তাক্বদীর

বইটির পিডিএফ কপি ডাউনলোড

তাক্বদীর: আল্লাহর সৃষ্টি ও মানবীয় কর্ম

সৃষ্টিজগতে বিশ্বপ্রভুর প্রাকৃতি নিয়ম নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ

আল্লাহর সৃষ্টি ও মানবীয় কর্ম

১। ‘আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা এবং মানুষের কর্মও আল্লাহর সৃষ্টি’ তথ্যটির তাৎপর্য

১৩:১৬ :: বলো, “আল্লাহই প্রত্যেক বস্তুর স্রষ্টা এবং তিনি একক, পরাক্রমশালী”।

৩৭:৯৬ :: আর আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা যা করো তাও (তিনিই সৃষ্টি করেছেন)।

২৫:৩ :: আর তারা গ্রহণ করেছে তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যান্য ইলাহ, যারা সৃষ্টি করেনি কোন কিছুই, আর তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়েছে। আর তারা ক্ষমতা রাখে না তাদের নিজেদের জন্যও কোনো ক্ষতির আর কোনো উপকারেরও না। আর তারা ক্ষমতা রাখে না মৃত্যু দেয়ার আর জীবন দেয়ারও না আর পুনরুত্থানেরও না।

১৬:৮১ :: আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট বস্তু দ্বারা তোমাদের জন্য ছায়া বানিয়েছে। পাহাড়সমূহে তোমাদের জন্য আশ্রয়স্থল তৈরী করেছেন এবং তোমাদের জন্যে পোশাক তৈরী করে দিয়েছেন, যা তোমাদেরকে গ্রীষ্ম এবং বিপদের সময় রক্ষা করে। এমনিভাবে তিনি তোমাদের প্রতি স্বীয় অনুগ্রহের পূর্ণতা দান করেন, যাতে তোমরা আত্মসমর্পণ কর।

আলোচনা : আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা, এর মধ্যে বান্দার কর্ম, ইচ্ছাশক্তি, কর্মশক্তি সবই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ যদি মানুষের মধ্যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তি সৃষ্টি না করতেন, তাহলে সে নিজের মধ্যে তা সৃষ্টি করতে পারতো না। সুতরাং আল্লাহই এ বিষয়গুলোর আদিস্রষ্টা বা মূল স্রষ্টা এবং সে এগুলো অর্জন করেছে এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ে রূপদান করছে মাত্র। আল্লাহ বান্দাকে যেসব বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তন্মধ্যে বান্দার ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তি অন্যতম। আর এতদুভয়ের মাধ্যমেই সে ভাল-মন্দ সবকিছু করে থাকে। অতএব বান্দার ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তির স্রষ্টাই তার কর্মেরও স্রষ্টা। অতএব সবকিছুই আল্লাহ্‌র সাধারণ সৃষ্টির মধ্যে গণ্য।

উপরোল্লেখিত শেষ আয়াতটিতে পোশাকের উপকরণকেই শুধু নয়, বরং তৈরিকৃত পোশাককে আল্লাহর তৈরি বলা হয়েছে। বস্তুত মানুষ এবং তার জ্ঞান, ইচ্ছা ও কর্মশক্তি এবং কোনো উপকরনের রুপান্তরের সূত্র আল্লাহর তৈরি, তাই বলা যায় মানুষের কর্ম আল্লাহর সৃষ্টি।

সুতরাং মানুষ ও মানুষের কর্ম আল্লাহর সৃষ্টি। কিন্তু মানুষের কর্ম আল্লাহর সৃষ্টি হওয়ার মানে এ নয় যে, মানুষ যা কিছু করে তা তার ভাগ্যে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে যে, এ সময় ও স্থানে সে এ কাজটি করবে আর তাই সে তা করেছে এবং তা করার পেছনে তার স্বাধীন ইচ্ছার কোনো প্রভাব ছিলো না, বরং সে তা করতে বাধ্য ছিলো বা তাকে দিয়ে তা করানো হয়েছে এবং তাই সে দায়ী হবে না।

বরং মানুষের কর্ম আল্লাহর সৃষ্টি হওয়ার প্রকৃত তাৎপর্য হলো, আল্লাহ প্রাকৃতিক আইনের আওতায় মানুষকে তার স্বাধীন ইচ্ছাক্রমে কাজটি সম্পাদনের সুযোগ রেখেছেন এবং মানুষ সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বাধীন ইচ্ছাক্রমে কাজটি সম্পাদন করেছে। যদি প্রাকৃতিক আইনের আওতায় ঐ কর্মের কোনোরূপ অবকাশ না থাকতো তাহলে মানুষের পক্ষে কাজটি বাস্তব রূপ দেয়া (সৃষ্টি করা) সম্ভব হতো না।

বান্দার একটি কাজ দেখা, আল্লাহই এ কাজের স্রষ্টা, কারণ আল্লাহর তৈরি নিয়মেই সে দেখতে পায়। অন্যদিকে সে কোন বিষয় কোন ধরনের মনোভাব নিয়ে দেখবে বা বা দেখবে না সেই বিষয়ে তার স্বাধীনতা রয়েছে। এ দিক থেকে সে যখন কোনো বিষয়কে দেখে ঐ পর্যায়ে সে তার ঐ কর্মের স্রষ্টা হিসেবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু আল্লাহর দেয়া চোখ ও দৃষ্টিশক্তি ছাড়া সে দেখতে সক্ষম নয় বিধায়, তাকে নিরঙ্কুশ স্রষ্টা বলা যেতে পারে না। তাকে আপেক্ষিকভাবে তার কোনো কাজের স্রষ্টা বলা যেতে পারে মাত্র।

আপেক্ষিক ‘সৃষ্টি’ স্বীকৃতি পায়, যখন আল্লাহকে ‘আহসানাল খালিক্বীন’ (স্রষ্টাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ) বলা হয়। আল্লাহ অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনেন, আর অন্যরা শুধুমাত্র আল্লাহ-প্রদত্ত সৃজনশীল যোগ্যতার মাধ্যমে কোনো কিছুর রূপান্তর ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং যখন মৌলিক ও নিরঙ্কুশ সৃষ্টির অর্থে বলা হয়, তখন আল্লাহকেই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা হিসেবে দাবি করা হয়।

সুতরাং মৌলিকভাবে আল্লাহই মানুষ ও তার কাজের একমাত্র নিরঙ্কুশ স্রষ্টা, কিন্তু সেই সাথে মানুষ তার সীমিত স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সম্পাদিত কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী।

২। আল্লাহর সৃষ্টি, প্রাকৃতিক নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণ

৭:১৯১ :: তারা কি আল্লাহর শরিক করে এমন কাউকে যারা সৃষ্টি করতে পারে না কোন কিছুই, আর তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়?

৪৬:৪ :: বলো, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তাদের কথা ভেবে দেখেছ কি? তারা পৃথিবীতে কি সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও অথবা আকাশমন্ডলীতে তাদের কোনো অংশীদারীত্ব আছে কি? পূর্ববর্তী কোনো কিতাব অথবা কোনো জ্ঞানগত নিদর্শন থাকলে তা তোমরা আমার নিকট উপস্থিত কর - যদি তোমরা সত্যবাদী হও।

২২:৭৩ :: হে মানুষ, একটি উপমা পেশ করা হল, মনোযোগ দিয়ে তা শোনো, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না। যদিও তারা এ উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়। আর যদি মাছি তাদের কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেয়, তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না। অন্বেষণকারী ও যার কাছে অন্বেষণ করা হচ্ছে উভয়েই দুর্বল।

১৬:৪০ :: নিশ্চয় কোনো কিছুর জন্য আমাদের কথা তো এরূপই হয় যে, যখন আমরা সেটার ইচ্ছা করি তখন এতটুকু করতে হয় যে, আমরা সেজন্য বলি, ‘হও’, সুতরাং তা হয়।

৩৬:৮২ :: নিশ্চয় তাঁর আদেশ তো হয় যখন তিনি ইচ্ছা করেন কোনো কিছু, এরূপ যে, তিনি সেজন্য বলেন, ‘হও’, সুতরাং তা হয়।

২:১১৭ :: তিনিই আসমানসমূহ ও জমিনের স্রষ্টা/ উদ্ভাবক/ অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্বে আনয়নকারী ও নমুনা ছাড়া মূল থেকে সৃষ্টিকারী। আর যখন তিনি সিদ্ধান্ত করেন কোন কার্য সম্পাদনের তখন মূলত সেজন্য বলেন, ‘হও’, সুতরাং তা হয়।

৪০:৬৮ :: তিনিই সেই সত্তা যিনি জীবনদান করেন আর মৃত্যুদান করেন। যখন তিনি ফায়সালা করেন কোনো ব্যাপারে, তখন বস্তুত সেজন্য তিনি বলেন, ‘হও’, তখন তা হয়।

১৯:৩৫ :: আল্লাহর জন্য শোভনীয় নয় যে, তিনি গ্রহণ করবেন কোনো সন্তান। তিনি পবিত্র। যখন তিনি সিদ্ধান্ত করেন কোনো কাজের জন্য, তখন প্রকৃতপক্ষে তিনি সেজন্য বলেন, ‘হও’, সুতরাং তা হয়।

৩:৪৭ :: সে (মারইয়াম) বললো, ‘আমার প্রতিপালক, কিরূপে আমার সন্তান হবে, অথচ আমাকে স্পর্শ করেনি কোনো মানুষ?’। তিনি বললেন, ‘ঐভাবেই। আল্লাহ সৃষ্টি করেন যা তিনি (সৃষ্টি করার) ইচ্ছা করেন। যখন তিনি কোনো কাজের সিদ্ধান্ত করেন তখন তিনি সেজন্য বলেন, ‘হও’, সুতরাং তা হয়।

৩:৫৯ :: নিশ্চয় ঈসার দৃষ্টান্ত আল্লাহর কাছে আদমের দৃষ্টান্তের মতো। (আর তা হচ্ছে) আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে (মাটির মৌলিক উপাদানসমৃদ্ধ করে)। তারপর সেজন্য বলেছেন, ‘হও’। সুতরাং সে হয়।

২১:৬৯ :: আমরা বললো, “হে আগুন, ইবরাহীমের উপর শান্তিদায়ক ঠান্ডা হও।”

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহে আল্লাহ তায়ালার মৌলিক নব-নব সৃষ্টি এবং সৃষ্টিকুলের এখতিয়ারাধীন বিষয়ে হস্তক্ষেপসহ সকল কার্যের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, যখন তিনি কোনো কার্য সম্পাদনের বিষয়ে ইচ্ছা করেন, তখন ‘হও’ বলে নির্দেশ দেন, ফলে তা হয়।

কিন্তু এ তথ্যের তাৎপর্য এরূপ নয় যে, কোনো বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘হও’ বলা এবং ‘তা হওয়া’ এর বিষয়টি মুহুর্তের মধ্যে সংঘটনের বিষয়। কারণ, তিনি যখন কোনো কিছুর ইচ্ছা করেন, তখন তাঁর ইচ্ছার মধ্যে শুধু সংশ্লিষ্ট সৃষ্টিটির বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ গঠনপ্রকৃতি ও তার উপাদান-উপকরণই শামিল থাকে না, বরং স্থানগত, কালগত ও প্রক্রিয়াগত উপাদানও শামিল থাকে এবং তদনুযায়ী যথাযথ প্রক্রিয়ায় যথাসময়ে ও যথাস্থানে সংশ্লিষ্ট সৃষ্টির আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে যায়।

অবশ্য আল্লাহ তায়ালা চাইলে কোনো সৃষ্টিকে তাৎক্ষণিকভাবে অস্তিত্ব প্রদান করতে পারেন, কিন্তু তাঁর জন্য এটা অপরিহার্য নয় যে, তিনি কেবল তাৎক্ষণিক ও মাধ্যম বিহীন সৃষ্টির ইচ্ছা করবেন এবং বিলম্বে কার্যকরোপযোগী ও মাধ্যম বিশিষ্ট সৃষ্টির ইচ্ছা করবেন না। বরং তিনি উভয় ধরনের সৃষ্টিরই ইচ্ছা করতে পারেন এবং যা-ই ইচ্ছা করেন ও যেভাবে ইচ্ছা করেন, সেভাবেই তার আবির্ভাব অনিবার্য।

আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি-সংক্রান্ত ইচ্ছাকে বা সৃষ্টিকার্য সম্পাদন প্রক্রিয়াকে দুইভাগে ভাগ করে বুঝা যেতে পারে, (ক) প্রত্যক্ষ সৃষ্টি-ইচ্ছা, (খ) পরোক্ষ সৃষ্টি ইচ্ছা। নিম্নে এ দুটি বিষয়ের উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো।

(১) আল্লাহ তায়ালার প্রত্যক্ষ সৃষ্টি সংক্রান্ত বিশেষ ইচ্ছার ক্ষেত্র হচ্ছে নতুন সৃষ্টি-উপাদান বা নতুন প্রজাতি সৃষ্টিকরণ এবং সৃষ্টিলোকের চলমান প্রক্রিয়ায় ক্ষেত্রবিশেষে হস্তক্ষেপকরণ। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সংশ্লিষ্ট সৃষ্টির বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ গঠন ও অব্যাহত থাকার প্রক্রিয়া, আবির্ভাবের স্থান ও কাল এবং অস্তিত্বলাভের উপায়-উপকরণ ও প্রক্রিয়া। তার উপায়-উপকরণ প্রকৃতি থেকে নেয়া হবে, নাকি তা সরাসরি সৃষ্টি করা হবে তাও তাঁর ইচ্ছার অন্তর্ভুক্ত।

(২) পরোক্ষ বা সর্বজনীন সৃষ্টি-ইচ্ছা হলো আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট কারণবিধির আওতায় স্বাভাবিকভাবে চলমান সৃষ্টি-প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার সূচনা ও তার নিয়মবিধি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ সৃষ্টি-ইচ্ছারই প্রতিফলন, অতঃপর এর ধারাবাহিকতা তাঁর সর্বজনীন ইচ্ছারই আওতায় অব্যাহত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালার এ সৃষ্টি-ইচ্ছার মধ্যে একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত ভবিষ্যতও অন্তর্ভুক্ত। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শর্তাবলী বা পূর্ণ কারণ বিদ্যমান হলে সৃষ্টিকার্য সম্পাদিত হবে, নচেৎ তা হবে না। এ ক্ষেত্রে সৃষ্টিকার্যে ভূমিকা পালনকারী উপাদানসমূহ যেহেতু আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি, সে হিসেবে এ সব উপাদানের ভূমিকা আল্লাহ তায়ালার পরোক্ষ সৃষ্টি-ইচ্ছার আওতাভুক্ত। এ উপাদানগুলো হচ্ছে :

১। আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিধিবিধান,

২। আল্লাহ তায়ালার পূর্ণ অনুগত সৃষ্টি ফেরেশতাগণ,

৩। প্রাণশীল সৃষ্টিনিচয়ের সহজাত প্রবণতা,

৪। ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন প্রাণশীল সৃষ্টিনিচয়ের সহজাত প্রবণতা এবং

৫। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতার অধিকারী সৃষ্টি (মানুষ ও জিন)।

৩। মানবীয় সৃষ্টিকর্মের ধারণা

মানবীয় সৃষ্টিকর্মকে দুইভাগে ভাগ করা যায়, (ক) মনোজাগতিক সৃষ্টি, (খ) বস্তুগত রূপান্তরমূলক সৃষ্টি।

মানুষ তার মনোজগতে অনেক কিছু সৃষ্টি করে। কিন্তু এসব মনস্তাত্ত্বিক সৃষ্টিও আল্লাহর প্রণীত মনস্তাত্ত্বিক জগতের সমূহ সম্ভাবনা ও তার মনোপ্রাকৃতিক নিয়মের বাহিরে নয়। বস্তুতঃ কল্পনা ও পরিকল্পনা (এবং চিন্তা-চেতনা) এক ধরনের অস্তিত্ব; অনস্তিত্ত্ব নয় বা সাথে সাথে অনস্তিত্ত্বে চলে যাওয়ার মতো বিষয় নয়। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :

“(হে রাসূল!) বলে দাও : তোমাদের অন্তঃকরণে যা কিছু আছে, তোমরা যদি তা গোপন করো বা প্রকাশ করো (উভয় অবস্থায়ই) আল্লাহ তা জানেন”। (সূরা আলে ইমরান : ২৯)

এছাড়া আল্লাহ তায়ালা অনেকগুলো আয়াতে নিজেকে ‘আলিমু বিযাতিছ ছুদূর’ বা ‘অন্তরস্থ বিষয়সমূহ সম্বন্ধে সদা অবগত) বলে উল্লেখ করেছেন। এর মাধ্যমে অন্তরস্থ বিষয়সমূহ বা মনোজাগতিক সৃষ্টিসমূহকে প্রকৃত অস্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

“তোমরা তোমাদের সত্তায় যা নিহিত আছে তা প্রকাশ করো বা গোপনই করো, আল্লাহ তার হিসাব গ্রহণ করবেন”। (সূরা বাক্বারাহ : ২৮৪)

আর মানুষ বস্তুজগতে যেসব পরিবর্তন সাধন করে (বাড়ি, গাড়ি ও আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সুপার কম্পিউটার তৈরি পর্যন্ত) তার ভিত্তি হচ্ছে মনোজগতে সৃষ্ট ঐ সব জিনিসের অবস্তুগত রূপ যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই সৃষ্টি এবং ঐ সব মনোজাগতিক সৃষ্টি পার্থিব উপাদানের উপর নির্ভরশীল নয়।

মানুষের বস্তুগত রূপান্তরমূলক সৃষ্টি বলতে বুঝায়- আল্লাহর সৃষ্ট উপাদান দ্বারা কিছু সৃষ্টি করা। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতটি লক্ষ্যণীয়-

৫:১১০ :: যখন আল্লাহ বলবেন, ‘হে ঈসা ইবনে মারইয়াম, স্মরণ করো আমার নিয়ামত যা আমি তোমার উপর করেছি আর তোমার মায়ের উপর করেছি। যখন তোমাকে সাহায্য করেছি পবিত্র আত্মা (জিবরীল) এর মাধ্যমে। তুমি মানুষের সাথে যথাযথভাবে কথা বলেছো দোলনায় চড়া বাল্যবয়সে এবং পরিণত প্রৌঢ় বয়সে। আর যখন তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি কিতাব ও হিকমাত, আর তাওরাত ও ইনজীল। আর যখন তুমি সৃষ্টি/গঠন করতে কাদামাটি থেকে পাখির কাঠামোসদৃশ আমার অনুমতিক্রমে। তারপর উহার মধ্যে ফুঁকে দিতে, যার ফলে উহা হয়ে যেতো পাখি আমার অনুমতিক্রমে। তুমি সুস্থ করতে অন্ধকে ও কুষ্ঠ রোগগ্রস্তকে আমার অনুমতিক্রমে। আর যখন তুমি মৃতকে (জীবিত করে) বের করতে আমার অনুমতিক্রমে। আর যখন আমি নিবৃত্ত করেছি বানী ইসরাইলকে তোমার (ক্ষতি করা) থেকে, যখন তুমি তাদের কাছে পৌঁছেছো স্পষ্ট প্রমাণসমূহসহ। তখন তাদের মধ্যকার যারা কুফর করেছে তারা বলেছে, ‘ইহা কিছু নয় প্রকাশ্য যাদু ছাড়া’।

এ আয়াতে সুস্পষ্টভাবেই হযরত ঈসা (আ.) কর্তৃক পাখির প্রতিকৃতি সৃষ্টি করার কথা বলা হয়েছে, যদিও তিনি তা আল্লাহর সৃষ্ট মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেন।

৪। আল্লাহর প্রতিটি সৃষ্টি সুন্দর ও ত্রুটিমুক্ত এবং সৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন ত্রুটি দেখা দেয়ার কার্যকারণ

৩২:৭ :: যিনি সুন্দর ও উত্তম করেছেন সবকিছুকে যা তিনি সৃষ্টি করেছেন। আর মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন মাটি থেকে।

৪০:৬৪ :: তিনিই আল্লাহ যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য পৃথিবীকে অবস্থানস্থলরূপে আর আকাশমন্ডলীকে সামিয়ানারূপে। আর তোমাদেরকে আকৃতি দিয়েছেন, তারপর উত্তম করেছেন তোমাদের আকৃতিসমূহকে। আর তিনি তোমাদেরকে রিযিক দিয়েছেন পবিত্র জিনিসসমূহ থেকে। তিনিই আল্লাহ তোমাদের প্রতিপালক ও বিধাতা। বড়ই বরকতময় সমগ্র মহাবিশ্বের প্রভু।

৬৭:৩-৪ :: যিনি সৃষ্টি করেছেন সাত আকাশ স্তরে স্তরে। তুমি দেখবে না দয়াময়ের সৃষ্টিতে কোনো অসংগতি। সুতরাং দৃষ্টি ফিরাও/ পর্যবেক্ষণ কর। তুমি দেখো কি কোনো ত্রুটি? তারপর আবার দৃষ্টি ফিরাও/ পর্যবেক্ষণ করো দ্বিতীয়বার। দৃষ্টি তোমার দিকে ফিরে আসবে ব্যর্থ হয়ে ক্লান্ত অবস্থায়।

২৩:১৪ :: তারপর আমরা পরিণত করি নুতফাকে (ফোঁটার আকৃতিসদৃশ শুক্রবিন্দুকে) আলাক্বাতে (শক্ত করে ঝুলে থাকা আকৃতিসদৃশ ভ্রুণে)। তারপর পরিণত করি আলাক্বাকে (শক্ত করে ঝুলে থাকা আকৃতিসদৃশ ভ্রুণকে) মুদগাতে (দুপাটির দাঁতের ছাপথাকাসদৃশ গোশতপিন্ডে)। তারপর পরিণত করি মুদগাকে (দুপাটির দাঁতের ছাপথাকাসদৃশ গোশতপিন্ডকে) ইযামে (অস্থিতে)। তারপর আমরা ঢেকে দিই ইযামকে (অস্থিকে) লাহমে (গোশতপিন্ডে)। তারপর আমরা তাকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব আল্লাহ অতীব বরকতময় সত্তা যিনি সর্বোত্তম সৃষ্টিকর্তা।

আল্লাহর প্রতিটি সৃষ্টির গঠনশৈলি অত্যন্ত চমৎকার, তা কোনো ক্ষুদ্র সৃষ্টি হোক বা বৃহৎ সৃষ্টি হোক। তবে যখন বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো এককের মধ্যে কোনো ত্রুটি দেখা যায়, সেটা মানুষকে ভাবিয়ে তুলতে পারে যে, তা কীভাবে হতে পারে? যেমন, যখন কোনো শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মগ্রহণ করে অথবা কোনো ফলের একপাশ শক্ত হয়ে যায় বা খাওয়ার উপযোগী থাকে না।

আল্লাহর প্রত্যক্ষ সৃষ্টি বা প্রাথমিক সৃষ্টিসমূহ এবং তাঁর প্রণীত প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী যে মৌলিক গঠনকাঠামোতে কোনো সৃষ্টি পরিগঠিত হয়, তাতে কোনো ত্রুটি চিহ্নিত হওয়া সম্ভব নয়। আবার আল্লাহর প্রণীত প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী যখন সৃষ্টির গঠনকাঠামোর ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক কোনো কার্যকারণ ক্রিয়াশীল হয়, তখন কোনো সৃষ্টির গঠনকাঠামোতে ত্রুটি ঘটতে পারে। কিন্তু এজন্য আল্লাহকে দায়ী করা যেতে পারে না বা বলা যেতে পারে না যে, আল্লাহর কোনো সৃষ্টিতে ত্রুটি রয়েছে। অর্থাৎ যখন আল্লাহর প্রতিটি সৃষ্টিকে ত্রুটিমুক্ত হিসেবে দাবি করা হয়, তখন মূলত আল্লাহর প্রত্যক্ষ সৃষ্টি বা প্রাথমিক সৃষ্টিসমূহ এবং তাঁর তৈরি প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী মৌলিক গঠনকাঠামোতে পরিগঠিত সৃষ্টির সৃষ্টিগত ত্রুটিহীনতাকে প্রকাশ করা হয়।

একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি বুঝা যেতে পারে। রোবট যে পণ্য উৎপাদন করে, তাকে কিন্তু রোবটের উৎপাদিত পণ্য বলা হয় না, বলা হয় অমুকের (রোবটের মালিকের) বা অমুক কোম্পানির উৎপাদিত পণ্য, কারণ তা উৎপাদনের মূলে রয়েছেন ঐ মালিক। কিন্তু রোবটের কর্মক্ষমতার সীমাবদ্ধতাজনিত কারণে পণ্যে যে ত্রুটি দেখা দেয় তার আনুষঙ্গিক কার্যকারণ যে রোবটের যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতামূলক বিভিন্ন বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত, সেই প্রশ্নেও বিতর্কের অবকাশ থাকে না।

পরোক্ষ প্রক্রিয়ায় সৃষ্টিতে ত্রুটির কারণ হিসেবে দায়ী হচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায় সক্রিয় উপাদানমূলক সৃষ্টির স্বেচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত নেতিবাচক ভূমিকা। পরোক্ষ প্রক্রিয়ায় এরূপ ব্যবস্থাপনা যাবতীয় সৃষ্টিকে প্রাকৃতিক নিয়মের মাধ্যমে সীমাবদ্ধতা প্রদানের সাথে সম্পর্কিত। এই সীমাবদ্ধতা আবার একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত, যেমন, মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মে অসুস্থ হয় আবার প্রাকৃতিক নিয়মে সুস্থ হয়। যখন সে সুস্থতার নীতিমালা চর্চার ক্ষেত্রে ত্রুটিযুক্ত হয় তখন সে অসুস্থ হয় এবং যখন সে অসুস্থতা থেকে নিরাময়ের পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে তখন সে সুস্থ হয়।

প্রাকৃতিক নিয়মের মাধ্যমে তৈরি হওয়া সীমাবদ্ধতার মধ্যেই আবার সৃষ্টির স্বার্থ ও বিকাশের বিভিন্ন অবস্থা পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ও সাংঘর্ষিকতার উপর নির্ভর করে। এর ফলে এক সৃষ্টি অন্য সৃষ্টির জন্ম, বিকাশ, বিস্তার ও পূর্ণতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি বড় গাছের নিচে গজানো চারাগাছ পুরোপুরি ভারসাম্যপূর্ণভাবে বিকাশ লাভে সক্ষম হয় না। একটি পোকার জীবনধারণ, বিকাশ ও পূর্ণতার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন, কিন্তু এই পোকাটির প্রয়োজন মিটাতে গিয়ে একটি ফল বা একটি উদ্ভিদ, এমনকি বিশালায়তন একটি বৃক্ষ ত্রুটিযুক্ত হয়ে পড়ে। রোগজীবাণু বা অন্য কোনো কিছুর নেতিবাচক প্রভাবে মানুষ ও অন্য প্রাণীর মধ্যে ত্রুটি (যেমন: বিকলাঙ্গতা, অন্ধত্ব ইত্যাদি) প্রকাশ পেতে পারে।

যে প্রাকৃতিক ব্যবস্থার মধ্যে এই সৃষ্টিকুল আবর্তিত হয় তাতে এরূপ স্বার্থদ্বন্দ্ব তাদের সামগ্রিক কল্যাণের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে। যেমন প্রাণীদের খাদ্য-শৃঙ্খলের কারণে বিশ্বে প্রাণী প্রজাতিসমূহের মধ্যে সংখ্যাগত ভারসাম্য বজায় থাকে।

তাছাড়া উদ্ভিদ, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ ও অন্যান্য প্রাণী প্রজাতিকে অন্যদের ভক্ষণ হতে নিরাপদ রাখা হলে তথা কোনো প্রাণীর মধ্যেই অন্য প্রাণীকে ভক্ষণের স্পৃহা সৃষ্টি করা না হলে প্রাণীকুলের জন্য খাদ্য হিসেবে শুধু জড় পদার্থ তথা মাটি ও পানি গ্রহণের স্পৃহা সৃষ্টি করতে হতো। তাহলে প্রাণীকুলের মধ্যে কোনো ধরনের আন্তঃক্রিয়াই সংঘটিত হতো না এবং আন্তঃক্রিয়া থেকে তাদের মধ্যকার যে সব গুণ-বৈশিষ্ট্য তথা প্রবণতা ও সম্ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তা ঘটতো না।

সুতরাং সৃষ্টিতে ত্রুটি ও দুর্বলতার অন্যতম কারন হচ্ছে বিভিন্ন সৃষ্টির মধ্যে সাংঘর্ষিকতা ও স্বার্থদ্বন্দ্ব, আর এটি প্রাকৃতিক ব্যবস্থা- যা সৃষ্টির জন্য অনিবার্য সীমাবদ্ধতা- এর মধ্যে সৃষ্টির সামগ্রিক কল্যাণের ব্যবস্থাপনা। তাই এ দ্বন্দ্বে নিজ নিজ সঙ্গত স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা অবলম্বনের মাধ্যমে স্বীয় বিকাশ ও পরিণতিতে উপনীত হওয়ার প্রচেষ্টাই প্রতিটি সৃষ্টির মৌলিক কর্মনীতি।

৫। আল্লাহ কর্তৃক মন্দ ও অকল্যাণ এবং আল্লাহ পছন্দ করেন না এমন কিছু সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি?

একটি সাধারণ চিন্তা হলো, “যদি মন্দের অস্তিত্ব আল্লাহর ইচ্ছাক্রমে থাকে, তাহলে মন্দের জন্য তিনিই দায়ী হন, আর যদি আল্লাহর ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও মন্দের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে তাঁকে তাঁর ইচ্ছা বাস্তবায়নে সর্বশক্তিমান বলা যায় না।”

এক্ষেত্রে প্রথমে ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির পার্থক্য বুঝে নেয়া প্রয়োজন। তাহলে আল্লাহ সর্বশক্তিমান হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ইচ্ছাক্রমে মন্দের অস্তিত্ব থাকা কিন্তু মন্দের জন্য তিনি দায়ী না হওয়ার বিষয়টি সহজে অনুধাবন করা যেতে পারে।

মানুষ কখনো কোনো কিছু পছন্দ না করা সত্ত্বেও কোনো মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তা সম্পাদনের ইচ্ছা করতে পারে। যেমন : অসুস্থ ব্যক্তি তেতো ওষুধ সেবন পছন্দ না করলেও রোগমুক্তির খাতিরে ইচ্ছা করে তা সেবন করতে পারে। এ থেকে বুঝা যায় যে, ইচ্ছা এবং সন্তুষ্টি অভিন্ন হওয়া অপরিহার্য নয়।

এখন আল্লাহ ভালবাসেন না কিন্তু সৃষ্টি করেন এরূপ বিষয়ের বাস্তবসঙ্গত কারণ বুঝার জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। একজন শিক্ষক যখন তাঁর ছাত্রদেরকে পরীক্ষা করার জন্য এমসিকিউ (MCQ) পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরী করেন, তখন চারটি অপশনের সবগুলি ইচ্ছা করে তৈরী করা সত্ত্বেও কিন্তু সবগুলিকে তিনি পছন্দ করেন না; বরং তিনি পছন্দ করেন মাত্র একটি অপশনকে। সেজন্য কোন ছাত্র শিক্ষকের পছন্দসই উত্তরটির বৃত্ত ভরাট না করলে তিনি খুশিও হন না এবং কোন নম্বরও দেন না। এই উদাহরণে দেখা গেল, শিক্ষক অপছন্দ সত্ত্বেও ইচ্ছা করেই একটি মহৎ উদ্দেশ্যে ভুল অপশনগুলি রাখেন। কিন্তু সেজন্য তিনি মোটেও দোষী নন; বরং তিনি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। ভুলভ্রান্তির সব দায়িত্ব এককভাবে ছাত্রকেই বহন করতে হয়। কেননা শিক্ষক ছাত্রকে যথারীতি পাঠদান সত্ত্বেও সে সঠিক উত্তরটি চয়ন করতে ভুল করেছে।

অনুরূপভাবে আল্লাহ কর্তৃক মন্দ ও অকল্যাণ সৃষ্টির পেছনে বিজ্ঞতাপূর্ণ রহস্য নিহিত রয়েছে। যেমন, ঈমান আল্লাহ্‌র নিকট প্রিয় এবং কুফর তাঁর নিকট অপ্রিয়। অথচ অপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি কুফর সৃষ্টি করেছেন। কারণ কুফর না থাকলে ঈমান চেনা যেত না এবং ঈমানের মর্যাদা নিরূপিত হতো না।

অনুরূপভাবে ভাল অবস্থার পাশাপাশি মন্দ অবস্থার মাধ্যমে মানুষকে পরীক্ষা করা হয় যে, সে ধৈর্য ধারণ করে কিনা।

২১:৩৫ :: আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি।  আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।

এছাড়া দুঃখ-দুর্দশা ও অসুস্থতার কারণে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সুস্থতাকে যথাযথভাবে অনুভব করা সম্ভব হয়।

এছাড়া কখনো কখনো কোনো কোনো দুঃখ আরো বড় ধরনের দুঃখ থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। যেমন : শরীরে কোনো ত্রুটি ঘটলে ব্যথা হতে পারে। ব্যথার অনুপস্থিতিতে শারীরিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতার ক্ষেত্রে খুব দেরি হয়ে যেতে পারে, যা সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করার ক্ষেত্রে অন্তরায়। তাই প্রাথমিক ব্যথাকে ছদ্মবেশে আশীর্বাদ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়।

৬। মন্দ কোনো কিছুকে আল্লাহর দিকে সম্বন্ধিত করা যাবে কি?

আল্লাহ্‌র মর্যাদা তথা আল্লাহর সাথে আদব রক্ষার্থে পৃথকভাবে শুধু অকল্যাণ তাঁর দিকে সম্বন্ধিত করা যাবে না। যেমন, “হে রিযিক্ব সংকীর্ণকারী!, হে অকল্যাণ সৃষ্টিকারী, হে বানর ও শুকর সৃষ্টিকারী” বা অনুরূপ কোনো শব্দের মাধ্যমে আল্লাহকে সম্বোধন করা যাবে না। বরং তাঁর প্রতি আদব বজায় থাকে এমন শব্দ ব্যবহার করতে হবে। যদিও আল্লাহই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। কারণ মানুষ তার ভাষারীতিতে যখন সীমিতভাবে কোনো বিষয় উল্লেখ করে তখন তাতে তার মনোভাবগত বিশেষ উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়, যাতে আদবের প্রশ্ন তৈরি হয়ে যায়।

৩৪:৫০ :: বলো, “আমি পথভ্রষ্ট হলে নিজের ক্ষতির জন্যই পথভ্রষ্ট হব। আর যদি আমি সৎপথ প্রাপ্ত হই, তবে তা আমার পালনকর্তা কর্তৃক আমার প্রতি অহি অবতীর্ণের কারণেই হয়”।

তবে নিম্নোক্ত তিনটি পদ্ধতিতে অকল্যাণ আল্লাহ্‌র দিকে সম্বন্ধিত করা যায়ঃ

১. সাধারণভাবে বলা যেতে পারে, আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তখন অকল্যাণও এর আওতাভুক্ত হবে।

১৩:১৬ :: বলো, “আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা”।

২. কর্তা বিলুপ্ত করে বলা যেতে পারে। যেমন-

৭২:১০ :: আমরা জানি না পৃথিবীবাসীদের অমঙ্গল সাধনের ইচ্ছা পোষণ করা হয়েছে নাকি তাদের পালনকর্তা তাদের মঙ্গল সাধন করার ইচ্ছা রাখেন।

৩. সৃষ্টির দিকে সম্বন্ধিত করে বলা যেতে পারে।

১১৩:২ :: তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে (আশ্রয় প্রার্থনা করছি)।

কোনো সৃষ্টির মধ্যে থাকা মন্দ বা কোনো সৃষ্টির মাধ্যমে সংঘটিত মন্দ একটি আপেক্ষিক বিষয়। একই জিনিস থেকে কোনো অবস্থায় ভালো কিছু এবং কোনো অবস্থায় মন্দ কিছু সংঘটিত হতে পারে। যেমন কোনো জিনিস থেকে উপকার পাওয়ার জন্য তার সঠিক পরিমাণ আবিষ্কার করা এবং সঠিক ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অল্প পরিমাণে আর্সেনিক উপকারী কিন্তু অধিক মাত্রার আর্সেনিক ধ্বংসাত্মক। এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানি জীবন রক্ষাকারী কিন্তু প্রচুর পরিমাণ পানিতে ডুবে মানুষের মৃত্যু ঘটে।

পরিশেষে বলা যায় যে, আল্লাহর সৃষ্টি এবং মানবীয় কর্ম ও সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্যসমূহ অত্যন্ত স্বাভাবিক বাস্তবতার সাবলীল অভিব্যক্তি। সকল কিছু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আল্লাহর সৃষ্টি। সেই হিসেবে মানুষের কর্ম ও সৃষ্টিকর্মও আল্লাহর সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু সকল কিছু আল্লাহর সৃষ্টি, তাই বাহ্যিকভাবে মন্দ, অকল্যাণ ও ত্রুটিকেও আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে সবকিছুর জন্য আল্লাহকে দায়ী করা এবং মানুষকে দায়ী না করার ধারণা বা ভাগ্যবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইনের আওতায় মন্দ, অকল্যাণ বা ত্রুটির অবকাশ রয়েছে বিধায় তা অস্তিত্বলাভ করতে পারে, কিন্তু সেজন্য মানুষের সাধ্যের মধ্যে স্বেচ্ছাকৃত যে ভূমিকা দায়ী, সেটাকে কোনোভাবে অস্বীকার করা যেতে পারে না। আর যেহেতু মানুষ ভালো বা মন্দ কাজের জন্য দায়ী, তাই তাকে সেজন্য পুরস্কার বা শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে, এটাই অনিবার্য ও অত্যন্ত যুক্তিসিদ্ধ।

আল্লাহর ইচ্ছা

আল্লাহর ইচ্ছা বুঝাতে ব্যবহৃত দুটি মূল শব্দ (আরাদাল্লাহ ও শাআল্লাহ)

আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কে অনুধাবনের জন্য আল্লাহর ইচ্ছা বুঝাতে যেসব আয়াতে ‘আরাদাল্লাহ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং যেসব আয়াতে ‘শাআল্লাহ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে উভয় ধরনের আয়াত দেখতে হবে। ‘আরাদাল্লাহ’ বলতে অনির্দিষ্টভাবে আল্লাহর ইচ্ছাকে বুঝায়, তা কোনো নীতিমালার সাথে সম্পর্কিত হোক বা না হোক। কিন্তু ‘শাআল্লাহ’ বলতে সুনির্দিষ্টভাবে আল্লাহর সেই ইচ্ছাকে বুঝায় যা কোনো নীতিমালার সাথে সম্পর্কিত রয়েছে। আরবি ভাষায় ও কুরআনে শব্দ দুটির ব্যবহার নিবিড় পর্যবেক্ষণ করলে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। নিম্নে আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সম্পর্কিত আয়াতসমূহ উল্লেখ করা হলো।

(১) ‘আরাদাল্লাহ’ বা অনুরূপ শব্দে ‘আল্লাহর ইচ্ছা’ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ

২:২৬, ২:১৮৫, ২:২৫৩, ৩:১০৮, ৩:১৭৬, ৪:২৬, ৪:২৭, ৪:২৮, ৫:১, ৫:৬, ৫:১৭, ৫:৪১, ৫:৪৯, ৬:১২৫, ৮:৭, ৮:৬৭, ৯:৫৫, ৯:৮৫, ১০:১০৭, ১১:৩৪, ১১:১০৭, ১৩:১১, ১৬:৪০, ১৭:১৬, ১৭:১৮, ১৮:৮২, ২১:১৭, ২২:১৪, ২২:১৬, ২৮:৫, ৩৩:১৭, ৩৩:৩৩, ৩৬:২৩, ৩৬:৮২, ৩৯:৪, ৩৯:৩৮, ৪০:৩১, ৪৮:১১, ৫১:৫৭, ৭২:১০, ৭৪:৩১, ৮৫:১৬।

২:২৬ :: নিশ্চয় আল্লাহ মশা কিংবা তার চেয়েও ছোট কিছুর উপমা দিতে লজ্জা করেন না। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে তারা জানে, নিশ্চয় তা তাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য। আর যারা কুফরী করেছে তারা বলে, আল্লাহ এর মাধ্যমে উপমা দিয়ে কী চেয়েছেন? তিনি এ দিয়ে অনেককে পথভ্রষ্ট করেন এবং এ দিয়ে অনেককে হিদায়াত দেন। আর এর মাধ্যমে কেবল ফাসিকদেরকেই পথভ্রষ্ট করেন।

২:১৮৫ :: রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।

২:২৫৩ :: ঐ রাসূলগণ, আমি তাদের কাউকে কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, তাদের মধ্যে কারো সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং কারো কারো মর্যাদা উঁচু করেছেন। আর আমি ঈসা ইবনে মারয়ামকে দিয়েছি সুস্পষ্ট প্রমাণাদি এবং আমি তাকে শক্তিশালী করেছি রূহুল কুদুস এর মাধ্যমে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তাদের পরবর্তীরা লড়াই করতো না, তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণসমূহ আসার পর। কিন্তু তারা মতবিরোধ করেছে। ফলে তাদের মধ্যে কেউ ঈমান এনেছে, আর তাদের কেউ কুফরী করেছে। আর আল্লাহ যদি চাইতেন, তাহলে তারা লড়াই করতো না। কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা করেন।

৩:১০৮ :: এগুলো আল্লাহর নির্দশন, যা আমি তোমার উপর যথাযথভাবে তিলাওয়াত করছি। আর আল্লাহ জগদ্বাসীর প্রতি যুলম করতে চান না।

৩:১৭৬ :: যারা কুফরীতে দ্রুত ধাবিত হয় তারা যেন তোমাকে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত না করে, নিশ্চয় তারা আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ চান যে, তাদের জন্য আখিরাতে কোন অংশ রাখবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাআযাব।

৪:২৬ :: আল্লাহ চান তোমাদের জন্য বিস্তারিত বর্ণনা করতে, তোমাদেরকে তোমাদের পূর্ববর্তীদের আদর্শ প্রদর্শন করতে এবং তোমাদের তাওবা কবূল করতে। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।

৪:২৭ :: আর আল্লাহ চান তোমাদের তাওবা কবূল করতে। আর যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা চায় যে, তোমরা প্রবলভাবে (সত্য পথ থেকে) বিচ্যুত হও।

৪:২৮ :: আল্লাহ তোমাদের বোঝা লঘু করতে চান যেহেতু মানুষ দুর্বল (রূপে) সৃষ্ট হয়েছে।

৫:১ :: হে মুমিনগণ, তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করো। তোমাদের জন্য গৃহপালিত চতুস্পদ জন্তু হালাল করা হয়েছে, তোমাদের নিকট যা বর্ণনা করা হচ্ছে তা ছাড়া। তবে হুরুম (হারাম মাসসমূহে থাকা) অবস্থায় শিকারকে হালাল করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ যা ইচ্ছা বিধান দেন।

৫:৬ :: হে মুমিনগণ, যখন তোমরা সালাতে দন্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা (ধৌত কর)। আর যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে ভালোভাবে পবিত্র হও। আর যদি অসুস্থ হও কিংবা সফরে থাক অথবা যদি তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে অথবা তোমরা যদি স্ত্রী সহবাস কর অতঃপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর। সুতরাং তোমাদের মুখ ও হাত তা দ্বারা মাসেহ কর। আল্লাহ তোমাদের উপর কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে চান না, বরং তিনি চান তোমাদের পবিত্র করতে এবং তার নিআমত তোমাদের উপর পূর্ণ করতে, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।

৫:১৭ :: অবশ্যই তারা কুফরী করেছে যারা বলে ‘নিশ্চয় মারইয়াম পুত্র মাসীহই আল্লাহ’। বল, যদি আল্লাহ ধ্বংস করতে চান মারইয়াম পুত্র মাসীহকে ও তার মাকে এবং যমীনে যারা আছে তাদের সকলকে ‘তাহলে কে আল্লাহর বিপক্ষে কোন কিছুর ক্ষমতা রাখে? আর আসমানসমূহ, যমীন ও তাদের মধ্যবর্তী যা রয়েছে, তার রাজত্ব আল্লাহর জন্যই। তিনি যা ইচ্ছা তা সৃষ্টি করেন এবং আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

৫:৪১ :: হে রাসূল, তোমাকে যেন তারা চিন্তিত না করে, যারা কুফরে দ্রুত ছুটছে- তাদের থেকে, যারা তাদের মুখে বলে ‘ঈমান এনেছি’ কিন্তু তাদের অন্তর ঈমান আনেনি। আর যারা ইয়াহূদী তারা মিথ্যা অধিক শ্রবণকারী, অন্যান্য কওমের প্রতি, যারা তোমার নিকট আসেনি তাদের পক্ষে তারা কান পেতে থাকে। তারা শব্দগুলোকে যথাযথ সুবিন্যস্ত থাকার পরও আপন স্থান থেকে বিকৃত করে। তারা বলে, ‘যদি তোমাদেরকে এটি প্রদান করা হয়, তবে গ্রহণ কর। আর যদি তা তোমাদেরকে প্রদান না করা হয়, তাহলে বর্জন কর’; আর আল্লাহ যাকে ফিতনায় ফেলতে চান, তুমি তার পক্ষে আল্লাহর বিরুদ্ধে কিছুরই ক্ষমতা রাখ না। এরাই হচ্ছে তারা, যাদের অন্তরসমূহকে আল্লাহ পবিত্র করতে চান না। তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়াতে লাঞ্ছনা এবং আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহাআযাব।

৫:৪৯ :: আর তাদের মধ্যে তার মাধ্যমে ফয়সালা কর, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর তাদের থেকে সতর্ক থাক যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তার কিছু থেকে তারা তোমাকে বিচ্যুত করবে। অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে জেনে রাখ যে, আল্লাহ তো কেবল তাদেরকে তাদের কিছু পাপের কারণেই আযাব দিতে চান। আর মানুষের অনেকেই ফাসিক।

৬:১২৫ :: সুতরাং যাকে আল্লাহ হিদায়াত করতে চান, ইসলামের জন্য তার বুক উন্মুক্ত করে দেন। আর যাকে ভ্রষ্ট করতে চান, তার বুক সঙ্কীর্ণ-সঙ্কুচিত করে দেন, যেন সে আসমানে আরোহণ করছে। এমনিভাবে আল্লাহ অকল্যাণ দেন তাদের উপর, যারা ঈমান আনে না।

৮:৭ :: আর স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তোমাদেরকে দু’দলের একটির ওয়াদা দিয়েছিলেন যে, নিশ্চয় তা তোমাদের জন্য হবে। আর তোমরা কামনা করছিলে যে, অস্ত্রহীন দলটি তোমাদের জন্য হবে এবং আল্লাহ চাচ্ছিলেন তাঁর কালেমাসমূহ দ্বারা সত্যকে সত্য প্রমাণ করবেন এবং কাফেরদের মূল কেটে দেবেন।

৮:৬৭ :: নবীর জন্য সঙ্গত নয় যে, তার কাছে থাকবে কোন যুদ্ধবন্দী (অর্থাৎ সে যুদ্ধে শত্রুকে বন্দী করা শুরু করবে), যতক্ষণ না সে (শত্রুদেরকে) আচ্ছামতো ধোলাই দেবে, পৃথিবীতে (অর্থাৎ রণাঙ্গনে/ যুদ্ধের ময়দানে)। তোমরা ইচ্ছা করো দুনিয়ার সম্পদ পেতে (অর্থাৎ মুক্তিপণ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা)। আর আল্লাহ ইচ্ছা করেন আখিরাত দিতে। আর আল্লাহ মহাশক্তিমান, মহাবিজ্ঞ।

৯:৫৫ :: অতএব তোমাকে যেন মুগ্ধ না করে তাদের ধন-সম্পদ এবং সন্তানাদি, আল্লাহ এর দ্বারা কেবল তাদের আযাব দিতে চান দুনিয়ার জীবনে এবং তাদের জান বের হবে কাফির অবস্থায়।

৯:৮৫ :: আর তোমাকে যেন মুগ্ধ না করে তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি, আল্লাহ এর দ্বারা কেবল তাদের দুনিয়ার জীবনে আযাব দিতে চান এবং কাফির অবস্থায় তাদের জান বের হয়ে যাবে।

১০:১০৭ :: ‘আর আল্লাহ যদি তোমাকে কোন ক্ষতি পৌঁছান, তবে তিনি ছাড়া তা দূর করার কেউ নেই। আর তিনি যদি তোমার কল্যাণ চান, তবে তাঁর অনুগ্রহের কোন প্রতিরোধকারী নেই। তিনি তার বান্দাদের যাকে ইচ্ছা তাকে তা দেন। আর তিনি পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু’।

১১:৩৪ :: ‘আর আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিতে চাইলেও আমার উপদেশ তোমাদের কোন উপকারে আসবে না, যদি আল্লাহ তোমাদের বিভ্রান্ত করতে চান। তিনি তোমাদের রব এবং তাঁর কাছেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে’।

১১:১০৭ :: সেখানে তারা (জাহান্নামীরা) স্থায়ী হবে, যতদিন পর্যন্ত আসমানসমূহ ও যমীন থাকবে, কিন্তু তোমার প্রভু যা ইচ্ছা করেন (তা-ই করতে পারেন)। নিশ্চয় তোমার রব তা-ই করে যা তিনি ইচ্ছা করেন।

১৩:১১ :: মানুষের জন্য রয়েছে, সামনে ও পেছনে, একের পর এক আগমনকারী প্রহরী, যারা আল্লাহর নির্দেশে তাকে হেফাযত করে। নিশ্চয় আল্লাহ কোন কওমের অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আর যখন আল্লাহ কোন জাতির মন্দ চান, তখন তা প্রতিহত করা যায় না এবং তাদের জন্য তিনি ছাড়া কোন অভিভাবক নেই।

১৬:৪০ :: যখন আমি কোন কিছুর ইচ্ছা করি, তখন আমার কথা হয় কেবল এই বলা যে, ‘হও’, ফলে তা হয়ে যায়।

১৭:১৬ :: আর যখন আমরা ইচ্ছা করি যে, আমরা ধ্বংস করবো কোন জনপদকে (তা এভাবে ঘটে যে), আমরা আদেশ দিই উহার সমৃদ্ধিশালীদেরকে; তারপর তারা তাতে দুষ্কার্য করে। তখন তারা নিজেদের উপর আমার (শাস্তির) বাণীর হক্বদার হয়ে যায়। তখন আমরা তা ধ্বংস করে দিই।

১৭:১৮ :: যে দুনিয়া চায় আমি সেখানে তাকে দ্রুত দিয়ে দেই, যা আমি চাই, যার জন্য চাই। তারপর তার জন্য নির্ধারণ করি জাহান্নাম, সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত, বিতাড়িত অবস্থায়।

১৮:৮২ :: ‘আর প্রাচীরটির বিষয় হল, তা ছিল শহরের দু’জন ইয়াতীম বালকের এবং তার নিচে ছিল তাদের গুপ্তধন। আর তাদের পিতা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। তাই আপনার রব চাইলেন যে, তারা দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে তাদের গুপ্তধন বের করে নেবে। এ সবই আপনার রবের রহমত স্বরূপ। আমি নিজ থেকে তা করিনি। এ হলো সে বিষয়ের ব্যাখ্যা, যে সম্পর্কে আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারেননি।

২১:১৭ :: আমি যদি খেলার উপকরণ গ্রহণ করতে চাইতাম, তবে আমার কাছে যা আছে তা দিয়েই করতাম। কিন্তু আমি তা করিনি।

২২:১৪ :: নিশ্চয় যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে দাখিল করবেন এমন জান্নাতে, যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন।

২২:১৬ :: এভাবেই আমি সুস্পষ্ট আয়াতরূপে তা (কুরআন) নাযিল করেছি। আর আল্লাহ নিঃসন্দেহে যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন।

২৮:৫ :: আর আমি চাইলাম সেই দেশে যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে এবং তাদেরকে নেতা বানাতে, আর তাদেরকে উত্তরাধিকারী বানাতে।

৩৩:১৭ :: বল, ‘আল্লাহ থেকে কে তোমাদেরকে রক্ষা করবে যদি তিনি তোমাদের কোন ক্ষতি করতে চান? অথবা তিনি তোমাদের রহমত দান করতে ইচ্ছা করেন (কে তোমাদের ক্ষতি করবে)’। আর তারা আল্লাহ ছাড়া তাদের কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না।

৩৩:৩৩ :: আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক-জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না। আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। হে নবী পরিবার, আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।

৩৬:২৩ :: আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্য ইলাহ গ্রহণ করব? যদি পরম করুণাময় আমার কোন ক্ষতি করার ইচ্ছা করেন, তাহলে তাদের সুপারিশ আমার কোন কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে উদ্ধারও করতে পারবে না’।

৩৬:৮২ :: তাঁর ব্যাপারতো শুধু এই যে, যখন তিনি কোনো কিছুর ইচ্ছা করেন তখন বলেন ‘হও’, ফলে তা হয়।

৩৯:৪ :: আল্লাহ যদি সন্তান গ্রহণ করতে চাইতেন, তাহলে তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তা থেকে যাকে ইচ্ছা বেছে নিতেন; কিন্তু তিনি পবিত্র মহান। তিনিই আল্লাহ, তিনি এক, প্রবল পরাক্রান্ত।

৩৯:৩৮ :: আর তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, কে আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে ‘আল্লাহ’। বল, ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ- আল্লাহ আমার কোন ক্ষতি চাইলে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ডাক তারা কি সেই ক্ষতি দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমাকে রহমত করতে চাইলে তারা সেই রহমত প্রতিরোধ করতে পারবে’? বল, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট’। তাওয়াক্কুলকারীগণ তাঁর উপরই তাওয়াক্কুল করে।

৪০:৩১ :: ‘যেমন ঘটেছিল নূহ, ‘আদ ও ছামূদ-এর কওম এবং তাদের পরবর্তীদের। আর আল্লাহ বান্দাদের উপর কোন যুলম করতে চান না।’

৪৮:১১ :: পিছনে পড়ে থাকা বেদুঈনরা তোমাকে অচিরেই বলবে, ‘আমাদের ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন আমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছিল; অতএব আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’ তারা মুখে তা বলে যা তাদের অন্তরে নেই। বল, ‘আল্লাহ যদি তোমাদের কোন ক্ষতি করতে চান কিংবা কোন উপকার করতে চান, তবে কে আল্লাহর মোকাবিলায় তোমাদের জন্য কোন কিছুর মালিক হবে’? বরং তোমরা যে আমল কর আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত।’

৫১:৫৭ :: আমি তাদের কাছে কোন রিয্ক চাই না; আর আমি চাই না যে, তারা আমাকে খাবার দিবে।

৭২:১০ :: ‘আর নিশ্চয় আমরা জানি না, যমীনে যারা রয়েছে তাদের জন্য অকল্যাণ চাওয়া হয়েছে, নাকি তাদের রব তাদের ব্যাপারে মঙ্গল চেয়েছেন’।

৭৪:৩১ :: আর আমি ফেরেশতাদেরকেই জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক বানিয়েছি। আর কাফিরদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ আমি তাদের সংখ্যা নির্ধারণ করেছি। যাতে কিতাবপ্রাপ্তরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে; আর মুমিনদের ঈমান বেড়ে যায় এবং কিতাবপ্রাপ্তরা ও মুমিনরা সন্দেহ পোষণ না করে। আর যেন যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা এবং অবশিষ্টরা বলে, এরূপ উপমা দ্বারা আল্লাহ কী ইচ্ছা করেছেন? এভাবেই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন আর যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে পরিচালিত করেন। আর তোমার রবের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানেন না। আর এ হচ্ছে মানুষের জন্য উপদেশমাত্র।

৮৫:১৬ :: তিনি (আল্লাহ) তা-ই করেন যা চান ।

(২) ‘শাআল্লাহ’ বা অনুরূপ শব্দে ‘আল্লাহর ইচ্ছা’ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ

২:২০, ২:৭০, ২:৯০, ২:১০৫, ২:১৪২, ২:২১২, ২:২১৩, ২:২২০, ২:২৪৭, ২:২৫১, ২:২৫৩, ২:২৫৫, ২:২৬১, ২:২৬৯, ২:২৭২, ২:২৮৪, ৩:৬, ৩:১৩, ৩:২৬, ৩:২৭, ৩:৩৭, ৩:৪০, ৩:৪৭, ৩:৭৩, ৩:৭৪, ৩:১২৯, ৩:১৭৯, ৪:৪৮, ৪:৪৯, ৪:৯০, ৪:১১৬, ৪:১৩৩, ৫:১৭, ৫:১৮, ৫:৪০, ৫:৪৮, ৫:৫৪, ৫:৬৪, ৬:৩৫, ৬:৩৯, ৬:৪১, ৬:৮০, ৬:৮৩, ৬:৮৮, ৬:১০৭, ৬:১১১, ৬:১১২, ৬:১২৮, ৬:১৩৩, ৬:১৩৭, ৬:১৪৮, ৬:১৪৯, ৭:৮৯, ৭:১০০, ৭:১২৮, ৭:১৫৫, ৭:১৫৬, ৭:১৭৬, ৭:১৮৮, ৯:১৫, ৯:২৭, ৯:২৮, ১০:১৬, ১০:২৫, ১০:৪৯, ১০:৯৯, ১০:১০৭, ১১:৩৩, ১১:১০৭, ১১:১০৮, ১১:১১৮, ১২:৫৬, ১২:৭৬, ১২:৯৯, ১২:১০০, ১২:১১০, ১৩:১৩, ১৩:২৬, ১৩:২৭, ১৩:৩১, ১৩:৩৯, ১৪:৪, ১৪:১১, ১৪:২৭, ১৬:২, ১৬:৯, ১৬:৩৫, ১৬:৯৩, ১৭:১৮, ১৭:৩০, ১৭:৫৪, ১৭:৮৬, ১৮:২৪, ১৮:৩৯, ১৮:৬৯, ২১:৯, ২২:৫, ২২:১৮, ২৩:২৪, ২৪:২১, ২৪:৩৫, ২৪:৩৮, ২৪:৪৩, ২৪:৪৫, ২৪:৪৬, ২৫:১০, ২৫:৪৫, ২৫:৫১, ২৬:৪, ২৭:৮৭, ২৮:২৭, ২৮:৫৬, ২৮:৬৮, ২৮:৮২, ২৯:২১, ২৯:৬২, ৩০:৫, ৩০:৩৭, ৩০:৪৮, ৩০:৫৪, ৩২:১৩, ৩৩:২৪, ৩৪:৯, ৩৪:৩৬, ৩৪:৩৯, ৩৫:১, ৩৫:৮, ৩৫:১৬, ৩৫:২২, ৩৬:৪৩, ৩৬:৪৭, ৩৬:৬৬, ৩৬:৬৭, ৩৭:১০২, ৩৯:৪, ৩৯:২৩, ৩৯:৫২, ৩৯:৬৮, ৪০:১৫, ৪১:১৪, ৪২:৮, ৪২:১২, ৪২:১৩, ৪২:১৯, ৪২:২৪, ৪২:২৭, ৪২:২৯, ৪২:৩৩, ৪২:৪৯, ৪২:৫০, ৪২:৫১, ৪২:৫২, ৪৩:২০, ৪৩:৬০, ৪৭:৪, ৪৭:৩০, ৪৮:১৪, ৪৮:২৫, ৪৮:২৭, ৫৩:২৬, ৫৬:৬৫, ৫৬:৭০, ৫৭:২১, ৫৭:২৯, ৫৯:৬, ৬২:৪, ৭৪:৩১, ৭৪:৫৬, ৭৬:২৮, ৭৬:৩০, ৭৬:৩১, ৮০:২২, ৮১:২৯, ৮২:৮, ৮৭:৭।

২:২০ :: বিদ্যুৎচমক তাদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার উপক্রম হয়। যখনই তা তাদের জন্য আলো দেয়, তারা তাতে চলতে থাকে। আর যখন তা তাদের উপর অন্ধকার করে দেয়, তারা দাঁড়িয়ে পড়ে। আর আল্লাহ যদি চাইতেন, অবশ্যই তাদের শ্রবণ ও চোখসমূহ নিয়ে নিতেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

২:৭০ :: তারা বলল, ‘তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দো‘আ কর, তিনি যেন আমাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন, তা কেমন? নিশ্চয় গরুটি আমাদের জন্য সন্দেহপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আর নিশ্চয় আমরা আল্লাহ চাহে তো পথপ্রাপ্ত হব’।

২:৯০ :: যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে তা কত জঘন্য (তা এই) যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা তারা অস্বীকার করেছে এই জিদের বশবর্তী হয়ে যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তার উপর তাঁর অনুগ্রহ নাযিল করেছেন। সুতরাং তারা ক্রোধের উপর ক্রোধের অধিকারী হল। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।

২:১০৫ :: আহলে কিতাব ও মুশরিকদের মধ্য থেকে যারা কুফরী করেছে, তারা চায় না যে, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের উপর কোন কল্যাণ নাযিল হোক। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে তাঁর রহমত দ্বারা খাস করেন এবং আল্লাহ মহান অনুগ্রহের অধিকারী।

২:১৪২ :: অচিরেই নির্বোধ লোকেরা বলবে, 'কীসে তাদেরকে তাদের কিবলা থেকে ফিরাল, যার উপর তারা ছিল?' বল, 'পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই। তিনি যাকে চান সোজা পথ দেখান'।

২:২১২ :: যারা কুফরী করেছে, দুনিয়ার জীবনকে তাদের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে। আর তারা মুমিনদের নিয়ে উপহাস করে। আর যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তারা কিয়ামত দিবসে তাদের উপরে থাকবে। আর আল্লাহ যাকে চান, বেহিসাব রিয্ক দান করেন।

২:২১৩ :: মানুষ ছিল এক উম্মত। অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে নবীদেরকে প্রেরণ করলেন এবং সত্যসহ তাদের সাথে কিতাব নাযিল করলেন, যাতে মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত। আর তারাই তাতে মতবিরোধ করেছিল, যাদেরকে তা দেয়া হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষবশত। অতঃপর আল্লাহ নিজ অনুমতিতে মুমিনদেরকে হিদায়াত দিলেন যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছিল। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন।

২:২২০ :: দুনিয়া ও আখিরাতের ব্যাপারে। আর তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে ইয়াতীমদের সম্পর্কে। বল, সংশোধন করা তাদের জন্য উত্তম। আর যদি তাদেরকে নিজদের সাথে মিশিয়ে নাও, তবে তারা তোমাদেরই ভাই। আর আল্লাহ জানেন কে ফাসাদকারী, কে সংশোধনকারী এবং আল্লাহ যদি চাইতেন, অবশ্যই তোমাদের জন্য (বিষয়টি) কঠিন করে দিতেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

২:২৪৭ :: আর তাদেরকে তাদের নবী বলল, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য তালূতকে রাজারূপে পাঠিয়েছেন। তারা বলল, ‘আমাদের উপর কীভাবে তার রাজত্ব হবে, অথচ আমরা তার চেয়ে রাজত্বের অধিক হকদার? আর তাকে সম্পদের প্রাচুর্যও দেয়া হয়নি’। সে বলল, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাকে তোমাদের উপর মনোনীত করেছেন এবং তাকে জ্ঞানে ও দেহে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহ যাকে চান, তাকে তাঁর রাজত্ব দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ’।

২:২৫১ :: অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে পরাজিত করল এবং দাঊদ জালূতকে হত্যা করল। আর আল্লাহ দাঊদকে রাজত্ব ও প্রজ্ঞা দান করলেন এবং তাকে যা ইচ্ছা শিক্ষা দিলেন। আর আল্লাহ যদি মানুষের কতককে কতকের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তবে অবশ্যই যমীন ফাসাদপূর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর উপর অনুগ্রহশীল।

২:২৫৩ :: ঐ রাসূলগণ, আমি তাদের কাউকে কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, তাদের মধ্যে কারো সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং কারো কারো মর্যাদা উঁচু করেছেন। আর আমি ঈসা ইবনে মারয়ামকে দিয়েছি সুস্পষ্ট প্রমাণাদি এবং আমি তাকে শক্তিশালী করেছি রূহুল কুদুস এর মাধ্যমে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তাদের পরবর্তীরা লড়াই করতো না, তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণসমূহ আসার পর। কিন্তু তারা মতবিরোধ করেছে। ফলে তাদের মধ্যে কেউ ঈমান এনেছে, আর তাদের কেউ কুফরী করেছে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তাহলে তারা লড়াই করতো না। কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা করেন।

২:২৫৫ :: আল্লাহ! তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি চিরজীবন্ত, চিরপ্রতিষ্ঠিত। তন্দ্রা ও নিদ্রা তাঁকে স্পর্শ করেনা। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু রয়েছে সবই তাঁর। কে আছে এমন, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে? সম্মুখের অথবা পশ্চাতের সবই তিনি অবগত আছেন। তিনি যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ত করতে পারেনা। তাঁর আসন আসমান ও যমীন ব্যাপী হয়ে আছে এবং এতদুভয়ের সংরক্ষণে তাঁকে বিব্রত হতে হয়না। তিনিই সর্বোচ্চ, মহীয়ান।

২:২৬১ :: যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ’ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।

২:২৬৯ :: তিনি যাকে চান প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে প্রজ্ঞা দেয়া হয়, তাকে অনেক কল্যাণ দেয়া হয়। আর বিবেক সম্পন্নগণই উপদেশ গ্রহণ করে।

২:২৭২ :: তাদেরকে হিদায়াত করার দায়িত্ব তোমার নয়, কিন্তু আল্লাহ যাকে চান হিদায়াত করেন এবং তোমরা যে সম্পদ ব্যয় কর, তা তোমাদের নিজদের জন্যই। আর তোমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যয় কর এবং তোমরা কোন উত্তম ব্যয় করলে তা তোমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে দেয়া হবে। আর তোমাদের প্রতি যুলম করা হবে না।

২:২৮৪ :: আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা আছে সবই আল্লাহর আয়ত্তে। আর যদি তোমরা তোমাদের মনে যা আছে তা প্রকাশ করো অথবা তা গোপন করো (উভয় অবস্থায়) আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নিবেন। তারপর তিনি যাকে ইচ্ছা করেন ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা করেন শাস্তি দিবেন। আর আল্লাহ সকল সত্তা ও বিষয়ের উপর প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণকারী ও সর্বশক্তিমান নিয়ন্ত্রণকারী।

৩:৬ :: তিনিই মাতৃগর্ভে তোমাদেরকে আকৃতি দান করেন যেভাবে তিনি চান। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

৩:১৩ :: নিশ্চয় তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে দু’টি দলের মধ্যে, যারা পরস্পর মুখোমুখি হয়েছিল। একটি দল লড়াই করছিল আল্লাহর পথে এবং অপর দলটি কাফির। তারা বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদেরকে ওদের দ্বিগুণ দেখছিল। আর আল্লাহ নিজ সাহায্য দ্বারা যাকে চান শক্তিশালী করেন। নিশ্চয় এতে রয়েছে চক্ষুষ্মানদের জন্য শিক্ষা।

৩:২৬ :: বল, ‘হে আল্লাহ, রাজত্বের মালিক, আপনি যাকে চান রাজত্ব দান করেন, আর যার থেকে চান রাজত্ব কেড়ে নেন এবং আপনি যাকে চান সম্মান দান করেন। আর যাকে চান অপমানিত করেন, আপনার হাতেই কল্যাণ। নিশ্চয় আপনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান’।

৩:২৭ :: ‘আপনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান। আর মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন। আর যাকে চান বিনা হিসাবে রিয্ক দান করেন’।

৩:৩৭ :: অতঃপর তার রব তাকে উত্তমভাবে কবুল করলেন এবং তাকে উত্তমভাবে গড়ে তুললেন। আর তাকে যাকারিয়্যার দায়িত্বে দিলেন। যখনই যাকারিয়্যা তার কাছে তার কক্ষে প্রবেশ করত, তখনই তার নিকট খাদ্যসামগ্রী পেত। সে বলত, ‘হে মারইয়াম, কোথা থেকে তোমার জন্য এটি’? সে বলত, ‘এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে। নিশ্চয় আল্লাহ যাকে চান বিনা হিসাবে রিয্ক দান করেন’।

৩:৪০ :: সে (জাকারিয়া) বলল, ‘হে আমার রব, কীভাবে আমার পুত্র হবে? অথচ আমার তো বার্ধক্য এসে গিয়েছে, আর আমার স্ত্রী বন্ধ্যা’। তিনি বললেন, ‘এভাবেই আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন’।

৩:৪৭ :: সে (মারইয়াম) বলল, ‘হে আমার রব, কিভাবে আমার সন্তান হবে? অথচ কোন মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি’! আল্লাহ বললেন, ‘এভাবেই’ আল্লাহ যা চান সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাকে শুধু বলেন, ‘হও’। ফলে তা হয়ে যায়।

৩:৭৩ :: (আহলে কিতাব বলে,) ‘আর যারা তোমাদের দীনের অনুসরণ করে তাদেরকে ছাড়া কাউকে তোমরা বিশ্বাস করো না’। বলো, ‘নিশ্চয় আল্লাহর হিদায়াতই হিদায়াত’। (তারা বলে,) ‘(বিশ্বাস করো না) যে, কোনো ব্যক্তিকে দেয়া হবে যেরূপ তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে। অথবা তারা তোমাদের রবের নিকট তোমাদের সাথে বিতর্ক করবে’। বলো, ‘নিশ্চয় অনুগ্রহ আল্লাহর হাতে, তিনি যাকে চান, তা দান করেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ’।

৩:৭৪ :: তিনি যাকে চান, তাঁর রহমত দ্বারা একান্ত করে নেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহের অধিকারী।

৩:১২৯ :: আর আল্লাহর জন্যই যা আছে আসমানসমূহে এবং যা আছে যমীনে । তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন, আর যাকে ইচ্ছা আযাব দেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

৩:১৭৯ :: আল্লাহ এমন নন যে, তিনি মুমিনদেরকে (এমন অবস্থায়) ছেড়ে দেবেন যার উপর তোমরা আছ। যতক্ষণ না তিনি পৃথক করবেন অপবিত্রকে পবিত্র থেকে। আর আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তোমাদেরকে গায়েব সম্পর্কে জানাবেন। তবে আল্লাহ তাঁর রাসূলদের মধ্য থেকে যাকে চান বেছে নেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন। আর যদি তোমরা ঈমান আন এবং তাকওয়া অবলম্বন কর তবে তোমাদের জন্য রয়েছে মহাপ্রতিদান।

৪:৪৮ :: নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যার জন্য তিনি চান। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে অবশ্যই মহাপাপ রচনা করে।

৪:৪৯ :: তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা নিজদেরকে পবিত্র মনে করে? বরং আল্লাহ যাকে চান তাকে পবিত্র করেন। আর তাদেরকে সূতা পরিমাণ যুলমও করা হবে না।

৪:৯০ :: তবে (তাদেরকে হত্যা করো না) যারা মিলিত হয় এমন কওমের সাথে, যাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সন্ধিচুক্তি রয়েছে। অথবা তোমাদের কাছে আসে এমন অবস্থায় যে, তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে কিংবা তাদের কওমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তাদের মন সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছে। আর আল্লাহ চাইলে অবশ্যই তাদেরকে তোমাদের উপর ক্ষমতা দিতে পারতেন। অতঃপর নিশ্চিতরূপে তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত। অতএব তারা যদি তোমাদের থেকে সরে যায় অতঃপর তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে এবং তোমাদের কাছে শান্তি প্রস্তাব উপস্থাপন করে, তাহলে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ রাখেননি।

৪:১১৬ :: নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শরীক করাকে এবং এ ছাড়া যাকে চান ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে তো ঘোর পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হল।

৪:১৩৩ :: হে মানুষ, যদি আল্লাহ চান তোমাদেরকে সরিয়ে দেবেন এবং অপরকে আনবেন। আর আল্লাহ এর উপর সক্ষম।

৫:১৭ :: অবশ্যই তারা কুফরী করেছে যারা বলে ‘নিশ্চয় মারইয়াম পুত্র মাসীহই আল্লাহ’। বল, যদি আল্লাহ ধ্বংস করতে চান মারইয়াম পুত্র মাসীহকে ও তার মাকে এবং যমীনে যারা আছে তাদের সকলকে ‘তাহলে কে আল্লাহর বিপক্ষে কোন কিছুর ক্ষমতা রাখে? আর আসমানসমূহ, যমীন ও তাদের মধ্যবর্তী যা রয়েছে, তার রাজত্ব আল্লাহর জন্যই। তিনি যা ইচ্ছা তা সৃষ্টি করেন এবং আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

৫:১৮ :: ইয়াহূদী ও নাসারারা বলে, ‘আমরা আল্লাহর পুত্র ও তার প্রিয়জন’। বল, ‘তবে কেন তিনি তোমাদেরকে তোমাদের পাপের কারণে আযাব দেন? বরং তোমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত মানুষ, যাদেরকে তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা আযাব দেন। আর আসমানসমূহ ও যমীন এবং তাদের মধ্যবর্তী যা আছে তার সার্বভৌমত্ব আল্লাহর এবং তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তন’।

৫:৪০ :: তুমি কি জান না যে, নিশ্চয় আল্লাহ, তাঁর জন্যই আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব, তিনি যাকে ইচ্ছা আযাব দেন এবং যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন, আর আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

৫:৪৮ :: আর আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যথাযথভাবে, এর পূর্বের কিতাবের সত্যায়নকারী ও এর উপর তদারককারীরূপে। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরীআত ও স্পষ্ট পন্থা এবং আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে তোমাদেরকে এক উম্মত বানাতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। সুতরাং তোমরা ভাল কাজে প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহরই দিকে তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন, যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে।

৫:৫৪ :: হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তার দীন থেকে ফিরে যাবে তাহলে অচিরেই আল্লাহ এমন কওমকে আনবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। তারা মুমিনদের উপর বিনম্র এবং কাফিরদের উপর কঠোর হবে। আল্লাহর রাস্তায় তারা জিহাদ করবে এবং কোন কটাক্ষকারীর কটাক্ষকে ভয় করবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে তা দান করেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।

৫:৬৪ :: আর ইয়াহূদীরা বলে, ‘আল্লাহর হাত বাঁধা’। তাদের হাতই বেঁধে দেয়া হয়েছে এবং তারা যা বলেছে, তার জন্য তারা লা‘নতগ্রস্ত হয়েছে। বরং তার দু’হাত প্রসারিত। যেভাবে ইচ্ছা তিনি দান করেন এবং তোমার উপর তোমার রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে তা তাদের অনেকের অবাধ্যতা ও কুফরী বাড়িয়েই দিচ্ছে। আর আমি তাদের মধ্যে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত শত্রুতা ও ঘৃণা ঢেলে দিয়েছি। যখনই তারা যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত করে, আল্লাহ তা নিভিয়ে দেন। আর তারা যমীনে ফাসাদ করে বেড়ায় এবং আল্লাহ ফাসাদকারীদের ভালবাসেন না।

৬:৩৫-৩৭ :: আর যদি তাদের উপেক্ষা তোমার উপর কঠিন মনে হয়, তাহলে যদি তুমি সমর্থ হও, তাহলে যমীনে কোনো সুড়ঙ্গ অথবা আসমানে কোন সিঁড়ি অনুসন্ধান করো, অতঃপর তাদের কাছে কোনো নিদর্শন নিয়ে আসো। যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তিনি অবশ্যই তাদেরকে হিদায়াতের উপর একত্র করতেন। সুতরাং তুমি কখনো মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। তারাই সাড়া দেয় যারা শুনে। আর মৃতদেরকে আল্লাহ আবার জীবিত করবেন। তারপর তার দিকেই প্রত্যাবর্তিত হবে। আর তারা বলে, ‘কেন নাযিল করা হয় না তার উপর কোনো নিদর্শন তার রবের পক্ষ থেকে?’ বলো, ‘নিশ্চয় আল্লাহ সক্ষম নিদর্শন নাযিল করতে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই (সক্ষমতা সত্ত্বেও নিদর্শন না পাঠানোর তাৎপর্য সম্পর্কে) জ্ঞান রাখে না’।

৬:৩৯ :: আর যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে তারা বধির ও বোবা, গভীর অন্ধকারে রয়েছে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা করেন সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথে রাখেন।

৬:৪১ :: বরং তাকেই তোমরা ডাকবে। অতঃপর যদি তিনি চান, যে জন্য তাকে ডাকছ, তা তিনি দূর করে দেবেন। আর তোমরা যা শরীক কর, তা তোমরা ভুলে যাবে।

৬:৮০ :: আর তার কওম তার সাথে বাদানুবাদ করল। সে বলল, তোমরা কি বাদানুবাদ করছ আমার সাথে আল্লাহর ব্যাপারে, অথচ তিনি আমাকে হিদায়াত দিয়েছেন? তোমরা তাঁর সাথে যা শরীক কর, আমি তাকে ভয় করি না, তবে আমার রব যদি কিছু করতে চান। আমার রব ইলম দ্বারা সব কিছু পরিব্যাপ্ত করে আছেন। অতঃপর তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না’?

৬:৮৩ :: আর এ হচ্ছে আমার দলীল, আমি তা ইবরাহীমকে তার কওমের উপর দান করেছি। আমি যাকে চাই, তাকে মর্যাদায় উঁচু করি। নিশ্চয় তোমার রব প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।

৬:৮৮ :: এ হচ্ছে আল্লাহর হিদায়াত, এ দ্বারা তিনি নিজ বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন। আর যদি তারা শির্‌ক করত, তবে তারা যা আমল করছিল তা অবশ্যই বরবাদ হয়ে যেত।

৬:১০৭ :: আর যদি আল্লাহ চাইতেন (বাধ্য করতেন), তারা শির্‌ক করত না এবং আমি তোমাকে তাদের উপর হিফাযতকারী বানাইনি। আর তুমি তাদের উপর কর্মবিধায়ক নও।

৬:১১১ :: যদি আমি তাদের কাছে ফেরেশতাদের অবতীর্ণ করতাম আর মৃতরা তাদের সাথে কথা বলতো আর আমি তাদের সামনে সবকিছু সমবেত করতাম তবুও আল্লাহর ইচ্ছে ব্যতীত তারা ঈমান আনতো না, কিন্তু (এটার পদ্ধতিগত কারণ হলো) তাদের অধিকাংশই মূর্খতা (বিবেক বহির্ভুত চিন্তাধারা ও আচরণ) অবলম্বন করে।

৬:১১২ :: আর এভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর শত্রু করেছি মানুষ ও জিনের মধ্য থেকে শয়তানদেরকে, তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে একে অপরকে চাকচিক্যপূর্ণ কথার কুমন্ত্রণা দেয় এবং যদি তোমার প্রভু ইচ্ছা করতেন, তবে তারা তা করতো না। সুতরাং তুমি তাদেরকে ও তারা যে মিথ্যা রটায়, তা ত্যাগ কর।

৬:১২৮ :: আর যেদিন আল্লাহ তাদের সবাইকে সমবেত করবেন। সেদিন বলবেন, ‘হে জিনের দল, মানুষের অনেককে তোমরা বিভ্রান্ত করেছিলে’ এবং মানুষদের মধ্য থেকে তাদের অভিভাবকরা বলবে, ‘হে আমাদের রব, আমরা একে অপরের দ্বারা লাভবান হয়েছি এবং আমরা সে সময়ে উপনীত হয়েছি, যা আপনি আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন’। তিনি বলবেন, “আগুন তোমাদের ঠিকানা, তোমরা তাতে স্থায়ী হবে। আল্লাহ যা (যেরূপ) ইচ্ছা করেন/করবেন তা (সেরূপ) ছাড়া।” নিশ্চয় তোমার রব প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।

৬:১৩৩ :: আর তোমার রব অমুখাপেক্ষী, দয়ালু। যদি তিনি চান, তোমাদেরকে সরিয়ে নেবেন এবং তোমাদের পরে যা ইচ্ছে স্থলাভিষিক্ত করবেন, যেমন তিনি তোমাদেরকে অন্য কওমের বংশ থেকে সৃষ্টি করেছেন।

৬:১৩৭ :: আর এভাবে অনেক মুশরিকের জন্য তাদের শরীকরা তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করা শোভিত করেছে, যাতে তাদেরকে ধ্বংস করতে পারে এবং তাদের নিকট তাদের দীনকে সংশয়পূর্ণ করতে পারে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তারা তা করতো না। সুতরাং তারা যে মিথ্যা বানায়, তা নিয়ে তুমি তাদেরকে থাকতে দাও।

৬:১৪৮ :: অচিরেই মুশরিকরা বলবে, ‘আল্লাহ যদি চাইতেন, আমরা শিরক করতাম না এবং আমাদের পিতৃপুরুষরাও না এবং আমরা কোন কিছু হারাম করতাম না’। এভাবেই তাদের পূর্ববর্তীরা মিথ্যারোপ করেছে, যে পর্যন্ত না তারা আমার আযাব আস্বাদন করেছে। বল, ‘তোমাদের কাছে কি কোন জ্ঞান আছে, যা তোমরা আমাদের জন্য প্রকাশ করবে? তোমরা তো শুধু ধারণার অনুসরণ করছ এবং তোমরা তো কেবল অনুমান করছ’।

৬:১৪৯ :: বল, ‘চূড়ান্ত প্রমাণ আল্লাহরই। সুতরাং যদি তিনি চান, অবশ্যই তোমাদের সবাইকে হিদায়াত দেবেন।’

৭:৮৯ :: আমরা তো আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করলাম যদি আমরা তোমাদের ধর্মে ফিরে যাই- সেই ধর্ম থেকে আল্লাহ আমাদেরকে নাজাত দেয়ার পর। আর আমাদের জন্য উচিত হবে না তাতে ফিরে যাওয়া। তবে আমাদের রব আল্লাহ চাইলে (সেটা ভিন্ন কথা)। আমাদের রব জ্ঞান দ্বারা সব কিছু পরিব্যাপ্ত করে আছেন। আল্লাহরই উপর আমরা তাওয়াক্কুল করি। হে আমাদের রব, আমাদের ও আমাদের কওমের মধ্যে যথার্থ ফয়সালা করে দিন। আর আপনি শ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী।

৭:১০০ :: যমীনের অধিবাসীদের (চলে যাবার) পর যারা তার উত্তরাধিকারী হয়, তাদের কাছে কি এ কথা পরিষ্কার হয়নি যে, আমি যদি চাই, তাদের পাপের কারণে তাদেরকে শাস্তি দিতে পারি? আর আমি মোহর মেরে দেই তাদের হৃদয়ে। অতঃপর তারা শোনে না।

৭:১২৮ :: মূসা তার কওমকে বলল, ‘আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও এবং ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয় যমীন আল্লাহর। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে তিনি চান তাকে তার উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন। আর পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য।’

৭:১৫৫ :: আর মূসা নিজ কওম থেকে সত্তর জন লোককে আমার নির্ধারিত স্থানের জন্য নির্বাচন করল। অতঃপর যখন ভূমিকম্প তাদেরকে পাকড়াও করল তখন সে বলল, ‘হে আমার রব, আপনি চাইলে ইতঃপূর্বে এদের ধ্বংস করতে পারতেন এবং আমাকেও। আমাদের মধ্যে নির্বোধরা যা করেছে তার কারণে কি আমাদেরকে ধ্বংস করবেন? এটাতো আপনার পরীক্ষা ছাড়া কিছু না। এর মাধ্যমে যাকে চান আপনি পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে চান হিদায়াত দান করেন। আপনি আমাদের অভিভাবক। সুতরাং আমাদের ক্ষমা করে দিন এবং আপনি উত্তম ক্ষমাশীল।

৭:১৫৬ :: আর আমাদের জন্য এ দুনিয়াতে ও আখিরাতে কল্যাণ লিখে দিন। নিশ্চয় আমরা আপনার দিকে প্রত্যাবর্তন করেছি।’ তিনি বললেন, ‘আমি যাকে চাই তাকে আমার আযাব দেই। আর আমার রহমত সব বস্তুকে পরিব্যাপ্ত করেছে। সুতরাং আমি তা লিখে দেব তাদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যাকাত প্রদান করে। আর যারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান আনে।

৭:১৭৬ :: আর আমি ইচ্ছা করলে উক্ত নিদর্শনাবলীর মাধ্যমে তাকে অবশ্যই উচ্চ মর্যাদা দিতাম, কিন্তু সে পৃথিবীর প্রতি ঝুঁকে পড়েছে এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে কুকুরের মত। যদি তার উপর বোঝা চাপিয়ে দাও তাহলে সে জিহবা বের করে হাঁপাবে অথবা যদি তাকে ছেড়ে দাও তাহলেও সে জিহবা বের করে হাঁপাবে। এটি হচ্ছে সে কওমের দৃষ্টান্ত যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে। অতএব তুমি কাহিনী বর্ণনা কর, যাতে তারা চিন্তা করে।

৭:১৮৮ :: বলো, ‘আমি আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আমার নিজের কোনো উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতাও রাখি না। আর যদি আমি গায়েব জানতাম তাহলে অনেক কল্যাণ অর্জন করতে পারতাম এবং আমাকে কোনো ক্ষতি স্পর্শ করতো না। আমিতো একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা ঈমান আনে।

[আলোচনা : আমি নিজের ততটুকুই উপকার বা ক্ষতি করতে পারি, যতটুকু আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় তথা আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী উপকার বা ক্ষতির পদ্ধতি অবলম্বন করে সম্পাদিত হয়।]

৯:১৫ :: আর তাদের অন্তরসমূহের ক্রোধ দূর করবেন এবং আল্লাহ যাকে চান তার তাওবা কবুল করেন। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।

৯:২৭ :: এরপর আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা তাদের তাওবা কবূল করবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

৯:২৮ :: হে ঈমানদারগণ, নিশ্চয় মুশরিকরা নাপাক, সুতরাং তারা যেন মসজিদুল হারামের নিকটবর্তী না হয় তাদের এ বছরের পর। আর যদি তোমরা দারিদ্র্যকে ভয় কর, তবে আল্লাহ চাইলে নিজ অনুগ্রহে তোমাদের অভাবমুক্ত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।

১০:১৬ :: বল, ‘যদি আল্লাহ চাইতেন, আমি তোমাদের উপর তা পাঠ করতাম না। আর তিনি তোমাদেরকে এ সম্পর্কে অবহিত করতেন না। ইতঃপূর্বে আমি তোমাদের মধ্যে দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করেছি। তবে কি তোমরা বুঝ না’?

১০:২৫ :: আর আল্লাহ শান্তির আবাসের দিকে আহবান করেন এবং যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেন সরল পথের দিকে।

১০:৪৯ :: বল, ‘আমি নিজের ক্ষতি বা উপকারের অধিকার রাখি না, তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন’। প্রত্যেক উম্মতের রয়েছে নির্দিষ্ট একটি সময়। যখন এসে যায় তাদের সময়, তখন এক মুহূর্ত পিছাতে পারে না এবং এগোতেও পারে না।

১০:৯৯ :: যদি তোমার প্রভু ইচ্ছা করতেন তাহলে পৃথিবীতে যারা আছে তাদের সকলে একত্রে ঈমান আনতো। তবে কি মানুষকে জবরদস্তি করবে যতক্ষণ না তারা মু’মিন হয়?

[অর্থাৎ আল্লাহ মানুষকে ঈমান আনতে বাধ্য করেন নি, বরং ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাই রসূলেরও উচিত হবে না কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঈমান আনতে বাধ্য করা।]

১০:১০৭ :: ‘আর যদি আল্লাহ্‌ আপনাকে কোনো ক্ষতির স্পর্শ করান, তবে তিনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই। আর যদি আল্লাহ্‌ আপনার মঙ্গল চান, তবে তাঁর অনুগ্রহ প্রতিহত করার কেউ নেই। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে তার কাছে সেটা পৌঁছান। আর তিনি পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।

১১:৩৩ :: সে বলল, ‘আল্লাহই তো তোমাদের কাছে তা হাজির করবেন, যদি তিনি চান। আর তোমরা তাকে অক্ষম করতে পারবে না’।

১১:১০৭ :: তারা তাতে (জাহান্নামে) স্থায়ী হবে, যতদিন আসমানসমূহ ও যমীন প্রতিষ্ঠিত থাকবে, আল্লাহ যা (যেরূপ) ইচ্ছা করেন/করবেন তা (সেরূপ) ছাড়া। নিশ্চয় তোমার রব তা-ই করে যা তিনি ইচ্ছা করেন।

১১:১০৮ :: আর যারা আনন্দিত হবে তারা যাবে জান্নাতে। তারা তাতে (জান্নাতে) স্থায়ী হবে, যতদিন আসমানসমূহ ও যমীন প্রতিষ্ঠিত থাকবে, আল্লাহ যা (যেরূপ) ইচ্ছা করেন/করবেন তা (সেরূপ) ছাড়া। (তারা পাবে এরূপ) পুরস্কার যা অবিচ্ছিন্ন।

১১:১১৮-১১৯ :: যদি তোমার রব চাইতেন, তবে সকল মানুষকে এক উম্মতে পরিণত করতেন, কিন্তু তারা পরস্পর মতবিরোধকারী রয়ে গেছে। তোমার প্রভু যাকে অনুগ্রহ করেছেন তারা ছাড়া (অন্যরা ইখতিলাফে রত)। আর এজন্যই (ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়ে পরীক্ষার জন্যই) তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আর পূর্ণ হয়ে গেছে তোমার রবের এই বাণী, ‘আমি অবশ্যই ভরে দেবো জাহান্নামকে জ্বিন ও মানুষ দিয়ে একত্রে’।

[অর্থাৎ যারা স্বেচ্ছায় সঠিক পথ বেছে নিয়েছে তারা আল্লাহর অনুগ্রহে পারস্পরিক মতবিরোধের সমাধান করতে সক্ষম হবে।]

১২:৫৬ :: আর এমনিভাবে আমি ইউসুফকে যমীনে কর্তৃত্ব প্রদান করেছি, সে তার যেখানে ইচ্ছা অবস্থান করতে পারত। আমি যাকে ইচ্ছা স্বীয় রহমত দান করি, আর আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করি না।

১২:৭৬ :: তারপর সে তার ভাইয়ের পাত্রের পূর্বে তাদের পাত্রগুলো দিয়ে (তল্লাশী) শুরু করল, তারপর সেটি তার ভাইয়ের পাত্র থেকে বের করল, এভাবে আমি ইউসুফের জন্য কৌশল করলাম। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া বাদশাহর আইনে সে তার ভাইকে রেখে দিতে পারত না, আমি যাকে ইচ্ছা তার মর্যাদা উঁচু করে দেই এবং প্রত্যেক জ্ঞানীর উপর রয়েছে একজন মহাজ্ঞানী।

১২:৯৯ :: অতঃপর যখন তারা ইউসুফের নিকট প্রবেশ করল, তখন সে তার পিতামাতাকে নিজের কাছে স্থান করে দিল এবং বলল, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় আপনারা নিরাপদে মিসরে প্রবেশ করুন’।

১২:১০০ :: আর সে তার পিতামাতাকে রাজাসনে উঠাল এবং তারা সকলে তার জন্য সেজদায় লুটিয়ে পড়ল এবং সে বলল, ‘হে আমার পিতা, এই হল আমার ইতঃপূর্বের স্বপ্নের ব্যাখ্যা, আমার রব তা বাস্তবে পরিণত করেছেন আর তিনি আমার উপর এহসান করেছেন, যখন আমাকে জেলখানা থেকে বের করেছেন এবং তোমাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন, শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করার পর। নিশ্চয় আমার রব যা ইচ্ছা করেন, তা বাস্তবায়নে তিনি সূক্ষ্মদর্শী। নিশ্চয় তিনি সম্যক জ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়’।

১২:১১০ :: অবশেষে যখন রাসূলগণ (কওমের ঈমান থেকে) নিরাশ হয়ে গেল এবং তারা মনে করল তাদের সাথে মিথ্যা বলা হয়েছে, তখন তাদের কাছে আমার সাহায্য আসল, অতঃপর আমি যাকে ইচ্ছা নাজাত দেই, আর অপরাধী কওম থেকে আমার শাস্তি ফেরানো হয় না।

১৩:১৩ :: আর বজ্র তার সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করে এবং ফেরেশতারাও তার ভয়ে। আর তিনি গর্জনকারী বজ্র পাঠান। অতঃপর যাকে ইচ্ছা তা দ্বারা আঘাত করেন এবং তারা আল্লাহ সম্বন্ধে ঝগড়া করতে থাকে। আর তিনি শক্তিতে প্রবল, শাস্তিতে কঠোর।

১৩:২৬ :: আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন জীবিকা প্রশস্ত করে দেন এবং (যাকে ইচ্ছা করেন জীবিকা) নির্ধারিত পরিমাণমতো দেন। আর তারা পার্থিব জীবন নিয়ে উল্লসিত, অথচ আখিরাতের তুলনায় পার্থিব জীবন (ক্ষণস্থায়ী) ভোগসামগ্রী ছাড়া কিছু নয়।

[অর্থাৎ কাউকে তার কোনো নৈতিক গুণের কারণে বা অন্য কোনো কারণে তথা তার নিজের বা সমাজ সমষ্টির কোনো কল্যাণার্থে তার চেষ্টা সাধনা অনুযায়ী ও প্রাকৃতিক কারণ ও ফলাফল বিধির আওতায় তার যা প্রাপ্য তার চেয়ে বেশি প্রদান করেন, অন্যদিকে কাউকে শুধু তা-ই প্রদান করেন যা প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণ অনুসারে সে পেতে পারে।]

১৩:২৭ :: আর যারা কুফরী করেছে, তারা বলে, ‘তার নিকট তার রবের পক্ষ থেকে কোন নিদর্শন কেন নাযিল হয় না’? বল, ‘নিশ্চয় আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যে তাঁর অভিমুখী হয়, তাকে তিনি তাঁর দিকে পথ দেখান’।

১৩:৩১ :: আর যদি এমন কোনো কুরআন হতো, যার দ্বারা পাহাড়সমূহকে চলমান করা যেতো অথবা যমীনকে টুকরো-টুকরো করা যেতো অথবা তার দ্বারা মৃতকে কথা বলানো যেতো (তবে সেটা এই কুরআনই হত, আর তারা ঈমান আনতো না)। বরং সব সিদ্ধান্ত আল্লাহরই। যারা ঈমান এনেছে, তারা কি (ওদের ঈমানের ব্যাপারে) নিরাশ হয় নি এবং তারা জানে যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে সমগ্র মানুষকে হিদায়াত দান করতেন? আর যারা কুফরী করে, তাদের কর্মের দরুন সর্বদা তাদের বিপদ ঘটতে থাকবে অথবা তাদের আবাসের আশপাশে বিপদ আপতিত হতে থাকবে, অবশেষে আসবে আল্লাহর ওয়াদা। নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না।

১৩:৩৯ :: আল্লাহ্ যা ইচ্ছে তা মিটিয়ে দেন এবং যা ইচ্ছে তা প্রতিষ্ঠিত রাখেন এবং তাঁরই কাছে আছে উম্মুল কিতাব।

১৪:৪ :: আর আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার কওমের ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে বর্ণনা দেয়, সুতরাং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ দেখান। আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

১৪:১১ :: তাদেরকে তাদের রাসূলগণ বলল, ‘আমরা তো কেবল তোমাদের মতই মানুষ, কিন্তু আল্লাহ তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন। আর আল্লাহর অনুমতি ছাড়া তোমাদের কাছে প্রমাণ নিয়ে আসার সাধ্য আমাদের নেই। আর কেবল আল্লাহর উপরই মুমিনদের তাওয়াক্কুল করা উচিত’।

১৪:২৭ :: আল্লাহ অবিচল রাখেন ঈমানদারদেরকে সুদৃঢ় বাণী দ্বারা দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে। আর আল্লাহ যালিমদের পথভ্রষ্ট করেন এবং আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।

১৬:২ :: তিনি তাঁর এ রূহকে (ওহীক) যে বান্দাহর উপর চান স্বীয় নির্দেশক্রমে ফেরেশতাদের মাধ্যমে অবতীর্ণ করেন (এই মর্মে যে) তোমরা সতর্ক কর যে, আমি ছাড়া সত্যিকারের কোন ইলাহ নেই, কাজেই আমাকে ভয় কর।

১৬:৯ :: আর সঠিক পথ বাতলে দেয়া আল্লাহর দায়িত্ব, এবং পথের মধ্যে কিছু আছে বক্র। আর যদি তিনি ইচ্ছা করতেন তবে তোমাদের সকলকে হিদায়াত করতেন।

১৬:৩৫ :: আর যারা শিরক করেছে, তারা বলল, যদি আল্লাহ চাইতেন তবে আমরা তাকে ছাড়া কোন কিছুর ইবাদাত করতাম না এবং আমাদের পিতৃপুরুষরাও না। আর তার বিপরীতে তো আমরা কোন কিছু হারাম করতাম না। এমনিই করেছে, যারা তাদের পূর্বে ছিল। সুতরাং স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া ছাড়া রাসূলদের কি কোন কর্তব্য আছে?

১৬:৯৩ :: আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে অবশ্যই তাদেরকে এক উম্মাতে পরিণত করতেন। কিন্তু তিনি যাকে ইচ্ছা করেন পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা করেন সঠিক পথে পরিচালিত করেন। আর তোমরা যা করো সে সম্পর্কে অবশ্যই তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে।

১৭:১৮ :: যে দুনিয়া চায় আমি সেখানে তাকে দ্রুত দিয়ে দেই, যা আমি চাই, যার জন্য চাই। তারপর তার জন্য নির্ধারণ করি জাহান্নাম, সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত, বিতাড়িত অবস্থায়।

১৭:৩০ :: নিশ্চয় তোমার রব যাকে ইচ্ছা তার জন্য রিয্ক প্রশস্ত করে দেন এবং সীমিত করে দেন। তিনি অবশ্যই তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত, পূর্ণ দ্রষ্টা।

১৭:৫৪ :: তোমাদের রব তোমাদের সম্পর্কে অধিক অবগত। তিনি যদি চান তোমাদের প্রতি রহম করবেন অথবা যদি চান তবে তোমাদেরকে শাস্তি দেবেন; আমি তোমাকে তাদের কর্মবিধায়ক করে প্রেরণ করিনি।

১৭:৮৬ :: আর আমি ইচ্ছা করলে তোমার কাছে ওহীর মাধ্যমে যা পাঠিয়েছি তা অবশ্যই নিয়ে নিতে পারতাম; অতঃপর তুমি এ বিষয়ে আমার বিরুদ্ধে তোমার জন্য কোন কর্মবিধায়ক পেতে না।

১৮:২৪ :: আর তাদের উভয়ের জন্য দয়াপরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, ‘হে আমার রব, তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা (মা-বাবা) আমাকে লালন-পালন করেছেন’।

১৮:৩৯ :: ‘তুমি যখন তোমার বাগানে প্রবেশ করলে তখন কেন বললে না, ‘আল্লাহ্ যা চান তা-ই হয়, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো শক্তি নেই? তুমি যদি ধনে ও সন্তানে আমাকে তোমার চেয়ে নিকৃষ্টতর মনে কর।

১৮:৬৯ :: সে বলল, “আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং কোনো বিষয়ে আমি আপনার অবাধ্য হব না।”

২১:৯ :: অতঃপর আমি তাদের প্রতি কৃত ওয়াদা পূর্ণ করলাম। আর আমি তাদেরকে ও যাদেরকে ইচ্ছা করি রক্ষা করলাম এবং সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে ধ্বংস করে দিলাম।

২২:৫ :: হে মানুষ! যদি তোমরা পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দেহে থাক তবে নিশ্চয়ই জেনে রেখো, আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর শুক্র থেকে, তারপর আলাকা থেকে, তারপর পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট অথবা অপূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট গোশ্ত থেকে। তোমাদের নিকট বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করার নিমিত্তে। আর আমি যা ইচ্ছা করি তা একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত মাতৃগর্ভে অবস্থিত রাখি। অতঃপর আমি তোমাদেরকে শিশুরূপে বের করি, পরে যাতে তোমরা যৌবনে উপনীত হও। তোমাদের মধ্যে কারো কারো মৃত্যু দেয়া হয় এ বয়সেই, আবার কাউকে কাউকে ফিরিয়ে নেয়া হয় হীনতম বয়সে, যাতে সে জ্ঞান লাভের পরও কিছু না জানে। তুমি যমীনকে দেখতে পাও শুষ্কাবস্থায়, অতঃপর যখনই আমি তাতে পানি বর্ষণ করি, তখন তা আন্দোলিত ও স্ফীত হয় এবং উদগত করে সকল প্রকার সুদৃশ্য উদ্ভিদ।

২২:১৮ :: তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করে যা কিছু রয়েছে আসমানসমূহে এবং যা কিছু রয়েছে যমীনে, সূর্য, চাঁদ, তারকারাজী, পর্বতমালা, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু ও মানুষের মধ্যে অনেকে। আবার অনেকের উপর শাস্তি অবধারিত হয়ে আছে। আল্লাহ যাকে অপমানিত করেন তার সম্মানদাতা কেউ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন।

২৩:২৪ :: তারপর তার সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয়গণ, যারা কুফরী করেছিল- তারা বলল, ‘এতো তোমাদের মত একজন মানুষ ছাড়া কিছুই না। সে তোমাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে চায়। আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে অবশ্যই ফেরেশতা নাযিল করতেন। এ কথাতো আমরা আমাদের পূর্ববর্তী পিতৃপুরুষদের সময়েও শুনিনি’।

২৪:২১ :: হে মুমিনগণ, তোমরা শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করো না। আর যে শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করবে, নিশ্চয় সে অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেবে। আর যদি তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া না থাকত, তাহলে তোমাদের কেউই কখনো পবিত্র হতে পারত না; কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন, পবিত্র করেন। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী।

২৪:৩৫ :: আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর আলো। তাঁর (ব্যবস্থাকৃত) আলোর দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যেমন একটি খাঁজ, তার মধ্যে আছে একটি প্রদীপ। আর প্রদীপটি আছে একটি স্বচ্ছ চিমনির মধ্যে। আর স্বচ্ছ চিমনিটি এমন যে, যেন তা উজ্জল গ্রহ। (প্রদীপটিকে) প্রজ্জলিত করা হয় বরকতময় যয়তূন/ জলপাই গাছের তেল দিয়ে। (যে গাছ) পূর্বেরও নয়, পশ্চিমেরও নয়। উপক্রম হয় উহার তেল (ঐ গাছের তেল) উজ্জল আলো দিতে, যদিও আগুন উহাকে (তেলকে) স্পর্শ করেনি। আলোর উপর আলো। আল্লাহ হিদায়াত করেন তাঁর আলোর দিকে, যাকে তিনি ইচ্ছা করেন। আর আল্লাহ মানুষের জন্য দৃষ্টান্তসমূহ উপস্থাপন করেন। আর আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞানী।

২৪:৩৮ :: যাতে তাদের কৃত উত্তম আমলের জন্য আল্লাহ তাদেরকে প্রতিদান দেন এবং তিনি স্বীয় অনুগ্রহে তাদেরকে আরো বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন অপরিমিত রিয্ক দান করেন।

২৪:৪৩ :: তুমি কি দেখনি যে, আল্লাহ মেঘমালাকে পরিচালিত করেন, তারপর তিনি সেগুলোকে একত্রে জুড়ে দেন, তারপর সেগুলো স্তুপীকৃত করেন, তারপর তুমি দেখতে পাও তার মধ্য থেকে বৃষ্টির বের হয়। আর তিনি আকাশে স্থিত মেঘমালার পাহাড় থেকে শিলা বর্ষণ করেন। তারপর তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন। আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা তা সরিয়ে দেন। এর বিদ্যুতের ঝলক দৃষ্টিশক্তি প্রায় কেড়ে নেয়।

২৪:৪৫ :: আর আল্লাহ প্রত্যেক জীবকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাদের কোনটি পেটে ভর দিয়ে চলে, কোনটি চলে দু’পায়ের উপর, আবার কোনটি চার পায়ের উপর চলে। আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান।

২৪:৪৬ :: অবশ্যই আমি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ নাযিল করেছি। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল সঠিক পথ দেখান।

২৫:১০ :: তিনি বরকতময়, যিনি ইচ্ছা করলে তোমার জন্য করে দিতে পারেন তার চেয়ে উত্তম বস্তু- অনেক বাগান, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত হয় এবং তিনি তোমাকে প্রাসাদসমূহ দিতে পারেন।

২৫:৪৫ :: তুমি কি তোমার রবকে দেখনি, কীভাবে তিনি ছায়াকে দীর্ঘ করেছেন, আর তিনি যদি চাইতেন, তাহলে তাকে অবশ্যই স্থির করে দিতে পারতেন। অতঃপর আমি সূর্যকে তার উপর নির্দেশক বানিয়ে দিয়েছি।

২৫:৫১ :: আর আমি ইচ্ছা করলে প্রতিটি জনপদে একজন সতর্ককারী পাঠাতাম।

২৬:৪ :: আমি ইচ্ছা করলে আসমান থেকে তাদের উপর এমন নিদর্শন অবতীর্ণ করতাম ফলে তার প্রতি তাদের ঘাড়গুলো নত হয়ে যেত।

২৭:৮৭ :: আর যেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, সেদিন আসমানসমূহ ও যমীনে যারা আছে সবাই ভীত হবে; তবে আল্লাহ যাদেরকে চাইবেন তারা ছাড়া। আর সবাই তাঁর কাছে হীন অবস্থায় উপস্থিত হবে।

২৮:২৭ :: সে বলল, ‘আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি (মূসা) আট বছর আমার মজুরী করবে। আর যদি তুমি দশ বছর পূর্ণ কর, তবে সেটা তোমার পক্ষ থেকে (অতিরিক্ত)। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ চাইলে তুমি আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত পাবে’।

২৮:৫৬ :: নিশ্চয় তুমি যাকে ভালবাস তাকে তুমি হিদায়াত দিতে পারবে না; বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেন। আর হিদায়াতপ্রাপ্তদের ব্যাপারে তিনি ভাল জানেন।

২৮:৬৮ :: আর তোমার রব যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং মনোনীত করেন, এতে তাদের কোনো এখতিয়ার নাই। আল্লাহ পবিত্র মহান এবং তারা যা শরীক করে তিনি তা থেকে ঊর্ধ্বে।

২৮:৮২ :: আর গতকাল যারা তার মত হতে প্রত্যাশা করেছিল তারা বলতে লাগল, ‘আশ্চর্য! দেখলে তো, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যার জন্য ইচ্ছা রিয্ক প্রসারিত অথবা সংকুচিত করেন। যদি আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করতেন তবে আমাদেরকেও তিনি দাবিয়ে দিতেন। দেখলে তো, কাফিররা সফল হয় না’।

২৯:২১ :: তিনি যাকে ইচ্ছা আযাব দেবেন এবং যাকে ইচ্ছা দয়া করবেন, আর তাঁর কাছেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।

২৯:৬২ :: আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা করেন রিয্ক প্রশস্ত করে দেন এবং যার জন্য ইচ্ছা সীমিত করে দেন। নিশ্চয় আল্লাহ সকল বিষয়ে সম্যক অবগত।

৩০:৫ :: আল্লাহর সাহায্যে। তিনি যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন। আর তিনি মহাপরাক্রমশালী, পরম দয়ালু।

৩০:৩৭ :: তারা কি দেখেনি, নিশ্চয় আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা রিয্ক প্রশস্ত করেন এবং সঙ্কুচিত করেন। নিশ্চয় এতে নিদর্শনাবলী রয়েছে সেই কওমের জন্য, যারা ঈমান আনে।

৩০:৪৮ :: আল্লাহ, যিনি বাতাস প্রেরণ করেন ফলে তা মেঘমালাকে ধাওয়া করে; অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেমন ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তাকে খন্ড- বিখন্ড করে দেন, ফলে তুমি দেখতে পাও, তার মধ্য থেকে নির্গত হয় বারিধারা। অতঃপর যখন তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদের উপর ইচ্ছা বারি বর্ষণ করেন, তখন তারা হয় আনন্দিত।

৩০:৫৪ :: আল্লাহ, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন দুর্বল বস্তু থেকে এবং দুর্বলতার পর তিনি শক্তি দান করেন। আর শক্তির পর তিনি আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।

৩২:১৩ :: আর যদি আমি ইচ্ছা করতাম, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার হিদায়াত দান করতাম (প্রত্যেক ব্যক্তিকে হিদায়াতের উপর থাকতে বাধ্য করতাম)। কিন্তু আমার পক্ষ থেকে (শাস্তি সম্পর্কিত) বাণী সত্যে পরিণত হবে যে, ‘নিশ্চয় আমি জিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করবো’।

৩৩:২৪ :: আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিলাম, তারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্রদর্শন করত, যখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখত।

৩৪:৯ :: তারা কি তাদের সামনে ও তাদের পেছনে আসমান ও যমীনে যা আছে তার প্রতি লক্ষ্য করে না? যদি আমি ইচ্ছা করি তাহলে তাদেরকে সহ ভূমি ধসিয়ে দেব অথবা আসমান থেকে এক খন্ড (আযাব) তাদের উপর নিপতিত করব, অবশ্যই তাতে রয়েছে আল্লাহমুখী প্রত্যেক বান্দার জন্য নিদর্শন।

৩৪:৩৬ :: বল, ‘আমার রব যার জন্য ইচ্ছা রিয্ক প্রশস্ত করেন অথবা সঙ্কুচিত করেন। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।’

৩৪:৩৯ :: বল, ‘নিশ্চয় আমার রব তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা রিয্ক প্রশস্ত করেন এবং সঙ্কুচিত করেন। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় কর তিনি তার বিনিময় দেবেন এবং তিনিই উত্তম রিয্কদাতা।’

৩৫:১ :: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা, ফেরেশতাদেরকে বাণীবাহকরূপে নিযুক্তকারী, যারা দুই দুই, তিন তিন ও চার চার পাখাবিশিষ্ট। তিনি সৃষ্টির মধ্যে যা ইচ্ছা বৃদ্ধি করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান।

৩৫:৮ :: কাউকে যদি তার অসৎ কাজ সুশোভিত করে দেখানো হয় অতঃপর সে ওটাকে ভাল মনে করে, (সে কি ঐ ব্যক্তির সমান যে ভালকে ভাল এবং মন্দকে মন্দ দেখে?) কেননা আল্লাহ যাকে ইচ্ছা গোমরাহ করেন আর যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন; অতএব তাদের জন্য আফসোস করে নিজে ধ্বংস হয়ো না। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা জানেন।

৩৫:১৬ :: যদি তিনি চান তোমাদেরকে সরিয়ে দেবেন এবং একটি নতুন সৃষ্টি নিয়ে আসবেন।

৩৫:২২ :: আর জীবিত ও মৃতও সমান নয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন শোনান; যারা ক্ববরে আছে তুমি তাদেরকে শোনাতে পার না।

৩৬:৪৩ :: আর যদি আমি চাই তাদেরকে নিমজ্জিত করে দেই, তখন তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী থাকে না এবং তাদেরকে উদ্ধারও করা হয় না।

৩৬:৪৭ :: আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে যে রিয্ক দিয়েছেন তা থেকে তোমরা ব্যয় কর’, তখন কাফিররা মুমিনদেরকে বলে, ‘আমরা কি তাকে খাদ্য দান করব, আল্লাহ চাইলে যাকে খাদ্য দান করতেন? তোমরা তো স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় রয়েছ’।

৩৬:৬৬ :: আমি ইচ্ছা করলে এদের চোখগুলোকে লোপ করে দিতে পারতাম, তখন এরা পথ চলতে চাইলে কি করে দেখতে পেত?

৩৬:৬৭ :: আর আমি যদি চাইতাম তবে তাদের স্ব স্ব স্থানে তাদেরকে বিকৃত করে দিতাম। ফলে তারা সামনেও এগিয়ে যেতে পারত না এবং পিছনেও ফিরে আসতে পারত না।

৩৭:১০২ :: অতঃপর যখন সে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন সে বলল, ‘হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, অতএব দেখ তোমার কী অভিমত’; সে বলল, ‘হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাই করুন। আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন’।

৩৯:৪ :: আল্লাহ যদি সন্তান গ্রহণ করতে চাইতেন, তাহলে তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তা থেকে যাকে ইচ্ছা বেছে নিতেন; কিন্তু তিনি পবিত্র মহান। তিনিই আল্লাহ, তিনি এক, প্রবল পরাক্রান্ত।

৩৯:২৩ :: আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী, সাদৃশ্যপূর্ণ একটি কিতাব (আল কুরআন), যা বারবার আবৃত্তি করা হয়। যারা তাদের রবকে ভয় করে, তাদের গা এতে শিহরিত হয়, তারপর তাদের দেহ ও মন আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়ে যায়। এটা আল্লাহর হিদায়াত, তিনি যাকে চান তাকে এর দ্বারা হিদায়াত করেন। আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার জন্য কোন হিদায়াতকারী নেই।

৩৯:৫২ :: তারা কি জানে না, আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন রিয্ক প্রশস্ত করে দেন আর সঙ্কুচিত করে দেন? নিশ্চয় এতে মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।

৩৯:৬৮ :: আর শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। ফলে আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা করেন তারা ছাড়া আসমানসমূহে যারা আছে এবং পৃথিবীতে যারা আছে সকলেই মূর্ছা যাবে। তারপর আবার শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, তখন তারা দাঁড়িয়ে তাকাতে থাকবে।

৪০:১৫ :: তিনি সুউচ্চমর্যাদার অধিকারী, 'আরশের অধিপতি, তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছে স্বীয় আদেশ হতে ওহী প্রেরণ করেন, যাতে তিনি সতর্ক করেন সম্মেলন দিবস, সম্পর্কে।

৪১:১৪ :: যখন তাদের অগ্র ও পশ্চাৎ থেকে রাসূলগণ তাদের কাছে এসে বলেছিল যে, ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করো না’। তারা বলেছিল, ‘যদি আমাদের রব ইচ্ছা করতেন তাহলে অবশ্যই ফেরেশতা নাযিল করতেন। অতএব, তোমাদেরকে যা দিয়ে পাঠানো হয়েছে নিশ্চয় আমরা তা প্রত্যাখ্যান করলাম।

৪২:৮ :: আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে এক জাতিভুক্ত করতে পারতেন; কিন্তু তিনি যাকে চান তাঁর রহমতে প্রবেশ করান আর যালিমদের জন্য কোন অভিভাবক নেই, সাহায্যকারীও নেই।

৪২:১২ :: আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর চাবি তাঁরই আয়ত্তে রয়েছে। তিনি যাকে ইচ্ছা করেন জীবিকা প্রশস্ত করে দেন এবং (যাকে ইচ্ছা করেন জীবিকা) নির্ধারিত পরিমাণমতো দেন। নিশ্চয় তিনি সব বিষয়ে জ্ঞানী।

৪২:১৩ :: তিনি তোমাদের জন্য দীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি তোমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তোমরা দীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না। তুমি মুশরিকদেরকে যেদিকে আহবান করছ তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়; আল্লাহ যাকে চান তাঁর পথে বেছে নেন। আর যে তাঁর অভিমুখী হয় তাকে তিনি হিদায়াত দান করেন।

৪২:১৯ :: আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অতি দয়ালু। তিনি যাকে ইচ্ছা রিয্ক দান করেন। আর তিনি মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী।

৪২:২৪ :: তারা কি একথা বলে যে, সে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে? অথচ যদি আল্লাহ চাইতেন তোমার হৃদয়ে মোহর মেরে দিতেন। আর আল্লাহ মিথ্যাকে মুছে দেন এবং নিজ বাণী দ্বারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। নিশ্চয় তিনি অন্তরসমূহে যা আছে, সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।

৪২:২৭ :: আর আল্লাহ যদি তার বান্দাদের জন্য রিয্ক প্রশস্ত করে দিতেন, তাহলে তারা যমীনে অবশ্যই বিদ্রোহ করত। কিন্তু তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণে যা ইচ্ছা নাযিল করেন। নিশ্চয় তিনি তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে পূর্ণ অবগত, সম্যক দ্রষ্টা।

৪২:২৯ :: আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি এবং এতদোভয়ের মধ্যে তিনি যে সব জীব-জন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন সেগুলো। তিনি যখন ইচ্ছা তখনই এগুলোকে একত্র করতে সক্ষম।

৪২:৩৩ :: তিনি যদি চান বাতাসকে থামিয়ে দিতে পারেন। ফলে জাহাজগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠে গতিহীন হয়ে পড়বে। নিশ্চয় এতে পরম ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে।

৪২:৪৯ :: আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা করেন তা-ই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা করেন কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা করেন পুত্র সন্তান দান করেন।

৪২:৫০ :: অথবা তাদেরকে পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা করেন বন্ধ্যা করেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।

৪২:৫১ :: কোন মানুষের এ মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন, ওহীর মাধ্যম, পর্দার আড়াল অথবা কোন দূত পাঠানো ছাড়া। তারপর আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে তিনি যা চান তাই ওহী প্রেরণ করেন। তিনি তো মহীয়ান, প্রজ্ঞাময়।

৪২:৫২ :: অনুরূপভাবে আমি তোমার কাছে আমার নির্দেশ থেকে ‘রূহ’কে ওহী যোগে প্রেরণ করেছি। তুমি জানতে না কিতাব কী এবং ঈমান কী? কিন্তু আমি একে আলো বানিয়েছি, যার মাধ্যমে আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করি। আর নিশ্চয় তুমি সরল পথের দিক নির্দেশনা দাও।

৪৩:২০ :: তারা আর বলে, ‘পরম করুণাময় আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমরা এদের ইবাদাত করতাম না’, এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই। তারা শুধু মনগড়া কথা বলছে।

৪৩:৬০ :: আর যদি আমি চাইতাম, তবে আমি তোমাদের পরিবর্তে ফেরেশতা সৃষ্টি করে পাঠাতাম যারা যমীনে তোমাদের উত্তরাধিকার হত।

৪৭:৪ :: অতএব তোমরা যখন কাফিরদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের ঘাড়ে আঘাত কর। পরিশেষে তোমরা যখন তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করবে তখন তাদেরকে শক্তভাবে বেঁধে নাও। তারপর হয় অনুগ্রহ না হয় মুক্তিপণ আদায়, যতক্ষণ না যুদ্ধ তার অস্ত্র নামিয়ে নেয়। এটাই বিধান। আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তোমাদের একজনকে অন্যের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তিনি কখনো তাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করবেন না।

৪৭:৩০ :: আর যদি আমি চাইতাম তবে আমি তোমাকে এদের দেখিয়ে দিতে পারতাম। ফলে লক্ষণ দেখেই তুমি তাদের চিনতে পারতে। তবে তুমি অবশ্যই কথার ভঙ্গিতে তাদের চিনতে পারবে। আল্লাহ তোমাদের আমলসমূহ জানেন।

৪৮:১৪ :: আসমানসমূহ ও যমীনের সার্বভৌমত্ব আল্লাহর; তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন, আর যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন। আর আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

৪৮:২৫ :: তারাইতো কুফরী করেছিল এবং তোমাদেরকে আল-মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দিয়েছিল আর কুরবানীর পশুগুলোকে কুরবানীর স্থানে পৌঁছতে বাধা দিয়েছিল। যদি মুমিন পুরুষরা ও মুমিন নারীরা না থাকত, যাদের সম্পর্কে তোমরা জান না যে, তোমরা অজ্ঞাতসারে তাদেরকে পদদলিত করবে, ফলে তাদের কারণে তোমরা দোষী হতে কিন্তু আমি তাদের উপর কর্তৃত্ব দিয়েছি যাতে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা স্বীয় রহমতে প্রবেশ করাবেন। যদি তারা পৃথক থাকত, তাহলে তাদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তাদেরকে আমি অবশ্যই যন্ত্রণাদায়ক আযাব দিতাম।

৪৮:২৭ :: অবশ্যই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে স্বপ্নটি যথাযথভাবে সত্যে পরিণত করে দিয়েছেন। আল্লাহ চাইলে তোমরা নিরাপদে তোমাদের মাথা মুন্ডন করে এবং চুল ছেঁটে নির্ভয়ে আল-মাসজিদুল হারামে অবশ্যই প্রবেশ করবে। অতঃপর আল্লাহ জেনেছেন যা তোমরা জানতে না। সুতরাং এ ছাড়াও তিনি দিলেন এক নিকটবর্তী বিজয়।

৫৩:২৬ :: আর আসমানসমূহে অনেক ফেরেশতা রয়েছে, তাদের সুপারিশ কোনই কাজে আসবে না। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন এবং যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট, তার ব্যাপারে অনুমতি দেয়ার পর।

৫৬:৬৫ :: আমি চাইলে তা খড়-কুটায় পরিণত করতাম, তখন তোমরা হতবুদ্ধি হয়ে যাবে।

৫৬:৭০ :: আমি চাইলে তা লবণাক্ত করে দিতাম: তবুও কেন তোমরা কৃতজ্ঞ হও না?

৫৭:২১ :: তোমরা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হও, যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীনের প্রশস্ততার মত। তা প্রস্তত করা হয়েছে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের প্রতি ঈমান আনে তাদের জন্য। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।

৫৭:২৯ :: (তা এজন্য যে,) আহলে কিতাবগণ যেন জেনে নিতে পারে, আল্লাহর অনুগ্রহের কোন বস্তুতেই তারা ক্ষমতা রাখে না। আর নিশ্চয় অনুগ্রহ আল্লাহর হাতেই, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দেন। আর আল্লাহ মহাঅনুগ্রহের অধিকারী।

৫৯:৬ :: আল্লাহ ইয়াহুদীদের নিকট থেকে তাঁর রাসূলকে ফায় হিসেবে যা দিয়েছেন তোমরা তার জন্য কোন ঘোড়া বা উটে আরোহণ করে অভিযান পরিচালনা করনি। বরং আল্লাহ তাঁর রাসূলগণকে যাদের ওপর ইচ্ছা কতৃত্ব প্রদান করেন। আল্লাহ সকল কিছুর ওপর সর্বশক্তিমান।

৬২:৪ :: এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহের অধিকারী।

৭৪:৩১ :: আর আমি ফেরেশতাদেরকেই জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক বানিয়েছি। আর কাফিরদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ আমি তাদের সংখ্যা নির্ধারণ করেছি। যাতে কিতাবপ্রাপ্তরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে; আর মুমিনদের ঈমান বেড়ে যায় এবং কিতাবপ্রাপ্তরা ও মুমিনরা সন্দেহ পোষণ না করে। আর যেন যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা এবং অবশিষ্টরা বলে, এরূপ উপমা দ্বারা আল্লাহ কী ইচ্ছা করেছেন? এভাবেই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন আর যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে পরিচালিত করেন। আর তোমার রবের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানেন না। আর এ হচ্ছে মানুষের জন্য উপদেশমাত্র।

৭৪:৫৬ :: আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না। তিনিই ভয়ের যোগ্য এবং ক্ষমা করার অধিকারী।

৭৬:২৮ :: আমরা তাদেরকে সৃষ্টি করেছি এবং তাদের গঠন সুদৃঢ় করেছি। আর আমরা যখন ইচ্ছে করব তাদের স্থানে তাদের মত (কাউকে) দিয়ে পরিবর্তন করে দেব।

৭৬:৩০ :: তোমরা ইচ্ছা করবেনা যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

৭৬:৩১ :: তিনি যাকে ইচ্ছা তাঁর রহমতে প্রবেশ করান এবং যালিমদের জন্য তিনি প্রস্তুত রেখেছেন যন্ত্রণাদায়ক আযাব।

৮০:২২ :: তারপর যখন তিনি ইচ্ছা করবেন, তাকে পুনর্জীবিত করবেন।

৮১:২৯ :: তোমরা ইচ্ছা কর না যদি না বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ ইচ্ছা করেন।

৮২:৮ :: যে আকৃতিতে চেয়েছেন, তিনি তোমাকে গঠন করেছেন।

৮৭:৬-৭ :: আমি তোমাকে পড়িয়ে দেব, যার ফলে তুমি ভুলে যাবে না। আল্লাহ যা (যেরূপ) ইচ্ছা করেন/করবেন তা (সেরূপ) ছাড়া। নিশ্চয় তিনি জানেন যা প্ৰকাশ্য ও যা গোপনীয়।

*********************

সামগ্রিক আলোচনা :

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের কী ওয়ার্ড হচ্ছে ‘শাআ’ (ইচ্ছা করা)। আয়াতগুলোর বক্তব্য অনুধাবনের জন্য প্রথমে এই শব্দের সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি বাক্যাংশের অর্থ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।

মান শাআ = (১) যে ইচ্ছা করে। (২) যাকে ইচ্ছা। যখন ‘মান শাআ’ কর্তৃবাচক তখন এর অর্থ হয় ‘যে ইচ্ছা করে’। আর যখন ‘মান শাআ’ কর্মবাচক তখন এর অর্থ হয় ‘যাকে ইচ্ছা’।

মা শা আল্লাহ = যা আল্লাহ চেয়েছেন

মা ইয়াশা আল্লাহ = যা আল্লাহ চান

ইল্লা মা শা আল্লাহ = আল্লাহ যা (যেরূপ) ইচ্ছা করেন/করবেন তা (সেরূপ) ছাড়া। (২:২৫৫, ৬:১২৮, ৭:১৮৮, ১০:৪৯, ১১:১০৭, ১১:১০৮, ৮৭:৬)।

লাও শা আল্লাহ = যদি আল্লাহ চাইতেন। (অর্থাৎ যদি আল্লাহ চাইতেন তবে বিপরীতটি করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা চান নি, বরং স্বেচ্ছায় তিনি তার চেয়ে অন্যরূপ চেয়েছেন।)

ইন শা আল্লাহ = যদি আল্লাহ চান। (অর্থাৱ যদি আল্লাহ চান, তবে এমনটি হবেই)।

‘ইইঁ ইয়াশাআল্লাহ’ = যদি আল্লাহ (বর্তমান বা ভবিষ্যতে) চেয়েই থাকেন। (অর্থাৎ যদি আল্লাহ চেয়েই থাকেন, তবে এমনটি হবে। এর মাধ্যমে আল্লাহর সাধারণ ইচ্ছার চেয়ে বিশেষ/তাৎক্ষণিক ইচ্ছার উপর জোর দেয়া হয়।)

ইল্লা আইঁ ইয়াশাআল্লাহ = এছাড়া যে, আল্লাহ তা (সেরূপ) চাইবেন। {অর্থাৎ আল্লাহর তৈরিকৃত নীতিমালা অনুযায়ী সবকিছু সম্পন্ন হওয়া ছাড়া}

এ পর্যায়ে আমরা ‘আল্লাহর ইচ্ছা’ সম্পর্কিত কয়েকটি বিশেষ বাক্যাংশের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে ‘আল্লাহর ইচ্ছা’ বলতে কী বুঝায় তা নিবিড়ভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করবো।

১। ‘লাও শাআল্লাহ’ (যদি আল্লাহ চাইতেন)

‘লাও শাআল্লাহ’ (যদি আল্লাহ চাইতেন) বাক্যের মাধ্যমে মূলত বর্তমানে যে অবস্থা আছে তা যে আল্লাহরই তৈরিকৃত প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী আছে এবং যদি তিনি চাইতেন তাহলে যে অন্যরূপ হতো সেই বিষয়টি তুলে ধরা হয়। আল্লাহ চাইলে, তিনি এর প্রাণঘাতী দিক ছাড়াই বিষ তৈরি করতেন, কিন্তু তিনি তা চাননি। তাই তিনি প্রাণঘাতী বৈশিষ্ট্যসহ বিষ তৈরি করেছেন। আমরা আরো বলতে পারি, যদি আল্লাহ চাইতেন তাহলে লবণ মিষ্টি হতো। কিন্তু বর্তমানে লবণের নোনতা স্বাদ রয়েছে। কেন? কারণ আল্লাহ তা চেয়েছেন। আল্লাহ কি লবণের স্বাদকে মিষ্টি করতে পারতেন বা পারেন? হ্যাঁ, তিনি তা পারতেন এবং পারেন। কিন্তু তিনি সাধারণত তা করবেন না। কারণ লবণকে যে নোনতা স্বাদ দেয়া হয়েছে তা তাঁর ইচ্ছাতেই হয়েছে। আর তিনি তাঁর সাধারণত তাঁর সাধারণ ইচ্ছাকে পরিবর্তন করেন না। তাঁর ইচ্ছা তাঁর তৈরি প্রাকৃতিক আইন হিসেবে কাজ করে।

ধর্মীয়, নৈতিক বা সামাজিক আইনের ক্ষেত্রে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা

যদি আল্লাহ চাইতেন তাহলে ধর্মীয়, নৈতিক বা সামাজিক আইনের ক্ষেত্রে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার পরিবর্তে তাদেরকে কোনো একভাবে আচরণ করতে এবং তার সাধারণ ফল ভোগে বাধ্য করতে পারতেন। কিন্তু তিনি মানুষকে সে কীভাবে আচরণ করবে সেক্ষেত্রে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন। অবশ্য সে স্বেচ্ছায় যেরূপ আচরণ করবে তাকে সেই আচরণের অনিবার্য ফলাফল ভোগ করতে হবে।

যেহেতু ধর্মীয়, নৈতিক বা সামাজিক আইনে মানুষকে পছন্দের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, তাই মানবজাতি স্বাভাবিকভাবেই ‘এক জাতি’তে আবদ্ধ হয় না। অন্য কথায়, বিভিন্ন মানুষ একই পরিস্থিতিতে বিভিন্নভাবে আচরণ করে।

মানব জাতির এই আচরণগত বিভিন্নতার ফলে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সেজন্য অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে যে, ‘আল্লাহ কেন সকল মানুষকে ভালো ও শান্তিপ্রিয় সৃষ্টি করেননি?

এ প্রশ্নের উত্তরে কুরআন থেকে আমরা জানতে-বুঝতে পারি যে, অবশ্যই মানুষকে ভালো ও শান্তিপ্রিয় হতে বাধ্য করার ক্ষমতা আল্লাহর রয়েছে। কিন্তু তিনি মানুষকে বাধ্য করতে চাননি, বরং তিনি ইচ্ছা করেই মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাই ধর্ম গ্রহণে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা কুরআনবিরোধী হিসেবে সাব্যস্ত।

ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকায় অনেকেই ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানায়, অথচ ঈমান আনাই তাদের জন্য কল্যাণকর হতো। এ বিষয়টি রসূলকে পেরেশান করে তোলে। কিন্তু আল্লাহ তাঁর রসূলকে এ বিষয়ে স্বাভাবিক পন্থায় নিজের অবস্থান বজায় রাখতে প্রশ্নের মাধ্যমে সচেতন করে তোলেন যে-

২৬:৩ :: তারা মু’মিন হচ্ছে না বিধায় তুমি কি (পেরেশানিতে) আত্মবিনাশী হবে?

মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দেয়ার মানে এ নয় যে, সে যা-ই পছন্দ করে তা-ই গ্রহণযোগ্য হবে বা দুটি পছন্দ একটি অন্যটির বিকল্প হবে বা একটির তুলনায় অন্যটি উত্তম হলেও উভয়টি গ্রহণযোগ্য হবে। বরং ইচ্ছার স্বাধীনতার মানে হলো, সে ভালো বা মন্দ যে কোনো কাজ পছন্দ করতে পারে এবং যদি সে ভালো কাজ পছন্দ করে তাহলে সে ভালো ফলাফল ও পুরস্কার লাভ করবে এবং যদি সে মন্দ কাজ পছন্দ করে তাহলে সে মন্দ ফলাফল ও শাস্তি লাভ করবে। তবে ইচ্ছার স্বাধীনতা বিদ্যমান থাকায় অনেক সময় সমাজে শান্তির পরিবর্তে যুদ্ধ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে এবং মানুষের প্রাণহানি ঘটে। নিম্নের আয়াতটিতে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে-

২:২৫৩ :: ঐ রাসূলগণ, আমি তাদের কাউকে কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, তাদের মধ্যে কারো সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং কারো কারো মর্যাদা উঁচু করেছেন। আর আমি ঈসা ইবনে মারিয়ামকে দিয়েছি সুস্পষ্ট প্রমাণাদি এবং আমি তাকে শক্তিশালী করেছি রূহুল কুদুস এর মাধ্যমে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তাদের পরবর্তীরা লড়াই করতো না, তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণসমূহ আসার পর। কিন্তু তারা মতবিরোধ করেছে। ফলে তাদের মধ্যে কেউ ঈমান এনেছে, আর তাদের কেউ কুফরী করেছে। আর আল্লাহ যদি চাইতেন, তাহলে তারা লড়াই করতো না। কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা করেন।

উপরের আয়াতটিতে বিশ্বব্যাপী যে সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড তা দেখে যে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে মনে আসে যে, আল্লাহ কেন তাঁর অলৌকিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই রক্তপাত বন্ধ করেন না, তার জবাব নিহিত রয়েছে। যদি আল্লাহ চাইতেন তাহলে তিনি তা অলৌকিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তা বন্ধ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি যা ইচ্ছা করেন তা-ই করেন। আর এক্ষেত্রে তাঁর ইচ্ছা এভাবে প্রকাশ পায় যে, তিনি সাধারণত অলৌকিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তা বন্ধ করেন না। এ থেকে একটি ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে যে, তাহলে কি যা যেভাবে আছে সেভাবে থাকাই আল্লাহর ইচ্ছা। বিষয়টি মোটেই তা নয়। বরং তিনিও চান মানুষ যেন এরূপ অন্যায় যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে। সেজন্য তিনি নবী-রসূলদের মাধ্যমে স্পষ্ট বিধান নাযিল করেছেন। কিন্তু মানুষকে ঐ বিধান গ্রহণ করা না করার বিষয়ে স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়ার কারণে কেউ ঈমান আনে এবং কেউ কুফর করে। সুতরাং মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সেজন্য আল্লাহ মানুষকে রক্তপাত থেকে অলৌকিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিরত রাখেন না।

অবশ্য এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, ইচ্ছার স্বাধীনতা মানে এ নয় যে, লোকে অনৈতিক কাজ করবে এবং সেজন্য কেউ তাকে শাস্তি দিতে পারবে না। বরং যারা আল্লাহর বিধানকে মেনে নেবে তাদেরকে বিধান দেয়া হয়েছে যে, যারা পৃথিবীতে বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ করবে যার দ্বারা অন্য ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদেরকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। যেমন, যারা ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করবে, জিনা-ব্যভিচার করবে, চুরি-ডাকাতি করবে ইত্যাদি। আর মু’মিনদেরকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

কিন্তু পরিস্থিতি যেমন আছে সেটাই আল্লাহর ইচ্ছা এবং আল্লাহ ইচ্ছা করেই এ পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছেন বা আল্লাহই মানুষকে এরূপ পরিস্থিতির জন্য বাধ্য করেছেন বলে ধারণা করলে তা হবে প্রকৃত জ্ঞানহীন জল্পনা-কল্পনা মাত্র। এরূপ ধারণাকেই ৬:১৪৮, ১৬:৩৫, ৪৩:২০ ও ৩৬:৪৭ আয়াতের মাধ্যমে খন্ডন করা হয়েছে।

২। ‘মা শাআল্লাহ’ (আল্লাহ যা চান)

 ‘মা শাআল্লাহ’ শব্দটির অর্থ হলো, ‘আল্লাহ যা চেয়েছেন (তা-ই হয়েছে)’। এর মাধ্যমে মূলত আল্লাহর তৈরিকৃত প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী সবকিছু হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। ভৌতজগতের সবকিছু যেমন আল্লাহর আইন অনুযায়ী হয়, উর্বরতা ও অনুর্বরতা, উন্নতি ও অবনতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে আল্লাহর তৈরি ‘কারণ ও ফলাফল বিধি’ অনুসারে হয়। তেমনি সামাজিক জীবনে একমাত্র আল্লাহর আইনই মানুষের প্রকৃত কল্যাণ-অকল্যাণের নির্ধারক। তাই মানুষকে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে হবে এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে তাঁর নিয়ামতের বণ্টন করতে হবে। যারা এ বিষয়টি মেনে নেয় না তারা নিজেরাই নিজেদের উপর অত্যাচার করে এবং কুফর ও শিরকে নিপতিত হয়। এটি নিম্নের আয়াতগুলোতে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে।

১৮:৩২-৪৪ :: আর পেশ করো তাদের কাছে দুই ব্যক্তির দৃষ্টান্ত। আমরা দিয়েছি তাদের দুজনের একজনকে আঙ্গুরের দুটি বাগান আর আমরা দুটিকেই পরিবেষ্টিত করেছিলাম খেজুর গাছ দিয়ে। আর আমরা স্থাপন করেছি উভয়ের মধ্যে শস্যক্ষেত্র। উভয় বাগান দিতো তার খাদ্য/ ফলফলাদি আর উহাতে কোন ত্রুটি করতো না। আর আমরা উৎসারিত/ প্রবাহিত করেছি উভয়ের ভিতর দিয়ে একটি নদী। আর তার ছিলো প্রচুর ফল-ফলাদি। তখন সে বলেছে তার সঙ্গীকে এ অবস্থায় যে, সে তার সাথে আলোচনা করছিলো, ‘আমি অধিক সমৃদ্ধ তোমার চেয়ে মাল-সম্পদে আর অধিক শক্তিশালী জনশক্তিতে’। আর সে দাখিল হয়েছে তার বাগানে আর সে ছিলো তার নফসের প্রতি অত্যাচারী। সে বলেছে, ‘আমি ধারণা করি না যে, ধ্বংস হবে ইহা কখনোই’। আর আমি ধারণা করি না যে, প্রলয় মুহুর্ত প্রতিষ্ঠিত হবে। আর অবশ্য যদি আমি ফিরে যাই আমার রবের কাছে, তাহলে আমিই পাবো উত্তম জিনিস, (যা বর্তমানে আছে) উহার চেয়েও পরিবর্তিত (উন্নত) স্থান’। তখন বলেছে তাকে তার সঙ্গী এ অবস্থায় যে, সে তার সাথে আলোচনা করছিলো, ‘তুমি কি কুফর/ অস্বীকার করছো ঐ সত্তাকে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, তারপর শুক্র থেকে, তারপর তোমাকে সুবিন্যস্ত করেছেন মানুষরূপে? কিন্তু তিনিই আল্লাহ, আমার রব। আর আমি শিরক করি না আমার রবের সাথে কাউকেই। আর কেন, যখন তুমি দাখিল হয়েছো তোমার বাগানে, তখন তুমি বললে না, ‘আল্লাহ যা চান তা-ই হয়, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কারো কোন শক্তি নেই’। যদি তুমি আমাকে দেখে থাকো যে, আমি স্বল্পতর তোমার চেয়েও সম্পদে ও সন্তানে। তবে আশা করা যায় আমার রব আমাকে দান করবেন তোমার বাগানের চেয়েও উত্তম (বাগান), আর তিনি প্রেরণ করবেন উহার উপর (তোমার বাগানের উপর) বিপর্যয়, আকাশ থেকে; তখন তা হয়ে যাবে উদ্ভিদশূন্য প্রান্তর। অথবা হয়ে যাবে উহার পানি ভূগর্ভে অন্তর্হিত। তখন কখনো তুমি সক্ষম হবে না উহার সন্ধান লাভ করতে। আর (শেষ পর্যন্ত বিপর্যয়ে) পরিবেষ্টিত হয়েছে তার ফলফলাদি। তারপর সে (আক্ষেপবশত:) কচলাতে লাগলো তার দুহাত, উহার দরুন যা সে ব্যয় করেছে উহার ক্ষেত্রে। আর উহা ভুমিসাৎ হয়েছিলো উহার মাচানগুলোসহ। আর সে বলেছে, ‘হায়! যদি আমি শিরক না করতাম আমার রবের সাথে কাউকেই!’ আর তার জন্য হলো না কোন বাহিনী যারা তাকে সাহায্য করবে, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া; আর সে নিজেও হতে পারেনি উহার প্রতিকারকারী। এরূপ পরিস্থিতিতে (প্রতিপন্ন হয় যে), ক্ষমতা ও অভিভাবকত্ব আল্লাহরই অধিকারভুক্ত, ইহাই পরম সত্য। তিনিই উত্তম প্রতিফল দানে আর (তিনিই) উত্তম পরিণতি নির্ধারণে।

 ৩। ‘ইল্লা মা শাআল্লাহ’ (তবে আল্লাহ যা চান/ আল্লাহ যা চান তা ছাড়া)

‘ইল্লা মা শাআল্লাহ’ (তবে আল্লাহ যা চান/ আল্লাহ যা চান তা ছাড়া) বলতে বুঝায় আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী যা সম্পন্ন হয় তা ছাড়া। যেমন : নিম্নের আয়াতটির মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোনো ব্যক্তি কোনো জ্ঞান অর্জন করতে পারে না। যার অর্থ হলো, ‘মানুষ আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী জ্ঞান অর্জন করা ছাড়া কোনো বিষয়ে জ্ঞানপ্রাপ্ত হয় না।

২:২৫৫ :: আল্লাহ! তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি চিরজীবন্ত, চিরপ্রতিষ্ঠিত। তন্দ্রা ও নিদ্রা তাঁকে স্পর্শ করেনা। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু রয়েছে সবই তাঁর। কে আছে এমন, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে? সম্মুখের অথবা পশ্চাতের সবই তিনি অবগত আছেন। তিনি যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ত করতে পারেনা। তাঁর আসন আসমান ও যমীন ব্যাপী হয়ে আছে এবং এতদুভয়ের সংরক্ষণে তাঁকে বিব্রত হতে হয়না। তিনিই সর্বোচ্চ, মহীয়ান।

অনুরূপভাবে নিম্নের আয়াত দুটিতে বলা হয়েছে যে, ‘আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ নিজেরও কোনো উপকার বা অপকার করতে পারে না’।

৭:১৮৮ :: বল, ‘আমি আমার নিজের কোন উপকার ও ক্ষতির ক্ষমতা রাখি না, তবে আল্লাহ যা চান। আর আমি যদি গায়েব জানতাম তাহলে অধিক কল্যাণ লাভ করতাম এবং আমাকে কোন ক্ষতি স্পর্শ করত না। আমিতো একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা এমন কওমের জন্য, যারা বিশ্বাস করে’।

১০:৪৯ :: বল, ‘আমি নিজের ক্ষতি বা উপকারের অধিকার রাখি না, তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন’। প্রত্যেক উম্মতের রয়েছে নির্দিষ্ট একটি সময়। যখন এসে যায় তাদের সময়, তখন এক মুহূর্ত পিছাতে পারে না এবং এগোতেও পারে না।

৪। ‘ইন শাআল্লাহ’ (যদি আল্লাহ চান)

কোনো বিষয়ে সংকল্প, প্রতিশ্রুতি ও আশাবাদের পরে ‘ইনশাআল্লাহ’ বলা হয়। শব্দটির শাব্দিক অর্থ ‘যদি আল্লাহ চান’। বাহ্যত মনে হয় ‘ইনশাআল্লাহ’ বলার মাধ্যমে অনিশ্চয়তা প্রকাশ পায় এবং কাজের বিষয়ে নিজেকে দায়বদ্ধতাকে হালকা করা হয়। এছাড়া এর মাধ্যমে কাজের ফলাফলকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়া হয় যে, ভাগ্যে থাকলে কাজটি হবে, অন্যথায় হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ‘ইনশাআল্লাহ’ বিষয়ে কুরআনের বক্তব্য কী এবং কুরআনে শব্দটি কী বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে?

প্রাকৃতিক নিয়মের কার্যকারিতা : সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ বনাম বহুবিধ সম্ভাবনা

বলা হয়েছে, আমি আগামীকাল এটা করবো, এ কথা নিশ্চিতভাবে না বলতে বা ‘ইনশাআল্লাহ’ বলা ছাড়া না বলতে। আরো বলা হয়েছে, কেউ জানে না আগামীকাল কী উপার্জন করবে। কিন্তু এরূপ নির্দেশনার কারণ কী?

ভাগ্যবাদী ধারণায় এরূপ নির্দেশনার কারণ হলো সবকিছু ভাগ্য দ্বারা নির্ধারিত হয়, তাতে মানুষের কিছুই করার নেই। যেহেতু কুরআন মানুষকে তার কাজের জন্য দায়ী করে এবং উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যথানিয়মে কর্মসম্পাদনের নির্দেশনা দেয়, তাই ভাগ্যবাদী ধারণা কুরআনসম্মত নয়। অবশ্যই এরূপ নির্দেশনার উদ্দেশ্য মানুষকে অনিশ্চয়তায় দোদুল্যমান রাখার জন্য নয়।

বরং এরূপ নির্দেশনার উদ্দেশ্য হলো, মানুষ যেন কোনো কাজে সফল হওয়ার জন্য তার সাধ্যমতো সকল শর্ত পূরণ করে এবং তার জানা-অজানা কোনো শর্ত পূরণে ত্রুটি থাকলে এবং অন্যদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মিথস্ক্রিয়ার ফলে কাজের ফলাফল প্রত্যাশার বিপরীত হওয়ার মতো কোনো অনুঘটক থাকলে সে বিষয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করার জন্য বা আশাবাদী হওয়ার জন্য।

আমরা শত বছর পরের সূর্যগ্রহণের মুহুর্ত বলতে পারলেও একটি মাছির পরবর্তী অবতরণ স্থল বলতে পারি না। কারণ তা বহুবিধ সম্ভাবনাবিশিষ্ট বিষয়। অনুরূপভাবে আমাদের কাজ ও তার ফলাফলের ক্ষেত্রে নানাবিধ অনুঘটক জড়িত রয়েছে। তাই আমাদেরকে যা করতে হবে তা হলো কোনো কাজে সফল হওয়ার জন্য আল্লাহর ইচ্ছার অনুসরণ বা করণীয়সমূহ সম্পাদন। তারপর যদি আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে হতাশ না হয়ে আমাদেরকে স্মরণ করতে হবে যে, আমরা কোথায় কোনো ত্রুটি করেছি এবং পরবর্তীতে সেই ত্রুটি থেকে সচেতন থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, তাহলে আশা করা যায় আরো নিশ্চিত হওয়া যাবে এবং সাফল্যের কাছাকাছি থাকা যাবে। আমাদের জানা-অজানা বিভিন্ন কারণের সম্মুখীন হয়ে আমরা কোনো কাজে ব্যর্থ হতে পারি। তাই অবশ্যই আমাদের আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে। আর আল্লাহর উপর ভরসার দুটি দিক রয়েছে- (১) আল্লাহর তৈরি নিয়ম অনুসরণে প্রত্যয়ী হওয়া এবং (২) অজ্ঞাত ত্রুটি ও অপ্রত্যাশিত প্রভাবক থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাওয়া।

প্রকৃতপক্ষে ‘ইনশাআল্লাহ’ (যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন)-এর তাৎপর্য হলো, ‘যদি আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়ম-নীতির শর্তাবলী পূর্ণ হয়’।

যেমন : ১১:৩৩ আয়াতে বলা হয়েছে, সে (নূহ) বলল, ‘‘আল্লাহই তা তোমাদের কাছে নিয়ে আসবেন যদি তিনি ইচ্ছা করেন, এবং তোমরা তা ব্যর্থ করতে পারবে না।

৫। মাইঁ ইয়াশা (যে ইচ্ছা করে বা যাকে ইচ্ছা করেন)

‘মাইঁ ইয়াশা’ শব্দটির দুটি অর্থ রয়েছে। (১) যে ইচ্ছা করে, (২) যাকে ইচ্ছা করেন। যখন ‘মান’ শব্দটি কর্তা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন এর অর্থ হয় ‘যে ইচ্ছা করে’। আর যখন ‘মান’ শব্দটি কর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন এর অর্থ হয় ‘যাকে ইচ্ছা করেন’।

কর্তৃবাচকে ‘মান শাআ’ (যে ইচ্ছা করে) শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে এমন কয়েকটি আয়াত হলো- ১৮:২৯, ২৫:৫৭, ৭৩:১৯, ৭৪:৩৭, ৭৪:৫৫, ৭৬:২৯, ৭৮:৩৯, ৮০:১২, ৮১:২৮।

সাধারণত ‘মাইঁ ইয়াশা’ (যাকে ইচ্ছা করেন) শব্দগুচ্ছ কর্মবাচকে ব্যবহৃত হয়েছে এবং তন্মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘ইচ্ছা’ ক্রিয়ার কর্তা হিসেবে আল্লাহকে বুঝানো হয়েছে।

‘যাকে ইচ্ছা’ শব্দ ধারণকারী আয়াতসমূহে যে ধরনের বক্তব্য রয়েছে তার মধ্যে কয়েকটি হলো- আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথনির্দেশ করেন এবং যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন, যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন, যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় উন্নীত করেন। এসব বক্তব্যকে প্রচলিত ধারণায় ভাগ্যবাদের সমার্থক হিসেবে দেখানো হয়, যেখানে কে হিদায়াত পাবে বা পাবে না, কে ক্ষমা পাবে বা পাবে না এবং কার পদমর্যাদা কিরূপ হবে, সেক্ষেত্রে মানুষের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার কোনো মূল্য নেই, বরং তা একান্তই আল্লাহর ইচ্ছা দ্বারা নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ বুঝানো হয় যে, একই ধরনের অপরাধ করা দুজন ব্যক্তির মধ্যে একজন ক্ষমা পেতে পারে এবং অন্যজন শাস্তি পেতে পারে এবং এই ক্ষমাপ্রাপ্তি বা শাস্তি পাওয়ার বিষয়টি নিতান্তই আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, এক্ষেত্রে ব্যক্তির কিছুই করার নেই। কিন্তু এ ধারণা যে সঠিক নয় তা যেমন সাধারণ জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি অনুসারে বুঝা যায়, তেমনি কুরআনে থাকা নীতিমালা থেকেও তা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। যেহেতু আল্লাহ জুলুম করেন না, তাই সকল দিক থেকে একইরূপ অবস্থানে থাকা দুজন অপরাধীর একজন ক্ষমা পাওয়া এবং অন্যজন শাস্তি পাওয়ার ধারণা সঠিক হতে পারে না। নিম্নে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক আয়াত উল্লেখসহ পর্যালোচনা করা হলো।

১। পথনির্দেশ ও পথভ্রষ্টতা :

১৬:৯৩ :: আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তোমাদের সকলকে এক জাতিতে পরিণত করতেন, কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন, আর যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেন। তোমরা যা করতে সে সম্পর্কে অবশ্যই তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে।

পর্যালোচনা : আয়াতটিতে যা বলা হয়েছে তাকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে-

(ক)  যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তাহলে সকলকে এক জাতিতে পরিণত করতে পারতেন। অর্থাৎ সবাইকে ইচ্ছা করে হিদায়াত প্রদান করা বা হিদায়াতে বাধ্য করা আল্লাহর পক্ষে সম্ভব ছিলো। কিন্তু তা ইচ্ছা করেন নি। বরং তিনি চেয়েছেন যে, মানুষ নিজেরাই হিদায়াত বা পথভ্রষ্টতা অবলম্বন করুক।

(খ) আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়াত প্রদান করেন। বক্তব্যের এ অংশটির সঠিক তাৎপর্য অন্বেষণ আমাদের উদ্দেশ্য।

(গ) ‘তোমরা যা করতে সে সম্পর্কে অবশ্যই তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে। অর্থাৎ মানুষ ভালো-মন্দ যা কাজ করে তথা হিদায়াত বা পথভ্রষ্টতা অবলম্বনের বিষয়ে সে দায়ী। এজন্য তার স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার ভূমিকা আছে। তাই এ বিষয়ে তাকে জবাবদিহি করতে হবে।

‘ক’ ও ‘গ’ নংয়ের ভিত্তিতে ‘খ’ নং অংশে থাকা বক্তব্য ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দেন এবং যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন’ তথ্যটির অর্থ হলো, ‘আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী কেউ হিদায়াত পায় এবং কেউ পথভ্রষ্ট হয়’। আর এর প্রকৃত তাৎপর্য হলো- কোনো ব্যক্তি হিদায়াত অবলম্বন করবে নাকি পথভ্রষ্টতা অবলম্বন করবে সেই বিষয়ে আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা সেট করে রেখেছেন। আর তিনি তাঁর সেই ইচ্ছা সেট করে রেখেছেন একটি নীতিমালা আাকরে। কোন ধরনের শর্ত পূরণ করলে কেউ হিদায়াত পাবে এবং কোন ধরনের শর্ত পূরণ করলে কেউ পথভ্রষ্ট হবে, সেই বিষয়ে আল্লাহ একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে রেখেছেন। যখন কেউ ঐ নীতিমালা অনুসারে হিদায়াত অবলম্বন করে, তখন তার অর্থ হলো, আল্লাহ ঐ নীতিমালার ভিত্তিতে তাকে হিদায়াত করেছেন। অনুরূপভাবে যখন কেউ ঐ নীতিমালা অনুসারে পথভ্রষ্টতা অবলম্বন করে, তখন তার অর্থ হলো, আল্লাহ ঐ নীতিমালার ভিত্তিতে তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন। আর এ বিষয়টিকেই এভাবে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর (অতাৎক্ষণিক) ইচ্ছা (তথা তাঁর তৈরি নীতিমালার ভিত্তিতে) কাউকে হিদায়াত দেন এবং কাউকে পথভ্রষ্ট করেন।

২। ক্ষমা ও শাস্তি

২:২৮৪ :: আল্লাহর জন্যই যা রয়েছে আসমানসমূহে এবং যা রয়েছে যমীনে। আর তোমরা যদি প্রকাশ কর যা তোমাদের অন্তরে রয়েছে অথবা গোপন কর, আল্লাহ সে বিষয়ে তোমাদের হিসাব নেবেন। অতঃপর তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন, আর যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেবেন। আর আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান/ আল্লাহ সবকিছুর জন্য প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণকারী।

পর্যালোচনা : এ আয়াতটিতে বলা হয়েছে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবেন। আর এর পরপরই বলা হয়েছে যে, আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্বাদীর বা ক্ষমতাবান অথবা প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণকারী। এ কথার দুটি তাৎপর্য রয়েছে- (ক) আল্লাহ ক্ষমা করা ও শাস্তি দেয়া উভয়টির ক্ষমতা ও অধিকার রাখেন। (খ) তিনি কাকে ক্ষমা করবেন এবং কাকে শাস্তি দিবেন এ বিষয়ে তিনি প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণ করে রেখেছেন। বস্তুত কোনো মানুষ যে প্রতিফলই লাভ করুক না কেন, তা তার কর্মের যথাযথ মূল্যায়নের ভিত্তিতেই করা হবে এবং কারো প্রতি কোনোরূপ জুলুম করা হবে না। যেমন ৫৩:৩৯ নং আয়াতে প্রতিফল সম্পর্কিত নীতিটি বর্ণিত হয়েছে যে, “মানুষের জন্য সে যেরূপ চেষ্টা করে তা ছাড়া অন্যরূপ কিছুই নেই”। সুতরাং যারা ক্ষমা পাওয়ার জন্য যথানিয়মে চেষ্টা করে তারাই ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে এবং অন্যরা শাস্তিপ্রাপ্ত হবে।

উপরোল্লেখিত তথ্য অনুসারে নিশ্চিতভাবে বুঝা যায় যে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবেন কথাটির অর্থ হলো, যে ক্ষমার যোগ্য হবে আল্লাহর ইচ্ছায় সে ক্ষমা পাবে এবং যে শাস্তির যোগ্য হবে, আল্লাহর ইচ্ছায় সে শাস্তি পাবে।

৩। পদমর্যাদা

৬:৮৩ :: আর এটা আমাদের যুক্তি-প্রমাণ যা ইবরাহীমকে তার জাতির মোকাবেলায় দান করেছি। আমি যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় উন্নীত করি। নিশ্চয় তোমার প্রভু বিজ্ঞ ও জ্ঞানী।

পর্যালোচনা : প্রচলিত ধারণায় মনে করা হয় যে, আল্লাহ কাকে মর্যাদায় উন্নীত করবেন সেক্ষেত্রে আল্লাহর যখন যা ইচ্ছা হয় তিনি তখন তা-ই করেন। কিন্তু কুরআন অনুযায়ী এ ধারণা সঠিক নয়। বরং মর্যাদায় উন্নীত করার ক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছা কী, তা তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। আর তা হলো-

৪৬:১৯ :: আর প্রত্যেকের জন্য তাদের কর্ম অনুসারে মর্যাদা রয়েছে এবং যাতে আল্লাহ প্রত্যেকের কাজের পুর্ণ প্রতিফল দিতে পারেন। আর তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না।

সুতরাং যে ব্যক্তি তার কর্ম অনুসারে মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার যোগ্য হবে আল্লাহ তাকে মর্যাদায় উন্নীত করার ইচ্ছা করেছেন। সুতরাং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় উন্নীত করেন তথ্যটির অর্থ হলো, যে তার কর্ম অনুসারে মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার যোগ্য আল্লাহ তাকে মর্যাদায় উন্নীত করেন।

৬। মা ইয়াশা/ মা ইউরীদ (যা ইচ্ছা করেন)

আল্লাহ শূন্য থেকে সৃষ্টি করেন এবং বস্তুর অস্তিত্ব, বিকাশ ও পরিণতির জন্য আইন প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লাহ যখন আদি সৃষ্টি করেন তখন তিনি একটি ইচ্ছা বা পরিকল্পনা করেন যা বাস্তবায়িত হওয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি অস্তিত্ব লাভ করে। পরবর্তীতে তাঁর ইচ্ছা তাঁর ঐ পরিকল্পনাকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ কোনো সৃষ্টির বিকাশ ও পরিণতির ক্ষেত্রে আল্লাহ কোনো ইচ্ছা করার অর্থই হলো সেটির বিকাশ ও পরিণতির জন্য তিনি যে প্রাকৃতিক আইন বা নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করেছেন সেই অনুযায়ী সেটির বিকাশ ও পরিণতি ঘটানো। সুতরাং আল্লাহর ইচ্ছার দুটি স্তর রয়েছে, একটি কোনো কিছুর জন্য প্রাকৃতিক আইন প্রণয়নের স্তর এবং অন্যটি ঐ প্রাকৃতিক আইন বাস্তবায়নের স্তর। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতটি লক্ষ্য করা যেতে পারে-

৪২:৪৯ :: আল্লাহর জন্যই আকাশসমূহ ও পৃথিবীর রাজত্ব। তিনি যা ইচ্ছা করেন তা-ই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা করেন কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা করেন পুত্র সন্তান দান করেন।

আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা-ই সৃষ্টি করেন। এছাড়া বিভিন্ন আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা-ই করেন। (২:২৫৩, ৩:৪০, ১১:১০৭, ১৪:২৭, ২২:১৪, ২২:১৮, ৮৫:১৬)।

নিম্নের আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ইচ্ছা বিধান দেন। এর মানে কোনোক্রমে এ নয় যে, আল্লাহর বিধানগত ইচ্ছা নিতান্তই তাঁর খেয়ালীপনা। বরং আল্লাহ হচ্ছেন সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় এবং পরম দয়ালু্ তাই তাঁর বিধানগত ইচ্ছা অবশ্যই তাঁর এ গুণগুলোর সাথে সম্পর্কিত রয়েছে।

৫:১ :: হে মুমিনগণ, তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ কর। তোমাদের জন্য বিচরণশীল তৃণভোজী চতুস্পদ জন্তু হালাল করা হয়েছে, তোমাদের নিকট যা বর্ণনা করা হচ্ছে তা ছাড়া। তবে হুরুমুন অবস্থায় শিকারকে হালাল করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ যা ইচ্ছা বিধান দেন।

‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা-ই করেন’ তথ্যটির তাৎপর্য হলো- আল্লাহ তাঁর দ্বারা ইতিমধ্যে নির্ধারিত প্রাকৃতিক আইন ও পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেন।

উদাহরণস্বরূপ আমরা ১৪:২৭ আয়াতটি দেখতে পারি, যেখানে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে যে, ‘আল্লাহ যা করেন তা-ই করেন’।

১৪:২৭ :: আল্লাহ অবিচল রাখেন ঈমানদারদেরকে সুদৃঢ় বাণী দ্বারা দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে। আর আল্লাহ যালিমদের পথভ্রষ্ট করেন এবং আল্লাহ যা করেন ইচ্ছা তা-ই করেন।

পার্থিব জীবনে আল্লাহর অনুগ্রহ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে কেউ তাঁর তৈরি প্রাকৃতিক নীতিমালা অনুসরণ করবে সে-ই তা লাভ করতে পারবে। কিন্তু পরকালের সুখ-সম্ভোগ সবার জন্য উন্মুক্ত নয়, বরং তা শুধুমাত্র আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে যারা কর্ম সম্পাদন করবে তাদের জন্য সংরক্ষিত। পক্ষান্তরে যারা তাঁর বিধান থেকে বিমুখ হবে তিনি তাদেরকে শাস্তি প্রদানের ইচ্ছা করেছেন। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতসমূহ দ্রষ্টব্য।

১৭:১৮-২০ :: যে দুনিয়া চায় আমি সেখানে তাকে দ্রুত দিয়ে দেই, যা আমি চাই, যার জন্য চাই। তারপর তার জন্য নির্ধারণ করি জাহান্নাম, সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত, বিতাড়িত অবস্থায়। আর যে আখিরাত চায় এবং তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে মুমিন অবস্থায়, তাদের চেষ্টা হবে পুরস্কারযোগ্য। তোমার প্রভুর দান থেকে আমরা এদের ও ওদের প্রত্যেককে সাহায্য করি এবং তোমার প্রভুর দান অবারিত।

৩:১৭৬ :: যারা কুফরীতে দ্রুত ধাবিত হয় তারা যেন তোমাকে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত না করে, নিশ্চয় তারা আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ চান যে, তাদের জন্য আখিরাতে কোন অংশ রাখবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।

৫:৪৯ :: আর তাদের মধ্যে তার মাধ্যমে ফয়সালা কর, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর তাদের থেকে সতর্ক থাক যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তার কিছু থেকে তারা তোমাকে বিচ্যুত করবে। অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে জেনে রাখ যে, আল্লাহ তো কেবল তাদেরকে তাদের কিছু পাপের কারণেই শাস্তি দিতে চান। আর মানুষের অনেকেই ফাসিক।

সম্মান-অসম্মানের নীতিমালা

২২:১৮ :: তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করে যা কিছু রয়েছে আসমানসমূহে এবং যা কিছু রয়েছে যমীনে, সূর্য, চাঁদ, তারকারাজী, পর্বতমালা, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু ও মানুষের মধ্যে অনেকে। আবার অনেকের উপর শাস্তি অবধারিত হয়ে আছে। আল্লাহ যাকে অপমানিত করেন তার সম্মানদাতা কেউ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন।

এ আয়াতটিকে ভাগ্যবাদের প্রভাবে সাধারণত এভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যে, আল্লাহ কাউকে সম্মানিত করবেন নাকি অপমানিত করবেন এটা আল্লাহর একটা ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার মাত্র। তিনি নিজ ইচ্ছায় কাউকে অপমানিত করলে সে সম্মানিত না হয়ে অপমানিত হয় এবং কোনোভাবেই সম্মানিত হতে পারে না। বস্তুত এ কথা তো ঠিক যে, আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী যে অপমানিত হওয়ার সে-ই অপমানিত হয় এবং যে সম্মানিত হওয়ার সে-ই সম্মানিত হয়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা বলতে যে এ বিষয়ে আল্লাহর তৈরি নৈতিক-প্রাকৃতিক আইনকে বুঝায়, তা না বুঝার কারণে এ বিষয়টিকে ভাগ্যবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয় এবং ভাগ্যবাদের পক্ষে একটি দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অথচ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ কাউকে সম্মানিত বা অপমানিত করার ইচ্ছা করার অর্থ হলো এ ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্ধারিত নৈতিক-প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী সে ব্যক্তি সম্মানিত বা অপমানিত হওয়ার যোগ্য হওয়ার কারণে তাকে সম্মানিত বা অপমানিত করা। এ বিষয়টি নিম্নের আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হতে পারে যেখানে কোনো ব্যক্তি তাকে তার প্রভু (আল্লাহ) কোনো সঙ্গত কারণ ছাড়াই অপমানিত করেছেন বলার জবাবে বলা হয়েছে যে, তাদের এ ধারণা সঠিক নয়, বরং তাদের অপমানিত হওয়ার পেছনে তাদের অনৈতিক আচরণই প্রকৃত কারণ। অন্য কথায়, মানুষ তাদের অনৈতিক আচরণের কারণেই অপমানিত হয়।

৮৯:১৬-২০ :: আর যখন তিনি তাকে পরীক্ষা করেন এবং তার উপর তার রিয্ককে সঙ্কুচিত করে দেন, তখন সে বলে, ‘আমার রব আমাকে অপমানিত করেছেন’। কক্ষণো নয়। বরং তোমরা ইয়াতীমের প্রতি সম্মানজনক আচরণ কর না। এবং তোমরা অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না। এবং তোমরা উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সম্পদ সম্পূর্ণ রূপে গ্রাস কর। আর তোমরা ধন-সম্পদকে অতিশয় ভালবাস।

আল্লাহর প্রতিশ্রুতি যা পূরণের দাবি রাখে (ওয়াদাম মাছঊলা)

২৫:১৬ :: সেখানে তাদের জন্য থাকবে যা তারা ইচ্ছা করবে, স্থায়ী অবস্থায়, এটা তোমার প্রভুর এমন ওয়াদা যা পূরণের দাবি রাখে।

২১:২৩ :: তিনি যা করেন সে বিষয়ে তিনি জিজ্ঞাসিত হবেন না (তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না বা প্রশ্ন করা হবে না); বরং তাদেরকেই প্রশ্ন/ জিজ্ঞাসা করা হবে।

উপরোল্লেখিত প্রথম আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, আল্লাহ যা কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা পূরণের দাবি রাখে অর্থাৎ তা পূরণ করা আল্লাহর জন্য অপরিহার্য। আল্লাহর ওয়াদা অবশ্য পূরণীয় বা পালনীয়। সুতরাং দ্বিতীয় আয়াতটিতে বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর যে আদি ইচ্ছা করেছেন বা প্রাকৃতিক ও নৈতিক আইন-কানুন তৈরি করেছেন সেই বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা যেতে পারে না বা কেউ তাঁকে প্রশ্ন করার অধিকার রাখে না। এরপর তথ্যটির আরো তাৎপর্য হলো, আল্লাহ এমন কোনো বিচারিক কার্যক্রম করবেন না যাতে কারো উপর জুলুম হয়, তাই তিনি প্রশ্নবিদ্ধ হবেন না। তিনি সার্বভৌমত্বের অধিকারী স্রষ্টা ও প্রভু বিধায় যেমন কেউ তাঁকে তাঁর কাজের বিষয়ে প্রশ্ন করা (আপত্তি বা জবাবদিহির জন্য প্রশ্ন করা) যেতে পারে না; তেমনি যদি তিনি নিজেই কাউকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেন সেক্ষেত্রেও তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেতে পারে, তাঁর এমন কোনো কাজ পাওয়া যাবে না। সুতরাং আল্লাহ তাঁর সার্বভৌমত্বের চর্চা এভাবে করেন না যে, তিনি নির্বিচারে যা ইচ্ছা তা-ই করেন। বরং তিনি তাঁর নির্ধারিত নীতিমালা অনুসারে যা ইচ্ছা তা করেন।

সুতরাং ‘আল্লাহ প্রশ্নের ঊর্ধ্বে’ এবং ‘তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করেন’ তথ্যের ভিত্তিতে যে স্বৈরাচারী আল্লাহর ধারণা এবং তার সাথে মিল করে ভাগ্যবাদ প্রচারিত হয়, কুরআনে আল্লাহ সম্পর্কে তার বিপরীত ধারণাই দেয়া হয়েছে। অবশ্যই আল্লাহ প্রশ্নের ঊর্ধ্বে এবং অবশ্যই আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা-ই করেন, কিন্তু এসবের অর্থ এ নয় যে, তিনি অবিবেচক স্বৈরাচারী, বরং তিনি তা-ই করেন যা হক্ব বা যথাযথ ও বাস্তবসম্মত। এবং শুধুমাত্র সার্বভৌম সত্তা হওয়ার কারণেই নয়, বরং সেই সাথে তিনি তাঁর তৈরি নীতিমালা অনুযায়ী ন্যায়বিচারমূলক কাজ করেন বলেই তিনি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে।

আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কে সাধারণ ধারণা ও তার ভিত্তিতে উত্থাপিত প্রশ্ন

আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারেই সবকিছু হয়। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয় না। আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তাই করেন। আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। মানুষের ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার অধীন। বরং আল্লাহর ইচ্ছাতেই মানুষ ইচ্ছা করে। মানুষের জন্ম-মৃত্যু, জীবিকা, জ্ঞান, ঈমান, আমল সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতির সাথে সম্পর্কিত। তিনি যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন ও শাস্তি দেন এবং যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন ও ক্ষমা করেন। তিনিই কাফিরদের চোখ, কান ও অন্তরে মোহর করে দিয়েছেন। এ প্রেক্ষিতে যে প্রশ্নটি আসে, তা হলো: তাহলে মানুষকে কীভাবে দায়ী করা যেতে পারে এবং পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া যৌক্তিক হতে পারে? যেহেতু আল্লাহই মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তি সৃষ্টি করেছেন, তাহলে কেন মানুষকে তাদের ভালো বা মন্দ ইচ্ছা ও কর্মের জন্য জান্নাত বা জাহান্নাম দেয়া হবে? এ প্রশ্নের সমাধান অনুধাবনের জন্য নিম্নের পয়েন্টগুলোতে কৃত আলোচনা কাজে আসতে পারে।

মানুষের ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার অধীন হওয়ার তাৎপর্য

৭৪:৫৪-৫৬ :: কোনোক্রমেই না। নিশ্চয় তা (কুরআন) উপদেশ। সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে যেন তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করে। আর তারা উপদেশ গ্রহণ করে না আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া। তিনিই ভয়ের যোগ্য এবং তিনিই ক্ষমা করার অধিকারী।

৭৬:২৯-৩০ :: নিশ্চয় এটা (কুরআন) উপদেশ। সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে যেন তার প্রভুর দিকে পথ অবলম্বন করে। আর তোমরা ইচ্ছা করো না আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া। নিশ্চয় আল্লাহ জ্ঞানী ও বিজ্ঞ।

৮১:২৭-২৯ :: তা (কুরআন) জগদ্বাসীর জন্য উপদেশ ছাড়া ভিন্নরূপ কিছু নয়। তোমাদের মধ্য থেকে যে সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকতে চায় তার জন্য। আর তোমরা ইচ্ছা করো না জগতসমূহের প্রভু আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া।

প্রচলিত ধারণা : উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহকে প্রচলিত ধারণায় যেভাবে তুলে ধরা হয় তাতে এর তাৎপর্য দাড়ায় এরূপ যে, আল্লাহ মানুষকে একটি উপদেশ হিসেবে কুরআন নাযিল করেছেন। তারপর মানুষ এই উপদেশ গ্রহণ করা বা না করার বিষয়ে তাকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে, মানুষের পক্ষে তার ইচ্ছার স্বাধীনতা প্রয়োগ করা সম্ভব নয় বা তার কোনো ইচ্ছার স্বাধীনতাই নেই। কারণ সে তা-ই ইচ্ছা করতে বাধ্য, সে যেরূপ ইচ্ছা করার জন্য আল্লাহ ইচ্ছা করেন। অর্থাৎ যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন যে, সে উপদেশ গ্রহণের ইচ্ছা করুক, তাহলে সে উপদেশ গ্রহণের ইচ্ছা করবে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন যে, সে উপদেশ গ্রহণ না করার ইচ্ছা করুক, তাহলে সে উপদেশ গ্রহণ না করার ইচ্ছা করবে। অন্য কথায় সে সেই ইচ্ছাটাই করবে, যে ইচ্ছাটা করার জন্য আল্লাহ ইচ্ছা করেন। আল্লাহর ইচ্ছার চেয়ে ভিন্নরূপ ইচ্ছা সে করে না, করবে না বা করতে পারে না।

পর্যালোচনা : প্রচলিত ধারণাটি কুরআনের বক্তব্যকে হাস্যকর বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করে। কারণ একদিকে বলা হবে, মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে এবং সাথে সাথেই বলা হবে যে, মানুষ কোনো ইচ্ছা করাই সম্ভব নয় ঐ ইচ্ছা ছাড়া যে ইচ্ছাটি সে করার জন্য আল্লাহ ইচ্ছা করেন। অথবা মানুষের পক্ষে তার ইচ্ছার স্বাধীনতা প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। অন্য কথায়, মানুষের কোনো ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই, বরং সে সেই ইচ্ছা করতে বাধ্য যে ইচ্ছা তাকে দিয়ে করানো হয়। এ বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্টত স্ববিরোধ রয়েছে। সুতরাং এ বক্তব্য তথা প্রচলিত ধারণাটি গ্রহণযোগ্য নয়।

আয়াতসমূহের প্রকৃত তাৎপর্য : ‘আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া মানুষ ইচ্ছা করে না’ তথ্যটির প্রকৃত তাৎপর্য হলো, মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা আল্লাহ প্রদত্ত। আল্লাহ যদি চাইতেন যে, মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকবে না, তাহলে তার ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকতো না। কিন্তু আল্লাহ ইচ্ছা করেই মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন। এছাড়া যে ক্ষেত্রে আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন সেক্ষেত্রে ছাড়া অন্যত্র মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই। যেমন, মানুষকে চোখ দিয়েই দেখতে হবে। এক্ষেত্রে মানুষ ইচ্ছা করলেও চোখ ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে দেখতে পারে না। সুতরাং যেক্ষেত্রে আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন শুধুমাত্র সেক্ষেত্রেই মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা রয়েছে। মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা আল্লাহ প্রদত্ত বিধায় মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা আল্লাহর ইচ্ছার বাস্তবায়নের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, বরং আল্লাহর এর মাধ্যমে আল্লাহর ইচ্ছারই বাস্তবায়ন ঘটেছে যে, তিনি ইচ্ছা করেছেন মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিবেন এবং তাই মানুষ ইচ্ছার স্বাধীনতা পেয়েছে এবং প্রয়োগ করতে পারে। মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা আল্লাহর ইচ্ছার অধীন। অর্থাৎ মানুষ কোনো বিষয়ে সফল হওয়ার ইচ্ছা করলে তা তখনি সম্ভভ হবে যখন সে বিষয়ে আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে বা আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে সফল হওয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে। মানুষের ইচ্ছা বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য আল্লাহর ইচ্ছায় অবকাশ থাকতে হবে। আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে যে সামগ্রিক ব্যবস্থা-কাঠামো তৈরি হয়, তাতে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি-সমষ্টির ইচ্ছার বাস্তবায়নের সুযোগ থাকলেই কেবল তা বাস্তবায়িত হতে পারে, অন্যথায় তা বাস্তবায়িত হয় না। এক কথায়, ‘আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া মানুষ ইচ্ছা করে না বা তার ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয় না’ তথ্যটি দ্বারা আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতাকে প্রকাশ করা হয়, কিন্তু তার মাধ্যমে কোনোভাবেই মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয় না।

ঈমান ও কুফর বা হিদায়াত ও দলালাত সম্পর্কে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কিত আয়াতসমূহ

১৮:২৯, ২৫:৫৭, ৩৯:১৫, ৪১:৪০, ৭৩:১৯, ৭৪:৩৭, ৭৪:৫৫, ৭৬:২৯, ৭৮:৩৯, ৮০:১২, ৮১:২৮।

১৮:২৯ :: আর বল, ‘সত্য তোমাদের রবের পক্ষ থেকে। সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে যেন ঈমান আনে এবং যে ইচ্ছা করে সে যেন কুফরী করে। নিশ্চয় আমি যালিমদের জন্য আগুন প্রস্ত্তত করেছি, যার প্রাচীরগুলো তাদেরকে বেষ্টন করে রেখেছে। যদি তারা পানি চায়, তবে তাদেরকে দেয়া হবে এমন পানি যা গলিত ধাতুর মত, যা চেহারাগুলো ঝলসে দেবে। কী নিকৃষ্ট পানীয়! আর কী মন্দ বিশ্রামস্থল!

২৫:৫৭ :: বল, ‘আমি এর উপর তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাই না। তবে যে ইচ্ছা করে সে তার রবের দিকে পথ অবলম্বন করুক।

৩৯:১৫ :: অতএব, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইচ্ছা তার ইবাদত করো। বলো, “‘ক্ষতিগ্রস্ত তারাই যারা কিয়ামতের দিন নিজেদের ও নিজেদের পরিজনবর্গের ক্ষতিসাধন করে।” জেনে রাখ, এটাই সুস্পষ্ট ক্ষতি।

৪১:৪০ :: নিশ্চয় যারা আমার আয়াতসমূহ বিকৃত করে তারা আমার অগোচরে নয়। যে অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হবে সে কি উত্তম, না যে কিয়ামত দিবসে নিরাপদভাবে উপস্থিত হবে? তোমাদের যা ইচ্ছা করো। নিশ্চয় তোমরা যা আমল করো তিনি তার সম্যক দ্রষ্টা।

৭৩:১৯ :: নিশ্চয় এ এক উপদেশ। সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে তার রবের দিকে পথ অবলম্বন করুক।

৭৪:৩৭ :: তোমাদের মধ্যে যে (কল্যাণের পথে) এগিয়ে যেতে চায় অথবা পেছনে পড়ে থাকতে চায় তার জন্য (এটা সতর্ককারী)।

৭৪:৫৫ :: অতএব যার ইচ্ছা সে তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করুক।

৭৬:২৯ :: নিশ্চয় এটি উপদেশ; সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে তার রবের দিকে পথ অবলম্বন করুক।

৭৮:৩৯ :: সেই দিনটি সত্য। সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে তার প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তনের পথ অবলম্বন করুক।

৮০:১২ :: অতএব যার ইচ্ছা সে তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করুক।

৮১:২৮ :: তোমাদের মধ্য থেকে যে সত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত পথে চলতে ইচ্ছা করে তার জন্য (এটা উপদেশ)।

তাৎক্ষণিক ও অতাৎক্ষণিক ইচ্ছা : ‘আল্লাহর ইচ্ছায় সবকিছু হয়’- তথ্যটির তাৎপর্য অনুধাবনের সূত্র

ইচ্ছার দুটি প্রকার হলো, তাৎক্ষণিক ইচ্ছা ও অতাৎক্ষণিক ইচ্ছা। তাৎক্ষণিক ইচ্ছা কোনো কাজ শুরু করার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে করা হয়। অন্যদিকে অতাৎক্ষণিক ইচ্ছা কোনো প্রোগ্রাম (নীতিমালা, নিয়ম-কানুন, আইন-বিধান ইত্যাদি) সেট করার মাধ্যমে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে। যদি আমি আপনার মোবাইল নাম্বারে কল করতে চাই তাহলে আমাকে আমার মোবাইল ফোনে আপনার মোবাইল নাম্বারের সকল ডিজিট সঠিকভাবে প্রেস করতে হবে (এক্ষেত্রে আবার যে ডিজিটটি যে বাটনে আছে সেই ডিজিটটি প্রেস করার জন্য সেই বাটনে প্রেস করতে হবে) এবং তারপর ‘কল’ বাটনে প্রেস করতে হবে। তাহলে আপনি আমার কল পাবেন। তাহলে এখানে আমি আপনার কাছে আমার তাৎক্ষণিক ইচ্ছায় কল করেছি। কিন্তু কল করেছি মোবাইল সেটের প্রকৌশলীর অতাৎক্ষণিক ইচ্ছাকে অনুসরণ করে। কারণ তিনি যে বাটন যেভাবে সেট করেছেন সেভাবে প্রেস করলেই কলটি যাবে, প্রোগ্রামের মাধ্যমে এ অতাৎক্ষণিক ইচ্ছাটি সেট করে রেখেছেন। এখন আমি ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে এর চেয়ে ব্যতিক্রম করলে আপনার কাছে কল দিতে পারবো না। অর্থাৎ তাৎক্ষণিক ইচ্ছাটি পূর্ণ করতে হবে আমাকে প্রকৌশলীর অতাৎক্ষণিক ইচ্ছাকে অনুসরণ করতে হবে। তাহলে বলা যায়, আমি আপনাকে কল করতে সফল হয়েছি আমার তাৎক্ষণিক ইচ্ছায় এবং প্রকৌশলীর অতাৎক্ষণিক ইচ্ছায়।

তাৎক্ষণিক ও অতাৎক্ষণিক ইচ্ছার প্রকারভেদ সম্পর্কিত জ্ঞানই হচ্ছে ‘আল্লাহর ইচ্ছায় সবকিছু হয়’ তথ্যটির তাৎপর্য অনুধাবনের সূত্র। আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতি ছাড়া কিছুই হয় না। তবে সর্বক্ষেত্রে তা তাৎক্ষণিক ইচ্ছা ও অনুমতির সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং তিনি বিভিন্ন অনুঘটক (Factor) সহ বিভিন্ন ঘটনা ও তার ফলাফলের বিভিন্ন অবস্থা প্রোগ্রাম করে রেখেছেন, যাকে তাঁর অতাৎক্ষণিক ইচ্ছা ও অনুমতি বলা যায়। তিনি তাৎক্ষণিক ইচ্ছা করলে তাঁর তৈরি কারণ ও ফলাফল বিধির পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। মানুষের জন্ম, মৃত্যু, জ্ঞান, জীবিকা এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলাফলের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে আল্লাহর অতাৎক্ষণিক ইচ্ছা ও বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁর তাৎক্ষণিক ইচ্ছা কার্যকর রয়েছে। মানুষ যদি তাঁর অতাৎক্ষণিক ইচ্ছা অনুযায়ী তথা তাঁর তৈরি করে রাখা প্রাকৃতিক নিয়ম বা কারণ ও ফলাফল বিধি অনুযায়ী কোনো কাজ করে তাহলে সে ঐ কাজটিতে সফল হয়, অন্যথায় সে তাতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে আল্লাহর নিকট যথানিয়মে প্রার্থনা (প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে যথাসাধ্য চেষ্টা করার পাশাপাশি প্রার্থনা এবং সঙ্গত ও কল্যাণকর বিষয়ে প্রার্থনা) করে, তাহলে আল্লাহ সেই প্রার্থনা কবুল করে থাকেন এবং এছাড়াও মানুষের ভুল কর্মকাণ্ডের ফলে যেসব বিপদাপদ হওয়ার কথা নিজ অনুগ্রহে আল্লাহ তার অনেক কিছু রদ করে দেন।

‘আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া মানুষ ইচ্ছা করে না’ তথ্যটির অর্থ হলো আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষ সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হয়েছে, অন্যথায় সে স্বাধীনভাবে কোনো ইচ্ছাই করতে পারতো না। তবে ঐ সীমিত স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সে দায়ী, যেহেতু ঐ সীমিত ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে তার ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ করে থাকে।

‘আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ ঈমান আনতে পারে না’ তথ্যটির অর্থ হলো আল্লাহর তৈরি ঈমান আনার নিয়ম অনুসরণ ছাড়া কেউ ঈমান আনতে পারে না। আর তিনি নিয়মটি জানিয়ে দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ প্রদত্ত Common sense প্রয়োগের মাধ্যমে তা অনুসারে সিদ্ধান্ত না নিয়ে প্রবৃত্তিতাড়িত সিদ্ধান্ত নেয় এবং সত্যকে অস্বীকার করে তারপর তার মধ্যে সত্যকে গ্রহনের যোগ্যতা হ্রাস পায় এবং এর ফলস্বরূপ সে ঈমান আনতে পারে না।

সুতরাং আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষ ঈমান আনে কিন্তু সে ইচ্ছা এমন যে, সে ঈমানের ক্ষেত্রে নিজ ইচ্ছায় আল্লাহর তৈরি নিয়ম অনুসরণ করে ঈমান আনে অথবা কুফর করে।

অনুরূপভাবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়াত দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে পথভ্রষ্ট করেন, কিন্তু আল্লাহর এ ইচ্ছা তাঁর ন্যায়নীতিকে লংঘন করে হয় না, বরং তিনি তাঁর ইচ্ছা তাঁর স্বরচিত একটি নীতিমালা অনুসারে কার্যকর করেন। আর তাহলো যে ব্যক্তি আল্লাহর অভিমুখী হয়, যে নিজে হিদায়াত পেতে চায় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দান করেন। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি নিজ ইচ্ছায় হিদায়াত না পাওয়ার মতো পথ অবলম্বন করেন আল্লাহ সজ্ঞানে তাকে পথভ্রষ্ট করেন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজে হিদায়াত চায় না আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না।

আল্লাহ কাফিরদের চোখ, কান, অন্তরে মোহর মেরে দেন তাই তারা কুরআনের সত্য দেখে না, শুনে না ও বলে না। কিন্তু আল্লাহ কোনো কারণ ও নিয়ম ছাড়া তাদের চোখ, কান ও অন্তরে মোহর মেরে দেন না। বরং প্রথমে তারা কুরআনের সত্য দেখা, শুনা ও বুঝার জন্য মনোযোগ দেয় না বরং এর বিপরীত বিষয়ে মনোযোগ দেয়, তাই তাদের পক্ষে কুরআনের সত্য দেখা, শুনা ও বুঝা অসম্ভব হয়ে পড়ে তথা তাদের চোখ, কান ও অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে চোখ, কান ও অন্তরে মোহর মেরে দেয়ার ঘটনা প্রথমে ঘটে না। বরং প্রথমে তারা কুফর করে এবং সেই কারণে ফলাফলস্বরূপ তাদের চোখ, কান ও অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়। তারপর তার কারণে ফলস্বরূপ তারা আর ঈমান আনে না।

আল্লাহর ইচ্ছার বিভিন্ন পর্যায় : মহাবিশ্বের মহাব্যবস্থাপনায় আল্লাহর সাধারণ (প্রাকৃতিক আইনগত) ও বিশেষ নিয়ন্ত্রণ

আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কিত বিভিন্ন আয়াত নিয়ে যুক্তি বিন্যাস পদ্ধতিতে চিন্তা গবেষণার মাধ্যমে আল্লাহর ইচ্ছার প্রকাশকে বিভিন্ন পর্যায়ের সাথে সম্পর্কিত করে বুঝা যেতে পারে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:

১। প্রাথমিক সৃষ্টিগত গঠন ও শৃঙ্খল সম্পর্কিত এবং প্রাকৃতিক নিয়মরূপ অতাৎক্ষণিক ইচ্ছা: আল্লাহ তাঁর স্বয়ং অধিকারের ভিত্তিতে এরূপ ইচ্ছার মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির প্রাণী সৃষ্টি করেছেন, তাদের লিঙ্গ নির্ধারণ করেছেন, বাস্তুসংস্থানমূলক খাদ্য শৃঙ্খল সৃষ্টি করেছেন ইত্যাদি। তিনি প্রতিটি সৃষ্টির যে মূল রূপ সৃষ্টি করেছেন সেটাই তার স্বাভাবিক ও সর্বোত্তম রূপ। তবে তাঁর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মরূপে কার্যকর কারণ ও ফলাফল বিধিতে থাকা নেতিবাচক সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে অস্বাভাবিকতার উদ্ভব ঘটে, যেমন কেউ জন্মান্ধ রূপে জন্মগ্রহণ করে। স্বাভাবিক উপলব্ধি ও গবেষণার মাধ্যমে মানুষ স্বাভাবিকতা ও অস্বাভাবিকতা নির্ণয় করতে পারে এবং প্রাকৃতিক নিয়মের গবেষণার মাধ্যমে অস্বাভাবিক অবস্থার চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াও মানুষের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।

প্রাকৃতিক নিয়মরূপে কার্যকর আল্লাহর অতাৎক্ষণিক ইচ্ছার ভিত্তিতে মানুষ চোখ দিয়ে দেখবে, কান দিয়ে শুনবে ইত্যাদি বিষয় নির্ধারিত হয়েছে। জন্ম-মৃত্যু ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সংঘটনের ক্ষেত্রে মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মে আবদ্ধ। তবে প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায় কোনো বিকল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মানুষ বিভিন্নভাবে দায়বদ্ধ। যেমন, আত্মহত্যা করা বা কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত হয়।

২। নিয়ন্ত্রণমূলক তাৎক্ষণিক ইচ্ছা ও নির্দেশনা প্রদানমূলক ইচ্ছা: প্রাকৃতিক নিয়মানুযায়ী সংঘটিতব্য অনেক বিষয়কে আল্লাহ তাঁর তাৎক্ষণিক ইচ্ছার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেন। কোনো অলৌকিক নিদর্শন প্রকাশ এবং কোনো জাতিকে তার সীমালংঘনের প্রেক্ষিতে ধ্বংস করে দেয়ার সিদ্ধান্তও এরূপ ইচ্ছার অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া তিনি নবী-রসূল মনোনীত করে কিতাব নাযিলের মাধ্যমে তাঁর আদেশ-নিষেধ ও অনুমোদন বিষয়ক নির্দেশনা প্রদান করেছেন।

৩। ন্যায় বাস্তবায়নমূলক বিচারিক ইচ্ছা: এরূপ ইচ্ছার মাধ্যমে সকল শর্তে হুবহু অভিন্ন মনোভাবসম্পন্ন ও কর্মসম্পাদনকারীর পুরস্কার বা শাস্তিও হুবহু অভিন্ন হবে। আল্লাহ কারো প্রতি সামান্য জুলুমও করেন না।

আল্লাহর ইচ্ছার প্রাথমিক পর্যায় ও তাঁর আইনগত ইচ্ছা

'কারণ এবং প্রভাবের’ প্রক্রিয়াটি একটি সাধারণ পর্যবেক্ষণের বিষয়। কিন্তু ঘটনার শৃঙ্খল প্রথম যখন থেকে শুরু হয়েছে বা একটি আদি অবস্থা- পেছনের দিকে যেখানে থামতে হবে, এমন একটি সূচনা বিন্দু রয়েছে। সেখানে প্রভাব একটি বস্তুগত কারণ ছাড়া হতে হয়েছে. অথবা সেখানেই ‘কারণ ও প্রভাব’ এর পদ্ধতির সূচনা ঘটেছে। এটাই আল্লাহর ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টির মুহূর্ত। তিনি যেভাবে ‘প্রভাব ও কারণ’ তৈরি করেছেন সেটা অবশ্যই সত্য পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তা উত্তম বা কল্যাণকর। কিন্তু তিনি কেন এভাবেই ‘কারণ ও প্রভাব’ ঠিক করলেন, কেন অন্য কোনোভাবে করলেন না? এ প্রশ্নের উত্তরে তাঁর অসীম ক্ষমতা এবং স্বেচ্ছায় কোনো একটি পদ্ধতিতে তার প্রকাশ ঘটানোর বিষয়টি মেনে নিতে হয়। তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন এবং তিনি যা করেছেন তা নিজ ইচ্ছাতেই করেছেন।

তিনি তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টির জন্য নির্দেশ বা আইন প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পানির স্তর বজায় রাখার বৈশিষ্ট্য আছে কেন? আগুন কেন গরম হয়? বিষ কেন প্রাণনাশ করে? কারণ আল্লাহ তা-ই চেয়েছিলেন। আমরা আমাদের চারপাশে ভৌত মহাবিশ্বে ‘আল্লাহর ইচ্ছা’ পালন করি। একইভাবে, তিনি সামাজিক মহাবিশ্বের জন্যও তাঁর আইন প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি মানুষকে তা গ্রহণ করা বা না করার বিষয়ে স্বাধীনতা দিয়েছেন। তিনি এ আইনগুলো বুঝার জন্য মানুষকে বিবেকসম্পন্ন করেছেন এবং তাঁর বার্তাবাহকদের মাধ্যমে আইনগুলোর বিষয়ে চূড়ান্ত বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। এ আইনগুলোকে গ্রহণ করলে মানুষ তা দ্বারা উপকৃত হয় কিন্তু গ্রহণ না করলে সে তার পরিণতিস্বরূপ দুর্ভোগের শিকার হয়। কারণ মানুষ আইনগুলো গ্রহণ করা না করার বিষয়ে স্বাধীন হলেও এর ফলাফল অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য।

সন্তুষ্টির সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে ইচ্ছার প্রকারভেদ

আল্লাহর ভালোবাসা এবং সন্তুষ্টি (রিদা বা রিদওয়ান) এর সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে আল্লাহর ইচ্ছাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। (ক) সৃষ্টি সম্পর্কিত ইচ্ছা, (খ) আইনগত ইচ্ছা।

সৃষ্টি সম্পর্কিত ইচ্ছা আল্লাহর সকল সৃষ্টিকে অন্তর্ভুক্ত করে। বলা হয়েছে-

৮৫:১৬ :: তিনি যা চান, তাই করেন।

১১:৩৪ :: আর আমি তোমাদের নছীহত করতে চাইলেও তা তোমাদের জন্য ফলপ্রসূ হবে না, যদি আল্লাহ তোমাদেরকে গোমরাহ করতে চান।

এই ইচ্ছার সাথে আল্লাহর আদেশ, ভালবাসা ও সন্তুষ্টি অপরিহার্য নয়। এই ইচ্ছার মাধ্যমে এমন কিছু ঘটতে পারে যেজন্য আল্লাহ আদেশ দেন না, যা তিনি ভালবাসেন না বা যাতে তাঁর সন্তুষ্টি নেই। যেমন আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া পাপকর্ম সংঘটিত হতে পারে না, কিন্তু তিনি তা পছন্দ করেন না এবং সেজন্য আদেশও দেন না বরং তা থেকে নিষেধ করেন। আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং পরীক্ষা করতে চান বিধায় তিনি পাপ-পুণ্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর পছন্দনীয় না হওয়া সত্ত্বেও পাপের অস্তিত্ব থাকার পেছনে এটাই রহস্য।

অন্যদিকে শরয়ী ইচ্ছা আল্লাহর আদেশ, ভালবাসা ও সন্তুষ্টির সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ যে বিষয়টি আল্লাহ ভালবাসেন বা যাতে তিনি সন্তুষ্ট এবং সেজন্য তিনি আদেশ দেন তা হলো আল্লাহর শরয়ী ইচ্ছা। কিন্তু তাঁর এ ইচ্ছা বাস্তবায়িত হওয়া অপরিহার্য নয়। অর্থাৎ তিনি যা নির্দেশ দিয়েছেন তা যাকে নির্দেশ দিয়েছেন বাস্তবায়ন নাও করতে পারে বা তাঁর ইচ্ছার (আদেশের) বিপরীত করতে পারে। আল্লাহ নিজ ইচ্ছায় বান্দাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন বিধায় তাঁর শরয়ী ইচ্ছা বাস্তবায়ন না হওয়া তাঁর সীমাবদ্ধতা হিসেবে সাব্যস্ত হয় না।

৪:২৭ :: আল্লাহ তোমাদের তওবা কবূল করতে চান।

৩৯:৭ :: তিনি তাঁর বান্দাদের কাফের হয়ে যাওয়া পছন্দ করেন না।

ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি (ইরাদা/মাশিয়াত ও রিদা) এর পার্থক্য বুঝার জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। কোনো ব্যক্তি অসুস্থ হলে প্রয়োজনে সে অপারেশন করতে সম্মত হয়, যদিও এ বিষয়টি তার জন্য সন্তোষজনক নয়। এক্ষেত্রে যদিও সাধারণভাবে অপারেশন তার পছন্দনীয় বিষয় নয়, তবুও তার ইচ্ছাতেই তা সম্পাদিত হয়। কারণ যদি সে কোনোভাবে সম্মত না হতো, তাহলে অপারেশনটি হতো না।

সুতরাং ভালো-মন্দ সকল কাজ আল্লাহর ইচ্ছায় হলেও তিনি ভালো কাজে সন্তুষ্ট হন এবং মন্দ কাজে অসন্তুষ্ট হন। প্রশ্ন হলো, যে কাজে তিনি অসন্তুষ্ট হন সেই কাজের পেছনে তাঁর ইচ্ছা রয়েছে কেন বা তিনি দয়াময় ও সর্বশক্তিমান হওয়া সত্ত্বেও সেই কাজ হতে দেন কেন? এর জবাব হলো, তিনি মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং মানুষ স্বেচ্ছায় ভালোকে গ্রহণ করুক এবং মন্দ থেকে বিরত থাকুক সেই নির্দেশ দিয়েছেন। তাই মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা হরণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি তা করেন না।

বান্দার কর্ম আল্লাহর ইচ্ছার অধীন। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ বা শরীয়াত নিরর্থক। কারণ এখানে আল্লাহর ইচ্ছা মানে এ নয় যে, আল্লাহ তাকে বাধ্য করেন এবং এও নয় যে, আল্লাহ কোনো পাপ কাজের আদেশ দিয়েছেন।

বান্দার পাপকাজ আল্লাহর ইচ্ছাতে হলেও তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি নেই এবং তা আল্লাহর হুকুমে বা আদেশে সংঘটিত হয় না। কারণ আল্লাহ পাপ কাজের আদেশ দেন না।

আল্লাহর সৃষ্টিগত ইচ্ছা ও আইনগত ইচ্ছার একটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, সৃষ্টিগত ইচ্ছা অনুসারে আল্লাহ চোখ দিয়েছেন দেখার জন্য। সুতরাং দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি চোখ খুললে দেখবেই। কিন্তু আল্লাহ চোখের সাথে সম্পর্কিত আইনগত বিধান দিয়েছেন, অর্থাৎ চোখের দেখার সীমারেখা নির্দিষ্ট করেছেন। তাই সবকিছু আগ্রহ সহকারে দেখা সম্ভব বা সঙ্গত নয়। আল্লাহর দেয়া আইনগত বিধান লঙ্ঘন করার কারণেই শাস্তি ভোগ করতে হবে। আর আল্লাহর শরয়ী ইচ্ছা পালনের মধ্যেই তাঁর সন্তুষ্টি নিহিত।

জাগতিক ঘটনাবলিতে আল্লাহর হস্তক্ষেপের অন্তর্নিহিত রহস্য : সূরা কাহাফে বর্ণিত ‘বালকের হত্যার’ সাথে সম্পর্কিত কিছু তথ্য

সূরা কাহাফে ৬০-৮২ আয়াতে রসূলুল্লাহ মূসাকে জাগতিক ঘটনাবলিতে আল্লাহর হস্তক্ষেপের অন্তর্নিহিত রহস্যের কিছু জ্ঞান প্রদানের বর্ণনা রয়েছে। তা থেকে জানা যায় যে, জাগতিক ঘটনাবলিতে আল্লাহর হস্তক্ষেপের পেছনে কোনো না কোনো কল্যাণকর কারণ নিহিত থাকে।

সূরা কাহাফে জাগতিক ঘটনাপ্রবাহে আল্লাহর হস্তক্ষেপের বিষয়ে রসূলুল্লাহ মূসার অভিজ্ঞতা অর্জন মূলক ভ্রমণে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ‘বালকের হত্যা’ সম্পর্কিত ঘটনাটির কিছু বিশেষ দিক লক্ষণীয়। ঘটনাটিতে একটি বালককে আল্লাহর সিদ্ধান্তক্রমে হত্যা করা হয় এজন্য যে, সে কাফির হয়ে তার মু’মিন পিতামাতাকে কষ্ট দেয়ার সম্ভাবনা ছিলো। এক্ষেত্রে প্রথম জ্ঞাতব্য বিষয় হলো, আল্লাহর এরূপ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য কর্মরত তাঁর বান্দাদেরকে ফেরেশতা বলা হয়। এ ঘটনার মধ্যে জাগতিক ঘটনাবলির নিয়ন্ত্রণে আল্লাহর হস্তক্ষেপের তাৎপর্য সম্পর্কিত অনেক তথ্য নিহিত রয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:

১। কাউকে বিশেষ অনুগ্রহ করার জন্য ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যেমন বালকটির পিতামাতাকে বিশেষ অনুগ্রহ করার জন্য বালকটিকে হত্যা করা হয়েছে। এখানে বালকটিকে হত্যা করা হয়েছে, তাকে বাঁচিয়ে রেখে তার কুফরের মনোভাবকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পাল্টে দেয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়নি। কারণ ব্যক্তির ভালো-মন্দ মনোভাব তার নিজেকেই পরিবর্তন করতে হয়, সেটাকে নিয়ন্ত্রণমূলক পদ্ধতিতে পরিবর্তিত করা হয় না।

২। কার্যকারণের পরিবর্তনের মাধ্যমে ঘটনাপ্রবাহে পরিবর্তন ঘটে। যেমন বালকটিকে হত্যা করায় বেঁচে থাকলে সে যে কুফর করতো তার সংঘটনকে প্রতিহত করা হয়েছে। তাকে হত্যা করায় তার মৃত্যু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তার অনুপস্থিতি এবং তাকে হত্যা না করলে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভূমিকা এ দুটি বিষয়ের ভিন্নরূপতা একটি অনিবার্য বিষয়। আল্লাহ জানতেন যে, তাঁর নির্দেশে বালকটিকে অগ্রিম হত্যা করা হবে এবং তাই সে বড় হয়ে কুফর করার ঘটনা ঘটবে না। সুতরাং যদি তাকে বাঁচিয়ে রাখা হতো তাহলে সে কুফর করতো সম্ভাবনাটি তার মধ্যে প্রস্ফুটন উন্মুখ ভাব অবস্থায় বিদ্যমান ছিলো বা এমন ফ্যাক্টর তাকে প্রভাবিত করেছিলো যার ফলে স্বাধীনভাবে কুফরের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই সে কুফর করার সম্ভাব্য অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলো।

৩। বালকটিকে হত্যা করা একটি ঘটনাক্রম ছিলো, কোনো অগ্রিম শাস্তি নয়। কারণ কেউ বাস্তবে কোনো কাজ সম্পাদনের পূর্বে তাকে সে বিষয়ে শাস্তি দেয়া হয় না, বরং কৃতকর্মের জন্যই শাস্তি দেয়া হয়। এ ঘটনার মাধ্যমে বালকটির পিতামাতার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করা হয়েছে।

৪। যারা বড় হওয়ার পর কুফর করে তারা প্রশ্ন করার অবকাশ নেই যে, কেন তাদেরকে এ বালকটির মতো কুফর করার আগেই হত্যা করা হলো না। কারণ তারা স্বাধীন ইচ্ছাতেই কুফর করেছে বিধায় তারা দায়ী হবে। যে ব্যক্তিকে যে অবস্থানে রাখা বা পৌঁছানো হয় সে সেই অবস্থান সাপেক্ষ বিচারযোগ্য হবে। প্রত্যেকে নিজ স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষতার প্রয়োগের জন্য দায়ী হবে, তার উপর অনিবার্যভাবে আরোপিত পরিস্থিতির জন্য নয়।

মুশরিকদের দাবির (আল্লাহর ইচ্ছায় তারা শিরক করছে) জবাব

৬:১৪৮-১৪৯ :: যারা শিরক করেছে তারা বলবে, “যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে আমরা ও আমাদের পূর্বপুরুষগণ শিরক করতাম না এবং কোনো কিছুই হারাম করতাম না।” এভাবে তাদের পূর্ববর্তীগণও মিথ্যারোপ করেছিলো। অবশেষে তারা আমার শাস্তি ভোগ করেছিলো। বলো, “তোমাদের নিকট কোনো জ্ঞান আছে কি? থাকলে তা আমার নিকট পেশ করো। তোমরা তো শুধু কল্পনারই অনুসরণ করো এবং শুধু মনগড়া কথা বলো।” বলো, “চূড়ান্ত যুক্তিপ্রমাণ তো আল্লাহরই আয়ত্তে। যদি তিনি ইচ্ছা করতেন, তাহলে অবশ্যই তোমাদের সকলকে হিদায়াত দান করতেন।”

৪৩:২০-২১ :: তারা বলে, “যদি দয়াময় (আল্লাহ) ইচ্ছা করতেন তাহলে আমরা তাদের (ফেরেশতাদের) ইবাদাত করতাম না।” এ বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। তারা তো কেবল মনগড়া কথা বলে। আমি কি তাদেরকে কুরআনের পূর্বে কোনো কিতাব দিয়েছি যা তারা দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছে? বরং তারা বলে, “আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি এক মতাদর্শের অনুসারী এবং আমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।”

১৬:৩৫-৩৬ :: মুশরিকরা বলবে, “যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে আমরা ও আমাদের পূর্বপুরুষরা তাঁর ছাড়া কারো ইবাদাত করতাম না এবং তাঁকে ছাড়া (তাঁর বিধানের বাইরে) কোনো কিছুকে হারাম করতাম না।” তাদের পূর্ববর্তীরাও এরূপই করতো। তবে কি স্পষ্ট প্রচার ছাড়া রসূলদের কোনো দায়িত্ব আছে? আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং পরিহার কর তাগূতকে। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ কাউকে হিদায়াত দিয়েছেন এবং তাদের মধ্য থেকে কারো উপর পথভ্রষ্টতা সাব্যস্ত হয়েছে। সুতরাং তোমরা যমীনে ভ্রমণ কর অতঃপর দেখ, অস্বীকারকারীদের পরিণতি কীরূপ হয়েছে।

৩৬:৪৭ :: যখন তাদেরকে বলা হয়, “আল্লাহ তোমাদেরকে যে জীবনোপকরণ দিয়েছেন তা থেকে ব্যয় করো।” তখন কাফিরগণ মু’মিনগণকে বলে, “আমরা কি তাদেরকে খাওয়াবো, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে যাদেরকে তিনিই খাওয়াতেন? তোমরা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছো।”

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে-

১. আরবের মুশরিকরা আল্লাহর ইচ্ছায় সবকিছু সংঘটিত হওয়ার বিষয় বিশ্বাস করতো এবং আল্লাহকে রহমান (দয়াময়) হিসেবে উল্লেখ করতো, তা সত্ত্বেও তারা মুশরিক।

২. তারা শিরক করার জন্য আল্লাহর ইচ্ছার দোহাই দিতো। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করতো যে, সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। তাই তারা শিরক করছে আল্লাহর ইচ্ছায়। সুতরাং শিরক করার জন্য তাদেরকে দায়ী করা যায় না। কারণ আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে শিরক থেকে বিরত রাখতে পারতেন। অর্থাৎ (ক) আল্লাহই ইচ্ছা করে তাদেরকে শিরক করিয়ে নিচ্ছেন, অথবা (খ) আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে শিরক থেকে বিরত রাখতেন এবং তারা শিরক করতো না। যেহেতু আল্লাহ তাদেরকে শিরক থেকে বিরত রাখেন নি, সুতরাং আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন যে, তারা শিরক করুক।

৩. আরবের মুশরিকরা শিরক করার পক্ষে তাদের ভাগ্য বিশ্বাসকে উল্লেখ করতো যে, তারা ও তাদের পূর্বপুরুষরা আল্লাহর ইচ্ছাক্রমেই শিরক করতো, তাই এজন্য তারা দায়ী হতে পারে না। অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে, তারা তাদের পূর্বপুরুষদেরকে যে মতাদর্শে পেয়েছে তারা স্বেচ্ছায় ঐ মতাদর্শকে গ্রহণ করে নিয়েছে, এজন্য আল্লাহ তাদেরকে নির্দেশও দেন নি, বাধ্যও করেন নি। সুতরাং তাদের ভাগ্য বিশ্বাস একটি বিভ্রান্তি এবং তাই ভাগ্যের দোহাই দেয়া সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তাদের ধারণাকে জ্ঞান ছাড়া নিছক আন্দায-অনুমানের অনুসরণ, মনগড়া বিষয় এবং মিথ্যারোপ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

৪. পূর্ববর্তী যুগে তাদের পিতৃপুরুষরাও অনুরূপ বিভ্রান্তিকর ধারণা পোষণ করতো।

৫. ভাগ্যের দোহাই দিয়ে তারা তাদের নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালনেও অস্বীকৃতি জানাতো। যেমন: তারা দাবি করতো যে, যারা অভাবগ্রস্ত রয়েছেন এটাই তাদের ভাগ্য, চাইলে আল্লাহই তাদেরকে খাওয়াতেন। যেহেতু তিনি তাদেরকে অভাবগ্রস্ত রেখেছেন, তাই এখানে কারো কিছু করণীয় নেই। ভাগ্য বিশ্বাসকে সঠিক ধরে নিয়ে তারা নৈতিক কর্তব্য সম্পাদনের নির্দেশকে বিভ্রান্তি হিসেবে দাবি করেছে। প্রকৃতপক্ষে নৈতিক কর্তব্য পালনের নির্দেশ যথার্থ এবং ভাগ্য বিশ্বাসই বিভ্রান্তি।

“আল্লাহ চাইলে আমরা শিরক করতাম না” এবং “আল্লাহ চাইলে তারা শিরক করতো না”- বক্তব্যদ্বয়ের প্রসঙ্গ-কাঠামোগত ভিন্নার্থ : একটি বাহ্যিক স্ববিরোধের অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্য

৬:১০৭ :: আর যদি আল্লাহ চাইতেন (বাধ্য করতেন), তারা শির্‌ক করত না এবং আমি তোমাকে তাদের উপর হিফাযতকারী বানাইনি। আর তুমি তাদের উপর কর্মবিধায়ক নও।

উপরোল্লেখিত আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, “আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা শিরক করতো না।” এটি আল্লাহর বক্তব্য। সুতরাং এটি একটি চূড়ান্ত সত্য।

অন্যদিকে পূর্বে উল্লেখিত কিছু আয়াতে আমরা দেখেছি যে, মুশরিকরা দাবি করেছে যে, “আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমরা শিরক করতাম না।” আয়াতগুলোতে মুশরিকদের ধারণা ও দাবিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং বিভ্রান্তি ও মিথ্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাহ্যত দেখা যায় যে, একই কথাকে একবার সত্য এবং আরেকবার মিথ্যা হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ বাহ্যত এ দুটি কথার মধ্যে স্ববিরোধ রয়েছে। অথচ কুরআনে স্ববিরোধ নেই। তাহলে এই বাহ্যিক স্ববিরোধের প্রকৃত তাৎপর্য কী? অথবা এর মধ্যে অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্য কী? নিম্নে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হলো।

যখন মুশরিকরা নিজেদের শিরকের বিষয়ে বলে যে, “আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমরা শিরক করতাম না।” তখন তাদের এ কথাটি প্রসঙ্গ-কাঠামো অনুসারে যে তাৎপর্য বহন করে তা হলো : তারা শিরক করার কারণ হিসেবে আল্লাহর ইচ্ছাকে দায়ী করছে। অর্থাৎ তারা বলতে চাচ্ছে যে, “আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন যে, তারা শিরক করুক, আর তাই তারা শিরক করছে”। অন্য কথায়, তারা শিরকের দায় নিতে চাচ্ছে না, বরং তারা বুঝাতে চাচ্ছে যে, তারা বাধ্য হয়েই শিরক করছে। সুতরাং তাদেরকে শিরক ত্যাগ করার আহবান করার কোনো মানে নেই। যেহেতু আল্লাহর ইচ্ছায় শিরক করছে, সেহেতু আল্লাহ চাইলে তারা শিরক করবে না, এক্ষেত্রে কোনো দাওয়াতের কোনো প্রভাব থাকা সম্ভব নয়। এজন্য তাদেরকে দাওয়াত দেয়া না দেয়া উভয়ই সমান। এভাবে তাদের বক্তব্যের উদ্দেশ্য হলো, দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করা।

আর যেখানে বলা হয়েছে যে, “আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা শিরক করতো না।” সেখানে বাক্যটি প্রসঙ্গ-কাঠামো অনুসারে যে তাৎপর্য বহন করে তা হলো : যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে তাদেরকে শিরক না করার ক্ষেত্রে বাধ্য করতে পারতেন, জোর করে শিরক থেকে বিরত রাখতে পারতেন, সেক্ষেত্রে তারা শিরক করতো না। কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে বাধ্য করেন নি, বরং ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাই তিনি তাদেরকে জোর করে শিরক থেকে মুক্ত রাখেন না। বরং তারা শিরক থেকে বিরত থাকলে নিজ ইচ্ছাতেই বিরত থাকবে, আর শিরক করলে নিজ ইচ্ছাতেই করবে।

আবার এ ইচ্ছার স্বাধীনতার বিষয়টি জীবনের এমন ক্ষেত্রের সাথে সম্পর্কিত যেক্ষেত্রে তাদেরকে দেয়া এই ইচ্ছার স্বাধীনতায় অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। কিন্তু ইচ্ছার স্বাধীনতা সত্ত্বেও যদি কেউ সমাজে সামাজিক অনাচারের ইচ্ছা করে, তবে সেক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তাতে হস্তক্ষেপ করা বা তাদেরকে শাস্তি প্রদান করার অধিকার অন্যদের রয়েছে। সুতরাং ধর্মীয় বিষয় এবং সামাজিক বিষয়ে ইচ্ছার স্বাধীনতার প্রয়োগের ক্ষেত্রে অন্যদের কর্তৃক বাধার সম্মুখিন হতে হবে কিনা তা পরস্পর ভিন্ন বিষয়।

সুতরাং মুশরিকদের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা তাদের শিরকের জন্য নিজেদেরকে দায়ী মনে করে না, বরং আল্লাহকেই দায়ী করে। বস্তুত মুশরিকদের এই মতবাদই ভাগ্যবাদ বা বলা যায় ভাগ্যবাদ মুশরিকদেরই মতবাদ। ভাগ্যবাদে মানুষকে স্রষ্টার পুতুল খেলার পুতুল রূপে উপস্থাপন করা হয়- “ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ, যেমনি নাচাও তেমনি নাচি পুতুলের কী দোষ!”।

‘আল্লাহর ইচ্ছা’ বিষয়টিকে কোনো ঘটনার জন্য ‘ভাগ্যবাদ’ বুঝাতে প্রয়োগের কিছু দৃষ্টান্ত হচ্ছে, “এমনটি ঘটেছে কারণ এটাই আল্লাহর ইচ্ছা ছিলো”, “আল্লাহ না চাইলে এমনটি হতো না বা আল্লাহ চেয়েছেন বলেই এমনটি হয়েছে”, “যা হয়েছে আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে” ইত্যাদি। আর এ ধরনের কথা যারা বলে তাদেরকেই বেশি ধার্মিক ও আল্লাহপ্রেমী মনে করা হয়। অথচ এ ধরনের কথার পেছনে যে ভাগ্যবাদ প্রচার করা হয়, কুরআন সেটাকে অজ্ঞতা হিসেবে চিহ্নিত করে।

সুতরাং তারা যখন বলে যে, “আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমরা শিরক করতাম না।” এবং যখন আল্লাহ বলেন যে, “আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা শিরক করতো না।” তখন এটাকে বাহ্যত একই বিষয়ে পরস্পর ভিন্ন দুটি বক্তব্য মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে দুই স্থানে বক্তব্য দুটি ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য প্রকাশ করে। আর এই তাৎপর্যগত ভিন্নতার কারণে এতে স্ববিরোধ নেই, বরং অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্য আছে। কোনো বাক্যের অর্থ শুধুমাত্র তার বাহ্যিক শব্দবিন্যাস দিয়ে হয় না, বরং তার প্রসঙ্গ-কাঠামোও তার অর্থ নির্ধারণের অন্যতম প্রভাবক হয়ে থাকে।

পরিশেষে বলা যায়, মুশরিকদের উক্তিটি ভাগ্যবাদের সমার্থক এবং মুশরিকদেরকে শিরক থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে বাড়াবাড়ি না করার জন্য তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহর উক্তিটি তাক্বদীরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভাগ্যবাদ এবং কুরআনে উল্লেখিত তাক্বদীর একটি অন্যটির সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা।

আল্লাহর অনুমতি

 আল্লাহর অনুমতি সম্পর্কিত আয়াতসমূহ

২:৯৭ :: বলো, “যে জিবরীলের শত্রু হবে, তবে নিশ্চয় সে (জিবরীল) তোমার অন্তরে তা অবতীর্ণ করেছে আল্লাহর অনুমতিক্রমে। তার সামনে থাকা কিতাবের সমর্থক, হিদায়াত ও মুমিনদের জন্য সুসংবাদরূপে।”

২:১০২ :: আর তারা অনুসরণ করেছে, যা শয়তানরা সুলাইমানের রাজত্বে পাঠ করত। আর সুলাইমান কুফরী করেনি; বরং শয়তানরা কুফরী করেছে। তারা মানুষকে যাদু শেখাত এবং (তারা অনুসরণ করেছে) যা নাযিল করা হয়েছিল বাবেলের দুই ফেরেশতা হারূত ও মারূতের উপর। আর তারা কাউকে শেখাত না যে পর্যন্ত না বলত যে, ‘আমরা তো পরীক্ষা, সুতরাং তোমরা কুফরী করো না। এরপরও তারা এদের কাছ থেকে শিখত, যার মাধ্যমে তারা পুরুষ ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাত। অথচ তারা তার মাধ্যমে কারো কোন ক্ষতি করতে পারত না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। আর তারা শিখত যা তাদের ক্ষতি করত, তাদের উপকার করত না এবং তারা অবশ্যই জানত যে, যে ব্যক্তি তা ক্রয় করবে, আখিরাতে তার কোন অংশ থাকবে না। আর তা নিশ্চিতরূপে কতই-না মন্দ, যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে। যদি তারা জানত।

২:২১৩ :: মানুষ ছিল এক উম্মত। অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে নবীদেরকে প্রেরণ করলেন এবং সত্যসহ তাদের সাথে কিতাব নাযিল করলেন, যাতে মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত। আর তারাই তাতে মতবিরোধ করেছিল, যাদেরকে তা দেয়া হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষবশত। অতঃপর আল্লাহ নিজ অনুমতিতে মুমিনদেরকে হিদায়াত দিলেন যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছিল। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন।

২:২২১ :: আর তোমরা মুশরিক নারীদের বিয়ে করো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে এবং মুমিন দাসী মুশরিক নারীর চেয়ে নিশ্চয় উত্তম, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে। আর মুশরিক পুরুষদের সাথে বিয়ে দিয়ো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। আর একজন মুমিন দাস একজন মুশরিক পুরুষের চেয়ে উত্তম, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে। তারা তোমাদেরকে আগুনের দিকে আহবান করে, আর আল্লাহ তাঁর অনুমতিতে তোমাদেরকে জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহবান করেন এবং মানুষের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ স্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।

২:২৪৯ :: অতঃপর যখন তালূত সৈন্যবাহিনী নিয়ে বের হলো, তখন সে বললো, “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে একটি নদী/ঝর্ণা দ্বারা পরীক্ষা করবেন। সুতরাং যে তা হতে পান করবে, সে আমার দলভুক্ত নয়। আর যে তার স্বাদ নেবে না, তাহলে নিশ্চয় সে আমার দলভুক্ত। তবে যে তার হাত দিয়ে এক কোষ নেবে, সে ছাড়া (অর্থাৎ তার দোষ ধরা হবে না)।” তারপর তা থেকে তারা (তৃপ্তি সহকারে) পান করেছে, তাদের মধ্য থেকে অল্পসংখ্যক ব্যক্তি ব্যতীত। তারপর যখন সে ও তার সাথি মুমিনগণ তা অতিক্রম করলো, তারা বললো, “আজ আমাদের জালূত ও তার সৈন্যবাহিনীর সাথে (যুদ্ধ করার) কষ্টসাধ্য সক্ষমতাও নেই।” যারা দৃঢ় ধারণা রাখতো যে, তারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতকারী হবে, তারা বললো, “কত ছোটো ছোটো দল বিজয়ী হয়েছে বড়ো বড়ো দলের উপর, আল্লাহর অনুমতিক্রমে! আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন।”

২:২৫১ :: তারপর তারা (তালুত ও তার সেনাবাহিনী) তাদেরকে (জালুত ও তার সেনাবাহিনীকে) পরাজিত করলো, আল্লাহর অনুমতিক্রমে; আর দাঊদ জালূতকে হত্যা করলো। আর আল্লাহ তাকে (দাঊদকে) রাজত্ব ও প্রজ্ঞা দান করলেন এবং তাকে শিক্ষা দিলেন, যা তিনি (শিক্ষা দেয়ার) ইচ্ছা করলেন। আর আল্লাহ যদি মানুষের কতককে কতকের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে অবশ্যই পৃথিবী ফাসাদপূর্ণ হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর উপর অনুগ্রহশীল।

২:২৫৫ :: আল্লাহ! তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি স্বাধীন ও নিত্য নতুন ধারক, সব কিছুর ধারক। তন্দ্রা ও নিদ্রা তাঁকে স্পর্শ করেনা। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু রয়েছে সবই তাঁর। কে আছে এমন, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে? সম্মুখের অথবা পশ্চাতের সবই তিনি অবগত আছেন। একমাত্র তিনি যতটুকু ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত, তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ত করতে পারেনা। তাঁর আসন আসমান ও যমীন ব্যাপী হয়ে আছে এবং এতদুভয়ের সংরক্ষণে তাঁকে বিব্রত হতে হয়না। তিনিই সর্বোচ্চ, মহীয়ান।

৩:৪৯ :: আর (সে হবে) একজন রসূল, বানী ইসরাইলের প্রতি। (ঈসা বানী ইসরাইলের নিকট রসূল হিসাবে উপস্থিত হওয়ার পর বলেছে) আমি নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত আয়াতসহ। আমি গঠন করবো তোমাদের জন্য কাদামাটি থেকে পাখির কাঠামোসদৃশ, তারপর উহার মধ্যে ফুঁকে দেবো, সুতরাং উহা হয়ে যাবে পাখি, আল্লাহর অনুমতিক্রমে। আর আমি সুস্থ করবো অন্ধকে ও কুষ্ঠ রোগগ্রস্তকে, আর আমি মৃতকে জীবিত করবো, আল্লাহর অনুমতিক্রমে। আর আমি তোমাদের কাছে ব্যক্ত করবো কী পরিমানে তোমরা খাবে আর কী পরিমাণে তোমরা মজুদ রাখবে তোমাদের ঘরসমূহে। নিশ্চয় উহার মধ্যে আছে তোমাদের জন্য নিদর্শন, যদি তোমরা হও বিশ্বাসী।

৩:১৪৫ :: আর কোনো প্রাণীর জন্য আল্লাহর অনুমতি (আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মের কার্যকারিতা) ছাড়া মৃত্যুবরণ করা সম্ভব নয়, (যেই অনুমতি) আয়ুসীমা নির্ধারণকৃত কিতাব হিসেবে রয়েছে। আর যে ইচ্ছা করে দুনিয়ার প্রতিফল পেতে আমরা তাকে দিই তা থেকে (দুনিয়া থেকে)। আর যে ইচ্ছা করে আখিরাতের প্রতিফল পেতে আমরা তাকেও দিই তা থেকে (আখিরাতের পুরস্কারের পাশাপাশি দুনিয়া থেকে)। আর শীঘ্রই আমরা কৃতজ্ঞদেরকে (কৃতজ্ঞতার) প্রতিফল দেবো।

৩:১৫২ :: আর নিশ্চয় আল্লাহ সত্যে পরিণত করেছেন তাঁর ওয়াদা যখন তোমরা (উহুদ যুদ্ধে) তাদেরকে বিনাশ করছিলে, তাঁর অনুমতিক্রমে, যতক্ষণ না তোমরা ছত্রভঙ্গ/নড়বড়ে হয়ে গেছো আর তোমরা মতবিরোধ করেছো (ঐ পরিস্থিতিতে) তোমাদের কাজের ব্যাপারে আর তোমরা অবাধ্যতা করেছো উহার পর যা তিনি তোমাদেরকে দেখিয়েছেন যা তোমরা ভালোবাসো। তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোক আছে যারা ইচ্ছা করে দুনিয়া পেতে আর তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোক আছে যারা ইচ্ছা করে আখিরাত পেতে। তারপর তিনি তোমাদেরকে সরিয়ে দিয়েছেন তাদের (প্রতিরোধ করা) থেকে (বা তোমরা সাময়িকভাবে পরাজিত হয়েছো), তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। আর (তোমরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারায়) নিশ্চয় শেষ পর্যন্ত তিনি উদারতা দেখিয়েছেন তোমাদের প্রতি। আর আল্লাহ মু’মিনদের উপর অনুগ্রহশীল ।

৩:১৬৫-১৬৬ :: কি হলো যখন তোমরা মুসিবতগ্রস্ত হয়েছো, (অথচ) নিশ্চয় (আগের বদর যুদ্ধে) তোমরা তাদের উপর ঘটিয়েছিলে উহার দ্বিগুণ মুসিবত, (তবুও) তোমরা বলেছো, ‘এটা কোথা থেকে এলো?’ বলো, ‘উহা তোমাদের নিজেদের নিকট থেকে (তোমাদের কার্যকলাপের কারণে)। নিশ্চয় আল্লাহ সকল সত্তা ও বিষয়ের উপর প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণকারী ও সর্বশক্তিমান নিয়ন্ত্রণকারী। আর তোমাদের উপর যে বিপদ এসেছিল দুই দল মুখোমুখি হওয়ার দিন তা আল্লাহর অনুমতিক্রমে এবং যাতে তিনি মুমিনদেরকে জেনে নেন।

৪:৬৪ :: আর আমি যে কোন রাসূল প্রেরণ করেছি তা কেবল এ জন্য, যেন আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদের আনুগত্য করা হয়। আর যদি তারা- যখন নিজদের প্রতি যুলম করেছিল তখন তোমার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইত এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইত তাহলে অবশ্যই তারা আল্লাহকে তাওবা কবূলকারী, দয়ালু পেত।

৫:১৬ :: এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে শান্তির পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে এবং তাঁর অনুমতিতে তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেন। আর তাদেরকে সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন।

৫:১১০ :: যখন আল্লাহ বলবেন, ‘হে ঈসা ইবনে মারইয়াম, স্মরণ করো আমার নিয়ামত যা আমি তোমার উপর করেছি আর তোমার মায়ের উপর করেছি। যখন তোমাকে সাহায্য করেছি পবিত্র আত্মা (জিবরীল) এর মাধ্যমে। তুমি মানুষের সাথে যথাযথভাবে কথা বলেছো দোলনায় চড়া বাল্যবয়সে এবং পরিণত প্রৌঢ় বয়সে। আর যখন তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি কিতাব ও হিকমাত, আর তাওরাত ও ইনজীল। আর যখন তুমি গঠন করতে কাদামাটি থেকে পাখির কাঠামোসদৃশ আমার অনুমতিক্রমে। তারপর উহার মধ্যে ফুঁকে দিতে, যার ফলে উহা হয়ে যেতো পাখি আমার অনুমতিক্রমে। তুমি সুস্থ করতে অন্ধকে ও কুষ্ঠ রোগগ্রস্তকে আমার অনুমতিক্রমে। আর যখন তুমি মৃতকে (জীবিত করে) বের করতে আমার অনুমতিক্রমে। আর যখন আমি নিবৃত্ত করেছি বানী ইসরাইলকে তোমার (ক্ষতি করা) থেকে, যখন তুমি তাদের কাছে পৌঁছেছো স্পষ্ট প্রমাণসমূহসহ। তখন তাদের মধ্যকার যারা কুফর করেছে তারা বলেছে, ‘ইহা কিছু নয় প্রকাশ্য যাদু ছাড়া’।

৭:৫৮ :: আর উৎকৃষ্ট ভূমি বের করে তার ফসল তার রবের অনুমতিক্রমে। আর যা নিকৃষ্ট (ভূমি), কঠিন পরিশ্রম ছাড়া তা কোনো ফসল বের করে না (এবং তাতে সাধারণত প্রত্যাশিত মান ও পরিমাণের উৎপাদন হয় না)। এভাবেই আমরা কৃতজ্ঞ সম্প্রদায়ের জন্য আয়াতসমূহকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করি।

৮:৬৬ :: এখন আল্লাহ তোমাদের থেকে (দায়িত্বভার) হালকা করে দিয়েছেন এবং তিনি জানেন তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। অতএব যদি তোমাদের মধ্যে একশ’ জন ধৈর্যশীল থাকে, তারা দু’শ জনের উপর বিজয়ী হবে এবং যদি তোমাদের মধ্যে এক হাজার জন থাকে, তারা দু’হাজার জনের উপর বিজয়ী হবে; আল্লাহর অনুমতিক্রমে।  আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।

১০:৩ :: নিশ্চয় তোমাদের রব আল্লাহ। যিনি আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে, তারপর আরশে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি সব বিষয় পরিচালনা করেন। তার অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করার কেউ নেই। তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব। সুতরাং তোমরা তাঁর ইবাদাত কর। তারপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?

১০:৫৯ :: বল, ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ তোমাদের জন্য যে রিয্ক নাযিল করেছেন, পরে তোমরা তার কিছু বানিয়েছ হারাম ও হালাল’। বল, ‘আল্লাহ কি তোমাদেরকে অনুমতি দিয়েছেন, নাকি আল্লাহর উপর তোমরা মিথ্যা রটাচ্ছ’?

১০:১০০ :: আর কোনো ব্যক্তির জন্য আল্লাহর অনুমতি ছাড়া ঈমান আনা সম্ভব নয়। আর যারা সহজাত বিচারবুদ্ধি বা Common sense প্রয়োগ করে না, তিনি তাদের উপর কলুষতা চাপিয়ে দেন।

১১:১০৫ :: যেদিন তা আসবে সেদিন তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ কথা বলবে না। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে কেউ হবে (কর্মদোষে) ত্যক্ত-বিরক্ত/বিষণ্ন/দুর্ভাগা, আর কেউ হবে (কর্মগুণে) পুলকিত/প্রসন্ন/সৌভাগ্যবান।

১৩:৩৮ :: আর অবশ্যই তোমার পূর্বে আমি রাসূলদের প্রেরণ করেছি এবং তাদেরকে দিয়েছি স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি। আর কোন রাসূলের জন্য এটা সম্ভব নয় যে, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন নিদর্শন নিয়ে আসবে। প্রতিটি সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য রয়েছে লিপিবদ্ধ বিধান।

১৪:১ :: আলিফ-লাম-রা; এই কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আন, পরাক্রমশালী সর্বপ্রশংসিতের পথের দিকে।

১৪:১১ :: তাদেরকে তাদের রাসূলগণ বলল, ‘আমরা তো কেবল তোমাদের মতই মানুষ, কিন্তু আল্লাহ তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন। আর আল্লাহর অনুমতি ছাড়া তোমাদের কাছে প্রমাণ নিয়ে আসার সাধ্য আমাদের নেই। আর কেবল আল্লাহর উপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিত’।

১৪:২৩ :: আর যারা ঈমান আনে এবং নেক আমল করে তাদের জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, যার তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে, তারা তাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে স্থায়ী হবে। তথায় তাদের অভিবাদন হবে ‘সালাম’।

১৪:২৫ :: যা (যে গাছ) তার রবের অনুমতিতে সব সময় ফল দান করে; আর আল্লাহ মানুষের জন্য নানা দৃষ্টান্ত প্রদান করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।

১৬:৮৪ :: আর যেদিন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে সাক্ষী উত্থিত করব। তারপর যারা কুফরী করেছে, তাদেরকে (ওযর পেশের) অনুমতি দেয়া হবে না এবং (আল্লাহকে) সন্তুষ্ট করতেও তাদেরকে বলা হবে না।

২০:১০৯ :: দয়াময় যাকে অনুমতি দিবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ব্যতীত কারও সুপারিশ সেদিন কোন কাজে আসবেনা।

২২:৩৯ :: তাদেরকে (যুদ্ধের) অনুমতি দেয়া হলো যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে। কারণ, তাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম।

২২:৬৫ :: তুমি কি দেখোনি যে, আল্লাহ নিয়োজিত করে দিয়েছেন তোমাদের কল্যাণের জন্য, যা কিছু পৃথিবীর মধ্যে আছে আর নৌযানসমূহ যা চলাচল করে সমুদ্রের মধ্যে তাঁরই আদেশে? আর তিনিই আটকে রেখেছেন আকাশকে যেন না তা পতিত হয় পৃথিবীর উপর, তাঁর অনুমতি ছাড়া? (আল্লাহর অনুমতিক্রমেই আকাশে ধারণকৃত মেঘ থেকে বৃষ্টিপাত হয়)। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াশীল।

২৪:৩৬ :: সে সব ঘরে যাকে সমুন্নত করতে এবং যাতে তাঁর নাম স্মরণ করতে আল্লাহ্‌ অনুমতি দিয়েছেন, সকাল ও সন্ধ্যায় সেখানে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে-

৩৩:৪৬ :: আর আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারী ও আলোকদীপ্ত প্রদীপ হিসেবে।

৩৪:১২ :: আর সুলাইমানের জন্য আমি বাতাসকে অনুগত করে দিয়েছিলাম, যা সকালে এক মাসের পথ এবং সন্ধ্যায় এক মাসের পথ অতিক্রম করত। আর আমি তার জন্য গলিত তামার প্রস্রবণ প্রবাহিত করেছিলাম। আর কতিপয় জিন তার রবের অনুমতিক্রমে তার সামনে কাজ করত। তাদের মধ্যে যে আমার নির্দেশ থেকে বিচ্যুত হয় তাকে আমি জ্বলন্ত আগুনের আযাব আস্বাদন করাব।

৩৪:২৩ :: আর আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন সে ছাড়া তাঁর কাছে কোন সুপারিশ কারো উপকার করবে না। অবশেষে যখন তাদের অন্তর থেকে ভয় বিদূরিত হবে তখন তারা বলবে, ‘তোমাদের রব কী বলেছেন’? তারা বলবে, ‘যা সত্য তা’ এবং তিনি সুমহান ও সবচেয়ে বড়।

৩৫:৩২ :: অতঃপর আমি এ কিতাবটির উত্তরাধীকারী করেছি আমার বান্দাদের মধ্যে তাদেরকে, যাদেরকে আমি মনোনীত করেছি। তারপর তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি যুলমকারী এবং কেউ কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী। আবার তাদের কেউ কেউ আল্লাহর অনুমতিসাপেক্ষে কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী। এটাই হলো মহা অনুগ্রহ।

৪০:৭৮ :: আর অবশ্যই আমি তোমার পূর্বে অনেক রাসূল পাঠিয়েছি। তাদের মধ্যে কারো কারো কাহিনী আমি তোমার কাছে বর্ণনা করেছি আর কারো কারো কাহিনী তোমার কাছে বর্ণনা করিনি। আর আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন নিদর্শন নিয়ে আসা কোন রাসূলের পক্ষে সম্ভব নয়। তারপর যখন আল্লাহর নির্দেশ আসবে, তখন ন্যায়সঙ্গতভাবে ফয়সালা করা হবে। আর তখনই বাতিলপন্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

৪২:২১ :: তাদের জন্য কি এমন কিছু শরীক আছে, যারা তাদের জন্য দীনের বিধান দিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? আর ফয়সালার ঘোষণা না থাকলে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েই যেত। আর নিশ্চয় যালিমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব।

৪২:৫১ :: কোন মানুষের এ মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন, ওহীর মাধ্যম, পর্দার আড়াল অথবা কোন দূত পাঠানো ছাড়া। তারপর আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে তিনি যা চান তাই ওহী প্রেরণ করেন। তিনি তো মহীয়ান, প্রজ্ঞাময়।

৫৩:২৬ :: আর আসমানসমূহে অনেক ফেরেশতা রয়েছে, তাদের সুপারিশ কোনই কাজে আসবে না। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন এবং যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট, তার ব্যাপারে অনুমতি দেয়ার পর।

৫৮:১০ :: বস্তুত গোপন পরামর্শ করা হয় শয়তানের পক্ষ থেকে তাদেরকে চিন্তিত করার জন্য যারা ঈমান এনেছে। আর সে তাদের ক্ষতি করতে পারবে না কিছুমাত্রও, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। আর আল্লাহরই উপর মু’মিনগণ ভরসা করা উচিত।

৫৯:৫ :: (রণকৌশল স্বরূপ) তোমরা যেসব খেজুর গাছ কেটে ফেলেছো অথবা সেগুলোকে মূল/শিকড়গুলোর উপর দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে দিয়েছো, তা তো আল্লাহর অনুমতিক্রমেই হয়েছে; আর (তা হয়েছে) তিনি ফাসেকদেরকে লাঞ্চিত করার জন্য।

৬৪:১১ :: আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো বিপদ-মুসিবত আপতিত হয় না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে তিনি তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালনা করেন। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞানী।

৭৭:৩৬ :: এবং তাদেরকে ওযর পেশ করার অনুমতি দেয়া হবেনা।

৭৮:৩৮ :: সেদিন রূহ (জিবরীল) ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে, যাকে পরম দয়াময় অনুমতি দেবেন সে ছাড়া অন্যরা কোন কথা বলবে না। আর সে সঠিক কথাই বলবে।

৯৭:৪ :: উহাতে (লাইলাতুল কদরে) নাজিল হয় ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরীল) তাদের রবের অনুমতি নিয়ে, প্রত্যেক দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে।

অনুমতির প্রকারভেদ ও আল্লাহর অনুমতির তাৎপর্য

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহে আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কিত আয়াতসমূহের মতো একই ধরনের বক্তব্য রয়েছে, যাতে বিভিন্ন বিষয় আল্লাহর অনুমতিক্রমে হওয়ার কথা বা কোনো বিষয় আল্লাহর অনুমতি ছাড়া না হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

মানুষ হিসেবে আমাদের মন, চিন্তাভাবনা সবসময় তুলনামূলক বা উদাহরণমূলক চিন্তা করতে পারে। আমি যদি একটি অপরিচিত ফলের বর্ণনা নিজেকে বা অন্যকে দিতে চাই যে ফলটি হয়তো আমি নিজে পূর্বে কখনো দেখিনি বা খাইনি, তাহলে আমরা সবসময়েই নতুন ফলটি বর্ণনা করতে গেলে তুলনা বা উদাহরণের সহায়তা নিতে বাধ্য হবো। যেমন: এই ফলটি দেখতে অনেকটা কাঠালের মতো বা পাকলে এটি খেতে আমের মতো। লক্ষ্যনীয় যে তুলনা বা উদাহরণ ছাড়া আমরা একটা কনসেপ্টকে বা ধারনাকে সঠিকভাবে ব্রেইনে ধারণ করতে পারি না। এটা ভাষায় বর্ণনা করতে গেলে আমাদের তুলনা বা উদাহরণে যেতে হয়। এই প্রেক্ষিতে আমরা ‘আল্লাহর ইচ্ছা’ বা ‘আল্লাহর অনুমতি’ বিষয়টিকে বুঝতে হলে আমাদেরকে ইচ্ছা বা অনুমতির বিভিন্ন ধরনের উদাহরণ অনুসারে বুঝতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর অনুমতির তাৎপর্য সম্পর্কে বুঝতে হলে ‘অনুমতির প্রকারভেদ’ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।

অনুমতিকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, যথা-

১. অতাৎক্ষণিক অনুমতি

২. তাৎক্ষণিক অনুমতি

যদি কেউ একজনের কাছে কোনো কিছু দিয়ে বলে যে, “যদি এই ধরনের লোক এসে তোমার কাছে এটা চায় তাহলে তুমি তাকে তা দিতে পারো।”; আর এর দীর্ঘ অনেক দিন পরে যদি ঐ ধরনের কোনো ব্যক্তি তার কাছে এসে তা চায় এবং সে পূর্বে দেয়া অনুমতির ভিত্তিতে তাকে তা দেয়, তাহলে সে এটা অতাৎক্ষণিক অনুমতি অনুসারে তাকে দিলো। অন্যদিকে তাৎক্ষণিক অনুমতি কর্ম সম্পাদনের ঠিক পূর্ব মুহুর্তে চাওয়া হয় বা দেওয়া হয়।

আল্লাহর অতাৎক্ষণিক অনুমতি হলো আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইনে থাকা অবকাশ বা তাঁর অবতীর্ণ বিধান অনুসারে প্রাপ্ত অনুমতি। এ বিষয়ে নিম্নে কিছু উদাহরণ দেয়া হলো :

১। আল্লাহর অনুমতিক্রমে ঈমান

১০:৯৯-১০০ :: আর যদি তোমার রব চাইতেন, তবে যমীনের সকলেই ঈমান আনত। তবে কি তুমি মানুষকে বাধ্য করবে, যাতে তারা মুমিন হয় ? আর কোনো ব্যক্তির জন্য আল্লাহর অনুমতি ছাড়া ঈমান আনা সম্ভব নয়। আর যারা সহজাত বিচারবুদ্ধি বা Common sense প্রয়োগ করে না, তিনি তাদের উপর কলুষতা চাপিয়ে দেন।

আলোচনা : এ আয়াতের বক্তব্য হলো, যদি কাউকে ঈমান আনতে বাধ্য করার হতো, তাহলে আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা সবাই ঈমান আনতে বাধ্য হতো। কিন্তু আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন যে, তারা ঈমান আনতে বাধ্য নয়, বরং তারা স্বেচ্ছায় ঈমান আনতে হবে। এমতাবস্থায় তাদের পক্ষে স্বেচ্ছায় ঈমান আনার কোনো বিকল্প নেই। তাদের পক্ষে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া ঈমান আনা সম্ভব নয়। আর এ অনুমতির অর্থ হলো, ঈমান আনার শর্ত পূরণ করা। সেই শর্ত হলো, বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করা। যারা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করবে না, তাদের পক্ষে কোনটি যৌক্তিক বিশ্বাস তা নির্ণয় করা সম্ভব হবে না এবং তাই সঠিক তথ্যকে সঠিক হিসেবে বিশ্বাস করাও সম্ভব হবে না, তারা যতই ঈমানের দাবি করুক না কেন। বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ না করলে তাদের উপর পথভ্রষ্টতা চেপে বসবে। তারা ভিত্তিহীনভাবে ঈমান আনবে বা ঈমান ত্যাগ করবে এবং উভয়টি সমান, যা তাদের পথভ্রষ্টতা ছাড়া কিছু নয়।

২। আল্লাহর অনুমতিক্রমে বৃষ্টিপাত

২২:৬৫ :: তুমি কি দেখোনি যে, আল্লাহ নিয়োজিত করে দিয়েছেন তোমাদের কল্যাণের জন্য, যা কিছু পৃথিবীর মধ্যে আছে আর নৌযানসমূহ যা চলাচল করে সমুদ্রের মধ্যে তাঁরই আদেশে? আর তিনিই আটকে রেখেছেন আকাশকে যেন না তা পতিত হয় পৃথিবীর উপর, তাঁর অনুমতি ছাড়া? (আল্লাহর অনুমতিক্রমেই আকাশে ধারণকৃত মেঘ থেকে বৃষ্টিপাত হয়)। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াশীল।

আলোচনা : মেঘ থেকে বৃষ্টিপাত বা বৃষ্টিচক্র আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই প্রাকৃতিক আইনের অনুসন্ধান ও সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে বর্তমানে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত সম্ভব হচ্ছে।

৩। আল্লাহর অনুমতিক্রমে ফসল উৎপাদন

৭:৫৮ :: আর উৎকৃষ্ট ভূমি বের করে তার ফসল তার রবের অনুমতিক্রমে। আর যা নিকৃষ্ট (ভূমি), কঠিন পরিশ্রম ছাড়া তা কোনো ফসল বের করে না (এবং তাতে সাধারণত প্রত্যাশিত মান ও পরিমাণের উৎপাদন হয় না)। এভাবেই আমরা কৃতজ্ঞ সম্প্রদায়ের জন্য আয়াতসমূহকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করি।

আলোচনা : আয়াতটিতে কৃষি-জমির উর্বরতা সম্পর্কিত প্রাকৃতিক আইনে থাকা অবকাশ অনুসারে ভালো ফসল হওয়াকে উৎকৃষ্ট জমি আল্লাহর অনুমতিক্রমে ফসল বের করা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

৪। আল্লাহর অনুমতিক্রমে যুদ্ধ ও কিছু গাছ কর্তন

২২:৩৯ :: তাদেরকে (যুদ্ধের) অনুমতি দেয়া হলো যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে। কারণ, তাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম।

৫৯:৫ :: (রণকৌশল স্বরূপ) তোমরা যেসব খেজুর গাছ কেটে ফেলেছো অথবা সেগুলোকে মূল/শিকড়গুলোর উপর দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে দিয়েছো, তা তো আল্লাহর অনুমতিক্রমেই হয়েছে; আর (তা হয়েছে) তিনি ফাসেকদেরকে লাঞ্চিত করার জন্য।

আলোচনা : যেহেতু আল্লাহ প্রতিরক্ষার্থে যুদ্ধের অনুমতি দিয়েছেন, আর সেই অনুমতি নির্দিষ্ট স্থান-কাল-পাত্রে অতীত হয়ে যাবে না, বরং যতবারই এরূপ পরিস্থিতি তৈরি হবে ততবারই প্রয়োজনীয় শর্তের পরিপ্রেক্ষিতে ঐ অনুমতি বহাল থাকবে, তাই যুদ্ধকৌশলের অংশ হিসেবে কোনো কাজ করলে তা আল্লাহর অনুমতিক্রমে বলেই সাব্যস্ত হবে।

৫। আল্লাহর অনুমতিক্রমে যুদ্ধে বিজয়

৮:৬৬ :: এখন আল্লাহ তোমাদের থেকে (দায়িত্বভার) হালকা করে দিয়েছেন এবং তিনি জানেন তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। অতএব যদি তোমাদের মধ্যে একশ’ জন ধৈর্যশীল থাকে, তারা দু’শ জনের উপর বিজয়ী হবে এবং যদি তোমাদের মধ্যে এক হাজার জন থাকে, তারা দু’হাজার জনের উপর বিজয়ী হবে; আল্লাহর অনুমতিক্রমে।  আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।

আলোচনা : আয়াতটিতে মু’মিনদের মধ্যে সবরের গুণসম্পন্ন একশত মু’মিন দুইশত কাফিরের উপর এবং অনুরূপভাবে এক হাজার মু’মিন দুই হাজার কাফিরের উপর বিজয়ী হতে পারবে বলে জানানো হয়েছে। আর তা হবে আল্লাহর অনুমতিক্রমে। এক্ষেত্রে আল্লাহর অনুমতি বলতে সৈন্যসংখ্যা এবং ঈমান ও সবরের তারতম্যের বিষয়টি ছাড়া সাধারণ যুদ্ধ উপকরণ ও যুদ্ধ কৌশলের ক্ষেত্রে যুদ্ধ জয়ের প্রাকৃতিক আইনে থাকা অবকাশকে বুঝায়।

৬। আল্লাহর অনুমতিক্রমে শয়তানের চক্রান্তের ক্ষতি ও তা প্রতিরোধ

৫৮:১০ :: বস্তুত গোপন পরামর্শ করা হয় শয়তানের পক্ষ থেকে তাদেরকে চিন্তিত করার জন্য যারা ঈমান এনেছে। আর সে তাদের ক্ষতি করতে পারবে না কিছুমাত্রও, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। আর আল্লাহরই উপর মু’মিনগণ ভরসা করা উচিত।

আলোচনা : অর্থাৎ যখন মু’মিনরা আল্লাহর উপর ভরসা করবে তথা আল্লাহর বিধানকে নিজেদের জন্য আবশ্যকীয় হিসেবে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে তখন শয়তানের পক্ষে তাদের কোনো ক্ষতি করা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে যখন তারা আল্লাহর বিধানের উপর নির্ভর করবে না, তখন তাদের উপর শয়তানি শক্তি কাজ করতে পারবে বা তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে। এটাই তাদেরকে শয়তান ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারার বিষয়ে অনুমতি।

৭। আল্লাহর অনুমতিক্রমে বিপদ-মুসিবত

৬৪:১১ :: আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো বিপদ-মুসিবত আপতিত হয় না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে তিনি তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালনা করেন। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞানী।

আলোচনা : যারা আল্লাহর বিধানে দৃঢ় বিশ্বাসী তাদের অন্তর সঠিক পথে পরিচালিত হয়। অর্থাৎ যেহেতু আল্লাহ সর্বজ্ঞ আর তাই আল্লাহর বিধান থেকেই সঠিক পথনির্দেশ পাওয়া যায়, তাই যারা তা অনুসরণ করে তারা ভালো সম্ভাবনাকে অর্জন করতে পারে। মানুষের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের কারণে তার উপর বিপদ আপতিত হয়। কিন্তু যদি সে তার ভুলকে সংশোধন করে নিতে পারে, তাহলে সে চূড়ান্ত বিপদাপদ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। সুতরাং আল্লাহর অনুমতিক্রমে বিপদ আসার অর্থ হলো, নিজেদের ত্রুটির কারণে বিপদ আসা। অন্য কথায়, যেক্ষেত্রে প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী ত্রুটি হবে, সেক্ষেত্রে তার ফলাফলরূপে বিপদ আসবে। এটাই বিপদ সম্পর্কিত অনুমতি। এ বিষয়ে নিম্নের আয়াতগুলো প্রণিধানযোগ্য।

৩:১৫২ :: আর নিশ্চয় আল্লাহ সত্যে পরিণত করেছেন তাঁর ওয়াদা যখন তোমরা (উহুদ যুদ্ধে) তাদেরকে বিনাশ করছিলে, তাঁর অনুমতিক্রমে, যতক্ষণ না তোমরা ছত্রভঙ্গ/নড়বড়ে হয়ে গেছো আর তোমরা মতবিরোধ করেছো (ঐ পরিস্থিতিতে) তোমাদের কাজের ব্যাপারে আর তোমরা অবাধ্যতা করেছো উহার পর যা তিনি তোমাদেরকে দেখিয়েছেন যা তোমরা ভালোবাসো। তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোক আছে যারা ইচ্ছা করে দুনিয়া পেতে আর তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোক আছে যারা ইচ্ছা করে আখিরাত পেতে। তারপর তিনি তোমাদেরকে সরিয়ে দিয়েছেন তাদের (প্রতিরোধ করা) থেকে (বা তোমরা সাময়িকভাবে পরাজিত হয়েছো), তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। আর (তোমরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারায়) নিশ্চয় শেষ পর্যন্ত তিনি উদারতা দেখিয়েছেন তোমাদের প্রতি। আর আল্লাহ মু’মিনদের উপর অনুগ্রহশীল ।

৩:১৬৫-১৬৬ :: কি হলো যখন তোমরা মুসিবতগ্রস্ত হয়েছো, (অথচ) নিশ্চয় (আগের বদর যুদ্ধে) তোমরা তাদের উপর ঘটিয়েছিলে উহার দ্বিগুণ মুসিবত, (তবুও) তোমরা বলেছো, ‘এটা কোথা থেকে এলো?’ বলো, ‘উহা তোমাদের নিজেদের নিকট থেকে (তোমাদের কার্যকলাপের কারণে)। নিশ্চয় আল্লাহ সকল সত্তা ও বিষয়ের উপর প্রাকৃতিক আইন নির্ধারণকারী ও সর্বশক্তিমান নিয়ন্ত্রণকারী। আর তোমাদের উপর যে বিপদ এসেছিল দুই দল মুখোমুখি হওয়ার দিন তা আল্লাহর অনুমতিক্রমে এবং যাতে তিনি মুমিনদেরকে জেনে নেন।

উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের ভিত্তিতে কৃত আলোচনা অনুসারে বলা যায় যে, “আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো বিপদ আপতিত হয় না” এবং ‘মানুষের নিজেদের ত্রুটির কারণেই বিপদ আপতিত হয়” তথ্য দুটি পরস্পর সম্পূরক।

৮। আল্লাহর অনুমতিক্রমে মৃত্যুবরণ

৩:১৪৫ :: আর কোনো প্রাণীর জন্য আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মৃত্যুবরণ করা সম্ভব নয়, (যেই অনুমতি) আয়ুসীমা নির্ধারণকৃত কিতাব (বিধান) হিসেবে রয়েছে। আর যে ইচ্ছা করে দুনিয়ার প্রতিফল পেতে আমরা তাকে দিই তা থেকে (দুনিয়া থেকে)। আর যে ইচ্ছা করে আখিরাতের প্রতিফল পেতে আমরা তাকেও দিই তা থেকে (আখিরাতের পুরস্কারের পাশাপাশি দুনিয়া থেকে)। আর শীঘ্রই আমরা কৃতজ্ঞদেরকে প্রতিফল দেবো।

আলোচনা : যারাই মৃত্যুবরণ করে তারা আল্লাহর অনুমতিক্রমেই মৃত্যুবরণ করে। আর আল্লাহর ঐ অনুমতি আয়ুসীমা নির্ধারণকৃত বিধান অর্থাৎ কারো আয়ুসীমা কখন শেষ হবে বা হবে না সেই সম্পর্কিত প্রাকৃতিক আইন আকারে সেট করে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ‘মৃত্যুর সময়, স্থান ও কারণ’ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

পরিশেষে বলা যায় যে, আল্লাহর অনুমতি বলতে অধিকাংশ স্থানে আল্লাহর অতাৎক্ষণিক অনুমতিকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ অধিকাংশ স্থানে আল্লাহর অনুমতি বলতে আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক বিধান অনুযায়ী কোনো কিছু সংঘটিত হওয়ার অবকাশ থাকাকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং আল্লাহর অনুমতি সম্পর্কিত আয়াতসমূহ ভাগ্যবাদকে সমর্থন করে না, বরং তা তাক্বদীর বা প্রাকৃতিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

>>  পরবর্তী পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য ক্লিক করুন