দি  ইন্সটিটিউট ফর কুরআনিক রিসার্চ এন্ড এ্যাপ্লিকেশন (ইক্বরা)

লক্ষ্য

ইক্বরার লক্ষ্য হলো বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য স্রষ্টার ঐশী বাণীর সমন্বিত অধ্যয়ন ও সার্বজনীন প্রয়োগের জন্য জ্ঞানদীপ্ত অনুশীলন।

উদ্দেশ্য

ইক্বরার উদ্দেশ্য হলো কুরআনের বাণীর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ অনুধাবনের জন্য টেকসই ভিত্তি প্রস্তুত করা এবং জীবন ও সমাজের প্রায়োগিকতার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানভিত্তিক ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামো নির্মাণ।

প্রকাশিত বইসমূহ

আল কুরআনে তাগুতের পরিচয়

২:২৫৬ :: দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় সত্যপথ স্পষ্ট হয়ে গেছে বিভ্রান্তি থেকে। সুতরাং যে ব্যক্তি তাগুতের প্রতি কুফর করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে সে এমন এক মজবুত হাতল আঁকড়ে ধরবে যা ভেঙ্গে যাবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

২:২৫৭ :: আল্লাহ মু’মিনদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন এবং কাফিরদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত, সে তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। তারাই (জাহান্নামের) আগুনের অধিবাসী, তারা তাতে চিরকাল থাকবে।

৪:৫১ :: তুমি কি তাদেরকে দেখনি যাদেরকে কিতাবের এক খণ্ড প্রদান করা হয়েছে, যারা জিবত (কুসংস্কার) ও তাগুতের প্রতি ঈমান রাখে এবং তারা কাফিরদের প্রসঙ্গে বলে যে, এরাই মু’মিনদেরকে চেয়ে অধিকতর সঠিক পথে রয়েছে।’?

৪:৬০-৬৩ :: তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা দাবী করে যে, নিশ্চয় তারা ঈমান এনেছে তার উপর যা নাযিল করা হয়েছে তোমার প্রতি এবং যা নাযিল করা হয়েছে তোমার পূর্বে। তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায় অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে অস্বীকার করতে। আর শয়তান চায় তাদেরকে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত করতে। আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা আসো যা আল্লাহ নাযিল করেছেন তার দিকে (কুরআনের দিকে) এবং রাসূলের দিকে’, তখন মুনাফিকদেরকে দেখবে তোমার কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে ফিরে যাচ্ছে। সুতরাং তখন কেমন হবে, যখন তাদের উপর কোন মুসীবত আসবে, সেই কারণে যা তাদের হাত পূর্বেই প্রেরণ করেছে (অর্থাৎ তাদের কৃতকর্মের কারণে)? তারপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করা অবস্থায় তোমার কাছে আসবে যে, আমরা উত্তম আচরণ ও সমঝোতার মাধ্যমে সামর্থ্যবৃদ্ধি ভিন্ন অন্য কিছু চাইনি। তাদের মনে যা আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তুমি তাদের বিষয়ে নির্লিপ্ত হও এবং তাদেরকে সদুপদেশ দাও এবং তাদেরকে তাদের (কর্মকাণ্ডের) পর্যালোচনাস্বরূপ মর্মস্পর্শী কথা বলো।

৪:৭৬ :: যারা মু’মিন তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে এবং যারা কাফির তারা তাগুতের পথে যুদ্ধ করে। সুতরাং তোমরা শয়তানের বন্ধুদের (তাগুত ও তার পথে যুদ্ধরত কাফিরদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। নিশ্চয় শয়তানের কায়দা-কৌশল অত্যন্ত দুর্বল।

৫:৬০ :: বলো, আমি তোমাদেরকে কি এর চেয়ে খারাপ কিছুর সংবাদ দেব যা আল্লাহর নিকট প্রতিদান হিসেবে আছে? (আর তা হলো) যাকে আল্লাহ লা‘নাত করেছেন, যার উপর তিনি ক্রোধান্বিত হয়েছেন, যাদের কতককে তিনি বানর ও শুকরে পরিণত করেছেন আর যারা তাগুতের ‘ইবাদাত করেছে তারাই সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানের লোক এবং সরল সত্য পথ হতে সবচেয়ে বিচ্যুত।

১৬:৩৬ :: আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ কাউকে হিদায়াত দিয়েছেন এবং তাদের মধ্য থেকে কারো উপর পথভ্রষ্টতা সাব্যস্ত হয়েছে। সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো অতঃপর দেখো সত্যকে মিথ্যা সাব্যস্তকারীদের পরিণতি কীরূপ হয়েছে।

৩৯:১৭ :: যারা তাগুতের দাসত্বকে বর্জন করে এবং আল্লাহর অভিমুখী হয়, তাদের জন্যই সুসংবাদ। সুতরাং সুসংবাদ দাও আমার (এরূপ) বান্দাদেরকে।

আলোচনা: জীবনের সকল বিভাগে একমাত্র আল্লাহর বিধানকে ‘পরম সংবিধান’ হিসেবে গ্রহণ করে উহার সীমারেখায় জীবন যাপন করাই আল্লাহর দাসত্ব করা। মানুষের জীবন যাপনের সঠিক মূলনীতি হলো, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁরই দাসত্ব করা। সেই সাথে তাগুতের প্রতি কুফর তথা অনাস্থা রাখা বা প্রত্যাখ্যান করা এবং তাগুতের দাসত্বকে বর্জন করা।

তাগুত (Taghut) সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে বুঝা যায় যে, যারা জোর করে আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে নিজের বিধান দ্বারা শাসন ও বিচারকার্য করে তথা মানুষকে বলপ্রয়োগ করে কুফরি ধর্মাদর্শ, মতবাদ এবং শাসন ও বিচার মানতে বাধ্য করে, ঈমান আনতে ও আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন-যাপনে বাধা দেয়, কাফিরদের মাধ্যমে মু’মিনদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী ভূমিকা পালন বা যুদ্ধ পরিচালনা করে তারাই তাগুত। অর্থাৎ তাগুত হচ্ছে ব্যক্তিসত্তা। অন্য কথায়, কাফিরদের মধ্যে যারা শুধুমাত্র নিজেরা কুফর করে তা নয়, বরং অন্যদেরকে কুফর করতে বাধ্য করে বা ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করে তারাই তাগুত। সকল সাধারণ কাফিররা এই তাগূত কাফিরদের আনুগত্য ও দাসত্বকারী। নবী-রসূলদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে তাগুতের প্রতি কুফর করে, তাগুতের ইবাদাত (দাসত্ব ও উপাসনা) পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের (দাসত্ব ও উপাসনার) দাওয়াত দেয়ার জন্য।

‘রব, মালিক ও ইলাহ হিসেবে আল্লাহর পরিচয়’ এবং ‘কোনো মানুষ রব, মালিক ও ইলাহ হওয়ার মিথ্যা দাবিদার হওয়ার’ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকলে তাগুতের পরিচয় ও তাগুতকে বর্জনের বিষয়টি যথাযথভাবে অনুধাবন করা সহজ হতে পারে।

আল কুরআনের শেষ সূরাটিতে মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্ককে ‘রব্বুন নাস’ (মানুষের প্রতিপালক, প্রভু, বিধানদাতা), ‘মালিকিন নাস’ (মানুষের অধিপতি) ও ‘ইলাহিন নাস’ (মানুষের উপাস্য, মানুষের উপর সার্বভৌমত্বের অধিকারী) হিসেবে প্রকাশ করেছেন।

আল্লাহ হচ্ছেন ‘রব্বুন নাছ’, ‘মালিকুন নাছ’ ও ‘ইলাহুন নাছ’ অর্থাৎ ‘মানুষের রব, মানুষের মালিক ও মানুষের ইলাহ’।

মানুষের রব = মানুষের প্রতিপালক, প্রভু, বিধানদাতা।

মানুষের মালিক = মানুষের অধিপতি, নিয়ন্ত্রক।

মানুষের ইলাহ = মানুষের প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ, নিয়ন্ত্রণ ও তার জন্য স্বাধীনভাবে বিধান নির্ধারণের সার্বভৌম সত্তা, ভয়-আশা-ভরসা-ভক্তি-ভালবাসা সহকারে পরম কাঙ্ক্ষিত আশ্রয় ও পূজনীয় সত্তা।

রব বা বিধাতা হিসেবে তিনি মানব জাতিকে তাঁর বিধান প্রদান করেছেন এবং মানুষ যেন তাঁকে ছাড়া নিজেদের মধ্য থেকে একে অন্যকে রব বা বিধানদাতা না বানায় সেই নির্দেশ দিয়েছেন। মালিক হিসেবে তিনি যাকে ইচ্ছা মানব জাতির সমাজ জীবনে রাজত্ব করার সুযোগ দান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছা রাজত্ব কেড়ে নেন। মালিক হিসেবে তিনি তাঁর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী রাজত্ব পরিচালনা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য নবী-রসূল প্রেরণ করেছেন এবং নবী প্রথার সমাপ্তিতে মু’মিনদের মধ্যকার ‘উলিল আমর’ নির্বাচন করে তার আনুগত্য করার জন্য মু’মিনদেরকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। ইলাহ হিসেবে তিনি মু’মিনদের সালাত, নুসুক (ধর্মীয় নির্দেশনাভিত্তিক অনুষ্ঠানাদি) ও মানব জাতির ঐক্যবদ্ধ জীবন যাত্রার কেন্দ্রীয় স্থান বা ক্বিবলা হিসেবে হিসেবে কা’বা/আল বাইতুল হারাম/ আল মাসজিদুল হারামকে নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ছাড়া কেউ রব, মালিক ও ইলাহ নয়। যদি আল্লাহর বিধানকে মূল বিধান হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে কেউ নিজের বিধান চালায় তাহলে সে নিজেকে রবের আসনে বসায়। যে নিজ আল্লাহর বিধানের বাহিরে রাজত্ব পরিচালনা করে সে নিজেকে মালিকের আসনে বসায় এবং যে নিজেকে সর্বেসর্বা হিসেবে বা সার্বভৌমত্বের অধিকারী হিসেবে দাবি করে সে নিজেকে ইলাহের আসনে বসায়। আর এভাবে যারা মানুষের রব, মালিক, ইলাহ সেজে বসে তারা তাগুত, যেমন ফিরআউন তাগুত ছিলো।

তাগুত হিসেবে ফেরাউনের পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে যে-

৭৯:১৭ :: ফিরআউনের কাছে যাও। নিশ্চয় সে চরম সীমালঙ্ঘন করেছে।

২০:২৪ :: ফিরআউনের কাছে যাও। নিশ্চয় সে চরম সীমালঙ্ঘন করেছে।

২০:৪৩ :: তোমরা দুজন ফিরআউনের কাছে যাও। নিশ্চয় সে চরম সীমালঙ্ঘন করেছে।

২০:৪৫ :: তারা দুজন (মূসা ও হারূন) বললো, “হে আমাদের রব, নিশ্চয় আমরা আশংকা করি যে, সে (ফিরআউন) দুর্ব্যবহার করবে আমাদের উপর বা (আচার-আচরণে) চরম সীমালঙ্ঘন করবে।”

ফিরআউন নিজেকে রব, মালিক ও ইলাহ হিসেবে দাবি করেছিল। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতগুলো লক্ষ্যণীয়।

৭৯:২৩-২৪ :: তারপর সে লোকজনকে সমবেত করেছিলো। তারপর সে ঘোষণা করেছিলো। তখন সে বলেছিলো, “আমিই তোমাদের মহান রব।”

৪৩:৫১ :: আর ডেকে বলেছিল ফেরাউন তার কওমের মধ্যে। সে বলেছিল, ‘হে আমার কওম, আমারই কর্তৃত্বাধীনে নয় কি মিসরের মুলক/ রাজত্ব (অন্য কথায়, আমি কি মিসরের মাটি ও মানুষের মালিক নই)? আর এ নদীসমূহ প্রবাহিত হয় আমার নিচ দিয়ে/ আওতাধীনে। তোমরা কি দেখতে পাও না?’

২৮:৩৮ :: আর ফেরাউন বলেছিলো, ‘হে নির্বাহী পরিষদ, আমি তো জানি না যে, তোমাদের জন্য আছে কোন ইলাহ, আমি ছাড়া। সুতরাং আগুন জ্বালাও আমার জন্য, হে হামান, মাটির উপর (অর্থাৎ ইট তৈরি করো)। তারপর বানাও আমার জন্য সুউচ্চ প্রাসাদ, যেন আমি তাতে আরোহন করে দেখতে পারি মূসার ইলাহকে। আর নিশ্চয় আমি তাকে (মূসাকে) মনে করি মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত।

অনেকে বলে, ‘ফিরআউন’ নিজেকে ‘আল্লাহ’ বলে দাবি করেছে। বস্তুত বিষয়টি তা নয়। বরং সঠিক কথা হলো, ফিরআউন আল্লাহর পরিবর্তে নিজেকে ‘রব, মালিক ও ইলাহ’ বলে দাবি করেছে।

ফিরআউনের নাস্তিক্যবাদ সত্ত্বেও সে মুশরিকদের ধর্মচর্চাকে সমর্থন করতো, এমনকি সে তাদের ইলাহগুলোকে নিজের ইলাহ হিসেবে অস্বীকার করে নি। নিম্নের আয়াতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

৭:১২৭ :: আর ফেরাউনের কওমের প্রধানগণ বলেছে, ‘আপনি কি ছেড়ে দেবেন মূসাকে আর তার কওমকে পৃথিবীতে ফাসাদ/ বিপর্যয় সৃষ্টি করার জন্য আর যেন পরিত্যাগ করে আপনাকে আর আপনার ইলাহদেরকে/ উপাস্যদেরকে?’ সে (ফেরাউন) বলেছে, ‘শীঘ্রই আমরা হত্যা করবো তাদের পুত্রদেরকে আর আমরা জীবিত রাখবো তাদের নারীদেরকে। আর নিশ্চয় আমরা তাদের উপর একচ্ছত্র ক্ষমতাধর’।

বলা হয়, ফেরাউন নিজেকে রব, মালিক ও ইলাহ বলে দাবি করলেও বর্তমানে কেউ নিজেকে রব, মালিক ও ইলাহ বলে দাবি করে না। কিন্তু এ বিষয়ে প্রকৃত কথা হলো, নির্দিষ্টভাবে ধর্মীয় পরিভাষা ব্যবহার করা বা না করার আক্ষরিকতাবাদে আটকে থাকলে তাগুতসহ বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক চিত্র অনুধাবন করা সম্ভব হবে না। যারা নিজেদের অন্যদের রিজিক্বদাতা মনে করে যে, আমার দেয়া বেতনে তোমার সংসার চলে, আমিই তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছি, সুতরাং আমার যেকোনো কথা নির্বিচারে ও নির্বিবাদে মেনে চলাই তোমার কাজ, নাহলে তোমাকে চাকুরিচ্যুত করবো, তখন না খেয়ে মরবে; যারা বলে যে, এটা আমার রাজত্ব, এখানে আমি যা বলি তা-ই শেষ কথা; যারা বলে যে, আমি যা বলি বা করি, তা ঠিক হলেও ঠিক, ভুল হলেও ঠিক, তুমি সেটাকে ঠিক হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং সেটারই প্রশংসা করতে হবে, আমার স্তব-স্তুতি করতে হবে; তারাই তো নিজেদেরকে রব, মালিক ও ইলাহ হিসেবে দাবি করা হলো, এবার তারা এ দাবির জন্য কোন শব্দ ব্যবহার করলো, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তাদের অবস্থানটাই গুরুত্বপূর্ণ।

কীভাবে কেউ নিজেদেরকে রবের আসনে বসায় বা কাউকে রবের আসনে বসানো হয় তা বুঝার জন্য নিম্নের আয়াতগুলো লক্ষ্যণীয়।

৯:৩১ :: তারা গ্রহণ করে তাদের আহবার ও রুহবানকে/ তাদের ধর্মগুরুদেরকে রব হিসাবে, আল্লাহকে ছাড়াও। আর মাসীহ ইবনে মারইয়ামকেও (তারা রব হিসাবে গ্রহণ করে)। অথচ তাদেরকে আদেশ দেয়া হয়নি এছাড়া যে, তারা ইবাদাত করুক একজনমাত্র ইলাহর (অর্থাৎ আল্লাহর)। কোনো ইলাহ নেই, তিনি ছাড়া (আল্লাহ ছাড়া)। তিনি (আল্লাহ) পবিত্র/ত্রুটিমুক্ত, তারা তাঁর সাথে যে শরিক করে তা থেকে।

৩:৭৯-৮০ :: কোন মানুষের দ্বারা সম্ভব নয় যে, আল্লাহ তাকে দেন কিতাব, হুকুম এবং নবুয়্যাত, তারপর সে বলে মানুষের উদ্দেশ্যে, ‘তোমরা হয়ে যাও আমার ইবাদাতকারী আল্লাহর ইবাদাতকারী হওয়ার পরিবর্তে’ (কারণ, আল্লাহ তো তার যোগ্যতা ও চরিত্র বুঝেই তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন)। কিন্তু তার কথা তো হবে এই যে, ‘তোমরা হয়ে যাও রব্বানী/ রবের বিধান বাস্তবায়নকারী, উহার মাধ্যমে যা তোমরা কিতাব শিক্ষাদান করো আর উহার মাধ্যমে যা তোমরা (কিতাবের) শিক্ষা অর্জন করো’। আর (হে ঐসব লোক, যারা ইতিমধ্যে মুসলিম হয়েছো), সে তোমাদেরকে নির্দেশ দেবে না যে, ‘তোমরা গ্রহণ করবে ফেরেশতাদেরকে ও নবীদেরকে রব/ বিধানদাতা হিসাবে’। সে কি তোমাদেরকে নির্দেশ দিবে কুফর করার প্রতি এরপরও, যখন তোমরা মুসলিমূন (আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী)? (অর্থাৎ যখন তোমরাই মুসলিম, অথচ একজন নবীই তোমাদেরকে কুফর করার নির্দেশ দিবে, তা অসম্ভব)।

৩:৬৪ :: বলো, ‘হে আহলে কিতাব, তোমরা আসো একটি কথার দিকে যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই। তা এই যে, আমরা ইবাদাত/ দাসত্ব করবো না আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো। আর আমরা শিরক/ অংশীদার সাব্যস্ত করবো না তাঁর সাথে কাউকেই। আর গ্রহণ করবে না আমাদের কেউ কাউকে রব/ বিধানদাতা হিসাবে, আল্লাহকে ছাড়া (অর্থাৎ আমরা একমাত্র আল্লাহকেই রব/ বিধানদাতা হিসাবে গ্রহণ করবো)’। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তোমরা বলো, ‘তোমরা সাক্ষী থাকো যে, আমরা মুসলিমূন (আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী)’।

আল্লাহকে রব, মালিক ও ইলাহ হিসেবে মেনে নেয়ার প্রায়োগিক পদ্ধতি হলো আল্লাহর দেয়া কিতাবকে বিধান হিসেবে গ্রহণ করা, আল্লাহর বিধান অনুসারে রসূল ও উলিল আমরের আনুগত্য করা এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে আল মাসজিদুল হারামকে মূল ক্বিবলা বা কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করা। উলিল আমর হলেন রসূলের প্রতিনিধিত্বকারী নির্বাহী নেতৃত্ব এবং যাবতীয় মাসজিদ হলো মুসলিমদের স্থানীয় ক্বিবলা বা ধর্মকেন্দ্র দ্বীনের কেন্দ্র। কুরআন, ‘রসূল ও উলিল আমর’ এবং মাসজিদ হলো মুসলিম উম্মাহর সংবিধান, সরকার ও রাজধানী বা ধর্মগ্রন্থ, ধর্মগুরু ও ধর্মালয়। মাসজিদ মুসলিমদের উপর কুরআনভিত্তিক সাংবিধানিক ও নির্বাহী বিধান ঘোষণার রাজসিংহাসন, কুরআনের বিধান অনুসারে সমষ্টিগত বিষয়াদির তদারকি ও বিচার অনুষ্ঠানের রাজদরবার এবং কুরআনের ভিত্তিতে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত বা ধন-সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের রাজকোষ হিসেবে কাজ করে, যাকে বলা যেতে পারে মুসলিম উম্মাহর সদর দপ্তর। আর উলিল আমর হলেন এই কার্যক্রমে নেতৃত্ব প্রদানকারী কুরআনের বিধান অনুসারে পরিচালিত কর্তৃপক্ষ।

কোথাও কাফিরদের বাস্তব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তার বাস্তবতা অস্বীকারের কিছু নেই, কিন্তু মু’মিনরা তাদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারভার রসূল ও তাঁর অনুপস্থিতিতে উলিল আমরের উপর অর্পণ করতে হবে। নিজেদের মধ্যকার বিষয়ে রসূলকে বা উলিল আমরকে বাদ দিয়ে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া যাবে না। নিতান্ত বাধ্য হয়ে তাগুতের অধীনে বা তাগুতের বিধানের আওতায় থেকে কর্মসম্পাদন করা আর নিজেদের মূল বিধান (সংবিধান) ও মূল নেতৃত্ব (সরকার) হিসাবে কুরআনের বিধান ও রসূলকে বা উলিল আমরকে গ্রহণ না করে (৪:৬১) তাগুতের আনুগত্য করা ও তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া (৪:৬০) এবং উহাকে উত্তম আচরণ ও সমঝোতার মাধ্যমে সামর্থ্য বৃদ্ধির প্রয়াস বলে অজুহাত পেশ করা (৪:৬২) দুটি ভিন্ন বিষয়।

নিজেদের মধ্যকার বিষয়ে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া যাবে না। কিন্তু তাদের নাগরিকের অপরাধের ক্ষেত্রে বিচার চাওয়াকে ৪:৬০ আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক বলে সাব্যস্ত করা যায় না। ৪:৫৯ – ৬৫ অনুযায়ী, কুরআন ও রসূলকে বাদ দিয়ে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া এবং নিজেদের পার্থিব স্বার্থবাদিতাকে আড়াল করার জন্য উহাকে ইহসান ও তাওফীক্বের প্রয়াস বলে অজুহাত পেশ করা মোনাফেকি। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর খেলাফত প্রাপ্তির পূর্বে তাগুতের কাছে তাদের নাগরিকের বিচার চাওয়া একটি ভিন্ন বিষয়, যে ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

যেহেতু দ্বীন গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো জবরদস্তি নেই, তাই কাফিররা তাদের নিজেদের দীন মতো চলার স্বাধীনতা আছে এবং মু’মিনরাও নিজেদের দীন মানার স্বাধীনতা আছে। যারা নিজেদের অপশক্তি প্রয়োগ করে মু’মিনদেরকে নিজেদের জীবনে তাদের দীন পালন থেকে বাধার সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে অন্যরূপ বিধানে চলতে বাধ্য করে তারাই তাগুত। মু'মিনরা তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করবে, তাদের স্বত:স্ফূর্ত আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবে তথা তাদের প্রতি কুফর করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করবে। এই পথ পরিক্রমার সূচনা থেকে ক্রমবিকাশ হলো ঈমান এবং সাধ্যানুসারে আমলে সালেহ। তাগুতের মোকাবেলায় মু’মিনদের কাজ হবে আমাদের নিজেদের মধ্যে ঈমানী ঐক্য গড়ে তোলা, তারপর আমাদের ঈমানের পথে যারাই বাধা দিবে, তারাই তাগুত এবং তাদের মোকাবেলায় পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্তক্রমে আমাদের করণীয় নির্ধারণ ও সম্পাদন করা।

তাগুতকে বর্জনের নির্দেশ পালনের জন্য লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, তাগুত বিভিন্ন বিভাগের হয়ে থাকে। যথা: রাজনৈতিক তাগুত, অর্থনৈতিক তাগুত এবং সামাজিক ও ধর্মীয় তাগুত। যেমন রসূলুল্লাহ মূসার সময়কালে ফিরআউন ওয়া মালায়েহী ছিলো রাজনৈতিক তাগুত, কারুন ও হামান ছিলো অর্থনৈতিক তাগূত এবং ছাহের ও কাহেন ছিলো ধর্মীয় তাগুত। ধর্মীয় তাগুতের প্রচারণার ফলে অনেকে শুধু রাজনৈতিক তাগুতকেই একমাত্র তাগুত মনে করে এবং অনেকে আবার তাগুত বলতে শয়তান, মূর্তি ও মূর্তিপুজা ইত্যাদিকে বুঝে। অথচ কুরআনে তাগুতকে ‘শয়তানের আওলিয়া বা বন্ধু’ বলা হয়েছে। শয়তান মানুষের মধ্যে শাসন ও বিচার করে না, অনুরূপভাবে মূর্তিও তা করে না। সুতরাং এগুলোকে তাগুত হিসেবে তুলে ধরা ধর্মীয় তাগুতের কারসাজি, যেন মানুষ প্রকৃত তাগুতের বিষয়ে সচেতন হতে না পারে।

ধর্মীয় তাগুত হচ্ছে তারা, যারা আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাবের দলীল ছাড়াই কোনো বিষয়কে ধর্মীয় বিষয় হিসেবে চালু করে দেয় এবং যখন আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাব অনুযায়ী সঠিক তথ্য ও বিধি-বিধান তুলে ধরা হয়, তখন তা গ্রহণ ও প্রচারের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। তাই ধর্মীয় তাগুতই দ্বীনুল হক্ব (সঠিক জীবনব্যবস্থা) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।

ট্যাগ / কী-ওয়ার্ড:

অন্যান্য প্রবন্ধ

October 6, 2025
On a New Understanding of Iman, Belief and Faith according to Quran

On the Reinterpretation of Iman in Islam This video explores a provocative reinterpretation of one of Islam’s fundamental concepts: iman. The author Dr. Hal al-Sed Hassan argues that the traditional understanding of iman as “faith” or “belief” has been deliberately misconstrued over centuries, and that this misunderstanding has led to significant social and theological consequences within the Islamic […]

June 7, 2025
শেষ জামানা সম্পর্কে কুরআন কি বলে?

শেষ জামানা বা আখিরুজ্জামান সম্পর্কে কুরআনে কি বলে? বিস্তারিত জানাচ্ছেন একজন কুরআনের স্কলার

May 30, 2025
প্রচলিত কুরবানি: কুরআন থেকে পর্যালোচনা

প্রচলিত কুরবানিকে যদি আমরা কুরআন থেকে পর্যালোচনা করি, তাহলে কি পাই?

May 16, 2025
Explaining the Qur'an through the Qur'an

Introductory presentation for a series applying the intratextual approach to the exegesis of Surat al-An'am, here on CASQI's channel.

May 3, 2025
কুরআনকে কি সংবিধান বলা যেতে পারে?

সাধারন ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যে একটি কমন ধারনা হলো: ইসলামের সংবিধান হলো কুরআন এবং আধুনিক সময়ে যেসব সেকুলার সংবিধান করা হয় তা হলো "তাগুত"। বিষয়টি কি সত্যিই এরকম সাদা কালো? কুরআন কি সংবিধানি? একজন ইসলামে বিশ্বাসীর পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে এই প্রশ্নের মিমাংসায় পৌছতে হলে আমাদের প্রথমে কয়েকটি কনসেপ্ট ক্লিয়ার করে এগুতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে […]

May 2, 2025
কোরআন বোঝা কি কঠিন?

মুসলিমদের জীবন বিধানের সকল মূলনীতি কোরআনে আল্লাহ বলে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তোমার ওপর যে কিতাব (কোরআন) নাজিল করা হয়েছে ‎তাতে রয়েছে সকল বিষয়ের বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৮৯) দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ দেশের মুসলিমদের কোরআন দেখে শুদ্ধ করে পড়ার প্রতি গুরুত্ব থাকলেও ইসলামি জীবন বিধানের মৌলিক উৎস […]

April 15, 2025
সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার : কুরআনে সামাজিক মূল্যবোধ

১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ যে মূলনীতিসমূহ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে এবং ২০২৪ সালে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য যে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ কর্তৃক পেশ করা হয়েছে তাতে অন্যতম তিনটি মূলনীতি হলো, ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’। বস্তুত এই মূলনীতিসমূহ […]

April 11, 2025
নাসর হামিদ আবু যায়েদ - একজন আধুনিক কুরআন স্কলারের কর্ম-পরিচিতি

নাসর হামিদ আবু যায়েদ - একজন আধুনিক কুরআন স্কলারের কর্ম-পরিচিতি ... তার কাজ ও জীবন সম্পর্কে