তাক্বদীর

বইটির পিডিএফ কপি ডাউনলোড

তাক্বদীর: মানুষের ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা এবং কর্মের দায়বদ্ধতা ও কর্মফল

সৃষ্টিজগতে বিশ্বপ্রভুর প্রাকৃতি নিয়ম নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ

মানুষ বাধ্যগত জীব নাকি তার ইচ্ছাশক্তি ও কর্মের স্বাধীনতা রয়েছে? সে কি তার কর্মের জন্য দায়বদ্ধ? ঈমান-আমল বা হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতার জন্য সে কি নিজেই দায়ী নাকি এটা তার ভাগ্য বা নিয়তি? এগুলো ভাগ্যবাদের পর্যালোচনার জন্য মৌলিক প্রশ্ন। এ প্রশ্নগুলোর সমাধান ভাগ্যবাদের অসারতা প্রমাণ করে।

মানুষ আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইনের অধীন। প্রাকৃতিক আইনের আওতায় কিছু ক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মশক্তি রয়েছে। এই সীমিত ক্ষেত্রেই মানুষ দায়ী। কারণ আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যসীমার বাহিরে দায়ভার অর্পণ করেন না।

মানবজীবনে প্রাকৃতিক আইন অনুসারে কোনো বিষয় সংঘটনের ক্ষেত্রে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার একটি উদাহরণ হল কোনো মানুষের জন্ম। যখন পিতামাতা সন্তান জন্মদানের ইচ্ছা করে এবং সেজন্য যথানিয়মে প্রাকৃতিক পদ্ধতি অবলম্বন করে তখন যদি প্রাকৃতিক আইন অনুসারে সন্তান জন্ম গ্রহণের অনুঘটকগুলো সঠিকভাবে পূর্ণ হয় তাহলে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। সুতরাং সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে পিতামাতার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভূমিকা রয়েছে কিন্তু এক্ষেত্রে সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভূমিকা নেই। আবার যদি কোনো ব্যক্তিকে অন্য কোনো ব্যক্তি হত্যা করে তখন তাতে হত্যাকারীর ইচ্ছা জড়িত রয়েছে, নিহত ব্যক্তির ইচ্ছা নয়। এছাড়া প্রাকৃতিক আইন অনুসারে একজন ব্যক্তি যদি কোনো ধরনের দুর্ঘটনার মধ্যে না পড়ে, তা সত্ত্বেও এক সময় তার মৃত্যু হবে এবং তাতে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো ভূমিকা নেই।

সুতরাং তাক্বদীর তথা প্রাকৃতিক আইন অনুসারে কিছু সীমিত ক্ষেত্রে মানুষের ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। একটি সহজ উদাহরণ হলো, মানুষ চোখ দ্বারা দেখবে, এখন ইচ্ছা করলে সে কোনো কিছু একাধিকবার দেখতে পারে আবার ইচ্ছা করলে কোনো কিছু থেকে থেকে চোখ বন্ধ রাখতে বা ফিরিয়ে নিতে পারে। কিন্তু কোনোভাবে সে চোখ ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে দেখবে না। আবার চোখ দ্বারা সে কত দূরের বা কাছের জিনিস দেখবে এবং কত ছোট বা বড় জিনিস দেখবে তাও প্রাকৃতিক আইন অনুসারে নির্ধারিত হয়। এছাড়া তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক আইন অনুসারে কর্ম সম্পাদনের ও তার ফলাফল ভোগের কোনো ক্ষেত্রে মানুষ ব্যক্তিগতভাবে দায়ী এবং কোনো ক্ষেত্রে মানুষ সমষ্টিগতভাবে দায়ী।

যারা তাক্বদীর বলতে ভাগ্য বুঝেন এবং মানুষকে সকল ক্ষেত্রে বাধ্যগত জীব মনে করেন তাদের ধারণা যে ভুল এ বিষয়টি মানুষ তাদের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব। যেমন যদি সবকিছু ভাগ্যের কারণেই হতো তাহলে মানুষের ন্যায়-অন্যায় বোধ এবং কোনো কাজ সঠিক বা ভুল হওয়ার কোনো অর্থ হতো না। এছাড়া কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিকল্পনা, পরামর্শ, নিয়ম-নীতি, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ইত্যাদির কোনো প্রয়োজন থাকতো না।

মানুষ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তির অধিকারী। তাই তার স্বাধীন কাজের জন্য সে নিজেই দায়ী। যেমন ঈমান-আমল বা হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতার জন্য সে নিজেই দায়ী। আর তাই তাকে তার কর্মের প্রতিফল ভোগ করতে হবে। এ বিষয়ে নিম্নে প্রাসঙ্গিক আয়াত ও তার আনুষঙ্গিক আলোচনা তথা ভাগ্যবাদের পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হলো।

১. মানুষের পছন্দ, ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টা

মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তি রয়েছে। তাই কোনো কাজের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মানুষের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টাকে বিবেচনায় নিতে হয়। ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত কাজের বিচার এক রকম হয় না। কোনো কাজে সফল হওয়ার জন্য যথাযথ ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়।

৪১:৪০ :: নিশ্চয় যারা অর্থ বিকৃত করে আমাদের আয়াতসমূহের ক্ষেত্রে তারা গোপন নয় আমাদের কাছে। তবে কি যাকে নিক্ষেপ করা হবে (জাহান্নামের) আগুনের মধ্যে সে উত্তম, নাকি সে যে আসবে নিরাপদ অবস্থায় কিয়ামাত দিবসে? তোমরা কাজ করো যেরূপ কাজ করতে তোমরা ইচ্ছা করো (অর্থাৎ তোমাদেরকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে)। নিশ্চয় তিনি তোমরা যা কর তার ব্যাপারে দৃষ্টিবান (অর্থাৎ তোমাদেরকে তোমাদের কর্মের স্বাভাবিক ফলাফল বহন করতে হবে, ফলাফল পরিবর্তন বা পছন্দ করার স্বাধীনতা দেয়া হয় নি)।

৮১:২৮-২৯ :: (কুরআন ঐব্যক্তির জন্য উপদেশ) তোমাদের মধ্যে যে সোজা চলতে চায়। আর তোমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছার বাইরে অন্য কিছুই ইচ্ছা করতে পার না।

আয়াত দু’টি প্রমাণ করেছে যে, বান্দার ইচ্ছাশক্তি রয়েছে এবং এর মাধ্যমেই সে হয় সরল পথ বেছে নেয়, না হয় বক্রপথ। আয়াতদ্বয় এটাও প্রমাণ করেছে যে, বান্দার এই ইচ্ছাশক্তি আল্লাহ্‌র ইচ্ছার বাইরে নয়, বরং তাঁর ইচ্ছার অধীনে।

১৮:২৯ :: আর বল, ‘সত্য তোমাদের রবের পক্ষ থেকে। সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে যেন ঈমান আনে এবং যে ইচ্ছা করে সে যেন কুফরী করে। নিশ্চয় আমি যালিমদের জন্য আগুন প্রস্ত্তত করেছি, যার প্রাচীরগুলো তাদেরকে বেষ্টন করে রেখেছে। যদি তারা পানি চায়, তবে তাদেরকে দেয়া হবে এমন পানি যা গলিত ধাতুর মত, যা চেহারাগুলো ঝলসে দেবে। কী নিকৃষ্ট পানীয়! আর কী মন্দ আশ্রয়স্থল!

আলোচনা : এ আয়াতে বান্দার ইচ্ছাশক্তি প্রমাণিত হয়। কিন্তু তা আল্লাহর ইচ্ছায় সবকিছু হয় তথ্যটির সাথে সাংঘর্ষিক নয়। বস্তুত বান্দার ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার অধীন।

৭৪:৩৭-৩৮ :: তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে সে এগিয়ে যাবে অথবা (যে ইচ্ছা করে) সে পিছিয়ে যাবে। প্রতিটি ব্যক্তিই সে যা উপার্জন করে সেজন্য (তথা নিজ কৃতকর্মের জন্য) দায়ী।

৯০:১০ :: আর আমরা তাকে (মানুষকে) উভয়/দুটি পথের (ভালো ও মন্দ/ সঠিক ও ভুল) বিষয়ে পথনির্দেশ করেছি।

৭৬:৩ :: আমি তাকে পথনির্দেশ করেছি। হয়তো সে কৃতজ্ঞ হবে, নয়তো সে অকৃতজ্ঞ হবে।

২৫:৬২ :: আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাতকে ও দিনকে (পরস্পরের) অনুগামী বা স্থলাভিষিক্ত করে। ইহা তার জন্য (নিদর্শনস্বরূপ) যে ইচ্ছা করে উপদেশ গ্রহণ করতে অথবা ইচ্ছা করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে।

৭:৯৬ :: যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ঈমান আনতো এবং স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করতো তবে আমি তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর (সুখময় উপকরণের) সমৃদ্ধি উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা অবিশ্বাস করলো। কাজেই আমি তাদের কর্ম অনুযায়ী ফল দান করলাম।

৬:১৬৪ :: বল, ‘আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন প্রভু অনুসন্ধান করবো অথচ তিনি সব কিছুর প্রভু? আর প্রতিটি ব্যক্তি যা অর্জন করে, তা শুধু তারই উপর বর্তায় (প্রত্যেকে নিজ কৃতকর্মের ফলই ভোগ করবে)। আর কোনো ভারবহনকারী অন্যের ভার বহন করবে না। অতঃপর তোমাদের রবের নিকটই তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল। সুতরাং তিনি তোমাদেরকে সেই সংবাদ দেবেন, যাতে তোমরা মতবিরোধ করতে।

১৭:১৮-২০ :: যে ইচ্ছা করে (সব সুখ-সম্পদ) তাড়াতাড়ি (পার্থিব জীবনেই) পেতে, আমরা তাড়াতাড়ি দিই তার জন্য তাতে (পৃথিবীতে) যা আমরা ইচ্ছা করি, যাকে আমরা (দেয়ার) ইচ্ছা করি। তারপর আমরা নির্ধারণ করি তার জন্য জাহান্নাম। সে তাতে জ্বলবে নিন্দিত অবস্থায় ও রহমত থেকে বঞ্চিত অবস্থায়। আর যে ইচ্ছা করে আখিরাত (আখিরাতের সাফল্য) পেতে আর সেজন্য কর্মপ্রচেষ্টা চালায় তার (যথাযথ) চেষ্টার মাধ্যমে, এ অবস্থায় যে, সে একজন মু’মিন, তারাই এমন লোক যাদের প্রচেষ্টা হয় (আল্লাহর কাছে) স্বীকৃত/ গৃহীত। (পার্থিব জীবনে) প্রত্যেককেই আমরা সাহায্য করি, এদেরকেও এবং ওদেরকেও, তোমার রবের দান থেকে। আর তোমার রবের দান বন্ধ-অবরুদ্ধ হয় না।

৪:১৩৪ :: যে ইচ্ছা করে দুনিয়ার প্রতিফল পেতে, তার জানা উচিত যে, আল্লাহর কাছে আছে দুনিয়া ও আখিরাতের (উভয় প্রকার) প্রতিফল। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।

৩:১৫২ :: … তোমাদের মধ্যে এমন লোক আছে যে দুনিয়ার (সুখ সম্পদ পেতে) ইচ্ছা করে এবং তোমাদের মধ্যে এমন লোক আছে যে আখিরাতের (সুখ সম্পদ পেতে) ইচ্ছা করে। …

পছন্দের স্বাধীনতা এবং ভালো-মন্দ ভাবের মধ্যে সংঘর্ষের কারণ

প্রসঙ্গত মানুষকে কেন পছন্দের স্বাধীনতা দেয়া হলো তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে। মানুষের পছন্দের স্বাধীনতার একটি যৌক্তিক পরিণতি হলো ভালো-মন্দের সংঘর্ষ। শুধুমাত্র একটি সম্ভাবনা থাকলে পছন্দের স্বাধীনতা থাকতে পারে না। পছন্দের মুহূর্তটি এমন একটি উপলক্ষ যেখানে মানুষের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো হয়। এই মহাবিশ্ব বিবর্তনের নীতিতে কাজ করে যা সংঘর্ষের উপর ভিত্তি করে। মন্দের সাথে সংঘর্ষ মানুষের মধ্যে ভালোকে উৎকর্ষিত করে। এটিকে বলা হয় 'তার নিজের (ব্যক্তিত্ব) বিকাশ'।

সুতরাং পছন্দের স্বাধীনতার উদ্দেশ্য মন্দের ঝুঁকি সত্ত্বেও ভালোর অমিত সম্ভাবনা। ফেরেশতারা মানুষের খিলাফাহর বিষয়ে মানুষ ফাসাদ সৃষ্টি করবে বলে যে আশংকা ব্যক্ত করলো মানুষের কার্যকলাপে সেই আশংকা বাস্তব রূপ লাভ করেছে। সুতরাং তাদের আশংকা অযৌক্তিক ছিলো না। কিন্তু তাদের আশংকার চেয়ে বৃহত্তর সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে মানুষকে খিলাফাহ দেয়া হয়েছে, যে বিষয়ে ফেরেশতাদের জ্ঞান ছিলো না। আর সেই সম্ভাবনা হলো, মানুষকে প্রদত্ত নামকরণের যোগ্যতা তাদেরকে ভালো নামের বিষয়ে অনুপ্রাণিত করবে এবং তা তাদের খিলাফাহর যৌক্তিক কারণে পরিণত হবে।

২. মানুষ নিজেই ঈমান আনে, কুফরী করে, আনুগত্য করে, অবাধ্য হয়

২:২৮ :: কেমন করে তোমরা আল্লাহ্‌র সাথে কুফরী কর? অথচ তোমরা ছিলে নিষ্প্রাণ। অতঃপর তিনিই তোমাদেরকে প্রাণ দান করেছেন।

৭৮:৩৯ :: অতএব, যার ইচ্ছা, সে তার পালনকর্তার নিকটে আশ্রয়স্থল তৈরী করে নিক।

৩:১৫২ :: তোমাদের মধ্যে কেউ দুনিয়া কামনা করে আর কেউ আখেরাত কামনা করে।

আলোচনা : এ আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, বান্দা নিজেই ঈমান আনে ও কুফরী করে।

২:২৫৬ :: দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় সঠিক পথ স্পষ্ট হয়েছে ভ্রষ্টতা থেকে। অতএব, যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

৫১:৯ :: উহা (কুরআনের বক্তব্য) থেকে সে-ই মুখ ফিরায় যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

৩. ভাল-মন্দ আমলের প্রতিদান

মানুষ তার সমস্ত কর্মের জন্য দায়ী যা ফলস্বরূপ ফলাফল বহন করে, একে তার ‘কাজের প্রত্যাবর্তন’ বলা যেতে পারে।

৩২:১৭ :: কেউ জানে না তার জন্য তার কৃতকর্মের কি চোখ-জুড়ানো প্রতিদান লুক্কায়িত আছে।

৫৩:৩৯ :: মানুষের যা বা যেরূপ কর্মপ্রচেষ্টা করে তাছাড়া তার জন্য কিছু নেই (অর্থাৎ মানুষ তার কর্মপ্রচেষ্টার ধরন অনুসারেই প্রতিফল, পারিশ্রমিক, পুরস্কার বা শাস্তি পাবে)।

অর্থাৎ মানুষ শুধু তাই পাবে যে ধরনের পুরস্কার বা শাস্তি পাওয়ার উপযোগী কর্মপ্রচেষ্টা সে করবে; এটা সম্ভব নয় যে, সে তো করেছে ভালো কাজ কিন্তু পেয়েছে শাস্তি, অথবা করেছে শাস্তির উপযোগী মন্দ কাজ কিন্তু পেয়েছে পুরস্কার; এটা ভিন্ন কথা যে, কারো ছোটো-খাটো ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে তাকে তার ভালো কাজের পুরস্কার দেয়া হবে।
৬:১৬৪ :: আর প্রত্যেক ব্যক্তি (তা থেকে) কিছুই অর্জন করে না যা তার উপর বর্তায় না (প্রত্যেকে স্বীয় কৃতকর্মের জন্য দায়ী); আর কেউ অন্যের বোঝা বহন করবে না।

১৭:১৫ :: যে সঠিক পথে চলে, তাহলে নিশ্চয় সে সঠিক পথে চলে তার নিজেরই কল্যাণের জন্য। আর যে ভ্রান্ত পথে চলে, তাহলে নিশ্চয় সে ভ্রান্ত পথে চলে তার নিজেরই অকল্যাণের জন্য। আর কোনো বোঝা বহন করবে না কোনো বোঝা বহনকারী, অন্যের বোঝা। আর আমরা শাস্তিদানকারী নই যতক্ষণ না আমরা সমুত্থিত/ প্রেরণ করি কোনো রসূল।

৩৫:১৮ :: আর বোঝা বহন করবে না কোনো বোঝা বহনকারী, অন্য কারো বোঝা। আর যদি ডাকে কোনো ভারাক্রান্ত ব্যক্তি তার বোঝা বহনের দিকে, তবুও বহন করা হবে না তার পক্ষ থেকে কিছুমাত্রও, যদিও হয়ে থাকুক কোনো নিকট আত্মীয়। নিশ্চয় তুমি তাদেরকেই সতর্ক করতে পারো যারা ভয় করে তাদের রবকে অদেখা সত্ত্বেও, আর সালাত প্রতিষ্ঠা করে। আর যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, তবে নিশ্চয় সে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে তার নিজেরই কল্যাণের জন্য। আর আল্লাহরই কাছে প্রত্যাবর্তন।

৩৯:৭ :: যদি তোমরা কুফর করো, তবে নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের থেকে অমুখাপেক্ষী। আর তিনি পছন্দ করেন না তাঁর বান্দাদের জন্য কুফরকে। আর যদি তোমরা শোকর/ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তিনি উহাকে (শোকরকে) পছন্দ করেন তোমাদের জন্য। আর বহন করবে না কোনো বোঝা বহনকারী, অন্যের বোঝা। তারপর তোমাদের রবের দিকে তোমাদের ফিরে যাবার স্থান। তারপর তিনি তোমাদেরকে সংবাদ দেবেন তোমরা যে কাজ করতে তা সম্পর্কে। নিশ্চয় তিনি মস্তিষ্কসমূহের চিন্তাধারা সম্পর্কে জানেন।

২০:১৫ :: নিশ্চয় প্রলয়-মুহুর্ত আসবেই। আমি উহা গোপন রাখতে চাই, যেন প্রতিফল পায় প্রত্যেক ব্যক্তি তার প্রচেষ্টার কারণে।

২১:৯৪ :: যে সৎকর্ম করে এ অবস্থায় যে, সে একজন মু’মিন; তাহলে অগ্রাহ্য করা হবে না তার প্রচেষ্টাকে। আর নিশ্চয় আমরা তা লিখে রাখছি।

১৭:১৮-২১ :: যে ইচ্ছা করে (সব সুখ-সম্পদ) তাড়াতাড়ি (পার্থিব জীবনেই) পেতে, আমরা তাড়াতাড়ি দিই তার জন্য উহাতে (পৃথিবীতে) যা আমরা ইচ্ছা করি, যাকে আমরা (দেয়ার) ইচ্ছা করি। তারপর আমরা নির্ধারণ করি তার জন্য জাহান্নাম। সে উহাতে জ্বলবে নিন্দিত অবস্থায় ও রহমত থেকে বঞ্চিত অবস্থায়। আর যে ইচ্ছা করে আখিরাত পেতে আর প্রচেষ্টা চালায় (কাজ করে) তার জন্য (তার উপযোগী) তার (যথাযথ) চেষ্টার মাধ্যমে, এ অবস্থায় যে, সে একজন মু’মিন, তারাই এমন লোক যাদের প্রচেষ্টা হয় (আল্লাহর কাছে) স্বীকৃত/ গৃহীত। (পার্থিব জীবনে) প্রত্যেককেই আমরা সাহায্য করি, এদেরকেও এবং ওদেরকেও, তোমার রবের দান থেকে। আর তোমার রবের দান অবরুদ্ধ হয় না। লক্ষ্য করো, কিরূপে আমরা বিশিষ্টতা দিয়েছি তাদের কাউকে অন্য কারো উপর। আর অবশ্যই (তাদের জন্য) আখিরাত মর্যাদার মাত্রাসমূহে ও অনুগ্রহে আরো বড়।

২:১৩৪ :: ঐ উম্মাত অতীত হয়ে গেছে। যা সে উপার্জন করেছে তা তার জন্য। আর যা তোমরা উপার্জন করেছো তা তোমাদের জন্য। আর তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না তাদের আমলের বিষয়ে।

২:১৪১ :: ঐ উম্মাত অতীত হয়ে গেছে। যা সে উপার্জন করেছে তা তার জন্য। আর যা তোমরা উপার্জন করেছো তা তোমাদের জন্য। আর তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না তাদের আমলের বিষয়ে।

২:২৮৬ :: আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে তার সাধ্যের চেয়ে বেশি দায়িত্বভার অর্পণ করেন না। (ভাল) যা সে উপার্জন করেছে তার ফল তারই জন্য। আর (মন্দ) যা সে উপার্জন করেছে তার পরিণামও তারই উপর। (মু’মিনদের দোয়া হয়-) ‘আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে ধরবেন না যদি আমরা ভুলে যাই অথবা যদি আমরা ত্রুটি করে ফেলি। আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে বহন করতে দেবেন না (এমন) বোঝা, যেমন আপনি বহন করতে দিয়েছেন তাদের উপর যারা ছিলো আমাদের আগে। আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে বহন করতে দেবেন না যার প্রতি আমাদের কষ্টসাধ্য সক্ষমতাটুকুও নেই। আমাদের প্রতি উদারতা দেখান, আর আমাদেরকে মাফ করে দিন, আর আমাদেরকে দয়া করুন। আপনিই আমাদের মাওলা (প্রভু)। আমাদেরকে সাহায্য করুন কাফির কাওমের বিরুদ্ধে।

২:৭৯ :: সুতরাং ধ্বংস তাদের জন্য যারা কিতাব লেখে তাদের (নিজস্ব চিন্তায় সক্রিয়) হাত দ্বারা, তারপর তারা বলে, ‘ইহা (তাদের কিতাব/ হাদিসগ্রন্থ) আল্লাহর নিকট থেকে (এসেছে)’, যেন উহা দ্বারা তুচ্ছ মূল্য ক্রয় করতে পারে। সুতরাং দুর্ভোগ তাদের জন্য তাদের হাত যা লেখেছে তার কারণে আর দুর্ভোগ তাদের জন্য তারা যা উপার্জন করেছে তার কারণে।

৭৪:৩৮ :: প্রত্যেক ব্যক্তি যা (যে পাপ বা পুণ্য) উপার্জন করে, তার জন্য সে দায়বদ্ধ।

৪:১২৩ :: (শেষ পরিণতি) হবে না তোমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আর আহলে কিতাবের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ীও নয়। যে-ই মন্দকাজ করে সে উহার প্রতিফল পাবে। আর সে পাবে না তার জন্য আল্লাহ ছাড়া অভিভাবক আর সাহায্যকারীও পাবে না।

১৬:৯৬-৯৭ :: যা কিছু আছে তোমাদের কাছে তা শেষ হয়ে যাবে আর যা কিছু আছে আল্লাহর কাছে তা স্থায়ী। আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে প্রতিফল দেবো যারা সবর করেছে তাদের পুরস্কার, তারা যা করতো তার অধিক উত্তম আমল অনুযায়ী। যে-ই সৎকর্ম করেছে পুরুষের মধ্য থেকে অথবা নারীর মধ্য থেকে, এ অবস্থায় যে, সে একজন মু’মিন, তাহলে আমরা তাকে হায়াত দেবো, হায়াতান তইয়িবান (সুস্থ, সুন্দর, পবিত্র জীবন)। আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে প্রতিফল দেবো তাদের পুরস্কার তারা যা করতো তার অধিক উত্তম আমল অনুযায়ী।

৩৪:৩৩ :: আর যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিলো তারা বলবে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে যারা অহংকার করতো/ বড় বনে ছিলো, ‘বরং (তোমাদের পক্ষ থেকে) রাত-দিনের কৌশল ছিলো, যখন তোমরা আমাদেরকে আদেশ দিতে যেন আমরা কুফর/ অবিশ্বাস করি আল্লাহর প্রতি আর যেন আমরা সাব্যস্ত করি তাঁর সমকক্ষ’। আর তারা গোপন করবে (তাদের) অনুতাপ (তারা মনে মনে অনুতপ্ত হবে), যখন তারা আযাব দেখবে। আর আমরা ফাঁস/ শিকল লাগিয়ে দেবো তাদের গলায় যারা কুফর/ অবিশ্বাস করেছিলো। প্রতিফল দেয়া হবে কি উহা অনুযায়ী ছাড়া যা তারা কাজ করতো?

৭:১৪৭ :: আর যারা মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে আমাদের আয়াতসমূহকে আর আখিরাতের মোলাকাতকে, ব্যর্থ হয়ে গেছে তাদের আমলসমূহ। তাদেরকে কি প্রতিফল দেয়া হবে তারা যে আমল করেছে তা ছাড়া অন্য কিছুর?

৫২:১৬ :: তোমরা উহাতে পুড়তে থাক। তারপর তোমরা সবর করতে পার বা তোমরা সবর করতে না পার, উহা তোমাদের উপর সমান। প্রকৃতপক্ষে তোমাদেরকে প্রতিফল দেয়া হবে তোমরা যা কিছু আমল করছিলে তা অনুযায়ী।

৩:১৯৫ :: সুতরাং জবাব দিয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে তাদের রব (প্রতিপালক/ বিধানদাতা), ‘আমি নষ্ট করবো না কোনো আমল কোনো আমলকারীর তোমাদের মধ্য থেকে, সে পুরুষের মধ্য থেকে হোক অথবা নারীর মধ্য থেকে হোক। (এ ক্ষেত্রে) তোমাদের একে অন্যের সমস্তরের। সুতরাং যারা হিজরত করেছে আর যাদেরকে বের করে দেয়া হয়েছে তাদের বাড়িঘর থেকে আর যারা নির্যাতিত হয়েছে আমার পথে আর সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে আর নিহত হয়েছে, আমি অবশ্যই মোচন করে দেব তাদের থেকে তাদের অতীতের মন্দসমূহ আর অবশ্যই তাদেরকে প্রবেশ করাবো জান্নাতে যার নিচ অংশে প্রবাহিত হয় নদীসমূহ। প্রতিফল আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর আল্লাহ এমন যে, তাঁরই কাছে আছে উত্তম প্রতিফল।

১২:৯০ :: তারা বলেছে, ‘তুমিই কি নিশ্চয় ইউসুফ?’ সে বলেছে, ‘আমি ইউসুফ। আর এ হচ্ছে আমার ভাই। নিশ্চয় আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন আমাদের উপর। নিশ্চয় যে স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করে ও সবর করে, তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ নষ্ট করেন না উত্তম আচরণকারীদের প্রতিফল’।

৩:১৪৪ :: আর মুহাম্মাদ একজন রসূল মাত্র। নিশ্চয় (মৃত্যুবরণের বা নিহত হওয়ার মাধ্যমে) গত হয়েছে তার আগে রসূলগণ। তবে কি যদি সে মৃত্যুবরণ করে অথবা নিহত হয়, তখন তোমরা তোমাদের গোড়ালীসমূহের উপর ভর দিয়ে অন্যদিকে ফিরে যাবে? আর যে তার গোড়ালীর উপর ভর দিয়ে অন্যদিকে ফিরে যায়, সে আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না, কিছুমাত্রও। আর আল্লাহ কৃতজ্ঞদেরকে শীঘ্রই প্রতিফল দেবেন।

২:৮১-৮২ :: বরং যে-ই উপার্জন করেছে নিকৃষ্ট কর্ম আর তাকে পরিবেষ্টিত করে নিয়েছে তার গুনাহখাতা, তারাই জাহান্নামবাসী হবে। তারা তাতে স্থায়ী হবে। আর যারা ঈমান/ বিশ্বাস করেছে ও সৎকর্ম করেছে তারাই জান্নাতবাসী হবে। তারা তাতে স্থায়ী হবে।

২:২৮১ :: তোমরা ভয় করো সেদিনকে তোমরা ফিরে যাবে যেদিন আল্লাহর দিকে। তারপর পূর্ণভাবে দেয়া হবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে যা সে উপার্জন করেছে (তার কর্মফল) আর তাদেরকে যুলুম করা হবে না।

৩:২৫ :: তখন কেমন হবে যখন আমরা তাদেরকে জমায়েত করবো সেদিন যেদিনের সম্মুখীন হওয়া সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই আর পূর্ণ করে দেয়া হবে সকল ব্যক্তিকে যা সে উপার্জন করেছে তার প্রতিফল? আর তাদেরকে জুলুম করা হবে না।

৩:১৬১ :: আর নবীর দ্বারা হতে পারে না যে, সে সততাহীন কাজ করবে। আর যে সততাহীন কাজ করে, সে হিসাব দিতে হবে সে যে সততাহীন কাজ করেছে তার কারণে কিয়ামাতের দিন। তারপর পূর্ণ করে দেয়া হবে সকল ব্যক্তিকে যা সে উপার্জন করেছে তার প্রতিফল। আর তাদেরকে যুলম করা হবে না।

৪০:১৭ :: (বলা হবে,) “আজ প্রতিফল দেয়া হবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে উহা অনুযায়ী যা (যে পূণ্য বা পাপ) সে উপার্জন করেছে। কোনো যুলুম হবে না আজ। নিশ্চয় আল্লাহ হিসাবকরনে দ্রুততম।”

১৭:৮ :: আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদেরকে রহমত করবেন। আর যদি তোমরা আবার অনুরূপ (ফাসাদ) করো, তাহলে আমরা আবার অনুরূপ (শাস্তিদান) করবো। আর আমরা বানিয়েছি জাহান্নামকে কাফিরদের জন্য অবরোধের স্থান।

২:১৫২ :: তোমরা আমাকে স্মরণ করো আমি তোমাদেরকে স্মরণ করবো। আর তোমরা আমার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। আর তোমরা কুফর (অবিশ্বাস/ অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ) করো না।

৪৭:৭ :: হে ঐসব লোক যারা ঈমান/ বিশ্বাস করেছো, যদি তোমরা আল্লাহকে (তাঁর দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার বিষয়ে) সাহায্য কর, তাহলে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন, আর তিনি দৃঢ় করে দেবেন তোমাদের কদমসমূহকে।

৩:১৮২ :: ইহা (শাস্তি) ঐ কারণে যা আগেই করেছে তোমাদের হাতসমূহ (অর্থাৎ এটা তোমাদের কৃতকর্মের ফল)। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর দাসগণের প্রতি যালিম নন।

আলোচনা : মানুষ তার যা কর্ম করে তার ফলাফলই তার কর্মফল। তাই কর্মফলকে এমন বিষয়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে যা সে আগেই তার জন্য পাঠিয়েছে।

২২:৯-১০ :: সে বাঁকা করে তার ঘাড়কে যেন বিভ্রান্ত করতে পারে আল্লাহর পথ থেকে। তার জন্য আছে দুনিয়াতে লাঞ্চনা আর আমরা তাকে স্বাদ আস্বাদন করাবো কিয়ামাত দিবসে আগুনে দহনের শাস্তি। উহা তোমার নিজ হাতের উপার্জনের কারণে। আর নিশ্চয় আল্লাহ বান্দাদের উপর যালিম নন।

২৮:৪৭ :: আর যদি না এমন হতো যে, তাদের উপর পড়তো কোনো মুসিবত উহার কারণে যা আগেই পাঠিয়েছে তাদের হাতগুলো (তাদের কৃতকর্মের কারণে), তার ফলে তারা বলতো, ‘হে আমাদের রব, কেন আপনি পাঠাননি আমাদের প্রতি কোন রসূলকে যার ফলে আমরা ইত্তেবা/ অনুসরণ করতাম আপনার আয়াতসমূহকে; আর আমরা হতাম বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত (তবে আমাদেরকে এ ব্যবস্থা করতে হতো না)।

৪:৬২ :: তারপর কেমন হবে যখন তারা মুসিবতগ্রস্ত হবে উহার কারণে যা আগেই সম্পাদন করেছে তাদের হাতসমূহ (তাদের কৃতকর্মের কারণে অর্থাৎ তাগুতের আনুগত্য ও তাগুতের কাছে বিচারভার অর্পণের কারণে)? তারপর তারা তোমার কাছে আসবে, তারা কসম করবে আল্লাহর নামে, (বলবে,) ‘আমরা ইচ্ছা করিনি এছাড়া যে তা হবে উত্তম আচরণ আর তাওফীক্ব (সহাবস্থান তৈরি ও দূরত্ব লাঘবের উপাদানের যোগান)।

৩০:৩৬ :: আর যখন আমরা মানুষকে রহমতের স্বাদ আস্বাদন করাই, তখন সে উহা পেয়ে আনন্দিত হয়। আর যদি তাদের কাছে পৌঁছে কোন মন্দ অবস্থা উহার কারণে যা আগেই করেছে তাদের হাতসমূহ (তাদের কৃতকর্মের কারণে), তখন তারা হতাশ হয়ে পড়ে।

৪২:৪৮ :: সুতরাং যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আমরা তোমাকে প্রেরণ করিনি তাদের উপর রক্ষক হিসাবে। তোমার উপর দায়িত্ব নেই পৌঁছে দেয়া/ প্রচার ছাড়া। আর নিশ্চয় আমরা যখন স্বাদ আস্বাদন করাই মানুষকে আমাদের পক্ষ থেকে রহমতের (স্বাদ), তখন সে উহা দ্বারা আনন্দিত হয়। আর যদি তাদের কাছে পৌঁছে কোন মন্দ, যা তাদের হাতগুলো আগেই সম্পন্ন করেছে তার কারণে (তাদের কৃতকর্মের কারণে), তখন নিশ্চয় মানুষ অকৃতজ্ঞ হয়।

৮৯:২৪ :: সে (শাস্তিযোগ্য ব্যক্তি) বলবে, ‘হায়, আমার আফসোস, যদি আমি আগেই কিছু পাঠাতাম/ করতাম এ জীবনের জন্য’।

৫:৮০ :: তুমি দেখেছো তাদের মধ্যকার অনেককে তারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে যারা কুফর করে। খুবই মন্দ যা আগে সম্পাদন করে রেখেছে তাদের জন্য তাদের নফসসমূহ। এজন্য আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়েছেন তাদের উপর। আর আযাবের মধ্যে তারা স্থায়ী হবে।

৭৩:২০ :: … আর যা তোমরা আগে পাঠাবে তোমাদের নিজেদেরই কল্যাণের জন্য উত্তম বিষয় থেকে, তোমরা উহাকে পাবে আল্লাহর কাছে। উহাই উত্তম আর প্রতিফল হিসাবেও মহিমান্বিত। আর তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াশীল।

৫৯:১৮ :: হে ঐসব লোক যারা বিশ্বাস করেছো, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর আর যেন লক্ষ্য করে প্রত্যেক ব্যক্তি যা সে আগে পাঠিয়েছে আগামীকালের জন্য আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আমলের বিষয়ে অবগত।

৮২:৫ :: আর প্রত্যেক ব্যক্তি জানবে যা সে আগে করেছে আর যা সে পিছনে রেখে এসেছে (ক্রিয়া ও তার প্রতিক্রিয়া)।

২:১১০ :: আর তোমরা সালাত কায়েম করো ও যাকাত দাও এবং যে ভালো তোমরা নিজদের জন্য আগে পাঠাবে, তা আল্লাহর নিকট পাবে। তোমরা যা করছো নিশ্চয় আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।

৯৯:৭-৮ :: তারপর যে বিন্দু পরিমাণও ভালো কাজ করবে সে তা দেখবে। আর যে বিন্দু পরিমাণও মন্দ কাজ করবে সে তা দেখবে।

২:২১৫ :: তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে? বল, ‘তোমরা যে সম্পদ ব্যয় করবে, তা পিতা-মাতা, আত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য। আর যে কোনো ভাল কাজ তোমরা করো, নিশ্চয় সে ব্যাপারে আল্লাহ সুপরিজ্ঞাত’ (অর্থাৎ তোমরা তার প্রতিফল পাবে)।

২৭:৮৯ :: যে ব্যক্তি ভালো কাজ নিয়ে আসবে তার জন্য থাকবে তা থেকে উত্তম প্রতিদান এবং সেদিনের ভীতিকর অবস্থা থেকে তারা নিরাপদ থাকবে।

২৮:৮০ :: আর যারা জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছিল, তারা বলল, ‘তোমাদের জন্য আফসোস! আল্লাহর প্রতিদানই উত্তম যে ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তার জন্য। আর তা শুধু সবরকারীরাই পেতে পারে।’

৭৩:২০ :: নিশ্চয় তোমার রব জানেন যে, তুমি রাতের দুই তৃতীয়াংশের কিছু কম, অথবা অর্ধরাত অথবা রাতের এক তৃতীয়াংশ দাঁড়িয়ে থাক এবং তোমার সাথে যারা আছে তাদের মধ্য থেকে একটি দলও। আর আল্লাহ রাত ও দিন নিরূপণ করেন। তিনি জানেন যে, তোমরা তা করতে সক্ষম হবে না। তাই তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করলেন। অতএব তোমরা কুরআন থেকে যতটুকু সহজ ততটুকু পড়। তিনি জানেন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে পৃথিবীতে ভ্রমণ করবে, আর কেউ কেউ আল্লাহর পথে লড়াই করবে। অতএব তোমরা কুরআন থেকে যতটুকু সহজ ততটুকু পড়। আর সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। আর তোমরা নিজদের জন্য মঙ্গলজনক যা কিছু অগ্রে পাঠাবে তোমরা তা আল্লাহর কাছে পাবে প্রতিদান হিসেবে উৎকৃষ্টতর ও মহত্তর রূপে। আর তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

জান্নাত ও জাহান্নাম মানুষের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ

৭:৪৩ :: আর তাদের অন্তরে যে ঈর্ষা ছিল, আমি তা বের করে নিয়েছি। তাদের নীচ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে। আর তারা বলবে, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি এর জন্য আমাদেরকে হিদায়াত দিয়েছেন। আর আমরা হিদায়াত পাওয়ার ছিলাম না, যদি না আল্লাহ আমাদেরকে হিদায়াত দিতেন। অবশ্যই আমার রবের রাসূলগণ সত্য নিয়ে এসেছেন’ এবং তাদেরকে ডাকা হবে যে, ‘ঐ হল জান্নাত, তোমরা যা আমল করেছ, তার বিনিময়ে তোমাদেরকে এর ওয়ারিস করা হয়েছে’।

৪৩:৭২ :: আর ইহাই সে জান্নাত তোমাদেরকে যার উত্তরাধিকারী করা হয়েছে, তোমরা যে কাজ করছিলে তার কারণে।

১৬:৩২ :: ফেরেশতারা যাদের মৃত্যু ঘটায় উত্তম অবস্থায়, তারা বলে, ‘তোমাদের উপর সালাম। জান্নাতে প্রবেশ কর, যে আমল তোমরা করতে তার কারণে।

৫৬:২৪ :: (জান্নাতের এসব নেয়ামত তো) তারা যে আমল করত তার কারণে দেয়া প্রতিফল।

১০:৫২ :: তারপর যারা যুলম করেছে তাদের বলা হবে, স্থায়ী আযাব আস্বাদন কর। তোমরা যা অর্জন করতে তোমাদেরকে কেবল তারই প্রতিদান দেয়া হচ্ছে।

৩২:১৪ :: কাজেই তোমরা তোমাদের এই দিনের সাক্ষাতকে যে ভুলে গিয়েছিলে, তার স্বাদ তোমরা আস্বাদন কর। নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে ভুলে গিয়েছি, আর তোমরা যা করতে, তার জন্য তোমরা স্থায়ী আযাব ভোগ কর।
জাহান্নামের জন্য (জাহান্নামের উপযোগী করে) ছড়িয়ে দেয়া

৭:১৭৯ :: আর অবশ্যই আমি জাহান্নামের জন্য (জাহান্নামের উপযোগী করে) ছড়িয়ে দিয়েছি বহু জিন ও মানুষকে। তাদের রয়েছে অন্তর, তা দ্বারা তারা বুঝে না; তাদের রয়েছে চোখ, তা দ্বারা তারা দেখে না এবং তাদের রয়েছে কান, তা দ্বারা তারা শুনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তারা অধিক পথভ্রষ্ট। তারাই হচ্ছে গাফেল।

আলোচনা : উপরের আয়াতটিকে অনেকে ভাগ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেন যে, আল্লাহ অনেক জিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য তৈরি করেছেন। সুতরাং আল্লাহ যাকে জাহান্নামের জন্য তৈরি করেছেন তার পক্ষে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্য কথায়, জান্নাত-জাহান্নাম ব্যক্তির আমলের উপর নির্ভর করে না, বরং আল্লাহ যাকে জান্নাতের জন্য তৈরি করেছেন সে জান্নাতে যাবে আর তিনি যাকে জাহান্নামের জন্য তৈরি করেছেন সে জাহান্নামে যাবে।

অথচ আয়াতটিতে ব্যবহৃত ‘লিজাহান্নামা’ (জাহান্নামের জন্য) কথাটির অর্থ তা নয়, যা ধরে নেয়া হয়েছে। বরং ‘জাহান্নামের জন্য’ বলতে বুঝায় ‘জাহান্নামের উপযোগী করে’। আর ‘যারা’না’ কথাটির অর্থ হচ্ছে ‘আমি ছড়িয়ে দিয়েছি’। ‘জাহান্নামের উপযোগী করে ছড়িয়ে দিয়েছি’ কথাটির প্রকৃত তাৎপর্য হলো, ‘তাদেরকে জাহান্নামের উপযোগী কর্ম সম্পাদনের জন্য ছড়িয়ে দিয়েছি- অববকাশের মাধ্যমে। তাদেরকে জাহান্নামের উপযোগী কর্মের সাথে সাথেই পাকড়াও করা হয় না, বরং অবকাশ দেয়া হয়, ফলে তারা পৃথিবীতে এমন কর্মকাণ্ডসহ ছড়িয়ে রয়েছে যে কর্মকাণ্ড তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে। আয়াতটির শেষদিকে যা বলা হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট যে, তারা জাহান্নামের উপযোগী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকার কারণ হলো, তারা তাদের চোখ-কান-অন্তরকে সঠিক কাজে লাগায় না। সুতরাং আয়াতটি কোনোভাবেই প্রাক-নিয়তিকে সমর্থন করে না, বরং কর্ম অনুযায়ী কর্মফল নীতিকেই সমর্থন করে।

বিশেষ করে যারা জাহান্নামে যাবে তারা জাহান্নামে যাবার কারণ এ নয় যে, তাদেরকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। বরং তারা তাদের বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করে নবী-রসূলদের কথা শুনে নি বিধায় তারা জাহান্নামে যাবে। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতটি লক্ষ্যণীয়:

৬৭:১০ :: আর তারা বলবে, ‘যদি আমরা (রসূলদের কথা) শুনতাম বা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করতাম তাহলে আমরা দোযখবাসী হতাম না।’

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মানুষকে তাদের ভালো-মন্দ কর্মের প্রতিফল হিসেবে জান্নাতের পুরস্কার বা জাহান্নামের শাস্তি দেয়া হবে। যদি সবকিছুর ভাগ্য নির্ধারিত থাকে, তাহলে মানুষকে তার কাজের পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া কি যৌক্তিক হতো? সুতরাং ভালো-মন্দ আমলের প্রতিফল দেয়ার ঘোষণা ভাগ্যবাদকে বাতিল সাব্যস্ত করে।

[উল্লেখ্য, মানুষ নিজেই হিদায়াত বা পথভ্রষ্টতা অবলম্বন করে। এ বিষয়টি ‘হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতার নীতিমালা’ শিরোনামে আলাদা অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে]

৪. মানুষ যা চায় তা-ই কি পায়?

৫৩:২৪-২৬ :: মানুষ যা চায় তা-ই কি পায়? আল্লাহরই আয়ত্তে রয়েছে পরকাল ও ইহকাল। আর আকাশমন্ডলীতে কত ফেরেশতা আছে তাদের সুপারিশ কারো জন্য কিছুমাত্রও ফলপ্রসূ হবে না, এরপরে ছাড়া যে, আল্লাহ অনুমতি দেবেন যার জন্য তিনি ইচ্ছা করবেন এবং (যার সুপারিশকে) তিনি পছন্দ করবেন।

আলোচনা : উল্লেখিত আয়াতের তাৎপর্য হলো, মানুষ যা-ই পেতে চায় তা-ই পায় না, বরং সে কিছু পাবে কি পাবে না তা আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন, নৈতিক নীতিমালা এবং তাঁর বিজ্ঞতাপূর্ণ ব্যবস্থাপনা ও অনুগ্রহমূলক সিদ্ধান্ত অনুসারে নির্ধারিত হয়। যেমন, মানুষ চাইতে পারে যে, তার জন্য কেউ শাফায়াত করুক এবং তা ফলপ্রসূ হোক, কিন্তু বাস্তবে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া (অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর তৈরি নীতিমালা অনুযায়ী অনুমতি প্রদান ও তা গ্রহণ করা ছাড়া) তাদের এ ইচ্ছা পূর্ণ হবে না। এ বিষয়টির স্বত:সিদ্ধ প্রমাণ হিসেবে প্রশ্ন করা হয়েছে যে, ‘মানুষ যা-ই চায় তা-ই কি পায়?’

মানুষ যা চায় তার অনেক কিছু সে পায় না। মানুষের প্রার্থনা ও প্রচেষ্টার ফল শতভাগ তার আশানুরূপ হয় না। আর পেছনে রয়েছে যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থাপনা। যেমন, অনেকেই চাইতে পারে যে, আমি যদি অত্যন্ত ধনী হতে পারতাম! বা রাজা হতে পারতাম! কিন্তু বাস্তবে সবাইকে ধনী করে দিলে বা সবাই রাজা হলে পৃথিবীতে পরস্পরের মধ্যে সেবার বিনিময় ব্যবস্থা তৈরি হতো না, বরং পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো। বস্তুত পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে থাকা বৈচিত্র্য ও অসমতা সৌন্দর্য ও পরীক্ষার উপকরণস্বরূপ।

২১:২২ :: আকাশ ও জমিনে এক আল্লাহ ছাড়া যদি অপর কোনো ইলাহ থাকতো, তাহলে তাতে বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো। অতএব, তারা যা বলে তা হলে আল্লাহ পবিত্র মহান।

উপরোল্লেখিত আয়াতটিতে একাধিক ইলাহ থাকলে মহাকাশ ও পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে পড়তো বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে পৃথিবীতে মানব জাতির মধ্যেও একই ভূখন্ডের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী একাধিক ব্যক্তি থাকতে পারে না। কারণ সেক্ষেত্রে বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলার বিকল্প নেই।

মানুষ যা চায়, তা-ই পায় না অর্থাৎ তার অনেক কিছু পায় এবং অনেক কিছু পায় না। মানুষ যা চায় তার সবই যদি পেয়ে যায় তাহলে সে তার প্রকৃত মূল্য দিতে পারে না। কারণ রাত ছাড়া যেমন দিনের মূল্য বুঝা যায় না, তেমনি অপ্রাপ্তি ছাড়া প্রাপ্তির মূল্য বুঝা যায় না। আর তা-ই মানুষ যা চায়, তার সবই পায় না, বরং তাকে তার অনেক কিছুর অপূর্ণতাকে মেনে নিতে হয়। যেমন-

(১) সন্তানের অপূর্ণতা

৪২:৪৯-৫০ :: আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে দেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই। আর যাকে ইচ্ছে বন্ধ্যা করেন। তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বাধিক অবহিত ও ক্ষমতাবান।

আল্লাহর কাছে সন্তানের প্রার্থনা করা যেতে পারে। কিন্তু তিনি যদি সন্তান না দেন, তাহলে তাতেও মনোক্ষুন্ন হওয়া উচিত নয়। কত সন্তান তো এমনো হয় যে, কোনো স্বার্থের মোহে অন্ধ হয়ে পিতাকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হয় না। তাহলে সন্তান তো অপকারীও হতে পারে।

(২) ধনসম্পদের অপূর্ণতা
প্রত্যেকেই ধনী হতে চায়, কিন্তু আল্লাহ প্রত্যেককে প্রচুর পরিমাণ দেন না। বস্তুত প্রত্যেককে প্রচুর পরিমাণ দিলে তা মানব সমাজের জন্য কল্যাণকর হতো না। যারা শুধু টাকার পেছনে ঘুরে অর্থাৎ টাকার নেশা যাদেরকে পেয়ে বসেছে সে স্ত্রী-সন্তান ও মানুষের ভালোবাসার যথার্থ কদর করতে পারে না। সে জীবনের পরতে পরতে শুধু লাভ-ক্ষতির হিসাব করে এবং তার জীবনটা যেন একটা যান্ত্রিক জীবনে পরিণত হয়।

(৩) দৈহিক সৌন্দর্যের অপূর্ণতা

৮২:৭-৮ :: তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাকে সুঠাম করেছেন। তারপর সুবিন্যস্ত করেছেন। তিনি যে আকৃতিতে ইচ্ছা তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।

আল্লাহ ইচ্ছা করলে মানুষকে গাধা, ঘোড়া, শূকর, কুকুর কিংবা যেকোনো ইতর প্রাণীর আকৃতি দিয়েও সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি মানুষকে সেগুলোর ভিন্ন তথা মানবীয় আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন, যা ‘আহছানা তাক্বউয়ীম’ বা ‘সুন্দরতম সৃষ্টি-কাঠামো’। আর মানুষের মধ্যে যাকে যে বর্ণ ও আকৃতিতে ইচ্ছা করেছেন তাকে সেরূপ সৃষ্টি করেছেন। যেমন- কেউ ফর্সা, কেউ কালো, কেউ বেঁটে, কেউ লম্বা।

বস্তুত চেহারা ও আকৃতিগত পার্থক্য মানুষের ব্যক্তিগত সাধারণ পরিচয়ের একটি স্বাতন্ত্র্য তৈরি করে, কিন্তু তার প্রকৃত মূল্য-মর্যাদা তার আকৃতিতে নয়, বরং তার চারিত্রিক গুণাবলীর উপর নির্ভর করে। সুতরাং মানুষের মধ্যে দৈহিক সৌন্দর্যের অপূর্ণতা অনুভূত হতে পারে। কিন্তু সে বুঝা উচিত যে, দৈহিক সৌন্দর্যের তারতম্য অনুসারে অহংকা বা হীনমন্যতা বোধ করার কিছু নেই।

(৪) স্বাস্থ্য বা সুস্থতার অপূর্ণতা

স্বাস্থ্য বা সুস্থতাকে সকল সুখের মূল বলা হয়। শরীর সুস্থ থাকা আল্লাহর একটি বড় নেয়ামত। তাই আমাদের উচিত আল্লাহর দেয়া নেয়ামত স্বাস্থ্য-সচেতনতা অবলম্বন করা, সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মনীতি মেনে চলা এবং অসুস্থ হলে চিকিৎসা গ্রহণ করা। আর সুস্থতার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা।

তবে অনেকে দীর্ঘদিন কোনো অসুস্থতায় ভুগতে পারেন। তাঁরা সুস্থ হতে চান, কিন্তু যথাযোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার না হওয়ায় তাঁদের পরিপূর্ণ সুস্থতার চাওয়া অপূর্ণ থাকা অসম্ভব নয়।

(৫) পেশাগত অপূর্ণতা

পেশাগত জীবনে সবাই সেরা পেশাটাই বেছে নিতে চায়। কিন্তু সবাই যদি একইরূপ পেশা বেছে নেয় ও পেয়ে যায়, তাহলে অন্যান্য পেশার কাজ কীভাবে হবে? বস্তুত বাস্তবসঙ্গত কারণেই মানুষের পেশাগত চাওয়ার ক্ষেত্রে অপূর্ণতা থেকে যাওয়া একটি স্বাভাবিক ও কল্যাণকর বিষয়।

(৬) ভ্রমণ ইচ্ছার অপূর্ণতা

ভ্রমণ হতে পারে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে, যেমন : ইসলাম প্রচারের জন্য, শিক্ষাভ্রমণ, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ভ্রমণ, নিতান্ত সৌন্দর্য উপভোগ ও বিনোদনের জন্য ভ্রমণ ইত্যাদি। অনেকের অনেক ভ্রমণ ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়, তা সাধ্যের অভাবে হোক বা কর্মব্যস্ততার কারণেই হোক।

(৭) বড় ব্যবসায়ী হওয়ার ইচ্ছার অপূর্ণতা

একজন ব্যবসায়ী ভাবতে পারে যে, আমি যদি অমুকের মতো বড় ব্যবসায়ী হতে পারতাম। আবার অমুক বড় ব্যবসায়ীও তার চেয়ে বড় কোনো ব্যবসায়ীর মতো হতে চায়। যেহেতু বড় ব্যবসায়ী হওয়ার বিষয়টি কোনো স্থির বিষয় নয়, তাই এরূপ ইচ্ছার অপূর্ণতা একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়।

(৮) জ্ঞানে বড় হওয়ার ইচ্ছার অপূর্ণতা

কেউ কোনো বিশেষ ক্ষেত্রের কোনো জ্ঞানীকে দেখে ভাবে, আমি যদি তার মতো জ্ঞানী হতে পারতাম। আবার কেউ কোনো ক্ষেত্রে তার জ্ঞানের অবদান রাখতে পেরে জ্ঞানের অহংকারী হয়ে যায়। বস্তুত সবাই যদি বড় ও সমান জ্ঞানী হতো তাহলে মানুষের মধ্যে জ্ঞানের বৈচিত্র্য থাকতো না এবং কেউ কারো দ্বারস্থ হতো না, কেউ কাউকে মূল্যায়ন করতো না।

৫. মানুষ তা-ই পাবে যা পেতে সে চেষ্টা করে

৫৩:৩৯-৪১ :: মানুষের জন্য কিছুই নেই যা সে চেষ্টা করে তা (তার ধরন অনুসারে) ছাড়া। আর তার চেষ্টা শীঘ্রই দেখা হবে। তারপর তাকে তার পূর্ণ প্রতিফল দেয়া হবে।

আলোচনা : উল্লেখিত আয়াতের তাৎপর্য হলো, আল্লাহর তৈরি ন্যায়বিচারের নীতিমালা এ-ই যে, মানুষ যে ধরনের চেষ্টা করে, সে সেই ধরনের চেষ্টার ফলাফলস্বরূপ যা পাওয়ার তা-ই পাবে। যেমন সে যদি ভালো কাজ করে তাহলে সে পুরস্কার পাবে, আর যদি সে মন্দ কাজ করে তাহলে সে শাস্তি পাবে। আর তাই তার কর্মপ্রচেষ্টা কী ধরনের ছিলো, তা কি ভালো কাজ ছিলো, নাকি মন্দ কাজ ছিলো, সেটা শীঘ্রই মূল্যায়ন করা হবে এবং সেই অনুযায়ী তাকে পূর্ণ প্রতিফল তথা যথাযথ পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া হবে।

উল্লেখিত প্রথম আয়াতের প্রচলিত একটি অর্থ হলো ‘মানুষ শুধু তা-ই পায় যা পেতে সে চেষ্টা করে’। তাই এ বিষয়টিকে অনেকে এভাবে বুঝার চেষ্টা করেছেন যে, যে বিষয়ে কোনো ব্যক্তি নিজে চেষ্টা করে না সে তা পায় না বা তা পাওয়া (গ্রহণ করা) তার জন্য সঙ্গত নয়। কিন্তু এ উপলব্ধিটি সঠিক নয়। কারণ বাস্তবে মানুষ এমন অনেক কিছু পায় যা পাওয়ার জন্য সে নিজে সরাসরি কোনো চেষ্টা করে না। দান-অনুদান, উত্তরাধিকারের বিধান ইত্যাদি প্রমাণ করে যে, যে বিষয়ে নিজের চেষ্টা জড়িত নয়, আল্লাহর বিধান অনুসারে সে তা পেতে পারে বা গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং এ আয়াতে পৃথিবীতে মানুষের কোনো কিছু পাওয়া না পাওয়ার বিষয় বলা হয় নি, বরং এতে মানুষের জন্য চূড়ান্ত প্রাপ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, যা তার সমগ্র জীবনের কর্মপ্রচেষ্টার বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাকে প্রদান করা হবে। আর এজন্য বলা হয়েছে যে, “শীঘ্রই তার কর্মপ্রচেষ্টা দেখা হবে এবং তারপর তাকে তার পূর্ণ প্রতিফল প্রদান করা হবে।”

পার্থিব জীবনে কোনো কাঙ্ক্ষিত ফল বা লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য মানুষকে চেষ্টা করতে হয়, তারপর সে তা পায় অথবা পায় না। কারণ এই পাওয়া না পাওয়া আরো কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তবে কোনোকিছু পাওয়ার অধিকার ও স্বাভাবিক সম্ভাবনা তখনই তৈরি হয়, যখন সেজন্য যথোপযুক্ত চেষ্টা করা হয়।

৬. ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত কাজের পার্থক্য

পুরষ্কার ও শাস্তির পুরো ব্যবস্থাটি মানুষের তার কাজের জন্য দায়ী হওয়ার উপর নির্ভর করে। আর দায়ী হওয়ার বিষয়টি পছন্দের স্বাধীনতার উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ তাকে শুধুমাত্র তার স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমে কৃত কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।

১৬:৭৫ :: আল্লাহ পেশ করছেন একজন দাসের দৃষ্টান্ত, সে অন্যের মালিকানাধীন, সে ক্ষমতা রাখে না কোন কিছুর উপর; আর এমন এক ব্যক্তির (দৃষ্টান্ত) যাকে আমরা রিযিক দিয়েছি আমাদের পক্ষ থেকে, উত্তম রিযিক, তারপর সে ব্যয় করে তা থেকে গোপনে আর প্রকাশ্যে। এ দুজন কি সমান হতে পারে? সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। বরং তাদের অধিকাংশই জ্ঞান রাখে না।

১৬:১০৬ :: যে কুফর / অস্বীকার করে আল্লাহকে তার ঈমানের / বিশ্বাসের পরও, সে ছাড়া যাকে বাধ্য করা হয়েছে অথচ তার কলব ঈমানে সুদৃঢ় (তবু প্রচন্ড নির্যাতনে বাধ্য হয়ে সাময়িকভাবে বাহ্যত কুফরী বাক্য উচ্চারণ বা কুফরী কার্য করেছে); কিন্তু (এদের কথা নয় বরং) যে উন্মুক্ত করে কুফরের জন্য তার মন-মস্তিষ্ককে, তাদের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে গযব পড়বে, আর তাদের জন্য আছে মহাশাস্তি।

৩৩:৫ :: তাদেরকে ডাকো তাদের (জন্মদাতা) পিতার (পুত্র) পরিচয়ে (‘অমুকের পুত্র’ হিসাবে)। তা-ই অধিক ন্যায়সঙ্গত, আল্লাহর কাছে (আল্লাহর বিধান অনুযায়ী)। যদি তোমরা তাদের পিতার পরিচয় না জানো, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই আর তোমাদের বন্ধু। আর তোমাদের উপর গুনাহ নেই তোমরা যে ভুল করে ফেলো (যখন তোমরা ভুল করে স্ত্রীর পিঠকে মায়ের পিঠের মতো বলে ফেলো বা পালক পুত্রের পিতা হিসাবে তার পালক পিতার নাম বলে ফেলো), কিন্তু তোমাদের কলবসমূহ যা ইচ্ছাকৃতভাবে করে (সেটার জন্য তোমাদের গুনাহ হবে)। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াশীল।

২:২২৫ :: আল্লাহ তোমাদেরকে ধরবেন না তোমাদের অনর্থক শপথের জন্য। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে ধরবেন তোমাদের কলবসমূহ যা উপার্জন করেছে তার জন্য (তোমাদের ইচ্ছাকৃত ও গুরুত্ববহ শপথের জন্য)। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহনশীল।

একই নীতি সাধারণ বিচারিক আইনের অধীনে রয়েছে যা ইচ্ছাকৃত (ঠান্ডা রক্তযুক্ত) এবং অনিচ্ছাকৃত (উষ্ণ রক্তযুক্ত বা দুর্ঘটনাজনিত) হত্যার মধ্যে পার্থক্য করে, তাদের জন্য বিভিন্ন শাস্তির প্রস্তাব করে (৪:৯২-৯৩)।

৪:৯২-৯৩ :: আর মু’মিনদের দ্বারা সম্ভব নয় যে, সে হত্যা করবে কোন মু’মিনকে ভুলবশত: হত্যা করা ছাড়া। আর (০১) যে হত্যা করেছে কোন মু’মিনকে ভুলবশত: তাহলে তার করণীয় হচ্ছে একজন মু’মিন দাসকে/ দাসীকে মুক্ত করা। আর (সেইসাথে) দিয়াত/ রক্তপণ সমর্পণ করতে হবে মৃত ব্যক্তির পরিবারের নিকট (তথা যারা মৃতব্যক্তির উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল ছিলো তাদের নিকট)। কিন্তু মৃতব্যক্তির পরিবারের পক্ষ থেকে রক্তপণকে সদকা করে দেয়া হলে (মাফ করে দেয়া হলে) তা ভিন্ন ব্যাপার। (০২) তবে যদি নিহত ব্যক্তি তোমাদের শত্রু ক্বাওমের অন্তর্ভুক্ত হয় আর সে (নিহত ব্যক্তি) মু’মিন হয়, তাহলে তার করণীয় হচ্ছে একজন মু’মিন দাসকে/ দাসীকে মুক্ত করা। আর (০৩) যদি নিহত মু’মিনটি হয় এমন কাওমের অন্তর্ভুক্ত তোমাদের ও যাদের মধ্যে সন্ধিচুক্তি আছে, তাহলে দিয়াত/ রক্তপণ সমর্পণ করতে হবে মৃত ব্যক্তির পরিবারের নিকট (তথা যারা মৃতব্যক্তির উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল ছিলো তাদের নিকট)। আর তার করণীয় হচ্ছে একজন মু’মিন দাসকে/ দাসীকে মুক্ত করা। তবে যে (দাস/ দাসী বা দাসী/ দাসীকে মুক্ত করার সামর্থ্য) পাবে না সে সিয়াম করবে (রোযা রখবে) দুই মাস ক্রমাগত। ইহা (তার ক্ষেত্রে) আল্লাহ প্রদত্ত তাওবাহ করার পদ্ধতি। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ। আর যে হত্যা করে কোন মু’মিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে, তার প্রতিফল হবে জাহান্নাম। সে তাতে স্থায়ী হবে। আর আল্লাহ গদব দিয়েছেন তার উপর আর তিনি লা’নত করেছেন তাকে আর তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন তার জন্য মহাশাস্তি।

৭. নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম) কর্তৃক তাঁদের পাপ স্বীকার

৭:২৩ :: তারা উভয়ে (আদম ও তার স্ত্রী) বললো, “হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজেদের প্রতি যুলম করেছি”।
২৮:১৬ :: সে (মূসা) বললো, “হে আমার পালনকর্তা! আমি তো নিজের উপর যুলম করে ফেলেছি। অতএব, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন”।

আলোচনা : এসব আয়াত থেকে জানা যায় যে, নবীগণ তাদের নিজেদের উপর জুলুম করার বিষয় স্বীকার করেছেন। সুতরাং বান্দারা নিজেরাই পাপ-পুণ্য আমল করে থাকে।

৮. আদম ও ইবলিসের ঘটনায় কর্মের দায়বদ্ধতা স্বীকার-অস্বীকার

আদম ও ইবলিস শয়তান উভয়কেই একটি করে আদেশ দেওয়া হয়েছিল। উভয়েই আদেশ অমান্য করেছিলো। তারপর আদমের মধ্যে অনুশোচনা হলো এবং তিনি ও তাঁর স্ত্রী বললেন যে, আমরা নিজেরাই নিজেদের উপর জুলুম করেছি এবং ক্ষমাপ্রার্থী। অর্থাৎ, আদম, অনুশোচনা করে এবং অবাধ্যতার স্বীকার করে, কর্মের দায় স্বীকার করে। এটি তাকে মুক্তির সুযোগ দিয়েছে। তাকে উদ্বিগ্ন না হতে বলা হয়েছিল।

৭:২৩ :: তারা দুজনে বলেছে, ‘হে আমাদের রব, আমরা যুলুম করেছি আমাদের নিজেদের উপর। আর যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন আর আমাদেরকে দয়া না করেন, তাহলে আমরা হয়ে যাবো ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত’।
২:৩৮ :: আমরা বলেছি, “চলে যাও তা থেকে তোমরা সবাই। তারপর যখন তোমাদের কাছে আসবে আমার পক্ষ থেকে পথনির্দেশ, তখন যারা অনুসরণ করবে আমার পথনির্দেশ, তাহলে তাদের কোনো ভয় নেই আর না তারা দু:খিত হবে।

বিপরীতে, ইবলিস তার নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় কৃতকর্মের জন্য আল্লাহকে দায়ী করে প্রতিক্রিয়া জানায়। যেহেতু সে নিজে দায়ী হওয়ার মতাদর্শ গ্রহণ করে নি, তাই ইবলিসের সংস্কারের কোনো সম্ভাবনা ছিলো না এবং তাকে তিরস্কার করা হয়েছিলো। সে চিরন্তন নিরাশাগ্রস্ত হয়ে থাকলো। (ইবলিস এর আক্ষরিক অর্থ নিরাশাগ্রস্ত)। যে নিজেকে আবদ্ধ মনে করে সে তার উন্নতি করতে পারে না এবং চিরকাল নিরাশ থাকে।

৭:১৬ :: সে (ইবলিস) বলেছে, “যেহেতু আপনি আমাকে পথচ্যুত করেছেন, সেহেতু আমি বসে থাকবো তাদের জন্য (তাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য) আপনার সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথে’।

১৫:৩৯ :: সে বলেছে, “হে আমার রব, যাদের কারণে আপনি আমাকে বিপথগামী করেছেন অবশ্যই আমি চাকচিক্যের সৃষ্টি করবো তাদের জন্য পৃথিবীতে, আর আমি তাদের সকলকেই বিপথগামী করবো”।

৭:১৮ :: তিনি (আল্লাহ) বলেছেন, “বেরিয়ে যাও তা থেকে (জান্নাত থেকে) ধিকৃতরূপে/ লাঞ্চিতরূপে ও বিতাড়িতরূপে। নিশ্চয় যে তোমার অনুসরণ করবে তাদের মধ্য থেকে, নিশ্চয় আমি পুর্ণ করবো জাহান্নামকে তোমাদের মধ্যকার সকলকে দিয়ে”।

৯. মানুষের মন্দ কাজের জন্য ইবলিস বা শয়তানকে দায়ী করা

মানুষের মন্দ কাজের জন্য একদিকে মানুষের প্রবৃত্তির অনুসরণকে দায়ী করা হয় এবং অন্যদিকে শয়তানের অনুসরণকে দায়ী করা হয়। সুতরাং এ দুয়ের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে।

৫০:১৬ :: আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি, আর তার নফস (নিজ সত্তা বা স্বীয় মন) তাকে যা কুমন্ত্রণা দেয় তাও আমি জানি। আমি তার গলার শিরা থেকেও নিকটবর্তী।

৪৫:২৩ :: তবে তুমি কি তাকে লক্ষ্য করেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে আপন দেবতা (ইলাহ, আদৌ যার বিরোধিতা করা যাবে না এমন সত্তা) বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জেনে-বুঝে তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন এবং তিনি তার কান ও অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন। আর তার চোখের উপর স্থাপন করেছেন আবরণ। অতএব আল্লাহর পর কে তাকে হিদায়াত করবে? তবে কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?

২৮:৫০ :: অতঃপর যদি তারা তোমার প্রতি সাড়া না দেয়, তাহলে জেনে রাখ, তারা তো নিজদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আর আল্লাহর পথনির্দেশ ছাড়া যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়াত করেন না।

শয়তানকে দায়ী করা সম্পর্কিত কিছু আয়াত

৩:১৫৫ :: নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্য থেকে যারা পিছু হটে গিয়েছিল সেদিন, যেদিন দু’দল মুখোমুখি হয়েছিল, শয়তানই তাদের কিছু কৃতকর্মের ফলে তাদেরকে পদস্খলিত করেছিল। আর অবশ্যই আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করেছেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, সহনশীল।

৩৬:৬০-৬২ :: হে বনী আদম, আমি কি তোমাদেরকে এ মর্মে নির্দেশ দেইনি যে, ‘তোমরা শয়তানের দাসত্ব করো না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’? আর আমারই দাসত্ব করো, এটিই সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথ (সিরাতুল মুসতাক্বীম)। অথচ (তা সত্ত্বেও) নিশ্চয় শয়তান তোমাদের বহু দলকে পথভ্রষ্ট করেছে। তবে কি তোমরা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করো নি?

৪:৬০ :: তুমি কি তাদেরকে দেখো নি যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তারা তাতে বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্যই তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে? এবং শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।

কুরআন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক গঠন এবং মানুষ হিসেবে সফলতা-ব্যর্থতার কারণ হিসেবে বলে যে, মানুষকে ভালো-মন্দ উভয় ধরনের প্রবণতা, বোধি ও বৈকল্পিক ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এবং যদি সে ভালো প্রবণতাকে বিকশিত করে বা নিজেকে পরিশুদ্ধ করে তাহলে সে সফলতা লাভ করে। এবং যদি সে ভালো প্রবণতাকে অবদমিত করে বা মন্দ প্রবণতার অনুসরণের মাধ্যমে নিজেকে কলুষিত করে, তাহলে সে ব্যর্থ হয়।

৯১:৭-১০ :: শপথ মানবসত্তার এবং যিনি তাকে সগঠিত করেছেন। তারপর তার মধ্যে পাপ-পুণ্যের প্রবণতা, বোধ ও বাছাই ক্ষমতা অন্তর্নিহিত করে দিয়েছেন। সুতরাং সেই সফল হলো যে তাকে পরিশুদ্ধ করলো। এবং সেই ব্যর্থ হলো যে তাকে কলুষিত করলো।

বস্তুত মানুষের মধ্যে রয়েছে একদিকে সহজাত প্রবৃত্তিগত আবেগ ও বুদ্ধি, এবং অন্যদিকে বিবেক বা ন্যায়-অন্যায় বোধ। স্থায়ী মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত না হলে মানুষ নিছক পশুর স্তরে অবস্থান করে। এমতাবস্থায় সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং তার বুদ্ধি তার প্রবৃত্তির অধীনে কাজ করে। আর যদি সে স্থায়ী মূল্যবোধের অনুসরণ করে সেক্ষেত্রে তার বুদ্ধি তার বিবেকের অধীনে কাজ করে।

যখন নিছক আবেগ বা প্রবৃত্তির অনুসরণ করা হয়, তখন তা মানব ব্যক্তিত্ব ও সমাজের জন্য বিপর্যয়কর হয়। অন্যদিকে আবেগ জীবনের সজীবতা ও বৈচিত্র্যের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান। অর্থাৎ যখন আবেগ স্থায়ী মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তখন তা হয় গঠনমূলক। তাই প্রবৃত্তির অনুসরণ না করার অর্থ প্রবৃত্তিকে অবদমন করা বা আবেগহীন হওয়ার বৃথা চেষ্টা করা নয়। বরং এর অর্থ হলো আবেগের যৌক্তিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা।

মানুষকে যেই উচ্চতর স্তরে সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে স্থায়ী মূল্যবোধের অনুসরণই তার জন্য স্রষ্টার নির্দেশ। কিন্তু যখন সে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তখন সে তার ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে এবং স্রষ্টার নির্দেশের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে যায়। এ অবস্থায় সে শয়তান হিসেবে আখ্যায়িত হয়। একজন প্রবৃত্তির অনুসারী ব্যক্তি অন্যদের উপর আগ্রাসন ও বাড়াবাড়িমূলক আচরণ করে থাকে। কিন্তু এক পর্যায়ে সে বিভিন্নভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ইবলিস শব্দটির শাব্দিক অর্থ হতাশাবাদী। সুতরাং এরূপ ব্যক্তিরা ইবলিসের প্রতিনিধিত্ব করে। এছাড়া, শয়তান নিয়ে একটি উপলব্ধি হচ্ছে, মানুষের প্রবৃত্তিকেই রূপকভাবে ‘শয়তান’ আখ্যায়িত করা হয়েছে।

ইবলিসের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে নিজের কর্মের দায় স্বীকার করে নি। অথচ সে তার নিজ কর্মের জন্য দায়ী ছিল। আর তাই সে অভিশপ্ত হয়েছিলো। মানুষও নিজ কর্মের জন্য দায়ী। ইবলিস মানুষকে মন্দ কাজে বাধ্য করতে পারে না। তাই ইবলিস মানুষকে মন্দ কাজে প্ররোচিত করার জন্য দায়ী, কিন্তু মানুষের মন্দ কাজ সম্পাদনের জন্য মানুষ নিজেই দায়ী।

১৪:২২ :: আর যখন যাবতীয় বিষয়ের ফয়সালা হয়ে যাবে, তখন শয়তান বলবে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে ওয়াদা দিয়েছিলেন সত্য ওয়াদা, তোমাদের উপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণশক্তি ছিল না, তবে আমিও তোমাদেরকে ওয়াদা দিয়েছিলাম, এখন আমি তা ভঙ্গ করলাম। তোমাদেরকে দাওয়াত দিয়েছি, আর তোমরা আমার দাওয়াতে সাড়া দিয়েছ। সুতরাং তোমরা আমাকে তিরস্কার করো না, বরং নিজদেরকেই তিরস্কার কর। আমি তোমাদের উদ্ধারকারী নই, আর তোমরাও আমার উদ্ধারকারী নও। ইতঃপূর্বে তোমরা আমাকে যার সাথে শরীক করেছ, নিশ্চয় আমি তা অস্বীকার করছি। নিশ্চয় যালিমদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব’ ।

ইবলিসের নিয়ন্ত্রণ কাদের ওপর প্রযোজ্য নয়

১৭:৬২-৬৫ :: সে বলল, “দেখুন, এ ব্যক্তি, যাকে আপনি আমার উপর সম্মান দিয়েছেন, যদি আপনি আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত সময় দেন, তবে অতি সামান্য সংখ্যক ছাড়া তার বংশধরদেরকে অবশ্যই পথভ্রষ্ট করে ছাড়ব।” তিনি বললেন, “যাও, অতঃপর তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, জাহান্নামই হবে তোমাদের প্রতিদান, পূর্ণ প্রতিদান হিসেবে। তোমার কণ্ঠ দিয়ে তাদের মধ্যে যাকে পারো প্ররোচিত কর, তাদের উপর ঝাপিয়ে পড় তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে এবং তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে অংশীদার হও এবং তাদেরকে ওয়াদা দাও।” আর শয়তান প্রতারণা ছাড়া তাদেরকে কোন ওয়াদাই দেয় না। “নিশ্চয় আমার বান্দাদের উপর তোমার কোনো ক্ষমতা নেই।” কর্মবিধায়ক হিসেবে তোমার রবই যথেষ্ট।

১৬:৯৯-১০০ :: নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের রবের উপর তাওয়াক্কুল করেছে, তাদের উপর শয়তানের কোন প্রভাব নেই। তার প্রভাব তো কেবল তাদের উপর, যারা তাকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে এবং যারা আল্লাহর সাথে শরীক করে।

৭:২০১ :: নিশ্চয় যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে যখন তাদেরকে শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো কুমন্ত্রণা স্পর্শ করে তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। তখনই তারা স্পষ্টভাবে (সঠিক পথ) দেখতে পায়।

১০. পাপ কাজ করে তাক্বদীর বা ভাগ্যের দোহাই দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয় কেন?

প্রথম কথা হলো তাক্বদীর এবং ভাগ্য এক বিষয় নয়। যদি তাক্বদীর বা ভাগ্য একই বিষয় হতো, তাহলে পাপ করে তাক্বদীরের দোহাই দেয়া গ্রহণযোগ্য হতো। যেমন কোনো অপরাধীকে উপদেশ দিলে সে যদি বলে যে, আল্লাহ আমার ভাগ্যে এটাই লিখে রেখেছেন বিধায় আমি তা করছি, তুমি কি আল্লাহর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছো বা আমার ভাগ্যের কারণে আমি এ পাপ করেছি, তাহলে তুমি কি করে আমাকে দোষ দিতে পারো? – তার এ অজুহাত গ্রহণযোগ্য হতো। তাক্বদীর যদি ভাগ্য হতো তাহলে হত্যা-ধর্ষণ ইত্যাদি জঘন্য অপরাধ করা সত্ত্বেও কাউকে শাস্তি প্রদান করা যেতো না।

তবে যারা তাক্বদীরকে ভাগ্য মনে করে এর দোহাই দেয়, বস্তুত তারা বিভ্রান্তিকর বিশ্বাসের প্রচার ও নিজেদের অপকর্মের ঢাল হিসেবে তা করে, কিন্তু নিজেরা তা গভীরভাবে বিশ্বাস করে না। যেমন, তাদের উপর কেউ অত্যাচার করে ভাগ্যের দোহাই দিলে তারা তা মেনে নেবে না। এছাড়া তারা ভালো শিক্ষার জন্য ভালো শিক্ষকের এবং ভালো চিকিৎসার জন্য ভালো চিকিৎসকের সন্ধান করে। অথচ ‘ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত’ হলে শিক্ষক ও চিকিৎসক ভালো হোক বা না হোক, উভয় অবস্থায় ফলাফল একই হবে এবং তাই ভালো শিক্ষক বা চিকিৎসকের সন্ধান করা অর্থহীন হবে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বস্তুত ভাগ্য বিশ্বাস কখনো মানুষের মধ্যে স্থিতিশীল হতে পারে না।

যে ব্যক্তি কোনো অপরাধ করে ভাগ্যের দোহাই দিবে, তাকে যথোচিত জবাব দেয়ার জন্য তাকে তার উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করে বলতে হবে যে, এটাও তোমার ভাগ্যেই ছিলো!

বস্তুত আল্লাহ ভাগ্য হিসেবে মানুষের জন্য পাপ-পুণ্য কাজ লিখে রাখেন নি। কিন্তু যারা মনে করে যে, ভাগ্য হিসেবে মানুষের জন্য পাপ-পুণ্য লিখে রেখেছেন এবং সে তার পাপের জন্য এ ভাগ্যের দোহাই দেয়, তাকে জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে যে, যেখানে তোমার জন্য পাপ-পুণ্যের দুটি দরজা খোলা এবং তুমি জানো না যে, তোমার ভাগ্যে কি লেখা আছে সেখানে কেন তুমি পুণ্য না করে পাপ করলে? যদি বলো যে, ভাগ্যে লেখা ছিলো বলেই তো! তাহলে প্রশ্ন হলো, যদি কোথাও যাওয়ার জন্য দুটি রাস্তা থাকে যার একটি নিরাপদ অন্যটি কণ্টকাকীর্ণ ও ভীতিকর, তাহলে তুমি কেন নিরাপদটি বাছাই করবে? কেন তুমি কম বেতনের চেয়ে অধিক বেতনের চাকরি পছন্দ করবে? এটা কি প্রমাণ করে না যে, ন্যায়-অন্যায় বা পাপ-পুণ্যের ক্ষেত্রে ভাগ্যের দোহাই দেয়া একটি নিতান্তই দুষ্টামি?

কোনো ভাগ্য বিশ্বাসী ব্যক্তির যদি অনেক গরু-ছাগল-উট থাকে এবং তার পরিচারক সেগুলোকে ঘাসহীন ময়দানে চরাতে নিয়ে যাওয়ার ফলে সেগুলো মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাহলে সে ব্যক্তি তার পশুগুলোর মৃত্যুর জন্য ভাগ্যের দোহাইকে মেনে নেবে না। অনুরূপভাবে তার ব্যবসা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ডাকাতির ভীতিপূর্ণ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ের মালামাল ডাকাতি হয়ে যায়, সে অবস্থায় সে ডাকাতির জন্য ভাগ্যের দোহাইকে মেনে নেবে না। অনুরূপভাবে যদি তার ছোট ছেলে-মেয়ে যারা এখনো সাঁতার শিখে নি, তাদেরকে সাঁতার কাটার জন্য কোনো কূপে একাকী নামিয়ে দেয়ার ফলে তাদের মৃত্যু হলে সেক্ষেত্রে সে ভাগ্যের দোহাইকে মেনে নেবে না। সে তার অধীনস্ত কর্মচারীদের এসব কর্মকাণ্ডের জবাবে ভাগ্যের দোহাইকে মেনে নেয় না, অথচ নিজের ক্ষেত্রে সে বিশ্বপ্রভুর কাছে ভাগ্যের দোহাই দিয়ে যাচ্ছে। এটা একটা অদ্ভুত স্ববিরোধিতা। বস্তুত কোনো ভাগ্য বিশ্বাসী এরূপ স্ববিরোধিতা থেকে মুক্ত হতে পারে না।

তাক্বদীর সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা যে ভুল বা তাক্বদীর বলতে যে ভাগ্য বুঝায় না বা পাপ করে ভাগ্যের দোহাই যে গ্রহণযোগ্য নয় তার আরো কয়েকটি প্রমাণ হলো :

১. যদি তাক্বদীর বলতে ভাগ্য বুঝাতো, তাহলে নবী-রসূল প্রেরণ, আসমানী কিতাব নাযিল, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ, তাওবাহ-ইস্তিগফার-দোয়া, বিশ্বব্যাপী ফিতনা-ফাসাদের বিপরীতে শরয়ী দণ্ডবিধি বা আইন-আদালত, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবই নিরর্থক হয়ে যায়।

৪:১৬৫ :: সুসংবাদদাতা এবং ভীতি-প্রদর্শনকারী হিসাবে রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূলগণের পরে মানুষের জন্য আল্লাহ্‌র প্রতি অপবাদ আরোপ করার মত কোন অবকাশ না থাকে। আল্লাহ পরাক্রমশীল, প্রাজ্ঞ।

২. যদি তাক্বদীর বলতে ভাগ্য বুঝাতো তাহলে ইবলীসের পক্ষ থেকে নিজের বিভ্রান্তির জন্য আল্লাহকে দায়ী করার দাবি গ্রহণযোগ্য হতো।

৭:১৬ :: সে (ইবলিস) বলল, “আপনি আমাকে যেহেতু বিভ্রান্ত করেছেন, সেহেতু আমিও তাদের জন্য আপনার সরল পথে ওঁৎ পেতে বসে থাকবো”।

৩. ভাগ্যের দোহাই দেওয়া গ্রহণযোগ্য হলে জাহান্নামীরা ভাগ্যের দোহাই দিত।

১৪:৪৪ :: (জাহান্নামীরা বলবে,) “হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে সামান্য মেয়াদ পর্যন্ত সময় দিন, যাতে আমরা আপনার আহবানে সাড়া দিতে পারি এবং রাসূলগণের অনুসরণ করতে পারি”।

৪. স্ত্রীমিলন ছাড়া কোনো পুরুষ পিতা হওয়ার বা সন্তান লাভের আশা করতে পারে না। যদি ভাগ্য বিশ্বাস সঠিক হতো তাহলে স্ত্রীমিলন করা হোক বা না হোক উভয় অবস্থায় সন্তান হতো। যদি ভাগ্য বিশ্বাস সঠিক হতো তাহলে পানাহার ছাড়াই ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কষ্ট এবং ক্ষুৎ-পিপাসার নিবৃত্তি সম্ভব হতো। একজন ভাগ্য বিশ্বাসী ব্যক্তি কেন রোগ-ব্যাধিতে চিকিৎসা গ্রহণ করবে? ভাগ্যে থাকলে তার রোগ থাকবে অন্যথায় এমনিতেই রোগ সেরে যাবে। কেন সে হিংস্র প্রাণী থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করবে? ভাগ্যে থাকলে তাকে হিংস্র প্রাণী কামড় দিবে, অন্যথায় কামড় দিবে না।

সুতরাং বুঝা গেলো, বস্তুত ভাগ্য বিশ্বাস একটি ভুল বিশ্বাস। তাক্বদীর এবং ভাগ্য এক বিষয় নয়। সন্তান লাভের জন্য স্বামী-স্ত্রীর মিলন করতে হবে, ক্ষুৎ-পিপাসার নিবারণের জন্য পানাহার করতে হবে, রোগ-ব্যাধিতে চিকিৎসা করতে হবে তথা ভালো ডাক্তার দ্বারা সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় ও যথাযথ ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে, হিংস্র প্রাণী থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে- এটাই তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক নির্ধারণ।

১১. বান্দা কর্তৃক সম্পাদিত কর্মকে আল্লাহ কর্তৃক সম্পাদিত কর্ম হিসেবে সাব্যস্ত করার তাৎপর্য

৮:১৭ :: … আর যখন তুমি মাটির মুষ্টি নিক্ষেপ করেছিলে, তখন তা মূলতঃ তুমি নিক্ষেপ করনি, বরং তা নিক্ষেপ করেছিলেন স্বয়ং আল্লাহ।…

এ আয়াতের মাধ্যমে মানুষ যে কাজ করে বস্তুত তা মানুষ নিজে থেকে করে না, বরং আল্লাহই মানুষের মাধ্যমে করে থাকেন বলে সাব্যস্ত করা হয়। কিন্তু এ আয়াতটি সকল মানুষের সকল কাজের বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছে না। বরং এখানে রসূল ও মু’মিনদের একটি নির্দিষ্ট সময় ও স্থানের কর্মকে চিহ্নিত করে। যখন মানুষ আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য কর্মউদ্যোগ গ্রহণ করে তখন কোনো পর্যায়ে সে সম্পূর্ণ সচেতনভাবে কোনো কাজ করার পরিবর্তে অবচেতনভাবে আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নে কাজ করতে পারে, আয়াতটি সে বক্তব্যকে তুলে ধরছে। যা সাধারণভাবে মানুষের কাজের জন্য তাকেই দায়ী করার সাথে সাংঘর্ষিক নয়।

১২. বান্দার কর্মের সাথে আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছা জড়িত থাকা সত্ত্বেও বান্দা দায়ী হওয়া না হওয়া

বান্দার কর্ম সম্পর্কে আল্লাহ পূর্ব থেকে জানেন এবং তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ীই বান্দার কর্ম সম্পাদিত হয়। তা সত্ত্বেও কেন বান্দাকে দায়ী করা হবে? এর কারণ আল্লাহর জানার কারণে বান্দা কোনো কাজ করে তা নয়। বরং বান্দা তার নিজ ইচ্ছা ও কর্মশক্তি অনুযায়ী কোনো কাজ করে এবং আল্লাহ তাঁর নিজ গুণে তা আগে থেকে জানেন। আবার বান্দার কর্ম আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী হলেও আল্লাহর ইচ্ছা বান্দাকে তার কাজে বাধ্য করে না, বরং বান্দা নিজ ইচ্ছা অনুসারে কাজটি নিজের জন্য বাছাই করে বিধায় সে দায়ী হবে।

বিষয়টি একটি উদাহরণের মাধ্যমে বুঝা যেতে পারে। উদাহরণটা হল, বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ ও বিদ্যুৎ গ্রাহকের ভূমিকা। বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে, তেমনি বিদ্যুৎ গ্রাহকও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু দায় বহন করতে হবে বিদ্যুৎ গ্রাহকের। মাস শেষে যখন হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিল আসল, তখন কর্তৃপক্ষকে এ কথা বলে দোষ দেয়া চরম বোকামি হবে যে, তারা কেন বিদ্যুৎ সরবরাহ করল, তারা ইচ্ছা করলে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে আমার বিদ্যুৎ খরচ কমাতে পারত।

তারা ইচ্ছা করলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে আপনার খরচ কমাতে পারত এটা যেমন ঠিক, তেমনি আপনিও সাশ্রয়ী হয়ে বিদ্যুৎ খরচ কমাতে পারতেন, এটাও ঠিক। আর খরচের এ দায়ভার বহন করবে গ্রাহক, সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষ নয়। কারণ কর্তৃপক্ষ আগেই এ নীতিমালা স্পষ্ট করে সতর্ক করেছে যে, এক্ষেত্রে গ্রাহককে দায়ী করা হবে, তাই জরিমানা থেকে বাঁচতে হলে ও পুরস্কার পেতে হলে তাকে সাশ্রয়ী হওয়ার ইচ্ছা ও কর্ম সম্পাদন করতে হবে।
এ বিষয়ে আরও মৌলিক উদাহরণ হলো, যদি আপনি কারো কাছে কল করার জন্য মোবাইল ফোনে তার নাম্বার প্রেস করেন কিন্তু শেষে ‘কল’ বাটনে প্রেস করার পরিবর্তে ‘ক্যানসেল’ বাটনে প্রেস করেন, তাহলে তার কাছে কল যাবে না। এখন এটা মোবাইল ফোনের প্রোগ্রামের ইচ্ছা অনুসারে হলেও এজন্য আপনিই দায়ী। কারণ আপনি আপনার কাজে সফল হওয়ার জন্য যে বাটনে প্রেস করা দরকার ছিলো, তাতে প্রেস করেন নি। প্রোগ্রামার আপনার জন্য দুটো অপশনই রেখেছেন, আর আপনি ‘কল’ অপশনের পরিবর্তে ‘ক্যানসেল’ অপশনকে বেছে নিয়েছেন।

১৩. আল্লাহ বান্দাকে দিয়ে কোনো কাজ করিয়ে নিলে ঐ কাজের জন্য পুরস্কার- শাস্তি প্রদান করা ন্যায়বিচার বলে গণ্য না হয়ে বরং জুলুম বলে সাব্যস্ত হয়

যদি আল্লাহ বান্দাকে দিয়ে কোনো কাজ করিয়ে নিতেন তাহলে তিনি তাদেরকে ভালো কাজের জন্য আদেশ এবং মন্দ কাজের প্রতি নিষেধ করতেন না। সেক্ষেত্রে তাদেরকে কর্মের মাধ্যমে পরীক্ষা নেয়ার কথাটিও অর্থবহ হতো না। এবং এ অবস্থায় মানুষের ভালো-মন্দ কাজের জন্য পুরস্কার-শাস্তি দিলে তাতে মানুষের প্রতি জুলুম হতো। কারণ যে কাজে মানুষের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার ভুমিকা নেই সে কাজের ভিত্তিতে তাকে শাস্তি দেয়া যুলুম (অত্যাচার)। অথচ আল্লাহ জুলুম করেন না।

বস্তুত আল্লাহ ইচ্ছাশক্তি, কর্মশক্তি এবং বিবেক-বুদ্ধি প্রদান করেছেন। সেই সাথে নবী-রসূলগণ ও আসমানী কিতাবের মাধ্যমে তাদেরকে ভালো কাজের নির্দেশ এবং মন্দ কাজে নিষেধ করেছেন। তিনি কাউকে ভালো বা মন্দ কাজে বাধ্য করেন নি। তাই বান্দার ভালো-মন্দ কাজের জন্য তারা নিজেরাই দায়ী।

৯৫:৭ :: আল্লাহ কি সবচেয়ে বড় ন্যায়বিচারক নন? (অর্থাৎ আল্লাহ সবচেয়ে বড় ন্যায়বিচারক)।

৫০:২৯ :: ‘আমি বান্দাদের প্রতি সামান্যতম যুলমকারী নই।

৪১:৪৬ :: আপনার পালনকর্তা বান্দাদের প্রতি বিন্দুমাত্র যুলমকারী নন।

১৮:৪৯ :: তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারো প্রতি যুলম করবেন না।

৩:১৮২ :: এ হল তোমাদের হাত যা আগাম পেশ করেছে এটা সে কারণে। আর নিশ্চয় আল্লাহ বান্দাদের প্রতি যালিম নন।

২২:১০ :: (সেদিন তাকে বলা হবে), “এটি তোমার দু’হাত যা পূর্বে প্রেরণ করেছে তার কারণে। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের প্রতি যুলমকারী নন”।

৮:৫১ :: তোমাদের হাত আগে যা প্রেরণ করেছে সে কারণে এ পরিণাম। আর নিশ্চয় আল্লাহ বান্দাদের প্রতি যুলমকারী নন।

৫০:২৯ :: আমার কাছে কথা রদবদল হয় না, আর আমি বান্দার প্রতি যুলমকারীও নই।

৩৬:৫৪ :: সুতরাং আজ কাউকেই কোন যুলম করা হবে না এবং তোমরা যা আমল করছিলে শুধু তারই প্রতিদান তোমাদের দেয়া হবে।

১৬:৩৩ :: আল্লাহ তাদের প্রতি অবিচার করেননি; বরং তারাই স্বয়ং নিজেদের প্রতি যুলম করেছিল।

১০:৪৪ :: নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি সামান্যতম যুলম করেন না, কিন্তু মানুষ নিজেই নিজের উপর যুলম করে।

৩:১১৭ :: যা তারা ইনফাক্ব/ ব্যয় করে এই দুনিয়াতে তার উপমা বায়ুর (সাথে সম্পর্কিত) উপমার মতো যার মধ্যে আছে ভীষণ ঠান্ডা, উহা প্রবাহিত হয় ঐ ক্বাওমের ক্ষেতে যারা যুলম করেছে তাদের নিজেদের উপর, তারপর তাকে ধ্বংস করে দেয়। আর আল্লাহ তাদের উপর যুলম করেননি। কিন্তু তারা তাদের নিজেদের উপর যুলম করতো।

৯:৭০ :: তাদের কাছে কি পৌঁছেনি তাদের সংবাদ যারা ছিলো তাদের আগে, যেমন নূহের কওমের, আর আদের, আর সামূদের, আর ইবরাহীমের কওমের, আর মাদইয়ানের অধিবাসীদের, আর উল্টিয়ে দেয়া জনপদের? তাদের কাছে এসেছিলো তাদের (জন্য প্রেরিত) রসূলগণ স্পষ্ট প্রমাণ সহকারে। সুতরাং আল্লাহ এমন নন যে, তাদের উপর যুলুম করবেন; কিন্তু তারা তাদের নিজেদের উপর যুলুম করতো।

১১:১০১ :: আর আমরা তাদের উপর যুলুম করিনি কিন্তু তারাই যুলুম করেছে তাদের নিজেদের উপর। সুতরাং কাজে আসেনি তাদের ব্যাপারে তাদের ইলাহসমূহ, যাকে যাকে তারা ডাকে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে, কিছুমাত্রও; যখন এসেছে তোমার রবের আদেশ; আর উহারা তাদেরকে কিছুই বাড়িয়ে দেয়নি ধ্বংস ছাড়া।

২৯:৪০ :: তারপর (তাদের) প্রত্যেককে আমরা পাকড়াও করেছিলাম তার নিজ পাপের কারণে। তখন তাদের মধ্য থেকে কেউ ছিলো আমরা প্রেরণ করেছিলাম যার উপর পাথর বর্ষণকারী ঝটিকা। আর তাদের মধ্য থেকে কেউ ছিলো যাকে পাকড়াও করেছিলো প্রচন্ড শব্দ। আর তাদের মধ্য থেকে কেউ ছিলো যাকে আমরা ধ্বসিয়ে দিয়েছিলাম পৃথিবীতে। আর তাদের মধ্য থেকে কেউ ছিলো যাকে আমরা ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। আর আল্লাহ যুলুম করার নন। কিন্তু তারাই তাদের নিজেদের উপর যুলুম করতো।

৪০:৩০-৩১ :: আর যে ঈমান/ বিশ্বাস করেছিলো সে বলেছিলো, ‘হে আমার কওম, নিশ্চয় আমি ভয় করছি তোমাদের উপর অতীতের দলসমূহের উপর আসা শাস্তির দিনের অনুরূপ শাস্তি আসার ব্যাপারে’। যেমন ঘটেছিলো নূহের কওম, আদ সম্প্রদায়, সামুদ সম্প্রদায় ও তাদের ক্ষেত্রে যারা তাদের পরবর্তীতে ছিলো। আর আল্লাহ ইচ্ছা করেন না তাঁর বান্দাদের প্রতি যুলুম করতে।

৪:১৪৭ :: আল্লাহ কী করবেন তোমাদেরকে আযাব দিয়ে যদি তোমরা শোকর/ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো আর তোমরা ঈমান/ বিশ্বাস করো? আর আল্লাহ শোকরের মূল্যায়নকারী, মহাজ্ঞানী।

৩৯:৬৯-৭০ :: আর উদ্ভাসিত হবে পৃথিবী তার রবের আলোতে। আর রাখা হবে আমলনামা (কার্যবিবরণী বই)। আর উপস্থিত করা হবে নবীদেরকে ও সাক্ষীদেরকে। আর ফায়সালা করে দেয়া হবে তাদের মধ্যে সত্যের ভিত্তিতে। আর তাদেরকে কোন যুলুম করা হবে না। আর পূর্ণ করে দেয়া হবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে যা সে কাজ করেছে তার প্রতিফল। আর তিনি জানেন যা তারা করছে তা সম্পর্কে।

৪০:১৭ :: (বলা হবে,) ‘আজ প্রতিফল দেয়া হবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে উহা অনুযায়ী যা (যে পূণ্য বা পাপ) সে উপার্জন করেছে। কোন যুলুম হবে না আজ। নিশ্চয় আল্লাহ হিসাবকরনে দ্রুততম।

১০:৪৭ :: আর প্রত্যেক উম্মাতের জন্যই আছে একজন রসূল। তারপর যখন এসেছে তাদের (জন্য প্রেরিত) রসূল, তখন ফায়সালা করে দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে ন্যায়বিচারের সাথে। আর তাদের উপর কোন জুলুম করা হয়নি।

১০:৫৪ :: আর যদি হতো প্রত্যেক যুলুমকারী ব্যক্তির জন্য যা আছে পৃথিবীতে তার সবই, তবে নিশ্চয় সে উহা মুক্তিপণস্বরূপ দিয়ে দিতো। আর তারা গোপনে করতে থাকবে অনুতাপ যখন তারা দেখবে শাস্তি। আর ফায়সালা করে দেয়া হবে তাদের মধ্যে ন্যায়বিচারের সাথে। আর তাদের উপর কোন যুলুম করা হবে না।

মানুষের কর্মের পরীক্ষা

৬৭:২ :: যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন তোমাদের (এ বিষয়ে) পরীক্ষা করার জন্য (পরীক্ষা নিয়ে ইনসাফের ভিত্তিতে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়ার জন্য), কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম।
মীযান বা ন্যায়বিচারের দাড়িপাল্লা

২১:৪৭ :: আর কিয়ামতের দিন আমি ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারো প্রতি কোন অবিচার করা হবে না। কারো কর্ম যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা হাযির করব। আর হিসাব গ্রহণকারীরূপে আমিই যথেষ্ট।

৭:৮-৯ :: আর সেদিনের ওজন/ মূল্যমান নিরূপণ/ পরিমাপ হবে যথাযথ পদ্ধতিতে (গুরুত্বের ভিত্তিতে)। সুতরাং যার পাল্লাসমূহ ভারী হবে (কর্মসমূহের মূল্যমান বেশি হবে), তারাই সফলতা লাভকারী। আর যার পাল্লাসমূহ হালকা হবে (কর্মসমূহের মূল্যমান শূন্য বা তার চেয়ে কম হবে), তারাই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে নিজেদেরকে, কারণ তারা আমাদের আয়াতসমূহের প্রতি যুলুম করতো (আয়াতসমূহকে অমান্য করতো)।

২৩:১০২-১০৩ :: সুতরাং যার পাল্লাসমূহ ভারী হবে (কর্মসমূহের মূল্যমান বেশি হবে), তারাই সফলতা লাভকারী। আর যার পাল্লাসমূহ হালকা হবে (কর্মসমূহের মূল্যমান শূন্য বা তার চেয়ে কম হবে), তারাই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে নিজেদেরকে। তারা জাহান্নামে স্থায়ী হবে।

১০১:৬-১১ :: তারপর যার পাল্লাসমূহ ভারী হবে (কর্মসমূহের মূল্যমান বেশি হবে), তাহলে সে সন্তোষপূর্ণ জীবনে থাকবে। আর যার পাল্লাসমূহ হালকা হবে (কর্মসমূহের মূল্যমান শূন্য বা তার চেয়ে কম হবে), তাহলে তার মা হবে হাবিয়া। কী জান, উহা কী? জ্বলন্ত আগুন।

১৮:১০৫ :: তারাই ঐসব লোক যারা কুফর করেছে তাদের রবের আয়াতসমূহের প্রতি আর তাঁর সাথে সাক্ষাতের প্রতি (আল্লাহর কাছে জবাবদিহির সম্মুখীন হবার প্রতি)। সুতরাং নিষ্ফল হয়ে গেছে তাদের কাজসমূহ। সুতরাং আমরা প্রতিষ্ঠিত করবো না তাদের জন্য কিয়ামাত দিবসে কোন ওজন/ মূল্যমান (= তাদের আমলসমূহকে কোন মূল্যই দেয়া হবে না, তাই তারা জান্নাতে যেতে পারবে না)।

মানুষকে তাদের কর্মের রেকর্ড জানানো ও দেখানো

১০:২৩ :: তারপর যখন তিনি তাদেরকে উদ্ধার করেন তখন তারা বিদ্রোহ করে পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে। হে মানুষ, নিশ্চয় তোমাদের বিদ্রোহ তোমাদের নিজেদেরই বিরুদ্ধে। পার্থিব জীবনের ভোগসামগ্রী ভোগ করে নাও। তারপর আমাদেরই কাছে তোমাদের ফিরে আসার স্থান। তখন আমরা তোমাদেরকে সংবাদ জানাবো ঐ ব্যাপারে যা তোমরা করতে।

৭৫:১৩-১৫ :: সেদিন ইনসানকে/ মানুষকে জানিয়ে দেয়া হবে যা সে আগে পাঠিয়েছে (তার কৃতকর্ম) ও যা সে পিছনে রেখে এসেছে (তার কাজের প্রতিক্রিয়া)। বরং মানুষ তার নিজের ব্যাপারে দৃষ্টিবান, যদিও সে পেশ করে তার ওজর-অজুহাত।

৯৯:৭-৮ :: অতএব, কেউ অণু পরিমাণ ভালকাজ করলে তা সে দেখবে, আর কেউ অণু পরিমাণ খারাপ কাজ করলে তাও সে দেখবে।

আমলনামা বা কার্য বিবরণী বই

৫০:১৮ :: তারা উচ্চারণ করে না কোন কথা, এছাড়া যে, তার কাছে থাকে সদা প্রস্তুত পর্যবেক্ষক।

৮২:১০-১৪ :: আর নিশ্চয় তোমাদের উপর রয়েছে হেফাযতকারীগণ (কার্যবিবরণী সংরক্ষণকারীগণ), সম্মানিত লেখকগণ। তারা জানে যা তোমরা করো। নিশ্চয় সৎকর্মশীলগণ নেয়ামতে থাকবে। আর নিশ্চয় পাপীগণ জাহান্নামে থাকবে।

১৭:১৩-১৪ :: আর প্রত্যেক মানুষ এমন যে, আমরা তাকে পরিয়েছি তার শুভাশুভ লক্ষণ বা কার্যকারণকে তার গলায়। আর আমরা বের করবো তার জন্য কিয়ামাত দিবসে একটি আমলনামা (কার্য বিবরণী বই), সে উহাকে পাবে উন্মুক্ত অবস্থায়। পাঠ করো তোমার আমলনামা (কার্য বিবরণী বই)। তুমি নিজেই যথেষ্ট আজ তোমার উপর হিসাবকারী হিসাবে।

৩৬:১২ :: নিশ্চয় আমরা জীবিত করবো মৃতদেরকে। আর আমরা লিখে যাচ্ছি যা সে আগে পাঠায় (তার কৃতকর্ম) ও যা সে পিছনে রেখে যায় (তার কৃতকর্মের প্রতিক্রিয়া)। আর সবকিছু আমরা সংরক্ষিত করেছি স্পষ্ট ইমামের (আমলনামার) মধ্যে।

১৪. চূড়ান্ত কর্মফল স্থানান্তরযোগ্য নয়

চূড়ান্ত কর্মফলের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নীতি কার্যকর হবে। এক ব্যক্তির কর্মের ফলাফল অন্যের কাছে স্থানান্তর করা যাবে না। অর্থাৎ একজনের ব্যক্তিত্বের উপর তার কর্মের পরিণতি অন্যের কাছে স্থানান্তরিত হতে পারে না। একজন ব্যক্তি নিয়মিত ব্যায়াম করার স্বাস্থ্যকর ফলাফল অন্যের কাছে স্থানান্তর করতে পারে না, এ বিষয়টাও সেরূপ। আবার একজনের কর্মের যে পরিণতি তার ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করবে, তা অন্য কারো মধ্যস্থতায় মুছে ফেলার কোনো অবকাশ নেই।

১৭:৭ :: যদি তোমরা উত্তম কাজ করে থাকো, তাহলে তোমরা উত্তম কাজ করেছো তোমাদের নিজেদের জন্য। আর যদি তোমরা মন্দকাজ করে থাকো, তাহলে উহাও (করেছো তোমাদের নিজেদেরই বিরুদ্ধে)। …

৪১:৪৬ :: যে সৎকর্ম করে সে তা তার নিজের কল্যাণের জন্যই করে, আর যে মন্দকর্ম করে, তাহলে তাও তার নিজের বিরুদ্ধে যায়। আর তোমার রব তাঁর বান্দাদের প্রতি যালেম/ অত্যাচারী নন।

৪৫:১৫ :: যে সৎকর্ম করে উহা তার নিজের জন্য কল্যাণকর। আর যে মন্দকর্ম করে উহা তার নিজের জন্য ক্ষতিকর। তারপর তোমাদের রবের কাছে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।

২৯:৬ :: আর যে জিহাদ/ সংগ্রাম করেছে, তাহলে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয় সে জিহাদ/ সংগ্রাম করে তার নিজেরই কল্যাণার্থে। নিশ্চয় আল্লাহ সমগ্র বিশ্ববাসী থেকে অমুখাপেক্ষী।

১০:২৩ :: তারপর যখন তিনি তাদেরকে উদ্ধার করেন তখন তারা বিদ্রোহ করে পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে। হে মানুষ, নিশ্চয় তোমাদের বিদ্রোহ তোমাদের নিজেদেরই বিরুদ্ধে। পার্থিব জীবনের ভোগসামগ্রী ভোগ করে নাও। তারপর আমাদেরই কাছে তোমাদের ফিরে আসার স্থান। তখন আমরা তোমাদেরকে সংবাদ জানাবো ঐ ব্যাপারে যা তোমরা করতে।

৪:১১১ :: আর যে উপার্জন করে পাপ সে তো উহা উপার্জন করে তার নিজের বিরুদ্ধে। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।

৬:১০৪ :: নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছে চাক্ষুস প্রমাণ (= কুরআন), তোমাদের রবের পক্ষ থেকে। সুতরাং যে দেখবে, তাহলে তা তার নিজের জন্যই (উপকারী) হবে আর যে নিজেকে অন্ধ করে রাখবে, উহা তার নিজেরই বিপক্ষে যাবে। আর আমি (রসূল) তোমাদের উপর রক্ষক নই।

১০:১০৮ :: বলো, “হে মানুষ, নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছে সত্য তোমাদের রবের পক্ষ থেকে। সুতরাং যে হিদায়াত পেলো তবে নিশ্চয় সে হিদায়াত পায় তার নিজেরই জন্য। আর যে বিভ্রান্ত হলো তবে নিশ্চয় সে বিভ্রান্ত হয় তার নিজেরই বিরুদ্ধে। আর আমি নই তোমাদের ব্যাপারে উকিল/ কর্মবিধায়ক”।

১০:১৫ :: যে সঠিক পথে চলে, তাহলে নিশ্চয় সে সঠিক পথে চলে তার নিজেরই কল্যাণের জন্য। আর যে ভ্রান্ত পথে চলে, তাহলে নিশ্চয় সে ভ্রান্ত পথে চলে তার নিজেরই অকল্যাণের জন্য। আর কোন বোঝা বহন করবে না কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা। আর আমরা শাস্তিদানকারী নই যতক্ষণ না আমরা সমুত্থিত/ প্রেরণ করি কোন রসূল।

৩১:১২ :: আর নিশ্চয় আমরা দিয়েছিলাম লুকমানকে বিজ্ঞতা, যেন আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আর যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, নিশ্চয় সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তার নিজেরই জন্য। আর যে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ অমুখাপেক্ষী ও (সদা) প্রশংসিত।

২:৪৮ :: আর তোমরা ভয় করো সেদিনকে যেদিন প্রতিদান দেয়ার কাজে আসবে না কোন ব্যক্তিই অপর কোন ব্যক্তির ব্যাপারে, কিছুমাত্রও। আর কবুল করা হবে না তার থেকে শাফায়াত/ সুপারিশ আর গ্রহণ করা হবে না তার থেকে বিনিময়। আর না তাদেরকে সাহায্য করা হবে।

২:১২৩ :: আর তোমরা ভয় করো সেদিনকে যেদিন প্রতিদান দেয়ার কাজে আসবে না কোন ব্যক্তিই অপর কোন ব্যক্তির ব্যাপারে, কিছুমাত্রও। আর কবুল করা হবে না তার থেকে বিনিময় আর তাকে উপকৃত করবে না সাফায়াত/সুপারিশ। আর না তাদেরকে সাহায্য করা হবে।

২:২৫৪ :: হে ঐসব লোক, যারা ঈমান/ বিশ্বাস করেছো, তোমরা ব্যয় করো তা থেকে যা আমরা তোমাদেরকে জীবিকাস্বরূপ দিয়েছি, এর পূর্বে যে, আসবে সেই দিন যেদিন কোন বেচাকেনা হবে না আর কোন বন্ধুত্ব বজায় থাকবে না আর কোন শাফায়াত/ সুপারিশ চলবে না। আর কাফিরগণ হচ্ছে যালিম।

২:১৩৯ :: বলো, ‘তোমরা কি আমাদের সাথে বিতর্ক করছো আল্লাহর সম্বন্ধে? অথচ তিনি আমাদেরও রব আর তোমাদেরও রব। আর আমাদের জন্য আমাদের কর্ম আর তোমাদের জন্য তোমাদের কর্ম। আর আমরা তাঁরই জন্য একনিষ্ঠ।

৩৪:২৫ :: বলো, ‘তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে না ঐ বিষয়ে যা আমরা অপরাধ করেছি। আর আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে না ঐ বিষয়ে যা তোমরা কাজ করেছো’।

১০:৪১ :: আর যদি তারা তোমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে, তাহলে বলো, ‘আমার জন্য আমার কাজ। আর তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ। তোমরা দায়মুক্ত তা থেকে যা আমি আমল করি। আর আমি দায়মুক্ত তা থেকে যা তোমরা আমল করো।

পরিশেষে বলা যায় যে, মানুষের ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা এবং কর্মের দায়বদ্ধতা ও কর্মফল সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য ভাগ্যবাদকে বাতিল সাব্যস্ত করে। সুতরাং তাক্বদীর বলতে কোনোক্রমে ভাগ্যবাদকে বুঝায় না, বরং তাক্বদীর বলতে বুঝায় ‘আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন বা প্রাকৃতিক নিয়ম বা প্রাকৃতিক ব্যবস্থা’ এবং মহাবিশ্ব-ব্যবস্থাপনায় আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ।



আল্লাহর স্ব-কর্ম নীতিমালা, আইনের দর্শন ও তাক্বদীর

তাক্বদীর তথা আল্লাহর কর্তৃক প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অনুধাবনের জন্য আল্লাহর স্বকর্ম নীতিমালা, আইনের দর্শন এবং আল্লাহর আইনের বিভিন্ন ধরন সম্পর্কে অনুধাবন করা প্রয়োজন। তাই এ অধ্যায়ে এ বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করা হলো।

১. নিজের জন্য আল্লাহর নীতিমালা

৬:১২ :: বলো, “কার অধিকারভুক্ত যা আছে আসমানসমূহে ও জমিনে?” বলো, “আল্লাহরই অধিকারভুক্ত”। তিনি লিখে নিয়েছেন তাঁর নিজের উপর (সুন্নাত/ মূলনীতি হিসাবে), রহমাত/ দয়া প্রকাশ করাকে। নিশ্চয় তিনি তোমাদেরকে একত্রিত করবেন কিয়ামাত দিবসে, যাহাতে (কিয়ামাতে) কোনো সন্দেহ নেই। যারা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তাদের নিজেদেরকে তারা বিশ্বাস করে না”।

৬:৫৪ :: আর যখন তোমার কাছে তারা আসে যারা বিশ্বাস করে আমাদের আয়াতসমূহের প্রতি, তখন তুমি বলো, “আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক”। লিখে নিয়েছেন তোমাদের রব নিজের উপর (একটি সুন্নাত/ মূলনীতি হিসাবে) রহমাত/ দয়া করাকে। তা এমন যে, যে করে বসে তোমাদের মধ্য থেকে কোনো মন্দ কাজ জাহালতবশত: তারপর তাওবা করে উহার পর (অবিলম্বে) আর আত্মসংশোধন করে, তাহলে নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, দয়াশীল।

১০:১০৩ :: তারপর আমরা (অশুভ পরিণতি থেকে) মুক্ত রেখেছি আমাদের রসূলদেরকে আর তাদেরকে যারা বিশ্বাস করেছে, এভাবেই। দায়িত্ব হিসাবে আছে আমাদের উপর মু’মিনদেরকে (অশুভ পরিণতি থেকে) মুক্ত রাখা।
উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ অনুসারে, আল্লাহ নিজের জন্য রহমত করাকে লিখে নিয়েছেন। সুতরাং তিনি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রহমত করবেন, এ বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী ও সুনিশ্চিত। অনুরূপভাবে আল্লাহ মু’মিনদেরকে অশুভ পরিণতি থেকে মুক্ত রাখাকে নিজের একটি দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সুতরাং মু’মিনরা যখন অন্যায় থেকে বিরত থাকে এবং নিষেধ করে, তখন অন্যদের অন্যায়ের অশুভ পরিণতি তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। অবশ্য এটি কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিষয় নয়, বরং ব্যক্তিত্ব ও আদর্শগত করুণ পরিণতির বিষয়কেই নির্দেশ করে।
নিজের উপর আল্লাহ কোনো কিছু লিখে নেয়া বা কোনো কিছুকে দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করার মতো আরেকটি বিষয় হলো কোনো কিছুকে নিজের প্রতিশ্রুতি হিসেবে উল্লেখ করা। নিম্নে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত কিছু আয়াত উল্লেখ করা হলো। উল্লেখ্য যে, তাঁর প্রতিশ্রুতির অন্যতম রূপ হলো তাঁর তৈরি অনিবার্য নীতিমালা।

১৬:৩৮ :: আর তারা কসম কাটে আল্লাহর নামে, (স্বীয় দাবি প্রমাণের) তীব্র প্রচেষ্টাপূর্ণ তাদের শপথ। কিন্তু আল্লাহ (পৃথিবীতে) তাকে পুনরুত্থিত করেন না যে মৃত্যুবরণ করে। বরং তাঁর ওয়াদা তার উপর সত্যরূপে বর্তাবে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জ্ঞান রাখে না।

৩১:৮-৯ :: নিশ্চয় যারা বিশ্বাস করেছে আর সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য আছে নেয়ামতপূর্ণ বাগান। তাতে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহর ওয়াদা সত্য। আর তিনি মহাশক্তিমান ও মহাবিজ্ঞ।

৩১:৩৩ :: হে মানুষ, তোমরা ভয় করো তোমাদের রবকে আর ভয় করো সেদিনকে যেদিন প্রতিদান দেয়ার কাজে আসবে না কোনো পিতা তার সন্তানের ব্যাপারে আর না কোনো সন্তান প্রতিদানদাতা হবে তার পিতার ব্যাপারে, কিছুমাত্রও। নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে পার্থিব জীবন। আর তোমাদেরকে যেন ধোঁকায় না ফেলে আল্লাহর ব্যাপারে কোনো ধোঁকাবাজ।

৩৫:৫ :: হে মানুষ, নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং তোমাদেরকে যেন ধোঁকায় না ফেলে পার্থিব জীবন। আর তোমাদেরকে যেন ধোঁকায় না ফেলে আল্লাহর ব্যাপারে কোনো ধোঁকাবাজ।

৪০:৫৫ :: সুতরাং ধৈর্য ধরো। নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। আর তুমি ক্ষমা চাও তোমার গুনাহের জন্য। আর পবিত্রতা বর্ণনা করো তোমার রবের প্রশংসা সহকারে ইশার সময় ও সকালবেলায়।

৪০:৭৭ :: সুতরাং তোমরা ধৈর্য ধরো। নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং হয় আমরা তোমাকে দেখাবো উহার কিছু অংশ যা আমরা তাদেরকে ওয়াদা দিচ্ছি, অথবা আমরা তোমাকে মৃত্যুদান করবো, তারপর আমাদের দিকে তাদেরকে ফিরিয়ে আনা হবে।

৩:১৯৪ :: আমাদের প্রভু, আমাদেরকে দান করুন যা আপনি ওয়াদা দিয়েছেন আপনার রসূলের কাছে। আর আমাদেরকে লাঞ্চিত করবেন না কিয়ামাত দিবসে। নিশ্চয় আপনি ওয়াদা খেলাফ করেন না (অর্থাৎ আমাদের প্রার্থনা হচ্ছে, আপনার ওয়াদা যাদের উপর প্রযোজ্য আপনি আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবার যোগ্যতা দান করুন)।

প্রসঙ্গত যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয় তা হলো, আল্লাহ যদি নিজের জন্য কিছু নীতিমালা স্থির করেন, যার ব্যতিক্রম তিনি করেন না এবং করবেন না, তাহলে তা ‘আল্লাহ সর্বশক্তিমান’ হওয়ার গুণের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কিনা?

এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায় যে, যদি আপনাকে আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, প্রতিদিন ভোরে তিন মাইল হাঁটতে বাধ্য করা হয়, আপনি বাধ্য হন। কিন্তু যদি আপনি এটি করার সিদ্ধান্ত নেন, আপনার নিজের ইচ্ছায়, আপনি স্বাধীন। যে ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি রাখে এবং জীবনে কিছু নীতি গ্রহণ করে, সে শক্তিহীন নয়। বিপরীতে, এই জাতীয় ব্যক্তিকে সম্মানিত, নীতির সমর্থক এবং নির্ভরযোগ্য বলে অভিহিত করা হয়। অতএব, আল্লাহ তার নিজ সিদ্ধান্তক্রমে নিজের জন্য যে নীতিমালা প্রণয়ন করেন, তিনি তার ব্যতিক্রম করেন না ও করবেন না। কিন্তু এতে তিনি তাঁর যা করার ইচ্ছা করবেন তা-ই করার সক্ষমতা ও সবকিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারান না। বরং তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর নিজ নির্ধারিত নীতিমালা ও প্রতিশ্রুতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ইচ্ছাই করে থাকেন ও স্বীয় ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেন।

২.আল্লাহর খালক্ব ও আমর (সৃষ্টি যাঁর, আইন তাঁর)

আল্লাহই স্বীয় ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুসারে সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টির জন্য স্বাধীনভাবে আইন প্রণয়ন করেছেন। সৃষ্টি যাঁর, আইনও তাঁর। সুতরাং আল্লাহর সৃষ্টি আল্লাহর আইন দ্বারা আবদ্ধ।

তিনি শূন্যতা থেকে সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টির বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছেন এবং সৃষ্টির ক্রিয়াকলাপকে কারণ ও প্রভাবের/ফলাফলের দ্বারা আবদ্ধ করেছেন, জীবের বংশবৃদ্ধি ঘটার পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন ইত্যাদি।

৭:৫৪ :: নিশ্চয় তোমাদের রব আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি রাতকে দ্বারা দিনকে ঢেকে দেন। প্রত্যেকটি একে অপরকে দ্রুত অনুসরণ করে। আর (সৃষ্টি করেছেন) সূর্য, চাঁদ ও তারকারাজী, যা তাঁর নির্দেশে নিয়োজিত। জেনে রাখ, সৃষ্টি ও নির্দেশ তাঁরই। আল্লাহ মহান, যিনি সকল সৃষ্টির রব।

২৪:৪৫ :: আল্লাহ সমস্ত জীব সৃষ্টি করেছেন পানি হতে, ওদের কতক পেটে ভর দিয়ে চলে এবং কতক দু’ পায়ে ভর করে চলে এবং কতক চলে চার পায়ে, আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।

২:১১৭ :: তিনি আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা। আর যখন তিনি কোন বিষয়ের (আমরের) সিদ্ধান্ত নেন, তখন কেবল বলেন ‘হও’ ফলে তা হয়।

৩০:১১ :: আল্লাহ সৃষ্টির সূচনা করেন, তারপর তিনিই তার পুনরাবৃত্তি করবেন। তারপর তাঁর কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।

৩. আইনের দর্শন, স্থায়ী মূল্যবোধ এবং মহাবিশ্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও পরিণতি

আইনের দর্শন হলো “প্রতিটি ক্রিয়া (তা সঠিক হোক বা ভুল) একটি প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।” শারীরিক ক্ষেত্রে এটি একটি নিয়মিত ঘটনা যা পর্যবেক্ষণ ও গ্রহণ করা সহজ। যেমন, খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে ক্ষুধার নিবৃত্তি হয়। কিন্তু অন্যায়ভাবে যোগাড় করা খাবার কিভাবে ব্যক্তিত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তা অনুভব করা সহজ নাও হতে পারে।
'জীবনের বস্তুবাদী ধারণা' স্থায়ী মূল্যবোধে বিশ্বাস করে না কারণ এটি মানুষের ব্যক্তিত্বের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয় না। বস্তুবাদীরা শুধুমাত্র সমাজ/সরকার কর্তৃক প্রণীত সামাজিক আইনকেই স্বীকৃতি দেয়। এই আইনগুলি তখনই পরিণতি বহন করে যখন প্রাসঙ্গিক সমাজ কাজগুলি জানতে পারে - এবং এটি একটি সমাজ থেকে অন্য সমাজে ভিন্ন বা পরিবর্তিত হয়।

কুরআন অনুসারে মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পেছনে স্থায়ী প্রাকৃতিক ও নৈতিক আইনের বন্ধন। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ লক্ষ্যণীয় :

৪৫:২২ :: আর আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী যথাযথভাবে/ যৌক্তিকভাবে/ সঠিক উদ্দেশ্যে। আর যেন প্রতিফল দেয়া যায় প্রত্যেক ব্যক্তিকে তারা যা উপার্জন করেছে তার কারণে। আর তাদেরকে যুলুম করা হবে না।

৫৩:৩১ :: আর আল্লাহরই আয়ত্তে যা কিছু আছে আকাশমন্ডলীতে ও যা কিছু আছে পৃথিবীতে। যেন তিনি তাদেরকে প্রতিফল দেন যারা মন্দ করেছে ঐ বিষয়ে যা তারা আমল করেছে। আর যেন তিনি তাদেরকেও প্রতিফল দেন যারা উত্তম কাজ করেছে উত্তম (প্রতিফল) এর মাধ্যমে।

১০:৪ :: তাঁরই কাছে তোমাদের সবার ফিরে যাবার স্থান। আল্লাহর ওয়াদা সত্য। নিশ্চয় তিনি সৃষ্টিকে প্রথম অস্তিত্বে আনেন তারপর তাকে পুনরাবর্তিত করবেন, তাদেরকে প্রতিফল দেয়ার জন্য যারা ঈমান/ বিশ্বাস করেছে আর সৎকর্ম করেছে, ন্যায়বিচারের সাথে; আর যারা কুফর করেছে তাদের জন্য আছে ফুটন্ত পানীয় আর কষ্টদায়ক শাস্তি; কারণ তারা কুফর করতো।

১১:৭ :: আর তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশমন্ডলী আর পৃথিবী ছয় দিবসে (ছয় মহাকালে)। আর এর আগে তাঁর আরশ (গদি/ ক্ষমতার আসন) ছিলো পানির উপর। যেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, তোমাদের মধ্যে কে কাজকর্মে অধিক উত্তম। আর নিশ্চয় যদি তুমি বলো, ‘নিশ্চয় তোমরা পুনরুত্থিত হবে মৃত্যুর পরে’, তাহলে যারা কুফর করেছে তারা বলবে, ‘ইহা (কুরআন) কিছু নয় স্পষ্ট যাদু/ ভেল্কিবাজি ছাড়া’।

১৮:৬ :: নিশ্চয় আমরা বানিয়েছি যা কিছু আছে পৃথিবীতে উহার সৌন্দর্যস্বরূপ, তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য যে তাদের মধ্যে কে কাজে কর্মে অধিক উত্তম?

৬৭:২ :: যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য তোমাদের মধ্যে কে কাজে কর্মে অধিক উত্তম? আর তিনি মহাশক্তিমান ও মহাক্ষমাশীল।

২১:৩৫ :: প্রত্যেক নফসই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর আমরা তোমাদেরকে পরীক্ষা করি মন্দ ও উত্তম অবস্থা দিয়ে, (যা তোমাদেরকে দেয়া হয়) পরীক্ষাস্বরূপ। আর আমাদের কাছেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে আনা হবে।

মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে ‘হক্ব’ সহকারে

কুরআন আমাদেরকে জানায় যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টি করা হয়েছে সঙ্গতভাবে, তা অসঙ্গতভাবে সৃষ্টি করা হয় নি। (হক্ব সহকারে : ১০:৫, ১৪:১৯, ১৫:৮৫, ১৬:৩, ২৯:৪৪, ৩৯:৫, ৪৪:৩৯, ৪৫:২২, ৬৪:৩; বাতিল নয় : ৩:১৯১, ৩৮:২৭)। হক্ব মানে সত্য, সঠিক, বাস্তবতা, যৌক্তিকতা, যথাযথ উদ্দেশ্য ও পরিণতি, সঙ্গত ব্যবস্থাপনা, গঠনমূলক।

সবকিছুর তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণ এই ‘হক্ব’ বা ‘বাস্তবতা’র একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান, যা উপলব্ধিযোগ্য। মানুষ এর ব্যাপক উপকার পেতে পারে যদি প্রকৃতির ভৌত আইন অধ্যয়ন করে এবং মানব সমাজের জন্য আল্লাহর আইন গ্রহণ করে কর্মে যোগ দেয়। ৪৫:১৩ ও ৬৫:৩ আয়াত এ বিষয়েই নির্দেশনা প্রদান করে।

৪৫:১৩ :: আর তিনি নিয়োজিত করে দিয়েছেন তোমাদের জন্য যা কিছু আছে আকাশমন্ডলীতে আর যা কিছু আছে পৃথিবীতে তার সবকিছুকে। নিশ্চয় উহাতে আছে নিদর্শনসমূহ সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা বৈজ্ঞানিক চিন্তা-গবেষণা করে।

সুতরাং মহাবিশ্বের সবকিছু যে প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে মানুষের উপকারে নিয়োজিত রয়েছে তা বৈজ্ঞানিক চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কারযোগ্য।

৬৫:৩ :: আর তিনি তাকে (স্রষ্টা-সচেতন ব্যক্তিকে) রিযিক দেবেন এমন স্থান থেকে/ এমন উপায়ে যা সে হিসাব/ ধারণাও করে না। আর যে ভরসা করে আল্লাহর উপর, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর আদেশদানে পূর্ণতার অধিকারী। নিশ্চয় আল্লাহ সেট করে দিয়েছেন সকল সত্তা ও বিষয়ের জন্য প্রাকৃতিক পরিমাপ।

সুতরাং যারা আল্লাহর বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করে তারা আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক পরিমাপ অনুসারে তাদের প্রাপ্য পাবে এবং সেই সাথে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে অভাবনীয় উপায়ে উত্তম জীবিকা প্রাপ্ত হবে।

মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর মহাপরিকল্পনা / মানুষের কর্মের পরীক্ষা এবং সেজন্য কাউকে কম-বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া

৬:১৬৫ :: আর তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছেন। এবং তিনি তোমাদের এককে অপরের তুলনায় যোগ্যতা-সামর্থ্য ও সুযোগ-সুবিধার বিভিন্ন মাত্রায় উন্নীত করেছেন। যেন তোমাদেরকে যা (কম বা বেশি) দেয়া হয়েছে তা অনুসারে (তা যথাযথভাবে বিবেচনায় রেখে) / তার ক্ষেত্রে (দায়িত্বশীলতার) পরীক্ষা নিতে পারেন (এবং তা বিবেচনায় রেখে সে অনুসারে তোমাদের পরীক্ষা নিতে পারেন)। নিশ্চয় তোমার প্রভু (দায়িত্বহীন আচরণের) শাস্তিদানে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণকারী এবং নিশ্চয় তিনি (অনুতপ্তদের প্রতি) ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
আল্লাহ কাউকে কম বা বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন কথাটির তাৎপর্য হলো আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মের কার্যকারিতার মাধ্যমে কেউ কম বা বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে।

কখনো কখনো মানুষ প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যায়, তখন মানুষ সেটাকে ‘ভাগ্য’ শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করে থাকে। অথচ তা মোটেই ‘ভাগ্য’ নয়, বরং তাও প্রাকৃতিক নিয়মের কার্যকারিতার মাধ্যমে অন্যদের মিথস্ক্রিয়ায় সংঘটিত ঘটনার মাধ্যমে উৎপন্ন। এছাড়া তা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ বা অবারিত দান হতে পারে।
মানবজীবনে যা কিছু ঘটনা ঘটে এর অনেক কিছুর ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজের পছন্দক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন সে কোথায় জন্মগ্রহণ করবে, কীরূপ মেধার অধিকারী হবে, সেখানে পূর্ব থেকে কোন ব্যবস্থার পাশাপাশি উপস্থিত অন্যান্য লোকদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মিথস্ক্রিয়া কী হবে ইত্যাদি। সুতরাং এসব অনুঘটকের প্রভাবে ব্যক্তির কাজ ও তার ফলাফল যতটুকু প্রভাবিত হয় সেজন্য সে দায়ী হবে না। বরং প্রাকৃতিক ও সামাজিক এসব পরিস্থিতিগত উপাদানগুলোর উপস্থিতিতে নৈতিক ও কার্যকর পদ্ধতিগত যে সিদ্ধান্ত সে নিজে গ্রহণ করে এবং সেজন্য সে প্রচেষ্টা করে তার ভালো মন্দ উপযোগিতার জন্যই সে দায়ী হবে। প্রত্যেককে যেসব সুযোগ-সুবিধা ও যোগ্যতা-সামর্থ্য দেয়া হয়েছে তার কম বা বেশি বিবেচনায় রেখে সে পরীক্ষা দিচ্ছে এবং এর সঠিক বিবেচনাসহ তার নৈতিক ফলাফল তথা পুরস্কার বা শাস্তি নির্ধারিত হবে।

আইনের দর্শন অনুসারে কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন ‘সূত্র ও ফলাফল’ বা নীতিমালা

যখন বলা হয় “যদি… তবে…’ তখন তার মাধ্যমে একটি সূত্র ও ফলাফল তথা কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে অর্জনে কী করবে হবে বা কীরূপ কাজের পরিণতি কীরূপ হবে সেই সম্পর্কিত নীতিমালা প্রকাশ পায়। নিচে কুরআন থেকে বিভিন্ন বিষয়ের ‘সূত্র ও ফলাফল’ প্রকাশ পায় এরূপ কতিপয় আয়াত উল্লেখ করা হলো :

১। যদি তোমরা মুমিন (প্রত্যয়) হও, তবে তোমরা বিজয়ী হবেন (৩:১৩৯)।

২। আল্লাহর সমর্থন থাকলে কেউ তোমাকে পরাভূত করতে পারবে না (৩:১৫৯)। যে তাঁর ‘দ্বীন’ এর জন্য কাজ করতে উঠে, তাকে আল্লাহর সমর্থন দেওয়া হয় (২২:৪০, ৪৭:৭)।

৩। যদি তারা (আহলে কিতাব) আল্লাহর বাণী অনুসরণ করতো, তবে তাদের প্রচুর খাবার থাকতো (৫:৬৬)।

৪। যদি তারা ঈমান আনতো ও তাক্বওয়া অবলম্বন করতো, তারা সমস্ত মহাবিশ্বের অনুগ্রহ উপভোগ করতো (৭:৩৬)।

৫। যদি মু’মিনদের বিশজন যোদ্ধা (আল্লাহর পথে) অবিচল থাকে, তবে তারা দুইশত শত্রুর উপর বিজয়ী হবে - এটি তখনই যখন তাদের অস্ত্রের সরবরাহ এবং সংস্থান একই হবে। প্রাথমিক সময়কালে দ্বিগুণ শত্রুকে পরাস্ত করতে পারবে (৮:৬৫-৬৬)।

৬। যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে (আল-দ্বীনকে সমুন্নত রাখার জন্য) চেষ্টা করবে, আল্লাহ তাকে পথ দেখাবেন (২৯:৬৯)।

৭। আপনি যদি আল্লাহর আইন থেকে সরে আসেন, তাহলে আপনার স্থলাভিষিক্ত হবে অন্য জাতি (৪৭:৩৮, ৯:৩৮)।

৮। যে আল্লাহ-প্রদত্ত স্মরণীয় তথ্য ও বিধি-বিধান এড়িয়ে চলে তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে (২০:১২৪)।

৯। যদি আপনি কৃতজ্ঞ হন (আল্লাহর অনুগ্রহকে তাঁর আইন অনুসারে ব্যবহার করুন) তবে আপনি সফল হবেন। অন্যথায়, আপনাকে শাস্তি দেওয়া হবে (১৪:৭)।

১০। যে অন্যকে দান করে এবং সতর্ক জীবনযাপন করে সে সহজ জীবন পাবে (৯২:৬-১০)।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহে মহাবিশ্ব-ব্যবস্থায় আল্লাহর যেসব আইন প্রতিষ্ঠিত থাকার কথা বলা হয়েছে তা কেউ বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করতে পারে, কিন্তু সেই বিশ্বাস বা অবিশ্বাসে বাস্তবতা বদলে যাবে না। এই আইনগুলো বাস্তব মহাবিশ্ব-ব্যবস্থাকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে, যে বিষয়ে সংশয় পোষণ করলে সংশয় পোষণকারী নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং যে ব্যক্তি যৌক্তিক নিদর্শনজ্ঞানের ভিত্তিতে সফলতা অর্জনের জন্য এই সূত্রসমূহকে অনুসরণ করবে সে-ই প্রকৃত কল্যাণের অধিকারী হবে।

পরিশেষে বলা যায় যে, মহাবিশ্বকে হক্বসহ সৃষ্টি করা হয়েছে। হক্বসহ সৃষ্টি করার তাৎপর্য হলো, এটিকে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সেই উদ্দেশ্য পরিপূরণের জন্য যেভাবে সৃষ্টি করা প্রয়োজন ছিলো সেভাবে যথাযথভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে যাবতীয় ঘটনা সংঘটনের বা সংঘটিত হতে পারার মধ্যে যৌক্তিক বিন্যাস রয়েছে। ‘মহাবিশ্ব-ব্যবস্থা’ অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ, যাতে যাবতীয় ঘটনা একটি মৌলিক শৃঙ্খলা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মহাবিশ্বের মহাব্যবস্থাপনার পেছনে অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানুষকে যা কিছু যোগ্যতা-সামর্থ্য ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে তার মাধ্যমে সে স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতার কীরূপ উত্তম কর্ম সম্পাদন করে তা পরীক্ষা করা। আর মহাবিশ্বের একটি যৌক্তিক পরিণতি রয়েছে যেখানে মানুষের কর্মের পরীক্ষায় সে চূড়ান্ত ফলাফল প্রাপ্ত হবে।

৪. আল্লাহর আইনের শ্রেণিবিভাগ ও বাস্তব রূপ

আল্লাহর আইনকে চার শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে:
১. প্রাকৃতিক আইন
২. নৈতিক আইন
৩. বিশ্বাসগত/ধর্মীয় আইন
৪. সামাজিক আইন

প্রাকৃতিক আইন বা ভৌত আইন হচ্ছে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ইত্যাদির আইন। মানবদেহ এ আইন দ্বারা পরিচালিত হয়।

নৈতিক আইন হচ্ছে ন্যায়-অন্যায় কর্মের প্রতিফল সম্পর্কিত আইন, যা রাষ্ট্র কর্তৃক বলবৎকৃত দণ্ডবিধি ছাড়াই কোনো ব্যক্তির উপর তার কর্মের প্রত্যাবর্তন হিসেবে বাস্তবায়িত হয়। যেমন, একজন মিথ্যাবাদীর ব্যক্তিত্ব তার নিজের ও অন্যদের কাছে অপমানিত হয়।

বিশ্বাসগত/ ধর্মীয় আইন হচ্ছে আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর পক্ষ থেকে তাঁর মনোনীত ব্যক্তিবর্গ ও তাদের কাছে অবতীর্ণ গ্রন্থের প্রতি বিশ্বাসের ভিত্তিতে উপাসনামূলক বিধি-নিষেধ।

সামাজিক আইন অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে স্থিরিকৃত সামাজিক আইন হচ্ছে আল্লাহর অবতীর্ণ গ্রন্থের মাধ্যমে প্রদত্ত সামাজিকভাবে বলবৎযোগ্য চিরন্তন বিধি-বিধান।

সামাজিক আইনের ক্ষেত্রে একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি ও সমাজকে চিরন্তন বিধানের বাইরে অন্যান্য ক্ষেত্রে সুবিচেনাপ্রসূত আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অধিকার দেয়া হয়েছে।

প্রতিটি আইনের ক্ষেত্রে মানুষকে আইন অনুসরণের স্বাভাবিক ফল ভোগ করতে হয়। সুতরাং মানুষ কোনো পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য দ্বারা আবদ্ধ নয়। মানুষ যা করে তা তার কর্ম পছন্দের ভিত্তিতে করে, পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যের কারণে নয়। আর মানুষ যা লাভ করে তাও পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য নয়, বরং পূর্বনির্ধারিত ‘ব্যক্তিগত এবং/বা সম্মিলিত কর্মের প্রত্যাবর্তন আইন’ অনুসারে প্রাপ্ত ফলাফল।

কুরআন মানুষকে তাদের কর্মের ফলাফলের জন্য কর্মের ধরন অনুযায়ী দায়ী করে। যেমন: মানুষকে তার সাধ্যাতীত কোনো কোনো বিষয়ে কিছু সম্পন্ন করতে না পারার জন্য দায়ী করা হবে না। আবার তাকে অনিচ্ছাকৃত বা বাধ্যবাধ্যকতাজনিত কর্মের জন্য দায়ী করা হবে না।

ভৌত মহাবিশ্বে আল্লাহর আইন স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যমান আছে। আর তিনি মানুষের কাছে তার ধর্মীয়, নৈতিক ও সামাজিক জীবনের জন্য ওহীর মাধ্যমে তাঁর নির্দেশনা পাঠিয়েছেন (22/16)।

প্রাকৃতিক আইন

প্রাকৃতিক বা শারীরিক আইনগুলি একটি কাজ এবং এর ফলাফলের মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত আন্তঃনির্ভরতা প্রদর্শন করে। যেমন আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে, এটা একটা শারীরিক আইন। এটা ঘটবেই। এটা সামাজিক বা বিচারিক আইনের মতো নয় যে, কোনো সামাজিক বা বিচারিক রায় কর্মের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রাকৃতিক আইনের আওতায় যে মধু সেবন করে সে-ই মধুর স্বাদ পায়, যে সেবন করে না সে পায় না। কিন্তু সেই সাথে পৃথিবীতে মানবজাতি সম্মিলিতভাবে এক জাতি হিসেবে নিজেদের কল্যাণে কাজ করতে দায়বদ্ধ। কিন্তু কোনো লোক যখন এই ঐক্যবোধকে বিসর্জন দেয়, তখন সে নিজের সংকীর্ণ স্বার্থে অন্যের ক্ষতি করতে পারে। যেমন, কেউ অন্যকে সেতু থেকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিতে পারে, যার ফলে যাকে ফেলে দেয়া হলো সে নদীতে ডুবে মারা যেতে পারে। অথবা সেতু নির্মাণে ত্রুটিপূর্ণ কাজের কারণে কেউ সেতু ভেঙ্গে পড়ে যেতে পারে। খারাপ প্রশাসনের কারণে জনদুর্ভোগ হতে পারে, একজন ড্রাইভারের অসাবধানভাবে ড্রাইভিং করার কারণে ঘটা দুর্ঘটনায় অনেক যাত্রী হতাহত হতে পারে, ইত্যাদি। এসব দুর্যোগ বা বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে মানব-প্রজাতিকে (ইনসান) দায়ী করা হয়, কারণ এতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি নিজে সরাসরি দায়ী না হলেও সামগ্রিকভাবে মানব জাতির কোনো না কোনো সদস্যের দোষ-ত্রুটির ফলে বিপর্যয়টি সংঘটিত হয়।

তবে চূড়ান্ত বিচার দিবসে কোনো ব্যক্তি কোনো ক্রমে অন্যের ভালো কাজের কারণে পুরস্কৃত হবে না এবং অন্যের দোষ-ত্রুটির কারণে শাস্তিও পাবে না। বরং প্রত্যেকে নিজের ভালো কাজের কারণে পুরস্কৃত হবে অথবা নিজের মন্দ কাজের কারণে শাস্তি পাবে।

বর্তমানে তথা পৃথিবীতে অসৎ সমাজে কোনো ব্যক্তি এমন বিষয়ের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যে বিষয়ে তিনি দায়ী নন। যখন অসৎ সমাজে একজন সৎ কর্মকর্তা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন, তখন মনে হতে পারে যে, নৈতিক আইন অনুযায়ী যেভাবে ঘটার কথা তা যেন বিপরীতভাবে কাজ করছে। অর্থাৎ মনে হতে পারে যে, ভালো কাজ ভালো ফলের পরিবর্তে মন্দ ফল উৎপন্ন করছে।

বস্তুত মানুষের ব্যক্তিজীবন সমাজ জীবনের মধ্যে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত, যেহেতু ব্যক্তি সমাজের সদস্য। আর তাই ব্যক্তি সমাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়, উপকৃত হয় এবং ক্ষতিগ্রস্তও হয়। যেমন একটি ভালো ফসল এমনকি যারা কৃষিকাজের সাথে একেবারেই যুক্ত নয় তাদেরও উপকার হয়। অন্যদিকে একটি ত্রুটিপূর্ণ কাজের ফলস্বরূপ ফেটে যাওয়া বাঁধ তাদেরকেও প্লাবিত বা ক্ষতিগ্রস্ত করে, যারা এর নির্মাণ বা রক্ষণাবেক্ষণের সাথে সম্পর্কিত নয়।

নুরূপভাবে যখন সমাজে মন্দের প্রসার ঘটে, তখন যারা এর প্রসার ঘটায় তাদের পাশাপাশি অন্যরাও এর দ্বারা মন্দভাবে প্রভাবিত হয়। তাই মু’মিনদের করণীয় হলো সমাজ সংস্কারের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অবলম্বন করা।
৮:২৫ :: আর তোমরা ভয় কর ফিতনাকে যা তোমাদের মধ্য থেকে বিশেষভাবে শুধু যালিমদের উপরই আপতিত হবে না। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ আযাব প্রদানে কঠোর।

এটা মানুষের অদ্ভুত আচরণ যে, সে যখন নিজে সরাসরি দায়ী নয় এমন কোনো ভালো সুযোগ-সুবিধা পায় তখন সে তা প্রত্যাখ্যান করে না। অথচ যখন সে সরাসরি দায়ী নয় এমন কোনো দুর্দশার সম্মুখীন হয় তখন সেটাতে নিজের পরোক্ষ দায়কে স্বীকার করে না।

আমরা সূরা সাবায় সমাজের নেতা ও জনতার মধ্যে সমাজের অসুস্থতার জন্য একে অপরকে দায়ী করার তর্কের একটি দৃষ্টান্ত পাই। আর কুরআন অন্যায়ের জন্য নেতা এবং তাদের ক্ষমতার ভিত্তি হওয়ার জন্য জনতা উভয়কে দায়ী করে, কারো অজুহাতকেই গ্রহণ করে না।

৩৪:৩১-৩৩ :: আর যারা কুফর করেছে তারা বলে, ‘আমরা ঈমান/ বিশ্বাস করবো না এই আল কুরআনের প্রতি আর যা উহার সামনে আছে (যা উহার আগে নাযিল হয়েছিলো) সেসবের প্রতিও (বিশ্বাস করবো) না’। আর যদি তুমি দেখতে যখন যালেমদেরকে দাঁড় করানো হবে তাদের রবের কাছে! তখন ফিরিয়ে দেবে তাদের একে অপরের দিকে (তার) কথাকে (তারা বাদানুবাদ করবে)। যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিলো তারা বলবে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে যারা অহংকার করতো/ বড় বনে ছিলো, ‘যদি তোমরা না থাকতে তাহলে আমরা মু’মিনীন/ বিশ্বাসী হতাম’। যারা অহংকার করতো/ বড় বনে ছিলো তারা বলবে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিলো, ‘আমরা কি তোমাদেরকে বাধা দিয়েছিলাম হিদায়াত গ্রহণ থেকে উহার পরও যখন তা তোমাদের কাছে এসেছিলো? বরং তোমরাই তো ছিলে অপরাধী (তোমরা স্বেচ্ছায় অন্যায়কে পছন্দ করে নিয়েছিলে)’। আর যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিলো তারা বলবে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে যারা অহংকার করতো/ বড় বনে ছিলো, ‘বরং (তোমাদের পক্ষ থেকে) রাত দিনের কৌশল ছিলো, যখন তোমরা আমাদেরকে আদেশ দিতে যেন আমরা কুফর/ অবিশ্বাস করি আল্লাহর প্রতি আর যেন আমরা সাব্যস্ত করি তাঁর সমকক্ষ’ (তাহলে কিভাবে তোমরা দায় এড়াতে পারো?)। আর তারা গোপন করবে (তাদের) অনুতাপ (তারা মনে মনে অনুতপ্ত হবে), যখন তারা আযাব দেখবে। আর আমরা ফাঁস/ শিকল লাগিয়ে দেবো তাদের গলায় যারা কুফর/ অবিশ্বাস করেছিলো। প্রতিফল দেয়া হবে কি উহা অনুযায়ী ছাড়া যা তারা আমল/ কাজ করতো?

৩৭:২৭-৩৪ :: আর সেদিন মোকাবেলা করবে তাদের একে অপরকে। তারা পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করবে। তারা (অনুসরণকারীরা) বলবে, “নিশ্চয় তোমরা আমাদের কাছে আসতে ডানদিক থেকে (তোমরা আমাদের উপর প্রভাবশালী ছিলে এবং আমাদেরকে শপথ করে বলতে যে, তোমরা আমাদের কল্যাণকামী।)।” তারা (তাদের নেতারা) বলবে, “বরং তোমরা মু’মিন/ বিশ্বাসী ছিলে না। আর আমাদের কাছে ছিলো না তোমাদের উপর কোন প্রমাণপত্র। বরং তোমরাই ছিলে বিদ্রোহী কওম। সুতরাং সত্য হয়েছে আমাদের উপর আমাদের রবের বাণী। নিশ্চয় আমরা (শাস্তির) স্বাদ আস্বাদনকারী হবো। কারণ আমরা তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিলাম। আর নিশ্চয় আমরাও ছিলাম বিভ্রান্ত।” তারপর নিশ্চয় তারা সেদিন আযাবের মধ্যে অংশীদার হবে। নিশ্চয় এরূপই আমরা করি অপরাধীদের সাথে।

সুতরাং কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী মানুষের কাছ থেকে অসহায় হওয়ার অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়, যখন সে তার অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কোনোরূপ চেষ্টা করে না।

যদিও এটা সম্পূর্ণভাবে সম্ভব যে, ব্যক্তিরা তাদের সমাজে পরিবর্তন আনতে তাদের প্রাথমিক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়। কিন্তু এটি নিষ্ক্রিয়তার অজুহাত হিসাবে অসহায়ত্বকে উপস্থাপন করা থেকে আলাদা।

৪:৯৭-৯৯ :: নিশ্চয় যারা এমন যে, তাদের (নফসের) ওফাত করে (তাদের মৃত্যুর সময় তাদের প্রাণ নিয়ে যায়) ফেরেশতাগণ তারা নিজেদের উপর যুলমকারী থাকা অবস্থায়। (তাদেরক মৃত্যুর সময় ফেরেশতাগণ) বলে, “তোমরা কী অবস্থায় ছিলে?” তারা বলে, “আমরা ছিলাম পৃথবীতে দুর্বল-নির্যাতিত-নিষ্পেষিত অবস্থায়।” (তখন ফেরেশতাগণ) বলে, “আল্লাহর পৃথিবী কি ছিলো না প্রশস্ত? সুতরাং তোমরা উহাতে হিজরাত করতে।” সুতরাং তারা এমন লোক যাদের আবাস জাহান্নাম। আর তা খুবই মন্দ অবস্থান। ঐ সব দুর্বল-নির্যাতিত-নিষ্পেষিতরা ছাড়া - পুরুষ, নারী ও শিশুদের মধ্য থেকে যারা সক্ষম হয় না কোনো উপায় অবলম্বনের আর তাদের পথও জানা নেই। তারাই এমন লোক যে, হয়তো আল্লাহ তাদেরকে উদারতা প্রদর্শন করবেন। আর আল্লাহ উদার, ক্ষমাশীল।

নৈতিক আইন বা স্থায়ী মূল্যবোধের আইন

নৈতিক আইনের প্রকৃতি অনুধাবনের জন্য প্রথমে উল্লেখ্য যে, কোনো কর্ম প্রসঙ্গে ‘যদি এ কাজটি করা হয় তাহলে সর্বদা এটি ঘটবে’ বা ‘এ কাজটি করা উচিত যেন এরূপ ফলাফল ঘটে’ কর্মবিধির মাধ্যমে স্বাধীন ইচ্ছার স্থান দেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমরা একজন অন্ধ ব্যক্তিকে বলতে পারি না যে, যদি আপনি কোথায় যাচ্ছেন সেদিকে না তাকান তাহলে আপনি ছিটকে পড়বেন। কারণ অন্ধ ব্যক্তির জন্য তাকানোর নির্দেশনা প্রযোজ্য হতে পারে না।

যদি তোমরা অভাবীদেরকে সহায়তা করো তাহলে তোমাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও সমাজের উন্নতি হবে, অন্যদিকে যদি তা না করো, তাহলে তোমাদের ব্যক্তিত্ব ও সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে, এটা একটা নৈতিক আইন বা স্থায়ী মূল্যবোধের আইন।

নৈতিক আইনে কোনো বিষয়ের নৈতিক ভালো-মন্দ মূল্যায়ন বা ফলাফলের ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য বা নৈতিক ব্যবহার বিবেচনাযোগ্য। একটি তলোয়ার যখন একজন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠার যোদ্ধা ব্যবহার করে তখন তার ব্যবহারকে ভালো কাজে ব্যবহার বলা যেতে পারে এবং যখন একজন জালিম তা ব্যবহার করে তখন তার ব্যবহারকে মন্দ কাজে ব্যবহার বলা যেতে পারে। সুতরাং বস্তুগত ব্যবহার ন্যায়সঙ্গত কিনা তা ব্যবহারের উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে।
নৈতিক আইনের প্রকৃত উপলব্ধি ও অনুসরণের জন্য আল্লাহর ওয়াহীর উপর নির্ভর করা প্রয়োজন হয়। কারণ মানুষ তার বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা স্থায়ী মূল্যবোধের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে, কিন্তু তার বংশগতি থেকে প্রাপ্ত জৈবিক প্রবৃত্তি (যেমন : আত্মরক্ষণ ও আগ্রাসন) বা আবেগ দ্বারা তার মনোভাব স্থায়ী মূল্যবোধ থেকে বিকর্ষিতও হতে পারে। এমতাবস্থায় সে স্থায়ী মূল্যবোধকে বিসর্জন দেয়াকে যুক্তিযুক্ত হিসেবে অনুমান করে বা দাবি করে। আত্মরক্ষণ গোষ্ঠী স্তরে জাতীয় স্বার্থরক্ষায় বিবর্তিত হয়। আর এটি উগ্র জাতীয়বাদের জন্ম দেয়। যার ফলে বিশ্বব্যাপী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এমনকি এই গোষ্ঠীস্বার্থের সংকীর্ণতা আবার নিজ জাতিকেও পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে।

এমতাবস্থায় নৈতিক ভালো-মন্দ সম্পর্কে আল্লাহর আইন অনুসরণ করার জন্য একমাত্র আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাবেই স্থায়ী মূল্যবোধ পাওয়া যায়। অর্থাৎ নৈতিক আইন অনুযায়ী কল্যাণ অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় স্থায়ী মূল্যবোধগুলো কুরআনে সংরক্ষিত আছে। মানুষ যখন আল্লাহর বাণী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্থায়ী মূল্যবোধ অনুসরণ করে, তখন মঙ্গল ঘটে। নইলে অমঙ্গল ঘটবে। যে সমাজ স্থায়ী মূল্যবোধকে অস্বীকার তাতে ভুল ব্যবস্থা চালু হয়, যার পরিণতি মন্দ হয়।

১৬:৩০ :: আর যারা স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করে তাদেরকে যখন বলা হয় যে, “তোমাদের প্রভু কী নাযিল করেছেন?” তখন তারা বলে, “কল্যাণ”। যারা ভালো কাজ করে তাদের জন্য দুনিয়াতেও কল্যাণ রয়েছে। আর (তাদের জন্য) আখিরাতের ঘরও কল্যাণময়। আর স্রষ্টা-সচেতনদের ঘর কত নেয়ামতপূর্ণ!

ভাল ও মন্দ শারীরিক স্তরে বস্তুগত লাভ-ক্ষতি হিসাবে বেশ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। কোনো কিছু কোনো পরিস্থিতিতে ভালো এবং ভিন্নরূপ পরিস্থিতিতে মন্দ হতে পারে। যেমন, যদি কেউ সুস্থ থাকে তবে দুধ ভাল কিন্তু রোগাক্রান্ত অবস্থায় তা মন্দ হতে পারে।

মানুষের ব্যক্তিত্ব বা নৈতিকতার স্তরে ভালো ও মন্দের বিষয়টি বস্তুগত লাভ-ক্ষতির চেয়ে ঊর্ধ্বে একটি বিষয়, যেখানে নৈতিক ভালোর জন্য কোনো বস্তুগত সুবিধা ত্যাগ করার প্রয়োজন হতে পারে। নৈতিকতার বিষয়টি পশু জগতের সাথে সম্পর্কিত নয়, তা মানব ব্যক্তিত্বের একচেটিয়া বিষয়।

একজন ধর্মনিরপেক্ষ বা অ-মু’মিন ব্যক্তির কাছে নৈতিক মূল্যবোধ স্থায়ী গুরুত্ব বহন করা নিশ্চিত নয়, কারণ তার কাছে তা মানুষের সামাজিক সুবিধার জন্য গড়ে উঠা সামাজিক মূল্যবোধ মাত্র। নৈতিক মূল্যবোধের ব্যক্তিত্বগত ফলাফল তার কাছে গৌন এবং আপোষযোগ্য। অন্যদিকে একজন মু’মিনের কাছে নৈতিক মূল্যবোধ স্থায়ী গুরুত্ব বহন করে। যেহেতু নৈতিক মূল্যবোধের লঙ্ঘনের ফলে ব্যক্তিত্বের অবক্ষয় ঘটে তাই সে মূল্যবোধের সংরক্ষণের জন্য শারীরিক ত্যাগ স্বীকারেও প্রস্তুত থাকে। যেমন রসূলুল্লাহ ইউসুফ ব্যভিচারের চেয়ে নিজের জন্য জেলখানাকে উত্তম বিবেচনা করেছেন।

ধর্মীয় আইন

ধর্মীয় আইনে যেসব ধর্মীয় রীতি-নীতি পালনের বিধান রয়েছে তা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যমূলক। যেমন : সালাতের মাধ্যমে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকা সম্ভব হয়। এখন যদি কোনো ব্যক্তি সালাত সম্পাদন করে অথচ সে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত না হয়, তার মানে হলো তার সালাত সেভাবে সম্পাদিত হচ্ছে না, যেভাবে তা সম্পাদিত হওয়া উচিত। এমতাবস্থায় তার সালাত ব্যর্থ হচ্ছে। এটাকে কুরআনে ‘আমল বিনষ্ট হওয়া’ শব্দে উল্লেখ করা হয়। তবে প্রচলিত চিন্তায় ধর্মীয় রীতিনীতি এমন বিষয়ে পর্যবসিত হয়েছে যার কোনো বাস্তবভিত্তিক উদ্দেশ্য নেই, বরং আচারটি সম্পাদন করলেই স্রষ্টা সন্তুষ্ট হবেন বলে ধরে নেয়া হয়। এটা ধর্মীয় রীতির বিষয়ে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। কুরআন এ ধারণার প্রতিবাদ করে এবং এরূপ আচারসর্বস্ব ধর্মীয় রীতিতে কোনো পুণ্য নেই, বরং যে ব্যক্তি এরূপ ধর্মাচার পালন করা সত্ত্বেও বাস্তব কাজে ঐ ধর্মাচারের প্রকৃত উদ্দেশ্যের বিপরীত চরিত্র ধারণ করা হয়, সে ধরনের ধর্মাচারীদের (মুসল্লী) জন্য দুর্ভোগের ঘোষণা দেয়।

সামাজিক আইন

সামাজিক বা বিচারিক আইন কোনো অন্তর্নিহিত পারস্পরিক নির্ভরতা দেখায় না। উদাহরণস্বরূপ, চুরি করার জন্য জেল বা জরিমানা উল্লেখ করে এমন একটি আইন নিন। মনে করি, একটি নির্দিষ্ট বিচার বিভাগ চুরি করাকে আইনগত অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করে না। সেক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি চুরি করা সত্ত্বেও পার পেয়ে যাবে বরং যে ব্যক্তির সম্পদ চুরি করলো সে-ই তিরস্কৃত হতে পারে যে, কেন সে আরো বেশি সাবধানতা অবলম্বন করলো না? তারপর যে সমাজে চুরিকে যেরূপ শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করে সেই সমাজে চুরির জন্য সেরূপ শাস্তির আইন প্রণয়ন করা হবে। অর্থাৎ যদি তুমি চুরি করো, তাহলে তোমাকে এই শাস্তি ভোগ করতে হবে- এটাই আইন (কর্ম ও কর্মফলের সম্পর্কনীতি)। সামাজিক আইনের এরূপ প্রকৃতির ফলে সামাজিক অপরাধের ফলাফল হিসেবে কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কার্যকরযোগ্য দণ্ডবিধি বিভিন্ন সমাজে বিভিন্নরূপ হতে পারে এবং তা পরিবর্তনশীল।

মু’মিনদের সমাজে সামাজিক আইনগুলো স্থায়ী মুল্যবোধের উপর ভিত্তিশীল এবং তাদের কাছে এ স্থায়ী মুল্যবোধ বিবেকের পাশাপাশি আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের (কুরআন) দ্বারা নির্ধারিত। এমতাবস্থায় কুরআন দ্বারা নির্ধারিত কোনো সামাজিক নৈতিকতাকে সে কোনোক্রমে এড়িয়ে যেতে পারে না। যেমন কুরআন অনুযায়ী ব্যভিচার একটি অপরাধ যা ব্যক্তিত্বের অবক্ষয় ঘটায় এবং একই সাথে এর ফলে সামাজিকভাবে বলবৎযোগ্য দণ্ড হলো জনসমক্ষে ১০০ বেত্রাঘাত। যেহেতু কুরআন এজন্য একটি শাস্তি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে এমতাবস্থায় এর শাস্তি স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট। এভাবে মু’মিনদের সমাজে সকল আইন ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের মতো অস্থায়ী নয়, বরং তাদের কাছে কুরআনে বর্ণিত আইনগুলো নির্দিষ্ট ও স্থায়ী এবং শুধুমাত্র এর বাইরে অন্যান্য সামাজিক আইন অস্থায়ী।

একটি বস্তুবাদী সমাজেও সামাজিক আচরণ ও সামাজিক কাঠামো অটুট রাখার উপযোগী আইন থাকে, যেগুলোর ভিত্তি হিসেবে সমাজ স্বীকৃত মূল্যবোধকে উল্লেখ করা হয়। এগুলোকে আপেক্ষিক বা একেক সমাজে একেক রকম হতে পারে বলে মেনে নেয়া হয়। এমতাবস্থায় সেখানে নৈতিকতার জন্য স্থায়ী অনুপ্রেরণার অভাব থাকে, যার ফলে মানব ব্যক্তিত্ব কোনোরূপ নৈতিক স্খলনের ক্ষেত্রে অনুশোচনা অনুভব করার যৌক্তিকতা উপলব্ধ হয় না।

উদাহরণস্বরূপ, একটি ধর্মনিরপেক্ষ (বস্তুবাদী) সমাজের একজন ব্যক্তি মিথ্যা বলার কিছুই ভাববেন না যদি এটি উপকারী হয় এবং সমাজের আইন-প্রয়োগকারী যন্ত্র দ্বারা এটি সনাক্ত করা যায় না।

অন্যদিকে কুরআন মানব-ব্যক্তিত্বের জন্য স্থায়ী মূল্যবোধের উৎস, যেখানে একজন ব্যক্তি নৈতিক আচরণ করার উদ্দেশ্য হলো তার ব্যক্তিত্বকে কলুষমুক্ত বা পরিশুদ্ধ রাখা। একজন বিশ্বাসী ব্যক্তিত স্থায়ী মূল্যবোধ রক্ষার জন্য বস্তুগত সুবিধা প্রত্যাখ্যান করে থাকে। যেহেতু সমাজে বস্তুবাদী ব্যক্তিদের অস্তিত্ব রয়েছে, তাই বিশ্বাসীগণ স্থায়ী মূল্যবোধের উপর অটল থাকতে গিয়ে বস্তুগত সম্মুখীন হয়ে থাকে।

তবে স্থায়ী মূল্যবোধ ও বস্তুবাদের মধ্যে সংঘাতের ক্ষেত্রে বস্তুগত ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকা এবং আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত উভয় ধরনের কল্যাণ অর্জনের জন্য স্থায়ী মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ-কাঠামো বিনির্মাণের প্রচেষ্টা করা উচিত। এরূপ সমাজ বিনির্মাণ করতে পারলে জাগতিক কল্যাণ ও পারলৌকিক কল্যাণ উভয়টি অর্জন করা সম্ভব হয়। স্থায়ী মূল্যবোধ রক্ষা করে জীবন যাপন করাকেই স্রষ্টা-সচেতনতা বা তাক্বওয়া বলা হয়।

২:১০৩ :: আর যদি তারা ঈমান আনতো এবং স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন করতো, তবে অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে (তাদের জন্য) প্রতিদান উত্তম/ কল্যাণকর হতো। যদি তারা জানতো!

৩:১৯৮ :: কিন্তু যারা তাদের প্রভুকে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশে প্রবাহিত হবে নহরসমূহ, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে মেহমানদারী। আর আল্লাহর নিকট যা রয়েছে তা সৎকর্মশীলদের জন্য উত্তম।

১৬:৯৫ :: আর তোমরা বিক্রয় করো না আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতিকে অল্প মূল্যে (বস্তুগত সুবিধার বিনিময়ে)। প্রকৃতপক্ষে যা আল্লাহর কাছে আছে উহাই তোমাদের জন্য উত্তম/ কল্যাণকর। যদি তোমরা জানতে!

২:২১৬ :: তোমাদের উপর যুদ্ধের বিধান দেয়া হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। এবং হতে পারে কোনো বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হতে পারে কোনো বিষয় তোমরা পছন্দ করছো অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।

৯:৪১ :: তোমরা হালকা ও ভারী উভয় অবস্থায় যুদ্ধে বের হও এবং তোমাদের মাল ও জান নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম/কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে!

অর্থাৎ স্থায়ী মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ-পরিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামে যে বস্তুগত ক্ষতি তা তোমাদের অপছন্দ এবং এরূপ সংগ্রাম থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে বস্তুগত সুবিধা ভোগ করা তোমাদের পছন্দ। কিন্তু এতে তোমাদের প্রকৃত কল্যাণ নেই। এ বিষয়টি তোমরা জানো না, কারণ তোমাদের তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতায় প্রকৃত কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কিন্তু আল্লাহ জানেন যে, তোমাদের ব্যক্তিত্বের কল্যাণ-অকল্যাণই তোমাদের জন্য চূড়ান্ত কল্যাণ-অকল্যাণ এবং সেজন্য সংগ্রাম-সাধনাই তোমাদের সার্বিক কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। তোমরা এটা জানবে শুধুমাত্র যদি তোমরা আল্লাহর জানানো তথ্য ও বিধানকে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করো।

একজন মু’মিন বস্তুগত লাভ-ক্ষতি বা ভালো-মন্দ অবস্থাকে পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। এ পরীক্ষায় তার কর্তব্য হলো, বস্তুগত স্বার্থের জন্য কোনোক্রমেই স্থায়ী মূল্যবোধকে বিসর্জন না দেয়া। কারণ স্থায়ী মূল্যবোধ ত্যাগ করলে তার ব্যক্তিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং চূড়ান্ত বিচারে সে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

২১:৩৫ :: প্রত্যেক নফসই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর আমরা তোমাদেরকে পরীক্ষা করি মন্দ ও উত্তম অবস্থা দিয়ে, (যা তোমাদেরকে দেয়া হয়) পরীক্ষাস্বরূপ। আর আমাদের কাছেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে আনা হবে।

৫. বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ-অকল্যাণ

৫:১০৫ :: হে ঐসব লোক যারা ঈমান/ বিশ্বাস করেছো, তোমাদের উপর দায়িত্ব তোমাদের নিজেদের। তোমাদেরকে ক্ষতি করতে পারবে না যে বিভ্রান্ত হয়েছে সে, যখন তোমরা হিদায়াতের উপর থাকবে। আল্লাহরই দিকে ফিরে যেতে হবে তোমাদের সকলকে। তারপর তিনি জানিয়ে দিবেন তোমাদেরকে ঐ বিষয়ে যা তোমরা করতে।

সূরা মায়েদার এ আয়াতটিতে (৫:১০৫) বলা হয়েছে যে, সঠিক পথনির্দেশ গ্রহণকারীরা অন্যায়কারীদের থেকে নিরাপদ থাকবে। তাই আমরা যখন বাস্তবে এর বিপরীত অভিজ্ঞতা পাই যে, একজন ধার্মিক, সৎ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়, অন্যায় করা হয় এবং তারা বিপথগামীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন আমাদের মধ্যে প্রশ্ন জাগে যে, কুরআনের উপরোক্ত বক্তব্যের প্রকৃত তাৎপর্য কী?

এ বিষয়টি বুঝার জন্য প্রথমে লক্ষণীয় যে, মানব জীবনের দুটি স্তর রয়েছে। একটি শারীরিক, প্রাকৃতিক আইন সাপেক্ষ। এক্ষেত্রে ভাল এবং খারাপ মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, উভয়ের জন্য সমানভাবে কাজ করে। একটি শিখা যে কাউকে পুড়িয়ে দেয় - আস্তিক বা অবিশ্বাসী। একইভাবে, বিষ উভয়কেই হত্যা করে। সঠিক কৃষি জ্ঞান অনুযায়ী জমি চাষ করলে প্রত্যেকের জন্য ভাল ফসল হয়।

১৭:১৮-২০ :: যে ইচ্ছা করে (সব সুখ-সম্পদ) তাড়াতাড়ি (পার্থিব জীবনেই) পেতে, আমরা তাড়াতাড়ি দিই তার জন্য উহাতে (পৃথিবীতে) যা আমরা ইচ্ছা করি, যাকে আমরা (দেয়ার) ইচ্ছা করি (অর্থাৎ যারা আল্লাহর প্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী চেষ্টা করে তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত পার্থিব সুবিধা পেয়ে থাকে)। তারপর আমরা নির্ধারণ করি তার জন্য জাহান্নাম। সে উহাতে জ্বলবে নিন্দিত অবস্থায় ও রহমত থেকে বঞ্চিত অবস্থায়। আর যে ইচ্ছা করে আখিরাত পেতে আর প্রচেষ্টা চালায় (কাজ করে) তার জন্য (তার উপযোগী) তার (যথাযথ) চেষ্টার মাধ্যমে, এ অবস্থায় যে, সে একজন মু’মিন (স্থায়ী মূল্যবোধে বিশ্বাসী), তারাই এমন লোক যাদের প্রচেষ্টা হয় (আল্লাহর কাছে) স্বীকৃত/ গৃহীত। (পার্থিব জীবনে) প্রত্যেককেই আমরা সাহায্য করি, এদেরকেও এবং ওদেরকেও, তোমার রবের দান থেকে। আর তোমার রবের দান বন্ধ-অবরুদ্ধ হয় না।

৪২:২০ :: যে পেতে ইচ্ছা করে আখিরাতের ফসল, আমরা তাকে বাড়িয়ে দিই তার ফসলের মধ্যে। আর যে পেতে ইচ্ছা করে দুনিয়ার ফসল, আমরা তাকে দান করি উহা থেকে (দুনিয়া থেকে)। আর তার জন্য নেই আখিরাতে কোনো অংশ।

জীবনের অন্য স্তর হলো শারীরিক থেকে উচ্চতর আধ্যাত্মিক স্তর এবং এ স্তরে মানুষ স্থায়ী নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই মূল্যবোধ অনুসারে জীবনযাপন করা মানুষের ব্যক্তিত্বকে উৎকর্ষিত করে এবং এই মূল্যবোধের লঙ্ঘনের ফলে মানুষের ব্যক্তিক্ত অবদমিত হয়।

একটি ইসলামভিত্তিক সামাজিক ব্যবস্থাপনায় মানুষের শারীরিক ও আধ্যাত্মিক সহাবস্থান বজায় থাকে, যেখানে একজন ব্যক্তি একই সাথে জাগতিক ও পারলৌকিক (আধ্যাত্মিক) কল্যাণ লাভ করতে পারে। কিন্তু একটি ধর্মবিমুখ সমাজ ব্যবস্থাপনায় ধার্মিক ও অন্যায়কারীদের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। কারণ অন্যায়কারীরা স্থায়ী মূল্যবোধে বিশ্বাসীদেরকে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করে। এরূপ পরিস্থতিতে মু’মিনরা স্থায়ী মূল্যবোধের কারনে পার্থিব সুবিধা ত্যাগ করে থাকে এবং শারীরিক জীবনের স্তরে কষ্ট পেতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের ব্যক্তিত্ব সুরক্ষিত থাকে। অন্যায়কারীরা তাদেরকে কিছু কষ্ট দিতে পারলেও তাদের ব্যক্তিত্বের ক্ষতিসাধন করতে পারে না। এছাড়া পার্থিব স্বার্থ এত তুচ্ছ বিষয় যে, যখন সমস্ত কর্মকাণ্ডের দায়বদ্ধতার চূড়ান্ত বিচার করা হবে, তখন যারা স্থায়ী মূল্যবোধের কারণে পার্থিব স্বার্থ ত্যাগ করেছিলো তারাই কল্যাণ লাভ করবে এবং অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে। সুতরাং চূড়ান্ত বিচারে স্থায়ী মূল্যবোধে বিশ্বাসীরা প্রাথমিক/সাময়িক/অন্তর্বর্তীকালীন যে কষ্ট পেয়ে থাকে তা তাদের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে সাব্যস্ত হয় না।

তবে কুরআন মু’মিনদেরকে প্রার্থনা করতে শিখায় দুনিয়ার কল্যাণ ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য।

২:২০১-২০২ :: আর তাদের মধ্যে এমনও আছে যে বলে, “আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দিন আর আর আখিরাতেও কল্যাণ দিন আর আমাদেরকে (জাহান্নামের) আগুনের শাস্তি থেকে বাঁচান।” তারাই ঐসব লোক যাদের জন্য আছে যা (পূণ্য) তারা উপার্জন করেছে তার প্রাপ্য অংশ। আর আল্লাহ হিসাবকরনে দ্রুততম।

দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণের জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা একটা মতাদর্শিক সংঘাতের সৃষ্টি করে। যেখানে একজন বস্তুবাদী এবং একজন স্থায়ী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ব্যক্তি সংঘাতের দুটি পক্ষ। এ সংঘাতে জয়লাভের জন্য একটি শর্ত হলো ঐক্যবদ্ধতা। যদি বস্তুবাদীরা তাদের পার্থিব স্বার্থে দলবদ্ধ থাকে কিন্তু স্থায়ী মূল্যবোধে বিশ্বাসীরা (মু’মিনরা) সমাজে পরস্পর বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে থেকে যায়, তাহলে তাদের পক্ষে আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা গঠন করা সম্ভব নয়। সংগ্রাম যুগ অতিক্রমের পরে আল্লাহর সাহায্যক্রমে মু’মিরাই চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে এবং তখন তারা আল্লাহর বিধান অনুসারে একটি ন্যায়নীতির সমাজ গঠন করে, যাতে মানুষের মধ্যে পার্থিব ও পারলৌকিক (আধ্যাত্মিক) কল্যাণ সাধিত হয়।

৩:১০৩-১০৫ :: আর তোমরা আঁকড়ে ধরো আল্লাহর রজ্জুকে সবাই একত্র হয়ে। আর তোমরা বিভিন্ন ফেরকায়/ দলে দলে ভাগ হয়ো না। আর তোমরা স্মরণ করো তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামত, যখন তোমরা ছিলে (একজন অন্যজনের) শত্রু, তারপর তিনি মিলিয়ে দিয়েছেন তোমাদের কলবসমূহের মধ্যে (গভীর সম্পর্ক), তাই তোমরা তাঁর নিয়ামতের মাধ্যমে ভাই ভাইয়ে পরিণত হয়েছো। আর তোমরা ছিলে আগুনের চুল্লীর কিনারার উপর তারপর তিনি তোমাদেরকে সরিয়ে এনেছেন তা থেকে। এভাবেই আল্লাহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ যেন তোমরা হিদায়াত পেতে পার। আর থাকতে হবে তোমাদের মধ্য থেকে (মুসলিম উম্মাহর মধ্য থেকে) একটি উম্মাহ। যারা (তাদের উপর অর্পিত নির্বাহী দায়িত্ব পালনার্থে) (১) উত্তম বিষয়ের (কুরআনের ও কল্যাণ কর্মের) দিকে ডাকবে। আর (২) ন্যায়ের আদেশ দেবে/ ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবে। আর (৩) অন্যায় থেকে বিরত রাখবে/ অন্যায়ের প্রতিরোধ ও প্রতিকার করবে। আর এরূপ লোকেরাই সফলতালাভকারী। আর তোমরা হয়ো না তাদের মতো যারা বিভিন্ন ফেরকায়/ দলে দলে ভাগ হয়েছে আর মতপার্থক্য করেছে উহার পরেও যা তাদের কাছে এসেছে সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসাবে (তারা সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পরও তা গ্রহণ না করে দলে দলে ভাগ হয়েছে ও মতপার্থক্য করেছে)। আর তারাই ঐসব লোক যাদের জন্য আছে মহাশাস্তি।

৩:১৪২ :: তোমরা কি হিসাব করে নিয়েছো যে, তোমরা প্রবেশ করবে জান্নাতে? অথচ আল্লাহ এখনো প্রকাশ করেননি তাদেরকে যারা সংগ্রাম করেছে তোমাদের মধ্য থেকে আর প্রকাশ করেননি সবরকারীদেরকে (ধৈর্যশীল ও অধ্যবসায়ীদেরকে)।

২:২১৪ :: তোমরা কি হিসাব করে নিয়েছো যে, তোমরা অনায়াসে প্রবেশ করবে জান্নাতে? অথচ এখনো তোমাদের উপর আসেনি তাদের অবস্থা যারা তোমাদের আগে গত হয়েছে। তাদেরকে স্পর্শ করেছে অর্থ সংকট ও দু:খ-ক্লেষ আর তাদেরকে কাঁপিয়ে তোলা হয়েছে যতক্ষণ না বলে উঠেছে রসূল আর যারা ঈমান/ বিশ্বাস করেছে তাঁর সাথে- “কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য?” (কবে তাঁদের প্রচেষ্টা সফল হবে?)। জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।

অর্থাৎ বর্তমান মু’মিনদেরকেও পূর্বের মু’মিনদের মতো বিরুদ্ধবাদীদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হবে বা সংগ্রাম-সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তবে সংগ্রামী সাথীদের প্রত্যেক সদস্য হুবহু একই মাত্রার প্রতিরোধের মুখে পড়া অবশ্যম্ভাবী নয়।

৩৩:৯-১১ :: হে ঐসব লোক যারা ঈমান/ বিশ্বাস করেছো, তোমরা স্মরণ করো তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামতকে, যখন তোমাদের উপর এসেছিলো (শত্রু) সেনাবাহিনী, তখন আমরা প্রেরণ করেছিলাম তাদের উপর (প্রবল) বাতাস, আর এমন সেনাবাহিনী যাকে তোমরা দেখনি। আর তোমরা যা কাজ করো আল্লাহ তার প্রতি দৃষ্টিবান। যখন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে এসেছিলো তোমাদের ঊর্ধ্ব অঞ্চল থেকে আর তোমাদের নিম্ন অঞ্চল থেকে, আর যখন তোমাদের দৃষ্টিভ্রম ঘটেছিলো আর তোমাদের কলবসমূহ তোমাদের কন্ঠনালীতে পৌঁছে গিয়েছিলো, আর তোমরা অনুমান করতে লাগলে আল্লাহর সম্পর্কে নানাবিদ অনুমান (যেমন : আল্লাহর প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দেহ)। তখনই পরীক্ষা করা হয়েছিলো মু’মিনদেরকে, আর তাদেরকে কাঁপিয়ে তোলা হয়েছিলো, ভীষণ প্রকম্পনে।

২:১৫৪-১৫৬ :: আর তোমরা বলো না তাদের প্রসঙ্গে যারা নিহত হয়েছে আল্লাহর পথে, (বলো না যে, তারা) মৃত। বরং তারা জীবিত কিন্তু তোমরা তা অনুভব করো না। আর অবশ্যই আমরা তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো (কাফিরদের কারণে উদ্ভুত) কিছু বিষয় দ্বারা যেমন ভয়-ভীতি, ক্ষুধা (খাদ্যের অভাব) এবং জান-মাল ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি। আর সবরকারীদেরকে (যারা ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবিচল থাকে তাদেরকে) সুসংবাদ দাও। যারা (এমন যে,) যখন তারা মুসীবতগ্রস্ত হয়, তারা বলে, “নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য (আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের সংগ্রামে নিবেদিত) আর নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে ফিরে যাবো।”

৩:১৩৯-১৪২ :: আর তোমরা মনভাঙ্গা হয়ো না। আর তোমরা দু:খিত থেকো না। আর তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মু’মিন হও। যদি তোমাদেরকে স্পর্শ করে কোন আঘাত তবে নিশ্চয় স্পর্শ করেছে ঐ কওমকে উহার (তোমাদেরকে স্পর্শ করা আঘাতের) অনুরূপ আঘাত। আর এই দিনসমূহ; উহাকে আমরা পর্যায়ক্রমে অদল-বদল করি মানুষের মধ্যে (অর্থাৎ জাতীয় বা ব্যক্তিগত জীবনে জয়-পরাজয় বা আনন্দ-বিষাদ ইত্যাদির দিনসমূহ মানুষের মধ্যে অদল-বদল করা হয়)। আর তা এজন্য যে, আল্লাহ তাদেরকে প্রকাশ করে দেন যারা ঈমান/ বিশ্বাস করেছে আর তিনি গ্রহণ করেন তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোককে শহীদ (চূড়ান্ত সাক্ষ্যদাতা) হিসাবে। (যারা আল্লাহর পথে জীবন বিলিয়ে দেয়ার মানসিকতাসহ ঈমান রাখে তারাই শহীদ, ৩:১৪০, ৫৭: ১৯)। আর আল্লাহ ভালোবাসেন না যালিমদেরকে। আর তা এজন্য যে, আল্লাহ তাদের থেকে পরীক্ষার মাধ্যমে খাঁটি-অখাঁটি বাছাই করেন যারা ঈমান/ বিশ্বাস করেছে। আর তিনি নিরাশ করেন কাফিরদেরকে।

৩:১২০ :: যদি তোমাদেরকে কোনো কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন তাদের কষ্ট হয়। আর যদি তোমাদেরকে কোনো মন্দ স্পর্শ করে, তখন তারা তাতে খুশি হয়। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধরো এবং স্রষ্টা-সচেতনতা অবলম্বন কর, তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছু ক্ষতি করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ তারা যা করে, তা পরিবেষ্টনকারী।

৬. ধর্মাদর্শগত স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও বিপর্যয় প্রতিরোধে কুরআনের নির্দেশনা

২:২৫৬ :: দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা) গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় বিভ্রান্তি থেকে সঠিক দিগ-দর্শন সুস্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং যে তাগুতকে (ধর্মীয় স্বাধীনতা নস্যাতকারী খোদাদ্রোহীদেরকে) প্রত্যাখ্যান করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, নিশ্চয় সে এমন মজবুত হাতল ধারণ করে যা কখনো ভেঙ্গে যাবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।

১০৯:৬ :: (কাফিরদেরকে বলো:) “তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা) এবং আমার জন্য আমার দ্বীন (ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা)।”

৪:৭৫ :: আর তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছো না অথচ নিপীড়িত হচ্ছে দুর্বল নারী-পুরুষ ও শিশুরা, যারা বলছে, “আমাদের প্রভু, আমাদেরকে এ জনপদ থেকে নিস্তার দিন যার শাসকরা যালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে অভিভাবক নির্ধারণ করুন এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে সাহায্যকারী নির্ধারণ করুন।

৫:৩৩-৩৪ :: নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে (আল্লাহ প্রদত্ত ও রসূলের প্রবর্তিত বিধান অনুযায়ী পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বা বিদ্রোহাত্মক) যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং পৃথিবীতে ফাসাদ করতে (তথা বিপর্যয় ঘটাতে বা জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা ধ্বংস করে দেয়ার অপতৎপরতা ও সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে) সচেষ্ট হয়, তাদের প্রতিফল (দন্ডবিধি) এই যে, তাদেরকে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হবে অথবা শুলে চড়িয়ে হত্যা করা হবে অথবা তাদের হাতসমূহ ও পাসমূহ বিপরীত দিকে থেকে (ডান হাত বাম পা বা বাম হাত ডান পা) কেটে দেয়া হবে অথবা তাদেরকে (মুক্তভাবে চলাচলের) ভূখন্ড থেকে নির্বাসিত করা হবে। এটা তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্চনা এবং তাদের জন্য আখিরাতে মহাশাস্তি রয়েছে। তারা ছাড়া যারা তোমাদের করায়ত্ত হওয়ার আগেই তাওবাহ করে। জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।

২:১৭৮-১৭৯ :: হে যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের উপর হত্যার দণ্ডবিধি হিসেবে ক্বিসাস (হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া) বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। হত্যাকারী স্বাধীন ব্যক্তি হলে ঐ স্বাধীন ব্যক্তিই দণ্ড পাবে, হত্যাকারী দাস হলে ঐ দাসই দণ্ড পাবে, হত্যাকারী নারী হলে ঐ নারীই দণ্ড পাবে। তবে যাকে তার ভাইয়ের (নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের) পক্ষ থেকে ক্ষমা করে দেয়া হয়, তখন একটি ন্যায়সঙ্গত অনুসরণ (পর্যবেক্ষণ) এবং তার দিকে (নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের দিকে) সদ্ভাবস্পন্ন ও উত্তম ধরনের (রক্তপণ) আদায় (প্রযোজ্য হবে)। এটা তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে একটি (দণ্ডবিধির) লঘুকরণ এবং দয়া। সুতরাং তারপর যে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ি করবে, তার জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। আর তোমাদের জন্য ক্বিসাসের (অন্যায় হত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ডের) মধ্যে জীবন/আয়ু রয়েছে, হে চিন্তাশক্তির অধিকারীরা, যেন তোমরা স্রষ্টা সচেতন হতে পারো।

২৪:২ :: ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী, তাদের প্রত্যেককে একশতটি কশাঘাত করো। আর আল্লাহর দ্বীন (বিধান) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি স্নেহ যেন তোমাদেরকে প্রভাবিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখো। আর যেন মু’মিনদের মধ্য থেকে একটি দল তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।
উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহসহ আরো অনেক আয়াতের ভিত্তিতে বলা যায় যে, আল কুরআনে মানুষকে ধর্মাদর্শগত স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। তবে কোনোক্রমে সামাজিক অনাচার-অবিচার-অত্যাচারের অবকাশ নেই। বরং মু’মিনদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আল্লাহর আইনের বাস্তবায়ন করবে এবং এক্ষেত্রে যারা বাধা প্রদান করবে প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে। এভাবে সামাজিক বিপর্যয় প্রতিরোধে কুরআনের নির্দেশনা প্রমাণ করে যে, মহাবিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ ‘ভাগ্য’ অনুসারে সংঘটিত হয় না, বরং এতে মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তথা কর্মপ্রচেষ্টার কার্যকর ভূমিকা রয়েছে।

৭. হক্বপন্থী ও বাতিলপন্থীদের দ্বান্দ্বিকতায় আল্লাহর ভূমিকা

২:২৪৯-২৫৩ :: তারপর যখন তালূত অভিযানে বের হয়েছে সেনাবাহিনীসহ তখন সে (তালূত) বলেছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন একটি নদী/ ঝর্ণা দ্বারা। সুতরাং যে পান করবে উহা থেকে সে আমার নয়। আর যে তার স্বাদ নেবে না নিশ্চয় সে-ই আমার। কিন্তু যে কোষে করে নেবে এক কোষ তার হাত দিয়ে তার কথা ভিন্ন (তার দোষ হবে না)’। তারপর তারা পান করেছে উহা থেকে (তৃপ্তি সহকারে) তাদের মধ্য থেকে অল্পসংখ্যক ব্যক্তি ব্যতীত। তারপর যখন উহা অতিক্রম করেছে সে আর যারা ঈমান/ বিশ্বাস করেছে তার সাথে তারা, তখন (যারা তৃপ্তিসহকারে পান করেছে) তারা বলেছে, “আজ আমাদের কষ্টসাধ্য সক্ষমতাও নেই জালুত ও তার সেনাবাহিনীর সাথে (যুদ্ধ করার)’। যারা ধারণা রেখেছে যে, তারা হবে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতকারী, তারা বলেছে, ‘কত ছোট ছোট দল বিজয়ী হয়েছে বড় বড় দলের উপর, আল্লাহর অনুমতিক্রমে। আর আল্লাহ সবরকারীদের সাথে থাকেন’।

আর যখন তারা (তালূত ও তার সেনাবাহিনী) মুখোমুখী হলো জালুত ও তার সেনাবাহিনীর, তারা (তালুত ও তার সেনাবাহিনী) বলেছে, ‘আমাদের প্রতিপালক, ঢেলে দিন আমাদের উপর সবর আর মজবুত রাখুন আমাদের কদমসমূহ আর আমাদেরকে সাহায্য করুন কাফির কওমের উপর’।

সুতরাং তারা (তালুত ও তার সেনাবাহিনী) তাদেরকে (জালুত ও তার সেনাবাহিনীকে) পরাজিত করেছে আল্লাহর অনুমতিক্রমে। আর হত্যা করেছে দাউদ জালুতকে। আর আল্লাহ তাকে (দাউদকে) দান করেছেন অধিনায়কত্ব ও বিজ্ঞতা। আর তাকে (দাউদকে) শিক্ষা দিয়েছেন যা (তাকে শিক্ষা দেয়ার) ইচ্ছা করেছেন। আর যদি না করা হতো আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিহত মানুষের একটি দলকে অপর একটি দল দ্বারা, তাহলে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ অনুগ্রহশীল সমগ্র বিশ্ববাসীর উপর।

এগুলি আল্লাহর আয়াত। আমরা উহা তিলাওয়াত করছি যথাযথভাবে/ সঠিক তথ্যসহ। আর নিশ্চয় তুমি রসূলদের অন্তর্ভুক্ত।

ঐ রসূলগণ - আমরা বিশিষ্টতা দিয়েছি তাদের কাউকে কারো উপর। তাদের মধ্য থেকে কারো সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন। আর সমুন্নত করেছেন তাদের কাউকে মর্যাদায়। আর আমরা দিয়েছি মারইয়ামের পুত্র ঈসাকে সুস্পষ্ট প্রমাণসমূহ আর তার হাতকে মযবুত করেছি পবিত্র রুহ দ্বারা। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তারা (পরস্পরে) যুদ্ধ করতো না, যারা তাদের (ঐ রসূলদের) পরে ছিলো, এরপরও যে, তাদের কাছে এসেছে সুস্পষ্ট প্রমাণসমূহ। কিন্তু তারা মতপার্থক্য করেছে। তারপর তাদের মধ্য থেকে কেউ বিশ্বাস করেছে আর তাদের মধ্য থেকে কেউ অবিশ্বাস করেছে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তারা (পরস্পরে) যুদ্ধ করতো না। কিন্তু আল্লাহ করেন যা (করার) ইচ্ছা করেন।

৬৮:৪৪-৪৫ :: সুতরাং ছেড়ে দাও আমাকে আর তাকে যে এ হাদীসের (আল কুরআনের) প্রতি মিথ্যা সাব্যস্ত করে। শীঘ্রই আমরা তাদেরকে ক্রমে ক্রমে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবো, যেখান থেকে (যে অবস্থানে থেকে) তারা জানতে পারবে না। আর আমি তাদেরকে অবকাশ দিচ্ছি। নিশ্চয় আমার কায়দা-কৌশল মজবুত।

৩০:৪৭ :: আর নিশ্চয় আমরা প্রেরণ করেছিলাম তোমার আগে অনেক রসূল তাদের কওমের প্রতি, তখন তারা (রসূলগণ) এসেছিলো স্পষ্ট প্রমাণসহ। তারপর আমরা প্রতিশোধ নিয়েছিলাম তাদের থেকে যারা অপরাধ করেছিলো। আর আমাদের উপর দায়িত্ব ছিলো মু’মিনদেরকে সাহায্য করা।

২:১৯০ :: আর তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো তাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করে তোমাদের বিরুদ্ধে। আর সীমালংঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালংঘনকারীদেরকে ভালোবাসেন না।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর পথে বাধাদানকারী, হক্বপন্থীদেরকে আক্রমণকারী ও অত্যাচারী দল বা গোষ্ঠী একটা প্রাকৃতিক অবকাশ পেয়ে থাকে, যার পর তাদেরকে ধরাশায়ী করা হয়। কিন্তু সেই সাথে হক্বপন্থীদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন এই জালিমদেরকে মোকাবেলা করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। আর হক্বপন্থী ও বাতিলপন্থীদের এই দ্বান্দ্বিকতায় হক্বপন্থীদেরকে আল্লাহ বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকেন।

>>  পরবর্তী পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য ক্লিক করুন