১। ‘হিদায়াত করা’ বলতে ‘পথনির্দেশ করা’ বুঝায় এবং অনুরূপভাবে ‘হিদায়াত পাওয়া বা গ্রহণ করা’ বলতে ‘পথনির্দেশ পাওয়া বা গ্রহণ করা’ বুঝায়। অনেক আয়াতে হিদায়াত শব্দটি সাধারণভাবে কোনো পথের দিশা পাওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ- মানুষের যোগাযোগ, যাতায়াত ও পরিবহনের সুবিধার জন্য পথঘাট চিনতে পারা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিদায়াত শব্দটি জীবনব্যবস্থার সঠিক পথের নির্দেশনা বা সঠিক পথের সন্ধান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। হিদায়াত শব্দের বিপরীতে ‘দলালাত’ বা ‘পথভ্রষ্টতা/বিভ্রান্তি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
২। হিদায়াত করাকে আল্লাহর দায়িত্ব হিসেবে জানানো হয়েছে। আল্লাহ হিদায়াতের জন্য মানুষের মধ্য থেকে নবী-রসূল প্রেরণ করে তাদের কাছে কিতাব নাযিল করেছেন। অর্থাৎ নবী-রসূলদেরকে কিতাবের মাধ্যমে হিদায়াতকারী হিসেবে এবং কিতাবকে হিদায়াত হিসেবে পাঠানো হয়েছে। আল্লাহই একমাত্র স্বাধীনভাবে হিদায়াতকারী। অন্যদিকে নবী-রসূল আল্লাহর পাঠানো কিতাবের মাধ্যমে হিদায়াতকারী।
৩। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন এবং যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন। আল্লাহ যাকে হিদায়াত করেন সেই হিদায়াত গ্রহণকারী হয় এবং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন সেই পথভ্রষ্ট হয়। আল্লাহ যাকে হিদায়াত করেন কেউ তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না এবং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন কেউ তাকে হিদায়াত করতে পারে না। নবী-রসূল যাকে চান বা যাকে ভালোবাসেন তাকে হিদায়াত করতে পারেন না, বরং আল্লাহই হিদায়াত করেন।
৪। আল্লাহর হিদায়াত দুই স্তরে বিভক্ত। এর প্রাথমিক স্তর হলো কোনটি ভালো ও কোনটি মন্দ সেই বিষয়ে পথনির্দেশ করা। এই স্তরের হিদায়াতের ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব হিদায়াতের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে এবং নবী-রসূলগণ ঐ মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে সাধারণ হিদায়াত করে থাকেন। কিন্তু হিদায়াতের চূড়ান্ত স্তর হলো- যারা হিদায়াত গ্রহণ করে তাদেরকে হিদায়াত বৃদ্ধি করে দেয়া বা হিদায়াত অনুসারে পরিচালিত করা বা হিদায়াতের দাবি অনুসারে চালিত হওয়ার মতো হিদায়াত করা। এটা শুধুমাত্র আল্লাহর কাজ। এক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য যে, কোনো নবী-রসূল যাকে ইচ্ছা বা যাকে ভালোবাসেন তাকে হিদায়াত করতে পারেন না। কারণ এরূপ হিদায়াত করার বিষয়টি শর্তযুক্ত এবং একবার হিদায়াতের প্রতি ইতিবাচক মানসিকতা গ্রহণ করার পর ঐ মানসিকতায় সুস্থির রাখার মতো মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা প্রদানের সাথে সাথে সম্পর্কিত। কেউ যখন হিদায়াত গ্রহণ করার পরও পুনরায় বক্রতার প্রতি দুর্বলতা দেখায়, তখন তাদের অন্তর উত্তরোত্তর অধিক বক্র হওয়ার মতো উপায়-উপাদানের দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। এরূপ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাদের অন্তর বক্র হয়ে যায়। এটাকে তাদের অন্তর বক্র করে দেয়া অর্থে উল্লেখ করা হয়। এজন্য হিদায়াতের পর যেন পুনরায় অন্তরকে বক্র করে দেয়া না হয়, সেজন্য প্রার্থনা করতে হয় বা সেই বিষয়ে আন্তরিক প্রয়াস থাকতে হয়।
৫। হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতার জন্য মানুষই দায়ী। অর্থাৎ মানুষ নিজেই হিদায়াত গ্রহণ করে এবং যে হিদায়াত গ্রহণ করে সে তার নিজেরই কল্যাণ করে। অনুরূপভাবে মানুষ নিজেই পথভ্রষ্ট হয় এবং যে পথভ্রষ্ট হয় সে নিজেরই অকল্যাণ করে।
৬। আল্লাহর পক্ষ থেকে এ বাণী বাস্তবসঙ্গত হয়েছে যে, তিনি জিন ও মানুষ দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করবেন।
৭। আল্লাহ কাফিরদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন। ফলে তারা পথভ্রষ্ট থাকে।
হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতার জন্য মানুষই দায়ী
হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতা বিষয়ক যে তথ্যকে ভাগ্যবাদের প্রমাণ হিসেবে মনে করা হয় বা পেশ করা হয় তা হলো : আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন এবং তিনি যাকে হিদায়াত করেন, কেউ তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না। অনুরূপভাবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন করেন, কেউ তাকে হিদায়াত করতে পারে না।
এ তথ্যটি কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে এবং তাই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ তথ্যটি প্রচলিত ভাগ্যবাদী ধারণায় এভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যে- কোনো ব্যক্তির সঠিক পথনির্দেশ অবলম্বন ও পথভ্রষ্টতার বিষয়ে তার কোনো দায়-দায়িত্ব নেই, বরং আল্লাহ পথনির্দেশ করলে কেউ পথনির্দেশ পায়, আর আল্লাহ পথভ্রষ্ট করলে কেউ পথভ্রষ্ট হয়। অন্য কথায়, পথনির্দেশ ও পথভ্রষ্টতার জন্য কোনো ব্যক্তি নিজে দায়ী নয়, বরং আল্লাহই দায়ী।
কিন্তু প্রচলিত এ ধারণা বা ভাগ্যবাদ কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা কুরআনের বক্তব্যের সঠিক তাৎপর্য নয়। কারণ কুরআনে হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে এই ধারণার বিপরীত বক্তব্য রয়েছে। সুতরাং পথনির্দেশ ও পথভ্রষ্টতার বিষয়ে আল্লাহর ভূমিকার সঠিক তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে কুরআনের আয়াতসমূহের সমন্বিত অধ্যয়ন অপরিহার্য।
কুরআন অনুযায়ী, আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে প্রাকৃতিক বিধানের হিদায়াত প্রদান করেছেন। মানুষের নৈতিক ও সামাজিক জীবনযাত্রার সঠিক পথনির্দেশের জন্য যেমন তিনি তাদেরকে বিবেকবুদ্ধি দিয়েছেন, তেমনি তাঁর নাযিলকৃত ওহী বা কিতাবের মাধ্যমে তাদেরকে সুষ্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট ও চূড়ান্ত হিদায়াত প্রদান করেছেন। তিনি পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাত্রার সূচনালগ্নেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি মানুষকে হিদায়াত প্রেরণ করবেন, যারা তা অবলম্বন করবে তাদের দুঃখিত ও উদ্বগ্ন হওয়ার কারণ নেই। আর যারা তা অবলম্বন করবে না তারাই তারাই জাহান্নামে স্থায়ী হবে। এই প্রতিশ্রুতি অনুসারে আল্লাহ মানুষের মধ্য থেকে নবী-রসূল মনোনীত করে তাদের মাধ্যমে মানুষের কাছে হিদায়াত প্রেরণ করেছেন। নবী-রসূলগণ আল্লাহর মনোনীত এবং নবী-রসূল হওয়া তাদের অর্জিত বিষয় নয়, বরং এটা তাদেরকে প্রদান করা হয়েছে। যদি তাঁদেরকে হিদায়াত দেয়া না হতো, তাহলে তারা অন্য কোনোভাবে তা পেতেন না এবং একইভাবে অন্য কোনো মানুষও তা পেতে পারতো না। হিদায়াতের উৎস একমাত্র আল্লাহ। তিনি যুগে যুগে নবী-রসূলদের কাছে তাঁর নাযিলকৃত কিতাবের মাধ্যমে হিদায়াত প্রদান করেছেন। তাঁর নাযিলকৃত সর্বশেষ কিতাব কুরআন, যা তাঁর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য হিদায়াত হিসেবে নাযিল করা হয়েছে। হিদায়াত করাকে আল্লাহ নিজের দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তবে এই হিদায়াত গ্রহণ করা না করা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার বিষয়। যারা তা গ্রহণ করে, তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত হয় আর তা গ্রহণ করে না তারা পথভ্রষ্ট হয়।
আল্লাহ কাদেরকে হিদায়াত দিবেন এবং কাদেরকে পথভ্রষ্ট করবেন সেই বিষয়ে আল্লাহর ইচ্ছা বলতে আল্লাহর নির্ধারিত নীতিমালাকে বুঝায়। অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর নীতিমালা অনুযায়ী যে হিদায়াত পাওয়ার উপযুক্ত তাকে হিদায়াত করেন এবং যে পথভ্রষ্ট হওয়ার উপযুক্ত তাকে পথভ্রষ্ট করেন। তাঁর ইচ্ছা বা নীতিমালা তাঁর ন্যায়বিচার ও বিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কিত। তিনি না জ্ঞান ও বিচক্ষণতা এবং ন্যায়বিচার লঙ্ঘনমূলকভাবে ইচ্ছা বা নীতিমালা প্রণয়ন করেন না। তাঁর নীতিমালা অনুযায়ী যে হিদায়াত পেতে চায় বা সত্যকে গ্রহণ করার ইচ্ছা করে ও সেজন্য আত্মনিয়োগ করে তিনি তাকে হিদায়াত করার ইচ্ছা করেন এবং তার জন্য সঠিক পথে চলা সহজ করে দেন। পক্ষান্তরে যে হিদায়াত চায় না বা যার সামনে সত্য আসলে সে তা প্রত্যাখ্যান করে বা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বাঁকা পথ বা পথভ্রষ্টতা অবলম্বন অবলম্বন করে, তিনি তার অন্তরকে বাঁকা করে দেন বা তাকে পথভ্রষ্ট করেন।
এ বিষয়ে থাকা কয়েকটি আয়াত নিম্নরূপ-
৪:১৬৫ :: রসূলগণ হচ্ছেন সুসংবাদদানকারী ও ভয়প্রদর্শনকারী যেন না থাকে মানুষের জন্য আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্কের/অভিযোগের অবকাশ, রসূলগণের আগমনের পর। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।
৬:১২৪ :: আর যখন তাদের কাছে আসে কোনো আয়াত, তখন তারা বলে, “আমরা বিশ্বাস করবো না যতক্ষণ না আমাদেরকে দেয়া হবে উহার অনুরূপ যা দেয়া হয়েছে আল্লাহর রসূলদেরকে।” আল্লাহ ভালো জানেন তিনি কোথায় তাঁর রিসালাত অর্পণ করবেন। যারা অপরাধ করেছে শীঘ্রই তাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে লাঞ্চনা ও কঠিন শাস্তি আপতিত হবে, তারা (সত্যের বিরুদ্ধে) যে কৌশল করতো তার কারণে।
৬:১০৪ :: নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছে চক্ষু উন্মোচন (সত্য দর্শনের উপায়), তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে। সুতরাং যে দেখবে, তাহলে তা তার নিজের জন্যই (উপকারী) হবে আর যে নিজেকে অন্ধ করে রাখবে, উহা তার নিজেরই বিপক্ষে যাবে। আর আমি (রসূল) তোমাদের উপর হিফাযাতকারী নই।
৯২:৫-১০ :: অতএব যে দান করে, স্রষ্টা-সচেতন হয় এবং উত্তম ব্যবস্থাকে সত্য সাব্যস্ত করে, আমি তাকে সহজ করে দেবো সহজ (বিবেকসঙ্গত) ব্যবস্থার জন্য। আর যে কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয় এবং উত্তম ব্যবস্থাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে, আমি তাকে সহজ করে দেবো কঠিন (বিবেকবিরুদ্ধ) ব্যবস্থার জন্য (সে সহজে নৈতিকতাকে লঙ্ঘন করে চলবে)।
৫:১৩ :: সুতরাং তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার কারণে আমরা তাদেরকে অভিশাপ দিয়েছি আর আমরা তাদের কলবসমূহকে করেছি কঠিন। তারা (তাওরাত/ ইনজীলের) বাক্যকে বিকৃত করে তার স্থান থেকে। আর তারা ভুলে গেছে তা থেকে একটি (বড়) অংশ যা তাদেরকে যিকর (স্মরণীয় তথ্য ও বিধিবিধান) হিসাবে দেয়া হয়েছে। আর তুমি সবসময় উদিত/ অবগত হবে তাদের খেয়ানতের/ বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়ে, তাদের মধ্যকার অল্প কয়েকজনের ব্যাপারে ছাড়া। সুতরাং তুমি তাদেরকে উদারতা দেখাও আর তাদেরকে উপেক্ষা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ভালোবাসেন উত্তম আচরণকারীদেরকে।
৬১:৫ :: আর যখন মূসা বলেছিল তার ক্বওমকে, “কেন তোমরা আমাকে কষ্ট দাও? অথচ নিশ্চয় তোমরা জানো যে, আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর রসূল।” তারপর যখন তারা বক্রতা অবলম্বন করেছে, তখন আল্লাহ বক্র করে দিয়েছেন তাদের অন্তরসমূহকে। আর আল্লাহ হিদায়াত করেন না ফাসিক্ব ক্বওমকে।
৯:১২৭ :: আর যখন নাযিল করা হয় কোন সূরা তাকিয়ে দেখে তাদের একে অন্যের দিকে। (তারা বলে), “তোমাদেরকে কি দেখে গেছে কেউ?” তারপর তারা সরে পড়ে। আল্লাহ সরিয়ে দিয়েছেন তাদের কলবসমূহকে, কারণ তারা এমন ক্বওম, যারা উপলব্ধি করে না।
৬:১২৫ :: সুতরাং যাকে আল্লাহ ইচ্ছা করেন যে, তাকে হিদায়াত করবেন, প্রশস্ত করে দেন তার মস্তিষ্ক ইসলামের জন্য। আর যাকে তিনি ইচ্ছা করেন যে, তাকে পথভ্রষ্ট করবেন, বানিয়ে দেন তার মস্তিষ্ককে অত্যন্ত সংকীর্ণ, যেন (সে ইসলামের অনুসরণ করার অর্থ হলো) সে অতি কষ্টে আরোহন করতে হচ্ছে আকাশের দিকে। এভাবে আল্লাহ চাপিয়ে দেন অপবিত্রতা/ কলুষতা তাদের উপর যারা বিশ্বাস করে না।
উপরোক্ত ৬:১২৫ আয়াতে আল্লাহ যাকে হিদায়াত করতে ইচ্ছা করেন এবং যাকে পথভ্রষ্ট করতে ইচ্ছা করেন তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহর কর্মনীতি বলা হয়েছে। আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ কাদের উপর কলুষতা চাপিয়ে দেন সেই বিষয়ে বলা হয়েছে যে, যারা নিদর্শননির্ভর বিশ্বাস করে না, তাদের উপর তিনি কলুষতা চাপিয়ে দেন। সুতরাং আল্লাহ কাউকে হিদায়াত করা ও পথভ্রষ্ট করার ইচ্ছা করার বিষয়টিতে মানুষের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার গুরুত্ব রয়েছে। অন্য কথায়, মানুষ হিদায়াত পাওয়া না পাওয়ার জন্য আল্লাহর নির্ধারিত শর্ত পূরণ করা আবশ্যক। যদি সে হিদায়াত পেতে হয়, তাহলে তাকে হিদায়াত পাওয়ার উপায় অবলম্বন করতে হবে, তাহলে আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী সে হিদায়াত পেতে পারবে।
আল্লাহ কাদেরকে হিদায়াত করেন এবং কাদেরকে হিদায়াত করেন না বা পথভ্রষ্ট করেন
কুরআন থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, আল্লাহ তাদেরকেই হিদায়াত করেন, যারা ঈমান আনে, আল্লাহর অভিমুখী হয়, আল্লাহর হিদায়াত পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা করে আল্লাহ তাদেরকেই হিদায়াত করেন।
অন্যদিকে আল্লাহ তাদেরকে হিদায়াত করেন না যারা মুশরিক, মুনাফিক্ব, কাফির, ফাসিক্ব, যালিম, ধর্মগুরু, বাপদাদা ও অধিকাংশের অন্ধ অনুসারী, তাগুতের অনুসারী, প্রবৃত্তির অনুসারী ও চোখ থাকতেও অন্ধের মতো পথ চলে। হিদায়াত হলো জীবপতের সঠিক গন্তব্যের পথনির্দেশ করার জন্য সেট করা সাইনপোস্ট, কিন্তু যদি কেউ সেগুলো না পড়াকে বেছে নেয় বা সেগুলোকে উপেক্ষা করে তাহলে সে হিদায়াত পেতে পারে না।
আল্লাহ কাউকে পথভ্রষ্ট করার কারণ ও ধরন
আল্লাহ কাউকে পথভ্রষ্ট করার কারণ ও ধরন সম্পর্কে বুঝার জন্য নিম্নে কিছু প্রাসঙ্গিক আয়াত ও তার আনুষঙ্গিক আলোচনা উপস্থাপন করা হলো।
২:২৬ :: নিশ্চয় আল্লাহ লজ্জাবোধ করেন না পেশ করতে (উহার) উপমা, যা মশা, সেই সাথে (উহার) উপমা যা (ক্ষুদ্রতায়) তার চেয়ে বড় (অর্থাৎ ক্ষুদ্রতর)। সুতরাং ব্যাপার এই যে, যারা বিশ্বাস করেছে তখন তারা জানে নিশ্চয় তা সঠিক তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে। আর ব্যাপার এই যে, যারা অবিশ্বাস করেছে তখন তারা বলে, কি ইচ্ছা করেছেন আল্লাহ এই উপমা দ্বারা? তিনি পথভ্রষ্ট করেন তা (উপমা) দ্বারা অনেককে আর তিনি হিদায়াত করেন তা (উপমা) দ্বারা অনেককে। আর তিনি বিভ্রান্ত করেন না তা দ্বারা ফাসিক্বদের ছাড়া অন্যদেরকে।
আলোনা : উল্লেখিত আয়াত থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ ফাসিক্বদেরকে উদাহরণের মাধ্যমে পথভ্রষ্ট করেন। অর্থাৎ আল্লাহ পথভ্রষ্ট করার কারণে তারা ফাসিক্ব নয়, বরং তারা ফাসিক্ব হওয়ার কারণে আল্লাহ তাদেরকে পথভ্রষ্ট করেন। এটা আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নীতিমালা যে, যে ব্যক্তি তার মনোভাবে সত্যাগ্রহ রাখে না, সে বিভিন্ন উদাহরণের সঠিক তাৎপর্য পরিগ্রহণ করে না, বরং তা তার পথভ্রষ্টতার জন্য সহায়ক হয় এবং সে পথভ্রষ্ট হয়। এভাবে আল্লাহ প্রাকৃতিক নিয়মে কাউকে পথভ্রষ্ট করেন। যেহেতু এভাবে পথভ্রষ্ট হওয়ার পেছনে সে ব্যক্তি নিজেই দায়ী অর্থাৎ সে ফাসিক্ব হওয়ার কারণে তাকে আল্লাহ নিজ তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মে পথভ্রষ্ট করেন, এজন্য এভাবে তাকে পথ্রভ্রষ্ট করা দোষনীয় নয়। বরং এভাবে তাকে পথভ্রষ্ট করা তাকে দেয়া ইচ্ছার স্বাধীনতার স্বাভাবিক ফলশ্রুতি, যাতে তাকে পথভ্রষ্ট করার মানে হলো হিদায়াতের শর্ত পূরণ না করার অনিবার্য ফলাফলস্বরূপ তার পথভ্রষ্ট হওয়ার নিয়মকে কার্যকর রাখা।
৩:৮৬ :: কিরূপে আল্লাহ হিদায়াত করবেন (এরূপ) কোনো সম্প্রদায়কে যারা অবিশ্বাস করেছে তারা বিশ্বাস করার পর, অথচ তারা সাক্ষ্য দিয়েছিলো যে, এই রসূল সঠিক। আর তাদের কাছে এসেছে স্পষ্ট যুক্তি-প্রমাণ। আর আল্লাহ হিদায়াত করেন না যালিম ক্বওমকে।
আলোচনা : উল্লেখিত আয়াতে “আল্লাহ কিভাবে সেই সম্প্রদায়কে হিদায়াত করবেন, যারা …” অভিব্যক্তির মাধ্যমে তাদেরকে হিদায়াত না করার কারণ উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। যতক্ষণ তারা সেই কারণ থেকে নিজেদেরকে পৃথক করবে না, ততক্ষণ তারা হিদায়াত পাবে না। কিন্তু যদি তারা তাদেরকে পৃথক করে নেয়, তবে তাদের জন্য হিদায়াতের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়ে যায়। যদি তারা আল্লাহর পথ খোঁজার ও তা বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তখন তারা হিদায়াত পেতে পারে। এজন্য তাদেরকে কুরআন দ্বারা উপদেশ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতটি লক্ষ্যণীয়-
৬:৭০ :: আর ছেড়ে দাও তাদেরকে যারা গ্রহণ করেছে তাদের জীবনব্যবস্থাকে খেলা ও কৌতুক হিসাবে, আর তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেছে পার্থিব জীবন। আর তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দাও উহা (কুরআন) দিয়ে যেন না ধ্বংসে নিক্ষিপ্ত হয় কোনো ব্যক্তি উহার কারণে যা সে উপার্জন করেছে (অর্থাৎ যেন তারা তাদের কৃতকর্মকে সংশোধন করে নিতে পারে)। তার জন্য নেই আল্লাহ ছাড়া কোনো অভিভাবক আর (আল্লাহ ছাড়া) কোনো (স্বাধীন) সুপারিশকারীও নেই। আর যদি সে সব ধরণের মুক্তিপণও দেয়, তার থেকে তা গ্রহণ করা হবে না। এরাই তারা, যারা ধ্বংসের শিকার হয়েছে তাদের কৃতকর্মের দরুন। তাদের জন্য রয়েছে ফুটন্ত পানীয় এবং বেদনাদায়ক শাস্তি, যেহেতু তারা অবিশ্বাস/অস্বীকার করতো।
আসমাউল হুসনার মধ্যে ‘মুদিল্লু’ (পথভ্রষ্টকারী) নেই
কুরআনে আল্লাহর আসমাউল হুসনা বা সুন্দরতম নামসমূহের মধ্যে ‘হাদ’ (হিদায়াতকারী) রয়েছে (২২:৫৪, ২৫:৩১)। কিন্তু ‘মুদিল্লু’ (পথভ্রষ্টকারী) নেই। এর কারণ হলো কোনো ব্যক্তি পথভ্রষ্টতার নীতি অবলম্বন না করা সত্ত্বেও তাকে পথভ্রষ্ট করা আল্লাহর ইচ্ছা নয় এবং তিনি এভাবে কাউকে পথভ্রষ্ট করেন না। ‘আল্লাহ কাউকে পথভ্রষ্ট করার ইচ্ছা করা’-র অর্থ হলো, ‘কোনো ব্যক্তি আল্লাহর তৈরি নীতিমালা অনুযায়ী পথভ্রষ্ট হওয়ার উপযোগী হওয়া’ এবং তিনি কাউকে পথভ্রষ্ট করার অর্থ হলো ‘কোনো ব্যক্তি আল্লাহর বিধানকে গ্রহণ না করার মাধ্যমে পথভ্রষ্ট হওয়া’।
অন্যদিকে শয়তান মানুষকে সত্য পথ থেকে পথভ্রষ্ট করতে চায় ও পথভ্রষ্ট করে এবং তাই সে ‘মুদিল্লু’ (পথভ্রষ্টকারী) হিসেবে আখ্যায়িত। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াত দুটি লক্ষ্যণীয়-
৪:৬০ :: তুমি কি দেখো নি তাদের অবস্থা যারা দাবি করে যে, তারা বিশ্বাস করেছে উহার প্রতি যা তোমরা প্রতি নাযিল করা হয়েছে আর ঐসবের প্রতি যা তোমার আগে নাযিল করা হয়েছে? তারা ইচ্ছা করে যে, তারা বিচারপ্রার্থী হবে তাগূতের কাছে। অথচ নিশ্চয় তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো উহার (তাগুতের) প্রতি কুফর করতে/ তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করতে। আর শয়তান ইচ্ছা করে তাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে, সুদূর পথভ্রষ্টতায়।
২৮:১৫ :: আর (একদা) সে (মূসা) শহরে প্রবেশ করলো উহার অধিবাসীরা অসচেতন/ অসতর্ক থাকা অবস্থায়। তারপর সে পেলো উহাতে দুজন পুরুষকে; তারা মারামারি/ দ্বন্দ্ব-সংঘাত করছিলো। এ একজন তার স্বগোত্রের আর এ আরেকজন তার শত্রুদের অন্তর্ভুক্ত। সে তার (মূসার) নিকট সাহায্য চাইলো যে ছিলো তার স্বগোত্রের অন্তর্ভুক্ত, (সাহায্য চাইলো) তার বিরুদ্ধে যে ছিলো তার শত্রুদের অন্তর্ভুক্ত। তখন মূসা তাকে এক ঘুষি মারলো। তার ফলে তার ব্যাপার চুকে গেলো (অর্থাৎ সে মরে গেলো)। তখনি সে (মূসা) বলেছিলো, “ইহা তো শয়তানের কর্মের অন্তর্ভুক্ত। নিশ্চয় সে স্পষ্ট পথভ্রষ্টকারী শত্রু।”
পথভ্রষ্টকারীরাই সবচেয়ে বড় জালিম
৬:১৪৪ :: আর উট শ্রেণী থেকে দুইটি জোড়া আর গরু শ্রেণী থেকে দুইটি জোড়া। বলো, “নর দুটিকেই কি তিনি হারাম করেছেন নাকি মাদী দুটিকে নাকি উহাকে যা মাদী দুটির গর্ভে রয়েছে? নাকি তোমরা ছিলে সাক্ষী, যখন আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন উহার সম্পর্কে? সুতরাং তার চেয়ে বড় জালিম কে হতে পারে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে, মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট করার জন্য (আসমানী কিতাবের) জ্ঞান না থাকার দরুন? নিশ্চয় আল্লাহ হিদায়াত করেন না যালিম ক্বওমকে।”
৫:৭৭ :: বলো, “হে আহলে কিতাব, তোমরা বাড়াবাড়ি করো না তোমাদের জীবনব্যবস্থার ব্যাপারে অন্যায়ভাবে। আর তোমরা অনুসরণ করো না এমন কোনো ক্বওমের প্রবৃত্তির, যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে ইতোপূর্বে এবং পথভ্রষ্ট করেছে অনেককে এবং পথভ্রষ্ট হয়েছে সরল-সোজা পথ থেকে।
১৪:২৮-২৯ :: তুমি কি ভেবে দেখোনি তাদের অবস্থা যারা আল্লাহর নিয়ামাতকে কুফর দ্বারা পরিবর্তন করেছে আর নিক্ষেপ করেছে তাদের কওমকে ধ্বংসযজ্ঞের ঘরে? জাহান্নামে, তারা তাতে জ্বলবে। আর তা অত্যন্ত মন্দ অবস্থানস্থল।
আলোচনা : পথভ্রষ্টকারীরা তাদেরকেই পথভ্রষ্ট করতে পারে যারা হিদায়াত পাওয়ার শর্ত পূরণ করে না। হিদায়াত গ্রহণ করা না করা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার বিষয়। আর জ্ঞান-যুক্তি বা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করে হিদায়াত গ্রহণ করা যায়। অন্যথায় হিদায়াত গ্রহণ করা যায় না।
আল্লাহর পক্ষ থেকে এ বাণী বাস্তবসঙ্গত হয়েছে যে, তিনি মানব এবং জিন জাতি দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করবেন
৩২:১৩-১৪ :: আর যদি আমরা ইচ্ছা করতাম তাহলে আমরা দিতাম প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার হিদায়াত। কিন্তু (শাস্তি সম্পর্কিত) বাণী বাস্তবসঙ্গত হয়েছে আমার পক্ষ থেকে যে, “অবশ্যই আমি পূর্ণ করবো জাহান্নামকে জ্বিন ও মানুষকে দিয়ে একত্রে।“ সুতরাং তোমরা স্বাদ আস্বাদন করো এ কারণে যে, তোমরা ভুলে গিয়েছিলে তোমাদের এ দিনের সম্মুখীন হওয়ার বিষয়ে। নিশ্চয় আমরাও তোমাদেরকে ভুলে গেলাম (অর্থাৎ তোমাদেরকে উপেক্ষা করলাম)। আর তোমরা স্বাদ আস্বাদন করো স্থায়ী শাস্তির, তোমরা যে ধরনের (অপরাধমূলক) কর্ম করতে তার কারণে।
আলোচনা : আয়াতটি থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, জিন ও মানব জাতিকে দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করার বিষয়টি বাস্তবসঙ্গত হয়ে গেছে। প্রশ্ন হলো, এমতাবস্থায় মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তির গুরুত্ব কী? এ প্রশ্নের জবাব হলো, জিন ও মানুষ দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করা হবে, কিন্তু তারা হলো অবাধ্য জিন ও মানুষ। সুতরাং জিন ও মানুষ দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করা হবে তথ্যটি মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তির সাথে সাংঘর্ষিক নয়।
“আল্লাহ কাফিরদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন” তথ্যটির তাৎপর্য
“আল্লাহ কাফিরদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন” এবং অনুরূপ তথ্য সম্বলিত কিছু আয়াত হলো-
২:৬-৭ :: নিশ্চয় যারা অবিশ্বাস/অস্বীকার করে তাদের জন্য সমান যে, তুমি কি তাদেরকে সতর্ক করো নাকি করো না। তারা বিশ্বাস করে না। আল্লাহ তাদের অন্তর এবং তাদের কানসমূহে মোহর মেরে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।
৪:১৫৫ :: তারপর (তারা লা’নতগ্রস্ত হয়েছে) তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে, আর আল্লাহর আয়াতসমূহের প্রতি তাদের অবিশ্বাসের কারণে, আর সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে নবীদেরকে হত্যা করার কারণে, আর তাদের এ কথার জন্য যে, ‘আমাদের কলবসমূহ গিলাফে আচ্ছাদিত’। বরং আল্লাহই মোহর এঁটে দিয়েছেন উহার (তাদের কলবের) উপর তাদের অবিশ্বাসের কারণে। সুতরাং তারা বিশ্বাস করে না, অল্প কয়েকজন ছাড়া।
৬:২৫ :: আর তাদের কেউ তোমার প্রতি কান পেতে শোনে, কিন্তু আমি তাদের অন্তরের উপর রেখে দিয়েছি আবরণ যেন তারা অনুধাবন না করে, আর তাদের কানে রয়েছে বধিরতা। আর যদি তারা প্রতিটি আয়াতও দেখে, তারা তার প্রতি ঈমান আনবে না; এমনকি যখন তারা তোমার কাছে এসে বাদানুবাদে লিপ্ত হয়, যারা কুফর করেছে তারা বলে, “এটা পূর্ববর্তীদের উপকথা ছাড়া কিছুই নয়।”
৯:৮৬-৮৭ :: আর যখন নাযিল করা হয় কোনো সূরা এ নির্দেশসহ যে, “তোমরা বিশ্বাস করো আল্লাহর প্রতি আর সংগ্রাম করো রসূলের সাথে মিলে, তখন তোমার কাছে অনুমতি/ ছুটি চায় তাদের মধ্যকার সামর্থবান লোকেরা। আর তারা বলে, “আমাদেরকে ছেড়ে দিন, আমরা থাকবো বসে থাকা লোকদের সাথে।” তারা সন্তুষ্ট হয়েছে এ ব্যাপারে যে, তারা থাকবে পিছনে সরে থাকা লোকদের অন্তর্ভুক্ত। আর মোহর করা হয়েছে তাদের কলবসমূহের উপর। সুতরাং তারা উপলব্ধি করে না।
৯:৯৩ :: নিশ্চয় (অভিযোগের) পথ আছে তাদের উপর যারা তোমার কাছে অনুমতি/ ছুটি চায় এ অবস্থায় যে, তারা ধনী। তারা সন্তুষ্ট হয়েছে এ ব্যাপারে যে, তারা থাকবে যারা পিছনে সরে থাকে তাদের সাথে। আর আল্লাহ মোহর করে দিয়েছেন তাদের কলবসমূহের উপর। সুতরাং তারা জ্ঞান রাখে না।
১০:৭৪ :: তারপর আমরা সমুত্থিত/ প্রেরণ করেছি তার (নূহের) পরবর্তীতে অনেক রসূল তাদের ক্বওমসমূহের কাছে। তখন তারা তাদের কাছে এসেছে স্পষ্ট যুক্তি-প্রমাণ সহকারে। কিন্তু তারা ছিলো না বিশ্বাস করার ঐ বিষয়ের প্রতি তারা মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলো যার ক্ষেত্রে তার আগেই। এভাবে আমরা মোহর লাগিয়ে দিই সীমালংঘনকারীদের কলবসমূহের উপর।
১৬:১০৬-১০৮ :: যে অবিশ্বাস করে আল্লাহকে তার বিশ্বাসের পরও, সে ছাড়া যাকে বাধ্য করা হয়েছে অথচ তার অন্তর ঈমানে সুদৃঢ় (তবু প্রচন্ড নির্যাতনে বাধ্য হয়ে সাময়িকভাবে বাহ্যত কুফরী বাক্য উচ্চারণ বা কুফরী কার্য করেছে); কিন্তু (এদের কথা নয় বরং) যে উন্মুক্ত রাখে কুফরের জন্য তার সম্মুখ মস্তিষ্কের অগ্রভাগকে, তাদের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে গযব পড়বে, আর তাদের জন্য আছে মহাশাস্তি। উহা এজন্য যে, তারা পছন্দ করেছে পার্থিব জীবনকে আখিরাতের তুলনায়। আর এজন্যও যে, আল্লাহ হিদায়াত করেন না কাফির ক্বওমকে। তারাই ঐসব লোক আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন যাদের কলবসমূহের উপর আর যাদের শ্রবণশক্তির উপর আর যাদের দৃষ্টিশক্তির উপর, আর তারাই উদাসীন।
১৭:৪৫-৪৬ :: আর যখন তুমি পাঠ করো আল কুরআন, তখন আমরা স্থাপন করি তোমার ও তাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস করে না আখিরাতের প্রতি, (স্থাপন করি) পর্দার আড়াল। আর আমরা স্থাপন করি তাদের কলবসমূহের উপর আবরণ, যেন না তারা উহা (কুরআন) উপলব্ধি করে; আর তাদের কানসমূহে আছে বধিরতা। আর যখন তুমি স্মরণ করো তোমার প্রভুকে কুরআনের মধ্যে তাঁর একত্ববাদের বিষয়ে, তখন তারা ফিরে যায় তাদের পিঠের দিকে, বিরাগবশত: পলায়নী মনোবৃত্তিতে।
৩০:৫৮-৫৯ :: আর নিশ্চয় আমরা পেশ করেছি মানবজাতির জন্য এই কুরআনে প্রত্যেক প্রকার দৃষ্টান্ত। আর যদি তুমি তাদের কাছে নিয়ে আসো কোনো আয়াত, তাহলেও তারা বলে যারা কুফর করেছে, “তোমরা নও বাতিলপন্থী ছাড়া অন্য কিছু।” এরূপে আল্লাহ মোহর করে দেন তাদের কলবসমূহের উপর যারা জেনে নেয় না।
৪০:৩৫ :: যারা বিতর্ক করে আল্লাহর আয়াতসমূহের ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো দলীল-প্রমাণ আসা ছাড়াই, তাদের এ কাজ অত্যন্ত ক্রোধের বিষয় আল্লাহর কাছে এবং তাদের কাছে যারা বিশ্বাস করেছে। এরূপেই আল্লাহ মোহর করে দেন প্রত্যেক অহংকারী ও স্বৈরাচারী (ব্যক্তির) কলবের উপর।
৪১:৫ :: আর তারা বলে, “আমাদের কলবসমূহ পর্দাসমূহের মধ্যে আছে, যেদিকে তোমরা আমাদেরকে ডাকছো তা থেকে। আর আমাদের কানসমূহে আছে বধিরতা। আর আমাদের ও তোমার মধ্যে আছে পর্দা/অন্তরায়। সুতরাং তুমি তোমার কাজ করো। নিশ্চয় আমরাও আমাদের কার্যসম্পন্নকারী।”
৪৫:২৩ :: তুমি কি ভেবে দেখেছো যে গ্রহণ করেছে তার ইলাহ হিসাবে তার প্রবৃত্তিকে, আর আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন জ্ঞানের ভিত্তিতে, আর তিনি মোহর করে দিয়েছেন তার কানের উপর ও তার কলবের উপর, আর তিনি রেখে দিয়েছেন তার চোখের উপর পর্দা। সুতরাং কে তাকে হিদায়াত করবে আল্লাহর পরে? তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না?
৪৭:১৬ :: আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ তোমার কথা শুনতে থাকে। শেষ পর্যন্ত যখন তারা বের হয়ে যায় তোমরা নিকট থেকে, তখন তারা বলে তাদের কাছে যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছিল, (বলে যে,) “কী তিনি বলেছিলেন এইমাত্র?” তারা এমন লোক আল্লাহ মোহর করে দিয়েছেন যাদের কলবসমূহের উপর, আর তারা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে।
৪৭:২০-২৩ :: আর যারা ঈমান এনেছে তারা বলে, ‘একটি সূরা নাযিল হয় না কেন?’ অতঃপর যদি কোনো মুহকাম (দ্ব্যর্থহীন) কোনো সূরা নাযিল হয় এবং তাতে যুদ্ধের কোনো নির্দেশ থাকে তুমি দেখবে যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা মৃত্যুভয়ে বিহ্বল মানুষের মত তোমার দিকে তাকাচ্ছে। সুতরাং তাদের জন্য দুর্ভোগ! আনুগত্য ও ন্যায়সঙ্গত কথা। অতঃপর যখন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়, তখন যদি তারা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা সত্যে পরিণত করতো, তবে তা তাদের জন্য কল্যাণকর হতো। তবে কি তোমরা তোমাদের ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লা'নত করেছেন, ফলে তিনি তাদের বধির করেন এবং তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করেন।
৩৬:৭-১১ :: নিশ্চয় তাদের অধিকাংশের উপর (প্রভুর) বাণী সত্য হলো। তাই তারা বিশ্বাস করে না। নিশ্চয় আমরা স্থাপন করেছি (পরিয়ে দিয়েছি) তাদের গলাসমূহে বেড়িসমূহ, তারপর তা চিবুকসমূহ পর্যন্ত (শৃংখলিত থাকে)। ফলে তারা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে আছে। আর আমরা স্থাপন করেছি তাদের সামনে একটি প্রাচীর এবং তাদের পিছনে একটি প্রাচীর। এভাবে আমরা তাদেরকে আচ্ছাদিত করেছি। সুতরাং তারা দেখতে পায় না। আর তাদের উপর সমান যে, তুমি কি তাদেরকে সতর্ক করেছো নাকি তুমি তাদেরকে সতর্ক করোনি?, তারা বিশ্বাস করে না। নিশ্চয় তুমি সতর্ক করতে পারো তাকে যে যিকর (স্মরণীয় তথ্য ও বিধিবিধান) অনুসরণ করে আর দয়াময়কে (আল্লাহকে) ভয় করে, অদেখা সত্ত্বেও। সুতরাং তুমি তাকে সুসংবাদ দাও ক্ষমার ও সম্মানজনক রিজিক্বের।
আলোচনা : উপরোল্লেখিত ৩৬:৭-১১ আয়াতে ‘তাদের উপর বাণী সত্য হলো’ তথ্যটির অর্থ হলো, ‘যারা সত্য গ্রহণের জন্য বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করে না তারা সত্যকে গ্রহণ করতে পারে না’ এই বাণী তাদের উপর সত্য হলো। প্রাসঙ্গিক আয়াত হিসেবে ১০:১০০ আয়াতটি দ্রষ্টব্য, যাতে বলা হয়েছে যে, “আর কারো জন্য আল্লাহ্র অনুমতি ছাড়া ঈমান আনা সম্ভব নয় এবং যারা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করে না আল্লাহ্ তাদের উপর কলুষতা চাপিয়ে দেন।” একইভাবে উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের শেষটিতে (৩৬:১১) কাদের জন্য উপদেশ কাজে আসবে তা বলা হয়েছে। সুতরাং যারা এরূপ নয়, তারা উপদেশ সত্ত্বেও ঈমান আনবার নয়।
সুতরাং আল্লাহর পথনির্দেশ লাভের জন্য নিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী মনোভাব পোষণ করতে হবে। অন্যথায় সঠিক পথনির্দেশ অনুসরণ করা বাস্তবে অসম্ভব।
অন্যদিকে ‘যদি আপনি চোখ বন্ধ রাখেন, তাহলে আপনি অন্ধকারে থাকবেন’। তাহলে এরূপ অবস্থায় কেন আপনি অন্ধকারে আছেন? আপনার কর্মের স্বাভাবিক ফল হিসেবে। কিন্তু এটা কিভাবে ঘটে? আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে। তাই বলা যেতে পারে, আল্লাহ তাঁর প্রাকৃতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে আপনাকে অন্ধকারে রেখেছেন। বিষয়টি বুঝার জন্য নিম্নের আয়াতগুলো লক্ষ্যণীয়।
৫১:৯ :: তাকেই বিমুখ করা হয় যে বিমুখ হয়।
৯:১২৭ :: আর যখন নাযিল করা হয় কোনো সূরা তাকিয়ে দেখে তাদের একে অন্যের দিকে। (তারা বলে,) “তোমাদেরকে কি দেখে গেছে কেউ?” তারপর তারা সরে পড়ে। আল্লাহ সরিয়ে দিয়েছেন তাদের কলবসমূহকে, কারণ তারা এমন কওম, যারা উপলব্ধি করে না।
৪৭:২৪ :: তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না, নাকি তাদের হৃদয়ের উপর তালা লাগানো রয়েছে?
৮৩:১৪ :: কখনো না। বরং তারা যা উপার্জন করতো (যে মন্দকর্ম করতো) তা-ই তাদের অন্তরের উপর মরিচা ধরিয়েছে।
মুশরিকরা দাবি করে যে, আল্লাহর ইচ্ছার কারণেই তারা শিরক ও অশ্লীল কাজ করে, তারা ভাগ্যের হাতে বন্দি, তাই এক্ষেত্রে তাদের কিছু করার নেই বা তারা দায়ী নয়। কিন্তু কুরআন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, আল্লাহ কাউকে শিরকে বাধ্য করেন না বরং তিনি তো মানুষকে একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করার নির্দেশ দিয়ে থাকেন, অনুরূপভাবে তিনি কোনো অশ্লীল নির্দেশ দেন না। সুতরাং আল্লাহ কাউকে পথভ্রষ্টতায় বাধ্য করেন না। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতগুলো লক্ষ্যণীয়।
৭:২৮ :: আর যখন তারা কোনো অশ্লীল কাজ করে, তখন তারা বলে, “আমরা পেয়েছি উহার উপর আমাদের বাপদাদাকে। আর আল্লাহ আমাদেরকে উহার প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।” বলো, “নিশ্চয় আল্লাহ নির্দেশ দেন না অশ্লীল কাজের জন্য। তোমরা কি বলছো আল্লাহর সম্বন্ধে (এমন কথা) যা (আল্লাহ বলেছেন কিনা তা) তোমরা জানো না?”
৯৮:৫ :: অথচ তাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছিলো জীবনব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ মনে একনিষ্ঠভাবে কেবল আল্লাহর দাসত্ব করার জন্য।
আল্লাহ কোনোভাবে কাউকে অন্যায়ে বাধ্য করেন না। যদি কারো অন্তরে ও কানে মোহর মেরে দেয়া হয়, চোখে আবরণ ফেলে দেয়া হয় আর এ কারণে তারা হিদায়াত গ্রহণ করতে না পারে তাহলে তো তাকে পথভ্রষ্টতার ক্ষেত্রে বাধ্য করা হলো এবং সে দায়ী হলো না। সুতরাং এরূপ উপলব্ধি গ্রহণযোগ্য নয়।
বস্তুত আল্লাহ কারো অন্তরে ও কানে মোহর মেরে দেন এবং চোখে আবরণ ফেলে দেন একটি প্রাকৃতিক নিয়মের মাধ্যমে। ঐ নিয়মটি নিম্নরূপ :
প্রথমে বুঝতে হবে যে, বিবেক-বুদ্ধি উৎকর্ষিত ও অবদমিত হয়। আর মানুষের মস্তিষ্কে যদি একটি বিষয়ে আগে থেকে কোনো ধারণা না থাকে (বা তাকে বিষয়টি বাস্তব ধারণা দেয়ার ব্যবস্থা না থাকে), তাহলে চোখ সেটি দেখে না অর্থাৎ দেখেও তার প্রকৃত অর্থ বা তাৎপর্য বুঝতে পারে না বা তা চিহ্নিত করতে পারে না। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতগুলো লক্ষণীয় :
৯১:৭-১০ :: আর নফসের/ (মানবীয়) ব্যক্তিসত্তার ও তাঁর যিনি উহাকে (নফসকে) সুবিন্যস্ত করেছেন। তারপর তাকে ইলহাম/ অতিপ্রাকৃতিকভাবে ভাবপ্রবণ, বোধশক্তিসম্পন্ন ও ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন করেছেন তার ফুজূর (পাপ) ও তার তাকওয়া (সংযত আচরণের) ব্যাপারে। নিশ্চয় সে-ই সফল হয়েছে যে তাকে (নফসকে/ নিজেকে) পরিশুদ্ধ করেছে। আর নিশ্চয় সে-ই ব্যর্থ হয়েছে যে তাকে (নফসকে/ নিজেকে) কলুষিত করেছে।
২২:৪৬ :: তবে কি তারা পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি ? তাহলে তাদের এমন ক্বলব/মন হতো যা দিয়ে তারা Common sense ব্যবহার করতে পারতো (Common sense ব্যবহার করে সাধারণ জ্ঞান অর্জন করতে পারতো) এবং এমন কান হতো যা দিয়ে তারা (সঠিক তথ্য) শুনতো। সুতরাং নিশ্চয় উহা তো (এই বাস্তবতার প্রতিফলন যে, এক্ষেত্রে) চোখ অন্ধ নয়, কিন্তু মনই অন্ধ হয়, যা আছে স্নায়ুকেন্দ্ররূপ সম্মুখ মস্তিষ্কের অগ্রভাগে।
মানুষের মস্তিষ্ককে কম্পিউটারের (বর্তমান যুগের যান্ত্রিক জ্ঞানের শক্তি) সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কম্পিউটারে ভাইরাস ঢুকলে তার কর্মশক্তি হ্রাস পায় এবং Hang হয়ে যায়। অনুরূপভাবে মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে অবদমিত করার মতো মন্দ চিন্তা-ভাবনা ও ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণার অনুপ্রবেশ ও তার চর্চা করতে থাকলে এক পর্যায়ে বিবেক-বুদ্ধি অবদমিত হয়ে যায়। আর এটিকেই রূপকভাবে ‘চোখ-কান-অন্তরে মোহর মেরে দেয়া’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাদেরকে বিবেক-বুদ্ধিকে একটা প্রাকৃতিক নিয়মে অবদমিত করে দেন তথা প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে তাদের বিবেক-বুদ্ধি অবদমিত হয়ে যায়। আর এর ফলে বিবেক-বুদ্ধির কাছে কুরআনের বার্তা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে যায়।
৯২:৫-১০ :: অতএব যে দান করে, স্রষ্টা-সচেতন হয় এবং উত্তম ব্যবস্থাকে সত্য সাব্যস্ত করে, আমি তাকে সহজ করে দেবো সহজ (বিবেকসঙ্গত) ব্যবস্থার জন্য। আর যে কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয় এবং উত্তম ব্যবস্থাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে, আমি তাকে সহজ করে দেবো কঠিন (বিবেকবিরুদ্ধ) ব্যবস্থার জন্য (সে সহজে নৈতিকতাকে লঙ্ঘন করে চলবে)।
‘আল্লাহ কাফিরদের অন্তরে মোহর মেরে দেন’ এবং অনুরূপ তথ্যের প্রেক্ষিতে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে যে, “এমতাবস্থায় তাদের ঈমান না আনার কারণে বা পথভ্রষ্টতার জন্য তো আল্লাহকেই দায়ী বলে বুঝা যায়, তাহলে এজন্য মানুষকে কিভাবে দায়ী করা যেতে পারে বা তাদেরকে শাস্তি দেয়া যৌক্তিক হতে পারে?”
এ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ যথাযথভাবে অধ্যয়ন করলে স্পষ্ট হয় যে, এই অন্তরে মোহর মেরে দেয়ার বিষয়টি ঘটে থাকে তাদের কুফরীর কারণে। সুতরাং বিষয় হলো, তারা প্রথমে ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানায় তারপর তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়, তারপর তারা ঈমান আনতে পারে না। যদি অন্তরে মোহর মেরে দেয়ার বিষয়টি অস্থায়ী হয়ে থাকে, তথা পরবর্তীতে মোহর সরিয়ে নেয়া হয়, তাহলে তাদের পক্ষে ঈমান আনা সম্ভব হতে পারে। কারণ কাফিরদের মধ্য থেকেও কেউ কেউ ঈমান এনে থাকে এবং তাদেরকে তাদের কুফর ত্যাগ করার জন্য আহবান করা হয়ে থাকে। কিন্তু কারো ক্ষেত্রে এই মোহর মেরে দেয়ার বিষয়টি স্থায়ী হতে পারে। অস্থায়ী বা স্থায়ী যা-ই হোক, তা তাদের মনোভাবের সাথে সঙ্গতিশীল হয়ে থাকে। সুতরাং এক্ষেত্রে বস্তুত তারা নিজেরাই দায়ী।
পরিশেষে বলা যায় যে, হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতার ক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছা ও ভূমিকা তাঁর তৈরি নীতিমালাকেই বর্ণনা করে। আর এ বিষয়ে নীতিমালা হলো, হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতার ক্ষেত্রে মানুষকে তাদের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার ভিত্তিতেই হিদায়াত করা হয় বা পথভ্রষ্ট করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, আল্লাহ-প্রদত্ত ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা অনুসারে মানুষ স্বেচ্ছায় হিদায়াত গ্রহণ করে বা পথভ্রষ্ট হয়। হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতা বিষয়ক আয়াতসমূহে ভাগ্যবাদকে নয়, বরং হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতার বিষয়টি যে, আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার আওতায় সংঘটিত হয়- সে কথাটিই তুলে ধরা হয়েছে। যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে সবাইকে হিদায়াত অবলম্বনে বাধ্য করতে পারতেন, কিন্তু স্বেচ্ছায় এ বিষয়ে মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন।
বিভিন্ন আয়াতে বলা হয়েছে যে, “আল্লাহ যাকে (ক্ষমা করার) ইচ্ছা করেন তাকে ক্ষমা করেন। আর তিনি যাকে (শাস্তি দেয়ার) ইচ্ছা করেন তাকে শাস্তি দেন।”
প্রশ্ন হলো, এটা কি সম্ভব যে, দুজন ব্যক্তি একই ধরনের প্রেক্ষাপটে একই ধরনের ও একই মাত্রার দোষ করলো, তারপর আল্লাহ তাদের একজনকে ক্ষমা করে দিলেন এবং একজনকে শাস্তি দিলেন? এর উত্তর হলো, না। কারণ, সেক্ষেত্রে জুলুম হয়। আর আর আল্লাহ জুলুম করেন না।
সুতরাং যে ধরনের দোষ করলে আল্লাহ কাউকে শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা করবেন, সেই ধরনের দোষ করা প্রত্যেক ব্যক্তিকে তিনি শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা করবেন।
অনুরূপভাবে যে ধরনের দোষ করলে বা দোষ করার পর যে ধরনের শর্ত পূর্ণ হলে তিনি কাউকে ক্ষমা করার ইচ্ছা কররবেন, সেই ধরনের সকল ব্যক্তিকে তিনি ক্ষমা করার ইচ্ছা করবেন।
আর এটাই হলো, কোনো নীতিমালা বজায় রেখে বা প্রতিশ্রুতি পালন করে করা ইচ্ছা।
আল্লাহ তাঁর তৈরি ও ঘোষিত ক্ষমা ও শাস্তির নীতিমালা ও তাঁর প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যাকে ক্ষমা করার ইচ্ছা করবেন তাকেই ক্ষমা করবেন এবং যাকে শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা করবেন, তাকেই শাস্তি দিবেন।
নিম্নে এ বিষয়টি অনুধাবনের জন্য প্রাসঙ্গিক কতিপয় আয়াত উল্লেখ করা হলো-
২:২৮৪ :: আল্লাহরই অধিকারভুক্ত যা আছে আসমানসমূহে আর যা আছে জমিনে। আর যদি তোমরা প্রকাশ করো যা আছে তোমাদের মনে অথবা তা গোপন রাখো, আল্লাহ তোমাদের থেকে তার হিসাব নেবেন। তারপর তিনি মাফ করবেন যাকে তিনি (মাফ করার) ইচ্ছা করবেন আর তিনি শাস্তি দিবেন যাকে তিনি (শাস্তি দেবার) ইচ্ছা করবেন। আর আল্লাহ সকল সত্তা ও বিষয়ের উপর সর্বশক্তিমান/ নীতি নির্ধারণকারী।
২৯:২১ :: তিনি শাস্তি দেন যাকে তিনি (শাস্তি দেয়ার) ইচ্ছা করেন। আর তিনি দয়া করেন যাকে তিনি (দয়া করার) ইচ্ছা করেন। আর তাঁরই দিকে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।
১৭:৫৪ :: তোমাদের রব জানেন তোমাদের সম্পর্কে। যদি তিনি ইচ্ছা করেন তোমাদেরকে দয়া করবেন অথবা যদি তিনি ইচ্ছা করেন তোমাদেরকে শাস্তি দিবেন। আর আমরা তোমাকে প্রেরণ করিনি তাদের উপর (সঠিক পথ বেছে নিতে বাধ্য করার জন্য) কর্মবিধায়ক করে।
৩:১২৮-১২৯ :: তোমার অধিকার নেই (ব্যক্তিগতভাবে) সিদ্ধান্ত গ্রহণের, কিছুমাত্রও। হয়তো তিনি তাদের তাওবাহ কবুল করবেন নয়তো তিনি তাদেরকে শাস্তি দিবেন। তবে নিশ্চয় তারা অত্যাচারী। [অর্থাৎ তারা এখন পর্যন্ত যালিম হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তাদেরকে অনতিবিলম্বে তাওবাহ করা (৪: ১৭-১৮) বা আযাবের জন্য প্রস্তুত থাকার দুটি পথের একটিকে বেছে নেয়ার সুযোগ দেবেন]। আর আল্লাহরই অধিকারভুক্ত যা আছে আসমানসমূহে ও যা আছে জমিনে। তিনি ক্ষমা করেন যাকে তিনি (ক্ষমা করার) ইচ্ছা করেন। আর তিনি শাস্তি দেন যাকে তিনি (শাস্তি দেয়ার) ইচ্ছা করেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল-দয়ালু।
৫:১৮ :: আর ইয়াহুদ ও নাসারা বলেছে, ‘আমরা আল্লাহর পুত্র আর তাঁর প্রিয়পাত্র’। বলো, ‘তাহলে কেন তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দেন তোমাদের পাপের কারণে? বরং তোমরা তাদেরই মতো মানুষ যাদেরকে তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি ক্ষমা করেন যাকে তিনি (ক্ষমা করার) ইচ্ছা করেন আর তিনি শাস্তি দেন যাকে তিনি (শাস্তি দেয়ার) ইচ্ছা করেন। আর আল্লাহরই জন্য আসমানসমূহ ও পৃথিবী এবং এ উভয়ের মাঝে যাকিছু আছে সবার আধিপত্য। আর তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে।
৪:১৪৭ :: আল্লাহ কী করবেন তোমাদেরকে শাস্তি দিয়ে যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো (আল্লাহর অনুগ্রহের সঠিক ব্যবহার করো) এবং বিশ্বাস করো? আর আল্লাহ শোকরের মূল্যায়নকারী, মহাজ্ঞানী।
৩:২১ :: নিশ্চয় যারা অবিশ্বাস করে আল্লাহর আয়াতসমূহের প্রতি আর অন্যায়ভাবে হত্যা করে নবীদেরকে এবং তাদেরকে যারা আদেশ দেয় ন্যায়নীতির ভিত্তিতে মানবজাতির মধ্য থেকে; তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও।
৫:৮০ :: তুমি দেখেছো তাদের মধ্যকার অনেককে তারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে যারা কুফর করে। খুবই মন্দ যা আগে সম্পাদন করে রেখেছে তাদের জন্য তাদের নফসসমূহ। এজন্য আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়েছেন তাদের উপর। আর শাস্তির মধ্যে তারা স্থায়ী হবে।
৩:৫৬ :: যারা অবিশ্বাস করেছে আমি তাদেরকে শাস্তি দেবো, কঠোর শাস্তি, দুনিয়াতে ও আখিরাতে। আর তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।
২৪:১৯ :: নিশ্চয় যারা পছন্দ করে যে, প্রসার লাভ করুক অশ্লীলতা তাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে, তাদের (অশ্লীলতার প্রসার পছন্দকারীদের) জন্য আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দুনিয়াতে ও আখিরাতে। আর আল্লাহ জানেন আর তোমরা জানো না।
৫:৩৬-৩৭ :: নিশ্চয় যারা কুফর করেছে যদি তাদের করায়ত্ত হয় যা কিছু আছে পৃথিবীতে তার সবকিছু আর তার সমপরিমাণ তার সাথে যোগ হয় উহার দ্বারা তাদের মুক্তিপণ দেয়ার জন্য। কিয়ামাত দিবসের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য; তা কবুল করা হবে না তাদের থেকে। আর তাদের জন্য আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তারা ইচ্ছা করবে তারা বের হতে (জাহান্নামের) আগুন থেকে। অথচ তারা তা থেকে বের হতে পারবে না। আর তাদের জন্য আছে স্থায়ী শাস্তি।
৬:৪৯ :: আর যারা মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে আমাদের আয়াতসমূহকে, তাদেরকে শাস্তি স্পর্শ করবে; কারণ, তারা দুষ্কার্য (ফিসক) করতো।
৮:২৫ :: আর তোমরা বেঁচে থাকো সেই ফিতনা/ অনাচার থেকে যা শুধু তাদেরকেই আক্রান্ত করবে না যারা যুলুম করেছে, তোমাদের মধ্য থেকে, বিশেষভাবে। আর তোমরা জেনে রাখো যে, আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা।
১১:১৮-২০ :: আর তার চেয়ে বড় জালিম কে হতে পারে যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে? ঐসব লোককে হাযির করা হবে তাদের রবের কাছে। আর সাক্ষীরা বলবে, ‘তারাই ঐসব লোক যারা তাদের রবের উপর মিথ্যা আরোপ করেছে’। জেনে রাখো, আল্লাহর লা’নত পড়বে যালিমদের উপর। যারা বাধা দেয় আল্লাহর পথ থেকে আর উহাতে তালাশ করে বক্রতা। আর তারা আখিরাতের প্রতি অবিশ্বাসী। ঐসব লোক সক্ষম ছিলো না পৃথিবীতে আল্লাহকে অক্ষম করতে। আর তাদের জন্য ছিলো না আল্লাহ ছাড়া কোন অভিভাবক। দ্বিগুণ করা হবে তাদের জন্য শাস্তি। তারা সক্ষম ছিলো না শুনতে আর তারা সক্ষম ছিলো না দেখতে।
৩:১০৫-১০৮ :: আর তোমরা হয়ো না তাদের মতো যারা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়েছে আর মতপার্থক্য করেছে উহার পরেও যা তাদের কাছে এসেছে সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসাবে (অর্থাৎ তারা সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পরও তা গ্রহণ না করে দলে দলে ভাগ হয়েছে ও মতপার্থক্য করেছে)। আর তারাই ঐসব লোক যাদের জন্য আছে মহাশাস্তি। সেদিন উজ্জল হবে অনেক মুখমন্ডল আর মলিন হবে অনেক মুখমন্ডল। তারপর যাদের মুখমন্ডল মলিন হবে (তাদেরকে বলা হবে) ‘তোমরা কি অবিশ্বাস করেছো তোমরা বিশ্বাস করার পরও? সুতরাং তোমরা শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করো; কারণ, তোমরা অবিশ্বাস করতে’। আর যাদের মুখমন্ডল উজ্জল হবে তারা আল্লাহর রহমতের মধ্যে থাকবে। তারা তাতে স্থায়ী হবে। উহা আল্লাহর আয়াত, তা আমরা পাঠ করছি তোমার কাছে যথাযথভাবে। আর আল্লাহ ইচ্ছা করেন না যুলম করতে বিশ্ববাসীদের প্রতি।
৭:১৫৬ :: (মূসা আরো বললো), “(প্রভু), লিখে দিন আমাদের জন্য এই দুনিয়ায় উত্তম উপকরন, আর আখিরাতেও। নিশ্চয় আমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছি আপনারই কাছে’। তিনি (আল্লাহ) বলেছেন, ‘আমার শাস্তি আমি দিয়ে থাকি যাকে আমি (শাস্তি দেয়ার) ইচ্ছা করি। আর আমার দয়া পরিবেষ্টন করে আছে সকল কিছুকেই। তারপর শীঘ্রই আমি উহা লিখে দেবো তাদের জন্য যারা স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করে ও যাকাত (পরিশুদ্ধতামূলক প্রদেয়) প্রদান করে আর যারা আমাদের আয়াতসমূহের প্রতি বিশ্বাস করে।
মাগফিরাহ (সুরক্ষা ও ক্ষমা)
মাগফিরাহ শব্দটির অর্থ হলো ‘সুরক্ষা, ক্ষমা’। যারা কোনো মহামারী থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করে তারা তা প্রতিরোধ করতে বা তা থেকে সুরক্ষা পেতে পারে। অন্যদিকে কেউ মহামারীর মাধ্যমে দুর্বল হয়ে পড়ার পর সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় হতে পারে। কুরআনে এ উভয় পর্যায়ের সুরক্ষা বা ক্ষমা বুঝাতে মাগফিরাহ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
অপরাধ থেকে ক্ষমা প্রাপ্তির শর্ত হলো ‘তাওবাহ’ করা। যখন কোনো ব্যক্তি ভুল পথে চলে যায়, তারপর সে অনুশোচনার মাধ্যমে যদি সেখানে ফিরে আসে যেখান থেকে সে ভুল দিকে বেঁকে গিয়েছিলো তবে এটাকে বলা হয় ‘তাওবাহ’ বা ‘প্রত্যাশিত পথে ফিরে আসা’।
৪:১৭-১৮ :: নিশ্চয় সেই তাওবাহ যা আল্লাহ কবুল করেন তাদের সাথেই সম্পর্কিত যারা মন্দকর্ম করে বসে জাহিলিয়্যাতের (বিবেকবিরুদ্ধ প্রবণতা) প্রভাবে, তারপর তাওবাহ করে অবিলম্বে, তারাই এমন লোক যাদের তাওবাহ আল্লাহ কবুল করেন। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ। আর তাওবাহ কবুল হবে না তাদের ক্ষেত্রে যারা মন্দ কাজ করতে থাকে যতক্ষণ না তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয়। তখন সে বলে, ‘নিশ্চয় আমি এখন তাওবাহ করছি’। আর তাদের তাওবাহও কবুল হবে না যারা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে (মৃত্যুর সময় ঈমানের ঘোষণা দেয় কিন্তু তা কবুল না হওয়ায় সে কাফিরই থেকে যায়)। তারাই এমন লোক, আমরা তৈরি করে রেখেছি যাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
৫:৩৩-৩৪ :: নিশ্চয় তাদের প্রতিফল যারা আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে (আল্লাহর প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী রসূলের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা উৎখাতের জন্য যুদ্ধ করে), আর প্রচেষ্টা চালায় পৃথিবীতে ফাসাদ/ বিশৃংখলা করার (তাদের প্রতিফল) এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে। অথবা তাদেরকে শূলে চড়ানো বা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে। অথবা তাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে। অথবা তাদেরকে দেশ থেকে অপসারিত করা হবে। উহা তাদের জন্য দুনিয়ার জীবনের লাঞ্চনা। আর তাদের জন্য আখিরাতের জীবনে আছে মহাশাস্তি। তারা ছাড়া যারা তাওবা করেছে এর আগে যে, তোমরা তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছো। তাহলে জেনে রাখো নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
৪:৩১ :: যদি তোমরা বর্জন করো উহা কবীরা গুনাহের স্তরে করাকে যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, তাহলে আমরা মোচন করে দেবো তোমাদের থেকে তোমাদের সগীরা গুনাহসমূহ। আর আমরা তোমাদেরকে প্রবেশ করাবো সম্মানজনক প্রবেশ পথে।
৫:৩৮-৪০ :: পুরুষ চোর আর নারী চোর, তোমরা কেটে দাও (বিচ্ছিন্ন না করে) উভয়ের হাতসমূহ; উহার প্রতিফলস্বরূপ যা তারা উপার্জন করেছে (তাদের অপরাধের শাস্তিস্বরূপ)। ইহা আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষামূলক শাস্তি। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ। তারপর যে (চুরির সমস্ত সম্পদ ফেরত দিয়ে) তাওবা করবে সে যুলুম (চুরি) করার পর, আর আত্মসংশোধন করবে, তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। তুমি কি জানো না, নিশ্চয় আল্লাহ এমন যে, তাঁরই অধিকারভুক্ত আসমানসমূহ ও যমিনের আধিপত্য? তিনি শাস্তি দেন যাকে তিনি (শাস্তি দেয়ার) ইচ্ছা করেন। আর তিনি ক্ষমা করেন যাকে তিনি (ক্ষমা করার) ইচ্ছা করেন। আর আল্লাহ সকল সত্তা ও বিষয়ের উপর প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণকারী ও সর্বশক্তিমান নিয়ন্ত্রণকারী।
৬:১৪৭ :: তারপর যদি তারা তোমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে, তাহলে বলো, ‘তোমাদের রব ব্যাপক রহমাতের অধিকারী কিন্তু ফিরানো যায় না তাঁর শাস্তি অপরাধী কাওমের থেকে’।
৫৩:৩২ :: যারা ত্যাগ করে কবীরা গুনাহসমূহ ও অশ্লীল কাজসমূহ, ছোটখাট ত্রুটি বিচ্যুতি ছাড়া, নিশ্চয় তোমার রব সেক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষমাশীল। তিনি জানেন যখন তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন ভূমি থেকে আর যখন তোমরা ছিলে ভ্রুণ অবস্থায় তোমাদের মায়েদের পেটসমূহের মধ্যে। সুতরাং পরিশুদ্ধ বলে দাবি করো না তোমাদের নিজেদেরকে। তিনি জানেন তার ব্যাপারে যে স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করে।
৮:৩৩-৩৪ :: আর আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন এ অবস্থায় যে, তুমি আছো তাদের মধ্যে অবস্থানরত। আর আল্লাহ এমনও নন যে, তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন এ অবস্থায় যে, তারা ক্ষমা চাচ্ছে (এমন একদলও তাদের মধ্যে অবস্থানরত)। তবে এখন তাদের কী অধিকার আছে যে, তিনি তাদেরকে শাস্তি দিবেন না এ অবস্থায় যে, তারা বাধা দিচ্ছে মাসজিদুল হারাম থেকে? অথচ তারা উহার তত্ত্বাবধায়ক নয়। কেউই উহার তত্ত্বাবধায়ক নয় স্রষ্টা-সচেতনগণ ছাড়া। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জ্ঞান রাখে না।
১৭:১৫ :: যে সঠিক পথে চলে, তাহলে নিশ্চয় সে সঠিক পথে চলে তার নিজেরই কল্যাণের জন্য। আর যে ভ্রান্ত পথে চলে, তাহলে নিশ্চয় সে ভ্রান্ত পথে চলে তার নিজেরই অকল্যাণের জন্য। আর কোন বোঝা বহন করবে না কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা। আর আমরা শাস্তিদানকারী নই যতক্ষণ না আমরা সমুত্থিত/ প্রেরণ করি কোন রসূল।
৬:১৩১-১৩২ :: বিষয় এই যে, তোমার প্রভু কোনো জনপদকে ধ্বংসকারী ছিলেন না জুলুমের দ্বারা এভাবে যে, তার অধিবাসীরা সত্য সম্পর্কে অনবহিত ছিলো। আর সকলের জন্য আছে মর্যাদাগত স্তর, তা অনুযায়ী যা তারা করেছে। আর তোমার উদাসীন নন তা থেকে যা তারা করে।
৬৩:৬ :: তাদের (মুনাফিক্বদের) জন্য সমান তুমি কি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো নাকি তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো নি। আল্লাহ কখনো তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ হিদায়াত করেন না দুষ্কর্ম পরায়ণ (ফাসিক) জনগোষ্ঠীকে।
৯:৮০ :: তুমি তাদের (মুনাফিক্বদের) জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো অথবা তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করো (দুটোই সমান)। যদি তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো সত্তর বারও, তবুও আল্লাহ কখনোই তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। উহা এ কারণে যে, তারা কুফর করেছে আল্লাহর প্রতি আর তাঁর রসূলের প্রতি। আর আল্লাহ হিদায়াত করেন না দুষ্কর্ম পরায়ণ (ফাসিক) জনগোষ্ঠীকে।
৫:৯ :: আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যারা বিশ্বাস করেছে আর সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য আছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।
২০:৮২ :: আর নিশ্চয় আমি ক্ষমাশীল তার জন্য যে তাওবাহ করে, বিশ্বাস করে, সৎকর্ম করে, তারপর হিদায়াতের পথে চলে।
৩:১৩৩ :: আর দ্রুত ধাবিত হও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে আর জান্নাতের দিকে, যে জান্নাতের বিশালতা আসমানসমূহ ও পৃথিবী (অর্থাৎ আসমানসমূহ ও পৃথিবীর বিশালতা এবং জান্নাতের বিশালতা সমান, ৫৭: ২১)। যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে স্রষ্টা-সচেতনদের জন্য।
৫৭:২১ :: অগ্রণী হও তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে ক্ষমার দিকে ও জান্নাতের দিকে, যার প্রশস্ততা আকাশের ও পৃথিবীর প্রশস্ততার মতো। উহা প্রস্তুত করা হয়েছে তাদের জন্য যারা বিশ্বাস করেছে আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলগণের প্রতি। উহা আল্লাহর অনুগ্রহ। তিনি উহা দান করেন যাকে তিনি ইচ্ছা করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।
৩৩:৩৫ :: নিশ্চয় আত্মসমর্পণকারী পুরুষ ও আত্মসমর্পণকারী নারী, আর বিশ্বাসী পুরুষ ও বিশ্বাসী নারী, আর বিনয়ী পুরুষ ও বিনয়ী নারী, আর সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, আর সবরকারী পুরুষ ও সবরকারী নারী, (দায়বদ্ধতার অনুভূতিতে) অবনমিত পুরুষ ও (দায়বদ্ধতার অনুভূতিতে) অবনমিত নারী, আর দানকারী পুরুষ ও দানকারী নারী, আর সিয়াম পালনকারী পুরুষ ও সিয়াম পালনকারী নারী, আর নিজেদের লজ্জাস্থান হেফাযতকারী পুরুষ ও নিজেদের লজ্জাস্থান হেফাযতকারী নারী, আর আল্লাহকে বেশি করে স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহকে বেশি করে স্মরণকারী নারী; আল্লাহ ওয়াদা করেছেন তাদের জন্য ক্ষমার ও মহাপুরস্কারের (ওয়াদা)।
৪৮:২৯ :: মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ আর যারা তার সাথে আছে তারা কাফেরদের প্রতি কঠোর আর তাদের নিজেদের মধ্যে রহমশীল। তুমি তাদেরকে দেখবে রুকুকারী ও সিজদাকারী। তারা তালাশ করে আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ (হালাল জীবিকা) ও (তাঁর) সন্তুষ্টি। তাদের লক্ষণ তাদের মুখমন্ডলে ফুটে থাকে সিজদার চিহ্ন থেকে (সিজদার প্রভাবে)। উহাই তাওরাতে তাদের দৃষ্টান্ত। আর ইনজীলে তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যেন একটি চারাগাছ যা বের করে তার অংকুর, তারপর উহাকে পুষ্টি যোগায়, তারপর উহা শক্ত হয়, তারপর উহা তার কান্ডের উপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়, তখন উহা চাষীদেরকে আনন্দ দেয়। (এভাবে আল্লাহ মু’মিনদেরকে মজবুতি দেন) যেন তাদের কারণে কাফেরদের গা জ্বালা করে। আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা করেছেন যারা বিশ্বাস করে ও তাদের মধ্য থেকে যারা সৎকর্ম করে (তাদেরকে) ক্ষমা ও মহাপুরস্কার দেয়ার (ওয়াদা করেছেন)।
২৪:২২ :: আর যেন কসম না করে তোমাদের মধ্যকার অনুগ্রহের অধিকারীরা ও প্রাচুর্যের অধিকারীরা যে, তারা দান করবে না আত্মীয় স্বজনকে ও মিসকীনকে ও আল্লাহর পথে হিজরতকারীদেরকে; আর তারা যেন উদারতা প্রকাশ করে আর তারা যেন ত্রুটি বিচ্যুতি উপেক্ষা করে। তোমরা কি পছন্দ করো না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
৪:১৩৭ :: নিশ্চয় যারা বিশ্বাস করেছে তারপর অবিশ্বাস করেছে তারপর বিশ্বাস করেছে তারপর অবিশ্বাস করেছে তারপর বাড়িয়ে নিয়েছে অবিশ্বাস, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন না আর তাদেরকে হিদায়াত করবেন না সঠিক পথ।
৪:১৬৮ :: নিশ্চয় যারা কুফর করেছে ও যুলুম করেছে আল্লাহ তাদেরকে মাফ করবেন না। আর তাদেরকে হিদায়াত করবেন না কোনো পথ।
৪:৪৮ :: নিশ্চয় আল্লাহ মাফ করেন না তাঁর সাথে শিরক করার গুনাহ আর তিনি মাফ করেন উহা ছাড়া অন্য গুনাহ যাকে তিনি (মাফ করার) ইচ্ছা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শিরক করে নিশ্চয় সে উহার মাধ্যমে রচনা করে মহাপাপ।
৪:১১৬ :: নিশ্চয় আল্লাহ মাফ করেন না তাঁর সাথে শিরক করার গুনাহ আর তিনি মাফ করেন উহা ছাড়া অন্য গুনাহ যাকে তিনি (মাফ করার) ইচ্ছা করেন। আর যে শিরক করে আল্লাহর সাথে, নিশ্চয় সে বিভ্রান্ত হয় বহুদূর বিভ্রান্তিতে।
১১:৭-১১ :: আর তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশমন্ডলী আর পৃথিবী ছয় দিবসে (ছয় মহাকালে)। আর এর আগে তাঁর আরশ (ক্ষমতার আসন) ছিলো পানির উপর। যেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, তোমাদের মধ্যে কে কাজকর্মে অধিক উত্তম। আর নিশ্চয় যদি তুমি বলো, ‘নিশ্চয় তোমরা পুনরুত্থিত হবে মৃত্যুর পরে’, তাহলে তারা বলবে যারা কুফর করেছে (বলবে,) ‘ইহা (কুরআন) কিছু নয় প্রকাশ্য যাদু/ ভেল্কিবাজি ছাড়া’। আর নিশ্চয় যদি আমরা বিলম্বিত করি তাদের থেকে শাস্তি গণাগণতির একটি সময়কাল পর্যন্ত; তাহলে তারা বলবে, ‘কে উহাকে আটকে রেখেছে?’ জেনে রাখো, যেদিন উহা তাদের কাছে আসবে, তখন উহা ফেরানো যাবে না তাদের থেকে। আর তাদেরকে উহাই ঘিরে ধরবে যে ব্যাপারে তারা ঠাট্টা করতো। আর যদি আমরা আস্বাদন করাই মানুষকে আমাদের পক্ষ থেকে দয়া তারপর আমরা উহা প্রত্যাহার করি তার থেকে, তাহলে নিশ্চয় সে হয় হতাশ ও অকৃতজ্ঞ। আর যদি আমরা তাকে আস্বাদন করাই নেয়ামত, ঐ দু:খ-কষ্টের পর যা তাকে স্পর্শ করেছিলো; তাহলে সে বলবে, ‘চলে গেছে বিপদসমূহ আমার থেকে’। নিশ্চয় তখন সে হবে উৎফুল্ল/ আনন্দিত ও অহংকারী। তারা ছাড়া যারা সবর করেছে আর সৎকর্ম করেছে। তারাই এমন লোক, যাদের জন্য আছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।
পরিস্থিতি অনুযায়ী শাস্তি
কুরআনে প্রদত্ত শাস্তিনীতিতে জড়িত অভিযুক্তের ব্যক্তিগত পরিস্থিতিকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। যেমন, একই অপরাধের দুই অপরাধীর একই রকম শাস্তি হওয়া উচিত নয় যদি তাদের ব্যক্তিগত পরিস্থিতিগত পটভূমিতে ভিন্নতা থাকে, যেমন, লালন-পালন, সুরক্ষা-ব্যবস্থা, শিক্ষাগত সচেতনতা ইত্যাদি। তাই, কুরআন প্রস্তাব করেছে যে কারো দাসত্বে থাকা নারীদেরকে স্বাধীনা নারীদের অর্ধেক শাস্তি দেওয়া হবে (৪:২৫ আয়াত দ্রষ্টব্য)। অন্যদিকে নবীর স্ত্রীদের কেউ যদি অশ্লীলতায় জড়িত হতো তবে তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হতো (৩৩:৩০)।
ক্ষমা প্রার্থনা
৪:১০৬ :: আর তুমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
৪:১১০ :: আর যে মন্দ কাজ করে অথবা যুলুম করে তার নিজ জীবনসত্তার উপর, তারপর (অবিলম্বে ৪:১৭-১৮) ক্ষমা প্রার্থনা করে আল্লাহর কাছে; সে আল্লাহকে পাবে ক্ষমাশীল, দয়ালু।
৫:৭৪ :: তবে কি তারা আল্লাহর দিকে তাওবাহ করবে না? আর তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
১১:৩ :: আর তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো তোমাদের রবের কাছে তারপর তাওবাহ করো তাঁর দিকে। তিনি তোমাদেরকে উপভোগ করতে দিবেন উত্তম ভোগসামগ্রী নির্ধারিত শেষ সময়সীমা পর্যন্ত। আর তিনি দিবেন প্রত্যেক অনুগ্রহ পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকে তাঁর অনুগ্রহ। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে নিশ্চয় আমি (রসূল) ভয় করি তোমাদের উপর বড় দিবসের শাস্তির ব্যাপারে।
২৪:৬২ :: নিশ্চয় মু’মিনূন তারাই যারা বিশ্বাস করেছে আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলের প্রতি আর যখন তারা থাকে তার সাথে কোন সমষ্টিগত কাজে, তখন তারা চলে যায় না যতক্ষণ না তার থেকে অনুমতি চায়। নিশ্চয় যারা তোমার অনুমতি চায় তারাই সেসব লোক যারা ঈমান/ বিশ্বাস করে আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলের প্রতি। সুতরাং যখন তারা তোমার অনুমতি চায় তাদের কোনো ব্যাপারে (প্রয়োজন থাকায়), তখন তুমি অনুমতি দাও যাকে তুমি ইচ্ছা করো তাদের মধ্য থেকে। আর তুমি ক্ষমা প্রার্থনা করো তাদের জন্য আল্লাহর কাছে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
৪০:৫৫ :: সুতরাং সবর করো। নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। আর তুমি ক্ষমা প্রার্থনা করো তোমার গুনাহের জন্য। আর পবিত্রতা বর্ণনা করো তোমার প্রভুর প্রশংসা সহকারে ইশার সময় ও সকালে।
৪১:৬ :: বলো, ‘বস্তুত আমি তোমাদের মত মানুষ। ওহী করা হয় আমার প্রতি এই যে, তোমাদের ইলাহ একজনমাত্র ইলাহ। সুতরাং তোমরা দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকো তাঁর দিকে। আর তাঁরই কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো। আর মুশরিকদের জন্য দুর্ভোগ।
৪৭:১৯ :: সুতরাং জেনে নাও যে, নেই কোন ইলাহ, আল্লাহ ছাড়া। আর তুমি ক্ষমা প্রার্থনা করো তোমার গুনাহের জন্য আর মু’মিন পুরুষদের ও মু’মিন নারীদের জন্য। আর আল্লাহ জানেন তোমাদের নড়াচড়া/ গতিবিধি ও তোমাদের অবস্থান।
৬০:১২ :: হে নবী, যখন তোমার কাছে আসবে মু’মিন নারীরা তোমার কাছে বাইয়াত করতে এ মর্মে যে, তারা শিরক (অংশীদারিত্ব সাব্যস্ত) করবে না আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে আর তারা চুরি করবে না আর তারা ব্যভিচার করবে না আর তারা হত্যা করবে না তাদের সন্তানদেরকে আর কোন অপবাদ/ মিথ্যা দাবি নিয়ে আসবে না (উহার বিষয়ে) যা তারা রচনা করে তাদের হাতগুলোর ও পাগুলোর মধ্যে (অপরের সন্তানকে স্বামীর ঔরসের আপন গর্ভজাত বলে মিথ্যা দাবি করবে না) আর তারা তোমাকে অমান্য করবে না ন্যায়সঙ্গত ক্ষেত্রে, তাহলে তাদেরকে বাইয়াত করাও আর তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
৭১:১০-১২ :: অতঃপর আমি (নূহ) বলেছি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা বর্ষণ করবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন, তোমাদের জন্য উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করবেন এবং তোমাদের জন্য নদী-নালা প্রবাহিত করবেন।
২৩:১১৮ :: আর বলো, ‘হে আমার রব, আমাকে ক্ষমা করুন ও দয়া করুন। আর আপনিই উত্তম দয়াশীল’।
৪:৬৪ :: আর আমরা প্রেরণ করিনি কোনো রসূল এ উদ্দেশ্য ছাড়া যে, যেন তার আনুগত্য করা হয় আল্লাহর অনুমতিক্রমে। আর যদি বাস্তবে তারা যখন (তাগুতের আনুগত্য ও তাগুতের কাছে বিচারভার অর্পণের মাধ্যমে) যুলুম করেছে তাদের নিজেদের উপর (তারপর অবিলম্বে) তারা তোমার কাছে আসতো তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতো আর রসূলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতো, তাহলে নিশ্চয় তারা আল্লাহকে পেতো তাওবাহ কবুলকারী, দয়ালু।
ভাগ্যবাদের অদ্ভুত সমীকরণ : মানুষকে পাপ করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে
যেহেতু বলা হয়েছে যে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবেন এবং যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন এবং বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল-দয়ালু এবং নিজ পাপের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেহেতু ভাগ্যবাদীরা কিছু অদ্ভুত সমীকরণ দাড় করিয়েছে। যেমন :
১. জান্নাত-জাহান্নাম বা ক্ষমা ও শাস্তি পাপ-পুণ্যের উপর নির্ভর করে না, বরং আল্লাহ চাইলে একজন পুণ্যবানকেও জাহান্নামের শাস্তি দিতে পারেন এবং একজন পাপীকেও ক্ষমা করে দিয়ে ও অনুগ্রহ করে জান্নাত দিতে পারেন।
২. আল্লাহ ন্যায়বিচার করতে বাধ্য নন, বরং তিনি অন্যায় করলেও সেটাই তাঁর জন্য ন্যায়। যেমন, তিনি যদি পুণ্যবানকে শাস্তি দেন কিংবা পাপীকে পুরস্কার দেন সেটাও তাঁর ন্যায়। তিনি জুলুম করলে সেটাকে জুলুম বলা যাবে না।
৩. আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহ ছাড়া কেউ তার ভালো কাজের কারণে জান্নাতে যেতে পারবে না। তাই স্রষ্টার কাছে ন্যায়বিচার, সৎকর্মের প্রতিদান বা পুরস্কার নয়, শুধুমাত্র ক্ষমা ও কৃপাপ্রার্থী হতে হয়। ক্ষমা ও কৃপা হলে যেকোনো পাপীও জান্নাতে যেতে পারে। আর তা না হলে যে কোনো পুণ্যবানও জাহান্নামে যেতে পারে।
৪. আল্লাহ পাপের জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। যদি মানুষ পাপ না করতো, তাহলে তিনি মানুষকে অপসারণ করে এমন কাউকে সৃষ্টি করতেন যে পাপ করতো, তারপর তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতো। কারণ তা না হলে তিনি ক্ষমাশীল হতে পারতেন না। পাপ করাই মানুষের ধর্ম এবং ক্ষমা চাওয়াই মু’মিনের ধর্ম।
উপরোক্ত সবগুলো ধারণা কুরআনের অনেক আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক। এ বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে প্রসঙ্গক্রমে আয়াতসমূহ আলোচিত হয়েছে। তাই এখানে তা পুনরাবৃত্তি করা হলো না।
আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবেন কথাটির মর্ম হলো, আল্লাহ তাঁর নির্ধারিত নীতি অনুসারে যাকে ক্ষমা করার ইচ্ছা করবেন অর্থাৎ যে ক্ষমার জন্য ঘোষিত নীতির আওতায় আসবে, তাকে ক্ষমা করবেন। অনুরূপভাবে যাকে শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা করবেন অর্থাৎ যে শাস্তির জন্য ঘোষিত নীতির আওতায় আসবে, তাকে শাস্তি দিবেন। এ অধ্যায়ে উল্লেখিত আয়াতসমূহ অধ্যয়ন করলে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। সুতরাং যাকে ইচ্ছা ক্ষমা ও যাকে ইচ্ছা শাস্তির বিষয়টি কোনোভাবেই ভাগ্যবাদকে সমর্থন করে না। আর তাই ভাগ্যবাদের উপকথা হিসেবে যেসব ধ্যান-ধারণা প্রচার করা হয় সেগুলো ভিত্তিহীন ও পরিত্যাজ্য।
আল্লাহ জানেন- যা কিছু ঘটেছে, ঘটছে ও ঘটবে তার সবকিছু, সৃষ্টির ভালো-মন্দ, আনুগত্য-অবাধ্যতা, সৎকর্ম ও অসৎকর্ম, তাদের যাবতীয় অবস্থা, অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যত কার্যকলাপ ও পরিণতি, হায়াত, মওত, রিজিক্ব, নড়াচড়া ও স্থির থাকা, সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য, পুনরুত্থান পরবর্তী অবস্থা ইত্যাদি সবকিছু।
৬:৫৯ :: আর তাঁর (আল্লাহর) কাছে আছে গায়েবের চাবিসমূহ। কেউ উহা (গায়েব) জানে না তিনি (আল্লাহ) ছাড়া। আর তিনিই জানেন যা আছে স্থলভাগে ও জলভাগে। আর পড়ে না কোনো পাতা তিনি উহা জানা ছাড়া। আর না কোনো শস্যদানা আছে জমিনের অন্ধকারসমূহের মধ্যে আর না আছে কোনো ভিজা জিনিস আর না আছে কোনো শুকনো জিনিস, তা (তার সময় ও স্থানগত পরিমান-পরিমাপ ও তার কার্যকারণ) সুস্পষ্ট কিতাবে (লাওহে মাহফুজে থাকা উম্মুল কিতাবে) লিখিত থাকা ছাড়া।
৩১:৩৪ :: নিশ্চয় আল্লাহর নিকটেই আছে প্রলয়মুহুর্তের জ্ঞান। আর তিনিই বর্ষণ করেন বৃষ্টি। আর তিনিই জানেন গর্ভসমূহে কী আছে? আর কোনো প্রাণীই জানে না সে কী উপার্জন করবে আগামী কাল। আর কোনো প্রাণীই জানে না কোন ভূমিতে সে মৃত্যুবরণ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবগত।
৭:১৮৭ :: তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে সায়াত/ প্রলয় মুহুর্ত সম্পর্কে, ‘কখন উহা ঘটবে?’ বলো নিশ্চয় উহার ইলম/ জ্ঞান আমার রবের কাছেই আছে। কেউ উহা প্রকাশ করতে পারবে না, উহার যথাসময়ে শুধু তিনিই উহা প্রকাশ করবেন। উহা ভারী হবে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে। উহা তোমাদের কাছে আসবে না, হঠাৎ করে আসা ছাড়া। তারা তোমার কাছে জিজ্ঞাসা করে যেন তুমি উহা সম্পর্কে পরিজ্ঞাত আছো। বলো, ‘নিশ্চয় উহার ইলম/ জ্ঞান তো আল্লাহরই কাছে আছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জ্ঞান রাখে না (যে, এর সুনির্দিষ্ট সময়-জ্ঞান আল্লাহর কাছেই সংরক্ষিত থাকার বিষয়)।
৭৩:২০ :: … তিনি জানেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হবে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে যমীনে বিচরণ করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত হবে।...
৫৯:২২ :: তিনিই হচ্ছেন আল্লাহ, যিনি ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই। তিনি অদৃশ্য এবং দৃশ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত।
২৭:৬৫ :: বলো, “কেউ জানে না যারা আছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে, গায়েব/ অদৃশ্য সম্পর্কে, আল্লাহ ছাড়া। আর তারা অনুভবও করতে পারে না যে, কখন তারা পুনরুত্থিত হবে?”
৩:২৯ :: বলো, “যদি তোমরা গোপন রাখো যা আছে তোমাদের মস্তিষ্কসমূহে অথবা তোমরা উহা প্রকাশ করো (উভয় অবস্থায়ই) আল্লাহ তা জানেন। আর তিনি জানেন যা আছে আসমানসমূহে আর যা আছে জমিনে (তার সবকিছুই)। আর আল্লাহ সকল সত্তা ও বিষয়ের উপর প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণকারী ও সর্বশক্তিমান নিয়ন্ত্রণকারী।
২:২৫৫ :: আল্লাহু, কোন ইলাহ নেই, তিনি (আল্লাহ) ছাড়া। তিনি চিরজীবন্ত, রপ্রতিষ্ঠিত। তাঁকে ধরে না তন্দ্রা আর ধরে না নিদ্রা। তাঁরই অধিকারে যা আছে আকাশসমূহে আর যা আছে জমিনে। কে সে যে শাফায়াত/ সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? তিনি জানেন যা আছে তাদের সামনে আর যা আছে তাদের পেছনে। আর তারা আয়ত্ত করতে পারে না জ্ঞান থেকে কিছুই তিনি যা (তাদেরকে যতটুকু জ্ঞান দেয়ার) ইচ্ছা করেন তা ছাড়া। পরিব্যাপ্ত রয়েছে তাঁর কুরসি (ক্ষমতার ব্যাপ্তি) আকাশসমূহ ও জমিনে। আর তাঁকে ক্লান্ত করে না এ উভয়ের (আকাশসমূহ ও জমিনের) হিফাযাত করার কাজ। তিনি আল সুমহান, সর্বশ্রেষ্ঠ।
আলোচনা : উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে জানা যায় যে, সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞান রয়েছে। আর মানুষ জানে না যে, আগামীকাল সে কী উপার্জন করবে এবং কোনো কাজ নির্ভুলভাবে সম্পাদন করতে পারবে কিনা। এসব তথ্য থেকে ভাগ্যবাদের জন্য নিম্নরূপ যুক্তি উপস্থাপন করা হয় :
(১) মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে আল্লাহর জ্ঞান রয়েছে। মানুষের ভবিষ্যত জানা সম্ভব যদি তা পূর্বনির্ধারিত হয়। একটি স্বাধীন ইচ্ছাকৃত সৃষ্টির ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। সুতরাং মানুষের ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত।
(২) মানুষ যদি স্বাধীন হয়, তাহলে আগামীকাল সে কী করবে তা নির্ধারণ করা তার পক্ষে কঠিন হবে না। কিন্তু কুরআনের তথ্য অনুসারে মানুষের পক্ষে তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং মানুষ স্বাধীন ইচ্ছা, পছন্দ ও কর্ম সম্পাদনের অধিকারী নয়, বরং সে ভাগ্য দ্বারা আবদ্ধ।
বস্তুত সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞান রয়েছে এবং মানুষের পক্ষে আগামীকাল সে কোনো কাজ নির্ভুলভাবে সম্পাদনকারী হতে পারবে কিনা তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়- তথ্য দুটি নি:সন্দেহে সত্য। কিন্তু তা দ্বারা কোনোক্রমে ভাগ্যবাদকে বুঝায় না। বরং আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইনের সাথে এ দুটি সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আল্লাহর জ্ঞানের প্রশ্নটি ‘সময়’ সম্পর্কিত ধারণার সাথে সম্পর্কযুক্ত। আল্লাহর জ্ঞান ও মানুষের জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যের সময়গত মাত্রা রয়েছে। কুরআন তার নিদর্শনগুলির মধ্যে 'পৃথিবীর সময়'কে 'দিন ও রাত্রি'-তে বিভক্ত করে; সময় গণনার যন্ত্র হিসেবে সূর্য ও চাঁদকেও উল্লেখ করে। এই 'সময়' বিভক্ত হয়, আমাদের পার্থিব প্রাণীদের জন্য, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতে। এটি আপেক্ষিক বিষয়। আমরা ঘুমের মধ্যে সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলি এবং তা থেকে সময়ের আপেক্ষিকতা সম্পর্কে কিছুটা অনুভূতি পেতে পারি। এছাড়া ঘুম বা কোমায় থাকা অবস্থায় আমরা সময়ের অবিচ্ছিন্নতার অনুভূতি হারিয়ে ফেলি। আল্লাহ কখনো জ্ঞান হারান না। তাঁর কাছে সময় হচ্ছে অবিচ্ছিন্ন বর্তমান।
আল্লাহ একই সাথে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সবই জানেন। এর একটি কারণ তো এই যে, কোনো কিছুই তাঁর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মকে লঙ্ঘন করতে পারে না এবং তিনিই তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তেমনি এর অন্য একটি কারণ হলো, আল্লাহ সময় ও স্থানের সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। যেহেতু মানুষ সময় ও স্থানের সীমাবদ্ধতায় অবস্থান করে তাই তার পক্ষে এটি যথাযথভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তবে একটি উদাহরণের মাধ্যমে এ বিষয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। তা হলো : ঘরের ভেতরে বসে বাইরের (অদৃশ্য) ঘটনা সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। কিন্তু, ভবনের ছাদে থাকা কারো জন্য সেই ঘটনাগুলো দৃশ্যমান। কুরআনের ভাষায় আল্লাহ হলেন, “দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানী, অর্থাৎ মানুষের কাছে যা অদৃশ্য তা আল্লাহর কাছে দৃশ্যমান”। সুতরাং যদিও মানুষ তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করতে সক্ষম, তবুও সে তার ভবিষ্যত ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে জানে না। কারণ সে জানে না যে, সে কী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বা তার সিদ্ধান্ত ও তার বাস্তবায়ন কোন কোন ভবিষ্যত ফ্যাক্টর দ্বারা প্রভাবিত হবে। কিন্তু আল্লাহ তা জানেন।
মানুষের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু তার স্বাধীনতা সীমাহীন নয়। এটি তার নিয়ন্ত্রণ এবং/অথবা জ্ঞানের বাইরে বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভরশীল। তার পরিবেশের উপর তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই এবং আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে, তার সহকর্মীদের ক্রিয়াকলাপের উপরও নয়। মানুষ তার চারপাশের ভৌত মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হতে পারে যদি কখনো তার জ্ঞানের অগ্রগতি হয়। তবে সে অন্যান্য ব্যক্তিদের স্বাধীন-ইচ্ছাকৃত ক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে না। আজকের বিশ্বে, একটি সুপার পাওয়ার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে) রাজনৈতিক পরিবর্তন সমগ্র বিশ্বকে প্রভাবিত করে। অতএব, মানুষ শুধুমাত্র তার পরিস্থিতির আলোকে বিভিন্ন কার্যকারণ বিবেচনা করে তার ক্ষমতার সীমার মধ্যে একটি বিন্দু পর্যন্ত তার কর্মের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু সূর্য বা চাঁদের বিপরীতে, ভবিষ্যতে সে কী পদক্ষেপ নেবে তা নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না।
আল্লাহ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সবই জানেন। কোনো ক্ষেত্রে কখনো তাঁর জানার ব্যতিক্রম কিছুই হবে না। কিন্তু তাঁর জানার কারণে কোনো ঘটনা সেভাবে ঘটছে তা নয়, বরং ঘটনা ঘটছে তাঁর তৈরি বিভিন্ন কারণ ও ফলাফল বিধি অনুসারে। অথবা কিছু ঘটনা ঘটে প্রাকৃতিক আইনের পাশাপাশি তাঁর নিজের বিষয়ে নিজের তৈরি নীতিমালা অনুযায়ী তাঁর বিভিন্ন ধরনের তাৎক্ষণিক ইচ্ছা বা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। আর আল্লাহ তাঁর স্বীয় গুণগত কারণে তা পূর্ব থেকে জানেন।
আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞানের বিষয়ে একটি প্রশ্ন আসে যে, যেহেতু আল্লাহ যা জানেন তার ব্যতিক্রম হতে পারে না, তাহলে ভাল-মন্দের জন্য মানুষ দায়ী হবে কেন?
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞানের কারণে আমরা আমাদের কৃতকর্মের জন্য দায়ী হওয়া থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারি না। আল্লাহ পূর্ব থেকে জানা সত্ত্বেও আমরা যেমন আমাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, যোগাযোগ, বিবাহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাজ করে থাকি, তেমনি তিনি পূর্ব থেকে জানার বিষয়টি আমাদের জন্য এসব কাজে তাঁর বিধানসঙ্গত কাজ করা থেকে বিরত থাকার কোনো অজুহাত হতে পারে না। বরং যদি তিনি যা জানেন তাই তো হবে বলে আমরা তাঁর বিধান লঙ্ঘন করি তাহলে তিনি পূর্ব থেকেই জানেন যে, আমরা কে কে তা লঙ্ঘন করবো। অনুরূপভাবে আমরা যদি তাঁর বিধান অনুসরণ করি তাহলে তিনি পূর্ব থেকেই জানেন যে, আমরা কে কে তাঁর বিধান অনুসরণ করবো। আমাদের কোনো সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তাঁর পূর্বজ্ঞানকে রোধ করা সম্ভব নয়, কারণ তাঁর পূর্বজ্ঞান তাঁর স্বয়ং গুণ। সুতরাং আমরা যা করবো তার মাধ্যমে আমরা দায়ী হবো এবং পুরস্কার বা শাস্তি পাবো। তাঁর পূর্বজ্ঞান আমাদেরকে আমাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করা থেকে নিষ্কৃতি দিবে না। আমাদের কর্ম ও কর্মফল যেমন তাঁর পূর্বজ্ঞানে রয়েছে, তেমনি আমাদের কর্ম অনুযায়ীই আমাদের কর্মফল হবে, এ উভয় বিষয় একই সাথে সত্য।
যেহেতু আল্লাহ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত এবং প্রকাশ্য ও গোপন সবই জানেন, তাই তাঁর দেয়া বিধানই সঠিক বিধান। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী কৃত কাজের ফলে সুফল পাওয়া যাবে এবং তাঁর বিধান লংঘন করে কৃত কাজের কুফলও ভোগ করতে হবে। সুতরাং আমাদের কাজকে তাঁর জানা প্রভাবিত করে না, বরং আমরা যাই করি না কেন তাতে আমাদের সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতা প্রয়োগের কারণে আমরা দায়ী এবং আল্লাহ নিজ গুণে তা পূর্ব থেকে জানেন।
আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞানের ভিত্তিতে ভবিষ্যদ্বাণী
পৃথিবীতে যা কিছু সংঘটিত হয় ও হবে তা আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়ম এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর কর্তৃক প্রাকৃতিক নিয়মকে নিয়ন্ত্রণ ও বিশেষ ইচ্ছার প্রেক্ষিতে সংঘটিত হয় ও হবে। আল্লাহ তাঁর স্বীয় চিরন্তন জ্ঞানের ভিত্তিতে তা আগে থেকে জানেন। বিষয় এ নয় যে, তিনি যা জানেন তা জানেন বিধায় তা সেভাবে ঘটে বা ঘটবে। বরং বিষয় এই যে, যা ঘটে ও ঘটবে তিনি তা জানেন, কারণ তিনি তিন কালের (অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত) জ্ঞান রাখেন। তাই তিনি যেভাবে জানেন তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটবে না। যদিও যা ঘটে ও ঘটবে তার ক্ষেত্রে মানুষের সীমিত স্বাধীন ইচ্ছার ভূমিকা রয়েছে এবং সেই সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা আল্লাহই মানুষকে দিয়েছেন। আল্লাহ তিন কালের জ্ঞান রাখেন, কারণ তিনি সময় ও স্থান দ্বারা সীমাবদ্ধ নন, বরং তিনিই সময় ও স্থান সৃষ্টি করেছেন।
নিম্নে কুরআন থেকে মানবজীবনে সংঘটিত কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে ভবিষ্যদ্বাণীমূলক আয়াত উল্লেখ করা হলো, যা ঘটনাগুলো সংঘটনের পূর্বেই সে বিষয়ে আল্লাহ জ্ঞাত থাকার তথ্য প্রকাশ করে।
১) নবী-রসূল ইসমাইল, ইসহাক, মূসা, ঈসা ও ইয়াহইয়ার জন্ম, গুণাবলী ও অন্যান্য বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী
৩৭:১০১ :: সুতরাং আমরা তাকে সুসংবাদ দিলাম সহনশীল এক পুত্রের (ইসমাইলের)।
৩৭:১১২ :: এবং আমরা তাকে সুসংবাদ দিয়েছিলাম ইসহাক সম্পর্কে, সৎকর্মশীলদের মধ্য থেকে একজন নবী।
১১:৬৯-৭৩ :: আর নিশ্চয় এসেছিলো আমাদের রসূলগণ (ফেরেশতাগণ) ইবরাহীমের কাছে সুসংবাদ নিয়ে। তারা বললো, ‘শান্তি’। সে (ইবরাহীম) বললো, ‘শান্তি’। তারপর দেরি হয়নি নিয়ে আসতে একটি কষানো বাছুর (মেহমানদারীর জন্য)। তারপর যখন সে (ইবরাহীম) দেখেছে তাদের হাতসমূহ প্রসারিত হচ্ছে না উহার (খাদ্যের) দিকে, তখন সে (ইবরাহীম) তাদেরকে সন্দেহ করলো আর তার মনে সঞ্চার হলো তাদের ব্যাপারে ভয়ভীতি। তারা বললো, ‘তুমি ভয় করো না। নিশ্চয় আমরা প্রেরিত হয়েছি লূতের কওমের প্রতি’। আর তার স্ত্রী দাঁড়ানো ছিলো। তখন সে হেসে উঠলো। তখন তাকে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে ইসহাকের আর ইসহাকের পরবর্তীতে দিয়েছি ইয়াকুবের সংবাদ। সে (ইবরাহীমের স্ত্রী) বললো, ‘হায়! আমার আফসোস! আমি কি সন্তান প্রসব করবো অথচ আমি বৃদ্ধা! আরএই যে আমার স্বামী বৃদ্ধ! নিশ্চয় ইহা আশ্চর্য ব্যাপার’। তারা (ফেরেশতারা) বললো, ‘তুমি কি আশ্চয়ান্বিত হচ্ছো আল্লাহর আদেশের ব্যাপারে? ‘আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত তোমাদের উপর হে গৃহবাসী!। নিশ্চয় তিনি প্রশংসিত ও মহিমান্বিত’।
২০:৩৮-৩৯ :: (আল্লাহ বললেন,) “(সেই সময়ের কথা উল্লেখ্য) যখন আমরা ওহী করেছিলাম তোমার (মূসার) মায়ের কাছে, যা ওহী করার ছিলো। ‘তাকে (তোমার শিশুকে/ মূসাকে) রেখে দাও সিন্ধুকের মধ্যে। তারপর তাকে ভাসিয়ে দাও উপনদীতে। তাহলে নদী তাকে ঠেলে দেবে নদীতীরে। তাকে তুলে নেবে আমার শত্রু ও তার শত্রু’। আর আমি ঢেলে দিয়েছি তোমার উপর আমার পক্ষ থেকে ভালবাসা আর যেন তুমি প্রতিপালিত হও আমার চোখের সামনে।”
২৮:৭ :: আর আমরা ওহী করেছিলাম মূসার মায়ের কাছে এই যে, “তাকে (মূসাকে) দুধপান করাও। তারপর যখন তুমি আশংকা করবে তার ব্যাপারে, তখন তাকে ভাসিয়ে দিবে উপনদীতে। আর তুমি ভয় করো না আর তুমি দু:খিত হয়ো না। নিশ্চয় আমরা তাকে ফিরিয়ে দেবো তোমার কাছে আর তাকে বানাবো রসূলদের অন্তর্ভুক্ত”।
৩:৪৫-৪৮ :: (সেই সময়ের কথা উল্লেখ্য) যখন ফেরেশতাগণ বললো, ‘হে মারইয়াম নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছেন তাঁর পক্ষ থেকে একটি কথার। তার নাম হবে মসীহ ঈসা ইবনে মারইয়াম, আর সে সম্মানিত হবে দুনিয়াতে ও আখিরাতে। আর সে (আল্লাহর) নৈকট্যপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর সে মানুষের সাথে যথাযথভাবে কথা বলবে দোলনায় চড়া বাল্যবয়সে এবং পরিণত প্রৌঢ় বয়সে। আর সে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে। সে (মারইয়াম) বললো, ‘আমার প্রতিপালক, কিরূপে আমার সন্তান হবে, অথচ আমাকে স্পর্শ করেনি কোনো মানুষ?’। তিনি বললেন, ‘ঐভাবেই। আল্লাহ সৃষ্টি করেন যা তিনি (সৃষ্টি করার) ইচ্ছা করেন। যখন তিনি কোনো কাজের সিদ্ধান্ত করেন তখন তিনি উহার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হও’, সুতরাং (তা) হয়। আর তাকে শিক্ষা দিবেন কিতাব ও হিকমাত, আর তাওরাত ও ইনজীল।
১৯:২০-২১ :: সে (মারিয়াম) বললো, "কিরূপে আমার পুত্র হবে, অথচ আমাকে স্পর্শ করেনি কোনো মানুষ, আর আমি নই সীমালংঘনকারী (সতীত্ব বর্জনকারী)"। সে (রূহ/ জিবরীল) বললো, “ঐরূপেই হবে। তোমার রব বলেছেন, ‘উহা আমার জন্য সহজ’। আর এজন্য যে, আমরা তাকে (তোমার পুত্রকে) করবো মানুষের জন্য নিদর্শনস্বরূপ আর আমাদের পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ। আর উহা হয়েছে (প্রাকৃতিক নিয়ম ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণমূলক) স্থিরিকৃত সিদ্ধান্ত”।
৩:৩৯-৪০ :: তারপর ফেরেশতারা তাকে (জাকারিয়্যাকে) ডাক দিলো এ অবস্থায় যে, সে সালাত করতে দাঁড়িয়েছিল ব্যক্তিগত কক্ষে, (তারা বললো,) ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছেন ইয়াহইয়ার বিষয়ে, (যে হবে) আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বাণীর সত্যতাপ্রতিপাদনকারী আর নেতা আর আত্মসংবরণকারী/ ব্রতচারী/ সন্ন্যাসী/ জিতেন্দ্রিয়/ স্ত্রী-সংস্রব-আসক্তি থেকে আত্মনিবারিত/ (আল্লাহর পথে) নিজেকে আবদ্ধ রাখা ব্যক্তি আর সৎকর্মশীলদের মধ্য থেকে একজন নবী। সে বলে উঠলো, ‘আমার প্রতিপালক, কিরূপে আমার ছেলে হবে? অথচ নিশ্চয় আমার কাছে পৌঁছে গেছে বার্ধক্য আর আমার স্ত্রী বন্ধ্যা’। তিনি বললেন, ‘এভাবেই হবে, আল্লাহ করেন যা করার তিনি ইচ্ছা করেন’।
১৯:৭-৯ :: ‘হে যাকারিয়া, নিশ্চয় আমরা তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছি একটি পুত্র সন্তানের, যার নাম হবে ইয়াহইয়া। আমরা করিনি উহাকে ইতিপূর্বে কারো নাম’। সে বললো, ‘হে আমার রব, কিরূপে আমার হবে কোন পুত্র; অথচ আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। আর নিশ্চয় আমি পৌঁছে গেছি বার্ধক্যে চরম পর্যায়ে?’ তিনি (আল্লাহ) বললেন, ‘ঐরূপেই হবে। তোমার প্রতিপালক বলেছেন, ‘উহা (তোমার স্ত্রীর বন্ধ্যাত্বের প্রতিকার করে তাকে সন্তান গর্ভধারণের উপযোগী করা) আমার জন্য সহজ। আর নিশ্চয় তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন ইতিপূর্বে অথচ তুমি ছিলে না কোন কিছুই (শূন্যতা থেকে সৃষ্টি)’।
২১:৮৯-৯০ :: আর যাকারিয়্যাকেও (সাহায্য করেছি)। যখন সে ডেকেছে তার রবকে। (এ কথা বলে যে,) ‘হে আমার প্রভু, আমাকে ছেড়ে দিবেন না একাকী (লা ওয়ারিস) অবস্থায়। আর আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ ওয়ারিস’। তখন আমরা তার ডাকে সাড়া দিয়েছি। আর তাকে (পুত্র হিসাবে) দিয়েছি ইয়াহইয়াকে। আর তার স্ত্রীকে (বন্ধ্যাত্ব থেকে) নিরাময় করে উহার জন্য উপযোগী করে দিয়েছি। নিশ্চয় তারা প্রচেষ্টা করতো কল্যাণকর কাজের ব্যাপারে। আর তারা আমাদেরকে ডাকতো আগ্রহের সাথে ও ভীতির সাথে। আর তারা ছিলো আমাদের জন্য (দায়বদ্ধতার অনুভূতিতে) অবনমিত।
২) রসূল আহমদের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী
৬১:৬ :: আর যখন ঈসা ইবনে মারিয়াম বলেছিল, ‘হে বনী ইসরাইল, নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর রসূল, উহার সত্যতা প্রতিপাদনকারী যা আমার সামনে আছে তাওরাত থেকে আর একজন রসূলের ব্যাপারে সুসংবাদদাতা যে আসবে আমার পরে, যার নাম হবে আহমদ’। তারপর যখন সে (আহমদ) তাদের কাছে এসেছিলো স্পষ্ট প্রমাণ সহকারে, তখন তারা বলেছিলো, ‘ইহা (বাইয়িনাত) স্পষ্ট যাদু’।
৩) রসূলুল্লাহ মুহাম্মদ সম্পর্কে তাওরাত ও ইনজীলে ভবিষ্যদ্বাণী
৭:১৫৭ :: যারা অনুসরণ করে এই রসূলান নবীর যিনি উম্মী (আহলে কিতাব থেকে ভিন্ন), তারা যার উল্লেখ পায় লিখিত অবস্থায় তাদের কাছে তাওরাত ও ইনজীলের মধ্যে। সে তাদেরকে ন্যায়ের আদেশ দেয় আর তাদেরকে অন্যায় থেকে নিষেধ করে, আর হালাল করে (হালাল হিসাবে কার্যকর করে) তাদের জন্য পবিত্র জিনিসসমূহকে, আর হারাম করে (হারাম হিসাবে কার্যকর করে) তাদের উপর অপবিত্র জিনিসসমূহকে। আর নামিয়ে দেয় তাদের থেকে তাদের বোঝা আর শৃংখলসমূহ যা তাদের উপর ছিলো। সুতরাং যারা তার প্রতি বিশ্বাস করে আর তাকে সম্মান ও সাহায্য করে আর অনুসরণ করে ঐ আলোর যা নাযিল করা হয়েছে তার সাথে (আল কুরআন); তারাই সফলতা লাভকারী।
৪) সূরা কাহাফে বর্ণিত মূসা নবীর সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি ঘটনা
১৮:৬০-৮২ :: আর (সেই সময়ের কথা উল্লেখ্য) যখন মূসা বললো তার যুবক সঙ্গীকে, ‘আমি থামবো না যতক্ষণ না আমি পৌঁছবো দুই সাগর পরস্পর মিলিত হওয়ার স্থানে অথবা আমি চলতে থাকবো বহু বছর ধরে’।
তারপর যখন তারা দুজনে পোঁছে গেছে উভয় (সাগর) এর মিলিত হওয়ার স্থানে, তখন তারা দুজনে ভুলে গেছে তাদের দুজনের মাছকে। তখন (মাছটি) ধরেছে তার পথ সাগরের মধ্যে নালার মতো করে (ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে)।
তারপর যখন তারা দুজন আরো কিছু পথ অতিক্রম করেছে, তখন সে (মূসা) বললো, তার যুবক সঙ্গীকে, আমাদেরকে দাও আমাদের নাস্তা। নিশ্চয় আমরা পেয়েছি আমাদের সফর থেকে এই ক্লান্তি’।
সে (মূসার যুবক সঙ্গী) বললো, ‘তুমি কি দেখেছো যখন (মাছটি পাশে রেখে) আমরা আশ্রয়/ বিশ্রাম নিয়েছি পাথরটির কাছে। তখন নিশ্চয় আমি ভুলে গিয়েছি মাছের বিষয়টি আর আমাকে উহা ভুলিয়ে দেয়নি শয়তান ছাড়া কেউ, এ ব্যাপারে যে, আমি উহার বিষয়টি উল্লেখ করবো (তোমার কাছে, যা আমি লক্ষ্য করেছি), আর (তা এই যে, মাছটি) ধরেছে উহার পথ সাগরের মধ্যে আশ্চর্যভাবে (নালার মতো করে)।
তখন সে (মূসা) বললো, ‘উহাই যা আমরা তালাশ করছিলাম (দুই সাগর মিলিত হবার স্থান)। সুতরাং তারা ফিরে গিয়েছে তাদের পদচিহ্ন অনুসারে।
তখন তারা (সেখানে) পেয়েছে আমাদের বান্দাদের মধ্য থেকে এক বান্দাকে। তাকে আমরা দিয়েছি আমাদের পক্ষ থেকে দয়া আর তাকে আমরা শিক্ষা দিয়েছি আমাদের পক্ষ থেকে জ্ঞান।
মূসা তাকে বললো, ‘আমি কি আপনাকে অনুসরণ করতে পারি, যেন আপনি আমাকে শিক্ষা দিতে পারেন তা থেকে যা আপনাকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, যা সঠিক/ যথার্থ’।
সে বললো, ‘নিশ্চয় আপনি কখনো পারবেন না আমার সাথে ধৈর্য ধরতে।
আর কিরূপে আপনি ধৈর্য ধরবেন সে বিষয়ের উপর যা আপনি আয়ত্ত করেননি (আপনার) অভিজ্ঞতায়?’
সে (মূসা) বললো, ‘আপনি আমাকে পাবেন, ইনশাআল্লাহ (যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন), ধৈর্যধারণকারীরূপে। আর আমি অবাধ্যতা করবো না আপনার আদেশের’।
সে বললো, ‘যদি আপনি আমার অনুসরণ করেন, তাহলে আমাকে প্রশ্ন করবেন না কোনো বিষয়ে যতক্ষণ না আমি বর্ণনা করি আপনার কাছে উহা থেকে (কোনো বিষয়ে) কোনো আলোচনা’।
তারপর তারা দুজন চললো। শেষপর্যন্ত যখন তারা দুজন চড়লো একটি নৌকায়, তখন সে উহা বিদীর্ণ করে দিলো। সে (মূসা) বললো, ‘আপনি কি উহা বিদীর্ণ করেছেন উহার আরোহীদেরকে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য? নিশ্চয় আপনি করে এসেছেন একটা গুরুতর কিছু’।
সে বললো, ‘আমি কি বলিনি, নিশ্চয় আপনি পারবেন না আমার সাথে ধৈর্য ধরতে?’
সে (মূসা) বললো, ‘আমাকে ধরবেন না উহার কারণে যা আমি ভুলে গিয়েছি। আর আমার উপর আরোপ করবেন না আমার কাজে কোনো কঠোরতা’।
তারপর তারা দুজন চললো। শেষ পর্যন্ত যখন তারা দুজন সাক্ষাত পেলো একটি বালকের, তখন সে তাকে (বালকটিকে) হত্যা করে ফেললো। সে (মূসা) বললো, ‘আপনি কি হত্যা করেছেন একটি পরিশুদ্ধ প্রাণকে, সে কাউকে হত্যা না করা সত্ত্বেও? নিশ্চয় আপনি করে এসেছেন একটা ভীষণ অন্যায় কিছু’।
সে বললো, ‘আমি কি আপনাকে বলিনি, নিশ্চয় আপনি পারবেন না আমার সাথে ধৈর্য ধরতে’।
সে (মূসা) বললো, যদি আমি আপনাকে প্রশ্ন করি কোনো কিছু সম্পর্কে এরপর, তাহলে আপনি আমাকে সঙ্গে রাখবেন না। নিশ্চয় আপনি পেয়ে গেছেন আমার পক্ষ থেকে ওযর আপত্তি’।
তারপর তারা দুজন চললো। শেষ পর্যন্ত যখন তারা দুজন আসলো একটি জনপদের অধিবাসীদের কাছে, তখন তারা দুজন খাদ্য পেতে চাইলো উহার অধিবাসীদের কাছে। কিন্তু তারা অস্বীকার করলো তাদের দুজনের মেহমানদারী করতে। তারপর তারা দুজন পেলো উহাতে (ঐ জনপদে) একটি দেয়াল, যা চাচ্ছিলো ভেঙ্গে পড়তে (যা পড়পড় অবস্থায় ছিলো)। তখন সে উহাকে (মেরামত করে) দৃঢ়-প্রতিষ্ঠিত করে দিলো। সে (মূসা) বললো, ‘যদি আপনি ইচ্ছা করতেন তাহলে আপনি গ্রহণ করতে পারতেন উহার বিনিময়ে (আপনার) মজুরি’।
সে বললো, ‘এ-ই হচ্ছে বিচ্ছেদ, আমার ও আপনার মধ্যে। কিন্তু শীঘ্রই আমি আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি ঐসবের তাৎপর্য সম্পর্কে, আপনি পারেননি যার ব্যাপারে ধৈর্য ধরতে।
নৌকাটির ব্যাপার হচ্ছে- যেহেতু উহা ছিলো কয়েকজন মিসকিনের। তারা কাজ করতো সাগরে। সুতরাং আমি ইচ্ছা করেছি উহাতে দোষ যুক্ত করতে। আর (তার কারণ হচ্ছে,) তাদের পিছনে ছিলো একজন রাজা/রাষ্ট্রপতি। সে নিয়ে যেতো প্রত্যেক (ত্রুটিমুক্ত) নৌকাকে জোরপূর্বক।
আর বালকটির ব্যাপার হচ্ছে- যেহেতু ছিলো তার পিতামাতা দুজন মু’মিন ব্যক্তি। তারপর আমরা আশংকা করেছি যে, সে তাদের দুজনকে কষ্ট দিবে বিদ্রোহবশত: ও কুফরবশত:।
সুতরাং আমরা ইচ্ছা করেছি যে, তাদের দুজনকে তার বদলে দিবেন তাদের দুজনের রব (এমন এক সন্তান যে হবে) পরিশুদ্ধতার দিক থেকে তার চেয়ে উত্তম আর দয়ার দিক থেকে নিকটতর।
আর দেয়ালটির ব্যাপার হচ্ছে- যেহেতু উহা ছিলো শহরের দুজন ইয়াতিম বালকের। আর উহার নিচে ছিলো তাদের দুজনের জন্য সঞ্চিত ধন। আর তাদের দুজনের পিতা ছিলো সৎকর্মশীল (তাদের পিতা নিজের সৎউপার্জন থেকে তাদের দুজনের জন্য উহা সঞ্চিত রেখেছিলো।) সুতরাং আপনার রব ইচ্ছা করেছেন যে, তারা দুজন পৌঁছবে তাদের দুজনের যৌবনে। আর (তখন) তারা দুজনে বের করবে তাদের দুজনের জন্য সঞ্চিত ধন (সেই বয়সে তাদের জন্য উহাতে স্বত্বাধিকার বজায় রাখা সহজ হবে)। এটা অনুগ্রহ, আপনার রবের পক্ষ থেকে। আর (যা কিছু আমি করেছি) আমি উহা করিনি আমার নিজস্ব সিদ্ধান্তক্রমে (অর্থাৎ আমি সবকিছু আল্লাহর আদেশেই করেছি)। ইহাই উহার তাৎপর্য আপনি পারেননি যার ব্যাপারে ধৈর্য ধরতে।
৫) বানী ইসরাইল দুইবার বিপর্যয় সৃষ্টি করার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী
১৭:৪-৮ :: আর আমরা নির্ধারণ করে দিয়েছি বানী ইসরাইলের প্রতি কিতাবের মধ্যে, ‘অবশ্যই তোমরা বিপর্যয় সৃষ্টি করবে (নিজ ইচ্ছায়, ১৭:৮) পৃথিবীতে দুইবার, আর অবশ্যই তোমরা বিদ্রোহ করবে, বড় ধরনের বিদ্রোহ।
তারপর যখন এসেছে দুটি ওয়াদার প্রথমটি, তখন আমরা সমুত্থিত/ প্রেরণ করেছি তোমাদের উপর আমাদের বান্দাদেরকে, যারা ছিলো অত্যন্ত শক্তিমান, তারপর তারা কঠোর হয়েছে (তোমাদের) ঘরবাড়ির অভ্যন্তরে, আর হয়েছিলো (শাস্তির) ওয়াদা সুসম্পন্ন/ কার্যকর/ বাস্তবায়িত।
তারপর আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি তোমাদের (বিজয়ের) পালা তাদের উপর। আর আমরা তোমাদেরকে সাহায্য করেছি মালসম্পদ দিয়ে আর সন্তানসন্ততি দিয়ে, আর আমরা তোমাদেরকে পরিণত করেছি প্রচুর সংখ্যক সদস্যবিশিষ্ট বাহিনীতে।
যদি তোমরা উত্তম কাজ করে থাকো, তাহলে তোমরা উত্তম কাজ করেছো তোমাদের নিজেদের জন্য। আর যদি তোমরা মন্দকাজ করে থাকো, তাহলে উহাও (করেছো তোমাদের নিজেদেরই বিরুদ্ধে)। তারপর যখন এসেছে দ্বিতীয় ওয়াদার সময় (তখন আমরা আমাদের বান্দাদেরকে প্রেরণ করেছি ১৭:৫), তারা কালিমাময় করার জন্য তোমাদের মুখমন্ডলকে/ চেহারাকে, আর তারা মসজিদে দাখিল হওয়ার জন্য যেমনভাবে উহাতে (মসজিদে) দাখিল হয়েছে প্রথম বারে (পাঠানো বান্দাগণ); আর তারা ধ্বংস করার জন্য যা-ই তাদের আয়ত্তে আসে, (যথাযথভাবে) ধ্বংস।
আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদেরকে রহমত করবেন। আর যদি তোমরা আবার অনুরূপ (ফাসাদ) করো, তাহলে আমরা আবার অনুরূপ (শাস্তিদান) করবো। আর আমরা বানিয়েছি জাহান্নামকে কাফিরদের জন্য অবরোধের স্থান।
৬) সূরা রুমে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণী
৩০:১-৭ :: আলিফ লাম মীম। রূম (রোমানগণ) পরাজিত হয়েছে। পৃথিবীর সর্বনিম্ন অঞ্চলে। আর তারা তাদের এ পরাজয়ের পর শীঘ্রই বিজয়ী হবে। কয়েক বছরের মধ্যেই। সিদ্ধান্ত আল্লাহরই, আগেও এবং পরেও। আর সেদিন আনন্দিত হবে মু’মিনগণ। আল্লাহর সাহায্যে। তিনি সাহায্য করেন যাকে তিনি ইচ্ছা করেন। আর তিনি মহাশক্তিমান ও দয়ালু। ইহা আল্লাহর ওয়াদা। আল্লাহ খেলাফ করেন না তাঁর ওয়াদা। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জ্ঞান রাখে না। তারা জানে পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিক। আর তারা আখিরাতের (পরবর্তী অনিবার্য বাস্তবতার) ব্যাপারে উদাসীন।
৭) সূরা ইউসুফে বর্ণিত ইউসুফের স্বপ্ন
১২:৪-৬ :: (উল্লেখ্য) যখন ইউসুফ বললো তার পিতাকে, ‘হে আমার আব্বা, নিশ্চয় আমি (স্বপ্নে) দেখেছি এগারোটি গ্রহ আর সূর্য ও চন্দ্রকে। আমি ঐসবকে দেখেছি আমার প্রসঙ্গে সিজদাকারী অবস্থায়’।
সে বললো, ‘হে আমার পুত্র, তুমি বর্ণনা করো না তোমার স্বপ্ন তোমার ভাইদের কাছে। তাহলে তারা কায়দা কৌশল করবে তোমার বিরুদ্ধে, (বড় ধরনের) কায়দা কৌশল। নিশ্চয় শয়তান মানুষের জন্য স্পষ্ট শত্রু’। আর এভাবে তোমাকে বাছাই করবেন তোমার রব। আর তোমাকে শিক্ষা দিবেন আহাদিসের/ (স্বপ্ন-)কথার তাৎপর্য। আর তিনি পূর্ণ করবেন তাঁর নিয়ামত তোমার উপর আর ইয়াকুবের বংশধরদের উপর; যেমন তিনি তা পূর্ণ করেছেন তোমার পিতৃপুরুষদের উপর, আগেও; ইবরাহীমের উপর আর ইসহাকের উপর। নিশ্চয় তোমার রব মহাজ্ঞানী ও মহাবিজ্ঞ।
৮) সূরা ইউসুফে বর্ণিত ইউসুফের দুই কারাসঙ্গীর ও বাদশাহর স্বপ্ন
১২:৩৬-৪৯ :: আর প্রবেশ করেছে তার সাথে (ইউসুফের সাথে) কারাগারে দুজন যুবক। তাদের দুজনের একজন বললো, ‘নিশ্চয় আমি স্বপ্নে দেখেছি আমি নিংড়ে বের করছি মদ। আর অন্যজন বলেছে নিশ্চয় আমি স্বপ্নে দেখেছি আমি বহন করছি আমার মাথার উপর রুটি, উহা থেকে পাখি খাচ্ছে। আমাদেরকে অবহিত করুন উহার তাৎপর্য। নিশ্চয় আমরা আপনাকে দেখছি উত্তম আচরণকারীদের অন্তর্ভুক্ত’।
সে (ইউসুফ) বললো, ‘তোমাদের দুজনের কাছে আসবে না খাদ্য, যা (তোমাদের) দুজনকে রিযিকস্বরূপ দেয়া হয়, এছাড়া যে।, আমি তোমাদেরকে অবহিত করবো উহার তাৎপর্য, (ঐ খাদ্য) তোমাদের কাছে আসার আগেই। উহা তা থেকেই (বলবো) যা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন আমার রব (আল্লাহ)। নিশ্চয় আমি ছেড়ে দিয়েছি ঐ কওমের মিল্লাত (ইবাদাতের বহুত্ববাদী স্বরূপ ও প্রকৃতি), যারা বিশ্বাস করে না আল্লাহর প্রতি আর তারা আখিরাতের প্রতিও অবিশ্বাসী।
আর আমি অনুসরণ করছি আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের মিল্লাত (ইবাদাতের একত্ববাদী স্বরূপ ও প্রকৃতি)। সঙ্গত নয় আমাদের জন্য শিরক করা আল্লাহর সাথে কোনো সত্তাকেই/ কোনো কিছুকেই। উহা (তাওহীদ) আল্লাহর অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত আমাদের উপর আর মানবজাতির উপর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।
হে আমার কারাগারের দুই সঙ্গী, পৃথক পৃথক রব কি উত্তম নাকি আল্লাহই উত্তম, যিনি একজনই ও একচ্ছত্র ক্ষমতাধর?
তোমরা তো দাসত্ব করছো না তাঁকে বাদ দিয়ে কিছু নামের ছাড়া, যার নামকরণ করেছো তোমরা আর তোমাদের বাপদাদা। আল্লাহ নাযিল করেননি যা সম্বন্ধে কোনো প্রমাণ। কারো অধিকার নেই আইন দেয়ার শুধু আল্লাহর ছাড়া।{বিচার-ফায়সালা শুধুমাত্র আল্লাহর আইন অনুযায়ী করতে হবে}। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা কারো দাসত্ব করো না একমাত্র তাঁর ছাড়া। ইহাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জ্ঞান রাখে না।
‘হে আমার কারাগারের দুই সঙ্গী, তোমাদের দুজনের একজনের স্বপ্নের ব্যাখ্যা হচ্ছে, সে পান করাবে তার প্রভুকে মদ; আর অন্যজনের স্বপ্নের ব্যাখ্যা হচ্ছে, তাকে শূলে চড়ানো/ ক্রুশবিদ্ধ করা হবে, তারপর পাখি খাবে তার মাথা থেকে। সম্পন্ন হয়েছে সেই বিষয়টি যা সম্বন্ধে তোমরা দুজন যথাযথ অভিমত জানতে চেয়েছো’।
আর সে (ইউসুফ) বললো তাকে উদ্দেশ্য করে যার সম্বন্ধে সে ধারণা করেছে যে, সে মুক্তি পাবে তাদের দুজনের মধ্য থেকে, ‘আমার কথা উল্লেখ করো তোমার প্রভুর কাছে। তারপর তাকে (মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদীকে) ভুলিয়ে দিয়েছে শয়তান তার প্রভুর কাছে (ইউসুফের কথা) উল্লেখ করতে। সুতরাং সে (ইউসুফ) পড়ে থাকলো কারাগারে কয়েকটি বছর’।
আর (একদা) রাজা/রাষ্ট্রপতি বললো, ‘নিশ্চয় আমি (স্বপ্নে) দেখেছি সাতটি গাভী মোটাতাজা, সেগুলোকে খেয়ে ফেলছে সাতটি চিকনা (গাভী)। আর সাতটি শীষ সবুজ আর অন্য (সাতটি) শুকনা। হে আমার মালায়ে/ নির্বাহী পরিষদ, আমাকে যথাযথ অভিমত জানাও আমার স্বপ্নের ব্যাপারে, যদি তোমরা আমার স্বপ্নের ব্যাপারে ব্যাখ্যা করতে পারো’।
তারা বললো, ‘এটা অর্থহীন স্বপ্ন। আর আমরা নই স্বপ্নের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে জ্ঞানী ব্যক্তি’।
আর বললো ঐ কয়েদী তাদের দুজনের মধ্যে যে মুক্তি পেয়েছে আর ভুলে যাওয়ার পর যার স্মরণে পড়েছে একটি সময়কাল পরে, (সে বললো) ‘আমি তোমাদেরকে অবহিত করবো উহার ব্যাখ্যা। সুতরাং আমাকে (আমার চেনা ব্যাখ্যাকারীর কাছে) প্রেরণ করো’।
(সে ইউসুফের কাছে গিয়ে বললো,) ‘ইউসুফ, হে সত্যবাদী, আমাদেরকে যথাযথ অভিমত জানাও এ (স্বপ্নের) ব্যাপারে যে, সাতটি গাভী মোটাতাজা, সেগুলোকে খেয়ে ফেলছে সাতটি চিকনা (গাভী)। আর সাতটি শীষ সবুজ, আর অন্য (সাতটি) শুকনা। যেন আমি ফিরে যাই লোকদের কাছে যেন তারা জানতে পারে’।
সে (ইউসুফ) বললো, ‘তোমরা চাষ করবে সাত বছর ক্রমাগতভাবে। তারপর যা (যে ফসল) তোমরা কাটবে, তোমরা উহা রেখে দিবে উহার শীষগুলোর মধ্যেই (সংরক্ষিত), অল্প পরিমাণ ছাড়া, তা থেকেই তোমরা খাবে’।
তারপর আসবে উহার পর কঠিন (দুর্ভিক্ষের) সাতটি বছর। (তখন) খাবে যা তোমরা আগেই সঞ্চয় করেছো ঐ (বছর)গুলোর জন্য, অল্প পরিমাণ ছাড়া, যা তোমরা সংরক্ষণ করবে।
তারপর আসবে উহার পর একটি বছর, উহাতে মানুষের জন্য বৃষ্টিপাত হবে আর উহাতে তারা ফলের রস নিংড়াবে’।
আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞান ও ক্ষমতা এবং মানুষকে পরীক্ষা ও ন্যায়বিচারের সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান
আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞান ও ক্ষমতা এবং মানুষের কর্মফলের বিষয়ে কিছু বহুল জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন হলো- আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং সেই সাথে সর্বশক্তিমান, ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু, তবুও কেন তিনি মন্দকে সংঘটিত হতে দেন? যেহেতু আল্লাহ পূর্ব থেকে জানেন এবং সর্বশক্তিমান, তাহলে কেন তিনি শুধু ভালোদেরকে সৃষ্টি করেন নি? যেহেতু কে কী করবে তা আল্লাহ জানেন, তাহলে আবার মানুষকে পরীক্ষা করার প্রয়োজন কি? কেন কিছু আয়াতে আল্লাহ বললেন যে, তাঁকে জেনে নিতে হবে?
প্রথম কথা হলো, আল্লাহ যা সৃষ্টি করবেন তিনি তা জানেন এবং তিনি যা সৃষ্টি করবেন বলে জানেন তিনি তা সৃষ্টি করেন। এটা আল্লাহর ‘পরম সত্তা’ হওয়ার সাথে সম্পর্কিত বিষয়। সুতরাং এ দাবি করা ভুল যে, তিনি যা সৃষ্টি করবেন বলে জানেন কেন তিনি তা সৃষ্টি করেন, কেন তিনি এমন কিছু সৃষ্টি করেন না যা তিনি সৃষ্টি করবেন বলে জানতেন না? কারণ এমন কিছু সৃষ্টি করার মানে হলো তাঁর পূর্বজ্ঞানের বাইরে কিছু হওয়া, যার ফলে তিনি সর্বজ্ঞ হতে পারেন না। আবার তিনি যা সৃষ্টি করবেন বলে জানেন তা তিনি সৃষ্টি করেন, কারণ তাঁর জ্ঞান শুধু তাঁর পরিকল্পনার সাথে নয়, বরং তাঁর ক্ষমতার সাথেও সম্পর্কিত। তিনি যা ইচ্ছা করেন তা করার ক্ষমতা রাখেন ও করেন। আর তিনি তা-ই করার ইচ্ছা করেন যা তাঁর গুণের সাথে সম্পর্কিত, তাঁর গুণহীনতা বা ত্রুটির সাথে নয়। কারণ তিনি যাবতীয় ত্রুটি থেকে প্রমুক্ত। আর ত্রুটি না থাকা কোনো ত্রুটি নয়, বরং সেটা গুণের পূর্ণতা। যেমন নিদ্রা যেতে না পারা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং নিদ্রাই দুর্বলতার ফলস্বরূপ। তাই আল্লাহকে নিদ্রা স্পর্শ করে না। এভাবে আল্লাহ তাঁর পরম সত্তার উপযোগী যাবতীয় গুণের অধিকারী এবং যাবতীয় ত্রুটি থেকে প্রমুক্ত।
মানুষের কর্ম ও কর্মফল আল্লাহর সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়টি ‘আল্লাহর সৃষ্টি ও মানবীয় কর্ম’ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
প্রশ্ন করা হয়- আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং সেই সাথে সর্বশক্তিমান, ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু, তবুও তিনি মন্দকে সংঘটিত হতে দেন কেন? যেহেতু আল্লাহ পূর্ব থেকে জানেন এবং সর্বশক্তিমান, তাহলে কেন তিনি শুধু ভালোদেরকে সৃষ্টি করেন নি?
এ প্রশ্নগুলোর জবাবে প্রথমে বলতে হয়- যেটাকে মন্দ হিসেবে অভিহিত করা হয়, যেমন- কষ্টের অনুভূতি, তা সৃষ্টির চেতনাবোধের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়। আল্লাহ তাঁর স্বাধীন ক্ষমতা ও পরম অধিকারের ভিত্তিতে কষ্ট ও সুখের অনুভূতি সৃষ্টি করেছেন। এর একটির অস্তিত্ব অন্যটিকে সঠিকভাবে মূল্যায়িত করে। সপ্রাণ সৃষ্টির মধ্যে ইতিবাচক প্রচেষ্টার যে প্রবণতা তৈরি করা হয়েছে তা তাকে কষ্টকে এড়িয়ে বা সীমিত কষ্ট সহ্য করে ততোধিক সুখের জন্য কর্মতৎপর করে। এভাবেই সৃষ্টির প্রাণচাঞ্চল্য এবং ক্রমবিকাশ অব্যাহত থাকে। তারপর যে কষ্ট তার জন্য অনিবার্য হয়ে যায়, সেটা সৃষ্টি ও বিকাশের পাশাপাশি তার লয়ের জন্য যে প্রক্রিয়া রয়েছে তার অংশ। বস্তুত লয়ের পূর্ব পর্যন্ত ইতিবাচকভাবে বিকশিত হওয়ার যে জীবন-পদ্ধতির ব্যবস্থা করেছেন সেটাই তাঁর দয়ার স্বরূপ।
তারপর যদি ‘মন্দ’ বলতে নৈতিক মন্দকে বুঝানো হয়, তাহলে আল্লাহ স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মের সীমিত ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, যে ভালো বা মন্দ করতে পারে। এই ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’ এর বিকল্প সুযোগ থাকার প্রেক্ষিতে মানুষের মধ্যে ভালো গুণের বিকাশ সাধন সম্ভব হয়, আবার যদি সে মন্দকে বেছে নেয়, তাহলে মন্দের প্রসার ঘটে। কিন্তু মন্দ করতে তাকে বাধ্য করা হয় নি, বরং নিষেধ করা হয়েছে, তাই সে মন্দ করার বিষয়টি তার অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত হয়। এখন ‘অপরাধ’ যেহেতু ‘অপরাধ’, তাই তার ‘শাস্তি’ সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। আবার আল্লাহ দয়ালূ বিধায় তিনি অপরাধের শাস্তি তাৎক্ষণিকভাবে দেন না, বরং সংশোধন করা ও সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য অবকাশ দেন। যদি সে তাওবাহ করে, তাহলে তিনি তাকে ক্ষমা করেন। এটাও তাঁর দয়ার স্বরূপ। আল্লাহ শুধু ভালোদেরকে সৃষ্টি করেন নি কেন, এ প্রশ্ন অবান্তর। কারণ, যদি তিনি ইচ্ছা করতেন, তাহলে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে ভালো বানাতে পারতেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদেরকে ইচ্ছার স্বাধীনতা সত্ত্বেও ‘ভালো’ হওয়ার জন্য যে পুরস্কার দেয়ার বিষয় রাখা হয়েছে, সেটা প্রাসঙ্গিক হতো না। আর তিনি ইচ্ছার স্বাধীনতা দেয়ার পর যারা ‘মন্দ’ করবে বলে তিনি জানেন, তাদেরকে তিনি সৃষ্টি না করলে তাঁর জানা সম্ভাবনার স্তরে থাকে, বাস্তবে তিনি কাউকে সৃষ্টি করেছেন এবং সে মন্দ করেছে, এমনটি হতো না। সেই সাথে, যারা মন্দ করেছে, তাদের সাথে দ্বান্দ্বিক অবস্থায় থাকার মাধ্যমে যারা ভালো করেছে তাদের ‘ভালো’ এর যে উৎকর্ষ, তা হতো না। মন্দের শাস্তি মন্দ হবে, আর তা সৃষ্টি ও বিকাশের পাশাপাশি ‘লয়’ এর বাস্তবতার অনুরূপ বিষয়। মন্দ করা সত্ত্বেও তাদেরকে তাৎক্ষণিক শাস্তি না দিয়ে অবকাশ দেয়া হয়েছিলো, এটা ছিলো তাদের প্রতি দয়া। তাদের প্রতি দয়া হিসেবে তাদেরকে সৃষ্টি না করাটা আবশ্যকীয় বিষয় নয়। তাদের মন্দকর্ম স্রষ্টার জানার প্রভাবে হয় নি, বরং তাদের স্বাধীন ইচ্ছায় হয়েছে। সুতরাং পাপের জন্য তাদের শাস্তি তাদের প্রতি দয়ার সাথে সাংঘর্ষিক নয়।
আল্লাহ পূর্ব থেকে জানেন কারা ঈমান আনবে এবং কারা কুফর করবে। তা সত্ত্বেও তিনি তাদেরকে পরীক্ষা করছেন। এই পরীক্ষার তাৎপর্য হলো, তাদের ভালো বা মন্দ কাজ করার বিষয়টি তাদের স্বাধীন ইচ্ছার সাথে সম্পর্কিত এবং তা আল্লাহর পূর্বজ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত নয়। অন্যদিকে আল্লাহর পূর্বজ্ঞান তাঁর একটি গুণবিশেষ। যখন বলা হয় যে, আল্লাহ জেনে নেবেন বা আল্লাহকে জেনে নিতে হবে, কে মু’মিন আর কে মুনাফিক্ব, তখন এর দ্বারা বুঝানো হয়, তাদের কর্মের মাধ্যমে তাদের ঈমান ও নিফাক্ব সম্পর্কে জানা। যদিও আল্লাহ পূর্ব থেকে তা জানেন, কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটনা সংঘটনের প্রেক্ষিতে জানার বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়। আল্লাহ ঘটনার পূর্ব থেকে যা জানেন, ঘটনা সংঘটনের প্রেক্ষিতেও তা-ই জানবেন। কিন্তু তিনি ঘটনা সংঘটনের প্রেক্ষিতে যা জানবেন, সেটাকেই তিনি বিচারের প্রমাণ হিসেবে সামনে আনবেন। আল্লাহকে জেনে নিতে হবে, কথাটির অর্থ এ নয় যে, কী ঘটবে আল্লাহ তা জানেন না। বরং এটি মানুষকে কর্মের বিষয়ে যে পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে তা স্পষ্ট করার জন্য মানবীয় বক্তব্যরীতি অনুসারে একটি অভিব্যক্তি মাত্র।
পরিশেষে বলা যায় যে, ‘আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞান ও ক্ষমতা’ এবং ‘মানুষকে পরীক্ষা ও ন্যায়বিচার’ বিষয় দুটির মধ্যে কোনোরূপ বাস্তব অসামঞ্জস্য নেই। আল্লাহ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত এবং প্রকাশ্য ও গোপন সব বিষয়ে জ্ঞানী। তিনি সর্বশক্তিমান, ন্যায়বিচারক ও দয়ালু। তিনি মানুষকে ভালো ও মন্দের মধ্যে যে কোনোটি বাছাই করার ইচ্ছা ও কর্মগত স্বাধীনতা দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা হচ্ছে। এ পরীক্ষায় সে ভালো প্রতিফল পাবে যদি সে ভালোকে বাছাই করে। আর সে মন্দ প্রতিফল পাবে যদি সে মন্দকে বাছাই করে। মানুষের কর্ম ও কর্মফলের জন্য সে-ই দায়ী। আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞানের সাথে ‘ভাগ্য’ এর কোনো সম্পর্ক নেই।
যেহেতু অনেক আয়াত থেকে জানা যায় যে, মহাবিশ্বের সকল বস্তু, বিষয় বা ঘটনা-দুর্ঘটনা একটি কিতাবে পূর্বলিখিত রয়েছে। তাই এ বিষয়টিকে কপালের লিখন বা ভাগ্যবাদের প্রমাণ হিসেবে দাবি করা হয়। এ অধ্যায়ে এ প্রসঙ্গে থাকা আয়াতসমূহ এবং তাতে থাকা ‘সবকিছু একটি কিতাবে লিখে রাখা এবং কিতাবের লেখা অনুযায়ী ঘটনার সংঘটন’-এর তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করা হবে।
কিতাব শব্দের অর্থ ও তাৎপর্য
কিতাব শব্দটির মূল অক্ষরসমূহ হলো ‘কাফ তা বা’। কিতাব শব্দটি যেমন লিখিত আলগা পাতা বাঁধা (গ্রন্থ বা বই) বুঝায়, তেমনি আবার যা লেখা হয়েছে তাকেই কিতাব বলা হয়, এমনকি তা যদি মাত্র একটি বাক্যের একটি চিঠিও হয়। কিতাব বলতে কার্যবিবরণী বুঝায়, আবার কারণ ও ফলাফল বিধি বা প্রাকৃতিক আইন এবং চিরন্তন বাধ্যতামূলক আইন-বিধানকে বুঝায়।
কোনো হুকুম (সিদ্ধান্ত বা আইন-বিধান) যখন স্থায়ী রূপ লাভ করে সেটাকে বুঝাতে ‘কিতাব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। প্রকৃতির আইন হলো আগুন তাপ বিকিরণ করে। আর সামাজিক স্তরে একটি সরকারি সিদ্ধান্ত হচ্ছে ‘সমস্ত ট্রাফিক রাস্তার বাম দিকে চলবে’। এ উভয়টির জন্য ‘কিতাব’ শব্দ ব্যবহৃত হতে পারে।
বিধিবদ্ধ আইন বা আইনগত বিষয় অর্থে ‘কিতাব’ শব্দের ব্যবহারের উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে ৪:২৪, ২:২৩৫, ৪:১০৩, ৮:৬৮, ৯৮:৩।
৪:২৪ :: আরও (হারাম করা হয়েছে) নারীদের মধ্যকার (সধবা তথা যে নারীর স্বামী জীবিত কিন্তু স্বামী তাকে তালাক দেয়নি অথবা সে নিজেও তার স্বামীকে আদালতের মাধ্যমে তালাক দেয়নি এরূপ) মুহসানাতকে (বিবাহের মাধ্যমে চরিত্র রক্ষার দুর্গে অবস্থানকারিনী নারীকে)। ‘মা মালাকাত আইমানুকুম’/‘যারা তোমাদের প্রভাবাধীনে থেকে তোমাদের দ্বারা তাদের রক্ষণাবেক্ষণলাভের প্রতিশ্রুতির আওতায় তোমাদের অধীনস্থ হয়েছে’ এরূপ নারী ছাড়া {‘যেসব নারী ইসলাম গ্রহণ করে তাদের কাফের স্বামীদেরকে ছেড়ে দারুল কুফর থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামে চলে এসেছে তাদের মধ্য থেকে যারা স্বাধীনভাবে উপার্জনের যোগ্যতাসম্পন্ন না হওয়ায় উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের জন্য তাদেরকে মু’মিন নারী বা পুরুষের অভিভাবকত্বাধীনে দিয়ে দেয়া হয়েছে তারা’ (৬০: ১০) ছাড়া}। ইহা তোমাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব/ বিধিবদ্ধ আইন। আর হালাল করা হয়েছে তোমাদের জন্য এ তালিকার বাহিরের সকল নারীদেরকে (যদি না তারা হয় মুশরিক বা যিনাকারিনী বা কাফির ২: ২২১, ২৪:৩, ৬০: ১০)। এ শর্তে যে, তোমরা তালাশ করবে তোমাদের মালসম্পদ ব্যয়ের মাধ্যমে, মুহসিনীন (বিবাহের মাধ্যমে চরিত্র রক্ষার দুর্গে অবস্থানকারী পুরুষ) হিসাবে, মুসাফিহীন (অর্থের বিনিময়ে সাময়িক/ নিছক যৌনসম্পর্ক স্থাপনকারী পুরুষ) হিসাবে নয়। সুতরাং তোমরা যা (যে অধিকার) লাভ করেছো তাদের নিকট থেকে তার ফলে (আল্লাহর বিধান অনুসারে ৪:৪) তাদেরকে দিয়ে দাও তাদের উজূর/ চুক্তির দ্বারা সাব্যস্ত প্রাপ্য, ফরজ হিসাবে। আর তোমাদের গুনাহ নেই ঐ অংশ কম করাতে তোমরা পরস্পর রাজি হও যে অংশ কম করার ক্ষেত্রে দেনমোহর নির্ধারিত হয়ে যাবার পর। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।
২:২৩৫ :: আর তোমাদের উপর কোন গুনাহ নেই সেক্ষেত্রে তোমরা যা (তোমাদের কথাবার্তায়) প্রকাশ করো (বিধবা) নারীদের বিবাহের পর্যায়ে পড়ে এমন কিছু অথবা (এরূপ চিন্তা) গোপন রাখো তোমাদের মনের মধ্যে (উহার বিষয়ে)। আল্লাহ জানেন যে, নিশ্চয় তোমরা তোমাদের আলোচনায় তাদেরকে রাখবেই। কিন্তু তোমরা তাদেরকে (বিবাহ করার) ওয়াদা করো না গোপনে। কিন্তু এটা হতে পারে যে, তোমরা তাদের সাথে কথা বলবে ন্যায়নীতি বজায় রেখে। আর তোমরা সিদ্ধান্ত করো না বিবাহ বন্ধনের যতক্ষণ না বিধিবদ্ধ বিষয় (অর্থাৎ ইদ্দাত) তার নির্ধারিত শেষ সীমায় পৌঁছে। আর জেনে রাখো যে, নিশ্চয় আল্লাহ জানেন কী আছে তোমাদের মনে। সুতরাং তোমরা তাঁকে ভয় করো। আর জেনে রাখো যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহনশীল।
৪:১০৩ :: তারপর যখন তোমরা সালাত সম্পাদন করো তখন আল্লাহকে স্মরণ করো দাঁড়িয়ে আর বসে আর কাত হয়ে শুয়ে। তারপর যখন তোমরা নিরাপদ হও তখন তোমরা সালাত কায়েম করো। নিশ্চয় সালাত মু’মিনদের উপর ওয়াক্তগত কিতাব বা বিধান হিসাবে বিদ্যমান বা বিধিবদ্ধ।
৮:৬৭-৬৮ :: নবীর জন্য সঙ্গত নয় যে, তার কাছে থাকবে কোন যুদ্ধবন্দী (সে যুদ্ধে শত্রুকে বন্দী করা শুরু করবে), যতক্ষণ না সে (শত্রুদেরকে) আচ্ছামতো ধোলাই দেবে, পৃথিবীতে (রণাঙ্গনে/ যুদ্ধের ময়দানে)। তোমরা ইচ্ছা করো দুনিয়ার সম্পদ পেতে (তথা মুক্তিপণ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা)। আর আল্লাহ ইচ্ছা করেন আখিরাত দিতে। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ। যদি আল্লাহর বিধান না থাকতো পূর্ব থেকে {৪৭:৪ মুক্তিপণের বিধান), তাহলে তোমাদেরকে যা তোমরা নিয়েছো সেই কারণে মহাশাস্তি স্পর্শ করতো।
৯৮:৩ :: উহাতে স্থায়ীভাবে লিখিত আছে স্থায়ী বিধানসমূহ।
এছাড়া কোনো বিধানকে বিধিবদ্ধ করে দেয়ার অর্থে ‘কুতিবা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন :
২:১৭৮ :: হে ঐসব লোক যারা ঈমান/ বিশ্বাস করেছো, বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে তোমাদের উপর কিসাস (ফৌজদারি মামলায় অপরাধীকে সমানুপাতিক শাস্তিপ্রদান), হত্যার বিচারের ক্ষেত্রে। হত্যাকারী স্বাধীন ব্যক্তি হলে তার বদলায় ঐ স্বাধীন ব্যক্তিকেই আর হত্যাকারী দাস হলে তার বদলায় ঐ দাসকেই আর হত্যাকারী নারী হলে তার বদলায় ঐ নারীকেই (হত্যা করতে হবে)। তারপর যাকে মাফ করে দেয়া হবে তার ভাইয়ের (হত্যাকারীর ভাই তথা নিহতের নিকটতম আত্মীয়দের) পক্ষ থেকে কিছুটা। তাহলে ন্যায়নীতির অনুসরণ করবে আর উত্তমভাবে তাকে (দিয়াত/ রক্তপণ) আদায় করে দেবে। উহা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে (শাস্তি) হ্রাসকরন ও দয়া। সুতরাং যে সীমালংঘন করবে এরপরও, তার জন্য আছে কষ্টদায়ক শাস্তি।
২:১৮০ :: বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে তোমাদের উপর যখন উপস্থিত হয় তোমাদের মধ্যে কারো মৃত্যু যদি সে ছেড়ে যায় সম্পদ, সে ওয়াসিয়্যাত করবে পিতামাতার জন্য আর নিকট আত্মীয়দের জন্য ন্যায়নীতির ভিত্তিতে। ইহা মুত্তাকীদের উপর দায়িত্ব।
২:১৮৩ :: হে ঐসব লোক যারা ঈমান/ বিশ্বাস করেছো, বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে তোমাদের উপর সিয়াম/ আত্মসংযম যেরূপে বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছিলো তাদের উপর যারা তোমাদের আগে ছিলো, যেন তোমরা স্রষ্টা-সচেতন হতে পারো।
২:২১৬ :: বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে তোমাদের উপর কিতাল/ (ন্যায় প্রতিষ্ঠার) যুদ্ধ। আর উহা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। আর হতে পারে যে, তোমরা অপছন্দ করো কোনো বিষয় অথচ উহা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার হতে পারে যে, তোমরা পছন্দ করো কোনো বিষয় অথচ উহা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ জানেন আর তোমরা জানো না।
নৈতিক মূল্যবোধের ফলাফল সম্পর্কিত প্রাকৃতিক আইনের বিষয়ে ‘কাতাবা’ শব্দের প্রয়োগের উদাহরণ হিসেবে ২১:১০৫ আয়াতের উল্লেখ করা যেতে পারে। যাতে বলা হয়েছে :
২১:১০৫ :: আর নিশ্চয় আমরা লিখে দিয়েছি ‘যাবূর’ নামক কিতাবে যিকিরের/ স্মরণীয় উপদেশের পর এ কথাটি যে, ‘নিশ্চয় পৃথিবীর ওয়ারিস হবে আমার সালেহ/ সৎকর্মশীল বান্দারা’।
প্রকৃতপক্ষে কুরআনের উদাহরণ থেকে জানা যায় যে, কিতাব বলতে কোথাও আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী-রসূলদের কাছে নাজিলকৃত কিতাবকে বুঝায়, কোথাও তা দ্বারা মানুষের আমলনামাকে বুঝায় যেন ঐ আমলনামা অনুসারে তাদেরকে চূড়ান্ত কর্মফল প্রদান করা যায়, আবার কোথাও এর দ্বারা নৈতিক ও প্রাকৃতিক বিধানকে বুঝায়।
সকল কিতাব যে মূল কিতাব থেকে উৎসারিত তাকে বলা হয় ‘উম্মুল কিতাব’। আবার একটি কিতাবের মূল বা কেন্দ্রীয় বক্তব্যকেও ‘উম্মুল কিতাব’ বলা হয়।
উম্মুল কিতাব এবং অন্যান্য কিতাবসমূহের ধারণাটি একটি উদাহরণের মাধ্যমে বুঝা যেতে পারে। কম্পিউটারে কোনো ফোল্ডারে যখন অনেকগুলো ফাইল থাকে, তখন ঐ ফোল্ডারটাকে বলা যেতে পারে ‘উম্মুল কিতাব’ এবং তাতে থাকা একেকটি ফাইলকে বলা যেতে পারে একেকটি কিতাব।
কুরআনে কোথায় আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত কিতাবের কথা বলা হচ্ছে এবং কোথায় মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক আইন সম্বলিত কিতাবের কথা বলা হচ্ছে তা বক্তব্য বিষয় ও তার পূর্বাপর প্রেক্ষিত থেকে স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায়।
মহাবিশ্বের সবকিছু বা সকল ঘটনা-দুর্ঘটনা একটি কিতাবে লিখিত রয়েছে
২২:৭০ :: তুমি কি জানো না যে, আসমান-যমীনে যা কিছু আছে, আল্লাহ সব বিষয়েই জানেন। উহা কিতাবে লিখিত আছে। উহা (কিতাবে লিখে রাখা) আল্লাহ্র জন্য সহজ।
২৭:৭৫ :: আর কোনো অদৃশ্য বিষয় / গোপন রহস্য নেই আকাশে ও পৃথিবীতে, উহা স্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ থাকা ছাড়া।
৬:৫৯ :: আর তাঁর (আল্লাহর) কাছে আছে গায়েবের চাবিসমূহ। কেউ তা (গায়েব) জানে না তিনি (আল্লাহ) ছাড়া। আর তিনিই জানেন যা আছে স্থলভাগে ও জলভাগে। আর ঝরে পড়ে না কোনো পাতা তিনি তা জানা ছাড়া। আর না কোনো শস্যদানা আছে জমিনের অন্ধকারের মধ্যে আর না আছে কোনো ভেজা জিনিস আর না আছে কোনো শুকনো জিনিস, তা (তার সময় ও স্থানগত পরিমাণ-পরিমাপ ও তার কার্যকারণ) সুস্পষ্ট কিতাবে (লাওহে মাহফুজে থাকা উম্মুল কিতাবে) লিখিত থাকা ছাড়া। (বা, তা ভৌত মহাবিশ্বের নিয়মের আওতায় থাকা ছাড়া)।
৫৭:২২-২৩ :: তোমাদের কাছে পৌঁছে না কোনো মুসিবত পৃথিবীতে আর তোমাদের নিজেদের মধ্যেও না, (উহার কার্যকারণ বা প্রাকৃতিক আইন) কিতাবে লিখিত থাকা ছাড়া, আমরা উহা (ঐ মুসিবত) সৃষ্টি করার পূর্ব থেকে (তা লিখিত রয়েছে)। নিশ্চয় উহা (সব ধরনের মুসিবতের সব ধরনের কার্যকারণ প্রণয়ন করা) আল্লাহর জন্য সহজ। যেন না তোমরা আক্ষেপ কর যা তোমরা হারাও তার ব্যাপারে। আর যেন না তোমরা উৎফুল্ল হও উহার কারণে যা তিনি তোমাদেরকে দান করেন। আর আল্লাহ ভালবাসেন না কোনো উদ্ধত অহংকারীকে।
৯:৫০-৫১ :: যদি তোমার কাছে পৌঁছে কোনো উত্তম অবস্থা, তাহলে তাদের (মুনাফিক্বদের) খারাপ লাগে। আর যদি তোমার কাছে পৌঁছে কোনো মুসিবত/ বিপদ, তাহলে তারা বলে, “নিশ্চয় আমরা সামলে নিয়েছি আমাদের ব্যাপারটা আগেই (আমরা মু’মিনদের ঝুঁকিপূর্ণ কর্মসূচী থেকে দূরে থাকায় বেঁচে গেছি)”। আর তারা (মুনাফিক্বরা) মুখ ফিরিয়ে নেয় আর তারা উৎফুল্ল থাকে। বলো, “আমাদের জন্য আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তা ছাড়া আমাদের কাছে অন্য কিছু পৌঁছবে না। তিনি আমাদের অভিভাবক। আর আল্লাহর উপরই মু’মিনদের ভরসা করা উচিত।”
৩:১৪৫ :: আর আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন প্রাণীর মৃত্যু হতে পারে না, মৃত্যুর অনুমতি সুস্পষ্টভাবে (উম্মুল কিতাবে) লিপিবদ্ধ আছে।
৩৫:১১ :: আর আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে তারপর শুক্রবিন্দু থেকে তারপর তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর জ্ঞাতসারে ছাড়া কোনো নারী তার গর্ভে কিছু ধারণ করে না এবং এবং প্রসব করে না। আর কিতাবের লেখা অনুযায়ী ছাড়া কোনো বয়স্ক ব্যক্তিকে আরো আয়ু দেয়া হয় না বা তার আয়ু থেকে (আয়ু) কমানো হয় না। নিশ্চয় তা (কিতাবে লিখে রাখা) আল্লাহর জন্য সহজ।
আলোচনা : উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের প্রচলিত ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয় যে, মহান আল্লাহর নিকট থাকা একটি কিতাবে মানুষের করা সকল কাজ, জীবন-মৃত্যু এবং বেহেশত বা দোযখ পাওয়ার একটি মাত্র পরিণতি, ফল বা অবস্হান লেখা আছে। মানুষ যতই চেষ্টা করুক কিতাবে লেখা থাকা ঐ পরিণতি, ফল বা অবস্হানের কোনো পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ আয়াতগুলোকে অপরিবর্তনীয় ও অনিবার্য ভাগ্য বিশ্বাসের দলীল হিসেবে তুলে ধরা হয় এবং আল্লাহকে মানুষের ভাগ্যের লেখক হিসেবে দাবি করা হয়।
যেহেতু ‘পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্যের’ ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়, তাই উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের প্রচলিত ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। (‘পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্য’-এর ধারণা অগ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণ পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে)।
ভাগ্যের ধারণা অনুসারে ৫৭:২২-২৩ আয়াতের প্রচলিত ব্যাখ্যায় বলা হয়- আমাদের প্রতিটি বিপর্যয় বা বিপদাপদ আমাদের ভাগ্যের লিখন। যেহেতু তা আমাদের ভাগ্যের লিখন, তাই আমাদেরকে ধৈর্য্যের সাথে তা মেনে নিতে হবে। এটাকে বলা যেতে পারে ‘আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তুষ্ট থাকা’ এবং এটা একটা ধার্মিকতার গুণ। অন্যদিকে বিপর্যয়ের পরিবর্তে ভালো যা কিছু ঘটে তাও ভাগ্যের কারণে ঘটে এবং সেটাও যেহেতু আল্লাহর দান, তাই সেজন্য উৎফুল্ল হওয়া বা গর্ব-অহংকার করা উচিত নয়।
অথচ আয়াতগুলোর এ প্রচলিত ব্যাখ্যাটি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এরূপ ব্যাখ্যা কুরআনের বর্ণিত মূলনীতি (কুরআনের স্ববিরোধ নেই) এর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। কুরআন অনুযায়ী, আল্লাহ বিনা কারণে ও অযৌক্তিকভাবে কাউকে মুসিবতে ফেলেন না, বরং মানুষের উপর আসা প্রতিটি বিপর্যয়ের জন্য মানুষই দায়ী।
সুতরাং উপরোক্ত আয়াতের প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে, তোমাদের কাছে যা কিছু মুসিবত ঘটে তা ঘটে আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী, যাতে তোমাদের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির কারণে তোমরা ঐ মুসিবতের সম্মুখীন হয়ে থাকো। এরূপ ব্যবস্থার কারণে যেন তোমরা কোনো মুসিবতে আক্ষেপ না করে বরং তা মোকাবিলা বা প্রতিরোধ-প্রতিকারের জন্য জাগতিক জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সঠিক কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করতে পারো। বিপদে হতাশার পরিবর্তে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে যে সক্রিয় উত্তরণ প্রচেষ্টা- এটাই সবর। যেমন শরীরের কোনো স্থান আগুনে পুড়ে গেলে ঐ পোড়া অবস্থায় নিষ্ক্রিয় না থেকে তার চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। কারণ আগুনে পুড়ে যাওয়া যেমন প্রাকৃতিক আইনের ফলাফল, তেমনি তার চিকিৎসাও একটি প্রাকৃতিক আইনের ফলাফল। অনুরূপভাবে, আল্লাহর কোনো অনুগ্রহ পেলে সেজন্য উৎফুল্ল ও অহংকারী না হয়ে বরং সেটার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি বিনয় ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে।
একইভাবে ভাগ্যের ধারণা অনুসারে ৯:৫০-৫১ আয়াতের প্রচলিত ব্যাখ্যায় বলা হয়- আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে যা লিখেছেন আমাদের কাছে তা-ই পৌঁছবে। তাই আমরা ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজে ভয় পাই না, কারণ আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে না লিখলে আমরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করলেও আমাদের কোনো বিপদ হবে না, আর তিনি আমাদের ভাগ্যে লিখলে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ না করলেও আমাদের ঐ বিপদটি হবে।
কিন্তু এ প্রচলিত ব্যাখ্যাটিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এটি কোনো আইন বা নিয়মের কথা বলে না। এমতাবস্থায়, আমরা যে কাজটি করতে চাচ্ছি বা করতে যাচ্ছি, সেই কাজের নির্দেশ দেয়ার কোনো বাস্তব কারণ অবশিষ্ট থাকে না। কেননা সেই ক্ষেত্রে কাজটি না করা সত্ত্বেও ভাগ্যে থাকলে কাজটির উদ্দেশ্য অর্জিত হবে, অন্যথায় হবে না। অথচ আল্লাহ এ জগতকে একটি নিয়মের মধ্যে পরিচালনা করছেন। তাই এখানে প্রতিটি কাজের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে এবং ঐ উদ্দেশ্য অর্জন করতে হলে কাজটি করতে হবে।
সুতরাং আয়াতে উল্লেখিত বক্তব্যের প্রকৃত তাৎপর্য হলো, “আমরা আমাদের করণীয় কাজ সম্পাদনে আত্মনিয়োজিত। আমরা জানি যে, আল্লাহ যে প্রাকৃতিক আইন পূর্বনির্ধারিত করেছেন (লিখে দিয়েছেন) তা ছাড়া আমাদের কাছে কোনো মুসিবত পৌঁছতে পারে না। আমরা মুসিবতের বিষয়ে এরূপ প্রাকৃতিক আইনের সঠিকত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত। তাই আমরা আমাদের করণীয় কাজের ক্ষেত্রে আমাদের সাধ্য অনুসারে প্রাকৃতিক আইনের অনুসরণের মাধ্যমে ঝুঁকি মোকাবিলা করবো, কিন্তু আমাদের করণীয় কাজ সম্পাদন থেকে বিরত হবো না। কারণ সম্ভাব্য ঝুঁকির চেয়ে আমাদের সংগ্রাম সাধনার উদ্দেশ্য অর্জন আমাদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আর সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করবো তথা তাঁর পথনির্দেশ অনুযায়ী সাধ্যমতো সাবধানতা অবলম্বন করবো এবং তাঁর অনুগ্রহ প্রত্যাশা করবো যে, আমাদের সাধ্যাতীত বিষয়ে যেন তিনি আমাদেরকে সাহায্য করেন এবং আমাদের পার্থিব ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করে তিনি আমাদের প্রচেষ্টায় সফলতা দান করেন।”
‘আল্লাহ আমাদের জন্য যা কিছু লিখে রেখেছেন’ কথাটির অর্থ ‘আমাদের ভাগ্য হিসেবে যা লিখে রেখেছেন’ হবে না, বরং এর অর্থ হবে, ‘আল্লাহ ইতোমধ্যে যে প্রাকৃতিক আইন প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেই অনুযায়ী’। এ বিষয়ে উদাহরণস্বরূপ নিম্নের আয়াতটি লক্ষ্যণীয় :
২:১৮৭ :: হালাল করা হয়েছে তোমাদের জন্য সিয়ামের রাতে তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি আবেগ উদ্দীপক ঘনিষ্ঠতা। তারা তোমাদের পোশাক আর তোমরা তাদের পোশাক। আল্লাহ জানেন যে, তোমরা খিয়ানত করেছো তোমাদের নিজেদের প্রতি। সুতরাং তিনি তোমাদের তাওবা কবুল করেছেন আর তোমাদেরকে মাফ করেছেন। সুতরাং এ পর্যায়ে তোমরা তাদের সাথে বিশেষ খোশালাপ ও দাম্পত্য সুখকর মিলন (সহবাস) করো আর তোমরা অন্বেষণ করো যা আল্লাহ তোমাদের জন্য লিখে দিয়েছেন। আর তোমরা খাও ও পান করো যতক্ষণ না তোমাদের জন্য ফজরের অন্তর্ভুক্ত সাদা আভা, কাল আভা থেকে সুস্পষ্ট হয়। তারপর তোমরা সিয়াম/ আত্মসংযম পূর্ণ করো রাত পর্যন্ত। আর তোমরা তাদের সাথে বিশেষ খোশালাপ ও দাম্পত্য সুখকর মিলন (সহবাস) করো না তোমরা মসজিদে এতেকাফরত (আত্মনিয়োজিত থাকা) অবস্থায়। উহা আল্লাহর সীমাসমূহ, সুতরাং তোমরা উহার (লংঘনের) নিকটবর্তী হয়ো না। এভাবে আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন তাঁর আয়াতসমূহ মানবজাতির জন্য যেন তারা স্রষ্টা-সচেতন হতে পারে।
এ আয়াতটিতে দেখা যায় যে, আল্লাহ যা লিখে দিয়েছেন তা অন্বেষণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদি ‘আল্লাহ যা লিখে দিয়েছেন’ এর অর্থ ‘ভাগ্য হিসেবে লিখে দেয়া’ হয়, তাহলে তা অন্বেষণ করতে নির্দেশ দেয়া অর্থহীন হয় না। বস্তুত ‘আল্লাহ যা লিখে দিয়েছেন’ তা হলো ‘আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী যা পাওয়া যেতে পারে’ সেজন্য তা অন্বেষণ করতে হয় তথা সেজন্য প্রাকৃতিক আইন অনুসরণ করতে হয়।
সুতরাং ‘আল্লাহ মহাবিশ্বের সবকিছু লিখে রেখেছেন’- বক্তব্য সম্বলিত আয়াতসমূহে বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহ সকল ঘটনার কারণ ও ফলাফল বিধি লিখে রেখেছেন যাতে কোনো বিষয়ে বিভিন্ন কারণে বিভিন্নরূপ ফলাফলের সকল সূত্র বা নিয়ম লিপিবদ্ধ রয়েছে। আর সর্বোপরি রয়েছে আল্লাহ কোনো কারণে তাতে উপস্থিত হস্তক্ষেপ করা না করার বিষয়ে তাঁর সাধারণ (হস্তক্ষেপ না করার) ও বিশেষ (ন্যায়সঙ্গতভাবে হস্তক্ষেপ করার) ইচ্ছার উপস্থিতি। তাই মানুষের উপর কোনো বিপদাপদ আপতিত হোক বা না হোক এবং কারো সন্তানাদি জন্মগ্রহণ করুক বা না করুক এবং কারো আয়ুর হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটুক বা না ঘটুক সবই আল্লাহর লিখে রাখা কিতাব অনুযায়ী হয়। যেমন তাতে মৃত্যুর জন্য যে সকল ফ্যাক্টরের সমন্বয়ের যতগুলো অবস্থান রয়েছে তার যে অবস্থানেই কেউ উপনীত হোক ঐ অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটবে। কেউ যেমন তার সাধারণ বয়ঃবৃদ্ধিক্রমের (Aging Process) নিয়মানুসারে তার জীবনকোষ যখন স্বাভাবিকভাবে অকার্যকর হয়ে যাওয়ার সময় মৃত্যুবরণ করতে পারে, তেমনি কেউ ঐ সময়ের আগে মৃত্যু ঘটানোর মতো কোনো অনুঘটকের উপস্থিতির কারণে নিহত হওয়ার মাধ্যমেও মুত্যুবরণ করতে পারে। উভয় অবস্থায় সে তার জন্য নির্ধারিত নিয়মে উপস্থিত মুত্যুমুহুর্তেই মৃত্যু বরণ করে, তার আগেও নয়, পরেও নয়। কোনো বিষয় সংঘটিত হওয়ার জন্য যেসব অনুঘটক এবং তার যে সকল সংমিশ্রণ নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা আপেক্ষিকভাবে অসংখ্য। এই অসংখ্য সূত্র ও ফলাফল লিখে রাখাকে আল্লাহর জন্য সহজ বলে জানানো হয়েছে।
মানুষের কোনো কাজের ফলাফল বিধির বাস্তবতা
১. একটি কাজের ফলাফল বা পরিণতির সাথে অসংখ্য অনুঘটক (Factor) জড়িত থাকে । সে অনুঘটকের কায়েকটি হলো-
(ক) প্রতিটি মানুষের জন্মসূত্রে পাওয়া (Hereditary) স্বতন্ত্র শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক গুণাগুণ;
(খ) মানুষের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার বিভিন্ন ধরন;
(গ) ধৈর্য, নিষ্ঠা, ত্যাগ, সাহসিকতা ইত্যাদি;
(ঘ) মানুষের অজানা বা জানা কিন্তু আল্লাহর জানা অসংখ্য বিষয়।
২. ঐ অনুঘটকের একটি পরিবর্তন হলে কাজের ফল পরিবর্তন হয়ে যায়।
৩.অসংখ্য পরিবর্তনশীল বিষয় পরিবর্তিত (Permutation Combination) হয়ে একটি কাজের ভালো ফলের অসংখ্য অবস্হান হতে পারে। আবার মন্দ ফলেরও অসংখ্য অবস্হান হতে পারে।
‘মানুষ ও মহাবিশ্বের সকল ঘটনা-দুর্ঘটনা আল্লাহর নিকট থাকা কিতাবের লেখা অনুযায়ী হয়’ তথ্যটির প্রকৃত তাৎপর্য
আয়াতসমূহে বলা হয়েছে যে, মানুষ ও মহাবিশ্বের সকল ঘটনা-দুর্ঘটনা আল্লাহর নিকট থাকা কিতাবের লেখা অনুযায়ী হয়। কিন্তু তাতে বলা হয় নি যে, আল্লাহর নিকটে থাকা কিতাবে প্রতিটি বিষয়ের একটিমাত্র পরিণতি বা অবস্থান লেখা আছে।
প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত পরিচয়ের বৈজ্ঞানিক সংকেত হলো ‘ডিএনএ কোড’ (DNA Code)। সুতরাং মানবজীবনের সকল ঘটনা-দুর্ঘটনা আল্লাহর নিকটে থাকা কিতাবের লেখা অনুযায়ী হওয়ার তাৎপর্য হলো, DNA Code এর ভিত্তিতে নাম নির্দিষ্ট করে আল্লাহর নিকটে থাকা একটি কিতাবে লেখা আছে-
১. মানুষের জীবনের সকল কাজে যতো পরিবর্তনশীল বিষয় (অনুঘটক/Factor) আছে তার সবগুলো ব্যবহার করে একটি কাজের যতো ধরনের ভালো বা মন্দ ফল হওয়া সম্ভব তার সবক’টি।
২. জীবন-মৃত্যুর ব্যাপারে সকল পরিবর্তনশীল বিষয় (রোগের ধরন, চিকিৎসার ধরন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ইত্যাদি) ব্যবহৃত হয়ে মৃত্যুর কারণ, সময় ও স্হানের যতো ধরনের অবস্হান হওয়া সম্ভব তার সবক’টি।
৩. আমলের ধরন, ওজর, অনুশোচনা, উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা, তাওবাহ ইত্যাদির ভিত্তিতে একজন মানুষের বেহেশত ও দোযখ পাওয়া না পাওয়া এবং তার মানের যতো ধরনের অবস্থান হতে পারে তার সবক’টি।
আল্লাহর সকল পরিবর্তনশীল (Variable) বিষয়ের তিনকালের (অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ) জ্ঞান আছে। তাই, আল্লাহর নিকট থাকা ঐ কিতাবে একজন মানুষের জীবনের প্রতিটি কাজ বা বিষয়ে যতগুলো অবস্থান বা ফলাফল লিখা আছে তার বাইরে কোনো অবস্থান বা ফলাফল ঘটবে না বা মানুষ ঘটাতে পারবে না। অন্যকথায় প্রতিটি বিষয়ে যেকোনো ধরনের পরিবর্তনশীল জিনিস ব্যবহার করে, ব্যক্তি মানুষ যে অবস্থায় বা যে ফলাফলেই পৌঁছাক না কেন ঐ কিতাবে তা (ঐরূপ ফলাফল ও তার কারণ) লিখিত আছে।
উপরোল্লেখিত উপলব্ধি সঠিক হওয়ার প্রমাণ :
যেসব কারণে তাক্বদীর বলতে ভাগ্য না বুঝিয়ে প্রাকৃতিক আইন বুঝায়, সেই একই কারণে আল্লাহর নিকট লিখিত কিতাবে প্রতিটি কাজের একটিমাত্র ফলাফল লিখিত থাকার পরিবর্তে বিভিন্ন অনুঘটকের সংমিশ্রণের ভিত্তিতে বিভিন্ন ফলাফল লিখিত থাকা বুঝায়। অর্থাৎ কোনো ঘটনা ঘটার একটিমাত্র কারণ ও একটিমাত্র ফলাফল লেখা আছে এমন নয়। বরং একটি ঘটনার জন্য একাধিক কারণ এবং একাধিক ফলাফল রয়েছে।
আল্লাহর কাছে লিখিত কিতাবে যে কোনো কাজের বিভিন্ন ধরনের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ফলাফল লিখিত রয়েছে তার একটি প্রমাণ হচ্ছে সূরা কাহাফের ১৮:২৩-২৪ আয়াতের বক্তব্য।
১৮:২৩-২৪ :: কোনো বিষয় সম্পর্কে কখনও এরকম বলো না যে, “আগামীকাল আমি কাজটি (শতভাগ সঠিকভাবে) করবো।” আল্লাহর (অতাৎক্ষণিক) ইচ্ছা ছাড়া; ভুলবশত কখনও এরকম বলে ফেললে তোমার রবকে স্মরণ করবে এবং বলবে- “আশা আছে আমার রব কাজটির (শতভাগ) সঠিক পথের কাছাকাছি অবস্থানের দিকে আমাকে পথ দেখাবেন।”
আয়াতটিতে কোনো কাজের ব্যাপারে কি কথা বলা যাবে না, কেন তা বলা যাবে না এবং কি দোয়া করতে হবে তা জানানো হয়েছে।
আয়াতটিতে প্রথমে জানানো হয়েছে যে, কোনো কাজের ব্যাপারে বলা যাবে না যে, আমি আগামীকাল কাজটি করবো। তারপর বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর (অতাৎক্ষণিক) ইচ্ছা ছাড়া’। অর্থাৎ কোনো কাজ শতভাগ নির্ভুলভাবে করতে হলে ঐ কাজের জন্য আল্লাহর তৈরী সফলতার প্রাকৃতিক আইনকে শতভাগ নিখুঁতভাবে অনুসরণ করতে হবে। যা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
আয়াতটির শেষে বলা হয়েছে, ভুলবশত কখনও ঐরকম বলা হয়ে গেলে তোমার রবকে স্মরণ করবে এবং বলবে, “আশা আছে আমার রব কাজটির শতভাগ সঠিক পথের (শতভাগ সঠিকভাবে কর্মসম্পাদনের) কাছাকাছি অবস্থানের দিকে আমাকে পথ দেখাবেন।”
সুতরাং আয়াত দুটি থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহর নিকট সংরক্ষিত কিতাবে একটি কাজের সর্বোত্তম যে ফলাফলটি লেখা আছে মানুষ কখনও সে ফলাফল অর্জন করতে পারবে না। কারণ- মানুষের পক্ষে আল্লাহর তৈরী করে রাখা প্রাকৃতিক আইনে একটি কাজের সর্বোত্তম ফলাফল পাওয়ার জন্য বড়ো ও ছোটো (Macroscopic & Microscopic) যতো অনুঘটক (Factor) আছে তার সবক’টি জেনে যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব নয়। তবে মানুষের মধ্যে যে যতো সঠিকভাবে চেষ্টা করবে সে ঐ সর্বোত্তম ফলের ততো কাছাকাছি যেতে পারবে।
এ বিষয়ে আরেকটি প্রমাণ হলো, ৭:১৮৮ আয়াত। আয়াতটিতে বলা হয়েছে-
৭:১৮৮ :: বলো, “আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ছাড়া আমি আমার নিজের জন্যও কোনো উপকার বা অপকার করার ক্ষমতা রাখি না। আর যদি আমি গায়েব জানতাম, তাহলে আমি হাসিল করতাম অনেক কল্যাণ, আর আমাকে কোনো অকল্যাণ স্পর্শ করতো না। আমি যারা ঈমান আনে সেই ক্বওমের জন্য একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা বৈ অন্যরূপ নই।”
উপরোক্ত আয়াতটিতে রসূলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন তিনি বলেন যে, যদি তিনি গায়েব জানতেন তাহলে তিনি অনেক কল্যাণ লাভ করতে পারতেন এবং কোনো ক্ষতি তাঁকে স্পর্শ করতে পারতো না। অর্থাৎ আল্লাহ যা নির্ধারণ করে রেখেছেন তা কোনো একটি ঘটনা দৈবাৎ ঘটার বিষয় নয় যে, তা কোনো ক্রমে পরিবর্তনশীল নয়; বরং তা হলো- কোনো ঘটনার জন্য বিভিন্ন কারণ এবং তার বিভিন্ন ফলাফল। আর তাই তা সরাসরি জানতে পারলে রসূল অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলগুলো রোধ করার জন্য কার্যকর কারণকে অবলম্বন করতে পারতেন।
এছাড়া এ থেকেও এটা বুঝা যায় যে, মু’মিনদের দুর্বলতাজনিত অবস্থায় তারা দ্বিগুণ কাফিরের মোকাবিলা করতে পারবে এবং সুদৃঢ় ঈমানের স্তরে তারা দশুগুণ কাফিরের মোকাবিলায় বিজয়ী হবে (৮:৬৫-৬৬)।
তাক্বদীর আপেক্ষিক গায়েবের অন্তর্ভুক্ত
৭:১৮৮ :: বলো, “আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ছাড়া আমি আমার নিজের জন্যও কোনো উপকার বা অপকার করার ক্ষমতা রাখি না। আর যদি আমি গায়েব জানতাম, তাহলে আমি হাসিল করতাম অনেক কল্যাণ, আর আমাকে কোনো অকল্যাণ স্পর্শ করতো না। আমি যারা ঈমান আনে সেই ক্বওমের জন্য একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা বৈ অন্যরূপ নই।”
আলোচনা : আয়াতটি থেকে বুঝা যায় যে, তাক্বদীর সম্পর্কিত গায়েবের জ্ঞান থাকলে মানুষের পক্ষে অকল্যাণ প্রতিরোধ ও কল্যাণ অর্জনে স্বীয় ভূমিকা পালন করা সম্ভব হতো। সুতরাং তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক আইন হিসেবে মানুষের জানা ফ্যাক্টরের পাশাপাশি অনেক অজানা ফ্যাক্টরও কার্যকর রয়েছে। প্রাকৃতিক গবেষণার মাধ্যমে মানুষের পক্ষে তাক্বদীরের অনেক ফ্যাক্টর সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পায়। সুতরাং তাক্বদীর আপেক্ষিক গায়েবের অন্তর্ভুক্ত বিষয়।
তাক্বদীর সুপরিজ্ঞাত বা আবিষ্কারযোগ্য
১৫:৪-৫ :: আর আমরা ধ্বংস করি না কোনো জনপদকে এছাড়া যে, উহার জন্য ছিলো সুপরিজ্ঞাত কিতাব (অর্থাৎ উহাকে কিতাবের মাধ্যমে সত্য মিথ্যার জ্ঞান দেয়া হয়েছিলো)। ত্বরান্বিত করতে পারে না কোনো উম্মাত তার শেষ সময়সীমা আর বিলম্বিতও করতে পারে না।
১৫:২১ :: আর কোনো কিছুই নেই এছাড়া যে, আমাদেরই কাছে আছে তার ধনভান্ডার। আর আমরা উহা নাযিল করি না সুপরিজ্ঞাত বা জানা-বোঝার উপযোগী নির্ধারিত প্রাকৃতিক আইন (natural law) ছাড়া।
৭৭:২০-২৩ :: আমরা কি তোমাদেরকে সৃষ্টি করি নি তুচ্ছ পানি থেকে? তারপর আমরা তা স্থাপন করেছিলাম সংরক্ষিত স্থানের মধ্যে? একটি সুপরিজ্ঞাত বা জানা-বোঝার উপযোগী প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নির্ধারিত যথোপযোগী সময় পর্যন্ত। সুতরাং আমরা প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণে সক্ষম হয়েছিলাম। সুতরাং (আমরা) কী উত্তম ক্ষমতাবান প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণকারী!
আলোচনা : জীবনের প্রতিটি ঘটনা (তা ব্যক্তিগত বা সামাজিক হোক এবং আনন্দদায়ক বা দুঃখজনক হোক) প্রকৃতির প্রতিষ্ঠিত আইন অনুসারে ঘটে। সেই প্রাকৃতিক আইনগুলোকে সুপরিজ্ঞাত বলা হয়েছে।
‘তাক্বদীর সুপরিজ্ঞাত’ হওয়ার তিনটি পর্যায় থাকা সম্ভব, যথা: (১) আল্লাহ যেসব প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণ করেছেন তা তাঁর জানা আছে, (২) তিনি ফেরেশতাদেরকে তাক্বদীর সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান দান করেছেন, (৩) মানুষও তাদের অভিজ্ঞতা ও গবেষণার মাধ্যমে তাক্বদীর সম্পর্কে তাদের সাধ্যসীমায় প্রয়োজনীয় জ্ঞান রাখে বা অর্জন করতে সক্ষম হয়।
সুতরাং প্রাকৃতিক জ্ঞান-গবেষণার মাধ্যমে তাক্বদীর সম্পর্কে জানা যেতে পারে বা প্রাকৃতিক আইন আবিষ্কার করা যেতে পারে।
তাক্বদীরকে বিশ্বাসের বিষয়বস্তু করা হয় নি, বরং তাক্বদীর হচ্ছে জানা-বোঝার উপযোগী বা আবিষ্কারযোগ্য বিষয়। তবে মানুষ তাক্বদীরের কতটুকু জানতে-বুঝতে বা আবিষ্কার করতে পারবে, তা একটি আপেক্ষিক বিষয়।
যেহেতু মহাবিশ্ব প্রাকৃতিক আইন দ্বারা আবদ্ধ তাই মহাবিশ্বের রহস্য আবিষ্কারযোগ্য। প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী মানুষ বিভিন্ন পরিস্থিতিকে সীমিত পরিসরে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। এ বিষয়টিকে এভাবে বলা হয়েছে যে-
৪৫:১৩ :: তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সব কিছু, তাঁর নিজ অনুগ্রহে। এতে (সাধারণ ও বৈজ্ঞানিক স্তরে) চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নির্দশন রয়েছে।
আল্লাহর বিধান অনুযায়ী প্রকৃতির অগণিত শক্তি রয়েছে। মানুষের সেই শক্তিগুলি আবিষ্কার করার এবং ব্যবহার করার ক্ষমতা একটি শক্তি নিয়ন্ত্রণকারী শারীরিক আইন আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত, এটি অনিয়ন্ত্রিত এবং ধ্বংসাত্মক থাকে। ব্যবহার করা হলে এটি গঠনমূলক হয়ে ওঠে। মানুষের শৈশবকালে প্রকৃতির অনেক শক্তি ভয়ঙ্করভাবে ধ্বংসাত্মক ছিল। সেগুলো গঠনমূলকভাবে দরকারী হয়ে ওঠে যখন ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক কাজের মাধ্যমে সেগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নিয়ন্ত্রিত না হলে বৃষ্টির পানি বন্যা হয় কিন্তু সঠিকভাবে কাজে লাগালে তা পুনরুজ্জীবিত করে। নিয়ন্ত্রিত ও অনিয়ন্ত্রিত আগুনও অনুরূপ একটি শক্তি। কুরআন তাদেরকে অভিনন্দন জানায় যারা বৈজ্ঞানিক মন নিয়ে মহাবিশ্বের বিভিন্ন শক্তিকে আবিষ্কার করে। কুরআন এই ধরনের গবেষকদেরকে উলেমা (জ্ঞানী) বলে অভিহিত করেছে।
৩:১৯০-১৯১ :: নিশ্চয় আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টিতে আর রাত ও দিনের আবর্তনে অবশ্যই আয়াত (বিশ্ব-আয়াত) আছে চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের জন্য। যারা আল্লাহকে স্মরণ করে (আল্লাহর বিধানের প্রতি লক্ষ্য রাখে) দাঁড়ানো অবস্থায় আর বসে থাকা অবস্থায় আর তাদের কাত হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায়। আর তারা চিন্তা-গবেষণা করে আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টি (গঠন) সম্পর্কে। (তারা বলে) ‘আমাদের প্রতিপালক-বিধাতা, আপনি সৃষ্টি করেননি ইহাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে/ অপরিকল্পিতভাবে/ অসঙ্গতভাবে। (অসঙ্গতভাবে কিছু সৃষ্টি করা থেকে) আপনি পবিত্র। আমাদেরকে (জাহান্নামের) আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।
৩৫:২৭-২৮ :: তুমি কি দেখনি যে, আল্লাহ বর্ষণ করেন আকাশ থেকে (বৃষ্টির) পানি, তারপর আমরা বের করি উহার মাধ্যমে ফলফলাদি যার রং বিভিন্ন; আর পাহাড়সমূহেও আছে সাদা ও কালো রেখাসমূহ যার রং বিভিন্ন, আর গাঢ় কালো (রেখাও আছে)? আর মানুষের মধ্যে, জীবজন্তুর মধ্যে আর গবাদি পশুগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন রঙ্গের আছে। এরূপই। নিশ্চয় আল্লাহকে ভয় করে তাঁর জ্ঞানী (উলামা) বান্দাদের মধ্য থেকেই। নিশ্চয় আল্লাহ মহাশক্তিমান ও ক্ষমাশীল।
ভৌত মহাবিশ্বের মতোই মানুষের সামাজিক জীবনও আল্লাহর তৈরি নৈতিক-প্রাকৃতিক নীতিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতটি লক্ষ্যণীয়।
৩৫:৪৪ :: আর তারা কি যমীনে ভ্রমণ করে না? তাহলে তারা দেখতো, কেমন ছিল তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম। অথচ তারা তো শক্তিতে ছিল এদের চেয়েও প্রবল। আল্লাহ তো এমন নন যে, আসমানসমূহ ও যমীনের কোনো কিছু তাকে অক্ষম করে দেবে। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান (বা সবকিছুর মান নির্ধারণকারী ও নিয়ন্ত্রক)।
পরিশেষে বলা যায় যে, ‘মহাবিশ্বের সবকিছু বা সকল ঘটনা-দুর্ঘটনা আল্লাহ একটি কিতাবে (উম্মুল কিতাবে) লিখে রেখেছেন’- বলতে সবকিছুর ভাগ্য লিখে রাখাকে বুঝায় না, বরং এর মাধ্যমে সবকিছুর জন্য সূত্র ও ফলাফল বা প্রাকৃতিক আইন লিখে রাখাকে বুঝায়। আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী এবং তাঁর নির্ধারিত নীতিমালার ভিত্তিতে তাঁর নিয়ন্ত্রণ অনুসারে সকল ঘটনা-দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। এই প্রাকৃতিক আইনে থাকা ফ্যাক্টর বা অনুঘটকসমূহের মধ্যে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার ধরন এবং পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মিথষ্ক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। তাই সবকিছু আল্লাহর লিখিত কিতাব অনুযায়ী সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি মানুষকে তার কর্ম ও কর্মফলের বিষয়ে দায়মুক্ত করে না, বরং এক্ষেত্রে মানুষ যথারীতি দায়ী থাকে।
দুঃখ-দুর্দশা বা মুসিবত-দুর্ঘটনার জন্য কুরআনে স্পষ্টভাবে মানুষকেই দায়ী করা হয়েছে। আল্লাহ যে প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে মানবজাতিকে বসতি স্থাপন ও জীবন যাপনের জন্য সুযোগ দিয়েছেন, তাতে মানুষকে প্রাকৃতিক বিষয়াদির দ্বারা সঠিকভাবে উপকৃত হওয়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আত্মরক্ষার জন্য যথোপযোগী পরিকল্পনা, গবেষণা ও ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হয়। যদি এক্ষেত্রে সে উদাসীনতা প্রদর্শন করে, তাহলে সে বিভিন্ন মুসিবত-দুর্ঘটনায় পতিত হয়।
মুসিবত-দুর্ঘটনার জন্য মানুষকে দায়ী করা সম্পর্কিত আয়াত
৪২:৩০ :: তোমাদের ওপর (ব্যক্তি ও সামষ্টিক পর্যায়ে) যে মুসিবত/বিপদাপদ আসে, তা তোমাদের নিজ হাতের অর্জন (নিজেদের কর্মের দোষে বা ভুলের ফলে আসে)। আর তিনি (আল্লাহ) অনেক বিপদাপদ ক্ষমা করে দেন (ঘটতে দেন না)।
৩০:৪১ :: মানুষের কৃতকর্মের ফলে জলে-স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে যাতে তিনি তাদেরকে তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা (অসৎ পথ হতে) ফিরে আসে।
১৬:৩৪ :: তারপর তাদের উপর আপতিত হয়েছে মন্দ শাস্তিসমূহ যেরূপ কাজ তারা করেছে। আর তাদেরকে পরিবেষ্টন করেছে তা-ই (কর্মফলের আইন), যে ব্যাপারে তারা ঠাট্টা বিদ্রূপ করতো।
৩৯:৪৮ :: আর প্রকাশিত হবে মন্দকাজসমূহ, যা তারা উপার্জন (সম্পাদন) করেছে। আর তাদেরকে পরিবেষ্টিত করবে উহাই (কর্মফলের আইন), যে ব্যাপারে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতো।
৩:১৬৫ :: যখন তোমাদের উপর কোন মুছীবত নেমে আসল, অথচ তোমরা তার পূর্বেই দ্বিগুণ কষ্টে উপনীত হয়েছ, তখন কি তোমরা বলবে, “এটা কোথা থেকে এলো?” তাহলে বলে দাও, “এ কষ্ট তোমাদের নিজেদের পক্ষ থেকেই নেমে এসেছে”।
৪:৭৯ :: তোমার যা কল্যাণ হয়, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। আর তোমার যা অকল্যাণ হয়, সেটা হয় তোমার নিজের পক্ষ থেকে (নিজের কর্মদোষে) হয়। আর আমরা তোমাকে প্রেরণ করেছি মানবজাতির জন্য রাসূল হিসাবে। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।
১৩:১১ :: মানুষের জন্য রয়েছে, সামনে ও পেছনে, একের পর এক আগমনকারী প্রহরী, যারা আল্লাহর নির্দেশে তাকে হেফাযত করে। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো জনগোষ্ঠীর অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা (মনোভাব, ইচ্ছা ও কর্মের মাধ্যমে) নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে। আর যখন আল্লাহ কোন জাতির মন্দ চান, তখন তা প্রতিহত করা যায় না এবং তাদের জন্য তিনি ছাড়া কোন অভিভাবক নেই।
৮:৫৩ :: ইহা এজন্য যে, আল্লাহ কোনো নিয়ামাতের পরিবর্তনকারী নন, যা তিনি নিয়ামাত হিসাবে দিয়েছেন কোনো ক্বওমকে, যতক্ষণ না তারা পরিবর্তন করে তাদের নিজেদের নৈতিক অবস্থা। আর নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
৮:২৫ :: আর তোমরা বেঁচে থাকো সেই ফিতনা/ অনাচার থেকে যা শুধু তাদেরকেই আক্রান্ত করবে না যারা যুলুম করেছে, তোমাদের মধ্য থেকে, বিশেষভাবে। আর তোমরা জেনে রাখো যে, আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা।
৭১:১০-১২ :: অতঃপর আমি বলেছি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা বর্ষণ করবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন, তোমাদের জন্য উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করবেন এবং তোমাদের জন্য নদী-নালা প্রবাহিত করবেন।
আলোচনা : উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের উপর এবং মহাবিশ্বে যে অরাজকতা তথা বিপদ-আপদ (সাইক্লোন, সুনামি, ভুমিকম্প, গ্রীন হাউজ ইফেক্ট, খরা, বন্যা ইত্যাদি) আসে, তা মানুষের নিজেদের কর্ম দোষের কারণেই আসে।
আল্লাহ কোনো জনগোষ্ঠীর অবস্থা পরিবর্তন করার জন্য শর্ত হলো তারা নিজেদের অবস্থাকে পরিবর্তন করা। এখানে দুই ধরনের অবস্থা রয়েছে, একটি কারণমূলক অবস্থা এবং অন্যটি ফলাফলমূলক অবস্থা। যে ধরনের ফলাফলমূলক অবস্থার জন্য যে ধরনের কারণমূলক অবস্থা দায়ী যতক্ষণ তার পরিবর্তন হয় না, ততক্ষণ ফলাফলমূলক অবস্থাও একইরূপ থাকে। সুতরাং কোনো জাতি তার অবস্থা পরিবর্তন করার অর্থ হলো তার মনোভাবগত ও নৈতিক অবস্থা এবং কর্মপ্রচেষ্টার ধরন পরিবর্তন করা।
কোনো জাতির উত্থান, পতন, পুনরুজ্জীবন ও বিলুপ্তি আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন দ্বারা আবদ্ধ বা তারা যা করে তা প্রকৃতির চিরন্তন নিয়ম অনুযায়ী পূর্বনির্ধারিত ফল দেয়।
অতীতে বনী ইসরাইলের উপর যে অপমান ও অসহায়ত্ব চেপে বসেছিলো, তা তাদের ভাগ্যের কারণে নয়, বরং তাদের অন্যায়-অপরাধের ফলাফলস্বরূপ বা শাস্তিস্বরূপ ছিলো।
৩:১১১ :: আপতিত হয়েছে তাদের উপর অপমান যেখানেই তাদেরকে পাওয়া গেছে, আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া রজ্জু (আঁকড়ে ধরা) ছাড়া আর মানুষের পক্ষ থেকে পাওয়া রজ্জু (আঁকড়ে ধরা) ছাড়া। আর তারা পরিবেষ্টিত হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে সৃষ্ট ক্রোধে। আর আপতিত হয়েছে তাদের উপর অসহায়ত্ব। উহা এ কারণে যে, তারা অবিশ্বাস করতো আল্লাহর আয়াতসমূহের প্রতি আর তারা হত্যা করতো নবীদেরকে অন্যায়ভাবে। উহা এ কারণে যে, তারা অবাধ্যতা করেছে আর তারা সীমালংঘন করতো।
প্রতিটি মুসিবতের জন্য কি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে দায়ী?
১০:৪৪ :: নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি কোনো জুলুম করেন না, বরং মানুষই নিজেদের প্রতি জুলুম করে থাকে।
৬:১৬৪ :: আর প্রত্যেক ব্যক্তি কিছুই অর্জন করে না যা তার উপর বর্তায় না (প্রত্যেকে স্বীয় কৃতকর্মের জন্য দায়ী)। আর কেউ অন্যের বোঝা বহন করবে না।
আলোচনা : অনেক সময় এ ধরনের আয়াতকে এ অর্থে অনুধাবন করা হয় যে, কোনো মানুষের যে বিপদ হয় সেজন্য সে নিজে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী এবং একজনের দোষের জন্য আসা বিপদ অন্যজনের ওপর চাপানো হয় না। কিন্তু এ অনুধাবন গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এখানে কর্মের দায়বদ্ধতার কথা বলা হয়েছে, যার ভিত্তিতে চূড়ান্ত পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া হবে এবং তা আখিরাতের বিষয়। অন্যদিকে পৃথিবীর জীবন পরীক্ষার কাল। তাই এখানে যা কিছু ঘটে সেজন্য মানুষ দায়ী হলেও প্রত্যেকে নিজ নিজ বিপদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হওয়া অপরিহার্য নয়।
বস্তুত পার্থিব জীবনে মানুষ যত ধরনের বিপদ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় সেটাকে মানবীয় দুর্বলতা এবং মানবীয় কৃতকর্মের ফল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণ অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, এর অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজে দায়ী নয়। যেমন একটি গাড়ি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে চালকের অসতর্কতার জন্য যাত্রী দায়ী নয় এবং অন্য এক চালকের অসতর্কতার জন্য অন্য চালক দায়ী নয়। এরূপ ক্ষেত্রে মানবজাতিকে সমষ্টিগতভাবে সম্বোধন করা হয়, কারণ তারা পরস্পরের দ্বারা এমনভাবে যুক্ত যে, একজনের কাজের প্রভাব অন্য জনের উপর পড়ে থাকে। তাই এ ধরনের পরিস্থিতিগুলো মোকাবিলার জন্য তাদেরকে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগী হতে হবে। তবে নৈতিক দায় বিচারের ক্ষেত্রে একজনের দায়ভার অন্যজন বহন করবে না।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কারো শরীরে যদি এইডসের জীবাণু থাকে, সে এইডসের রোগী। এই রোগীর রক্ত যদি কোনো মানুষের শরীরে দেয়া হয় সেও এইডসে আক্রান্ত হবে। কিংবা এইডস রোগীকে যে সিরিঞ্জ দিয়ে ইনজেকশন দেয়া হয়, সে সিরিঞ্জ ভালোভাবে পরিষ্কার না করে যদি তা কারো শরীরে পুশ করা হয় তাহলে তারও এইডস হতে পারে। তখন ঐ রোগীকে এ অপবাদ দেয়া ঠিক নয় যে, অবৈধ যৌন মিলনের কারণেই তার এ অবস্থা হয়েছে।
বিপদ-মুসিবতের মাধ্যমে মানুষের পরীক্ষা
২:১৫৫-১৫৭ :: আর সুসংবাদ শুনিয়ে দিন এমন ধৈর্যশীলদের যখন তাদের ওপর মুসিবত আসে তখন বলে, আমরা তো আল্লাহর জন্যই। আর আমরা সকলে তাঁরই কাছে ফিরে যাবো। তাদের প্রতি বর্ষিত হবে বিশেষ করুণাধারা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এবং সাধারণ করুণাও। আর এরাই এমন লোক যারা হিদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছে।
২:১৭৭ :: … বরং নেক কাজ তো এটা যে, কোনো ব্যক্তি ঈমান রাখে আল্লাহর প্রতি, আখিরাত দিবসের প্রতি, … আর যারা ধৈর্যধারণ করে অভাব-অনটন, অসুখে-বিসুখে ও যুদ্ধ-জিহাদে। এরাই সত্যবাদী এবং এরাই আল্লাহভীরু।
২১:৩৫ :: আমি তোমাদের ভালো ও মন্দ দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা ফিরে আসবে।
আলোচনা : আল্লাহ মানুষকে যে প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায় রেখেছেন তাতে মানুষের উপর কখনো ভালো এবং কখনো মন্দ অবস্থা এসে থাকে। এর মাধ্যমে তার পরীক্ষা হয়। এসব পরীক্ষায় মানুষ যদি আল্লাহর নির্দেশনা অনুসরণ করে সবর ও শোকরের প্রমাণ দিতে পারে তাহলে সে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করে থাকে। আর কাউকে আল্লাহ কোনো নিয়ামাত দেয়ার পর অতিপ্রাকৃতিকভাবে তা কেড়ে নেন না। কিন্তু মানুষ যদি আল্লাহর নিয়ামতের শোকর আদায় না করে, তাহলে তিনি তার ভুলের কারণে যেসব দুঃখ-কষ্ট এসে পড়ে, সেটাকে সে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার জন্য একটি উদ্দীপকে পরিণত করতে পারেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, কুরআনে মুসিবত-দুর্ঘটনা বা বিপদাপদের জন্য মানুষকে দায়ী করা হয়েছে। আর এটি স্পষ্টভাবে ভাগ্যের ধারণাকে খণ্ডন করে। বস্তুত তাক্বদীর হলো প্রাকৃতিক আইন, যার আওতায় বিভিন্ন বিপদাপদ ঘটে থাকে এবং এসব বিপদাপদের জন্য মানুষের কর্মকাণ্ডই কারণ হিসেবে কাজ করে। মানুষ তাদের কর্মনীতির পরিবর্তনের মাধ্যমে বিপদাপদের প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে সক্ষম হয়।
মানব জীবনে কল্যাণ-অকল্যাণ সংঘটনে আল্লাহর ভূমিকা তাক্বদীর প্রসঙ্গে একটি অন্যতম আলোচ্য বিষয়। আমাদের জীবনে যা কিছু কল্যাণ ও অকল্যাণ হয়ে থাকে তার সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। আবার কল্যাণের কারণ আল্লাহর অনুগ্রহ, কিন্তু অকল্যাণের জন্য আমরাই দায়ী। এ কথা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না যে, “কল্যাণ-অকল্যাণের জন্য নিছক নিয়তি ছাড়া কোনো কারণ নেই।” এ অধ্যায়ে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো।
নিয়ামাত আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং তিনি তা অযথা পরিবর্তন করেন না
১৬:৫৩ :: আর যা কিছু আছে তোমাদের কাছে নিয়ামাতের মধ্য থেকে, তার সবই আল্লাহর থেকে এসেছে। তারপর যখন তোমাদেরকে স্পর্শ করে দু:খ-কষ্ট, তখন তাঁরই কাছে তোমরা ফরিয়াদ করো।
৮:৫৩ :: ইহা এজন্য যে, আল্লাহ কোনো নিয়ামাতের পরিবর্তনকারী নন, যা তিনি নিয়ামাত হিসাবে দিয়েছেন কোনো ক্বওমকে, যতক্ষণ না তারা পরিবর্তন করে তাদের নিজেদের নৈতিক অবস্থা। আর নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
মুসিবাত বা বিপদাপদ আল্লাহর অনুমতিক্রমেই সংঘটিত হয়
৬৪:১১ :: আল্লাহ্র অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো মুসিবাত বা বিপদ আসে না। যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞানী।
কল্যাণ-অকল্যাণ সাধনে আল্লাহর চরম ক্ষমতা
৬:১৭ :: আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোনো অকল্যাণ দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনি ছাড়া তা অপসারণকারী কেউ নেই। আর যদি তিনি তোমাকে কোনো কল্যাণ দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনিই সকল সত্তা ও বিষয়ের উপর প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণকারী ও সর্বশক্তিমান নিয়ন্ত্রণকারী।
১০:১০৭ :: আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোনো অকল্যাণ দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনি ছাড়া তা অপসারণকারী কেউ নেই। আর যদি তিনি ইচ্ছা করেন তোমার জন্য কোনো কল্যাণ, তবে তাঁর অনুগ্রহের কোনো কোনো প্রতিরোধকারী নেই। তিনি তা পৌঁছান যাকে তিনি ইচ্ছা করেন তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে। আর তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু।
৩৯:৩৮ :: আর যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো, “কে সৃষ্টি করেছেন আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী?” তাহলে অবশ্যই তারা বলবে, ‘আল্লাহ’। বলো, “তোমরা কি ভেবে দেখেছো তাদের ব্যাপারে যাদেরকে তোমরা ডাকো আল্লাহকে বাদ দিয়ে? যদি আল্লাহ আমার ব্যাপারে ইচ্ছা করেন কোনো অকল্যাণ করতে, তারা কি তাঁর কৃত অকল্যাণকে অপসারণ করতে পারবে? অথবা তিনি আমার ব্যাপারে ইচ্ছা করেন দয়া করতে, তারা কি তাঁর দয়াকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে?” বলো, “আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট। তাঁরই উপর ভরসা করে ভরসাকারীরা।”
সূরা নিসা ৭৮-৭৯ আয়াত তথা কল্যাণ ও অকল্যাণের জন্য আল্লাহকে দায়ী করা বা না করার তাৎপর্য
পূর্বের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে, বিপদাপদ বা মুসিবাত তথা অকল্যাণের জন্য মানুষকেই দায়ী করা হয়েছে। অন্যদিকে ৪:৭৮ আয়াতে কল্যাণ-অকল্যাণ উভয়টির জন্য আল্লাহকে দায়ী করা হয়েছে। অথচ তার ঠিক পরবর্তী ৪:৭৯ আয়াতে কল্যাণের জন্য আল্লাহকে এবং অকল্যানের জন্য মানুষকে দায়ী করা হয়েছে। ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে পড়লে আয়াতগুলোর বক্তব্যকে স্ববিরোধী মনে হতে পারে। অথচ প্রকৃতপক্ষে কুরআনে স্ববিরোধী বক্তব্য নেই। আয়াতসমূহের বক্তব্যের প্রসঙ্গ-কাঠামো নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা করলে এর সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধি করা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে আয়াতগুলোতে স্ববিরোধী বক্তব্য নেই। কল্যাণ ও অকল্যাণের জন্য আল্লাহকে দায়ী করা বা না করার তাৎপর্য প্রসঙ্গে নিম্নে আয়াতদ্বয় (৪:৭৮-৭৯) ও তার আনুষঙ্গিক আলোচনা উপস্থাপন করা হলো।
৪:৭৮ :: যেখানেই তোমরা থাকো মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই, যদিও তোমরা থাকো সুউচ্চ সুদৃঢ় দুর্গে। আর যদি তাদের কোনো উত্তম অবস্থা হয় তখন তারা বলে, “ইহা আল্লাহর পক্ষ থেকে (আল্লাহ কর্তৃক প্রভাবিত হওয়া ফলাফলস্বরূপ)।” আর যদি তাদের কোনো মন্দ অবস্থা হয়, তখন তারা বলে, “ইহা তোমার পক্ষ থেকে (রসূল কর্তৃক প্রভাবিত হওয়া ফলাফলস্বরূপ)।” বলো, “(কল্যাণ-অকল্যাণ) সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে (আল্লাহ কর্তৃক প্রভাবিত হওয়া ফলাফলস্বরূপ)।” তারপর এসব ক্বওমের কী হলো যে, তারা মোটেই উপলব্ধি করে না কোনো কথা?
৪:৭৯ :: তোমার যা কিছু উত্তম অবস্থা হয় তা আল্লাহর থেকে। আর তোমার যা কিছু মন্দ অবস্থা হয় তা তোমার নিজের থেকে। আর আমরা তোমাকে প্রেরণ করেছি মানবজাতির জন্য রাসূল হিসাবে। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।
আলোচনা : ৪:৭৮ আয়াত অনুসারে, তাদের ভালো কিছু হলে তারা বলে যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে (আল্লাহ কর্তৃক প্রভাবিত হওয়া ফলাফলস্বরূপ)। আর তাদের মন্দ কিছু হলে তারা বলে যে, এটা তোমার পক্ষ থেকে (তোমার কর্তৃক প্রভাবিত হওয়া ফলাফলস্বরূপ)। অথচ প্রকৃত সত্য হলো, সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে (আল্লাহর কর্তৃক প্রভাবিত হওয়া ফলাফলস্বরূপ), কোনোকিছু কিরূপ ফলাফল বয়ে আনবে তা মানুষের কর্মকান্ড দ্বারা প্রভাবিত হলেও মূলত তা আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন অনুসারে নির্ধারিত এবং একমাত্র আল্লাহ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। তিনিই একমাত্র সত্তা যিনি কার্যকারণের অমোঘ নিয়ম চালু করেছেন এবং কল্যাণ-অকল্যাণ নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র ক্ষমতা রাখেন। এমতাবস্থায়, রাসূলের মিশনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে জান-মালের বস্তুগত ক্ষতি হলে সেজন্য রসূলকে দায়ী করা ন্যায়সঙ্গত নয়। কারণ, আল্লাহর তৈরি মৃত্যুর অনিবার্য প্রাকৃতিক আইন অনুসারে আসন্ন মৃত্যুকে যেমন এড়ানো যায় না, তেমনি আল্লাহর রসূল হিসেবে রিসালাতের মিশন বাস্তবায়নের পথে যেসব সংকট অতিক্রম করতে হয়, সেজন্য রসূলকে দায়ী করা যেতে পারে না এবং এসব সংকট থেকে বেঁচে থাকার জন্য রসূলের সাথে অসহযোগিতা করা যেতে পারে না।
তারপর ৪:৭৯ আয়াত অনুসারে, তোমার যা কিছু ভালো হয় তা আল্লাহর থেকে অর্থাৎ তা তোমার সঠিক সিদ্ধান্তের ফলে আল্লাহর তৈরি নিয়মে হয়ে থাকে অথবা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহক্রমে হয়ে থাকে। আর তোমার যা কিছু মন্দ হয় তা তোমার থেকে অর্থাৎ তা আল্লাহর তৈরি নিয়মে হলেও তা শুধুমাত্র তোমার (জেনে বা না জেনে, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত) ভুল সিদ্ধান্ত ও কর্মের ফলে হয়ে থাকে এবং আল্লাহ তা হতে দেন বিধায় তা হয়, কিন্তু তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তোমাকে কোনো অকল্যাণ চাপিয়ে দেবেন- এমনটি কখনো হতে পারে না। সুতরাং যদিও অকল্যাণও আল্লাহ কর্তৃক প্রভাবিত হওয়া ফলাফলস্বরূপ হয়ে থাকে, তবে তা কখনো এরূপ হয় না যে, সাধারণ নিয়মে তোমার কল্যাণ হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু আল্লাহ সেটাকে রোধ করে তোমার অকল্যাণ সাধন করেছেন। পক্ষান্তরে কল্যাণ আল্লাহ কর্তৃক প্রভাবিত হওয়া ফলাফলস্বরূপ হয়ে থাকে এবং সেক্ষেত্রে এরূপ হওয়া সম্ভব যে, সাধারণ নিয়মে তোমার কোনো অকল্যাণ হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু আল্লাহ তা থেকে তোমাকে উদ্ধার করে তোমার কল্যাণ সাধন করেছেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, আল্লাহ কারো অকল্যাণ করার অর্থ হলো, কারো কর্মফল হিসেবে যে অকল্যাণ সাধিত হয়, সেই অকল্যাণ সাধিত হতে দেয়া বা তাকে তার উপযুক্ত কর্মফল হিসেবে কোনো শাস্তি প্রদান করা। আর আল্লাহ কারো কল্যাণ করার অর্থ যেমন তাকে তার ভালো কাজের ভালো প্রতিফল দেয়া, তেমিন আল্লাহর দেয়া যাবতীয় নিয়ামাত যা তিনি তাকে পরীক্ষাস্বরূপ বা অনুগ্রহস্বরূপ দিয়েছেন তার সবই এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং কল্যাণ-অকল্যাণ সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে হলেও অকল্যাণের জন্য মানুষই দায়ী। আর এটা আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হয়ে থাকে। “কল্যাণ-অকল্যাণ সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়”- তথ্যটির মাধ্যমে প্রত্যেকের ভাগ্যে কোনো বাস্তব সঙ্গত কারণ ছাড়া কল্যাণ বা অকল্যাণ পূর্বনির্ধারিত করে দেয়াকে বুঝায় না।
পৃথিবীর জীবন পরীক্ষার কাল এবং এতে তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী সংঘটিত কল্যাণ-অকল্যাণও মানুষের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। একজন অমুমিন এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সঠিক কর্মনীতি অবলম্বনে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে একজন মু’মিন অকল্যাণের ক্ষেত্রে সবর এবং কল্যাণের ক্ষেত্রে শোকর আদায় করবে। সবরের অর্থ ধৈর্য্য ও অধ্যবসায় এবং শোকরের অর্থ কৃতজ্ঞতা ও কল্যাণকে অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়া। এ অধ্যায়ে এ প্রসঙ্গে আয়াত ও বাস্তবতার বিভিন্ন দিক থেকে আলোকপাত করা হলো।
কল্যাণ-অকল্যানের ক্ষেত্রে অমুমিন ও দুর্বলমনা মুমিনের কর্মধারা
একজন অমুমিন কোনো কল্যাণ লাভ করলে বা কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে গেলে সেটাতে ভীষণ উৎফুল্লা বা আনন্দে আত্মহারা ও বেসামাল হয়ে যায়। সে এজন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে না এবং সে বিষয়ে সঠিক মূল্যায়ন করতে পারে না। বিষয়টিকে সে নিছক নিজ যোগ্যতার তা পেয়েছে বলে মনে করে এবং অন্যদের কল্যাণে আন্তরিক অবদান রাখে না। বরং সে যদি অন্যদের জন্য কিছু করে তাও প্রশংসা বা সুখ্যাতির জন্য করে এবং এমনভাবে করে যে, যেন সে তাদের প্রতি নিছক করুণা করছে। সে যা-ই লাভ করে, সেটা তার মধ্যে অহংকার বাড়িয়ে দেয়।
এছাড়া একজন অমু’মিন ব্যক্তি তাক্বদীর তথা প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী কোনো কল্যাণ লাভের জন্য সঠিকভাবে চেষ্টা করার পরিবর্তে যে ব্যক্তি কোনো কল্যাণ লাভ করেছে সেটাকে অপছন্দ ও তার কল্যাণের পতন ঘটিয়ে তা নিজে পাওয়ার অপচেষ্টা করে তথা সে ভীষণ হিংসুক হয়ে থাকে।
সে লাগামহীন চাহিদার পেছনে ছুটতে থাকে এবং একটা চাহিদা পূর্ণ হলে অন্যের চেয়ে আরো বেশি পাওয়ার প্রতিযোগিতা করতে থাকে। তার চাহিদা যত বেশি পূর্ণ হতে থাকে, তত বেশি সে অন্যদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করতে থাকে, যেন সে তাদেরকে মানুষই মনে করে না।
অন্যদিকে সে বিপদাপদের মোকাবেলায় ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে এবং তার মধ্যে অসন্তোষ ও ক্রোধের উদ্রেক হয়, নিজ গালে আঘাত করে, বুক চাপড়ায়, চুল ছেঁড়ে, জামা-কাপড় ছেঁড়ে, বিলাপ ইত্যাদি বিভিন্নভাবে সে তার হতাশাজনিত প্রতিক্রিয়া দেখায়। কেউ কেউ আল্লাহর উপর অবিচারের অভিযোগ করে থাকে। অথচ আল্লাহ বান্দার কাছ থেকে যা নিয়েছেন, তা তিনিই তাকে যা দিয়েছেন, এমতাবস্থায় আল্লাহর উপর অবিচারের অভিযোগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ বিপদের মোকাবেলায় স্বীয় মৃত্যু কামনা করে যা তাকে জীবন থেকে নিরাশ করে দেয়। আবার কেউ কেউ আত্মহত্যা করে ফেলে। অথচ আত্মহত্যার মাধ্যমে সে যেমন পৃথিবীর কল্যাণকর সম্ভাবনা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে তেমনি সে মৃত্যু পরবর্তী জীবনেও নিজেকে জাহান্নামের উপযুক্ত করে নেয়।
আবার দুর্বলমনা মু’মিনরা বিপদাপদের সময় আল্লাহর কাছে দীর্ঘ প্রার্থনা করে। কিন্তু বিপদাপদ কেটে গেলে আল্লাহকে যথাযথভাবে স্মরণ করে না বা আল্লাহর বিধিবিধান যথানিয়মে পালন করে না।
এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষ্যণীয়।
৯৬:৬-৭ :: বস্তুত মানুষ তো সীমালঙ্ঘন করেই থাকে। কারণ সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে।
১৭:৮৩ :: মানুষ যখন আমাদের অনুগ্রহ উপভোগ করে, তখন সে (আল্লাহর বিধান থেকে অহংকার করে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু যখন তার কাছে অমঙ্গল আসে, তখন সে হতাশ হয়ে পড়ে।
৩০:৩৬ :: আর যখন আমরা মানুষকে রহমতের স্বাদ আস্বাদন করাই, তখন সে উহা পেয়ে আনন্দিত হয়। আর যদি তাদের কাছে পৌঁছে কোনো মন্দ অবস্থা উহার কারণে যা আগেই করেছে তাদের হাতসমূহ (তাদের কৃতকর্মের কারণে), তখন তারা হতাশ হয়ে পড়ে।
৪২:৪৮ :: সুতরাং যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আমরা তোমাকে প্রেরণ করিনি তাদের উপর রক্ষক হিসাবে। তোমার উপর দায়িত্ব নেই পৌঁছে দেয়া/ প্রচার ছাড়া। আর নিশ্চয় আমরা যখন স্বাদ আস্বাদন করাই মানুষকে আমাদের পক্ষ থেকে রহমতের (স্বাদ), তখন সে উহা দ্বারা আনন্দিত হয়। আর যদি তাদের কাছে পৌঁছে কোনো মন্দ, যা তাদের হাতগুলো আগেই সম্পন্ন করেছে তার কারণে (তাদের কৃতকর্মের কারণে), তখন নিশ্চয় মানুষ অকৃতজ্ঞ হয়।
৪:২৯-৩০ :: ... আর তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের প্রতি দয়ালু। যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন এবং যুলমের বশবর্তী হয়ে এরূপ করবে, তাকে অচিরেই আমরা জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করব। আর ইহা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজসাধ্য।
৪১:৫১ :: আর যখন আমরা অনুগ্রহ করি মানুষের উপর, তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় আর তার পাশ কেটে যায়/ এড়িয়ে চলে। আর যখন তাকে স্পর্শ করে দু:খকষ্ট, তখন দীর্ঘ দোয়ায় রত হয়।
১০:১২ :: আর যখন মানুষকে বিপদ স্পর্শ করে, তখন সে শুয়ে, বসে বা দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকে। অতঃপর আমি যখন তার বিপদ দূর করে দেই, তখন সে এমনভাবে চলতে থাকে মনে হয় যেন তাকে কোনো বিপদ স্পর্শ করার কারণে সে আমাকে ডাকে নি। এভাবেই সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য তারা যা আমল করত তা শোভিত করে দেয়া হয়েছে।
৩৯:৪৯ :: বস্তুত যখন মানুষকে স্পর্শ করে কোনো বিপদআপদ, তখন সে আমাদেরকে ডাকে। তারপর যখন আমরা তাকে দান করি আমাদের পক্ষ থেকে নেয়ামত/ অনুগ্রহ, তখন সে বলে, “বস্তুত উহা আমাকে দেয়া হয়েছে আমার জ্ঞানের কারণে।” বরং উহা পরীক্ষা। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জ্ঞান রাখে না।
কল্যাণ-অকল্যাণের ক্ষেত্রে মু’মিনের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতি
একজন মু’মিন সঠিক জীবন-দর্শনের অধিকারী। সে জানে যে, স্বাভাবিক ক্ষুধা এবং খাদ্য আল্লাহর দুটি নেয়ামত বা অনুগ্রহ, যার জন্য তাঁর প্রশংসা করতে হবে, কারণ ক্ষুধার কারণে খাদ্যের স্বাদ পাওয়া যায় আর খাদ্যের মাধ্যমে ক্ষুধার নিবারণ হয়। উভয় নেয়ামতের শোকর হলো ক্ষুধা নিবারণের জন্য বৈধ প্রচেষ্টায় খাদ্য সংগ্রহ এবং খাদ্য সংগ্রহের ক্ষমতায় তারতম্যের ভিত্তিতে অধিক খাদ্য সংস্থানের ক্ষেত্রে যাদের দ্বারা কম খাদ্য সংস্থান সম্ভব হয়েছে তাদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করা। কাদের পক্ষে কতটুকু ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাদ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা হবে সেটা কার্যকর প্রাকৃতিক নিয়ম ও মানুষের অনুসৃত নৈতিক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। আল্লাহ জীবিকার ব্যবস্থা করেছেন এ দ্বিবিধ পরিস্থিতির সংমিশ্রিত অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল পর্যায়ে। আবার পৃথিবীর জীবনকে পরীক্ষাকাল করা হয়েছে।
সুতরাং এখানে জীবিকার বাস্তব হ্রাসবৃদ্ধি এবং অনুরূপ বিভিন্ন অবস্থার জন্য আল্লাহর উপর কোনো অভিযোগ আরোপিত হতে পারে না, বরং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী নিজেদের দায়িত্ব পালন থেকে বিচ্যুত হলে আল্লাহর কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হতে হবে। একটি বাঘ একটি হরিণকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা নিয়ে যেমন আল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যেতে পারে না, তেমনি যে শিশুকে জাহিলিয়াতের যুগে তার পিতা অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে সে শিশুকে কেন তার পিতা হত্যা করতে পারলো সে প্রশ্নে আল্লাহর উপর অভিযোগ করা যেতে পারে না। মানুষ স্বীয় মৃত্যু পর্যন্ত প্রাকৃতিক ও নৈতিক নিয়মের আওতায় থাকা বিভিন্ন পরিস্থিতি সাপেক্ষে আল্লাহর অনুগ্রহ পেয়ে থাকে। সর্বোত্তম পর্যায়ে আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়ার উপায় হলো সর্বোত্তম পর্যায়ে আল্লাহর দেওয়া নৈতিক বিধানের বাস্তবায়ন করা। আর পৃথিবীতে যাকে যে ধরনের অনুগ্রহ কম বা বেশি করা হয়েছে তা কাজে লাগিয়ে মানুষ নিজ ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতায় যেরূপ কাজ করবে তদনুসারে সে পুরস্কার বা শাস্তি পাবে।
একজন মু’মিন কল্যাণে আত্মহারা এবং অকল্যাণে নিরাশ হয় না। সে সর্বাবস্থায় আল্লাহর ব্যবস্থাপনার প্রতি আস্থাশীল ও আল্লাহর প্রতি ভরসা পোষণকারী হয়ে থাকে। সে বিশ্বাস করে যে, বাহ্যত অকল্যাণের একটি বিষয় প্রকৃতপক্ষে তার জন্য কল্যাণকরও হতে পারে যে রহস্য সম্পর্কে সে অবগত নয়। হতে পারে তা তার কোনো অপরাধের লঘু শাস্তিস্বরূপ অথবা হতে পারে তা তার ভবিষ্যতে বড় কোনো অকল্যাণ থেকে বেঁচে যাওয়ার উপায়স্বরূপ। সে বিষয়টিকে তার জন্য একটি পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে এবং ধৈর্য্যের সাথে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে উত্তম পুরস্কারের উপযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে।
রোগ-ব্যাধি ও বিপদাপদের ফলে মানুষ সুস্থতা ও নিরাপত্তার মূল্যায়ন করতে পারে। সুস্থ ও নিরাপদ থাকার জন্য আল্লাহর দরবারে ধর্ণা দেয়, তাঁর শোকর/কৃতজ্ঞতা আদায় করে। এভাবে মু’মিনের মধ্যে নৈতিক গুণের বিকাশ হয়।
একজন মু’মিন বৈধ পথে তার সাধ্যমতো সঠিকভাবে কাজ করার চেষ্টা করে এবং ফলাফলের জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করে ও তাঁর কাছে দোয়া করা। সফল হলে আল্লাহর শোকর আদায় করে এবং ব্যর্থ হলে সবর করে। অকল্যাণ থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে এবং তা থেকে উত্তরণের জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে।
নিম্নে শোকর ও সবর সম্পর্কিত কিছু আয়াত উল্লেখ করা হলো।
২:১৭২ :: হে যারা বিশ্বাস করেছো, তোমরা খাও পবিত্র (খাদ্য) থেকে, যা আমরা তোমাদেরকে রিজিক্বস্বরূপ দিয়েছি। আর আল্লাহর শোকর/ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, যদি তোমরা শুধু তাঁরই দাসত্ব করে থাকো।
৪:১৪৭ :: আল্লাহ কী করবেন তোমাদেরকে শাস্তি (কষ্ট) দিয়ে যদি তোমরা শোকর/ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো আর তোমরা বিশ্বাস করো? আর আল্লাহ শোকরের মূল্যায়নকারী, সর্বজ্ঞ।
৭:১০ :: আর নিশ্চয় আমরা তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছি/ বসবাসের স্থান দিয়েছি, আর আমরা সৃষ্টি করেছি তোমাদের জন্য উহাতে জীবিকা নির্বাহের উপায়সমূহ। কিন্তু তোমরা অল্পই শোকর/ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো।
১৪:৭ :: আর (সেই সময়ের কথা উল্লেখ্য) যখন তোমার প্রভু ঘোষণা করেছেন, “যদি তোমরা শোকর/ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো তাহলে অবশ্যই আমি তোমাদেরকে (আমার অনুগ্রহ) বাড়িয়ে দেবো। আর যদি তোমরা কুফর/ অবিশ্বাস/ অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো তাহলে নিশ্চয় আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন।”
৩৯:৭ :: যদি তোমরা কুফর (অবিশ্বাস/অকৃতজ্ঞতা) করো, তবে নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের থেকে অমুখাপেক্ষী। আর তিনি পছন্দ করেন না তাঁর বান্দাদের জন্য কুফরকে। আর যদি তোমরা শোকর/ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তিনি উহাকে (শোকরকে) পছন্দ করেন তোমাদের জন্য। আর বহন করবে না কোনো বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা। তারপর তোমাদের প্রভুর দিকে তোমাদের ফিরে যাবার স্থান। তারপর তিনি তোমাদেরকে সংবাদ দেবেন তোমরা যে কাজ করতে তা সম্পর্কে। নিশ্চয় তিনি মস্তিষ্কসমূহের চিন্তাধারা সম্পর্কে জানেন।
২:১৫৫ :: আর অবশ্যই আমরা তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো কিছু বিষয় দ্বারা যেমন আশংকা, ক্ষুধা এবং মালসম্পদ, জান-জীবন ও ফলফলাদির ক্ষয়ক্ষতি। আর সবরকারীদেরকে সুসংবাদ দাও।
৩:১৪৬ :: আর কত নবী ছিলো যারা যুদ্ধ করেছে, তার সাথে ছিলো অনেক রিব্বুয়্যু (প্রতিপালন ব্যবস্থা বাস্তবায়নকারী)। তখন তারা মনভাঙ্গা হয় নি এজন্য যে, কখনো কখনো কোনো মুসিবত তাদের ওপর ঘটে গেছে (অর্থাৎ যদিও তারা কখনো কখনো মুসিবতে পড়েছে তবুও তারা মনভাঙ্গা হয় নি)। আর তারা দুর্বলতা দেখায় নি আর তারা মাথানত করে নি। আর আল্লাহ সবরকারীদেরকে ভালোবাসেন।
১৪:১২ :: (রসূলগণ বলেছিলো), “‘আর আমাদের কী হয়েছে যে, আমরা ভরসা করবো না আল্লাহর উপর? অথচ নিশ্চয় তিনি আমাদেরকে আমাদের অনুসরণীয় পথের হিদায়াত করেছেন। আর তোমরা আমাদেরকে যে কষ্ট দিচ্ছো সেই বিষয়ে আমরা অবশ্যই সবর করবো। আর ভরসাকারীগণ আল্লাহরই উপর ভরসা করা উচিত।”
৪৭:৩১ :: আর আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো, যতক্ষণ না আমরা (তোমাদের কর্মের মাধ্যমে) জেনে নেব তোমাদের মধ্যকার সংগ্রামকারীদেরকে ও সবরকারীদেরকে। আর আমরা তোমাদের খবরসমূহ পরীক্ষা করবো।
৩৪:১৮-১৯ :: আর আমরা স্থাপন করেছিলাম তাদের ও ঐ জনপদের মধ্যে, যাতে আমরা বরকত দিয়েছিলাম, (স্থাপন করেছিলাম) দৃশ্যমান জনপদসমূহ, আর আমরা উহাতে প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নির্ধারণ করেছিলাম ভ্রমণ দূরত্ব। (আমি বলেছিলাম), “তোমরা উহাতে ভ্রমণ করো রাতসমূহে আর দিনসমূহে, নিরাপত্তাসহকারে।” তারপর তারা বলেছিলো, “হে আমাদের রব, দূরত্ব বাড়িয়ে দিন আমাদের সফরের ক্ষেত্রে (অর্থাৎ আমরা যেন আরো দুর-দূরান্তের দেশ-দেশান্তরে বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য সফর করতে পারি)।” আর তারা যুলুম করেছিলো তাদের নিজেদের উপর। তারপর আমরা তাদেরকে পরিণত করলাম ইতিহাসের কাহিনীতে। আর আমরা তাদেরকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিলাম, প্রত্যেক বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে। নিশ্চয় উহাতে আছে নিদর্শন, প্রত্যেক সবরকারী ও শোকরকারীর জন্য।
পরিশেষে বলা যায় যে, কল্যাণ-অকল্যাণের প্রেক্ষিতে মু’মিনের করণীয় বিষয়ক নির্দেশনা ভাগ্যবাদের সমর্থক নয়। কারণ যদি শোকর ও সবরের নির্দেশনা দ্বারা ভাগ্যবাদকে বুঝাতো, তাহলে তাকে সবর ও শোকরের নির্দেশনা দেয়াটাও অর্থহীন হতো। কারণ সেক্ষেত্রে তার ভাগ্য অনুসারে সে শোকর ও সবর করতো বা করতো না। তার ভাগ্যে যদি ঠিক করে দেয়া থাকতো যে, সে শোকর ও সবর করবে, তাহলে সে তা করতো, অন্যথায় করতো না। কিন্তু কুরআন আমাদেরকে এরূপ অদ্ভুত ধারণা থেকে মুক্ত করে বরং শোকর ও সবরের নির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তাক্বদীর মানে ভাগ্য নয়, বরং এর মানে আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন ও তাঁর নিয়ন্ত্রণ।
‘যদি এরূপ হতো, তবে এরূপ হতো’ বলা কোন ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য এবং কোন ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য?
তাক্বদীর (ভাগ্য?) প্রসঙ্গে একটি প্রচলিত কথা হলো, ‘যদি এমন হতো, তবে এমন হতো’ বা ‘যদি এমন হয়, তবে এমন হবে’ এরূপ কথা বলা সঙ্গত নয়। আরো আপত্তিকর কথা হলো, যখন বলা হয়- ‘যদি শয়তানের উক্তি’। কারণ ভাগ্যে যা আছে তাই হয়েছে ও হবে, এখানে ‘যদি’-র কোনো অপশন নেই। তাই এ অধ্যয়ে আমরা ‘যদি … তবে …’ তথা ‘যদি এমন হতো, তবে এমন হতো’ বা ‘যদি এমন হয়, তবে এমন হবে’ এরূপ কোনো কথা সঙ্গত কিনা অথবা তা কোন ক্ষেত্রে সঙ্গত ও কোন ক্ষেত্রে অসঙ্গত তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
লাও (যদি এমন হতো, তবে এমন হতো)
অতীতকালের বিষয়ে ‘যদি’ অর্থ প্রকাশ করার জন্য আরবিতে ‘লাও’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। নিম্নে ‘লাও’ শব্দ সম্বলিত কিছু আয়াত উল্লেখ করা হলো যাতে ‘যদি এমন হতো, তবে এমন হতো’- তথ্য-সম্বলিত বক্তব্য রয়েছে।
৩:১৫৯ :: মূলত আল্লাহর রহমতের ফলে তুমি কোমল হয়েছো তাদের জন্য। আর যদি তুমি হতে রুক্ষ মেজাজের, আচরণে কঠোর মনের অধিকারী; তবে অবশ্যই তারা সরে যেতো তোমার চারপাশ থেকে। সুতরাং তাদেরকে উদারতা দেখাও আর ক্ষমা চাও তাদের জন্য। আর তাদের সাথে পরামর্শ করো নির্বাহী দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে। তারপর যখন তুমি সিদ্ধান্ত করো তখন ভরসা করো আল্লাহর উপর। নিশ্চয় আল্লাহ ভালোবাসেন তাঁর উপর ভরসাকারীদেরকে।
৪:৯ :: আর তারা ভয় করুক যদি তারা (মৃত্যুর সময়) ছেড়ে যেতো তাদের পিছনে দুর্বল সন্তান-সন্ততি, তবে তারা ভয় পেতো তাদের (ভবিষ্যতের) ব্যাপারে। সুতরাং তারা যেন আল্লাহকে ভয় করে। আর তারা যেন সঠিক কথা বলে।
৪:৬৪ :: আর আমরা প্রেরণ করি নি কোনো রসূল এ উদ্দেশ্য ছাড়া যে, যেন তার আনুগত্য করা হয় আল্লাহর অনুমতিক্রমে। আর যদি বাস্তবে তারা যখন (তাগুতের আনুগত্য ও তাগুতের কাছে বিচারভার অর্পণের মাধ্যমে) যুলুম করেছে তাদের নিজেদের উপর (তারপর অবিলম্বে) তারা তোমার কাছে আসতো তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতো আর ক্ষমা চাইতো তাদের জন্য রসূল নিজেও, তবে নিশ্চয় তারা আল্লাহকে পেতো তাওবাহ কবুলকারী, দয়ালু।
৪:৬৬ :: আর যদি নিশ্চয় আমরা তাদের উপর বিধিবদ্ধ করে দিতাম যে, তোমরা হত্যা করো তোমাদের নিজেদেরকে অথবা তোমরা বেরিয়ে যাও তোমাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে, তবে তারা তা পালন করতো না, তাদের অল্প কয়েকজন ছাড়া। আর যদি বাস্তবে তারা পালন করতো যা পালন করার জন্য তাদেরকে উপদেশ দেয়া হয়, তবে নিশ্চয় তা কল্যাণকর হতো তাদের জন্য, আরো হতো মনের স্থিরতায় দৃঢ়তর।
৪:৮৩ :: আর যখন তাদের কাছে আসে কোনো শান্তিপূর্ণ বিষয় অথবা ভীতিপ্রদ বিষয়, তারা উহা সর্বত্র প্রচার করে। অথচ যদি তারা উহা পৌঁছে দিতো রসূলের কাছে আর তাদের মধ্যকার উলিল আমরের কাছে, তবে নিশ্চয় তারা তা জানতো যারা উহার ইস্তিম্বাত (যথার্থতা নির্ণয়ে তথ্যানুসন্ধান) করতে পারতো। আর যদি না থাকতো আল্লাহর অনুগ্রহ তোমাদের উপর আর (না থাকতো) তাঁর দয়া, তবে নিশ্চয় তোমরা শয়তানের অনুসরণ করতে, অল্পসংখ্যক ছাড়া।
৫:৬৬ :: আর যদি তারা প্রতিষ্ঠা করতো তাওরাত ও ইনজীল আর যা নাযিল করা হয়েছে তাদের প্রতি তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে, তবে তারা খাদ্য পেতো তাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) আর তাদের পায়ের নিচ থেকে (যমিন থেকে)। তাদের মধ্যে আছে মিতাচারী উম্মাত (যারা আচার-আচরণে ভালো)। আর তাদের অধিকাংশই মন্দ কাজ করে।
৬:৭-৯ :: আর যদি আমরা নাযিল করতাম তোমার উপর কাগজে লেখা কিতাব, তারপর তারা তা স্পর্শ করতো তাদের হাতসমূহ দ্বারা, তবে সেক্ষেত্রেও তারা বলতো যারা কুফর করেছে, “ইহা কিছুই নয়, প্রকাশ্য যাদু ছাড়া।” আর তারা বললো, “কেন নাযিল করা হয় নি তার উপর কোনো ফেরেশতা?” আর যদি আমরা নাযিল করতাম কোনো ফেরেশতা, তবে সিদ্ধান্ত হয়ে যেতো; তারপর তাদেরকে অবকাশ দেয়া হতো না। আর যদি আমরা ফেরেশতা প্রেরণ করতাম, তবে সেক্ষেত্রে আমরা তাকে (ফেরেশতাকে) প্রেরণ করতাম পুরুষ মানুষরূপে; আর আমরা তাদেরকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দিতাম যেমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে এখন তারা পড়ে রয়েছে।
৬:৫৮ :: বলো, ‘যদি তা (আযাব) হতো আমার কাছে যা তোমরা শীঘ্রই পেতে চাচ্ছো, তবে ব্যাপারটির ফায়সালা হয়েই যেতো আমার ও তোমাদের মধ্যে। আর আল্লাহ ভালভাবেই পরিজ্ঞাত যালিমদের সম্পর্কে।
৬:১৫৭ :: অথবা তোমরা বলতে পারো, “যদি বাস্তবিক নাযিল করা হতো আমাদের উপর কিতাব, তবে আমরা হতাম তাদের তুলনায় অধিক হিদায়াত গ্রহণকারী। সুতরাং এখন নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছে স্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণ, তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে, আর হিদায়াত ও দয়া। সুতরাং তার চেয়ে বড় জালিম কে হতে পারে, যে মিথ্যা সাব্যস্ত করে আল্লাহর আয়াতসমুহের প্রতি আর মুখ ফিরিয়ে থাকে উহা থেকে? শীঘ্রই আমরা তাদেরকে প্রতিফল দেবো যারা মুখ ফিরিয়ে থাকে আমাদের আয়াতসমূহ থেকে, নিকৃষ্ট শাস্তি, তারা মুখ ফিরিয়ে রাখার কারণে।
৭:৯৬ :: আর যদি এসব জনপদের অধিবাসীরা বিশ্বাস করতো ও স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করতো, তবে আমরা খুলে দিতাম তাদের উপর বরকতসমূহ, আসমান থেকে ও জমিন থেকে। কিন্তু তারা মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে। সুতরাং আমরা তাদেরকে পাকড়াও করেছি তারা যে পাপ উপার্জন করেছে তার কারণে।
৭:১৮৮ :: বলো, “আমি না ক্ষমতা রাখি আমার নিজের জন্যও কোনো উপকার করার আর না অপকার করার, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া। আর যদি আমি গায়েব জানতাম, তবে আমি গ্রহণ করতাম অনেক কল্যাণ, আর আমাকে কোনো অকল্যাণ স্পর্শ করতো না। আমি নই সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা ছাড়া অন্য কিছু, সেই ক্বওমের জন্য যারা বিশ্বাস করে।
৮:৪২ :: (স্মরণ করো) যখন তোমরা ছিলে নিকটতর প্রান্তে আর তারা ছিলো দূরবর্তী প্রান্তে। আর (তাদের) কাফেলা ছিলো তোমাদের চেয়ে নিম্নভূমিতে। আর যদি তোমরা পারস্পরিক ওয়াদাক্রমে (পরামর্শক্রমে) এটি নির্ধারণ করতে, তবে নিশ্চয় তোমরা মতভেদ করতে এ মীয়াদের (সময় নির্ধারণের) ব্যাপারে {অর্থাৎ পরামর্শের ভিত্তিতে পূর্ব পরিকল্পনার মাধ্যমে রণকৌশল নির্ধারণ করলে তোমরা এখনই যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না।} কিন্তু তা ঘটেছে এজন্য যে, যেন আল্লাহ ফায়সালা করেন এমন একটি ব্যাপারে যা কার্যকর হয়েছে। (আর তা হচ্ছে) যেন ধ্বংস হয়ে যায় যে ধ্বংস হওয়ার যোগ্য স্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণের ভিত্তিতে, আর যেন জীবিত থাকে যে জীবিত থাকার যোগ্য স্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণের ভিত্তিতে। আর নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
৮:৪৩ :: (স্মরণ করো) যখন আল্লাহ তোমাকে দেখিয়েছেন তোমার স্বপ্নের মধ্যে (তাদের) অল্পজনশক্তি (অর্থাৎ তাদের বিজয়ের জন্য যা প্রয়োজন তার চেয়ে কম জনশক্তি)। আর যদি তিনি তোমাকে দেখাতেন তাদের জনশক্তি বেশি (অর্থাৎ তোমাদের তুলনায় তাদের জনশক্তি যত বেশি হলে তারা বিজয়ী হতে পারে তত বেশি), তবে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলতে। আর তোমরা মতবিরোধ করতে নির্বাহী সিদ্ধান্তের ব্যাপারে। কিন্তু আল্লাহ (এর মাধ্যমে তোমাদেরকে) সুষ্ঠু (সংগঠনভুক্ত) রেখেছেন। নিশ্চয় তিনি মস্তিষ্কসমূহের চিন্তাধারা সম্পর্কে জ্ঞাত।
৮:৬৩ :: আর তিনি জুড়ে দিয়েছেন তাদের (মু’মিনদের) কলবসমূহকে। যদি তুমি ব্যয় করতে যা আছে পৃথিবীতে তার সবই, তবে তা সত্ত্বেও তুমি জুড়ে দিতে পারতে না তাদের কলবসমূহকে। কিন্তু আল্লাহ জুড়ে দিয়েছেন তাদেরকে। নিশ্চয় তিনি মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।
৯:৪২ :: যদি (সহজলভ্য) হতো নিকটবর্তী ফায়দা আর সফরও হতো সুগম, তবে তারা তোমার অনুসরণ করতো। কিন্তু দীর্ঘ হয়ে গেলো তাদের উপর কষ্টসাধ্য যাত্রাপথ। আর তারা কসম করবে আল্লাহর নামে, “যদি আমরা পারতাম, তবে আমরা বের হতাম তোমাদের সাথে।” আসলে তারা ধ্বংস করেছে তাদের নিজেদেরকেই। আর আল্লাহ জানেন, নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।
৯:৪৬-৪৭ :: আর যদি তারা ইচ্ছা করতো বের হতে, তবে তো তারা প্রস্তুতি নিতো উহার জন্য, যথাযথ প্রস্তুতি। কিন্তু আল্লাহ অপছন্দ করেছেন তাদের অভিযাত্রা, সুতরাং তিনি তাদেরকে বিরত রেখেছেন। আর তাদেরকে বলা হয়েছে, “তোমরা বসে থাকো তাদের সাথে যারা বসে আছে।” যদি তারা বের হতো তোমাদের মধ্যে মিশে, তবে তারা তোমাদের মধ্যে কিছুই বাড়াতো না, অস্বস্তি ছাড়া। আর তারা ঘোড়া ছুটাতো তোমাদের মধ্যে, তারা তোমাদের মধ্যে তালাশ করতো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। আর তোমাদের মধ্যে আছে তাদের কথা শুনার মতো লোক। আর জালিমদের সম্বন্ধে আল্লাহ সম্যক জ্ঞাত।
৯:৫৭ :: যদি তারা পেতো আশ্রয়স্থল অথবা গুহা অথবা ঢুকে বসার মতো জায়গা, তবে তারা ফিরে যেতো সেদিকে আর তারা দ্রুত ছুটে যেতো।
১০:১১ :: আর যদি আল্লাহ তাড়াতাড়ি করতেন মানুষের জন্য অকল্যাণ দেয়ার ব্যাপারে যেমন তাড়াতাড়ি তারা চায় কল্যাণ পেতে; তবে সম্পন্ন হয়ে যেতো তাদের ক্ষেত্রে তাদের অবকাশের সময়সীমা। সুতরাং আমরা তাদেরকে ছাড় দিয়েছি যারা আশা রাখে না আমাদের (কাছে জবাবদিহির জন্য) সাক্ষাতের বিষয়ে। তারা তাদের বিদ্রোহে/ সীমালংঘনে উদ্ভ্রান্ত/ দিশেহারা হয়ে ঘুরছে।
১৩:৩১ :: আর যদি এমন হতো যে, কুরআন দিয়ে টলানো যেতো পাহাড়সমূহকে অথবা খন্ড বিখন্ড করা যেতো উহা দিয়ে পৃথিবীকে অথবা কথা বলানো যেতো উহা দিয়ে মৃতকে, (তবে তা সত্ত্বেও তারা বিশ্বাস করতো না)। বরং আল্লাহরই অধিকারভুক্ত সমস্ত বিষয়/ কাজ। তবে কি তারা নিরাশ হয় নি যারা বিশ্বাস করেছে এ কারণে যে, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে নিশ্চয় হিদায়াত করতেন সমস্ত মানুষকে। আর সর্বদাই যারা অবিশ্বাস করেছে তাদের কাছে পৌঁছবে ঐ কারণে যা তারা করেছে, (পৌঁছবে বিভিন্ন) বিপদাপদ অথবা তা নেমে আসবে তাদের ঘরবাড়ির নিকটে, যতক্ষণ না আসবে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি। নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না।
১৭:১০০ :: বলো, “যদি তোমরা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হতে আমার প্রভুর রহমতের ভান্ডারসমূহের, তবে তখন তোমরা উহা ধরে রাখতে ব্যয় হয়ে যাওয়ার ভয়ে। আর মানুষ হলো সংকীর্ণমনা/ কৃপণ।”
২০:১৩৪ :: আর যদি এমন হতো যে, আমরা তাদেরকে ধ্বংস করে দিতাম আযাব দিয়ে তাকে প্রেরণের আগে। তবে তারা বলতো, “হে আমাদের প্রভু, কেন আপনি প্রেরণ করেন নি আমাদের কাছে কোনো রসূল, যার ফলে আমরা অনুসরণ করতে পারতাম আপনার আয়াতসমূহ, আমরা অপমানিত ও লজ্জিত হওয়ার আগে।
২৩:৭১ :: আর যদি অনুসরণ করতো সত্য, তাদের প্রবৃত্তিকে, তবে বিপর্যস্ত হয়ে যেতো আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী আর যারা উহাদের মধ্যে আছে তারা। বরং আমরা তাদেরকে দিয়েছি তাদের যিকির (স্মরণীয় তথ্য ও বিধিবিধান)। তবে কি তারা তাদের যিকির (স্মরণীয় তথ্য ও বিধিবিধান) থেকে বিমুখ হয়ে থাকবে?
৩৩:১৩-১৪ :: আর যখন তাদের মধ্য থেকে একটি দল বলেছিলো, “হে ইয়াসরিববাসী, তোমাদের জন্য নেই কোনো দাঁড়াবার/ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্থান। সুতরাং তোমরা ফিরে যাও।” আর অব্যাহতি/ ছুটির অনুমতি চায় তাদের মধ্য থেকে একটি দল, নবীর কাছে। তারা বলে, “নিশ্চয় আমাদের ঘরসমূহ অরক্ষিত।” অথচ উহা ছিলো না অরক্ষিত অবস্থায়। তারা ইচ্ছা করে না, পলাতক (হতে চাওয়া) ছাড়া। আর যদি (শত্রু) প্রবেশ করতো তাদের উপর উহার চারদিক থেকে, তারপর ফিতনা ছড়ানোর জন্য প্রার্থী হতো (আহবান করতো), তবে তারা উহাতে এসে পড়তো (তাদের আহবানে সাড়া দিতো), আর তারা উহাতে বিলম্ব করতো না, সামান্য সময় ছাড়া।
৩৩:২০ :: তারা হিসাব/ ধারণা করে যে, (আক্রমণকারী) সেনাদলসমূহ চলে যায় নি। আর যদি (ফিরে) আসে (আক্রমণকারী) সেনাদলসমূহ, তবে তারা কামনা করবে, যদি এমন হতো যে, তারা প্রকাশিত হতো আ’রববাসীদের মধ্যে, (তারপর সেখান থেকে) তারা জিজ্ঞাসাবাদ করতো তোমাদের সংবাদাদি! আর যদি তারা তোমাদের মধ্যে থাকতো, তবে তারা যুদ্ধ করতো না, অল্পসংখ্যক ছাড়া।
৪১:৪৪ :: আর যদি আমরা উহাকে করতাম আ’যমী/ অনারবী (ভাষার) কুরআন, তবে তারা বলতো, “কেন বিস্তারিত ব্যাখ্যারূপে বিবৃত হয় নি উহার আয়াতসমূহ? (এটা আশ্চর্যের ব্যাপার যে, কুরআন হচ্ছে) আ’যমী/ অনারবী আর (রসূল হচ্ছে) আ’রবী।” বলো, “উহা যারা বিশ্বাস করেছে তাদের জন্য হিদায়াত ও (মনের) রোগ নিরাময়কারী।” আর যারা বিশ্বাস করে না, তাদের কানগুলোর মধ্যে আছে বধিরতা, আর তাদের উপর আছে অন্ধত্ব। ঐসব লোককে যেন ডাকা হচ্ছে কোনো দূরবর্তী স্থান থেকে।
৪২:২৭ :: আর যদি আল্লাহ প্রচুর পরিমাণে রিজিক্ব দিতেন তাঁর সব বান্দাদেরকে, তবে তারা বিদ্রোহ করতো পৃথিবীতে। কিন্তু তিনি নাযিল করেন নির্ধারিত প্রাকৃতিক আইন (natural law) অনুযায়ী, যা তিনি ইচ্ছা করেন। নিশ্চয় তিনি তাঁর বান্দাদের বিষয়ে অবগত, দৃষ্টিবান।
৪৮:২২ :: আর যদি (তোমার মক্কা অভিযানের সময়) তারা যুদ্ধ করতো তোমাদের সাথে যারা অবিশ্বাস করেছে, তবে তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতো। তারপর তারা পেতো না কোনো অভিভাবক আর কোনো সাহায্যকারীও (পেতো) না।
৪৮:২৫ :: তারাই এমন লোক যারা অবিশ্বাস করেছে আর তোমাদেরকে বাধা দিয়েছে আল মাসজিদুল হারাম থেকে, আর আটকে দেয়া হয়েছে (কা’বায় পৌঁছানোর) হাদিয়া, উহার যথাস্থানে পৌঁছানো থেকে। আর যদি না থাকতো এমন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারী, যাদেরকে তোমরা (মু’মিন হিসাবে) জানতে না, তাই তোমরা তাদেরকে পর্যুদস্ত করতে, তাই তোমাদের কাছে পৌঁছতো তাদের প্রেক্ষিতে কলংক, অজ্ঞতাবশত: (তবে তিনি যুদ্ধকে আটকে দিতেন না)। (তা করা হয়েছে) যেন আল্লাহ প্রবেশ করান তাঁর রহমতের মধ্যে যাকে তিনি ইচ্ছা করেন। যদি তারা পৃথক থাকতো, তবে (যুদ্ধ থেকে বিরত না রেখে) আমরা শাস্তি দিতাম তাদের মধ্য থেকে যারা অবিশ্বাস করেছে তাদেরকে, যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
৪৯:৭ :: আর জেনে রাখো যে, তোমাদের মধ্যে আছে আল্লাহর রসূল। যদি সে তোমাদের তোমাদের কথা মেনে নেয় অধিকাংশ ব্যাপারে, তাহলে তোমরাই কষ্টে পড়বে। কিন্তু আল্লাহ পছন্দনীয় করে দিয়েছেন তোমাদের কাছে ঈমানকে আর তিনি উহাকে শোভনীয় করে দিয়েছেন তোমাদের কলবসমূহের মধ্যে। আর তিনি অপছন্দনীয় করে দিয়েছেন তোমাদের কাছে অবিশ্বাস, অবাধ্যতা ও অমান্যতাকে। এ ধরনের লোকেরাই সত্যপথগামী।
৫৯:২১ :: যদি আমরা নাযিল করতাম এ আল কুরআনকে কোনো পাহাড়ের উপর, তবে তোমরা উহাকে দেখতে অবনমিতরূপে বিদীর্ণ অবস্থায়, আল্লাহর ভয়ে। আর উহাই দৃষ্টান্ত, আমরা তা পেশ করি মানবজাতির জন্য, যেন তারা (সাধারণ ও বৈজ্ঞানিক স্তরে) চিন্তা-গবেষণা করে।
৬৭:১০ :: আর তারা বলবে, “যদি আমরা শুনতাম অথবা আমরা আকল/ বিবেক-বুদ্ধি/ common sense প্রয়োগ করতাম, তবে আমরা হতাম না প্রজ্জলিত আগুনের অধিবাসী।”
৬৯:৪৪-৪৭ :: আর যদি সে আমাদের নামে কোনো কথা বানিয়ে বলত। তবে আমরা তার ডান হাত ধরে ফেলতাম। তারপর আমরা তার গলার রগ কেটে দিতাম। তারপর তোমাদের মধ্য থেকে কেউ (আমাকে) উহা থেকে বিরত রাখতে পারতো না।
ইন (যদি এমন হয়, তবে এমন হবে)
ভবিষ্যতকালের বিষয়ে ‘যদি’ অর্থ প্রকাশ করার জন্য আরবিতে ‘ইন’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। নিম্নে ‘ইন’ শব্দ সম্বলিত কিছু আয়াত উল্লেখ করা হলো যাতে ‘যদি এমন হয়, তবে এমন হবে’- তথ্য-সম্বলিত বক্তব্য রয়েছে।
২:১৩৭ :: তারপর যদি তারা বিশ্বাস করে তোমাদের বিশ্বাসের অনুরূপ (অর্থাৎ যদি তারাও নবীদের প্রতি তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছাড়াই বিশ্বাস করে), তবে তারা হিদায়াত পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয় তারা বিরোধে লিপ্ত থাকবে। সুতরাং তাদের বিপক্ষে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
২:১৪৫ :: আর নিশ্চয় যদি তুমি এনে দাও যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে (তাদের নিকট) প্রত্যেক নিদর্শন, তবে তা সত্ত্বেও তারা তোমার ক্বিবলাহর অনুসরণ করবে না। আর তুমি তাদের ক্বিবলাহর অনুসারী নও। আর তাদের কোনো দলই অন্য দলের ক্বিবলাহর অনুসারী নয়। আর নিশ্চয় যদি তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো উহার পরও যা তোমার কাছে এসেছে জ্ঞান থেকে, তবে নিশ্চয় তুমি তখন যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
৩:৭৫ :: আর আহলে কিতাবের মধ্য থেকে কেউ কেউ আছে যে এমন যে, যদি তার কাছে আমানত রাখো ধনভান্ডার, সে তা ফেরত দেবে তোমার (আমানতদাতার) কাছে। আর তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ আছে যে এমন যে, যদি তার কাছে আমানত রাখো (মাত্র) একটি দীনার/ স্বর্ণমুদ্রা, সে তা ফেরত দেবে না তোমার (আমানতদাতার) কাছে, এ ছাড়া যে, তুমি চড়াও হবে তার উপর মজবুতভাবে দাঁড়িয়ে। উহা এজন্য যে, তারা বলে, “আমাদের উপর উম্মীদের (যাদের কাছে কিতাবের জ্ঞান নেই তাদের) ব্যাপারে কোনো (দায়িত্বের) মাত্রা নেই।” আর তারা জেনে-বুঝে আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা বলে।
৩:১০০ :: হে যারা বিশ্বাস করেছো, যদি তোমরা আনুগত্য করো যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যকার কোনো দলের, তবে তারা তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেবে তোমরা বিশ্বাস করার পরে কাফির হিসাবে।
৩:১১১ :: তারা কখনো তোমাদের (গুরুতর) ক্ষতি করতে পারবে না, (সামান্য) কষ্ট দেয়া ছাড়া। আর যদি তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তাহলে তারা তোমাদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে পালিয়ে যাবে। তারপর তাদেরকে সাহায্যও করা হবে না।
৩:১২০ :: যদি তোমাদেরকে স্পর্শ করে কোনো উত্তম অবস্থা, তবে তাদের খারাপ লাগবে। আর যদি তোমাদেরকে আহত করে কোনো মন্দ অবস্থা, তবে তারা তাতে আনন্দিত হয়। আর যদি তোমরা ধৈর্য ও অধ্যবসায় এবং স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করো, তবে তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না তাদের কায়দা কৌশল, কিছুমাত্রও। নিশ্চয় আল্লাহ পরিবেষ্টনকারী যা কিছু কর্ম তারা সম্পাদন করে।
৩:১৩৯ :: আর তোমরা মনভাঙ্গা হয়ো না। আর তোমরা দু:খিত থেকো না। আর যদি তোমরা মু’মিন হও, তবে তোমরাই বিজয়ী হবে।
৩:১৪৯ :: হে যারা বিশ্বাস করেছো, যদি তোমরা আনুগত্য করো তাদেরকে যারা অবিশ্বাস করেছে, তবে তারা তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেবে তোমাদের গোড়ালীসমূহের উপর ভর করিয়ে ঘুরিয়ে। সুতরাং তখন তোমরা পাল্টে যেয়ে হয়ে যাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
৪:৭৩ :: আর যদি তোমাদের কাছে পৌঁছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো অনুগ্রহ, তবে তারা অবশ্যই বলবে এমনভাবে যেন ছিলো না তোমাদের ও তার মধ্যে কোনো আন্তরিক সম্পর্ক, (তারা বলবে,) “হায়! আমার আফসোস, যদি আমি থাকতাম তাদের সাথে, তবে আমি সফল হতাম মহাসাফল্য লাভ করে।”
৪:১৪১ :: যারা অপেক্ষা করে তোমাদের ব্যাপারে (কী ঘটে তা দেখার জন্য)। সুতরাং যদি তোমাদের বিজয় হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে, তবে তখন তারা (মু’মিনদেরকে) বলবে, “আমরা কি ছিলাম না তোমাদেরই সাথে?” আর যদি কাফিরদের আংশিক বিজয় হয়, তবে তখন তারা (কাফিরদেরকে) বলবে, “আমরা কি প্রবল ছিলাম না তোমাদের উপর? আর আমরাই তোমাদেরকে রক্ষা করেছি মু’মিনদের (হাত) থেকে।” সুতরাং আল্লাহ ফায়সালা করে দেবেন তাদের মধ্যে কিয়ামাত দিবসে। আর আল্লাহ রাখেন নি কাফিরদের জন্য মু’মিনদের উপর আধিপত্যলাভের কোনো পথ।
৫:১০১ :: হে যারা বিশ্বাস করেছো, তোমরা জিজ্ঞাসা করো না এমন বিষয় জানার জন্য, যদি তা প্রকাশ করা হয় তোমাদের কাছে, তবে তা তোমাদের জন্য কষ্টকর হবে। আর যদি তোমরা জিজ্ঞাসা করো ঐরূপ বিষয় সম্পর্কে কুরআন নাযিল করার সময়, তবে তা প্রকাশ করা হবে তোমাদের কাছে। (আগে যা হয়েছে) সে ব্যাপারে আল্লাহ উদারনীতি অবলম্বন করেছেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহনশীল।
৬:২৫ :: আর তাদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা কান পেতে রাখে তোমার দিকে। আর আমরা দিয়ে রেখেছি তাদের কলবসমূহের উপর আবরণ যেন না তারা উপলব্ধি করতে পারে, আর তাদের কানসমূহে আছে বধিরতা। আর যদি তারা দেখে প্রত্যেক নিদর্শন, তবে তা সত্ত্বেও তারা তাতে বিশ্বাস করবে না। এমনকি যখন তারা তোমার কাছে আসে, তারা তোমার সাথে বিতর্ক করে, যারা কুফরি করেছে তারা তখন বলে, “ইহা (কুরআন) কিছুই নয়, পূর্ববর্তীদের উপকথা ছাড়া।”
৬:৬৩ :: বলো, “কে তোমাদেরকে মুক্তি দেন স্থলভাগের ও জলভাগের অন্ধকারসমূহ থেকে, যখন তোমরা তাঁকে ডাকো কাতরভাবে আর গোপনে? (যখন বলে থাকো), “যদি তিনি আমাদেরকে মুক্তি দেন এই বিপদ থেকে, তবে আমরা হবো শোকরকারীদের অন্তর্ভুক্ত।”
৬:১১৬ :: আর যদি তুমি আনুগত্য করো পৃথিবীবাসীদের অধিকাংশের, তবে তারা তোমাকে বিভ্রান্ত করবে আল্লাহর পথ থেকে। তারা অনুসরণ করে না অনুমান ছাড়া অন্য কিছু। আর তারা যৌক্তিক কিছু করে না জল্পনা-কল্পনা করা ছাড়া।
৬:১২১ :: আর তোমরা খেয়ো না সেই খাদ্য থেকে আল্লাহর নাম নেয়া হয় নি যার উপর। আর নিশ্চয় তা অবাধ্যতা। আর নিশ্চয় শয়তানরা ওহী করে/ অনুপ্রেরণা দেয় তার বন্ধুদের প্রতি তোমাদের সাথে বিতর্ক করার জন্য। আর যদি তোমরা তাদের আনুগত্য করো, তবে নিশ্চয় তোমরা হবে মুশরিক।
৭:১৪৩ :: আর যখন মূসা উপনীত হয়েছে আমাদের নির্ধারিত সময়কালে, আর তার সাথে কথা বলেছেন তার প্রভু। সে বললো, “হে আমার প্রভু, আমাকে দেখা দিন, যেন আমি আপনাকে দেখি।” তিনি (আল্লাহ) বললেন, “তুমি কখনই আমাকে দেখবে না, কিন্তু তুমি লক্ষ্য করো পাহাড়টির দিকে, যদি তা স্থির থাকে তার স্থানে, তবে তুমি আমাকে দেখবে।” তারপর যখন নূরের তাজাল্লী প্রকাশ করেছেন তার প্রভু পাহাড়টিতে, ফলে তা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেলো, আর পড়ে গেলো মূসা বেহুঁশ হয়ে। তারপর যখন সে চেতনা ফিরে পেলো, তখন সে বললো, “আপনি পবিত্র। আমি তাওবাহ করছি আপনার কাছে। আর আমিই প্রথম মু’মিন।”
৭:১৪৬ :: শীঘ্রই আমি তাদের দৃষ্টিকে ফিরিয়ে দেবো আমার নিদর্শনসমূহ থেকে, যারা পৃথিবীতে অহংকার করে যা একান্তই অন্যায়। আর যদি তারা দেখেও প্রত্যেক নিদর্শন, তবে তা সত্ত্বেও তারা উহার প্রতি বিশ্বাস করবে না। আর যদি তারা দেখে সঠিক পথ, তবে তারা উহাকে গ্রহণ করবে না পথ হিসাবে। আর যদি তারা দেখে ভ্রান্ত পথ, তবে তারা উহাকে গ্রহণ করবে পথ হিসাবে। ইহা এজন্য যে, তারা মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে আমাদের আয়াতসমূহের প্রতি, আর তারা ছিলো উহা থেকে উদাসীন।
৭:১৬৯ :: তারপর স্থলাভিষিক্ত হয়েছে তাদের পরে এমন প্রতিনিধিগণ/ স্থলাভিষিক্তগণ যারা কিতাবের ওয়ারিস হয়েছে অথচ তারা গ্রহণ করে এই দুনিয়ার বৈষয়িক স্বার্থকে আর বলে, “আমাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে।” আর যদি আবারও তাদের কাছে আসে উহার অনুরূপ বৈষয়িক স্বার্থ, তবে তারা উহা গ্রহণ করবে। তাদের থেকে কি গ্রহণ করা হয় নি কিতাবের প্রতিশ্রুতি যে, তারা বলবে না আল্লাহর সম্পর্কে সত্য ছাড়া (অন্য কথা)? আর তারা শিক্ষা লাভ করেছে যা উহাতে (কিতাবে) আছে। আর আখিরাতের আবাসই তাদের জন্য উত্তম যারা স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করে। তোমরা কি আকল/ বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করো না?
৭:১৮৯ :: তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে একটিমাত্র প্রাণকোষ/ জীবনসত্তা (life-cell) থেকে। আর তিনি বানিয়েছেন তার থেকে তার জোড়া যেন সে তার কাছে শান্তি পায়। তারপর যখন সে (স্বামী) তাকে (স্ত্রীকে) ঢেকে নেয়, তখন সে (স্ত্রী) গর্ভধারণ করে, হাল্কা গর্ভ। সুতরাং সে সহজেই চলাফেরা করে তা নিয়ে। তারপর যখন গর্ভ ভারী হয় (কিছু দম্পতি এমনও আছে যে,) তখন তারা দুজনেই আল্লাহর কাছে দোয়া করে, যিনি তাদের উভয়ের প্রভু, “নিশ্চয় যদি আপনি আমাদেরকে দেন ভালো সন্তান, তবে নিশ্চয় আমরা হবো সে ব্যাপারে শোকরকারীদেরই অন্তর্ভুক্ত।”
৮:৩৮ :: যারা কুফর করেছে তাদেরকে বলো যে, যদি তারা বিরত হয়, তবে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে, তাদের যে কুফর অতীত হয়ে গেছে সে ব্যাপারে। আর যদি তারা পুনরাবৃত্তি করে, তবে নিশ্চয় গত হয়েছে আগের জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে আল্লাহর সুন্নাত বা অবলম্বিত কর্মনীতি (আর এদের ব্যাপারটাও অনুরূপ হবে)।
৮:৬৫-৬৬ :: হে নবী, মু’মিনদেরকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করো। যদি তোমাদের মধ্য থেকে হয় বিশজন সবরকারী, তবে তারা বিজয়ী হবে দুইশতজনের উপর। আর যদি তোমাদের মধ্য থেকে হয় একশত জন, তবে তারা বিজয়ী হবে এক হাজার জনের উপর; তাদের সাথে সংঘাতে যারা কুফর করেছে। এ কারণে যে, তারা এমন এক ক্বওম, যারা (সত্যকে) উপলব্ধি করে না। বর্তমানে আল্লাহ বোঝা হালকা করে রেখেছেন তোমাদের থেকে। আর তিনি তো জানেন যে, এখনো তোমাদের মধ্যে আছে দুর্বলতা। সুতরাং এখন যদি তোমাদের মধ্য থেকে হয় একশতজন সবরকারী, তবে তারা বিজয়ী হবে দুইশতজনের উপর; আর যদি তোমাদের মধ্য থেকে হয় এক হাজার জন, তবে তারা বিজয়ী হবে দুই হাজার জনের উপর; আল্লাহর অনুমতিক্রমে। আর আল্লাহ সবরকারীদের সাথে থাকেন।
৮:৭০ :: হে নবী, যারা তোমাদের করায়ত্ত আছে যুদ্ধবন্দী হিসাবে তাদেরকে বলো, “যদি আল্লাহ জেনে থাকেন তোমাদের কলবসমূহের ব্যাপারে, (তাতে আছে) কোনো কল্যাণ, তবে তিনি তোমাদেরকে দিবেন আরো উত্তম তা থেকেও যা নেয়া হয়েছে তোমাদের থেকে, আর তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
৯:৮ :: কিরূপে (চুক্তি বহাল থাকবে)? অথচ যদি তারা বিজয়ী হয় তোমাদের উপর, তারা তোমাদের ব্যাপারে আত্মীয়তার বিষয়টিও খেয়াল রাখবে না, আর যিম্মাদারির বিষয়টিও না। তারা তোমাদেরকে সন্তুষ্ট করে তাদের মুখের কথা দিয়ে আর তা প্রত্যাখ্যান করে তাদের কলবসমূহ। আর তাদের অধিকাংশই অবাধ্য।
৯:৫০ :: যদি তোমার কাছে পৌঁছে কোনো উত্তম অবস্থা, তবে তাদের খারাপ লাগবে। আর যদি তোমার কাছে পৌঁছে কোনো মুসিবত/ বিপদ, তবে তারা বলবে, “নিশ্চয় আমরা সামলে নিয়েছি আমাদের ব্যাপারটা আগেই।” আর তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় আর তারা উৎফুল্ল থাকে।
৯:৬৫ :: আর নিশ্চয় যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো, তবে তারা বলবে, “আসলে আমরা আলাপচারিতা করছিলাম আর আমরা খেলতামাসা করছিলাম।” বলো, “তবে কি আল্লাহর প্রতি ও তাঁর আয়াতসমূহের প্রতি ও তাঁর রসূলের প্রতি তোমরা হাসি তামাসা করছিলে?”
৯:৭৪ :: তারা কসম করে আল্লাহর নামে, তারা সে কথা বলে নি। অথচ নিশ্চয় তারা বলেছে সেই কুফরি কথাটি। আর তারা কুফর করেছে তাদের ইসলাম গ্রহণের পরও। আর তারা সাহস দেখিয়েছে এমন কিছু করতে যা তারা করতে পারে নি। আর তারা প্রতিশোধ নিচ্ছে না এজন্য ছাড়া যে, তাদেরকে স্বচ্ছল করে দিয়েছেন আল্লাহ ও তাঁর রসূল, তাঁর অনুগ্রহ বন্টন করে। সুতরাং যদি তারা তাওবাহ করে, তবে তা-ই তাদের জন্য কল্যাণকর হবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন, যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি, দুনিয়াতেও এবং আখিরাতেও। আর তাদের জন্য না আছে পৃথিবীতে কোনো অভিভাবক আর না আছে কোনো সাহায্যকারী।
৯:৭৫ :: আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, “নিশ্চয় যদি তিনি (আল্লাহ) আমাদেরকে দেন তাঁর অনুগ্রহ, তবে আমরা সদাক্বাহ করবো আর অবশ্যই আমরা থাকবো সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত।”
৯:৮৩ :: তারপর যদি আল্লাহ তোমাকে ফিরিয়ে আনেন তাদের মধ্যকার কোনো দলের কাছে, তবে তারা তোমার কাছে অনুমতি চাইবে বের হওয়ার জন্য। তখন তাদেরকে বলো, “(মুখে যদিও অনুমতি চাচ্ছো কিন্তু বাস্তবে) তোমরা বের হবে না আমার সাথে কখনোই। আর তোমরা যুদ্ধ করবে না আমার সাথে কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে। নিশ্চয় তোমরা সন্তুষ্ট থেকেছো বসে থাকার ব্যাপারে প্রথম বার। সুতরাং এখনও তোমরা বসে থাকো পিছনে সরে থাকা লোকদের সাথে।”
১০:২২ :: তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে ভ্রমণ করান স্থলভাগে ও জলভাগে। এমন কি যখন তোমরা থাকো নৌযানে আর সেগুলো চলে তাদেরকে নিয়ে অনুকূল বাতাসে আর তারা আনন্দিত হয় সে কারণে, তারপর যখন আসে ঝড়ো বাতাস আর তাদের উপর আসে সব জায়গা থেকে উত্তাল ঢেউ আর তারা ধারণা করে যে, তারা পরিবেষ্টিত হয়ে গেছে সেগুলো দ্বারা (উত্তাল ঢেউয়ে), তখন তারা আল্লাহকে ডাকে তাঁরই জন্য জীবনব্যবস্থাকে খাঁটি করে নিয়ে। (তখন তারা বলে), “নিশ্চয় যদি আপনি আমাদেরকে উদ্ধার করেন ইহা (এই বিপদ) থেকে, তবে নিশ্চয় আমরা থাকবো শোকরকারীদের/ কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত।”
১১:৭ :: আর তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশমন্ডলী আর পৃথিবী ছয় দিবসে (মহাকালে)। আর এর আগে তাঁর আরশ (ক্ষমতার আসন) ছিলো পানির উপর। যেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, তোমাদের মধ্যে কে কাজকর্মে অধিক উত্তম। আর নিশ্চয় যদি তুমি বলো, “নিশ্চয় তোমরা পুনরুত্থিত হবে মৃত্যুর পরে।”, তবে যারা কুফর করেছে তারা বলবে, “ইহা (কুরআন) কিছু নয় প্রকাশ্য যাদু/ ভেল্কিবাজি ছাড়া।”
১১:৮ :: আর নিশ্চয় যদি আমরা বিলম্বিত করি তাদের থেকে শাস্তি গণাগণতির একটি সময়কাল পর্যন্ত; তবে তারা বলবে, “কে উহাকে আটকে রেখেছে?” জেনে রাখো, যেদিন উহা তাদের কাছে আসবে, তখন উহা ফেরানো যাবে না তাদের থেকে। আর তাদেরকে উহাই ঘিরে ধরবে যে ব্যাপারে তারা ঠাট্টা করতো।
১৪:৭ :: আর (সেই সময়ের কথা উল্লেখ্য) যখন ঘোষণা করেছেন তোমাদের প্রভু, “অবশ্যই যদি তোমরা শোকর/ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তবে অবশ্যই আমি তোমাদেরকে (আমার অনুগ্রহ) বাড়িয়ে দেবো। আর অবশ্যই যদি তোমরা কুফর/ অবিশ্বাস/ অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তবে নিশ্চয় আমার শাস্তি হবে অত্যন্ত কঠিন।”
১৭:৮৮ :: বলো, “যদি একত্রিত হয় মানবজাতি ও জিনজাতি এ বিষয়ের উপর যে, তারা আনবে এই কুরআনের অনুরূপ কিছু, তবে তা সত্ত্বেও তারা আনতে পারবে না উহার অনুরূপ কিছু; যদিও হয় তাদের একে অন্যের জন্য সাহায্যকারী।”
১৮:২০ :: নিশ্চয় যদি তারা (শহরবাসী) বিজয় লাভ করে তোমাদের (আসহাবে কাহাফের) উপর, তবে তারা তোমাদেরকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করবে, অথবা তারা তোমাদেরকে ফিরিয়ে নিবে তাদের মিল্লাতে (অর্থাৎ তাদের ইবাদাতের বহুত্ববাদী স্বরূপ ও প্রকৃতিতে)। আর তোমরা সফলতা লাভ করতে পারবে না তাহলে তখন কখনোই।”
১৮:৫৭ :: আর তার চেয়ে বড় যালিম কে হতে পারে যাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় তার প্রভুর আয়াতসমূহ দিয়ে তারপর সে মুখ ফিরিয়ে নেয় উহা থেকে আর সে ভুলে থাকে ঐসব কাজের পরিণাম, যা আগেই পাঠিয়েছে তার দুহাত (অর্থাৎ তার অতীতের কর্মকান্ডের পরিণাম কী হতে পারে তা সে ভুলে থাকে)? নিশ্চয় আমরা স্থাপন করেছি তাদের কলবসমূহের উপর আবরণ, যেন না তারা উহা উপলব্ধি করতে পারে, আর তাদের কানসমূহে আছে বধিরতা। আর যদি তুমি তাদেরকে ডাকো হিদায়াতের দিকে, তবে তা সত্ত্বেও তারা হিদায়াত পাবে না এখন আর কখনোই।
২১:৪৬ :: আর যদি তাদেরকে স্পর্শ করে কিছুমাত্রও তোমার প্রভুর কোনো শাস্তি, তবে তারা অবশ্যই বলবে, “হায়! আমাদের আফসোস, নিশ্চয় আমরা ছিলাম যালিম।”
২৯:১০ :: আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ এমনও আছে যে বলে, “আমরা বিশ্বাস করেছি আল্লাহর প্রতি”; তারপর যখন সে নির্যাতিত হয় আল্লাহর ব্যাপারে, তখন গণ্য করে মানুষ কর্তৃক নির্যাতনকে আল্লাহর দেয়া শাস্তির মতো। অথচ অবশ্য যদি আসে তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য, তবে তারা অবশ্যই বলবে, “নিশ্চয় আমরা ছিলাম তোমাদেরই সাথে।” আল্লাহ কি পরিজ্ঞাত নন বিশ্ববাসীর মস্তিষ্কসমূহে কী আছে তা সম্পর্কে?
৩০:৫৮ :: আর নিশ্চয় আমরা পেশ করেছি মানবজাতির জন্য এই আল কুরআনে প্রত্যেক প্রকার দৃষ্টান্ত। আর যদি তুমি তাদের কাছে নিয়ে আসো কোনো নিদর্শন, তবে তা সত্ত্বেও যারা কুফর করেছে তারা বলবে, “তোমরা নও বাতিলপন্থী ছাড়া অন্য কিছু।”
৪৭:৭ :: হে যারা বিশ্বাস করেছো, যদি তোমরা আল্লাহকে (তাঁর দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার বিষয়ে) সাহায্য করো, তবে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন, আর তিনি দৃঢ় করে দেবেন তোমাদের কদমসমূহকে।
৪৭:৩৬-৩৭ :: নিশ্চয় (আখিরাতের বিবেচনা না থাকলে) পার্থিব জীবন খেলা ও কৌতুক মাত্র। আর যদি তোমরা বিশ্বাস কর ও স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন কর, তবে তিনি তোমাদেরকে দান করবেন তোমাদের প্রতিফল। আর তিনি তোমাদের কাছে চান না তোমাদের মালসম্পদ (অর্থাৎ তিনি তোমাদেরই কল্যাণের জন্য তোমাদের সম্পদ ব্যয়ের নীতিমালা দিয়েছেন)। যদি তিনি তোমাদের কাছ থেকে উহা চান তারপর উহার জন্য চাপ দেন, তবে তোমরা কৃপণতা করবে, আর তিনি (প্রকাশ্যে) বের করে আনবেন তোমাদের গোপন দোষ।
৪৭:৩৮ :: তোমরাই সেসব লোক যাদেরকে আহবান করা হচ্ছে যেন তোমরা ব্যয় করো আল্লাহর পথে, কিন্তু তোমাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ কৃপণতা করে। আর যে কৃপণতা করে, প্রকৃতপক্ষে সে কৃপণতা করে তার নিজের সাথে। আর আল্লাহ অভাবমুক্ত আর তোমরা অভাবগ্রস্ত। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি (তোমাদের) বদলস্বরূপ আনবেন তোমাদেরকে ছাড়া অন্য ক্বওমকে। তারপর তারা হবে না তোমাদের মতো।
৪৮:১৬ :: আ’রববাসীদের মধ্য থেকে পিছনে থেকে যাওয়া লোকদেরকে বলো, “শীঘ্রই তোমাদেরকে ডাকা হবে এক প্রবল শক্তিশালী ক্বওমের বিরুদ্ধে। তোমাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে অথবা তারা আত্মসমর্পণ করবে। তখন যদি তোমরা আনুগত্য করো, তবে আল্লাহ তোমাদেরকে দিবেন উত্তম পুরস্কার। আর যদি তোমরা পিছনে ফিরে যাও যেমন তোমরা পিছনে ফিরে গিয়েছিলে ইতিপূর্বে, তবে তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দিবেন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
৫৯:১২ :: যদি তাদেরকে (আহলে কিতাবকে) বের করে দেয়া হয়, তবে তারা (মুনাফিক্বরা) তাদের সাথে বের হবে না। আর যদি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়, তবে তারা তাদেরকে সাহায্য করবে না। আর যদি তাদেরকে সাহায্য করেও, তবে অবশ্যই তারা পিঠ ফিরিয়ে পালাবে, তারপর তাদেরকে সাহায্য করা হবে না।
৬৪:১৭ :: যদি তোমরা আল্লাহকে ঋণ দাও, উত্তম ঋণ, তবে তিনি উহাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন তোমাদের জন্য। আর তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ কৃতজ্ঞতার মূল্যায়নকারী ও সহনশীল।
৭১:২৬-২৭ :: আর নূহ বলেছিল, “হে আমার প্রভু, আপনি ছেড়ে দিবেন না পৃথিবীর উপর কাফিরদের মধ্য থেকে কোন গৃহবাসীকে। নিশ্চয় আপনি যদি তাদেরকে ছেড়ে দেন, তবে তারা পথভ্রষ্ট করবে আপনার বান্দাদেরকে আর তারা জন্ম দেবে না পাপাচারী কাফির ছাড়া কাউকে।”
আলোচনা : ‘লাও’ এবং ‘ইন’ এর অনেক ব্যবহার থেকে বুঝা যায় যে, সেখানে বিভিন্ন সূত্র (ফর্মুলা) উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি এমনটি হতো, তাহলে এমনটি হতো বা যদি এমনটি হয়, তাহলে এমনটি হবে। এর অনেক কিছু আল্লাহর স্বকর্ম নীতিমালা বা প্রতিশ্রুতির সাথে সম্পর্কিত। মু’মিনরা তাদের ঈমান দ্বারা এবং কাফিররা তাদের ঈমান দ্বারা পরিচালিত হয় বিধায় তাদের প্রসঙ্গে এভাবে কোনো বিষয়কে চিহ্নিত করা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। অনুরূপভাবে সত্য এবং আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী যা হওয়াটা স্বাভাবিক তা বুঝাতে গিয়েও এই শব্দগুলো প্রয়োগ করা হয়েছে। তাই কোনো বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক আইনের বাস্তবতায় ‘যদি এমন হতো, তবে এমন হতো’ বা ‘যদি এমন হয়, তবে এমন হবে’ এভাবে বলার মধ্যে কোনো দোষ নেই। কোনো শর্তমূলক প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করতেও ‘যদি’ শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে।
অতীতের বিষয়ে মুনাফিক্বদের মিথ্যা কথা
৯:৪২ :: যদি (সহজলভ্য) হতো নিকটবর্তী ফায়দা আর সফরও হতো সুগম, তাহলে তারা তোমার অনুসরণ করতো। কিন্তু দীর্ঘ হয়ে গেলো তাদের উপর কষ্টসাধ্য যাত্রাপথ। আর তারা কসম করবে আল্লাহর নামে, “যদি আমরা পারতাম তাহলে আমরা বের হতাম তোমাদের সাথে।” আসলে তারা ধ্বংস করেছে তাদের নিজেদেরকেই। আর আল্লাহ জানেন, নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।
৩:১৬৬-১৬৭ :: :: আর তোমাদের উপর যা ঘটেছে দুটি সেনাবাহিনীর মোকাবেলার দিন তা আল্লাহর অনুমতিক্রমে ঘটেছে। আর তা এজন্য হয়েছে যেন তিনি (পরীক্ষার মাধ্যমে) জেনে নেন মু’মিনদেরকে। আর যেন তিনি জেনে নেন তাদেরকে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। (অর্থাৎ পরীক্ষার মাধ্যমে কে মু’মিন কে মুনাফিক্ব তা স্পষ্ট হয়ে যায়)। আর যখন তাদেরকে বলা হলো, “তোমরা আসো, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো বা তোমরা (অন্তত) প্রতিরক্ষার কাজ করো।” (তখন) তারা বললো, “যদি আমরা জানতাম যে, যুদ্ধ হবে, তাহলে আমরা তোমাদের অনুসরণ করতাম।” তারা কুফরের ক্ষেত্রে সেদিন বেশি কাছাকাছি পৌঁছেছিলো তাদের ঈমানের তুলনায়। তারা তাদের মুখে বলে যা তাদের অন্তরে নেই। (তারা মনে রাখে এক কথা, মুখে বলে আরেক কথা)। আর আল্লাহ তা জানেন, যা তারা গোপন রেখেছে।
আল্লাহর পথে নিহত হওয়া বা না হওয়া প্রসঙ্গে মুনাফিক্বদের অযৌক্তিক উক্তি ও তার জবাব
৩:১৫৪ :: তারপর তিনি নাযিল করেছেন তোমাদের উপর এই বিষাদের/ দু:খের পর নিরাপত্তাবোধ তন্দ্রারূপে, যা আচ্ছন্ন করে তোমাদের মধ্যকার একটি দলকে। আর একটি দল, নিশ্চয় (তাদের নিজেদেরকে) উদ্বিগ্ন করেছে তাদের নিজেদের জান-প্রাণ রক্ষার ভাবনায়। তারা ধারণা করেছে আল্লাহর সম্পর্কে অযৌক্তিকভাবে, জাহিলিয়াতের ধারণা। তারা বলে, ‘আমাদের কি কোনো নির্দেশের বিষয়ে (স্বাধীনভাবে) কোনো কিছু করার আছে?’ বলো, ‘সকল বিষয়ে (স্বাধীনভাবে) নির্দেশ প্রদান শুধু আল্লাহর অধিকারে।” তারা গোপন রাখে তাদের নিজেদের মধ্যে যেই মনোভাব তারা প্রকাশ করে না তোমার কাছে। তারা বলে, “যদি কোনো বিষয়ের নির্দেশ আমাদের অধিকারে থাকতো, তাহলে এখানে আমরা নিহত হতাম না (অর্থাৎ আমাদের মধ্য থেকে যারা নিহত হয়েছে তারা নিহত হতো না।” বলো, ‘যদি (যুদ্ধের সময় নিহত হওয়ার ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে না এসে) তোমরা থাকতে তোমাদের ঘরসমূহে, তাহলেও (তখন বা অন্য কোনো সময়, সেখানে বা অন্য কোনো স্থানে, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়) তারা বের হতো- যাদের উপর নিহত হওয়া লিখে দেয়া হয়েছে (অর্থাৎ নিহত হওয়ার মতো প্রাকৃতিক বিধি কার্যকর হয়েছে)- তাদের নিহত হওয়ার স্থানের দিকে। আর আল্লাহ তা ঘটিয়েছেন তোমাদের স্নায়ুকেন্দ্রে (মন-মানসিকতায়) কী আছে তা পরীক্ষা করার জন্য। আর তোমাদের মনে যা (ধ্যান-ধারণা) আছে তা পরিশোধন করার জন্য। আর আল্লাহ মন-মানসিকতায় থাকা বিষয় (ভাবধারা) সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞাত।
৩:১৫৬ :: হে যারা বিশ্বাস করেছো, তোমরা হয়ো না তাদের মতো যারা অবিশ্বাস করেছে আর যখন তাদের ভাইয়েরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করেছে (ও সেখানে মৃত্যুবরণ করেছে) অথবা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হয়েছে (ও তাতে নিহত হয়েছে) তখন তারা তাদের প্রসঙ্গে বললো, “যদি তারা আমাদের কাছে থাকতো তাহলে তারা মৃত্যুবরণ করতো না এবং তারা নিহত হতো না।” (এরূপ হয়ে থাকে) যেন আল্লাহ উহাকে আক্ষেপে পরিণত করে দেন তাদের অন্তরে (অর্থাৎ এরূপ কথার মাধ্যমে কাফিররা জীবন মৃত্যুর প্রকৃত কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে না বুঝে হাহুতাশ করতে থাকে)। আর আল্লাহ (সাধারণত তাঁর তৈরি প্রাকৃতিক আইন প্রয়োগ করে এবং মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য) জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান । আর আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্মের প্রতি দৃষ্টিবান।
৩:১৬৮ :: যারা নিজেরা বসে থেকে তাদের ভাইদের প্রসঙ্গে বললো, “যদি তারা আমাদের আনুগত্য করতো, তাহলে তারা নিহত হতো না।” বলো, “তাহলে তোমরা তোমাদের মৃত্যুকে হটিয়ে দাও, যদি তোমরা (তোমাদের দাবিতে) সত্যবাদী হও।”
আলোচনা : যেহেতু আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইনকে লঙ্ঘন করা যেতে পারে না, তাই প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী যা হবার তা হবেই। যেমন, প্রতিটি মানুষকেই মরতে হবে এবং কেউ তা থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। এমতাবস্থায় নিহত বা আহত হওয়া থেকে দূরে থাকার জন্য আল্লাহর পথে সংগ্রাম থেকে বিরত থাকা ও বিরত রাখা গ্রহণযোগ্য নয়। বরং অত্যাবশ্যকীয় সংগ্রামে অংশ নিয়ে কিভাবে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো বা হ্রাস করা যায়, সেদিকে সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে। যেহেতু মৃত্যুর বহু ফ্যাক্টর রয়েছে, তাই কোনো ব্যক্তি কোনো সংগ্রামে অংশগ্রহণ না করলেও কোনো না কোনো ফ্যাক্টরের কারণে স্বাভাবিক সর্বোচ্চ আয়ুসীমার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করতে বা নিহত হতে পারে। এজন্য যারা আল্লাহর পথে সংগ্রামে অংশ নিয়ে নিহত হয়েছে তাদের প্রসঙ্গে মোনাফেক্বদের উক্তিকে অনিশ্চিত বিষয়ে তাদের অযৌক্তিক বক্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের সেই উক্তি হলো, “যদি তারা আমাদের কথা মানতো, তাহলে তারা নিহত হতো না।”
মুনাফিক্বদের উক্তির সমালোচনার কারণে এ দাবি করা যেতে পারে না যে, কোনো ক্ষেত্রেই ‘যদি এমন হতো, তবে এমন হতো’ বা ‘যদি এমন হয়, তবে এমন হবে’- বলা যাবে না। বরং ‘যদি… তবে…’ সম্পর্কিত পূর্বে উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্ট হয় যে, প্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক আইনের প্রেক্ষিতে কোনো বিষয়ে এরূপ বলা দোষণীয় নয়। তবে যেক্ষেত্রে বহুবিধ সম্ভাবনা রযেছে সেক্ষেত্রে কোনো একটি সম্ভাবনাকে নির্দিষ্ট করে কোনো দাবি করা গ্রহণযোগ্য নয়।
আল্লাহ কোনো বিষয়ে যে তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক আইন তৈরি করেছেন তা পরিবর্তন করা হওয়া সম্ভব কিনা? যদি আল্লাহ তা পরিবর্তন করে থাকেন, তাহলে কেন এবং কীরূপে তা পরিবর্তন করেন? কোনো কাজে ত্রুটির ফলে তাক্বদীর অনুসারে যে মন্দ পরিণতি হওয়ার কথা তা পরিবর্তন করানোর জন্য মানুষের করণীয় কী? এ প্রসঙ্গগুলো নিয়ে এ অধ্যায়ে আলোচনা করা হলো।
তাক্বদীরে থাকা ফলাফল পরিবর্তন হওয়া সম্ভব কিনা?
কোনো কাজে পরিপূর্ণ সফল হওয়ার জন্য যে সব ফ্যাক্টর রয়েছে তার সবগুলো হুবহু সঠিকভাবে না জানার কারণে মানুষের কাজে ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। আর কোনো কাজে ত্রুটির ধরন অনুসারে কাজটির কি ধরনের ফল হবে তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নির্ধারিত রয়েছে। আবার মানুষ কোনো নীতিমালা না জানার কারণে হোক বা জানা সত্ত্বেও অমান্য করার কারণে হোক, নীতিমালা লঙ্ঘন করলে লঙ্ঘনের ধরন অনুসারে তার একটি পরিণতি রয়েছে।
জেনে বা না জেনে এবং ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ত্রুটি রেখে কোনো কাজ করার জন্য বা কোনো ভুল ও মন্দ কাজ করার জন্য যে প্রাকৃতিক ফলাফল রয়েছে তা পরিবর্তন করার ক্ষমতা মানুষের নেই। তবে নিজ অনুগ্রহে ঐ ফলাফল পরিবর্তন করে মানুষকে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি বা বিপদাপদ থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা আল্লাহর রয়েছে এবং তিনি প্রয়োজন মনে করলে নিজ ইচ্ছায় তা করে থাকেন।
এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষ্যণীয়।
১১:১০৭ :: নিশ্চয়ই তোমার রব যা ইচ্ছা তা করার ক্ষমতা রাখেন।
আলোচনা: আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা-ই করার ক্ষমতা রাখেন। সুতরাং তিনি ইচ্ছা করলে তাক্বদীরে থাকা ফলাফলের পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখেন।
৪২:৩০ :: আর তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল এবং অনেক বিপদ-আপদ তিনি ক্ষমা করে দেন (ঘটতে দেন না)।
আলোচনা : এ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে, মানুষের কৃতকর্মের কারণে তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী যে ধরনের বিপদাপদ আসার কথা তার কিছু কিছু মহান আল্লাহ নিজ ইচ্ছা ও অনুগ্রহে রহিত করে দেন।
নির্ধারিত তাক্বদীর পরিবর্তন বা তাৎক্ষণিক নিয়ন্ত্রণে আল্লাহর ভূমিকা
তাক্বদীর পরিবর্তন বা তাৎক্ষণিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বুঝার জন্য একটি উদাহরণ হলো মানুষ কর্তৃক রিমোট কন্ট্রোলের (Remote Control) ব্যবহার। বর্তমানে আমরা দেখছি বিজ্ঞানীরা একটি পরিচালনা পদ্ধতি নির্ণয় করার পর সে পদ্ধতি অনুসরণ করে মানুষবিহীন রকেট মহাশূন্যে পাঠান। রকেট সে পরিচালনা পদ্ধতি অনুযায়ী চলতে থাকে। কিন্তু পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের নিকট একটি রিমোট কন্ট্রোল থাকে যার সাহায্যে তারা পৃথিবীতে বসেই ঐ পরিচালনা পদ্ধতি পরিবর্তন করতে পারেন এবং বাস্তবে দরকার হলে তা করেনও।
আল্লাহর কর্তৃক তাক্বদীর পরিবর্তন বা তাৎক্ষণিক নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা রিমোর্ট কন্ট্রোলের মতো একটি বিষয়।
২:১১৬-১১৭ :: আসলে পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলীর সমস্ত জিনিস তাঁরই; সবকিছুই তাঁর আদেশের অনুগত। তিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর স্রষ্টা; আর তিনি যে বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেন সে সম্পর্কে শুধু বলেন, ‘হও’, আর তা হয়।
এ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, মহাবিশ্বের সকল কিছু আল্লাহর আদেশের অনুগত। আর আল্লাহর আদেশ বলতে আল্লাহর অতাৎক্ষণিক ও তাৎক্ষণিক উভয় ধরনের আদেশকে বুঝাবে। আল্লাহর অতাৎক্ষণিক আদেশই হচ্ছে তাঁর তৈরি করে রাখা তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক আইন। অন্যদিকে তাঁর তাৎক্ষণিক আদেশের মধ্যে তাক্বদীরের পরিবর্তনের মাধ্যমে কোনো বিষয়কে নিয়ন্ত্রণকেও বুঝাবে।
পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তাঁর আদেশ প্রয়োগের উপায় জানিয়ে দিয়েছেন। আর তা হলো তিনি যখন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তখন বলেন, ‘হও’, আর তা হয়। এই সিদ্ধান্ত যদি তাঁর তৈরি প্রাকৃতিক আইনের প্রয়োগ বুঝায়, সেক্ষেত্রে ঘটনাটি প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী হয়। আর যদি সিদ্ধান্তটি দ্বিতীয় স্তরের নিয়ন্ত্রণমূলক তথা তাক্বদীর পরিবর্তন বা স্থগিতকরনের মাধ্যমে কোনো নিয়ন্ত্রণ বুঝায়, তবে তাও সেভাবে হয়।
আল্লাহ প্রাকৃতিক আইনের পরিবর্তন বা স্থগিতকরনের মাধ্যমে কোনো বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করার বা কোন কাজ বা বিষয়ের ফলাফল, পরিণতি বা গুণাগুণ পাল্টিয়ে দেয়ার জন্য ‘কুন’ (হও) নির্দেশ দেয়ার একটি উদাহরণ হলো ২১:৬৯ আয়াতে বর্ণিত ‘নবী ইবরাহীমের জন্য আগুনকে শান্তিদায়ক ঠাণ্ডা করে দেয়া’।
২১:৬৯ :: আমি বললাম-হে আগুন, শান্তিদায়ক ঠাণ্ডা হও ইব্রাহীমের জন্যে।
আগুনের জন্যে নির্দিষ্ট তাকদীর হচ্ছে পুড়িয়ে দেয়া। কিন্তু আল্লাহ তাঁর তাৎক্ষণিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নবী ইবরাহীমের জন্য আগুনের দাহ্য ক্ষমতা স্থগিত করে সেটাকে শান্তিদায়ক ঠাণ্ডায় রূপান্তরিত করে দিয়েছেন।
তাকদীরে থাকা ফলাফল পরিবর্তন করানোর উপায়
তাকদীরে থাকা ফলাফল পরিবর্তন করানোর উপায় হলো আল্লাহর নিকট দোয়া করা। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষ্যণীয়।
২:১৮৬ :: আর আমার বান্দারা যখন আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে (তখন বলে দাও) আমি অতি নিকটে; আমি দোয়াকারীর দোয়ায় সাড়া দেই যখন সে আমার কাছে (যথাযথভাবে) দোয়া করে। সুতরাং তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি বিশ্বাস রাখে, যেন তারা সঠিক পথে চলতে পারে।
৪০:৬০ :: তোমাদের প্রভু বলেন, তোমরা আমার কাছে দোয়া করো, আমি তোমাদের দোয়ায় সাড়া দেবো। নিশ্চয় যারা আমার দাসত্ব না করার অহংকার করে, তারা অপমানিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
২৭:৬২ :: অথবা তিনি কে, যিনি সাড়া দেন আর্তের প্রতি, যখন সে দোয়া করে? আর তিনিই কষ্ট দূর করেন। আর তোমাদেরকে করেছেন পৃথিবীতে খলিফা (আধিপত্যে স্থলাভিষিক্ত)। আল্লাহর সাথে কোনো ইলাহ আছে কি? তাদের সংখ্যা অত্যন্ত কম যারা স্মরণীয় তথ্য ও বিধি-বিধান গ্রহণ করে।
প্রতিটি কাজে মানুষের কিছু না কিছু ভুল-ত্রুটি থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই কৃতকাজের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে আল্লাহ যাতে ভালো ফলাফল দেন সে জন্য তাঁর কাছে যথাযথভাবে দোয়া করা উচিত। আর বান্দারা যখন আল্লাহর কাছে দোয়া করে আল্লাহ অবশ্যই তাতে সাড়া দেন। তাদের আন্তরিক প্রার্থনা ও সামগ্রিক কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে তিনি তাক্বদীরে থাকা নেতিবাচক ফলাফল পরিবর্তন করে দিতে পারেন।
আল্লাহ প্রার্থনায় সাড়া দেয়া ও কবুল করার তাৎপর্য : মানুষের সব দোয়া কি হুবহু কবুল হয়?
৪০:৪৯-৫০ :: আর তারা বলবে যারা (জাহান্নামের) আগুনের মধ্যে থাকবে জাহান্নামের রক্ষীদেরকে, “তোমরা দোয়া করো তোমাদের প্রভুর কাছে, যেন তিনি হ্রাস করে দেন আমাদের থেকে আযাব থেকে একটি দিন।” তারা বলবে, “তোমাদের কাছে কি আসে নি তোমাদের রসূলগণ স্পষ্ট যুক্তিপ্রমাণসহ?” তারা বলবে, “হ্যাঁ, এসেছিলো।” তখন তারা বলবে, “তাহলে তোমরাই দোয়া করো। আর কাফিরদের দোয়া নয় ব্যর্থই হয়ে থাকে।”
৬:৪০-৪১ :: বলো, “তোমরা কি ভেবে দেখেছো যদি তোমাদের কাছে আসে আল্লাহর আযাব অথবা তোমাদের কাছে আসে প্রলয়-মুহুর্ত, আল্লাহ ছাড়া কি তোমরা (অন্য কারো কাছে) দোয়া করবে? (জবাব দাও) যদি তোমরা হও সত্যবাদী।” বরং এমন অবস্থায় তোমরা শুধু তাঁর কাছে দোয়া করো, তখন তিনি দূর করে দেন যা দূর করার জন্য তোমরা তাঁর কাছে দোয়া করো, যদি তিনি ইচ্ছা করেন। আর (বিপদের সময়) তোমরা তাদেরকে ভুলে যাও যাদেরকে তোমরা (তাঁর সাথে) শরীক করো।
৭:৫৬ :: আর পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না তাতে সংস্কার-সংশোধনের পর। আর তোমরা তাঁর (আল্লাহর) কাছে দোয়া করো ভয়ের সাথে ও আশার সাথে। নিশ্চয় আল্লাহর রহমত উত্তম আচরণকারীদের অত্যন্ত নিকটবর্তী।
১৭:১১ :: আর মানুষ অকল্যাণের জন্য দোয়া করে, যেমন তার দোয়া হয় কল্যাণের জন্য। আর মানুষ হলো তাড়াহুড়াপ্রবণ (ধৈর্যহারা)।
আলোচনা : উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, দোয়ার মাধ্যমে কাফিরের কুফরের শাস্তি হ্রাস পেতে পারে না। অন্যদিকে মু’মিনের কাজে-কর্মে কোনো ত্রুটির ফলে যে মন্দ ফলাফল হতে পারে তা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য কৃত প্রার্থনা কবুল হতে পারে।
আল্লাহ যখন কাউকে তার পাপের কারণে কোনো পার্থিব শাস্তি দেন, যেন সে পাপ থেকে ফিরে আসার সুযোগ পায়, তখন সে দোয়া করলে আল্লাহ ঐ শাস্তি দূর করে দেন, যদি তিনি ইচ্ছা করেন। সুতরাং আল্লাহ কোনো দোয়া কবুল করবেন কিনা তা তাঁর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। আর তাঁর ইচ্ছা তাঁর ন্যায়সঙ্গত ও কল্যাণকর নীতিমালার ভিত্তিতে হয়ে থাকে।
আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর নিকট ভয়ের সাথে ও আশার সাথে দোয়া করার জন্য। তাঁর রহমত পেতে হলে উত্তম আচরণকারী হতে হবে। একজন উত্তম আচরণকারীর প্রার্থনা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
সর্বোপরি মানুষ অনেক সময় উপস্থিত মুহুর্তে যে জিনিসেরই প্রয়োজন অনুভব করে সেজন্যই দোয়া করে বসে। অথচ পরে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানতে পারে যে, সে সময় যদি তার দোয়া কবুল হয়ে যেতো, তাহলে তা তার জন্য কল্যাণকর হতো না। মানুষ তাড়াহুড়াপ্রবণ বা ধৈর্যহারা প্রমাণিত হয়েছে। সে সময় নিয়ে যথেষ্ট ভেবে-চিন্তে প্রার্থনা করার পরিবর্তে তাৎক্ষণিকভাবে কাঙ্ক্ষিত জিনিস পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে।
সুতরাং আল্লাহ মানুষের দোয়ায় সাড়া দেয়ার অর্থ হলো তিনি দোয়াকারীর দোয়া সম্পর্কে অবগত থাকেন এবং তা হুবহু বা ভিন্নভাবে এবং তাৎক্ষণিক বা একটি সময়-ব্যবধানে কবুল করে থাকেন। সর্বক্ষেত্রে মানুষের প্রকৃত কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়। দোয়া করার ক্ষেত্রে প্রকৃত কল্যাণের দোয়া করার উপায় হলো কুরআনের আলোকে কল্যাণ-অকল্যাণের বিষয়ে প্রকৃত ধারণা অর্জনের চেষ্টা করা।
তাক্বদীর শব্দটিকে ‘ভাগ্য’ শব্দ দ্বারা অনুবাদ করে এবং ভাগ্য বিশ্বাসকে ঈমানের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর চরম অধ:পতন ঘটানো হয়েছে। কুরআনের কিচু আয়াতকে অন্যান্য আয়াতের থেকে বিচ্ছিন্নভাবে এবং ভাসা-ভাসা অধ্যয়নের মাধ্যমে ভাগ্যবাদের সমার্থক করে ব্যাখ্যা করা হয়। তাক্বদীরের সাথে সম্পর্কিত করে যেসব বিষয়কে উপস্থাপন করা হয় তার প্রায় সব বিষয়ে কুরআনের আয়াতসমূহের সংকলন ও সমন্বিত অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা বিস্তৃত পর্যালোচনা উপস্থাপন করেছি।
বইটির শেষ দিকে এসে আমরা বলতে পারি যে, আশা করা যায়, বইটির অধ্যয়ন তাক্বদীর সম্পর্কে স্ববিরোধমুক্ত সঠিক ধারণা অর্জনে সহায়ক হবে এবং এর ফলে যাদের মনে এ বিষয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে তা দূরীভূত হতে পারে। যারা ইসলামে ভাগ্য বিশ্বাস রয়েছে মনে করে এজন্য উপহাস করে তার মোকাবেলায় তাক্বদীরের সঠিক ধারণা অপরিহার্য। এছাড়া জীবনের সকল ক্ষেত্রে সঠিক কর্মনীতি ও কর্মপ্রচেষ্টা অবলম্বনের মাধ্যমে প্রকৃত কল্যাণ অর্জনে তাক্বদীরের সঠিক ধারণার বিকল্প নেই।
তাক্বদীরের সাথে সম্পকির্ত সকল আয়াতের সমন্বিত অধ্যয়নের ভিত্তিতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তাক্বদীর হচ্ছে সৃষ্টিজগতে বিশ্বপ্রভুর প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ। যেকোনো কর্মপ্রচেষ্টায সফল হওয়ার জন্য মুসলিমদের প্রাকৃতিক আইন আবিষ্কার ও তার যথাযথ অনুসরণ করা প্রয়োজন। এছাড়া আল্লাহর রাজ্যে একমাত্র আল্লাহর সার্বভৌমত্ব রয়েছে। তিনি সকল কিছুর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রক। তাই মু’মিনরা একমাত্র আল্লাহর বিধানের অনুসরণ করবে, আল্লাহর উপর ভরসা করবে এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের প্রকৃত উপায় সম্বন্ধে জানতে ও তা অবলম্বন করতে পারবে। এটা মুসলিম উম্মাহকে পুনরায় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নৈতিক বস্তুগত শ্রেষ্ঠত্বে অধিষ্ঠিত করবে। আর এই বিজয়ী অবস্থান থেকে তারা আল্লাহর বিধানের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতির জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণ ব্যবস্থা কার্যকর করতে সক্ষম হবে, ইনশাআল্লাহ।
১। ‘তাক্বদীর (ভাগ্য!) পূর্বনির্ধারিত’ তথ্যটির প্রচলিত ও প্রকৃত ব্যাখ্যা, প্রফেসর ডা. মো. মতিয়ার রহমান
২। আল্লাহর ইচ্ছা, অনুমতি, মনে মোহর মেরে দেওয়া- কথাগুলোর প্রচলিত ও প্রকৃত ব্যাখ্যা : প্রফেসর ডা. মো. মতিয়ার রহমান
৩। মৃত্যুর সময় ও কারণ পূর্বনির্ধারিত তথ্যটির প্রচলিত ও প্রকৃত ব্যাখ্যা : প্রফেসর ডা. মো. মতিয়ার রহমান
৪। কিতাবুত তাক্বদীর, চৌধুরি গোলাম আহমেদ পারভেজ
৫। অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম, নূর হোসেন মজিদী
৬। তাক্বদীরের হাক্বীকত, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী
৭। তাক্বদীর আল্লাহর এক গোপন রহস্য, আবদুল আলীম ইবনে কাওসার, অনুবাদ : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ জাকারিয়া
৮। Islamic Theory of Evolution : T.O. Shanavas
৯। মানুষ যা চায় তা-ই কি পায়?, হুসাইন আল জাওয়াদ
১০। কে বলে কুরআন স্রষ্টার বাণী নয়? অভিযোগের জবাবে কুরআন ও বিজ্ঞান, ডা. শাহ মুহাম্মদ হেমায়েত উল্লাহ
১১। ইন্টারনেটে থাকা তাক্বদীর সম্পর্কিত বিভিন্ন আর্টিকেল বা প্রবন্ধ