা এবং সাবিয়ীন’ এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে, তারপর আবার তাদের সবার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ‘যারা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান এনেছে’ তখন এ থেকে স্বত:সিদ্ধভাবে বুঝা যায় যে, প্রথমে উল্লেখিত ‘যারা ঈমান এনেছে’ তারা ‘যারা ইয়াহুদ হয়েছে এবং নাসারা এবং সাবিয়ীন’ থেকে আলাদা এবং তারা হলো ‘যারা কুরআন ও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে’। তারপরবর্তী অংশ অনুসারে চারটি অবস্থা তৈরি হয়-

(ক) যারা (কুরআন ও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর প্রতি) ঈমান এনেছে তাদের মধ্য থেকে যারা (সত্যিকারার্থে) আল্লাহর প্রতি ও আখিরাতের প্রতি ঈমান এনেছে;

(খ) যারা ইয়াহুদ হয়েছে তাদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাতের প্রতি ঈমান এনেছে;

(গ) যারা নাসারা তাদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাতের প্রতি ঈমান এনেছে;

(ঘ) যারা সাবিয়ীন তাদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাতের প্রতি ঈমান এনেছে।

এই চার শ্রেণির প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, যদি তারা আমলে সালেহ বা সৎকর্মও করে তাহলে তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না, তাদের প্রভুর কাছে তাদের পুরস্কার আছে।

সুতরাং যারা কুরআন ও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর প্রতি ঈমান আনেনি (আবার কুফরও করেনি) একটা পর্যায় পর্যন্ত তাদের আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান আনাকে অগ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত করা হবে না এবং তারা সৎকর্মও সম্পাদন করলে তাদেরকে সেজন্য পুরস্কৃত করা হবে।

আবার যখন মু’মিন ও আহলে কিতাবের মধ্যকার এই বিভাজনের প্রসঙ্গ কাঠামো ছাড়া বলা হয় যে, ‘যারা ঈমান এনেছে ও আমলে সালেহ করেছে’ তারা জান্নাতে যাবে, তখন এর দ্বারা কুরআন নাযিলের পূর্ববর্তী মু’মিনদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কুরআনের প্রতি ঈমান না আনা সাপেক্ষে আহলে কিতাব অমু’মিন। অমু’মিন মাত্রই কাফির নয়, যার কাছে কুরআনের সত্যতা স্পষ্ট হয়েছে তবুও সে তা প্রত্যাখ্যান করেছে সে কাফির। অন্যদিকে যাদের কাছে তারা যাচাই পর্বে থাকা একটা পর্যায় পর্যন্ত কুরআনের সত্যতা স্পষ্ট হয়নি তাই গ্রহণ করেনি আবার প্রত্যাখ্যানও করেনি তারা অমু’মিন কিন্তু কাফির নয়। তবে কার কাছে কুরআনের সত্যতা স্পষ্ট হয়েছে এবং কার কাছে স্পষ্ট হয়নি, অথবা কে সাধ্যমতো তথ্য যাচাইয়ের নীতি অবলম্বন করছে আর কে তা করছে না, তা নির্ণয় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

২:৬২ ও ৫:৬৯ আয়াতের প্রথমদিকে ‘আল্লাযীনা আমানূ’ বলতে কুরআন সাপেক্ষ মু’মিনদেরকে বুঝানো হয়েছে এবং শেষদিকে ‘মান আমানা …’ বলতে কুরআনে মু’মিন হওয়ার পর্যায়ে অথবা কুরআন অনপেক্ষ পর্যায়ে (এ দুই পর্যায়ের কোনো পর্যায়ে) ঈমান আনে’ বলে বুঝানো হয়েছে।

আহলে কিতাব অমু’মিন যদি আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান আনে এবং আমলে সালেহ করে তাহলে সে জান্নাতে যাবে। প্রশ্ন হলো, কুরআন ও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর প্রতি ঈমান ছাড়াই কি কোনো আহলে কিতাব জান্নাতে যেতে পারে? এর জবাব হলো: আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের মধ্যে পার্থক্য করা যাবে না। এখন যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে, সে কুরআন সাপেক্ষ মু’মিন না হয়ে কুরআন অনপেক্ষ মু’মিন হলে একটা পর্যায় পর্যন্ত তাদের জন্য অবকাশ রয়েছে যে, তাদের সৎকর্ম ব্যর্থ হবে না। কিন্তু শর্ত হলো তারা কুরআনের প্রতি কাফির হতে পারবে না। এছাড়া কুরআনের প্রতি মু’মিন হওয়ার দায়িত্ব থেকে তাদেরকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি দেয়া হয়নি, সুতরাং তাদের কে কুরআনের বিষয়ে সন্দেহ নিরসনের জন্য কিভাবে স্বীয় ভূমিকা পালন করছে তার উপর ভিত্তি করে তাদের একেক জনের ক্ষেত্রে একেক সময় ‘কুরআন অনপেক্ষ মু’মিন’ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার পর্যায় সমাপ্ত হয়ে যাবে।

উপরোল্লেখিত বিভিন্ন অবস্থার জটিল সংমিশ্রণের বাস্তবতার কারণে মু’মিনদের কর্তব্য হলো আহলে কিতাবের প্রসঙ্গে থাকা নির্দেশনাগুলো সরলভাবে পালন করা। যেমন, তাদেরকে দীনের ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়ে যাওয়ার ন্যায় অন্তরঙ্গ বন্ধু বানানো যাবে না, তাদের মধ্য থেকে যারা দীনের বিষয়ে তীব্র বিরুদ্ধতা, নিন্দা-সমালোচনা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত নয় তাদের সাথে সাধারণ সামাজিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা, তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও পারস্পরিক খাদ্য হালাল হওয়ার বিষয়টিকে অগ্রাহ্য না করা, দীনের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ে এরূপ কোনো বিষয়ে তাদের কোনো দলের আনুগত্য না করা এবং তাদেরকে কুরআন ও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহসহ সকল নবী-রসূলের প্রতি ঈমান আনার আহবান জানানো ও উত্তম পন্থায় বিতর্ক ইত্যাদি।

(গ) মানুষ ঈমান ও আমলের জন্য সাধ্য অনুযায়ী দায়ী

আল্লাহ মানুষকে ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে তাদের সাধ্য অনুযায়ী দায়ভার অর্পণ করেছেন। অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষ ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে সাধ্য অনুযায়ী দায়ী হবে। ‘যারা সাধ্য অনুযায়ী ঈমান করে’ কথাটি যারা ঈমানের নীতিতে আছে তাদের প্রসংগে প্রযোজ্য। আর যাদের প্রসংগে ঈমান আনার বিষয়টি প্রযোজ্য নয় তারা কেউ আসহাবুল জান্নাত হবে কিনা সে বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে বলা হয়নি। কিন্তু ঈমান আনা বিষয়টি যাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তারা যেমন সাধ্য অনুযায়ী ঈমান আনার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ তা থেকে পরোক্ষ শিক্ষা হচ্ছে যাদের ক্ষেত্রে ঈমান আনা বিষয়টি প্রযোজ্য নয়, তারা এ প্রসংগ কাঠামোর আওতা বহির্ভুত এবং তারা ঈমান প্রশ্নের পূর্ব পর্যায়ে মানুষ হিসেবে যে বিষয়ে দায়বদ্ধ তথা ইলহাম অনুসারে মা’রূফ কাজ করা ও মুনকার কাজ না করা (বিবেকসংগত কাজ করা না করা) বিষয় সাপেক্ষে দায়ী হবে এবং দায়মুক্ত হলে এ দায়মুক্তির পুরস্কারস্বরূপ জান্নাতবাসী হবে।

(ঘ) অমু’মিন ও কাফিরের পার্থক্য এবং আখিরাতে বিচারের মানদণ্ড

ইতোমধ্যে উল্লেখিত আয়াতসমূহের ভিত্তিতে এ বিষয়ে আমরা স্পষ্ট হয়েছি যে, কোনো ব্যক্তি যদি সৎকর্ম করে অথচ ঈমান না আনে তাহলে তার ঐসব সৎকর্ম আখিরাতে মূল্যহীন বিবেচিত হবে। কিন্তু ঈমান না আনা এবং ঈমানের পর্যায় না আসা দুটো ভিন্ন বিষয়। একজন ব্যক্তি ঈমান আনতে পারে, কুফর করতে পারে এবং ঈমান ও কুফরের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি এরূপ পর্যায়ভুক্ত হতে পারে, যার প্রকৃত অবস্থা একমাত্র আল্লাহ জানেন।

যেহেতু Common sense প্রয়োগের মাধ্যমেই আল্লাহর নাযিলকৃত ওহীর জ্ঞানের উপর ঈমান অর্জিত হয়। কোনো ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা যত বেশিই হোক না কেন সে যদি বিবেক অনুসারে চলার নীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে বরং হাওয়া বা প্রবৃত্তি অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাহলে সে ঈমান না করে কুফর করতে পারে। বিবেক প্রয়োগ না করার ফলেই কেউ কুফর করতে পারে। তাই বিবেক প্রয়োগ না করা এবং কুফর করার ফলাফল একইরূপ, উভয়কে সর্বনিকৃষ্ট পশু বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সুতরাং আখিরাতে বিচার করার প্রধান মানদণ্ড দুটি হলো বিবেকের অনুসরণ করা না করা এবং ঈমান (ও ঈমান অনুযায়ী আমল) করা না করা।

বিবেকের অনুসরণের এক পর্যায়ে ঈমানের প্রশ্নটি সামনে এলে তখন যে ঈমান করে এবং যে ঈমান করে না এ দুই ব্যক্তি সমান হতে পারে না।

কুরআনের দৃষ্টিতে, যখন ঈমান আনা বিবেকের দৃষ্টিতে অপরিহার্য হয়ে পড়ে তখন একজন ব্যক্তি কুফরের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পিছনে থাকে তার অহংকার, প্রবৃত্তি পুজা, আখিরাতের তুলনায় দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেয়া, সদিচ্ছার অভাব, সত্যের (জ্ঞানের) মোকাবেলায় অনুমানের (অজ্ঞতার) অনুসরণ, যেখানে সে অজ্ঞতাকেই জ্ঞান এবং জ্ঞানকেই অনুমান হিসেবে সাব্যস্ত করে এবং সর্বোপরি সত্যকে স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাব।

যারা বিবেকের অনুসরণ করে না (২) এবং যারা কুফর করে উভয় শ্রেণি পরবর্তীতে বিভিন্ন অপরাধে লিপ্ত থাকে এবং তাই তারা তাদের কর্মফল হিসেবে জাহান্নামের শাস্তিপ্রাপ্ত হবে।

(২) অর্থাৎ কখনো কখনো কিছু বিবেকসঙ্গত কাজ করলেও সেটা বিবেকের অনুসরণের নীতির ভিত্তিতে নয়, বরং প্রবৃত্তির সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়ার কারণে করে; সিদ্ধান্তকর নীতি হিসেবে নয় বরং সাধারণ প্রবণতাজনিত বিষয় হিসেবে করে।

সাধারণভাবে ঈমান করেনি বলতে বুঝায়, যার উপর ঈমান করার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে অথচ সে ঈমান করেনি। আর ঈমানের দায়িত্ব আসার পূর্বাবস্থা সাধারণ বক্তব্য প্রসঙ্গ হয় না। সেটা হয় একটি ব্যতিক্রমমূলক বক্তব্য প্রসঙ্গ। তাই এ উভয় ধরনের প্রসংগ একসাথে বিবেচনা করলে ঈমান করা না করার ভিত্তিতে পুরস্কার বা শাস্তির নীতিমালায় যেসব অবস্থার উদ্ভব ঘটতে পারে তা নিম্নরূপ:

ক. যাদের কাছে তথ্য পৌঁছেনি বিধায় তারা গাফিল (অসচেতন), এ অবস্থায় তাদের বিচার হবে বিবেক অনুযায়ী ভালো কাজ করা না করার ভিত্তিতে। বিবেক প্রয়োগ না করার কারণে যে গাফলত তা ক্ষমাযোগ্য নয়। বিবেকের প্রয়োগ সত্ত্বেও ধর্মীয় সঠিক বুঝে উপনীত হতে না পারায় যে গাফলত ধর্মীয় ক্ষেত্রে তা ক্ষমাযোগ্য হলেও, সামাজিক অপরাধ সংঘটিত হলে তা ক্ষমাযোগ্য নয়। কারণ সামাজিক ন্যায়-অন্যায় বোধ মানুষের বিবেকে স্বয়ংক্রিয় করে দেয়া হয়েছে যা ইলহাম শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে, এবং যে কারণে ন্যায় কাজকে মা’রুফ ও অন্যায় কাজকে মুনকার নাম দেয়া হয়েছে। বিবেকের প্রয়োগ করলে এবং ধর্মের যুক্তিযুক্ত উপস্থাপনা পৌঁছলে এক পর্যায়ে বিবেক সঠিক তথ্যে উপনীত হবেই। কারণ বিবেক ও সঠিক ধর্মীয় যুক্তির সমন্বয় ঘটা অবশ্যম্ভাবী।

খ. যাদের কাছে কোনোভাবে তথ্য পৌঁছেছে কিন্তু যৌক্তিক তথ্য সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে বা নিজেদের সাময়িক জ্ঞানগত দুর্বলতার কারণে নিশ্চয়তাবোধে উপনীত হয়নি, তাই মু’মিন হয়নি কিন্তু কাফিরও (সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় বিরোধী) হয়নি, বরং ঈমান করা না করার ক্ষেত্রে আরো সময় নেয়ার মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছে এবং মু’মিন ও কাফিরদের কিছু লক্ষণের দ্বারা কারা সঠিক হতে পারে তার সম্ভাব্য পরিচিতি লাভের কারণে তাদের মনোভাব মু’মিনদের প্রতি কোমল ছিল। এ ধরনের লোক আ’রাফবাসী হবে, যারা জান্নাতে যাওয়ার আশাবাদ পোষণ করবে এবং জাহান্নামবাসীদের সঙ্গী হওয়া থেকে রক্ষা পেতে প্রার্থনা করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

গ. যাদের কাছে তথ্য পৌঁছেছে কিন্তু তারা নিশ্চয়তাবোধ পায়নি, কারণ তারা সঠিক যুক্তিচর্চা পরিহার করেছিল। তারা শাস্তিযোগ্য হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

ঘ. যাদের কাছে তথ্য পৌঁছেছে এবং তারা নিশ্চয়তাবোধ পেয়েছে অথচ ঈমান (সিদ্ধান্তকর বিশ্বাস) আনেনি। তারাও শাস্তিযোগ্য হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

(ঙ) কুরআনের প্রতি ঈমান আনার আবশ্যকতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার তাৎপর্য

কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহর প্রতি ও আখিরাতের প্রতি ঈমান আনে, সেইসাথে সৎকর্ম করে তাহলে তারা এজন্য পুরস্কৃত হবে। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার অনিবার্য দাবি হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা কিতাবসমূহ ও রসূলগণের প্রতিও ঈমান আনা। তাই আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান আনা যে ব্যক্তির কাছে কোনো রসূল ও কিতাবের তথ্য পৌঁছে যায় তার অবশ্য কর্তব্য হলো রসূল ও কিতাবের প্রতি ঈমান আনা। সুতরাং যার নিকট আল্লাহর নাযিলকৃত সর্বশেষ কিতাব কুরআনের তথ্য পৌঁছবে তার কর্তব্য হলো কুরআনের প্রতি ঈমান আনা। যদি কুরআনের বিষয়ে সন্দেহ হয়, তাহলে ঐ সন্দেহ নিয়ে থাকা যাবে না, বরং কুরআনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব কিনা সেই যাচাইপর্বে ঈমান বহির্ভুত থাকা স্বাভাবিক।

আহলে কিতাব যদি কুরআনকে গ্রহণ না করে তবে তারা তাদের কাছে থাকা কিতাব অনুযায়ী ফায়সালা করা উচিত এবং এ বিষয়ে তাদেরকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। তবে এর মানে এ নয় যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের উপর কুরআনকে গ্রহণ করার দায়িত্ব নেই, বরং এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সকল কিতাব ও রসূলের উপর ঈমান আনতে হবে।

অনুরূপভাবে ‘লা ইক্বরাহা ফিদ দ্বীন’ (দ্বীন গ্রহণে কোনো জবরদস্তি নেই) কথাটির অর্থও এ নয় যে, যে দ্বীনই অবলম্বন করা হোক, তাতে আল্লাহর কাছে অপরাধ হবে না। বরং এর মানে এই যে, সঠিক দ্বীন অবলম্বনের জন্য সবাইকে নিজ বিবেকসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে এবং যারা আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন বা জীবনব্যবস্থাকে গ্রহণের জন্য কারো উপর জবরদস্তি বা বলপ্রয়োগ করা হবে না। এক্ষেত্রে এ সত্যও জানিয়ে দেয়া হয়েছে, সঠিক দ্বীনের উপর ঈমান আনার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা বুদ্ধিবৃত্তি নয়, বরং সদিচ্ছার অভাব। তবে বুদ্ধিবৃত্তি আপেক্ষিক / সাময়িক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।

মু’মিনদের নিকট অজ্ঞাত মু’মিন ও মুনাফিক (গোপন কাফির) বা শত্রু-মিত্র

৪৮:২৪-২৫ :: আর তিনিই সেই সত্তা যিনি মাক্কার অভ্যন্তরে তাদের হাতকে তোমাদের থেকে এবং তোমাদের হাতকে তাদের থেকে বিরত রেখেছিলেন; এ সত্ত্বেও যে, তোমাদেরকে সক্ষমতা দেয়া হয়েছিল তাদেরকে পরাস্ত করার জন্য। আর তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। তারাই এমন লোক যারা কুফর (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান) করেছে এবং তোমাদেরকে আল মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দিয়েছে এবং (কা’বায় পৌঁছানোর) হাদিয়াকে (উপহারকে) সেটার যথাস্থানে পৌঁছানো থেকে আটকে দেয়া হয়েছে। আর যদি না থাকতো এমন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারী, যাদেরকে তোমরা (মু’মিন হিসেবে) জানতে না, তাই তোমরা তাদেরকে পর্যুদস্ত করতে, তাই তাদের প্রেক্ষিতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কলংকযুক্ত হতে, (তাহলে তিনি বিরত রাখতেন না)। (তিনি বিরত রেখেছিলেন) যেন আল্লাহ তাকে তাঁর রহমতের মধ্যে প্রবেশ করান যাকে তিনি ইচ্ছা করেন। যদি তারা পৃথক থাকতো তাহলে আমি (যুদ্ধ থেকে বিরত না রেখে) তাদের মধ্যকার কাফিরদেরকে (সত্য অবিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে) কষ্টদায়ক শাস্তি দিতাম।

৯:১০১ :: আর তোমাদের চারপাশে থাকা অশহরবাসীদের (আ’রাবের) মধ্যে অনেকেই মুনাফিক (গোপন কাফির) এবং শহরবাসীদের মধ্যেও অনেকে মুনাফিক। তারা নিফাকে (কপটতায়) পাকাপোক্ত হয়েছে। তোমরা তাদেরকে (মুনাফিক হিসেবে) জানো না, আমি তাদেরকে (মুনাফিক হিসেবে) জানি। শীঘ্রই আমি তাদেরকে দুইবার শাস্তি (পার্থিব কষ্ট ও মৃত্যুকালীন যন্ত্রণা) দেবো। তারপর তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে মহাশাস্তির (জাহান্নামের) দিকে।

৮:৬০-৬৩ :: আর তোমরা তাদের (কাফিরদের) মোকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি এবং রণকৌশলের প্রশিক্ষিত ঘোড়া প্রস্তুত রাখো। তোমরা এর মাধ্যমে ভীত-সন্ত্রস্ত রাখবে আল্লাহর ও তোমাদের শত্রুদেরকে এবং তারা ছাড়াও অন্য অনেককে যাদের শত্রুতা সম্পর্কে তোমরা জানো না কিন্তু আল্লাহ জানেন। আর তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছুই ব্যয় করবে তিনি তোমাদেরকে তা পূর্ণ করে দিবেন। আর তোমাদের প্রতি যুলুম করা হবে না। আর যদি তারা শান্তিচুক্তির দিকে ঝুঁকে তাহলে তোমরাও সেদিক ঝুঁকো, আর আল্লাহর উপরই ভরসা করো। নিশ্চয় তিনি, তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। আর যদি তারা তোমাকে ধোঁকা দিতে চায়, তাহলে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি তাঁর সাহায্য দ্বারা ও মু’মিনদের দ্বারা তোমাকে শক্তি যুগিয়েছেন। আর তিনি তাদের (মু’মিনদের) অন্তরগুলোকে প্রীতির বন্ধনে যুক্ত করে দিয়েছেন। যদি তুমি পৃথিবীতে যা আছে তার সবই ব্যয় করতে তবুও তাদের অন্তরসমূহকে প্রীতির বন্ধনে যুক্ত করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে প্রীতির বন্ধনকে যুক্ত করেছেন। নিশ্চয় তিনি মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।

আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে জানা যায় যে, মু’মিনদের অজ্ঞাত কিন্তু আল্লাহর জ্ঞাত এমন অনেক মু’মিন ও মুনাফিক বা গোপন কাফির থাকতে পারে। মু’মিনরা যাদেরকে শত্রু হিসেবে জানে তার বাহিরেও তাদের শত্রু থাকতে পারে, যাদেরকে তারা শত্রু হিসেবে জানে না কিন্তু আল্লাহ জানেন যে, তারা মু’মিনদের প্রতি শত্রুতা পোষণকারী। অনুরূপভাবে মু’মিনরা যাদেরকে বন্ধু হিসেবে জানে এর বাহিরে কেউ মু’মিনদের বন্ধু হতে পারে।

ঈমানের পর্যায়সমূহ

১। পরিবর্তনের সম্ভাবনার দিক থেকে ঈমানের পর্যায়

৪:১৩৭ :: নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে তারপর কুফর করেছে, তারপর ঈমান এনেছে, তারপর কুফর করেছে, তারপর কুফরকে বাড়িয়ে দিয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করার নন এবং তাদেরকে পথ প্রদর্শন করার নন।

৪৯:১৫ :: মু’মিন তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উপর ঈমান আনে, অতঃপর কোনরূপ সন্দেহ করে না, আর তাদের মাল দিয়ে ও জান দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে; তারাই সত্যবাদী।

আলোচনা: উল্লেখতি আয়াতসমূহ থেকে বলা যায় যে, পরিবর্তনের সম্ভাবনার দৃষ্টিকোণ থেকে ঈমানের দুটি পর্যায় রয়েছে। যথা: পরিবর্তনের অজ্ঞাত সম্ভাবনাযুক্ত ঈমান তথা যখন একজন ব্যক্তি ঈমান আনে অথচ পরবর্তীতে কোনো কারণে আবার সে ঈমান ত্যাগ করে কুফর করে, এরপর আবার ঈমান করে, এরপর আবার কুফর করে এভাবে বাস্তব অভিজ্ঞতায় বুঝা যায় যে, তার ঈমান হলো পরিবর্তনের অজ্ঞাত সম্ভাবনাযুক্ত ঈমান। আর অন্যদিকে আছে এমন ঈমান যারপর আর কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে না এরূপ অপরিবর্তনীয় প্রকৃত ঈমান।

২। আহলে কিতাবের ক্ষেত্রে ঈমানের পর্যায়

পূর্বে বর্ণিত কিছু আয়াতের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি যে, আহলে কিতাবের মধ্যে কিছু মু’মিন আছে এবং কেউ কুরআনের প্রতি মু’মিন হোক বা আহলে কিতাব হোক, কেউ যদি আল্লাহর প্রতি ও আখিরাতের প্রতি মু’মিন হয়ে থাকে তবে তার কোনো ভয় নেই এবং তারা আল্লাহর কাছে পুরস্কারপ্রাপ্ত হবে। অন্যদিকে আহলে কিতাবকে আহবান জানানো হয়েছে যে, তারা কুরআন ও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে হবে অর্থাৎ আল্লাহর নাযিলকৃত পূর্বের কিতাবসমূহের মতো কুরআনের প্রতিও ঈমান আনতে হবে এবং অন্যান্য রসূলদের মতো মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর প্রতিও ঈমান আনতে হবে, রসূলদের মধ্যে পার্থক্য করা যাবে না। তাদেরকে আহবান করা হয়েছে যেন তারাই প্রথম কাফির না হয়। বলা হয়েছে আহলে কিতাবের মধ্যে যারা কুফর করবে তারা জাহান্নামবাসী হবে। আরো বলা হয়েছে আহলে কিতাবের মধ্যকার মু’মিনরা এক পর্যায়ে কুরআনের প্রতি ঈমান আনে। এসব প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কুরআনের বিষয়ে যখন তাদের মধ্যে অস্পষ্টতা থাকবে না তখন তারা কুরআনের প্রতি ঈমান না আনলে তাদের পূর্বের ঈমান গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং সমন্বিত অধ্যয়নের ভিত্তিতে বলা যায় যে, আহলে কিতাবের মধ্যকার মু’মিনরা দুই ভাগে বিভক্ত থাকা সম্ভব। যথা: যারা কুরআনের প্রতিও ঈমান রাখে এবং তাদের এ ঈমানের বিষয় গোপন রাখে। আর দ্বিতীয়ত, যারা কুরআনের প্রতি ঈমান আনার পর্যায়ে এখনো উপনীত হয়নি, তবে তাদের কাছে থাকা কিতাবের প্রতি তাদের ঈমান আছে এবং কুরআনের প্রতি এখনো ঈমান না আনলেও তারা কুরআনের প্রতি কুফরও করে না। সুতরাং তারা কুরআন অনপেক্ষভাবে মু’মিন বলে সাব্যস্ত। সুতরাং আহলে কিতাবের জন্য ঈমানের দুটি পর্যায় রয়েছে। কুরআন অনপেক্ষ মু’মিন তথা কুরআনের প্রতি এখনো ঈমান না আনলেও তাদের কাছে থাকা কিতাবের প্রতি ঈমান রাখে এবং কুরআনের প্রতি কুফরও করে না। তারপরের পর্যায় হলো যখন তারা কুরআনের প্রতি প্রকাশ্যে বা গোপনে ঈমান আনে।

৩। মজবুতির দিক থেকে ঈমানের পর্যায়

৪:১৩৬ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি তাঁর রাসূলের উপর নাযিল করেছেন এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি পূর্বে নাযিল করেছেন। আর যে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং আখিরাত দিবসকে অস্বীকার করবে, সে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত হবে।

আলোচনা: এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, মজবুতির দিক থেকে ঈমান দুই ভাগে বিভক্ত, দুর্বল ঈমান ও মজবুত ঈমান। তাই যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আবার ঈমান আনার জন্য নির্দেশ দেয়া হচ্ছে অর্থাৎ ঈমানকে নবায়িতকরণ বা সুদৃঢ়করণের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। সুতরাং প্রত্যেকের উচিত মজবুত ঈমানের অধিকারী হতে চেষ্টা করতে থাকা। তবে ঈমানের এ শ্রেণিবিভাগ নিজেকে মজবুত ঈমানদার বলে দাবি করার জন্য নয় বা একজন অন্যজনের ঈমানের দৃঢ়তা নিয়ে মন্তব্য করার জন্য নয়।

ঈমান ও আমলের সম্পর্ক

৬:১৫৮ :: তারা কি শুধু এরই প্রতীক্ষা করে যে, তাদের কাছে ফিরিশতাগণ আসবে অথবা তোমার প্রভু আসবেন অথবা তোমার প্রভুর কোনো নিদর্শন আসবে? যেদিন যেদিন তোমার প্রভুর কোনো নিদর্শন আসবে সেদিন তার ঈমান কোনো কাজে আসবে না যে পূর্বে ঈমান আনেনি অথবা যে ব্যাক্তি (পূর্বে ঈমান আনলেও) তার ঈমানের মাধ্যমে কল্যাণ অর্জন করেনি (তথা ঈমানের দাবি অনুযায়ী যথানিয়মে সৎকর্ম করেনি)। বলুন, ‘তোমরা প্রতীক্ষা কর , আমরাও প্রতীক্ষায় রইলাম।’

৫:৫ :: … আর যে ঈমানের সাথে কুফর করবে, অবশ্যই তার আমল বরবাদ হবে এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।

২:৮৪-৮৫ :: আর যখন আমি তোমাদের থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছিলাম (এ নির্দেশনার মাধ্যমে) যে, তোমরা নিজেদের রক্তপাত করবে না এবং তোমাদের কোনো লোককে তোমাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দিবে না, তারপর তোমরা তা স্বীকার করে নিয়েছো এবং তোমরাই এর সাক্ষী। তারপর তোমরাই তারা যারা তোমাদের নিজেদের লোককে হত্যা করছো এবং তোমাদের মধ্যকার এক দলকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছো তাদের বিরুদ্ধে পাপ ও সীমালঙ্ঘন সহকারে পরস্পরকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে। আর যদি তারা তোমাদের কাছে বন্দী হিসেবে আসে (তোমরা তাদেরকে বন্দী হিসেবে দেখতে পাও) তখন তাদেরকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণ প্রদান কর। তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে (কিছু বিধানে) ঈমান আনো এবং কিছু অংশকে (কিছু বিধানকে) কুফর/অবিশ্বাস ও অস্বীকার করো? তাহলে যারা (কিতাবের বিষয়ে) এরূপ আচরণ করে তাদের প্রতিফল পাথির্ব জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া আর কী হতে পারে? আর কিয়ামাত দিবসে তাদেরকে কঠিন শাস্তির দিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। আর তোমরা যা করো আল্লাহ তা সম্পর্কে উদাসীন নন।

৪৭:২৫-২৮ :: নিশ্চয় যারা নিজেদের কাছে সৎপথ স্পষ্ট হবার পর তাদের পেছনের দিকে ফিরে যায়, শয়তান তাদের প্ররোচিত করেছে এবং তাদের কাছে মিথ্যে আশাবাদকে প্রলম্বিত করেছে। এটা এজন্য যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা যারা অপছন্দ করে তাদেরকে তারা বলে, আমরা কিছু বিষয়ে তোমাদের আনুগত্য করব; আর আল্লাহ তাদের গোপন ষড়যন্ত্র অবগত আছেন। তখন কেমন হবে যখন ফেরেশতা তাদের মুখমণ্ডল ও পিঠে আঘাত করতে করতে মৃত্যু ঘটাবে? এটা এজন্য যে, তারা সেটি অনুসরণ করে যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের প্রয়াসকে অপছন্দ করে, এজন্যে তিনি তাদের সকল আমল নিষ্ফল করে দেবেন।

২৯:২-৩ ::মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদেরকে (আমলের মাধ্যমে) পরীক্ষা করা হবে না?  আমিতো তাদের পূর্ববর্তীদেরকেও (আমলের মাধ্যমে) পরীক্ষা করেছিলাম। সুতরাং আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিবেন (ঈমান আনার দাবিতে) কারা সত্যবাদী ও কারা মিথ্যাবাদী।

১৬:১০৬ :: যে ব্যক্তি তার ঈমানের পরে আল্লাহর প্রতি কুফর করে, সে ছাড়া যাকে সেজন্য জবরদস্তি করে বাধ্য করা হয়েছে অথচ তার অন্তর ঈমানের প্রতি প্রস্বস্তিপূর্ণ, কিন্তু যে তার অন্তরকে কুফরের জন্য উন্মুক্ত করেছে, তাহলে তাদের উপর আল্লাহর ক্রোধ এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।

৪:১৭-১৮ :: অবশ্যই আল্লাহ তাদের তাওবাহ কবুল করবেন, যারা মুর্খতাবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে, এরাই হল সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন; আল্লাহ মহাজ্ঞানী মহাবিজ্ঞ। আর এমন লোকদের জন্য কোনো ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমনকি যখন মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকে - আমি এখন তওবা করছি। আর তাদের জন্যও তাওবাহ নেই যারা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।

আলোচনা: ঈমান ছাড়া আমল ব্যর্থ হবে এবং আমল ছাড়া ঈমান ব্যর্থ হবে। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে ঈমানের পুরস্কার পাওয়ার জন্য ঈমানের দাবি অনুযায়ী যথানিয়মে সৎকর্ম করতে হবে এবং আমলের পুরস্কার পেতে হলে আমল হতে হবে ঈমান সহকারে।

ঈমান অনুযায়ী আমল অন্তরে ঈমান থাকার প্রমাণ। ঈমানের দাবি অনুযায়ী আমল করা না করার মাধ্যমে কে ঈমান আনার দাবিতে সত্যবাদী ও কে ঈমান আনার দাবিতে মিথ্যাবাদী সেটা প্রকাশ হয়ে পড়বে। সুতরাং যারা প্রচণ্ড জবরদস্তির কারণে বা জীবন বাঁচানোর ওজরের কারণে বাহ্যত কুফর করে তারা আল্লাহর নিকট মু’মিন হিসেবেই সাব্যস্ত হবে। অন্যদিকে যারা কোনো ওজর ছাড়াই খুশিমনে বা স্বচ্ছন্দে ঈমানের দাবি অনুযায়ী আমল করে না তারা ঈমান আনার দাবিতে মিথ্যাবাদী অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে তারা কাফির। অবশ্য কেউ কোনো ওজর ছাড়া কিন্তু প্রবৃত্তির প্রভাবে বা কোনো লোভ-লালসাবশত ঈমানের বিপরীত আমল করে ফেললে যদি অনতিবিলম্বে তাওবা করে তাহলে তারা কাফির হিসেবে সাব্যস্ত হবে না।

শিরক (শিরকযুক্ত ঈমান) আখিরাতে ক্ষমার অযোগ্য তথা সবচেয়ে বড় অপরাধ হওয়ার তাৎপর্য

১২:১০৬ :: তাদের অধিকাংশ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না এরূপ অবস্থায় ছাড়া যে, তারা মুশরিক। (অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ সঠিক প্রকৃতির মু’মিন নয়, বরং মুশরিক)।

৪:৪৮ :: নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করার অপরাধকে ক্ষমা করবেন না এবং তিনি তা ছাড়া (শিরক ছাড়া) অন্য অপরাধের ক্ষেত্রে যাকে ইচ্ছা করবেন ক্ষমা করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করে সেতো অতিবড় পাপ করে।

৪:১১৬ :: নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করার অপরাধকে ক্ষমা করবেন না এবং তিনি তা ছাড়া (শিরক ছাড়া) অন্য অপরাধের ক্ষেত্রে যাকে ইচ্ছা করবেন ক্ষমা করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লহর সাথে শিরক করে সে সুদূর পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হলো।

১৬:১০৬ :: যে ব্যক্তি তার ঈমানের পরে আল্লাহর প্রতি কুফর করে, সে ছাড়া যাকে সেজন্য জবরদস্তি করে বাধ্য করা হয়েছে অথচ তার অন্তর ঈমানের প্রতি প্রস্বস্তিপূর্ণ, কিন্তু যে তার অন্তরকে কুফরের জন্য উন্মুক্ত করেছে, তাহলে তাদের উপর আল্লাহর ক্রোধ এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।

৬:১৩১ :: এটা এজন্য যে আল্লাহ কোন জনপদকে ধ্বংস করেন না অন্যায়ভাবে এবং (সত্যপথ কোনটি আর ভুলপথ কোনটি সে সম্পর্কে) যখন তারা থাকে অসচেতন।

৩৬:৬ :: (কুরআন নাযিল করা হয়েছে) যাতে তুমি সতর্ক করতে পার এমন এক জাতিকে যাদের বাপদাদাদেরকে সতর্ক করা হয়নি, যার ফলে তারা অসচেতন।

৯:৫-৭ :: তারপর যখন হারাম মাসসমূহ (বিধিবদ্ধ যুদ্ধবিরতির ও সংরক্ষিত মাসসমূহ) অতিবাহিত হয়ে যাবে তখন তোমরা মুশরিকদেরকে (হারাম এলাকার) যেখানেই পাও (সম্মুখ যুদ্ধে / এনকাউন্টারে) হত্যা করো এবং তাদেরকে (সরাসরি) ধরে ফেলো এবং তাদেরকে অবরোধ ও (অগ্রাভিযান ও পারস্পরিক যোগাযোগে) বাধাগ্রস্ত করো এবং তাদের জন্য (তাদেরকে আচমকা ধরা ও গেরিলা যুদ্ধের জন্য) প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওঁৎ পেতে বসো। তবে যদি তারা তাওবা করে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত প্রদান করে তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াশীল। আর যদি মুশরিকদের মধ্য থেকে কেউ তোমার কাছে আশ্রয় চায় তাহলে তাকে আশ্রয় দাও, যতক্ষণ না সে আল্লাহর বাণী (আল কুরআন) শুনে, তারপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দাও। এটা এজন্য যে, তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা সঠিক জ্ঞান রাখে না। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে কিভাবে মুশরিকদের জন্য কোনো চুক্তি বহাল থাকবে? তাদের সাথে ছাড়া, যাদের সাথে তোমরা আল মাসজিদুল হারামের প্রাঙ্গনে চুক্তি করার পর (তারা তা ভঙ্গ করে নি), সুতরাং যতক্ষণ তারা তোমাদের জন্য (চুক্তির উপর) প্রতিষ্ঠিত থাকে, তোমরাও তাদের জন্য (চুক্তির উপর) প্রতিষ্ঠিত থাক। নিশ্চয় আল্লাহ তো আল্লাহ সচেতনদেরকেই ভালবাসেন।

৯:১১ :: তবে যদি তারা (মুশরিকরা) তাওবা করে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত প্রদান করে,তাহলে তারা দ্বীনের (জীবনব্যবস্থার) ভিত্তিতে তোমাদের ভাই। আর আমি আয়াতসমূহকে তফসীল আকারে (বিস্তারিত) বর্ণনা করেছি,সেই কওমের জন্য যারা জ্ঞানাজর্ন করে।

১৮:১৪-১৫ :: আমি তাদের (আসহাবে কাহাফের) অন্তর মজবুত করে দিলাম যখন তারা উঠে দাঁড়ালো এবং বললো, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালকই আমাদের প্রতিপালক। আমরা কখনো তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহকে আহবান করবো না (শিরক করবো না)। নিশ্চয়ই তাহলে তখন আমরা অত্যন্ত অপরাধমূলক কথা বলবো (অর্থাৎ যদি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে আহবান করি তবে সে আহবান এমন হবে যাতে আমরা অপরাধী হয়ে যাব)। এরাতো আমাদেরই কওম, এরা আল্লাহর পরিবর্তে অনেক ইলাহ গ্রহণ করেছে। এরা তাদের ইলাহ হবার উপর কোনো স্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণ উপস্থিত করে না কেন? তাহলে তার চেয়ে বড় জালিম কে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে (তথা শিরক করে)? (কাহাফ/১৮: ১৪-১৫)

৬:১৪৪ :: আর উটের স্ত্রী-পুরুষ দু‘টি এবং গরুর স্ত্রী-পুরুষ দু‘টি পশু। বলো, আল্লাহ কি এ দু‘টি পুরুষ পশুকে বা এ দু‘টি স্ত্রী পশুকে হারাম করেছেন, অথবা উভয় স্ত্রী গরু ও উটের গর্ভে যা রয়েছে তা হারাম করেছেন? আল্লাহ যখন এসব (হালাল-হারাম করার) বিধান জারি করেন তখন কি তোমরা সাক্ষী ছিলে? তার চেয়ে বড় জালিম কে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে, মানুষকে ভুল পথে পরিচালনার জন্য, অজ্ঞতা সত্ত্বেও? নিশ্চয় আল্লাহ এমন জালিম কাওমকে হিদায়াত করেন না।

২:১৬৮ :: নিশ্চয় সে (শয়তান) তোমাদেরকে আদেশ দেয় মন্দ ও অশ্লীল কথা ও কাজের এবং আল্লাহর ব্যাপারে এমন কিছু বলার জন্য যা (সত্য কিনা) তোমরা জান না।

৭:৩৩ :: বলো, আমার প্রভু হারাম (নিষিদ্ধ) করেছেন প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীলতা, পাপ কাজ, সত্যের সীমালঙ্ঘন ও অনধিকার বিরোধ এবং আল্লাহর সাথে শিরক (অংশীস্থাপন) করা যার পক্ষে আল্লাহ কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি, আর আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যা (সত্য কিনা) তা তোমরা জানো না।

৬:২২- ২৪ :: আর যেদিন আমি তাদের সকলকে সমবেত করব তারপর যারা শিরক করেছে তাদেরকে বলব, ‘তোমাদের শরীকরা কোথায়, যাদেরকে তোমরা (শরীক) মনে করতে?’ তখন তাদের এ ছাড়া কোনো ফিতনা থাকবে না যে, তারা বলবে, “আমরা তো মুশরিক ছিলাম না!”। দেখো, কিভাবে তারা নিজেদের উপর মিথ্যা বলছে। আর তারা যা মিথ্যা উদ্ভাবন করেছিলো তা তাদের থেকে উধাও হয়ে যাবে।

৬:৭৪-৭৯ :: আর (উল্লেখ্য) যখন ইবরাহীম তার পিতা আজরকে বলেছিল, আপনি কি মূর্তিগুলোকে ইলাহরূপে গ্রহণ করেছেন, আমি তো আপনাকে আর আপনার জাতিকে স্পষ্টভাবে পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত দেখছি। আর এভাবে আমি ইবরাহীমকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী রাজ্যের ব্যবস্থাপনা দেখিয়েছি (পর্যবেক্ষণ করিয়েছি) যাতে সে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে: অতঃপর যখন রাত তার উপর আচ্ছন্ন হল, সে একটি গ্রহ দেখলো, সে বললো, ‘এটা আমার প্রভু’। অতঃপর যখন তা ডুবে গেলো, তখন সে বললো, ‘যারা ডুবে যায় আমি তাদেরকে ভালবাসি না’। অতঃপর যখন সে চাঁদকে উজ্জ্বলরূপে উদীয়মান দেখলো, সে বলল, ‘এটা আমার প্রভু’। পরে যখন তা ডুবে গেলো, সে বললো, ‘যদি আমার প্রভু আমাকে হিদায়াত না করেন, নিশ্চয় আমি পথভ্রষ্ট কওমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো’। অতঃপর যখন সে সূর্যকে উজ্জ্বলরূপে উদীয়মান দেখলো, সে বললো, ‘এটা আমার প্রভু, এটা সবচেয়ে বড়’। পরে যখন তা ডুবে গেলো, তখন সে বললো, ‘হে আমার কওম, তোমরা যা শরীক কর, নিশ্চয় আমি তা থেকে মুক্ত। আমি আমার সত্তাকে একনিষ্ঠভাবে সেই সত্তার অভিমুখী করছি যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’।

আলোচনা: কোনো বাক্যে যখন ঈমান সম্পর্কে বলা হয় তখন সাধারণত তাতে প্রকৃত ঈমান প্রসঙ্গে বলা হয়। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঈমান শব্দটি প্রকৃত গ্রহণযোগ্য ঈমান অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে অগ্রণযোগ্য ঈমান প্রসঙ্গেও ব্যবহৃত হতে পারে, যখন সম্পূর্ণ বাক্য থেকে সে বিষয়ে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, বাক্যটিতে ঈমান শব্দটি তার নির্ভুল স্বরূপের বিষয়ে ব্যবহৃত হয়নি। যেমন, ১২:১০৬ আয়াতে আল্লাহর উপর শিরকযুক্ত ঈমানের কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ শিরকের কথা বলা হয়েছে। শিরক হলো আল্লাহর প্রতি ঈমানের একটি ধরন, যখন আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করা হয়।

শিরকযুক্ত ঈমান তথা শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ, তবে এটা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সীমাবদ্ধ অপরাধ, যেটাকে অপরাধ সাব্যস্ত করা সত্ত্বেও এর জন্য কোনো মানুষের দ্বারা প্রয়োগযোগ্য কোনো পার্থিব দণ্ডবিধি নেই, এটা কোনো সামাজিক অপরাধ নয়। বরং এরূপ অপরাধী তার অপরাধ করার জন্য ধর্মীয়ভাবে স্বাধীনতার অধিকারী। কারণ শিরক পরিহার করে যথাযথ ঈমান আনার জন্য কাউকে বাধ্য করা যাবে না। মুশরিকরা তাদের কল্পিত ইলাহদের ইবাদাত করবে, তাদের নিজেদের দীন বা ধর্মাদর্শ অনুসরণ করবে, এক্ষেত্রে তারা স্বাধীন।

মহান আল্লাহ আখিরাতে শিরকের অপরাধ ক্ষমা করবেন না এবং শিরক ছাড়া অন্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। শিরকের অপরাধ ক্ষমা না করার বিষয়টি শর্তহীন নয়, এর ক্ষেত্রে শর্ত প্রযোজ্য। আর সে শর্তটি হলো, শিরক করার পর তাওবা না করা। সুতরাং ‘শিরকের অপরাধ আল্লাহ ক্ষমা করবেন না’ তথ্যটি আখিরাতের প্রসঙ্গে প্রযোজ্য, সেখানে যে ব্যক্তি মুশরিক হিসেবে উপস্থিত হবে বা মুশরিক হিসেবে সাব্যস্ত হবে তাকে ক্ষমা করা হবে না। পক্ষান্তরে পৃথিবীতে যে ব্যক্তির শিরকের পর তাওবাহ করবে বা ঈমান আনবে, সে আর মুশরিক হিসেবে গণ্য হবে না, তার পূর্বের শিরকের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হবে।

অনুরূপভাবে শিরক বা কুফর প্রভৃতির বিষয়ে যে শাস্তির কথা বলা হয় তা দ্বারা শাস্তিযোগ্য বা অপরাধ হিসেবে গণ্য পর্যায়ে সংঘটিত শিরক বা কুফরকে বুঝানো হয়ে থাকে। যেমন, যে ব্যক্তিকে কুফরের জন্য বাধ্য করা হয় সে যদি বাহ্যত কুফর করে কিন্তু তার মনে কুফরের পরিবর্তে ঈমান থাকে, তার বাহ্যিক কুফরকে শাস্তিযোগ্য কুফর হিসেবে সাব্যস্ত করা হবে না। সুতরাং কুফর বা শিরক বলতে বাধ্য হয়ে করা কুফর বা শিরককে বুঝায় না, বরং বিশ্বাসগত বা ইচ্ছাকৃত আচরণজনিত শিরককে বুঝায়।

অনুরূপভাবে যেখানে বলা হয়েছে যে, ‘যে শিরক করে তাকে ক্ষমা করা হবে না’ সেখানে এ কথার অর্থ হচ্ছে যে ব্যক্তি অপরাধ হওয়ার স্তরে শিরক করে। কেউ যদি বোধোদয়ের বা আত্মজিজ্ঞাসা তৈরি হওয়ার পূর্বে অথবা তার কাছে তাওহীদের যৌক্তিক উপস্থাপনা উপস্থাপিত হওয়ার পূর্বে শিরক করে, যা সম্পর্কে সে সচেতন নয়, তবে তার এরূপ শিরককে অপরাধমূলক শিরক বলা যেতে পারে না। যে ব্যক্তি শিরক যে সঠিক নয় এ ধারণায় উপনীত হতে পারেনি, সে ব্যক্তির শিরক ঐ ব্যক্তির শিরকের মতো নয় যে এ ধারণা পেয়েছে অথচ যথাযথভাবে বিবেকের ব্যবহার না করায় এবং অগ্রহণযোগ্য যুক্তিকে অবলম্বন করে অথবা কোনো ব্যক্তিস্বার্থগত বা অযৌক্তিক আবেগগত কারণে/ বাপদাদার ঐতিহ্যপ্রীতির কারণে শিরক করেছে।

মানুষকে যে মানবপ্রকৃতি দেয়া হয়েছে তদনুসারে সে চিন্তাভাবনার অধিকারী, তার মধ্যে চিন্তার বিকাশ ঘটে। যা করছে কেন করছে তা যথার্থ কিনা এ প্রশ্ন তার মধ্যে তৈরি হয়। তখন বিভিন্নভাবে তার চিন্তা প্রভাবিত হয়, কখনো তাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে, কখনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এক্ষেত্রে তার উচিত বিবেকের অনুসরণ করা এবং অনুমানের মধ্যে পড়ে না থেকে অনুমানের যথার্থতা যাচাই করা। এক্ষেত্রে মানুষকে সত্যের পথনির্দেশ করার জন্য তথা তার বিবেককে সত্য পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য আল্লাহ তাঁর কিতাব নাযিল করেছেন।

কুরআনে এমন ব্যক্তিদের প্রসঙ্গও রয়েছে যাদের কাছে রসূল প্রেরিত হয়নি বিধায় তারা গাফিল ছিলো। বিভিন্ন আয়াতের সমন্বিত অধ্যয়ন অনুসারে, এই গাফেলতি আবার দুই প্রকার: (ক) যে গাফেলতির জন্য ব্যক্তি নিজে দায়ী নয়, কারণ তার মধ্যে সাধারণভাবে সাধ্যমতো সচেতনতা অবলম্বনের প্রক্রিয়া চলমান ছিলো, (খ) যে গাফেলতির জন্য ব্যক্তি নিজে দায়ী, কারণ তার মধ্যে সাধারণভাবে সাধ্যমতো সচেতনতা অবলম্বনের প্রক্রিয়া চলমান ছিলো না। প্রথম প্রকারের ব্যক্তি ক্ষমাযোগ্য হলেও দ্বিতীয় প্রকারের ব্যক্তি ক্ষমাযোগ্য হতে পারে না।

যে ব্যক্তির সামনে কোনোভাবে তাওহীদের ধারণা এসেছে বা শিরকের বিষয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে অথচ সে কোনো অযৌক্তিক যুক্তিকে আশ্রয় করে বা সঠিক যুক্তি চর্চা পরিহার করার কারণে শিরকের পক্ষে নিজেকে স্বান্ত্বনা দিয়েছে বা ধারণা করেছে যে, এটা শিরক নয়, সে দায়মুক্ত হবে না। তারা কিয়ামাত দিবসে বলবে যে, ‘আমরা মুশরিক ছিলাম না’। অথচ তা হবে তাদের নিজেদের ব্যাপারে নিজেদের মিথ্যা কথা, কারণ তারা মুশরিক ছিল। অর্থাৎ তারা ধারণা করতো যে, তারা যা করে তা শিরক নয়। কিন্তু তাদের এ ধারণা তাদেরকে তাদের শিরকের অপরাধ থেকে মুক্ত করবে না। কারণ তাদের এ ধারণা এজন্যই তৈরি হতে ও বজায় থাকতে পেরেছিল যে, তারা সঠিক যুক্তিচর্চা পরিহার করেছিল।

শিরক হলো আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করা এবং সবচেয়ে বড় অপরাধ। আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করার অন্যতম দুটি দিক হলো শিরক করা এবং আল্লাহ বলেননি এমন কথাকে আল্লাহর নামে চালিয়ে দেয়া। প্রকৃতপক্ষে মানুষের জন্য সঠিক কর্মনীতি সে আল্লাহর বিষয়ে জ্ঞানের ভিত্তিতে কথা বলবে, তাহলে সে নিজেও সঠিক পথপ্রাপ্ত হবে এবং অন্যদেরকেও সঠিক পথের সন্ধান জানাতে পারবে। কিন্তু কোনো বিষয়ে জ্ঞান ছাড়াই বা অজ্ঞতা সত্ত্বেও আল্লাহর নামে কিছু বলা বৈধ নয়। এটা ভিন্ন বিষয় যে, আল্লাহর কিতাবে থাকা কোনো বক্তব্য বুঝতে গিয়ে কখনো অনিচ্ছাকৃত ভুল হতে পারে। কিন্তু কোনো বিষয়ে সত্যের সীমালঙ্ঘন করা যাবে না এবং কারো সাথে অনধিকার বিরোধ করা যাবে না। যে বিষয়ে সাধ্যমতো জ্ঞানানুশীলনের পর কোনো তথ্যে প্রতীতি বা প্রত্যয় সৃষ্টি হয় সেটাকে সেভাবে বলা এবং যে বিষয়ে সম্ভাব্য ধারণা হয় সেটাকে সেভাবেই বলা উচিত। তারপর কোনো বিষয়ে পূর্বের প্রত্যয় সৃষ্টি হওয়া তথ্যের কোনো ত্রুটি চিহ্নিত হলে সেটাও সংশোধন করে নিতে হবে। অন্যদিকে জ্ঞানচর্চার সাথে সম্পর্কহীনভাবে বা আল্লাহর পক্ষ থেকে থাকা কোনোরূপ যুক্তিপ্রমাণ ছাড়া আল্লাহর নামে এমন কিছু আরোপ করা যা সত্য কিনা জানা নেই, এটা মানুষের সবচেয়ে বড় অপরাধ। যেহেতু শিরক সত্য নয় এবং শিরকের বিষয়ে আল্লাহ কোনো যুক্তিপ্রমাণ অবতীর্ণ করেননি এবং কেউ জ্ঞানের ভিত্তিতে শিরক করে না, তাই শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ এবং আখিরাতে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

ঈমানের বৃদ্ধি এবং ঈমান ও আমলের যথাসাধ্য পরিপূর্ণতা

৪:১৫০-১৫৩ :: নিশ্চয় যারা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলগণের প্রতি কুফর করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলগণের মধ্যে (ঈমানের ক্ষেত্রে) পার্থক্য করার ইচ্ছা করে এবং বলে “আমরা তাঁদের কারো প্রতি ঈমান রাখি এবং কারো প্রতি কুফর করি এবং তারা এ দুয়ের মধ্যবর্তী কোনো পথ ধরতে চায়। তারাই পাক্কা কাফির। আর আমি কাফিরদের জন্য অপমানকর শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি। আর যারা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলগণের প্রতি ঈমান আনে এবং তাঁদের কারো মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে না, তাদেরকে শীঘ্রই তাদের পুরস্কার দেয়া হবে এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়।

৮:২ :: নিশ্চয় তারাই মু’মিন যাদেরকে আল্লাহকে স্মরণ করা হয় তখন তাদের অন্তর কম্পিত হয় এবং যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ আবৃত্তি করা হয় তখন তাদের ঈমান (পরিধি/বিষয়বস্তুগতভাবে এবং চেতনা/মানগতভাবে) বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রভুর উপর ভরসা করে।

২:২০৮ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ করো। এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের স্পষ্ট শত্রু।

৭:৪২ :: যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, অবশ্য আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত পর্যায়ে দায়ভার অর্পণ করি না, তারাই ‘আসহাবুল জান্নাত’ (জান্নাতবাসী হবে)।

৬৪:১৬ :: তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য আল্লাহ সচেতন হও, শোনো, আনুগত্য করো ও ব্যয় করো তোমাদের নিজেদেরই কল্যাণে। আর যাদেরকে অন্তরের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করা হয়েছে তারাই সফল।

আলোচনা: ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে ঈমান আনবো এবং কিছু বিষয়ে ঈমান আনবো না তা হতে পারে না। তবে যখন কোনো মু’মিনের সামনে কুরআন আবৃত্তি করা হয় তার ঈমান বৃদ্ধি পায়। এর অর্থ হলো, ঈমানের পরিধি বা বিষয়বস্তুও যেমন বৃদ্ধি পেতে পারে, তেমনি ঈমানের চেতনা / মানও বৃদ্ধি পেতে পারে।

পরিধি ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে ঈমানের বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টিকে নিম্নরূপে উপস্থাপন করা যেতে পারে। ঈমানের বিষয়বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত দুটি বিষয় হলো:

১. মূলনীতি: আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সকল তথ্যে ঈমান রাখার নীতি অবলম্বন করা।

২. পরিধি: আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা যত তথ্য জানা যাবে তত তথ্যে ঈমান আনতে থাকা।

প্রথমটি তথা মূলনীতিতে সকল মু’মিন একই পর্যায়ে অবস্থান করে কিন্তু দ্বিতীয়টির সাপেক্ষে কারো চেয়ে কারো জ্ঞাত তথ্যের পরিমাণগত তারতম্য থাকতে পারে। তথ্য সংখ্যার ভিত্তিতে নয়, বরং জ্ঞাত বা অনুধাবনকৃত তথ্যের সমানুপাতিক বিষয়বস্তুতে ঈমান করার প্রেক্ষিতে প্রত্যেক মু’মিনই সমনীতিতে মূল্যায়নের অধিকাী। এই প্রেক্ষিতে যারা কুরআন অনুযায়ী প্রমাণিত প্রতিটি তথ্যে ঈমান রাখার নীতিতে বিশ্বাসী তারা মু’মিন হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, যেসব বিষয়ে কোনো তথ্য কুরআনসঙ্গত কিনা তা নিয়ে উপলব্ধিগত তারতম্য ঘটে সেজন্য কাউকে অমু’মিন বলে সাব্যস্ত করা যাবে না, যতক্ষণ না তার মুনাফিকির লক্ষণ স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে কিছু গ্রহণ ও কিছু অগ্রহণ করার সুযোগ নেই। পরিপূর্ণভাবে ঈমান করতে হবে এবং ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করতে হবে তথা ঈমানের দাবি অনুযায়ী করণীয় সকল কাজই করতে হবে। তবে এ বিষয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিক প্রয়োগের দিক থেকে প্রত্যেক ব্যক্তি তার জানা ও মানার সুযোগগত তারতম্যের প্রেক্ষিতে প্রত্যেকে সাধ্য অনুসারে পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্যই দায়বদ্ধ।

ঈমানের পরীক্ষা, ক্বিতাল (ন্যায়যুদ্ধ) ও মু’মিনদের খিলাফাত (ক্ষমতায়ন)

২:২১৪ :: তোমরা কি মনে করেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ এখনো তোমাদের নিকট তাদের মত অবস্থা আসেনি, যারা তোমাদের পূর্বে বিগত হয়েছে। তাদেরকে (জালিম কর্তৃক) স্পর্শ করেছিল দুঃখ-কষ্ট ও দুর্দশা এবং তারা কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তার সাথি মুমিনগণ বলছিল, ‘আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে’?

৩:১৪২ :: তোমরা কি মনে করেছো যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো (তোমাদের বাস্তব কর্মের মাধ্যমে) তোমাদের মধ্যকার তাদেরকে জেনে নেননি যারা (তাঁর বিধিবিধান বাস্তবায়নের জন্য) সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে এবং তাদেরকেও জেনে নেননি যারা ধৈর্যশীল।

২:১৫৫ :: আর নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো (কাফিরদের কারণে) কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতির দ্বারা। আর ধৈর্যশীলদেরকে সুসংবাদ দাও।

৩:১৮৬ :: অবশ্যই তোমাদেরকে তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের নিজ জীবন সম্পর্কে পরীক্ষা করা হবে। আর অবশ্যই তোমরা শুনবে তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে এবং মুশরিকদের পক্ষ থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধরো এবং স্রষ্টা সচেতনতা অবলম্বন করো তবে নিশ্চয় তা হবে দৃঢ় সংকল্পের কাজ।

১৬:১০৬ :: যে ব্যক্তি তার ঈমানের পরে আল্লাহর প্রতি কুফর করে, সে ছাড়া যাকে সেজন্য জবরদস্তি করে বাধ্য করা হয়েছে অথচ তার অন্তর ঈমানের প্রতি প্রস্বস্ত, কিন্তু যে তার অন্তরকে কুফরের জন্য উন্মুক্ত করেছে, তাহলে তাদের উপর আল্লাহর ক্রোধ এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।

২:২১৭ :: … তারা (কাফিররা) তোমাদের সাথে লড়াই করতে থাকবে, যতক্ষণ না তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দেয়, যদি তারা সক্ষম হয়।

২:১৯০ :: তোমরা আল্লাহর পথে সেই লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, কিন্তু সীমা লংঘন করো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই সীমা লংঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না।

২:১৯৩ :: আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যতক্ষণ না ফিতনার (ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের) অবসান ঘটে এবং দীন বা জীবনব্যবস্থা হয় আল্লাহর জন্য (আল্লাহর মনোনীত জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, যাতে অন্যদেরকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে)। তারপর যদি তারা (ষড়যন্ত্র, আক্রমণ ও ক্ষয়ক্ষতি সাধন থেকে) বিরত হয়, তাহলে অত্যাচারীদের উপর ছাড়া কোনো কঠোরতা নয়।

২৪:৫৫ :: তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে এ মর্মে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি নিশ্চিতভাবে তাদেরকে পৃথিবীর ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ততা (খিলাফাত) প্রদান করবেন, যেমন তিনি ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ততা প্রদান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দীনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তিনি তাদের ভয়-ভীতি শান্তি-নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা আমারই ইবাদাত (দাসত্ব-উপাসনা) করবে, আমার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করবে না। আর এরপর যারা কুফর করবে তারা ফাসিক (অবাধ্য)।

৩:১১০ ::তোমরাই (মু’মিনগণ) হলে সর্বোত্তম উম্মত,যাদেরকে মানুষের কল্যাণের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ন্যায় কাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে। আর যদি আহলে কিতাব ঈমান আনতো, তবে অবশ্যই তা তাদের জন্য কল্যাণকর হতো। তাদের মধ্যে কিছু আছে মু’মিন এবং তাদের অধিকাংশই ফাসিক।

আলোচনা: আদর্শিক দ্বন্দ্ব একটি চিরন্তন দ্বন্দ্ব। যারা হাওয়া (প্রবৃত্তি, ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি, নিতান্ত জনমত) অনুযায়ী রচিত সংবিধানকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং যারা ঈমান এনেছে তথা ওহীভিত্তিক জীবন বিধানকে গ্রহণ করেছে এ দুইয়ের মধ্যে দ্বান্দ্বিক অবস্থা এক চিরন্তন বাস্তবতা। যারা ইসলামী জীবনাদর্শে বিশ্বাসী তাদের নিকট কুরআনের সাথে যা যতটুকু অসঙ্গতিশীল তা বাতিল বলে গণ্য। অন্যদিকে যারা কুরআনে বিশ্বাসী নয়, তাদের কাছেও তাদের নিজেদের রচিত সংবিধানের সাথে যা যতটুকু অসঙ্গতিশীল তা বাতিল বলে গণ্য। এই প্রেক্ষিতে তারা কুরআনের বিধানকে পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে কখনো প্রস্তুত নয়। অন্যদিকে যারা কুরআনে বিশ্বাসী তারা কুরআনের বিধানকেই পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এখন কিছু বিষয় তো Common বিষয়কে ধারণ করতে পারে, যেমন মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, মানবকল্যাণ ইত্যাদি, কিন্তু ঐ বিষয়গুলোর মূল প্রকৃতি, ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি উভয় সংবিধানে নিজস্ব ব্যাখ্যাসম্পন্ন হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কুরআনে প্রত্যেককে বিশ্বাসের স্বাধীনতা দেয়ার পাশাপাশি কুরআনের দিকে আহবানও অব্যাহত রেখেছে এবং তাতে বিশ্বাসীদেরকে দায়িত্ব দিয়েছে যে, তারা যেন কুরআনের বিধিবিধান বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যায়। আর রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও কুরআন প্রদত্ত ব্যবস্থা উদারনৈতিক, এতে মানুষের স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় উত্থান পতনের বাস্তবতায় মু’মিনদের ক্ষমতায়নের (খিলাফাত) জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, মু’মিনরা ঈমান আনতে হবে এবং আমলে সালেহ (সৎকর্ম ও যোগ্যতা-দক্ষতা উন্নয়নমূলক কার্যাবলি) সম্পাদন করতে হবে। একজন মু’মিনের নিকট সৎকর্মের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যাবতীয় ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশনা অনুসরণ। মু’মিনদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তারা সাধ্যমতো আল্লাহ প্রদত্ত জীবনব্যবস্থার বাস্তবায়ন করবে এবং ন্যায়ের নির্দেশ ও অন্যায়ে নিষেধ করবে। কুরআনের এসব সুমহান নির্দেশনা এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতা নীতি সত্ত্বেও যারা অন্যদের উপর বাড়াবাড়ি না করে নিজেরা আল্লাহকেই একমাত্র সার্বভৌমত্বের অধিকারী হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর আইনকেই নিজেদের জন্য সর্বোচ্চ আইন বলে মেনে নেয়, তাদেরকে সত্য প্রত্যাখ্যানকারীরা কখনও সহ্য করতে পারে না। তারা মু’মিনদের উপর অযথা নির্যাতন-নিপীড়ন করে থাকে এবং মু’মিনদের উপর অন্যায়ভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় এবং তা চালিয়ে যেতে চায় যতক্ষণ না তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে, যদি তারা সক্ষম হয়। এ প্রেক্ষিতেই কুরআনে ক্বিতাল বা ন্যায়যুদ্ধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যে কোনো জাতিরাষ্ট্র তার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের হেফাযত করার জন্য এবং কোনো জনগোষ্ঠীকে জালিম শাসকের অপশাসন বা অত্যাচার নির্যাতন থেকে উদ্ধারের জন্য যুদ্ধের ন্যায়নীতি রক্ষা করে যুদ্ধ করাকে শান্তির বিপরীত বলতে পারে না, বরং কখনো কখনো শান্তি নিশ্চিত করার জন্য আক্রমণকারী ও অত্যাচারী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মু’মিনরা ততক্ষণ যুদ্ধ করতে নির্দেশপ্রাপ্ত যতক্ষণ ফিতনা দূর না হয় তথা ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত না হয়। আর সততা ও যোগ্যতাসম্পন্ন ঈমানদারদের ক্ষমতায়ন ঘটলে তারা ন্যায়ের আদেশ দেয় এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করে।

মু’মিন ও অমু’মিনদের আদর্শগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক

মু’মিন ও অমু’মিনের পারস্পরিক আদর্শগত ও সামাজিক সম্পর্ক কিরূপ হবে এ সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে যেভাবে দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ:

যারা কুরআনের উপর ঈমান আনবে এবং যারা কুরআনের উপর ঈমান আনবে না কিন্তু সাধারণ ন্যায়কাজ করবে উভয় পক্ষ পরস্পর সাধারণ ন্যায়কাজে সহযোগিতাপূর্ণ এবং ন্যায়সঙ্গত সদাচার বজায় রাখবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে দ্বীন চর্চার ক্ষেত্রে দ্বীনের ভিত্তিতেই ‘ওয়ালিয়াত’ বা ‘বন্ধুত্ব বলয়’ সৃষ্টি হবে। সবার সাথে সুন্দর কথা বলতে হবে, সুন্দর আচরণ করতে হবে, কিন্তু নিজের পিতা বা ভাইও যদি ঈমানের চেয়ে কুফরকে পছন্দ করে তাদেরকে নিজের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না, অর্থাৎ দ্বীন চর্চার ক্ষেত্রে তাদের সাথে আপোষরফা করা যাবে না।

আহলে কিতাব নারীকে বিয়ে করা যাবে, কিন্তু দ্বীনী বিষয়ে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। কুরআনে ‘ওয়ালিয়াত’ শব্দটি ‘আদর্শগত বন্ধুত্ব’ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।

আহলে কিতাব এবং মুশরিকের মধ্যে আহলে কিতাব নারীকে বিয়ে করা যাবে এবং মুশরিক নারীকে বিয়ে করা যাবে না। শিরকের কারণে মুশরিকদের সাথে তাওহীদ বিশ্বাসীদের বৈবাহিক সম্পর্ককে অবৈধ করা হয়েছে। অন্যদিকে কুরআনের প্রতি অমু’মিন হলেও আহলে কিতাব আল্লাহর কিতাবকেই ধারণ করছে যা কুরআনের পুর্বে নাযিল হয়েছে এবং কুরআন স্বয়ং তার সত্যতা প্রতিপাদনকারী এবং সেই সাথে তারা তাওহীদের উপর রয়েছে।

যদি আহলে কিতাবের মধ্যকার কেউ একই সাথে আহলে কিতাব হয় এবং একই সাথে মুশরিক হয় তবে তারা নিরেট আহলে কিতাবের তালিকা থেকে বাদ যাবে এবং মুশরিক হওয়ার কারণে তাদের নারীকে বিয়ে করা যাবে না।

এটি এভাবেও বুঝা যেতে পারে যে, যে পশুকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নাম জবেহ করা হয় তা অবৈধ। অন্যদিকে আহলে কিতাবের খাদ্য বৈধ। এখন কোনো আহলে কিতাব যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে পশু জবেহ করে তবে ঐ পশু আহলে কিতাবের দ্বারা যবেহকৃত হলেও তা অবৈধ, কারণ এক্ষেত্রে আহলে কিতাব ব্যক্তিটি তার নিরেট অবস্থানে থাকেনি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যারা আল্লাহর কিতাবের বাহিরেও রসূল কোনো মূল বা স্থায়ী বিধান দিতে পারেন বলে বিশ্বাস করে এবং সেই প্রেক্ষিতে কোনো বিধান পালন করে তারা মু’মিন ও আহলে কিতাব হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে না, তারা মুশরিক।

যারা তাওহীদে বিশ্বাসী তথা আল্লাহর সাথে শিরক করে না তারা আহলে কিতাব হলেও তাদের নারীকে বিয়ে করা যাবে। অন্যদিকে যারা তাওহীদে বিশ্বাসী নয়, তারা বাহ্যত কুরআনকে বিশ্বাস করলেও কুরআনের পাশাপাশি দ্বিতীয় কোনো গ্রন্থকে (যা আল্লাহর কিতাব পদবাচ্য হতে পারে না) দ্বিতীয় মূল ও শাশ্বত বিধানগ্রন্থের মর্যাদা দিলে সেও মুশরিক।

হজ্জে সবাই যেতে পারবে, আল মাসজিদুল হারামে সবাই যেতে পারবে, যদি তারা হয় মু’মিন অথবা আহলে কিতাব অথবা উম্মীয়্যুন বা সাবিয়ী (ধর্মনিরপেক্ষ) বা মাজুসী (সমাজতাত্ত্বিক দার্শনিক), কিন্তু যারা মুশরিক তারা আল মাসজিদুল হারামের কাছে যাওয়ার নৈতিক অধিকার রাখে না, যতক্ষণ না তারা শিরক ত্যাগ করে নিরপেক্ষ অবস্থানে আসে।

মুশরিকদের সাথে মু’মিনদের আদর্শগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ব্যবধানের বিষয় রয়েছে এর মধ্যে মু’মিন ও মুশরিকদের মধ্যে পারস্পরিক বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে মু’মিনদের কিছু বিশেষ সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, যেসব নারীকে হারাম তালিকাভুক্ত করে তার বাহিরের সকল নারীকে হালাল করা হয়েছে সেই তালিকায় (৪:২২-২৪) মুশরিক নারী অন্তর্ভুক্ত নয়। পক্ষান্তরে মুশরিক নারীকে হারাম করা হয়েছে আদর্শগত কারণে এবং তাতে মু’মিন নারীর সাথে তার আদর্শগত তুলনা উপস্থাপন করা হয়েছে (২:২২১)। একজন মুশরিক নারী তার শিরক ত্যাগ করলে তখন আর সে মুশরিক থাকে না। সুতরাং এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর হারামকে অমান্য করে কেউ যদি কোনো মুশরিক নারীকে বিয়ে করে তাহলে সে একটি ধর্মীয় বিধি অমান্য করার কারণে কবীরা গুনাহগার হিসেবে সাব্যস্ত হবে অথবা তার মানসিকতার ধরণ অনুসারে কাফির ও মুশরিক হিসেবে সাব্যস্ত হবে। কিন্তু বিয়ে নামক সামাজিক চুক্তিটি স্বয়ং অকার্যকর হয়ে যাবে না। এছাড়া কোনো মু’মিন যদি কোনো মুশরিক নারীকে বিয়ে করে তাহলে বিয়ের পর সে মু’মিনের তাওবাহ করার পদ্ধতিস্বরূপ মুশরিক স্ত্রীকে তালাক দেয়ারও কোনো নির্দেশনা নেই। তাই এরূপ ব্যক্তিকে মু’মিন হিসেবে সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে অন্য মু’মিনরা তার অন্যান্য কার্যাবলিকে বিবেচনা করবে।

৪:২২-২৪ আয়াতে যাদেরকে বিয়ে করা হারাম করা হয়েছে তা তাদের অপরিবর্তনীয় অবস্থান। অন্যদিকে মুশরিক ও যিনাকারীর অবস্থান পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ শিরক ও যিনা ত্যাগ করলে তারা আর মুশরিক ও যিনাকারী থাকে না। তাই যারা স্থায়ীভাবে হারাম বা যাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন অসম্ভব (মা, বোন, কন্যা প্রমুখ) এরূপ কোনো নারীকে বিয়ে করলে ঐ বিয়ে বিয়ে হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হবে না এবং তা অবশ্যই বাতিল বলে গণ্য হবে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে এরূপ বিয়ে করে যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হলে তাতে একটি সামাজিক অপরাধের দন্ডবিধি হিসেবে জিনার শাস্তিও প্রযোজ্য হবে।

কোনো ব্যক্তিকে নিজেদের ইচ্ছামতো কোনো কাজের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত করে মুশরিক সাব্যস্ত করার অবকাশ নেই। বরং যে ব্যক্তি তার কথা ও কাজের মাধ্যমে নিজেকে মুশরিক হিসেবে প্রকাশ করে, তাওহীদের পরিবর্তে শিরককে সঠিক হিসেবে সাব্যস্ত করে, যেমন স্পষ্টভাবে দাবি করে যে, কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে আল্লাহ শাফায়াতের ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন যে শাফায়াতের মাধ্যমে নিজ ইচ্ছামতো ব্যক্তিদেরকে মুক্তি পাইয়ে দিতে পারবে, তাহলে সে মুশরিক। অন্যদিকে যে শিরকী কথা ও কাজের সাথে সরাসরি যুক্ত নয়, বরং কোনো না কোনোভাবে সে মুশরিক কিনা এ বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকে, তাকে মুশরিক করা সঠিক হবে না। কারণ আমাদেরকে তার স্পষ্ট অবস্থান সাপেক্ষেই মূল্যায়ন করতে হবে যেন আমরা কাউকে অযথা অভিযুক্ত করা থেকে দায়মুক্ত থাকতে পারি।

যখন কোনো ব্যক্তির সামনে সত্য স্পষ্ট হয় কিন্তু কোনো অগ্রহণযোগ্য কারণে সে সত্যকে গ্রহণের বিষয়ে অনচ্ছিুক হয় তখনই সে ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করেছে হিসেবে সাব্যস্ত হয়। প্রকৃত মু’মিন ও কাফির একমাত্র আল্লাহর পক্ষেই জানা সম্ভব। অন্যদিকে মানুষকে এ বিষয়ে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কাউকে মু’মিন ও কাফির হিসেবে সাব্যস্ত করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। যারা নিজেকে মু’মিন বলে দাবি করে এবং সম্ভাব্য যাচাইয়ের মাধ্যমে তাদেরকে কাফির হিসেবে সাব্যস্ত করার কোনো প্রমাণ পাওয়া না যায়, তাদেরকে মু’মিন হিসেবে মেনে নিতে হবে। অনুরূপভাবে যারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে (বাস্তবে তার কাছে সত্য সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে কিনা সে বিষয়ে আল্লাহই ভালো জানেন) এবং তাদের কাছ থেকে এমন লক্ষণ প্রকাশ পায় যার মাধ্যমে সত্যের প্রতি তাদের অনীহা এবং বিরোধিতা প্রতীয়মান হয়, তাদেরকে কাফির হিসেবে সাব্যস্ত করতে হবে। অন্যদিকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি কিন্তু তারা পর্যবেক্ষণ করছে বলে প্রতীয়মান হয় তাদেরকে কাফির সাব্যস্ত করা যাবে না। যাদের ক্ষেত্রে সে মু’মিন বা কাফির বা সত্য বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছে কিনা বা এ বিষয়ে অপেক্ষমান কিনা কিছু জানা নেই, তাদের বিষয়ে ‘নো কমেন্ট’ অবস্থায় থাকতে হবে, তাদেরকে কাফির সাব্যস্ত করার প্রয়োজন নেই। কাউকে দাওয়াত দিলে অথচ সে তা গ্রহণ না করলে আবার মিথ্যা সাব্যস্ত না করলে তাকেও কাফির সাব্যস্ত করার প্রয়োজন নেই। বস্তুত তাদেরকেই কাফির সাব্যস্ত করতে হবে যাদের মধ্যে স্পষ্টভাবে কুরআনে উল্লেখিত কাফিরের বৈশিষ্ট্যাবলী পাওয়া যায়, যেমন তারা কুরআনের আদর্শ ধারণ করার কারণেই মু’মিনদেরকে আক্রমণ করে থাকে।

বাস্তবসঙ্গত কারণে মু’মিনরা অন্যদেরকে মু’মিন, কাফির, মুনাফিক বা সন্দেহজনক হিসেবে সাব্যস্ত করতে হয় এবং এক্ষেত্রে তারা তাদের সাধ্যমতো অন্যদের কাজকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসতে হয় (৬০:১০, ৪:৮৮-৮৯, ৪:৯৪, ৯:১০৫, ৯:১০৭-১০৮, ৯:১১৩, ৯:৮৪, ৩:১১৮, ৩:২৮)।

মু’মিনরা তাদের পিতা বা ভাইকেও তাদের এরূপ বন্ধু বানাতে পারবে না যার কারণে ঈমানের প্রশ্নে কোনো আপোষ করা হয় (দ্রষ্টব্য- ৯:২৩-২৪, ৫৮:২২)। ঈমানের চেয়ে কুফরিকে অগ্রাধিকার দেয়া লোকগুলোকে যে বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত করা হবে তা হলো- তারা ঈমানের কারণে মু’মিনদের ক্ষতি চায়, ঈমানের পথে মু’মিনদেরকে বাধাগ্রস্ত করে, ঈমান ও ইসলামের বিষয়ে হাসি-তামাশা করে।

অনুরূপভাবে ইয়াহুদ ও নাসারাকেও বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না (৫:৫১)। তবে মু’মিনরা তাদের কার্যক্রমে কে তাদের বন্ধুত্বে বা তাদের সাথে মহানুভবতার সম্পর্কের দিক থেকে নিকটতর এবং কে সবচেয়ে বেশি হিংসাত্মক আচরণ করে এসব বিষয়কেও বিবেচনায় রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে জানানো হয়েছে যে, মুশরিকরা এবং ইয়াহুদ মু’মিনদের সাথে সবচেয়ে বেশি শত্রুতা পোষণকারী এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে এমন নিরহংকার জ্ঞান গবেষক ও সন্ন্যাসী রয়েছে যারা এক পর্যায়ে ঈমান আনে, তাদের প্রভাবে খ্রিস্টানরা মু’মিনদের প্রতি বন্ধুত্বের নিকটতর (৫:৮২-৮৫)

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এসব আয়াতে বন্ধুত্ব বুঝাতে যে আরবি শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তাহলো ‘তাওয়াল্লা’। 'তাওয়াল্লা' + কোনো ব্যক্তি/ব্যক্তিসত্তা = ঐ ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব করা বা ঐ ব্যক্তির অভিভাবকত্ব করা। যেমন, ৭:১৯৬ আয়াতে ‘আল্লাহ সৎকর্মশীলদের অভিভাবকত্ব করেন’ বুঝাতে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যে ‘তাওয়াল্লা’ করে সে যদি বন্ধুত্ব করার স্তরে থাকে, তবে সে বন্ধুত্ব করে। যদি সে অভিভাবকত্ব করার স্তরে থাকে, তাহলে সে বন্ধুত্ব ও অভিভাবকত্ব করে। বন্ধুত্ব বলতে সাধারণ সদাচারমূলক সম্পর্ক নয়। অমু’মিনদের সাথে মু’মিনদের বন্ধুত্বের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কুরআনে ওয়ালিয়াত/বন্ধুত্ব বলতে আদর্শিক প্রভাবের দিক থেকে প্রভাবিত হওয়ার মতো স্তরকে নির্দেশ করা হয়েছে।

আহলে কিতাবের সাথে মু’মিনদের পারস্পরিক খাদ্য গ্রহণ ও বৈবাহিক সম্পর্ককে বৈধ করা হয়েছে (৫:৫), তেমনি তাদের সাথে আর্থ-সামাজিক কায়-কারবারের ক্ষেত্রেও নির্দেশনা রয়েছে (৩:৭৫)। নিজ বলয়ের বাহিরের লোকদের ব্যাপারে আর্থ-সামাজিক নৈতিকতার দায়-দায়িত্ব না থাকার বিষয়টিকে আল্লাহর নামে মিথ্যারোপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন কারো আমানত বা সম্পদ আত্মসাৎ করা একটি অবৈধ কাজ, সেটা যার সম্পদই হোক না কেন।

কাফিরদের মু’মিন স্ত্রীরা যদি তাদেরকে ছেড়ে মু’মিনদের কাছে হিজরত করে আসে তাহলে তাদেরকে কাফিরদের কাছে ফেরত পাঠানো যাবে না বরং তারা এবং কাফিররা একে অন্যের জন্য অবৈধ হয়ে যাবে এবং অনুরূপভাবে মু’মিনদের কাফির স্ত্রীরা যদি কাফিরদের কাছে চলে যেতে চায় তাহলে তাদেরকে বিয়ে বন্ধনে আটকে রাখা যাবে না (দ্রষ্টব্য ৬০:১০)।

পিতামাতা যদি শিরকের নির্দেশ দেয় সেক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করা যাবে না কিন্তু তাদের সাথে পার্থিব বিষয়াদিতে সদয় আচরণ করতে হবে (৩১:১৪-১৫, ২৯:৮)। মু’মিনদের স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে তাদের প্রতি আদর্শগত কারণে শত্রুতা পোষণকারী থাকতে পারে, তাদের প্রতি যথাসম্ভব ক্ষমাসুলভ আচরণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে (৬৪:১৪)।

মু’মিনদেরকে ঈমানের বিষয়ে যেমন দৃঢ় ও আপোষহীন হতে হবে তেমনি আবার নিজেদেরকে পবিত্র পরিশুদ্ধ বলে দাবি করা থেকেও বিরত থাকতে হবে (৫৩:৩২, ৪:৪৯)। এছাড়া পরকালের বাসস্থান তথা জান্নাতকে শুধু নিজেদের জন্য বরাদ্দ বলেও দাবি করা যাবে না (২:৯৪-৯৫, ৬২:৬)। সুতরাং ঈমানের বিষয়ে আপোষহীন হওয়া সত্ত্বেও সাধারণভাবে কে মু’মিন কে কাফির সে সনদ দেয়া মু’মিনদের কাজ নয়, তারা শুধুমাত্র আদর্শগত কারণে যারা মু’মিনদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিরোধিতামূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত তাদেরকে সীমিত ক্ষেত্রে কাফির সাব্যস্ত করতে পারে এবং নিজেদের কাছে যাদের বাস্তব বিরুদ্ধতার প্রেক্ষিতে কাফির হিসেবে প্রতিভাত হয় তাদের সাথে নিজেদের গোপনীয়তা শেয়ার করা ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাওয়ার মতো বন্ধুত্ব করা থেকে বিরত থাকবে।

মু’মিনদেরকে মু’মিন অ’মুমিন নির্বিশেষে সর্বজনীন মানব কল্যাণমূলক কাজ করতে হবে, কারণ এজন্য আল্লাহর কিতাবের মাধ্যমে তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা মানবজাতির মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং তাদেরকে যাবতীয় জুলুম শোষণ থেকে উদ্ধার করার জন্য এবং তাদের অসহায়ত্বে তাদের প্রতি দয়ার্দ্র আচরণ করার জন্য নির্দেশপ্রাপ্ত।

স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর বিধানকে মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ করা যাবে না। তবে স্রষ্টা মানুষকে যে Common জিনিসটি দিয়েছেন সেই Common sense অনুসারে ন্যায়নীতি লঙ্ঘন করলে তথা সামাজিক অপরাধ করলে সেটা প্রতিরোধের জন্য বলপ্রয়োগ করা যাবে। যদি স্রষ্টা বিশ্বাসীরা সমাজ পরিচালনার সুযোগ লাভ করে তবে তারা সামাজিক বিষয়গুলোতে স্রষ্টার বিধান প্রয়োগ করবে। কারণ এক্ষেত্রে যারাই পরিচালনায় থাকে তারাই সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে স্বীয় মতাদর্শভিত্তিক পরিচালনা পদ্ধতি গ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনোক্রমে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাসনির্ভর উপাসনার বিষয়ে বা তাঁর বিধানগ্রন্থে থাকা বিধানকে স্বর্গীয় বিধান হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য করা যাবে না। কারণ বলপ্রয়োগপূর্বক বিশ্বাস কোনো বিশ্বাস নয়।

সুতরাং যদিও সামাজিক অপরাধ এবং ধর্মীয় বিশ্বাসগত অপরাধ এর মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসগত অপরাধই বড় অপরাধ, যেমন কাউকে হত্যা করার চেয়ে শিরক করা বড় অপরাধ, তবুও ধর্মীয় বিশ্বাসগত অপরাধ শুধুমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে আখিরাতে শাস্তির জন্য তাঁর ফেরেশতাদের কর্তৃক রেকর্ডকৃত অপরাধ হিসেবেই থাকবে, সেটাকে পৃথিবীতে মানুষের দ্বারা দন্ডবিধানের মতো কোনো অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা যাবে না, বরং এ বিষয়টি বিশ্বাসগত বিষয় হওয়ার কারণে এ বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং কাউকে বলপ্রয়োগ করে শিরক করা থেকে নিবৃত্ত করাই বরং স্বয়ং আল্লাহর নির্দেশ অমান্যা করার ধর্মীয় অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

ধর্মীয় বিশ্বাসগত পার্থক্যের কারণে কারো সাথে যুদ্ধ করা যাবে না। যখন মু’মিনদের উপর অন্যায়ভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয় তখন ফিতনা (বিশ্বাস ও মতাদর্শ বা ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ) দূরীভূত হওয়ার জন্য এবং দ্বীন শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দ্বীন শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য হওয়ার অর্থ হলো আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন বিজয়ী হওয়া এবং এই দ্বীনের ঘোষিত মূলনীতি অনুযায়ী ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হওয়া। সমাজে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হলেও অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য তাদের ধর্মীয় বিষয়ে তাদের ধর্মীয় আচার-বিচারের সুযোগ থাকবে, শর্ত হলো তার মাধ্যমে কোনো সামাজিক অপরাধ (যেমন ধর্মের নামে নরবলি বা সতীদাহ) সংঘটিত হতে পারবে না।

ঈমানের বিষয়ে মু’মিনের স্বাধীনতা এবং ঈমান ত্যাগের স্বাধীনতা

৩৩:৩৬ :: আর কোনো মু’মিনের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোনো বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিলে সেই বিষয়ে ভিন্নরূপ (মত পোষণ ও কার্য সম্পাদন) করার ইখতিয়ার (স্বাধীনতা) নেই। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হয় সে স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হয়।

৪:১৩৭ :: নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে তারপর কুফর করেছে, তারপর ঈমান এনেছে, তারপর কুফর করেছে, তারপর কুফরকে বাড়িয়ে দিয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করার নন এবং তাদেরকে পথ প্রদর্শন করার নন।

আলোচনা: কোনো ব্যক্তি মু’মিন হলে সে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সিদ্ধান্তের বিপরীত মত পোষণ ও কার্য সম্পাদন করার স্বাধীনতা রাখে না। কারণ যদি সে তা করে তা হবে আল্লাহর ও তাঁর রসূলের অবাধ্যতা। আর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্যতা করার অর্থ হলো স্পষ্ট পথভ্রষ্টতা। এরূপ অবাধ্যতার অবস্থায় সে মু’মিন থাকে না। সুতরাং একদিকে মু’মিন হবে অন্যদিকে আল্লাহর ও তাঁর রসূলের কোনো সিদ্ধান্তের বিপরীতে মত পোষণ ও কার্য সম্পাদন করবে এটা সম্ভব নয়। তবে একজন মানুষ হিসেবে সে মু’মিন না থেকে কাফির হয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা তার রয়েছে। কোনো ব্যক্তি একবার মু’মিন হবে তারপর কাফির হবে তারপর মু’মিন হবে তারপর কাফির হবে তারপর তার কুফরকে বৃদ্ধি করে নিবে ইত্যাদির অবকাশ আছে। যদিও এভাবে শেষ পর্যন্ত যে কাফির অবস্থায় থাকবে সে পরকালে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে, কিন্তু পৃথিবীতে এজন্য কোনো দণ্ডবিধি নেই।

গোপন মু’মিন অবস্থায় থাকার অবকাশ

৪০:২৮ :: আর ফির‘আউন বংশের এক মুমিন ব্যক্তি যে তার ঈমান গোপন রেখেছিলো, সে বললো, ‘তোমরা কি একটি লোককে কেবল এ কারণে হত্যা করবে যে সে বলে, ‘আমার প্রভু আল্লাহ’ অথচ সে তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছে? সে যদি মিথ্যাবাদী হয় তবে তার উপরই বর্তাবে তার মিথ্যা; আর সে যদি সত্যবাদী হয় তবে যে বিষয়ে সে তোমাদেরকে ওয়াদা দিচ্ছে তার কিছু তোমাদের উপর আপতিত হবে। নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না, যে সীমালংঘনকারী, মিথ্যাবাদী’।

২৯:১০ :: মানুষের মধ্যে কতক লোক বলে, “আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি”। কিন্তু যখন তাদেরকে আল্লাহর পথে থাকার কারণে কষ্ট দেয়া হয় তখন তারা মানুষের উৎপীড়নকে আল্লাহর শাস্তির মত গণ্য করে। অথচ যদি তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য আসে তখন তারা বলে, ‘আমরাতো তোমাদের সাথেই ছিলাম’। বিশ্ববাসীর অন্তরে যা আছে আল্লাহ কি তা সম্যক অবগত নন?

আলোচনা: যারা ঈমানের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে বা নিজেকে মু’মিন হিসেবে পরিচয় দেয় এরূপ মু’মিন হলো প্রকাশ্য মু’মিন। অন্যদিকে কোনো ব্যক্তি কোনো বিশেষ ওজরের কারণে ঈমানের কথা প্রকাশ করে না অথচ সে মু’মিন, এ ধরনের ব্যক্তিকে আমরা মু’মিন হিসেবে জানতে না পারলেও আল্লাহর কাছে সে মু’মিন হিসেবে সাব্যস্ত হয়। যখন হিজরাত বা ন্যায়যুদ্ধ আবশ্যকীয় দায়িত্ব হয়ে যায় তখন যেমন সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ভয়ে হিজরাত বা ন্যায়যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার অবকাশ নেই, তেমনি যখন ঈমানের প্রকাশ করা আবশ্যক হয়ে পড়ে, যেমন নিজের ঈমানের প্রকাশ না করে মু’মিনদেরকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়, এরূপ অবস্থায় গোপন মু’মিনদের করার ঈমানের প্রকাশ করার দায়িত্ব এসে যায়, এ সময় কাফিরদের নির্যাতনের ভয়কে প্রাধান্য দেয়ার অবকাশ নেই।

আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাগুতকে বর্জন

২:২৫৬ :: দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় সত্যপথ স্পষ্ট হয়ে গেছে বিভ্রান্তি থেকে। সুতরাং যে ব্যক্তি তাগুতের প্রতি কুফর করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে সে এমন এক মজবুত হাতল আঁকড়ে ধরবে যা ভেঙ্গে যাবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

২:২৫৭ :: আল্লাহ মু’মিনদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন এবং কাফিরদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত, সে তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। তারাই (জাহান্নামের) আগুনের অধিবাসী, তারা তাতে চিরকাল থাকবে।

৪:৫১ :: তুমি কি তাদেরকে দেখনি যাদেরকে কিতাবের এক খণ্ড প্রদান করা হয়েছে, যারা জিবত (কুসংস্কার) ও তাগুতের প্রতি ঈমান রাখে এবং তারা কাফিরদের প্রসঙ্গে বলে যে, এরাই মু’মিনদেরকে চেয়ে অধিকতর সঠিক পথে রয়েছে।’?

৪:৬০-৬৩ :: তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা দাবী করে যে, নিশ্চয় তারা ঈমান এনেছে তার উপর যা নাযিল করা হয়েছে তোমার প্রতি এবং যা নাযিল করা হয়েছে তোমার পূর্বে। তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায় অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে অস্বীকার করতে। আর শয়তান চায় তাদেরকে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত করতে। আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা আসো যা আল্লাহ নাযিল করেছেন তার দিকে (কুরআনের দিকে) এবং রাসূলের দিকে’, তখন মুনাফিকদেরকে দেখবে তোমার কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে ফিরে যাচ্ছে। সুতরাং তখন কেমন হবে, যখন তাদের উপর কোন মুসীবত আসবে, সেই কারণে যা তাদের হাত পূর্বেই প্রেরণ করেছে (অর্থাৎ তাদের কৃতকর্মের কারণে)? তারপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করা অবস্থায় তোমার কাছে আসবে যে, আমরা উত্তম আচরণ ও সমঝোতার মাধ্যমে সামর্থ্যবৃদ্ধি ভিন্ন অন্য কিছু চাইনি। তাদের মনে যা আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তুমি তাদের বিষয়ে নির্লিপ্ত হও এবং তাদেরকে সদুপদেশ দাও এবং তাদেরকে তাদের (কর্মকাণ্ডের) পর্যালোচনাস্বরূপ মর্মস্পর্শী কথা বলো।

৪:৭৬ :: যারা মু’মিন তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে এবং যারা কাফির তারা তাগুতের পথে যুদ্ধ করে। সুতরাং তোমরা শয়তানের বন্ধুদের (তাগুত ও তার পথে যুদ্ধরত কাফিরদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। নিশ্চয় শয়তানের কায়দা-কৌশল অত্যন্ত দুর্বল।

৫:৬০ :: বলো, আমি তোমাদেরকে কি এর চেয়ে খারাপ কিছুর সংবাদ দেব যা আল্লাহর নিকট প্রতিদান হিসেবে আছে? (আর তা হলো) যাকে আল্লাহ লা‘নাত করেছেন, যার উপর তিনি ক্রোধান্বিত হয়েছেন, যাদের কতককে তিনি বানর ও শুকরে পরিণত করেছেন আর যারা তাগুতের ‘ইবাদাত করেছে তারাই সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানের লোক এবং সরল সত্য পথ হতে সবচেয়ে বিচ্যুত।

১৬:৩৬ :: আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ কাউকে হিদায়াত দিয়েছেন এবং তাদের মধ্য থেকে কারো উপর পথভ্রষ্টতা সাব্যস্ত হয়েছে। সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে  ভ্রমণ করো অতঃপর দেখো সত্যকে মিথ্যা সাব্যস্তকারীদের পরিণতি কীরূপ হয়েছে।

৩৯:১৭ :: যারা তাগূতের দাসত্বকে বর্জন করে এবং আল্লাহর অভিমুখী হয়, তাদের জন্যই সুসংবাদ। সুতরাং সুসংবাদ দাও আমার (এরূপ) বান্দাদেরকে।

আলোচনা: জীবনের সকল বিভাগে একমাত্র আল্লাহর আদেশের সীমারেখায় জীবন যাপন করাই আল্লাহর দাসত্ব করা। উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের বক্তব্য অনুযায়ী, যারা জোর করে আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে নিজের বিধান দ্বারা শাসন ও বিচারকার্য করে এবং কাফিরদের মাধ্যমে মু’মিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে তাদেরকে তাগুত বলা হয়। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার অনিবার্য দাবি হচ্ছে তাগুতের প্রতি কুফর করতে হবে তথা তাগুতের দাসত্বকে বর্জন করতে হবে।

যেহেতু দ্বীন গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো জবরদস্তি নেই, তাই কাফিররা তাদের নিজেদের দীন মতো চলার স্বাধীনতা আছে এবং মু’মিনরাও নিজেদের দীন মানার স্বাধীনতা আছে। যারা নিজেদের অপশক্তি প্রয়োগ করে মু’মিনদেরকে নিজেদের জীবনে তাদের দীন পালন থেকে বাধার সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে অন্যরূপ বিধানে চলতে বাধ্য করে তারাই তাগুত।

কোথাও কাফিরদের বাস্তব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তার বাস্তবতা অস্বীকারের কিছু নেই, কিন্তু মু’মিনরা তাদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারভার রসূল ও তাঁর অনুপস্থিতিতে উলিল আমরের উপর অর্পণ করতে হবে। নিজেদের মধ্যকার বিষয়ে রসূলকে বা উলিল আমরকে বাদ দিয়ে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া যাবে না। নিতান্ত বাধ্য হয়ে তাগুতের অধীনে বা তাগুতের বিধানের আওতায় থেকে কর্মসম্পাদন করা আর নিজেদের মূল বিধান (সংবিধান) ও মূল নেতৃত্ব (সরকার) হিসাবে কুরআনের বিধান ও রসূলকে বা উলিল আমরকে গ্রহণ না করে (৪:৬১) তাগুতের আনুগত্য করা ও তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া (৪:৬০) এবং উহাকে উত্তম আচরণ ও সমঝোতার মাধ্যমে সামর্থ্য বৃদ্ধির প্রয়াস বলে অজুহাত পেশ করা (৪:৬২) দুটি ভিন্ন বিষয়।

নিজেদের মধ্যকার বিষয়ে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া যাবে না। কিন্তু তাদের নাগরিকের অপরাধের ক্ষেত্রে বিচার চাওয়াকে ৪:৬০ আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক বলে সাব্যস্ত করা যায় না। ৪:৫৯ – ৬৫ অনুযায়ী, কুরআন ও রসূলকে বাদ দিয়ে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া এবং নিজেদের পার্থিব স্বার্থবাদিতাকে আড়াল করার জন্য উহাকে ইহসান ও তাওফীক্বের প্রয়াস বলে অজুহাত পেশ করা মোনাফেকি। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর খেলাফত প্রাপ্তির পূর্বে তাগুতের কাছে তাদের নাগরিকের বিচার চাওয়া একটি ভিন্ন বিষয়, যে ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

ঈমান ও সৎকর্মের পার্থিব সুফল ও আখিরাতকে অগ্রাধিকার

২০:১২৪ :: ‘আর যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ থাকবে, নিশ্চয় তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন সমবেত করব অন্ধ অবস্থায়।

৩০:৪১ :: মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে যাতে তিনি তাদেরকে তাদের কোন কোন কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা (অসৎ পথ হতে) ফিরে আসে।

২০:২ :: আমি তোমার উপর এজন্য কুরআন নাযিল করিনি যে, তুমি দুর্দশায় থাকবে।

১৬:৯৭ :: যে মুমিন অবস্থায় নেক আমল করবে, পুরুষ হোক বা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং (আখিরাতে) তাদের সর্বোত্তম কর্মের উপর ভিত্তি করে তাদেরকে পুরস্কার দান করবো।

২:১৫৫ :: আর নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো (কাফিরদের কারণে) কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতির দ্বারা। আর ধৈর্যশীলদেরকে সুসংবাদ দাও।

৫:৬৬ :: আর যদি তারা তাওরাত, ইনজীল ও তাদের নিকট তাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা কায়েম করত, তবে অবশ্যই তারা আহার করত তাদের উপর থেকে এবং তাদের পদতল থেকে। তাদের মধ্য থেকে সঠিক পথের অনুসারী একটি দল রয়েছে এবং তাদের অনেকেই যা করছে, তা কতইনা মন্দ!

৭:৯৬ :: যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ঈমান আনতো এবং স্রষ্টা সচেতনতা অবলম্বন করতো তবে আমি তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর (সুখময় উপকরণের) সমৃদ্ধি উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা অবিশ্বাস করলো। কাজেই আমি তাদের কর্ম অনুযায়ী ফল দান করলাম।

৬৫:২-৩ :: … যে ব্যক্তি আল্লাহর ও পরকাল দিবসের প্রতি ঈমান আনে এবং আল্লাহ-সচেতন হয় তাহলে আমি তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা করে দিই। আর তাকে এমন উপায় / উৎস থেকে জীবিকা দিয়ে থাকি যা সে হিসাবও করেনি। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর কাজকে পরিপূর্ণতায় পৌছান। নিশ্চয় আল্লাহ সকল কিছুর বিষয়ে প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণ করেছেন।

৮:৫৩ :: এটা এজন্য যে, আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের নিকট দেয়া তাঁর নিয়ামতকে পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেদের (মনোভাব, গুণবৈশিষ্ট্য ও কর্মনীতির) কারণে তা পরিবর্তন করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

৭:৩২ :: বলো, 'আল্লাহ নিজের বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে?’ বলো, ‘পার্থিব জীবনে, বিশেষ করে কেয়ামতের দিনে এ সব তাদের জন্য, যারা ঈমান আনে।’ এভাবে আমি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করি।

২০:১৩১ :: আর তুমি কখনো প্রসারিত করো না তোমার দু’চোখ সে সবের প্রতি, যা আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণীকে দুনিয়ার জীবনের জাঁক-জমকস্বরূপ উপভোগের উপকরণ হিসেবে দিয়েছি। যাতে আমি সে বিষয়ে তাদেরকে পরীক্ষা করে নিতে পারি। আর তোমার রবের প্রদত্ত রিয্ক সর্বোৎকৃষ্ট ও অধিকতর স্থায়ী।

১৫:৮৮ :: আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণীকে ভোগ বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি তার প্রতি তুমি কখনও তোমার চক্ষুদ্বয় প্রসারিত করনা; তাদেরকে যা দেয়া হয়েছে সেই জন্য তুমি ক্ষোভ করনা; তুমি মু’মিনদের জন্য তোমার বাহু অবনমিত করো।

২৮:৭৭ :: আর আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন তাতে তুমি আখিরাতের নিবাস অনুসন্ধান করো। তবে তুমি দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তোমার প্রতি আল্লাহ যেরূপ অনুগ্রহ করেছেন তুমিও সেরূপ অনুগ্রহ করো। আর যমীনে ফাসাদ করতে চেয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ ফাসাদকারীদের ভালবাসেন না’।

৩:১৪ :: মানুষের কাছে সুশোভিত করা হয়েছে কাঙ্ক্ষিত ভালবাসা- নারী, সন্তান, স্ত্তপীকৃত স্বর্ণ ও রৌপ্যভান্ডার, চিহ্নযুক্ত অশ্বরাজি, গৃহপালিত পশু এবং শস্যক্ষেত্র। এসব পার্থিব জীবনের সম্পদ। আর আল্লাহ! তাঁরই নিকট রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল।

৯:২৪ :: বল, ‘তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্বামী/স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা যার মন্দা হওয়ার আশঙ্কা তোমরা করছ এবং সে বাসস্থান, যা তোমরা পছন্দ করছ, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত’। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।

৫:১০০ :: বলো, পবিত্র ও অপবিত্র সমান নয়, যদিও অপবিত্র বস্তুর প্রাচুর্য তোমাকে মোহগ্রস্ত করে। সুতরাং আল্লাহ সচেতন হও হে চিন্তাশক্তির অধিকারী সম্প্রদায়, যেন তোমরা প্রকৃত সফলতা পেতে পারো।

আলোচনা: ঈমান ও সৎকর্মের পরকালীন সুফলের পাশাপাশি এর ফলে পার্থিব জীবনে যে সুফল লাভ করা যাবে তা হলো, পৃথিবীতে পবিত্র জীবন যাপন করা যাবে এবং আল্লাহ যা কিছুকে বৈধ করেছেন যথানিয়মে ও ন্যায়সঙ্গতভাবে তা অর্জনের মাধ্যমে পৃথিবীতেও সুখী,সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল জীবন যাপন করা যাবে। ঈমান ও সৎকর্মের মাধ্যমে বৈধভাবে যা অর্জন করা যায় সেটাই শ্রেয়। অন্যদিকে কাফিরদের যে পার্থিব ভোগবিলাসের সম্পদের প্রাচুর্য তাতে পবিত্রতা নেই এবং তা পার্থিব জীবনে তাদের কাজে লাগলেও পরকালীন জীবনে তাদের জন্য কিছু নেই। মু’মিনরা কাফিরদের কর্তৃক প্রতিবন্ধকতার কারণে কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন জানমালের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে, তবে তারা যদি যথানিয়মে পরস্পরের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণসহ ধৈর্যের সাথে কাজ করে যায় তাহলে তাদেরকে দুর্দশায় পড়ে থাকতে হবে না। অন্যদিকে কাফিররা বাহ্যত প্রচুর সম্পদ পেলেও তাদের জীবন যাপন সংকুচিত হয়ে পড়বে। সর্বোপরি যখন ঈমানের প্রশ্নে পার্থিব ও পারলৌকিক জীবনের বিষয়ে অগ্রাধিকারের প্রশ্ন তৈরি হয় তখন ঈমানের ভিত্তিতে পারলৌকিক জীবনকেই অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।

ঈমানের বিষয়সমূহ

২:১৭৭ :: পুণ্য কাজ এ নয় যে, তোমরা পূর্ব ও পশ্চিম ক্বিবলার দিকে তোমাদের মুখ ফিরাও। কিন্তু পুণ্যকাজ সে-ই করে যে বিশ্বাস করে আল্লাহর প্রতি এবং আখিরাত দিবসের প্রতি এবং ফেরেশতাদের প্রতি এবং  ‘আল কিতাবের’ প্রতি এবং নবীগণের প্রতি এবং তার মহব্বতের মাল দান করে আত্মীয়-স্বজনকে, ইয়াতীমদেরকে, অভাবগ্রস্তদেরকে এবং পথে আটকে পড়া ব্যক্তিকে/ ছিন্নমূলকে/উদ্বাস্তুকে এবং সাহায্যপ্রার্থীকে এবং কারো ঘাড়কে (দাসত্ব থেকে) মুক্ত করার ক্ষেত্রে। এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত প্রদান করে এবং তারা যখন প্রতিজ্ঞা করে সেই প্রতিজ্ঞা পূরণকারী এবং অর্থ-সংকটে, দু:খ-ক্লেষে ও সংগ্রাম সংকটের সময় সবরকারী। তারাই ঐসব লোক যারা সত্যবাদী এবং তারাই সত্যাগ্রহী, আল্লাহ সচেতন।

৪:১৩৬ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমরা ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি তাঁর রাসূলের উপর নাযিল করেছেন এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি পূর্বে নাযিল করেছেন। আর যে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং আখিরাত দিবসকে অস্বীকার করবে, সে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত হবে।

আলোচনা: উপরোল্লেখিত আয়াতদ্বয়সহ ঈমান বিষয়ক আয়াতসমূহ থেকে জানা যায় যে, ঈমানের বিষয়সমূহ হলো-

১. আল্লাহর প্রতি ঈমান

২. আল্লাহর ফেরেশতাগণের প্রতি ঈমান

৩. আল্লাহর কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান

৪. আল্লাহর নবী-রসূলগণের প্রতি ঈমান

৫. আখিরাতের প্রতি ঈমান

>>  পরবর্তী পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য ক্লিক করুন